মায়ান
ক্যালেন্ডার কিঃ
মায়ান
ক্যালেন্ডার শব্দটি এসেছে মায়া সভ্যতা থেকে। বর্তমান মেক্সিকো, বেলিজ থেকে‘মায়া’ সভ্যতার উৎপত্তি,
প্রাচীন মেসোআমেরিকান মায়া সভ্যতার কথা কম বেশী সকলেই জানে।, যার শুরু খৃষ্টপূর্ব
২০০০ সালেরও অনেক আগে থেকে। মায়ান যুগের মানুষ গণিতশাস্ত্র, স্থাপত্যকলা,
চিত্রকলা, জ্যোতির্বিদ্যায় ছিল মহা পারদর্শী। গণিতে ‘জিরো’র হিসেব মায়ান সভ্যতা
থেকেই এসেছে। মায়ান গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিদগন ভবিষ্যতে পৃথিবীতে কী কী ঘটবে, সেই
সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে তৈরী করেছিলেন ক্যালেন্ডার, যা মায়ান ক্যালেন্ডার নামে
পরিচিত। ধারণা করা হয়, মায়ান ক্যালেন্ডার তৈরী হয়েছিল নির্ভুল গননা অনুসারে, ক্যালেন্ডারে
বর্ণিত ভবিষ্যতবাণী বিশ্বাস করে, পৃথিবীতে এমন মানুষের সংখ্যা প্রচুর। অনেকের মতে,
এই ক্যালেন্ডারে কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া সুনামি’র উল্লেখ আছে, ৯/১১ এর টুইন টাওয়ার
ধ্বংসের কথাও আছে। কাজেই অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে ক্যালেন্ডারে উল্লেখিত
ভবিষ্যত বাণী অনুযায়ী, ২১শে ডিসেম্বার ভয়ানক কিছু ঘটতে যাচ্ছে।কী ঘটতে পারে ২১শে ডিসেম্বারঃ
চারদিকে গুঞ্জণ শোনা যাচ্ছে, ২১ তারিখে ভয়ানক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। কী ঘটতে যাচ্ছে, অথবা আদৌ কিছু ঘটতে যাচ্ছে কিনা, সেই সম্পর্কে কেউ কিছু জানেনা। কেউ কেউ ভাবছে, সেদিন ভুমিকম্প হবে, অথবা গ্যালাক্সীতে এমন কিছু উলট-পালট হবে যে পৃথিবীর প্রাণীকূলের মাথা খারাপ হয়ে যাবে, একজন আরেকজনের প্রতি মারমুখী হয়ে উঠতে পারে, পারস্পরিক হানাহানি হতে পারে। এলিয়েন আসতে পারে, এলিয়েনের ভয়ানক থাবার আঘাতে অনেকের মৃত্যু ঘটতে পারে। এমনও হতে পারে, জুম্বি ( জীবন্ত মৃত মানুষ) এসে আক্রমন করতে পারে। যৌক্তিক গল্পের পাশাপাশি অতিরঞ্জিত গল্প তৈরীতে সাধারণ আমেরিকানদের জুড়ি নেই। নানা ধরণের আজগুবি গল্পের কারণেই সকলের মধ্যে একই সাথে আশংকা ও কৌতুহল কাজ করছে। ভয়ংকর কিছু যদি ঘটে, তা ঠিক কোন মুহূর্তে ঘটবে, সে সম্পর্কে কারোর মনেই কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। অনেকের মতে, ভয়াবহ সুনামি হতে পারে, ভয়ানক ঘূর্ণিঝড় বা টর্নেডো, ভুমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতও হতে পারে। কেউ কেউ মনে করে, ভিন গ্রহ থেকে এলিয়েন আসবে, ধ্বংসলীলা চালাবে পৃথিবীব্যাপী। এমনও হতে পারে, পৃথিবী, বিভিন্ন গ্রহ এবং সূর্য, একই লাইনে চলে আসবে, শুরু হবে ভয়ংকর প্রাকৃতিক তান্ডবলীলা, অথবা সূর্য চলে যাবে ব্ল্যাক হোলের আড়ালে, পৃথিবী ঢেকে যাবে ঘন আঁধারে! এই ধরণের নানা রকম কাল্পনিক আশংকা নিয়ে সকলে অপেক্ষা করছে আসন্ন ‘পৃথিবী শেষ’ মুহূর্তটির জন্য। তবে শুকনো মুখে সর্বনাশের অপেক্ষায় থাকার মত মানসিকতা আমেরিকানদের মধ্যে নেই। শেষ মুহূর্তটিও উপভোগ করার নীতিতে বিশ্বাসী সাধারণ আমেরিকানরা সাত দিন আগে থেকেই মজুত করতে শুরু করবে খাবার দাবার, কোল্ড ড্রিঙ্কস, শুকনো খাবার, পানি, হার্ড ড্রিঙ্ক, মোমবাতি, টর্চসহ আরও আবশ্যকীয়, অনাবশ্যকীয় জিনিসপত্র।
যারা অনেক বেশী যুক্তিবাদী, হুজুগে মেতে উঠেনা, তাদের মধ্যেও অনেকের ধারণা, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মত ভয়ানক কিছু না ঘটলেও, নানা কারণেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় হতেই পারে। তাই যে কোন ধরণের খারাপ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আগাম প্রস্তুতি থাকা ভাল। তাদের মতে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে হিসেব অনুযায়ী জরুরী ভিত্তিতে পাণীয়, শুকনো খাবার, ফার্স্ট এইড, ইমার্জেন্সী লাইটের ব্যবস্থা রাখা উচিত।
তরুণ-তরুণীদের
মধ্যে আসন্ন ২১শে ডিসেম্বার নিয়ে দূর্ভাবনা নেই, বরং তারা ‘বিদায় পৃথিবী’ উৎসব
আয়োজনের চিন্তা করছে। আমেরিকার জনগন হুজুগপ্রিয়। যেহেতু ২১শে ডিসেম্বার পৃথিবী
ধ্বংস হয়ে যাওয়া নিয়ে হাস্যকর অথবা অস্বস্তিকর রব উঠেছে, তাই পার্টি পাগল
আমেরিকানদের মাথায় ‘ বিদায় পৃথিবী’ পার্টি আমেজ চলে এসেছে। তরুণ-তরুণীরা এখন থেকেই
নানা ছুতোয় পার্টি করে চলেছে, এবার ক্রীসমাস পার্টি হবে কি না, তা বুঝা যাবে ২১
তারিখের পরে। কাজেই ২১ তারিখে যদি পৃথিবী ধ্বংসই হয়ে যায়, ২০ তারিখে ‘বিদায়
পৃথিবী’ বা ‘শেষ পৃথিবী’ নাম দিয়ে ইচ্ছেমত আনন্দ ফূর্তি করতে বাধা কোথায়। বিভিন্ন
স্টোরগুলোতে ২১শে ডিসেম্বার সামনে রেখে নানা রকম বিনোদন উপকরণের সামগ্রী বিক্রী
শুরু হয়েছে।
একটা বিষয় পরিষ্কার হচ্ছেনা, মায়ান ক্যালেন্ডারে কি শুধুই আমেরিকার ভুত-ভবিষ্যতের কথা লেখা আছে, নাকি বাংলাদেশের কথাও লেখা আছে? মায়ান ক্যালেন্ডারে যদি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কথা লেখা না হয়ে থাকে, তাহলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সাথে নিশ্চয়ই বাংলাদেশের কোন যোগসূত্র নেই, বাংলাদেশ অবশ্যই ধ্বংসযজ্ঞের আওতামুক্ত থাকবে। ডিসেম্বার মাস বাংলাদেশের বহু আদরের-বহু আকাংক্ষার ‘বিজয়ের মাস’। আমেরিকাবাসী যখন আসন্ন ‘শেষ পৃথিবী’ পার্টি করবে, বাংলাদেশের জনগনের ততদিনে ‘বিজয় দিবসের’ পার্টি বা আনন্দানুষ্ঠান উদযাপন করা হয়ে গেছে!
আপাততঃ পৃথিবী
ধ্বংস হচ্ছেনা!
২১শে ডিসেম্বার
কী পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে? কঠিন পাথরের চাঁই ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়বে? ভূমি ফেটে
চৌচির হয়ে যাবে? ধরণী দুই ভাগ হয়ে যাবে? সমুদ্রের জল ডাঙ্গায় উঠে আসবে? সম্ভবত
এগুলোর কোনটাই হচ্ছে না। মায়ান ক্যালেন্ডারে কী বলা আছে? মায়ান ক্যালেন্ডারে কী
উল্লেখ করা হয়েছে যে ২১শে ডিসেম্বার পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে! না, মায়ান
ক্যালেন্ডারে আক্ষরিক অর্থে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার কথা কোথাও উল্লেখ করা হয় নি। যদিও
মায়ান ক্যালেন্ডারের গ্রহণযোগ্যতা অনেক, কারন খৃষ্টপূর্ব ২০০০ বছর আগে ‘মায়া’
সভ্যতার শুরু। মায়া সভ্যতার সময়কালীন মায়ান জনগন গণিতবিশারদ ছিলেন। তাঁদের নির্ভুল
হিসেব ও গননা অনুযায়ী মায়ান ক্যালেন্ডার তৈরী হয়েছিল। ৫,২০০ বছরের আগাম গণনা করা
আছে এই ক্যালেন্ডারে, যা শেষ হতে চলেছে ২০১২ সালের ২১শে ডিসেম্বার। অর্থাৎ মায়ান
ক্যালেন্ডারের পাতা ফুরিয়ে গেছে, ২১ ডিসেম্বার মায়ান ক্যালেন্ডার শেষ হয়ে যাচ্ছে,
অথচ মায়ান ক্যালেন্ডার বিশ্বাসীগন এটাকেই পৃথিবী ধ্বংসের দিন অথবা ‘ডুম ডে’ হিসেবে
চিহ্নিত করেছে। প্রকৃতপক্ষে ক্যালেন্ডারের পাতা শেষ হওয়ার সাথে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে
যাওয়ার কোন সম্পর্ক নেই।
তবুও এবং তারপরেও অনেকের মনে এখনও সন্দেহ এবং ভয়
বাসা বেঁধেছে। তারা বাস করছে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে। পৃথিবী জুড়ে এমনিতেই
নানা অশান্তি, চারিদিকে যুদ্ধ বিগ্রহের হুমকী ধামকী শোনা যায়, আবহাওয়ায় ব্যাপক
পরিবর্তণ, ক্রমান্বয়ে আবহাওয়া শুষ্ক হয়ে উঠেছে, বৃষ্টির অভাব, অকালে বন্যা,
সুনামী, ভুমিকম্পতো লেগেই আছে। এই সকল দূর্যোগের পরিনতিও ভয়াবহই। মায়ান
ক্যালেন্ডারের হিসেব অনুযায়ী ২১শে ডিসেম্বার না হলেও অচিরেই সারা
পৃথিবীব্যাপী হাহাকার শুরু হবে। মানব
সভ্যতার অতি আধুনিক ক্রমবিকাশের সাথে সাথে পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও ক্রমেই বৃদ্ধি
পাচ্ছে। নিউ ইয়র্কের আকাশরেখা অনেক কালো হয়ে এসেছে, হারিকেন স্যান্ডির দাপটে
নিউইয়র্কের মত বিশাল সিটির জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে, হ্যালুইনের সন্ধ্যায়
নিউইয়র্কসহ আশেপাশের আরও শহরে নেমে আসে ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা। বৈজ্ঞানিকগন আশংকা
করছেন, বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা যে আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা মানব সভ্যতার
হুমকীস্বরূপ। তাহলেই কী পৃথিবী হঠাৎ করে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে? নাসা বিজ্ঞানীদের
মতে, এখনই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে না। তাঁরা মায়ান ক্যালেন্ডার এবং ক্যালেন্ডারে
বর্ণিত পৃথিবী ধ্বংসের ব্যাপারটিকে হেসে উড়িয়ে দিচ্ছেন।
তারা তাঁদের বক্তব্য মায়ান অনুসারীদের ‘পৃথিবী
ধ্বংস’ তত্ত্বের বিপক্ষে নিজেদের নানা যুক্তি, তত্ত্ব ও তথ্যসহ পরিবেশনের মাধ্যমে
আমাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে দুই চারটি যুক্তি পড়লেই সকলের চিন্তা
চেতনা থেকে অমূলক ভয় কেটে যাবে।
প্ল্যানেট নিবিরু
মায়ান বিশ্বাসীদের ধারণা, অতি খারাপ প্ল্যানেট
‘নিবিরু’ নেমে আসবে পৃথিবীর বুকে, এবং পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষ বাঁধবে। এই সংঘর্ষ ২০০৩
সালে হওয়ার কথা ছিল, হয়নি, তা বলাই বাহুল্য। প্রকৃতপক্ষে নাসা বিজ্ঞাণীরা
‘নিবিরু’র অস্ত্বিত্ব অস্বীকার করেছেন। কাল্পনিক ‘নিবিরু’ প্ল্যানেটের কোন
অস্তিত্ব মহাকাশ বিজ্ঞাণীরা এখনও পান নি।
কসমিক এলাইনমেন্ট
অনেকের ধারণা, ২১শে ডিসেম্বারেই সৌর মন্ডলীর সকল গ্রহ,
উপগ্রহ হঠাত করে এক লাইনে চলে আসবে, যার প্রভাবে পৃথিবীতে আমূল পরিবর্তণ হবে। কারো
কারো মতে, এই দিনে সূর্য্য সৌরমন্ডলীর সমতলে চলে আসবে। কিন্তু বিজ্ঞাণীরা বলেছেন,
সূর্য্য অবশ্যই গ্যালাক্সীকে অতিক্রম করবে, তবে তা করতে ৬৭ আলোক বর্ষ লেগে যাবে,
যা কিনা কয়েক মিলিয়ন বছরের সমতুল্য।সৌর ঝড়
ডুম’ডে বিশ্বাসীদের মতে, ২১শে ডিসেম্বার সৌর ঝড় হতে পারে। সৌর ঝড়ে সূর্য্য সাধারণত তেজষ্ক্রীয় কনা বিকিরণ করে, যা পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষ ঘটলে রাতের আকাশে আলোর ফুলকী সৃষ্টি করে এবং এই সংঘর্ষের ফলে স্যাটেলাইটের ক্ষতি হতে পারে, বৈদুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতে পারে। ১৮৫৯ সালে একবার সৌর ঝড় হয়েছিল, এর পরে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের চোখে সৌর ঝড়ের সম্ভাবনা নেই।
মেরু পরিবর্তন
মায়ান ক্যালেন্ডারে বিশ্বাসীদের মতে, ২১শে ডিসেম্বার
পৃথিবীর দুই মেরুর মধ্যে স্থান পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা আছে, এবং তা হলে পৃথিবী
ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বিজ্ঞানীগন দুই মেরুর মধ্যেকার ‘ফ্লিপ-ফ্লপের’ কোন সম্ভাবনা
দেখতে পাচ্ছেন না। প্রতি ৫০০,০০০ বছরে প্ল্যানেটে পোল ফ্লিপ-ফ্লপ হইয়ে থাকে। আপাতত
সে সম্ভাবনা নেই।
সুতরাং পৃথিবী
ধ্বংস হয়ে যাওয়ার হাস্যকর ভীতি থেকে সকলকে মুক্ত থাকার আহবান জানিয়েছে নাসার
বিজ্ঞানীগন।
:) বেশ লিখেছ।
ReplyDelete