Saturday, November 23, 2013

সুখ এবং সুখী!!



আজ আমার বড়ই সুখের দিন, কারণ আগামী দুইদিন আমার ছুটি। এমন সুখের দিন প্রতিমাসের চতুর্থ সপ্তাহে আসে। আগে এমন ছিলনা, গত দুমাস হলো, স্বার্থ কিছু ছাড় দিয়ে এই সুখ কিনেছি।
ওয়ালমার্টে ডিপার্টমেন্ট ম্যানেজার বাদে আর কারোরই উইকএন্ড ছুটি থাকেনা। সপ্তাহে দুই দিন ছুটি থাকে, তবে সেই দুই দিন সপ্তাহের যে কোন দুই দিন হতে পারে। আমি এইসব নিয়মের গভীরে যাইনা, যা নিয়ম আছে, সেভাবেই মেনে চলি। চাকরীর শুরুতেই জেনেছি, প্রতি শনি বা রবিবার যদি আমি অফ থাকতে চাই, অফ থাকতে পারবো, বিনিময়ে আমার ফুল টাইম আওয়ার কমে যাবে। ফুল টাইম আওয়ার কমে গেলে এক সময় আমি পার্টটাইম স্ট্যাটাসে চলে যাব। পার্ট টাইম এসোসিয়েটদের সুযোগ সুবিধা অনেক কম, ফুল টাইমারদের হেলথ ইনসিওরেন্স থেকে শুরু করে বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। আমার তিন মেয়েকে আমি আমার হেলথ ইন্সিওরেন্স পলিসির মধ্যে রেখেছিলাম (ডাক্তার হওয়ার পর মৌটুসীর নিজের আলাদা ইন্সিওরেন্স হয়ে গেছে), তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই ফুলটাইম স্ট্যাটাস মেইনটেইন করে চলেছি।

আমি খুবই পরিবারবৎসল মানুষ। ছোটবেলা থেকেই মা-বাবা, ভাই, আত্মীয় স্বজন নিয়ে থাকতে ভালোবাসি। আমার বাবা-মা দুজনেই ছিলেন চাকুরীজীবি। প্রতিদিন সকালেই আমরা দলছুট হয়ে যার যার কাজে বেরিয়ে যেতাম, সন্ধ্যায় আবার সবাই একত্র হতাম। স্কুলে পড়ার সময় খারাপ লাগতোনা, মায়ের সাথেই স্কুলে যেতাম, মায়ের সাথেই একই সময়ে ফিরতাম। যেদিন আগে ফিরতাম, রান্নাঘরে ঢুকে দেখতাম, আমার ভাগের ডাল, তরকারী ঢাকা দেয়া আছে, সকালের রান্না করা ভাত ঠান্ডা হয়ে থাকতো, সেই ঠান্ডা ভাতই নিজেকে নিয়ে খেতে হতো। আমার কি খারাপ লাগতো? মাঝে মাঝে খারাপ লাগতো, মনে হতো, ইস! সবার মা ভাত মেখে খাওয়ায়ে দেয়, নাহলে ভাত বেড়ে খেতে দেয়, আমাকে নিজে নিয়ে খেতে হয়। মাঝে মাঝে খারাপ লাগা কেটে যেত যদি খাবারের মেন্যু ভাল থাকতো। আমাদের খাবারের মেন্যুতে কমন দুটি আইটেম ছিল, মুসুরের ডাল, কেচকী মাছ। দুটি আইটেমই আমার দুই চক্ষের বিষ ছিল, কিন্তু মাপা আয়ের সংসারে মায়ের কিছু করার ছিলনা। পাঁচ টাকায় বাজার হতো, চার আনা ভাগার কেচকি মাছ, পাঁচ ভাগা বা ছয় ভাগা আনা হতো। বেগুণ, আলু, ঝিঙ্গে কুচি দিয়ে রান্না করলে এতগুলো হতো। অবশ্য সব দিনই খারাপ যেত না, যেদিন ডাটা দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল রান্না হতো, সাথে ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে পাঁচ মিশালী তরকারী, সেদিন বরফ ঠান্ডা ভাতও দুই মুঠো বেশী খেয়ে ফেলতাম। খেতাম আর মনে হতো, আহ! কি স্বাদ! এই মুহূর্তে আমার চেয়ে সুখী আর কেউ নেই।
সবাই বলে, যার যার মায়ের হাতের রান্না নাকি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রান্না, আমি কখনও তা বলিনি। আমার মায়ের হাতের সব রান্নাই পৃথিবী শ্রেষ্ঠ ছিলনা, কিন্তু ইলিশ মাছের ঝোল, ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে সব্জী, অথবা চ্যাঁপা শুঁটকী ভর্তা, ডাটা, কুমড়ো, ঝিঙ্গে, আলু, বেগুণ, কাঁঠালবীচি দিয়ে চ্যাঁপা শুটকীর তরকারী, কুচো চিংড়ি আর বেগুণ, ঝিঙ্গে দিয়ে ঝাল ঝাল মাখা মাখা রান্না করতো, এই আইটেমগুলো শুধু পৃথিবী শ্রেষ্ঠ বললে ভুল হবে, জগৎ শ্রেষ্ঠ বললেও কম বলা হবে, এই সাধারণ আইটেম রেঁধে মা স্বর্গের রাঁধুণীকেও হার মানাতে পারতো। আমাদের পারিবারিক সুখের দিন ছিল সপ্তাহের রবিবার। সবার ছুটি, বাবা বাজারে যেতো, বাবার নজর খুব ভাল, মাছ খুব ভাল চিনতো, সব্জীও খুব ভাল কিনতো, ইয়া বড় বড় চিংড়ির মাথা কিনে আনতো, বড় মাছ আনতো, সেই মাছের তেলের বড়া আর চিংড়ির মাথা ভাজা, আহাহা! কি সুখের সময় ছিল, আমরা চার ভাই বোন আর বাবা-মা একসাথে মেঝেতে গোল হয়ে খেতে বসতাম। রবিবারের সুখ ছিল একেবারেই অন্যরকম।

খারাপ লাগা শুরু হয়েছে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে। দুপুরে কলেজ থেকে ফিরে ফাঁকা ঘরে খুব খারাপ লাগতো, খেতে ইচ্ছে করতোনা। বিকেল চারটা বাজলেই মন অপেক্ষা করতো কখন গেট নড়ার আওয়াজ পাব, মা চলে আসলেই পরিবেশ পালটে যেত। এমন নয় যে মা সব সময় খুব সোনা মুখ করে কথা বলতো, কিন্তু মা, বাবা, ভাইয়েরা সবাই ঘরে থাকলেই আমার অন্যরকম ভালো লাগতো। রাতের বেলা সবাই গোল হয়ে বসে রুটি (আমার দুই চক্ষের বিষ)আর তরকারী খেতাম, খারাপ লাগতোনা, কেমন যেনো সুখী সুখী মনে হতো।

ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে পরিবারের জন্য অন্যরকম টান বোধ করতাম। দূরে চলে গেছি বলে মা তার শাসনের মাত্রাও কমিয়ে দিয়েছিল, বরং আমার উপর নির্ভরতা বেড়েছিল। এরশাদ ভ্যাকেশনে বাড়ী এলে সেশান পিছিয়ে যাচ্ছে ভেবে বাবার মাথা গরম হয়ে যেতো, কিন্তু মা খুশী হতো। আমার উপর রান্নার দায়িত্ব দিয়ে মা ধীরে সুস্থে স্কুলে যেতে পারতো। এরশাদ ভ্যাকেশানে আমিও খুশী হতাম, অনেকদিন পর আমরা বাবা-মা, চার ভাইবোন একসাথে হতাম, কি সুখ, কি আনন্দ। আমাদের পাশের ঘরেই থাকতো আমার দাদু দিদিমা, মামা-মাসী। চলতো আমাদের তুমুল আড্ডা। মনে মনে চাইতাম, এরশাদ ভ্যাকেশান যেন অনন্তকাল ধরেই চলে।

বিয়ের পর মাস্টার্স কমপ্লীট করা পর্যন্ত আমার শুক্র-শনি বলতে কিছু ছিলনা। যখন স্বামী-কন্যা নিয়ে সত্যিকারের সংসার শুরু হলো, তখন থেকে আবার নতুন করে ছুটির দিনের সুখ শুরু হলো। আমার উত্তম কুমার দাম্পত্য জীবনের প্রথম পাঁচ বছর এনজিও গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালে চাকুরী করেছেন, আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়, উত্তম কুমারের তত্বাবধানে দেশীয় কোম্পাণীতেই ওষুধের কাঁচামাল প্রস্তুত করা শুরু হয়, সেই প্ল্যান্ট তৈরী করার সময়, দিন-রাতের অধিকাংশ সময় তাকে প্ল্যান্টে থাকতে হতো। শুক্রবারের দুপুরেও তাকে প্ল্যান্টে যেতে হতো। আমার সপ্তাহান্তের সুখ এসেও ফুড়ুৎ করে উড়ে যেত। উত্তমের একটি ব্যাপার খুবই ভাল ছিল, কাজের পরে এক মুহূর্তও সে বাড়ীর বাইরে থাকতোনা। সে জীবনের অনেকটা সময় একা একা কাটিয়েছে বলেই সংসারের নিরবচ্ছিন্ন সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাইতোনা।

পরবর্তী পাঁচ বছর সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগে অধ্যাপনা করেছে, ফার্মেসী বিভাগও তখন সবেমাত্র খুলেছে। আমরা ততদিনে ঢাকা চলে এসেছি, উত্তম কুমার ঢাকা টু জাবি যাওয়া আসা করতো। এটা ছিল বড়ই সুখের সময়, টাকাপয়সা ছিলনা, কিন্তু সংসারে সুখ ছিল। উত্তম প্রতিদিন সকালে বের হয়তো, দুপুরে বাড়ী চলে আসতো। উত্তম বাড়ী ফিরলে আমরা একসাথে খেতে বসতাম। আমি চাকুরী করতামনা, মৌটুসী আর মিশাকে নিয়ে থাকতাম, টুকী টুকী করে কত রকমের তরকারী রান্না করতাম, একটা কচু কিনলে, কচু থেকেই চার রকমের তরকারী রেঁধে ফেলতাম। আমি যাই রাঁধতাম, উত্তম তা খুব তৃপ্তি নিয়ে খেত। আমাদের সংসারটা ছিল, অনেকটা গরীব কিষাণের সংসারের মত, সচ্ছলতা নেই, সুখ আছে। প্রায় শুক্রবারেই কারো না কারো বাসায় বেড়াতে যেতাম। উত্তম হয়তো যেতে চাইতোনা, বৃহস্পতিবার এলেই আমার বায়না শুরু হয়ে যেত। সপ্তাহের ছয় দিন ঘরে থেকেছি, কাজেই শুক্রবার ঘরে থাকবোনা।

আমাদের বাড়ীতে মানুষজন বেড়াতে আসতে ভালোবাসতো। আমরা দুজনেই অতিথিপরায়ণ, আমার মেয়েরাও হয়েছে আমাদের মত, সব সময় লোকজন ভালোবাসে। উত্তমের ছাত্র-ছাত্রীরা আমাদের বাসায় আসতো, বিশেষ করে অমিয়, আলী, পিযূষ, খোরশেদ। অমিয়, আলী, পিযূষ থিসিসের কাজ নিয়ে যে কোন সময়ই আসতো, রাত দশতা এগারোটা বেজে যেত ওদের কাজ শেষ হতে। আমার ঘরে ওদের ভাত লেখা থাকতো, ওরাও জানতো, স্যারের বাসায় গেলে বৌদি ভাত খাইয়ে দিবে। তেমন কিছুই থাকতোনা, হয়তো ডাল চচ্চড়ী করতাম, আলু ভাজতাম, নাহয় ঝাল করে আলুর ভর্তা, দুই এক পদের সব্জী, মাছের ঝোল। ওরা কত আগ্রহ করে খেতো, এই দৃশ্য দেখার মধ্যে কি যে সুখ ছিল! নিজকে ভীষণ সুখী মনে হতো। সেদিনের সেই ছেলেমেয়েগুলো আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এখনও তাদের স্যারকে মনে রেখেছে, মাঝে মাঝেই ফোন করে।

অস্ট্রেলিয়া তিন বছর থেকে আবার বাংলাদেশে ফিরেছি। চার বছর উত্তম কুমার দেশের নামকরা ওষুধ কোম্পাণীতে বড় পোস্টে চাকুরী করেছে। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়, অর্থে, ধনে, জনে, মানে সবদিক দিয়েই সুখ উপচে উপচে পড়তো। তবে কাজের চাপে উত্তমের তখন সপ্তাহের ছয় দিন জান বেরিয়ে যেত। শুক্রবার সে বাড়ীতে থাকতো। আমি সপ্তাহের ছয় দিন গাড়ী নিয়ে টো টো করে বেড়াতাম, কাজেই শুক্রবারে না বেড়ালেও চলতো। শুক্রবারের সকালে ঘুম থেকে দেরী করে উঠতাম, বুয়া চা বানিয়ে আমাকে ডাকতো। গরম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে দিন শুরু করতাম।

দুই বছর আমি শিক্ষকতা করেছি। সেই সময় বুয়া রান্না করতো। আমার যেদিন মর্জি হয়তো, আমি রান্না করতাম। বুয়া চাইতো শুক্রবারের দিনে দাদা যেহেতু বাড়ীতে থাকে, তাই আমিই যেন রান্না করি। আমিও চাইতাম তা করতে, কিন্তু করা হতোনা। তিন মেয়ে নিয়ে আমি উত্তমের চারপাশে ঘুর ঘুর করতাম। তিন মেয়েকে ঘিরে ছিল তার জীবন। মেয়ে তিনটি এইজন্যই বাবার ন্যাওটা হয়েছে। কারোরই ক্ষিদে পেতোনা, গায়ে গায়ে লেপটে বসে থাকতাম, টিভি দেখতাম, ছোট্ট মিথীলা ওয়াকারে চড়ে ঘুরতো আমাদের সামনে দিয়ে। এক সময় হয়তো বুয়াকে ডেকে বলতাম, বুয়া তুমিই রান্না করে ফেলো। আমি আজকে রান্না করবোনা। বুয়া জানতো, এমনটিই হবে। দুপুর বা সন্ধ্যার দিকে উত্তম যখন কম্পিউটার টেবিলে বসে কাজ করতো, আমি তার চেয়ারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতাম। উত্তমের সেই ধ্যানমগ্ন, মনোযোগী চেহারাটি দেখতে এত ভাল লাগতো, মনে হতো, এই জ্ঞাণী, বিদ্বান পুরুষটি আমার স্বামী,(স্ব+আমি),আমার যাবতীয় আবদার, আহ্লাদ, অভিযোগ, দাবী সবই তার কাছে করতে পারি, আমার চেয়ে সুখী আর কে আছে!


আর যদি আমাদের বাসায় তখন আমার মা, ছোট মাসী থাকতো, তখন তো আর লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে উত্তমের কাছে গিয়ে বসে থাকতে পারতামনা, আমাকে রান্নাঘরে যেতেই হতো। নাহলে স্বামীকে রান্না করে খাওয়াইনা অভিযোগে মায়ের ক্যাটক্যাটানি শুনতে হতো। কাজেই রান্নাঘরে মাসী-বোনঝি মিলে রান্না করতাম, রান্না অবশ্য আমিই করতাম কারণ আমার ছোট মাসী সকল অসাধ্য সাধন করার ক্ষমতা রাখলেও রান্নার মত সহজ কাজটি খুব সহজে করতে পারেনা। রান্না করার সময় মা চেয়ার টেনে বসে নিজের জীবনের রকমারী গল্প শুনিয়ে যেত। ফাঁকে ফাঁকে বুয়া চা বানাতো, আমাদের সবাইকে চা খাওয়াতো। মিথীলার পাপা তখন মিথীলার কান্ড কারখানা দেখতো, আমাদের আসরে এসে শুনিয়ে যেত গুড্ডু (মিথীলা) কি মজার কান্ড করেছে। তেমন দিনে কুটু(মিশা)কে ডাকতো তার মাথা চুলকে দেয়ার জন্য! কোন কোন উইকএন্ডে মেজদাও এসে যোগ দিত। সে এক উৎসব লেগে থাকতো।কখনও কখনও আমরা দল বেঁধে বেড়াতে যেতাম। সারা বাড়ী হই হুল্লোড়ে মেতে থাকতো। কি যে সুখ ছিল, প্রথম জীবনের সুখে টাকার ছোঁয়া ছিলনা, শুধুই নিজেদের মধ্যে শান্তি এবং সুখ ছিল, আমেরিকা আসার আগের চার বছরের সুখে টাকারও ছোঁয়া ছিল, তাই সুখগুলোকে অনেকের মধ্যে ভাগ করে দিতে পেরেছিলাম।


আমেরিকা চলে এসেছি, সুখের কিছু ব্যত্যয় ঘটেছে। শুধু স্বামী-স্ত্রী, তিন কন্যাতে আর কতটুকু সুখী হওয়া যায়, তারপরেও উইকএন্ডগুলো ভালোভাবেই কাটিয়েছি। দুই বছর পর মৌটুসী ভার্জিনিয়া কলেজে চলে গেলো, আমরা মিসিসিপি চলে এলাম, ভেঙ্গে গেলো পাঁচজনের নিরবচ্ছিন্ন সুখের সংসার। নিজেও ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম নার্সিং পড়ার জন্য, বরের টাকায় পড়তে সংকোচ হচ্ছিল বলে নার্সিং পড়তে পড়তেই ওয়ালমার্টে চাকুরী নিলাম। ভাল রেজাল্ট করবো বলে উইকএন্ডেও প্রচুর পড়াশোনা করতাম, রেজাল্ট হতো সব সাবজেক্টে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানাটমী ল্যাবের দরজায় ডঃ বিল পার্কার একখানি নামতালিকা টাঙিয়ে রেখেছেন, কে কোন বছর অ্যানাটমীতে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছে। আমার নামের পাশে সবচেয়ে বেশী স্কোর ৯৮% লেখা আছে। এগুলো করতে গিয়ে সুখ কিছুদিনের জন্য নির্বাসিত হলো। শেষ পর্যন্ত দুই সেমেস্টার বাকী থাকতে প্রফেসরের উপর রাগ করে নার্সিং পড়া ছেড়ে দিলাম। আসলে, তখন তো আমার মনে সুখ ছিলনা, টাকার ছোঁয়া না থাকা সুখ, অথবা টাকার ছোঁয়া থাকা সুখ, কোনটাই ছিলনা, তাই পড়া ছেড়ে দিতে সময় লাগেনি।

ওয়ালমার্টেই ফুলটাইম চাকুরী শুরু করলাম। আমেরিকায় প্রথম চাকুরী, আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা কারো কাছেই প্রকাশ করিনা। আমার স্বভাবে সব ব্যাপারেই দ্বিমুখী নীতি কাজ করে। ছোটবেলা থেকেই আমার ফেরীওয়ালীর জীবন খুব ইন্টারেস্টিং মনে হতো, মাথায় টুকরী নিয়ে সারা পাড়া ঘুরে বেড়ায়, কত কিছু দেখে, কত মানুষের সাথে পরিচয় হয়, আমারও ইচ্ছে করতো মাথায় টুকরী নিয়ে বেরিয়ে পড়তে। লেখাপড়ায় মোটামুটি মেধাবী ছিলাম বলে ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ইউনিভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন দেখতাম। যখন আড়ং; চালু হলো, আড়ং এর সেলস গার্লদের দেখলে নিজেকে তুচ্ছ মনে হতো, মনে হতো, ইস! আমি যদি সেলস গার্লের চাকরী করতে পারতাম। কি সুন্দর করে কথা বলে বলে জিনিস বিক্রী করতাম। আবার ভাবতাম, এত ডিগ্রী নিয়ে সেলসগার্লের চাকুরী করবো? আমি যখন এগুলো ভাবি, ঈশ্বর তখন হাসেন। মাঝ বয়সে এসে পূর্ণ হলো কৈশোরের স্বপ্ন। আমি ওয়ালমার্টে সেলস এসোসিয়েটের কাজ করি, সুখী হওয়ারই কথা। সুখী হই, মাঝে মাঝে দ্বিমুখী মন আমাকে খোঁচা দেয়, কেমিস্ট্রি তে অনার্স, মাস্টার্স, বিএড, নার্সিং(স্থগিত) বিদ্যা নিয়ে রীটা রয় ফোন বিক্রী করে। তখনই মনে হয়, অনেক হয়েছে, আর করবোনা চাকরী।

আমার সেই হারাণো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে, বুকের ভেতর কান্নাগুলো ছলকে ছলকে উঠে। কাজে যাই মুখ ব্যাদান করে, বাসায় ফিরি মুখ ব্যাদান করে। আমার ছোট্ট মিথীলা একেবারে একা একা বড় হচ্ছে। আগে তো বাসার পরিবেশ আমি প্রাণবন্ত করে রাখতাম, পাশে ছিল মৌটুসী, মিশা। এখন তো শুধুই উত্তম কুমার, মিথীলা আর আমি। উত্তম কুমার তার লেখাপড়ার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, যে কাজ করতে দশ মিনিট লাগার কথা, সেই কাজ মিথীলা নিজের ঘরে সারা দিনমান লাগিয়ে করে, ক্ষিদে পায় কিনা জানিনা, আমার বাড়ী ফেরার অপেক্ষায় থাকে। আমি ফিরলে আমার সাথে বসে খায়। এ কোন জীবন হলো? প্রায়ই হুমকী ধমকী দেই, ছেড়ে দিব এই চাকরী। কিন্তু হুমকী ধমকী কাকে দেবো? কেউ তো আমাকে বলেনি চাকুরী করতে! আমার হুমকী ধমকী শুনে তিতি বিরক্ত হয়ে উত্তম বলে, ভাল না লাগলে ছেড়ে দাও চাকরী, চাকরী করতেই হবে এমন তো কোন কথা নেই

হঠাৎ মনে হলো, আওয়ার কাটা যায় যাক, পার্ট টাইম হয়ে যাই যাক, আমি সপ্তাহের প্রতি শনিবার পারমানেন্ট অফ ডে করে নেবো। যা ভাবা, সেই কাজ। গত দুই মাস আগেই আমি ম্যানেজারকে দিয়ে শনিবারের ছুটি অ্যাপ্রুভ করিয়েছি। অনেক আগে আমি মাসের চতুর্থ রবিবার অফ রেখেছিলাম। শনিবার অফ হওয়াতে ভেবেছিলাম, আগের রবিবারের ছুটি বোধ হয় বাতিল হয়ে যাবে। দেখলাম, পার্সোনেল ম্যানেজারের চোখে পড়েনি অথবা সে ব্যাপারটি নিয়ে মাথা ঘামায়নি। এখন প্রতি শনিবার এবং মাসের চতুর্থ রবিবার আমার ছুটি থাকে।

মিথীলা খুব ঠান্ডা সুস্থির মেয়ে, আমি বাসায় থাকলে ও খুব হই হই করেনা, আবার শুক্রবার আসলেই জিজ্ঞেস করতে ভুলেনা, মা, তোমার কালকে ছুটি? যখন বলি, হ্যাঁ ছুটি, তাহলে ও বলবে, কাল তাহলে কোথাও যাচ্ছি, নাকি কেউ আসবে আমাদের বাসায়? আমার এত ভালো লাগে! এতো আমারই মেয়ে, আমার স্বভাব পেয়েছে। মাঝে মাঝেই জিজ্ঞেস করে, মিআ (মিশা)কবে আসবে? মিশা এলে মিথীলার আনন্দ আর ধরেনা। মিশার খিদমত করে খুব আনন্দ পায়। মৌটুসী আসেনা কতদিন, গত বছর ক্রীসমাসে এসেছিল, এই বছর ক্রীসমাসে আসবে। মৌটুসী এলে মিথীলার আদর বেড়ে যায়। আমার সংসার আবার আগের মতো কলবলিয়ে উঠে। বুঝি, এ সবই সাময়িক। উৎসব শেষে সব পাখী নীড়ে ফিরে যায়।

আমি কাল বেলা বারোটায় ঘুম থেকে উঠবো। আমার আগেই উত্তম কুমার উঠে যাবে, চা বানাবে, নিজের চা খাবে, আমার চায়ের কাপ ঢেকে রাখবে। ঘুম ভেঙ্গে মিথীলা, মনা, বাবলুসোনা, যাও তো আমার চা গরম করে নিয়ে এসো বলে আড়মোড়া ভাঙ্গবো। মিথীলা চা নিয়ে আসবে, সাথে বিস্কুট। আমি বলবো, বিস্কুট খাবোনা। মিথীলা বলবে, খালি পেটে চা খাবে কেন? প্রাণটা জুড়িয়ে যাবে। মা কোথাও নেই, আবার মা যেন সর্বত্রই আছেন। আসলে কাল আমার ঘুম ভেঙ্গে যাবে সকাল ছয়টায়, অন্যদিন তো ঘুম ভেঙ্গে গেলে আবার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। কাল যেহেতু ছুটি, তাই চোখ বন্ধ হবেনা, সাতটার মধ্যে বিছানা ছেড়ে ঘর-দোর পরিষ্কার করে কম্পিউটারে বসে যাব। দেশপ্রেম টপিকের উপর একটি গল্প লিখে শেষ করবো।

আজ ব্রেড কিনে এনেছি, সাথে মকা ব্রেড স্প্রেড এবং এপ্রিকট জেলী এনেছি। ছোটবেলায় জানতাম, বড়লোকেরা পাউরুটিতে মাখন মেখে চিনি ছড়িয়ে খায়। একেবারে স্বপ্নের খাবার মনে হতো। আমরা পাঁউরুটি পেতাম জ্বর হলে পরে। জ্বরমুখে সেই পাঁউরুটি বিস্বাদ লাগতো। যখন স্বপ্নের পাঁউরুটি আর মাখন বাস্তবে ধরা দিল, তখন স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে গেছি, বাটার খাইনা। হঠাৎ করেই আজ বেপোরোয়া হয়ে গেলাম, এইসব চকোলেট স্প্রেড অনেক কাল খাইনা, কাল খাবো। গল্প লিখবো আর মিথীলাকে বলবো, মিথ, শোনো, কিচেনে গিয়ে দেখো, পাপা চা করে রেখেছে, চা গরম করে, সাথে দুই পিস ব্রেড মকা স্প্রেড দিয়ে মেখে আনো

দুপুরে কিছু একটা বানিয়ে খেয়ে নেবো। রাতে বন্ধুর বাড়ীতে আমাদের নেমন্তন্ন আছে। উত্তম বলেছে, কিছু একটা খাবার বানিয়ে নিয়ে যেতে। ভাবলাম, এগ ডেভিল বানিয়ে নিয়ে যাব। সে বানাতে আর কতক্ষণইবা লাগবে। নেমন্তন্ন খেয়ে বাড়ীতে যখনই ফিরিনা কেন, তাড়া তো কিছু নেই। পরের দিনও আমার ছুটি। বেলা বারোটায় ঘুম থেকে উঠবো, হাতের কাছেই পাব গরম চায়ের পেয়ালা। আহারে! সুখ কি কোন অচিন পাখী? সুখী হতে এর চেয়ে বেশী আর লাগে কি?

Monday, November 18, 2013

এদিন নতুন মা’ হলাম!





Rita Roy Mithu's photo.
Rita Roy Mithu's photo.
Rita Roy Mithu's photo.





সেদিনের কথা, তখন অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ি, জানতে পারলাম আমাদের সংসারে নতুন অতিথি আসছে। নতুন অতিথি আসছে, এতো ভারী খুশীর সংবাদ, কিন্তু তখন আমি এমনই ক্যাবলা ছিলাম যে মা হতে চলেছি কথাটা বলার মধ্যে গর্বের চেয়েও লজ্জা বা সংকোচ পেতাম বেশী, তাই মুখ ফুটে কাউকেই কখনওই বলতে পারিনি মেয়ে থেকে পূর্ণাঙ্গ নারী হয়ে উঠার গৌরবকথা।
লেখাপড়াতে আগেও আমার মনোযোগ ছিলনা, সন্তান আগমনের সংবাদে অনার্স পরীক্ষা দেয়ার কথাও ভুলে গেলাম। পাশে পেয়েছি মহামানব উত্তম কুমারকে, যদি বলি পড়বোনা, সে বলে, ওকে, পড়োনা। পড়ালেখাটাই তো আর জীবনের শেষ কথা হতে পারেনা। যদি বলি, পড়বো, তাহলে বলবে, অবশ্যই পড়বে, একমাত্র লেখাপড়ার মাধ্যমেই মানুষ জীবনকে উপলব্ধি করতে পারে

আমার অবস্থা হয়েছে এমন যে অনার্সের ক্লাস ফাঁকীও দিতে পারিনা, আবার প্রতি পদে পদে আহ্লাদ আর ঢং করা বাদ দিতে পারিনা। মজার কথা হচ্ছে, একই সময়ে আমার ছোট মাসীও প্রথম মা হতে চলেছে। মাসীর শ্বশুরবাড়ী সুনামগঞ্জে, আমার স্বামীর বাসা সাভারের গণস্বাস্থ্যে। মাসী তো দিদিমার ছোট মেয়ে, শুরু থেকেই দিদিমা উনার মেয়েকে নারায়ণগঞ্জে এনে রেখে দিয়েছে। ওদিকে আমি তো ছটফট করি, সব আদর আর আহ্লাদ মাসী একা পাচ্ছে, আর আমি গণস্বাস্থ্যের বাসায় বসে কেমিস্ট্রির রিঅ্যাকশান মুখস্থ করে যাচ্ছি। দিদিমার কাছে যেমন উনার ছোট মেয়ে, আমার মায়ের কাছেও তো আমি একটা মাত্র মেয়ে। আমাদের লেখাপড়ার ব্যাপারে বাবা যতটা কঠোর ছিলেন, মা ছিলেন ততটাই উদাসীন। কাজেই মা আমাকে নারায়ণগঞ্জে আসতে বললেন। তখন উত্তম কুমার ছিল খুবই ভাল মানুষ, এখনকার মত অত লায়েক হয়ে উঠেনি। আমি যা চাই, তাতেই হ্যাঁ, আমি চেয়েছি মায়ের কাছে যেতে, উত্তম কুমার সাথে সাথে বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই যাবে। উত্তমকে একা ফেলে রেখে, অনার্স ক্লাস বাদ রেখে আমি মায়ের কাছে চলে এলাম।

ছোট মাসী আবার হাত গুণতে জানে, বিয়ের আগেই আমার হাত গুণে বলে দিয়েছে, আমার প্রথম সন্তান ছেলে হবে। এদিকে উত্তম তো আবার রাম না জন্মাতেই রামায়ণ রচনা করে ফেলেছেন। বিয়ের আগে কবে কোথায় কোন এক বাচ্চা মেয়েকে দেখেছে, খুবই টুকটুকী ধরণের, সেই বাচ্চার নাম মৌটুসী। সেদিনই বাল্মিকী মুনির মত উনি ঠিক করে ফেলেছেন, তার প্রথম সন্তান হবে কন্যা, কন্যার নাম হবে মৌটুসী। উত্তমের রামায়ণ শুনে আমি হাসি, মনে মনে বলি, আমার ছোট মাসী সোনার চেন ঘুরিয়ে গণনা করে, সবাইকে ঠিকমত বাচ্চা-কাচ্চার কথা বলে দেয়, গণনা একেবারে সঠিক প্রমানিত হয়েছে। আমাকেও বিয়ের আগেই বলেছে, আমার প্রথম সন্তান হবে ছেলে। উত্তমকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিলাম, তাই ছেলের কথা শুনলে দুঃখ পেতে পারে ভেবে তাকে আর মনের কথা বলিনি। মনে মনে ছেলের নাম খুঁজে বেড়িয়েছি।

নারায়ণগঞ্জে এসে মাসী-বোনঝি খুব গলাগলি ভাব, আবার একটু রেষারেষি ভাব। মাসী জানে, তার মেয়ে হবে, মেয়ে খারাপ নয়, তারপরেও সমাজে সবাই বলে পুত্রের মা ভাগ্যবতী। কাজেই আমার প্রতি তো একটু ঈর্ষা হবেই, উনি নিজেই তো গুণে বলেছেন আমার ছেলে হওয়ার কথা। আর আমিও অহংকার দেখানোর সুযোগ ছাড়বো কেন। আমার চালচলনেই সর্বক্ষণ হাওয়ায় উড়ি ভাব। লাজুকলতা ছিলাম বলে নবাগত অতিথিকে নিয়ে মুখে কিছু বলতামনা,তবে আচারে ব্যবহারে আহ্লাদীপনা বেড়ে গিয়েছিল। ঘরে কোন কাজকর্ম করতে হয়না, মাসী-বোনঝি মিলে এখানে যাই, ওখানে যাই। ভুলেই গেছি, আমার যেখানে সেখানে আছাড় খাওয়ার বাতিক আছে। তখন বাবুটা গর্ভে পাঁচ মাস বয়সের হয়েছে বোধ হয়, মাসীর সাথে হা হা হি হি করে দৌড়ে ঘর থেকে বের হতে গিয়েছি, চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে সোজা দাঁড়ানো থেকে ধপাস করে বারান্দার ফ্লোরে বসে পড়ে গেছি। ভীষণ আওয়াজে সবাই ঘর থেকে বের হয়ে দেখে আমি বারান্দায় বসে আছি, সোজা হয়ে উঠতেই পারছিনা। তারপর নিজে নিজেই উঠে দাঁড়ালাম, টের পাচ্ছিলাম সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যাওয়ার অনুভূতি! ছোট মাসী বার বার জিজ্ঞেস করে, মিঠু, কীভাবে পড়ে গেলি! কোথায় ব্যথা পাইছস? পেটে ব্যথা পাস নাই তো?
আমি তো তখন বোকার মত হেসে বলি, নাহ! কিছু হয় নাই।
আমার বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, বললেন, ডাক্তার ডাকতে। বাবার কথা শুনে আমি তো লজ্জায় মরে যাই। এমনিতেই আমি বাবা, মা, ভাইদের সামনে দাঁড়াতে লজ্জা পেতাম, তার উপর সেদিন সবাই ভীড় করেছে। মাসী বলল, আমি ওকে নিয়ে ামাদের কৈলাস ডাক্তারের কাছে যাই, আর্নিকা খেতে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। মাসীর সাথে পাড়ার হোমিওপ্যাথী ডাক্তার কৈলাস বাবুর চেম্বারে গেলাম। উনি চিনির গুল্লী খেতে দিলেন। এখন মনে পড়েনা, কৈলাস ডাক্তারই কি বলেছিলেন নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আনার কথা, নাকি মাসী নিজে থেকেই গেছিল, যেটাই হোক, দুজনে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে গেলাম, তাও আবার রিকসায় চড়ে, রাস্তার ভাঙ্গায় ঠোকর খেতে খেতে! এখন ভাবি, ২৭ বছর আগেও আমরা কত বোকা আর অজ্ঞ ছিলাম। না বুঝেই এক ভুল থেকে আরেক ভুল করতাম।

নারায়ণগঞ্জ হাসপাতাল থেকে বলে দিল, সব ঠিক আছে। মনে মনে বলি, ঠিক থাকতেই হবে। এই বাচ্চার তো এতদিনে আমার গর্ভেই থাকার কথা ছিলনা, প্রেগন্যান্সীর প্রথম দিকে কিছুই না জেনে স্কিন অ্যালার্জীর জন্য ডাক্তারের পরামর্শে টেট্রাসাইক্লিন কোর্স কমপ্লীট করেছিলাম। গায়নোকোলোজিস্ট ডাঃ সুফিয়া খাতুন যখন জানতে পেরেছেন, টেট্রাসাইক্লিনের কথা, উনি তো সাথে সাথে এম আর করিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। আমরাও মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, এম আর করিয়ে ফেলবো। আমার মন মানছিলনা, কারণ মাসি বলেছে, আমার ভাগ্যে দুটো বাচ্চা আছে, প্রথম ছেলে, পরে মেয়ে। ছেলেটাকে ফেলে দিতে হবে? যাই হোক, ডাঃ ফিরোজা বেগমের কাছে গেলাম, উনি বললেন, টেট্রাসাইক্লিন তিন মাস প্রেগন্যান্সী থেকে ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। আমার যেহেতু একেবারে শুরু ছিল, তাই ক্ষতি হবেনা। এই তো আমার ছেলেটা গর্ভে রয়ে গেল।

আমার সন্তান যখন আটমাসের গর্ভে, মাসীর কোল জুড়ে এলো মিত্রা। মিত্রাকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল থেকে মাসী বাড়ী এলো, দিদিমা তাঁর নাতনীকে কি যে যত্ন করতে লাগলো। আমার মা কি এগুলো লক্ষ্য করতো কিনা কে জানে! আমি জানালা দিয়ে উঁকী দিয়ে সব লক্ষ্য করতাম, আর মনে মনে হিংসা করতাম, ইস! মেয়েকে নিয়ে বুড়ীর কত ঢং, আমার দিকে ফিরেও তাকায়না। আবার মজাও পেতাম। ভাবতাম, মাসীর তো মেয়ে হয়েছে, তাই নিয়েই দিদিমার এত আহ্লাদ, আর আমার যখন ছেলে হবে, তখন মজা বুঝবে।

এদিকে আটমাসের সময় ডাঃ সুফিয়া খাতুন বলে দিলেন, বাচ্চা ব্রিচ পজিশনে আছে, তাই সিজারিয়ান অপারেশান হবে। বাসায় এলাম, এই সময়টাতে উত্তম কুমার প্রতি উইক এন্ডে চলে আসতো। তখন সময়টা ছিল আহ্লাদ-আনন্দে ভরা, চারদিকে শুধুই ভালোবাসার রঙ। সিজারিয়ান অপারেশান করা হবে, তাই ডাক্তার আগে থেকেই দিন,ক্ষণ ঠিক করে দিলেন, ২৬শে নভেম্বার অপারেশান হবে। নভেম্বারের প্রথম সপ্তাহে ছোট মাসী আমার হাতে সোনার চেন ঘুরালো, আমার মনে আছে, চেন উল্টোদিকে ঘুরছিল, অর্থাৎ মেয়ে হবে। মাসী আবার ঘুরালো, আবার উলটো দিকেই ঘুরে। আমরা সবাই হেসে কুটিপাটি, মাসীকে নিয়ে ঠাট্টা করি। তৃতীয়বারে মাসী জোর করেই যেন চেনকে ঠিকভাবে ঘুরিয়ে বলল, কি জানি, আমার আঙ্গুল বোধ হয় ঘামে ভিজে গেছে, তাই চেন ঠিকমত ঘোরেনি। এই তো এখন আবার বলছে, ছেলে হবে। তখনও ছেলের জন্য কোন জুতসই নাম খুঁজে পাইনি।

১৮ই নভেম্বার কি জানি কেন, মনে হলো, আমার শরীর ভালো লাগছেনা। প্রথম অভিজ্ঞতা তো, তাই অল্পেই ঘাবড়ে যাই। হুলুস্থূলু লাগিয়ে দিলাম, মনে ভয় তো আগেই ছিল, টেট্রাসাইক্লিন খেয়েছিলাম, পড়ে গেছিলাম, যদি একটু সময়ের হেরফের হয় ভুল হয়ে যায়, তাহলে আমার ছেলেটা তো মরেই যাবে। সেই ভয়েই মাতামাতি বেশী করছিলাম। অপারেশান হবে জানার পর থেকে বাসার সকলেই আমার প্রতি বেশী মনোযোগী হয়ে পড়েছিল। বড়দা তখন ডকইয়ার্ডে চাকুরী করে, উত্তম কুমার সাভার, মেজদা নারায়ণগঞ্জ সোনালী ব্যাঙ্কে। ব্যাঙ্ক থেকে মেজদাকে আনানো হলো, বড়দাকে আনানো হলো সোনাকান্দা ডকইয়ার্ড থেকে, তখন ফোন সার্ভিস কি বাজে ছিল, মাসী দৌড়ে গিয়ে বাড়ীওয়ালার বাসা থেকে গণস্বাস্থ্যে ফোন করেছিল, ভাগ্য ভাল ছিল, প্রথম সুযোগেই উত্তমের কাছে ফোন পৌঁছে গেল। মা আর বড়দার সাথে ঢাকা ইবনে সিনা ক্লিনিকে পৌঁছে গেলাম। ওদিক থেকে উত্তম কুমারও ক্লিনিকে পৌঁছে গেছে। বিকেল সাড়ে তিনটায় সিজারিয়ান অপারেশানের মাধ্যমে মৌটুসীকে পৃথিবীতে নিয়ে আসা হলো।

অপারেশান করা হয়েছিল ফুল অ্যানেসথিসিয়া দিয়ে, তাই আমি জানতে পারিনি, ছেলে নয়, মৌটুসী এসেছে। কয়েক ঘন্টা পর যখন আমার জ্ঞাণ ফিরেছে, সারা শরীরে কি যন্ত্রণা, গলায় প্রচন্ড যন্ত্রণা, চোখ মেলে দেখি টিউব লাইটের আলো চারদিকে, শিয়রের কাছে দাঁড়ানো বড়দা, ঢাকার বৌদি, আরও কারো কারো কথা শোনা যাচ্ছে, মায়ের গলা পাচ্ছি, বলছে, ওরে বল, রাজনন্দিনী এসেছে। বড়দা বলছে, মিঠু, তোর তো খুব সুন্দর একটা মেয়ে হয়েছে। তোর মেয়ে কিন্তু সবার আগে আমার কোলে উঠেছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলামনা, প্রচন্ড ব্যথায় অস্থির হয়েও খুব খুশী হয়েছি জ্ঞাণ ফিরে এসেছে বলে। আমি ফুল অ্যানেসথেসিয়া দিতে চাইনি, ভয় ছিল, আর যদি জেগে না উঠতে পারি। কাজেই জেগে উঠার আনন্দে ছেলে না হয়ে মেয়ে হয়েছে, রাজপুত্রের বদলে রাজনন্দিনী হয়েছে, এসব কিছু বুঝতে পারছিলামনা। উত্তম কুমার বলে, আমাদের কাছে ছোট্ট একটা মৌটুসী এসেছে

একটু পরে, পাশের বেডে বসা মায়ের কোলে সাদা তোয়ালে জড়ানো এক বাচ্চা দেখলাম। কাঠি কাঠি হাত পা ছুঁড়ে কাঁদছে, ধবধবে সাদা গায়ের রঙ। মা বলছে, এই যে দ্যাখ, তোর রাজনন্দিনী মা হাসতে হাসতে কুটিপাটি হয়ে যাচ্ছে, বলে, ঐ যে টেট্রাসাইক্লিন খেয়েছিলি, টেট্রাসাইক্লিনের প্রতিক্রিয়ায় তোর ছেলেটা মেয়ে হয়ে গেছে। আমি তো থ হয়ে গেছি, কি ব্যাপার, মেয়ে হয়েছে বলছে কেন? বাচ্চার দিকে তাকাতেও পারছিলামনা, সিজারিয়ান অপারেশানে যে সারা শরীরে এমন যম যন্ত্রণা হয়, কে জানতো! বাচ্চা ট্যাঁও ট্যাঁও করে কাঁদে, কান্না থামেনা, শাশুড়ী-জামাই কতরকমভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে মৌটুসীর ট্যাঁও ট্যাঁও থামাতে। দুজনের একজনও কোন কাজের না। ইস! এতক্ষণ লাগে একটা বাচ্চার কান্না থামাতে, আমার তো হাত নাড়াবার শক্তিটুকুও নেই, নাহলে অদের শিখিয়ে দিতে পারতাম কি করে বাচ্চাকে দোল দিতে হয়। এদিকে মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছিনা, লজ্জা লাগে। সবাই বলবে, কি বেলাজা মেয়ে, বাচ্চা নিয়ে কত আদিখ্যেতা করে দেখো। অথচ বাচ্চাটাকে কোলে নিতে ইচ্ছে করছে। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের বৌদি বাচ্চাকে তুলে এনে আমার পাশে শুইয়ে দিল। আমি যে কি পরিমান লজ্জা পাচ্ছিলাম তা বুঝাতে পারবোনা।

প্রতিদিন অতিথির ভীড় লেগেই আছে। দ্বিতীয় দিনে আমাকে বেড থেকে তোলা হলো, ধরে ধরে বিছানা থেকে নামানো হলো, হাঁটতে চেষ্টা করলাম। খাওয়া-দাওয়া নেই, শুধু স্যালাইন দিয়ে রেখেছে আমাকে। স্যালাইন এক জায়গায় বেশীক্ষণ রাখা যাচ্ছেনা, সেখানে ফুলে ব্লকড হয়ে যাচ্ছে, সব মিলিয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। আমি তখনও মা হওয়ার অনুভূতি টের পাচ্ছিলামনা।

পঞ্চম দিনে এলেন হুমায়ুন আহমেদ ও গুলতেকীন আহমেদ, হাতে এক গুচ্ছ ফুল, এবং একটি প্যাকেট। হুমায়ুন আহমেদ আমার হাতে প্যাকেটটি দিলেন, গুলতেকীন ভাবী দিলেন ফুলের গুচ্ছ।


হুমায়ুন আহমেদের হাত থেকে উপহার পেয়ে আমি অভিভূত। সবাই মিলে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। হুমায়ুন আহমেদ বললেন উনার শীলা মেয়ের জন্মের অভিজ্ঞতা। আমেরিকার হাসপাতালে যখন শীলা জন্মালো, গুলতেকীন ভাবী তখন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্বামীকে আজান দিতে বললেন। আমেরিকার নিয়ম অনুযায়ী স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সন্তান জন্ম দেয়ার পুরো প্রক্রিয়া উনাকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে বলে উনি এতটাই ঘাবড়ে গেছিলেন যে আজান দেয়ার সময় নাকি মনে হয়েছে উনি চীৎকার করছেন। রুগীর স্বামীকে এমন অদ্ভুতভাবে চীৎকার করতে দেখে কর্তব্যরত ডাক্তার, নার্স সকলেই হতচকিত হয়ে গেছিল। হুমায়ুন আহমেদ যা বলতেন, যেভাবে বলতেন, শুনতে ভাল লাগতো। গুলতেকীন ভাবী বললেন, বাবা মা দুজনেই সুন্দর, তাই মেয়েও সুন্দর হয়েছে। বলতো মেয়ে কার মতো হয়েছে, জীবেনদার মত নাকি মিঠু ভাবীর মত? হুমায়ুন আহমেদ বললেন, পৃথিবীর সব বাচ্চার চেহারাই আমার কাছে একরকম লাগে

উনারা চলে গেলেন। আমি উপহারের প্যাকেট খুললাম,

প্যাকেটের ভেতর তিনটি বই ছিল,

শঙ্খনীল কারাগার
সৌরভ
অচিনপুর
প্রতিটি বইয়ের পাতা উল্টাতেই দেখতে পেলাম, হুমায়ুন আহমেদের হাতে লেখা,

নতুন মাকে
হুমায়ুন আহমেদ
২৩শে নভেম্বার, ১৯৮৫

আমি বুঝতে পারছিলামনা, নতুন মাটি কে? আমি নাকি মৌটুসী? দুজনেই তো নতুন। পরমুহূর্তেই খেয়াল হলো, আরে! আমিই তো মা, আমিই তো নতুন মা! হুমায়ুন আহমেদের ভাষায় ১৮ই নভেম্বার আমি নতুন মা হলাম।

Thursday, November 14, 2013

চোরকাহিনী!!



 Photo






আমি আগে ভাবতাম, আমেরিকাতে চোর-ডাকাত বলে কিছু নেই। এমন ভাববার কারণ আছে, উত্তম কুমারের সাথে আমার বিয়ে হওয়ার পর থেকেই আমেরিকা সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পেয়ে এসেছি। আমেরিকা সম্পর্কে কিছু বলতে হলে, উত্তম কথা শুরু করে এভাবে, এটা একটা দেশ বটে, দেশ বটে আমেরিকা। ভাবা যায়না, এত ডিসিপ্লিন, লাইফ এত স্মুদি, পৃথিবীর স্বর্গ বলা চলে। এমন শুনতে শুনতে আমার মাথাতেও ঢুকে গেছিল, আমেরিকা একটা দেশ বটে। বাংলাদেশে শুধু চোরের ভয়, খালি বাসা রেখে কোথাও যাওয়া যায়না, একবার দরজায় তালা ঝুলিয়ে বনানী বড়দার বাসায় বেড়াতে গেছি, সন্ধ্যাবেলা (গ্রীনরোডের ভুতের গলির) বাসায় ফিরে দেখি, দরজার তালা ভাঙ্গা। আরেকবার দুর্গাপূজার সময়, নারায়ণগঞ্জ যাব বলে জামা কাপড়ের ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি, ব্যাগদুটো জানালার কাছে রেখেছিলাম, সকালবেলা দেখি ব্যাগ কাত হয়ে মাটিতে পড়ে আছে, ব্যাগ তুলে দেখি ভেতরে কিছু নেই। জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে চোর সব নিয়ে গেছে। মৌটুসী, মিশা তখন কত ছোট, আমরা তখন কত গরীব, বাড়তি টাকা-পয়সাও হাতে নেই যে আবার জামা কিনে দেবো। আমার নিজস্ব একটা গোপন সঞ্চয়ী ব্যাংক ছিল, উত্তম জানতোনা সেটার হদিস, উপায় না দেখে শেষমেষ নিজের সঞ্চয় ভেঙ্গে মৌটুসী আর মিশার জন্য আড়াইশ টাকা দামে হালকা গোলাপী রঙের জামা কিনে এনেছিলাম। সঞ্চয় থেকে পাঁচশ টাকা চলে গেলো!

মিসিসিপিতে আছি নয় বছর হয়ে গেছে। ছোট্ট বাড়ীটি ব্যাংকের লোনের পয়সায় কিনেছি, তাও পাঁচ বছর হয়ে গেল। বাড়ীতে উঠার পর দেখি, ঘরের মধ্যে সিকিউরিটি অ্যালার্ম ফিট করা। চোর ঢুকলেও অ্যালার্ম বেজে উঠবে, সাধু ঢুকলেও অ্যালার্ম বেজে উঠবে। উত্তম কুমার অ্যালার্ম ডিঅ্যাক্টিভেট করে দিয়েছে। আমেরিকাতে চোর আসার প্রশ্নই যেখানে নেই, সেখানে অণর্থক অ্যালার্ম বাজিয়ে সাধুকে বিব্রত করে লাভ কি?

আমার একটা ভাঙ্গা গাড়ী ছিল, অচেনা এক লোকের কাছ থেকে নগদ টাকায় কিনেছি। গাড়ীটা আমি একদিন রাস্তার পা্রে পার্ক করে ঘরে ঢুকে গেছি। এদেশে অনেকেই রাস্তার পারে গাড়ী পার্ক করে। পরদিন দুপুরে কাজে যাব, গাড়ীর কাছে গিয়ে দেখি, জানালার কাঁচ নেই, ভাঙ্গা কাঁচ রাস্তা, গাড়ীর সীট, সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। আমি তো থতমত খেয়ে গেছি। বিষয় কি? গাড়ির কাঁচ ভাঙ্গলো কে? ফোন করলাম উত্তমকে, কাঁদতে কাঁদতে কি বললাম, কে জানে। উত্তম চলে এলো, দেখে আমার হাতব্যাগ গাড়ীর সীটের উপর পড়ে আছে। ঐ তো, যত দোষ নন্দ ঘোষ। উত্তম বলে, এইজন্যই তো গাড়ীর কাঁচ ভেঙ্গেছে। সাধে কি আর ভেঙ্গেছে? ব্যাগ রেখে গেছো গাড়ীর ভেতরে। আমি বলি, ব্যাগে তো টাকা নেই, আমার টাকা থাকে আমার ছোট পার্সে, প্যান্টের পকেটে। আমার গল্পের বইয়ের সাথে ব্যাগটাও গাড়ীতেই থাকে”। উত্তম বলে, চোরের দোষ কি, চোর কি জানে যে তুমি ব্যাগে টাকা রাখোনা? আমি বলি,  "চোরের দোষ নেই মানে, এই না বলো, আমেরিকা একটা দেশ বটে, এখানে হাতীশালে হাতী, মশাশালে মশা, মানুষশালে মানুষই থাকে ,চোর থাকেনা। তাহলে এই চোর কোত্থেকে আসলো?

আমাদের লন মোয়ার বাড়ীর ব্যাকইয়ার্ডে থাকতো। একসময় আমি নিজেই লন মোয়িং করতাম। তখন আমার মাথায় ফেসবুকও ছিলনা, লেখালেখিও ছিলনা। বাড়ীর সামনে, পেছনের লন মো করে মোয়ার ঠিক জায়গায় রেখে দিতাম। হঠাৎ একদিন উত্তম লন মো করে মোয়ার বাইরের গ্যারাজে রেখে দিয়েছে। গ্যারাজে আগে থেকেই মোটা শেকল ঝুলানো ছিল। আমি বুঝতেও পারিনি এই শেকল কেন? আমাদের আগে যে বুড়ীমা থাকতেন এই বাড়ীতে, উনিই এইসব সাবধানতা অবলম্বন করে থাকতেন। শেকল দিয়ে নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় জিনিস বেঁধে রাখা হতো। আমিও উত্তমকে বলেছিলাম, লন মোয়ারটা শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে। উত্তম সেটা করেছিল। তিন দিনের দিন, এক কালো লোক এসে উত্তমের সাথে খুব খাতির করলো, আমাদের লন মোয়ার চাইলো, সে কাছেই এক বাড়ীর ঘাস কেটে দিয়ে পয়সা পাবে। ওর নিজের মোয়ার নষ্ট, তাই আমাদের মোয়ার ব্যবহার করতে চায়। উত্তমের আরেক নাম দয়ার সাগর। সে খুব দান করে, স্ত্রী আর কন্যা ছাড়া বাকী সব কিছু সে দান করে দিতে পারে।
দয়ার সাগর আমাদের মোয়ার সেই লোকটাকে দিয়েছে। লোকটা মোয়ার আবার ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। মোয়ার ফিরিয়ে দেয়ার পর উত্তম সেটিকে আর শেকল দিয়ে বাঁধেনি, বলেছিলাম বেঁধে রাখতে। সে বলেছে, " আরে, তোমার সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। এদেশে চুরী হয়না, তুমি দরজা হাট করে খুলে রাখলেও চুরী হবেনা।
চার দিন পর, সেই লোকটা আবার এসেছে, সেদিন উত্তম বাড়ী ছিলনা, আমার কাছে মোয়ার চাইলো। আমি মনে মনে বলি, এটা কি মামার বাড়ীর আবদার নাকি? তোমাদের আমেরিকার মানুষদের বিশ্বাস কি? পান থেকে চুন খসলে তোমরা স্যু করে দাও। পরে দেখা যাবে এই মোয়ারে তোমার কোন ক্ষতি হলে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আমাদেরকেই বিপদে ফেলবেলোকটার চেহারাতেই পুরো চোরের ছাপ আছে। কিন্তু মুখে বলেছি, না দুঃখিত, মোয়ার বাইরে দেয়া যাবেনা
দুই দিন পরেই দেখি মোয়ার হাওয়া। উত্তমই আগে দেখেছে, মোয়ার নেই। আমি বলি, "ঐ লোকটাই মোয়ার নিয়ে গেছে"। উত্তম বলে, " ছি ছি! না জেনে একজনকে চোর বলা ঠিকনা"। আমার মাথায় তখন আগুণ জ্বলছে, দুইশ ডলার দিয়ে মোয়ার কিনেছিলাম, সেই মোয়ার সে দানছত্র থেকে রাস্তার এক চোরকে দিয়েছে, আবার সেই চোরকে চোর বলাতে আমাকে ছি ছি করছে। এরপর আরও দুইবার চুরী হওয়ার পর উত্তমের খেয়াল হয়েছে, প্রয়োজনীয় জিনিস বাড়ীর ভেতরে রাখতে হবে।

গত সপ্তাহের ঘটনা। ওয়ালমার্ট থেকে ফেরার সময় খুব বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টির জলে আমার পায়ের জুতো ভিজে গেছে। আমাদের গ্যারাজে শাটারের ব্যবস্থা নেই, চারদিক খোলা, উপরে ছাদ। পরদিন কাজে যাওয়ার আগে ভেজা জুতোজোড়া গ্যরাজের ফ্লোরে রোদের মধ্যে শুকোতে দিয়ে কাজে চলে গেছি। পর পর দুদিন জুতো ওখানেই ছিল। তৃতীয় দিনে আমি তখনও কাজে যাইনি, রেডী হচ্ছিলাম, ক্লাস শেষে লাঞ্চে উত্তম বাড়ী এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা, ওখানে জুতো জোড়া কার ছিল? একটা জুতো পড়ে আছে। আমি বলি, আমার জুতো ছিল, কি বলো, একটা জুতা থাকবে কেন? নিশ্চয়ই কোন কুকুরের কাজ। কিন্তু এদেশে তো মালিক ছাড়া কুকুর বের হয়না, তাহলে মালিকের সামনেই আমার জুতো নিয়ে গেছে। এটা কেমন কথা"। উত্তমের বিশ্বাস হয়না কুকুর জুতা নিতে পারে। বলে, " কুকুর তোমার জুতো নিবে কেন?" 
দুই দিন পর উত্তম ইউরেকাইউরেকা করে বাড়ী ফিরেই বলে, তুমি ঠিকই বলেছো, তোমার একপাটি জুতো মুখে নিয়ে একটা কুকুর লাফালাফি করছে দেখলাম। কুকুরের মালিককে বললাম, তোমার কুকুর আমার বাড়ী থেকে জুতা নিয়ে এসেছে
বললাম, আমি সব সময় ঠিকই বলি। সেদিনই বলেছি, এটা কুকুরের কাজ। তুমি বিশ্বাস করোনি। যাই হোক, তোমার কথা শুনে কি সেই লোক লজ্জা বা ভয় পেয়েছে? পায়নি, কারণ তার সাথে থেকেই তার কুকুর এই কাজ করেছে"। কি আর করা, বাকী জুতো গার্বেজ করে দিলাম। এরপর শুরু করলাম গজগজানি। 
"ছোটলোকের দেশ, চোরের দেশ, এই দেশের মানুষগুলিও ছোটলোক, তাদের কুত্তাগুলিও ছো্টলোক। সাধারণ একপাটি জুতো, সেটিকেও নিয়ে গেছে। বলিহারী যাই এমন কুত্তাপ্রেমিকের নিকুচী করি, এটা কোন কথা হলো নাকি যে আরেকজনের বাড়ীর সীমানার ভেতরে ঢুকে মুখে করে জুতা নিয়ে যাবে আর মালিক তা দেখে আনন্দে বগল বাজাবে?

উত্তম বলে, " তোমারই তো দোষ, তুমি জুতা এখানে রেখেছো কেন?

"আমার দোষ মানে? আমার বাড়ীর আঙ্গিনায় জুতা রাখবো নাকি ঝাড়ু রাখবো, সেটাও কি তোমার সাধের আমেরিকানদের মর্জির উপর নির্ভর করবে?

সে হাসে, বলে, একবার ভেবেছিলাম, কুকুরের মালিককে বলি, তোমার কুকুরের মুখ থেকে আমার বউয়ের জুতা উদ্ধার করে দাও। পরে আর বললামনা, একটা জুতাই তো, কিনে নিও।

বলি, তুমি ভাবলে কি করে যে কুত্তায় খাওয়া জুতা আমি পায়ে পড়বো? আমাকে তো দেখি তুমি এখনও চেনোনি।!

এগুলো তো বললাম আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা। চোর আর কী-ইবা দেখেছি, আসল চোর দেখা যায় ওয়ালমার্টে। পুরো পাক্কা চোর, অভিজ্ঞ চোর। চারদিকে এত মানুষের মধ্যেই কি করে যেন ফোন চুরী করে নেয়। ামরা দাঁড়িয়ে আছি, একদল ছেলেপিলে দামী দামী ফোনগুলোকে হাতিয়ে দেখে, ওরা চলে যায়, আমরা দেখি ফোনের বাক্স ঝুলছে, বাক্সের ভেতরে ফোন নেই। এর বড় বড় টিভি চুরী হয়ে যায়, মহিলাদের জামা কাপড়ের সেকশানে গেলে তো কথাই নেই, নানাভাবে চুরী করে। জামাকাপড়ের সেকশানে ট্রায়াল রুম আছে, এই মোটকা মোটকা মহিলাগুলি ট্রায়াল দেয়ার জন্য জামাকাপড় নিয়ে রুমে ঢুকে, নিজের দেহের 'তেলকাসটি, নোংরা অন্তর্বাস থেকে শুরু করে, যা কিছু সম্ভব বদলে নতুনগুলো পড়ে নেয়, ওদের পুরানোগুলো সুন্দর করে হ্যাঙ্গারে ট্যাগসহ লাগিয়ে ট্রলীর মধ্যে ফেলে রেখে যায়। এমন সব পাকা চোর।
ওয়ালমার্টে চোর ধরার জন্য তিন চারজন কাজ করে চলেছে। তাদের সর্দারণীর নাম শন্ডা। শন্ডার দেহখানি একেবারে পর্বতের মত, চালচলন গুন্ডার মত, কিন্তু মুখখানি ভারী মিষ্টি, মায়াবী। গায়ের রঙ সাদা, মুখে একধরণের হাসি লেগে থাকে। শন্ডাকে আমি চোরধরণি ডাকি। মানে চোর ধরে সে। শন্ডার ধারে কাছে থাকিনা। ওকে সব সময় দেখাও যায়না, ওর জন্য একটি রুম আছে। রুমের জানালা কালো পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে, রুমের ভেতর সে শুধু ক্যামেরা মনিটর করে। এটাই ওর কাজ। চুরীর কিছু ঘটলে, এসোসিয়েটরা কিছু বেয়াইনী কাজ করলে শন্ডার ক্যামেরায় তা ধরা পড়ে যায়। তখন সে তার পর্বত দেহ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে, অন্যান্য ম্যানেজারদের সাথে নিয়ে চোরকে চেজ করে। পুলিশে কল দেয়, পুলিশ এসে চোরের হাতে হাতকড়া পড়ায়। আর এসোসিয়েটের ব্যাপার হলে সংশ্লিষ্ট ম্যানেজারের কাছে রিপোর্ট করে।

আমি ছুটির দরখাস্ত করেছিলাম। স্টোর ম্যানেজারের কাছ থেকে ইয়েস শোনার অপেক্ষায় ছিলাম। আমাকে জানানো হলো, শন্ডা আমাকে ডেকেছে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। শন্ডা আমাকে ডাকবে কেন, তার কাজ চোর ধরা। আমি কি চোর নাকি? বলাও যায়না, কে কোথা দিয়ে আমার কি সর্বনাশ করে ফেলেছে, শন্ডার ক্যামেরায় তা ধরা পড়েছে বলেই এখন ডাকছে। চুরীর কেইসে ফেঁসে গেলে কী লজ্জার ব্যাপার হবে! 
আমার নিজের চোখে দেখা ঘটনা। একদিন টী-রুমে বসে খাবার খাচ্ছিলাম, সাথে আর চার পাঁচজন ছিল। হঠাৎ দেখি শন্ডা, মিশকালো স্টোর ম্যানেজার, আর দুই পুলিশ টি রুমে প্রবেশ করেছে, ওদের সাথে ছিল সারাহ নামের এক মাঝবয়সী ক্যাশিয়ার। সারাহ একজন খুব শান্ত-শিষ্ট ভদ্রমহিলা। ভেবেছি, সারাহ'র বোধ হয় কিছু খোয়া গেছে, তাই সে পুলিশে রিপোর্ট করেছে, পুলিশ এসেছে বলে সাথে শন্ডা আর ম্যানেজারও এসেছে। আমি তো কত কিছুই ভাবি, সাদা মনে সাদা ভাবনা, দেখি পুলিশ সারাহ'র হাতে হাতকড়া পড়াচ্ছে, আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, শরীর কাঁপতে শুরু করেছে, এ আমি কি দেখছি। সারাহ চোর?

ভয়ে ভয়ে শন্ডার রুমের দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে দিল মিশকালো স্টোর ম্যানেজার। রুমে ঢুকে দেখি পর্বতদেহী শন্ডা চেয়ারে বসা, ম্যানেজার আমার দিকে চেয়ার ঠেলে দিল। দুইজন দুই বিপরীত মেরুর মানুষের মাঝে আমি তৃতীয় মেরুর মানুষ, বুঝে গেলাম, কিছু একটা সর্বনাশা ঘটনা ঘটে গেছে। নাহলে এই দুজন ডেঞ্জারাস ব্যক্তি আমাকে ডাকবে কেন? আমাকেও কি পুলিশের হাতে তুলে দিবে? মরীয়া হয়ে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, কি ব্যাপার, আমি কি কোন ভুল করেছি? মিশকালো ম্যানেজার তার দুধসাদা দাঁতে হেসে বললো, চিন্তার কিছু নেই, তোমার সাথে ছুটি বিষয়ে কথা বলবো। তুমি একজন মহিলা এসোসিয়েট, তোমার সাথে একান্তে কথা বলতে গেলে আরেকজন উইটনেস থাকতে হবে, তাই শন্ডাকে রেখেছি উইটনেস"।এটা শুনে শান্তি পেলাম।

শন্ডার ডাকে ভয় পেয়েছিলাম, কারণ চোরের মন পুলিশ পুলিশ। দিন পাঁচেক আগে আমি আর উত্তম এক বাড়ীতে বেড়াতে গেছি। সেখানে আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন, সকলেই উত্তমের বন্ধু। কথা শুরু হয়েছে শেয়ার মার্কেট ব্যবসা নিয়ে। উত্তম বলল, সে যা কিছু শেয়ার কিনেছে, তার সবই বিক্রী করে দিয়েছে, তার যেমন লাভ হয়নি, লোকসানও হয়নি। একজন বললেন, উনি শেয়ার বিজনেসে টাকা ঢালেননা। আরেকজন কোটি টাকার উপর লস খেয়েছেন। এগুলো শুনে আমি বলি, আমার প্রায় চার লাখ টাকাও তো বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটে ধূলায় মিশে গেছে।

উত্তম বলে চুরীর টাকা তো, ঐজন্যই লস খেয়েছো।

উপস্থিত সবাই জিজ্ঞেস করলো, চুরীর টাকা মানে? কি ব্যাপার?

আমি তো থতমত খেয়ে গেছি। বলে কি সে? এতগুলো দাদার সামনে আমাকে চোর বলছে! তবে কি আমি ধরা পড়ে গেলাম?

উত্তম বলতে শুরু করেছে, আরে, আমি তো জানতাম, আমার টাকা পয়সা নাই, যা আয় তা ব্যয়। অথচ মাঝে মাঝেই দেখতাম সে কোথা থেকে যেন টাকা বের করে দেয়। গতবার মামনির বিয়ের সময়ও বলে, তোমার চিন্তা নাই, বাংলাদেশে মেয়ে বিয়ের টাকা রেখে আসছি। আমি ভাবি, এত টাকা ও জমালো কি করে? পরে বুঝতে পেরেছি, আমার তো টাকা পয়সার কোন হিসেব থাকতোনা, প্যান্টের পকেটে, শার্টের পকেটে গুচ্ছের টাকা পড়ে থাকতো। জামাকাপড় ধুতে দেয়ার সময় টাকাগুলো নিয়ে সে নিজের কাছে রেখে দিত, আমাকে আর ফেরত দিত না, ওগুলোই সে পরে শেয়ার মার্কেটে খাটিয়েছে। এইজন্যই চুরীর টাকা বলেছি।

পাশ থেকে আরেক ভদ্রলোক বলেন, বৌদি তো সংসারের ভালর জন্যই ওটা করেছে, ইন ফ্যাক্ট আপনার চিন্তা কমিয়ে দিয়েছে। বৌদিতো দারুণ বুদ্ধিমতী। এটাকে ওরকমভাবে 'চুরী' বলা ঠিক হচ্ছেনা দাদা। উত্তম হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে।


আমি তখনও টাস্কি লেগে বসে আছি। হায় হায়, এই ভদ্রলোকগুলো আমাকে এতদিন কত ভাল জেনে এসেছেন, আর আজ জানলেন 'চোর' হিসেবে, তার চেয়েও বড় কথা, এতদিন উত্তমকে সরল সোজা মানুষ ভেবেছিলাম, ভেবেছিলাম, উত্তম কুমার জীবনের কঠিন বিষয়গুলোর কিছুই বোঝেনা, কিছুই টের পায়না। বিয়ের পর থেকেই দেখেছি, টাকা পয়সার ব্যাপারে সে চরম উদাসীন ছিল। আমাদের সঞ্চয় বলতে কিছুই ছিলনা। যে যখন তার কাছে টাকা চাইতো, দুম করে দিয়ে দিত। আমি যদি সঞ্চয়ের কথা বলতাম, তাহলেই সে তেলে বেগুণে জ্বলে উঠতো। বলতো, " জীবন দুই দিনের, সঞ্চয় করে কি করবে, খরচ করো"। সে এমনই খরুচে ছিল যে শার্ট প্যান্ট ধুতে গেলে দেখা যেত পকেটে টাকার গোছা পড়ে আছে। আগে তো সে লন্ড্রীতে কাপড় কাচতো, এরপর আমিই ঘরে কাপড় কেচে দিতাম, সঞ্চয়ের আর কোন পথ না পেয়ে পকেটের টাকাগুলো সরিয়ে রাখতাম, যা পেতাম গুছিয়ে ব্যাংকে রেখে দিতাম, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে বলে। সংসার খরচ থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রেখে দিতাম, সেগুলোই এক সময় জমে সঞ্চয় হয়েছে, কাজে লাগিয়েছি। এই টাকা থেকে আমি কত কিছু করেছি। এমন কি গতবছর মৌটুসীর বিয়েতে উত্তমকে কিছুই খরচ করতে হয়নি, সবই আমার চুরীর টাকায় হয়ে গেছে। সঞ্চয় আরেকটু বাড়াবো বলেই টাকা শেয়ার মার্কেটের ব্যবসায় খাটিয়েছি। ব্যবসা মাইর খেয়েছে, আর এখন কিনা সে বলে, চুরীর পয়সা দেখেই শেয়ার মার্কেটে লস খেয়েছি?। 
আমি বললাম, " তুমি আমাকে চোর বললে কেন?" 
সে হাসে আর বলে, " চোরকে চোর বলেছি"।
আরেক দাদা ভেবেছেন, আমি বুঝি খুব রেগে গেছি, এই দাদার কোটি টাকার উপরে খোয়া গেছে আমেরিকান শেয়ার মার্কেটে। উনি আমাকে বলেন, " আমার ভাইটা এমনিতেই হালকা জোক করেছে, তুমি আবার আমার ভাইয়ের উপর রেগে যাইওনা।" 
টাসকী লাগা মুখে বলি, "না, রাগের কিছু না, কথায় আছে, যার জন্য করি চুরী, সেই কয় চোর"!

Thursday, October 31, 2013

ভুত উৎসব হ্যালুইন!!



 



 

ছোটবেলা থেকেই আমেরিকাকে স্বপ্নের দেশ হিসেবে জেনে এসেছি। আমেরিকা মানেই আলো ঝলমলে দেশ, দিবা-রাত্রি চারদিকে শুধুই আলোর ছড়াছড়ি, কোথাও এতটুকু অন্ধকার নেই। অন্ধকার নেই, ভুতও নেই। আমি আবার ভুতে ভয় পাই, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই কম-বেশী ভুতে বিশ্বাস করে। ভুতে বিশ্বাস করে কারণ আমাদের দেশে দিন-রাতের অধিকাংশ সময়ই বিদ্যুত থাকেনা, রাতের বেলা দেশ থাকে অন্ধকারে ডুবে।অন্ধকারে তাই ভুতের কথা মনে আসে সবার আগে।

ভুত-প্রেত, জ্বীন-পরী নিয়েই আমাদের বসবাস। ভুত যেমন আছে, তেমনি ভুত বা জ্বীন তাড়ানোর ওঝাও আছে। তবে ছোটবেলায় আমেরিকাতে ভুত টুত নেই বলে যেমন ভাবতাম, সেটি আসলে ভুল। আমেরিকাতে ভুত-প্রেত আছে। এবং অবাক হলেও সত্যি যে এদেশে আমেরিকানদের অনেকের বাড়ীতেই ভুত থাকে। হ্যাঁ, ওরা ওরকমই বলে। এমনকি আমেরিকার প্রত্যেক স্টেটে কম করে হলেও ছয়-সাতখানা ‘ভুতের বাড়ী’ আছে যা দর্শনার্থীদের জন্য বছরের বারো মাস খোলা থাকে। মানুষজন খুব উৎসাহ নিয়ে সেইসব বাড়ীতে ভুত দেখতে যায়। অনেক মানুষ বিশ্বাস করে যে তাদের বাড়ীতেও ভুত বা অন্য কোন অশরীরি আত্মার উপস্থিতি আছে। তারা নাকি সেটা টের পায় প্রতি মুহূর্তে।

আমেরিকা অধিকাংশ বাড়ীতেই বেসমেন্ট থাকে। বেসমেন্ট হচ্ছে মাটিরে নীচে ঘর। ঘরের ভেতরে থেকে বুঝার উপায় নেই মাটির নীচে আছি নাকি মাটির উপরে আছি। কারন সব রুমগুলোই একইভাবে সাজানো থাকে। তবে ভুতেরা মনে হয় বুঝতে পারে মাটির নীচের ঘর আর মাটির উপরের ঘরের পার্থক্য। তাই বেশীর ভাগ সময় বেসমেন্টেই ভুতদেরকে পাওয়া যায়। মাটির নীচে নিরালায় নিভৃতে থাকতেই তাদের ভালো লাগে।

সিবিএস নিউজ থেকে কয়েক বছর আগে একটি জরিপ চালানো হয়েছিল, জরিপে ৮০৮ জন প্রাপ্ত বয়স্ককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাদের ভুতে’ বিশ্বাস আছে কিনা।

শতকরা ৪৮% আমেরিকান ‘ভুতে’ বিশ্বাস করে এবং ৪৫% মনে করে ভুত বলে কিছু নেই। ভুত বিশ্বাসীদের মধ্যে মহিলা সদস্যই বেশী। প্রতি পাঁচ জনে একজন জীবনে অনেকবার ভুত দেখেছে বলে দাবী করে।

প্রতি বছর ‘হ্যালুইন’ নামে এক উৎসব হয়, যা ‘ভুত উৎসব’ হিসেবে পরিচিত। হ্যালুইন উৎসবে বাচ্চারা বিভিন্ন ধরণের কস্ট্যুম পড়ে ভুত-পেত্নী সেজে বাড়ী বাড়ী ঘুরে, সকলকে ভয় দেখায়, গৃহস্বামীর কাছ থেকে চকোলেট আদায় করে নেয়। মজার ব্যাপার হলো, অনেকেই বিশ্বাস করে, ভুতের কস্ট্যুম পরিহিতদের মধ্যেই সত্যিকারের ভুতও থাকে।

এখানে আলাদা একটি টিভি চ্যানেল আছে যেখানে শুধুই ভুত সম্পর্কিত অনুষ্ঠান দেখানো হয়। তবে ভুত যেমন আছে তেমনি ‘ভুত শিকারীও’ আছে। তাদেরকে ‘ঘোস্ট হান্টার’ বলা হয়। ঘোস্ট হান্টারদের ঘোস্ট হান্টিং এর সমস্ত অভিযান ভিডিও করে দেখানো হয় ঐ চ্যানেলটিতে। যারা দেখে, তাদের পক্ষে ভুতে বিশ্বাস না করে উপায়ও নেই। কারন ঘোস্ট হান্টাররা নিজেরাই অনেক সময় বিভ্রান্ত হয়, তারাও বলতে বাধ্য হয়, ভুতই হোক বা অন্য কিছুই হোক, জীবনের বাইরেও অন্য কিছু একটা রহস্য থেকেই যায়।

জরিপ চালিয়ে আরও জানা গেছে, ব্যক্তিগতভাবে ভুত দেখেছে এমন লোকের সংখ্যা ২২%। তবে ভুত দেখেনি কিনতু মৃত্যুর পরেও অন্য ভুবন আছে, যেখানে মৃত আত্মারা ঘুরে বেড়ায়, এমনটা বিশ্বাস করে ৭৮% আমেরিকান। অনেকেই বিশ্বাস করে, তাদের পূর্ব পুরুষের মৃত আত্মারা প্রিয়জনকে ছেড়ে ওখানে থাকতে পারেনা বলেই অন্যভাবে, অন্যরূপে পৃথিবীতে ঘুরে ঘুরে আসে। মৃত আত্মাদের চলার গতি আলোর গতির কাছাকাছি বলেই তারা যখন যেখানে খুশী চলে যেতে পারে। আমেরিকানদের মধ্যে অনেকের ধারনা, ভুত মানেই খারাপ কিছু নয়, বেশীর ভাগ ভুতই নাকি ভালো। বেশীর ভাগ সময় তারা মানুষকে সাহায্য করতেই চায়। যারা ভুত ভয় পায়, ভুত তাদেরকে আরো বেশী করে ভয় দেখিয়ে মজা পায়।

আমেরিকাতে বেশীর ভাগ মানুষই ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই ভুতের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে। তারা ভুতকে জীবনের একটি অংশ হিসেবেই দেখে থাকে। কারন তাদের বিশ্বাস, মৃত্যুর পরে যে জগত আছে, সেই জগতের বাসিন্দাদেরকেই পৃথিবীর মানুষ ‘ভুত’ নামে অভিহিত করে থাকে। সবই মানুষের আজন্ম সংস্কার, আজন্ম বিশ্বাস। বিশ্বাসকে বিশ্বাস দিয়েই মানতে হয়। বিজ্ঞানের ক্ষমতা নেই এই বিশ্বাসকে পুরোপুরি ভেঙ্গে দেয়া বিজ্ঞান এখনও গবেষনা চালিয়েই যাচ্ছে ‘ভুত আছে কি নেই’ এর উপর। বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত প্রমান করতে পারেনি ‘ভুত বলে কিছু নেই’। মানুষের কঠিন বিশ্বাসের কাছে বিজ্ঞানও মাঝে মাঝে নাস্তানাবুদ হয়।

৩১শে অক্টোবর আমেরিকাসহ বিশ্বের নানাদেশে খুব উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে পালিত হবে ‘ভুত উৎসব’ হ্যালুইন। হ্যালুইনকে সরল বাংলায় ‘ভুত উৎসব’ বলাটাই সমীচীন। কারন বছরের এই দিনটি ঘিরে ছোট বড়, শিশু-বুড়োদের মধ্যে এক ধরনের শিশুতোষ আনন্দ-উত্তেজনা বিরাজ করে। হ্যালুইন উৎসবকে কুমড়ো ভুতএর উৎসব বললেও অত্যুক্তি হবেনা। কারণ এই সীজনে প্রচুর কুমড়ো পাওয়া যায় এবং হ্যালুইন উৎসবে ভুত বানানর কাজে এই কুমড়ো ব্যবহৃত হয়। অক্টোবার মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই শুরু হয় হ্যালুইন কস্টিউম এবং কুমড়ো কেনার পালা। কস্টিউম ছাড়াও বিপনী বিতান গুলোতে পাওয়া যায় ছোট বড় নানা সাইজের মিষ্টি কুমড়ো, খড় বিচালী দিয়ে তৈরী নানা চেহারার কাকতাড়ুয়া, কিম্ভূত কিমাকার চেহারার খড়-বিচালীর ভুত, নানা সাইজের কঙ্কালসহ এমনি হরেক রকমের জিনিস। মিষ্টি কুমড়োর সাইজ হয় আমাদের দেশে চাল রাখার মাটির জালার মত। এই মিষ্টি কুমড়োগুলোর ভেতর থেকে প্রথমে সমস্ত মাংস, বীচি বের করে ফেলা হয়, এরপর ছুরী দিয়ে কেটে কেটে বড় বড় গোল গোল ভুতুরে চোখ, নাক এবং আকর্ন বিস্তৃত হাসির অবয়ব দেয়া হয়, যা দেখে সত্যি সত্যি হাস্যময় অশরীরি মনে হয়।
হ্যালুইন সন্ধ্যায় সকলের বাড়ির মূল দরজার সামনে এই ‘ভুতুরে কুমড়োর’ ভেতরে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়। দূর থেকে দেখেই বোঝা যায়, ঐ বাড়ির আঙিণায় সুখী ভুত বসে আছে। ভাল করে সন্ধ্যা নেমে আসার আগেই ‘ভুতরূপী’ মানুষেরা যার যার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তাদের হাতে থাকে ঝোলা, পরনে থাকে সাদা অথবা কালো আলখাল্লা জাতীয় পোষাক, মুখ ঢাকা থাকে ‘ভৌতিক মুখোশ’ দিয়ে। এই উৎসবে নিয়ম হলো, ভুতরূপী মানুষগুলো দল বেঁধে সকলের বাড়ীর দরজায় গিয়ে হাজির হয়ে নাঁকি সুরে বলবে ‘ ট্রিঁক অঁর ট্রিঁট’!! গৃহস্বামী ঘরের দরজা খুলে বের হয়ে আগত অতিথিদের দেখে ভয় পেয়ে যান, অতিথিকে খুশী করার জন্য মুঠো মুঠো চকোলেট, নানা বর্ণের ক্যান্ডি দিয়ে ওদের ঝোলা ভর্তি করে দেন। গৃহকর্তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে ‘ভুত বাবাজীরা’ অত্যন্ত খুশী মনে বাড়ির সীমানা ত্যাগ করে বাইরে চলে আসেন।
হ্যালুইন অরিজিন্যালি শুরু হয়েছিল আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ডএ। আইরিশ ও স্কটিশ লোকসাহিত্যে হ্যালুইনকে বলা হয়েছে সুপারন্যাচারাল এনকাউন্টারস হিসেবে। ঐ সময়ের মানুষের বিশ্বাস ছিল যে সামারের শেষ, শীতের শুরুতে হ্যালুইন সন্ধ্যায় সমস্ত মৃত আত্মীয়-স্বজনের আত্মারা নেমে আসে এই পৃথিবীর বুকে। অষ্টম শতাব্দীতে পোপ গ্রেগরী ১লা নভেম্বার কে অল সেইনটস ডে ঘোষণা করেন এবং আগের সন্ধ্যা মানে ৩১শে অক্টোবারকে অল- হ্যালোস-ইভ বা হ্যালুইন নামে অভিহিত করেন। মানুষের অন্ধ বিশ্বাস ছিল অল-হ্যালোস-ইভ-এ প্রেতাত্মারা নেমে আসে, তারা মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আসে,  আর তাই এই প্রেতাত্মাদেরকে প্রতিহত করার জন্য জীবিত স্বজনদের  সকলে একসাথে জড়ো হয়ে আগুন জ্বালিয়ে নানা ভঙ্গিতে নৃত্য করতো এবং মৃত স্বজনের রূপ ধরে আসা ভুতকে পালটা ভয় দেখাত। সেই বনফায়ার থেকেই জ্যাক-ও-লন্ঠন এর উৎপত্তি। আইরিশ ও স্কটিশরা  টারনিপ (শালগম) কে সুন্দর করে কেটে কেটে ভুতের মুখের অবয়ব(হাসি মুখ) দিয়ে লন্ঠন বানিয়ে সকলের বাড়ীর সীমানাতে জ্বালিয়ে রাখত যাতে করে প্রেতাত্মারা আলো দেখেই ভয়ে পালিয়ে যায়। অনেকে খড়-বিচালী দিয়ে কাক-তাড়ুয়া বানিয়ে সাজিয়ে রাখত একই ঊদ্দেশ্যে।
আইরিশ ইমিগ্র্যান্টরাই হ্যালুইনের প্রচলন করে এই উত্তর আমেরিকাতে। সময়ের স্রোতে হ্যালুইনের সূচনালগ্নের কুসংস্কার ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়ে পেয়েছে স্যেকুলার, শিশোতোষ আনন্দের নির্মল চেহারা। হ্যালুইনকে এখন শুধুই বাচ্চাদের আনন্দ উৎসব বললে ঠিক বলা হয়। সাথে যোগ হয়েছে আমেরিকান ব্যবসায়িক বুদ্ধি ও সাফল্য। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয়, যেহেতু হ্যালুইনের সাথে আইরিশ ও স্কটিশদের ধর্মীয় অনুভূতি জড়িত, তাই ভুত-প্রেতের থিমটাও রাখা হয়েছে। বাচ্চারা ঐদিন যে কোন রকম অশরীরীর গেট-আপ নিয়ে সবাইকে ভয় দেখিয়ে আনন্দ পায়।  আবার এই ভুতদে খুশী করতেই চকোলেট, ক্যান্ডি দেয়া হয়। ট্রিক অর ট্রিট হচ্ছে বাচ্চাদের কাছে সবচেয়ে মজার খেলা। তারা হাঁউ মাঁউ করে বড়দের ভয় দেখাবে আর বড়রা ভয় পাওয়ার অভিনয় করবে, তখনই বাচ্চারা বলবে ট্রিক অর ট্রিট ( হয় আমাদের খুশী কর নয়তো ভয় দেখাবো)।বড়রা সাথে সাথে তাদের হাত ভরে চকোলেট দেবে, চকোলেট পেলেই ওরা খুশী হয়ে বিদায় নেবে।  মাত্র এক সন্ধ্যার জন্য বাবা মায়েরা কত ডলার খরচ করে তার কোন হিসেব নেই।

ওয়াল-মার্ট সুপার সেন্টারের একটি বিশাল অংশ জুড়ে ডিসপ্লে করা আছে নানারকম ভৌতিক কস্ট্যুম, কংকালের মুখোশ, স্পাইডারম্যান বা সুপারম্যানের কস্ট্যুম সহ কালো বিড়াল, কালো বাঘের নানারকম ভয়ংকর ভঙ্গীমায় তৈরী পোষাক এবং মুখোশ। মেয়েদের জন্য থাকে পরীর কস্ট্যুম, সিনডেরেলা, তুষার কন্যার কস্ট্যুম। আর বিক্রী হয় চকোলেট, ক্যান্ডি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমেরিকাতে সারা বছরে বিক্রীত ক্যান্ডির এক চতুর্থাংশ বিক্রী হয় হ্যালুইনের সময়।
আমি হ্যালুইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কি ধারণা তা জানার জন্য আমার কাজের জায়গাতে বিভিন্ন বয়সী সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম। যাদের জিজ্ঞেস করেছি, তাদের প্রায় সকলেই বলেছে তারা এর পেছনের ইতিহাস জানেনা, শুধু জানে যে বাচ্চারা ঐদিন একটু মজা করে ছেলেবেলাতে তারাও শুধুই ফান করতো ঐদিন, ব্যস এইটুকুই। লিওনার্দো নামে আমার এক সহকর্মী আছে সে বলেছে , দেখো, একসময় যারা ধর্মে বিশ্বাস করতোনা, তারা ঈশ্বরের উপাসণাকে চ্যালেঞ্জ করে ঘোস্ট উপাসনার মত করে এই হ্যালুইন উদযাপন করা শুরু করে। তারা এমনও বলতো যে ঐরাতে সকল ভুত-প্রেত পৃথিবীতে নেমে আসে, তারা তাদের প্রিয়জনদের দেখতে আসে। ঈশ্বর বলে কিছু নেই, মৃত্যুর পরে সবাই ভুত হয়ে যায়। এই ধরনের প্রচারণাতে সমাজের অনেকের বিশ্বাসে আঘাত লাগতে থাকে, কিনতু আমেরিকাতে যেহেতু কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যায়না, তাই সমাজে কোন রকম অসন্তোষ সৃষ্টির আগেই বানিজ্যিক কোম্পাণীগুলো এই ভুতভাবনাকে অন্যভাবে পরিবেশন করতে শুরু করে। তারা এই ফসল কাটার সময়টাকে বেছে নেয় হ্যালুইন উদযাপনের জন্য। এই উপলক্ষে এত এত মিষ্টি কুমড়া বিক্রী করে কৃষকের লাভ হয়, এত কস্ট্যুম, এত মুখোশ, এত রাশি রাশি চকোলেট, ক্যান্ডি বাজারজাত করে ব্যবসায়িক কোম্পাণীগুলো লাভবান হয়। আর মানুষ খুব সহজেই এই উপলক্ষটাকে বাচ্চাদের জন্য ফান হিসেবে গ্রহন করে। আর এভাবেই সেই মুষ্টিমেয় কিছু ঈশ্বর অবিশ্বাসীদের উদ্দেশ্য বিফলে যায়।
রয় নামে আরেক সহকর্মী বলল, এটা কিছুইনা, শুধুই বিজনেস। আমেরিকাতে সব কিছুর পেছনে থাকে বিজনেস। এই সময়টা হচ্ছে ফসল কাটার মরশুম, এর পরেই শীত চলে আসবে। সকলে ঘরে ঢুকে যাওয়ার আগে আরেকবার ফূর্তি করার উপলক্ষ্য এটা। তবে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য একটা গল্প চালু আছে। গল্পটা হলো, এক সৈনিককে যুদ্ধের মাঠে তার শত্রু তরবারীর আঘাতে ধড় থেকে মাথা কেটে ফেলে দেয়। এরপর থেকে ঐ মুন্ডুহীন সৈনিক ভুত হয়ে রাতের বেলা ঐ পথ দিয়ে কাউকে যেতে দেখলেই তাকে মেরে ফেলতে শুরু করে। এতে করে লোকজন মুন্ডুহীন সৈনিকের মুখোমুখি না হয়ে ঘুরপথে যেতে শুরু করে। তাই মুন্ডুহীন সৈনিক বুদ্ধি করে ফসলের মাঠ থেকে এই সময়ের ফসল মিষ্টি কুমড়া দিয়ে তার মাথা বানিয়ে ঘাড়ে বসিয়ে দিয়ে আবার শুরু করে হত্যাযজ্ঞ রয় আর বাকীটুকু জানেনা, তাই আমি গল্পটা শেষ করে দিলাম এভাবে, কুমড়োমাথা ভুতকে খুশী করার জন্য গ্রামবাসী ঠিক করে যে তাকে তার প্রিয় মিষ্টি খেতে দিলেই সে এই অত্যাচার বন্ধ করবে। আর সেই থেকেই তাকে মিষ্টি খেতে দেয়া হয় এবং সে খুব খুশী হয়ে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করে দেয় আর এভাবেই নিশ্চয় মিষ্টি, চকোলেট, পামপকিন কেক, পামপকিন পাই এর বিজনেস রমরমা হয়ে উঠে। আর বিস্বাদু মিষ্টি কুমড়োগুলিকে হাস্যমুখ ভুত বানিয়ে বিক্রী করে দেয়া হয়। আমার এই শেষাংশটুকু রয়ের খুব পছন্দ হয়।
তবে অনেকে এই ফেস্টিভ্যালটাকে পছন্দ করেনা। কেউ কেউ মনে করে এইসব হচ্ছে কুসংস্কার, কেউ কেউ ভাবে পয়সার অপচয়, অনেকে ঐদিন সন্ধ্যায় ঘর বন্ধ করে অন্য কোথাও চলে যায়, যাতে বাচ্চাদের চকোলেট না দিতে হয়, কিছু পয়সাতো বাঁচে। আবার শাহীনের মত শিশু দরদী ছেলে প্যাকেট ভর্তি চকোলেট নিয়ে ২৫ মাইল রাস্তা ড্রাইভ করে আমাদের বাড়ী এসে আমার ছোট মেয়েকে চকোলেট দিয়ে যায়। ইদানীং অনেক বাবা-মা বাচ্চাদের একা একা চকোলেট হান্টিং বা ট্রিক অর ট্রিট এ বের হতে দেননা। কারণ দিনকাল এদেশেও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যে কোন সময় বাচ্চা কিডন্যাপ হয়ে যেতে পারে, শত্রুতা করে কেউ খাবারের সাথে বি্ষ মিশিয়ে দিতে পারে বলে তাদের ভয়। আবার কেউ কেউ ট্রিক অর ট্রিট এর উছিলায় এসে ঘরে ঢুকে ডাকাতিও করে যেতে পারে। সময় এখানেও খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
যে যাই বলুক, আমি হ্যালুইনের সাথে আমাদের দেশের কিছু পরবের মিল খুঁজে পেয়েছি প্রথমতঃ হিন্দুদের দীপাবলী বা দিওয়ালীর সাথেতো মিল আছেই, আরো মিল আছে হেমন্তের শেষ ও শীতের শুরুতে ফসল কাটার উৎসব, গ্রামদেশে খড় দিয়ে তৈরী শীতের বুড়ো পোড়ানো উৎসবের সাথে। আমরা চকোলেট ক্যান্ডি দেইনা, ঘরে ঘরে পিঠা-পায়েস বানানো হয়, এভাবেই শীতকে বরণ করা হয় অথবা শীতের শুরুতে ঘরে ঢুকে যাওয়ার আগে একটু আনন্দ ফূর্তি করা্র উপলক্ষ তৈরী করা হয়। ভালো লাগে ভেবে যে পৃথিবীর দুই প্রান্তে থেকেও সংস্কৃতির কিছু কিছু জায়গাতে এখনও কত মিল যা মনে করিয়ে দেয়, মানব সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে মানুষের ভাবনাগুলো স্থান-কাল নির্বিশেষে একভাবে, এক নিশানায় কাজ করেছে।