Friday, March 22, 2013

ভালোবাসা


মিথীলা আমার কনিষ্ঠ সন্তান। খুবই চুপচাপ স্বভাবের, দুই বছর বয়সে আমেরিকা এসেছে, বাংলা শব্দভান্ডার খুবই দূর্বল বলেই হয়তো কথা কম বলে! কথা কম বলে, তাই মনের ভাব প্রকাশ করার সুযোগও সীমিত। আমি হচ্ছি ওর স্বভাবের বিপরীত। কথা বেশী বলি, মনের ভাব বেশীক্ষণ লুকিয়ে রাখিনা ( নিজের চাওয়াগুলো শুধু লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি)। তিন মেয়ের সাথেই আমার গলায় গলায় ভাব, মেজ মেয়ের সাথে গলায় গলায় ভাবও আছে, আবার 'কাইট্টা ফালামু' ভাবও আছে। মেজ মেয়েটা আমার স্বভাব পেয়েছে। সবার জন্য তার ভালোবাসা, এমনকি গায়ে মশা বসলেও সে 'আহারে'! বলে উড়িয়ে দেয়। আমি ছোটবেলায় এই কাজটি করতাম। মশা কামড়ে ধরেছে, কোথায় এক চাপড় মেরে 'ভর্তা' বানিয়ে দেবো, তা না করে মশাকে উড়িয়ে দিতাম, আর ভাবতাম, শত্রুর প্রতি ভালোবাসা দেখিয়েছি, আমার পূণ্যভান্ডারে সঞ্চয়ের পরিমান বেড়ে গেলো!

আমি 'ভালোবাসি' টাইপ মানুষ। জীবনকে ভালোবাসি, মানুষ ভালোবাসি, প্রকৃতি ভালোবাসি, স্বজনদের ভালোবাসি, বন্ধুদের ভালোবাসি, শত্রুদেরকেও মনে হয় ভালোইবাসি, তবে সর্বোপরি নিজেকে ভালোবাসি। নিজেকে ভালোবাসতে গিয়েই অন্তরে অনেক অভিমান জমে গেছে। কেবলই মনে হয়, আমি যাদের এত ভালোবাসি, তারা তো কই আমাকে ভালোবাসে না! আমার ভালোতেও হাসে না, মন্দতেও কাঁদে না! আমার সুখেও হাসে না, অসুখেও বিচলিত হয় না!

এমন ভাবতে ভাবতেই গত সপ্তাহে গলায় ঠান্ডা বসে গেল, তারও আগের সপ্তাহে জ্বর হয়ে গেল! আমার যে মেয়েটির সাথে 'কাইট্টা ফালামু' সম্পর্ক আছে, সেই মেয়েটিই জ্বরের রাতে আমাকে ফোন করে বলল, " তুমি কাল কাজে যাবে না, যাবেনা বলেছি যাবে না। ছুটি নিয়ে ঘরে বিশ্রাম নিবে"। তার গলার স্বরে ' কাইট্টা ফালামু' টাইপের ভালোবাসা ছিল। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে জেগেই আমি 'সীক কল' দিয়ে দিলাম। একটানা তিনদিন বিশ্রাম নিলাম। এই বিশ্রামের সময়টুকুতে 'বাংলা কম জানা' মেয়েটি নীরবে আমার সেবায় এগিয়ে এলো। যখনই সে বাড়ীতে থাকে, আমার জন্য 'চা' নিয়ে আসে, পুষ্টির জন্য 'ফল' নিয়ে আসে, তার ভাঙ্গা ল্যাপটপ আমার বিছানায় এনে দেয়, জিজ্ঞেস করে 'মাথা টিপে দেব'? ঐ সময়টাতেই ভাঙ্গা ল্যাপটপে লিখেছিলাম ' জ্বর এলেই কেন মা'কে মনে পড়ে'!

গত সপ্তাহে স্প্রিং ব্রেকে অনেক বেড়ালাম, অনেকদিন বেড়ানো খেলানো হয় না বলেই বোধ হয় ধকল সইতে পারি নি। ঠান্ডা লেগে গলা বসে গেছে, আওয়াজ বের হয় না। এর মধ্যেই চাকুরীতে জয়েন করতে হয়েছে। আমি কথা বলতে পারছি না, ঘরও একেবারে নিঝুমপুরী হয়ে আছে। আমার বংলা কম জানা মিথীলার নিশ্চয়ই এই নিস্তব্ধতা ভালো লাগে না। সে আমাকে 'গরম চা' য়ের কাপ এগিয়ে দেয়, গলায় মাফলার জড়াতে বলে। আমি ছদ্ম রাগ দেখাই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে গলে যেতে থাকি। গোপনে কাঁদি, ভালোবাসা দিতে অভ্যস্ত আমি ভালোবাসা নিতে কেমন আড়ষ্ট বোধ করি। তবুও ভালো লাগে ছোট্ট মেয়েটির কাছ থেকে এমন যত্ন পেতে, এই মেয়ের জন্মের পর আমি কেঁদেছিলাম, আমার মা আমাকে বকেছিলেন, বলেছিলেন, " তোর দুঃখের দিনে এই মেয়েই তোর পাশে থাকবে"। মেয়েটিকে আমি বুকে আগলে বড় করেছি, ভালোবাসায় ওর চারিপাশ ভরিয়ে রেখেছি, ও ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই দেখেনি।

গতকাল সারাদিন আমার মনটা খারাপ ছিল, শরীর খারাপ থাকলে মনও দূর্বল থাকে। ঘুরে ফিরে আমার প্রতি মানুষের অন্যায় আচরণগুলোর কথাই মনে আসে! অযথাই মৃত মায়ের কথা মনে পড়ে! গতকালও মা'কে মনে পড়ছিল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নীরবে কাঁদছিলাম, আমার অসুখ-বিসুখ কমই হয়, অথচ দুই সপ্তাহ ধরে শরীরে নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে, হয়ত এটাই লক্ষ্মণ, পৃথিবী থেকে বিনা নোটিশে তো যেতে পারবো না, নোটিশ পেতে শুরু করেছি। এগুলোই ভাবছিলাম, ম্যানেজার এসে অনুরোধ করলো, যদি আধ ঘন্টা সময় বেশী থেকে যাই, তাহলে উনার খুব উপকার হয়। আমি এমনই মানুষ, সহজে 'না' বলতে পারি না, বললাম ' হ্যাঁ'। পরিবার প্রধানকে জানিয়ে দিলাম, ফিরতে রাত সোয়া দশটা বেজে যাবে।

রাত সোয়া দশটায় যখন গাড়ীতে স্টার্ট দিয়েছি, ফোন বেজে উঠেছে। তাকিয়ে দেখি 'হোম' থেকে কল এসেছে। ঝট করে মেজাজ বিগড়ে গেল। আমি সতেরোবার বাড়ীতে ফোন করে সবার খোঁজ খবর নেই, আর 'হোম' থেকে আমার খোঁজ কেউ নেয়না( আমি ভুলে যাই, নিজেই তো সতেরবার ফোন করে নিজের অস্ত্বিত্ব জানান দেই, তাহলে ওরা কেন ফোন করতে যাবে), শুধুমাত্র 'এটা লাগবে, ওটা এনো' বলার জন্য 'হোম' থেকে ফোন আসে। আমার আর ইচ্ছে করছিল না গাড়ী থেকে নেমে গিয়ে শপিং সেন্টারে যেতে। ফোন ধরলাম, বিরক্তি নিয়ে 'হ্যালো' বলতেই শুনি, মিথীলা বলছে,
" মা, তুমি কোথায়? এত দেরী হচ্ছে কেন? আমি ভেবেছি, তোমার কোন বিপদ হয়েছে!"

-কেন, তুমি জানতে না যে আমার আজ ফিরতে দেরী হবে!

-না, জানতাম না, পাপা শাওয়ার নিচ্ছে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত দশটা বেজে গেছে। তুমি তো সাড়ে নয়টায় চলে আসো। ঠিক আছে, মা সাবধানে ড্রাইভ করো। চলে আসো বাসায়"।

গাড়ীর স্টার্ট বন্ধ করে দিলাম, দুই চোখ ফেটে জল এলো। আহ! আমার খোঁজ নেয়ার মানুষ আছে এই পৃথিবীর বুকে। রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে সারা দেশের মানুষ কাঁদছে, আমার মত পিপীলিকাসম মানুষের মৃত্যুতেও দুই একজন কাঁদবে, এটা ভেবেই কান্না উথলে উঠলো। বাড়ী ফিরলাম। খাওয়া-দাওয়া করে ফেললাম। দেখি, মিথীলা খাবার নিচ্ছে। রেগে মেগে জিজ্ঞেস করলাম,
" রাত এগারোটায় তোমার খাওয়ার সময় হলো? এতক্ষণ কী করেছো"?
-তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম।

আমি এর জবাবে কিছু বলিনি। উপরে গিয়ে কম্পিউটার খুলে বসলাম, রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে কিছু লিখবো বলে তৈরী হলাম। কিছু তথ্যের প্রয়োজন ছিল, পত্রিকাগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করলাম, পেলাম না। দুই একজন অতি পরিচিত সাংবাদিক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করতেও 'প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে শোকাহত' বন্ধুরা আমাকে ফিরিয়ে দিল। কেউ বিনীতভাবে, কেউ 'দূর্বিনীতভাবে' ফিরিয়ে দিল। আমার আবার মন খারাপ হলো। গলার কাছটায় যন্ত্রণা টের পেলাম। মিথীলাকে ডাকলাম,

" বাবলু, আমাকে এক কাপ গরম জল এনে দিবে? একটা টি-ব্যাগ চুবিয়ে দিও"।

মিথীলা এক কাপ চা নিয়ে এলো, চায়ের কাপে দেখি একটু ফেনা দেখা যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, ফেনা কিসের?

-কিচ্ছু না, আমি চিনি দিয়ে অনেক নেড়েছি তো, তাই 'বাবল' উঠেছে।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই লাফ দিয়ে উঠলাম। একী!!! লবন দিয়েছো তো চায়ে! একেবারে লবনকটা লাগছে।

মিথীলা বোবা হয়ে গেছে। বারবার বলছে, " মা, আমি লবন দেবো কেন? চিনি দিয়েছি"।

-হেসে ফেললাম। বললাম, চিনি আর লবন, দুটোই একই রকম বোয়ামে রাখা আছে বলে তুই নিজের হাতেই বোয়ামের গায়ে 'সল্ট', 'সুগার' লিখে রেখেছিলি, আর নিজেই এই ভুলটা করলি!!!!!!! হা হা হা! থাক, আর চা বানাতে হবে না। যা, ঘুমিয়ে থাক।

মিথীলা কিন্তু ঘুমাতে যায়নি। আবার নতুন করে 'চা' বানিয়ে এনেছে। বলেছে,
" মা, এবার চিনি মিশিয়েছি। গরম থাকতে থাকতে চা' খাও, গলার ব্যথা সেরে যাবে। এবার আমি ঘুমুতে যাই!"

-অনেক ধন্যবাদ মিথীলা, গুডনাইট, স্লীপ টাইট!

Like · · Promote ·

1 comment:

  1. This is blog writing at its best. And I'm not flattering you. The more I read it, the more I feel the pathos of an individual who is distanced, deferred and alienated yet striving her best to accommodate herself to the tunes of harsh reality. Actually this piece reminds me of Lamb, the master of personal prose.
    You have really the flair of free personal prose that captures personal emotions to ooze out.

    ReplyDelete