Friday, February 16, 2018

ভালোবাসার কথাই তো, মন্দবাসার কথা তো নয়!

ভালোবাসার কথাই তো, মন্দবাসার কথা তো নয়!
প্রায় বছর চারেক আগে ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় ‘ভালোবাসার সাত রঙ’ শিরোনামে একখানা লেখা ছাপা হয়েছিল। আমারই লেখা ‘ভালোবাসার সাত রঙ’। তখন পত্রিকায় টুকরো টাকরা লেখা ছাপা হয়, সেই আনন্দে নতুন নতুন বিষয় নির্বাচন করে তার উপর লেখার চেষ্টা করতাম। ভালোবাসার সাত রঙও তেমন উৎসাহে লেখা। ভালোবাসারতো সত্যিকারের কোন রঙ হয়না, ভালোবাসা হচ্ছে প্রকাশের ব্যাপার। সাত রঙ মিলিয়েছিলাম সাত রঙের গোলাপ থেকে। যেখানে প্রতিটি রঙ ভালোবাসা প্রকাশে ব্যবহ্ররুত হয়ে থাকে।
ভালোবাসা যে কত রকম হতে পারে, ভালোবাসার সম্পর্ক কত রকম হতে পারে, ভালোবাসার ধরণ কত রকম হতে পারে, আনন্দে-শোকেও ভালোবাসার প্রকাশ থাকে, এর কিছুই জানা হতোনা যদি সাত রঙের গোলাপ নিয়ে ভালোবাসার সাত রঙ না লিখতাম। কারণ নতুন কিছু লিখার আগে সেই বিষয় সম্পর্কে একটু পড়াশোনা করতেই হয়। ভালোবাসার সাত রঙ লেখার সময়ও ভালোবাসা দিবস এবং বিভিন্ন রঙের গোলাপ সম্পর্কে অল্প পড়াশোনা করতে হয়েছিল। তখনই গোলাপের কত বর্ণ হতে পারে, তা কিছু জেনেছি।
গত দুই বছরের বেশি সময় আমি পত্রিকায় লেখা পাঠাইনা। যা কিছু লিখতে মন চায় ফেসবুকেই লিখি। ফেসবুকে লিখলে লেখা দ্রুত পাঠকের কাছে পৌঁছে যায়। লেখক লিখেই তো পাঠকের জন্য। গত দেড় মাসের উপর হয়ে গেলো আমি ফেসবুকে লিখতে পারছিনা। কোন কারণে হয়তোবা আমার কিছু ফেসবুক বন্ধুর বিরাগভাজন হয়েছিলাম। তারা আমার দুই তিন বছর আগে লেখা স্ট্যাটাসে সমাজ বিধ্বংসী শব্দের ব্যবহার পেয়ে দ্রুততার সাথে দলে দলে ফেসবুক এডমিনের কাছে রিপোর্ট করেছে। ফেসবুক এডমিনও কোথায় আগুন লেগেছে, আদৌ আগুন লেগেছে কিনা, আগুনে তাপ কতটুকু, আগুনের আঁচে কারো কোন ক্ষতি হলো কিনা খোঁজ খবর করে সময় নষ্ট করতে চায়নি। তারা আমার আইডির মেইন সুইচই অফ করে দিয়েছে। এরপর তালিয়া বাজিয়ে বলেছে, “ নে এবার তোরা তোরা মারামারি কর”।
সে তো গেলো আমার প্রতি বিরূপ বন্ধু আর তাদের ফেসবুক এডমিনের আগুন নিভিয়ে সুখে শান্তিতে ঘর করার গল্প। এদিকে বিনা মেঘে বজ্রপাতের আগুনে আমার মন পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। সেই কয়লায় না আছে আগুন না আছে ছাই। স্রেফ কাঠকয়লা যেমন হয়, তেমন। কথায় বলে কয়লা ধুলেও ময়লা যায়না, তাই আমি কয়লা ধুয়ে মন পরিষ্কারের চেষ্টা করিনি।
কয়লা মন নিয়ে ঘর সংসার করি, কয়লা মন নিয়ে ওয়ালমার্টে যাই, কয়লা মনে রেখে মুখে হীরের দ্যুতি ছড়িয়ে চাকরির আট ঘন্টা কাটাই। যখন ব্লগে লিখতাম, ‘ কত রকমের মানুষ’ নামে একটি পর্ব লিখতাম। ওয়ালমার্টে প্রতিদিন যত মানুষের সাথে দেখা হয়, তাদের কথা, তাদের সাথে আমার আবেগ অনুভূতি আদান প্রদানের গল্প লিখতাম সেই ‘কত রকমের মানুষ’ ধারাবাহিকে। সেই ধারাবাহিক থেকেই লেখা হয়ে গেলো আমার দ্বিতীয় বই ‘ মুহূর্তে দেখা মানুষ’।
এরপর যদিও ব্লগে লেখাও বাদ দিয়েছি ( কারণ হেফাজতিদের ভাষায় ব্লগার মানেই নাস্তিক, নাস্তিক মানেই পাপী, পাপী হলেই ঘাড়ে চাপাতি! বুড়ো বয়সে বিনা অপরাধে চাপাতির কোপ খেতে ইচ্ছে হয়নি বলে ব্লগে লেখা বাদ দিয়েছিলাম) তারপরেও ওয়ালমার্টে প্রতিদিন গেছি, প্রতিদিন কত রকমের মানুষ দেখেছি, কত রকমের জীবনের গল্প শুনেছি। আমার কাজ ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে, আমেরিকার প্রতিটি মানুষ ফোন ব্যবহার করে, তাই কাজের সুবাদেই প্রতিদিন নানা জাতের মানুষের সাথে কথা বলতেই হয়।
লেখাটি শুরু করেছিলাম ভালোবাসা দিয়ে, ভালোবাসার সাত রঙ। গতকালই ভ্যালেন্টাইন ডে গেলো তো, তাই মাথায় ভালোবাসার রকমারি রঙ খেলা করছিল। ওয়ালমার্টে চাকরিটা না করলে আমার জানাই হতোনা ভালোবাসার এত রঙ হয়, গোলাপের এত রঙ হয়। গোলাপের প্রতিটি রঙই ভালোবাসার কথা বলে। ভালোবাসার সাত রঙ যখন লিখেছিলাম, তখন জেনেছিলাম,
হালকা গোলাপী রঙের গোলাপ সুখ, রোম্যান্স, আনন্দ প্রকাশের প্রতীক এবং গাঢ় গোলাপী গোলাপ প্রাপকের প্রতি প্রেরকের ভালোবাসার স্বীকৃতি, হৃদয়ের স্নিগ্ধ ভালোবাসার প্রকাশ।
হলুদ গোলাপ অপরকে স্বাগত জানাতে, বন্ধুত্বের প্রতীক,পরম নির্ভরতা, আনন্দ-উচ্ছাস, ভালোবাসার প্রতীক। অপরকে স্বাগত জানাতে, নতুনকে আবাহন করতে, নতুন মা, নতুন গ্র্যাজুয়েট অথবা বাগদান বা বিয়ের আশীর্বাদ হয়ে যাওয়া পাত্র পাত্রীকে শুভেচ্ছা জানাতে
হলুদ গোলাপের জুড়ি মেলা ভার! হলুদ গোলাপ নতুন জীবন শুরুর আনন্দ ও ভালোবাসার প্রতীক।
পীচ ফল রঙা (হলদে কমলা) গোলাপ মানুষের মনের সৌন্দর্য্য ও নমনীয় ব্যাক্তিত্ব প্রকাশ করে। অপরের উন্নতিতে প্রশংসা করতে অথবা প্রিয় মানুষটির প্রতি মনের গভীর অনুভূতি বা আকুলতা প্রকাশ করতে পীচ রঙা গোলাপ হচ্ছে একমাত্র উপহার! কারো প্রতি সহানুভূতি প্রকাশেও পীচ গোলাপের জুড়ি নেই।
কমলা রঙের গোলাপ নিয়ে আসে অহংকার, উচ্ছ্বাস, আকাংক্ষার বার্তা! উজ্জ্বল কমলা রঙের গোলাপ প্রিয়জনকে জানিয়ে দেয় প্রেরকের মনের উষ্ণ, উদ্দীপনামূলক ভালোবাসার বার্তা, জানিয়ে দেয় প্রিয়জনকে কাছে পেতে চাওয়ার পরম আকাংক্ষার কথা! পূর্ণ প্রস্ফুটিত গোলাপের অর্থ, “ আমি তোমাকে নিয়ে গর্বিত”! কোমল ও বিষন্ন কমলা রঙের গোলাপ গুচ্ছ প্রেরকের স্বভাবের কোমলতা ও নমনীয়তাকে প্রকাশ করে।

‘প্রথম দর্শনেই প্রেম’ প্রকাশের অন্যতম উপহার হচ্ছে এক গুচ্ছ ল্যাভেন্ডার রঙের গোলাপ। ল্যাভেন্ডার বা হালকা বেগুণী রঙ একজনের প্রতি আরেকজনের গভীর ভালোবাসা বর্ণনা করে। প্রিয়জনকে ভালোবাসার গভীরতা বুঝাতে ল্যাভেন্ডার গোলাপের জুড়ি নেই।
একমাত্র ভালোবাসার সমপর্কে নীল গোলাপের স্থান নেই। তাই পৃথিবীতে নীল গোলাপের অস্তিত্বও নেই। রঙ হিসেবে ‘নীল’ অনেকেরই প্রিয়, কিন্তু ভালোবাসার মানুষটিকে উপহার দেয়ার জন্য, কৃত্রিম ‘নীল গোলাপ’ও দেয়া উচিৎ নয়।
নীল ব্যতীত সব রঙের গোলাপেই ভালোবাসার কথা লেখা আছে, কালো রঙের গোলাপেও ভালোবাসার কথা আছে। ভালোবাসার মৃত্যু নেই, পারস্পরিক সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলেও সম্পর্ক জোড়া দিতে কালো গোলাপ উপহারের জুড়ি নেই। কালচে লাল বা কালচে মেরুন গোলাপকেই ‘কালো গোলাপ’ বলা হয়। কালো গোলাপ মানে হচ্ছে পুণর্জন্ম, অথবা নতুন করে শুরু। অর্থাৎ ভালোবাসায় পরাজয় বলে কিছু নেই, হেরে যাওয়া জীবনে কালো গোলাপ ‘ আবার শুরু করি’ বার্তা বহন করে।

তবে ‘লাল গোলাপ’ ভালোবাসার নিরবচ্ছিন্ন প্রতীক। লাল মানে উষ্ণতা, লাল মানেই রোম্যান্স, লাল মানে সাহস! প্রিয় মানুষটিকে যদি এক গুচ্ছ লাল গোলাপ দেয়া যায়, স্বর্গীয় ভালোবাসা পৃথিবীতেই মূর্ত হয়ে উঠে!
গতকাল ভ্যালেন্টাইন ডে ছিল, ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার জুড়ে ছিল শুধু ‘ভালোবাসি ভালোবাসি’ গুন গুন, ‘ভালোবাসবো ভালোবাসবো’ সঙ্গিতের মূর্ছনা। রঙ বেরঙের গোলাপ হাতে রেজিস্টারের দিকে সকলের ভীড়। ৯৯ ভাগ পুরুষ ক্রেতা। প্রতি বছর এই দিনে ওয়ালমার্টে আমার কাজের স্কেজিউল থাকেই, এবং তাতে আমি মহাখুশি থাকি। কারণ মানুষের চোখে মুখের অভিব্যক্তিতে ভালোবাসা দেখতে আমার ভালো লাগে। একেকজনের অভিব্যক্তি একেকরকম। পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধ যখন তাঁর বৃদ্ধার জন্য গোলাপ কিনে, তাঁর ছানি পড়া চোখে ভালোবাসার যে স্নিগ্ধ আলো দেখা যায়, চব্বিশ বছরের আফ্রিকান আমেরিকান তরুণের চোখের তারায় স্নিগ্ধতা থাকেনা, দেখা যায় ভালোবাসার চকচকে আলো। আবার মধ্য চল্লিশের একজন পুরুষ দুই সন্তান সাথে নিয়ে যখন তার ভালোবাসার নারীটির জন্য গোলাপের ঝাড় কিনে, সেই চল্লিশের পুরুষের চোখে দেখা যায় ভালোবাসার পরিতৃপ্ত সুখের দ্যুতি। গতকাল এমন অনেক পুরুষ ক্রেতার কাছে ফোন, চকোলেট এবং গোলাপ বিক্রি করেছি।
বাড়ি ফিরে আমিও পেয়েছি আমার ষাটোর্ধ স্বামীর কাছ থেকে ভ্যালেন্টাইন ডে’র উপহার, তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি , দৃষ্টিতে কোন আলোকছটা নেই আছে পরম নিশ্চিন্ততা। এও ভালোবাসার আরেক রঙ। জাতে বাঙালি তো, রক্তে মিশে আছে বাঙালিপনা, ষাট বছর বয়সে পঞ্চাশের স্ত্রীর চোখে চোখ রাখতেই যেখানে লজ্জা পাওয়ার কথা, সেখানে দৃষ্টিতে পরম নিশ্চিন্ততার শীতল ছায়া মেখে তাকিয়েছে, ভালোবাসার সবুজ শ্যামল এই রঙটি কিন্তু আমেরিকার সাত রঙের মধ্যে দেখতে পাইনি।
ফেসবুক আইডিটা ব্যান হয়ে আছে প্রায় দুই মাস, আরও কত মাস ব্যান থাকবে জানা নেই। ফেসবুক ছিল আমার ভালোবাসার আসর। কত রঙের ভালোবাসায় ভরে থাকতো আমার ফেসবুক আঙিনা, সেই আঙিনা হঠাত ঝড়ে ঝরাপাতায় আলুঝালু হয়ে গেলো। মনটা খারাপ ছিল অনেক দিন, কিন্তু ভালোবাসা দিবসে মন খারাপ করে থাকতে নেই, আমি মন খারাপ করে থাকার ফুরসতও পাইনি। তবুও যাই ফেসবুকে, ফেসবুকের তালা বন্ধ ঘরে বসে দেখি উন্মুক্ত ঘরের বন্ধুদের হাসি খেলা সারাবেলা। তাদের মধ্যেই শায়লা খান, হাসান মৃধা, সেঁজুতিরা আছে, উম্মে আতিয়া আছে, তিথি, টুলু, আখতার ভাই, আতাউর ভাই, আছে, আমার খোঁজ নেয়। বইমেলা শুরু হয়েছে, বইমেলা চলছে, আমার বুকে ভাঙনের শব্দ শোনা যায়। আমার বুক ভাঙে, মন ভাঙে! হাসান তা বুঝতে পারে, সে বইমেলায় যায়। সিঁড়ি প্রকাশনে গিয়ে কিনে আনে আমার লেখা দুটো বই, ‘মুহূর্তে দেখা মানুষ’ সাগর ডাকে আয়’।
মুহূর্তে দেখা মানুষ ২০১৫ তে লিখেছিলাম। হাসান আমাকে বই দুটোর ছবি পাঠায়, আমাকে খুশি করবে তাই বই দুটোর ছবি দিয়ে হাসান কভার পিকচার বানায়। বই কিনে এনে হাসান বই শোকেসে সাজিয়ে রাখেনি। গতকাল কাজ থেকে ফিরে যখন ফেসবুকে বসেছি, দেখি হাসান পর পর দুটো মেসেজ দিয়েছেঃ
“মুহূর্তে দেখা মানুষ' বইটি পড়া শেষ করলাম। অনেক ভাল লিখো তুমি। লিখা একদম ঠিক আছে। কোন প্রবলেম নাই। তাছাড়া বইটি পড়ে কত কিছু জানলাম। এককথায় তোমার লিখার ধরণ অসাধারণ। খুব মায়া দিয়ে, আদর দিয়ে, গুছিয়ে লিখেছো প্রত্যেকের জীবনে গল্প গুলো। কোন কোন গল্প পড়ে আবেগে আমার চোখ দিয়ে জল পড়েছে, আবার হেসেও ফেলেছি তোমার দুষ্টুমিতে। অসাধারণ দিদি, সত্যি অসাধারণ। তুমি এইভাবে লিখা চালিয়ে যাও। থেমে যেও না। ( এবার তোমার ডাকে সাগর বেড়াতে যাচ্ছি, ফিরে এসে জানাবো।) লাভ ইউ দিদি।
“দিদি, তোমার 'সাগর ডাকে আয়' বইটি পড়তে পড়তে হারিয়ে যাচ্ছি, ফিরে আসতে পারব কিনা জানি না.... ভাল থেকো”।
ভালোবাসার এই আরেক রঙ। আমার হাতে একশো এক গোলাপ দিলেও মনে হয় আমি এত খুশি হতামনা, যত খুশি হয়েছি হাসানের মেসেজ দুটো পড়ে। এই তো ভালোবাসা! ভালোবাসা গ্রহণ করলে কিছু ভালোবাসা উপহারও দিতে হয়।
আমি হাসানকে লিখলাম,
“হাসান, মুসলমান পূর্ব জন্ম বিশ্বাস করেনা। কিন্তু তুমি পূর্ব জন্মে আমার মায়ের পেটের ভাই ছিলে। “
হাসানের জন্য এটাই ছিল আমার ভ্যালেনটাইন ডে’র উপহার।
আজ ছিল ভ্যালেন্টাইন ডে’র পরের দিন। আজও এসেছিল প্রচুর মানুষ, তবে আজ পুরুষের চেয়ে নারী বেশি এসেছে। কারণ গতকালের বেঁচে যাওয়া ফুল আজ অর্ধেক দামে দিয়েছে। অর্ধেক দাম দিয়ে কিনতে পছন্দ করে মেয়েরা, ছেলেরা নয়। ছেলেরা পুরোপুরিতে বিশ্বাস করে, ভাগাভাগিতে নয়। মেয়েরা ভাগাভাগির অংশ পেয়ে বড় হয় বলেই বোধ হয় পুরো দাম দিয়ে ভালোবাসা কিনতেও ভয় পায়, ভালোবাসা দিবসের পরের দিন এসে অর্ধেক দামে ভালোবাসা কিনে নিয়ে যায়। এটাও ভালোবাসার আরেক রঙ, অর্ধেক লাল অর্ধেক আড়াল।
আমার হাজার হাজার ইমিটেশনের গহনা আছে, বেশির ভাগই কানের দুল, কানের ফুল। হাজারটা কানের দুল আমার একার নয়, তিন কন্যা নিয়ে সংসার, চার নারীর গহনা জমে হাজারটা হয়েছে। গহনাগুলো ব্যবহার করা হয়না। আগে কানের দুল পালটে পালটে পরতাম, তখন বয়স আরেকটু কম ছিল, সাজু গুজু করতে ভালো লাগতো। এখন কানের দুল পাল্টাতে আলসেমি লাগে, দেড় বছর আগে অনলাইনে মাত্র এক ডলার দিয়ে কেনা এক জোড়া কানের দুল পরেছিলাম, আজও খুলিনি। মজার কথা হচ্ছে, কানে থাকা এই দুল জোড়া ওয়ালমার্টে যে দেখে সেই সুন্দর বলে। এমনকি সাত আট বছরের বালিকার নজরও এড়ায়না। আমাকে ডেকে বলে, তোমার কানের দুলগুলো কী সুন্দর! আমেরিকায় থাকতে থাকতে একটা জিনিস খুব বুঝেছি, যা কিছু ভাল, তা এপ্রিসিয়েট করতে হয়। এটা ভদ্রতা, এটা স্বভাবের কমনীয়তা, ঈর্ষাহীন মনোভাবের প্রকাশ। আজও এক সুন্দরী ফ্যাশন সচেতন সাদা মেম আমার সাথে কথা বলার এক ফাঁকে আমার কানে ঝুলতে থাকা দুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, " কী সুন্দর তোমার কানের দুলগুলো। এত সুন্দর রঙ, তোমার কানে মানিয়েছে দারুণ"।
ব্যস, মন খারাপের এই বয়সে সুন্দরী কোন বিদেশীনির মুখ থেকে অমন সুন্দর কথা শুনলে মন কতক্ষণ খারাপ থাকে! আমার মনটাও খুব ভাল লাগায় ভরে গেছিল। জানা কথা, চেনা কথা , এপ্রিসিয়েশনের কথা বার বার শুনতে ভাল লাগে।
ভালোবাসার আরেকটা গল্প বলি। আজ সকালে পঁচিশ বছর বয়সী এক তরুণ এলো। তরুণ বোধ হয় ওয়ালমার্টে খুব একটা আএনা। ওয়ালমার্টে আসে সাধারণ বিত্তের মানুষেরা, সস্তা দামী সব রকম দামের জিনিস পাওয়া যায় বলে। সেই তরুণ এসেছে, তার ফোন ভেঙ্গে গেছে, এখন তার ভাল একটা ফোন চাই। আমি সকল গ্রাহকের সাথেই ভাল ব্যবহার করি, ভাল ব্যবহার করার শিক্ষা আমেরিকা আসার আগেই পেয়েছিলাম, পরিবার থেকে। আমেরিকায় এসে দুয়ে দুয়ে চার হয়ে ভাল ব্যবহার এখন মহা ভালতে পরিণত হয়েছে। আমার মহা ভাল ব্যবহারে তরুণ মুগ্ধ হয়ে ফোনে সিম কার্ড ভরবার কায়দাও ভুলে গেছে। ফোনের ব্যাক কভারটাও খুলতে পারছেনা, হাত কাঁপছে। আমি সব কিছু করে দেয়ার পর সে আমার দিকে এমন অবাক করা, মুগ্ধ কৃতজ্ঞ দৃষ্টি মেলে তাকালো, ঐ চোখে আমি শুধু ভালোবাসার বর্ষা দেখলাম। আমার পুরো দিনটাই ভালোবাসাময় হয়ে উঠলো।
ভালোবাসার গল্প বলতে ভালো লাগে। আরেক রঙের ভালোবাসার কথা বলি। আজ এক বুড়ো দম্পতি এসেছিলেন। কি কিনেছিলেন, মনে পড়ছেনা। আমার মাথায় গেঁথে আছে বুড়ো বুড়ির ভালোবাসার টুকরো কথা। ওঁরা প্রথম যখন আমার কাছে হেল্প চাইলো, আমি উনাদের সাথে কথা বলতে বলতেই বুড়ির গলায় থাকা সোনার চেনের দিকে তাকালাম, সেখানে খুব ছোট্ট একটা লকেট।
লকেটটার ডিজাইন হচ্ছে, ছোট দুটি পাতাসহ অতি ক্ষুদ্র এক গোলাপ। বুড়ো কাস্টমারদের মন মেজাজ একটু খিটখিটে হয়তো, তাই শুরুতেই আমি বুড়োদের এটা প্রশংসা করে, ওটা প্রশংসা করে মনের উপর তেলের প্রলেপ দিয়ে দেই। বুড়োরা এজন্য আমাকে খুব পছন্দ করে। তা এই বুড়ির মনেও তেল দিয়ে দিলাম, বললাম, “ তোমার গলায় যে হারটা আছে, লকেটটা ভারী সুন্দর! বুড়ি একেবারে মোমের মত গলে গেলো। কেমন উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, “ এই লকেটটা তেত্রিশ বছর আগে আমাকে ‘ও’ ভ্যালেন্টাইন’স ডেতে উপহার দিয়েছিল। ওর কাছ থেকে পাওয়া প্রথম উপহার। এই পর্যন্ত পাঁচ বার হারিয়েছি লকেটটা, জানো আমার কি ভাগ্য, প্রতিবার কেউ না কেউ লকেটটা খুঁজে আমার হাতে দিয়েছে। একবার কি হয়েছে জানো, রাস্তার মধ্যেই পড়ে গেছে লকেট। আমি পাগলের মত খুঁজে চলেছি, এত ছোট লকেট এত বড় রাস্তায় পাওয়া যাওয়ার কথাই নয়। পাশ দিয়ে এক মেয়ে যাচ্ছিল, সেই লকেটটা দেখতে পেলো, তুলে এনে আমার হাতে দিয়ে বলল, “ এটা খুঁজছো তুমি?” এরপর থেকে আর হারাইনি, এখনও আছে।“
পাশ থেকে বুড়ো কিছু বলার জন্য উত্তেজনায় ছটফট করছিল। বুড়ি একটু দম নিয়েছে, সেই সুযোগে বুড়ো বলতে শুরু করেছে, “ এই দেখো, আমার গলায় দেখো, এই যে চেইন সাথে লকেট, এটাও তেত্রিশ বছর আগে ‘ও’ আমাকে দিয়েছিল। সেই যে গলায় পরিয়ে দিয়েছিল, আমি আজও খুলিনি গলা থেকে। তেত্রিশ বছর যাবত গলায় ঝুলছে, লকেট আমার বুক ছুঁয়ে আছে”।
ভালোবাসার গল্প কি এর চেয়েও সুন্দর হয়! বুড়ো বুড়িদের ভালোবাসার গল্প শুনতে গেলে আমার মন ছটফট করে, বুকের ভেতর যেন কিছু একটা তোলপাড় হয়। মনে পড়ে, আমাদের দেশে আমাদের দেশের বুড়ো বুড়িদের কথা, প্রৌঢ় প্রৌঢ়াদের কথা। বিয়ের বয়স দশ বছর পেরোতেই স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা কেমন নিস্তেজ হয়ে আসে, প্রেম ভালোবাসার ব্যাপারটা শুধু দুজনের মধ্যে থাকেনা, মন প্রাণ ধ্যান ধারণা আবর্তিত হতে থাকে অন্য দিকে। সংসার, সন্তান, পাড়া পড়ছি, চাকরি, বাজার, রান্নাঘরের হলুদ মরিচের কৌটার ভেতর। ওরা ইংরেজি ভ্যালেন্টাইন ডে বুঝেনা, বাংলায় ভালোবাসি বলতে জানেনা, হাত পা কাঁপতে কাঁপতেও যে একজন আরেকজনকে ‘ভালোবাসি’ বলা যায়, এই ধারণাটাই আমাদের সমাজে আজও তৈরী হয়নি।
আমার বাবা কি কখনও মা’কে বলেছে, “ চলো, তোমাকে নিয়ে একটা সিনেমা দেখে আসি”। আমি শুনিনি। অথচ সেদিন অসুস্থ বাবা বলল, “ তোর মা ছিল সিনেমা দেখার পোকা। বিয়ের পর তোর মা স্কুল থেকে সোজা তোর দাদুর বাড়ি চলে আসতো, আমি অফিস থেকে আমাদের বাসায় না গিয়ে তোর মাকে নিয়ে সিনেমা হলে চলে যেতাম”।
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি, যৌবনে আমার বাবা মাও রোমান্টিক ছিল, শুধু দুজনে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছে! এরপর আমরা বড় হতেই বাবা মায়ের ভালোবাসা, প্রেমের গতিপথ ঘুরে উল্টোমুখি হয়ে গেছে! কেন, লজ্জায়? সকলের সামনে ‘ভালোবাসি’ বলা শরমের ব্যাপার বলে?
তবুও ভাল, আমেরিকা আছি বলেই আমার ষাটোর্ধ বর ভ্যালেন্টাইন ডেতে আমাকে প্রতি বছর উপহার দেয়, মেয়েরা ফোন করে জিজ্ঞেস করে, “ পাপা, মা’কে কি দিয়েছো?” মেয়েদের বাবা লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলে ফেলে, “ তোমাদের মা’কেই জিজ্ঞেস করো, কি দিয়েছি”।
আমেরিকায় বড় হওয়া মেয়েরা মায়ের সাথে হাসাহাসি করে তাদের বাবার ভালোবাসা প্রকাশে লজ্জা পাওয়া নিয়ে। তারপরেও মেয়েরা খুব খুশি হয়, বলে,” মা, আমেরিকা থাকার একটা ভাল দিক কি জানো, ড্যাডি এখন আর ভুলে যায়না বিবাহ বার্ষিকীর কথা, ভ্যালেন্টাইন’স ডের কথা। বাংলাদেশে থাকতে ড্যাডি নির্ঘাত ভুলে যেত, নাহলে লজ্জা পেতো তোমাকে ‘ভালোবাসি’ বলতে, তাইনা মা?”
অনেকেই বলে, বাঙালির মা দিবস প্রতিদিন, বাবা দিবস প্রতিদিন, ভালোবাসা দিবস প্রতিদিন। আমি বলি, প্রতিদিনই মা দিবস বাবা দিবস ভালোবাসা দিবস বলেই তো আমাদের কাছে সব পানসে, আলুনি মনে হয়, সব কিছু গা সহা মনে হয়। প্রতিদিন আলুনি পানসে দিবস না কাটিয়ে বছরে একদিন জম্পেশ করে একেকটা উপলক্ষ তৈরী করে সবাই মিলে উদযাপন করলে মন্দ কি! ভালোবাসার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করতে সমস্যা কোথায়! দুনিয়াকে জানিয়ে, সবাইকে শুনিয়ে ‘ তোমাকে‘ভালোবাসি’ বলতে লজ্জা কি! ভালোবাসার কথাই তো, মন্দবাসার কথা তো নয়!

সবারে বাসরে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবেনা রে’

 ১৪ই ফেব্রুয়ারী, আমেরিকার আকাশে বাতাসে প্রিয়ার চোখে প্রিয়র চোখে প্রিয়জনের হাসিতে ভালোবাসা লুটোপুটি খাবে, ছুটোছুটি করবে, সুরের তালে নাচের ছন্দে ভেসে ভেসে বেড়াবে, উড়ে উড়ে বেড়াবে। আগামীকাল ভালোবাসাময় দিন, আজ রাত বারোটা পর্যন্ত সুপার স্টোর, বিপনী বিতান, শপিং মল জেগে থাকবে। জেগে থাকবে ভালোবাসার মানুষদের জন্য, যারা শেষ মুহূর্তেও ছুটে আসবে প্রিয়র জন্য উপহার কিনতে। আজকের দিনে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হবে গোলাপ, চকোলেট, পারফিউম, জুয়েলারি। উপহার সামগ্রীর নাম শুনেই বুঝা যায়, এসব কিছুর ক্রেতা পুরুষ, কিনবে নারীর জন্য। হ্যাঁ, ভালোবাসা নর নারী বুড়ো বুড়ি সকলের জন্যই সমান অর্থ বহন করলেও ভ্যালেন্টাইন ডে’র ভালোবাসার প্রকাশ খুব বেশি মূর্ত হয়ে উঠে নারীর প্রতি নরের ভালোবাসায়। কারণ ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইন ডে নামকরণই হয়েছে প্রেমিক পুরুষ ভ্যালেন্টাইনের নামানুসারে।
** তৃতীয় শতকে রোমের প্রধান পুরোহিত ছিলেন ভ্যালেন্টাইন নামের এক সাধু। ওই সময় সম্রাট ক্লডিয়াসের (দ্বিতীয়) ধারণা জন্মায় যে, বিবাহিত পুরুষের চেয়ে অবিবাহিত পুরুষই তার সেনাবাহিনীর জন্য বেশি উপযুক্ত। কোনো পিছুটান থাকবে না অবিবাহিত সেনাদের মনে। ফলে তারা অনেক বেশি দক্ষতা অর্জন করতে পারবে নিজেদের পেশায়। তার সেনাবাহিনীও হয়ে উঠবে অত্যন্ত চৌকস। তাই তিনি তার সেনাবাহিনীতে তরুণদের জন্য বিবাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আইন জারি করে দিয়েছিলেন।
প্রধান পুরোহিত ভ্যালেন্টাইন এই আইনটিকে খুবই অনৈতিক ও অযৌক্তিক মনে করেছিলেন। তিনি গোপনে অনেক তরুণ-তরুণীর বিয়ে নিজে উপস্থিত থেকে সম্পন্ন করেছিলেন। একসময় সম্রাটের কানে পৌঁছে যায় এই সংবাদ, সম্রাটের তৈরী আইন ভঙ্গ করছেন পুরোহিত এই মর্মে সম্রাট অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন ভ্যালেন্টাইনের উপর। সম্রাট ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
কারাগারে বন্দী ভ্যালেন্টাইনকে জেলারের তরুণী কন্যা প্রায়ই দেখতে আসত। মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত ভ্যালেন্টাইন আসন্ন মৃত্যুর কথা ভুলে যান, তাঁর হৃদয়ে বেজে ওঠে ভালোবাসার সুর। ধীরে ধীরে তিনি জেলারের তরুণী কন্যার প্রেমে পড়ে যান। বন্দী পুরুষ আর মুক্ত নারীর চোখের তারায় তারায় রচিত হতে থাকে ভালোবাসার কবিতা, চোখের তারায় ফুটে উঠতে থাকে স্বর্গীয় প্রেমের ফুল।
দন্ড কার্যকরের দিন এগিয়ে আসে, এবং মৃত্যুদন্ডের ক্ষণ এসে উপস্থিত হয়। চোখের তারায় তারায় রচিত প্রেমের দস্তখত রেখে যান ভ্যালেন্টাইন প্রেয়সীকে লেখা একটি মাত্র চিঠিতে। মৃত্যুর আগে ভ্যালেন্টাইন তার তরুণী প্রেমিকাকে উদ্দেশ করে একটি চিঠি লিখেছিলেন। নিচে দস্তখত করেছিলেন ‘তোমার ভ্যালেন্টাইন’ বলে। এই একটিমাত্র সম্বোধন,’ভ্যালেন্টাইন’ যা আজও সব তরুণ-তরুণী, কিশোর কিশোরী বুড়ো বুড়ি হৃদয়ে ঝঙ্কার তোলে।
ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনা চরিত্রদের মাঝে কিছু কাল্পনিক চরিত্র থাকে, প্রিয় চরিত্রগুলোকে নায়ক নায়িকা বানাতে তাঁদের সম্পর্কে মনের মাধুরী মেশানো বানানো গল্প থাকে। হতে পারে ভ্যালেন্টাইন ডে’র গল্পটিও কাল্পনিক , তবে পুরোহিত ভ্যালেন্টাইন সেই তরুণ সেনাদের কাছে মহান ছিলেন, সম্রাটের আদেশ অমান্য করে যাদের বিবাহ তিনি সম্পন্ন করেছিলেন, যে কারণে ভ্যালেন্টাই্ন মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন। সেই তরুণ সেনাদের মুখেই হয়তো এই প্রেমকাহিনী রচিত হয়েছিল, সেটাই ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুর পর বাতাসের কণায় কণায় ছড়িয়ে পড়েছিল! ভ্যালেন্টাইন ডে’র গল্পে ধোঁইয়াশা থাকতে পারে, ভিন্ন মত থাকতে পারে কিন্তু ইতিহাসে ভ্যালেন্টাইনের নাম লেখা আছে। ইতিহাস বলে, ভ্যালেন্টাইন ছিলেন অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল, সাহসী এবং রোমান্টিক। ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুর পর ‘সেইন্ট’(মহৎপ্রাণ সাধুদের মৃত্যুর পরে চার্চ থেকে ‘সেইন্ট’ ঘোষণা করা হয়) ঘোষণা করা হয়। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সবচেয়ে জনপ্রিয় সেইন্টদের মধ্যে ভ্যালেন্টাইন ছিলেন অন্যতম।
সত্যি মিথ্যে যাই হোক, সাধু ভ্যালেন্টাইনকে নিয়ে রচিত প্রেমের গল্পে, গল্পটা তো ভালোবাসার। ভালোবাসার চেয়ে মূল্যবান কিছুতো আজও সৃষ্টি হয়নি জীবকূলের মাঝে।
ফেব্রুয়ারিতে ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপিত হয়, অন্যতম কারণ হচ্ছে, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যু হয়েছিল। এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতেই ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপন করা শুরু হয় (সময়টা ছিল ২৭০ এ.ডি)।
তারও অনেক পরে, ফেব্রুয়ারীর ১৪ তারিখ ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে নির্বাচিত হয়। ফ্রান্স ও ইংলান্ডে সাধারণ বিশ্বাস ছিল যে, ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ পাখিকুলের‘মেটিং সিজন’ শুরু হয়। তাই ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখটিকে ‘ডে ফর রোমান্স’ হিসেবে ভ্যালেন্টাইনস ডে নির্বাচন করা হয়।
ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষে উপহার দেয়ার রীতির শুরু অষ্টাদশ শতাব্দীতে। সপ্তদশ শতাব্দীতে গ্রেট ব্রিটেনে ভ্যালেন্টাইনস ডে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হতো। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় বন্ধু বা সমাজের সর্বস্তরের ভালোবাসার জনদের মধ্যে ছোটখাটো উপহার, হাতে লিখা ছোট ছোট নোটস আদান প্রদান শুরু হয়। এই শতাব্দীর শেষের দিকে ছাপাখানায় মুদ্রিত কার্ডের প্রচলন শুরু হয়। সরাসরি ভালোবাসার কথা জানানো যেখানে সামাজিকভাবে নিরুৎসাহিত করা হতো, ছাপাখানায় মুদ্রিত ‘ভালোবাসি’ কার্ড সকল ভালোবাসানুরাগীদের ভালোবাসা প্রেম অনুরাগ প্রকাশ সহজ করে দেয়।
আমেরিকায় ১৭০০ সাল পর্যন্ত হাতে লেখা ভ্যালেন্টাইন নোটের প্রচলন ছিল। ১৮৪০ সালের দিকে এস্থার এ হাউল্যান্ড নামের ভদ্রলোক সর্বপ্রথম ব্যাপক আকারে ভ্যালেন্টাইন কার্ড বাজারজাত করে।
ভ্যালেন্টাইন ডে’তে শুধু যে পুরুষ ভ্যালেন্টাইনগণই উপহারের মাধ্যমে ভালোবাসা প্রকাশ করে, তা নয়। মেয়ে ভ্যালেন্টাইনগণও পিছিয়ে থাকেনা। নারীর মনতো বারো মাসই ভালোবাসায় পূর্ণ থাকে, মনের মত পাত্র পেলে ভালোবাসা দিয়ে পাত্র কানায় কানায় পূর্ণ করে দিতে নারীর জুড়ি মেলা ভার। তারপেও ভ্যালেন্টাইন ডে’র দিনটিতে নারীও উপহার কিনে তার ভালোবাসার মানুষটির জন্য। আর কিছু নাহোক, “ তোমায় ভালোবাসি’ লেখা কার্ড কিনে প্রিয়কে ভালোবাসার কথা জানাতে ভুল করেনা।
গ্রিটিং কার্ড এসোসিয়েশনের হিসাব অনুসারে আমেরিকায় আনুমানিক এক বিলিয়ন ভ্যালেন্টাইন কার্ড প্রতি বছর বিক্রি হয়ে থাকে। শতকরা ৮৫ ভাগ ভ্যালেন্টাইন কার্ডের ক্রেতা হচ্ছে মেয়েরা। আমেরিকা ছাড়াও ভ্যালেন্টাইনস ডে বিপুল সমারোহে উদযাপিত হয় কানাডা, মেক্সিকো, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ায়।
এসব পরিসংখ্যানবিদেরা অবশ্য জানেনা, হালে বাংলাদেশেও দারুণ উৎসাহে পালিত হয় ভ্যালেন্টাইন’স ডে। দিন বদলে গেছে, যুগ বদলে গেছে। আমাদের আগের প্রজন্মে, অর্থাৎ আমাদের বাবা মায়ের আমলে কন্যা কিশোরী হয়ে উঠার সাথে সাথে বিয়ে দিয়ে স্বামীর সংসারে পাঠিয়ে দিত, কিশোরী জানতেই পারতোনা প্রেম ভালোবাসা কি জিনিস, স্বামীও ভাবতে পারতোনা বিবাহিতা স্ত্রীকেও ‘ ভালোবাসি’ বলে আন্দোলিত করা যায়!, যে সমাজে স্বামী তার স্ত্রীকে ‘ভালোবাসি’ কথা মুখ ফুটে বললে সমাজে সে ‘স্ত্রৈন, ভেড়া পুরুষ’ বলে বিবেচিত হতো, সেই সমাজ আজ বদলে গেছে।
বর্তমান সমাজে ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপিত হয়, যদিও শহর কেন্দ্রিক তবুও কম কথা নয়। মানুষ আজ শহরমুখি, তাই ভালোবাসা সকলের মাঝেই ছড়িয়ে পড়ছে। আজকের সময়ে আমাদের প্রজন্মের প্রৌঢ় স্বামী তার মাঝবয়সী স্ত্রীর হাতে গোলাপ তুলে দিতে লজ্জা পায়না, স্ত্রী সকলের আড়ালে বুড়ো স্বামীর হাতে চায়ের পেয়ালা তুলে দিয়ে ঠিকই বলে, “ আজ নাকি ভালোবাসা দিবস। এই নাও, চায়ের মধ্যে ভালোবাসা মিশিয়ে এনেছি”। তরুণ তরুণীদের কথা বাদ দিলাম, ভালোবাসা দিবস তাদেরই জন্য। ভালোবাসুক ওরা, প্রাণ-মন ভরে ভালোবাসুক সবাই সবাইকে।
ভালোবাসা এমন এক অনুভূতি, যা সবার সঙ্গে বিনিময় করা যায়। প্রেমিক তার প্রেমিকাকে ভালোবাসবে, প্রেমিকা ভালোবাসবে প্রেমিককে, স্বামী তার স্ত্রীকে, স্ত্রী ভালোবাসবে স্বামীকে, বাবা-মা ভালোবাসবে সন্তানকে, গৃহস্বামী ভালোবাসবে গৃহকর্মে নিয়োজিত পরিচারক-পরিচারিকাকে, পরিচারক-পরিচারিকা ভালোবাসবে গৃহস্বামীকে। মনিব ভালোবাসবে তার পোষা কুকুর বা বিড়ালকে, খুকী ভালোবাসবে তার আদরের ময়না পাখিটাকে, খোকা ভালোবাসবে তার রাবারের ফুটবলকে, আর্জেন্টিনার সমর্থক ভালোবাসবে ব্রাজিল সমর্থককে, ব্রাজিল ভালোবাসবে আর্জেন্টিনাকে, মিত্র ভালোবাসবে শত্রুকে, সবাই ভালোবাসবে সবাইকে_ এমনটা ভাবতেই ভালো লাগে।
কবিগুরু সেই কবে কোনকালে গেয়েছিলেন_ ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি, এই সুরে কাছে-দূরে, জলে-স্থলে বাজাই বাঁশি।’ ঠিক এই ভালোবাসার সুরটি পৃথিবীজুড়েই বাজে বছরের একটি দিনে, ১৪ ফেব্রুয়ারিতে।অথবা অতুলপ্রসাদের সুর, " সবারে বাসরে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবেনা রে"।
ফুল তো বিক্রি হয় সারা বছরই, কিন্তু ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে আমেরিকাসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে যত গোলাপ বিক্রি হয়, সারা বছরের বিক্রীত গোলাপের চেয়েও সংখ্যায় অনেক অনেক বেশি। শুধু গোলাপই নয়, গোলাপের সঙ্গে কার্ড, ক্যান্ডি, নানা রকম মনোহারি উপহার। সবাই কেনে। কারণ একটাই, এই একটি দিন উপলক্ষে ছোট-বড়, তরুণ তরুণী কিশোর কিশোরী বুড়ো বুড়ি বস-সহকর্মি, বন্ধু-বান্ধবী সবাই আবেগতাড়িত হয়, পরস্পর শুভেচ্ছা-সম্ভাষণে দিনটিকে ভরিয়ে তুলতে চায়, যার রেশ পরের দিন, তারপরের দিন, তারও পরের দিন পর্যন্ত সবাইকে মানসিকভাবে উৎফুল্ল রাখে, দুশ্চিন্তামুক্ত রাখে।
আজ আমার কাজের স্কেজিউল বিকেল তিনটা থেকে রাত দশটা অবধি। এত রাত পর্যন্ত কাজে থাকতে ভাল লাগার কথা নয়, কিন্তু আমার খারাপ লাগছেনা। কারণ রাত দশটা অবধি আমি মানুষের ঢল দেখতে পাবো ওয়ালমার্টে। শিশু তরুণ কিশোর অল্প বয়সী পুরুষ, বয়স্ক পুরুষেরা ছুটে ছুটে আসবে যার যার প্রিয়জনের জন্য ফুল, চকোলেট বেলুন কার্ড জুয়েলারি কিনতে। আমার রেজিস্টারে যে পুরুষেরা আসবে, তাদের সকলের চোখের তারায় দেখতে পাব আলোর দ্যুতি, একটু একটু করে ঝিলিক দিবে। সবাই দেখতে পাবেনা এই ঝিলিক, আমার দেখার চোখ আছে তাই আমি দেখতে পাবো।
মেয়েরাও আসবে আজ, তবে কেউই হুড়মুড়িয়ে আসবেনা। খুব শান্ত পায়ে, ধীর গতিতে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখবে আর এর ফাঁকেই টুক করে প্রিয় জিনিসটি শপিং বাস্কেটে তুলে ফেলবে আমাদের নজর এড়িয়ে।
মেয়েরা সংসারের জিনিস কিনে সবাইকে জানান দিয়ে, বাচ্চার জিনিস কিনে সবাইকে জানান দিয়ে, কিন্তু ভালোবাসার মানুষটির জন্য ভালোবাসার উপহার কিনে খুব গোপনে। কেন গোপনে কিনে তা এক রহস্য। আমি নিজেও যা কিছু কিনি, খুব গোপনে, কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগে। হয়তো নারীর এই লজ্জাটুকুই তার অনুরাগ, ভালোবাসার অনুভব।
লেখাটি শুরু করেছিলাম, আগামীকাল দিয়ে। শেষ করছি আজ দিয়ে। কারণ আজই বর্তমান, বর্তমানই সত্য। অতীত আমাদের পাঠক্রম, যা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানকে সাজাই।আগামী আমাদের আশা, যার পানে তাকিয়ে বর্তমানের পথ পাড়ি দেই
সবাইকে ভালোবাসি, সবার প্রতি ভালোবাসা। হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন’স ডে

Monday, January 22, 2018

কুয়াশা কুয়াশা দৃষ্টি (স্মৃতির মুকুরে সরস্বতী পূজো)

সময় এখন রাত ৯টা, আমেরিকার রাত। আমেরিকার উল্টোদিকে এখন সকাল হয়েছে। বাংলাদেশে সময় এখন সকাল ৯টা। আমেরিকায় আজ রবিবার, বাংলাদেশে সোমবার। আমেরিকার ছোট এক বাড়িতে আমি আজ বড্ড বেশি একা, বাংলাদেশে পরিবার পরিজন, বন্ধু বান্ধব সরস্বতী পূজোর আয়োজন নিয়ে মহাব্যস্ত।
হ্যাঁ, আজ দেশে সরস্বতী পূজো হচ্ছে। মহা ধুমধামে সরস্বতী পূজো উদযাপিত হচ্ছে নাকি শুধু কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যেই পূজো শেষ হয়ে যাচ্ছে, জানা সম্ভব নয়। একেতো আমেরিকার অনেক দূরের এক গ্রামে থাকি, তার উপর ফেসবুকে বিচরণ করতে পারছিনা, কাউকেতো জিজ্ঞেস করার উপায় নেই। মনটা একটু খারাপ খারাপ লাগছে। দেবী সরস্বতী কত কোমল মনের দেবী, মন দিয়ে সাধনা করলেই দেবীকে পাওয়া যায়। অথচ আজকের দিনে আমি একটু সাধনা করতে পারছিনা, দেবী মূর্তি চোখের সামনে না থাকলে মনোসংযোগ ঘটে? চোখের সামনে দেবীকে দেখবো কি করে, ফেসবুকে কী এক ছাইয়ের ব্যান হয়ে আছি যে! সরস্বতীকে দেখতে নিজের ওয়াল ছেড়ে এখন অন্যের ওয়ালে ঘুরতে যেতে হবে? আমি কি ছোঁচা নাকি! এর চেয়ে মনে দুঃখ চেপে রাখাই ভাল।
মনে মনে গুন গুন করে চলেছি, "মনের দুঃখ মনেই রইলো গো, কার কাছে বলে বেড়াই বলো, আমার দুঃখের কথা শুনবে তেমন মানুষ কোথা পাই"! স্বরচিত গান, এখনই রচনা করে ফেললাম। আজ দেবী সরস্বতীর পূজো বলে কথা,দেবী স্বয়ং উপস্থিত ভক্তদের মাঝে! 
কে না জানে, সরস্বতী বিদ্যার দেবী, সঙ্গিতের দেবী, জ্ঞান বুদ্ধি বিকাশের দেবী। ছোটবেলায় বাবা বলতেন, এমন দিনেই নাকি বেশি করে পড়তে হয়, সরস্বতী পৃথিবীতে এসে যাকেই বই হাতে দেখে, বিদ্যে বুদ্ধি জ্ঞান নাকি তাকেই দেয়। বাবার এই উপদেশ মানতে পারিনি কোনকালেই, তবে আজও মনে রেখেছি।  
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কাল তো অনেক বছর আগেই চুকিয়ে ফেলেছি, তাই বলে সরস্বতীর সাধনা একেবারে চুকিয়ে ফেলিনি। গল্পের বই পড়ি, ফেসবুকে কত শত লেখা পড়ি। গানের গলা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেও নীচু কন্ঠে সবসময় গুন গুন করি। এই গুন গুনানি সাধনাবলেই আজকাল অবসর সময়ে নিজে নিজে  দুই এক লাইন গান লিখে তাতে সুরারোপ করে গেয়েও ফেলি। দেবী সরস্বতীর কৃপা আছে বলতেই হয়। সরস্বতী দেবী রূপে, বসনে যেমনি শ্বত শুভ্র, দেবীর মনটাও একেবারে সাদা। বিদ্যে চাইলেই বিদ্যে দেয়, জ্ঞান চাইলে জ্ঞান দেয়, আর সঙ্গিত চাইলে কিছু নাহোক দুই চার লাইন গান রচনা করার ক্ষমতা তো দেয়! নাহলে আমি যখন তখন গান বাঁধি কি করে! দেবী লক্ষ্মীর কৃপা পাওয়া কঠিন, সাধনা করতে করতে গায়ের তেল গলে যায়, হাড়মাস কালো হয়ে যায়। তবুও লক্ষ্মী দেবী কৃপা করতে চায়না, নামে লক্ষ্মী হলেও লক্ষ্মী দেবীর অন্তর ভীষণ কঠিন, সহজে নরম হয়না। 

আমি যে আজ সত্যি সত্যি একা, আমার মনটাও যে আজ ভীষণ ফাঁকা, তা বুঝতে পারছি এলেবেলে কথা বলার ভঙ্গি থেকেই। যা মনে আসছে তাই লিখছি। আমি বুঝতে পারছি, লেখার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে এত্তগুলো কান্না ঝরে পড়ছে, এত্তগুলো অভিমান গলে পড়ছে। কুয়াশায় ঝাপসা চোখের দৃষ্টি থেকে কুয়াশার চাদর সরে সরে যাচ্ছে, আর এই মধ্য বয়সে শৈশব কৈশোরের স্মৃতিকণারা চোখের সামনে দিয়ে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে! এক ফাঁকে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসিও খেলে গেলো, কারণ সরস্বতী পূজোর দিন অতিরিক্ত বিদ্যা পাওয়ার লোভে সরস্বতী মায়ের বন্দনা করে কাগজে খাগের কলম দিয়ে লিখতাম, ওঁ সরস্বতী মায়ের চরণে নমঃ, সরস্বতী বানান লিখতে গিয়ে কলম ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হতো। বুঝতে পারতাম না, ব-ফলা কোন স এর পায়ে বসবে? যদি ভুল বানান লিখি, তাহলে সরস্বতী মা বিদ্যা দিবেনা--এই ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেতো। 
অলস বসে অলস ভাবনায় স্মৃতিকণাগুলো যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে! কত কিছুই মনে পড়ে যায়। সেই স্কুল জীবনের দিনগুলো, নবম শ্রেণীর শেষ, দশম শ্রেণীর শুরুর দিকে আমি প্রবন্ধ লিখতাম, আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় প্রবন্ধ পাঠাতাম, প্রবন্ধ লেখা শুরুর পূর্বে সরস্বতী মা'কে স্মরণ করতাম। কি করে যেন সব প্রতিযোগিতায় আমার প্রবন্ধটাই প্রথম স্থান পেতো। সেই কোনকালে ফেলে এসেছি আমার স্কুল, আমার লেখার প্রতিভা, কত কিছু, সব কিছু-----সেদিনের লেখালেখির অভ্যাসটা যদি বয়ে নিয়ে আসতাম, নিশ্চয়ই আজ লিখে ফেলতাম, 'স্মৃতির মুকুরে সরস্বতী পূজো'। কেমন হতে পারতো সেই স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধখানি!


শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজো হয়ে থাকে। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আবার চলে এলো মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী। প্রবাস জীবনে সারাটাক্ষণ গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে প্রায়ই হাঁপিয়ে উঠি। দেশে থাকতে দিনের প্রতিটি মুহূর্ত কাজ করে তো অভ্যস্ত ছিলামনা। দেশে কাজের ফাঁকে ফাঁকে কতরকম আনন্দ উৎসবে মেতে থাকতাম আমরা। আমাদের বাংলা সংস্কৃতিতে কত রকমের পালা পার্বণ, কত ধরনের যে উৎসব আছে, তাতো আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। হিন্দুদের বারোমাসে তেরো পার্বণের কথা প্রবাদের মত হয়ে গেছে। তেত্রিশ কোটি দেব দেবী নিয়ে হিন্দুদের নিত্য জীবনের নিত্য বসবাস। 
হিন্দুধর্মাবলম্বীগণ বিশ্বাস করে, জীবনের প্রতিটি পর্বে একজন করে নিয়ন্ত্রক (দেব দেবী) থাকেন, যিনি স্বর্গ থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। মানুষের জীবনে পুরুষগণ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকলেও ঐশ্বরিক ক্ষেত্রে দেবীরাই বেশী ক্ষমতা রাখেন। স্বয়ং শিবঠাকুরতো ভোলানাথ হয়ে সব ভুলে বসে থাকেন, দেবী দূর্গাকেই জাগতিক সবকিছুর দিকে খেয়াল রাখতে হয়। সব খেয়াল করতে গিয়ে নিশ্চয়ই দেবী দূর্গার মাথাটাই এলোমেলো হওয়ার যোগার হয়েছিল, তাই উনি উনার অধঃস্তনদের মধ্যে দপ্তর বন্টন করে দিয়েছেন। দপ্তর বন্টন পর্বে কন্যা সরস্বতীকে দিয়েছেন ‘শিক্ষা ও শিল্পকলা’ দপ্তর। এবং দপ্তর বন্টনকালে কন্যাটিকে উনি জানিয়ে দিয়েছেন বাংলা বছরের মাঘমাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে যেনো বাংলার মাটিতে একবার করে ঘুরে যান এবং সকল শিক্ষার্থীদের উপর উনার করুণা বর্ষণ করে যান। অন্যান্য অধঃস্তনদের কাজের পরিধি কতটুকু নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা অজানা থাকলেও দেবী সরস্বতীর কাজের পরিধি একটু বিস্তৃত আকারেই নির্ধারণ করে দেয়া আছে। দেবী সরস্বতীকে শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কথা ভাবলেই চলেনা, হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খৃষ্টান নির্বিশেষে সকলের কথা উনার ভাবতে হয়।তাই দেবী সরস্বতীকে সকল ধর্মের অনুসারীরা সম্মান করে থাকে। কারণ জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে জ্ঞান অর্জনটাই বড় কথা, এখানে ধর্ম বিবেচ্য নয়। সেইজন্যই একমাত্র সরস্বতী পূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘর ছাড়িয়ে বাংলাদেশ, ভারতের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।



সরস্বতী পূজার দিনে গায়ে কাঁচা হলুদ আর নিমপাতা বাটা মেখে ভোর সকালে স্নান করার প্রথা যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরে, এই সরস্বতী পূজার একটি আচারের মধ্যে পড়ে। মনে পড়ে, স্কুলে যখন নীচের ক্লাসে পড়তাম, সরস্বতী পূজা এলেই মন আনন্দে নেচে উঠতো। আমি ছিলাম ফর্সা মায়ের কালো মেয়ে। কালো বাবার গায়ের রংটাই যে কেনো পেয়েছিলাম তা নিয়ে অনেক আক্ষেপ ছিল মনে। 
আশেপাশের বাড়ীর সব মেয়েদের দেখতাম প্রতিদিন স্নানের আগে কাঁচা হলুদ বাটা, দুধের সর বাটা, কমলার খোসা বাটা গায়ে মাখতো, গায়ের ফর্সা রঙ আরও উজ্জ্বল করার জন্য। আমি এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে তাদের রূপ চর্চা দেখে যেতাম। আমার বাবা মনে করতেন, দেহের সৌন্দর্য্যের চেয়ে মনের সৌন্দর্য্য অনেক বেশী ইম্পর্ট্যান্ট। তাই এইসব রূপচর্চা নিয়ে ভাবার অবকাশ দিতেননা। মনে পড়লে আজও হাসি পায়, সরস্বতী পূজোর দিনে গায়ে হলুদ মাখার সুযোগ পেয়ে খুশিতে মনে মনে বাক বাকুম করতাম।থলুদ মেখে ফর্সা হওয়ার  এতবড় সুযোগটা আমি হাতছাড়া করতামনা। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই চলে যেতাম প্রতিবেশীদের ঘরে।
প্রতিবেশী মাসিমার ঘরে একটা নির্দিষ্ট পাটা-পুতা ছিলই শুধু কাঁচা হলুদ নিমপাতা বাটার জন্য। কাঁচা হলুদের সাথে কেন নিমপাতা জুড়ে দেয়া হয়েছে, এটা ভেবে আমার মন খারাপ হতো। নিমপাতার মত এমন বিশ্রী জিনিস জীবনে আর দুইটা দেখিনি। ভয় পেতাম, এমন যমতিতা জিনিস আমার কালো চামড়াতে মাখলে নাজানি আমি আরও কালো হয়ে যাব। আবার নিমপাতা না মাখলে যদি পূজার নিয়ম না মানা হয়, পাপ হলে সরস্বতী মা যদি বিদ্যা না দেয়! সেই ভয়ে একটু নিমপাতা মিশাতাম অনেকটা হলুদের সাথে। তারপর জবজবে করে হলুদ সারা মুখে, হাতে, পায়ে মেখে বসে থাকতাম। সহজে স্নানঘরে ঢুকতে চাইতামনা, স্নানের জলের সাথে সব হলুদ ধুয়ে চলে যাবে এই ভয়ে। 
 স্নান করতেই হতো, কিনতু মুখে সাবান মাখতামনা। সারাদিন হলুদ বর্ণের মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম, কালো হয়ে জন্মানোর যে দুঃখ, তা ঐ একদিনে পুষিয়ে নিতাম। বন্ধুরা অবশ্য আমাকে টিপ্পণী কাটতে ছাড়তোনা, ফর্সা দেখানোর জন্য যে আমি হলুদ মেখে বসে আছি, তা তারা কিভাবে জানি বুঝে ফেলতো।
 স্নান শেষে শুরু হতো দেবীর পায়ের কাছে বই খাতা কলম রেখে দেয়ার হিড়িক। এটা একটা রীতি যে সরস্বতী পূজার দিনে পড়তে নেই, বই খাতা দেবীর পায়ের নীচে দিয়ে রাখলে দেবী খুশী হয়ে বিদ্যা বুদ্ধি দিয়ে থাকেন ঐ বইয়ের ভেতর। দেবীর পূজার ফুল বেলপাতা বইয়ের ভেতর গুঁজে রাখলেই পরীক্ষায় ভালো ফল করা যাবে। আমাদের পরিবারে নিয়ম ছিল উলটো। উলটো নিয়ম চালু করেছিলেন আমাদের বাবা। সরস্বতী পূজার দিন সরস্বতী মা পৃথিবীতে নেমে আসে, যে বাড়িতে ছেলেমেয়েরা পড়তে বসে, সরস্বতী দেবী তাদের বেশি করে বিদ্যা দেয় বলে পূজার দিন সকালে আমাদেরকে পড়তে বসাতেন। উনার কথা ছিলো, আজকেই সুযোগ, কেউ পড়েনা, তোমরা যদি পড়ো দেবী তোমাদের উপর সন্তুষ্ট হবেন। আমাদের এক ঘন্টার জন্য হলেও বই পড়তেই হতো। বন্ধুরা জানালার কাছে এসে হাত ইশারা করতো আর আমরা বাবার ভয়ে পড়তাম। বাবা ঠিকই বুঝতে পারতেন আমাদের কষ্ট, তারপরেও কেনো জানি উনি এই ‘শাস্তি’টুকু আমাদের জন্য বরাদ্দ রাখতেন!
 সব পূজার আচারেই একেকটা নির্দিষ্ট নিয়ম থাকে। যেমন বিদ্যার দেবী তাই সরস্বতী পূজাতে ‘খাগের কলম ও দুধজলে ভরা কালির দোয়াত’ লাগে। আরও লাগে পলাশ ফুল, কুল বড়ই। নিমপাতা কাঁচা হলুদ দিয়ে স্নান করতেই হয়।পূজাতে ‘কুল বড়ই’ লাগে, তাই ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা নিয়ম চালু আছে, সরস্বতী পূজার আগে ‘বড়ই’ খেতে হয়না,  পূজার পরে যত ইচ্ছা বড়ই খাওয়া যায়। বড় হয়ে বুঝতে শিখেছি, মাঘের এই সময়টাতে কুল পাকে, অন্য সময়ে কাঁচা কুল খেয়ে অসুখ করার সম্ভাবনা থাকে। তাই সরস্বতী পূজা পর্যন্ত কুল খাওয়ার জন্য অপেক্ষার এই কঠিন নিয়ম। খাওয়া দাওয়ায় এই কঠিন নিয়মটুকু গায়ে লাগতোনা একটা বড় কারণে। সেটা হচ্ছে, সারাদিনে লেখাপড়ার সাথে কোন সম্পর্ক থাকতোনা। কারণ যাবতীয় বই খাতা কলম সরস্বতী মায়ের চরণের সামনে জমা রাখা হতো যেন দেবী আমাদের বই খাতা ভর্তি করে বিদ্যা দিয়ে যান। সারাদিন, সারারাত বই খাতা থাকতো পূজামন্ডপে। আর থাকতো আমাদের প্রত্যেকের নামে একটা করে দুধ জলে পূর্ণ দোয়াত আর খাগের কলম। দোয়াত আর কলম পরদিন সকালে কাজে লাগতো।
 সরস্বতী পূজার দিনে মেয়েদের সবাই হলুদ শাড়ি পড়ে। ছোটরা সকলে মিলে পূজো করে, পূজোর প্রসাদ গ্রহণ করে, এরপর ঘরে গিয়ে মিঠাই ক্ষীর খই দই মুড়ি নাড়ু, সন্দেশ, পায়েস খিঁচুড়ি লাবড়া চাটনি দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সারে। রাতের বেলা ইলিশ মাছ এবং কলাই শাক খাওয়া হয়। 
পরদিন সকালে আমরা দৌড়ে চলে যেতাম কলাগাছ তলায়। কলাপাতা ছিঁড়ে আনতাম, দুধ জল পূর্ণ দোয়াতে খাগের কলম চুবিয়ে তা দিয়ে কলাপাতায় লিখতাম, " ওঁ সরস্বতী মায়ের চরণে নমঃ" তিনবার লিখতাম এই কথা ক'টি। এরপর কলাপাতা ভাঁজ করে সরস্বতী মায়ের পায়ে দিয়ে আসতাম, কেউ হাতে গুঁজে দিত। এটা করার পর মনে এক অগাধ বিশ্বাস আসতো, " আমার অনেক বিদ্যা হবে"।




এতো গেলো বালিকা সময়ের কথা। যখন স্কুলের নবম- দশম শ্রেণীতে পড়ি, তখনতো মাতব্বরী করার অধিকার অর্জন করে ফেলেছি। আমি এমনিতে তেমন ডাকাবুকো ছিলামনা, নেতাগিরি আমার রক্তে নেই, তারপরেও নেতা হয়ে গেছিলাম। আসলে তখন ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল বা ফার্স্ট বয়দের মেঘ না চাইতে জলের মত করেই ক্লাস ক্যাপ্টেন হওয়ার সুবাদে হাতে নেতৃত্বের ক্ষমতা চলে আসতো। সরস্বতী পূজা বা বার্ষিক মিলাদ মাহফিলের মত অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব পেয়ে যেতাম। আমাকে কিছুই করতে হতোনা, আমাকে শিখন্ডী হিসেবে রেখে যারা মাতব্বরী করতে অভ্যস্ত ছিল, তারাই সব ব্যবস্থা করে ফেলতো।আমাকে জানিয়েই  নিজেদের জন্য অতিরিক্ত মিষ্টির প্যাকেট বরাদ্দ করা হতো। আমি ডাকাবুকো ছিলামনা, কিনতু অতিরিক্ত মিষ্টির প্যাকেটের লোভ ঠিকই ছিলো। তখনও গায়ে হলুদ মেখে রঙ ফর্সা করার উপসর্গ আমার মাঝে বেঁচেছিল, বরং নতুন আরেকটি উপসর্গ যোগ হয়েছিলো। শাড়ী পড়ে বড় সাজার হাস্যকর চেষ্টা। শাড়ি পড়তাম, বড়দের মতো করে চুল বাঁধতাম। মনে পড়ে অনুভা, ফরিদা, সেলিনা, সীমার কথা। একটা গ্রুপ ছিলাম আমরা, টিচারদের গুড বুকে আমাদের নাম ছিলো, আমি আর সেলিনা যেখানে থাকতাম, টিচাররা নিশ্চিন্ত বোধ করতেন। তাছাড়া এইসব অনুষ্ঠানে বয়েজ স্কুল থেকে ছাত্ররাও আসতো, প্রতিমা দর্শনের পাশাপাশি আমাদের চোখেও চোখ রেখে যেতো। এটাইতো কৈশোরের এক দুরন্ত মজার জিনিস। বয়েজদের স্কুলে তো আর যেতে পারতামনা আমরা, পরিবার থেকেই নিষিদ্ধ ছিল, ফলে এই চোখাচোখির ব্যাপারটা আরও বেশি আনন্দময় ছিল। 
 এরপর কলেজ, তরুণীকাল শুরু। কলেজের জীবনটা আমার জন্য একটুও সুখকর ছিলোনা। বারো জাতের স্কুল থেকে বারো জাতের মেয়েরা এসে জড়ো হয় কলেজে। সেখানে আমি কে, আর তুমিই বা কে? কেউ কারো অধীন নয়। স্কুলে সকলে ছিল আমার অধীন, স্কুলটা ছিল আমার রাজত্ব। কলেজে গিয়ে নিজের অস্তিত্বকে টেরই পেতামনা। তার উপর কলেজের পড়া, একটুও ভালো লাগতোনা। কলেজের পড়া ভালো লাগেনি, কলেজের পরিবেশটাও ছিলো খাপছাড়া। আমাদের প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম ব্যস্ত ছিলেন উনার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার কাজে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাথে উনার খুব ভালো কানেকশান ছিল। উনি আমাদের কলেজের কোন কিছুতেই খেয়াল রাখতেননা, কলেজের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড নিয়েও উনার কোন আগ্রহ ছিলোনা। ফলে কলেজে গিয়ে কেমন খেই হারিয়ে ফেলে দুই বছর মুষড়ে পড়েছিলাম। সরস্বতী পূজা কলেজে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিনা তাও আমার মনে পড়েনা।

চলে গেলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছি প্রথম তিন বছরে। জাহাঙ্গীর নগরে এসে আবার ফিরে পেয়েছিলাম রাজত্ব করার সুখ। আহ! কি মধুর স্মৃতি! এখানে প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এমন জাঁকজমকপূর্ণ হতো যে বাড়ী ঘরে ফেরার কথাও ভুলে যেতাম। সরস্বতী পূজার কথাই বলি। জাহাঙ্গীরনগরে এসেই মনে হয়েছে, সরস্বতী পূজা শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই পূজা আসলে সকল শিক্ষার্থীর জন্য বিদ্যালাভের আরাধনা। আরাধনা ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যে কেউ করতে পারে, এবং সকলে তাই করতো। 
পূজা মন্ডপে শুধুই ছাত্রছাত্রীরা থাকতাম, মন্ডপ সাজাতাম ছাত্রছাত্রীরা, শুধুমাত্র অভ্যাস নেই বলেই পূজার আয়োজনে মুসলিম মেয়েরা অংশ গ্রহণ করতোনা। তাতে কি, পূজোর নৈবেদ্য সাজানোর অংশটুকু বাদ দিলে আর বাকী সব কিছুতেই আমরা ছিলাম শুধুমাত্র শিক্ষার্থী। দিনে পূজার আনন্দ, সন্ধ্যায় আরতি। আরতি করতো ছেলে শিক্ষার্থীরা, মেয়েরা থাকতো দর্শক ও হাততালি গ্রুপে। 
স্কুল জীবনের 'চোখাচোখি' পর্বটি এখানেও চলতো, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবা মায়েরাতো আর পাহারা দিতে আসতোনা। মজাই পেতাম ছেলে মেয়ে চার চোখে তাকিয়ে। আমাদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়টির কোন বদনাম ছিলনা, দেবী সরস্বতীর কৃপা আমরা সবাই পেয়েছিলাম। আশির দশকের শেষ দিকে এসেও জাহাঙ্গীর নগরের শিক্ষার্থীরা ছিল সকলের জন্য অনুকরণীয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সরস্বতী পূজা ছিল অতি বিখ্যাত, একবার মাত্র গিয়েছিলাম পূজা দেখতে, জাঁকজমক দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। এখন কি আগের মত করেই পূজা হয় জগন্নাথ হলে, খুব জানতে ইচ্ছে করে।
আমি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শেষের দিকে বিয়ে করে ফেলেছিলাম বলেই বন্ধুদের সাথে আর নিরবচ্ছিন্ন সময় কাটাতে পারিনি। কিনতু যে সময় আমি কাটিয়ে এসেছি বন্ধুদের সাথে, আমার কন্যাদের সাথে সে সমস্ত দিনের গল্প করার সময় আমার চোখে মুখে নিশ্চয়ই আলো ফুটে উঠে! মাত্র ত্রিশ বছর আগেও আমরা কত আধুনিক মনের ছিলাম, আমাদের মধ্যে প্রেম ছিল, কিনতু কোন শঠতা ছিলনা, চরিত্রে নির্মলতা ছিলো, কোন কলুষতা ছিলোনা, আচরণে স্থিরতা ছিলো, কোন রকম অধৈর্য্যতা বা অস্থিরতা ছিলনা, অভিমান ছিল কিনতু আক্রোশ ছিলনা। আজকাল স্মৃতিতে আক্রান্ত হই। মেয়েদের কাছেই গল্প করি আমার ছাত্রজীবনের কথা। ছাত্রজীবনে স্কুল কলেজের প্রতিটি অধ্যায়ের গল্প করতে গিয়ে মনটা কেমন এক ধরণের ভালোলাগায় মাখামাখি হয়ে যায়।
ত্রিশ বছর সময় কি খুব বেশী আগের কথা! একমাত্র মোবাইল ফোন ছিলনা তখন, কম্পিউটারও ছিলনা, এটুকুই তফাৎ। তাহলে কি প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে মানুষের আচরণের বৈরীতা আছে! মনে হয় আছে, কালির দোয়াতে খাগের কলম ডুবিয়ে লিখতেন রবীন্দ্রনাথ, তাই তিনি হয়েছিলেন বিশ্বকবি, প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে আমাদের খাগের কলমের বদলে ‘ফাউন্টেন পেন’, তারপরে এলো ‘বলপেন’ , এরওপরে এলো কম্পিউটার, ল্যাপ্টপ আর কীবোর্ড। এখন আর আমাদের কলম না হলেও চলে, আমরা ল্যাপ্টপ, আইপ্যাড, কিনডেল, ট্যাবলেট, নুক নামের ইলেকট্রনিক বই ব্যাবহার করি। যুগের উন্নতির সাথে সাথে ভাষাও বদলে যাচ্ছে, আমরা এখন আর রাবিন্দ্রীক ভাষায় লিখিনা, কবিতার ভাষাও বদলে গেছে। এখন রবীন্দ্র সঙ্গীতকে বলা হয় প্যানপ্যানানি সঙ্গীত, গানের ধরণও পালটে গেছে, এখন রবীন্দ্র সঙ্গীত রিমেক করা হচ্ছে ব্যান্ডের সাথে সিনকোনাইজ করে, আরও এসেছে বাজারে র‌্যাপ, রক, হেভী মেটাল সহ আরও ভারী ভারী নামে। এখন কেউ আর রবীন্দ্র নজরুল হতে চায়না, এমনকি আইন্সটাইনও হতে চায়না। কি যে হতে চায় আমাদের সন্তানেরা, সেটাও বুঝতে পারিনা। শিক্ষাঙ্গনগুলোতে এত অস্থিরতা দেখেই কি সরস্বতী দেবীও ভয় পেয়ে গেছেন কিনা কে জানে। নাহলে এখনকার ছেলেমেয়েরা কেনো দেবীর কৃপা লাভে বঞ্চিত হচ্ছে!

নাহ! বেশিক্ষণ মন খারাপ করে থাকতে নেই। আজ রবিবারের রাত, কাল আমেরিকাতে সোমবারের ভোর হবে, এরপর সকাল হবে। কাঁচা হলুদ নেই, হলুদ গুঁড়ো জলে গুলে মুখে হাতে মেখে ছোটবেলার মত ফর্সা হবো। কাল আমার ডে অফ, ফলমূল, দই, মোয়া, দুধ কিনে এনেছি আজ। কাল সকালে স্নান সেরে নিজে নিজেই পূজোর নৈবেদ্য সাজিয়ে সরস্বতী মায়ের চরণে আমার আরাধনা, আমার সাধনা, আমার প্রার্থনা পূজোর ফুল বানিয়ে সমর্পণ করে দেবো। আমার বয়স তেপ্পান্ন, আমি স্কুল কলেজের পাট বহু বছর আগে চুকিয়ে বুকিয়ে চলে এসেছি। তাতে কি? লেখাপড়ার কি শেষ আছে? পাঠ্যবই পড়িনা, কি হয়েছে, এখনও বিদ্যাচর্চা করি, নাহয় ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখি, তাতে কি, এটাও বিদ্যাচর্চার একটি ইন্টারনেটিয় রূপ। এখানেও প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াই চলে নিরন্তর। জীবনটাই কেটে গেলো নানারকম লড়াই সংগ্রামে। এখন চলছে ফেসবুকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াই, লড়াইয়ে আমাকে জিততেই হবে। হারবার জন্য আমি জন্মাইনি, আমার মানসিক শক্তি প্রবল আছে, শুধু প্রয়োজন সরস্বতী মায়ের কৃপা। সরস্বতী মায়ের কৃপা পাবো বলেইনা আজকের এত আয়োজন!

Sunday, January 21, 2018

সরস্বতী বিদ্যাবতী, তোমায় দিলাম খোলা চিঠি (৬ বছর পূর্বে লেখা)






 27/01/2012 - 3:12pm
দেবী সরস্বতী শ্রীচরণকমলেষু,

দেবী, আশা করি এই মুহূর্তে তুমি খুবই আনন্দে আছো, কেননা তিথি নক্ষত্রের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশ সময় শনিবার ভোর সকালেই তোমাকে নিয়ে তোমার হংসবাহন বাংলার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে ও দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে পৌঁছে যাওয়ার কথা। হাতে আছে মাত্র আর একদিন সময়। রাজ্যের গোছগাছ নিশ্চয়ই পড়ে আছে। আসতে গেলেতো তোমাকে অন্ততঃ সাত দিনের সময় হাতে নিয়ে আসতে হবে। শুধু দেশেই তো নয়, প্রবাসেও তো তোমার বাঙ্গালী ছাত্র ছাত্রী একেবারে কম নেই! তাদের দুয়ারেও তো তোমার পদধূলি দিতে হবে। 
জানি চিঠিখানি পেয়ে তুমি যুগপৎ অবাক ও বিরক্ত হবে। কিনতু আমি নিরুপায় মা। তুমি এই ধরাতে আসই বছরে একটিবার, তাছাড়া একবার এসে পৌঁছালে তোমার ভক্তদের যন্ত্রণায় তোমার কাছে পৌঁছানোই যাবেনা। অথচ তোমার সাথে কথা বলাটা আমার অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে যে! সেই জন্যই তোমাকে সরাসরি চিঠি লেখাটাই যুক্তিযুক্ত মনে হলো।
মাগো, ইনানি বিনানি বাদ দিয়ে আসল কথা শুরু করি। আচ্ছা, স্বর্গে বসে কি বাংলাদেশের সংবাদপত্র পড়তে পারা যায় অথবা অনলাইনের ব্যাপার স্যাপারগুলো কি স্বর্গেও আছে? কি জানি, জানার কোন উপায় নেই, আসলে পৃথিবীতে এত কিছু আবিষ্কার হয়েছে কিনতু স্বর্গ-নরকের ব্যাপারটাই এখনও আবিষ্কৃত হয় নাই। তবে ধারণা করি দেশের কোন খবরই তোমার কানে পৌঁছায়না। পৌঁছালে জানতে পারতে আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে এখন কি চলছে! আমি নিজেওতো ভাল জানিনা, দেশে আগের মত প্রতিটি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজা হয় কিনা! পূজা-পার্বন এখন শিকেয় উঠেছে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে এখন ক্ষমতা প্রদর্শনের লড়াই।
কথা নাই বার্তা নাই, হয় কথায় নয় কথায় দেখি ছাত্রদের হাতে রাম-দা, চাপাতি, কিরীচ জাতীয় সব আদিম যুগের অস্ত্র। সত্যি বলছি মা, যদি বিশ্বাস না হয়, দেশে যখন আসবে কারো কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে তিন চার দিন আগের যে কোন পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালেই দেখবে, একটি ছবিতে ছেলেরা হাতে ছুরি, চাপাতি, কাস্তে নিয়ে কাউকে ধাওয়া করছে। আর একটু কষ্ট করে যদি ছবির নীচের খবরটা পড়ে ফেলতে পারো, দেখবে তোমারও চোখ কপালে উঠে যাবে। ছোট্ট ঘটনা,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে এক জেলা ছাত্র কল্যাণ সমিতির চাঁদা উঠানোকে কেন্দ্র করে ঝগড়া লেগে যায়। একবার ভেবে দেখো, চাঁদা তোলার কথা ছাত্র কল্যাণ তহবিলের জন্য, অথচ মারামারি কাটাকাটি করেই সব কল্যাণের ভরাডুবি করে ফেলেছে। শুধু কি ছাত্রলীগ, যখন যে দল দেশের ক্ষমতায় থাকে, তার অঙ্গসংগঠন হিসেবে তাদের ছাত্রসংগঠনগুলো ভীষণরকম বেপোরোয়া হয়ে উঠে।
লজ্জার কথা হচ্ছে, দুই সপ্তাহ আগেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘটে গেছে আরেক নারকীয় ঘটনা। ইংরেজী বিভাগের এক ছাত্রকে তারই এককালের বন্ধুরা আগের শত্রুতার জের ধরে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। মাগো, এবার কি আমাকে একটু একটু চেনা চেনা মনে হচ্ছে! তোমার কি মনে পড়ছে, অনেক আগে আমরা কি জাঁকজমক করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমার পূজা উদযাপন করতাম! আমাদের হাতে ছিল তখন কলম। পিস্তল বন্দুক বা চাপাতি, কিরীচ বা ছুরি আমরা চোখেও দেখিনি। 
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা বলছি। কি চমৎকার নৈসর্গিক পরিবেশে ছিলাম আমরা! অমন পরিবেশে থেকে আমরা কি সুন্দরভাবেই না শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, চলনে, বলনে, আচারে আচরণে শিক্ষিত হয়ে উঠছিলাম। ছেলেমেয়ে সকলের মধ্যেই ছিল কি মধুর সম্পর্ক। অথচ এখন কি বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে জাহাঙ্গীরনগরের পরিবেশ! এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই মানিক নামের তথাকথিত এক ছাত্র ধর্ষণে নাকি সেঞ্চুরী করেছে! অবাক হচ্ছো তো শুনে? হ্যাঁ আমিও অবাক হয়েছিলাম এমন খবর পাঠ করে। শুধু কি তাই, গত কয়েক বছরের হিসাব থেকে জানা গেছে, এই পর্যন্ত নাকি ১২/১৩ জন ছাত্র এই ধরনের ক্ষমতার সন্ত্রাসের বলি হয়েছে!
দেবী, আমি চাইনি যাত্রার আগ মুহূর্তে তোমার মনটা খারাপ করে দিতে! তারপরেও আমাকে এই বিশ্রী কাজটা করতে হচ্ছে। আসলে তুমিইতো বিদ্যার দেবী! বিদ্যা বলি, বুদ্ধি বলি, অথবা জ্ঞান বলি, যা-ই বলিনা কেন, সব ক্ষেত্রেইতো তোমার গুণবন্দনা শুনি। সেই জন্যই তোমার দরবারে নালিশ করছি। 
শুধু তো উপরের দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাই শেষ কথা নয়, সারা দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া শুধু ছাত্রদের দোষ দিয়েই কি হবে! শিক্ষক হচ্ছে পরম গুরুজন, সেই শিক্ষক তার ছাত্রীকে বলাৎকার করে, এমন খবর হরহামেশা পত্রিকার পাতায় ছাপা হচ্ছে, আরো কি হয় জানো, ভর্তি বাণিজ্য চলে! 
অবাক হচ্ছো ভর্তি বাণিজ্যশব্দটি শুনে? অবাক হওয়ার আর কিছু নেই, ভর্তি নিয়েও বাণিজ্য হয়, পরীক্ষার হলে সীট ফেলা নিয়ে বাণিজ্য হয়, চাকুরীর ইন্টারভ্যু নিয়ে বাণিজ্য হয়, চাকুরীতে প্রমোশান পাওয়া নিয়ে বাণিজ্য হয়, শিক্ষকরা স্কুলে কলেজে নিয়মিত ক্লাস না নিয়ে টিউশানি করেন, সেই টিউশানীতেও বাণিজ্য আছে! শুধু পড়ালেখাই নয়, গান-বাজনা, অভিনয়, নাট্যকলা, সিনেমা জগতসহ শিল্পের যে কোন শাখাতেই চলছে এই ধরনের অসাধু বাণিজ্য। 
ধরো, কারো টিভিতে অভিনয়ের শখ, তাকে টিভিতে চান্স পেতে গেলে নাকি অভিনয় জানার চাইতেও বেশী জরুরী পরিচালক প্রযোজকদেরকে সন্তুষ্ট করা। আমাকে ডিটেইলসে যেতে বলোনা, কিছুটা আন্দাজ করে নিও আমি কি বুঝাতে চাইছি।
মাগো, তুমি হলে শুভ্রবসনা, তোমার অন্তরটাও শুচি শুভ্র। তোমার একহাতে ধরা বীণা, আরেক হাতে পুস্তক। বিদ্যা-বুদ্ধি, সঙ্গিত, জ্ঞানচর্চা নিয়েই তোমার সময় কাটে। বছরে এই একটা দিন সময় পেয়েছো একটু বেড়াবার। তোমাকে এত কঠিন বাস্তবের কথা না বলাটাই ভালো ছিল। কিনতু অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকে মা! কার জন্য করে যাচ্ছো এই জ্ঞানের সাধনা! তুমিতো জাননা মনে হয়, এখন আর এনালগের যুগ নেই, সবই ডিজিটাল হয়ে গেছে। আগে তোমার পূজাতে তোমার চরণে নিবেদন করতাম খাগের কলম আর জলদুধে ভরা কালির দোয়াত’, অথচ এখন কলম টলম আর চলেনা। তুমি যখন আসনে বসবে, ভালো করে খেয়াল করে দেখো, তোমার চরণতলে এখন আর কেউ আমাদের মত করে এক বস্তা বই, খাতা কলম, হারমোনিয়াম রেখে দেয়না। কেউ কেউ হয়ত দুই চারটা বলপেন’ সাজিয়ে দিবে তোমার চরণতলে।
 তা সবাইতো আর সন্ত্রাসী নয়, কিছু কিছু ছেলেপেলে এখনও আছে, যারা এত প্রতিকূলতার মাঝেও লেখাপড়া শেখার সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তাদেরই কেউ কেউ হয়ত এখনও দুই একটা বই বা বলপেন এনে দেয় তোমার চরনতলে তোমার কৃপা লাভের আশায়। তাদের জন্যই মনটা আমার কাঁদে। আহারে! বেচারারা এত জুলুমের সাথে পেরে উঠছেনা।
মাগো, আমি কেন লিখে যাচ্ছি এতকথা! তোমারতো কিছুই অজানা থাকার কথা নয়! এক সময় শুধু তোমার সাধনা করে, শুধুমাত্র জ্ঞানসাধনা করে, বিদ্যাচর্চ্চা করে একজন বিদ্যাসাগর, একজন রবীন্দ্রনাথ, একজন নজরুল, একজন জগদীশ বসুর জন্ম হয়েছে। বিদ্যাসাগর বা নজরুলের কথাই ধরোনা কেন, তোমার বোন লক্ষ্মীদেবী তো তাঁদের প্রতি কোন কৃপা করেননি, তাঁরা শুধু তোমার কৃপা পেয়েই জীবনে ধন্য হয়ে গেছেন! কবি সুকান্ত বা কবি জীবনানন্দ, তাঁদের প্রতিও লক্ষ্মীদেবী সহায় ছিলেননা, তবে তুমিতো ঠিকই তাঁদের সহায় ছিলে!সকলেই জানে তোমাতে আর তোমার বোন লক্ষ্মীদেবীতে আড়াআড়ি সম্পর্ক। তুমি যদি কাউকে বিদ্যে দাও, লক্ষ্মীদেবী তাকে ধন সম্পদ দেয়না। কাজেই এটা আমাদের চয়েস, যে বিদ্যা চায় সে বিদ্যা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে, যে ধন চায় সে ধনলাভের কাজে সচেষ্ট হয়। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, সরস্বতী এবং লক্ষ্মী দুজনেরর কৃপাধন্য হয়েছে এমন লোকের সংখ্যাও কম নেই। এগুলো সব স্বর্গে বসেই তোমরা ঠিকঠাক করে এসেছো এতকাল। তাই শিক্ষাঙ্গনগুলোতে কখনও মারামারি, কাটাকাটি হয়নি, বিদ্যাচর্চায় কোন ব্যাঘাতের সৃষ্টিও হয়নি এতকাল।
তাহলে কি এমন ঘটে গেলো যে তুমি এভাবে পরাস্ত হয়ে গেলে! কেনো আজ সকলে বিদ্যার পেছনে না ছুটে ধনসম্পদের পেছনে ছুটছে? কেনো তুমি প্রতিযোগিতায় নিজেকে এভাবে সরিয়ে নিচ্ছো! কোন অভিমানে তুমি লক্ষ্মীদেবীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতিয়ে দিচ্ছো?তুমি অভিমান করেছো বলেই লক্ষ্মীদেবীকে পাওয়ার জন্য এখনকার ছেলেমেয়েরা ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। এই ডিজিটাল যুগে সবাই শর্টকাট রাস্তা বের করে ফেলেছে বড়লোক হওয়ার জন্য। বড়লোক হতে গিয়ে অনেকেই অসাধু পথটাকেই বেছে নিচ্ছে। পড়ালেখার যে সর্বোচ্চ পীঠস্থান, সেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই শোনা যায় অস্ত্রের ঝনঝনানি, আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। সেজন্যই আমার খুব ভয় লাগছে দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে।
মাগো, সনৎ সিংহে্র গাওয়া গানটি কি তোমার আর মনে পড়ে!

সরস্বতী বিদ্যাবতি, তোমায় দিলাম খোলা চিঠি

একটু দয়া করো মাগো, বিদ্যা যেনো হয়।
এসব কথা লিখছি তোমায় নালিশ করে নয়

দেবী সরস্বতী, মা আমার, আমিও কোন অভিযোগ করিনি এতক্ষন। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আমাদের, আমাদের দিনও শেষ হয়ে এসেছে। আসলে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে আমাদের উত্তরসুরীদের কি অবস্থায় রেখে যাচ্ছি, কি দিয়ে যাচ্ছি তাদেরকে, এটা হিসেব করতে বসেছিলাম, হিসেব মেলাতে পারছিলামনা। হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেলো আগামী শনিবার তোমার পূজা, তোমার মূর্তির দিকে তাকালেই মনের ভেতর এক পবিত্র স্নিগ্ধতার ছোঁয়া লাগে, মনে আশা জাগে, ভরসা পাই। সেই ভরসা থেকেই তোমার কাছে আকুল আবেদন করছি, আমাদের এই ডিজিটাল যুগের ছেলেমেয়েরা আসলে কোন কিছুর সাথে তাল রাখতে পারছেনা বলেই দিশেহারা হয়ে এমন উলটা পালটা কাজ করে ফেলছে। দোষ নিওনা মা, এরা সবাই অবুঝ ছেলেমেয়ের দল। তোমার চরণতলেই এদের ভাগ্যকে সমর্পন করে দিলাম। তুমি এদেরকে তোমার চরনে ঠাঁই দাও মা। এদের অস্থির চিত্তে দাও তোমার স্পর্শের কোমলতা, সবার অন্তরের বন্ধ দরজা খুলে দাও, যেনো জ্ঞানের আলো ঢুকতে পারে সবার অন্তরে। ভালো থেকো তুমি নিজে, আমাদেরকেও ভালো রেখো।

তোমার সন্তান
রীতা রায় মিঠু

Saturday, January 20, 2018

প্রস্তর যুগের পথে!


ধর্ষণ তাও আবার উন্মুক্ত উঠোনে, স্বামী-সন্তানের সামনে? কখন এমন ঘটনা ঘটে? যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটে, যেমনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটেছিল বাংলাদেশে। পাকিস্তানী মিলিটারী আর বাংলাদেশের রাজাকার, আলবদরেরা প্রতিদিন বাঙ্গালী মেয়েদের 'মুরগী ধরা'র মত ধরে নিয়ে যেত, দিনরাত ধর্ষণ করে শরীরের ক্ষিদে মিটিয়ে মেয়েগুলোকে মেরে ফেলতো। মেরে ফেলার আগে ফ্যানের আংটার সাথে চুল বেঁধে ঝুলিয়ে মেয়েগুলোর স্তন কেটে দিত, ঠোঁট কেটে দিত, সারা শরীর কামড়ে ক্ষত বিক্ষত করে দিত, শেষে বেয়নেট বা বন্দুকের নল মেয়েদের নিম্নাঙ্গে ঢুকিয়ে দিয়ে উল্লাস করতো।
সেতো ১৯৭১ সালের কথা, এখন ২০১৬ সাল। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৫ বছর আগে। আমরা এখন বিশ্বে মধ্যম আয়ের দেশ! বিশ্বে 'বাংলাদেশ'-এর নাম এখন অনেকেই জানে। বাংলাদেশ এখন 'মডারেট' মুসলিম দেশ। 'মডারেট' দিয়ে কি বুঝানো হয় তা আমার জানা নেই। বাংলাদেশের সরকার, বিরোধীদল, বুদ্ধিজীবীদের সকলেই বলেন, বাংলাদেশ একটি 'অসাম্প্রদায়িক' দেশ। অত্যন্ত আনন্দের কথা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানতো এমনই একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের, স্বপ্নের বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। স্বপ্ন বাস্তবায়নের শুরুতেই তাঁকে পরিবার পরিজনসহ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তবুও ভাগ্য ভালো বাংলাদেশের, বঙ্গবন্ধুর দুটি কন্যা প্রাণে বেঁচে গেছিলেন। নাহলে আজ বাংলাদেশের নাম বদলে বাংলাস্তান হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিলনা। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশটাকে 'বাংলাস্তান' হয়ে যেতে দেননি। তাই দেশের বুদ্ধিজীবী, মন্ত্রী, বিরোধী নেতাগণ মিথ্যে করে হলেও বাংলাদেশ নামের সাথে 'মডারেট, অসাম্প্রদায়িক, উদার' বিশেষণ যোগ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারছেন।
২০০১ সালের কথা, রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছিল বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি। শেখ হাসিনার আওয়ামীলীগের নৌকায় ভোট দেয়ার অপরাধে হিন্দু বাড়িগুলো আক্রান্ত হয়। পূর্ণিমা রাণী শীল, ১৪ বছরের কিশোরী, বিএনপির ক্যাডাররা দলবেঁধে পূর্ণিমাকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণ করার মজাই আলাদা, মিনি মাগনা মেয়ে শরীর পেয়ে যাওয়া, সেই শরীর কিশোরীর নাকি যুবতীর, নাকি তিন বছরের শিশুর তা দেখার দরকার কি। নারী অঙ্গ হাতের মুঠোয় পাওয়া গেলেই হলো, আর সেই নারী অঙ্গ যদি নৌকায় ভোট দেয়া কোন হিন্দু

বাপের মাইয়ার হয়, তাহলেতো কথাই নেই। সে গণিমতের মাল, সবাই চেটেপুটে খাওয়ার জিনিস। পূর্ণিমাকেও ওরা চেটেপুটে খেয়েছিল, লুকিয়ে চুরিয়ে খায়নি। পূর্ণিমার বাবাকে স্বাক্ষী রেখে, পূর্ণিমার মাকে স্বাক্ষী রেখেই খেয়েছিল। ওরা এতজন এসেছিল পূর্ণিমাকে খেতে যে পূর্ণিমার মা ভয় পেয়ে বলেছিল, " বাবারা, একজন একজন কইরা যান, আমার মাইয়াডা ছোট"।
২০১৬ সালের জানুয়ারীর ঘটনা, বানিয়াচং-এর ঘটনা। এক হিন্দু রমনীর দেহের দিকে নজর যায় একজনের, এবার আর নৌকা বনাম বিএনপি নয়। এখন দেশে বিএনপি নেই, সবাই আওয়ামীলীগ হয়ে গেছে। তেমনই এক আওয়ামীলীগ নেতার ইচ্ছে হয়েছে হিন্দু বউটাকে চেখে দেখার। বউটাতো লাল টকটকে আপেল, লোভ সামলানো দায়। লাল আপেল কচকচ করে খাওয়ার মজাই আলাদা, আওয়ামী নেতা কচ কচ করে আপেল খেলেন, তাই দেখে আপেলের মালিক মানে বউটার স্বামী পুলিশে বিচার দেবে বলায় আওয়ামী নেতা বউটাকে আরেকবার খেলো, এবার খেলো বউটার স্বামী আর সন্তানের চোখের সামনে।
২০১৬ সালের জানুয়ারী। আরেকটি লোমহর্ষক ঘটনা, ঘটনার সূত্রপাত মামীর প্রতি ভাগ্নের যৌনক্ষুধার ছোবল! এ ঘটনা কিন্তু কোন হিন্দু পরিবারের ঘটনা নয়, এটি একটি মুসলিম পরিবারে ঘটে যাওয়া হৃদয় বিদারক ঘটনা। নারায়ণগঞ্জে একই পরিবারে পাঁচজন খুন হলো। কি কারণ? ২০ বছর বয়সী মামী লামিয়াকে তার ভাগ্নের খেতে ইচ্ছে হয়েছে। মামীতো নয়, যেন চৌধুরী বাড়ির লাল টুকটুকে মুরগী। ভাগ্নের মুরগী খেতে ইচ্ছে হয়েছে, মুরগীকে খাবে বলে কত রকমের ফন্দী, বাড়ির মালিক টের পেয়েছে জেনে ভাগ্নে তার মামী মুরগী, মুরগীর বাচ্চাসহ পাঁচজনকে কেটেকুটে খেয়ে ফেলেছে। কোন জমানায় বাস করছি আমরা?
এই হচ্ছে আমার প্রাণপ্রিয় দেশ, এই দেশটার জন্য আমরা দূরে বসে কাঁদি। বৃষ্টি বাদলা, তুষারপাত উপেক্ষা করে কাজে যাই, হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করি, দেশে টাকা পাঠাই, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ে। রাতের নিরলে ফেসবুকে বসে দেশের ছোঁয়া পাই, দেশের গন্ধ নাক মুখ ভরে নেই, পরম তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে যাই। ঘু্মের মধ্যে স্বপ্ন দেখি সবুজ ধানের ক্ষেত, নয়তো হলুদ সরষের ক্ষেত। সুন্দর মন নিয়ে ঘুম থেকে জাগি।
এমনইতো হওয়ার কথা, কিন্তু সব সময় এমন হচ্ছেনা আজকাল। মাঝে মাঝেই স্বপ্নে দেখি ভূত, আমার চারদিকে ভূত। ঘুম ভাঙ্গতেই শুনি সত্যি সত্যি ভূত এসেছিল, বাংলাদেশের কিছু কিছু বাড়িতে। ভূতগুলো বাড়ির সকলের ঘার মটকে দিয়েছে, কাউকে প্রাণে, কাউকে মানে মেরেছে। এই আমার প্রাণপ্রিয় দেশ।
আদিম যুগে মানুষ ঘরবাড়ি বানানোর বুদ্ধি বের করতে পারেনি তাই গুহায় বাস করতো, আগুন জ্বালাতে জানতোনা তাই কাঁচা মাংস খেতো, পোশাকের ব্যবহার জানতোনা, পোশাকের প্রয়োজনীয়তা বুঝতোনা, তাই উলঙ্গ হয়ে ঘুরতো, সকলেই উলঙ্গ থাকতো বলে লোকলজ্জার ব্যাপার ছিলনা।। রিপুর তাড়না সকল প্রাণীর মধ্যেই ছিল, উলঙ্গ মানুষের মধ্যেও ছিল। জৈবিক কামনা নিবৃত্ত করতে তাদের আড়ালের প্রয়োজন হতোনা। বাপ-কন্যা, ভাই-বোন, মা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার ছিলনা। উলঙ্গ নারী দেহ দেখে উলঙ্গ পুরুষের কাম রিপু জেগে উঠতো, যাকে সামনে পেতো তার সাথেই কাম ক্রিয়ায় মেতে উঠতো।
ধীরে ধীরে মানুষের বোধ বুদ্ধি জাগ্রত হয়েছে, বুঝতে শিখেছে দেহের উপরিভাগ (মুশশ্রী) সুন্দর হলেও নীচের অংশ ( যৌনাঙ্গ) সুন্দর নয়, এটাও বুঝতে শিখলো যে অসুন্দরকে সকলের চোখের আড়ালে রাখার কথা। শুরু হলো গাছের ছাল বাকল দিয়ে নিম্নাঙ্গ আবৃত করার প্রয়াস। শিখে গেলো পোশাক পরার প্রয়োজনিয়তা। আগুন জ্বালতে শিখলো, শুরু হলো মাংস পুড়িয়ে খাওয়ার প্রয়াস, শিখে গেলো রান্না।
সে মানুষ সভ্য হয়েছে, জামাকাপড় পরতে শিখেছে, গাছের আড়ালে গিয়ে 'হাগু মুতু' করতে শিখেছে, সকলের সামনে নর-নারীর কামক্রিয়া বন্ধ হয়েছে। বাবা-কন্যা, ভাই-বোন,-মা-ছেলের সম্পর্ক বুঝতে শিখেছে, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধবসহ আলাদা আলাদা সম্পর্ক দিয়ে মানুষ সমাজ গড়েছে।
ধীরে ধীরে মানুষ সুন্দর হয়েছে,সৃষ্টি হয়েছে ধর্মীয় বোধ, শিক্ষিত হয়েছে, আধুনিক হয়েছে, ধার্মিক হয়েছে, বৈজ্ঞানিক হয়েছে। 'হাগু মুতু করার জন্য আলাদা ঘর বানিয়েছে, ঘুমানোর জন্য ঘর বানিয়েছে, নর নারীতে শুধুই কামড়া কামড়ি নয়, প্রেমের আকুতি, প্রেমের অনুভূতি, ভালোবাসার সম্পর্ক থাকার প্রয়োজনিয়তা বুঝেছে। মানুষ আরও বুঝেছে, শুধু শরীরের ক্ষিদেই নয়, নর নারীর দৈহিক মিলনের ক্ষেত্রে মনের চাহিদা, দুজনের পারস্পরিক অনুমতি গ্রহণের ব্যাপার আছে।
শরীরের ক্ষিদে মেটায় পশু-পাখী, পশু-পাখির মনে ক্ষিদে থাকেনা অথবা মনের ক্ষিদে তারা অনুভব করেনা, ঐজন্যই তারা মানুষ নয়। মানুষও যখন পশু-পাখির পর্যায়ে ছিল তখন মানুষের মনের ক্ষিদে ছিলনা, শারীরিক মিলনের মাধ্যমে শরীরের ক্ষিদে মেটাতো।
এগুলো প্রস্তর যুগের কথা, এখন ডিজিটাল যুগ। এখনকার মানুষ হবে অনেক বেশী যুক্তিবাদী, অনেক বেশী বুদ্ধিমান, অনেক বেশী মানবিক। এখন মানুষ মানুষকে চিনবে বুদ্ধির বিচারে, জ্ঞানের বিচারে। ধর্মের প্রচার শুরু হয়েছিল মানুষের মধ্যে বিবেক, ভালোবাসা, প্রেম, মানবতা, পরমত সহিষ্ণুতা জাগ্রত করার জন্য। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহামানবের আবির্ভাব হয়েছিল এই পৃথিবীতে, প্রত্যেক মহামানব মানুষের কল্যাণেই ধর্মের বাণী প্রচার করেছিলেন, সৃষ্টি হয়েছিল হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, ইহুদি, শিখ, জৈন --বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়। সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় পুস্তকে মহামানবের বাণীর মূল সুরে বিবেক,ভালোবাসা , প্রেম, মানবতা, পরমত সহিষ্ণুতার কথা বলা হয়েছে।
এতদিনে আমাদের সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু কেন জানি আমরা মানুষ নাহয়ে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান হওয়ার পর থেমে গেছি। আমাদের আর সামনে এগোনো হচ্ছেনা। সামনে এগোনোর পথ আছে, কিন্তু আমাদের কোমড়ে জোর নেই, পায়ে জোর নেই, তার চেয়েও বড় কথা মাথায় ঘিলু নেই। মাথার ঘিলু পচে গোবর হয়ে গেছে, গোবরে পোকা ধরেছে। ইদানিং ঘিলু নামক গোবরের পোকাগুলো আমাদের কামড়াচ্ছে, অহর্নিশ কামড়াচ্ছে। আমরা বিবেক, লজ্জা, আত্মমর্যাদা, মানবতা, অনুশোচনা, গ্লানিবোধের ব্যাপারগুলো ভুলে যাচ্ছি।
এখন আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখিনা, মানুষকে দেখি পুরুষ আর মহিলা হিসেবে। মহিলাকে একজন নারী হিসেবে দেখিনা, দেখি একতাল মাংসের শরীর হিসেবে। অনেক পুরুষ আছে যারা নিজেকে পুরুষ হিসেবে দেখেনা, নিজেকে দেখে যৌনক্ষুধা আক্রান্ত রোগী হিসেবে। যৌনক্ষুধা আক্রান্ত পুরুষগুলোর এখন আর ভাতের ক্ষিদে পায়না, ওদের সারাক্ষণ ঊর্ধ্বাঙ্গ-নিম্নাঙ্গ জুড়ে চলে যৌনক্ষুধার দাবদাহ।
যৌনক্ষুধা আক্রান্ত পুরুষটি তাই মায়ের শরীরে নিজের ক্ষুধা মেটানোর পথ খুঁজে পায়, মামীর দেহে, বোনের দেহে, অবুঝ শিশুর কচি দেহে, রাস্তার উলঙ্গ পাগলীর দেহেও ক্ষুধা মেটানোর পথ খুঁজে পায়। এইসব ক্ষুধার্ত কামার্ত পুরুষগুলো প্রতিবেশী নারীর দেহে ক্ষুধা মেটানোর রসদ খুঁজে পায়। কামার্ত পুরুষ হিন্দু মুসলমান বিচার করেনা, দেশে ক'টাইবা হিন্দু আছে? অথচ শহরে গ্রামে প্রতিদিন কত নারী ধর্ষিত হচ্ছে, ধর্ষিত নারী খুন হচ্ছে। এদের শরীরে ধর্ম লেখা নেই, এরা শুধুই কমজোরী নারী। নারী যদি অন্য কোন পুরুষের বউ হয়, তখন যৌনক্ষুধাক্রান্ত পুরুষটির ক্ষুধা বেড়ে যায়।
এমনই পাগলা যে ভুলেই গেছে, অন্যের স্ত্রীকে উলঙ্গ করে ধর্ষণ করার সময় নিজেকেও উলঙ্গ হতে হয়েছে। তার কুৎসিত, কদাকার পুরুষ যন্ত্রটি যা প্রস্তর যুগের মানুষ গাছের ছাল বাকল দিয়ে আবৃত করে রাখতো, সেই কুৎসিত দর্শন যন্ত্রটি ধর্ষণের উসিলায় উন্মুক্ত হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে মানুষের পোশাক পরিচ্ছদে ধর্মীয় ভাব অনেকটাই বেড়েছে, এর সাথে যদি ধর্মীয় মূল্যবোধ ধর্মীয় চেতনাটুকু বৃদ্ধি পেতো, তাহলে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য মঙ্গলজনক হতো। ধর্মীয় মূল্যবোধ মানেই বিবেক,ভালোবাসা , প্রেম, মানবতা, পরমত সহিষ্ণুতা। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এই বোধগুলো ক্রমেই কমে আসছে, এখন হাজার মানুষের উপস্থিতিতে একজন নিরস্ত্র মানুষ খুন হয়ে যায়, কেউ বাঁচাতে আসেনা। নিরপরাধ বিশ্বজিত প্রাণভয়ে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে, হাতে চাপাতি নিয়ে তথাকথিত রাজনৈতিক নেতারা বিশ্বজিতের পিছু ধাওয়া করে, এই দৃশ্য ভিডিও করার মানুষ ছিল প্রচুর, বিশ্বজিতকে কিভাবে কোপানো হলো, তাও ভিডিও করা হয়েছে, কিন্তু হাতের ভিডিও ক্যামেরাটি দিয়ে কেউ একজন চাপাতিওয়ালার হাতে আঘাত করে বলেনি, " ওকে ছেড়ে দাও, মেরে ফেলোনা"।
বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থাতেও গতি আসছেনা, রাজনৈতিক মূল্যবোধ ব্যাপারটি বই পুস্তকে বন্দী হয়ে গেছে। অপরাধী ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আসছে।
বাংলাদেশের নারীরা দেশের কল্যাণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে, দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সংসদ নেত্রী, বিরোধী নেত্রীসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নারীগণ অধিষ্ঠিত থাকার পরেও বাংলাদেশে নারী নির্যাতন, নারী/শিশু ধর্ষণ বন্ধ হচ্ছেনা। বাংলাদেশে ধর্ষকের বিচার হয়না। ধর্ষকরা শাস্তি পাচ্ছেনা, ফলে ধর্ষণ একটি 'উপভোগ্য খেলা'য় পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রায় সকলেই কথায় কথায় পাশ্চাত্যের দেশগুলোর বিশেষ করে আমেরিকার নারীদের পোশাক নিয়ে সমালোচনা করে, পাশাচাত্যের নারী পুরুষ অবাধ মেলামেশার সমালোচনা করে। বাংলাদেশের কয়জন মানুষ জানে যে আমেরিকান পুরুষগণ আমেরিকান নারীদের পোশাক নিয়ে মাথা ঘামায়না, প্রকাশ্যে কোন টিটকারি দেয়না, অশোভন বা অশ্লীল মন্তব্য করেনা। বাস, ট্রেনের ভীড়ে অপরিচিত কোন মেয়ের বুকে বা পাছায় হাত দেয়না।
আমেরিকান ছেলেমেয়েদের স্কুল শিক্ষার এক পর্যায়ে 'সেক্স এডুকেশান' দেয়া হয়। সবাই জানে, মেয়েদের প্রতিটি অঙ্গ দেহের একটি অংশ বিশেষ, নারীর দেহের বিশেষ অঙ্গ নিয়ে আমেরিকান পুরুষ বিশেষভাবে মাথা ঘামায়না। এদেশে কোন কিছু নিয়েই রাখঢাক নেই বলেই যৌন সুড়সুড়ি দেয়া কোন ছ্যাঁচড়ামি নেই। পোশাকের ব্যাপারেও সমালোচনা করার কিছু দেখিনা। যস্মিন দেশে যদাচার, আরব দেশে মেয়েরা ওদের রুচী অনুযায়ী পোশাক পরে, আমেরিকান মেয়েরা তাদের রুচী অনুযায়ী পোশাক পরে। তাই বলে কি আমেরিকায় মেয়েরা ধর্ষিত হয়না? আরব দেশের মেয়েরা ধর্ষিত হয় না?, আমেরিকায় মেয়েরা ধর্ষিত হয়, তবে ধর্ষকের বিচার হয়, শাস্তি হয়।
বাংলাদেশেও পুরোমাত্রায় নাহলেও স্কুলের শেষ পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীকে পরিমিত পর্যায়ে সেক্স এডুকেশান দেয়ার ব্যবস্থা করা ভাল যাতে প্রতিটি ছেলেমেয়ে নিজেদের ভাল-মন্দটুকু বুঝতে পারে। আর অতীব প্রয়োজন ধর্ষক, নারী নির্যাতনকারীর কঠোর শাস্তি। নাহলে আমরা পায়ে পায়ে, ধীরে ধীরে প্রস্তর যুগের দিকেই ফিরে যাবো।  (January 22, 2016)