Thursday, May 30, 2013

প্রতিদান!

আজ বিকেলের দিকে হঠাৎ করেই মিথীলার শখ হয়েছে রাতে বাইরে কোন রেস্টুরেন্টে খাবে। আমার রাতের রান্না কমপ্লীট, লেখালেখি টানছে, আমার কিছুতেই ইচ্ছে করছিল না বাইরে যেতে। আমি অনেক বদলে গেছি, সংসারে মনোযোগ দিচ্ছি না, রান্না-বান্নাও জোড়াতালি দিয়ে চলছে। নানা কারণে মন মেজাজ ভালো থাকে না, পরিবারের সকলেই এর জন্য ফেসবুককে দায়ী করছে। করুক দায়ী, কিন্তু আমি তো জানি, ফেসবুকের কল্যানেই আমি অনেক না-দেখা জীবনও দেখছি, না-জানা মানুষকে জানছি।
মানুষ আমায় বরাবর টানে, মানুষের টানেই আমি ফেসবুকে সময় দেই। ফেসবুকের সূত্র ধরেই ব্লগ, ব্লগের সূত্র ধরেই রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে লেখালেখি, ব্লগের সূত্র ধরেই গল্প-উপন্যাসের জগতে প্রবেশ! কিন্তু সেটা আমি বুঝি, মিথীলার বুঝবার কথা নয়, তাই সে কোনভাবেই মানছিল না যখন বলেছি,
” বাবলুসোনা, আজ নয়, আরেকদিন যাব বাইরে খেতে”।
মিথীলা বলে, ” যদি আজ বাইরে খেতে যাও, তাহলে আমি ১০ মিনিটের মধ্যে স্নান সেরে ফেলবো, ১০ মিনিটের মধ্যে পূজা সেরে ফেলবো, নয়া গেলে এক ঘন্টা লাগাবো”।
বাচ্চা মানুষ, কী বাচ্চামানুষী আলটিমেটাম দিয়েছে আমাকে, মিথীলা খুব ধীরগতির বালিকা, আরও অনেক বেশী চটপটে হতে হবে ওকে, দিনরাত এই মন্ত্র ওর কানের কাছে জপে যাই, এটা বুঝেই আমাকে ও ১০ মিনিটের আলটিমেটাম দিয়েছে। আমি মনে মনে হাসি, সবাই খালি আলটিমেটাম দেয়, কিছুদিন আগে ৪ঠা মে তারিখেই বোধ হয়, বেগম জিয়াও ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। আল্টিমেটামের খবর মিথীলা জানে না, এর পরিনতিও জানে না। ভাবলাম, থাক! ছোট মানুষ, আলটিমেটাম তত্ব বুঝে কাজ নেই।
বললাম, ঠিক আছে, যাব। বাইরেই খাব, রেডী হও।
আমি বাদে পরিবারের সকলেই মোটামুটি সব ধরণের খাবারে অভ্যস্ত। জাপানীজ সুশী যে ওরা কী করে খায়, তা ওরাই জানে। মেক্সিকান ফুডও আমার কাছে একঘেয়ে লাগে বলাতে মিথীলা বলে, ” আমরা যে রোজ ডাল-ভাত খাই, সেটাও তো তাহলে একঘেয়ে”। এটা বলার জন্য কী ওকে একটা চড় দেয়া উচিত ছিল? ছিলনা, কারণ যুক্তির কথা বলেছে, যুক্তির কাছে আমি হার মানতে লজ্জা পাই না, কিন্তু অযৌক্তিক এবং ঠ্যাটা মারা কথা শুনলে মাথাটা গরম হয়ে যায়! ইদানিং কিছু বন্ধু ‘আমেরিকাবাসী’ বলে নানাভাবে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে, দেশে গিয়ে ‘ফাল’ পারতে উপদেশ দেয়। কিছুদিন আগে তো এক ভদ্রলোক বলেই বসলেন যে আমি নাকি আমেরিকার নাগরিকত্ব ভিক্ষা করে নিয়েছি, এখানে নাকি মানবেতর জীবন কাটাচ্ছি আর নির্লজ্জের মত আমেরিকার জয়গান করে যাচ্ছি। এসব কথার উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না, নাহলে বলতাম, আমরা কোটি কোটি প্রবাসী যদি দেশের টানে পাগল হয়ে গাতটি বোঁচকা বগলে করে দেশে গিয়ে উপস্থিত হই, আপনাদের মুখের চেহারা তখন কী হবে? ১৩ দফা দাবী নিয়ে ৫ই মে তারিখে যখন দেশে অবস্থিত ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগণের পায়ের চাপে ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত হয়েছিল, তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? ভয়ের চোটে তো ঘরের দরজায় খিল এঁটে বসেছিলেন, ঢাকাকে শংকামুক্ত করতে সরকারকে কেন ১৫ মিনিটের ” গণহত্যা” [ বিরোধী নেত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী] চালাতে হয়েছিল! আমাদেরকে দেশে ডাকার আগে আরেকবার ভেবে দেখুন, আমাদের পদভারের চাপ সামলাতে পারবেন তো???????
যাই হোক, আমি ইদানিং বাইরে খাওয়া-দাওয়া করিই না। আমাদের শহরে বাংলা ক্যুজিন তো দূরের কথা, ইন্ডিয়ান ক্যুজিনও নেই, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমেরিকান স্যান্ডুইচই নানা নামে, নানা ঢঙে পাওয়া যায়, নাহলে চায়নীজ অথবা জাপানীজ রেস্ট্যুরেন্ট আছে, আর আছে মেক্সিকান, থাই, ইটালিয়ান। সব খাওয়া হয়ে গেছে, নতুনত্ব নেই। আমিই বললাম, চায়নীজ রেস্টুরেন্টে যেতে পারি, আমি মঙ্গোলিয়ান গ্রীল ( সামনে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের পছন্দমত আইটেম উত্তপ্ত লোহার বড় প্লেটে ভাজা ভাজা করে নেয়া যায়) খাব। ওরা রাজী, মিথীলা, ওর বাবা আর আমি চলে গেলাম ওখানে। বলে রাখা ভাল, মিথীলা কিন্তু ঠিকই ১০ মিনিট এবং আরও ১০ মিনিটে ওর করণীয় কাজ সেরে ফেলেছে। তার মানে, ইচ্ছে করলেই ও দ্রুত কাজ করতে পারে, কিন্তু করে না, বাংলাদেশে জন্মানোর কারণেই বোধ হয় এই ঢিলেমীপনা, কে জানে!
রেস্টুরেন্টে পৌঁছাতে রাত আটটা বেজে গেছে, ঢুকে দেখি মালিক আর কর্মচারী ছাড়া আর কেউ নেই। মালিক ছেলেটি আমাকে চিনতে পেরেছে, ফোন কিনতে যায় তো, তাই সে বেশ আন্তরিকভাবে আমাদেরকে ডেকে ভেতরে নিয়ে বসিয়েছে। এই রেস্টুরেন্টে রাতের বেলাতেও বাফে সিস্টেম (ব্যুফে) চালু আছে। মালিককে জিজ্ঞেস করলাম, মঙ্গোলিয়ান গ্রীল কী আজ বন্ধ রেখেছো? সে বললো, ” না, আমি করে দিচ্ছি”। মিথীলা পাশ থেকে ফোড়ন কাটলো,
” মা, এখানে এটাকে মঙ্গোলিয়ান গ্রীল বলে না, হিবাচি গ্রীল বলে”।
বললাম, ” চুপ থাক, সব জায়গায় গিয়ে মাতব্বরী করবি না। সাউদার্ণ ইংলিশ শিখাস ঠিক আছে, এখন নাক বোচাদের সাথেও এত ভেবে কথা বলতে হলেতো আমার বিপদ!”
মিথীলা চুপ হয়ে গেছে, ও আমাকে ঘাঁটাতে চাইলো না, কে জানে, কত সাধ্য সাধনা করে মা’কে বাইরে আনা হয়েছে, এরপরে যদি মা সটান বেরিয়ে যায়!
মালিক ছেলেটি এর মধ্যেই লোহার প্লেট অন করে দিয়েছে। আমি একটি প্লেটে কাঁচা চিংড়ি, চিকেন ফিলে তুলে ছেলেটার হাতে দিয়ে বললাম, একেবারে কড়কড়ে করে ভেজে দাও, কোথাও যেন কাঁচা না থাকে, আরেকটি প্লেটে দিলাম মাশরুম, ব্রকলী, পেঁয়াজ, জুকিনি ( ঝিঙ্গা ধরনের সবজি), মরিচের সস, রসুনের কুচি আর দুটো ডিম।
ছেলেটি বলল, ভাত বা নুডলস দিবে না?
বললাম, নাহ! শুধু এগুলোই দাও, ভাত লাগবে না, শুধু খেয়াল রাখবে যেন কাঁচা না থাকে।
ছেলেটি সব প্লেটে ছেড়ে দিয়ে ক্যাশ বাক্সের কাছে চলে গেলো, বললো, সে সব ঠিকমত করে দেবে।
আমি একটি বাটিতে এগড্রপ স্যুপ নিচ্ছিলাম, খেয়াল করে দেখলাম, অন্য একটা কর্মচারী সেই গরম লোহার প্লেটের কাছে গিয়ে নাড়াচাড়া করছে, ক্যাশবাক্স থেকে ছেলেটি এক দৌড়ে চলে গেলো চুলার কাছে, কর্মচারীকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই আবার কুক করতে লাগলো। ছোট একটি ব্যাপার, আমার নজর এড়ায়নি, খুব ভালো লেগেছে। একে বলে ‘প্রতিদান’। এই ছেলেটিকে আমি ফোন কেনার সময় অনেক সাহায্য করেছিলাম, ওটা ছিল আমার দায়িত্ব, আমার সহকর্মী কৃষনাঙ্গ মেয়েগুলো খুবই অপেশাদারী আচরণ করে ভিনদেশী বা স্বদেশী বৃদ্ধদের সাথে। তাই ভিনদেশীরা আমাকে খুঁজে বের করে, আমি ওদের সমস্যা বুঝি, নিজের জীবন দিয়েই ওদের সমস্যা উপলব্ধি করি। আজ তার প্রতিদান পাচ্ছি, সে এত বড় ব্যবসার মালিক, তার সামনেই আছে তার কর্মচারী, তবুও এই সম্মানটুকু সে আমাকে দিয়েছে। ভাবলাম, পৃথিবী থেকে এখনও ভালোমানুষী বিদায় নেয় নি।
আমরা খাচ্ছিলাম, আধা পথে সেই মালিক ছেলেটি দুই হাতে করে মঙ্গোলিয়ান গ্রীলের প্লেট ( সরি, হিবাচি গ্রিল) এনে আমাদের টেবিলে রেখে গেলো, খাবার এনজয় করতে বললো। আমরা ছাড়া আর মাত্র দুজন বাইরের লোক ছিল, বুধবার রাত সাড়ে আটটার সময় আমেরিকানরা বেডে থাকে, রেস্টুরেন্টে থাকার কথাও না। আমার পাশেই বসেছিল উত্তম কুমার, সে দেখালো, আমাদের থেকে একটু দূরে কোণাকুণি দুই টেবিলে খেতে বসা কিছু চায়নীজ ছেলে মেয়েকে! বললো, “ওরা বোধ হয় কর্মচারী, কাজ শেষে এখন খাচ্ছে”।
আমার সাইড থেকে ভালই দেখা যাচ্ছিল, প্লেট ভর্তি সাদা রঙের আঠা ভাত, আর একটা কিছু তরকারী, সামনে বাটি থেকে গরম ধোঁয়া উঠছে। স্যুপ কিনা কে জানে! চার পাঁচটি ছেলে মেয়ে আঙ্গুলে কাঠি ধরে কপাকপ করে সাদা আঠা ভাত খাচ্ছে। বুঝা যাচ্ছে, এগুলো ওদের জন্য আলাদা রান্না করা হয়েছে। আমার আর খেতে ভাল লাগছিল না। মনে হচ্ছিল, কেইস ভর্তি এত হরেক রকম খাবার আর ওরা খাচ্ছে শুধু ভাত আর পাতলা স্যুপ। আমাদের দেশে কিছু ধনী ব্যক্তির বাড়ীর রান্নাঘরে দুই রকমের চাল মজুত থাকে। নিজেদের জন্য রান্না হয় দিনাজপুরের ‘কাটারীভোগ’, আর গৃহভৃত্যদের জন্য মোটা ‘ইরিচাল’। আমার নিজের চোখে দেখা জিনিস, কখনওই মেনে নিতে পারিনি। কৈফিয়ত হিসেবে উত্তর পেয়েছি,
“ওরা তো অনেক ভাত খায়, কাটারীভোগ দিয়ে পোষাবে না, তাই ওদের জন্য মোটা চাল”।
বুঝলাম মোটামুটি যুক্তি আছে ধরে নিলাম, কিন্তু রুইমাছ বা কই মাছ নয় কেন ওদের জন্য?
উত্তরে শুনেছি, ওরা মরিচ পোড়া আর আলু ভর্তাতেই বেশী খুশী থাকে।
হতে পারে সত্যি কথা, কিন্তু আমার বাসার বুয়ারা আমার চেয়ে বেশী ভাত খেতো না, আলু ভর্তা নিজের বাড়ীতে খেতো বলেই মাছের টুকরা দুই একটা বেশী পেলে বাটিতে ঢাকা দিয়ে বাসায় নিয়ে যেত। আমার কাছে কতটুকু আদর পেত আমার বুয়ারা জানিনা, কিন্তু যতদিন থেকেছে, আমাকে আগলে রেখেছে বুয়া। প্রতিদান দিয়েছে, আমার মা’কে দাওয়াত দিয়ে বস্তিতে নিয়ে গেছিল, মা’কে নিজের বিছানায় বসিয়ে ‘চা’ বানিয়ে খাইয়েছে। সারা বস্তির মানুষ এসে নাকি জড়ো হয়েছিল, ‘মাসী’কে দেখতে। আমার যখন তৃতীয় সন্তান (মিথীলা) হবে, বুয়া মানত করেছিল, ‘দিদির একটা ছেইলে হইলে মিল্লাদ পড়ামু”!!!
ছেইলের বদলে মেয়ে হয়েছে দেখে বুয়া একটুও অখুশী হয় নি, মিথীলাকে কত যত্ন করে সে লালন-পালন করেছে, বুয়ার কাছে মিথীলাকে রেখে আমি বিএড কমপ্লীট করেছিলাম, বুয়ার কাছে দেড় বছরের মিথীলাকে রেখে আমি তিনদিনের জন্য ‘দুবাই’ বেড়াতে গেছিলাম!
২০০১ সালের নির্বাচনের সময় আমি বুয়াকে দিয়ে ‘নৌকা’ মার্কায় ভোট দেয়ার জন্য প্রচার চালিয়েছিলাম। বুয়াকে বলেছিলাম, ” বুয়া, আমি দেশে থাকলে নৌকা মার্কা হাইরা যায়, ‘৯১ সালেও হারছিল, ‘৯৬ তে আমি ছিলাম না দেশে, নৌকা জিতছিল, এইবার দেশে আছি, এইবারও না জানি নৌকা হাইরা যাইব, তুমি এক কাজ করো, তোমাদের বস্তিতে কত মানুষ, আমারে তো সবাই চিনে, তাগোরে গিয়া কও, নৌকায় যেন ভোট দেয়, নৌকা জিতলে আমি তাগোরে একদিন খাওয়ামু”।
আগের রাতে বুয়া এসে বলে গেছে, ” দিদি, অবস্থা বেগতিক, বিপক্ষের লোক আইসা সবতেরে টেকা দিয়া গেছে, আমার আনোয়ারের বাপেরেও সাধছিল টেকা, আনোয়ারের বাপে লয় নাই, কইছে না, টেকা নিমুনা, ভোট যারে খুশী দিমু।”
একে বলে প্রতিদান! বুয়াকে ভালোবাসছি, বুয়া তার প্রতিদান দিতে চেয়েছে। আমাদের ড্রাইভার মোকসেদ আলীকে তার স্যার যে কতভাবে সাহায্য করতো, ঠিক ঠিকানা নাই। হুমায়ুন আহমেদের নাটক ‘বহুব্রিহীতে’ রহিমার মা’কে সবার সাথে টেবিলে বসিয়ে খেতে দেয়া হয়েছিল বলে দর্শকদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ প্রতিবাদ করেছিল। ওটাতো নাটকে দেখিয়েছে, আর বাস্তবে আমার উত্তম কুমার মোকসেদ আলীকে পাশে বসিয়ে কতদিন যে ভাত খেয়েছে, তার হিসেব নেই।
মোকসেদ আলী আমাকে নিয়ে যখনই নারায়ণগঞ্জে যেত, আমার বাবা সোফা থেকে উঠে মোকসেদকে বসতে দিতেন। মোকসেদ খুব লজ্জা পেত, বাবা তার পিঠে হাত বুলিয়ে বসাতেন। আমি সামনে থাকতাম না, কারণ আমাকে দেখলেই মোকসেদ উঠে দাঁড়িয়ে থাকতো, যত বলতাম, মোকসেদ, আপনি আমার বাবার বাড়ীতে অতিথি, এখানে আমার সামনে আপনাকে লজ্জা পেতে হবে না, কিন্তু শত হলেও বসের স্ত্রী আমি, অতটা সমাজতন্ত্র তো দেশে আসেনি! আমরা আমেরিকা চলে আসার পরেও মোকসেদ আলী নারায়ণগঞ্জে মাঝে মাঝে যেত মা-বাবাকে সালাম জানাতে, নিজের বাড়ির গাছের পাকা পেঁপে দিয়ে আসতো, একে বলে ভালোবাসার প্রতিদান! যাই হোক, নির্বাচনের আগে আমি মোকসেদের মতি গতি বুঝতে পারতাম না, তবে মোকসেদ আমার মতিগতি ভাল বুঝতো, নির্বাচনের আগের দুই একদিন মোকসেদ বলেছিল নিজের থেকে, ” আপা, নিশানা ভাল বুঝা যায় না, আহসান উল্লাহ মাস্টাররে হারানোর জন্য একদল লোক টাকা লইয়া ঘুরতাছে!”
বললাম, ” আপনি কী নৌকা মার্কার লোক?”
মোকসেদ বলে, ” হ, নৌকার লোক, তবে আহসানউল্লাহ মাস্টারের জন্য জান কোরবান”।
নির্বাচনের ফলাফল যেদিন বের হয়েছে, এখন মনে পড়লে হাসিও পায়, বুয়া এসে গালে হাত দিয়ে আমার ঘরের দরজায় বসেছে, আমি খাটে শুয়ে আছি চুপ করে, পাথর হয়ে গেছি অপমানে, কেন যে এত অপমান লেগেছিল, কে জানে! বুয়া বলে, ” দিদি, কইছিলাম না আপনেরে, প্রচুর টেকা ঢালছে বস্তিতে, এইবার দেখলেন ত,”
আমি বলি, ” যাক বুয়া, তোমাদের দোষ নাই, গরীব মানুষ, যে টাকা দিবে তার কথাই শুনতে হবে, নাহলে বস্তি জ্বালিয়ে দিলে তোমরা কই যাবে?”
বুয়া বলে, ” আমারে বুঝানো লাগবে না, আপনে বুঝলেই হয়। সক্কাল থিকা মরার মত পইড়া রইছেন, নৌকা হারছে ত কী হইছে, একবার হারছে, পরের বার জিতব। এখন শোক কইরা লাভ আছে? উঠেন শোয়া থাইক্কা, চউক্কে মুখে পানি দেন। আপনের সমস্যা কী, আপনে ত যাইতাছেন গা আমরিকা, সমস্যা হইব আমার। বিরুধী দলের লোকে আমার চেহারা চিন্যা রাখছে, এইবার আমারে ধরবো”।
আমি বলি, ” হায় হায়, এইটা কী কও বুয়া, তোমার বস্তির বাড়ীওলারে গিয়া আমার কথা কইও, দরকার হইলে আমারে লইয়া যাইও একদিন, আমি বুঝায়া বলবো নে, কিছু বলবে না তোমারে”।
” হেই বেবস্থা আমি কইরা থুইছি, চিন্তা নাইক্কা, হেগোরে কইছি, আমি ধানের শীষে ভোট দিছি, না দিলে ধানের শীষ জিতছে কেমনে? বস্তির ভোট গইন্না দেহেন, তাইলেই টের পাইবেন”।
বুয়ার কথায় আমি চমৎকৃত না হয়ে পারিনি। ছোট্টখাট্ট মানুষ, যেদিন আমার বাসায় প্রথম আসে, কী লজ্জা লজ্জা মুখ, চার বছরে কত স্মার্ট হয়ে গেছে, বুয়া আমার কাছে থেকে কী আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে, দেখে আমি খুব খুশী হয়েছি। এরপর আমেরিকা থেকে যতবার দেশে গিয়েছি, বুয়ার খোঁজ নিতেই বুয়া অন্য বাড়ীর কাজ কমিয়ে দিয়ে আমার কাছে দুই মাস থেকেছে। অন্য বাড়ীতে বলে এসেছে, “দুই মাস আমারে একটু ক্ষমা করতেই হইব, আমেরিকা থিকা আমার দিদি আসছে, দিদি না থাকলে আমার ত এইখানে থাকাই হইত না, গাট্টি বোচকা লইয়া বাড়ীতে যাওন লাগতো।” আমি বুয়ার জন্য কী করেছি তা আমার মনে নেই, কিন্তু বুয়া মনে রেখেছে!
এই হচ্ছে প্রতিদান! প্রায়ই শুনি, কাজের বুয়াকে মারধোরের সংবাদ, খারাপ লাগে, আবার বুঝি, দুই পক্ষেই দোষ আছে, গৃহকর্তার যেমন দোষ আছে, গৃহভৃত্যদেরও দোষ থাকে। তারপরেও যতটুকু সম্ভব বৈষম্যনীতি পরিহার করে চললে মনের দিক থেকে স্বস্তি পাওয়া যায়। কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে এসেছি। রেস্টুরেন্টে বসে চায়নীজদের কথা বলছিলাম, সেখানেই শেষ করতে চেয়েছিলাম, বাংলাদেশের বুয়া ঢুকে গেছে গল্পের মাঝে। তবে বুয়া ঢুকে পড়াতে একটা উপকার হয়েছে, লেখার যবনিকা টানতে সুবিধা হয়েছে এই বলে যে,
শ্রেণী বৈষম্য সব দেশে, সব জাতিতেই বিদ্যমান আছে, কোথাও কম, কোথাও বেশী। তেমনি প্রতিদানের চেষ্টাও সব দেশের সব মানুষের মাঝেই আছে, এটাই মানবচরিত্রের ভাল বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য!

Wednesday, May 29, 2013

'ধানী মরিচে'র জন্মদিনে!

আজ ২৯শে মে, আমার ছোট ভাই, 'ধানী মরিচে'র শুভ জন্মদিন। মা' কে ছাড়া প্রথম জন্মদিন। তাই মায়ের দেয়া নামেই আজ ওকে সম্বোধন করছি।   কাল রাত থেকেই আমি অপেক্ষা করছিলাম, আমাদের দুপুর একটা, বাংলাদেশ সময় রাত বারোটা বাজার সাথে সাথে আমি ধানী মরিচকে ফোন করে বার্থডে উইশ করবো। সকাল এগারোটায় অফিস গিয়েছি, দুপুর একটায় ওর নাম্বারে কল দিয়েছি, শুনি 'এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া যাচ্ছে না"! জানতাম, এমনটাই হবে। 'ধানী মরিচ'  ছোটবেলা থেকেই এরকম স্বভাবের। সন্ধ্যারাতেই কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমালে নাকি স্বাস্থ্য ভাল থাকে, তাই রাত দশটা বাজতেই ধানী মরিচ ঘুমিয়ে পড়ে, শীত, গ্রীষ্ম বারোমাস।

ছোটবেলায় আমি, মেজদা আর ছোটভাই, একসাথে পড়তে বসতাম। একটা তক্তপোশে ( আমরা বলতাম 'চকি') তিন ভাইবোন গোল হয়ে বসে পড়াশোনা করতাম। রান্নাঘরে  মা হয়তো রাতের খাবারের জন্য রুটি  তৈরী করছেন, বাবা হয়তোবা তখনও রাতের অফিস সেরে বাসায় ফিরেননি। রাত আটটা বাজার সাথে সাথে  ছোটভাই বইখাতা মুড়ে রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তো। ওর  একটা সবুজ রঙের গায়ের চাদর ছিল, চাদরের পাড়ে ছিল ছোট ছোট প্রজাপতি ছাপ। খুবই সস্তা দামের চাদর, শীতের সকালে গ্রামদেশে বাচ্চারা এই চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আমার ভাইটাও এই চাদরটাকে আশেপাশেই রেখে দিত। রাত আটটার মধ্যে যদি মায়ের রুটি বানানো শেষ না হতো, তাহলে ভাই সবুজ রঙের চাদরে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে শুয়ে পড়তো। শুয়ে পড়ার আগে অবশ্য মা'কে ডেকে বলতো, " মা, আমার পেটের মধ্যে জ্বর আইছে, আমি ঘুমায় থাকি"। এই বলে আর মুহূর্ত দেরী করতো না, কারণ দেরী হলেই বাবার চলে আসার সম্ভাবনা। বাবা বাসায় ফিরে আসা মানেই ইংলিশ বই নিয়ে পড়তে বসা। ও বেশী পড়াশুনা করতে চাইতো না। ঘরে সবার ছোট বলে আহ্লাদটা একটু বেশী পেত। আমার বা মেজদার সাহসে কুলাতো না বাবা বাসায় ফেরার আগে অমন করে সটান শুয়ে পড়তে। মায়ের পক্ষপাতিত্ব ছিল ছোট ছেলের প্রতি। বাবা বাসায় ফিরে ওর কথা জিজ্ঞেস করলেই মা  হেসে হেসে বলতো, " ওর নাকি পেটের মধ্যে জ্বর আসছে", অথচ আমার আর মেজদার নামে মা প্রতিদিন বাবার কাছে বিচার দিত, বিশেষ করে মেজদার নামে, আর বাবার হাতে উত্তম মধ্যম খেতাম আমরা। আমার ভাই টাইম সম্পর্কে সচেতন সেই ছোটবেলা থেকেই। আমার দাদু ঘড়ির আন্দাজ করতেন ভাইয়ের শুয়ে পড়া থেকে। রাত 'আটটা'র একচুলও এদিক সেদিক হতো না। ওর স্বাস্থ্য খুবই হালকা পাতলা ছিল বলে ও বলতো, ' আগে আগে শুয়ে পড়লে স্বাস্থ্য ভাল হয়'!

ছোটভাই সন্ধ্যারাতে ঘুমিয়ে পড়ার ফল ভোগ করেছিল একবার। তখন অবশ্য ও  ক্লাস এইটে পড়ে, হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় 'হিন্দুধর্মশিক্ষা'য় ১৩ পেয়েছিল। প্রগ্রেস রিপোর্ট দেখে মায়ের তো মাথায় হাত। আমরা সবাই ক্লাসে ফার্স্ট হতাম আর ছোট ভাই পরীক্ষায় এক সাব্জেক্টে ফেল! তাও আবার আমার মায়ের মত এমন ধর্ম বিশেষজ্ঞের ছেলে হয়ে! আমার মা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা, সাধারণ গনিত, সমাজ বিজ্ঞান পড়ানোর পাশাপাশি হিন্দুধর্মও পড়াতেন। সেই মায়ের ছেলে হয়ে সে ধর্মের মত এত সহজ সাবজেক্টে ১৩ পায়!!! এরপর কয়েকদিন মা ছেলের পাশে বসে থেকে ধর্ম বই পড়িয়ে ছেলেকে ধর্মে মোটামুটি পন্ডিত বানিয়ে ছেড়েছেন। বার্ষিক পরীক্ষায় সে খুবই ভাল ফল করেছে, ১৩ থেকে এক লাফে ৭৬ পেয়েছে, ক্লাসে ফার্স্টও হয়েছে। বাবারও অনেক দূর্বলতা ছিল এই ছেলের প্রতি। আমাদের মধ্যে কেউ যদি কোন বিষয়ে সর্বোচ্চ নাম্বার না পেতাম, বাবার কাছে কৈফিয়ত দিতে দিতে জান বেরিয়ে যেত। আর ছোটছেলের বেলায় বাবা খুব আহ্লাদ করে বলতো,

" থাক গিয়ে, ওরা তো ডাক্তার -ইঞ্জিনীয়ার হইবো, বড়লোক হইয়া আমারে পাত্তা দিবনা, বুড়া বয়সে আমারে কে দেখবো? আমার এই ছোটছেলের তো পড়াশুনা বেশীদূর আগাইবো না, ওরে  সাথে নিয়া আমি একটা তেলেভাজার দোকান খুলবো। বাপ বেটাতে মিলে দোকান চালাবো।"
[*** বাবার একটি আশা পূরণ হয়েছে, বাবা-মা উনাদের অবসর জীবন থেকে এখন পর্যন্ত ছোট ছেলের সাথেই আছেন। ছোট ছেলে আর তার বউ, বাবা-মাকে মাথায় করে রেখেছে। কিন্তু বাবার তেলেভাজার দোকান খোলার স্বপ্ন আর পূরণ হয় নি। বাবার ছোট ছেলে, যাকে বাবা খুব ছোটবেলায় 'সাহেব' নামে ডাকতো, একটু বড় হওয়ার পরে 'ডুলাঝাড়া' বলতো, আরও একটু বড় হওয়ার পর তেলেভাজার ব্যবসার ভবিষ্যত সহকারী  ভাবতো, সেই ছেলে ম্যাট্রিকে কমার্স গ্রুপে দ্বাদশ স্থান পেয়েছে, উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম বিভাগ, হিসাব বিজ্ঞান অনার্সে প্রথম শ্রেনী, মাস্টার্সে প্রথম শ্রেনী পেয়ে বিসিএস পরীক্ষার ফলাফলেও ২৯তম স্থান পেয়েছিল। সে এখন সরকারী কলেজে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সর্বজনপ্রিয় অধ্যাপক!***]



আমাদের ছোটভাইটির কিন্তু অনেকগুলো নাম আছে, খুব ছোটবেলায় ও দেখতে খুবই সুন্দর ছিল, তাই বাবা, মা থেকে শুরু করে আত্মীয় -স্বজনদের মধ্যে থেকেও কেউ কেউ নিজের দেয়া নামে ওকে ডাকতো। গায়ের রঙ ছিল ধবধবে ফর্সা, তাই বাবা ডাকতো  'সাহেব', ওর পোশাকী নাম মা রেখেছিলেন, সেই নামে ও স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচিত। মায়ের কোলপোঁছা ছেলে ছিলেন বলে মা তাঁর কোলপোঁছাকে আরও বহু বিচিত্র নামে ডাকলেও উনার দেয়া 'ধানী মরিচ' নামটিই তার স্বভাব ও চরিত্রের সাথে মানিয়ে গেছে। ছোটবেলায় যে ছেলে খুব বেশী রকম কোমল -সুন্দর ছিল, বড় হতে হতে সেই ছেলেই কী করে যেন 'কাঠখোট্টা আদর্শবান' হয়ে গেছে। নীতির বাইরে চলে না, নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে না, আমাদের কারো কোন অন্যায় আবদারে সাড়া দেয় না, উলটো আরও কঠিন কথা শুনিয়ে দেয়, ওর এমন পরিনতি দেখে শেষ পর্যন্ত আমরা সকলেই ওকে আড়ালে ধানী মরিচ ডাকতে শুরু করেছি। নামটা মা নিজে দিয়েছে, মা অবশ্য 'ধাইন্যা মরিচ' ডাকতো, সেটাও ওর আড়ালে। সামনাসামনি ডাকতো না। আমাদের পরিবারের অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কোন একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, আমাদের সকলের মিলিত মতামতে কিছুই যাবে আসবে না, যতক্ষণ 'ধানী মরিচ' মতের পক্ষে সমর্থণ না দেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ শান্তি পাই না। ধানী মরিচের সমর্থণ মানে নৈতিক সমর্থণের মত। অধ্যাপনা করে তো, তার উপর আবার 'হিসাব বিজ্ঞান' পড়ায়, ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পুণ্য বিচার করে চলা মানুষ, সে 'হ্যাঁ' বলা মানেই যুদ্ধ না করে যুদ্ধজয়ের মত ব্যাপার! খুবই টেনশানে থাকি, নিজেদের মধ্যে কথা বলি, একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করি, 'প্রফেসার কী বলে? প্রফেসার হ্যাঁ না করা পর্যন্ত তো 'বিল' পাস হবে না। তার উপর এই প্রফেসার হচ্ছে 'একগুঁয়ে', যাকে আমরা রাগের চোটে 'ঘাউরা' ডাকি, নাহলে বলি, 'ঘাড় ত্যাড়া' পোলা একটা।

আমি ব্লগে লেখালেখি করি, এইনিয়েও ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকি। আমার বড়দা তো সরল মানুষ, আমার সব লেখাতেই 'হ্যাঁ' বলে, মেজদাকেও 'হ্যাঁ' বলতেই হয়, নাহলে আমার হাতে 'মাইর' খাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়, কিন্তু 'প্রফেসার' কে নিয়ে সমস্যা। সে বাবার কাছে নালিশ করেছিল একদিন, বাবা আমাকে ফোন করে এমন ধ্যাতানী দিয়েছিল যে অভিমানে আমি দুই মাস কারো সাথে কথা বলিনি। এতে করে হয়তো প্রফেসারের মনটাও কিছুটা ভিজেছে, হয়তো মনে পড়েছে ছোটবেলায় এই ফুলদি'র কোলে চড়ে বেড়িয়েছে, এই ফুলদি'কে সে 'তুতু' ডাকতো, সেই ছোটবেলার 'তুতু'র সাথে এত কঠিন হওয়া বোধ হয় ঠিক না, তার উপর মা'ও চলে গেলো, সবেধন নীলমনি একটাই বোন, সেও যদি এমন গাল ফুলিয়ে থাকে , তাহলে চলে কী করে! তাই হয়তো আর কখনও বাবার কাছে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করেনি। আমিও সবদিক বিবেচনা করে, ভেবে চিনতে লেখালেখি শুরু করেছি। ভয়ে ভয়ে ওকে ফোন নয়া করে ওর বউকে ফোন করে ওর কুশল জানি, তবুও ধানী মরিচকে ফোন করি না। মাঝে মাঝে ছোটমাসীকে ফোন করে ধানী মরিচের কথা জিজ্ঞেস করি, মাসীও উত্তর দেয়, " মাগো মা, ওর কথা কইতে পারবো না, এই নীতিবাগীশ যখন মুখ খুলে, ভয়ে বুক কাঁপে"। এই যখন অবস্থা, তখন তাকে ধানী মরিচ নয়া দেকে করবো কী! ভালো কথা, যে বা যারা ধানী মরিচ সম্পর্কে কিছুই জানে নয়া, তাদের জন্য বলে রাখি, ধানী মরিচ দেখতে খুব ছোট হয়, কিন্তু এর ঝাল হয় আকাশ ছোঁয়া!

ছোট ভাইটাকে নিয়ে অনেক রসিকতা করলাম, কারণ আমার ভাইটি কঠিন নীতিবাগীশ হলেও  দারুণ রসিক, ওর হিউমার সেন্স খুবই ভাল। স্মৃতিশক্তিও খুব প্রখর, এতদিন ভেবেছি,  মায়ের প্রখর স্মৃতিশক্তি বোধ হয় আমার এবং মেজদার মধ্যেই আছে, কিন্তু এখন বুঝেছি, ধানী মরিচের স্মৃতিশক্তি খুবই প্রখর। সে কথা কম বলে, তাই তাকে সব সময় পরিমাপ করা যায় না। ছোটবেলার স্মৃতিকথা নিয়ে গল্প করতে আমি আর মেজদা বরাবরই ভালোবাসি, মায়ের সাথে বসে আমরা অনেক গল্প করতাম। ধানী মরিচকে গল্পের আসরে ডাকতাম না,  ভাবতাম, একেতো ও আমাদের চেয়ে অনেক ছোট, কিছুই মনে থাকার কথা না, তার উপর আবার পেশাগত জীবনে 'হিসাববিজ্ঞানের' অধ্যাপক, হিসেবের বাইরে কথা বলে না, কিন্তু ধারণা ভুল। ছোটবেলার অনেক কথা ওর মনে আছে। ওর মনে আছে, আমাদের ছোটবেলা কেটেছে খুবই সাধারণভাবে, একটি সাধারণ মধ্যবিত্তের সংসারে যতটুকু মেপেজুখে চলা সম্ভব, তার চেয়েও বেশী অর্থনৈতিক চাপাচাপির মধ্যে আমরা বড় হয়েছি। আমার এই ভাইটি অধ্যাপনা শুরু করার সাথে সাথে আমার মা-বাবার সংসারে স্বচ্ছলতা আসুক আর নাই আসুক, রান্নাঘরে প্রতিবেলাতে পাঁচ -ছয় পদের কম আইটেম রান্না হয় না। মা মাছ খেতে ভালোবাসতেন বলে মায়ের কোলপোঁছা ছেলে বাজারের সেরা মাছ এনে বারান্দা ভরে ফেলতো। অধ্যাপকের বউটিও হয়েছে ভারী লক্ষ্মী। স্বামীর এই সকল হুজ্জোতেপনা হাসিমুখেই মেনে নেয়। অধ্যাপক হয়তো বা বিকেলে কোথাও ঘুরতে বেরিয়েছে, ফেরার পথে দেখতে পেলো, টাটকা মাছের ঝুড়ি নিয়ে জেলে বসে আছে, অধ্যাপক সাথে সাথে কিনে ফেলবে সেই মাছ। বাড়ী নিয়ে আসবে, অধ্যাপকের মা বাজার দেখে আহ্লাদে মুখ গদগদ করে হাসি দিবে, ছেলের প্রশংসায় গলে গলে পড়বে, এটাই ছিল আমাদের বাসার পরিচিত দৃশ্য।

এ বছর দৃশ্যপট বদলে গেছে। মা নেই, চলে গেলো গত অক্টোবার মাসে, অধ্যাপক ছেলে এখনও বাজার থেকে রাশি রাশি মাছ কিনে আনে, মায়ের ছবির কাছে গিয়ে হয়তো মনে মনে বলে, " মা, তুমি এভাবে চলে গেলা, এখন বারান্দা ভরে মাছেরা খেলা করে, মাগুর, শিং, কই মাছ লাফালাফি করে, কাছে থেকে তো দেখতে পাও না, দূর থেকেই দেখো, তুমি না দেখা পর্যন্ত আমার শান্তি লাগে না"! মা হয়তো কোন না কোনভাবে উনার ছেলের মনের আকুতি বুঝতে পারেন, নাহলে তো আবার সমস্যা আছে, ' ধাইন্যা মরিচ' হয়তো রেগে গিয়ে বাজার করাই বন্ধ করে দিবে।

আর কিছু লিখতে চাই না। আমার ভাইগুলি একেকটি রত্ন, যাকে নিয়েই লিখতে শুরু করি, হাত ব্যথা হয়ে যায়, লেখা শেষ হয় না। কত কথা বলতে পারতাম আমার এই ছোট ভাইকে নিয়ে। কলেজে ছাত্রছাত্রী-সহকর্মীদের মধ্যে কী যে জনপ্রিয়তা, হবে নাই বা কেন, আমার ভাইটা তো আর একালের ব্যবসায়ী মনোবৃত্তি নিয়ে ছাত্র পড়ায় না! ও একজন আদর্শ শিক্ষক! যে কলেজেই ওর পোস্টিং হোক, সেখানেই কিছু গরীব ছাত্র ছাত্রীকে ও বিনে পয়সায় পড়ায়! সংসারেও ও খুব দায়িত্ববান, বাবা-মা, স্ত্রী, দুই ছেলেকে যথেষ্ট সময় দেয়, টিউশনী নামক যান্ত্রিক পেশায় নিজেকে জড়ায় নি। কখনও ছাত্র-ছাত্রীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেনি, পড়ানোতে ফাঁকী দেয় না, সিলেবাস বাকী রাখে না, এমন একটি ভাইকে নিয়ে রসিকতা করতে 'সাহস' লাগে। আর কারো সেই সাহস নেই, আমার সাহস আছে বলেই এত কথা লিখলাম। 'সাহস' কী আছে? একটু আগেই তো ওকে ফোন করে বললাম,
" তোকে নিয়ে কিছু স্মৃতিচারণ করেছি, ওয়ালে পোস্ট করবো? রাগ করবি না তো"!
আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বলে, " রাগ করবো কেন, তুমি দাও। ব্লগে লেখা নিয়ে একবারই রাগ করেছিলাম, তখন পরিস্থিতি কারো অনুকূলে ছিল না, সেইজন্য। এখনতো আর কিছু বলি না।"

সকালে ওকে ফোন করেছিলাম, ফোন তখনও বন্ধ। বাবার নাম্বারে কল দিলাম, বললাম, " বাবা, আজকে তো রানুর জন্মদিন।" বেচারা বাবা অবাক হয়ে গিয়ে উলটো প্রশ্ন করেছে আমাকে, " আজকে রানুর জন্মদিন? কই, আমি জানিনা তো"! বললাম, " যিনি জানাতেন, উনি তো এখন আর নাই, তাই তুমি জানো না, অসুবিধা নাই, আমিই তো এখন মায়ের দায়িত্ব নিয়েছি, তোমাকে জানালাম। তুমি ওকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করো।" ফেসবুকে দেখি, অনেক আগেই বড়দা ওকে বার্থডে উইশ করেছে, মেজদাও করেছে, মেজ বৌদি করবে, সুনামগঞ্জ থেকে মাসী করবে, হবিগঞ্জ থেকে মিত্রা ফোন করবে, ওর ছাত্র ছাত্রীরা করবে, আদরের ভাগ্নী মিশা করবে!!! সবাই করবে, শুধু এই বছর ওর জন্য কালীবাড়ীতে কেউ পূজা পাঠাবে না, সেই মানুষটা তাঁর 'ধাইন্যা মরিচ'কে স্বর্গ থেকে আশীর্বাদ করবে। মায়ের বৌমা নিশ্চয়ই তার প্রফেসার স্বামীকে আমাদের  সকলের আগে 'হ্যাপী বার্থ ডে' বলেছে, আদরের টুকরা নাতি 'অতনু' বলেছে ' হ্যাপী বার্থডে বাবা', আরেক নাতি যীশু নিশ্চয়ই তার বাবার কাঁধে চড়ে বসে আছে!

শুভ জন্মদিন রানু, আমরা তোকে অনেক অনেক ভালোবাসি! কঠিন আবরণে নিজেকে ঢেকে রাখলেও তোর অন্তরের স্বচ্ছতা আমাদের কারো নজর এড়ায় না!!

Wednesday, May 22, 2013

অপমানের ক্ষত শুকোলেই আবার ব্লগে লিখবো!

না-দেখা একটি মেয়ে, নাম দিলাম 'আফসানা', থাকে আমেরিকার কোন একটি স্টেটে, তিন বছর হলো, এদেশে এসেছে। তরুণ স্বামীর সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখবে বলে মেয়েটি ধনুক ভাঙ্গা পণ করেছে। তাই স্বামী যেভাবে বলে, আফসানা সেভাবেই চলতে পছন্দ করে। স্বামী চায় না আফসানা 'ফেসবুক' করুক, আফসানা ফেসবুক করেনা। স্বামী চায় না তার লক্ষ্মী বৌটা বাঙ্গালীদের সাথে মেলামেশা করুক, আফসানা কারো সাথে মেলামেশা করেনা। স্বামী সুযোগ পেলেই আফসানাকে নিয়ে বেড়াতে যায়, রেস্টুরেন্টে খায়, একসাথে টিভি দেখে, কিন্তু যখন স্বামীর সে সুযোগ হয় না, যখন স্বামী কাজে ব্যস্ত থাকে, তখন একাকী আফসানার সময় কী করে কাটে, সেদিকে অবশ্য স্বামীর খেয়াল নেই। স্বামীকে তো আর একা থাকতে হয় না, অফিসে গেলে সহকর্মী, বাড়ীতে ফিরলে আফসানাকে পায়। তাই একাকী আফসানা কম্পিউটারে বসে, এটাতে ক্লিক করে, ওটাতে ক্লিক করে শেষ পর্যন্ত বাংলা ব্লগ খুঁজে পায়।  বাংলা ব্লগে নানারকম লেখা পড়ে  সে  সময় কাটায়। এভাবেই আফসানার একাকী মুহূর্তগুলো কাটে।

একদিন 'প্রিয় ব্লগে' বিশ্বজিতের উপর একটি লেখাতে আফসানার নজর আটকে যায়। লেখাটি ওপেন করে পড়তে থাকে, একটু পরেই খেয়াল করে ওর দুগাল চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে। বিশ্বজিতকে আফসানা খুব ভাল করে চেনে, শরীয়তপুরে আফসানাদের প্রতিবেশী ওরা। পূজা-পার্বণে, ঈদে-রোজায় সকলে মিলে কতই আনন্দ করেছে। সেই বিশ্বজিতের করুণ মৃত্যুতে আফসানার তরুণ হৃদয় কষ্টে নীল হয়েছিল। ও ভেবেছিল, ওর মত করে আর কেউ বোধ হয় ভাবছে না, আর কেউ তো বিশ্বজিতের মা-বাবাকে চেনে না, তাই জানেনা, ছেলে হারিয়ে পাশের বাড়ীর কাকীমার কত কষ্ট হচ্ছে। প্রিয় ব্লগে রীতা রায় মিঠুর লেখা পড়ে ও জানতে পারলো, বিশ্বজিতের জন্য এই লেখকের মনও তাহলে ওর মত করেই কেঁদেছে। ও যেমন করে পুত্রহারা  'কাকীমা' (বিশ্বজিতের মা)র কথা ভাবছে, এই লেখিকাও তো দেখি তেমন করেই ভাবছে, লেখিকাকে  ওর খুব ভাল লেগে গেল। ও লেখিকার অন্যান্য লেখাগুলোও পড়তে শুরু করলো। বেশীর ভাগ লেখাতেই পেল পারিবারিক গল্প, মায়ের অনুভূতি, মেয়েদের জন্য আলাদা মমতা, ছেলেদের জন্য কিছু স্নেহমাখা কথা। আফসানা এই লেখিকার লেখার মধ্যে নিজের মা'কে খুঁজতে শুরু করে দিল। লেখিকার সাথে যোগাযোগ করতে ইচ্ছে হলো, নাম-ঠিকানা জানা নেই, তাতে কী হয়েছে, বুদ্ধিমতী আফসানা লেখিকার কোন একটি লেখার সূত্র ধরে লেখিকার কর্মস্থলের ফোন নাম্বার যোগার করে ফেললো। ফোন নাম্বার যোগার করার সাথে সাথেই সে ফোনও করে ফেললো। আফসানার ভাগ্য ভালই ছিল, সেদিন রীতা রায় মিঠু কাজে এসেছিল, তাই তার সাথে সরাসরি কথা বলতে পেরেছে। লেখিকা তার ফোন নাম্বার চাওয়াতে আফসানা বিপদে পরে যায়, প্রথম আলাপেই ও লেখিকাকে জানাতে চায় নি পারিবারিক সমস্যার কথা। তাই ভদ্রতাবশতঃ ফোন নাম্বার দিয়েও ছোট করে বলে দিয়েছে, প্রয়োজনে ও নিজেই ফোন করবে লেখিকাকে, লেখিকা যেন ওকে ফোন না করে।

আফসানা খেয়াল করে, লেখিকা ওকে ফোন করছে না, তরুণী মনে কিছুটা অভিমান জন্মায়,  লেখিকাকে  সে 'আন্টি' ডেকেছে, মায়ের সম্মান দিয়েছে, তবুও আন্টি তাকে ফোন করলো না, অথচ আন্টিটাকে নিষ্ঠুরও মনে হচ্ছে না, আন্টির লেখা পড়ে তা মনেও হয় না্‌, সাত পাঁচ ভেবে আফসানা আরেকদিন আন্টির ফোনে কল দেয়, আন্টি ফোন ধরেনা, আফসানা মেসেজ রাখে," আন্টি, আপনি কী আমার উপর রাগ করেছেন? যদি রাগ করে থাকেন, তাহলে আর কল দেবো না্‌, আপনি কেন আমাকে কল দেন না, আমি কিন্তু আপনার লেখাগুলো খুব ভালোবেসে পড়ি"। মেসেজ দেয়াতে কাজ হয়েছে, আন্টি কল ব্যাক করেছে, " আফসানা, মামনি, তুমি তো আমাকে সময় বেঁধে দিয়েছো, আমি বুঝতে পেরেছি তোমাকে হয়ত কিছু সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে, তাই না জেনে কল দিয়ে তোমাকে বিপদে ফেলতে চাইনি। তোমাকে বরং আমার নিজের ব্লগের লিঙ্ক দেই, ওখানে তুমি আমার সব ধরনের লেখা পড়তে পারবে। পারিবারিক, সামাজিক, আমেরিকান সংস্কৃতি নিয়ে লেখাও আছে। কারেন্ট ইস্যু নিয়ে লিখি, ওখান থেকেও আমার সংবাদ জানতে পারবে।" আফসানা খুশী হয়, খুবই খুশী।

এভাবে কয়েকমাস কেটে যায়। আফসানা তার আন্টির লেখার ভেতর দিয়েই আন্টিকে পায়, তার আম্মুকে পায়, আর আমি টের পাই আফসানা নামের এক একনিষ্ঠ ভক্তের উপস্থিতি। দুই মাস আগে আফসানা আবার মেসেজ রাখে, " আন্টি, আপনি খুব ভাল করেছেন, শয়তানদের বিরুদ্ধে লিখেছেন। এগুলি শয়তান, দেশটাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে"। আফসানার মেসেজ পেয়ে আমি বিশাল বড় এক ধাক্কা খাই। আমি বেশ কিছুদিন প্রজন্ম মঞ্চ, গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষে অনেক লেখা লিখেছিলাম। ব্লগে, স্বদেশখবর নামক সাপ্তাহিকে।  আমি জানতাম না এই সব ছোটখাটো লেখা, বাদ-প্রতিবাদ  চব্বিশ বছর বয়সী আফসানাদের নজর এড়ায় না।  অনুপ্রাণিত হয়ে আরও বেশী করে লিখতে শুরু করি। কারো উপকারে না আসুক, নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকি।

গত পরশুদিন আফসানা আবার ফোন করেছিল, আমাকে পায়নি, মেসেজ রেখেছে,
আন্টি, আপনি কেমন আছেন? অনেকদিন আপনার কোন লেখা পড়ি না। আপনাকে বলেছিলাম, এখানে আমি খুব একা, আমার হাজব্যান্ড একটু অন্যরকম, আমাকে ফেসবুক করতে দেয় না, আমার ই-মেইল অ্যাকাউন্ট নেই, এখানে বাঙালীদের সাথে মিশতে দেয় না। আমি ব্লগে গিয়ে আপনার লেখা পড়তাম,  আমার অনেক ভাল লাগতো। এখন আর কোথাও আপনার লেখা পাই না। এমন কী আপনার নিজের ব্লগেও কোন নতুন লেখা নেই। আপনি কী লেখালেখি ছেড়েই দিলেন? একেবারেই ছেড়ে দিলেন আন্টি?  আন্টি, জানি, ব্লগারদের নিয়ে দেশে অনেক গন্ডগোল হচ্ছে, কিন্তু আপনি তো কত ভাল ভাল লেখা লিখেন, কারো নামে তো বদনাম লিখেন না, তাহলে ব্লগে লিখছেন নয়া কেন? আমাকে ফোন দিবেন আন্টি।  আপনার বাগানের ফুলের ছবি দেখেছি 'আমার ব্লগ' এ। অনেক সুন্দর লেগেছে। আপনি অনেক ভালো থাকেন আন্টি, আপনার লেখায় আম্মুকে খুঁজে পাই।"

আফসানা ঠিকই বলেছে, আমি এখন বেশ কিছুদিন হয়ে গেল, ব্লগে লিখিনা। আগে লিখতাম, প্রতিদিন একটা না একটা কিছু লিখে ব্লগে পোস্ট করতাম। আফসানা আমার লেখার একজন গুণমুগ্ধ পাঠক। যে লেখা পড়ে অনেকেই ছাইপাশ বলে ট্র্যাশ ক্যানে ফেলে দেয়, সেই লেখাতেও আফসানা ভালোবাসা খুঁজে পায়, সুদূর বাংলাদেশে থাকা আম্মুকে খুঁজে পায়! আমার জন্য এ তো বিশাল পাওয়া! আফসানার মত এমন লক্ষ্মী পাঠকের প্রতি লেখকের অনেক দায় থেকে যায়। ওতো শুধু আমার লেখা পড়েই না, লেখার ভেতর দিয়েই ও আমার হালহকিকত সম্পর্কে সচেতন থাকে। আমি যে ইদানিং ব্লগে লিখছিনা, তা ও খেয়াল করেছে, চিন্তিত হয়েছে আমার শারীরিক সুস্থতা সম্পর্কে। আমাকে পালটা ফোন করে বলতে হয়েছে, আমার শরীর ভালই আছে, মনটা ভাল নেই। মন খারাপের কারণেই ব্লগে লিখিনা। 

 'ব্লগ ও ব্লগার' কে বাংলাদেশের মানুষ এখন গালি হিসেবে ব্যবহার করে। একেবারে মাদ্রাসার কোমলমতি শিশু থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নামকরা কলামিস্ট,  'বঙ্গবীর' খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সহ অনেকেই 'ব্লগার এবং ব্লগ' শুনলে ' ওয়াক থুঃ' বলে মুখ বিকৃত করে ফেলে। দেশের 'অযুত নিযুত' সংখ্যক বুদ্ধিজীবি  সকল ব্লগারদেরকে সকালের নাস্তার টেবিলে বসে একবার গালি দেয়, বিকেলের টিভি চ্যনেলের টকশো টেবিলে বসে আরেকবার গালি দেয়। এই সকল গালিগালাজ শুনে মনটাতে একধরণের নির্লিপ্তি এসে গেছে। খুব বেশী অপমানিত হয়েছি যেদিন আন্দালিব রহমান পার্থ নামক এক সাংসদ টকশো টেবিলে রসিয়ে রসিয়ে বলেছে, সে নাকি সকল ব্লগারদের কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবে, সকল ব্লগারকে দিয়ে নাকে খত দেয়াবে। কী কারণে? কারণ, ব্লগাররা সবাই 'নাস্তিক'। আন্দালিব পার্থ একজন সাংসদ, অর্ধ ব্যারিস্টার ( 'ডাঃ আইজু নামের সুপরিচিত ব্লগার 'আন্দালিব পার্থের 'ব্যারিস্টার' উপাধীর খোঁজ খবর নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ' আন্ডা তুই আর ফুটলি না' নামে। সেখানেই বলা আছে, পার্থ ব্যারিস্টারী পড়া কমপ্লীট না করেই দেশে চলে আসে) সাংসদ হচ্ছে আমাদের দেশের আই্নপ্রণেতাদের একজন। সেই আইনপ্রণেতা যদি মনে করে, বাংলাদেশে 'নাস্তিক'দের ঠাঁই নেই, তাহলে আর বাংলাদেশের পক্ষে-বিপক্ষে লেখার কোন অধিকারই তো  কোন ব্লগা্রের  নেই। তাহলে আর ব্লগে লিখে কী হবে! ব্লগারদেরকে যারা নিয়মিত গালি দিয়ে নাস্তা শুরু করেন, তারাও তো কই একবারও এই অর্ধ ব্যারিস্টারকে ডেকে বললো না, " খোকা, ব্লগাররা নাস্তিক হতে পারে কিন্তু কেউ অর্ধ শিক্ষিত নয়, অর্ধ ডিগ্রীধারীও নয়, তাদের কান ধরতে বলেছো কোন আক্কেলে, 'সরি' বলো"।" সেজন্যই অপমান ও অভিমানে  ব্লগে লেখালেখি থেকে নিজেকে বিরত রেখেছি।



আমি নিয়মিত বাংলাদেশের পত্র পত্রিকা পড়ি। অনেক পুরানো অভ্যাস। কিন্তু ব্লগে লেখালেখির অভ্যাস খুব বেশীদিনের নয়। আফসানার মত আমিও অনেকটা একাকী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। মেয়েরা বড় হয়ে গেছে, বিভিন্ন স্টেটে পড়াশুনা করছে, সামাজিক কুটকচালিতে আমি কখনওই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিনা বলে কোন গসিপেও থাকিনা, অথচ বিদেশ বিভুঁইয়ে সময় কাটাতে তো হবে। একাকীত্ব কাটাতেই লেখালেখি শুরু। আহামরি কিছুই না, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে গল্পের ছলে কিছু লিখে যাওয়া, যদি কারও কোন উপকারে লাগে! সেই ভেবেই লিখতাম, এর মাঝেই শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা। আমি রাজনীতি বুঝিনা, কিন্তু রাজনীতি সচেতন একজন মানুষ।  'মানবিক রাজনীতির সপক্ষে থাকি, ধ্বংসাত্মক রাজনীতি পছন্দ করিনা। আমি মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন একজন মানুষ, তাই মুক্তবুদ্ধির সপক্ষে কথা বলি। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধির সাথে সাথে  ব্লগে আমার লেখার ধরণ পালটে যেতে থাকে, যেমন পালটে যেতে থাকে 'ব্লগ ও ব্লগার' নিয়ে সাধারণ মানুষের চিন্তা ভাবনাগুলো।


একজন মানুষ, যে নিজের নামের বানানটাও শুদ্ধ করে লিখতে পারেনা, যে নিজের নামের বাংলা অর্থ জানেনা, যে জানেইনা, ব্লগ কী জিনিস, তাদের মত মানুষেরাই হঠাৎ করে 'ব্লগ ও ব্লগার' নিয়ে হইচই শুরু করে দেয়। একটি ছোট উদাহরণ দেই, মোটামুটি শিক্ষিতজনের সকলেই জানে,  'রেখা' একটি গাণিতিক শব্দ, যার অর্থ 'পথ', 'রেখা'র কোন হিন্দু/মুসলমান নেই। সালমা রেখা নামের একটি মেয়ের সাথে আমি বোন ' সম্পর্ক পাতিয়েছি, ওকে আমি ফেসবুকে 'বোন' হিসেবে পরিচয় দেই। সম্প্রতি একজন শিক্ষিত ভদ্রলোক ফেসবুকে প্রশ্ন রেখেছে সালমা রেখা কী করে রীতা রায়ের বোন হয়?,  রীতা রায় হিন্দু,  আর সালমা রেখার সালমা হচ্ছে মুসলিম নাম, রেখা হচ্ছে হিন্দু নাম, এর ভেতর  কী কোন রহস্য আছে?   আমি নিশ্চিত, এই ভদ্রলোকও সেই দলের যারা 'ব্লগার' মানে নাস্তিক ভাবে। যারা জানেই না, 'নাস্তিকতা' একটি বিশ্বাস। আস্তিকতা যেমন একটি বিশ্বাস, নাস্তিকতাও বিশ্বাস। এই পৃথিবীতে 'আস্তিকের যদি বেঁচে থাকার অধিকার থাকে, 'নাস্তিকের'ও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। কেউ মরণের পরেও জীবন আছে বিশ্বাস করে, কেউ মরণেই সব শেষ বলে বিশ্বাস করে। যারা মৃত্যুর পরে ঈশ্বর-আল্লাহ, স্বর্গ-নরক, বেহেশত-দোজখে বিশ্বাস করে, তাদেরকেই 'আস্তিক' বলে, যারা ঈশ্বর, স্বর্গ-নরক বিশ্বাস করেনা, তাদেরকেই 'নাস্তিক' বলে। আমার ধারণা, বুদ্ধিজীবিগণের সকলেই 'আস্তিক-নাস্তিক' এর তফাত জানেন, তারপরেও তারা 'ব্লগ, ব্লগার, আস্তিক, নাস্তিক' ঝড়ে দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলেছেন।  যে ব্যারিস্টারি পড়া শেষ না করেও নামের আগে ব্যারিস্টার লাগায়, সেও যখন ব্লগারদের কান ধরিয়ে রাখবে বলে বেআইনী হুমকী দেয়, যারা ক্ষমতার লোভে, খ্যাতির লোভে, সস্তা পরিচিতির লোভে, জনপ্রিয়তালাভের আকাংক্ষায় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কোমলমনে উগ্রতার বীজ বুনে দেন, কোমলমতি সাধারণ জনগণের অন্তরে ক্রোধের আগুন জ্বেলে দেন, তখন একজন সচেতন মানুষ হিসেবে, জন্ম এবং বেড়ে উঠার সূত্র ধরে মাতৃভূমির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে আপাতত ব্লগে লেখালেখি বন্ধ রেখেছি।

লেখালেখির নেশাতে যাকে একবার পেয়ে বসে, তাকে যখন কলম বন্ধ করে বসে থাকতে হয়, সুদিনের অপেক্ষায় থাকতে হয়, তার মনের গভীরের কষ্ট কী কেউ জানে! প্রবাসের একঘেঁয়ে জীবনের একাকীত্ব  কাটিয়ে তুলতে ব্লগে প্রবেশ করেছিলাম।  লেখালেখির জন্য  ব্লগ আমার কাছে খুবই প্রিয় একটি মাধ্যম। নিজের মনের কথা, নিজস্ব চিন্তা চেতনার কথা খোলাখুলি প্রকাশ করা যায়, শব্দ ব্যবহারে সীমারেখা থাকেনা। ব্লগে ঢুকে কতজনের সাথে পরিচয় হয়েছে, কী তুখোড়, মেধাবী তরুণ সব, যারা লেখালেখি করতে পছন্দ করেন,  লিখেন বা অন্যের লেখাগুলো পড়েন। কেউ কেউ আছেন, নিজে লিখেন ্না, তবে অন্যের লেখার উপর মন্তব্য করেন, সেই মন্তব্যগুলোও খুবই উপভোগ্য। মন্তব্য থেকেও বর্তমান প্রজন্মের মন মানসিকতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ব্লগে তো শুধু আওয়ামী ঘরাণার পাঠকই থাকেনা, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, নির্দলীয়, গৃহিনী, চাকুরীজীবি, বেকার থেকে শুরু করে কত পাঠক নিয়মিত ব্লগ পড়ে। ব্লগে প্রগতিশীল এবং চরম প্রতিক্রিয়াশীল, দু ধরণের লেখক ও পাঠক বর্তমান। আধুনিক মানসিকতাসম্পন্ন তরুণ লেখকদের বিশ্লেষণধর্মী লেখা, যে কোন বিখ্যাত  কলামিস্টদের কাছে চিন্তার খোরাক হয়ে দাঁড়ায়। একেকটি লেখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। কিছু কিছু ব্লগার প্রচুর পড়াশোনা করে, গবেষনা করে একেকটি লেখা তৈরী করে। 

লেখালেখি করা নেশার মতো।  ব্লগে লেখালেখি করে কোন রকম আয়-উপার্জন হয় না। ভালো লাগা থেকে লিখে সবাই, প্রত্যেকেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র, অনেকেই পেশাজীবি, আমার মত কেউ কেউ মাঝ বয়সীও আছে, যারা শখের বশে লিখে থাকে। আমিও  দু বছর ধরে শখের বশে লিখি। কোন পয়সা পাইনা, সংসারে কাজের ক্ষতি হয়, সামাজিকতা রক্ষা করতে পারি না, তবুও লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছিলাম। ব্লগে লেখালেখির সূত্র ধরেই দু' একটি পত্র পত্রিকাতেও লেখালেখির সুযোগ পেয়েছি। দায়িত্ব নিয়ে লিখতে গেলে প্রচুর পড়াশুনো করতে হয়, একটি বিষয়ের উপর পড়াশুনো করতে গিয়ে কাছাকাছি আরও অনেক বিষয় সম্পর্কে অবহিত হতে হয়। যারা মনে করে, ব্লগে লেখালেখি করা পাপ কাজের শামিল, তারা কেউ ব্লগ সম্পর্কে ধারণা রাখে না। তারা নিজেদেরকে সর্বজ্ঞানী ভাবে, তারা ধরেই নেয়, তাদের চেয়ে বেশী জ্ঞান আর কারও নেই, বা থাকতে পারে ্না। তারা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধকে বলে 'গন্ডগোলের' বছর, তাদের অনেকেই বলে, মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছর পরে যুদ্ধাপরাধী বলে কিছু থাকা উচিত নয়, যা হয়ে গেছে, তা পেছনে চলে গেছে। এখানেই বিপত্তি বেঁধেছে, ব্যক্ত্বিত্বের সংঘাত, বর্তমান তরুণ প্রজন্মের সিংহ ভাগই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সচেতন, তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, কিন্তু আধুনিক টেকনোলজী ব্যবহার করে , নানা তথ্য উপাত্ত ঘাঁটাঘাঁটি করে অনেক অজানা তথ্য সম্পর্কে জেনেছে, তারাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজেদের রিসার্চলব্ধ তথ্য উপাত্ত ব্লগে প্রকাশ করে দিয়ে সকল পাঠকের সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছেন। 

ব্লগাররা সব সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে সোচ্চার ছিল, তারাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য বর্তমান সরকারের দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের সকলেরই দায়বদ্ধ থাকার কথা, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বলেই আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের বিজ্ঞজনেরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গর্ব করতে ভালোবাসে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের গভীরতা নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ স্বীকার করে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের রূপকারকে স্বীকার করে না। এভাবেই বাংলাদেশে আমাদের প্রজন্ম, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় একেবারেই শিশু ছিলাম, যাদের বেড়ে উঠা ছিল সীমিত সুযোগের ভেতরে, আধুনিক টেকনোলজীর সাথে পরিচয় ছিল না, তারা মুক্তিযুদ্ধ এবং আমাদের জীবনে তার গুরুত্ব সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাইনি। ফলে আমাদের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক বিষয়েই ধোঁয়াশা নিয়ে বড় হয়েছি, নানাভাবে বিভ্রান্ত হয়েছি। এর জন্য যারা দায়ী, তারাই  ব্লগারদের উত্থানে  ভয় পেয়েছে, তারাই পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে সারাদেশে 'আস্তিক-নাস্তিক' ঝড় তুলে মেধাবী কিছু ছেলেমেয়ের জীবনকে হুমকীর মুখে ঠেলে দিয়েছে। তারাই অরাজনৈতিক চেতনায় গড়ে উঠা 'শাহবাগ মঞ্চ'কে বিতর্কিত করেছে, তারাই টিভিতে প্রচারিত টকশোতে গিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে যে শাহবাগ মঞ্চ একটি  সরকারী ছায়ায় প্রতিপালিত মঞ্চ। তারাই সকল ব্লগারকে 'নাস্তিক' আখ্যা দিয়েছে। তাদের কারণেই হেফাজত মঞ্চ তৈরী হয়েছে। তাদের দাবীর মুখে মেধাবী তরুণদের হাতে 'হাতকড়া' পরেছে, তাদের কারণেই হেফাজতীরা ব্লগারদের ফাঁসীর দাবী তুলেছে। তারাই সকল মেধাবী ব্লগারদের অপমান করেছে, তারা দলবেঁধে একজন অপরাধী ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের মুক্তি চায়, অথচ তারা চারজন  মেধাবী ব্লগারের হাতে হাতকড়া দেখে উল্লসিত হয়! তাদের ক্রমাগত উস্কানীমূলক আক্রমনের শিকার হয়েছে 'গণজাগরণ মঞ্চ'। ব্লগাররাই একটি ছোট্ট গাঁথুণীর উপর তৈরী করেছিল মানুষের বিশাল আস্থার মঞ্চ, কতিপয় নোংরা স্বার্থান্বেষীদের রোষানলে পড়েই ভেঙ্গে গেল 'শাহবাগ মঞ্চের 'গণজাগরণ চেতনা'। সরকারে আদেশে ভেঙ্গে দেয়া হলো ব্লগারদের তৈরী মঞ্চ।


এই বুদ্ধিজীবিরা কতভাবে ব্লগারদের অপমান করেছে। তাদের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ প্রথম সারির দৈনিকে 'প্রজন্ম মঞ্চ' কে কটাক্ষ করে নোংরা গল্প লিখেছে, টাকা পেয়ে ফরমায়েশী গল্পে তারা প্রতিবাদী নারীকে 'পতিতা' বানিয়েছে,  প্রতিবাদী তরুণকে 'পতিতার দালাল' বানিয়েছে, তারাই একটি '৫ই মে' র জন্ম দিয়েছে। তাদের অনেকেই গলা ফাটিয়ে বলেছে, ৫ই মে ঢাকা শহরে 'গণহত্যা' হয়েছে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের' 'বঙ্গবীর', যিনি গণহত্যার ভয়াল রূপ দেখেছেন, সেই তিনিও শাপলা চত্বরে ১০ মিনিটে 'গণহত্যা' হয়েছে বলে দাবী করেছেন, 'গণহত্যা'র পরবর্তী ১৮ দল আয়োজিত গায়েবানা জানাজায় অংশ নিয়েছে্ন।  এখানেই তিনি থামেননি, যখন খেয়াল করেছেন, সরকার শাপলা চত্বর ইস্যুকে কিছুটা ঠান্ডা করে এনেছেন, সেই ঠান্ডাকে আবার চাঙ্গা করে তোলার জন্য ১৪ই মে এবং ২১শে মে'র ' বাংলাদেশ প্রতিদিন' পত্রিকায় পর পর দুটি উস্কাণীমূলক মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন। জানিনা, এতে উনার কতটুকু লাভ হয়েছে, তবে আমাদের মত প্রগতীশীলদের জন্য অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। উনার মত একজন প্রথিতযশা বীর মুক্তিযোদ্ধাকে এই প্রথম অবিশ্বাস করতে শুরু করেছি। এই প্রথম মনে সন্দেহ জাগছে, উনি কোন আদর্শে উদ্বুদ্ব হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন! যে স্যেকুলার, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য উনারা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন, কোথায় হারিয়ে গেলো সেই চেতনা! কেন বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে, হুমায়ুন আজাদের লেখা একটি উক্তি, " একজন মুক্তিযোদ্ধা সব সময় মুক্তিযোদ্ধা থাকেনা"। এগুলো ভাবতে চাই না, কিন্তু ভাবনাগুলো পিছু ছাড়ে না, শুধু তো বঙ্গবীরই নন, আরও কত ডাকসাইটে মুক্তিযোদ্ধারা আজ অন্য সুরে কথা বলছে! স্যেকুলারিজমের পরিবর্তে তারা আজ আস্তিক-নাস্তিক বিতর্কে দেশকে  নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে!

এখন কথায় কথায় মানুষের লাশ পড়ে, কথায় কথায় গাড়ীতে , বাসে বোমা পড়ে, যাত্রী মারা যায়, পথচারী মারা যায়, পুলিশ মারা যায়, পুলিশের গুলীতে নিরপরাধ মানুষ মারা যায়, ধর্মীয় জিহাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে আসা উত্তাল জনতার মধ্যেও কতজন মারা গেলো! আহারে! মানুষের প্রাণ, যার যায়, সেই শুধু বুঝতে পারে, কী হারিয়ে গেলো, কে হারিয়ে গেলো! অথচ এগুলো কিছুই হতো না যদি একটি দৈনিক পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক  পত্রিকা জুড়ে 'ব্লগারদের' সম্পর্কে কুৎসিত রটনাগুলো না প্রচার করতেন, এসব কিছুই হতো না যদি সেই 'উত্তরা ষড়যন্ত্রের নায়ককে' 'বঙ্গবীর' সহ  কতিপয় বুদ্ধিজীবি সমর্থণ না জানাতেন, এর কিছুই হতো না যদি একদল রাজনীতিবিদ তড়িঘড়ি করে  ক্ষমতায় না যেতে চাইতেন, এর কিছুই ঘটতো না যদি একদল কলামিস্ট  নিজ আদর্শের বাইরে গিয়ে ফরমায়েশী উস্কাণিমূলক লেখা না লিখতেন, এর কিছুই ঘটতো না যদি সরকার সময়মত বিচক্ষনতার পরিচয় দিতেন। আজ আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, ভবন ধ্বসে বারো'শ প্রাণ বেরিয়ে গেছে, ধর্মীয় জিগির থেকে সৃষ্ট টর্ণেডোতে কত নিরীহ প্রাণ ঝরে গেছে, মাইকিং ঘোষণায় কত প্রাণ ঝরে গেছে, মহাসেন সাইক্লোনে কত ক্ষতি হয়েছে,   বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে সবচেয়ে সফল গার্মেন্টস শিল্পে ধ্বস নেমেছে, এসবের কিছুই হতো না যদি ক্ষমতালোভী মানুষগুলো একটু ধৈর্য্যশীল, সহনশীল এবং পারস্পরিক সহানুভূতিশীল হতেন।

আমাকে আফসানা ছাড়াও বেশ কিছু পাঠক ফেসবুকে মেসেজ পাঠিয়ে জানতে চেয়েছেন, আমি কেন আর ব্লগে লেখালেখি করি না, কেউ কেউ জানতে চেয়েছেন আমি কেন আর বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় লিখিনা, দু'জন জানিয়েছেন, গত দুটি সংখ্যায় তারা 'স্বদেশখবর' এ আমার লেখা পান নি! আমি নিয়মিত লেখক নই, এই লেখার শুরুতেই বলেছি আমার অতি সম্প্রতি লেখক হওয়ার কারণ সম্পর্কে! তবে খুব অল্প সময় ধরে লিখলেও লেখালেখির প্রতি এক ধরণের নেশা বোধ করি। হাতে গোনা কয়েকজন আমার লেখা পড়তে ভালোবাসেন, তাই তারা আমার অনুপস্থিতিতে চিন্তিত হয়েছেন, তারা আমার লেখার ভক্ত পাঠক, আমার মত অতি সাধারণ এক লেখকের জন্য তাদের উদ্বেগ আমাকে আশান্বিত করেছে, আস্থাহীন মনে আস্থার বীজ বপন করেছে। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাদের কাছে আমি ভালোবাসার দায়ে আবদ্ধ হয়ে গেছি, সেজন্যই আজকের এই কৈফিয়ত! ব্লগে লিখবো, পত্রিকাতেও আবার লিখবো, অপমানের ক্ষত শুকোতে যতটুকু সময় লাগে, ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা, আসলে আমি সুদিনের অপেক্ষায় আছি!

Wednesday, May 1, 2013

"লোকে মরে 'কলঙ্কিনী' নাম দিয়ে"

মেয়েটির নাম মিশা, বয়স ২২। বাংলাদেশে জন্ম হলেও ও বেড়ে উঠেছে  অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকার জল হাওয়ায়। বাংলা পড়তে পারে, কিন্তু লিখতে পারে বলে মনে হয় না। আমেরিকাবাসী হলেও বাংলাদেশের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। প্রতি দুই বছরে একবার দেশে যায়, কাটিয়ে আসে টানা তিন মাস। বর্তমানে ও পড়াশুনা করছে আমেরিকার একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিষয় 'পাবলিক হেলথ'।

মিশার জন্ম হয়েছে  সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে।  জন্মের সময় সাভারের মাটিতে তখনও এত বিশাল বিশাল অট্টালিকা তৈরী হয়নি, রানা প্লাজা, অমুক প্লাজা, তমুক প্লাজা  কিছুই তৈরী হয়নি। সাভারের লালচে মাটির রাস্তা ধরে সারি সারি কাঁঠালের গাছ ছিল। সাভার বাজার থেকে কিছুদূর গেলেই  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, তারওপরে  জাতীয় স্মৃতিসৌধ, স্মৃতিসৌধ থেকে কয়েক কদম এগোলেই 'গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র', একটি বেসরকারী  প্রতিষ্ঠান। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র  মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্বপ্ন সফল প্রতিষ্ঠান। নারীদের জন্য, বিশেষ করে গরীব, স্বল্পশিক্ষিত, বাপে-মায়ে খেদানো, রূপ-জৌলুসহীন চেহারা, অনূঢ়া, বিধবা, স্বামীর বাড়ী থেকে বিতাড়িত নারীদের স্বনির্ভর হয়ে উঠার জন্য 'গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র' এর অবদান অনস্বীকার্য্য। বাংলাদেশের প্রথম পেশাদার মহিলা ট্রাক ড্রাইভার (ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে দেখিয়েছিল)  সালেহা হচ্ছেন ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্বপ্নপুরীর একটি উদাহরণ।

আজ থেকে আরও চল্লিশ বছর আগে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দৃশ্যমান অংশগুলো পরিচালিত হতো মহিলাদের দ্বারা। এখানে মেয়েরা ক্ষেতে গিয়ে ধান বুনতো, বেকারীতে গনগনে আগুনের তাপে পাউরুটী, বিস্কুট বানাতো, ক্যান্টিনে রান্না বান্না করতো, ডাইং এবং বুটিকের কাজ করতো, গণ পাঠশালায় বাচ্চাদেরকে অবৈতনিক শিক্ষাও দিত। গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে প্যারামেডিক, নার্স, আয়া, থেকে শুরু করে সর্বত্র ছিল নারীদের উপস্থিতি। যে মেয়ে বাপ বা স্বামীর ঘরে মানবেতর জীবন যাপন করতো, সেই মেয়ে অনায়াসে রুগীদের শরীরে ইঞ্জেকশান দিত, মুমূর্ষু রুগীকে অক্সিজেন দেয়া , অপারেশান থিয়েটারে যেয়ে সার্জনকে সাহায্য করার মত কাজ অনায়াসেই করে যেত। সেই কোন আমল থেকেই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নারী শ্রমিকরা শার্ট, প্যান্ট পরিহিত হয়ে, হাতে লাঠি নিয়ে গেট পাহারা দিত।  নারী কর্মীরা সাইকেল চালাতো, মাঠকর্মীরা সাইকেলে চেপে আশে পাশের গ্রামে যেত।  সে এক অন্যরকম সাম্রাজ্য। কিন্তু দূর্জনের ছলের অভাব হয় না। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নারী কর্মীদের বিরুদ্ধে আশেপাশের গ্রামে কতরকম রসালো গল্প চলতো, মেয়েগুলোর নামে নানা কুৎসা রটানো হতো। একজন পুরুষ কর্মীর কাজ আর নারীকর্মীর কাজে কোন তফাৎ ছিল না, তবুও যেন নারীরা তাদের প্রাপ্য সম্মান পেতো না।  তবুও তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছিল, কারো ঘাড়ে বোঝা হয়ে ফিরে যেতে হয়নি।


গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে জন্মেছে বলেই মিশার গায়ে এখনও সাভারের লাল মাটির গন্ধ পাওয়া যায়, অনায়াসেই সে মাটির কাছাকাছি মানুষদের সাথে মিশে যায়। গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে জন্মেছে বলেই সেখানকার নারী শ্রমিকদের মতই স্বাধীনচেতা। নাচ এবং ফটোগ্রাফীতে ওর দারুণ উৎসাহ। ফটোগ্রাফীতে পুরস্কারও পেয়েছে। মেয়ে পুরস্কার পায়, বাবা -মা খুব খুশী হয়। ফলে মিশা আরও বেশী উৎসাহী হয়ে উঠে। উৎসাহের চোটে একদিন সে তার বাবাকে বলে, " বাবা, আমার খুব ইচ্ছে, প্রস্টিটিউটদের নিয়ে একটা ডকুমেন্টারী টাইপ কিছু বানানো। ওদের জীবনটা খুব কষ্টের। আমি ওদের এলাকায় যেতে চাই, ওদের সাথে কথা বলতে চাই, ছবি তুলতে চাই।  সত্যিকার অর্থেই প্রোডাক্টিভ কিছু করার চেষ্টা করতে চাই। কোন একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারো"?  মিশার বাবা মেয়ের কথা শুনে চমকালো না, থমকালো না। নরম সুরে বললো, " মা গো, তোমার ঊদ্দেশ্য মহৎ, কিন্তু এর বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। কত রকমের বাধা এসে উপস্থিত হবে, তুমি ধারণাও করতে পারবে না। আমাদের দেশে তো 'ওদের'কে কেউ মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখে না। উলটো তুমি বিপদে পড়ে যাবে"।

মিশা গেল মায়ের কাছে, একই আবদার নিয়ে।  মা বললেন, " মিশা শোন, তুমি যে দেশে বড় হচ্ছো, সেদেশের সমাজে প্রস্টিটিউটদের অবস্থান ভিন্ন। আমেরিকায় প্রস্টিটিউটদের শ্রমিকের মর্য্যাদা দেয়া হয়।  কারণ, যৌনবৃত্তি তার পেশা। আমেরিকায় চুরী করলে জেলে যেতে হয়, কারণ চৌর্য্যবৃত্তি কারো পেশা হতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশের  পরিবেশ ও পরিস্থিতি, সংস্কৃতি  পশ্চিমা দেশগুলোর চেয়ে একেবারেই পৃথক। আমাদের দেশে নারীদের অবস্থান সবচেয়ে দূর্বল এবং বিতর্কিত। বাংলাদেশে যে নারীকে 'মায়ের' মর্য্যাদায় ভূষিত করা হয়, সেই একই নারীকে পয়সার লোভ দেখিয়ে আরব দেশগুলিতে পাচার করে দেয়া হয় শেখদের মনোরঞ্জনের জন্য। বাংলাদেশে যে মেয়েকে 'বোন' বলে সম্বোধণ করা হয়, সেই একই মেয়েকে ভুলিয়ে ভালিয়ে পতিতালয়ে পাচার করে দেয়া হয়। আমাদের দেশে নারীর অবস্থানের নির্দিষ্ট কোন মাত্রা নেই।  আমেরিকায় কেউ কোন নারীকেই জোর করে বেশ্যা বানানো হয় না, বেশ্যাবৃত্তি যার পছন্দ, সে নিজ থেকেই এই পেশা গ্রহণ করে। যেহেতু  পতিতাবৃত্তি সমাজ স্বীকৃত পেশা, তাই একজন পতিতা সমাজে সকলের সাথে উঠা-বসা করতে পারে।

তুমি বলছো, পতিতারাও মানুষ, ওদেরও অধিকার আছে সুস্থভাবে বাঁচবার।  কিন্তু আমাদের সমাজে পতিতাদেরকে 'মানুষ' ভাবা হয় না, পতিতাকে 'পতিতা' ভাবা হয়। পতিতা কথাটি এসেছে 'পতিত' থেকে। পতিত মানে হচ্ছে যার কোন মূল্য নেই,  যে কিনা অস্পৃশ্য, যার কিনা পতন হয়েছে, অর্থাৎ পচে গেছে। আমাদের দেশে 'পতিতারা' কেউ নিজের ইচ্ছেয় পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে না। ওরা খুব গরীব ঘরের সন্তান,  বেঁচে থাকার তাগিদে, রোজগারের আশায় অন্যের ফুসলানীতে বিভ্রান্ত হয়ে ওরা ঘর ছাড়ে। অচেনা পৃথিবীতে ওরা সহজেই ফাঁদে আটকা পড়ে যায়, দালালদের কারসাজীতে ওরা হয়ে যায় 'নারী' থেকে 'পতিতা'।

আমাদের দেশে পতিতাকে 'শ্রমিক' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলছো? মাথা খারাপ? এখানে সকলে ভাবে , যৌনবৃত্তি  একটি অসামাজিক কাজ। আমাদের দেশে 'চৌর্য্যবৃত্তি'কে বড় অপরাধ হিসেবে ধরা হয় না, কারণ রাঘব বোয়াল থেকে শুরু করে চুনোপুঁটি পর্যন্ত এই চৌর্য্যবৃত্তিতে জড়িত। তাই ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হওয়ার যোগার হবে।  এখানে পতিতাবৃত্তিকে এতই নিকৃষ্ট কাজ মনে করা হয় যে কাউকে গালিগালাজ করতে হলেও 'বেশ্যা' শব্দটি প্রায়শঃই ব্যবহার করা হয়। এই তো কিছুদিন আগেই হাসনাত আবদুল হাই নামের এক বিখ্যাত লেখক 'প্রথম আলো' পত্রিকায় একটি গল্প লিখেছিল, যেখানে প্রজন্ম মঞ্চের এক শিক্ষিত নারীকে 'বেশ্যা' বলা হয়েছে। অথচ লেখক-কবিদের নাকি বেশ্যালয়ে গমন না করিলে কালজয়ী সাহিত্য সৃষ্টি হয় না। কত নামী দামী লেখকের জবাণীতে পড়েছি, তারাও নাকি জীবনকে পুরোপুরি দেখার জন্য নিয়মিত পতিতালয়ে যাতায়াত করতেন।  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একখানি উপন্যাসে আছে, কেউ একজন বলছেন,  বেশ্যানারীর হাতে সাজানো খিলি পান মুখে না দিলে নাকি কবিতার পংক্তিগুলো ঠিকমত বের হতে চায় না। শুধু কবি-লেখকই নয়, নিকৃষ্ট নারীদের কাছে দেশের উৎকৃষ্ট মানের পুরুষেরাও যাতায়াত করতেন এবং এখনও করেন। অথচ পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সকলের আপত্তি। পতিতাবৃত্তিকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দিলে  তো পেশাটিকে নিয়ে আর নাক কুচঁকানানো যাবে না। এই সেদিনও বক্তৃতায় এক নেতা  অপরপক্ষিয় এক নেতাকে ঊদ্দেশ্য করে বললো, উনি নাকি রাজনীতির বেশ্যাবৃত্তি করেন। কাজেই তোমার বাবার কথাই ঠিক, আমাদের দেশে পতিতালয়ে গিয়ে সরেজমিনে সব দেখে এসে রিপোর্ট তৈরী করবে, এমনটা কখনওই হবে না।"

মিশা এবার ওর মা-বাবা দুজনকেই ঊদ্দেশ্য করে বললো, " পলিটিক্যাল লীডাররা কেন একে অপরকে 'রাজনৈতিক বেশ্যা বলবে? বেশ্যাবৃত্তিতে যারা নিয়োজিত, তারা তো কোন অসাধু উপায়ে উপার্জন করছে না। কাউকে ঠকাচ্ছে না। দৈহিক ক্ষয়ের বিনিময়ে তারা উপার্জন করছে। সবচেয়ে বড় কথা, ওদেরকে কেন পতিতা বলা হবে? পতিতা আবার কি? চুরী করা তো মহাপাপ, তাই বলে চোরকে কি পতিত বলা হয়? যাদেরকে তোমরা পতিতা বলছো, ওরা কত দুঃখী। ওদের মা বাবা নেই, পরিবার পরিজন নেই, আত্মীয় নেই। ওরা শুধুমাত্র দুটি ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য নিজের দেহকে যাদের হাতে তুলে দেয়, তারাই কিনা বাইরে গিয়ে এই মেয়েদেরকে গালি দেয়! এজন্যই আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল ওদের জীবনের কঠিন ও সরল দিক সম্পর্কে একটু ওদের মুখ থেকে শোনা।"

 মিশার মা বললেন, " শোন আমাদের দেশে পতিতাদেরকে সম্মান দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, পতিতাকে মাতৃরূপী ভূমিকায় দেখেছিলেন শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব।  শ্রী রামকৃষ্ণদেবের কৃপালাভে সমর্থ হয়ে একজন পতিতা নারী 'নটি বিনোদিনী' হিসেবে থিয়েটার জগতে অক্ষয় হয়ে আছেন। এরপর আর কোন সমাজ সংস্কারক বা ধর্মীয় নেতাকে  পতিতাদের পক্ষে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি । বাংগালী পতিতারা শুধুই 'কলঙ্কিনী' হিসেবেই সমাজে অচ্ছুৎ হয়ে আছে।