Tuesday, October 22, 2013

শুধু মনে রেখো!



অনেকদিন পর ফুটন্ত তেলে, ডুবন্ত করে চিঁড়ে ভাজলাম। আমার উত্তম কুমারের মন-পছন্দ খাবার এটি, মচমচে চিঁড়ে ভাজার সাথে পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কাও ভেজে দিতে হবে, নাহলে পুরোপুরি তার মন-পছন্দ হবেনা। আমি আবার এসব ভাজাভুজি খাবার এড়িয়ে চলি, স্বাস্থ্য সচেতনতা বলে একটি ব্যাপার আমার মধ্যে আছে, তবে অন্যের ইচ্ছেয় হস্তক্ষেপ করিনা। আমার মায়েরও ছিল এইসব ভাজাভুজি খাবারের দিকে নজর। ভাজাভুজি খাবার, সাথে গরম গরম চা। ঢাকা যখনই আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতো, বিশেষ করে রমজানের সময়, প্রতি সন্ধ্যায় উত্তম কুমার হাত ভর্তি করে ইফতারীর প্যাকেট নিয়ে ফিরতো। ইস! শাশুড়ি-জামাই কি তৃপ্তি করেই যে ইফতারী খেতো। আমি চোখ পাকিয়ে মাকে বলতাম, এই রাস্তার পারের তেলে ভাজা জিনিস খাচ্ছো, অসুস্থ হলে টের পাবে। মা বলতো, গরম তেলে সব রোগ জীবানু মরে যায়। উত্তমকে কিছু বলেও লাভ হতোনা, সে নামী দোকানের বাক্স দেখিয়ে বলতো, রাস্তার পারের না, ভালো দোকান থেকে এনেছি।" আজ হঠাৎ করেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। গরম তেলে ডুবন্ত চিঁড়ে, কি সুন্দর ফুড়ফুড়ে, ঝরঝরে করে ভাজা হচ্ছিল, যে মানুষটি খুব আরাম করে কুড়মুড় আওয়াজ তুলে চিঁড়ে ভাজা খেতো, সে মানুষটি আজ কোথায় চলে গেলো!

মায়ের ভাল লাগতো রাস্তার পাড়ের খাবার। বাসে বা ট্রেনে কোথাও বেড়াতে গেলে, জানালা দিয়ে ঝালমুড়িওয়ালাদের কাছ থেকে ঝালমুড়ি কিনে নিজেও খেত, দলের সবাইকে খাওয়াতো। ইন্ডিয়া বেড়াতে যেতাম, মায়ের সাথে বেড়ানোর এই একটা মজা আছে, ফেরীতে খাওয়া, বর্ডারে গিয়ে ডাবওয়ালার কাছ থেকে ডাব কিনে খাওয়া, পিপাসা নেই, তবুও ডাব খেতে হবে, বাংলাদেশ বর্ডার ক্রস করে হরিদাসপুর সীমানায় ঢুকে গেলাম, বাবা হয়তো পাসপোর্ট নিয়ে ব্যস্ত, মা আমাদের সবাইকে নিয়ে ঢুকে যেত চায়ের দোকানে। গরম গরম কচুরী, সাথে ছোলার ডাল, আর মাটির ভাঁড়ে চা। এরপর ট্রেনে উঠেই ফেরীওয়ালার কাছ থেকে টাকায় দশখানা নেবু ভাল কমলানেবু কেনা হতো, আহ! কি সব দিন ছিল!

মায়ের বয়সী হিন্দু মহিলারা সাধারণতঃ হোটেল রেস্টুরেন্টে খেতেননা, বিশেষ করে আদর্শ হিন্দু হোটেল নাহলে তো হোটেলে গিয়ে ভাত খাওয়ার প্রশ্নই আসেনা। ভাবতাম মাও বোধ হয় হিন্দু হোটেল বলেই মাছের ঝোল দিয়ে গরম গরম ভাত, তৃপ্তি সহকারে খায়। আমাদের তো আর হিন্দু-মুসলিম বাছ বিচার ছিলনা, সব খানেই অবাধ বিচরণ। কিন্তু আমার হিসেবে ভুল ছিল, মা তো স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, হিন্দু, মুসলিম, খৃস্টান সকলের সাথেই মায়ের উঠাবসা ছিল। এই ব্যাপারটি মাথায় ছিলনা। ভাবতাম, মা বোধ হয় আর সকলের মতই খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে খুব রক্ষণশীল। একবার এক মজার ঘটনা ঘটেছিল।

৯৮ সালের কথা। ঢাকার উত্তরাতে কোম্পানীর দেয়া বাড়ীতে থাকি, কোম্পানীর দেয়া গাড়ীতে চড়ি, দারুণ আনন্দময় জীবন। আমরা আমেরিকা চলে আসার আগের চার বছর উত্তম কুমার ইন্ডাস্ট্রিতে চাকুরী করেছেন, আমার জীবনের স্বর্ণযুগ ছিল ওটা। কোম্পাণীর দেয়া গাড়ী-বাড়ীতে আমি মনের আনন্দে থেকেছি। আমার কত পরিচিতকে দেখেছি, গাড়ীর অহংকারে, বাড়ীর অহংকারে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ভাল করে কথাই বলতো না। পাছে আত্মীয়-স্বজন গাড়ীর সুবিধা চায়, সেই ভয়ে সব সময় বলতো, ড্রাইভার বাড়ী গেছে, ড্রাইভারের শরীর ভালনা, গাড়ীর ইঞ্জিনে গোলমাল আছে, নাহলে শত রকমের বাহানা দেখিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের এড়িয়ে চলতো। আমি সেটা করতামনা। অফিসের নিয়ম নীতি মেনেই সবাইকে সাথে নিয়ে চলতে চাইতাম। যদিও আমাদের জন্য অফিস থেকে ২৪ ঘন্টার গাড়ী এবং ড্রাইভার দেয়া হয়েছিল, তবুও আমরা অফিস টাইমের চেয়ে এক ঘন্টা বেশী রাখলেও ড্রাইভারকে বখশিশ দিয়ে পুষিয়ে দিতাম। এইজন্যই গাড়ী নিয়ে যখন খুশী, যেথায় খুশী বেরিয়ে পড়তাম। ড্রাইভার সাহেবও চাইতেন আমি যেন সব সময়ই বেড়াতে যাই।
ছুটির দিন হলে তো কথাই নেই, দূরে কোথাও চলে যেতাম, একা যেতামনা, সাথে করে চেলা-চামুন্ডা, লটবহর নিয়ে যেতাম। মনে পড়লে হাসি পায়, যখন বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধণ করা হলো, আমাদের সাত/আট সীটের পাজেরো গাড়ীতে মোট এগারো জনকে নিয়ে টাঙ্গাইল গেছিলাম। দুখানা ছোট মোড়া নিয়েছিলাম সাথে, একজনকে কোলে, আর দু'জনকে মোড়ায় বসিয়ে ছিলাম। শুনে যে কেউ বলবে, কাজটা ঠিক হয়নি, কিন্তু আমি বলি, শতভাগ ঠিক হয়েছে। ভাল জিনিস একা খেয়ে সুখ নেই, সুন্দর স্থান একা দেখে সুখ নেই, এগারো জন সেদিন যে আনন্দ পেয়েছিলাম, পাঁচজনে গেলে তার কিছুই পেতামনা। এখনও আমরা একসাথে বসলে সেদিনের সেই স্মৃতি নিয়ে অনেক মজা করি।

'৯৮ সালের এক শুক্রবারে মাকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছিলাম, ঢাকা শহর ঘুরে ফেরার পথে গুলশান না কোথায় যেন একটা রেস্টুরেন্টে থামলাম। আমি থামতে চাইনি, উত্তম থেমেছে। রেস্টুরেন্টের নাম কলাপাতা’, নতুন ওপেন করেছে। এই পথ দিয়ে আসা-যাওয়ার সময় রেস্টুরেন্টের নাম কলাপাতা দেখে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলাম, এই রেস্টুরেন্টে একদিন খেতে আসবো, নিশ্চয়ই এখানে কলাপাতায় খেতে দেয়া হয়। আমার খুব কলাপাতায় খাওয়ার শখ
উত্তম কুমারের এই ব্যাপারগুলো খুব ভাল লাগে, খাবার দাবার, কাপড়-চোপরের ব্যাপারে সে খুব শৌখিন, আতিথেয়তার ব্যাপারে সে অনন্য। সে মনে রেখেছে, আমি কলাপাতায় খেতে চেয়েছিলাম।
কলাপাতার সামনে গাড়ী থেমেছে, সাথে মা আছে। আমি অস্বস্তিতে পড়ে গেছি, এটা তো হিন্দু হোটেল না, মা হয়তো এই রেস্টুরেন্টে খেতে চাইবেনা, কি খাবার আছে, তাইবা কে জানে, জামাইকে মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছেনা। আমিও উত্তমের কাছে আমার মা হিন্দু হোটেল ছাড়া খায়না বলে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে চাইছিলামনা। পাছে উত্তম আমার মাকে ্প্রাচীনপন্থী মনে করে, সেই ভয়ে উত্তমকে বললাম, আজ বাড়ী ফিরে যাই, মা সাথে আছে, মা তো বাইরের খাবার খাবেনা, বাসায় সব রান্না করা আছে, অন্য একদিন তুমি আর আমি এসে এখানে খেয়ে যাব। আমার মাকে আমার চেয়েও অনেক বেশী চিনে ফেলেছে সে, একই পথের পথিক তো, বলে, কে বলেছে মা খাবেনা? অবশ্যই খাবে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলি, মা, থাক, তোমার চিন্তা নাই, তোমার যদি এখানে খেতে ইচ্ছে না করে, খেতে হবেনা, আমিও তোমার সাথে বসে থাকবো। মা বলে, খাবনা কেন? এইখানে কি মাছ পাওয়া যাবেনা? জামাই বাবাজী শুনে ফেলেছে, বলে, সব পাওয়া যায়। মাছ, তরকারী সবই আছে। আপনার যেটা দিয়ে খেতে ইচ্ছে করবে, সেটা দিয়েই খাবেন

রেস্টুরেন্টে ঢুকে দেখি, এলাহী কারবার। ৯৮ সালের কথা, তখনও রেস্টুরেন্ট গুলোতে এত এত আইটেম থাকতোনা। ভর্তাই যে কত রকমের, মাছের কত পদ, মাংস না খেলেও চলে। সব্জী ছিল কিনা জানিনা, আমার মায়ের কাছে মাছই ছিল পরম প্রিয়, সব্জী নিয়ে অত আদিখ্যেতা ছিলনা। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলি, মা, তোমার কি অস্বস্তি হচ্ছে? মা বলে, অস্বস্তি হবে কেন? বলি, এটা তো হিন্দু হোটেলনা, তুমি তো হিন্দু হোটেল ছাড়া অন্য কোন হোটেলে খাওনি এর আগে। মা বলে, কে বলছে খাইনি? আমাদের স্কুলে যে রান্না পরীক্ষা হয়, কোন বামুন ঠাকুর এসে রান্না করে? বুঝলাম, ভুল আমার হয়েছে। মন থেকে আমার সকল জড়তা কেটে গেলো। মাকে এই ভর্তা দেই, সেই ভর্তা দেই, চিতল মাছের পেটি দেই, আমার এখনও মনে পড়লে চোখ ভিজে উঠে। আমার মা ছিলেন অভিজাত মনের মানুষ, কোন ক্ষুদ্রতা তাঁকে স্পর্শ করতোনা। মনে যদি খুঁতখুঁতানি থেকেও থাকতো, মেয়ে জামাই এমন সমাদর করে এমন সুন্দর রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে, শুধু এই কারণেই মা সকল অস্বস্তিকে জয় করে ফেলেছিল। সেদিন মা অনেক তৃপ্তি করে খেয়েছিলেন, যে আইটেমটা আমার কাছে ভাল লাগেনি, সেটি মায়ের কাছে খুবই সুস্বাদু মনে হয়েছিল। আমার মা মাঝে মাঝেই একটি কথা বলতো, পূর্ব জন্মে কোন ভাল কাজ করছিলাম, তাই মেয়েকে সুপাত্রে দান করেছি। কে জানে, কোন গভীর দুঃখ অথবা আনন্দ থেকে মা এই কথা বলতো!


চিঁড়ে ভাজা হয়ে যেতেই চূলায় চায়ের জল চাপালাম। মায়ের গল্প করছিলাম, মায়ের আরেকটি অভ্যাস ছিল, ঘড়ির কাঁটা ধরে চা চাই। সকাল ছয়টায় এক কাপ চা, বেলা দশটায় এক কাপ আর বিকেল চারটায় এক কাপ। দুই বেলায় তিন কাপ চা। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলেই সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যেত। মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হতো, এই একটি মাত্র উপসর্গ মাকে কাহিল করে ফেলতো। মা আমাদের ঢাকার বাসায় সাধারণতঃ বিকেলের দিকে আসতো। ঘরে ঢুকেই প্রথম কথা বলতো,
অই, আমারে আগে এক কাপ চা দে, চা না খাওয়া পর্যন্ত আমি কোন কথাই কইতে পারবোনা
কোনদিন যদি একটু দেরী হয়ে যেত, মায়ের সেই মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হয়ে যেত। আমার নিজের তো এই ধরণের উপসর্গ ছিলনা, তাই অন্যের ব্যথা উপলব্ধি করতে পারতামনা। তাছাড়া আমার মধ্যে একটু মাস্টারী ভাবও ছিল, মাকে হেদায়েত করতাম,
আসছো একটা জায়গা থেকে, একটু বসো, দম নাও, তারপর ধীরে সুস্থে চা খাও
আমার মা নিজেই ছিলেন শিক্ষক, একটানা ৪৫ বছর শিক্ষকতা করেছেন, কথায় কথায় ধমকাতেন, আমার মাতব্বরীকে থোড়াই কেয়ার করতেন, আমাকে ডিঙ্গিয়ে নাতনীকে বলতেন, মিশা, তোমার মাকে বলো তো, মাস্টারী বাদ দিয়ে আমাকে যেন এক কাপ চা দেয়
মায়ের এই ব্যাপারগুলোকে প্রশ্রয় দিত আমার ছোটমাসী। মা তখনই আমাদের বাসায় আসতো যখন ছোটমাসীও সুনামগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জ বেড়াতে আসতো। আর ছোটমাসী পাশে থাকলে মায়েরও আনন্দ, আমারও আনন্দ। মা তাঁর যত দাপট তাঁর বোনের উপর দিয়েই দেখাতো, আমার নামে যত অভিযোগ, সব তাঁর বোনের কাছেই পেশ করতো। যদিও জানতো, মেয়ের নামে অভিযোগ করে লাভ নেই, নিজেই বলতো, তোর কাছে বইনঝির নামে কিছু বলেও লাভ নাই, মাসী-বোনঝি তো আবার ফেভিকলের আঠা


মাকে শেষবারের মত আপ্যায়ণ করেছিলাম, গত বছর জুলাইয়ের ২২ তারিখে, মাত্রই রমজান মাস শুরু হয়েছে। মাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা স্কয়্যার হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলাম, একটু চেক আপের জন্য। আমার সাথে ছিল ছোটমাসীর মেয়ে মিত্রা, আর মায়ের সাথে ছিল আমাদের প্রতিবেশী মামী, যার সাথে মা খুব ফ্রীলি কথা বলতে পারতেন। আমি চিন্তায় অস্থির মায়ের কি হলো, চিন্তায় অস্থির মাঝ রাতে আমার ফ্লাইট, চিন্তায় অস্থির কিছুই গোছগাছ হয়নি, কখন কি করবো। এদিকে মায়ের মনে উৎসব উৎসব ভাব। দেহে রোগের যন্ত্রণা, সেদিকে খেয়াল নেই, হাসপাতালে প্রবেশ করেই প্রথম কথা ছিল, মিঠু, এই সাত সকালে তোর মামীরে লইয়া আসছি, মানুষটা কিন্তু কিছুই খায় নাই। তুই আগে দ্যাখ, তোর মামীরে কিছু খাওয়াতে পারিস কিনা
আমি তো রেগেও উঠতে পারিনা, মামী শুনে ফেলবে, বরং মামী বলল, দিদি, আমারে নিয়ে চিন্তা করবেন না তো। আগে আপনার পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে যাক। মা বলে, না গো, সুমনের মা, আমার নিজেরও এক কাপ চা খাইতে হবে, নাইলে আমার মাথ ধরে যাবে

মিত্রার দিকে আমি হতাশ চোখে তাকালাম, এই হাসপাতালের কিছুই চিনিনা, কোথা দিয়ে কই যায়, জানিনা, আর মা জানে, নীচতলায় ক্যান্টিন আছে। মা জানে, কারণ মাত্র এক বছর আগেই বাবাকে এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। আমার ভাইয়েরা বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল, আর আমার মা ব্যস্ত ছিল, বাবাকে যারা দেখতে আসে, তাদেরকে ঠিকমত আপ্যায়ণ করা হয় কিনা সেদিক ভেবে। মেজদাকে নাকি ফোনের উপর ফোন করতো, আর বলতো, তোর বৌদিকে ক্যান্টিনে নিয়ে চা-কফি খাওয়া

যাই হোক, মায়ের মাথা ব্যথা হতে দেয়া যাবেনা, ডাক্তার অনেকগুলো টেস্ট করতে দিয়েছে। এক টেস্টের সাথে আরেক টেস্টের সময়ের ব্যবধান এক ঘন্টা। সেই একঘন্টার বিরতিতে মিত্রা আমাদেরকে পথ দেখিয়ে ক্যান্টিনে নিয়ে গেলো। এক নজরেই দেখে ফেললাম, বার্গার আর পেস্ট্রি ছাড়া কিছু নেই। রমজান মাস বলে ক্যান্টিনও ফাঁকা। এক টেবিলে সবাই গোল হয়ে বসেছি, টেনশান হলে আমার ক্ষিদে থাকেনা। বললাম, মা, আমি কিন্তু খাবনা
মা বলে, সবার জন্য খাবারের অর্ডার দে, আমি বিল দিব
বলি, চা খাবে বলছিলে, এখন খাবারের অর্ডার দিতে বলছো কেন?
তোরে কি কইছিলাম, কইছিনা, তোর মামী না খেয়ে আসছে 
মামী না খেয়ে আসছে, মামীর জন্যই খাবার কিনি
তুই বেশী কথা কইবিনা, আমিও খামু, মিত্রাও খাইব, তুই না খাইলে না খাবি

মায়ের যে মরণ রোগ হয়েছে, সেটা তো আমার মনেও জাগেনি, তাই মায়ের সাথে নর্ম্যাল ব্যবহারই করছিলাম। মায়ের সাথে আমার কথোপকথন এমনই ছিল। এটাই আমাদের স্টাইল ছিল। আমি কাউন্টারে গিয়ে জেনে আসলাম, লুচি, ছোলার ডাল, ডিমের ওমলেট আছে। আইটেম শুনে মা রাজী হলো, অথচ মা লুচি দুই চোখে দেখতে পারতোনা। খাবার ট্রে নিয়ে এসেছি, আমার জন্যও নিয়েছি, নাহলে মা মানবেনা। উলটাপালটা কথা বলবে, বলবে ‘টাকার জন্য চিন্তা করিসনা, তুই খা, আমিই বিল দেবো এমনি হাজারো কথা। মা জানতে চেয়েছে,
বিল কত হয়েছে?
হেসে দিলাম, বললাম, বিল যাই হোক, তোমার চিন্তা নেই, আমি একেবারে টিপস সহ দিয়ে দিয়েছি, খুচরো চল্লিশ টাকা আর ফেরত নেইনি
মা বলল, ভালই করছস, গরীবের ছেলে, পেটের দায়ে কাজ করে
মা, সবাই পেটের দায়েই কাজ করে, আমরাও পেটের দায়েই বিদেশে পড়ে আছি, চুপ থাক। 
মা চুপ করে গেল, মা জানে, প্রতিবার আমেরিকা ফেরার সময় হলেই আমার ব্যবহার খুব অভদ্র হয়ে উঠে, আমি আমেরিকা ফিরতে চাইনা, কিন্তু ফিরতে হয়, সেই রাগ আমি বাবা,মা, ভাই আর কন্যাদের উপর ঝাড়ি।

এবার আসল জিনিস, চা। চায়ের অর্ডার দিতে গিয়ে শুনি, রমজান মাসে চা বিক্রী হয়না। কফি বিক্রী হয়, কিন্তু চা হয়না। আমার শরীর ঘামতে শুরু করলো, আমি জানি, চা হচ্ছে মায়ের টনিক, এখন যদি চা না পাই, উপায় থাকবেনা, মায়ের মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হয়ে যাবে। বাকী টেস্ট করাবো কেমনে? তার চেয়েও বড় কথা, আজ আমি চলে যাচ্ছি, মা'কে এক কাপ চা দিতে পারবোনা! 
মাকে বললাম, মা, চা নাই, কফি আছে। তুমি কফি খাও। 
মা প্রায় রাজী হয়েই গেছিল, কিন্তু পাশে বসা মামী বলল, মিঠু, আমি তো কফি খাইনা মা। থাক, চা না থাকলে নাই, বাদ দাও

মামীকে মা সাথে করে নিয়ে এসেছে, মামীকে চা খাওয়াবে বলে ক্যান্টিনে এসেছে, এখন মামীই যদি চা না পায়, মামীর পাশে বসে মা কফি খাবেনা। তাছাড়া আমি তো মায়েরই মেয়ে, আতিথেয়তার পুরোটাই মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি। ক্যান্টিন বয়ের কাছে গেলাম, খুব বেশী অনুরোধ করতে হলোনা, আমার মুখের দিকে তাকিয়েই ছেলেটি বলল, আপনি অপেক্ষা করেন, দেখি সুপারভাইজারের সাথে কথা বলে। অফিসে, কোম্পানীতে যারাই চাকুরী করে, তাদের প্রত্যেকের ঘরেই একটি করে মা, একটি করে বোন আছে, সেই মা, বোনেরা মাঝে মাঝেই অবুঝ হয়, কাজেই সুপারভাইজার এবং ক্যান্টিন বয় আমাকে সেই যাত্রা বাঁচিয়ে দিল। শুধু আমার জন্য ওরা চার কাপ চায়ের ব্যবস্থা করে দিল। আজ এই ভগ্ন হৃদয়ে আমি সেই সুপারভাইজার এবং ক্যান্টিন বয়টির মঙ্গলের জন্য দুই হাত তুলে প্রার্থণা করছি। ওরা সেদিন ঈশ্বরের রূপ ধরে আমার কাছে এসেছিল বলেই জন্মদাত্রী মায়ের শেষ আব্দারটুকু রাখতে পেরেছিলাম। আমার সাথে ওটাই ছিল মায়ের শেষ আহার! খুব বেশী কিছু উনি চাননি, ক্যান্টিনে বসে খেতে চেয়েছিলেন, আর চেয়েছিলেন এক কাপ গরম চা।

** আমি যখন মাত্র তিন মাস পরেই দ্বিতীয় বার দেশে গেলাম, মাকে শেষ বারের মত দেখতে, মাকে দেখতে আসা মেজদার বন্ধু সুভাশীষদা( অভিনেতা সুভাশীষ ভৌমিক)কে নিয়ে ক্যান্টিনে ঢুকেছিলাম। কি আশ্চর্য্য! সেই ক্যান্টিনবয়, আমাকে দেখে মুখ খুলে হাসি দিল, পরিচিতের হাসি, মাত্র তিন মাস আগে এক নজর দেখেছিল আমায়, আমার জন্য চায়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, সেই ছেলেটি আজকেও, এই সময়েই ডিউটিতে আছে! প্রতিদিন কত শত শত কাস্টমারের কাছে ওরা খাবার বিক্রী করে, এর মধ্যে থেকে আমাকে সে কি করে মনে রাখলো***
Photo

2 comments:

  1. দিদি মা'কে নিয়ে তোমার লেখা কোনটাই পুরা পড়তে পারিনা। তার আগেই... শুনেছি আমার মা সেই স্কুল জীবন থেকেই রাজনীতি করতেন। ছাত্র ইউনিয়ন। আমি যখন পেটে তখন ওনার নামে হুলিয়া। পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। পরে বাবা, বড় মামা উনি আর রাজনীতি করবেননা মর্মে বন্ড দিয়ে হুলিয়া প্রত্যাহার করে বাসায় ফিরিয়ে আনেন। আমার গান শুনা, ছবি দেখা, ঘুরাঘুরি সব ওনার মা'র সাথেই। আমাকে স্কুলে দিয়ে মা কলেজে যেতেন। কলেজ স্পোর্টসে সাঁতার আর ১০০ মিটার দৌড়ে ওনাকে কেউ হারাতে পারেননি। উনিও ছিলেন স্কুল টীচার।
    আরেকটা কথা; বাবা'র চাকরির সূত্রে আমাদের একটা বড় ল্যান্ডরোভার জিপ ব্যাবহারের জন্য ছিল। ড্রাইভারের নাম পুরাটা মনে নেই, আমি মজিদ মামা বোলে ডাকতাম। আমাদের বাসাতেই থাকতেন। ২০০০ সালের দিকে কাওরান বাজারে ওনার সাথে দেখা। এক হাট লোকের সামনে আমাকে চকলেট দিলেন, খেতেই হবে। আমি চা খেতে চাইলে ধমক দিয়ে বললেন, তুই মার কাছে সেই ছোটটাই আছিস... হায়রে মানুষের ভালবাসা।

    ReplyDelete
  2. জীবনের সুন্দর সুন্দর সব গল্প তোমার লেখায় আরো সুন্দর করে ফুটে উঠে... মা একজন সুজ্জন এবং খাঁটি মানুষ ছিলেন... মা'কে অন্তর থেকে প্রণাম...।।

    "অফিসে, কোম্পানীতে যারাই চাকুরী করে, তাদের প্রত্যেকের ঘরেই একটি করে মা, একটি করে বোন আছে, সেই মা, বোনেরা মাঝে মাঝেই অবুঝ হয়, কাজেই সুপারভাইজার এবং ক্যান্টিন বয় আমাকে সেই যাত্রা বাঁচিয়ে দিল। শুধু আমার জন্য ওরা চার কাপ চায়ের ব্যবস্থা করে দিল। আজ এই ভগ্ন হৃদয়ে আমি সেই সুপারভাইজার এবং ক্যান্টিন বয়টির মঙ্গলের জন্য দুই হাত তুলে প্রার্থণা করছি। ওরা সেদিন ঈশ্বরের রূপ ধরে আমার কাছে এসেছিল বলেই জন্মদাত্রী মায়ের শেষ আব্দারটুকু রাখতে পেরেছিলাম। আমার সাথে ওটাই ছিল মায়ের শেষ আহার! খুব বেশী কিছু উনি চাননি, ক্যান্টিনে বসে খেতে চেয়েছিলেন, আর চেয়েছিলেন এক কাপ গরম চা। " ......... এখানে এসে চোখের পানি ধরে রাখা গেলো না। মাকে খুব ফীল করো, তাই না দিদি। তোমার লেখা পড়ে আমারো মনে পড়ে যায় আমার মা'কে। যেখানেই থাকুক কেনো ওনারা ভালো থাকুক।

    ReplyDelete