Thursday, February 28, 2013

স্বল্পভাষীনি নেত্রীর কাছে অধীনার নিবেদন!

মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রী, আপনি আজ সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন। খুবই ভালো কথা। দেশে ছিলেন না, সিঙ্গাপুরে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে এসেছেন, নিশ্চয়ই এতদিনে আপনার শরীর স্বাস্থ্য সেরে উঠেছে। তা উঠুক, আপনি সুস্থ থাকুন, সুখে থাকুন, আপনার সুখ দেখে আমরাও সুখী হবো। তা আপনার ডাকা সংবাদ সম্মেলনের সংবাদ পেয়েই আপনার বরাবর অধীনার নিবেদন জানাতেই এই উদ্যোগ।

নেত্রী, আপনি সংবাদ সম্মেলন কেন ডেকেছেন? দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনার দলের নীতি বা ভূমিকা কি, তা পরিষ্কার করার জন্যই তো সম্মেলন ডেকেছেন! বাহ! খুবই ভালো কথা। তা দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চয়ই জেনেছেন। কারণ উন্মুক্ত মিডিয়ার সুবাদে কোন সংবাদই তো আর গোপন থাকে না। তাছাড়া, আপনার নিজস্ব দলীয় পত্রিকা আছে, দলীয় টিভি আছে, সরকার দলীয় টিভি বা সংবাদপত্রও আছে। জানিনা, আপনি সংবাদপত্র পাঠ করেন কিনা, অনলাইনে যান কিনা, টিভিতে হিন্দী সিরিয়াল, বাংলা সিরিয়াল ছাড়া আর কোন প্রোগ্রাম দেখেন কিনা, নিদেনপক্ষে টিভিসংবাদের হেডলাইনগুলো শোনেন কিনা, যদি এর কোনটাই না করে থাকেন, তাহলে আপনাকে সবিনয় অনুরোধ করে বলতে চাই, সংবাদ সম্মেলন শুরু করার আগে আপনি নিজে শুধু আজকের টিভি সংবাদ শুনুন, অনলাইনে যাওয়ার সীমাবদ্ধতা থাকলে পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও অনলাইনে যান। যদি ব্লগ না বুঝেন, (আজকাল সরকারী দল বা বিরোধী দলের কেউই নাকি ব্লগ বুঝে না), খুব সহজ করে বুঝিয়ে বলি, ব্লগ হচ্ছে অনলাইন পত্রিকার মত ব্যাপার, যেখানে যে কেউ স্বাধীনভাবে লিখতে পারে। আমিও লিখি, আপনিও লিখতে পারেন। শুধু নাম রেজিষ্ট্রি করে নিলেই হয়।

তবে এটা সত্যি, এইসব অনলাইনে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অবাধ বিচরণ, আমাদের মত মধ্যবয়সের মানুষজনের কাছে কম্পিউটার মানেই অচেনা জগত, অনলাইন মানেই কল্পলোক, আর ব্লগ মানেই ‘নাস্তিক রাজ্য’! তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি একটু সাহস করেই অনলাইনে ওয়ার্ল্ডে বিচরণ করে থাকি। প্রবাসে থাকি তো, তাই দেশের পত্র পত্রিকা আমার হাতে এসে পৌঁছায় না, অথচ দেশের সংবাদ জানার জন্য প্রাণটা আঁইঢাঁই করে। আমার নাম দেখে আপনার হয়তো আমার ‘দেশপ্রেম’ সম্পর্কে সন্দেহ হতেই পারে, কারণ আপনার দলের মূলনীতি অনুযায়ী, আমি একজন ‘সংখ্যালঘু’। সংখ্যালঘুর আবার দেশপ্রেম কি? সংখ্যালঘু মানেই তো গনিমতের মাল। এরা পাবলিক প্রোপার্টি। একটা সুযোগ পেলেই হলো, দাও এক ধাক্কায় ইন্ডিয়া পাঠিয়ে, এই তো বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের আসল চিত্র।

তবে আপনাকে দায়ী করি না, প্রাক্তন শাসক মরহুম জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং লেঃ জেঃ হোসেইন মুহম্মদ এরশাদ আমাদেরকে সংখ্যালঘু বানিয়ে দিয়েছেন। আপনি তো শুধু আপনার স্বামীর মৃত্যুর পর উনার রেখে যাওয়া দলের হাল ধরেছেন, ঠিক যেমনটি ধরেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর পিতার মৃত্যুর পরের আওয়ামীলীগের হাল। যাই হোক, আপনার দলের নীতি যেটাই হোক, তাতে করে আমার জন্মভূমিকে তো আর অস্বীকার করতে পারি না। তাই দেশের টানেই পত্র পত্রিকা পড়তে চাই। সব পত্রিকা একসাথে পাওয়া যায় শুধুমাত্র অনলাইনে গিয়ে। সেজন্যই আমি অনলাইনে যেতে শিখেছি, অনেকটা প্রাণের তাগিদে, মনের তাগিদে। দেশে রয়েছে আমার স্বজন, বন্ধু, তাদের সাথে আমার নাড়ীর টান।

মাননীয় নেত্রী, ব্লগের কথা বলছিলাম, জানিনা, ব্লগ সম্পর্কে আপনার কী ধারণা আছে! যদি অন্যের মুখে ঝাল খান, তাহলে ব্লগ সম্পর্কে একটুও ভাল ধারণা থাকার কথা নয়। কারণ বর্তমানে অনেক বুড়ো বুদ্ধিজীবিরাই মনে করেন, ব্লগ হচ্ছে ‘নৈরাজ্যমূলক প্রতিষ্ঠান’, ‘নাস্তিকদের রাজ্য’ ‘নাপাক, অপবিত্র’। যদিও তাঁরা ব্লগ বুঝেন না, তারপরেও কী করে ব্লগকে এমন ‘ভিলেন’ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন কে জানে! ওদের কথায় বিশ্বাস করতে পারেন, তবে আমার কথাও শুনে দেখতে পারেন। এই যে আমি আপনার কাছে নিয়মমাফিক রীতি মেনে লিখছি, এই লেখাটি ব্লগে পোস্ট করবো। লেখাটি পড়ে কোথাও কোন নৈরাজ্য সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে কিনা দেখবেন!

নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে ব্লগ দরকার হয় না, পত্রিকায় লিখেই নৈরাজ্য সৃষ্টি করা যায়। এই যেমন ‘দৈনিক আমার দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাহেব উনার পত্রিকায় বৈষম্যমূলক, সাম্প্রদায়িক, উস্কাণীমূলক লেখা লিখে সারা দেশে নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছেন। সে তার লেখায় ব্লগ এন্ড ব্লগার সম্পর্কে দেশের মানুষকে ভুল ধারণা দিয়েছে। সে খুব নোংরাভাবে ব্লগ এন্ড ব্লগারদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়েছে। সে বলেছে, ব্লগার মানেই নাস্তিক, আর নাস্তিক মানেই ‘চরম পাপী’। তার প্রচারিত এমন কুৎসিত প্রোপাগান্ডায় বিভ্রান্ত হয়ে অনেক মন্ত্রী, মিনিস্টার, লেখক, সাংবাদিক, অধ্যাপক, আমলা, আইনজীবি থেকে শুরু করে অনেক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিই নিজেকে ‘আস্তিক’ প্রমানের জন্য জান লড়িয়ে দিচ্ছে। বক্তৃতা, বিবৃতি, টকশোতে এসে তারা অকপটে স্বীকার করছে, তাঁরা ‘ব্লগ’ বুঝেন না, ব্লগে কী লেখা থাকে তা জানেন না, তাঁরা অনলাইনে যান না, এগুলো বলার সময় তাঁদের একবারও মনে হয় না, বর্তমান আধুনিকায়নের যুগে, অনলাইনে না যাওয়াটা কোনভাবেই গৌরবের নয়। তাঁরা অনলাইন বা ব্লগে যান না বলেই বুঝেন না, জানেন না, ব্লগ একটি লেখালেখির মাধ্যম। এর বেশী কিছু না। উনারা ব্লগে যান না বলেই উক্ত সম্পাদক সাহেবের জন্য সহজ হয়েছে, ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সরল অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দিয়ে সবাইকে উত্তেজিত করে দেয়া। আপনার স্নেহভাজন সম্পাদকের ঊদ্দেশ্য সফল হয়েছে, তার ক্রমাগত উস্কাণীমূলক প্রচারণার কল্যানে আজ সারাদেশে আগুণ জ্বলছে। হিন্দুর ঘরবাড়ী পুড়ছে, মন্দিরে লুটিপাট হচ্ছে, মন্দিরের নিরীহ সেবায়েত মারা পড়ছে, দেবতার নিষ্প্রাণ মূর্তি ভেঙ্গে গুঁড়ো হচ্ছে, পুলিশ মারা যাচ্ছে, মুসল্লী মারা যাচ্ছে, বাহ! বেশ বেশ! এটাই চেয়েছিল আপনার স্নেহভাজন সম্পাদক।

কারো ধর্মীয় অনুভূতিতেই আঘাত করা সঠিক ধার্মিকের কাজ হতে পারেনা। অথচ আপনার দলীয় পত্রিকায় আপনার স্নেহভাজন সম্পাদকসহ, এককালের ‘বঙ্গবীর’ উপাধী পাওয়া দূর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক কথা ছড়িয়ে দিয়েছে, সরল ধর্মপ্রাণ মুসল্লীদের রক্তে আগুন জ্বালিয়েছে। তারা বলেছে, দেশ থেকে ইসলাম চলে যাবে, দেশে কোন ইসলামিক দল থাকবে না, শুধু হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান থাকবে। এমন কি আপনার একান্ত অনুগত গয়েশ্বর রায় পর্যন্ত দলীয় মিটিং এ বলেছে, দেশে নাকি ইসলাম বিপন্ন, জামাতে ইসলামী বিপন্ন। ছিঃ এমন চাটুকারেরা আপনাকে ঘিরে থাকে! ৯০% ভাগ মুসলমানের দেশে কী করে ১০% ‘সংখ্যালঘু’ রাজত্ব করবে, সেই হিসেবে কেউ গেল না, শুরু করে দিল তান্ডব! যে প্রাণগুলো ঝরে গেল, এর কোন দাম নেই? আপনি তো দেশে ছিলেন না, তাই হয়তো আপনি সব খবর পান নি।

আপনি দেশে থাকতেই দেখে গিয়েছিলেন, যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবীতে প্রজন্ম চত্বর গঠিত হয়েছিল। আপনি নিজেও প্রজন্ম চত্বরের সরাসরি বিরোধিতা করেন নি, বলেছেন, পর্যবেক্ষণ করবেন। তা পর্যবেক্ষণ তো করেছেন, আপনিই বলুন, পর্যবেক্ষণ করে কী পেলেন? প্রজন্ম চত্বর থেকে কী একবারের জন্যও বলা হয়েছে যে দেশ থেকে ইসলাম উঠিয়ে দেয়া হবে, থাকবে শুধু হিন্দু, বৌদ্ধ, আর খৃষ্টান? তারাতো শুধু '৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। আপনারা যারা দেশ শাসন করছেন গত ৪২ বছর ধরে, আপনাদেরইতো উচিৎ ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। আপনারা অযথাই মিথ্যে কথা প্রচার করেছেন, বঙ্গবন্ধু নাকি সবাইকে ক্ষমা করে দিয়ে গেছেন। ভুল ভুল, এমন কথা সর্বৈব মিথ্যা। আপনারা না জানলেও বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অনলাইন ঘেঁটে মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত ইতিহাস জেনেছে। এই জন্যই তারা তথাকথিত সাম্প্রদায়িক বলয় থেকে বের হতে পেরেছে। তাদের দাবী আজ সারা দেশে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আজ যুদ্ধাপরাধী দেইল্যা রাজাকারের ফাঁসীর রায় ঘোষনা করা হতেই সারা দেশব্যাপী তান্ডব শুরু হয়েছে!

আজ আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, আপনার দলীয় নেতাদের ক্রমাগত উস্কাণী পেয়ে জামায়াত শিবিরের নেতা কর্মীরা সারাদেশে তান্ডব চালিয়েছে। আমি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছি যখন দেখেছি, আপনার অনুগতদের হাতে সারাদেশের নিরীহ সংখ্যালঘুদের বাড়ীঘর দাউ দাউ করে জ্বলছে। মাননীয় নেত্রী, আমরা তো সংখ্যায় খুবই কম, ১০% এরও কম। আমরা শত নির্যাতন সয়েও শুধুমাত্র মাটির টানে দেশে পড়ে আছি। আমাদের নিজস্ব পৈতৃক ভিটায়ও থাকতে পারি না, পৈতৃক ভিটা আপনার দলীয় ক্যাডারদের হাতে ২০০১ সালের পরেই ছিনতাই হয়ে গেছে। তারপরেও মাতৃভূমির টানে ‘সংখ্যালঘু’রা পরের বাড়ীতে ঘর ভাড়া নিয়ে থেকেও দেশে থাকার তৃপ্তিতে ঢেঁকুর তোলার চেষ্টা করে। সেই সুখটুকুও আপনার অনুগতদের সহ্য হলো না। আর সরকারের কথা কী-ইবা বলবো। উনারা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কিছু ধর্মান্ধ পিশাচের হাতে দেশের হিন্দু সম্প্রদায় লাঞ্ছিত হচ্ছে, উনারা কিছুই করতে পারছেন না। এ থেকেই বুঝে নিয়েছি, প্রধান মন্ত্রীর কাছে নালিশ জানিয়ে লাভ নেই, উনার নিজের জীবনই তো দেখি হুমকীর মুখে থাকে। সেই দিক থেকে আপনাকে খুবই নিরাপদ জীবনের অধিকারী মনে হয়। তাই আপনার কাছে আবেদন, আজকের সংবাদ সম্মেলনে যা কিছুই বলেন না কেন, সাথে এটুকু যোগ করবেন, হিন্দুদের উপর অত্যাচার যেন বন্ধ করে।

আর কত ভারত জুজুর ভয় দেখাবেন? ভারত থেকে প্রজন্ম চত্বরের দাবীকে সমর্থণ জানানো হতেই আপনার দলের মহাসচিবের গায়ে ফোস্কা পড়েছে। তা পড়তেই পারে, আমাদের দেশ সম্পর্কে অন্য দেশ কেন নাক গলাবে! এখানেই আমার একটি প্রশ্ন, ১৯৯২ সালে ভারতের অযোধ্যাতে ‘বাবরী মসজিদ’ নিয়ে যে হুলুস্থূল হয়েছিল, তার দায় কেন বাংলাদেশের হিন্দুদেরকে বহন করতে হয়েছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেই আক্রোশের শিকার হয়েছিলাম। ঐ সময় আমরা থাকতাম গ্রীন রোডের ভুতের গলির ‘যুগল নিবাস’ নামের একটি বিল্ডিং এর দোতালার ফ্ল্যাটে। এত বড় বিল্ডিং এ আমরাই ছিলাম একটিমাত্র হিন্দু পরিবার। আমাদের উপরেই যারা থাকতো, তারা ছিল বিএনপির সমর্থক। ওরা বিএনপির সমর্থক হলেও বাড়ীর কর্ত্রীর সাথে আমার ছিল খুব সখ্যতা। আমার স্বামী একজন অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক ছিলেন। ছোট ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে আমরা ঐ দোতলার বাসায় ভাড়া থাকতাম। যেদিন সুদূর অযোদ্ধায় বাবরী মসজিদ ইস্যুতে হিন্দু-মুসলমান’ দাঙ্গা হয়েছিল, সেদিন আমি ছোট দুই মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ঘরের ভেতর চুপ করে বসেছিলাম, ঘরের বাতি অফ করে দিয়ে। ঠিক রাত নয়টার দিকে, তিনতলা থেকে নেমে আসে ঐ বাড়ীর ছোট ছেলে, সাথে আরও তিনজন বন্ধুকে নিয়ে। আমাদের বন্ধ দরজার উপর দড়াম দড়াম করে লাথি মারে আর বলতে থাকে,
“অই মালাউনের বাচ্চা, দরজা খোল। লাইট অফ কইরা বইসা আছস ক্যান? তরা ইন্ডিয়া যা”!
আমার মেয়ে দুটো থরথর করে কাঁপছিল, স্বামী আঙুল ঠোঁটে চেপে চুপ থাকতে ইশারা করেছেন। আমি পা টিপে টিপে হেঁটে দরজার কাছে গিয়ে ফুটো দিয়ে ওদের হিংস্র চেহারা দেখে ভয়ে নীল হয়ে গেছিলাম (বাইরের লাইট জ্বালানো ছিল)।মাননীয় নেত্রী, সেদিনের সেই ভয় আমাকে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। প্রাণের ভয়ে, ইজ্জতের ভয়ে আমরা পালিয়ে গেছিলাম, আমাদের মেধা ছিল, তাই প্রবাসে মেধাকে কাজে লাগাচ্ছি।

নেত্রী, কথায় বলে, চুন খেয়ে মুখ পুড়লে দৈ দেখলে ভয় করে"। আমার গল্প শুনে হয়তো বলবেন, এই একটা পুচকে ছেলের হুমকীতে কেন দেশ ছাড়লাম! নেত্রী, '৬৪ সালে যে রায়ট হয়েছিল, তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে, সেই রায়টে আমাদের বাড়ীর আটটি তাজা প্রাণকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল। সেই থেকে ধর্মের নামে যে কোন যুদ্ধকে ভয় পাই, ঘৃণা করি। আমি বিশ্বাস করি, যার যার ধর্ম তার তার কাছে। এই সুযোগেই বলে রাখি, 'নাস্তিক'দের নিয়ে আমার মনে কোন দুশ্চিন্তা নেই। নাস্তিকতাও আরেক টাইপের ধর্ম। নাস্তিক বলতে আমি বুঝি, আস্তিকের বিপরীত শব্দ, আমি বিশ্বাস করি, একজন আস্তিকের মত একজন নাস্তিকেরও নিজ দেশের মাটিতে সসম্মানে বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার আছে। বর্তমানে টিভিতে বুড়ো ধাড়িদের নিজেকে ধার্মিক প্রমাণ করার প্রতিযোগীতা দেখে লজ্জা পাই, মনে হয় জনগণের ট্যাক্সে চালিত টিভিতে পুরো ছ্যাবলামী হচ্ছে।

এখন আপনিই বলুন, আপনার অনুগতরা যদি কথায় কথায় আমাদের দরজায় লাথি মারে, মন্দির ভাঙ্গে, বিগ্রহ ভাঙ্গে, হিন্দুদের বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয়, তাহলে আমরা কোথায় যাব? আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে বলেই আজ প্রজন্ম চত্বরের সৃষ্টি হয়েছে। প্রাণের ভয়ে, ইজ্জতের ভয়ে আমরা পালিয়ে গেছিলাম, কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েরা পালাতে রাজী নয়। আমাদের ছেলেমেয়েরা ভারতকে সালিশ মানতে রাজী নয়। তারা শুধু একটি সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। সেই ছেলেমেয়েরা বাঙালী, ওদের গায়ে কোন ধর্মীয় স্টিকার লাগানো নেই। এই মুহূর্তে হয়তো সরলপ্রাণ মুসলমানদের অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দিয়ে অশান্তি করা যাবে, তবে আমাদের ছেলেমেয়েরা আমাদের মত পালিয়ে বাঁচতে চায় না। তারা নিজেদের অধিকার আদায়ে একসাথে লড়ছে, এদেরকে বলে ‘তরুণ প্রজন্ম’, এদেরকে বলে ‘দ্বিতীয়বারের মুক্তিযোদ্ধা’।

এইজন্যই আপনার কাছে অনুরোধ করেছি, আপনি কথা কম বলেন, এইজন্য আপনাকে অনেকেই স্বল্পভাষীনি বলে থাকে। নেত্রী, আপনি স্বল্প কথায় আজকের সংবাদ সম্মেলনে দলের সকলকে হুঁশিয়ার করে দেন, আর যেন সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা না বলে।  হিন্দুরাও বাংলাদেশের নাগরিক, আপনাকে আবার ক্ষমতায় আসতে হলে ‘গয়েশ্বর রায়’ নামক কিছু হিন্দুর সহযোগীতা লাগবে। আপনার দলে কতবড় মুক্তিযোদ্ধা আছে জানিনা, দেশ বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীকেও তরুণ প্রজন্ম ‘নব্য রাজাকার’ আখ্যা দিতে ভয় পায় নি। কাদের সিদ্দিকী বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, উনি বুঝতে পারছেন, এই জাগ্রত তরুণরা উনার চেয়ে কম সাহসী নয়। আর এটা জানেন বলেই বাঘের কন্ঠ থেকে মিঁউ মিঁউ শোনা যাচ্ছে।

নাফিসের কথা মনে পড়ে মাননীয় নেত্রী? আপনার এখনই রাশ টানা জরুরী হয়ে পড়ছে। নাহলে এই সকল অর্বাচীনদের কল্যানে আরও ‘নাফিস’ তৈরী হবে, দেশ ছাড়িয়ে জিহাদ করতে মার্কিন মুল্লুকে আসবে। এসেই এফ বি আই এর পাতা ফাঁদে পা দেবে। জিহাদের স্বপ্ন ধূলায় লুটাবে, বাবা-মায়ের কোলের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে আমেরিকার জেলে বসে বার্গার খেতে হবে পরবর্তী ত্রিশ বছর! ভারত জ্জুজুর ভয় দেখিয়েও কাজ হবে না, আমেরিকা নামের অতি বড় জুজু আড়ালে থেকে হাসবে।

Friday, February 22, 2013

প্রজন্ম চত্বর ও একজন নগন্য ব্লগারের ভাতঘুম!

আজ আবিষ্কার করলাম, গত আট দিনে এক বেলার জন্যও ভাত খাইনি, মানে ভাত খাওয়ার কথা খেয়াল হয়নি। অথচ ভাত আমার অতি প্রিয় খাদ্য। তিন বেলা ভাত খাই না অবশ্য, দেশে থাকতে দু'বেলা ভাত খেতাম, আর আমেরিকান হওয়ার পর থেকে একবেলা ভাত খাই। বেশীর ভাগ সময়, রাতের বেলাতেই জম্পেশ করে তিন চার পদ দিয়ে ভাত না খেলে মনের মধ্যে কেমন একটা অপূর্ণতা টের পাই। এমনও হয়েছে, আমেরিকান ডিনারে গিয়েছি, ঘাস-পাতা (স্যালাড), দিয়ে স্যান্ডুইচ বানিয়ে খেতে হয়েছে, কারণ আমি তো আবার হ্যাম বা বীফ, অথবা টার্কী, কোনটাই খাইনা। ডেজার্ট হিসেবে হয়তো দু'পিস কেক খেয়ে বাড়ী ফিরেছি। বাড়ী ফেরার একটুক্ষণ পরেই শুরু হয়ে যেত 'অপূর্ণতার অস্বস্তি'। ভাত না খাওয়ার অতৃপ্তি। পরিবারের সবার কাছে হাসির পাত্র হয়ে যাব ভেবে হয়তো বা  ভাত না খাওয়ার অতৃপ্তি নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছি। নাহলে একমুঠো ভাত খেয়ে ঘুমিয়েছি। যত নামী দামী রেস্টুরেন্টে খেয়ে আসি না কেন, ভাত না খেতে পেলে মনে হয় জীবনই বৃথা।

এমন অনেক বার হয়েছে, মেয়েদের সাথে সোস্যাল স্টাডিজ ফেয়ার, সায়েন্স ফেয়ার, স্পীচ কম্পিটিশানে গেছি, ধারে কাছে কোথাও ইন্ডিয়ান বা বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট নেই, মুখ গোঁজ করে আমেরিকান ঘাস-পাতা, নাহলে ইটালিয়ান পিৎজা বা পাস্তার মত 'ম্যাদামারা' খাবার খেতে হয়েছে আমাকে। সবাই মিলে হয়তো বা দুই তিনদিনের জন্য সমুদ্র স্নানে গেছি, সেখানেও যতসব উদ্ভট খাবার খেতে হয়েছে। মেয়েদের বাবা মেয়েদেরকে খুব ভালোবাসে, তাই মেয়েদের শখেই সব সময় সায় দেয়, তারপরেও মনে হয় মাঝে মধ্যে মেয়েদের মায়ের দুঃখী চেহারার দিকে তাকিয়ে হৃদয়ের কোথাও না কোথাও যন্ত্রণা হয়। সেজন্যই বেশ কয়েক বছর ধরে যে কোন স্থানে বেড়াতে যাওয়ার সময় রাইস কুকার, চাল, ডিম, আলু, কাঁচালঙ্কা, সরিষার তেল, লবন সাথে করে নিয়ে নেয়। রাতের বেলাটা অন্ততঃ হোটেলের রুমে বসে ভাত আর আলু ডিম সেদ্ধ দিয়ে চালানো যায়। সাপও মরে লাঠিও ভাঙ্গে না। আমিও খুশী থাকি, তার পকেটও নিরাপদ থাকে।


আমার মত এমন ভাত পাগল মানুষ একটানা আট দিন ধরে ভাত খাইনি, এটা গিনেসবুকে উঠার মত ঘটনা। আমার গণসংযোগ খুব দূর্বল বলেই গিনেসবুকে নাম উঠলো না, নাহলে মাঝে মাঝেই তো দেখি, এর নাম গিনেস বুকে, তার নাম গিনেস বুকে উঠছে, ওথচ আমার নাম উঠলো না। এদিকে এমন আশ্চর্য্যজনক ঘটনার পরেও আমার ভাত না খাওয়ার কথা ঘরের মানুষই জানে না। ঘরের মানুষের অবশ্য দোষ দেই না, সে আমাকে দেখে কম্পিউটারে মাথা গুঁজে বসে থাকি।  সে ত আর জানেনা, খাওয়া -দাওয়া, রান্না বান্না ভুলে  কম্পিউটারে বসে বসে আমি কী করি। তার না জানার কারণ হচ্ছে, সে ফেসবুক বা ব্লগ, এ দুটোর কোনটাতেই  থাকে না। টিভিতে বাংলা নিউজে ব্লগার অ্যাক্টিভিটির খবর শুনে বেশ উচ্ছ্বসি্ত হয়, অথচ জানেইনা তার ঘরেই ব্লগার বসে আছে।

ব্লগিং তো আছেই, তার উপর ডঃ ওজ'এর হেলদি ডায়েট প্রোগ্রাম আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আমরা গত একমাস ধরেই দুপুরে স্যালাড বা ওরকমই কিছু খাই, রাতে এক মুঠো পরিমান ভাত, সাথে ডাল, সব্জী, মাংস/মাছ  খাই। এতে আমার উপর রান্নার চাপও কমে গেছে। রান্নার চাপ কমে যাওয়াতে আমি খুব আগ্রহের সাথে শাহবাগের 'প্রজন্ম চত্বরে' চলে যাই। ফেসবুকে ঢুকে যাওয়া মানেই প্রজন্ম চত্বরে চলে যাওয়া। এ ওকে 'ছাগু' বলছে, সে তাকে 'গেলম্যান' বলছে, সব কিছু বুঝিনা , কিন্তু খুব এক্সাইটেড ফিল করি। আমার এক বন্ধুস্থানীয় ভদ্রলোক সেদিন দুষ্টামী করেই আমাকে 'ছাগু' ডেকেছে। আমিও বলেছি, " দূর মিয়া, তুমি হইলা 'ছাগু'র নেতা, মহা ছাগু'। কী চমৎকার এক অনুভূতি। এখানেই গেরো লেগেছে।  গত আট  দিনের তুমুল উত্তেজনায় আমি ঘরের বাকী সদস্যদের কথাই ভুলে গেছি। ক্ষিদে-তৃষ্ণাও ভুলে গেছি। ওয়ালমার্টে যাই ঠিকই, কিন্তু কাজে মনোযোগ দিতে ভুলে গেছি। আমার মাথায় সব সময় ঘোরে, আজ কী হলো চত্বরে, কে জানে!


দুইদিন আগেই দেখি, আমার কর্তা ফ্রীজার থেকে দশ পাউন্ড চিকেন লেগের প্যাকেট বের করে 'থ হতে দিয়েছে, সাথে স্যামন ফিশ ফিলে। স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়েছি, উত্তরে খুব দৃঢ়চেতা মনোভাব নিয়ে বলে, " গ্রীল করবো"।
বলি, " তা এতবড় প্যাকেট দিয়ে কী হবে? সাথে আবার মাছের প্যাকেটও বের করেছো কেন"?

" ডঃ ওজ তো না খেয়ে থাকতে বলেনি,  ঘরে তো দেখি আজকাল রান্না বান্না বন্ধ। তাই  একবারে  বেশী করে গ্রিল করে রাখি, আগামী সাতদিন চলে যাবে।"

মনের ভেতর একটু দ্বিধা বা সংকোচ বোধ করছিলাম, কিন্তু পরক্ষণেই গা থেকে সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেললাম। এখন সময়টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, স্বামী যদি ভাল 'কুক' হয়, নিজে থেকে রান্নায় এগিয়ে আসে, তাকে স্বাগত জানানোটাই বুদ্ধির কাজ। এখন সময় অন্যরকম। এই মুহূর্তে অত মেয়েলী সেন্টিমেন্ট নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমার মা-ও বেঁচে নেই যে আমাকে বকা দিবেন, কেন রান্নাবান্না না করে বিপ্লব করছি। প্রফেসার ভদ্রলোককে ওভাবেই রেখে আমি কাজে চলে গেছি। রাতে বাড়ী ফিরে 'গ্রিলড চিকেন' খেয়ে কম্পিউটারে বসে গেছি। একবারের জন্যও মনে পড়ে নি, শুধু গ্রিলড চিকেন খেলাম, ভাত বা রুটি কিছুই খেলাম না। রাত দুইটা/তিনটা পর্যন্ত জেগে থাকি, ব্লগারদের পোস্ট দেখি, পড়ি আর হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ি। হঠাৎ করেই পেটে ছুঁচোর লম্ফ-ঝম্ফ টের পাই। হাতের কাছে রেখে দেয়া এক কাপ দই খেয়ে ফেলি। খেয়ালও হয়না, আমি আমার সবচেয়ে অপছন্দের খাবারটি অবলীলায় খেয়ে ফেলেছি।

ঘটনা ঘটেছে গতকাল। মাঝরাত্তিরে বসে প্রজন্ম চত্বরের মহাসমাবেশ নিয়েই ভাবছিলাম। এক কলামিস্ট বন্ধু চ্যাট বক্সে নক করতেই এক কথায় দুই কথায় জানতে চাইলাম , সে ঐ মুহূর্তে কী করছে। জানালো, দুপুরে খাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে, খেয়ে দেয়ে প্রজন্ম চত্বরে যাবে, মহাসমাবেশে উপস্থিত থেকে বইমেলা ঘুরে আসবে। বন্ধু দুপুরের খাবার খাচ্ছে ডাল, লালশাক, আর মাছের ঝোল দিয়ে। আমার হঠাৎ করেই কান্না পেয়ে গেল। মনে পড়ে গেল, আমি অনেকদিন ধরে ভাত খাই না। আমি রান্নাও করিনা, খাইও না। আমার ঘরের আর দু'জন মানুষ কী খাচ্ছে, সে খবরও রাখি না। ট্র্যাশ ক্যানে দেখি মাছের লম্বা লম্বা কাঁটা পড়ে থাকে। অর্থাৎ গ্রিলড স্যামন খেয়ে তারা রাত পার করে দিচ্ছে। দুপুরে অবশ্য খুবই সুস্বাদু স্যুপ বানিয়েছিলাম এক সসপ্যান। এখন সময়টা একেবারেই অন্যরকম। ভীষন এক অগ্নিপরীক্ষা শুরু হয়েছে। কী উজ্জ্বল, মেধাবী তরুণ-তরুণীরা আজ মাঠে নেমেছে।  আমরা দেশে নেই বলে কিছুই করতে পারছি না, এমন গ্লানি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতেই অনলাইনে বসে থেকে আমার যতটুকু সাধ্য, আমি করে চলেছি। আমার তিন মেয়ের মধ্যে এক মেয়ে খুব হুজুগে নাচনি। আমার সাথে সাথে সেও দেখি বুঝে বা না বুঝেই বিভিন্ন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে লেখা স্ট্যাটাসগুলো শেয়ার করে, লাইক দেয়। নিজেও প্রজন্ম চত্বরের ছবি সংগ্রহ করে কভার পিকচার বানায়। অথচ আমার মেয়েগুলো সেই ছোট্টবেলাতেই আমেরিকা চলে এসেছে। আমার মেয়ের কান্ড দেখে আমি খুশী হই, ভালো লাগে।

আজ আমার কাজের স্কেজিউল ছিল বেলা বারোটা থেকে। ঘুম থেকে উঠেছি সকাল নয়টায়। ঘুম থেকে জেগে আমার প্রথম কাজই হচ্ছে কম্পিউটার অন করা। তারপর আমি দেবতা প্রণাম করি। কম্পিউটারে বসে কিছু লেখার চেষ্টা করতে গিয়েই মনে পড়ে গেলো, আজ আমাকে কিছু রান্না করতে হবে। অ্যাট লিস্ট, একটা মাছের ঝোল। বাড়ী ফিরবো রাত নয়টায়, আমার মেয়ে আর মেয়ের বাবা না খেয়ে থাকবে। প্রতিদিন কী গ্রিলড চিকেন খাওয়া যায়? খুবই ঝটপট করে 'বাইল্লা মাছ'এর চচ্চড়ি রান্না করে ফেললাম, নিয়ম ভেঙ্গে ভাতও রান্না করলাম। আজ নিয়ম ভাঙ্গার দিন। আমার একটি লেখার উপর কেউ কেউ খুব বাজে মন্তব্য করেছে, আমি সাধারণতঃ কারো খারাপ কমেন্টের উত্তর দেই না, আজ দিলাম। আজ নিয়ম ভাঙ্গার দিন। কোন 'ছাগু'কে ছাড় দেয়া হবে না। এটাই প্রজন্ম চত্বরের মূল শ্লোগান। পনের দিন ধরে অনলাইনের ভেতর দিয়েই প্রজন্ম প্রজন্ম করেছি, ব্লগে একটার পর একটা লেখা পোস্ট করেছি, এগুলো করতে করতে আমি নিজেও প্রজন্মচত্বরের অংশীদার হয়ে গেছি। ওদের সুরে সুর মিলিয়ে আজ থেকেই বলা শুরু করেছি,

" কোন ছাগুকে ছাড়ান দেবো না।" প্রথিতযশা কলামিস্টের ওয়ালে গিয়ে কাদের সিদ্দিকীর অপরাধ সম্পর্কে মন্তব্য লিখে এসেছি, কাদের সিদ্দিকী একজন  দেশবরেণ্য বীর মুক্তিযোদ্ধা। উনার উচিৎ ছিল, গণজাগরণ মঞ্চে উপস্থিত হয়ে এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের পাশে দাঁড়ানো, পাশে দাঁড়িয়ে হুংকার ছাড়া, কিন্তু উনি তার ধারে কাছে দিয়েও যাননি, উলটো এক কুখ্যাত সম্পাদক, 'উত্তরা ্ষড়যন্ত্রের নায়কের' পক্ষে ওকালতি করা শুরু করেছেন। তরুণদের পাশে তো দাঁড়ানইনি, উলটো তরুণদের আন্দোলনকে বিতর্কিত করে তুলছেন নানারকম সাম্প্রদায়িক কথা বলে। এই জন্যই উনার প্রতি দূর্বল কলামিস্টের ওয়ালে নিজের মতামত লিখে দিয়েছি। এও এক ধরণের পবিত্র কাজ। আমার পক্ষে এটুকু করাও অনেক।

এবার ওয়ালমার্টে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। খুব লোভ হচ্ছে মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে। আজ নিয়ম ভাঙ্গার দিন। খেলাম মাছের ঝোল দিয়ে ভাত। খাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল, স্বর্গ থেকে পাঠানো হয়েছে এই খাবার। পৃথিবীর খাবার এত সুস্বাদু হতেই পারে না! টের পেলাম, অনেক দিন পর ভাত খাচ্ছি, আঙুল গুনে দেখি, গত বুধবার রাতে খেয়েছিলাম ভাত, আর আটদিন পর আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে খাচ্ছি ভাত। আরে! এওতো একধরণের কৃচ্ছ্রসাধন! আমি ভাতের পোকা, সেই ভাত না খেয়ে আটদিন পার করে দিলাম ঘোরের মধ্যে। তার মানে আমিও এই আন্দোলনের একজন অংশিদার হতে পেরেছি। আহ! কী সুখ!  খেয়ে দেয়ে কাজে চলে গেলাম।


ওয়ালমার্টে পৌঁছার ঘন্টাখানেক পর থেকেই দেখি ঘন ঘন 'হাই' উঠে! আরে! 'হাই' উঠে কেন? এরপর দেখি দু'চোখের পাতা ভারী লাগে। আমি তো কখনও দুপুরে ঘুমাই না। আমার এমন তো হয় না। তাই এমন পরিস্থিতে কী করবো, বুঝে উঠতে পারছিলাম না! বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল ছিটিয়েছি, কফিরুমে গিয়ে হট চকোলেট মিল্ক খেলাম, ঘুম তাড়িয়ে  ফ্লোরে ফিরতেই দেখি আবার ঘুম পায়। একটু বাদেই খেয়াল হয়েছে, এটাকেই বলে 'ভাতঘুম'।  ঘুম ঘুম চোখে, ঘন ঘন 'হাই' তুলে নয়টি ঘন্টা ছিলাম ওয়ালমার্টে, বের হওয়ার কোন উপায় ছিল না। আজকের দিনটাই অন্যরকম। আজ সব কিছু ভিন্ন গতিতে চলবে। নাহলে নয় ঘন্টা একটানা আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি হবে কেন? বৃষ্টি হয়েছে বলেই তো আমি লাঞ্চ ব্রেকে বাড়ী ফিরতে পারি নি। মাথার মধ্যে ঘুরছিল, মহাসমাবেশ থেকে কী কর্মসূচী দিল, কে জানে! আহারে! বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা কী অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে একটানা সতের -আঠারো দিন ধরে। এর মধ্যে দু'জন সহযোদ্ধাকে হারিয়েছে, সারাক্ষণ হুমকী ধামকীর মধ্যেই ওরা এগিয়ে যাচ্ছে। কী কর্মসূচী দিল কে জানে! সকালে এক ফাঁকে 'আমারব্লগে' প্রীতমের লেখা পড়েছিলাম, যে কয়টি আলটিমেটাম দেখেছি, ভালো লেগেছে। এতদিনে একটা নির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা পাওয়া গেছে। ডাঃ আইজু নামের আরেক মেধাবী ব্লগার সেই কবে থেকেই কলম চালিয়ে যাচ্ছে, সবাইকে উজ্জিবীত রাখছে নানা পরিকল্পনার ছক এঁকে দিয়ে। এমন মেধাবী ব্লগারদের নামে কুৎসা রটাচ্ছে কিছু 'ছাগু'? সকল ছাগুকে উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে, অনেক বেশী বাড় বেড়েছে ছাগুদের। বাংলার মাটিতে 'ছাগু'র জায়গা নেই!

Wednesday, February 20, 2013

THUMBS UP FOR MITHILA!!!

THUMBS  UP  FOR  MITHILA!!

আজ সকালে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, 

উফ!! মাঝে মাঝে কী বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়!! আমার গাড়ী চালানোর দৌড় হচ্ছে বাড়ী থেকে ওয়ালমার্ট, ওয়ালমার্ট থেকে বাড়ী, মাত্র ১০মিনিটের মামলা। আর আজ সকালে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে হাইওয়ে দিয়ে গাড়ী চালিয়ে মিথীলাকে স্কুলে পৌঁছে দিতে হবে!! এটা একটা কথা হলো? আমাকে গাড়ী চালাতেই দেয়া হয় না আবার পেছন থেকে মন্তব্যও করা হয়, অ্যাকসিডেন্ট করি কিনা!!
মেয়ের সায়েন্স ফেয়ার কম্পিটিশানের ব্যাপার, রিজিওনে যাচ্ছে, তাই মুখ বুজে সব সহ্য করে মেয়েকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে এলাম। এমনই কপাল, মেয়েও দেখি স্কুলের কাছাকাছি হতেই বলে, " মা, ভাল করে দ্যাখো, ফেরার সময় কিন্তু ঐ যে ঐ লেইন ধরে আসতে হবে। ভুল করো না কিন্তু"। দিছি একটা ধমক, " ঐ মাইয়া, চুপ থাক"! 
 
স্ট্যাটাসের দুটি অংশ আছে। প্রথম অংশটি বেশ কৌতুকপূর্ণ, ওখানে স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, ড্রাইভার হিসেবে আমার পারদর্শিতা কতখানি। আর দ্বিতীয় অংশটি অপূর্ণ রয়ে গেছে। মিথীলার আজ 'সায়েন্স ফেয়ার অ্যাট রিজিওন' ছিল। স্কুল থেকে ওদেরকে বাসে করে নিয়ে গেছিল স্টেট ইউনিভার্সিটিতে, সে জন্যই আমি ওকে স্কুল পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলাম। দায়িত্ব ভালোভাবেই পালন করেছি। এবার পুরো গল্প বলি।


মিথীলা  যখন ক্লাস টু'তে পড়তো, তখন থেকেই স্কুলের সায়েন্স ফেয়ারে অংশগ্রহণ করতো। নিয়মানুযায়ী স্কুলে ফার্স্ট হলে প্রোজেক্ট নিয়ে রিজিওনে যেত। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত রিজিওনে গিয়েই প্রতিযোগীতা শেষ হতো। সেভেন থেকে শুরু হয়েছে, রিজিওন টু স্টেট।  গত বছর মিথীলা রিজিওনে ফার্স্ট হয়ে স্টেটে গিয়ে সেকেন্ড হয়েছিল। ক্লাস এইট পর্যন্ত স্টেটে গিয়েই প্রতিযোগীতা শেষ হয়। ক্লাস নাই টু  টুয়েলভ  স্টেটে ফার্স্ট হয়ে সরাসরি  ন্যাশনালে যায়,  সেখান থেকে ইন্টারন্যাশনাল। এভাবেই এদেশে স্কুল লেভেলে সায়েন্স কম্পিটিশান হয়ে থাকে।

আমার মিথীলাকে নিয়ে অতদূর ভাবি না। ও আমাদের খেলার পুতুল, ও আমাদের নিঃসংগ জীবনে একমাত্র আনন্দ। ওর উপস্থিতিটুকুই আমাদের কাছে বিশাল পাওয়া মনে হয়। তাই ওকে পড়ালেখা, গান-বাজনা, খেলা ধূলা, কোন কিছু নিয়েই চাপ দেই না। ওকে ওর মত করেই বড় হতে দিচ্ছি। তবে আমার মধ্যে 'টিকটিকি' স্বভাব আছে, মাঝে মাঝে গোয়েন্দাগিরি করি। খবর নেই, কী বই পড়ছে, কী মুভী দেখছে, কাদের সাথে বন্ধুত্ব হচ্ছে, হালকা রসিকতার সুরেই আসল তথ্য জেনে নেই। মিথীলা খুবই সরল মনের একটি মেয়ে, আমার চাতুরী ধরতে পারে না। তাছাড়া আমেরিকায় বাচ্চারা মিছে কথা বলেও না। দুই বছর বয়স থেকে মিথীলা এই দেশে আছে, তাই আমেরিকান কৃষ্টি তো কিছু শিখবেই।

মিথীলা এখন ক্লাস এইটে পড়ে। আগেই বলেছি, ওর লেখা পড়ার খোঁজ আমি নেই না। অবশ্য নিলেও কতদূর কী করতে পারতাম জানিনা। এদেশের লেখাপড়ার কায়দা কানুন আমি বুঝি কম। তাছাড়া এখন আমার বয়স হচ্ছে, নিজের মত করে থাকতে বেশী ভাল লাগে। দুই মেয়ে মোটামুটি মানুষ হয়ে গেছে, ছোটটাও মানুষ হয়ে যাবে, এমনই একটা নিশ্চিন্ত ভাব নিয়ে আমি দিন কাটাই। মাঝে মাঝে মিথীলাকে ডেকে অযথা হম্বী তম্বী করি, 

"অ্যাই মেয়ে, তুমি কী ভাবো যে আমি তোমার কোন খবর রাখিনা? সব খবর রাখি। আমার কিন্তু তিনটি চোখ, তিন নাম্বার চোখ লুকিয়ে রাখি, সেই চোখ দিয়ে তোমাদের কান্ডকীর্তি দেখি। কাজেই সাবধানে চলবে"। ব্যস, এটুকুই যথেষ্ট। 
প্রায়ই দেখি মিথীলা এই প্রোজেক্ট, সেই প্রোজেক্ট নিয়ে বাসায় আসে। ওর তো খেলার সঙ্গী নেই, গল্পের বই ওর বড় সঙ্গী। প্রচুর বই পড়ে, আমি থাকি ওয়ালমার্টে, ওর পাপা থাকে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, ওর দিকে কেউ নজর দেয়ার নেই। তাই ও পাঁচ মিনিটের কাজ এক ঘন্টা সময় নিয়ে করে। ওর রুমের চারদিকে কাগজ, পোস্টার ছড়ানো থাকে, জিজ্ঞেস করলেই বলে রিডিং প্রজেক্ট, হিস্ট্রি প্রজেক্ট সহ এমনই আরও হ্যানা ত্যানা প্রজেক্টের গল্প শুনি। হুমকী দেই, 

" অই মাইয়া, এত সব প্রজেক্টের মধ্যে 'বাংলা প্রজেক্ট' এর কী খবর?"  সাথে সাথে চুপসে যায়। মাঝে মাঝে অযথাই ধমক দেই, বাংলা বই থেকে এক প্যারা পড়তে দেই। ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে যায়, যুক্তাক্ষরে গিয়ে ঢোঁক গিলতে শুরু করে, আমিও ছদ্ম রাগে আরও জোরে ধমক দেই, ওমা, সাথে সাথে শুদ্ধ উচ্চারণে পড়ে যায়।  মিথীলাকে নিয়ে দারুণ মজার খেলা এটা। মিথীলা খুব একটা আবদার করে না। ওর মধ্যে এমন একটা কোমল ভাব আছে যা ওকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। আমাদের বন্ধুস্থানীয়রাও মিথীলাকে খুব আদর করে। এভাবেই একা একা থেকেও মিথীলা সকলের স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয় না। সেই মিথীলা কখন যেন বড় হয়ে গেছে। বড় তো অবশ্যই হয়েছে, ক্লাস এইটে পড়ে! কিন্তু আমরা ওকে বড় ভাবি না। এখনও ওকে বাবলু' গুবলু' সুঙ্কু মুঙ্কু' কত নামে ডাকি।

 মিথীলা যে বড় হয়ে গেছে, তার একটা প্রমান অবশ্য পেয়েছি, গত মাসে। আমি এর আগেও খেয়াল করেছি, মিথীলা খুব অন্তর্মুখী, স্কুলে ওর অনেক সুনাম, অথচ আমি কিছুই জানিনা। মিথীলা কখন কী পুরস্কার পায়, সেই খবরও রাখি না। ও নিজেও কিছু বলে না। দৈবক্রমে যদি আমি জেনে ফেলি, তখন অবাক হয়ে বলি, 

" মিথীলা, তুমি এমন ভাল একটা খবর আমাকে জানাও নি? ও বুঝেছি, আমাকে তুমি সংসারে বাতিল মাল ভেবেছো, তাই না? আমি তোমার কোন খোঁজ নিতে পারি না বলে আমাকে আর কিছুই জানাও না"। সাথে সাথে ও বলে, " আরে! এটা তো কিছুই না। সবাই পায় এমন পুরস্কার, আমি একটু বেশী পাই, কিন্তু তোমাকে বলতে ভুলে যাই। পাপাকে বলি তো"।
আমি বলি, " তা তো বলবেই পাপা কে, পাপা তোমার খোঁজ রাখে, আমি রাখি না"

হাসতে হাসতে জবাব, " তোমরা দুজনের কেউই খোঁজ রাখো না। আমি যে সায়েন্স ফেয়ারে ফার্স্ট হয়েছি স্কুলে, নেক্সট মান্থে রিজিওনাল এ যাব, তোমরা তো জানোও না"।

-অ্যাঁ!!! তুই স্কুলে ফার্স্ট হয়েছিস, তোদের সায়েন্স ফেয়ার কম্পিটিশান কবে হলো?  তোর কী টপিক ছিল?

-হি হি হি হি!!! মা, গত সপ্তাহে হয়েছে কম্পিটিশান। আমার টপিক ছিল, "  Cooking  With  Curcumin"। তুমি হলুদের গুঁড়া দিয়ে যে রান্না করো, সেই হলুদ নিয়েই কাজ করেছি। তবে প্লীজ, এখন আবার জানতে চেও না, কী কী করেছি, এখন বলতে ইচ্ছে করবে না। তবে পরে তোমাকে বুঝিয়ে বলবো"।


মিথীলার কথায় বিরাট ধাক্কা খেলাম। আমি থাকি আমার লেখার জগত নিয়ে, ওর পাপা অবশ্য ওকে একটু হেল্প করে, তবে ওর পাপার বক্তব্য হচ্ছে, 


" এই মেয়ে বেশী মাতব্বর। সব কিছুই সে  আগে আগে  বুঝে।  কোন কথা শুনতে চায় না, নিজের মতের বাইরে যাবেই না।"

ওর পাপা যখন এমন কথা বলে, তখন আমার মাতৃত্ব জেগে উঠে। এক 'ধাপকী' দেই, " এমন করে বলো কেন? ও যদি নিজে নিজে বুঝে সব কিছু করতে পারে, ক্ষতি কি? আমরা কী ওকে সময় দেই? ওতো কখনও অভিযোগ করে না। ওকে কক্ষনও বকবে না"

'ইশ! নিজের কথা ভাবেন, আপনি কী করেন অতটুকু মেয়ের সাথে? এই কান ছিঁড়ে ফেলব, চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেবো, এগুলি কে বলে? আমি বলি?"

-আমি এগুলো বলি, ওকে তটস্থ রাখার জন্য, লাগাম আমার হাতে রাখার জন্য, আমি বলি বলেই তো তুমি কিছু বলবে না। তুমি শুধুই আদর ভালোবাসা দেখাবে।"

পাপা আর মায়ের তর্কাতর্কির মাঝে ঢুকে পড়ে মিথীলা। দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে বলতে থাকে, " ওকে ,ওকে! তোমরা এবার ঝগড়া থামাও, তোমরা কেউই আমাকে বকো না তো, দুজনেই আদর করো। ব্যস, এবার মা আবার লেখালেখি করো, পাপা গিয়ে টিভি দেখো"।


সাতদিন আগে মিথীলা আমাকে বললো, " মা , সামনের মঙ্গলবার আমাকে স্কুলে দিয়ে আসতে পারবে?"

-না, আমি অত সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারবো না। সামনের মঙ্গলবার কী উপলক্ষ্য?

-আমার সায়েন্স ফেয়ার, রিজিওনালে যেতে হবে।

-স্টেট ইউনিভার্সিটিতে তোমাকে কে নিয়ে যাবে? প্রত্যেকবার কেন আমাদেরকে নিয়ে যেতে হবে? স্কুল থেকে কেন ব্যবস্থা করে না? তোমার স্কুলটা দেখতেই বিশাল, কোন কাজের না।

-আহা! মা, না জেনেই খালি বকাবকি করছো কেন? স্কুল বাসেই যাব। পাপার তো সকাল আটটায় ক্লাস, তাই পাপা আমাকে নিয়ে যেতে পারবে না, তোমাকেই নিতে হবে।

-আমার ঘুম ভাঙ্গলে যাব ( মনে মনে অবশ্য ঘাবড়ে যাচ্ছিলাম, ওর স্কুলে যেতে হয় হাইওয়ে দিয়ে, একটা জায়গায় গিয়ে গাড়ী একবার বামে, একবার ডানে, একেবারে ভেজাল)।

গতকাল মেয়ের বাপ সরাসরি সমন জারি করেছেন, " কাল তুমি ওকে নিয়ে যাবে। সোয়া সাতটায় বের হলেই হবে"
মিথীলা বলে, " এত সকালে কেন যাব? আমাদের বাস ছাড়বে আটটার সময়"।

-এত সকালে যাবে, কারণ তখন রাস্তা ফাঁকা থাকে। তোমার মা চালাবে গাড়ি, অ্যাকসিডেন্ট না জানি হয়!

-আমাকে নিয়ে যদি অ্যাকসিডেন্টের ভয় থাকে, তাহলে তুমিই তো নিয়ে গেলে পারো।

-আরে না! আমার ক্লাস আছে।

-তাহলে আর এত আলগা চিন্তা দেখিয়ে লাভ কি?


আজ সকাল সাতটার আগেই মিথীলা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে। আমার দুই চোখের পাতা ঘুমে ভারী হয়ে আছে। কাহাতক সহ্য হয়, একবার ইচ্ছে হলো মিথীলাকে বলি, " মা রে, যা না, তোর পাপাকে বলনা, তোকে দিয়ে আসতে। বলা আর হলো না, বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমেই বাসী ঘর-দোর ঝাঁট দিয়ে মেয়েকে নিয়ে রওনা হলাম। একফাঁকে মিথীলা বললো, 

" মা, আমার জন্য ঠাকুরের কাছে একটু প্রে করতো"

-চুপ থাক, নিজের প্রে নিজেকে করতে হয়। কালকে সারাদিন তুমি ল্যাপটপে মুভী দেখেছো, আর এখন আমাকে বলছো তোমার জন্য প্রে করতে। খেয়ে দেয়ে কাজ নাই আমার। চল, রওনা দেই। 

গাড়ীতে উঠেছি, মিথীলা আগেই তার প্রোজেক্ট বোর্ড থেকে শুরু করে ডিস্পলে টেবিল, চাদর, ফোল্ডিং চেয়ার সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছে। ওকে বলেছি পেছনের সীটে বসতে। বলা তো যায় না, অন্য গাড়ী ধাক্কা দিলে মেয়েটা মাঝের সীটে থাকলে ব্যথা কম পাবে। আমি মাত্র গাড়ী স্টার্ট দিয়েছি, মিথীলা কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে,

"মা, আমার ভয় করছে!"

-কী???? আমি গাড়ী চালাবো বলে ভয় করছে?
-নাহ, আমার মনে হচ্ছে পাপাকে কতগুলো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার ছিল, এখন ভুলে গেছি। কিন্তু জাজ জিজ্ঞেস করলে যদি না পারি!

-কেমনটা লাগে এই মাইয়া নিয়া, বলেই ওর পাপাকে হাতের ইশারায় ডাকলাম। সাথে সাথে মেয়ে বলে উঠলো, মা , দেরী হয়ে যাচ্ছে, থাক লাগবে না।

-মিথীলা শোন, তোর একটা শিক্ষা হওয়া দরকার।  তোরে বলছিলাম, ২১শে ফেব্রুয়ারীর মধ্যে বাংলা পড়া গড়গড়িয়ে পড়তে শিখতে, তুই সেইটা করিস নাই, ভগবান রাগ করেছে মায়ের কথা শুনিস নাই বলে। এই জন্যই তোর মাথা থেকে সব মুছে গেছে। ভালো হয়েছে, পুরস্কার না পেলেই ঠিক হবে। ফাজিল মেয়ে, কাল সারাদিন মুভী দেখার সময় মনে ছিল না?

দুই মিনিট পরেই স্বর শান্ত করে বললাম, ঠিক আছে, মনে মনে ভাবতে থাকো, যখন মনে পড়বে, কাগজে লিখে নাও, পাপাকে ফোন করে উত্তর জেনে নিও। অত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কম্পিটিশানে জিতলে ভাল, না জিতলেও হায় হায় করার কিছু নেই। তবে তোমার একটা শিক্ষা হওয়ার দরকার ছিল। আর শোন, আমাকে দেখিয়ে দিবি, কোথায় গিয়ে টার্ণ নিতে হবে।

_মা, তুমি চালাও, আমি দেখিয়ে দেব। হ্যাঁ মনে পরেছে প্রশ্ন, দাঁড়াও পাপাকে ফোন করি। 

পাপাকে ফোন করে দেখি একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে, আমি গাড়ী চালাবো কি, মনে হচ্ছিল হাতের কাছে পেলে ওকে দুই গালে দুই চড় দিতাম। আমার স্বভাব কোত্থেকে পেল? কত সাহসী মেয়ে ছিল ও, আজ দেখি একেবারে আমার মত নার্ভাস হয়ে গেছে, কেমন টা লাগে! শুনি পাপাকে বলছে, 

"পাপা, এখন রাখি। মা'কে দেখাতে হবে কোথায় টার্ন নিতে হবে। পরে আবার ফোন করবো। মা, ঐ যে ওখানে টার্ন নাও।

-অ্যাই, তুই আমার সাথে কথা বলবি না, মায়ের সাথে বেয়াদবী করছিস বলেই এখন শেষ মুহূর্তে সব ভুলে গেছস।

-আরে, তুমি চালাও গাড়ী। আর দেখে রাখো, ফেরার সময় ঐ লেইন ধরে ফিরবে।

-চুপ থাক মাইয়া, মাতব্বরী করতে হবে না।

-মা, আরেকবার তো তুমি রাস্তা ভুল করে অন্যদিকে চলে গেছিলে।

-ও হো, ঠিক বলেছিস তো। আবার দেখা, কোন লেইন?

-হি হি হি! ঐ যে, অন্য গাড়ী যাচ্ছে, দেখে রাখো। ভয়ের কিছু নেই। আমাকে নামিয়ে দিয়ে ঠিক মত চলে যেও।


মিথীলাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলে এসেছি। ওকে ফোন করেছি, লাইনে পাই নি, ভয়েস মেসেজ রেখেছি, " মিথীলা, বাবলু, চিন্তা করো না। ভালভাবে প্রজেক্ট প্রেজেন্ট করতে পারলেই হলো। টেনশান করো না, সব মনে পড়বে। উইশ ইউ গুড লাক"।

আমি ওয়ালমার্টে চলে গেছি। মাথার থেকে মিথীলা প্রসংগ বাদ। মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে। তিন বছর আগেও ওর সাথে আমি আর ওর পাপা যেতাম, সারাদিন ইউনিভার্সিটি কলেসিয়ামে কাটিয়েছি, পুরস্কার বিতরণী দেরী হলে ওর বাবার তাড়াহুড়োতে পুরস্কার না  নিয়েই চলে এসেছি। পরে স্কুল থেকে মেডেল সংগ্রহ করেছে। ক্লাস সিক্সে থাকার সময় একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান পর্যন্ত বসে থেকেও কোন লাভ হয় নি। মিথীলা কোন প্লেস পায় নি। মেয়ের মন খারাপ দেখে আমরা অনেক সান্ত্বনা দিয়েছি। সাতদিন পর শিক্ষাবোর্ড থেকে একটি মেইল পাঠিয়েছে, খামের ভেতর যুগ্ম ফার্স্টের মেডেল আর ক্ষমা চাহিয়া পত্র।

বিকেলে মিথীলাকে ফোনে পেলাম। বললো, এখন প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশান হবে। জিজ্ঞেস করলাম, " তোমারটা কেমন হলো? সব ভালোভাবে বলতে পেরেছ? কয়জন জাজ এসেছিল?

" মনে হয়, ভালো হয়েছে। দুইজন জাজ এসেছিল। একজন ছিল ইন্ডিয়ান, আরেকজন আমেরিকান'।

-তাই?? ইন্ডিয়ান হলে তো মজা, হলুদের ব্যাপার সে ভালো বুঝবে। তা ওরা কী কিছু কমেন্ট করেছে, যা থেকে বুঝা যাবে যে ওরা তোমার কথায় সন্তুষ্ট"

-হা হা হা , আমেরিকান জাজ বেশী প্রশ্ন করে নি।

-এই রে! প্রশ্ন না করা ভালো কথা না। তার মানে ওদের কাছে ভালো লাগে নি।

-আরে না, জাজ বলেছে, আমি নাকি এত ভালোভাবে এক্সপ্লেইন করেছি যে তার আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। আর ইন্ডিয়ান জাজ ক্রিটিসাইজ করেছে।

-অ্যাঁ!! শেষ পর্যন্ত ইন্ডিয়ানটায় তোরে ক্রিটিসাইজ করলো, তা কী বললো?

-কী কী ভুল থাকবে?

-কী, ভুল থাকবে মানে? তোর প্রোজেক্টে ভুল আছে বলেছে? তাহলে কী তুই ভুলভাল লিখছস নাকি?

-আহ মা!!!!! সে বলেছে, আমি যে পিনাট অয়েলে কাজ করেছি, সেটা ছাড়াও যেন অন্য সলভেন্ট ইউজ করি। নাহলে রেজাল্টে ভুল আসতে পারে। আমি তখন বলেছি, আমি তো এটার উপর কাজ চালিয়ে যাব, তোমার সাজেশান মনে থাকবে। ফলো করবো"

-মিথীলা, তুই এত গুছিয়ে কথা বলতে পারিস?

-ইংলিশে হলে বলতে পারি। বাংলায় একটু উলটাপালটা হয়।

আচ্ছা, তোর প্রজেক্টটা কী রে?

-মা, হলুদের মধ্যে কারকিউমিন নামের যে কেমিক্যাল আছে, সেটা আমাদের দেহে কী কাজ করে। এখন বলতে পারবো না। পরে কথা বলবো।

-শোন, মনে হচ্ছে তুই এবার পুরস্কার পাবি না, আগেই বলে দেই, মন খারাপ করিস না। নেক্সট টাইম ভালো করবি।

-আমার মনে হয় পুরস্কার পেতেও পারি।

-ফার্স্ট না হলে আমার কাছে পুরস্কারের দাম নাই, আমি আগেই বলে দিলাম।

-ফার্স্টই হবো।


সন্ধ্যার সময় ফোন করে মিথীলাকে পাই না, বাসায় ওর বাবার কাছে ফোন করে জানলাম, মেয়ে নাকি বলেছে, বাসায় ফিরে সারপ্রাইজ দিবে। তাহলে তো মনে হয় ফার্স্ট হয়েছে, তাই না? -হতে পারে।

এবার পেয়ে গেলাম ওকে ফোনে। মিথীলা, কী খবর?

বাসায় এসে বলবো। পুরস্কার পেয়েছি, তবে কী পুরস্কার তা বাসায় এসে বলবো।

-মারে, আমি তো বাসায় ফিরবো রাত ৯টার পরে, এতক্ষণ আমি না জেনে থাকবো, আর তোর পাপা আগেভাগে জেনে ফেলবে।

-আচ্ছা একটা বলি, আমার ক্যাটাগরীতে ফার্স্ট হয়েছি। আর কিছু বলবো না।

একটা বলি মানে, কয়টা পুরস্কার পেয়েছিস?

মিথীলা ফোন রেখে দিয়েছে, এত পাজী।  রাত আটটার দিকে মিশা ফোন করেছে আমাকে। বললাম, মিথীলা তো সায়েন্স ফেয়ার রিজিওনালে এবারও ফার্স্ট হয়েছে।

-হ্যাঁ শুনেছি তো, ওতো 'বেস্ট অফ দ্য ফেয়ার' ট্রফি পেয়েছে। 

-অ্যাঁ কী বলো!! তাই নাকি?

-কেন, তুমি জানো না?

-আমাকে নাকি সারপ্রাইজ দিবে।
-তাহলে আমি আর বলছি না। বাসায় গিয়ে সারপ্রাইজড হও।

কাজ থেকে ফেরার সময় চট করে মিথিলার জন্য 'ব্লুবেরী মাফিন' আর 'পিকান পাই' কিনে নিলাম। মিথীলা মিষ্টি জাতীয় খাবার খুব ভালোবাসে। ইদানিং আমার ঘরে হেলদি ডায়েট প্রোগ্রাম চলছে বলে এগুলো আর কেনা হয় না। আমি ভাবতেই পারছিলাম না, এই পুচকী মেয়ে একা একা এতদূর কিভাবে এগিয়ে গেলো।  নিজে নিজে পোস্টার রেডী করা, কম্পিউটারে টাইপ করা, প্রিন্ট করা, পেস্ট করা থেকে শুরু করে সব একা করেছে।  ওর পাপা নিজের ল্যাবে নিয়ে গিয়ে প্রোডাক্ট অ্যানালিসিসের সময় হেল্প করেছে, এটা করতেই হবে। অতটুকু বাচ্চার হাতে কেমিস্ট্রি ল্যাব ছেড়ে দেয়া যাবে না বলেই পাশে থেকেছে। আর আমি তো আজকেই জানলাম, ওর প্রজেক্টের নাম। 

কেমিস্ট্রি খুবই কমপিটিটিভ ক্যাটাগরী, সেখানে ফার্স্ট হয়েছে ভালো কথা, 'বেস্ট অব দ্য ফেয়ার' ট্রফি পেয়েছে আমাদের মিথীলা, মায়ের কথা খুব মনে হচ্ছিল। মিথীলা আমার তিন নাম্বার মেয়ে, ওর জন্মের পর আমি খুব কেঁদেছিলাম। তখন মা বলেছিল, 

" তোর এই মেয়েই তোকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যাবে। ভগবানের দান, এমন হেলা অশ্রদ্ধা করতে নাই। তোর তিন মেয়ে তিন রত্ন হবে বলে দিলাম"।

মা, তুমি কী উপর থেকে সব দেখতে পাচ্ছ? মা, আমার শরীর কাঁপছে। মা, আজকেও ওর বাবা আর আমি ওর উপর বিরক্ত হয়েছি। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছি, মেয়েটা বেশী মাতব্বরী করে। কারো কথা শুনবে না, নিজে যেটা ভালো মনে করবে, সেটাই করবে। মা, এখন তো দেখছি, ও আমাদের সবার থেকে অনেক বেশী ভাল বুঝে! 

বাড়ী ফিরতেই মিথীলা খুব হাসতে হাসতে আমার কাছে ওর ট্রফী, মেডেল এবং আরেকটি 'টপ টেন পার্সেন্ট' সার্টিফিকেট নিয়ে এলো। আমি মুহূর্তটিকে ধরে রাখতে চাইলাম, ওর পাপাকে ডাকলাম  আনন্দময় মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দী করে রাখার জন্য। ওর পাপা বিনা বাক্য ব্যয় করেই কতগুলো 'ঝাপসা' ছবি তুলে দিল। ছবির দিকে তাকাতেই আমি আর মিথীলা দুজনেই হেসে গড়িয়ে পড়ি। আমার মিথীলা এর চেয়ে হাজার গুণ বেশী ভাল ছবি তোলে। যাই হোকম মিথীলার কাছে জেনে নিলাম ওর স্টেট ফেয়ারের তারিখ। এবার আর ওকে একা যেতে দেবো না, আমরাও সাথে যাব।


'

এ যেন আমার কাছে মরুর বুকে বৃষ্টি!


ব্যক্তিগত আনন্দের খবর শেয়ার করি। আমি তো গণজাগরণ আন্দোলনের সাথে নিজেকে মানসিকভাবে জড়িয়ে ফেলেছি। সংসারের দিকে তাকানোর ফুরসত পাইনা, মিথীলার মুখটাও ভাল করে দেখার সুযোগ হয় না। মিথীলার লেখাপড়ার খোঁজ নেইনা, কেমন এক উদভ্রান্তির মধ্যে সময় কাটে আমার। সেই উদভ্রান্ত মার্কা জীবনে মিথীলা নিয়ে এসেছে প্রাপ্তি সংবাদ।

গত সপ্তাহে মিথীলা গিয়েছিল স্টেট ( মিসিসিপির সব স্কুল) সায়েন্স ফেয়ারে, ফিরেছে 'থার্ড' হয়ে। মিথীলার সাফল্য নিয়ে 'কাব্য' রচনা করা হয়নি।

আজ মিথীলা ওর বন্ধুর বাবার গাড়ীতে চড়ে গিয়েছিল টেনেসী রাজ্যের মেমফিস শহরে। ওয়ার্ল্ড হিস্টোরী ইন্টারস্টেট ( ছয়টি স্টেটের ৩০ জন প্রতিযোগী) কমপিটিশানে। ফিরেছে 'প্রথম পাঁচজনে'র একজন হয়ে। [এখানে কোন পজিশান দেয়া হয়নি কাউকেই]

নেক্সট জুনে ইন্টারস্টেট থেকে দশ জন যাচ্ছে ন্যাশনাল কম্পটিশানে, ভেন্যু আটলান্টা। মিথীলার কাছে জিজ্ঞেস করে জানলাম, দশজনের আটজন এসেছে বিল ক্লিন্টনের রাজ্য 'আরকানসা' থেকে আর বাকী দু'জন গরীব রাজ্য মিসিসিপি থেকে, দুজনের একজন হচ্ছে বাংলা মায়ের সন্তান **মিথীলা**! হিপ হিপ হুররে!!!!!!

* মজার ব্যাপার হচ্ছে, আজকের এত বড় কম্পিটিশানের আদ্যোপান্ত শুনলাম মিনিট পনের আগে, মিথীলার গলায় মেডেল ঝুলছিল, মেডেলের গায়ে লেখা ছিল 'হিস্টোরী' জাতীয় কিছু শব্দ। থাক, মিথীলা তার মা'কে খুব ভালোবাসে, ও জানে, ওর মায়ের মাথাটা এখন একটু উলট পালট হয়ে আছে*
Like · · Promote ·




Monday, February 18, 2013

'সংখ্যালঘু' হওয়ার গ্লানি থেকে মুক্তি চাই!!

অনলাইন সংবাদ থেকে যখন জানতে পেরেছি, সংসদে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার আইন সংশোধন করা হয়েছে, যখন জানতে পেরেছি, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের অপরাধকেও বিচারের আওতায় আনা হয়েছে, মনে মনে আমাদের প্রধান মন্ত্রীকে একশত বার সালাম করেছি। সাথে সাথে মনের পর্দায় ভেসে উঠেছে, '৮৩ সালের এক বিকেলের ছবি। যে বিকেলে বর্তমান প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় বিলুপ্ত 'ছাত্রলীগ' আয়োজিত সভায় 'সভানেত্রী' হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। জাতির পিতার কন্যাকে খুব কাছে থেকে এক নজর দেখার জন্য কেমিস্ট্রি ল্যাবে না গিয়ে 'প্রান্তিকের' পাশের স্বল্প পরিসরে আয়োজিত সমাবেশে উপস্থিত হয়েছিলাম।
মনে পড়ে, সভা আয়োজনে কোন জাঁকজমক ছিল না, কোন প্রচার ছিল না, সাধারণ সাদামাটাভাবেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। জাঁকজমক করার সামর্থ্যও ছিল না তৎকালীন ছাত্রলীগের সদস্যদের, কারণ, তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ছিল 'সংখ্যালঘু', সংখ্যালঘু হওয়ার কারণেই তাদের প্রচার বা প্রসার, কোনটাই ঠিকভাবে হয়ে উঠেনি। আর সেই 'সংখ্যালঘু' ছাত্রদের নেত্রী ছিলেন পিতা-মাতা, ভাই হারাণো 'এতিম, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। অতি সাধারণ লাল পাড় সাদা জমিন ঢাকাই তাঁতের শাড়ী পড়ে এসেছিলেন তিনি, মুখে হাসি লেগেই ছিল, মাথা থেকে লম্বা চুলের বিনুনী কোমড় ছাড়িয়ে হাঁটু ছুঁয়েছিল, সাধারণ বেঞ্চ জোড়া দিয়ে যে ডায়াস তৈরী করা হয়েছিল, সেখানে দাঁড়িয়ে উনি বক্তৃতা করেছিলেন। স্বাধীন দেশের রূপকার, বীর বাঙালী জাতির পিতার 'এতিম কন্যা'টিকে দেখামাত্র তরুণ হৃদয়ে কান্না উথলে উঠেছিল। দূর্বা ঘাসের উপর বসে দুই হাঁটুর উপর মাথা রেখে অনেকক্ষণ কেঁদেছি। দেশের সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের একজন আমি, তৎকালীন সরকারের কৃপায় কপালে জুটেছে ,'সংখ্যালঘু' নামের কালো টীকা, ফলে হৃদয়ে ছিল অসহায় বোবা কান্না, নেত্রী শেখ হাসিনাকে দেখামাত্র বুক মুচড়ে উঠেছিল। উনাকে দেখার সাধ ছিল, দেখেই চলে এসেছিলাম। কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ থাকার পরেও কাছাকাছি যাইনি।
এত বছর বাদে আজ মনে হচ্ছে, যদি সেদিনের সেই দুঃখী কিন্তু সদা হাস্যমুখ মানুষটির কাছে আরেকটিবার যাওয়ার সুযোগ পেতাম, একটি কথাই শতবার বলতাম " মাননীয় প্রধান মন্ত্রী, সেদিনের আপনার সাথে আজকের আপনার আকাশ আর পাতাল তফাৎ। সেদিন আপনি ছিলেন শুধুই দুঃখী, এতিম, সংখ্যালঘু, আর আজ আপনি নিজের যোগ্যতাবলে জনপ্রিয়তা, ক্ষমতা, ভালোবাসার উচ্চশিখরে আছেন। আপনাকে এ অবস্থানে দেখে আজকেও আমার কান্না পাচ্ছে, তবে এই কান্না আনন্দের, ভরসার, বিজয়ের। আপনি দেশের সকল দন্ডমুন্ডের কর্তা, আপনি দেশপ্রেমিক, আপনি জাতির পিতার কন্যা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সদা ভাস্বর। আপনার মাধ্যমেই আজ জাতির কপালে লেগে থাকা 'বিষফোঁড়া' উৎপাটনের সকল আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে। আপনার মাধ্যমেই মহান সংসদে যুদ্ধাপরাধী বিচারের বিল পাশ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে দেশ এক গহীন বেদনার বালুচর থেকে মুক্তি পাবে।
মাননীয় প্রধান মন্ত্রী, সেদিন আপনার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ ছিল, এখন আর তা নেই। সেদিন আপনার আর আমার মাঝে একটি জায়গায় মিল ছিল, আপনিও ছিলেন 'সংখ্যালঘু', আমিও ছিলাম 'সংখ্যালঘু'। আজকের অবস্থানে আসতে আপনাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, আজ আপনি বিজয়ী, আজ আর আপনি 'সংখ্যালঘু' নন কিন্তু আমার কপাল থেকে 'সংখ্যালঘু' নামের টিকা মুছে যায় নি। আমরাও নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছি, আমাদের সন্তানেরা সংগ্রাম করছে, তবুও কপাল থেকে 'সংখ্যালঘু' নামক কলঙ্ক টীকা মুছতে পারিনি। এর একটাই কারণ, 'সংখ্যালঘু' নামের কলঙ্ক টীকা রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের কপালে সেঁটে দেয়া হয়েছে, তাই টীকা মোচনও রাষ্ট্রীয়ভাবেই করতে হবে।
আপনি জাতির প্রধান, সারাদেশ, সকল তরুণ আপনার পাশে এসে জড়ো হয়েছে, এই তো সময়, দেশের সংবিধান থেকে সামপ্রদায়িক রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করুন, আমাদেরকে সংখ্যালঘু হওয়ার গ্লানি থেকে মুক্ত করুন। আমরা আর দশজন সাধারণ নাগরিকের মত বাঁচতে চাই, স্বাধীনভাবে দেশে বসবাস করতে চাই। আপনি একটি দেশের প্রধান, দেশের প্রতিটি নাগরিকের জান-মাল, মান-ইজ্জত, ধর্ম- ধর্মাচার রক্ষার গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই আপনি দেশ পরিচালনায় নেমেছেন। দেশের প্রতিটি নাগরিক তার জন্মগত অধিকার নিয়ে যেন বসবাস করতে পারে, তা দেখভাল করার গুরুদায়িত্বও আপনার কাঁধেই বর্তেছে। আপনি একজন আলোকিত মানুষ, আপনি একজন দেশপ্রেমিক, আপনার রাজত্বে একটি নাগরিকের প্রতিও রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন অনিয়ম থাকা উচিত নয়। একজন সুশাসক, একজন দেশপ্রধানের দৃষ্টিতে প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার থাকার কথা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমার দেশে, আমার বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশের সংবিধান থেকে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' বাতিল করে, শুধুমাত্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর সংখ্যা বিচার করে দেশকে ইসলামিক রাষ্ট্র ঘোষণা করে দেশের সংখ্যালঘিষ্ঠ নাগরিকের কপালে 'সংখ্যালঘু' টীকা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে, এক মায়ের সন্তান হয়েও আমরা আজ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে গেছি। অনুগ্রহ করে আমাদের কপাল থেকে এই 'রাষ্ট্রীয় কলঙ্ক টিকা' মুছে দিন।
একমাত্র আপনিই পারবেন এই মহান কাজটুকু করতে, আগে পিছে আর কেউ পারবে না। আপনি দেশের প্রধান, আপনিই দেশের মা-বাপ, এর আগে যারা দেশের শাসনদন্ড হাতে নিয়েছিল, তাদের চোখে আমরা ছিলাম 'পরগাছা'। তাই আমাদের জন্মগত অধিকার তারা কেড়ে নিয়েছিল। আপনি আমাদের স্নেহময়ী মা, আপনি আমাদের স্নেহময়ী বোন! আমাদের মত দূর্বল মানুষগুলোর প্রতি আপনার সমদৃষ্টি হানুন, রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদেরকে কোন ক্রমিক নাম্বার ব্যতীতই শুধু নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিন। যে কোন উগ্রপন্থী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে নিজের সুনাম অক্ষুন্ন রাখুন। নানাজনে নানান কথা বলে। অনেকেই আপনাকে সুবিধাবাদী বলে, আপনাকে অতীতের দুই একটি ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য গাল-মন্দ করে, আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, যে কেউ আপনার বিষয়ে এই ধরণের কথা বলে, আমি অন্তরে জ্বালা টের পাই। ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠি আপনাকে নিয়ে অমন বিদ্রূপাত্মক কথা শুনে। আপনি জাতির পিতার কন্যা, বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই একই পিতার সন্তান। যারা মানে না পিতাকে, তাদের কথা আলাদা, কিন্তু যারা পিতাকে মেনেছি, পিতাকে জেনেছি, সেই সন্তানেরা কেন দেশের নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার পাব না! কেন আপনার শাসনামলে রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে ভিন্নমতের রাজনীতিবিদেরা বিভিন্ন টকশো তে গিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কটাক্ষ করে কথা বলবে, কেন রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে 'সংখ্যালঘু' দের জন্য অলিখিত আইন থাকবে, কেন একজন 'সংখ্যালঘু' প্রচন্ড মেধাবী হওয়া সত্বেও শুধুমাত্র নামের কারণে মেধা প্রতিযোগীতার রেস থেকে ছিটকে পড়বে! আমি অবশ্যই বিশ্বাস করি, এ সমস্ত অনিয়ম, অভিযোগের কথা আপনার কান পর্যন্ত পৌঁছে না, তাই আপনি 'সংখ্যালঘু'র বেদনার কথা জানেন না।
মাননীয় প্রধান মন্ত্রী, এ এক লজ্জার কথা, এ এক বেদনার কথা। একটি দেশে জন্মে, শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয়ভাবে 'বৈমাত্রেয়সুলভ' আচরণ পেয়ে কতশত মেধাবী তরুণ-তরুণী অভিমানে মাতৃভূমি ছেড়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে যাযাবরের মত ঘুরছে, তাদের কোন ঠিকানা নেই, তাদের কোন দেশ নেই, নিজেদের মেধা অন্য দেশের উন্নয়নে বিক্রী করে দিচ্ছে! বিক্রী করে দিচ্ছে কথাটিই প্রযোজ্য, কারণ পরবাসের সরকার পয়সা দিয়েই তাদের মেধা কিনে নিচ্ছে! দেশমায়ের কাছ থেকে বিমাতাসুলভ আচরণ পেয়ে তারা মনের দুঃখে বৈদেশে পড়ে আছে, পরবাসে দেশমাতৃকার জন্য চোখের জলে ভাসে! বুকে প্রচন্ড অভিমান নিয়ে অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে ঠিকই, কিন্তু মনে-প্রাণে নাগরিক হতে পারে না। রক্তের টান, মাটির টান পিছু টেনে ধরে।
মাননীয় প্রধান মন্ত্রী, আপনি আমাদেরকে বাঁচান। আপনি অনেক সয়েছেন, অনেক ক্ষয়েছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি আপনার নামও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে সমান অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার আইন করেছিলেন, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রেখেছিলেন, ব্যক্তি জীবনে উনি ছিলেন একজন প্রকৃত মুসলমান, উনি জন্মেছেন একটি ধর্মভীরু সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারে। উনি ছিলেন প্রকৃত ধার্মিক, তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগনের একজন হয়েও অন্য ধর্মাবলম্বীদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমান অধিকার দিয়েছিলেন। যারা বঙ্গবন্ধুর এই অসামান্য মহানুভবতা মেনে নিতে পারে নি, তারাই 'কাপুরুষের' মত পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে উনাকে হত্যা করেছে। তারাই কলমের এক খোঁচায় সংবিধান থেকে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' কেটে দিয়ে আমার প্রিয়জন্মভূমির কপালে কলঙ্ক লেপে দিয়েছে। তারাই দেশের জনগণকে 'সংখ্যাগুরু' আর 'সংখ্যালঘু' নামে দুই ভাগ করে দিয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ব্যক্তিজীবনে আপনি একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তানের জননী। আমাদের সংস্কৃতিতে পুত্রের মা ভাগ্যবতী, এই বিশ্বাস বহু যুগ ধরে প্রচলিত। আপনি নিজেও জানেন সামাজিক এই বৈষম্যনীতির খুঁটিনাটি বিষয়গুলো সম্পর্কে। আমার 'পুত্র' সন্তান নেই বলে সমাজে আমাকে ' আহারে! একটা ছেলে নেই' চোখে দেখা হয়, আমি অবশ্য বুঝতে পারি না, পুত্র থাকলে আমার মাতৃত্বে ভিন্ন কোন মাত্রা যোগ হতো কিনা! যার পুত্র ও কন্যা দুইই আছে, একমাত্র সেই বুঝতে পারবে, পুত্র আর কন্যাতে কী তফাৎ, আদৌ কোন তফাৎ আছে কিনা! সৌভাগ্যক্রমে আপনি পুত্র এবং কন্যার জননী হয়েছেন, আপনি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই, মায়ের কাছে পুত্র বা কন্যার অবস্থানগত কোন পার্থক্য আছে কিনা। আচ্ছা, পুত্র জয় আর কন্যা পুতুলের মধ্যে কাকে বেশী ভালোবাসেন? কে বেশী মেধাবী, কে বেশী বিত্তশালী, কার পেশীর জোর বেশী, এগুলো দিয়ে কী আপনি সন্তানকে বিচার করেন? আপনাকে কে বেশী ভালোবাসে? পুত্র জয় নাকি কন্যা পুতুল? আপনাকে যখন জেলে রাখা হয়েছিল, কে বেশী আপনার জন্য কেঁদেছিল? পুত্র জয় নাকি কন্যা পুতুল? আমি জানি, আপনি দুই সন্তানের ভালোবাসায় কোন বিভাজন রেখা টানতে পারবেন না। আপনি মা, মায়ের চোখে সব সন্তান সমান।
এবার নিজেকে দেশমাতার সাথে তুলনা করুন, মাগো, আমরা সংখ্যায় কম হতে পারি, তবুও তো আমরা তোমার সন্তান। সংখ্যা কম বলে আমাদেরকে তোমার স্নেহসুধা থেকে বঞ্চিত করে রাখবে? মায়ের চোখে তো সব সন্তানই সমান। কন্যাও যা, পুত্রও তাই। প্রাক্তন শাসকদের মধ্যে কেউ ছিল শুধুই পুত্র সন্তানের জনক, কেউ বা ছিল নিঃসন্তান, তাই কলমের এক খোঁচায় তারা সংবিধান থেকে আমাদের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক অধিকার বাদ দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমরাতো তোমার কাছে জন্মের ঋণে আটকা পড়েছি। কেউ দেশে বসেই বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হচ্ছি, কেউ পরবাসে বসে তোমার স্নেহসুধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। মাগো, আমাদের কপাল থেকে 'সংখ্যালঘু'র টীকা মুছে দাও, সন্তান কষ্টে থাকলে মায়ের ভাগ্যে সুখ থাকে না। মায়ের সুখ না দেখলে সন্তান ভালো থাকে না। আমরা কেউই ভালো নেই, আমার বাংলা মা ভালো নেই, আমরাও ভালো নেই। দেশের কিছু দুষ্টচক্রের হাতে আমার দেশ আজ বন্দী। তোমার বুকে বসে তোমার কিছু 'কুসন্তান' বিভিন্ন সভা সমাবেশে, বিভিন্ন মিডিয়ায় অনবরতঃ 'সংখ্যালঘু'দের নাম তুলে গালি-গালাজ করে। টিভিতে বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত 'টকশো' গুলোতে কিছু চিহ্নিত সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব এসে অযথা 'সংখ্যালঘু' সম্প্রদায়ের গায়ে 'ভারতের' তকমা লাগায়! আমাদের পূর্ব পুরুষের জন্ম এই দেশের মাটিতে, আমাদের জন্ম এই দেশের মাটিতে, তবে কেন আমাদেরকে উঠতে বসতে 'অন্যদেশ ভারতের দালাল' বলা হবে? আমরা তো ভারতের নাগরিক নই, ভারত যদি অন্যায় আচরণ করে, তার দায় কেন আমাদের উপর বর্তাবে? আমরা তো ভারতের নাগরিক নই, আমরা জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। তারপরেও অনবরতঃ চলতে থাকা এইসব অনাচার, অপপ্রচার, কুৎসা, অন্যায় যেহেতু রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তাই বাংলাদেশের সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগণ ভয় পেতে পেতে একেবারে শামুকের মত গুটিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে, সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগণ নিজেদেরকে ' সংখ্যালঘু' হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। যা একটি দেশের জন্য, একটি জাতির জন্য বেদনাদায়ক। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের কাছে প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার, সমান দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। এবং আমাদের মধ্যে তা পুরো মাত্রায় আছে। প্রবাসে বসে আমরা নিজেদেরকে 'বাংলাদেশী' হিসেবেই পরিচয় দেই। দিতেই হয়, মায়ের পরিচয় না দেয়ার মত 'কুসন্তান' আমরা নই।
বাংলাদেশের জন্মলগ্নেই প্রতিটি নাগরিকের সম অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছিল, বাংলাদেশের জন্মলগ্নে আমাদের প্রজন্ম ছিল নিতান্তই শিশু। কিন্তু ঐ শিশু বয়সেই পেয়েছিলাম স্বাধীনতার সুখ, যদিও সুখ ছিল স্বল্প সময়ের জন্য। একদল কাপুরুষের হাতে জাতির পিতাকে সপরিবারে প্রাণ দিতে হয়, অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলার ভবিষ্যত ধূলিসাৎ হয়ে যায়! '৭৫ এর আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সাথে আমরা সংখ্যালঘুরা ভালই ছিলাম, আমাদের একটাই পরিচয় ছিল, আমরা বাঙালী। ভাই-ভাই, বোন-বোন পাশাপাশি বড় হচ্ছিলাম। ঝগড়া করতাম, আবার হাতের খাবার ভাগাভাগি করে খেতাম। এখনও আমরা আগের মত থাকতে চাই। পাশাপাশি বসবাস করে বন্ধুর কাছ থেকে, ভাইয়ের কাছ থেকে 'গালি' শুনতে রাজী আছি, কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে গালিগালাজ শুনতে রাজী নই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশ আজ জেগেছে। তারুণ্য জেগেছে। এই তারুণ্য মেধাবী, এই তারুণ্য সাহসী, এই তারুণ্য অসাম্প্রদায়িক, এই তারুণ্য মুক্তিযুদ্ধ না দেখেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জ্বল, ওরা মুক্তিকামী, ওরা দাসত্বের শৃংখল ভাঙ্গতে চায়, ওদেরকে একটু সাহায্য করুন। বঙ্গবন্ধুর পরে একমাত্র আপনার হাতেই দেশের ভবিষ্যত নিরাপদ, আপনি ছাত্রজীবনে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। আপনি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, আপনি জানেন, মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, উপজাতি থেকে শুরু করে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই অংশগ্রহণ করেছিল, যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের সকলেই বাঙালী, তাঁদের একমাত্র পরিচয় বাংলা মায়ের সন্তান হিসেবে, যারা বেঁচে গেছেন, তাদের সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনেকেই নিঃস্ব হয়েছে। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তাদের কথা বাদ। তারা বাংলা মায়ের সন্তান হলেও তারা 'কুসন্তান'। সেই 'কুসন্তানে'রাই এতকাল দেশটাকে, দেশের সংবিধানকে দুমড়ে মুচড়ে নস্যাৎ করে গায়ের জ্বালা মেটাতে চেয়েছিল।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দুষ্টলোকে মন্দ কথা বলবে, স্বার্থে ঘা লাগে বলেই ওরা কুৎসা রটাতে চায়। যে যাই বলুক, দিবালোকের মত স্পষ্ট বিষয় হচ্ছে, আপনার শাসনামলেই ঐসকল ঘৃণ্য অপরাধীদেরকে চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে, আপনার তত্বাবধানেই তাদের বিচারিক কাজ শুরু হয়েছে, যুদ্ধাপরাধী বিচার দাবীর মূল উদ্যোক্তা শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে আপনিই সাহস ও শক্তি যুগিয়েছিলেন, শহীদ জননীর পাশে ছিলেন সবসময়। আপনাকে সালাম জানাই। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আপনার প্রতি পরম নির্ভরতা আমাদের। আপনার বিরুদ্ধে অনেকেই অনেক কথা বলেছে, বলছে এবং আরও বলবে। অনেকেই বলছে, আপনার পক্ষে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সম্ভব নয়। সাহসী পিতার সাহসী কন্যা আপনি, এই সকল কুৎসাকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে আপনার শাসনামলেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে কবর দিন। আমাদের মত দুঃখী সংখ্যালঘিষ্ঠ বাঙালীর কপাল থেকে 'সংখ্যালঘু'র কলঙ্ক মুছে দিন। ভবিষ্যত প্রজন্ম আপনাকে তাদের মাথায় ও বুকে ঠাঁই দেবে। ইতিহাসের পাতায় জাতির পিতার মত আপনার নামও স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে।