Tuesday, March 19, 2013

জোড় ফল!!

গতকালকেই আমি ওয়ালমার্ট থেকে ছয় বক্স স্ট্রবেরী কিনে এনেছি, জ্যাম বানাবো বলে। স্ট্রবেরী এখানে মোটামুটি দামী ফলের মধ্যেই পড়ে। এক পাউন্ড স্ট্রবেরী বক্সের দাম তিন ডলার,  তিন পাউন্ডের এক ব্যাগ আপেলও তিন ডলার। তাই আমার দৈনন্দিন বাজারের মেন্যুতে  আপেল থাকে, স্ট্রবেরী থাকে না। মাঝে মাঝে এক বা দুই বক্স কিনে আনি। শুধু দামের কথাই বা বলি কেন, স্ট্রবেরী খুব দ্রুত পচনশীল বলেও আমি এই ফলটির রূপে-গন্ধে বিমোহিত হয়েও ঘরে এনে তুলি না। আরেকটি ব্যাপারও আছে, স্ট্রবেরী দেখতে যতই লাল টুকটুকে হোক না কেনো, স্বাদে ঠিক তার উলটো। বেশীর ভাগ স্ট্রবেরীই খেতে ভীষন টক লাগে। আমার পরিবারে সদস্যসংখ্যা বর্তমানে মাত্র তিন জন। এই তিন জনের কেউই টক পছন্দ করি না। স্ট্রবেরী না কেনার পেছনে এটাও একটি কারণ। এতগুলো কঠিন কারণ থাকার পরেও কেন ছয় বক্স স্ট্রবেরী কিনে ফেললাম! আমাকে যারা খুব কাছে থেকে দেখেছে, তারা এক মুহূর্তেই বলে দেবে,

" নিশ্চয়ই আজকে স্ট্রবেরী সেল দিয়েছে, নাহলে অতগুলো বক্স কিনে আনতে না"!

ধরা আমাকে পড়তেই হবে। কারণ আমার এই স্বভাব আছে, সেলে যদি 'বিষ'ও দেয়, আমি সেই 'বিষ' কিনে এনে ঘর ভরিয়ে ফেলবো। তবে গত দুই বছর ধরে আমার মধ্যে অনেক পরিবর্তণ এসেছে। আমি আর 'সেল' খুঁজি না, মূল্যহ্রাসে জিনিস কিনে ঘর ভরে তুলি না। কারণ একটাই,  মূল্যহ্রাসে কেনা জিনিসের  কোন কদরই নেই আমার পরিবারে। মাঝে মাঝেই পরিবার প্রধান মূল্যহ্রাসে কেনা সামগ্রীগুলো বস্তায় ভরে স্যালভেশান আর্মীর দোকানে দিয়ে আসে, নাহলে বস্তায় ভরে বাড়ীর বাইরে রেখে দেয়, যার ইচ্ছে ওখান থেকে পছন্দমত জিনিস তুলে নিয়ে যায়, বাকীগুলো মিউনিসিপ্যালিটির ট্রাক এসে তুলে নিয়ে যায়। এজন্যই আর মূল্যহ্রাসে কিছু কিনি না।

গতকাল অবশ্য এতগুলো স্ট্রবেরী কিনেছি আমার একজন সহকর্মীর প্ররোচনায় উদ্বুদ্ব হয়ে। ডেবী'র বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি।  বেকারী ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার সে। কোন এক অজানা কারণেই ডেবী আমাকে ভালোবাসে, তার ডিপার্টমেন্ট আর আমার ডিপার্টমেন্টের মধ্যে ব্যবধান অনেক, তবুও সে আমার সাথে দেখা করার জন্য একবার হলেও আমাদের ডিপার্টমেন্টে চলে আসে। ডেবী'র রান্নার হাত খুব চমৎকার, বাড়ীতে যা কিছু ভাল-মন্দ রান্না হবে, আমার জন্য একটু হলেও নিয়ে আসবে। আমি অবশ্য জানি না, এই শ্বেতাঙ্গ রমণী আমার মত বাদামী চামড়ার নারীর মুখে কার ছায়া খুঁজে পেয়েছে! সেই ডেবীই কাল দৌড়ে এসেছে আমার কাছে, এসেই  গোপন কথা বলার মত স্টাইলে ফিসফিস করে বলেছে,

" রীটা, আজ স্ট্রবেরী সেলে দিয়েছে। আমি বত্রিশ বাক্স স্ট্রবেরী কিনেছি, জ্যাম বানাবো, এক ফাঁকে ওখানে গিয়ে তুমিও কিনে ফেলো। নাহলে লোক জানাজানি হয়ে গেলে ফুরিয়ে যাবে"।

ডেবীর কথা ফেলি কী করে! তার কথার সম্মান রাখতে গিয়েই আমি ছয় বাক্স স্ট্রবেরী কিনে ফেলেছি। বাড়ী ফিরতেই ছোট মেয়েটা চোখ বড় বড় করে বলল,
" মা, এতগুলো স্ট্রবেরী কিনেছ?"
বললাম, " সেলে দিয়েছে তো, তাই নিয়ে এলাম"।
-কিন্তুক (ও কিন্তু বলতে পারেনা) স্ট্রবেরী তো পচে যায়, এতগুলো স্ট্রবেরী শেষ করবো কীভাবে?
-শেষ করতে হবে, স্ট্রবেরী খুবই পুষ্টিকর, প্রতিদিন ছয়-সাতটা করে খেলেই শেষ হয়ে যাবে।
-কিন্তুক, স্ট্রবেরী অনেক টক, ছয়-সাতটা খাওয়া যাবে না।

-এই দ্যাখ, আমি কীভাবে খাই--বলেই একটি বক্স খুলে স্ট্রবেরী বের করতে গিয়ে দেখি 'জোড়া' বাঁধা স্ট্রবেরী আছে বেশ কয়েকটি। জোড়া স্ট্রবেরীগুলোকে আলাদা করে রাখছি দেখে মেয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

" মা, এই 'টুইন' গুলোকে আলাদা করে রাখছো কেন?
-হুম, টুইন ফল মেয়েদের খেতে হয় না। টুইন ফল খেলে 'টুইন' বেবী হয়। এই স্ট্রবেরী গুলো তোমার পাপা খাবে।

-কী বলো এসব, টুইন ফল খেলে টুইন বেবী হবে কেন? মেয়েরা খেলে টুইন বেবী হবে, ছেলেরা খেলেও তো টুইন বেবী হবে!

-তা জানিনা, ছোটবেলা্য  তোমার দিদা আমাকে জোড়া ফল খেতে দিত না, বলতো, মেয়েদের জোড়া ফল খেতে নেই, জোড়া ফল খেলে যমজ সন্তান হয়। জোড়া ফল দেখলে আমি কত খুশী হতাম, কিন্তু তোমার দিদা জোড়া ফলগুলো তোমার মামাদেরকে দিয়ে দিত।

-হা হা হা!! যাদের টুইন বেবী আছে, ওরা সবাই কী টুইন ফল খেয়েছে?

-এই মেয়ে, এত কথা জিজ্ঞেস করো কেন? আমি বলেছি তো, আমি জানিনা। শুধু শুধু কথা প্যাঁচাও কেন, টুইন স্ট্রবেরীগুলো তোমাকে খেতে না করেছি, খাবে না।

-আচ্ছা, খাব না, কিন্তু টুইন বেবী হলে প্রবলেম কী? তুমি তো বলো, টুইন বেবী দেখতে তোমার খুব ভাল লাগে।

-বলি তো অনেক কথা, কিন্তু সব কথা কী মেনে চলি? এই যেমন তুমিও আমাকে প্রতিদিন বলো, 'বাংলা পড়বো, বাংলা পড়বো', তুমি কী প্রতিদিন বাংলা পড়ো? একদিনও পড়ো না। সেরকমই ব্যাপার।

বাংলা পড়ার কথা তুলেই মেয়েকে  মোক্ষম আঘাত আঘাত দিয়েছি, জোড়া ফল খাওয়া না খাওয়া নিয়ে মেয়ে আর তর্ক করবে না। আমাদের মা-বাবারাও তো  আমাদের সাথে যুক্তিতে হেরে গেলে এভাবেই আমাদেরকে থামিয়ে দিত, তাই আমিও দিয়েছি ওকে থামিয়ে। কিন্তু ওকে থামিয়ে দিয়েও তো নিজের মনের ভেতর জমে থাকা অন্ধ কুসংস্কারগুলোকে তাড়াতে পারছি না। সত্যিই তো, আমিও জানি, জোড় ফল খাওয়ার সাথে 'যমজ সন্তান' হওয়ার কোন সম্পর্কই নেই, তারপরেও কেন জোড় স্ট্রবেরীগুলোকে আলাদা করে রাখলাম! মেয়ের যুক্তির কাছে হেরে যাচ্ছি ভয়ে মেয়েকে কেন অযৌক্তিকভাবে থামিয়ে দিলাম! যে জিনিসের কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই, যে কথার কোন চাক্ষুষ প্রমাণ নেই, শুধু  ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে, নিছক আবেগের বশে, মেয়ের মনে জেগে উঠা প্রশ্নকে থামিয়ে দিলাম! ঠিক এই কারণেই হয়তো আমাদের মনের অন্ধকার কাটে না!

শুধু কী জোড় ফল খাওয়া নিয়েই সংস্কার আছে?  মেয়েদের আরও কত রকম সংস্কার-কুসংস্কারের ভেতর দিয়ে চলতে হয়! সকল কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মনে প্রশ্ন জাগলেও তার  সঠিক ব্যাখ্যা চাওয়ার জো নেই। 'মহাফাজিল', 'বেয়ারা', 'কূটতার্কিক' খেতাব পাওয়ার ভয়েও অনেক মেয়ে টুঁ শব্দ করে না। মুখ বুজে মান্ধাতা আমলের কু-সংস্কারের বেড়াজালে নিজেকে আটকে রাখে। বেড়াজাল কেটে আর বের হতে পারে না। আমার নিজের মনেও অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। খুব ছোট করে দু'একটি  মেয়েলী সংস্কারের কথা বলি। সংস্কারগুলোকে কী কুসংস্কার বলবো, নাকি ধর্মীয় বিধান বলবো, তা আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারি নি। যদিও আমাকে এ সকল সংস্কারের বেড়াজালের ভেতর দিয়েই আসতে হয়েছে, তবুও মেয়েলী এসকল সংস্কারের পেছনে  কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাইনি,  আবার প্রতিবাদ করার সাহসও হয় নি। 

ছোটবেলার একটি ঘটনা। আমাদের প্রতিবেশী মাসীমার একটি মেয়ে হয়েছে। হাসপাতাল থেকে কেউ একজন সংবাদ নিয়ে এসেছে, বাচ্চাটির উপরের ঠোঁট কাটা, এ খবর শোনার সাথে সাথে প্রতিবেশী আর সকল মাসীমা গোত্রীয়দের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। সকলেই একই কথা বলতে লাগলো,

" আরে! হবেই তো, ঐ দিদিতো সারাক্ষণই  সুঁই সূতা, কাঁচি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। গ্রহণও মানে না, নিশ্চয়ই গত সূর্য্যগ্রহণের সময় কাঁচি দিয়ে কাপড় কেটেছে, এইজন্যই বাচ্চার ঠোঁট কাটা হয়েছে! নিয়ম মানতে হয়, গ্রহণ হচ্ছে খুবই মারাত্মক ব্যাপার, উনার তো এটা পঞ্চম সন্তান, উনার তো বুঝা উচিৎ ছিল, গ্রহণের দিন টান টান হয়ে শুয়ে থাকা নিয়ম, আর উনি কিনা সেলাই ফোড়াই নিয়ে ব্যস্ত ছিল"!

বাচ্চা নিয়ে মাসীমা যখন হাসপাতাল থেকে বাড়ী ফিরলেন, বাড়ীর সবাই হুমড়ী খেয়ে পড়েছে বাচ্চার দেখার জন্য। আমিও ছিলাম সেই হুমড়ী খাওয়া মানুষের দলে। বাচ্চাটিকে দেখে আমি ভয় পেয়েছিলাম, উপরের ঠোঁট একেবারেই নেই। মাসীমা চোখে আঁচল চাপা দিয়ে রেখেছিলেন। সামনাসামনি কেউ কিছু না বললেও পেছনে এসে আবারও সেই একই কথা আলাপ করছিল, মাসীমা যেহেতু সেলাই ফোড়াই করতে ভালোবাসতো, তাই সবার ধারণা হয়েছে সূর্য্যগ্রহণের সময় ভুল করেই মাসীমা কাঁচি দিয়ে কাপড় কেটেছে। এই ভীড়ে আমার মা ছিলেন না। আমি ঘরে এসে মা'কে বলতেই বিশাল এক ধমক খেয়েছি। মায়ের কথা, মাসীমাকে এই মুহূর্তে কিছুটা সময় নিজের মত করে থাকতে দেয়া উচিত। বাচ্চাটা দেখার জন্য এভাবে দলে দলে ভীড় করা ঠিক হয় নি। তবে আমার মা'ও সবার কথা বিশ্বাস করেছে দেখে আমি বিভ্রান্ত হয়েছি। কারণ, আমার মা যুক্তি ছাড়া কোন কথা বলেন না, মা অযথা কোন কিছু নিয়েই কৌতূহল দেখান না। সেই যুক্তিবাদী মা যখন বিশ্বাস করেছেন, মাসীমার গ্রহণের সময় কাঁচি দিয়ে কাপড় কেটেছে বলেই বাচ্চার ঠোঁট কাটা হয়েছে, তাহলে ঘটনা সত্যি। আমার ছোট মেয়ের মত আমিও প্রশ্ন করেছিলাম, কাঁচি দিয়ে কাপড় কেটেছে, কাঁচি দিয়ে তো পেট কাটে নি। আর সূর্য্য তো থাকে আকাশে, সেই সূর্য্য গ্রহণের সাথে পেটের ভেতর ঘুমিয়া থাকা বাবুটার কী সম্পর্ক।  কোন সঠিক উত্তর তো পাইই নি, উলটো বড়দের কথায় থাকার জন্য ধমক খেয়েছে। কী জানি, মা এবং আরও অন্যান্য মহিলারা কত ঘটনার কথা শোনালেন। আমাকে শোনাননি, উনারা আলোচনা করছিলেন, আমি শুনেছি।

মা তো একেবারে চাক্ষুষ প্রমান দিয়েছেন! আমার জন্মের সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই নাকি এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। মায়ের পাশের বেডেই ছিলেন আরেক মহিলা, বাচ্চা হবো হবো স্টেজে ছিলেন, এর মধ্যেই চন্দ্রগ্রহণ লেগে গেছে। মহিলা নাকি মন খারাপ করে সারারাত দুই পা ভাঁজ করে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ছিলেন। পাশের বেড থেকে মা নাকি অনেকবার তাঁকে ডেকে বলেছে, " আপা, এভাবে শুয়ে থাকবেন না, আজকে চন্দ্রগ্রহন, সোজা হয়ে শুয়ে থাকেন"। মহিলার মনে অনেক দুঃখ ছিল, তার শ্বশুরবাড়ীতে তার কোন কদর ছিল না, হাসপাতালে কেউ দেখতে আসতো না। সেই দুঃখে উনি অমন করে শুয়ে ছিলেন। আমার মা'কে দেখতে যেত দলে দলে, অথচ পাশের বেডের রুগীকে কেউ আসতো না একটু চোখের দেখা দেখতে, রুগীর মনে কষ্টতো হবেই। তিনদিন পরেই মহিলার একটি মেয়ে বাচ্চা হলো। বাচ্চাটার পা দুটো ভাঁজ করা অবস্থায় ছিল। আমার মায়ের নিজের চোখে দেখা, আয়ারা এসে গুজুর গুজুর করছিল, এমনকি মহিলাকে ধমকাচ্ছিল, " হইবই তো বাচ্চা এমন, সেইদিন গ্রহণ ছিল, আপনি সারাটা দিন রাত গুটিশুটি মাইরা শুইয়া ছিলেন, বাচ্চার পা দুইটা ঐজন্যই ভাঁজ হইয়া গেছে। এখন আর কাইন্দা কী হবে। নিয়ম কানুন মানতে হয়।"

আরও মজার গল্প শুনেছি, মায়ের এক দিদি ছিলেন, উনার যমজ ছেলেমেয়ে হয়েছে। ছেলে বাচ্চার কানের লতিতে একটি দাগ ছিল, চিমটি কাটার মত দাগ। মায়েরা সবাই মিলে মত দিলেন, " দিদি ভরা পোয়াতী অবস্থায় সূর্য্যগ্রহণের সময় লুডু খেলছিল। খেলার সময়  লুডুর গুটি চিমটি দিয়া তুলেছিল ত, তাই ছেলেটার কানের লতিতে চিমটির দাগ পড়েছে"।

আমার এক বন্ধু ছিল, সীমা। ওর কানের লতির ঠিক উপরে দুটি ছোট ছোট দানার মত ছিল, অনেকটাই মটরশুঁটি সাইজের। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই মটরশুঁটির রহস্য কি? ও বলেছে, " আমি যখন মায়ের পেটে ছিলাম, একবার সূর্য্যগ্রহণ লেগেছিল, আমার মা গ্রহণের সময় ভুল করে মটরশুঁটি বাছছিল, পরে কেউ একজন গ্রহণের কথা মনে করিয়ে দিতেই মটরশুঁটি বাছা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু যেটুকু করেছে, তাতেই আমার কানের উপর মটরশুঁটির মত ছোট্ট দানা হয়েছে। আমি বলেছিলাম, " এটা তো টিউমার", সাথে সাথে ও প্রতিবাদ করেছে, না ওটা টিউমার নয়, ওটা মটরশুঁটি।


এবার আসি নিজের কথায়। ছোটবেলা থেকে এমন সব অদ্ভূত গল্প শুনে বড় হয়েছি, বিশ্বাস -অবিশ্বাসের দোলাচলে থেকেছি, কিন্তু নিজের জীবনে এসে এই কুসংস্কারগুলোকে আর কুসংস্কার মনে হয় নি। আমার প্রথম সন্তান জন্মের সময়, সারারাত ব্যাপী চন্দ্রগ্রহণ ছিল। আমার তখন একেবারে পূর্ণ সময়, এমতাবস্থায় এত লম্বা সময়ের চন্দ্রগ্রহণ কী করে পার করবো, সেই চিন্তায় সকলে অস্থির। আমার বয়স কম, এত সময় টান টান হয়ে শুয়ে থাকার মত ধৈর্য্য থাকবে কিনা, এই চিন্তায় মা, দিদিমা সকলেই অস্থির। আমি বললাম, " আমি পারবো, ঘুমাবো না, তাহলেই আর পা বাঁকা হবে না।"  সারারাত না ঘুমিয়ে থাকলে মা ও গর্ভের শিশু, দুজনেরই ক্ষতি হবে, এই চিন্তা করে দিদিমা  কোথা থেকে যেন লম্বা এক কাঠি যোগাড় করে এনেছেন। শিয়রের কোনায় কাঠি রেখে দিলে নাকি কোন বিপদ হবে না। আমার শিয়রের কোনায় কাঠি, তবুও আমি নিশ্চিন্ত হতে পারিনি। দুই পা সটান করে দিয়ে সাতটি ঘন্টা পার করতে আমার কী পরিমান কষ্ট হয়েছে, তা কী আমার মেয়ে জানে! আমিই কী জানতাম, আমাকে গর্ভে রেখে দশটি মাস মা'কে কত পরিশ্রম করতে হয়েছে, কী কষ্ট যে হতো মায়ের, হাঁস ফাঁস লাগা থেকে শুরু করে কত রকমের যন্ত্রণা সইতে হয়েছে, আমার নিজের সন্তান হওয়ার আগে তো আমি তা বুঝতেই পারি নি। যাই হোক, আমার তিনটি সন্তান হওয়ার সময় আমি একই নিয়মের ভেতর দিয়ে গেছি। যখন আমি নিজে গেছি ঐ সময়ের ভেতর দিয়ে, তখন এই নিয়মগুলোকে কুসংস্কার মনে হয় নি। এক সন্তানের ভারেই কাত হয়ে যেতাম, তার উপর যদি 'যমজ সন্তান' হতো, কী অবস্থা হতো! ঠিক ঐ অবস্থায় আমার মনে হয়েছিল, এইজন্যই মা 'জোড় ফল' খেতে দিত না।

মা'কে তো এই অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, মা জানে, কী কষ্ট হয় গর্ভকালীন সময়ে! যে এর ভেতর দিয়ে না যায়, তার তো আর জানার উপায় থাকে না। ছেলেদের যেহেতু এই অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয় না, সেইজন্যই 'জোড় ফল' ছেলেদেরকেই খেতে দেয়া হয়। তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়, একটি বাচ্চার জন্মের পেছনে তো ছেলেদের ভূমিকা মেয়েদের ভূমিকার সমতুল্য। তাহলে যে ছেলেটি 'জোড় ফল' খেল, তার থেকে তো 'যমজ সন্তান'ই আশা করা যায়! কিন্তু আমাদের সমাজে মা' কাকীদেরকে এমন প্রশ্ন করা একেবারে বেয়াদবীর পর্যায়ে চলে যায়, কখনও কখনও প্রশ্নের যৌক্তিকতা এমন অখন্ডনীয় হয়ে দাঁড়াতে পারে যে উত্তর জানা না থাকলে প্রশ্নকারীকে 'নাস্তিক' বলে হুমকী দেয়া যায়। কোন মা-ই চান না, তাঁর সন্তানকে কেউ 'নাস্তিক' ঘোষণা করুক। তার আগেই সন্তানের অনুসন্ধিৎসু বিবেককে ধর্মের দোহাই দিয়ে থামিয়ে দেয়া ভাল। এইজন্যই আমিও আমার ছোট মেয়েকে থামিয়ে দিয়েছি।


No comments:

Post a Comment