Friday, February 1, 2013

গেরস্ত সংবাদ-৩


কাজ থেকে বাড়ী ফিরেছি রাতে। ঘরে ঢুকেই ইন্ডিয়ান রান্নার গন্ধ পাওয়া গেলো। কী ব্যাপার! আমি তো সেই সকালেই রান্না করে গেছিলাম, সেই গন্ধ এখনও বাতাসে আটকে আছে! ঘরে ঢুকে রান্নার এই তেল কাসটে গন্ধ আমাদের কারোই ভালো লাগে না। কিন্তু কিছু করার নেই, শীতের আমেরিকায় দরজা-জানালা  বন্ধ থাকে বলেই রান্নার গন্ধ বের হতে পারেনা। তবে আজকে তেল কাসটে গন্ধ ছিল না, ভালো গন্ধই ছিল। আমি জানি, আমার রান্না ভালো, গন্ধও ভালো হবে, এ আর তেমন কি বড় কথা! কিন্তু একটু পাশ ফিরে ব্রেকফাস্ট টেবিলের দিকে তাকাতেই দেখি দুই তিন প্যাকেট বিস্কিট রাখা আছে। আরে! কেউ এসেছে নাকি! তাসমিন একবার ফোন করেছিল আমাকে, আহাদকে নিয়ে বেড়াতে আসতে চেয়েছিল। ওরা কী এসেছিল! সাথে করে কুকী নিয়ে এসেছিল মনে হয়! নাতো! প্যাকেটের গায়ে ভেজিটেবল কুকি লেখা আছে।

বুঝেছি, উত্তম কুমারের কান্ড!  আর মুখ বুঝে সহ্য করতে পারলো না বোধ হয়! আমাদের ডাঃ ওজি'স ডায়েট প্রোগ্রামে বোধ হয় আর লেগে থাকতে পারলো না! অথচ তারই সবার আগে প্রয়োজন 'বেলী ফ্যাট' কমানো। তাকে উৎসাহ দেয়ার জন্য আমি নিজে এই কষ্ট করে যাচ্ছি! আমার আগেই বুঝা উচিৎ ছিল, যখন আজ আমার এক ফিলিপিনো বন্ধু বলেছিল,

' হেই রীটা, আই স' ইওর হাজব্যান্ড টুডে!

আমি হাত দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছি ওর কথা! কোথা থেকে যে ও আমার হাজব্যান্ডকে দেখলো, কে জানে! আমার উত্তমের ঘুমিয়ে থাকার কথা, শিক্ষকতা পেশায় পয়সা নেই, কিন্তু দেহের আরাম আছে! বারো মাসে তেরো পাবণের মত ব্যাপার! কত যে ছুটি থাকে তাদের!  দুই তিন ঘন্টা পরে আমার আরেক সহকর্মী 'অরল্যান্ডো' বললো,

-তোমার হাজব্যান্ড এসেছিল, অনলাইনে কিছু একটা জিনিস কিনেছে, সেটা নিতে এসেছিল।

এবার রোজিটার কথা বিশ্বাস হলো, আমার উত্তম কুমার অনলাইন শপিং বেশ পছন্দ করে। প্রায়ই দেখি সে অনলাইনে জিনিস কেনে। আগের কাল হলে দিতাম ধাতানি, এখন নাটাই থেকে সূতা ছাড়ছি, উড়তে থাক ঘুড়ি, সূতায় যখন হ্যাঁচকা টান দেবো, তখন মজা বুঝবে বাছাধন! এভাবেই মনে মনে গজরাচ্ছিলাম।

এখন তো ঘরে ফিরে দেখলামই কান্ড কারখানা। এরপর অ্যাবাউট টার্ণ করে কিচেন টেবিলের দিকে নজর দিতেই দেখি এক চূলায় একখানা সসপ্যান রাখা, সসপ্যানের ভেতর থেকে ডালের চেহারা দেখা যাচ্ছে। উনি আজ ডাল রান্না করেছেন। আমি কাজে যাওয়ার আগেই রাতের রান্না সেরে গেছিলাম, কাউন্টার টেবিলে সব বাটি বাটি সাজিয়ে রেখেছিলাম। ডাঃ ওজি বলেছেন, সকালে একটা ডিম আর এক কাপ দই, দুপুরে স্যালাড, আর ডিনারে মন যাহা চায়। আমি তো জানি, আমার উত্তমের মন কোনভাবেই স্যালাড চায় না, শাক-পাতা চায় না। উত্তম হয়েছে আমার মায়ের মত স্বভাব। মাছ বা মাংস না হলে মুখে রোচে না। এদিকে এমন সুন্দর মানুষটার ভুড়ি হয়ে কী বিতিকিচ্ছিরী দেখা যায়! আমি আর আগের মত স্বামী গরবে গরবীনি ভাব দেখাতে পারিনা! ডাকলাম মিথীলাকে। উত্তম বসার ঘরে আছে জেনেই গলা উঁচুতে তুলে মিথীলার সাথে কথা বলছিলাম, অর্থাৎ 'ঝি কিলিয়ে বউ কে শেখা'তে চাইছিলাম।

-মিথীলা~~~~~~~~~~
-কেনো?
-অ্যাই মেয়ে, ঘরে রান্নার গন্ধ কেনো?
-পাপা আজ রান্না করলো।
-কেনো পাপা রান্না করলো? টেবিলের উপর কত কিছু রেখে গেছি, এগুলো দেখতে পায় নি তোমার পাপা?
-তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে মনে হয়। ও আরেকটা কথা, পাপা আজকে 'গ্রীল মেশিন' কিনে এনেছে।
-বাহ বাহ! খুব ভালো, খুব ভালো। আর কি! আমার কষ্ট কমে গেলো, পাপা এখন ব্যাগ ভরে ভরে চিকেন লেগ আনবে আর গ্রীল করে খাবে। আমার আর রান্না করতে হবে না। তা কী রেঁধেছে তোমার পাপা? চিকেন কিমা দিয়ে ডাল?

-পাপা তো ঐ ঘরে আছে, পাপাকেই জিজ্ঞেস করো।

গেলাম উত্তমের সাথে দেখা করতে। মোলায়েম সুরে বললাম,

-তুমি কী আজকে ওয়ালমার্টে গেছিলে?

মাথা নাড়িয়ে 'হ্যাঁ।

চিকেন কিমা দিয়ে ডাল রান্না করছো, কিমা কি আজকেই কিনে এনেছো?
-মাথা নাড়িয়ে 'হ্যাঁ'।

-কেন, ফ্রীজারেই তো কিমার প্যাকেট ছিল।
-এবার উনি মুখ খুললেন। থাক ফ্রীজে, অন্য সময় ব্যবহার করা যাবে।
-তুমি কী ডায়েট প্রোগ্রাম থেকে ইস্তফা দিয়েছো? এই একটা রান্না পেয়েছো, কিমা দিয়ে ছোলার ডাল। আমার  ডালের স্টক তো শেষ করে ফেলছো।

-তোমার স্টকে হাত পড়ে নি। ডাল কিনে এনেছি। ওয়ালমার্টে এক ধরণের মটর পাওয়া যায়, সেগুলো এনেছি।

-হুম! আমি অযথাই পরিশ্রম করে যাচ্ছি। থাকুক, আর করবো না ডায়েট প্রোগ্রাম! তোমাকে কী না খাইয়ে রাখছিলাম? কত যত্ন করে স্যালাড বানাই, কত যত্ন করে চিকেন স্যুপ করি, আর তুমি নিজে নিজে শেফ 'টমি মিয়া' হয়ে গেছো?

-আমি টমি মিয়ার চেয়েও ভাল রান্না জানি। তুমি তো আমার রান্না খাওই না। টুম্পা নিউইয়র্ক থেকে সেদিন ফোন করেছিল, কিমা-ডালের রেসিপি চেয়েছে। এখানে আহাদ, তাসমিন সবাই এই ডালের প্রশংসা করে। তুমি ছাড়া সবাই ভালো বলে।

-আচ্ছা, বলুক ভালো, চলো, খেতে চলো।

-আর তোমার প্রোগ্রামে তো ডিনারে যাহা খুশী তাহা খাওয়া যাবে। এটাতো ডাল, ভাত তো না। ভাত আমি নাহয় খাবই না।

-হা হা হা!! আচ্ছা থাক, হয়েছে, ভাত না খেয়ে কাজ নেই, পরে দেখা যাবে, আগামীকাল পোলাও বা বিরিয়ানী রেঁধে বসে থাকবা। দরকার নেই, ভাতই খাও।


ব্যাপারটি খেয়াল করেছি গত পরশুদিন। সাত দিন আগে বোধ হয় ডাঃ ওজি'স ডায়েট শুরু করেছিলাম। সকালে যে যার মত ডিম আর চা খেয়ে বের হয়ে যেতাম। প্রথম চার দিন লাঞ্চের জন্য স্যালাড রেডী করে গেছি। স্যালাডের রেসিপি বলিঃ

শসা, টমেটো, লেটুস, গাজর কুচি, অ্যাভোকেডো, গ্রীলড চিকেন, আলমন্ড, সানফ্লাওয়ার সীডস, কিসমিশ,  দুই চামচ টক দই, কমলার কোয়া, আপেল কুচি মোৎসারেলা চীজ এবং বেকড কুরমুরি।

দুইদিন দুপুরে খেয়েছি"ঃ  শসা, টমেটো, গাজর, সাথে অ্যাভোকেডো ভর্তা। কলা, আপেল, কমলা সাথেই ছিল।

গতকাল আর আজ খেলাম চিকেন স্যুপ। ছবিতে স্যুপের চেহারা যেমনই হোক, খেতে হয়েছে পাঁচতারা হোটেলের স্যুপের টেস্ট। আমি নিজে বললাম। স্যুপে ছিলঃ

চিকেন, ডিম, ব্রকলী, গাজর, বরবটি, মাশরুম, মটরশুটি আর এক প্যাকেট র‌্যামেন ( ম্যাগী নুডলস) নুডলস। সাথে বেকড কুরমুরি তো ছিলই।

রাতের খাবার রেখেছি একেবারে সাধারণ বাঙ্গালী খাবার। ডাল, মাছ/মাংস, শাক, তরকারী।

এই ক'দিন এভাবেই চলছিল। পরশুদিন উত্তম আমাকে তার ডিপার্টমেন্ট থেকে ফোন করেছেঃ

-হ্যালো, শোন, আমার আজ আসতে দেরী হবে।

-ওমা, দেরী হবে কেন? সাথে তো কোন খাবারও নাওনি। সকালেও শুধু ডিম আর চা খাও। ক্ষিদে পাবেতো!

-না, আমার এখন ক্ষিদে পায় না। আমি ঠিক করেছি, একদিন পুরো উপোস দেব। আমার কলিগ সপ্তাহে একদিন পুরো উপোস দেয়।

-না না, কী বলো, উপোস দিতে হবে না। ক্ষিদে পায় না কেনো?  প্রতিদিন  স্যালাড খাও বলে?

-জানিনা, বুঝতে পারছি না, একেবারেই ক্ষিদে নেই।

-অ্যাই জানো, আমারও ক্ষিদে পায় না। আসলে ঘাস-পাতা খেয়ে মনে হয় পেট ঢামুস হয়ে থাকে। কিন্তু, তুমিই তো এই ডায়েটের কথা বলছো। এখন একবার শুরু করে একটা মাস না দেখেই ছেড়ে দিবে!

-ছাড়ার কথা কে বলেছে! খেয়ে নেবো কিছু একটা।

-অ্যাই শোন, তোমার ওয়েইট কি কিছু কমেছে? আমার কিন্তু কমতে শুরু করেছে! আহ হা! কী মজা! আচ্ছা তুমি কি আমার উপর রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে দিতে চাচ্ছ?

- আর তো আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, এখন ফোন রাখো। আমার ক্লাস আছে। স্টুডেন্ট এসে বসে আছে।

-না, ঐ যে সেদিন পিঙ্কীর কাছে বিচার দিলাম, চানাচুর-মুড়ি খেয়ে শেষ করে ফেলছো!

-ভাল করেছি। মানুষ বেঁচে থাকে কীসের জন্য। না খেয়ে শুটকী লেগে বেঁচে থেকে কী হবে। একটু মন প্রাণ খুলে চলতে না পারলে বেঁচে থাকার সার্থকতা কি!

-আরে! উলটাপালটা খেয়ে দশ বছর বেঁচে থাকার চেয়ে স্বাস্থ্য সম্মতভাবে খেয়েদেয়ে  বিশ বছর বেশী বাঁচলে ভালো না?

-তুমি বাঁচো, বিশ বছর না, চল্লিশ বছর বাঁচো। এবার ফোন রাখি। ক্লাসে যাই।


পরশুদিন পার হয়েছে ভালোভাবেই, গতকালকেও ডাঃ ওজি'স ডায়েট চলেছে, আর কত? আমার কাজের স্কেজিউল ছিল বেলা বারোটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত। আজকে উত্তমের ল্যাব ছিল না, দুপুরেই চলে গেছে শপিং এ। এসে রান্নাবান্না কম্পলীট। আমি তো ভেবেছি, সে বোধ হয় খাওয়া-দাওয়াও সেরে ফেলেছে। পরে শুনি, না, তার ডিনার তখনও করা হয় নি। বোধ হয় অপেক্ষায় ছিল, আমার কী প্রতিক্রিয়া হয়, দেখার জন্য। আমি তো মানুষ খারাপ নই। প্রতিক্রিয়া আর কী দেখাবো। শুধু মিথীলাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছি,

-তোর পাপা বোধ হয় আর এই প্রোগ্রামে থাকবে না মিথীলা। না থাকুক, আমি শুরু করেছি, শেষও করবো। আমার সামনে দেখিয়ে দেখিয়ে তোরা যা খুশী খেতে পারিস, আমি আমার পথে ঠিক থাকবো। ওই দ্যাখ, শসা, টমেটো কেটে দিলাম, সেটাও নিল না তোর পাপা। কেমনটা লাগে! স্যুপ কী এতই খারাপ হয়েছিল খেতে?

-মা, স্যুপটা খুবই ভালো হয়েছিল। থাক, পাপার একটু শখ হয়েছে রান্নার, রেঁধেছে। কালকেই আবার স্যালাড খাবে।

উত্তম কুমারকে দেখলাম, পাশের ঘর থেকে এসে নীরবে শসা আর টমেটো তুলে নিয়ে গেলো। আমি আমার প্লেটে হাত লাগালাম। আমার বিরুদ্ধে উত্তমের একটা অভিযোগ আছে, আমি নাকি তার কিমা-ডাল খাই না। খেলেও কখনওই ভাল বলি না। অভিযোগ শতকরা ষাট ভাগ সত্যি। তবে চল্লিশ ভাগের ভেতর লুকিয়ে আছে আসল ঘটনা। আমি ডাল খুব একটা পছন্দ করি না। যদি খেতেই হয়, পাতলা পেঁয়াজ সম্বার দিয়ে মুসুরের ডাল, নাহয় ঘি-দেয়া মুগের ডাল। এইসব কিমা ডাল আমার অসহ্য লাগে!

অনেকক্ষণ বকেছি, এবার উত্তমকে খুশী করার পালা। নিলাম প্লেটে ডাল, একটু ভাতের সাথে মিশিয়ে মুখে দিতেই অপূর্ব স্বাদ টের পেলাম।  কেমন করে যেনো ২৭ বছর আগের হোস্টেলের স্মৃতি মনে পড়ে গেলো! প্রতিদিন সকালে আমার আর ফরিদার জন্য রাশিদা খালা ভাত আর ডাল চচ্চড়ি রেঁধে দিতেন। অপূর্ব ছিল সেই স্বাদ। আজকে একই রকম স্বাদ টের পেলাম।  কোকিলকন্ঠে জানতে চাইলাম, " মুসুরের ডাল দিয়ে রেঁধেছো?"

-নাহ! ওয়ালমার্ট থেকে 'চিক পি' ( ডাবলি মটর) এনেছিলাম।
-খুবই ভালো হয়েছে রান্না, খুবই ভালো। দারুণ হয়েছে তো খেতে!

উত্তম খুশী হয়েছে, খুবই খুশী। সবাই তার এই রান্নাটাকে ভালো বলতো, বাকী ছিলাম আমি। সেই আমিও আজ তিনবার বলেছি, দারুণ হয়েছে। মনে হচ্ছে, আগামীকাল থেকে উত্তম আবার ডাঃ ওজি'স ডায়েট ফলো করবে। 'কিমা-ডাল' পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে আজকে।














No comments:

Post a Comment