Wednesday, January 30, 2013

'কলিজু' কাহিণী

 আমার 'তুতোবোন' টাকে  গত সাতদিন ধরে ফোন করে চলেছি, সে ফোন ধরে না। তাকে মেসেজ রাখি, নো রিপ্লাই। আজ সকালেও ফোন করেছি, ফোন বেজে চলে। মেসেজ অপশনে গিয়ে শুধু 'এক শব্দে'  মেসেজ রেখে  কাজে চলে গেছি। যখন আমার টি ব্রেক চলছিল, সে আমাকে ফোন করেছেঃ

'হ্যালো ফুলদিভাই!

-বলো, আমার 'কলিজু'!

- কী, কী বললে? কলিজু!

-হ্যাঁ, কলিজু

-সূর্য্য কোন দিকে উঠেছে আজকে? মেসেজে দিলে গালি, আর এখন একেবারে 'কলিজু'।

-হুম! কলিজু। নতুন শুনলাম শব্দটা। হাহাহাহাহহাআহ

- কে বলছে? দাদাভাই?

-হ, দাদাভাইয়ের তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নাই, আমাকে অমন সুন্দর করে ডাকবে!

-তাইলে, কার কাছ থেকে শুনছো?

-বাবারে! তোরে এগুলো বলা যাবে না। সব নষ্টকাহিণী!

- কীসব বলো, নষ্টকাহিণী মানে কি?

-নষ্টকাহিণী মানে নষ্ট কাহিণী। এক মহিলা তার গোপন প্রেমিককে ফোনে 'কলিজু' বলে ডাকছিল। প্রেমিক আবার বাংলাদেশে অতি পরিচিত, এক নামে সবাই তাঁকে চিনে। বর্তমানে তো দেশে এই ঘটনা নিয়েই তোলপাড় চলছে।

-তুমি এত শয়তান হলে কবে থেকে? অন্যের  ফোনে আড়ি পাতো, আবার তাদের প্রেমালাপ শোন!

-আরে! আমি শয়তান না হতে চাইলেও  মাঝে মাঝে  শয়তানী করে ফেলি!  কী করবো বল, আমি কী কারো ফোনে আড়ি পেতেছি নাকি?  কালকে ইউটিউব------

-কথা শেষ করো! থামলে কেনো?

-বাদ দে! এগুলি সব ফাউল কথা বার্তা! তোর শুনে কাজ নেই। ছোটমানুষ,  বয়স্ক লোকের কেরামতি বুঝবি না।  ইউটইউবে গেলেই বুঝা যায় সব। তাছাড়া দেশের কোন খবর রাখস না, এমন একজন পরিচিত লোকের কাহিণী এটা, আমি বেট ধরতে পারি, নাম শুনলে তুই বলবি, 'এই বেটা আবার কে?"

-ভালো হইছে, তুমি দেশপ্রেমিক, তুমি ইন্দিরা গান্ধী, তুমিই শুধু দেশের খবর রাখো, আমরা তোমার মত দেশপ্রেমিক না।

-আরে, রাগ করস কেনো? ইচ্ছে করেই বলছি না। আমেরিকার মত দেশেও এখন ফোনে আড়িপাতা হয়, কার কথা কখন টেপ হয়, কার কথা কখন ফাঁস হয়ে যায় তার ঠিক নাই। হা হা হা হা! মজার কথা শোন, বললাম না যে এক মহিলা তার প্রেমিককে 'কলিজু' বলে ডাকছিল,  আর কলিজু ডাক শুনে সেই প্রেমিকের সে কী গদগদ কথা! আঞ্চলিক ভাষায় কথাবার্তা চলছিল, সব কথা বুঝিও না। একবার শুনি প্রেমিকরে তার বউ ফোনে শাসাইতেছে।
বইন রে বইন, বিশ্বাস কর, প্রেমিকের বৌ ভাই জিনিস একজন। কী তেজ, কী সাহস রে! কী বকা যে বকছিল স্বামীরে, স্বামী তার বৌরে একবার ধমকায়, আরেকবার মাফ চায়!!!!!!!!!   অথচ এই লোকই আবার দেশের সব মান্য গন্য মানুষদেরকে অভিশাপ দিয়ে চলছে। হা হা হা !!

-ফুলদিভাই, আর এইসব আলতু ফালতু জিনিস শুনোনা তো!

-নাহ! আমি এগুলি শুনিনা। গতকালকে সারাদিন খুব কান্নাকাটি করছিলাম, সন্ধ্যার পরে ইউটিউবে গান শুনতে গিয়ে এই অবস্থা।  দাঁড়া, আরও দশ মিনিট বাকী আছে ব্রেক শেষ হতে। তোরে খোলাখুলি বলি, নাহলে আমাকে খারাপ ভাববি।


-তোমাকে কোনদিনও খারাপ ভাবি না। এমনিতেই বললাম। বলো শুনি তোমার 'কলিজু' কাহিণী।

-শোন, আমি যখন কথা বলবো, তুই শুধু শুনে যাবি, হ্যাঁ হুঁ করবি, এর বেশী কিছু না।

-আচ্ছা ঠিক আছে, বলো।


 আমি গতকাল সারাদিন কেঁদেছি আর নিজের প্রয়োজনীয় লেখা লিখেছি। লিখতে লিখতে একসময় খুব ক্লান্ত লাগছিল, চলে গেলাম ইউটিউবে। বেশ কিছুক্ষণ গান শুনলাম। মান্না দে, কিশোর শুনে সার্চে গিয়ে শ্যামল মিত্র টাইপ করা শুরু করেছি। শ্যামল এর এস টাইপ করার সাথে সাথে এস আদ্যক্ষরের আরেকজনের নাম চলে এসেছে ( অবশ্য এস তাঁর নামের শেষ অংশের আদ্যক্ষর, তাঁর নামের শেষ অংশ দিয়েই তাঁকে সবাই চিনে, নামের প্রথম অংশের আদ্যক্ষর অবশ্য 'ডি')। বর্তমান সময়ের খুব আলোচিত অডিও কালেকশান, সিরিয়্যালী চলে এসেছে। এই লিঙ্কটা প্রায় বিশ দিন আগেই আমাকে আমার কিছু বন্ধু পাঠিয়েছিল ই-মেইল করে, সাথে সাথে ডিলিট করে দিয়েছিলাম। কাল ইউটিউবের সিরিয়াল থেকে একটা অডিও অন করলাম, ভাবলাম, দেখি না কী ব্যাপার! কী এত কথা হয়েছিল তাহার সনে!  আমি কোন সিকোয়েন্স ধরে শুনিনি। এমনি খেয়ালের বশে যেটাতে প্রথম ক্লিক করেছি, সেটাই শুনেছি।  মিথীলাকে আমার কম্পিউটার চেয়ারে বসে থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম, কানে হেডফোন লাগিয়ে ল্যাপটপে গান শুনছে। নিশ্চিন্ত হলাম, ইউটিউবের কথা ওর কান পর্যন্ত পৌঁছাবে না!  এদিকে আমি আমার ইয়ার ফোন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি তো সারাক্ষণ বাংলা গান চালিয়ে রাখি যেনো মিথীলার কানেও যায়। তাই ইয়ারফোনের খোঁজ রাখিনি। ইয়ারফোন ছাড়াই সেই অতি বিখ্যাত অডিও শোনা আরম্ভ করেছি।

বাবারে!!  শুনবো কি, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি। আমি আমার উত্তমকে  কোকিল সুরে ডাকার জন্য কোন জুতসই সম্বোধণই খুঁজে পাই না,  আর এই অডিও টেপের মধ্যে দেখি সম্বোধণের প্রতিযোগীতা চলেছে। একজন যদি বলে 'সোনা পাখী', আরেকজন বলে ' ময়না পাখী'! একজন যদি বলে 'যাদু মানিক', আরেকজন বলে ' কলিজু'। কলিজু শোনার পর আমি আর নিঃশব্দে হাসতে পারলাম না। খিলখিল করে হাসি, মিথীলার কান ঢাকা আছে হেডফোনে, তাই ও অডিওর কথা শোনেনি, বেঁচে গেছি।  যা সমস্ত কথাবার্তা হচ্ছিল কী বলবো! ভাগ্যিস ও কিছু শোনেনি, কিন্তু ও আমাকে দেখতে পাচ্ছিল, জিজ্ঞেস করলো,

" মা, তুমি এত হাসছো কেনো? কোন নাটক দেখছো? মা, তুমি আবার নাটক দেখা শুরু করেছো?

আমি তো আগে ইউটিউবে রেগুলার নাটক দেখতাম, মুভী দেখতাম। তখন আমার মুড খুব ভালো থাকতো।  আমার মুড ভালো থাকা মানেই বুঝতে পারিস, আশপাশের দুনিয়া ভালো থাকে। গত তিনমাস আমাকে তো মিথীলা হাসতে দেখেনি। তাই আমাদের দুনিয়া খুব অন্ধকার যাচ্ছে! তার উপর, গতকাল সন্ধ্যেবেলা দেখেছে, কম্পিউটার টেবিলে বসেই আমি খুব কাঁদছিলাম।  তুই তো জানস, আমার হাসি বা কান্না, দুইই খুব জোরালো হয়। কাজেই কিছুক্ষণ আগে ক্রন্দনরত মা'কে দেখেছে সে, এর মধ্যেই এমন কী ঘটলো যে মা এভাবে খিলখিল করে হাসছে! সরাসরি তো আর বলতে পারেনা যে মা 'পাগল' হয়ে গেছে! তাই বোধ হয় ঘুরিয়ে জানতে চেয়েছে আমি নাটক দেখছি কিনা!

বললাম, -নাটক দেখছি না, নাটক শুনছিলাম!

-ওটা কী খুব হাসির নাটক?

-হাসি বলতে হাসি? এটা 'হাসির বাবা' নাটক। হা হা হা হা

-কী হয়েছে নাটকে, আমাকে একটু বলো না।

-একজন আরেকজনকে 'কলিজু' ডেকেছে।

- কলিজু কী একটা হাসির ওয়ার্ড?

-অবশ্যই হাসির ওয়ার্ড! নাহলে আমি হাসবো কেনো!

-মা, শুধু একটা ওয়ার্ড শুনেই তুমি এভাবে হাসছো!

-নাহ! রে মা, হাসি এসেছে অন্য কারণে।  তোমাকে বলা যাবে না। তুমি বুঝবে না।

-ওকে, বাট আমি কলিজু ওয়ার্ডটা লাইক করলাম। কলিজু ওয়ার্ড শুনেই তো তুমি হাসছো। আজ তো তুমি অনেক কেঁদেছো, একজন কলিজু বলাতেই তো অ্যাট লিস্ট তুমি হাসছো!!


- হা হা হা !! ফুলদিভাই, আমিও মিথীলার সাথে সুর মিলায়ে বলি, করুক তারা ফোনে প্রেম, হোক পরকীয়া,  কলিজু শুনে তবু তো তুমি হাসছো। আবার  মেসেজে আগের মত আমাকে একটা 'গালিও' দিছ। আমি তো মেসেজে তোমার গালি শুনে অবাক হয়ে গেছি। আরে! ফুলদিভাই তো দেখি আগের ফর্মে ফিরে আসছে! মাঝে মাঝে শুইনো, এরকম কলিজু কাহিণী যদি ফ্রী পাও, তো খাও কলিজু ভর্তা খাও! হা হাহাহ!

এইবার রাখি বইন। থাক, তুই আবার ইউটিউবে গিয়ে এসব দেখিস না। ফালতু ফালতু। তবে আমি মানুষের চরিত্রের রঙিলা দিক দেখে অবাক হয়ে গেছি। বিশ্বাস কর, মানুষ যে কত খারাপ আর বিটকেল হতে পারে, এই তোতালাপ শুনে বুঝলাম! বাইরে থেকে শোনায় ঈশ্বরের বাণী, আর ভেতরে ভেতরে প্রেমধ্বনি! যত্তসব!


ভালো থাকিস, রাখি। আচ্ছা, যা, পারমিশান দিলাম, যে কোন ব্লগে যাবি, ইউটিউবে যাবি, গিয়ে শুধু  'ডি' 'এইচ' 'এস' টাইপ করবি। তবে সাবধান, পড়তে চাইলে নিজ দায়িত্বে পড়বি, পড়ার পরে যদি 'বমি' করস, সেই দায়িত্ব কিন্তু আমি নেবো না।

-ফুলদিভাই, প্রথমে তুমি বলেছিলে, নাম শুনে আমি বলবো, এই বেটা আবার কে?  আমাকে অত কাঁচা ভাববার কোন কারণই নাই। আমি ডি এইচ এস শুনেই বুঝে গেছি, কার কথা বলছো!

-বলতো কার কথা!

-নাম বললে তো আবার বিপদ আছে, তুমিই বলেছো। তবে তার কাম-কাজের কথা বলি, সে মাইকে ওয়াজ মাহফিল করে। সবাইরে ধর্মজ্ঞান দেয়। পৃথিবীতে কী পাইলা সেইসব হিসেব না করেই বেহেশতে গিয়ে কী পাইবা, সেইসব স্বপ্ন দেখায়। আর কিছু শুনবা?

-সাবাশ বইন সাবাশ! তুই তো দেখি এক্কেবারে বিচ্ছু'বাহিণীর সদস্য হয়ে গেছস! বিচ্ছু বাহিণী বুঝস তো? মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল ওরা, গেরিলা যোদ্ধা, আমরা চরমপত্র শুনতাম, ঐখানে বিচ্ছু বাহিণীর কথা থাকতো। বাদ দে, এত কথা তুই বুঝবি না। তবে আমার টি ব্রেক টা তুই আনন্দময় করে দিছস! এই জন্য তোরে আবার পারমিশান দিলাম, যা, অডিও টেপ শোন, নিজের মনে চিন্তা করে দ্যাখ, আমি মুখ ফুটে যা বলতে পারি নাই, কান পেতে শুনে দ্যাখ, মানুষ কত খবিস হতে পারে! আর সেই সকল 'বিচ্ছুবাহিণীর' সদস্যদেরকে সালাম জানা, যারা ফোনালাপ রেকর্ড করে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছে! কাজটা অবশ্যই অন্যায়, তবে মাঝে মাঝে অন্যায়গুলোই বেঁচে থাকার জন্য শক্ত হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। বিচ্ছুবাহিণী এই অন্যায় কাজটুকু না করলে কেউই জানতেই পারতোনা, মুখে যার মধু ঝরে, অন্তরে তার কত বিষ জমে থাকে!



** আমার 'বইন'টি কাল্পনিক!

Tuesday, January 29, 2013

আবিষ্কার!!

দুইদিন আগে বিশাল এক ব্যাপার আবিষ্কার করেছি। শব্দটি যখন 'আবিষ্কার' , তার মানে কারো সাহায্য ছাড়াই কাজটি আমি করে ফেলেছি। ব্যাপারটি আবিষ্কার করার পর থেকে আমি আর আমার মধ্যে নেই, একেবারে কিশোরী আনন্দে লাফাচ্ছি।

খুলেই বলি, আমার মেয়ে মিশার কাছে প্রথম শুনেছি ফেসবুকের কথা। আজ থেকে আরও চার বছর আগে। মিশা তখন কলেজে পড়ে। ছুটিতে বাড়ী আসে, ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বসে থাকে। ল্যাপটপে কি? ফেসবুক। ফেসবুক মানে কি? ফেসবুক মানে বন্ধু। ঘরে বসে থেকে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে থাকা স্বজন-বন্ধুর সাথে আড্ডা, গল্প, ছবি শেয়ার করা। পড়ালেখার ক্ষতি করে এইসব? পড়ালেখার ক্ষতি করে কিছুই করে না সে, এমনই বলেছে আমাকে। আমি হলাম ট্র্যাডিশনাল বাঙ্গালী মা, মেয়ের স্তোকবাক্যে সহজে ভুলবার পাত্রী নই। নাছোড়বান্দা মা'কে আশ্বস্ত করার জন্যই মিশা তার ফেসবুকে আমাকে প্রবেশাধিকার দিয়েছিল। নিজেকে মায়ের কাছে স্বচ্ছ প্রমান করার জন্য নিজের পাসওয়ার্ডও দিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ওর অ্যাকাউন্টে ঢুকে আমি আমার আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবের ছবি দেখতে পারি। অস্ট্রেলিয়াতে আমাদের অনেক বন্ধু আছে, তাদের ছেলেমেয়েরা আমার মেয়েদের মতই বড় হয়ে গেছে, তারা দেখতে কেমন হয়েছে, তা দেখার জন্যই মিশার অ্যাকাউন্টে ঢুকতাম।

মিশার অ্যাকাউন্টে ঢুকে আমি ছবিগুলোই শুধু দেখতাম, ওয়ালের সবকিছু আমার কাছে জটিল মনে হতো। নোটিফিকেশানে দেখতাম নাম্বার দেখায়, একটা খামের মত আইকনে দেখতাম নাম্বার দেখায়, তার পাশেই মানুষের অবয়বেও দেখি নাম্বার দেখায়। সবকিছু খুব জটিল মনে হতো, তবে ছবিগুলো দেখেই আমি উইন্ডো ক্লোজ করে দিতাম। লাল বক্সে দেখানো নাম্বারে কখনও ক্লিক করতাম না। মা আর মেয়ে সম্পর্ক হলেও পারস্পরিক বিশ্বাস বড় কথা। আমি কখনও মেয়েদের উপর স্পায়িং করিনি, মেয়েরা নিজে থেকেই আমাদের সাথে সব কথা খোলাখুলি বলে।

তা মিশা একদিন বলল, " মা, আমার বন্ধুরা যখন শোনে, তুমি আমার অ্যাকাউন্টে যাও, ওরা আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকায়! আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। শোন, তোমাকে বরং একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দেই, তোমার পুরানো বন্ধুদের পাবে, নিজের ছবি পোস্ট করতে পারবে, অন্যের ছবি দেখতে পারবে। আমি ভয় পাই, " আরে না! এগুলো অনেক কঠিন কাজ, আমি কিছুই বুঝি না। তাছাড়া আমার বন্ধুদের কেউ ফেসবুকে নেই, ফেসবুক খুলে ফাঁকা ওয়াল নিয়ে বসে থাকবো, কেমন লজ্জার ব্যাপার।" মেয়ে তার মা'কে আশ্বস্ত করে, " ফাঁকা থাকবে না, পুরানো বন্ধুদের না পেলে নতুন বন্ধু তৈরী হবে। ভালো না লাগলে বন্ধ করে দিও। কিনতু মেয়ের অ্যাকাউন্টে ঢুকা ঠিক না। আমরা বন্ধুরা সবাই কত আলতু ফালতু কথা লিখি ফেসবুকে, তুমি পড়ে ফেললে খবর আছে"।

আমার সম্মতি নিয়েই আড়াই বছর আগে মিশা আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়। নিজের পরিচিত বন্ধুদের কাছে আমার জন্য রিকোয়েস্ট পাঠায়, দুই দিনের মধ্যে বন্ধু সংখ্যা ৩৬ এ দাঁড়ায়। আমি খুশী, কয়েকদিন খুশী থেকে 'মহাখুশী' হতে চেয়েছি। নিজে নিজে ওয়ালের ডানে -বামে তাকিয়ে দুই একটা 'অ্যাড ফ্রেন্ড' দেখে ক্লিক করে দিয়েছি। প্রতিদিন মিশার ওয়ালে যাই, দেখি ওর ফ্রেন্ড সংখ্যা পাঁচশ'র উপরে। ছিছি! মেয়ের ফ্রেন্ড সংখ্যা পাঁচশ, আর মায়ের ফ্রেন্ড মাত্র চল্লিশ! লজ্জার কথা! বুঝিও না, কীভাবে মেসেজ পাঠাতে হয়, কীভাবে ছবি পোস্ট করতে হয়। মিশাকে ফোন করি, " মিশা, আগেই ভালো ছিল, তোর অ্যাকাউন্টে গিয়ে সবার ছবি দেখতাম। এখনতো তোর পাসওয়ার্ড বদলায় ফেলছস, আর ঢুকতে পারি না, ছবিও দেখতে পারি না"।
" মা, তোমাকে তো নিজের অ্যাকাউন্ট খুলে দিলাম, এখন আর আমার অ্যাকাউন্টে যাওয়ার দরকার কি? তোমার ওয়ালে থেকেও ছবি দেখতে পারবে। বন্ধুদের সাথে চ্যাট করতে পারবে।"

" কিন্তু, আমি তো ফেসবুকের কিছুই বুঝি না। চ্যাট কিভাবে করে? তাছাড়া আমার ফ্রেন্ড লিস্টে বন্ধু অনেক কম। এত কম বন্ধু নিয়ে আমি ফেসবুক করবো না। তোরা সবাই কত সুন্দর সুন্দর ছবি পোস্ট করস, আর আমার অ্যাকাউন্টে কোন ছবিও নাই"।

" হায়রে! ঠিক আছে, নেক্সট টাইম বাসায় এসে তোমাকে সব শিখিয়ে দিয়ে যাব। তার আগে তুমি নিজেও একটু একটু করে চেষ্টা করো"।

শুরু হলো আমার চেষ্টা। দুই চারজনকে আন্দাজেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি, তারা রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করতেই আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছি। বন্ধু আবিষ্কারের আনন্দ। এরপর মিশা বাড়ী এসেছে, কাকুতি-মিনতি করে ওকে দিয়ে কিছু ছবি পোস্ট করিয়েছি। আমি জানিও না, আমার ইন্টারেস্ট, আমার হোম টাউন থেকে শুরু করে সব কিছু মিশা লিখে দিয়েছে। আমি তো ওগুলো পড়েও দেখিনি। এভাবেই কেটে গেছে এক বছর। এক বছরে আমার বন্ধু সংখ্যা হয়েছে একশ'এর কিছু বেশী। এর মধ্যেই শিখে ফেলেছি কি করে চ্যাট করতে হয়, কী করে মেসেজ পাঠাতে হয়। কিন্তু কাহাতক আর ভালো লাগে! একঘেয়ে লাগে সব কিছু। শুধু মিশা যখন বাড়ী আসে, ওকে দিয়ে ছবি আপলোড করাই। এই একটা ব্যাপারে আমাদের মা-মেয়ের খুব মিল আছে। দুজনেই ছবি তোলাতে ভালোবাসি, মিশা অবশ্য ছবি তুলতেও ভালোবাসে। আমি ক্যামেরা হাতে নেই না, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে যাই। ফলে ছবিতে 'লাইক' পড়ে, কমেন্ট পড়ে, আমি খুশী হই।

মিশার কাছ থেকে স্ট্যাটাস লিখার কায়দা শিখি। বাংলিশে স্ট্যাটাস লিখি, কী সব মাথামুন্ডু লিখি, তাও বুঝি না। মাঝে মাঝে অন্যের ওয়ালে বাংলায় লেখা দেখি, একদিন খুব আফসোস করছিলাম, আমি যদি আমাদের কম্পিউটারে বাংলায় লিখতে পারতাম, কত ভালো হতো! আফসোসটুকু বেশ উচ্চঃস্বরেই করেছিলাম। পাশের রুম থেকে আমার ছোট্ট মেয়ে মিথীলা শুনে ফেলেছিল। ও চট করে আমাকে বলল, " মা, আমাদের কম্পিউটারে তো বাংলা ফন্ট আছে। দাঁড়াও, আমি বের করে দেই"। মিথীলা আগে থেকে ইন্সটল করা 'অভ্র' বের করে দিল। আমি জানিনা কী করে ইংলিশ কী-বোর্ডে বাংলা টাইপ করতে হয়। মিথীলার তো জানার প্রশ্নই আসে না। আন্দাজের উপর ভর করে টাইপ করি, শুদ্ধ হয়, ভুলও হয়। হঠাৎ একবার  খুব ভয়ে ভয়ে উপরের টুলবারে 'বাংলা' শব্দের পাশের 'অ্যা্রো' তে ক্লিক করেছি, দেখি বেশ কিছু অপশন দেখাচ্ছে। তার মধ্যে বাংলা 'কীবোর্ড লে আউট' ছিল। ওটাতে ক্লিক করতেই আমার চোখের সামনে খুলে গেলো ধন-ভান্ডারে ভরা জগতের বিশাল দরজা। বেশ কিছুক্ষণ আমি থম ধরে বসে ছিলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, আমি নিজে নিজে এতবড় এক দুনিয়া আবিষ্কার করে ফেলেছি! মাত্র এক ঘন্টায় পুরো লে আউট আমি মুখস্থ করে ফেলেছি। আনন্দের আতিশয্যে তখনই বাংলায় লিখে স্ট্যাটাস দিলাম, " মিথীলা আমাকে বাংলা ফন্ট অভ্রের সন্ধান দিয়েছে"।

আরও কিছুদিন বাদে আমার ফেসবুক বোন 'সালমা রেখা'  ক্রমাগত আমার ওয়ালে নানা কবিতা ট্যাগ করা শুরু করে। কবিতা আমি বুঝিও কম, সেজন্য উৎসাহও পেতাম না। তারপরেও কেউ একজন  আমাকে সৃষ্টিশীল সাহিত্য পাঠের অংশীদার করতে চেয়েছে, ভেবেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছি। রেখা আমাকে বলেছে, আমিও যেনো কবিতা লিখে পোস্ট করি। কবিতা লেখার প্রশ্নই উঠেনা, পারলে তো লিখবো! একদিন খুব ভয়ে ভয়ে 'আলো' ব্লগে ঢুকেছি।  দেখি লেখা আছে ' Write here'। কিছুই না বুঝে ওখানেই ছোট একটু প্যারা বাংলায় লিখে নীচে 'পোস্ট' কথাটি দেখে পোস্ট করেছি। আবার ফিরে এসেছি নিজের ওয়ালে। মিনিট পাঁচেকের ভেতর নোটিফিকেশান পেতে শুরু করেছি। আমি তো আঁতকে উঠেছি, আরে! আমাকে আবার কে এতো নোটিফিকেশান পাঠাচ্ছে! ক্লিক করে দেখি সুনামগঞ্জের সৌরভ ভুষন, আর শৈলেন্দ্র আমার লেখার উপর কমেন্ট দিয়েছে। তাদের দু'জনেই আমার কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। এই প্রথম আমার লেখার শুরু এবং এই প্রথম আমার লেখা পড়ে কেউ আমার কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে।

নিজের লেখার প্রতিভা আবিষ্কারের আনন্দে নিজেই আত্মহারা। তখনও শিখিনি কিভাবে 'কপি এন্ড পেস্ট' করতে হয়। জানিনা মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে কি করে লেখা সেভ করে রাখতে হয়। প্রতিদিন 'আলো'তে যাই, ওখানেই লিখি, ওখানেই পোস্ট করি। আমার তো ধারণাতে ছিল না, 'আলো'তে প্রতি মুহূর্তে সদস্যরা লিখা পোস্ট করে চলেছে। ফলে এক ঘন্টা পরেই নিজের লেখা আর খুঁজে পেতাম না। স্ক্রল ডাউন করতাম, অনেকদূর যাওয়ার পর নিজের লেখা পেতাম। 'আলো' থেকে লেখাটি কপি এন্ড পেস্ট করে ফেসবুক ওয়ালে দেয়ার কথাও জানতাম না।

আজ থেকে ঠিক দেড় বছর আগে, ২০১১ এর আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি আবিষ্কার করলাম আমার লেখক জীবনের 'কান্ডারী' অথবা 'পথপ্রদর্শক' আমারই প্রিয় কলামিস্ট 'পীর হাবীবুর রহমান' কে। উনাকে আবিষ্কার করেছিলাম আমার ফেসবুক ওয়ালের ডানপাশে ভেসে উঠা ছবি থেকে। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি, উনি অ্যাকসেপ্ট করেছেন। উনার আগে আরও বড় বড় বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে দুই একজন আমার রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করে আমাকে কৃতার্থ করেছিলেন! আমার সাথে কথা বলেন নি। পীর হাবীব ভাই ব্যতিক্রম। উনি নিজে থেকে আমার সাথে কথা বলেছেন, কথা বলে উনার মনে হয়েছে, আমি বোধ হয় লেখালেখি করি। আমাকে বার বার জিজ্ঞেস করছিলেন, কোথাও লেখালেখি করি কিনা। সবিনয়ে নিজের অক্ষমতার কথা স্বীকার করে, কিছুটা লাজুকভাবেই বলেছিলাম, ' আলো' তে দুই চারটি ফীচার লিখেছি। পড়ে দেখতে পারেন। আমার কাছ থেকে 'আলো' ওয়েবসাইটের ঠিকানা নিয়ে উনি আমার লেখা দুই একটা অংশ পড়ে আমাকে ফিরতি জানালেন, আমার ইচ্ছেমত কিছু লিখে উনার কাছে পাঠিয়ে দিতে।

মহা ফাঁপরে পরে গেছি। এত বড় একজন কলামিস্ট আমাকে বলেছে, স্বাধীনভাবে কিছু লিখতে। আমি কী মনে করে যেনো কিশোরীবেলায় বঙ্গবন্ধুকে দেখার স্মৃতি নিয়ে নাতিদীর্ঘ একখানি প্রবন্ধ লিখে ফেলেছিলাম। দুই দিন পর ১৮ই আগস্ট, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়ে গেলো আমার লেখা। পড়ে দেখি, লেখাটি হুবহু ঠিক রেখে হাবীব ভাই নিজ থেকে আরও অনেক তথ্য যোগ করে দারুণ সুন্দর করে ছাপিয়েছেন। নিজেকে লেখক হিসেবে আবিষ্কার করলাম।

এরপর থেকে নিয়মিত বাংলাদেশ প্রতিদিন এ দুটো একটি করে লেখা ছাপা হতে লাগলো। কী বিশ্রী, কী ভীষন কাঁচা লেখা, তারপরেও আমার প্রিয় কলামিস্ট লেখাগুলোকে পরম যত্নে উনার পত্রিকায় ছাপিয়েছেন, আর আমার ভেতর আত্মবিশ্বাসের ভিত রচনা করে গেছেন। এর মধ্যেই একদিন আমি আমার কাজিন অভিজিতের ওয়ালে গেছি, দেখি ওর ওয়ালে জাকারিয়া স্বপনের লেখা একটি লিঙ্ক শেয়ার করা আছে। খুব সম্ভব বাংলাদেশের যানবাহনের উপর ছিল লেখাটি। জাকারিয়া স্বপনের নাম আমি আগেই শুনেছি, পত্র পত্রিকায় উনার লেখা পড়েছি। চুপ করে আমার ওয়ালে এসে সার্চ বারে উনার নাম টাইপ করে উনার প্রোফাইলে গিয়ে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি। মনে নেই, কি লিখেছিলাম। হয়ত ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম। এই যে সার্চ বারে গিয়ে উনার নাম টাইপ করেছি, ওটাও ছিল আমার নিজের আবিষ্কার। কেউ শিখিয়ে দেয়নি। যাই হোক, আমার ভাগ্য ভালো, জাকারিয়া স্বপন  অনলাইনেই ছিলেন, রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করলেন, মেসেজের উত্তর দিলেন। তখন আমি বললাম, আমি প্রিয় ব্লগে লিখতে চাই, কী করে নাম রেজিস্ট্রেশান করবো, জানিনা। স্বপন ভাই খুব যত্নের সাথে, ধৈর্য্যের সাথে আমাকে ব্লগে নাম রেজিস্ট্রেশান করায় সর্বাংশে সাহায্য করেছিলেন। এমন কি, বলেছিলেন, যা মন চায় লিখে পোস্ট করে দেখতে, পোস্ট হয় কিনা। ৩রা সেপ্টেম্বার, ২০১১ তে আমি লিখেছিলাম " অর্থহীন রাজনীতি" নামে দুই প্যারাগ্রাফের একটি লেখা। স্বপন ভাইয়ের সাথে কথা হওয়ার আগমুহূর্তে 'অনিরুদ্ধ অঞ্জন' নামের এক বন্ধুর সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছিল, রাজনীতি নিয়ে। ব্যস, লিখে ফেললাম 'অর্থহীন রাজনীতি'। পোস্টও হয়ে গেলো। এই প্রথম সত্যিকারের ব্লগে লেখা শুরু। চোখের সামনে খুলে গেলো ব্লগ দুনিয়া।

ধীরে ধীরে বন্ধু সংখ্যা বাড়ছিল, প্রিয় ব্লগে লিখতে গিয়েই নানারকম অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ফেললাম। আমার লেখাগুলো ছিল আবেগ নির্ভর, সততা নিয়ে লিখতাম, তাই যা মনে আসতো তাই লিখতাম। তখন রাজনীতি বিষয়ক লেখাই বেশী লিখতাম। প্রিয় ব্লগে কিছু গোঁয়ার -গোবিন্দ টাইপ লেখক আছেন, কিছু নোংরা মন্তব্যকারী পাঠকও ছিলেন। তাঁদের মতের সাথে মিল না হলেই তাঁরা যাচ্ছে তাই ভাষায় লেখককে গালিগালাজ করতেন। আমি নারী বলেই যে আমাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হতো, ভাবা ভুল। কেউ কেউ আমাকে 'তসলিমা নাসরীনের' পরিনতির কথা স্মরণ করিয়ে হুমকী দিতো। আরও খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে। আবার এখানেই পেয়েছি 'সঞ্চয় রহমান' নামের অত্যন্ত গুণী, রুচীবান, অতি বিনয়ী ও ভদ্র তরুণকে, যিনি নিজে থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন, মন খারাপ করতে না করেছিলেন, সকল নোংরামীকে উপেক্ষা করতে বলেছিলেন। খারাপের পাশাপাশি আবিষ্কার করলাম দারুণ ভালো কিছু। সঞ্চয়ের কথা আমার হৃদয়ে সঞ্চিত আছে। ওতো শুধুই আমার ছোট ভাইই নয়, আমার স্বজনও সে। মানুষের খারাপ -ভালো প্রসঙ্গটি এনেছি আবিষ্কারের কথা বলতে গিয়ে। প্রিয় ব্লগে লিখতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, আমার মধ্যে ধৈর্য্য, মানসিক ও মানবিক সৌনদর্য্য, সহনশীলতা, অপরের মতকে সম্মান করার গুণাবলী আছে, এবং তা খুব বেশী পরিমানেই আছে। আমি টিকে গেলাম ব্লগ রাজ্যে। প্রবেশ করলাম বিডিনিউজ২৪ ব্লগে। এবার নিজে নিজে সব করলাম। শুরু করলাম দ্বিতীয় ব্লগে লেখালেখি। ততদিনে আমার লেখার মান কিছুটা উন্নত হয়েছে।

ব্লগে লেখালেখির সূত্র ধরে আমার অনেক বন্ধু তৈরী হয়েছে। ততদিনে আমার মেয়ে মিশা তার ছোটবোনকে ট্রেনিং দিয়েছে, কী করে মায়ের ছবিগুলো ফেসবুকে পোস্ট করে দিতে হবে। মিশা জানতো না, ওর মা এর আগেই অনেক কারিগরী শিখে ফেলেছে। আগে দেখতাম, মিশা, ওর বন্ধুরা প্রায় প্রায় lol, :-P, (y), :) :(, :-D  <3 সাইন ব্যবহার করে। মিশাকে জিজ্ঞেস করি, ও হাসে। ভাবে হয়তো, কী বিপদে পড়া গেলো, মা এখন তারুণ্যের দিকে হাত বাড়াচ্ছে! এমনিতেই দুই বছরে আমার বন্ধু সংখ্যা চারশ ছাড়িয়ে যেতে দেখে ও কিছুটা ভিরমী খেয়ে গেছে। তার উপর যদি এইসব সাইন শিখে ফেলে, তাহলে তো চিন্তার বিষয়!

আমাকে তো মিশা চিনে না, আমি আমার কাজিন শমিতকে জিজ্ঞেস করেছি, আরেক বন্ধু অঞ্জন খান'কে জিজ্ঞেস করেছি, সাইনগুলো কী করে দিতে হয়! ওরা দুজনই আমাকে চ্যাট বক্সে লিখে পাঠিয়েছে। ওরা সাইন লিখে পাঠায়, আমি নকল করে লিখি, ওরা খুশী হয়, বাহবা দেয়। ভালো স্টুডেন্ট পেয়ে বেশ সন্তুষ্ট হয়। শমিত আমার বড় মেয়ের চেয়ে দেড় বছরের ছোট। কিন্তু আমার সাথে খুব বন্ধুত্ব। ওকে আমি 'সত্যজিত রায়' ডাকি। ও খুব ভালো শর্টফিল্ম বানায়। একদিন আবিষ্কার করলাম, শমিত খুবই সংস্কৃতিমনা এক তরুণ। আমাদের বংশে এই একটি মাত্র ছেলেকে দেখলাম, যে ফিল্ম বানানোর দিকে ঝুঁকেছে, এবং আরও আবিষ্কার করলাম, আমাদের বংশে আমিই একমাত্র মেয়ে যে লেখালেখির দিকে ঝুঁকেছি। এই আবিষ্কারের কারণেই শমিতের সাথে আমার খাতির আরও বেড়ে যায়। ও আমাকে মাঝে মাঝেই পরীক্ষা নেয়, সাইনগুলো মনে আছে কিনা। আমার কমন সাইনগুলো মনে থাকে, কিন্তু বাঘ, হ্যাট, ব্যাং, কান্না এগুলো ভুলে যাই। নিজেকে বোকার বেহদ্য ভাবি। শমিতের মত ছোট একটা ছেলে পর্যন্ত কম্পিউটারের এত কিছু বুঝে, আর আমি বুঝি না। আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।

গত পরশুদিন, কোন এক বন্ধুর সাথে চ্যাট করে লাইন অফ করে দিয়েছি। মাউসটা খুব বেগড়বাই করছে। আমি ব্লগ থেকে একটা লেখা কপি করে আমার ওয়ালে পোস্ট করতে চাইছিলাম, মাউস ডান দিকে ক্লিক হচ্ছিলনা, কারসার খুব নড়ছিল। যে বন্ধুর সাথে চ্যাট করেছিলাম, সেই স্ক্রীণটা তখনও খোলা ছিল। কারসারটা নড়াচড়া করতে করতে চ্যাট উইন্ডোর একেবারে নীচের দিকে 'সাইন এন্ড সিমবল' এর হালকা ছবির মধ্যে টাচ করতেই সব রকম সিম্বলসহ ' সাইন' বক্স ওপেন হয়ে গেলো! আবিষ্কার করে ফেলেছি! ইয়াহু!!!!!!!! পেয়ে গেছি!!! এখন বুঝতে পেরেছি, সোনার চাঁদেরা কোথা থেকে আমাকে এত টেকনিক শেখাতো! আমি তো কথায় কথায় থ্যাঙ্ক ইউ থ্যাঙ্ক ইউ করতাম, আর অঞ্জন , শমিত দুজনেই চুপ করে আমার দেয়া ধন্যবাদগুলো নিয়ে নিত। আমি ভাবতাম, এই রে! দুনিয়া কতদূর এগিয়ে গেছে, ওরা কী সুন্দর নিজে নিজে সিম্বল বানায়, আর আমি কিছুই পারি না! বুঝলাম, লেগে থাকলে কী না হয়! আমিও পারি!

Sunday, January 27, 2013

স্বপ্নে দেখলাম তিমিমাছ, অতঃপর!!!!!

আমি কখনওই দিবানিদ্রা দেই না। তাই দিবা স্বপ্নও দেখি না। রাতে যে কয় ঘন্টা ঘুমাই, খুব নির্ভেজাল, নিশ্চিন্তের ঘুম হয় সেটা। বই পুস্তক পড়ে জেনেছি, গভীর ঘুমে মানুষ স্বপ্ন দেখে খুব কম। কিন্তু আমি গভীর ঘুমেই সারারাত স্বপ্ন দেখি। ঘুম ভাঙ্গেনা, কিন্তু একটার পর একটা স্বপ্ন দেখে যাই। ভাল স্বপ্নই বেশী দেখি, মাঝে মাঝে  অর্থহীন অদ্ভুত সব স্বপ্নও দেখি,  তবে ভয়ের স্বপ্নও কম দেখি না। সবচেয়ে ভয়ের স্বপ্নগুলো হয় পরীক্ষার হল সংক্রান্ত। বলে রাখা ভাল, পড়ালেখায় আমি সারা জীবন ফাঁকি দিয়েছি। এমন কোন পরীক্ষার কথা আমার মনে পড়ে না যে, মনে খুব আনন্দ নিয়ে পরীক্ষাটা দিতে গেছি। এই জন্যই এই মধ্য বয়সে এসেও পরীক্ষার হলে প্রশ্ন কমন না পড়ার স্বপ্ন দেখে ভয় পাই। তবুও ঘুম ভাঙ্গে না। কিছুক্ষণ পরেই অন্য সিকোয়েন্স চলে আসে। ভাল-মন্দ স্বপ্ন দেখে রাত পার করে দেই। ঘুম ভেঙ্গে যে সমস্ত স্বপ্নগুলোর কথা মনে থাকে, সেগুলো নিয়ে মনে মনে বিশ্লেষণ করা শুরু করি। স্বপ্নটা  কেন দেখলাম, স্বপ্নে কোন সংকেত পাচ্ছি কিনা, এই ধরণের আয়েসী কল্পনা করে ঘন্টা দুই পার করে দেই।  এটা আর কিছুই না, বার্ধক্যের লক্ষ্মণ!

সূচনাতে এত কথা বলার কোন কারণ ছিল না, বয়সের ভারে বেশী কথা বলার লক্ষ্মণ টের পাচ্ছি। এবার মূল কথায় চলে আসি। কাল রাতেও আমার খুব গভীর ঘুম হয়েছে, অনেক স্বপ্নও দেখেছি। যে স্বপ্ন স্মৃতিতে নিয়ে ঘুম ভেঙ্গেছে, সে হচ্ছে একটি তিমি মাছ। কাল স্বপ্নে তিমি মাছ দেখেছি। তিমি মাছ কেন  দেখলাম , জানিনা।  বিদেশে রুই মাছই খেতে পাই না, তার আবার তিমি মাছ! আমি তো মাছের কথা ভুলেই যাচ্ছি প্রায়।  আটলান্টা, ডালাস থেকে মাছ আনাই, জমিয়ে রাখি, মাসে দুই একদিন মাছ খাই। তাই মাছ নিয়ে আর ভাবিনা, স্বপ্ন দেখার তো প্রশ্নই আসে না। তবুও কেনো তিমি মাছ স্বপ্নে দেখলাম ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেলো বর্তমান সময়ের আলোচিত ছবি, ' দ্য লাইফ অফ পাই' এর কথা। এই তো পেয়েছি ক্লু, এই মুভীটার গল্প মাথার ভেতর ঘুরছিল, তাই স্বপ্নে তিমি মাছ দেখেছি।


আমি সিনেমা পাগল নই। ছোটবেলাতে মায়ের সাথে সিনেমা হলে গিয়ে কয়েকটা সিনেমা দেখেছি ঠিকই, সিনেমাগুলো আমাকে দেখানোর জন্য মা আমাকে নিয়ে যেত ভাবাটা ভুল। কোন মা তাঁর পাঁচ বছরের মেয়েকে 'নীল আকাশের নীচে', ' আবির্ভাব', ' মোমের আলো' সিনেমা দেখাতে নিয়ে  যায় না, আসলে মা আমাকে সঙ্গী হিসেবে নিয়ে যেতেন। আরও অনেক পরে, যখন আমার কৈশোর, তারুণ্যকাল, পায়ে  শাসণের  অদৃশ্য শেকল টের পেয়েছি। সিনেমা দেখবো কি, স্কুল, কলেজের বাইরে আর কোথাও বেরোনোরই সুযোগ ছিল না। তারও অনেক পরে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বন্ধুদের সাথে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছি, সেটাও বলার মত কিছু নয়। সাভার ক্যান্টনমেন্ট 'গ্যারিসন' এ মাঝে মাঝেই ভারতীয় বাংলা সিনেমা চলতো, বিশেষ করে উত্তম কুমার অভিনীত সিনেমা, সেগুলো দেখতাম। বেশীদিন অবশ্য এই স্বাধীনতা ভোগ করা হয় নি, এরশাদ ভ্যাকেশানের কবলে পড়ে সব বাতিল হয়ে গেছিল। এরপর যে দুই একটা সিনেমা দেখেছি, তার একটা ছিল গুলিস্তান সিনেমা হলে। জাহাঙ্গীরনগর থেকে এসেছিলাম চার বন্ধু। সিনেমা শেষ হতেই সন্ধ্যেবেলা রাতের শেষ বাস ধরবো বলে হাঁটা শুরু করেছি, সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় ছিল শেষ বাস, গুলিস্তানের ভীড়ে দ্রুত হাঁটছিলাম, এর চেয়েও দ্রুত গতিতে একটি দুঃসংবাদ চারদিকে গুঞ্জরিত হচ্ছিল, " ইন্দিরা গান্ধীকে গুলী করে মেরে ফেলেছে"! আমার সঙ্গী বন্ধুদের মনে এই সংবাদ কতখানি প্রভাব ফেলেছিল, জানিনা, তবে আমি জোর ধাক্কা খেয়েছিলাম।

ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আমার এক ধরণের আত্মিক বন্ধনের ব্যাপার ছিল। আমার বাবা, আমার সেই ছোটবেলাতেই আমাকে 'ইন্দিরা গান্ধী' বানানোর প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন।  বাবা প্রতি রবিবার আমার কালো কোঁকড়াণো ঝাঁকরা চুলে শ্যাম্পু করিয়ে দিতেন, চুল শুকানোর পরে মাথার চুলে ক্রীম মাখাতেন আর বলতেন, " মেয়েটারে ইন্দিরা গান্ধী বানাবো। ইন্দিরা গান্ধীর মত ঝাঁকড়া চুলেই ওকে মানাবে, সাহসী আর তেজস্বিনী বানাবো ওকে"। সেই থেকে অদেখা তেজস্বিনী আমার হৃদয়ে বসে ছিলেন। বড় হতে হতে তেজস্বিনীর তেজ আর সাহস দেখে অবাক হয়েছি, বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করেছি এমন এক নারীর আদর্শে আমাকে তৈরী করতে চেয়েছেন বলে। সেই তেজস্বিনীকে তাঁর দেহরক্ষী গুলী করে হত্যা করেছে, এমন সংবাদ শুনলাম সিনেমা হল থেকে বের হয়ে, যাহ! আর সিনেমাই দেখবো না। ব্যস!  বন্ধুদের সাথে এরপর আর কোন সিনেমা দেখিনি।

বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীর সাথে সিনেমা হলে গিয়ে খুব সিনেমা টিনেমা দেখে, আমি দেখিনি। দেখিনি, কারণ আমি সিনেমা পাগল নই বলে। আমেরিকা এসেছি, তাও প্রায় বারো বছর হতে চলেছে। সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছি মাত্র দুইটি। হ্যাঁ, সত্যি কথা বলছি। তাও আবার ছোট মেয়ের পীড়াপিড়িতে ২০০৫ সালে দেখেছি 'চার্লি এন্ড দ্য চকোলেট ফ্যাক্টরী' আর ২০১২ তে দেখলাম ' দ্য লাইফ অফ পাই'। অদ্ভুত সুন্দর ছবি।  দুটি ছবিই দারুণ অ্যাডভেঞ্চারে ঠাসা এবং এর ভেতরেই শিক্ষণীয় এবং দার্শণিক তত্ত্বগুলো খুবই মসৃণভাবে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।  'দ্য লাইফ অফ পাই' সিনেমার দার্শণিক তত্ত্বে যাচ্ছি না, অ্যাডভেঞ্চার থেকে একটি ছোট টুকরো বেছে নিচ্ছি। কারণ, এই সিনেমাতেই 'তিমি' দেখেছি। ছবির নায়ক কিশোর পাই' যখন মাঝ সমুদ্রে বাঁচার জন্য সংগ্রাম করছিল, এক পর্যায়ে হঠাৎ করেই সে 'তিমিমাছ' দেখতে পায়। তিমিমাছের ডিগবাজির প্রতিক্রিয়ায় 'পাই'এর লাইফ সেভিং বোটটি তখন ওলট-পালট খাচ্ছিল, অথচ কিশোর ঐ অবস্থায় প্রকৃতির এই বিশাল সৃষ্টিকে দু'চোখ ভরে দেখছিল। আরেকবার 'পাই' হঠাৎ করে উড়ন্ত মাছের ঝড়ে পড়েছিল। চারদিক থেকে ছুটে আসা উড়ন্ত মাছগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল, অসীম গতিতে ছুটে আসা অসংখ্য তীর, চক্রাকারে ঘুরছে আর আছড়ে আছড়ে পড়ছে। এই ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে  আত্মরক্ষার নিষ্ফল চেষ্টার পাশাপাশি  কিশোর 'পাই' সৃষ্টির এই অসম্ভব সৌন্দর্য্যটুকু উপভোগ করতে ছাড়ে নি।

কিশোর 'পাই' যা কিছু করেছে, তার সবটুকুই সিনেমা, মোটামুটি অবাস্তব ঘটনা মনে হওয়া স্বাভাবিক। তবে অসম্ভব কিছু নয়, মানুষ পারে না, এমন কোন কাজ নেই। দিল্লীর জ্যোতি বা দামিনী নামের সেই মেয়েটি 'লাইফ অফ পাই' দেখেই  সিনেমা হল থেকে বের হয়েছিল সেদিন। বাকীটুকু কুৎসিত ইতিহাস হয়ে গেছে। এইসব কথাই ভাবছিলাম বসে বসে। সাথে এও ভাবছিলাম, আমি যদি অমন মাঝ সমুদ্রে পড়ি আর দেখি, পাশ দিয়ে তিমি যাচ্ছে, কেমন হবে ব্যাপারটি! সাঁতার জানিনা, এমন ঘটার সম্ভাবণা একেবারেই নেই, সমুদ্রে নেমে কোমড় জলে দাঁড়িয়ে জলকেলি করি, ওপাশ থেকে বিরাট ঢেউ আসতে দেখলেই ' বাবাগো, মাগো' বলে উলটো দিকে দৌড় দেই। পায়ের নীচের ভেজা বালিতে পা ঢুকে দড়াম করে আছাড় খাই, নোনাজলে নাক-মুখ-গলা ডুবে যায়, ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে নাক ঝাড়ি, খক খক করে কাশতে থাকি, মুখের ভেতর ঢুকে যাওয়া নোনাবালি জল থু থু করে বের করতে করতে আরেক ঢেউয়ের ধাক্কায় দ্বিতীয়বার উলটে পড়ি। সেই আমি বসে বসে কল্পনা করি, 'পাই' এর মত অবস্থায় পড়লে আমার কী হবে! সেই কল্পনা থেকেই স্বপ্ন দেখেছি। গভীর ঘুমে 'তিমি' মাছ দেখি। স্বপ্ন বিশারদরা হয়তো বলতে পারবেন, 'তিমি মাছ' স্বপ্নে দেখলে তিমির মত বিশাল  সাইজের সম্পত্তি পাওয়া যাবে নাকি তিমির লেজের  ঝাপটা কপালে জুটবে! কোনটা ভাগ্যে আছে জানি না। তবে একটা মজার কাহিণী মনে পড়ে গেছে।

'৯৬ সালের ডিসেম্বারে আমরা অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে বেড়াতে গেছিলাম। আমরা মানে, আমি, আমার স্বামী, দুই মেয়ে মৌটুসী আর মিশা। আমরা তখন মেলবোর্ণে থাকতাম, সিডণিতে আমাদের এক বন্ধুর আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম, দিন সাতেকের জন্য। আমরা এবং আমাদের আর দুই বন্ধু গেছি। সকলেই পরিবার নিয়েই গেছিলাম। আমার খুব কাছের বন্ধু ছিল সাথী। খুব প্রাণবন্ত মেয়ে, সব সময় ওর সাথে খুব মজা করতাম। ওর জন্ম কলকাতায় হলেও ওর বাবা-মা দুজনেই পূর্ববঙ্গের লোক ছিলেন। তার উপর ওর বাবা ছিলেন স্বদেশী। ফলে  বাঙালদের প্রতি ওর সব সময় দূর্বলতা ছিল। ওর বর 'সঞ্জয়'দাও বাঙ্গাল। ওদের  আড়াই বছর বয়সী একটা মাত্র মেয়ে সঙ্গীতা। ওরা দুজনই আমাদেরকে খুব ভালোবাসতো। আমার স্বামীকে ওরা বড় দাদার মত মান্য করতো। মূল কথায় আসি।  সাথী আমার সাথে খুব ঠাট্টা ইয়ার্কী করতো, ওর বাঙাল স্বামীকে ক্ষেপাত বাঙালপণার জন্য।  আমরা প্রায় প্রতিদিন একজন আরেকজনের বাড়ীতে হাজিরা দিতাম। একসাথে খাওয়া দাওয়া করতাম। মনের কথা খুলে বলতাম।

তা সেবার সিডণীতে সাথী আর সঞ্জয়'দাও গিয়েছিল। সিডণীতে কত কিছু দেখার আছে! সব কিছু ঘুরে দেখতে গেলে দুই মাস সময় লাগার কথা। সাতদিনে আর কী হয়!  তাই  সিডণীতে গিয়ে সব কিছু দেখা হয় নি। তবে অনেক কিছুই দেখেছি যা নয়ন সার্থক হয়ে আছে। আমরা  উঠেছিলাম কমল'দার বাড়ীতে, আর সাথীরা উঠেছিল ওদের পরিচিত কারো ফ্ল্যাটে। খালিই পড়েছিল ফ্ল্যাট, সেখানে ওরা থেকেছে আর আমাদের সাথে একসাথেই ঘুরেছে।

কমল'দা আর বৌদি খুব আদর যত্ন করেছেন। আমরা আর সাথীরা নিজেদের মত করে ঘুরেছি, কখনও কমলদা'কে সাথে নিয়ে গেছি। কমলদা ব্যস্ত মানুষ, সব সময় আমাদের সাথে যেতে পারেন নি, মাঝে মাঝে গেছেন।  একদিন গেছি থ্রী সিস্টারস দেখতে, কমলদা'ও আমাদের সাথে গেছেন। উনার গাড়ীতে চড়েই আমরা গেছিলাম। থ্রী সিস্টারস (তিন পাহাড়ের চূড়া এক সারিতে, সে এক নয়ণাভিরাম দৃশ্য) দেখা শেষ হতে কমল'দা জানতে চাইলেন, 'আই ম্যাক্স' মুভী দেখবো কিনা!

'আই ম্যাক্স' মুভী কী জিনিস, আমি জানতাম না। টিকিটের দাম ১২ ডলার। আমার মাথা ঘুরে গেছে। স্বামীকে  ফিসফিসিয়ে বলি,

 " কী দরকার, এইসব আই ম্যাক্স দেখে, চারজনে ১২x ৪ = ৪৮ ডলার খরচ করে এক ঘন্টার সিনেমা দেখার চেয়ে চলো আর কোথাও ঘুরে আসি"!

আমার স্বামী আবার দিলদরিয়া মানুষ, বললেন,

-আই ম্যাক্সও দেখবো, আরও কোথাওও ঘুরবো। চিন্তা নেই, টাকা পয়সা থাকে কিসের জন্য, একজায়গায় বেড়াতে  এসেছো, দেখে নাও নতুন নতুন জিনিস। ৫০ ডলার কোন ব্যাপার না। আর শোন, আই ম্যাক্স মানে থ্রি ডি ছবি। যা দেখাবে, মনে হবে তোমার সামনেই সব ঘটছে। আমি অনেকবার দেখেছি, তোমাদের দেখা হয় নি, আজ দেখবে।"

তর্ক করে লাভ নেই জেনে সিনেমা হলে ঢুকে গেলাম। ছবিটা ছিল ' দ্য হোয়েইল' অর্থাৎ 'তিমিমাছ'।  হলে ঢোকার আগেই চোখে পড়তে হয়েছে বিশেষ চশমা। চশমা পড়তে গিয়েই বুঝেছি, ব্যাপার গুরুতর। সাথে ছিল দুই মেয়ে মৌটুসী আর মিশা।  সাথীর সাথে  ছিল ওর আড়াই বছরের মেয়ে সঙ্গীতা। সিনেমা শুরু হয়ে গেলো। আরে! ট্রেইলারে এসব কী দেখাচ্ছে! থ্রী সিস্টারস দেখাচ্ছে। একটু আগেই দূরবীণে চোখ রেখে দেখে এসেছি, এখন দেখি পাহাড়ের চূড়ায় বসে আছি! হ্যাঁ, এমনই দেখাচ্ছিল, হঠাৎ করেই এক চীৎকার দিলাম আমি। ট্রেইলারে 'সাপ' দেখিয়েছে, আমার সাপ ফোবিয়া আছে, সেই সাপ দেখি আমার পাশে! আমার এক পাশে বসা আমার স্বামী, আরেক পাশে সাথী। দুজনেই জানে আমার ফোবিয়ার কথা। দুদিক থেকে দুজনে আমাকে জাপটে ধরে সাহস দিচ্ছে,

" এই তো শেষ হয়ে গেছে, আর দেখাচ্ছে না। তাকাও , তাকাও, আমাদের সিনেমাতে সাপ দেখাবে না, ওটা ছিল পরের শো'য়ের ট্রেলার। "

আমি তখন থরথর করে কাঁপছি, স্বামী বেচারা অপ্রস্তুত। শুরু হয়ে গেছে 'দ্য হোয়েইল'। সমুদ্রের গর্জন শুনে মুখ তুলেছি, বিশাল এক ধাক্কা খেলাম সমুদ্রের পাগলা ঢেউয়ের। একেবারে আমার উপর এসে আছড়ে পড়েছে ঢেউ! চেয়ারের হাতল শক্ত করে চেপে ধরেছি। চারদিক থেকে বাচ্চাদের চীৎকার, সবাই ভয় পেয়েছে। কয়েক সেকেন্ড পরেই 'তিমি মহারাজ' দেখা দিলেন। উফ! সে কী দৃশ্য! ততক্ষণে আমি ধাতস্থ হয়ে গেছি, কিন্তু এবার  সাথী  ভয় পেয়েছে।  মৌটুসী বা মিশা, কেউ ভয় পাচ্ছিল না,  শুধু আমি, সাথী আর পিচ্চী সঙ্গীতা ভয় পেয়েছি। মিনিট পাঁচেক তিমির তান্ডব দেখে হাত পায়ের খিল খুলতে শুরু করেছে, এর মধ্যেই তিমির নাক মুখ দিয়ে জল ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু হয়েছে। কী ভীষন আওয়াজ! কিছুক্ষণ পরেই টের পেলাম, সাথী খিল খিল করে হাসছে। কী ব্যাপার! তিমি জল ছুঁড়ছে, এতে হাসির কী আছে! প্রশ্ন করার আগেই সাথী আমাকে ডেকে কানে কানে বলছে,

" ও মিঠু, তিমির জল ছোঁড়ার আওয়াজটা শোন, আমার বাঙাল বরটা ঠিক এভাবেই নাক ডাকে।"

আমি সিনেমা দেখবো কি, সাথীর কথা শুনে ওর চাইতেও বেশী জোরে হাসতে শুরু করেছি। আমি হাসি, সাথীও হাসে। আড়চোখে সঞ্জয়'দার দিকে তাকাতেই 'দাদা' প্রশ্ন নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে দেখলাম। সাথী আমাকে হাতে টিপ দিয়ে বলে,

" ওকে কিছু বলোনা, ও মাইন্ড করবে। কিন্তু বিশ্বাস করো, ও যখন ঘুমের মধ্যে নাক ডাকে, ঠিক এমন আওয়াজ হয়, একেবারে তিমি মাছের জল ছোঁড়ার মত আওয়াজ।"

এরপরের অংশটুকু আর ভালোভাবে দেখতেই পারলাম না। দুই সখী মিলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি। কী করবো, বারবার তিমিমাছের কান্ডকীর্তি দেখি আর সঞ্জয়'দার নাসিকা গর্জণ শুনি। সিনেমা দেখা শেষ হতেও আমাদের হাসি থামে না। দুইদিন পরেই আমরা সিডনী থেকে রওণা হয়েছি মেলবোর্ণের পথে। মাঝখানে ক্যানবেরা থেমেছি, আরেক বন্ধুর বাড়ীতে। আমরা আর সাথীরা। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিচ্ছিলাম, সঞ্জয়'দা বেশী রাত জাগতে পারেন না, ঘুমাতে চলে গেছেন। আমরা গল্প করছি, হঠাৎ করেই শুনতে পেলাম, হুইসলের মত আওয়াজ। শুরুটা তীব্র হুইসলের মত, এরপরেই ভররররররর ফুস!!!!!!!!!! একেবারে অচেনা, এমন আওয়াজ জীবনে কোনদিন শুনিনি, সকলেই সচকিত হয়ে গেলাম। সাথী হাসতে শুরু করেছে, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। প্রথমে বুঝিনি, সাথী নিজেকে সামলে শুধু বলতে পারলো,

-মিঠু, বলছিলাম না, তিমি মাছের গর্জণ! এইবার শোন, ঘরের ভেতর তিমিমাছের ডাক শোন!

আমাদের বন্ধু তো আর কিছুই জানে না, তবে সঞ্জয়'দার নাক ডাকার আওয়াজ শুনে সকলেই আশ্চর্য্য হয়ে গেছে। আমার স্বামী খুবই ভদ্র, সেই ভদ্রমানুষটিও নিজেকে সামলাতে পারলেন না। আমাদের হাসিতে শামিল হলেন, তবে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন। সাথীকে বললেন,

" সাথী, সঞ্জয়ের তো নাকের ভেতর সমস্যা আছে। ডাক্তার দেখাও। নাকের ভেতর হাড় বড় হলে অথবা কোন পলিপ থাকলেও এমন হতে পারে। ব্যাপারটা বেশ গুরুতর মনে হচ্ছে। স্বাভাবিক নাক ডাকার মত আওয়াজ মনে হচ্ছে না।"

-দাদা, আমি তো সিনেমা হলে বসেই টের পেয়েছি, এই আওয়াজটা শুধু মাত্র তিমি মাছেরা করতে পারে, আর পারে আমার বর। হি হি হি হি!!!!

-যাহ! এসব কি কথা! এবার মেলবোর্ণ ফিরেই ডাক্তার দেখাবে।

সাথী এবার আমার হাত ধরে টেনে উঠালো। বললো,

-চলো, তোমারে দেখায়ে আনি।

আমি বলি, " দূর! সঞ্জয়'দা যদি দেখে ফেলে, তার বউয়ের সাথে সাথে আমিও উনাকে নিয়ে ঠাট্টা করছি, উনি মনে খুব কষ্ট পাবে।

-চল না, পা টিপে টিপে চল, দেখবা কিভাবে শ্বাস টানে।

এবার আমার বর সাথীকে এক বকা দিল, " সাথী, যাহ! এমন দুষ্টামী করা ঠিক না। তুমি গিয়ে ওকে পাশ ফিরিয়ে দাও, ঠিক হয়ে যাবে।

*** সাথীর কান্ড কারখানা এমনই। খুব প্রাণবন্ত মেয়ে এই সাথী, ওর বর সঞ্জয়'দাও জানে, সাথী ওর বাঙাল বরটাকে কত ভালোবাসে! ইচ্ছে করে 'বাঙাল' বলে ক্ষ্যাপায় আর  বাঙাল বরকে নিয়ে খুব গর্ব করে বেড়ায়।

Wednesday, January 23, 2013

গেরস্ত সংবাদ (২)

 আমার উত্তম কুমারের সাথে প্রথম সাক্ষাতের দিনটি যদি স্মরণ করি, এখনও চোখের সামনে দেখতে পাই ' আমেরিকা ফেরত আধুনিক রাজকুমার' কে। প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা, টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ, মেদহীন ছিপছিপে গড়ণের রাজকুমারকে দেখেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছিল। রাজকুমার  নিজ সিদ্ধান্তে আমাকে বিয়ে করে ফেললো। আমিও নিজ সিদ্ধান্তে তাকে 'উত্তম কুমার' এর স্বীকৃতি দিয়ে দিলাম। উত্তম কুমার ছিল আমার স্বপ্নপুরুষ,  না-ইবা হলাম সুচিত্রা সেন,  উত্তম কুমারকে পাশে পেয়ে তখন নিজেকে সুচিত্রা সেনের চেয়েও এক ডিগ্রী বেশী ভাবতে শুরু করে কিছু ভুল করেছি বলে মনে হয় নি। সেই উত্তম কুমারকে নিয়ে ভালোয়-মন্দয় ( ভালোর ভাগ বেশী) সাতাশ বছর কাটিয়ে দিলাম।

সাতাশ বছরে সেদিনের রাজকুমারের চেহারায় অনেক পরিবর্তণ এসেছে। ছিপছিপে গড়ন ফিকে হয়ে গিয়ে পেটে এসে বাসা বেঁধেছে কিছু স্নেহ জাতীয় পদার্থ। ফলে প্রায় ছয় ফিট মানুষটিকে এখন যেনো আর ছয় ফিট মনে হয় না! গায়ের রঙ বেশ তামাটে হয়ে গেছে। ভাগ্যিস রাণীমা ( আমার শাশুড়ী মা) বেঁচে নেই, নাহলে  ছোট রাজকুমারকে দেখে উনি খুবই দুঃখ পেতেন। হয়তো বা সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপাতেন। বলতেন,

" মিঠু গো, আমার ছেলেটার দিকে তোমার কোন খেয়াল নাই। এমন রাজপুত্রের চেহারা ছিল আমার ছেলের,  চোখের সামনে নষ্ট হয়ে গেলো সব। তুমি নিশ্চয়ই ছেলেকে ' ব্যালান্সড ডায়েট দাও না'। ইদানিং তো শুনি, কত রকমের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দাবারের কথা বলে টিভিতে, তুমি কী সেটাও খেয়াল করো না?"

আমি বৌ মানুষ তো আর রাণীমার মুখে মুখে তর্ক করতে পারতাম না। ঝগড়াটে বৌ হলে হয়তো বলতাম,

" রাণীমা, আমার দোষটাই দেখলেন! আপনি কী জানেন যে আপনার রাজপুত্র ডিপার্টমেন্ট থেকে বাড়ী ফিরেই তার সিংহাসনে গিয়ে বেশ জাঁকিয়ে বসে! সিংহাসনের আশেপাশে তার সব কিছু রাখা আছে। টিভির রিমোট কন্ট্রোল, কফি মাগ, বাদাম ভর্তি বোয়াম, মুড়িভাজা ভর্তি টিন, চকোলেটসহ তার প্রিয় যাবতীয় জিনিসে ঠাসা হয়ে আছে সিংহাসনের চারিপাশ। ল্যাপটপটাও সাথেই রেখেছে। আগে আমি অনেক বলেছি, জিমে যেতে। আপনি তো জানেন না, ইউনিভার্সিটির জিমটা কী ভালো।  ছয় বছর আগে যাও বা জিমে নাম লিখিয়েছিল, সেখানে গিয়ে সে এক বুড়া প্রফেসারের সাথে গল্প জুড়ে দিত। কাজের কাজ কিছুই করতো না। এদিকে আবার ঠাট-বাট ছিল, একসারসাইজ করার উপযোগী টিশার্ট, ট্রাউজার, রানার শু ( বাংলাদেশে যেগুলোকে কেডস বলে), সবকিছু কিনে এনেছিল।  জোর করে পাঠাতে হতো জিমে, এইজন্য আমাকে সে 'ক্যাটক্যাটানি' বলতো। আপনিই বলেন,  আমি তার ভালোর জন্য বলতাম, আর সে আমাকে নাম দিয়েছে ক্যাটক্যাটানি! আমার শ্বশুরমশাই যদি আপনাকে এই নামে ডাকতেন, আপনার কেমন লাগতো! আপনি নিশ্চয়ই উনার উপর অভিমান করে সব কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতেন! আমিও তাই করেছি। কোনরকম ক্যাটর ক্যাটর করি না। জিমে গিয়ে যেটুকু মেদ ঝরেছিল, গত চার বছরে তা সুদে আসলে দ্বিগুণ হয়ে ফিরে এসেছে। যদি আমার কথা বলেন, আমি কিন্তু রান্না বান্না ভালই করি। খাবারের মেন্যুতে শাক-সব্জী তো থাকেই।  তা শাক-সব্জী আবার উনার তেমন পছন্দ হয় না। ডাল, মাছ, মাংস হলে খুব খুশী।   রাণীমা, আরেকটি কথা বলি, আপনার রাজকুমার যখন যুবক ছিল, তখন ভাত খেতে চাইতো না, রুটি বেশী পছন্দ করতো।  কিন্তু ইদানিং  সে আটার রুটি পছন্দ করে না, রুটি থাকলেও সে ভাত খায়। আমি যদি  তিনজনের  জন্য ছয়খানা রুটি বানাই, আপনার পুত্র খায় মাত্র একখানা রুটি। ডিম খেতে হলে সেটাকে তেলে ভেজে খাবে, জল পোচ করে দিতে চাইলে, খাবেনা। রুটির বদলে যদি পরোটা বানায়ে দেই, তাহলে খাবে, সাথে চীজ ভর্তি ডিম ভাজা।  আগে ফলমূল খেতে পছন্দ করতো, এখন তার ধারে কাছে দিয়েও যায় না। তাহলে  এবার বলুন, কার দোষ বেশী"!


হ্যাঁ, আমার উত্তমের শরীরটা ইদানিং একটু ভারীর দিকেই যাচ্ছে। খুব শৌখিন এবং আরামপ্রিয় মানুষ উনি। আমাদের লিভিং রুমের এককোণে একখানি আরামদায়ক সোফা আছে।  সেই সোফাতেই তিনি দিনের অর্ধেকের বেশী সময় কাটিয়ে থাকেন। সোফাতে বসে টিভিও দেখেন, লেখালেখিও করে্ন।  টিভি সারাক্ষণ অন করাই থাকে। সিএনএন, বিবিসি, এবিসি, বাংলা সাতটি চ্যানেল  আছে টিভিতে। গত তিন বছর ধরেই চলছে তার এই আরাম-বিলাস।  আরামের সাথে যোগ হয়েছে 'ব্যারাম'। যেমন, সে চায়ের কাপে বিস্কুট না চুবিয়ে খেতে পারে না।  বিস্কুট চায়ে ভিজিয়ে অনেকেই খায়। এটা তেমন নিন্দনীয় কিছু নয়, ব্যারাম হচ্ছে, চায়ে ভেজানো বিস্কুট মুখে তোলার আগেই টপ টপ করে মেঝের কার্পেটের উপর পড়ে। চায়ে ভেজানো বিস্কুটের দাগে কার্পেটের একপাশ বিচিত্রবর্ণ ধারণ করেছে।  দেশে থাকতে আম খাওয়ার সময় একই চিত্র দেখা যেতো। মায়ের রাজপুত্র আম খাচ্ছেন, হাত বেয়ে আমের রসে চারদিক আঠা হচ্ছে!  মায়ের সর্বশেষ সন্তান বলেই এমন 'নাড়ু গোপাল' হয়েছে বোধ হয়!

এই আরাম কেদারায় বসা থাওকতে থাকতেই গত বছর জানুয়ারীতে তার লেখা একটি টেক্সট বই ( ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স)   ইংল্যান্ড থেকে পাবলিশড হয়েছে, এ বছর আরেকটি বই আমেরিকা থেকেই পাবলিশড হবে। বই লেখা নাকি খুবই জটিল কাজ, একমনে বসে লিখতে হয়। লেখার সময় বৌ, ছেলেপেলে এসে জ্বালাতন করলে লেখা এগোয় না। তাই আমরাও কোনদিন তাকে জ্বালাতন করিনি। সে বসে থাকে সোফার গভীরে, আমি বসে থাকি কম্পিউটার চেয়ারে। আমার চেয়ারটি আবার খটখটে শক্ত।  লেখায় মন বসাতে পারি না, পিঠে ব্যথা পাই। তাই বোধ হয় আমার লেখা এগোয় না। তবে আমি খুবই বুঝদার মানুষ। উত্তম আমাকে আগের মত সময় দিতে পারছে না বলে রাগ করি না, তবে মনে মনে ফন্দী আঁটি, কী করে উত্তমকে একটু টাইট দেয়া যায়! দুইদিন আগেই টাইট দেয়ার কায়দা পেয়ে গেছি।

আগেই বলেছি, আমি উত্তমের সাথে বেশী কথা বলে তাকে বিরক্ত করি না। তবে মাঝে মাঝে  তাকে নিয়ে দুই একটা বন্ধুর বাড়ী বেড়াতে যাই, তারও ভালোই লাগে সেখানে গিয়ে। শিক্ষক মানুষ, কথা বলতে জানে খুব ভালো।  সেখানে গিয়েও সে টিভিতে দেখা নানা অনুষ্ঠানের গল্প জুড়ে দেয়। সেই গল্প ওবামাকে নিয়েও হতে পারে, উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেনকে নিয়েও হতে পারে। মাঝে মাঝে ক্লিন্টনকেও ডাকে, ডঃ ইউনূসকে টানে। প্রায়ই দেখি ইটিভিতে দেখানো নানা নাটকের দৃশ্য বর্ণনা করে। বুঝি, টিভি তার বেশ ভালোই দেখা হয়। গত সপ্তাহে সে একটি ভিন্ন অনুষ্ঠানের কথা বলতেই আমি কান সজাগ করে ফেলেছি। কোন এক সেলেব্রিটিকে টিভিতে  স্বাস্থ্যকথায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এক জনপ্রিয় ডাক্তার 'ওজি' সেই অনুষ্ঠানের হোস্ট ছিলেন।   অনুষ্ঠানে দেহ থেকে  কী করে 'বেলী ফ্যাট' ঝরানো যায়, দর্শক-শ্রোতার মঙ্গলের কথা ভেবে ডাক্তার ওজি একটি ডায়েট চার্ট করে দিয়েছেন,

ব্রেকফাস্টে একখানা ডিম পোচ + এক কাপ দই
লাঞ্চে স্যালাড
আর্লি ডিনারঃ যাহা খুশী তাহা, তবে কার্বোহাইড্রেট কম।

পর পর দুই দিন  বন্ধুদের সাথে এই গল্প আমি তাকে করতে শুনেছি, পেয়ে গেছি সুযোগ। এত উৎসাহ নিয়ে যখন ডাক্তারের গল্প বলছে, তখন নিজেদের উপর এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে দেখি, কেমন হয়!  আমি সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছি না, এভাবে খাওয়া দাওয়া করলে আমাদের দেহ থেকে অতিরিক্ত স্নেহ ঝরে পড়বে। দেখতেও ফিট থাকবো, অসুখ-বিসুখও কম হবে।

আমার কিচেনের খাদ্যভান্ডারে মাছ, মাংস, সব্জী বারো মাসই মজুত থাকে। এলোমেলোভাবে  খাওয়া হয়, ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ মোতাবেক খাওয়া হয় না। অনেক আগে  মেয়েরা যখন ছোট ছিল, আমিই ছিলাম সংসারের একমাত্র দন্ডমুন্ডের কর্ত্রী, তখন অনেক হেলথি ডায়েট চলতো আমার তত্বাবধানে। মেয়েরা বড় হতে তারাও মাতব্বর হয়ে উঠলো, বাবা পেয়ে গেলো মেয়েদেরকে, মেয়েরা পেলো বাবা কে। চোরে চোরে মামাত ভাইয়ের মত অবস্থা। আমি হয়ে গেলাম কোণঠাসা। শুধু ছোট মিথীলা আমার পক্ষে আছে। কোণঠাসা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পেয়ে গতকালকেই আমি 'স্যালাড' এর জন্য বোনলেস চিকেন, কেইজ ফ্রী ডিম, লেটুস, টমেটো, শসা, লেবু, কমলা, আপেল, অ্যাভোকাডো, বেকড কটকটে ঝুরিভাজা কিনে এনেছি। আজ দুপুর বারোটায় আমার কাজের স্কেজিউল, ঘুম থেকে দেরী করে উঠবো বুঝেই কাল রাতেই চিকেন বেক করে রেখেছি। সকাল হতেই লেটুস, শসা, টমেটো কেটে সাজিয়ে রেখেছিলাম। মেয়োনিজের বদলে টক দই, লেবুর টুকরো রেখেছি। এভোকেডো ( এক ধরণের স্বাদহীন সব্জী বা ফল) টুকরো করে টমে্টোর পাশেই রেখেছি। নিজের জন্য স্যালাড সাজিয়ে নিয়ে গেছি। তাড়াহুড়ো করে রওণা দিয়েছি কাজে, পথে অনেক বড় ধরণের বিপত্তি ঘটেছে। সে অন্য গল্প, পরে বলা যাবে। রাত আটটায় বাড়ী ফিরে ভয়ে ভয়ে উত্তমকে জিজ্ঞেস করেছি, স্যালাড কেমন হয়েছিল। বলেছে,

" বেশ ভালো হয়েছে"।

ঐ পাশ থেকে মিথীলাও বলেছে, " স্যালাড খুব ভালো হয়েছে।"  আমি বললাম, তাহলে চলো, ডিনার করে ফেলি। জবাব এলো,

" আমি তো আর্লি ডিনার করে ফেলেছি"।

-বাবারে! তুমি তো দেখি ডঃ ওজির পরামর্শ শতভাগ মেনে চলছো। বৌ এত কষ্ট করে সব রেডী করলো আর বৌ এর জন্য একটু অপেক্ষা করতে পারলে না!!

-ঠিকমত ফলো না করলে তো রেজাল্ট পাওয়া যাবে না। তুমি এত কসরৎ করছো আমাকে স্লিম বানানোর জন্য, আমার তো উচিৎ তোমাকে সহযোগীতা করা। তাছাড়া দুপুরে এতগুলো ঘাস-পাতা খেয়ে সন্ধ্যে না হতেই খিদে পেয়ে গেছিল।

-খুব ভালো কাজ করেছো। একমাস অন্তঃত চলতে হবে এই নিয়মে, তবেই বুঝবো টিভি দেখার সার্থকতা কতটুকু!

Tuesday, January 22, 2013

কো-ইনসিডেন্স!

 আমার তিন মেয়ে তিন স্টেটের তিন শহরে  থাকে,  বড় দুই মেয়ে আমাদের কাছ থেকে দূরে থাকলেও ছোট মেয়ে আমাদের সাথে আছে। আজ ছিল মার্টিন লুথার কিং ডে!  কাকতালীয়ভাবে  তিনজনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই আজ ছুটি ছিল। আমার স্বামী অধ্যাপনা করেন, তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ছুটি ছিল। বাকী রইলাম আমি। আমি চাকুরী করি ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টারে। এখানে কখনওই সরকারী ছুটির নিয়মে ছুটি হয় না, এমনকি রেগুলার উইকএন্ড বলেও কিছু নেই।  ওয়ালমার্টের নিজস্ব শিডিউল জেনারেটিং সিস্টেমে সকলের  জন্য সপ্তাহে দুইদিন অফ ডে নির্ধারিত হয়। সেই অটো স্কেজিউল (শিডিউল) জেনারেটিং সিস্টেমে  আজকের দিনটি আমার অফ ডে হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে তিন সপ্তাহ আগে। আমার ছোট মেয়ে আমাদের সাথে আছে।  তাই মার্টিন লুথার কিং ডে'তে আমাদের তিনজনের ছুটি পাওয়া, এটা একটি কো-ইনসিডেন্স ছাড়া আর কিছুই না।

যেহেতু  কাকতালীয়ভাবে আমাদের তিনজন একসাথে ছুটি পেয়েছি, চেষ্টা করেছি দিনটিকে উপভোগ করার জন্য। অনেক আগে যখন তিন মেয়েই আমাদের সাথে ছিল, আমিও চাকুরী করতাম না, তখন প্রায়ই আমরা পাঁচজনে মিলে আউটিং-এ চলে যেতাম। দুই বা তিন দিনের ছুটিতে চলে যেতাম অন্য কোন স্টেটে, সমুদ্র সৈকতে। সমুদ্র আমার ভীষন প্রিয়। সাঁতার জানিনা, তবুও সমুদ্র আমায় টানে। দুই মেয়ে পড়াশোনার কারণে এখন অনেক দূরে থাকে, তাই আগের মত আর বেড়ানো হয় না। ছোট মেয়েটি কিছুটা নিঃসঙ্গভাবে বড় হচ্ছে। কী মনে হতেই আজ বেড়িয়ে পড়েছিলাম শহর থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরের এক রিসর্টে।

 রিসর্টের নাম ' লেক টিয়াকু খাতা'। ভারী সুন্দর এই রিসর্টটি। একটি লেক, তার চারিপাশের সবুজ গাছপালা, লেকের উপর ঘুরে বেড়ানো রাজহাঁসের ঝাঁক, লেকের পাড়ে ভ্রাম্যমান বাড়ী, রেস্টুরেন্ট, সে এক মনোরম পরিবেশ! ওখানে পৌঁছেই মন ভালো হয়ে গেলো। গাড়ী থেকে নামতেই শীতের কনকনে হাওয়ায় দাঁতে দাঁত লেগে ঠকঠক করছিলো, তবুও ভালো লাগছিল। আজকে আকাশ ছিল ঝকঝকে পরিষ্কার। মেয়ে মিথীলাকে নিয়ে লেকের ধার ঘেঁষে হাঁটি, নানা পোজে ছবি তুলি, রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুঁ মেরে দেখি, এমনই সব এলোমেলো খেলা চলছিল মা আর মেয়েতে। মেয়ের বাবা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থেকে প্রকৃতি উপভোগ করছিলেন। আমার ছোট মেয়েটা একা থেকে থেকে একটু শান্তই হয়ে গেছে। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অশান্ত করার চেষ্টা করছিলাম। বললাম,

-সামারে আমরা আবার আসবো। নাহলে মাসখানেক পরেই আবার আসবো, তখন ঘরের থেকেই খাবার নিয়ে আসবো। এখানে নিজের পছন্দমত জায়গায় বসে খাবার খাব।

-হ্যাঁ, রাইস কুকার নিয়ে এসো, আলু সেদ্ধ, ডিম সেদ্ধ আর ভাত রান্না করতে পারবে ( হি হি হি হি)!

-মিথীলা, তুই এত ফাজিল হয়ে গেছিস? রাইস কুকার আনবো কেনো? আমি কী স্যান্ডুইচ বানাতে জানিনা?

-তুমি তো ভাত ছাড়া কিছু খেতে ভালোবাসো না, তাই রাইস কুকারের কথা বলেছি। ( হি হি হি)

-ভালো হয়েছে, আমি বাঙ্গালী মানুষ, ভাত পছন্দ করি।

-স্যান্ডুইচ কিন্তু আমি বানাবো।

-ঠিক আছে, বানাবি। ভালো করে বানাতে হবে, নাহলে খাব না।


ঘন্টাখানেক শীতের 'টিয়াকু খাতা' লেক রিসর্টে কাটিয়ে আবার পথে নামলাম। পরের গন্তব্য 'মেক্সিকান রেস্টুরেন্ট ' লা রোডেরো'। রাস্তার ধারেই রেস্টুরেন্ট, ঢুকে গেলাম। বেলা দুইটার পর আমেরিকান রেস্টুরেন্ট খোলা থাকেনা, ব্যতিক্রম শুধু চাইনীজ, মেক্সিকান আর ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টগুলো। 'লা রোডেরো' তে ঢুকে ভালোই লাগলো। স্বল্প পরিসরে বেশ ছিমছাম করে সাজানো। লাল শার্ট, কালো প্যান্ট পরিহিত মেক্সিকান যুবকেরা খাবারের অর্ডার নিচ্ছে, খাবার সার্ভ করছে। আমরা টেবিলে বসতেই একজন সুদর্শণ ছেলে এসে স্প্যানিশ অ্যাকসেন্টে  'হেলো' বলেই মেন্যু বুক ধরিয়ে দিল। এর বেশী ইংলিশ ওরা বলে না। 'হ্যালো, থ্যাঙ্ক ইউ আর বাই বাই' -এই তিনটি শব্দ দিয়েই ওরা ওদের ব্যবসা খুব ভালোভাবে চালাচ্ছে। ওরা ইংলিশ না জানলেও কাস্টমারকে খাবার খাইয়ে সন্তুষ্ট রাখে। প্লেটে খাবারের পরিমান এত বেশী থাকে যে কাস্টমার তার খাবারের বাকী অংশ প্যাকেট করে বাড়ী নিয়ে গিয়ে আরেকবেলা চালিয়ে দিতে পারে। ওখানে আমরা খাওয়া দাওয়া করলাম খুব তৃপ্তি নিয়ে। খাওয়া শেষ হতেই আবার পরবর্তী গন্তব্যের দিকে ছুটলাম। সারাপথ গাড়ীতে বাংলা গান বাজছিল, সিডি প্লেয়ারে। যেই মুহূর্তে ইন্দ্রানী সেনের কন্ঠে " আজ আবার সেই পথেই দেখা হয়ে গেলো" বাজছিল, মিথীলা বলে উঠেছে,

" এই একটা গান সারা পথ বাজছে, বার বারই একই গানই শুনছি"।
মিথীলা বাংলায় কথা বলে, তবে ওকে মাত্র দুই বছর বয়সে এখানে নিয়ে এসেছি বলে বিস্তারিত বাংলা শিখে উঠতে পারেনি। তাই বাংলা আধুনিক গানগুলোর সুর বা প্যাটার্ণ ওর কাছে একরকম মনে হয়। ওতো বাংলা গানের কথা ফলো করেনা, ব্যাপারটা আমার মাথায় আটকে গেলো। আমি ওকে বাংলা পড়তে শিখিয়েছিলাম, এক সময় ও খুব ভালোভাবে বাংলা পড়তে পারতো, নিজে নিজে লিখতেও শিখেছিল। অনভ্যাসে বিদ্যাহ্রাস হয়েছে। আমি এখন ওকে নিয়ে আর বসতে পারি না, তবে মাঝে মাঝেই পেছন পেছন ট্যাকর ট্যাকর করে যাই, " মিথীলা, একদিন তোকে ধরবো আমি, অনেক কষ্ট করে বাংলা পড়া শিখিয়েছিলাম, যদি ভুলে যাও, তোমার খবর করে ছাড়বো"। হুমকী শুনে হয়তো বা কোন একটা ছড়া ছবির বই বের করে পুরানো মুখস্ত ছড়া না দেখেই গড়গড়িয়ে পড়ে যায়। আমি সবই টের পাই, তাই হুমকী অব্যাহত রাখি। আজকে গান সম্পর্কে ওর মন্তব্য শুনে মন খারাপ হয়েছে। ভেবেছি, পরে ওকে বুঝিয়ে বলবো।

শাহীন-নিশো আমাদের সকলের কাছেই খুব প্রিয়। এই মুহূর্তে শাহীন তার পিএইচডি রিসার্চ পেপার নিয়ে ব্যস্ত, নিশো ব্যস্ত তার ইউএসএমএলই পার্ট টু পরীক্ষার প্রিপারেশান নিয়ে। অনেকদিন ওদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ নেই, আগে যখনই মন চাইতো, হয় ওরা চলে আসতো আমাদের বাড়ীতে, নাহয় আমরাই চলে যেতাম ওদের বাড়ীতে। লেক টিয়াকু খাতা যে পথ দিয়ে গেছি, সেই পথেই মিসিসিপি স্টেট ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস টাউনে ওরা থাকে। আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, বাড়ী ফেরার পথে ওদের সাথে দেখা করবো, ওদের বাড়ীতে এক কাপ চা খাব। যেই ভাবা সেই কাজ, পথে ওদের বাড়িতে নেমেছি। শাহীন-নিশো অতিথিপরায়ণ, আমাদের পেয়ে ওরা খুশী হয়েছে। প্রায় চার ঘন্টা ওদের সাথে আড্ডা দিয়ে  সন্ধ্যে সাড়ে  সাতটায় বাড়ীর দিকে রওনা হয়েছি।

গাড়ীতে তখনও একই গানের সিডি বাজছিল। ভালো গান বার বার শুনতে আমার ক্লান্তি আসে না বলেই সিডি পাল্টাই না। হঠাৎ করেই ' আজ আবার সেই পথে দেখা হয়ে গেলো" গানটি শুরু হতেই মিথীলাকে বললাম,

" মিথীলা, বিকেলে এই গানটি যখন বাজছিল, তুমি বলেছো, সারা পথেই নাকি একই গান বাজছিল। তার মানে তুমি গানের কথা বুঝো না, তাই সব গান শুনেই মনে করো, একই গান।

- আরে না, আমার মনে হয়েছে, কেমন যেনো একই টোনে গান বেজে চলেছে।

-ঠিক আছে, আমি তোমাকে আগেও বলেছি, একদিন তোমাকে ধরবো, এখন তুমি গানটা ভালো করে শোন, তারপর আমাকে বলো, গানটাতে কী বলছে।

-ওয়েল! একজন তার মেমরী থেকে বলছে, অনেক কিছু মনে পড়ছে।

-কে বলছে? কাকেই বা বলছে।

-প্রেমিককে কল্পনা করে বলছে ( ঠিক এই কথাটিই ও বলেছে)।

-ভালো করে শোনো, তারপর বলো।

মিথীলা বুঝে গেছে, আমার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে গানের কথাগুলো শুনতেই হবে। আমি হয়তো আগেই লিখেছি, আমি আমার মেয়েদের সাথে খুব ফ্রী, তাই তের বছরের মিথীলাকে অনায়াসেই এই গানের মানে জিজ্ঞেস করতে পেরেছি। মেয়ের বাবা অবশ্য আমার কান্ড কারখানায় মাঝে মাঝে ভড়কে যায়, আলতো প্রতিবাদও করে, " কী সব প্রশ্ন করো"? আমি বলি, " তবুও তো ভালো, আমি জানছি, মেয়েদেরকে আমি কী শেখাচ্ছি, আর স্কুলে গিয়ে যদি ভুলভাল শিখে আসে, কিছুইতো খবর রাখবো না। তার চেয়ে এই ভালো, ওদের সাথে খোলাখুলি কথা বললে ওরাও আমাদের কাছে ফ্রী হতে পারবে। আমাদের কথা ভাবো, বাবা মায়ের চোখের দিকে তাকাতে ভয় পেতাম, মা-বাবা বকবে ভয়ে জীবনে প্রেম করতে পারলাম না, জীবনের একটা অংশ অসম্পূর্ণ থেকে গেলো ( হা হা হা হা)"। এই হচ্ছি আমি। মিথীলা বলতে শুরু করেছে,

-একটা মেয়ে তার প্রেমিককে বলছে, ওদের পাস্টের অনেক গল্প মনে পড়ছে।

-কেনো, পাস্টের গল্প কেনো? গল্পগুলো মেমরী হয়ে গেলো কেনো?

-ওদের রিলেশান ব্রেক আপ হয়ে গেছে। কিন্তু ওরা এখনও বন্ধু আছে। এইজন্য বলেছে, ' বলো, ভালো আছোতো"?


মিথীলা, আমি খুব খুশী হয়েছি, আবার মন খারাপও করছি। তুমি এত ভালো বাংলা বুঝো, অথচ বাংলাটা প্র্যাকটিসই করছো না। আবারও বলি, বাংলা পড়া শুরু করো।

-মা, আমি যখন বন্ধুদের সামনেই তোমাদের সাথে ফোনে বাংলায় কথা বলি, ওরা খুব ফ্যাসিনেটেড হয়ে যায়। ওরা বাংলা শিখতে চায়। আমি ঠিক করেছি, একদিন বাংলা বই নিয়ে ওদেরকে দেখাবো, আমি তো বাংলা পড়তে পারি, তবে ফ্লুয়েন্টলী পারি না।

-মিথীলা, ঠিক আছে, এখন ফ্লুয়েন্টলী পারো না, কিন্তু যদি আমার কথামত প্র্যাকটিস করো, তাহলে পারবে।

-টুম্পা মাসী বলেছে, অনলাইনে গিয়ে বাংলা মিসট্রি পড়তে।

অনলাইনে যাওয়ার আগে একমাস তুমি এক প্যারা করে বাংলা গল্প পড়ো। আমি সিওর, একমাস পড়ে তুমি ফ্লুয়েন্টলী বাংলা পড়তে পারবে। তুমি তো এমনিতেই গল্পের বই পড়ো, প্রতিদিন তোমার গল্পের বই খোলার আগে বাংলা বই খুলে এক প্যারা পড়ে নিও। কোথাও আটকে গেলে মার্ক করে রেখো, আমাকে পরে দেখালে আমি বুঝিয়ে দেবো। আজ থেকেই শুরু করো।

-আজ থেকে!! কাল থেকে শুরু করি?

-নাহ! আজ থেকেই। কাল কখনও আসেনা মিথীলা। আজই শুরু করো। আজ কত তারিখ? ২১ তারিখ। ঠিক এক মাস পরে আরেক ২১ তারিখে----------
আরে!!!!!!!! মিথীলা, আরেক ২১ মানে তো ২১শে ফেব্রুয়ারী!

-ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে!

-হ্যাঁ তো!! আমাদের দেশ থেকেই তো মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে শুরু! তুমি ঠিক ২১শে ফেব্রুয়ারীতেই গড়গড়িয়ে বাংলা পড়তে শিখে যাবে????  তুমি বুঝতে পারছো, কিভাবে মিলে গেলো!!!!

-হ্যাঁ, একেবারে কোইনসিডেন্স!!!!!

Sunday, January 20, 2013

জাস্ট রি-ওয়াইন্ড দ্য টেপ!!

 আমাদের ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের পাশেই ইলেকট্রনিক ডিপার্টমেন্ট, অনেকটা গায়ে গায়ে লাগানো প্রতিবেশীর বাড়ীর মত। আমার সাইডে  আমরা পাঁচজনই মেয়ে।  ইলেকট্রনিকস এ মেয়েদের পাশাপাশি দুই জন ছেলেও কাজ করে, মুলতঃ ঐ দু'জন ছেলেই ইলেকট্রনিক্সের নাড়ী নক্ষত্র জানে।

কাজের সময় আমি বেশী কথা বলি না,  অবসরে সবার সাথে গল্প গুজব করি। আমি বাদে বাকী চারটি মেয়ের বয়স তিরিশের নীচে, কিন্তু ইলেকট্রনিক ডিপার্টমেন্টে সকলেই ত্রিশের উপরে বয়স, চল্লিশের উপর বয়সীও আছে দুই তিনজন।  ওদের মাঝে আমাকে মনে হয় মঙ্গল গ্রহ থেকে এসেছি। চেহারা, স্বভাব, ভাষা, সংস্কৃতি--সব কিছুতেই আমি ওদের  থেকে আলাদা। আমার ইংলিশ উচ্চারণে ওরা খুব মজা পায়, আমিও ওদের প্রশ্রয় দেই। ঠিক আছে করো, মজা করো। মিসিসিপির মানুষের আউটলুক খুব কম, ওরা মিসিসিপির বাইরে কিছু জানে না অথবা জানতেও চায় না। ওরা  আমার সব কিছুতেই খুব অবাক হয়, এমনকি যখন শোনে, আমাদের দাম্পত্য জীবনের বয়স সাতাশ বছর, একেবারে চোখ গোল করে ফেলে।  একজন মাত্র লোকের সাথে একটানা সাতাশ বছর ধরে কী করে সংসার করছি, এটা নিয়ে ওদের অনেক বিস্ময় আছে মনে। কত রকম প্রশ্ন করে আমাকে, " কখনও আমার স্বামীর সাথে ঝগড়া হয় কিনা" অথবা স্বামীকে লুকিয়ে আর কোন ছেলের সাথে প্রেম করেছি কিনা অথবা একই মানুষের সাথে ঘর করতে একঘেঁয়ে লাগে কিনা! খুব সরল মনে ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করে এসকল কথা। আমিও খুব আনন্দের সাথেই ওদের কথার জবাব দেই। ওরা খুব মজা পায়। আমাকে নিয়ে মজা করলেও  আমাকে  ওরা ভালোবাসে,  আর আমিও যখন ওদের মাঝে থাকি,  ওদের মত চলি। কখনও ভেতরের আমিকে প্রকাশ করিনা। ওদের সাথে সাথে হাসি, ওদের সব কথা না বুঝলেও মাথা দুলিয়ে 'হ্যাঁ' 'না' করে যাই। ওদের সবকথা না বুঝার একটাই কারণ, ওরা সাউদার্ণ ইংলিশ বলে, যা শুদ্ধ ইংলিশ থেকে অনেকটাই  আলাদা।।


ইলেকট্রনিকস এ জুলিয়া এবং টেরী নামে দুইজন এসোসিয়েটের সাথে আমার মাঝে মাঝেই পারিবারিক ঘটনা নিয়ে গল্প হয়। দুজনের সাথেই আমার বেশ খাতির আছে। ওরা দুজন আবার নিজেরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। টেরী হোয়াইট, চতুর্থ স্বামীর ঘর করছে, জুলিয়া ব্ল্যাক, একটি ছেলের মা, একা থাকে।  এই দুজন আজ আমাকে নিয়ে বসেছে। আজ ছিল রবিবার,  বেশ স্লো ছিল পুরোটা দিন। তাই কাজের ফাঁকে গল্প করা গেছে। ওরা জানতে চেয়েছে, আমার অফ ডে কবে। বলেছি, আগামীকাল আমার অফ ডে। সাথে সাথে প্রশ্নঃ

-রীটা, তুমি অফ ডে তে কী করো?
-সারাদিন ফেসবুক করি।
-হোয়াট! সারাদিন ফেসবুক করো? তোমার হাজব্যান্ডকে সময় দাও না?
-হাজব্যান্ড তো ইউনিভার্সিটিতে থাকে, সময় দিতে হলে আমাকে গিয়ে তার অফিসে বসে থাকতে হবে ।

দুজনেই হাসে। আবার জিজ্ঞেস করে,
-তুমি যে সারাদিন ফেসবুকে বসে থাকো, তোমার হাজব্যান্ড কিছু বলে না? স্পায়িং করে না?

এবার আমি হাসি। বলি,
-সাতাশ বছর ধরে সংসার করছি, তোমরাই তো বলো, এক মানুষের সাথে এত বছর ঘর করলে নাকি বোরিং লাগার কথা! হা হা হা! তা আমার হাজব্যান্ডেরও নিশ্চয়ই বোরিং লাগে একমুখ দেখে দেখে। হয়তো ভাবে, যাক গিয়ে,  বৌ যদি পারে আর কারো সাথে গুজুর গুজুর করতে, তাহলে আমি বেঁচে যাই ক্যাটক্যাটানির হাত থেকে। থাকুক ব্যস্ত ফেসবুক নিয়ে।

-তুমি কী  ঝগড়া করো তোমার হাজব্যান্ডের সাথে?

-না, আমি বা আমার হাজব্যান্ড, কেউই খুব ভালো ঝগড়া করতে পারি না। আমার হাজব্যান্ড তাও মাঝে মাঝে উল্টাপাল্টা কথা বলে ফেলে, আমি একেবারেই বলি না। তবে ইদানিং আমরা যার যার জগত নিয়ে থাকি। আমি থাকি ফেসবুক নিয়ে, আমার হাজব্যান্ড থাকে তার ল্যাপটপ নিয়ে। সে অবশ্য খুব টিভি দেখে, আমি টিভি দেখিনা।

-তোমার ছোট মেয়ে তাহলে অনেক একা হয়ে গেছে না?

-জুলিয়া শোন, আমার ছোট মেয়েটা খুব লক্ষ্মী, ও ছোটবেলা থেকেই খুব ইনডিপেন্ডেন্ট। একটাই দোষ, খুব স্লো। সবই করে, তবে সারা দিনমান লাগিয়ে করে। সেদিন আমার বড় মেয়েও আমাকে বলেছে, " মামনি, মিথীলার প্রতি একটু নজর দাও। বাবির প্রতি একটু নজর দাও। বাবি কেমন যেনো একা হয়ে যাচ্ছে! আমি বলেছি, " হুম! বাবির প্রতি নজর দেবো, মিথীলার প্রতি নজর দেবো, তা আমার প্রতি নজর কে দিবে?" মেয়ে বলে, " এতকাল তো তুমিই সবার দিকে নজর রেখেছো, তাই এটাই সকলের কাছে এক্সপেকটেড হয়ে গেছে"। আমি হেসে বলেছি, " এক্সকিউজ মি, এতকাল করেছি বলে বাকী কালও করে যেতে হবে, এমন কোন চুক্তিনামা সই করি নি। তোমরা কী করো? তোমরা ফোন করবে বাবাকে, বোনকে। আমি এখন আমার লেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। এক ফাঁকে রান্না বান্না, বাজার সদাই করি, চাকরী করি, বাকী সময় লেখি।

-রীটা, তোমার হাজব্যান্ড কী খেয়াল করেছে, তোমাকে ইদানিং খুব টায়ার্ড দেখায়? চোখের নীচে কালি পড়ছে!

-আমার হাজব্যান্ড জানে, আমি একটা আস্ত বাদাইম্যা। আমার ঘুমের কোন ঠিক নেই তো। সারারাত কম্পিউটারে বসে থাকি, ভোর চারটার দিকে বেডে যাই, আবার সকাল আটটায় উঠে পড়ি। প্রথম প্রথম একটু ভ্যানর ভ্যানর করতো, এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে।

-কাল তো মার্টিন লুথার কিং ডে, তোমাদের সকলের ছুটি, কালও তুমি ফেসবুকে থাকবে?
-না, কাল আমি আমাদের অতীতের কিছু সময়কে রি-ওয়াইন্ড করবো।
-মানে? বুঝলাম না।

-শোন, কয়েক বছর আগে আমাদের পরিবারটি ছিল পাঁচ সদস্যের। তিন কন্যা নিয়ে আমরা স্বামী-স্ত্রী।  আমরা পাঁচজনে মিলে অনেক মজা করেছি, অনেক ঘুরেছি। আমাদের কোন বন্ধু না হলেও চলে যেতো। এত বেড়িয়েছি পাঁচজনে একসাথে যে, ব্যাপারটি আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছিল। এরপর বড় দুই মেয়ে  পড়াশোনার কারণে দূরে চলে যেতেই আমরা একা হয়ে গেলাম। তাছাড়া 'মিড এজ ক্রাইসিস' বলে একটা কথা আছে। আমরা হয়তো বা ঐ ক্রাইসিস কাল পার করছি। আমাদের সাথে সাথে আমার ছোট মেয়েটা একটু হলেও সাফার করছে। তবে ওকে নিয়ে আমি চিন্তা করি না।

-কেনো, ওকে নিয়ে চিন্তা করো না কেন?

ওকে আমি সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, " মিথীলা, সেদিন তোমার দুই দিদি আমাকে বলেছে, তোমার পাপার দিকে একটু খেয়াল করতে, পাপা নাকি একা হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন একা থাকে।  তুমি তো  বলতে গেলে আমেরিকান হয়ে গেছো। আমেরিকানদের কালচার তুমি আমার চেয়েও ভালো জানো। তোমার দৃষ্টিতে বলো তো, তোমার মা-বাবা সম্পর্কে তোমার মূল্যায়ণ কি?

সে বলে, " মা, আমি একেবারেই আমেরিকান হই নি। সব সময় বাংলা কথা বলি, বাংলা খাবার খাই, আমি  পুরোপুরি আমেরিকান না। তোমরা তো ভালোই আছো, অ্যাট লিস্ট মারামারি তো করো না। একা একা থাকা তো খারাপ কিছু না। আমার বন্ধুদের মা-বাবারা তো অনেক বেশী অন্যরকম। আর দিদিরা ঠিক বলে নি। পাপা একা থাকে কারণ পাপা একা থাকা এনজয় করে। তোমার অনেক কষ্ট, তুমি তো একা থাকতে পারো না, তাই তোমার কষ্ট হচ্ছে।

আমি বলি, " তোমার বন্ধুদের মা বাবারা মারামারি করে"?

জবাব দিয়েছে, " আমার বন্ধুদের মা-বাবা করেনা, তবে এখানে মা-বাবারা ফাইট করে। তোমরা তো মারামারি করো না, জাস্ট একটু একা হয়ে যাচ্ছো, এর চেয়েও তো বেশী খারাপ হতে পারতো"।

-তোমার এই ছোট মেয়ে এমন কথা বলেছে? মাই গড, হাউ স্মার্ট সী ইজ!

-শোন, ও আরও বলেছে, " মা, আমাদের আগের লাইফ অনেক বেশী ভালো ছিল। আমরা সবাই মিলে অনেক বেড়াতাম, আনন্দ করতাম,  অনেক দূরে গেলে হোটেলে থাকতাম, অনেক মজা হতো। কিন্তু তখন সবাই ছোট ছিলাম, এখন তো দিদিরা বড় হয়ে গেছে, দূরে চলে গেছে। এখন আর সেই আগের মত আনন্দ হয় না বলেই তোমরা একা হয়ে গেছো। আমার বন্ধু লরেলের মা বাবা ওদেরকে নিয়ে মাঝে মাঝে আউটিং এ যায়। লরেলরা দুই বোন। প্রতি উইকএন্ডে ওরা ওদের বাবা মায়ের সাথে রিভার ওয়াকে যায়। আমরা আগে যেমন খাবার নিয়ে যেতাম সাথে করে, পার্কের বেঞ্চে বসে খেতাম, ওরাও তেমনি করে খায়। কিন্তু তুমি তো রিভার ওয়াকে যেতে চাইবে না। ওখানে সাপ আছে।

আমি বলি, " বাবারে! আমি মরে গেলেও রিভার ওয়াকে যাবো না মিথীলা।  আচ্ছা, লরেল যখন গল্প করে, তোমার কী খুব খারাপ লাগে? তুমি কী কখনও কেঁদেছো আগের জীবনের আনন্দের কথা ভেবে?"

ও বলেছে, " না, আমি কাঁদিনা। ভাবি, আগের মত থাকতে পারলে ভালো হতো। লরেল তো আমার বয়স,  আর ওর ছোট বোনের বয়স মাত্র চার বছর। ওর মা বাবা অনেক ইয়াং। তোমরাও যখন অনেক ইয়াং ছিলে, তখনতো লাইফ অনেক অন্যরকম ছিল।  কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব না, আর কোনদিন হবে না। দিদিরাও  দূরে চলে গেছে।  সেজন্য মন খারাপ করি না। তবে এটা বুঝি, পাপা এখন একা থাকতেই বেশী ভালোবাসে। সারাক্ষণ লেখালেখি করে, নাহয় টিভি তো চলেই, বন্ধুর সাথে মুভী দেখতে যায়, নাহলে আঙ্কলের বাড়ী যায়। তোমার তো কিছুই হয় না। তোমার জন্য খারাপ লাগে"।

-ওহ! হাউ সুইট! তোমার মেয়ে এত কথা শিখলো কখন? এই তো সেদিন বাবার সাথে আসতো, কত ছোট একটা বাচ্চা।

-আমি ঠিক করেছি, কালকে আমরা সারাদিন বাইরে কাটাবো, ঠিক আগের মত। এখানে একটু ঘুরবো, তারপর চলে যাব স্টার্কভিল, ওখানে দুইটা লেক আছে, দু জায়গাতেই যাব, দুপুরে কোন রেস্টুরেন্টে খাব, বিকেলে কোন বন্ধুর বাড়ী গিয়ে চা খাব, সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরবো।

-তোমার হাজব্যান্ড রাজী হয়েছে?

-রাজী না হয়ে যাবে কোথায়? আমি সহজে কিছু চাই না, কিন্তু যদি চাই, সেটা হতেই হবে।

-তোমার মেয়েকে রেখে যাবে?

-আমার মেয়েকে রেখে যাবো কেনো? ওর জন্যই তো বাইরে যাওয়া।

টেরী বললো, না, তোমরা দুজন  একসাথে সময় কাটাতে পারো, তার মধ্যে মেয়েকে ঢুকাবে কেনো?

বললাম, তোমরা তো জানো না, আমাদের মধ্যেকার সম্পর্কটা অন্য রকম। আমার মেয়েরা তাদের বাবা-মায়ের মধ্যেকার খুনসুটি, প্রেম, আহ্লাদীপণা দেখে বড় হয়েছে। আমি ওদের সামনেই আমার বরের সাথে ঢং করি। মাঝে মাঝে তর্কও করি। মেয়েরা বেশীর ভাগ সময় ওদের বাবার পক্ষ নেয়, ওরা বলে, আহারে! বাবাটা একা হয়ে গেছে, আমরা চারজন মেয়ে আর বাবা একা একটা ছেলে। থাক, আমরা না হয় বাবার পক্ষ নেই! আমি মজা পেতাম ওদের কান্ড দেখে। আমিই তো ওদের শিখিয়েছিলাম, বাবাকে ছায়া দিয়ে রাখতে। ওরা তাই করতো, এখনও করে।  ছোট থেকে ওদেরকে ওভাবেই বড় করেছি, শিখিয়েছি, তোমরা আমারই দেহের অংশ। আমি যা, তোমরাও তাই। তোমরা আমার বাইরে কেউ নও। কাজেই আমার ছোট মেয়ের সামনেই আমরা সুখ দুঃখের কথা বলতে পারি।

-হাউ সুইট, কী সুন্দর কথা শিখিয়েছো ওদের, " তোমরা আমার দেহের অংশ, আমি যা, তোমরাও তাই"। রীটা , তোমার সাথে কথা বললে কত মজার কথা শুনি। আমার মেয়েরা আমার কাছে আসবেও না, আর আসলে দড়াম করে পাছায় লাথি মেরে দেবো।

-ছি ছি! টেরী, কী যা তা বলো!

-যা-তা বলিনি, ইট'স ট্রু! তাহলে তো তোমার কিউট বেবীকে সাথে নিয়ে যেতেই হয়।

-হ্যাঁ, সেদিন ও বলেছে, অতীতের মত আবার আনন্দ করতে চায়, অতীতের দিনগুলোকে ফিরে পেতে চায়। কাজেই ওকে অতীতের কিছু মুহূর্ত ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করবো। আমার এই মেয়েটা কেমন সুন্দর করে বিশ্লেষন করে বুঝিয়েছে, আমার ধারণাতেও ছিল না, কখন মেয়েটা এত কিছু শিখে গেছে! আমি বুঝতেই পারিনি যে ফেলে আসা দিনের জন্য ওর মন খারাপ হয়!  তাই ওকে পুরানো দিনের টেপ রি-ওয়াইন্ড করে দিতে চাই। এবং ঠিক করেছি মাঝে মাঝেই এমন আউটিং এ চলে যাব। আমার দুই মেয়ে শুনেও খুব খুশী হবে। ওদের খুব খারাপ লাগে, ছোট বোনের জন্য। আমার নিজের জন্যও একটু আউটিং এর দরকার আছে! দিনগুলো রি-ওয়াইন্ড করতে পারলে আমার হাজব্যান্ডেরও ভালো লাগতে পারে, কী বলো!

-গো অ্যাহেড! মনে হচ্ছে, তোমার কথাই ঠিক। 'জাস্ট রি-ওয়াইন্ড দ্য টেপ'!! উফ! ভাবতেই পারিনা, তোমার সেই ছোট মেয়ে এত বড় হয়ে গেলো কখন! হাউ সুইট বেবী!

Saturday, January 19, 2013

স্লীপ ওভার! হ্যাং আউট!

আজ আমাদের মিথীলা ওর বন্ধু জোয়ির বাড়ীতে হ্যাং আউট করতে গেলো। এটাই ওর প্রথম হ্যাং আউট। বাড়ীটা একেবারে ফাঁকা লাগছে, ঘরে দুই বুড়ো বুড়ী। এটাই আমাদের জীবনে প্রথম একা হয়ে যাওয়া। একদিন না একদিন তো ঘর ফাঁকা হবেই। দুই মেয়ে অনেক আগেই ঘরের বাইরে, হোস্টেলে থাকে, বাকী শুধু মিথীলা, আর  কয়েক বছর পরে ওকেও হোস্টেল বা ডর্মে চলে যেতে হবে। তখন আমাদের দু'জনের প্রকৃত দাম্পত্যকাল শুরু হবে। হয়তো  সারাদিন খুনসুটি করবো এবং অনেক বেশী কাছাকাছি আসবো, নয়তো সারাদিন খিটিমিটি ঝগড়া করবো এবং  নিজেদের মাঝে অনেক দূরত্ব তৈরী করবো। কোনটা হবে জানিনা, তবে আজ খুব একা লাগছে।


 মিথীলা আমাদের তৃতীয়া কন্যা, আরও শুদ্ধ বাংলায় কনিষ্ঠা কন্যাও বলা যায়। তারচেয়ে বেশী শ্রুতিমধুর লাগে, যখন বলি, ও আমাদের  ছোট মেয়ে। ছোট মেয়ে মানে, ছোট মেয়েই। বয়স গুণে বলা যায়, ও বালিকাকাল পার করে কৈশোরে পা দিয়েছে, অর্থাৎ তের বছর বয়স হলো। অথচ মিথীলাকে আমরা কেউই কৈশোরের স্বীকৃতি দিতে নারাজ। ওকে সেই ছোটবেলার গাপুলু গুপুলু মিথীলা করেই রেখেছি। এখনও ওর দিদিরা ওকে হরেক নামে ডাকে। একজন ডাকে 'ঝনিল', আরেকজন ডাকে 'কনি'। মাঝে মাঝে 'ঝনিল' থেকে 'টনি' হয়ে যায় আর 'কনি' থেকে হয়ে যায় 'কন' । শুধু কী দিদিরা, মিথীলার পাপা ডাকে আরেক নামে, আমি অবশ্য মিথীলা' ডাকি। এত কথা বলার একটাই অর্থ, মিথীলা এখনও আমাদের কাছে সেই ছোটটিই আছে।


এই যে মিথীলাকে আমরা ছোটটি করে রেখেছি, এটা কী মিথীলার জন্য সুখকর কিছু? অবশ্যই না। এদেশে জন্মের পর ড্যাডি, মাম্মি শিখেই 'বয়ফ্রেন্ড', গার্ল ফ্রেন্ড' শিখতে শুরু করে বাচ্চারা। এটা সর্বাংশে সত্যি না হলেও মোটামুটি সত্যিই ধরে নেয়া যায়। দেখছি তো আশপাশ, চারিপাশ। তবে এ নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই, যস্মিন দেশে যদাচার। এটাই এখানের রীতি, এভাবেই ওরা বড় হয়। এই বড় হতে গিয়েই ওরা 'স্লীপ ওভার' , হ্যাং আউট', 'প্রম' শিখে এবং খুব এনজয় করে। বড় হয়ে যাওয়ার পর ছেলেবেলার এই আনন্দময় দিনগুলো নিয়ে খুব গৌরব করে। প্রায়ই বাচ্চার মা বাবা কে বলতে শোনা যায়, আজ আমার ছেলে ওর বন্ধুর বাড়ীতে স্লীপ ওভার করছে অথবা বলবে ' এই তো আমার মেয়ে বের হয়েছে বন্ধুদের সাথে হ্যাং আউট করতে।


 মোটামুটি ছোট অবস্থাতেই তিন মেয়েকে এদেশে এনেছি। বড়মেয়ের বয়স ছিল চৌদ্দ, মেজো দশ এবং ছোট দুই বছর। এর আগে আমরা অস্ট্রেলিয়াতে থেকেছি দুই মেয়েকে নিয়ে। বিদেশে থাকলেও বাচ্চারা ছোট ছিল এবং আমার মধ্যে 'স্বদেশীভাব' খুব বেশী ছিল যা মোটেও সুস্থতার লক্ষ্মণ ছিল না।  অস্ট্রেলিয়াতে থাকাকালীণ সময়টুকুতে শুধুই বাঙ্গালীদের সাথে মিশেছি, বাচ্চারা নষ্ট হয়ে যাবে ভয়ে বিদেশীদের ধারে কাছেও যেতাম না। মেয়েরা স্কুল থেকে ফিরলেই বাঙ্গালীপনা শুরু করে দিতাম, ভাবখানা এমন ছিল যেনো দিনের সাত ঘন্টা  সাহেবের বাচ্চাদের সাথে থেকে নিশ্চয়ই উল্টোপাল্টা শিখে এসেছে। সাথে সাথে বাংলা থেরাপী না দিলে এরা আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। আসলে  ছোটবেলা থেকেই এক ধরণের ভুল শিক্ষা পেয়ে আমরা বড় হয়েছি, একতরফাভাবে শিখেছি,  আমাদের দেশের মানুষরাই জগত শ্রেষ্ঠ, আমাদের সংস্কৃতিই জগৎসেরা, বাকী সব 'নষ্ট মানুষ', গায়ের চামড়া সাদা হলেই তারা ' সাহেব-মেম' আর সাহেব মেম মানেই ' চুমোচুমি', 'মেম' মানেই প্রায় 'লেংটো' হয়ে থাকা জাতীয় উদ্ভট সব ধারণা, এবং আমি বাজী রেখে বলতে পারি, এখনও আমাদের দেশের অনেকের মনে এই ধারণাগুলো বদ্ধমূল হয়ে আছে। তাই অস্ট্রেলিয়া থেকে আমি নতুন কিছুই শিখে আসিনি। নতুন পাঠ নিতে শুরু করেছি আমেরিকা আসার পর থেকে।


 প্রথম প্রথম আমি হ্যাং আউট আর হ্যাং ওভার কে গুলিয়ে ফেলতাম। 'প্রম' ব্যাপারটি সম্পর্কে তো কোন ধারণাই ছিল না। এই শব্দগুলো শিখেছি আমার মেয়েদের কাছ থেকে। আমার মেয়েগুলোকে যেটাই জিজ্ঞেস করি না কেনো, ওরা খুব ভালোভাবে আমাকে তা বুঝিয়ে বলে দেয়। কাজটি ওরা নিজেদের স্বার্থেই করে থাকে, নাহলে আমি হয়তো অনেক মানুষের মাঝে উদ্ভট কথা বলে ওদেরকে বিপদে ফেলে দেবো, এই কাজটি আমি করি, ঐ যে বলেছি, ছোটবেলা থেকে বিদেশী সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বড় হয়েছি, তার রেশ তো কিছু থেকে গেছে। এই জন্যই আমি 'হ্যাং আউট' আর 'হ্যাং ওভার' শব্দদুটোকে গুলিয়ে ফেলি। মেজো মেয়েকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছি 'হ্যাং আউট' কথার মানে, আর 'হ্যাং ওভার' কথার মানে। এই দুটো টার্মই এখানের ছেলেমেয়েদের বেলায় প্রযোজ্য। 'হ্যাং আউট' নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই, হ্যাং আউট মানে বন্ধুরা সবাই মিলে কোথাও বসে আড্ডা দেয়া, তা কারো ঘরেই হোক অথবা রাস্তায়ই হোক, নাহলে কলেজ ক্যাম্পাসে বা শপিং মলেও হেটা হতে পারে। আর 'হ্যাং ওভার' মানে বেশ কাহিল করা শব্দ, প্রচুর ড্রিংক করলে অনেকের শরীর বিদ্রোহ করে মাঝে মাঝে, সেই বিদ্রোহের লক্ষ্মণগুলোই 'হ্যাং ওভার'। মোটামুটি বুঝে ফেলেছি। আর 'প্রম' ও ভয়ানক কিছু নয়, সারাজীবনের বন্ধুদের সাথে মিলে এক ধরণের নাচানাচি আনন্দোল্লাস! ছেলে-মেয়ে জোড়া বেঁধে নাচ করা, এই নাচ কোন ছোটখাটো ব্যাপার নয়। আমরা পূজা-ঈদে নতুন জামাকাপড় কিনি, এখানের ছেলেমেয়েরা 'প্রম' এ যাওয়ার জন্য প্রচুর পয়সা খরচ করে স্বপ্নের ড্রেস তৈরী করায়। বাবা মায়েরা প্রচন্ড উৎসাহ নিয়ে ছেলেমেয়ের জন্য প্রম ড্রেস বানিয়ে দেয়। সবাই চায়, আমার মেয়েটি নাচের জন্য যেনো তার পছন্দের পার্টনার খুঁজে পায়, অথবা আমার ছেলেটিকে যেনো একা না থাকতে হয়, তার পছন্দের রাজকন্যা এসে যেনো তার হাত ধরে। ভবিষ্যতে ঘর-সংসার করতে যাওয়ার আগে জুটি বাছাইয়ের একটু প্র্যাকটিস আর কি!

আমার বড় মেয়েটি খুব সীমিত সংখ্যক বন্ধু নিয়ে চলে, ওর বন্ধুরা সবাই ইনটেলেকচুয়্যাল ধরণের। এটা এখনকার কথা নয়, বড় মেয়ে যখন বাংলাদেশে ওয়াইডব্লিউ স্কুল, শাহীন স্কুল, আগা খান স্কুলে পড়তো, তখনও ওর বন্ধুর সংখ্যা ছিল হাতেগোনা, এবং তাদের সকলেই বেশ গুরুগম্ভীর। গুরুগম্ভীর ছেলেমেয়েরা আর দশজন ছেলেমেয়ের মত হ্যাং আউট, স্লীপ ওভার করে না ( আমার ধারণা)।  বড় মেয়ে এদেশে এসে ক্লাস টেনে ভর্তি হয়েছিল। স্কুলে যেতো আর বাড়ী ফিরে লেখাপড়া করতো। নানা কমপীটিশানে অংশগ্রহণ করতো, তার চেয়েও বড় কথা, স্যাট, এসিটি নামক মারাত্মক কমপিটিটিভ পরীক্ষার জন্য প্রিপারেশান নিত। আমিও খুব খুশী থাকতাম, মেয়ে আমার অন্য কোন দিকে মন দেয় না। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার যে শহরে থাকতাম, সেখানে আশেপাশে বাঙ্গালী ছিল না, একটি মাত্র বাঙ্গালী পরিবার ছিল, উনারা ত্রিশ বছর ধরে ঐ শহরে একা বাঙ্গালী হিসেবে থাকতে থাকতে অর্ধেকের বেশী আমেরিকান হয়ে গেছিল। তাদের দুই মেয়ের এদেশেই জন্ম, এদেশেই বড় হওয়া, তারা পুরোপুরি আমেরিকান স্টাইলে বড় হয়েছে। ঐ বাড়ীতেই আমি  স্লীপ ওভার, হ্যাং আউট, প্রম শব্দগুলো প্রথম শুনি। স্লীপ ওভারের মানে বুঝি, কোন বন্ধুর বাড়ীতে রাত কাটানো, কিন্তু হ্যাং আউট মানে যে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া, সেটাই গুলিয়ে ফেলতাম কাছাকাছি শব্দ হ্যাং ওভারের ( অতিরিক্ত ড্রিংক করার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া) সাথে। 'আমার পরিবারে কাউকে তো দেখিনি 'হ্যাং ওভারের' ঝামেলায় পড়তে, তাই অনভিজ্ঞ আমি কোন একটা আসরেই হয়তো বলে দিতাম, ওরা হ্যাং ওভার করতে গেছে। আমার দুই মেয়ে দুই দিক থেকে আমাকে বকা দিত, উলটা পালটা কথা বলছি বলে। ভুল বুঝতে পেরে আমি সাথে সাথে 'সরি' বলে ফেলতাম।


সেই বাড়ীতেই একদিন বড় মেয়েকে বলতে শুনলাম, ওদের স্কুলের বন্ধুরা সবাই মিলে হ্যাং আউট করবে। তখন ওদের টুয়েলভ ক্লাস শেষ হয়ে যাচ্ছে, সবাই কলেজে চলে যাবে, আর কখনও সবার সাথে হয়তো বা দেখা হবে না, তাই একটা রাত হ্যাং আউট করার পরিকল্পনা ছিল ওদের। ঐ বাড়ীর আন্টির কাছে তো এগুলো জলভাত ব্যাপার, কিন্তু আমার কাছে ছিল পচা ভাতের মত ব্যাপার। ওখানে কিছুই না বলে বাড়ী ফিরে মেয়েকে বলেছি, হ্যাং আউট করতে না যেতে। মেয়ে অবাক চোখে তাকিয়েছে  আমার দিকে, এমন অনুরোধ আমি করবো, এটা ওর ধারণার বাইরে ছিল। কারণ, আমি আমার মেয়েকে চিনি, ও খুবই ভাল একটা মেয়ে, কখনও এমন করে কিছু চায়নি, কখনও কোন অবাধ্যতা করেনি, অথচ স্কুল জীবনের শেষের দিকের একটা প্রোগ্রাম, এত এত ছেলেমেয়ে থাকবে, আর ওর মামনি কিনা ওকে যেতে মানা করছে! এমনিতেই ওকে 'প্রমে' যেতে দেইনি। ওকে বুঝিয়েছি, " মামনি, প্রমে গিয়ে ছেলে আর মেয়ে পেয়ার পেয়ার করে নাচে, এটা আমার ভালো লাগে না। হোক বন্ধু, বন্ধু হলেই কী এভাবে পেয়ার পেয়ার করে নাচতে হবে? স্কুল তো আমরাও পাশ করেছি, তাই বলে কী কারো সাথে নেচেছি"?  মেয়ে আমার সাথে কোন তর্কে যায়নি, প্রমেও যায় নি। কী মনে হতে মেয়েকে বলেছি, " আচ্ছা, ঠিক আছে, তোমার বাবা যদি হ্যাং আউট করতে যেতে বলে তো যাও"। মেয়ের বাবা হচ্ছে মেয়েদের সব ব্যাপারেই 'হ্যাঁ'। 

কাজেই সিদ্ধান্ত হয়ে গেলো, মেয়ে হ্যাং আউটে যাচ্ছে। যেদিন প্রোগ্রাম, সেদিন ও বিকেলে স্কুল থেকে ফিরেই ঘুম দিয়েছে। রাত দশটায় ডেকে দিতে বলেছে। রাত বারোটায় সবাই স্কুলে গিয়ে জড়ো হবে। মেয়ে ঘুমায় আর আমি চিন্তা করি, আমেরিকা হচ্ছে একটা ভয়ানক দেশ। এখানে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা 'প্রম' নাম দিয়ে জোড়ায় জোড়ায় নাচে, ওরা ছোট বেলা থেকেই প্রেম করে, ওরা অনেক ছোট বেলাতেই বাবা মা হয়ে যায়, এমন এক ভয়ানক দেশে থেকে মেয়েগুলোকে কীভাবে মানুষ করবো?  আজকে যদি মেয়েটাকে ওখানে পাঠাই, ও তো এসবের কিছু মাথামুন্ডু বুঝবে না। আমার মেয়েটা অনেক শান্ত শিষ্ট, কে বা কারা ভুলিয়ে ভালিয়ে ওয়াইন খাওয়ায় দেবে, নাহলে খুনও করে ফেলতে পারে। ও মাত্র দুই বছরেই ক্লাসের সেরা স্টুডেন্ট হয়ে গেছে, কারও মনে যদি কোন হিংসে থাকে, দিবে ওকে হাপিস করে! এগুলো ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, না, মেয়েকে হ্যাং আউট করতে যেতে দেয়া যাবে না। যেই ভাবা সেই কাজ, রাত সাড়ে নয়টার সময় মেয়েকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছি, " মামনি, ও মামনি, আজকে তুমি যেওনা সোনা, আমার অনেক ভয় করছে। মনে হচ্ছে আজ তুমি গেলে অনেক বড় বিপদের মধ্যে পড়বে"! আমার মেয়ে হয়তো জানতো ওর যাওয়া হবে না, তাই কোন কথা না বলে শুধু 'আচ্ছা' বলে পাশ ফিরে শুয়েছে।

পরের দিন ও স্কুল থেকে ফেরার পর ওকে জিজ্ঞেস করেছি, " কী হয়েছিল মামনি কালকে? কারো কোন বিপদ হয় নি?"  মেয়ে বলেছে, " বিপদ হবে কেনো? এখানে স্কুলে বন্ধুরা প্রায়ই নিজেদের মধ্যে হ্যাং আউট করে, কিছুই হয় না। মামনি শোন, হ্যাং আউটের বাংলা মানে হচ্ছে 'আড্ডা দেওয়া'।  তুমি তোমার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দাওনি? এটাও তেমনি ব্যাপার। আমাকে করতে দিলে না ঠিক আছে, কিন্তু মিশার সাথে এমন করো না। আমেরিকাতে নিয়ে এসেছো, সবার সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে বলো, ভালো রেজাল্ট করতে বলো অথচ আমাদের মনের আনন্দের দিকটা দেখবে না, এটা কেমন কথা। এখানে কেউ জোর করে কাউকে খারাপ করে দেয় না মামনি। আমরা তো জানি, আমাদের কী করতে হবে, আমরা না চাইলে কেউ আমাদের খারাপ করতে চাইবেনা"। বড় মেয়ে খুব মেপে কথা বলে, আমি বুঝেছি, মেয়ে খুব কষ্ট পেয়েছে, নিশ্চয়ই ওর বন্ধুদের কাছে মাথা হেঁট হয়েছে, কে জানে!

মেয়ের কাছ থেকে এক বড় রকমের শিক্ষা গ্রহণ করলাম। মনের ভেতর থেকে ভয় কে্টে গিয়ে লজ্জা এসে ভর করলো। মেয়েকে 'সরি' বললাম, মেয়েটা এমন বোকা, আমার উপর কোন রাগ বা অভিমান রাখলো না।

এরপর যখন মেজো মেয়ের স্কুল শেষের পালা এলো, ততদিনে আমি অনেক শক্ত হয়ে গেছি। তাছাড়া আমার মেজোমেয়ে হয়েছে আমার মত বাদাইম্যা টাইপ। বড় মেয়ের উল্টো। সে সব সময় বন্ধুদের সাথে আড্ডা, হৈ হুল্লোড় কতে ভালোবাসতো। এখন সে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, এখনও তার আড্ডায় কোন কমতি নেই। স্কুলের শেষের সকল অনুষ্ঠানে সে অংশগ্রহণ করেছে,  সে প্রমেও গেছে, যখন তখন বন্ধুদের সাথে হ্যাং আউটও করেছে এবং রুমমেটের বাড়ীতে স্লীপ ওভারও করেছে। আমি কিছু বলতাম না, কারণ, মেজো মেয়ে পড়েছে স্কুল ফর দ্য গিফটেড স্টুডেন্টস এ। কাজেই এক ধরনের বিশ্বাস ছিল, গিফটেড স্টুডেন্টরা কখনওই খারাপ কিছু করবে না। বড় মেয়ে ততদিনে বেশ গার্জিয়ান হয়ে উঠেছে। দুই বোনে এমনিতে আড়াআড়ি সম্পর্ক হলেই কি, এসব স্বাধীনতার ব্যাপার হলেই বড় বোন দূর থেকে ছোট বোনের হয়ে ওকালতি করতো। তা মেজো মেয়ের কপালেও খারাপ কিছু ঘটেনি। দিব্যি সুন্দর গটগট করে স্কুল কলেজ পাশ করে ফেললো। কলেজে গিয়ে তো আর চিন্তা নেই, একটা ফোন করে বলে দিত, " মা, আজকে আমরা সবাই স্বাতীদের বাড়ীতে হ্যাং আউট করছি, অথবা এলিজাবেথের বাড়ীতে স্লীপ ওভার করছি। চিন্তা করো না, আর চিন্তা লাগলে আমাকে ফোন করো"।

এবার আসি মিথীলা প্রসঙ্গে। আগেই বলেছি, মিথীলার বয়স তের হলেও ওকে আমরা এখনো আহ্লাদী করে রেখেছি। তের বছর বয়সে এখানে সবাই দুই তিনবার প্রেম করে ফেলে। মিথীলার সাথে আমি এসব নিয়ে অনেক মজা করি। ও অস্বীকার করে না, তবে বলে, " মা, আমার বন্ধুদের বাবা মা তোমার মত কড়া। ওরা কেউ প্রেম করে না। আমরা সব সময় পড়াশোনা নিয়ে কথা বলি"। মিথীলার কথা বিশ্বাস না করার কোন কারণ নেই। ও এমনই এক মেয়ে, যার মুখের দিকে তাকালে এখনও মনে হয়, কোন ছল চাতুরী ওর মধ্যে নেই। প্রতিটি মানুষ ওকে এইজন্যই খুব বেশী পছন্দ করে। সেই মিথীলা আজকে ওর বন্ধুর বাড়ী গেলো স্লীপ ওভার করতে। ব্যাপারটি হঠাৎ করেই ঘটে গেলো। আজ সন্ধ্যার শো'তে ওরা সাত আট জন বন্ধু মিলে মুভী দেখতে যাওয়ার প্ল্যান অনেক আগে থেকেই ছিল।  বাবা বা মা যার যার ছেলে মেয়েকে মুভী থিয়েটারে পৌঁছে দিবে, তারপর রাত নয়টায় আবার থিয়েটার হল থেকে তুলে নিয়ে আসবে। এদিকে  হঠাৎ করে এক বড় ভাইয়ের বাড়ীতে আমাদেরকে ডিনারে ডেকেছে। উনার বাড়ী আমাদের বাড়ী থেকে ত্রিশ  মাইল দূরে। সেখানে গেলে মিথীলাকে থিয়েটার থেকে তুলবো কী করে? তাছাড়া ওর মুভী শেষ হবে রাত নয়টায়, এরপর ওকে নিয়ে উনার বাড়ীতে পৌঁছাতে বেজে যাবে রাত দশটা! কী বিপদ! বড় মেয়েকে হ্যাং আউট করতে দেইনি, সেই কষ্ট আমার মেয়ের মনে এখনও রয়ে গেছে, এটা জানি বলেই বাকীদেরকে আর কষ্ট দেই না।

আজকে প্রথমবারের মত মিথীলা বলল, " মা, আমি যদি আঙ্কলের বাড়ীতে না যাই, তুমি কি রাগ করবে? মুভি দেখা হয়ে গেলে আমি জোয়ীদের বাসায় চলে যাই? ওর সাথে স্লীপ ওভার করতে চাইলে ও অনেক খুশী হবে। ওরা সব সময় স্লীপ ওভার করে, ওরা জানে, তুমি আমাকে স্লীপ ওভার করতে দিবে না, তাই ওরা আমাকে কখনও স্লীপ ওভার করতে বলে না।  আজকে আমি স্লীপ ওভার করলে ওরা অনেক অনেক খুশী হবে। জোয়ির মা বাবা আমাকে অনেক ভালোবাসে। ওরাও খুশী হবে। আমি কী ওদের বাড়ীতে থাকতে পারি"? ছোট্ট মিথীলা যদি এভাবে অনুরোধ করে, আমি কীভাবে না করি! আমার বাইরেটা যতই কঠিন দেখাক, হৃদয়টা তো একেবারে কোমল। সহজেই নরম হয়ে যাই। বললাম, ' ঠিক আছে, যাও, কিন্তু ভালোভাবে থেকো। আমাকে ফোন করো'।

মিথীলা কী পরিমান খুশী হয়েছে তা বুঝানোর জন্য আমাকে বলল, " মা, তোমাকে একটা হাগ দেই? আমাকে আবার পুশ করো না।  মিমি সেদিন বলেছে, তোমাকে হাগ করলে তুমি যদি আমাকে পুশ করো, তাহলে আমিও নাকি তোমাকে একটা পুশ করবো। হা হা হা! "। ( আমাকে মেয়েরা কখনও 'হাগ' করলে আমি ওদেরকে হালকা করে ঠেলে দিয়ে বলি, আর ঢং দেখাতে হবে না, যা ভাগ!)

-মিমি বেশী পাজী, বড় বোনের বিরুদ্ধে কথা বলে। ( আমার মামাতো বোন টুম্পাকে মিথীলা মাসী না ডেকে 'মিমি; ডাকে)।  আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই মিথীলা আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমি অবশ্য ওকে ঠেলে দেই নি, শুধু বলেছি, " হয়েছে, আর ঢং করতে হবে না, যা ভাগ"।





















Friday, January 18, 2013

শীতের আমেরিকা!

আমেরিকাতে সময়টা এখন শীতের মাঝামাঝি।  শীতের শুরুতে এখানে ভালোই লাগে, অনেকটা বাংলাদেশের শীতের মত, আকাশ পরিষ্কার থাকে, সারাদিন রোদে ঝলমল করতে থাকে চারদিক, সন্ধ্যে এগিয়ে আসে একটু তাড়াহুড়ো করেই। মাঝে মাঝেই গায়ে শীতকাঁটা দেয়, ক্লজেট থেকে গরম কাপড়-চোপর বের হতে থাকে একটা একটা করে। শীতের তীব্রতা অনুযায়ী শীতবস্ত্রের ব্যবহার চলে। অবশ্য আমেরিকানদের মধ্যে এর কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। তারা চল্লিশ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রায়ও হালকা সোয়েটার পড়ে ঘুরে বেড়ায়। এখানে সর্বত্র একটি সার্বক্ষণিক সুবিধা আছে, নিজের বাড়ী, গাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস, কারখানাসহ সর্বত্র তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের সুব্যবস্থা আছে। ফলে শীত, গ্রীষ্ম কোথা দিয়ে আসে, কোথা দিয়ে চলে যায়, তা ভালো করে আঁচ করা যায় না।

আমেরিকার স্টেটের সংখ্যা হচ্ছে পঞ্চাশ। প্রতিটি স্টেটেই শীত আসে একই সময়ে, তবে শীতের তীব্রতায় থাকে পার্থক্য। যেমন আমেরিকার উত্তর দিকের রাজ্যগুলোতে শীত মানেই তুষারপাত এবং দক্ষিণী রাজ্যগুলোতে  তুষারপাত ছাড়াই হাড়কাঁপানো শীত। রাজ্যগুলোতে তুষারপাত না হলেও বৃষ্টিপাত হয়। আর সে বৃষ্টির পানির ফোঁটাতে কী ধার, গায়ে পড়লেই মনে হয়, ঠান্ডা একেবারে হাড়ের মধ্যে গিয়ে বিঁধেছে বুঝি। দক্ষিনী রাজ্যের মানুষগুলো উত্তর রাজ্যের মানুষদের থেকে এই একটি দিকে অনেকটাই যেনো পিছিয়ে আছে। এই রাজ্যে তুষারপাতের মত  দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক শোভা নেই, পরিবর্তে আছে টর্ণেডো, হ্যারিকেনের মত বিধ্বংসী ব্যাপার -স্যাপার। অনেকটাই আমাদের বাংলাদেশের মত অবস্থা। বাংলাদেশ নাম শুনলেই যেমন ইউরোপ-আমেরিকানদের ধারণা, সাইক্লোন, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, তেমনি দক্ষিনী রাজ্য শুনলেই মনে হয়, টর্ণেডো আর হ্যারিকেনের কথা। কোন কোন বছর প্রকৃতি সদয় হলে, দক্ষিনী রাজ্যগুলোতেও এক আধদিন অল্প-স্বল্প তুষারপাত হয় বৈকি! তেমন ঘটনা ঘটলে রাজ্যবাসীদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ওয়েদার ফোরকাস্ট শুনে আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে, কিভাবে সামাল দেবে আসন্ন তুষারবর্ষণকে। অযথাই তিনদিন আগে থেকে শুরু হয়ে যায় খাবার-দাবার মজুদ করার কাজ,  সাথে ফ্ল্যাশ লাইট, মোমবাতি, ওয়াইন,পাণীয় জল, সফট ড্রিঙ্ক, গ্যাস সিলিন্ডার থেকে শুরু করে হেন জিনিস নেই যে কারো নজর এড়িয়ে যাবে। অফিসে, দোকানে খুব গল্প চলতে থাকে  আসন্ন তুষারপাত নিয়ে। একজন অন্যজনকে সাবধান করে দেয়, গাড়ী যেনো সাবধানে ড্রাইভ করে, রাস্তাঘাট আইসি (বরফ জমে পিচ্ছিল) হয়ে থাকার সম্ভাবণা, সাবধানে না চালালে গাড়ী স্লীপ কেটে চলে যাবে আরেক ট্র্যাকে, অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে--এমন ধরনের গল্প চলতেই থাকে।

 শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এক সপ্তাহ আগে থেকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস মনিটর করতে থাকে। শেষ মুহূর্তে হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা চাইই চাই। তুষারপাত তো আর সাধারণ কোন ঘটনা নয়, সারা শীতকাল ধরে শুধু অন্য স্টেটের তুষার বর্ণনা শুনতে হয়, এবার নিজেদের স্টেটেও তুষার ঝরছে, হোক তা অতি সামাণ্য, না হয় শাবল দিয়ে পরিষ্কার করার প্রয়োজন হলোই না, তবুও তো আকাশ থেকে ঝরছে ওরা, কেমন পেঁজা তুলোর মত! এটুকু জমে জমে যতটুকু হয়, তাই দিয়ে না হয় ছোট ছোট স্নোম্যান বানানো যাবে, তবুও তো তুষারপাত হচ্ছে। অনেকটাই যেনো জাতে উঠার প্রতিযোগীতায় টিকে থাকার মত ব্যাপার।

আমেরিকায় শীতের শুরুতেই সকল গাছের পাতা ঝরে যায়, ন্যাড়ামুন্ডি গাছগুলো ডালা-পালা ছড়িয়ে দিয়ে শূণ্যদৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পত্রবিহীন গাছগুলোর দিকে তাকালে কখনওই মনে হয় না, যে ওরা আবার পত্রফুল্লশোভিত হয়ে উঠবে। যে সকল স্টেটে তুষারপাত হয়, ঐ সকল স্টেটে গাছের ন্যাড়া শাখায়  তুষার জমে জমে  অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়! দেখে মনে হয় প্রতিটি গাছে থোকা থোকা শ্বেতশুভ্র ফুল ফুটে আছে। টিভিতে ওয়েদার চ্যানেল থাকেআবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রতি ঘন্টায় আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়া হয়। আমেরিকার উত্তরের রাজ্যগুলোতে তুষারপাত মানেই সুন্দরের সাথে বাড়তি কিছু পরিশ্রম যোগ হওয়া। সারারাত যখন তুষার ঝড় হয়, আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় যেনো সারা আকাশজুড়ে সাদা চাদর উড়ে বেড়াচ্ছে। তুষারঝড় থেমে গেলে উড়ন্ত চাদরগুলোই যেনো ভূমিতে, বাড়ীর ছাদে, গাছের ডালে এসে নেতিয়ে পড়ে। চাদরের পরত জমে জমে বরফের পাহাড় হয়ে যায়। তাপমাত্রা থাকে শূণ্য ডিগ্রীর অনেক নীচে, ফলে তুষার জমে বরফ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবণা থাকে। একবার বরফ হয়ে গেলে, কখনও কখনও তা বিপদজনক হয়ে দাঁড়ায়। পথ চলতি পথিক পা পিছলে পড়ে কোমড় ভাঙ্গে, দূর্ভাগ্যবশতঃ কোমড় ভাঙ্গার পর্বটি যদি কারো বাড়ীর সামনের রাস্তায় ঘটে যায়, পথচারী সেই বাড়ীর মালিকের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়। নিজ বাড়ীর সামনের রাস্তা হলেও পথচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রতিটি বাড়ীর মালিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।

কারণেই তুষারপাত শুরু হওয়ার আগেই মিউনিসিপ্যালিটি থেকে ট্রাকে করে সারা রাস্তায় তুষার গলানো লবন ছিটানো হয়, প্রতিটি বাড়ীর মালিকেরা নিজেদের ড্রাইভওয়ে, পথচারী চলাচলের রাস্তায় একইভাবে লবন ছড়িয়ে দেয়। লবন ছিটানো রাস্তায় তুষার পড়ে সেটা আর বরফ হয় না, তার আগেই গলে যায়। ভারী তুষারপাত হলে গৃহস্বামীকে হাতে শাবল, কোদাল নিয়ে বের হতে হয়, কোদাল দিয়ে জমে থাকা বরফের পাহাড় ভেঙ্গে রাস্তা বের করতে হয়। খুবই কঠিন ও পরিশ্রমের কাজ এটা, কিন্তু করতেই হয়। ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে জমে থাকা বরফ গলে পানি হয়ে যায়।


যতই কষ্ট হোক বরফ পরিষ্কার করতে, তারপরেও তুষারপাতের নান্দনিক দিকটিই অনেক বেশী আকর্ষণীয় মনে হয় প্রতিটি মানুষের কাছে। শীতকাল এগিয়ে এলেই সবার মাথায় প্রথম চিন্তা আসে, বছরের ক্রীসমাসটি কেমন হবে, হোয়াইট নাকি স্বাভাবিক? যে ক্রীসমাসে তুষারপাত হয়, সে ক্রীসমাসে সকলের মন আনন্দে পরিপূর্ণ থাকে। তাদের মনে হয়, স্যান্টা ক্লজ নর্থ পোল থেকে বুঝিবা তুষার নিয়ে এসেছে। তবে এ বছর শীত তেমন জোরালোভাবে আসেনি, অন্যবারের মত তুষারপাতও হয় নি। যেটুকু হয়েছে, তা অন্য বছরের তুলনায় অনেক কম। আবহাওয়ার গতি প্রকৃতি হয়তো বদলে যাচ্ছে, এখন তুষারপাতের পরিবর্তে বৃষ্টিপাত বেশী হয় শীতকালে। তারপরেও যে কটা দিন তুষারপাত হয়েছে, সেটাই বা কম কি!


তুষারপাতের বর্ণনা লিখতে গিয়ে নায়াগ্রা ফলসের কথা মনে পরে গেলো। নায়াগ্রা ফলসের নাম পৃথিবীব্যাপী সকলেই জানে। সারাবছর কত লক্ষ লক্ষ পর্যটক আসে নায়াগ্রা ফলস দেখতে। নায়াগ্রা ফলস দুই দেশ থেকে দেখা যায়, আমেরিকা প্রান্ত এবং কানাডা প্রান্ত। দুই প্রান্তের মধ্যে আবার রেষারেষিও আছে, কেউ মনে করে, নায়াগ্রা ফলস আমেরিকা প্রান্ত থেকে বেশী কাছের মনে হয়, কারণ হাতের পাশ দিয়েই নায়াগ্রা বয়ে যায়, আবার কানাডাবাসী মনে করে ওদের প্রান্ত থেকে নায়াগ্রার আসল সৌন্দর্য্য দেখা যায়! সবার কথাই ঠিক, নায়াগ্রা নদী, যে যার সুবিধামত দেখবে, এটাই স্বাভাবিক। সারাবছর নায়াগ্রা দেখা যায়, তবে শীতকালে যদি নায়াগ্রা ফলস দেখতে যাওয়া যায়, সেখানে গিয়ে অপূর্ব এক দৃশ্য দেখা যাবে। নায়াগ্রা ফলস যারা দেখেন নি, তাদের বুঝে নেবার সুবিধার্থে এটুকুই বলা চলে, নায়াগ্রা রিভারের জল ক্রমাগত বয়ে বয়ে একটা জায়গায় এসে সামনে চলার আর কোন পথ পায় না, পথ না পেয়ে হঠাৎ করেই যেনো নীচে পড়ে যায়। গভীর নীচে, অনেক গভীর সেই খাদ। যার তলদেশ দেখা যায় না। নায়াগ্রা নদীর নীচে পড়ে যাওয়ার ঘটনা থেকেই ‘নায়াগ্রা ফলস’ এর উৎপত্তি। নায়াগ্রা নদী যেখানে এসে পড়ে যাচ্ছে, তার চারপাশে নদীর লক্ষ লক্ষ জলকনা ছিটকে পড়তে থাকে। ফলে ঐ অঞ্চলের চারপাশ নায়াগ্রার জলে ভেজা থাকে। শীতকালে তাপমাত্রা শূণ্য ডিগ্রীর নীচে নেমে যায় বলে নায়াগ্রার ছিটানো পানি চারদিকে ক্রিস্ট্যাল তৈরী করে। সূর্য্যের কিরণ পড়ে সেই আইসি ক্রিস্ট্যালগুলো থেকে রঙধনুর সাতরং বিচ্ছুরিত হয়। সে এক অপূর্ব দৃশ্য! হাড়কাঁপানো শীত উপেক্ষা করেও শত শত পর্যটক ওখানে গিয়ে ভীড় করে, এই দৃশ্য দেখার জন্য। চারদিক বরফ হয়ে গেলেও নায়াগ্রা থামে না, বয়ে চলে, চলতে চলতেই শেষ পর্যন্ত সেই অতল গভীরে ঝাঁপ দেয়।

এক সময় শীত কেটে যায়, তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। তুষারপাত কমে আসতে আসতে এক সময় থেমে যায়। বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয়। শীতে কুঁকড়ে থাকা মানুষ হাত-পা খুলে আড়মোড়া ভেঙ্গে নতুনভাবে দিন শুরু করে। উত্তর রাজ্যের মানুষ আগামী শীতের আগ পর্যন্ত বেশ ঝরঝরে থাকে, আর দক্ষিণ রাজ্যের মানুষ অপেক্ষা করে, সামনের শীতে যেনো আরেকটু বেশী স্নো হয়, বাচ্চাগুলো যেনো ভালো করে একখানা স্নোম্যান বানাতে পারে।