Sunday, January 21, 2018

সরস্বতী বিদ্যাবতী, তোমায় দিলাম খোলা চিঠি (৬ বছর পূর্বে লেখা)






 27/01/2012 - 3:12pm
দেবী সরস্বতী শ্রীচরণকমলেষু,

দেবী, আশা করি এই মুহূর্তে তুমি খুবই আনন্দে আছো, কেননা তিথি নক্ষত্রের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশ সময় শনিবার ভোর সকালেই তোমাকে নিয়ে তোমার হংসবাহন বাংলার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে ও দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে পৌঁছে যাওয়ার কথা। হাতে আছে মাত্র আর একদিন সময়। রাজ্যের গোছগাছ নিশ্চয়ই পড়ে আছে। আসতে গেলেতো তোমাকে অন্ততঃ সাত দিনের সময় হাতে নিয়ে আসতে হবে। শুধু দেশেই তো নয়, প্রবাসেও তো তোমার বাঙ্গালী ছাত্র ছাত্রী একেবারে কম নেই! তাদের দুয়ারেও তো তোমার পদধূলি দিতে হবে। 
জানি চিঠিখানি পেয়ে তুমি যুগপৎ অবাক ও বিরক্ত হবে। কিনতু আমি নিরুপায় মা। তুমি এই ধরাতে আসই বছরে একটিবার, তাছাড়া একবার এসে পৌঁছালে তোমার ভক্তদের যন্ত্রণায় তোমার কাছে পৌঁছানোই যাবেনা। অথচ তোমার সাথে কথা বলাটা আমার অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে যে! সেই জন্যই তোমাকে সরাসরি চিঠি লেখাটাই যুক্তিযুক্ত মনে হলো।
মাগো, ইনানি বিনানি বাদ দিয়ে আসল কথা শুরু করি। আচ্ছা, স্বর্গে বসে কি বাংলাদেশের সংবাদপত্র পড়তে পারা যায় অথবা অনলাইনের ব্যাপার স্যাপারগুলো কি স্বর্গেও আছে? কি জানি, জানার কোন উপায় নেই, আসলে পৃথিবীতে এত কিছু আবিষ্কার হয়েছে কিনতু স্বর্গ-নরকের ব্যাপারটাই এখনও আবিষ্কৃত হয় নাই। তবে ধারণা করি দেশের কোন খবরই তোমার কানে পৌঁছায়না। পৌঁছালে জানতে পারতে আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে এখন কি চলছে! আমি নিজেওতো ভাল জানিনা, দেশে আগের মত প্রতিটি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজা হয় কিনা! পূজা-পার্বন এখন শিকেয় উঠেছে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে এখন ক্ষমতা প্রদর্শনের লড়াই।
কথা নাই বার্তা নাই, হয় কথায় নয় কথায় দেখি ছাত্রদের হাতে রাম-দা, চাপাতি, কিরীচ জাতীয় সব আদিম যুগের অস্ত্র। সত্যি বলছি মা, যদি বিশ্বাস না হয়, দেশে যখন আসবে কারো কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে তিন চার দিন আগের যে কোন পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালেই দেখবে, একটি ছবিতে ছেলেরা হাতে ছুরি, চাপাতি, কাস্তে নিয়ে কাউকে ধাওয়া করছে। আর একটু কষ্ট করে যদি ছবির নীচের খবরটা পড়ে ফেলতে পারো, দেখবে তোমারও চোখ কপালে উঠে যাবে। ছোট্ট ঘটনা,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে এক জেলা ছাত্র কল্যাণ সমিতির চাঁদা উঠানোকে কেন্দ্র করে ঝগড়া লেগে যায়। একবার ভেবে দেখো, চাঁদা তোলার কথা ছাত্র কল্যাণ তহবিলের জন্য, অথচ মারামারি কাটাকাটি করেই সব কল্যাণের ভরাডুবি করে ফেলেছে। শুধু কি ছাত্রলীগ, যখন যে দল দেশের ক্ষমতায় থাকে, তার অঙ্গসংগঠন হিসেবে তাদের ছাত্রসংগঠনগুলো ভীষণরকম বেপোরোয়া হয়ে উঠে।
লজ্জার কথা হচ্ছে, দুই সপ্তাহ আগেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘটে গেছে আরেক নারকীয় ঘটনা। ইংরেজী বিভাগের এক ছাত্রকে তারই এককালের বন্ধুরা আগের শত্রুতার জের ধরে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। মাগো, এবার কি আমাকে একটু একটু চেনা চেনা মনে হচ্ছে! তোমার কি মনে পড়ছে, অনেক আগে আমরা কি জাঁকজমক করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমার পূজা উদযাপন করতাম! আমাদের হাতে ছিল তখন কলম। পিস্তল বন্দুক বা চাপাতি, কিরীচ বা ছুরি আমরা চোখেও দেখিনি। 
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা বলছি। কি চমৎকার নৈসর্গিক পরিবেশে ছিলাম আমরা! অমন পরিবেশে থেকে আমরা কি সুন্দরভাবেই না শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, চলনে, বলনে, আচারে আচরণে শিক্ষিত হয়ে উঠছিলাম। ছেলেমেয়ে সকলের মধ্যেই ছিল কি মধুর সম্পর্ক। অথচ এখন কি বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে জাহাঙ্গীরনগরের পরিবেশ! এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই মানিক নামের তথাকথিত এক ছাত্র ধর্ষণে নাকি সেঞ্চুরী করেছে! অবাক হচ্ছো তো শুনে? হ্যাঁ আমিও অবাক হয়েছিলাম এমন খবর পাঠ করে। শুধু কি তাই, গত কয়েক বছরের হিসাব থেকে জানা গেছে, এই পর্যন্ত নাকি ১২/১৩ জন ছাত্র এই ধরনের ক্ষমতার সন্ত্রাসের বলি হয়েছে!
দেবী, আমি চাইনি যাত্রার আগ মুহূর্তে তোমার মনটা খারাপ করে দিতে! তারপরেও আমাকে এই বিশ্রী কাজটা করতে হচ্ছে। আসলে তুমিইতো বিদ্যার দেবী! বিদ্যা বলি, বুদ্ধি বলি, অথবা জ্ঞান বলি, যা-ই বলিনা কেন, সব ক্ষেত্রেইতো তোমার গুণবন্দনা শুনি। সেই জন্যই তোমার দরবারে নালিশ করছি। 
শুধু তো উপরের দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাই শেষ কথা নয়, সারা দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া শুধু ছাত্রদের দোষ দিয়েই কি হবে! শিক্ষক হচ্ছে পরম গুরুজন, সেই শিক্ষক তার ছাত্রীকে বলাৎকার করে, এমন খবর হরহামেশা পত্রিকার পাতায় ছাপা হচ্ছে, আরো কি হয় জানো, ভর্তি বাণিজ্য চলে! 
অবাক হচ্ছো ভর্তি বাণিজ্যশব্দটি শুনে? অবাক হওয়ার আর কিছু নেই, ভর্তি নিয়েও বাণিজ্য হয়, পরীক্ষার হলে সীট ফেলা নিয়ে বাণিজ্য হয়, চাকুরীর ইন্টারভ্যু নিয়ে বাণিজ্য হয়, চাকুরীতে প্রমোশান পাওয়া নিয়ে বাণিজ্য হয়, শিক্ষকরা স্কুলে কলেজে নিয়মিত ক্লাস না নিয়ে টিউশানি করেন, সেই টিউশানীতেও বাণিজ্য আছে! শুধু পড়ালেখাই নয়, গান-বাজনা, অভিনয়, নাট্যকলা, সিনেমা জগতসহ শিল্পের যে কোন শাখাতেই চলছে এই ধরনের অসাধু বাণিজ্য। 
ধরো, কারো টিভিতে অভিনয়ের শখ, তাকে টিভিতে চান্স পেতে গেলে নাকি অভিনয় জানার চাইতেও বেশী জরুরী পরিচালক প্রযোজকদেরকে সন্তুষ্ট করা। আমাকে ডিটেইলসে যেতে বলোনা, কিছুটা আন্দাজ করে নিও আমি কি বুঝাতে চাইছি।
মাগো, তুমি হলে শুভ্রবসনা, তোমার অন্তরটাও শুচি শুভ্র। তোমার একহাতে ধরা বীণা, আরেক হাতে পুস্তক। বিদ্যা-বুদ্ধি, সঙ্গিত, জ্ঞানচর্চা নিয়েই তোমার সময় কাটে। বছরে এই একটা দিন সময় পেয়েছো একটু বেড়াবার। তোমাকে এত কঠিন বাস্তবের কথা না বলাটাই ভালো ছিল। কিনতু অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকে মা! কার জন্য করে যাচ্ছো এই জ্ঞানের সাধনা! তুমিতো জাননা মনে হয়, এখন আর এনালগের যুগ নেই, সবই ডিজিটাল হয়ে গেছে। আগে তোমার পূজাতে তোমার চরণে নিবেদন করতাম খাগের কলম আর জলদুধে ভরা কালির দোয়াত’, অথচ এখন কলম টলম আর চলেনা। তুমি যখন আসনে বসবে, ভালো করে খেয়াল করে দেখো, তোমার চরণতলে এখন আর কেউ আমাদের মত করে এক বস্তা বই, খাতা কলম, হারমোনিয়াম রেখে দেয়না। কেউ কেউ হয়ত দুই চারটা বলপেন’ সাজিয়ে দিবে তোমার চরণতলে।
 তা সবাইতো আর সন্ত্রাসী নয়, কিছু কিছু ছেলেপেলে এখনও আছে, যারা এত প্রতিকূলতার মাঝেও লেখাপড়া শেখার সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তাদেরই কেউ কেউ হয়ত এখনও দুই একটা বই বা বলপেন এনে দেয় তোমার চরনতলে তোমার কৃপা লাভের আশায়। তাদের জন্যই মনটা আমার কাঁদে। আহারে! বেচারারা এত জুলুমের সাথে পেরে উঠছেনা।
মাগো, আমি কেন লিখে যাচ্ছি এতকথা! তোমারতো কিছুই অজানা থাকার কথা নয়! এক সময় শুধু তোমার সাধনা করে, শুধুমাত্র জ্ঞানসাধনা করে, বিদ্যাচর্চ্চা করে একজন বিদ্যাসাগর, একজন রবীন্দ্রনাথ, একজন নজরুল, একজন জগদীশ বসুর জন্ম হয়েছে। বিদ্যাসাগর বা নজরুলের কথাই ধরোনা কেন, তোমার বোন লক্ষ্মীদেবী তো তাঁদের প্রতি কোন কৃপা করেননি, তাঁরা শুধু তোমার কৃপা পেয়েই জীবনে ধন্য হয়ে গেছেন! কবি সুকান্ত বা কবি জীবনানন্দ, তাঁদের প্রতিও লক্ষ্মীদেবী সহায় ছিলেননা, তবে তুমিতো ঠিকই তাঁদের সহায় ছিলে!সকলেই জানে তোমাতে আর তোমার বোন লক্ষ্মীদেবীতে আড়াআড়ি সম্পর্ক। তুমি যদি কাউকে বিদ্যে দাও, লক্ষ্মীদেবী তাকে ধন সম্পদ দেয়না। কাজেই এটা আমাদের চয়েস, যে বিদ্যা চায় সে বিদ্যা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে, যে ধন চায় সে ধনলাভের কাজে সচেষ্ট হয়। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, সরস্বতী এবং লক্ষ্মী দুজনেরর কৃপাধন্য হয়েছে এমন লোকের সংখ্যাও কম নেই। এগুলো সব স্বর্গে বসেই তোমরা ঠিকঠাক করে এসেছো এতকাল। তাই শিক্ষাঙ্গনগুলোতে কখনও মারামারি, কাটাকাটি হয়নি, বিদ্যাচর্চায় কোন ব্যাঘাতের সৃষ্টিও হয়নি এতকাল।
তাহলে কি এমন ঘটে গেলো যে তুমি এভাবে পরাস্ত হয়ে গেলে! কেনো আজ সকলে বিদ্যার পেছনে না ছুটে ধনসম্পদের পেছনে ছুটছে? কেনো তুমি প্রতিযোগিতায় নিজেকে এভাবে সরিয়ে নিচ্ছো! কোন অভিমানে তুমি লক্ষ্মীদেবীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতিয়ে দিচ্ছো?তুমি অভিমান করেছো বলেই লক্ষ্মীদেবীকে পাওয়ার জন্য এখনকার ছেলেমেয়েরা ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। এই ডিজিটাল যুগে সবাই শর্টকাট রাস্তা বের করে ফেলেছে বড়লোক হওয়ার জন্য। বড়লোক হতে গিয়ে অনেকেই অসাধু পথটাকেই বেছে নিচ্ছে। পড়ালেখার যে সর্বোচ্চ পীঠস্থান, সেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই শোনা যায় অস্ত্রের ঝনঝনানি, আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। সেজন্যই আমার খুব ভয় লাগছে দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে।
মাগো, সনৎ সিংহে্র গাওয়া গানটি কি তোমার আর মনে পড়ে!

সরস্বতী বিদ্যাবতি, তোমায় দিলাম খোলা চিঠি

একটু দয়া করো মাগো, বিদ্যা যেনো হয়।
এসব কথা লিখছি তোমায় নালিশ করে নয়

দেবী সরস্বতী, মা আমার, আমিও কোন অভিযোগ করিনি এতক্ষন। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আমাদের, আমাদের দিনও শেষ হয়ে এসেছে। আসলে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে আমাদের উত্তরসুরীদের কি অবস্থায় রেখে যাচ্ছি, কি দিয়ে যাচ্ছি তাদেরকে, এটা হিসেব করতে বসেছিলাম, হিসেব মেলাতে পারছিলামনা। হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেলো আগামী শনিবার তোমার পূজা, তোমার মূর্তির দিকে তাকালেই মনের ভেতর এক পবিত্র স্নিগ্ধতার ছোঁয়া লাগে, মনে আশা জাগে, ভরসা পাই। সেই ভরসা থেকেই তোমার কাছে আকুল আবেদন করছি, আমাদের এই ডিজিটাল যুগের ছেলেমেয়েরা আসলে কোন কিছুর সাথে তাল রাখতে পারছেনা বলেই দিশেহারা হয়ে এমন উলটা পালটা কাজ করে ফেলছে। দোষ নিওনা মা, এরা সবাই অবুঝ ছেলেমেয়ের দল। তোমার চরণতলেই এদের ভাগ্যকে সমর্পন করে দিলাম। তুমি এদেরকে তোমার চরনে ঠাঁই দাও মা। এদের অস্থির চিত্তে দাও তোমার স্পর্শের কোমলতা, সবার অন্তরের বন্ধ দরজা খুলে দাও, যেনো জ্ঞানের আলো ঢুকতে পারে সবার অন্তরে। ভালো থেকো তুমি নিজে, আমাদেরকেও ভালো রেখো।

তোমার সন্তান
রীতা রায় মিঠু

1 comment:

  1. হাজার বছর আগে
    মায়া'রা বলেছিলো সাল ২০১২'য়
    পৃথিবীটা ভেঙেচুড়ে আমূল বদলে যাবে,
    তা'ই হয়েছে আর আমিও পৃথিবীর
    সেই বদলে যাওয়ার এক
    স্বাক্ষী........








    ReplyDelete