Saturday, January 13, 2018

কুয়াশা কুয়াশা দৃষ্টি ( ছুটকি গহনা, ছোট্ট লকেট)!


সোনাদানা-হীরে-জহরতের প্রতি নারীর যে প্রকৃতি নির্ধারিত টান থাকে, প্রকৃতির এই আশীর্বাদ থেকে আমরা চার প্রজন্ম ধরে বঞ্চিত হয়েছি। দিদিমা--মা--আমি--আমার তিন কন্যার কেউই সোনারূপার প্রতি কোন আকর্ষণ বোধ করিনা। ভারী ভারী সোনার গহনা আমাদের কারোর গায়ে সয়না বলে সোনার গয়না পড়িওনা। তাই বলে দু'একটা গহনা থাকবেনা, তাতো হতে পারেনা।
আমার বিয়ে হয়েছে মায়ের গহনা দিয়ে, বিয়ের পর ওগুলো যত্ন করে রেখে দিয়েছি, এক সময় কি মনে হয়েছে, সজ্ঞানেই গয়নাগুলো তিন মেয়ের বিয়ের জন্য আলাদা বক্সে ভাগ করে রেখে দিয়েছি। বিয়ের গয়নাগুলো মেয়েদের নামে ভাগ করে দেয়ার পর ওগুলোর প্রতি আমি আর কোন দাবী রাখিনি, ওগুলো আর আমার সম্পদ নয়।
দাম্পত্য জীবনের স্বর্ণযুগে, যখন আমরা একটু টাকাপয়সার মুখ দেখেছিলাম, ঠিক তখন আমার উত্তম মায়ানমার থেকে আমার জন্য 'রুবী' পাথরে তৈরী কানের ফুল, লকেট এবং আংটির একখানি সেট নিয়ে এসেছিল। তারও আগে যখন অস্ট্রেলিয়া ছিলাম, তখন পয়সা কম ছিল, দেশে ফেরার আগে টুনটুনির কানাকড়ি থেকে কিছু খরচ করে ছোট ছোট চারটি 'ওপাল' কিনেছিলাম। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে আসার পর, সেই ওপাল দিয়ে কানের টপ, লকেট এবং একটি আংটি্র সেট বানিয়েছিলাম। একই সময়ে মুক্তো বসিয়েও কানের টপ, লকেট আর আংটির আরেকটি সেট বানিয়েছিলাম। এই তিন সেট গহনাকে নাম দিয়েছিলাম , 'ছুটকী গহনা"।
'ছুটকি গহনা' বানানোই সার, অভ্যাস নেই তো, তাই ব্যবহার করিনি, যেখানে সেখানে অবহেলা ভরে ফেলে রেখেছিলাম। গত বছর ক্রীসমাসের ছুটিতে আমার বোন টুম্পা বেড়াতে এসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছুটকী ছুটকী গহনাগুলো গুছিয়ে রেখে গেছে। আমি জানতেও চাইনি কোথায় রেখে গেছে। আজ কি মনে হলো, পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেলো, সেই স্বল্প সময়ের বড়লোকী জীবনের কথা মনে হতেই ছুটকী গহনা গুলোর কথা মনে হলো, বিশেষ করে মায়ানমার থেকে উত্তমের নিয়ে আসা 'রুবী'র সেটটির কথা।
এই ব্যাগ খুলি, নেই, ঐ ঝুড়ি খুলি, নেই। এই ড্রয়ার খুলি নেই, কোথাও নেই। টুম্পার কাজ খুব পাকা, জানতাম আমি যেখানে খুঁজছি, টুম্পা সেখানে রাখবেনা। তবুও খুঁজেই চলছিলাম। না পেয়ে কেন জানি কান্না পেয়ে গেলো, গহনার শোকে নয়, উত্তমের দেয়া উপহার খুঁজে পাচ্ছিলামনা, এই শোকেই দিশেহারা ছিলাম। টুম্পাকে ফোন দিইয়ে একটা ধ্যাতানী দেবো ভেবেই ফোন হাতে নিয়েছিলাম, হঠাৎ করেই একটা ছোট ব্যাগের দিকে নজর গেল, সেখানে পেলাম সেই বড়লোক সময়ে পাওয়া উপহার 'ছুটকী ছুটকী' গহনা, রুবী, ওপাল, মুক্তো দিইয়ে তৈরী ছুটকী গহনা, ফিরে এলো আমার সেই সোনালী দিনের স্মৃতি, যখন আমরা উত্তরার বাড়ীতে ছিলাম, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সদা ব্যস্ত ছিলাম, যখন চারদিকে প্রাণ ছিল, আনন্দের জোয়ার ছিল, বেঁচে থাকায় সুখ ছিল। ছুটকী গহনাগুলোকেও কত দামী মনে হতো, সেগুলোর মূল্য এখনও একই আছে, কেবল প্রকৃতি সোনাদানা-হীরে জহরতের মোহনীয় টান থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।
ছুটকি গহনার ছোট ব্যাগের মুখ বাঁধতে যাব, কোথা থেকে যে সেই লকেট উঁকী দিল, আমি থ হয়ে গেলাম। আজ শুধুই ফিরে যাওয়া, অতীতে ফিরে যাওয়া। আমি যেবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, আমার মা আমার জন্য গলার চেন, সাথে ছোট লকেট গড়িয়ে দিল। কেন এটি করা হয়েছিল জানিনা, তবে লকেটটি আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। কি ঝলমলে পাথর, সেই লকেটটি কোথায় ছিল, তাইতো জানতামনা। আজ সে আমার কাছে ধরা দিল, নতুন রূপে, নতুন মায়ায়। ( জানুয়ারী, ২০১৪ ফেসবুক স্ট্যাটাস)No automatic alt text available.

1 comment:

  1. তোমার কাছ থেকে কত কিছু জানলাম ‍দিদি। তোমার স্মৃতি গুলো সত্যি সোনালী সময়।

    ReplyDelete