Sunday, December 30, 2012

ধর্ষিতার আবার শান্তিপূর্ণ মৃত্যু!!--এ কথায় কাঁদবো না হাসবো!

" দিল্লীতে একটি মেয়েকে বাসের সবাই মিলে রেপ করেছে"--অনলাইনে যাওয়ার আগেই ভয়ংকর এই সংবাদটি পেয়েছিলাম মেজো মেয়ের কাছ থেকে।  বাইশ বছর বয়সী তরুণীর মুখে তেইশ বছর বয়সী তরুণীর রেপড হওয়ার সংবাদ শোনার মধ্যে স্বস্তি নেই।  অস্বস্তি নিয়েই  অসহায় এক কান্না বুকের মাঝে চেপে রেখে ধর্ষিতা মেয়েটির আরোগ্য কামনা করেছি। 'ধর্ষণ' বা 'রেপ' শব্দটি উচ্চারণ করতেই আমার অস্বস্তি লাগে, এই ধরণের সংবাদ পাঠ করতে ভয় লাগে, তাই দিল্লীতে গণধর্ষণের শিকার মেডিক্যাল স্টুডেন্ট 'দামিনী' মায়ের উপর ঘটে যাওয়া পাশবিক অত্যাচারের কাহিণী পড়েও দেখিনি। এটা আমার পলায়ণপর মনোবৃত্তি নয়, এই ধরণের সংবাদ পাঠ করার সময় আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। কারণ যে কোন ঘটনা-দূর্ঘটনা আমি আমার নিজের উপর টেনে এনে কল্পনা করি, স্বভাবতঃই  মাথা এলোমেলো হয়ে যায়।

ধর্ষকের ভূমিকায় থাকে পুরুষ, এই পুরুষই আমার বাবা, আমার ভাই, আমার স্বামী, আমার চাচা, মামা, খালু, প্রিয় বন্ধু, অতি পরিচিত আরও আরও কতজন। এই সকল পুরুষের সাথে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে আমার নিবিড় সম্পর্ক। এরা সকলেই আমার আপন, এরা সকলেই আমার হিতৈষী। এরা তো কখনওই 'ধর্ষক' হতে পারে না! তাহলে 'ধর্ষণ' করার জন্য আলাদা কিছু পুরুষ থাকে, যারা মায়ের পেটে জন্মায় না, যাদের কোন বোন থাকে না, যেহেতু তারা 'ধর্ষণেই আনন্দ পায়, তাই তাদের বিয়ে করার প্রয়োজন হয় না, বিয়ে করে না বলে তাদের কোন কন্যা সন্তানও জন্মায় না। এরা পৃথিবীতে আসে 'ধর্ষক' হয়ে। এদের সাথে আমার পরিচয় নেই, তাই এদের কৃতিত্বপূর্ণ ধর্ষনের সংবাদ শুনলেই ভয়ে কুঁকড়ে যাই। দিল্লীর মেয়ে দামিণীর সংবাদটি না পড়েও, শুধু পত্রিকার সংবাদের শিরোনাম দেখেই জানতে পেরেছিলাম, মেয়েটিকে ধর্ষন করেও ক্ষান্ত হয়নি সেই 'এলিয়েন ধর্ষক পুরুষেরা', তারা মেয়েটিকে পিটিয়েছে, তারপর দেহের ক্ষিদে মিটিয়ে বাস থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এতগুলো পুরুষের আবেগহীন, রোমান্স বিহীন, কামণার তীব্র কামড়ের জ্বালা, লোহার রডের আঘাতের যন্ত্রণা, চলন্ত বাসের থেকে তীব্র গতিতে ছিটকে কংক্রীটের রাস্তায় পড়ে যাওয়া---তেইশ বছর বয়সী তরুণীর সেখানেই মৃত্যু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দামিণী 'মেয়ের জাত', কই মাছের প্রাণ, এত সহজে মরবে কেনো? শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেছিল। মেয়েটির এমন সাহসী, দৃপ্ত, প্রত্যয়ী আত্মবিশ্বাস দেখে মমতায় গলে গেছি, চোখ দুটো আনন্দে ভিজেছে, বুকে সাহস সঞ্চয় করেছি, আরেকবার আধুনিক প্রজন্মের তারুণ্যকে 'স্যালুট' করেছি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করেছি, মেয়েটির দ্রুত আরোগ্যলাভের জন্য, সংবাদ শিরোনামে দেখেছি, মেয়েটিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়েছে। মনে মনে খুশী হয়েছি, যাক, এ যাত্রা মেয়েটি বেঁচে গেলো।



গত সন্ধ্যায়  আমরা সবাই একসাথে গল্প করছিলাম, আমার  মেজো মেয়েটিই  সংবাদ দিল, ' দিল্লীতে রেপড মেয়েটি শেষ পর্যন্ত মারা গেছে'! সংবাদটি শোনার সাথে সাথে চমকে গেছি, চমকে গেছি আমার মেয়ের গলার স্বর শুনে। এমন নিস্পৃহ, অপমানিত গলার স্বর এর আগে আমি শুনিনি। এক ঝটকায় মুখ তুলে ওর মুখটি দেখার চেষ্টা করতেই দেখি, আমার মেয়ে মুখ ঘুরিয়ে সোজা ওর রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। বাকী রাত আমাদের কারো সাথে আর কোন কথা না বলে, না খেয়ে চুপচাপ নিজের আইপ্যাড নিয়ে বসে কাটিয়েছে।

আমার মেয়ের বয়স  বাইশ, 'পাবলিক হেলথ' এর উপর মাস্টার্স করছে,  দামিণীর  বয়স তেইশ, মেডিক্যাল কলেজে পড়ছিল। ওরা প্রায় সমবয়সী। আমার মেয়ে থাকে আমেরিকায়, দিল্লী, মুম্বাইয়ের প্রচুর ছেলেমেয়ের সাথে নিত্যদিন উঠাবসা ওর, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সকলেই ওর সহপাঠী। কাজেই 'দামিণী'র প্রতিও নিশ্চয়ই এক ধরণের সমবয়সীসুলভ টান অনুভব করেছে। মোটামুটি নিশ্চিন্ত পরিবেশে বড় হতে থাকা একটি মেয়ে  ধর্ষণের সংজ্ঞা  জানে, কিন্তু ধর্ষণের পর মানসিক ও শারীরিক  ভয়ানক প্রতিক্রিয়া  সম্পর্কে কতটুকু জানে, তা আমার জানা নেই। তবে আমার মেয়েটির মুখ চোখ শুকিয়ে গেছে।  কারণ, ওকেও রাতে-বিরেতে ডিপার্টমেন্ট থেকে গাড়ী ড্রাইভ করে নিজের এপার্টমেন্টে ফিরতে হয়, রাত বারোটা বেজে গেলেই আমি ফোনের পর ফোন করে তাড়া দেই নিজের রুমে ফেরার জন্য। লজ্জায় ও সংকোচে বলতেও পারি না, কেনো আমার এই উদ্বেগ, কিসের দুঃশ্চিন্তা। কী করে বলি, মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়ার সাথে সাথেই কপালে  সারা জীবনের জন্য অলিখিতভাবে 'এলিয়েন পুরুষের ভোগের জন্য তুমি'  ছাপ পড়ে যায়!

'ধর্ষণ' কাকে বলে? একজন নারী ও পুরুষের মধ্যে জোরপূর্ব্বক, বলপ্রয়োগপূর্ব্বক, একতরফা উৎসাহে যে দৈহিক মিলন ঘটে বা ঘটানো হয়, সেটাকেই তো 'ধর্ষণ' বা বলাৎকার বলা হয়ে থাকে!  আর সেই 'ধর্ষণ' নামক অতি ভয়ংকর কর্মের নায়ক অবশ্যই 'পুরুষ' এবং ধর্ষিতা অবশ্যই 'নারী'। ধর্ষকের কি কোন দেশ থাকে? ধর্ষকের কি কোন জাত থাকে? ধর্ষকের কি মা-বোন থাকে? ধর্ষকের কি কন্যা সন্তান থাকে? ধর্ষকদের চেনা যায় কী করে? এদের চেনার তো কোন উপায় নেই! ভালো করে নাম-ধাম জানার আগেই তো এরা মেয়েদের উপর হামলে পড়ে। এমনকি কখনও কখনও স্বামীও নাকি ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে! স্বামী-স্ত্রীর দৈহিক সম্পর্ক  'সুস্থ-স্বাভাবিক' সম্পর্ক হিসেবে চির স্বীকৃত হলেও  মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, সুস্থ দৈহিক মিলনের ক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রী, দুজনের সম্মতি থাকতে হবে,  নাহলে স্ত্রীর অনিচ্ছায় যে মিলন, সেটাকেও ধর্ষণ বলা হয়ে থাকে।

পৃথিবীর সব দেশেই প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ নারী ধর্ষিত হচ্ছে, সে স্ত্রীই হোক, সৎ কন্যাই হোক, বান্ধবীই হোক, আত্মীয়া বোনই হোক  অথবা  চলতি পথে হঠাৎ সুযোগে পেয়ে যাওয়া তরুণীটিই হোক। ধর্ষণ হয়ে চলেছে, যুগ যুগ ধরে।  ঘরে -দুয়ারে, হাটে-বাজারে, গ্রামে-গঞ্জে, আনাচে-কানাচে, যুদ্ধক্ষেত্রে, এমনকি পতিতালয়েও নারী ধর্ষিত হয়ে চলেছে। শুধুই কি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেই নারীর এমন অপমান হচ্ছে? কখনওই নয়, আমেরিকার মত পরাক্রমশালী দেশটিতে প্রতিদিন কতভাবেই যে নারীর অপমান হচ্ছে, তার পরিসংখ্যান দেখে ভিরমী খেতে হয়। ' স্টেপ ডটার' রেপ তো প্রতিদিন, প্রতিবেলাতেই ঘটছে! কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে,  কেনো মানুষ সেই আদিম যুগের মতই রাস্তা-ঘাটে উলংগ হচ্ছে, উলংগ করে দিচ্ছে নিজেকে, উলঙ্গ করে দিচ্ছে সমাজকে, উলঙ্গ করে দিচ্ছে মানব সভ্যতাকে! মানুষের সভ্যতার ক্রম বিকাশের সাথে সাথে মানুষের এই আদি রিপু প্রকাশের ক্ষেত্রে  সংযম আসছে না কেনো।

নারীর অপমান কি শুধুই ধর্ষণেই সীমাবদ্ধ? আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো ছাড়াও পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে শক্তিশালী পুরুষের হাতের চড়-চাপড়, কিল-ঘুষি, লাথি-ঠ্যাঙাণী খেয়েই নারী বিছানা ছাড়ে, আবার এগুলো খেয়েই মাঝরাতে বিছানায় যায়। এই তো নারীর কপাল! নারী শিক্ষিত হলেই কি, আর অশিক্ষিত থাকলেই বা কি! উচ্চশিক্ষিত নারীকে বাইরে থেকে যতই স্মার্ট দেখা যাক না কেনো, অন্দর-মহলে সে শুধুই একজন নারী। তাকে বাইরে বের হওয়ার আগে ঘরের সকলের চাহিদা মেটাতে হয়, কর্মশেষে বাড়ী ফিরেও তার মুক্তি নেই। তাকে একঘেয়ে জীবনের ঘানি ঘুরাতে হয়। এওতো এক ধরণের অত্যাচার! নারীরও একটি দেহ আছে, সেই দেহে নানা রকম চাহিদা আছে, দেহের রোগ-শোক আছে, ক্লান্তি আছে, এসব খবর কেউ নেয় না, এটাওতো নারীর এক ধরণের অতৃপ্তি! নারী বিয়ের আগে থাকে বাবা-ভাইয়ের কঠিন শাসনে, বিয়ের পর স্বামী-শ্বশুরের শাসনে, শাসনে থেকে থেকেই নারীর ভবলীলা সাঙ্গ হয়, ইহজীবনে  স্বাধীনতার স্বাদ পায় না,  নারীর জন্য এটাওতো এক ধরণের মানসিক অশান্তি! আজকের সংবাদে দেখলাম, দামিণী মায়ের মৃত্যুর পরে সিঙ্গাপুর হাসপাতালের ডাক্তার বলেছেন,  মেয়েটির শান্তিতে মৃত্যু হয়েছে! 'ধর্ষিতার আবার শান্তিতে মৃত্যু!! কাঁদবো না হাসবো!

নারীকে সৌন্দর্য্যের প্রতীক বলা হয়, আবার নারীর পোশাক পরার স্বাধীনতাকে নারীর দুঃসাহসিক অভিলাষ মনে করা হয়।  সারাক্ষণ হাজার চোখের ভ্রু কুঞ্চন উপেক্ষা করে নারীকে চলতে হয়। অত্যধিক গরমে পুরুষ খাটো প্যান্ট পড়তে পারে, মেয়েরা পারবে না। পুরুষের পেশীবহুল শরীর ও পা দেখে মেয়েদের মন বা শরীর চুলকায় না, অথচ মেয়েদের স্বল্প বসনে দেখতে পেলেই পুরুষের মনে সুড়সুড়ি লাগে, এটা কেমন কথা! নিজেকে সংযম করার নামই তো 'আত্মসংযম'! এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যদি পুরুষ 'আত্মসংযমী' হতে না শিখলো, এ লজ্জার ভার বইবে কে? গতকাল সাংবাদিকদের কাছে  ইতালীর কোন মূর্খ ধর্মজাযক বলেছেন, মেয়েরা সংক্ষিপ্ত কাপড়-চোপড় পড়ে পুরুষের কামনার উদ্রেক ঘটায়! এমন উক্তি অনেক মোল্লা, ব্রাক্ষ্মণ, সমাজপতিরা অহরহ কানের কাছে জপে যাচ্ছে। এই মন্ত্র জপবার সময় একবারও ভেবে দেখছে না, এতে করে  নিজেদের বিকৃত মানসিকতা, অনিয়ন্ত্রিত অভিলাষগুলো প্রকাশিত হয়ে পড়ছে! ওরা একবারও ভেবে দেখছে না, নিজেদের কুকর্মের দ্বারা পৃথিবীর কোটি কোটি সুস্থ পুরুষকে অপমানিত করে চলেছে!  মাঝে মাঝেই ছুঁড়ে দেয়া এ সকল ছবক দ্বারা যে কেউ প্রভাবিত হতেই পারে! এভাবেই এই সকল মোল্লা-পুরুত-ফাদাররা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করে চলেছে। এই সব সমাজপতিদের প্রতি একরাশ ঘৃণা ছুঁড়ে দিচ্ছে এই পৃথিবীর কোটি কোটি নারী, হোক তারা শক্তিতে দূর্বল, হোক তারা সমাজে অবহেলিত, তারপরেও ঘৃণার থুতুতে শুধু ঘৃণাই থাকে, রাশি রাশি ঘৃণা!

Saturday, December 29, 2012

হলিডে'জ ভ্যেনু, হলিডে'জ মেন্যু

এ বছর ক্রীসমাসের ছুটিতে আমরা কোথাও যাইনি।  কারণ আমাদের বাড়ীকে এবারের ক্রীসমাস ব্রেক এর ভেন্যু বানিয়েছি, মেয়েরা  আসবে, অতিথি  আসবে এবং আমার বোন  আসবে তার সাড়ে চার বছর বয়সী  কিউট পুত্রটিকে নিয়ে। এরকম প্ল্যানই ছিল আমাদের।  মেয়েরা বলতে আমার বড় দুই মেয়ে, অতিথি হচ্ছে কাছাকাছি আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড আর বোন হচ্ছে আমার 'তুতো' বোন। আগের একটি লেখাতে  যে 'তুতো' বোনের বেড়াতে আসার কথা লিখেছিলাম, সে ইতোমধ্যেই আমাদের কাছে চলে এসেছে। এখানে আসার প্ল্যান সে করেছে আরও দুই মাস আগে থেকে, তবে  আসার ব্যাপারে  আমাকে আগাম কিছুই বলেনি।  একেবারে কিছুদিন আগে তার আসার সংবাদ জানিয়ে সারপ্রাইজড করেছে।

কয়েকদিন আগে আমার এক অতি প্রিয়ভাজন জানতে চেয়েছে, 'তুতো' বোন ব্যাপারটি কি? তাকে বলেছি, তুতো  শব্দটি এসেছে  মাসতুতো, পিসতুতো, জ্যেঠতুতো, খুড়তুতো, মামাতো ভাই-বোন সম্পর্ক থেকে।  আমার বেশ কয়েকটি তুতো বোন আছে। সবগুলো আমাকে জ্বালিয়ে মারে। তুতো হলেও আমার বোনগুলো আমার কাছে আমার সন্তানের মত,  আমাকে 'ফুলদিভাই' বলে ডাকে।  'ফুলের সাথে মিলিয়ে ফুলদিভাই, ফুলদিভাই ডাকে আর  আব্দারের ঝুলি খুলে বসে। আব্দারেরও কি শেষ আছে, ফুলদিভাই এটা খাব, ফুলদিভাই ওখানে যাবো, ফুলদিভাই বেড়াতে আসো, ফুলদিভাই মন খারাপ, ফুলদিভাই মাথা ব্যথা, ফুলদিভাই ওর সাথে ঝগড়া হয়েছে, ফুলদিভাই সে আমাকে বকেছে---------------বিরামহীন।

ওরা আমার কাছে আব্দার যেমন করে, তেমনি আমার কথা মান্যও করে।  শরীর খারাপ হলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে আমাকে ফোন করবে, রান্না করতে হলে আমার কাছে রেসিপি জানতে চাইবে, কারো সংবাদ জানতে হলে আমাকে জিজ্ঞেস করবে, কতভাবে যে আমাকে ওরা ব্যস্ত রাখে তার ইয়ত্তা নেই। আমার ভাইগুলো কিন্তু ওদের মত আবদারে নয়, আবদার করার আগেই আমি ভাইদের পাশে দাঁড়িয়ে যাই। এ নিয়ে অবশ্য বোনদের মনে একটু আধটু ঈর্ষা হয়, তবে আমার ধ্যাতানি খেয়ে আবার চুপ করে যায়। ঈর্ষা করার ব্যাপারে যে মহাওস্তাদ, সেই তুতো বোনটিই আমার কাছে বেড়াতে এসেছে।  দুজনেই আমেরিকায় থাকি, অথচ দেখা হলো ছয় বছর পর। এরই নাম জীবন-যাপন,  এরই নাম মেয়েদের কপাল, এরই নাম কঠিন বাস্তব!

আমার তুতো বোনটির নাম চৈতালী। চৈতালী নামটি রেখেছিল আমার মা। ছোটবেলায় চৈতালী ভীষন চঞ্চল ছিল, এখন সে বড় হয়েছে, সংসার করছে, সংসারের বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে চঞ্চলতা বাহ্যতঃ কমে গেছে , তবে জন্মগত চঞ্চলতা নিপুণভাবে নিজের ভেতরে চেপে রেখেছে। অবশ্য 'ফুলদিভাই' এর কাছে এসে ছোটবেলা হয়তো বা একটু একটু করে ফিরে আসছে। কত খলবল করে কথা বলতো চৈতালী, সে এখন পুত্রকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, ফুলদিভাইয়ের কাছে আবদার করার সুযোগ পায় না। দেখে মায়া লাগে। তবে এখানে আসার আগে ফোনে কতবার বলেছে,

-ফুলদিভাই, তোমার কাছে গেলে আমাকে অনেক কিছু রান্না করে খাওয়াবে। যা চাই তা খাওয়াবে। একেবারে আমাদের বাপের বাড়ীর স্টাইলের রান্না, ঘরোয়া খাবার কিন্তু আমাদের পুরাণো স্টাইলে, ছোটবেলাতে যেমন খেতাম।

-কী কী খাবি, আগে থেকে বল, রেডী করে রাখি।

-এই ধরো, সব সময় স্বাভাবিক খাবার কিন্তু ফাঁকে ফাঁকে পোলাও, বিরিয়ানি, চিংড়িমাছের মালাইকারী, চিকেন রোস্ট, নানা রকম ভর্তা, ধইনা পাতার বাটা, বাকীগুলি পরে বলবো।

চৈতালী আসার আগের দুইদিন আমাদের বাড়ীতে প্রচুর অতিথি এসেছিল, নিমন্ত্রণ করেছিলাম। অনেক কিছু রান্না করেছিলাম। ২৩শে ডিসেম্বার আমাদের কাছাকাছি বয়সী কিছু বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম, ১২-১৩ পদ রান্না করেছিলাম। পরের দিন ২৪ শে তারিখে আমার মেজো মেয়ে বেশীর ভাগ রান্না করেছে, আর নিমন্ত্রিত অতিথিদের সকলেই একটি একটি আইটেম নিয়ে এসেছিল। এদিনের অতিথিরা ছিল বয়সে তরুণ , তাই আনন্দ ফূর্তিও প্রচুর হয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার তো হিসেবই নেই।

চৈতালী  এসেছে ২৫শে ডিসেম্বার। এদিন রান্না করেছে আমার উত্তম কুমার। মুরগীর কিমা দিয়ে ছোলার ডাল, স্যালমন ফিশ ফ্রাই, আগের দিনে রান্না করা রুই মাছের ঝোল, ক্যাট ফিশ ফিলে তন্দুরী, আমের চাটনি, লেমন রাইস, সাদা ভাত।

পরদিন বেলা এগারোটায় ঘুম থেকে উঠে চা আর কুকি, দুপুরে ছিল ফ্রিজ থেকে বের করা চিকেন বিরিয়ানী, আগের দিনে রান্না করা চিকেন রোস্ট, চিংড়ি মাছের ডাল, তিন চার পদের সব্জী,  পায়েস----

ডিনারে ছিল, চিংড়ি মাছের মালাইকারী, মাটন কারী,  ডালের বড়ি দিয়ে রান্না করা পাবদা মাছের ঝোল,  মুসুরের ডাল, পালং শাক চিংড়ি মাছ, বরবটি ভর্তা---------

আগামী পরশু আমার বড় মেয়ে ফিরে যাবে তার বাড়ীতে। আজ কাজে 'সিক' কল দিয়েছি। বেলা এগারোটায় সবাই চা খেলাম, চা বানিয়েছে গৃহকর্তা। চা এর সাথে রকমারী কুকী। দুপুরে খেতে দিয়েছিলাম, গরম গরম ডালপুরী, ছানা মিশিয়ে  ঝিঙ্গে-কুমড়ো চচ্চড়ি, মাটনকারী, বেকড চিকেন।

আজ ডিনারে ছিল, মুসুর ডাল,  বরবটি ভর্তা, পাঁচমিশেলী সব্জী, পালংশাক-চিংড়ি, কেচকী মাছের চচ্চড়ি, চিকেনের পাতলা ঝোল, কাঁচা কাঁঠাল -চিংড়ি-আলুর রসা।

আগামীকাল সারাদিন বাইরে থাকবো, গাড়ীতে করে শুধুই ঘুরবো, দুপুরে যাব এক বন্ধুর বাড়ী, আলু-পরাটা খাওয়াবে। আমার মেয়ের ধারণা, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আলুপরাটা তৈরী হয় আমাদের বন্ধুর বাড়ীতে। আর সন্ধ্যায় যাব আহাদ-তাসমিন দম্পতির সাজানো ছিমছাম ফ্ল্যাটে। ডিনারে নেমন্তন্ন করেছে। মাত্র তিনদিন আগেই ওরা আমাদেরকে খাইয়েছে, চিকেন বিরিয়ানী, চিংড়ি মালাইকারী। আবার আগামীকাল খাওয়াবে।

চৈতালীর সময় কেমন কাটছে? খুব একটা ভালো কাটছে বলে মনে হয় না। আমি আগেই ফোনালাপে বলেছিলাম, এখানে এসে আমার বাড়ীঘর একটু গুছিয়ে দিয়ে যেতে। ফোনালাপের সময় অতিরিক্ত আনন্দের চোটে কথা দিয়ে ফেলেছিল, ঘর সাজিয়ে দিয়ে যাবে। আমার এই বোনটি বাড়ীঘর সাজিয়ে রাখার ব্যাপারে ওস্তাদ। এখানে আসার পরের দিনই ও আমার কিচেন গুছাতে গিয়ে মহাবিপদে পড়ে গেছে। দুনিয়ার জিনিস জমেছে, এগুলো নিয়ে ও বিপদে পড়েছে। 'গুছাতে পারবো না' বলতেও পারছেনা, ফোনে দুজনেই দুজনকে কথা দিয়েছি, আমি আমার কথা রাখার চেষ্টা করছি, চৈতালীকেও তার কথা রাখতে হবে।  কাজ সহজ করার জন্য জিনিস  ফেলে দিতে যায়, ছোট মেয়ে মিথীলা গিয়ে আটকায়, বলে যে এ জিনিসটা মায়ের খুব কাজে লাগে, ফেলে দিও না।

অসহায় ভঙ্গীতে চৈতালী আমার অন্য দুই মেয়েকে ডাকে,  মেজো মেয়ে চালাক, আইপ্যাড নিয়ে বসে থাকে,  এই কাজে আসেনা। বড় মেয়ে এসে চৈতালীকে সাহায্য করে আর উৎসাহিত করে জিনিস ফেলে দেয়ার ব্যাপারে। ওরা যখন ফেলে দিতে যায়, আমি তখন করুণ সুরে বলি, তোদের সংসার জীবন শুরু, কোন জিনিসের উপর মায়া জন্মেনি, খুব সহজেই ফেলতে পারিস, আমার সাতাশ বছরের সংসার, মায়ায় জড়িয়ে গেছি, কোন কিছুই ফেলতে ইচ্ছে করে না। আমার আর্তি শুনে বড় মেয়ে বলে,

- আমি আগেই জানতাম মামনি কিছুই ফেলতে দিবে না, এগুলি বরং আবার আগের জায়গায় রেখে দাও।

চৈতালী বলে, না রে! তোর দিদা বলেছে, কাউকে কিছু দিয়ে ফিরিয়ে নিতে হয় না, ফিরিয়ে নিলে পরের জন্মে কালীঘাটের কুত্তা হয়ে জন্মাতে হয়।

মেয়ে বলে, -তুমি তো কাউকে কিছু দাও নি।

-ফুলদিভাইকে ফোনে কথা দিছিলাম ঘর গুছিয়ে দেয়ার ব্যাপারে, কথা ফিরিয়ে নিলে কালীঘাটের কুত্তা হবো।

হাসতে হাসতে আমি বলি, পাড়ার নেড়ী কুত্তা আর কালীঘাটের কুত্তার মধ্যে তফাৎ কি রে!

-চৈতালী হেসে দেয়, তা অবশ্য জানি না, কুত্তা হইতে চাই না।

আমি বলি, কথা দিছিলি আমেরিকায় বসে, কাজেই কথা না রাখলে পরজন্মে আমেরিকায় কুত্তা হয়ে জন্মাবি। এর চেয়ে মধুর জীবন আর আছে নাকি!

আমার কথা শুনে ওরা হেসে ফেলে।  এত বছর পর আবার ফুলদিভাইকে কাছে পেয়ে চৈতালী  মনে হয় ওর ছোটবেলায় ফিরে যেতে চায়! একেকবার হাসে, একটু পরেই আমাকে মুখ ঝামটা দেয়। আবার কাজে ব্যস্ত হয়। ওর ছোট্ট ছেলেটা দেখতে রাজপুত্রের মত হয়েছে, পুরো মায়ের রূপ পেয়েছে। হ্যাঁ, চৈতালী দারুণ রূপসী, দারুণ স্মার্ট, ভালো চাকুরী করে। বাইরের দুনিয়ায় স্মার্ট মেয়েটি তার ফুলদিভাইয়ের কাছে এসে একেবারেই কিশোরী হয়ে যায়। ভাইদের প্রতি আমার বিশেষ নজর সম্পর্কে খোঁটা দেয়! মনে করিয়ে দেই, ওর ফরমায়েশ মত রান্না করতে গিয়ে আমি কাজ থেকে ছুটি নিয়েছি, সেটার মূল্যায়ন করতে বলি।

আমাদের দুই বোনের কথা শুনে বড় মেয়ে  হাসি দিয়ে জায়গা ছেড়ে চলে যায়, চৈতালী বসে বসে গুছায়। আমার কাছে একটু পর পর চা চায়, রান্নার ব্যাপারে আমার একটুও অলসতা নেই, তা ওরা সবাই জানে। আমি খুব সুন্দর করে 'চা' বানাই, দুই বোনে যার যার কাজ করি আর চুক চুক করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে যাই। দুজনের কেউই বেশীক্ষণ চুপ করে থাকতে পারি না। আবার কলকল শুরু করে দেই।



Thursday, December 27, 2012

হার না মানা জেদ!

গল্পকবিতা ডট কম নামে একটি ওয়েবসাইট আছে। নতুন নতুন লেখক সৃষ্টির প্রয়াসে সেখানে প্রতি মাসে সকলের কাছে একটি  গল্প ও একটি কবিতা লিখে জমা দেয়ার জন্য আহবান জানানো হয়। লেখার বিষয়বস্তু এবং লেখা জমা দেয়ার শেষ তারিখ আগেই বলে দেয়া হয়। সংগৃহীত গল্প ও কবিতার উপর মাসব্যাপী ভোট নেয়া হয়।  পাঠক ভোট থেকে সেরা পঁচিশ নির্বাচিত হয় এবং তারপর বিচারকের কাছে পাঠানো হয়। পাঠক ভোট এবং বিচারকের দেয়া নাম্বার থেকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থাণ নির্ধারণ করা হয়।

 এই ওয়েবসাইটে এ বছরের ফেব্রুয়ারী মাস থেকে আমিও একটি করে গল্প লিখে জমা দেই।  গল্পের মান কেমন হয়? সেটা অবশ্য বুঝতে পারছি না। শুরুর দিকে আমার লেখা গল্প সেরা পঁচিশে অনায়াসে ঠাঁই পেতো, কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, সেরা পঁচিশে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এর মানে কি! হয় আমার লেখার মান খারাপ হচ্ছে, নাহয় তো ভাল ভাল লেখকের অংশগ্রহণ বাড়ছে। মহাচিন্তায় পড়ে গেছি। কারণ, নিজের মূল্যায়ন থেকে এটুকু বলতে পারি, আমার মধ্যে  যে কোন ব্যাপারেই  ' হার মানবো না' টাইপ জেদ আছে।   স্বাভাবিক সময়ে  আমি খুব হালকা মুডের মানুষ, হাসি-আনন্দ, আড্ডা ফূর্তিতে থাকতে ভালোবাসি। কিন্তু যেই মাত্র প্রতিযোগীতার আসরে নামবো, তাহলেই আমি আমূল বদলে যাই। আমার আশপাশ ভুলে যাই, বাস্তবতা ভুলে যাই, আমার সেই 'হার মানবো না' জেদ আমাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলে।  এ  কারণেই সেরা পঁচিশে স্থাণ পাওয়ার জন্য আমি আরও ভালো লেখার চেষ্টা করি। তারপরেও সেরা পঁচিশে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছে। পাঠকের ভোটে নির্ধারিত হয় সেরা পঁচিশ, ব্যবসায়ীর কাছে যেমন গ্রাহক লক্ষ্মী, লেখকের লক্ষ্মী হচ্ছে পাঠক। তাই আমি পাঠকের মনোরঞ্জনের চেষ্টায় নিজের জেদটিকে ব্যবহার করি। আমার এই জেদটি বেশীর ভাগ সময় মনের ভেতর সুপ্ত থাকে। আমার অজান্তেই সময়মত তা বেরিয়ে আসে। প্রতিযোগীতা যত বেশী কঠিন হয়, আমার জেদের শক্তিও তত বেশী প্রবল হয়।

ঘ্যানানি প্যানানি অনেক করলাম। মূল গল্পে চলে আসি। গল্প কবিতা ডট কমে ডিসেম্বার মাসের টপিক ছিল 'ঈর্ষা'। গল্প লিখে জমা দেয়ার শেষ তারিখ ছিল ২৬শে ডিসেম্বার। ডিসেম্বারের এক তারিখ থেকেই মনে মনে মক্সো করা শুরু করেছি, গল্পটি কত বেশী সুন্দর, কত বেশী প্রতিযোগীতামূলক হিসেবে লেখা যায়। আজ যদি একরকম ঘটনা ভেবে রাখি, কালকেই তা বদলে ফেলি। তবে বদলালেও প্রতিটি বিষয় মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে লিখে রেখেছি। বলা তো যায় না, মূল গল্প লেখার সময় কোন বিষয়টি ভালো লেগে যায়!  এটাই আমার গল্প লেখার পদ্ধতি, এভাবেই আমি লিখি। আর যখন তখন লেখাগুলো যখন তখনই লিখি।  যেমন এ লেখাটি আমার 'যখন তখন লেখা'।

 এতদিনে আমার বাড়ীর প্রতিটি দূর্বাঘাসেরও জানা হয়ে গেছে যে বাড়ীর মালকিন ওয়ালমার্টে চাকুরী করে। ওয়ালমার্টের চাকুরীতে উইকএন্ড বলে কিছু নেই, সিজনাল ছুটি বলেও কিছু নেই। ওয়ালমার্টের পলিসিতে লিখিতভাবেই নিয়ম আছে, অক্টোবার থেকে ১লা জানুয়ারী পর্যন্ত কেউ কোন ভ্যাকেশান লীভ পাবে না। প্রতিটি বাড়ীতে যখন আনন্দ উৎসব চলে, ওয়ালমার্ট এসোসিয়েটের বাড়ীতে চলে 'ক্রন্দন উৎসব'। ডিসেম্বার এলে সারাক্ষণ শুধু কাজ, কাজ, আর কাজ।  আনন্দ-উৎসব করবো কখন! বেশীর ভাগ সময় মন মেজাজ ঠিক থাকেনা। অল্পেই রেগে যাই, কথায় কথায় চাকুরী ছেড়ে দেয়ার চিন্তা করি। পরিবারের সকলের মাঝেই আমাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তার মাত্রা বেড়ে যায়। এ বছর তাদের দুঃশ্চিন্তার মাত্রা এতই বেড়ে গেছে যে তাদের মনে হচ্ছে আমাকে খুব তাড়াতাড়ি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে।

এ বছরের ক্রীসমাস ছুটিতে আমার বাড়ীতে আমার মেয়েরা এসেছে,  বোন এসেছে। ছয় বছর পর দেখা হলো বোনের সাথে। ও আমার মামাতো বোন হলেও আমার কাছে সন্তানের মতো। বাড়ী ভর্তি আপন জন, আর আমি ব্যস্ত থাকি ওয়ালমার্টে। কাহাতক ভালো লাগে! বাড়ী ফিরি মন খারাপ করে, কথায় কথায় হা-হুতাশ করি। মনে পড়ে যায়, 'ঈর্ষা' নিয়ে গল্প লিখা হয়ে উঠেনি। একটা গল্প লিখা শুরু করেছিলাম, প্রায় ১৫০০ শব্দ নিয়ে লেখা হয়েও গেছিল, হঠাৎ করেই মনে হলো, গল্পটি এগোতে চাইছে না। কী যন্ত্রণা! আবার নতুন করে লিখতে গেলে, কখন লিখবো! ভেতরের হতাশাগুলো নানাভাবে প্রকাশিত হতে দেখে তিন মেয়ে আর বোন মিলে সিদ্ধান্ত নিল, আমার ডিপ্রেশান চলছে। খুব বেশীদিন আমাকে এভাবে থাকতে দিলে অচিরেই বড় ধরণের সর্বনাশ ঘটে যাবে। কাজেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতেই হবে।

বছরে একদিন, পঁচিশে ডিসেম্বার ওয়ালমার্ট ছুটি থাকে। কাজেই এই দিনটি সকল এসোসিয়েট নিজ নিজ বাড়ীতে থাকতে পারে। আমিও ছিলাম। কিন্তু আমার মাথায় আনন্দের বদলে ছিল টেনশান। আর মাত্র একদিন বাকী, 'ঈর্ষা' নিয়ে গল্প জমা দিতে হবে। অথচ বাড়ী ভর্তি আমার আপনজনে। আগের রাতে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে এসেছিল, সবাই মিলে ক্রীসমাস ইভ পার্টি করেছি, তাই ২৫শে ডিসেম্বারের সকালে ঘুম ভাঙ্গতে দেরী হয়ে গেছে। সারাটিদিন কেটে গেছে পরিবারের সকলের সাথে, হাসি-আনন্দে, গল্প-গুজবে, খাওয়া-দাওয়ায়। বলে রাখা ভালো, বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছি এ বছরের জুনে, বিয়ের পর ওরা দু'জনে একসাথে এই প্রথমবার আমাদের কাছে এসেছে। কাজেই আনন্দের মাত্রা অনেক বেশী। আনন্দ করতে আমার আপত্তি নেই, সব সময় আনন্দ করতে ভালোবাসি, কিন্তু মাথায় টেনশান নিয়ে আনন্দ করতে পারি না। আমার টানাপোড়েন ওরা সকলেই বুঝতে পারছিল। রাত বারোটার পরে ওরা আমাকে ছেড়ে দিল গল্পটি লিখে শেষ করার জন্য। কম্পিউটারে বসে আমার কান্না পাচ্ছিল। যে দুটি লেখা মোটামুটি তৈরী করে রেখেছিলাম, তার কোনটিই আমার পছন্দ হচ্ছিল না। নতুন করে লেখা শুরু করলাম।  পাশের বিছানায় ছোট বাচ্চা নিয়ে শুয়ে থাকা বোন টুম্পা বারবার আমাকে বলতে লাগলো,

" ফুলদিভাই, এতো রাত জাগো কেনো? তোমার শরীরটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। রাত জাগলে আরও খারাপ হবে।
-নারে! গল্পটা আজকের মধ্যে শেষ না করতে পারলে লাস্ট ডেট পার হয়ে যাবে। কাল থেকে ঠিক সময়ে ঘুমাবো।

-ফুলদিভাই, তোমার শরীরটা এত খারাপ হয়েছে কেনো?

-অনেক কারণ আছে, প্রথম কারণ, লেখালেখির জন্য আমাকে রাত জাগতে হয়, এই রাত জাগা আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে,  আবার সকালেই উঠতে হয়, চাকরীতে যেতে হয়, মাত্র চার-পাঁচ ঘন্টা ঘুমাই। এইজন্যই মনে হয় শরীরটা খারাপ হয়েছে।

-তুমি তো জ্ঞান পাপী। সবই বুঝ, তারপরেও অনিয়ম করো।

-অ্যাই মাইয়া চুপ থাক, তুই ঘুমা, গল্প শেষ না কইরা আমি উঠবো না।

-গল্প শেষ হইব কখন? কত বড় গল্প?

-এখনই শেষ হয়ে যাবে। ৩০০০ শব্দের মধ্যে শেষ করবো।

-কত হাজার? তুমি কি সুচিত্রা ভট্টাচার্য্য হয়ে গেছো?

-নাহ! আমি রীতা রায় মিঠু, সুচিত্রা ভট্টাচার্য্য হমু কিভাবে?  আচ্ছা তোর সমস্যা কি? তোর ঘুম তুই ঘুমা, এতো প্যাচাল পারিস না। আমি এখনই লেখাটা সাবমিট করে দিবো। তাইলে ঘুমটা ভালো হবে।

-যা ইচ্ছা করো। আমার কি, শরীর খারাপ হইলে হাসপাতালে পইরা থাকবা।

রাত সাড়ে তিনটার দিকে একটি গল্প মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেলো। আমার পছন্দ হয়ে গেলো গল্পটি। গল্পটি যে পেজে লেখা শুরু করেছিলাম, সেখানে গল্পের নাম লেখা ছিল 'চোখের জলে'। গল্পের কাহিণীর সাথে এই নাম যাবে না, নাম বদলে দিলাম, একজন কবির অপমৃত্যু। এবার গল্পটি ডেস্ক টপে সেভ করতে চাইলাম।  টুলবারের উপরে লেখা 'চোখের জলে', নীচে লেখা, চোখের জলে' নামে কি গল্পটি সেভ করতে চাও? আমার মাথাটা পুরোপুরি ফাঁকা হয়েছিল। খেয়াল করিনি, ফট করে 'নো' তে প্রেস করতেই আমার চোখের সামনে পুরো গল্প ডিলিট হয়ে গেলো।

পুরো গল্প ডিলিট হয়ে গেছে! আমি জানি, আর কোনভাবেই গল্পটি উদ্ধার করা যাবে না। মাথাটা ঘুরে গেলো, ঐ মুহূর্তে চোখে সব কিছু ঝাপসা দেখছিলাম। এমনও হয়!! কী করবো, কাকে ডাকবো, কেউ কি বুঝবে আমার কত বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে!  ইচ্ছে করছিল, মেয়েদেরকে ঘুম থেকে ডেকে তুলি, ওরা কম্পিউটারের কারিগরি জানে, নিশ্চয়ই গল্পটি ডাম্প বিন থেকে তুলে আনতে পারবে। কিন্তু এত রাতে ওদের ডাকবো কি করে, ডেকে কি-ইবা বলবো, ওরা তো আগেই বলেছিল, রাত জেগে গল্প না লিখে পরের দিন সকালে লিখতে। ওরা তো জানেনা, লেখালেখির জন্য মনোসংযোগের প্রয়োজন আছে। সম্পূর্ণ একা না হলে মনোসংযোগ ঘটে না। আমার খুব কান্না পাওয়ার কথা, কিন্তু কান্না পাচ্ছিল না। এক  অসহায় আক্ষেপে বুকটা মুচড়ে উঠছিল। একবার ভাবলাম, টুম্পা তো কাছেই আছে, ওকে ডেকে দেখি, ওতো কম্পিউটার নিয়ে কাজ করে, ও যদি কিছু করতে পারে। কিন্তু ওর ঘুমন্ত সরল মুখটার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, গোল্লায় যাক আমার লেখালেখি, এ মেয়ে জীবন যুদ্ধে বিপর্যস্ত, একটু বিশ্রামের দরকার, মেয়েটা আজকে মাত্র এসেছে, ঘুমাক, ও ঘুমাক।

এত সহজে হারবো না। এমন অনেকবার হয়েছে, এর চেয়েও কঠিন সময় আমি নীরবে সামাল দিয়েছি, আর এতো কয়েকটি ঘন্টার ব্যাপার। জেগে উঠেছে আমার জেদ,  আরেক নাম 'কচ্ছপের কামড়', কচ্ছপ কামড়ে ধরলে নাকি আর ছাড়ে না। আমারও সেই অবস্থা, শেষ না দেখে ছাড়ি না। অদম্য জেদে আবার নতুন করে টাইপিং শুরু করলাম। জানিনা, কখন শেষ হবে লেখা। ওদের ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখবে আমি ভুতের মত টাইপ করে চলেছি। আমি লেখালেখির বুঝিটা কি! আসলে একটা জিনিস শুরু করে শেষ না দেখা পর্যন্ত আমি থামি না। বন্ধুত্বের বেলাতেও তাই। কেউ যদি আমাকে ভুল বুঝে, আমার সাথে সম্পর্ক কেটে দিতে চায়, আমি তাকে তা করতে দেবো, তবে শেষ পর্যন্ত আমাকে জানতে হবে, কোথাও কোন ভুল হয়েছে কিনা।

যে গল্পটি একবার লিখেছিলাম, তার কাঠামোটি মনে আছে, ভেতরের ডায়ালগ সব মনে পড়ছিল না। তারপরেও একই কাঠামোতে টাইপিং শুরু করলাম, টুম্পা জেগে উঠলো।
-তুমি না বললা, তোমার লেখা শেষ হয়ে গেছে, এখনও বসে আছ কেন?

টুম্পাকে ঘটনা খুলে বললাম এবং জিজ্ঞেস করলাম, ও কোন কায়দায় আগের লেখাটি খুঁজে আনতে পারবে কিনা। জানা উত্তর পেলাম, সম্ভব না। ওকে বললাম, রাত সাড়ে চারটা পর্যন্ত যতটুকু সম্ভব লিখবো, তারপর তিন ঘন্টা ঘুমাবো। বাকীটা কাল সকালে দেখবো। অফিসে যাওয়ার আগে লেখাটি শেষ করে সাবমিট করে যাব। আহারে! কোনভাবেই আর এগোচ্ছে না, কম্পিউটার অফ করে শুয়ে পরলাম। ঘুম আসেনা, কি যেন এক হতাশায় মন ভেঙ্গে যাচ্ছে। হিসেব কষছি, কাল কি কি রান্না করতে হবে, কতটুকু ফ্রী সময় পাবো! ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম ভাঙ্গলো সকাল সাড়ে নয়টায়।  দুদিন  ছুটি কাটিয়ে মেয়ের বর ফিরে যাচ্ছে, তাকে রওনা করিয়ে দিয়ে ফ্রী হলাম সাড়ে দশটায়। আমার মনটা খুব খারাপ দেখে বোন টুম্পা এগিয়ে এলো। আমাকে পাঠিয়ে দিল কম্পিউটারে, রান্নাঘরের দায়িত্ব ওরা নিয়ে নিল। আমাকে কাজে যেতে হবে দুপুর একটার আগে। কারণ আমার কাজের শিফট ছিল একটা থেকে রাত নয়টা। বেলা সাড়ে বারোটায় গল্প একটা দাঁড়িয়ে গেলো। ডিলিট হয়ে যাওয়া গল্পের আদলেই গল্পটি হয়েছে, তবে যা হারিয়ে যায়, তা তো আর ফিরে আসে না। মানুষের বেলাতেও যা সত্যি, আমার লেখার বেলাতেও সেটাই সত্যি। গল্পের নাম আবার পালটে গেলো। এবার নাম দিলাম 'পুণর্জন্ম'। গল্পটি সাবমিট করে দিলাম, রিভাইস করে লাভ নেই, গল্প হয়েছে সাদামাটা, মনের মত করে যেটা সাজিয়েছিলাম, সে তো হারিয়েই গেলো। এখন এই আধখেঁচড়া গল্প রিভাইস করতে যাওয়া মানেই ভেতরের কান্নাকে বের করে আনা।

কম্পিউটার টেবিল ছেড়ে উঠে কোনমতে রেডি হয়ে দিলাম ছুট। অফিসে দেরী হয়ে যাচ্ছে। খাওয়ার সময় পেলাম না, চুলে চিরুণী বুলাতে পারলাম না, কিন্তু মুখে একরাশ তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে টুম্পাকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। একঘেয়ে চাকুরীর যন্ত্রণাকে আর যন্ত্রণা মনে হলো না, আমার চেহারা আসলেই খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে, আমার সহকর্মীরাও তা বলে। তবে ২৬ তারিখে আমাকে দেখে আমার সহকর্মীরাও অবাক হয়ে গেছে! অনেকদিন পর আমার শুকনোমুখে ওরা তৃপ্তির ছায়া দেখতে পেয়েছে, আর আমি খুঁজে পেয়েছি আবার ভালো করে বেঁচে থাকার গুপ্তিমন্ত্র!




পাটিসাপটার নতুন নাম 'পিষ্টা'


আমার মেয়ে মৌটুসীর বিয়ে হয়েছে এ বছরের জুন মাসে। বরের নাম মনীশ, নেপালের ছেলে, ভারতীয় অরিজিন, বাংলা বলতে পারেনা, কিন্তু ধীরলয়ে বলা বাংলাকথা বুঝতে পারে। মৌটুসী বাংলা, হিন্দী, ইংলিশ ভাষায় সমানভাবেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তবে, ওর বর যেহেতু হিন্দীভাষী, তাই ওদের মধ্যে হিন্দীতেই কথাবার্তা চলে।

সমস্যা হয়েছে আমাকে নিয়ে। আমি 'বাংলাকে ভালোবাসি' জেদের বশেই মনীশের সাথে বাংলায় কথা বলি। ছেলেটা এতো বেশী নমণীয় ও ভদ্র যে আমার এই ভাষার অত্যাচার হাসিমুখে মেনে নেয়।  মেনে নেয়া ছাড়া উপায়ও নেই, আমার মেয়ে আগেই ওকে সতর্ক করে দিয়েছে, " মামনি তোমাকে মাথায় তুলে রাখবে যদি তুমি বাংলায় কথা বলতে পারো"। সেই থেকে মনীশ আমার সাথে বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করে।  আমি ওকে ফোন করে বাংলায় প্রশ্ন করি,

-মনীশ, কেমন আছো?

-  মনীশ খুব সুন্দর করে বলে,
 " হ্যালো মাসী, আমি ভালো আছি, আপনি কেমন আছো?

-মনীশ, বলো, মাসী আপনি কেমন আছেন?
-মাসী, আপনি কেমন আছেন?
-আমি ভালো আছি। তুমি কী করছিলে?
-আমি ডিনার খাইছো
-বলো, আমি ডিনার খাচ্ছি।
হা হা হা! মাসী, আমি ডিনার খাচ্ছি।

এভাবেই চলে আমাদের মধ্যে ফোনালাপ। ফোনালাপ না করে উপায় নেই। ওরা থাকে আমাদের থেকে অনেক দূরে, ডালাসে। ফোনালাপ ছাড়া দেখা সাক্ষাৎ করার উপায় নেই। জুন মাসে ওদের বিয়ে হয়েছে, ক্রীসমাসের সময় ওরা আমাদের বাড়ীতে এসেছে, বিয়ের পর এই প্রথম আসা।  মনীশের ছুটির মেয়াদ ছিল মাত্র তিনদিন। এই তিনদিনে ওকে কী কী খাওয়ানো যায়, সেই ভাবনায় আমি অস্থির! কারণ, মনীশের মত আমারও একই অবস্থা। ছুটি নেই, প্রতিদিন ওয়ালমার্ট যেতে হয়। তারপরেও এরই ফাঁকে ফাঁকে কিছু কিছু রান্না করে এগিয়ে রেখেছিলাম।

মনীশ মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসে। আমার হাতে বানানো চমচম আর রসগোল্লার গল্প নাকি ও সারা দুনিয়াতে বলে বেড়িয়েছে। কাজেই আমি তো খুশী হবোই। এবার চিন্তা করেছি, ক্ষীরের পুর দিয়ে পাটিসাপটা পিঠে বানিয়ে খাওয়াব। যা ভাবা তাই করা। ওরা আসার আগেই দুধ ঘন করে ক্ষীর বানিয়ে রেখেছি। দেশ থেকে খেজুর গুড় এনেছিলাম, পিঠার গোলা বানাতে চেয়েছি খেজুর গুড়ের রসে। আগের রাতে বিশাল সাইজের একখানা গুড় জলে ভিজিয়ে রেখেছিলাম গলে যাওয়ার জন্য। সেদিন সন্ধ্যেবেলাতেই মনীশ আর মৌটুসী এসেছে। পরেরদিন আমাদের কিছু পারিবারিক বন্ধুকে দুপুরে খেতে ডেকেছি। পাটিসাপটা পিঠে  বানাবো, খেজুর গুড়ের পায়েস রেঁধেছি, সাথে থাকবে পাটিসাপটা পিঠে। মনীশের জন্য অতি উত্তম ডেজার্ট।

পরদিন সকালে তাড়াহুড়ো করে রান্না করতে গিয়ে একটা গন্ডগোল করে ফেলেছি। ডাল রান্না করবো বলে একটি সসপ্যান খুঁজছিলাম। যে প্যানে গুড় ভিজিয়েছিলাম, গুড় গলে গিয়ে জলটি কালচে বর্ণ ধারণ করেছিল। ডাল বসানোর চিন্তায় এতোটাই মগ্ন ছিলাম যে গুড়ের জলকে ভেবেছি, বেগুন ধোয়া নোংরা জল। প্যান কাত করে সমস্ত জল বেসিনে ঢেলে দিতেই তলানীতে গুড়ের গুঁড়ো দেখতে পেয়ে আমার " গেছে রে গেছে, আমার সব শেষ হয়ে গেছে' ধরণের অবস্থা। কিন্তু হাতের ঢিল ছুঁড়ে দিয়েছি, আর ফেরাবার উপায় নেই। আবার আরেকটি গুড়ের চাকা ভেজালাম। এবার হামানদিস্তায় গুড় ভেঙ্গে গুঁড়া করেছি।

দুপুরে নিমন্ত্রিত অতিথিদের সকলেই এসেছেন, খুব আড্ডা, গল্প চলেছে। বিকেল হতেই পিঠে ভাজা শুরু করলাম। আমন্ত্রিত অতিথিদের কেউই পিঠে খাওয়ার মুডে ছিল না। কারণ, এখানে সবাই এমন পিঠে পায়েস অহরহ বানায়। নতুন কিছু তো নয়। তবে মনীশের কাছে ব্যাপারটি নতুন। মনীশ খেয়েছে পিঠে। আগত অতিথিদের সাথে মনীশ বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করেছে, খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার, তবুও করেছে। আমাকে খুশী করার জন্যই এত কসরত। এক সময় আমি বললাম,

-মনীশ, আর কষ্ট করতে হবে না, তুমি হিন্দীতে বলো, আমি হিন্দী বুঝি, তুমিও বাংলা বুঝো, কাজেই আমরা যে যার ভাষাতেই কথা বলবো। মনে হলো, মনীশ আমার প্রস্তাবে রাজী নয়, সে বাংলাতেই কথা বলার চেষ্টা করে গেলো।

পরের দিন আমি জিজ্ঞেস করলাম,

মনীশ, কালকেই তো তুমি চলে যাচ্ছো, আমি কিছু স্পেশ্যাল খাবার বানিয়ে খাওয়াতে চাই। তুমি এমন একটি খাবারের নাম বলো, আমি বানাবো।

-মাসী, আর কিছু লাগবে না। আমি পুরানা হয়েছি। নতুন নেই। আমি ঠিক আছি। আপনি রেস্ট নাও।

-তুমি কখনও পুরানা হবে না। এখন আমাকে বলো, লাস্ট টু ডে'জে কোন খাবার তোমার পছন্দ হয়েছে!

-আচ্ছা, পিস্টা বেশী পছন্দ।

-পিস্টা কোনটা!

-ঐ যে মালাই আছে, ঐটা।

মৌটুসী এগিয়ে এলো, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে,  বরের কানে কানে বললো, পিস্টা না, পিস্টা না, পাটিসাপটা!

পাটিসাপটা পিঠার নাম 'পিস্টা' শুনে আমার এমন মজা লেগেছে, আমি বললাম,

-আজ থেকে আমার বাড়ীতে পাটিসাপটার নতুন নাম 'পিস্টা' ই থাকবে।

মনীশ বলে চলেছে, ওকে , পাটিসাপটা পিঠা খেতে চাই।

-না না, মনীশ, বলো, পিস্টা খেতে চাই।

সবাই মিলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। মনীশও হাসছে। আমি তো খুব খুশী। মনীশকে চমকে দিতে চেয়েছিলাম, ক্ষীরভরা পাটিসাপটা খাইয়ে। তা পেরেছি। রাতের বেলা আবার চালের গুঁড়ো, খেজুর গুড় ভিজিয়ে রেখেছিলাম। পরদিন সকালে মনীশ চলে যাবে। রাতের বেলা আমার ঘুম হয় নি। সারারাত জেগে গল্প লিখতে হয়েছে। একটি প্রতিযোগীতায় গল্পটি জমা দেবো, রাত সাড়ে তিনটায় গল্প লিখে শেষ করেছি, সেইভ করার বদলে ডিলিট করে দিয়েছি। আবার নতুন করে লেখা শুরু করেছি, ভোর পাঁচটা পর্যন্ত লিখে একটু ঘুমাতে গেছি, সকাল সাড়ে নয়টায় ঘুম ভাঙ্গতেই মনে পড়েছে, মনীশ চলে যাবে। 'পিস্টা' বানাতে হবে। দৌড়ে কিচেনে এসে দেখি চালের গুঁড়ার গোলা ফারমেন্টেড হয়ে গেছে, টক গন্ধ বের হয়েছে! কী করবো! হাতে সময় মাত্র আধ ঘন্টা। ছেলেটাকে 'পিস্টা' না খাওয়ায়ে পাঠাবো! আমার জেদ খুব বেশী। আবার গোলা তৈরী করলাম, তবে গুড়ের বদলে চিনি দিয়ে। ভাগ্যিস, ক্ষীরের ভান্ডার ছিল অফুরন্ত, ঝটপট কয়েকটা 'পিস্টা' বানিয়ে প্যাকেট করে মনীশের সাথে দিয়ে দিলাম।

পাটিসাপটা পিঠা আমার নিজের কাছেও খুব প্রিয়, কিন্তু এ কয়দিনে আমি একটাও চেখে দেখার সুযোগ পাই নি। কে বলে যে উড়তে গেলে দুই পাখা লাগে! আমার পাটিসাপটা পিঠা ডানা ছাড়াই উড়ে গেছে! আমার জন্য একটাও ছিল না। কী মনে করে যেনো আমার কাছে বেড়াতে আসা ছোট বোন টুম্পা দুইটা পিঠা প্যাকেটে ভরে ফ্রীজে রেখে দিয়েছিল। আজ আমি যখন বলছিলাম,

-পিস্টাটা মনে হয় খুব ভালো হয়েছিল, বেশী থাকলে আমি একটা খেতে পারতাম।
 টুম্পা জানালো, দুইটা পিঠা সে তুলে রেখেছে। তার থেকে একটা আমি খেয়েছি, আরেকটি খেয়েছে মিশা। খেয়ে বুঝলাম, পিস্টা খেতে খুবই ভালো হয়েছিল। মনীশও আমাকে টেক্সট পাঠিয়েছে, " মাসী, পিসটা খুব ভাল হইছে। অনেক ধন্যবাদ"। খুশী না হয়ে আমার উপায় আছে!

Monday, December 24, 2012

“হো হো হো!! আই উইশ ইউ মেরী ক্রিসমাস”!!!



আজ ২৫শে ডিসেম্বার, যীশুখৃষ্টের জন্মদিন। পৃথিবীর সর্বত্র মহা আড়ম্বরে পালিত হচ্ছে ক্রীসমাস উৎসব, বাংলায় যা ‘বড়দিন উৎসব’ হিসেবে পরিচিত। ক্রীসমাস মানেই যীশুখৃষ্ট, ক্রীসমাস মানেই লাল- সবুজ, ক্রীসমাস মানেই ক্রীসমাস ট্রি, ক্রীসমাস মানেই স্যান্টা ক্লজ, ক্রীসমাস মানেই উপহার সামগ্রী, ক্রীসমাস মানেই সুস্বাদু কেক, ক্রীসমাস মানেই চকোলেট, ক্যান্ডী এবং ক্রীসমাসের ছুটি। ক্রীসমাস সীজন শুরু হতেই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষা নিয়ে টানাপোড়েন থাকেনা, থাকে পক্ষকালব্যাপী ছুটির আমেজ। নভেম্বারের থ্যাঙ্কস গিভিং পর্ব শেষ হতে না হতেই শুরু হয়ে যায় ক্রীসমাসের জন্য রেডী হওয়া, ঘরে-বাইরে, হাটে-বাজারে সর্বত্র হৈ হৈ রৈ রৈ চলতেই থাকে। কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়। বিপণী বিতান গুলো এই একটি সীজনেই রোজগার করে নেয় সারা বছরের উপার্জন যা দেশীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক সাফল্য নিয়ে আসে। অর্থনীতির সূচক উপরের দিকে উঠতে থাকে।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর মত গত একমাস ধরে আমেরিকার সর্বত্র দেখা যাচ্ছে শুধুই লাল আর সবুজের সমাহার। আমেরিকানদের ঘরে তো বটেই, স্কুল, কলেজ, দোকান-পাট সর্বত্রই বিশাল সাইজের ক্রীসমাস ট্রী সাজিয়ে রাখা হয়েছে, এবং তা সাজানো থাকবে নতুন বছর ২০১৩ আসা পর্যন্ত। সবুজ ক্রীসমাস ট্রির সাথে আছে টকটকে লাল রিবনে তৈরী বো, অথবা স্যান্টা ক্লজের লাল স্টকিংস, অথবা স্যান্টার মাথার লাল টুপী। এছাড়া রাস্তাঘাট সাজানো হয়েছে ছোট ছোট টুনী লাইট দিয়ে। টুনী লাইট দিয়ে ক্রীসমাস ট্রী, অথবা স্যান্টাক্লজের আদল বানানো হয়েছে, এমন কী  স্যান্টার সাথে আসা রেইন ডিয়ার, ছোট ছোট এঞ্জেলও সাজানো হয়েছে। তবে যা কিছুই করা হোক না কেনো, লাল আর সবুজের ভেতরেই সব হচ্ছে। ক্রীসমাসকে ঘিরে লাল ও সবুজ রঙের একটি বিশেষ তাৎপর্য্য আছে। লাল রঙ যীশুর পবিত্র রক্তের প্রতীক যা যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার পর দেহ থেকে বেরিয়ে এসেছিল, আর সবুজ হচ্ছে চির সবুজের প্রতীক, যেমন চিরচেনা ক্রীসমাস ট্রী, চির সবুজ গাছ, যার পাতা শীতেও ঝরে পড়ে না।
বিপনি বিতানগুলোতে ক্রীসমাস ট্রী শুধু সবুজই হয় না, এদেশে সাদা বা লাল ক্রীসমাস ট্রীও সমান জনপ্রিয়। তবে বেশীর ভাগ আমেরিকানদের কাছে সবুজ এর উপর আর কথা নেই। যদিও যীশুর জন্মের সাথে ক্রীসমাস ট্রী’র কোনই যোগসূত্র নেই, তবুও ইতিহাসের হাত ধরে কীভাবে যেন ক্রীসমাস ট্রী পৃথিবীর সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।

খৃষ্টধর্ম প্রচারিত হওয়ার পূর্বে, ‘পেগান’ জনগোষ্ঠির অধিকাংশই ছিল প্রকৃতির পূজারী। গাছ-পালা, লতা-পাতা, সব কিছুর মাঝেই তারা ঈশ্বরকে দেখতে পেতো। খৃষ্ট ধর্ম প্রচারিত হওয়ার কালে, পেগানদের অধিকাংশই খৃষ্ট ধর্মের অনুসারী হয়ে যায়। তারাই সর্বপ্রথম ক্রীসমাস ট্রি’র তিনকোনা আকৃতিতে স্বর্গমুখী রূপ খুঁজে পায়। অর্থাৎ ত্রিকোন ক্রীসমাস ট্রি’র সরু ও তীক্ষ্ম শীর্ষদেশ আকাশমুখী হয়ে স্বর্গের অবস্থান (ট্রিনিটি) নিশ্চিত করে, যেখানে ঈশ্বর, ঈশ্বর পুত্র (যীশু খ্রীষ্ট) এবং পবিত্র আত্মারা বাস করেন। সেই থেকেই ক্রীসমাস বা যীশু খৃষ্টের জন্মোৎসবের সাথে ক্রীসমাস ট্রী’ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ক্রীসমাস ট্রি ব্যবহারের রেওয়াজ প্রচলিত ছিল জার্মানীতে, পরবর্তিতে বৃটেনের তৃতীয় জর্জের স্ত্রী, কুইন শার্লট ১৮৩৫ সাল থেকে সমগ্র বৃটেনে ক্রীসমাস উৎসবের সময় ক্রীসমাস ট্রি সাজানোর রীতি চালু করেন। ১৮৪১ সালের দিকে ক্রীসমাস ট্রি ব্যবহার আরও বেশী জনপ্রিয় হতে থাকে এবং ১৮৭০ সাল থেকে আমেরিকাতেও শুরু হয় ক্রিসমাস ট্রি’র ব্যবহার। আমেরিকানরা বরাবর হুজুগপ্রিয়, যখন যা ভালো লাগবে, সেটাতেই মজে যাবে। এই ক্রীসমাস ট্রি কালচার আমেরিকাতে প্রবেশের সাথে সাথেই জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ক্রীসমাস ট্রি নানা অর্নামেন্ট, লাইট দিয়ে মাসব্যাপী সাজিয়ে রাখা তেমনই একটি জনপ্রিয় ব্যাপার। গাছগুলো সাজানো হয়, চমৎকার করে। গাছের গায়ে ঝুলিয়ে দেয়া হয় ছোট ছোট সুদৃশ্য ঘন্টা, স্যান্টা ক্লজের এক জোড়া মোজা, স্যান্টার মাথার টুপী, হাতের দস্তানা, ক্যান্ডি কেইনসহ আরও কত কিছু।
ক্রীসমাস ট্রি ছাড়া ক্রীসমাস উৎসবের সবচেয়ে বড় আইকন হচ্ছে স্যান্টা ক্লজ। স্যান্টা ক্লজ বলতে ছোট ছোট শিশুরা অজ্ঞান। তারা মনে করে, স্যান্টা ক্লজ বাচ্চাদের পরম বন্ধু, স্যান্টা ক্লজ খুব দয়ালু। 

ক্রীসমাসের সময় সুদূর উত্তর মেরু থেকে স্যান্টা বুড়ো তার পিঠে বাচ্চাদের জন্য উপহারের বোঝা নিয়ে আসে, প্রতি বাড়ী বাড়ী যায়, সে বাড়ীর বাচ্চাটির জন্য উপহারটি রেখে দিয়ে চলে যায়। কোথায় যায় স্যান্টা? স্যান্টা কোথাও থামেনা, পৃথিবীর যত শিশু আছে, তাদের প্রত্যেকের কথা স্যান্টা জানে। কাজেই স্যান্টাকে দৌড়ের উপর থাকতে হয়। তবে ভাগ্য ভালো, স্যান্টা আসে শ্লেজ গাড়ীতে চড়ে। নয়টি রেইন ডিয়ার চালায় স্যান্টার শ্লেজ। তাই ভারী শরীরখানা নিয়ে স্যান্টাকে হাঁটতে হয় না। স্যান্টা এত মোটা কেনো? এ প্রশ্ন যে কোন বাচ্চাকে করা হলে, খুব সহজে উত্তর দেয়, সবার বাড়ীতে গিয়ে স্যান্টাকে ‘দুধ আর কুকী’ খেতেই হয়, তাই স্যান্টা অমন মোটা হয়ে গেছে। শিশু মনের আধুনিক উত্তর।


ক্রীসমাসের মূল আনন্দ হয় ক্রীসমাসের আগের সন্ধ্যায়, ২৪শে ডিসেম্বার, যা ক্রীসমাস ইভ’ নামে পরিচিত। খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীরা তাদের জন্য নির্ধারিত চার্চে যায়, সেখানে ধর্মীয় সঙ্গীত হয় (কেরল, গসপেল), প্রার্থণা সভা হয়, সবার সাথে সবার দেখা সাক্ষাৎ হয়। চার্চে ফিস্ট হতে পারে, যার যার বাড়ীতেও উৎসবের ভোজ আয়োজন হয়ে থাকে। খাবারের মেন্যু যার যার দেশীয় রীতিতে হয়ে থাকে। যেমন ‘সিসিলি’ তে ক্রীসমাস ইভ’ পার্টিতে বারো রকমের মাছ খাওয়া হয়। ইংল্যান্ড, জার্মানী, ফ্রান্স,অস্ট্রিয়া বা আমেরিকাতে খাওয়া হয়, টার্কী অথবা হাঁস, পর্ক এবং বীফ, গ্রেভী, আলু, সব্জী এবং ব্রেড, ডেজার্টে দেয়া হয় ফ্রুট কেক, ক্রীসমাস পুডিংসহ আরও অনেক কিছু। ক্রীসমাস ডে’তে সকলেই থাকে হ্যাপী মুডে, ছুটির আমেজে। ভোর সকালেই বাচ্চারা ঘুম থেকে জেগে, এক দৌড়ে ছুটে যায় ক্রীসমাস ট্রীর নীচে। সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করে, স্যান্টা ক্লজের রেখে যাওয়া রকমারী উপহারের রঙ বেরঙের প্যাকেট। চোখে লেগে থাকা ঘুম উবে যায়, যত দ্রুত সম্ভব প্যাকেট খোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শিশুরা শুধু উপহার পেয়েই বসে থাকেনা, স্যান্টা এসেছিল কি না, তা পরখ করে দেখার জন্য কিচেনে গিয়ে ঢুকে। সেখানে আগের রাতে রেখে দেয়া দুধের গ্লাস এবং কুকীর প্লেট পরখ করে দেখে, দুধশূণ্য গ্লাস আর কুকীশূণ্য প্লেট দেখে তারা আনন্দে নেচে উঠে। যার সাথে দেখা হয়, তাকেই ডেকে বলে, স্যান্টা তার বারীতে এসেছিল! ( ওদের কেউ কেউ হয়তোবা আন্দাজ করে, ড্যাডি বা মাম্মি দুধ ও কুকী খেয়েছে, তবুও ওরা মুখে তা স্বীকার করে না)।এরপর সারাদিনই চলে খানাপিনা আর স্যান্টার কাছ থেকে পাওয়া উপহার নিয়ে মাতামাতি।

শুরুতে ক্রীসমাস শুধুমাত্র খৃষ্টান ধর্মাবলম্বরা পালন করতো। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও ক্রীসমাসের আনন্দ উদযাপনে শরীক হয়। স্যান্টা ক্লজও তার ভুবনজয়ী ‘হো’ হো’ হো’ হাসি ছড়িয়ে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত চষে বেড়ায়। ধর্ম-বর্ণ, জাতি, গোত্র নির্বিশেষে সব বাড়ীর চিমনি বেয়ে রান্নাঘরে ঢুকে, ক্রীসমাস ট্রির নীচে বাড়ীর বাচ্চাদের জন্য গিফট রেখে, তার জন্য সাজিয়ে রাখা দুধের গ্লাস এক চুমুকে সাবাড় করে দিয়েই আবার চিমনি দিয়ে বের হয়ে যায়। এভাবেই কোমলমতি শিশুদের মনে স্যান্টা উদারতা, মমতা, পরমত সহিষ্ণুতা, ভদ্রতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সকলকে ভালোবাসার মন্ত্রবীজ দিয়ে যায়।

২০১২ সালের ক্রীসমাস ইভে স্যান্টা নিশ্চয়ই আবারও সকলের বাড়ী ঘুরে ঘুরে শিশুদের মাথায় তাঁর স্নেহস্পর্শ বুলিয়ে গেছে। স্যান্টা নিশচয়ই প্যালেস্টাইন থেকে শুরু করে কানেকটিকাট, কানেকটিকাট ঘুরে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান, ভারত সর্বত্রই চষে বেড়িয়েছে আর সকল সুখী ও দুঃখী শিশুর কানে কানে ভালোবাসা, আদর, মমতার মন্ত্র শুনিয়ে গেছে। মন্ত্র শুনিয়ে গেছে নতুন বছরের, মন্ত্র শুনিয়েছে নতুন জীবনের, মন্ত্র শুনিয়েছে ভালোবাসার, মন্ত্র শুনিয়েছে আনন্দের। স্যান্ট ক্লজ নিশ্চয়ই তার ভুবনজয়ী ‘হো’ হো’ ‘হো’ হাসির সাথেই বলে গেছে,
আই উইশ ইউ মেরী ক্রীসমাস, উই উইশ ইউ মেরী ক্রীসমাস!!! 

Wednesday, December 19, 2012

ফোনালাপ, বোনালাপ!

হ্যালো, ফুলদিভাই! কেমুন আছ?
-ভাল আছি, তোরে না কইছি, আমি যখন কাজে থাকি, আমারে ফোন করবি না।
-তুমি ত সারাক্ষণই কাজে থাক, যখনই ফোন করি, ফোন ধরো না। এইটা কেমুন কথা। তোমার ওয়ালমার্ট কি তোমারে এতটুক স্বাধীনতাও দেয় না?

-চুপ থাক, আমি ত তোর মত চেয়ার টেবিলে বইসা অফিসারের চাকরী করি না। খাইট্টা খাই, ওয়ালমার্ট কী আমার মামা লাগে যে স্বাধীনতা দিব!  কি কইতে চাস, কইয়া ফ্যাল।

-আগে কও, তোমার কথা শোনার টাইম আছে কিনা!
-দরকারী কথা থাকলে শুনমু, আজাইরা প্যাচাল পারলে ফোন লাইন ঘচ কইরা দিমু।
-আমার প্লেনের টিকিট কাটা অইছে।
-গুড নিউজ। কবে আইবি?
-২৫ তারিখে।

-২৫ তারিখে কী রঙ দেখাইতে আইবি? আমার কী আগে পরে ছুটি আছে? এই একটা দিনই ছুটি পাইছি, তাও আইবি তুই ২৫ তারিখ বিকালে। আমারে এক সন্ধ্যা পাইবি।

-ফুলদিভাই, এইটা কেমুন কথা? আমি ২৫ তারিখে টিকিট অনেক সস্তা পাইছি, আগে কিনলে অনেক বেশী দাম দিয়া কিনতে অইব। তুমি কী দিবা আমার প্লেনের ভাড়া?

-আমার মত সাধারণ এক শ্রমিকের কাছে প্লেনের ভাড়া চাস, লজ্জাও করলো না?

-না লজ্জা করে না, তুমি শ্রমিকের কাজ করো ক্যান? তোমার কী ডিগ্রী কিছু কম আছে?

-কী আর করা, শত ডিগ্রী থাকলেও আমার শ্রমিকের কাজই ভাল লাগে। তোরা তো বাড়ীর ভিতরেও দেখস একই মুখ, অফিসে গিয়া টেবিল চেয়ারে বইসা দেখস একই মুখ। আমি ত ওয়ালমার্টে গিয়া পুরা মিসিসিপির মানুষ গো ক্যারিকেচার দেখি। বিশেষ কইরা কাইল্লাগুলির ক্যারিকেচার দেখতে দারুণ লাগে।

-এইজন্যই তোমারে তোমার মাইয়ারা 'রেসিস্ট' ডাকে।

-ডাকুক, আমি রেসিস্ট আছি, ভালো আছি। এখন তাড়াতাড়ি কইয়া ফেলেন, কি বলতে চান।
-ফুলদিভাই,  তোমার বাসায় গেলে আমারে কী খাওয়াইবা?
-কী খাইতে ইচ্ছা করে লিস্ট বানাইয়া আমারে দিস।
-লিস্ট বানান লাগতো না, আমারে বিরানী খাওয়াইবা।
-আইচ্ছা, বিরাণী খাওয়ামু, আর কি?
-মুরগীর রোস্ট। বাংলাদেশের বিয়া বাড়ীর মত।
-ঠিক আছে। আর কী?
-অহন মনে করতে পারতাছি না। তবে বিরাণী কিন্তু তিন বেলা খামু।
-ঠিক আছে, মাঝরাতে ঘুম ভাইঙ্গাও খাইতে পারবি। মাত্র এই দুইটা জিনিস?

-না, আমার অনেক কিছু খাইতে ইচ্ছা করে। তোমার হাতের রান্ধা খামু। আমারে স্বাস্থ্যটা ভাল কইরা দিবা।

-তোর স্বাস্থ্য ভালো করনের দরকার নাই, তোর মত স্লীম ফিগারের মেয়ের আমেরিকায় বহুত দাম। মিসিসিপিতে মোটকা মোটকা মানুষ দেখতে দেখতে আমার চোখ মাছের চউখের মত হইয়া গেছে।

-মাছের চউখ মানে!

-এইটাও বুঝস না! মাছের চউখের পাতা পড়ে না, মানে চক্ষুস্থির হইয়া গেছে।
-হা হা হা হা হা ফুলদিভাই,  তুমি একটা জিনিস বটে! আমি আইলে পরে আমরা  সবাই মিল্লা রাত জাইগা গল্প করুম। তোমার উত্তরার বাসায় থাকতে যেমনে আড্ডা দিতাম।
-আমি তো এখন আর রাত জাইগা আড্ডা দেই না। লেখালেখি করি।

-ওহো, তুমি ত আবার লেখিকা হইয়া গেছ।  যন্ত্রণা অইছে। বুড়া বয়সে ভিমরতী ধরছে তোমারে।  ঠিক আছে যাও, লেখালেখির ফাঁকেই নাহয় একটু সময় দিলা!

-তোরে যে আমার উপন্যাসের স্ক্রিপ্ট পাঠাইছি, সেইটার খবর কি?
-আমি একটু একটু কইরা পড়ি আর মার্ক কইরা রাখি।
-হাসাহাসি করছ না তো? হাসবিনা কিন্তু। মেজদাইয় কইছে, ভাষাতে এখনও দুধভাত গন্ধ আছে।

-ফুলদিভাই, ভাষা নিয়া আমার কোন মাথাব্যথা নাই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজে একটা লেখায় লিখছে, তাঁর প্রথম দিকের লেখা পড়লে নাকি তাঁর এখন হাসি পায়। তোমার প্রথম উপন্যাস একটু দুর্বল হইতেই পারে, লেখতে লেখতে সবল হইবা। আশাপূর্ণা দেবীরে ফেল ফালাইবা।

-ফাইজলামি করছ? যাহ! বিরাণী, চিকেন রোস্ট বাদ।

-ফুলদিভাই, ফাইজলামী করলেও কথা সত্য কইছি। তুমি অনেক ভাল লেখক হইবা, অলরেডী লেখক হইয়া গেছ। বিরাণী আর রোস্ট না খাওয়াইলে খুব খারাপ অইয়া যাইব।

-আইচ্ছা মাফ কইরা দিলাম। আমার লেখাটা ভাল কইরা সমালোচনা কইরা দিস। আরেকটা কথা, বাসাবাড়ী অগোছালো হইয়া রইছে। লেখিকার বাড়ী যেমন থাকে। তুই গুছাইয়া দিয়া যাইস।

-ফুলদিভাই, আমি আইতাছি রেস্ট নিতে, আর তুমি আমারে দিয়া এত কাজ করাইবা?
-বইন শোন, একজন অসহায় নারীকে আলোকিত জীবনের সন্ধান দিতে সাহায্য করতেছস, এইটাত একটা মহৎ কাজ।

-কী কইলা, তুমি অসহায় নারী? তুমি যদি অসহায় নারী হও, দজ্জাল নারী তাইলে-----
-থামলি ক্যান? কথা শেষ কর। আমি দজ্জাল?

-আরে নাহ! অন্য কথা কইতে চাইছিলাম। ম্যানেজার ডাক পাঠাইছে। পরে আবার কথা কমু। ভালো থাইকো।
-ঠিক আছে, যাহ, ম্যানেজারের হুকুম পালন কইরা আয়।দজ্জাল কইয়া থাইমা গেছস, এই দজ্জালের থিকা আবার কথা শুরু অইব। তোর খবর আছে দাঁড়া।

২১শে ডিসেম্বার, শুক্রবার, পৃথিবী কী ধ্বংস হয়ে যাবে!!



আগামী ২১শে ডিসেম্বার, শুক্রবার, যে কোন মুহূর্তে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে! অবিশ্বাস্য মনে হলেও, মায়ান ক্যালেন্ডারে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা দিন, তারিখসহ উল্লেখ করা আছে। এবং পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মায়ান ভবিষ্যতবাণীকে বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদরাও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছেনা। কারণ বলা হয়ে থাকে, মায়ান ক্যালেন্ডারে উল্লেখিত ভবিষ্যত বাণীর সত্যতার প্রমান এর আগেও পাওয়া গেছে! যেমন, অনেকেই বিশ্বাস করে, মায়ান ক্যালেন্ডারে ‘সুনামী’র কথা উল্লেখিত ছিল, আরও স্পষ্টভাবে উল্লেখিত ছিল ৯/১১ এ টুইন টাওয়ার ধ্বংসের কথা। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের কথা যেভাবে উল্লেখ করা আছে, তার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, “ ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বার আকাশ হতে বিশাল বড় দুই পাখী এসে আমেরিকার উত্তর অংশের একটি শহরের উপর আছড়ে পড়বে, প্রচুর হতাহতের ঘটনা ঘটবে”। প্রাচীন মায়া সভ্যতার নিদর্শন, ‘মায়ান ক্যালেন্ডারে’র হিসেব শেষ হয়ে যাচ্ছে ২১শে ডিসেম্বার, ২০১২। ক্যালেন্ডারে ২১শে ডিসেম্বারের পরে আর কিছু নেই। ক্যালেন্ডার ওখানেই সমাপ্ত। মায়া সভ্যতায় বিশ্বাসীদের ধারণা, মায়ান ক্যালেন্ডার যেখানে শেষ হয়েছে, পৃথিবীও ওখানেই শেষ হয়ে যাবে।
  
মায়ান ক্যালেন্ডার কিঃ
মায়ান ক্যালেন্ডার শব্দটি এসেছে মায়া সভ্যতা থেকে। বর্তমান মেক্সিকো, বেলিজ থেকেমায়া’ সভ্যতার উৎপত্তি, প্রাচীন মেসোআমেরিকান মায়া সভ্যতার কথা কম বেশী সকলেই জানে।, যার শুরু খৃষ্টপূর্ব ২০০০ সালেরও অনেক আগে থেকে। মায়ান যুগের মানুষ গণিতশাস্ত্র, স্থাপত্যকলা, চিত্রকলা, জ্যোতির্বিদ্যায় ছিল মহা পারদর্শী। গণিতে ‘জিরো’র হিসেব মায়ান সভ্যতা থেকেই এসেছে। মায়ান গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিদগন ভবিষ্যতে পৃথিবীতে কী কী ঘটবে, সেই সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে তৈরী করেছিলেন ক্যালেন্ডার, যা মায়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। ধারণা করা হয়, মায়ান ক্যালেন্ডার তৈরী হয়েছিল নির্ভুল গননা অনুসারে, ক্যালেন্ডারে বর্ণিত ভবিষ্যতবাণী বিশ্বাস করে, পৃথিবীতে এমন মানুষের সংখ্যা প্রচুর। অনেকের মতে, এই ক্যালেন্ডারে কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া সুনামি’র উল্লেখ আছে, ৯/১১ এর টুইন টাওয়ার ধ্বংসের কথাও আছে। কাজেই অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে ক্যালেন্ডারে উল্লেখিত ভবিষ্যত বাণী অনুযায়ী, ২১শে ডিসেম্বার ভয়ানক কিছু ঘটতে যাচ্ছে।

কী ঘটতে পারে ২১শে ডিসেম্বারঃ
চারদিকে গুঞ্জণ শোনা যাচ্ছে, ২১ তারিখে ভয়ানক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। কী ঘটতে যাচ্ছে, অথবা আদৌ কিছু ঘটতে যাচ্ছে কিনা, সেই সম্পর্কে কেউ কিছু জানেনা। কেউ কেউ ভাবছে, সেদিন ভুমিকম্প হবে, অথবা গ্যালাক্সীতে এমন কিছু উলট-পালট হবে যে পৃথিবীর প্রাণীকূলের মাথা খারাপ হয়ে যাবে, একজন আরেকজনের প্রতি মারমুখী হয়ে উঠতে পারে, পারস্পরিক হানাহানি হতে পারে। এলিয়েন আসতে পারে, এলিয়েনের ভয়ানক থাবার আঘাতে অনেকের মৃত্যু ঘটতে পারে। এমনও হতে পারে, জুম্বি ( জীবন্ত মৃত মানুষ) এসে আক্রমন করতে পারে। যৌক্তিক গল্পের পাশাপাশি অতিরঞ্জিত গল্প তৈরীতে সাধারণ আমেরিকানদের জুড়ি নেই। নানা ধরণের আজগুবি গল্পের কারণেই সকলের মধ্যে একই সাথে আশংকা ও কৌতুহল কাজ করছে। ভয়ংকর কিছু যদি ঘটে, তা ঠিক কোন মুহূর্তে ঘটবে, সে সম্পর্কে কারোর মনেই কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। অনেকের মতে, ভয়াবহ সুনামি হতে পারে, ভয়ানক ঘূর্ণিঝড় বা টর্নেডো, ভুমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতও হতে পারে। কেউ কেউ মনে করে, ভিন গ্রহ থেকে এলিয়েন আসবে, ধ্বংসলীলা চালাবে পৃথিবীব্যাপী। এমনও হতে পারে, পৃথিবী, বিভিন্ন গ্রহ এবং সূর্য, একই লাইনে চলে আসবে, শুরু হবে ভয়ংকর প্রাকৃতিক তান্ডবলীলা, অথবা সূর্য চলে যাবে ব্ল্যাক হোলের আড়ালে, পৃথিবী ঢেকে যাবে ঘন আঁধারে! এই ধরণের নানা রকম কাল্পনিক আশংকা নিয়ে সকলে অপেক্ষা করছে আসন্ন ‘পৃথিবী শেষ’ মুহূর্তটির জন্য। তবে শুকনো মুখে সর্বনাশের অপেক্ষায় থাকার মত মানসিকতা আমেরিকানদের মধ্যে নেই। শেষ মুহূর্তটিও উপভোগ করার নীতিতে বিশ্বাসী সাধারণ আমেরিকানরা সাত দিন আগে থেকেই মজুত করতে শুরু করবে খাবার দাবার, কোল্ড ড্রিঙ্কস, শুকনো খাবার, পানি, হার্ড ড্রিঙ্ক, মোমবাতি, টর্চসহ আরও আবশ্যকীয়, অনাবশ্যকীয় জিনিসপত্র।

যারা অনেক বেশী যুক্তিবাদী, হুজুগে মেতে উঠেনা, তাদের মধ্যেও অনেকের ধারণা, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মত ভয়ানক কিছু না ঘটলেও, নানা কারণেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় হতেই পারে। তাই যে কোন ধরণের খারাপ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আগাম প্রস্তুতি থাকা ভাল। তাদের মতে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে হিসেব অনুযায়ী জরুরী ভিত্তিতে পাণীয়, শুকনো খাবার, ফার্স্ট এইড, ইমার্জেন্সী লাইটের ব্যবস্থা রাখা উচিত।

তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আসন্ন ২১শে ডিসেম্বার নিয়ে দূর্ভাবনা নেই, বরং তারা ‘বিদায় পৃথিবী’ উৎসব আয়োজনের চিন্তা করছে। আমেরিকার জনগন হুজুগপ্রিয়। যেহেতু ২১শে ডিসেম্বার পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়া নিয়ে হাস্যকর অথবা অস্বস্তিকর রব উঠেছে, তাই পার্টি পাগল আমেরিকানদের মাথায় ‘ বিদায় পৃথিবী’ পার্টি আমেজ চলে এসেছে। তরুণ-তরুণীরা এখন থেকেই নানা ছুতোয় পার্টি করে চলেছে, এবার ক্রীসমাস পার্টি হবে কি না, তা বুঝা যাবে ২১ তারিখের পরে। কাজেই ২১ তারিখে যদি পৃথিবী ধ্বংসই হয়ে যায়, ২০ তারিখে ‘বিদায় পৃথিবী’ বা ‘শেষ পৃথিবী’ নাম দিয়ে ইচ্ছেমত আনন্দ ফূর্তি করতে বাধা কোথায়। বিভিন্ন স্টোরগুলোতে ২১শে ডিসেম্বার সামনে রেখে নানা রকম বিনোদন উপকরণের সামগ্রী বিক্রী শুরু হয়েছে।

একটা বিষয় পরিষ্কার হচ্ছেনা, মায়ান ক্যালেন্ডারে কি শুধুই আমেরিকার ভুত-ভবিষ্যতের  কথা লেখা আছে, নাকি বাংলাদেশের কথাও লেখা আছে? মায়ান ক্যালেন্ডারে যদি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কথা লেখা না হয়ে থাকে, তাহলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সাথে নিশ্চয়ই বাংলাদেশের কোন যোগসূত্র নেই, বাংলাদেশ অবশ্যই ধ্বংসযজ্ঞের আওতামুক্ত থাকবে। ডিসেম্বার মাস বাংলাদেশের বহু আদরের-বহু আকাংক্ষার ‘বিজয়ের মাস’। আমেরিকাবাসী যখন আসন্ন ‘শেষ পৃথিবী’ পার্টি করবে, বাংলাদেশের জনগনের ততদিনে ‘বিজয় দিবসের’ পার্টি বা আনন্দানুষ্ঠান উদযাপন করা হয়ে গেছে!




আপাততঃ পৃথিবী ধ্বংস হচ্ছেনা!

২১শে ডিসেম্বার কী পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে? কঠিন পাথরের চাঁই ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়বে? ভূমি ফেটে চৌচির হয়ে যাবে? ধরণী দুই ভাগ হয়ে যাবে? সমুদ্রের জল ডাঙ্গায় উঠে আসবে? সম্ভবত এগুলোর কোনটাই হচ্ছে না। মায়ান ক্যালেন্ডারে কী বলা আছে? মায়ান ক্যালেন্ডারে কী উল্লেখ করা হয়েছে যে ২১শে ডিসেম্বার পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে! না, মায়ান ক্যালেন্ডারে আক্ষরিক অর্থে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার কথা কোথাও উল্লেখ করা হয় নি। যদিও মায়ান ক্যালেন্ডারের গ্রহণযোগ্যতা অনেক, কারন খৃষ্টপূর্ব ২০০০ বছর আগে ‘মায়া’ সভ্যতার শুরু। মায়া সভ্যতার সময়কালীন মায়ান জনগন গণিতবিশারদ ছিলেন। তাঁদের নির্ভুল হিসেব ও গননা অনুযায়ী মায়ান ক্যালেন্ডার তৈরী হয়েছিল। ৫,২০০ বছরের আগাম গণনা করা আছে এই ক্যালেন্ডারে, যা শেষ হতে চলেছে ২০১২ সালের ২১শে ডিসেম্বার। অর্থাৎ মায়ান ক্যালেন্ডারের পাতা ফুরিয়ে গেছে, ২১ ডিসেম্বার মায়ান ক্যালেন্ডার শেষ হয়ে যাচ্ছে, অথচ মায়ান ক্যালেন্ডার বিশ্বাসীগন এটাকেই পৃথিবী ধ্বংসের দিন অথবা ‘ডুম ডে’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রকৃতপক্ষে ক্যালেন্ডারের পাতা শেষ হওয়ার সাথে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কোন সম্পর্ক নেই।

তবুও এবং তারপরেও অনেকের মনে এখনও সন্দেহ এবং ভয় বাসা বেঁধেছে। তারা বাস করছে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে। পৃথিবী জুড়ে এমনিতেই নানা অশান্তি, চারিদিকে যুদ্ধ বিগ্রহের হুমকী ধামকী শোনা যায়, আবহাওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তণ, ক্রমান্বয়ে আবহাওয়া শুষ্ক হয়ে উঠেছে, বৃষ্টির অভাব, অকালে বন্যা, সুনামী, ভুমিকম্পতো লেগেই আছে। এই সকল দূর্যোগের পরিনতিও ভয়াবহই। মায়ান ক্যালেন্ডারের হিসেব অনুযায়ী ২১শে ডিসেম্বার না হলেও অচিরেই সারা পৃথিবীব্যাপী  হাহাকার শুরু হবে। মানব সভ্যতার অতি আধুনিক ক্রমবিকাশের সাথে সাথে পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিউ ইয়র্কের আকাশরেখা অনেক কালো হয়ে এসেছে, হারিকেন স্যান্ডির দাপটে নিউইয়র্কের মত বিশাল সিটির জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে, হ্যালুইনের সন্ধ্যায় নিউইয়র্কসহ আশেপাশের আরও শহরে নেমে আসে ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা। বৈজ্ঞানিকগন আশংকা করছেন, বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা যে আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা মানব সভ্যতার হুমকীস্বরূপ। তাহলেই কী পৃথিবী হঠাৎ করে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে? নাসা বিজ্ঞানীদের মতে, এখনই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে না।  তাঁরা মায়ান ক্যালেন্ডার এবং ক্যালেন্ডারে বর্ণিত পৃথিবী ধ্বংসের ব্যাপারটিকে হেসে উড়িয়ে দিচ্ছেন।
তারা তাঁদের বক্তব্য মায়ান অনুসারীদের ‘পৃথিবী ধ্বংস’ তত্ত্বের বিপক্ষে নিজেদের নানা যুক্তি, তত্ত্ব ও তথ্যসহ পরিবেশনের মাধ্যমে আমাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে দুই চারটি যুক্তি পড়লেই সকলের চিন্তা চেতনা থেকে অমূলক ভয় কেটে যাবে।

প্ল্যানেট নিবিরু

মায়ান বিশ্বাসীদের ধারণা, অতি খারাপ প্ল্যানেট ‘নিবিরু’ নেমে আসবে পৃথিবীর বুকে, এবং পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষ বাঁধবে। এই সংঘর্ষ ২০০৩ সালে হওয়ার কথা ছিল, হয়নি, তা বলাই বাহুল্য। প্রকৃতপক্ষে নাসা বিজ্ঞাণীরা ‘নিবিরু’র অস্ত্বিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাল্পনিক ‘নিবিরু’ প্ল্যানেটের কোন অস্তিত্ব মহাকাশ বিজ্ঞাণীরা এখনও পান নি।

কসমিক এলাইনমেন্ট
অনেকের ধারণা, ২১শে ডিসেম্বারেই সৌর মন্ডলীর সকল গ্রহ, উপগ্রহ হঠাত করে এক লাইনে চলে আসবে, যার প্রভাবে পৃথিবীতে আমূল পরিবর্তণ হবে। কারো কারো মতে, এই দিনে সূর্য্য সৌরমন্ডলীর সমতলে চলে আসবে। কিন্তু বিজ্ঞাণীরা বলেছেন, সূর্য্য অবশ্যই গ্যালাক্সীকে অতিক্রম করবে, তবে তা করতে ৬৭ আলোক বর্ষ লেগে যাবে, যা কিনা কয়েক মিলিয়ন বছরের সমতুল্য।

সৌর ঝড়
ডুম’ডে বিশ্বাসীদের মতে, ২১শে ডিসেম্বার সৌর ঝড় হতে পারে। সৌর ঝড়ে সূর্য্য সাধারণত তেজষ্ক্রীয় কনা বিকিরণ করে, যা পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষ ঘটলে রাতের আকাশে আলোর ফুলকী সৃষ্টি করে এবং এই সংঘর্ষের ফলে স্যাটেলাইটের ক্ষতি হতে পারে, বৈদুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতে পারে। ১৮৫৯ সালে একবার সৌর ঝড় হয়েছিল, এর পরে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের চোখে সৌর ঝড়ের সম্ভাবনা নেই।
মেরু পরিবর্তন
মায়ান ক্যালেন্ডারে বিশ্বাসীদের মতে, ২১শে ডিসেম্বার পৃথিবীর দুই মেরুর মধ্যে স্থান পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা আছে, এবং তা হলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বিজ্ঞানীগন দুই মেরুর মধ্যেকার ‘ফ্লিপ-ফ্লপের’ কোন সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না। প্রতি ৫০০,০০০ বছরে প্ল্যানেটে পোল ফ্লিপ-ফ্লপ হইয়ে থাকে। আপাতত সে সম্ভাবনা নেই।
সুতরাং পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার হাস্যকর ভীতি থেকে সকলকে মুক্ত থাকার আহবান জানিয়েছে নাসার বিজ্ঞানীগন।

অফ ডে'র কাসুন্দি!

ওয়ালমার্টের চাকুরীতে উইকএন্ড বলে কিছু নেই। সাত দিনে যে কোন দুই দিন অফ থাকার কথা, তাই থাকে। কপাল ভালো হলে, অফ ডেগুলো উইকএন্ডের সাথে মিলে যায়। আমার কপাল অবশ্য তত ভাল নয়। অটোমেটিক উইক এন্ড আমার ভাগ্যে জোটে না বলেই মাসের দ্বিতীয় শনিবার এবং চতুর্থ রবিবার 'অফ ডে' চয়েসে এনট্রি করে দিয়েছিলাম।এই থেকে মাসে একটি শনিবার এবং একটি রবিবারের ছুটি সম্পর্কে আমি নিশ্চিন্ত থাকি। ওয়ালমার্টের শিডিউল সিস্টেমে আরেকটি নিয়ম আছে, তা হলো, বিশেষ দিনে ছুটি প্রয়োজন হলে কমপক্ষে তিন সপ্তাহ আগে তা কম্পিউটারে লগ ইন করে জানাতে হবে। কাজের শিডিউল (স্কেজিউল) তিন সপ্তাহ আগেই সকলের জানা হয়ে যায়।

আমাদের  দুই মেয়ে থাকে দুই স্টেটে, ছোট মেয়ে থাকে আমাদের সাথে। আমার এক বোন ( আপন বোন নয় কিন্তু, তুতো বোন, এইরে! এই লেখা ওর চোখে পড়লে আমার খবর আছে)  থাকে অন্য আরেক স্টেটে। ক্রীসমাসের ছুটি চলে এসেছে। আমাদের সকলেই এই ছুটির জন্য অপেক্ষা করছে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে এ বছরের জুন মাসে। বিয়ের পর মনীশকে নিয়ে আমাদের এখানে ওর আসা হয় নি। আমার 'তুতো বোন' গত পাঁচ বছরে একবারও আসতে পারেনি। এবার ওরা সকলেই আসবে আমাদের এখানে। আমি খুব খুশী, কতদিন পর সবাই একসাথে হবো।

আগে আমি প্রতি বছর ক্রীসমাসে আমাদের বাড়ীতে বন্ধু-বান্ধবদের নেমন্তন্ন করে খাওয়াতাম। তখন কোমরে জোর ছিল, একা একা সব সামলাতে পারতাম। এখন টেংরীর জোর কমে গেছে, একা হাতে এত মানুষ নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে ভয় পাই। এ কারণেই আমার পুরাণো বন্ধুদেরকে আর ডাকা হয় না। বন্ধুরাও এর পালটা নেয়। নিজেরা নিজেরা অনেক পার্টি করে, আশপাশের সকল বাঙ্গালীকে নেমন্তন্ন করে, আমাদেরকে শুধু বাদ দেয়। খুব যে মনোকষ্টে ভুগি তা নয়, তবে খারাপ লাগে। কী আর করা, একা একা এত কাজ সামলাতে পারিনা বলেই সমাজচ্যুত হয়ে পড়ছি, ব্যস, সহজ হিসেব মেনে নিয়েছি। তারপরেও ট্র্যাডিশান বজায় রাখতে প্রতি বছর ক্রীসমাসের সময় কিছু কিছু ছেলেমেয়েকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে চেষ্টা করি। এবার কেনো যে মনে হলো, আমার পুরণো বন্ধুদের নেমন্তন্ন করে খাওয়ানোর কথা! শুধুই কয়েকটি পরিবার মিলে গেট টুগেদার করবো বলে নিয়ত করেছি। মাথা গুনে হিসেব করেছি, আমাদেরকে নিয়ে গোটা পঁয়ত্রিশ জন মানুষ হবে।  যে দিনটি নেমন্তন্ন খাওয়ায়নোর জন্য ঠিক করেছি, দিনটি মাসের চতুর্থ রবিবার, আমার অটোমেটিক ছুটি। রবিবার দুপুরে সবাইকে আসতে বলেছি। রান্না করবো কি কি? রান্না করবোই বা কখন? গত সাত দিন ধরে এই চিন্তা করে যাচ্ছি। চিকেনের একটি আইটেম তো থাকবেই, মাছের একটা আইটেম থাকবেই, সাথে শাক-সব্জী। শাক-সব্জী যখন তখন কেনা যাবে, গত সপ্তাহে বিশ পাউন্ড মুরগী কিনেছি, তারও আগে আটলান্টা থেকে বাংলাদেশের রুই মাছ আনিয়ে রেখেছি, চিংড়ি মাছকে তো মাছ হিসেবে গণ্যই করা হয় না, ঠিক আছে, চিংড়ি পোকা আনিয়েছি। সব কিছু এনে ফ্রীজারে রেখে দিয়েছিলাম।

স্কেজিউল পেপারে দেখে রেখেছিলাম, মঙ্গলবার আর শুক্রবার আমার অফ ডে। আজ ছিল মঙ্গলবার, আমার অফ ডে।  সামনের রবিবার পঁয়ত্রিশজন অতিথি খাবে আমার বাড়ীতে। এখন থেকেই ফাঁকে ফাঁকে কাজ এঁটে না রাখতে পারলে বিপদে পড়ে যাব। সকলেই জানে ( বিশ্বাস করে কিনা জানিনা), আমাদের রান্নাঘরে মূল কাজগুলো আমাকে করতে হয়। উত্তম কুমারের দোষ নেই, বিবাহিত জীবনের শুরুতেই যাকে মহানায়কের ভূমিকায় রেখেছি, তাকে দিয়ে তো আর 'আবদুল' এর কাজ করানো যাবেনা। সেজন্য উত্তম কুমার নায়কের ভূমিকাতেই থাকে, আমি মাঝে মাঝে চরিত্র বদল করি। বেশীর ভাগ সময় 'রহিমার মা'র ভূমিকাতে অভিনয় করি। তবে আধুনিক রহিমার মা। ব্রেনে সব সময় ছক কষতে থাকি, কখন কোন কাজটা করলে আমার শিডিউল ঠিক থাকবে।

আমি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, মঙ্গলবার মাছ আর মাংস কেটে বেছে ধুয়ে রাখবো। শুক্রবার মাছ, মাংস, আর ডেজার্টের জন্য মিষ্টি বানিয়ে রেখে দেবো। শনিবার রাতে অর্ধেক সব্জী রাঁধবো, রবিবার সকালে স্ন্যাকস বানাবো। অন্য সময় আমার মেজো মেয়ে স্ন্যাকস বা ডেজার্ট বানাতে সাহায্য করে, কিন্তু এবার ওদের কারো কাছ থেকে সাহায্য নেবো না ঠিক করেছি। কারণ, কিছুদিন আগে আমার উত্তম হঠাৎ করেই ছবি বিশ্বাসের ভূমিকায় অভিনয় করে ফেলে। আমার উপর কঠিন আদেশ জারি করে, আমি যেনো তার মেয়েদের উপর জুলুম, নির্যাতন না করি। ছবি বিশ্বাসের আদেশ শুনে আমার মনে ভয়ের বদলে অভিমান জন্মেছে। এ কেমন কথা! তার মেয়ে মানে? দশ মাস পেটে রাখলাম আমি আর এখন বলে তার মেয়ে! ঠিক আছে, আমি না হয় জনমদুঃখী মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করবো। এই ভেবেই গত রাতে ফ্রীজার থেকে বিশ পাউন্ড মুরগীর পা ( থাই ও রান সহ, এখানে বলে লেগ কোয়ার্টার) , ছয় পাউন্ড রুই মাছের টুকরো ( আঁশ সহ),  দুই পাউন্ড খোসাসহ চিংড়ি পোকা, দুই পাউন্ড খাসীর মাংস ( মনীশের জন্য) বাইরে বের করে রেখেছি 'থ' করার জন্য।

কাল রাতে কম্পিউটারে একটি গল্প লিখা শুরু করেছিলাম, শেষ করতে পারিনি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আজ সকাল সাড়ে আটটায় মেয়ে মিশার ফোনে একবার ঘুম ভেঙ্গেছিল। মিশা জানতে চেয়েছিল, আটলান্টা থেকে আসার সময় কিছু বাজার করে আনতে হবে কিনা। ঘুমের চোখে কী বলেছি নিজেরও মনে নেই। ভাল করে যখন ঘুম ভাংলো, দেখি সকাল সাড়ে নয়টা। বিছানা ছেড়ে সবার আগে কম্পিউটার অন করলাম। এরপর মুখ চোখ ধুয়ে কম্পিউটারে বসে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, সকাল দশটা পর্যন্ত লিখবো, গল্পটা শেষ করে এক বন্ধুকে মেইল করে দিয়ে তবে বাসি ঘর ঝাঁটপাট করবো। যখন লেখা শেষ হলো, দেখি সকাল এগারোটা বাজে। লাফ দিয়ে উঠে ঘর ঝাড়ু দিলাম, বিছানা ঠিক করলাম, রান্নাঘরে ঢুকে দেখি, উত্তম চা বানিয়ে রেখে দিয়েছে, মাইক্রো ওয়েভ ওভেনে চা গরম করতে দিয়ে নীচে কিছু টুকিটাকী কাজ সারলাম। চায়ের কাপ আর দুটো বিস্কুট হাতে আবার কম্পিউটার টেবিলে বসলাম। প্ল্যান করেছি, বেলা বারোটার সময় দুপুরের জন্য পরোটা বানাবো, লাঞ্চের পরে মাছ, মাংস নিয়ে বসবো। সাড়ে এগারোটা নাগাদ কিচেনে টুং টাং আওয়াজ পাচ্ছিলাম। ঘরে উত্তম ছাড়া আর কেউ তো নেই। উপর থেকেই হাঁক ছাড়লাম, " তুমি কী খাবার গরম করছো নাকি"?

উত্তর এলো, " হ্যাঁ, ক্ষিদে পেয়েছে, অল্প ভাত আছে, এটা দিয়েই আমার লাঞ্চ হয়ে যাবে।

বললাম, " আমি ভেবেছিলাম, পরোটা বানিয়ে দেবো"।

পরোটা উত্তমের খুব প্রিয়, একটু থমকালো, তারপর বললো, না থাক, ভাতেই চলে যাবে।

উত্তমের লাঞ্চ হয়ে যাচ্ছে, মিথীলা আসবে বিকেল চারটায়, আর কী চাই। কিছুক্ষণ সময় কাটাই চ্যাট করে। কতদিন হয়ে গেলো, কারো সাথে চ্যাট করা হয় না। অনেক দিন পর আমার অনেক প্রিয় এক ছোট ভাইকে অনলাইনে পেলাম। তার সাথে গল্প করছি তো করছি। এই ভাইটির সাথে আগেও গল্প করতে আমার ভালো লাগতো। আওয়ামী রাজনীতির ব্যাপারে সে অন্ধ। এত আত্মবিশ্বাস যে কোথা থেকে পায়, কে জানে! তার সাথে গল্প করতে করতে চল্লিশ মিনিট পার হয়ে গেলো। কথা শেষ করলাম। পেটে ছুঁচো ডন-বৈঠক শুরু করে দিয়েছে। বেলা বাজে আড়াইটা। এবার নীচে নামতেই হয়। আগে কিছু খেয়ে নিয়ে তারপর কাজে নামবো। ফ্রীজ খুলে মাছের মাথা দিয়ে রান্না করা সব্জীর বাটি বের করলাম, রাইস কুকারের ঢাকা সরিয়ে ভাত নিতে গিয়ে দেখি, রাইস কুকার ফাঁকা। ভাত নেই। কী করি! এখন আর রুটি বা ভাত, কোনটাই বানাতে ইচ্ছে করছে না। পাউরুটি খাওয়া যায়, কিন্তু খাব না। উত্তম কুমারকে আর উত্তম ডাকবো কিনা ভাবছিলাম, উত্তম না ডেকে 'ভোলানাথ' ডাকলে কেমন হয়! ভোলানাথ তো ভুলেই গেছে, ঘরে 'রহিমার মা' আছে, রহিমার মা দুপুরে কী খাবে, সেটা জিজ্ঞেস করতেও ভুলে গেছে। কী আর করা, ভোলানাথকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, চা খেতে চায় কিনা। কপাল ভাল, 'না' করে নি। ভোলানাথ যদি 'না' করতো, শুধু নিজের জন্য মরে গেলেও চা বানাতাম না। চায়ের জল বসিয়ে খাসীর মাংসের প্যাকেট আগে খুললাম। মাংস মোটামুটি পরিষ্কার আছে দেখে ভাল করে ধুয়ে টক দই, হলুদ, মরিচের গুঁড়ো, গরম মশলার গুঁড়ো, লবন দিয়ে মাখিয়ে জীপ লক ব্যাগে ভরে ফ্রীজে রেখে দিলাম। চায়ের জল ফুটতে শুরু করেছে। রুই মাছের তিন প্যাকেট বের করেছি, এক প্যাকেট খুলে ক্ষিপ্র গতিতে মাছের টুকরো থেকে আঁশ ছাড়াতে লাগলাম। মাছের টুকরোর চেহারা দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। পেটের টুকরোগুলো এত সরু আর এত ছোট, নিজেরাও ঘরে এত ছোট টুকরোর মাছ খাইনা। সিদ্ধান্ত নিলাম, পিঠের টুকরো দিয়ে হবে মাছের কালিয়া, পেটের টুকরো গুলো ভেজে, রঙ বেরঙের সব্জী সাথে দিয়ে স্টার ফ্রাই করবো। চায়ের জল শুকিয়ে গেছে, আবার জল দিয়ে নতুন করে বসালাম। এবার মাছের বাকী দুই প্যাকেটকেও সাইজ করে ফেললাম। মাছের টুকরো তে নুন, হলুদ মাখিয়ে জীপ লক ব্যাগে পুরলাম।



ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে চা বানালাম। এক কাপ চা ভোলানাথকে দিয়ে আসলাম, আরেক কাপ চা নিজের জন্য। এক ফাঁকে দুই পীস ব্রেড টোস্ট করতে দিয়েছিলাম। ব্রেডে নতুন ধরনের ক্যারামেল স্প্রেড মিশিয়ে একটা কামড় দিতেই মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। কেনো খারাপ হলো, তা অবশ্য জানিনা। হতে পারে, কানেকটিকাট ম্যাসাকার নিয়ে গল্প লিখছিলাম, তার অনুভূতিগুলো তখনও মাথায় ঘুরছিল। যাই হোক, চা আর টোস্ট শেষ করেই চিংড়ি পোকায় হাত দিলাম। এবার মাটিতে গ্যাঁট হয়ে বসলাম। এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ চলছিল, এবার দেশ থেকে আনা বটি পেতে বসেছি। চিংড়ির খোসা ছাড়িয়ে, শুঁড়, দাড়ি, গোঁফ কেটে বাদ দিয়ে, মাথা আলাদা, শরীর আলাদা করে কেটে বেছে ধুয়ে, হলুদ নুন মাখিয়ে ফ্রীজে পাঠিয়ে মনে হলো, এবার উপরে গিয়ে আবার গল্পটা নিয়ে বসি। প্রথমবারে অনেক কিছু বাদ পড়ে গেছে, পরে এসে না হয় চিকেনের বস্তা নিয়ে বসবো। ঘড়িতে দেখি পাঁচটা বেজে গেছে। মত বদলালাম। নিজেকে চিনি, একবার উপরে উঠে গেলে চিকেন আর কাটা হবে না। কাল আমার সকালে কাজ, কাজেই মরি কী বাঁচি, এখনই মুরগী কাটবো। এক প্যাকেট খুলে পাগুলো বের করেছি। একেক প্যাকেটে চৌদ্দ-পনেরোটা করে পা। পায়ের সাইজ হচ্ছে, আট নয় মাস বয়সী স্বাস্থ্যবান ছেলের পায়ের সাইজের মত। মুরগীগুলো দেখতে কত বড় হয়, কে জানে! পায়ের গায়ে মোটা চামড়া লেগে থাকে, চামড়ার নীচে হলুদ বর্ণের মোটা স্তরের চর্বী, চামড়া এবং চর্বি, দুটোই আমার দু'চক্ষের বিষ। চামড়া কাটতে গেলে সব সময় আমার হাতের একটা আঙ্গুল কাটবেই কাটবে। ভেবেছি আজকে আর আঙ্গুল কাটবে না। মুরগী কাটতে কাটতে হঠাৎ করেই কপালের সামনে এক গোছা চুল এসে পড়েছে, অস্বস্তি হচ্ছিল, হাতের কব্জী তুলে চুলগুলো সরিয়ে দিতে গিয়ে হাতটা নাকের মধ্যে একটু গুঁতো খেয়েছে। পাত্তা না দিয়ে আবার মুরগী কাটায় মন দিয়েছি। মুরগী কাটার ফাঁকে ফাঁকে গল্পের প্লট নিয়ে ভাবছিলাম। গল্পকবিতা ডট কমে প্রতি মাসে একটা করে গল্প লিখে জমা দেই। প্রতিযোগীতা আর কি! আমার তো পরিচিত তেমন কেউ নেই, তাই পাঠক ভোটে অনেক পিছিয়ে পড়ি। তবুও লিখে যাই, লিখতে লিখতে হাত পাকা করছি। সেই গল্পের প্লট নিয়ে ভাববো কি, নাক জ্বালা করতে শুরু করেছে। এর মধ্যেই নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে, আবার হাত উঁচুতে তুলে নাকটা মুছতে গেছি, নাকের ভেতর কিছু ঝাঁঝ টের পেলাম। মরিচের গুঁড়োর গন্ধ। হাত উল্টিয়ে দেখি, হাতের কব্জীতে মরিচের গুঁড়া লেগে আছে। খাসীর মাংসে মরিচ দেয়ার সময় প্যাকেটের গা থেকে গুঁড়ো হাতে লেগেছিল।



তাড়াতাড়ি উঠে আবার সাবান দিয়ে হাত ধুলাম, নাক ধুলাম, আবার মাটিতে বসে মুরগী কাটায় মন দিলাম। এক প্যাকেট শেষ করেই আমার উঠে যেতে ইচ্ছে করছিল। একটা বুয়া থাকলে কত ভালো হতো। সেদিন সেলিনা হোসেনের সাক্ষাৎকারে পড়লাম, লেখিকা হওয়ার প্রথম ও শেষ শর্ত, একা হওয়া। উনি এমন কথা বলতেই পারেন, উনি একা হতে পেরেছেন কারণ উনার সংসারে দাস দাসী ছিল, আমি একা হবো কী করে? আমার এক বন্ধু বলেছে, বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে খাওয়ার জন্য। কয়দিন খাবার কিনে খাব? পয়সাও যাবে, বাইরের খাবার স্বাস্থ্যসম্মতও না। কান্না পাচ্ছিল, আমি কী তবে সত্যি সত্যি লেখক হতে চাইছি? এত সোজা নয়, লেখক হওয়া, গায়ক হওয়া এমন কী নায়ক হওয়া। হঠাৎ করেই ঘ্যাঁচ করে পরিচিত আওয়াজ টের পেলাম, বুড়ো আঙ্গুল চোখের সামনে নিয়ে এলাম, কেটে গেছে, রক্ত বের হতে সময় লাগবে। আমি অ্যানিমিক, কেটে ছড়ে গেলে রক্ত বের হতে একটু সময় লাগে। বটিতে কাটা, আঙ্গুল টিপে রক্ত বের করলাম, কে জানে, যদি সেপটিক হয়ে যায়। সেপটিক হওয়ার চেয়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত বের করে দেয়া ভাল। রক্ত পড়া বন্ধ করতে এক খাবলা চিনি নিয়ে চেপে ধরলাম কাটা জায়গায়। রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেলো। মুরগীর পা গুলোকে আছাড়াতে ইচ্ছে করছিল, পায়ে চাপা বটিটাকে ঢিল মেরে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছিল, কিন্ত এর কোনটাই করলাম না। মুরগী কাটা শেষ করে সবকিছু ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে বিশ পাউন্ড মুরগীকে ম্যারিনেট করে রাখলাম। হঠাৎ করেই  মনে হলো, মনীশ মিষ্টি খেতে ভালোবাসে। যতই বলি, আমার শাশুড়ী হতে ইচ্ছে করে না, যতই মনীশকে বলি না কেনো, আমাকে 'মাসী' ডাকতে, তারপরেও মনীশ আমার মেয়ের জামাই, আমি আইনত মনীশের শাশুড়ী।  কাজেই মনীশকে একটু পিঠে-পায়েস খাওয়াতে হবে। সব কিছু আগে আগে করে রাখার একটাই কারণ, মনীশকে ফিরে যেতে হবে দু'দিন পরেই। আমি ছুটি পাইনি, তাই রান্নাগুলো আগে সেরে রাখলে, ওরা নিজেরা নিয়ে খেতে পারবে। পাটিসাপ্টা পিঠে বানাবো, আগেই ভেবে রেখেছি। পাটিসাপ্টা পিঠেতে আমি খাঁটি ক্ষীর দেই পুর হিসেবে। শুধুই ক্ষীর, নারকেল মিশাই না। ক্ষীর বানানোর জন্য দুধ ঘন করে রাখলাম। কাল কাজ থেকে ফিরবো বিকেলে, সন্ধ্যাবেলা পিঠে বানানোর সরঞ্জাম রেডী করে রাখবো।



রাইস কুকারে ভাত রান্না করলাম, আগে থেকে রেঁধে রাখা মাছ, তরকারী, ডাল গরম করে উত্তম ( সব কাজ শেষ হয়ে গেছে, রাগ কমে গেছে, তাই ভোলানাথ আবার 'উত্তম' হয়ে গেছে) কুমারকে ডাকলাম। ঘড়িতে বাজে পৌণে আটটা। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে কম্পিউটারে বসে 'হলদে বাড়ীর আঙিনায়' মাত্র খুলেছি, রিটাইপ করছি, আঙ্গুল কোন একটা বাটনে চাপ লেগে পুরা স্ক্রীণ বদলে গেলো। কাহাতক ভালো লাগে! ডাকলাম মিথীলাকে, মিথীলা এসে কী টেপাটেপি করলো, কোনই লাভ হলো না, শেষে পরামর্শ দিল, মজিলা ফায়ার ফক্স বাদ দিয়ে গুগল ক্রোমে যেতে। দাঁতে দাঁত চেপে গেলাম গুগল ক্রোমে। গল্পটাকে ঠিক করে এক বন্ধুর কাছে মেইল করলাম। দেখি, পত্রিকায় ছাপা হয় কিনা। 'অফ ডে' টা এভাবে পার করে দেবো? আমার ফেসবুক পাঠকের জন্য নতুন কিছুই লিখবো না? তাই কী হয়? লিখে ফেললাম, আমার 'অফ ডে'র কাসুন্দি।

Tuesday, December 18, 2012

হলদে বাড়ীর আঙিনায়

ছোট হলুদ রঙের বাড়ীটি  নিউটাউন শহরের বিশিষ্ট মনোবিদ জেন রোজেনের। স্ত্রী লিন্ডাকে নিয়ে  এই বাড়ীটিতে  উনি অনেক বছর ধরেই আছেন।  জেনের বয়স ৬৯ পূর্ণ হলো গত নভেম্বারে, হাসপাতালের চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছেন তিন বছর আগে,  নিজস্ব ক্লিনিক আছে, ওখানেই তিনি স্বাধীনভাবে প্র্যাকটিস করেন।  তার স্ত্রী লিন্ডার বয়স ৬৬, সরকারী চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছে গত জুন মাসে।  তাদের এক ছেলে, এক মেয়ে নিজেদের সংসার নিয়ে সুখেই আছে। বছরে দু'বার ওরা বাবা-মায়ের কাছে এসে ছুটি কাটাতে পছন্দ করে। জেন ও লিন্ডার সময় খুব দ্রুত কেটে যায় নাতি-নাতণীদের কাছে পেলে।  অবসর জীবন মোটামুটি  আরামেই কাটছে। তাদের পাড়াটা খুবই ভালো, আশেপাশে প্রতিবেশী যারা আছে, খুবই সজ্জন লোক। মিঃ রোজেনের বাড়ী থেকে একশ গজ দূরেই  স্যান্ডি হুক এলিমেন্টারী স্কুল নামে বাচ্চাদের একটি স্কুল আছে। দিনের সময়টুকু  ছোট ছোট বাচ্চাদের কলকাকলীতে  চারপাশ মুখর থাকে। প্লে টাইমে ছোট ছোট বাচ্চারা  প্লে গ্রাউন্ডে এসে হুটোপুটি করে, প্রতি দিন ক্লিনিকে আসা-যাওয়ার পথে জেন এই দৃশ্য দেখতে পায়। তার খুব ভালো লাগে, পুরাণো দিনের কথা মনে পড়ে। স্কুলটি প্রায় ষাট বছর আগে তৈরী করা হয়েছিল, তার নিজের দুই ছেলেমেয়ে এই স্কুলে পড়েছে, এলিমেন্টারী স্কুল হলেও  আয়তনে  স্কুলটি অনেক বড়। বর্তমানে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা সাতশ'র উপরে। নিউটাউন শহরের নামকরা স্কুল এটি। তাদের বাড়ীর কাছাকাছি স্কুলটি থাকাতে ওদের জন্য ভালোই হয়েছে, ছেলেমেয়েরা কাছাকাছি না থাকলেও নিজেকে একা মনে হয় না। সারাদিনই বাচ্চাদের টুঁই টুঁই শোনা যায়।

রোজেন পরিবারের বাড়ীটি খুব বেশী বড় নয়, তবে বাড়ীটি ছোট হলেও দেখতে বেশ ছিমছাম এবং সাজানো।  বাড়ীর সামনের দিকে ড্রাইভ ওয়ে ঘিরে রঙ বেরঙের মৌসুমী ফুলের বাগান, সারা বছরই কিছু না কিছু ফুল ফোটে।  আর  পেছন দিকে বেশ খানিকটা চওড়া জমি আছে, সেখানে দুই চারটি পাতাবাহারের গাছ, একটি কমলালেবুর গাছ, দুটি ব্লুবেরী গাছ  খুব সুন্দর করে প্ল্যানমাফিক লাগানো হয়েছে। গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে দুই চারটি কৃত্রিম ফাউন্টেন বসানো আছে , ফাউন্টেনগুলো অবশ্য পাখীদের জল খাওয়ার জন্য রাখা হয়েছে।  সারাদিনে প্রচুর পাখী এসে ভীড় করে ফাউন্টেনের চারপাশে। ঘরে বসে পাখীদের কিচির মিচির শুনতে বেশ লাগে!  বাগানের আরেক কোণে  কিছুটা জায়গা সিমেন্ট বাঁধানো, সেখানে আয়রণ স্টিকে তৈরী টেবল-চেয়ারের সেট আছে,  ছ'টি সাদা স্টিকের চেয়ারের মাঝে কুচকুচে কালো আয়রণ স্টিকে তৈরী গোল টেবিল।  সাদা কালোয় দারুণ কম্বিনেশান।  আর বাগানের ঠিক  মাঝখানটিতে  ছোট একটি জলাশয় আছে, সেখানে রঙ বেরঙের মাছেরা খেলা করে। জলাশয়টি নাতি-নাতণীদের মনোরঞ্জনের জন্য বানানো হয়েছে।  তাদের নাতি-নাতণীদের ভীষন পছন্দের জায়গা এটা। বাগান সাজানোর ব্যাপারে লিন্ডার কথাই শেষ কথা।  তার নির্দেশমতো যখন যা প্রয়োজন, জেন তা যোগান দিয়ে যায়। প্রতিদিন বিকেল হলেই লিন্ডা বাইরের  চেয়ারে এসে বসে, পাখীদের কিচির মিচির শোনে আর কুরুশ কাঁটায় ডিজাইন তুলে নাহয় গল্পের বই পড়ে। 

জেন রোজেন প্রতি সকালেই নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে উঠে। ঘড়িতে সকাল সাতটার এলার্ম সেট করাই থাকে, এলার্ম না বাজলেও সাতটা বাজলেই জেনের ঘুম ভেঙ্গে যায়।  তার স্ত্রী অবশ্য অত সকালে বিছানা ছাড়ে না। সকাল দশটার আগে তো বিছানা ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ লিন্ডা ঘুমাতে যায় অনেক দেরী করে।  মাঝরাত পর্যন্ত জেগে থেকে  সে সেলাই-ফোঁড়াই করে, ফলে সকালে ঘুম থেকে ওঠা হয় না। এখনতো সেলাই নিয়ে অনেক বেশী ব্যস্ত সে। ক্রীসমাস চলে এসেছে। আর আটদিন পরেই ছেলে মেয়েরা আসবে। ওরা আসার আগেই ঘর-বাড়ী রেডী করে ফেলতে হবে। গিফট বক্স র‌্যাপ করার কাজ আছে, দোকান দোকান ঘুরে বাচ্চাদের জন্য গিফট কেনার ব্যাপার আছে, কাজ তো কম নয়, লিন্ডা এগুলো সামলায়। শুধু নিজের নাতি-নাতণীর জন্য নয়, অন্য বাচ্চাদের জন্যও সে গিফট কেনে, গিফট গুলো চার্চে গিয়ে দিয়ে আসে। ওখান থেকেই গরীব বাচ্চাদের কাছে গিফট চলে যায়। কাল সারারাত গিফট র‌্যাপ করেছে সে। সেজন্যই আজ সে অনেকক্ষণ ঘুমাবে।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ বুলিয়ে  দিনের প্রোগ্রাম  দেখে নেয়া মিঃ রোজেনের নিত্য তিরিশ দিনের অভ্যাস। আজও তার ব্যত্যয় ঘটে নি।  ১৪ই ডিসেম্বার, শুক্রবারের তারিখটিতে গোল করে দাগ কাটা আছে, অর্থাৎ  আজ ক্লিনিকে স্পেশ্যাল কেইস আছে। হাতে বেশ কিছু সময় নিয়ে বের হতে হবে। নিজের ব্রেকফাস্ট করা হয়ে গেলে  বেইলী কে খাওয়াতে হবে। বেইলী ওদের পোষা বেড়ালের নাম। এমন আরামপ্রিয় আর প্রভুভক্ত বেড়াল জেন আর কোথাও দেখে নি। তার হাতে ছাড়া আর কারো হাতেই সে খাবে না।  এমনকি লিন্ডার হাতেও সে খায় না। কাজেই বাইরে বের হওয়ার আগে তাকেই  বেইলীকে খাওয়ানোর কাজটি করতে হয়। বেইলীকে খাওয়াতে  অবশ্য  তার খুবই ভালো লাগে। খাওয়ার বাটি হাতে জেনকে দেখতে পেলেই হলো, এক লাফে কোলে উঠে বসবে, কিছুক্ষণ মিয়াঁও মিঁয়াও করে আদর খেয়ে তবেই খাবারে মুখ দেবে।

ঘড়িতে এখন সকাল ৯টা বেজে ৩৩ মিনিট। বেইলীর খাওয়া শেষ হয়েছে, লিন্ডা এখনও মনে হচ্ছে কম্ফর্টারের নীচে আরামে ঘুমুচ্ছে। আর মিনিট পনের পরেই জেনকে বের হতে হবে।। হঠাৎ করেই যেনো কাছে পিঠে কোথাও থেকে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ ভেসে এলো । একসাথে বেশ অনেকগুলো। বন্দুক ছুঁড়ছে কেউ। হরিণ শিকারের সময় এটা। পাশের জঙ্গলে শিকারীরা হয়তো একসাথে অনেকগুলো হরিণ পেয়েছে! কে জানে! যাক, আর দেরী করা ঠিক নয় ভেবে মিঃ রোজেন ঠিক পৌণে দশটায় ঘর থেকে বের হয়ে গ্যারাজে ঢুকল। গাড়ীটাকে বের করতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে নজরে এলো, তার ড্রাইভ ওয়ের সামনেই ফুটফুটে কয়েকটি বাচ্চা অর্ধ বৃত্তাকারে বসে আছে। বাচ্চাগুলোর পাশে দাঁড়ানো এক যুবক। জেন গাড়ীর দরজা না খুলেই বাচ্চাগুলোর কাছে এগিয়ে গেল।  পাশের স্যান্ডি হুক এলিমেন্টারী স্কুলের ছাত্র। ইউনিফর্মের শার্টে স্কুলের লোগো দেখা যাচ্ছে। কী ব্যাপার! স্কুলে না গিয়ে এরা এখানে কেনো!  কাছাকাছি যেতেই ওদের পাশে দাঁড়ানো যুবকটিকে বলতে শুনল, " কোন চিন্তা করো না, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে"।

সাথে সাথে বাচ্চাগুলো সমস্বরে বলে উঠলো, " নো ওয়ে! সব মেসড আপ হয়ে গেছে। আমাদের টিচারকে গুলী করে মেরে ফেলেছে। মিস সোটো ইজ ডেড"!

নিজের অজান্তেই জেনের কপাল কুঁচকে গেলো, বলছে কী এরা? টীচার ডেড, মানে কী?  বাচ্চাগুলোর মুখের চেহারায় ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।  ছয়টি বাচ্চার মধ্যে চারটি মেয়ে, দুটো ছেলে। সবার বয়স পাঁচ আর ছয়ের মধ্যেই হবে। ওরা হাত ধরাধরি করে বসেছিল,  স্কুলে স্টোরী টাইম বা ইনডোর গেম চলাকালে  যেভাবে বসে ওরা অভ্যস্ত। ছয়জনই শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্কুলের দিকে। জেন রোজেনের বাড়ী থেকে এলিমেন্টারী স্কুল দেখা যায়।  জেন বাচ্চাগুলোর কাছে গিয়ে খুব নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো, " কিসের কথা বলছো তোমরা? স্কুলে না গিয়ে এখানে বাইরে বসে আছো কেনো? কেউ কিছু বলেছে তোমাদেরকে?"

-আমরা স্কুলে যাব না। ওখানে খারাপ লোক আছে, আমাদের টিচারকে গুলী করে মেরে ফেলেছে। আমরা এক ছুটে এখানে চলে এসেছি। তুমি কী রাগ করছো আমরা এখানে বসেছি বলে?

-না , আমি রাগ করিনি, তোমরা এসেছো, আমি খুশী হয়েছি। কিন্তু টিচারকে মেরে ফেলেছে, কে মেরেছে? কী হয়েছে বলোতো সোনামনিরা।  তোমরা কী দেখেছো?

-হ্যাঁ, আমরা দেখেছি। একটা ইয়াং গাই, দুই হাতে বন্দুক নিয়ে এসেছিল, ওটা দিয়ে ফায়ার করেছে। আমাদের টিচারকে মেরে ফেলেছে। আমরা আর কখনও যাব না ওখানে। আমাদেরকেও মেরে ফেলতো, কিন্তু আমরা দৌড়ে পালিয়ে এসেছি। আমাদের টিচার পালাতে পারেনি। মিস সোটোকে মেরে ফেলেছে। 

-ঠিক আছে, তোমাদের কোথাও যেতে হবে না,  এখানেও বসতে হবেনা,  আমি তোমাদের সবাইকে বাড়ীর ভেতরে নিয়ে যাচ্ছি। কোন ভয় নেই বাছারা। আমার নাম জেন রোজেন, এটা আমার বাড়ী। তোমরা এখানে বসেছিলে কেনো? আমার দরজায় নক করো নি কেনো?

-আমরা এখানে বসে আছি, অপেক্ষা করছি  আমাদের বন্ধু এলিস, এমিলি আর  জোয়ানের জন্য।  

-এলিস, জোয়ান, এমিলি ওরা কোথায়?

-আমরা সবাই একসাথে ছুটেছিলাম, কিন্তু এখানে এসে দেখি ওরা আসেনি। কিন্তু ওরা আসবে, ঠিক আসবে।

-নিশ্চয়ই ওরা আসবে।  তোমরা আমার সাথে এসো, এই যে  ইয়াংম্যান এখানে দাঁড়িয়ে আছে, সে এলিস, এমিলি আর জোয়ানের জন্য অপেক্ষা করবে। ওদেরকে দেখতে পেলেই আমাদের কাছে নিয়ে আসবে, ঠিক আছে?

জেনের কাছ থেকে আশ্বাসবাণী শুনে অনেকটাই নিশ্চিন্ত বোধ করলো বাচ্চাগুলো। উঠে দাঁড়িয়ে জেনের হাত দুটো দুদিক থেকে ওরা ধরে রাখলো। জেন টের পাচ্ছিল, বাচ্চাদের হাত গুলো একটু একটু করে কাঁপছে। পাশে দাঁড়ানো যুবকের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই যুবকটি বলল,

 " আমি স্কুল বাস চালাই। একটু আগেই  স্কুলে অনেক গোলাগুলি হয়েছে। শুনেছি অনেক বাচ্চা মারা গেছে। খবর পেয়েই ছুটে আসছিলাম, ওদেরকে এখানে বসে থাকতে দেখে আমি দাঁড়িয়েছি। অবাক হয়ে গেছি, ওরা কিভাবে পালিয়ে আসতে পারলো?  অপেক্ষা করছিলাম, কখন ওদের বাবা মা আসবে, তাদের কাছে বাচ্চাগুলোকে তুলে দিতে হবে তো! তা এখন তো তুমিই ওদের দায়িত্ব নিয়ে নিলে, আমি তাহলে একটু এগিয়ে যাই। কী ঘটেছে দেখা দরকার!
 

-আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না, একটু আগে বেশ কিছু গুলীর শব্দ শুনতে পেয়েছি। এই কী তবে সেই গুলীর আওয়াজ। হায় ঈশ্বর, আমি ভেবেছিলাম, কেউ বোধ হয় হরিণ শিকার করছে! হায় হায়, এখন কী হবে! ঠিক আছে, তুমি এগোও, পথে আর কোন বাচ্চাকে দেখতে পাওয়া মাত্র আমার বাড়ীতে নিয়ে এসো। গড ব্লেস ইউ!

জেন বাচ্চাগুলোকে নিয়ে বাড়ীর ভেতরে ঢুকছিল আর দু'দিকে মাথা নাড়িয়ে বিন বিন করে বলছিল, গড ব্লেস আমেরিকা! এ কী কঠিন সময় পার করছি আমরা! সাত সকালে এ কী অনাসৃষ্টি কান্ড!  ছেলেপেলের হাতে পিস্তল-বন্দুক থাকে কী করে! বাচ্চাদের মারতেই বা ইচ্ছে হয় কিভাবে"!  

ক্লিনিকে যে এপয়েন্টমেন্ট আছে, তা একদিন পিছিয়ে দিতে হবে। আজ আর যাওয়া হবে না। এসব ভাবতে ভাবতেই জেন চাবি ঘুরিয়ে দরজার লক খুলে বাচ্চাগুলোকে পরম আদরে ঘরের ভেতর নিয়ে এলো। বাচ্চাগুলো ঘরে ঢুকতেই ওদের মুখ থেকে ক্ষনিক আগের সেই ভয় কেটে গেছে। জেন বাচ্চাদের সবকটাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েই স্ত্রীকে ঘুম থেকে উঠাতে বেডরুমে চলে গেল। লিন্ডা জেগেই ছিল, সেও গুলির আওয়াজ শুনেছে। বাইরে থেকে তার স্বামীর কথা-বার্তার টুকরো টুকরো অংশ কানে এসেছে। বুঝে নিয়েছে, ধারে কাছে কোথাও  শুটিং হয়েছে। তবে বুঝতে পারেনি, বাড়ীর পাশের এলিমেন্টারী স্কুলটাতে গোলাগুলী হয়েছে।  জেন বেডরুমে ঢুকতেই লিন্ডা জিজ্ঞেস করলো, " হানি,  ঠিক কী হয়েছে বলো তো!  ঘরের ভেতর বাচ্চাদের কথা শুনতে পাচ্ছি!

-হানি, আমাকে জিজ্ঞেস করোনা কী হয়েছে,  আমি ভাবতেই পারছিনা, স্যান্ডি হুকে ম্যাসাকার হয়ে গেছে। আমাদের ড্রাইভ ওয়েতে ছয়টি বাচ্চা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল। এই বাচ্চাগুলোর চোখের সামনেই ওদের টিচারকে গুলী করে মেরে ফেলেছে। বাচ্চাগুলো কী করে যে পালিয়ে আসতে পেরেছে, তা কে জানে! 

-ওরা এঞ্জেল,  ঈশ্বর ওদেরকে আমাদের বাড়ীতে নিয়ে এসেছে। ওদেরকে কিছু খেতে দাও। বাছারা ভয়ে নীল হয়ে আছে, আহারে!

-ডার্লিং, তুমি একটু আসো তো, আমার মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। এ আমি কী শুনলাম! বাস ড্রাইভার বললো, অনেক বাচ্চাকে মেরে ফেলেছে।

-অ্যাঁ বলো কি!!

-হ্যাঁ, ড্রাইভারের মুখে যা শুনেছি তাই বললাম, টিভি অন করেছি, ওখানেও একই কথাই বলছে। তবে  এই বাচ্চাগুলোর উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারি না। ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে আসার কথা কী করে ওদের মাথায় এলো! তাছাড়া, আরেকটি ব্যাপার আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না। বাচ্চাগুলো কী করে বেরিয়ে এলো! এত বড় স্কুলে কেউই দেখতে পেলো না! ওদেরকে এগুলো জিজ্ঞেস করাও ঠিক না, মাত্র ছয় বছর বয়সেই মৃত্যুকে দেখে ফেললো!

-না থাক, ওদেরকে এখন বিরক্ত না করাই ভালো। টিভির সাউন্ড কমিয়ে দাও, ওদের কানে যেনো না যায়।

রোজেন দম্পতী সবার আগে বাচ্চাগুলোকে খেতে দিল। ঘরে চেরী ছিল, আপেল আর কলা সবসময় মজুত থাকে, সেটাও  দিল। সাথে চকোলেট চিপস কুকী, ফ্রুট জুস পেয়ে বাচ্চাদের চেহারা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এলো। এঘর-ওঘর ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো।  যশোয়া নামের ছোট ছেলেটি ঘোষণা দিল, 

" আমরা এখানেই থাকবো। আর স্কুলে ফিরে যাব না। ওখানে  মিস সোটোকে মেরে ফেলেছে। আমরা আর যাব না ওখানে। কোথাও যাব না। এই বাড়ীতে থাকবো"।

যশোয়ার সাথে সাথে সকলেই এক সুরে চেঁচিয়ে উঠলো, " আমরা আর কোথাও যাব না, এখানেই থাকবো"।
খুব শান্ত যে মেয়েটি, সে শুধু বললো, " তোমাদের বাড়ীটা অনেক ছোট। আমরা সবাই থাকতে পারবো না। আমি থাকবো না। আমার মায়ের কাছে যেতে চাই"। 

জেন  পেশায় একজন মনোবিজ্ঞাণী, মুহূর্তের মধ্যে বাচ্চাগুলোকে বশ করে ফেললো। এ বাড়ীতে 'টয় রুম' নামে একটি কক্ষ আছে। দুনিয়ার যাবতীয় খেলনা দিয়ে সাজানো। জেনের নাতি-নাতণীরা বেড়াতে এলে এই রুম থেকে আর বের হতে চায় না। জেন দম্পতি কক্ষটিকে শিশু- স্বর্গ বানিয়ে রেখেছে । আজকের অতিথিরাও স্বর্গের সন্ধান পেয়ে গেছে। ওরা সকলেই যখন খেলায় মগ্ন, জেন ওদের প্রত্যেকের কাছ থেকে সুকৌশলে ওদের মা-বাবার ফোন নাম্বার জেনে নিল। লিন্ডাকে বলে রাখলো, বাচ্চাদের দিকে একটু নজর রাখতে। ফোন রিসিভার কানে তুলে একটার পর একটা নাম্বারে ডায়াল করতে লাগলো এবং সকলকেই একই কথাই বললো, 

তোমরা অনেক লাকী বাবা-মা, তোমাদের বাচ্চা খুবই স্মার্ট, মৃত্যুর দুয়ার থেকে পালিয়ে এসেছে। ঈশ্বরের কাছে শুকরিয়া আদায় করো, তোমার বাচ্চাটি আমার কাছে নিরাপদে আছে। তোমাদের সময়মত তোমরা ওকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও। দুঃশ্চিন্তা করো না, সময় নাও, নিজেকে শান্ত করো,  তারপর গাড়ীতে স্টার্ট দাও, ওরা এখন আমার 'টয় রুমে' বসে মনের আনন্দে খেলা করছে"।

ফোন কল শেষ করে বাইরে এসে দেখে, বাচ্চাগুলো ব্যাকইয়ার্ডে লিন্ডার হাত ধরে ঘুরছে। নিজের নাতি-নাতণীর জন্য ছোট একটা কৃত্রিম পুকুর বানিয়েছে জেন, নিজের হাতে। সেখানে গোল্ড ফিশ ছেড়েছে, সাথে আরও কিছু রঙ বেরঙের মাছ। সবগুলো বাচ্চা পুকুর ঘিরে বসে পড়েছে। দৃশ্যটি দেখে আবেগ সামলাতে পারলো না জেন। দু'চোখ ছাপিয়ে জল এলো। টিভি তখনও অন করা ছিল, টিভি স্ক্রীণে এখন শুধুই কানেকটিকাট ট্র্যাজেডি দেখাচ্ছে। বিশ-পঁচিশজন স্পট ডেড! আহারে! সোনা মানিকেরা শীত ঘুমকে উপেক্ষা করে সাত সকালে স্কুলে এসেছিল! আজ শুক্রবার, আগামী দু'দিন উইকএন্ড এর ছুটি। আর কয়দিন পরেই ক্রীসমাস, স্যান্টা আসবে ওদের জন্য উপহার নিয়ে, কত স্বপ্ন চোখে এঁকে ওরা আজ স্কুলে এসেছিল। এ কী হয়ে গেলো! হায় ঈশ্বর! তুমি কী অন্ধ হয়ে গেছো! তুমি কী বোবা হয়ে গেছো! 

চোখের জল মুছে নিয়ে আবার ফোনের ডায়াল ঘোরাল। নিজের মেয়েকে কল দিয়ে বলতে হবে, আগামী কয়েকদিন যেনো ছেলে-মেয়েকে স্কুলে না পাঠায়। দুই রিং হতেই মেয়ে ফোন ধরলো,

 " ড্যাডি, এসব কী শুনছি?  স্যান্ডি হুকে ফায়ারিং হয়েছে! আমার খুব ভয় করছে, ড্যাডি, কী করবো? জর্জকে স্কুল থেকে নিয়ে আসবো? লিসা বাড়ীতেই আছে, ওর শরীর একটু খারাপ লাগছে বলে স্কুলে পাঠাইনি।

-বেবী, খুব খারাপ, খুব খারাপ খবর এখানে। ছোট ছোট বাচ্চা, আহারে! সাত সকালে নিষ্পাপ শিশুগুলোকে মেরে ফেলেছে! জানো তো, ছয়টি বাচ্চা কী করে যেনো স্কুল থেকে বের হয়ে আমাদের বাড়ী পর্যন্ত চলে এসেছে।

-তাই নাকি!!! ওহ মাই গড, থ্যাঙ্কস গড। 

-বেবী, এখন রাখছি। থাক, জর্জকে আনতে হবে না।  সাবধানে থেকো। লাভ ইউ মাই চাইল্ড।

-লাভ ইউ টু ।

মেয়ের সাথে ফোনে কথা শেষ করতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। জেনই এগিয়ে গেলো দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই দেখে,  একজোড়া দম্পতি দাঁড়িয়ে। মেয়েটিকে সুস্থ দেখাচ্ছে না, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আছে, ছেলেটি নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছে। জেন জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কারা?

ওরা নিজেদেরকে যশোয়ার বাবা-মা বলে পরিচয় দিল।  মেয়েটি তার ব্যাগ থেকে যশোয়ার পিকচার আইডি বের করে দেখালো, নিজেদের নাম,  ঠিকানা, ফোন নাম্বার সব কিছুই জানালো। জেন ওদেরকে জিজ্ঞেস করলো, 

-তোমরা কী কোন কোড বলতে পারো যা তোমাদের ছেলেকে বললে বুঝতে পারবে!
-মেয়েটি বলো, আমি ওকে আদর করে 'যসমস',' ক্রিসপি পাই', এঞ্জেল ডাকি।
মেয়েটির কাছ থেকে কোড জেনে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো জেন। ব্যাকইয়ার্ডে গিয়ে শুধু বললো, 

এখানে ক্রিসপি পাই কোনজন?

যশোয়া এগিয়ে এলো, বললো, তুমি এ নাম কী করে জানো? এটা তো আমার সিক্রেট নেম, ওনলি আমার মাম্মা জানে।

-তোমার মাম্মা এসেছে তোমাকে নিয়ে যেতে। মাম্মা বলেছে আমাকে, এটা তোমার সিক্রেট নেম।

জেনকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে যশোয়া এক ছুটে দরজার কাছে চলে এলো। ওর মনেই পড়লো না, একটু আগেই ও বলেছিল, এই বাড়ী ছেড়ে ও আর কোথাও যেতে চায় না।  দরজা ভেতর থেকে বন্ধ বলে ও বাইরে যেতে পারলো না। জেন ও লিন্ডা দুজনেই এগিয়ে গিয়ে যশোয়াকে ওর মা-বাবার হাতে তুলে দিল। এতক্ষণ ছেলেটিকে খুব শক্ত মনে হচ্ছিল, কিন্তু যশোয়াকে কাছে পেয়ে ছেলেটি সবার আগে ভেঙ্গে পড়লো। ছেলেকে বুকে চেপে হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। কাঁদুক,  আরও কাঁদুক।  এ কান্না সুখের, এ কান্না আনন্দের! এ দৃশ্য বড়ই মধুর! জেনের দু'চোখ আবার ভিজে উঠছে।

এরপর মাত্র ঘন্টাখানেকের ভেতর বাকী পাঁচটি ছেলেমেয়েকে ওদের বাবা-মায়েরা এসে নিয়ে গেলো। অবশ্য বাচ্চা হাতে পাওয়ার আগে প্রত্যেককেই কোড নেম বা তেমনি কিছু একটা প্রমাণ দিতে হয়েছে। জেন যখন ফোন করেছিল ওদেরকে, তখনই প্রিপেয়ারড হয়ে আসতে বলেছিল। সাথে বিনয়ের সুরে এটাও বলেছে, যা কিছু জেন করছে, সবই তাদের বাচ্চার নিরাপত্তার কথা ভেবে। সকলেই রোজেন দম্পতিকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বাচ্চা সাথে নিয়ে চলে গেছে।  বাচ্চাগুলো বাবা মায়ের সাথে ফিরে যাওয়ার সময় লিন্ডা প্রত্যেকের হাতে একটা করে ক্রিসমাস গিফটের প্যাকেট ধরিয়ে দিতে ভোলেনি।  যমের চোখ এড়িয়ে আজ সকালে ওরা তাদের  আঙিনায় এসে বসেছিল, লিন্ডার বুকের ভেতরে কান্না গুমরে গুমরে উঠছে। আহারে! ওদের মত করে বাকী বাচ্চাগুলোও যদি এক ছুটে তাদের আঙিনায় চলে আসতে পারতো। ঘরের সমস্ত খেলনা ওদেরকে দিয়ে দিত, আবার আগামী বছরের জন্য খেলনা কেনা শুরু করতো লিন্ডা। এমনি নানা ধরণের উলটাপালটা কথা ভাবছিল আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল। 

সবাই চলে যাওয়ার পর জেন  রেডী হচ্ছিল তার ক্লিনিকে যাওয়ার জন্য। এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো। একবার, দু'বার, তিনবার। জেন একটু অবাকই হলো, কলিং বেল না টিপে কে টোকা দিচ্ছে! আরও কোন বাচ্চা নয় তো!  এমিলি বা এলিস নয় তো! হয়তো কলিং বেলের সুইচ নাগাল পায় নি। এটা মনে হতেই এক দৌড়ে জেন দরজার কাছে গিয়ে কী-হোলে চোখ রাখতেই দেখে অল্প বয়সী এক নারী দাঁড়িয়ে আছে। 

দরজা খুলে জেন জিজ্ঞেস করলো, " বেবী, তুমি কী কাউকে খুঁজছো?

মেয়েটির চোখমুখ দেখেই বুঝা যায়, সে দিশেহারা, চোখ দুটো কেঁদে কেঁদে ফুলে গেছে। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। জেন কাছে গিয়ে পরম মমতায় জিজ্ঞেস করলো, " তুমি কাকে খুঁজছো? আমি তোমাকে কিভাবে হেল্প করতে পারি!

-আমার ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছি না। সকালে ওকে স্কুলে ড্রপ করে গেছি, অফিসে বসেই খবর পেয়েছি স্কুলে গুলী হয়েছে। স্কুলে এসে দেখি পুলিশ ঘিরে আছে। অনেক বাচ্চা মারা গেছে বলে শুনেছি।  যারা সুস্থ আছে, তাদের একজন একজন করে  যার যার মা বাবার হাতে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমার ছেলেকে এখনও দেয় নি। ওদেরকে ছেলের নাম বলেছি, ওরা বলে, সবাইকেই এক এক করে আনা হচ্ছে। দুই ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি, আমার ছেলেকে আনে নি। অনেকেই বলাবলি করছিল, এই বাড়ীতে নাকি কয়েকটি বাচ্চাকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। আমি একটু দেখতে এসেছি, আমার ছেলেটা কি এখানে আছে নাকি!

-মাগো! আমার বাড়ীর আঙিনায় যে ছয়টি বাচ্চা এসেছিল, তাদের সবাইকে বাবা-মায়েরা এসে নিয়ে গেছে। তুমি আবার স্কুলে ফিরে যাও, ছেলেকে ওখানেই পেয়ে যাবে। একটু বেশী সময় লাগছে, এত বড় একটা দূর্ঘটনা সামাল দিতে গিয়ে সকলেই হকচকিয়ে গেছে। আমি বলি, তুমি স্কুলেই পাবে তোমার ছেলেকে। আর যদি তোমার ছেলে অন্য কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকে, সেখান থেকে ও তোমাকে ফোন করবে। তুমি কিচ্ছু ভেবো না মা। চোখ মোছ, একটু শক্ত হও, বিপদ আসবেই, বিপদ সামাল দেয়াটাই বড় কথা। ভেঙ্গে পড়ো না। তোমাকে একটু বিশ্রাম নিতে বলা আমার কর্তব্য ছিল, কিন্তু তা বলতে পারছি না, তোমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। দেখো গিয়ে, হয়তো তোমার ছেলেকে নিয়ে ওরা সবাই তোমার অপেক্ষায় আছে।

মেয়েটি চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো। জেনের বুকটা কেঁপে উঠলো অজানা আশংকায়। এ কেমন সকাল! তার ৬৯ বছরের জীবনে অনেক বিপর্যয় এসেছে, বিপর্যয় কেটেও গেছে, কিন্তু এমন অসহ্য রকমের সকাল এর আগে কখনও আসেনি। ঘরে ঢুকে জেন বাইরে যাওয়ার পোষাক খুলে ফেললো। আজ আর অন্য কোন কাজে মন বসবে না। টিভি অন করাই আছে, কান দুটোকে  সজাগ রেখে জেন টিভির নিউজে মন দিল।

 একটা ছোট্ট ভুল হয়ে গেছে। মেয়েটির ফোন নাম্বার রাখা হয় নি, নাম্বার জানা থাকলে মেয়েটিকে ফোন করা যেতো। বাচ্চাটাকে পেলো কিনা, না জানা পর্যন্ত শান্তি লাগছে না মনটায়। মেয়েটিকে এতটাই বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল যে ওকে একটু আশ্বস্ত করার কথাই মনে এসেছে, ওর ফোন নাম্বার জিজ্ঞেস করার কথা মাথায় আসেনি। জেন মনে মনে প্রার্থণা করতে লাগলো, হে ঈশ্বর, মেয়েটির বুক খালি যেনো না হয়! ও যেনো ওর বুকের মানিককে জীবিত অবস্থায় ফিরে পায়, -আমেন!

টিভিতে একটার পর একটা আপডেট দিয়ে চলেছে। আজ দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি। বাচ্চাগুলো চলে যেতেই লিন্ডা চুপ হয়ে গেছে। দুপুরে প্রেয়ারে বসেছিল,  বাচ্চাগুলো জর্জ আর লিসার বয়সী, খারাপতো লাগবেই।  সারাদিনে আর কেউ আসেনি। 

টিভির সংবাদে  ঘটনাটি মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেছে। সকালে বাচ্চাগুলো ওদের টিচার মিস সোটোর কথা বলছিল বারবার। মিস সোটো নামের মেয়েটির ছবি বার বার টিভি পর্দায় ভেসে উঠছে। দারুণ প্রাণবন্ত এক তরুণী। নিজের ছাত্রছাত্রীদের বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে। আ ব্রেইভ গার্ল!



এ পর্যন্ত বিশটি শিশু মারা যাওয়ার খবর নিশ্চিত করা হয়েছে, তাদের নামগুলো বার বার পড়ে শোনানো হছে। নামগুলো শোনার পর থেকে জেনের হার্ট বীট  বেড়ে গেছে, শরীর অস্থির লাগছে। এক গ্লাস পানি পাওয়া গেলে ভালো হতো, তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই জেন ডুকরে কেঁদে উঠে।  বিশটি বাচ্চার মধ্যে এমিলি আছে, আরও আছে সকালে আসা সেই দিশেহারা মায়ের ছেলেটি!



 পাদটীকাঃ  গত ১৪ই ডিসেম্বার, শুক্রবারের সকালে কানেকটিকাট রাজ্যের নিউটাউন শহরে অবস্থিত  স্যান্ডি হুক এলিমেন্টারী স্কুলে  অ্যাডাম ল্যানজা নামের বিশ বছর বয়সী এক তরুণ, দুই হাতে দুই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করে। সে প্রথমেই স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল, সাইকোলোজী টিচারকে গুলী করে, তাঁরা তৎক্ষনাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এরপর গুলী ছুঁড়তে ছঁড়তে সে আশপাশের  ক্লাসরুমগুলোতে তল্লাশী চালায়। গুলীর আওয়াজ শুনে বিপদ টের পেয়ে ক্লাস ওয়ানের ক্লাস টিচার  মিস ভিক্টোরিয়া  সোটো ঝটপট তার ক্লাসের বাচ্চাগুলোকে ক্লাসরুমের  ক্লজেটের ভেতর ঢুকিয়ে দরজা টেনে দিয়েছিল। খুনী ল্যানজা মিস সোটোর রুমে ঢুকেই বাচ্চাদের খোঁজ করছিল। মিস সোটো বলেছিল, বাচ্চারা  ঐ দূরের অডিটোরিয়ামে আছে। কিন্তু মিস সোটোর কথা শেষ না হতেই দরজার আড়াল থেকে কিছু বাচ্চা দৌড়ে সামনে চলে আসে। বাচ্চাগুলো প্রাণভয়ে দৌড় দিয়েছিল, কিছু বের হতে পেরেছে, বাকীগুলোর বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে ল্যানজার গুলীতে। একই সময়ে মিস সোটোকেও হত্যা করা হয়। এর মধ্যেই পুলিশ চলে আসার আলামত টের পেয়ে ল্যানজা নিজের মাথায় গুলী করে। পুলিশ এসে ক্লজেটের ভেতর থেকে লুকিয়ে থাকা বাচ্চাদের বের করে নিয়ে আসে। সংবাদে আরও জানা যায়, মিস সোটোর রুমে প্রবেশ করার আগে ল্যানজা আরেকটি ক্লাসরুমে ঢুকে ক্লাস টিচারসহ পনেরটি বাচ্চাকে মেরে ফেলে।  মিস সোটোর রুম থেকে যারা পালাতে পেরেছিল, তারাই আজ জেন রোজেনের বাড়ীতে  আশ্রয় নিয়েছিল। স্কুলটিতে প্রবেশ করার আগে সে নিজ বাড়ীতে তার মা'কে গুলি করে হত্যা করে।








Friday, December 14, 2012

'৭১ এর এক টুকরো স্মৃতি!

সময়টা ছিল খুব সম্ভব মে মাসের মাঝামাঝি। ঊনিশ'শ একাত্তর সালের  কথা বলছি। ২৫শে মার্চের কালো রাতের পর, নারায়ণগঞ্জ শহর ছেড়ে অনেকেই পালাতে শুরু করে।  ২৭ শে মার্চ  আমরাও  শহর থেকে পালিয়ে উদ্ধবগঞ্জ নামের একটি গ্রামে পৌঁছেছিলাম দাদু দিদিমার সাথে। উদ্ধবগঞ্জে দাদুর মুহুরীর বাড়ী। প্রাণভয়ে প্রচুর মানুষ ঐ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। আমার মা বাবা তখনও নারায়ণগঞ্জ শহরেই থেকে গেছিলেন, পরিস্থিতি আঁচ করার জন্য। আমাদের বয়স কম ছিল, একেবারেই শিশু,  যুদ্ধের ভয়াবহতা বুঝবার মত বোধ তৈরী হয়নি। শুধু বুঝতাম, পাকিস্তানী মিলিটারীদের সামনে পড়ে গেলেই গুলী করে মেরে ফেলবে। পাকিস্তানী মিলিটারীর ভয়েই সবাই পালিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে গোলাগুলির সংবাদ, পাড়া  ছেড়ে সবাইকে পালাতে দেখে, ভয়ের বদলে ছোটদের মনে ছিল 'যুদ্ধ-যুদ্ধ' খেলার সাময়িক উত্তেজনা।  শহর ছেড়ে  দূরে কোথাও চলে যেতে পারছি, সেই ভেবে আনন্দ।


উদ্ধবগঞ্জের পাশের গ্রাম সোনারগাঁও।  সেখানে দাদুর আরেক মক্কেল ননীবাবুর বাড়ী। মুহুরীবাবুর বাড়ীতে  গাদা গাদা অসহায় মানুষের পাশে উকিল বাবুকে উনি থাকতে দিতে চান নি। দশ বারো দিনের ব্যাপার, সব ঝামেলা চুকে গেলে উকিলবাবু আবার নারায়ণগঞ্জে উনার নিজের বাড়ীতে ফিরে যাবেন, এই কয়টা দিন নিজের বাড়ীতে এনে আদর সমাদর করা উনার বিরাট দায়িত্ব হিসেবে মেনে নিলেন।   লাল ইঁটের দোতালা দালানে উনি আমাদেরকে নিয়ে তুললেন। দশ বারোদিনের মধ্যে সব ঝামেলা চুকে যাবে, ননীবাবুর ধারণাটি সঠিক ছিল না। দশ বারোদিনের পরিবর্তে আমরা দুই মাস থেকে গেলাম।  এই দুই মাস ছোটদের জন্য ছিল বেশ সুখের সময়। আমাদের দালান থেকে সোনারগাঁও জমিদার বাড়ী  দেখা যেত,  দালানের পেছনদিকে  যে বিশাল বড় মাঠ দেখা যেত, সেই মাঠ পেরোলেই ছিল  'পানাম' জমিদার বাড়ি ।


দুইদিকে জমিদার বাড়ী দেখে নিজেদেরকেও জমিদার জমিদার মনে হতো। বাড়ীর সামনেই বিশাল চওড়া দীঘি ছিল, দীঘির জলে প্রচুর মাছ, চারদিকে চার ঘাটলা, রাতের বেলা খাওয়া দাওয়া শেষে বাসন ধুতে গেলে দেখা যেত, ঘাটের উপরে চিংড়ি মাছ, বড় বড় পুঁটি মাছেরা এসে ভীড় করেছে। আমার দাদুর বাজার করার ব্যাপারে ছিল দারুণ খ্যাতি। প্রতিদিন সকালে বাজারে গিয়ে তিন চার সের দুধ কিনতো, মাছ কিনতো। আসলে তখন সব কিছুই সস্তা দেখে দাদুর যুদ্ধের কথা মাথায় থাকতো না।  অনেক বড় হয়ে বুঝেছি, দাদুর মাথায় আইনের ধারা ছাড়া আর কিছু খেলা করতো না।  রাজনীতি নিয়ে কখনও মাথা ঘামাতেন না। রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতেন আমার বাবা। সেজন্যই বাবার কাছে খুব অস্বস্তিকর মনে হতো যখন দাদু বাজার থেকে দুধের কারিয়া হাতে বাসায় ফিরতো।


দাদু সাথে করে যা কিছু টাকা নিয়ে এসেছিল, সেগুলিই দেদারসে খরচ করে যাচ্ছিল। উনার ধারণা ছিল, আগামী সপ্তাহেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এমন ধারণা করার কারণও ছিল,  উনার মক্কেলরাই উনার কাছে সংবাদ এনে দিত, সামনের সপ্তাহেই সব ঠিক হয়ে যাবে! বাবা মানা করতেন, বাজার করার বহর দেখলে মানুষ ভুল বুঝতেও পারে। ঠিকই মিলেছে বাবার কথা,  দাদুর বাজার করার বহর দেখে 'বাজারে' কেউ কেউ কুমতলব  আঁটতে শুরু করে। দুই দিন পর পর দূরের গ্রামে ডাকাত পরার সংবাদ পাওয়া যায়। হঠাৎ এক রাতে খুব কাছে থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ শোনা যায়।  আরেকদিন, সকালের দিকে কেউ এসে বলে, 'বাজারে মিলিটারী আইছে', ব্যস, মা আর দিদিমা সাবান, জল নিয়ে মাথার সিঁথিতে থাকা সিঁদুর ঘষে ঘষে তুলে ফেলে। এরপর আমাদের নিয়ে পাশের মুসলমান বাড়ীতে গিয়ে পালিয়ে  থাকে। কিছুক্ষণ পরে আবার সব ঠিকঠাক হয়ে যায়।

পরের দিন ননীবাবু এসে দাদুকে বলতে বাধ্য হয়, " বাবু, অবস্থা ভাল ঠেকতেছে না। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জের অবস্থা খুব খারাপ। মিলিটারী বাইছা বাইছা হিন্দু ধইরা ধইরা মারতে আছে। হিন্দু মাইয়াগোরে ধইরা লইয়া যাইতাছে। কী করুম! আপনে আমার অতিথি। আপনেরে এইভাবে রাইখা আমি কোথাও যাইতে পারুম না। ছোট ছোট পোলাপান লইয়া আগরতলা  চলে গেলে কেমন হয়!"।

আমার দাদু খুব ভীরু প্রকৃতির ছিলেন। ননীবাবুর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, সোনারগাঁও আর থাকা যাবে না। আগরতলা দিয়ে কলকাতা চলে যাবেন। ননীবাবু নিজেও চলে যাবেন। নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে এখানে আমাদের সুখেই দিন কাটছিল। এর মধ্যে দাদু সোনারগাঁও ছেড়ে যেতে চাইছেন শুনে ছোটদের মনে আবার কিছুটা উত্তেজনা দেখা দিল। নতুন কিছু ঘটার অপেক্ষা, নতুন কিছু শোনার অপেক্ষায় আমাদের প্রহর গোনা শুরু হলো। দুই দিন পরেই বাজারে একদল ডাকাত ধরা পড়ে। পরে জানা যায়, আমাদের অস্থায়ী নিবাসে ডাকাতি করার জন্যই ওরা আসছিল। এই সংবাদ শোনার পরে বড়দের সকলেই একমত হলো, সবকিছু গোছগাছ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই গ্রাম ছেড়ে পালাতে হবে।

আমরা নারায়ণগঞ্জ থেকে হাতব্যাগে যে কয়টা জামাকাপড় আঁটে, তাই নিয়েই চলে এসেছিলাম। এখনতো আর নারায়ণগঞ্জে ফিরে যাওয়া যাবেনা, তাছাড়া আগরতলা যাওয়া ছাড়া আর কোন গতিও ছিল না। হাতে কিছু টাকা পয়সা না নিয়ে এতগুলো বাচ্চা নিয়ে কোথাও বের হওয়াও মুশকিল। মায়ের সোনা গয়নার ছোট পোঁটলা, দিদিমার কিছু গয়না নারায়ণগঞ্জের বাসাতেই ট্রাঙ্কে রয়ে গেছিল। কোন অজানার ঊদ্দেশ্যে রওণা হচ্ছি সবাই, আর কখনও ফিরে আসা হবে কিনা, সেই ভয়ে মা আর দিদিমা নিজেদের গয়নাগুলো  নারায়ণগঞ্জের বাসায় ফেলে যাওয়া সমীচীন মনে করেনি। সিদ্ধান্ত হয়, দাদুর মুহুরী হামিদ মিয়ার সাথে মা যাবে শহরে, ঘরবাড়ি তালা মেরে আসতে হবে, কিছু টাকা তুলতে হবে ব্যাঙ্ক থেকে, সাথে গয়নাগুলো নিয়ে আসবে। এভাবে এক কাপড়ে  কোথাও যাওয়া যায় না, কিছু কাপড়-চোপর নিয়ে আসতে হবে। ঘরে যখন এগুলো নিয়ে আলাপ হচ্ছিল, আমি চুপচাপ সব শুনে যাচ্ছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, সোনা গয়না মাটির নীচে গর্ত করে রেখে দিলেই তো কেউ জানতে পারবে না। নিজের মতামত জানাতেই এক ধমক খেলাম, বড়দের গোপন পরামর্শ শুনে ফেলেছি বলে।

পরের দিন খুব সকালে হামিদ নানা আসবে। মা'কে মুসলমান বৌ সাজিয়ে নেয়া হবে। মুসলমান সাজার একটাই মাত্র উপায়, বোরকায় নিজেকে ঢেকে ফেলা। দুই মাসে সোনারগাঁও এর আশেপাশের মানুষজনের সাথে আমাদের খাতির হয়ে গেছিল। পাশের বাড়ীর সখিনার মায়ের কালো বোরকা আনা হলো। আমার মা খুব সুন্দরী ছিলেন, বয়স কম ছিল, কিন্তু ব্যক্তিত্ব ছিল খুব প্রখর। তাছাড়া নারায়ণগঞ্জ মায়ের জন্মস্থান, পেশায় শিক্ষক, মনের জোর ছিল আলাদা। তাই মা'কে নিয়ে কেউ দুঃশ্চিন্তা করছিল না। আগের সন্ধ্যায় আমাদের সবার সামনে মা'কে বোরকা পড়িয়ে ট্রেনিং দেয়া হলো। বোরকার মুখের উপর যে পর্দা থাকে, সেই পর্দার ঝিরি ঝিরি ফুটো দিয়ে মা ভাল করে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। তাই এলোমেলোভাবে পা ফেলছিল। তাই দেখে আমরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিলাম।

পরের দিন খুব সকালে মা তাদের 'হামিদ চাচা'র সাথে রওনা হয়ে গেলো। পানামের দিকে যেতে যে বিশাল মাঠ, সেই মাঠ পেরিয়ে কালো বোরকা পড়া মা'কে যেতে দেখে আমার বুকটা মুচড়ে উঠেছিল। কেনো জানি মনে হচ্ছিল, মা আর ফিরে আসবে না। সারাদিন বাড়ীতে সবাই চুপ করে বসেছিল। ছোটরা হই হই করছিল না। দিন পার হয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসতেই তিন বছর বয়সী ছোট ভাই কান্না শুরু করে দেয়, মা আসেনা ক্যান, মা আসেনা ক্যান বলে। ঠিক অন্ধকার হওয়ার আগ মুহূর্তে আমার মেজভাইকে দেখা গেল, দূর থেকে দৌড়ে আসছে। মা আইছে, মা আইছে বলে চীৎকার করছিল, মেজদার চীৎকার শোনার সাথে সাথে দিদিমা, ঠাকুমার দেহে প্রাণ ফিরে আসে।  দেখা গেল, মায়ের সাথে আমার দুই মামাও চলে আসছে। বলা বাহুল্য,' দেখা যাক কী হয়' ধারণা নিয়ে আমার দুই মামা শহরে তাদের মুসলিম বন্ধুদের সাথেই রয়ে গেছিল। মা যখন ঘরে ফিরে বোরকা খুলেছে, মায়ের চেহারা রক্তশূণ্য। আমি তো আর রক্তশূন্য বুঝিনা, দিদিমাকে বলতে শুনেছি, ' কী হইছিল? তোর চেহারা এমুন দেখা যায় ক্যান? একেবারে রক্তশূইন্য চেহারা"!

হামিদ নানা বলল, " কর্তা, আম্মারে লইয়া আইজ বড় বিপদের মইদ্যে পড়ছিলাম। আর দিন পায় নাই, আইজই আজরাইল আইয়া হাজির অইছে নারায়নগঞ্জ শহরে। আম্মারে বাড়ীর ভিতরে পাঠাইয়া দিয়া আমি গেছি কোর্ট বিল্ডিং এ, গিয়া আধ ঘন্টা দাড়াইতে পারি নাই, ট্রাক ভইরা মিলিটারী আইয়া হাজির। মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ি, আমি কলেমা পড়ুম কী, আম্মার কথা মনে অইতেই আমি অস্থির অইয়া গেছি। ক্যামনে ক্যামনে যে আম্মারে আবার আপনের কাছে ফিরাইয়া দিতে পারছি, আমি নিজেই কইতে পারুম না"।

আমরা মায়ের দিকে তাকিয়ে আছি, মা কী বলে! মা হামিদ নানাকে কিছু খেতে দিতে বললো সবার আগে। এরপর মা যা বললেন, তা রীতিমত ভয়াবহ। শহরে আমরা থাকতাম বিরাট বড় এক বাড়ীতে, যেখানে শুধু বাড়ীওয়ালা ছিলেন মুসলমান, ভাড়াটেদের সবাই হিন্দু। কাজেই এই বাড়ী হিন্দু বাড়ী নামেই বাইরে পরিচিত ছিল। দরজার তালা খুলে মা কেবল ঘরে ঢুকেছে, বাড়ীর মালিক, হাজী সাহেবের কাছে সংবাদ চলে এসেছে, নারায়ণগঞ্জে মিলিটারী ভর্তি ট্রাক ঢুকছে।  পাড়ায় পাড়ায় বাড়ী বাড়ী সার্চ করতেছে। এই কথা শোনার সাথে সাথেই একটু আগে খুলে রাখা বোরকা পড়ে নিয়ে মা কোনমতে ট্রাঙ্ক খুলে টাকা, গয়না নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলে। কাপড় চোপর আলনার মধ্যে যা ছিল, তাই টেনে নিয়ে বোঁচকা বাঁধে। মা ভেবেছিল, আমাদের পাড়ার ভেতর ঢোকার আগেই মা হামিদ চাচার সাথে বের হয়ে যেতে পারবে। কিন্তু তা সম্ভব হয় নি। হামিদ চাচা তখনও কোর্ট থেকে এসে পৌঁছেনি, কিন্তু ততক্ষণে আমাদের পাড়ার ভেতর মিলিটারী ঢুকে গেছে। পাড়াটা হিন্দুপ্রধান ছিল বলে মিলিটারীরা প্রতি বাড়ীতে ঢুকে ঢুকে সার্চ করছিল। এই সুযোগে হাজী সাহেব আমার মা'কে দাদুর বৈঠকখানা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে দেয়।

বেড়ার ঘরের ভেতর বসে মা ঠকঠক করে কাঁপছিল। বাইরে বুটের আওয়াজ শুনে মা'র গলা শুকিয়ে কাঠ। বেড়ার ঘরের দরজায় একটা ছোট লাথি দিলেই দরজা ভেঙ্গে যাবে। মা তো আর ঊর্দু কথা বুঝেনা, তারপরেও হাজী সাহেবের কথা শুনছিল, " কাফের নেহী হ্যায়, মুসলমান হ্যায়"। এতবড় বাড়ী টহল দিয়ে দেখেছে,  লাভ হয় নি, সব বাড়ির দরজা তালাবন্ধ, কেউ কোথাও নেই। মিলিটারীরা চলে গেলো। আমার মামা কোথাও লুকিয়ে ছিল, মিলিটারী সরে যেতেই মামা, হামিদ নানা এসে উপস্থিত। তারা শুনে এসেছে, কাছাকাছি কোথায় নাকি এক বাড়ীতেই দুই জনকে গুলী করে মেরে ফেলেছে। ততক্ষণে আমার মায়ের দেহে প্রাণ ছিল না। ঘরের মজুত খাদ্য বাড়ীওয়ালাকে দিয়ে দিলেন, নিজের সেলাই মেশিন আর ঘরের একটা মাত্র সিলিং ফ্যান মামার বন্ধুর বাড়ীতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ব্যস! কিছু টাকা আর গয়না নিয়ে হামিদ চাচার সাথে রওনা হয়ে গেলেন। পথে গাড়ী-রিকশা বন্ধ ছিল বলেই ঘুরপথে, মিলিটারীর চোখ এড়িয়ে 'হামিদ নানা উনার 'আম্মারে'  উকিল বাবুর কাছে এনে পৌঁছে দিয়ে যায়। সেদিন থেকে আমরা যারা ছোট ছিলাম, তারা হঠাৎ করেই বড় হয়ে গেলাম। বুঝে গেলাম, যুদ্ধ কোন খেলা নয়, এর সাথে বাঁচা-মরা জড়িত। মা' আর একটু হলেই মিলিটারীর কাছে ধরা পড়ে যেতে পারতো, কোনদিন আর ফিরে আসতোনা । এরপর তো সোনারগাঁও থাকার আর কোন যুক্তিই ছিল না। এই ঘটনার সাত দিনের মধ্যেই আমরা ননীবাবুর আশ্রয় ছেড়ে, ননীবাবুর ঠিক করে রাখা দালালের পিছু পিছু  রওনা দিয়েছিলাম।