Monday, January 22, 2018

কুয়াশা কুয়াশা দৃষ্টি (স্মৃতির মুকুরে সরস্বতী পূজো)

সময় এখন রাত ৯টা, আমেরিকার রাত। আমেরিকার উল্টোদিকে এখন সকাল হয়েছে। বাংলাদেশে সময় এখন সকাল ৯টা। আমেরিকায় আজ রবিবার, বাংলাদেশে সোমবার। আমেরিকার ছোট এক বাড়িতে আমি আজ বড্ড বেশি একা, বাংলাদেশে পরিবার পরিজন, বন্ধু বান্ধব সরস্বতী পূজোর আয়োজন নিয়ে মহাব্যস্ত।
হ্যাঁ, আজ দেশে সরস্বতী পূজো হচ্ছে। মহা ধুমধামে সরস্বতী পূজো উদযাপিত হচ্ছে নাকি শুধু কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যেই পূজো শেষ হয়ে যাচ্ছে, জানা সম্ভব নয়। একেতো আমেরিকার অনেক দূরের এক গ্রামে থাকি, তার উপর ফেসবুকে বিচরণ করতে পারছিনা, কাউকেতো জিজ্ঞেস করার উপায় নেই। মনটা একটু খারাপ খারাপ লাগছে। দেবী সরস্বতী কত কোমল মনের দেবী, মন দিয়ে সাধনা করলেই দেবীকে পাওয়া যায়। অথচ আজকের দিনে আমি একটু সাধনা করতে পারছিনা, দেবী মূর্তি চোখের সামনে না থাকলে মনোসংযোগ ঘটে? চোখের সামনে দেবীকে দেখবো কি করে, ফেসবুকে কী এক ছাইয়ের ব্যান হয়ে আছি যে! সরস্বতীকে দেখতে নিজের ওয়াল ছেড়ে এখন অন্যের ওয়ালে ঘুরতে যেতে হবে? আমি কি ছোঁচা নাকি! এর চেয়ে মনে দুঃখ চেপে রাখাই ভাল।
মনে মনে গুন গুন করে চলেছি, "মনের দুঃখ মনেই রইলো গো, কার কাছে বলে বেড়াই বলো, আমার দুঃখের কথা শুনবে তেমন মানুষ কোথা পাই"! স্বরচিত গান, এখনই রচনা করে ফেললাম। আজ দেবী সরস্বতীর পূজো বলে কথা,দেবী স্বয়ং উপস্থিত ভক্তদের মাঝে! 
কে না জানে, সরস্বতী বিদ্যার দেবী, সঙ্গিতের দেবী, জ্ঞান বুদ্ধি বিকাশের দেবী। ছোটবেলায় বাবা বলতেন, এমন দিনেই নাকি বেশি করে পড়তে হয়, সরস্বতী পৃথিবীতে এসে যাকেই বই হাতে দেখে, বিদ্যে বুদ্ধি জ্ঞান নাকি তাকেই দেয়। বাবার এই উপদেশ মানতে পারিনি কোনকালেই, তবে আজও মনে রেখেছি।  
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কাল তো অনেক বছর আগেই চুকিয়ে ফেলেছি, তাই বলে সরস্বতীর সাধনা একেবারে চুকিয়ে ফেলিনি। গল্পের বই পড়ি, ফেসবুকে কত শত লেখা পড়ি। গানের গলা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেও নীচু কন্ঠে সবসময় গুন গুন করি। এই গুন গুনানি সাধনাবলেই আজকাল অবসর সময়ে নিজে নিজে  দুই এক লাইন গান লিখে তাতে সুরারোপ করে গেয়েও ফেলি। দেবী সরস্বতীর কৃপা আছে বলতেই হয়। সরস্বতী দেবী রূপে, বসনে যেমনি শ্বত শুভ্র, দেবীর মনটাও একেবারে সাদা। বিদ্যে চাইলেই বিদ্যে দেয়, জ্ঞান চাইলে জ্ঞান দেয়, আর সঙ্গিত চাইলে কিছু নাহোক দুই চার লাইন গান রচনা করার ক্ষমতা তো দেয়! নাহলে আমি যখন তখন গান বাঁধি কি করে! দেবী লক্ষ্মীর কৃপা পাওয়া কঠিন, সাধনা করতে করতে গায়ের তেল গলে যায়, হাড়মাস কালো হয়ে যায়। তবুও লক্ষ্মী দেবী কৃপা করতে চায়না, নামে লক্ষ্মী হলেও লক্ষ্মী দেবীর অন্তর ভীষণ কঠিন, সহজে নরম হয়না। 

আমি যে আজ সত্যি সত্যি একা, আমার মনটাও যে আজ ভীষণ ফাঁকা, তা বুঝতে পারছি এলেবেলে কথা বলার ভঙ্গি থেকেই। যা মনে আসছে তাই লিখছি। আমি বুঝতে পারছি, লেখার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে এত্তগুলো কান্না ঝরে পড়ছে, এত্তগুলো অভিমান গলে পড়ছে। কুয়াশায় ঝাপসা চোখের দৃষ্টি থেকে কুয়াশার চাদর সরে সরে যাচ্ছে, আর এই মধ্য বয়সে শৈশব কৈশোরের স্মৃতিকণারা চোখের সামনে দিয়ে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে! এক ফাঁকে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসিও খেলে গেলো, কারণ সরস্বতী পূজোর দিন অতিরিক্ত বিদ্যা পাওয়ার লোভে সরস্বতী মায়ের বন্দনা করে কাগজে খাগের কলম দিয়ে লিখতাম, ওঁ সরস্বতী মায়ের চরণে নমঃ, সরস্বতী বানান লিখতে গিয়ে কলম ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হতো। বুঝতে পারতাম না, ব-ফলা কোন স এর পায়ে বসবে? যদি ভুল বানান লিখি, তাহলে সরস্বতী মা বিদ্যা দিবেনা--এই ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেতো। 
অলস বসে অলস ভাবনায় স্মৃতিকণাগুলো যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে! কত কিছুই মনে পড়ে যায়। সেই স্কুল জীবনের দিনগুলো, নবম শ্রেণীর শেষ, দশম শ্রেণীর শুরুর দিকে আমি প্রবন্ধ লিখতাম, আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় প্রবন্ধ পাঠাতাম, প্রবন্ধ লেখা শুরুর পূর্বে সরস্বতী মা'কে স্মরণ করতাম। কি করে যেন সব প্রতিযোগিতায় আমার প্রবন্ধটাই প্রথম স্থান পেতো। সেই কোনকালে ফেলে এসেছি আমার স্কুল, আমার লেখার প্রতিভা, কত কিছু, সব কিছু-----সেদিনের লেখালেখির অভ্যাসটা যদি বয়ে নিয়ে আসতাম, নিশ্চয়ই আজ লিখে ফেলতাম, 'স্মৃতির মুকুরে সরস্বতী পূজো'। কেমন হতে পারতো সেই স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধখানি!


শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজো হয়ে থাকে। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আবার চলে এলো মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী। প্রবাস জীবনে সারাটাক্ষণ গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে প্রায়ই হাঁপিয়ে উঠি। দেশে থাকতে দিনের প্রতিটি মুহূর্ত কাজ করে তো অভ্যস্ত ছিলামনা। দেশে কাজের ফাঁকে ফাঁকে কতরকম আনন্দ উৎসবে মেতে থাকতাম আমরা। আমাদের বাংলা সংস্কৃতিতে কত রকমের পালা পার্বণ, কত ধরনের যে উৎসব আছে, তাতো আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। হিন্দুদের বারোমাসে তেরো পার্বণের কথা প্রবাদের মত হয়ে গেছে। তেত্রিশ কোটি দেব দেবী নিয়ে হিন্দুদের নিত্য জীবনের নিত্য বসবাস। 
হিন্দুধর্মাবলম্বীগণ বিশ্বাস করে, জীবনের প্রতিটি পর্বে একজন করে নিয়ন্ত্রক (দেব দেবী) থাকেন, যিনি স্বর্গ থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। মানুষের জীবনে পুরুষগণ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকলেও ঐশ্বরিক ক্ষেত্রে দেবীরাই বেশী ক্ষমতা রাখেন। স্বয়ং শিবঠাকুরতো ভোলানাথ হয়ে সব ভুলে বসে থাকেন, দেবী দূর্গাকেই জাগতিক সবকিছুর দিকে খেয়াল রাখতে হয়। সব খেয়াল করতে গিয়ে নিশ্চয়ই দেবী দূর্গার মাথাটাই এলোমেলো হওয়ার যোগার হয়েছিল, তাই উনি উনার অধঃস্তনদের মধ্যে দপ্তর বন্টন করে দিয়েছেন। দপ্তর বন্টন পর্বে কন্যা সরস্বতীকে দিয়েছেন ‘শিক্ষা ও শিল্পকলা’ দপ্তর। এবং দপ্তর বন্টনকালে কন্যাটিকে উনি জানিয়ে দিয়েছেন বাংলা বছরের মাঘমাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে যেনো বাংলার মাটিতে একবার করে ঘুরে যান এবং সকল শিক্ষার্থীদের উপর উনার করুণা বর্ষণ করে যান। অন্যান্য অধঃস্তনদের কাজের পরিধি কতটুকু নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা অজানা থাকলেও দেবী সরস্বতীর কাজের পরিধি একটু বিস্তৃত আকারেই নির্ধারণ করে দেয়া আছে। দেবী সরস্বতীকে শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কথা ভাবলেই চলেনা, হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খৃষ্টান নির্বিশেষে সকলের কথা উনার ভাবতে হয়।তাই দেবী সরস্বতীকে সকল ধর্মের অনুসারীরা সম্মান করে থাকে। কারণ জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে জ্ঞান অর্জনটাই বড় কথা, এখানে ধর্ম বিবেচ্য নয়। সেইজন্যই একমাত্র সরস্বতী পূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘর ছাড়িয়ে বাংলাদেশ, ভারতের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।



সরস্বতী পূজার দিনে গায়ে কাঁচা হলুদ আর নিমপাতা বাটা মেখে ভোর সকালে স্নান করার প্রথা যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরে, এই সরস্বতী পূজার একটি আচারের মধ্যে পড়ে। মনে পড়ে, স্কুলে যখন নীচের ক্লাসে পড়তাম, সরস্বতী পূজা এলেই মন আনন্দে নেচে উঠতো। আমি ছিলাম ফর্সা মায়ের কালো মেয়ে। কালো বাবার গায়ের রংটাই যে কেনো পেয়েছিলাম তা নিয়ে অনেক আক্ষেপ ছিল মনে। 
আশেপাশের বাড়ীর সব মেয়েদের দেখতাম প্রতিদিন স্নানের আগে কাঁচা হলুদ বাটা, দুধের সর বাটা, কমলার খোসা বাটা গায়ে মাখতো, গায়ের ফর্সা রঙ আরও উজ্জ্বল করার জন্য। আমি এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে তাদের রূপ চর্চা দেখে যেতাম। আমার বাবা মনে করতেন, দেহের সৌন্দর্য্যের চেয়ে মনের সৌন্দর্য্য অনেক বেশী ইম্পর্ট্যান্ট। তাই এইসব রূপচর্চা নিয়ে ভাবার অবকাশ দিতেননা। মনে পড়লে আজও হাসি পায়, সরস্বতী পূজোর দিনে গায়ে হলুদ মাখার সুযোগ পেয়ে খুশিতে মনে মনে বাক বাকুম করতাম।থলুদ মেখে ফর্সা হওয়ার  এতবড় সুযোগটা আমি হাতছাড়া করতামনা। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই চলে যেতাম প্রতিবেশীদের ঘরে।
প্রতিবেশী মাসিমার ঘরে একটা নির্দিষ্ট পাটা-পুতা ছিলই শুধু কাঁচা হলুদ নিমপাতা বাটার জন্য। কাঁচা হলুদের সাথে কেন নিমপাতা জুড়ে দেয়া হয়েছে, এটা ভেবে আমার মন খারাপ হতো। নিমপাতার মত এমন বিশ্রী জিনিস জীবনে আর দুইটা দেখিনি। ভয় পেতাম, এমন যমতিতা জিনিস আমার কালো চামড়াতে মাখলে নাজানি আমি আরও কালো হয়ে যাব। আবার নিমপাতা না মাখলে যদি পূজার নিয়ম না মানা হয়, পাপ হলে সরস্বতী মা যদি বিদ্যা না দেয়! সেই ভয়ে একটু নিমপাতা মিশাতাম অনেকটা হলুদের সাথে। তারপর জবজবে করে হলুদ সারা মুখে, হাতে, পায়ে মেখে বসে থাকতাম। সহজে স্নানঘরে ঢুকতে চাইতামনা, স্নানের জলের সাথে সব হলুদ ধুয়ে চলে যাবে এই ভয়ে। 
 স্নান করতেই হতো, কিনতু মুখে সাবান মাখতামনা। সারাদিন হলুদ বর্ণের মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম, কালো হয়ে জন্মানোর যে দুঃখ, তা ঐ একদিনে পুষিয়ে নিতাম। বন্ধুরা অবশ্য আমাকে টিপ্পণী কাটতে ছাড়তোনা, ফর্সা দেখানোর জন্য যে আমি হলুদ মেখে বসে আছি, তা তারা কিভাবে জানি বুঝে ফেলতো।
 স্নান শেষে শুরু হতো দেবীর পায়ের কাছে বই খাতা কলম রেখে দেয়ার হিড়িক। এটা একটা রীতি যে সরস্বতী পূজার দিনে পড়তে নেই, বই খাতা দেবীর পায়ের নীচে দিয়ে রাখলে দেবী খুশী হয়ে বিদ্যা বুদ্ধি দিয়ে থাকেন ঐ বইয়ের ভেতর। দেবীর পূজার ফুল বেলপাতা বইয়ের ভেতর গুঁজে রাখলেই পরীক্ষায় ভালো ফল করা যাবে। আমাদের পরিবারে নিয়ম ছিল উলটো। উলটো নিয়ম চালু করেছিলেন আমাদের বাবা। সরস্বতী পূজার দিন সরস্বতী মা পৃথিবীতে নেমে আসে, যে বাড়িতে ছেলেমেয়েরা পড়তে বসে, সরস্বতী দেবী তাদের বেশি করে বিদ্যা দেয় বলে পূজার দিন সকালে আমাদেরকে পড়তে বসাতেন। উনার কথা ছিলো, আজকেই সুযোগ, কেউ পড়েনা, তোমরা যদি পড়ো দেবী তোমাদের উপর সন্তুষ্ট হবেন। আমাদের এক ঘন্টার জন্য হলেও বই পড়তেই হতো। বন্ধুরা জানালার কাছে এসে হাত ইশারা করতো আর আমরা বাবার ভয়ে পড়তাম। বাবা ঠিকই বুঝতে পারতেন আমাদের কষ্ট, তারপরেও কেনো জানি উনি এই ‘শাস্তি’টুকু আমাদের জন্য বরাদ্দ রাখতেন!
 সব পূজার আচারেই একেকটা নির্দিষ্ট নিয়ম থাকে। যেমন বিদ্যার দেবী তাই সরস্বতী পূজাতে ‘খাগের কলম ও দুধজলে ভরা কালির দোয়াত’ লাগে। আরও লাগে পলাশ ফুল, কুল বড়ই। নিমপাতা কাঁচা হলুদ দিয়ে স্নান করতেই হয়।পূজাতে ‘কুল বড়ই’ লাগে, তাই ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা নিয়ম চালু আছে, সরস্বতী পূজার আগে ‘বড়ই’ খেতে হয়না,  পূজার পরে যত ইচ্ছা বড়ই খাওয়া যায়। বড় হয়ে বুঝতে শিখেছি, মাঘের এই সময়টাতে কুল পাকে, অন্য সময়ে কাঁচা কুল খেয়ে অসুখ করার সম্ভাবনা থাকে। তাই সরস্বতী পূজা পর্যন্ত কুল খাওয়ার জন্য অপেক্ষার এই কঠিন নিয়ম। খাওয়া দাওয়ায় এই কঠিন নিয়মটুকু গায়ে লাগতোনা একটা বড় কারণে। সেটা হচ্ছে, সারাদিনে লেখাপড়ার সাথে কোন সম্পর্ক থাকতোনা। কারণ যাবতীয় বই খাতা কলম সরস্বতী মায়ের চরণের সামনে জমা রাখা হতো যেন দেবী আমাদের বই খাতা ভর্তি করে বিদ্যা দিয়ে যান। সারাদিন, সারারাত বই খাতা থাকতো পূজামন্ডপে। আর থাকতো আমাদের প্রত্যেকের নামে একটা করে দুধ জলে পূর্ণ দোয়াত আর খাগের কলম। দোয়াত আর কলম পরদিন সকালে কাজে লাগতো।
 সরস্বতী পূজার দিনে মেয়েদের সবাই হলুদ শাড়ি পড়ে। ছোটরা সকলে মিলে পূজো করে, পূজোর প্রসাদ গ্রহণ করে, এরপর ঘরে গিয়ে মিঠাই ক্ষীর খই দই মুড়ি নাড়ু, সন্দেশ, পায়েস খিঁচুড়ি লাবড়া চাটনি দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সারে। রাতের বেলা ইলিশ মাছ এবং কলাই শাক খাওয়া হয়। 
পরদিন সকালে আমরা দৌড়ে চলে যেতাম কলাগাছ তলায়। কলাপাতা ছিঁড়ে আনতাম, দুধ জল পূর্ণ দোয়াতে খাগের কলম চুবিয়ে তা দিয়ে কলাপাতায় লিখতাম, " ওঁ সরস্বতী মায়ের চরণে নমঃ" তিনবার লিখতাম এই কথা ক'টি। এরপর কলাপাতা ভাঁজ করে সরস্বতী মায়ের পায়ে দিয়ে আসতাম, কেউ হাতে গুঁজে দিত। এটা করার পর মনে এক অগাধ বিশ্বাস আসতো, " আমার অনেক বিদ্যা হবে"।




এতো গেলো বালিকা সময়ের কথা। যখন স্কুলের নবম- দশম শ্রেণীতে পড়ি, তখনতো মাতব্বরী করার অধিকার অর্জন করে ফেলেছি। আমি এমনিতে তেমন ডাকাবুকো ছিলামনা, নেতাগিরি আমার রক্তে নেই, তারপরেও নেতা হয়ে গেছিলাম। আসলে তখন ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল বা ফার্স্ট বয়দের মেঘ না চাইতে জলের মত করেই ক্লাস ক্যাপ্টেন হওয়ার সুবাদে হাতে নেতৃত্বের ক্ষমতা চলে আসতো। সরস্বতী পূজা বা বার্ষিক মিলাদ মাহফিলের মত অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব পেয়ে যেতাম। আমাকে কিছুই করতে হতোনা, আমাকে শিখন্ডী হিসেবে রেখে যারা মাতব্বরী করতে অভ্যস্ত ছিল, তারাই সব ব্যবস্থা করে ফেলতো।আমাকে জানিয়েই  নিজেদের জন্য অতিরিক্ত মিষ্টির প্যাকেট বরাদ্দ করা হতো। আমি ডাকাবুকো ছিলামনা, কিনতু অতিরিক্ত মিষ্টির প্যাকেটের লোভ ঠিকই ছিলো। তখনও গায়ে হলুদ মেখে রঙ ফর্সা করার উপসর্গ আমার মাঝে বেঁচেছিল, বরং নতুন আরেকটি উপসর্গ যোগ হয়েছিলো। শাড়ী পড়ে বড় সাজার হাস্যকর চেষ্টা। শাড়ি পড়তাম, বড়দের মতো করে চুল বাঁধতাম। মনে পড়ে অনুভা, ফরিদা, সেলিনা, সীমার কথা। একটা গ্রুপ ছিলাম আমরা, টিচারদের গুড বুকে আমাদের নাম ছিলো, আমি আর সেলিনা যেখানে থাকতাম, টিচাররা নিশ্চিন্ত বোধ করতেন। তাছাড়া এইসব অনুষ্ঠানে বয়েজ স্কুল থেকে ছাত্ররাও আসতো, প্রতিমা দর্শনের পাশাপাশি আমাদের চোখেও চোখ রেখে যেতো। এটাইতো কৈশোরের এক দুরন্ত মজার জিনিস। বয়েজদের স্কুলে তো আর যেতে পারতামনা আমরা, পরিবার থেকেই নিষিদ্ধ ছিল, ফলে এই চোখাচোখির ব্যাপারটা আরও বেশি আনন্দময় ছিল। 
 এরপর কলেজ, তরুণীকাল শুরু। কলেজের জীবনটা আমার জন্য একটুও সুখকর ছিলোনা। বারো জাতের স্কুল থেকে বারো জাতের মেয়েরা এসে জড়ো হয় কলেজে। সেখানে আমি কে, আর তুমিই বা কে? কেউ কারো অধীন নয়। স্কুলে সকলে ছিল আমার অধীন, স্কুলটা ছিল আমার রাজত্ব। কলেজে গিয়ে নিজের অস্তিত্বকে টেরই পেতামনা। তার উপর কলেজের পড়া, একটুও ভালো লাগতোনা। কলেজের পড়া ভালো লাগেনি, কলেজের পরিবেশটাও ছিলো খাপছাড়া। আমাদের প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম ব্যস্ত ছিলেন উনার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার কাজে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাথে উনার খুব ভালো কানেকশান ছিল। উনি আমাদের কলেজের কোন কিছুতেই খেয়াল রাখতেননা, কলেজের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড নিয়েও উনার কোন আগ্রহ ছিলোনা। ফলে কলেজে গিয়ে কেমন খেই হারিয়ে ফেলে দুই বছর মুষড়ে পড়েছিলাম। সরস্বতী পূজা কলেজে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিনা তাও আমার মনে পড়েনা।

চলে গেলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছি প্রথম তিন বছরে। জাহাঙ্গীর নগরে এসে আবার ফিরে পেয়েছিলাম রাজত্ব করার সুখ। আহ! কি মধুর স্মৃতি! এখানে প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এমন জাঁকজমকপূর্ণ হতো যে বাড়ী ঘরে ফেরার কথাও ভুলে যেতাম। সরস্বতী পূজার কথাই বলি। জাহাঙ্গীরনগরে এসেই মনে হয়েছে, সরস্বতী পূজা শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই পূজা আসলে সকল শিক্ষার্থীর জন্য বিদ্যালাভের আরাধনা। আরাধনা ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যে কেউ করতে পারে, এবং সকলে তাই করতো। 
পূজা মন্ডপে শুধুই ছাত্রছাত্রীরা থাকতাম, মন্ডপ সাজাতাম ছাত্রছাত্রীরা, শুধুমাত্র অভ্যাস নেই বলেই পূজার আয়োজনে মুসলিম মেয়েরা অংশ গ্রহণ করতোনা। তাতে কি, পূজোর নৈবেদ্য সাজানোর অংশটুকু বাদ দিলে আর বাকী সব কিছুতেই আমরা ছিলাম শুধুমাত্র শিক্ষার্থী। দিনে পূজার আনন্দ, সন্ধ্যায় আরতি। আরতি করতো ছেলে শিক্ষার্থীরা, মেয়েরা থাকতো দর্শক ও হাততালি গ্রুপে। 
স্কুল জীবনের 'চোখাচোখি' পর্বটি এখানেও চলতো, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবা মায়েরাতো আর পাহারা দিতে আসতোনা। মজাই পেতাম ছেলে মেয়ে চার চোখে তাকিয়ে। আমাদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়টির কোন বদনাম ছিলনা, দেবী সরস্বতীর কৃপা আমরা সবাই পেয়েছিলাম। আশির দশকের শেষ দিকে এসেও জাহাঙ্গীর নগরের শিক্ষার্থীরা ছিল সকলের জন্য অনুকরণীয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সরস্বতী পূজা ছিল অতি বিখ্যাত, একবার মাত্র গিয়েছিলাম পূজা দেখতে, জাঁকজমক দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। এখন কি আগের মত করেই পূজা হয় জগন্নাথ হলে, খুব জানতে ইচ্ছে করে।
আমি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শেষের দিকে বিয়ে করে ফেলেছিলাম বলেই বন্ধুদের সাথে আর নিরবচ্ছিন্ন সময় কাটাতে পারিনি। কিনতু যে সময় আমি কাটিয়ে এসেছি বন্ধুদের সাথে, আমার কন্যাদের সাথে সে সমস্ত দিনের গল্প করার সময় আমার চোখে মুখে নিশ্চয়ই আলো ফুটে উঠে! মাত্র ত্রিশ বছর আগেও আমরা কত আধুনিক মনের ছিলাম, আমাদের মধ্যে প্রেম ছিল, কিনতু কোন শঠতা ছিলনা, চরিত্রে নির্মলতা ছিলো, কোন কলুষতা ছিলোনা, আচরণে স্থিরতা ছিলো, কোন রকম অধৈর্য্যতা বা অস্থিরতা ছিলনা, অভিমান ছিল কিনতু আক্রোশ ছিলনা। আজকাল স্মৃতিতে আক্রান্ত হই। মেয়েদের কাছেই গল্প করি আমার ছাত্রজীবনের কথা। ছাত্রজীবনে স্কুল কলেজের প্রতিটি অধ্যায়ের গল্প করতে গিয়ে মনটা কেমন এক ধরণের ভালোলাগায় মাখামাখি হয়ে যায়।
ত্রিশ বছর সময় কি খুব বেশী আগের কথা! একমাত্র মোবাইল ফোন ছিলনা তখন, কম্পিউটারও ছিলনা, এটুকুই তফাৎ। তাহলে কি প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে মানুষের আচরণের বৈরীতা আছে! মনে হয় আছে, কালির দোয়াতে খাগের কলম ডুবিয়ে লিখতেন রবীন্দ্রনাথ, তাই তিনি হয়েছিলেন বিশ্বকবি, প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে আমাদের খাগের কলমের বদলে ‘ফাউন্টেন পেন’, তারপরে এলো ‘বলপেন’ , এরওপরে এলো কম্পিউটার, ল্যাপ্টপ আর কীবোর্ড। এখন আর আমাদের কলম না হলেও চলে, আমরা ল্যাপ্টপ, আইপ্যাড, কিনডেল, ট্যাবলেট, নুক নামের ইলেকট্রনিক বই ব্যাবহার করি। যুগের উন্নতির সাথে সাথে ভাষাও বদলে যাচ্ছে, আমরা এখন আর রাবিন্দ্রীক ভাষায় লিখিনা, কবিতার ভাষাও বদলে গেছে। এখন রবীন্দ্র সঙ্গীতকে বলা হয় প্যানপ্যানানি সঙ্গীত, গানের ধরণও পালটে গেছে, এখন রবীন্দ্র সঙ্গীত রিমেক করা হচ্ছে ব্যান্ডের সাথে সিনকোনাইজ করে, আরও এসেছে বাজারে র‌্যাপ, রক, হেভী মেটাল সহ আরও ভারী ভারী নামে। এখন কেউ আর রবীন্দ্র নজরুল হতে চায়না, এমনকি আইন্সটাইনও হতে চায়না। কি যে হতে চায় আমাদের সন্তানেরা, সেটাও বুঝতে পারিনা। শিক্ষাঙ্গনগুলোতে এত অস্থিরতা দেখেই কি সরস্বতী দেবীও ভয় পেয়ে গেছেন কিনা কে জানে। নাহলে এখনকার ছেলেমেয়েরা কেনো দেবীর কৃপা লাভে বঞ্চিত হচ্ছে!

নাহ! বেশিক্ষণ মন খারাপ করে থাকতে নেই। আজ রবিবারের রাত, কাল আমেরিকাতে সোমবারের ভোর হবে, এরপর সকাল হবে। কাঁচা হলুদ নেই, হলুদ গুঁড়ো জলে গুলে মুখে হাতে মেখে ছোটবেলার মত ফর্সা হবো। কাল আমার ডে অফ, ফলমূল, দই, মোয়া, দুধ কিনে এনেছি আজ। কাল সকালে স্নান সেরে নিজে নিজেই পূজোর নৈবেদ্য সাজিয়ে সরস্বতী মায়ের চরণে আমার আরাধনা, আমার সাধনা, আমার প্রার্থনা পূজোর ফুল বানিয়ে সমর্পণ করে দেবো। আমার বয়স তেপ্পান্ন, আমি স্কুল কলেজের পাট বহু বছর আগে চুকিয়ে বুকিয়ে চলে এসেছি। তাতে কি? লেখাপড়ার কি শেষ আছে? পাঠ্যবই পড়িনা, কি হয়েছে, এখনও বিদ্যাচর্চা করি, নাহয় ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখি, তাতে কি, এটাও বিদ্যাচর্চার একটি ইন্টারনেটিয় রূপ। এখানেও প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াই চলে নিরন্তর। জীবনটাই কেটে গেলো নানারকম লড়াই সংগ্রামে। এখন চলছে ফেসবুকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াই, লড়াইয়ে আমাকে জিততেই হবে। হারবার জন্য আমি জন্মাইনি, আমার মানসিক শক্তি প্রবল আছে, শুধু প্রয়োজন সরস্বতী মায়ের কৃপা। সরস্বতী মায়ের কৃপা পাবো বলেইনা আজকের এত আয়োজন!

Sunday, January 21, 2018

সরস্বতী বিদ্যাবতী, তোমায় দিলাম খোলা চিঠি (৬ বছর পূর্বে লেখা)






 27/01/2012 - 3:12pm
দেবী সরস্বতী শ্রীচরণকমলেষু,

দেবী, আশা করি এই মুহূর্তে তুমি খুবই আনন্দে আছো, কেননা তিথি নক্ষত্রের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশ সময় শনিবার ভোর সকালেই তোমাকে নিয়ে তোমার হংসবাহন বাংলার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে ও দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে পৌঁছে যাওয়ার কথা। হাতে আছে মাত্র আর একদিন সময়। রাজ্যের গোছগাছ নিশ্চয়ই পড়ে আছে। আসতে গেলেতো তোমাকে অন্ততঃ সাত দিনের সময় হাতে নিয়ে আসতে হবে। শুধু দেশেই তো নয়, প্রবাসেও তো তোমার বাঙ্গালী ছাত্র ছাত্রী একেবারে কম নেই! তাদের দুয়ারেও তো তোমার পদধূলি দিতে হবে। 
জানি চিঠিখানি পেয়ে তুমি যুগপৎ অবাক ও বিরক্ত হবে। কিনতু আমি নিরুপায় মা। তুমি এই ধরাতে আসই বছরে একটিবার, তাছাড়া একবার এসে পৌঁছালে তোমার ভক্তদের যন্ত্রণায় তোমার কাছে পৌঁছানোই যাবেনা। অথচ তোমার সাথে কথা বলাটা আমার অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে যে! সেই জন্যই তোমাকে সরাসরি চিঠি লেখাটাই যুক্তিযুক্ত মনে হলো।
মাগো, ইনানি বিনানি বাদ দিয়ে আসল কথা শুরু করি। আচ্ছা, স্বর্গে বসে কি বাংলাদেশের সংবাদপত্র পড়তে পারা যায় অথবা অনলাইনের ব্যাপার স্যাপারগুলো কি স্বর্গেও আছে? কি জানি, জানার কোন উপায় নেই, আসলে পৃথিবীতে এত কিছু আবিষ্কার হয়েছে কিনতু স্বর্গ-নরকের ব্যাপারটাই এখনও আবিষ্কৃত হয় নাই। তবে ধারণা করি দেশের কোন খবরই তোমার কানে পৌঁছায়না। পৌঁছালে জানতে পারতে আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে এখন কি চলছে! আমি নিজেওতো ভাল জানিনা, দেশে আগের মত প্রতিটি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজা হয় কিনা! পূজা-পার্বন এখন শিকেয় উঠেছে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে এখন ক্ষমতা প্রদর্শনের লড়াই।
কথা নাই বার্তা নাই, হয় কথায় নয় কথায় দেখি ছাত্রদের হাতে রাম-দা, চাপাতি, কিরীচ জাতীয় সব আদিম যুগের অস্ত্র। সত্যি বলছি মা, যদি বিশ্বাস না হয়, দেশে যখন আসবে কারো কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে তিন চার দিন আগের যে কোন পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালেই দেখবে, একটি ছবিতে ছেলেরা হাতে ছুরি, চাপাতি, কাস্তে নিয়ে কাউকে ধাওয়া করছে। আর একটু কষ্ট করে যদি ছবির নীচের খবরটা পড়ে ফেলতে পারো, দেখবে তোমারও চোখ কপালে উঠে যাবে। ছোট্ট ঘটনা,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে এক জেলা ছাত্র কল্যাণ সমিতির চাঁদা উঠানোকে কেন্দ্র করে ঝগড়া লেগে যায়। একবার ভেবে দেখো, চাঁদা তোলার কথা ছাত্র কল্যাণ তহবিলের জন্য, অথচ মারামারি কাটাকাটি করেই সব কল্যাণের ভরাডুবি করে ফেলেছে। শুধু কি ছাত্রলীগ, যখন যে দল দেশের ক্ষমতায় থাকে, তার অঙ্গসংগঠন হিসেবে তাদের ছাত্রসংগঠনগুলো ভীষণরকম বেপোরোয়া হয়ে উঠে।
লজ্জার কথা হচ্ছে, দুই সপ্তাহ আগেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘটে গেছে আরেক নারকীয় ঘটনা। ইংরেজী বিভাগের এক ছাত্রকে তারই এককালের বন্ধুরা আগের শত্রুতার জের ধরে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। মাগো, এবার কি আমাকে একটু একটু চেনা চেনা মনে হচ্ছে! তোমার কি মনে পড়ছে, অনেক আগে আমরা কি জাঁকজমক করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমার পূজা উদযাপন করতাম! আমাদের হাতে ছিল তখন কলম। পিস্তল বন্দুক বা চাপাতি, কিরীচ বা ছুরি আমরা চোখেও দেখিনি। 
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা বলছি। কি চমৎকার নৈসর্গিক পরিবেশে ছিলাম আমরা! অমন পরিবেশে থেকে আমরা কি সুন্দরভাবেই না শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, চলনে, বলনে, আচারে আচরণে শিক্ষিত হয়ে উঠছিলাম। ছেলেমেয়ে সকলের মধ্যেই ছিল কি মধুর সম্পর্ক। অথচ এখন কি বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে জাহাঙ্গীরনগরের পরিবেশ! এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই মানিক নামের তথাকথিত এক ছাত্র ধর্ষণে নাকি সেঞ্চুরী করেছে! অবাক হচ্ছো তো শুনে? হ্যাঁ আমিও অবাক হয়েছিলাম এমন খবর পাঠ করে। শুধু কি তাই, গত কয়েক বছরের হিসাব থেকে জানা গেছে, এই পর্যন্ত নাকি ১২/১৩ জন ছাত্র এই ধরনের ক্ষমতার সন্ত্রাসের বলি হয়েছে!
দেবী, আমি চাইনি যাত্রার আগ মুহূর্তে তোমার মনটা খারাপ করে দিতে! তারপরেও আমাকে এই বিশ্রী কাজটা করতে হচ্ছে। আসলে তুমিইতো বিদ্যার দেবী! বিদ্যা বলি, বুদ্ধি বলি, অথবা জ্ঞান বলি, যা-ই বলিনা কেন, সব ক্ষেত্রেইতো তোমার গুণবন্দনা শুনি। সেই জন্যই তোমার দরবারে নালিশ করছি। 
শুধু তো উপরের দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাই শেষ কথা নয়, সারা দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া শুধু ছাত্রদের দোষ দিয়েই কি হবে! শিক্ষক হচ্ছে পরম গুরুজন, সেই শিক্ষক তার ছাত্রীকে বলাৎকার করে, এমন খবর হরহামেশা পত্রিকার পাতায় ছাপা হচ্ছে, আরো কি হয় জানো, ভর্তি বাণিজ্য চলে! 
অবাক হচ্ছো ভর্তি বাণিজ্যশব্দটি শুনে? অবাক হওয়ার আর কিছু নেই, ভর্তি নিয়েও বাণিজ্য হয়, পরীক্ষার হলে সীট ফেলা নিয়ে বাণিজ্য হয়, চাকুরীর ইন্টারভ্যু নিয়ে বাণিজ্য হয়, চাকুরীতে প্রমোশান পাওয়া নিয়ে বাণিজ্য হয়, শিক্ষকরা স্কুলে কলেজে নিয়মিত ক্লাস না নিয়ে টিউশানি করেন, সেই টিউশানীতেও বাণিজ্য আছে! শুধু পড়ালেখাই নয়, গান-বাজনা, অভিনয়, নাট্যকলা, সিনেমা জগতসহ শিল্পের যে কোন শাখাতেই চলছে এই ধরনের অসাধু বাণিজ্য। 
ধরো, কারো টিভিতে অভিনয়ের শখ, তাকে টিভিতে চান্স পেতে গেলে নাকি অভিনয় জানার চাইতেও বেশী জরুরী পরিচালক প্রযোজকদেরকে সন্তুষ্ট করা। আমাকে ডিটেইলসে যেতে বলোনা, কিছুটা আন্দাজ করে নিও আমি কি বুঝাতে চাইছি।
মাগো, তুমি হলে শুভ্রবসনা, তোমার অন্তরটাও শুচি শুভ্র। তোমার একহাতে ধরা বীণা, আরেক হাতে পুস্তক। বিদ্যা-বুদ্ধি, সঙ্গিত, জ্ঞানচর্চা নিয়েই তোমার সময় কাটে। বছরে এই একটা দিন সময় পেয়েছো একটু বেড়াবার। তোমাকে এত কঠিন বাস্তবের কথা না বলাটাই ভালো ছিল। কিনতু অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকে মা! কার জন্য করে যাচ্ছো এই জ্ঞানের সাধনা! তুমিতো জাননা মনে হয়, এখন আর এনালগের যুগ নেই, সবই ডিজিটাল হয়ে গেছে। আগে তোমার পূজাতে তোমার চরণে নিবেদন করতাম খাগের কলম আর জলদুধে ভরা কালির দোয়াত’, অথচ এখন কলম টলম আর চলেনা। তুমি যখন আসনে বসবে, ভালো করে খেয়াল করে দেখো, তোমার চরণতলে এখন আর কেউ আমাদের মত করে এক বস্তা বই, খাতা কলম, হারমোনিয়াম রেখে দেয়না। কেউ কেউ হয়ত দুই চারটা বলপেন’ সাজিয়ে দিবে তোমার চরণতলে।
 তা সবাইতো আর সন্ত্রাসী নয়, কিছু কিছু ছেলেপেলে এখনও আছে, যারা এত প্রতিকূলতার মাঝেও লেখাপড়া শেখার সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তাদেরই কেউ কেউ হয়ত এখনও দুই একটা বই বা বলপেন এনে দেয় তোমার চরনতলে তোমার কৃপা লাভের আশায়। তাদের জন্যই মনটা আমার কাঁদে। আহারে! বেচারারা এত জুলুমের সাথে পেরে উঠছেনা।
মাগো, আমি কেন লিখে যাচ্ছি এতকথা! তোমারতো কিছুই অজানা থাকার কথা নয়! এক সময় শুধু তোমার সাধনা করে, শুধুমাত্র জ্ঞানসাধনা করে, বিদ্যাচর্চ্চা করে একজন বিদ্যাসাগর, একজন রবীন্দ্রনাথ, একজন নজরুল, একজন জগদীশ বসুর জন্ম হয়েছে। বিদ্যাসাগর বা নজরুলের কথাই ধরোনা কেন, তোমার বোন লক্ষ্মীদেবী তো তাঁদের প্রতি কোন কৃপা করেননি, তাঁরা শুধু তোমার কৃপা পেয়েই জীবনে ধন্য হয়ে গেছেন! কবি সুকান্ত বা কবি জীবনানন্দ, তাঁদের প্রতিও লক্ষ্মীদেবী সহায় ছিলেননা, তবে তুমিতো ঠিকই তাঁদের সহায় ছিলে!সকলেই জানে তোমাতে আর তোমার বোন লক্ষ্মীদেবীতে আড়াআড়ি সম্পর্ক। তুমি যদি কাউকে বিদ্যে দাও, লক্ষ্মীদেবী তাকে ধন সম্পদ দেয়না। কাজেই এটা আমাদের চয়েস, যে বিদ্যা চায় সে বিদ্যা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে, যে ধন চায় সে ধনলাভের কাজে সচেষ্ট হয়। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, সরস্বতী এবং লক্ষ্মী দুজনেরর কৃপাধন্য হয়েছে এমন লোকের সংখ্যাও কম নেই। এগুলো সব স্বর্গে বসেই তোমরা ঠিকঠাক করে এসেছো এতকাল। তাই শিক্ষাঙ্গনগুলোতে কখনও মারামারি, কাটাকাটি হয়নি, বিদ্যাচর্চায় কোন ব্যাঘাতের সৃষ্টিও হয়নি এতকাল।
তাহলে কি এমন ঘটে গেলো যে তুমি এভাবে পরাস্ত হয়ে গেলে! কেনো আজ সকলে বিদ্যার পেছনে না ছুটে ধনসম্পদের পেছনে ছুটছে? কেনো তুমি প্রতিযোগিতায় নিজেকে এভাবে সরিয়ে নিচ্ছো! কোন অভিমানে তুমি লক্ষ্মীদেবীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতিয়ে দিচ্ছো?তুমি অভিমান করেছো বলেই লক্ষ্মীদেবীকে পাওয়ার জন্য এখনকার ছেলেমেয়েরা ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। এই ডিজিটাল যুগে সবাই শর্টকাট রাস্তা বের করে ফেলেছে বড়লোক হওয়ার জন্য। বড়লোক হতে গিয়ে অনেকেই অসাধু পথটাকেই বেছে নিচ্ছে। পড়ালেখার যে সর্বোচ্চ পীঠস্থান, সেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই শোনা যায় অস্ত্রের ঝনঝনানি, আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। সেজন্যই আমার খুব ভয় লাগছে দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে।
মাগো, সনৎ সিংহে্র গাওয়া গানটি কি তোমার আর মনে পড়ে!

সরস্বতী বিদ্যাবতি, তোমায় দিলাম খোলা চিঠি

একটু দয়া করো মাগো, বিদ্যা যেনো হয়।
এসব কথা লিখছি তোমায় নালিশ করে নয়

দেবী সরস্বতী, মা আমার, আমিও কোন অভিযোগ করিনি এতক্ষন। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আমাদের, আমাদের দিনও শেষ হয়ে এসেছে। আসলে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে আমাদের উত্তরসুরীদের কি অবস্থায় রেখে যাচ্ছি, কি দিয়ে যাচ্ছি তাদেরকে, এটা হিসেব করতে বসেছিলাম, হিসেব মেলাতে পারছিলামনা। হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেলো আগামী শনিবার তোমার পূজা, তোমার মূর্তির দিকে তাকালেই মনের ভেতর এক পবিত্র স্নিগ্ধতার ছোঁয়া লাগে, মনে আশা জাগে, ভরসা পাই। সেই ভরসা থেকেই তোমার কাছে আকুল আবেদন করছি, আমাদের এই ডিজিটাল যুগের ছেলেমেয়েরা আসলে কোন কিছুর সাথে তাল রাখতে পারছেনা বলেই দিশেহারা হয়ে এমন উলটা পালটা কাজ করে ফেলছে। দোষ নিওনা মা, এরা সবাই অবুঝ ছেলেমেয়ের দল। তোমার চরণতলেই এদের ভাগ্যকে সমর্পন করে দিলাম। তুমি এদেরকে তোমার চরনে ঠাঁই দাও মা। এদের অস্থির চিত্তে দাও তোমার স্পর্শের কোমলতা, সবার অন্তরের বন্ধ দরজা খুলে দাও, যেনো জ্ঞানের আলো ঢুকতে পারে সবার অন্তরে। ভালো থেকো তুমি নিজে, আমাদেরকেও ভালো রেখো।

তোমার সন্তান
রীতা রায় মিঠু

Saturday, January 20, 2018

প্রস্তর যুগের পথে!


ধর্ষণ তাও আবার উন্মুক্ত উঠোনে, স্বামী-সন্তানের সামনে? কখন এমন ঘটনা ঘটে? যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটে, যেমনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটেছিল বাংলাদেশে। পাকিস্তানী মিলিটারী আর বাংলাদেশের রাজাকার, আলবদরেরা প্রতিদিন বাঙ্গালী মেয়েদের 'মুরগী ধরা'র মত ধরে নিয়ে যেত, দিনরাত ধর্ষণ করে শরীরের ক্ষিদে মিটিয়ে মেয়েগুলোকে মেরে ফেলতো। মেরে ফেলার আগে ফ্যানের আংটার সাথে চুল বেঁধে ঝুলিয়ে মেয়েগুলোর স্তন কেটে দিত, ঠোঁট কেটে দিত, সারা শরীর কামড়ে ক্ষত বিক্ষত করে দিত, শেষে বেয়নেট বা বন্দুকের নল মেয়েদের নিম্নাঙ্গে ঢুকিয়ে দিয়ে উল্লাস করতো।
সেতো ১৯৭১ সালের কথা, এখন ২০১৬ সাল। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৫ বছর আগে। আমরা এখন বিশ্বে মধ্যম আয়ের দেশ! বিশ্বে 'বাংলাদেশ'-এর নাম এখন অনেকেই জানে। বাংলাদেশ এখন 'মডারেট' মুসলিম দেশ। 'মডারেট' দিয়ে কি বুঝানো হয় তা আমার জানা নেই। বাংলাদেশের সরকার, বিরোধীদল, বুদ্ধিজীবীদের সকলেই বলেন, বাংলাদেশ একটি 'অসাম্প্রদায়িক' দেশ। অত্যন্ত আনন্দের কথা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানতো এমনই একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের, স্বপ্নের বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। স্বপ্ন বাস্তবায়নের শুরুতেই তাঁকে পরিবার পরিজনসহ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তবুও ভাগ্য ভালো বাংলাদেশের, বঙ্গবন্ধুর দুটি কন্যা প্রাণে বেঁচে গেছিলেন। নাহলে আজ বাংলাদেশের নাম বদলে বাংলাস্তান হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিলনা। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশটাকে 'বাংলাস্তান' হয়ে যেতে দেননি। তাই দেশের বুদ্ধিজীবী, মন্ত্রী, বিরোধী নেতাগণ মিথ্যে করে হলেও বাংলাদেশ নামের সাথে 'মডারেট, অসাম্প্রদায়িক, উদার' বিশেষণ যোগ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারছেন।
২০০১ সালের কথা, রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছিল বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি। শেখ হাসিনার আওয়ামীলীগের নৌকায় ভোট দেয়ার অপরাধে হিন্দু বাড়িগুলো আক্রান্ত হয়। পূর্ণিমা রাণী শীল, ১৪ বছরের কিশোরী, বিএনপির ক্যাডাররা দলবেঁধে পূর্ণিমাকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণ করার মজাই আলাদা, মিনি মাগনা মেয়ে শরীর পেয়ে যাওয়া, সেই শরীর কিশোরীর নাকি যুবতীর, নাকি তিন বছরের শিশুর তা দেখার দরকার কি। নারী অঙ্গ হাতের মুঠোয় পাওয়া গেলেই হলো, আর সেই নারী অঙ্গ যদি নৌকায় ভোট দেয়া কোন হিন্দু

বাপের মাইয়ার হয়, তাহলেতো কথাই নেই। সে গণিমতের মাল, সবাই চেটেপুটে খাওয়ার জিনিস। পূর্ণিমাকেও ওরা চেটেপুটে খেয়েছিল, লুকিয়ে চুরিয়ে খায়নি। পূর্ণিমার বাবাকে স্বাক্ষী রেখে, পূর্ণিমার মাকে স্বাক্ষী রেখেই খেয়েছিল। ওরা এতজন এসেছিল পূর্ণিমাকে খেতে যে পূর্ণিমার মা ভয় পেয়ে বলেছিল, " বাবারা, একজন একজন কইরা যান, আমার মাইয়াডা ছোট"।
২০১৬ সালের জানুয়ারীর ঘটনা, বানিয়াচং-এর ঘটনা। এক হিন্দু রমনীর দেহের দিকে নজর যায় একজনের, এবার আর নৌকা বনাম বিএনপি নয়। এখন দেশে বিএনপি নেই, সবাই আওয়ামীলীগ হয়ে গেছে। তেমনই এক আওয়ামীলীগ নেতার ইচ্ছে হয়েছে হিন্দু বউটাকে চেখে দেখার। বউটাতো লাল টকটকে আপেল, লোভ সামলানো দায়। লাল আপেল কচকচ করে খাওয়ার মজাই আলাদা, আওয়ামী নেতা কচ কচ করে আপেল খেলেন, তাই দেখে আপেলের মালিক মানে বউটার স্বামী পুলিশে বিচার দেবে বলায় আওয়ামী নেতা বউটাকে আরেকবার খেলো, এবার খেলো বউটার স্বামী আর সন্তানের চোখের সামনে।
২০১৬ সালের জানুয়ারী। আরেকটি লোমহর্ষক ঘটনা, ঘটনার সূত্রপাত মামীর প্রতি ভাগ্নের যৌনক্ষুধার ছোবল! এ ঘটনা কিন্তু কোন হিন্দু পরিবারের ঘটনা নয়, এটি একটি মুসলিম পরিবারে ঘটে যাওয়া হৃদয় বিদারক ঘটনা। নারায়ণগঞ্জে একই পরিবারে পাঁচজন খুন হলো। কি কারণ? ২০ বছর বয়সী মামী লামিয়াকে তার ভাগ্নের খেতে ইচ্ছে হয়েছে। মামীতো নয়, যেন চৌধুরী বাড়ির লাল টুকটুকে মুরগী। ভাগ্নের মুরগী খেতে ইচ্ছে হয়েছে, মুরগীকে খাবে বলে কত রকমের ফন্দী, বাড়ির মালিক টের পেয়েছে জেনে ভাগ্নে তার মামী মুরগী, মুরগীর বাচ্চাসহ পাঁচজনকে কেটেকুটে খেয়ে ফেলেছে। কোন জমানায় বাস করছি আমরা?
এই হচ্ছে আমার প্রাণপ্রিয় দেশ, এই দেশটার জন্য আমরা দূরে বসে কাঁদি। বৃষ্টি বাদলা, তুষারপাত উপেক্ষা করে কাজে যাই, হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করি, দেশে টাকা পাঠাই, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ে। রাতের নিরলে ফেসবুকে বসে দেশের ছোঁয়া পাই, দেশের গন্ধ নাক মুখ ভরে নেই, পরম তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে যাই। ঘু্মের মধ্যে স্বপ্ন দেখি সবুজ ধানের ক্ষেত, নয়তো হলুদ সরষের ক্ষেত। সুন্দর মন নিয়ে ঘুম থেকে জাগি।
এমনইতো হওয়ার কথা, কিন্তু সব সময় এমন হচ্ছেনা আজকাল। মাঝে মাঝেই স্বপ্নে দেখি ভূত, আমার চারদিকে ভূত। ঘুম ভাঙ্গতেই শুনি সত্যি সত্যি ভূত এসেছিল, বাংলাদেশের কিছু কিছু বাড়িতে। ভূতগুলো বাড়ির সকলের ঘার মটকে দিয়েছে, কাউকে প্রাণে, কাউকে মানে মেরেছে। এই আমার প্রাণপ্রিয় দেশ।
আদিম যুগে মানুষ ঘরবাড়ি বানানোর বুদ্ধি বের করতে পারেনি তাই গুহায় বাস করতো, আগুন জ্বালাতে জানতোনা তাই কাঁচা মাংস খেতো, পোশাকের ব্যবহার জানতোনা, পোশাকের প্রয়োজনীয়তা বুঝতোনা, তাই উলঙ্গ হয়ে ঘুরতো, সকলেই উলঙ্গ থাকতো বলে লোকলজ্জার ব্যাপার ছিলনা।। রিপুর তাড়না সকল প্রাণীর মধ্যেই ছিল, উলঙ্গ মানুষের মধ্যেও ছিল। জৈবিক কামনা নিবৃত্ত করতে তাদের আড়ালের প্রয়োজন হতোনা। বাপ-কন্যা, ভাই-বোন, মা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার ছিলনা। উলঙ্গ নারী দেহ দেখে উলঙ্গ পুরুষের কাম রিপু জেগে উঠতো, যাকে সামনে পেতো তার সাথেই কাম ক্রিয়ায় মেতে উঠতো।
ধীরে ধীরে মানুষের বোধ বুদ্ধি জাগ্রত হয়েছে, বুঝতে শিখেছে দেহের উপরিভাগ (মুশশ্রী) সুন্দর হলেও নীচের অংশ ( যৌনাঙ্গ) সুন্দর নয়, এটাও বুঝতে শিখলো যে অসুন্দরকে সকলের চোখের আড়ালে রাখার কথা। শুরু হলো গাছের ছাল বাকল দিয়ে নিম্নাঙ্গ আবৃত করার প্রয়াস। শিখে গেলো পোশাক পরার প্রয়োজনিয়তা। আগুন জ্বালতে শিখলো, শুরু হলো মাংস পুড়িয়ে খাওয়ার প্রয়াস, শিখে গেলো রান্না।
সে মানুষ সভ্য হয়েছে, জামাকাপড় পরতে শিখেছে, গাছের আড়ালে গিয়ে 'হাগু মুতু' করতে শিখেছে, সকলের সামনে নর-নারীর কামক্রিয়া বন্ধ হয়েছে। বাবা-কন্যা, ভাই-বোন,-মা-ছেলের সম্পর্ক বুঝতে শিখেছে, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধবসহ আলাদা আলাদা সম্পর্ক দিয়ে মানুষ সমাজ গড়েছে।
ধীরে ধীরে মানুষ সুন্দর হয়েছে,সৃষ্টি হয়েছে ধর্মীয় বোধ, শিক্ষিত হয়েছে, আধুনিক হয়েছে, ধার্মিক হয়েছে, বৈজ্ঞানিক হয়েছে। 'হাগু মুতু করার জন্য আলাদা ঘর বানিয়েছে, ঘুমানোর জন্য ঘর বানিয়েছে, নর নারীতে শুধুই কামড়া কামড়ি নয়, প্রেমের আকুতি, প্রেমের অনুভূতি, ভালোবাসার সম্পর্ক থাকার প্রয়োজনিয়তা বুঝেছে। মানুষ আরও বুঝেছে, শুধু শরীরের ক্ষিদেই নয়, নর নারীর দৈহিক মিলনের ক্ষেত্রে মনের চাহিদা, দুজনের পারস্পরিক অনুমতি গ্রহণের ব্যাপার আছে।
শরীরের ক্ষিদে মেটায় পশু-পাখী, পশু-পাখির মনে ক্ষিদে থাকেনা অথবা মনের ক্ষিদে তারা অনুভব করেনা, ঐজন্যই তারা মানুষ নয়। মানুষও যখন পশু-পাখির পর্যায়ে ছিল তখন মানুষের মনের ক্ষিদে ছিলনা, শারীরিক মিলনের মাধ্যমে শরীরের ক্ষিদে মেটাতো।
এগুলো প্রস্তর যুগের কথা, এখন ডিজিটাল যুগ। এখনকার মানুষ হবে অনেক বেশী যুক্তিবাদী, অনেক বেশী বুদ্ধিমান, অনেক বেশী মানবিক। এখন মানুষ মানুষকে চিনবে বুদ্ধির বিচারে, জ্ঞানের বিচারে। ধর্মের প্রচার শুরু হয়েছিল মানুষের মধ্যে বিবেক, ভালোবাসা, প্রেম, মানবতা, পরমত সহিষ্ণুতা জাগ্রত করার জন্য। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহামানবের আবির্ভাব হয়েছিল এই পৃথিবীতে, প্রত্যেক মহামানব মানুষের কল্যাণেই ধর্মের বাণী প্রচার করেছিলেন, সৃষ্টি হয়েছিল হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, ইহুদি, শিখ, জৈন --বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়। সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় পুস্তকে মহামানবের বাণীর মূল সুরে বিবেক,ভালোবাসা , প্রেম, মানবতা, পরমত সহিষ্ণুতার কথা বলা হয়েছে।
এতদিনে আমাদের সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু কেন জানি আমরা মানুষ নাহয়ে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান হওয়ার পর থেমে গেছি। আমাদের আর সামনে এগোনো হচ্ছেনা। সামনে এগোনোর পথ আছে, কিন্তু আমাদের কোমড়ে জোর নেই, পায়ে জোর নেই, তার চেয়েও বড় কথা মাথায় ঘিলু নেই। মাথার ঘিলু পচে গোবর হয়ে গেছে, গোবরে পোকা ধরেছে। ইদানিং ঘিলু নামক গোবরের পোকাগুলো আমাদের কামড়াচ্ছে, অহর্নিশ কামড়াচ্ছে। আমরা বিবেক, লজ্জা, আত্মমর্যাদা, মানবতা, অনুশোচনা, গ্লানিবোধের ব্যাপারগুলো ভুলে যাচ্ছি।
এখন আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখিনা, মানুষকে দেখি পুরুষ আর মহিলা হিসেবে। মহিলাকে একজন নারী হিসেবে দেখিনা, দেখি একতাল মাংসের শরীর হিসেবে। অনেক পুরুষ আছে যারা নিজেকে পুরুষ হিসেবে দেখেনা, নিজেকে দেখে যৌনক্ষুধা আক্রান্ত রোগী হিসেবে। যৌনক্ষুধা আক্রান্ত পুরুষগুলোর এখন আর ভাতের ক্ষিদে পায়না, ওদের সারাক্ষণ ঊর্ধ্বাঙ্গ-নিম্নাঙ্গ জুড়ে চলে যৌনক্ষুধার দাবদাহ।
যৌনক্ষুধা আক্রান্ত পুরুষটি তাই মায়ের শরীরে নিজের ক্ষুধা মেটানোর পথ খুঁজে পায়, মামীর দেহে, বোনের দেহে, অবুঝ শিশুর কচি দেহে, রাস্তার উলঙ্গ পাগলীর দেহেও ক্ষুধা মেটানোর পথ খুঁজে পায়। এইসব ক্ষুধার্ত কামার্ত পুরুষগুলো প্রতিবেশী নারীর দেহে ক্ষুধা মেটানোর রসদ খুঁজে পায়। কামার্ত পুরুষ হিন্দু মুসলমান বিচার করেনা, দেশে ক'টাইবা হিন্দু আছে? অথচ শহরে গ্রামে প্রতিদিন কত নারী ধর্ষিত হচ্ছে, ধর্ষিত নারী খুন হচ্ছে। এদের শরীরে ধর্ম লেখা নেই, এরা শুধুই কমজোরী নারী। নারী যদি অন্য কোন পুরুষের বউ হয়, তখন যৌনক্ষুধাক্রান্ত পুরুষটির ক্ষুধা বেড়ে যায়।
এমনই পাগলা যে ভুলেই গেছে, অন্যের স্ত্রীকে উলঙ্গ করে ধর্ষণ করার সময় নিজেকেও উলঙ্গ হতে হয়েছে। তার কুৎসিত, কদাকার পুরুষ যন্ত্রটি যা প্রস্তর যুগের মানুষ গাছের ছাল বাকল দিয়ে আবৃত করে রাখতো, সেই কুৎসিত দর্শন যন্ত্রটি ধর্ষণের উসিলায় উন্মুক্ত হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে মানুষের পোশাক পরিচ্ছদে ধর্মীয় ভাব অনেকটাই বেড়েছে, এর সাথে যদি ধর্মীয় মূল্যবোধ ধর্মীয় চেতনাটুকু বৃদ্ধি পেতো, তাহলে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য মঙ্গলজনক হতো। ধর্মীয় মূল্যবোধ মানেই বিবেক,ভালোবাসা , প্রেম, মানবতা, পরমত সহিষ্ণুতা। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এই বোধগুলো ক্রমেই কমে আসছে, এখন হাজার মানুষের উপস্থিতিতে একজন নিরস্ত্র মানুষ খুন হয়ে যায়, কেউ বাঁচাতে আসেনা। নিরপরাধ বিশ্বজিত প্রাণভয়ে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে, হাতে চাপাতি নিয়ে তথাকথিত রাজনৈতিক নেতারা বিশ্বজিতের পিছু ধাওয়া করে, এই দৃশ্য ভিডিও করার মানুষ ছিল প্রচুর, বিশ্বজিতকে কিভাবে কোপানো হলো, তাও ভিডিও করা হয়েছে, কিন্তু হাতের ভিডিও ক্যামেরাটি দিয়ে কেউ একজন চাপাতিওয়ালার হাতে আঘাত করে বলেনি, " ওকে ছেড়ে দাও, মেরে ফেলোনা"।
বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থাতেও গতি আসছেনা, রাজনৈতিক মূল্যবোধ ব্যাপারটি বই পুস্তকে বন্দী হয়ে গেছে। অপরাধী ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আসছে।
বাংলাদেশের নারীরা দেশের কল্যাণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে, দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সংসদ নেত্রী, বিরোধী নেত্রীসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নারীগণ অধিষ্ঠিত থাকার পরেও বাংলাদেশে নারী নির্যাতন, নারী/শিশু ধর্ষণ বন্ধ হচ্ছেনা। বাংলাদেশে ধর্ষকের বিচার হয়না। ধর্ষকরা শাস্তি পাচ্ছেনা, ফলে ধর্ষণ একটি 'উপভোগ্য খেলা'য় পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রায় সকলেই কথায় কথায় পাশ্চাত্যের দেশগুলোর বিশেষ করে আমেরিকার নারীদের পোশাক নিয়ে সমালোচনা করে, পাশাচাত্যের নারী পুরুষ অবাধ মেলামেশার সমালোচনা করে। বাংলাদেশের কয়জন মানুষ জানে যে আমেরিকান পুরুষগণ আমেরিকান নারীদের পোশাক নিয়ে মাথা ঘামায়না, প্রকাশ্যে কোন টিটকারি দেয়না, অশোভন বা অশ্লীল মন্তব্য করেনা। বাস, ট্রেনের ভীড়ে অপরিচিত কোন মেয়ের বুকে বা পাছায় হাত দেয়না।
আমেরিকান ছেলেমেয়েদের স্কুল শিক্ষার এক পর্যায়ে 'সেক্স এডুকেশান' দেয়া হয়। সবাই জানে, মেয়েদের প্রতিটি অঙ্গ দেহের একটি অংশ বিশেষ, নারীর দেহের বিশেষ অঙ্গ নিয়ে আমেরিকান পুরুষ বিশেষভাবে মাথা ঘামায়না। এদেশে কোন কিছু নিয়েই রাখঢাক নেই বলেই যৌন সুড়সুড়ি দেয়া কোন ছ্যাঁচড়ামি নেই। পোশাকের ব্যাপারেও সমালোচনা করার কিছু দেখিনা। যস্মিন দেশে যদাচার, আরব দেশে মেয়েরা ওদের রুচী অনুযায়ী পোশাক পরে, আমেরিকান মেয়েরা তাদের রুচী অনুযায়ী পোশাক পরে। তাই বলে কি আমেরিকায় মেয়েরা ধর্ষিত হয়না? আরব দেশের মেয়েরা ধর্ষিত হয় না?, আমেরিকায় মেয়েরা ধর্ষিত হয়, তবে ধর্ষকের বিচার হয়, শাস্তি হয়।
বাংলাদেশেও পুরোমাত্রায় নাহলেও স্কুলের শেষ পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীকে পরিমিত পর্যায়ে সেক্স এডুকেশান দেয়ার ব্যবস্থা করা ভাল যাতে প্রতিটি ছেলেমেয়ে নিজেদের ভাল-মন্দটুকু বুঝতে পারে। আর অতীব প্রয়োজন ধর্ষক, নারী নির্যাতনকারীর কঠোর শাস্তি। নাহলে আমরা পায়ে পায়ে, ধীরে ধীরে প্রস্তর যুগের দিকেই ফিরে যাবো।  (January 22, 2016)

Thursday, January 18, 2018

আই হেট ইউ!



অফিস থেকে আজ একটু আগেই বেরিয়েছে রুমা, জুলাইয়ের শেষ, বাইরে অসম্ভব গরম, গায়ে ফোস্কা পড়ার মত অবস্থা। দরজার লক খুলে গাড়ির ভেতর ঢুকতেই অসম্ভব তাপে রুমার চোখ মুখ জ্বালা করে উঠলো। সকাল থেকে সারাদিন গাড়ি বিশাল পার্কিং লটে ছিল, রোদে পুড়ে ভাজা ভাজা হয়েছে। গরমের ভাপে রুমার একবার মনেও হলো, অফিসের ভেতর ঠান্ডা, ফিরে যাই অফিসেই, সন্ধ্যার পর নাহয় বাড়ি ফিরবো। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে গেলো, আজ আগে আগে বাড়ি ফিরতে হবে। রুবাবার স্কুল বাস চলে আসার আগেই রুমাকে বাড়ি পৌঁছাতে হবে।
ইঞ্জিন স্টার্ট করেই রুমা এসি অন করে দিয়েছে, এসি ফ্যানের বাতাসেও আগুনের হলকা। এসি মেশিনে ফ্রিওন কমে গেছে বোধ হয়, ইদানিং সহজে ঠান্ডা হতে চায় না গাড়ি। গরম রুমা সহ্য করতে পারেনা, অল্প গরমেই মাথা ব্যথা করে, বমি পায়। এসি মেশিনে ফ্রিওন ভরা দরকার, রুমা গাড়ি ড্রাইভ করতে পারে, মাঝে মাঝে সাবান পানি দিয়ে গাড়ির বডি ওয়াশ করতে পারে, গাড়িতে গ্যাস নিতে পারে। গাড়ি সার্ভিসিং, নিয়মিত টায়ার বদলের কাজগুলোর জন্য ওকে নাসিমের উপর নির্ভর করতে হয়। নাসিম খুবই মুডি, মেজাজ এই ভাল তোঁ এই খারাপ। মেজাজ ভাল থাকলে নাসিম আরও আগেই এসি ঠিক করিয়ে আনতো, নাসিমের মেজাজ ইদানিং একেবারেই ভালো নেই। একমাত্র সন্তান রুবাবাকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে প্রতিদিন ঝগড়া চলছে।

মেজাজ রুমারও ভাল নেই, আর কত সহ্য করা যায়! বিয়ে হয়েছে প্রায় কুড়ি বছর হয়ে এলো, রুমা মনে করতে পারেনা বিয়ের পর থেকে আজ অবধি তার মন কখনও খুব বেশী ভাল ছিল কিনা।
আব্বা মারা গেলো রুমার দশ বছর বয়সে, ভাইগুলো লেখাপড়া বেশীদুর করতে পারেনি, সংসারের জোয়াল কাঁধে নিতে হয়েছে। আব্বার  রেখে যাওয়া কাপড়ের ব্যবসা নিয়েই বড় দুই ভাইকে হিমশিম খেতে হয়েছে, তবুও একমাত্র বোন রুমার লেখাপড়ায় কোন বাধা দেয়নি। এস এস সি, এইচ এস সিতে রুমা ফার্স্ট ডিভিশান পেয়েছে।
রুমা খুব সুন্দরী ছিল, সুন্দরী বোনের উপর বখাটে ছেলেদের কুদৃষ্টি পড়বার আগেই বড় ভাই আমেরিকাবাসী পাত্রের সন্ধান পেয়ে যায়। সুন্দরী বোনটাকে ভাইয়েরা সেই যে বেড়াল পার করে দিল, ভাইদের কেউ আমেরিকাবাসী পাত্রের স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে খোঁজ খবর নি্লোনা!
উঠ ছেঁড়ি তোর বিয়া লাইগাছে ডাক শুনে রুমা বুঝতেও পারলোনা বিয়ে কি জিনিস, বিয়ে আনন্দের নাকি দুঃখের। সবে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে রুমা, বাপ মরা মেয়ে ভাইদের ঘাড়ে বোঝা হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে গেলো।







বিয়ের সাত দিনের মাথায় রুমাকে ওর বাপের বাড়িতে রেখে নাসিম আমেরিকা চলে এসেছিল, রুমার দেহ মন থেকে লজ্জা, আড়ষ্টতা কাটেনি তখনও। নাসিমের সাথে মন খুলে কথা বলা হয়নি, সবাই বিয়ের পর হানিমুন করে, রুমার হানিমুনও হয়নি। হানিমুনতো হয়নি, বরের সাথে প্রেম-ভালোবাসার কথাও হয়নি। মা বলে দিয়েছিল, আমেরিকান ছেলে্র সাথে আদব কায়দা দেখিয়ে কথা বলতে।

বাসর ঘরে রুমা ভয়েই কাতর ছিল, আমেরিকান ছেলে কি ইংলিশে কথা বলবে? রুমা কখনও ইংলিশে কথা বলেনি, বরের কথার উত্তর দিতে পারবেতো? বাসরঘরে কি বর কঠিন ইংলিশ বলবে? রুমা মনে মনে এটাও ভাবছিল, বরকে আই লাভ ইউ বলা উচিত কিনা।

তোমার নামটা সুন্দর, রুমা, খুব সুন্দর নাম। তুমি দেখতেও খুব সুন্দর। রুমা, তোমাকে একটা কথা বলি, তোমার সাথে বিয়েটা আমার ইচ্ছেতে হয়নি, আমার মাকে খুশী করতে আমাকে বিয়ে করতে হয়েছে---কথাটা যখন নাসিম বলল, রুমা কিছুই না বুঝে যন্ত্রচালিতের মত মাথা ঝুঁকিয়ে আচ্ছা বলেছিল।
রুমার ভয় করছিল, ছেলের অমতে বিয়ে করিয়েছে মা, কাল সকালেই যদি ছেলে ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়, তাহলে কী হবে! রুমা চাইছিল, নাসিম যেন কোনভাবেই রুমার উপর রাগ না করে। মায়ের কথা মনে পড়লো, আমেরিকার ছেলের সাথে আদব কায়দা মেনে কথা বলতে। সত্যিইতো, এই মানুষটার তো দোষ নেই, তার মা জোর করে বিয়ে করিয়ে দিলে সে কী করে মায়ের কথা অমান্য করবে?

না, নাসিম রুমার উপর রাগ করেনি, বাসর রাতে ওদের দুজনের মধ্যে আর কোন কথা হয়নি। নাসিম ঘুমিয়ে পড়েছিল, একবুক ভয় নিয়ে সারারাত জেগে বসেছিল রুমা ভোর হওয়ার অপেক্ষায়।
দুই দিন পর ঘুমের ঘোরে অথবা রুমার রূপের মোহে আকৃষ্ট হয়ে নাসিম রুমাকে আদর সোহাগ করেছিল। আঠারো বছরের তরুণী আমেরিকা ফেরত ছেলের বুকের ভেতর লেপ্টে থেকে ভাবছিল, আহারে! কত ভালো মানুষটা, মা জোর করে বিয়ে করিয়েছে, তবুও রুমাকে কত আদর করছে।

পরের রাতে আদর সোহাগে গলে রুমা জিজ্ঞেস করলো, আমি আপনাকে কী বলে ডাকবো?
নাসিম বলেছিল, আমাকে তুমি পাবেই কতক্ষণ যে ডাকাডাকি করবে? আমি চলে যাচ্ছি।
রুমা সাথে সাথে সাবধান হয়ে গেছে, আবারও মাথা ঝুঁকিয়ে বলেছে, আচ্ছা
নাসিম বলল, শোন রুমা, চারদিন পরেই আমি আমেরিকা ফিরে যাচ্ছি। তোমাকে একটি সত্যি কথা বলি, আমেরিকায় আমার গার্ল ফ্রেন্ড আছে। ওর নাম মনিকা, মনিকাকে ছাড়া আমি বাঁচবোনা। মা আমাকে মিথ্যে কথা বলে দেশে এনেছে, এরপর জোর করে তোমার সাথে বিয়ে করিয়ে দিলো। আমি ফিরে গিয়েই আবার মনিকার সাথে থাকবো। আমি কিন্তু তোমাকে ঠকাতে চাইনি, আমার খুব খারাপ লাগছে তোমাকে দুঃখ দিয়ে। তবুও একটাই শান্তি, তোমার কাছে কিছুই লুকালাম না।

রুমা জিজ্ঞেস করলো, মনিকা ম্যাডাম কি খুব সুন্দর?

নাসিম ফিক করে হেসে দিল, মনিকা সুন্দর, তবে তোমার কাছে কিছুই না, তুমি খুব সুন্দর, আমার মায়ের পছন্দ ভাল। কিন্তু মনিকার সাথে আমার সম্পর্ক সাত বছর যাবৎ, ওকে ছাড়তে পারবোনা।
রুমা বলল, আপনার মা জানেনা মনিকা ম্যাডামের কথা?
নাসিম বলল, মা জানে বলেই তো আমাকে শরীর খারাপের মিথ্যে সংবাদ দিয়ে দেশে এনে বিয়ে করিয়ে দিল। মা ভেবেছে, সুন্দরী বউ পেলে ছেলে তার প্রেমিকাকে ভুলে যাবে।

রুমা বলল, আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?

নাসিম বলল, তোমার উপর রাগ করিনি। তোমার ভাইয়েরা চেয়েছে বোন আমেরিকা যাক। আচ্ছা, সব কথা জানার পরও কি তোমার ইচ্ছে করবে আমেরিকা যেতে?

রুমার খুব ভয় করছিল, এখন যদি মানুষটা বলে, তোমাকে আমেরিকা নেয়া যাবেনা, তাহলে ভাইয়ারা ওর দোষ দিবে
ঢোঁক গিলে রুমা বলল, আপনি যদি আমাকে আমেরিকা না নেন, তাইলে আশেপাশের মাইনষে আমার নামে বদনাম দিবে। আমার এই বয়স পর্যন্ত কেউ আমার নামে একটাও খারাপ কথা কইতে পারে নাই। এবার বলবে

আই অ্যাম রিয়েলি সরি রুমা। যাকগে, তুমি যদি চাও আমি ফিরে গিয়ে কাগজপত্র পাঠিয়ে দেব, তুমি কিন্তু জানলে মনিকার সাথে আমার সম্পর্কের কথা, তবুও তুমি যাবে কিনা বলো।
- আমার চাওয়া না চাওয়ায় কি আসে যায়। ভাইদের সম্মান বাঁচাতেই আমাকে যাইতে হবে। চিন্তা করবেননা, মনিকা ম্যাডামের কথা আমি কাউকে বলবোনা।
-রুমা, এত কথা শোনার পর আমাকে তোমার ঘেন্না করছেনা?
-জী না, মানুষকে আমি ঘেন্না করিনা। আপনি কোন অন্যায় করেন নাই, প্রেম-ভালোবাসার মধ্যে অন্যায় নাই, আপনার মায়ের উপর রাগ পুইষা রাইখেননা, সবই আমার কপালের লিখন।





নাসিম আমেরিকা ফিরে যাওয়ার পরের তিন বছরে রুমা বি এ পাশ করেছে, স্পোকেন ইংলিশ কোর্স করেছে আর আমেরিকা থেকে কাগজপত্র আসার অপেক্ষায় থেকেছে। নাসিম রুমার ভিসার জন্য কাগজপত্র পাঠিয়েছে, তবে তিন বছরে রুমাকে হাত খরচের জন্য একটি টাকা পাঠায়নি। মাঝে মাঝে ফোন করে জানতে চেয়েছে, কাগজপত্র পেয়েছে কিনা, তবুও একটিবারের জন্যও আই লাভ ইউ বলেনি। রুমার মা মাঝে মাঝেই রুমাকে জিজ্ঞেস করেছে, নাসিম টাকা পাঠায় কিনা। রুমা মিথ্যে করে বলেছে যে সে নিজেই নাসিমকে টাকা পাঠাতে মানা করেছে।

আমেরিকা আসার আগে মাকে জড়িয়ে কয়েকদিন ঘুমিয়েছে রুমা, মায়ের শরীরের গন্ধ একেবারে নিজের সারা গায়ে মাখামাখি করে নিয়েছে, যেন মাকে দেখতে ইচ্ছে করলে, মায়ের জন্য কান্না পেলে নিজের হাত শুঁকে মায়ের গন্ধ নিতে পারে। ভাইদের সাথে খুব ভাল ব্যবহার করেছে, ভাইয়েরা বুঝতেও পারেনি তাদের উপর অভিমান করে রুমা চলে যাচ্ছে। শাশুড়িকে সালাম করার সময় রুমা একটুক্ষণের জন্য ভেঙ্গে পড়েছিল, দ্রুত তা সামলেও নিয়েছে। পাড়া প্রতিবেশীদের সকলেই রুমার সৌভাগ্য নিয়ে কত ইশারা ঠিশারা করে কথা বলেছে। সব কিছুকে পেছনে রেখে রুমা সতেরো বছর আগে চলে আসে আমেরিকা।

আমেরিকার মাটিতে পা দিয়ে রুমার মনে হয়েছিল, তিন বছর পর রুমাকে দেখবে নাসিম, নিশ্চয়ই রুমাকে একটা হাগ দিবে, হাতে আলতো করে চুমো দিবে। অফিস থেকে হয়তো কয়েক দিন ছুটি নিয়েছে, বিয়ের পর হানিমুন হয়নি, রুমার কত শখ ছিল হানিমুনে যাবার। নিশচয়ই রুমাকে নিয়ে হানিমুনে যাবে সুন্দর কোন জায়গায়, রুমা জানে আমেরিকায় অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। বঙ্গবাজার ঘুরে রুমা বেশ কিছু ড্রেস কিনে এনেছে, তিন বছর হলেই কি, রুমার চোখে নাসিম এখনও নতুন বর। আসার আগে রুমার বন্ধু পূরবী রুমাকে একখানা পারফিউম দিয়েছে, রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে ঘাড়ের পাশে, বুকের খাঁজে পারফিউম স্প্রে করার কথা বলে দিয়েছে। পূরবীর কথায় রুমা লজ্জাও পেয়েছে, মনে মনে খুশীও হয়েছে। তিন বছর আগের কয়েকটি রাতের কথা মনে হয়ে দেহে মনে ভালো লাগার শিহরণ জেগেছে।

রুমাকে এয়ারপোর্ট থেকে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে আসার পর নাসিম বলেছিল, আমেরিকা আসতে চেয়েছিলে, চলে এসেছো। তুমি নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত, জামাকাপড় পালটে একটু খাওয়া দাওয়া করে ঘুম দাও। আমি বরং অফিসে যাই, ফিরতে একটু রাত হবে

মা-ভাই, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশীদের কোন দূরে রেখে রুমা এসেছিল স্বামীর কাছে, বিয়ের তিন বছর পর দেখা, রুমার মনে কত স্বপ্ন আঁকা ছিল, রুমাকে দেখেই নাসিম হাসি দিবে, জড়িয়ে ধরবে, আমেরিকায় সকলেই চুমু খায়, নাসিমও খাবে। কিছুই হয়নি রুমার চাওয়া অনুযায়ী, অথচ রুমাকে বিদেশ বিভুঁইয়ে এভাবে একা রেখে নাসিম চলে যাচ্ছে অফিসে? মরীয়া হয়ে রুমা বলেছিল, আমি প্লেনে ঘুমিয়েছি, একটুও ক্লান্ত নই, বিশ্বাস করো আমি ক্লান্ত নই

নাসিম আর কোন কথা বললোনা, জুতোতে পা গলিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। রুমা মানুষকে ঘেন্না করেনা, কিন্তু আজ নাসিমকে ঘেন্না করলো, মনে মনেই এক দলা থুতু নাসিমের মুখের উপর ছুঁড়ে দিল। নাসিম তা দেখতে পেলোনা, দেখলোনা বাংলাদেশ থেকে আসা মেয়েটি কেমন চোখ কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।




দুই

দিন থেকেই মনটায় অশান্তির ঝড় বয়ে যাচ্ছে। একমাত্র সন্তান রুবাবাকে নিয়ে অশান্তি, রুবাবার নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা। এত অস্থির মন নিয়ে হাইওয়েতে গাড়ি চালাতেও ভয় লাগে। গত পরশু স্পীডের কারণে পুলিশের টিকেট পেয়েছে, আনমনা হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল রুমা, স্পীড কখন উঠে গেছে খেয়াল করেনি। রুমার কপালটাই খারাপ, এর চেয়েও অনেক বেশী স্পীডে কত গাড়ি পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে ছুটে যায়, তাদেরকে পুলিশ টিকিট দেয়না, টিকিট দেয় রুমার মত পোড়াকপালিকে। টিকেটে কত জরিমানা করেছে তা এখনও জানা হয়নি, আর কয়দিন পরেই মেইল আসবে। মেইলেই সব হিসেব নিকেশ দেয়া থাকবে। মেইল নাসিমের চোখে না পড়লেই হয়, নাসিম জানতে পারলে সমস্যা হবে।

আজ রুমা গাড়ির স্পীডোমিটারের দিকে কড়া নজর রেখেছে। জীবন কত বিচিত্র, কোথাকার এক ছোট্ট পাড়া গাঁয়ের মেয়ে রুমা, বাপ মরা মেয়ে রুমা, মা-ভাইয়ের আদরের কন্যা রুমা, আমেরিকার রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছে। রুমার একটু হাসি পেলো কি!

রুমার পুতুলের মত দেখতে মেয়েটা বাবা-মায়ের উপর রাগ করে ব্লেড দিয়ে হাতের চামড়া ক্ষত বিক্ষত করে ফেলছে, মেয়ের স্কুলের প্রিন্সিপাল সেদিন রুমাকে ডেকে বলেছে, সন্তানের প্রতি সজাগ দৃষ্টি না রাখতে পারলে রুমার মেয়েকে ওরা নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নিবে।
রুমা আবার একটু হেসে ফেললো কি! হাসলো ঠিকই, অসহায়ত্বের হাসি। মার পোড়েনা মাসির দরদ এদের। মা যত্ন নিতে পারেনা মেয়ের, ওরা যত্ন নিবে। নিয়ে যাও, নিয়ে খুব যত্ন করো, বিশাল মানুষ বানিয়ে দাও, আমি রুবাবার মা নই, আমি রুবাবার কেউ নই, আমি পারছিনা মেয়েকে মানুষ করতে, তোমরাই মানুষ করে দাও

রুমার দুই চোখ বেয়ে জলের ধারা নামছে, এখন রুমা হাসছেনা, এখন রুমা কাঁদছেওনা, চোখের জলের উপর ওর নিয়ন্ত্রণ নেই তাই জল বেরিয়ে যাচ্ছে শুধু।

বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর পার্কিং লটে ঢুকে গেলো রুমা। ছত্রিশটি অ্যাপার্টমেন্টের জন্য ছত্রিশটি পার্কিং আইল। রুমা আঠারো নাম্বার পার্কিং আইলে গাড়ি পার্ক করে সাথে সাথে গাড়ি থেকে নামলোনা, স্টিয়ারিং পার্কিং এ দিয়ে চুপ করে বসে থাকলো। টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে আলতো করে চোখের জলের দাগ মুছে ফেললো। নাহলে আবার সেদিনের মত কে কোথা দিয়ে দেখে ফেলবে, শুরু করবে গাড়ির জানালায় টুক টুক, হেলো ম্যাম, এনি প্রবলেম? নিড হেল্প? রুমা চায় না আর কেউ ওর দুঃখগুলো জানুক। কারো কাছ থেকেই করুণা নিতে চায় না, ঘেন্না ধরে গেছে এই জীবনে।

রুবাবার স্কুল বাস আসবার সময় হয়েছে, রুমা দেখতে চায় বাস থেকে রুবাবা একা নামে নাকি সাথে আর কেউ নামে। দিন তিনেক আগে চব্বিশ নাম্বারের মিস থম্পসন রুমাকে হাত ইশারায় কাছে ডেকে বলেছিল, তোমার মেয়েকে আজ দেখলাম সিন্ডির সাথে। সিন্ডি খুব বাজে মেয়ে, ওকে আমি চিনি। মেয়েকে সিন্ডির সাথে মিশতে দিওনা
সিন্ডিকে রুমা চিনে না।
মিস থম্পসন বলল, সিন্ডির মা ড্রাগ ব্যবসা করে, চোরাই মাল বিক্রি করতে গিয়ে কয়েকবার জেলে গেছে। সিন্ডির বাপ কে তা সিন্ডি জানেনা। সিন্ডিও খুব বেশী সুবিধার নয়।

রুবাবাকে নিয়ে রুমা ভীষণ অশান্তিতে আছে। দিন পনেরো আগে রুবাবার স্কুলের প্রিন্সিপাল রুবাবার পেরেন্টসকে ডেকেছিল। রুমাকে একা যেতে হয়েছিল, নাসিম যায়নি প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করতে। নাসিম রুবাবাকে সহ্য করতে পারেনা। নাসিম চায়নি রুবাবা জন্মাক, আমেরিকা আসবার দেড় মাসের মাথায় রুমা কনসিভ করেছিল, নাসিম বলেছিল এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নেয়ার দরকার নেই। ক্লিনিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল অ্যাবর্ট করাতে। ক্লিনিকে গিয়ে সব হারাতে মন সায় দেয়নি রুমার, তাই বলেছিল, আমাদের প্রথম সন্তান আমাদের কাছে আসছে, আমরা ওকে আসতে দেবোনা কেন?
নাসিম হিসহিস করে বলেছিল, তুমি আমেরিকা আসতে চেয়েছিলে, আমেরিকা এনেছি, সব মিটে যাওয়ার কথা। তবু তোমারে সাথে নিয়া ঘুমাই, আদর সোহাগ করি, এর চেয়ে বেশী আর কিছু চেয়োনা। আমার সব কথা তুমি জানো, তোমাকে জানিয়েছিলাম, দেশ থেকে আসার সময় বেশী করে পিল নিয়ে আসতে পারোনি?

একুশ বছর বয়সটা খুব স্পর্শকাতর, নিজের দেয়া প্রাণ কেউ মেরে ফেলতে চায়, পাষন্ড ছাড়া? একুশ বছরের রুমা ঘাড় বাঁকা করে বলেছিল, আমাকে পাশে নিয়ে শোও কারণ আমি তোমার স্ত্রী, আমার গর্ভে যে ঘুমাচ্ছে, সে তোমার দেয়া প্রাণ, তুমি দিয়েছো আমি গ্রহণ করেছি। গ্রহণ করেছি যাকে তাকে ফেলতে পারবোনা।

নাসিম বলেছে, নাটলের সংলাপ শোনাবে না, ঠিক আছে, এই প্রসঙ্গ নিয়ে আর কোনদিন আমার সাথে কথা বলবেনা। মা হওয়ার শখ হয়েছে, নিজ দায়িত্বে মা হবে, বাচ্চা তোমারই থাকবে, আমাকে জড়াবেনা

আহা! কী সব দুঃসহ বেদনার দিন রাত পার করে রুমা আজ এখানে পৌঁছেছে। রুবাবার বয়স ষোল বছর, ওর বাবা ওকে কোনদিন কাছে ডাকেনি, মা বলে ডাক দেয়নি। কোথাও বেড়াতে নেয়নি, ছোট্ট রুবাবা কতদিন বাবার হাত ধরে বায়না করেছে, বার্বি কিনে দাও, মিনি মাউস কিনে দাও, সিনডেরেলা কিনে দাও বলে। নাসিম ছোট্ট রুবাবার হাত সরিয়ে দিয়েছে।


তিন  

রুবাবার স্কুলের প্রিন্সিপাল রুবাবা সম্পর্কে ওর পেরেন্টসের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। রুবাবার পেরেন্টস বলতে একমাত্র রুমা নাসিম কন্যার ভালোমন্দ কোনো কিছুতেই উৎসাহ দেখায় না। নাসিমের একটাই কথা, আমি এত তাড়াতাড়ি সন্তান চাই নাই, তোমার শখ হইছে মা হওয়ার, তা হইছো। এখন মাতৃত্ব দেখাও। মেয়ের ভালোমন্দ নিয়া আমার কোনো চিন্তা নাই তোমার মেয়ে তুমি বুঝব।’

রুমা অবাক হয়ে ভাবে, কোনো বাবা এভাবে কথা বলতে পারে? রুমা কি ইচ্ছে করে মা হয়েছে? রুমা আমেরিকা আসার পরে বিছানায় বেহুঁশের মতো আচরণ কে করেছিল? রুমা, নাকি নাসিম? বাচ্চা কনসিভ করার পর যদি বলা হয়, বাচ্চা নষ্ট করতে হবে, কোনো মেয়ে পারে- হাতে ধরে পেটে আসা সন্তানকে মেরে ফেলতে? নাসিম অনেকবার বলেছিল অ্যাবরশন করিয়ে ফেলতে, রুমা রাজি হয়নি। সেই থেকে নাসি রুমার পর গোসা

রুবাবাকে নাসিম কোনোদিন কোলে তোলেনি, আদর করেনি, একটা খেলনা পর্ন্ত কিনে দেয়নি। ছোট্ট রুবাবা তার বাবার কোলে যাওয়ার জন্য কত কান্নাকাটি করত, নাসিম বাচ্চার হাতটাও ছুঁয়ে দেখত না। রুবাবা কাঁদতো, রুমা কোলে নিয়ে মেয়েকে ভুলানোর চেষ্টা করতো। মায়ের আদর পেয়ে রুবাবার কান্না থেমেও যেত কিন্তু বাবার ব্যবহার ছোট্ট শিশুর মনে কী ভীষণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতো বাইরে থেকে রুমা তা জানতে পারেনি।

বাবার কাছ থেকে এমন ব্যবহার পেয়েই রুবাবা বড় হয়েছে, ওর বয়স এখন ১৬ বছর, দেখতে ফুটফুটে সুন্দর হলে ক হবে, স্বভাবে কিছু পাগলামি আছে। নাইনথ গ্রেডে পড়ে, স্কুল থেকে প্রায়-প্রায়ই কমপ্লেইন আসে। বাবা-মাকে ডাকা হয় বাবা যায় না, মা যায় কাউন্সেলর রুমাকে বলে দেয় রুবাবার প্রতি আরেকটু বেশি মনোযোগী হতে। রুবাবা নাকি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। রুমা বুঝে উঠতে পারে না, রুবাবা কেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে? রুমা ওকে যথাসাধ্য যত্নে বড় করছে।




সেদিন প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করতে গিয়ে প্রথম জানতে পারলো রুমা, রুবাবা ক্লাসে বন্ধুদের সাথে ঝগড়া করে, বন্ধুরা প্রিন্সিপালের কাছে রুবাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। রুবাবা বন্ধুদের এফ ওয়ার্ডে গালি দেয়। স্কুলে এফওয়ার্ড, বি ওয়ার্ড বলা নিষিদ্ধ। বন্ধুরা প্রিন্সিপালের কাছে রুবাবার বিরুদ্ধে গালি দেয়ার অভিযোগের পাশাপাশি এটিও বলে দেয়, রুবাবার ফ্যামিলিতে অশান্তি, রুবাবা নাকি ওদের কাছে বলেছে যে ওর পেরেন্টস খুবই নিষ্ঠুর, ওরা রুবাবার টেক কেয়ার করে না। তাই তার মন-মেজাজ খারাপ থাকে, সব সময় তার ইচ্ছে করে সুইসাইড করতে। এক দুটো করে স্লিপিং টেবলেট জমাচ্ছে ও, সাথে ব্লেডও রাখে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলে মাঝে মাঝেই ব্লেড দিয়ে টেনে টেনে হাতের বিভিন্ন জায়গায় কেটে ফেলে। রক্ত বের হলে নাকি ওর মাথা ঠান্ডা হয়।

অন্য স্টুডেন্টের কাছে এসব অভিযোগ শোনার পর প্রিন্সিপাল রুবাবাকে ডেকেছিলেন, রুবাবার সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, রুবাবা নীরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ও জানিয়েছে, ওদের বাবা-মায়ের মধ্যে একটুও মিল নেই। বাবা কখনো রুবাবাকে নিজের সন্তান বলে স্বীকার করে না। বাবা চায়নি, রুবাবা পৃথিবীতে আসুক মা জোর করে রুবাবাকে এই বাজে পৃথিবীতে এনেছে এখন তাকে নিয়েই বাবা-মা ঝগড়া করে। রুবাবার কারণেই ওর মাকে ওর বাবা প্রায়ই পেটায়। তার বাবা যখন ওর মাকে পেটায়, রুবাবার মরে যেতে ইচ্ছে করে। পাশের ঘরে বসে রুবাবা তখন ব্লেড দিয়ে হাতের চামড়া কেটে ফালা ফালা করে। রুবাবা এও জানিয়েছে, ওর বাবার গার্ল ফ্রেন্ড আছে, সেই গার্ল ফ্রেন্ডের ঘরে ওর বাবার একটা ছেলে আছে, ছেলেটাকে রুবাবা দেখেছে। দশ-বারো বছর বয়স ছেলেটার রুবাবা নিজের চোখে দেখেছে, ছেলের হাত ধরে ওর বাবা আইসক্রিম পার্লারে ঢুকেছে। ওর তখন মরে যেতে ইচ্ছে করেছে, ওকে বাবা কোনদিন আদর করেনি, রুবাবা এই পৃথিবীতে আর থাকতে চায়না, ও এই পৃথিবীটাকেই হেইট করে। মাকে হেইট করে, বাবাকে হেইট করে, বন্ধুদের হেইট করে সবাইকে হেইট করে।

প্রিন্সিপাল যখন এসব কথা বলছিল, রুমা বিশ্বাস করতে পারছিল না। যদিও অভিযোগের প্রায় সবটুকুই সত্য রুমাকে নাসিম প্রায়ই মারধর করে এক বিছানায় ওরা ঘুমায় না অনেক কাল হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে রুমা চায়, নাসিমের পাশে শুতে, নাসিম তা পছন্দ করে না। একদিন নাসিম এমন কথাও বলেছে, তুই যে আমার সঙ্গে শুইতে চাস, কেন চাস? আদর-সোহাগ পাওয়ার জন্য? শরীরের দিকে খেয়াল করছোস? পেটটা ত ঝুলে পড়ছে, যার বুনির চেয়ে পেট বড়, তারে দেখলে কোন বেটার শরীর জাগবো?

সেই থেকে রুমা আর কখনো নাসিমের বিছানার ধারেকাছেও যায়নি। রাতে পাশের ঘরেই ছোট ডিভানে শরীর এলিয়ে দেয়। তবে রুমা জানতেও পারেনি ওর প্রাণের ধন, কলিজার টুকরো পুতুল মেয়েটি মায়ের অপমানের শোধ নিজের পর দিয়ে তুলছে। প্রিন্সিপালের উপস্থিতিতেই রুমা দেখল, রুবাবার ফরসা হাত দুটোর সর্বত্র কাটা দাগ। এত দিন দাগগুলো খেয়াল করেনি কেন? রুবাবার মুখের দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারেনি রুমা। নিজের কালো মুখ মেয়েকে দেখাতে চায়নি।

রুমার সামনেই রুবাবা প্রিন্সিপালের কাছে বলেছে, ওর পেরেন্টস ভালো না, ওকে ভালোবাসেনা। পেরেন্টস  সারাক্ষণ ঝগড়া করে। রুবাবার বাবা এত নোংরা ভাষায় ওর মাকে গালিগালাজ করে যে রুবাবার ইচ্ছে করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। ওর ইচ্ছে করে মরে যেতে। বাবাকে ও ঘেন্না করে, এখন মাকেও ঘেন্না করে।
রুবাবাকে ক্লাসে পাঠিয়ে প্রিন্সিপাল জানালেন, রুবাবা মানসিকভাবে খুবই ডিস্টার্বড। যদি রুমা রুবাবার প্রতি বিশেষ মনোযোগ না দিতে পারে, তাহলে স্কুল কর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে। সোশ্যাল ওয়ার্কারদের সাথে যোগাযোগ করবে, তারা হয়তো রুবাবার সার্বিক নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে রুবাবাকে ওদের কেয়ারে নিয়ে যেতে চাইবে। তেমন যদি ঘটে, রুমার সাধ্য নেই রুবাবাকে নিজের কাছে ধরে রাখার। কারণ, রুবাবাকে নিয়ে রুবাবার বায়োলজিক্যাল ফাদার নাসি্মের কোন আগ্রহ নেই। রুবাবার নিজেরও তার বাবা মায়ের প্রতি এতটুকু রেসপেক্ট বা ভালোবাসা নেই।



চার

প্রিন্সিপালের অফিস থেকে বেরিয়ে রুমা গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে খুব কাঁদছিল। পার্কিং লটে রুবাবাদের ড্রামা টিচার গাড়ি থেকে নামবার সময় রুমাকে ওভাবে দেখে জানালায় নক করেছিল, জানতে চেয়েছিল কোন হেল্প চায় কিনা। সেই টিচারের সাথে রুমার অনেকক্ষণ কথা হয়, সেই টিচারই একজন সাইকিয়াট্রিস্টের নাম বলেন, সেই থেকে রুমাকে অনেক হেল্প করছেন।
রুবাবাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে রুমা নিজেই নিয়ে যায়। সাইকিয়াট্রিস্ট ডঃ রয় খুব ভাল ডাক্তার, বয়স খুব কম। ড্রামা টিচারের ছেলেরও সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম হয়েছিল, ডঃ রয় চিকিৎসা করেছেন, ছেলে এখন মেডিক্যাল স্কুলে থার্ড ইয়ারের ছাত্র। ভদ্রলোক বলেছেন, রুবাবাও ভাল হয়ে যাবে।
সাইকিয়াট্রিস্টের কাছেও রুবাবা একই কথা বলেছে, ওর মা-বাবা নাকি ওকে ভালোবাসেনা, মা-বাবা নিজেরাও সারাদিন ঝগড়া করে, মারামারি করে। ওর এখন আর বাঁচতে ইচ্ছে করেনা। ডঃ রয় চেয়েছিলেন রুবাবার চিকিৎসার পাশাপাশি রুমা এবং নাসিমের সাথেও কথা বলতে। নাসিম আসেনি, আসবেনা বলেছে।
রুমা নাসিমের পায়ে পড়ে কেঁদেছিল, রুবাবাকে বাঁচাতেই হবে বলেছিল।
নাসিম বলেছে, নাটক করবেনা, নাটক আমি পছন্দ করিনা। সারাক্ষণ শুধু নাটক আর নাটক, ড্রামা কুইন, আই হেইট ইউ অল! গেট লস্ট! ধরে নাও, তোমার মেয়ের বাবা মারা গেছে।

ডঃ রয় রুবাবার সাথে অনেক রকমের গল্প করেছেন, রুবাবা ডক্টরের সাথে কথা বলেছে। সপ্তাহে তিন দিন যেতে হয়। ডঃ রয় রুমাকে বলেছে, রুবাবার সমস্যাটা অ্যালার্মিং স্টেজে চলে গেছে, ওকে সারিয়ে তুলতে কিছু সময় লাগবে। এই সময়টুকু ধৈর্য্য হারালে চলবেনা। একেবারে কাছে গিয়ে নয়, একটু আলগা থেকে রুবাবার দিকে নজর রাখতে হবে যেন ওর হাতের কাছে ধারালো কিছু না থাকে। ওর সাথে সব সময় পজিটিভ কথা বলতে হবে, স্বামী স্ত্রীতে কোনরকম বাকবিতন্ডা চলবেনা। রুমাকেই বুঝতে হবে ঠিক কি করলে রুমার স্বামী বিগড়াবেনা। রুমার উচিৎ হবে সমস্ত কাজ রুবাবার ভালো চিন্তা করে করা। সেই থেকে রুমা টিভির দিকে চোখ রেখে রাত তিনটে পর্যন্ত রুবাবার বিছানার পাশে বসে থাকে, রুবাবাও ঘুমায়না, রুমাও ঘুমায়না। রুবাবা চায়না ওর আশেপাশে কেউ থাকুক, এদিকে ডাক্তার বলে দিয়েছে রুবাবার প্রতিটি কাজের ব্যাপারে রুমাকে সজাগ থাকতে।
ডাক্তারের চেম্বারে আরও অনেকের সাথে কথা বলে রুবাবা জেনেছে, টিন এজে পৌঁছে কিছু ছেলেমেয়ে নিজেদেরকে অন্য সবার থেকে আলাদা ভাবতে শুরু করে, তারা জীবনের সবকিছুতে নিগেটিভ দেখে। ওরা কালো পোশাক পছন্দ করে, মেয়েরা লম্বা চুল দিয়ে মুখের একপাশ ঢেকে রাখতে পছন্দ করে, কালো লিপস্টিক, কালো নেলপলিশ ব্যবহার করে।  এদেরকে বলে ইমো, এরা নিউরোসিস সমস্যায় ভুগে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে ওরা আবার ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু যাদের সমস্যা হাত কাটা, রগ কাটা, সুইসাইড করতে চাওয়া পর্যন্ত পৌঁছায়, তারা সাইকোসিস সমস্যায় পৌঁছে যায়, চিকিৎসা না করলে তা ফ্যাটাল হতে পারে। শোনার পর থেকে রুমা রুবাবার ব্যাপারে আরও বেশী সচেতন হয়ে গেছে।



রুবাবা আইপ্যাড কোলে নিয়ে শুয়ে থাকে, রুমা পাশের চেয়ারে বসে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু মন থাকে রুবাবার দিকে। রুবাবা ওর মায়ের সাথে কথা বলেনা, প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়না। সেদিন ইচ্ছে করেই গুণগুণ করছিল,
আই হেইট ইউ অল, গো টু হেল

রুমার বুকের পাঁজরে গিয়ে বিঁধছিল। হঠাত খেয়াল করলো, বিছানার চাদরের যে কোণাটুকু মাটির দিকে ঝুলে আছে, সেখানে কয়েক ফোঁটা তাজা রক্তের দাগ। রুমা লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে রুবাবাকে জাপটে ধরলো, দাও ব্লেড দাও, কোথায় রেখেছো ব্লেড দাও, কোথায় কাটলে বলো, আমি ওষুধ লাগিয়ে দেই

রুবাবা হাসতে হাসতে বলল, ওষুধ লাগবেনা, তোমাকে অবাক করে দিলাম। প্রতি রাতে তুমি আমাকে পাহারা দাও কেন? আমি কি কচি খুকী? তুমি পাহারা ছিলে, দেখো ঠিকই হাত কেটেছি, আমি চাইলে সুইসাইড করতে পারি। তোমরা এত ঝগড়া করো কেন? আমি কি দেখতে পচা ছিলাম? তাহলে বাবা আমাকে কোলে নেয়নি কেন? বাবা আমাকে আনতে স্কুলে যায়নি কখনও, বাবা কেন গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে থাকবে? আমাকে বাবা চায়নি তাহলে বাবার কেন আরেকটি বাচ্চা হলো? তোমরা পচা। আমি তোমাদের সাথে কথা বলবোনা, তোমরা চাওনি আমি পৃথিবীতে আসি, তোমরা খুব বাজে। আমি পৃথিবী থেকে চলে যাব।



গত পাঁচ দিন যাবৎ রুমা রুবাবার পাশে বসেনা, রুবাবার সাথে খুব নরম স্বরে কথা বলে। রুবাবাকে বাঁচার স্বপন দেখায়। নতুন কিছু সৃষ্টির কথা বলে উৎসাহিত করে। রুবাবা উত্তরও দেয়না, আবার রেগেও যায়না। মাঝে মাঝে মনেও হয়, রুবাবা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু পরশুদিন মিস থম্পসন যে বলল সিন্ডির কথা?
ঐ তো স্কুল বাস এসে থেমেছে। বাস থেকে যে মেয়েটা নামলো সে সিন্ডি? রুবাবা কোথায়? রুবাবা নামছেনা কেন? ওমা বাস তো আবার স্টার্ট দিলো, রুবাবা নামলোনা ত!

রুমা স্কুলে ফোন করলো, অফিস তখনও খোলা। অফিসের কেরানী মেয়েটির গলার আওয়াজ সুন্দর, বলল, রুবাবা অফিস রুমে আছে, স্কুল বাস মিস করেছে এক বন্ধুর কারণে। সেই বন্ধুর নাম সিন্ডি। রুবাবা বাথরুমে গেছিল, সিন্ডি ওকে স্কুলে ফেলে রেখেই চলে এসেছে। এখন রুবাবা ওর মায়ের সাথে কথা বলতে চায়।


হ্যালো বলতেই রুবাবা বলল, তোমরা সবাই খারাপ, সবাই আমাকে ঠকায়। সিন্ডি খুব খারাপ, আমি বাথরুমে গেছি, আমাকে না নিয়ে সিন্ডি চলে গেছে। আমি আর কোনদিন সিন্ডির সাথে কথা বলবোনা। তুমি কি একটু আসবে আমাকে নিয়ে যেতে? আমি আর কখনও তোমাকে আই হেট ইউ বলবোনা, তুমি আসো, আমাকে নিয়ে যাও। আমার আজকেও মাথা গরম হয়েছে, তবুও ব্লেড দিয়ে হাত কাটিনি। আমি আর হাত কাটবোনা, তুমি আসো।