Wednesday, April 18, 2012

চোখ যায় যদ্দুর


এক
এখন ঘড়িতে বাজে সকাল সাড়ে ছয়টা। আজকে ভোর পাঁচটার দিকেই রূপার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। এমনিতে এতো সকালে রূপা কখনও ঘুম থেকে উঠেনা। ছোটবেলাকার অভ্যাসমত সকাল সাতটার দিকেই রূপা ঘুম থেকে উঠে। আজ হঠাৎ করেই ঘুমটা ভেঙ্গে যাওয়াতে অনেককাল পরে রূপার ইচ্ছে করলো কটেজের বারান্দায় বসে সকালটা উপভোগ করতে। তিনদিন আগেই ওরা সপরিবারে এসেছে এই রিসোর্টে স্প্রিং ব্রেকের ছুটিতে। রূপা ও রূপার বর জীতু সারা বছর একটানা কাজ করে পাওনা ছুটিগুলোকে জমিয়ে রাখে। ছুটি জমে যখন মাসখানেকের মতো হয়, ওরা ভ্যাকেশান কাটাতে বাইরে কোথাও বেড়িয়ে পড়ে। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে স্বামী স্ত্রী এবার এসেছে নিউ অর্লিন্সে। ওদের বাংলোটা একেবারে মিসিসিপি নদীর ধার ঘেঁসা পাওয়া গেছে। পয়সা একটু বেশী গুনতে হয়েছে, তবুও ওরা সবাই মিলে এই বাংলোটাই পছন্দ করেছে। সবচেয়ে বেশী খুশী হয়েছে রূপা নিজে। বাংলোর বারান্দায় বসলেই মিসিসিপি নদীকে ভালোভাবে দেখা যায়। মিসিসিপির বুকে ছোট ছোট জাহজগুলো দেখলেই রূপার মনের ভেতরে জেগে উঠে ফেলে আসা শৈশব। ছোটবেলায় ওদের কোয়ার্টারগুলো ছিলো নদীর পাড়ে। প্রথম যেদিন ওরা এখানে এসেছে, তখন বেলা প্রায় শেষ, সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই রূপার কাছে সবকিছু কেমন যেনো পরিচিত মনে হচ্ছিল। সেই এক রকম বারান্দা, টিনের ঘর, সামনে কালো পীচঢালা রাস্তা, রাস্তার পড়েই নদী, রূপার মনে হচ্ছিল যেনো ওরা নারায়নগঞ্জে আছে, নিউ অর্লিন্সে নয়।

পরদিন সকাল সাতটার বদলে সকাল ছয়টাতেই রূপা ঘুম থেকে উঠে বারান্দাতে এসে বসেছিল। সকালেও আগের দিনের মতই লাগছিলো, যেনো নারায়নগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়েই ও বসে আছে, মিসিসিপি নদীর তীরে নয়। জায়গাটা ওর ভালো লেগে গেছে, তাই আজকেও ভোরে ঘুম ভাঙ্গতেই রূপা উঠে এসে বসেছে কটেজের বারান্দায়। ভোরের এই সময়টাতে রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা, আমেরিকানরা এতো সকালে ঘুম থেকে উঠেনা, ছুটির দিন হলেতো কথাই নেই, মাঝরাত অব্দি পার্টি করো, বেলা পর্যন্ত ঘুমাও। এমন সকালে রূপার লিখতে ইচ্ছে করছে। শৈশবের কথা, শীতলক্ষ্যা পারের কথা, রামসুন্দর বসাকের বাল্য শিক্ষা অথবা আদর্শ লিপির কথা, লক্ষ্মীকান্ত প্রাইমারী স্কুলের কথা, কত স্মৃতি এসে ভীড় করছে! রূপা চট করে ঘরে ঢুকে গিয়ে ওর ডায়েরীটা সাথে করে নিয়ে এলো। ডায়েরীটা জীতু প্রেজেন্ট করেছে, এই গেলো বছর ক্রীসমাসের সময়। ডায়েরীটাতে কিছুই লিখা হয়নি এখন পর্যন্ত। রূপা ডায়েরীটার প্রথম পাতা খুলতেই জীতুর শুভেচ্ছাবাণী ‘ রূপার সুন্দর লেখাতে ডায়েরীটা ভরে উঠুক’ আরেকবার পড়লো। সামনের মিসিসিপির বুকে ভাসছে দুটো ছোট জাহাজ। একটি থেকে ছোট্ট করে ভেঁপু বাজালো। রূপা কলমটার ক্যাপ খুলে লিখতে শুরু করলো।

দুইঃ
’৬৯-’৭০ সালের দিকে আমার বয়স ছিল পাঁচ বছর। আমরা থাকতাম নারায়নগঞ্জের নগর খানপুর এলাকাতে। আমার বাবা ফিনলে কোম্পাণীতে চাকুরী করতেন। খুব বড় কোন পোস্টে না, খুব ভালো ইংরেজী জানতেন আমার বাবা, তাই ফিনলে কোম্পাণীতে স্টেনোগ্রাফারের পদে উনি চাকুরী করতেন। ফিনলে কোম্পাণী থেকে কোয়ার্টার দেয়া হয়েছিল, সেই কোয়ার্টারে থাকতাম আমরা। আমাদের কোয়ার্টারের ঘরগুলো ছিলো টিনের চাল, টিনের বেড়া কিন্তু সিমেন্ট বাঁধানো মেঝে। আমার এখনও মনে আছে, একলাইনে মোট সাতটি বাড়ী ছিলো। প্রত্যেকটি বাড়ী একেক স্টাফের জন্য আলাদা আলাদা করে বানানো হয়েছিল, কিনতু কোন এক রহস্যময় কারনে আমাদেরটা আলাদা ছিলোনা, আরেকজনের ঘরের সাথে আমাদের অংশ জোড়া দেয়া ছিল। আমরা দুই পরিবার এক বারান্দা শেয়ার করতাম। মজার কথা হলো, আর বাকী পাঁচ বাড়ীর সামনের দিকে কোন বারান্দা ছিলোনা। তারা সবাই আমাদের বারান্দাতে বসে আড্ডা দিতো। কি যে সুন্দর লাগতো বারান্দায় বসে বসে শীতলক্ষ্যার বুকে পাল তোলা নৌকা, জাহাজগুলোকে দেখতে! সাতটি বাড়ির মধ্যে আমাদের কোয়ার্টার হাউজটি ছিলো তিন নাম্বার পজিশনে।

আমাদের ঘরের ডানপাশের একেবারে শেষের কোয়ার্টারে যিনি থাকতেন, তাঁকে সবাই সত্যেন সাধু বলে ডাকতো। আমরা ছোটরা ডাকতাম সাধু দাদু বলে। উনি ছিলেন অবিবাহিত। কোম্পাণীতে চাকুরী করতেন, অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যার সময় খোল বাজিয়ে কীর্তন করতেন। প্রতিদিন উনার গৃহ দেবতার সামনে নিজ হাতে রেঁধে ভোগ নিবেদন করতেন। পূজা শেষে খোলে বাড়ি দিয়ে সব বাচ্চাদেরকে জানান দিতেন যেনো উনার কাছ থেকে প্রসাদ নিয়ে আসে। আমার মেজো ভাইকে অনেক আদর করতেন উনি। আমার ভাইটা প্রতিদিন উনার কাছ থেকে প্রসাদ আনতে যেতো। ভোগের প্রসাদ মেখে গোল গোল করে লাড্ডু বানিয়ে সবাইকে দিতেন। আমি অবশ্য যেতামনা।

এর পরেরটাতে থাকতো আমাদের সুন্দর দাদু (আমার বাবার আপন কাকা), সুন্দর ঠাকুমা, দুই কাকা ও দুই পিসী। আমার দাদু চাকুরী করতেন, এক কাকা অন্য কোথাও চাকুরী করতো, আরেক কাকা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়তো। দুই পিসী হাই স্কুলে পড়তো। ওদের একটা পোষা কুকুর ছিলো, নাম লালু। ওদের বাড়ীর উঠানে ছিলো মস্ত বড় এক আমগাছ। সেই গাছটাতে প্রায়ই ইষ্টিকুটুম পাখী এসে বসতো আর ‘ইষ্টি কুটুম’ বলে শিস দিতো। সাথে সাথে আমার পিসীরা বলে উঠতো, ‘আইজ আমগোর বাড়িতে ইষ্টি আইবো’।

আমাদের কোয়ার্টার হাউজের বামপাশের কোয়ার্টারে থাকতেন কম্পাউন্ডার কাকু। উনাকে আমরা ডাকতাম পাচ্চু কাকু বলে। পাচ্চু কাকুর মেয়েদের নাম ছিল বাবলী আর সন্ধ্যা। পাচ্চু কাকুর একটা ছেলে ছিলো কিনা মনে পড়ছেনা। বাবলী ছিলো একটু বোকা কিসিমের, আর সন্ধ্যা ছিল চালাক। পাচ্চুকাকুদের একটা আঙ্গুরলতার ঝাড় ছিলো। আমাদের দুই বাড়ীর মাঝখানে একটা টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা মাটির উঁচু ঢিবিতে লাগানো ছিল গাছটা। আমি ছোটবেলাতে একটু ‘ঢ্যাপুস’ টাইপের ছিলাম। কথায় কথায় পা হড়কে পড়ে যেতাম। এক দুপুরে আমি আঙ্গুরলতার গোড়াতে উঠে দাঁড়িয়েছি, পাশে ছিল আমার ছোটবেলার সাথী কুকি। কুকি হঠাৎ করেই ঐ ঢিবি থেকে লাফ দিয়ে মাটিতে পড়েছে, তাই দেখে আমিও লাফ দিয়েছিলাম। কিনতু আমি মাটিতে না পড়ে পুরানো টিনের ঘেরাটোপের উপর পড়েছি। সাথে সাথে বাম পা টা তিন ইঞ্চি পরিমান কেটে গেছিল। কি রক্ত কি রক্ত! পাশের বাড়ীর পাচ্চু কাকা এসে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে একটা ইনজেকশান দিয়েছিল। আমিতো ভয়ের চোটে কাঁদিওনি। পায়ের কাটা দাগটা এত বছর পরও তেমনি আছে। কাটা দাগটি দেখলেই চল্লিশ বছর আগের কথা চোখের সামনে ভেসে উঠে।

পাচ্চুকাকাদের ঘরের পরের ঘরটা ছিল লেদু কাকাদের। লেদুকাকা দেখতে দারুন সুন্দর ছিল অথচ উনার নামটা কে এমন রেখেছিল কে জানে! লেদু কাকার দুই মেয়ের নাম ছিল ময়না ও সম্পা। দুইটা মেয়েই অনেক সুন্দর ছিল দেখতে। একবার ময়নার পায়ের পাতার নীচে একটা বেলকাঁটা ঢুকে গেছিল। আমাদের ঘরের সামনেই রাস্তার ধার ঘেঁসে ছিল বিরাট এক বেলগাছ। মোট দুইটি বেলগাছ ছিল এক সারিতে। বেলগাছ ছাড়াও আরও ছিল বাদাম গাছ। কি বাদাম গাছ ছিলো ওগুলো, নাম জানিনা। আমরা বলতাম কাঠবাদামের গাছ। বাদাম পেকে গেলেই গাছ থেকে টুপটাপ মাটিতে পড়তো। পাকা বাদাম দারুন রসালো ছিলো খেতে, আমরা বাদামের রসালো অংশটা খেয়ে ভেতরের সাদা শাঁস খেতে কি যে পছন্দ করতাম! যাই হোক, সেদিন ময়নার পায়ে বেল কাঁটা ফুটেছিল। ময়না কাঁদছিল অনেক। আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। পাচ্চু কাকীমা একটা সেফটিপিন কেরোসিনের কুপীর আগুনে সেঁকে নিয়ে কাঁটাঁটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করে ফেলেছিল।
লেদুকাকাদের ঘরের পরের ঘরটাই ছিলো বড়ুয়া কাকুদের। বড়ুয়া কাকু ছিল চিটাগাং এর মানুষ। বড়ুয়া কাকুর মেয়ের নাম ছিলো ছুটু আর ছেলের নাম কাজল। কাজল একটু বোকা ছিল। ওরা ছিলো বৌদ্ধ। কাজলই আমাদেরকে বলতো যে বৌদ্ধরা নাকি কোন প্রাণী মারেনা। ওরা নাকি জ্যান্ত মাছ নিজেরা কাটেনা, অন্যে কেটে দিলে সেটা ওরা খেতে পারে। কিসব উলটা পালটা কথাই না আমরা বলতাম। স্বাধীনতার পরে শুনেছি কাজল নাকি মারা গেছে। আমার এখনও মনে পড়ে কাজলের সেই কথাগুলো।  
একেবারে শেষ বাড়ীটাতে যারা থাকতো তাদের মধ্যে দুই জনের নাম মনে আছে। একজন ছিলো ইয়া লম্বা, খোকন কাকা, আরেকজন ছিলো কম লম্বা, দিলীপ কাকা। ওদেরকে কাকা ডাকলেও ওরা ছিলো অনেক ইয়াং। আমার মায়ের কাছে গল্প শুনেছি, আমার ছোটভাইকে নাকি খোকন কাকা উপরে তুলে ছুঁড়ে দিয়ে আবার লুফে নিতো। এভাবে খেলতে গিয়ে একদিন আমার ভাইটা তার হাত ফসকে মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিল। সে এক বিরাট বিশ্রী ব্যাপার হয়ে যেতো যদি ভাইটার কিছু হয়ে যেতো সেদিন। এখন মনে পড়ছে, তাদের মা ছিলো অনেক সুন্দরী, লম্বা, ফর্সা, কপালে লাল বড় সিঁদুরের টিপ, সবাই ডাকতো ‘মঞ্জুর মা’ বলে। আমি মঞ্জু কে দেখিনি, কিনতু ঐ সুন্দরী মাসীকে সকলেই মঞ্জুর মা বলে ডাকতো। সেই বাড়ীতে খোকন কাকার মায়ের কাছে কাছে আরেক বুড়ি আসতো, পিঠ কুঁজা হয়ে হাঁটতো । এমন কুঁজো ছিলো মানুষটা যে মাথাটা একেবারে প্রায় তার হাঁটুর কাছে গিয়ে ঠেকতো।

এবার আমাদের কোয়ার্টার এর কথা বলি। আমরা দুই পরিবার থাকতাম পাশাপাশি। একমাত্র আমাদের কোয়ার্টারে চওড়া সুন্দর বারান্দা ছিল। যেহেতু অন্যদের কারো বারান্দা ছিলোনা, তাই প্রতিদিন বড়রা সন্ধ্যার পরে আমাদের বারান্দায় এসে বসে গল্প করতো। বেশীর ভাগ সময় দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতো। আমার যে সময়টার কথা স্পষ্ট মনে আছে, সেই সময়টাই ছিলো ’৬৯ এর গনআন্দোলনের সময়। আমাদের পাশাপাশি থাকতো সন্তোষ কাকা। সন্তোষ কাকা কিনতু ফিনলে কোমাপাণীতে চাকুরী করতোনা। উনার বাবা ঐ কোম্পাণীতে চাকুরী করতেন বলেই উনারা কোয়ার্টারটাতে থাকতে পেরেছিল। তবে সন্তোষ কাকার ছোটভাই বসন কাকা তার বাবার জায়গাতে চাকুরীটা পেয়েছিল। বসন কাকার কথা তেমন মনে নেই, শুধু মনে আছে বসন কাকা দেখতে সুন্দর ছিল, গলায় একটা সোনার চেইন ছিল, প্রতিদিন সকালে নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজতো, আর মুখে নানা রকম আওয়াজ তুলে মুখ ধুতো। এরবেশী আর কিছু মনে পড়েনা, কারন বসনকাকা বোধ হয় অন্য কোথাও চলে গেছিল কিনতু সন্তোষ কাকা রয়ে গেছিল। সন্তোষ কাকাদের পূর্ব পুরুষের পেশা ছিল নরসুন্দর বা চুলকাটার পেশা। তখনতো আর সেলুনের বেশী চল ছিলোনা, রাস্তার পারেই চুলকাটার সরঞ্জাম নিয়ে ক্ষৌরকারেরা বসে যেতো। কি জানি কেনো, সন্তোষ কাকাদের পরিবারে একমাত্র সন্তোষ কাকাই তাদের আদি পেশাটিকে ধরে রেখেছিলেন। সন্তোষ কাকার ছিল দুই মেয়ে দুই ছেলে। কল্পনা দিদি ছিল সকলের বড়, হাই স্কুলে ক্লাস টেনে পড়তো, তারপরেই ছিল স্বপন দাদা, মনা দাদা, সবার ছোট কুকি। কুকি আর আমি খুব বন্ধু ছিলাম। কাকীমা ছিল দেখতে কালো, কিনতু এই কাকীমা আমাদের সবাইকে অনেক ভালবাসত। আর সন্তোষ কাকা পেশাতে ক্ষৌরকার হলে কি হবে, সন্তোষ কাকা ছিল মজলিশী মানুষ, খুবই হিউমার জানত, এমন সব কথা বলতো যে প্রতিটি কথাই অনেক তাৎপর্য্যপূর্ণ। একটা কথা নিয়ে আমরা এখনও হাসাহাসি করি। সন্তোষকাকা লেখাপড়া কতদূর করেছিল জানিনা, কিনতু আমার বাবাকে খুব সম্মান করতো। আমার বাবার কথা বলতে গেলে বিরাট ইতিহাস হয়ে যাবে, এখানে অন্য সবার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আমার বাবা ছিলেন একজন আদর্শ মানুষ। চাকুরী করতেন খুবই সাধারন, কিনতু তাঁর হাত ধরেই আমাদের পরিবার থেকে বের হয়েছে বিশ্যবিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ইঞ্জিনীয়ার, ব্যাঙ্কার, সরকারী কলেজের অধ্যাপকসহ দারুন দারুন সব কীর্তিমানেরা। সন্তোষ কাকা সব সময় চাইতো, স্বপন দাদা যেনো আমার বড় ভাইয়ের মতই পড়াশুনাতে মনোযোগী হয়। কিনতু স্বপন দাদা পড়াশুনায় তেমন মনোযোগী ছিলনা বলে সন্তোষ কাকা নিজের ছেলেকে, ‘গোলামের ঘরের গোলাম’ নাহলে ‘টীক্কা খান’ সহ নানা বিদ্রূপাত্মক কথা দিয়ে শাসন করার চেষ্টা করতেন। স্বাধীনতার পরে অবশ্য সেই স্বপন দাদা মাস্টার্স পাশ করে, ছায়ানটে গান শিখে একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেছে। স্বপন দাদা ব্যাঙ্কের বড় অফিসার এখন।
আমাদের পরিবারে ছিলাম মোট আটজন। আমার বাবা মা, আমরা তিন ভাই ও আমি, আমাদের ঠাকুমা, আর আমাদের এক জ্ঞাতি পিসী। আমার বাবা প্রায়ই গ্রাম থেকে পিসীদের একজন একজন করে শহরে এনে হাই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতেন, ম্যাট্রিক পাশ করিয়ে তবে বাড়ী পাঠাতেন। উহ! মাসীমার কথা বলতে ভুলেই গেছি। মাসীমা যাকে ডাকতাম, বড়রা তাকে ডাকতো ‘পরেশের মা’ বলে। আমাদের বাড়ীতে থেকে কাজ করতো। দারুন ফর্সা সুন্দর ছিল মাসীমা। লাল টকটকে সিঁদুরের টিপ কপালে জ্বলজ্বল করতো। ইদানিং দেশে খবরের কাগজে প্রায়ই দেখি, কাজের মেয়ের উপর অত্যাচারের করূন কাহিণী। অথচ এই মাসীমা কিনতু সেই তথাকথিত কাজের মহিলাই ছিল, অথচ আমরা ভুলেও ওভাবে চিন্তাই করিনি। মানে বড়রা আমাদেরকে যেভাবে শিখিয়েছেন, সেভাবেই আমরা শিখেছিলাম। এই মাসীমার সাথে শুধুই আমার একটা খুব সুন্দর স্মৃতি আছে। মাসীমার জন্য যখনই আমার মা শাড়ী কিনে নিয়ে আসতো, মাসীমা আমাকে চুপ করে রান্নাঘরে ডেকে নিয়ে যেতো। ওখানে তার জন্য আনা নতুন শাড়ী আমাকে কুচি দিয়ে পড়িয়ে দিতো। আমিতো খুশীতে ডগমগ হয়ে যেতাম। এর কোন কারন আমি জানতামনা, পরে মা’কে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম, অনেকেই নাকি আনকোড়া নতুন শাড়ী পড়েনা। সেই জন্যই মাসীমা আমাকে একবার পড়িয়ে দিয়ে শাড়ীর নতুনত্ব ভাঙ্গতো। রাতের বেলা মাসীমার কাছে আমরা সবগুলি বাচ্চা গোল হয়ে বসে অনেক গল্প শুনতাম। আমার ভাইয়েরা হয়তো ভুলেও গেছে সবকথা, কিনতু এই রূপা রানী কিছুই ভুলে নাই।

৩.

’৬৯ এর দিকেই আমাকে লক্ষ্মীকান্ত প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। আমি যেতাম ‘বেবী ক্লাসে’। বেবী ক্লাসে পড়লে কি হবে, আমিতো আমার দাদাদের বই থেকেও অনেক কবিতা মুখস্থ করে ফেলতাম। আমাদের শীতলক্ষ্যা পাড়ের ঐ কোয়ার্টারগুলিতে রাতের বেলা হারিকেন জ্বলতো। কারেন্টের চলন ছিলোনা। ঘরে খাট পালঙ্ক ছিলোনা, বদলে দুইটা চৌকি বা তক্তপোশ একসাথে জোড়া দিয়ে বড় ঘরটাতে পেতে রাখা হয়েছিল। একপাশে ছিলো একটা কাঠের টেবিল ও একটি চেয়ার। পার্টিশান দেয়া পাশের ঘরটিতে ছিলো আরেকটি চৌকিপাতা, সাথে একটি চেয়ার ও টেবিল। আর একেবারে ভেতরের দিকে আরেক ফালি জায়গা যেটুকু ছিলো, তার একদিকে আমার ঠাকুমার জন্য একটি  চৌকি পাতা ছিল, আরেক দিকে আমার বিধবা ঠাকুমার জন্য নিরামিষ রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমার ঠাকুমা অন্য সব সাধারন ঠাকুমাদের মত ছিলোনা, খুবই সচেতন, ঠান্ডা সুস্থির মানুষ ছিলেন। আমাদের ঘরের এমন সাজসজ্জার ভেতর আমরা কোন প্রশ্ন ছাড়াই বড় হচ্ছিলাম। আমরা সন্ধ্যাবেলাতে কেরোসিনের একটি হ্যারিকেন জ্বালাতাম, বড় চৌকিটার উপর হ্যারিকেন রেখে আমরা তার চারপাশে গোল হয়ে বসতাম, আর জোরে জোরে আওয়াজ তুলে পড়াশুনা করতাম। বিশেষ করে কবিতা বা ছড়াগুলো সুর করে করে পড়তে ভালো লাগতো। আমরা দুই একটা কবিতা নিয়ে ব্যঙ্গও করতাম। যেমন একটি কবিতা ছিলো,
‘দেশে দেশে পড়ে সাড়া, বুক টান করে দাঁড়া’। আমার মেজ ভাইটা বলতো, “এই কথার মানে কি বুঝছস? মানে হইলো, এইবার পশ্চিম পাকিস্তানের লগে আমগোর যুদ্ধ হইব। আমাদেরকে এটেনশান হইয়া থাকতে বলছে”।
আমরা তখন অনেক ছোট হলেও কিছু কিছু জিনিস আমরা আঁচ করতে পারতাম। যেমন আমাদের বাড়ীর কাছাকাছি মারোয়ারী বা বিহারীদের কলোনী ছিল। আমাদের বাড়ীর সামনের রাস্তা দিয়ে কতগুলো বিহারী ছেলে দলবেঁধে যাওয়ার সময় আমরা সুর করে করে চেঁচাতাম, ‘ মাউরা সব ঘাউরা খায়’। বলেই দিতাম ছুট। প্রায়ই ছেলেগুলো আমাদের উলটো তাড়া করতো। আমি অনেক ভয় পেতাম, তারপরেও ভাইদের দেখাদেখি এটা করেই যেতাম। একদিন আমার মেজভাই ঘরে এসে বললো, ‘ঐ মাউরা ছেলেদের সাথে খাতির করতে হবে। ওদের মনের ভিতরে কত প্ল্যান আছে, সেইটা আগে জানতে হবে। ওরা একটা ছড়া বলে, “ মু’মে দাড়ি, হোঁট মে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান”। হায় হায় এমন কথা শুনেতো একদিন আমার বাবা মেজো ভাইকে এই মারেতো সেই মারে অবস্থা। এমন ছড়া আমার ভাইটা আর কোনদিন আওড়ায়নি।
লক্ষ্মীকান্ত প্রাইমারী স্কুলে যেতাম, আমার জন্য একজন মাসী ঠিক করা হয়েছিল। মাসী সব সময় কালো বোরকা পড়ে থাকতো। এই মাসী আমাকে যেমন  স্কুলে দিয়ে আসতো, ছুটির পরে আবার আমাকে নিয়েও আসতো।  স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রায় দিন অন্য বাচ্চা ছেলেমেয়েদের লাফিয়ে লাফিয়ে একটি ছড়া বলতে শুনতামঃ আজকে ইস্কুল বন্ধ, গোলাপ ফুলের গন্ধ। ঢাকা গাড়ী চলেনা, আমরা ঢাকায় যামুনা।‘ ’৬৯ ‘’৭০ এর গন আন্দোলনের সময়  হরতাল, অবরোধতো লেগেই ছিলো। শ্লোগানে শ্লোগানে চারিপাশ ছিল মুখরিত। আমাদের বাড়িগুলো ছিলো একেবারে রাস্তার উপরেই। আমাদের বাড়ীর পরেই ছিলো কালো চওড়া পীচঢালা রাস্তা। এই রাস্তার পরেই ছিলো শীতলক্ষ্যা নদী। আমরা বারান্দায় বসে বসে অনেক দৃশ্যই দেখতে পেতাম। নদীতে অনেক নৌকার যাতায়াত ছিল। কোন কোন নৌকার ছৈ এর উপর মাইক বসানো থাকতো। দূরপাল্লার নৌকাগুলোতেই মাইক বাজানো হতো, আর যদি কোন বিয়ের যাত্রী নিয়ে নৌকা যেতো, সেই নৌকা থেকে গান ভেসে আসতো, ‘ ঢেউ দিয়োনা ঢেউ দিও না, ঢেউ দিওনা জলে, ওলো প্রান সজনী, আর জলে ঢেউ দিয়োনা’ অথবা ‘ আগুন জ্বালাইসনা আমার গায় রে, আগুন জ্বালাইসনা আমার গায়”। এমন গান শুনলে পরে আমার গায়ে কেমন যেনো কাঁটা দিতো। কেউতো আর পাঁচ ছয় বছর বয়সী মেয়ের মনের খবর রাখতোনা, তাই মেয়েটি মনের মাধুরী মিশিয়ে কত কিছু যে ভাবতো তার ঠিক নেই।
এভাবেই নদীর নৌকা রাস্তায় উঠে এলো। হ্যাঁ, সত্তর এর নির্বাচন এগিয়ে এলো। আওয়ামী লীগের মার্কা ছিলো নৌকা। প্রায় দিন রাস্তা দিয়ে মিছিল যেত, ‘জেলের তালা ভাঙ্গবো, শেখ মুজিবকে আনবো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’ অথবা ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’। আরেকটা মজার শ্লোগান ছিল, ‘ এক টাকা সের ভুট্টা, আইয়ুব শালায় চোট্টা’, ‘দুই টাকা সের আদা, আইয়ুব শালায় গাধা’। মোনায়েম খাঁ আর আইয়ুব খাঁ কে একসাথে মিলিয়ে যে শ্লোগান ছিলো, সেটা ছিলো ‘ আলু মূলা দুই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসী চাই’ এমনই আরও কত মজার মজার শ্লোগানে রাস্তাঘাট মুখর থাকতো।

নির্বাচন যতই এগিয়ে আসতে লাগলো, নৌকা নিয়ে মিছিলও তত বেশী ঘন ঘন আসতো। আমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছোট বড় সবাই মিলে সেই মিছিল দেখতাম আর হাততালি দিতাম। এক সন্ধ্যায় বিরাট বড় এক ‘মশাল মিছিলের’ কথা মনে পড়ছে। কত কত লোক হাতে লাঠির আগায় আগুন জ্বালিয়ে ‘মানিনা মানিনা’ বলে শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছিলো, আমার মেজ ভাই আমার চেয়ে মাত্র তিন বছরের বড় হলেও সারা দুনিয়ার খবর রাখতো। মেজ ভাইই আমাকে বলেছিল, “এগুলিকে বলে মশাল। পাকিস্তানীরা বেশী বাড়াবাড়ি করলে এই মশাল দিয়া ‘আলু-মূলার’ গদিতে আগুন লাগাইয়া দিবে।“একদিন আমার বাবা খুব হন্তদন্ত হয়ে অফিস থেকে বাসায় ফিরে এসেছিলো। বলেছিল যে আজকে কার্ফিউ দিবে। আমি মেজদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মেজদা কার্ফু কি?’ সবজান্তা মেজদা বলেছিল, ‘কার্ফু হইল কার্ফু। মনে কর, আমরা যেমুন হরতাল করি, রাস্তাঘাটে কোন গাড়ী চলতে দেইনা, তেমুনই আলু-মূলা খাঁনেরা যখন হরতাল করে, সেইটারে কয় কার্ফু। তারা পাবলিকরে রাস্তায় নামতে দেয়না। রাস্তায় কাউরে দেখলেই মিলিটারী দিয়া গুল্লী কইরা মারে”। আমিও খুব মাথা ঝাঁকিয়ে ‘সব বুঝেছি’ ভাব দেখাইতাম। তা একদিন এক কার্ফ্যুর বিকেলে আমি আর আমার ঠাকুমা আমাদের বাড়ীর পেছন দিক দিয়ে খুব সাবধানে পা টিপে টিপে আমার সুন্দর দাদুর কোয়ার্টারে গেছিলাম। পরে ঠারুমার সাথেই আবার নিজেদের ঘরে ফিরতে গিয়ে ঠাকুমাকে থমকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেনো থেমেছো?’ ঠাকুমা জবাবে ফিসফিস করে বলেছিল, ‘চুপ করে থাক, মিলিটারী ট্রাক নামছে, আওয়াজ পাইতাছি, একটুক্ষন দেইখা যাই, ট্রাক পার হইয়া গেলেই আমরা ঘরে চইলা যামুনে’। ট্রাক একটা চলে গেলো আমাদের বাড়ীর সামনে দিয়ে, তারপরেও ঠাকুমা আমার হাত ধরে একটানে বাসায় চলে এসেছিলো। এভাবেই হরতাল আর কার্ফ্যুর পাল্টাপাল্টির দিনগুলোর মধ্যেই আমার বাবা একদিন এসে বললেন যে উনাদের ফিনলে কোম্পাণী তাদের ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ করে নিজের দেশে চলে যাচ্ছে। সবার চাকুরী শেষ। তখন সব খবরই শুনতে এক রকম লাগতো। কেমন যেনো সবকিছুতেই হায় হায় রব ছিল। একদিন আমার বাবা ঘরে এসে বললেন, উনি আরেক জায়গায় চাকুরী পেয়ে গেছেন। আমরা আর এই কোয়ার্টারে থাকতে পারবোনা, অন্য কোথাও চলে যেতে হবে।
সত্তর সালের অক্টোবার এর দিকেই আমরা আমাদের এতো প্রিয় ফিনলে কোম্পাণীর কোয়ার্টার ছেড়ে চলে গেলাম আমলাপাড়াতে। সেখানে আমার দাদুর বাসা ছিল। দাদুর বাসার কাছাকাছিই আমাদের বাসা ভাড়া করা হয়েছিল। নতুন বাসায় এসে আমি বিরাট পরিবর্তন দেখলাম। আগের কোয়ার্টার ছিলো টিনের ঘর, হ্যারিকেনের আলো, আর এখনকার বাসা ছিলো দালানের কোঠা (একেবারে নতুন বানানো), ইলেকট্রিক লাইট ফিট করা, ঘরের ভেতর রান্না ঘর, বাথরুম। একেবারে উল্টোচিত্র। নতুন বাড়ীতে এসে ভালোভাবে বসতেও পারিনি, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো।

৪.

রূপা সেই সকাল থেকেই একটানা লিখেই চলছিলো। জীতু কখন যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, রূপা খেয়াল করেনি। জীতুর ডাকেই যেনো রূপার ধ্যান ভাঙ্গলো। কলমটা হাতে ধরাই ছিলো, রূপা কেমন ঘোরলাগা চোখে জীতুর দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন। জীতু জিজ্ঞেস করলো, ‘ কি ব্যাপার, কি ভাবছো? অমন করে তাকিয়ে আছো, দেখে মনে হচ্ছে তুমি অন্য কোন জগতে আছো! কি লিখছিলে সারাদিন?” রূপা এবার একটু নড়েচড়ে বসলো। মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। বললো, “ তাইতো! কখন এমন বিকেল হয়ে গেলো টেরই পাইনি। তুমি বলছিলে, আমি অন্য দুনিয়ায় ছিলাম! হ্যাঁ, অন্য দুনিয়া বটে। আমি ছিলাম ছোটবেলার সেই নগর খানপুরের দিনগুলিতে। মার্চ মাসতো, মার্চ এলেই আমার সেই দিনগুলোর কথা মনে হয়। কত ঘটনা চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। জানোতো, মুক্তিযুদ্ধের উপর কত বই লেখা হয়েছে, তারপরেও মনে হয় কিছুই লিখা হয়নি। এই যে আমার মত সাধারন একজন মানুষ, আমি কিভাবে দেখেছিলাম ঐ সময়ের দিনগুলিকে, যদি সময় থাকতেই ডায়েরীতে লিখে রাখতে পারতাম, সেটাও একটা মুক্তিযুদ্ধের দলিল হিসেবে কাজে আসতো।“ জীতু বললো, ‘এতোদিন লিখোনি, এখন লিখবে। তোমার স্মৃতিশক্তি অসম্ভব ভালো, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। লিখতে শুরু করো, দেখবে সব মনে পড়বে। আসলেই দলিল হয়ে থাকবে প্রতিটি কথা। স্বাধীনতা এসেছে তোমার আমার সকলের অংশগ্রহনের ভেতর দিয়ে। আগে লিখোনি তা নিয়ে দুঃখ করোনা, আজকের দিনটি তোমার ডায়েরীর পাতায় চিহ্ন হয়ে থাকবে। সেই সাথে আমার নামটিও স্মরণীয় হয়ে থাকবে, কি বলো? ভাগ্যিস ডায়েরীটা দিয়েছিলাম, তাইতো তোমার লিখতে ইচ্ছেও হলো। আমার খুব ভালো লাগছে অন্য কারনে। তুমি নানা কাগজে, খাতায় কত কিছুর খসড়া লিখে রেখেছো। অথচ তোমার শৈশব শুরু করেছো এই ডায়েরীতে। তোমার শৈশব মানেইতো ঊনসত্তরের গন আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।“ রূপা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে জীতুর দিকে। মানুষটিকে সব সময় কেমন যেনো আত্মভোলা মনে হয়েছে এতোকাল। রূপা নিজে যতটা আবেগপ্রবন, জীতুকে কখনও তেমন আবেগপ্রবন হতে দেখেনি রূপা। অথচ আজ কত গভীর থেকে কথাগুলো সে বলে যাচ্ছে। জীতু এবার রূপাকে বললো, “ শোন, আজ আর লিখোনা। একদিন বিশ্রাম নাও লেখালেখি থেকে। চলো বাইরে থেকে একটু হেঁটে আসি, এতে করে মনটা ফুরফুরে লাগবে, দেখবে পরের প্লট লিখতে গেলে কলম আর থামতে চাইবেনা। তুমি বরং উপন্যাস লিখার কথা ভাবতে পারো।“ রূপা কলম ও ডায়েরী বন্ধ করে উঠে পড়লো। জীতুকে একটু বসতে বলে সে ভেতরে চলে গেলো। বাথরুমে ঢুকেই সে বেসিনের কলটা ছেড়ে দিলো। চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে নিলো কয়েকবার। রূপার ভেতরটা এক নিদারুন কষ্টে ছেয়ে আছে। নগর খানপুরের যে কোয়ার্টারের স্মৃতি আজও চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়, সেই কোয়ার্টারগুলো একাত্তরের জুন মাসের দিকেই মনে হয়, পাকবাহিণী আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছিল। তারা খবর পেয়েছিলো, ঐ কোয়ার্টারগুলোতে সব কাফের থাকতো, তাই কাফেরদের চিহ্ন রাখতে চায়নি তারা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে মায়ের সাথে রূপা আর তার মেজদা গিয়েছিলো নগর খানপুরে। গিয়ে দেখতে পায়, শুধু পাচ্চু কাকাদের ঘর আর বড়ুয়া কাকুদের ঘর দুটো আছে, রূপাদের ঘরের থেকে শুরু করে শেষ সাধু দাদুর বাড়ী পর্যন্ত জায়গাটুকু একেবারে ফাঁকা। কিছুই অবশিষ্ট ছিলোনা। রূপার মেজদাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলোনা, পরে দেখা গেলো রূপার মেজদা সাধু বাবুর বাড়ীর দিকটাতে গিয়ে আমগাছটার গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে আছে আর সমানে দুই চোখ মুছেই যাচ্ছে।

No comments:

Post a Comment