Monday, April 30, 2012

হেনরীর হাতুরীর বীণ!

স্কুলজীবনে নানা উপলক্ষে মাঝে মাঝেই স্কুল ছুটি থাকতো। তার মধ্যে একটি উপলক্ষ ছিল ‘মে দিবস’। ‘মে দিবসের’ ছুটি নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তেমন কোন উৎসাহ ছিলনা সঙ্গত কারণে। কারণ ‘মে দিবসে’ ছাত্রছাত্রীদের কোন কিছুই করার ছিলনা বাড়ী বসে ছুটি কাটানো ছাড়া। সকলেই জানতাম ‘মে দিবস’ মানে শ্রমিক দিবস যেদিন আসলে কলকারখানা, গাড়ী ঘোড়া বন্ধ থাকে বেলা বারোটা পর্যন্ত। আমরা বড় হয়েছি নারায়নগঞ্জ শহরে। নারায়নগঞ্জ হচ্ছে শ্রমিকদের জন্য খ্যাত। নারায়নগঞ্জ আদমজী জুট মিল, বাওয়ানী মিল, লক্ষী নারায়ন মিল, গেঞ্জীর হোসিয়ারী মিলে নারায়নগঞ্জ ছিল সত্যিকারের শ্রমিক সমৃদ্ধ শহর। ফলে মে দিবস সম্পর্কে অল্প বিস্তর আমাদের জানা ছিল।

এরপরে বড় হতে হতে গনসঙ্গীতশিল্পী শ্রদ্ধেয় ফকির আলমগীরের গান, ‘ হেনরীর হাতুরীর বীণ’ শুনেতো আমি মুগ্ধ হয়েছি। সেই গানের মধ্যে দিয়েই শ্রমিকদের প্রতি আলাদা এক অনুভূতি জন্ম নেয়। ওদের ন্যায্য দাবীর প্রতি একটু একটু করে দূর্বল হতে শুরু করি। বেশ ছোটকালে দেখতাম, আমাদের ঘরে মাঝে মাঝে অতিরিক্ত যে মানুষটি থাকতেন ‘অমুকের মা’ বা তমুকের মা’ নামে, তাদের প্রতি আমার মায়ের স্নেহ ঝরে পরতো। আমার বয়সী ছোট কাজের মেয়েকে আমার মত করেই রাখা হতো। একদামের জামা কাপড় আমাদের দুজনকেই দেয়া হতো। এমনটা যেমন দেখেছি আবার আমার নিজের চোখেই দেখেছি আশে পাশের বাড়ীর কাজের মানুষগুলো খুবই ছোটখাটো ভুল করেও পার পায়নি। খুব পরিচিত একজনকে দেখতাম কাজের মেয়ে ভুল করলে আর রক্ষা নেই! হাতের লাঠি দিয়ে ধড়াম ধড়াম করে পিটানো হতো। অনেক বছর পার হয়ে গেছে, মনে হয়না গৃহকর্মীদের প্রতি মানুষের আচরণে তেমন কোন পরিবর্তন এসেছে।

একসময় পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই ‘জোর যার মুল্লুক তার’ অবস্থা ছিল। একসময় ক্রীত দাস প্রথাও ছিল। অসহায় মানুষগুলোকে দিয়ে বিনা বেতনে দিবারাত্রি কাজ করানো হতো। এভাবে পশুর মত খাটতে খাটতে সেই বোবা মানুষগুলোও নড়তে চড়তে শুরু করেছিল। প্রথমে কারো না কারো মনে হয়েছিল নিশ্চয়ই সারা দিনের বদলে ‘দিনে আট ঘন্টা কাজ’ করার কথা। সেই থেকেই প্রস্তাবটি নিয়ে অনেক বেশী সাড়া পাওয়া যায় সবার মাঝে। মে দিবস দাবীর আইডিয়াটির প্রথম সূচনা অস্ট্রেলিয়াতে। ১৮৫৬ সালে সকল শ্রমিক বছরে একটি দিন বিরতি পালন করতে চেয়েছে। বছরে একটি দিন মাত্র কর্ম বিরতি। ২১শে এপ্রিল দিবসটি পালন করা হয়েছিল। তবে এই ধরনের এক্সপেরিমেন্ট ছিল শুধুমাত্র ঐ বছরের জন্য। কিন্তু প্রথমবারই সাধারণ জনগন থেকে প্রচুর সাড়া পাওয়া গেছে।

অস্ট্রেলিয়ার পরেই আমেরিকাতে শুরু হয় শ্রমিকদের ‘৮ ঘন্টা কাজ’ এর পক্ষে আন্দোলন।।১৮৮৬ সালে ‘শিকাগো’ তে ২০০০,০০ শ্রমিকদের একটি প্রতিবাদ সভা চলাকালীন সময়ে, পুলিশ বিনা উস্কানীতে সভাটি ছত্রভংগ করে দেয়। ঐ সভাটি ছিল শ্রমিকদের ‘৮ ঘন্টা কাজ’ এর দাবীতে। দিনরাত বিরতিহীন কাজের পরিবর্তে দিনের নির্দিষ্ট আট ঘন্টা কাজ করার দাবী নিয়ে আরও আগে থেকেই শ্রমিকদের মধ্যে জল্পনা কল্পনা চলছিল। শিকাগোর ‘হে মার্কেটে’ সভা চলাকালীন সময়ে পুলিশ নৃশংস আক্রমন চালায়। পুলিশের আক্রমনের প্রতিবাদে এক শ্রমিকের ছুঁড়ে দেওয়া ডিনামাইট বোমার আগুনে এবং পুলিশের গোলাগুলীতে প্রচুর শ্রমিক ,ও পুলিশ সদস্য মৃত্যুবরণ করে। এরপরে তারা সিদ্ধান্ত নেয় একই দাবীতে পরবর্তী সমাবেশ ১৮৯০ সালের ১লা মে তারিখে হওয়ার ব্যাপারে।

ইতোমধ্যে সারা ইউরোপে ‘৮ ঘন্টা কাজের’ সমর্থণে শ্রমিক সংগঠনগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠে। তাদের দাবী দিনে দিনে অনেক বেশী জোরালো হতে থাকে। ‘হে মার্কেট’ ম্যাসাকারের পরে ১৮৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লব দিবস উদযাপন উপলক্ষে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের প্রথম কংগ্রেসের ৪০০ সদস্যের যে অধিবেশন হয়েছিল, সেখানেই শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে রেমন্ড ল্যাভিন নামের এক শ্রমিক ১৮৯০ সাল থেকে ‘শিকাগো প্রতিবাদ’ দিবস উদযাপনের প্রস্তাব করেন। তার প্রস্তাবকে আমেরিকান সংগঠনের পক্ষে আরেক শ্রমিক সমর্থন করে। তখনই প্রস্তাব করা হয়, বিশ্বে শ্রমিকদের জন্য সরকারী ছুটির দিন থাকা উচিৎ। ১৮৯১ সালের দ্বিতীয় কংগ্রেস অধিবেশনেই ১লা মে দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব করা হয়। ১৮৯৪ সালে আরেকবার শ্রমিক-পুলিশ দাঙ্গা হয়। ১৯০৪ সালে আমস্টার্ডামে আন্তর্জাতিক সামাজিক সংগঠকদের এক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বিশ্বের সকল ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি’ সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে আহবান জানানো হয়, তৃনমূল জনগোষ্ঠির দাবী অনুযায়ী ‘৮ ঘন্টা কাজ’ এর দাবী সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ার কথা। সভায় আরও জানানো হয় ১লা মে তারিখে সকল শ্রমিকদের কাজ বন্ধ রাখার প্রস্তাব পাশের কথা। সেই থেকে শুরু, সেই থেকেই মে দিবস উদযাপিত হচ্ছে। পৃথিবীর খেটে খাওয়া মানুষগুলো বছরে একটি দিন পায় নিজেদের জন্য। এতেই তারা খুশী। এতেই শ্রমিকেরা সম্মানিত হয়।

১লা মে ‘মে দিবস’ অথবা শ্রমিক দিবস পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই মর্যাদার সহিত পালিত হয়ে থাকে। বর্তমানে পৃথিবীর ৬০টি দেশে ১লা মে সরকারী ছুটির দিন। আমাদের দেশেও মে দিবসে কলকারখানা বন্ধ থাকে,রাস্তায় গাড়ীও চলেনা। আমাদের দেশে খেটে খাওয়া মানুষের দাবী আছে কি নেই তা আমি জানিনা, তবে দাবী থাকলেও তা পূরণ হয়না, সেটা জানি। এখনও নারী শ্রমিকেরা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়। এখনও গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীগুলোতে শুধু প্রবেশদ্বারই আছে, বিপদ ঘটলে বাহির হওয়ার পথ নেই। প্রতিবছর কোন না কোন কারখানাতে যে কোন কারনেই আগুন লাগে, খাঁচার ভেতর থেকে বের হওয়ার কোন রাস্তা থাকেনা বলে একটাই তালাবন্ধ গেট খুলতে খুলতে কতজন যে প্রাণ হারায়, তবুও মালিকশ্রেণীর হুঁশ হয়না। শ্রমিকদের থেকে শ্রম আদায় করা হলেও তাদের জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়না। আরও জানি, আমাদের দেশে সকলেই তক্কে তক্কে থাকে কাকে কত বেশী ঠকানো যায়। এভাবেই মালিক ঠকায় কর্মচারীকে, রাজনৈতিক নেতারা ঠকায় সা্ধারন জনগনকে, আইন ঠকায়  অসহায় গরীব বিচার প্রার্থীকে এভাবেই চলেছি আমরা। আর এভাবেই মে দিবসের চেতনা শোষকের হাতে ধূলায় লুটায়!

ছেলেবেলার গল্পশোনার দিনগুলো এখন কতদূরে...

আমার বাগানে ঝিঙ্গেলতা হলুদফুলে ছেয়ে আছে। আরো আছে সীমের লতা যেখানে বেগুনী ফুল ফুটতে শুরু করেছে। ক্লাস সেভেন/এইট-এ আমাদের বাংলা পাঠ্যবই-এ দুইটা কবিতার চরণ মনে পড়ে।
‘ঝিঙ্গেফুল ঝিঙ্গে ফুল, সবুজ পাতার দেশে হলুদিয়া ঝিঙ্গেফুল।
গুল্মের পর্ণে, লতিকার কর্ণে,দোল দোল দোলে দোল, ঝিঙ্গে ফুল ঝিঙ্গে ফুল’।
অথবা ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতায়,
‘ তুমি যদি যাও, দেখিবে সেখানে, মটরলতার সনে,
সীম আর সীম হাত বাড়ালেই মুঠি ভরে সেই ক্ষণে’।
আমার মেয়েরা দেশে খুব বেশীদিন থাকেনি, যতদিন থেকেছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়েছে ( কারণ আমার মেয়েকে অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফেরার পর কোন বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি নেয়নি)।ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বাংলা থাকে একটা সাবজেক্ট হিসেবে। কাজেই আমার মেয়েদের বাংলা শেখার সুযোগ তেমন ছিলনা। তার উপর শহরে থেকেছি বলে বাংলার রূপ তেমন দেখেনি ওরা।
তারপরেও আমার বড় মেয়ে যদিও ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে, কিনতু তার বই পড়ার প্রচন্ড নেশা আছে বলে সে নিজে থেকেই অনেক বাংলা বই পড়েছে, এখন তার ডাক্তারী পড়ার চাপে গল্পের বই পড়া আপাতত বন্ধ আছে, কিনতু বাংলার প্রতি তার আগ্রহ কমেছে বলে মনে হয়না। মেজো মেয়ে মোটামুটি বাংলা পড়তে পারে, লিখতে পারে (কেউ জিজ্ঞেস করলে সে গর্বের সাথে বলে যে সে ‘লক্ষ্মীর পাঁচালী’ পড়তে পারে) , কিনতু মেজো মেয়ে বাংলা গল্পের বই না পড়লেও ফটোগ্রাফীতে ও এত ভাল যে দেশে গেলে ওর ক্যামেরাতে উঠে আসে গ্রাম বাংলার অপূর্ব দৃশ্যগুলো, যেগুলো দিয়ে অনায়াসে পোস্টার বানানো যায়, আমার বড় মেয়ে ও এই মেয়ে তাদের স্কুল কলেজে বাংলা সংস্কৃতিকে তাদের নাচ ও গানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছে।
গত বছর দিওয়ালীর প্রোগ্রামে আমার মেজো মেয়ে পাঁচজন আমেরিকান বন্ধুকে নিয়ে হাবীবের গানের সাথে নাচ করেছে, এবার পাঁচ জনের বদলে ৯ জন আমেরিকান মেয়েকে নিয়ে সে বাংলা নাচ করবে। আমার মেজো মেয়ের রেফারেন্সেই তার এক আমেরিকান বন্ধু যে কখনও আমেরিকার বাইরে যায়নি, এই কিছুদিন আগেই দুই বছরের স্কলারশিপ নিয়ে বাংলাদেশে গেছে। সে বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে আমার মেয়ের সাথে, সে খুব খুশী বাংলাদেশে থেকে, ছোটটি দুই বছর বয়সে চলে আসে আমেরিকাতে। তার কোন সুযোগ হয়নি বাংলাদেশকে ভাল করে দেখার বা জানার। তারপরেও আমার ছোটমেয়ে খুব সুন্দর করে বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে, সেরাকন্ঠ, ক্লোজ-আপ ওয়ান, ক্ষুদে গানরাজ, সুরদরিয়া এপার ওপার দেখে দেখে বাংলা গানের সাথে পরিচিত হয়ে গেছে।
আমি আমার বাবার কাছ থেকে মুখে মুখে বলে, কাজের মাধ্যমে, অথবা হাতে কলমে বাচ্চাদের কিছু শেখানোর কায়দাটা ভাল রপ্ত করেছি। আমার মিথীলাকে বাংলা পড়তে শিখিয়েছি, লিখতেও শিখিয়েছিলাম (চর্চ্চার অভাবে একটু ভুলে যাচ্ছে), সে বাংলা যে কোন বাঙ্গালী বাচ্চার চেয়েও ভাল বলতে শিখেছে। এই মুহূর্তে ও আমাদের সাথে আছে। বাকী দুইমেয়ে যার যার কলেজের ডর্মে থেকে পড়াশুনা করছে। আর এই সময়টাতেই আমার মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার দিনগুলো। কারণ আমার চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায় আমার মিথীলা ঠিক আমার ছোটবেলার রূপ ধরে। ওকে আমি চিনিয়ে ফেলেছি দোপাটি ফুল, গন্ধরাজ ফুল, জবা ফুল, পদ্ম ফুল, বেলী ফুল, নয়নতারা ও সন্ধ্যামালতী। আমি আমার বাগানে এলোমেলোভাবে লাগিয়েছি এই সমস্ত ফুলের গাছ। বাগানে অনেক পরিশ্রম করে ঝিঙ্গের লতা, সীমের লতা, পুঁই এর লতা, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, কলমিশাক, করলার লতা লাগিয়েছি, একেবারে শেষের দিকে কচুগাছ লাগিয়েছি। আমার মিথীলা এর প্রতিটির সাথে খুব ভালভাবে পরিচিত হয়ে গেছে। আমাদের প্রতিদিনের খাবারের মেন্যুতে ডাল আর শাক রাখতেই হয়, মিথীলার জন্যে। এই দুই আইটেম থাকলে মিথীলাকে খুব নিশ্চিন্ত দেখা যায়।মাছ সে ভালোবাসে। সুযোগ পেলেই বাংলাদেশী দোকান থেকে মাছ কিনে আনি, তার মধ্যে সে ভালোবাসে ইলিশ, পাবদা, বেলে (বাইল্লা), রুই। পটল পেলেতো খুশীর সীমা থাকেনা তার। সে আরও যা ভালোবাসে তা হলো দুধ কলাভাত, দুধকলা ভাত খেতে বসলেই আমি ওকে আমার ছোটবেলায় শোনা অতি পছন্দের ছড়াটা আমার মত করে শুনাই,
খুকী খুকী করছি মায়
খুকীটা গেলো কাদের নায়
সাতটি কাকে দাঁড় বায়
খুকীরে তুই ঘরে আয়”
ছোট্ট মানুষ সে, দেশে গেলেই তাকে মশা কামড়ায়, তারপরেও সে প্রতি বছর দেশে যেতে চায়। গরমের মধ্যে ফুল স্লীভ জামা, পায়জামা পড়ে থাকে, মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য( সে নিজেই বের করেছে উপায়)। এই মিথীলাই আমার ছোটবেলা, এই মিথীলাই আমার বাংলাদেশ। এই মিথীলাকে আমি গল্পের ছলে শুনিয়ে যাই, আমার ছোট্টবেলাতে শেখা কিছু ছড়া, যা আমার এখনও মনে আছে।
আমার পাঁচ আর ছয় বছর বয়সে শেখা তিনটি ছড়া মিথীলাকে শুনিয়েছি সেদিনঃ
"খুকু যেদিন জন্ম নিলো, ছোট্ট মোদের ঘরে
পরীরা সব দেখতে এলো, কত সোহাগ ভরে।
আদর করে দোল খাওয়ালো, ফুলের বিছানায়"
‘এক যে আছে একানোরে, সে খালি তালগাছেতে চড়ে,
দাঁতদুটো তার মূলোর মতন, পিঠখানা তার কুলোর মতন,
কানদুটো তার নোটা নোটা, চোখ দুটো আগুনের ভাটা
কোমরে বিচুলীর দড়ি, বেড়ায় লোকের বাড়ী বাড়ী,
যে ছেলেটা কাঁদে, তাকে ঝোলার ভেতর বাঁধে,
গাছের উপর চড়ে আর তুলে আছাড় মারে
অথবা
'ও পাড়েতে যেওনা ভাই, ফটিং টিং এর ভয়
তিন মিনসের মাথাকাটা পায়ে কথা কয়'
প্রথম ছড়াটা মিথীলাকে বলার সময় ছোট্ট একটা গল্প জুড়ে দেই। বলি জানিসতো, এই ছড়াটা আমাকে নিয়ে লিখা হয়েছিল। কারণ আমি জন্মানোর আগে আমাদের বাড়ী শুধুই ছেলে আর ছেলেতে ভর্তি ছিল। আমার মায়ের মনে খুব দুঃখ ছিল, ঘরে একটাও মেয়ে ছিলনা বলে। তখন আমি জন্ম নিলাম। সত্যি সত্যি সব পরীরা নেমে এসেছিলো, আকাশ থেকে, আমাকে দেখবে বলে। তখনই ছড়াকার এই ছড়াটা লিখেছিল। কথাগুলো বিশ্বাস করবে কি করবেনা তা ভেবে মিথীলা একটু বিভ্রান্ত হয়। কিনতু আমার মুখে এই ধরনের গল্প শুনতে ওর ভালো লাগে তা ওর হাসি হাসি মুখটার দিকে তাকালেই বুঝতে পারি।

Friday, April 27, 2012

আমিই ডাঃ মৌটুসীর মা

২০০০  সালের জানুয়ারী মাসের কোন  একদিনে,  বঙ্গবন্ধু  মেডিক্যাল  কলেজ  হাসপাতালে  গিয়েছিলাম  ছোট্ট  একটি  অপারেশানের  জন্য।  সারাদিন  অপেক্ষার  পরে  আঙ্গুল  থেকে  টিউমারটি  অপারেশান  করা  হয়েছিল। এত  দীর্ঘসময়  হাসপাতালে  অপেক্ষার  একপর্যায়ে  আমার  মেয়েদের  বাবা  দীর্ঘশ্বাস  ছেড়ে  বলেছিলেন, " যদি  আমাদের  তিন  মেয়ের  একজনও  ডাক্তার  হতে  পারে,  তাহলে-----" ।  আমি  বাড়ী ফিরে  মৌটুসী  ও  মিশার  কাছে  আর্জি  পেশ  করেছিলাম।  ওরা  তখন  বেশ  ছোট।  বাবা মায়ের  এমন  সাত সতেরো  কথা  মনে  রাখার  মত  বয়স  ছিলনা।  কিনতু  মৌটুসী  মনে  রেখেছিল   কথাটি।

আমেরিকাতে  এসেই  মৌটুসীকে  ক্লাস  টেনে  ভর্তি  হতে  হয়েছে।  আশেপাশে  কেউ  ছিলনা  মেয়েটাকে  একটু  সাজেশান  দিতে  পারে।  মৌটুসীর  ছোটবেলা  থেকেই  নানা  বিষয়ে  পড়ার  খুব  আগ্রহ  ছিল  বলেই  নিজে  নিজেই  পড়ে  স্যাট, এসিটি  নামক  কম্পিটিটিভ  পরীক্ষাতে  দারুন  রেজাল্ট  করেছিল।  আমাদের  ভিসার  স্ট্যাটাস  তখন  'ডিপেন্ডেন্ট'  ক্যাটাগরীতে থাকায়  কোন  স্টেট  ইউনিভার্সিটিতে  ফুল  স্কলারশীপ  পাওয়ার  কোন সুযোগ  ছিলনা। অথবা  আমরা  তখন  একেবারেই  নতুন  ছিলাম  বলে  অনেক  কিছু  জানতামওনা।  ফলে  একটি  প্রাইভেট  ইউনিভার্সিটিতে  স্কলারশীপের  জন্য  ইন্টারভিউ  দিতে  হয়েছে।  দুই দিন  ব্যাপী  কঠিন  ইন্টারভিউ।  ৬৭ জনের  মধ্যে  পাঁচজনকে  দেবে  ফুল  স্কলারশীপ।  আমাদের  মৌটুসী  ছিল  একমাত্র  নন আমেরিকান। ইনটারভিউ  শেষে  আমরা  আশা  ছেড়ে  দিয়েই  অপেক্ষা  করছিলাম।  তৃতীয়দিনে  একটি  ফোন  এলো,  যেখানে  বলা  হলো, " আমি  হলিন্স  ইউনিভারসিটির  প্রেসিডেন্ট  বলছি।  তুমি  ওর  মা?  তুমিই  তাহলে  মেয়ের  সুখবরটি  আগে  শোন।  ঋত্বিকা  ফুল  স্কলারশীপ  পেয়েছে।  তুমি  একজন  প্রাউড  মা"।  আনন্দের  খবরে  কান্না  আসে  সেটা  প্রথম  টের  পেলাম  সেদিন।  আমি  একা  ঘরে  হাউমাউ  করে  কেঁদেছিলাম  খুশীতে।  কারন  এই  স্কলারশীপ  না  পেলে  আমাদেরকে  ব্যাঙ্ক  থেকে  বছরে  ২৫,০০০ ডলার  লোন  করতে  হতো।

হলিন্স  ইউনিভার্সিটি  থেকে  'ওয়োম্যান  স্টাডিজ' এর  উপর  চার  বছরের  ডিগ্রী  শেষ  করেছে জিপিএ ৪  (সর্বোচ্চ) পেয়ে।  এরপর  মেডিক্যাল  স্কুলে  এপ্লাই  করার  জন্য  এমক্যাট  নামের  কম্পিটিটিভ  পরীক্ষা  দিতে  হয়েছে।  এখানেও  মৌটুসী  দারুন  স্কোর  করেছে।  মৌটুসী  আমাদের  কাছছাড়া  হয়ে  থেকেছে  ওর  ষোল  বছর  বয়স  থেকে।  আমি  ভগবানের  কাছে  প্রার্থণা  করেছিলাম  যেনো  মৌটুসী  মিসিসিপি  মেডিক্যাল  স্কুলে  চান্স  পায়।  মৌটুসীর  জন্য  মিসিসিপি  মেডিক্যাল  স্কুল  আহামরি  কিছুনা।  মৌটুসী  এখানে  আসতেই  চায়নি।  কিনতু  ভগবান  আমার  মত  মায়ের  ডাকেই  সাড়া দিয়ে  থাকেন।  এদেশে  ডাক্তারী  পড়তে  গেলে  সবাইকেই  লোন করে  পড়তে  হয়।  কিনতু  মৌটুসী  ওর  রেজাল্টের  কল্যানে  মিসিসিপি  মেডিক্যাল  স্কুল  থেকে   একটি  প্রাইভেট  স্কলারশীপ  পেয়ে  যায়।  যা  কিনা  মৌটুসীর  পড়ার  খরচ  মিটিয়েও  থাকা  খাওয়াসহ  সবকিছু  কাভার  করেছে।  কিনতু  মৌটুসী  ভার্জিনিয়ার মত  স্টেটে  চার  বছর  থেকে  এসেছে,  ওখানে  নানারকম  এক্টিভিটিতে  নিজেকে  সম্পৃক্ত  রেখেছে।  সেই  মেয়ের  কাছে  মিসিসিপির  মত  এমন  কনজারভেটিভ  স্টেট  ভালো  লাগার  কথা  নয়।  মৌটুসীর  ভালো  লাগেওনি।  এখানে  আসার  পরেই  আমার  এমন  গুনী  মেয়েটি  কেমন  যেনো  নিষ্প্রভ  হয়ে  পড়ে  আস্তে  আস্তে।  পড়ুয়া  মেয়েটি  পড়াশুনাতে  আকর্ষন হারাতে  থাকে।  যে  মেয়ে  সহজে  কান্নাকাটি  করতোনা,  সেই  মেয়েই  ফোনে  প্রায়  প্রায়  কাঁদতো। মৌটুসীকে সকলেই জানে মিতভাষিণী হিসেবে। খুব শান্ত একটা মেয়ে মাঝে মাঝে শুধু বোন মিশার সাথে ঝগড়া করতো। সেই মৌটুসী একেবারে অন্যরকম হয়ে গেলো। মিশার সাথে প্রতি মুহূর্তে ঝগড়া করতো। আসলে মিশাকে দেখত আনন্দফূর্তি করছে, নাচ করছে, সরাসরি বলে দিচ্ছে মরে গেলেও ডাক্তারী পড়বেনা, সাধারন চাকুরী করেই জীবন কাটাবে, এগুলো শুনেই বোধ হয় ওর রাগে শরীর জ্বলতো। আমরা শুনেছি, ডাক্তারী পড়ার চাপ সইতে না পেরে অনেকেই অনেক উলটাপালটা কাজ করে ফেলে। তাই একটু দুশ্চিন্তা হতো। আবার এমন একটি স্কলার মেয়ে ডাক্তারীতে ফুল স্কলারশীপ পেয়েও পড়বেনা, এটাও ভাবতে খারাপ লাগতো।

 মৌটুসী ওর কলেজের কাছেই এপার্টমেন্ট  ভাড়া  করে  একা  থাকতো।  আমি  ভয়  পেতাম। কেবল মনে হতো, একা ঘরে মৌটুসী যদি অজ্ঞান হয়ে যায়, যদি মনের দুঃখে সুইসাইড করে ফেলে, এমন হাজার রকমের ভয় দানা বাঁধতে শুরু করে আমার মনে। ঐসময়  আমিও এখানে ইউনিভার্সিটিতে  নার্সিং পড়ছিলাম। এদেশে নার্সিং পেশাটি ডাক্তারী পেশার মতই মূল্যবান। যাই হোক, আমার রেজাল্টও খুব ভাল হতে লাগলো। আমরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতাম, মৌটুসী  ডাক্তার হবে আর আমি হবো ওর নার্স। শেষের  দিকে  এক  টিচারের উপর রাগ করে দুই  সেমেস্টার  বাকী  থাকতেই  আমি  নার্সিং  পড়া ছেড়ে দিয়ে চলে আসলাম। নার্সিং ডিপার্টমেন্ট থেকে আমাকে অনেকবার  বলা  হয়েছিল পড়া শেষ করার জন্য। আমার রেজাল্ট ভালো ছিল, তাই আমার এমন ডিসিশানে সবাই অবাক হয়ে গেছিল। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার মনটা এমনিতেই দূর্বল ছিল, তার উপর মৌটুসিকে নিয়ে চিন্তা। একবার মৌটুসীদের এক ভ্যাকেশান শেষে কি একটা ওয়ার্কশপ চলছিল। এই মেয়ে তার বাবার মতই একটু আনমনা।  তাই আমি নিয়মিত দিনে চারবার ফোন করতাম।  আমাকে নিয়ে অনেকে হাসাহাসি করেছে । এমনকি আমার মেয়েও ফোন ধরেই বলতো, বেঁচে আছি।  সেদিন ও আমাকে বলেই নাই তার ওয়ার্কশপের কথা। আমি সকালে ফোন করে ওকে পাইনি, মোবাইলে রিং হয়, মেয়ে ফোন ধরেনা। বিকেল তিনটার মধ্যে সাতবার ফোন করেও ওর সাড়া না পেয়ে আমি কান্নাকাটি শুরু করে দেই। শুধু কান্নাকাটি না, আমি আমার বরকে ভয়ংকরভাবে  বর্ণনা দিতে লাগলাম, কিভাবে মৌটুসী অজ্ঞান হয়ে মরে গেছে। আশেপাশে কেউ নেই, কেউ জানবেওনা আমার মেয়েটা ঘরের ভেতর নিশ্চয় অনেকক্ষন অজ্ঞান হয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত মরেই গেলো"। এমন বর্ণনা শুনলে কারোর মাথা ঠিক থাকার কথা নয়। আমার বর বিশ্বাস করতে শুরু করলো। ফুল ফ্যামিলি রওনা দিলাম মেয়ের কাছে। ৩০-৪০ মাইল যাওয়ার পরে আমার ফোন বাজতে শুরু করলো। দেখি মৌটুসী কল করেছে। আমার তখন কি যে অবস্থা! ফোন ধরেই কাঁদতে কাঁদতে ওর চৌদ্দগুষ্ঠী উদ্ধার করে পরে জানলাম ওয়ার্কশপে ফোন নেয়া যায়না বলে ফোন রুমে রেখে গেছিল।

আমেরিকাতে  ডাক্তারী  পড়া  কত  যে  কষ্টের  আর  কত  যে  রসকষহীন,  তা  গত  চার  বছরে  হাড়ে  হাড়ে  টের  পেয়েছি।  প্রথম  দুই  বছরে  মৌটুসী  কতবার  ডিসিশান  নিয়েছিল  ডাক্তারী  পড়া  ছেড়ে  দিয়ে  'ইনটেরিয়ার  ডিজাইন'  পড়বে।  আমাদের  এই  মেয়ে  যা-ই  পড়তো,  সব কিছুতেই  ওকে  মানিয়ে  যেতো।  তারপরেও  আমি  অনেক  বুঝিয়েছি,  অনেক  কান্নাকাটি  করেছি। একদিন আমার পিসতুত ভাইয়ের কাছে বেড়াতে গেছিলাম। তিনদিন থেকে ফিরে আসার সময় গাড়ীতে মৌটুসী মিশার সাথে খুব বাজে ব্যবহার করছিল দেখে আমি বকা দিয়েছি, বকা খেয়ে মেয়ে বলতে লাগলো যে আসলে ওর মাথার ঠিক নেই। ওর কিচ্ছু ভালো লাগেনা। এই মিসিসিপির দম বন্ধ করা পরিবেশে ও একটুও ভালো নেই। ও নাকি ডিসিশান নিয়ে ফেলেছে, মিসিসিপিতে থেকে ও আর পড়াশুনা করবেনা। ওর ডাক্তারী পড়ার শখ চলে গেছে। পুরানো কথাই নতুন করে খুব জোরের সাথে বলাতে শেষমেষ  আমিও  ডিসিশান  দিয়ে  দিয়েছিলাম,  " ওকে,  বাদ  দিয়ে  দাও।  পড়াশুনাতো  জীবনের  চেয়েও  বেশী  ইমপর্ট্যান্ট  না।  পড়তে  গিয়ে  যদি  মরেই  যাও,  এমন  পড়া  আমি  চাইনা।  তুমি  অলরেডী  'ওয়োম্যান  স্টাডিজ' এ চার  বছরের ডিগ্রী  করে  ফেলেছো।  চাকুরী  পাবে।  তারপরে  যদি  অন্যকিছু  পড়তে  ইচ্ছে  করে পড়ো"।  এই  কথা  বলেই  আড়ালে  অনেক  কেঁদেছি। ওর বাবাও বলেছে, " মামনি, ঠিক আছে যে কোন কিছু ছাড়তে বেশী সময় লাগেনা। যে কোন সময় ছেড়ে দিতে পারো। ডাক্তারী পড়তে গিয়ে তুমি একাতো কষ্ট পাচ্ছোনা, আমরা সকলেই কষ্ট পাচ্ছি। তোমার মত মেয়ে যদি এমন পাগলামী করো তাহলে আর কি করা। পড়া ছেড়ে দেওয়ার আগে অন্যান্য ইউনিভার্সিটিতে খোঁজ নাও, সব রাস্তা ঠিক করে তারপর ডাক্তারী পড়া ছেড়ে দিও। আগেই হুট করে কিছু করোনা"। বাসায় ফিরে এসেই একঘন্টা পরেই মৌটুসী গাড়ী নিয়ে চলে গেলো জ্যাকসান। আমি এই প্রথম বাইরে বের হইনি ওকে টা টা করার জন্য। তিন চার  ঘন্টা  বাদের  মৌটুসী  ফোন  করে  আমাকে  বলেছিল, " ওকে মামনি,  আমি  ডাক্তারী  পড়া  শেষ  করবো।  আর  কখনও  পড়া  ছেড়ে  দেয়ার  কথা  বলবোনা।  কথা  দিলাম"।

ডাক্তারী  পড়ার  এই  কঠিন  জীবনে  অন্যদিকে তাকানোর ফুরসত ছিলনা মেয়ের। আমি একদিন বলেছি বিয়ের কথা। বাঙ্গালী ছেলে বিয়ে করতে বলাতে ও আমাকে বলেছে বাঙ্গালী ছেলে খুঁজে এনে দিতে। আমি ওকে বলেছিলাম 'সাদী ডট কমে' প্রোফাইল খুলতে। আসলে ওকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা আমার ছিলনা। আমি চেয়েছিলাম মনটা একটু অন্যদিকে ডাইভার্ট হওয়া দরকার। সব বয়সের একটা ধর্ম থাকে। পড়া পড়া করে জীবন শেষ করার কোন মানে হয়! মৌটুসী খুবই ভাল একটি মেয়ে, সে মেয়ে জীবনের এমন সুন্দর সময় পার করে দেবে এই পড়া পড়া করে! শেষ পর্যন্ত  গতবছর মনীশ  গুপ্তা নামের চমৎকার একটি ছেলের  সাথে  মামনির পরিচয়  হয়। পরিচয়  থেকে  বোঝাপড়া, বোঝাপড়া থেকে  এনগেজমেন্ট।  মনীশের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই মৌটুসী আস্তে আস্তে আবার আগের ফর্মে ফিরতে শুরু করে। আমিও আর প্রতিদিন ফোন করিনা। জানি মনিশ ওর খবর রাখে। আমার দুশ্চিন্তা কমে গেছে। তবুও অভ্যাস কি আর সহজে যায়! মাঝে মাঝেই মনে হয় আমার মেয়েটার গলার আওয়াজ কতদিন ধরে শুনিনা! সাথে সাথে ফোন করি। ফোন ধরলেই বলি, কেমন আছো জানার জন্য ফোন করলাম। আগের ফর্মে ফিরে যাওয় মৌটুসী হয়ত ঠাট্টা করে কোন জবাব দেয়।  মৌটুসী রান্না করতে ভালোবাসতোনা। মৌটুসী এখন আগ্রহ নিয়ে রান্না করে, বাঙ্গালী রান্নার রেসিপি জিজ্ঞেস করে।  ডাক্তারী এখন ওর ভালো লাগে। কত জায়গাতে ও একমাস বা দুই মাসের জন্য ইন্টার্নশীপ করে আসলো। এই হচ্ছে আসল মৌটুসী। মিসিসিপিতে ইন্টার্নশীপ করবেনা, অনেক ভালো জায়গাতে চান্স পেয়েছে, ডালাসে।  গতবছর ওদের এনগেজমেন্ট হয়েছে, বিয়েটা  হবে  এ  বছর জুন মাসে।  আর বিয়ের  আগেই  মৌটুসী  ডাক্তারী  পড়া  শেষ  করে  ফেললো।

আজকে  ছিল  মৌটুসীর  মেডিক্যাল  স্কুলের  শেষদিন।
আজ  থেকে  আমি  ডাক্তার  মৌটুসীর  মা।  মৌটুসীকে  আমার  অন্তর  নিঙড়ানো  ভালোবাসা,  স্নেহ,  আদর  আদর  আদর আদর-------------

Wednesday, April 25, 2012

আমেরিকান কনের বাংলাদেশী ‘বর’ পছন্দ!!!

আমার সহকর্মী ওরা। রেজিনা, চ্যাসিটি, শেইলা, টেরী, মাইশা। টেরী এবং শেইলা আমার বয়সী, চ্যাসিটি সবার ছোট ২২ বছর বয়স ওর। মাইশা ও রেজিনার বয়স ২৭ অথবা ২৮। ওদের একটু আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দিলে লেখাটি পড়তে সহজ হবে।

রেজিনাঃ কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী, বিবাহিত। রেজিনা ফোন সার্ভিসে চাকুরী করার পাশাপাশি অনলাইনে ‘অফিস ম্যানেজমেন্ট’ এর উপর পড়াশুনা করছে। ওর স্বামী গাড়ী সারাইয়ের দোকানে মেকানিকের কাজ করে। ওরা সুখী দম্পতি। রেজিনা কাজে আসার পর থেকে ওর বর প্রতি ঘন্টায় ফোন করে, বউয়ের খোঁজ নেয়। আমি মাঝে মাঝেই মজা করে বলি, আমার বরটাকে তোমার বরের কাছে পাঠিয়ে দেবো, বউ খুশী করার কিছু টিপস শিখে আসবে। রেজিনার স্বামী রেজিনার মায়ের বাড়ীতেই থাকে। অনেকটা ঘর-জামাইয়ের মত।

চ্যাসিটিঃ বাচ্চা একটি মেয়ে। কৃষ্ণাঙ্গ হলেও গায়ের রঙ আমাদের মতই বাদামী। সিঙ্গল মায়ের একমাত্র মেয়ে, বিলাসী, স্টাইলিশ। গত এক বছরে তিনবার ‘আইফোন’ বদলেছে। ইমেলদা মার্কোসের পরেই মনে হয় চ্যাসিটির নাম আসবে, এত জোড়া জুতা ওর। চ্যাসিটি চাকুরী করে, কলেজে পড়াশুনাও করে। ওর একটি তিন বছর বয়সী মেয়ে আছে। ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে এখন ওর কাট-আপ হয়ে গেছে। মেয়েকে নিয়ে চ্যাসিটি ওর মায়ের কাছেই থাকে। তবে অপেক্ষায় আছে বয়ফ্রেন্ডের সাথে সম্পর্ক জোড়া লাগার জন্য। বিয়ে নিয়ে চিন্তা করছেনা। কি ধরনের ছেলে ওর পছন্দ জিজ্ঞেস করতেই বলেছিল, পয়সাওয়ালা ছেলে। যে ওকে রাজসুখে রাখবে।

শেইলাঃ শেইলাকে আমরা ডাকি শেলী বলে। শেলী বিবাহিত। কৃষ্ণাঙ্গ রমণীর দুই ছেলে মেয়ে। ছেলে কুমারীকালীন সন্তান, মেয়ে বিবাহিত জীবনের সন্তান। ছেলে মেয়ের মা এক, বাবা ভিন্ন। মেয়ে অন্তঃপ্রাণ। ৭ বছরের বিবাহিত জীবন ওর। সেদিন কথায় কথায় বলছিল, যদি কোন কারনে ওর স্বামী ওর আগে মারা যায়, তাহলে ও আর বিয়ে করবেনা। বাকী জীবন একা থাকবে। শেলীর স্বামীও কোন কারখানাতে চাকুরী করে।

টেরীঃ শ্বেতাঙ্গীনি টেরীকে সকলেই পছন্দ করে। ওর পূর্ব পুরুষ আমেরিকান ইন্ডিয়ান। ওর চেহারার মধ্যে রেড ইন্ডিয়ানদের কিছু আদল আছে। টেরী বিবাহিত। এটা তার চতুর্থ বিয়ে। সাত বছরের বিবাহিত জীবন। দুই মেয়ে টেরীর। দারুন সুন্দরী মেয়ে দুটি। বড় মেয়ে ওর প্রথম স্বামীর সন্তান আর ছোট মেয়ে ওর তৃতীয় স্বামীর সন্তান। চতুর্থ স্বামী মিলিটারীতে চাকুরী করতো, এখন রিটায়ার্ড। তিনটি স্বামীকেই ও ডিভোর্স দিয়েছে। ব্যক্তি জীবনে স্বামীদের নাক গলানো সহ্য করতে না পেরেই নাকি তাদেরকে ‘কিক আউট’ করে দিয়েছে। বর্তমান স্বামী তা করছেনা বলেই এখনও তার ঘর করে চলেছে। তবে আর বিয়ে করার ইচ্ছে নেই।

মাইশাঃ সিঙ্গল মাম। পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চার মা। মাইশা কৃষ্ণাঙ্গ গোত্রের হলেও ওর গায়ের রঙ আমার চেয়েও উজ্জ্বল। মাইশা ডিভোর্সড। ওর একজন বয়ফ্রেন্ড আছে বর্তমানে। মাইশার স্বভাব খুব মিষ্টি। সাধারণ কালো মেয়েদের মত মুখরা নয়। বয়ফ্রেন্ডের কাছ থেকে প্রপোজেল পাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছে।

উপরের সহকর্মীদের প্রত্যেকেই নিজেদের মধ্যে প্রায়ই সংসার খরচ নিয়ে কথা বলে। আমি সব সময় চুপ করে শুনে যাই। স্বামীর সংসার বা মায়ের সংসার, সবখানেই ওদের খরচ দিতে হয়। আমাকে ওরা কখনওই গ্যাস, বিদ্যুত, ওয়াটার বিল নিয়ে কথা বলতে শোনেনি। আমি কখনওই ট্যাক্স রিটার্ণ নিয়েও কথা বলিনা কারো সাথে। কারন আমি এগুলো নিয়ে কখনও ডিল করিনা। ওরা জানে যে আমার হাজব্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসারী করে। ওদের ধারনা হয়েছে, আমার বুঝি অনেক টাকা পয়সা আছে।

গতকালকে ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল প্লেনের টিকিট কেটেছি কিনা। ওরা জানে আমি প্রতি দুই বছরে একবার হোমে যাই। টিকিট কাটতে কত লেগেছে জিজ্ঞেস করতেই ডলারের অংকটা বলে দিলাম। শুনে ওদের চোখ কপালে উঠে গেছে। জানতে চাইলো কে দিয়েছে এই টাকা। বললাম যে আমিই দিয়েছি। তখন ওরা আরও অবাক হয়ে জানতে চাইলো, সংসারের বিল দিয়ে আমার কাছে কিভাবে এতো টাকা থাকে! বললাম যে সংসারে আমাকে কোন খরচ দিতে হয়না। পরের প্রশ্ন তাহলে আমি কেনো চাকুরী করি। বললাম সময় কাটে এবং দেশে যাওয়ার প্লেন ভাড়াটা উঠে যায়। প্লেন ভাড়া নিয়ে ওরা আর উৎসাহ না দেখিয়ে জানতে চাইলো, সংসারে কোন খরচ না দিয়ে ২৬ বছর ধরে এক স্বামীর ঘর কিভাবে করছি! এমন প্রশ্ন ওরা আমাকে প্রায়ই করে। আমি বললাম, আমাদের দেশের ছেলেরা বিয়ে করার সময় বউ এর ভরণ-পোষণসহ যাবতীয় দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ফেলে। বাকী জীবন দায়িত্ব পালন করে যায়।

ওদের প্রশ্ন ছিল আমি সংসারে কোন কাজ করি কিনা, প্রতিদিন রান্না করি কিনা, স্বামী যা করতে বলে তাই করি কিনা, ওয়াশিং মেশিন চালাই কিনা, লন মো করি কিনা যার বিনিময়ে আমার স্বামী আমার সাথে সংসার করছে! আমি বললাম, সব কাজ আমি করিনা। যেটা করতে ভালো লাগে যেমন রান্না করতে ভালো লাগে বলেই আমি প্রতিদিন রান্না করি, আবার আমি যখন কাজে থাকি তখন বাড়ীর অনেক কাজ আমার স্বামী করে ফেলে। এভাবেই মিলে মিশে কাজ করি। শীলা জানতে চাইলো আমি স্বামীকে জামা কাপড় কিনে দেই কিনা। বললাম যে নানা উপলক্ষে গিফট কিনে দেই। মেয়েদের পড়াশুনার খরচ কাউকেই দিতে হয়না। স্কলারশীপের টাকাতেই ওদের চলে। তবে আমার টাকাটা আমি জমিয়ে রাখি দেশে যাওয়ার জন্য। আমার বরতো দেশে যেতে চায়না, আমি একা একা যাই। আমার বর যেহেতু দেশে যায়না তাই দেশে যাওয়ার টাকা আমি তার কাছ থেকে নেইনা, ধরে নাও এটা আমার এক ধরনের অভিমান। আমি চাই সকলে মিলে বেড়াতে, কিনতু আমার বর প্লেন চড়তে ভয় পায় বলে দেশেই যাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছে, এটাতো আমি মেনে নিয়েছি, তাহলে আমার বর কেনো মানবেনা আমার আবদার। আমাদের সম্পর্কটা একটা ভালো বোঝাপড়ার মধ্যে টিকে আছে। বোঝাপড়া ঠিক থাকলে সবার সম্পর্কই দীর্ঘস্থায়ী হয়।

এবার চ্যাসিটি বলে উঠলো, ‘ রীটা দেশ থেকে আমার জন্য একটা ছেলে নিয়ে এসো, বিয়ে করবো’। শীলা বললো, ” আমার জন্যও তোমার দেশী ছেলে নিয়ে এসো, বিয়ে করবো”। একে একে বাকী তিনজনই একই কথা বললো। তারা আর সংসারের বিল শেয়ার করতে চায়না। তারা চায় আমার মত নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুরতে। তারা চায় রোজগারের টাকা নিজের ইচ্ছেমত খরচ করতে। আমি হেসে ফেললাম। আমি বললাম, চ্যাসিটি আর মাইশা অবিবাহিত, ওদের জন্য নাহয় ছেলে আনতে পারি, কিনতু তোমাদের জন্য ছেলে নিয়ে আসলেতো তোমাদের স্বামীরা আমার গলা টিপে ধরবে। হাসতে হাসতেই শেলী বলে ফেললো, তোমার গলা টিপে ধরার আগেই স্বামীকে ‘কিক আউট’ করে দেবো। এরপরেই রেজিনার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম, ওর স্বামী প্রতি ঘন্টায় খোঁজ নেওয়ার পরেও ও কেন বাংলাদেশী ছেলে বিয়ে করবে! ওকে জানালাম বাংলাদেশী ছেলেরা বউয়ের খোঁজ নেয়াকে কাপুরুষতা মনে করে। তখন চ্যাসিটি হাসতে হাসতে বললো, রেজিনার বরের মত ছেলেরা আসলে ভালোবেসে খোঁজ নেয়ার পাশাপাশি বউয়ের উপর নজরদারীও করে। রেজিনা অবশ্য চ্যাসিটির কথা অগ্রাহ্য করে বললো যে ভালোবাসারও একটা লিমিট থাকতে হয়, এতো বেশী ভালোবাসা সব সময় ভালো লাগেনা।

আমি হেসে ফেললাম, কিনতু মনে মনে বললাম, “বন্ধুরা, সব দেশেই মানুষের মাঝে ভাল-মন্দ আছে। তোমরা স্বাধীন, টেরীর মত ভালো না লাগলেই যখন তখন স্বামীকে ডিভোর্স করতে পারো। আমাদের দেশে একজন বিদ্রোহী নারী এই কাজটি করতে পেরেছে, মতে মিলেনি বলে স্বামীদেরকে ছেড়ে দিয়েছে, কিনতু অন্য নারীরাই তার সমালোচনা করেছে। তিনি একজন লেখিকা। নারীর পক্ষে বলতে গিয়ে সেই লেখিকা ‘বিতর্কিত’ উপাধী পেয়েছে। পুরুষেরা তাকে দেশছাড়া করেছে। সরকারীভাবেই সে আজ দেশে নিষিদ্ধ। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের দেশের মেয়েদের নেই। আমাদের দেশের সুখী মেয়েদের মনের ভেতর তোমাদের মতই অনেক যন্ত্রনা আছে। তোমাদের মত যন্ত্রণা প্রকাশের স্বাধীনতা নেই বলে মুখ বুজে সংসার করে, না হয়তো কিল গুঁতা খায়। অনেক মেয়েকে আত্মাহুতিও দিতে হয়। সম্পর্ক তৈরী করতে গেলে পুরুষ ও নারী, দুজনকেই সমানভাবে চেষ্টা করতে হয়। নিজেদের মধ্যে অত বেশী হিসেব নিকেশ করে যেমন সুখী হওয়া যায়না, আবার সবকিছুতে একক কর্তৃত্ব ফলাতে গেলেও পারস্পরিক সুখী হওয়া যায়না। দুজনের সম্পর্কে আসলে পারস্পরিক বোঝাপড়াটাই আসল, তা যে কোন দেশে যে কোন সম্পর্কের বেলায় প্রযোজ্য।

Tuesday, April 24, 2012

ঝুমুর আবার বাজবে


এক.

লাবণ্য বেশ অনেকক্ষন ধরেই বারান্দায় বসে ছিল। শীতের শেষ বিকেলের রোদে পিঠ দিয়ে খাতা কলম নিয়ে কিছু আঁকিবুকি করার চেষ্টা করছিল। কাল সকাল আটটায় একটা ক্লাস আছে, তারপর মাঝে তিন ঘন্টা বিরতি দিয়ে এগারোটায় দিনের শেষ ক্লাস নিয়েই ছুটতে হবে তাদের সংগঠন ‘আমরাই শক্তি’র এক জরুরী মিটিং্যে। আজ সকালেই মায়া এসেছিল। ছুটির দিন বলে বেলা এগারোটার দিকে লাবণ্য সবেমাত্র দিনের দ্বিতীয় কাপ চা নিয়ে বসেছে, এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠে। ছোট মেয়ে টুকী দরজা খুলে দিতেই মায়ার গলা শোনা গেলো। লাবণ্য, লাবণ্য করে হাঁক ডাক করতে করতে মুহূর্তেই মায়া লাবণ্যর কাছে চলে এলো। এসে প্রথম কথাই বললো, “লাবণ্য, ঝুমুরের কথা মনে আছেতো! সেই যে একদিন এসেছিল আমাদের প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখবে বলে। দেখতে পরীর মত সুন্দরী, সেই ঝুমুর আজ সকালে ক্লাবে এসে উপস্থিত। সাথে করে নিয়ে এসেছে দুই বছরের ছেলে আর একটা স্যুটকেস। ঘটনা খুব একটা সুবিধের মনে হলোনা। শরীরের নানা জায়গায় চড় চাপড়ের দাগ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, ঘাড়ের কাছে, ফর্সা হাতে কালসিটে পড়ে গেছে। কতভাবে জানার চেষ্টা করলাম, কি হয়েছে, কেউ মেরেছে কিনা, তা মেয়ে কিছুই বলেনা, শুধু বলেছে তাকে যদি কয়েকটা দিন আমাদের কাছে থাকার সুবিধা করে দিতে পারি, তাহলেই বাকীটা সেই নাকি সামলে নিবে।“ লাবণ্য এতটুকু শুনেই বুঝে ফেলেছে যাই ঘটে থাকুক, ঘটনা অবশ্যই জটিল, খুব সহজে সমস্যার সমাধান মিলবেনা।

     ঝুমুরের সাথে কথা বলতে হবে, ওর সাথে সরাসরি কথা না বলতে পারলে কিছুই বোঝা যাবেনা।  ঝুমুরকে এর আগে একবারই দেখেছে লাবন্য। ওর বান্ধবী পায়েলের কাছে  সংগঠনটির কথা শুনে একদিন দেখতে এসেছিল। লাবন্য সেদিন ওখানেই ছিল, ঝুমুরের সাথে গল্প করেছে, ধনী বাড়ির বউ তা মেয়ের সাজগোজ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, কিনতু একবারও মনে হয়নি মেয়েটির জীবনে এত বড় অশান্তি চলছে। পায়েল অবশ্য পরে বলেছে ঝুমুরের কথা। ঝুমুর খুব সুন্দরী বলে ওর মা বাবা মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিল। ঝুমুরের শ্বশুরবাড়ী থেকে ঝুমুরকে বিয়ের পরেও পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়াতেই ঝুমুর বিয়েতে মত দেয়। কিনতু বিয়ের পরেই ঝুমুরের স্বামী, ননদ, শাশুড়ী থেকে শুরু করে সকলেই তাদের প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়ে ঝুমুরের উপর নানা বাধা নিষেধের কড়াকড়ি আরোপ করতে শুরু করে। আস্তে আস্তে ঝুমুরও বিগড়াতে শুরু করে, নিজে নিজেই ভর্তি হয়ে যায় কলেজে, উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্টও করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্সও পেয়ে যায়, কিনতু শ্বশুড় বাড়ী থেকে আর কোনভাবেই পারমিশান পায়নি ইউনিভারসিটিতে পড়ার ব্যাপারে। এর মধ্যেই ঝুমুরের একটি ছেলে বাচ্চা হয়, বাচ্চাটিকে নিয়ে ভালোই কাটছিল ঝুমুরের সময়। হঠাৎ করেই আবার নাকি ইদানিং ঝুমুরের উপর সবার অত্যাচার বেড়েই চলছিলো। তখনই পায়েলের কাছে লাবণ্য ও মায়ার গল্প শুনে একদিন এসেছিলো ঝুমুর, শুধুই দেখে যেতে। পায়েলকে লাবণ্য ভালো চিনে, বেশ ক’বছর আগে লাবন্যর ছাত্রী ছিল, এখনও লাবন্যর কাছে মাঝে মাঝেই আসে পায়েল, এমনি দেখা করতে। একাও আসে আবার কখনও তার বর ইমনকে নিয়েও আসে। পায়েলের স্বামী ইমন খুব শ্রদ্ধা করে লাবন্যকে। পায়েল যদিও লাবণ্যকে আগের অভ্যাসমত ম্যাডাম ডাকে, ইমন সরাসরি দিদি বলে ডাকে। লাবণ্যকে দেখলেই নাকি ইমনের নিজের বড় বোনের কথা মনে পড়ে যায়।

লাবণ্যর বয়স চল্লিশ পার হয়েছে এই গত আশ্বিনে। তবে চুলে পাক ধরেনি এখনও, চেহারাতেও ক্লান্তির কোন ছাপ নেই। গত বা্রো বছর যাবত একটি কলেজে বাংলা পড়াচ্ছে সে। কলেজে সে খুব জনপ্রিয়। কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা অন্য ক্লাস ফাঁকি দিলেও লাবন্য ম্যাডামের ক্লাস ফাঁকি দেয়না। লাবন্য এমনিতে কখনও কোন স্টুডেন্টের উপর বিরক্ত হননা সহজে। তাঁর গলার আওয়াজে, কথা বলার স্টাইলে এমন কিছু আছে, যা ছোট বড় সকলকেই খুব কাছে টানে। তার লাবণ্য নাম যেই রেখে থাকুক, তার দূরদর্শিতার প্রশংসা করতেই হয়। লাবন্যর সারা দেহে মুখে লাবন্য যেনো মাখামাখি করে থাকে। মানুষটি লম্বায় পাঁচ ফিট হবে হয়তো, গায়ের রঙ শ্যামলা, কিনতু মুখের চেহারায় এমন স্নিগ্ধ ভাব আছে যা দেখলে তার উপর ভরসা করতে ইচ্ছে করে। তার চোখ দুটোতে বুদ্ধি খেলা করে, গভীর কালো চোখ, আর হাসিতে গালে টোল না পড়লেও এমন হাসি দিয়ে বিশ্ব জয় করা যায়। তাঁর পড়ানোর স্টাইলটাও অন্যরকম। ছেলেমেয়েদেরকে কখনও গৎবাঁধা মুখস্ত করতে উৎসাহিত করেননা, সব সময় বলেন, যে কোন একটা বিষয়ে নিজের চিন্তা ভাবনাকেই গুছিয়ে লিখতে। পড়ানোর সময় এতো সুন্দর সুন্দর গল্প বলে বলে পড়া বুঝিয়ে দেন যে ছাত্র ছাত্রীদের বই মুখস্ত করার যন্ত্রনা পেতে হয়না। সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র, তা লাবন্যর বেলায় পুরোপুরি সত্যি। কলেজের অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে কলেজের কেয়ারটেকার পর্যন্ত সবার কাছেই লাবন্যর গ্রহনযোগ্যতা ঈর্ষনীয় পর্যায়ে পড়ে। অনেকেই আসে তার কাছে পরামর্শ চাইতে। এত ধীর স্থির মানুষটার পরামর্শের অনেক মূল্য সবার কাছে।

তা আজকে মায়ার মুখে ঝুমুরের ঘর ছেড়ে চলে আসার কথাটা শুনে লাবন্যর মনটা একটু অস্থির লাগছে। কম শিক্ষিত মানুষের সমস্যা সমাধান করা অনেক সহজ, ঝুমুরের স্বামীর মত উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধান করা চারটিখানি কথা নয়। তারা আর কতটুকুই বা করতে পারে, শুধুই কাউন্সেলিং করে কি আর কারো ভাঙ্গা সংসার জোড়া দেওয়া যায়! ‘আমরাই শক্তি’র শুরু থেকেই মায়া মোর্শেদ লেগে আছে সংগঠনটির ভালো-মন্দ সব কিছুতেই। মায়ার স্বামী মোর্শেদ আর লাবন্যর স্বামী অতীন, একই প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে কর্মরত আছে। সেই প্রতিষ্ঠানের এক পার্টিতে লাবন্যর সাথে মায়া মোর্শেদের পরিচয়। পরিচয় আস্তে আস্তে সখ্যতায় রূপ নেয়। তখনই একদিন মায়া লাবণ্যকে বলে, “ লাবণ্য, জানোতো আমার টাকা পয়সার অভাব নেই, ছেলেপুলেও হলোনা, মাঝে মাঝেই খুব পাগল পাগল লাগতো, সময় কাটতে চাইতোনা। আমি করেছি কি জানো, আশেপাশের মেয়েদেরকে নিয়ে একটি ছোট ক্লাব করেছি। মেয়েদের হাতের কাজ শেখাই, একটু আধটু গান বাজনা শেখাই, এসব নিয়েই আছি, তুমি কি আসবে একদিন আমার ক্লাবে?”  লাবণ্য গিয়েছিল, এমনি এমনি ঘুরতে ঘুরতে চলে গিয়েছিল। মায়ার অনুরোধে এরপরেও আরও কয়েকবার ক্লাবে গিয়েছিল। মায়ার কাজে একটু আধটু সাহায্যও করার চেষ্টা করতো লাবণ্য। এভাবেই মায়াকে একটু সাহায্য করতে এসে নিজের অজান্তেই লাবণ্য এইসব কাজে খুব বেশী জড়িয়ে পড়েছে মনে হয়। লাবন্যকে সাথে পাওয়াতে ‘আমরাই শক্তি’ অনেক গতি ফিরে পায় কাজে। লাবণ্য গত সাত বছরে সংগঠনটির চেহারাই পালটে ফেলেছে।        

‘আমরাই শক্তি’ অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান। এটা যখন গড়া হয়েছিল, তখন শুধু মেয়েদের হাতের কাজ শেখানো হতো। কিনতু লাবণ্য এসেই অনেক কিছু যোগ করতে লাগলো। লাবণ্য ছোটবেলাতে দেখেছে তাদের পাড়া প্রতিবেশীদের ঘরের মেয়েরা সারাক্ষন পরনিন্দা পরচর্চ্চা করতেই বেশী ভালোবাসত। অথচ তার মা’কে কখনও ওইসব আসরে যেতে দেখেনি। তার মা সব সময় অবসর পেলেই গল্পের বই পড়তেন। সেই থেকে লাবণ্যও বই পড়তে প্রচন্ড ভালোবাসে। তখন থেকেই লাবণ্যও চিন্তা করে দেখলো, শুধু হাতের কাজ না শিখিয়ে মহিলাদের নিয়েতো একটু গঠনমূলক আড্ডা আসরের ব্যবস্থা করা যায়! মহিলাদের বিনোদনের দিকটা অবহেলিত থেকে যায়। লাবন্য বড় হয়েছে খুবই আধুনিক চিন্তাধারার ভেতর দিয়ে, তার উপর বেশ ক’বছর বিদেশে কাটিয়ে এসেছে, তার চিন্তা ভাবনা বরাবরই একটু অন্যরকম। তার বাবার কাছ থেকেই সে শিখেছে যে যতদিন মেয়েদের মুক্তভাবে চিন্তা করার সুযোগ না দেয়া যাবে, ততদিন সংসারে অশান্তি লেগেই থাকবে। তাই মেয়েদের একটু বিশ্রাম, একটু অবসর, অবসরে ভালো কিছু নিয়ে ব্যস্ত রাখা, এইসব চিন্তা থেকেই এই ক্লাবটিকে আরও বড় করা হয়েছে। এরপর আস্তে আস্তে অনেকে নানা সমস্যা নিয়ে আসতে শুরু করেছে। সবাইকে একটু আধটু পরামর্শ দিতে দিতে কখন যে লাবন্য কাউন্সেলারের মর্যাদা পেয়ে গেছে, তা সে নিজেও জানেনা। মায়া বড়লোকের গিন্নী হলেও খুবই সংবেদনশীল, পরোপকারী মানুষ। তাই লাবণ্যর সাথে মায়ার কখনও কোন মতবিরোধ হয়না।

এখানে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার যেটা সেটা হলো ‘সন্ধ্যার আড্ডা’ নামে দুই ঘন্টার এক আসর। এই সময়টুকু গৃহিণীদের জন্য নির্ধারিত করা আছে। এখানে যারাই আসে, তাদের সবাইকেই দৈনিক পত্রিকা পড়ে আসতে হয়, কারন এখানে প্রতি সন্ধ্যায় সাধারন আলোচনা্ হয়, কার কাছে পত্রিকার কোন খবরটা বেশী ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে, কেন এটা ইন্টারেস্টিং মনে হলো, সব কিছু হাসিঠাট্টার মধ্যে দিয়ে আলোচনা হয়। এইসব আলোচনায় পয়েন্ট দেওয়া হয়, মাসের শেষে যে সবচেয়ে বেশী পয়েন্ট পায়, তাকে একটা পুরস্কার দেওয়া হয়, অবশ্যই সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিস। ঘরের পুরুষেরাও খুব খুশী তাদের স্ত্রী আর জননীর এই ধরনের ব্যস্ততায়। লাবন্যের গল্পের ঝুলিতে গল্পের শেষ নেই, রামায়ন, মহাভারত, বিষাদ সিন্ধু থেকে শুরু করে রবীন্দ্র, নজরুল, শঙ্কর, বিভুতিভূষন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী, তসলিমা নাসরিন, হুমায়ুন আহমেদ কে নেই! শরৎচন্দ্র খুব প্রিয় সবার কাছে, সবাই বুঝতে পারে শরৎবাবু মেয়েদের পক্ষে কথা বলে গেছেন, আশাপূর্ণা দেবী আর তসলিমাকেও অনেকে পছন্দ করে, তবে সবার মত হচ্ছে আশাপূর্ণা দেবীর লেখা  তসলিমা নাসরিনের চাইতেও বেশী ভালো। তসলিমার লেখা ভালো লাগে, তবে  ভাষাগুলি একটু খারাপ লাগে শুনতে। সেদিন মুনিয়ার মা বলছিলো, “ তসলিমা নাসরিনের লেখা অনেক শক্তিশালী, ঠিক কথাই কয় পুরুষ জাত সম্পর্কে”। সাথে সাথে মঞ্জু খালা বলে উঠলো, “শক্তিশালীতো বুঝলাম, তবে এত খোলামেলা কথা পড়তে ভাল লাগেনা, শুনতেও ভাল লাগেনা, যতই আমাগো পক্ষে হোক।“। এই ধরনের আলোচনা চলে ‘’সন্ধ্যার আড্ডায়’।

দুই.

লাবন্যরা থাকে কলেজের কাছাকাছি এক বাড়ীতে। বেশীদিন হয়নি বাড়ীটা ওরা কিনেছে। খুব বেশী বড় বাড়ি নয় এটা, তবে নিজের বাড়ী বলে কথা। বিয়ে হয়েছে তাওতো বাইশ বছর হয়ে গেলো। লাবন্যরা চার ভাই এক বোন। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে সে। লাবন্যর বড় তিন ভাই, ছোট এক ভাই। লাবন্যর বাবা খুব সাধারন চাকুরী করতেন, মা ছিলেন একটি গার্লস স্কুলের অংকের শিক্ষিকা। খুবই সাধারন মধ্যবিত্তের সংসার বলতে যা বোঝায়, তার চেয়েও সাধারনভাবে ওরা বড় হয়েছে। লাবন্যদের ছোটবেলাটা কেটেছে শীতলক্ষ্যা নদীর পারে, ফিনলে কোম্পাণীর কোয়ার্টারে। লাবন্যর এখনও মনে আছে, ওদের ঘর থেকে বের হলেই চওড়া কালো পীচঢালা রাস্তা, রাস্তার পরেই শীতলক্ষ্যার শাখা, সেই শাখানদীর এক পাড়ে ছিল লাল সুরকী বিছানো রাস্তা, যা চলে গেছে অনেকদূর পর্যন্ত, শেষ হয়েছে গিয়ে সাহেব বাংলোতে। আরেক পাড়ে চওড়া বড় মাঠ, মাঠের শেষ প্রান্তে ছিল ‘বরফকল’ নামে বরফ তৈরীর কারখানা। লাবন্যদের ঘরগুলো ছিল টিনের চাল ও টিনের বেড়া দেওয়া, কিনতু মেঝে ছিল সিমেন্টের পাকা মেঝে যেমন হয় তেমন।

লাবন্যর মা ছিলেন অনেক সুন্দরী, গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা, কালো গভীর চোখ, কালো কোঁকড়ানো চুল, অনেকটাই লক্ষ্মী দেবীর মত দেখতে, কিনতু লাবন্যর বাবা ছিলেন কালো। লাবন্যের তিন ভাই পেয়েছে মায়ের গায়ের রঙ, আর লাবন্য ও তার আরেকভাই পেয়েছে বাবার গায়ের রঙ। একটা মাত্র মেয়ে, লাবন্যর বাবা কি যে করবে মেয়েকে নিয়ে, তার কোন থৈ কিনারা পেতোনা। এমনিতে লাবন্যর বাবাকে সবাই খুব মেজাজী বলেই জানতো, কিনতু সেই মেজাজী মানুষটাই প্রতি রবিবার ছুটির দিনে মেয়েকে নিয়ে পড়তেন। মেয়ে মাথার চুল পেয়েছে মায়ের দিক থেকে, ঘন কালো কোঁকড়া চুল, কেমন রিং রিং হয়ে থাকতো, খুব ভালো লাগতো দেখতে। লাবন্যর বাবার তেমন পয়সাকড়ি ছিলনা, বিলাসিতাও ছিলনা, কিনতু মেয়ের জন্য সেই পাকিস্তান আমলেই শ্যাম্পু, চুলের ক্রীম নিজে কিনে নিয়ে আসতেন। প্রতি রবিবারের দুপুরে নিজে হাতে ছোট্ট পাঁচ বছরের লাবন্যকে শ্যাম্পু করে স্নান করাতেন। তারপর চুল শুকালে মাথার চুলে ক্রীম মাখতেন আর বলতেন, “ আমার একটা মাত্র মাইয়া, কালো হইছেতো কি হইছে, আমার মাইয়ারে আমি ইন্দিরা গান্ধী বানামু। সাহসী মাইয়া হইব, সরোজিনী নাইডু বানামু, না হইলে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বানামু। কেউ যদি আমার মাইয়ারে কালো কয়, আমার সামনে তারে লইয়া আইবা, মজা বুঝামু, আমার মাইয়ারে কালো না কইয়া কইবা ইন্দিরা গান্ধী”। লাবন্য এখনও মাঝে মাঝে ভাবে, তার বাবা তাকে ইন্দিরা গান্ধী বানাতে চেয়েছিলেন, বাবার সেই চাওয়াটাই কি তার ভেতর একধরনের দৃঢ়তা তৈরী করেছে! নাহলে যে কোন অন্যায় দেখলেই তার মন কেন শক্ত অবস্থান নিয়ে ফেলে সেই অন্যায়ের বিরূদ্ধে!

লাবন্যর বাবা ছিলেন খুবই উদার মনের মানুষ। তার চেয়েও বড় কথা উনি ছিলেন নারী প্রগতির পক্ষে। লাবন্যর মায়ের যখন বিয়ে হয়, ওর মা তখন মাত্র ক্লাস নাইনে পড়ে। লাবন্যর বাবা সেই চুয়ান্ন পঞ্চান্ন বছর আগে কারো কোন কথার তোয়াক্কা না করে লাবন্যর মা’কে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। ম্যাট্রিক পাশ করার পর আশেপাশে মেয়েদের জন্য কোন কলেজ ছিলনা বলে ওর মায়ের আর কলেজ পড়া হয়নি। তাই বলে লাবন্যর বাবা থেমে থাকেননি। ঐ বছরই মেয়েদের জন্য একটি হাই স্কুল চালু হয়, লাবন্যর মা’কে ঐ স্কুলে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। উনার বক্তব্য ছিল, “ মাইয়া মানুষ ঘরে থাকলে খালি কুটকচালি করবে, পরনিন্দা পরচর্চা করবে, এতে সংসার উচ্ছন্নে যায়, যেই ঘরের মা মনের দিক থেকে খুব শক্তিশালী, সেই বাড়ির পোলাপানও হয় সাহসী আর বিদ্বান”। লাবন্যর মা নিজেও ছিলেন খুব পড়ুয়া টাইপ, গল্পের বই পড়তে ভালোবাসতেন। লাবন্য আর তার এক ভাই পেয়েছে মায়ের এই গল্পের বই পড়ার নেশা। লাবন্য দেখেছে, তাদের মা পাড়ার অন্য মায়েদের চেয়ে আলাদা ছিল। পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে মিশতো কিনতু কোন পরনিন্দা পরচর্চাতে থাকতেননা। কি ব্যক্তিত্ব, অংকে যেমন ভালো ছিলেন উনি, সাহিত্যেও তেমন ভালো। কে বলবে যে উনি ম্যাট্রিক পাশ করার পর আর কলেজে পড়ার সুযোগ পান নাই। লাবন্যর বাবার কথাই ঠিক হয়েছে, লাবন্যদের পাঁচ ভাইবোনের সবাই দারুন দারুন রেজাল্ট করেছে সারা শিক্ষা জীবনে। লাবন্যর বাবা শুধু নিজের ছেলে মেয়েকেই না, গ্রাম থেকে উনার জ্ঞাতি বোনদেরকে নিজের কাছে এনে সবাইকে ম্যাট্রিক পাশ করিয়ে দিয়েছিলেন। আর নিজের দিদির ছেলেকেতো সেই ছোট্টবেলা থেকেই নিজের কাছে রেখে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব দরজা ঘুরিয়ে এনেছেন। সেই ভাগ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসাইটে প্রফেসার, লাবন্যর ভাই ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, প্রফেসার আর লাবন্য নিজেতো অধ্যাপনা করছেই।

এখন লাবন্য যেমন করে ‘আমরাই শক্তির’ ‘সান্ধ্য আড্ডায়’ সবাইকে গল্প শুনায়, লাবন্যর মা সব সময় ছেলেমেয়েদের কাছে যত স্বদেশী আন্দোলনের গল্প শোনাতেন। মানুষটার স্বদেশীদের প্রতি মমতায় হৃদয় আর্দ্র হয়ে থাকতো। এমন বাবা মায়ের সংসারে থেকে লাবন্য সেই কোন ছোটকালেই ক্ষুদিরাম, মাষ্টার’দা, বা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের কথা জানতো, আর ইন্দিরা গান্ধীর কথাতো জানতোই যেহেতু বাবার স্বপ্নই ছিল মেয়েকে ইন্দিরা গান্ধী বানাবেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের একটা দিনের কথা প্রায় প্রায় মনে পড়ে। সোনারগাঁওয়ে দুইমাস লাবন্যরা ছিল, এরপরে আর দেশে থাকাটা নিরাপদ ছিলনা বলে সবাই বসে আলোচনা করছিল কিভাবে ইন্ডিয়া যাওয়া যায়। প্রায় প্রায় শোনা যেতো ওখানে পাকিস্তানী মিলিটারী মানুষ মারছে, আবার শোনা যেতো দুই দিন পরেই গ্রামে হানা দিবে, লাবন্যর দাদু, বাবা, মা, ঠাকুমা ,দিদিমা সকলেই ভয়ে অস্থির ছিল। তাদের এমন ভয়ার্ত মুখ দেখে ছয় বছরের লাবন্য একবার বলেই ফেললো, “আমি মুক্তিযুদ্ধ করতে চাই, মিলিটারী আসতে লইলে আমি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মত বুকে বোমা বাইন্দা মিলিটারী ট্রাকের নীচে শুয়ে পড়মু, ট্রাক মিলিটারী লইয়া ধ্বংস হইয়া যাবে। আমাদের এখানে আর আসতে পারবোনা”। লাবন্যর মুখে এই কথা শুনে কেউ অবাক হয়নি, যেনো জানতোই লাবন্য এমন কথাই বলবে।

তিন.

সেই লাবন্যই যখন কলেজে পড়ে, লাবন্যর মা মাঝে মাঝে মেয়ের বিয়ের স্বপ্ন দেখতেন, দুঃশ্চিন্তা করতেন। ভাবতেন, কালো মেয়ে লাবন্য, কেমন বাড়ীতে বিয়ে হবে কে জানে, যৌতুকও দিতে পারবেননা তারা, মেয়েটা ভাল বর পাবেতো! শাশুড়ী ননদে জ্বালাবেনাতো! লাবন্যর খুব খারাপ লেগেছে এমন কথা জানতে পেরে, সে তার মা’কে বলেছে, “আমি বিয়েই করবোনা। যদি বিয়ে করি, আর শাশুড়ী জ্বালাতন করে, তাইলে পরদিনই আমি ঐ বাড়ী ছেড়ে চলে যাব। আমি নিজে চাকরী করে সমাজসেবা করে বেড়াব”। আর লাবন্যর বাবা বলে দিয়েছিলেন, “ মেয়ের বিয়ে নিয়া চিন্তা করবানা, মেয়ে এমএসসি পাশ না করায়ে আমি বিয়া দিতেছিনা। মাইয়াগোর একবার বিয়া হইয়া গেলে পড়াশুনা আর হয়না। আমার মাইয়ারে আমি নিজের কাছে রাইখা এ্মএসসি পাশ করায় দিমু, আমার এমুন শিক্ষিত মাইয়ারে যদি কেউ বিয়া না করতে চায়, আমার মাইয়ার বিয়া করনের দরকার নাই। মাইয়া প্রফেসারী করবো, সেইটাই ভালো, নিজের সম্মান লইয়া থাকবো”। সেই লাবন্যর জীবনে হঠাৎ করেই যেনো এক পরিবর্তন চলে এলো। লাবণ্যর জীবনে এলো অতীন। পুরো ব্যাপারটা একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত মনে হয়েছে লাবন্যর বাবার কাছে। মেয়ে মাত্রই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছে, এখনই যদি বিয়ে করে ফেলে তাহলেতো মেয়ের পড়ালেখা এখানেই সাঙ্গ হয়ে যাবে। একটামাত্র মেয়েকে ছেলেদের সমান যত্ন করে বড় করেছেন উনি। এখন মেয়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে সারা জীবনের জন্য যে পস্তাতে হবে, তা তো মেয়ে বুঝতে পারছেনা।

লাবন্য বাবার আশঙ্কা একেবারেই বুঝতে পারেনি, কথাটা ঠিক না। লাবন্য বাবার মনের অবস্থা ঠিক বুঝেছে। কিনতু বাবাতো অতীনকে চিনেনা, তাই ভয় পাচ্ছে। একদিন লাবন্য তার মায়ের কাছে বললো, “ মা, আমিও ভাবিনি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করবো। বাবাকে বলো, অতীন খুব ভালো ছেলে, আমি তোমাদের মেয়ে, আমি যদি মানুষ চিনতে না পারি, তাহলেতো তোমাদের এতদিনের শিক্ষার কোন মূল্য থাকেনা। বাবাকে আরও বলবা, আমি বিয়ের পরে পড়া চালায়ে যাব, মাস্টার্স ঠিক কম্পলীট করবোই করবো। নাহলে আমার নাম ইন্দিরা গান্ধী থাকবেনা।“ অতীনের সাথে কথা বলে লাবন্যর বাবা অনেকটাই আশ্বস্ত হলেন, আরও বেশী খুশী হলেন যখন শুনলেন অতীন যৌতুক নিবেনা, শুধু লাবন্যকেই পেতে চায়, অতীন এও বলেছে, লাবন্য বিয়ের পরে পড়তে চাইলে অতীন সহযোগীতা করবে তবে জোর করবেনা। কারো উপর জোর করা অতীনের স্বভাবে নেই। শুভ লগ্নে লাবন্যর সাথে অতীনের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পরে লাবন্য ঠিকই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী কম্পলীট করেছে, আরও অনেক পরে বিএড করেছে, বরের সাথে কয়েক বছর বিদেশে কাটিয়ে এসেই এই কলেজে জয়েন করেছে। তার নিজের তিনটি ছেলেমেয়ে হয়েছে।  নিজের বাবা মায়ের মতো করেই লাবন্য নিজের ছেলেমেয়েদেরকে মানুষ করার চেষ্টা করছে। খুব লক্ষ্মী ছেলেমেয়ে হয়েছে ওরা। লাবন্যরাতো অনেক সাধারন জীবনযাপন করে বড় হয়েছে, কোন বিলাস ছিলনা, শুধুই স্বপ্ন ছিল মনে, লাবন্য নিজের সন্তানদেরকেও তেমন বিলাসিতা করতে দেয়না, কিনতু স্বপ্ন দেখায়, নিজের জীবনের গল্প শোনায়। আর কেমন করে যেনো লাবন্যর তিনটি ছেলেমেয়েই মায়ের মত বই পড়ার নেশা পেয়েছে। ফলে তারাও অনেক কিছুই জানে, বুঝে।  বড় ছেলেটা ফুল স্কলারশীপ পেয়ে ডাক্তারীতে চান্স পেয়েছে, মেয়েটা গতবার ম্যাট্রিকে গোল্ডেন ফাইভ পেয়েছে, ছোট মেয়েটি সবার চেয়ে বেশী বুদ্ধিমতী হয়েছে, এখনই তা বুঝা যায়। লাবন্য ও অতীনকে ছেলেমেয়েদের নিয়ে অহেতুক ভাবনা ভাবতে হয়না।

এতক্ষনে রোদ মরে এসেছে, একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। লাবন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আবার ঝুমুরের কথা মনে পড়ে গেলো। গত সাত বছরে কত পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন ‘আমরা শক্তির’ সদস্যদের মধ্যে।  ক্লাবে আসা যাওয়ার পর থেকে শীলার শাশুড়ীওতো এখন কত নরম হয়ে গেছেন, শীলার সাথে কত ভালো ব্যবহার করেন। লাবন্য এখনও বিশ্বাস করে,  মেয়েদের ঘরে আটকে রাখতে নেই, মেয়েদেরকে একটু আলোর মুখ দেখাতে হয়, মেয়েরা হলো সংসারের চাবিকাঠি। সন্তান জন্মেই মায়ের কাছাকাছি থাকে বেশ অনেকটা সময়। তাই মায়ের কাছ থেকেই সন্তান পায় তার জীবনের প্রথম শিক্ষা। একজন মুক্তমনা স্বাধীন মায়ের সন্তানেরাও হয় বিদ্বান, সাহসী, তেজস্বী। ঝুমুরের স্বামীটাকে এনে বুঝাতে হবে, ঝুমুর মেয়েটা খুব বুদ্ধিমতী, এমন স্ত্রী সংসারে থাকাটাই বিরাট সৌভাগ্যের লক্ষ্মণ, কাজেই কানকথা শুনে লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলতে নেই। কে জানে, কতটুকুই বা বুঝতে চাইবে লাবণ্যদের কথা! তবুও চেষ্টা করে দেখা। নাহলে ঝুমুরের পাশে দাঁড়াতেই হবে, এমন একটি প্রতিভা নষ্ট হতে দেয়া ঠিক হবেনা। এইসব পাঁচ রকমের কথা ভাবতে ভাবতেই লাবন্য ঘরের ভেতর ঢুকে গে্ল, এরপর প্রতিদিনের মত একইভাবে একটা একটা করে প্রতিটি রুমে আলো জ্বেলে দিতে লাগলো।

Monday, April 23, 2012

বীণার তারে বাজে মুক্তির গান


অনেকেই পাখী হয়ে জন্মাতে চায়, মুক্তডানা মেলে আকাশে উড়বে বলে।
কেউ চায় নদী হয়ে জন্মাতে, আপনমনে সাগরের পানে ছুটবে বলে।
কেউবা চায় পাহাড়ের মত হতে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বলে।
আমার কেনো এমন ইচ্ছে জাগেনা!

ঘুরে ফিরে ভাবনায় আসে শুধু, 'আমি পাখী হতে চাইনা'
পাখীতো শুধু উড়তেই জানে, মুক্তির মানে জানেনা।
কলকাকলীতে অপরের ঘুম ভাঙ্গায় অথচ নিজে স্বপন দেখেনা।
আমার ডানা নেই তবুও মনে হয় নাইবা থাকলো আমার ডানা,
আছেতো ইচ্ছেডানা, আমি ইচ্ছেডানায় ভর করে 
উড়ে যেতে পারি হেথা হতে হোথা, নেইতো কোন মানা।
উড়ে যেতে পারি দেশ থেকে দেশান্তরে, বন-বনান্তরে,
নদী না হয়েও বয়ে যেতে পারি সাগরের পানে,
সাত-সমুদ্দুর পার হয়েও চলে যাই ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমীর দেশে!
পাহাড়তো শুধু বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েই থাকে, পারে কি ঠেকাতে আমাকে
যখন আমি পাহাড়কে ডিংগিয়ে চলে যাই অচিনপুরের দিকে!
তবুও কেনো কেউ পাখী হতে চায়, কেনোই বা চায় প্রজাপতি হতে!
শুধু আমারই কেনো এমন ইচ্ছে জাগেনা!

আচ্ছা! সত্যি সত্যিই যদি পাখী হতাম, কখনও কি
পারতাম অন্যায়ের বিরূদ্ধে জ্বলে উঠতে!
পারতাম কি মেশিনগান, কামানের গোলার বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়াতে!
কি লাভ হতো স্থবির পাহাড়ের মতো শুধুই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থেকে!
পাহাড় কি পেরেছে কখনও তর্জনী উঁচিয়ে স্বাধীনতার ডাক দিতে!
পেরেছে কি তর্জনী উঁচিয়ে অন্যায়-জুলুম-অত্যাচারের বিরূদ্ধে হুঁশিয়ারী জানাতে!
নদীতো কেবল বয়েই চলেনা, যখন প্রমত্তা হয়, হুঁশ জ্ঞান কিছুই থাকেনা।
স্রোতের টানে ভাসিয়ে নিয়ে চলে গরীবের খড়ের চালা,
ধানী জমিটুকু শুধু টেনে নিতেই জানে, কৃষকের সুখ-দুঃখের হিসেবতো রাখেনা।

পাখী্তো হইনি, নদী বা পাহাড়ও হইনি, জন্মেছি মানুষ হয়ে
মান ও হুঁশ দুইই আছে চেতনায় ও হৃদয়ে,
আরো আছে রক্ত কণিকার প্রবাহে।
মান অপমান বোধ আছে বলেই হতে পেরেছি একজন ক্ষুদিরাম অথবা নেতাজী সুভাষ
মান হুঁশ আছে বলেই না পেয়েছি বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল থেকে শুরু করে
জাহানারা ইমাম বা হালের তসলিমার চেতনায় মুক্তির আভাস!
তবুও অনেকেই চায় পাখী্র মত শুধুই ডানা মেলে উড়তে, চায় নদীর মত
কলকল রবে বয়ে যেতে, অথবা চায় বিশাল পাহাড়ের ধ্যানমগ্নতা
মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর নামে আসলে স্থবি্রতা।
আমার কেনো এমন ইচ্ছে জাগেনা!

আমি সুখী, আমি ধন্য! পেয়েছি মানব জন্ম।
মানুষ হয়ে জন্মেছি বলেই স্বপ্ন দেখতে শিখেছি
মানুষ হয়ে জন্মেছি বলেই বিবেকানন্দ হতে পেরেছি,
হতে পেরেছি মহাত্মা গান্ধী, হতে পেরেছি ম্যান্ডেলা
হতে পেরেছি মার্টিন লুথার কিং অথবা মাদার তেরেসার চেলা।
শেখ মুজিব হয়ে জন্মেছি বলেই দিয়েছিলাম মুক্তির ডাক,
ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয় সূর্য্য, বিশ্ব হয়েছে হতবাক!
পাখী বা নদী কোনটিই হইনি, হইনি স্থবির পাহাড়, হয়েছি মানুষ 
তাই অন্যায়ের বিরূদ্ধে একহাতে গর্জায় মেশিনগান,
আরেকহাতে ধরা বীণার তারে বাজে মুক্তির গান!

ঋষিকন্যা


তখন থেকেই আমি তাকিয়ে আছি ঋষিজার দিকে,
   কেমন ধীর-স্থির চলন-বলন তার।

অতি মৃদুস্বরে যখন সে বাবা বলে ডাকে,
আমার হৃদয়ের গহীনে টের পাই শীতলতার আমেজ!

ভাবি আমি, ঋষিজা নামের মানে যদি হয় ‘ঋষিকন্যা’,
    আমিই তাহলে সেই ঋষি!

আগেতো কোনদিন ভাবিনি এমন করে নামের কি মহিমা,
যিনি ঋষিজা নামটি রেখেছিলেন,
     বাংলা ভাষার প্রতি
তাহার মমতাকেই ধরে নিয়েছিলাম এমন
    নামকরনের কারন হিসেবে।

আমার চেতনায় ছিলোনা নামের কি গুরুত্ব, নাম তো নাম,
মনে পড়ে, কতশিশুর নাম রাখা হয়েছিল ‘মিলেনিয়াম’
যারা ভুমিষ্ঠ হয়েছিল একুশ শতকের প্রথম দিবসে
অথবা প্রথম মাসের যে কোন এক ক্ষনে!

    আহ! একুশ শতকের কথা ভাবতেই
‘একুশ’ কেমন ঝংকার তুললো হৃদয় বীণার তারে!

বাংলা ভাষার জন্য প্রান উৎসর্গ করেছিলেন
রফিক, শফিক, বরকত, জব্বার, সালাম নামের তরুনের দল
    সেও তো আজ থেকে ষাট বছর আগে!
ষাট বছর পরেও দেখি প্রায় প্রতি রাতের ঘুম
    বিসর্জন দিয়ে চলেছে এক নারী,
তাঁর কিশোরী বালিকাটিকে বাংলা শেখানোর অদম্য উৎসাহে!
দোষ আমার! উচ্চশিক্ষার মানসে চলে এসেছিলাম
    স্বদেশ ছেড়ে মার্কিন মুলুকে।
আমার উপর নির্ভর করেই ওরাও এসেছিল,
     মা ও তিন মেয়ে।

কাজের চাপে দিশেহারা আমি, খেয়াল করার অবসর নেই
মায়েরা আমার মাতৃভাষা ভুলেই গিয়েছে কিনা!
আসলে খেয়াল করার প্রয়োজনই বোধ করিনি
সারাক্ষন তো ‘বাবা’ ডাক শুনি, ‘মা’ ডাক শুনি
কই ‘ড্যাডি’ বা ‘মাম্মি’ তো এখনও শুনিনা
তাহলে আমিই বা কেন অযথা উতলা হতে যাব
    মেয়েরা বাংলা ভুলে গেছে ভেবে!

আমি প্রতিদিন খাবারের থালাতে দেখি গরম ধোঁয়া উঠা ভাত
    সাথে ডাল, মাছ আর একটা সব্জী।
আমার পাশে বসেই ‘ঋষিজা’ হাত দিয়েই ভাত মেখে
    কেমন সুন্দর করে খেয়ে যায়!
রুই, ইলিশ, পাবদা, কই ভালো চেনে, আরও
    জানে পিঠা পায়েসের কথা।
মাকে ডেকে বলে, ‘মা, পাটিসাপটা পিঠা বানাও,
    ক্ষীর দেবে বেশী করে’
তার মায়ের দেখি মুখ উপচে পড়ে খুশীর ঝলক!
    তা পড়ারই কথা।

‘ঋষিজা’কে নিয়ে এসেছিলাম যখন সে মাত্র দুই বছরের শিশু,
    ভাল করে কথাই ফুটেনি মুখে।
মনে পড়ে, এসে উঠেছিলাম বাঙ্গালী বিবর্জিত এক শহরে।
    ঋষিজা পড়ে গিয়েছিল মহাবিপদে
কি হবে তার মুখের ভাষা, ইংরেজী নাকি বাংলা!

ছয় নম্বর বিপদ সঙ্কেত টের পেয়েছিলাম যখন
ঋষিজা ‘বাংলিশ’ এ কথা বলা শুরু করেছিল।
আমার মুখে অসহায়তা দেখে মেয়ের মা বলেছিল,
    “মেয়ের নাম ঋষিজা, নামের প্রভাবেই
    ঋষিকন্যা সকল বাধা কাটিয়ে উঠবে”।

তা বাধা সকলই কেটে গেছে, ঘুচে গেছে সকল সংশয়
ঋষিজা এখন আর ‘বাংলিশ’ এ কথা বলেনা
    নিরেট ইংলিশেও কথা বলেনা।
যখন যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনি করেই
    ও কথার আদান-প্রদান করে।

তার মুখের ঝরঝরে বাংলা উচ্চারণ শুনলে দেশের
   ‘বাংলিশ’ ছেলেমেয়ের বাবা মায়েরাও
   থমকাবে, নিজের ছেলেমেয়েদের প্রতি,
নিজের ভাষার প্রতি তাদের চরম অবহেলার জন্য।

তারা এখানেও থমকায়, যখন ঋষিজা ‘একুশের অনুষ্ঠানে’
   শুদ্ধ বাংলায় কবিতা আবৃত্তি করে যায়।
গত তিন বছর আগেই মাত্র নয় বছর বয়সে
   ঋষিজা আবৃত্তি করেছিল, ‘কাজলা দিদি’
হলভর্তি মানুষের চোখ আবেগে ছলছল করে উঠেছিল।
তারা ঋষিজাকে বুকে চেপে ধরে আহ্লাদে আহ্লাদে ভরিয়ে দিয়েছিল।

গেলো বছর ‘একুশের’ অনুষ্ঠানেই ঋষিজা আবৃত্তি করলো ‘নিমন্ত্রণ’।
সবাই এখন ধরেই নিয়েছে, এ বছরের ‘একুশে’তে
ঋষিজা আরও বড় কোন কবিতা আবৃত্তি করবে।
   হয়তো সত্যিই ঋষিজা এবছর
   আরও বড় কোন চমক দেখাবে।
সবকিছু নির্ভর করে ঋষিজার বাংলাপ্রেমী মায়ের উপর।

এই নারীকে দেখলেই বাংলাকে দেখা হয়ে যায়,
   তার সাথে কথা বললেই বাংলাকে
   ভালো না বেসে উপায় থাকেনা।
‘একুশে পদক’ পায় শুধুমাত্র মুখচেনা কীর্তিমানেরা
যখন ঋষিজার মায়েরা থেকে যায় পর্দার অন্তরালে!

সে কোন পদকের অপেক্ষায় থাকেনা, যেমন
থাকেনি ষাট বছর আগের সেই দামাল তরুনেরা।
এঁরা জন্মেছেই সবার হয়ে মাতৃভূমির প্রতি
     ঋণশোধের দায় নিয়ে।


Sunday, April 22, 2012

মেজদার জীবনের হাফ সেঞ্চুরী!!!!


সাধারন মধ্যবিত্তের সংসারে আমার বাবা মায়ের সন্তান সন্ততির সংখ্যা ছিল চারজন। তিন ছেলে ও এক মেয়ে। চারজনের মধ্যে আমার অবস্থান তিন নাম্বারে। আমার বাবা মা দুজনেই ছিলেন চাকুরীজীবি। বাবা চাকুরী করতেন অফিসে, মা ছিলেন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিকা। শৈশবে আমাদের দেখভাল করতেন আমাদের ঠাকুরমা (বাবার মা)।দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত আমাদের ঠাকুমা আমাদের সাথে ছিলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ভারত থেকে আমার বাবা মা যখন দেশে ফিরে আসেন আমাদেরকে নিয়ে, আমার ঠাকুরমা আমাদের সাথে আর আসেননি, ওখানেই থেকে গেছিলেন আমার কাকাদের কাছে। এই হচ্ছে আমাদের সংসারের একটি মোটামুটি চিত্র।

আমার তিন ভাইয়ের মাঝে আমার বড় ভাই বরাবরই একটু সমীহ পেত ছোট বড় সকলের কাছ থেকে। পরিবারের প্রথম সন্তান হিসেবেতো বটেই, অত্যন্ত সুবোধ ও মেধাবী ছেলে হিসেবে পরিবারের গন্ডী ছাড়িয়ে পাড়া মহল্লাতেও তার আলাদা একটি অবস্থান ছিল। আমি বরাবরই একটু ‘অহংকারী’ ছিলাম একটি মাত্র মেয়ে বলে। অহংকারী হওয়ার প্রশ্রয় পেতাম বাবার কাছ থেকে। আমার অসম্ভব রাগী বাবার আমার প্রতি দূর্বলতা ছিল সকল তর্ক বিতর্কের ঊর্ধ্বে। আমার ছোটভাই খুব বেশী সুন্দর ছিল দেখতে, বরাবর শান্ত স্বভাবের ভাইটিকে সকলেই আদর করতো। বাকী থাকলো আমার মেজভাই, আমার ‘মেজদা’।

জন্মের পরে শিশুর নামকরন করার সময় বেশীর ভাগ মানুষ শিশুটির উপর নামের প্রভাবের কথা বিবেচনায় রাখেনা, ইচ্ছেমত একটি নাম রেখে দেয়। ব্যাপারটি আমাদের ভাইবোনদের নামকরনের বেলাতেও মনে হয় ঘটেছিল। আর তাই ্না বুঝেই আমার মেজদার নাম রাখা হয়েছিল ‘চঞ্চল’। বড়দাকে ডাকা হতো ‘মানিক’ নামে। ব্যস! ওটুকুই যথেষ্ট। নামের প্রভাব বেশ ভালোভাবেই পড়েছিল আমার মেজ ভাইটির উপর। চঞ্চল নামের ছেলেটি শৈশবেই তার নামের প্রতি সুবিচার করা শুরু করেছিল।

আমার মেজদাটি ছিল ভীষন চঞ্চল। মেজদাকে তার চঞ্চলতার কারনেই আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সকলেই প্রচন্ড রকমের ভালোবাসত। সেই তিন চার বছর বয়স থেকেই চঞ্চল মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসত। এক জায়গাতে বসেই সে  ৯/১০ টা রসগোল্লা খেয়ে ফেলতে পারতো। আমাদের ছেলেবেলাতে খেতে পারাটা ছিল একটি বিশেষ গুন। কোথাও নেমন্তন্ন খেতে গেলে দেখা যেত, আসরে যে ব্যক্তিটি যত বড় ভোজন রসিক, তার সমাদর ছিল তত বেশী। খাওয়ার আসরে তাকে ঘিরে থাকত লোকজন, শুধুমাত্র তার ‘দৃষ্টিনন্দন খাওয়া’ উপভোগ করার জন্য। আমার মেজদাটি সেই ছোটবেলাতেই তেমন একটি গুন অর্জন করেছিল বলেই বাইরে ঘরে তার আদর ছিল। আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে সে দেখতেও ছিল ভারী মিষ্টি।

আমাদের চার ভাইবোনের  মধ্যে আমি আর আমার মেজদা পেয়েছি বাবার গায়ের রঙ, কালো বা শ্যামলা, বাকী দুই ভাই পেয়েছে আমার মায়ের গায়ের রঙ, গৌর বর্ণ। ফলে তখন থেকেই ভাইবোনের মধ্যে একটি শ্রেণীভেদ তৈরী হয়ে যায়। আমি আর আমার মেজদা নিজেদের মধ্যে একধরনের একাত্মতা টের পাই। সেই ছোট্ট বয়সেই আমার মেজদাটি  আমাকে অনেক বেশী ভালোবাসত। তার কাঁধে চড়িয়ে ‘দই নিবেন দই’ বলে সারা বাড়ী ঘুরত। আমি তার মাথার ঘন কোঁকড়া চুল জাপ্টে ধরে থাকতাম, ব্যথায় নিশ্চয়ই তার দম বেরিয়ে যেতে চাইতো, তার পরেও আমাকে কাঁধ থেকে নামাতোনা, শুধু বলতো ‘এত জোরে চুল টানিসনা, ব্যথা পাই’। তবে আমাকে যেমন কাঁধে চড়িয়ে ঘুড়াতো, তেমনি আবার খেতে বসলে আমার থালাতে যদি কোন একটা খাবার ভাগে বেশী পড়ে যেতো, বিনা বাক্যব্যয়ে সে সেটা তুলে নিত। এটাই ছিল আমাদের অলিখিত নিয়ম।

আমার মেজদাটিকে স্কুলেও টিচাররা অনেক আদর করতো। সারাদিন ‘বান্দরামী’ করা একটা ছেলে পরীক্ষার খাতায় কিভাবে এমন গড়গড় করে ইতিহাস, ভূগোলের মত খটমট জিনিস পাতার পর পাতা লিখে যেত, সেটাই ছিল আশ্চর্য্যের ব্যাপার। সারাদিন সে স্কুলে ‘বান্দরামী’ করতো, এই দেয়াল টপকাচ্ছে, এই গাছে ঝুলছে, স্কুল বিল্ডিং এর রেলিং বাইছে, মোটের উপর টিচারদের ভাষায় যা ছিল ‘পোলা বড় বান্দর’। আমার মা নিজেও শিক্ষিকা ছিলেন বলেই অন্য স্কুলের শিক্ষকরা মায়ের এই চঞ্চল ছেলেটির নামে নালিশ করা অবশ্য কর্তব্য মনে করতেন। আমার অতি নীতিবান মা, ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথে আর দেরী করতেননা, বাসায় ফিরেই উচ্চ আদালতে তা পেশ করে দিতেন। আমার ‘বীর, পরাক্রমশালী’ বাবা এতটুকু সময় অপচয় করতেন না বিচারের দন্ড হাতে নিয়ে। দড়াম দড়াম করে শুরু করতেন পিট্টি। আহারে! আমার বাবা মা যদি আমেরিকাতে থাকতেন, কতবার যে তাঁদের জেলের ভাত খেতে হতো, সেটাই এখন ভাবি। আমার বাবা আমার মেজদাকে পিটাতেন, আমার মেজদা এতটুকু চিৎকার করতোনা, পিটানিগুলি সহ্য করতো, আর আমি পাশের ঘরে থেকে টের পেতাম কি ব্যথাই পাচ্ছে আমার প্রিয় ভাইটা। আমি ছোটভাইকে সাথে নিয়ে হাউমাউ করে চীৎকার শুরু করে দিতাম। আমার এখনও চোখ ফেটে জল আসছে, সেই সময়ের কথা মনে পড়ে। আমি কাঁদতাম আর বলতাম, ‘ও বাবা আর মাইরোনা, ও বাবা আর মাইরোনা’। আমার বাবার হাত অবশ হয়ে আসতো, মাইর বন্ধ হয়ে যেত। একঘন্টা পরেই বাবা যখন আমাদের সবাইকে নিয়ে খেতে বসতো, নিজের থালা থেকে মাছের টুকরাটা তুলে তাঁর ছেলের পাতে দিয়ে দিতেন। এটাই ছিল পরিচিত দৃশ্য। আমার মেজদার মনে হয় কোন মান অভিমান ছিলনা। বাবার কাছ থেকে মাছ পেয়ে মনে হয় পিটানি খাওয়ার কথা ভুলে যেত।

আমার মেজদার স্মৃতিশক্তি ও মুখস্থবিদ্যা ছিল ঈর্ষনীয় পর্যায়ের। একমাত্র অঙ্কে ছিল তার দারুন ভয়। অঙ্ক ভালো বুঝতোনা অথবা বুঝার চেষ্টা করতোনা। নাহলে আমাদের বাকী তিন ভাইবোনের সকলেই ছিলাম অঙ্কে দারুন ভাল, একমাত্র মেজদা ছাড়া। আমরা চার ভাইবোনই ছিলাম স্কুলের ফার্স্ট বয়/গার্ল। স্কুল থেকেই আমাদের উপর অনেক আশা ভরসা করা হতো। অংকে তেমন একটা ভালো ছিলনা (?) বলেই আমার মেজদা স্বাভাবিকভাবেই মানবিক বিভাগে পড়তো। আমাদের কোন প্রাইভেট টিউটর ছিলনা। ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে যখন প্রিটেস্ট পরীক্ষা হলো, মেজদা প্রিটেস্টে অঙ্কে পেয়েছিল ২৯। টিচার গ্রেস দিয়ে ওটাকে ৩৩ করে দিয়েছিল। আমাদের পরিবারে ফার্স্ট বয় অঙ্কে ফেল করেছে, এমন সংবাদ পরিবারের প্রধানের ভেতর কেমন ঘূর্ণী সৃষ্টি করতে পারে, তা মোটামুটি আশেপাশের সকলেই জানতো। অনেকেই মজা দেখার অপেক্ষায় থাকতো, কিভাবে চঞ্চল নামের চঞ্চল কিশোরটিকে তার বাবা বেধড়ক পিটায়, এটা দেখার জন্যও মনে হয়, প্রতিবেশীদের অনেকে ‘আহারে, মাস্টার দিদির পোলা অঙ্কে ফেল করছে’ বলে বাবাকে উসকে দিয়েছিল। বাবা যথারীতি পিটিয়ে ক্ষান্ত হলে পরে আমার বড়দা ম্যাট্রিকের আগের তিনমাস ছোট ভাইটিকে অংক শিখিয়েছিল। পরীক্ষা দিয়ে এলে পরে উৎকন্ঠিত সকলেই জিজ্ঞেস করেছিল, পরীক্ষা কেমন হয়েছে। মেজদা বলেছিল, ৬৫র উত্তর দিয়েছি। শুনে সকলের মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। ইংরেজী পরীক্ষা্র আগের দিন বাবা জানতে চেয়েছিলেন ‘প্যাট্রিয়টিজম’ Essay শিখেছে কিনা। মেজদা বলেছে, শিখে নাই। পরীক্ষার আগের দিন তাকে যথারীতি পিট্টি খেয়ে Essay নিয়ে বসতে হয়েছিল। মাত্র দুই ঘন্টা সময়ে চঞ্চল তিন চার পৃষ্ঠার রচনাটি গড়গড় করে মুখস্থ বলতে পেরেছিল। পরেরদিন পরীক্ষায় প্যাট্রিয়টিজম এসেটি এসেছিল। (অন্য এসেও কমন পড়েছিল, কিনতু আমার বাবা চাইতেন আমরা যেনো ্কঠিন টপিকের উপর লিখি)। ম্যাট্রিকের রেজাল্ট যখন বের হলো, দেখা গেল, ১৯৭৬ সালের ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফলাফলে আমার মেজদা মানবিক বিভাগ থেকে ফার্স্ট ডিভিশান পেয়ে পাশ করেছে। বিস্তারিত জানা গেলো দুই এক ঘন্টা পরেই। মানবিক বিভাগে সারা ঢাকা বিভাগে মাত্র ৫৫জন এবং নারায়নগঞ্জ সাবডিভিশানে মাত্র একজন ফার্স্ট ডিভিশান পেয়েছিল। সেই একজনটি হচ্ছে ১৪ বছর বয়সী দুরন্ত, চঞ্চল কিশোর ‘অশোক কুমার দাস’। আমার বাবা মায়ের মুখে দেখা গেল বিজয়ীর হাসি। মার্কশীট এলে দেখা গেল, সে অংকে পেয়েছে ৬৪। তার ধারনা ছিল ৬৫ তে ৬৫ পাবে, হয়ত জ্যামিতিতে কোথাও ১ নম্বর কাটা গেছে। আর আমরা সকলেই অবাক হলাম, অংকও কিভাবে মুখস্থ করা যায়, তা দেখে।

কলেজে গিয়ে উচ্চমাধ্যমিক ক্লাসে ভর্তি হতেই মনে হয় সেই কৈশোরের চঞ্চলতা কমে যেতে শুরু করলো। উচ্চমাধ্যমিকে মানবিক বিভাগে কেউই ফার্স্ট ডিভিশান পায়নি, আমার মেজদাও ফার্স্ট ডিভিশান পায়নি তবে  যুক্তিবিদ্যাতে লেটার মার্ক পেয়েছে। মেজদার পাশে থেকে তখনই শিখেছিলাম, গরু ঘাস খায়, মানুষ গরু খায় তাই মানুষ ঘাস খায়। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে আমার মেজদাকে আর পিটানি খেতে হয়নি। তারপরতো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবার ইচ্ছেতেই ইংলিশ অনার্স পড়তে শুরু করলো। বাড়ী থেকে এত দূরে গিয়ে ঘরের সবচেয়ে চঞ্চল ভোজন বিলাসী ছেলেটা কিভাবে থাকতো, তা নিয়ে আমাদের সকলের মনেই একটু চাপা কষ্ট ছিল। ১৯৮১ সালে বাসে করে মানিকগঞ্জ যাওয়ার পথে জাহাঙ্গীরনগর বিশেবিদ্যালয়কে পাশে রেখে বাস ছুটছিল, আমার দুই চোখ ছাপিয়ে জল চলে এসেছিল, শুধু ভেবে যে আহারে আমার মেজদাটা এত দূরে পড়ে আছে! কেউ নেই তাকে একটু আদর করার, হোস্টেলের খাওয়া দাওয়া তার ভালো লাগার কথা নয়। আমার বাবা একেবারে মাপা পয়সার বাইরে একটা টাকাও দিতে পারতোনা। কিভাবে আমার মেজদা এখানে আছে কে জানে! এমনটা ভেবেই কাঁদছিলাম।

আমরা জানতে পারিনি আমার মেজদা ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছিল। এরপরে আমিও যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গেলাম, ভর্তি পরীক্ষায় আমি খুবই ভালো রেজাল্ট করেছিলাম, আমার মেজদা রেজাল্টের কাগজটি হাতে নিয়ে আমাকে পাশে রেখেই হাঁটছিল, হঠাৎ করেই আমার মেজদা কাঁদতে শুরু করলো। আমি থতমত খেয়ে যেতেই সে বলতে পারলো, “ তোরা সবাই বাবার লক্ষ্মী ছেলেমেয়ে, আমি ছাড়া। তোরা সবাই কত ভাল রেজাল্ট করলি, আর আমি অনার্সে মনে হয় থার্ড ক্লাস পাব। আমি সারা জীবন বাবারে জ্বালিয়ে গেলাম। তোদের মত সায়েন্স পড়তে পারলামনা, আর্টস পড়লাম, এইবার যদি থার্ড ক্লাস পাই, কি যে হবে”। আমার যে মেজদা বাবার পিটানি খেয়েও কাঁদে নাই কোনদিন, সেই মেজদাকে কাঁদতে দেখে আমার যে কি কষ্ট হচ্ছিল, কিনতু আমি নিজেকে সামলে নিয়ে তখন থেকেই শুরু করলাম মেজদাকে অভয় দেয়া। আমি বাবাকে কিছুই বলিনি, আমার মেজদা রাজনীতি করতে গিয়ে পড়ালেখাতে ফাঁকী দিয়েছিল, ফলে ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ারের রেজাল্ট বেশ খারাপ হয়েছিল, থার্ড ইয়ারে তাকে এত বেশী মেকাপ করতে হতো যে এমন অবস্থায় আমি হলে ফেল করতাম। আমি মেজদাকে সাহস দিতাম, জানিনা আমার অসম্ভব মেধাবী, তুখোড় স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন মেজদার সেই দিনগুলোর কথা মনে আছে কিনা। আমার নিজের মাসের খরচ থেকে পয়সা বাঁচিয়ে মেজদাকে দিতাম, সে একটু খেতে ভালোবাসত বলে বাবার পাঠানো টাকায় তার চলতে চাইতোনা। আমি টাকা দিতাম বলে সে প্রান্তিকে গিয়ে কয়েকটা মাস বেশ ভালোই চলেছে মনে হয়।

১৯৮৩ সালে তুমুল ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ১৪ই ফেব্রুয়ারী আমাকে না বলেই আমার মেজদা ঢাকা চলে গেছিল। ব্যস! আটকা পড়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন এক হোস্টেলে। তখন ফোন ছিলনা, হোস্টেলের একটিমাত্র ফোন থেকে কল দিতে গেলে বিরাট লাইনে দাঁড়াতে হতো। নওয়াব ফয়জুন্নেছা হল থেকে মীর মোশাররফ হোসেন হলে ফোন করার ব্যর্থ চেষ্টা করে সারারাত জেগে ছিলাম, মেজদার কোন খোঁজ না পেয়ে। পরের দিন কোন একফাঁকে সে ঢাকা থেকে ফিরে এসেছিল, বলেছিল আগের রাতে ঘটে যাওয়া অসম্ভব ঘটনার কিছু অংশ। প্রেসিডেন্ট এরশাদের সেনাবাহিনী হলগুলোতে ঢুকে সব কক্ষ তল্লাশী করে ছাত্রদের ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। মেজদা যে রুমে আশ্রয় নিয়েছিল, সেই রুমে আরেকজন ভর্তিচ্ছু ছাত্র ছিল, সে এসেছিল মঠবাড়িয়া থেকে, তার কাছ থেকে মঠবাড়িয়ার কলেজের নামঠিকানা শুনে মেজদা মনে রেখেছিল, মিলিটারী এসে ঢুকে তল্লাশী চালাতেই সে অকপটে মঠবাড়িয়া থেকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছে বলে পার পেয়ে গেছে। পরের দিন সে ফিরে এসেছে। এদিকে আমি প্রায়ই তাকে মনে করিয়ে দিতাম তার ফাইনাল পরীক্ষার কথা, সাহস দিতাম, ভরসা দিতাম। শেষ পর্যন্ত আমার মেজদা সকল প্রতিকূলতার ভেতর দিয়েই ইংলিশ অনার্স পরীক্ষায় ভালোভাবেই আকাংক্ষিত সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছিল। হলে কি হবে, ‘চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী’ র মতই হয়েছে আমার ভাইটির অবস্থা। এরপরেও সে আবার আন্দোলনে যোগ দিত, শেষ পর্যন্ত আরেকবার ১৯৮৪ সালে এরশাদ ভ্যাকেশানের সময় আমার ভাইটির সাথে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়ে হোস্টেল ছেড়ে আমি বাড়ী চলে গেলাম, আর নারায়নগঞ্জ থেকে আমার বড়দা এলো ছোট ভাইটিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। বড়দা এসে দেখতে পেয়েছিল, মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনের মাঠে ঠা ঠা রোদে অনেক ছাত্রের সাথে রোদে ভাজা ভাজা হচ্ছিল তার ভাইটিও, মিলিটারীরা সবাইকে গার্ড দিয়ে রেখেছিল। সেইবার বড়দা আমার মেজদাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল, ঐ শেষ, এরপরে আর কখনও মেজদা ঐ পথে পা বাড়ায়নি।

আমার মেজদা অধ্যাপনা করতে চেয়েছিল, কিনতু আমার বাবার ইচ্ছেতে তাকে ব্যাঙ্কিং পরীক্ষায় বসতে হয়, এবং মাস্টার্স পাশ করার আগেই সে চাকুরী পেয়ে যায়। মাস্টার্স পাশ করেই সে যোগ দেয় চাকুরীতে। এত কম বয়সে এমএ পাশ করতে আর কাউকে দেখিনি ঐ সময়ে। যাই হোক, মেজদাকে অধ্যাপনা করতে দিতে রাজী না হওয়ার অন্যতম কারন ছিল, ছেলেকে আর চোখের সামনে থেকে ছাড়তে চায়নি আমার বাবা। আমরা অনেক পরে বুঝতে পেরেছি, আমার বাবা বাইরে দিয়ে বাঘ হলেও ভেতরে একজন স্নেহান্ধ বাবা ছাড়া আর কিছুইনা। উনার স্নেহের বলি হয়েছে আমাদের ভাইদের ক্যারিয়ার। কাউকেই কাছছাড়া করতে চাননি বলেই শেষ পর্যন্ত তাদের আর চাকুরী বদল করা হয়নি।

আমার মেজদা এখনও সোনালী ব্যাঙ্কে বহাল তবিয়তেই আছে। এক ছেলের বাবা সে। ছেলেটি অবশ্য বাবার চঞ্চলতার কিছুই পায়নি। আমার মেজদা নিজের বাবার হাতে অনেক পিট্টি খেয়েছে বলেই মনে হয় নিজের ছেলের গায়ে কখনও হাত তোলেনি। তবে মেজদা যেমন বাবার আদর পেয়েছে, সেই আদরটুকু কিনতু সেও করছে নিজের ছেলেকে। আমার মেজদাটি আমার অনেক আদরের একজন মানুষ, তার এতটুকু মানসিক কষ্টও আমাকে অনেক কাঁদায়। আমার মেজদা আমাকে সেই ছোটবেলাতে যেমন ভালোবাসত, আমার অত্যাচার সহ্য করতো, এখনও সে আমার অত্যাচার হাসিমুখেই সহ্য করে। আমি বিয়ের পরে সঞ্চয় করতামনা, সে নিজে উদ্যোগী হয়ে বাসে করে সাভার যেতো, প্রতি মাসে আমার কাছ থেকে টাকা এনে তার ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দিত, এভাবেই সে আমার পায়ের তলায় একটু শক্ত মাটি তৈরী করে দিয়েছে। আমার মেজদার কাছে পাড়া প্রতিবেশীরা আসে সঞ্চয়ের পরামর্শ নিতে, সে হাসিমুখে সবাইকে সাহায্য করে।

প্রতি বছর আমার মেজদার জন্মদিনে আমি আমেরিকা থেকে ফোন করি। সে খুশী হয়। সবার সব দিকে খেয়াল থাকেনা, হয়ত আমাদের অনেকেই ভুলে যায় তাকে ঠিক সময়ে শুভেচ্ছা জানাতে, মেজদা বাচ্চা ছেলেদের মতই অভিমান করে। আমি তাকে বুঝাতে চেষ্টা করি, এমন করোনা, তোমাকে সবাই ভালোবাসে, ভালোবাসা অনুভব করার ব্যাপার। আমার মেজদার অভিমান জল হয়ে যায়। ইদানিং আমি একটু লেখালেখি করি, আমার লেখালেখির ব্যাপারে পরিবারের আর কারো কোন প্রতিক্রিয়া আছে বলে মনে হয়না, ব্যতিক্রম মেজদা। ফেসবুকে প্রায় প্রায় সে আমাকে মেসেজ পাঠায়, “ মিঠু, আমার গর্বে বুকটা ভরে উঠে যখন আমার সহকর্মী কেউ বলে, আপনার বোনের লেখা ছাপা হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিনে। আমি নিজেও অবাক হই, বোন হিসেবে না দেখে তোকে লেখিকা হিসেবেই দেখি, দুই একটা লেখা এমন চমৎকার হয়েছে যে বলে বোঝাতে পারবোনা”। এই আমার সেই মেজদা যে ছোটবেলাতে আমাকে কাঁধে চড়াতো, যে আমার খাবার থালা থেকে মাছের টুকরাটি অবলীলায় তুলে নিয়ে যেত, যে আমার ভর্তির রেজাল্ট দেখে কিছুটা আনন্দে কিছুটা দুঃখে কেঁদে ফেলেছিল, এই আমার সেই মেজদা যে আমার বকা খেয়েও আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে এসে আমার একাউন্টে জমা করে দিত, সেই মেজদাটি আমার ঘ্যান ঘ্যান সহ্য করতে না পেরে কিছু টাকা শেয়ার মার্কেটে খাটিয়ে দিয়েছিল, শেয়ার মার্কেটে ধ্বস নামার পরে আমার এই মেজদাটি আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছিল, প্রয়োজনে সে নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে হলেও আমার মূলধন ফিরিয়ে দেবে বলে। আমার মেজদা পৃথিবীতে একটাই হয়। এমন মেজদার উদাহরন আর কেউ দেখাতে পারবেনা, কারন আমি এই নাতিদীর্ঘ লেখাটিতে আমার মেজদার ভালোমানুষীর এক চতুর্থাংশ লিখেছি, বাকী তিন চতুর্থাংশ জমা করে রেখেছি, প্রয়োজনে লিখব।

আজ আমার মেজদার পঞ্চাশতম জন্মদিনে আমি ফোন করিনি। আমার স্বামীকে সে খুব পছন্দ করে। বয়সে অনেক ছোট হলেও বউএর বড় ভাই বলে কথা, কিনতু না, আমার স্বামীটিও চঞ্চল নামের সদা আনন্দময়, বেশ অভিমানী, ছেলেটিকে ছোটভাই বা বন্ধুর মত ভালোবাসে। আমার স্বামী তাকে ফোন করে উইশ করেছে আর আমি? এইতো মেজদার প্রতি আমার প্রীতি উপহার!!
শুভ জন্মদিন মেজদা!!!!!!!

Friday, April 20, 2012

ক খ গ ঘ ঙ


আমার কাছে একটি ই-মেইল এসেছে। মেইলটি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ সমিতির সাংস্কৃতিক সম্পাদিকা রেখা। এ বছর নববর্ষ উপলক্ষে সমিতি এখানের সকল বাঙ্গালীদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চাচ্ছে। রেখা জানতে চেয়েছে আমার মেয়ে গুড্ডু ঐদিন একটা কবিতা আবৃত্তি করতে পারবে কিনা। এর আগেও একুশে ফেব্রুয়ারী, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে। কিনতু আমরা যেতে পারিনি, গুড্ডুর মায়ের কাজের জায়গা থেকে ছুটির অনুমতি না থাকায়। মেইলটি আমি গুড্ডুর মায়ের বরাবর ফরোয়ার্ড করে দিয়েছি। কারন এই ব্যাপারগুলো আমার মেয়েদের মা’ই দেখে থাকে। আমাদের তিন মেয়ে। তাদের পোষাকীনাম, ডাকনাম তাদের মা রেখেছে, তবে আমি আমার নিজের দেয়া নামেই ওদের ডাকি। বড়মেয়েকে ডাকি মামনি, মেজো মেয়েকে ডাকি কুটু আর ছোটটাকে ডাকি গুড্ডু। গুড্ডুর বয়স ১২। ওকে নিয়ে যখন আমরা এই দেশে আসি, তখন ওর বয়স ছিল দুই বছর। একটু একটু করে কথা বলতে শিখেছে।  কুটু আর মামনি মিলে ওকে নিয়ে সবসময় আনন্দে মেতে থাকত। সেই গুড্ডু এখন বড় হয়ে গেছে, ক্লাস সেভেনে পড়ে।

আমরা এদেশে এসেছি ২০০১ সালের অক্টোবার মাসে, ৯/১১ এর ঠিক একমাস পরেই। আমি এখানে বিশ্ববিদ্যালেয়ে কেমিস্ট্রি পড়াই। বর্তমানে আমরা আছি কলম্বাস নামের ছোট্ট একটা শহরে। প্রথম যখন আমেরিকাতে আসি, তখন ছিলাম ক্লার্ক্সবার্গ নামের আরেকটি ছোট্ট শহরে। ক্লার্ক্সবার্গের আশেপাশে কোথাও কোন বাঙ্গালী ছিলোনা। আমরা প্রথমেই এসে খুব ফাঁপড়ে পরে গেছিলাম। আমাদের মেয়েগুলো তখন বেশ ছোট। মামনির বয়স ছিল ১৪, কুটু ছিল সাড়ে দশ বছরের আর গুড্ডু মাত্রই দুই বছর বয়স। দেশে থাকতে ওরা ছিল দাদু দিদা, মামা মামী, কাকা কাকী সকলের আদরের। এখানে এসে পর্যন্ত একটিও বাঙ্গালীর মুখ দর্শন দূরে থাকুক, সাধারন একটা ইন্ডিয়ান গ্রোসারী শপও ছিলনা যেখান থেকে চাল ডাল পর্যন্ত কেনা যায়। গুড্ডু ডাল, ভাত, মাছ খেয়ে অভ্যস্ত ছিল, মামনি বা কুটুকে নিয়ে সমস্যা ছিলনা, কারন এর আগে বিদেশে থাকার অভিজ্ঞতা তাদের দুজনেরই ছিল। গুড্ডুর জন্মের আগে আমরা মামনি ও কুটুকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়াতে ছিলাম তিন বছর।

গুড্ডুর মায়ের সে-কি কান্না গুড্ডুকে কিছু খাওয়াতে না পেরে। আমারও কাজের এত চাপ ছিল, তাছাড়া তখন আমাদের গাড়ীও ছিলনা, আর পাহাড় ঘেরা রাজ্যে নিজের গাড়ী ছাড়া জীবন একেবারেই অচল ছিল। তারপরেও গুড্ডুর মা নিজেই নানা উপায় বের করতো গুড্ডুকে ভাত খাওয়ানোর জন্য। মুশকিল ছিল যে এই মেয়ে ম্যাগডোনাল্ডস বা কেএফসি্র মত মুখরোচক খাবারও খেতনা। আমি একদিন বিরক্ত হয়ে গুড্ডুর মাকে বলেছিলাম,” মেয়ে বাংলা ভুলে যাবে বলে খাবারেও বাংলাকে চালু রেখেছো, এখন এই বিপদ কিভাবে সামাল দেবো!” গুডডুর মা অবশ্য আমার একথায় রাগ করেনি, দেখে মনে হয়েছিল যেনো সেও একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। পরে অবশ্য আমি আমার এক বন্ধুকে ফোনে বলেছিলাম আমাদের এই খাবারের সমস্যার ব্যাপারে। বন্ধু পরে চাল ডাল, হলুদ, মরিচ সব কিছু মেইল করে পাঠিয়েছিল। এতো গেলো গুড্ডুর কথা, গুড্ডুর মাকে নিয়েও হয়েছিল বিপদ, সে কাঁচামরিচ ছাড়া ভাত খেতে পারেনা, টিয়া পাখীর মতই কচকচ করে কাঁচামরিচ খায় সে। যে শহরে চাল ডাল পাওয়া যায়না, সে শহরে কাঁচামরিচের আশা করাই বৃথা। এদিকে গুড্ডুর মায়েরও খাওয়া দাওয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখে গুড্ডুর এক মামা দুই প্যাকেট কাঁচা মরিচ মেইল করে পাঠিয়েছিল। এগুলো ভাবলে এখন আমার খুব হাসি পায়।

খাওয়ার সমস্যা কোন না কোনভাবে সামাল দেয়া গেছে, কিনতু ভাষার সমস্যা সামাল দিতে গিয়ে আমাদের হিমশিম খাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। হিমশিমই খেতে হয়েছে বলবো, কেননা এখানে আসার আগে আমাদের ধারনাতেই ছিলনা যে ক্লার্ক্সবার্গ শহরের ধারে কাছে কোথাও বাঙ্গালী ছিলনা। এদিকে গুড্ডুর মায়ের আবার স্বদেশ, স্বজাতি, মাতৃভাষার ব্যাপারে ভীষন দূর্বলতা। আমরা এর আগে যখন অস্ট্রেলিয়াতে গেছিলাম তখন কুটু ছিল মাত্র চার বছরের। আমার এই মেয়েটা খুব রোগা ভোগা ছিল বলে দেশে থাকতে তখনও ওকে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পাঠাইনি, ঘরেও পড়ানো শুরু করিনি। ফলে কুটুর বাংলা বা ইংরেজী বর্ণ পরিচয় তখনও হয়নি। অস্ট্রেলিয়াতে গিয়েই কুটুকে স্কুলে ভর্তি করাতে হয়েছে। প্লেস্কুল ধরনের স্কুল। কুটু ছোটবেলা থেকেই খুব চালাক চতুর ছিল। তাই আমাদের খুব কৌতুহল ছিল,  স্কুলে গিয়ে কুটু কিভাবে সবার সাথে কথা চালায় তা দেখা! কারন স্কুল থেকে বাড়ীতে ফিরে সে সব সময় এমনভাবে আমাদেরকে স্কুলের গল্প শুনাত যে মনেই হতোনা এই বাচ্চা ইংরেজী জানেনা। সে তার টিচারের নাম বলতো, ‘মিস গাইও’, আমি যতবার নাম ঠিক করে দিতাম ‘মিস গেইল’ বলে, সে আবারও বলতো ‘মিস গাইও’। তাই একদিন ওর মা স্কুলে গেলো টিচারের সাথে কথা বলতে এবং মেয়ের অগ্রগতির ব্যাপারে জানতে। স্কুলে গিয়ে জানতে পারলো কুটুকে নিয়ে তাদের কোন সমস্যাই হচ্ছিলনা, কারন কুটু তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়েই নাকি সবকথা বুঝাতে পারতো। এরপর খুব তাড়াতাড়ি কুটু ইংরেজী আয়ত্ব করে ফেলেছিল, কিনতু ইংরেজী শেখা নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যথা ছিলনা, মাথাব্যথা ছিল বাংলা শেখানো নিয়ে। কারন আমরা অস্ট্রেলিয়া গেছিলাম মাত্র তিন বছরের জন্য। আমাদের দেশে ফেরার প্ল্যান ছিল বলেই কুটুকে বাংলা পড়া শেখাতে হচ্ছিল। ঐ ছোট্ট বয়সের রোগাভোগা একটা বাচ্চাকে ইংরেজী ও বাংলা দুই ভাষা শেখানোটা ছিল রীতিমত কঠিন চ্যালেঞ্জ। আমি নিজে এই ব্যাপারে খুবই অসহায়। অন্যের ছেলেমেয়ে পড়িয়ে মানুষ করছি, কিনতু নিজের মেয়ের বেলায় আমার মাথায় কোন উপায় বের হয়নি।

একদিন দেখি কুটুর মা কুটুকে নিয়ে বসেছে, কুটুকে দিয়ে একটি চিঠি লেখাবে বলে। আমি আড়চোখে দেখছিলাম মা মেয়ের কান্ড। মা মেয়েকে বলছে, ‘তুমিতো দিদাকে খুব মিস করছো, আমি আজ দিদার কাছে চিঠি লিখবো, তুমিও যদি বাংলাতে দিদাকে দুই লাইন লিখতে পারো, তাহলে সেই চিঠিও আমি দিদার কাছে পাঠিয়ে দিতে পারবো। তুমি বাংলাতে চিঠি লিখলে দিদা অনেক খুশী হবে। আমি দেখিয়ে দেবো কিভাবে লিখতে হয়’। এই কথা শুনে মেয়েও দেখলাম খুব উৎসাহিত হয়ে উঠলো এবং বাংলা অ আ ক খ না জানা মেয়ে অন্ধের মত করে মায়ের হাতের লেখাকে অনুকরন করে তিন লাইনের একটি চিঠি লিখে ফেললো। কুটুর কাছে মনে হয় এই ব্যাপারটা খুবই ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছিল। এরপর থেকে দেখি প্রায়ই মায়ের কাছে বসে দুই তিন লাইন করে বাংলা কপি করে করে একসময় বাংলা পড়তে শিখে গেলো।

অস্ট্রেলিয়াতে আমাদের আশেপাশে অনেক বাঙ্গালী ছিল। তাই ওখানে বাংলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই থাকতো। ঐসব অনুষ্ঠানে মামনি ও কুটু ছিলো অনুষ্ঠানের মধ্যমনি। মামনি আগাগোড়াই ধীরস্থির স্বভাবের, যা শেখানো হতো, তাই শিখতো, কোন বাদ প্রতিবাদে যেতোনা, কিনতু কুটু ছিল বেশী টরটরে, যতটুকু না শেখানো হতো নিজে নিজেই তার চেয়ে বেশী শিখে ফেলতো। তাই ওকে ওখানের সবাই খুব আদর করতো। সব অনুষ্ঠানে ওকে দিয়ে নাচ করাতো, আবৃত্তি করাতো। কুটুর মুখস্থ শক্তি খুব ভালো ছিলো, পাঁচ বছর বয়সেই সে ‘সৎপাত্র’, ‘লিচুচোর’, ‘কাজলাদিদি’ সহ বড় বড় কবিতাগুলো মুখস্থ বলতে পারতো (অভিনয় সহকারে)।

তিন বছর পরে আমরা যখন দেশে ফিরে যাই, মামনি ও কুটুকে নিয়ে ওদের মা গেলো ওয়াইডাব্লিউসিএ স্কুলে ভর্তি করাতে। মামনিকে পেয়ে প্রধান শিক্ষিকাতো মহাখুশী (মামনি ক্লাস থ্রী পর্যন্ত পড়েছিল এই স্কুলে), কিনতু কুটুকে ভর্তি নিতে পারবেনা বলে দিলেন উনি। কারন কুটু ক্লাস টুতে পড়ার মত বাংলা শিখেনি তখনও। আমরা থাকতাম উত্তরাতে, শুধু বাংলা স্কুলে পড়ানোর জন্য মেয়ের মা গ্রীনরোডের ওয়াইডাব্লিউসিএ স্কুলে নিয়ে যেতে রাজী হয়েছিল। কিনতু স্কুল কর্তৃপক্ষ কুটুকে ভর্তি নিতে রাজী না হওয়ায় মেয়ের মা’র ইগোতে লেগেছে। সে দুই মেয়েকে নিয়েই উত্তরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে গেলো। সেখানে আবার আরেক বাহানা। সেখানে বলা হলো মামনি নাকি বাংলাদেশের লেভেলে অঙ্ক পারবেনা, আর কুটু নাকি ক্লাস টু লেভেলে পড়া পারবেনা। মেয়ের মা’কে তারা পরামর্শ দিল দুই মেয়েকেই যেনো এক ক্লাশ করে নীচে নামিয়ে দেয়া হয়। আমি জানি মেয়ের মা’কে, তারাতো আর জানেনা মেয়ের মায়ের জেদ সম্পর্কে। মেয়ের মা রাগ করে মামনিকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করালো বি এস এফ শাহীন স্কুলে যথারীতি ক্লাস সিক্স-এ আর কুটুকে ভর্তি করালো উত্তরার ঐ স্কুলটাতেই এবং ক্লাস টু-তেই, তবে সে নিজে দায়িত্ব নিয়েছিল তিন মাসের মধ্যে কুটুকে ক্লাস টু এর প্রতিটি বিষয়েই উপযুক্ত করে তুলবে। বলাই বাহুল্য, এই কাজটি সে দুই মাসের মধ্যেই করে ফেলেছিল। কিভাবে করেছিলো আমি জানিনা, তবে প্রথম টার্ম পরীক্ষাতেই কুটুর ফলাফল দেখে ঐ স্কুলের প্রিন্সিপাল কুটুর মা’কেও শিক্ষক হিসেবে উনার স্কুলে নিয়ে নিলো। আমার কুটুর বয়স এখন ২০ বছর, গত দশ বছর ধরে আছে আমেরিকাতে, আমার কুটু এখনও বাংলা বর্ণমালা ব্যাপারটির সাথে পরিচিত না, অথচ ও বাংলা পড়তে ও লিখতে পারে, সারাদিন বাংলা গান শুনছে, উত্তম সুচিত্রার মুভি দেখছে, কাঁচামরিচ ঘষে ঘষে ভাত খাচ্ছে, মোটের উপর মায়ের কাছ থেকে সে খুব ভালো ট্রেনিং পেয়ে গেছে।

এবার গুড্ডুর কথাতেই ফিরে আসি। আমেরিকাতে এসেই গুড্ডুর মা ঘরে অনেকটাই সান্ধ্য আইন জারি করে দিল। ঘরে বাংলা ছাড়া অন্য কোন শব্দ ব্যবহার করা যাবেনা। মেয়েরা পড়ে গেছে বিপদে। ওদেরতো স্কুল আর বাসা ছাড়া আর কোথাও যাতায়াত ছিলনা প্রথমদিকে। তাই দিনের বেশীটুকু সময় স্কুলে ইংরেজীতে কথা বলে বাড়ী যখন ফিরে আসতো, মুখ ফসকে ইংরেজীটাই বেরিয়ে আসতো। তাদের দেখাদেখি গুড্ডুও দুই একটা করে ইংরেজী শব্দ শিখে যাচ্ছিল। ঐ সময়ে ডিশ নেটওয়ার্কে বাংলাদেশের চ্যানেল পাওয়া যেতোনা, গুড্ডুর মা কম্পিউটারে খুব বেশী সড়গড়ও ছিলোনা যে ইউটিউব দেখে দেখে গুড্ডুকে বাংলা শেখাবে! তাই বড় দুই মেয়েকে সঙ্গী করে নিলো ‘গুড্ডুর বাংলা শিক্ষা প্রকল্পে’। চার বছর বয়স পর্যন্ত ঘরে বাংলা বলতে বলতে গুড্ডু ইংলিশ ‘ইয়েস’ ‘নো’ শব্দ দুটিও ভুলে গেলো। আমার সহকর্মীরা আমাকে সাজেশান দিয়েছিল, কিন্ডারগার্টেনে ভর্তির আগে কয়েকমাস যেনো গুড্ডুকে প্রাইভেট কোন ডে কেয়ার সেন্টারে ভর্তি করানো হয়, তাতে করে অন্য বাচ্চাদের সাথে থেকে আমার মেয়ে ইংরেজী শিখে ফেলবে। সাজেশানটা আমারও মনে ধরেছিল, কিনতু বাড়ীতে এসে বলতেই মেয়ের মা দেখি কলমের এক খোঁচায় আমার আর্জি বাতিল করে দিলো। মেয়েকে যথাসময়ে স্কুলে পাঠালাম, মেয়ে স্কুলে যায় আসে, কিনতু ওর চেহারাতে কোন আনন্দ দেখিনা। স্কুলে গিয়ে খোঁজ নিলাম, জানতে পারলাম ও কারো সাথে মিশতে পারেনা, ও কোন কথা বুঝতেও পারেনা, বুঝাতেও পারেনা।

মেয়ের মা’কে বললাম মেয়ের সম্পর্কে মেয়ের টিচারের রিপোর্ট। মেয়ের মা দেখি উলটো টিচারের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে গেলো। তার কথা হলো, এই টিচার আসলে কোন জাতের টিচার না। সত্যিকারের শিক্ষক হলে তার দায়িত্ব একটি বাচ্চার সাথে কম্যুনিকেট করা। সে হার মানতে রাজী নয়, এরপর থেকে সে স্পেশাল পারমিশান নিয়ে গুড্ডুর সাথে স্কুলে যাওয়া শুরু করলো। দেশে থাকতে সে নিজে বাচ্চাদের স্কুলে দুই বছর শিক্ষকতা করেছে, এদেশে আসার আগেই সে বিএড ডিগ্রী অর্জন করেছে, এদেশে না আসলে সে তখন দেশের নামকরা এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতো, এমনটাই কথা ছিলো, কাজেই তার অর্জিত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমার কোন দ্বিমত ছিলনা, তবে বাবার প্রানতো, মেয়ের দুরবস্থা দেখে বুকটা ফেটে যেতো। এদিকে একমাসের মধ্যেই দেখি গুড্ডু পটপট করে ইংলিশ বলা শুরু করেছে, গুড্ডুর মাকে আর যেতে হয়না মেয়ের সাথে স্কুলে। মেয়ে পটপট করে ইংরেজী বলে, শুনে আমার বুকটা ভয়ে গুড়গুড় করে উঠে। মেয়ের মাকেতো জানি, পটপট করে ইংরেজী বলা মেয়েকে ধরবে আর দুইদিন পরেই। হ্যাঁ, আমার আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে, মেয়ে একটা করে ইংরেজী শব্দ বলে, মেয়ের মা বসে যায় সেই ইংরেজী শব্দের বাংলা অর্থ বুঝিয়ে দিতে। আমার হাসিও পেতো, আবার ভালোও লাগতো। এভাবেই কিছুদিন চলার পর আমদেরকে ক্লার্কসবার্গ ছেড়ে চলে আসতে হলো কলম্বাস নামের ছোট শহরে।

হায়রে! ‘অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়’  অবস্থা হয়েছে গুড্ডুর মায়ের। এখানে এসেও প্রথম ছয়মাস কোন বাঙ্গালীর দেখা পাওয়া গেলোনা। গুড্ডু ততদিনে এলিমেন্টারি স্কুলে যেতে শুরু করেছে। গুড্ডুর মা দেশ থেকে ‘আদর্শলিপি’ বই, ‘খুকুমনির ছড়া’ বই আনিয়েছে গুড্ডুকে বাংলা পড়ানোর জন্য। এবার মেয়েকে বর্ণমালা দিয়েই পড়া শুরু করিয়েছে। গুড্ডু খুবই লক্ষ্মী একটা বাচ্চা, খুব শান্তশিষ্ট এবং মেধাবী। সে খুব তাড়াতাড়ি অ আ ক খ পড়তে শিখে গেলো। আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ জাগে মনে, কার কৃতিত্ব বেশী, মেয়ের মেধা নাকি মায়ের শেখানোর কৌশল। যেটাই হোক, আমার কোনরকম ইনভল্ভমেন্ট ছাড়াই আমার তিন মেয়েই দেখি বাংলা পড়তে ও লিখতে শিখে গেছে। আরেকটা কথা না বললেই নয়, আমার মামনি কিনতু বেশীদিন থাকেনি দেশে, সেও সেই ছোট্ট বয়স থেকেই প্রবাসেই আছে। কিনতু মামনি বাংলা উপন্যাস থেকে শুরু করে বাংলা সায়েন্স ফিকশান পর্যন্ত সব বই পড়ে ফেলেছে, অর্থাৎ আমাদের ঘরের লাইব্রেরীতে যত বই আছে আমাদের নিজস্ব সংগ্রহে। আসলে আমরা প্রতি দুই বছরে একবার করে দেশে যাই, ফিরে আসার সময় মেয়েদের মা স্যুটকেস ভর্তি করে গল্পের বই নিয়ে আসে। তার নিজের জন্য। আজ পর্যন্ত ভালো দামের একটা শাড়ী সে কিনেনি, কিনতু একবার ডাবল ফাইন দিতে হয়েছিল তার বইয়ে ঠাসা অতিরিক্ত ওজনের স্যুটকেসটির জন্য। ইদানীং অবশ্য সে কম্পিউটারে বসেই বই পড়ে ফেলে।  

তা নানাভাবেই বাংলা চর্চ্চা হচ্ছিল আমার পরিবারে। কিনতু এত চেষ্টার পরেও দেখি গুড্ডু বাংলা ইংরেজী মিলিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। আরেকটা জিনিস খেয়াল করলাম, সে ইংলিশকে বাংলাতে অনুবাদ করে কথা বলতো। এক আসরে গুড্ডুকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেছিল, উত্তরে সে বলেছিল, ‘ ওয়েইট, একটু থিঙ্ক করে বলি’। ব্যস, এটাই হয়ে গেছিল ্গুড্ডুর জন্য একেবারে ট্রেডমার্ক। অয়ন নামের একটি ছেলে ছিল এখানে, বাংলাতে খুব ভালো দখল ছিল তার, পিএইচডি করতে এসেছিল, গুড্ডুর মায়ের এই বাংলা শেখানোর প্রচেষ্টাকে সে খুব শ্রদ্ধা করতো। অয়নের সাথে এখনও আমাদের যোগাযোগ আছে, অয়ন গুড্ডুর কথা জানতে চাইলেই এভাবে জিজ্ঞেস করে,’ আমাদের ওয়েইট থিঙ্ক করে বলি’ কেমন আছে”? সেই গুড্ডু তার নয় বছর বয়সে বাংলাদেশ সমিতির বিজয় দিবস অনুষ্ঠানে খালি গলায়, ‘ জাদুর পেন্সিল, আহা! জাদুর পেন্সিল’ গানটি গেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। এই গানটি শ্রদ্ধেয় ফেরদৌসী রহমানের গাওয়া একটি গান। গুড্ডুর মা ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠান যখন দেখতো, তখনই মুখস্থ করে ফেলেছিল। নিজের জীবনে এসে মেয়েকে এই গানটি শিখিয়েছে গানের অর্থ সহকারে। ফলে মেয়ে অনুষ্ঠানে একেবারে শুদ্ধ উচ্চারনে গানটি করতে পেরেছে।

পরের বছর একুশে ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠানে গুড্ডু যতীন্দ্রনাথ বাগচীর ‘কাজলা দিদি’ কবিতাটি আবৃত্তি করেছে। সবচেয়ে বেশী অবাক হয়েছিলাম আমি। ঘরে থেকেও আমি জানতেই পারিনি আমার সেই ‘ওয়েইট, থিঙ্ক করে বলি’ মেয়েটা কখন এত সুন্দর আবৃত্তি করতে শিখে গেলো! এর পরের বছর, মানে গত বছর গুড্ডু আবৃত্তি করেছে জসীমউদ্দীনের ‘নিমন্ত্রন’ কবিতার প্রায় সবটুকু, এবার আরও পরিনত হয়েছে তার আবৃত্তির স্টাইল। গুড্ডুকে এখন সবাই বাংলা শেখার ব্যাপারে বাচ্চাদের জন্য একটি আইডল মনে করে। তবে আমি নিজেও মনে করি, গুড্ডু মাত্র দুই বছর বয়সে আমেরিকাতে এসে এমন সুন্দর বাংলা বলতে পারলে তাকে বাংলার আইডল বলাই যায়। তাছাড়া সেতো শুধু বাংলা নিয়েই থাকেনা, স্কুলের পড়া আছে, ‘সায়েন্স ফেয়ার’, ‘রিডিং কমপিটিশান’, ‘উইকলি টেস্ট’, ‘মান্থলী টেস্ট’, ‘এন্যুয়েল টেস্ট’- এও তাকে সেরা ফলাফল করতে হয়। না, আমরা কেউ ওর উপর ‘সেরা হতেই হবে’ ব্যাপারটি চাপিয়ে দেইনি। মায়ের কাছে বাংলা শিখতে গিয়ে এমন কঠিন এক চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে ওকে যেতে হয়েছে, তখন থেকেই ‘আমাকে পারতে হবে’ ব্যাপারটা ওর মাথায় ঢুকে গেছে।


ইদানিং শুনি, গুড্ডু নাকি বাংলা পড়া কিছু কিছু ভুলে যাচ্ছে! অস্বাভাবিক কিছু নয়, যেখানে থাকি, কোন বাংলা স্কুল নেই, মেয়ের মা ফুল টাইম চাকুরী করেন, বাড়ী এসে উনার গৃহকর্ম করতে হয় (আমাকে উনি বা আমার মেয়েরা ঘরের কাজ করা থেকে নিষ্কৃতি দেওয়াতে হাতে হাতে সাহায্য করার অভ্যাসটাই আমার মধ্যে তৈরী হয়নি), সময়ের সাথে সাথে বয়সও বাড়ছে, আগের সেই ধৈর্য্যও নেই, তাছাড়া মেয়েটাও বড় হয়েছে, ওর নিজের একটি কিশোরী জগত তৈরী হচ্ছে, কাজেই আগের মতো করে আর সম্ভবও হচ্ছেনা মেয়েকে নিয়ে বাংলা চর্চ্চা করার। তারপরেও মাঝে মাঝেই মেয়ের মায়ের হুঙ্কার শুনি, ‘ শোন, আজকে যদি তুমি বাংলা বই একটুও না পড়ো, তাহলে তোমাকে বাংলা পত্রিকার এক পৃষ্ঠা পড়তে দেবো। পড়তে না পারলে মজা বুঝাবো”। আমি মনে মনে হাসি।

আমার মেইলটা মনে হয় গুড্ডুর মা পেয়েছে। এই মুহূর্তে আমি পরীক্ষার খাতা দেখছি আর মা মেয়ের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি। তাদের কথার ধরন থেকেই বুঝে গেছি, সকালে বাংলাদেশ সমিতির রেখার পাঠানো যে মেইলটি গুডডুর মাকে ফরোয়ার্ড করেছিলাম তা পেয়েই মা মেয়েকে ডেকেছে অনলাইনে পত্রিকা পড়ার জন্য। বুঝাই যাচ্ছে মেয়েকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। মেয়ে পড়ছে শুনতে পারছি, ‘ বিনিয়োগ, শেয়ার মার্কেটে দরপতন, বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অগ্নিমূল্য’ জাতীয় শব্দ। যোগ্য শাস্তি বটে! আমিতো অবাক হয়ে শুনছি মেয়ে যদি বাংলা ভুলেই গিয়ে থাকে তাহলে এইসব কঠিন শব্দ কিভাবে পড়ছে! মেয়েকে পড়তে শুনে আমিতো মহা খুশী যে যাক মেয়ে আমার শাস্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে! ওমা, দেখি এখানেই শেষ নয়, মেয়ের মা ঐ সমস্ত বাংলাশব্দের ইংলিশ জানতে চাইছে! আমি প্রমাদ গুনতে শুরু করেছি, এইরে! না পারলে শাস্তির ধরন কি হবে কে জানে! দেখলাম, মেয়ের মা অতটা কঠিন হৃদয়ের নয়, দুই একটা শব্দ আছে যেগুলোর ইংলিশ মেয়ে জানেনা, মেয়ের মা বলে দিলো সঠিক উত্তর, কিনতু একটা হুমকীও দিলো, ‘ আবার তোমাকে ডাকবো পত্রিকা পড়তে, যদি না পারো, বুঝবে মজা, কত ধানে কত চাল হয়’।

আমি গুড্ডুর মাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম তার ছুটি আছে কিনা নববর্ষের অনুষ্ঠানের দিন, কারন আমাকে জানাতে হবে আমরা ওখানে যাচ্ছি কিনা। গুড্ডুর মা গুড্ডুকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো, ‘ ছুটি না থাকলে ছুটি নেবো, মেয়েকে ওখানে এবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করতে হবে। কোন আপত্তি শুনতে চাইনা’। যাক! আমিও বাঁচলাম, গুড্ডুর মাকে আবার দেখতে পাবো সেই আগের রূপে, মেয়েকে কি অসীম ধৈর্য্যের সাথে কবিতা পড়াচ্ছে, কবিতা আবৃত্তির নিজস্ব স্টাইল শেখাচ্ছে। এক সময় আমার মামনি, কুটু যখন ছোট ছিলো, তাদের মা তাদেরকে নিয়ে কত জায়গায় যেতো, মেয়েরা বাংলা গানের সাথে নাচ করতো, কি সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতো, বিশেষ করে কুটুতো অস্ট্রেলিয়াতে একেবারে ‘স্টার; বনে গেছিল মাত্র তিন বছরে। সেইসব দিনে গুড্ডুর মাকেও দেখেছি কি উৎসাহ নিয়ে সব কাজ করতো। ইদানিং তাকে কেমন একটু ঝিমিয়ে যেতে দেখে আমার নিজেরও মনটা খারাপ লাগে। সেজন্যই পহেলা বৈশাখ কাছে আসাতে গুড্ডু আর গুড্ডুর মায়ের কবিতা চর্চ্চার মজাদার ‘নাটক’ (নাটক বলেছি এই কারনে, এই সময়টুকু আমার ঘরে এই হাসি, এই কান্নার খেলা চলবে) দেখতে পাব ভেবেই আমার মনটা ভালো লাগতে শুরু করেছে।

'মোদের গরব মোদের আশা, আ'মরি বাংলা ভাষা'

রয় শেফার্ড নামে আমার এক বন্ধু ও সহকর্মী আছে। সে জার্মান বংশোদ্ভুত। শিশুকালেই বাবা মায়ের সাথে চলে এসেছে আমেরিকাতে। তবে যতদিন তার মায়ের দেহে শক্তি সামর্থ্য ছিল, মায়ের সাথে মাঝে মাঝেই তারও জার্মানীতে যাওয়া আসা ছিল। এখন আর যাওয়া হয়না জার্মানীতে। তবে তার চেহারা থেকে জার্মান ছাপ এতটুকুও মিলিয়ে যায়নি। ওর বয়স ৩৫, খুব ভালো ফ্যামিলির ছেলে, তার বাবা আমেরিকান, সেনাবাহিনীতে চাকুরী করতো, সেই সুবাদেই জার্মাণীতে পোস্টেড হয়েছিল, সেখানেই তার জার্মান মায়ের সাথে পরিচয়, ও পরিনয়, ওখানেই ওদের সব ভাই বোনের জন্ম হয়েছে। ফলে মাতৃভূমির সূত্র ধরে রয় নিজেকে জার্মান বলে পরিচয় দেয়। রয়ের সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগে, সে অনেক বেশী শোনে, জানার কৌতুহল অপরিসীম। আমেরিকার অন্য কোথায় কি হয় আমি জানিনা, তবে আমি যে দুই স্টেটে থেকেছি, সেখানের জনগন পুরোপুরি আমেরিকান, অর্থাৎ আমেরিকার বাইরেও যে বিরাট পৃথিবী রয়ে গেছে, নানা ভাষার, নানা সংস্কৃতির মানুষ রয়ে গেছে, যারা প্রতিদিন একজন আমেরিকানের মতই রাতে ঘুমাতে যায়, সকালে ঘুম থেকে উঠে, এই খবরটা ওরা জানার প্রয়োজন অনুভব করেনা। এমন একটা পরিবেশে আমার মত ‘কাঠ বাঙ্গাল’ কে থাকতে হচ্ছে বছরের পর বছর, এ যে কি কষ্টের তা আর কেউ না বুঝলেও আমার এই জার্মান বন্ধুটি কিছুটা হলেও অনুমান করতে পারে। আর সেই কারণেই রয়কে আমার খুব আপন মনে হয়।
রয় অবসরে নাটক লিখে, মিউজিকের উপর ওর খুব টান, ও এখানে একটি ব্যান্ড দলের সদস্য। আমি যেখানে থাকি, সেখানে কালো জনগোষ্ঠীই মেজরিটি। কালোদের মধ্যে একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়, তা হলো, তারা সব সময় শরীরে নাচের ঢেউ তুলে চলা ফেরা করে থাকে। তাদের চলনে বলনে র‌্যাপ মিউজিক এর তাল থাকেই। আমি গান পাগল মানুষ ঠিকই, তার চেয়েও বেশী আমি বাংলা পাগল। কালোদের যখন দেখি র‌্যাপ গুনগুন করে আর হাত পা নাচিয়ে চলে, আমার কন্ঠে অটোমেটিকভাবেই বাংলা গানের সুর গুনগুনিয়ে বাজতে থাকে। আমি আপনমনে কাজ করি আর রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর ভাঁজতে থাকি। আমার মত এমন সুরে কেউ কোনদিন গুনগুন করেনি, তাই আমার সহকর্মীদের কানে চট করেই পৌঁছে যায় আমার আপনমনের গুনগুনানি। আগে তারা অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করতো, কোন কারনে আমার মন খারাপ নাকি! কারন আমার গুনগুনানিটা নাকি ভেতর থেকে উঠে আসা কান্নার মত শোনা যায়। আমি হেসে ফেলতাম, স্বীকার করে নিতাম, আসলেই আমার ভেতরে অনেক কান্না জমে থাকে। আমার নিজের অজান্তে গানের সুরগুলো কান্নার সুর হয়ে বের হয়ে আসে। ওরা এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে আমার গুনগুনানির সাথে। ওরা জেনে গেছে, বাংলাদেশ নামের একটি ছোট্ট দেশ আছে, ইন্ডিয়ার পাশেই, একটি স্বাধীন দেশ, সেই স্বাধীন দেশের মেয়েটা তার দেশের কথা ভেবে, তার আপনজনের কথা ভেবে মনে মনে কাঁদে, সেই কান্নাটাই তারা শুনতে পায়।
রয় যেহেতু মিউজিক নিয়ে কাজ করে তাই সে আমার গুনগুনানি শুনেই ধরতে পারে সুরের ভাষা। সে যে সত্যি সত্যি বাংলার সুরগুলো বুঝতে পারে, ব্যাপারটা আমি ধরতে পেরেছি ফেসবুক থেকে। আমার ফেসবুকে আমার আমেরিকান সহকর্মীদের মধ্যে অনেকেই বন্ধু লিস্টে ছিল, একেবারে প্রথম দিকে আমার বাংলা কী-বোর্ড ছিলনা, ফলে ইংলিশ ব্যবহার করতাম। আমার ছোট মেয়েটা, সেও জানে আমার বাংলা প্রীতির কথা। ইংলিশ ব্যবহার করতে হতো বলে আমি ফেসবুক তেমন ইউজ করতামনা, তাই দেখে একদিন আমার মেয়েটাই আমাকে ‘বাংলা কী-বোর্ড অভ্র’ ব্যবহার করা শিখিয়ে দিল (ও জানতো কোন এক সময় ওর বাবা ‘অভ্র’ ডাউনলোড করেছিলো)। আর যায় কোথা! আমার চোখের সামনে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হলো, শুরু করে দিলাম বাংলার ব্যবহার! বাংলায় স্ট্যাটাস দেই প্রতিদিন, বাংলা গানের লিঙ্ক ফেসবুকে শেয়ার করি, মানে বাংলাকে জাপটে ধরেছি ফেসবুকে। আস্তে আস্তে দেখি আমার আমেরিকান বন্ধুরা নীরব হতে শুরু করেছে আমার ফেসবুক থেকে, একমাত্র যে টিকে আছে সে হচ্ছে রয়। রয় বুঝে না বুঝে আমার বাংলা স্ট্যাটাসে ‘লাইক’ দিয়ে যেতো, এরপর থেকে গানের লিঙ্কগুলোতে ‘লাইক’ দেওয়া শুরু করলো। আমি ভাবতাম আমাকে খুশী করার জন্য রয় এগুলো করে। পরে সে আমাকে বললো যে আমার শেয়ার করা গানের লিঙ্ক ও শুনে, শুনে ভালো লাগলেই ও লাইক দেয়।
রয় আমার দেশের ইতিহাস শুনতে চায়, সে যেহেতু নাটক লিখে, তাই ও বলিউড মুভি দেখে অনলাইনে গিয়ে। আমি তাকে বাংলা মুভির লিঙ্ক দেই, যে সমস্ত ছবিতে সাবটাইটেল আছে, সেগুলো রেফার করে দেই। রয়কে বলেছি বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস, ও জানে ২৬শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বারের কথা। ও জানে পহেলা বৈশাখ, দূর্গা পূজা, ঈদের কথা। ও জানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধদের কথা। ও শুনেছে আমাদের তিন বেলা ভাত খাওয়ার কথা, জানে আমাদের নদী-সাগরের কথা। জানতোনা, আমার কাছে শুনে শুনে জানার চেষ্টা করে, হয়তো ওর নাটকের পান্ডুলিপিতে সাহায্য করবে। অথবা নিছক কৌতুহল, আমাদের মতোই নিজের জানাকে আরেকটু এগিয়ে দেশের বাইরে ছড়িয়ে দেয়া। রয়কে ভাষা দিবসের কথাও বলেছিলাম, কিনতু সব কিছু মনে রাখতে পারেনা। হয়তো ভুলে গেছে।
আমার বাংলা প্রীতি দেখে আমার স্বজাতিদের মধ্যে অনেকেই এটাকে আদিখ্যেতা মনে করে, কিনতু এই ভিনদেশী আমাকে সেল্যুট করে যখন সে জানতে পেরেছে আমি আমার ঘরে বাংলাকে খুব পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। সে আরও জানে, আমার মেয়েরা বাংলা পড়তে পারে, লিখতে পারে। সেও নাকি জার্মান ভাষা পড়তে পারতো, কিনতু এখন আর পারেনা, ভুলে গেছে। আমার মত করে সেও বিশ্বাস করে, মাতৃভাষাকে ঠিক রেখে আরও যে কোন ভাষা আয়ত্ব করা যায়, এতে করে ভাষাজ্ঞান অনেক বেশী সমৃদ্ধ হয়। সে নতুন করে জার্মান ভাষা চর্চ্চা শুরু করেছে, আমাকে খুশী করার জন্য দুই চারটা বাংলা শব্দ শিখে আমার ফেসবুকে সে লিখে ফেলে। আমি খুশী হই এবং সেটা তাকে জানাই। আমি সেদিন রয়কে বললাম ‘গুগল’ সার্চ করে ‘গেরিলা’ ছবিটা দেখতে এবং তার মতামত জানাতে। সে ঠিকই গেরিলা দেখেছে এবং তার মতামত জানিয়েছে। আমি দুইদিন আগে ইন্দ্রানী সেনের কন্ঠে গাওয়া ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মনরে আমার’ গানের লিঙ্কটি ফেসবুকে শেয়ার করার দশ মিনিটের মধ্যেই ্রয় ‘লাইক’ দিয়েছে, পরে কাজে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছি, গানটা সে শুনেছে কিনা! আমাকে অবাক করে দিয়েছে রয়, সে গানের সুর বুঝেছে, বলেছে যে এই গানের সুরে নাকি আছে আমার ভেতরের কান্না, আমার আক্ষেপ! আমি তাকে গানের কথা সবটুকু অনুবাদ করে দিলাম। সে এই সুরটা নাকি তার বাঁশীতে তুলবে, যে বাঁশীটা আমি দেশ থেকে নিয়ে এসেছিলাম ওর জন্য। হঠাৎ করেই রয় আমাকে জিজ্ঞেস করলো যে খুব কাছাকাছি আমাদের কোন জাতীয় দিবস আছে কিনা। বললাম, আমাদের ষাটতম ভাষা দিবসের কথা।
রয় জানতে চাইলো, ভাষা দিবসে আমরা কি করি! আমি আমাদের শহীদ দিবসের ইতিহাস সংক্ষেপে রয়কে বললাম, বললাম আমাদের ‘শহীদ মিনারের’ কথা। নাম ধরে ধরে বললাম ভাষা শহীদদের কথা, বললাম আমাদের সেই বাংলা পাগল তরুনদের কথা, যারা ভাষা দিবসকে ‘আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের’ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। এবার রয়ের অবাক হওয়ার পালা, যখন সে শুনলো, ভাষা দিবস এখন শুধু বাংলাদেশের সীমানায় আটকে নেই, ২১শে ফেব্রুয়ারী দিনটি সারা পৃথিবীর সব দেশের ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমার সাথে সাথে সেও দিনটি সেলিব্রেট করতে পারে, এটা জেনেই সে খুব খুশী হলো। আমার কাছে জানতে চাইলো, সে কি করবে ঐদিন! বললাম, “ সারাদিন তুমি জার্মান ভাষায় কথা বলবে, ভুলেও ইংলিশ বলবেনা( দুষ্টামী করেছি), সকালে মা’কে ফোন করবে, কাজের শেষে মায়ের বাড়ীতে যাবে, মা’কে জড়িয়ে ধরে থাকবে বেশ কিছু সময়, এই একটা দিন অন্ততঃ তোমাদের দেশী খাবার খেয়ো, স্বজাতিদের সাথে সময় কাটিয়ো, দেখবে অন্যরকম এক অনুভূতি আসবে সারা মন জুড়ে, সারা দেহ জুড়ে! তুমি আরও বেশী করে অনুভব করতে পারবে আমার কান্না, প্রবাসে থাকার যন্ত্রণা, দেশের জন্য, আমার মায়ের জন্য আমার ভেতরের হাহাকার, বাবা ভাইয়ের জন্য আমার পাগলা ভালোবাসা। তুমি নিজের জীবনে, নিজের পরিবারে তোমার মাতৃভাষার চর্চ্চা চালু করবে, দেহে মনে দেশপ্রেম লালন করবে। অন্যের কথা ভেবে লাভ নেই, আগে নিজেকে যাচাই করতে হয়, আমি আমার দায়িত্ব কতটুকু পালন করেছি এক জীবনে, যদি বুঝতে পারো তুমি তোমার করণীয় কাজ করে গেছো, সেটাই এক জীবনের বড় প্রাপ্তি, এটাই ভাষা দিবসের মূল চেতনা”। কথাগুলো শুনে আমার তরুন নাট্যকার, মিউজিক কম্পোজার বন্ধু রয়ের চেহারাতে এক ধরনের অনিন্দ্য সুন্দর আলো ফুটে উঠলো! দেখেই আমার মনটা ভরে উঠলো, এক ধরনের পরিতৃপ্তি আমার চেহারাতেও ফুটে উঠলো।