Sunday, April 28, 2013

ছেলেটির গায়ে ছিল কালো স্ট্রাইপ শার্ট!!

একটু আগে টিভিতে চ্যানেল ২৪ এর সংবাদপ্রচার দেখছিলাম। সাভার ট্র্যাজেডির পর এই প্রথম টিভিতে প্রচারিত সংবাদপাঠ দেখার জন্য একটুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়েছি। কালো স্ট্রাইপ শার্ট গায়ে একটি যুবক ভাঙ্গা ছাদের নীচে চাপা পড়ে কাতরাচ্ছে।  এ কয়দিন সংবাদপত্রের পাতায় শুধুই মৃতের ছবি দেখেছি,  আজ টিভিতে জীবন্ত মানুষের চেহারা দেখতে পেয়ে উৎসাহ বেড়ে গেল। কী বলছে শোনার চেষ্টা করলাম। যুবকটি শরীরের অর্ধেক উঁচুতে তুলছে আর বলছে, " ও আল্লাহরে, আমারে বাঁচাও! আমারে বাঁচাও। বলেই ক্লান্ত দেহ নিয়ে শুয়ে পড়ছে। এর বেশী কিছু করার সাধ্য নেই, কারণ তার কোমড় থেকে বাকী দেহ বিশাল ভারী কংক্রীটের ভাঁজে আটকে গেছে। যুবকটির মুখটা তখনও সতেজ, শুধু যন্ত্রণায় কোঁকাচ্ছিল। খবরে জানালো, যুবকটিকে শেষ পর্যন্ত জীবিতাবস্থায় বের করে আনা সম্ভব হয় নি। পরদিন তার নিথর দেহ বের করে আনা হয়েছে। বুঝতে একটু সময় লাগলো, কী বলছে, একটু আগে যে স্পষ্ট স্বরে 'আল্লাহ'কে ডাকছিলো, সে পরদিনই মারা গেলো! এমন সংবাদ শোনার জন্য থেমেছিলাম! মনে হলো, কী নিষ্ঠুর সংবাদ পাঠক!!

মিডিয়ায় যেভাবে সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে, তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছে।  পত্রিকার পাতা খুললেই রক্তাক্ত দেহ, সেই কতদিন থেকেই দেখে চলেছি। শুরুটা হয়েছিল বিশ্বজিতের রক্তাক্ত ছবি দিয়ে, এরপর ব্লগার রাজীবের রক্তাক্ত লাশের ছবি।  এরপর আর যেন থামেই না, পুলিশের রক্তাক্ত দেহ, পুলিশের  দুই হাতের কব্জী কাটা ছবি,  ফটিকছড়ির ভুজপুরের হতভাগ্য চার আওয়ামী কর্মীর রক্তাক্ত দেহের ছবি, শিবির কর্মীদের রক্তাক্ত দেহের ছবি।  প্রতিদিনই  একটি না একটি রক্তাক্ত লাশ বা দেহের  ছবি সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হয়েই চলেছে। ওভাবেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সব কিছুরই একটি নির্দিষ্ট মাত্রা থাকে। অসুস্থ হলে ওষুধ সেবনও মাত্রা ধরেই হয়ে থাকে। কিন্তু সেদিনের 'রানা প্লাজা' দূর্ঘটনার ছবিগুলো যেন সকল মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে।  কিছু কিছু ছবি দেখে তার ভয়াবহতা সহ্য করার মত শক্তি অনেকের নেই এটা সত্য, কিন্তু  এতে সংবাদকর্মীরা কতখানি দায়ী হতে পারে? তাদের দায়িত্ব সংবাদ সংগ্রহ করে আনা, তারা তো সেটিই করছে। সাভারের বাজার রোডের রানা প্লাজার ভাঙ্গা বিল্ডিং-এর স্ল্যাবের নীচে চাপা পড়ে যদি মানুষ চ্যাপ্টাই হয়ে যায়, সংবাদকর্মীরা তো সেই চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া দুঃখী মানুষগুলোর রক্তাক্ত ছবিই নিয়ে আসবে, এর মধ্যে বাড়াবাড়ির কিছু তো দেখিনা। 


রানা প্লাজার এত বড় দূর্ঘটনার জের ধরে যার জীবন ও দেহের উপর দিয়ে ঝড় গেল এবং এখনও যাচ্ছে, যার স্বজনের দেহ কুৎসিত বিভৎসতার শিকার হয়েছে, তারা কী করে সহ্য করছে!! মাথা থেকে কালো স্ট্রাইপ শার্ট পরিহিত যুবকের ছবিটি সরছে না। চাইও না ছবিটা সরে যাক, ছবিটা মুছে যাক। বাঁচার জন্য আকুতি দেখলাম, তরতাজা প্রাণ নিথর হয়ে যাওয়ার সংবাদ পেলাম ! বাংলাদেশে জীবন কত সস্তা, এই ছিল, পরক্ষণেই পৃথিবী থেকে মুছে গেল, সে যখন আল্লহকে ডাকছিল, তার মন কী বলছিল? সে কী ভেবেছিল যে সে সত্যিই মরে যাবে!! আমরা তো যখন তখন, বিপদে পড়লেই আল্লাহ বা ভগবানকে ডাকি! অভ্যাসবশেই ডাকি, তখন কী একবারও মনে হয় যে মরে যাচ্ছি! বরং ভরসা জাগে, ঈশ্বর কোন একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু কালো  স্ট্রাইপ শার্ট পরিহিত যুবকের চীৎকার বোধ হয় আল্লাহর দরবারে পৌঁছাতে পারেনি, 'আর্তের চীৎকার' নামক নেটওয়ার্ক  নিশ্চয়ই খুব বিজি ছিল।

কালো স্ট্রাইপ শার্ট পরিহিত ছেলেটির বাঁচার জন্য যে ক্রন্দন আর আকাংক্ষা দেখলাম,মিডিয়াতে সংবাদগুলো ছবিসহ প্রচারের যৌক্তিকতা খুঁজে পেলাম। ঠিকই আছে, আমাদের মত সাত তলা দালানে আরাম কেদারায় বসে থাকা রোবটগুলোর মধ্যে মানবিকতা জাগ্রত হোক। এ কেমন অভিযোগ যে মিডিয়া বাড়াবাড়ি করছে! যারাই সংবাদ সংগ্রহ করছে, তারা তো  সত্যিকার অর্থেই নরক দর্শন করে আসছে, নরকে গিয়ে যা দেখেছে, সেটাই তুলে এনেছে। নরকে গিয়ে তো আর নন্দন কানন দেখার কথা নয়। আমি খুব দূর্বল চিত্তের মানুষ, 'সহ্য করতে পারি না' বলে দূরে দাঁড়িয়ে থাকবো, ভয়াবহতার চেহারা দেখবো না, দুইদিন পরেই ভুলে যাব। তার চেয়ে এই ভাল হয়েছে, স্বজাতির নারকীয়তা দেখাচ্ছে, দেখছি এবং দেখবো! তারপরেও আমার বিবেক জাগ্রত হোক, বিবেকের দংশন থাকুক, আজ-কাল-এবং বাকী জীবন। প্রতি মুহূর্তে যেন মনে হয়, জীবন অনেক মূল্যবান। এই জীবনটা কারোর দয়ার দান নয়, কারোর লোভের 'বলি' হওয়ার জন্য নয়, কারো চাপাতির আঘাত সইবার জন্য নয়! যার যার জীবন তার তার। আহারে! স্বজনেরাই শুধু বুঝতে পারে স্বজন হারাণোর বেদনা। মাথায় ঘুরছে শুধুই কালো স্ট্রাইপ শার্টের যুবকের বাঁচার আকুতি।

Friday, April 26, 2013

তিনি এবং ডাঃ ফ্রিলুক্স

শেষ পর্যন্ত তিনি ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাঃ ফ্রিলুক্স উনাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান। ফ্রিলুক্সকে উনি পছন্দ করেন, মুখের দিকে তাকালেই এক ধরণের নির্ভরতা খুঁজে পাওয়া যায়। ফ্রিলুক্সের কাছে অকপটে মনের কথা খুলে বলা যায়। তিনিও আজ মনের কথা খুলে বলবেন বলেই ডাক্তারের চেম্বারে গেলেন। নার্স এগিয়ে এসে জানতে চাইলো,
" কী সমস্যা আপনার?"
"সমস্যা তো অনেক। কোনটা রেখে কোনটা বলবো?"
"একটি একটি করে সবই বলুন, ডক্টরের কাছে আগে থেকেই সমস্যা জানাতে হয়, ডক্টর ওভাবেই তৈরী হয়ে আসেন"।
" আমাকে তোমার ডক্টর ভালভাবেই জানেন, কারণ উনি আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান। আমার ফাইল উনার কাছে আছে।"
" তবুও আপনাকে নির্দিষ্ট করে বলতে হবে সমস্যার কথা, এটাই আমার কাজ"।
" ঠিক আছে, বলছি, গত কয়েকমাস যাবৎ আমার দুটি চোখ সারাক্ষণ জলে ভরে থাকে, গত একমাস যাবৎ আমার হৃদযন্ত্রে ব্যথা হয়, গত পঁচিশ দিন ধরে মস্তিষ্কের কোষে কোষে যন্ত্রণারা ছুটে বেড়ায়, আর কিছুদিন ধরে মনের ভেতর কেমন হাহাকারের শব্দ শুনি, তারপর~~~~~~
" আর বলতে হবে না, আপনি অপেক্ষা করুণ, আমি ভেতরে যাচ্ছি।" বলেই নার্স মেয়েটি চোখ সরু করে উনার দিকে তাকাল। উনাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই গট গট করে চলে গেল ভেতরের দিকে।

নার্স মেয়েটিকে উনার পছন্দ হলো না, বেশী ফাজিল টাইপের। সমস্যার কথাগুলো শেষ করতে দিল না। মনে বিরক্তি নিয়েই তিনি সাইড টেবিলে থাকা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতে শুরু করলেন। একটার পর একটা পাতা উলটে যান, সব স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ফীচারে ভরে আছে। ভাল লাগে না এগুলো পড়তে। হাতের কব্জী উলটে ঘড়িতে সময় দেখলেন, ত্রিশ মিনিট পার হয়ে গেছে, নার্স মেয়েটি এখনও ফিরলো না। একপাশের ওয়ালে টাঙানো টিভিতে রান্না-বান্নার অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে, খাবারের গুণগত মান ঠিক রেখে কীভাবে রান্না করতে হয়, সেগুলোই দেখাচ্ছে, এমন কিছু না, পাস্তা আর সালসা বানানোর টেকনিক। কেউ দেখছে না, তারপরেও যতসব ভ্যাজর ভ্যাজর! ব্যাগের ভেতরে থাকা মোবাইল ফোনটি বের করে দেশে ফোন করার চেষ্টা করলেন। দেশ মানে বাংলাদেশ। উনার বাবা-মা, ভাই বোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব মিলে বিশাল এক পৃথিবী আছে ওখানে। প্রতিদিন তাদের সাথে কথা না বললে উনার ঘুম হয় না। এটা ভাবতেই মনে পড়ে গেল, আরে, নার্সকে তো এটা বলা হয় নি, রাতে ঘুম আসেনা, তন্দ্রার মত আসে, তখন খুব ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেন। গত পরশু রাতেই দেখেছেন, একদল কালো পোশাক পড়া মানুষ উনাকে ঘিরে রেখেছে, তাদের দাবী হচ্ছে, উনি নাকি নাস্তিক, নাস্তিকদের ফাঁসী চাই, তাই উনারও ফাঁসী হবে। উনি যতই বলার চেষ্টা করছেন যে উনি ব্লগে লিখেন না, উনি সব সময় আল্লাহ খোদার নাম নেন, তবুও তারা মানতে রাজী নয়।

নার্স মেয়েটি কাছে এসে উনাকে মৃদু কন্ঠে ডাক দিল, " ম্যাডাম, আসুন, আমার সাথে"।
ভেতরে নিয়ে গিয়ে নার্স মেয়েটি উনার ওজন নিল, উচ্চতা কত জানতে চাইল। উনার খুব বিরক্ত লাগলো, কেনরে বাবা, আমার ফাইল খুলে দ্যাখ, সেখানেই তো লেখা আছে উচ্চতা। নাহলে আবার উচ্চতা মেপে নে, অত জিজ্ঞেস করার দরকার কি? বিরক্তি চেপে রেখে উনি বললেন, " আগে আমার উচ্চতা ছিল ৫ফিট ১ ইঞ্চি। এখন হয়তো একটু কমে গেছি, মা বলেছেন, বয়সের সাথে সাথে মানুষ বেঁটে হতে থাকে। " এত কথা বলার দরকার ছিল না, বয়স হয়েছে বুঝা যায়। নার্স মেয়েটি উনার উচ্চতা মেপে বললো ৫ ফিট, ৩/৪ ইঞ্চি। ১/৪ ইঞ্চি কমে গেছে! হুম, মা তো ঠিকই বলতেন।

ডাঃ ফ্রিলুক্স উনার চেয়ারে পেছনে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। উনাকে দেখেই বলে উঠলেন,
" হেল্লো, মিস ব্যাংলাডেশ!"
উনি বললেন, বলো বাংলাদেশ, ব্যাংলাডেশ না।
ফ্রিলুক্স বললেন, " ওহো! সরি, ভুলেই গেছিলাম, তুমি বলেছিলে যে দেশের ব্যাপারে তুমি কোন কম্প্রোমাইজ করো না। ঠিক আছে, আমি আমার কথা ফিরিয়ে নিলাম। কেমন আছো মিস বাংলাডেশ!
তিনি হেসে ফেললেন। বললেন, আমি কেমন আছি সেটা জানার জন্যই তো তোমার কাছে এলাম। নার্স মেয়েটিকে সমস্যার কথা বলছিলাম, কিন্তু মেয়েটি পুরোপুরি না শুনেই চলে এলো।
ডাঃ ফ্রিলুক্স বললেন, তোমার তো অনেক সমস্যা দেখলাম। আমি প্রতিটি সমস্যার জন্য আলাদা আলাদা ডাক্তারের কাছে রেফার করে দিচ্ছি। উনারা দেখবেন, তারপর তোমার চিকিৎসা শুরু হবে।
তিনি বললেন, তোমাদের দেশের এই ঢং আমার সহ্য হয় না। কার কার কাছে যেতে হবে, সেটা তো আমিই জানি, তারপরেও তোমার রেফারেন্স লাগবে, কেন? শুধু শুধু আজকের পুরো দিন নষ্ট করলাম এই রেফারেন্স নেয়ার জন্য!

মিস বাংলাডেশ, সরি ফর দ্যাট! কিন্তু এটাই এখানের নিয়ম। তুমি আগামী মাসের ৫ তারিখে আবার আসবে। ততদিনে ওদের কাছ থেকে রিপোর্ট পেয়ে যাব।

আজ ৫ তারিখ। তিনি ডাঃ ফ্রিলুক্সের চেম্বারে গেলেন। উনাকে দেখেই ডাঃ সারা মুখ ছড়িয়ে হাসি দিল। তিনি বুঝতে পারছেন না, খবর ভাল না মন্দ! এখানের ডাক্তাররা রুগীর মৃত্যুর দিন ক্ষণও হাসিমুখে জানিয়ে দেয়। উনার কত সমস্যা , নিশ্চয়ই উনাকেও মৃত্যুর দিনক্ষণ জানানো হবে, তারই পূর্ব প্রস্তুতি চলছে।

" বসো মিস বাংলাডেশ! আমার কাছে সব রিপোর্ট চলে এসেছে।"
" তা তো বুঝেছি, শুধু বুঝতে পারছি না, আমার মৃত্যুর তারিখ কত হতে পারে"?
" হোয়াট! মৃত্যুর তারিখ মানে"!
" না, ও কিছু না, মনটা খুব দূর্বল। ক্রমাগত দুঃখ-কষ্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি"।
" কেন, তোমার মিঃ কী তোমাকে আর ভালোবাসে না? তার কী নতুন কোন গার্ল ফ্রেন্ড হয়েছে"?
"আরে না, আমার মিঃ এর কপাল খারাপ, তোমাদের দেশে জন্মালে নতুন নতুন গার্ল ফ্রেন্ড পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু বাংলাদেশের ছেলেদের সেই উপায় নেই, তাদের বউগুলো এত সুন্দর আর এত বেশী মায়াবী যে অন্য মেয়েদের দিকে চোখ দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এখন কাজের কথা বলো, টেনশান হচ্ছে।"

বলছি, তবে তার আগে তোমার মন্তব্যটিকে শতভাগ সমর্থণ করলাম। তোমার মত এমন সুন্দরী তরুণী বউ পাশে থাকতে তোমার স্বামীর তো অন্যদিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই, ঠিকই বলেছো। যাক, এবার আসল কথায় আসি,
চোখের ডাক্তার বলেছে, তোমার চোখে উল্লেখ করার মত কোন সমস্যা পায়নি।
হার্টের ডাক্তার বলেছে, তোমার হৃদযন্ত্রের কোথাও কোন ব্লক বা ফুটো নেই, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক, হার্টের মাসলেও কোন অ্যাবনর্ম্যাল কিছু পায় নি।
নিউরোলজিস্ট বলেছে, মস্তিষ্কের কোন কোষেই কোন সমস্যা নেই।

মনের ডাক্তার কী বলেছে, সেটা বলার আগে আমি নিজে কিছু বলতে চাই। মিস বাংলাডেশ, তুমি আমার পুরানো রুগী, আমি তোমার ইতিবৃত্তান্ত জানি। প্রথমবার যখন এসেছিলে, আমার সাথে কথা বলার সময় বার বার তুমি ' আমার দেশে' 'আমার দেশে' করছিলে। ফরমে লেখা ছিল তুমি আমেরিকান সিটিজেন, অথচ আমেরিকাকে তুমি একবারও আমার দেশ বলে বলছিলে না, উপরন্তু তুমি আমেরিকার প্রতিটি বিষয় নিয়ে বাংলাডেশের সাথে তুলনা করছিলে। প্রথম দিন আমি তোমার উপর বিরক্ত হয়েছিলাম। দ্বিতীয় দিনেও তুমি একই কাজ করছিলে, বাড়ী ফিরে আমি আমার স্ত্রীর কাছে তোমার গল্প করেছি। আমার স্ত্রীর চোখ ভিজে উঠেছে। সে বলেছে, তুমি নাকি খাঁচায় বন্দী এক পাখী। তুমি তো জানোই, আমার স্ত্রী একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। যদিও আমি তোমাকে তার কাছে রেফার করিনি। আমার স্ত্রী বাংলাডেশ সম্পর্কে পড়াশোনা করেছে। তোমার এই রিপোর্টগুলো তাকে দেখাইনি, তবে তোমার সমস্যার কথাগুলো তাকে গল্প করতেই সে সমাধান দিয়ে দিয়েছে। সে বলেছে,

তোমার দেশে গত কয়েকমাস ধরেই চলছে নানা অশান্তি। বাংলাডেশ একটি শান্তিপ্রিয় দেশ, বাংলাডেশের মানুষ খুবই ইমোশনাল ( সেটা আমার চেয়ে বেশী আর কে জানে বলো), বাংলাডেশের মেয়েরা খুবই সুন্দরী এবং গুণী। এই দেখো, আমার গায়ের শার্টটি মেড ইন বাংলাডেশ, এই শার্টটি আমাকে কী সুন্দর মানিয়েছে বলো! সেই দেশের শান্তি বিনষ্ট করছে কিছু ডেভিল, আমার স্ত্রী ইন্টারনেট থেকে একটি সংবাদ পড়ে শোনালো। যাদের হাতে আমার গায়ের শার্টটি তৈরী হয়েছে, তাদের উপর বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়েছে। এবং বিল্ডিংটি্তে আগে থেকেই ক্র্যাক ছিল, তারপরেও ডেভিলগুলো শ্রমিকদেরকে সেই বিন্ডিং এ কাজ করতে পাঠিয়েছে। ছবি দেখে আমি শিউরে উঠেছি। মানুষ এমন নিষ্ঠুর হতে পারে? আমি রেগে উঠতেই আমার স্ত্রী আরেকটি সংবাদ দেখালো, সেখানে দেখলাম বাংলাডেশের আসল রূপ। সাধারণ মানুষেরা হুমড়ী খেয়ে পড়েছে বিল্ডিং এর নীচে চাপা পড়া ভাই বোনদের উদ্ধার করতে। তোমাদের দেশে ত্রান সামগ্রী অপ্রতুল, কিন্তু মানুষের প্রতি মানুষের দরদ দেখে চমৎকৃত হয়েছি। তোমার রোগের কারণও নির্ণয় করতে পেরেছি।

তোমার দুই চোখের কোনে বে অফ বেঙ্গলের (বঙ্গোপসাগর) জল ধরা আছে, সেটাই উপচে উপচে পড়ছে, কারণ তুমি তোমার ডেশে যেতে পারছো না।

তোমার হৃদযন্ত্রটিতে 'ভালোবাসা'র পরিমান এত বেশী যে তার প্রেশারে তোমার বুকে ব্যথা হচ্ছে।

তোমার মস্তিষ্কের অনুভূতি ও আবেগপ্রবণ কোষগুলো এই মুহূর্তে খুব বেশী সক্রিয় হয়ে উঠেছে, জানো তো, আবেগ ও অনুভূতি একসাথে ছোটে, তাই মাথার যন্ত্রণাও ডাবল হয়ে গেছে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে আমি ফোনে আলাপ করেছি। উনি বলেছেন, তোমার রোগটির নাম হচ্ছে 'ব্যাংলাডেশ সিনড্রোম' [ সরি, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তো তোমার বকা খায় নি, তাই বাংলাডেশ বলতে শিখেনি, হা হা হা]। উনি
উনি তোমাকে খুব লো ডোজে ট্র্যাঙ্কুইলাইজার দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। দুঃশ্চিন্তা করতে না করেছেন, প্রতি রাতে এক গ্লাস দুধ খাওয়ার কথাও বলেছেন। আর আমার স্ত্রী বলেছেন, তোমার খাঁচার ঢাকা খুলে দিতে, তুমি ডানা মেলে উড়ে যাও বাংলাডেশ নামের সেই স্বপ্নপুরীতে। সেখানে গিয়ে তুমি সবার হাতে হাত রাখো, ডেভিলদেরকে ঝাড়ু পেটা দিয়ে আমাদের আমেরিকা পাঠিয়ে দাও। দেখো, আমরা কী ব্যবস্থা করি! হা হা হা!
মিস বাংলাডেশ, মুখ নীচু করে বসে আছো কেন? কী, পছন্দ হলো না আমার পরামর্শ?

তিনি ব্যাগ থেকে টিস্যু পেপার বের করে দুই চোখে চেপে ধরলেন। দুই মিনিট পর ডাঃ ফ্রিলুক্সের দিকে তাকাতে পারলেন। ডাঃ ফ্রিলুক্স চোখ টিপে 'ইটস ওকে' করলেন। এবার তিনি মুখ ফুটে শুধু বললেন,
ডঃ তোমার স্ত্রীকে আমার সালাম দিও। আমার অসুখ তিনিই ধরতে পেরেছেন বলে নয়, সালাম জানাচ্ছি, উনি ইন্টারনেটে গিয়ে আমার বাংলাদেশ সম্পর্কে পড়াশোনা করেছেন, উনি আমার কষ্ট বুঝতে পেরেছেন, উনি আমার দুঃখে সমব্যথী হয়েছেন, উনি বাংলাদেশের 'ডেভিল' দের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের মানবতার দিকটি বড় করে দেখেছেন! আর তুমি? এমন একজন অসাধারণ মহিলার স্বামী, তুমিও অসাধারণ। আমি একজন নিয়মিত রুগী বই তো কিছু নই। তুমি আমাকে খুশী করার জন্য 'মেড ইন বাংলাদেশ' শার্ট কিনেছ এবং তা আজকেই পড়ে এসেছো। আমি তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। উপচে পড়া ভালোবাসা থেকে তোমাদেরকে কিছু দিতে চাই, নাহলে বুকটাতে খুব বেশী চাপ হয়ে যাচ্ছে!


মন্ত্রী মহোদয়, আল্লার দোহাই লাগে, আর ভুলভাল কিছু বলবেন না, প্লীজ!

 গত দুটি দিন টিভির পর্দায় চোখ রাখতে পারছি না। গত দুটি দিন মুখে ভাত তুলতে পারছি না। গত দুটি দিন ধরে কারো সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছি না। গত দু'রাত দুচোখের পাতা বন্ধ করতে পারছি না।  চোখে ভাসে শুধু সাভারের 'রানা প্লাজার' ধ্বংস্তুপের ছবি, নুপূর ঝুলতে থাকা একটি পায়ের ছবি, কালো বুট জুতা পরা আরেকটি পায়ের ছবি, মৃত্যুর আগে যে যুবক তার প্রিয় কোন জনকে জরিয়ে ধরে রেখেছিল, সেই ছবি, একটি সাদা কাগজ হাতে ধরা কোন এক নারীর হাতের ছবি, শুধু ছবি আর ছবি, ছবি আর ছবি। পত্রিকার পাতায় চোখ বুলাতে পারিনা, মৃত লাশগুলোর ছবি দেখলেই এড়িয়ে যাই, ব্লগে যেতে পারছি না, সেখানেও মাতম আর ক্রোধ, ফেসবুকে বসি, সেখানেও একই দৃশ্য। কে বলে যে ব্লগাররা 'নাস্তিক'? যারা ব্লগারদেরকে 'নাস্তিক বলে, এমনকী প্রধানমন্ত্রীকে বাধ্য করা হয়, সংসদে দাঁড়িয়ে বলতে " নাস্তিক ব্লগারদের গ্রেফতার করা হয়েছে" , সেই তারা একটিবার এসে উঁকী দিয়ে যাক, ব্লগে কী চলছে! আজ ব্লগ বেঁচে আছে বলেই রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে দুই হাজারের বেশী আহতকে জীবিত অবস্থায় বের করা সম্ভব হয়েছে, ব্লগ বেঁচে আছে বলেই রক্তদানকারীর ভীড় ক্রমশঃ বাড়ছে! ব্লগাররা প্রয়োজনের বাইরে  অতিরিক্ত কিছু বলছেও না, করছেও না। এই ব্লগারদের মন্ত্রীত্ব পাওয়ার বাসনা নেই, মন্ত্রীত্ব টিকিয়ে রাখারও ব্যাপার নেই। তাই তারা অপ্রোয়জনীয়, গা-জ্বালানো, অমানবিক, নিষ্ঠুর মন্তব্য ছোঁড়াছুঁড়ির প্রতিযোগীতাতেও লিপ্ত হয় নি। তারা দূর্গতদের উদ্ধার সেবায় যত রকম উপায়ে সম্ভব, কাজ করে চলেছে।



গত সপ্তাহে আমেরিকার বোস্টনে ঘটে গেল ভয়ানক বোমা হামলার ঘটনা।  শতবর্ষ পুরানো ঐতিহ্যবাহী ম্যারাথন রেসের শেষ মুহূর্তে আচম্বিতে পর পর দুটো বোমা বিস্ফোরিত হয়। তিনজনের মৃত্যু হয়, আহত হয় শতাধিক। কে বা কারা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, তা খুঁজে দেখার আগে আমেরিকান পুলিশ বাহিনী  বোমা হামলায় আহত-নিহতদের উদ্ধারকাজেই বেশী তৎপর হয়ে উঠে। টিভি সংবাদগুলোতেও শুধুমাত্র বোমা বিস্ফোরণের সংবাদই প্রচারিত হচ্ছিল, সাথে পুলিশী উদ্ধার অভিযানের সংবাদ।  সংবাদ প্রচারের মাঝে মাঝেই সিটি মেয়র, পুলিশ প্রধান, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ছোট ছোট মন্তব্য প্রচার করা হচ্ছিল। মন্তব্যগুলো প্রচারের প্রধান ঊদ্দেশ্যই ছিল, জনগণকে আশ্বাস দেয়া যে বিপদের সময় ধৈর্য্য হারাতে নেই, বিপদের সময় ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে যাওয়াটাই প্রধান কাজ। ঐক্যবদ্ধ জাতিকে ঈশ্বর সহায়তা করেন।  মত ও পথের পার্থক্য থাকা সত্বেও প্রতিটি আমেরিকান মনে প্রাণে একটি মন্ত্র জপে যায় "গড ব্লেস আমেরিকা" !

প্রথম দেড়দিন আসামী ধরা পড়েনি, এবং প্রশাসন থেকে আগে ভাগে কোন মন্তব্যও করা হয় নি।  প্রেসিডেন্ট ভবন থেকেও কোন মন্তব্য করা হয় নি, এমন কি আমেরিকান জনগণও অগ্রিম কোন মন্তব্য করে নি।  আগে ভাগে মন্তব্য করার অভ্যাস বোধ হয় একমাত্র বাঙালীদেরই আছে। যেদিন বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে, সেদিন আমি ছিলাম কর্মস্থলে। বাড়ী ফিরেই টিভি অন করে বাংলা চ্যানেল দেখতে চাইছিলাম, আমার স্বামী জানালেন যে বোস্টনে ম্যারাথন রেস চলাকালীন সময়ে বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে। আমি কোন আগুপিছু চিন্তা না করেই বলে দিলাম, " জেহাদীদের কাজ"। আমার স্বামী জাতিতে বাঙালী হলেও  কথা বার্তায় আমেরিকানদের মত হিসেবী, আমার মত বেহিসেবী কথা বলেন না। 'জেহাদী' বলার সাথে সাথে উনি আমাকে থামিয়ে দিলেন এই বলে যে না জেনে কোন মন্তব্য করা ঠিক না। ফেসবুকে দেখলাম, দুই একজন মন্তব্য করেছে, " আরে, ঐ নাফিস যদি পুলিশের হাতে ধরা না পড়তো, তাহলে তো সেও এমন কাজই করতো"।

দেখা গেল আমার কথাই ঠিক হয়েছে। যদিও বোমা বিস্ফোরণের সাথে সাথেই আসামী ধরা পড়ে নি, যখন ধরা পড়েছে, তখন জানা গেল চেচনিয়ান দুই সহোদর মিলে এই কান্ড করেছে। পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে এক ভাই  মারা গেছে, ছোট ভাই আহত হয়ে ধরা পড়েছে। আমার কথাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল আমার স্বামী, দুইদিন পরেই আমার কথার সত্যতা মিলে যাওয়ায় মনে মনে বেশ আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছি। কিন্তু এত কিছুর পরেও প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে, মন্ত্রীদের কাছ থেকে, প্রশাসন থেকেও কোন রকম উস্কাণীমূলক মন্তব্য শোনা যায় নি। ব্যাপারটি আমাকে একটু ভাবিয়ে তুলেছে।

আমি প্রতিদিন বাংলাদেশের সংবাদপত্র পড়ি, টিভিতে বাংলা চ্যানেল দেখি, দেশে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজনকে ফোন করি, সর্বোপরি ফেসবুক তো আছেই। প্রতিদিনই কিছু না কিছু ঘটছে, আর সেই ঘটনা নিয়ে চলছে রটনা, জল্পনা, কল্পনা, সহ আরও কত রকমের কথার ফুলঝুরী। কথার ফুলঝুরী ছোটাতে সকলেই ওস্তাদ। ডক্টরেট থেকে শুরু করে পানের দোকানী, জ্ঞানবৃদ্ধ থেকে শুরু করে পাড়ার বখাটে যুবক, ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন থেকে শুরু করে হালের হেফাজতের ক্যাডার, সকলেই কথার ফুলঝুরী ছোটায়। তবে কথার যাদুতে বাংলাদেশের মন্ত্রী-মিনিস্টাররা থাকেন সবার উপরে। উনারা এমন একেকটি মন্তব্য করেন যা শুনে দু'রকম প্রতিক্রিয়া হয়। যেমন মন্ত্রীর কথা যদি খুবই যুক্তিযুক্ত হয়, উনার অনুসারীরা তাহলে আনন্দের চোটে ক্যানেস্তারা পিটিয়ে কথার যুক্তিকে আরও পাকাপোক্ত করে ফেলে, তখন মন্ত্রীর বিরোধী শিবিরে চলে এক ধরণের নীরবতা বা মন্ত্রীকে খাটো করার ফন্দী আঁটার চেষ্টা। আর মন্ত্রী যদি বেফাঁস কিছু বলে ফেলে, তাহলে মন্ত্রীর অনুসারীদের মুখ আড়াল করার উপক্রম হয়ে যায়, কারণ বিরোধী শিবিরে তখন মন্ত্রীকে নিয়ে চলে হাসাহাসি আর উপহাস। উপহাস না করে উপায়ই বা কী!

বাংলাদেশের মন্ত্রীদের কথা উঠলেই প্রথমেই 'স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী' পদটির দিকে নজর চলে যায়। বাংলাদেশের 'স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী' নামক চেয়ারের গদীটি কোন আমলের কে জানে! মাঝে মাঝে মনে হয়, চেয়ারটি 'গোপাল ভাঁড়ের' ছিল না তো! নাহলে এমন হবে কেন? যিনিই এই চেয়ারটিতে এসে বসেন, তিনিই কেমন করে যেন পালটে যান। তা তিনি অবসরপ্রাপ্ত  জেনারেলই হোন, অথবা ডক্টরেট ডিগ্রীধারী অবসর প্রাপ্ত ডাকসাইটে আমলাই হোন! এই চেয়ারটির কাছাকাছি যাঁরা থাকেন, তারাও কিন্তু কম যান না। চুলে জেল মাখা, অর্ধশিক্ষিত পাঙ্কুই হোক অথবা একসময়ের আইনজীবি, রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মঠ রাজনৈতিক  নারীকর্মীই হোক, তিনি বয়স্কই হোন অথবা যুবকই হোন, পুরুষই হোন অথবা নারীই হোন, ফলাফল  কিন্তু একই। 'স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী' নামের গদীওয়ালা চেয়ারে বসলেই তাঁদের বাক-ভ্রম হয়। মাঝে মাঝেই উল্টো-পাল্টা কথা বলে ফেলেন। তাঁরা মেঘের ডাকও বুঝেন না, ব্যাঙের ডাকও বুঝেন না। এমন সব মন্তব্য করেন যে মানুষ অমর না হলেও তাদের মন্তব্যগুলো 'অমরত্ব' লাভ করে।

তেমনই অমরত্ব লাভ করা কয়েকটি মন্তব্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে,
" আল্লাহর মাল আল্লায় নিয়া গেছে"
"উই আর লুকিং ফর শত্রু"
"৪৮ ঘন্টার মধ্যে 'সাগর-রুনী' হত্যাকান্ডের খুনী ধরা পড়বে"
"হরতালকারীরা ফাটল ধরা দেয়ালে নাড়া দিছে বলেই বিল্ডিং ধ্বসে পড়েছে"।

'অমরত্ব' পাওয়া প্রথম দুটি মন্তব্যের কথা বাদ দিলাম, কারণ মন্তব্যকারীরা এখন হিসেবের খাতায় নেই, অনেক আগেই তামাদি হয়ে গেছে। 'তৃতীয়' মন্তব্যটি তামাদিও হয় নি, আবার তরতাজা অবস্থায়ও নেই। কিন্তু সমস্যা হয়েছে চতুর্থ মন্তব্যটি নিয়ে। এই মন্তব্যটি এখনও খুবই সতেজ আছে, তামাদি হতে দেরী হবে। কারণ 'রানা প্লাজা'র ধ্বংসস্তুপ থেকে এখনও মানুষের গোঙাণী শোনা যাচ্ছে। 'রানা প্লাজা'র মালিক, সোহেল রানা আওয়ামী যুবলীগের স্থানীয় নেতা, প্রচন্ড প্রভাবশালী,  জমি দখলকারী। আর মন্তব্যটি করেছেন স্বয়ং বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়।  এই মন্তব্যটি ছাড়াও শুরু থেকেই সরকার থেকেই এক ধরণের অযৌক্তিক দাবী করা হচ্ছে যে সোহেল রানা যুবলীগের কেউ নয়। সাভারবাসী সকলেই সাক্ষ্য দিচ্ছে রানার বিরুদ্ধে, এমনকী আওয়ামীলীগের নেতারাও বলেছেন রানার অত্যাচার, জোর জুলুমের কথা, কিন্তু সরকার এই ব্যাপারটিকে অযথাই অস্বীকার করতে চাইছে। যে আওয়ামী লীগের গায়ে বিরোধীপক্ষ লেবেল এঁটে দিয়েছে হিন্দুদের ভোট পাওয়া দল বলে, সেই আওয়ামী রাজনীতির লেবেল গায়ে এঁটে কী করে সোহেল রানা 'রবীন্দ্রনাথ সাহা' নামের হিন্দু ব্যক্তির জমি জবরদখল করে নিল?  এই অভিযোগ তো আর মিথ্যে নয়? আর  সোহেল রানা  যদি যুবলীগের কেউ না-ই হবে, তাহলে তাকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কারের কথা উঠছে কেন?

পাঙ্কু বাবর অথবা আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে নিয়ে কারোরই কোন আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে আমাদের আগ্রহ আছে। ডঃ ম, খা, আলমগীর সাহেব অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান, উনার বড় ভাই  ডঃ বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, উনার ভাতিজা  ডঃ মুনতাসীর মামুন বাংলাদেশের কৃতি সন্তান। এত উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী সন্তানদের কাছ থেকে দেশ ও দেশের জনগণ অমন বেহিসেবী মন্তব্য আশা করে না। সত্যি কথা স্বীকার করে নিতে বাধা কোথায়? হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান হয় না, একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সকলেই আদর্শবাদী হয় না। সোহেল রানার কোন আদর্শ নেই, এটা তো আপনাদের দোষ নয়। তাহলে স্বীকার করতে অসুবিধা কোথায় যে, সোহেল রানা যুবলীগের নেতা, কিন্তু যেহেতু সে চরম অন্যায় করেছে, দন্ড তাকে পেতেই হবে।
কেন ঘটনার আদ্যোপান্ত না জেনেই আপনারা মন্তব্য করেন? কেনই বা প্রধানমন্ত্রীকেও বলতে হয় যে সোহেল রানা নামে কেউ যুবলীগের নাম তালিকায় নেই! কেনই বা কেন্দ্রীয় যুবলীগের সভা আহবান করা হয় সোহেল রানার বিরুদ্ধে অ্যাকশান নেয়ার জন্য! কেনই বা হানিফ সাহেবকে বলতে হয়, উলটাপালটা মন্তব্য না করে আর্তের সেবায় এগিয়ে আসুন।

মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়, আমরা যারা সাধারণ মানুষ, আমরা অনেক কথাই বলতে পারি, কিন্তু আপনি যতক্ষণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নামক চেয়ারটিতে আসীন আছেন, আপনি তো বলতে পারেন না, কারণ আপনাদের একেকটি কথার মূল্য অনেক। আপনারা ভাল কথা বললে আমরা খুশী হই, কেন হই জানেন? তাহলে বিরোধী পক্ষকে চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিতে পারি, " এই দেখো, আমাদের দলের নেতা নেত্রীদের মধ্যে কোন ছল চাতুরী নেই। উনারা সাদাকে সাদা দেখেন, কালোকে কালো। খুনীকে খুনীই বলেন, নিজ দলের হলেও বলেন, সাধুকে বলেন সাধু, অন্য দলের হলেও।" কেন সোহেল রানাকে অস্বীকার করছেন, ভাবছেন স্বীকার করে নিলে  জনসমর্থণ কমে যাবে? একেবারেই ভুল, আপনারা অযথাই ভয় পাচ্ছেন! আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, যতই ভুল ভ্রান্তি হোক, তার পরেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, অসাম্প্রদায়িক চেতনাগুলো আওয়ামীলীগের কাছেই নিরাপদ, আমরা আওয়ামীলীগের প্রাণ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখি মায়ের মত। আপনাদেরকে ভালোবাসি বলেই ভুলগুলো বড় বেশী চোখে লাগে! জনগণ সাহসী, সৎ সত্যবাদী, দয়ালু, কর্মঠ, বিনয়ী শাসক চায়। বিনয়, নমনীয়তা মানুষকে অনেক উঁচুতে তুলে দেয়। যা চলে গেছে, যে চলে গেছে, যারা চলে গেছে, তারা চিরদিনের তরেই চলে গেছে, যারা রয়ে গেছে, আসুন সবাই মিলে তাদেরকেই সুস্থ করে তুলতে সহযোগীতা করি। দেশের জরুরী মুহূর্তে সব বিভেদনীতি ভুলে গিয়ে, রাজনৈতিক জিঘাংসাকে পেছনে ঠেলে দিয়ে, কিছুটা আমেরিকান স্টাইলে  কথা কম বলি, কাজ বেশী করি।  আমেরিকান স্টাইলে  আমরাও বলি " গড ব্লেস বাংলাদেশ"! 'গড' বলতে যদি  নীতিগত বা ধর্মীয় সমস্যা থাকে, তাহলে না হয় বলি , " আল্লাহ ব্লেস বাংলাদেশ"!

Wednesday, April 24, 2013

চাচা, বৌমার ছোট্ট আব্দারটুকু রাখতেই হবে!

কিশোরগঞ্জের সন্তান, সাতবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য, বর্তমান সংসদের স্পীকার, আবদুল হামিদ সাহেব বাংলাদেশের বিশতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন, খবরটি শোনার সাথে সাথে আনন্দে আমার ডিগবাজী খাওয়ার মত অবস্থা। কিন্তু ডিগবাজী খেতে পারছি না। একেতো বয়স হয়ে গেছে, তার উপর আবদুল হামিদ সাহেব সম্পর্কে আমার 'চাচাশ্বশুর' হন। বৌমা বলে কথা, অমন শিশুসুলভ আচরণ করা তো ঠিক না। আমার শ্বশুর ভাগ্যটা বেশ ভাল, আগের রাষ্ট্রপতি সদ্য প্রয়াত জিল্লুর রহমান সাহেবও সম্পর্কে আমার 'চাচা শ্বশুর' ছিলেন। এই জন্যই আমার এত আনন্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতর এক চিলতে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। দেরী না করে চট করে বসে গেলাম কাগজ আর কলম নিয়ে। হামিদ চাচাকে অভিনন্দন জানিয়ে একটা চিঠি লিখে ফেললাম। 'রাষ্ট্রপতি ভবনের' ঠিকানায় না পাঠিয়ে চিঠিখানি আকাশের ঠিকানায় ছেড়ে দিলাম।

প্রিয় হামিদ চাচা,
সালাম নিবেন। আমারে চিনছুইন? আপনেরার গ্রামের রায় বাড়ীর বউ আমি। আমার শ্বশুর মশাইকে 'রায় দাদা' বলে ডাকতেন, সেই হিসেবে আমার স্বামী আপনাকে চাচা বলে ডাকতো। অনেক বছর আগের কথা, ভুলে যেতেই পারেন, এত কর্মব্যস্ত মানুষ আপনি। তবে আমার কিন্তু সব কথা মনে আছে। প্রথম যখন শ্বশুর বাড়ীর ভিটায় পা দিলাম, তখন থেকেই আমি কিশোরগঞ্জকে ভালোবেসে ফেললাম। কয়দিন সবার সাথে থেকে থেকে দুই চারটা শব্দও শিখে ফেললাম। যেমন, গ্রামের সকলের মুখে 'আমরার' ' তুমরার', ' খাইছুইন' , 'গেছুইন', 'বালা আছুইন', 'চিনছুইন নি আমারে' শুনতে এত ভালো লাগতো যে আমিও মাঝে মাঝে আমার স্বামীর সাথে ওভাবে কথা বলার চেষ্টা করতাম। ভীষন সরল, সহজ, মাটির জীবন আপনাদের। আমার স্বামী, অর্থাৎ আপনাদের 'রায় দাদা'র ছেলেও আপনার মতই খুব সহজ, সরল জীবনে অভ্যস্ত। এখনও জিল্লুর চাচার কথা বলে, তার মন খারাপ হয়, সাথে সাথে আমার মনও খারাপ হয়ে যায়। বড় ভাল মানুষ ছিলেন তিনি। জিল্লুর চাচা রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর আমরা অনেক খুশী হয়েছিলাম। আপনি স্পীকার হয়েছিলেন জেনে আরও অনেক বেশী খুশী হয়েছিলাম। কিশোরগঞ্জের রত্ন আপনারা।


মনে আছে, প্রথম যখন বউ হয়ে গেলাম, মাথা ঢাকা ঘোমটা দেখে অনেকেই অবাক হয়ে গিয়েছিল, তাদের ধারণা ছিল, 'শহইরা বিবি' মাথায় ঘোমটা দিতে জানে না। যখন 'চাচা', চাচীদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছিল, সে ছিল এক মজার কান্ড। আমি মাটিতে নীচু হয়ে বসে সব গুরুস্থানীয়দের প্রনাম করছিলাম, গ্রামের মানুষগুলো যেন 'বোবা' হয়ে গেল! এ ওকে চিমটি কাটে, একজন আরেকজনকে একটু ঠেলে দেয়! চাচা, চাচীরা বললেন, " না, আমরার দুলাল তো দেখি খুবই বালা মাইয়া পছন্দ করছুইন। ময় মুরুব্বী মানে, আদব কায়দা জানে। দুলাল ত দেহি বেডা একখান! আম্রিকা থিক্কা মেম বিয়া কইরা আনছুইন না, এক্কেবারে আমরার লাহানই সাদাসিদা মাইয়া বিয়া কইরা আনছুইন"। চাচা, কথাগুলো এখনও কানে বাজে। এই সেদিনও আপনাকে দেখলাম টেলিভিশনে সংসদ পরিচালনা করাকালীন সময়ে, আপনি কথা বললেই আমি বুঝতে পারি, কিশোরগঞ্জী টান। মাটির টান যে বড় বেশী গভীরে টানে।


চাচা, আজ আমরার বড়ই সুখের দিন। আপনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে চীৎকার করে বলি, দেখো আমাদের হামিদ চাচা, কিশোরগঞ্জের অহংকার, দেশের সবচেয়ে উচ্চ আসনে আসীন হয়েছেন! আমরা আগেও খুশী হয়েছিলাম যখন আপনি স্পীকার নির্বাচিত হয়েছিলেন আর জিল্লুর চাচা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিল। এবার আবারও খুশী হয়েছি আপনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ায়। দেশ থেকে কত হাজার হাজার মাইল দূরে আছি আমরা, তারপরেও খুশী হওয়ার বেলায় কোন কমতি দেখছি না। খুশীর চোটে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাসও দিয়ে ফেলেছি, এবং স্ট্যাটাসটি অনেকে লাইক করেছে। আগেই একটা কথা খোলাসা করে নেই, আপনার ভাতিজা, মানে আমার স্বামীকে আমি 'উত্তম কুমার' নামে ডাকি, আপনি নিজেও খুব হাস্যরসপ্রিয় মানুষ, তাই আপনার কাছে 'উত্তম কুমার' রহস্যটা খোলাসা করে দিলাম। চাচা এইবার শোনেন, স্টাটাসে কী লিখেছি,


"অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি কেন আমার উত্তম কুমাররে নিয়া এত্ত অহংকার করি! তাগোরে বুঝাই কেমনে, দেখতে হইব তো, কুন বাড়ীর পোলা সে!! যেন তেন বাড়ীর পোলা না তো সে, রাষ্ট্রপতির ভাইয়ের ছাওয়াল হয় সে। সাধে কী আর উত্তম কুমার ডাকি! জ্বী, ঠিকই বলতেছি, সদ্য প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ছিলেন আমার চাচা শ্বশুর, আর নতুন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও আমার চাচা শ্বশুর। আর আমি হইলাম তারার অতি আদরের 'বৌমা'।
কিশোরগঞ্জের ছেলে, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, আপনাকে অভিনন্দন! বৌমার একটি অনুরোধ রাখতেই হবে, আমরার 'চাইর ব্লগার' রে এইবার মুক্তি দেন চাচা! বৌমার এই আব্দারটুকু রাখেন!!!"


চাচা, সংসদীয় গণতন্ত্রে 'রাষ্ট্রপতি'আসনটি দেশের সর্বোচ্চ পদ হলেও, দেশ পরিচালনায় 'রাষ্ট্রপতি'র নাকি কোন ভূমিকাই থাকে না! এমন ধারণা থাকার পরেও আপনার শরনাপন্ন হলাম। চাচা, নিজের জন্য আমি কারো কাছে কোনদিনই কিছু চাইনি, আজ গ্রেফতারকৃত চারজন মেধাবী ব্লগারের মুক্তির জন্য আপনার দ্বারস্থ হয়েছি। আপনিই শেষ ভরসা। চাচা, এর আগে আমি আরও কয়েক দরজা ঘুরে এসেছি, কারো কাছ থেকে কোন সাড়া পাই নি। মায়ের প্রাণ আমার, ওদের চিন্তায় অস্থির থাকি। মা যে কী জিনিস, ভুক্তভুগী মাত্রেই জানে। চাচা, আমাকে হয়তো আপনার মনে পড়ছে না, চিনতেও পারছেন না, কিন্তু আমাকে আমার শ্বশুরবাড়ীর গ্রামসুদ্ধ মানুষ 'ভাল বৌ' হিসেবে জানে। আমিও আমার শ্বশুর বাড়ী নিয়ে গর্ব করি, জিল্লুর চাচা আর আপনাকে নিয়ে গর্ব করি। চাচা, আপনার বৌমাকে খালি হাতে ফিরায়ে দিবেন না!


চাচা, আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, এর আগের রাষ্ট্রপতিরা কিন্তু 'খুনের আসামী'র মৃত্যুদন্ড মওকুফ করে দিয়েছিলেন। ভেবে দেখেন, ওরা ছিল 'খুনের আসামী', আর এই চার ব্লগার খুন, রাহাজানি, চুরী ডাকাতি কিছুই করেনি, মিডিয়ায় লেখালেখির জন্য আজ তাদেরকে এত হেনস্থা করা হচ্ছে। চাচা, আওয়ামীলীগ এত বেশী পুরানো দল হয়েও ভুল ভ্রান্তি প্রচুর করছে। এই যে চারজন ব্লগারকে আটকে রাখা হয়েছে, এটা কিন্তু বিরাট ভুল। এরা প্রগতীশীল, এরা মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন যুবক। ওদের সকলেই দেশের উন্নতির কথা ভাবে, দেশ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের নির্মূল করতে চায়। ওদের সকলেই হয়তো বা আওয়ামী রাজনীতি করেনা, কিন্তু ওরা বিশ্বাস করে যে একমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষেই সম্ভব এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সমাপ্ত করা। তাই এই তরুণেরাই বর্তমান সরকারের পক্ষাবলম্বন করে বাংলা ব্লগে কলমযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। এই সকল তরুণ ব্লগারদের মেধার কাছে পরাজিত হয়ে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিরোধীপক্ষ অন্যায়ভাবে, মিথ্যাচার করে এই মেধাবী কলমযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে ক্ষেপিয়ে তুলতে চাইছে। মিথ্যাচার করতে গিয়ে ওরা শেষ পর্যন্ত পবিত্র ধর্ম ইসলামকে ব্যবহার করেছে, তারা সকল ব্লগারদেরকে 'নাস্তিক' আখ্যা দিয়ে দেশবাসীর চোখে ভিলেন বানাতে চেয়েছে।


চাচা, বিরোধীপক্ষ এত বেশী মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছে যে ওরা এখন আর কোন রাখ-ঢাক মানছে না, গলগল করে মিথ্যে বলে যাচ্ছে। এই সেদিনও বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য, সরদার শাখাওয়াত হোসেন বকুল, '৭১ টিভি মঞ্চে, বঙ্গবন্ধুর নামে চরম মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল। উনি বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু নাকি ১৯৭৪ সালের ও আই সি সম্মেলনে যুদ্ধাপরাধী শাহ আজিজুর রহমানকে সফরসঙ্গী হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন। চাচা, অনুষ্ঠানে উপস্থিত অপর দুই রাজনীতিবিদ কিন্তু মুখ বন্ধ করেছিলেন, কোন প্রতিবাদ করতে পারেননি। আমরাও এই মিথ্যে কথাটিই বিশ্বাস করে ফেলতাম যদি না ঐ মুহূর্তে তোফায়েল চাচা উনার বাড়ী থেকে স্টুডিওতে ফোন করতেন। তোফায়েল চাচা বকুল সাহেবের মিথ্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে উনাকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন, এমন অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রমান দেখানোর জন্য। চাচা, ভেবেছিলাম, বকুল সাহেব লজ্জা পেয়েছেন, আর কথা বাড়াবেন না এই বিষয়ে। কিন্তু ' বেলাজের যদি থাকে লাজ, ভাবিয়া মরার কোন কাজ" হয়েছে অবস্থা। বকুল সাহেব আরও বড় কেলেংকারী করে ফেলেছেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে পাকিস্তানের প্রটোকল অফিসারের ছবি দেখিয়ে বলেছে, ঐটিই শাহ আজিজুর রহমান। সেদিন মঞ্চে উপস্থিত অন্য দুই তুখোড় সাংবাদিকের সামনে বকুল সাহেবের মিথ্যাচার ধরা পড়ে যেতেই, আমাদের কাছে বাকী সব দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গেছে।


চাচা, এবার বিশ্বাস করতেই পারেন, বিরোধীপক্ষের আসল টার্গেট আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা। যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এরা মরীয়া হয়ে গেছে। কত রকম ফন্দী ফিকির খুঁজছে, ব্লগে, টকশো'তে, কিছু পত্রিকায় এদের পোষা কর্মচারীরা মিথ্যাচার করেই যাচ্ছে। আর ঠিক এই প্রয়োজনীয় মুহূর্তে সরকার চারজন নিরীহ ব্লগারকে আটকে রেখেছে, এটা কী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরাট ভুল সিদ্ধান্ত নয়? ওরা আটক আছে বলে কেউ স্বাধীনভাবে কিছু লিখতেও পারছে না, পাছে আবার কোন গ্যাঁড়াকলে পড়তে হয়! অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে চাচা। এই ব্লগাররা মুক্ত হয়ে গেলেই অন্যান্যরা আবার নতুন উদ্যমে বর্তমান সরকারের পক্ষে কলম চালিয়ে যেতে পারতো। আর মাত্র কয়েক মাস আছে নির্বাচনের, বিরোধী শিবিরের ওরা কিন্তু থেমে নেই, মিথ্যার বেসাতী সাজিয়ে নিয়ে বসেছে নানা মিডিয়ায়, ব্লগে, টকশোতে। আর প্রগতীশীল ব্লগাররা সতীর্থদের মুক্তির অপেক্ষায় বসে আছে, সতীর্থদের মুক্তির জন্য আন্দোলন করছে।


শুধু কী বকুল সাহেব? এই তো সেদিন, নাজিউর রহমান মঞ্জুরের ছেলে আন্দালিব রহমান পার্থ, কী বিশ্রী ভাষায়, বিশ্রী ভঙ্গীতে ব্লগারদেরকে গালিগালাজ করলো, সবচেয়ে মারাত্মক ভুল সে করেছে যা অনেকের চোখ এড়িয়ে গিয়েছে, তা হলো, সে দুই নেত্রীকে অপদস্থ করেছে সবার সামনে, বলেছে দুই নেত্রীর নিজের মতামত ছাড়া কোন কাজ হয় না, সে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপুমনির নামোল্লেখ করে যাচ্ছে তাই সমালোচণা করেছে, সর্বশেষ সে বাপের বয়সী নেতা , বর্ষিয়ান তোফায়েল আহমেদ চাচার নাম ধরে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে, এতই অভব্য হয়ে উঠেছে এরা যে তোফায়েল চাচার নামের শেষে 'চাচা' সম্বোধণটুকু করে নি। এই তো হচ্ছে বিরোধী শিবিরের চেহারা। চাচা, টকশো'তে উপস্থিত থাকে আওয়ামীলীগ ঘরাণার অন্য টকাররা, কেউ পারেনা এই সব বেয়াদবদের মুখের উপর প্রতিবাদ করতে, আমাদের মত ব্লগারদেরই এগিয়ে আসতে হয়। আপনি হয়তো জানেন না, ব্লগে ব্লগে এখন শুধু কলমযুদ্ধ চলছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি আর বিপক্ষশক্তির মধ্যে। আস্তিক-নাস্তিক কিছুই না চাচা। আমার কথা বিশ্বাস করুন, প্লীজ!



চাচা, চারজনকে ছেড়ে দিন, বৌমার অনুরোধটুকু রাখুন। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ভোট ছাড়া কোন দলই ক্ষমতায় যেতে পারবে না। যদি চার ব্লগারের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগে ন্যুনতম সত্যতাও থেকে থাকে, এতদিনেও কী ওদের শাস্তি শেষ হয় নি? আপনারা তো আইন করলেন এই সেদিন, [ ওরা লিখেছে বলে আমরা কেউ বিশ্বাস করি না, তবুও তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম], ওদের বয়স কম, সারাটা জীবন পড়ে আছে সামনে, মেধাবী ছেলে সব, কী এক তুচ্ছ কারণে ওদের আটকে রাখা হয়েছে, আমার এই সোনার দেশটা এগোবে কাদেরকে নিয়ে? চাচা, প্লীজ ওদের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিন, ওদেরকে বলুন যেন এই ধরণের হঠকারীতা আর কখনও না করে। এরপরেও যদি ওরা আবার একই কাজ করে, তাহলে যে সাজা পাওনা হবে , সে সাজাই ওদেরকে দিন।


চাচা, এত বড় সম্মান, এত বড় দায়িত্ব সৃষ্টিকর্তা আপনার কাঁধে অর্পণ করেছেন, আপনি দেশের সর্বময় কর্তা, আপনার আগে দুই রাষ্ট্রপতি খুনের আসামীর সাজা মওকুফ করে দিয়েছিলেন, জিল্লুর চাচার এত প্রশংসার মধ্যেও এই একটি কাজ বেমানান হয়ে আছে, আর ইয়াজুদ্দীন সাহেবের তো কথাই নেই, এমন মানী -জ্ঞাণী একজন অধ্যাপক, কোন ভাল কাজের নিদর্শন রেখে যেতে পারেন নি। আপনি মাত্র কয়েক মাসের জন্য দায়িত্ব পেয়েছেন, চাইলে এইটুকু সময়ের মধ্যেই অনেক কিছু করে ফেলতে পারেন, যেমনটি করেছেন তোফায়েল চাচা। এক ধমকে শাখাওয়াত বকুলদের 'মিথ্যাচার'এর মুখোশ জনগনের সামনে তুলে ধরেছেন, আর আমরা যারা ব্লগে লেখালেখি করি, তারা পুরো ব্যাপারটিকে লুফে নিয়েছি। আপনার দিকে তাকিয়ে আছি, চার ব্লগারকে মুক্তি দিন, ওদেরকে সাথে নিয়ে আমরা বাকী সব মিথ্যুকদের মুখোশ উন্মোচন করে দেবো, আমরা আর পেছনের দিকে তাকাতে চাই না, সোনার বাংলা গড়ার দৃপ্ত শপথ নিয়েই মাঠে নেমেছি। আমরা থাকবো না, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর দেশ রেখে যেতে চাই। জয় আমাদের সুনিশ্চিত, আপনি শুধু পাশে থাকুন চাচা।

আপনাদের 'বৌমা'।
মিসিসিপি, আমেরিকা

Monday, April 22, 2013

কারাগারের বাগান থেকে বেরিয়ে!!!!!!


অনেক অনেক দিন পর, আজ আমি আমার বাগানে একটুক্ষণের জন্য উঁকী দিয়েছিলাম। ওমা! বাগানে উঁকী দিয়েই তো আমি থ' বনে গেছি। তাজ্জব ঘটনা, ন্যাড়ামুন্ডি গোলাপ গাছে ইয়া বড় বড় গোলাপ ফুটে আছে। গত চার বছরে এমনটি আর দেখিনি। আমি বাগান করতে ভালোবাসি, তাই বাগানের ছোটখাটো পরিবর্তণগুলোও আমার নজর এড়ায় না! কৌতুহল জাগলো, ভাবলাম, দেখি তো ওদেরকে জিজ্ঞেস করে, এমন অসময়ে ওরা কোথা থেকে এলো, কেনই বা এলো!

প্রথমেই গেলাম আগুন রঙা গোলাপের কাছে! জিজ্ঞেস করলাম,

" কী গো আগুন সুন্দরী, কী মনে করে এই অসময়ে আমার বাগানে এসেছো"?

-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন দিদি, একটু আগে আগেই চলে আসতে হলো। যেখানে ছিলাম, সেখানকার পরিবেশ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, আমাদেরও মাথা গরম হচ্ছিল নানা রকম দূরাচার দেখে। এমনিতেই আমার সারা দেহে আগুন জ্বলে, তার উপর যদি এমন অবিচার করা হয় আমাদের প্রতি~~~

-ঠিক ধরতে পারছি না ব্যাপারটা, কিছু মনে করো না আগুন সুন্দরী, তুমি কোথা থেকে এসেছো, জানতে পারি? জায়গার নাম বলতে যদি কোন সমস্যা থাকে, তাহলে বলতে হবে না,
তোমাদেরকে দেখে আমি খুবই খুশী হয়েছি, জানো তো, গত আড়াই মাস ধরে আমার মন খারাপ, কিছুই ভালো লাগে না। বাংলাদেশ নামে একটি ছোট্ট সুন্দর দেশ আছে, আমি সে দেশের মেয়ে, আমেরিকাতে থাকলে কী হবে, মন পড়ে থাকে বাংলাদেশে, কিন্তু বর্তমানে সেই দেশটাতে চলছে ~~~~~~~

-ব্যাস, ব্যাস!! আর বলতে হবে না দিদি, আমি সেখান থেকেই এসেছি।

-কী!! কী বললে!! তুমি বাংলাদেশ থেকে এসেছো? বাংলাদেশের কোন বাড়ীর বাগান আলো করে ছিলে তোমরা? কার বাড়ীর পরিবেশ তোমাদের বাসের অযোগ্য হয়ে উঠলো? তুমি কী মনে করে আমার বাড়ীর বাগানে চলে এলে!!

-হুম! বলি শোন, আমরা কারো বাড়ীতে ছিলাম না, আমরা ছিলাম দেশের সবচেয়ে বড় কারাগারের বাগানে। ভালই ছিলাম, সাজাপ্রাপ্ত আসামীরা আমাদেরকে খুব ভালোবাসতো, আমাদের রূপে মুগ্ধ হয়ে সব সময় যত্ন আত্তি করতো, ধারে কাছে এতটুকুও আগাছা জন্মাতে দিত না, সময় হলেই আমাদের গোড়ায় জল দিত, শুকনো মরা ডাল-পালা ছেঁটে দিত, অর্থাৎ অনেক যতন করে বাগান করতো, তাই আমরাও প্রাণখোলা হাসিতে সকলের মন আলো করে রাখতাম। মালীর কাজ পাওয়া আসামীদের সকলেই সাময়িক সময়ের জন্য দন্ডপ্রাপ্ত, কেউই ফাঁসীর আসামী না, অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত আসামী না। আমাদের একটা সম্মান আছে না!! হাজার হলেও ফুলের রানী বলে কথা!

-সবই তো বুঝলাম, এত সুখ ছেড়ে এখানে এলে কেন?

-সেটাই তো কথা! কলিকাল, কলিকাল! একেবারে ঘোর কলিকাল! নাহলে কোন আক্কেলে একজন যুদ্ধাপরাধীকে মালীর কাজ দেয়! দিদি, তুমিই বলো, এমনিতেই কারাগার মানেই আসামীদের জগত, তারপরেও মেনে নিয়েছিলাম, আসামীরাও তো মানুষ, ওদেরও বাড়ীঘর ছিল, সংসার ছিল, হয়তো মাথা গরম করে কোন অকাজ কুকাজ করে ফেলেছে, এমনতো না যে খুন-খারাবী করে এসেছে, খুনের আসামীদের তো আর মালীর কাজ দেয় না!

-কেন, খুনের আসামীদের মালীর কাজ করতে দেয়া হয় না কেন?

-কী যে বলো দিদি! খুনীদের হাতে কী কখনও ফুল ফোটে? পড়েছো না? যে ফুল ভালোবাসে না, সে মানুষ খুন করতে পারে!

-হ্যাঁ, তা তো পড়েছি। তা কারাগারের নিয়ম ভঙ্গ করে যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামীকে মালীর কাজ দিল??

-এইতো একটা লাখ টাকা দামের প্রশ্ন করেছো? সাধে কী আর কারাগারের বাগান ছেড়ে চলে এসেছি? যে বেটার মৃত্যুদন্ড পাওয়ার কথা, সেই বেটা পেয়েছে যাবজ্জীবন কারাদন্ড! আচ্ছা ভালো কথা, তোমাদের বিচারে যা সঠিক মনে হয়েছে, সেটাই রায় দিয়েছো। আমার আপত্তির কিছু নেই, আমার আপত্তি হচ্ছে, যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামীকে দরকার হলে ভি আই পি মর্য্যাদা দিয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভি আই পি কেবিনে রাখো, রেখেছো তো এক নব্বই বছরের বৃদ্ধকে, একেবারে জামাই আদরেই রেখেছো, তা এই বেটাকেও রাখতে পারতে জামাই আদরে, আমাদের কাছে কেন পাঠিয়েছো বাপু!! যে লোক মুক্তিযুদ্ধের সময় এত এত বাঙালীকে হত্যা করেছে, এত এত নারীদের বলাৎকার করেছে, হিন্দুদের ঘর-বাড়ী লুটপাট করেছে, তাকে কি না পাঠিয়েছো আমাদের বাগানে! আরে, আমরা কী ঘাসফুল নাকি? আমরা হচ্ছি ফুলের রানী, গোলাপসুন্দরী! এমনকি যে মেয়ে দেখতে সুন্দর, তার সৌন্দর্য্য বুঝাতে আমাদের রেফারেন্স টানতে হয়, গোলাপের মত সুন্দর বললে সকলেই বুঝে যায়, মেয়ে কত সুন্দর! আর আমাদের হেফাজতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ঐ যুদ্ধাপরাধীর উপর!! ধিক, তোমাদের এই মানব সমাজকে!

-আগুনসুন্দরী, তোমার কথা শুনে শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে আসছে। তুমি ফুল, তোমারও মান-অপমান বোধ আছে, অথচ আমরা মানুষ, তার উপর আবার বাঙালী, আমাদের মান-অপমান বোধগুলো লোপ পেয়ে যাচ্ছে। সত্যিই তো, তুমিও বুঝতে পারো অপরাধের মাত্রা, অপরাধীর মাত্রা, আর আমরা বুঝি না। তুমি কারাগারের বাগান ছেড়ে চলে এসেছো, একজনের অপরাধে অন্যেরা শাস্তি পাবে যে! যে সব আসামী তোমাকে দেখে প্রিয়জনদের কথা ভুলে থাকতো, তারা এখন কীভাবে দিন কাটাবে? তাছাড়া, মানব সমাজের উপর এত গোসসা তোমাদের, সেই আরেক মানবীর কাছেই তো এলে! হা হা হা !!

-দিদি, শোন, রাগের মাথায় অনেক কথাই বলে ফেলেছি। আমাদের ফুলের মধ্যেও তো অনেক বিভাজন আছে, ধুতুরা ফুলও ফুল, গোলাপ ফুলও ফুল। এবার পার্থক্য করে নাও! তোমরা হচ্ছো, গোলাপ ফুল, আর যুদ্ধাপরাধীগুলি হচ্ছে ধুতুরা ফুল। আর একজনের অপরাধে কেন অন্যেরা শাস্তি পাবে বলছো? এটাই তো হচ্ছে আজকাল! একজনের অপরাধে অন্যেরা শাস্তি পায়, এটাই বাংলাদেশের নিয়ম হয়ে গেছে। তুমি তো আমেরিকা বসে আছো, দেশের ভেতর কী হচ্ছে, সব তো আর জানো না, আমি দেখে এসেছি, কারাগারের ভেতরের অনিয়ম! এই যে চারদিকে ব্লগার ব্লগার শোনা যাচ্ছে, সেই ব্লগারদের কষ্ট দেখেও কষ্ট পেয়েছি। এই চারটি ছেলেও তো অন্যের অপরাধের শাস্তি ভোগ করছে! আমি কী কিছু বুঝিনা ভেবেছো? সবই বুঝি, কারাগার ছেড়ে চলে আসার এটাও একটি কারণ!
বাচ্চা একটা ছেলে শুভ, কী সুন্দর পবিত্র মুখের চেহারা, আরও তিনজনের চেহারাও দেখেছি, কত উচ্চশিক্ষিত ছেলেপেলে সব, তাদের নিয়ে যেই পরিমান টানা হেঁচড়া করা হচ্ছে, দেখে তো আমার গায়ের রঙ আরও বেশী আগুন হয়ে গেছে! এইসব অনাচার, অবিচার সহ্য করতে পারছিলাম না বলেই বিদ্রোহ করেছি। এইজন্যই আমাকে অন্যান্যবারের তুলনায় বেশী 'আগুন' দেখছো।

প্রথমে আমি আমার দলবল নিয়ে বেরিয়ে এসেছি, তুমি তো বাগানে আসো না, ঐ দিকে তাকিয়ে দেখো, মিষ্টিগোলাপীও চলে এসেছে, তবে সদলবলে আসতে পারে নি, কিছু চলে গেছে অন্য বাড়ীতে, তোমার বাড়ীর পেছনে গিয়ে দেখবে, হলুদগোলাপের দল এসে ভীড় করেছে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে, এখনও কুঁড়ি অবস্থায় আছে, ফুটলো বলে। সবাই চলে আসছে, তোমার বাড়ীতে কিছু, তোমার সতীর্থদের বাড়ীতে কিছু , এভাবেই আমরা দলে দলে ভাগ হয়ে গেছি। ঠিক করেছি, কারাগারে যতদিন ঐ বেটা থাকবে, যতদিন ঐ বেটাকে দিয়ে মালীর কাজ করানো হবে, ততদিন আমরা কারাগারে ফিরে যাবো না, তোমাদের বাড়ীতেই ভাগাভাগি করে থেকে যাবো। যদি তোমার আপত্তি থাকে বলো, অন্য কোথাও জায়গা খুঁজে নেবো!

-আগুনসুন্দরী, তুমি সারাজীবন আমার বাগানে থাকো। তোমাকে দেখে অনেক কিছু শেখার আছে। আমরা অযথাই নিজেদেরকে নিয়ে অহংকার করি, " মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব" বলে নিজেদের ঢাক নিজেরা পেটাই! ছিঃ!! একটি ফুল হয়েও তোমার ভেতর যে আত্মসম্মানবোধ আছে, সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও আমাদের মধ্যে তার ছিঁটেফোঁটাও নেই। তুমি থাকো, আমি আমার বন্ধুদের কাছে তোমার এই অভূতপূর্ব প্রতিবাদের কাহিনী গল্প করে বেড়াবো। তোমার গল্প শুনে যদি শতকরা দশজনের ভেতরও চেতনা জাগ্রত হয়, সেটাই হবে আমার বিজয়!

মা'কে ছাড়া মেজদার প্রথম জন্মদিন!

সকাল সাতটা বাজতেই আমার মেজদা'কে একটা কল দিয়েছি। আজ বাইশে এপ্রিল, দুনিয়া উলটে যাবে, কিন্তু মেজদাকে ফোন করবোই। তবে সমস্যা হলো, মেজদার ফোনে শুধু " আমার সারাটা দিন, মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি তোমাকে দিলাম" বাজতেই থাকে। ওপাশ থেকে মেজদা 'হেলো' বলে না। যদি এই নিয়ে অভিযোগ করি, তাহলে বলবে,

"মিঠু, ইচ্ছে করে ফোন ধরি নি, এই গানটা তো তোর খুব প্রিয়, তাই ভাবলাম, গানটা শুনতে থাক।"  আর  নাহলে  বলবে, " মিঠু,  আমার ফোনটায় সমস্যা আছে। অনেকেই বলে, ফোন করলে আমি ফোন ধরি না, কথাটা ঠিক না রে!  আমি তো কোন রিং শুনতে পাই না"।

আমার জবাবও রেডী থাকবে,
" মেজদা,  মনে আছে তোমার, মা তোমাকে ফোন করতো, তুমি ফোন না ধরলেই মা বলতো, " তোর  আকাশের  মেঘ কোনকালেই কাটবে না! ফোন করলে ফোন ধরে না, শুধু মেঘলা আকাশ মেঘলা আকাশ করে"!! মেজদা আমার কথা শুনে হাসতে থাকবে, মা'র কথাটা রিপিট করবে, আবার হাসবে। তারপরই মন খারাপ করবে, বলবে,
" এইবারই প্রথম মা'কে ছাড়া জন্মদিন। মিঠু, এই ফোন নিয়ে যে মা কত কথা শুনাত। একদিন কী হয়েছে শোন, মা যখন খুব অসুস্থ, আমাকে কাছে ডাকছে,  আমার হাতে ৫,০০০ টাকা দিয়ে বলে, এই টাকাটা তোরে দিলাম। টাকাটা দিয়ে তুই একটা নতুন ফোন সেট কিনে ফেল। আমি তোরে উপহার দিলাম"।

সাথে সাথে আমাদের দুই ভাই বোন কিছুক্ষণ নীরব হয়ে থাকবো, একই সাথে একই দৃশ্য কল্পনা করবো।  গত ৫ই অক্টোবার ছিল মায়ের জন্মদিন। আমি আর মেজদা, দুজনে একসাথে সকালবেলাতেই হসপিটালে গিয়ে হাজির হয়েছি। আমি নেভী ব্লু জমিন, লালা জড়িপাড়ের তাঁতের শাড়ী পরেছি, কপালে বড় লাল টিপ, আমার সাজ দেখে মেজদা প্রশ্ন তোলার আগেই বলে দিলাম, " আজকে মা'র জন্মদিন, আমাকে মা সেই কোন ছোটবেলা থেকে শাড়ী পরিয়ে রাখতো, সালোয়ার কামিজ পরতেই দিত না, গত দুই দিন সালোয়ার কামিজ পড়ে এসেছি, এইটাই মায়ের শেষ জন্মদিন, আজকে মায়ের সামনে মায়ের পছন্দমত সাজ করেই যেতে চাই, সুন্দর দৃশ্য দেখে যাক মা"!

মেজদার মনে পড়ে গেল, মা ৫,০০০ টাকা দিয়েছিল, টাকাটা মা'কে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য মেজদা অনেক কৌশল খুঁজছিল, কিন্তু মত বদলে ফেললো,  আমাকে বলল,
" মিঠু, তোর ফোনটা আমাকে একটু দিবি? মা'কে দেখাব, বলবো, মা তোমার টাকা দিয়ে নতুন ফোন কিনলাম। মা'কে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, নতুন একটা সেট কেনার সময়ই পাই নি রে! ঠিকই বলছিস, মা'কে একটু  খুশী করি তোর ফোনটা দেখিয়ে। বিকেলে মার্কেটে গিয়ে মায়ের টাকাটা দিয়েই একটা ফোন সেট কিনবো"।

আমরা দুই ভাই বোন দশ মিনিটের অনুমতি নিয়ে আইসিইউতে গেলাম, মায়ের দেহ বিকল, কিন্তু পুরোপুরি  জ্ঞানে আছে। ভাই বোন মিলে ডাক দিলাম, " মা, শুভ জন্মদিন!"
মা হঠাৎ করেই খুব অস্থির ভঙ্গীতে মুখের ভেতরে থাকা মোটা নলটিকে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছিল, জিভ দিয়ে ঠেলে বের করে দিতে চাইছিল। কিছু বলতে চায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় ছেলে মেয়ে দুটিকে।  আমি মা'কে শান্ত করার চেষ্টা করলাম, মেজদা বোকার মত কান্না শুরু করে দিল।  মেজদাকে আমরা কেউ কখনওই কাঁদতে দেখিনি। ছাত্রাবস্থায় মেজদা খুব চঞ্চল ছিল, পড়ালেখায় ফাঁকীও দিত, ক্লাসের বইয়ের নীচে লুকিয়ে রেখে গল্পের বই পড়তো। গল্পের বইগুলোও আবার তেমনই ছিল, স্বদেশী আন্দোলনের বই, মায়ের সংগ্রহ ছিল সব। লেখাপড়া ছাড়া আমাদের বাবা আর কিছুই বুঝতে চাইতেন না, তাই স্কুল থেকে নালিশ আসলেই  বাবা  মেজদাকে বেদম প্রহার করতো,  আমি হাউ মাউ করে কাঁদতাম আর বলতাম, " বাবা, মেজদা মরে যাবে, আর মেরো না, আর মেরো না"! মেজদা কিন্তু একটুও কাঁদতো না, পিটানিগুলো কায়দা করে ঠেকাতে চেষ্টা করতো। হয়তো স্বদেশী আন্দোলনের বই পড়ে 'মাইর ঠেকানো' কায়দা আয়ত্ত করে ফেলেছিল।
পরে মেজদাকে নিয়ে আমরা খুব হাসাহাসি করতাম।  আমার মেজদাটা এতই ভাল যে আমাদের সকলের অত্যাচার হাসিমুখে মেনে নিত। শুধু তো বাবা অত্যাচারী ছিলেন, তা-ই নয়, মায়ের অত্যাচার ছিল আরও মারাত্মক!  মেজদার উপর ক্ষেপে গেলেই  মা  মেজদাকে ' মোশতাক খন্দকার'  বলে গালি দিত। আমরা অনেক বড় হয়েও 'মোশতাক খন্দকার' নিয়ে হাসাহাসি করতাম।
'মোশতাক খন্দকার' যে কী ভয়ানক গালি, এটা আমি ততটা না বুঝলেও মেজদা বুঝতো। চঞ্চল প্রকৃতির কিশোর, চঞ্চলতার জন্য পিটানি খেতে পারে, তাই বলে এমন একটি কুখ্যাত লোকের সাথে তুলনা!!! মেজদার মুখটা মলিন হয়ে যেত, আমি মেজদার খুব কাছের মানুষ, দুই ভাইবোনে ভাবও ছিল, কামড়া-কামড়ি সম্পর্কও ছিল। একবার তো আমি সত্যি সত্যি মেজদাকে কামড়ে দিয়েছিলাম। সেদিন মায়ের প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝেছিলাম, যতই একমাত্র কন্যা হই না কেন, মায়েদের টান থাকে পুত্র সন্তানের প্রতি বেশী। ভাই বোন ঝগড়া লেগেছি, মেজদা আমার হাঁটু বরাবর এক লাথি মেরেছিল, আমাকে হয়তো  মহাভারতের দূর্য্যোধন ভেবেছিল, আর নিজে সেজেছিল ভীম, গদা না পেয়ে লাথিতেই হাঁটু ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম করেছিল। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে একেবারে মেজদার বাহুতে দিয়েছি মরণ কামড়! আহারে! আমার ভাইটা প্রস্তুত ছিল না এমন প্রতি আক্রমনের, এমন জোরে চীৎকার দিয়েছিল, সেই চীৎকারের আওয়াজ এখনও, প্রায় ৩৬ বছর পরেও আমার মনে আছে। আরও মনে আছে, মা আমার যন্ত্রনার প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করেই মেজদার হাতে খুঁজে পেল, দাঁত বসে গেছে, রক্ত বের হচ্ছে ক্ষত স্থান থেকে। মা কী এক ঘৃণার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল, আমি আজও ভুলিনি। মা কাঁদছিল মেজদার জন্য, আর আমি কাঁদছিলাম আমার প্রতি মায়ের অবজ্ঞার জন্য!  কত কথাই যে মনে পড়ে যায়।
মেজদাকে ইশারায় কান্না থামাতে বললাম। মেজদা চোখ মুছে গলার স্বর পালটে মা'কে বলল,
" মা, তুমি আমাকে ৫,০০০ টাকা দিয়েছিলে, একটা ফোন কিনতে। এই যে দেখো, ফোন কিনেছি" বলে আমার ফোনটা দেখালো।  মাথা কাত করে মা 'আচ্ছা' ভঙ্গী করলো, দুই চোখের কোল বেয়ে জল পড়তে লাগলো। মা'কে সহজ করতে চাইলাম, বললাম,
" মা, তোমার কী মনে আছে, আজ তোমার কততম জন্মদিন?"
মা খুব একটা উৎসাহ দেখালেন না, অথবা যন্ত্রণায় অস্থির ছিলেন বলে খেয়াল করতে পারলেন না। আমরা দুই ভাই বোন মিলে আবার চেষ্টা করলাম মা'কে সহজ করতে। বললাম, " মা, আজ কী তোমার পঁচাত্তর বছর, নাকি চুয়াত্তর বছর, নাকি ছিয়াত্তর বছর বয়স পূর্ণ হলো", 
মা,  নল গোঁজা মুখেই বোবাদের মত ভঙ্গীতে বলল, " পঁচাত্তর"। ভাই বোন খুব খুশী হওয়ার অভিনয় করলাম। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম, মা দুই চোখ বুজে ফেললো, চলে গেল চেতনার গভীর অতলে।

আমরা  এই দুই ভাই বোন কেউই মায়ের গায়ের রঙ পাইনি, বাবার মত শ্যামলা হয়েছি।  আমার বড়দা আর ছোট ভাই পেয়েছে মায়ের গায়ের রঙ। মেজদাকে অবশ্য আমার চেয়ে একটু বেশী কালো দেখা যেতো, তাই মা মেজদাকে  মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে ডাকতো 'কালিদাস'।  রেগে গেলে বা ঝগড়া লাগলে আমি মেজদাকে 'মেজদা' না ডেকে ডাকতাম ' কাইল্লা'। কাইল্লা বলার সময় নিজের চেহারার দিকে তাকাতাম না এবং কোন এক অজানা কারণে কেউই আমাকে 'কালি' বলতো না। এমন কী মেজদাও কোনদিন আমাকে কালি বলে পালটা প্রতিশোধ নিত না।  আমাদের জন্ম তারিখেও ঊনিশ আর বিশ তফাৎ! আমার জন্মতারিখ ২১, মেজদার ২২। দুজনেই পিঠোপিঠি ভাই বোন, তাই খাতিরও  প্রায় সমান সমান, হয়তো আমি মেজদাকে ভালোবাসি বিশ, মেজদা আমাকে ভালোবাসে ঊনিশ। ঝগড়া-ঝাঁটিও ঊনিশ-বিশ পরিমানেই হয়। আমি ঝগড়ায় বিশ, মেজদা ঊনিশ। গল্পের বই পড়ার বেলায় মেজদা অবশ্য আমার থেকে অনেক এগিয়ে। ছোট বেলায় চুরী করে বই পড়তো, আমি আর ছোট ভাই পাহাড়া দিতাম, বাবা বা মায়ের পায়ের আওয়াজ পেলেই মেজদাকে ইশারা করে দিতাম। মেজদা শুধু চুরী করে বইই পড়তো না, চুরী করে দুধের সর খেয়ে ফেলতো, বাজারের ফর্দ থেকে পয়সা চুরী করতো, মায়ের কাছে ধরা পড়ে যেত, তারপরেও করতো। খুব বেশী না, হয়তো এক আনা কী  দুই আনা। বড় দাগে চুরী করেছিল একবার বৈশাখী মেলার সময়। আমি ছোটবেলায় ছিলাম হাড়কিপ্টে, পারলে পিঁপড়ার মুখ থেকে চিনি কেড়ে রেখে দিতাম, এক পয়সা, দুই পয়সা করে জমিয়ে জমিয়ে কাঁচের বোয়াম ভরে ফেলেছিলাম। মায়ের কাছে ' টিনের ট্রাঙ্কে গোডরেজ তালার ভরসায় বোয়ামটি রাখা হয়েছিল। দুর্গাপূজায় খরচ করব বলে রেখে দিয়েছিলাম। একদিন মা ট্রাঙ্ক খুলে দেখে বোয়াম পুরোটাই খালি। বিশ টাকা জমেছিল, মেজদা সব সাফা করে দিয়েছে। এর জন্য কী মার খেয়েছিল মেজদা? মনে পড়ে না।

এই গল্পগুলো আমাদের দুই ভাইবোনেরই মনে আছে। দুজনেই মায়ের প্রখর স্মৃতিশক্তি পেয়েছি।  মায়ের বাবা , মানে আমাদের দাদু ছিলেন প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী, ৯৫ বছর বয়সেও আইনের ধারাগুলো বলতে পারতেন, আমাদের মা ৭৫ বছর বয়সেও মহাভারত পুরোটাই বলতে পারতেন। ইদানিং যদি মুক্তিযুদ্ধ সময়কালীন দুই একটি ঘটনার কথা জিজ্ঞেস করতাম, মা অবশ্য বলতেন , " কী জানি, এখন অনেক কিছুই ভুলে গেছি"। মেজদা'কে যদি জিজ্ঞেস করি, মেজদাও বলে, " এখন অনেক কিছু ভুলে গেছি মিঠু"। সেদিন মেজদাকে দিয়েছি এক প্রচন্ড ধমক, বলেছি, " সবাই যদি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভুলে যাও, তাহলে কী করে হবে? তোমাদের এই অপরাধের ক্ষমা নেই। আমার অনেক কিছুই মনে আছে, আমার একটু সাহায্য চাই, মেজদা আমাকে সাহায্য করো। রুটগুলির নাম উলট পালট মনে আছে, ঘটনা বলতে হবে না, শুধু রুটগুলোর নাম বলে দাও"।

জবাব পাই, " মিঠু, তিন বছর আগে যে অ্যাকসিডেন্ট হলো, মাথায় তো প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিলাম, এরপর থেকে আমার অনেক কিছুই আর মনে থাকে না।"

বললাম, " মনে পড়াতে হবে, আমি মুক্তিযুদ্ধে দেখা ঘটনাগুলো লিখে রাখতে চাই। মেজদা, দুইটা পায়ে পড়ি, প্লীজ, একটু মনে করার চেষ্টা করো, তুমি সব সময় এক ধরণের হীণমণ্যতায় ভুগো যে তোমাকে কেউ ভালোবাসে না। কথাটা ঠিক না, মেজদা, যদি আমি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে কিছু লিখি, তুমিই হবে সেই কাহিণীর মূল নায়ক"।
এবার একটু নরম হয়েছে, বলেছে, ঠিক আছে, চেষ্টা করে দেখবো। তবে বেশী ভাবতে পারি না, মাথা ব্যথা করে। এরপরই সে যোগ করলো,
" মিঠু, তোদের টিভিতে কী চ্যানেল '৭১ দেখা যায়?"
-হ্যাঁ, দেখা যায়।
-একটা ভিডিও দেখালো সেদিন, আওয়ামীলীগের চারটি কর্মীকে কীভাবে পিটিয়ে, কুপিয়ে মেরে ফেললো। বইন রে! কী হবে এগুলো  নিয়ে লেখালেখি করে!
-কী হবে জানিনা, নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকবো।


চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন, 'দখিনা' তে আমি নিয়মিতভাবে লিখছি। 'দখিনা'র সম্পাদক  ভ্রাতৃপ্রতিম রাফসান গালিবের অনুমতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধের শৈশবকালীন স্মৃতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করেছি। রাফসানকে বলেছি, আমার লেখাটি হবে পুরোপুরি একটি শিশুর চোখ থেকে দেখা। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি নিতান্তই শিশু ছিলাম, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো এমনই ঘটনাবহুল ছিল যে স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। আমার খুব ইচ্ছে, শিশুর স্মৃতি থেকে লিখলেও, লেখাটি যেন বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠে, তা নিশ্চিত করা। এ ব্যাপারে আমাকে সবচেয়ে বেশী সাহায্য যে করতে পারে, সে আমার মেজদা। অসম্ভব প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী সে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে ছিল নয় বছর বয়সী এক বালক। যে দুটি পর্ব আমি লিখেছি, সেখানে আমার মেজদা হচ্ছে মূল চরিত্র।

মেজদা, তোমাকে কী যে ভালোবাসি! আমরা সবাই তোমাকে ভালোবাসি। মায়ের মৃত্যুতে তুমি একেবারেই স্তব্ধ হয়ে গেছো। ব্যাপারটি আমাদের সকলকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। তুমি মায়ের সাথে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়ায়ে ছিলে, মায়ের বকা খেতে হাসিমুখে, মায়ের যত আবদার পূরণ করতে হাসিমুখে।  সময় নেই- অসময় নেই, মা তোমাকে ফোন করে আসতে বলতো, তুমি চলে আসতে। কয়েকদিন পর পর  প্রায় অচল, নোংরা টাকার নোট তোমাকে দিত, ব্যাঙ্ক থেকে বদলে ঝা চকচকে নোট এনে দিতে, তুমি তাই করে দিতে, সবই হাসি মুখে। মা যখন তোমাকে 'মোশতাক খন্দকার' বলে বকা দিত, তখনও তোমার মুখে হাসি লেগেই থাকতো, বিষন্ন হাসি। তোমাকে তো মা ঠাট্টা করে মোশতাক খন্দকার বলতো, মোশতাক খন্দকারের ভাবী ছিলেন মায়ের সহকর্মী, খন্দকার আপা। সেই খন্দকার আপা স্কুলে এসে সবার কাছে খন্দকার মোশতাকের নামে বিচার দিত। মোশতাক খন্দকারের চাপা চিমসে ছিল, তোমার যখন উঠতি বয়স, তখন  তোমারও দুই গালে হাড় উঁচু হয়ে বের হয়ে থাকতো, তখনই মা তোমাকে দেখে বলতো,

" এই যে, খনকার সাব আসছে। আর মানুষ পাইল না, আমার ছেলে হইছে চোরা খন্দকারের মত দেখতে"। আমি তখন প্রতিবাদ করতাম, " মা, খন্দকার মুশতাকতো খুনী, বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলছে, মেজদা তো কিছু করেনি, তাহলে কেন ্মেজদাকে এই চোরের সাথে তুলনা দিবে?" মা মিটিমিটি হাসতো।  তুমিও হাসতে, তবে হা হা করে হাসতে! সেই তুমি হাসতে ভুলে গেছো। এটা ঠিক নয় মেজদা। মা কিন্তু সবই দেখছেন, তোমার মলিন মুখ দেখলে মায়ের কষ্ট হবে, ঠিক যেমন কষ্ট পেয়েছিল তোমাকে কামড়ে দিয়েছিলাম দেখে, মা আমার সাথে অনেকদিন কোন কথা বলে নি। মেজদা, তোমাকে আমরা সবাই ভালোবাসি। আমরা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি না ঠিকমত, তাই মুখ ফুটে বলতে পারিনা, " মেজদা তোমাকে আমরা ভালোবাসি"। কিন্তু ভালো যে বাসি, তা পোস্টেড ছবিগুলোর দিকে তাকালেই বুঝবে। কত যত্ন করে রেখেছি ছবিগুলো।

 মা নেই, মা'কে ছাড়া তোমার প্রথম জন্মদিন! জানি, তোমার ভেতর ক্ষয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমরাতো আছি, আমরা থাকবো আজীবন একইভাবে, পুরানো স্মৃতি নিয়েই কাটাবো সামনের দিন!
তোমার আজকের দিন শুভ হোক, তোমার কালকের দিন শুভ হোক, তোমার বাকী জীবন সুখের হোক!
শুভ জন্মদিন মেজদা!!!!!!!!!!

Sunday, April 21, 2013

একটি নেমন্তন্ন, যেনো বৈশাখী গরমে এক পশলা বৃষ্টি!

দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকার 'নববর্ষ' সংখ্যায় ' প্রবাসে পহেলা বৈশাখঃ বাঁশী আর আগের মত বাজে না' নামে আমার লেখা একটি নাতি দীর্ঘ ফীচার ছাপা হয়েছে। সেখানে আমি লিখেছিলাম, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে আমরা পর পর দুই শনিবার আনন্দানুষ্ঠান করবো। প্রথম শনিবারের অনুষ্ঠানে আমি যাই নি, টিভিতে ফটিকছড়ির নৃশংস ঘটনার ভিডিও দেখে হতবিহবল হয়ে গেছি, বিক্ষুব্ধ হয়েছি, তাই নীতিগত কারণে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যাই নি। কিন্তু দ্বিতীয় অনুষ্ঠানটি এককভাবে আয়োজন করেছে মারুফ এবং রান্তা। মারুফ-রান্তা দম্পতিকে আমরা সকলেই খুব পছন্দ করি।  আগের লেখাতেই আমি মারুফ-রান্তা, শাহীন-নিশো, আহাদ-তাসমিন, ফারহান-সনি'র নামোল্লেখ করেছি। রান্তার মা এসেছেন বাংলাদেশ থেকে, এ উপলক্ষ্যেই ওরা সবাইকে নতুন বছরের দাওয়াত দিয়েছে। আমার নিজেরও একটু ব্রেক দরকার ছিল। গত দুই মাসে নানা হতাশা, গ্লানি, ক্ষোভ, ঘৃণা জমে জমে মনটাই বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছিল। কোন না কোনভাবে একটু ব্রেক চাইছিলাম।  তাই  মারুফ-রান্তার নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করার মত বোকামী করিনি। কারণ এই তরুণ দম্পতী শুধু রান্না-বান্না করে খাওয়ায়ই না, ছোট্ট পরিসরে দারুণ উপভোগ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনও করে। এ ব্যাপারে রান্তার সৃজনী শক্তি, উদ্যম এবং একাগ্রতার প্রশংসা না করলেই নয়। অনুষ্ঠানে পুরষ্কারও দেয়া হয়, এর আগেও ওদের বাড়ীতে এমন আনন্দানুষ্ঠান হয়েছে।

আজকের নিমন্ত্রণের ভ্যেনু ছিল মারুফ-রান্তার অ্যাপার্টমেন্ট, সময় দেয়া হয়েছিল দুপুর সাড়ে বারোটা,  মেন্যু ছিল পোলাও, ডিনের কোরমা, চিকেন কোর্মা, বোনলেস চিকেন কারী, তিন রকমের সব্জী, সালাদ, এবং আরও দু'একটা আইটেম। ডেজার্টে ছিল 'ম্যাঙ্গো লস্যি', বলে রাখি, ম্যাঙ্গো লস্যির চেয়ে লস্যির গ্লাসের ডেকোরেশান ছিল অনেক বেশী আকর্ষনীয়! বাঙালী কখনও টাইম মেইনটেইন করতে পারে না বলে যে দূর্নাম আছে, সেই দূর্নামের ধারা অব্যাহত রাখার জন্যই বোধ হয় আমরা নির্দিষ্ট সময়ের চল্লিশ মিনিট পরে ওদের বাড়ী পৌঁছেছি। গিয়ে দেখি আমাদের আগেই বাকী সবাই উপস্থিত হয়ে গেছে। তবে আমার বেলায় 'সাত খুন মাফ', ওরা সবাই আমাকে দারুণ ভালোবাসে, আন্টি ডাকে, তবে আমার সাথে ওরা বন্ধুর মত আচরণ করে। ওরাও হয়তো জানে, আমি ওদের সবাইকে কত ভালোবাসি। দেরী করে পৌঁছেই 'সরি, সরি' বলে মাথা নীচু করেছি, ব্যস সাতখুন মাফ হয়ে গেছে।

রান্তা বেশ কিছুদিন আগেই আমাকে মেসেজ করেছিল, ওর অনুষ্ঠানে যেন শাড়ী পড়ে যাই, শাড়ীর রঙ যেনো লাল অথবা সবুজ হয়, সাথে আরেকটু যোগ করেছে, যেন খুব সেজেগুজে যাই, ওর আম্মুকে দেখাতে চায়, এখানে ওরা কত আনন্দে আছে। ওদেরকে নিয়ে আম্মু যেনো কোন টেনশান না করে। আমি রান্তার  আকাংক্ষার মর্য্যাদা রাখতে সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। আমাকে দেখেই রান্তা খুব খুশী হয়েছে এবং অনুষ্ঠানচলাকালীন সময়ে সকলের ঊদ্দেশ্যে কথাটি বলেওছে যে ওর অনুরোধের ভাষা নাকি আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি। আমি খুব খুশী হয়েছি রান্তার খুশী হওয়া দেখে।

খাওয়া -দাওয়া পর্বশেষে রান্তা শুরু করে দিল ওর বিশেষ আয়োজন। প্রথমেই ছোট একটি টেবিলকে সামনে রেখে 'মঞ্চ' বানানো হয়েছে। আগের রাতেই কাগজ কেটে  ফুল বানিয়ে দেয়ালে ডিজাইন করেছে, রান্তার স্বামী, আমাদের প্রিয় মারুফ, যে এ বছর 'আউটস্ট্যান্ডিং পিএইচডি স্টুডেন্ট' পুরষ্কার পেয়েছে স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে, সেই মারুফ খুবই সাবলীল ভঙ্গীতে ল্যাপটপ, সাউন্ড সিস্টেম, আরও কী কী সব তারে প্যাঁচানো ইলেকট্রনিক ডিভাইস ফিট করে দিয়েছে, এরপরেই রান্তা তার অনুষ্ঠান শুরু করেছে। ও প্রথমেই অতিথিদের নাম ধরে ধরে, যার যার চারিত্রিক বা কর্মধারা অনুযায়ী খেতাব দেয়া 'ব্যাজ' সকলের পোশাকে আটকে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। আমার উত্তম কুমারকে দিয়েছে ' এভারগ্রীন' ব্যাজ, ব্যাজ পরিয়ে দেয়ার আগে খেতাবটি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য দুই লাইন করে মন্তব্যও করেছে। এভারগ্রীন ব্যাজ পরানোর আগে রান্তা বলেছে,

" আঙ্কেল আমার বাবার বয়সী হলেও উনি এখনও খুবই প্রাণবন্ত, আমাদের সকলের সাথে খুবই বন্ধুর মত ব্যবহার করেন, সব সময় হাসিখুশী থাকেন, তাই আঙ্কেলকে 'এভারগ্রীণ' খেতাব দিলাম"। সকলেই দেখলাম, " ঠিক, ঠিক' ভোটে প্রস্তাব পাশ করে দিল। আমার পালা আসতেই আমি চট করে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, আর অমনি রান্তা হই হই করে বলে উঠলো,
" মিঠু আন্টি, আমি তো এখনও আপনাকে মঞ্চে আসতে বলি নাই, আগে আমাকে বলতে দেন"। কী আর করা , ফিরে এসে সোফায় বসলাম, ততক্ষণে বাকী সবাই হেসে খুন। আমাকে নিয়ে ওরা অনেক মজা করে। বিশেষ করে পিঙ্কী। কলকাতার মেয়ে পিঙ্কী, আমার সাথে ননদ-বৌদি সম্পর্ক, সব সময় আমার 'লেগ পুলিং' করবেই। পিঙ্কীর হাসি থামিয়ে দিয়ে রান্তা শুরু করলো,
" আপনারা সবাই জানেন, মিঠু আন্টি লেখালেখি করে, আমি আন্টির লেখা পড়ি, ইদানিং আন্টি গরম গরম লেখা দেয় ফেসবুকে, সব সময় আন্দোলন মার্কা কথা, তাই আন্টির খেতাব দিছি, ' বিদ্রোহী নারী', সবাই তালি দেন জোরে জোরে"।
ব্যাজ আনতে গেলাম ওর কাছে, ফিস ফিস করে বললাম, বিদ্রোহী না, বলো 'বিপ্লবী'। পটাতে পারলাম না। বিদ্রোহী নারীর খেতাব নিয়ে এভারগ্রীন স্বামীর পাশে এসে বসলাম। উত্তম কুমারের চেহারার দিকে আর তাকাতে সাহস হলো না, কী জানি, ্কখন আবার আমার চেহারায় বিদ্রোহী স্ত্রীর ছায়া এসে পড়ে!

দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলা ছিল প্রতিযোগীতা। রান্তার লিস্ট থেকেই রান্তা যাকে যাকে ডেকেছে, শুধু তাকে তাকেই ওখানে পারফর্ম করতে হয়েছে। বিষয়বস্তু ও নির্বাচন করে দিয়েছে। দর্শকদের কাজ ছিল, প্রত্যেকের পারফরম্যান্স খুঁটিয়ে দেখা, অনুষ্ঠান শেষে ভোটের ব্যবস্থা ছিল, দর্শকের ভোটে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। রান্তার লিস্টিতে সবার প্রথম ছিল রনি। রনিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে নিউটনের তিনটি সূত্র। উপস্থিত সকলেই ধাঁধায় পড়ে গেছে। আমি তো বিদ্রোহী খেতাব পেয়েছি, তাই নিউটনের তৃতীয় সূত্রটিকেই মনে রেখেছি। রনিকে বলেছি, ' বলো, প্রত্যেকটি ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে"! হা হা হা! মজা হয়েছে, কারো মাথায় আসছিল না, পিঙ্কী ওর আই ফোনে চলে গেছে গুগল সার্চে। পাশে থেকে আহাদ দ্বিতীয় সূত্রটি জোড়াতালি দিয়ে বলে দিয়েছে। সবাই খুব মজা পাচ্ছিল, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের লেগ পুল করছিল। কারণ উপস্থিত সকলের মধ্যে ৮০% বুয়েট থেকে এসেছে, বাকীরাও সায়েন্সের স্টুডেন্ট, এমনকি আমিও। যাক, আমার ভাগ্যে এসেছে, একটি গান করার সুযোগ। এক বছর আগেও আমি খুব দরাজ গলায়, খুবই উৎসাহ নিয়ে গান করতাম। এক বছর পরের ঘটনা হচ্ছে, খুব টেনসড থাকি,  গানের স্কেল ঠিকমত ধরতে পারি না,গলা ক্র্যাক করে, সবচেয়ে অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, গানের কলি ভুলে যাই। কিছুই মনে পড়ে না। তারপরেও প্রতিযোগীতা বলে কথা, হটে আসতে রাজী নই। গেয়ে ফেললাম, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত গান " কতদিন পরে এলে, একটু বসো"। গানটি আমার খুবই পছন্দের গানগুলোর মধ্যে অন্যতম, গানটি শুনলেই মনে হয়, পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে আমার অপেক্ষায় কেউ বসে আছে, কেউ আমার প্রতীক্ষায় আছে ভাবলেই বেঁচে থাকার আনন্দ বেড়ে যায়।

তৃতীয়  রাউন্ডে ছিল দম্পতীদের জন্য গেম। দশটি প্রশ্ন স্বামী সম্পর্কে, এমন একটি প্রশ্নপত্র দেয়া হয়েছে চারজন নারীর হাতে, আর একই প্রশ্ন 'নিজের' সম্পর্কে, এমন প্রশ্নপত্র দেয়া হয়েছে চার পুরুষের হাতে। প্রশ্ন হাতে নিয়ে আমার মাথা ঘুরে গেছে। আমি তো স্বামীর পছন্দ-অপছন্দগুলো কিছুই জানি না মনে হলো। অযথাই উত্তম কুমারকে নিয়ে বড়াই করি! মনে হচ্ছিল, পরীক্ষার হলে বসে আছি। আমার পাশে বসেই দিপি ভাবী দেখি ফটাফট উত্তর দিয়ে পরীক্ষা শেষ করে খাতা জমা দিয়ে দিয়েছে। আরেক পাশে থাকা নতুন বউ সনি'কে দেখলাম পরীক্ষক রান্তাকে ডেকে প্রশ্ন বুঝতে চাইছে, রান্তাও খুব সিরিয়াস ভঙ্গীতে সনি'কে প্রশ্ন বুঝিয়ে দিয়েছে। নিশো মাঝে মাঝেই আমার দিকে হতাশ নয়নে তাকায়। আর আমি তো কলম তুলেই বসে আছি। আমার স্বামীর 'সকার' এর প্রিয় খেলোয়াড় কে? আমার মাথায় ঘুরছিল শাহবাগ, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম, আবাহনী ক্লাবের ছবি। উত্তমের বয়স বিবেচনা করে বসিয়ে দিলাম 'সালাহউদ্দিন' এর নাম।  আরেকটি প্রশ্ন এসেছে, আমার রান্না খাবারগুলোর মধ্যে কোন আইটেমটি আমার স্বামীর কাছে অসহ্য মনে হয়?  উত্তর জানা নেই। ভাবলাম, উত্তম কুমার নিশচয়ই লিখবে, আমার বউয়ের রান্না সব খাবারই ভাল। তাই উত্তর লিখলাম, ' নাথিং'। পরীক্ষার সময় শেষ, আর বাড়তি টাইম দেয়া যাবে না, বলে সবাই চেঁচাচ্ছিল। আমি বলি, প্রশ্ন কঠিন, আরেকটু সময় দাও, ফেল করবো তো। আরেকটা প্রশ্ন ছিল, আমার স্বামীর প্রিয় ব্যক্তিত্ব কে? আমি অবলীলায় লিখে দিলাম, বারাক ওবামা। কারণ উত্তম কুমার সকালে ঘুম থেকে উঠে বারাক ওবামার নাম নিয়ে, ঘুমাতে যায়ও ওবামার নাম নিয়ে, তাহলে তো প্রিয় ব্যক্তিত্ব বারাক ওবামাই হবে।  একটি প্রশ্ন ছিল, আমার স্বামীর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মধ্যে কোন জীবনটিকে সে খুব মিস করে? উত্তমের মুখে তার স্কুল জীবনের গল্প শুনিনি, নটরডেম কলেজে পড়ার সময়কার গল্প শুনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্পও শুনিনি। আমি অবলীলায় লিখে দিয়েছি, কলেজ জীবন।  আমার স্বামী কোন টুথপেস্ট ব্যবহার করতে পছন্দ করে? এই রে! বাজার করি আমি, যা এনে দেই, তাই দিয়েই তো সে দাঁত মাজে। কোন ব্র্যান্ডের পেস্ট যেনো আনি! মনে পড়ছে, গত সপ্তাহে 'কলগেট' এনেছিলাম, ভাবলাম, উত্তমের তো অনেক বুদ্ধি, যেটা দিয়ে এখন দাঁত মাজছে, নিশ্চয়ই সেই পেস্টের নামই লিখবে। লিখে দিলাম 'কলগেট'। উত্তরপত্র টেনে নেয়ার আগ মুহূর্তে উত্তরপত্র জমা দিয়ে দিলাম।

এর মধ্যেই এক রাউন্ড চা খাওয়া হয়ে গেছে। এবার ফল জানানোর পালা। আমি বললাম, " প্রশ্ন অনেক কঠিন ছিল"। নিশো সমর্থণ দিয়ে বললো, " গত পাঁচ বছরের সিলেবাসে এমন কঠিন প্রশ্ন ছিল না"। দিপী ভাবী বললো, " কোথায়, প্রশ্ন তো ভালই ছিল"। বললাম, " গত অনুষ্ঠানে চ্যাম্পিয়ান হয়েছি, আর এই অনুষ্ঠানে জিরো পাব"। নিশো তার স্বামীকে ডেকে বললো, " হানি, ভুল হলে আমার দোষ নেই, প্রশ্ন কঠিন ছিল।' এরপরেই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, " আন্টি গতবার তো আমরাও চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলাম, যুগ্ম চ্যাম্পিয়ান হয়েছি, এবার যে কী হবে"। রান্তা এবং মারুফ ফলাফল ঘোষণা করতে শুরু করলো।

চার দম্পতীর মধ্যে আমি-উত্তম কুমার সবচেয়ে পুরানো, আর ফারহান-সনি সবচেয়ে নতুন। ফলাফল নতুন দম্পতী থেকে শুরু, ওরা তো মাত্র কয়েক মাস ধরে সংসার শুরু করেছে, তাই ওদের উত্তরগুলো বেশী মিলে নি। এরপর খালেদ ভাই-দিপি ভাবীর পালা। গত অনুষ্ঠানে উনারা মাত্র দুটো উত্তর সঠিক দিয়েছিল। [সেই অনুষ্ঠানে ছিল উলটো। স্ত্রীদের পছন্দ স্বামীরা জানে কিনা! সেই পরীক্ষায় আমি-উত্তম এবং শাহীন-নিশো যুগ্মভাবে জয়ী হয়েছিলাম]। এবার দেখলাম উনারা তিনটি সঠিক, একটি অর্ধ সঠিক উত্তর দিয়েছেন। নিশো-শাহীন দম্পতী আমাদের সকলের কাছেই খাঁটি দম্পতী বলে বিবেচিত। ওরা পাঁচ বছর প্রেম করে চার বছর হলো সংসার করছে। নিশোকে সবাই পছন্দ করে ওর আহ্লাদীপনার জন্য। ওর আহ্লাদীপনাতে দারুণ এক সৌন্দর্য্য আছে। নিশো-শাহীনের সাতটি উত্তর সঠিক হয়েছে। সবশেষে আমাদের পালা। দেখা গেল, পারি না পারি না করেও আমরা পাঁচটি উত্তর সঠিক করেছি।  ভুল উত্তর ছিল, " উত্তমের প্রিয় খেলোয়াড়, ম্যারাডোনা। উত্তমের প্রিয় টুথপেস্ট 'ক্রেস্ট' ( কলগেটের নাম নাকি মনে আসছিল না)। আমার রান্না খাবারের মধ্যে 'বাঁধাকপি' তার কাছে অসহ্য লাগে। সে নাকি 'স্কুল জীবন' মিস করে।( হায়রে! জীবনেও স্কুলের গল্প করলো না) এবং তার প্রিয় ব্যাক্তিত্ব 'উত্তম কুমার' [ সে নাকি ভেবেছে, আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব কে, এটা জানতে চেয়েছে। হুম, এত বড় প্রফেসারও তাহলে প্রশ্ন উলটা বুঝে]।

দ্বিতীয় দফা চা খাওয়া হলো। ভোটাভুটি শুরু হলো। প্রথম রাউন্ডে যে ইনডিভিজুয়াল পারফর্ম্যান্স হয়েছিল, তার উপর ভোটাভুটি। উত্তম কুমারকে ডাকা হলো প্রথম। যে কোন তিন জনকে একটি করে ভোট দিতে হবে। উত্তমের পরে আরও তিন জন গিয়ে ভোট দিয়ে এলো। হঠাৎ দেখি উত্তম কুমার ' সেরেছে, বিরাট ভুল করেছি' বলে উঠে দাঁড়িয়েছে। প্রিজাইডিং অফিসার রান্তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, " তোমার আন্টিও কি প্রতিদ্বন্দ্বি নাকি? ওর নাম তো দেখিনি। এখন কী ভুল সংশোধন করা যাবে?" রান্তা ব্যালট পেপারে আমার নামের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো, ' ভোটাভুটি শেষ হলে আপনার আবেদন বিবেচনা করে দেখবো"। রান্তার কথা শুনে উত্তম কুমার বলল, " না না ঠিক আছে, যা দিয়েছি, সেটাই চলুক"। কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, " তুমি আমাকে ভোট দাও নি!! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।" উত্তর দিল, " তোমার নাম সবার নীচে, চোখই যায় নি"।

ভোট গননা শেষে ফলাফল। "তৃতীয় হয়েছেন, আমাদের মিঠু আন্টি, আঙ্কে্‌ আপনি যদি ভুল না করতেন, ফলাফল অন্যরকম হতো। দ্বিতীয় হয়েছে নিশো ভাবী এবং প্রথম হয়েছে সনি। একেক জনের নাম ধরে ডাকবো,  এসে পুরষ্কার গ্রহণ করবেন। প্রথমেই ডাকছি মিঠু আন্টিকে। আন্টির হাতে পুরষ্কার তুলে দিবেন আমার আম্মু"। আমি এত খুশী হয়েছি যে বলার নয়। রান্তার আম্মুকে আমার খুব পছন্দ, বেশী দিন হয় নি উনার স্বামী মারা গেছেন, উনার চেহারার মধ্যে গভীর বিষাদের ছায়া, খুব পর্দানশীল, দারুণ আধুনিক মনোভাবাপন্ন এক নারী। সিলেটের অধিবাসী এই ভাবীর মুখে সিলেটি ভাষা শুনলে মন চলে যায় সুদূর সিলেট-সুনামগঞ্জে, আমার অনেক প্রিয়জনের বাস ওখানে। সব অনুষ্ঠান শেষে দারুণ পরিতৃপ্তি নিয়ে বাড়ী ফিরেছি। বাড়ী ফিরতেই মন চলে গেল উত্তপ্ত রাজনীতির মাঠে। স্মৃতিতে রয়ে গেল দারুণ আনন্দময় পাঁচটি ঘন্টা। রান্তা-মারুফের কল্যাণেই এমন সুন্দর সময় কাটালাম, মনে হলো, এ যেনো বৈশাখী গরমে এক পশলা বৃষ্টি!

Saturday, April 13, 2013

মুছে যাবে গ্লানি, ঘুচে যাবে জরা, নতুন শপথে প্রত্যয়ী মোরা!



আমেরিকার মিসিসিপি রাজ্যের ছোট্ট একটি বাড়ী্, সেই বাড়ীর অ্যাটিকে খুবই ছোট একটি পরিসরে আমি মাঝে মাঝেই প্রার্থণায় বসি। প্রতি মাসের কোন একটি শনি অথবা মঙ্গলবার আমি দেবী বিপদনাশিনী মায়ের পূজা করি। পূজা শেষে যখন প্রার্থণায় বসি, আমার নিজের জন্য কিছু চাইতে ভুলে যাই। আমার সকল চাওয়া জুড়ে থাকে আমার প্রিয়জনেরা। সে প্রিয়জন যে কেউ হতে পারে। আমার বাবা-মা, ভাই বোন থেকে শুরু করে না-দেখা কোন বন্ধুও হতে পারে। আমি অনেকবার প্রমান পেয়েছি, খুব সংকটকালে আমি যখন প্রার্থণায় বসি, সংকট কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে আমার মনে অন্যরকম 'নিশ্চিন্ততা' এসে ভর করে। আমি বুঝে যাই, সংকট কেটে যাবে।
আমার মনে আছে, গত বিএনপি সরকারের আমলে পার্থ সাহা নামের এক যুবককে মিথ্যে অভিযোগে গ্রেফতার করেছিল 'পাঙ্কু বাবরের' সৈনিকেরা। প্সেরার্থণায় বসে ই ছেলেটির মুক্তির জন্য আমি অনেক কেঁদেছিলাম, ছেলেটি জীবিত অবস্থায় ফিরেছে। আমার এক স্নেহভাজন ছোট ভাই রেজা, পরিচয় হয়েছিল ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে থাকার সময়, ২০০৪ সালে যখন মিসিসিপি চলে আসি, তার তিন মাস পরেই রেজার স্ত্রী, আমার অতি আদরের ছোট বোন সোমা, বাচ্চা প্রসবকালীন নানা জটিলতায় ক্লিনিক্যালী মারা গিয়েছিল ( ক্লিনিক্যালী ডেড), লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলার আগে রেজার অনুমতির অপেক্ষায় ছিল চিকিৎসকেরা, রেজা অনুমতি দেয় নি। মিসিসিপির ছোট ঘরে বসে আমি আকুল নয়নে কেঁদেছিলাম, বিপদনাশিনী মায়ের কাছে সোমার প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলাম, পূজার ফুল সাথে নিয়ে ১৮ ঘন্টা ড্রাইভ করে সোমাকে শেষবারের মত দেখতে গিয়েছিলাম। ক্লিনিক্যালী ডেড সোমার বালিশের নীচে পূজার ফুল রেখে এসেছিলাম। সোমা এখন হুইল চেয়ারে করে চলাফেরা করে। বিস্তারিত আর কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করছি না, কারণ এগুলো একান্তই বিশ্বাসের ব্যাপার।

আজকেও আমি বসেছিলাম দেবী বিপদনাশিনীর পূজার্চনায়! প্রত্যেকের নামে একটি করে মোমবাতি জ্বালিয়েছি, যাদের নামে মোমবাতি জ্বালিয়েছি, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, 'বাংলাদেশ'। হ্যাঁ, আমি সমগ্র বাংলাদেশের নামে একটি মোমবাতি জ্বালিয়েছি। আকুল হয়ে প্রার্থণা করেছি যেন দেশে শান্তি ফিরে আসে, যেন নতুন বছরের প্রথম দিনটা দিয়েই শুরু হয় সামনের দিকে এগিয়ে চলা। প্রার্থণা কবুল হবে কী হবে না, জানিনা, তবে মনের ভেতর এক ধরণের নিশ্চিন্ততা বোধ করছি। গতকাল পর্যন্ত ভেবে রেখেছিলাম, দেশে মৌলবাদীদের অত্যাচারের প্রতিবাদ হিসেবে ১৪২০ সালের পহেলা বৈশাখ আমি অরন্ধন দিবস হিসেবে কাটিয়ে দেবো। মত বদলেছি, পূজায় বসার আগেই দেশে বাবার কাছে ফোন করেছিলাম, ৮৫ বছর বয়সী বাবা বলেছেন, অন্যান্যবারের তুলনায় আরও বেশী উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে নববর্ষের দিনটি পালন করতে। এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যে কয়েকটি যুক্তি তুলে ধরেছেন, আমার মনের বিষাদ ও ভয় কেটে গিয়ে সাহস ফিরে এসেছে। মূল উপদেশ ছিল, কোন অপশক্তিকে ভয় পেতে নেই, ভয় পেলেই এরা মাথায় চড়ে বসবে। বাবার মতে মৃত্যু যখন আসবে, তখনই মরা ভাল, মরার আগেই মরে যাওয়া কোন প্রগতীবাদীর কাজ নয়। বর্তমান গণজাগরণের প্রতি বৃদ্ধ মানুষটির অবিচল আস্থা আছে। বাবার সাথে কথা শেষ করেই আমি নতুন করে প্রাণ ফিরে পেলাম। বাবা বলেছেন, বাংলাদেশে এইসব অপশক্তি আগেও ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতে থাকবে কিনা তা নির্ভর করছে বর্তমান প্রজন্মের মন মানসিকতার উপর। বর্তমান প্রজন্মের কথা উঠতেই আমার মুখটাতে আলো দেখা গেল। মন চলে গেল ঢাকার রমনার বটমূলে।


বাংলাদেশের সরকারী পঞ্জিকা অনুযায়ী আজ থেকেই বাংলা নতুন বছরের হিসেব শুরু হলো, ১৪২০ সালের ১লা বৈশাখ। ্বাংলাদেশের জাতীয় উৎসবগুলোর অন্যতম উৎসব হচ্ছে 'পহেলা বৈশাখ', অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমুজ্জ্বল এ উৎসবটি শুধুমাত্র বাঙালীদের প্রাণের উৎসব হিসেবেই উদযাপিত হয়, বাংলাদেশে, পশ্চিমবঙ্গে এবং বিশ্বের যে কোন বাঙালীর পরিবারে। উৎসবটির অঙ্গে কোন ধর্মীয় আবরণ নেই, যা আছে তা শুধুই আবহমান বাংলার সংস্কৃতি, বাঙালী চেতনা আর বাঙালীর প্রাণের সুর। বাঙালীকে আবেগপ্রবণ জাতি হিসেবেই সারা বিশ্ববাসী চেনে। এ আবেগ একেবারেই অন্যমাত্রার আবেগ, এ আবেগ একেবারেই বিশুদ্ধ আবেগ। দেশের জন্য, বাংলা মায়ের জন্য, বাংলা ভাষার জন্য একমাত্র বাঙালীই পারে মন-প্রাণ উজার করে দিতে। দিয়েওছিল একবার ১৯৫২ সালে, সৃষ্টি হয়েছিল অমর একুশে, আরেকবার মন-প্রাণ উজার করে দিয়েছিল ১৯৭১ সালে, সৃষ্টি হয়েছে নতুন একটি স্বাধীন ভূখন্ড, যার নাম বাংলাদেশ, এরওপরে বাঙালী বহুবার, বহুভাবে নিজেকে উৎসর্গ করেছে বাংলা মা'কে ভালোবেসে।

বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে ১৯৭১ সালে, কিন্তু এরও কয়েক বছর আগে থেকেই ছায়ানটের কলাকুশলীদের তত্বাবধানে পহেলা বৈশাখের ঊষালগ্নে ঢাকার রমনা বটমূলে ছোট্ট পরিসরে গানের মাধ্যমে নববর্ষকে স্বাগত জানানো হতো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও প্রতি বছরই ছায়ানটের শিল্পীরা বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান আয়োজন অব্যাহত রেখেছেন। তবে সময়ের সাথে সাথে রমনা বটমূলের নববর্ষ উদযাপনের নান্দনিক দিকটি সম্পর্কে সারা দেশবাসীর উৎসাহ বেড়েছে, পরিসর বেড়েছে, মানুষের অংশগ্রহণ বেড়েছে। পাকিস্তান আমলে তৎকালীন শাসকবাহিণী বাংলা নববর্ষ উদযাপণকে 'হিন্দুদের পরব' হিসেবে গণ্য করতো। যেহেতু চৈত্র সংক্রান্তি এবং পহেলা বৈশাখে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা ধর্মীয় কিছু রীতি নীতি, আচার-আচরণ মেনে পালন করতো, তাই পাকিস্তানীরা পহেলা বৈশাখকে হিন্দুদের পরব বলে বাংলার জনগণকে ভাঁওতা দিতে চেয়েছিল। যেহেতু বাংলার জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই ছিল ধর্মভীরু মুসলমান, তাই পাকিস্তানী শাসকদের দূরভীসন্ধিমূলক অপপ্রচারে কিছুটা বিভ্রান্ত ছিল, তাই 'রমনা বটমূলে'র বৈশাখী অনুষ্ঠান সীমিত পরিসরেই উদযাপিত হতো। কিন্তু সময় বদলেছে, মানুষের মন মানসিকতা বদলেছে, এক প্রজন্ম থেকে নতুন আরেক প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটেছে, তাই রমনার বটমূলের বৈশাখী উৎসবের চেহারাই পালটে গেছে। এখন আর কারো সাধ্যি নেই যে বলবে, পহেলা বৈশাখ হচ্ছে হিন্দুদের পরব।

তাহলে কী পাকিস্তানীদের প্রেতাত্মারা বাংলা মায়ের বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে! অবশ্যই না, প্রেতাত্মারা নিশ্চিহ্ন হয় না, এরা ভূতের মতই ঘুরে বেড়ায়, আশেপাশের সকলকে ভয় দেখিয়ে বেড়ানো হচ্ছে ওদের একমাত্র কাজ। এরা যুগে যুগে মানুষের অকল্যান সাধনে ব্যস্ত থাকে, প্রেতাত্মা বলেই অন্ধকারে ওদের বসবাস, আলোকে ওরা বরাবরই ভয় পায়। ওরা তাই মোমবাতি ভয় পায়, ওরা প্রদীপ দেখে চমকে উঠে, ঢোলের বাদ্য শুনলে ওদের গা জ্বালা করে, দৃষ্টি নন্দন আল্পনা দেখে ওদের মতিভ্রম হয়! আর তাই বাংলার আবহমানকালের সংস্কৃতি, শিক্ষা-দীক্ষা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার সাথে ওদের বিরোধ। সেই বিরোধের জের ধরেই ওরা ২০০১ সালের ১৪ই এপ্রিল, ১৪০৮ সালের ১লা বৈশাখে রমনা বটমূলের বাঙালী মিলনমেলায় ঘটিয়েছিল স্মরণকালের নৃশংস ঘটনা, যে ঘটনায় কতগুলো তাজা প্রাণ নিথর হয়ে গেছিল, স্তব্ধ হয়ে গেছিল রমনার বটবৃক্ষের শাখা-প্রশাখা, নিস্তব্ধ হয়ে গেছিল বটমূলের বাঁধানো চওড়া বেদী। কতগুলো তাজা প্রাণ ঝরে গেল সেদিন! প্রতিবছরের ন্যায় আমারও সেদিন যাওয়ার কথা ছিল পরিবার-পরিজন নিয়ে, যাওয়া হয় নি কারণ পরদিন আমার বি এড ফাইন্যাল পরীক্ষা ছিল। আসলে আমার আয়ুর জোর ছিল, তাই বি এড পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। অতর্কিত হামলায় যে প্রাণগুলো ঝরে গেলো, সেই ঝরে যাওয়া মুখগুলো এখনও স্মৃতিকোষে জমা আছে, এখনও স্মৃতি হাতড়ালেই শিল্পীর মুখখানা ভেসে উঠে। ভাই-ভাবীর কাছে বেড়াতে এসেছিল শিল্পী, ফিরে গেল বোমায় ক্ষত-বিক্ষত লাশ হয়ে।

এত বড় নৃশংস হত্যাকান্ডের পরেও কিন্তু পহেলা ্বৈশাখ বা বইমেলা অথবা বিজয় দিবস অথবা স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ থেমে থাকেনি, যেমন থেমে থাকে্নি একুশের প্রথম প্রহরে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন পর্ব। প্রেতাত্মাদের জীবিত স্বজনেরা এখনও নানাভাবে প্রচার চালায় মঙ্গলদীপ প্রজ্বলনের বিরুদ্ধে, অপপ্রচার চালায় বৈশাখী মেলার বিরুদ্ধে, অপপ্রচার চলে পহেলা বৈশাখের চারুকলা আয়োজিত মুখোশ র‌্যালীর বিরুদ্ধে, প্রবল আপত্তি উঠায় রাস্তা-ঘাট আলপনার বিরুদ্ধে! তারা জোরে শোরে বিভিন্ন বক্তৃতা বিবৃতি, সভা সমাবেশ, নানা টকশো-তে খোলামেলাভাবেই বলে যায়, বাঙ্গালীর এই শাশ্বত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, খোলামেলাভাবেই বলে যে এগুলো সবই হিন্দুয়ানী কালচার। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, যে সংস্কৃতি বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব গৌরব, সেই সংস্কৃতিকে কী করে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর মালিকানাধীন সম্পত্তি বলে প্রচার চালান হয়!

আলপনা কেন হিন্দুদের পৈতৃক সম্পত্তি হতে যাবে! একজন মুসলমান নারী যখন তার স্বামী বা সন্তানের জন্য পরম মমতায় নক্সী কাঁথা তৈরী করে, তখন কেন কাঁথায় সূচিত আলপনাগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠে না, যে চিত্রকর্ম কাঁথায় ফুটিয়ে তুললে অপরাধ হয় না, একই চিত্র কর্ম শহীদ মিনার চত্বর অথবা কংক্রীটের রাস্তায় করলে কেন অপরাধ হবে, সেই উত্তর এখন পর্যন্ত জানা হলো না। মঙ্গলদীপ জ্বালানোই হয় পারস্পরিক মঙ্গল-অমঙ্গলের কথা চিন্তা করে। আলোর ধর্মই হচ্ছে অন্ধকার বিদূর করা, আলোর ধর্মই হচ্ছে সামনের পথ দেখানো। গ্রামে- গঞ্জে গৃহবধূরা এখনও মাটির পিদিম জ্বেলে সন্তানের শিয়রে বসে থাকে, বৈদ্যুতিক আলো চলে গেলে শহর-বন্দরে বসবাসকারী মানুষ পিদিমের বদলে মোমবাতি জ্বালায়, অভিজাতরা শুভ জন্মদিনের কেক কাটার আগে মোমবাতি ফুঁ দেয়। শুধুই কী হিন্দুদের মন্দির বা উপাসনালয়েই মোমবাতি, আগরবাতি জ্বালানো হয়? কত সম্মানিত পীরের মাজারে, গির্জায় মোমবাতি, আগরবাতি জ্বালানো হয়ে থাকে। নিজস্ব প্রয়োজনের সময় মোমবাতি প্রজ্বলন করা জায়েজ, কিন্তু যে কোন গণ আন্দোলনে মোমবাতি প্রজ্বলনকে জায়েজ বলা যাবে না, শুধুই 'হিন্দুদের পূজা' মনে করা হবে, এমন দ্বিমুখী কথার কোন জবাব আছে কিনা, তাইবা কে জানে! অবশ্য এটাও ঠিক, যে কথার জবাব হয় না, তার জবাব আশা করাও বাতুলতা।

তবে, আশার কথা, সুবিধাবাদীদের অপপ্রচারে বর্তমান প্রজন্ম ভুলেও বিভ্রান্ত হচ্ছে না। তারা প্রত্যেকেই মনে ও আচরণে শতভাগেরও অধিক বাঙ্গালী। সুবিধাবাদীদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে গেছে বলেই বর্তমান প্রজন্মের মেধাবী তরুণ-তরুণীরা অপপ্রচারের খেলাটি খুব ভালো করে অনুধাবন করতে পেরেছে। আর তাই শত হুমকী-ধামকীর মধ্যেও রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখ অনেক বেশী জাঁকজমক সহকারে উদযাপিত হয়। এমন কি ২০০১ সালের সেই বোমা হামলার পরেও বাঙালী বটমূলে যাওয়া বন্ধ করেনি। বরং যে নারী ২০০১ সালে কিশোরী মেয়ের হাত ধরে যেত, সেই নারী ২০১৩ সালে সেদিনের কিশোরী মেয়ের ঘরের ফুটফুটে বাবুটাকে কোলে নিয়ে যায়, যে যুবক ২০০১ সালে প্রেমিকার হাত ধরে বটমূলে গিয়েছিল, সেদিনের সেই যুবক আজকে সাথে করে স্ত্রী, কন্যা, পুত্রকে নিয়ে যায়। এভাবেই রমনার বটমূলে জনস্রোত বেড়েই চলেছে, কোন রকম ফতোয়া জারী করেও এই বাঙালী জনস্রোতকে থামানো যাবে না। এ বছরও আবার শকুনেরা এসে ভীড় করতে চাইছে। তবে কোটি প্রাণ আজ জেগেছে, সকল জরা-জীর্ণতাকে ঝেড়ে ফেলে সকলে একসাথে মিলে সব শকুনের মোকাবেলা করবে।

Friday, April 12, 2013

মিশা বলেছিল, 'ব্যাঙ একটি শ্রদ্ধার প্রাণী'!!!

"ব্যাঙ একটা শ্রদ্ধার প্রাণী!!" 

আমার দুই মেয়ে মৌটুসী ও মিশা, চার বছরের ছোট-বড়। বড় মৌটুসী খুবই শান্ত, ধীর-স্থির, বুদ্ধিমতী এবং কঠিন পার্সোন্যালিটির, আর মেজো মিশা চঞ্চল, আমার মতই শর্ট টেম্পার্ড, এবং 'আহারে'! পার্সোন্যালিটির।  দেখতেও ওরা দুই রকম।  একজন পেয়েছে মায়ের চেহারা, আরেকজন বাপের। স্বভাবেও ঠিক তাই, মৌটুসী পেয়েছে বাবার স্বভাব, মিশা পেয়েছে মায়ের। মৌটুসীর গায়ের রঙ আমার মত শ্যামলা, আমার মতই ছোটোখাটো গড়ন, ওর আছে মনভুলানো হাসি, মায়াবী চোখ। আর মিশা পেয়েছে ওর বাবার গায়ের রঙ, অর্থাৎ ফর্সা, আমার  চেয়ে চার/পাঁচ ইঞ্চি বেশী উচ্চতা, বাদামী চোখ, ঘন কোঁকাড়ানো চুল।  খুব ছোটবেলা থেকেই পরিচিতজনেরা দুই বোনকে দেখে বলতো " বড় মেয়ে মায়ের মত শ্যামলা হইছে, মেজো মেয়ে বাপের মত সুন্দর হইছে"। 

ছোটবেলায় মিশা  বড় বোনকে 'দিদিসোনা' বলে ডাকতো, মৌটুসী ওকে ডাকতো 'বোনসোনা'। তখন ছিল দুজনের মধ্যে 'মধুমাখা' সম্পর্ক। কিছুটা বড় হওয়ার সাথে সাথে সম্পর্কের মধু ঝরে যেতে থাকে, তৈরী হতে থাকে  'দা-কুমড়ো' সম্পর্ক। তবে মিশার স্বভাবে 'আহারে' ভাব থাকার কারণে দিদিসোনার সাথে ঝগড়া করলেও 'দিদিসোনাকে' সে খুবই ভালোবাসতো। ছোটবেলা থেকেই অন্যের মুখে " মিশা সুন্দর' শুনতে শুনতে ওর ছোট্ট মায়াবী হৃদয়ে খুব কষ্ট হতো,  দিদিসোনাকে খুশী করার জন্য বলতো, 
" দিদিসোনা অনেক জ্ঞানী, অনেক কিছু জানে। দিদিসোনা তো বেশী কালো না, একটু কালো। মা তো কালো, এইজন্যই বাবার মতো নায়ক জামাই ( এভাবেই মিশা বলতো) পেয়েছে, দিদিসোনা, তুমিও নায়ক জামাই পাবে, আমিও নায়ক জামাই পাবো"।
সাথে সাথে মৌটুসী হয়তো বলতো, " তুমি তো ফর্সা, তুমি তো নায়ক জামাই পাবেনা, আমি শুধু নায়ক জামাই পাব, হা হা হা কী মজা, তুমি ফর্সা, নায়ক জামাই পাবেনা"।
মিশা বলতো, দিদিসোনা, দেখো আমিও তোমার মতোই কালো হয়ে যাচ্ছি"।

মৌটুসী হেসে ফেলতো, বলতো, " আমাকে আর খুশী করতে হবেনা, আমার কোন দুঃখ নেই কালো হয়েছি বলে। তোমাকে রোদে পুড়ে আর জোর করে কালো হতে হবেনা। আমি বিয়েই করবোনা"।

এভাবেই ওরা কখনও ঝগড়া, কখনও বন্ধুত্ব আবার কখনও বড়-ছোট সম্পর্ক বজায় রেখে চলতো।  মিশা খুব দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করতো যে তার দিদিসোনা পৃথিবীর সবকিছু সমন্ধে অনেক বেশী জানে।  হয়তো দিদিসোনাকে কেউ সুন্দর বলতোনা বলে মিশার মনে এক ধরণের চাপা কষ্ট হতো। ওরা তো আর জানতোনা, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় শিশুদের মনস্তত্ব নিয়ে কেউ ভাবেনা! ভাবলে ওরা কখনও দুইটি বাচ্চার সামনে বলতে পারতোনা, বড় মেয়ে কালো হইছে, মেজোটা বাপের মত ফর্সা-সুন্দর"। একটা গল্প মনে পড়ে গেলো। যখন মেলবোর্ণে ছিলাম, ডঃ সজল পালিত'দার সাথে খুব খাতির ছিল ছোট্ট মিশার। পালিত'দা মিশাকে খুব আদর করতেন। একদিন পালিত'দা মিশার হাত দেখে বলেছেন, 
" আরে! এই মেয়েতো বড় হয়ে অনেক বড়লোক হবে। বিরাট ধনীর ছেলের সাথে বিয়ে হবে মিশার"।---এই কথা শুনে মিশা ভারী খুশী। ওর সব সময় বড়লোক হতে ইচ্ছে করতো। পালিত আংকেল যখন বলেছে, ওর বড়লোকের সাথে বিয়ে হবে, তাহলে আর চিন্তার কিছু নেই, ও বড়লোক হবে। তিন বছর পরে আমরা তখন ঢাকাতে থাকি। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের ডি আই জি ক্ষিতীশ চন্দ্র দে'র সাথে উনার ছেলের মাধ্যমে পরিচয় হয়। মিশা ও মৌটুসী উনাকে দাদু ডাকতো, আমি ডাকতাম মেসোমশায়। তখনও মিথীলার জন্ম হয়নি। মেসো খুব ভাল হাত দেখতে পারতেন। উনি মৌটুসীকে খুব আদর করতেন। অবশ্য শুধু উনি নন, মৌটুসীর ধীর-স্থির স্বভাবের জন্য অনেকেই ওকে পছন্দ করতো, যাই হোক, মেসোমশায় মিশা-মৌটুসীর হাত দেখে বলেছে, " মৌটুসী,  তুমি বড়লোক হইবা। বড়লোকের ছেলের সাথে বিয়ে হবে"। মিশাকে বিয়ের কথা কিছু বলেনি। বাসায় ফিরে মিশা কী কান্না! বলে, " দিদিসোনার বড়লোকের সাথে বিয়ে হবে কেন?" মৌটুসী হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে, বলে, " কেন, আমি কালো বলে বুঝি বড়লোকের সাথে বিয়ে হতে পারবেনা!" সাথে সাথে মিশা ভুল বুঝতে পেরে কথা ঘুরিয়ে বলে, " দাদু তো আমাকেও বলতে পারতো। আমাদের দুই বোনেরই বড়লোকের সাথে বিয়ে হোক"।  এই চলতো দুই বোনের মধ্যে সারাক্ষণ।


ঝগড়া করলেও মিশা সব সময় মৌটুসীকে অনুকরণ করার চেষ্টা করতো। কারণও আছে, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সকলেই জানতো, মৌটুসী খুবই লক্ষ্মী একটা মেয়ে, আর মিশা মায়ের মত পাগলী স্বভাবের মেয়ে। তাই মিশার মধ্যে একধরণের নিরাপত্তাহীনতা কাজ করতো, ও ভাবতো, দিদিসোনা যাই করে, সেটাই বোধ হয় অনুকরণীয়। মৌটুসী জিটিভিতে 'হরর শো' দেখতো, ভুতের ভয়ে অস্থির মিশা রাত জেগে দিদিসোনার পাশে বসে বসে এই হরর শো দেখতো আর ওকে জাপটে ধরে রাখতো। মৌটুসী নাচ শিখতো, ছোট্ট মিশা দিদিসোনাকে অনুকরণ করে নিজের চেষ্টায় নাচের মুদ্রা পায়ে তুলে ফেলতো। মৌটুসী ছোটবেলা থেকেই খুব ভালো ছবি আঁকতো। আমেরিকায় এসে ইলেভেনথ গ্রেডে স্কুলে আর্ট ক্লাস নিয়ে খুব ভাল ভাল কিছু আর্ট করেছিল। মিশা পিছিয়ে থাকবে কেন? ও যখন ইলেভেনথ গ্রেডে উঠলো, ও  আর্ট ক্লাস নিয়ে ফেললো।  দিদিসোনা বাবার জন্মদিনে পেইন্টিং গিফট করেছে, তাই মিশাও  বাবার জন্মদিনে  পেইন্টিং গিফট করেছে। দিদিসোনা মিথীলাকে 'টনি' ডাকে, তাই মিশাও মিথীলাকে 'কনি' ডাকে। সবকিছুতে দিদিসোনাকে অনুকরণ করা চাই।

খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও ছিল দিদিসোনার সাথে মিশার কমপিটিশান! দিদিসোনার থেকে কোন অংশেই ও পিছিয়ে থাকতে রাজী ছিলনা। মৌটুসী মোটামুটি সর্বভুক, গরু বাদে হাতী, ঘোড়া, বাঘ ভাল্লুক, শিয়াল, হরিণ সবই সে খেতে পারবে। মিশা সেটি পারতো না। খাবার দাবারের ব্যাপারে ও খুব ভীতু ছিল, কিন্তু দিদিসোনার কাছে হেরে যাবার ভয়ে রেস্টুরেন্টে অথবা প্লেনে  সে শামুক, ঝিনুক জাতীয় ল্যাতল্যাতে খাবার চোখ-নাক বন্ধ করে খেয়ে ফেলতো।  দুটি মজার ঘটনা  বলিঃ

২০০২ সালের ঘটনা। আমরা তখন ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে থাকি। সবাই মিলে একটি চায়নীজ রেস্টুরেন্টে খেতে গেছি। সাথে নিয়ে গেছি এক আমেরিকান দম্পতী বন্ধুকে।  রেস্টুরেন্টে ছিল বুফে ( বাফে) সিস্টেম। ১৫০টি আইটেম সাজানো, যে যার মত খাবার দাবার নিয়ে এসে টেবিলে বসেছি। আমার পাশেই বসেছে মৌটুসী, উল্টোদিকে  মিশা। মৌটুসীর প্লেটের  খাবারগুলো অন্যরকম। ঝিনুক,  থলথলে জেলী ফিস, সী উইড ( গাঢ় সবুজ রঙের সামুদ্রিক শাক) কাঁচা মাছ দিয়ে তৈরী র‍্যাপ 'সুশী' এবং বেশ কিছু ছোট ছোট পাখীর ঠ্যাং ভাজা। প্লেটের পাখীর ঠ্যাং দেখিয়ে বলেছি, " বাহ! এগুলো কী পাখি রে? কী সুন্দর দেখা যাচ্ছে"। মৌটুসী জবাব দিল, " এগুলো তো পাখীর পা না, ব্যাঙের পা।"


আমি তো ' অ্যাঁ! ব্যাঙের পা'!!! ইয়াক!! বলে ওর কাছ থেকে শরীর যতখানি সম্ভব ছোট্ট মিথীলার দিকে সরিয়ে নিয়েছি। মৌটুসী নির্বিকার ভাবে বললো, " হ্যাঁ, ব্যাঙের পা তো অনেকেই খায়। আমিও একটু টেস্ট করে দেখতে চাই"। মিশার প্লেটের দিকে তাকালাম। দেখি মিশার প্লেটে চিকেন ফ্রাই আর 'সুশী'। দিদিসোনার দেখাদেখি 'সুশী' নিয়ে এসেছে, ক্কিন্তু কাঁচা মাছে তৈরী বলে সাহস করে মুখে দিতে পারছে না। এদিকে দিদিসোনা তো গপাগপ করে খেয়ে চলেছে। হেরে যাওয়ার আগ মুহূর্তে মিশা বললো,

" দিদিসোনা, তুমি কেন ব্যাঙের পা এনেছো?"

মৌটুসী বললো, টেস্ট করে দেখতে। তোমার ইচ্ছে হলে তুমিও নিয়ে আসো।

মিশার জবাব, " দিদিসোনা, ব্যাঙ একটা শ্রদ্ধার প্রাণী। কেন তুমি ব্যাঙ খাবে"?

আমরা সবাই ( আমেরিকান বন্ধুরা বাদ) বিষম খেলাম, মুখে খাবার, হাসতেও পারছিলাম না ভাল করে!

মৌটুসী বললো, " কী???? ব্যাঙ একটা শ্রদ্ধার প্রাণী???? আর তুমি যে চিকেনের পা খাচ্ছো, চিকেন কী অশ্রদ্ধার প্রাণী?

মিশা  মরীয়া হয়ে বললো, হ্যাঁ শ্রদ্ধার প্রাণীই তো,  ব্যাঙ অনেক কিউট দেখতে, কত মায়া লাগে ব্যাঙের চেহারার দিকে তাকালে।

মৌটুসী বলল, " মুরগীর দিকে তাকালে মায়া লাগে না? মুরগী কী কিউট না? তাহলে তো মুরগীও একটা শ্রদ্ধার প্রাণী!! হা হা! ব্যাঙ নাকি শ্রদ্ধার প্রাণী, আর মুরগী নাকি অশ্রদ্ধার প্রাণী, হা হা! হা হা!

মিশা বলল, আমরা সবাই তো মুরগী খাই, কিন্তু কেউ ত ব্যাঙ খাই না, তুমি শুধু ব্যাঙ খাও। তোমার একটুও ঘেন্না লাগে না, মা তো ঘেন্না পেয়েছে, মায়ের জন্য একটুও মায়া লাগে না?

মৌটুসী হেসেই চলেছে, আর বলে চলেছে, ব্যাঙ একটা শ্রদ্ধার প্রাণী,  মুরগী হচ্ছে অশ্রদ্ধার প্রাণী।  মিশা ব্যাঙের ঠ্যাং খায় না, কিন্তু মুরগীর ঠ্যাং খায়।

শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, " মৌটুসী, এরপর থেকে তোমার সাথে আমি আর খেতে বসবোনা, সাপ-ব্যাঙ নয়া খেলে কী চলেনা? এত অ্যাডভেঞ্চার করার কী আছে? খাওয়া-দাওয়া রুচীর ব্যাপার। এমন কুৎসিত রুচীর খাবার কেন খাবে?
মৌটুসীর জবাব, মামনি, এইমাত্র তুমি বললে, খাওয়া-দাওয়া রুচীর ব্যাপার, তাহলে তো যার যার রুচীমতই তার তার খাওয়া উচিত। মিশা ব্যাঙের ঠ্যাঙ খেতে পারছেনা, আমি পারছি। আমি কী মিশাকে বলেছি একবারও যে মিশা আমার দেখাদেখি তুমিও ব্যাঙের ঠ্যাঙ খাও! মিশাতো বলেইছে ব্যাঙ একটা শ্রদ্ধার প্রাণী, হা হা হা!!!!!

সেই মিশা  ২০১০ সালে আমরা সবাই যখন মিসিসিপিতে থাকি, দিদিসোনার সাথে রেস্টুরেন্টে গিয়ে কুমীরের মাংস খেয়ে এসেছে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, " মিশা, ছিঃ তুইও শেষ পর্যন্ত কুমীর খেলি?"
ওর উত্তর, মা, দিদিসোনা আসলে অনেক অভিজাত রুচীর মানুষ। আগে বুঝতামনা, বড় হয়ে বুঝি, দিদিসোনার স্বভাব একেবারে হাই ফাই সেলেব্রিটিদের মত। তবে কুমীরের মাংস আমার ভাল লাগেনি। আর খাবনা।

মিশা মৌটুসীকে নিয়ে আরও মজার গল্প আছে। ইলিশ মাছ খাওয়ার গল্প বলি। মিশা ছোটবেলায় মাছ খেতে খুব ভালোবাসতো। মৌটুসী মাছ  খেতে হতো বলেই খেতো। মিশা ছোট মাছ, বড় মাছ, কাটা মাছ, কাটা ছাড়া মাছ, সব রকম মাছই পরম আনন্দে খেলেও মৌটুসী ছোট মাছ খেতো না, মাছের শরীর খুঁটে খুঁটে খেয়ে মাছের মাথা, কাঁটা মিশাকে দিয়ে দিত। ইলিশ মাছের পিঠের চাক খেতো মৌটুসী, আর মিশা খেত কোলের টুকরা। কোন এক অজানা কারণে মিশা কোল থেকে মাছের ডিম বের করে দিদিসোনাকে দিয়ে দিত। ভালোবাসা থেকে দিত না, কারণ মৌটুসীকে পাশে ্না পেলে আমাকে দিত। আমি ত মহাখুশী হতাম ইলিশ মাছের ডিম পেয়ে। একদিন কথায় কথায় জানতে চেয়েছি, 

-মিশা, ইলিশ মাছের ডিম কত ভাল খেতে, তুই খাস না কেন?
-মা, মাছের ডিমের মধ্যে কত হাজার হাজার বাচ্চা মাছ থাকে। আমি মাছের বাচ্চাদের খেতে চাইনা। আমার মায়া লাগে! ইস! বাচ্চা মাছ কত কিউট!

ছোট্ট মিশার কথা শুনে 'থ হয়ে গেছি, মৌটুসী বলল, " তুমি একটা ভন্ড সাধু মিশা! রান্না করা মাছের ডিম খাওনা, অথচ মাছ খাচ্ছ। মাছের বাচ্চাদের জন্য মায়া লাগে, আর মা মাছের কোল খেয়ে ফেলছো, তখন মায়া লাগে না?
মিশা প্রতিবাদ করতে পারেনা, কারণ ওতো জানে, ওর দিদিসোনা অনেক জ্ঞানী, অনেক বুদ্ধিমতি। দিদিসোনা যা বলে ঠিকই বলে। কিন্তু তারপরেও মিশা প্রাণে ধরে মাছের ডিমগুলোকে খেতে পারেনা, এখনও না!

Monday, April 8, 2013

আউলা-ঝাউলা ছড়া

খুকী  খুকী  করে  মায়
খুকী  গেছে  কাদের  গাঁয়
কাঠবেড়ালী  মানচিত্র খায়
শীগগীর  খুকী  ঘরে  আয়!

খুকী  যেতে  চায়  পাঠশালে
শকুন  বসেছে  ঘরের  চালে
কাঠবেড়ালী  গাছের  ডালে
নেইতো  হাওয়া  নৌকার  পালে
যেতে  হবে না  পাঠশালে
ঘুমাও  খুকী  মায়ের  কোলে


ঘুম পাড়ানী পাপিয়া মনি
মোদের  বাড়ী  এসো
চতুর্থ মাত্রার  চেয়ার নেই
ঘরের  মেঝেতেই  বসো।
মিথ্যে  কথার  লাড্ডু  দেবো
দু'গাল  ভরে  খেয়ো
খুকীর  চোখে  ঘুম  নেই
ঘুম  দিয়ে  যেও!

খুকী  ঘুমালো  প্রাণ  জুড়ালো
শকুনীরা   এলো  দেশে
ইঁদুর বেড়ালে  ধান  খেয়েছে
খাজনা  দেবো  কিসে!
ধান  ফুরালো  পান ফুরালো
খাজনার  উপায় কি
আর ক'টা দিন  সবুর  কর
শাহের  বাগে  রসুন বুনেছি।



ভোর  হলো  দোর  খোল
খুকীমনি  ওঠোরে!
ওই শোন, কাঁঠাল  গাছে
কাক  শকুনী  ডাকেরে!

কাক ডাকে কা কা কা
শকুনেরা কয় খা খা খা
যত বলি হুশ হুশ হুশ
যা  যা যা যা যা যা!
তত বেশী ডাকে ওরা
খা  খা  খা  খা  খা!

মাগো,  আমায়  দেখাসনে  আর
কাক  শকুনের   ভয়
আজকাল  আর  আমি  তোমার
ছোট্ট  খুকী   নয়।
থোড়াই  আমি  কেয়ার  করি
কা কা   খা  খা  ডাক
কা কা খা খা'র চেয়েও মধুর
বাংলা মায়ের  ঢাক।

তাক দুমাদুম  ঢাক  বাজিবে
ঢোলে  উঠিবে  বোল
খোকা খুকী  সবাই  মিলে
তোল  রে  আওয়াজ  তোল!


ঢোলের  বোলে  কাক  পালাবে
পালাবে  শকুনের  দল
শেলেট পেন্সিল, বই হাতে সব
পাঠশালে তে চল।

'অ' তে  'অমিত' সাহস  বুকে  নিয়ে
'আ' তে 'আমি' যাই এগিয়ে
সাধ্য  কারো  নেই  যে  আমার
বিজয়ের  পথ  রুখে  দাঁড়াবার
বন্ধ  ঘরে  রাখিবে  আমায়
'নারী' কে যে চিনতে হবেই তোমায়।


"থাকবো  না  কো  বদ্ধ  ঘরে
দেখবো  এবার  জগৎটাকে
কেমন  করে  ঘুরছে  মানুষ
যুগান্তরের  ঘূর্ণী পাকে"

আর  ডেকো না  'কা' 'কা' রবে
তরুণ  প্রাণ  জেগেছে  সবে
শুনতে  কী  পাও  সমুদ্র  গর্জন
মুক্তিযুদ্ধের  বিশাল  অর্জন!




Tuesday, April 2, 2013

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, আমি ‘সংখ্যালঘু’ হীনমণ্যতায় ভুগি!

গত কয়েকদিন আগে, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানকে উপলক্ষ করে আমি ‘প্রিয় ব্লগ’ এ একটি রাজনৈতিক লেখা পোস্ট করেছিলাম। রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে লেখা, স্বাভাবিকভাবেই সেখানে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু নিয়ে কোন কথা ছিল না। তারপরেও জনৈক পাঠক, খুব কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন, রাজনৈতিক লেখা না লিখে ওয়ালমার্টের জীবন নিয়ে যেন ধারাবাহিক লিখে যাই। পরের দিন আরেক পাঠক প্রথম মন্তব্যকারীর বক্তব্যকে সমর্থণ করেছেন এবং বোনাস হিসেবে আমার সমন্ধে বলেছেন,
“মিঠু দিদি কেন যে আজকাল একটু তালকাটা ধরণের আগডুম বাগডুম করছেন; বিষয়টা আমিও ধরতে পারছি না। মাঝে মাঝে দিদি কালকে সাদার সাথে মিশিয়ে ভুল করে বসেন। নিজেকে সংখ্যালঘু বিবেচনা করে তিনি বরাবরই একটু হীনমণ্যতায় ভোগেন;”।
আমি মন্তব্যের জবাবে লিখেছি,
” হ্যাঁ, আমি বরাবরই হীনমণ্যতায় ভুগি। এটাই নিয়ম, যারা হীন, তারা হীনমণ্যতায় ভোগে। আমাদের তো পেশীর জোর নেই বা গলার জোরও নেই, আমাদের দেবী মূর্তির দেহে প্রাণও নেই, আমাদের ধর্মের জোরও নেই, ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানে লড়াই করার মত তেমন জোরালো যুক্তিও নেই, ধর্মকে নিয়ে বড়াই করারও ক্ষ্যামতা নেই, এমনই কোমড়ভাঙ্গা পাবলিক আমরা। আমাদের মত এমন কাপুরুষ বাংলাদেশে কত পার্সেন্ট আছে বলেন তো! আমরাতো সংখ্যায় খুবই কম, সংখ্যায় কম মানেই তো সংখ্যালঘু!
আমাদের সংখ্যা এতই নগন্য যে সংখ্যাগুরুদের চোখেই পড়ে না। আর তাই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সরকারের নাকের ডগায়, বিরোধী দলের ( সরকারবিরোধী যত দল) উস্কাণীর মুখে, আমাদের তুলসী মঞ্চ ভেঙ্গে ফেলা হয়, দেবী মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয়, ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়া হয়, আপনারা চেয়ে চেয়ে দেখেন। আর নিরাপদ দূরত্বে থেকে আমার মত দুই একজন যখন নিজেদের জন্মভূমির মাটিতে থাকার দাবী তুলি, আপনাদের মত জ্ঞাণী গুণী, উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের মুখে শুনতে হয়, আমি সংখ্যালঘু হীনমন্যতায় ভুগি। আপনাদের মত জ্ঞানী গুনী পন্ডিত ব্যক্তিবর্গের কারোরই জানা নেই, সংখ্যালঘু কী জীব, সংখ্যালঘুরা দেখতে কেমন হয়।
এরপর থেকে কয়েকটি দিন আমি অনবরতঃ ভেবেই চলেছি। কোন দিকে যাচ্ছে আমাদের এই দেশ।
আজ থেকে বিয়াল্লিশ বছর আগে আমাদের দেশটির জন্ম হয়েছে, সেই বিয়াল্লিশ বছর আগের সরকার কতটা গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক চেতনার ছিল যে স্বাধীন দেশের সংবিধানে ‘সেক্যুলারিজম’ বা ধর্মনিরপেক্ষতা যোগ করা হয়েছিল। সংবিধান প্রণেতাগণ সংবিধান প্রনয়ণ করেছিলেন, কিন্তু উনারা ধারণা করেননি, কিছু শ্রেণীর মানুষের কাছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র মানে ‘ধর্মহীনতা,’ ধর্মনিরপেক্ষতার মানে সংখ্যাগুরু হয়েও সংখ্যালঘুদের কাছে ‘নীচু’ হয়ে যাওয়া, ধর্মনিরপেক্ষতা মানেই পেশীক্ষমতা প্রদর্শনের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়া। সেই কতিপয় মানুষ বিষয়টিকে ভালো মনে মেনে নেয়নি। শুরু হয়ে যায় সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, আসে পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট, বাংলাদেশের স্থপতি, স্বাধীন বাংলার রূপকার, বাঙালী জাতির পিতাকে নির্বংশ করার জন্য পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্যটিসহ সকলকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। পথের কাঁটা সরিয়ে দেয়া হয়, সংবিধানকেও কাটাছেঁড়া করে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কে বাদ দেয়া হয়। বাংলাদেশ থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা উঠে যায়, অলিখিতভাবে দেশের জনগণকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু। দেশের মুসলমান জনগণ হয়ে যায় ‘সংখ্যাগুরু, বাকীরা হয় ‘সংখ্যালঘু’, আরও স্পষ্টভাবে বলা যায়, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা হয়ে যায় সংখ্যালঘু।।
পঁচাত্তরের পটপরিবর্তণের পর সারা দেশের মানুষ এক ধাক্কা খেয়েছে, ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকেই স্তব্ধ হয়ে গেছে, তাই সংবিধান কাঁটাছেঁড়া নিয়ে কেউই কোন উচ্চবাচ্য করার সাহস পায়নি। অথবা এমনও হতে পারে, সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কেটে ফেলে দেয়ায় দেশের সংখ্যাগুরুরা খুশীই হয়েছেন, তাই বোধ হয় বঙ্গবন্ধুর তত্বাবধানে যে মহান কর্মটি ( সেক্যুলার সংবিধান রচনা) বিংশ শতাব্দীতে সাধিত হয়েছিল, একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় দাঁড়িয়ে সেই মহান কর্মটি পুনরায় করার মত সাহস বা চেতনা কারো মধ্যেই আর দেখা যায় নি। একটি মুসলমান প্রধান রাষ্ট্রের সংবিধান রচিত হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে, এমন সাহসী এবং মহান সিদ্ধান্তের জন্যও বঙ্গবন্ধুকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী নেতা বলা যেতে পারে।
সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেয়া হয়েছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে, তখনও ‘সংখ্যালঘু’ কথাটি এখনকার মত এত ঘন ঘন উচ্চারিত হতে শুনিনি। হিন্দু বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি যা কিছু অসাম্যতা, অবজ্ঞা, অবহেলা করা হতো, সবই নীরবে চলতো। ’৯১ সালের পর থেকেই যেনো সংখ্যালঘু কথাটি গতি পায়। বিশেষ করে ‘৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বার তারিখে ভারতে রাম মন্দির বনাম বাবরী মসজিদ দাঙ্গা শুরু হতেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর প্রথম ঝড় বয়ে যায়। উন্মুক্ত হয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িকতার ভয়াল চেহারা। সুদূর অযোধ্যায় মসজিদ-মন্দির নিয়ে দাঙ্গা হচ্ছে, তার সাথে বাংলাদেশের কোমড় ভাঙ্গা সংখ্যালঘু হিন্দুদের কী সম্পর্ক, সে প্রশ্ন কেউ তোলেনি, তুললেও উত্তর পাওয়া যেতো বলে মনে হয় না। সেই থেকে শুরু, সরকারে ছিল বিএনপি, যে দলের স্রষ্টা বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে কেটে দিয়েছিলেন, সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রতি সে দলের দৃষ্টিভঙ্গী আর যাই হোক, কখনওই মাতৃসুলভ বা বন্ধুসুলভ ছিল না। এই সুযোগে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো দূর্বার গতিতে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে।
তাছাড়া দূর্বল হিন্দুকে ভয় দেখাতে খুব বেশী কথা খরচ করতে হয় না। বাড়ীর কর্তাকে ‘মাইয়া তুইল্লা লইয়া যামু’ বললে অথবা কালো চাদরের আড়ালে লুকিয়ে রাখা ছোরা দেখালেই যথেষ্ট। রাজাকার, আলবদরদের দাপটতো আর ফুরিয়ে যায় নি, একাত্তরে কত হিন্দুকে মুসলমান বানিয়ে হাত পাকিয়েছে তারা, তাদের হুমকী শুনে ভয় পাবে না, এমন বাঘা হিন্দু কী আর বাংলাদেশে অবশিষ্ট আছে?
’৯১ থেকে ধারাবাহিকভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতন চলে আসলেও ইদানিং নানা টকশো, বক্তৃতা, বিবৃতিতে সুশীলগণ মুখে পরিতৃপ্তির হাসি নিয়ে বলেন, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নহর বয়ে যাচ্ছে। সরকার থেকেও বলা হয়, বিরোধী দল থেকেও বলা হয়, বিশ্বের যে কোন দেশের সংখ্যালঘু জনগণের তুলনায় বাংলাদেশের হিন্দুরা নাকি অনেক বেশী ভাল আছে। এমন কথা শুনে আমাদের ক্ষত স্থান ফুলে উঠে, দগদগে ঘা আরও দগদগে হয়, কিছুতেই ভুলতে পারিনা, ’৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বারের রাতে আমাদের ঘরের দরজায় লাথি পড়ার শব্দ, সাথে “ অই মালাউনের বাচ্চারা, দরজা খোল” হুমকী, কী করে ভুলি ২০০১ সালে কী নারকীয় অত্যাচার নেমে এসেছিল হিন্দুদের উপর। কোন রাখ ঢাক না রেখেই তৎকালীন সরকার দলীয় ক্যাডারেরা হিন্দুদের কুপিয়েছিল, মায়ের সামনে, বাপের সামনে কোমলমতি হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করেছিল, মা’কে আহাজারি করে বলতে হয়েছিল, “ বাবারা আমার মাইয়াটা ছোট, তোমরা একজন একজন কইরা আস”। এগুলোই ছিল প্রায় প্রতিদিনের চিত্র। ২০০৫ সালের মধ্যে কত হিন্দু পরিবার ভিটেছাড়া হয়ে গেছে! এরপরও সুশীলেরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেন সংখ্যালঘুরা ভালো আছে বলে, জনৈক পাঠক আমাকে তিরস্কার করেন সংখ্যালঘু হীনমণ্যতায় ভুগি বলে।
গত দুই মাস ধরে যুদ্ধাপরাধী বিচারকে কেন্দ্র করে সারা দেশে যে তান্ডব শুরু হয়েছে, সে সম্পর্কে আমার আলাদা করে কিছু বলার নেই, সারা বিশ্বে সকল বাঙালীরা জেগে উঠেছে। বাঙালীর এই জাগরণ ছিল আমাদের দেশের জন্য আশীর্বাদ, কিন্তু অভাগা জাতি সেটাও যেন সামাল দিতে পারলো না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হয়েছে এবং একটি রায় তরুণ প্রজন্ম মেনে নিতে পারেনি, প্রতিবাদস্বরূপ তারা দল বেঁধে শাহবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে রায়ের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিবাদ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল। তারা আন্দোলন শুরু করেছে গত ৫ই ফেব্রুয়ারী থেকে, প্রজন্ম মঞ্চ বানিয়ে। মূলতঃ কয়েকজন ব্লগারের উদ্যোগেই শুরু হয়েছিল এই প্রজন্ম আন্দোলন। স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলন পছন্দ হয় নি, একটি বিশেষ গোষ্ঠী থেকে অপপ্রচার শুরু করা হয় তরুণ ব্লগারদের বিরুদ্ধে। যারা ব্লগ কী জানে না, ব্লগে কী করা হয় জানে না, ইন্টারনেট ব্যবহার করতে জানে না, তারাও দেখি ব্লগারদের বিরুদ্ধে তুমুল হৈ চৈ শুরু করেছে।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান এবং সরল ধর্মভীরু। তারা ইসলামের বিরুদ্ধে কোন বিরূপ মন্তব্য পছন্দ করেনা, মেনেও নেয়না। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে সেই দুষ্টচক্র। বর্তমান হাই টেকের যুগে কম্পিউটারে দিনকে রাত বানানো যায়, রাতকে দিন। তারাও দিনকে রাত বানিয়েছে, ব্লগারদের নামে ইসলাম বিদ্বেষী পোস্টার ছাপিয়ে সারাদেশে প্রচার করে সরল ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে আঘাত দিয়েছে। যে দুই একজন ব্লগার তাদের ব্যক্তিগত প্রোফাইলে নিজের অভিরুচী অনুযায়ী লেখা লিখেছে, সে সকল লেখা ব্লগারের ব্যক্তিগত প্রোফাইলের গন্ডী পেরিয়ে কুচক্রীদের মারফত সারাদেশে প্রচার করা হয়েছে। রাজীব হায়দার নামের এক ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। এখন দাবী উঠেছে, ব্লগার মানেই নাস্তিক, যুদ্ধাপরাধীদের পরিবর্তে এই নাস্তিকদের বিচার নিয়ে সবাই মেতে উঠেছে।
শুধু ব্লগারদের বিরুদ্ধে বিচার চেয়েই ক্ষান্ত নয় কেউ, ব্লগারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-প্রতিবাদের অংশ হিসেবে সারা দেশের শত শত হিন্দুদের ঘর-বাড়ী আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে, মন্দিরে ঢুকে পুরোহিতকে হত্যা করা হয়েছে, এবং প্রায় প্রতিদিন হিন্দুদের দেব দেবীর মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। সরকার থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপি-জামাত এগুলো করছে, আর বিএনপি থেকে বলা হচ্ছে, আওয়ামীলীগ এগুলো করছে। যাক, একটি ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেছে, দেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর অত্যাচার চলছে, তা সে যে পক্ষই করুক না কেন। সরকার থেকে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছে, কেউ যেন ইসলামের বিরুদ্ধে কোন কটুক্তি না করে, ব্লগেও যেন কেউ ইসলাম অবমাননা করে কিছু না লিখে। আমি মাননীয় সরকারের এই অত্যন্ত মূল্যবান সিদ্ধান্তের সাথে সহমত পোষণ করছি, তবে, এটাও জানতে চাইছি, হিন্দুরা তো ইসলাম বা অন্য কোন ধর্ম নিয়ে কোন কটু মন্তব্য করেনি। তাহলে আজ কেন হিন্দুদের উপর এই অত্যাচার নেমে এসেছে। আর কেন কোন রাখঢাক না রেখেই হিন্দুদের বাড়ীঘরে হামলা হচ্ছে? আজ আপনাদের সকলের সামনে যখন মন্দিরে হামলা হচ্ছে, দেব দেবীর মূর্তি ভাংচুর হচ্ছে, তখন আমাদের দেবদেবীর এই অপমানকে কী দৃষ্টিতে দেখছেন সকলে? নাকি কেউই দেখতে চাইছেন না লজ্জা পাবেন বলে! নাকি গালে হাত রেখে ভাবছেন, “সংখ্যালঘুদের আবার ধর্ম কি? আমাদের দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে টইটুম্বুর করছে, এখানে সংখ্যালঘু বলে কিছু আছে নাকি?”
উত্তর একটাই, যে দেশে সংখ্যা বিচারে একটি ধর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়, সে দেশে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের হয় ‘সংখ্যালঘু’ হয়ে থাকতে হয়, নাহলে নিজ ধর্ম বিসর্জন দিয়ে সংখ্যাগুরুদের সাথে মিশে যাতে হয়। এতকিছুর পরেও এতটাকাল বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি সংখ্যালঘুদের (এভাবেই আমরা পরিচিত) অবিচল আস্থা ছিল। কিন্তু এ আস্থায় টান ধরেছে, খুবই স্পস্ট মনে হচ্ছে, বর্তমান সরকারের আমলেই যেন সংখ্যালঘু নিধন কাজ খুব বেশী দ্রুততার সাথে বেড়েই চলেছে এবং হিন্দুদের সংখ্যা ক্রমে ক্রমেই কমে আসছে ( মানবাধিকার চেয়ারম্যানের রিপোর্ট পড়ে যা বুঝেছি)।এই যদি হয় বাস্তবতা, প্রাণ বাঁচাতে এক সময় হয়তো দলে দলে সংখ্যালঘুরা ধর্মান্তরিত হতে চাইবে, মানের বিনিময়ে প্রাণটা তো বাঁচবে। তখন সুশীলেরা কী বলবেন, সংখ্যালঘুদের আবার ধর্ম কি? যদি তা না বলেন, তাহলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এই সমস্যার সমাধান কী? বড় বড় বই থেকে বুলি আওড়ালে তো ঘরহীন, সংসারহীন সংখ্যালঘুর সমস্যার সমাধান হবে না। তাদের পোড়া ভিটে থেকে চাল পোড়া গন্ধই বের হবে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার (শাহরিয়ার কবিরে বলেন, দাঙ্গা কথাটি ঠিক নয়, দাঙ্গা হয় দুই দলে, বাংলাদেশে হয় একতরফা) আগুনে পোড়া চালের ছাই সরিয়ে এক দানা রতনও পাওয়া যাবে না।
মাত্র দুইদিন আগেই ‘আমার ব্লগ’ নামের ব্লগটিকে বাংলাদেশের জন্য নাকি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, ‘আমার ব্লগের’ তিনজন ব্লগারকে ডিবি পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। হায়, সারা পৃথিবীর মানুষ যখন ইন্টারনেটে গুগল সার্চ করে দুনিয়া জেনে ফেলছে, আমার দেশের অসহায় মানুষ তখন ধর্মীয় জুজু’র ভয়ে সাধারণ একটি ‘ব্লগ’ কে সহ্য করতে পারছে না। পৃথিবীর একদিকে আলো, আমার এদিকটায় শুধুই অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে।
কিন্তু অন্ধ হলেই কী প্রলয় বন্ধ থাকে!! যে মুহূর্তে ঘরের বন্ধ জানালাগুলো খুলে দেয়া উচিৎ, সেই মুহূর্তে খোলা জানালাগুলোকেও বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে! গুমোট গরম আর অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে থেকে দম ফেটে মরে যাওয়ার চেয়ে জানালার গরাদে সূক্ষ্ম তারজালির পর্দা সেঁটে দেয়া অনেক বুদ্ধির নয় কি! বাইরের আলো-বাতাসও এলো, ধূলা-ময়লাগুলো তারজালির পর্দায় আটকে গেলো! কে কাকে বুঝাবে!