Tuesday, June 26, 2012

সেদিনের কলিকাতা, এদিনের কলকাতা


কলকাতা ঘুরে এলাম। কলকাতা ভ্রমণ আমার জন্য নতুন কোন ঘটনা নয়। অনেক ছোটবেলা থেকেই আমি কলকাতা যাওয়া আসা করি। বলতে গেলে কলকাতা আমার 'সেকেন্ড হোম'। কারন আমাদের পরিবারের বেশ কিছু স্বজন '৬৪ সালের  পরেই তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে 'কলিকাতা' চলে গেছিলেন। আমার বাবা মায়ের সাথে আমরা আজ অবধি স্বদেশেই আছি। আগে আমার বাবা মা আমাদেরকে নিয়ে প্রতি দুই বছরে একবার কলিকাতা যেতেন। ওখানে গিয়ে আমরা আমাদের কাকাদের বাড়ীতে উঠতাম, কাকাত ভাই-বোনদের সাথে মিলে মিশে একটি মাস মহা আনন্দে পার করে দিতাম। '৭০ সালে আমরা প্রথম গিয়েছিলাম কলিকাতা। সেবারে আমার বাবা যেতে পারেননি, আমার মা, দাদু, দিদিমা, মাসীদের সাথে গিয়েছিলাম কলিকাতা নামের বিস্ময় নগরী দেখতে। বিস্মিত হয়েছিলাম ঠিকই। বয়স খুবই কম ছিল, তারপরেও 'গড়ের মাঠে' আমার তিন বছর বয়সী ছোট ভাই লাল টুকটুকে ফুলস্লীভ গেঞ্জী পড়ে দৌড়াচ্ছিল, ঘটনাটি মনে আছে। 'শোভা বাজারের 'পরেশনাথের মন্দির' দেখতে গিয়ে আমার তের বছর বয়সী বড়দা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে গিয়ে সব গুবলেট করে ফেলেছিল, সবাই মিলে খুব হাসাহাসি করছিল, এটাও মনে আছে। আরও মনে আছে চিড়িয়াখানা, যাদুঘর দেখার টুকরো টুকরো স্মৃতি। 'ইলেকট্রিক ট্রেন' দেখার প্রাথমিক উত্তেজনা, ট্রেন স্টেশানে ঢুকার অনেক আগে থাকতেই আমার মা আমাদেরকে সাবধান করতে থাকতেন, " সবাই দূরে থাক, নাহলে ট্রেনের বাতাসে উড়ে গিয়ে ট্রেন লাইনে পড়ে যাবে"। আমরাও দূর থেকে ট্রেনের  লাইট দেখার সাথে সাথে বড়দেরকে জাপটে ধরে রাখতাম। ট্রেনে উঠা ছিল আরেকটি মজার ব্যাপার। কী যে ভীড় লেগেই থাকতো ট্রেনে! আমাদের ছোটদেরকে কেউ না কেউ কোলে তুলে নিত, তারপরেই এক ধাক্কায় ট্রেনে উঠে পড়তো। ট্রেনে একবার উঠতে পারলেই শুরু হতো নাম ধরে ডাকাডাকি," মনা উঠছে? দেখতো মানিক, চঞ্চল উঠলো কিনা", এগুলো এখনও স্পষ্ট মনে আছে।

আমার প্রথম কলিকাতা যাত্রা ১৯৭০ সালে। '৭০ সালে গিয়েছিলাম মাসখানেকের জন্য বেড়াতে, আমার মা বই পড়ে পড়ে দর্শনীয় স্থানগুলো আগেই পরিকল্পনায় রেখেছিলেন বলেই একমাসে অনেক দেখেছি। দ্বিতীয়বার কলিকাতা গেলাম ১৯৭১ সালে।  '৭১ সালে অবশ্য বেড়াতে যাইনি,  গেছিলাম শরণার্থী হয়ে! আট নয় মাসের মত ছিলাম কলিকাতাতে। অন্য রকম সময়, অন্য রকম এক কাল কাটিয়েছি তখন। অবশ্য কলিকাতার মানুষের জীবনের দৈনন্দিন অভ্যাসে তেমন কোন পরিবর্তন ছিলনা। সেই একরকম ভাবেই ঘুম থেকে উঠেই বাদুরঝোলা হয়ে ইলেকট্রিক ট্রেন চেপে কাজে যাওয়া, অথবা ঘুম থেকে  উঠেই 'ঘুঁটে' দিয়ে কয়লার উনুন জ্বালানো, সারাদিন রাস্তাঘাটে মানুষের কোলাহল, চায়ের স্টলগুলোতে কয়লার উনুনে সারাদিন চায়ের কেটলীতে চা ফুটতো, বিকেল হতেই তেলেভাজা, আলুকাবলী, ঝালমুড়ি, ঘটিগরম, আলুর চপ, বেগুনী ভাজা হতো। ছোটবেলার স্মৃতিতে এগুলোই ধরা ছিল। '৭১ সালের আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে, ঐ সময় অনেকেরই চোখ লাল হয়ে এক ধরনের ইনফেকশান হতো (কনজাংটিভাইটিস) যার নাম দেয়া হয়েছিল 'জয় বাংলা'। কারো কনজাংটিভাইটিস হলেই বলা হতো "ওর জয় বাংলা হয়েছে"।, কলিকাতার অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে মিলে আমরাও বলতে শিখেছিলাম, " জয়বাংলার লোক ঢ্যাবা ঢ্যাবা চোখ'। আমাদের মায়ের কাছে একদিন খুব বকা খেয়েছিলাম এর জন্য। তারপর থেকে আর বলতামনা। সাত আট মাসে আমরা কলকাত্তাই বাংলা শিখে গেছিলাম প্রায়। 'খেয়েচি, গিয়েছি, এলুম গেলুম' টাইপ কথা। এরপরে দেশ স্বাধীন হতেই নতুন বাংলাদেশে ফিরে এলাম।

স্বাধীনতার পরে আমার ঠাকুরমাকে দেখতে আমরা দুই বছর পর পর কলিকাতা যেতাম একমাসের শীতকালিন ছুটিতে। আমাদের আনন্দের সীমা থাকতোনা। ইলেকট্রীক ট্রেন চড়া, আলো ঝলমলে কলিকাতা নগরী দেখা, প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাওয়ার মজাই ছিল আলাদা। আর আত্মীয়-স্বজনদের আদর সমাদরতো ছিলই। আমরা ছিলাম ছোট ছোট। বাংলাদেশে তখনও রকমারী খাবার দাবারের চল শুরু হয়নি। ঢাকার মিষ্টির দোকানগুলোতেও রসগোল্লা, চমচম, রাজভোগ, কালোজাম, সন্দেশ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যেতোনা। 'কমলাভোগ, ক্ষীরভোগ, মিহিদানা, তালশাঁস, শোনপাপড়ি, জলভরা সন্দেশের নাম কলিকাতাতে গিয়েই প্রথম জেনেছি। চানাচুরের কত রকম বাহার যে ছিল। ঝাল চানাচুর যেমন ছিল, নরেশ কাকুর দোকানে মিষ্টি চানাচুরও পাওয়া যেত। দেশে থাকতেই আমরা পরিকল্পনা করতাম কলিকাতাতে গিয়ে কি কি খাব! দুই একটা আত্মীয়-স্বজনের বাড়ীতে মা নিয়ে যেত, আমরাও যেতাম  তবে 'অখুশী' মনে। কারন ঐ বাড়িগুলোর মালিক ধনী হলেও চায়ের সাথে শুধুই ব্রিটানিয়া থিন এরারুট বিস্কুট খেতে দিত। আরেকটা বাড়ীতে যেতাম খুব খুশী মনে। তারা স্বচ্ছল ছিলনা কিনতু আমাদেরকে 'মহিষের দুধ' এর রসগোল্লা খাওয়াতো। মহিষের দুধ দিয়েও মিষ্টি তৈরী হয়, এটা জেনেছি কলিকাতাতে গিয়ে। মাটির ভাড়ে করে চা বিক্রী হতো, রসগোল্লা আসতো মাটির ভাঁড়ে, রসের গুড় আসতো মাটির কলসীতে করে। আমার বিয়ের আগে পর্যন্ত নিয়মিতভাবেই বাবা মায়ের সাথে কলিকাতা গিয়েছি। তখনই দেখেছি, কলিকাতার মেয়েদের স্বাধীন মুক্ত জীবন। কোন মেয়েকে সাথে ভাইকে পাহারা নিয়ে কোথাও যেতে দেখিনি। কত মেয়েকেই দেখেছি রাত নয়টা দশটার পরেও টিউশানি সেরে বাড়ী ফিরতে, মেয়েদেরকে দেখেছি পুরুষদের সাথে ঠেলা ধাক্কা দিয়েই ট্রেনে উঠতে, ট্রেনের দরজায় পুরুষের পাশাপাশি মেয়েদেরকেও ঝুলে দাঁড়াতে দেখেছি।রাস্তা দিয়ে একটা ছেলে ও একটা মেয়েকে পাশাপাশি হাঁটতে দেখেছি সেই কবে থেকে! এগুলো দেখতাম আর মনে মনে বিস্মিত হতাম। এগুলো দেখে দেখেই বোধ হয় আমার মা বাবা মাঝে মাঝে আমাকেও রাস্তাঘাটে একা একা চলতে দিতেন। তবে বাংলাদেশে মেয়েদের জীবন এখনও অনেকটাই প্রাচীন নিয়মের বেড়াজালে বাঁধা। কলিকাতার মেয়েরা পাড়ার ছেলেদের মতই কিছুটা মাস্তান গোছের আচরনও করতো। আমার কাকার মেয়েকে আমি কী যে ভয় পেতাম। সব সময় আমাদেরকে শাসাত, " বেশী ঘাঁটাবিনা আমাকে, ঘুষি মেরে নাক উড়িয়ে দেবো" টাইপ কথা বার্তা বলে।

আমার বিয়ের পরে কলিকাতা আর তেমন করে যাওয়া হতোনা। প্রধান কারন ছিল, আমার শ্বশুরবাড়ীর কেউ কলিকাতাতে ছিলেননা। তাছাড়া ততদিনে আমার ঠাকুমাও স্বর্গবাসী হয়েছেন। আমিও দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছি, কলিকাতা যাওয়ার সময় পাইনি। কিনতু তখনও কলিকাতাকে আমার সেকেন্ড হোম মনে হতো, যেখানে আমার কাকা-কাকীমা, মামা-মামী, মাসী-মেসোর মত অতি আপনার জনেরা থাকতেন।  আমার সাথে সকলের যোগাযোগ ছিল, ফলে কলিকাতা নিয়ে আমার উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়েনি কখনও। আমাদের আত্মীয়স্বজনেরা থাকতেন উত্তর কলিকাতাতে। উত্তর কলিকাতাতে সাধারনতঃ পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীদের বসবাস। খুবই জনবহুল এলাকা এই উত্তর কলিকাতা, চারিদিকেই  বাঙ্গাল টানে কলকাত্তাই কথা শোনা যায়, অপ্রশস্ত রাস্তাঘাট, চারিদিকেই কয়লার উনুনের ধোঁয়া, বাড়ীর বাউন্ডারীর ওয়ালে গোবরের ঘুঁটে, রাস্তায় সাইকেলের ট্রিং ট্রিং ঘন্টি, রিক্সার প্যাঁ পোঁ, প্যাঁ পোঁ হর্ণ শুনেই আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। দক্ষিন কলিকাতা হচ্ছে বড়লোকের ঠিকানা এমনটাই জানতাম। আমাদের আত্মীয়-স্বজনেরা বড়লোক ছিলেননা বলেই উত্তর কলিকাতার আশে পাশে থাকতেন। দক্ষিন কলিকাতাতে রাস্তা ঘাট প্রশস্ত, বাস ট্রামের সুব্যবস্থা আছে কিনতু কোথাও কোন হ য ব র ল ভাব নেই, রিক্সার এত বেশী প্যাঁ পোঁ শোনা যায়না, এমনটা জেনেই বড় হয়েছি। উত্তর কলিকাতার ট্রেনে উঠলেই পকেট সাবধানে রাখার নির্দেশ থাকতো। যখন তখন পকেটমার হয়ে যেতো। ট্রেনের কামরায় উঠার মুখেই জমাট ভীড়, নামার মুখেও জমাট ভীড়, পকেটমার হওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়। আমার বিয়ের অনেক পরে আমি আমার বরের সাথেই গিয়েছিলাম কলিকাতাতে। বেলঘরিয়াতে নেমেছি ট্রেন থেকে, সাথে ছিল নেদারল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা দামী কাঁধ ব্যাগ। আমার বরের কাছ থেকে পাওয়া এমন অমূল্য রতনটিকে কাঁধে ঝুলিয়েই বের হয়েছিলাম। ট্রেনে ভীড় ছিলনা, কিনতু দরজার কাছে বরাবরের মতই কিছু যাত্রী দাঁড়ানো ছিল। ট্রেন থেকে নামতেই হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার ব্যাগটা লম্বালম্বি করে ছুরী জাতীয় কিছু দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে। বুকটা ধ্বক করে উঠতেই ব্যাগে হাত দিয়ে দেখি দুই হাজার টাকার বান্ডিলটা একেবারে ভেতরের দিকে থাকায় রক্ষা পেয়েছে। কিনতু ব্যাগটিতো নষ্ট হয়ে গেলো!

২০০১ সালে আমেরিকা যাওয়ার পর থেকে প্রতি দুই বছরে একবার করে আমি বাংলাদেশে আসি। প্রতিবারই কলিকাতাতেও যাই দিন পনেরোর জন্য হলেও। সেকেন্ড হোম বলে কথা। গিয়ে একই দৃশ্য দেখি, পরিচিত দৃশ্য দেখে খুশী হই। অতীতকে ফিরে পাই, ছেলেবেলার দিনগুলোকে ছুঁতে পারি। এরপর হঠাৎ করেই একদিন জানতে পারলাম কলিকাতাকে আর কলিকাতা বলা যাবেনা।'কলিকাতা' থেকে নগরীটির নাম হয়ে গেছে কলকাতা।   আরো অনেক কিছুতেই পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। আনুমানিক ছত্রিশ বা সাঁইত্রিশ বছর ধরে  বাম রাজত্ব ছিল। ব্যতিক্রম ঘটেছে এবার। এবার রাজ্য সরকারের গদীতে আছেন আমাদের সেই বহুল আলোচিত মমতা দিদি। তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা ব্যানার্জী। মমতা নামের সাথে মমতা জড়িয়ে থাকারই কথা, তবে বাংলাদেশের জনগনের জন্য তাঁর মমতায় ঘাটতি আছে। মমতা দিদির ব্যবহারে তাঁর প্রতি আমাদের ভীষন রকম অভিমান হয়েছে। তিস্তা বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সে অনুষ্ঠানে দিদি আসেননি। বাংলাদেশে তাঁকে সম্মান জানানোর জন্য কত ঘটা পটা হয়েছিল, সবই বিফল হয়েছিল। সেই মমতা দিদির কলকাতাতে গিয়েছিলাম এবার।

মমতা দিদির কলকাতাতে গিয়ে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছি। প্রথমেই বিস্মিত হয়েছি দমদম নেতাজী সুভাষ বোস আন্তর্জাতিক এয়ার্পোর্টে পৌঁছে। খুবই সাদামাটা টাইপ বিমানবন্দর,  আলো কম চারদিকে, কাস্টমস অফিসারদের ব্যবহার কেমন চোয়ারে টাইপ। আমার স্মৃতিতে দমদম এয়ারপোর্টের অন্যরকম চেহারা ছিল। সবশেষ '৭৪ সালে আমরা বিমানে চড়ে কলিকাতা গিয়েছি। এরপর থেকে বাসে চেপে গিয়েছি। সাধারন মধ্যবিত্তের পক্ষে প্লেন ভাড়াটা সাধ্যের বাইরে মনে হতো বলেই কম পয়সার বাস সার্ভিস ছিল ভরসা। এবার অবশ্য প্লেনে গিয়েছি সকলের চাপে পড়্বে। সবার ধারনা, আমেরিকাতে থেকে থেকে আমাদের শরীর খুব আরামপ্রিয় হয়ে গেছে, তাই বাস জার্নির ধকল সইতে পারবোনা। যাই হোক প্লেনে চড়ে যাওয়াতেই পরিবর্তনটুকু চোখে পড়লো। সেই আলো ঝলমলে দমদম এয়ারপোর্টের বদলে নেতাজী সুভাষ বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির  সে কি ম্যারম্যরে চেহারা। তুলনায়  আমাদের শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি নেক বেশী সুন্দর! কত বড়, কেমন সাজানো গোছানো আলো ঝলমলে চারদিক। কাস্টমস অফিসারদের ব্বেযবহারও ভাল। আমাদের দেশের কাস্টমস অফিসারদেরকে মিডল ইস্ট থেকে আসা যাত্রীদের সাথে একটু খারাপ ব্যবহার করতে দেখেছি যা কিনা আমার কাছে পীড়াদায়ক মনে হয়েছে।  যাই হোক দমদম বিমান বন্দর থেকে বেরিয়েই অপেক্ষারত ট্যাক্সীতে গিয়ে বসলাম। গাড়ী বেশ ভাল গতিতেই চলতে লাগলো। মনে পড়ে গেলো, ২০০৩ সালে আমার ছোট মেয়েকে নিয়ে ট্যাক্সী করেই ফিরছিলাম। গাড়ী আটকা পড়ে গেলো ট্র্যাফিক জ্যামের মধ্যে। গরমে সিদ্ধ হচ্ছিলাম, গাড়ী নড়েনা, মেয়ের সে কী চীৎকার! ও গরম সহ্য করতেই পারেনা। তাই এবারে ছোট মেয়েকে সাথে নেইনি। অথচ রাস্তায় কোন জ্যাম নেই। অবাকতো হবোই। পরদিন সকালের ট্রেনে চড়ে বেলঘরিয়া যাচ্ছিলাম। ট্রেন একেবারেই ফাঁকা ছিল, আমি তো আবারও অবাক হলাম।যত বাড়ীতে গিয়েছিলাম, রাস্তাঘাট ছিল সাজানো গোছানো। আগের সেই চির পরিচিত ময়লা আবর্জনার স্তুপ দেখিনি কোথাও। সকাল বা বিকেল, সব সময়ই এক রকম। এবারই প্রথম কয়লার উনুন জ্বলতে দেখিনি কারো বাড়ীতে বা দোকান বা রাস্তার মোড়ে। উনুনের ধোঁয়ার সেই পরিচিত গন্ধ পাওয়া হলোনা, আদি কলিকাতাকে মিস করেছি বর্তমান কলকাতাতে থেকে। মেজো মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের সাধারন কামরায় না উঠে লেডীজ কামরায় উঠেছিলাম। এখানে অবশ্য পেয়েছি সেই পরিচিত দৃশ্য।  অফিস ফেরত টাইমে ধাক্কাধাক্কি করে ট্রেনে উঠতে গিয়ে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হওয়ার যোগার হয়েছিল। কথিত আছে, লেডীজ কামরাতেই পকেটমার হয়। আমার ব্যাগে ছিল দামী ক্যামেরা, বেশ কিছু টাকা। কিনতু এবার কোন অঘটন ঘটেনি, বরং এক ভদ্রমহিলা আমাকে অনেক সাহায্যই করেছে।

ছয়দিন ছিলাম কলকাতাতে, রাস্তাঘাটে  আগেকার দিনের মত মানুষের ঠেলাঠেলি ছিলনা, অটোরিক্সা লাইন ধরে দাঁড়ানো থাকে, রিক্সাও লাইনে থাকতে দেখেছি। নতুন যা দেখলাম তা হচ্ছে, ট্রেন থেকে নেমেই যাত্রীরা লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে। একটা করে অটো বা একটা করে রিক্সা এসে থামবে যাত্রীদের সামনে, আগে আসা যাত্রীটি সুযোগ পাবে রিক্সাতে উঠার। বিদেশে বেড়ে উঠা আমার মেজো মেয়ে আমাকে বললো, " মা দেখো, ইন্ডিয়া যে এগিয়ে যাচ্ছে তার মস্ত বড় প্রমান হচ্ছে এমন ডিসিপ্লিন্ড হয়ে উঠা মানুষজন। কেউ আমি আগে যাব বলে ঠেলাঠেলি করছেনা! একজন যাত্রী ভুল করেই একটা রিক্সাতে উঠতে গেছিল, আমি দেখলাম রিক্সাওয়ালাটা তাকে না নিয়ে লাইনে দাঁড়ানো অন্যজনকে তুলে নিল।" আরেকটি ভালো ব্যবস্থা হয়েছে মেয়েদের জন্য, মমতা দিদি ক্ষমতায় এসে শুধুমাত্র মেয়েরদের জন্য 'লেডীজ ট্রেন' চালু করেছেন। আমি বাংলাদেশের মেয়ে, মেয়েদের জন্য বিশেষ সুবিধা পেয়ে অভ্যস্ত, তাই লেডীজ ট্রেনের আইডিয়া আমার কাছে  খুব ভাল লেগেছে। রাস্তাতে কোথাও কোন দীর্ঘস্থায়ী ট্র্যাফিক জ্যাম হয়নি। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে তবে রাস্তাঘাটে কোন আন্দোলন হতে দেখিনি। গত ছয়দিনে কোন মিটিং মিছিল দেখিনি। হয়তোবা জনগন অনেক বেশী সচেতন হয়েছে। তারা নিজেরাও চেষ্টা করছে দেশটাকে, দেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করতে।  একদিনের একটি ঘটনা মনে আছে। ট্রেনে চেপে শিয়ালদহ যাচ্ছিলাম। স্টেশানে নেমেই মাইকে যাত্রী সাধারনের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছিল, " কল্যানী লাইনে কন্সট্রাকশানের কাজ চলছে, যাত্রী সাধারনের সুবিধার জন্য  কল্যানী রুটে বাড়তি বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে। আপনারা অত নাম্বার প্ল্যাটফর্মের গেইট ধরে বের হলেই বাস রেডী পাবেন" জাতীয় কথা। ছয়দিনে কলকাতা চষে বেড়িয়েছি।  চারিদিকে কন্সট্রাকশানের কাজ চলছে কলকাতাকে আধুনিক নগরী বানানোর উদ্দেশ্যে। ভোটের আগে দিদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কলকাতাকে আধুনিক নগরী বানাবেন। রাস্তাঘাটে আরেকটি জিনিসের উপর নজর পড়েছে আমার। চারিদিকে মমতা দিদির ছবি সংবলিত ফেস্টুন। মমতা দিদির হাত জোড় করা বিনম্র ভঙ্গীতে তোলা ছবিটি চারিদিকে শোভা পাচ্ছে। ছবিটি দেখে আমার মনে হয়েছে, জনগনের  নেতা নেত্রীদের ভঙ্গী এমনই হওয়া উচিত।

আমার খুব কাছের মানুষ, বয়সে তরুন তরুনীদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম মমতা দিদি সমপর্কে তাদের কি ধারনা। সকলের এক কথা, দিদি যখন বিরোধী দলে ছিলেন তখন নাকি জনগনের কথা বেশী বলতেন, যখন তখন প্রতিবাদে ফেটে পড়তেন, সরকারী অন্যায়ের প্রতিবাদে রাস্তার উপর শুয়ে পড়তেন। এখন নাকি ক্ষমতায় গিয়ে আর কিছুই করেননা। নিজের দলের লোকের জন্যই তাঁর সকল দরদ, নিজের দলের ক্যাডারদেরকেই কাজ দেন, সন্ত্রাসীও যদি তাঁর দলের হয়, তাহলে সাতখুন মাফ। পুলিশ বাহিনী নাকি দূর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এই প্রথম শুনলাম কলকাতায় মেয়েদের নিরাপত্তা নেই, এমন কথা শুনে অবশ্যই আঁতকে উঠেছি। কলকাতার মেয়েরা কত স্বাধীনভাবে চলতে পারে, নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখতাম আর এক ধরনের ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগতাম। সেই কলকাতায় মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা!  বিশ্বাস হয়নি আমার। ওদের বলেছি, "ছয়টা দিন মেয়েকে নিয়ে চষে বেড়িয়েছি সারা কলকাতা, কোন রকম অসঙ্গতি চোখে পড়েনি, কেউ শিস মারেনি আমার মেয়েকে দেখে, বাসে উঠতেই অনেকেই নিজের সীটটি ছেড়ে দিয়ে আমাদের বসতে দিয়েছেন।" এগুলো বলতেই পাশ থেকে  একজন বলে উঠলো, " এরা সবকটাই সিপিএমের ক্যাডার, তাই মমতার নামে অমন দূর্নাম ছড়াচ্ছে"।

অয়ন নামে একজনকে  আমি খুব ভালোভাবে চিনি, আমেরিকাতে ছিল বেশ কয়েক বছর, পিএইচডি করতে গিয়েছিল,  সে ছিল কট্টর 'দিদিপন্থী'। সে জোর গলায় দাবী করতো, একদিন মমতা ব্যানার্জী রাজ্য সরকারের ক্ষমতায় আসবে।  তাকে অনেকেই ক্ষ্যাপাত এই কারনে। আমিও মনে মনে ভাবতাম, এটা কি কখনও সম্ভব হবে নাকি! কিনতু বাস্তবে তা ঘটেছে। মানুষ পরিবর্তন চেয়েছে, পরিবর্তন এসেছে।  অয়নের  সাথে এবার দেখা করেছি, দেখা হতেই তার কাছে জানতে চাইলাম দিদির রাজকার্য দেখে সে কতটা সন্তুষ্ট, তার কি মূল্যায়ন! সে বললো, " এক বছর খুবই কম সময় একজনকে মূল্যায়ন করার জন্য। ভালো বা মন্দ, কোনটারই মূল্যায়ন সম্ভব নয় এত তাড়াতাড়ি"। এটা খুবই সত্যি কথা। তারপরেও আমার নিজের কাছে মনে হয়েছে, দিদি কাজ করছেন। বেশ আন্তরিকভাবেই কাজ করে চলেছেন। সাথে যোগ হয়েছে জনগনের ব্যক্তি সচেতনতা। যদিও আমি আমার চির পরিচিত কলিকাতাকে দেখতে পাইনি,   আমার ছেলেবেলাকে পাইনি,  অতীতের ভালোলাগাকে ছুঁতে পারিনি, তারপরেও সেদিনের কলিকাতার পুরানো খোলস ভেঙ্গে  এদিনের নতুন কলকাতাকে দেখে এলাম। আমি খুবই ইমোশনাল, অতীতকে পাইনি বলে কষ্ট লেগেছে, তারপরেও ভালো লেগেছে ভেবে যে জনগনের নেত্রী জনগনকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, তিনি তাঁর কথা রাখার চেষ্টা করছেন। আমাদের এই উপমহাদেশে রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের সম্পর্কে বহুল প্রচলিত একটি ধারনা আছে, " যেই যায় লংকায়, সেই হয় রাবণ"! ক্ষমতায় যাওয়ার আগে নেতা নেত্রীরা জনগনকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে থাকেন, ক্ষমতায় যেতে পারলে নিজেরাই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন এবং তড়িঘড়ি করে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, জনগনের কথা বেমালুম ভুলে যান। মনে হয় মমতা দিদি বাংলাদেশের জনগনের প্রতি অবিচার করলেও নিজ দেশের জনগনের প্রতি দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার চেষ্টা করছেন।

Saturday, June 23, 2012

মনে হয় বাবা যেন বলছে আমায়, "আয় খুকু আয়'

কয়েক বছর আগে চ্যানেল আই ক্ষুদে গানরাজ' সঙ্গীত প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠানে ছোট্ট মেয়ে তুবা গেয়েছিল, " চোখ মুছে মুখ তোল, স্নেহের বাঁধন খোল, এবার তোমায় দিতে যে হয় যাবার অনুমতি-----আমি যাচ্ছি বাবা'। গানটি অনুষ্ঠানে আগত অনেককে কাঁদিয়েছিল, আমাকে এখনও কাঁদায়। তিন মিনিটের গানটিতে গীতিকার ও সুরকার বাবা আর মেয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে না কেঁদে উপায় নেই। তাই আমিও কাঁদি। কান্নার ভেতর দিয়ে বাবাকে অনুভব করি। অনুভব করি জীবনে বাবার অস্তিত্বকে, অনুভব করি জীবনের স্বপ্ন সিঁড়ি তৈরীর কারিগরটিকে।

আজ বিশ্ব বাবা দিবস। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে ফাদার’স ডে উদযাপিত হয় মহা আড়ম্বরের সাথে। যদিও আমরা বিশ্বাস করি যে বাবা বা মায়ের জন্য আলাদা কোন দিন থাকা উচিত নয়, কারন আমাদের জীবনের প্রতিটি দিনের সাথে বাবা মা জড়িয়ে আছে, তারপরেও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে অনেকটাই মাদার’স ডের পরিপূরক হিসেবে ফাদার’স ডে পালন করা শুরু হয়েছে। মা দিবসে মায়ের জন্য যতটা আবেগ, অনুভূতি, দরদ প্রকাশ করে নানা রকম আনন্দ উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে, বাবা দিবসে ঠিক ততটা না হলেও উৎসব আয়োজনে তেমন একটা কমতিও থাকেনা। বাবা দিবস আয়োজনের মধ্যে দিয়েই বাবার প্রতি সম্মান, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়ে থাকে। অধিকাংশ দেশে জুন মাসের তৃতীয় রবিবার ‘ফাদার’স ডে’ পালিত হয়ে থাকে।

আমাদের এই উপ মহাদেশে বাবা দিবস অথবা মা দিবস নামে আলাদা কিছু ছিলনা। আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, বছরের প্রতিটি দিনই বাবা এবং মা’ কে ঘিরে আমাদের সুখ-দুঃখ, স্বপ্ন-কল্পনা, ভালো-মন্দ, হাসি-কান্না জড়িয়ে আছে। আলাদা করে বছরের নির্দিষ্ট একটি দিনে বাবা বা মা’কে নিয়ে সমস্ত কর্মকান্ড, হাসি উল্লাসের কথা আমাদের ভাবনাতে ছিলনা। মা দিবস বা বাবা দিবস উৎসবের শুরুটা হয়েছে পাশ্চাত্যের দেশগুলো থেকে। সূত্রমতে ১৯১০ সালে অফিসিয়ালি ফাদার’স ডে পালিত হয় আমেরিকার ওয়াশিংটন রাজ্যের স্পোকেন শহরের ছোট্ট এক বাড়ীতে। সোনোরা স্মার্ট ডড নামের এক তরুণী সর্বপ্রথম ফাদার’স ডে সেলিব্রেট করে ১৯১০ সালের ১৯শে জুন। সোনোরার বিপত্নীক পিতা উইলিয়াম জ্যাকসন স্মার্ট তার ছয় সন্তানকে পরম মমতায় বড় করেছিলেন। মাতৃহীন সংসারে ‘সিভিল ওয়ার ভেটেরান’ পিতা উইলিয়াম স্মার্ট একাধারে বাবা ও মায়ের ভূমিকা পালন করেছিলেন। সোনোরা তাদের জীবনে বাবার ভূমিকাকে গৌরবান্বিত করার লক্ষ্যেই ‘ফাদার’স ডে’ সেলিব্রেট করার পরিকল্পনা করেন। এই পরিকল্পনা সকলের মাঝে প্রচারের জন্য সোনোরা প্রতিটি চার্চ, বিপনন কেন্দ্র, ওয়াই এম সি এ, অফিস-কাচারীসহ সম্ভাব্য সকল জায়গায় যোগাযোগ করতে থাকেন। এভাবেই এক সময় তার এই প্রচেষ্টা সাফল্যের মুখ দেখে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ১৯১০ সালে প্রথমবারের মত ‘ফাদার’স ডে’ উদযাপিত হয়।

এরপর ১৯১৩ সালে আমেরিকান কংগ্রেসে জুনের তৃতীয় রবিবারকে ফাদার’স ডে হিসেবে ঘোষণা করার জন্য বিল উথথাপণ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯১৬ সালে প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন এবং ১৯২৪ সালে তৎকালীণ প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলী ‘ফাদার’স ডে’ বিলটি সমর্থন করেন। কিনতু দুইবারই কংগ্রেস কর্তৃক প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যাত হয়। তারপরেও পরবর্তী আরও অনেক বছর ফাদার’স ডে বিলটি নিয়ে অনেক দেন দরবার চলে। ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিনডন জনসন ফাদার’স ডে বিলটি আমলে নেন এবং কংগ্রেসে আলোচনার ঘোষণা দেন। ছয় বছর পরে ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন বিলটি সাইন করেন এবং এরপর থেকে ফাদার’স ডে জাতীয়ভাবে উদযাপন করা হয়।

ফাদার’স ডে’ উপলক্ষ্যে পশ্চিমা দেশগুলোতে একমাস আগে থাকতেই সাজ সাজ রব উঠে। বাবাকে উপলক্ষ্য করে কত রকমের উপহার সামগ্রী দিয়ে বিপণী বিতানগুলো সাজানো থাকে। টি শার্টের গায়ে ‘লাভ ইউ ড্যাড’, ‘মাই ড্যাড ইজ মাই হিরো’ জাতীয় কতরকম আবেগী কথামালা লেখা থাকে। আমাদের দেশেও বাবা দিবসে নিশ্চয়ই নানা রকম উপহার সামগ্রীতে বিপনী বিতানগুলো ভরে উঠে। লাখ লাখ টাকার পন্য সামগ্রী ক্রয় বিক্রয় হয়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আমেরিকাতে 'ফাদার'স ডে' উপলক্ষ্যে বিলিয়ন ডলারের উপহার বিক্রী হয়ে থাকে প্রতি বছর। উপহার দেয়া ছাড়াও এই দিনটিতে 'বাবা'কে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া, মুভী দেখা, ফিশিং করতে যাওয়া, রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়াসহ আরও কত কিছুর আয়োজন থাকে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে নিজ বাবা ছাড়াও স্টেপ ড্যাড, ফস্টার ড্যাড, গডফাদার জাতীয় বাবা সম্পর্কিত সকলকেই সম্মান জানানো হয়। মাদার'স ডে বা ফাদার'স ডে উপলক্ষ্যে আমেরিকানদের উচ্ছাস, আনন্দ, আবেগের মধ্যে কোন অভিনয় থাকেনা। ওদের উৎসব আয়োজনে থাকে আন্তরিকতার ছোঁইয়া। দেখে মন ভরে যায়। প্রবাসীদের মনকেও তা ছুঁইয়ে যায়। আমরা যারা প্রবাসে থাকি, তারা আবেগাক্রান্ত হই, ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে দেশে ফোন করি, পরম মমতাভরা কন্ঠে বাবাকে বলি, " হ্যাপী ফাদার'স ডে বাবা'। ফোনের অপরপ্রান্তে 'ফাদার'স ডে' কালচারে অনভ্যস্ত বাবাটিও আহ্লাদে গদগদ হয়ে উঠেন। কোন উপহারের প্রয়োজন পড়েনা, সন্তানের গলার আওয়াজটি পেয়েই বাবা খুশী হয়ে উঠেন, চাপা গর্বে পাড়ার দোকানে হঠাৎ দেখা প্রতিবেশীকে ডেকে হয়ত বলেন, " আজকে মেয়ে ফোন করেছিল, ফাদার'স ডে জানালো"। এইই হচ্ছে বাবা। বাবা তো এমনই হয়!


বাবা শব্দটিতে কত মাধুর্য্য, কত নির্ভরতা। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মেয়ে 'মা' হতে পারে। কিনতু প্রায় প্রতিটি পুরুষ 'বাবা' হতে পারেনা। সন্তান জন্ম দিলেই একটি মেয়ে 'মা' হয়ে উঠে, কারন প্রকৃতিই তা নির্ধারণ করে দেয়। মায়ের নাড়ীর সাথে সন্তানের যোগ থাকে বলেই 'মা-সন্তানের' সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য, অটুট। বাবার ক্ষেত্রে তা হয়না। সকল জন্মদাতাই পিতা বা বাবা হতে পারেনা। আর তাই পৃথিবীতে হতভাগ্য কোটি কোটি শিশু মায়ের নাম জানলেও তার 'বাবা'র পরিচয় জানেনা। কারন হতভাগ্য কোটি শিশুর জন্মদাতা বীরপুরুষেরা মনের আনন্দে অথবা খেলাচ্ছলে্‌ কখনওবা বিকৃত উল্লাসে নির্দ্বিধায় শিশুগুলোকে পৃথিবীতে নিয়ে আসে, কিনতু তারা কেউ 'বাবা' হতে চায়না। তারা আনন্দ-ফূর্তি করতে রাজী আছে, যে কোন সময় অসহায় নারীকে বলাৎকার করতে প্রস্তুত থাকে, কিনতু ক্ষনিক আনন্দের ফসলটিকে ঘরে তুলতে চায়না, অনেক ক্ষেত্রেই তারা জানতেও পারেনা তাদের ক্ষনিক আনন্দের প্রাপ্তিটুকু নিয়ে অসহায় এক নারী কি বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে! রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, দেশে দেশে যুদ্ধ হয়, আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই অবধারিতভাবে কিছু মানব সন্তানের জন্ম হয়, যাদেরকে বলা হয় 'যুদ্ধশিশু'। সেই সমস্ত শিশুর 'বীরাঙ্গনা মা' থাকে, 'বাবা' থাকেনা। 'পতিতালয়' নামক সমাজের আরেকটি অংশে প্রতিদিনই শিশুর জন্ম হচ্ছে, যাদের শুধু মা থাকে, বাবা থাকেনা। পশ্চিমা দেশগুলোতে মা ও শিশু থাকে, 'বাবা' থাকেনা। এইজন্যই বলা হয়, জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায়না, 'বাবা' হতে হয়। অনেক ত্যাগ তিতীক্ষা, অনেক পরিশ্রম, অনেক দায়িত্ববোধ, বিশাল হৃদয়, অকৃত্রিম ভালোবাসা, অশেষ স্নেহ জড়ানো থাকে 'বাবা' হয়ে উঠার পেছনে। এমন কঠিন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যে মানুষটি সংসারে আবির্ভূত হয়ে থাকেন, সংসারে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকেন, 'সংসার নৌকা'র হালটি ধরে রাখেন, যেই মানুষটি স্বপ্ন দেখেন ও স্বপ্ন দেখান, সেই মানুষটিই আমাদের 'বাবা'। সেই বাবাটিকে বছরের প্রতিটি দিনই আমাদের জীবনে প্রয়োজন, আর আমাদের প্রয়োজন একটিমাত্র দিন, যেদিনটিতে আমরা 'বাবা'দের 'বাবাত্ব'কে সম্মান করতে পারি, বাবাত্বের মহত্ততাকে নত মস্তকে স্বীকৃতি জানাতে পারি, সন্তানের কাছে বাবার যতখানি প্রাপ্য, তার কিঞ্চিৎ অংশটুকুও দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি। এইজন্যই একটি বাবা দিবস দরকার, এবং 'বাবা দিবস' এর প্রয়োজন আছে।

কিশোরীবেলায় শোনা হেমন্ত মুখার্জী ও শ্রাবন্তী মজুমদারের দ্বৈতকন্ঠে গাওয়া গান, " মনে হয় বাবা যেনো বলছে আমায়, আয় খুকু আয়" এখনও আমাকে কাঁদায়। আমার সত্যি সত্যি মনে হয় আমার বাবা আমাকে পেছন থেকে ডেকেই চলেছেন, আমার যে কোন প্রয়োজনে বাবা যেনো আমাকে এখনও সাহস দিচ্ছেন, ভরসা দিচ্ছেন। মা’কে নিয়ে কত কাব্য রচিত হয়েছে, কত গীত রচিত হয়েছে বহুকাল আগে থেকে। কিন্তু বাবাকে নিয়ে তেমন করে কাব্যগাঁথা রচিত হয়নি। তাই বলে 'বাবা'রা কি থেমে আছেন! বাবা নামের জীবন নৌকার মাঝিটি কিনতু শক্ত হাতে নৌকার হালটি ধরেই আছেন। আজকের এই দিনে পৃথিবীর সকল বাবাকে সম্মান জানাই। সকল বাবার জন্যই আমাদের ভালোবাসা।

Thursday, June 14, 2012

পঁচিশ মিনিটের বাসযাত্রায়!

কলকাতা বেড়াতে এসেছি ছয় দিনের জন্য। সাথে নিয়ে এসেছি মেয়ে মিশাকে। কারন একমাত্র মিশা যে কোন পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। যেমন কলকাতাতে এখন দারুণ গরম। এই গরমে কোন প্রয়োজন ছাড়া আমার অন্য মেয়েরা বাইরে বের হবেনা, কিনতু মিশা ব্যতিক্রম। তাই মিশাকে নিয়ে বেড়াতে এসেছি।

গতকাল গিয়েছিলাম জোড়াসাঁকো। আজ যাচ্ছি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ও গড়ের মাঠ। সকালবেলাতে মাসীর বাড়ী থেকে রওনা দিয়েছি। মাসীর বাড়ী থেকে ২৩৭ নাম্বার বাসে চড়ে বাগুইহাটি যাওয়ার কথা। বাগুইহাটিতে থাকে আমার কাকীমা। কাকাত ভাই দীপকে তুলে নেওয়ার কথা। দীপ ডকুমেন্টারী ফিল্ম তৈরী করে। ওকে সাথে নিয়ে গেলে অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে বলেই ওর কাছে এসেছি। বাসে উঠেই দুটি খালি সীট পেয়েছি। যাত্রা শুভ ধরে নিয়েছি। কারন কলকাতার বাসে বাঁ ট্রেনে উঠে বসার সীট পাওয়ার কথা ভাবাই যায়না। বাসে উঠে মা আর মেয়ে বসতেই বাসটা ছেড়ে দিয়েছে। দেড় মিনিট বাদেই একটি স্টপে বাস থেমেছে, এক ঝাঁক মানুষ সাথে সাথেই বাসে উঠে গেছে। আমার ঘাড়ের উপর এসে দাঁড়িয়েছে কয়েকজন। এসবই আমার চেনা দৃশ্য। হঠাৎ করেই নারীকন্ঠে এক আর্তনাদ শুনলাম, " ওরে বাবারে! দিয়েছে, দিয়েছেরে!! আমার চোখটা গেলে ফেলেছে। ও মাগো! গেলুমরে গেলুমরে! পাশ থেকে মেয়েটির স্বামী একটি রুমাল এগিয়ে দিল, " একটু গরম স্যাঁক দাওতো,   স্যাঁক দাও। ব্যথা কমে যাবে'খন।"। বউটি স্বামীর দিকে ফিরেও তাকালোনা।

আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকাতেই দেখতে পেলাম মেয়েটিকে। কম বয়সী এক বউ, একহাতে বাম চোখটিকে চেপে ধরে চেঁচিয়েই চলেছে। মেয়েটি দেখতে খারাপ না, পরনে ছিল হালকা গোলাপী রঙের সূতীর শাড়ী। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে পড়েছে শাড়ীটিকে। দেখে মায়া লাগল। কিনতু মেয়েটি যেমন করে উঃ আঃ করছিল, আমার কাছে একটু অতিরঞ্জিত মনে হচ্ছিল। ের মধ্যেই মেয়েটি ঘাড় ঘুড়িয়ে আসল কালপ্রিটের দিকে তাকিয়েই মুখ ঝামটে উঠলো, " বাসে উঠে হাতটাকে একটু সামলে চলতে পারেননা? যত্তসব বেয়াক্কেলে লোক এসে জুটেছে। আমার চোখটাকে গেলেই ফেলেছেরে! এমনিতেই গরমে আমার মাথাটা ভারী হয়ে আচে, তাঁর উপর অমন গুঁতো! উঃ আঃ " এভাবে চলছিল। লক্ষ্য করলাম 'কালপ্রিট' টি শান্তশিষ্ট, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোষাকে এক ভদ্রলোক। বউটির আক্রমনে ভদ্রলোক মুখটি আড়াল করে সরে গেলো।

পরের স্টপেজে আরও কিছু যাত্রী উঠলো। তাদের মধ্যে জীনস ও টপস পরা এক তরুনী ছিল। মেয়েটি বললো, " আমাকে একটু ভেতরে যেতে দিন।' বলেই যেই না মেয়েটি ভেতরের দিকে ঢুকতে লাগলো, সেই বউটি চেঁচিয়ে উঠলো, " একটু থামুননা, অত ঠেলা ধাক্কা করার কি হয়েচে! আমি বুঝি ব্যথায় মরে যাচ্চি"। জীনস পরা মেয়েটি জবাবে বললো, " আমিতো আগে থেকেই বলে নিয়েছি। অত চেঁচামেচি করার কি হলো। আমিতো ইনফর্ম করেছি'। ধ্যাতানি খেয়ে বউটি এই বেলা আর কিছু বললোনা।  ের মধ্যেই বউয়ের স্বামীটি বসার জন্য একটি সীট পেয়ে যেতেই বসে পড়ে বউকে ডাকলো, " ওগো, তোমার হাতের ব্যাগটা আমাকে দিয়ে দাও। শুনছো, ব্যাগটা আমাকে দাও"। বউটা এবারেও ফিরে তাকালোনা। আমার মনে হলো, আজ সকালেই বউটির সাথে তাঁর স্বামীর খুব একচোট হয়েছে। স্বামী বেচারা তাঁর কাফফারা দিয়ে চলেছে।

আমার উপর দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের চাপ বাড়ছিল। আমি আমার মেয়ের উপর ঝুঁকে পড়ছিলাম। মেয়ে আবার আমাকে ধমকাচ্ছিল, " এই গরমের মধ্যে তুমি আমার উপর হেলে পড়ছো কেন"?। বললাম, " বউটা আমার উপর পড়ছে। এমনিতেই বউটা ক্যাঁ কোঁ করছে, এখন যদি আমি ওকে সরতে বলি, আবার আমার উপর ক্ষেপে যাবে। থাক, একটুক্ষন সয়ে যাওয়া ভালো"। বলে শেষ করতেই আমার পেছনের সীট থেকে এক কর্কশ কন্ঠের চীৎকার শুনলাম। কর্কশ কন্ঠ বলছিল,"  এই তোমার কান্ডটা কি শুনি? তকন থেকে ফোন বেজে চলেচে, ফোন ধরার নাম নেই? কি করচিলে শুনি! তোমাকে বলেচিলুম ফোনে টাকা ভরতে। ভরেচিলে? কত ভরেচো শুনি! ৫০ টাকা ভরতে বলেছি, আর তুমি খচ্চর দিয়েচো তিরিস টাকা। কেনো তিরিস দিলে? শালা সয়তান কোতাকার! এই রেকে দিচ্ছি ফোন" বলেই ফোন অফ করে দিল।

আমার স্টপেজ কাছে চলে আসতেই ভাই দীপ আমাকে ফোন করে জানতে চাইলো, আমরা কোথায় আছি। আমি এখানের কিছুই চিনিনা। আরেক ভাই টুংকা বাসে তুলে দিয়ে বলেছিল, জোড়া মন্দিরের সামনে নামতে। আমি কিছু বলতে পারছিলামনা বলে দীপ জিজ্ঞেস করলো, " তোমার আশেপাশে কি দেখছো বলো"। বাসটা থেমেছিল একটি ময়লা আবর্জনার বিশাল এলাকার পাশ ঘেঁষে। আমি বললাম, "আমার পাশে ময়লা আবর্জনা দেখতে পাচ্ছি'। এটা শুনেই মিশা এক ধমক দিলো, " এটা একটা কথা হলো? ময়লা আবর্জনা দেখছি বলছো কেনো? বলো বিগ বাজার ছাড়িয়ে জোড়া মন্দিরের কাছে এসেছি"। আমি বলার আগেই বাস জোড়া মন্দিরের কছে চলে এলো, কন্ডাক্টর খুব যত্ন করে আমাদের মা মেয়েকে স্টপে নামিয়ে দিলো। বাস থেকে নেমেই পেয়ে গেলাম দীপকে। দীপের সাথে রওনা দিলাম।