Saturday, November 23, 2013

সুখ এবং সুখী!!



আজ আমার বড়ই সুখের দিন, কারণ আগামী দুইদিন আমার ছুটি। এমন সুখের দিন প্রতিমাসের চতুর্থ সপ্তাহে আসে। আগে এমন ছিলনা, গত দুমাস হলো, স্বার্থ কিছু ছাড় দিয়ে এই সুখ কিনেছি।
ওয়ালমার্টে ডিপার্টমেন্ট ম্যানেজার বাদে আর কারোরই উইকএন্ড ছুটি থাকেনা। সপ্তাহে দুই দিন ছুটি থাকে, তবে সেই দুই দিন সপ্তাহের যে কোন দুই দিন হতে পারে। আমি এইসব নিয়মের গভীরে যাইনা, যা নিয়ম আছে, সেভাবেই মেনে চলি। চাকরীর শুরুতেই জেনেছি, প্রতি শনি বা রবিবার যদি আমি অফ থাকতে চাই, অফ থাকতে পারবো, বিনিময়ে আমার ফুল টাইম আওয়ার কমে যাবে। ফুল টাইম আওয়ার কমে গেলে এক সময় আমি পার্টটাইম স্ট্যাটাসে চলে যাব। পার্ট টাইম এসোসিয়েটদের সুযোগ সুবিধা অনেক কম, ফুল টাইমারদের হেলথ ইনসিওরেন্স থেকে শুরু করে বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। আমার তিন মেয়েকে আমি আমার হেলথ ইন্সিওরেন্স পলিসির মধ্যে রেখেছিলাম (ডাক্তার হওয়ার পর মৌটুসীর নিজের আলাদা ইন্সিওরেন্স হয়ে গেছে), তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই ফুলটাইম স্ট্যাটাস মেইনটেইন করে চলেছি।

আমি খুবই পরিবারবৎসল মানুষ। ছোটবেলা থেকেই মা-বাবা, ভাই, আত্মীয় স্বজন নিয়ে থাকতে ভালোবাসি। আমার বাবা-মা দুজনেই ছিলেন চাকুরীজীবি। প্রতিদিন সকালেই আমরা দলছুট হয়ে যার যার কাজে বেরিয়ে যেতাম, সন্ধ্যায় আবার সবাই একত্র হতাম। স্কুলে পড়ার সময় খারাপ লাগতোনা, মায়ের সাথেই স্কুলে যেতাম, মায়ের সাথেই একই সময়ে ফিরতাম। যেদিন আগে ফিরতাম, রান্নাঘরে ঢুকে দেখতাম, আমার ভাগের ডাল, তরকারী ঢাকা দেয়া আছে, সকালের রান্না করা ভাত ঠান্ডা হয়ে থাকতো, সেই ঠান্ডা ভাতই নিজেকে নিয়ে খেতে হতো। আমার কি খারাপ লাগতো? মাঝে মাঝে খারাপ লাগতো, মনে হতো, ইস! সবার মা ভাত মেখে খাওয়ায়ে দেয়, নাহলে ভাত বেড়ে খেতে দেয়, আমাকে নিজে নিয়ে খেতে হয়। মাঝে মাঝে খারাপ লাগা কেটে যেত যদি খাবারের মেন্যু ভাল থাকতো। আমাদের খাবারের মেন্যুতে কমন দুটি আইটেম ছিল, মুসুরের ডাল, কেচকী মাছ। দুটি আইটেমই আমার দুই চক্ষের বিষ ছিল, কিন্তু মাপা আয়ের সংসারে মায়ের কিছু করার ছিলনা। পাঁচ টাকায় বাজার হতো, চার আনা ভাগার কেচকি মাছ, পাঁচ ভাগা বা ছয় ভাগা আনা হতো। বেগুণ, আলু, ঝিঙ্গে কুচি দিয়ে রান্না করলে এতগুলো হতো। অবশ্য সব দিনই খারাপ যেত না, যেদিন ডাটা দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল রান্না হতো, সাথে ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে পাঁচ মিশালী তরকারী, সেদিন বরফ ঠান্ডা ভাতও দুই মুঠো বেশী খেয়ে ফেলতাম। খেতাম আর মনে হতো, আহ! কি স্বাদ! এই মুহূর্তে আমার চেয়ে সুখী আর কেউ নেই।
সবাই বলে, যার যার মায়ের হাতের রান্না নাকি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রান্না, আমি কখনও তা বলিনি। আমার মায়ের হাতের সব রান্নাই পৃথিবী শ্রেষ্ঠ ছিলনা, কিন্তু ইলিশ মাছের ঝোল, ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে সব্জী, অথবা চ্যাঁপা শুঁটকী ভর্তা, ডাটা, কুমড়ো, ঝিঙ্গে, আলু, বেগুণ, কাঁঠালবীচি দিয়ে চ্যাঁপা শুটকীর তরকারী, কুচো চিংড়ি আর বেগুণ, ঝিঙ্গে দিয়ে ঝাল ঝাল মাখা মাখা রান্না করতো, এই আইটেমগুলো শুধু পৃথিবী শ্রেষ্ঠ বললে ভুল হবে, জগৎ শ্রেষ্ঠ বললেও কম বলা হবে, এই সাধারণ আইটেম রেঁধে মা স্বর্গের রাঁধুণীকেও হার মানাতে পারতো। আমাদের পারিবারিক সুখের দিন ছিল সপ্তাহের রবিবার। সবার ছুটি, বাবা বাজারে যেতো, বাবার নজর খুব ভাল, মাছ খুব ভাল চিনতো, সব্জীও খুব ভাল কিনতো, ইয়া বড় বড় চিংড়ির মাথা কিনে আনতো, বড় মাছ আনতো, সেই মাছের তেলের বড়া আর চিংড়ির মাথা ভাজা, আহাহা! কি সুখের সময় ছিল, আমরা চার ভাই বোন আর বাবা-মা একসাথে মেঝেতে গোল হয়ে খেতে বসতাম। রবিবারের সুখ ছিল একেবারেই অন্যরকম।

খারাপ লাগা শুরু হয়েছে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে। দুপুরে কলেজ থেকে ফিরে ফাঁকা ঘরে খুব খারাপ লাগতো, খেতে ইচ্ছে করতোনা। বিকেল চারটা বাজলেই মন অপেক্ষা করতো কখন গেট নড়ার আওয়াজ পাব, মা চলে আসলেই পরিবেশ পালটে যেত। এমন নয় যে মা সব সময় খুব সোনা মুখ করে কথা বলতো, কিন্তু মা, বাবা, ভাইয়েরা সবাই ঘরে থাকলেই আমার অন্যরকম ভালো লাগতো। রাতের বেলা সবাই গোল হয়ে বসে রুটি (আমার দুই চক্ষের বিষ)আর তরকারী খেতাম, খারাপ লাগতোনা, কেমন যেনো সুখী সুখী মনে হতো।

ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে পরিবারের জন্য অন্যরকম টান বোধ করতাম। দূরে চলে গেছি বলে মা তার শাসনের মাত্রাও কমিয়ে দিয়েছিল, বরং আমার উপর নির্ভরতা বেড়েছিল। এরশাদ ভ্যাকেশনে বাড়ী এলে সেশান পিছিয়ে যাচ্ছে ভেবে বাবার মাথা গরম হয়ে যেতো, কিন্তু মা খুশী হতো। আমার উপর রান্নার দায়িত্ব দিয়ে মা ধীরে সুস্থে স্কুলে যেতে পারতো। এরশাদ ভ্যাকেশানে আমিও খুশী হতাম, অনেকদিন পর আমরা বাবা-মা, চার ভাইবোন একসাথে হতাম, কি সুখ, কি আনন্দ। আমাদের পাশের ঘরেই থাকতো আমার দাদু দিদিমা, মামা-মাসী। চলতো আমাদের তুমুল আড্ডা। মনে মনে চাইতাম, এরশাদ ভ্যাকেশান যেন অনন্তকাল ধরেই চলে।

বিয়ের পর মাস্টার্স কমপ্লীট করা পর্যন্ত আমার শুক্র-শনি বলতে কিছু ছিলনা। যখন স্বামী-কন্যা নিয়ে সত্যিকারের সংসার শুরু হলো, তখন থেকে আবার নতুন করে ছুটির দিনের সুখ শুরু হলো। আমার উত্তম কুমার দাম্পত্য জীবনের প্রথম পাঁচ বছর এনজিও গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালে চাকুরী করেছেন, আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়, উত্তম কুমারের তত্বাবধানে দেশীয় কোম্পাণীতেই ওষুধের কাঁচামাল প্রস্তুত করা শুরু হয়, সেই প্ল্যান্ট তৈরী করার সময়, দিন-রাতের অধিকাংশ সময় তাকে প্ল্যান্টে থাকতে হতো। শুক্রবারের দুপুরেও তাকে প্ল্যান্টে যেতে হতো। আমার সপ্তাহান্তের সুখ এসেও ফুড়ুৎ করে উড়ে যেত। উত্তমের একটি ব্যাপার খুবই ভাল ছিল, কাজের পরে এক মুহূর্তও সে বাড়ীর বাইরে থাকতোনা। সে জীবনের অনেকটা সময় একা একা কাটিয়েছে বলেই সংসারের নিরবচ্ছিন্ন সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাইতোনা।

পরবর্তী পাঁচ বছর সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগে অধ্যাপনা করেছে, ফার্মেসী বিভাগও তখন সবেমাত্র খুলেছে। আমরা ততদিনে ঢাকা চলে এসেছি, উত্তম কুমার ঢাকা টু জাবি যাওয়া আসা করতো। এটা ছিল বড়ই সুখের সময়, টাকাপয়সা ছিলনা, কিন্তু সংসারে সুখ ছিল। উত্তম প্রতিদিন সকালে বের হয়তো, দুপুরে বাড়ী চলে আসতো। উত্তম বাড়ী ফিরলে আমরা একসাথে খেতে বসতাম। আমি চাকুরী করতামনা, মৌটুসী আর মিশাকে নিয়ে থাকতাম, টুকী টুকী করে কত রকমের তরকারী রান্না করতাম, একটা কচু কিনলে, কচু থেকেই চার রকমের তরকারী রেঁধে ফেলতাম। আমি যাই রাঁধতাম, উত্তম তা খুব তৃপ্তি নিয়ে খেত। আমাদের সংসারটা ছিল, অনেকটা গরীব কিষাণের সংসারের মত, সচ্ছলতা নেই, সুখ আছে। প্রায় শুক্রবারেই কারো না কারো বাসায় বেড়াতে যেতাম। উত্তম হয়তো যেতে চাইতোনা, বৃহস্পতিবার এলেই আমার বায়না শুরু হয়ে যেত। সপ্তাহের ছয় দিন ঘরে থেকেছি, কাজেই শুক্রবার ঘরে থাকবোনা।

আমাদের বাড়ীতে মানুষজন বেড়াতে আসতে ভালোবাসতো। আমরা দুজনেই অতিথিপরায়ণ, আমার মেয়েরাও হয়েছে আমাদের মত, সব সময় লোকজন ভালোবাসে। উত্তমের ছাত্র-ছাত্রীরা আমাদের বাসায় আসতো, বিশেষ করে অমিয়, আলী, পিযূষ, খোরশেদ। অমিয়, আলী, পিযূষ থিসিসের কাজ নিয়ে যে কোন সময়ই আসতো, রাত দশতা এগারোটা বেজে যেত ওদের কাজ শেষ হতে। আমার ঘরে ওদের ভাত লেখা থাকতো, ওরাও জানতো, স্যারের বাসায় গেলে বৌদি ভাত খাইয়ে দিবে। তেমন কিছুই থাকতোনা, হয়তো ডাল চচ্চড়ী করতাম, আলু ভাজতাম, নাহয় ঝাল করে আলুর ভর্তা, দুই এক পদের সব্জী, মাছের ঝোল। ওরা কত আগ্রহ করে খেতো, এই দৃশ্য দেখার মধ্যে কি যে সুখ ছিল! নিজকে ভীষণ সুখী মনে হতো। সেদিনের সেই ছেলেমেয়েগুলো আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এখনও তাদের স্যারকে মনে রেখেছে, মাঝে মাঝেই ফোন করে।

অস্ট্রেলিয়া তিন বছর থেকে আবার বাংলাদেশে ফিরেছি। চার বছর উত্তম কুমার দেশের নামকরা ওষুধ কোম্পাণীতে বড় পোস্টে চাকুরী করেছে। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়, অর্থে, ধনে, জনে, মানে সবদিক দিয়েই সুখ উপচে উপচে পড়তো। তবে কাজের চাপে উত্তমের তখন সপ্তাহের ছয় দিন জান বেরিয়ে যেত। শুক্রবার সে বাড়ীতে থাকতো। আমি সপ্তাহের ছয় দিন গাড়ী নিয়ে টো টো করে বেড়াতাম, কাজেই শুক্রবারে না বেড়ালেও চলতো। শুক্রবারের সকালে ঘুম থেকে দেরী করে উঠতাম, বুয়া চা বানিয়ে আমাকে ডাকতো। গরম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে দিন শুরু করতাম।

দুই বছর আমি শিক্ষকতা করেছি। সেই সময় বুয়া রান্না করতো। আমার যেদিন মর্জি হয়তো, আমি রান্না করতাম। বুয়া চাইতো শুক্রবারের দিনে দাদা যেহেতু বাড়ীতে থাকে, তাই আমিই যেন রান্না করি। আমিও চাইতাম তা করতে, কিন্তু করা হতোনা। তিন মেয়ে নিয়ে আমি উত্তমের চারপাশে ঘুর ঘুর করতাম। তিন মেয়েকে ঘিরে ছিল তার জীবন। মেয়ে তিনটি এইজন্যই বাবার ন্যাওটা হয়েছে। কারোরই ক্ষিদে পেতোনা, গায়ে গায়ে লেপটে বসে থাকতাম, টিভি দেখতাম, ছোট্ট মিথীলা ওয়াকারে চড়ে ঘুরতো আমাদের সামনে দিয়ে। এক সময় হয়তো বুয়াকে ডেকে বলতাম, বুয়া তুমিই রান্না করে ফেলো। আমি আজকে রান্না করবোনা। বুয়া জানতো, এমনটিই হবে। দুপুর বা সন্ধ্যার দিকে উত্তম যখন কম্পিউটার টেবিলে বসে কাজ করতো, আমি তার চেয়ারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতাম। উত্তমের সেই ধ্যানমগ্ন, মনোযোগী চেহারাটি দেখতে এত ভাল লাগতো, মনে হতো, এই জ্ঞাণী, বিদ্বান পুরুষটি আমার স্বামী,(স্ব+আমি),আমার যাবতীয় আবদার, আহ্লাদ, অভিযোগ, দাবী সবই তার কাছে করতে পারি, আমার চেয়ে সুখী আর কে আছে!


আর যদি আমাদের বাসায় তখন আমার মা, ছোট মাসী থাকতো, তখন তো আর লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে উত্তমের কাছে গিয়ে বসে থাকতে পারতামনা, আমাকে রান্নাঘরে যেতেই হতো। নাহলে স্বামীকে রান্না করে খাওয়াইনা অভিযোগে মায়ের ক্যাটক্যাটানি শুনতে হতো। কাজেই রান্নাঘরে মাসী-বোনঝি মিলে রান্না করতাম, রান্না অবশ্য আমিই করতাম কারণ আমার ছোট মাসী সকল অসাধ্য সাধন করার ক্ষমতা রাখলেও রান্নার মত সহজ কাজটি খুব সহজে করতে পারেনা। রান্না করার সময় মা চেয়ার টেনে বসে নিজের জীবনের রকমারী গল্প শুনিয়ে যেত। ফাঁকে ফাঁকে বুয়া চা বানাতো, আমাদের সবাইকে চা খাওয়াতো। মিথীলার পাপা তখন মিথীলার কান্ড কারখানা দেখতো, আমাদের আসরে এসে শুনিয়ে যেত গুড্ডু (মিথীলা) কি মজার কান্ড করেছে। তেমন দিনে কুটু(মিশা)কে ডাকতো তার মাথা চুলকে দেয়ার জন্য! কোন কোন উইকএন্ডে মেজদাও এসে যোগ দিত। সে এক উৎসব লেগে থাকতো।কখনও কখনও আমরা দল বেঁধে বেড়াতে যেতাম। সারা বাড়ী হই হুল্লোড়ে মেতে থাকতো। কি যে সুখ ছিল, প্রথম জীবনের সুখে টাকার ছোঁয়া ছিলনা, শুধুই নিজেদের মধ্যে শান্তি এবং সুখ ছিল, আমেরিকা আসার আগের চার বছরের সুখে টাকারও ছোঁয়া ছিল, তাই সুখগুলোকে অনেকের মধ্যে ভাগ করে দিতে পেরেছিলাম।


আমেরিকা চলে এসেছি, সুখের কিছু ব্যত্যয় ঘটেছে। শুধু স্বামী-স্ত্রী, তিন কন্যাতে আর কতটুকু সুখী হওয়া যায়, তারপরেও উইকএন্ডগুলো ভালোভাবেই কাটিয়েছি। দুই বছর পর মৌটুসী ভার্জিনিয়া কলেজে চলে গেলো, আমরা মিসিসিপি চলে এলাম, ভেঙ্গে গেলো পাঁচজনের নিরবচ্ছিন্ন সুখের সংসার। নিজেও ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম নার্সিং পড়ার জন্য, বরের টাকায় পড়তে সংকোচ হচ্ছিল বলে নার্সিং পড়তে পড়তেই ওয়ালমার্টে চাকুরী নিলাম। ভাল রেজাল্ট করবো বলে উইকএন্ডেও প্রচুর পড়াশোনা করতাম, রেজাল্ট হতো সব সাবজেক্টে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানাটমী ল্যাবের দরজায় ডঃ বিল পার্কার একখানি নামতালিকা টাঙিয়ে রেখেছেন, কে কোন বছর অ্যানাটমীতে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছে। আমার নামের পাশে সবচেয়ে বেশী স্কোর ৯৮% লেখা আছে। এগুলো করতে গিয়ে সুখ কিছুদিনের জন্য নির্বাসিত হলো। শেষ পর্যন্ত দুই সেমেস্টার বাকী থাকতে প্রফেসরের উপর রাগ করে নার্সিং পড়া ছেড়ে দিলাম। আসলে, তখন তো আমার মনে সুখ ছিলনা, টাকার ছোঁয়া না থাকা সুখ, অথবা টাকার ছোঁয়া থাকা সুখ, কোনটাই ছিলনা, তাই পড়া ছেড়ে দিতে সময় লাগেনি।

ওয়ালমার্টেই ফুলটাইম চাকুরী শুরু করলাম। আমেরিকায় প্রথম চাকুরী, আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা কারো কাছেই প্রকাশ করিনা। আমার স্বভাবে সব ব্যাপারেই দ্বিমুখী নীতি কাজ করে। ছোটবেলা থেকেই আমার ফেরীওয়ালীর জীবন খুব ইন্টারেস্টিং মনে হতো, মাথায় টুকরী নিয়ে সারা পাড়া ঘুরে বেড়ায়, কত কিছু দেখে, কত মানুষের সাথে পরিচয় হয়, আমারও ইচ্ছে করতো মাথায় টুকরী নিয়ে বেরিয়ে পড়তে। লেখাপড়ায় মোটামুটি মেধাবী ছিলাম বলে ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ইউনিভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন দেখতাম। যখন আড়ং; চালু হলো, আড়ং এর সেলস গার্লদের দেখলে নিজেকে তুচ্ছ মনে হতো, মনে হতো, ইস! আমি যদি সেলস গার্লের চাকরী করতে পারতাম। কি সুন্দর করে কথা বলে বলে জিনিস বিক্রী করতাম। আবার ভাবতাম, এত ডিগ্রী নিয়ে সেলসগার্লের চাকুরী করবো? আমি যখন এগুলো ভাবি, ঈশ্বর তখন হাসেন। মাঝ বয়সে এসে পূর্ণ হলো কৈশোরের স্বপ্ন। আমি ওয়ালমার্টে সেলস এসোসিয়েটের কাজ করি, সুখী হওয়ারই কথা। সুখী হই, মাঝে মাঝে দ্বিমুখী মন আমাকে খোঁচা দেয়, কেমিস্ট্রি তে অনার্স, মাস্টার্স, বিএড, নার্সিং(স্থগিত) বিদ্যা নিয়ে রীটা রয় ফোন বিক্রী করে। তখনই মনে হয়, অনেক হয়েছে, আর করবোনা চাকরী।

আমার সেই হারাণো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে, বুকের ভেতর কান্নাগুলো ছলকে ছলকে উঠে। কাজে যাই মুখ ব্যাদান করে, বাসায় ফিরি মুখ ব্যাদান করে। আমার ছোট্ট মিথীলা একেবারে একা একা বড় হচ্ছে। আগে তো বাসার পরিবেশ আমি প্রাণবন্ত করে রাখতাম, পাশে ছিল মৌটুসী, মিশা। এখন তো শুধুই উত্তম কুমার, মিথীলা আর আমি। উত্তম কুমার তার লেখাপড়ার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, যে কাজ করতে দশ মিনিট লাগার কথা, সেই কাজ মিথীলা নিজের ঘরে সারা দিনমান লাগিয়ে করে, ক্ষিদে পায় কিনা জানিনা, আমার বাড়ী ফেরার অপেক্ষায় থাকে। আমি ফিরলে আমার সাথে বসে খায়। এ কোন জীবন হলো? প্রায়ই হুমকী ধমকী দেই, ছেড়ে দিব এই চাকরী। কিন্তু হুমকী ধমকী কাকে দেবো? কেউ তো আমাকে বলেনি চাকুরী করতে! আমার হুমকী ধমকী শুনে তিতি বিরক্ত হয়ে উত্তম বলে, ভাল না লাগলে ছেড়ে দাও চাকরী, চাকরী করতেই হবে এমন তো কোন কথা নেই

হঠাৎ মনে হলো, আওয়ার কাটা যায় যাক, পার্ট টাইম হয়ে যাই যাক, আমি সপ্তাহের প্রতি শনিবার পারমানেন্ট অফ ডে করে নেবো। যা ভাবা, সেই কাজ। গত দুই মাস আগেই আমি ম্যানেজারকে দিয়ে শনিবারের ছুটি অ্যাপ্রুভ করিয়েছি। অনেক আগে আমি মাসের চতুর্থ রবিবার অফ রেখেছিলাম। শনিবার অফ হওয়াতে ভেবেছিলাম, আগের রবিবারের ছুটি বোধ হয় বাতিল হয়ে যাবে। দেখলাম, পার্সোনেল ম্যানেজারের চোখে পড়েনি অথবা সে ব্যাপারটি নিয়ে মাথা ঘামায়নি। এখন প্রতি শনিবার এবং মাসের চতুর্থ রবিবার আমার ছুটি থাকে।

মিথীলা খুব ঠান্ডা সুস্থির মেয়ে, আমি বাসায় থাকলে ও খুব হই হই করেনা, আবার শুক্রবার আসলেই জিজ্ঞেস করতে ভুলেনা, মা, তোমার কালকে ছুটি? যখন বলি, হ্যাঁ ছুটি, তাহলে ও বলবে, কাল তাহলে কোথাও যাচ্ছি, নাকি কেউ আসবে আমাদের বাসায়? আমার এত ভালো লাগে! এতো আমারই মেয়ে, আমার স্বভাব পেয়েছে। মাঝে মাঝেই জিজ্ঞেস করে, মিআ (মিশা)কবে আসবে? মিশা এলে মিথীলার আনন্দ আর ধরেনা। মিশার খিদমত করে খুব আনন্দ পায়। মৌটুসী আসেনা কতদিন, গত বছর ক্রীসমাসে এসেছিল, এই বছর ক্রীসমাসে আসবে। মৌটুসী এলে মিথীলার আদর বেড়ে যায়। আমার সংসার আবার আগের মতো কলবলিয়ে উঠে। বুঝি, এ সবই সাময়িক। উৎসব শেষে সব পাখী নীড়ে ফিরে যায়।

আমি কাল বেলা বারোটায় ঘুম থেকে উঠবো। আমার আগেই উত্তম কুমার উঠে যাবে, চা বানাবে, নিজের চা খাবে, আমার চায়ের কাপ ঢেকে রাখবে। ঘুম ভেঙ্গে মিথীলা, মনা, বাবলুসোনা, যাও তো আমার চা গরম করে নিয়ে এসো বলে আড়মোড়া ভাঙ্গবো। মিথীলা চা নিয়ে আসবে, সাথে বিস্কুট। আমি বলবো, বিস্কুট খাবোনা। মিথীলা বলবে, খালি পেটে চা খাবে কেন? প্রাণটা জুড়িয়ে যাবে। মা কোথাও নেই, আবার মা যেন সর্বত্রই আছেন। আসলে কাল আমার ঘুম ভেঙ্গে যাবে সকাল ছয়টায়, অন্যদিন তো ঘুম ভেঙ্গে গেলে আবার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। কাল যেহেতু ছুটি, তাই চোখ বন্ধ হবেনা, সাতটার মধ্যে বিছানা ছেড়ে ঘর-দোর পরিষ্কার করে কম্পিউটারে বসে যাব। দেশপ্রেম টপিকের উপর একটি গল্প লিখে শেষ করবো।

আজ ব্রেড কিনে এনেছি, সাথে মকা ব্রেড স্প্রেড এবং এপ্রিকট জেলী এনেছি। ছোটবেলায় জানতাম, বড়লোকেরা পাউরুটিতে মাখন মেখে চিনি ছড়িয়ে খায়। একেবারে স্বপ্নের খাবার মনে হতো। আমরা পাঁউরুটি পেতাম জ্বর হলে পরে। জ্বরমুখে সেই পাঁউরুটি বিস্বাদ লাগতো। যখন স্বপ্নের পাঁউরুটি আর মাখন বাস্তবে ধরা দিল, তখন স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে গেছি, বাটার খাইনা। হঠাৎ করেই আজ বেপোরোয়া হয়ে গেলাম, এইসব চকোলেট স্প্রেড অনেক কাল খাইনা, কাল খাবো। গল্প লিখবো আর মিথীলাকে বলবো, মিথ, শোনো, কিচেনে গিয়ে দেখো, পাপা চা করে রেখেছে, চা গরম করে, সাথে দুই পিস ব্রেড মকা স্প্রেড দিয়ে মেখে আনো

দুপুরে কিছু একটা বানিয়ে খেয়ে নেবো। রাতে বন্ধুর বাড়ীতে আমাদের নেমন্তন্ন আছে। উত্তম বলেছে, কিছু একটা খাবার বানিয়ে নিয়ে যেতে। ভাবলাম, এগ ডেভিল বানিয়ে নিয়ে যাব। সে বানাতে আর কতক্ষণইবা লাগবে। নেমন্তন্ন খেয়ে বাড়ীতে যখনই ফিরিনা কেন, তাড়া তো কিছু নেই। পরের দিনও আমার ছুটি। বেলা বারোটায় ঘুম থেকে উঠবো, হাতের কাছেই পাব গরম চায়ের পেয়ালা। আহারে! সুখ কি কোন অচিন পাখী? সুখী হতে এর চেয়ে বেশী আর লাগে কি?

1 comment:

  1. প্রাণের কথা । পড়েও প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো ।

    ReplyDelete