Saturday, March 30, 2013

ইস্টার সানডের সকালে ইস্টার বানির আগমন!!



ইস্টার সানডের সকালে ইস্টার বানির আগমন!!


আজ ইস্টার সানডে! শিশুদের জন্য পরম আনন্দের দিন। ভোর সকালে চকোলেটের ঝুড়ি হাতে ঝুলিয়ে ধবধবে সাদা খরগোশটি লাফিয়ে লাফিয়ে সবার বাড়ীর উঠোন পেরিয়ে যাবে, যাওয়ার সময় ঝুড়ি থেকে ডিম ফেলে ফেলে যাবে, ডিমগুলো কখনও ঝোপের আড়ালে থাকবে, কখনওবা নরম ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে থাকবে। দুরন্ত খরগোশ এমনভাবেই ডিমগুলোকে ফেলে যায় যে, ছোট সোনামনিদের খরগোশের ডিম খুঁজে পেতে কোন অসুবধাই হয় না। ইস্টার সানডে’র সকালের এই ধবধবে সাদা খরগোশটির নাম ‘ইস্টার বানি’।

বাংলাদেশে যেমন বারো মাসে তেরো পার্বণ,পশ্চিমা দেশগুলোতেও তেমনি বারো মাসে তেরো-চৌদ্দ পার্বণ লেগেই থাকে। বিশেষ করে আমেরিকাতে প্রতি মাসে একটা না একটা কিছু পরব আছেই। এবং শুধুমাত্র শিশুদের জন্য বিশেষ উৎসব হচ্ছে ইস্টার সানডে’র ইস্টার বানি উৎসব এবং ক্রিসমাস ডে’র স্যান্টা ক্লজ উৎসব। শিশুরা চকোলেট, ক্যান্ডি ভালোবাসে বলে ইস্টার বানি এবং স্যান্টা ক্লজ ওদের জন্য চকোলেট, ক্যান্ডিসহ নানা বর্ণের উপহার নিয়ে আসে। যদিও ক্রিসমাস ও ইস্টার পরবের সাথে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য্যের সম্পর্ক আছে, কিন্তু এরই সাথে আছে শিশুতোষ আনন্দের সম্পর্ক। ক্রিসমাস মানেই যেমন স্যান্টা ক্লজ, তেমনি ইস্টার সানডে মানেই ইস্টার বানি বা খরগোশ! এবারের ইস্টার সানডেতেও ঝুড়ি ভর্তি ডিম (চকোলেট) নিয়ে ইস্টার বানি ছুটে গিয়েছে এবাড়ী থেকে ওবাড়ী, আর রেখে এসেছে শিশুদের জন্য সাথে নিয়ে আসা উপহার।



কেনো খরগোশ!

চান্দ্রমাসের হিসেব অনুযায়ী ইস্টার উদযাপিত হয় বসন্তকালে। যে কোন উৎসবেরই মূল ভাবনা হচ্ছে জীবনের কল্যান। দ্বিতীয় শতাব্দীতে শুরু হওয়া ইস্টার উৎসবের ঐ সময়কালীন প্রেক্ষাপটে সমাজের বিস্তৃতি ও সমৃদ্ধিই ছিলো জীবনের মূল চেতনা। বিস্তৃতি ও সমৃদ্ধির ধারণাটিকে ঠিক রেখেই ইস্টার সানডে উৎসবের লোগো করা হয়েছে খরগোশ। ইস্টার খরগোশকে নিয়ে অনেক মিথ চালু থাকলেও, প্রানীকুলের মধ্যে খরগোশকে ‘সিমবল অফ ফার্টিলিটি’ বলা হয়ে থাকে। একমাত্র খরগোশই একেকবারে প্রচুর বাচ্চা প্রসব করে। বসন্তের এই সময়টাতেই খরগোশ বাচ্চা প্রসব করে। তাই সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবেই খরগোশকে ‘ইস্টার বানি’বলা হয়। ইস্টার বানিকে বানিজ্যিকভাবে সফল করেছে বানিজ্যিক সংস্থাগুলো। বিশেষ করে চকোলেট কোম্পাণীগুলোই চকোলেট দিয়ে খরগোশের নানা প্রতিকৃতি, খরগোশের ডিম তৈরী করে শিশুমনের কল্পনাতে এক বিরাট ভুমিকা রেখেছে।

ইস্টার বানি এপ্রিল মাসে আসার কথা থাকলেও এ বছর আরেকটু আগেই চলে এসেছে। এ বছর এপ্রিলের পরিবর্তে ৩১শে মার্চ ‘বানি’ এসেছে। সাধারণতঃ মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই এখানের স্টোরগুলোতে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। প্রতি বছর নানা সাইজের খরগোশ ও নানা রঙের ডিম দিয়ে দোকানগুলো সাজানো হয়। স্টাফড খরগোশ, গল্পের বইয়ে খরগোশ, এনিমেটেড ছবিতে খরগোশ, ডিভিডিতে খরগোশ, বাচ্চাদের পোষাকে খরগোশ, চুলের হেয়ার ব্যান্ডে খরগোশ, বাচ্চাদের প্লেট গ্লাস, ওয়াটার বটল, পায়ের জুতা মোজা সবকিছুতেই খরগোশের লোগো থাকে। ডিমগুলো হয় রঙ বেরঙের। বসন্তকালীন উৎসব বলেই হয়তো প্রকৃতির সাজের সাথে মিল রেখে ডিমগুলোকে রাঙানো হয়ে থাকে। ডিম ছাড়াও চকোলেটের তৈরী নানা আকৃতির খরগোশ থাকে। প্লাস্টিকের রঙ্গীন ডিমের ভেতরে থাকে চকোলেট, রঙ বেরঙের রাংতা কাগজে মোড়ানো থাকে নানা সাইজের চকোলেট। এমন দৃষ্টিনন্দন জিনিস সকলেরই দেখতে ভালো লাগে। একমাস ধরেই চলে চকোলেট কোম্পাণীগুলোর আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন ও বিপনন। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ জুড়ে ছিল ফটোসেশান। দোকানে, শপিং মলে, খরগোশের কস্ট্যুম পড়ে ‘মানুষ বানি’ সব বয়সের বাচ্চাদের সাথে ছবি তুলেছে, আর ইস্টার সানডের সকাল থেকে বাচ্চাদের হাত ভরে চকোলেট দিয়েছে।

এগ হান্টিং
ইস্টার উৎসবের মূল আনন্দই হচ্ছে এগ হান্টিং। বাচ্চাদের ধারণা, ইস্টার বানি তাদের জন্য চকোলেট ডিম নিয়ে এসে বাড়ির চারিদিকে লুকিয়ে রেখে যায়। পরের দিন সবগুলো ডিম খুঁজে বের করাই তাদের একমাত্র কাজ। অনেক কঠিন এই খেলা, কারন বানি বাচ্চাদের সাথে মজা করতে ভালোবাসে। সে চকোলেট ডিম বাগানে রাখে, বারান্দার কোনে কোনে রাখে, ঘরের ভেতর ঢুকে কত জায়গায় যে লুকিয়ে রাখে তার ঠিক নেই। বালিশের নীচে, খেলনার ঝুড়িতে, বুকসেলফ এর আড়ালে, টিভির আড়ালে (এটা বিপদজনক, চকোলেট খুঁজতে গিয়ে টিভি উলটে পড়ে দূর্ঘটনা ঘটেছে অনেকবার), কিচেনে, চিনির বোয়ামে, এমনি আরও নানা জায়গায়। সারাটাদিন পার হয়ে যায় ডিমগুলোকে খুঁজে বের করতে। শুধু কি নিজের বাড়িতে এগ হান্টিং চলে? গ্র্যান্ডমা, আন্টি, আঙ্কলদের বাড়িতেও যেতে হয়, বানি ওখানেও রেখে আসে ডিম।

বাচ্চারা শনিবারের রাতেই তাদের মাথার টুপী বা বাস্কেট বাগানের গাছের ঝোপে রেখে দেয়। তারা জানে, ইস্টার বানি রাতের আঁধারে এসে বাস্কেটগুলো ভরে দিয়ে যাবে ‘চকোলেট এগ’ দিয়ে। রবিবার ভোরে ঘুম ভেঙ্গেই বাচ্চারা ছুটে যায় বাগানে। আগের রাতে রেখে আসা হ্যাট বা বাস্কেট ভর্তি নানা রঙের ডিম দেখে তাদের খুশীর সীমা থাকেনা। বাগানের হান্টিং শেষে তারা ঘরে হান্টিং শুরু করে। দিনের শেষে দেখা যায় ঝুড়ি উপচে পড়ছে চকোলেট ডিম। ইস্টার বানি বাচ্চাদের বন্ধু। স্যান্টা ক্লজের মতই বানিও সারা পৃথিবী দৌড়ে বেড়ায় আর বাচ্চাদেরকে ঝুড়ি ভর্তি ডিম দিয়ে আসে। ডিম ছাড়াও বানি বাচ্চাদের জন্য নানা ধরণের উপহারও নিয়ে যায়। বানির কাছ থেকে পাওয়া চকোলেট বাচ্চারা সবার সাথে শেয়ার করে খায়। এভাবেই বাচ্চারা ছোটবেলা থেকেই শেয়ারিং শিখে।

ইস্টার বানি কেনো আসে

স্যান্টা ক্লজ অথবা ইস্টার বানির কাছ থেকে বাচ্চারা শুধু নিতেই শিখে না, দিতেও শিখে। বাচ্চা বয়সে শেখা এই মহৎ গুনগুলো জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত বহন করে যাওয়া খুবই কঠিন। কৈশোর পেরোলেই মানুষের মনে স্বার্থচিন্তা ঢুকে যায়, তখন মানুষ দিতে চায় না, নিয়ে সুখ পায়। আজ পৃথিবীতে এত হানাহানি, এত স্বার্থপরতা, এত বেশী আগ্রাসন! তাই বুঝি এমনই অশান্তিময় সময়ে স্যান্টা ক্লজ বা ইস্টার বানি বছরের নির্দিষ্ট সময়ে নেমে আসে এই ধরণীতে, ছুটে ছুটে যায় প্রতিটি শিশুর কাছে। চেষ্টা করে শিশুদের মধ্যে ভালোবাসার বীজ বপন করে দিতে। শিশুরা নির্মল, শিশুরা পবিত্র, এই শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যত। প্রতি একশত শিশুর মধ্যে একজন শিশুও যদি পারে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত আর্তের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে, তাহলেই পৃথিবীটা হয়ে উঠবে অনেক আনন্দের, অনেক ভালোবাসার। এই আশাতেই স্যান্টাক্লজ ও ইস্টার বানি এখনও পিঠে উপহারের ঝোলা নিয়ে ছুটে ছুটে আসে এই ধরণী মাঝে, শিশুদের কাছে।   

Tuesday, March 26, 2013

মার্চ মাসে বিশ্বের যে দেশগুলোর স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল!

২৬শে মার্চ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবস। ‘স্বাধীনতা’ মানেই পরাধীনতার শৃংখল ভাঙ্গার গান। বিশ্বের প্রতিটি প্রাণীর স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে, আর মানুষ হচ্ছে সৃষ্টির সেরা জীব। সেই মানুষকেই যদি অন্যের শাসনাধীনে থাকতে হয়, কখনও না কখনও তার অন্তরে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে। পরাধীনতার শৃংখল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার জন্য মন আঁকুপাকু করে। দিনে দিনে বুকের ভেতর সাহস সঞ্চয় করে এবং এক সময় বারুদের মত জ্বলে উঠে। পরাধীনতার যন্ত্রণা যখন একজন হয়ে অন্যজনকে ছুঁয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে আশপাশের সকলের মধ্যেই প্রতিবাদী চেতনার জন্ম হয়, তখনই মানুষ জোটবদ্ধ আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের মাত্রা যত জোরালো হয়, অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাওয়ার শক্তিও তত জোরালো হয়ে উঠে। আর এভাবেই জন থেকে দল, দল থেকে গোষ্ঠী, গোষ্ঠী থেকে জাতি পর্যন্ত ব্যাপৃত হয়ে যায় প্রতিবাদের আগুন। প্রতিবাদের আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় অন্যায়কারীর সিংহাসন, প্রতিবাদের কাছে নতি স্বীকার করতেই হয় জুলুমবাজদের।
এই বিশ্বে প্রায় ১৭৪ টি দেশেই কোন না কোন সময় প্রতিবাদের আগুন জ্বলেছিল, প্রতিবাদ আন্দোলন হয়েছিল দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। উল্লিখিত সংখ্যার দেশগুলো যুগের পর যুগ ধরে অন্য দেশের অধীনে ছিল, পরাধীন দেশগুলোর পরাধীন জনগণ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছে কয়েক যুগ ধরে, আন্দোলন তুঙ্গে উঠতেই বীরদর্পে পরাধীনতার কবল থেকে মুক্ত হয়ে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। যে নির্দিষ্ট দিনটিতে ‘স্বাধীনতা’ ঘোষিত হয়েছে, সেই দিনটিকেই ‘স্বাধীনতা দিবস’ বা ‘ইনডিপেন্ডেন্ট ডে’ হিসেবে প্রতি বছর পালন করা হয়ে থাকে।
হিসেব করে দেখা যায়, বারো মাসের প্রতিটি মাসেই কোন না কোন দেশের ইনডিপেন্ডেন্স ডে বা জাতীয় দিবস উদযাপিত হয়। মার্চ মাসে বাংলাদেশ ছাড়াও আরও আটটি দেশে স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয়। যে আটটি দেশ মার্চ মাসে স্বাধীন হয়েছিল, তাদের প্রতিটি দেশই অনেক বছর ধরে শক্তিশালী গ্রেট বৃটেন, জার্মানী, অস্ট্রিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স কর্তৃক অধিকৃত ছিল। সেই পরাধীন দেশগুলো হচ্ছে,
১) বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, ২) ঘানা, ৩) হাঙ্গেরী, ৪) লিথুয়ানিয়া, ৫) মরিশাস, ৬) তিউনিসিয়া, ৭) নামিবিয়া, ৮) গ্রীস।
বসনিয়া-হার্জেগোভিনা ১৯৯২ সালের ১লা মার্চ যুগোশ্লাভিয়ার অধীনতা থেকে মুক্তি লাভ করে। বসনিয়া-হার্জেগোভিনা দক্ষিন-পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি দেশ। বসনিয়ার রাজধানী শহরের নাম সারাজেভো। বসনিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য পৃথিবীর পর্যটকদেরকে বিমোহিত করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত বসনিয়া ছিল সার্ব, ক্রোয়েট এবং শ্লোভেনিয়ানদের রাজ্য হিসেবে পরিচিত, ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নাম বদলে নতুন নাম হয় যুগোশ্লাভিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যুগোশ্লাভিয়া ফেডারেশান নামে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পূর্ণ স্ট্যাটাস পায়। বসনিয়ানরা যুগোশ্লাভিয়ার অধীনস্থ হয়ে থাকতে চায় নি। আভ্যন্তরীন যুদ্ধ (বসনিয়া যুদ্ধ), হানাহানির শেষে ১৯৯২ সালে সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটিয়ে সোশ্যালিস্ট ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোশ্লাভিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বসনিয়া-হার্জেগোভিনা নামে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
ঘানা স্বাধীন হয়েছে ১৯৫৭ সালের ৬ই মার্চ, নতুন নাম রিপাবলিক অফ ঘানা। পশ্চিম আফ্রিকার অন্তর্গত ছোট এই দেশটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। প্রাচীন ঘানা সাম্রাজ্যের নামানুসারে দেশটির নাম হয়েছে ঘানা, যার আভিধানিক অর্থ ‘যোদ্ধা রাজ’। ঘানা ছিল স্বর্ণখনির জন্য প্রসিদ্ধ। ফলে প্রাচীনকাল থেকেই এখানে বিভিন্ন সময়ে পর্তুগীজ, ডাচ, স্প্যানিশ এবং ব্রিটিশ বনিকদের আস্তানা তৈরী হয়েছিল। স্বর্ণখনির প্রচার ও প্রসারের একপর্যায়ে ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশরাজ ঘানাতে ‘গোল্ড কোস্ট ক্রাউন কলোনী’ স্থাপন করেছিল, এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসন চলেছিল ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত। কলোনিয়াল শাসন ব্যবস্থায় ঘানার জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, প্রায়ই ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন, বিদ্রোহ, খন্ড যুদ্ধ চলতো। ১৯৪৮ সালের দিকে দাঙ্গা, বিদ্রোহ যখন ছড়িয়ে পড়ে, তখন ঘানার অবিসংবাদিত জননেতা ‘নক্রুমা’কে অ্যা্রেস্ট করা হয়। নক্রুমা যতদিন জেলবন্দী ছিলেন, ততদিন তাঁর গঠিত রাজনৈতিক দল ‘কনভেনশন পিপল পার্টি’ স্বাধীনতার আন্দোলন চালিয়ে যায়। ১৯৫২ সালে ‘নক্রুমা’কে বন্দীদশা থেকে মুক্তি দেয়া হয়। বৃটিশরাজের সাথে দেন- দরবার চলতে থাকে, এবং ১৯৫৭ সালের ৬ই মার্চ রাত ১২টার সময় নক্রুমা ঘানার স্বাধীনতা ঘোষনা করেন।
মার্চে স্বাধীনতা অর্জন করে লিথুয়ানিয়া। ১৯৯০ সালের ১১ই মার্চ সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্লক থেকে বের হয়ে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেয়া হয়।
‘ডোডো’ পাখীর দেশ মরিশাস। আশপাশের কয়েকটি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে মরিশাস, যা বর্তমানে ‘দ্য রিপাবলিক অব মরিশাস’ নামে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে ঠাঁই পেয়েছে। স্বাধীনতা পাওয়ার আগ পর্যন্ত দেশটি পর্যায়ক্রমে ডাচ, ফ্রেঞ্চ এবং সর্বশেষ ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। ১৯৬৮ সালের ১২ই মার্চ ব্রিটিশ শাসন থেকে মরিশাস মুক্ত, স্বাধীন হয় এবং ‘দ্য রিপাবলিক পব মরিশাস’ নামে নতুন রাষ্ট্র গঠন করে।
মার্চে স্বাধীনতা লাভকারী আরেকটি দেশ হচ্ছে হাঙ্গেরী। সেন্ট্রাল ইউরোপের এই দেশটির রাজধানীর নাম বুদাপেস্ট। ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত অস্ট্রিয়ার শাসনাধীনে থাকা দেশটিতে স্বাধীকার আন্দোলনের লড়াই শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকে। সেই ধারাবাহিক আন্দোলন ইউরোপিয়ান অন্যান্য দেশগুলোর ‘রেভ্যুলিউশান অব ১৮৪৮’ এর রূপ ধারণ করে এবং অবশেষে ১৮৪৮ সালের ১৫ই মার্চ অস্ট্রিয়ার অধীনতা থেকে মুক্ত হয়।।
উত্তর আফ্রিকার সবচেয়ে ছোট দেশটির নাম তিউনিসিয়া। অত্যন্ত গরীব এই দেশটি ১৮৬৯ সালে নিজেদেরকে ‘দেউলিয়া’ ঘোষনা করার পর আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে তিউনিসিয়ার অর্থনীতির চাকা সচল রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। অর্থনৈতিকভাবে ঋণগ্রস্ত দেশটিতে ১৮৮১ সালে ৩৬,০০০ সদস্যের সেনাবাহিনী নিয়ে ফ্রান্স দেশটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং দেশটির দখলদারিত্ব নিয়ে নেয়। তিউনিসিয়ার জনগণ ফ্রান্সের শাসন ব্যবস্থায় থাকতে চায়নি বলেই ধীরে ধীরে আন্দোলন শুরু করে। একসময় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ‘হাবীব বরগুবা। অবিসংবাদিত নেতা হাবীব বরগুবা’র (পরবর্তীতে তিউনিসিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট) নেতৃত্বে ১৯৫৬ সালের ২০শে মার্চ, দখলদার ফ্রান্সের কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ‘দ্য রিপাবলিক অব তিউনিসিয়া’ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই পায়।
‘নামিব’ মরুভূমির নামানুসারে যে দেশটির নাম হয়েছে ‘নামিবিয়া’, সেই দেশটির ভুখন্ডে ১৮৮৪ সালে জার্মানবাহিনী ঘাঁটি গেড়েছিল এবং নিজেদের কলোনী গঠন করেছিল। পরবর্তীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জার্মান বাহীনিকে পরাস্ত করে সাউথ আফ্রিকা নামিবিয়া ভূখন্ডের দখল নেয়। সাউথ আফ্রিকার অধীনতা থেকে মুক্তি পেতে নামিবিয়ানদের মধ্যে জন্ম নেয় স্বাধীনতার চেতনা, দানা বাঁধতে থাকে আন্দোলনের স্পৃহা। আন্দোলন সফলতার মুখ দেখে ১৯৯০ সালের ২১শে মার্চ, জন্ম হয় স্বাধীন দেশ ‘দ্য রিপাবলিক অব নামিবিয়া’।
গ্রীসের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল ১৮২১ সালের ২৫শে মার্চ। ‘দ্য গ্রীক ওয়্যার অব ইনডিপেন্ডেন্ট’ যা ‘গ্রীক রেভ্যুলিউশান’ নামে পরিচিত, তা ছিল ওট্টোমান ( টার্কিশ বীর, যিনি ১৩শ শতাব্দীতে এশিয়ার অনেক দেশ জয় করেছিলেন) রাজত্বের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ, গ্রীক ওয়্যার ছিল গ্রীক বিপ্লবীদের একটি সফল সংগ্রাম। শক্তিশালী ওট্টোম্যান সম্রাটকে পরাজিত করার জন্য রাশিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য এবং আরও বিভিন্ন ইউরোপিয়ান দেশ সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। ১৮১৪ সালে ‘ফিলিকি এটেরিয়া’ নামে গুপ্তবাহিনী গঠিত হয় যারা দেশ মাতৃকার জন্য বিদ্রোহ করেছিল শাসক বাহিনীর বিরুদ্ধে। এদিকে ওট্টোম্যানের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল মিসরীয় বীর মেহমেত আলীর পুত্র ইব্রাহিম পাশা। কিন্তু রাশিয়া, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের ত্রিশক্তির কাছে ওট্টম্যান-মেহমেত আলীকে পরাজয় বরণ করতেই হয়। ১৮৩২ সালে গ্রীস চূড়ান্তভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পায়। ২৫ শে মার্চ আধুনিক গ্রীসের জাতীয় দিবস, তাই এই দিনটিতেই গ্রীসের স্বাধীনতা দিবস উদফযাপিত হয়।
২৬শে মার্চ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান ‘দ্য ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান(মুলতঃ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান)-এর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের গভীর রাতে পশ্চিম পাকিস্তানের মিলিটারীরা পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ জনগণের উপর ট্যাঙ্ক, কামান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ২৫শে মার্চের গভীর রাতেই পাক আর্মীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগেই দিবাগত ২৬শে মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লিখে তা দেশব্যাপী সম্প্রচারের দায়িত্ব সহযোগী নেতাদের উপর দিয়ে যান। সেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বেশ কয়েকবার প্রচারিত হয় চট্টগ্রাম থেকে। খুবই দূর্বল বেতার তরঙ্গের কারণে দফায় দফায় প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণা দেশের সাড়ে সাত কোটি জনগনের অধিকাংশের কানে পৌঁছেনি। ২৭শে মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেছিলেন এবং সামরিক, আধা সামরিক, পুলিশ, ই পি আর বাহিনীসহ দেশের আপামর জনসাধারণকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনের জন্য আহবান জানিয়েছিলেন। মেজর জিয়াউর রহমানের কন্ঠস্বর দেশের নানা প্রান্তে থাকা অনেকের কানেই পৌঁছেছিল। ২৭শে মার্চ তারিখে পঠিত স্বাধীনতার ঘোষণাটি যেহেতু ২৬শে মার্চের দিবাগত রাতে রচিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর কর্তৃক, তাই ২৬শে মার্চ তারিখটিই বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে উদযাপন করা হয়।

Monday, March 25, 2013

স্বাধীনতা’র ঘোষণা সম্পর্কে ‘উইকিপিডিয়া’ যা বলেছে!



স্বাধীনতা’র ঘোষণা সম্পর্কে ‘উইকিপিডিয়া’ যা বলেছে!

স্বাধীনতার ঘোষক প্রশ্নে বাংলাদেশে বহুদিন থেকেই বিতর্ক চলে আসছে। বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার ঘোষক প্রশ্নে হয়তো বা এখনও কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে আছে। কিন্তু বিশ্ববাসী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রশ্নে যা জানছে, 'উইকিপিডিয়া' থেকে তথ্য নিয়ে বঙ্গানুবাদ করে আমার সন্তানসম পাঠকদের ( এ প্রজন্মের তরুণ-তরুণী) জন্য তা এখানে পোস্ট করে দিলাম। ( অনুবাদে ভাষার দিক থেকে হয়তো বা একটু আধটু ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকবে, আমার অনিচ্ছাকৃত ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ করছি]

 

 

Declaration of independence

স্বাধীনতা’র ঘোষণা

The violence unleashed by the Pakistani forces on 25 March 1971, proved the last straw to the efforts to negotiate a settlement. Following these outrages, Sheikh Mujibur Rahman signed an official declaration that read:

২৫শে মার্চ, ১৯৭১, বাংলাদেশের নিরীহ জনগণের উপর বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যে লাগামহীন বর্বর আক্রমন চালিয়েছে- এরপর দুই দেশের নেতাদের মধ্যে আর কোন রাজনৈতিক সমঝোতার পথ খোলা ছিল না। এই উপলব্বধি থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’পত্রে স্বাক্ষর করেন এবং তা সারাদেশবাসীকে জানিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন।


Today Bangladesh is a sovereign and independent country. On Thursday night, West Pakistani armed forces suddenly attacked the police barracks at Razarbagh and the EPR headquarters at Pilkhana in Dhaka. Many innocent and unarmed have been killed in Dhaka city and other places of Bangladesh. Violent clashes between E.P.R. and Police on the one hand and the armed forces of Pakistan on the other, are going on. The Bengalis are fighting the enemy with great courage for an independent Bangladesh. May Allah aid us in our fight for freedom. Joy Bangla.

আজ থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হইল। বৃহস্পতিবারের গভীর রাতে পশ্চিম পাকিস্তানের সশস্ত্র সেনাবাহিনী ঢাকার পিলখানা ই পি আর হেডকোয়ার্টার এবং রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাকে অতর্কিত আক্রমন চালায়। এই অতর্কিত আক্রমনে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষ অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করে। ই পি আর এবং পুলিশবাহিনী সাহসের সাথে সশস্ত্র পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। বীর বাঙালী একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সাহসের সাথে শত্রুর মোকাবিলা করছে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমাদের এই মুক্তির সংগ্রামে মহান আল্লাহ বাঙ্গালী জাতির সহায় হোন। জয় বাংলা।



Sheikh Mujib also called upon the people to resist the occupation forces through a radio message. Mujib was arrested on the night of 25–26 March 1971 at about 1:30 am (as per Radio Pakistan's news on 29 March 1971).

শেখ মুজিব রেডিও বার্তার মাধ্যমে দেশের সকল জনগণের প্রতি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য আহবান জানান। এরপরই মুজিব ২৫-২৬ মার্চ, ১৯৭১ দিবাগত রাত ১:৩০ মিনিটে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন (সূত্রঃ ১৯৭১ সালের ২৯শে মার্চ রেডিও পাকিস্তান থেকে সম্প্রচারিত সংবাদ)

A telegram containing the text of Sheikh Mujibur Rahman's declaration reached some students in Chittagong. The message was translated to Bengali by Dr. Manjula Anwar. The students failed to secure permission from higher authorities to broadcast the message from the nearby Agrabad Station of Radio Pakistan. They crossed Kalurghat Bridge into an area controlled by an East Bengal Regiment under Major Ziaur Rahman. Bengali soldiers guarded the station as engineers prepared for transmission. At 7:45 PM on 26 March 1971,[56] Major Ziaur Rahman broadcast announcement of the declaration of independence on behalf of Sheikh Mujibur Rahman.

শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা সংবলিত একটি টেলিগ্রাম চট্টগ্রামের কিছু ছাত্রনেতার হাতে পৌঁছানোর পর ডঃ মঞ্জুলা আনোয়ার সেটি বাংলায় অনুবাদ করেন। ছাত্রনেতারা সেই অনুবাদিত টেলিগ্রামটি নিরাপত্তাজনিত কারণে আগ্রাবাদ রেডিও পাকিস্তান থেকে সম্প্রচারের অনুমোদন পাননি। ছাত্রনেতারা তখন কালুরঘাট ব্রীজ পেরিয়ে মেজর জিয়াউর রহমান নিয়ন্ত্রিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এলাকায় পৌঁছান। তারা কালুরঘাট রেডিও স্টেশান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি সম্প্রচারের চেষ্টা করেন। ইঞ্জিনিয়ারগণ যখন ট্র্যান্সমিশান চালু করার চেষ্টা করছিলেন, বাঙালী সৈনিকেরা রেডিও স্টেশানটি পাহারা দিয়ে রেখেছিল। ২৬শে মার্চ, ১৯৭১, সন্ধ্যে ৭:৪৫ মিনিটে মেজর জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন।

This is Swadhin Bangla Betar Kendra. I, Major Ziaur Rahman, at the direction of Bangobondhu Mujibur Rahman, hereby declare that Independent People's Republic of Bangladesh has been established. At his direction , I have taken the command as the temporary Head of the Republic. In the name of Sheikh Mujibur Rahman, I call upon all Bengalees to rise against the attack by the West Pakistani Army. We shall fight to the last to free our motherland. Victory is, by the Grace of Allah, ours. Joy Bangla.[57]

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে, আমি, মেজর জিয়াউর রহমান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। তাঁহার নির্দেশানুযায়ী, আমি অস্থায়ী প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। শেখ মুজিবুর রহমানের নামে, আমি সকল বাঙালীকে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠার ডাক দিচ্ছি। মাতৃভূমিকে শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করার জন্য শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাব। মহান আল্লাহর অশেষ কৃপায় জয় আমাদের হবেই। জয় বাংলা।

The Kalurghat Radio Station's transmission capability was limited, but the message was picked up by a Japanese ship in Bay of Bengal. It was then re-transmitted by Radio Australia[58] and later by the British Broadcasting Corporation.

কালুরঘাট রেডিও স্টেশানের সম্প্রচার ক্ষমতা ছিল খুবই সীমিত, কিন্তু স্বাধীনতার বার্তাটি বঙ্গোপসাগরে নোঙ্গরকরা জাপানী জাহাজের ট্র্যান্সমিশানে ধরা পড়ে, এবং তা রেডিও অস্ট্রেলিয়া এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশানের ট্র্যান্সমিশানে তরঙ্গায়িত হয়।

M A Hannan, an Awami League leader from Chittagong, is said to have made the first announcement of the declaration of independence over the radio on 26 March 1971.[59] There is controversy now as to when Major Zia gave his speech. BNP sources maintain that it was 26 March, and there was no message regarding declaration of independence from Mujibur Rahman. Pakistani sources, like Maj. Gen. Fazal Muqeem Khan in his book "PAKISTAN’S CRISIS IN LEADERSHIP"[60] Brigadier Zahir Alam Khan in his book "THE WAY IT WAS"[61] and Lt. Gen. Kamal Matinuddin in his book "TRAGEDY OF ERRORS:EAST PAKISTAN CRISIS, 1968-1971"[62] had written that they heard Major Zia's speech on 26 March 1971 but Maj. Gen. Hakeem A. Qureshi in his book "THE 1971 INDO-PAK WAR: A SOLDIER'S NARRATIVE"[63](Oxford University Press,Karachi,2002), gives the date of Major Zia's speech as 27 March 1971.

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি রেডিওতে সর্বপ্রথম পাঠ করেছিলেন চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগের নেতা এম এ হান্নান, ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ। বর্তমানে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠের সময় নিয়ে বিতর্ক আছে। বিএনপি দাবী করে, মেজর জিয়া ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, এবং মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা সংবলিত কোন মেসেজ আসেনি। পাকিস্তানী সোর্স, যেমন মেজর জেনারেল মুকিম খান তাঁর লেখা বই “THE WAY IT WAS” এবং লেফট্যানেন্ট জেনারেল কামাল মতিনউদ্দীন, তাঁর লেখা বই “TRAGEDY OF ERRORS:EAST PAKISTAN CRISIS, 1968-1971” তে লিখেছেন যে তাঁরা উভয়েই ২৬শে মার্চ, ১৯৭১ তারিখে মেজর জিয়ার কন্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণাপাঠ শুনেছিলেন। অপরপক্ষে, মেজর জেনারেল হাকিম এ কোরেশী, তাঁর লেখা বই “"THE 1971 INDO-PAK WAR: A SOLDIER'S NARRATIVE"[63](Oxford University Press,Karachi,2002),” তে লিখেছেন, মেজর জিয়ার ঘোষণাটি ছিল ২৭শে মার্চ, ১৯৭১।


26 March 1971 is considered the official Independence Day of Bangladesh, and the name Bangladesh was in effect henceforth. In July 1971, Indian Prime Minister Indira Gandhi openly referred to the former East Pakistan as Bangladesh.[64] Some Pakistani and Indian officials continued to use the name "East Pakistan" until 16 December 1971.


সরকারীভাবে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং একই সময়ে রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’ সরকারীভাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সর্বপ্রথম মুক্তকন্ঠে প্রাক্তন ‘পূর্ব পাকিস্তান’কে বাংলাদেশ নামে স্বীকৃতি দিয়েছেন। যদিও কতিপয় পাকিস্তানী এবং ভারতীয় অফিসার ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বারের আগে পর্যন্ত “ইস্ট পাকিস্তান” নামটিই বলবৎ রেখেছিলেন।

Saturday, March 23, 2013

রাষ্ট্রপতির মৃত্যু, বেগম জিয়ার শোক এবং বুদ্ধিজীবিগণের উচ্ছ্বাস!!

আজকের লেখাটি ঠিক কীভাবে শুরু করবো, তার কোন সূত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভীষন এক অস্থিরতায় ভুগছিলাম, অস্থিরতা কাটানোর জন্যই অনলাইনে সংবাদপত্র পড়তে শুরু করে দিলাম। অনলাইনে গিয়ে আমার পছন্দসই পত্রিকার শিরোনাম পড়ে ফেললাম। গতকাল সদ্য প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের নামাজে জানাজা শেষে উনাকে বনানী কবরস্থানে উনার প্রাণপ্রিয় পত্নীর কবরেই চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে। গত তিনটি দিন ধরে পত্রিকার পাতা জুড়ে শুধুই আমাদের রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে।

যাঁরাই লিখেছেন, সকলেই খুব দরদ দিয়ে লিখেছেন, আবেগ দিয়ে লিখেছেন, একেকটা লেখা পড়েছি, ভালোলাগা, শ্রদ্ধায় মন আপ্লুত হয়েছে। তা আজকের পত্রিকায়ও রাষ্ট্রপতি সংবাদে খুবই আবেগঘন সংবাদ ছাপা হয়েছে। আমার জীবনে এই প্রথমবারের মত দেখলাম, একজন মানুষের প্রতি দেশের সর্বস্তরের জনগণের অকুন্ঠ ভালোবাসার প্রকাশ। সদ্য প্রয়াত রাষ্ট্রপতির প্রতি দেশের প্রতিটি মানুষের শোক, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা দেখে চোখ ভিজে উঠেছে।

পত্রিকা পড়তে পড়তেই একফাঁকে লেখার সূত্র খুঁজে পেয়েছি। রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে লেখা সংবাদগুলো যখন পড়ছি, তখনই একটি বিশেষ সংবাদের প্রতি আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছে। বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গতকাল বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতির কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন, শোক বইয়ে স্বাক্ষর করেছেন, রাষ্ট্রপতির সন্তানদের সাথে কথা বলেছেন। এই সংবাদ পড়ে আমার খুব ভালো লেগেছে। বেগম জিয়ার রাজনৈতিক নেত্রীসুলভ ব্যবহার দেখে খুবই খুশী হয়েছি। তবে খুশী হলেও বিষয়টিকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করেছি, এর মধ্যে কোন ব্যতিক্রমতা বা বিশালত্ব খুঁজিনি। কিন্তু আমি বিশালত্ব না খুঁজলে কী হবে, কিছু কিছু বুদ্ধিজীবি এই ঘটনার মধ্যে অনেক বিশালত্ব আবিষ্কার করেছেন। কেউ কেউ তো চব্বিশ ঘন্টা পার হতে দেন নি, বেগম জিয়ার স্তুতি বন্দনা করে বিরাট বড় আর্টিক্যালও লিখে ফেলেছেন। আর্টিক্যালে তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, বেগম জিয়াকে নাকি বংগভবনে যথাযথ সম্মান দেয়া হয় নি। কোন রকম সাদর সম্ভাষণ জানানো হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেখানে উপস্থিত থাকলেও সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রীর সাথে কথা পর্যন্ত বলেন নি। কেউ কেউ আবার বলেছেন, এই সুযোগে দুই নেত্রী একসাথে বসে (রাষ্ট্রপতির কফিনকে সামনে রেখে ) দেশের চলমান সমস্যা নিয়ে আলোচনাও করেন নি।

আজকের সংবাদপত্রগুলো পড়েই বুঝে গেছি, আগামী দিনের রাজনৈতিক আলোচনা কোনদিকে মোড় নিতে যাচ্ছে। পত্রপত্রিকায় কলাম লেখার ধুম পড়ে যাবে, টিভিতে টকশো এর ধুম পড়ে যাবে, কলাম এবং টকশোগুলো জুড়ে থাকবে বেগম জিয়ার স্তুতি বন্দনা, টকশোতে নিয়ে আসা হবে মুখচেনা কিছু কুতার্কিককে, যারা অন্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেরাই টেবিল চাপড়ে যুদ্ধংদেহীরূপে রেকর্ড বাজাবে এই বলে, " অমুক দিনের বাংলদেশ প্রতিদিন, আমাদের সময়, আমার দেশ, মানবজমিন সাথে করেই নিয়ে এসেছি, দেখুন, সবাই কত উচ্চ গলায় দেশনেত্রী বেগম জিয়ার ভুয়সী প্রশংসা করেছেন, বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন বলে। আর শেখ হাছিনা তো (নামের আগে প্রধান মন্ত্রী যোগ করবেন না) বেগম জিয়ার সাথে দেখা পর্যন্ত করলেন না।"। অপরপাশে মুখে তালা লাগিয়ে বসে থাকা আওয়ামী ঘরাণার বুদ্ধিজীবিরা মুখের তালা খুলতে খুলতে টকশোয়ের সময় শেষ হয়ে যাবে।

আমি টকশোগুলো দেখবো আর মনে মনে আওয়ামী ঘরাণার বুদ্ধিজীবিদেরকে উত্তর শিখিয়ে দেবোঃ বলবো, আমার সাথে সাথে বলেনঃ

মাননীয় বিরোধী দলের নেত্রী রাষ্ট্রপতির মরদেহে পুষ্পস্তবক অর্পন করতে বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন বলে দেশের সকলেই খুশী হয়েছে। সকলেই তো চায়, দুই নেত্রী মিলেমিশে দেশ শাসন করুক। তবে বেগম জিয়াকে বংগভবনে সাদর অভ্যর্থনা জানানো হয়নি বলে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তার উত্তরে বলা যায়, বাঙ্গালী অতিথিপরায়ন, গৃহে অতিথি এলে তাঁকে যথাযথ সম্মান দিয়েই অভ্যর্থণা করা আমাদের সংস্কৃতির অংশ, তবে সেদিনের অনুষ্ঠানটি ছিল একটি জাতীয় শোকানুষ্ঠান, ভ্যেনু ছিল বঙ্গভবনে, প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির বাড়ীতে নয়, এমতাবস্থায় বিরোধী দলীয় নেত্রীকে প্রধান মন্ত্রীর পক্ষ থেকে সাদর অভ্যর্থণা করতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা না থাকলেও, পারস্পরিক সৌজন্যবোধ থাকা উচিত ছিল, এমন কি শত্রুর মুখ বন্ধ করতে হলেও সরকারী দলের এই দিকে খেয়াল রাখা উচিত ছিল। সংসদ নেত্রী যেমন ছোট হতেন না বিরোধী নেত্রীর সাথে কুশল বিনিময় করলে, তেমনই বিরোধী নেত্রীও হেরে যেতেন না যদি দুই পা এগিয়ে গিয়ে সংসদ নেত্রীকে 'হেলো' বলতেন। বিনয় বা ভদ্রতার চেয়ে দামী ব্যবহার আর কী-ই বা হতে পারে!


শেখ হাসিনা সংসদে সরকারী দল তথা সংসদ নেত্রী এবং বেগম জিয়া এখনও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দেশের রাষ্ট্রপতির চেয়ারখানি অলংকৃত করে রেখেছিলেন।

রাষ্ট্রপতির পদটি কার্যক্ষমতাহীন হলেও, প্রকৃতই তা দেশের সর্বোচ্চ আসন। রাষ্ট্রপতির উপরে একমাত্র মহান সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ নেই। প্রধান মন্ত্রী থেকে শুরু করে দেশের সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তিটিও রাষ্ট্রপতির অধীন। কাজেই রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে, উনার বিদেহী আত্মার প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান জানানো, শোক প্রকাশ করা এবং সর্বোপরী শেষবারের মত ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদ, বিরোধী দলীয় নেতা এবং সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এটা প্রত্যেকের নিজস্ব অধিকার বা দাবীর ব্যাপার। তাছাড়া বঙ্গভবন তো প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন নয়, গণভবণও নয়, সেদিনের অনুষ্ঠানটিও প্রধানমন্ত্রীর কোন পারিবারিক অনুষ্ঠান ছিল না, তাহলে বঙ্গভবনে যেতে হলে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নিমন্ত্রণপত্র পেতে হবে কেন?


রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে পুরো জাতি যেখানে শোকাভিভূত, সেখানে ব্যক্তি বিশেষের কথা আসে কেন? রাষ্ট্রপতি তো সকলের অভিভাবক ছিলেন। কোন পরিবারে পিতার মৃত্যুতে বড় ভাই যেমন শোকাভিভূত হন, ছোট ভাইও একই রকম শোকাভিভূত হয়ে থাকেন। তবে হ্যাঁ, এই শোকের সময়টুকু দুই ভাইকে একসাথে সামাল দিতে হয়, এটাই সংসারের নিয়ম। আর ভাইয়ে ভাইয়ে যদি আকচা আকচি থাকে তাহলে বলবো, পারস্পরিক 'মেকী হাসী' বিনিময় করার চেয়ে নীরবে শোক সয়ে যাওয়া অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য।

এবার আসি, দুই নেত্রীর সংলাপের প্রশ্নে। বাঙ্গালী জাতির মনে 'আবেগ' এত বেশী খলবল করে ফুটতে থাকে যে, কখন কী বলে ফেলে তার কোন হিসেব থাকে না। গতকাল ছিল প্রয়াত রাষ্ট্রপতিকে শেষবারের মত শ্রদ্ধা জানানোর দিন, বঙ্গভবনের দরবার হলে রাষ্ট্রপতির কফিন রাখা হয়েছিল। মৃতের প্রতি সম্মান জানানোর প্রধান এবং প্রথম ধাপই হচ্ছে 'নীরবতা'। নীরবতাই শোক প্রকাশের অনন্য ধাপ। বঙ্গভবনে যখন দেশী-বিদেশী হাজার হাজার শোকার্ত মানুষের ঢল নেমেছিল, সকলেই যখন সুশৃংখলভাবে, নীরবতায় মাথা হেঁট করে ভালোবাসার মানুষটিকে সম্মান জানাচ্ছিল, শ্রদ্ধা জানাচ্ছিল, তখন কোন যুক্তিতে দুই নেত্রী দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ আলোচনা শুরু করবেন! কেনই বা তা করতে যাবেন! দুই নেত্রীকে অনেক ধন্যবাদ যে কালকের দিনে এই নাটকের সূচনা করেন নি বলে।

কেউ কেউ আবেগের আতিশয্যে বলেছেন, বেগম জিয়া নাকি রাষ্ট্রপতিকে দেখার জন্য নিজ থেকেই 'ছুটে' গেছেন, অথচ বঙ্গভবনে কেউ নাকি উনাকে কেউ সাদর সম্ভাষণ জানায় নি, (পত্রিকায় অবশ্য পড়েছি অন্যকথা, বেগম জিয়ার স্বাস্থ্যের দিকটি বিবেচনা করেই নাকি উনাকে ভীড়ের রাস্তা পরিহার করে অন্যপথে বিশেষ দরজা দিয়ে প্রবেশ করানো হয়েছিল)। উনারা বলেছেন, নেত্রী বিষন্ন বদনে নাকি রাষ্ট্রপতির কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পন করেছেন, শোক বইয়ে সই করেছেন, এমনই সব হাজারো উপমা দিয়ে বেগম জিয়াকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেছেন। উনারা নেত্রীর বিষন্ন বদন দেখেছেন, আর নিন্দুকেরা দেখেছেন নেত্রীর পরনের 'গোলাপী জর্জেট' শাড়ী। নিন্দুকেরা মনে করেন, সব অনুষ্ঠানের একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ণ থাকে। শোকের রঙ কালো। এমন একটি শোকের দিনে নেত্রীর 'গোলাপী শাড়ী' নির্বাচন করা ঠিক হয় নি। গোলাপী শাড়ীর গোলাপী আভায় উনার মুখমন্ডলের বিষন্নতা ঢাকা পড়েছিল।

কেউ কেউ লিখেছেন,

"মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি ও আপনার দল শোক জানাতে বিলম্ব করেননি। এমনকি বিরোধী দলের নেতা হিসেবে দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বঙ্গভবনে ছুটে গিয়ে শোকার্ত হৃদয়ে বিষণ্ন মুখে আপনি রাষ্ট্রপ্রধানের কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। বঙ্গভবনের প্রধান ফটকে সরকারের কেউ আপনাকে অভ্যর্থনা জানাল কি না, দরবার হলে কেউ আপনাকে সম্মান দেখিয়ে বরণ করতে এলো কি না তা আপনি আমলে নেননি। যারা আপনার আগমনের সংবাদ পেয়েও বঙ্গভবনের প্রধান ফটকে বা দরবার হলে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে আসেনি এটা তাদের দৈন্যতা হলেও আপনি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যে সম্মান দেখিয়েছেন, যে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন, যেভাবে শোকবইয়ে স্বাক্ষর করেছেন, শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনকে ডেকে সমবেদনা জানিয়েছেন তাতে আপনিই বড় হয়েছেন। আপনার ও আপনার দলের নেতারা শোকার্ত চিত্তে যেভাবে বঙ্গভবন থেকে জাতীয় ঈদগাহের জানাজায় শরিক হয়েছেন তাতে গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় বাংলাদেশের মানমর্যাদা উচ্চতায় উঠেছে। আপনি তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক কর্মসূচির সঙ্গে একাত্দ হয়েছেন, দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন এমনকি আপনার দুই দিনের বগুড়া ও জয়পুরহাট সফরসূচিসহ দলীয় কর্মসূচি যেভাবে স্থগিত করেছেন তা আমাদেরও সম্মানিত করেছে। এতে এই স্বাধীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন জনতার হৃদয়ের শ্রদ্ধাই কুড়াননি, মহামান্য রাষ্ট্রপতির আত্দাও শান্তি পেয়েছে। আমাদের জাতীয় জীবনে চলমান রাজনীতি ঘুটঘুটে আঁধার নামিয়েছিল। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে শান্তির পথে যিনি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন তিনিই জনতার হৃদয়ে ঠাঁই পান। এই দেশের জনগণ শুধু প্রধানমন্ত্রীকেই ক্ষমতায় অভিষিক্ত করেনি, আপনাকেও বার বার অভিষিক্ত করেছে।"



হায়রে! কিছুদিন আগেই ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রনব মুখার্জী যখন এসেছিলেন, তখন আমাদের বিরোধী নেত্রী জামাতের সাথে একতালে একটানা হরতাল দিয়েছিলেন, যে হরতালে গাড়ী ঘোড়ায় আগুন দেয়া হয়েছিল, মানুষ হত্যা করা হয়েছিল, আর নেত্রী বক্তৃতায় বলেছিলেন, আরও হরতাল দিবেন, হরতালে যে ক্ষতি হবে তা মেনে নিতে বলেছিলেন, কই, তখনতো কেউ একবারের জন্যও বিরোধী নেত্রীর এহেন আচরণের কঠোর সমালোচনা করেন নাই! আর সেই নেত্রীই আজ উনার বগুড়ার সমাবেশ স্থগিত করায় কলামিস্টদের মুখ থেকে প্রশংসার ফুলঝুরী ছুটেছে। শুধু ফুলঝুরীতে ফুল টান পড়ে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর বেলায়। প্রধান মন্ত্রীকে তুলাধূনা করছেন কেন উনি বিরোধী নেত্রীকে বঙ্গভবনের দরজা থেকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে যাননি। কেন প্রধান মন্ত্রী বিদেশী মেহমানদের সাথে খোশগল্পে (!) মেতেছিলেন, কেনই বা তিনি মেহমানদের কাছে বিরোধী নেত্রীকে আলাপ করিয়ে দেননি।



প্রধান মন্ত্রী কী করে ভুলে যাবেন, মাত্র দুই সপ্তাহ আগেই ভারতের রাষ্ট্রপতির প্রতি বাংলাদেশের বিরোধী দলীয় নেত্রীর অশোভন আচরনের কথা! ভারতের প্রথম বাঙ্গালী রাষ্ট্রপতি আমাদের দেশে এসেছিলেন সস্ত্রীক, বাংলাদেশ সফরের আনন্দে কী উচ্ছ্বসিত ছিলেন এই দম্পতি, রাষ্ট্রপতি প্রথমবার শ্বশুরবাড়ী নড়াইলে যাবেন, আগে থেকেই প্রোগ্রাম করা ছিল, বেগম জিয়ার সাথে সাক্ষাত হবে, এটাও আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। অথচ বেগম জিয়া ভারতের রাষ্ট্রপতির সাথে পূর্ব নির্ধারিত সাক্ষাতকার বাতিল করে দিয়ে একটানা হরতাল ডেকেছিলেন। বিরাট কোন ইস্যু ছিল না, শাহবাগে তরুণ প্রজন্মের কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে, নাস্তিকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই এই একটানা হরতাল আহবান করেছিলেন। ভারতের রাষ্ট্রপতিকে বাংলাদেশে এসে হরতালে অবরুদ্ধ থাকতে হয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন আমাদের দেশের মেহমান। উনি নড়াইল গিয়েছিলেন হরতালের মধ্যেই। কই, তখনতো খালেদা জিয়া একদিনের জন্য হরতাল স্থগিত করেন নি! এবং তা নিয়ে প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবিদের কলম থেকে এক ফোঁটাও কালি বের হতে দেখিনি। অথচ এক কলামিস্ট তো প্রনব মুখার্জী আসার আগেই বেগম জিয়ার ঊদ্দেশ্যে কত মধুর ভাষায় আবেদন করেছিলেন, যেন বেগম জিয়া সংসদে যান, প্রনব মুখার্জীকে দেখিয়ে দিতে পারেন, শুধু ভারতের লোকসভাতেই নয়, বাংলাদেশের মহান সংসদেও দারুণ গনতন্র আছে। বিরোধী দল খুব শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে চলেছে। হাঃ কথায় বলে " তোমার কথা তুমি কইতে থাক, শোনা না শোনার ভাগ আমার"। বেগম জিয়া সেদিন যা করেছিলেন, এতে করে তো উনি শুধু ভারতের রাষ্ট্রপতিকেই অসম্মান করেন নি, আমাদের পুরো দেশের অসম্মান করেছেন। কতবড় আনন্দময় ঘটনা হতে পারতো যেদিন দুই দেশের দুই বাঙ্গালী রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের মাটিতে একত্রিত হয়েছিলেন, কত আনন্দের, কত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা ছিল বিশ্বের আপামর বাঙ্গালীদের জন্য।


মাত্র কয়েকদিন আগেই মানিকগঞ্জ আর মুন্সিগঞ্জে দলীয় সমাবেশে বেগম খালেদা জিয়া কী অশোভনভাবে বক্তৃতা করে এসেছেন, ইউটিউবে উনার বক্তৃতা শুনে যে কোন সভ্য মানুষের পিলে চমকে উঠার কথা। বেগম জিয়ার সমাবেশ শেষ হতে না হতেই নেত্রকোনা, বগুরা তে হিন্দুদের বাড়ীঘরে হামলা হয়েছে, মন্দিরে দেব দেবী ভাংচুর হয়েছে, সংখ্যালঘুদের ভাঙ্গা মেরুদন্ড আরও ভেঙ্গে গেছে। কই, আজকের কলামিস্টদের কলম থেকে, আজকের বীর টকারদের মুখ থেকে তো এতটুকু প্রতিবাদ শোনা গেলো না। বেগম জিয়াও তো ছুটে গেলেন না সংখ্যালঘু হিন্দুদের পাশে! আর আজ উনি বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন বলে দেশের বুদ্ধিজীবিরা একেবারে বিনয়ে গলে গলে পড়ছেন।


বুদ্ধিজীবিরা কী করে ভুলে গেলেন যে আজকের রাষ্ট্রপতি মানসিকভাবে ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট তারিখেই মারা গেছিলেন, যেদিন অতর্কিত গ্রেনেড হামলায় ২৩জন নেতা কর্মীর সাথে রাষ্ট্রপতির স্ত্রী , আওয়ামী মহিলা লীগের সভানেত্রী আইভী রহমান মারা গেছিলেন। কেউ কেউ ভুলে যায় সব ঘটনা , আমরা ভুলিনি কিছুই! তখন বর্তমান বিরোধী দল সরকারে ছিলেন। এতবড় বিধ্বংসী গ্রেনেড হামলার বিচার তো হয়ই নি, উলটো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নানা সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগই নাকি নিজেরা বোমাবাজি করেছে। উনার দলের নেতারা, যারা আজ বড় বড় গলায় গণতন্ত্রের কথা বলে, তারা বলেছিল, শেখ হাসিনা নাকি নিজের ব্যাগে বোমা নিয়ে এসেছিল। কিছুই ভুলিনি আমরা। বুদ্ধিজীবিরা নিজেদেরকেই শুধু বুদ্ধিমান মনে করেন। আমরা যেন সবাই গাধা গরু। এই তো সেদিনও টকশোতে হালের গজিয়ে উঠা ঝগড়ুটে বিএনপি দলীয় মহিলা সংসদ সদস্য, হাত মুখ নাচিয়ে, মুখের চেহারা বিকৃত করে টিভি স্টেশান কাঁপিয়ে দিয়ে এক নাগাড়ে বলে গেলেন, আওয়ামী লীগই নাকি সেদিন গ্রেনেড হামলা করেছিল। উনি আরও বলে গেলেন, হাওয়া ভবনের কাছ থেকে সকলের রাজনীতি শেখা উচিত। তারেক জিয়ার কাছ থেকে নাকি রাজনৈতিক শিক্ষা নিতে হবে সবাইকে।

আমাদের রাষ্ট্রপতি স্ত্রীর শোকে মুহ্যমান ছিলেন বলে তো আর বধীর ছিলেন না, অন্ধও হয়ে যান নি। বুকে পাথর চাপা দিয়ে এইসব ভাঁড়ামো দেখে গেছেন, মিতভাষী ছিলেন, সহনশীল ছিলেন, শতভাগ রাজনীতিক ছিলেন, সৎ ছিলেন, আদর্শ স্বামী ছিলেন, তাই স্ত্রীর এমন নৃশংস মৃত্যুর শোক নিজ বুকে ধারণ করেছিলেন, কারো বিরুদ্ধে কিছু নালিশ করেন নি। কিন্তু উনি কী জানতেন না কে বা কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে! কলামিস্ট সাহেব লিখেছেন, বেগম জিয়ার উপস্থিতিতে নাকি রাষ্ট্রপতির আত্মা শান্তি পাবে। জীবিতকালে উনার আত্মায় কতখানি কষ্ট লুকানো ছিল, তার খবর কী নিয়েছিলেন? যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আতি পাতি নেতা নেত্রীরাও গলা ফাটিয়ে বলেছিল, শেখ হাসিনা বোমা ফাটিয়েছে! উনারা কী জানতেন না, শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানাকে জিল্লুর রহমান সাহেব সন্তানের মত ভালোবাসতেন। এ ছাড়াও শেখ হাসিনা ছিলেন দলের সভানেত্রী, তাঁকেই যখন 'আইভী রহমানের' মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়েছিল, এই ভিত্তিহীন অভিযোগ উনার হৃদয়ে কতখানি ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল, সেই খবর কী কলামিস্ট সাহেব অনুভব করতে পারেন নি?

এখন একেবারে হঠাৎ করেই বেগম জিয়াকে বঙ্গভবন এপিসোডের 'নায়িকার' আসনে বসানো হচ্ছে! বেগম জিয়াতো অসম্ভব কিছুই করেন নি। দেশের পনের কোটি ( জামাত এবং মৌলবাদী দল বাদে) জনগণের সাথে উনিও রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে আন্তরিকভাবেই শোক প্রকাশ করেছেন, এটা নিয়ে কারোরই এত উচ্ছ্বসিত হওয়ার তো কিছু নেই। বরং আফসোস হতে পারে এই ভেবে যে, রাষ্ট্রপতিকে এই সম্মানটুকু উনার জীবদ্দশায় দেখালেই ভালো হতো। নিদেনপক্ষে, বন্ধুপ্রতিম দেশের দুই বাঙ্গালী রাষ্ট্রপতি যখন একত্রিত হলেন, তখন যদি বেগম জিয়া হরতাল প্রত্যাহার করে নিতেন, অতিথির কাছে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মুখ উজ্জ্বল হতো। বাঙ্গালী যে সত্যিই অতিথিপরায়ন জাতি, তা আরেকবার প্রমানিত হতো। উনিও জীবিতকালেই উনার প্রতি বিরোধীদলীয় নেত্রীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার প্রকাশ দেখে যেতে পারতেন। গতকাল বেগম জিয়া বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন ঠিকই, আন্তরিকভাবেই গিয়েছিলেন, শোকও প্রকাশ করেছিলেন, তবে বড্ড দেরী হয়ে গেছে। রাষ্ট্রপতি এগুলো দেখার জন্য আর অপেক্ষায় ছিলেন না, উনি চলে গেছেন উনার অপেক্ষায় থাকা প্রিয়তমা স্ত্রী 'আইভী রহমানের কাছে'।

Friday, March 22, 2013

একজন মানুষের কয়বার মৃত্যু হয়!

২০০৪ সালের ২১শে অগাস্টের বিকেলে আওয়ামীলীগের জনসভায় যখন ভয়াল গ্রেনেড হামলা হচ্ছিল, আমি তখন আমেরিকার মিসিসিপি রাজ্যের ছোট শহর কলম্বাসের অ্যাপার্টমেন্টে গভীর ঘুমে ছিলাম।  কারণ তখন আমেরিকায় ভোর রাত। মনে আছে, মাত্র তিনদিন আগেই অ্যাপার্টমেন্টে এসে উঠেছিলাম। কম্পিউটার সেট আপ করা হয়ে উঠেনি, টিভি সেট করা হয় নি, অর্থাৎ আধুনিক বিশ্বের সাথে কোন যোগাযোগই ছিল না আমার। আমেরিকার ২১শে অগাস্ট বিকেলে আমি আমার  কাজিনের কাছ থেকে একটি ফোন কল পেয়েছিলাম, যার সারমর্ম ছিল,

ঢাকায় আওয়ামীলীগের জনসভায় কে বা কারা গ্রেনেড হামলা করেছে। গ্রেনেড হামলায় প্রচুর মানুষ হতাহত হয়েছে। শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও উনার গায়ের আঘাত লেগেছে। বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানের দুই পা উড়ে গেছে।

এমন ভয়ানক সংবাদ শোনার পর থেকে সম্ভব-অসম্ভব অনেক কিছুই ভাবছিলাম। মনের পর্দায় ভেসে উঠলো '৭৫ এর ১৫ই অগাস্টের সেই কালো সকালের কথা। সেদিন আমি ছিলাম নিতান্তই এক বালিকা, কম্পিউটারের নামই শুনিনি তখনও। 'বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে' খবরটি নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে  এসেছিল আমার ১৩ বছর বয়সী ভাই। তার মানে, আমার ভাইগুলো সব সময় ভয়ানক দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে আসে। আমি রাজনীতি সচেতন পরিবারের মেয়ে, শিশুকাল থেকেই  ক্ষুদিরাম, বিনয়, বাদল, দীনেশ, মাস্টার'দা, প্রীতিলতা, চিত্তরঞ্জন দাস,  ঋষি অরবিন্দ, মহাত্মা গান্ধী,  শেখ মুজিব (বঙ্গবন্ধু), শেরেবাংলা, মাওলানা ভাসানীর গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন  নানা দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে বলে 'মুক্তিযুদ্ধ' নিয়ে গর্ব করতে শিখেছি। বড় হয়ে সরাসরি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ততা না থাকলেও রাজনৈতিক আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেছি। আর এ সকল কারণেই  সুদূর আমেরিকায় বসে দেশের মাটিতে ঘটে যাওয়া এমন প্রলয়ংকরী ঘটনায় খুবই বিপন্ন বোধ করেছি।

আমার স্বামীকে ফোন করে জানিয়েছি গ্রেনেড হামলার সংবাদ। সাথে সাথে এও বলেছি, যেখান থেকে সম্ভব হয় একজন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞকে ধরে নিয়ে আসতে। আমার স্বামী বুঝতে পেরেছিলেন আমার অস্থিরতার পরিমান, দেশের সংবাদ জানার আকুলতায় আমি খুব ছটফট করছিলাম।

সেই বিকেলেই  বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে এসে ইন্টারনেট সেট আপ করে দিয়ে গেল। আমি কম্পিউটার অন করেই সংবাদপত্রের পাতা খুলে বসলাম।  যে বিভৎস ছবি দেখলাম, তা আমার মস্তিষ্কের কোষে কোষে আলোড়ণ সৃষ্টি করলো। রক্তাক্ত লাশ, রাস্তার উপর হুমড়ী খেয়ে পড়ে থাকা মহিলা, পুরুষের নিথর দেহ, জুতা, স্যানডেল চারদিকে ছড়ানো, কালো ধোঁয়া, সাদা ধোঁয়ায় ঢাকা চারিধারের সুউচ্চ দালান কোঠার ছবির পাশেই আরেকটি ছবি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আমার দিকে। ছবির মানুষটির পরণে সাদা জমিনের মাঝে কালো বুটি দেয়া শাড়ী, সেই সাদা-কালো শাড়ীটি রক্তে রাঙানো, মানুষটির দুই চোখ খোলা, পাথর চোখে তাকিয়ে আছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে, চোখের পলক পড়েনি অনেকক্ষণ। উনাকে ঘিরে আছে আরও কিছু মানুষ, কেউ বা তাঁকে পাঁজাকোলা করার চেষ্টায় ছিল, তখনই ছবিটা তোলা হয়েছে। ছবির নীচে মানুষটির পরিচয় দেয়া ছিল, বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমান।

২০০৪ সালে আমাদের ডিশ নেটওয়ার্ক ছিল না, তাই পরের দিনের অনলাইন সংবাদের অপেক্ষায় থেকেছি, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করেছি, " ঈশ্বর, যদি পারো, মানুষটিকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তাঁর পরম প্রিয় স্বামী-সন্তানের কাছে ফিরিয়ে দাও, নাহলে তোমার কাছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টেনে নাও"। আমার প্রার্থণায় খাদ ছিল না, আমি যখনই জেনেছি, আইভী রহমানের দুটি পা উড়ে গেছে,  আমি এরপর থেকেই মনে প্রাণে চেয়েছি, পরম করুণাময় যেন সকলের প্রিয় আইভী চাচীকে নিজের কোলে তুলে নেন।

ঈশ্বর আমার প্রার্থণা শুনেছেন, তিনদিন চরম কষ্ট পাওয়ার পর আইভী রহমান শান্তির দেশে, না ফেরার দেশে চলে গেছেন। না ফেরার দেশে চলে গিয়ে আইভী রহমান বাংলাদেশের পনের কোটি জনগণকে চরম গ্লানি, চরম লজ্জার হাত থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে গেছেন। একবিংশ শতাব্দীর বাঙালী এত নিষ্ঠুর, এত পিশাচ, এত রক্ত পিপাসু, এত ক্ষমতালোভী যে সামান্য গদী রক্ষার লোভে গ্রেনেড হামলা করে এতগুলো তরতাজা প্রাণের স্পন্দন থামিয়ে দিল! এই লজ্জা সারা বাংলার মানুষের, এ লজ্জা আধনিক সভ্যতার! এ আমাদের জন্য এক বিরাট কলঙ্ক। তৎকালীন বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনা কী করে যেন প্রাণে বেঁচে গেছিলেন, তা কেউ জানে না। মাঝে মাঝে ঈশ্বর তাঁর স্নেহময় হাত কারো কারো দিকে প্রসারিত করে দেন, সে যাত্রায় ঈশ্বরের হাত শেখ হাসিনার দিকে প্রসারিত ছিল বলেই বৃষ্টির মত নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড বা বোমার আঘাত থেকে উনি বেঁচে গেছিলেন।

গ্রেনেডের আঘাত থেকে বেঁচে গেছিলেন আরও একজন, আওয়ামী লীগের  সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান সাহেব। পত্রিকায় একটি ছবি দেখেছিলাম, বিধ্বস্ত একটি ট্রাকের এপাশে জিল্লুর রহমান সাহেব মাথা নীচু করে নিজেকে আড়াল করেছেন, আর ট্রাকের অপর পাশে গ্রেনেড হামলায় হতাহতরা নিথর হয়ে পড়ে আছে। তখন তো উনি জানতেও পারেননি, কী ভয়াবহ দুঃসংবাদ উনার জন্য অপেক্ষা করছে! আমার মত উনিও নিশ্চয়ই পত্রিকা পড়ে অথবা লোকমুখে জানতে পেরেছিলেন যে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী বোমার আঘাতে পা দুটি হারিয়েও আশপাশের সহকর্মীদের কাছে বার বার স্বামীর খোঁজ নিচ্ছিলেন। আইভী রহমানকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখনও নাকি উনি আশপাশের কর্মীদের বলছিলেন, তারা যেন জিল্লুর রহমানের খোঁজ নেয়। এই না হলে স্ত্রী, এই না হলে প্রেমিকা, এই না হলে নারী! আহ! এমন একজন মমতাময়ী স্ত্রীর স্বামী ছিলেন জিল্লুর রহমান, যাঁদের বিয়ে হয়েছিল স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর সহযোগীতায়।

পত্রপত্রিকা পড়েই জেনেছি, ষাটের দশকে উনাদের বিয়ে হয়েছিল। আইভী রহমান ছিলেন বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে, দারুণ সুন্দরী, স্মার্ট, শিক্ষিতা। জিল্লুর রহমানও ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান, যাঁর পিতা ছিলেন আইনজীবী, উনি নিজেও ছিলেন উচ্চশিক্ষিত।  কতখানি আধুনিক মনস্ক হলে পরে সেই ষাটের দশকের রাজনীতিতে জড়িত হতে পেরেছিলেন আইভী রহমান, ভাবলে অবাক হতে হয়। শখের রাজনীতি করেননি বলেই বিয়ের পরও রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন ২০০৪ সালের ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার আগ পর্যন্ত।

স্বামী-স্ত্রী দুজনেই রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থেকেও দাম্পত্য জীবনে ছিলেন ঈর্ষণীয় পর্যায়ের সুখী, তিনটি সন্তানের পিতা-মাতা। স্ত্রী হিসেবে আইভী রহমান ছিলেন অত্যন্ত গুণী। বাইরে-ঘরে সমস্ত দিক সামলে রেখেও স্বামীর দিকে পূর্ণ খেয়াল রাখতে পারে কয়জন নারী! স্বামীকে কোন পোষাকে মানাবে ভাল,  কোন অনুষ্ঠানে কোন পোষাক পড়ে যাবেন, অথবা ঈদের পাঞ্জাবী কেমন হবে, স্বামী কোন খাবারটা বেশী পছন্দ করেন, এ সকল অতি ছোট ছোট বিষয়ের দিকেও উনি খেয়াল রাখতেন বলেই হয়তো বা জিল্লুর রহমান সাহেবের জীবনটা এত সুশৃংখল ছিল।  ব্যক্তিজীবনে সুখী ছিলেন বলেই রাজনৈতিক জীবনেও ছিলেন  কর্মের প্রতি, নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বস্ত, নিষ্ঠাবান এবং দায়িত্বশীল। তিনটি ছেলে-মেয়েকে উনারা রাজনীতির বাইরে রেখে মানুষ করেছেন, কোন দূর্নীতির বেড়াজালে জড়ান নি। নিন্দুকেরাও বলে, জিল্লুর রহমান এবং আইভী রহমান ছিলেন আদর্শ দম্পতি।

আইভী রহমান নিজেও ছিলেন শৌখিন স্বভাবের, রাজনীতির বাইরে উনার যে সুখী গৃহকোন ছিল, সেই গৃহকোনটি ছিল নিজের পছন্দে সাজানো। উনি অতিথি আপ্যায়ন করতে ভালোবাসতেন। দলীয় কর্মীদের ভালোবাসতেন, অপরকে খাওয়াতে ভালোবাসতেন, নিজেও দুই একটা জিনিস খেতে পছন্দ করতেন। দুপুরের খাবার শেষে মিষ্টি খাওয়া ছিল উনার প্রিয় অভ্যাস। সেই ২১শে আগস্টের দুপুরেও উনি মিষ্টি খেয়েছিলেন। মিষ্টিমুখ করেই আওয়ামীলীগের সমাবেশে গিয়েছিলেন।  সেদিনের পর আর উনার নিজ হাতে সাজানো সুখী গৃহকোনে ফিরে আসেননি। সঙ্গী হারা, জুটিহারা হয়ে শূণ্যগৃহে ফিরে এসেছিলেন একাকী জিল্লুর রহমান। সেদিনই উনাদের এত দীর্ঘ সুখী জীবনের সমাপ্তি ঘোষিত হয়েছিল।

সকলের চোখে যাঁরা আদর্শ দম্পতি হিসেবে বিবেচিত হতেন, সেই দম্পতির একজন যদি বিনা অপরাধে, একেবারে অতর্কিতে, অসহায় অবস্থায়  অপরের জিঘাংসার গ্রেনেডে বেঘোরে প্রাণ হারায়, তাহলে অপরজনের কী অবস্থা হতে পারে! ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্টের গ্রেনেড হামলায় কী শুধু আইভী রহমানই মারা গেছিলেন, উনার সাথে সাথে কী জিল্লুর রহমানেরও মৃত্যু হয় নি? একজন মানুষ কয়বার মরতে পারে? দেহের মৃত্যুটাই কী সব? মনের মৃত্যু কী কিছুই না?  একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মন যখন মরে যায়, তার দেহটিকে তখন পাখীশূণ্য খাঁচা মনে হয়। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্টের পর থেকে ২০১৩ সালের ২০শে মার্চের বিকেল পর্যন্ত জিল্লুর রহমানের দেহটাই শুধু বেঁচে ছিল, সে দেহে প্রাণ ছিল না। ২০শে মার্চ তারিখে সেই দেহটিও বিদ্রোহ করলো।

রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুতে সারা দেশ শোকাহত, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি মানুষ কেঁদেছে, সকলেই উনার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেছে। রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে বিরোধী দল বিএনপি তাদের পূর্বঘোষিত হরতাল কর্মসূচি স্থগিত করেছে। মাননীয় প্রধান মন্ত্রী,  মাননীয় বিরোধী নেত্রী  বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছেন। সারা দেশের  শোকসন্তপ্ত জনগণ প্রয়াত রাষ্ট্রপতির প্রতি বেগম জিয়ার শ্রদ্ধাঞ্জলীকে খুবই ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। তাদের সকলের মনেই ক্ষীন প্রত্যাশা জেগেছে, দুই নেত্রীই হয়তো বা অনুধাবন করতে পারবেন, জীবন একটাই, আজ হোক কাল হোক, সকলকেই এই পৃথিবীর মায়া কাটাতে হবে, মানুষ চলে যায়, রেখে যায় তাদের কর্ম, ফেলে যায় পালক পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি উনার কর্মের দ্বারাই এত বড় স্বীকৃতি পেয়েছেন। লাখ লাখ মানুষ এসেছিল উনাকে শেষ বারের জন্য দেখতে, প্রাণের ভালোবাসা উৎসর্গ করতে। আমাদের দুই নেত্রীকেও আমরা সবাই ভালোবাসতে চাই। দেশটা চলেছে স্রোতের উল্টোপিঠে। আপনারা দুজন মিলে দেশটিকে বাঁচান, শত্রুর বিষাক্ত ছোবল হতে রক্ষা করুন। আর কাউকে যেন এভাবে একটানা নয়টি বছর জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে না থাকতে হয়!




ভালোবাসা


মিথীলা আমার কনিষ্ঠ সন্তান। খুবই চুপচাপ স্বভাবের, দুই বছর বয়সে আমেরিকা এসেছে, বাংলা শব্দভান্ডার খুবই দূর্বল বলেই হয়তো কথা কম বলে! কথা কম বলে, তাই মনের ভাব প্রকাশ করার সুযোগও সীমিত। আমি হচ্ছি ওর স্বভাবের বিপরীত। কথা বেশী বলি, মনের ভাব বেশীক্ষণ লুকিয়ে রাখিনা ( নিজের চাওয়াগুলো শুধু লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি)। তিন মেয়ের সাথেই আমার গলায় গলায় ভাব, মেজ মেয়ের সাথে গলায় গলায় ভাবও আছে, আবার 'কাইট্টা ফালামু' ভাবও আছে। মেজ মেয়েটা আমার স্বভাব পেয়েছে। সবার জন্য তার ভালোবাসা, এমনকি গায়ে মশা বসলেও সে 'আহারে'! বলে উড়িয়ে দেয়। আমি ছোটবেলায় এই কাজটি করতাম। মশা কামড়ে ধরেছে, কোথায় এক চাপড় মেরে 'ভর্তা' বানিয়ে দেবো, তা না করে মশাকে উড়িয়ে দিতাম, আর ভাবতাম, শত্রুর প্রতি ভালোবাসা দেখিয়েছি, আমার পূণ্যভান্ডারে সঞ্চয়ের পরিমান বেড়ে গেলো!

আমি 'ভালোবাসি' টাইপ মানুষ। জীবনকে ভালোবাসি, মানুষ ভালোবাসি, প্রকৃতি ভালোবাসি, স্বজনদের ভালোবাসি, বন্ধুদের ভালোবাসি, শত্রুদেরকেও মনে হয় ভালোইবাসি, তবে সর্বোপরি নিজেকে ভালোবাসি। নিজেকে ভালোবাসতে গিয়েই অন্তরে অনেক অভিমান জমে গেছে। কেবলই মনে হয়, আমি যাদের এত ভালোবাসি, তারা তো কই আমাকে ভালোবাসে না! আমার ভালোতেও হাসে না, মন্দতেও কাঁদে না! আমার সুখেও হাসে না, অসুখেও বিচলিত হয় না!

এমন ভাবতে ভাবতেই গত সপ্তাহে গলায় ঠান্ডা বসে গেল, তারও আগের সপ্তাহে জ্বর হয়ে গেল! আমার যে মেয়েটির সাথে 'কাইট্টা ফালামু' সম্পর্ক আছে, সেই মেয়েটিই জ্বরের রাতে আমাকে ফোন করে বলল, " তুমি কাল কাজে যাবে না, যাবেনা বলেছি যাবে না। ছুটি নিয়ে ঘরে বিশ্রাম নিবে"। তার গলার স্বরে ' কাইট্টা ফালামু' টাইপের ভালোবাসা ছিল। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে জেগেই আমি 'সীক কল' দিয়ে দিলাম। একটানা তিনদিন বিশ্রাম নিলাম। এই বিশ্রামের সময়টুকুতে 'বাংলা কম জানা' মেয়েটি নীরবে আমার সেবায় এগিয়ে এলো। যখনই সে বাড়ীতে থাকে, আমার জন্য 'চা' নিয়ে আসে, পুষ্টির জন্য 'ফল' নিয়ে আসে, তার ভাঙ্গা ল্যাপটপ আমার বিছানায় এনে দেয়, জিজ্ঞেস করে 'মাথা টিপে দেব'? ঐ সময়টাতেই ভাঙ্গা ল্যাপটপে লিখেছিলাম ' জ্বর এলেই কেন মা'কে মনে পড়ে'!

গত সপ্তাহে স্প্রিং ব্রেকে অনেক বেড়ালাম, অনেকদিন বেড়ানো খেলানো হয় না বলেই বোধ হয় ধকল সইতে পারি নি। ঠান্ডা লেগে গলা বসে গেছে, আওয়াজ বের হয় না। এর মধ্যেই চাকুরীতে জয়েন করতে হয়েছে। আমি কথা বলতে পারছি না, ঘরও একেবারে নিঝুমপুরী হয়ে আছে। আমার বংলা কম জানা মিথীলার নিশ্চয়ই এই নিস্তব্ধতা ভালো লাগে না। সে আমাকে 'গরম চা' য়ের কাপ এগিয়ে দেয়, গলায় মাফলার জড়াতে বলে। আমি ছদ্ম রাগ দেখাই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে গলে যেতে থাকি। গোপনে কাঁদি, ভালোবাসা দিতে অভ্যস্ত আমি ভালোবাসা নিতে কেমন আড়ষ্ট বোধ করি। তবুও ভালো লাগে ছোট্ট মেয়েটির কাছ থেকে এমন যত্ন পেতে, এই মেয়ের জন্মের পর আমি কেঁদেছিলাম, আমার মা আমাকে বকেছিলেন, বলেছিলেন, " তোর দুঃখের দিনে এই মেয়েই তোর পাশে থাকবে"। মেয়েটিকে আমি বুকে আগলে বড় করেছি, ভালোবাসায় ওর চারিপাশ ভরিয়ে রেখেছি, ও ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই দেখেনি।

গতকাল সারাদিন আমার মনটা খারাপ ছিল, শরীর খারাপ থাকলে মনও দূর্বল থাকে। ঘুরে ফিরে আমার প্রতি মানুষের অন্যায় আচরণগুলোর কথাই মনে আসে! অযথাই মৃত মায়ের কথা মনে পড়ে! গতকালও মা'কে মনে পড়ছিল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নীরবে কাঁদছিলাম, আমার অসুখ-বিসুখ কমই হয়, অথচ দুই সপ্তাহ ধরে শরীরে নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে, হয়ত এটাই লক্ষ্মণ, পৃথিবী থেকে বিনা নোটিশে তো যেতে পারবো না, নোটিশ পেতে শুরু করেছি। এগুলোই ভাবছিলাম, ম্যানেজার এসে অনুরোধ করলো, যদি আধ ঘন্টা সময় বেশী থেকে যাই, তাহলে উনার খুব উপকার হয়। আমি এমনই মানুষ, সহজে 'না' বলতে পারি না, বললাম ' হ্যাঁ'। পরিবার প্রধানকে জানিয়ে দিলাম, ফিরতে রাত সোয়া দশটা বেজে যাবে।

রাত সোয়া দশটায় যখন গাড়ীতে স্টার্ট দিয়েছি, ফোন বেজে উঠেছে। তাকিয়ে দেখি 'হোম' থেকে কল এসেছে। ঝট করে মেজাজ বিগড়ে গেল। আমি সতেরোবার বাড়ীতে ফোন করে সবার খোঁজ খবর নেই, আর 'হোম' থেকে আমার খোঁজ কেউ নেয়না( আমি ভুলে যাই, নিজেই তো সতেরবার ফোন করে নিজের অস্ত্বিত্ব জানান দেই, তাহলে ওরা কেন ফোন করতে যাবে), শুধুমাত্র 'এটা লাগবে, ওটা এনো' বলার জন্য 'হোম' থেকে ফোন আসে। আমার আর ইচ্ছে করছিল না গাড়ী থেকে নেমে গিয়ে শপিং সেন্টারে যেতে। ফোন ধরলাম, বিরক্তি নিয়ে 'হ্যালো' বলতেই শুনি, মিথীলা বলছে,
" মা, তুমি কোথায়? এত দেরী হচ্ছে কেন? আমি ভেবেছি, তোমার কোন বিপদ হয়েছে!"

-কেন, তুমি জানতে না যে আমার আজ ফিরতে দেরী হবে!

-না, জানতাম না, পাপা শাওয়ার নিচ্ছে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত দশটা বেজে গেছে। তুমি তো সাড়ে নয়টায় চলে আসো। ঠিক আছে, মা সাবধানে ড্রাইভ করো। চলে আসো বাসায়"।

গাড়ীর স্টার্ট বন্ধ করে দিলাম, দুই চোখ ফেটে জল এলো। আহ! আমার খোঁজ নেয়ার মানুষ আছে এই পৃথিবীর বুকে। রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে সারা দেশের মানুষ কাঁদছে, আমার মত পিপীলিকাসম মানুষের মৃত্যুতেও দুই একজন কাঁদবে, এটা ভেবেই কান্না উথলে উঠলো। বাড়ী ফিরলাম। খাওয়া-দাওয়া করে ফেললাম। দেখি, মিথীলা খাবার নিচ্ছে। রেগে মেগে জিজ্ঞেস করলাম,
" রাত এগারোটায় তোমার খাওয়ার সময় হলো? এতক্ষণ কী করেছো"?
-তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম।

আমি এর জবাবে কিছু বলিনি। উপরে গিয়ে কম্পিউটার খুলে বসলাম, রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে কিছু লিখবো বলে তৈরী হলাম। কিছু তথ্যের প্রয়োজন ছিল, পত্রিকাগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করলাম, পেলাম না। দুই একজন অতি পরিচিত সাংবাদিক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করতেও 'প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে শোকাহত' বন্ধুরা আমাকে ফিরিয়ে দিল। কেউ বিনীতভাবে, কেউ 'দূর্বিনীতভাবে' ফিরিয়ে দিল। আমার আবার মন খারাপ হলো। গলার কাছটায় যন্ত্রণা টের পেলাম। মিথীলাকে ডাকলাম,

" বাবলু, আমাকে এক কাপ গরম জল এনে দিবে? একটা টি-ব্যাগ চুবিয়ে দিও"।

মিথীলা এক কাপ চা নিয়ে এলো, চায়ের কাপে দেখি একটু ফেনা দেখা যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, ফেনা কিসের?

-কিচ্ছু না, আমি চিনি দিয়ে অনেক নেড়েছি তো, তাই 'বাবল' উঠেছে।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই লাফ দিয়ে উঠলাম। একী!!! লবন দিয়েছো তো চায়ে! একেবারে লবনকটা লাগছে।

মিথীলা বোবা হয়ে গেছে। বারবার বলছে, " মা, আমি লবন দেবো কেন? চিনি দিয়েছি"।

-হেসে ফেললাম। বললাম, চিনি আর লবন, দুটোই একই রকম বোয়ামে রাখা আছে বলে তুই নিজের হাতেই বোয়ামের গায়ে 'সল্ট', 'সুগার' লিখে রেখেছিলি, আর নিজেই এই ভুলটা করলি!!!!!!! হা হা হা! থাক, আর চা বানাতে হবে না। যা, ঘুমিয়ে থাক।

মিথীলা কিন্তু ঘুমাতে যায়নি। আবার নতুন করে 'চা' বানিয়ে এনেছে। বলেছে,
" মা, এবার চিনি মিশিয়েছি। গরম থাকতে থাকতে চা' খাও, গলার ব্যথা সেরে যাবে। এবার আমি ঘুমুতে যাই!"

-অনেক ধন্যবাদ মিথীলা, গুডনাইট, স্লীপ টাইট!

Like · · Promote ·

Tuesday, March 19, 2013

জোড় ফল!!

গতকালকেই আমি ওয়ালমার্ট থেকে ছয় বক্স স্ট্রবেরী কিনে এনেছি, জ্যাম বানাবো বলে। স্ট্রবেরী এখানে মোটামুটি দামী ফলের মধ্যেই পড়ে। এক পাউন্ড স্ট্রবেরী বক্সের দাম তিন ডলার,  তিন পাউন্ডের এক ব্যাগ আপেলও তিন ডলার। তাই আমার দৈনন্দিন বাজারের মেন্যুতে  আপেল থাকে, স্ট্রবেরী থাকে না। মাঝে মাঝে এক বা দুই বক্স কিনে আনি। শুধু দামের কথাই বা বলি কেন, স্ট্রবেরী খুব দ্রুত পচনশীল বলেও আমি এই ফলটির রূপে-গন্ধে বিমোহিত হয়েও ঘরে এনে তুলি না। আরেকটি ব্যাপারও আছে, স্ট্রবেরী দেখতে যতই লাল টুকটুকে হোক না কেনো, স্বাদে ঠিক তার উলটো। বেশীর ভাগ স্ট্রবেরীই খেতে ভীষন টক লাগে। আমার পরিবারে সদস্যসংখ্যা বর্তমানে মাত্র তিন জন। এই তিন জনের কেউই টক পছন্দ করি না। স্ট্রবেরী না কেনার পেছনে এটাও একটি কারণ। এতগুলো কঠিন কারণ থাকার পরেও কেন ছয় বক্স স্ট্রবেরী কিনে ফেললাম! আমাকে যারা খুব কাছে থেকে দেখেছে, তারা এক মুহূর্তেই বলে দেবে,

" নিশ্চয়ই আজকে স্ট্রবেরী সেল দিয়েছে, নাহলে অতগুলো বক্স কিনে আনতে না"!

ধরা আমাকে পড়তেই হবে। কারণ আমার এই স্বভাব আছে, সেলে যদি 'বিষ'ও দেয়, আমি সেই 'বিষ' কিনে এনে ঘর ভরিয়ে ফেলবো। তবে গত দুই বছর ধরে আমার মধ্যে অনেক পরিবর্তণ এসেছে। আমি আর 'সেল' খুঁজি না, মূল্যহ্রাসে জিনিস কিনে ঘর ভরে তুলি না। কারণ একটাই,  মূল্যহ্রাসে কেনা জিনিসের  কোন কদরই নেই আমার পরিবারে। মাঝে মাঝেই পরিবার প্রধান মূল্যহ্রাসে কেনা সামগ্রীগুলো বস্তায় ভরে স্যালভেশান আর্মীর দোকানে দিয়ে আসে, নাহলে বস্তায় ভরে বাড়ীর বাইরে রেখে দেয়, যার ইচ্ছে ওখান থেকে পছন্দমত জিনিস তুলে নিয়ে যায়, বাকীগুলো মিউনিসিপ্যালিটির ট্রাক এসে তুলে নিয়ে যায়। এজন্যই আর মূল্যহ্রাসে কিছু কিনি না।

গতকাল অবশ্য এতগুলো স্ট্রবেরী কিনেছি আমার একজন সহকর্মীর প্ররোচনায় উদ্বুদ্ব হয়ে। ডেবী'র বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি।  বেকারী ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার সে। কোন এক অজানা কারণেই ডেবী আমাকে ভালোবাসে, তার ডিপার্টমেন্ট আর আমার ডিপার্টমেন্টের মধ্যে ব্যবধান অনেক, তবুও সে আমার সাথে দেখা করার জন্য একবার হলেও আমাদের ডিপার্টমেন্টে চলে আসে। ডেবী'র রান্নার হাত খুব চমৎকার, বাড়ীতে যা কিছু ভাল-মন্দ রান্না হবে, আমার জন্য একটু হলেও নিয়ে আসবে। আমি অবশ্য জানি না, এই শ্বেতাঙ্গ রমণী আমার মত বাদামী চামড়ার নারীর মুখে কার ছায়া খুঁজে পেয়েছে! সেই ডেবীই কাল দৌড়ে এসেছে আমার কাছে, এসেই  গোপন কথা বলার মত স্টাইলে ফিসফিস করে বলেছে,

" রীটা, আজ স্ট্রবেরী সেলে দিয়েছে। আমি বত্রিশ বাক্স স্ট্রবেরী কিনেছি, জ্যাম বানাবো, এক ফাঁকে ওখানে গিয়ে তুমিও কিনে ফেলো। নাহলে লোক জানাজানি হয়ে গেলে ফুরিয়ে যাবে"।

ডেবীর কথা ফেলি কী করে! তার কথার সম্মান রাখতে গিয়েই আমি ছয় বাক্স স্ট্রবেরী কিনে ফেলেছি। বাড়ী ফিরতেই ছোট মেয়েটা চোখ বড় বড় করে বলল,
" মা, এতগুলো স্ট্রবেরী কিনেছ?"
বললাম, " সেলে দিয়েছে তো, তাই নিয়ে এলাম"।
-কিন্তুক (ও কিন্তু বলতে পারেনা) স্ট্রবেরী তো পচে যায়, এতগুলো স্ট্রবেরী শেষ করবো কীভাবে?
-শেষ করতে হবে, স্ট্রবেরী খুবই পুষ্টিকর, প্রতিদিন ছয়-সাতটা করে খেলেই শেষ হয়ে যাবে।
-কিন্তুক, স্ট্রবেরী অনেক টক, ছয়-সাতটা খাওয়া যাবে না।

-এই দ্যাখ, আমি কীভাবে খাই--বলেই একটি বক্স খুলে স্ট্রবেরী বের করতে গিয়ে দেখি 'জোড়া' বাঁধা স্ট্রবেরী আছে বেশ কয়েকটি। জোড়া স্ট্রবেরীগুলোকে আলাদা করে রাখছি দেখে মেয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

" মা, এই 'টুইন' গুলোকে আলাদা করে রাখছো কেন?
-হুম, টুইন ফল মেয়েদের খেতে হয় না। টুইন ফল খেলে 'টুইন' বেবী হয়। এই স্ট্রবেরী গুলো তোমার পাপা খাবে।

-কী বলো এসব, টুইন ফল খেলে টুইন বেবী হবে কেন? মেয়েরা খেলে টুইন বেবী হবে, ছেলেরা খেলেও তো টুইন বেবী হবে!

-তা জানিনা, ছোটবেলা্য  তোমার দিদা আমাকে জোড়া ফল খেতে দিত না, বলতো, মেয়েদের জোড়া ফল খেতে নেই, জোড়া ফল খেলে যমজ সন্তান হয়। জোড়া ফল দেখলে আমি কত খুশী হতাম, কিন্তু তোমার দিদা জোড়া ফলগুলো তোমার মামাদেরকে দিয়ে দিত।

-হা হা হা!! যাদের টুইন বেবী আছে, ওরা সবাই কী টুইন ফল খেয়েছে?

-এই মেয়ে, এত কথা জিজ্ঞেস করো কেন? আমি বলেছি তো, আমি জানিনা। শুধু শুধু কথা প্যাঁচাও কেন, টুইন স্ট্রবেরীগুলো তোমাকে খেতে না করেছি, খাবে না।

-আচ্ছা, খাব না, কিন্তু টুইন বেবী হলে প্রবলেম কী? তুমি তো বলো, টুইন বেবী দেখতে তোমার খুব ভাল লাগে।

-বলি তো অনেক কথা, কিন্তু সব কথা কী মেনে চলি? এই যেমন তুমিও আমাকে প্রতিদিন বলো, 'বাংলা পড়বো, বাংলা পড়বো', তুমি কী প্রতিদিন বাংলা পড়ো? একদিনও পড়ো না। সেরকমই ব্যাপার।

বাংলা পড়ার কথা তুলেই মেয়েকে  মোক্ষম আঘাত আঘাত দিয়েছি, জোড়া ফল খাওয়া না খাওয়া নিয়ে মেয়ে আর তর্ক করবে না। আমাদের মা-বাবারাও তো  আমাদের সাথে যুক্তিতে হেরে গেলে এভাবেই আমাদেরকে থামিয়ে দিত, তাই আমিও দিয়েছি ওকে থামিয়ে। কিন্তু ওকে থামিয়ে দিয়েও তো নিজের মনের ভেতর জমে থাকা অন্ধ কুসংস্কারগুলোকে তাড়াতে পারছি না। সত্যিই তো, আমিও জানি, জোড় ফল খাওয়ার সাথে 'যমজ সন্তান' হওয়ার কোন সম্পর্কই নেই, তারপরেও কেন জোড় স্ট্রবেরীগুলোকে আলাদা করে রাখলাম! মেয়ের যুক্তির কাছে হেরে যাচ্ছি ভয়ে মেয়েকে কেন অযৌক্তিকভাবে থামিয়ে দিলাম! যে জিনিসের কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই, যে কথার কোন চাক্ষুষ প্রমাণ নেই, শুধু  ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে, নিছক আবেগের বশে, মেয়ের মনে জেগে উঠা প্রশ্নকে থামিয়ে দিলাম! ঠিক এই কারণেই হয়তো আমাদের মনের অন্ধকার কাটে না!

শুধু কী জোড় ফল খাওয়া নিয়েই সংস্কার আছে?  মেয়েদের আরও কত রকম সংস্কার-কুসংস্কারের ভেতর দিয়ে চলতে হয়! সকল কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মনে প্রশ্ন জাগলেও তার  সঠিক ব্যাখ্যা চাওয়ার জো নেই। 'মহাফাজিল', 'বেয়ারা', 'কূটতার্কিক' খেতাব পাওয়ার ভয়েও অনেক মেয়ে টুঁ শব্দ করে না। মুখ বুজে মান্ধাতা আমলের কু-সংস্কারের বেড়াজালে নিজেকে আটকে রাখে। বেড়াজাল কেটে আর বের হতে পারে না। আমার নিজের মনেও অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। খুব ছোট করে দু'একটি  মেয়েলী সংস্কারের কথা বলি। সংস্কারগুলোকে কী কুসংস্কার বলবো, নাকি ধর্মীয় বিধান বলবো, তা আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারি নি। যদিও আমাকে এ সকল সংস্কারের বেড়াজালের ভেতর দিয়েই আসতে হয়েছে, তবুও মেয়েলী এসকল সংস্কারের পেছনে  কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাইনি,  আবার প্রতিবাদ করার সাহসও হয় নি। 

ছোটবেলার একটি ঘটনা। আমাদের প্রতিবেশী মাসীমার একটি মেয়ে হয়েছে। হাসপাতাল থেকে কেউ একজন সংবাদ নিয়ে এসেছে, বাচ্চাটির উপরের ঠোঁট কাটা, এ খবর শোনার সাথে সাথে প্রতিবেশী আর সকল মাসীমা গোত্রীয়দের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। সকলেই একই কথা বলতে লাগলো,

" আরে! হবেই তো, ঐ দিদিতো সারাক্ষণই  সুঁই সূতা, কাঁচি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। গ্রহণও মানে না, নিশ্চয়ই গত সূর্য্যগ্রহণের সময় কাঁচি দিয়ে কাপড় কেটেছে, এইজন্যই বাচ্চার ঠোঁট কাটা হয়েছে! নিয়ম মানতে হয়, গ্রহণ হচ্ছে খুবই মারাত্মক ব্যাপার, উনার তো এটা পঞ্চম সন্তান, উনার তো বুঝা উচিৎ ছিল, গ্রহণের দিন টান টান হয়ে শুয়ে থাকা নিয়ম, আর উনি কিনা সেলাই ফোড়াই নিয়ে ব্যস্ত ছিল"!

বাচ্চা নিয়ে মাসীমা যখন হাসপাতাল থেকে বাড়ী ফিরলেন, বাড়ীর সবাই হুমড়ী খেয়ে পড়েছে বাচ্চার দেখার জন্য। আমিও ছিলাম সেই হুমড়ী খাওয়া মানুষের দলে। বাচ্চাটিকে দেখে আমি ভয় পেয়েছিলাম, উপরের ঠোঁট একেবারেই নেই। মাসীমা চোখে আঁচল চাপা দিয়ে রেখেছিলেন। সামনাসামনি কেউ কিছু না বললেও পেছনে এসে আবারও সেই একই কথা আলাপ করছিল, মাসীমা যেহেতু সেলাই ফোড়াই করতে ভালোবাসতো, তাই সবার ধারণা হয়েছে সূর্য্যগ্রহণের সময় ভুল করেই মাসীমা কাঁচি দিয়ে কাপড় কেটেছে। এই ভীড়ে আমার মা ছিলেন না। আমি ঘরে এসে মা'কে বলতেই বিশাল এক ধমক খেয়েছি। মায়ের কথা, মাসীমাকে এই মুহূর্তে কিছুটা সময় নিজের মত করে থাকতে দেয়া উচিত। বাচ্চাটা দেখার জন্য এভাবে দলে দলে ভীড় করা ঠিক হয় নি। তবে আমার মা'ও সবার কথা বিশ্বাস করেছে দেখে আমি বিভ্রান্ত হয়েছি। কারণ, আমার মা যুক্তি ছাড়া কোন কথা বলেন না, মা অযথা কোন কিছু নিয়েই কৌতূহল দেখান না। সেই যুক্তিবাদী মা যখন বিশ্বাস করেছেন, মাসীমার গ্রহণের সময় কাঁচি দিয়ে কাপড় কেটেছে বলেই বাচ্চার ঠোঁট কাটা হয়েছে, তাহলে ঘটনা সত্যি। আমার ছোট মেয়ের মত আমিও প্রশ্ন করেছিলাম, কাঁচি দিয়ে কাপড় কেটেছে, কাঁচি দিয়ে তো পেট কাটে নি। আর সূর্য্য তো থাকে আকাশে, সেই সূর্য্য গ্রহণের সাথে পেটের ভেতর ঘুমিয়া থাকা বাবুটার কী সম্পর্ক।  কোন সঠিক উত্তর তো পাইই নি, উলটো বড়দের কথায় থাকার জন্য ধমক খেয়েছে। কী জানি, মা এবং আরও অন্যান্য মহিলারা কত ঘটনার কথা শোনালেন। আমাকে শোনাননি, উনারা আলোচনা করছিলেন, আমি শুনেছি।

মা তো একেবারে চাক্ষুষ প্রমান দিয়েছেন! আমার জন্মের সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই নাকি এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। মায়ের পাশের বেডেই ছিলেন আরেক মহিলা, বাচ্চা হবো হবো স্টেজে ছিলেন, এর মধ্যেই চন্দ্রগ্রহণ লেগে গেছে। মহিলা নাকি মন খারাপ করে সারারাত দুই পা ভাঁজ করে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ছিলেন। পাশের বেড থেকে মা নাকি অনেকবার তাঁকে ডেকে বলেছে, " আপা, এভাবে শুয়ে থাকবেন না, আজকে চন্দ্রগ্রহন, সোজা হয়ে শুয়ে থাকেন"। মহিলার মনে অনেক দুঃখ ছিল, তার শ্বশুরবাড়ীতে তার কোন কদর ছিল না, হাসপাতালে কেউ দেখতে আসতো না। সেই দুঃখে উনি অমন করে শুয়ে ছিলেন। আমার মা'কে দেখতে যেত দলে দলে, অথচ পাশের বেডের রুগীকে কেউ আসতো না একটু চোখের দেখা দেখতে, রুগীর মনে কষ্টতো হবেই। তিনদিন পরেই মহিলার একটি মেয়ে বাচ্চা হলো। বাচ্চাটার পা দুটো ভাঁজ করা অবস্থায় ছিল। আমার মায়ের নিজের চোখে দেখা, আয়ারা এসে গুজুর গুজুর করছিল, এমনকি মহিলাকে ধমকাচ্ছিল, " হইবই তো বাচ্চা এমন, সেইদিন গ্রহণ ছিল, আপনি সারাটা দিন রাত গুটিশুটি মাইরা শুইয়া ছিলেন, বাচ্চার পা দুইটা ঐজন্যই ভাঁজ হইয়া গেছে। এখন আর কাইন্দা কী হবে। নিয়ম কানুন মানতে হয়।"

আরও মজার গল্প শুনেছি, মায়ের এক দিদি ছিলেন, উনার যমজ ছেলেমেয়ে হয়েছে। ছেলে বাচ্চার কানের লতিতে একটি দাগ ছিল, চিমটি কাটার মত দাগ। মায়েরা সবাই মিলে মত দিলেন, " দিদি ভরা পোয়াতী অবস্থায় সূর্য্যগ্রহণের সময় লুডু খেলছিল। খেলার সময়  লুডুর গুটি চিমটি দিয়া তুলেছিল ত, তাই ছেলেটার কানের লতিতে চিমটির দাগ পড়েছে"।

আমার এক বন্ধু ছিল, সীমা। ওর কানের লতির ঠিক উপরে দুটি ছোট ছোট দানার মত ছিল, অনেকটাই মটরশুঁটি সাইজের। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই মটরশুঁটির রহস্য কি? ও বলেছে, " আমি যখন মায়ের পেটে ছিলাম, একবার সূর্য্যগ্রহণ লেগেছিল, আমার মা গ্রহণের সময় ভুল করে মটরশুঁটি বাছছিল, পরে কেউ একজন গ্রহণের কথা মনে করিয়ে দিতেই মটরশুঁটি বাছা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু যেটুকু করেছে, তাতেই আমার কানের উপর মটরশুঁটির মত ছোট্ট দানা হয়েছে। আমি বলেছিলাম, " এটা তো টিউমার", সাথে সাথে ও প্রতিবাদ করেছে, না ওটা টিউমার নয়, ওটা মটরশুঁটি।


এবার আসি নিজের কথায়। ছোটবেলা থেকে এমন সব অদ্ভূত গল্প শুনে বড় হয়েছি, বিশ্বাস -অবিশ্বাসের দোলাচলে থেকেছি, কিন্তু নিজের জীবনে এসে এই কুসংস্কারগুলোকে আর কুসংস্কার মনে হয় নি। আমার প্রথম সন্তান জন্মের সময়, সারারাত ব্যাপী চন্দ্রগ্রহণ ছিল। আমার তখন একেবারে পূর্ণ সময়, এমতাবস্থায় এত লম্বা সময়ের চন্দ্রগ্রহণ কী করে পার করবো, সেই চিন্তায় সকলে অস্থির। আমার বয়স কম, এত সময় টান টান হয়ে শুয়ে থাকার মত ধৈর্য্য থাকবে কিনা, এই চিন্তায় মা, দিদিমা সকলেই অস্থির। আমি বললাম, " আমি পারবো, ঘুমাবো না, তাহলেই আর পা বাঁকা হবে না।"  সারারাত না ঘুমিয়ে থাকলে মা ও গর্ভের শিশু, দুজনেরই ক্ষতি হবে, এই চিন্তা করে দিদিমা  কোথা থেকে যেন লম্বা এক কাঠি যোগাড় করে এনেছেন। শিয়রের কোনায় কাঠি রেখে দিলে নাকি কোন বিপদ হবে না। আমার শিয়রের কোনায় কাঠি, তবুও আমি নিশ্চিন্ত হতে পারিনি। দুই পা সটান করে দিয়ে সাতটি ঘন্টা পার করতে আমার কী পরিমান কষ্ট হয়েছে, তা কী আমার মেয়ে জানে! আমিই কী জানতাম, আমাকে গর্ভে রেখে দশটি মাস মা'কে কত পরিশ্রম করতে হয়েছে, কী কষ্ট যে হতো মায়ের, হাঁস ফাঁস লাগা থেকে শুরু করে কত রকমের যন্ত্রণা সইতে হয়েছে, আমার নিজের সন্তান হওয়ার আগে তো আমি তা বুঝতেই পারি নি। যাই হোক, আমার তিনটি সন্তান হওয়ার সময় আমি একই নিয়মের ভেতর দিয়ে গেছি। যখন আমি নিজে গেছি ঐ সময়ের ভেতর দিয়ে, তখন এই নিয়মগুলোকে কুসংস্কার মনে হয় নি। এক সন্তানের ভারেই কাত হয়ে যেতাম, তার উপর যদি 'যমজ সন্তান' হতো, কী অবস্থা হতো! ঠিক ঐ অবস্থায় আমার মনে হয়েছিল, এইজন্যই মা 'জোড় ফল' খেতে দিত না।

মা'কে তো এই অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, মা জানে, কী কষ্ট হয় গর্ভকালীন সময়ে! যে এর ভেতর দিয়ে না যায়, তার তো আর জানার উপায় থাকে না। ছেলেদের যেহেতু এই অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয় না, সেইজন্যই 'জোড় ফল' ছেলেদেরকেই খেতে দেয়া হয়। তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়, একটি বাচ্চার জন্মের পেছনে তো ছেলেদের ভূমিকা মেয়েদের ভূমিকার সমতুল্য। তাহলে যে ছেলেটি 'জোড় ফল' খেল, তার থেকে তো 'যমজ সন্তান'ই আশা করা যায়! কিন্তু আমাদের সমাজে মা' কাকীদেরকে এমন প্রশ্ন করা একেবারে বেয়াদবীর পর্যায়ে চলে যায়, কখনও কখনও প্রশ্নের যৌক্তিকতা এমন অখন্ডনীয় হয়ে দাঁড়াতে পারে যে উত্তর জানা না থাকলে প্রশ্নকারীকে 'নাস্তিক' বলে হুমকী দেয়া যায়। কোন মা-ই চান না, তাঁর সন্তানকে কেউ 'নাস্তিক' ঘোষণা করুক। তার আগেই সন্তানের অনুসন্ধিৎসু বিবেককে ধর্মের দোহাই দিয়ে থামিয়ে দেয়া ভাল। এইজন্যই আমিও আমার ছোট মেয়েকে থামিয়ে দিয়েছি।


যে দেহকে ভালোবাসি, সেই আমায় কাঁদায় বেশী!

নাহিদ জাহান লীনার সাথে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল না। তাকে আমি আগে কোথাও দেখিওনি, তার কথা শুনিওনি।   আজকেই তাঁর কথা প্রথম জানলাম।  দুপুরে অনলাইনে গিয়ে পত্রিকা পড়ার জন্য প্রিয়. কমে যেতেই একটি  আর্টিক্যালের দিকে আমার নজর আটকে গেলো,  নাহিদ জাহান লীনাকে নিয়ে লেখা আর্টিক্যাল। আর্টিক্যালটির দিকে এক লহমায় নজর গেছে লীনার অনিন্দ্য সুন্দর ছবির দিকে তাকিয়ে।  গতকাল ১৭ই মার্চ রবিবার রাত ১টার দিকে  ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত লীনা শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হার মানেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৪০। পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। সাংবাদিকতা ছাড়াও তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নানারকম সামাজিক কর্মকান্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। মরণব্যাধি ক্যান্সারের সাথে লীনা লড়াই করছিল ২০০৯ সাল থেকে। ২০১৩ সালের শুরুতেই তাঁকে  মৃত্যুর কাছে পরাজয় বরণ করতে হলো। তাঁর মৃত্যুতে  একমাত্র সন্তান ছয় বছর বয়সী 'আনা' মাতৃহীন হয়ে গেল। কয়েকমাস আগে আমিও মাতৃহীন হয়ে গেছি। আনার সাথে আমার বয়সের পার্থক্য আকাশ  আর  পাতালের  মধ্যেকার  পার্থক্যের সমান হলেও,  আমাদের  দুজনের মধ্যে  মিলও আছে, সেটা হচ্ছে আমরা দুজনেই আজ  মাতৃহারা  এবং দুজনের মা-ই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আনা তার মায়ের জন্য যতখানি কাঁদছে, আমি এখনও আমার মায়ের জন্য ততখানিই কাঁদছি। আমরা দুজনেই আজ অসহায়, ক্যান্সারের নির্মম শক্তির কাছে পরাজিত।


আমি ইদানিং ঘরে থাকতেই বেশী পছন্দ করি। সাত বছরেরও বেশী সময় ধরে ওয়ালমার্টে চাকুরী করছি, প্রথম প্রথম খুব ভালো লাগতো, ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে কাজ করতে গিয়ে কত ধরণের মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে, কত রকমের গল্প শুনেছি, কত ধরণের নতুন নতুন অভিজ্ঞতা যে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। ইদানিং খুব টায়ার্ড লাগে, আর ভাল লাগে না অফিস কাছারী করতে। সেজন্যই ছুতোয় নাতায় বাড়ী চলে আসি।  বিশেষ করে এক ঘন্টার লাঞ্চ ব্রেকেতো আসা চাই-ই চাই, বাড়ী আসতে গেলে আসা-যাওয়ায় চলে যায় বিশ মিনিট, বাকী চল্লিশ মিনিট আমি ঘরে থাকি।  খুব ভাল লাগে।  নিন্দুকেরা অবশ্য  বলে, আমি নাকি ফেসবুকের টানে বাড়ী চলে আসি। জানিনা, নিন্দুকের কথা সত্যি কিনা, তবে বাড়ী এসে আমি সত্যিই কম্পিউটারে গিয়ে বসি। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ঘোরাঘুরি করি, এখানেও হরেক রকমের সংবাদ পাঠ করি। আগে অবশ্য কাজে যাওয়ার সময় সাথে করে বিরাট এক গল্পের বই নিয়ে যেতাম। পনের মিনিটের টি-ব্রেকেও আমি গল্পের বইয়ে নাক-মুখ ডুবিয়ে রাখতাম। বইগুলো এখন আমার বুকশেলফে শোভা পাচ্ছে। বই পড়তে আর ভাল লাগে না। তার চেয়ে ফেসবুক অনেক বেশী জীবন্ত, অনেক বেশী দুরন্ত মনে হয়।

আমার মায়ের মৃত্যুর পরে আমার মধ্যে এই পরিবর্তণটা এসেছে। সম্প্রতি আমার মা মারা গেছেন  ইউটেরাসে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে। রোগ চিহ্নিত হয়েছে অগাস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে, মা মারা গেছেন অক্টোবারের আট তারিখে। মাত্র দুই মাসের মধ্যে সব কিছু শেষ। সেই থেকে আমার মনের এই পরিবর্তন! একটুও শান্তি পাই না মনে। আমার মায়ের বয়স হয়েছিল পঁচাত্তর বছর। আমি মায়ের তৃতীয় সন্তান, মায়ের কনিষ্ঠ সন্তানের বয়স চল্লিশ পার হয়ে গেছে। অর্থাৎ গত চল্লিশ বছর  আগে মায়ের দেহের অভ্যন্তরে থাকা 'ইউটেরাস' বা 'জরায়ু' নামক অর্গ্যানটি তার দায়িত্ব শেষ করেছিল মায়ের কনিষ্ঠ সন্তানটিকে ধারণ করে। মা হয়তো ভুলেও গেছিল তার দেহের ভেতরে থাকা 'জরায়ু' নামের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটিকে। কিন্তু মা ভুলে গেলেও ক্যান্সার নামক কর্কটরোগ মশাই সেটা ভুলে নি। সে তার বিষাক্ত থাবায় খাবলে ধরেছে  আমার বৃদ্ধ মায়ের জরায়ুটিকে, যেখানে মা আমাদের চার ভাই বোনকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে ভাবি, কী এমন ক্ষতি হতো আমার মা'কে শান্তিতে মরতে দিলে! পঁচাত্তর বছর বয়সে মারা যাওয়ার জন্যতো কত রকমের অসুখ আছে। হার্ট অ্যাটাক হলেও মন্দ হতো না, শেষ পর্যন্ত ক্যান্সার, তাও আবার দেহের রিটায়ার্ড একটি অংশে। ঈশ্বরের লীলা বুঝা ভার। ক্যান্সারের নাম শুনলে এখনও আমাদের বুক কাঁপে। শুনেছি, আমার মায়েরও বুক কেঁপেছিল। তবে উনাকে জানতে দেয়া হয়নি যে উনার ক্যান্সার হয়েছে। বলা হয়েছিল, ইউটেরাসে সিরিয়াস ইনফেকশান হয়েছে। রেডিওথেরাপী দিলেই সেরে যাবে। মা একবার বলেছিল, " দেখিস, আবার যেন কেমোথেরাপী না লাগে। কেমোথেরাপী দিলে বাঁচবো না"! আমরা মা'কে জানতে দিতে চাইনি বলেই বোধ হয় থেরাপী শুরু হওয়ার আগেই মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। খুব বেঁচে থাকার শখ ছিল,  কর্কট রোগ আমার বৃদ্ধা মায়ের জরায়ুতে অযাচিতভাবে, অনাহুতের মত গিয়ে বাসা বেঁধেছিল। জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত দেহ পারেনি ক্যানসারকে রুখে দাঁড়াতে। আহারে! নারীর এত সাধের অঙ্গ, যেখানে একটি ভ্রূন থেকে একটি পূর্ণাংগ মানবশিশুর সৃষ্টি হয়, তার প্রতি এমন অবিচার!

লীনার করুণ জীবনাবসানের খবরটি আমার অন্তরে-বাহিরে ঝড় তুলেছে। অদৃশ্য ক্যান্সারের প্রতি ঘৃণা উপচে পড়ছে। ক্যান্সারের কী কোন বিবেক বিবেচনা থাকতে নেই! ক্যান্সারও কি পাকিস্তানী মিলিটারীর মত পিশাচ, ক্যান্সার কী কতগুলো নারীলোলুপ পুরুষের মত উন্মাদ! ক্যান্সারও কি 'ধর্ষক' , 'কামুক' পুরুষের ন্যায় নির্লজ্জ, পাষন্ড?  ক্যান্সারের কী সৌন্দর্য্যবোধ, রুচী বোধ থাকতে নেই! নারী শরীর দেখলেই কি ক্যান্সারের ক্ষিদে পেয়ে যায়? নাহলে পাকিস্তানী হায়েনাদের মত কেন সে স্থান কাল ভুলে একজন বৃদ্ধার 'জরায়ু'তে আক্রমণ করলো, কেনই বা সে দুই বছর বয়সী শিশুর মায়ের স্তনে গিয়ে আস্তানা গাড়লো? এই সব নষ্ট রক্তবীজের ঝাড়দের কি আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই?  পঁচাত্তর বছর বয়সের এক নারী তো এমনিতেই তাঁর দেহের 'নারী অঙ্গের' অস্ত্বিত্বের কথা ভুলেই যায়। নারীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গই তো হচ্ছে 'স্তন এবং জরায়ু', যা নারীকে 'নারী'র মর্যাদা দিয়েছে, নারী জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে।  প্রতিটি নারীর কাছেই তার দেহের এই দুটি অঙ্গ পরম ভালোবাসার, পরম মমতার। এ দুটি অঙ্গ নারীকে দিয়েছে এক ও অদ্বিতীয় ক্ষমতা।  এ দুটি অঙ্গ আছে বলেই পৃথিবী আজও ঘুরছে, আজও নতুন নতুন প্রাণের সৃষ্টি হচ্ছে। আজও কোটি কোটি শিশুর  কলকাকলীতে আকাশ বাতাস মুখরিত হচ্ছে।  পৃথিবীর বুকে এসে প্রথম যে পাণীয়ের সাথে শিশুর পরিচয় ঘটে, তা হচ্ছে মায়ের বুকের দুধ। শিশুকে স্তন্য দান করার সাথে সাথে নারী হয়ে উঠে 'মা'। আর সেই মা'কেই কিনা সন্তানের কাছ থেকে এভাবে কেড়ে নিতে হয়!

ছবিতে লীনাকে দেখে নিজের অজান্তেই দুই চোখ জলে ভরে এসেছে। কী প্রাণবন্ত, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, দারুণ মিষ্টি দেখতে! একমাত্র মেয়ের সাথে তোলা ছবিগুলো দেখে বুক ফেটে যায়! আর আর্টিক্যালটা পড়ার পর থেকে কোনভাবেই শান্তি পাচ্ছি না। আমি জীবনকে বড্ড বেশী ভালোবাসি। বেঁচে থাকার যে কী সুখ, তা যেন পলে পলে উপলব্ধি করি। মানুষ হয়ে জন্মেছি, এ যে কত আনন্দের, কত গর্বের! এই জীবন ছেড়ে চলে যেতে হয় এত তাড়াতাড়ি! মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে! অসহায়ের মত আমারও ঈশ্বরকে দোষারোপ করতে ইচ্ছে করে।

ঈশ্বরকে তো এমনিতেই হাজারবার দায়ী করি নারীকে অবলা বানিয়ে পাঠিয়েছেন বলে।  দেয়ার মধ্যে দিয়েছেন একতাল রূপ আর মাতৃত্বের ক্ষমতা। অথচ এত রূপৈশ্বর্য্য দিয়েও ঐশ্বর্য্যকে রক্ষা করার মন্ত্র শিখিয়ে দেননি। স্তন যুগলে অমৃত ধারা দিয়েছেন সন্তানের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্যে, অথচ হায়েনার কামড় থেকে বাঁচবার জন্য অমৃত কুম্ভের তলায় একটু বিষের ব্যবস্থা রাখেন নি। যদি বিষের ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে যে বিকৃত কামুকের দল নারীর এই অনাবিল সৌন্দর্য্যের আধারকে নিছক একতাল মাংস মনে করে খুবলে খেতে চায়, তাদের সারাদেহ বিষের প্রতাপে বিকল হয়ে যেতে পারতো। সব দোষ ঈশ্বরের। যখনই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কোন লেখা পড়ি,  ঐ সময়ে পাকিস্তানী হায়েনাদের অত্যাচারের কাহিনী পড়ি, যখনই পড়ি, কী অত্যাচারটাই তারা করেছিল লাখ লাখ মেয়ে, নারীর উপর, দূর্দমনীয় আক্রোশে পা থেকে মাথা পর্যন্ত গরম হয়ে যায়। আহ! কত কাহিনীতে যে পড়লাম, হায়েনার দল তাদের ক্যাম্পে রেখে মেয়েগুলোক্বে শুধু বলাৎকারই করেনি, পৈশাচিক উল্লাসে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয় নি, নখের আঁচড়ে, বিষাক্ত দাঁতের কামড়ে নারীদেহ ক্ষত বিক্ষত করেছে, নারীর দেহ থেকে তার স্তন যুগল কেটে ফেলেছে, আরও যতরকম সম্ভব-অসম্ভব, অবর্নণীয় কায়দায় অত্যাচার করেছে, এগুলো জানার পর শুধুই ঈশ্বরকে দোষারোপ করা ছাড়া  আমি অবলা আর কী করতে পারি!

শুধুই পাকিস্তানী মিলিটারী কেন, আমাদের চারপাশে কত ভদ্রবেশী পশু আছে, যাদের ভয়ে মেয়েদেরকে সব সময় তটস্থ থাকতে হয়। বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, ভীড়ে যেখানেই যাক নারী, কিছু হায়েনাও সেখানে জুটে যায়। হায়েনারা সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় তক্কে তক্কে থাকে, সুযোগ পেলেই লোমশ হাত দিয়ে নারীর বক্ষ ছুঁইয়ে দেয়, পৈশাচিক আনন্দে চোখ মুখ চকচক করে উঠে। আর 'অবলা নারী', সবাই তো আর 'ফেরদৌসী প্রিয়ভাষীনির' মত অমন সাহসী নয়, অথবা একজন 'তসলিমা নাসরীনের' মত বিদ্রোহী নয়,  তাই মুখ বুজে অপমান সয়ে মাথা নীচু করে সরে আসাকেই স্বস্তির মনে করে। এইজন্যই 'ক্যানসার' এর উপর আমার এত রাগ। ক্যান্সারও তো পাকিস্তানী মিলিটারী বা আমাদের চারপাশে লুকিয়ে থাকা হায়েনাদের মতই হিংস্র। ক্যান্সার হিংস্র বলেই  আজকের পৃথিবীতে কোটি কোটি নারী হয় ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে, নয়তো ইউটেরাস, ওভারীর ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে।

লীনাকে আমি চিনতাম না, তাই লীনার কষ্টগুলোকে কাছে থেকে দেখিনি কিন্তু আমার মা'কে দেখেছি। কী কষ্ট বুকে নিয়ে, কী বেদনা দেহে নিয়ে উনি দুটি মাস বিছানায় ছটফট করেছেন। লীনা নাকি এক মুহূর্তের জন্যও সাহস হারায় নি, কেমোর পর কেমো নিয়ে গেছে, অপারেশান করিয়েছে, আমার মা-ও ভয় পাননি, সাহস বুকে নিয়েই অপারেশান থিয়েটারে গিয়েছিলেন, পর পর দুইবার। লীনার কথায় কেন বার বার আমার মা'কে মনে পড়ছে! নারীরা মায়ের জাত বলে! লীনা তার শিশু কন্যাটির জন্য বাঁচতে চেয়েছিল, আমাদের মা আমাদের জন্য বাঁচতে চেয়েছিলেন। অথচ দুরারোগ্য ক্যান্সার একজনের স্তনে বাসা বেঁধেছিল, আরেকজনের অকেজো জরায়ুতে বাসা বেঁধেছিল। এ দুটি অঙ্গই নারীর অহংকার, এ দুটি অঙ্গ নিয়েই নারী পুরুষ থেকে আলাদা, এ দুটি অঙ্গ পারস্পরিকভাবেই মানব সন্তান সৃষ্টি ও রক্ষনাবেক্ষনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে! আমি নারী যে আমার এ দুটি অঙ্গকে বড়ই ভালোবাসি! এ দুটি অঙ্গ দিয়েই আমি আজ একাধারে নারী ও মা হতে পেরেছি। নিজের অঙ্গকে ভালো না বেসে পারা যায়! আর ভালোবাসি যাকে, ভালোবাসি যা, সে তো কাঁদাবেই, সেই তো কাঁদায়!


Friday, March 15, 2013

স্টেশানে পৌঁছিবার পূর্বেই ট্রেন ছাড়িয়া গেল!!!

আমাদের ছাত্রজীবনে  নবম এবং দশম শ্রেণীর ইংরেজী দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষায় বাংলা থেকে ইংলিশে অনুবাদ করতে দেয়া হতো। প্রশ্নপত্রের এই অংশটিকে আমরা বলতাম ট্র্যানশ্লেশান। দশটি বাংলা বাক্যকে ইংলিশে অনুবাদ করতে হতো। খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ট্র্যানশ্লেশান, কারণ  ট্র্যানশ্লেশান শুদ্ধ হলে  ১০x ২ =২০ নাম্বার পাওয়া যেত। আমাদের প্রশ্নপত্রে্র ট্র্যানশ্লেশান পর্বে দুটি বাক্য খুব বেশী 'কমন' ছিল

১) ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রুগী মরিয়া গেল
২) স্টেশানে পৌঁছুবার পূর্বেই ট্রেন ছাড়িয়া গেল

আমাদের ভাইবোনদের সকলেই ইংলিশ পড়তাম বাবার কাছে। বাবা খুব যত্ন করে গ্রামার বুঝিয়ে দিতেন,ফলে ইংলিশে আমরা বরাবর ভাল নাম্বার পেয়েছি। উপরোল্লিখিত ট্র্যানশ্লেশান দুটো আমার কখনওই ভুল হয় নি। তবে এই বাক্য দুটি সেই কৈশোরেই ভীষনভাবে নাড়া দিত আমার চেতনাকে। ইংলিশ শুদ্ধভাবে লিখতে পারাতেই যেন আমার মন ভরতো না।  উপরের বাক্য দুটো নিয়ে সব সময় ্নিজের অজান্তেই মনের ভেতর নানা রকম টানাপোড়েন চলতো। যেমন  'ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রুগী মরিয়া গেল" বাক্যটি নিয়ে অনেক ভাবতাম, আহারে! ডাক্তাররা কেনো যে এত দেরী করে রুগীর বাড়ী আসে! আরেকটু আগে এলেই হয়তো রুগীটি বেঁচে যেত। ডাক্তারী পেশা যদি একটি মহান পেশা হয়ে থাকে, তাহলে রুগীর বাড়ীতে তো ডাক্তারকে রুগী বেঁচে থাকতেই যেতে হবে, রুগীই যদি মরে গেলো, তাহলে আর ডাক্তারের রুগী বাড়ী গিয়ে কাজ কি!

" স্টেশানে পৌঁছিবার পূর্বেই ট্রেন ছাড়িয়া গেল" বাক্যটি নিয়েও আমার কম ভাবনা ছিল না। এই বাক্যটি পড়ার সময় কল্পনায় দেখতে পেতাম, আমি স্টেশানে পৌঁছানোর আগেই দিনের শেষ ট্রেনটি স্টেশান ছেড়ে চলে গেছে! স্টেশানে আমি একা বসে আছি, কোথাও কেউ নেই। অথচ আমাকে আজ গন্তব্যে পৌঁছুতেই হতো। আমি গন্তব্যে না পৌঁছুলে মা-বাবা কেঁদে ভাসাবে, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব দুঃশ্চিন্তা করবে আমার জন্য! অথবা আমার অপেক্ষায় বসে থাকা কিছু অসহায় মানুষ আমার গন্তব্যে পৌঁছানোর অপেক্ষায় থাকবে!  আবার ভয়ও হতো, একা  স্টেশানে রাত গভীর হতে থাকলে কত রকমের বিপদ হতে পারে! কল্পনায় নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করতো, কেন আরও একটু আগে স্টেশানে এসে পৌঁছুতে পারলাম না! আমার সময়ের হিসেবে গোলমাল ছিল বলেই ট্রেন চলে গেছে!

ইদানিং পত্রপত্রিকা পড়ি আর কৈশোরে পড়া ট্র্যানশলেশানগুলোর কথা মনে পড়ে। বিশেষ করে অতি সম্প্রতি বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যখন উনার বক্তৃতায় 'সংখ্যালঘু' নামক নির্জীব, নির্বিষ প্রাণীদের উপর  সরকারের অত্যাচার বন্ধের  দাবী জানিয়েছেন,  ঠিক তখনই কৈশোরে পড়া "  স্টেশানে পৌঁছিবার পূর্বেই ট্রেন ছাড়িয়া গেল" ট্র্যানশ্লেশানটির কথা মনে পড়ে গেল।  উনি সরকারকে হুঁশিয়ার করলেন সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন না করতে! যখন নোয়াখালীতে ৭৬টি হিন্দু বাড়ী লুট-পাট, ভাঙচুরসহ  অসহায় হিন্দুদের বাড়ী ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল, তখন উনি কোথায় ছিলেন, দেশে না থাকলেও খুব কাছের দেশ সিঙ্গাপুরেই তো ছিলেন, দলের মহাসচিবের  মাধ্যমেই তো সরকারকে হুঁশিয়ার করতে পারতেন, অথবা উনার এই হুঁশিয়ারী বানীটি  যে কোন মিডিয়ার বদৌলতে ( আমার দেশ, নয়া দিগন্ত)   দেশব্যাপী প্রচার করতে পারতেন,  এতে করে সংখ্যালঘুরাও কিছুটা সান্ত্বনা পেতে পারতো! এখন দেরী হয়ে গেছে, হিন্দুরা শুধু চোখের জলে ভাসছে আর  পোড়া ধানের ছাইয়ের গাদায় বসে  নেতা নেত্রীদের 'ভানুমতির খেল' দেখছে।  কতদিন পেরিয়ে গেল, আপনি এই দুঃস্থ, অসহায় 'সংখ্যালঘু' প্রাণীদের প্রতি  এতটুকু করুণা বর্ষণ করলেন না, এতদিন পরে আপনি শুধু বললেন,
" সরকার নিজেরাই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়ে এর দোষ বিরোধী দলের ওপর চাপানোর অপচেষ্টা করছে। এ দেশ সবার। আমাদের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছি, তারা যেন সংখ্যালঘুদের পাশে থাকে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলব, আমরা সব সময় আপনাদের পাশে ছিলাম; আছি, থাকব।" ( দৈনিক সমকাল ১৪/৩/১৩)!

 সিঙ্গাপুর থেকে দূর্বৃত্তদের বিরূদ্ধে কিছুই বললেন না, আর এখন আপনি বাতাসের দিকে ফুঁ দিচ্ছেন, সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে! হায়রে! ট্রেন তো স্টেশান ছেড়েছে অনেক আগেই, এখন আর পেছন থেকে ফ্ল্যাগ উড়ালেও ট্রেনচালক আপনার উড়ানো ফ্ল্যাগের দিকে তাকানোর ফুরসৎ পাবে না।  সরকারকে হুঁশিয়ার করছেন, সংখ্যালঘুদের উপর নির্বিচারে আক্রমণ তো এই সরকারের আমলেই প্রথম নয়, ২০০১ সালে আপনি যখন ক্ষমতায় এলেন, তখনকার সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভয়াল  স্মৃতি মনে পড়লে এখনও ভয়ে বুক কাঁপে! থাক নেত্রী, সংখ্যালঘুদের জন্য মায়াকান্না নাই-বা কাঁদলেন!  সংখ্যালঘুরা হচ্ছে 'শুকনা মরিচ', পাটা আর পুতার মাঝখানে সংখ্যালঘুর স্থান, এর বেশী কিছু নয়।

মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রী, আপনি শাহবাগ মঞ্চের সকলকে 'নাস্তিক' বলেছেন। এটা কী ঠিক হলো?  ইদানিং 'নাস্তিক' আর আস্তিক' শব্দ দুটো আপনাদের হাতে বেশ বাজছে তো! 'নাস্তিক' মানে জানতাম যারা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। কিন্তু এই প্রজন্ম আন্দোলনের সূত্র ধরে কত কিছুই যে নতুন ভাবে জানছি! 'নাস্তিক'এর মানেও বদলে গেছে! ইদানিং 'নাস্তিক' বলতে শুধুমাত্র ইসলাম বিদ্বেষী  বুঝানো হচ্ছে। কী আশ্চর্য্য! তাবড় তাবড় ডক্টরেট ডিগ্রীধারী থেকে শুরু করে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত দেশের কোটি তরুণকে 'নাস্তিক' বলে গালি দিচ্ছে!  অথচ তারা আদৌ জানেন কিনা জানিনা, ' নাস্তিকতাও  আস্তিকতার বিপরীত  বিশ্বাস। নাস্তিকতার মানে কখনও  ধর্মবিদ্বেষ  হতে পারে না, হতে পারে প্রচলিত ধর্মীয় রীতিতে অবিশ্বাস, আস্তিকের বিপরীত শব্দ নাস্তিক। অবিশ্বাস আর বিদ্বেষ, কখনওই সমার্থক নয়।

তাছাড়া নাস্তিক মানে কি? নাস্তিক মানে কী শুধু ইসলাম বিরোধী? শাহবাগে আগতদেরকে নাস্তিক বলা হয় কেন? শাহবাগে কী শুধু মুসলিমরাই আসে? অন্য ধর্মাবলম্বীরা কেউ আসেনা?  তাহলে কী অন্য ধর্মাবলম্বীরাও নাস্তিক? নাস্তিকতা বা আস্তিকতা  তো যার যার নিজস্ব বিশ্বাস। কেউ পুতুল খেলা পছন্দ করে, কেউ বা ফুটবল খেলা পছন্দ করে। তাই বলে কী একজন ফুটবল খেলোয়ারের উচিত হবে, নিজে পুতুল খেলা পছন্দ করে না বলে অন্যের হাত থেকে পুতুলের বাক্স টেনে বাইরে  ছুঁড়ে ফেলে দেয়া! গণজারণ মঞ্চ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ছাড়া তো আর কিছুই  চাওয়া হয় নি। ওখানে কোন ধর্ম নিয়েই কটূক্তি করা হয় নি। তাহলে আপনিই বা কেন বক্তৃতায় এমন কথা বলেন, " সরকার একদিকে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি করছে, অন্যদিকে 'বিধর্মী-নাস্তিকদের' পাহারা দিয়ে লালন-পালন করছে। বিভিন্ন জায়গায় মঞ্চ তৈরি করছে। এসব 'মঞ্চ-ফঞ্চ' বন্ধ না হলে জনগণের মঞ্চ তৈরি হবে।"(দৈনিক সমকাল)


মাননীয় বিরোধী নেত্রী, আপনার বক্তৃতার এই অংশটুকু  "সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলব, আমরা সব সময় আপনাদের পাশে ছিলাম; আছি, থাকব।" শুনে তো ভালই লাগে। যেই সংখ্যালঘুদের পাশে থাকবেন বলে আশ্বাস দিলেন, সেই সংখ্যালঘুরা বাড়ী ঘর হারিয়ে গাছতলায় পড়ে আছে, নাকি হাটতলায় বসে আছে, তা দেখার জন্য কী একবারও আপনি আপনার জেলা শহরের কাছাকাছি কোথাও  গিয়েছিলেন? যে মন্দির গুলো দূর্বৃত্তরা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিল, আপনার দলের কেউ কী আজ পর্যন্ত সে সকল মন্দিরের ধারে কাছেও হেঁটে এসেছে! খোলা আকাশের নীচে যে সকল সংখ্যালঘুদের দিন কেটে যাচ্ছে, তাদের জন্য কী  আপনার দলীয় ভান্ডার থেকে একবেলার খাবার বিতরণ করার ব্যবস্থা  হয়েছে?  অথচ সংখ্যালঘুদের নাম ব্যবহার করে আপনারা সব সময় রাজনীতি করছেন। সংখ্যালঘুরা তো কোন ধর্মের আগেও নেই পিছেও নেই।  ওরা অন্য ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তি করবে কী করে? ওরা তো নিজ ধর্মই পালন করার সুযোগ পায় না, অন্যদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হিন্দুদের বিরুদ্ধে যখন গিবৎ গাওয়া হয়, নানা রকম কুৎসিত মন্তব্য করে সরলপ্রাণ আস্তিকদের রক্তে সাম্প্রদায়িকতার উত্তেজনা তৈরী করে দেয়া হয়, সাম্প্রদায়িকতার সেই বিষবাষ্প থেকে নিজেকে দূরে রাখার ফুরসৎটুকুও পায় না এই আধমরা সংখ্যালঘুর দল, তার আগেই তাকে নিঃস্ব হতে হয়। নেত্রী, সরকারকে দোষারোপ করতেই পারেন, আপনারা একজন আরেকজনের ভুল ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা করবেন, তা ঠিক আছে। কিন্তু প্রবাদ আছে, " নিজে আচরি ধর্ম শিখাও পরেরে", আপনি নিজেই যদি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধানে আন্তরিক হতেন, তাহলে সরকারের  বিরুদ্ধে সমালোচনা  অনেক বেশী কার্যকরী মনে হতো।

মাননীয় নেত্রী, আপনি বক্তৃতায় বলেছেন যে নাস্তিকদের মঞ্চ-ফঞ্চ বন্ধ করে দিতে। বন্ধ তো করতে চাইলে সব কিছুই বন্ধ করা যায়, কিন্তু তরুণ প্রজন্মের  চোখ -কান তো খোলা আছে। চোখ দুটো দিয়ে দেখে যায়, কান দুটো দিয়ে শুনে যায়। তরুণ প্রজন্মকে এভাবে চারদিক থেকে ধমক দেয়া কী ঠিক হচ্ছে? নির্বাচনের সময় তো এরাই আপনাদের বল ভরসা! তা এখনই যদি  সকলে মিলে ওদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলে, এটা কারো জন্যই ভালো হবে না। বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে। যুদ্ধাপরাধী বিচারের ব্যাপারে ওরা এখন এক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, এই দাবীর সাথে ওরা  কোনরকম আপোষ করবে না। ওরা তো আপনাকে, আমাকে, সকল মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন জনগণকেই  চায় ওদের পাশে! আমাদের মধ্যে থেকে যে কেউ যদি এই প্রজন্মের দাবীর ভাষা বুঝতে পারেন, ওদেরকে আস্তিক-নাস্তিক দিয়ে নয়, মানুষ হিসেবে বিচার করতে পারেন, তাহলেই আবার পরের দিনের ট্রেন ধরতে পারবেন, নাহলে আবারও দিনের শেষ ট্রেন আমরা স্টেশানে পৌঁছার পূর্বেই ছাড়িয়া যাইবে!