সেদিনের কথা, তখন অনার্স থার্ড ইয়ারে
পড়ি, জানতে পারলাম আমাদের সংসারে নতুন অতিথি আসছে। নতুন অতিথি আসছে, এতো ভারী
খুশীর সংবাদ, কিন্তু তখন আমি এমনই ক্যাবলা ছিলাম যে ‘মা হতে চলেছি’ কথাটা বলার মধ্যে গর্বের চেয়েও লজ্জা বা সংকোচ পেতাম বেশী,
তাই মুখ ফুটে কাউকেই কখনওই বলতে পারিনি মেয়ে থেকে পূর্ণাঙ্গ নারী হয়ে উঠার
গৌরবকথা।
লেখাপড়াতে আগেও আমার মনোযোগ ছিলনা,
সন্তান আগমনের সংবাদে অনার্স পরীক্ষা দেয়ার কথাও ভুলে গেলাম। পাশে পেয়েছি ‘মহামানব উত্তম কুমারকে’, যদি বলি পড়বোনা,
সে বলে, “ওকে, পড়োনা। পড়ালেখাটাই তো আর জীবনের শেষ কথা হতে পারেনা”। যদি বলি, “ পড়বো”, তাহলে বলবে, “অবশ্যই পড়বে, একমাত্র লেখাপড়ার মাধ্যমেই মানুষ জীবনকে উপলব্ধি করতে পারে”।
আমার অবস্থা হয়েছে এমন যে অনার্সের ক্লাস
ফাঁকীও দিতে পারিনা, আবার প্রতি পদে পদে আহ্লাদ আর ঢং করা বাদ দিতে পারিনা। মজার
কথা হচ্ছে, একই সময়ে আমার ছোট মাসীও প্রথম মা হতে চলেছে। মাসীর শ্বশুরবাড়ী
সুনামগঞ্জে, আমার স্বামীর বাসা সাভারের গণস্বাস্থ্যে। মাসী তো দিদিমার ছোট মেয়ে,
শুরু থেকেই দিদিমা উনার মেয়েকে নারায়ণগঞ্জে এনে রেখে দিয়েছে। ওদিকে আমি তো ছটফট
করি, সব আদর আর আহ্লাদ মাসী একা পাচ্ছে, আর আমি গণস্বাস্থ্যের বাসায় বসে
কেমিস্ট্রির রিঅ্যাকশান মুখস্থ করে যাচ্ছি। দিদিমার কাছে যেমন উনার ছোট মেয়ে, আমার
মায়ের কাছেও তো আমি একটা মাত্র মেয়ে। আমাদের লেখাপড়ার ব্যাপারে বাবা যতটা কঠোর
ছিলেন, মা ছিলেন ততটাই উদাসীন। কাজেই মা আমাকে নারায়ণগঞ্জে আসতে বললেন। তখন উত্তম
কুমার ছিল খুবই ভাল মানুষ, এখনকার মত অত লায়েক হয়ে উঠেনি। আমি যা চাই, তাতেই
হ্যাঁ, আমি চেয়েছি মায়ের কাছে যেতে, উত্তম কুমার সাথে সাথে বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই যাবে”। উত্তমকে একা
ফেলে রেখে, অনার্স ক্লাস বাদ রেখে আমি মায়ের কাছে চলে এলাম।
ছোট মাসী আবার হাত গুণতে জানে, বিয়ের
আগেই আমার হাত গুণে বলে দিয়েছে, আমার প্রথম সন্তান ছেলে হবে। এদিকে উত্তম তো আবার
রাম না জন্মাতেই রামায়ণ রচনা করে ফেলেছেন। বিয়ের আগে কবে কোথায় কোন এক বাচ্চা
মেয়েকে দেখেছে, খুবই টুকটুকী ধরণের, সেই বাচ্চার নাম ‘মৌটুসী’। সেদিনই বাল্মিকী মুনির মত উনি ঠিক করে ফেলেছেন, তার প্রথম
সন্তান হবে কন্যা, কন্যার নাম হবে ‘মৌটুসী’। উত্তমের রামায়ণ শুনে আমি হাসি, মনে মনে বলি, আমার ছোট মাসী সোনার চেন ঘুরিয়ে
গণনা করে, সবাইকে ঠিকমত বাচ্চা-কাচ্চার কথা বলে দেয়, গণনা একেবারে সঠিক প্রমানিত
হয়েছে। আমাকেও বিয়ের আগেই বলেছে, আমার প্রথম সন্তান হবে ছেলে”। উত্তমকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিলাম, তাই ছেলের কথা শুনলে দুঃখ পেতে পারে ভেবে তাকে
আর মনের কথা বলিনি। মনে মনে ছেলের নাম খুঁজে বেড়িয়েছি।
নারায়ণগঞ্জে এসে মাসী-বোনঝি খুব গলাগলি
ভাব, আবার একটু রেষারেষি ভাব। মাসী জানে, তার মেয়ে হবে, মেয়ে খারাপ নয়, তারপরেও
সমাজে সবাই বলে পুত্রের মা ভাগ্যবতী। কাজেই আমার প্রতি তো একটু ঈর্ষা হবেই, উনি
নিজেই তো গুণে বলেছেন আমার ছেলে হওয়ার কথা। আর আমিও অহংকার দেখানোর সুযোগ ছাড়বো
কেন। আমার চালচলনেই সর্বক্ষণ হাওয়ায় উড়ি ভাব। লাজুকলতা ছিলাম বলে নবাগত অতিথিকে
নিয়ে মুখে কিছু বলতামনা,তবে আচারে ব্যবহারে আহ্লাদীপনা বেড়ে গিয়েছিল। ঘরে কোন
কাজকর্ম করতে হয়না, মাসী-বোনঝি মিলে এখানে যাই, ওখানে যাই। ভুলেই গেছি, আমার
যেখানে সেখানে আছাড় খাওয়ার বাতিক আছে। তখন বাবুটা গর্ভে পাঁচ মাস বয়সের হয়েছে বোধ
হয়, মাসীর সাথে হা হা হি হি করে দৌড়ে ঘর থেকে বের হতে গিয়েছি, চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে
সোজা দাঁড়ানো থেকে ধপাস করে বারান্দার ফ্লোরে বসে পড়ে গেছি। ভীষণ আওয়াজে সবাই ঘর
থেকে বের হয়ে দেখে আমি বারান্দায় বসে আছি, সোজা হয়ে উঠতেই পারছিনা। তারপর নিজে
নিজেই উঠে দাঁড়ালাম, টের পাচ্ছিলাম সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যাওয়ার অনুভূতি! ছোট
মাসী বার বার জিজ্ঞেস করে, “ মিঠু, কীভাবে পড়ে
গেলি! কোথায় ব্যথা পাইছস? পেটে ব্যথা পাস নাই তো”?
আমি তো তখন বোকার মত হেসে বলি, নাহ! কিছু
হয় নাই।
আমার বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, বললেন,
ডাক্তার ডাকতে। বাবার কথা শুনে আমি তো লজ্জায় মরে যাই। এমনিতেই আমি বাবা, মা,
ভাইদের সামনে দাঁড়াতে লজ্জা পেতাম, তার উপর সেদিন সবাই ভীড় করেছে। মাসী বলল, আমি
ওকে নিয়ে ামাদের কৈলাস ডাক্তারের কাছে যাই, আর্নিকা খেতে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। মাসীর
সাথে পাড়ার হোমিওপ্যাথী ডাক্তার কৈলাস বাবুর চেম্বারে গেলাম। উনি চিনির গুল্লী
খেতে দিলেন। এখন মনে পড়েনা, কৈলাস ডাক্তারই কি বলেছিলেন নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে
ডাক্তার দেখিয়ে আনার কথা, নাকি মাসী নিজে থেকেই গেছিল, যেটাই হোক, দুজনে
নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে গেলাম, তাও আবার রিকসায় চড়ে, রাস্তার ভাঙ্গায় ঠোকর খেতে
খেতে! এখন ভাবি, ২৭ বছর আগেও আমরা কত বোকা আর অজ্ঞ ছিলাম। না বুঝেই এক ভুল থেকে
আরেক ভুল করতাম।
নারায়ণগঞ্জ হাসপাতাল থেকে বলে দিল, সব
ঠিক আছে। মনে মনে বলি, “ ঠিক থাকতেই হবে।
এই বাচ্চার তো এতদিনে আমার গর্ভেই থাকার কথা ছিলনা, প্রেগন্যান্সীর প্রথম দিকে
কিছুই না জেনে স্কিন অ্যালার্জীর জন্য ডাক্তারের পরামর্শে টেট্রাসাইক্লিন কোর্স
কমপ্লীট করেছিলাম। গায়নোকোলোজিস্ট ডাঃ সুফিয়া খাতুন যখন জানতে পেরেছেন,
টেট্রাসাইক্লিনের কথা, উনি তো সাথে সাথে এম আর করিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। আমরাও
মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, এম আর করিয়ে ফেলবো। আমার মন মানছিলনা, কারণ
মাসি বলেছে, আমার ভাগ্যে দুটো বাচ্চা আছে, প্রথম ছেলে, পরে মেয়ে। ছেলেটাকে ফেলে
দিতে হবে”? যাই হোক, ডাঃ ফিরোজা বেগমের কাছে গেলাম, উনি বললেন,
টেট্রাসাইক্লিন তিন মাস প্রেগন্যান্সী থেকে ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। আমার যেহেতু
একেবারে শুরু ছিল, তাই ক্ষতি হবেনা। এই তো আমার ছেলেটা গর্ভে রয়ে গেল।
আমার সন্তান যখন আটমাসের গর্ভে, মাসীর
কোল জুড়ে এলো মিত্রা। মিত্রাকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল থেকে মাসী বাড়ী এলো, দিদিমা
তাঁর নাতনীকে কি যে যত্ন করতে লাগলো। আমার মা কি এগুলো লক্ষ্য করতো কিনা কে জানে! আমি
জানালা দিয়ে উঁকী দিয়ে সব লক্ষ্য করতাম, আর মনে মনে হিংসা করতাম, ইস! মেয়েকে নিয়ে
বুড়ীর কত ঢং, আমার দিকে ফিরেও তাকায়না। আবার মজাও পেতাম। ভাবতাম, মাসীর তো মেয়ে
হয়েছে, তাই নিয়েই দিদিমার এত আহ্লাদ, আর আমার যখন ছেলে হবে, তখন মজা বুঝবে।
এদিকে আটমাসের সময় ডাঃ সুফিয়া খাতুন বলে
দিলেন, বাচ্চা ব্রিচ পজিশনে আছে, তাই সিজারিয়ান অপারেশান হবে। বাসায় এলাম, এই
সময়টাতে উত্তম কুমার প্রতি উইক এন্ডে চলে আসতো। তখন সময়টা ছিল আহ্লাদ-আনন্দে ভরা,
চারদিকে শুধুই ভালোবাসার রঙ। সিজারিয়ান অপারেশান করা হবে, তাই ডাক্তার আগে থেকেই
দিন,ক্ষণ ঠিক করে দিলেন, ২৬শে নভেম্বার অপারেশান হবে। নভেম্বারের প্রথম সপ্তাহে
ছোট মাসী আমার হাতে সোনার চেন ঘুরালো, আমার মনে আছে, চেন উল্টোদিকে ঘুরছিল, অর্থাৎ
মেয়ে হবে। মাসী আবার ঘুরালো, আবার উলটো দিকেই ঘুরে। আমরা সবাই হেসে কুটিপাটি,
মাসীকে নিয়ে ঠাট্টা করি। তৃতীয়বারে মাসী জোর করেই যেন চেনকে ঠিকভাবে ঘুরিয়ে বলল, “কি জানি, আমার আঙ্গুল বোধ হয় ঘামে ভিজে গেছে, তাই চেন ঠিকমত ঘোরেনি। এই তো এখন
আবার বলছে, ছেলে হবে”। তখনও ছেলের জন্য কোন জুতসই নাম খুঁজে পাইনি।
১৮ই নভেম্বার কি জানি কেন, মনে হলো, আমার
শরীর ভালো লাগছেনা। প্রথম অভিজ্ঞতা তো, তাই অল্পেই ঘাবড়ে যাই। হুলুস্থূলু লাগিয়ে
দিলাম, মনে ভয় তো আগেই ছিল, টেট্রাসাইক্লিন খেয়েছিলাম, পড়ে গেছিলাম, যদি একটু
সময়ের হেরফের হয় ভুল হয়ে যায়, তাহলে আমার ছেলেটা তো মরেই যাবে। সেই ভয়েই মাতামাতি
বেশী করছিলাম। অপারেশান হবে জানার পর থেকে বাসার সকলেই আমার প্রতি বেশী মনোযোগী
হয়ে পড়েছিল। বড়দা তখন ডকইয়ার্ডে চাকুরী করে, উত্তম কুমার সাভার, মেজদা নারায়ণগঞ্জ
সোনালী ব্যাঙ্কে। ব্যাঙ্ক থেকে মেজদাকে আনানো হলো, বড়দাকে আনানো হলো সোনাকান্দা
ডকইয়ার্ড থেকে, তখন ফোন সার্ভিস কি বাজে ছিল, মাসী দৌড়ে গিয়ে বাড়ীওয়ালার বাসা থেকে
গণস্বাস্থ্যে ফোন করেছিল, ভাগ্য ভাল ছিল, প্রথম সুযোগেই উত্তমের কাছে ফোন পৌঁছে
গেল। মা আর বড়দার সাথে ঢাকা ‘ইবনে সিনা
ক্লিনিকে’ পৌঁছে গেলাম। ওদিক থেকে উত্তম কুমারও ক্লিনিকে পৌঁছে গেছে।
বিকেল সাড়ে তিনটায় সিজারিয়ান অপারেশানের মাধ্যমে মৌটুসীকে পৃথিবীতে নিয়ে আসা হলো।
অপারেশান করা হয়েছিল ফুল অ্যানেসথিসিয়া
দিয়ে, তাই আমি জানতে পারিনি, ছেলে নয়, মৌটুসী এসেছে। কয়েক ঘন্টা পর যখন আমার জ্ঞাণ
ফিরেছে, সারা শরীরে কি যন্ত্রণা, গলায় প্রচন্ড যন্ত্রণা, চোখ মেলে দেখি টিউব
লাইটের আলো চারদিকে, শিয়রের কাছে দাঁড়ানো বড়দা, ঢাকার বৌদি, আরও কারো কারো কথা
শোনা যাচ্ছে, মায়ের গলা পাচ্ছি, বলছে, “ওরে বল,
রাজনন্দিনী এসেছে”। বড়দা বলছে, “মিঠু, তোর তো খুব
সুন্দর একটা মেয়ে হয়েছে। তোর মেয়ে কিন্তু সবার আগে আমার কোলে উঠেছে”। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলামনা, প্রচন্ড ব্যথায় অস্থির হয়েও খুব খুশী হয়েছি
জ্ঞাণ ফিরে এসেছে বলে। আমি ফুল অ্যানেসথেসিয়া দিতে চাইনি, ভয় ছিল, আর যদি জেগে না
উঠতে পারি। কাজেই জেগে উঠার আনন্দে ছেলে না হয়ে মেয়ে হয়েছে, রাজপুত্রের বদলে ‘রাজনন্দিনী’ হয়েছে, এসব কিছু বুঝতে পারছিলামনা। উত্তম কুমার বলে, “আমাদের কাছে ছোট্ট একটা মৌটুসী এসেছে”।
একটু পরে, পাশের বেডে বসা মায়ের কোলে
সাদা তোয়ালে জড়ানো এক বাচ্চা দেখলাম। কাঠি কাঠি হাত পা ছুঁড়ে কাঁদছে, ধবধবে সাদা
গায়ের রঙ। মা বলছে, “ এই যে দ্যাখ, তোর রাজনন্দিনী’ মা হাসতে হাসতে কুটিপাটি হয়ে যাচ্ছে, বলে, ঐ যে টেট্রাসাইক্লিন খেয়েছিলি,
টেট্রাসাইক্লিনের প্রতিক্রিয়ায় তোর ছেলেটা মেয়ে হয়ে গেছে”। আমি তো থ’ হয়ে গেছি, কি ব্যাপার, মেয়ে হয়েছে বলছে কেন? বাচ্চার দিকে
তাকাতেও পারছিলামনা, সিজারিয়ান অপারেশানে যে সারা শরীরে এমন যম যন্ত্রণা হয়, কে
জানতো! বাচ্চা ট্যাঁও ট্যাঁও করে কাঁদে, কান্না থামেনা, শাশুড়ী-জামাই কতরকমভাবে
চেষ্টা করে যাচ্ছে ‘মৌটুসী’র ট্যাঁও ট্যাঁও
থামাতে। দুজনের একজনও কোন কাজের না। ইস! এতক্ষণ লাগে একটা বাচ্চার কান্না থামাতে,
আমার তো হাত নাড়াবার শক্তিটুকুও নেই, নাহলে অদের শিখিয়ে দিতে পারতাম কি করে
বাচ্চাকে দোল দিতে হয়। এদিকে মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছিনা, লজ্জা লাগে। সবাই বলবে,
কি বেলাজা মেয়ে, বাচ্চা নিয়ে কত আদিখ্যেতা করে দেখো। অথচ বাচ্চাটাকে কোলে নিতে
ইচ্ছে করছে। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের বৌদি বাচ্চাকে তুলে এনে আমার পাশে শুইয়ে দিল।
আমি যে কি পরিমান লজ্জা পাচ্ছিলাম তা বুঝাতে পারবোনা।
প্রতিদিন অতিথির ভীড় লেগেই আছে। দ্বিতীয়
দিনে আমাকে বেড থেকে তোলা হলো, ধরে ধরে বিছানা থেকে নামানো হলো, হাঁটতে চেষ্টা
করলাম। খাওয়া-দাওয়া নেই, শুধু স্যালাইন দিয়ে রেখেছে আমাকে। স্যালাইন এক জায়গায়
বেশীক্ষণ রাখা যাচ্ছেনা, সেখানে ফুলে ব্লকড হয়ে যাচ্ছে, সব মিলিয়ে বিতিকিচ্ছিরি
অবস্থা। আমি তখনও ‘মা’ হওয়ার অনুভূতি
টের পাচ্ছিলামনা।
পঞ্চম দিনে এলেন হুমায়ুন আহমেদ ও
গুলতেকীন আহমেদ, হাতে এক গুচ্ছ ফুল, এবং একটি প্যাকেট। হুমায়ুন আহমেদ আমার হাতে
প্যাকেটটি দিলেন, গুলতেকীন ভাবী দিলেন ফুলের গুচ্ছ।
হুমায়ুন আহমেদের হাত থেকে উপহার পেয়ে আমি অভিভূত। সবাই মিলে
বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। হুমায়ুন আহমেদ বললেন উনার শীলা মেয়ের জন্মের অভিজ্ঞতা।
আমেরিকার হাসপাতালে যখন শীলা জন্মালো, গুলতেকীন ভাবী তখন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা
স্বামীকে আজান দিতে বললেন। আমেরিকার নিয়ম অনুযায়ী স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে থেকে
সন্তান জন্ম দেয়ার পুরো প্রক্রিয়া উনাকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে বলে উনি এতটাই ঘাবড়ে
গেছিলেন যে ‘আজান’ দেয়ার সময় নাকি
মনে হয়েছে উনি চীৎকার করছেন। রুগীর স্বামীকে এমন অদ্ভুতভাবে চীৎকার করতে দেখে
কর্তব্যরত ডাক্তার, নার্স সকলেই হতচকিত হয়ে গেছিল। হুমায়ুন আহমেদ যা বলতেন, যেভাবে
বলতেন, শুনতে ভাল লাগতো। গুলতেকীন ভাবী বললেন, “বাবা মা দুজনেই সুন্দর,
তাই মেয়েও সুন্দর হয়েছে। বলতো মেয়ে কার মতো হয়েছে, জীবেনদা’র মত নাকি মিঠু ভাবীর মত?” হুমায়ুন আহমেদ
বললেন, “ পৃথিবীর সব বাচ্চার চেহারাই আমার কাছে একরকম লাগে”।
উনারা চলে গেলেন। আমি উপহারের প্যাকেট
খুললাম,
প্যাকেটের ভেতর তিনটি বই ছিল,
শঙ্খনীল কারাগার
সৌরভ
অচিনপুর
প্রতিটি বইয়ের পাতা উল্টাতেই দেখতে
পেলাম, হুমায়ুন আহমেদের হাতে লেখা,
নতুন মা’কে—
হুমায়ুন আহমেদ
২৩শে নভেম্বার, ১৯৮৫
আমি বুঝতে পারছিলামনা, নতুন মা’টি কে? আমি নাকি মৌটুসী? দুজনেই তো নতুন। পরমুহূর্তেই খেয়াল হলো, আরে! আমিই তো মা, আমিই তো
নতুন মা! হুমায়ুন আহমেদের ভাষায় ১৮ই নভেম্বার আমি নতুন মা হলাম।
No comments:
Post a Comment