Friday, February 16, 2018

ভালোবাসার কথাই তো, মন্দবাসার কথা তো নয়!

ভালোবাসার কথাই তো, মন্দবাসার কথা তো নয়!
প্রায় বছর চারেক আগে ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় ‘ভালোবাসার সাত রঙ’ শিরোনামে একখানা লেখা ছাপা হয়েছিল। আমারই লেখা ‘ভালোবাসার সাত রঙ’। তখন পত্রিকায় টুকরো টাকরা লেখা ছাপা হয়, সেই আনন্দে নতুন নতুন বিষয় নির্বাচন করে তার উপর লেখার চেষ্টা করতাম। ভালোবাসার সাত রঙও তেমন উৎসাহে লেখা। ভালোবাসারতো সত্যিকারের কোন রঙ হয়না, ভালোবাসা হচ্ছে প্রকাশের ব্যাপার। সাত রঙ মিলিয়েছিলাম সাত রঙের গোলাপ থেকে। যেখানে প্রতিটি রঙ ভালোবাসা প্রকাশে ব্যবহ্ররুত হয়ে থাকে।
ভালোবাসা যে কত রকম হতে পারে, ভালোবাসার সম্পর্ক কত রকম হতে পারে, ভালোবাসার ধরণ কত রকম হতে পারে, আনন্দে-শোকেও ভালোবাসার প্রকাশ থাকে, এর কিছুই জানা হতোনা যদি সাত রঙের গোলাপ নিয়ে ভালোবাসার সাত রঙ না লিখতাম। কারণ নতুন কিছু লিখার আগে সেই বিষয় সম্পর্কে একটু পড়াশোনা করতেই হয়। ভালোবাসার সাত রঙ লেখার সময়ও ভালোবাসা দিবস এবং বিভিন্ন রঙের গোলাপ সম্পর্কে অল্প পড়াশোনা করতে হয়েছিল। তখনই গোলাপের কত বর্ণ হতে পারে, তা কিছু জেনেছি।
গত দুই বছরের বেশি সময় আমি পত্রিকায় লেখা পাঠাইনা। যা কিছু লিখতে মন চায় ফেসবুকেই লিখি। ফেসবুকে লিখলে লেখা দ্রুত পাঠকের কাছে পৌঁছে যায়। লেখক লিখেই তো পাঠকের জন্য। গত দেড় মাসের উপর হয়ে গেলো আমি ফেসবুকে লিখতে পারছিনা। কোন কারণে হয়তোবা আমার কিছু ফেসবুক বন্ধুর বিরাগভাজন হয়েছিলাম। তারা আমার দুই তিন বছর আগে লেখা স্ট্যাটাসে সমাজ বিধ্বংসী শব্দের ব্যবহার পেয়ে দ্রুততার সাথে দলে দলে ফেসবুক এডমিনের কাছে রিপোর্ট করেছে। ফেসবুক এডমিনও কোথায় আগুন লেগেছে, আদৌ আগুন লেগেছে কিনা, আগুনে তাপ কতটুকু, আগুনের আঁচে কারো কোন ক্ষতি হলো কিনা খোঁজ খবর করে সময় নষ্ট করতে চায়নি। তারা আমার আইডির মেইন সুইচই অফ করে দিয়েছে। এরপর তালিয়া বাজিয়ে বলেছে, “ নে এবার তোরা তোরা মারামারি কর”।
সে তো গেলো আমার প্রতি বিরূপ বন্ধু আর তাদের ফেসবুক এডমিনের আগুন নিভিয়ে সুখে শান্তিতে ঘর করার গল্প। এদিকে বিনা মেঘে বজ্রপাতের আগুনে আমার মন পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। সেই কয়লায় না আছে আগুন না আছে ছাই। স্রেফ কাঠকয়লা যেমন হয়, তেমন। কথায় বলে কয়লা ধুলেও ময়লা যায়না, তাই আমি কয়লা ধুয়ে মন পরিষ্কারের চেষ্টা করিনি।
কয়লা মন নিয়ে ঘর সংসার করি, কয়লা মন নিয়ে ওয়ালমার্টে যাই, কয়লা মনে রেখে মুখে হীরের দ্যুতি ছড়িয়ে চাকরির আট ঘন্টা কাটাই। যখন ব্লগে লিখতাম, ‘ কত রকমের মানুষ’ নামে একটি পর্ব লিখতাম। ওয়ালমার্টে প্রতিদিন যত মানুষের সাথে দেখা হয়, তাদের কথা, তাদের সাথে আমার আবেগ অনুভূতি আদান প্রদানের গল্প লিখতাম সেই ‘কত রকমের মানুষ’ ধারাবাহিকে। সেই ধারাবাহিক থেকেই লেখা হয়ে গেলো আমার দ্বিতীয় বই ‘ মুহূর্তে দেখা মানুষ’।
এরপর যদিও ব্লগে লেখাও বাদ দিয়েছি ( কারণ হেফাজতিদের ভাষায় ব্লগার মানেই নাস্তিক, নাস্তিক মানেই পাপী, পাপী হলেই ঘাড়ে চাপাতি! বুড়ো বয়সে বিনা অপরাধে চাপাতির কোপ খেতে ইচ্ছে হয়নি বলে ব্লগে লেখা বাদ দিয়েছিলাম) তারপরেও ওয়ালমার্টে প্রতিদিন গেছি, প্রতিদিন কত রকমের মানুষ দেখেছি, কত রকমের জীবনের গল্প শুনেছি। আমার কাজ ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে, আমেরিকার প্রতিটি মানুষ ফোন ব্যবহার করে, তাই কাজের সুবাদেই প্রতিদিন নানা জাতের মানুষের সাথে কথা বলতেই হয়।
লেখাটি শুরু করেছিলাম ভালোবাসা দিয়ে, ভালোবাসার সাত রঙ। গতকালই ভ্যালেন্টাইন ডে গেলো তো, তাই মাথায় ভালোবাসার রকমারি রঙ খেলা করছিল। ওয়ালমার্টে চাকরিটা না করলে আমার জানাই হতোনা ভালোবাসার এত রঙ হয়, গোলাপের এত রঙ হয়। গোলাপের প্রতিটি রঙই ভালোবাসার কথা বলে। ভালোবাসার সাত রঙ যখন লিখেছিলাম, তখন জেনেছিলাম,
হালকা গোলাপী রঙের গোলাপ সুখ, রোম্যান্স, আনন্দ প্রকাশের প্রতীক এবং গাঢ় গোলাপী গোলাপ প্রাপকের প্রতি প্রেরকের ভালোবাসার স্বীকৃতি, হৃদয়ের স্নিগ্ধ ভালোবাসার প্রকাশ।
হলুদ গোলাপ অপরকে স্বাগত জানাতে, বন্ধুত্বের প্রতীক,পরম নির্ভরতা, আনন্দ-উচ্ছাস, ভালোবাসার প্রতীক। অপরকে স্বাগত জানাতে, নতুনকে আবাহন করতে, নতুন মা, নতুন গ্র্যাজুয়েট অথবা বাগদান বা বিয়ের আশীর্বাদ হয়ে যাওয়া পাত্র পাত্রীকে শুভেচ্ছা জানাতে
হলুদ গোলাপের জুড়ি মেলা ভার! হলুদ গোলাপ নতুন জীবন শুরুর আনন্দ ও ভালোবাসার প্রতীক।
পীচ ফল রঙা (হলদে কমলা) গোলাপ মানুষের মনের সৌন্দর্য্য ও নমনীয় ব্যাক্তিত্ব প্রকাশ করে। অপরের উন্নতিতে প্রশংসা করতে অথবা প্রিয় মানুষটির প্রতি মনের গভীর অনুভূতি বা আকুলতা প্রকাশ করতে পীচ রঙা গোলাপ হচ্ছে একমাত্র উপহার! কারো প্রতি সহানুভূতি প্রকাশেও পীচ গোলাপের জুড়ি নেই।
কমলা রঙের গোলাপ নিয়ে আসে অহংকার, উচ্ছ্বাস, আকাংক্ষার বার্তা! উজ্জ্বল কমলা রঙের গোলাপ প্রিয়জনকে জানিয়ে দেয় প্রেরকের মনের উষ্ণ, উদ্দীপনামূলক ভালোবাসার বার্তা, জানিয়ে দেয় প্রিয়জনকে কাছে পেতে চাওয়ার পরম আকাংক্ষার কথা! পূর্ণ প্রস্ফুটিত গোলাপের অর্থ, “ আমি তোমাকে নিয়ে গর্বিত”! কোমল ও বিষন্ন কমলা রঙের গোলাপ গুচ্ছ প্রেরকের স্বভাবের কোমলতা ও নমনীয়তাকে প্রকাশ করে।

‘প্রথম দর্শনেই প্রেম’ প্রকাশের অন্যতম উপহার হচ্ছে এক গুচ্ছ ল্যাভেন্ডার রঙের গোলাপ। ল্যাভেন্ডার বা হালকা বেগুণী রঙ একজনের প্রতি আরেকজনের গভীর ভালোবাসা বর্ণনা করে। প্রিয়জনকে ভালোবাসার গভীরতা বুঝাতে ল্যাভেন্ডার গোলাপের জুড়ি নেই।
একমাত্র ভালোবাসার সমপর্কে নীল গোলাপের স্থান নেই। তাই পৃথিবীতে নীল গোলাপের অস্তিত্বও নেই। রঙ হিসেবে ‘নীল’ অনেকেরই প্রিয়, কিন্তু ভালোবাসার মানুষটিকে উপহার দেয়ার জন্য, কৃত্রিম ‘নীল গোলাপ’ও দেয়া উচিৎ নয়।
নীল ব্যতীত সব রঙের গোলাপেই ভালোবাসার কথা লেখা আছে, কালো রঙের গোলাপেও ভালোবাসার কথা আছে। ভালোবাসার মৃত্যু নেই, পারস্পরিক সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলেও সম্পর্ক জোড়া দিতে কালো গোলাপ উপহারের জুড়ি নেই। কালচে লাল বা কালচে মেরুন গোলাপকেই ‘কালো গোলাপ’ বলা হয়। কালো গোলাপ মানে হচ্ছে পুণর্জন্ম, অথবা নতুন করে শুরু। অর্থাৎ ভালোবাসায় পরাজয় বলে কিছু নেই, হেরে যাওয়া জীবনে কালো গোলাপ ‘ আবার শুরু করি’ বার্তা বহন করে।

তবে ‘লাল গোলাপ’ ভালোবাসার নিরবচ্ছিন্ন প্রতীক। লাল মানে উষ্ণতা, লাল মানেই রোম্যান্স, লাল মানে সাহস! প্রিয় মানুষটিকে যদি এক গুচ্ছ লাল গোলাপ দেয়া যায়, স্বর্গীয় ভালোবাসা পৃথিবীতেই মূর্ত হয়ে উঠে!
গতকাল ভ্যালেন্টাইন ডে ছিল, ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার জুড়ে ছিল শুধু ‘ভালোবাসি ভালোবাসি’ গুন গুন, ‘ভালোবাসবো ভালোবাসবো’ সঙ্গিতের মূর্ছনা। রঙ বেরঙের গোলাপ হাতে রেজিস্টারের দিকে সকলের ভীড়। ৯৯ ভাগ পুরুষ ক্রেতা। প্রতি বছর এই দিনে ওয়ালমার্টে আমার কাজের স্কেজিউল থাকেই, এবং তাতে আমি মহাখুশি থাকি। কারণ মানুষের চোখে মুখের অভিব্যক্তিতে ভালোবাসা দেখতে আমার ভালো লাগে। একেকজনের অভিব্যক্তি একেকরকম। পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধ যখন তাঁর বৃদ্ধার জন্য গোলাপ কিনে, তাঁর ছানি পড়া চোখে ভালোবাসার যে স্নিগ্ধ আলো দেখা যায়, চব্বিশ বছরের আফ্রিকান আমেরিকান তরুণের চোখের তারায় স্নিগ্ধতা থাকেনা, দেখা যায় ভালোবাসার চকচকে আলো। আবার মধ্য চল্লিশের একজন পুরুষ দুই সন্তান সাথে নিয়ে যখন তার ভালোবাসার নারীটির জন্য গোলাপের ঝাড় কিনে, সেই চল্লিশের পুরুষের চোখে দেখা যায় ভালোবাসার পরিতৃপ্ত সুখের দ্যুতি। গতকাল এমন অনেক পুরুষ ক্রেতার কাছে ফোন, চকোলেট এবং গোলাপ বিক্রি করেছি।
বাড়ি ফিরে আমিও পেয়েছি আমার ষাটোর্ধ স্বামীর কাছ থেকে ভ্যালেন্টাইন ডে’র উপহার, তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি , দৃষ্টিতে কোন আলোকছটা নেই আছে পরম নিশ্চিন্ততা। এও ভালোবাসার আরেক রঙ। জাতে বাঙালি তো, রক্তে মিশে আছে বাঙালিপনা, ষাট বছর বয়সে পঞ্চাশের স্ত্রীর চোখে চোখ রাখতেই যেখানে লজ্জা পাওয়ার কথা, সেখানে দৃষ্টিতে পরম নিশ্চিন্ততার শীতল ছায়া মেখে তাকিয়েছে, ভালোবাসার সবুজ শ্যামল এই রঙটি কিন্তু আমেরিকার সাত রঙের মধ্যে দেখতে পাইনি।
ফেসবুক আইডিটা ব্যান হয়ে আছে প্রায় দুই মাস, আরও কত মাস ব্যান থাকবে জানা নেই। ফেসবুক ছিল আমার ভালোবাসার আসর। কত রঙের ভালোবাসায় ভরে থাকতো আমার ফেসবুক আঙিনা, সেই আঙিনা হঠাত ঝড়ে ঝরাপাতায় আলুঝালু হয়ে গেলো। মনটা খারাপ ছিল অনেক দিন, কিন্তু ভালোবাসা দিবসে মন খারাপ করে থাকতে নেই, আমি মন খারাপ করে থাকার ফুরসতও পাইনি। তবুও যাই ফেসবুকে, ফেসবুকের তালা বন্ধ ঘরে বসে দেখি উন্মুক্ত ঘরের বন্ধুদের হাসি খেলা সারাবেলা। তাদের মধ্যেই শায়লা খান, হাসান মৃধা, সেঁজুতিরা আছে, উম্মে আতিয়া আছে, তিথি, টুলু, আখতার ভাই, আতাউর ভাই, আছে, আমার খোঁজ নেয়। বইমেলা শুরু হয়েছে, বইমেলা চলছে, আমার বুকে ভাঙনের শব্দ শোনা যায়। আমার বুক ভাঙে, মন ভাঙে! হাসান তা বুঝতে পারে, সে বইমেলায় যায়। সিঁড়ি প্রকাশনে গিয়ে কিনে আনে আমার লেখা দুটো বই, ‘মুহূর্তে দেখা মানুষ’ সাগর ডাকে আয়’।
মুহূর্তে দেখা মানুষ ২০১৫ তে লিখেছিলাম। হাসান আমাকে বই দুটোর ছবি পাঠায়, আমাকে খুশি করবে তাই বই দুটোর ছবি দিয়ে হাসান কভার পিকচার বানায়। বই কিনে এনে হাসান বই শোকেসে সাজিয়ে রাখেনি। গতকাল কাজ থেকে ফিরে যখন ফেসবুকে বসেছি, দেখি হাসান পর পর দুটো মেসেজ দিয়েছেঃ
“মুহূর্তে দেখা মানুষ' বইটি পড়া শেষ করলাম। অনেক ভাল লিখো তুমি। লিখা একদম ঠিক আছে। কোন প্রবলেম নাই। তাছাড়া বইটি পড়ে কত কিছু জানলাম। এককথায় তোমার লিখার ধরণ অসাধারণ। খুব মায়া দিয়ে, আদর দিয়ে, গুছিয়ে লিখেছো প্রত্যেকের জীবনে গল্প গুলো। কোন কোন গল্প পড়ে আবেগে আমার চোখ দিয়ে জল পড়েছে, আবার হেসেও ফেলেছি তোমার দুষ্টুমিতে। অসাধারণ দিদি, সত্যি অসাধারণ। তুমি এইভাবে লিখা চালিয়ে যাও। থেমে যেও না। ( এবার তোমার ডাকে সাগর বেড়াতে যাচ্ছি, ফিরে এসে জানাবো।) লাভ ইউ দিদি।
“দিদি, তোমার 'সাগর ডাকে আয়' বইটি পড়তে পড়তে হারিয়ে যাচ্ছি, ফিরে আসতে পারব কিনা জানি না.... ভাল থেকো”।
ভালোবাসার এই আরেক রঙ। আমার হাতে একশো এক গোলাপ দিলেও মনে হয় আমি এত খুশি হতামনা, যত খুশি হয়েছি হাসানের মেসেজ দুটো পড়ে। এই তো ভালোবাসা! ভালোবাসা গ্রহণ করলে কিছু ভালোবাসা উপহারও দিতে হয়।
আমি হাসানকে লিখলাম,
“হাসান, মুসলমান পূর্ব জন্ম বিশ্বাস করেনা। কিন্তু তুমি পূর্ব জন্মে আমার মায়ের পেটের ভাই ছিলে। “
হাসানের জন্য এটাই ছিল আমার ভ্যালেনটাইন ডে’র উপহার।
আজ ছিল ভ্যালেন্টাইন ডে’র পরের দিন। আজও এসেছিল প্রচুর মানুষ, তবে আজ পুরুষের চেয়ে নারী বেশি এসেছে। কারণ গতকালের বেঁচে যাওয়া ফুল আজ অর্ধেক দামে দিয়েছে। অর্ধেক দাম দিয়ে কিনতে পছন্দ করে মেয়েরা, ছেলেরা নয়। ছেলেরা পুরোপুরিতে বিশ্বাস করে, ভাগাভাগিতে নয়। মেয়েরা ভাগাভাগির অংশ পেয়ে বড় হয় বলেই বোধ হয় পুরো দাম দিয়ে ভালোবাসা কিনতেও ভয় পায়, ভালোবাসা দিবসের পরের দিন এসে অর্ধেক দামে ভালোবাসা কিনে নিয়ে যায়। এটাও ভালোবাসার আরেক রঙ, অর্ধেক লাল অর্ধেক আড়াল।
আমার হাজার হাজার ইমিটেশনের গহনা আছে, বেশির ভাগই কানের দুল, কানের ফুল। হাজারটা কানের দুল আমার একার নয়, তিন কন্যা নিয়ে সংসার, চার নারীর গহনা জমে হাজারটা হয়েছে। গহনাগুলো ব্যবহার করা হয়না। আগে কানের দুল পালটে পালটে পরতাম, তখন বয়স আরেকটু কম ছিল, সাজু গুজু করতে ভালো লাগতো। এখন কানের দুল পাল্টাতে আলসেমি লাগে, দেড় বছর আগে অনলাইনে মাত্র এক ডলার দিয়ে কেনা এক জোড়া কানের দুল পরেছিলাম, আজও খুলিনি। মজার কথা হচ্ছে, কানে থাকা এই দুল জোড়া ওয়ালমার্টে যে দেখে সেই সুন্দর বলে। এমনকি সাত আট বছরের বালিকার নজরও এড়ায়না। আমাকে ডেকে বলে, তোমার কানের দুলগুলো কী সুন্দর! আমেরিকায় থাকতে থাকতে একটা জিনিস খুব বুঝেছি, যা কিছু ভাল, তা এপ্রিসিয়েট করতে হয়। এটা ভদ্রতা, এটা স্বভাবের কমনীয়তা, ঈর্ষাহীন মনোভাবের প্রকাশ। আজও এক সুন্দরী ফ্যাশন সচেতন সাদা মেম আমার সাথে কথা বলার এক ফাঁকে আমার কানে ঝুলতে থাকা দুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, " কী সুন্দর তোমার কানের দুলগুলো। এত সুন্দর রঙ, তোমার কানে মানিয়েছে দারুণ"।
ব্যস, মন খারাপের এই বয়সে সুন্দরী কোন বিদেশীনির মুখ থেকে অমন সুন্দর কথা শুনলে মন কতক্ষণ খারাপ থাকে! আমার মনটাও খুব ভাল লাগায় ভরে গেছিল। জানা কথা, চেনা কথা , এপ্রিসিয়েশনের কথা বার বার শুনতে ভাল লাগে।
ভালোবাসার আরেকটা গল্প বলি। আজ সকালে পঁচিশ বছর বয়সী এক তরুণ এলো। তরুণ বোধ হয় ওয়ালমার্টে খুব একটা আএনা। ওয়ালমার্টে আসে সাধারণ বিত্তের মানুষেরা, সস্তা দামী সব রকম দামের জিনিস পাওয়া যায় বলে। সেই তরুণ এসেছে, তার ফোন ভেঙ্গে গেছে, এখন তার ভাল একটা ফোন চাই। আমি সকল গ্রাহকের সাথেই ভাল ব্যবহার করি, ভাল ব্যবহার করার শিক্ষা আমেরিকা আসার আগেই পেয়েছিলাম, পরিবার থেকে। আমেরিকায় এসে দুয়ে দুয়ে চার হয়ে ভাল ব্যবহার এখন মহা ভালতে পরিণত হয়েছে। আমার মহা ভাল ব্যবহারে তরুণ মুগ্ধ হয়ে ফোনে সিম কার্ড ভরবার কায়দাও ভুলে গেছে। ফোনের ব্যাক কভারটাও খুলতে পারছেনা, হাত কাঁপছে। আমি সব কিছু করে দেয়ার পর সে আমার দিকে এমন অবাক করা, মুগ্ধ কৃতজ্ঞ দৃষ্টি মেলে তাকালো, ঐ চোখে আমি শুধু ভালোবাসার বর্ষা দেখলাম। আমার পুরো দিনটাই ভালোবাসাময় হয়ে উঠলো।
ভালোবাসার গল্প বলতে ভালো লাগে। আরেক রঙের ভালোবাসার কথা বলি। আজ এক বুড়ো দম্পতি এসেছিলেন। কি কিনেছিলেন, মনে পড়ছেনা। আমার মাথায় গেঁথে আছে বুড়ো বুড়ির ভালোবাসার টুকরো কথা। ওঁরা প্রথম যখন আমার কাছে হেল্প চাইলো, আমি উনাদের সাথে কথা বলতে বলতেই বুড়ির গলায় থাকা সোনার চেনের দিকে তাকালাম, সেখানে খুব ছোট্ট একটা লকেট।
লকেটটার ডিজাইন হচ্ছে, ছোট দুটি পাতাসহ অতি ক্ষুদ্র এক গোলাপ। বুড়ো কাস্টমারদের মন মেজাজ একটু খিটখিটে হয়তো, তাই শুরুতেই আমি বুড়োদের এটা প্রশংসা করে, ওটা প্রশংসা করে মনের উপর তেলের প্রলেপ দিয়ে দেই। বুড়োরা এজন্য আমাকে খুব পছন্দ করে। তা এই বুড়ির মনেও তেল দিয়ে দিলাম, বললাম, “ তোমার গলায় যে হারটা আছে, লকেটটা ভারী সুন্দর! বুড়ি একেবারে মোমের মত গলে গেলো। কেমন উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, “ এই লকেটটা তেত্রিশ বছর আগে আমাকে ‘ও’ ভ্যালেন্টাইন’স ডেতে উপহার দিয়েছিল। ওর কাছ থেকে পাওয়া প্রথম উপহার। এই পর্যন্ত পাঁচ বার হারিয়েছি লকেটটা, জানো আমার কি ভাগ্য, প্রতিবার কেউ না কেউ লকেটটা খুঁজে আমার হাতে দিয়েছে। একবার কি হয়েছে জানো, রাস্তার মধ্যেই পড়ে গেছে লকেট। আমি পাগলের মত খুঁজে চলেছি, এত ছোট লকেট এত বড় রাস্তায় পাওয়া যাওয়ার কথাই নয়। পাশ দিয়ে এক মেয়ে যাচ্ছিল, সেই লকেটটা দেখতে পেলো, তুলে এনে আমার হাতে দিয়ে বলল, “ এটা খুঁজছো তুমি?” এরপর থেকে আর হারাইনি, এখনও আছে।“
পাশ থেকে বুড়ো কিছু বলার জন্য উত্তেজনায় ছটফট করছিল। বুড়ি একটু দম নিয়েছে, সেই সুযোগে বুড়ো বলতে শুরু করেছে, “ এই দেখো, আমার গলায় দেখো, এই যে চেইন সাথে লকেট, এটাও তেত্রিশ বছর আগে ‘ও’ আমাকে দিয়েছিল। সেই যে গলায় পরিয়ে দিয়েছিল, আমি আজও খুলিনি গলা থেকে। তেত্রিশ বছর যাবত গলায় ঝুলছে, লকেট আমার বুক ছুঁয়ে আছে”।
ভালোবাসার গল্প কি এর চেয়েও সুন্দর হয়! বুড়ো বুড়িদের ভালোবাসার গল্প শুনতে গেলে আমার মন ছটফট করে, বুকের ভেতর যেন কিছু একটা তোলপাড় হয়। মনে পড়ে, আমাদের দেশে আমাদের দেশের বুড়ো বুড়িদের কথা, প্রৌঢ় প্রৌঢ়াদের কথা। বিয়ের বয়স দশ বছর পেরোতেই স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা কেমন নিস্তেজ হয়ে আসে, প্রেম ভালোবাসার ব্যাপারটা শুধু দুজনের মধ্যে থাকেনা, মন প্রাণ ধ্যান ধারণা আবর্তিত হতে থাকে অন্য দিকে। সংসার, সন্তান, পাড়া পড়ছি, চাকরি, বাজার, রান্নাঘরের হলুদ মরিচের কৌটার ভেতর। ওরা ইংরেজি ভ্যালেন্টাইন ডে বুঝেনা, বাংলায় ভালোবাসি বলতে জানেনা, হাত পা কাঁপতে কাঁপতেও যে একজন আরেকজনকে ‘ভালোবাসি’ বলা যায়, এই ধারণাটাই আমাদের সমাজে আজও তৈরী হয়নি।
আমার বাবা কি কখনও মা’কে বলেছে, “ চলো, তোমাকে নিয়ে একটা সিনেমা দেখে আসি”। আমি শুনিনি। অথচ সেদিন অসুস্থ বাবা বলল, “ তোর মা ছিল সিনেমা দেখার পোকা। বিয়ের পর তোর মা স্কুল থেকে সোজা তোর দাদুর বাড়ি চলে আসতো, আমি অফিস থেকে আমাদের বাসায় না গিয়ে তোর মাকে নিয়ে সিনেমা হলে চলে যেতাম”।
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি, যৌবনে আমার বাবা মাও রোমান্টিক ছিল, শুধু দুজনে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছে! এরপর আমরা বড় হতেই বাবা মায়ের ভালোবাসা, প্রেমের গতিপথ ঘুরে উল্টোমুখি হয়ে গেছে! কেন, লজ্জায়? সকলের সামনে ‘ভালোবাসি’ বলা শরমের ব্যাপার বলে?
তবুও ভাল, আমেরিকা আছি বলেই আমার ষাটোর্ধ বর ভ্যালেন্টাইন ডেতে আমাকে প্রতি বছর উপহার দেয়, মেয়েরা ফোন করে জিজ্ঞেস করে, “ পাপা, মা’কে কি দিয়েছো?” মেয়েদের বাবা লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলে ফেলে, “ তোমাদের মা’কেই জিজ্ঞেস করো, কি দিয়েছি”।
আমেরিকায় বড় হওয়া মেয়েরা মায়ের সাথে হাসাহাসি করে তাদের বাবার ভালোবাসা প্রকাশে লজ্জা পাওয়া নিয়ে। তারপরেও মেয়েরা খুব খুশি হয়, বলে,” মা, আমেরিকা থাকার একটা ভাল দিক কি জানো, ড্যাডি এখন আর ভুলে যায়না বিবাহ বার্ষিকীর কথা, ভ্যালেন্টাইন’স ডের কথা। বাংলাদেশে থাকতে ড্যাডি নির্ঘাত ভুলে যেত, নাহলে লজ্জা পেতো তোমাকে ‘ভালোবাসি’ বলতে, তাইনা মা?”
অনেকেই বলে, বাঙালির মা দিবস প্রতিদিন, বাবা দিবস প্রতিদিন, ভালোবাসা দিবস প্রতিদিন। আমি বলি, প্রতিদিনই মা দিবস বাবা দিবস ভালোবাসা দিবস বলেই তো আমাদের কাছে সব পানসে, আলুনি মনে হয়, সব কিছু গা সহা মনে হয়। প্রতিদিন আলুনি পানসে দিবস না কাটিয়ে বছরে একদিন জম্পেশ করে একেকটা উপলক্ষ তৈরী করে সবাই মিলে উদযাপন করলে মন্দ কি! ভালোবাসার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করতে সমস্যা কোথায়! দুনিয়াকে জানিয়ে, সবাইকে শুনিয়ে ‘ তোমাকে‘ভালোবাসি’ বলতে লজ্জা কি! ভালোবাসার কথাই তো, মন্দবাসার কথা তো নয়!

সবারে বাসরে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবেনা রে’

 ১৪ই ফেব্রুয়ারী, আমেরিকার আকাশে বাতাসে প্রিয়ার চোখে প্রিয়র চোখে প্রিয়জনের হাসিতে ভালোবাসা লুটোপুটি খাবে, ছুটোছুটি করবে, সুরের তালে নাচের ছন্দে ভেসে ভেসে বেড়াবে, উড়ে উড়ে বেড়াবে। আগামীকাল ভালোবাসাময় দিন, আজ রাত বারোটা পর্যন্ত সুপার স্টোর, বিপনী বিতান, শপিং মল জেগে থাকবে। জেগে থাকবে ভালোবাসার মানুষদের জন্য, যারা শেষ মুহূর্তেও ছুটে আসবে প্রিয়র জন্য উপহার কিনতে। আজকের দিনে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হবে গোলাপ, চকোলেট, পারফিউম, জুয়েলারি। উপহার সামগ্রীর নাম শুনেই বুঝা যায়, এসব কিছুর ক্রেতা পুরুষ, কিনবে নারীর জন্য। হ্যাঁ, ভালোবাসা নর নারী বুড়ো বুড়ি সকলের জন্যই সমান অর্থ বহন করলেও ভ্যালেন্টাইন ডে’র ভালোবাসার প্রকাশ খুব বেশি মূর্ত হয়ে উঠে নারীর প্রতি নরের ভালোবাসায়। কারণ ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইন ডে নামকরণই হয়েছে প্রেমিক পুরুষ ভ্যালেন্টাইনের নামানুসারে।
** তৃতীয় শতকে রোমের প্রধান পুরোহিত ছিলেন ভ্যালেন্টাইন নামের এক সাধু। ওই সময় সম্রাট ক্লডিয়াসের (দ্বিতীয়) ধারণা জন্মায় যে, বিবাহিত পুরুষের চেয়ে অবিবাহিত পুরুষই তার সেনাবাহিনীর জন্য বেশি উপযুক্ত। কোনো পিছুটান থাকবে না অবিবাহিত সেনাদের মনে। ফলে তারা অনেক বেশি দক্ষতা অর্জন করতে পারবে নিজেদের পেশায়। তার সেনাবাহিনীও হয়ে উঠবে অত্যন্ত চৌকস। তাই তিনি তার সেনাবাহিনীতে তরুণদের জন্য বিবাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আইন জারি করে দিয়েছিলেন।
প্রধান পুরোহিত ভ্যালেন্টাইন এই আইনটিকে খুবই অনৈতিক ও অযৌক্তিক মনে করেছিলেন। তিনি গোপনে অনেক তরুণ-তরুণীর বিয়ে নিজে উপস্থিত থেকে সম্পন্ন করেছিলেন। একসময় সম্রাটের কানে পৌঁছে যায় এই সংবাদ, সম্রাটের তৈরী আইন ভঙ্গ করছেন পুরোহিত এই মর্মে সম্রাট অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন ভ্যালেন্টাইনের উপর। সম্রাট ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
কারাগারে বন্দী ভ্যালেন্টাইনকে জেলারের তরুণী কন্যা প্রায়ই দেখতে আসত। মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত ভ্যালেন্টাইন আসন্ন মৃত্যুর কথা ভুলে যান, তাঁর হৃদয়ে বেজে ওঠে ভালোবাসার সুর। ধীরে ধীরে তিনি জেলারের তরুণী কন্যার প্রেমে পড়ে যান। বন্দী পুরুষ আর মুক্ত নারীর চোখের তারায় তারায় রচিত হতে থাকে ভালোবাসার কবিতা, চোখের তারায় ফুটে উঠতে থাকে স্বর্গীয় প্রেমের ফুল।
দন্ড কার্যকরের দিন এগিয়ে আসে, এবং মৃত্যুদন্ডের ক্ষণ এসে উপস্থিত হয়। চোখের তারায় তারায় রচিত প্রেমের দস্তখত রেখে যান ভ্যালেন্টাইন প্রেয়সীকে লেখা একটি মাত্র চিঠিতে। মৃত্যুর আগে ভ্যালেন্টাইন তার তরুণী প্রেমিকাকে উদ্দেশ করে একটি চিঠি লিখেছিলেন। নিচে দস্তখত করেছিলেন ‘তোমার ভ্যালেন্টাইন’ বলে। এই একটিমাত্র সম্বোধন,’ভ্যালেন্টাইন’ যা আজও সব তরুণ-তরুণী, কিশোর কিশোরী বুড়ো বুড়ি হৃদয়ে ঝঙ্কার তোলে।
ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনা চরিত্রদের মাঝে কিছু কাল্পনিক চরিত্র থাকে, প্রিয় চরিত্রগুলোকে নায়ক নায়িকা বানাতে তাঁদের সম্পর্কে মনের মাধুরী মেশানো বানানো গল্প থাকে। হতে পারে ভ্যালেন্টাইন ডে’র গল্পটিও কাল্পনিক , তবে পুরোহিত ভ্যালেন্টাইন সেই তরুণ সেনাদের কাছে মহান ছিলেন, সম্রাটের আদেশ অমান্য করে যাদের বিবাহ তিনি সম্পন্ন করেছিলেন, যে কারণে ভ্যালেন্টাই্ন মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন। সেই তরুণ সেনাদের মুখেই হয়তো এই প্রেমকাহিনী রচিত হয়েছিল, সেটাই ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুর পর বাতাসের কণায় কণায় ছড়িয়ে পড়েছিল! ভ্যালেন্টাইন ডে’র গল্পে ধোঁইয়াশা থাকতে পারে, ভিন্ন মত থাকতে পারে কিন্তু ইতিহাসে ভ্যালেন্টাইনের নাম লেখা আছে। ইতিহাস বলে, ভ্যালেন্টাইন ছিলেন অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল, সাহসী এবং রোমান্টিক। ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুর পর ‘সেইন্ট’(মহৎপ্রাণ সাধুদের মৃত্যুর পরে চার্চ থেকে ‘সেইন্ট’ ঘোষণা করা হয়) ঘোষণা করা হয়। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সবচেয়ে জনপ্রিয় সেইন্টদের মধ্যে ভ্যালেন্টাইন ছিলেন অন্যতম।
সত্যি মিথ্যে যাই হোক, সাধু ভ্যালেন্টাইনকে নিয়ে রচিত প্রেমের গল্পে, গল্পটা তো ভালোবাসার। ভালোবাসার চেয়ে মূল্যবান কিছুতো আজও সৃষ্টি হয়নি জীবকূলের মাঝে।
ফেব্রুয়ারিতে ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপিত হয়, অন্যতম কারণ হচ্ছে, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যু হয়েছিল। এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতেই ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপন করা শুরু হয় (সময়টা ছিল ২৭০ এ.ডি)।
তারও অনেক পরে, ফেব্রুয়ারীর ১৪ তারিখ ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে নির্বাচিত হয়। ফ্রান্স ও ইংলান্ডে সাধারণ বিশ্বাস ছিল যে, ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ পাখিকুলের‘মেটিং সিজন’ শুরু হয়। তাই ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখটিকে ‘ডে ফর রোমান্স’ হিসেবে ভ্যালেন্টাইনস ডে নির্বাচন করা হয়।
ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষে উপহার দেয়ার রীতির শুরু অষ্টাদশ শতাব্দীতে। সপ্তদশ শতাব্দীতে গ্রেট ব্রিটেনে ভ্যালেন্টাইনস ডে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হতো। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় বন্ধু বা সমাজের সর্বস্তরের ভালোবাসার জনদের মধ্যে ছোটখাটো উপহার, হাতে লিখা ছোট ছোট নোটস আদান প্রদান শুরু হয়। এই শতাব্দীর শেষের দিকে ছাপাখানায় মুদ্রিত কার্ডের প্রচলন শুরু হয়। সরাসরি ভালোবাসার কথা জানানো যেখানে সামাজিকভাবে নিরুৎসাহিত করা হতো, ছাপাখানায় মুদ্রিত ‘ভালোবাসি’ কার্ড সকল ভালোবাসানুরাগীদের ভালোবাসা প্রেম অনুরাগ প্রকাশ সহজ করে দেয়।
আমেরিকায় ১৭০০ সাল পর্যন্ত হাতে লেখা ভ্যালেন্টাইন নোটের প্রচলন ছিল। ১৮৪০ সালের দিকে এস্থার এ হাউল্যান্ড নামের ভদ্রলোক সর্বপ্রথম ব্যাপক আকারে ভ্যালেন্টাইন কার্ড বাজারজাত করে।
ভ্যালেন্টাইন ডে’তে শুধু যে পুরুষ ভ্যালেন্টাইনগণই উপহারের মাধ্যমে ভালোবাসা প্রকাশ করে, তা নয়। মেয়ে ভ্যালেন্টাইনগণও পিছিয়ে থাকেনা। নারীর মনতো বারো মাসই ভালোবাসায় পূর্ণ থাকে, মনের মত পাত্র পেলে ভালোবাসা দিয়ে পাত্র কানায় কানায় পূর্ণ করে দিতে নারীর জুড়ি মেলা ভার। তারপেও ভ্যালেন্টাইন ডে’র দিনটিতে নারীও উপহার কিনে তার ভালোবাসার মানুষটির জন্য। আর কিছু নাহোক, “ তোমায় ভালোবাসি’ লেখা কার্ড কিনে প্রিয়কে ভালোবাসার কথা জানাতে ভুল করেনা।
গ্রিটিং কার্ড এসোসিয়েশনের হিসাব অনুসারে আমেরিকায় আনুমানিক এক বিলিয়ন ভ্যালেন্টাইন কার্ড প্রতি বছর বিক্রি হয়ে থাকে। শতকরা ৮৫ ভাগ ভ্যালেন্টাইন কার্ডের ক্রেতা হচ্ছে মেয়েরা। আমেরিকা ছাড়াও ভ্যালেন্টাইনস ডে বিপুল সমারোহে উদযাপিত হয় কানাডা, মেক্সিকো, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ায়।
এসব পরিসংখ্যানবিদেরা অবশ্য জানেনা, হালে বাংলাদেশেও দারুণ উৎসাহে পালিত হয় ভ্যালেন্টাইন’স ডে। দিন বদলে গেছে, যুগ বদলে গেছে। আমাদের আগের প্রজন্মে, অর্থাৎ আমাদের বাবা মায়ের আমলে কন্যা কিশোরী হয়ে উঠার সাথে সাথে বিয়ে দিয়ে স্বামীর সংসারে পাঠিয়ে দিত, কিশোরী জানতেই পারতোনা প্রেম ভালোবাসা কি জিনিস, স্বামীও ভাবতে পারতোনা বিবাহিতা স্ত্রীকেও ‘ ভালোবাসি’ বলে আন্দোলিত করা যায়!, যে সমাজে স্বামী তার স্ত্রীকে ‘ভালোবাসি’ কথা মুখ ফুটে বললে সমাজে সে ‘স্ত্রৈন, ভেড়া পুরুষ’ বলে বিবেচিত হতো, সেই সমাজ আজ বদলে গেছে।
বর্তমান সমাজে ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপিত হয়, যদিও শহর কেন্দ্রিক তবুও কম কথা নয়। মানুষ আজ শহরমুখি, তাই ভালোবাসা সকলের মাঝেই ছড়িয়ে পড়ছে। আজকের সময়ে আমাদের প্রজন্মের প্রৌঢ় স্বামী তার মাঝবয়সী স্ত্রীর হাতে গোলাপ তুলে দিতে লজ্জা পায়না, স্ত্রী সকলের আড়ালে বুড়ো স্বামীর হাতে চায়ের পেয়ালা তুলে দিয়ে ঠিকই বলে, “ আজ নাকি ভালোবাসা দিবস। এই নাও, চায়ের মধ্যে ভালোবাসা মিশিয়ে এনেছি”। তরুণ তরুণীদের কথা বাদ দিলাম, ভালোবাসা দিবস তাদেরই জন্য। ভালোবাসুক ওরা, প্রাণ-মন ভরে ভালোবাসুক সবাই সবাইকে।
ভালোবাসা এমন এক অনুভূতি, যা সবার সঙ্গে বিনিময় করা যায়। প্রেমিক তার প্রেমিকাকে ভালোবাসবে, প্রেমিকা ভালোবাসবে প্রেমিককে, স্বামী তার স্ত্রীকে, স্ত্রী ভালোবাসবে স্বামীকে, বাবা-মা ভালোবাসবে সন্তানকে, গৃহস্বামী ভালোবাসবে গৃহকর্মে নিয়োজিত পরিচারক-পরিচারিকাকে, পরিচারক-পরিচারিকা ভালোবাসবে গৃহস্বামীকে। মনিব ভালোবাসবে তার পোষা কুকুর বা বিড়ালকে, খুকী ভালোবাসবে তার আদরের ময়না পাখিটাকে, খোকা ভালোবাসবে তার রাবারের ফুটবলকে, আর্জেন্টিনার সমর্থক ভালোবাসবে ব্রাজিল সমর্থককে, ব্রাজিল ভালোবাসবে আর্জেন্টিনাকে, মিত্র ভালোবাসবে শত্রুকে, সবাই ভালোবাসবে সবাইকে_ এমনটা ভাবতেই ভালো লাগে।
কবিগুরু সেই কবে কোনকালে গেয়েছিলেন_ ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি, এই সুরে কাছে-দূরে, জলে-স্থলে বাজাই বাঁশি।’ ঠিক এই ভালোবাসার সুরটি পৃথিবীজুড়েই বাজে বছরের একটি দিনে, ১৪ ফেব্রুয়ারিতে।অথবা অতুলপ্রসাদের সুর, " সবারে বাসরে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবেনা রে"।
ফুল তো বিক্রি হয় সারা বছরই, কিন্তু ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে আমেরিকাসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে যত গোলাপ বিক্রি হয়, সারা বছরের বিক্রীত গোলাপের চেয়েও সংখ্যায় অনেক অনেক বেশি। শুধু গোলাপই নয়, গোলাপের সঙ্গে কার্ড, ক্যান্ডি, নানা রকম মনোহারি উপহার। সবাই কেনে। কারণ একটাই, এই একটি দিন উপলক্ষে ছোট-বড়, তরুণ তরুণী কিশোর কিশোরী বুড়ো বুড়ি বস-সহকর্মি, বন্ধু-বান্ধবী সবাই আবেগতাড়িত হয়, পরস্পর শুভেচ্ছা-সম্ভাষণে দিনটিকে ভরিয়ে তুলতে চায়, যার রেশ পরের দিন, তারপরের দিন, তারও পরের দিন পর্যন্ত সবাইকে মানসিকভাবে উৎফুল্ল রাখে, দুশ্চিন্তামুক্ত রাখে।
আজ আমার কাজের স্কেজিউল বিকেল তিনটা থেকে রাত দশটা অবধি। এত রাত পর্যন্ত কাজে থাকতে ভাল লাগার কথা নয়, কিন্তু আমার খারাপ লাগছেনা। কারণ রাত দশটা অবধি আমি মানুষের ঢল দেখতে পাবো ওয়ালমার্টে। শিশু তরুণ কিশোর অল্প বয়সী পুরুষ, বয়স্ক পুরুষেরা ছুটে ছুটে আসবে যার যার প্রিয়জনের জন্য ফুল, চকোলেট বেলুন কার্ড জুয়েলারি কিনতে। আমার রেজিস্টারে যে পুরুষেরা আসবে, তাদের সকলের চোখের তারায় দেখতে পাব আলোর দ্যুতি, একটু একটু করে ঝিলিক দিবে। সবাই দেখতে পাবেনা এই ঝিলিক, আমার দেখার চোখ আছে তাই আমি দেখতে পাবো।
মেয়েরাও আসবে আজ, তবে কেউই হুড়মুড়িয়ে আসবেনা। খুব শান্ত পায়ে, ধীর গতিতে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখবে আর এর ফাঁকেই টুক করে প্রিয় জিনিসটি শপিং বাস্কেটে তুলে ফেলবে আমাদের নজর এড়িয়ে।
মেয়েরা সংসারের জিনিস কিনে সবাইকে জানান দিয়ে, বাচ্চার জিনিস কিনে সবাইকে জানান দিয়ে, কিন্তু ভালোবাসার মানুষটির জন্য ভালোবাসার উপহার কিনে খুব গোপনে। কেন গোপনে কিনে তা এক রহস্য। আমি নিজেও যা কিছু কিনি, খুব গোপনে, কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগে। হয়তো নারীর এই লজ্জাটুকুই তার অনুরাগ, ভালোবাসার অনুভব।
লেখাটি শুরু করেছিলাম, আগামীকাল দিয়ে। শেষ করছি আজ দিয়ে। কারণ আজই বর্তমান, বর্তমানই সত্য। অতীত আমাদের পাঠক্রম, যা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানকে সাজাই।আগামী আমাদের আশা, যার পানে তাকিয়ে বর্তমানের পথ পাড়ি দেই
সবাইকে ভালোবাসি, সবার প্রতি ভালোবাসা। হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন’স ডে