Tuesday, October 30, 2012

লক্ষ্মী পূজোর নাড়ু!

দেশে বাবাকে ফোন করেছিলাম। আমার মায়ের ফোনটা এখন বাবা ব্যবহার করেন। প্রথমবার ডায়াল করতে সাত আটটি রিং হয়ে ফোন থেমে গেল। কী ব্যাপার! বাবা কেনো ফোন ধরলেন না, মনে একটু ভয় ধরে গেল। তবে কি বাবা অসুস্থ?  সম্প্রতি মা মারা যাওয়ার পর এই ব্যাপারটা খুব বেশী করে মনে হয়। মা বেঁচে থাকতে ফোন করে মায়ের সাথেই কথা বলতাম, বাবার সাথে কথা বলতাম নববর্ষ, পূজা, জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকীতে। বাবার বয়স হয়েছে, মোবাইল ফোনের সাউন্ড খুবই কম মনে হয় উনার কাছে, আমরা কথা বলে যাই, আর উনি শুধু 'হ্যালো' হ্যালো' করতে থাকেন। দু তরফেই বিরক্তির মাত্রা বাড়তে থাকে বলে বাবার সাথে কথা না বলে মায়ের কাছ থেকে সমস্ত সংবাদ জেনে নিতাম। এখনতো আর মা নেই, বাবার খোঁজ বাবার কাছ থেকেই নিতে হবে। সেজন্যই বাবা ফোন না ধরায় মনটা কেমন করে উঠেছে। মাথায় আসেনি, বাবা তো ফোনের রিং শুনতে পান নি। ব্যাকুল হয়ে ভাইয়ের নাম্বারে কল দিতেই জানতে পারলাম, বাবা ভাল আছেন। ভাইয়ের ফোন হাতে নিয়েই বাবা বললেন, 'হ্যালো'!

আমিও পালটা বললাম, ' হ্যালো বাবা, কেমন আছ'

বাবাঃ হ্যালো, হ্যালো, এই যাহ! লাইন কেটে গেছে।

আমিঃ বাবা, লাইন কাটেনি। আমি শুনতে পাচ্ছি, হ্যালো বাবা

বাবাঃ এই কে আছিস! নে ফোন নিয়ে যা, লাইন কেটে গেছে। ও আবার ফোন করবে, তখন দিস।

আমার ভাই ফোন হাতে নিয়েই বললো, কই লাইন তো কাটেনি, এত তাড়াহুড়ো করে কথা বলো কেন, এই জন্যই তো ফুলদি'র কথা শুনতে পাও না। স্পীকার ছেড়ে দিলাম, কথা বলো।

বাবাঃ হ্যালো হ্যালো! মিঠু!! হ্যাঁ এইবার বল, শুনতে পাচ্ছি।

আমিঃ কেমন আছো?

বাবাঃ দূর! এইটা একটা প্রশ্ন হইল? প্রত্যেক দিন একই প্রশ্ন। কালকে যেমন ছিলাম, আজকেও তেমনই আছি। ভাল আছি, অন্য কথা বল।

আমি হেসে ফেললাম এবং অপরপ্রান্তে ছোট ভাইয়ের হাসির আওয়াজ পেলাম। এটা আমাদের ভাই বোনদের মাঝে প্রচলিত একটি খেলা। বাবা অথবা মা যদি আমাদের  চার ভাইবোনের মধ্যে যে কোন একজনকে বকা দেন, অন্য তিনজন মহা খুশী হই, কৌতুকের হাসি বের হয়ে আসে চোখে মুখে। উপস্থিত সকলেই হাসি, কেউ যদি অনুপস্থিত থাকে, তাকেও যথাসময়ে সংবাদ পৌঁছে দেই। এমন  কি, আমি আমেরিকাতে বসে থেকেও ফোনে সংবাদ পেয়ে যাই, যদি আর কারো কপালে এমন বকা জোটে! আগেই বলেছি, খেলাটি  শুধুই আমাদের ভাইবোনের মাঝেই সীমাবদ্ধ।

হাসতে হাসতেই বাবাকে বললাম, বাবা কারো সাথে কথা শুরু করতে গেলে প্রথম বাক্যটি তো এমনই হয়, কুশল সংবাদ জানতে চাইতে হয় সবার আগে। ঠিক আছে, তুমি ভালো আছো জেনে শান্তি পেলাম। এবার তুমিই কথা বলো, আমি শুনি।

বাবাঃ আজকে তো লক্ষ্মী পূজা। তুই লক্ষ্মী পূজা করবি না?

আমিঃ বাবা, আমাদের এখানে তো আর কোন বাঙ্গালী নেই, একা একা উৎসব আয়োজনে কোন সুখ নেই।  তবুও আগে যখন মৌটুসী, মিশা ছিল, রান্না বান্না করতে ভাল লাগতো। এখন আর ভাল লাগেনা  আমি  এমনিতেই একটু ফল-জল দিয়ে লক্ষ্মী মায়ের ছবি পূজা করবো, সন্ধ্যাবেলা।

বাবাঃ নাড়ু বানাবি না? তোদের ঐখানে আখের গুড় পাওয়া যায় না?

আমিঃ নাহ! আখের গুড় পাওয়া যায় না ( আমার বাবা গ্রামের ছেলে, চিনির বদলে আখের গুড় খেয়েছেন, সেই অভ্যাসেই এখন নারকেলের নাড়ু বলতে আখের গুড়ের পাকে বানানো নাড়ুকে বুঝেন। আমার ভাল লাগে চিনির পাকের নাড়ু।)
বাবাঃ নারিকেল পাওয়া যায়?

-নারিকেল পাওয়া যায়। তবে নারিকেল কুরাবো কিভাবে?

-কেন, তোর নারিকেল কোরানি নাই?

-নাহ! আমার নারিকেল কোরানি নাই।

-কী কস! কতবার দেশে আসলি, স্যুটকেস বোঝাই কইরা জিনিস লইয়া যাস, আর একটা নারিকেল কোরানি নিতে পারলি না?

-বাবা, নারিকেল কোরানি আনলেও লাভ নাই, আমার এত কাজ  করতে ভাল লাগেনা। একলা একলা নারিকেলের নাড়ু খেয়ে সুখ নাই।

-একলা একলা আবার কি?  মৌটুসী, মিশা না হয় দূরে থাকে,  মিথীলা তো আছে, ওর বাবা আছে, পূজা-পরবে যদি দুই একটা ভাল মন্দ কইরা না খাওয়াস, এইটা কেমন কথা! না হয়, চিনি দিয়াই একটু নারিকেল পাক দিয়া নাড়ু বানাইস। তোর মা'রে দেখছস তো, শত ঝামেলার মধ্যেও পূজা পার্বণে এই জিনিসগুলি বানাইতো।

-আচ্ছা ঠিক আছে, দেখা যাক। আমাদের এখানে ইন্ডিয়ান স্টোর নাই, আমেরিকান স্টোরে নারকেলের কুচি পাওয়া যায়, সেগুলি দিয়া নাড়ু হয় না, তবুও চেষ্টা করব।

-কেমন দেশে থাকস? কিছুই পাওয়া যায় না! এর চাইতে আমাদের দেশ ই ভালো, হাজার গুনে ভাল।

-সত্যি কথাই বলছো, আমি নিজেও তো আমেরিকাতে থাকতে চাই না, নিজের দেশেই থাকতে চাই। ভাবো তো, দেশে থাকলে আজকে কি আর 'নারকেলের নাড়ু' বানানো নিয়ে তোমার কাছ থেকে এত কথা শুনতে হইতো ( হেসে ফেললাম)। ঠিক আছে বাবা, আজকে রাখি। ভালো থাইকো।

হ্যাঁ, আমেরিকার মিসিসিপিতে থেকে পূজা-পার্বণ, ঈদ, পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা যে কত কঠিন, তা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানে। আমেরিকার বড় বড় সিটিতে অবশ্য অন্য রকম চিত্র। নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্ণিয়া, হিউস্টন, ডালাস, ফ্লোরিডাতে উৎসব পালনে কারো কোন অসুবিধা হয় না। আমাদের এখানে বাঙ্গালী খুব কম, তাই উৎসব উদযাপনে উৎসাহও কম। আমি একা একা ঘরে নাড়ু, মোয়া, তিলের তক্তি বানাবো, খাবে কে? উৎসবের মূল আনন্দই তো অতিথি আপ্যায়নে। যাই হোক, আজকে বাবার কাছ থেকে এমন অনুরোধ শুনে মনে একটু খচখচানি টের পেলাম। যে বাবা সব সময় শাসনের উপর রাখতেন, সেই বাবা এখন মায়ের ভূমিকায় নেমেছেন। যে কথা মায়ের বলার ছিল, সেই একই কথা এখন বাবা বলছে।

ঘুম ভাঙ্গতে দেরী হয়েছিল। আমেরিকা, কানাডাতে আগের রাতেই অনেকে লক্ষ্মীপূজা করে ফেলেছে। আমি করিনি। সাধারণতঃ  ভরা পূর্ণিমা তিথিতে লক্ষ্মী পূজা হয়।  আমরা এখানে এমনিতেই দেশ থেকে বারো ঘন্টা পিছিয়ে আছি। নিয়মানুযায়ীদেশে যখন পূজা হচ্ছে, তখন তাদের সন্ধ্যা, আমাদের সকাল। তাহলে কিভাবে আমি সকালে পূজা করবো? এক ধরনের আলসেমীতে পেয়ে বসেছে আমাকে। আলসেমীর কারনেই নানা যুক্তি খুঁজে বের করছি। একবার পূজাতে বসলে আমার অনেক দেরী হয়। ঘরে নারকেল বা ব্রাউন সুগার কিছুই নেই। ইচ্ছে করলেই গাড়ি নিয়ে বের হতে পারি, কিনতু বের হতে ইচ্ছে করছেনা। নিয়ম আছে, লক্ষ্মীপূজো শেষে এয়োস্ত্রীকে একটু মাছ স্পর্শ করতে হয়। আমার ফ্রীজে  রান্না করা খাবারের কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমি চাইছিলাম, সারাদিনে রান্না করে, সব কিছু রেডী করে পূজায় বসবো। কিনতু ততক্ষনে পূর্ণিমা শেষ হয়ে যাবে! যন্ত্রনা! নিউইয়র্কে ধর্ম বিশেষজ্ঞ বোন টুম্পা'কে কল দিলাম। টুম্পা আমার মামাত বোন, আমার কোলে চড়েই বড় হয়েছে। অথচ আমি ধর্ম সম্পর্কে কিছুই না জানলেও সে অনেক কিছু জানে। ওর সাথে কথা বলে আমি অনেক কিছুই ঠিক করি। ফোন টুম্পা ধরেছেঃ
-হ্যালো, ফুলদিভাই, কী ব্যাপার!

-টুম্পা, তুই কি লক্ষ্মীপূজা করে ফেলছস?

-এখন করতেছি। কেনো এই প্রশ্ন কেনো?

-সবাই পূজা করে ফেলছে, আমার এখন ইচ্ছে করতেছেনা, আচ্ছা, পূর্ণিমাতে পূজা হয়, কি বুঝে তোরা এখন পূজা করতেছস? পৃথিবীটা তো ঘুরতেছে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সন্ধ্যা, পূর্ণিমা, আমাদের এখানেতো দিন, বারো ঘন্টা পরে আমরা পূর্ণ চন্দ্রের মুখ দেখবো, তখন হবে আমাদের সন্ধ্যা, আচ্ছা, তুইই বল, আমাদের আজকে সন্ধ্যায় পূজা করা উচিত না?

-মুহূর্ত থেমে টুম্পার জবাব, কথা সত্য। এবার টুম্পা হেসে ফেললো, ফুলদিভাই, আলসেমী কইরা তুমি পূজা দিতেছোনা, কিনতু যুক্তি তো ভালই বাইর কইরা ফেলছো।

- না, বিশ্বাস কর, এইখানে সবাইকেই দেখি, দেশের পঞ্জিকামতে সব করে, পূজা, ঈদ সবকিছুই। আমি একা একা ভাবি, পঞ্জিকার তিথি অনুযায়ী কিছু করতে গেলে, দিন রাতের হিসেবেই করা উচিত। আছি আমেরিকাতে, অথচ কাজ করবো বাংলাদেশের তিথিতে, তাহলে তো চলবেনা।

-হাসতে হাসতে টুম্পার জবাব, না তোমার কথাই ঠিক। তুমি সন্ধ্যাবেলাতে নিষ্ঠান্ডা মনেই পূজা করো। তবে, তোমার তো আবার বাসন কোসনের সমস্যা আছে। নাড়ু মোয়া বানাইবা কেমনে?

-চুপ থাক! আমার বাসন কোসনের সমস্যা আছে, তোরে কে বলছে? আমার সমস্যা হইল, আমার মনে। কেউ নাই, মৌটুসী, মনিশমিশা, তুই থাকলে কত আনন্দ কইরা সব করতাম। এই একলা ঘরে কিচ্ছু করতে ভাল লাগেনা।

-মিথীলা আছে, দাদাভাই আছে, এদের জন্যই করো।

-আচ্ছা ফোন রাখি। তুই যখন বললি, আজ সন্ধ্যায় পূজা দিলে ঠিক আছে, তাইলে সব ঠিক। তুই তো আবার হিন্দুধর্ম বিশেষজ্ঞ।

-টুম্পার হাসি, কী করবো, তোমার মত এমন দিদি যার আছেযে কিনা হাঁটুর বয়সী ছোট বোনের কাছে বিধি-বিধান শুনে নেয়, তার তো নিজে থেকেই কিছু শিখতে হইব। ঐজন্যই আমার বড় পিসী তোমারে না শিখায়া আমারে শিখায়ে গেছে সব কিছু।

-আমিও হেসে ফেললাম, ঠিকই কইছস, ভাগ্যিস, মা তরে অনেক কিছু বলে গেছে।

টুম্পার সাথে কথা শেষ করেই পূর্ণ উদ্যমে শুরু করে দিলাম নিত্যদিনের রান্না-বান্না। আগের দিন আমাদের এক পারিবারিক বন্ধু মিত্রা, তার বাগান থেকে প্রচুর সব্জী দিয়েছিল আমাকে, সেগুলো দিয়েই শুরু করলাম। রান্না-বান্না শেষ করেই চুলা-টুলা ধুয়ে মুছে নিলাম। এবার স্বামীকে পাঠালাম ওয়ালমার্টে, কাঠির মত লম্বা লম্বা কুচানো নারকেলের প্যাকেট, ব্রাউন সুগার ( আখের গুড়ের বদলে) নিয়ে আসার জন্য, সাথে পূজোর জন্য কিছু ফল। বাজার ফেরত ব্যাগ থেকে নারকেলের প্যাকেট আর বাদামী চিনির প্যাকেট বের করেই চূলায় স্টীলের কড়াই চাপিয়ে দিলাম। আমার মা পেতলের মালসাতে নারকেলের পাক দিতেন, উনি কাঁসা-পেতলের আধুনিক সংস্করন 'স্টীল' কোনভাবেই মানতে পারতেন না। কিনতু আমি স্টিলের বাসন কোসন অনেক বেশী পছন্দ করি। অনেক হালকা ওজনের বাসন কোসন ব্যবহার করতেও সহজ।

নারকেলের পাক আর উঠেনা, একটু পর পর নেড়ে দেই, আবার দোতলায় উঠে পূজার আয়োজন করি। এক সময় নারকেল পাক শেষ করে কড়াইসহ পূজার ওখানে নিয়ে গেলাম। একবার ভাবি, নারকেলের মন্ডটাই পূজার নৈবেদ্যতে নিবেদন করি। আবার মনের ভেতর বাঙ্গালী নারী কথা বলে উঠে, নাড়ুর মত গোল গোল করে গড়ে না দিলে যদি লক্ষ্মী মা অসন্তুষ্ট হন। কী আর করা, ধোঁয়া উঠা গরম মন্ড থেকেই নারকোল নিয়ে হাতে চেপে চেপে গোল করার ব্যর্থ চেষ্টা করে গেলাম। আমি ছোটবেলায় মা'কে নাড়ু বানাতে সাহায্য করতাম। মা কোনভাবেই হাতের তালুতে গরম সহ্য করতে পারতেন না। অথচ আমি অবলীলায় গরম নারকেলের দলা হাতে নিয়ে মসৃন নাড়ু বানিয়ে দিতাম। আমার মা'কে এই নিয়ে একটুও চিন্তিত হতে দেখিনি। মেয়ের হাত পুড়ে যেতে পারে, এমন চিন্তা মাথায় ছিল না তাঁর, বরং একটু গর্বিত ছিলেন, তাঁর মেয়ে এমন গরম জিনিস হাতের তালুতে অবলীলায় ঘুরিয়ে যাচ্ছে।

আসলে আমরা থাকতাম বিশাল বড় এক বাড়ীতে। অনেক ভাড়াটিয়া ছিল একই বাড়িতে। লক্ষ্মীপূজার জন্য আমাদের ঘর বাদে আর সকলের বাড়িতে সাজ সাজ রব পড়ে যেত। দশ দিন আগে থেকেই প্রত্যেকের বাড়ীতে ঝুড়ি ভর্তি করে নারকেল আসতো, মুড়িওয়ালাদের অবিরাম আসা-যাওয়া, বাজার থেকে তিল এনে ধুয়ে , কুলাতে ছড়িয়ে রোদে শুকানো, হাঁড়ি ভরে রসের গুড়, আখের গুড়, খই, চিড়ার বড় বড় পোঁটলাতে টুকরি ভরে বাজার থেকে ফেরা, এ সবই বারান্দায় বসে বসে দেখতাম। আমারও খুব ইচ্ছে হতো, আমাদের বাড়ীতেও এমন আয়োজন হোক। কিনতু মনে মনে জানতাম, আমার বাবার হিসেবের সংসার, মাপের বাইরে কিচ্ছু হওয়ার জো নেইফলে পূজার ঠিক আগের দিন আমাদের ঘরে গুনে গুনে চার-পাঁচটি নারকেল আসতো, কিছু তিল, মুড়ি আর কিছু খই। আমাদের খাওয়ার আয়োজনে থাকতো মুড়ির মোয়া, খইয়ের উপরা, দুই রকমের নারকেলের নাড়ু (চিনি এবং গুড়) আর তিলের তক্তি। আর অন্যদের বাড়িতে হতো সত্যিকারের আয়োজন। আমার মা শুধু নারকেলের গোল গোল নাড়ু বানাতে জানতো, কিনতু অন্য বাড়িতে দেখতাম নারকেল কুচিয়ে 'চিড়া' বানাতো, মোয়ার কত রকম আকৃতি, চিড়ার মোয়া, সুজির লাড্ডু, খই দিয়ে কত রকম জিনিস, ভেজা চিঁড়া দিয়ে এক ধরনের মিষ্টি বানাতে দেখতাম। আমার কাজ ছিল, ঘুরে ঘুরে নাড়ু, লাড্ডু বানানো দেখা, আমি শিখে ফেলতাম। এখনও আমি সেই স্মৃতি থেকেই কলা কৌশলগুলো ব্যবহার করে নানারকম খাবার তৈরী করি। বিজয়া দশমীর লাড্ডুও আমি নিজের ধারনা থেকেই বানাই, সকলেই খুব উচ্চ প্রশংসা করে। এখানে দুধ পাওয়া যায় প্রচুর, আমি নিজে নিজেই রসগোল্লা, চমচম, কালোজাম, লালমোহন, সন্দেশ বানাতে শিখেছি, সাথে লাড্ডু আর মিষ্টি দই। মজা করে অনেকে আমাকে 'মিঠু ময়রা' ডাকে। মনে মনে আমি সেই মানুষগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করি, যাদের সৃজনশৈলী দেখে আমি বড় হয়েছি।

সেই আমিই যখন এমন আধখেঁচড়া নারকেলের মন্ড থেকে হাত পাকিয়ে নাড়ু বানালাম, নাড়ুর চেহারা দেখে আমি নিজেই আঁতকে উঠেছি। তবে লক্ষ্মী দেবী নিশ্চয়ই আমার আন্তরিক প্রচেষ্টা দেখে প্রীত হয়েছেন। কারন, প্রসাদ বিলোতে গিয়ে দেখি, নাড়ু একেবারে টান টান হয়ে গেছে, হাতে নিয়ে আরেকটু চাপ দিতেই গোল হয়ে গেল। ছোট মেয়ে মিথীলা ঠাকুর প্রনাম করতে এসে ঠাকুরের দিকে না তাকিয়ে প্রসাদী থালার দিকে আগে নজর দিয়েছে। খুশী হয়ে বলে উঠেছেঃ
-উহ! নাড়ু বানিয়েছো? সবগুলি আমাদের খেতে দিবে?

-তুমি ঠাকুর প্রনাম করতে এসে নাড়ুর দিকে নজর দিয়েছো!!

-সরি! নাড়ু খেতে ভালো লাগে!

আমার মনে পড়ে গেলো, সকালে বাবা বলেছিলেন, মেয়ের জন্য হলেও দুটো নাড়ু বানাতে। আমি তো জানতামই না, আমেরিকার জল হাওয়ায় বেড়ে উঠা মিথীলা নাড়ু দেখে এমন খুশী হবে! মিথীলা ঠাকুর প্রনাম শেষে প্রসাদ খেতে চাইলো। ঘরে আমরা মাত্র তিনজন। প্রসাদের থালা থেকে সবকিছু তিনটি প্লেটে মোটামুটি সমানভাবেই ভাগ করে দিলাম। বাপ-মেয়ে প্রসাদ খাচ্ছে আর আমি পূজার স্থান পরিষ্কার করায় ব্যস্ত হয়ে গেছি। সব কাজ শেষে নিজের প্লেট নিয়ে বসতেই মিথীলা এসে উপস্থিত।

-মা, নাড়ু কি সব শেষ?

-হুম! সব দিয়ে দিলাম তো।

-নাহ! আমার প্লেটে কম পড়েছে।

-এমন তো হওয়ার কথা না। আমি সমানভাবে দিয়েছি।

-না, পাপার প্লেটে অনেকগুলো নাড়ু পড়েছে, আমি গুনে দেখেছি।

-অসম্ভব, তা হতেই পারেনা। তাছাড়া, তুমিই তো নিজের হাতে পাপাকে দিয়েছ।

-হ্যাঁ, দেওয়ার সময় দেখিনি, পরে দেখেছি, আমি পেয়েছি মাত্র তিনটা নাড়ু, আর পাপা পেয়েছে পাঁচটা।
আমি হেসে ফেললাম, বললাম, ঠিক আছে, তোমার পাপার ভাগ্যে ছিল, তাই পেয়েছে। আমার প্লেটে দেখো, সব ভাঙ্গা ভাঙ্গা নাড়ু। তুমি ইচ্ছে করলে এখান থেকে নিতে পারো, তবে নাড়ু আমারও খুব প্রিয়। চিন্তা করোনা, এখনও আরও আছে, কাল দেবো।

মিথীলা সামনে থেকে সরে যেতেই আমার খুব হাসি পেল। নাড়ু এমনই এক জিনিস, দেশে থাকতে পূজোর ছুটি শেষে যখন হোস্টেলে ফিরে যেতাম, বন্ধু বান্ধবীরা ঘিরে ধরতো, কিরে! নাড়ু আনছোস? আমি তো তেমন কিছু নিতে পারতাম না, তবে আমার রুমমেট উমা নিয়ে আসতো ওদের বাড়ী থেকে। মানিকগঞ্জে ছিল ওদের বাড়ী, অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়ে উমা, অনেক কিছু আনতো, আমাদের সবাইকে দিত।

সত্যি কথা বলতে কি, আমি নিজেও নারকেলের যে কোন প্রিপারেশান খুব ভালোবাসি। আমার প্লেটে এখনও দুই একটা টুকরো পড়ে আছে, মিথীলাকে ডাকলাম,

-মিথীলা, উপরে উঠে আসো, আমার প্লেট থেকে নাড়ু নিয়ে যাও।

-নাহ! থাক, তুমি খাও।

-আরে! আসো তো। আমি খেয়েছি, তুমি নিয়ে যাও।

-মা, নাড়ুর জন্য আবার উপরে আসতে চাই না। কালকে নাড়ু দিবে বলেছো, তখনই খাব।

Wednesday, October 24, 2012

এক নজরেঃ বোকা নারী/ বোকা পুরুষ

নারীঃ   এ যুগেও অনেক শিক্ষিত নারী বিবাহিত জীবনে স্বামীকে তার নিজস্ব সম্পত্তি ভাবে, অথচ স্বামীর প্রতি আস্থা রাখতে পারে না!! তাদের মনে সব সময় এক ধরনের ‘হারাই হারাই’ ভাব কাজ করে। স্বামী বাইরে ঘরে কাজ করবে, কিনতু কোন মেয়ের সাথে মিশতে পারবেনা! শুরু হয়ে যায় পারস্পরিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ঝগড়া-ঝাঁটি, এক পর্যায়ে নারী তার স্বামীকে নিজস্ব সম্পত্তি ভেবেই নিজ আঁচলে বেঁধে রাখতে চায়! এরই ধারাবাহিকতায় স্বামীকে দিয়ে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করায়, নতুবা সন্তানের মঙ্গল-অমঙ্গলের চিন্তা না করেই সন্তানের মাথার দিব্যি দেয় যেনো স্বামী নিজের স্ত্রী ছাড়া আর কোন নারীর (হোক সে নিখাদ বন্ধুত্ব) কাছাকাছি না যায়। কোন কোন নারী আবার আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে, আদরের সন্তানটিকে দিয়ে বাবার পেছনে স্পাইং পর্যন্ত করায়। মোবাইল ফোনের 'কল লিস্ট চেক করা, এসএমএস চেক করার' মত অতিশয় হীন কাজ করতেও গ্লানি বোধ করে না। শুধুমাত্র ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের দখলে রাখার শিশুসুলভ কাজটুকু করতে গিয়ে কোমলমতি সন্তানদের এঁচোড়ে পাকার ব্যবস্থা করে ফেলে। সংখ্যায় অল্প হলেও কিছু নির্দোষ স্বামী বেচারা মনে অনেক যাতনা পুষে ঘুরে বেড়ায়, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়, জোরে জোরে হেসে উঠে, মনে দহন হয়, ঘরে-বাইরে ভালোবাসা-বিশ্বাসের বদলে সমঝোতা করে চলাকেই স্বস্তিদায়ক মনে করে। বাইরে গিয়ে বন্ধু-বান্ধবীদের বলতেও পারেনা, কী যন্ত্রনার মধ্যে তার দিন কাটে, ধীরে ধীরে শরীরে নানা রকম রোগ বাসা বাঁধে। বোকা নারী স্বামীকে কি শেষ পর্যন্ত আঁচলে বেঁধে রাখতে পারে, যখন আজরাইল বা যমরাজ এসে সামনে দাঁড়ায়!! এ যুগেও নারী কেনো এমন বোকা হয়! কেনো কিছু কিছু ব্যাপারে ছাড় দেয়ার কথা মনে আসে না! কেনো পারস্পরিক বিশ্বাস তৈরী হয় না, সুখী দাম্পত্যে পারস্পরিক বিশ্বাস অর্জনই তো বড় কথা! এক জীবনে কী আর সব পাওয়া যায়!



পুরুষঃ বর্তমান আধুনিক সমাজে অনেক উচ্চশিক্ষিত পুরুষ নিজের স্ত্রীটিকে ‘আলাদা’ একজন মানুষ না ভেবে নিজস্ব সম্পত্তি মনে করে চার দেয়ালের সিন্দুকে ভরে রাখে। স্ত্রীকে সিন্দুকে রেখে নিজে নানা সভা সেমিনারে যায়, ‘নারী স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা’ সম্পর্কে অনেক বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়, সেমিনার শেষে কিছু আলোকিত, মুক্তমনা নারীদের সাথে এক টেবিলে বসে চা পান করে, আর মনে মনে নিজের ‘ঘরকুনো স্ত্রী’র সাথে আলোকিতা নারীর তুলনা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বোকা স্বামী বাইরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘরে ঢুকেই সিন্দুকের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মেজাজ খারাপ করে, ‘মূর্খ-বোকা’ বলে গালাগাল করে, কদাচিৎ খাবার টেবিলে বসে রান্না ভাল হয় নি বলে খাবারের থালা ঠেলে উঠে যায়, বেশীর ভাগ সময় ‘বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি’ বলে তেতো মুখে ঘুমাতে যায়। শুয়ে শুয়ে আলোকিত নারীর মুখ মনে পড়ে, ঘুম আসেনা, অম্বল হয়, বদহজম হয়, তবুও বোকা স্বামীর একবারও সিন্দুকের ডালা খুলে স্ত্রীটিকে বাইরে বের করার কথা মনে পড়ে না!

Tuesday, October 23, 2012

আজ বিজয়া দশমী, মা আমাদের সকলের, সকলকে শুভ বিজয়ার শুভেচ্ছা!

আজ বিজয়া দশমী। বাংলার ঘরে ঘরে, সকলের অন্তরে অন্তরে বাজছে বিষাদের সুর। মা দুর্গা স্বর্গ থেকে মর্ত্যে এসেছিলেন, ্পাঁচদিনের আনন্দসফর শেষে আজ মায়ের ফিরে যাওয়ার পালা। আমরা মর্ত্যবাসী মায়ের বিদায়ের দুঃখে কাতর। ঢাকের বোলে শুনি বিসর্জনের কান্না, যেনো বলছে,
“ঠাকুর থাকবে কতক্ষন, ঠাকুর যাবে বিসর্জন”!
কান্নাতেই শেষ নয়, কান্নাকাটি শেষে বাঙ্গালী আবার স্বপ্ন দেখে, পরের বছর মায়ের পুনরাগমনের। ঢাকের বোল পালটে যায়,
“বাজে ঢোল নরম-গরম তালে তে
বিসর্জনের ব্যথা ভুলি, আগমনীর সুরেতে”!!
আজ দশমী পূজা শেষে হবে দেবী বিসর্জন। ঢাকের বাদ্যির তালে তালে বাঙ্গালী সন্তানের কাঁধে চড়ে মা দুর্গা যাবেন উনার পিত্রালয় ছেড়ে শ্বশুরালয়ে। দেবীমূর্তি নদীতে বিসর্জনের ভেতর দিয়েই হবে এ বছরের দূর্গা পূজার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি। দেবী দুর্গা জগজ্জননী, বিশ্বমাতারূপে বিশ্বের সর্বত্র বিরাজিত। এককোষী প্রাণী থেকে শুরু করে জগতের প্রতিটি জীবের তিনিই মাতা। দেবী মঙ্গলময়ী, সর্ব মঙ্গলা।
প্রতি বছরের ন্যায় স্বর্গবাসীনি মা আমাদের এবছরেও মাত্রই দিন পাঁচেকের জন্য মর্ত্যে নেমে এসেছিলেন। সাথে নিয়ে এসেছিলেন উনার স্বর্গের গোটা সংসার। আমরা উনার অধম সন্তান, যতটুকু সাধ্যে কুলোয়, সেটুকু দিয়েই মায়ের পূজা করেছি, মা’কে আপ্যায়নের চেষ্টা করেছি মাত্র। মায়ের চরনে মাথা ঠুকে কেঁদেছি জগতের সকলের দুঃখ দূর্দশা দূর করে দেয়ার আর্তি নিয়ে। মা সন্তানের আকুতিতে নিশ্চয়ই সাড়া দিবেন, সেই আশাতেই মায়ের কাছে কায়োমনোবাক্যে প্রার্থণা করেছি, ” মা গো, জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক, সকলের মঙ্গল হোক” এই স্নেহাশীর্বাদটুকু আমাদের দিয়ে যাও। আগামী এক বছর যেনো আমরা সকলেই ভায়ে ভায়ে, বোনে বোনে, পিতা-পুত্রে, মাতা-কন্যায়, বন্ধু-স্বজন, আত্মীয়-অনাত্মীয়ে, ধনী-গরীবে মিলে মিশে দিনের প্রতিটি সুখ-দুঃখকে ভাগাভাগি করে নিতে পারি। আগামী বছর তোমার পুনরাগমনের প্রতীক্ষায় থাকবো, আমরা মর্ত্যলোকের সকল সন্তানেরা।
বলো বলো, দূর্গা মাই কী~~~~ জ- অ- অ-অ-য়!!!!
আজকের এই শুভ ক্ষণে, সকলকে জানাই শুভ বিজয়ার শুভেচ্ছা!! ঘরে-বাইরে, দেশে-বিদেশে অবস্থানরত প্রত্যেককে জানাই ‘শুভ বিজয়ার’ শুভেচ্ছা! দেখা হবে আগামীতে! সকলেই ভালো থেকো, সকলের মঙ্গল হোক!

Sunday, October 21, 2012

সন্তানের অপকর্মের দায় নেয় অভাগা পিতামাতা, কুনাগরিকের দায় নেয় অভাগা রাষ্ট্র!

নাফিস’কে নিয়ে মহাবিপদে পড়েছে বাংলাদেশ নামের বিশ্বে ১১তম সুখী রাষ্ট্রটি। নাফিস এখন ‘নয় মণ দুধে এক ফোঁটা গো-চনা’ তুল্য। আমার মধ্যম কন্যার বয়সী নাফিসকে নিয়ে লিখতে গিয়ে মা হিসেবে বুকে এক ধরনের কষ্ট টের পাচ্ছি। কষ্ট পাচ্ছি নাফিসের জন্য, মেধাবী ছেলেটি তার মেধার সদ্ব্যবহার করতে পারলো না, দেশের উন্নতিতে কোনই অবদান রাখতে পারলো না, বিকশিত হওয়ার আগেই বিমূর্ত কিছু ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজে ডুবে গেল, বাবা-মা কে ডুবালো, শেষমেষ ১৬ কোটি বাঙ্গালীর সম্মান ডুবিয়ে দিল। দারিদ্র্যকে সহ্য করা যায়, অপমান সহ্য করা যায়না। বাংগালী লবন-পান্তা খেয়েও সুখী ছিল, বিশ্বে সুখী দেশের তালিকায় এগারো নাম্বারে থাকা কি সোজা কথা! সেই সুখের মধ্যে ছাই দিল ‘নাফিস’ নামের কথিত ‘মেধাবী, ধার্মিক’ ছেলেটি। এখন উচ্চশিক্ষার্থে  অথবা যে কোন প্রয়োজনে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকাতে আসা  কত কঠিন হয়ে উঠবে!

৯/১১ এর আগে পর্যন্ত আমেরিকায় বসবাস করা মোটামুটি আরামেরই ছিল, একথা আমার নয়, অনেকদিন ধরে আমেরিকায় বসবাস করছেন এমন সব প্রবাসী বাঙ্গালীর কথা এটা। প্রায়শঃই তাঁরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এ কথা করটি বলেন। আমি আমেরিকায় এসেছি ৯/১১ এর পরে। তাই ৯/১১ পূর্ববর্তী আমেরিকার  সোনালী দিন দেখার ভাগ্য আমার হয়নি। পুরানোদের মুখ থেকে যা শুনি, তাই বিশ্বাস করি।  জেনেছি, তখন আসা যাওয়ার পথে এয়ারপোর্টগুলোতেও নাকি কোন কড়াকড়ি ছিলনা।  শুনে খুবই অবাক হই, আফসোস হয়, কেনো এমন সুখের সময়ে আমেরিকা আসিনি, আর কেনোইবা এমন অস্বস্তিকর সময়টাই বেছে নিতে হলো! এখন তো সারা সময় এক ধরনের ভয়ের মধ্যে দিন কাটে। তবে এতদিন ভয় ছিল অন্য সকলের মত, কিনতু সম্প্রতি 'নাফিস' গ্রেফতার হওয়ার পরে ভয় বেড়ে গেছে। অন্যরকম ভয়, আমাদের জাতীয়তা, আমাদের পরিচিতিতে আগে ছিল ঔজ্জ্বল্য, সেই ঔজ্জ্বল্য ম্লান হয়ে যাওয়ার ভয় এটা। প্রতি বছর কত মেধাবী ছেলে মেয়ে আসে উচ্চশিক্ষার্থে। নাফিসের গ্রেফতারের পরে কী আর অত সহজে কারো ভিসা মিলবে? আমাদের দেশে এক শ্রেণীর মানুষ অলরেডী বলতে শুরু করেছে, নাফিসকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই, এফবি আই নাফিসকে ভুলভাবে প্রভাবিত করেছে, তারপরেও কথা থেকে যায়। নাফিসের চেয়েও কমবয়সী ছেলেমেয়ে প্রতিবছর বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা থেকে আমেরিকাতে আসছে। কই, তাদের মধ্যে থেকে কাউকে তো প্রভাবিত করতে পারলোনা! বেছে বেছে এফ বি আই শুধু নাফিসকেই কেনো টার্গেট করলো! আর নাফিস তো ছোট্ট বালক নয়, ২১ বছরের যুবক, ভাল-মন্দ, হিত-অহিত বুঝার বয়স হয়েছে। সে কেনো এই ফাঁদে পা দিল!  সে এসেছিল মিসৌরীতে, এক সেমিস্টার পড়া শেষ করেই সে নিউইয়র্কে চলে এলো কেনো? সে তো বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাস ট্র্যান্সফার করেনি! আরও কথা আছে, সে আত্মীয়ের বাড়ীতে উঠেছিল, মসজিদ খোঁজার জন্য আত্মীয়ের সাহায্য না নিয়ে অপরিচিত লোকের সাহায্য নিতে গেলো কেনো? তার পরিবার থেকে বলা হয়েছে, সে খুব লাজুক, কারো সাথে মিশতে পারেনা, সেই ছেলে নিউইয়র্কের মত বড় শহরে এসে অপরিচিতের কাছে সাহায্য চাইলে, ব্যাপারটিতে একটু অস্বাভাবিকতা আছে মনে হতেই পারে। তা যাই হোক, আসল ধাক্কা যাবে বাংলাদেশীদের উপর।

এমনিতেই  ৯/১১ এর টুইন টাওয়ার বিধ্বংসী ঘটনার পর পর আমেরিকার হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ব্যবস্থা খুবই জোরদার করা হয়। প্রথমদিকে ভিসা প্রদানে কড়াকড়ি করা তো হতোই, ভিসা নিয়ে আগত যাত্রীদেরকে নানাভাবে তল্লাশী করা হতো। মনে পড়ে, ঐ সময়টাতে আমাদের দেশের সাধারন কুচুটে কিছু মানুষের পাশাপাশি দেশের অনেক বুদ্ধিজীবিরাও আমেরিকান হোমল্যান্ড সিকিউরিটির এই পলিসির অনেক সমালোচনা করেছিল। তাঁরা সরাসরিই বলতো, আমেরিকান কাষ্টমস বেছে বেছে ‘মুসলিম নামধারী’ যাত্রীদেরকে হ্যারাস করে। অবশ্য কথাগুলো তাঁরা নিজের দেশের পত্রিকাতেই লিখতো। শুনিনি, কেউ আমেরিকান দূতাবাসে এসে প্রতিবাদ করেছে। তাঁদের মাথায় একবারও আসেনি, প্রতিটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষার কথা রাষ্ট্রের কন্সটিটিউশানে লেখা থাকে। দেশের নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে নিরাপত্তারক্ষীবাহিণী যে কোন পদক্ষেপ নিতে পারে। তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝে বাড়াবাড়িও করেছে আমেরিকান কাস্টমস। দূর্ভাগ্যক্রমে দুই একজন অভিজাত ব্যক্তি কাস্টমসের সেই বাড়াবাড়ির শিকার হয়েছেন। তবে শুধু মুসলিমদেরকে হ্যারাস করা হতো, এই কথাটির সাথে আমি পুরোপুরি একমত হতে পারিনি। বরং বলা ভাল, যাদের চেহারাতে ভারতীয় অথবা মিডল ইস্টের ছাপ দেখা যেত, অথবা বাদামী চামড়ার কেউ, তাদের প্রতিই যেন কাস্টমসের সন্দেহের তীর ছুঁড়ে দিত।

আমার নিজের কথাই বলি, অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট নিয়ে আমরা আমেরিকা এসেছি ২০০১ সালের ১১ই অক্টোবর, ৯/১১ এর ঠিক এক মাস পরে। ৯/১১ এর আগেই আমার স্বামী আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সুযোগ পায়। সব কাগজপত্র হাতে এসে পৌঁছানোর পূর্বেই ৯/১১ এর ঘটনা ঘটে যায়। কাগজপত্র নিয়ে আমেরিকান এমবাসীতে ভিসা আনতে যাই অক্টোবারের প্রথম সপ্তাহে। আগেই বলেছি, আমাদের ছিল অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট ( বাংলাদেশে ডুয়েল সিটিজেনশীপ এলাউড), আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সত্যায়িত কাগজপত্র সাথে থাকার পরেও ‘ইন্টারভিউ’ নেয়ার অজুহাতে আমাদের জেরবার করে ফেলে। ভিসা অফিসার আমার স্বামীকে রীতিমত  ‘অর্গ্যানিক কেমিস্ট্রির’ উপর  ভাইবা নিয়ে ফেলে। এরপর যখন ‘নিউ আর্ক’ এয়ারপোর্টে এসে নামলাম, ওরে বাবারে! কী তল্লাশী। আমরা তো নামেও মুসলিম ছিলাম না, অথবা বাংলাদেশী পাসপোর্টেও আসিনি, তারপরেও আমাদেরকে এই প্রসেসের ভেতর দিয়েই আসতে হয়েছে। পরবর্তীতে যতবার দেশে যাওয়া আসা করেছি, আমাকে আলাদা কক্ষে নিয়ে ব্যাগ, জামাকাপড় স্ক্যানার দিয়ে দ্বিতীয়দফা চেক করেছে। আমি এতটুকুও বিচলিত হইনি, কারন যা কিছুই করা হয়েছে, যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্যই করা হয়েছে, নিজের দেশের নিরাপত্তার জন্যই করা হয়েছে। আমি নন- মুসলিম বলেই আমাকে রেহাই দেয়নি। অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট থাকলেও চেহারাতে ভারতীয় ছাপ, পাসপোর্টে জন্মস্থান বাংলাদেশ, ব্যস আর কী লাগে! এটা কি কোনভাবেই অস্বীকার করা যাবে, টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পরে ঢাকার রাস্তাতেও ‘লাদেনের’ পক্ষে জয়ধ্বনি করা হয়েছিল! দেশের মাটিতে বসে  সি আই এ’ বিরুদ্ধে কত বড় বড় লেকচার দেয় একেকজন, মাথায় থাকেনা, আমরাই আমেরিকা যাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করি, আমেরিকা আসার জন্য এক পা বাড়িয়ে রাখি আবার আমেরিকার মুন্ডুপাত করি, সি আই এ এজেন্টরা এসব কিছুই জায়গা মত রিপোর্ট করে দেয়।

টুইন টাওয়ার ধ্বংসে কত শত নিরীহ মানুষের প্রান গেল, কতজনের চাকুরী গেলো, চারটি প্লেনের আরোহীদের জীবন গেলো, তাদের জন্য একবারও শোক প্রকাশ করিনা, অথচ আমেরিকাকে একটা ধাক্কা দিয়েছে বলে লাদেন নামক দৈত্যের জয়গান করি। আমেরিকার বুকে বসে, আমার পরিচিত বন্ধুদের অনেকেই ঘরোয়া আড্ডায় গর্বের সাথে বলেছে, লাদেন ঠিক কাজ করেছে। দেয়ালের যদি কান থাকে, তাহলে এফ বি আই এর এজেন্টদেরও কান আছে। এভাবেই একটু একটু করে দিনে দিনে তাদের কানে পৌঁছেছে আমাদের বন্ধুদের কথা। আর এভাবেই সন্দেহের তালিকায় আমরাও ঢুকে গেছি, শুধু মুসলিম নয়, শুধু ইসলামিক দেশের নাগরিকরাই নয়, আমাদের মত বাদামী চামড়ার মানুষ মাত্রেই পড়ে গেছি সেই দলে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি একটুও অখুশী নই। আমি জানি, আমার মনে পাপ নেই, কাজেই কেউ যদি তার নিজের নিরাপত্তার জন্য, দেশের জান-মালের নিরাপত্তার জন্য আমাকে এতটুকুও হুমকীস্বরূপ মনে করে, নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে আমি বরং তাদেরকে সহায়তা করবো।

তবে লাদেনের মৃত্যুর ( অনেকেই স্বীকার করে না, লাদেন মৃত) পর আমেরিকায় আবার একটু স্বস্তির বাতাস বইতে শুরু করেছে। লাদেনের মৃত্যুর পর আমরা আরেকবার দেশে গেছিলাম। আমেরিকান কাস্টমস আগের মত কঠোরতা দেখায়নি, সিকিউরিটি চেকিং অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছিল। জানিনা, এটাও কোন কৌশল ছিল কিনা। যে কৌশলে ‘নাফিস’কে ধরা হলো। নাফিস গ্রেফতারের পর বাংলাদেশের পত্র পত্রিকাতে এখন জোরেশোরে দাবী তোলা হচ্ছে, ‘নাফিস’ কে কেনো প্ররোচিত করা হয়েছে এই ধ্বংসাত্মক কাজে, নাফিসকে নাকি ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে সহ নানা রকম কথাবার্তা। বাংলাদেশের এক শ্রেনীর  শিক্ষিতের প্রায় প্রত্যেকে ঘুম থেকে উঠেই ‘ইন্ডিয়া’ কে একটা গালি দেয়, দ্বিতীয় গালি দেয় আমেরিকাকে। তা গালি দিতেই পারে, গালি দেয়ার মত কাজ করে বলেই এই দুই দেশকে গালি দেয়া হয়। কথা হচ্ছে যাকে গালি দিয়ে দিন শুরু করলাম, বেলা বাড়ার সাথে সাথে বর্ডার পার হয়ে ‘ইন্ডিয়াতে চলে গেলাম শপিং করতে, চিকিৎসা করতে, এমন কি বর্ডার থেকে  চোরাই পথে আসা কোরবাণীর গরু আনতে,  আর লাদেনের পক্ষে শ্লোগান দিয়েই আমেরিকান এমবাসীতে চলে গেলাম  ভিসা আনতে। ভন্ডামীর একটা সীমা থাকে, বাংলাদেশের  ঐ সমস্ত শিক্ষিত শ্রেনীর  উল্লেখিত মানুষের ভন্ডামী দেখলে স্তব্ধ হয়ে যাই। এগুলো করার সময় তাদের একবারও খেয়াল হয় না, পরিবারের ছোট সদস্যটিও ঘুম ভেঙ্গে উঠে বড়দের মুখনিঃসৃত মধুবাণীগুলো শোনে, খুব ধীরে ধীরে তাদের মগজ ধোলাই হতে থাকে। এভাবেই একেক জন ‘নাফিস’ তৈরী হয়।

নাফিসের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সকলেই খুব জোর দিয়ে বলছে, নাফিস খুব মেধাবী ছিল, খুবই ধার্মিক ছিল, এর সাথে সাথে মুখ ফসকে আরেকটি কথাও বলছে, নাফিসকে কারো সাথে মিশতে দেখা যেতোনা, নাফিস খেলাধূলা করতোনা, এমন কি নাফিস তার কাজিনদের সাথেও মিশতো না। এই শেষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই বলে দেয় ‘নাফিস মানসিকভাবে সুস্থ ছিল না। আমি সাইকোলজী পড়েছি, সুস্থ মানসিকতার ছেলে মেয়ে এই বয়সে হবে চনমনে, স্মার্ট, খেলাধূলার প্রতি আগ্রহী, হৈ হুল্লোড়, আনন্দ ফূর্তিতে থাকবে প্রানোচ্ছল। এমন নিস্তেজ, ঘরকুনো, চুপচাপ থাকাটা ২১ বছর বয়সী ছেলেকে মানায় না। বোঝা যাচ্ছে, নাফিস রীতিমত বিষন্নতায় ভুগছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সে তার মেধা পড়ালেখায় ব্যয় করেনি, নাহলে জিপিএ ৫ পাওয়া ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ফেল করে! যাই হোক, নাফিসের বাবা-মা ভাল বলতে পারবেন, উনাদের এমন ঘরকুনো ছেলে কে কী বুঝে একা একা আমেরিকার মত এমন দেশে ছেড়েছেন। আমি হলে ছেলেকে এভাবে ছাড়তাম না। আহারে! একমাত্র ছেলে আছে মহাবিপদে, বাবা-মা ভয়ে ঘর-ছাড়া হয়ে পালিয়ে বেড়ায়! নাফিসের বাবা-মায়ের জন্য যতটা খারাপ লাগছে, যদি নাফিস সত্যি সত্যি কাজটা করে ফেলতো, তাহলে কত বাবা মায়ের জন্য যে আহাজারী করতে হতো! এই মুহূর্তে একটা প্রার্থণা, নাফিসের বিচার যেন স্বচ্ছ হয়। ইশ! সন্তানের অপকর্মের দায় নিতে হয় অভাগা পিতা-মাতাকে, আর কুনাগরিকের দায় বর্তায় অভাগা রাষ্ট্রের উপর!

যাই হোক, নাফিসের বিষয়টি এখন খুবই স্পর্শকাতর, এই বিষয়ে কোন কথা না বলা ভাল। কিনতু নাফিসের এই গ্রেফতার হওয়ার ঘটনায় প্রবাসী বাংলাদেশীরা ভীষন  মুষড়ে পড়েছেন। মুষড়ে পড়ারই কথা, এতদিন ‘ আমরা সবাই লাদেন হব’ শ্লোগানে ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত হতো, আমেরিকাতে আমাদের গায়ে এর বাতাস লাগতো না, আর এখন খোদ আমেরিকায় ধরা পড়ে গেলো বাংলাদেশের ছেলে, ‘লাদেনের ভাবশিষ্য’ হয়ে! এখন আমাদের গায়ে বাতাস লাগবেই,  এখন আমাদের  তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরা  কি বলবেন?  আমাদের হয়ে কি কিছুই বলবেন না? এর আগে ব্লগে, টুইন টাওয়ার এর গাঠনিক এবং নান্দনিক দিক নিয়ে একটি লেখা পোস্ট করেছিলাম, ৯/১১ উপলক্ষে। একেবারেই নির্দোষ সেই লেখাটির উপর এমন সব কমেন্ট এসেছে, একেকবার মনে হয়েছে ঠিক জায়গায় লেখাটি পোস্ট করিনি। কেউ কেউ মন্তব্য করেছে, আমেরিকা প্ল্যান করেই এটা করেছে,  কেউ বলেছে  সেদিন নাকি কোন ইহুদী মারা পড়ে নি!  যেনো ইহুদী মারা পড়লেই ব্যাপারটা অন্যরকম হতো! মানুষ কতটা অমানবিক হলে পরে এমন মন্তব্য করতে পারে! তাদের একবারের জন্যু মনে হলোনা, ইহুদী মারা না গেলেও, যারাই মারা গেছে, সকলেই নিরপরাধ, এর মধ্যে আমাদের বাংলাদেশী ছেলেমেয়েও ছিল। তাহলে আমাদের ঘরে তো এমন তরুন ‘নাফিস; দের জন্ম হবেই। আমেরিকান কাস্টমস এতদিন না হয় ‘মুসলিম’ নাম বেছে বেছে হ্যারাস করতো, এখন কী হবে? এখন তো শুধু আমেরিকা তেই না, বিশ্বের প্রতিটি দেশেই বাংলাদেশী পাসপোর্টধারীদের হ্যারাস করা হবে! আমরা কিচ্ছু বলতে পারবো না। আমাদের কিচ্ছু বলার মুখও নেই। অলরেডি শুরু হয়ে গেছে হ্যারাসমেন্ট। মাত্র তিন দিন আগের ঘটনা বলি।

হঠাৎ সংবাদে আমি দেশে গিয়েছিলাম ১২ দিনের জন্য। গিয়েছিলাম কাতার এয়ারওয়েজে করে। ফিরেছিও একই এয়ার ওয়েজে। আসলে ৯/১১ এর পর থেকে যতবার দেশে গেছি, আমি সব সময় আরব দেশের ফ্লাইটকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। এমিরেটস, গালফ এয়ার, কাতার এয়ার ওয়েজে করে গিয়েছি। যুক্তি দেখিয়েছি, আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান বা ইন্ডিয়ান ফ্লাইটে গেলে প্লেন হাইজ্যাক হওয়ার ভয় থাকে,কিনতু এরাবিয়ান ফ্লাইটে সেই ভয় নেই! এটা নিতান্তই আমার ধারনা। এবার আমেরিকান পাসপোর্ট নিয়ে গিয়েছি। আমেরিকান পাসপোর্ট হাতে নিয়ে চলাফেরায় কিছু বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়, আমিও সেটা পেয়েছি, তবে সেটা ঢাকা যাওয়ার সময়। ফেরার দিন দোহা এয়ারপোর্টের কাস্টমসে গিয়ে দেখি হ য ব র ল অবস্থা। মায়ের মৃত্যু পরবর্তী শোকে মুহ্যমান ছিলাম, আমার সাথে ছিল ভ্যানিটি ব্যাগ এবং মায়ের শাড়ী দিয়ে ভর্তি করা একটি মুখ খোলা হাত ব্যাগ। কাস্টমস অফিসার ছিলেন একজন আরবীয়।  আমাকে ওখানেই থামিয়ে দিয়ে দুটি ট্রে দিয়েছে এবং আমাকে ভ্যানিটি ব্যাগ এবং মুখ খোলা হাত ব্যাগের জিনিস ট্রেতে ঢেলে দিতে বলেছে। কাসটমস অফিসার আমাকে হিন্দীতে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিল। আমি হিন্দী বুঝি, কিনতু বলতে পারিনা,  কিছু না বুঝেই সব বের করে দিতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করলাম, অফিসারটি  কিছু কিছু হোয়াইট যাত্রীর ব্যাগ না খুলেই স্ক্যানারে দিচ্ছে। আমার পাসপোর্ট আমেরিকান হলেও চেহারা ভারতীয়, পাসপোর্টে জন্মস্থান লেখা আছে, বাংলাদেশ। আমার ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর পাসপোর্ট, ডলার, কিছু দামী জিনিস ছিল বলে বের করতে ইতস্তত করছিলাম, একটু ভেবে না খুলেই ব্যাগ ট্রে তে দিলাম, হাত ব্যাগ থেকে সব বের করে ট্রেতে দিলাম। ঠিক করলাম, অফিসার কিছু বললে চ্যালেঞ্জ করবো আমার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরন করা হচ্ছে বলে। হঠাৎ করেই একটু সন্দেহ জাগলো মনে, তবে কি এর মধ্যে আবার কোন ‘ঘটনা’ ঘটে গেলো নাকি! এবার কি তাহলে আমেরিকানরা কিছু ঘটিয়ে ফেললো নাকি? যাই হোক ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে আর কোন ঝামেলা হয়নি। এটা ঘটেছে দোহা এয়ারপোর্টে, হিউস্টন এয়ারপোর্টে অবশ্য এতটা কড়াকড়ি ছিল না।

বাড়ী ফিরেছি গভীর রাতে, সকালে নেটে বসতেই দেখি নাফিসের ছবি দিয়ে গ্রেফতার সংবাদ। হি্সেব মিলিয়ে দেখি, কাতার এয়ারপোর্টে অবস্থানকালীন সময়টি ছিল ‘বুধবার’। বুধবারেই নাফিস গ্রেফতারের সংবাদটি প্রচারিত হয়। খবর প্রচারের প্রথম দিনেই আমেরিকান পাসপোর্টধারীর এই অবস্থা, তাও আবার খোদ আরবদেশীয় এক রাষ্ট্রে, তাহলে খোদ আমেরিকায় কড়াকড়ি কতখানি বাড়বে (আমাদের সেটা মেনে নিতেও হচ্ছে ও হবে) প্রবাসী বাংলাদেশীদের উপর (শুধু মুসলিম না), সেটা ‘নাফিসের প্রতি দরদী’দের বুঝানোর জন্যই আমার নিজের উপর দিয়ে ঘটে যাওয়া অতি তুচ্ছ ঘটনাটুকু বললাম। দেশে এবং বিদেশে অবস্থানকারী একচক্ষুওয়ালা ভাই-বোনদের প্রতি অনুরোধ, এবার আপনারা শান্ত হোন। দেশের ভেতর উস্কানীমূলক শ্লোগান দিয়ে, বিদেশের মাটিতে ঘরে বসে অন্নদাতার শ্রাদ্ধ করে আমাদের আর বিপদের মুখে ঠেলে দিবেন না। আমেরিকা বা অন্য যে কোন দেশ থেকে যদি আমাদের অন্ন উঠে যায়, আমরা কিনতু পঙ্গপালের মত দেশের মাটিতে গিয়ে আছড়ে পড়বো। আমাদের স্থান দিবেন কোথায়?

Saturday, October 20, 2012

সার্বজনীন দুর্গোৎসব হয়ে উঠুক সার্বজনীন!

পঞ্জিকার তিথি অনুযায়ী, আজ, ২০শে অক্টোবার থেকে শুরু হচ্ছে সার্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসব।  আজ ষষ্ঠী পূজো দিয়ে শুরু এবং সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমীপূজো শেষে ২৪শে অক্টোবার প্রতিমা বিসর্জন শেষে হবে শারদোৎসবের সমাপ্তি। পূজা বছরের যে কোন সময় করা যায়, দুর্গাপূজাও ক্ষেত্রবিশেষে, গোষ্ঠী বিশেষে অন্যনামে অন্য ঋতুতেও অনুষ্ঠিত হয়। কিনতু বাঙ্গালীর দুর্গাপূজা উদযাপিত হয় শরৎকালে, সেই রামায়ণের যুগ থেকে। ধর্মীয় গল্প সম্পর্কে আমার জ্ঞান সীমিতের চেয়েও অনেক কম, নেই বললেই চলে। সম্প্রতি প্রয়াত মায়ের কাছ থেকেই শিখেছি, সকল ধর্মের মূলবাণী এক, সেই মূলবাণীটি হচ্ছে, মানবধর্মই আসল ধর্ম। 

কর্মজীবনে মা ছিলেন  স্কুলের গনিত ও হিন্দুধর্মের শিক্ষিকা। পুরোপুরি বিপরীত বিষয়, বিজ্ঞান ও ধর্ম, এই দুটি বিষয়েই মায়ের ছিল পরিষ্কার ধারনা। এই দুই থেকেই মা মূলটুকু নিয়েছেন, আমাদের শিখিয়েছেন, যে কোন পরিস্থিতিতে মনে ও মননে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করতে,  জীবে দয়া করতে, দুঃখীকে সেবা করতে। কতটুকু শিখেছি জানিনা, তবে মায়ের নির্দেশ সব সময় পালন করতে না পারলেও অমান্য করিনা। মা অনেক ধর্মীয় গল্প জানতেন, যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে মা'কে জিজ্ঞেস করলেই 'পুরাণ' থেকে দুই একটা গল্প শুনিয়ে দিতেন, ঈশপের গল্প শোনাতেন, উনি চাইতেন, গল্পের মূল বাণীটুকু যেন হৃদয়ঙ্গম করতে পারি। আমার মা প্রচুর পড়াশোনা করতেন, বিপ্লবী বই থেকে শুরু করে গল্প-উপন্যাস, ধর্মীয় শিক্ষার বইও ছিল উনার সংগ্রহে। শুধু হিন্দু ধর্মই নয়, ইসলাম , বাইবেল সম্পর্কেও উনি অনেক কিছু জানতেন। স্কুলের মৌলবী স্যারের কাছ থেকে গল্প শুনে, নানা বই পড়ে  আমার মা হয়ে উঠেছিলেন 'দারুন অসাম্প্রদায়িক' এক ব্যক্তিত্বের অধিকারীনি।  মায়ের কাছ থেকে পাঠ নিয়েছি, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খৃষ্টান, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সবাই মানুষ। ৭৫ বছর বয়সী মা আমার, কতখানি অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, ৮ই অক্টোবার উনার মৃত্যুর পরেই তা আরেকবার প্রমানিত হয়েছে, উনার সন্তানদেরকে সান্ত্বণা দিতে আসা মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে। আমার মা' ছিলেন সর্বজনের, 'মা' ছিলেন সার্বজনীন, সকল সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেই মা ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত। উনার মৃত্যুতে পাড়ার সুইপার থেকে শুরু করে, স্কুলের আয়া 'মেহের খালা',  বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাইটে প্রফেসারকেও কাঁদতে দেখে আমার কান্না থেমে গেছে। শোকের বদলে মনে এক ধরনের আনন্দ এসেছে।  উপলদ্ধি করেছি, মা শুধু আমার ছিলেন না, উনি ছিলেন সকলের। মা তাঁর কর্মের মাধ্যমেই হয়ে উঠেছিলেন  অসাম্প্রদায়িক,  সকল গোত্রের, সকল ধর্মের ক্রন্দনরত মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে আরেকবার মেনে নিয়েছি,  মানব ধর্মই হবে জীবনের মূল বাণী।

 ধর্মীয় কাহিণী সম্পর্কে আমার কোন ধারনা না থাকলেও মায়ের গল্পের  একনিষ্ঠ শ্রোতা, তাঁরই ভ্রাতুষ্পুত্রী, নূপুরের খুব ভাল ধারনা আছে। কম বয়সী এই মেয়েটি থাকে নিউইয়র্কে, নূপুরের কাছেই জেনেছি, শরৎঋতুতে দুর্গাপূজা উদযাপনের কাহিণী। হয়তো সকলের ধারনার সাথে মিলবে না, তবুও নূপুরের বলা গল্পটি আমার ভাল লেগেছেঃ

ত্রেতাযুগ বা রামায়ণ যুগের পূর্বে মূল দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতো বসন্ত ঋতুতে।  ত্রেতাযুগে্ শ্রী রাম সর্ব প্রথম শরৎকালে দূর্গাপূজা করেন।  রাবন রাজার শৃংখল থেকে  সীতাকে উদ্ধার করতে গিয়ে, শ্রী রাম  বিশাল সমুদ্রের কাছে এসে তাঁর যাত্রা থামিয়ে দেন।  সমুদ্র পার হওয়ার কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে ভীষন মুষড়ে পড়েন।  সমুদ্র কিভাবে ডিঙ্গানো যায় সেই দুঃশ্চিন্তা, দুর্ভাবনায় অস্থির রামকে 'সমুদ্র দেবতা' স্বপ্নে দেখা দেন। স্বপ্নেই শ্রীরাম কে সমুদ্র দেবতা দেবী মহামায়ার পূজা করার জন্য অনুরোধ করেন। বলেন, একমাত্র দেবী মহামায়া সন্তুষ্ট হলেই রাম সমুদ্র ডিঙ্গাতে পারবেন এবং রাবন রাজাকে পরাস্ত করে সীতা দেবীকে উদ্ধার করতে পারবেন। স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশমত যথাসময়ে রাম দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। বিধি অনুযায়ী ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে দূর্গা মায়ের পূজা সম্পন্ন হয়, শ্রী রাম ১০৭টি নীলপদ্ম যোগাড় করতে পেরেছিলেন। একটিমাত্র নীলপদ্মের জন্য পূজা হবেনা, তাই কি হয়? রামচন্দ্রের চোখের রং ছিল নীল, একটি নীলপদ্মের বিকল্প হিসেবে  নিজের একটি চোখ দান করতে উদ্যত হতেই দেবী দূর্গা রামচন্দ্রকে দেখা দেন। রামচন্দ্রের পূজায় তুষ্ট হয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করেন। 'রাম-রাবণ' যুদ্ধে রামচন্দ্র  দিগবিজয়ী রাবনরাজকে পরাস্ত করেন, ধর্মের জয় হয়,  স্ত্রী সীতাকে রাবন রাজার কবল থেকে মুক্ত করেন।

আরও অনেক পরে, 'কলিযুগে' আরেকবার দূর্গাপূজা উদযাপিত হয় শরৎকালে। সুরেশ বৈদ্য নামের এক বনিকের সপ্তডিঙ্গা নদীতে ডুবে যায়, বানিজ্যে সমস্ত সম্পত্তি হারিয়ে উদভ্রান্তের মত ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে পথিমধ্যে রাজ্যহারা আরেক রাজার সাথে  বনিকের সাক্ষাৎ হয়। রাজ্যহারা, সম্পত্তিহারা দুই অসহায় পুরুষ,  চলতিপথে এক মুনিঋষির সাক্ষাৎ পান। সেই ঋষি দুই ভাগ্যহীনকে 'শ্রী রামচন্দ্রের' 'অকালবোধন' পূজার গল্প শোনান, দেবী দূর্গার পূজা করতে বলেন। রামচন্দ্রের দূর্গাপূজার কাহিণী শুনে দুই ভাগ্যহারা অনুপ্রাণিত হন, দুজনে মিলে দূর্গাপূজা করেন। সেই সময়টাও ছিল শরৎকাল। পূজায়  দেবী সন্তুষ্ট হন, তাঁদের হারানো সম্পদ আবার তাঁরা ফিরে পান। সেই থেকেই  'দূর্গাপূজা' উদযাপিত হয় শরৎকালে।

দুর্গাদেবী মুলতঃ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আরাধ্য দেবী হলেও দুর্গাপূজা হচ্ছে সার্বজনীন। বাংলার হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টানসহ দেশের সকল সম্প্রদায়ের মাঝে দুর্গাপূজা বাংলার শারদোৎসব হিসেবে পরিচিত। সার্বজনীন শারদোৎসবে বাংলার প্রতিটি মানুষের অংশগ্রহণ মানুষে মানুষে মহামিলনের বাণীকে উদ্দীপিত করে। আমার জেলাশহর নারায়নগঞ্জের আমলাপাড়াতে প্রতিবছর উদযাপিত হয় শহরের সবচেয়ে  প্রাচীন দূর্গাপূজা। শতবর্ষ আগে পাড়াটি ছিল হিন্দু প্রধান, এমন কি মুক্তিযুদ্ধের আগেও দেখেছি আমলাপাড়াতে হিন্দুদের প্রাধান্য।  এখন আমলাপাড়ার জনগোষ্ঠির অর্ধেক হিন্দু, অর্ধেক মুসলমান। পরিবর্তন এসেছে জনগোষ্ঠীতে, পরিবর্তন আসেনি উৎসব উদযাপনে। আমলাপাড়ার দূর্গাপূজাতে হিন্দু ধর্মালম্বীদের পাশাপাশি মুসলমান ধর্মাবলম্বীরাও অংশ গ্রহণ করেন। দেবীমূর্তি স্থাপন থেকে শুরু করে বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের সময়ও হিন্দু-মুসলিম ছেলেরা একসাথে প্রতিমার কাঠামোতে হাত লাগান। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী পূজাতে সন্ধ্যারতির সময় ঢাকের বাদ্যির তালে তালে যারা নাচেন, তাদের মধ্যে থেকে হিন্দু-মুসলিম আলাদা করে চেনার প্রয়োজন হয়না। শারোদোৎসবে সকলেই মিলে-মিশে একাকার হয়ে যান।


প্রতি বছর দুর্গাপূজার প্রারম্ভে পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে, দেশের বিভিন্ন স্থানে দেবী মূর্তি ভাংচুরের ঘটনা। মন খারাপ হয়, প্রবাসে বসেই চোখের জল ফেলি। ঐ সমস্ত দুর্বৃত্তদেরকে ডেকে বলতে ইচ্ছে হয়, " তোরা আয়, দেখে যা এসে, নারায়নগঞ্জে হিন্দু-মুসলিম মিলে মিশে কিভাবে দুর্গাপূজা উদযাপন করি"।  অতি সম্প্রতি ব্লগে 'বিন্দু বিসর্গ' নামের এক ব্লগার আমার একটি লেখার উপর মন্তব্য করেছে,
" আমাদের এলাকাতে অল্পকিছু সংখ্যক হিন্দু ধর্মা্বলম্বী বাস করেন। সংখ্যায় এতই কম যে দুর্গা উৎসবে পুজো তুলে তা বিসর্জন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব না। তার পরেও প্রতিবছর তারা পুজো উদযাপন করেন। আর একাজে সর্ব ভূমিকা নেয় এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়। পুজোর ঢাক বাজানো থেকে শুরু করে আয়রতি ও বিসর্জন সব কাজেই পাড়ার ছেলেরাই অগ্রগামী যা উৎসবকে সার্বজনীন রুপ দেয়। আমি কখনও শুনি নাই যে তাদের পুজো উৎসবে কোন সমস্যা হয়েছে। স্বগতম হে দেবী—"
'বিন্দু বিসর্গের' এলাকার অসম্ভব অসাম্প্রদায়িক জনগনের প্রতি আমার শ্রদ্ধা থাকলো।



প্রবাসে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয় একেবারেই ভিন্ন আঙ্গিকে। খুব বড় শহর ছাড়া প্রবাসের আর কোথাও দুর্গাপূজা তিথি অনুসারে সম্পন্ন হয়না। কারন তিথি অনুযায়ী পূজা আয়োজন করতে গেলে উইক ডে তে আয়োজন করতে হয়, কারোর ছুটি থাকেনা। সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার নিমিত্তেই পূজা উদযাপনের দিনক্ষন পালটে যায়, শনি, রবি ছাড়া পূজা আয়োজন করা সম্ভব হয়না।  তাছাড়া পুরোহিত স্বল্পতার সমস্যাও আছে।  একজন পুরোহিতের পক্ষে কখনওই সম্ভব হয়না, একই সাথে দুই তিন জায়গায় পূজা করা। এক স্টেট থেকে আরেক স্টেটে যেতেও কমপক্ষে তিন চার ঘন্টা সময় লাগে। তাই পুরোহিতের সময়ের উপরও নির্ভর করতে হয় আমাদেরকে।


আমি থাকি মিসিসিপিতে। এ বছর মিসিসিপির জ্যাকসান শহরে দুর্গাপূজা হবে ২৭শে অক্টোবার। মূল পূজা উদযাপনের এক সপ্তাহ পরে। মনটা অবশ্যই খারাপ লাগছে, কিনতু কিছুই করার নেই। যে পুরোহিত পূজা করবেন, আগের সপ্তাহে তিনি টেনেসী রাজ্যের মেমফিস শহরে পূজা করবেন। মেমফিসে তুলনামূলক অনেক বেশী বাঙ্গালী (হিন্দু-মুসলিম), পুরোহিত থাকেন মেমফিসে, তাই 'মেমফিসবাসী'র দাবী বেশী।  আমাদের পূজা হয় একদিনে, শুধুই শনিবার। খুব কম বাঙ্গালী বলেই পূজাটি ঘরোয়া রূপ নেয়। দেবী মূর্তি কলকাতা থেকে আনানো হয়েছে, বছর দুই আগে। অন্যান্য স্টেটের মত আমাদের স্টেটের দেবীমূর্তিও পূজাশেষে খুব যত্ন করে সংরক্ষনের ব্যবস্থা করা হয়। খুবই ব্যয় বহুল ব্যাপার প্লেনে করে মূর্তি আনানো। সেজন্যই একবারের পূজিত মূর্তি দিয়েই পরের বছর কাজ চালানো হয়।  প্রবাসে নিয়ম নাস্তি, এটাই আমাদের সান্ত্বণা। ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে শ্রীরামচন্দ্র দূর্গা পূজা করেছিলেন, আমরা কোথায় পাব নীলপদ্ম! আমার বাড়ীর আঙীণায় স্থলপদ্মের গাছ আছে, এই সময়টাতেই স্থল পদ্ম ফুটে।  আমরা থাকি জ্যাকসান শহর থেকে অনেকটা দূরের এক শহর কলম্বাসে,  তিন ঘন্টা ড্রাইভ করে এক গোছা স্থলপদ্ম নিয়ে আমরা গিয়ে হাজির হই জ্যাকসানে। আমার বাড়ীর স্থলপদ্ম দেবী দুর্গার দশ হাতে শোভা পায়, দেখে দু'চোখ জলে ভরে আসে। মনে মনে প্রার্থণা করি, "মা গো, জগতের সকলেই সুখী হোক, সকলের দুঃখ দূর করে দাও মা"।

গত পাঁচ বছর ধরেই মিসিসিপির জ্যাকসানে আমরা দূর্গাপূজা করছি। আশেপাশের ছোট ছোট শহর থেকে কিছু কিছু বাঙ্গালী চলে আসে মিসিসিপির পূজাতে যোগ দিতে। অন্য জায়গায় কি হয় জানিনা, কিন্তু মিসিসিপির জ্যাকসান শহরে গেলে দেখা যায়, হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি। এখানে পূজা-পার্বন, ঈদ-রোজা, ক্রীসমাস থেকে শুরু করে যে কোন উৎসবে সকলের উপস্থিতি আরেকবার মনে করিয়ে দেয়, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খৃষ্টান----আমরা বাঙ্গালী!

দুর্গাপূজা সার্বজনীন, তাই সকলকে সার্বজনীন শারদীয় শুভেচ্ছা!

Thursday, October 18, 2012

সহযাত্রী!

দুই সপ্তাহ আগেই মায়ের গুরুতর অসুস্থতার সংবাদ পেয়েছুটে গেছিলাম দেশে। আমি থাকি আমেরিকায়, যখন তখন দেশে যেতে পারিনা। দুই বছরে একবার যাই, পুরো পরিবারসহ। এই  হিসেবেই গত এগারো বছর ধরে আমরা দেশে যাওয়া আসা করি। এই বছর সামারে দুই মাসের জন্য দেশে গিয়েছিলাম, পুরো পরিবার। আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা মোট পাঁচজন। তিন কন্যা, স্বামী, আর আমি। এই সামারে বড় কন্যার বিয়ে দিলাম, পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচের বদলে ছয় হলো অথবা পাঁচের বদলে চার হলো। দুটোই সত্যি। লেখাটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা নিয়ে নয়, ধান ভানতে শীবের গীত গাওয়া আমার স্বভাব। মূল কথায় চলে আসি। লেখাটি লিখতে চেয়েছি আমার দেশে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে, দেশে যাওয়ার পথে সহযাত্রীদের নিয়ে।

ছোটবেলা থেকেই আমি একা পথ চলতে ভয় পাই। মায়ের শাসনে বড় হয়েছি বলেই আমার মধ্যে এক ধরনের জড়তা কাজ করে। বিশেষ করে পথ চলতে গেলেই আমি কাবু হয়ে যাই, একা একা কোথাও যেতে সাহস পাইনা। নির্দিষ্ট একটা বয়সের পরে মা আমাকে কোথাও  একা একা যেতে দিতেন না। স্কুল আর কলেজের গন্ডীটুকু ছাড়া আমি কোথাও যাইনি, তাই আমার নিজের শহর নারায়নগঞ্জের কিছুই ভালভাবে চিনতেও শিখিনি। একা একা কোথাও যেতাম না বলেই একা একা চলতেও শিখিনি। বাইরে বেরোবো কি, পথ হারিয়ে ফেলতে পারি ভয়ে পরবর্তী জীবনেও সাথী ছাড়া কোথাও বের হইনি।  বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হতেই স্বাধীনতা পেয়েছি। বাইরে ঘরে চলার স্বাধীনতা, তবে খাঁচার পাখী ছিলাম তো, তাই আকাশে উড়ার সুযোগ পেলেও উড়তে পারিনি। সব সময় সাথে একজন সঙ্গী থাকতোই আমার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারায়নগঞ্জ আসতে গেলেও দুই একজন বন্ধু আমার সাথে আসতো, গুলিস্তান এসে নারায়নগঞ্জের বাসে তুলে দিয়ে যেত। এই হচ্ছি আমি।
বিয়ের পরে তো সর্বক্ষনের সঙ্গী পেয়েই গেলাম। আমার স্বামীই আমাকে গাইড করেছে। যদিও উঠতে বসতে ‘বোকা’ বলে মৃদু ধমক দিয়েছে, তারপরেও আমাকে কোথাও একা ছাড়েননি। যেখানেই গিয়েছি, হয় আমার স্বামী নাহয় আমার তিন কন্যাকে পেয়েছি সহযাত্রী হিসেবে। সহযাত্রী হিসেবে আমার মধ্যম কন্যাটি সর্ব শ্রেষ্ঠ। মধ্যম কন্যার নাম ‘মিশা’। মিশা পাশে থাকলে যে কোন অন্ধও অনায়াসে পৃথিবী ভ্রমন করতে পারবে নিশ্চিন্ত মনে। যতবার দেশে গেছি, মিশা আমাকে গাইড করেছে। দেশে যেতে আমার লাগেজ হয়ে যায় অতিরিক্ত ওজনে ঠাসা। কাস্টমসে গিয়ে কাস্টমস অফিসারকে কিভাবে যেনো ভুলিয়ে ফেলে মিশারানী। অতিরিক্ত এক কেজি ওজন যেখানে এলাউড না, অতিরিক্ত চার কেজি ওজনও পার পেয়ে গেছে মিশার বদৌলতে। প্লেনে উঠে একটি মাত্র জানালার পাশের সীট মিশা আমাকে দিয়ে দেয়। খাবারের কার্ড নিয়ে যখন বিমান বালা সামনে আসেন, ‘ভ্যাবলাকান্ত’ মায়ের জন্য খাবারের মেন্যু ঠিক করে দেয় মিশা। আমি নিশ্চিন্ত মনে প্লেন যাত্রা উপভোগ করি। আমার পরিবারের সদস্যরাই ছিল আমার সহযাত্রী, এভাবেই আমি অভ্যস্ত ছিলাম। এবারই প্রথম ব্যতিক্রম ঘটলো। যে মায়ের শাসনে থেকে আমি এমন ভীতু হয়েছি, বলা নেই কওয়া নেই, সেই মা’ই হঠাৎ করেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মাত্র দুই মাস আগেই দেশ থেকে ফিরেছি সুস্থ মা’কে দেখে। মা এমনই অসুস্থ হলেন যে সবার বদ্ধমূল ধারনা হয়ে গেল, মা আমার যখন তখন আমাদের মায়া কাটিয়ে চলে যাবেন।

আমি মায়ের একটা মাত্র মেয়ে। মা আমাকে শেষ বারের মত আরেকবার দেখবেন না, তা কি করে হয়! সিদ্ধান্ত হয়ে গেলো, আমি দেশে যাব। কিনতু মনে মনে ভীষন মুষড়ে পড়লাম। একা একা কীভাবে যাব! মিসিসিপি নামের যে স্টেটে আমি থাকি, এর অবস্থান এমনই এক জায়গায়, যেখান থেকে দেশে যেতে গেলে দুই তিনবার প্লেন পাল্টাতে হয়। এবার আমি গিয়েছি, মিসিসিপি টু হিউস্টন, হিউস্টন টু দোহা, দোহা টু ঢাকা। হিউস্টন এয়ার্পোর্ট হয়ে এর আগেও আমরা গিয়েছি দেশে। তখন সাথে ছিল মিশা, মৌটুসী নামের দারুন স্মার্ট দুই কন্যা। ওরা আমাকে বলতে গেলে চোখ বন্ধ করেই নিয়ে গেছে। হিউস্টন এয়ারপোর্টে অনেকগুলো টার্মিনাল আছে। এক টার্মিনাল থেকে ট্রেনে চেপে আরেক টার্মিনালে যেতে হয়। হাতে সময় থাকে অল্প। এই সময়ের মধ্যেই লাগেজ নিয়ে ছুটতে হয়। আমি ওদের পেছন পেছন ছুটেছি, এই পর্যন্ত।
হাতে প্লেনের টিকিট পেয়েই আমি ঘামতে শুরু করেছি। মায়ের কাছে যেতে পারবো তো! প্লেন যদি মিস করি! ভুল করে যদি অন্য প্লেনে উঠে যাই! যদি লাগেজ হারিয়ে ফেলি! পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলবো না তো! মাত্র একদিনের সিদ্ধান্তে অতিরিক্ত ডলার খরচ করে পরের দিনের টিকিট কেটেছি। রাতের বেলা মিশাকে ফোন করে বলেছি, কিভাবে যেতে হবে তার একটি ডায়াগ্রাম একে যেন মেসেজ করে পাঠায়। মিশা সাথে সাথে অ আ ক, খ করেই পাঠিয়েছিল ডায়াগ্রাম। কিনতু দূর্ভাগ্যবশতঃ ডায়াগ্রামটি ওপেন করতে পারিনি। সম্পূর্ণ একা রওনা হয়েছি। মিসিসিপি এয়ারপোর্টে পৌঁছে আমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করেছি, কোথায় কোথায় থামতে হবে। সে সংক্ষেপে বলে দিয়েছে, ঠিক কোন কোন জায়গায় আমাকে থামতে হবে। ব্যস! আমি রওনা হয়ে গেছি। প্রথম ধাপ পেরিয়ে প্লেনে উঠে বসেছি। মায়ের কথা মাথায় ছিল না, একটাই চিন্তা ছিল, হিউস্টনে গিয়ে কিভাবে টার্মিনাল পার হবো।

আমি মানুষের সাথে কথা বলতে পারি, এই একটা গুণ আমার আছে। সেই গুণকে সম্বল করেই মনে সাহস আনতে চেষ্টা করছিলাম, প্রথম সহযাত্রী হয়ে আমার পাশে বসলো বিরাট লম্বা চওড়া এক হোয়াইট যুবক।  মাথা কামানো, হাতে ট্যাটু করা যুবকটিকে আমি আগেই লাইনে দাঁড়ানো দেখেছিলাম। তাকে দেখে আমার একটুও পছন্দ হয়নি, আর সে-ই কিনা আমার সহযাত্রী! আমেরিকান এয়ারলাইন্স গুলো হচ্ছে পিশাচের পিশাচ। এরা প্লেনে কিছুই খেতে দেয়না, তার উপর  সীট গুলো এমনই ছোট এবং চাপা যে দু’জন দূর্বল স্বাস্থ্যের মানুষও ভালোভাবে বসতে পারেনা। সেই জায়গায় এই বিশালদেহী আমার পাশে বসে আবার ঘুমিয়েও পড়েছে। আমি একেবারেই কোনঠাসা অবস্থায় বসে আছি। আমার অবশ্য কোন শুচিবাই নেই। একজন এত জায়গা নিয়ে বসেছে, তার শরীরের অনেকটা অংশই আমার সীটের উপর এসে পড়েছে বলেই যে আমি  ‘আমার মান সম্ভ্রম চলে গেছে’ বলে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াব, তেমন অবিবেচক আমি নই। তবে ছেলেটি কিনতু অবিবেচক ছিল, তার এই বিশাল দেহ আরেক যাত্রীর সীটে চলে যাওয়ার পড়েও সে কিভাবে ঘুমিয়ে গেলো, সেটাই আমার বোধগম্য হচ্ছিল না।
দুই ঘন্টায় প্লেন হিউস্টনের মাটি স্পর্শ করলো। নেমে গেলাম প্লেন থেকে, গিয়ে পৌঁছলাম ‘বি’ টার্মিনালে। যেতে হবে ‘ ডি’ টার্মিনালে। কিভাবে যাবো, সকলকেই দেখি টিভি স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি টিভি স্ক্রীনের দিকে না তাকিয়ে একজনকে থামালাম, বললাম ‘ডি’ টার্মিনালে যাব। সাথে সাথে সে আমাকে বললো, তাকে ফলো করার জন্য। কিনতু ‘কাতার’ এয়ার লাইনসের কথা বলতেই সে বললো, টিভি স্ক্রীনে চেক করে নেয়ার জন্য। এবার আমি জিজ্ঞেস করলাম টার্মিনাল পুলিশকে। সে আমাকে রাস্তা দেখিয়ে দিতেই আমি টুক টুক করে এস্কেলেটার পালটিয়ে পালটিয়ে চলে গেলাম ট্রেন স্টেশানে। অবশ্যই মিশার নির্দেশ মত সাইন গুলোও পড়ছিলাম। ট্রেনে উঠেই মিশার ফোন পেলাম। ও যখন জানতে পারলো যে আমি ট্রেনে উঠে গেছি, ও যে কী খুশী হলো। ট্রেন থেকে নেমেই আমি প্রথমেই একজন এয়ারপোর্ট স্টাফকে বললাম, কাতার এয়ারওয়েজ এর গেইট দেখিয়ে দেয়ার জন্য। সে আমাকে বললো, ডোহা ডোহা? মনে পড়ে গেলো, এরা দোহা বলতে পারেনা, বলে ডোহা। বললাম, ইয়েস ডোহা। সে বলে দিল, সোজা চলে যাও ১২ নাম্বার গেইটে। ব্যস! সকল আনুষ্ঠানিকতা সেরে উঠে বসলাম প্লেনে।

এবারও  আমি পেলাম জানালার পাশের সীট, পরবর্তী সীটে এসে বসলো আরেকটি হোয়াইট ছেলে, এর মাথাও সম্পূর্ণ কামানো।  দোহা গিয়ে কিভাবে ঢাকার ফ্লাইট ধরবো, সেই চিন্তায় একটু অস্থির ছিলাম। আশা করছিলাম, আমার সহযাত্রী যদি ঢাকাগামী কেউ হয়! যাই হোক আমেরিকান সহযাত্রীর কাছে জানতে চাইলাম, সে কোথায় যাচ্ছে। বললো, নেপাল। আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, সে কি নেপালী কি না! বললো, সে ইউরোপিয়ান আকেরিকান,  নেপাল যাচ্ছে হাইকিং করতে। একা যাচ্ছে কিনা জানতে চাইতেই একটু দূরে দাঁড়ানো আরেক জনকে দেখিয়ে বললো, বাবার সাথে যাচ্ছে। বাবা এসে তিন নাম্বার সীটে বসতেই আমি নিজে থেকে আলাপ শুরু করে দিলাম। বাবার নাম স্টীভ, ছেলের নাম পিটার। একমাত্র সন্তান পিটারকে নিয়ে বাবা যাচ্ছেন হাইকিং করতে। বাপ-ছেলেতে মিলে বছরে একবার অন্তঃত নানা দেশে যায়, হাইকিং করতে। ছেলের মা’কে খুব বেশী কিছু জানায়না, মা ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে ভেবে। নেপালে স্টীভ এর আগেও আরেকবার গিয়েছিল, এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে পারেনি, তবে অনেকটাই উঠেছিল। স্টীভ খুব গর্বের সাথেই বললো, ছেলের কথা। স্টীভ শুধুই হাইকিং করে, কিনতু ছেলে পিটার  ক্লাইম্বিংএও পারদর্শী। এমন সহযাত্রী পেয়ে আমার ভালো লেগেছে। সাহসী সহযাত্রী পাশে থাকলে মনে সাহসের সঞ্চার হয়। তাদেরকে বললাম, আমাকে একটু সাহায্য করতে দোহা এয়ারপোর্টে গিয়ে। ঠিক গেইটে যেনো উপস্থিত হতে পারি। দোহা পৌঁছে স্টীভ আর পিটার আমার জন্য গেইটে অপেক্ষা করছিল। ততক্ষনে এয়ার পোর্ট পুলিশকে জিজ্ঞেস করে আমি জেনে নিয়েছি ঢাকা যাওয়ার গেইট নাম্বার। আমাকে সেই পথে যেতে দেখে স্টীভ হাত তুলে ‘গুড লাক’ জানিয়ে অন্য পথে চলে গেলো।

দোহা থেকে যে ফ্লাইটে উঠেছি, সেটা এক কথায় অসহ্য। আমার সীট পড়েছে মাঝের রো তে। আমার আগে যারা উঠেছে, তারা প্লেনে উঠেই ক্যাঁচোর ব্যাঁচোর শুরু করে দিয়েছে। এত বছর বাইরে থেকেও আমার দেশী ভাই বোনেরা ন্যুনতম ভদ্রতা শিখেনি, এটা দেখলেই মন খারাপ হয়ে যায়। একজনের সীটে আরেকজন বসে পড়ার মত ঘটনা তো আছেই, প্লেনে উঠেই লাগেজ রাখার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করে দেয়। প্লেন যখন ল্যান্ড করে, প্লেনের চাকা না থামতেই পাইলটের ‘ নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সীটে বসে থাকুন’  ঘোষনাকে অমান্য করেই অনেকেই সীট বেল্ট খুলে দাঁড়িয়ে  লাগেজ বক্স খুলে ফেলে। এয়ারহোস্টেসদের দৌড়ে আসতে হয় তাদের থামানোর জন্য। এটা প্রতিবার ঘটে।  আমার যাত্রাটিকে আরেকটু অসহণীয় করে তোলার জন্যই বোধ হয় এবারই বেশ কিছু যাত্রীর  সাথে ‘নন স্টপ ক্রাইং’ বাচ্চা ছিল । সারাটা পথ বাচ্চাদের চীৎকারে এক সময় অসহণীয় হয়ে উঠেছিল পথটুকু।  বাচ্চাদের অভিভাবকেরা বাচ্চাগুলোকে কান্না থামানোর কোন চেষ্টাই করছিল না। বাচ্চাদের ভুলানোর কত কৌশল আছে, কাউকেই দেখলাম না এতটুকু বিচলিত হতে। একজন  যাত্রী বলেই ফেললো, বাচ্চার কান্না থামান প্লীজ! আর কেউ অবশ্য এমন অনুরোধ করেনি, কারন বিষয়টি অত্যন্ত সেনসিটিভ। বাচ্চাদের মা বাবাকে দেখে মনে হচ্ছিল,  টাকা খরচ করে উঠেছি প্লেনে, বাচ্চার কান্না থামানোর দায়ও প্লেনের এয়ারহোস্টেসদের নিতে হবে।

এক মহিলা শেষ মুহূর্তে এসে উঠেছে প্লেনে। সাথে ছোট বাচ্চা, কিনতু টিকেট কেটেছে একটা। বাচ্চা কোলে নিয়ে যাবে। এক ভদ্রলোক ছিলেন জানালার পাশে বসা। মহিলা সেই ভদ্রলোককে বললেন, তাকে যেন জানালার পাশের সীটটি দিয়ে দেয়। ভদ্রলোক এক কথায় উনার সীট দিয়ে দিলেন। এরপর মহিলা তার বাক্স প্যাঁটরা খুলে বসেছে। হঠাৎ করেই সে আবিষ্কার করেছে, অদূরে একটি সীট খালি পড়ে আছে, মহিলা সেই ভদ্রলোককে বললো, উঠে সেই খালি সীটে গিয়ে বসতে। ভদ্রলোক উঠে যেতেই মহিলা দুই সীট জুড়ে বসে গেছে। এক টিকিটে দুই সীটের সুবিধা পেয়ে গেল। মহিলাকে দেখে মনে হয়েছে, এর আগেও সে এভাবেই গিয়েছে। একেবারে অভিজ্ঞ যাত্রী। একটু পর পর এয়ারহোস্টেসকে ডাকছিলেন আর এই লাগবে, সেই লাগবে করেই যাচ্ছিলেন। প্লেন ল্যান্ড করার আগ মুহূর্তে সে প্লেনের সহকারী পাইলটের কাছেই বোধ হয় এক প্যাকেট খাবার চেয়ে নিলেন। কারন মহিলাকে তার বান্ধবীর কাছে বলতে শুনেছি, এয়ার হোস্টেসের কাছে চাইলে দিত না, যেটাই চাই সবই বলে নাই নাই, সেজন্য পাইলটের কাছ থেকে খাবার চেয়ে নিলাম। মায়ের কথা ভুলে আমি এসবই দেখছিলাম। আর আমার পাশে যে বসেছে, সে ছিল নিতান্তই সাধারন এক শ্রমিক। প্লেনের অনেক কিছুই সে বুঝতে পারছিল না, আমি তার প্রতি বড়বোনসুলভ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। সে আমার প্রতি এতটাই কৃতজ্ঞ ছিল যে বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হয়েছে, দূরযাত্রায় একজন আরেক জনকে সাহায্য করবে, এটাই স্বাভাবিক। আমাকেও অনেকের সাহায্য নিয়ে এখানে আসতে হয়েছে। এবার আসি বাথরুমের কথায়।  যে কোন স্থান থেকে ঢাকাগামী ফ্লাইটগুলোর বাথরুম গুলো শেষ পর্যন্ত আর ব্যবহারযোগ্য থাকেনা। মাঝে মাঝেই পাইলটকে ঘোষনা দিয়ে বলতে হয়, ঠিক মত ফ্ল্যাশ টানতে, বাচ্চাদের ন্যাপিগুলো  ট্র্যাশ ক্যানে ফেলতে।  ঢাকাগামী ফ্লাইটগুলোতে এয়ারহোস্টেসদেরকে দেখলে খুব অসহায় মনে হয়। এবারও তাই মনে হয়েছে। এভাবেই এক সময় ঢাকা পৌঁছে গেলাম।

এবার ঢাকা থেকে ফেরার পালা। ঢাকা টু বাংলাদেশ ফ্লাইটে উঠেই সহযাত্রী পেলাম এক যুবককে। খুবই মিষ্টি চেহারার ছেলেটি সীটে বসেই ফোনে কাউকে বলছিল, ‘ আম্মাকে চলে যাইতে বলেন। আমার প্লেন এখনই ছেড়ে দিবে। আম্মাকে চলে যাইতে বলেন”। বুঝলাম, তার মা এসেছে তাকে বিদায় জানাতে। সময় তখন ভোর রাত সাড়ে চারটা। আহারে! আমি সদ্য মা’কে হারিয়ে এলাম, আর এই ছেলেটিও মা’কে ছেড়ে যাচ্ছে কোন সুদূরে! জানতে চাইলাম, সে কোথায় যাচ্ছে। বললো, ওয়াশিংটন ডিসি। বুঝলাম, দোহা গিয়ে আমাদের দুজনকে দুদিকে যেতে হবে। জানলাম ছেলেটি ২০০৩ সাল থেকে আমেরিকাতে আছে, পারিবারিক ব্যবসা তাদের। দেশে গিয়ে বিয়ে করেছে, এবার গিয়েছে নতুন বৌয়ের সাথে কয়েকটা মাস সময় কাটাতে। তিন মাস ছিল দেশে, মা ও নতুন বৌয়ের কাছে। বৌয়ের কাগজপত্র রেডি হয়ে গেছে। আর কয়েক মাস পরেই বৌ কে নিয়ে যেতে পারবে। সুন্দর গল্প, সুখের গল্প। শুনতে ভাল লেগেছে।

পাঁচ ঘন্টার জার্নিতে অন্য যাত্রীরা বাথরুমের অবস্থা কী করেছে জানিনা,  আমি একবার বাথরুম গিয়ে ফিরে আসতেই এয়ার হোস্টেস আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ফ্ল্যাশ টেনেছি কিনা। আমার একটুও রাগ হয়নি, হাসি মুখেই বললাম, হ্যাঁ ফ্ল্যাশ টেনেছি। এই এয়ারহোস্টেসটিকে শুরুতেই খুব বিরক্ত হতে দেখেছি। তাই তার বিরক্তি আর বাড়াতে চাইনি। তার কাছে জলের বোতল চেয়েছি, সে আমাকে ছোট একখানি কাপ দিয়েছে। আমি আবার বললাম, কাপ চাইনা, ছোট এক বোতল জল দাও। সে এবার বিরাট বড় এক বোতল তুলে দিল আমার হাতে। সেটা নিয়ে আমি আবার সীটে বসেছি। এয়ারহোস্টেসের দোষ নেই, ঢাকাগামী বা ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ফ্লাইটে ডিউটি পড়লে যে কারো মাথা খারাপ হবেই হবে।
দোহা টু হিউস্টন ফ্লাইটে উঠে আবার সীট  পড়লো মধ্যম সারিতে। আমার পাশের সীটে বসেছে অবাঙ্গালী এক যুবক। খুবই ভাল ছেলে, সীটের উপর পা তুলে বসতে গিয়ে কতবার ছেলেটির গায়ে পা ঠোকর খেয়েছে, সে হাসিমুখে আমাকে ‘দ্যাটস ওকে’ বলে আশ্বস্ত করেছে। তবে আমার সামনের সীটে বসা যাত্রীগুলো ছিল একেবারেই অদ্ভুত। মিডল ইস্টের এক পরিবার। স্বামী, স্ত্রী, তিন কন্যা। তৃতীয় কন্যাটি এক কথায় স্পয়েলড। মেয়েটির বয়স দশ -এগারো হবে আর কি! আমি বাচ্চাদের খুবই ভালোবাসি, তবে স্পয়েল্ড বাচ্চাদেরকে এভয়েড করে চলি। স্পয়েল্ড বাচ্চাদের দুষ্টামী সহ্য করতে পারিনা। এই পরিবারের মহিলা ও তিনটি মেয়েই দেখতে সুন্দর। বড় মেয়ে দুটি যেমন সুন্দর তেমনই শান্ত। বড় মেয়ে দুটিকে নিয়ে তাদের মা বসেছে এক সারিতে, আর স্পয়েল্ড মেয়েটিকে নিয়ে তাদের বাবা বসেছে আমার সামনের সারিরতে। তাদের পোষাক  দেখেই বলে দেয়া যায়, পয়সাওয়ালা লোক এরা। কিনতু ভদ্রলোকটি এমনই নির্বিকার, দেখে মনে হয়, মেয়েদের বাবা হতে পেরেই উনার কাজ শেষ, মেয়েগুলির প্রতি তার কোন অভিব্যক্তি দেখলাম না ১৫ ঘন্টার জার্নিতে।  খাবারের ট্রলি ঠেলে এয়ার হোস্টেস কাছে আসতেই ছোট মেয়েটি এমন পাগলামী করছিল যে আমার লজ্জা লাগছিল। এয়ার হোস্টেসটি অসহায়ভাবে বাচ্চার বাবা মায়ের দিকে তাকাচ্ছিল, আর ১০ বছর বয়সী মেয়েটি পাগলের মত ট্রলি থেকে একবার এই স্যান্ডুইচ টেনে নেয়, গন্ধ শুঁকে, আবার ফিরিয়ে দেয়। পাশে বসা বাবা অথবা আরেক পাশে বসা মা’কে দেখলাম নির্বিকারভাবে মেয়ের খেলা দেখা যাচ্ছে।  কী অসভ্যতা! এয়ার হোস্টেস চলে যেতেই মেয়ে সীটের উপর উঠে দাঁড়িয়ে রইলো। আমার সামনের সীটটিই ছিল মেয়েটির। মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়লেই আমার ভয় লাগে, যদি উলটে আমার উপর এসে পড়ে।  তাছাড়া মেয়েটি বেশ কয়েকবার  সীটে দাঁড়িয়ে প্লেনের লাগেজ কেইসের ঢাকা খুলে ফেলেছে, পাশের আমেরিকান সহযাত্রী নিজে উঠে সেই ঢাকা বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিবার।  একবার একটি ব্যাগ দুম করে এসে পড়েছে আমার পায়ের কাছে। এসব দেখেও পাশে বসা বাবা মা কিছুই বলেনা। আমিই এক সময় চোখ গোল করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ওকে সীটে বসতে বললাম। মেয়েটি বসে গেল, পরক্ষনেই হাত পেছনে দিয়ে আমার সীটের ডিভিডির রিমোট কন্ট্রোল দিল ছুটিয়ে।

সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি , মা আর মেয়ে মিলে খাবারের খালি প্যাকেট, চকোলেটের খোসা, দইয়ের শূণ্য কাপ সীটের পাশেই ফ্লোরে ফেলে রেখেছে। হাত ফসকে যদি পড়ে গিয়েও থাকে, তবুও নীচু হয়ে সেটা তুলে ফেলার মত ভদ্রতাটুকুও করেনি মহিলাটি। এক সময় এয়ার হোস্টেস এসে সব পরিষ্কার করে গেলো। বাকী যে দু’টি মেয়ের কথা বললাম, মেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকালেই বুঝা যায়, এরা স্কুলে পড়াশোনা করার পাশাপাশি সহবৎও শিখেছে। তিনজনেই বোরকা দিয়ে সম্পূর্ণ ঢাকা হলেও মুখগুলো অনাবৃত ছিল। ওভাবেই অনিন্দ্য সুন্দর মুখগুলো দেখতে পেয়েছি। দুজনের একজনকে দেখেছি, এক ফাঁকে মায়ের নোংরা করা জায়গাতেই নামাজ পড়তে। যাই হোক এভাবেই ১৫ ঘন্টা পার করলাম। প্লেন থামতেই যাত্রীরা দাঁড়িয়েছি দরজা খোলার অপেক্ষায়, ছোট মেয়েটি ঘ্যানর ঘ্যানর করেই চলেছে। বাবা টা হঠাৎ করেই সামনে দাঁড়ানো  আমেরিকান যাত্রীকে বলে ফেললো, এবার সামনে যাও, আমাদেরকে বের হতে দাও। যাত্রীটি অনেকক্ষন ধরেই এদের অত্যাচার সহ্য করেছে, কারন প্রথম দিকে সে অনেকবার ওদেরকে হেল্প করেছে হাজার বার লাগেজ কেইসের ঢাকনা খুলতে আর বন্ধ করতে।  এবার ভদ্রলোক সেই বাপের দিকে সরাসরি তাকিয়ে জবাব দিল, প্লেনের নিয়ম আছে। যখন ওরা বলবে সিঁড়ি রেডী, তখনই আমি বের হতে পারবো। ততক্ষন তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে।

হিউস্টন টু মিসিসিপি আসাটা খুব একটা কঠিন ছিল না। প্লেন থেকে নামতেই সময় বুঝে মিশা ফোন করেছে। বলেছে কিভাবে কাস্টমস পার হতে হবে, লাগেজ তুলতে হবে, লাগেজ আবার কিভাবে নতুন করে বুকিং দিতে হবে। মিশার নির্দেশ মতই কাজ করেছি, তবে অবশ্যই এয়ারপোর্ট পুলিশদেরকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছি। কাস্টমস অফিসার কে জিজ্ঞেস করেছি, ব্যাগেজ ক্লেইম করতে কোথা দিয়ে যেতে হবে। অফিসার খুব সুন্দর করে আমাকে রাস্তা বলে দিয়েছে। সব সেরে যখন প্লেনে উঠেছি, ১৯ নাম্বার সীট খুঁজতে খুঁজতে প্লেনের শেষ প্রান্তে গিয়ে সব শেষ সীটটি খুঁজে পেয়েছি। দুই সীটের মধ্যে একটি আমার। অপেক্ষা করেছি সহযাত্রীটির জন্য। শেষ পর্যন্ত সহযাত্রী আর কাউকে পেলাম না। আমি একাই দুই সীট জুড়ে বসে মিসিসিপি এসে পৌঁছেছি।