Friday, March 15, 2013

স্টেশানে পৌঁছিবার পূর্বেই ট্রেন ছাড়িয়া গেল!!!

আমাদের ছাত্রজীবনে  নবম এবং দশম শ্রেণীর ইংরেজী দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষায় বাংলা থেকে ইংলিশে অনুবাদ করতে দেয়া হতো। প্রশ্নপত্রের এই অংশটিকে আমরা বলতাম ট্র্যানশ্লেশান। দশটি বাংলা বাক্যকে ইংলিশে অনুবাদ করতে হতো। খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ট্র্যানশ্লেশান, কারণ  ট্র্যানশ্লেশান শুদ্ধ হলে  ১০x ২ =২০ নাম্বার পাওয়া যেত। আমাদের প্রশ্নপত্রে্র ট্র্যানশ্লেশান পর্বে দুটি বাক্য খুব বেশী 'কমন' ছিল

১) ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রুগী মরিয়া গেল
২) স্টেশানে পৌঁছুবার পূর্বেই ট্রেন ছাড়িয়া গেল

আমাদের ভাইবোনদের সকলেই ইংলিশ পড়তাম বাবার কাছে। বাবা খুব যত্ন করে গ্রামার বুঝিয়ে দিতেন,ফলে ইংলিশে আমরা বরাবর ভাল নাম্বার পেয়েছি। উপরোল্লিখিত ট্র্যানশ্লেশান দুটো আমার কখনওই ভুল হয় নি। তবে এই বাক্য দুটি সেই কৈশোরেই ভীষনভাবে নাড়া দিত আমার চেতনাকে। ইংলিশ শুদ্ধভাবে লিখতে পারাতেই যেন আমার মন ভরতো না।  উপরের বাক্য দুটো নিয়ে সব সময় ্নিজের অজান্তেই মনের ভেতর নানা রকম টানাপোড়েন চলতো। যেমন  'ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রুগী মরিয়া গেল" বাক্যটি নিয়ে অনেক ভাবতাম, আহারে! ডাক্তাররা কেনো যে এত দেরী করে রুগীর বাড়ী আসে! আরেকটু আগে এলেই হয়তো রুগীটি বেঁচে যেত। ডাক্তারী পেশা যদি একটি মহান পেশা হয়ে থাকে, তাহলে রুগীর বাড়ীতে তো ডাক্তারকে রুগী বেঁচে থাকতেই যেতে হবে, রুগীই যদি মরে গেলো, তাহলে আর ডাক্তারের রুগী বাড়ী গিয়ে কাজ কি!

" স্টেশানে পৌঁছিবার পূর্বেই ট্রেন ছাড়িয়া গেল" বাক্যটি নিয়েও আমার কম ভাবনা ছিল না। এই বাক্যটি পড়ার সময় কল্পনায় দেখতে পেতাম, আমি স্টেশানে পৌঁছানোর আগেই দিনের শেষ ট্রেনটি স্টেশান ছেড়ে চলে গেছে! স্টেশানে আমি একা বসে আছি, কোথাও কেউ নেই। অথচ আমাকে আজ গন্তব্যে পৌঁছুতেই হতো। আমি গন্তব্যে না পৌঁছুলে মা-বাবা কেঁদে ভাসাবে, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব দুঃশ্চিন্তা করবে আমার জন্য! অথবা আমার অপেক্ষায় বসে থাকা কিছু অসহায় মানুষ আমার গন্তব্যে পৌঁছানোর অপেক্ষায় থাকবে!  আবার ভয়ও হতো, একা  স্টেশানে রাত গভীর হতে থাকলে কত রকমের বিপদ হতে পারে! কল্পনায় নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করতো, কেন আরও একটু আগে স্টেশানে এসে পৌঁছুতে পারলাম না! আমার সময়ের হিসেবে গোলমাল ছিল বলেই ট্রেন চলে গেছে!

ইদানিং পত্রপত্রিকা পড়ি আর কৈশোরে পড়া ট্র্যানশলেশানগুলোর কথা মনে পড়ে। বিশেষ করে অতি সম্প্রতি বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যখন উনার বক্তৃতায় 'সংখ্যালঘু' নামক নির্জীব, নির্বিষ প্রাণীদের উপর  সরকারের অত্যাচার বন্ধের  দাবী জানিয়েছেন,  ঠিক তখনই কৈশোরে পড়া "  স্টেশানে পৌঁছিবার পূর্বেই ট্রেন ছাড়িয়া গেল" ট্র্যানশ্লেশানটির কথা মনে পড়ে গেল।  উনি সরকারকে হুঁশিয়ার করলেন সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন না করতে! যখন নোয়াখালীতে ৭৬টি হিন্দু বাড়ী লুট-পাট, ভাঙচুরসহ  অসহায় হিন্দুদের বাড়ী ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল, তখন উনি কোথায় ছিলেন, দেশে না থাকলেও খুব কাছের দেশ সিঙ্গাপুরেই তো ছিলেন, দলের মহাসচিবের  মাধ্যমেই তো সরকারকে হুঁশিয়ার করতে পারতেন, অথবা উনার এই হুঁশিয়ারী বানীটি  যে কোন মিডিয়ার বদৌলতে ( আমার দেশ, নয়া দিগন্ত)   দেশব্যাপী প্রচার করতে পারতেন,  এতে করে সংখ্যালঘুরাও কিছুটা সান্ত্বনা পেতে পারতো! এখন দেরী হয়ে গেছে, হিন্দুরা শুধু চোখের জলে ভাসছে আর  পোড়া ধানের ছাইয়ের গাদায় বসে  নেতা নেত্রীদের 'ভানুমতির খেল' দেখছে।  কতদিন পেরিয়ে গেল, আপনি এই দুঃস্থ, অসহায় 'সংখ্যালঘু' প্রাণীদের প্রতি  এতটুকু করুণা বর্ষণ করলেন না, এতদিন পরে আপনি শুধু বললেন,
" সরকার নিজেরাই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়ে এর দোষ বিরোধী দলের ওপর চাপানোর অপচেষ্টা করছে। এ দেশ সবার। আমাদের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছি, তারা যেন সংখ্যালঘুদের পাশে থাকে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলব, আমরা সব সময় আপনাদের পাশে ছিলাম; আছি, থাকব।" ( দৈনিক সমকাল ১৪/৩/১৩)!

 সিঙ্গাপুর থেকে দূর্বৃত্তদের বিরূদ্ধে কিছুই বললেন না, আর এখন আপনি বাতাসের দিকে ফুঁ দিচ্ছেন, সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে! হায়রে! ট্রেন তো স্টেশান ছেড়েছে অনেক আগেই, এখন আর পেছন থেকে ফ্ল্যাগ উড়ালেও ট্রেনচালক আপনার উড়ানো ফ্ল্যাগের দিকে তাকানোর ফুরসৎ পাবে না।  সরকারকে হুঁশিয়ার করছেন, সংখ্যালঘুদের উপর নির্বিচারে আক্রমণ তো এই সরকারের আমলেই প্রথম নয়, ২০০১ সালে আপনি যখন ক্ষমতায় এলেন, তখনকার সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভয়াল  স্মৃতি মনে পড়লে এখনও ভয়ে বুক কাঁপে! থাক নেত্রী, সংখ্যালঘুদের জন্য মায়াকান্না নাই-বা কাঁদলেন!  সংখ্যালঘুরা হচ্ছে 'শুকনা মরিচ', পাটা আর পুতার মাঝখানে সংখ্যালঘুর স্থান, এর বেশী কিছু নয়।

মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রী, আপনি শাহবাগ মঞ্চের সকলকে 'নাস্তিক' বলেছেন। এটা কী ঠিক হলো?  ইদানিং 'নাস্তিক' আর আস্তিক' শব্দ দুটো আপনাদের হাতে বেশ বাজছে তো! 'নাস্তিক' মানে জানতাম যারা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। কিন্তু এই প্রজন্ম আন্দোলনের সূত্র ধরে কত কিছুই যে নতুন ভাবে জানছি! 'নাস্তিক'এর মানেও বদলে গেছে! ইদানিং 'নাস্তিক' বলতে শুধুমাত্র ইসলাম বিদ্বেষী  বুঝানো হচ্ছে। কী আশ্চর্য্য! তাবড় তাবড় ডক্টরেট ডিগ্রীধারী থেকে শুরু করে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত দেশের কোটি তরুণকে 'নাস্তিক' বলে গালি দিচ্ছে!  অথচ তারা আদৌ জানেন কিনা জানিনা, ' নাস্তিকতাও  আস্তিকতার বিপরীত  বিশ্বাস। নাস্তিকতার মানে কখনও  ধর্মবিদ্বেষ  হতে পারে না, হতে পারে প্রচলিত ধর্মীয় রীতিতে অবিশ্বাস, আস্তিকের বিপরীত শব্দ নাস্তিক। অবিশ্বাস আর বিদ্বেষ, কখনওই সমার্থক নয়।

তাছাড়া নাস্তিক মানে কি? নাস্তিক মানে কী শুধু ইসলাম বিরোধী? শাহবাগে আগতদেরকে নাস্তিক বলা হয় কেন? শাহবাগে কী শুধু মুসলিমরাই আসে? অন্য ধর্মাবলম্বীরা কেউ আসেনা?  তাহলে কী অন্য ধর্মাবলম্বীরাও নাস্তিক? নাস্তিকতা বা আস্তিকতা  তো যার যার নিজস্ব বিশ্বাস। কেউ পুতুল খেলা পছন্দ করে, কেউ বা ফুটবল খেলা পছন্দ করে। তাই বলে কী একজন ফুটবল খেলোয়ারের উচিত হবে, নিজে পুতুল খেলা পছন্দ করে না বলে অন্যের হাত থেকে পুতুলের বাক্স টেনে বাইরে  ছুঁড়ে ফেলে দেয়া! গণজারণ মঞ্চ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ছাড়া তো আর কিছুই  চাওয়া হয় নি। ওখানে কোন ধর্ম নিয়েই কটূক্তি করা হয় নি। তাহলে আপনিই বা কেন বক্তৃতায় এমন কথা বলেন, " সরকার একদিকে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি করছে, অন্যদিকে 'বিধর্মী-নাস্তিকদের' পাহারা দিয়ে লালন-পালন করছে। বিভিন্ন জায়গায় মঞ্চ তৈরি করছে। এসব 'মঞ্চ-ফঞ্চ' বন্ধ না হলে জনগণের মঞ্চ তৈরি হবে।"(দৈনিক সমকাল)


মাননীয় বিরোধী নেত্রী, আপনার বক্তৃতার এই অংশটুকু  "সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলব, আমরা সব সময় আপনাদের পাশে ছিলাম; আছি, থাকব।" শুনে তো ভালই লাগে। যেই সংখ্যালঘুদের পাশে থাকবেন বলে আশ্বাস দিলেন, সেই সংখ্যালঘুরা বাড়ী ঘর হারিয়ে গাছতলায় পড়ে আছে, নাকি হাটতলায় বসে আছে, তা দেখার জন্য কী একবারও আপনি আপনার জেলা শহরের কাছাকাছি কোথাও  গিয়েছিলেন? যে মন্দির গুলো দূর্বৃত্তরা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিল, আপনার দলের কেউ কী আজ পর্যন্ত সে সকল মন্দিরের ধারে কাছেও হেঁটে এসেছে! খোলা আকাশের নীচে যে সকল সংখ্যালঘুদের দিন কেটে যাচ্ছে, তাদের জন্য কী  আপনার দলীয় ভান্ডার থেকে একবেলার খাবার বিতরণ করার ব্যবস্থা  হয়েছে?  অথচ সংখ্যালঘুদের নাম ব্যবহার করে আপনারা সব সময় রাজনীতি করছেন। সংখ্যালঘুরা তো কোন ধর্মের আগেও নেই পিছেও নেই।  ওরা অন্য ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তি করবে কী করে? ওরা তো নিজ ধর্মই পালন করার সুযোগ পায় না, অন্যদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হিন্দুদের বিরুদ্ধে যখন গিবৎ গাওয়া হয়, নানা রকম কুৎসিত মন্তব্য করে সরলপ্রাণ আস্তিকদের রক্তে সাম্প্রদায়িকতার উত্তেজনা তৈরী করে দেয়া হয়, সাম্প্রদায়িকতার সেই বিষবাষ্প থেকে নিজেকে দূরে রাখার ফুরসৎটুকুও পায় না এই আধমরা সংখ্যালঘুর দল, তার আগেই তাকে নিঃস্ব হতে হয়। নেত্রী, সরকারকে দোষারোপ করতেই পারেন, আপনারা একজন আরেকজনের ভুল ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা করবেন, তা ঠিক আছে। কিন্তু প্রবাদ আছে, " নিজে আচরি ধর্ম শিখাও পরেরে", আপনি নিজেই যদি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধানে আন্তরিক হতেন, তাহলে সরকারের  বিরুদ্ধে সমালোচনা  অনেক বেশী কার্যকরী মনে হতো।

মাননীয় নেত্রী, আপনি বক্তৃতায় বলেছেন যে নাস্তিকদের মঞ্চ-ফঞ্চ বন্ধ করে দিতে। বন্ধ তো করতে চাইলে সব কিছুই বন্ধ করা যায়, কিন্তু তরুণ প্রজন্মের  চোখ -কান তো খোলা আছে। চোখ দুটো দিয়ে দেখে যায়, কান দুটো দিয়ে শুনে যায়। তরুণ প্রজন্মকে এভাবে চারদিক থেকে ধমক দেয়া কী ঠিক হচ্ছে? নির্বাচনের সময় তো এরাই আপনাদের বল ভরসা! তা এখনই যদি  সকলে মিলে ওদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলে, এটা কারো জন্যই ভালো হবে না। বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে। যুদ্ধাপরাধী বিচারের ব্যাপারে ওরা এখন এক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, এই দাবীর সাথে ওরা  কোনরকম আপোষ করবে না। ওরা তো আপনাকে, আমাকে, সকল মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন জনগণকেই  চায় ওদের পাশে! আমাদের মধ্যে থেকে যে কেউ যদি এই প্রজন্মের দাবীর ভাষা বুঝতে পারেন, ওদেরকে আস্তিক-নাস্তিক দিয়ে নয়, মানুষ হিসেবে বিচার করতে পারেন, তাহলেই আবার পরের দিনের ট্রেন ধরতে পারবেন, নাহলে আবারও দিনের শেষ ট্রেন আমরা স্টেশানে পৌঁছার পূর্বেই ছাড়িয়া যাইবে!

No comments:

Post a Comment