Thursday, February 7, 2013

সাত ঘন্টার গল্পসংগ্রহ থেকে!

আমি গত সাত বছর ধরে ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টারে চাকুরী করছি, কোন রকম ক্লান্তি বা অবসাদ আমাকে গ্রাস করেনি। ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার মানেই আলাদা এক পৃথিবী।এই পৃথিবীতে প্রতিদিন কত রকমের মানুষ যে আসে, তার ইয়ত্তা নেই। কেউ ভালো করে খেয়ালও করেনা, কারা আসে, কারা যায়! আমিও খেয়াল করে দেখিনি এতদিন। গত বৃহস্পতিবার  আমার কাজের স্কেজিউল ছিল বেলা ১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। ইদানিং আমার কাজে যেতে আর ভালো লাগে না, একঘেঁয়ে লাগে। আমি চাকুরী করি কানেকশান সেন্টারে। একই কাজ, একই কথা, একই ঊদ্দেশ্যের মানুষজনের আনাগোনা চলে সারাদিন। কাজে নতুনত্ব কিছু নেই।

এই বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ ৩১শে জানুয়ারী আমার মনটা খুব ভালো ছিল। তাই কাজে গিয়েছিলাম হালকা মনে। কাজের স্কেজিউল নিয়ে খুব টানাপোড়েন চলছিল, ঘরে উত্তম কুমার বুঝিয়েছে, কোন কিছু নিয়েই অযথা স্ট্রেস না নিতে। কাজকর্ম হালকা মন নিয়ে করলে নাকি কাজ কখনও একঘেঁয়ে মনে হয় না। আমি সেদিন হালকা মন নিয়ে গেছি এবং ঠিক করেছি, সাত ঘন্টায় কী ধরণের মানুষের সাথে আমার ইন্টার‍্যাকশান হয়, তার একটি হিসেব রাখা। এটা ভাবার সাথে সাথে মন খুব চনমনে হয়ে উঠলো। এক্সপেরিমেন্ট শুরু হলো একটি ফোন কলের মাধ্যমেঃ

ইস্যু এক)  মহিলা কন্ঠঃ হ্যালো, আমি  আইফোন এক্সপার্টএর সাথে কথা বলতে চাই।
   আমিঃ আমরা ফোন সার্ভিস বিক্রী করি, ফোন বিক্রী করি, কেউ ফোন এক্সপার্ট নই। তারপরেও শুনি, কী জানতে চাইছো?

মহিলাঃ তোমরা কি আইফোনের 'স্লীম কার্ড' বিক্রী করো?

আমিঃ না, আমরা আলাদা করে সিম কার্ড বিক্রী করি না।

মহিলাঃ আচ্ছা, আমি শুনেছি, যদি ওয়ালমার্ট ক্রেডিট কার্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করি, আর অ্যাপ্রুভড হই, তাহলে নাকি আই ফোন একেবারে ফ্রী পাওয়া যাবে?

আমিঃ হোয়াট!!!!!!!!!!!

মহিলাঃ হ্যাঁ, যদি ক্রেডিট কার্ডের জন্য আপ্রুভড হই, তাহলে নাকি আইফোন ফ্রী পাওয়া যাবে।

(ফোনের উপরেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এই এক যন্ত্রণা! পাবলিক শুধু 'ফ্রী' ফোনের খোঁজ করে। যত দোষ নন্দ ঘোষ! শুধু বাঙ্গালীদের বদনাম, বাঙ্গালী নাকি 'ফ্রী' পেলে বিষও খেতে চায়! হুঃ আর তোমরা আমেরিকানরা কি? সাধু তোমরা!)

বললাম, ম্যাডাম, তুমি কার কাছ থেকে এই অদ্ভুত তথ্য সংগ্রহ করেছো জানিনা, তবে ৭০০ ডলার দামের ফোন ফ্রী পাওয়া যায়, এটা তোমার কাছে প্রথম শুনলাম।

মহিলাঃ কোন আই ফোনের দাম ৭০০ ডলার?

 আমিঃ আই ফোন ৫

মহিলাঃ আই ফোন ৪ এর দাম কত?

(মনে মনে বলি, দাম যতই হোক, তুমি তো ফ্রী চেয়েছো, এখন এত প্যাঁচাল পারছো কেনো বাপু?)

বললাম, আই ফোন ৪ এর দাম ৪৯৯ ডলার।

আমি যদি ক্রেডিট কার্ড পাই, তাহলে আইফোন ৪ কী ফ্রী পাবো?

(মনে মনে বলি, আরে বেটি, ক্রেডিট কার্ডের জন্য আগে অ্যাপ্লাই কর, দ্যাখ অ্যাপ্রুভড হয় কিনা, তারপরেতো দামের কথা ভাববি, 'গাছে রইছে আম, বাপে পুতে খাম' অবস্থা)

মুখে বললাম, ম্যাডাম শোন, মনোযোগ দিয়ে শোন, আগে তোমাকে আমাদের স্টোরে আসতে হবে, ক্রেডিট কার্ড নিয়ে কাজ করে যারা, তাদের সাথে দেখা করবে। ওখান থেকে অ্যাপ্রুভড লেটার পেলে তবেই আমাদের এখানে আসবে। তোমার ক্রেডিট লিমিটের উপর নির্ভর করবে, ফোনটার জন্য তোমাকে আগাম কত দিতে হবে। বুঝাতে পারছি? ফোন ফ্রী নয়, ফোন ডিস্কাউন্টও প্রাইসেও নয়, রেগুলার প্রাইসে কিনবে, তবে ক্রেডিট স্কোর ভালো হলে বিনা সুদে মাসে মাসে কিস্তিতে শোধ করতে পারবে। নগদ কিছু দিতে হবে না। এটাকেই তুমি ধরে নিয়েছো যে ফোন ফ্রী পাবে। ফ্রী পাবে না,  এক বা দুই বছরের কিস্তিতে শোধ করবে। সবার আগে তোমাকে ক্রেডিট  অ্যাপ্রুভ্যাল সংগ্রহ করতে হবে। এবং ক্রেডিট অ্যাপ্রুভ্যাল ওয়ালমার্ট দেয় না, ক্রেডিট ব্যুরো থেকে আসে। আমি কি বুঝাতে পেরেছি?

মহিলাঃ ক্রেডিট লিমিট কত থাকে?

(আর সহ্য করা যায় না, এই মহিলা কিছুই বুঝে নাই, শুধু ফ্রী 'আই ফোন ' পাওয়া যাবে শুনেই এক লাফ দিয়েছে)। বললাম, ম্যাডাম, আমি তো ক্রেডিট কার্ড সেকশানে কাজ করি না, তাই আমার ধারণা নেই। তুমি স্টোরে আসো, এসে সংশ্লিষ্ট এসোসিয়েটের সাথে কথা বলো। সব কাজ শেষ হলে আমার কাছে এসো, আমি তখন কথা বলবো। এখন রাখি, হ্যাভ এ গুড ডে!




ইস্যু দুইঃ  কাস্টমার মা-মেয়ে। এসেছে 'স্ট্রেইট টক' নামের প্রিপেইড ফোন কিনতে। দুজনকে দেখেই বুঝা যায়, ধনীর দুলালী। মা জানতে চাইলোঃ

আমি 'গ্যালাক্সী এস টু' ফোন কিনতে চাই। সাথে আনলিমিটেড প্ল্যান। ফোনের দাম কত?
- ফোনের দাম ২৯৯ ডলার। প্ল্যান কার্ড ৪৫ ডলার।

-ইয়ে, মানে ফোনটা ভালো হবে তো?
-খুব ভালো।

-না, মানে বলছিলাম কি, খারাপ বলে কী কেউ ফোন রিটার্ণ করে দেয়?

আমার একটু দুষ্টামী করতে ইচ্ছে হলো, বললাম, তা কেউ কেউ তো ফেরৎ দিয়ে যায়।

মহিলার ফর্সা মুখে ভয়ের ছায়া দেখা গেলো। বললো, বেশী মানুষ ফেরত দেয় নাকি কম মানুষ?

-বলা মুশকিল। আমি তো সব সময় ফ্লোরে থাকিনা, তাই সঠিক হিসেব দিতে পারবো না। যেমন ধরো, আমার কাছে দু'জন ফেরত নিয়ে এলো, সেটা আমি জানি, অন্যের কাছে কেউ ফেরত নিয়ে এলে তো আমি জানবো না, তাই ঠিক বলতে পারছিনা।

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মা হতাশ হয়ে স্বগতোক্তি করলো, তাহলে কী হবে!

ঘাবড়ে গেছে, থাক এবার আমার বিক্রেতাসুলভ আচরণ করা উচিৎ।
ওদেরকে খুশী করার জন্য বললাম, এই ফোনের দাম গত সপ্তাহেই  ছিল ৩৪৯ ডলার। তিন দিন আগেই দাম কমে ২৯৯ ডলার হয়েছে।

আমার এই কথায় হিতে বিপরীত হলো। মা বললো,

-ভাল জিনিসের তো দাম কমার কথা নয়! ভালো জিনিসের দাম বাড়ে! তার মানে কি? এই ফোনটার রেপ্যুটেশান কেমন?

এবার আমার বিরক্ত হবার পালা। মনে মনে ঠিকই বিরক্ত হয়েছি, কিন্তু বাইরে থেকে তা বুঝতে দেইনি। বললাম,

- আচ্ছা, তুমি আমার কাছে এসে সরাসরি 'গ্যালাক্সী টু' চেয়েছো কেন? নিশ্চয়ই অন্যের মুখে এই ফোনের সুবিধা সম্পর্কে জেনেই এসেছো। যদি না জানতে, তাহলে আমাকেই জিজ্ঞেস করতে, কোন ফোনটা বেশী ভাল। তাছাড়া এই ফোনটার দাম অন্য সব প্রিপেইড ফোনের চেয়ে অনেক বেশী। কাজেই ভালো না হলে কী এত দাম হতো!

-না দেখো, কিছু মনে করো না, আমি একটু খুঁতখুঁতে স্বভাবের। তাই জানতে চেয়েছিলাম।

(মনে মনে বলি, তুমি অবশ্যই খুঁতখুঁতে টাইপের। চেহারা সুন্দর, বড়লোকের বৌ, খুঁতখুঁতে হবে না তো কী করবে! খেয়েদেয়ে তো আর কোন কাজ নেই তোমার, সব কিছু নিয়ে খুঁতখুঁত করো)। মুখে বললাম,

- দেখো, এত দাম দিয়ে খুব বেশী মানুষ গ্যালাক্সী টু কিনে না। তাই ফেরত দেয়ার প্রশ্নও আসেনা। আরেকটি কথা, আমাদের ঊদ্দেশ্য প্রোডাক্ট সেল করা, আমরা তো চাইবো প্রোডাক্ট সেল করার জন্য সম্ভাব্য সব রকম সুযোগ সুবিধা খুঁজে বের করতে। গ্রাহকের সুবিধার জন্যই ফোনের দাম কমানো হয়েছে। তুমি নিশ্চিন্ত মনে ফোন কিনতে পারো। তাছাড়া, আমাদের রিটার্ণ পলিসিতে আছে, আগামী পনের দিনের মধ্যে যে কোন সময় ফোন ফেরত দিয়ে যেতে পারবে। ব্যবহার করে দেখো।

এতকথা বলার পর বোধ হয় সুন্দরীর মনের ভয় কিছুটা কেটেছে, শেষ পর্যন্ত মা আর মেয়ে, দুজনের জন্য ২৯৯ ডলার দামের দুটি ফোন কিনে বাড়ীর পথে পা বাড়িয়েছে।




ইস্যু তিনঃ এক দম্পতি এসে হাজির। বয়স্ক দম্পতিটি দুই দিন আগেও এসেছিল। উনারা উনাদের বর্তমান কোম্পাণীর ফোন সার্ভিস বাদ দিয়ে অন্য কোম্পাণীর ফোন সার্ভিস কিনতে চাইছিলেন।  সেদিন আমার কাছ থেকেই ফোন কিনে নিয়ে গেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন, আগের কোম্পাণীর ফোন নাম্বার রেখে দিতে চাইলে কী করতে হবে? জানিয়েছিলাম, আগের কোম্পাণীর একাউন্ট নাম্বার জানা থাকলেই চলবে। বাকী কাজ নতুন কোম্পাণীর ওরা করে দিবে।

তাহলে আজকে কেন এসেছে আবার?

আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ঘন্টা দুই আগে আমি  সেদিনের কেনা ফোনগুলো ফেরত দিয়ে গেছিলাম। আমি আবার আমার পুরানো কোম্পাণীর সার্ভিস ফিরে পেতে চাই। একই নাম্বারও চাই। ঐ ফোন বক্সের ভেতর আগের কোম্পাণীর একাউন্ট নাম্বারসহ কাগজ রয়ে গেছে। বিশ মাইল গাড়ী চালিয়ে আমাকে আবার আসতে হলো।

আমি পড়ে গেছি বিপদে, আমার আগে যেই মেয়ে ছিল, সে কোথায় নিয়ে রেখেছে ফোন কে জানে? গেলাম স্টোর রুমে, যেখানে ক্লেইমড মালামাল জমা রাখা হয়। খুঁজে পেলাম দুই ফোন। সাথে নিয়ে এসে ফোন খুলে দেখালাম, কিন্তু কোথাও একাউন্ট নাম্বারসহ কোন কাগজ খুঁজে পায় না বুড়ো। আন্দাজের উপর ভর করে এক টুকরো কাগজে ফোনের সিরিয়্যাল লাম্বার কপি করে দিলাম। বললাম, কী কী করতে হবে।

 (মনে মনে বললাম, কী যে ঝামেলা বাধাও! কী দরকার ছিল বার বার ফোন সার্ভিস বদলানোর! আর বদলালেই যদি, একই ফোন নাম্বার বার বার  ফিরে পেতে চাও কেন বাপু? এগুলো কী সোজা কাজ? তাছাড়া এইসব ফালতু কাজের জন্যতো অতিরিক্ত পারিশ্রমিকও পাই না)। বুড়োবুড়ি চলে গেলো।

আধঘন্টা বাদে আবার ফিরে এলো বুড়োবুড়ি। বুড়োবুড়িকে দেখেই আমার ভয় লাগলো, এই ধরণের কাস্টমারকে পাশ কাটানো যায় না, মুখের দিকে তাকালেই নিজের বাবা মায়ের কথা মনে হয়। অথচ এঁরা ফোনের কিছুই বুঝে না, কিন্তু সবকিছু পেতে চায়। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী প্রয়োজন? ফোনের সিরিয়্যাল নাম্বার লিখে দেয়া কাগজ হারিয়ে ফেলেছে। আবার আমাকে ফিরে যেতে হলো স্টোর রুমে, সেখান থেকেই কাগজে নাম্বার টুকে নিয়ে এলাম। বুড়োকে নিজে হাতে তার সাথে নিয়ে আসা ঝোলার ভেতর কাগজের স্লীপ ঢুকিয়ে দিয়ে বিদায় করলাম।


ইস্যু চারঃ  অনেকদিন পর একজনকে দেখলাম, যাকে দেখার সাথে সাথে নিজের তরুণ বয়সের কথা মনে পড়ে গেলো। তরুণ বয়সের ধর্ম যা হয়, অন্যের খুঁত বের করা, অন্যকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করা, মানুষকে নিয়ে কৌতুক করা এবং এ সমস্ত বিষয় থেকে নির্দোষ আনন্দ লাভ করা। আমার  উকিল দাদুর কাছে এক মক্কেল আসতো, প্রায়ই আসতো, লোকটিকে দেখতে পেলেই আমরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতাম। হাসাহাসির মূল কারণ, লোকটির চাল-চলণ, বেশ-ভূষা, কথা বলার ঢং। সে মাথায় জবজবে করে তেল মাথতো, মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি কাটতো, ঠোঁটের উপরেই ছিল চার্লি চ্যাপলিন মোচ, শার্ট আর প্যান্ট ইন করে পরে ইয়া চওড়া বেল্ট কোমড়ে বাঁধতো। সেই বেল্ট থাকতো অনেকটাই বুকের কাছাকাছি। লোকটির আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই ভালো, তারপরেও তার কথা বলার ধরণে ব্যক্তিত্বের লক্ষ্মণ প্রকাশ পেতো না। কেমন যেনো যাত্রার ঢং-এ কথা বলতো।  অনেক কাল মনে ছিল লোকটির চেহারা, পরবর্তিকালে যে কোন পুরুষকে মাঝ বরাবর সিঁথি কাটতে দেখলেই বলতাম, "দাদুর ক্যাবলা মক্কেল'।

আজ আমার রেজিস্টারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে 'দাদুর ক্যাবলা মক্কেল'। বিনয়ের সাথেই জিজ্ঞেস করলাম, উনার কী প্রয়োজন। আমার চেয়েও অধিক বিনয়ের সাথে 'দাদুর ক্যাবলা মক্কেল' বললো, তার মোবাইল ফোনের মিনিট শেষ হয়ে গেছে। রিচার্জ করতে চায়। যেহেতু আমাদের কাছে কমপক্ষে পনেরো টি বিভিন্ন কোম্পাণীর ফোন এবং ফোনকার্ড মজুদ আছে, তাই জানতে চাইলাম, কোন কোম্পাণীর সার্ভিস সে ব্যবহার করে। লোকটি বিনয়ে গলে গিয়ে বললো, " স্যামসাং ফোন'।
বললাম, স্যামসাং তো ফোনের ব্র্যান্ড, কিন্তু কোন কোম্পাণীর সার্ভিস তুমি ব্যবহার করো?

লোকটি' দাদুর ক্যাবলা মক্কেলের' মতই ক্যাবলা হাসি মুখে ছড়িয়ে বললো, 'স্যামসাং ফোন'।

বুঝলাম, আমাকে অন্যভাবে বুঝতে হবে, মিনিটের পরিমান জিজ্ঞেস করতে হবে অথবা কত টাকা দামের কার্ড সে ব্যবহার করে, ঐ হিসেব ধরেও জানতে চেষ্টা করা যায়। তার আগে আমি একটু শয়তানী করলাম। বললাম,

তুমি কোথায় থাকো?
-আজ্ঞে, এই শহরেই।
-চাকুরী করো?
-আমার বিজনেস আছে।
-তুমি তো অনেক বড়লোক, তাহলে এই সস্তা ফোন কিনছো কেনো? আরও দামী ফোন কেনো।
-এই ফোনটা আমার জন্য না, আমার এক বন্ধুর ফোন, আমি জানিনা, সে কোন সার্ভিস ব্যবহার করে।
-তা এতক্ষণে বলতে হয়? আগে বললেই তো আমাদের ফোন ব্যবহার করে তুমি বন্ধুর কাছ থেকে জেনে নিতে পারতে, সে কোন সার্ভিস ব্যবহার করে"।

(মনে মনে বলি, তুমি একেবারে আমার 'দাদুর ক্যাবলা মক্কেলের' মত দেখতে! একই রকম স্টাইলে চুলে জবজবে তেল বা ক্রিম মেখেছো, মাঝখান বরাবর সিঁথি কেটেছো, প্যান্ট শার্ট ইন করে পড়েছো ঠিকই কিন্তু বেল্ট বেঁধেছো বুকের কাছে, তার উপর আবার এমন নত মুখে কথা বলছো। সব কিছু মিলিয়ে তুমি আমাকে  আটাশ বছর আগের কথা মনে করিয়ে দিয়েছো। যেহেতু তুমি আমাকে আমার তারুণ্যকাল ফিরিয়ে দিয়েছো, তাই আমি তোমাকে আমার সাধ্যমত সাহায্য করবো)।

আমি খুব নরম স্বরে ভদ্রলোকের সাহায্যে এগিয়ে গেলাম। অনেক চেষ্টা করে তার বন্ধুর ফোন সার্ভিসের নাম বের করেছি। বন্ধুকে ফোন করার কথা বলে নিজেরই মনে হয়েছে, বন্ধুর ফোন তো এই ভদ্রলোক সাথে করে নিয়ে এসেছে। বন্ধুকে পাওয়ার কোন উপায় জানা নেই। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সফল মনোরথ হয়েই ভদ্রলোক আমাদের কাউন্টার থেকে বিদায় নিলো।




ইস্যু পাঁচঃ  ওয়ালমার্টে প্রায়ই ভাল ভাল জিনিসের উপর মূল্য হ্রাস টিকিট লাগানো হয়ে থাকে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ, হোম অফিস থেকে অর্ডার আসে, একেক জিনিসের উপর একেক পার্সেন্টেজ ধরে মূল্য হ্রাস করা হয়। মূল্যহ্রাস করার পরে হ্রাসকৃত মূল্যের টিকেট আইটেমের গায়ে লাগিয়ে দিয়ে ডিসপ্লেতে দেয়া থাকে। বেশীর ভাগ সময়েই টিভির উপর মূল্যহ্রাস হয়ে থাকে। সেদিনও আমার এক বন্ধু মূল্যহ্রাসের টিকিট লাগিয়ে টিভিগুলোকে ডিস্পলেতে সাজিয়ে রাখছিল। আমি ওর পাশে দাঁড়িয়ে থেকে ওর কাজগুলো দেখছিলাম।

এমন সময় আমাদের পাশের ফ্যাব্রিক্স ডিপার্টমেন্ট থেকে ক্রিং ক্রিং ঘন্টা শোনা গেল। অর্থাৎ থান কাপড় কিনতে এসেছে কাস্টমার। আশেপাশে বোধ হয় কাউকে দেখতে পায়নি, তাই বেল বাজিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। আবারও ক্রিং ক্রিং শোনা গেল। ঠিক একই সময়ে আমার পেছন দিক থেকে কেউ একজন মুখে আওয়াজ করলো ক্রিং ক্রিং, আইসক্রিম, ক্রিং ক্রিং আইসক্রিম!! চমকে পেছন ফিরে দেখি, এক ভদ্রলোক আর এক ভদ্রমহিলা আমাদের ঠিক পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।

আমার দিকে চোখাচোখি হতেই ভদ্রলোক আবার বললো, ক্রিং ক্রিং আইসক্রীম! আমাদের ছোটবেলায় এভাবে আইসক্রিমওয়ালা রাস্তা দিয়ে যেত।

সাদা সাহেবের মুখে এমন কথা শুনেতো আমি অবাক! আমাকে অবাক হতে দেখে লোকটি আবার বললো, " বিশ্বাস করো, আমাদের ছেলেবেলায় রাস্তা দিয়ে আইসক্রীমওয়ালা এভাবে ঘন্টি বাজিয়ে যেত, আর আমরা বাচ্চারা তার  পেছন পেছন ছুটতাম!

বললাম, " কোন দেশের গল্প তুমি বলছো? আমেরিকায় তো এমন হতে দেখিনি"

বলল, " সাউথ আফ্রিকায়। আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা সাউথ আফ্রিকায়। ওখানে আইসক্রিমওয়ালা রাস্তা দিয়ে আইসক্রীম , আইসক্রীম হাঁক দিয়ে যায়। এখনও যায়, এখনও ছোট ছোট  ছেলেমেয়েরা তার পেছন পেছন দৌড়ায়!

" মাই গড! তুমি তো আমাকে আমার  ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দিলে"
"জানি তো, তুমি নিশ্চয়ই ভারতীয়! তোমার চেহারায় তাই বলে। আমাদের ওখানে তো ভারতীয় ভর্তি, লিটল ইন্ডিয়া বলতে পারো।"।

-"আমি মুলতঃ বাংলাদেশের, তবে এখানে আমার দেশের নাম অনেকেই জানেনা, আমাকে ভারতীয় ভাবে, আমরা আলাদা দুটি ভূ-খন্ডের হলেও চেহারা ছবি একই রকম। তাই আমাকে ভারতীয় বলে। হ্যাঁ, আমিও জানি, সাউথ আফ্রিকায় প্রচুর ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষের বাস। তা সেখানেও একই ভাবে আইসক্রীম বিক্রী হয়? আচ্ছা, সাউথ আফ্রিকা থেকে তুমি এখানে এসেছো কোন সোর্স ধরে? চাকুরী নিয়ে?

" না, এই যে আমার পাশে দাঁড়ানো ভদ্রমহিলাকে দেখছো, সে আমাকে আমার জন্মভূমি থেকে টেনে নিয়ে চলে এসেছে।"

এবার মেম সাহেব মুখ খুললেন। " হ্যাঁ, আমিই ওকে নিয়ে এসেছি। ও এখানে এসে সাউথ আফ্রিকাকে খুব মিস করছে। দেখলে তো, একটু আগেই কিরকম ক্রিং ক্রিং করছিল।  হা হা হা হা! আচ্ছা, তুমি তো নিশ্চয়ই জানো, এখানে কোথায় ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট আছে"!

" জানি, তবে কেনো? তোমার হাজব্যান্ড কী ইন্ডিয়ান খাবারের সন্ধান করছে নাকি?"

ভদ্রলোক বললেন, " প্লীজ, যদি জানো বলো। আমি অনেকদিন চিকেন কারী খাই না, উম! জিভে জল এসে গেলো। উফ! ওখানে আমরা স্পাইসি খাবার খেতাম, আর এখানে এসে শুধু বিস্বাদের চিকেন ফ্রাই খাই।

বউ হাসতে লাগলো, বললো, দেখো কী কান্ড! অবশ্য আমিও যখন ওখানে ছিলাম, প্রায়ই ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে চলে যেতাম। গ্রীন কালারের একটা চিকেন কারী হয়, তুমি কী জানো, কীভাবে রান্না করে?

" ধনে পাতা আর ক্রীম দিয়ে রান্না করে মনে হয়।" তুমি নিজেই তো বাড়ীতে রান্না করতে পারো। নাহলে আবার সাউথ আফ্রিকায় ফিরে যাও"

বউ হাসতে হাসতে বললো, 'মন্দ বলো নি, আমার এই পাগলা কে নিয়ে আবার সাউথ আফ্রিকায় যেতে হবে। দেখি, ওখানেই একটা চাকুরী জুটিয়ে নেবো"।

আর কথা বাড়ালাম না। জেনে নিলাম, ভদ্রমহিলা আর্মিতে আছেন, সেই সূত্রেই সাউথ আফ্রিকা গিয়েছিলেন, অনেক বছর থেকেছিলেন, আলোচ্য ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় ও প্রনয় হওয়ার পর বিয়েটা ওদেশে সেরে স্বামী নিয়ে নিজের দেশে ফিরেছেন। আর স্বামী ভদ্রলোকও এখানেই চাকুরী পেয়েছেন, তবে দেশের জন্য, দেশের খাবারের জন্য, নিজের ছোটবেলার জন্য হা-পিত্যেশ করে মরছেন! আমার সাথে ভীষন মিল পেলাম, মনে শান্তিও পেলাম এই ভেবে যে এ দেশে আমি একা নই, আমার মত আরও কেউ আছে যে প্রতি মুহূর্তে মাতৃভূমিকে মিস করছে!


 ইস্যু ছয়ঃ

আমি একফাঁকে নিজের কাজগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। যতগুলো কন্ট্র্যাক্ট সাইন করিয়েছি, সেগুলোর ডাটা লগবুকে এন্ট্রি করছিলাম। পেছন থেকে বাচ্চা কন্ঠে কেউ ডাকলো, অ্যাই মাম!!
খেয়ালে ছিল না আমি আমেরিকান স্টোরে আছি, ডাক শুনে মনে হলো আমার ছোট মেয়ে বুঝি ডাকছে! মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো, " কী হলো!"
রেজিস্টারের দিকে তাকিয়ে দেখি এক কালো বালক শিশু দাঁড়িয়ে! নিজের ভুল বুঝতে পেরে সাথে সাথে সামলে নিলাম। ওর বয়সী ব্ল্যাক ছেলেদের দেখলেই আমার আদর করতে ইচ্ছে করে! মাথা ভর্তি কালো কোঁকড়া চুল, মুখে অনিন্দ্য সুন্দর হাসি, আদর না করে পারা যায়! আমার মেয়েরা আমাকে সব সময় 'রেসিস্ট' বলে আনন্দ পায়। কারণ, আমি  অধিকাংশ ব্ল্যাক মহিলাদের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষন করি না।  ওদের  আচরণে ঝগড়াটে ভাব দেখে ভয় পাই, তাই সব সময় ওদের কাছ থেকে শত হস্ত দূরে থাকার চেষ্টা করি। আমার এই মনোভাব মেয়েদের কাছে খুবই নিন্দনীয়! আমি অবশ্য মানুষের প্রতি মেয়েদের এই অনুভূতিকে শ্রদ্ধা করি। আমার বড় দুই মেয়েই কিছুটা নারীবাদী। এ কারণেও ওরা আমার উপর ক্ষ্যাপা! আমি যখন অতি ভাল কালো মহিলাদের সম্পর্কে জয়গান করি, সেগুলো ওরা আমলে নেয় না, কালো ছেলেদের ব্যাপারে আমি খুব নমণীয়, কালো ছেলেদের ব্যবহারে সরলতা থাকে, ওরা ঝগড়ুটে স্বভাবের হয় না, সারাক্ষণ নাচ-গানের ছন্দে চলাফেরা করে। এমন কথা শুনলেই আমার মেয়েরা রেগে যায়, বলে, আমি নাকি পুরুষদের হয়ে সাফাই গাই, মেয়ে হয়েও মেয়েদের বিরুদ্ধে কথা বলি! তা বলুক ওরা, ওদের কথার মধ্যেও  যুক্তি আছে! থাকুক যুক্তি, তাই বলে তো আর অনিন্দ্য সুন্দর কালো বালক বা কিশোর ছেলের প্রতি আমার যুক্তিহীন ভালোবাসার কিছু কমতি হবে না!

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণ কিশোরকে জিজ্ঞেস করলাম,

-কী হলো তোর! তোর জন্য কী সাহায্য করতে পারি, বলতো সোনা!
-আমি একটা ফোন কার্ড কিনতে চাই। এই যে টাকা নিয়ে এসেছি।
-দাঁড়া, আগেই টাকা বের করছিস কেন? এত উতলা হয়েছিস কেন? কী, গার্লফ্রেন্ডকে ফোন করতে হবে?
-দারুণ লজ্জা পেয়ে সে বললো, আরে নাহ! আমার মায়ের জন্য কার্ড কিনতে এসেছি।
-ওহ আচ্ছা, আয় আমি তোর জন্য কার্ড খুঁজে দেই। কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে, তোরও একখানা কার্ড দরকার আছে, তাইনা?
-লজ্জা মাখা মুখে, আমার তো ফোন নেই।
-সে কী রে!! তোর ফোন নেই?? হায় হায়! তোর গার্ল ফ্রেন্ড আছে তো!!!!!

আমাকে অবাক করে দিয়ে সে 'হ্যাঁ' সূচক মাথা নাড়ালো। আমি ওর সাথে মজা করছিলাম, এত ছোট ছেলের আবার গার্ল ফ্রেন্ড থাকে নাকি? সাইজ দেখে মনে হচ্ছিল আট বছর হবে বয়স। কিন্তু গার্ল ফ্রেন্ডের কথা বলতেই অমন করে লজ্জা পেলো কেনো! ব্যস! শুরু হয়ে গেলো আমার দুষ্টামী! বললাম,

-সোনাবাবু, তোর বয়স কতরে!
-বারো বছর!
-বলিস কী!! বারো বছর তোর, অথচ তোর ফোন নেই?
-না, আমার মা আমাকে ফোন কিনে দেয় নি। যদি ভেঙ্গে ফেলি, সেই জন্য ফোন দেয় নি।
-কেন, ফোন ভেঙ্গে ফেলার কথা মনে হচ্ছে কেনো? তুমি কী মায়ের অনেক দামী জিনিস ভেঙ্গে ফেলেছো?
-না, অনেক জিনিস ভাঙ্গিনি, তবে আমার হাত থেকে অনেক জিনিস পড়ে যায়। ফোনও যদি পড়ে যায়, তাহলে ভেঙ্গে যাবে, মায়ের হাতে তাহলে পিটানি খেতে হবে!
-তাহলে তো তোর অনেক সমস্যা! গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে যোগাযোগ করিস কীভাবে?
-স্কুলে গেলেই তো ওর সাথে দেখা হয়!
-তাও তো বটে! তা তোর গার্ল ফ্রেন্ডের ফোন আছে?
-হ্যাঁ, ওর ফোন আছে।
-ও কী তোকে কখনও ওর ফোন ব্যবহার করতে দেয়?
-না, ওর ফোন আমাকে ব্যবহার করতে দেয় না। তাছাড়া আমিও ওর ফোন ব্যবহার করতে চাই না।
-এটা খুবই ভালো কথা। তোর আত্মসম্মান বোধ দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। আচ্ছা, এই বয়সেই প্রেম করছিস, লেখাপড়া করিস না?
-করি। লেখাপড়াও করি।
-হুম! খুব ভালো। এতক্ষণ ধরে তোর সাথে কথা বলছি, তোর নামই জানা হলো না। তোর নাম কি বাবা?
-কুইন্টেরিয়াস!
-অনেক কঠিন নাম, কিন্তু খুব সুন্দর নাম। আর তোর গার্ল ফ্রেন্ডের নাম কি?
-এটা বলা যাবে না!
-কেনো, বলা যাবে না কেনো?
-ও চায় না, ওর কথা অন্য কেউ জানুক।
-বাহ! তোর গার্ল ফ্রেন্ডটা তো দারুণ বুদ্ধিমতী! কিন্তু আমার যে খুব ইচ্ছে করছে অমন একটা বুদ্ধিমতী মেয়ের নাম শুনতে!

আবার ওর মুখে লজ্জা এসে ভর করলো, বললো, তোমাকে শুধু বলি, কাউকে বলে দিও না, ওর নাম অ্যাঞ্জেলিনা!
-ওরে! খুব সুন্দর নাম। তোদের দুজনকেই আমার পছন্দ হয়ে গেছে। অ্যাঞ্জেলিনাকে না দেখেই পছন্দ হয়ে গেছে। তোর মত এমন লক্ষ্মী একটা ছেলের সাথে ও ফ্রেন্ডশীপ করেছে, ও তো অনেক লাকী। কুইন্টেরিয়াস, তোর কাছে তো পয়সা নেই, ভ্যালেন্টাইন'স ডে'তে অ্যাঞ্জেলিনা কে কী উপহার দিবি?

-ভাবতে হবে!

-বেশী ভাবতে হবে না। ওর জন্য একটা কবিতা লিখবি, আর বাগান থেকে একটা সুন্দর গোলাপ তুলে কবিতার সাথে আটকে দিয়ে অ্যাঞ্জেলিনাকে প্রেজেন্ট করবি। দেখবি অ্যানজেলিনা তোর দিকে অ্যাঞ্জেলিনা জোলির মত হাসি দিবে!
-হেই ম্যাম! তুমি কী যে বলো! অনেক মজা করে কথা বলো। হা হা হা হা! আমার হাসি পাচ্ছে।

-হুম! এতক্ষণ মজা করে কথা বলেছি, তোমার সাথে গল্প করে আমার খুব ভালো লেগেছে। তুমি ভাল করে লেখাপড়া করো, বড় হয়ে যেন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পারো, তাহলে তোমার অ্যাঞ্জেলিনা জোলিও খুশী হবে, তোমার মাও খুশী হবে।

-হি হি হি হি!! ওকে, ঠিক আছে। বাই!
-বাই বলতে হয় না, সী ইউ বাচ্চা, ভালো থেকো।


সেদিন এমনি আরও অনেক ছোটখাটো ঘটনা ঘটেছিল, তবে মনে গেঁথে আছে এই ঘটনাগুলো।

No comments:

Post a Comment