Thursday, November 14, 2013

চোরকাহিনী!!



 Photo






আমি আগে ভাবতাম, আমেরিকাতে চোর-ডাকাত বলে কিছু নেই। এমন ভাববার কারণ আছে, উত্তম কুমারের সাথে আমার বিয়ে হওয়ার পর থেকেই আমেরিকা সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পেয়ে এসেছি। আমেরিকা সম্পর্কে কিছু বলতে হলে, উত্তম কথা শুরু করে এভাবে, এটা একটা দেশ বটে, দেশ বটে আমেরিকা। ভাবা যায়না, এত ডিসিপ্লিন, লাইফ এত স্মুদি, পৃথিবীর স্বর্গ বলা চলে। এমন শুনতে শুনতে আমার মাথাতেও ঢুকে গেছিল, আমেরিকা একটা দেশ বটে। বাংলাদেশে শুধু চোরের ভয়, খালি বাসা রেখে কোথাও যাওয়া যায়না, একবার দরজায় তালা ঝুলিয়ে বনানী বড়দার বাসায় বেড়াতে গেছি, সন্ধ্যাবেলা (গ্রীনরোডের ভুতের গলির) বাসায় ফিরে দেখি, দরজার তালা ভাঙ্গা। আরেকবার দুর্গাপূজার সময়, নারায়ণগঞ্জ যাব বলে জামা কাপড়ের ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি, ব্যাগদুটো জানালার কাছে রেখেছিলাম, সকালবেলা দেখি ব্যাগ কাত হয়ে মাটিতে পড়ে আছে, ব্যাগ তুলে দেখি ভেতরে কিছু নেই। জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে চোর সব নিয়ে গেছে। মৌটুসী, মিশা তখন কত ছোট, আমরা তখন কত গরীব, বাড়তি টাকা-পয়সাও হাতে নেই যে আবার জামা কিনে দেবো। আমার নিজস্ব একটা গোপন সঞ্চয়ী ব্যাংক ছিল, উত্তম জানতোনা সেটার হদিস, উপায় না দেখে শেষমেষ নিজের সঞ্চয় ভেঙ্গে মৌটুসী আর মিশার জন্য আড়াইশ টাকা দামে হালকা গোলাপী রঙের জামা কিনে এনেছিলাম। সঞ্চয় থেকে পাঁচশ টাকা চলে গেলো!

মিসিসিপিতে আছি নয় বছর হয়ে গেছে। ছোট্ট বাড়ীটি ব্যাংকের লোনের পয়সায় কিনেছি, তাও পাঁচ বছর হয়ে গেল। বাড়ীতে উঠার পর দেখি, ঘরের মধ্যে সিকিউরিটি অ্যালার্ম ফিট করা। চোর ঢুকলেও অ্যালার্ম বেজে উঠবে, সাধু ঢুকলেও অ্যালার্ম বেজে উঠবে। উত্তম কুমার অ্যালার্ম ডিঅ্যাক্টিভেট করে দিয়েছে। আমেরিকাতে চোর আসার প্রশ্নই যেখানে নেই, সেখানে অণর্থক অ্যালার্ম বাজিয়ে সাধুকে বিব্রত করে লাভ কি?

আমার একটা ভাঙ্গা গাড়ী ছিল, অচেনা এক লোকের কাছ থেকে নগদ টাকায় কিনেছি। গাড়ীটা আমি একদিন রাস্তার পা্রে পার্ক করে ঘরে ঢুকে গেছি। এদেশে অনেকেই রাস্তার পারে গাড়ী পার্ক করে। পরদিন দুপুরে কাজে যাব, গাড়ীর কাছে গিয়ে দেখি, জানালার কাঁচ নেই, ভাঙ্গা কাঁচ রাস্তা, গাড়ীর সীট, সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। আমি তো থতমত খেয়ে গেছি। বিষয় কি? গাড়ির কাঁচ ভাঙ্গলো কে? ফোন করলাম উত্তমকে, কাঁদতে কাঁদতে কি বললাম, কে জানে। উত্তম চলে এলো, দেখে আমার হাতব্যাগ গাড়ীর সীটের উপর পড়ে আছে। ঐ তো, যত দোষ নন্দ ঘোষ। উত্তম বলে, এইজন্যই তো গাড়ীর কাঁচ ভেঙ্গেছে। সাধে কি আর ভেঙ্গেছে? ব্যাগ রেখে গেছো গাড়ীর ভেতরে। আমি বলি, ব্যাগে তো টাকা নেই, আমার টাকা থাকে আমার ছোট পার্সে, প্যান্টের পকেটে। আমার গল্পের বইয়ের সাথে ব্যাগটাও গাড়ীতেই থাকে”। উত্তম বলে, চোরের দোষ কি, চোর কি জানে যে তুমি ব্যাগে টাকা রাখোনা? আমি বলি,  "চোরের দোষ নেই মানে, এই না বলো, আমেরিকা একটা দেশ বটে, এখানে হাতীশালে হাতী, মশাশালে মশা, মানুষশালে মানুষই থাকে ,চোর থাকেনা। তাহলে এই চোর কোত্থেকে আসলো?

আমাদের লন মোয়ার বাড়ীর ব্যাকইয়ার্ডে থাকতো। একসময় আমি নিজেই লন মোয়িং করতাম। তখন আমার মাথায় ফেসবুকও ছিলনা, লেখালেখিও ছিলনা। বাড়ীর সামনে, পেছনের লন মো করে মোয়ার ঠিক জায়গায় রেখে দিতাম। হঠাৎ একদিন উত্তম লন মো করে মোয়ার বাইরের গ্যারাজে রেখে দিয়েছে। গ্যারাজে আগে থেকেই মোটা শেকল ঝুলানো ছিল। আমি বুঝতেও পারিনি এই শেকল কেন? আমাদের আগে যে বুড়ীমা থাকতেন এই বাড়ীতে, উনিই এইসব সাবধানতা অবলম্বন করে থাকতেন। শেকল দিয়ে নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় জিনিস বেঁধে রাখা হতো। আমিও উত্তমকে বলেছিলাম, লন মোয়ারটা শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে। উত্তম সেটা করেছিল। তিন দিনের দিন, এক কালো লোক এসে উত্তমের সাথে খুব খাতির করলো, আমাদের লন মোয়ার চাইলো, সে কাছেই এক বাড়ীর ঘাস কেটে দিয়ে পয়সা পাবে। ওর নিজের মোয়ার নষ্ট, তাই আমাদের মোয়ার ব্যবহার করতে চায়। উত্তমের আরেক নাম দয়ার সাগর। সে খুব দান করে, স্ত্রী আর কন্যা ছাড়া বাকী সব কিছু সে দান করে দিতে পারে।
দয়ার সাগর আমাদের মোয়ার সেই লোকটাকে দিয়েছে। লোকটা মোয়ার আবার ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। মোয়ার ফিরিয়ে দেয়ার পর উত্তম সেটিকে আর শেকল দিয়ে বাঁধেনি, বলেছিলাম বেঁধে রাখতে। সে বলেছে, " আরে, তোমার সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। এদেশে চুরী হয়না, তুমি দরজা হাট করে খুলে রাখলেও চুরী হবেনা।
চার দিন পর, সেই লোকটা আবার এসেছে, সেদিন উত্তম বাড়ী ছিলনা, আমার কাছে মোয়ার চাইলো। আমি মনে মনে বলি, এটা কি মামার বাড়ীর আবদার নাকি? তোমাদের আমেরিকার মানুষদের বিশ্বাস কি? পান থেকে চুন খসলে তোমরা স্যু করে দাও। পরে দেখা যাবে এই মোয়ারে তোমার কোন ক্ষতি হলে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আমাদেরকেই বিপদে ফেলবেলোকটার চেহারাতেই পুরো চোরের ছাপ আছে। কিন্তু মুখে বলেছি, না দুঃখিত, মোয়ার বাইরে দেয়া যাবেনা
দুই দিন পরেই দেখি মোয়ার হাওয়া। উত্তমই আগে দেখেছে, মোয়ার নেই। আমি বলি, "ঐ লোকটাই মোয়ার নিয়ে গেছে"। উত্তম বলে, " ছি ছি! না জেনে একজনকে চোর বলা ঠিকনা"। আমার মাথায় তখন আগুণ জ্বলছে, দুইশ ডলার দিয়ে মোয়ার কিনেছিলাম, সেই মোয়ার সে দানছত্র থেকে রাস্তার এক চোরকে দিয়েছে, আবার সেই চোরকে চোর বলাতে আমাকে ছি ছি করছে। এরপর আরও দুইবার চুরী হওয়ার পর উত্তমের খেয়াল হয়েছে, প্রয়োজনীয় জিনিস বাড়ীর ভেতরে রাখতে হবে।

গত সপ্তাহের ঘটনা। ওয়ালমার্ট থেকে ফেরার সময় খুব বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টির জলে আমার পায়ের জুতো ভিজে গেছে। আমাদের গ্যারাজে শাটারের ব্যবস্থা নেই, চারদিক খোলা, উপরে ছাদ। পরদিন কাজে যাওয়ার আগে ভেজা জুতোজোড়া গ্যরাজের ফ্লোরে রোদের মধ্যে শুকোতে দিয়ে কাজে চলে গেছি। পর পর দুদিন জুতো ওখানেই ছিল। তৃতীয় দিনে আমি তখনও কাজে যাইনি, রেডী হচ্ছিলাম, ক্লাস শেষে লাঞ্চে উত্তম বাড়ী এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা, ওখানে জুতো জোড়া কার ছিল? একটা জুতো পড়ে আছে। আমি বলি, আমার জুতো ছিল, কি বলো, একটা জুতা থাকবে কেন? নিশ্চয়ই কোন কুকুরের কাজ। কিন্তু এদেশে তো মালিক ছাড়া কুকুর বের হয়না, তাহলে মালিকের সামনেই আমার জুতো নিয়ে গেছে। এটা কেমন কথা"। উত্তমের বিশ্বাস হয়না কুকুর জুতা নিতে পারে। বলে, " কুকুর তোমার জুতো নিবে কেন?" 
দুই দিন পর উত্তম ইউরেকাইউরেকা করে বাড়ী ফিরেই বলে, তুমি ঠিকই বলেছো, তোমার একপাটি জুতো মুখে নিয়ে একটা কুকুর লাফালাফি করছে দেখলাম। কুকুরের মালিককে বললাম, তোমার কুকুর আমার বাড়ী থেকে জুতা নিয়ে এসেছে
বললাম, আমি সব সময় ঠিকই বলি। সেদিনই বলেছি, এটা কুকুরের কাজ। তুমি বিশ্বাস করোনি। যাই হোক, তোমার কথা শুনে কি সেই লোক লজ্জা বা ভয় পেয়েছে? পায়নি, কারণ তার সাথে থেকেই তার কুকুর এই কাজ করেছে"। কি আর করা, বাকী জুতো গার্বেজ করে দিলাম। এরপর শুরু করলাম গজগজানি। 
"ছোটলোকের দেশ, চোরের দেশ, এই দেশের মানুষগুলিও ছোটলোক, তাদের কুত্তাগুলিও ছো্টলোক। সাধারণ একপাটি জুতো, সেটিকেও নিয়ে গেছে। বলিহারী যাই এমন কুত্তাপ্রেমিকের নিকুচী করি, এটা কোন কথা হলো নাকি যে আরেকজনের বাড়ীর সীমানার ভেতরে ঢুকে মুখে করে জুতা নিয়ে যাবে আর মালিক তা দেখে আনন্দে বগল বাজাবে?

উত্তম বলে, " তোমারই তো দোষ, তুমি জুতা এখানে রেখেছো কেন?

"আমার দোষ মানে? আমার বাড়ীর আঙ্গিনায় জুতা রাখবো নাকি ঝাড়ু রাখবো, সেটাও কি তোমার সাধের আমেরিকানদের মর্জির উপর নির্ভর করবে?

সে হাসে, বলে, একবার ভেবেছিলাম, কুকুরের মালিককে বলি, তোমার কুকুরের মুখ থেকে আমার বউয়ের জুতা উদ্ধার করে দাও। পরে আর বললামনা, একটা জুতাই তো, কিনে নিও।

বলি, তুমি ভাবলে কি করে যে কুত্তায় খাওয়া জুতা আমি পায়ে পড়বো? আমাকে তো দেখি তুমি এখনও চেনোনি।!

এগুলো তো বললাম আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা। চোর আর কী-ইবা দেখেছি, আসল চোর দেখা যায় ওয়ালমার্টে। পুরো পাক্কা চোর, অভিজ্ঞ চোর। চারদিকে এত মানুষের মধ্যেই কি করে যেন ফোন চুরী করে নেয়। ামরা দাঁড়িয়ে আছি, একদল ছেলেপিলে দামী দামী ফোনগুলোকে হাতিয়ে দেখে, ওরা চলে যায়, আমরা দেখি ফোনের বাক্স ঝুলছে, বাক্সের ভেতরে ফোন নেই। এর বড় বড় টিভি চুরী হয়ে যায়, মহিলাদের জামা কাপড়ের সেকশানে গেলে তো কথাই নেই, নানাভাবে চুরী করে। জামাকাপড়ের সেকশানে ট্রায়াল রুম আছে, এই মোটকা মোটকা মহিলাগুলি ট্রায়াল দেয়ার জন্য জামাকাপড় নিয়ে রুমে ঢুকে, নিজের দেহের 'তেলকাসটি, নোংরা অন্তর্বাস থেকে শুরু করে, যা কিছু সম্ভব বদলে নতুনগুলো পড়ে নেয়, ওদের পুরানোগুলো সুন্দর করে হ্যাঙ্গারে ট্যাগসহ লাগিয়ে ট্রলীর মধ্যে ফেলে রেখে যায়। এমন সব পাকা চোর।
ওয়ালমার্টে চোর ধরার জন্য তিন চারজন কাজ করে চলেছে। তাদের সর্দারণীর নাম শন্ডা। শন্ডার দেহখানি একেবারে পর্বতের মত, চালচলন গুন্ডার মত, কিন্তু মুখখানি ভারী মিষ্টি, মায়াবী। গায়ের রঙ সাদা, মুখে একধরণের হাসি লেগে থাকে। শন্ডাকে আমি চোরধরণি ডাকি। মানে চোর ধরে সে। শন্ডার ধারে কাছে থাকিনা। ওকে সব সময় দেখাও যায়না, ওর জন্য একটি রুম আছে। রুমের জানালা কালো পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে, রুমের ভেতর সে শুধু ক্যামেরা মনিটর করে। এটাই ওর কাজ। চুরীর কিছু ঘটলে, এসোসিয়েটরা কিছু বেয়াইনী কাজ করলে শন্ডার ক্যামেরায় তা ধরা পড়ে যায়। তখন সে তার পর্বত দেহ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে, অন্যান্য ম্যানেজারদের সাথে নিয়ে চোরকে চেজ করে। পুলিশে কল দেয়, পুলিশ এসে চোরের হাতে হাতকড়া পড়ায়। আর এসোসিয়েটের ব্যাপার হলে সংশ্লিষ্ট ম্যানেজারের কাছে রিপোর্ট করে।

আমি ছুটির দরখাস্ত করেছিলাম। স্টোর ম্যানেজারের কাছ থেকে ইয়েস শোনার অপেক্ষায় ছিলাম। আমাকে জানানো হলো, শন্ডা আমাকে ডেকেছে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। শন্ডা আমাকে ডাকবে কেন, তার কাজ চোর ধরা। আমি কি চোর নাকি? বলাও যায়না, কে কোথা দিয়ে আমার কি সর্বনাশ করে ফেলেছে, শন্ডার ক্যামেরায় তা ধরা পড়েছে বলেই এখন ডাকছে। চুরীর কেইসে ফেঁসে গেলে কী লজ্জার ব্যাপার হবে! 
আমার নিজের চোখে দেখা ঘটনা। একদিন টী-রুমে বসে খাবার খাচ্ছিলাম, সাথে আর চার পাঁচজন ছিল। হঠাৎ দেখি শন্ডা, মিশকালো স্টোর ম্যানেজার, আর দুই পুলিশ টি রুমে প্রবেশ করেছে, ওদের সাথে ছিল সারাহ নামের এক মাঝবয়সী ক্যাশিয়ার। সারাহ একজন খুব শান্ত-শিষ্ট ভদ্রমহিলা। ভেবেছি, সারাহ'র বোধ হয় কিছু খোয়া গেছে, তাই সে পুলিশে রিপোর্ট করেছে, পুলিশ এসেছে বলে সাথে শন্ডা আর ম্যানেজারও এসেছে। আমি তো কত কিছুই ভাবি, সাদা মনে সাদা ভাবনা, দেখি পুলিশ সারাহ'র হাতে হাতকড়া পড়াচ্ছে, আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, শরীর কাঁপতে শুরু করেছে, এ আমি কি দেখছি। সারাহ চোর?

ভয়ে ভয়ে শন্ডার রুমের দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে দিল মিশকালো স্টোর ম্যানেজার। রুমে ঢুকে দেখি পর্বতদেহী শন্ডা চেয়ারে বসা, ম্যানেজার আমার দিকে চেয়ার ঠেলে দিল। দুইজন দুই বিপরীত মেরুর মানুষের মাঝে আমি তৃতীয় মেরুর মানুষ, বুঝে গেলাম, কিছু একটা সর্বনাশা ঘটনা ঘটে গেছে। নাহলে এই দুজন ডেঞ্জারাস ব্যক্তি আমাকে ডাকবে কেন? আমাকেও কি পুলিশের হাতে তুলে দিবে? মরীয়া হয়ে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, কি ব্যাপার, আমি কি কোন ভুল করেছি? মিশকালো ম্যানেজার তার দুধসাদা দাঁতে হেসে বললো, চিন্তার কিছু নেই, তোমার সাথে ছুটি বিষয়ে কথা বলবো। তুমি একজন মহিলা এসোসিয়েট, তোমার সাথে একান্তে কথা বলতে গেলে আরেকজন উইটনেস থাকতে হবে, তাই শন্ডাকে রেখেছি উইটনেস"।এটা শুনে শান্তি পেলাম।

শন্ডার ডাকে ভয় পেয়েছিলাম, কারণ চোরের মন পুলিশ পুলিশ। দিন পাঁচেক আগে আমি আর উত্তম এক বাড়ীতে বেড়াতে গেছি। সেখানে আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন, সকলেই উত্তমের বন্ধু। কথা শুরু হয়েছে শেয়ার মার্কেট ব্যবসা নিয়ে। উত্তম বলল, সে যা কিছু শেয়ার কিনেছে, তার সবই বিক্রী করে দিয়েছে, তার যেমন লাভ হয়নি, লোকসানও হয়নি। একজন বললেন, উনি শেয়ার বিজনেসে টাকা ঢালেননা। আরেকজন কোটি টাকার উপর লস খেয়েছেন। এগুলো শুনে আমি বলি, আমার প্রায় চার লাখ টাকাও তো বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটে ধূলায় মিশে গেছে।

উত্তম বলে চুরীর টাকা তো, ঐজন্যই লস খেয়েছো।

উপস্থিত সবাই জিজ্ঞেস করলো, চুরীর টাকা মানে? কি ব্যাপার?

আমি তো থতমত খেয়ে গেছি। বলে কি সে? এতগুলো দাদার সামনে আমাকে চোর বলছে! তবে কি আমি ধরা পড়ে গেলাম?

উত্তম বলতে শুরু করেছে, আরে, আমি তো জানতাম, আমার টাকা পয়সা নাই, যা আয় তা ব্যয়। অথচ মাঝে মাঝেই দেখতাম সে কোথা থেকে যেন টাকা বের করে দেয়। গতবার মামনির বিয়ের সময়ও বলে, তোমার চিন্তা নাই, বাংলাদেশে মেয়ে বিয়ের টাকা রেখে আসছি। আমি ভাবি, এত টাকা ও জমালো কি করে? পরে বুঝতে পেরেছি, আমার তো টাকা পয়সার কোন হিসেব থাকতোনা, প্যান্টের পকেটে, শার্টের পকেটে গুচ্ছের টাকা পড়ে থাকতো। জামাকাপড় ধুতে দেয়ার সময় টাকাগুলো নিয়ে সে নিজের কাছে রেখে দিত, আমাকে আর ফেরত দিত না, ওগুলোই সে পরে শেয়ার মার্কেটে খাটিয়েছে। এইজন্যই চুরীর টাকা বলেছি।

পাশ থেকে আরেক ভদ্রলোক বলেন, বৌদি তো সংসারের ভালর জন্যই ওটা করেছে, ইন ফ্যাক্ট আপনার চিন্তা কমিয়ে দিয়েছে। বৌদিতো দারুণ বুদ্ধিমতী। এটাকে ওরকমভাবে 'চুরী' বলা ঠিক হচ্ছেনা দাদা। উত্তম হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে।


আমি তখনও টাস্কি লেগে বসে আছি। হায় হায়, এই ভদ্রলোকগুলো আমাকে এতদিন কত ভাল জেনে এসেছেন, আর আজ জানলেন 'চোর' হিসেবে, তার চেয়েও বড় কথা, এতদিন উত্তমকে সরল সোজা মানুষ ভেবেছিলাম, ভেবেছিলাম, উত্তম কুমার জীবনের কঠিন বিষয়গুলোর কিছুই বোঝেনা, কিছুই টের পায়না। বিয়ের পর থেকেই দেখেছি, টাকা পয়সার ব্যাপারে সে চরম উদাসীন ছিল। আমাদের সঞ্চয় বলতে কিছুই ছিলনা। যে যখন তার কাছে টাকা চাইতো, দুম করে দিয়ে দিত। আমি যদি সঞ্চয়ের কথা বলতাম, তাহলেই সে তেলে বেগুণে জ্বলে উঠতো। বলতো, " জীবন দুই দিনের, সঞ্চয় করে কি করবে, খরচ করো"। সে এমনই খরুচে ছিল যে শার্ট প্যান্ট ধুতে গেলে দেখা যেত পকেটে টাকার গোছা পড়ে আছে। আগে তো সে লন্ড্রীতে কাপড় কাচতো, এরপর আমিই ঘরে কাপড় কেচে দিতাম, সঞ্চয়ের আর কোন পথ না পেয়ে পকেটের টাকাগুলো সরিয়ে রাখতাম, যা পেতাম গুছিয়ে ব্যাংকে রেখে দিতাম, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে বলে। সংসার খরচ থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রেখে দিতাম, সেগুলোই এক সময় জমে সঞ্চয় হয়েছে, কাজে লাগিয়েছি। এই টাকা থেকে আমি কত কিছু করেছি। এমন কি গতবছর মৌটুসীর বিয়েতে উত্তমকে কিছুই খরচ করতে হয়নি, সবই আমার চুরীর টাকায় হয়ে গেছে। সঞ্চয় আরেকটু বাড়াবো বলেই টাকা শেয়ার মার্কেটের ব্যবসায় খাটিয়েছি। ব্যবসা মাইর খেয়েছে, আর এখন কিনা সে বলে, চুরীর পয়সা দেখেই শেয়ার মার্কেটে লস খেয়েছি?। 
আমি বললাম, " তুমি আমাকে চোর বললে কেন?" 
সে হাসে আর বলে, " চোরকে চোর বলেছি"।
আরেক দাদা ভেবেছেন, আমি বুঝি খুব রেগে গেছি, এই দাদার কোটি টাকার উপরে খোয়া গেছে আমেরিকান শেয়ার মার্কেটে। উনি আমাকে বলেন, " আমার ভাইটা এমনিতেই হালকা জোক করেছে, তুমি আবার আমার ভাইয়ের উপর রেগে যাইওনা।" 
টাসকী লাগা মুখে বলি, "না, রাগের কিছু না, কথায় আছে, যার জন্য করি চুরী, সেই কয় চোর"!

No comments:

Post a Comment