অফিস থেকে আজ একটু আগেই বেরিয়েছে রুমা,
জুলাইয়ের শেষ, বাইরে অসম্ভব গরম, গায়ে ফোস্কা পড়ার মত অবস্থা। দরজার লক খুলে গাড়ির
ভেতর ঢুকতেই অসম্ভব তাপে রুমার চোখ মুখ জ্বালা করে উঠলো। সকাল থেকে সারাদিন গাড়ি
বিশাল পার্কিং লটে ছিল, রোদে পুড়ে ভাজা ভাজা হয়েছে। গরমের ভাপে রুমার একবার মনেও
হলো, “অফিসের ভেতর ঠান্ডা, ফিরে যাই অফিসেই, সন্ধ্যার পর নাহয়
বাড়ি ফিরবো”। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে গেলো, আজ আগে আগে বাড়ি ফিরতে
হবে। রুবাবার স্কুল বাস চলে আসার আগেই রুমাকে বাড়ি পৌঁছাতে হবে।
ইঞ্জিন স্টার্ট করেই রুমা এসি অন করে দিয়েছে,
এসি ফ্যানের বাতাসেও আগুনের হলকা। এসি মেশিনে ফ্রিওন কমে গেছে বোধ হয়, ইদানিং সহজে
ঠান্ডা হতে চায় না গাড়ি। গরম রুমা সহ্য করতে পারেনা, অল্প গরমেই মাথা ব্যথা করে,
বমি পায়। এসি মেশিনে ফ্রিওন ভরা দরকার, রুমা গাড়ি ড্রাইভ করতে পারে, মাঝে মাঝে
সাবান পানি দিয়ে গাড়ির বডি ওয়াশ করতে পারে, গাড়িতে গ্যাস নিতে পারে। গাড়ি
সার্ভিসিং, নিয়মিত টায়ার বদলের কাজগুলোর জন্য ওকে নাসিমের উপর নির্ভর করতে হয়।
নাসিম খুবই মুডি, মেজাজ এই ভাল তোঁ এই খারাপ। মেজাজ ভাল থাকলে নাসিম আরও আগেই এসি
ঠিক করিয়ে আনতো, নাসিমের মেজাজ ইদানিং একেবারেই ভালো নেই। একমাত্র সন্তান রুবাবাকে
নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে প্রতিদিন ঝগড়া চলছে।
মেজাজ রুমারও ভাল নেই, আর কত সহ্য করা
যায়! বিয়ে হয়েছে প্রায় কুড়ি বছর হয়ে এলো, রুমা মনে করতে পারেনা বিয়ের পর থেকে আজ
অবধি তার মন কখনও খুব বেশী ভাল ছিল কিনা।
আব্বা মারা গেলো রুমার দশ বছর বয়সে,
ভাইগুলো লেখাপড়া বেশীদুর করতে পারেনি, সংসারের জোয়াল কাঁধে নিতে হয়েছে।
আব্বার রেখে যাওয়া কাপড়ের ব্যবসা নিয়েই বড়
দুই ভাইকে হিমশিম খেতে হয়েছে, তবুও একমাত্র বোন রুমার লেখাপড়ায় কোন বাধা দেয়নি। এস
এস সি, এইচ এস সিতে রুমা ফার্স্ট ডিভিশান পেয়েছে।
রুমা খুব সুন্দরী ছিল, সুন্দরী বোনের উপর
বখাটে ছেলেদের কুদৃষ্টি পড়বার আগেই বড় ভাই আমেরিকাবাসী পাত্রের সন্ধান পেয়ে যায়।
সুন্দরী বোনটাকে ভাইয়েরা সেই যে বেড়াল পার করে দিল, ভাইদের কেউ আমেরিকাবাসী
পাত্রের স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে খোঁজ খবর নি্লোনা!
উঠ ছেঁড়ি তোর বিয়া লাইগাছে’ ডাক শুনে রুমা বুঝতেও পারলোনা বিয়ে কি জিনিস, বিয়ে আনন্দের নাকি দুঃখের। সবে
ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে রুমা, বাপ মরা মেয়ে ভাইদের ঘাড়ে বোঝা হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে
গেলো।
বিয়ের সাত দিনের মাথায় রুমাকে ওর বাপের
বাড়িতে রেখে নাসিম আমেরিকা চলে এসেছিল, রুমার দেহ মন থেকে লজ্জা, আড়ষ্টতা কাটেনি
তখনও। নাসিমের সাথে মন খুলে কথা বলা হয়নি, সবাই বিয়ের পর হানিমুন করে, রুমার
হানিমুনও হয়নি। হানিমুনতো হয়নি, বরের সাথে প্রেম-ভালোবাসার কথাও হয়নি। মা বলে
দিয়েছিল, আমেরিকান ছেলে্র সাথে আদব কায়দা দেখিয়ে কথা বলতে।
বাসর ঘরে রুমা ভয়েই কাতর ছিল, আমেরিকান
ছেলে কি ইংলিশে কথা বলবে? রুমা কখনও ইংলিশে কথা বলেনি, বরের কথার উত্তর দিতে
পারবেতো? বাসরঘরে কি বর কঠিন ইংলিশ বলবে? রুমা মনে মনে এটাও ভাবছিল, বরকে ‘আই লাভ ইউ’ বলা উচিত কিনা।
“তোমার নামটা সুন্দর, রুমা, খুব সুন্দর নাম। তুমি দেখতেও খুব
সুন্দর। রুমা, তোমাকে একটা কথা বলি, তোমার সাথে বিয়েটা আমার ইচ্ছেতে হয়নি, আমার মা’কে খুশী করতে আমাকে বিয়ে করতে হয়েছে”---কথাটা যখন
নাসিম বলল, রুমা কিছুই না বুঝে যন্ত্রচালিতের মত মাথা ঝুঁকিয়ে ‘আচ্ছা’ বলেছিল।
রুমার ভয় করছিল, ছেলের অমতে বিয়ে করিয়েছে
মা, কাল সকালেই যদি ছেলে ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়, তাহলে কী হবে! রুমা চাইছিল, নাসিম
যেন কোনভাবেই রুমার উপর রাগ না করে। মায়ের কথা মনে পড়লো, আমেরিকার ছেলের সাথে আদব
কায়দা মেনে কথা বলতে। সত্যিইতো, এই মানুষটার তো দোষ নেই, তার মা জোর করে বিয়ে
করিয়ে দিলে সে কী করে মায়ের কথা অমান্য করবে?
না, নাসিম রুমার উপর রাগ করেনি, বাসর
রাতে ওদের দুজনের মধ্যে আর কোন কথা হয়নি। নাসিম ঘুমিয়ে পড়েছিল, একবুক ভয় নিয়ে
সারারাত জেগে বসেছিল রুমা ভোর হওয়ার অপেক্ষায়।
দুই দিন পর ঘুমের ঘোরে অথবা রুমার রূপের
মোহে আকৃষ্ট হয়ে নাসিম রুমাকে আদর সোহাগ করেছিল। আঠারো বছরের তরুণী আমেরিকা ফেরত
ছেলের বুকের ভেতর লেপ্টে থেকে ভাবছিল, আহারে! কত ভালো মানুষটা, মা জোর করে বিয়ে
করিয়েছে, তবুও রুমাকে কত আদর করছে।
পরের রাতে আদর সোহাগে গলে রুমা জিজ্ঞেস
করলো, “ আমি আপনাকে কী বলে ডাকবো?”
নাসিম বলেছিল, “আমাকে তুমি পাবেই কতক্ষণ যে ডাকাডাকি করবে? আমি চলে যাচ্ছি।”
রুমা সাথে সাথে সাবধান হয়ে গেছে, আবারও
মাথা ঝুঁকিয়ে বলেছে, ‘আচ্ছা’।
নাসিম বলল, “ শোন রুমা, চারদিন পরেই আমি আমেরিকা ফিরে যাচ্ছি। তোমাকে একটি সত্যি কথা বলি,
আমেরিকায় আমার গার্ল ফ্রেন্ড আছে। ওর নাম মনিকা, মনিকাকে ছাড়া আমি বাঁচবোনা। মা
আমাকে মিথ্যে কথা বলে দেশে এনেছে, এরপর জোর করে তোমার সাথে বিয়ে করিয়ে দিলো। আমি
ফিরে গিয়েই আবার মনিকার সাথে থাকবো। আমি কিন্তু তোমাকে ঠকাতে চাইনি, আমার খুব
খারাপ লাগছে তোমাকে দুঃখ দিয়ে। তবুও একটাই শান্তি, তোমার কাছে কিছুই লুকালাম না।“
রুমা জিজ্ঞেস করলো, “ মনিকা ম্যাডাম কি খুব সুন্দর?”
নাসিম ফিক করে হেসে দিল, “মনিকা সুন্দর, তবে তোমার কাছে কিছুই না, তুমি খুব সুন্দর, আমার মায়ের পছন্দ
ভাল। কিন্তু মনিকার সাথে আমার সম্পর্ক সাত বছর যাবৎ, ওকে ছাড়তে পারবোনা।
রুমা বলল, “ আপনার মা জানেনা মনিকা ম্যাডামের কথা?”
নাসিম বলল, “ মা জানে বলেই তো আমাকে শরীর খারাপের মিথ্যে সংবাদ দিয়ে দেশে এনে বিয়ে করিয়ে
দিল। মা ভেবেছে, সুন্দরী বউ পেলে ছেলে তার প্রেমিকাকে ভুলে যাবে।“
রুমা বলল, “ আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?”
নাসিম বলল, “ তোমার উপর রাগ করিনি। তোমার ভাইয়েরা চেয়েছে বোন আমেরিকা যাক। আচ্ছা, সব কথা
জানার পরও কি তোমার ইচ্ছে করবে আমেরিকা যেতে?
রুমার খুব ভয় করছিল, এখন যদি মানুষটা
বলে, “তোমাকে আমেরিকা নেয়া যাবেনা, তাহলে ভাইয়ারা ওর দোষ দিবে”।
ঢোঁক গিলে রুমা বলল, “ আপনি যদি আমাকে আমেরিকা না নেন, তাইলে আশেপাশের মাইনষে আমার নামে বদনাম দিবে।
আমার এই বয়স পর্যন্ত কেউ আমার নামে একটাও খারাপ কথা কইতে পারে নাই। এবার বলবে”।
“আই অ্যাম রিয়েলি সরি রুমা। যাকগে, তুমি যদি চাও আমি ফিরে গিয়ে
কাগজপত্র পাঠিয়ে দেব, তুমি কিন্তু জানলে মনিকার সাথে আমার সম্পর্কের কথা, তবুও
তুমি যাবে কিনা বলো।”।
- আমার চাওয়া না চাওয়ায় কি আসে যায়।
ভাইদের সম্মান বাঁচাতেই আমাকে যাইতে হবে। চিন্তা করবেননা, মনিকা ম্যাডামের কথা আমি
কাউকে বলবোনা।
-রুমা, এত কথা শোনার পর আমাকে তোমার
ঘেন্না করছেনা?
-জী না, মানুষকে আমি ঘেন্না করিনা। আপনি
কোন অন্যায় করেন নাই, প্রেম-ভালোবাসার মধ্যে অন্যায় নাই, আপনার মায়ের উপর রাগ
পুইষা রাইখেননা, সবই আমার কপালের লিখন।
নাসিম আমেরিকা ফিরে যাওয়ার পরের তিন বছরে
রুমা বি এ পাশ করেছে, স্পোকেন ইংলিশ কোর্স করেছে আর আমেরিকা থেকে কাগজপত্র আসার
অপেক্ষায় থেকেছে। নাসিম রুমার ভিসার জন্য কাগজপত্র পাঠিয়েছে, তবে তিন বছরে রুমাকে
হাত খরচের জন্য একটি টাকা পাঠায়নি। মাঝে মাঝে ফোন করে জানতে চেয়েছে, কাগজপত্র
পেয়েছে কিনা, তবুও একটিবারের জন্যও “ আই লাভ ইউ” বলেনি। রুমার মা মাঝে মাঝেই রুমাকে জিজ্ঞেস করেছে, নাসিম টাকা পাঠায় কিনা।
রুমা মিথ্যে করে বলেছে যে সে নিজেই নাসিমকে টাকা পাঠাতে মানা করেছে।
আমেরিকা আসার আগে মা’কে জড়িয়ে কয়েকদিন ঘুমিয়েছে রুমা, মায়ের শরীরের গন্ধ একেবারে নিজের সারা গায়ে
মাখামাখি করে নিয়েছে, যেন মা’কে দেখতে ইচ্ছে
করলে, মায়ের জন্য কান্না পেলে নিজের হাত শুঁকে মায়ের গন্ধ নিতে পারে। ভাইদের সাথে
খুব ভাল ব্যবহার করেছে, ভাইয়েরা বুঝতেও পারেনি তাদের উপর অভিমান করে রুমা চলে
যাচ্ছে। শাশুড়িকে সালাম করার সময় রুমা একটুক্ষণের জন্য ভেঙ্গে পড়েছিল, দ্রুত তা
সামলেও নিয়েছে। পাড়া প্রতিবেশীদের সকলেই রুমার সৌভাগ্য নিয়ে কত ইশারা ঠিশারা করে
কথা বলেছে। সব কিছুকে পেছনে রেখে রুমা সতেরো বছর আগে চলে আসে আমেরিকা।
আমেরিকার মাটিতে পা দিয়ে রুমার মনে
হয়েছিল, তিন বছর পর রুমাকে দেখবে নাসিম, নিশ্চয়ই রুমাকে একটা হাগ দিবে, হাতে আলতো
করে চুমো দিবে। অফিস থেকে হয়তো কয়েক দিন ছুটি নিয়েছে, বিয়ের পর হানিমুন হয়নি,
রুমার কত শখ ছিল হানিমুনে যাবার। নিশচয়ই রুমাকে নিয়ে হানিমুনে যাবে সুন্দর কোন
জায়গায়, রুমা জানে আমেরিকায় অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। বঙ্গবাজার ঘুরে রুমা
বেশ কিছু ড্রেস কিনে এনেছে, তিন বছর হলেই কি, রুমার চোখে নাসিম এখনও নতুন বর। আসার
আগে রুমার বন্ধু পূরবী রুমাকে একখানা পারফিউম দিয়েছে, রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে ঘাড়ের
পাশে, বুকের খাঁজে পারফিউম স্প্রে করার কথা বলে দিয়েছে। পূরবীর কথায় রুমা লজ্জাও
পেয়েছে, মনে মনে খুশীও হয়েছে। তিন বছর আগের কয়েকটি রাতের কথা মনে হয়ে দেহে মনে
ভালো লাগার শিহরণ জেগেছে।
রুমাকে এয়ারপোর্ট থেকে নিজের
অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে আসার পর নাসিম বলেছিল, “আমেরিকা আসতে
চেয়েছিলে, চলে এসেছো। তুমি নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত, জামাকাপড় পালটে একটু খাওয়া দাওয়া
করে ঘুম দাও। আমি বরং অফিসে যাই, ফিরতে একটু রাত হবে”।
মা-ভাই, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশীদের কোন
দূরে রেখে রুমা এসেছিল স্বামীর কাছে, বিয়ের তিন বছর পর দেখা, রুমার মনে কত স্বপ্ন
আঁকা ছিল, রুমাকে দেখেই নাসিম হাসি দিবে, জড়িয়ে ধরবে, আমেরিকায় সকলেই চুমু খায়,
নাসিমও খাবে। কিছুই হয়নি রুমার চাওয়া অনুযায়ী, অথচ রুমাকে বিদেশ বিভুঁইয়ে এভাবে
একা রেখে নাসিম চলে যাচ্ছে অফিসে? মরীয়া হয়ে রুমা বলেছিল, “ আমি প্লেনে ঘুমিয়েছি, একটুও ক্লান্ত নই, বিশ্বাস করো আমি ক্লান্ত নই”।
নাসিম আর কোন কথা বললোনা, জুতোতে পা
গলিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। রুমা মানুষকে ঘেন্না করেনা, কিন্তু আজ নাসিমকে ঘেন্না
করলো, মনে মনেই এক দলা থুতু নাসিমের মুখের উপর ছুঁড়ে দিল। নাসিম তা দেখতে পেলোনা,
দেখলোনা বাংলাদেশ থেকে আসা মেয়েটি কেমন চোখ কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
দুই
ক’দিন থেকেই মনটায়
অশান্তির ঝড় বয়ে যাচ্ছে। একমাত্র সন্তান রুবাবাকে নিয়ে অশান্তি, রুবাবার নিরাপত্তা
নিয়ে দুশ্চিন্তা। এত অস্থির মন নিয়ে হাইওয়েতে গাড়ি চালাতেও ভয় লাগে। গত পরশু
স্পীডের কারণে পুলিশের টিকেট পেয়েছে, আনমনা হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল রুমা, স্পীড কখন
উঠে গেছে খেয়াল করেনি। রুমার কপালটাই খারাপ, এর চেয়েও অনেক বেশী স্পীডে কত গাড়ি
পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে ছুটে যায়, তাদেরকে পুলিশ টিকিট দেয়না, টিকিট দেয় রুমার মত
পোড়াকপালিকে। টিকেটে কত জরিমানা করেছে তা এখনও জানা হয়নি, আর কয়দিন পরেই মেইল
আসবে। মেইলেই সব হিসেব নিকেশ দেয়া থাকবে। মেইল নাসিমের চোখে না পড়লেই হয়, নাসিম
জানতে পারলে সমস্যা হবে।
আজ রুমা গাড়ির স্পীডোমিটারের দিকে কড়া
নজর রেখেছে। জীবন কত বিচিত্র, কোথাকার এক ছোট্ট পাড়া গাঁয়ের মেয়ে রুমা, বাপ মরা
মেয়ে রুমা, মা-ভাইয়ের আদরের কন্যা রুমা, আমেরিকার রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছে। রুমার
একটু হাসি পেলো কি!
রুমার পুতুলের মত দেখতে মেয়েটা
বাবা-মায়ের উপর রাগ করে ব্লেড দিয়ে হাতের চামড়া ক্ষত বিক্ষত করে ফেলছে, মেয়ের
স্কুলের প্রিন্সিপাল সেদিন রুমাকে ডেকে বলেছে, সন্তানের প্রতি সজাগ দৃষ্টি না রাখতে
পারলে রুমার মেয়েকে ওরা নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নিবে।
রুমা আবার একটু হেসে ফেললো কি! হাসলো ঠিকই,
অসহায়ত্বের হাসি। মা’র পোড়েনা মাসির দরদ এদের। মা যত্ন নিতে পারেনা মেয়ের, ওরা
যত্ন নিবে। “নিয়ে যাও, নিয়ে খুব যত্ন করো, বিশাল মানুষ বানিয়ে দাও, আমি
রুবাবার মা নই, আমি রুবাবার কেউ নই, আমি পারছিনা মেয়েকে মানুষ করতে, তোমরাই মানুষ
করে দাও”।
রুমার দুই চোখ বেয়ে জলের ধারা নামছে, এখন
রুমা হাসছেনা, এখন রুমা কাঁদছেওনা, চোখের জলের উপর ওর নিয়ন্ত্রণ নেই তাই জল বেরিয়ে
যাচ্ছে শুধু।
বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর পার্কিং
লটে ঢুকে গেলো রুমা। ছত্রিশটি অ্যাপার্টমেন্টের জন্য ছত্রিশটি পার্কিং আইল। রুমা
আঠারো নাম্বার পার্কিং আইলে গাড়ি পার্ক করে সাথে সাথে গাড়ি থেকে নামলোনা,
স্টিয়ারিং পার্কিং এ দিয়ে চুপ করে বসে থাকলো। টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে
আলতো করে চোখের জলের দাগ মুছে ফেললো। নাহলে আবার সেদিনের মত কে কোথা দিয়ে দেখে
ফেলবে, শুরু করবে গাড়ির জানালায় টুক টুক, “ হেলো ম্যাম, এনি
প্রবলেম? নিড হেল্প?” রুমা চায় না আর কেউ ওর দুঃখগুলো জানুক। কারো কাছ থেকেই
করুণা নিতে চায় না, ঘেন্না ধরে গেছে এই জীবনে।
রুবাবার স্কুল বাস আসবার সময় হয়েছে, রুমা
দেখতে চায় বাস থেকে রুবাবা একা নামে নাকি সাথে আর কেউ নামে। দিন তিনেক আগে চব্বিশ
নাম্বারের মিস থম্পসন রুমাকে হাত ইশারায় কাছে ডেকে বলেছিল, “ তোমার মেয়েকে আজ দেখলাম সিন্ডির সাথে। সিন্ডি খুব বাজে মেয়ে, ওকে আমি চিনি।
মেয়েকে সিন্ডির সাথে মিশতে দিওনা”।
সিন্ডিকে রুমা চিনে না।
মিস থম্পসন বলল, সিন্ডির মা ড্রাগ ব্যবসা
করে, চোরাই মাল বিক্রি করতে গিয়ে কয়েকবার জেলে গেছে। সিন্ডির বাপ কে তা সিন্ডি
জানেনা। সিন্ডিও খুব বেশী সুবিধার নয়।
রুবাবাকে নিয়ে রুমা ভীষণ অশান্তিতে আছে।
দিন পনেরো আগে রুবাবার স্কুলের প্রিন্সিপাল রুবাবার পেরেন্টসকে ডেকেছিল। রুমাকে
একা যেতে হয়েছিল, নাসিম যায়নি প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করতে। নাসিম রুবাবাকে সহ্য
করতে পারেনা। নাসিম চায়নি রুবাবা জন্মাক, আমেরিকা আসবার দেড় মাসের মাথায় রুমা
কনসিভ করেছিল, নাসিম বলেছিল এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নেয়ার দরকার নেই। ক্লিনিকে নিয়ে
যেতে চেয়েছিল অ্যাবর্ট করাতে। ক্লিনিকে গিয়ে সব হারাতে মন সায় দেয়নি রুমার, তাই
বলেছিল, “ আমাদের প্রথম সন্তান আমাদের কাছে আসছে, আমরা ওকে আসতে
দেবোনা কেন?”
নাসিম হিসহিস করে বলেছিল, “তুমি আমেরিকা আসতে চেয়েছিলে, আমেরিকা এনেছি, সব মিটে যাওয়ার কথা। তবু তোমারে
সাথে নিয়া ঘুমাই, আদর সোহাগ করি, এর চেয়ে বেশী আর কিছু চেয়োনা। আমার সব কথা তুমি
জানো, তোমাকে জানিয়েছিলাম, দেশ থেকে আসার সময় বেশী করে পিল নিয়ে আসতে পারোনি?”
একুশ বছর বয়সটা খুব স্পর্শকাতর, নিজের
দেয়া প্রাণ কেউ মেরে ফেলতে চায়, পাষন্ড ছাড়া? একুশ বছরের রুমা ঘাড় বাঁকা করে
বলেছিল, “ আমাকে পাশে নিয়ে শোও কারণ আমি তোমার স্ত্রী, আমার গর্ভে যে
ঘুমাচ্ছে, সে তোমার দেয়া প্রাণ, তুমি দিয়েছো আমি গ্রহণ করেছি। গ্রহণ করেছি যাকে
তাকে ফেলতে পারবোনা।“
নাসিম বলেছে, “ নাটলের সংলাপ শোনাবে না, ঠিক আছে, এই প্রসঙ্গ নিয়ে আর কোনদিন আমার সাথে কথা
বলবেনা। মা হওয়ার শখ হয়েছে, নিজ দায়িত্বে মা হবে, বাচ্চা তোমারই থাকবে, আমাকে জড়াবেনা”।
আহা! কী সব দুঃসহ বেদনার দিন রাত পার করে
রুমা আজ এখানে পৌঁছেছে। রুবাবার বয়স ষোল বছর, ওর বাবা ওকে কোনদিন কাছে ডাকেনি, ‘মা’ বলে ডাক দেয়নি। কোথাও বেড়াতে নেয়নি, ছোট্ট রুবাবা কতদিন
বাবার হাত ধরে বায়না করেছে, ‘বার্বি কিনে দাও,
মিনি মাউস কিনে দাও, সিনডেরেলা কিনে দাও” বলে। নাসিম ছোট্ট
রুবাবার হাত সরিয়ে দিয়েছে।
তিন
রুবাবার স্কুলের প্রিন্সিপাল রুবাবা
সম্পর্কে ওর পেরেন্টসের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। রুবাবার পেরেন্টস বলতে একমাত্র
রুমা। নাসিম কন্যার ভালোমন্দ কোনো কিছুতেই উৎসাহ দেখায় না। নাসিমের একটাই কথা, ‘আমি এত তাড়াতাড়ি সন্তান চাই নাই, তোমার শখ হইছে মা হওয়ার, তা হইছো। এখন
মাতৃত্ব দেখাও। মেয়ের ভালোমন্দ নিয়া আমার কোনো চিন্তা নাই। তোমার মেয়ে তুমি বুঝবা।’
রুমা অবাক হয়ে ভাবে, কোনো বাবা এভাবে কথা বলতে পারে? রুমা কি
ইচ্ছে করে মা হয়েছে? রুমা আমেরিকা আসার পরে বিছানায় বেহুঁশের মতো আচরণ কে করেছিল? রুমা, নাকি নাসিম?
বাচ্চা কনসিভ করার পর যদি বলা হয়, বাচ্চা নষ্ট করতে হবে, কোনো মেয়ে পারে- হাতে ধরে পেটে আসা সন্তানকে মেরে ফেলতে? নাসিম
অনেকবার বলেছিল অ্যাবরশন করিয়ে ফেলতে, রুমা রাজি হয়নি। সেই থেকে নাসিম রুমার ওপর গোসা।
রুবাবাকে নাসিম কোনোদিন কোলে তোলেনি, আদর করেনি, একটা খেলনা পর্যন্ত কিনে দেয়নি। ছোট্ট রুবাবা তার বাবার কোলে যাওয়ার জন্য কত
কান্নাকাটি করত, নাসিম বাচ্চার হাতটাও ছুঁয়ে দেখত না। রুবাবা কাঁদতো, রুমা কোলে
নিয়ে মেয়েকে ভুলানোর চেষ্টা করতো। মায়ের আদর পেয়ে রুবাবার কান্না থেমেও যেত কিন্তু
বাবার ব্যবহার ছোট্ট শিশুর মনে কী ভীষণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতো বাইরে থেকে রুমা
তা জানতে পারেনি।
বাবার কাছ থেকে এমন ব্যবহার পেয়েই রুবাবা
বড় হয়েছে, ওর বয়স এখন ১৬ বছর, দেখতে ফুটফুটে সুন্দর হলে কী হবে, স্বভাবে কিছু পাগলামি আছে। নাইনথ গ্রেডে পড়ে, স্কুল থেকে প্রায়-প্রায়ই কমপ্লেইন আসে। বাবা-মাকে ডাকা হয়। বাবা যায় না, মা যায়। কাউন্সেলর রুমাকে বলে দেয় রুবাবার প্রতি আরেকটু বেশি মনোযোগী হতে। রুবাবা নাকি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। রুমা বুঝে
উঠতে পারে না, রুবাবা কেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে? রুমা ওকে যথাসাধ্য যত্নে বড়
করছে।
সেদিন প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করতে গিয়ে
প্রথম জানতে পারলো রুমা, রুবাবা ক্লাসে বন্ধুদের সাথে ঝগড়া করে, বন্ধুরা
প্রিন্সিপালের কাছে রুবাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। রুবাবা বন্ধুদের ‘এফ’ ওয়ার্ডে গালি দেয়। স্কুলে ‘এফ’ ওয়ার্ড, ‘বি’ ওয়ার্ড বলা নিষিদ্ধ। বন্ধুরা প্রিন্সিপালের কাছে রুবাবার বিরুদ্ধে গালি দেয়ার
অভিযোগের পাশাপাশি এটিও বলে দেয়, রুবাবার ফ্যামিলিতে অশান্তি, রুবাবা নাকি ওদের
কাছে বলেছে যে ওর পেরেন্টস খুবই নিষ্ঠুর, ওরা রুবাবার টেক কেয়ার করে না। তাই তার মন-মেজাজ খারাপ থাকে, সব সময় তার ইচ্ছে করে সুইসাইড করতে। এক দুটো করে
স্লিপিং টেবলেট জমাচ্ছে ও, সাথে ব্লেডও রাখে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলে মাঝে মাঝেই
ব্লেড দিয়ে টেনে টেনে হাতের বিভিন্ন জায়গায় কেটে ফেলে। রক্ত বের হলে নাকি ওর মাথা
ঠান্ডা হয়।
অন্য স্টুডেন্টের কাছে এসব অভিযোগ শোনার
পর প্রিন্সিপাল রুবাবাকে ডেকেছিলেন, রুবাবার সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, রুবাবা
নীরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ও জানিয়েছে, ওদের বাবা-মায়ের মধ্যে একটুও মিল নেই। বাবা কখনো রুবাবাকে নিজের সন্তান বলে স্বীকার করে না।
বাবা চায়নি, রুবাবা পৃথিবীতে আসুক। মা জোর করে রুবাবাকে এই বাজে পৃথিবীতে এনেছে। এখন তাকে নিয়েই বাবা-মা ঝগড়া করে। রুবাবার কারণেই ওর মাকে ওর বাবা প্রায়ই পেটায়। তার বাবা যখন ওর মাকে পেটায়, রুবাবার মরে যেতে ইচ্ছে করে। পাশের
ঘরে বসে রুবাবা তখন ব্লেড দিয়ে হাতের চামড়া কেটে ফালা ফালা
করে। রুবাবা এও জানিয়েছে, ওর বাবার গার্ল ফ্রেন্ড আছে, সেই
গার্ল ফ্রেন্ডের ঘরে ওর বাবার একটা ছেলে
আছে, ছেলেটাকে রুবাবা দেখেছে। দশ-বারো বছর বয়স ছেলেটার। রুবাবা নিজের চোখে দেখেছে, ছেলের হাত ধরে ওর বাবা আইসক্রিম
পার্লারে ঢুকেছে। ওর তখন মরে যেতে ইচ্ছে করেছে, ওকে বাবা কোনদিন আদর করেনি, রুবাবা
এই পৃথিবীতে আর থাকতে চায়না, ও এই পৃথিবীটাকেই হেইট করে। মা’কে হেইট করে, বাবাকে হেইট করে, বন্ধুদের হেইট করে সবাইকে হেইট করে।
প্রিন্সিপাল যখন এসব কথা বলছিল, রুমা
বিশ্বাস করতে পারছিল না। যদিও অভিযোগের প্রায় সবটুকুই সত্য। রুমাকে নাসিম প্রায়ই মারধর করে। এক বিছানায় ওরা ঘুমায় না অনেক কাল হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে
রুমা চায়, নাসিমের পাশে শুতে, নাসিম তা পছন্দ করে না। একদিন নাসিম এমন কথাও বলেছে,
‘তুই যে আমার সঙ্গে শুইতে চাস, কেন চাস? আদর-সোহাগ পাওয়ার
জন্য? শরীরের দিকে খেয়াল করছোস? পেটটা ত ঝুলে পড়ছে, যার বুনির চেয়ে পেট বড়, তারে
দেখলে কোন বেটার শরীর জাগবো?’
সেই থেকে রুমা আর কখনো নাসিমের বিছানার ধারেকাছেও যায়নি। রাতে
পাশের ঘরেই ছোট ডিভানে শরীর এলিয়ে দেয়। তবে রুমা জানতেও পারেনি ওর প্রাণের ধন,
কলিজার টুকরো পুতুল মেয়েটি মায়ের অপমানের শোধ নিজের ওপর দিয়ে তুলছে। প্রিন্সিপালের উপস্থিতিতেই রুমা দেখল,
রুবাবার ফরসা হাত দুটোর
সর্বত্র কাটা দাগ। এত দিন দাগগুলো খেয়াল করেনি কেন? রুবাবার মুখের দিকে মুখ তুলে
তাকাতে পারেনি রুমা। নিজের কালো মুখ মেয়েকে দেখাতে চায়নি।
রুমার সামনেই রুবাবা প্রিন্সিপালের কাছে
বলেছে, ওর পেরেন্টস ভালো না, ওকে ভালোবাসেনা। পেরেন্টস সারাক্ষণ ঝগড়া করে। রুবাবার বাবা এত নোংরা
ভাষায় ওর মাকে গালিগালাজ করে যে রুবাবার ইচ্ছে করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। ওর ইচ্ছে
করে মরে যেতে। বাবাকে ও ঘেন্না করে, এখন মাকেও ঘেন্না করে।
রুবাবাকে ক্লাসে পাঠিয়ে প্রিন্সিপাল জানালেন, রুবাবা মানসিকভাবে খুবই
ডিস্টার্বড। যদি রুমা রুবাবার প্রতি বিশেষ মনোযোগ না
দিতে পারে, তাহলে স্কুল কর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে। সোশ্যাল
ওয়ার্কারদের সাথে যোগাযোগ করবে, তারা হয়তো রুবাবার সার্বিক নিরাপত্তার দিক বিবেচনা
করে রুবাবাকে ওদের কেয়ারে নিয়ে যেতে চাইবে। তেমন যদি ঘটে, রুমার সাধ্য নেই
রুবাবাকে নিজের কাছে ধরে রাখার। কারণ, রুবাবাকে নিয়ে রুবাবার বায়োলজিক্যাল ফাদার
নাসি্মের কোন আগ্রহ নেই। রুবাবার নিজেরও তার বাবা মায়ের প্রতি এতটুকু রেসপেক্ট বা
ভালোবাসা নেই।
চার
প্রিন্সিপালের অফিস থেকে বেরিয়ে রুমা
গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে খুব কাঁদছিল। পার্কিং লটে রুবাবাদের ড্রামা টিচার গাড়ি থেকে
নামবার সময় রুমা’কে ওভাবে দেখে জানালায় নক করেছিল, জানতে চেয়েছিল কোন হেল্প
চায় কিনা। সেই টিচারের সাথে রুমার অনেকক্ষণ কথা হয়, সেই টিচারই একজন
সাইকিয়াট্রিস্টের নাম বলেন, সেই থেকে রুমাকে অনেক হেল্প করছেন।
রুবাবাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে রুমা নিজেই
নিয়ে যায়। সাইকিয়াট্রিস্ট ডঃ রয় খুব ভাল ডাক্তার, বয়স খুব কম। ড্রামা টিচারের
ছেলেরও সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম হয়েছিল, ডঃ রয় চিকিৎসা করেছেন, ছেলে এখন মেডিক্যাল
স্কুলে থার্ড ইয়ারের ছাত্র। ভদ্রলোক বলেছেন, রুবাবাও ভাল হয়ে যাবে।
সাইকিয়াট্রিস্টের কাছেও রুবাবা একই কথা
বলেছে, ওর মা-বাবা নাকি ওকে ভালোবাসেনা, মা-বাবা নিজেরাও সারাদিন ঝগড়া করে,
মারামারি করে। ওর এখন আর বাঁচতে ইচ্ছে করেনা। ডঃ রয় চেয়েছিলেন রুবাবার চিকিৎসার
পাশাপাশি রুমা এবং নাসিমের সাথেও কথা বলতে। নাসিম আসেনি, আসবেনা বলেছে।
রুমা নাসিমের পায়ে পড়ে কেঁদেছিল,
রুবাবাকে বাঁচাতেই হবে বলেছিল।
নাসিম বলেছে, “ নাটক করবেনা, নাটক আমি পছন্দ করিনা। সারাক্ষণ শুধু নাটক আর নাটক, ড্রামা
কুইন, আই হেইট ইউ অল! গেট লস্ট! ধরে নাও, তোমার মেয়ের বাবা মারা গেছে।”
ডঃ রয় রুবাবার সাথে অনেক রকমের গল্প
করেছেন, রুবাবা ডক্টরের সাথে কথা বলেছে। সপ্তাহে তিন দিন যেতে হয়। ডঃ রয় রুমাকে
বলেছে, রুবাবার সমস্যাটা অ্যালার্মিং স্টেজে চলে গেছে, ওকে সারিয়ে তুলতে কিছু সময়
লাগবে। এই সময়টুকু ধৈর্য্য হারালে চলবেনা। একেবারে কাছে গিয়ে নয়, একটু আলগা থেকে
রুবাবার দিকে নজর রাখতে হবে যেন ওর হাতের কাছে ধারালো কিছু না থাকে। ওর সাথে সব
সময় পজিটিভ কথা বলতে হবে, স্বামী স্ত্রীতে কোনরকম বাকবিতন্ডা চলবেনা। রুমাকেই
বুঝতে হবে ঠিক কি করলে রুমার স্বামী বিগড়াবেনা। রুমার উচিৎ হবে সমস্ত কাজ রুবাবার
ভালো চিন্তা করে করা। সেই থেকে রুমা টিভির দিকে চোখ রেখে রাত তিনটে পর্যন্ত
রুবাবার বিছানার পাশে বসে থাকে, রুবাবাও ঘুমায়না, রুমাও ঘুমায়না। রুবাবা চায়না ওর
আশেপাশে কেউ থাকুক, এদিকে ডাক্তার বলে দিয়েছে রুবাবার প্রতিটি কাজের ব্যাপারে
রুমাকে সজাগ থাকতে।
ডাক্তারের চেম্বারে আরও অনেকের সাথে কথা
বলে রুবাবা জেনেছে, টিন এজে পৌঁছে কিছু ছেলেমেয়ে নিজেদেরকে অন্য সবার থেকে আলাদা
ভাবতে শুরু করে, তারা জীবনের সবকিছুতে নিগেটিভ দেখে। ওরা কালো পোশাক পছন্দ করে,
মেয়েরা লম্বা চুল দিয়ে মুখের একপাশ ঢেকে রাখতে পছন্দ করে, কালো লিপস্টিক, কালো
নেলপলিশ ব্যবহার করে। এদেরকে বলে ‘ইমো’, এরা নিউরোসিস সমস্যায় ভুগে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে ওরা আবার
ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু যাদের সমস্যা হাত কাটা, রগ কাটা, সুইসাইড করতে চাওয়া পর্যন্ত
পৌঁছায়, তারা সাইকোসিস সমস্যায় পৌঁছে যায়, চিকিৎসা না করলে তা ফ্যাটাল হতে পারে।
শোনার পর থেকে রুমা রুবাবার ব্যাপারে আরও বেশী সচেতন হয়ে গেছে।
রুবাবা আইপ্যাড কোলে নিয়ে শুয়ে থাকে,
রুমা পাশের চেয়ারে বসে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু মন থাকে রুবাবার দিকে।
রুবাবা ওর মায়ের সাথে কথা বলেনা, প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়না। সেদিন ইচ্ছে করেই
গুণগুণ করছিল,
“আই হেইট ইউ অল, গো টু হেল”।
রুমার বুকের পাঁজরে গিয়ে বিঁধছিল। হঠাত
খেয়াল করলো, বিছানার চাদরের যে কোণাটুকু মাটির দিকে ঝুলে আছে, সেখানে কয়েক ফোঁটা
তাজা রক্তের দাগ। রুমা লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে রুবাবাকে জাপটে ধরলো, “ দাও ব্লেড দাও, কোথায় রেখেছো ব্লেড দাও, কোথায় কাটলে বলো, আমি ওষুধ লাগিয়ে
দেই”।
রুবাবা হাসতে হাসতে বলল, “ওষুধ লাগবেনা, তোমাকে অবাক করে দিলাম। প্রতি রাতে তুমি আমাকে পাহারা দাও কেন?
আমি কি কচি খুকী? তুমি পাহারা ছিলে, দেখো ঠিকই হাত কেটেছি, আমি চাইলে সুইসাইড করতে
পারি। তোমরা এত ঝগড়া করো কেন? আমি কি দেখতে পচা ছিলাম? তাহলে বাবা আমাকে কোলে
নেয়নি কেন? বাবা আমাকে আনতে স্কুলে যায়নি কখনও, বাবা কেন গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে
থাকবে? আমাকে বাবা চায়নি তাহলে বাবার কেন আরেকটি বাচ্চা হলো? তোমরা পচা। আমি
তোমাদের সাথে কথা বলবোনা, তোমরা চাওনি আমি পৃথিবীতে আসি, তোমরা খুব বাজে। আমি
পৃথিবী থেকে চলে যাব।”
গত পাঁচ দিন যাবৎ রুমা রুবাবার পাশে
বসেনা, রুবাবার সাথে খুব নরম স্বরে কথা বলে। রুবাবাকে বাঁচার স্বপন দেখায়। নতুন
কিছু সৃষ্টির কথা বলে উৎসাহিত করে। রুবাবা উত্তরও দেয়না, আবার রেগেও যায়না। মাঝে
মাঝে মনেও হয়, রুবাবা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু পরশুদিন মিস থম্পসন যে বলল সিন্ডির
কথা?
ঐ তো স্কুল বাস এসে থেমেছে। বাস থেকে যে
মেয়েটা নামলো সে সিন্ডি? রুবাবা কোথায়? রুবাবা নামছেনা কেন? ওমা বাস তো আবার
স্টার্ট দিলো, রুবাবা নামলোনা ত!
রুমা স্কুলে ফোন করলো, অফিস তখনও খোলা।
অফিসের কেরানী মেয়েটির গলার আওয়াজ সুন্দর, বলল, ‘রুবাবা অফিস রুমে
আছে, স্কুল বাস মিস করেছে এক বন্ধুর কারণে। সেই বন্ধুর নাম সিন্ডি। রুবাবা বাথরুমে
গেছিল, সিন্ডি ওকে স্কুলে ফেলে রেখেই চলে এসেছে। এখন রুবাবা ওর মায়ের সাথে কথা
বলতে চায়।
হ্যালো বলতেই রুবাবা বলল, “ তোমরা সবাই খারাপ, সবাই আমাকে ঠকায়। সিন্ডি খুব খারাপ, আমি বাথরুমে গেছি,
আমাকে না নিয়ে সিন্ডি চলে গেছে। আমি আর কোনদিন সিন্ডির সাথে কথা বলবোনা। তুমি কি
একটু আসবে আমাকে নিয়ে যেতে? আমি আর কখনও তোমাকে “ আই হেট ইউ’ বলবোনা, তুমি আসো, আমাকে নিয়ে যাও। আমার আজকেও মাথা গরম হয়েছে, তবুও ব্লেড
দিয়ে হাত কাটিনি। আমি আর হাত কাটবোনা, তুমি আসো।
No comments:
Post a Comment