Thursday, October 31, 2013

ভুত উৎসব হ্যালুইন!!



 



 

ছোটবেলা থেকেই আমেরিকাকে স্বপ্নের দেশ হিসেবে জেনে এসেছি। আমেরিকা মানেই আলো ঝলমলে দেশ, দিবা-রাত্রি চারদিকে শুধুই আলোর ছড়াছড়ি, কোথাও এতটুকু অন্ধকার নেই। অন্ধকার নেই, ভুতও নেই। আমি আবার ভুতে ভয় পাই, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই কম-বেশী ভুতে বিশ্বাস করে। ভুতে বিশ্বাস করে কারণ আমাদের দেশে দিন-রাতের অধিকাংশ সময়ই বিদ্যুত থাকেনা, রাতের বেলা দেশ থাকে অন্ধকারে ডুবে।অন্ধকারে তাই ভুতের কথা মনে আসে সবার আগে।

ভুত-প্রেত, জ্বীন-পরী নিয়েই আমাদের বসবাস। ভুত যেমন আছে, তেমনি ভুত বা জ্বীন তাড়ানোর ওঝাও আছে। তবে ছোটবেলায় আমেরিকাতে ভুত টুত নেই বলে যেমন ভাবতাম, সেটি আসলে ভুল। আমেরিকাতে ভুত-প্রেত আছে। এবং অবাক হলেও সত্যি যে এদেশে আমেরিকানদের অনেকের বাড়ীতেই ভুত থাকে। হ্যাঁ, ওরা ওরকমই বলে। এমনকি আমেরিকার প্রত্যেক স্টেটে কম করে হলেও ছয়-সাতখানা ‘ভুতের বাড়ী’ আছে যা দর্শনার্থীদের জন্য বছরের বারো মাস খোলা থাকে। মানুষজন খুব উৎসাহ নিয়ে সেইসব বাড়ীতে ভুত দেখতে যায়। অনেক মানুষ বিশ্বাস করে যে তাদের বাড়ীতেও ভুত বা অন্য কোন অশরীরি আত্মার উপস্থিতি আছে। তারা নাকি সেটা টের পায় প্রতি মুহূর্তে।

আমেরিকা অধিকাংশ বাড়ীতেই বেসমেন্ট থাকে। বেসমেন্ট হচ্ছে মাটিরে নীচে ঘর। ঘরের ভেতরে থেকে বুঝার উপায় নেই মাটির নীচে আছি নাকি মাটির উপরে আছি। কারন সব রুমগুলোই একইভাবে সাজানো থাকে। তবে ভুতেরা মনে হয় বুঝতে পারে মাটির নীচের ঘর আর মাটির উপরের ঘরের পার্থক্য। তাই বেশীর ভাগ সময় বেসমেন্টেই ভুতদেরকে পাওয়া যায়। মাটির নীচে নিরালায় নিভৃতে থাকতেই তাদের ভালো লাগে।

সিবিএস নিউজ থেকে কয়েক বছর আগে একটি জরিপ চালানো হয়েছিল, জরিপে ৮০৮ জন প্রাপ্ত বয়স্ককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাদের ভুতে’ বিশ্বাস আছে কিনা।

শতকরা ৪৮% আমেরিকান ‘ভুতে’ বিশ্বাস করে এবং ৪৫% মনে করে ভুত বলে কিছু নেই। ভুত বিশ্বাসীদের মধ্যে মহিলা সদস্যই বেশী। প্রতি পাঁচ জনে একজন জীবনে অনেকবার ভুত দেখেছে বলে দাবী করে।

প্রতি বছর ‘হ্যালুইন’ নামে এক উৎসব হয়, যা ‘ভুত উৎসব’ হিসেবে পরিচিত। হ্যালুইন উৎসবে বাচ্চারা বিভিন্ন ধরণের কস্ট্যুম পড়ে ভুত-পেত্নী সেজে বাড়ী বাড়ী ঘুরে, সকলকে ভয় দেখায়, গৃহস্বামীর কাছ থেকে চকোলেট আদায় করে নেয়। মজার ব্যাপার হলো, অনেকেই বিশ্বাস করে, ভুতের কস্ট্যুম পরিহিতদের মধ্যেই সত্যিকারের ভুতও থাকে।

এখানে আলাদা একটি টিভি চ্যানেল আছে যেখানে শুধুই ভুত সম্পর্কিত অনুষ্ঠান দেখানো হয়। তবে ভুত যেমন আছে তেমনি ‘ভুত শিকারীও’ আছে। তাদেরকে ‘ঘোস্ট হান্টার’ বলা হয়। ঘোস্ট হান্টারদের ঘোস্ট হান্টিং এর সমস্ত অভিযান ভিডিও করে দেখানো হয় ঐ চ্যানেলটিতে। যারা দেখে, তাদের পক্ষে ভুতে বিশ্বাস না করে উপায়ও নেই। কারন ঘোস্ট হান্টাররা নিজেরাই অনেক সময় বিভ্রান্ত হয়, তারাও বলতে বাধ্য হয়, ভুতই হোক বা অন্য কিছুই হোক, জীবনের বাইরেও অন্য কিছু একটা রহস্য থেকেই যায়।

জরিপ চালিয়ে আরও জানা গেছে, ব্যক্তিগতভাবে ভুত দেখেছে এমন লোকের সংখ্যা ২২%। তবে ভুত দেখেনি কিনতু মৃত্যুর পরেও অন্য ভুবন আছে, যেখানে মৃত আত্মারা ঘুরে বেড়ায়, এমনটা বিশ্বাস করে ৭৮% আমেরিকান। অনেকেই বিশ্বাস করে, তাদের পূর্ব পুরুষের মৃত আত্মারা প্রিয়জনকে ছেড়ে ওখানে থাকতে পারেনা বলেই অন্যভাবে, অন্যরূপে পৃথিবীতে ঘুরে ঘুরে আসে। মৃত আত্মাদের চলার গতি আলোর গতির কাছাকাছি বলেই তারা যখন যেখানে খুশী চলে যেতে পারে। আমেরিকানদের মধ্যে অনেকের ধারনা, ভুত মানেই খারাপ কিছু নয়, বেশীর ভাগ ভুতই নাকি ভালো। বেশীর ভাগ সময় তারা মানুষকে সাহায্য করতেই চায়। যারা ভুত ভয় পায়, ভুত তাদেরকে আরো বেশী করে ভয় দেখিয়ে মজা পায়।

আমেরিকাতে বেশীর ভাগ মানুষই ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই ভুতের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে। তারা ভুতকে জীবনের একটি অংশ হিসেবেই দেখে থাকে। কারন তাদের বিশ্বাস, মৃত্যুর পরে যে জগত আছে, সেই জগতের বাসিন্দাদেরকেই পৃথিবীর মানুষ ‘ভুত’ নামে অভিহিত করে থাকে। সবই মানুষের আজন্ম সংস্কার, আজন্ম বিশ্বাস। বিশ্বাসকে বিশ্বাস দিয়েই মানতে হয়। বিজ্ঞানের ক্ষমতা নেই এই বিশ্বাসকে পুরোপুরি ভেঙ্গে দেয়া বিজ্ঞান এখনও গবেষনা চালিয়েই যাচ্ছে ‘ভুত আছে কি নেই’ এর উপর। বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত প্রমান করতে পারেনি ‘ভুত বলে কিছু নেই’। মানুষের কঠিন বিশ্বাসের কাছে বিজ্ঞানও মাঝে মাঝে নাস্তানাবুদ হয়।

৩১শে অক্টোবর আমেরিকাসহ বিশ্বের নানাদেশে খুব উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে পালিত হবে ‘ভুত উৎসব’ হ্যালুইন। হ্যালুইনকে সরল বাংলায় ‘ভুত উৎসব’ বলাটাই সমীচীন। কারন বছরের এই দিনটি ঘিরে ছোট বড়, শিশু-বুড়োদের মধ্যে এক ধরনের শিশুতোষ আনন্দ-উত্তেজনা বিরাজ করে। হ্যালুইন উৎসবকে কুমড়ো ভুতএর উৎসব বললেও অত্যুক্তি হবেনা। কারণ এই সীজনে প্রচুর কুমড়ো পাওয়া যায় এবং হ্যালুইন উৎসবে ভুত বানানর কাজে এই কুমড়ো ব্যবহৃত হয়। অক্টোবার মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই শুরু হয় হ্যালুইন কস্টিউম এবং কুমড়ো কেনার পালা। কস্টিউম ছাড়াও বিপনী বিতান গুলোতে পাওয়া যায় ছোট বড় নানা সাইজের মিষ্টি কুমড়ো, খড় বিচালী দিয়ে তৈরী নানা চেহারার কাকতাড়ুয়া, কিম্ভূত কিমাকার চেহারার খড়-বিচালীর ভুত, নানা সাইজের কঙ্কালসহ এমনি হরেক রকমের জিনিস। মিষ্টি কুমড়োর সাইজ হয় আমাদের দেশে চাল রাখার মাটির জালার মত। এই মিষ্টি কুমড়োগুলোর ভেতর থেকে প্রথমে সমস্ত মাংস, বীচি বের করে ফেলা হয়, এরপর ছুরী দিয়ে কেটে কেটে বড় বড় গোল গোল ভুতুরে চোখ, নাক এবং আকর্ন বিস্তৃত হাসির অবয়ব দেয়া হয়, যা দেখে সত্যি সত্যি হাস্যময় অশরীরি মনে হয়।
হ্যালুইন সন্ধ্যায় সকলের বাড়ির মূল দরজার সামনে এই ‘ভুতুরে কুমড়োর’ ভেতরে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়। দূর থেকে দেখেই বোঝা যায়, ঐ বাড়ির আঙিণায় সুখী ভুত বসে আছে। ভাল করে সন্ধ্যা নেমে আসার আগেই ‘ভুতরূপী’ মানুষেরা যার যার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তাদের হাতে থাকে ঝোলা, পরনে থাকে সাদা অথবা কালো আলখাল্লা জাতীয় পোষাক, মুখ ঢাকা থাকে ‘ভৌতিক মুখোশ’ দিয়ে। এই উৎসবে নিয়ম হলো, ভুতরূপী মানুষগুলো দল বেঁধে সকলের বাড়ীর দরজায় গিয়ে হাজির হয়ে নাঁকি সুরে বলবে ‘ ট্রিঁক অঁর ট্রিঁট’!! গৃহস্বামী ঘরের দরজা খুলে বের হয়ে আগত অতিথিদের দেখে ভয় পেয়ে যান, অতিথিকে খুশী করার জন্য মুঠো মুঠো চকোলেট, নানা বর্ণের ক্যান্ডি দিয়ে ওদের ঝোলা ভর্তি করে দেন। গৃহকর্তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে ‘ভুত বাবাজীরা’ অত্যন্ত খুশী মনে বাড়ির সীমানা ত্যাগ করে বাইরে চলে আসেন।
হ্যালুইন অরিজিন্যালি শুরু হয়েছিল আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ডএ। আইরিশ ও স্কটিশ লোকসাহিত্যে হ্যালুইনকে বলা হয়েছে সুপারন্যাচারাল এনকাউন্টারস হিসেবে। ঐ সময়ের মানুষের বিশ্বাস ছিল যে সামারের শেষ, শীতের শুরুতে হ্যালুইন সন্ধ্যায় সমস্ত মৃত আত্মীয়-স্বজনের আত্মারা নেমে আসে এই পৃথিবীর বুকে। অষ্টম শতাব্দীতে পোপ গ্রেগরী ১লা নভেম্বার কে অল সেইনটস ডে ঘোষণা করেন এবং আগের সন্ধ্যা মানে ৩১শে অক্টোবারকে অল- হ্যালোস-ইভ বা হ্যালুইন নামে অভিহিত করেন। মানুষের অন্ধ বিশ্বাস ছিল অল-হ্যালোস-ইভ-এ প্রেতাত্মারা নেমে আসে, তারা মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আসে,  আর তাই এই প্রেতাত্মাদেরকে প্রতিহত করার জন্য জীবিত স্বজনদের  সকলে একসাথে জড়ো হয়ে আগুন জ্বালিয়ে নানা ভঙ্গিতে নৃত্য করতো এবং মৃত স্বজনের রূপ ধরে আসা ভুতকে পালটা ভয় দেখাত। সেই বনফায়ার থেকেই জ্যাক-ও-লন্ঠন এর উৎপত্তি। আইরিশ ও স্কটিশরা  টারনিপ (শালগম) কে সুন্দর করে কেটে কেটে ভুতের মুখের অবয়ব(হাসি মুখ) দিয়ে লন্ঠন বানিয়ে সকলের বাড়ীর সীমানাতে জ্বালিয়ে রাখত যাতে করে প্রেতাত্মারা আলো দেখেই ভয়ে পালিয়ে যায়। অনেকে খড়-বিচালী দিয়ে কাক-তাড়ুয়া বানিয়ে সাজিয়ে রাখত একই ঊদ্দেশ্যে।
আইরিশ ইমিগ্র্যান্টরাই হ্যালুইনের প্রচলন করে এই উত্তর আমেরিকাতে। সময়ের স্রোতে হ্যালুইনের সূচনালগ্নের কুসংস্কার ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়ে পেয়েছে স্যেকুলার, শিশোতোষ আনন্দের নির্মল চেহারা। হ্যালুইনকে এখন শুধুই বাচ্চাদের আনন্দ উৎসব বললে ঠিক বলা হয়। সাথে যোগ হয়েছে আমেরিকান ব্যবসায়িক বুদ্ধি ও সাফল্য। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয়, যেহেতু হ্যালুইনের সাথে আইরিশ ও স্কটিশদের ধর্মীয় অনুভূতি জড়িত, তাই ভুত-প্রেতের থিমটাও রাখা হয়েছে। বাচ্চারা ঐদিন যে কোন রকম অশরীরীর গেট-আপ নিয়ে সবাইকে ভয় দেখিয়ে আনন্দ পায়।  আবার এই ভুতদে খুশী করতেই চকোলেট, ক্যান্ডি দেয়া হয়। ট্রিক অর ট্রিট হচ্ছে বাচ্চাদের কাছে সবচেয়ে মজার খেলা। তারা হাঁউ মাঁউ করে বড়দের ভয় দেখাবে আর বড়রা ভয় পাওয়ার অভিনয় করবে, তখনই বাচ্চারা বলবে ট্রিক অর ট্রিট ( হয় আমাদের খুশী কর নয়তো ভয় দেখাবো)।বড়রা সাথে সাথে তাদের হাত ভরে চকোলেট দেবে, চকোলেট পেলেই ওরা খুশী হয়ে বিদায় নেবে।  মাত্র এক সন্ধ্যার জন্য বাবা মায়েরা কত ডলার খরচ করে তার কোন হিসেব নেই।

ওয়াল-মার্ট সুপার সেন্টারের একটি বিশাল অংশ জুড়ে ডিসপ্লে করা আছে নানারকম ভৌতিক কস্ট্যুম, কংকালের মুখোশ, স্পাইডারম্যান বা সুপারম্যানের কস্ট্যুম সহ কালো বিড়াল, কালো বাঘের নানারকম ভয়ংকর ভঙ্গীমায় তৈরী পোষাক এবং মুখোশ। মেয়েদের জন্য থাকে পরীর কস্ট্যুম, সিনডেরেলা, তুষার কন্যার কস্ট্যুম। আর বিক্রী হয় চকোলেট, ক্যান্ডি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমেরিকাতে সারা বছরে বিক্রীত ক্যান্ডির এক চতুর্থাংশ বিক্রী হয় হ্যালুইনের সময়।
আমি হ্যালুইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কি ধারণা তা জানার জন্য আমার কাজের জায়গাতে বিভিন্ন বয়সী সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম। যাদের জিজ্ঞেস করেছি, তাদের প্রায় সকলেই বলেছে তারা এর পেছনের ইতিহাস জানেনা, শুধু জানে যে বাচ্চারা ঐদিন একটু মজা করে ছেলেবেলাতে তারাও শুধুই ফান করতো ঐদিন, ব্যস এইটুকুই। লিওনার্দো নামে আমার এক সহকর্মী আছে সে বলেছে , দেখো, একসময় যারা ধর্মে বিশ্বাস করতোনা, তারা ঈশ্বরের উপাসণাকে চ্যালেঞ্জ করে ঘোস্ট উপাসনার মত করে এই হ্যালুইন উদযাপন করা শুরু করে। তারা এমনও বলতো যে ঐরাতে সকল ভুত-প্রেত পৃথিবীতে নেমে আসে, তারা তাদের প্রিয়জনদের দেখতে আসে। ঈশ্বর বলে কিছু নেই, মৃত্যুর পরে সবাই ভুত হয়ে যায়। এই ধরনের প্রচারণাতে সমাজের অনেকের বিশ্বাসে আঘাত লাগতে থাকে, কিনতু আমেরিকাতে যেহেতু কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যায়না, তাই সমাজে কোন রকম অসন্তোষ সৃষ্টির আগেই বানিজ্যিক কোম্পাণীগুলো এই ভুতভাবনাকে অন্যভাবে পরিবেশন করতে শুরু করে। তারা এই ফসল কাটার সময়টাকে বেছে নেয় হ্যালুইন উদযাপনের জন্য। এই উপলক্ষে এত এত মিষ্টি কুমড়া বিক্রী করে কৃষকের লাভ হয়, এত কস্ট্যুম, এত মুখোশ, এত রাশি রাশি চকোলেট, ক্যান্ডি বাজারজাত করে ব্যবসায়িক কোম্পাণীগুলো লাভবান হয়। আর মানুষ খুব সহজেই এই উপলক্ষটাকে বাচ্চাদের জন্য ফান হিসেবে গ্রহন করে। আর এভাবেই সেই মুষ্টিমেয় কিছু ঈশ্বর অবিশ্বাসীদের উদ্দেশ্য বিফলে যায়।
রয় নামে আরেক সহকর্মী বলল, এটা কিছুইনা, শুধুই বিজনেস। আমেরিকাতে সব কিছুর পেছনে থাকে বিজনেস। এই সময়টা হচ্ছে ফসল কাটার মরশুম, এর পরেই শীত চলে আসবে। সকলে ঘরে ঢুকে যাওয়ার আগে আরেকবার ফূর্তি করার উপলক্ষ্য এটা। তবে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য একটা গল্প চালু আছে। গল্পটা হলো, এক সৈনিককে যুদ্ধের মাঠে তার শত্রু তরবারীর আঘাতে ধড় থেকে মাথা কেটে ফেলে দেয়। এরপর থেকে ঐ মুন্ডুহীন সৈনিক ভুত হয়ে রাতের বেলা ঐ পথ দিয়ে কাউকে যেতে দেখলেই তাকে মেরে ফেলতে শুরু করে। এতে করে লোকজন মুন্ডুহীন সৈনিকের মুখোমুখি না হয়ে ঘুরপথে যেতে শুরু করে। তাই মুন্ডুহীন সৈনিক বুদ্ধি করে ফসলের মাঠ থেকে এই সময়ের ফসল মিষ্টি কুমড়া দিয়ে তার মাথা বানিয়ে ঘাড়ে বসিয়ে দিয়ে আবার শুরু করে হত্যাযজ্ঞ রয় আর বাকীটুকু জানেনা, তাই আমি গল্পটা শেষ করে দিলাম এভাবে, কুমড়োমাথা ভুতকে খুশী করার জন্য গ্রামবাসী ঠিক করে যে তাকে তার প্রিয় মিষ্টি খেতে দিলেই সে এই অত্যাচার বন্ধ করবে। আর সেই থেকেই তাকে মিষ্টি খেতে দেয়া হয় এবং সে খুব খুশী হয়ে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করে দেয় আর এভাবেই নিশ্চয় মিষ্টি, চকোলেট, পামপকিন কেক, পামপকিন পাই এর বিজনেস রমরমা হয়ে উঠে। আর বিস্বাদু মিষ্টি কুমড়োগুলিকে হাস্যমুখ ভুত বানিয়ে বিক্রী করে দেয়া হয়। আমার এই শেষাংশটুকু রয়ের খুব পছন্দ হয়।
তবে অনেকে এই ফেস্টিভ্যালটাকে পছন্দ করেনা। কেউ কেউ মনে করে এইসব হচ্ছে কুসংস্কার, কেউ কেউ ভাবে পয়সার অপচয়, অনেকে ঐদিন সন্ধ্যায় ঘর বন্ধ করে অন্য কোথাও চলে যায়, যাতে বাচ্চাদের চকোলেট না দিতে হয়, কিছু পয়সাতো বাঁচে। আবার শাহীনের মত শিশু দরদী ছেলে প্যাকেট ভর্তি চকোলেট নিয়ে ২৫ মাইল রাস্তা ড্রাইভ করে আমাদের বাড়ী এসে আমার ছোট মেয়েকে চকোলেট দিয়ে যায়। ইদানীং অনেক বাবা-মা বাচ্চাদের একা একা চকোলেট হান্টিং বা ট্রিক অর ট্রিট এ বের হতে দেননা। কারণ দিনকাল এদেশেও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যে কোন সময় বাচ্চা কিডন্যাপ হয়ে যেতে পারে, শত্রুতা করে কেউ খাবারের সাথে বি্ষ মিশিয়ে দিতে পারে বলে তাদের ভয়। আবার কেউ কেউ ট্রিক অর ট্রিট এর উছিলায় এসে ঘরে ঢুকে ডাকাতিও করে যেতে পারে। সময় এখানেও খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
যে যাই বলুক, আমি হ্যালুইনের সাথে আমাদের দেশের কিছু পরবের মিল খুঁজে পেয়েছি প্রথমতঃ হিন্দুদের দীপাবলী বা দিওয়ালীর সাথেতো মিল আছেই, আরো মিল আছে হেমন্তের শেষ ও শীতের শুরুতে ফসল কাটার উৎসব, গ্রামদেশে খড় দিয়ে তৈরী শীতের বুড়ো পোড়ানো উৎসবের সাথে। আমরা চকোলেট ক্যান্ডি দেইনা, ঘরে ঘরে পিঠা-পায়েস বানানো হয়, এভাবেই শীতকে বরণ করা হয় অথবা শীতের শুরুতে ঘরে ঢুকে যাওয়ার আগে একটু আনন্দ ফূর্তি করা্র উপলক্ষ তৈরী করা হয়। ভালো লাগে ভেবে যে পৃথিবীর দুই প্রান্তে থেকেও সংস্কৃতির কিছু কিছু জায়গাতে এখনও কত মিল যা মনে করিয়ে দেয়, মানব সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে মানুষের ভাবনাগুলো স্থান-কাল নির্বিশেষে একভাবে, এক নিশানায় কাজ করেছে।


Sunday, October 27, 2013

শতায়ু হও ‘বাবা’




 Photo

আমাদের বাড়ীটি মিসিসিপি স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাত্র ৩০ মাইল দূরে, এই ইউনি- ভার্সিটিতে এপার বাংলা-ওপার বাংলা মিলিয়ে বেশ কিছু ছাত্র ছাত্রী পিএইচডি করতে আসে, পিএইচডি কমপ্লীট হয়ে গেলেই ওরা চাকুরী নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। বর্তমানে এখানে ৩৫ থেকে ৪০ জন বাঙ্গালী ছেলেমেয়ে আছে। ওদের সকলের সাথে আমাদের বেশ হৃদ্যতা আছে। ওরা আমাদের সন্তানের মত, আমাকে ডাকে কাকীমা/আন্টি, আর আমার স্বামীকে ডাকে কাকু/আঙ্কেল। আমরা এ কজন বাঙ্গালী বিভিন্ন উপলক্ষে একত্রে মিলে আসর বসাই, সেখানে আড্ডা এবং খাওয়া-দাওয়া দুইই চলে। কয়েক ঘন্টা একসাথে হই হুল্লোড় করে কাটিয়ে দেই। আমি যেহেতু ওদের আন্টি, তাই বছরে দুই তিনবার আমাদের বাড়ীতে ওদের নেমন্তন্ন করে খাওয়াতাম। কিন্তু গত বছর মা মারা যাওয়ার কারণেই কিনা জানিনা, আমার বাড়ীতে গত এক বছরে আর কোন আনন্দানুষ্ঠান করিনি। কাউকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াইনি। এ বছর শেষ হয়ে আসতেই ভাবলাম, অনেকদিন পার হয়ে গেছে, আমার ঘরে কোন আনন্দ অনুষ্ঠান হয়না। কেমন যেন চারদিক শুনশান নীরব হয়ে থাকে। হঠাৎ করেই খারাপ লাগলো, খেয়াল হলো, এই ছেলেমেয়েগুলো ওদের বাবা-মা, আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে এখানে আছে, প্রবাসে আমরাই ওদের স্বজন। আমি কি বুঝে এতদিন ওদের থেকে দূরে থাকতে পারলাম! যেই ভাবা সেই কাজ, ওদের সবাইকে আমাদের বাসায় নেমন্তন্ন করলাম। আগামীকাল দুপুর, মানে ২৭শে অক্টোবার, রবিবার দুপুরে ওরা আমাদের বাসায় লাঞ্চ করবে।

এক বছর পর আন্টির কাছ থেকে নেমন্তন্ন পেয়ে, সকলেই প্রশ্ন করেছে, আন্টি, কি উপলক্ষ? আমি তো কোন উত্তর খুঁজে পাইনা, বলি, কোন উপলক্ষ নেই, অনেকদিন তোমাদের জন্য রাঁধিনি, সেটিই উপলক্ষ।



আমার মা ছিলেন জীবন্ত কম্পিউটার, পঞ্চার বছরের পুরানো টাকা পয়সার হিসেব, দেনা-পাওনার হিসেব, বাড়িভাড়া, গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিলের হিসেব থেকে শুরু করে পরিচিত (বিখ্যাত-অবিখ্যাত) সকলের জন্ম তারিখ, বিয়ের তারিখ, বিবাহ বিচ্ছেদের তারিখ, মৃত্যু তারিখ সঠিকভাবে বলে দিতে পারতেন। স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন, উনার সহকর্মীরাও কোন হিসেব জানতে হলেই শংকরীদিদির শরণাপন্ন হতেন।

মায়ের কাছেই জেনেছিলাম, আমার বাবার জন্ম হয়েছিল কার্তিক মাসে, কার্তিক মাসে জন্ম হলে নাকি মরা কার্তিকে জন্ম বলা হয়। কেন মরা কার্তিক বলে, এর কারণও নিশ্চয়ই বলেছিল, আমি ভুলে গেছি। আমার বাবার জীবনটা তো খুব দুঃখ- সংগ্রামের ভেতর দিয়ে কেটেছে, সেই প্রসঙ্গেই বোধ হয় বলেছিল, মরা কার্তিকের শিশু। যাই হোক, বাবার মা, অর্থাৎ আমাদের ঠাকুমা বলেছিল, বাবার জন্ম হয়েছে ১৩৩৪ সালের ৯ই কার্তিক। আমার কম্পিউটার মা হিসেব করে বলেছে ১৯২৭ সনের অক্টোবার মাসের ২৬, ২৭ অথবা ২৮য়ের মধ্যে যে কোন একটি তারিখ।

আমাদের নিজেদের জন্মদিনে একজন আরেকজনকে হ্যাপী উইশ করার রেওয়াজ আমিই চালু করেছিলাম। তেমন তো কিছু নয়, শুধু ফোন করে বলা, হ্যাপী বার্থডে। আমার এই রীতি মায়ের খুব মনে ধরেছিল। যার যখন জন্মদিন, মা অপেক্ষা করতো, আমার ফোনের। যদি কখনও একটু দেরী হয়ে যেত, মা পাল্টা ফোন করে মনে করিয়ে দিত জন্মদিনের কথা। এমনও হয়েছে, কোন কারনে আমি মাকে ফোন করেছি, লাইন কেটে দেয়ার আগেই আমাকে মনে করিয়ে দিত পনের দিন পরে কারো জন্মদিনের কথা।

গত সপ্তাহে আমার কি কারণে যেন মনে হলো, বাবার জন্মদিন ২০শে অক্টোবার। আমি যথারীতি ১৯শে অক্টোবার দেশে ফোন করে ছোট ভাইকে বললাম যে পরের দিন যেন বাবাকে বার্থডে উইশ করা হয়। আমার ভাই তখন বলল, বাবার জন্মদিন ৯ই কার্তিক, আজ তো ১লা কার্তিক। আমি বললাম, ওহ! আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল, ২০শে অক্টোবার বাবার জন্মদিন। ভাই বলল, অসুবিধা নাই, বাবার জন্মদিন যদি ২০ তারিখেও হয়ে থাকে, এই এক সপ্তাহ বাবাকে পুরাদমে ফিস্ট খাওয়াচ্ছি। আমি হেসে ফেলি, জানতে চাই, ঘটনা কি? ভাই বলে, বাবা একদিন ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল, মালপোয়া দিয়ে বুটের ডাল খাবে, আরেকদিন ইচ্ছে করেছিল খাসীর মাংস দিয়ে পরোটা খাবে। এমন আরও কয়েকটি ইচ্ছের কথা শুনিয়ে ভাই বলল, এক সপ্তাহ ধরেই লাগাতার আমরা ফিস্ট করছি। গতকাল বাবা খেলো খাসীর মাংস আর পরোটা, তার আগের দিন খেয়েছে মালপোয়া দিয়ে বুটের ডাল
মালপোয়া দিয়ে বুটের ডাল আবার ক্যামনে খায়? বাবার সাথে কথা বললাম, বাবাও দেখি বলে, মালপোয়া দিয়ে বুটের ডাল খেয়েছে। খাসীর মাংসটা নাকি এতই ভাল ছিল যে আঙ্গুলে ধরতে গেলেই মাখনের মত গলে যায়। খাওয়ার সময় নাকি আমাদের কথা মনে পড়ছিল আর খারাপ লাগছিল। এত ভাল মাংস আমাদের ফেলে খেতে পারছিলনা। আমি বিশ্বাস করেছি, বাবা বাইরে থেকে সিংহ, ভেতরে তালের শাঁস, স্নেহরসে টইটুম্বুর। একবার আমার সারা শরীর অ্যালার্জীতে ঘা হয়ে গেছিল, ডার্মাটোলজিস্ট আমাকে অনেক কিছু খেতে নিষেধ করেছেন তার মধ্যে ইলিশ আর চিংড়ি ছিল। বাবা আমাদের বাসায় একটানা পাঁচ বছর, যতদিন আমি চিংড়ি খাওয়া শুরু করিনি, চিংড়ি আর ইলিশ কিনেনি। আমি পটল খেতে ভালোবাসি বলে হোস্টেল থেকে বাসায় এলেই বাবা বাজার থেকে পটল আনতে বলতো, মাকে বলতো আমার জন্য আলু পটলের রসা রান্না করতে। কাজেই সেই একই মানুষ, এখনও আমি তাঁর সেই মেয়ে, আর বাবাও আমার সেই বাবা, খাসীর মাংস খেতে গিয়ে মন খারাপ লাগতেই পারে। কিন্তু আমি জানতে চাইলাম, মালপোয়া দিয়ে বুটের ডাল আবার ক্যামনে খায়! বাবা বলল, জীবনে তো খাস নাই, তাই বুঝস না। মালপোয়া হবে কম মিস্টি আর বুটের ডাল হবে ঝাল ঝাল স্বাদে। আমাকেই খেয়ে দেখতে বলল, আমি বললাম, না বাবা, মালপোয়া দিয়ে বুটের ডাল খাবনা। ফোন রেখে দিলাম, জানলাম ৯ই কার্তিক, কিন্তু হিসেব করলামনা বাংলা ৯ই কার্তিক অক্টোবারের কত তারিখ। আমি অপেক্ষা করি, বাবার জন্মদিনে হ্যাপী উইশ করবো বলে। কিন্তু সঠিক দিন-তারিখ ঠিক করতে পারিনি।

গতকাল ছিল ২৫শে অক্টোবার, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, শুনেছি বেগম জিয়া তিন দিন হরতাল ডেকেছেন, অশান্তি মন নিয়ে বাবাকে ফোন করেছি। বাবা বাথরুমে ছিলেন, ফোন ধরেছে আমার ছোট ভাই। বললাম, বাবার জন্মদিন কবে রে?
ভাই বলল, আগামীকাল
ভাইয়ের সাথে কথা শেষ করতে না করতেই বাবা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে ফোন ধরলো। বাবার সাথে দেশ নিয়ে অনেকক্ষণ কথা হলো। আমার বাবা অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন, দেশ সচেতন, উদার, বিবেকবান একজন মানুষ। ভাগ্য বিড়ম্বণার কারণেই বাবা আজ এমন সাধারণ এক জীবন যাপন করে গেলেন। নাহলে আমার বাবাও হয়তো সমাজে প্রতিষ্ঠিত কোন ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারতেন।
মরা কার্তিকে জন্মালেও বাবা জন্মেছিলেন বাড়ীর প্রথম পুত্র সন্তান হয়ে। সারা বাড়ীতে প্রথম পুত্র, আনন্দই আলাদা। আমার ঠাকুরদাদা ছিলেন নারায়ণগঞ্জ কোর্টের মোহরার, ঠাকুমা ছিলেন কোচবিহারের ধনী পরিবারের মেয়ে। যে কালে বরের বংশ পরিচয় কন্যা সম্প্রদানের প্রধান বিচার্য্য বিষয় হয়ে থাকে, সে কালেই ঠাকুমার বিয়ে হয়েছিল সাধারণ এক মোহরারের সাথে। অতি সাধারণ মানের জীবন-যাপন করছিলেন ঠাকুমা। বাবার বয়স যখন মাত্র তের, ঠাকুরদাদা মারা গেলেন, আর্থিক অসচ্ছলতা আর চারপাশের স্বজনের অবহেলার কাল শুরু হলো। লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম, বাবা দিনের বেলা স্কুলে যেতেন, রাতের বেলায় কুপির আলোয় বিড়ি বানাতেন। একেক বান্ডিল বিড়ি, মাত্র চার পয়সা দরে বিক্রী হতো। এই গল্প শোনাতে গিয়েই বাবা বলেছিল, বিড়ি পাকাতে পাকাতেই বিড়ি খাওয়া শুরু করে।

১৯৪২-৪৩ সালের মন্বন্তরের সময় বাবা ক্লাস নাইনে পড়ে। চারদিকে কি অভাব, আমাদের বাড়ীতে সদস্য সংখ্যাও ছিল অনেক বেশী, চরম অভাবে কারো জন্য কারো দরদ ছিলনা,  একান্নবর্তী পরিবারে প্রত্যেকে তার নিজের সন্তানের বেঁচে থাকা নিয়ে ভাবতো, আমার বাবার মাথার উপর রোজগেরে কেউ ছিলনা, বাবার তখন বাড়ন্ত বয়স, ছোট দুই ভাই, সকালে পায়ে হেঁটে চার মাইল দূরের স্কুলে যেত, পকেটে থাকতো বুট ভাজা, বিধমা মা এইটুকুই যোগাড় করতে পারতো। একমুঠ বুটভাজা আর স্কুলের চাপকলএর জল খেয়ে সারাদিন পার করে বিকেলে বাড়ী ফিরে আসতো। সন্ধ্যায় ছোট থেকে বড়, সকলেই বাটি মাপা পাতলা জলের মত খিচুড়ী খেতে পেত। ঐ মন্বন্তরে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গেছিল। বাবার এক কাকাত ভাই, খুব ছোট, একটু ভাতের জন্য কাঁদতো, আরেক কাকার আর্থিক অবস্থা কিছুটা ভাল ছিল, তাই তার বাচ্চার জন্য এক মুঠ চালের ভাত রান্না করা হয়তো, দুঃখী মা তার ভাত পাগল বাচ্চার জন্য ঐ সুখী মায়ের কাছ থেকে ভাতের মাড় চেয়ে নিত, শিশুকে খাওয়াতো, শেষ পর্যন্ত শিশুটি মারা যায়। এমনই নিষ্ঠুর, নির্দয় হয়ে উঠেছিল মানুষ।
এই গল্প আমি খুব বেশী শুনিনি, বাবার মুখে তো শুনিইনি, মায়ের কাছে শুনেছি। মা শুনেছিল আমার ঠাকুমার কাছে। আমি যখনই বাবার কথা ভাবি, তখনই বাবার কৈশোরের কষ্টকর দিনগুলোর কথা ভেবে কেঁদে ফেলি। আমারই বাবা, অথচ কি কষ্টের ভেতর দিয়ে বড় হয়েছে। বিধবা মা আর ছোট দুই ভাইয়ের কথা ভেবে ম্যাট্রিকুলেশান পাশ করে চাকুরীতে ঢুকে গেছে। ট্রেনের ওভারশিয়ারের চাকুরী, স্কুলে মাস্টারীর চাকুরীতে পোষাতোনা। বাবা শর্টহ্যান্ড রাইটিং আর টাইপিং শিখে ফেলে দ্রুততার সাথে। পাট কোম্পাণীতে চাকুরী পেয়ে যায়, খুব ভাল ইংলিশ জানতো বলে ইংরেজ সাহেব বাবাকে পছন্দ করতো।
বাবার বড় মামা ছিলেন ১৯১০ সালের দিকেই এমবিবিএস ডাক্তার, খুব নামকরা ছিলেন, তখনকার দিনে লাখপতি, বিশাল অবস্থা। ইচ্ছে করলেই ভাগ্নেকে নিজের কাছে রেখে লেখাপড়া শিখাতে পারতেন। উনার ইচ্ছেয় কোন ফাঁকী ছিলনা, কিন্তু উনার স্ত্রী আমার বাবাকে দিয়ে মাঠে রাখালের কাজ করাতো, বাড়ীতে সংসারের কাজ করাতো, লেখাপড়ার কোন সুযোগ রাখেনি। মামীর বিরুদ্ধে কোন নালিশ না করে দুই বছর পর বাবা গ্রামের বাড়ীতে ফিরে আসে, আমার দাদু বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, আত্মসম্মানবোধের কারণেই ঠাকুমা নিজের স্বামীর অসুস্থতার খবর নিজের বড় ভাইকে জানাননি।  

যে মানুষটি নিজের জীবনে মাতৃস্নেহ বাদে আর কোন স্নেহ পাননি, যে মানুষটির ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছিল, যে মানুষটি ডাক্তার মামার কাছে থেকে লেখা পড়া করতে চেয়েছিল, সেটি উনার জীবনে বাস্তবায়িত হয়নি বলেই, নিজের জীবনে সে সকল অনাস্বাদিত আকাংক্ষা পূর্ণ করেছিলেন ভাগিনা, খুড়তুতো বোনদের নিজের কাছে রেখে বড় করে। আমার পিসীমার দুই ছেলে, খুব ছোটবেলাতেই আমার বাবার কাছে থেকে যায়। একজন তো ম্যাট্রিক, ইন্টার -মিডিয়েট পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করে, ইউনিভার্সিটিতে অনার্স মাস্টার্স ফার্স্টক্লাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে্র ডাকসাঁইটে প্রফেসার হিসেবে রিটায়ার করেন।আরেক ভাগিনাও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী করেন, বাবার বোনেরা বিয়ের পর এখন যার যার সংসাত্রে ভালই আছে। বাবা নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, নারীর মুক্তিতে বিশ্বাস করেন। প্রতিটি মেয়ের জীবনে লেখাপড়াকেই প্রধান শক্তি মনে করেন।

বিয়ের সময় মা ক্লাস নাইনে পড়তেন, বিয়ের পর মায়ের লেখাপড়া বন্ধ হতে দেননি। পাশ করার পরেও মাকে ঘরে বসে থাকতে দেননি। মা নারায়ণগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকুরীতে যোগদান করেন এবং বাবার সাহচর্য্য পেয়ে একটানা ৪২ বছর শিক্ষকতা শেষে চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। আমরা তিন ভাই, এক বোন বাবার নিজহাতে গড়া। নিজহাতে বলতে যতটুকু বুঝা যায়, তার চেয়েও অনেক বেশী শ্রম ও স্নেহ দিয়ে বাবা আমাদের বড় করেছেন। সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা ছিলনা, কিন্তু সুখ ছিল। বাবা, মা, চার সন্তানের সুখের সংসার। অবাক হয়ে ভাবি, আমার বাবা কি করে আমাদের সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পার করিয়ে এনেছেন, একজনও বাদ যায়নি। নিজের ভাই বোন, আমার মায়ের ভাই-বোন, পাড়া প্রতিবেশীর ছেলেমেয়ে সকলকেই অনেক সহযোগীতা করেছেন, আজ আমরা সকলেই যার যার জীবন সততা ও নিষ্ঠার সহিত যাপন করে যাচ্ছি। বাবার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা নিজেদের জীবনে কাজে লাগাচ্ছি।

সেই যে সততার ভেতর দিয়ে বাবা জীবন শুরু করেছিলেন, সততার গন্ডীর ভেতরেই নিজেকে আটকে রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে আজন্ম বিশ্বাস, বিশ্বাসে এখনও অটল আছেন,  ভালোই তো আছেন, এই ৮৬ বছর বয়সে পৌঁছেও এখনও যুবকের মত দৃপ্ত ভঙ্গী নিয়ে কথা বলেন। উনাকে দেখে একটি উপমাই মনে হতে পারে, বটবৃক্ষ এবং জ্ঞাণবৃক্ষ। আজ একটি বিষয় ভেবে অবাক হচ্ছি, আমি আজ পর্যন্ত জানিনা আমার বাবার চোখ দুটো দেখতে কেমন! এর আগে কোনদিন মনেও হয়নি আমার বাবা দেখতে কেমন, ভাল করে একটু তাকিয়ে দেখি তো। চোখের প্রতি আমার আজন্ম দূর্বলতা অথচ কোনদিন মনে হয়নি আমার বাবার চোখ দুটি দেখতে কেমন? মনে হয়নি এসব কিছুই, বাবাকে শুধু বাবা বলেই জেনেছি। বাবা তো বাবা, বাবা এমনই হয়, বাবাকে আবার আলদা আলাদা নাক চোখ দিয়ে বিচার করতে হয় নাকি? পৃথিবী শ্রেষ্ঠ বাবাদের নাক মুখ চোখ সবই সুন্দর হয়, সব সুন্দর মিলে মিশে একাকার হয়ে সৃষ্টি হয় বাবা

আগামীকাল আমাদের বাড়ীতে এতগুলো ছেলেমেয়ে আসবে, আজ সারাদিন আমি রান্না করেছি, রাতে বাবাকে কল দিলাম, বার্থ ডে উইশ করার জন্য। মায়া লাগে, কি বিষন্ন কন্ঠ, সঙ্গীহীন জীবনে একাকীত্ব ভর করতে চায়। দুষ্টুমী করে ইংলিশে বলেছিলাম, হ্যাপী এইটি সিক্সথ বার্থডে মাই ড্যাড। বাবা থতমত খেয়ে বলে, হু আর ইউ স্পিকিং প্লীজ? আমি হেসে ফেলি, বাবাও হেসে ফেলে, নিজের ভুল বুঝতে পারে। আজ আর রাজনীতি নিয়ে কথা বলিনি। বাবা বলল, আমাত্র জন্মদিন উপলক্ষে তোরা মন খুলে খাওয়া দাওয়া কর, আমি তোদের নামে এখানে বিল পাস করে দিচ্ছি। বললাম, বাবা, কাকতালীয়ভাবে, তোমার জমদিনের দিন আমি বেশ কিছু ছেলেমেয়েকে নেমন্তন্ন করেছি। ওরা জানতে চেয়েছিল, উপলক্ষ কি? এখন তো বলতে পারবো। আমার বাবার জন্মদিন

শুভ জন্মদিন বাবা, শতায়ু হও, প্লীজ!

Tuesday, October 22, 2013

শুধু মনে রেখো!



অনেকদিন পর ফুটন্ত তেলে, ডুবন্ত করে চিঁড়ে ভাজলাম। আমার উত্তম কুমারের মন-পছন্দ খাবার এটি, মচমচে চিঁড়ে ভাজার সাথে পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কাও ভেজে দিতে হবে, নাহলে পুরোপুরি তার মন-পছন্দ হবেনা। আমি আবার এসব ভাজাভুজি খাবার এড়িয়ে চলি, স্বাস্থ্য সচেতনতা বলে একটি ব্যাপার আমার মধ্যে আছে, তবে অন্যের ইচ্ছেয় হস্তক্ষেপ করিনা। আমার মায়েরও ছিল এইসব ভাজাভুজি খাবারের দিকে নজর। ভাজাভুজি খাবার, সাথে গরম গরম চা। ঢাকা যখনই আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতো, বিশেষ করে রমজানের সময়, প্রতি সন্ধ্যায় উত্তম কুমার হাত ভর্তি করে ইফতারীর প্যাকেট নিয়ে ফিরতো। ইস! শাশুড়ি-জামাই কি তৃপ্তি করেই যে ইফতারী খেতো। আমি চোখ পাকিয়ে মাকে বলতাম, এই রাস্তার পারের তেলে ভাজা জিনিস খাচ্ছো, অসুস্থ হলে টের পাবে। মা বলতো, গরম তেলে সব রোগ জীবানু মরে যায়। উত্তমকে কিছু বলেও লাভ হতোনা, সে নামী দোকানের বাক্স দেখিয়ে বলতো, রাস্তার পারের না, ভালো দোকান থেকে এনেছি।" আজ হঠাৎ করেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। গরম তেলে ডুবন্ত চিঁড়ে, কি সুন্দর ফুড়ফুড়ে, ঝরঝরে করে ভাজা হচ্ছিল, যে মানুষটি খুব আরাম করে কুড়মুড় আওয়াজ তুলে চিঁড়ে ভাজা খেতো, সে মানুষটি আজ কোথায় চলে গেলো!

মায়ের ভাল লাগতো রাস্তার পাড়ের খাবার। বাসে বা ট্রেনে কোথাও বেড়াতে গেলে, জানালা দিয়ে ঝালমুড়িওয়ালাদের কাছ থেকে ঝালমুড়ি কিনে নিজেও খেত, দলের সবাইকে খাওয়াতো। ইন্ডিয়া বেড়াতে যেতাম, মায়ের সাথে বেড়ানোর এই একটা মজা আছে, ফেরীতে খাওয়া, বর্ডারে গিয়ে ডাবওয়ালার কাছ থেকে ডাব কিনে খাওয়া, পিপাসা নেই, তবুও ডাব খেতে হবে, বাংলাদেশ বর্ডার ক্রস করে হরিদাসপুর সীমানায় ঢুকে গেলাম, বাবা হয়তো পাসপোর্ট নিয়ে ব্যস্ত, মা আমাদের সবাইকে নিয়ে ঢুকে যেত চায়ের দোকানে। গরম গরম কচুরী, সাথে ছোলার ডাল, আর মাটির ভাঁড়ে চা। এরপর ট্রেনে উঠেই ফেরীওয়ালার কাছ থেকে টাকায় দশখানা নেবু ভাল কমলানেবু কেনা হতো, আহ! কি সব দিন ছিল!

মায়ের বয়সী হিন্দু মহিলারা সাধারণতঃ হোটেল রেস্টুরেন্টে খেতেননা, বিশেষ করে আদর্শ হিন্দু হোটেল নাহলে তো হোটেলে গিয়ে ভাত খাওয়ার প্রশ্নই আসেনা। ভাবতাম মাও বোধ হয় হিন্দু হোটেল বলেই মাছের ঝোল দিয়ে গরম গরম ভাত, তৃপ্তি সহকারে খায়। আমাদের তো আর হিন্দু-মুসলিম বাছ বিচার ছিলনা, সব খানেই অবাধ বিচরণ। কিন্তু আমার হিসেবে ভুল ছিল, মা তো স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, হিন্দু, মুসলিম, খৃস্টান সকলের সাথেই মায়ের উঠাবসা ছিল। এই ব্যাপারটি মাথায় ছিলনা। ভাবতাম, মা বোধ হয় আর সকলের মতই খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে খুব রক্ষণশীল। একবার এক মজার ঘটনা ঘটেছিল।

৯৮ সালের কথা। ঢাকার উত্তরাতে কোম্পানীর দেয়া বাড়ীতে থাকি, কোম্পানীর দেয়া গাড়ীতে চড়ি, দারুণ আনন্দময় জীবন। আমরা আমেরিকা চলে আসার আগের চার বছর উত্তম কুমার ইন্ডাস্ট্রিতে চাকুরী করেছেন, আমার জীবনের স্বর্ণযুগ ছিল ওটা। কোম্পাণীর দেয়া গাড়ী-বাড়ীতে আমি মনের আনন্দে থেকেছি। আমার কত পরিচিতকে দেখেছি, গাড়ীর অহংকারে, বাড়ীর অহংকারে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ভাল করে কথাই বলতো না। পাছে আত্মীয়-স্বজন গাড়ীর সুবিধা চায়, সেই ভয়ে সব সময় বলতো, ড্রাইভার বাড়ী গেছে, ড্রাইভারের শরীর ভালনা, গাড়ীর ইঞ্জিনে গোলমাল আছে, নাহলে শত রকমের বাহানা দেখিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের এড়িয়ে চলতো। আমি সেটা করতামনা। অফিসের নিয়ম নীতি মেনেই সবাইকে সাথে নিয়ে চলতে চাইতাম। যদিও আমাদের জন্য অফিস থেকে ২৪ ঘন্টার গাড়ী এবং ড্রাইভার দেয়া হয়েছিল, তবুও আমরা অফিস টাইমের চেয়ে এক ঘন্টা বেশী রাখলেও ড্রাইভারকে বখশিশ দিয়ে পুষিয়ে দিতাম। এইজন্যই গাড়ী নিয়ে যখন খুশী, যেথায় খুশী বেরিয়ে পড়তাম। ড্রাইভার সাহেবও চাইতেন আমি যেন সব সময়ই বেড়াতে যাই।
ছুটির দিন হলে তো কথাই নেই, দূরে কোথাও চলে যেতাম, একা যেতামনা, সাথে করে চেলা-চামুন্ডা, লটবহর নিয়ে যেতাম। মনে পড়লে হাসি পায়, যখন বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধণ করা হলো, আমাদের সাত/আট সীটের পাজেরো গাড়ীতে মোট এগারো জনকে নিয়ে টাঙ্গাইল গেছিলাম। দুখানা ছোট মোড়া নিয়েছিলাম সাথে, একজনকে কোলে, আর দু'জনকে মোড়ায় বসিয়ে ছিলাম। শুনে যে কেউ বলবে, কাজটা ঠিক হয়নি, কিন্তু আমি বলি, শতভাগ ঠিক হয়েছে। ভাল জিনিস একা খেয়ে সুখ নেই, সুন্দর স্থান একা দেখে সুখ নেই, এগারো জন সেদিন যে আনন্দ পেয়েছিলাম, পাঁচজনে গেলে তার কিছুই পেতামনা। এখনও আমরা একসাথে বসলে সেদিনের সেই স্মৃতি নিয়ে অনেক মজা করি।

'৯৮ সালের এক শুক্রবারে মাকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছিলাম, ঢাকা শহর ঘুরে ফেরার পথে গুলশান না কোথায় যেন একটা রেস্টুরেন্টে থামলাম। আমি থামতে চাইনি, উত্তম থেমেছে। রেস্টুরেন্টের নাম কলাপাতা’, নতুন ওপেন করেছে। এই পথ দিয়ে আসা-যাওয়ার সময় রেস্টুরেন্টের নাম কলাপাতা দেখে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলাম, এই রেস্টুরেন্টে একদিন খেতে আসবো, নিশ্চয়ই এখানে কলাপাতায় খেতে দেয়া হয়। আমার খুব কলাপাতায় খাওয়ার শখ
উত্তম কুমারের এই ব্যাপারগুলো খুব ভাল লাগে, খাবার দাবার, কাপড়-চোপরের ব্যাপারে সে খুব শৌখিন, আতিথেয়তার ব্যাপারে সে অনন্য। সে মনে রেখেছে, আমি কলাপাতায় খেতে চেয়েছিলাম।
কলাপাতার সামনে গাড়ী থেমেছে, সাথে মা আছে। আমি অস্বস্তিতে পড়ে গেছি, এটা তো হিন্দু হোটেল না, মা হয়তো এই রেস্টুরেন্টে খেতে চাইবেনা, কি খাবার আছে, তাইবা কে জানে, জামাইকে মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছেনা। আমিও উত্তমের কাছে আমার মা হিন্দু হোটেল ছাড়া খায়না বলে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে চাইছিলামনা। পাছে উত্তম আমার মাকে ্প্রাচীনপন্থী মনে করে, সেই ভয়ে উত্তমকে বললাম, আজ বাড়ী ফিরে যাই, মা সাথে আছে, মা তো বাইরের খাবার খাবেনা, বাসায় সব রান্না করা আছে, অন্য একদিন তুমি আর আমি এসে এখানে খেয়ে যাব। আমার মাকে আমার চেয়েও অনেক বেশী চিনে ফেলেছে সে, একই পথের পথিক তো, বলে, কে বলেছে মা খাবেনা? অবশ্যই খাবে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলি, মা, থাক, তোমার চিন্তা নাই, তোমার যদি এখানে খেতে ইচ্ছে না করে, খেতে হবেনা, আমিও তোমার সাথে বসে থাকবো। মা বলে, খাবনা কেন? এইখানে কি মাছ পাওয়া যাবেনা? জামাই বাবাজী শুনে ফেলেছে, বলে, সব পাওয়া যায়। মাছ, তরকারী সবই আছে। আপনার যেটা দিয়ে খেতে ইচ্ছে করবে, সেটা দিয়েই খাবেন

রেস্টুরেন্টে ঢুকে দেখি, এলাহী কারবার। ৯৮ সালের কথা, তখনও রেস্টুরেন্ট গুলোতে এত এত আইটেম থাকতোনা। ভর্তাই যে কত রকমের, মাছের কত পদ, মাংস না খেলেও চলে। সব্জী ছিল কিনা জানিনা, আমার মায়ের কাছে মাছই ছিল পরম প্রিয়, সব্জী নিয়ে অত আদিখ্যেতা ছিলনা। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলি, মা, তোমার কি অস্বস্তি হচ্ছে? মা বলে, অস্বস্তি হবে কেন? বলি, এটা তো হিন্দু হোটেলনা, তুমি তো হিন্দু হোটেল ছাড়া অন্য কোন হোটেলে খাওনি এর আগে। মা বলে, কে বলছে খাইনি? আমাদের স্কুলে যে রান্না পরীক্ষা হয়, কোন বামুন ঠাকুর এসে রান্না করে? বুঝলাম, ভুল আমার হয়েছে। মন থেকে আমার সকল জড়তা কেটে গেলো। মাকে এই ভর্তা দেই, সেই ভর্তা দেই, চিতল মাছের পেটি দেই, আমার এখনও মনে পড়লে চোখ ভিজে উঠে। আমার মা ছিলেন অভিজাত মনের মানুষ, কোন ক্ষুদ্রতা তাঁকে স্পর্শ করতোনা। মনে যদি খুঁতখুঁতানি থেকেও থাকতো, মেয়ে জামাই এমন সমাদর করে এমন সুন্দর রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে, শুধু এই কারণেই মা সকল অস্বস্তিকে জয় করে ফেলেছিল। সেদিন মা অনেক তৃপ্তি করে খেয়েছিলেন, যে আইটেমটা আমার কাছে ভাল লাগেনি, সেটি মায়ের কাছে খুবই সুস্বাদু মনে হয়েছিল। আমার মা মাঝে মাঝেই একটি কথা বলতো, পূর্ব জন্মে কোন ভাল কাজ করছিলাম, তাই মেয়েকে সুপাত্রে দান করেছি। কে জানে, কোন গভীর দুঃখ অথবা আনন্দ থেকে মা এই কথা বলতো!


চিঁড়ে ভাজা হয়ে যেতেই চূলায় চায়ের জল চাপালাম। মায়ের গল্প করছিলাম, মায়ের আরেকটি অভ্যাস ছিল, ঘড়ির কাঁটা ধরে চা চাই। সকাল ছয়টায় এক কাপ চা, বেলা দশটায় এক কাপ আর বিকেল চারটায় এক কাপ। দুই বেলায় তিন কাপ চা। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলেই সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যেত। মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হতো, এই একটি মাত্র উপসর্গ মাকে কাহিল করে ফেলতো। মা আমাদের ঢাকার বাসায় সাধারণতঃ বিকেলের দিকে আসতো। ঘরে ঢুকেই প্রথম কথা বলতো,
অই, আমারে আগে এক কাপ চা দে, চা না খাওয়া পর্যন্ত আমি কোন কথাই কইতে পারবোনা
কোনদিন যদি একটু দেরী হয়ে যেত, মায়ের সেই মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হয়ে যেত। আমার নিজের তো এই ধরণের উপসর্গ ছিলনা, তাই অন্যের ব্যথা উপলব্ধি করতে পারতামনা। তাছাড়া আমার মধ্যে একটু মাস্টারী ভাবও ছিল, মাকে হেদায়েত করতাম,
আসছো একটা জায়গা থেকে, একটু বসো, দম নাও, তারপর ধীরে সুস্থে চা খাও
আমার মা নিজেই ছিলেন শিক্ষক, একটানা ৪৫ বছর শিক্ষকতা করেছেন, কথায় কথায় ধমকাতেন, আমার মাতব্বরীকে থোড়াই কেয়ার করতেন, আমাকে ডিঙ্গিয়ে নাতনীকে বলতেন, মিশা, তোমার মাকে বলো তো, মাস্টারী বাদ দিয়ে আমাকে যেন এক কাপ চা দেয়
মায়ের এই ব্যাপারগুলোকে প্রশ্রয় দিত আমার ছোটমাসী। মা তখনই আমাদের বাসায় আসতো যখন ছোটমাসীও সুনামগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জ বেড়াতে আসতো। আর ছোটমাসী পাশে থাকলে মায়েরও আনন্দ, আমারও আনন্দ। মা তাঁর যত দাপট তাঁর বোনের উপর দিয়েই দেখাতো, আমার নামে যত অভিযোগ, সব তাঁর বোনের কাছেই পেশ করতো। যদিও জানতো, মেয়ের নামে অভিযোগ করে লাভ নেই, নিজেই বলতো, তোর কাছে বইনঝির নামে কিছু বলেও লাভ নাই, মাসী-বোনঝি তো আবার ফেভিকলের আঠা


মাকে শেষবারের মত আপ্যায়ণ করেছিলাম, গত বছর জুলাইয়ের ২২ তারিখে, মাত্রই রমজান মাস শুরু হয়েছে। মাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা স্কয়্যার হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলাম, একটু চেক আপের জন্য। আমার সাথে ছিল ছোটমাসীর মেয়ে মিত্রা, আর মায়ের সাথে ছিল আমাদের প্রতিবেশী মামী, যার সাথে মা খুব ফ্রীলি কথা বলতে পারতেন। আমি চিন্তায় অস্থির মায়ের কি হলো, চিন্তায় অস্থির মাঝ রাতে আমার ফ্লাইট, চিন্তায় অস্থির কিছুই গোছগাছ হয়নি, কখন কি করবো। এদিকে মায়ের মনে উৎসব উৎসব ভাব। দেহে রোগের যন্ত্রণা, সেদিকে খেয়াল নেই, হাসপাতালে প্রবেশ করেই প্রথম কথা ছিল, মিঠু, এই সাত সকালে তোর মামীরে লইয়া আসছি, মানুষটা কিন্তু কিছুই খায় নাই। তুই আগে দ্যাখ, তোর মামীরে কিছু খাওয়াতে পারিস কিনা
আমি তো রেগেও উঠতে পারিনা, মামী শুনে ফেলবে, বরং মামী বলল, দিদি, আমারে নিয়ে চিন্তা করবেন না তো। আগে আপনার পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে যাক। মা বলে, না গো, সুমনের মা, আমার নিজেরও এক কাপ চা খাইতে হবে, নাইলে আমার মাথ ধরে যাবে

মিত্রার দিকে আমি হতাশ চোখে তাকালাম, এই হাসপাতালের কিছুই চিনিনা, কোথা দিয়ে কই যায়, জানিনা, আর মা জানে, নীচতলায় ক্যান্টিন আছে। মা জানে, কারণ মাত্র এক বছর আগেই বাবাকে এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। আমার ভাইয়েরা বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল, আর আমার মা ব্যস্ত ছিল, বাবাকে যারা দেখতে আসে, তাদেরকে ঠিকমত আপ্যায়ণ করা হয় কিনা সেদিক ভেবে। মেজদাকে নাকি ফোনের উপর ফোন করতো, আর বলতো, তোর বৌদিকে ক্যান্টিনে নিয়ে চা-কফি খাওয়া

যাই হোক, মায়ের মাথা ব্যথা হতে দেয়া যাবেনা, ডাক্তার অনেকগুলো টেস্ট করতে দিয়েছে। এক টেস্টের সাথে আরেক টেস্টের সময়ের ব্যবধান এক ঘন্টা। সেই একঘন্টার বিরতিতে মিত্রা আমাদেরকে পথ দেখিয়ে ক্যান্টিনে নিয়ে গেলো। এক নজরেই দেখে ফেললাম, বার্গার আর পেস্ট্রি ছাড়া কিছু নেই। রমজান মাস বলে ক্যান্টিনও ফাঁকা। এক টেবিলে সবাই গোল হয়ে বসেছি, টেনশান হলে আমার ক্ষিদে থাকেনা। বললাম, মা, আমি কিন্তু খাবনা
মা বলে, সবার জন্য খাবারের অর্ডার দে, আমি বিল দিব
বলি, চা খাবে বলছিলে, এখন খাবারের অর্ডার দিতে বলছো কেন?
তোরে কি কইছিলাম, কইছিনা, তোর মামী না খেয়ে আসছে 
মামী না খেয়ে আসছে, মামীর জন্যই খাবার কিনি
তুই বেশী কথা কইবিনা, আমিও খামু, মিত্রাও খাইব, তুই না খাইলে না খাবি

মায়ের যে মরণ রোগ হয়েছে, সেটা তো আমার মনেও জাগেনি, তাই মায়ের সাথে নর্ম্যাল ব্যবহারই করছিলাম। মায়ের সাথে আমার কথোপকথন এমনই ছিল। এটাই আমাদের স্টাইল ছিল। আমি কাউন্টারে গিয়ে জেনে আসলাম, লুচি, ছোলার ডাল, ডিমের ওমলেট আছে। আইটেম শুনে মা রাজী হলো, অথচ মা লুচি দুই চোখে দেখতে পারতোনা। খাবার ট্রে নিয়ে এসেছি, আমার জন্যও নিয়েছি, নাহলে মা মানবেনা। উলটাপালটা কথা বলবে, বলবে ‘টাকার জন্য চিন্তা করিসনা, তুই খা, আমিই বিল দেবো এমনি হাজারো কথা। মা জানতে চেয়েছে,
বিল কত হয়েছে?
হেসে দিলাম, বললাম, বিল যাই হোক, তোমার চিন্তা নেই, আমি একেবারে টিপস সহ দিয়ে দিয়েছি, খুচরো চল্লিশ টাকা আর ফেরত নেইনি
মা বলল, ভালই করছস, গরীবের ছেলে, পেটের দায়ে কাজ করে
মা, সবাই পেটের দায়েই কাজ করে, আমরাও পেটের দায়েই বিদেশে পড়ে আছি, চুপ থাক। 
মা চুপ করে গেল, মা জানে, প্রতিবার আমেরিকা ফেরার সময় হলেই আমার ব্যবহার খুব অভদ্র হয়ে উঠে, আমি আমেরিকা ফিরতে চাইনা, কিন্তু ফিরতে হয়, সেই রাগ আমি বাবা,মা, ভাই আর কন্যাদের উপর ঝাড়ি।

এবার আসল জিনিস, চা। চায়ের অর্ডার দিতে গিয়ে শুনি, রমজান মাসে চা বিক্রী হয়না। কফি বিক্রী হয়, কিন্তু চা হয়না। আমার শরীর ঘামতে শুরু করলো, আমি জানি, চা হচ্ছে মায়ের টনিক, এখন যদি চা না পাই, উপায় থাকবেনা, মায়ের মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হয়ে যাবে। বাকী টেস্ট করাবো কেমনে? তার চেয়েও বড় কথা, আজ আমি চলে যাচ্ছি, মা'কে এক কাপ চা দিতে পারবোনা! 
মাকে বললাম, মা, চা নাই, কফি আছে। তুমি কফি খাও। 
মা প্রায় রাজী হয়েই গেছিল, কিন্তু পাশে বসা মামী বলল, মিঠু, আমি তো কফি খাইনা মা। থাক, চা না থাকলে নাই, বাদ দাও

মামীকে মা সাথে করে নিয়ে এসেছে, মামীকে চা খাওয়াবে বলে ক্যান্টিনে এসেছে, এখন মামীই যদি চা না পায়, মামীর পাশে বসে মা কফি খাবেনা। তাছাড়া আমি তো মায়েরই মেয়ে, আতিথেয়তার পুরোটাই মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি। ক্যান্টিন বয়ের কাছে গেলাম, খুব বেশী অনুরোধ করতে হলোনা, আমার মুখের দিকে তাকিয়েই ছেলেটি বলল, আপনি অপেক্ষা করেন, দেখি সুপারভাইজারের সাথে কথা বলে। অফিসে, কোম্পানীতে যারাই চাকুরী করে, তাদের প্রত্যেকের ঘরেই একটি করে মা, একটি করে বোন আছে, সেই মা, বোনেরা মাঝে মাঝেই অবুঝ হয়, কাজেই সুপারভাইজার এবং ক্যান্টিন বয় আমাকে সেই যাত্রা বাঁচিয়ে দিল। শুধু আমার জন্য ওরা চার কাপ চায়ের ব্যবস্থা করে দিল। আজ এই ভগ্ন হৃদয়ে আমি সেই সুপারভাইজার এবং ক্যান্টিন বয়টির মঙ্গলের জন্য দুই হাত তুলে প্রার্থণা করছি। ওরা সেদিন ঈশ্বরের রূপ ধরে আমার কাছে এসেছিল বলেই জন্মদাত্রী মায়ের শেষ আব্দারটুকু রাখতে পেরেছিলাম। আমার সাথে ওটাই ছিল মায়ের শেষ আহার! খুব বেশী কিছু উনি চাননি, ক্যান্টিনে বসে খেতে চেয়েছিলেন, আর চেয়েছিলেন এক কাপ গরম চা।

** আমি যখন মাত্র তিন মাস পরেই দ্বিতীয় বার দেশে গেলাম, মাকে শেষ বারের মত দেখতে, মাকে দেখতে আসা মেজদার বন্ধু সুভাশীষদা( অভিনেতা সুভাশীষ ভৌমিক)কে নিয়ে ক্যান্টিনে ঢুকেছিলাম। কি আশ্চর্য্য! সেই ক্যান্টিনবয়, আমাকে দেখে মুখ খুলে হাসি দিল, পরিচিতের হাসি, মাত্র তিন মাস আগে এক নজর দেখেছিল আমায়, আমার জন্য চায়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, সেই ছেলেটি আজকেও, এই সময়েই ডিউটিতে আছে! প্রতিদিন কত শত শত কাস্টমারের কাছে ওরা খাবার বিক্রী করে, এর মধ্যে থেকে আমাকে সে কি করে মনে রাখলো***
Photo

Monday, October 7, 2013

“আগুনপোড়া হৃদয়”



আগুনপোড়া হৃদয়

দুই বছর আগের কথা, ফেসবুকে আমি একেবারেই নবাগত। বন্ধু লিস্টে তেমন কেউ ছিলনা, মেজো মেয়ে মিশা আমাকে ফেবু একাউন্ট খুলে দিয়েছিল, মাকে খুশী করার জন্য নিজের বন্ধুদের কাছে অনুরোধ পাঠিয়েছিল যেন ওরা আমাকে ওদের সাথে অ্যাড করে নেয়। মিশার বন্ধুরা মিঠু আন্টিকে বন্ধু হিসেবে অ্যাড করেছিল। মিশার বন্ধুদের মধ্যে কেউই বাংলাভাষী ছিলনা, তাই আমার ফ্রেন্ড লিস্টে ওদের উপস্থিতি থাকা আর না থাকা সমান কথা ছিল। 
আমি তখন স্ট্যাটাস লিখতাম, বাধাধরা নিয়মে নয়, যা মনে আসতো, তাই লিখতাম। পাঠক ছিলনা, নিজের কয়েকজন বন্ধু সেখানে লাইক দিত। তেমনই এক পাথর সময়ে বাবর নামে এক ছেলে আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করি। ছেলেটি এত চমৎকার ইংলিশে ইনবক্স মেসেজ পাঠাতো যে আমি পড়ে মুগ্ধ হয়ে যেতাম। ওর মেসেজের উত্তর পাঠাতাম। আমাকে ম্যাডাম সম্বোধণ করতো, কিছুতেই দিদি, বৌদি, মাসী বা খালা, বা আন্টি বলতোনা।

বাবরের মেসেজগুলো ছিল দার্শনিক টাইপের। একদিন ও আমাকে জানালো, ওর কিছু নিজস্ব কষ্টের কথা আমার সাথে শেয়ার করতে চায়। বললাম, অবশ্যই শেয়ার করতে পারো। তুমি যা কিছু বলতে চাও, খোলামনে বলো, আমি কাজ থেকে ফিরে তা পড়বো এবং উত্তর পাঠাবো। কাজ থেকে ফিরে বাবরের মেসেজ পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ও লিখেছিল, ওরা দুই ভাই, সাধারণ মধ্যবিত্তের সংসারে নানা রকম টানাপোড়েণের মধ্যে বড় হয়েছে। ক্যারিয়ার গড়বার সময়ে ওদের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং বাবাকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকগণ জবাব দিয়ে দিয়েছে, বলেছে দেশে চিকিৎসা নেই, বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করালেও খুব বেশী হলে মাস ছয়েক রুগী বাঁচবে, এরপর মৃত্যু অবধারিত। একজন ডাক্তার নয়, ডাক্তারদের বোর্ড বসিয়েই এই সিদ্ধান্তে তাঁরা উপনীত হয়েছিলেন। বিদেশ নিয়ে চিকিৎসা করাতে খরচ হবে প্রায় বারো লাখ টাকা। ওদের বাবা একটি মাত্র জমি কিনে রেখেছিলেন, যার মূল্যমান ছিল পাঁচ/ছয় লাখ টাকা। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব সকলে বাবরের উপর সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার ছেড়ে দিয়েছিল। ২৫ বছরের যুবকের সামনে তখন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, সে তার বাবাকে প্রচন্ড ভালোবাসে, বাবার মৃত্যু কোনভাবেই কাম্য নয়, অথচ বাবার মৃত্যু উপস্থিত, জমি বিক্রী করে ছয় লাখ টাকা পাওয়া যাবে, বাকী ছয় লাখ টাকা কর্জ করতে হবে, তবেই বাবাকে আরও ছয় মাস বাঁচিয়ে রাখা যাবে।

বাবরের ছোট ভাই তখনও সাবালক হয়নি, বাবরের মা সাধারণ গৃহবধূ, বাবরের নিজস্ব কোন আয় রোজগার ছিলনা, তাই বাবর জীবনের কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সে বাবাকে দেশে রেখেই চিকিৎসা করিয়েছিল। যে কয়দিন বাবা হাসপাতালের বেডে শুয়েছিলেন, বাবর তার বাবার পাশেই বসে থেকেছে, বাবার বেডের নীচেই কম্বল পেতে রাতে শুয়ে থেকেছে। এক রাতে ছোট্ট একটু আওয়াজ শুনেই বাবরের ঘুম ভেঙ্গে যায়, তাকিয়ে দেখে, তার বাবা খুব কষ্ট করে বেড সাইড টেবল থেকে জলের গ্লাস নিতে চেষ্টা করছেন, বাবর তার বাবাকে মৃদু তিরষ্কার করে কেন তিনি ছেলেকে ডেকে দিলেননা! বাবা বলেন, তুমি সারাদিন আমার পেছনে খেটে যাচ্ছ, তোমার একটু বিশ্রাম দরকার, কেমন অসহায়ের মত ঘুমাচ্ছিলে, তাই তোমাকে আর জাগাতে ইচ্ছে করেনি
বাবার এই কথাটুকু বাবরের মনে শক্তিশেলের আঘাত হানে, মৃত্যুপথযাত্রী বাবা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও ছেলের ক্লান্তির কথা ভাবছেন, আর পাষন্ড ছেলে টাকার চিন্তা করে বাবাকে বিদেশ নিয়ে চিকিৎসা করালোনা। কিন্তু ততদিনে বাবার জীবন প্রদীপ নিভে এসেছে, এক সময় বাবা মৃত্যুর কাছে পরাজিত হয়েছেন, কিন্তু ছেলের হৃদয়ে সারা জনমের জন্য দাগ কেটে দিয়ে গেছেন।

এরপর বাবর মধ্যপ্রাচ্যের কোন এক দেশে চাকুরী নিয়ে এসেছে, প্রচুর অর্থ সমাগম ঘটেছে, গ্রামের বাড়ীতে বিধবা মায়ের জন্য প্রাসাদ তুলে দিয়েছে, ছোট ভাইকে মিডল ইস্টে নিয়ে এসেছে, মাকে সোনার থালায় ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে, সবই হয়েছে কিন্তু মন থেকে সেদিনের সেই গ্লানিবোধ মুছতে পারেনি। ওর মন ভালো থাকেনা, কষ্টের কথাটুকু কারো সাথে শেয়ার করতে পারেনা, কি মনে করে যেন আমাকে ওর খুব বিশ্বস্ত মনে হয়েছে, খুব কাছের কেউ মনে হয়েছে, কষ্ট আর চেপে রাখতে পারছিলনা বলেই আমার কাছে কষ্টের কথাগুলো বলে জানতে চেয়েছে, আমি কি সেদিন পিতৃ হন্তারকের ভূমিকা পালন করেছিলাম?

বাবরের মেসেজ পড়ে আমি এতটুকু সময় ব্যয় করিনি, উত্তর দিয়েছিলাম, বাবর, তুমি যা করেছো, বাবার ভালোর জন্য করেছো। তোমার বাবা জমিখানি কিনেছিলেন উনার স্ত্রী আর দুই পুত্রের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। এই জমিটুকুই ছিল উনার একমাত্র সম্বল, উনার অহংকার। উনি নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন, খুব বেশীদিন উনি বাঁচবেননা, কারণ মৃত্যুরোগ রুগীকে নানাভাবে জানিয়ে দেয়, তার আয়ু শেষ হয়ে এসেছে। উনি যদি জানতেন যে উনার কষ্টের সঞ্চয় বিক্রী করা হয়েছে নিষ্ফল চিকিৎসার জন্য, এতে করে উনার মৃত্যু সহজ হতোনা, আরও কঠিন হতো, এক বুক হতাশা নিয়ে উনি পৃথিবী ছাড়তেন। উনি তো জানতেননা যে ডাক্তাররা বলেছেন বিদেশের চিকিৎসায় উনি আরও ছয়মাস বাঁচবেন। কাজেই উনি যেটা জেনে গেছেন যে উনার বড় ছেলেটি রাত-দিন উনার পাশে থেকে সেবা করেছে, জলের গ্লাসে টুং করে আওয়াজ হতেই ছেলে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠেছে, বাবাকে শিয়রে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে, এটিই সত্যি হয়ে আছে। উনি তখনই বুঝে গেছেন, উনার অবর্তমানে বাবর তার মা আর ছোট ভাইকে আগলে রাখবে। উনি সেই দোয়া করে গেছেন বলেই আজ তুমি জীবনে সাকসেসফুল হয়েছো। কাজেই মন থেকে সমস্ত গ্লানি দূর করে দাও।


প্রায় এক বছর হয়ে গেল, বাবর আমাকে আর মেসেজ পাঠায়না, ওর ধারণা হয়েছে, আমি বুঝি এখন আর সেদিনের আমি নেই, আমার প্রচুর বন্ধু, আমি তাদের নিয়েই ব্যস্ত থাকি। তাই বাবর আমাকে বিরক্ত করতে চায়না।

আমি সেদিন ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি, বাবরের মত অগ্নিপরীক্ষায় একদিন আমাকেও বসতে হবে, পরীক্ষা শেষে আগুনপোড়া হৃদয় নিয়ে বাকী জীবন কাটাতে হবে।

গত বছর জুন মাসের ৮ তারিখে আমার মেয়ে মৌটুসীর বিয়ে হয়েছে, আমার শ্বশুর-শাশুড়ী গত হয়েছেন অনেক বছর আগে, আমার তিন মেয়ে দাদু-দিদার আদরে বড় হয়েছে, তাই দাদু-দিদার উপস্থিতিতে মেয়ের বিয়ে দেবো বলে বাংলাদেশে বিয়ের আয়োজন করেছিলাম। আমার মা ্নাতনী বিয়ের সকল মাঙ্গলিক কাজ নিজে হাতে করেছেন, নাতনীকে শ্বশুরবাড়ীতে পাঠিয়েছেন, আমাকেও বিদায় জানিয়েছেন। তবে এবারের বিদায়পর্বটা ছিল অন্যরকম। প্রতিবার বিদায়ের দুই দিন আগেই মা ঢাকা আমার অস্থায়ী বাসায় চলে আসতেন, বাজার থেকে বড় বড় ট্যাংরা মাছ আনাতেন, বেগুণ, ধনেপাত্‌ ডালের বড়ি দিয়ে মাছের ঝোল রান্না করতেন, মেয়েকে আর মেয়ে জামাইকে আর না, আর না করে খাওয়াতেন, গাড়ীতে উঠার আগ মুহূর্তে কেঁদে দিয়ে বলতেন, এইবারই আমার সাথে তোর শেষ দেখা, পরেরবার আর আমাকে দেখবিনা। 
এ বছর আর সেটা ঘটেনি, গতবছর মা আমার অস্থায়ী বাসায় আসবে বলেও আসেননি, শরীর খারাপ লাগে বলেছেন, আমরা সবাই বিশ্বাস করতাম, পৃথিবীর সবার বাবা-মা মরে গেলেও আমাদের বাবা-মা বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল, এতটাই সুস্থ-সমর্থ তাঁরা ছিলেন। মায়ের শরীর খারাপ শুনেছি, তাই বলে মা শেষ মুহূর্ত্তে আমার বাসায় আসার প্রোগ্রাম বাতিল করে দি্লেন? খুব অভিমান হয়েছে আমার মনে, আমিও আর মাকে ফোন করিনি, কথাও বলিনি। শেষ মুহূর্তে জানতে পেরেছি, মায়ের ইউটেরাসে প্রবলেম, ডাক্তার ইমিডিয়েটলী ইউটেরাসের বায়োপসী করাতে চেয়েছেন। ফোন পেয়ে পড়ি-মরি করে ২২শে জুলাইয়ের সকালে গাড়ী নিয়ে নারায়ণগঞ্জে গিয়ে মাকে নিয়ে সরাসরি স্কয়্যার হাসপাতালে চলে এসেছি। 
আমি মাকে হসপিটালে এনেছিলাম, যাতে নিজে উপস্থিত থেকে স্কয়্যার হাসপাতালের মত অত্যাধুনিক হাসপাতালের প্যাথলজীতে ইউটেরাসের টিস্যু দিয়ে যেতে পারি, এবং সঠিক বায়োপসী রিপোর্ট পাওয়ার পর সঠিক চিকিৎসা করাতে পারি। একটাই সমস্যা ছিল, আমার হাতে সময় ছিলনা, সেই রাতেই আমার আমেরিকাগামী ফ্লাইট। 
ডাক্তারকে আমার সমস্যার কথা বলে অনুরোধ করলাম, নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে নারায়ণগঞ্জের ডাক্তারের রিপোর্টের ভিত্তিতেই যেন মায়ের ইউটেরাসের টিস্যু কালেকশান করে বায়োপসীর জন্য পাঠানো হয়, সাথে এও বললাম, আমি আমেরিকা চলে গেলে আমার ভাইদের পক্ষে সম্ভব হবেনা মায়ের সাথে এই মেয়েলী সমস্যা নিয়ে কথা বলতে। এইসব ব্যাপারে আমাদের মা খুবই লাজুক ছিলেন, ভাইয়েরাও এইসব ব্যাপারে তেমন কিছু জানেনা, ছেলেবৌ আছে, তারপরেও মেয়ের কাছে যতখানি ফ্রী হওয়া যায়, ছেলের বৌদের কাছে তো আর ততখানি ফ্রী হওয়া যায়না।

ডাক্তার আমার কথা মানলেননা, উনি মায়ের দেহের আরও সাত সতেরো ইনভেসটিগেশান দিলেন এবং বলে দিলেন, বায়োপসী করার আগে ইউটেরাস ফেলে দিতে হবে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, আমি একবার বললামও, ম্যাম, বায়োপসী না করিয়েই যদি ইউটেরাস রিমুভ করা হয়, এবং বাই চান্স যদি ধরা পড়ে যে ইউটেরাস ক্যানসারাস, তাহলে তো ক্যানসার সারা দেহে ছড়িয়ে যাবে। অপারেশানের আগে যদি বায়োপসীটুকু করিয়ে দিতেন----

আমি হচ্ছি সাধারণ এক মানুষ, জ্ঞান-গম্যি কম, ডাক্তারী বিদ্যাও জানা নেই, আমার কথার মূল্য কি? ডাক্তার সাহেবা আমার কথার মূল্য দিলেননা, মাকে নিয়ে সারাদিন পার করে দিলাম হাসপাতালের বিভিন্ন ফ্লোরে। বার বার দৌড়াদৌড়িতে মা ক্লান্ত হয়ে পড়লেন, সাথে ছিল মিত্রা, আমার ছোটমাসীর মেয়ে, মিত্রা না থাকলে সেদিন আমাকেই হয়তো হাসপাতালে ভর্তি করতে হতো।

*** সেদিনই বোধ হয় আমার মন প্রথম টের পেলো, মা বাঁচবেনা। কেন এমন মনে হলো, জানিনা। তখনও তো মায়ের অসুখ সম্পর্কে নিশ্চিত হইনি! হালকা সবুজ জমিন, জরিপাড় তাঁতের শাড়ী পরণে, সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ, হাসপাতালের করিডোরের অপেক্ষমান চেয়ারে বসে মা শূণ্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন উল্টোদিকের দেয়ালে। ছবিটা আমার মনে গাঁথা হয়ে আছে, মাকে সেদিন কি অসহায় দেখা যাচ্ছিল! এই ছবি দেখেই আমার মনে হয়েছে, মা আর বাঁচবেনা।***

মাকে শেষ বিদায় দিলাম গুলিস্তানের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। আমার মেজদা আগে থেকেই ওখানে দাঁড়িয়েছিল, ক্লান্ত দেহ টেনে টেনে মা ট্যাক্সিতে গিয়ে বসলেন, আমার দিকে তাকালেনও না, আমিও তাকালামনা মায়ের মুখের দিকে, দুজনেই বুঝে গেছি, এ দেখাই শেষ দেখা। সারাদিনের পরিশ্রমে আমি ব্যর্থ, শেষ চেষ্টা দিয়েও পারলামনা মায়ের ইউটেরাইন টিস্যু দিয়ে আসতে। আমি ব্যর্থ, এই প্রথম আমি ব্যর্থ হলাম, মাকে সারাদিনে এত কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে যে মা তিতিবিরক্ত হয়ে গেছিলেন আমার উপর। মায়ের ধারণা হয়েছে, আমি অযথাই মাকে কষ্ট দিয়েছি। আসলেই সত্যি, অযথাই কষ্ট দিয়েছি। নারায়ণগঞ্জের ডাক্তারের পরামর্শমত যদি ঢাকার নাম না জানা প্যাথলজীতে ইউটেরাইন টিস্যু পৌঁছে দেয়া হতো বায়োপসী করার জন্য, তাহলেই আমাদের মা আরও কিছু দিন আমাদের মাঝে বেঁচে থাকতো। আমার ছোট ভাইটা প্রস্তুত ছিল, সকালে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে মায়ের দেহ থেকে ডাক্তার টিস্যু সংগ্রহ করতেন, ছোট ভাইয়ের কাছে তা দিতেন, ভাই সেটি ঢাকা নিয়ে এসে প্যাথলজীতে পৌঁছে দিত। রিপোর্টে ক্যানসার ধরা পড়তো, হয়তো আমরা বিশ্বাস করতামনা, দ্বিতীয়বারে অন্য কোন প্যাথলজী থেকে টেস্ট করাতাম, হয়তো আবারও ক্যানসার ধরা পড়তো, এরপর আমরা ভেবে দেখতাম, মায়ের চিকিৎসা কীভাবে করা যায়। প্রয়োজনে ইন্ডিয়া নিয়ে যেতাম, অপারেশান না করিয়েই যতটুকু চিকিৎসা সম্ভব, করানো হতো, মা তো কিছুদিন বেঁচে থাকতেন। আমার বেশী মাতব্বরীর জন্যই বায়োপসী ছাড়াই মায়ের ইউটেরাস অপারেশান করা হলো, মায়ের মৃত্যু তরান্বিত হলো। এবং আমার আশংকাই সত্যি হলো, ক্যানসার সারা দেহে ছড়িয়ে গেলো, ১০ই আগস্ট মায়ের দেহে অস্ত্রোপচার হলো, ১লা অক্টোবার মুমূর্ষু অবস্থায় মাকে আবার হসপিটালে ভর্তি করানো হলো।

আমি মাত্র দুই মাস আগেই দেশে ১০ সপ্তাহ ছুটিয়ে কাটিয়ে, কাজে জয়েন করেছি, আর কোন ছুটি অবশিষ্ট ছিলনা, ম্যানেজারের কাছে কেঁদে কেটে মাত্র দুই সপ্তাহ ছুটি নিয়ে আবার দেশে গিয়ে পৌঁছেছি। আশা ছিল, মাকে নিজের হাতে যত্ন করবো, আমি জানি, কিভাবে রুগীর সেবা করতে হয়, আগেই শুনেছি মা কিছুই খেতে পারেনা, যা খায়, তাই বমি হয়ে যাচ্ছে, রক্তে লবনের পরিমান কমে যাচ্ছে, রক্তে পুষ্টিও যাচ্ছেনা, দেশে যাওয়ার সময় তাই মায়ের জন্য ফর্টিফায়েড মিল্ক কিনেছি, ফোনে মাকে বলেছি, " মা, আরেকটু অপেক্ষা করো, তোমার জন্য ব্যালেন্সড মিল্ক নিয়ে আসছি, ওটা খেলে তোমার দেহে বল ফিরে আসবে।" মা'কে জিজ্ঞেস করেছি মা, আমি আসি? মায়ের মন, একবার ভাবে কত টাকা পয়সা খরচ হয়েছে মেয়ের বিয়েতে, আবার আসতে গেলে আরও টাকা খসে যাবে। তাই আমতা আমতা করে বলে, কি হইব আইসা? কত টাকা খরচ, মিথীলা ছোট, জীবেনেরও তো বয়স হইছে, তুই আইলে ওদের কে দেখবে? আবার বলে, দ্যাখ, ভাল করে চিন্তা করে, আসবি কিনা। আমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার কি করা উচিত? সে বলে, তোমার যাওয়া উচিত। বললাম, অনেক খরচ, সে বলে, রাখো তো খরচ, যখন যেটা প্রয়োজন, সেটাই আগে করা উচিত

আমি প্লেনে উঠলাম আমেরিকান ২রা অক্টোবারের দুপুরে, প্লেনে যখন বসে আছি, আমার স্বামী ফোন করে বললেন, " শোন, একটা মোটামুটি সুখবর আছে, মায়ের পেট যেভাবে ফুলে যাচ্ছিল, সেটা নাকি থেমে আছে, আমি ওদেরকে বলেছি, তুমি যাওয়ার পর অপেরেশান হবে"। আমি বললাম, " কেন, প্রয়োজন হলে তো আগেই অপারেশান করে ফেলতে পারে"। আমার স্বামী আগেই বুঝেছিলেন, মা বাঁচবেনা, আমাকে বললেন, " এত বড় একটা অপারেশান, বলা তো যায়না, কি হবে, তার চেয়ে এই ভাল, তুমি যাও, তোমাকে উনি দেখুক, তারপর অপারেশান হোক"। 
আমি ঢাকা পৌঁছালাম ৪ তারিখের সকালে, এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি হসপিটালে যেতে চেয়েছি, আমাকে যিনি আনতে গিয়েছিলেন, সেই অঞ্জন'দা বললেন, " গতকাল মাসীমার অপারেশান হয়ে গেছে, উনি এখন আইসিইউ তে আছেন"। এই কথা শুনে আমি কেমন যেন বোধহীন হয়ে গেলাম, আমার মাথায় আর কোন কিছুই কাজ করছিলনা, এরপর থেকে মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত কোন এক যান্ত্রিক নিয়মে আমি দিন পার করেছি। ৩ তারিখ মায়ের অপারেশান হয়েছে, কারণ ডাক্তাররা ধরতেই পারছিলেননা, মায়ের পেট কেন প্রতি দুই ঘন্টায় এক সেন্টিমিটার করে ফুলে যাচ্ছে। মেজদা অনুরোধ করেছিল, অপারেশানের তারিখ এক দিন পিছিয়ে দিতে, যেন আমি পৌঁছে মাকে দেখতে পাই। মা বলেছিল, আজকেই অপারেশান হোক, মিঠুর ভাগ্যে থাকলে আমার সাথে দেখা হবে। মাকে যখন ওটিতে নেয়া হয়, আমার দুই ভাই, মেজো বৌদি, মামী আর মামাত ভাই অপু পাশে ছিল। মামী বলেছিল, দিদি, একটুও ভয় পাইয়েন না, অপারেশান হইলেই আপনি ভাল হয়ে যাবেন। মা নাকি কেঁদে দিয়েছিল, বলেছিল, যাইতেছি, যদি ফিরে আসি, তোমাদের সাথে দেখা হবে, নাহলে আমাকে তোমরা সবাই ক্ষমা করে দিও। মামী শুধু বলতে পেরেছিল, এইটা কি কন দিদি, আপনি কেন ক্ষমা চাইবেন, আমরা ক্ষমা চাই আপনার কাছে----ট্রলীতে করে মা চলে গেলেন ওটিতে।

আমি যখন আইসিইউতে গেলাম, জানালা দিয়ে বেডে শোয়া যাঁকে দেখলাম, উনি আমার মা নয়, একজন জবুথবু, অসহায় মানুষ, কি ছোট্ট এক শরীর, আমার মাথাটা ঘুরিয়ে গেলো, কি কঠিন পরীক্ষা, মায়ের এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী, বেশী ভাল করতে চেয়েছিলাম, আমার কারণেই মায়ের এই অবস্থা। মায়ের জন্য কতকিছু এনেছি, মা জানতেই পারলোনা। যতবার দেশে আসি, আসার আগে মাকে জিজ্ঞেস করি, মা, কি আনবো? মা প্রথমে বলে, কিচ্ছু আনতে হবেনা, তুই ঠিকমত আয়। প্রত্যেকবার রাজ্যের জিনিস লইয়া স্যুটকেস টানতে টানতে আইয়ছ, দরকার হইলে দেশ থেকেই জিনিস কিনে দিবি"। এই কথা বলতো ঠিকই, এরপর থেকে শুরু হতো একটু একটু করে ফরমায়েশ, মিঠু, তেমন কিছু আনিসনা, কয়টা নোকপালিশ আনিস, কয়টা লিপস্টিক আনিস, জনসন বেবী লোশান আনিস, কিসমিস আনিস, দারচিনির গুঁড়া আনিস, ওহ ভাল কথা, সাবান আনিস, সাথে টুথপেস্ট” এইভাবে লিস্ট বড় হতো। আমরা সবাই হাসাহাসি করতাম, মায়ের নিজের জন্য একটা সূতাও আনতে বলতোনা, যা কিছু, তার সবই দান ধ্যান করার জন্য। সেই মা নীরব নিথর হয়ে বেডের মধ্যে ছোট্ট দেহ নিয়ে পড়ে আছে, আমাকে জিজ্ঞেস করবেনা আমি কি এনেছি, এতো আমার মা নয়, অন্য কেউ, অন্য কেউ, আমার মা নয়। অনেক বড় শ্বাস টেনে রুমের ভেতর ঢুকে মায়ের কাছে গেলাম, আমার শরীর শক্ত হয়ে গেল, ভাঙ্গবোনা আমি, ডাকলাম, মা, মা

সারা শরীরে নল লাগানো, মুখের ভেতর দুই নল, নাকের ভেতর দুই নল, দুই হাতে সুঁচ ফোটানো, এই আমার মা, এই আমার মা, এও কি সম্ভব? আমার মায়ের ৭৫ বছরের জীবনে আমি যে কটা দিন মা'কে দেখেছি, মাইগ্রেনের ব্যথা ছাড়া মা'কে কখনও বিছানা নিতে দেখিনি। তখনও জানিনা, মায়ের পেট ওপেন করে দেখা গেছে, পরিপাক তন্ত্রের পুরোটাই পেঁচিয়ে গেছে, একটার সাথে আরেকটা জোড়া লেগে গেছে, ডাক্তার অনেকটা কেটে বাদ দিয়েছে, কিডনী কোলাপসড, সবকিছু ওভাবেই রেখে ডাক্তার পেট সেলাই করে দিয়েছে, গলার কাছে নতুন করে ফুটো করে কৃত্রিম খাদ্যনালী তৈরী করে দিয়েছে, আরও কি কি করেছে জানিনা, শুধু জানি, এই অবস্থাতেও মায়ের জ্ঞান ফিরে এসেছে। ওটিতে যাওয়ার আগে মা জানতো, পরের দিন সকালে আমি এসে পৌঁছাবো, জীবনে এই প্রথম আমি একা বের হয়েছি, মা জানে, আমি একা চলতে ভয় পাই, অপারেশানের দিন সকালেই আমার ভাগ্নী অদিতি টুম্পাকে বলেছে, টুম্পা শোন, তোমার মামী এলে তোমাদের বাসায় নিয়ে যাবে, ঘন্টা দুই বিশ্রাম করতে দিবে, খেতে দিবে, তারপর এখানে নিয়ে আসবে

আমার মা ডাক শোনার অপেক্ষায়ই বোধ হয় মা ছিল, এমন চমকে উঠেছে, দুই চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়েই কেঁদে দিয়েছে। আমার মা সহজে কাঁদেনা, এই জল কোথা থেকে এলো, মা এভাবে কেন কাঁদছে, মা কি বুঝতে পেরেছে যে তাঁর মেয়েটা কষ্টে কষ্টে মরে যাচ্ছে। মায়ের শরীর কাঁপছে, আমি ভয় পেয়ে গেছি, এই বুঝি নার্স আমাকে বের করে দিবে। নার্স মেয়েটা বলছে, এই জন্যই আইসিইউতে কাউরে আসতে দেয়না। রুগীর শরীর আরও খারাও করবে। আমি নিজেকে শক্ত রেখেছি, এটি আমি খুব ভাল পারি, কারো সামনে ভাঙ্গিনা, আড়ালে গিয়ে ভেঙ্গে পড়ি। মায়ের মাথায় হাত পৌঁছাচ্ছেনা, হাতের সামনেই লোহার রডে সব যন্ত্রপাতি ঝুলছে, মাকে লাইফ সেভিং মেশিনে রাখা হয়েছে, আমি যদি কাছে যাই, নাড়াচাড়া লেগে যদি লাইফ সেভিং মেশিনের নল খুলে যায়, তাহলে তো মা মরেই যাবে। এই ভয়ে দূর থেকে হাত বাড়িয়ে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, মা, কেঁদোনা, তুমি কাঁদলে শরীর খারাপ করবে, ডাক্তার তাহলে আমার উপর রাগ করবে, আমাকে বের করে দিবে। তোমার অপারেশান খুব ভালো হয়েছে, তুমি ভাল হয়ে যাবে। বাচ্চা মেয়ের মত মা কান্না বন্ধ করে দিল, মাথা কাত করে আচ্ছা বলল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মা, জল খাবে? কি গভীর আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকালো। গত কয়টি দিন মা একটু জলের জন্য অনেক কেঁদেছে, ডাক্তারের কাছে নাকি দুই হাত জড়ো করে বলেছে, " আমাকে একটু জল খাওয়ার অনুমতি দিন", জল দিলেই মা বমি করবে, কষ্ট বেড়ে যাবে বলে ভয়ের চোটে কেউ মা'কে জল দেয়নি।
নার্সকে বললাম, আমাকে একটু জল এনে দিতে পারেন? নার্স বলে, রুগীর মুখে কিছুই দেয়া যাবেনা। বললাম, প্লীজ, একটু জল এনে দিন, এক ফোঁটা জল দেবো, মায়ের খুব তৃষ্ণা ছিল, একটু জলের জন্য মা অনেক কেঁদেছে, তখনও ডাক্তারের ভয়ে কেউ মায়ের মুখে দুই ফোঁটা জল দিতে পারেনি। এখন আমি দেবো। নার্স খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেলো, বলে, দিলেও লাভ নেই, পানি তো উনার পেটে যাবেনা। বললাম, পেটে যাওয়ার জন্য তো আমি জল খাওয়াবোনা, একটু জিভ ভেজাবো। নার্স বলে, ওহ বুঝছি, আপনে কি গঙ্গাজল দিতে চাইতেছেন? নার্স মেয়েটির সারল্য আমার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল, মা সব শুনতে পাচ্ছে, আমি যে মায়ের মুখে কেন জল দিতে চাইছি এই গাধা মেয়ে সব বলে দিল। একটু কঠিন স্বরে বললাম, গঙ্গাজল খাওয়াবো কেন, মায়ের মুখটা শুকিয়ে গেছে, আপনি মিনারেল ওয়াটার আনেন, দুই ফোঁটা জল দিয়ে মায়ের জিভটা ভিজিয়ে দেবো

নার্স ডাক্তারের কাছে গিয়ে কি বলেছে কে জানে, ডাক্তার অনুমতি দিয়েছে। আমি আঙ্গুল ডুবিয়ে মায়ের জিভে ফোঁটা ফোঁটা জল দিলাম, নার্স বলেছে, জল নাকি বেরিয়ে আসবে। কিন্তু জল বের হয়ে আসেনি, মা জিভ নেড়ে জলটুকু গ্রহণ করেছেন। মাত্র দশ মিনিট সময় আমাকে থাকতে দিয়েছে। বেরিয়ে আসার আগে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, মা, আমি তো বাইরের থেকে এসেছি, আমি থাকলে ইনফেকশান হতে পারে, সেইজন্য ডাক্তার আমাকে এখন চলে যেতে বলেছে, আমি কোথাও যাবনা, বারান্দায় বসে থাকবো, তুমি ভয় পেয়োনা, আমি আর মেজদা কাছেই আছি, তুমি একা নেই, আমরা আছি। ঠিক আছে? মা খুব শান্তিতে মাথা নাড়িয়ে ঘুমিয়ে গেলেন।
৫ তারিখ ছিল মায়ের জন্মদিন, সকালে মাকে হ্যাপী উইশ করেছি, মা তখনও আমাদের সাথে খুব ভালভাবে রেসপন্স করেছে। বিকেলের দিকে আমি একা মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছি। মায়ের চোখ বন্ধ, মুখের ভেতর দুই নল ঢোকানো আছে, মুখ ঈষৎ হাঁ করা। মায়ের দিকে তাকিয়ে আছি, মা মুখ খুলে হাসছে, আমার শরীর অবশ হয়ে এলো, তার মানে মা এখন স্বপ্ন দেখছে, দেহের এই অবস্থাতেও মা স্বপ্ন দেখছে, এমন স্পষ্ট হাসি, মা কি দেখে হাসছে? মা কি স্বপ্নে তাঁর বাবা কে দেখছে? তাঁর মাকে দেখছে? নাকি ভগবানকে দেখছে? মা কি দেখে এভাবে হাসছে!! হাসি শেষ, মা আবার স্বাভাবিকভাবে ঘুমাচ্ছে। সইতে পারলামনা, মায়ের বেড ধরে নীচু হয়ে বসে পড়লাম, নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম, আমার হাতের কাঁপুনীতে মায়ের বেড কাঁপছে, তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলাম।

৪, ৫, ৬ তারিখ পর্যন্ত দুই বেলাতেই মায়ের সাথে দশ মিনিট করে সময় কাটিয়েছি, কোন উন্নতি নেই, কিডনি পুরাপুরি অকেজো, তরুণ ডাক্তারদের অনেকেই আমাকে বলেছে, মায়ের খুব কষ্ট হচ্ছে, আমাদের উচিত, মাকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়া। কীভাবে মুক্তি? লাইফ সাপোর্ট খুলে দিলেই মুক্তি। লাইফ সাপোর্ট খুলে দেয়া মানেই মায়ের মৃত্যু। মা তো মরতে চাননি, মাস খানেক আগেও আমার সাথে কথা হয়েছে, বলেছিলাম, মা, তুমি মৌটুসীর বিয়ে দিলা, মিশা তোমার এত আদরের নাতনী, ওর বিয়া দিবানা? তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যাও মা। মা তখনও বলেছে, মিশা আমারে একটা ফোন দিয়া খোঁজ লয়না, আমি দিমু মিশার বিয়া। মিশাকে বলতেই মিশা পড়িমরি করে দিদাকে ফোন দিয়েছে, হড়বড় করে বলেছে তার হাজার ব্যস্ততার কথা, দিদা নাকি বুঝতে পেরেছে নাতনী অনেক ব্যস্ত। মিশাকে বলেছে, তোমার মা তো বলেছে, তোমার বিয়েটা পর্যন্ত থাকতে। তুমি ভাল ছেলে বিয়ে করলে আমি থাকবো, সাহেব বিয়ে করলে তো আমার দরকার হবেনা। সেই মাকে লাইফ সাপোর্ট খুলে দেবো? ডাক্তারদের সাথে অনেক কথা হয়েছে, তারা সকলেই বলেছে, এখন মায়ের কষ্ট শুধু বাড়ছেই, একজন ডাক্তার বলল, তাঁর বাবা এই হসপিটালেই ছিলেন, ক্যান্সারের পেশেন্ট, ছেলে ডাক্তার বলেই বাবাকে লাইফ সাপোর্টে রাখেনি, মৃত্যু তরান্বিত করে বাবাকে প্রচন্ড কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়েছে।

৬ তারিখে মায়ের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে এলো, খুব বড় করে তাকাচ্ছিল, যেন খুব জোর করে দেখতে চাইছে। বুঝতে পারলাম, মায়ের সকল ইন্দ্রিয় গুলো অকেজো হয়ে আসছে, তাই দৃষ্টি শক্তিও ক্ষীণ হয়ে আসছে। এই দৃষ্টিকেই পুরানো দিনের মানুষেরা ভয় পেত, ভাবতো রুগী তার মৃত আত্মীয়-স্বজনকে দেখতে পাচ্ছে, তাই অমন চোখ বড় করে তাকাচ্ছে। সেদিন বিকেলের দিকে আমি একা মায়ের পাশে দাঁড়ানো, কি মনে হতেই মায়ের পায়ের পাতা দুটো ধরলাম, অনেক কালের চেনা পা, চেনা আঙ্গুল, হাতের নখ, পায়ের নখ, সবই আমার চেনা, মায়ের পায়ের পাতায় একটু চাপ দিলাম, পা কেঁপে উঠলো, আমি পায়ের পাতা একটু একটু করে টিপে দিতে শুরু করলাম, জিজ্ঞেস করলাম, " মা, আরাম লাগছে?" মা আমার দিকে তাকালো, মাথা নাড়িয়ে বলল, "হ্যাঁ"। আমার যাওয়ার সময় হলো, দশ মিনিট শেষ, কিসের আইসিইউ, এখানে রুগীকে শুধুই যান্ত্রিক চিকিৎসা দেয়া হয়, মানসিক শান্তি তো দেয়া হয়না। যে মুহূর্তে মা বলল, পায়ের পাতা টিপুনিতে কিছুটা আরাম লাগছে, সেই মুহূর্তেই আমাকে চলে যেতে বলা হলো।
আমার বড়দা, অর্থাৎ মায়ের প্রথম সন্তান, যাকে কোলে নিয়ে মা প্রথম মা হয়েছিলেন, সেই ছেলে এসে পৌঁছাবে ৮ তারিখ সকালে, মায়ের ছোট বোন, আমার ছোট মাসী, যে পাশে থাকলে মায়ের শেষ সময়টুকু অনেক বেশী আরামের হতো, গত একমাস ধরে তাকে বেড রেস্টে থাকতে হয়েছে বলে সে সুনামগঞ্জ থেকে আসতে পারেনি, ডাক্তারের কাছ থেকে কাকুতি-মিনতি করে বিশেষ ব্যবস্থায় ছোট মাসী আসছে ৮ তারিখ সকালে। আমরা ভাবছি, মায়ের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। আমার ভাইয়েরা কোনভাবেই মায়ের লাইফ সাপোর্ট খোলার বিষয়ে মতামত দিবেনা, মরে গেলেওনা। টাকা খরচ হয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে, তবুও বলবেনা, এই বুড়ি মাকে এভাবে বাঁচিয়ে রেখে লাভ কি?

আজরাইলের ভূমিকায় আমি নামলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, বড়দা আর ছোট মাসী এসে মাকে দেখবে, এরপরই মায়ের লাইফ সাপোর্ট মেশিন খুলে দেয়া হবে। কাগজে সাইন করবো আমি। মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি, আমি ভাল করে খেয়াল করেছি, মায়ের দেহে ফিট করা ক্যাথেটার একেবারেই শুকনো, এক ফোঁটা ইউরিন বের হচ্ছেনা, মাকে শুধু স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে, নিউট্রিশান দেয়া হচ্ছেনা, খেয়াল করলাম, মায়ের শরীর নড়েনা, শুধু হাতের আঙ্গুল নড়ে, দুই দিন আগেও দৃষ্টি স্বচ্ছ ছিল, জ্ঞান টনটনে ছিল, এর সবই কমে গেছে, প্রতিদিন আইসিইউর ভাড়া গুণতে হচ্ছে ৫০,০০০ টাকা, বাকী টেস্টের খরচ তো আছেই। কি টেস্ট করা হয়, তাও জানিনা, কিডনি ফেইলড, ডায়ালিসিস করলেও নাকি ত্রিশ দিনের বেশী বাঁচবেনা, সেটাও লাইফ সাপোর্টের উপর, ডাক্তারের কাছেই জেনেছি, মায়ের আর কোন চিকিৎসা হচ্ছেনা, হসপিটালের পলিসি অনুযায়ী লাইফ সাপোর্টে যতক্ষণ রুগী বেঁচে থাকে, ততক্ষণ বাঁচিয়ে রাখা হবে। এভাবে ঠিক কতদিন মা বেঁচে থাকবে, তা ডাক্তাররা বলতে পারেনা। আর বাঁচিয়ে রাখলেও মাকে নাকি ঘুম পাড়িয়ে রাখা হবে। কারণ ক্যান্সারের যন্ত্রণা নাকি মরণ যন্ত্রণার চেয়েও অনেক বেশী ভয়ংকর। আমার ভাইয়েরা কেউই টাকার চাষ করেনা, সৎ পথে আয় করা টাকা ডিমও পাড়েনা, তাদের নিজেদের ছেলেমেয়েরা এখনও অনেক ছোট, সহায় সম্পত্তিও নেই যে বিক্রী করবে, কেউ একজনকে তো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। 
কঠিন সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে নিলাম, তবে শত হলেও আমি তো মানুষ, একেবারে অমানবিকতা দেখাই কি করে! ডাক্তারদের কাছে হাত জোড় করলাম, বললাম, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মায়ের লাইফ সাপোর্ট খুলে দেয়ার। আমার একটা অনুরোধ, আমার মায়ের জন্য একটা কেবিনের ব্যবস্থা করুন, আমি আমাদের সকল আপনার জনকে খবর দেই, লাইফ সাপোর্ট খুলে মাকে কেবিনে দিন, আমরা সবাই মায়ের চারপাশে ঘিরে থাকবো, আমাদের মা আমাদের মাঝে থেকে হাসিমুখে বিদায় নিবেন, শত যন্ত্রনার মধ্যেও মা যদি চোখ খুলে একটিবার দেখেন, তাঁর প্রিয়জনেরা তাঁকে ঘিরে আছে, মা তখন নিশ্চিন্তে স্বর্গের দিকে পা বাড়াবেন। বিশ্বাস করেন, মা মৃত্যুকে ভয় পেতোনা, মা শুধু একা থাকাকে ভয় পায়। এইটুকু দয়া করেন, প্লীজ প্লীজ, আমার অনুরোধ, এইটুকু দয়া করেন। ডাক্তার ছেলেগুলো ভীষণ বিব্রত বোধ করে, বলে, আপনার কষ্ট বুঝতে পারছি, কিন্তু হসপিটালের পলিসিতে নেই, লাইফ সাপোর্ট খুলে দিলে রুগীকে আমাদের হসপিটালে রাখতে পারবোনা। এক কাজ করেন, অন্য কোন হাসপাতালে ব্যবস্থা করেন, সেখানে নাহয় মাকে নিয়ে গেলেন

আমার মনে হলো, কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর, এ কেমন পলিসি? এক দিকে বলে রুগীকে কষ্ট দিবেননা, আরেকদিকে বলে এই রুগী নিয়ে অন্য হাসপাতালে যান। এক হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া রুগী অন্য হাসপাতাল নিবে কেন? তাছাড়া রুগীর আত্মীয়স্বজনের মাঝে থেকে রুগী শেষ নিঃশ্বাস ফেলবে, এর চেয়ে মানবিক আর কি হতে পারে? লাইফ সাপোর্ট খুলে অক্সিজেন দিয়ে রুগীকে কম কষ্টে চলে যেতে দেয়া বেশী মানবিক নাকি রুগীর শোকগ্রস্ত পরিবারকে মৃত্যুপথযাত্রী রুগী নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করা বেশী মানবিক? দুঃখে অভিমানে সিদ্ধান্ত নিলাম, মাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের বাসায় চলে যাব। মৃত্যু তো হবেই, আমাদের কোলে থেকেই মায়ের মৃত্যু হোক। মায়ের কাছে মনে মনে প্রার্থণা করলাম, মা তুমি চেয়েছো বলে আমি পৃথিবীর আলো দেখেছি, আজ আমি চাইছি বলেই তোমাকে এই জাগতিক কষ্ট থেকে মুক্তি দিচ্ছি, যদি ভুল কিছু করে থাকি, আমাকে ক্ষমা করে দিবে।

৮ তারিখ সকালে বড়দা আর মাসী এলো, আইসিইউতে মায়ের কাছে গেল, বড়দা মা বলে ডাকলো, মাসী ডাকলো দিদি বলে। দুইজনের বেশী যেতে দেয়না, তাই আমি আজরাইল বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। বড় ছেলের ডাক শুনে মা গভীর সমুদ্র থেকে জেগে উঠেন, সন্তানের বয়সী ছোট বোনের দিদি ডাক শুনে তাকান, দুই প্রিয় মানুষকে দেখেই মা কেঁদে ফেলেন, বড়দার মন খুব নরম, প্লেন থেকে নেমেই মাকে এই অবস্থায় দেখবে ধারণাই করেনি, মাত্র এক মাস আগেই মাসীর দেহে বিরাট অপারেশান হয়েছে, নিজের দেহেই অপারেশানের যন্ত্রণা, তার মায়ের মত দিদিকে এভাবে দেখবে, ধারণাও করেনি, দুই জনেই নাকি মায়ের পাশে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। মা বোধ হয় তখনই বুঝে যায়, শেষ সময় উপস্থিত।

আমি সব দিক থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম, সংসারে আমার কথার মূল্য আছে, কীভাবে এই মূল্য অর্জণ করেছি জানিনা, আমি যেহেতু বলেছি, মাকে লাইফ সাপোর্ট খুলে দেবো, এর উপর দিয়ে কেউ কোন কথা বলেনি। মামীর বাসা থেকে গঙ্গাজল নিয়ে এসেছিলাম, জানি, আমার মা সাক্ষাত ভগবতী, গঙ্গাজলের দরকার নেই, তবু ধর্মীয় সংস্কার বলে কথা, বড়দার হাত দিয়ে প্রথম গঙ্গাজল দিয়েছি, এরপর মেজদার হাতে, আমার ছোটভাইটা নারায়ণগঞ্জে ওর বাচ্চা দুটি আর বাবাকে সামাল দিচ্ছিল, ও আসতে পারেনি, আগের দিন এসে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদে গেছে, আমার মায়ের কোলপোঁছা ছেলে, মা-বাবাকে এতকাল মাথায় করে রেখেছে, মা বিনে কিছুই বুঝতোনা, সেই মা চলে যাচ্ছে, আমি মাকে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিচ্ছি, ও সহ্য করতে পারছিলনা, বাসাতেই চুপ করে বসেছিল। আমি মায়ের মুখে জল দিলাম, দুই দিন আগেই বুঝেছিলাম, মায়ের জলতৃষ্ণা কমে এসেছে। প্রথম দুই দিন খুব আগ্রহ করে জলের ফোঁটাগুলো খেয়েছিল, এরপর আর সেই আগ্রহ ছিলনা। অথবা এমনও হতে পারে, আরও বড় কোন সরোবরের ছবি মা ঘুমের মধ্যেই দেখেছে, পৃথিবীর জলে আর রুচী ছিলনা। তবুও জল দেই। মা জিভ নাড়েনা, তাড়াহুড়োয় একটা ফোঁটা ঠোঁটের পাশে পড়লো, আমি বিষন্ন মনে তাকিয়ে আছি, মা ত গঙ্গাজল নিচ্ছেননা, হঠাৎ দেখি, মা জিভটা বের করে ঠোঁটে আটকে থাকা জলের ফোঁটাটুকু চেটে নিলেন। আমি কি যে খুশী হয়েছি, কি যে শান্তি পেয়েছি, আইসিইউ'র এই মুহূর্তটিও আমার মনে গাঁথা হয়ে আছে।

বেলা এগারোটার দিকে আমি সমস্ত কাগজে সাইন করলাম, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে সাইন করছিলাম, তার পাশেই মায়ের রুম, জানালা দিয়ে মা'কে দেখা যায়, আমি মায়ের দিকে পেছন দিয়ে দাঁড়ালাম যেন মা তাঁর মেয়ের এই অপকর্ম দেখতে না পায়। নিজেকে 'মহাপাপী, চোর' মনে হচ্ছিল। চুরী করে একজনের জীবন শেষ করে দিচ্ছি, স্বেচ্ছায় মায়ের লাইফ সাপোর্ট খুলে নিয়ে যাচ্ছি, উইটনেস ছিল আমার সর্বসময়ের সঙ্গী ভাগ্নী অদিতি টুম্পা। 
শেষ চেষ্টা হিসেবে বড়দা সিনিয়র ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিল, মাকে বাঁচানোর আর কোন পথ খোলা আছে কিনা। ডাক্তার বলেছেন, ডায়ালিসিস করলে হয়তো আরও কিছুদিন বাঁচবেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জুনিয়র ডাক্তার না পেরে বাধ্য হয়ে বলেই ফেললো, এই পেশেন্ট ডায়ালিসিসের ধকল সইতে পারবেনা, উনার দেহে আর এতটুকু শক্তিও অবশিষ্ট নেই, উনি লাইফ সাপোর্ট ছাড়া কয়েক ঘন্টার বেশী বাঁচবেননা। সিনিয়র ডাক্তার আর কিছু বললেননা। চলে গেলেন, জুনিয়র ডাক্তাররা আবারও আমাকে বলল, যা করছি, মায়ের ভাল হচ্ছে, নাহলে মাকে আরও অনেক বেশী কষ্ট দেয়া হবে। অনেকেই বলে, ডাক্তারদের কোন অনুভূতি থাকেনা, কথাটি ঠিক নয়, ডাক্তাররাও অনেক অনুভূতিশীল হয়, মাকে আইসিইউতে রেখে দিলে ওদের তো কোন আপত্তি ছিলনা, কিন্তু মায়ের প্রতি আমাদের এই আবেগ আর কান্না দেখেই ওরা সত্যি কথাটি বলে দিয়েছে, পর পর কয়েকদিন ওরা আমাকে বুঝিয়েছে, মাকে আর ধরে রাখা ঠিক নয়। হাসপাতালের পলিসিতে যদি থাকতো, তাহলে আমি নিশ্চিত, ওরা মায়ের জন্য একটা কেবিন তৈরী করে দিত, ডাক্তার ছেলেগুলোকে ঐ মুহূর্তে নিষ্ঠুর মনে হলেও যখন আমি সুস্থির হয়েছি, সেই ডাক্তার ছেলেগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করেছি, ওদের মঙ্গল কামনা করেছি।

সেদিন ছিল সোমবার, বড়দা এক জুনিয়র ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিল, এই যে আমরা মায়ের লাইফ সাপোর্ট খুলে দিচ্ছি, কাজটা কতটা অমানবিক হচ্ছে? ডাক্তার বলল, অবশ্যই অমানবিক কাজ এটা, তবে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে যতদিন বাঁচিয়ে রাখবেন, সেটি হবে বহুগুণে অমানবিক। ক্যান্সার রোগের যন্ত্রণা যে কি, তা কেউ জানেনা। বড়দা বলল, লাইফ সাপোর্ট খুলে দেয়ার সাথে সাথেই কি রুগী মারা যায়? ডাক্তার বলে, না, চার পাঁচ ঘন্টা থাকে। আসলে এটি আল্লাহর ইচ্ছা, রুগী টের পায়না, অক্সিজেনের পরিমান কমে আসতে থাকে, রুগীর ব্রেন সেলগুলো অকেজো হতে থাকে, রুগীর ফিলিংস হয় অনেকটা ঘুমিয়ে থাকার মত, ঘুমের মধ্যেই রুগী এক সময় চলে যায়

নারায়ণগঞ্জে আসতে গেলে যা ট্র্যাফিক জ্যাম হয়, সেদিন কোন জ্যাম ছিলনা। আমি নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, মাকে প্রিয় শহর নারায়ণগঞ্জে জীবিত অবস্থায় নিয়ে যাব, সকালে মাকে বলেওছিলাম, মা, এইখানে তো তোমাকে একা একা থাকতে হয়, আমাদের কাউকে ঢুকতে দেয়না, সেইজন্য ঠিক করেছি, তোমাকে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যাব, নারায়ণগঞ্জের ক্লিনিকেই তোমাকে ভর্তি করবো, আজকেই আমরা যাব। মা শুনেছে, কি বুঝেছে জানিনা। ভয়ে ভয়ে ছিলাম, মা'কে শেষ পর্যন্ত জীবিত অবস্থায় নারায়ণগঞ্জে নিতে পারবো তো? যাত্রাবাড়ীর ট্র্যাফিক জ্যামে আটকা পড়লে তো চার ঘন্টা লেগে যাবে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছাতে, তখন কি হবে? অক্সিজেনের অভাবে মা মরে যাবে!! মাত্র দেড় ঘন্টায় আমরা নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে গেলাম।

নারায়ণগঞ্জের এক ক্লিনিকে মিথ্যে তথ্য দিয়ে ভর্তি করালাম। নারায়ণগঞ্জ আমার মায়ের প্রাণের শহর, তিন বছর বয়সে এই শহরে মা এসেছেন, ৭৫ বছর বয়সে এই শহরের একটি ক্লিনিকে মা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। একটা জিনিস খেয়াল করেছি, আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে মা ছিলেন ঠিকই, কিন্তু মায়ের চেহারাতে ছিল স্পষ্ট যন্ত্রণার ছাপ, একদিন মুখের নলগুলোকে মা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছিলেন, হাত দুটো বাঁধা ছিল বলে হাত দিয়ে টানতে পারছিলেননা। অথচ ক্লিনিকের বেডে দেয়ার সাথে সাথে মায়ের চেহারা থেকে যন্ত্রণার ছাপ মুছে যেতে থাকে। ডাক্তারের কথাই ঠিক, ঈশ্বরের কৃপা, ব্রেন সেলগুলো অকেজো হতে থাকে বলেই অনুভূতিও কমে যেতে থাকে, তাই ব্যথা বেদনা আর বোধ করেনা। হসপিটালের বেডে ছিল মা একা, নারায়ণগঞ্জের ক্লিনিকে আমার বাবা, ভাই, মাসী, পিসী, মামী, দাদা, মেজদি, বৌদি, মায়ের নাতি, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, পাড়া-প্রতিবেশীদের সকলেই এসে উপস্থিত হয়। মা বোধ হয় সব টের পাচ্ছিল, কি পরম শান্তিতে চোখ বুজেছিল, একা থাকতে মায়ের ভয় ছিল, আমি চেয়েছিলাম মা সবার মাঝে থেকে বিদায় নিবে, সেটিই ঘটেছে।

৮ই অক্টোবার, সোমবার বিকেল চারটার সময় আমরা নারায়ণগঞ্জ ক্লিনিকে পৌঁছেছি, মায়ের ভ্রাতৃবধূসম প্রতিবেশী নমিতা মামী আর তাঁর ছেলে সুমন, দৌড়ঝাঁপ করে ক্লিনিকের এই বেড যোগাড় করেছিল, নাহলে মা'কে নিয়ে কি করতাম জানিনা। একবার মনে হয়, সীট যোগাড় নাহলে ভালো হয়তো, মা'কে নিয়ে নিজের বিছানায় শোয়ায়ে দিতে পারতাম। সেদিন অক্সিজেন যোগাড় করতেও অনেক কষ্ট হয়েছিল, তবুও যোগাড় হয়েছে, মানুষে ভর্তী হয়ে গেছিল ক্লিনিকের রুম, ক্লিনিকের ইনচার্জ আমাদের সবাইকে ধমকাচ্ছিল এত ভীড় করেছি বলে। আমরা জানতাম অন্যায় করছি, তবুও সবাই চুপ করে মাকে ঘিরে বসেছিলাম। 

***চারদিকে কেমন এক উৎসব উৎসব ভাব, অপেক্ষার উৎসব, আমাদের সবার মাঝে থেকে একজন চলে যাচ্ছে, কখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে উপস্থিত হয়, তার অপেক্ষা।***

এর মধ্যেই কেউ কেউ খেয়াল করে, আমাদের কিছু খাওয়া হয়নি, আমার ভ্রাতৃসম সুমন আর নন্দাদা, কোথা থেকে যেন খাবার কিনে নিয়ে আসে, আমাদেরকে খুব জোরাজুরি করে কিছু মুখে দেয়ার জন্য। আমি পারিনি কিছু মুখে দিতে, আমি কিছু মুখে দিতে পারিনি, খারাপ লাগছিল, ওদের সকলের কষ্টের পয়সা, ওরা কেউই সচ্ছল নয়, কিন্তু ভালোবাসার টানে ওরা প্রবাসী ভাই বোনের জন্য দামী ফল, দামী বিস্কুট নিয়ে এসেছে, আমি তো কিছুই খেতে পারছিলামনা, কাঁদতেও পারছিলামনা, মায়ের মুখটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কি শান্তিতে মা ঘুমাচ্ছে, গত পাঁচ দিনে মায়ের মুখের সেই যন্ত্রনা আর নেই, আমার খুব ভাল লাগছিল, আমি মাকে জীবিত অবস্থায় বাবা আর ছোট ভাইয়ের কাছে এনে পৌঁছে দিতে পেরেছি। সেই শান্তিতেই আমি কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, আমাকে কালঘুমে পেয়েছিল, পাশের বেডে শুয়ে ঘুমিয়ে গেছিলাম। হঠাৎ কিছু একটা অনুভূতি হলো, মনে হলো, কোথায় যেন হট্টগোল হচ্ছে, আমি লাফ দিয়ে উঠে বসলাম, দেখি, আমার মামী, ছোটমাসী, বড়দা, বাবা, মেজদা, মেজবৌদি সহ আর সবাই মায়ের মুখের উপর ভীড় করে আছে। আমি হাউ মাউ করে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে পড়ে মায়ের কাছে গেলাম। মা একটা শ্বাস নিল, সবাই বলছে, ঘড়ি দেখ, ঘড়ি দেখ। মানে, মা চলে গেল, আমি তাকিয়েই আছি মায়ের মুখের দিকে, এক মিনিটের মধ্যে গলা থেকে ছোট একটি শ্বাস বের হলো, অনেকটা খুব ছোট্ট করে ঢেঁকুর তোলার মত, মায়ের আত্মা বেরিয়ে যেতে দেখলাম।