Tuesday, December 11, 2012

রোস্টেড টার্কী--যে স্বাদ ভুলবার নয়!!!

ছোট ছোট তিন মেয়েকে সাথে নিয়ে  আমেরিকা এসেছি ২০০১ সালের ১১ই অক্টোবার। আমার স্বামী  ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার সেলেম ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনার চাকুরী নিয়ে এসেছিলেন। সেলেম খুবই ছোট ইউনিভার্সিটি শহর।  জনবসতি খুবই কম। তার উপর বাঙ্গালীর কোন নাম গন্ধই ছিল না। দিন পনের সেলেম শহরে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।  মানুষের মাঝে থাকার জন্য ক্লার্ক্সবার্গ নামে অপেক্ষাকৃত জনবহুল এবং বড় শহরে আমরা বাসা ভাড়া নিয়ে চলে আসি। দেশ থেকে চাট্টি বাট্টি গুটিয়ে চলে এসেছি, মনের অবস্থা খুবই খারাপ। প্রতিদিন তিন মেয়েকে সাথে নিয়ে ঠ্যাং ছড়িয়ে কাঁদতে বসি। এমনিতে আমি কাঁদিনা, ছিঁচকাঁদুনে বলতে যা বুঝায়, আমি তার ধারে কাছেও নই। ছোটবেলায় মা-বাবার কড়া শাসনে থেকেও কাঁদেনি যে মেয়ে, সে কিনা আমেরিকার মত এমন রাজকীয় দেশে এসে কান্নাকাটি শুরু করে দিল!

স্বামী বেচারা আমাদের নিয়ে কিছুটা ফাঁপরে পড়ে গেছে! আমেরিকা যাব, আমেরিকা যাব বলে আমিই সবচেয়ে বেশী আবদার করতাম। আমেরিকা নিয়ে আমার স্বামীর বেশ আহ্লাদীপনা থাকলেও বাংলাদেশেই সে মহাসুখে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতো, ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল, কী করতে যে আমার কথা শুনতে গেলো! আমার কথা শুনেই তো আমেরিকার দুই একটা ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করেছিল। সেলেম ইউনিভার্সিটি থেকে তাকে  জব অফার দিয়েছেই যখন, তখন স্ত্রীর এই আকাংক্ষাটুকু পূরণ করতে অসুবিধা কোথায়! এই ভেবেই ভদ্রলোক চাকুরীটি নিয়ে ফেলে। কিন্তু তখন স্ত্রীকে আর জানায়নি, বাঙ্গালী বিবর্জিত পাহাড়ী রাজ্যে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যেখানে একটি চাইনিজ গ্রোসারী শপ পর্যন্ত নেই। পৃথিবীর সব দেশের আনাচে কানাচে ইন্ডিয়ান প্যাটেল ব্রাদার্সের গ্রোসারী শপ থাকে, অথচ ব্যতিক্রম শুধু সেলেম, ক্লার্কসবার্গ আর ব্রীজপোর্ট নামের তিনটি শহর! আমার কান্নাকাটি বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেল। বাঙ্গালী নেই ব্যাপারটি তবুও মেনে নেওয়া যেত, ঘরে প্রচুর গল্পের বই ছিল, দুই বছর বয়সী ছোট মেয়েটা ছিল, সময় কাটতে পারতো। কিন্তু সমস্যা হলো রান্না করতে গিয়ে। মাছ, ডাল, কাঁচামরিচের মত অতি গুরুত্বপূর্ণ তিনটি জিনিসের অভাবে আমার রান্নাঘরে ঠিকমত চুলাই জ্বলতো না। শুধু চিকেনের ঝোল রাঁধতে আর কতক্ষণই বা লাগে! কাঁচামরিচ ছাড়া আমার খাওয়া হয় না, ডাল ছাড়া ছোট বাচ্চাটা খেতে পারেনা, আমার কান্নাকাটি করার রাইট আছে ঘোষণা দিয়েই আমি কাঁদতে বসতাম।

ইউনিভার্সিটিতে ডঃ ব্রুস আমার স্বামীর খুব ভাল বন্ধু হয়ে গেলো। ব্রুস আর নোরা, খুবই ভাল দম্পতি।  নোরা আঞ্চলিক সংবাদপত্র অফিসে চাকুরী করতো। বন্ধুত্ব হওয়ার পরে আমার স্বামী ব্রুসকে বোধ হয় বলেছে,

" তুমি তো তোমার বউ নিয়ে ভালই আছ,  এদিকে আমার  অবস্থা কেরোসিন! ঘরে গিয়ে দেখি হাঁসের বাচ্চাদের নিয়ে হংসরাণী ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে কাঁদে। তোমাদের দেশের এত প্রশংসা আমি করেছি বৌয়ের কাছে যে এই দেশে আসার জন্য সে মরীয়া হয়ে গেছিল। আমিও বউকে খুশী করার জন্য এখানে নিয়ে এলাম। এখন পরে গেছি মহা ফাঁপরে!

-কী সমস্যা তোমার!

-আরে! আমি কী জানতাম যে তোমাদের শহরগুলোতে কোথাও কোন এশিয়ান স্টোর নেই! আমার বউ হট পেপারে ঘচ করে একটা কামড় না দিয়ে ভাত খেতে পারেনা। আর ভাতই বা কোথায় পাবে! আংকেল বিন নামের যে চালের প্যাকেট পাওয়া যায়, এতো আর আমাদের দেশের কালোজিরা চালের মত না। এগুলি হচ্ছে আমাদের দেশের ইরি চালের মত। বউ  মোটা চালের ভাত খেতে পারেনা। হয়তো বা পারতো যদি সাথে কাঁচামরিচ থাকতো।

-আহারে! তোমাদের তো খুবই কষ্ট হচ্ছে! দেখি আমার বউয়ের সাথে কথা বলে। সে তো তার চাকুরীর সুবাদে অনেক খোজ খবর রাখে। যদি কোন এশিয়ান স্টোরের খোঁজ পায় তাহলে তোমাকে নিশ্চয়ই জানাবো।


একদিন বাড়ীর কর্তা ইউনিভার্সিটিটি থেকে খুব খুশীমনে বাড়ী ফিরেছেন। আমাদের মা-মেয়েকে একসাথে পেয়ে খুবই উচ্ছ্বাসের সাথে বললেন,
-আগামী বৃহস্পতিবার তোমাদেরকে ব্রুসের বাড়ী নিয়ে যাব। ওদের বাড়ীতে আমাদের সবার নিমন্ত্রণ।
মেজোমেয়ে আনন্দ মনে চেপে রাখতে পারেনা, এক লাফ দিয়ে উঠলো, - সত্যি সত্যি, আমাদের নিমন্ত্রণ!
-হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই নিমন্ত্রণ। টার্কী রোস্ট খাওয়াবে। ঐদিন থ্যাঙ্কস গিভিং ডে।

আমি প্রশ্ন করলাম, নেমন্তন্ন কি দুপুরে নাকি রাতে?
-তা তো জিজ্ঞেস করিনি, বলেছে থ্যাঙ্কস গিভিং ডিনার! ডিনার যখন, তখন তো রাতেই হওয়ার কথা, তবুও জিজ্ঞেস করে দেখবো। ঐদিন নাকি আস্ত টার্কী রোস্ট করা হবে। ব্রুস নিজেই নাকি রোস্ট বানাবে!

-টার্কী কোনগুলিরে বলে?

-মুরগীর মতই তবে অনেক বড়।

-আমাদের ছোটবেলায় বাড়ীওয়ালার বাড়ীতে মুরগী পালতো, কয়েকটার গলাতে কোন লোম ছিল না, আমরা বলতাম গলা ছোলা মুরগী, আবার অন্যেরা বলতো, তিতির'। ঐ রকমই নাকি?

-তা জানিনা, হবে হয়তো বা ওরকমই কিছু একটা।

-থ্যাঙ্কস গিভিং মানে কি?
-এটা এখানে একটা উৎসব। ক্রীসমাসের মতই কিছু একটা ব্যাপার হবে। আমি অবশ্য অত ইতিহাস জানিনা। যাচ্ছিই তো, ব্রুসের বৌকে জিজ্ঞেস করে দেখো। নোরা তো লেখালেখি করে, বলতে পারবে।


দু'দিন পরেই জানা গেল, নেমন্তন্নের সময় দিয়েছে বেলা বারোটা। ভেতরে ভেতরে খুবই এক্সাইটেড ফিল করছিলাম। আমেরিকা এসেছি প্রায় দুই মাস হতে চললো, একটা পরিবারের সাথেও পরিচয় হলোনা আমার, নেমন্তন্ন তো দূরের কথা। দেশে থাকলে এই দুই মাসে কতজনকে নিজের বাড়ীতে ডাকতাম, নিজেও কতজনের বাড়ীতে গিয়ে আড্ডা মেরে আসতাম! সাধের আমেরিকায় এসে বন্দী হয়ে গেছি! ব্রুসের বাড়ীতে যাওয়ার উৎসাহ বেড়ে দ্বিগুন হয়েছে, আস্ত টার্কী রোস্টের কথা শুনে। আমি বরাবর মুরগীর মাংস খেতে ভালোবাসি। গত দুই মাসে মুরগীর ঝোল খেতে খেতে তিতি বরক্ত হয়ে গেছি। বৃহস্পতিবার জিভের স্বাদটা একটু বদলাবে। ওরা কী ঝাল খায়? মনে হয় খায় না! ওরা কি মাংসে আদা, রসুন, পেঁয়াজ   দেয়? নিশ্চয়ই দেয়! মরিচের গুঁড়া না থাকলে গোলমরিচের গুঁড়া তো অবশ্যই পাওয়া যাবে। ঠিক আছে, তাই সই। সবকিছু ঠিক থাকলে কাঁচামরিচের বদলে না হয় গোল মরিচের গুঁড়াই মিশিয়ে নেয়া যাবে। বাচ্চাদের মত করেই নানা রঙের ভাবনায় ডুবে ছিলাম। স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম,

-আমেরিকান সাহেবের বাড়ীতে শাড়ী পড়ে যাবো নাকি শার্ট-প্যান্ট পড়তেই হবে?

-তোমার যে ড্রেস পড়তে ভালো লাগে, সেটাই পড়বে। আমেরিকানরা পোশাক নিয়ে মাথা ঘামায় না।

-ঠিক আছে, আমি তাহলে শাড়ী পড়েই যাব। আচ্ছা, আরও অনেক মানুষ আসবে?

-তা তো জানিনা, আসলে আসতেও পারে। ওর অন্য বন্ধুদেরকে যদি বলে থাকে!

বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই আমাদের মা-মেয়েদের মধ্যে বেশ একটা সাজ সাজ রব পড়ে গেলো। আমার স্বামীর মুড খুব ভালো আছে, কারণ গত তিন চারদিন আমি কান্নাকাটি করিনি। ব্রুসের বাড়ী আস্ত টার্কী রোস্ট খাওয়ার ভাবনায় মজেছিলাম। আমেরিকান সাহেবের বাড়ী যাচ্ছি আমি, বেছে বেছে 'লাল-সবুজে' ছাপা সিল্কের শাড়ী পড়লাম। দেশকে রিপ্রেজেন্ট করার ব্যাপার আছে তো! মেয়েদেরকে পড়ালাম বাংলাদেশী ব্লগ ছাপা জামাকাপড়। স্বামীকে পড়তে বললাম পা-জামা -পাঞ্জাবী। নভেম্ববারের শেষ, চারদিকে শীতের কনকনে বাতাস, আমাদের পোশাক নির্বাচন মোটেও ঠিক হয়নি! কিন্তু কী আর করা, ব্রুসের বৌ তো এখানের পত্রিকায় রিপোর্টার। বলা তো যায় না, আমাদেরকে নিয়ে একটা রিপোর্টও করে ফেলতে পারে! 'বিদেশে একা' শিরোণামে! কত কিছুই ভাবছিলাম!


গাড়ী পাহাড়ী রাস্তা ধরে এঁকে বেঁকে একসময় ব্রুসের বাড়ীর আঙিনায় এসে পৌঁছালো। ব্রুসের বৌ নোরা সবার আগে আমাদের গাড়ী দেখতে পেয়েই দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। নোরা খুব সুন্দরী, লম্বা স্কার্ট পড়েছে, মাথার কোঁকড়া চুলগুলো পিঠের উপর ছড়ানো, ফুল শ্লীভ শার্ট গায়ে নোরাকে দেখতে রাশিয়ান গল্পের বইয়ে আঁকা মেয়েদের মত লাগছিল। নোরা এগিয়ে এসে আমাকে 'হাগ' দিল, বাচ্চাদেরকে হেল্লো বললো, ছোট মেয়ের গাল দুটো টিপে দিল। প্রথমেই নোরা আমাদের মন জয় করে ফেললো। বাড়ীর ভেতর ঢুকে দেখি চারদিকে শুনশান নিরবতা। স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় ইংরেজীতে সব সময় খুব ভাল নাম্বার পেয়েছি, ভাবতাম ইংলিশে কথাও বলতে পারবো ফটর ফটর করে। বাস্তবে দেখলাম, মুখ থেকে 'ইয়েস' 'নো' 'ভেরী গুড' 'থ্যাঙ্কস' ছাড়া একটাও কথা বের হচ্ছে না। স্বামীর পিঠে খোঁচা দিয়ে জিজ্ঞেস করি,

-আমরা কী ভুল সময়ে এসে পড়লাম? ডিনার বলেছে, আর আমরা এসেছি দুপুরে!

-আরে! ব্রুস নিজে টাইম দিয়েছে বেলা বারোটা।

-তাহলে রান্নার কোন গন্ধ পাচ্ছি না তো! টার্কী রোস্ট করলে, মাংসের গন্ধে চারদিক ম ম করার কথা। তাছাড়া আর কোন লোকজনও দেখছি না।

এবার মেজোমেয়ে একটু বিরক্ত হয়ে গেলো মায়ের উপর। বলল, -মা, ওদের বাড়ীটা ত অনেক বড়, কিচেন মনে হয় অনেক দূরে, সেজন্যই রান্নার গন্ধ পাচ্ছ না। আর কেউ না থাকে তো ভালই হয়েছে, টার্কী রোস্ট শুধু আমরাই খাব। আমাদের কথা শেষ হওয়ার আগেই ব্রুসকে নিয়ে নোরা ফিরে আসলো। ব্রুস এসেই হই হই করে কথা বলা শুরু করলো। আমি তখনও জানতাম না, ওরা নিঃসন্তান। আর কাউকে না দেখে আমি জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,

-বাড়ীতে আর কেউ নেই?

-নোরা বললো, আমরা তিনজনই থাকি এই বাড়ীতে। আমি, ব্রুস আর রাসটি। বলেই রাসটি কে নাম ধরে ডাকতেই ইয়া বিশাল এক কুকুর এসে হাজির। কুকুরের গলায় আদর করতে করতে নোরা বললো, এই যে আমাদের একমাত্র সন্তান 'রাসটি'।

-বললাম, আর কেউ কি আসবে?

-নাহ! শুধু তোমরা আর আমরা। থ্যাঙ্কস গিভিং ডিনারে আমরা প্রতি বছর একজন বন্ধুকে ডাকি। এ বছর ব্রুসের সাথে তোমার হাজব্যান্ডের খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়েছে। তাই এ বছর তোমাদের ডেকেছি।

কিছুক্ষণ গল্প করে আমাদেরকে নিয়ে ওরা সরাসরি খাওয়ার টেবিলে চলে গেলো। ছিমছাম সাজানো সংসার। সোভিয়েত রুপকথা পড়ার সময় এমন একটা বাড়ির ছবিই আমি সব সময় কল্পনায় দেখতাম। ছয়জন বসতে পারে এমন একখানি টেবিলে ধবধবে সাদা চাদর বিছানো, ছ'খানা কাঠের চেয়ারও পাতা আছে। আমার ছোট মেয়েটির জন্য এক্সট্রা টুল এনে পেতে দিয়েছে নোরা। প্রতিটি জিনিসে সুক্ষ্ম রুচীর ছাপ লেগে আছে।  ঘরের দেয়ালে দুটি ছবি টাঙানো আছে। একটি ছবিতে 'টার্কী মহারাজ' পেখম তুলে দাঁড়িয়ে আছে, আরেকটি ছবিতে শুধুই  গাছপালার সারি। টার্কীর ছবি দেখে মনে হচ্ছিল যেনো একটি ময়ুর পেখম তুলে দাঁড়িয়ে আছে।  এসব ছাপিয়ে আমি চারদিকে চোখ বুলাতে লাগলাম। এক কোণে দেখি লম্বা ডিজাইনের একখানা বেঞ্চের উপর কয়েকটি খাবারের পট ঢাকা দেয়া আছে।  মনে মনে নিশ্চিন্ত বোধ করলাম। ব্রুস চলে গেলো ভেতরের ঘরে। নোরা আমাদের বসতে বলে নিজেও একখানা চেয়ার টেনে বসে গেলো। আমরা বসতে না বসতেই বাড়ীর হোস্ট, ডঃ ব্রুস ভেতরের ঘর থেকে বিরাট বড় একটা ট্রে হাতে এসে ঢুকলো। ট্রের মধ্যেই বসানো আছে আমাদের সেই পরম আকাংক্ষিত 'টার্কী মহারাজ'।

সবাই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠলাম! কেন দাঁড়িয়ে পড়লাম তা বলতে পারছি না। উনারা আমাদের জন্য এত আন্তরিকতা দেখাচ্ছে, তার প্রতি সম্মান জানাতেই বোধ হয় দাঁড়িয়েছি, আমার দেখাদেখি আমার মেয়েরা। টার্কীর সাইজ দেখে মনের ভেতর গুড় গুড় আওয়াজ টের পাচ্ছিলাম, এ তো কোনভাবেই আমার দেখা সেই 'গলাছোলা মুরগী বা তিতির' হতে পারে না! এ তো দেখি সাইজে সত্যিই ময়ুরের মত। এত বড় পাখীটাকে আস্ত রোস্ট করা, খুব সোজা কথা তো নয়! আমাদের সকলের হাতেই ছুরী আর কাঁটা চামচ ধরিয়ে দিয়ে সকলের আগে ব্রুস এগিয়ে গেল। রোস্টেড টার্কী কাটার নিয়ম আছে, শুধু কেটে নিলেই হবে না, টার্কী খাওয়ারও কিছু নিয়ম আছে। ব্রুস বলে চলেছে তার কথা, আর আমি মনে মনে হিসেব কষছি অন্যভাবে। টার্কীর শরীরে শুধুই চামড়ার আস্তরণ। কোথাও কোন মশলার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে  না, বাতাসে  মশলার কোন গন্ধও ভাসছে না! কিভাবে টার্কীটা রোস্ট করলো, সে সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসও পাচ্ছি না! আমেরিকান সাহেবের সাথে ইংলিশে বাতচিত করার মত হিম্মত তখনও আমার ছিল না। সবার সামনে স্বামীকেও কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল না। ভাবলাম, দেখি সবাই কী করে! আমিও তাই করবো।

ব্রুস টার্কীর পেটের ভেতর থেকে চামচে করে আটার দলার মত জিনিস কুরিয়ে কুরিয়ে বের করতে লাগলো। পেটের ভেতরের জিনিসে বাদাম, কিসমিস, শুকনো ক্র্যানবেরী মেশানো দেখা যাচ্ছে। ব্রুসের কাছেই জানলাম, পেটের ভেতরের এই পদার্থকে বলে 'স্টাফিন'। পাউরুটির গুঁড়োর (ব্রেড ক্রাম্ব) সাথে শুকনো ফল, নানা রকম সস মিশিয়ে মেখে টার্কীর পেটের ভেতর ভরে দিয়ে টার্কীটাকে আভেনে ঢুকিয়ে দিতে হয়। টার্কীর পেটের মধ্যে থেকেই ওটা সেদ্ধ হয়ে যায়, বাইরে থেকে জল মেশাতে হয় না, টার্কীর বডি থেকে যে জুস বেরিয়ে আসে, তাতেই সমস্ত স্টাফিং রান্না হয়ে যায়। রান্না-বান্নার প্রতি ইন্টারেস্ট আমার ছোটবেলা থেকেই। জিজ্ঞেস করলাম, টার্কী রোস্ট কিভাবে করতে হয়। ব্রুস পেশায় শিক্ষক, কথা বলার সময় শিক্ষকসুলভ ভঙ্গী চলে আসে। ব্রুসের কথা বলার স্টাইলটি আমার কাছে নতুন কিছু মনে হয় নি। নিজে সংসার করি শিক্ষকের সাথে, সারা গুষ্ঠীতে শিক্ষকের ছড়াছড়ি। তাই ব্রুসের লেকচার শুনতে ভাল লাগছিল।

একটি গোটা টার্কীকে আগের রাতে ম্যারিনেট করতে হয়। ম্যারিনেট করার ব্যাপারটি ব্যক্তি পছন্দের উপর নির্ভর করে। যার যেভাবে খুশী, সে সেভাবেই তা করতে পারে। ব্রুস আগের রাতে টার্কীটাকে ভিনিগার, সয়াসস, গোল মরিচের গুঁড়ো আর অল্প লবন দিয়ে মেখে রেখেছিল। আজ সকালে ওটাকে সে প্রথমে বেকিং ট্রেতে বসিয়ে আগে থেকে তৈরী করে রাখা ব্রেডক্রাম্বের মন্ড টার্কীর পেটের ভেতর ঢুকিয়ে পেটের মুখটা সুঁই সূতোয় সেলাই করে দিয়েছে যেন রান্নার সময় কিছুই বের হয়ে না আসে। এবার বড় একখানা কুকিং টাবে টার্কীটাকে বসিয়ে টাবটি আভেনে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। টেম্পারেচার মেইনটেইন করার জন্য বেকিং থার্মোমিটারও একটা টার্কীর বডিতে ফিট করা হয়েছে। আভেন আগে থেকেই প্রিহিটেড করা ছিল। আভেনের তাপমাত্রা সেট করা হয়েছে ৩৫০ ডিগ্রী ফারেনহাইট। তিন থেকে চার ঘন্টা সময় লেগেছে টার্কী পুরোপুরি সেদ্ধ হতে। একটা ছোট বাটিতে একখানা ডিম আর অলিভ অয়েল একসাথে ফেটিয়ে রাখা ছিল। আভেনে বেকিং হওয়ার ফাঁকে  কিছুক্ষণ পর পর অলিভ অয়েল -ডিম মিক্সচারে ব্রাশ চুবিয়ে নিয়ে সেই ব্রাশটি  টার্কীর বডিতে বুলিয়ে দিয়েছে। তাতে করে উপরের এই সোনালী রঙ তৈরী হয়েছে।

টার্কী রোস্টের পদ্ধতি শুনে মনে মনে বেশ একটা নিশ্চিন্ত বোধ করেছি। একটাই খুঁতখুঁতি ছিল, রন্ধন প্রনালীর কোথাও আদা, রসুন, পেঁয়াজের কথা উল্লেখ করেনি বলে। ব্রুসের দেখাদেখি আমরা সকলেই ছুরী দিয়ে টার্কীর একপাশ থেকে কেটে কেটে নিতে শুরু করলাম। আমার একটা সমস্যা আছে। আমি খুব একটা ভোজন রসিক না হলেও আমার মধ্যে দৃষ্টিক্ষুধা আছে, এটা আমার কথা না, আমার মা আর আমার স্বামী, দুজনেরই অভিমত। সেই দৃষ্টিক্ষুধার কারণেই আমি প্রথম সুযোগেই চার পাঁচ স্লাইস টার্কী নিয়ে ফেলেছি। পাশে থেকে আমার পতি দেবতা একটু আস্তে করে বলেছে, ' আগেই এতটা নিয়েছ, যদি ভাল না লাগে"! পতির কথা শুনে রাগে শরীর জ্বলে গেছে। সব সময় তালে থাকে, কখন আমার প্লেটের দিকে নজর লাগানো যায়! যত্তসব!

প্লেটে টার্কী নিলে সাথে ক্র্যানবেরী সস নিতে হয়। টার্কী খাওয়ার এটাই নিয়ম। লাল টুকটুকে ক্র্যানবেরী সস দেখেই দৃষ্টি জুড়িয়ে যায়। নিলাম, ক্র্যানবেরী সসও নিলাম, পাশে নিলাম গ্রীন বীনস ( ছোট সাইজের বরবটি সেদ্ধ), ম্যাশড পটেটো ( আলু ভর্তা), এবং স্মোকড বিনস ( লাল রঙের বরবটির বীচি বারবিকিউ সসে রান্না করা)। প্লেট উপচানো খাবার নিয়ে টেবিলে এসে বসতেই ব্রুস প্রেয়ারে মন দিল। খাওয়া শুরু আগে ঈশ্বর বন্দনার এই রীতিটি সম্পর্কে জেনেছি  আমার বড় মেয়ে যখন ঢাকা ওয়াই ডাব্লিউ সি এ স্কুলে পড়তো, তখন। আমার খুব ভালো লাগে খাওয়ার আগে ঈশ্বরকে বন্দনা করার এই রীতি ( যদিও খাওয়ার আগে আমি কখনওই এই অতি পবিত্র কাজটুকু করি না)। ব্রুসের সাথে সাথে আমরা সবাই 'আমেন' বলে খাওয়া শুরু করলাম। পাণীয় হিসেবে আমাদের সকলকে দেয়া হয়েছে আইসড টি, কোক, মিনারেল ওয়াটারের বোতল, কিন্তু নোরা নিয়েছে গ্লাস ভরে ঠান্ডা দুধ। নোরা জলের বদলে সব সময় দুধ খায়। আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। আমি সব্জী প্রিয় মানুষ হয়েও প্রথমেই টার্কীর টুকরা মুখে পুরে দিয়েছি। প্রথম দফায় টের পাইনি, দ্বিতীয় দফাতেই টার্কীর বোঁটকা গন্ধে সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। একটা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো, ' প্লেটের টার্কী শেষ করবো কী করে"! মুখের স্বাদ পাল্টানোর জন্য দ্বিতীয় ভুল করলাম। চামচে করে 'স্টাফিন' তুলে মুখে পুরে দিলাম! খেয়াল ছিল না, টার্কীর বডি থেকে যে নির্যাস বের হয়েছে, সেই রসেই স্টাফিন সেদ্ধ হয়েছে। কাজেই স্টাফিনের মধ্যে উৎকট গন্ধ আরও বেশীই লাগছিল।  আমার মুখের চেহারাতে কিছু কী ধরা পরেছিল? নাহলে নোরা কেন আমাকে বলল তার বানানো আফ্রিকান ডেজার্ট টেস্ট করতে! আমি ধরা পড়তে রাজী ছিলাম না বলেই একটু দেরী করছিলাম আফ্রিকান ডেজার্ট নিতে। বদলে আমি গোলমরিচের গুঁড়ো চেয়ে নিলাম। এবার টার্কী স্লাইসের উপর ইচ্ছেমত মরিচের গুঁড়ো ছড়াতে লাগলাম দেখে আবার আমার সমস্ত শরীর জ্বালিয়ে দিয়ে আমার স্বামী পিন পিন করে বললো,

 " এটা তো নতুন না, তুমি সব সময় না বুঝেই খাবার দিয়ে প্লেট ভরে ফেলো। খেতে তো পারো না শেষ পর্যন্ত। অল্প অল্প করে নিলেই হয়"!

 জবাবে বললাম, " কই! আমার কাছে তো খারাপ লাগছে না খেতে! খুবই ভাল, শুধু একটু মশলা হলে ভাল হতো। তুমি নিজের খাওয়া বাদ দিয়ে আমার প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছো কেনো"?

স্বামীর জবাব, " বেশ, ভালো লাগলে খাও, কোনই অসুবিধা নেই"।

একজনের বাড়ীতে বেড়াতে এসে তাঁর রান্না করা খাবার যদি  ভালো লাগছে না বলে ট্র্যাশ ক্যানে ফেলে দেই, এর চেয়ে বড় অভদ্রতা আর কী হতে পারে! ( আমেরিকানদের অনেকেই খাবার দাবার ভাল না লাগলে ঝুপ করে ট্র্যাশ ক্যানে ফেলে দেয়) । তাছাড়া একটু আগে মাত্র স্বামীটিকে বলেছি, টার্কী খেতে আমার  খুব একটা খারাপ লাগছে না। কাজেই প্লেটের সমস্ত খাবার আমাকে খেয়ে শেষ করতেই হবে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম, আর কোনদিন এভাবে না বুঝে প্লেট ভরে খাবার নেবো না, নেবো না।  নোরার কথামত সেই আফ্রিকান ডেজার্ট প্লেটে তুলে নিয়ে আসলাম। দারুণ সুবাস বের হচ্ছে ডেজার্ট থেকে।  মিষ্টি আলু আর ব্রাউন সুগার, সাথে প্রচুর বাটার দিয়ে রান্না করা ডেজার্টটির উপরে রাশি রাশি পিকান (কাঠবাদাম বোধ হয়), কাজুবাদাম, কিশমিশ ছড়ানো। একটু মুখে দিয়ে দেখি, খাবার তো নয়, এ যেনো অমৃত! মন ঠিক করে ফেলেছি, নাক বন্ধ করে ঐ টার্কীর ঝামেলা শেষ করে ফেলবো। তারপরেই খাবো আফ্রিকান অমৃত!

অসুবিধা তো কিছু নেই, নাক দিয়ে বাতাস টানবো না, তাহলে আর বোঁটকা গন্ধ নাকে লাগবে না ভেবে গোল মরিচের গুঁড়ো ছড়িয়ে শেষ পর্যন্ত টার্কীর স্লাইসগুলো আমি খেয়ে ফেলেছিলাম। স্টাফিনে ক্র্যানবেরী সস মিশিয়ে স্বাদটুকু আচারের মত করে ফেলেছিলাম। সেভাবেই স্টাফিনটাও শেষ করেছি। সব্জী আমার খুব প্রিয়, তাই গ্রীন বিন, স্মোকড বিন আর ম্যাশড পটেটো সবার শেষে খেয়েছি। কথায় বলে যার শেষ ভাল, তার সবই ভাল।  সেদিনের খাবার শেষ করেছি এক প্লেট আফ্রিকান অমৃত খেয়ে। আমার স্বামী যত কিছুই বলুক না কেনো, প্লেটে খাবার আমি আমাপা কিছু নেইনা। একজন  পূর্ণ বয়স্ক বাঙ্গালী এক স্কুপ ম্যাশড পটেটো, কিছু বরবটি সেদ্ধ, একটু বীন সেদ্ধ, আর এক স্কুপ স্টাফিন, সাথে চার স্লাইস টার্কী, খুব বেশী হয়ে গেলো?? আমার স্বামী আমার সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি দেখতে পায়! ঠিক এমনটা ভেবে মনে সাহস সঞ্চয় করছিলাম যেনো আরেকবার উঠে গিয়ে আফ্রিকান ডেজার্টে প্লেট ভরে ফেলতে পারি।  ভাগ্যিস নোরা এই খাবারটি রান্না করেছিল, সেজন্যই সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছি। এরপরে গত দশ বছরে আমি আর কোনদিন টার্কীর মাংস স্পর্শও করিনি। বলতে গেলে আমি এখন ভেজিটেরিয়ান হয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আছি। কারণ এখনও আমরা আমাদের আশে পাশে কোন বাঙ্গালী পরিবার দেখি না, বাংলাদেশী গ্রোসারী শপ নেই, খুব মাঝে মাঝে আটলান্টা, হিউস্টন নামের বড় শহরে কেউ গেলে, তাদের সাথে বাংলাদেশের মাছ আনিয়ে, সেই মাছই রসিয়ে রসিয়ে সারা বছর খাই। আর নিজের মনেই নিজের দেশী খাবারের গুনকীর্তণ করতে থাকি। বাজারে যা কিছু পাই, চেষ্টা করি দেশী স্টাইলে রান্না করতে।  নিজেরা খাই, আমেরিকান বন্ধুদেরকেও খাওয়াই!

No comments:

Post a Comment