Monday, August 27, 2012

রুগী যখন জানতে পারে, রোগটির নাম 'ক্যানসার'!

খুব ছোটবেলাতে  আমরা ডাক্তার -রুগী খেলতাম। খেলার সময়  গলায় মিছিমিছি স্ট্যাথোস্কোপ ঝুলিয়ে, নাকে ঝুলন্ত চশমাকে উপরের দিকে ঠেলে দিয়ে গলা ভারী করে রুগীকে আড়াল করে তার আত্মীয়কে বলতাম, ' রুগীর ক্যান্সার হইছে। বাঁচানো যাইবোনা। জানেনইতো, ক্যান্সার নো এনসার"। তখনতো জানতাম ক্যান্সার বলতে ব্লাড ক্যানসারকেই বুঝানো হয়। সিনেমাতে দেখানো হতো নায়ক বা নায়িকা ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত অথবা যক্ষ্মায় আক্রান্ত। নায়ক বা নায়িকাকে মেরে ফেলতে হলে এই দুই রোগের যে কোন একটাকে দেখানো হতো।  তার মানে ক্যান্সার হলে কেউ বাঁচেনা। তবে আরেকটু জানতাম, ব্লাড ক্যান্সার হলে শরীরের সব রক্ত পাল্টাতে হয়, রক্ত পাল্টালেই রুগী বাঁচে। বড় হয়ে শুনেছি নায়িকা সুচিত্রা সেনের ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। বছরে দুইবার করে শরীরের রক্ত পাল্টিয়ে উনি নাকি বেঁচে আছেন।।ক্যানসার সম্পর্কে বিচিত্র সব তথ্য শুনে হঠাৎ করেই আমার মনের ভেতর ক্যানসার ভীতি দানা বাঁধতে শুরু করে। ক্রমে ক্রমে জানতে পারি, ক্যান্সার বলতে শুধু ব্লাড ক্যানসারকেই বুঝানো হয়না, ক্যানসার দেহের যে কোন অংশে হতে পারে।


দুরন্ত যৌবনে কেউই মৃত্যু নিয়ে ভাবেনা, অথবা মৃত্যুকে ভয় করেনা।  যৌবন মানেই জীবন। তবে  সমস্যা হচ্ছে যৌবনের স্থায়িত্বকাল খুবই কম। যে মানুষটি একসময় মৃত্যুকে থোড়াই কেয়ার করেছে,  জীবনের এক পর্যায়ে এসে তাকেও মৃত্যুচিন্তায় পেয়ে বসে। আমার কথা আলাদা। আমি ছোটবেলা থেকেই মৃত্যুকে ভয় পাই।   সব সময় ঈশ্বরের কাছে  প্রার্থণা করি," হে ঈশ্বর, যখন কেউ আমাকে আর ভালোবাসবেনা, যখন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে দূর্বিষহ মনে হবে, তখনই যেনো আমার মৃত্যু হয়। মৃত্যুটা যেন আমার অজানতেই হয়"।  আর বাড়ীর সকলকে জানিয়ে দিয়েছি, আমার যদি কখনও ক্যানসার হয়, আমাকে যেন সেটা জানতে না দেয়া হয়।  কারন ক্যানসার হয়েছে শুনলেই শতকরা ৯৯ ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগেই রুগী 'মরে যাব' ভয়েই অর্ধেক মরে যায়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে যতই উন্নতি হোক না কেন এমন আধামরা রুগীদের শুধু চিকিৎসায় সুস্থ করে তোলা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।

গত এক সপ্তাহে আমার খুব কাছের দু'জন মানুষ,  রক্তের সম্পর্ক না থেকেও যারা ছিলেন আমার একান্ত কাছের, দু'জনই ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হয়ে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে কোথায় কোন অজানার দেশে চলে গেলেন। তাঁদের একজন মারা গেলেন কলকাতায়, আরেকজন মারা গেলেন আমেরিকায়। কলকাতায় যিনি মারা গেলেন সম্পর্কে উনি আমার মেসো ( আমাকে যিনি মেয়ে জ্ঞানে স্নেহ করতেন), আমেরিকায় যিনি মারা গেলেন উনাকে ডাকতাম খালাম্মা বলে ( এই মানুষটি এই বিদেশ বিভুঁইয়ে আমাকেই একমাত্র আপনার জন ভাবতেন, ঘন্টার পর ঘন্টা টেলিফোনে আমার কাছে জীবনের না বলা কথাগুলো বলতেন)। এই দুজনের প্রত্যেককেই শুরুতেই ডাক্তারগন জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের রোগটির নাম 'ক্যানসার'। জানিনা, রোগের নাম জানিয়ে দিয়ে ডাক্তারগন চিকিৎসায় কতটুকু সফল হতে পেরেছেন! ক্যানসার হয়েছে জানার আগে দুজনেই হেঁটে হেঁটেই হাসপাতালে গিয়েছিলেন, 'আপনার ক্যানসার হয়েছে' জানার পরে দুই দিনের মধ্যেই তাঁরা শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় রুগীকে তার রোগ সম্পর্কে জানানোটাই যদি নিয়ম হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের দেশের রুগীকে 'মরনরোগ' সম্পর্কে জানতে না দেয়ার পুরাতন পদ্ধতিকেই আমি সমর্থন করি। মেসো ব্যাঙ্গালোর গিয়েছিলেন মেয়ের বাড়ীতে বেড়াতে, ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার আগে আমার সাথে ফোনে তাঁর কথা হয়। বেড়াতে যাচ্ছেন বলে খুব ফূর্তির মুডে ছিলেন, ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার দশদিনের মাথায় বোনের কাছ থেকে সংবাদ পাই, পেটে ব্যথা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে ' খাদ্যনালী ও পাকস্থলীর সংযোগস্থলে ক্যানসারের'  কথা শুনে  মেসো ভেঙ্গে পড়েছেন। সেই যে মানসিকভাবে উনি ভেঙ্গে পড়লেন, পরবর্তী ছয়মাসের মধ্যে আর মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারলেননা। উনাকে দেখতে গিয়েছিলাম, দেখে মনে হয়েছে না দেখাই ভালো ছিল। বেঁচে থাকা অবস্থায় যে মানুষ মরে গেছে, তাঁকে দেখার মধ্যে কোন আনন্দ নেই।

খালাম্মা থাকতেন মেয়ের কাছে। অসুস্থ মেয়েকে দেখাশোনা করতেন। এই বছর ফেব্রুয়ারী মাসে উনার সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল, টেলিফোনে। সেদিন উনি আমাকে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের আরেক ভদ্রলোকের মৃত্যু সংবাদ, যিনি আমাদের পূর্ব পরিচিত ছিলেন। সেই ভদ্রলোকের ক্যানসার হয়েছিল এবং উনাকে তা জানানো হয়েছিল। আমেরিকায় উন্নত চিকিৎসা পেয়েও দুই বছরের বেশী উনাকে বাঁচানো যায়নি। সেই দুই বছরে উনি আসলেই কি বেঁচেছিলেন? মনে তো হয়না। এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, বিয়ের ছবি দেখেছি, মেয়ে, নতুন জামাইয়ের পাশে সবার সাথে উনিও দাঁড়ানো। সবার মুখে প্রানবন্ত হাসি, উনার মুখে জোর করে আনা হাসি। উনার নিশচয়ই তখন সবকিছু অর্থহীন মনে হচ্ছিল। উনি জীবিত থাকতে থাকতে যেন মেয়ের বিয়েটা দেখে যেতে পারেন, এটাই ছিল বিয়ে আয়োজনের মূল ঊদ্দেশ্য। কিনতু যাঁর জন্য এত আয়োজন, তাঁর মনে তখন কী তোলপাড় চলছে তা উনিই বলতে পারতেন। আমি আবারও অসমর্থণ করি, আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় রুগীকে তার মৃত্যুরোগ সম্পর্কে অবহিত করার এই নিষ্ঠুর এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারটিকে।
যে কথা বলছিলাম, যেদিন খালাম্মা আমাকে ঐ ভদ্রলোকের মৃত্যুসংবাদ দিলেন, উনি সাথে এটাও বলেছিলেন, কিছুদিন ধরেই উনার পেটে প্রচন্ড ব্যথা, অসুস্থ মেয়েকে নিয়েই এত ব্যস্ত যে নিজের কথা মনে থাকেনা।

মেয়েকে সেবা করতে হলেও নিজেকে সুস্থ রাখা দরকার' বললাম খালাম্মাকে। ডাক্তারের কাছে যেতে পরামর্শ দিলাম, চারদিন পরে খালাম্মার মেয়ে জামাই আমাকে ফোন করে জানালো, খালাম্মার 'কোলনে ক্যানসার ধরা পড়েছে এবং উনাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। সেই যে খালাম্মা হাসপাতালে গেলেন, তিনদিন আগে মেয়ের মায়া, ছেলের মায়া, পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে কোথায় চলে গেলেন! খালাম্মা ফোনে কত গল্প করতেন আমার সাথে, আমার এখনও ভাবতে অবাক লাগছে, আমার সাথে উনার শেষ কথা হয়েছিল, নাজির সাহেবের ক্যান্সারে মৃত্যু নিয়ে, খালাম্মাও আমার সাথে একমত ছিলেন যে ক্যানসার হয়েছে শুনলে পরে এমনিতেই মানুষ অর্ধেক মরে যায়। সেই খালাম্মাই যখন  দুই দিন পরে নিজের ক্যানসার হয়েছে জানতে পেরেছিলেন, তখন কি উনার কাছে মনে হয়েছিল যে ডাক্তার সাহেব খুব নিষ্ঠুর, নিষ্ঠুর ডাক্তার কেমন সহজে বলে দিতে পারলেন তাঁরও ক্যানসার হয়েছে। সেই যে উনি জীবনের আনন্দ থেকে, বেঁচে থাকার আনন্দ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন, তখনইতো তাঁর মৃত্যু হয়েছে, তিনদিন আগে শুধু উনার দেহটাও মারা গেল।



অনেক আগে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একখানা লেখা পড়েছিলাম। উনার স্ত্রী অধ্যাপিকা জেসমিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর লেখাটা কোন এক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। উনি লিখেছিলেন, উনার স্ত্রী যখন জানতে পেরেছিলেন যে তাঁর ক্যানসার হয়েছে, তারপর থেকেই উনি চুপ হয়ে গেছিলেন। প্রায়ই উনাকে দেখা যেত, জানালার শিক ধরে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। অসুখ যখন ভয়ানক হয়ে উঠে, উনি ধীরে ধীরে চেতনার বাইরে চলে যান এবং একসময় জীবন থেমে যায়। লেখাটা পড়ার পরেই আমার মনে হয়েছিল, আহারে, মৃত্যুর আগে যে কয়টা দিন উনি বেঁচেছিলেন, উনার আশেপাশের জীবন দেখে নিশ্চয়ই তাঁর কান্না পেতো। নিশ্চয়ই তাঁর মনে হতো, 'সবাই থাকবে, সবই থাকবে, শুধু আমিই থাকবোনা"। উনি জানালার শিক ধরে বাইরে তাকিয়ে কী ভাবতেন? উনি কি ভাবতেন, " এই পৃথিবীর সকল সুন্দর ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হবে। কোথায় যাবো তা তো জানিনা। গন্তব্য জানা থাকলে আসন্ন মৃত্যুটাকে মেনে নিতে সহজ হতো। এমন অজানার পথে পা বাড়াতে আমার ভয় লাগছে। আমি কেনো বেঁচে থাকলামনা, বেঁচে থাকলে আরও কত কী করতে পারতাম, কত কী দেখতে পেতাম"! এগুলো সবই আমার কল্পনা, আমি নিজেকে অধ্যাপিকা জেসমিন চৌধুরীর স্থানে বসিয়ে কল্পনা করেছি।

আমেরিকায় আছি গত বারো বছর ধরে। যে বয়সে এদেশে এসেছি, সেই বয়সে নতুন করে কিছুই শেখার নেই। মানিয়ে চলাটাই এই বয়সের ধর্ম। ইতোমধ্যে অনেক কিছুই মানিয়ে নিতে শিখেছি আবার কিছু কিছু ব্যাপার মানতেই পারিনা। যেমন এখানে অসুস্থ হয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে,  নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ডাক্তার অবলীলায় রুগীকে তার রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত বলে দেন। রোগটি যদি হয় ক্যানসার অথবা এইডস, তাতেও কোন ভ্রূক্ষেপ করেননা। ইমোশনাল ব্যাপারগুলো এদেশে নেই বললেই চলে। এটা নিয়ে অনেকেই অনেক যুক্তি দাঁড় করাতে পারলেও আমার মন কোন যুক্তিই মানতে চায়না। আমার শুধু মনে হয়, আমার ভয়ানক রোগ সম্পর্কে কিছু না জেনেই আমি মারা যেতে চাই। রোগের নাম জেনে কী হবে, আমি কি পারবো ঢাল তলোয়ার নিয়ে 'ক্যানসার' এর গলা কেটে দিতে? অনেকেই যুক্তি দেখান, রোগ সম্পর্কে রুগীকে জানানো হলে, রুগী মৃত্যুর আগেই যতখানি সম্ভব জীবনের অসমাপ্ত কাজগুলো  সেরে যেতে পারে। বাপরে! কী ভয়ানক সব যুক্তি! আমি মরে যাব মানে তো মরেই যাব,  আমার আবার অসমাপ্ত কাজ কী? আমার জীবন যেখানে অসমাপ্ত রেখে সারা জীবনের তরে চলেই যাচ্ছি, তাহলে আমাকে দিয়ে মৃত্যুর আগে অসমাপ্ত কাজ করতে দেয়াটা, অনেক বেশী নিষ্ঠুর মনে হয় না? কী জানি, হয়তো আমার ভাবনায় অনেক ভুল আছে, আসলে আমি খুব ভীতু বলেই হয়তো মহৎ কিছু চিন্তা করতে পারিনা, আমি পারিনা মৃত্যুকে মেনে নিতে।

আমেরিকাতে এসে আমি শখের বশে নার্সিং পড়তে গিয়েছিলাম। তৃতীয় সেমিস্টারে ( এই সেমিস্টারে এসেই আর মাত্র একটি সেমিস্টার বাকী থাকতে টীচারের উপর রাগ করে পড়া ছেড়ে চলে এসেছিলাম) মাঝে মাঝেই অতিথি স্পীকার আসতেন নানা বিষয়ের উপর বক্তব্য রাখতে। একদিন এলেন এক মহিলা, কোন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। উনি এসে আমাদের নিজের জীবনের গল্প শুনালেন।

ধরে নিলাম উনার নাম ক্যাথি। ক্যাথির বয়স যখন ৪৫, একদিন সে ডাক্তারের কাছে গেল। কারন তার মনে হয়েছে সে তার ব্রেস্টে লাম্প টের পেয়েছে ( এদেশে নিজে নিজে ব্রেস্ট একজামিন করার কৌশল সব মেয়েকেই শেখানো হয়, সচেতন মাত্রেই তা করে থাকে)। ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা ( দুই দিন ধরে)  করে তাকে জানালো, তার ধারনা সঠিক। লাম্প যেটা সে টের পেয়েছে, সেটা ক্যান্সারে পরিনত হয়েছে এবং এটা ফোর্থ স্টেজ এ চলে গেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্রেস্ট রিমুভ করতে হবে, কঠিন কেমোথেরাপী দিতে হবে এবং এর পরেও সে বাঁচবে কিনা তা ডাক্তাররা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবেনা। ক্যাথি অনেকটাই পাগলের মত বাড়ী ফিরে যায়। বাড়ীতে তার প্রিয়জনদের মুখের দিকে তাকায় আর বুক ঠেলে কান্না বের হয়ে আসে। আড়ালে কাঁদে, ঘর সংসারের দিকে তাকিয়ে বুক ভেঙ্গে যায়। ক্যাথি স্বামী বা সন্তান কাউকেই বলতে পারেনি তার এই অবস্থার কথা। ডাক্তারের কাছে অপারেশান করতে যাওয়ার আগে সবাইকে বলে গেছে যে সে কিছুদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছে।

ডাক্তারের কাছে এসে সে নিজ দায়িত্বে অপারেশান করানোর কথা বলে। অপারেশানের পরে যেনো তার স্বজনদের খবর দেয়া হয়, এমন কথা নিয়ে সে অপারেশান টেবিলে যায়। অপারেশান ভালোভাবেই হয়, এরমধ্যেই তার স্বজনেরা খবর পেয়ে যায়। তারপর তাকে কেমোও দেয়া হয়। বাকীটুকু বলা বাহুল্য, দুই ব্রেস্ট হারিয়ে , ক্যান্সার নির্মূল করে সে আমাদের মাঝে এসেছে বক্তব্য রাখতে। কারো কোন প্রশ্ন আছে কিনা জানতে চাওয়ায় অনেকের সাথে আমিও হাত তুলেছি।

ক্যাথীর কাছে আমার প্রশ্ন ছিল, " তোমাদের দেশে রোগীকে জানিয়ে দেয়া হয় তার রোগ সম্পর্কে। ক্যানসার যে মরণ ব্যাধি, তা আমরা সকলেই জানি। তোমাকে যখন জানানো হলো, তোমার ক্যানসার,  তুমি অনেক কেঁদেছো গোপনে। বলেছ স্বজনদের দিকে তাকিয়ে তোমার মনে হয়েছে সবাই থাকবে, শুধু তুমি থাকবেনা।  মৃত্যুভয়ে তুমি অস্থির হয়েছো। ঈশ্বরের কৃপায় তুমি বেঁচে গেছো। আমারও খুব ভালো লাগছে তোমাকে এখানে দেখতে পেয়ে। আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। এখানে কেনো রোগীকে জানিয়ে দেয়া হয়, যদি রোগটা হয় ক্যানসার। ক্যানসার ফোর্থ স্টেজে চলে যাওয়া মানেই শতকরা পাঁচ ভাগ বাঁচার সম্ভাবনা। যে রোগী কিছুদিন পরেই মারা যাচ্ছে, তাকে ক্যানসারের কথা জানানো মানেই মৃত্যুটাকে তরান্বিত করা। জীবনের শেষ কয়েকটা দিন খুবই মনোকষ্টে থাকা। ধরে নিলাম চিকিৎসার সুবিধার্থেই রুগীকে ক্যানসারের কথা বলা হয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ক্যানসার না বলে  কি অন্যভাবে বলা যায়না?   অনেক ক্ষেত্রে রোগী যদি বুঝতেও পারে তার ক্যানসার হয়েছে, তবুও ডাক্তার যদি বলে যে এটা ক্যানসার নয়, এক ধরনের কঠিন ইনফেকশান যা কিনা রেডিও থেরাপী বা কেমো থেরাপী দিয়ে সারানো যায়।  আমি বিশ্বাস করি রোগী এতে করে মানসিক বল অনেক বেশী ফিরে পাবে, তার চিকিৎসা করা অনেক সহজ হবে এবং চিকিৎসায় সুফলও আসবে।  আর কিছু না হোক অন্ততঃ মৃত্যুর আগের কয়েকটা দিন রোগীকে মৃত্যু ভয় গ্রাস করবেনা"।

এটা আসলে আমার প্রশ্ন ছিলনা। নিজেই প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দেয়ার মত। পিন পতন নীরবতায় সকলেই সকলের কথা শোনে। আমার কথা শুনে ক্যাথীর চেহারায় একটু পরিবর্তন দেখলাম। সে শুধু বললো, " তোমার ভাবনার সাথে আমিও একমত। তবে এদেশে এটাই রীতি, চিকিৎসা বলো, অথবা অন্য যে কোন পেশা বলো, নিজেকে স্বচ্ছ রাখাটা কাজের একটি অঙ্গ। তবে ক্যানসারের রুগীর ব্যাপারে তুমি যে মূল্যবান মতামত দিলে আমি তা পূর্ণ সমর্থন করি। কারন আমাকে এর ভেতর দিয়ে আসতে হয়েছে।"

গত বছর হুমায়ুন আহমেদের ক্যানসার ধরা পড়লো, উনাকে জানানো হলো উনার শারীরিক অবস্থার কথা। উনাকে না জানানো হলেও উনার মত জ্ঞাণী মানুষ ঠিকই বুঝতে পারতেন। তবে ক্যানসার ফোর্থ স্টেজে চলে গেছে না জানালেই ভালো হতো। সেকেন্ড স্টেজে আছে বলেও যদি চিকিৎসা করা হতো, উনার নিশচয়ই মনের জোর আরও বেশী থাকতো। উনি শেষের দিকের এক সাক্ষাৎকারে যদিও বলেছেন যে মৃত্যু নিয়ে উনি বিচলিত নন, তারপরেও উনি প্রায় প্রতিদিন কাঁদতেন ( দৈনিক আমাদের সময়ে 'গাজী কাশেমের' লেখাতে আছে)। কেনো কাঁদতেন উনি? নিশচয়ই দুই শিশু পুত্রের দিকে তাকিয়ে ভাবতেন, কিছুদিন পরে এদের ছেড়ে কোথায় চলে যাবো কে জানে! মরন যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে একসময় শাওনের নাম ধরে ডেকেওছিলেন, " কুসুম আমাকে বাড়ী নিয়ে যাও, এরা আমাকে মেরে ফেলবে" বলে। মুখে বললেও মৃত্যুকে কে পারে সহজে মেনে নিতে? মাঝখান থেকে জীবনের শেষের দিনগুলো কতই না মনোকষ্টে কেটেছে উনার।

 আমার দেশের অনেক কিছুই এখনও পুরানো দিনের ধ্যান ধারনায় চলছে। উঠতে বসতে আমাদের দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে গাল-মন্দ করি। কথায় কথায় আমেরিকা ইউরোপের নানা দেশের রেফারেন্স টেনে কথা বলি। একেক সময় মনে হয়, আমাদের দেশের রাষ্ট্র, সমাজ সর্বত্র আমূল পরিবর্তন না আনলে বুঝি আর চলেনা। পরিবর্তন একেবারেই আসছেনা সেটাও পুরোপুরি সত্যি নয়। আমাদের দেশটাও অনেক দিক দিয়েই এগোচ্ছে, ধীরে ধীরে হলেও। আমি চাই সব দিক দিয়ে এগিয়ে যাক আমার দেশ, শুধু একটা জায়গা বাদ থাকুক। তা হলো আমাদের ইমোশান। বাঙ্গালী ভীষন আবেগপ্রবণ। এই আবেগ অনুভূতিগুলো অপরিবর্তিত থাকুক। ক্যানসারের রুগীকে 'ক্যানসার' হয়েছে জানতে না দেয়ার মধ্যে কতখানি মমতা, ভালোবাসা, আবেগ জড়িয়ে থাকে, তা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্বীকৃতি না পেলেও অসুবিধা নেই।  আধুনিক রাষ্ট্রে থেকে, সকল রকম আধুনিক সুযোগ সুবিধা পেয়েও আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় রুগীকে তার যে কোন অনিরাময়যোগ্য  রোগ সম্পর্কে পূর্ণ তথ্য প্রদান করার আধুনিকতার নিকুচি করি।

Friday, August 24, 2012

তিন প্রজন্মের চোখে বঙ্গবন্ধু







আমার বাবার বয়স ৮৫ বছর। অথচ বয়স এখনও উনাকে কাবু করতে পারেনি। শারীরিকভাবে কিছুটা দূর্বল হলেও চিন্তা চেতনায় যে কোন তরুনকেও হার মানাতে পারেন। চোখে মোটা লেন্সের চশমা এঁটে এখনও নানা বিষয়ের উপর পড়াশোনা চালিয়ে যান। রাজনৈতিক বিষয় হলেতো কোন কথাই নেই।  আমরাও মোটামুটি রাজনীতি সচেতন এবং সচেতনতাটুকু উনার কাছ থেকেই এসেছে। এই বয়সেও বাবা নেহেরু, ইন্দিরা, বংগবন্ধু পড়ে অবসর সময় কাটান। রাজনীতি বলতে উনি বঙ্গবন্ধুকে বুঝেন, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির অন্ধভক্ত। উনার মত বঙ্গবন্ধুভক্ত আমার জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। বাবা কোনভাবেই মানতে রাজী নন যে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পরিচালনায় কোন ভুল থাকতে পারে উনার মতে, রাষ্ট্র পরিচালনায় দুই একটা ভুল হলেও তাঁর গৌরব ম্লান হওয়ার মত ভুল উনি কখনওই করেননি। এই বিশ্বাসে অটল থেকেই উনি  পঁচাত্তর পরবর্তী দুঃসহ সময়টাতেও জোর গলায় সারা পাড়া কাঁপিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা করতেন।  এমন বঙ্গবন্ধুভক্ত পিতার সন্তান হওয়াতেই বোধ হয় বঙ্গবন্ধুপ্রীতি আমার মধ্যেও ছড়িয়ে গেছে।

দ্বিতীয় প্রজন্মে বঙ্গবন্ধুঃ

আমার জীবনে বংগবন্ধুর অস্তিত্ব অন্য সকলের চেয়ে আলাদা। বঙ্গবন্ধুকে আমি সামনা সামনি দেখেছি, মাথায় উনার স্নেহস্পর্শ পেয়েছি। বংগবন্ধু শব্দটি আমার জীবনের প্রেরণাস্বরূপ, সৌভাগ্যের প্রতীক। বঙ্গবন্ধুকে আমি সামনা সামনি দেখেছিলাম '৭৫ এর মাঝামাঝি সময়ে।  আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট দাউদ খান এসেছিলেন বাংলাদেশ সফরে। উনাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু চাঁদপুর বেড়াতে গেছিলেন। প্রেসিডেন্টের সেই সফর উপলক্ষ্যে নারায়নগঞ্জের পাগলা ফেরিঘাট রঙ বেরঙের তিনকোনা পতাকায় সাজানো হয়েছিল। আশেপাশের স্কুলগুলো থেকে ব্লুবার্ড, গার্লস গাইড, স্কাউটদের সাথে কিছু মেধাবী ছাত্রছাত্রীদেরকেও আনা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর অতিথিকে  দাঁড়িয়ে থেকে সম্বর্ধণা জানানোর জন্য। মেধাবী ছাত্রী হিসেবে আমিও সুযোগ পেয়েছিলাম সকলের সাথে দাঁড়ানোর। এখনও যেমন করে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা  জাতীয় পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীদেরকে সম্বর্ধণা দেয়ার জন্য, আমরাও সেদিন দাঁড়িয়েছিলাম ঘন্টার পর ঘন্টা। তবে আমার মনে কোন আক্ষেপ ছিলনা এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম বলে। আমি অপেক্ষা করছিলাম স্বপ্নের মানুষটিকে দেখার জন্য, যাঁর কথা আমার বাবার মুখে প্রতিদিন একবার করে শুনতাম।
সেদিন ভাগ্য আমার সুপ্রসন্ন ছিল। বংগবন্ধু উনার অতিথিকে নিয়ে যখন আমাদের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, কি মনে করে একটু থেমে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, " কি রে দুপুরে কিছু খাইছস"আমি অভিভুত হয়ে গেছিলাম। বঙ্গবন্ধু  আমার মাথায় হাত রেখেছেন, আমি ধন্য হয়ে গেছি।
'৮২ সালের শেষের দিকে আমি যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলামবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ শাখা  থেকে হাতে লেখা ভর্তি গাইড বই বের করা হয়েছিল। তারই একটা আমিও পেয়েছিলাম। গাইড বইয়ের শেষের পাতায় 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' লেখা ছিল। এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল আমার মনমতো হয়নি বলে খুবই আপসেট ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনের মত সাবজেক্টে চান্স পাইনি। সামনে একটাই সুযোগ, জাহাঙ্গীরনগরে কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হতেই হবে। আমি গাইড  বইয়ের 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু'  শ্লোগানটির দিকে তাকাতাম, মনে মনে আওড়াতাম, "বঙ্গবন্ধুর নামে গাইড বই পড়ছি, আমাকে এখানে চান্স পেতেই হবে'  ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে মেধা তালিকায় প্রথম তিনজনের মধ্যে স্থাণ পেয়েছিলাম।
আমি আগে কখনওই পত্রপত্রিকায় লেখালিখি করিনি। কিনতু গত বছরের  আগস্ট মাসেই বন্ধু পীর হাবীবুরহমানের অনুপ্রেরনায় বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় একটি লেখা পাঠিয়েছিলামজীবনের প্রথম লেখাটি ছোটবেলায় বঙ্গবন্ধুকে দেখার স্মৃতি থেকে লিখেছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখাটি ছাপা হয়েছিল খুব সম্ভব ১৮ই আগস্টের বাংলাদেশ প্রতিদিনের ‘খোলা কলমে  এরপর  থেকে আমি নিয়মিত লিখছি। আমার এই লেখকসত্তা বিকাশের সূচনাতে বঙ্গবন্ধুই আছেন ‘শুভ সূচনা’ প্রতীক হয়ে।

 তৃতীয় প্রজন্মে বঙ্গবন্ধুঃ

৯৪ সালের ১৫ ই আগস্টের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নাম্বার বাড়ীটি 'বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর' হিসেবে জনসাধারনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা (মাননীয় প্রধান মন্ত্রী) ও শেখ রেহানা একমত হয়ে জাতির পিতার স্মৃতিবহুল বাড়ীটি জাতির জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে যোগ্য বাবার যোগ্য সন্তানের মত কাজ করেছেন। দেশের জনগন এই দু'বোনের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে আজীবন।
৯৪ সালের এক বিকেলে পারিবারিক বন্ধু শিখা বৌদির সাথে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর দেখতে। সাথে নিয়ে গেলাম ৭ বছরের মেয়ে  মৌটুসী(ঋত্বিকা)কে। ছোটবেলা থেকেই মৌটুসী খুব ধীর-স্থির  স্বভাবের, সব সময় নিজস্ব ভাবনার জগতেই থাকে। ৯৪ সালে আমার মেয়ে ঢাকা ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ত। ওকে সাথে নিয়ে ৩২ নাম্বার বাড়ীতে পৌঁছে শুরুতেই আমি কেমন যেনো আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। বাড়িটির প্রতিটি ধূলিকনাতেও যেনো বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি টের পাচ্ছিলাম। প্রতিটি রুম ঘুরে দেখি আর চোখের জলে ভাসি।
মৌটুসী আমার হাত ধরে ধরে হাঁটে আর দেয়ালের প্রতিটি ক্যাপশা পড়ে। হঠাৎ করেই ও আমাকে প্রশ্ন করে, " মামণি, শেখ রাসেলতো অনেক ছোট ছিল, আমার সমান ছিল। ওকে মেরে ফেলেছে কেনো"র এমন প্রশ্নে আমি অবাক না হলেও আমাদের কাছাকাছি দর্শণার্থীরা অবাক হয়েছিল। এক ভদ্রলোক বলেই ফেললেন, " তোমার যতটুকু বুদ্ধি আছে, অতটুকু বুদ্ধিও যদি ঐ জানোয়ারদের থাকতো তাহলে শেখ রাসেলকে মারতোনা"। আরেক ভদ্রলোক আমাকে বললেন, " এত ছোট বাচ্চাকে সাথে না আনলেই ভালো করতেন। বাচ্চাটার মনে একটা খারাপ দাগ কেটে গেলো"। আমি শুধু বলতে পারলাম, " আমার মেয়ে খারাপ ভালো চিনেই বড় হোক, এটাই আমি চাই"।
বঙ্গবন্ধু যাদুঘর উন্মুক্ত হওয়ার পরে বেশ কিছুদিন দর্শণার্থীদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার জন্য বিরাট বড় বাঁধানো খাতা রাখা হয়েছিল। যাদুঘর প্রদক্ষীণ শেষে ঐ খাতায় অনেককেই লিখতে দেখলাম। এই শোকপুরী ঘুরে দেখে ছোট্ট মৌটুসী কী বুঝলো তা পরখ করে দেখার জন্য ওকে বললাম, " মামনি,  বঙ্গবন্ধু যাদুঘর ঘুরে দেখে সবাই নিজেদের মতামত ঐ খাতায় লিখছে,  আমি চাই তুমিও তোমার মতামত এই খাতায় লিখে যাও। তোমার লেখা এই খাতায় থাকবে সারাজীবন"। মৌটুসী খুব সুন্দর করে গোটা গোটা অক্ষরে লিখল, " শেখ রাসেলতো ছোট ছিল, ওকে মেরেছে কেন"? নীচে ওর বয়স, স্কুলের নাম লিখে দিয়ে চলে এলো।
পরের দিন মৌটুসীর লেখা সেই ছোট্ট কমেন্টটি দৈনিক আজকের কাগজেবঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘর’ ফলোআপের শিরোনাম হয়ে গেল '৯৪ সালে দৈনিক 'আজকের কাগজ' খুবই জনপ্রিয় পত্রিকা ছিল। বহুল প্রচারিত দৈনিকে " ছোট্ট ঋত্বিকার প্রশ্ন, শেখ রাসেলতো ছোট ছিল, ওকে মেরেছে কেনো"শিরোনামে বিরাট বক্স নিউজ হয়েছে দেখে আমি যারপরনেই খুশী হয়েছিলাম। সংবাদটির দিকে তাকিয়ে আমার একটাই অনুভূতি হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু আমার অস্তিত্বে মিশে আছে। ছোটবেলা বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধণা জানাতে শত শত ছেলে মেয়ের সাথে আমিও উপস্থিত হয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধু সবাইকে বাদ দিয়ে আমার মাথায় হাত রেখে জানতে চেয়েছিলেন, দুপুরে কিছু খেয়েছি কিনা! আর এবার কতজনেই মন্তব্য খাতায় মন্তব্য লিখেছে, সবারটা বাদ দিয়ে শুধু মৌটুসীর মন্তব্যটাই এতবড় সংবাদের ক্যাপশান হয়ে গেলো!এরপরে মৌটুসী অনেক বড় হয়েছে,  বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এখন ও অনেক কিছু জানে, বঙ্গবন্ধুর কথা উঠলেই  এখনও  মৌটুসীর মানসপটে সেদিনের স্মৃতি ভেসে উঠে।
আমার দ্বিতীয় মেয়ে মিশা ছোটবেলা থেকেই বিদেশের মাটিতে বড় হচ্ছে। দেশ সম্পর্কে ওর কতটুকু ধারণা আছে সেটা আমার জানা ছিলনা। ওর কলেজ স্কলারশীপ ইন্টারভিউতে আফ্রিকান এক প্রফেসার ওকে আচমকাই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল। আমাকে অবাক করে দিয়ে মিশা উত্তরে বলেছিল, “ খুব সংক্ষেপে বলি, বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা। বাঙ্গালী জাতির মুক্তির জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি। যদিও কিছু বিশ্বাসঘাতকের হাতে উনাকে জীবন দিতে হয়েছে, তারপরেও উনিই বাঙ্গালী জাতির মুক্তিদূত”। প্রফেসার খুবই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন মিশার উত্তর শুনে। আমি নিজেও অভিভূত হয়েছি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মিশার দৃষ্টিভংগী দেখে।
১২ বছরের মেয়ে মিথীলা জন্মের পর থেকেই আমেরিকাতে বড় হচ্ছে। দুই বছর আগে মিথীলাকে নিয়ে ৩২ নাম্বারের বাড়ীতে গেছিলাম। ঊদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকে চেনানো। সেদিনের দেখায় মিথীলা কতটুকু চিনেছিল তা পরখ করে দেখার সুযোগ হয়নি এতোদিন। এ বছর দেশে গিয়ে মিথীলাকে নিয়ে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে গেছিলাম। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার মুখেই তিনকোনা ডিজাইনের একটি স্থাপত্য শোভা পাচ্ছে যার প্রথমটিতে বংগবন্ধুর মুখচ্ছবি খোদাই করে অংকিত আছে। কিছু না ভেবেই আমি মিথীলাকে জিজ্ঞেস করলাম, " মিথীলা বলতো এটা কার ছবি"?
মিথীলার জবাবঃ "শেখ মুজিবুর রহমান"।
আমিঃ " নামের আগে বংগবন্ধু বলতে হয়। তুমি কি জানো উনি কে ছিলেন"?
মিথীলাঃ " ঐ যে ফ্রীডম ফাইটের লীডার, মানে মেইন লীডার ছিল"।
আমি ভেতরে ভেতরে খুশীতে ফুটতে শুরু করেছি। আরেক ধাপ এগিয়ে প্রশ্ন করলাম, " আচ্ছা একটু বুঝিয়ে বলো, ধরো আমেরিকার কোন লীডারের সাথে বংগবন্ধুকে তুলনা করা যায়"?
মিথীলার চটপট উত্তরঃ মার্টিন লুথার কিং"।
আমি খুবই খুশী হয়েছি আমাদের তৃতীয় প্রজন্মের সর্ব কনিষ্ঠ সদস্যটি সঠিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করতে পেরেছে দেখে। আমেরিকার জল-হাওয়ায় বেড়ে উঠা বারো বছরের মিথীলার পক্ষে বঙ্গবন্ধুকে জানা খুবই কঠিন ব্যাপার। তারপরেও দুই বছর আগে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’ ঘুরে ফিরে দেখে মিথীলা যে পাঠটুকু নিয়েছে, আমি চমৎকৃত না হয়ে পারিনি। ওকে বললাম, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার যেমনি করে নিপীড়িত কালো জনগোষ্ঠির মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, একইভাবেই বংগবন্ধুও পরাধীন বাঙ্গালী জাতির মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। দুজনের সংগ্রামই সফল হয়েছে। কালো জনগোষ্ঠী যেমনি করে আমেরিকায় বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সমান অধিকার পেয়েছে, বাঙ্গালীও নিজের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছে। এরপর মিথীলাই যোগ করে দিল, “ কিনতু দুজনকেই খারাপ লোকেরা মেরে ফেলেছে”। আমি ওর সাথে একমত হলাম, “ অবশ্যই ওরা খারাপ লোক ছিল, সেজন্যই নিজেদের নেতাকে হত্যা করতে পেরেছে। ভালো লোক হলে এটা করতে পারতোনা”।  






বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আমাদের ঘরে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ শোনা নিষিদ্ধ ছিল

রুমানার সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছিল তিন বছর আগে।, মিসিসিপিতে। বাংলাদেশের মেয়ে রুমানা মিসিসিপি স্টেট ইউনিভারসিটিতে উচ্চশিক্ষা নিতে এসেছিল। এবছর রুমানার বিয়েতে গিয়ে ওর বড় ফুফুর সাথে পরিচয় হয়।। মাঝবয়সী ভদ্রমহিলাকে দেখলেই খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে হয়। রুমানার বাবা-মায়ের সাথে আগেই আমার পরিচয় ছিল। আমাকে ফুফুর সাথে পরিচয় করানো হয় এই বলে, “ ইনিই সেই লেখিকা, যিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারন করে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় লিখেছিলেন”। নতুন পরিচয়ে এমন ভূমিকা শুনে আমি খুবই লজ্জা পাচ্ছিলাম। আমাকে লজ্জা পেতে দেখে রুমানার ফুফু বললেন, “ লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আপনার লেখাটি আমি পড়েছিলাম। ভালো লেগেছে। আপনি বঙ্গবন্ধুর  স্পর্শ পেয়েছেন, লেখার ক্ষমতা আছে বলে লিখেছেন। আমিতো কত কিছুই লিখতে পারতাম, কিনতু কিকছুই লিখে গেলামনা। বঙ্গবন্ধু অমনই ছিলেন, সবার জন্য মায়া। আমাকে দেখলেই বলতেন, “ মাগো, বিয়ার পরও পড়াশুনা করবা। পড়াশুনা ছাড়বা না”।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ আপা আপনি বঙ্গবন্ধুকে এতবার দেখলেন কিভাবে”?
উনি বললেন, “ বঙ্গবন্ধু কতবার আমাদের বাড়ীতে আসছে! আমার আব্বা পাকিস্তান আমল থেকেই তিনবারের এমপি। নোয়াখালিতে আসলে বঙ্গবন্ধু আমাদের বাড়ীতে আসতেন”।
বললাম, “ আরে! আপনারা তো দেখি দারুন ভাগ্যবান। রুমানার আব্বু তো কিছুই বলেননি”।
উনি বললেন, “ আমরা কখনও কোথাও আমাদের গল্প করিনা। আমার ভাই আজ কত কিছুই করতে পারতো বাবার পরিচয় ভাঙ্গাইয়া, বঙ্গবন্ধুর পরিচয় দিয়া, কিনতু আমরা এসবের কিছুই করি নাই”।
রুমানার ফুফুকে দেখে আমার মনটা ভরে গেছে। ভদ্রমহিলার ছেলেমেয়েরা সবাই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছে। পুরো পরিবারটি দারুন সংস্কৃতিমনা। এখনও পরম শ্রদ্ধায় বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারন করে আছেন, কোন ঢাক ঢোল পিটাননা, অথচ বঙ্গবন্ধুকে কত কাছে থেকে এঁরা দেখেছেন।

বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারন করে আছেন আরেকজন, আমার বাবা। বঙ্গবন্ধুর এমন একনিষ্ঠ ভক্ত আমি দ্বিতীয়টি আর দেখিনি। আমাদের ছোটবেলা থেকেই ছকে বাঁধা কিছু নিয়ম চালু ছিল। যেমন সকাল সাতটা বাজলে ‘বাংলাদেশ বেতার ঢাকা’ স্টেশান অন হয়ে যেত, সকালের খবর শোনার জন্য। সকাল সাতটার খবর আরম্ভ হলেই আমি ঘুম থেকে উঠতাম। বঙ্গবন্ধুকে যেদিন হত্যা করা হলো, বাংলাদেশ বেতারে সকাল সাতটার খবর প্রচারের বদলে “ আমি মেজর ডালিম বলছি-----শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে” প্রচারিত হতে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার বাবা বেশ কিছুক্ষন হতভম্ব হয়েছিলেন। এক সময় রেডিও বন্ধ করে দেন। এরপর ‘বাংলাদেশ বেতার’ পালটে ‘রেডিও পাকিস্তানে’র আদলে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ করা হলো, কিনতু আমাদের ঘরে ঢাকা স্টেশান আর অন করাই গেলোনা। যেদিন রেডিও বাংলাদেশ বদলে আবার ‘বাংলাদেশ বেতার’ চালু হলো, আমার বাবা ঢাকা স্টেশানে আবার সকাল সাতটার সংবাদ শুনতে আরম্ভ করলেন।

বংগবন্ধুর মৃত্যুর পরে অনেকদিন, অনেক বছর, এমনকি এখনও অনেককেই বলতে শুনি, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে দেশের কেউ কাঁদেনি। এমন কথা শুনলে সব সময়ই আমি আসর ছেড়ে উঠে যাই। অরুচীকর কোন কখা্র মধ্যে আমি থাকিনা। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে কেউ কাঁদেনি শুনলেই আমার মনে পড়ে যায় সেদিনের সকালের কথা।

নারায়নগঞ্জে শহরে আমরা থাকতাম। নারায়নগঞ্জ শহরের যে পাড়াতে আমরা থাকতাম, সেই পাড়াটি একসময় হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। আমরা যে বাড়ীতে ভাড়া থাকতাম, সে বাড়ীর মালিক ছিলেন হাজী সাহেব। হাজী সাহেবের ১৮ ঘর ভাড়াটিয়ার মধ্যে একঘর মাত্র মুসলিম পরিবার ছিল। বাকী সবাই হিন্দু। তবে হিন্দু অধ্যুষিত পাড়া হলেও আমাদের পাড়ায় হিন্দু মুসলমানের সম্পর্ক ছিল পরম আত্মীয়ের মত। আমাদের বাড়ীওয়ালা ও সেই একঘর মুসলিম ভাড়াটের সাথে আমাদের নিত্যদিন একসাথে উঠাবসা সম্পর্ক ছিল। মুসলিম ভাড়াটে চাচা ছিলেন পেশায় ডাক্তার। উনার বাড়ীতে উনারই দূর সম্পর্কের আত্মীয় থাকতো, যাকে আমরা সবাই ‘জামাল ভাই’ বলে ডাকতাম।

আমাদের ঐ বাড়ীর ভাড়াটিয়াদের রুটিনমাফিক একটি কাজ ছিল, তা হলো সকাল সাড়ে ছয়টা বাজলে সব মহিলারা সাপ্লাইয়ের জল নেওয়ার জন্য কলতলায় হাজির হতো। সেই কলতলা থেকে রাস্তা দেখা যেত। ১৫ই আগস্টের সকালে সব মাসীমারা কলতলায় বসে  পালা করে কলসী, বালতিতে সাপ্লাইয়ের জল ভরছিল। হঠাৎ করেই রাস্তা থেকে আমার মেজদা চীৎকার করে ‘ সবাই শোন, বঙ্গবন্ধুকে মাইরা ফেলছে’ বলতে বলতে দৌড়ে আসছিল। মেজদার বয়স ১৪ পূর্ণ হয়নি, সতীশ স্যারের কাছে গ্রুপে পড়তে গিয়ে এমন খবর শুনে পড়া ফেলে দৌড়ে বাড়ী চলে এসেছে।
মেজদা খুবই হাঁফাচ্ছিল। মেজদার মুখ থেকে এমন খবর শুনে কেউ বিশ্বাস করেনি। মহিলাদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হতেই পাশের ঘরে রেডিও অন করে “আমি মেজর ডালিম বলছি” শোনা গেল। আমি তখন বেশ ছোট। ঘোষণার অনেক কথাই মনে নেই শুধু ‘আমি মেজর ডালিম বলছি, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে’ ছাড়া। ততক্ষণে সবার বাড়ীতে রেডিও অন হলো, ভাবখানা এমন যেনো একেক রেডিওতে একেক রকম ঘোষণা আসবে। এক ঘন্টার মধ্যে সমস্ত আমলাপাড়া স্তব্ধ হয়ে গেলো। এমনকি কাকের কা কা পর্যন্ত শোনা গেলোনা।

ঘরে আমার বাবা শুধু একটা কথাই বলছিলেন, “ এইটা কী হইল, কী সব্বনাশ হইয়া গেলো। এইটা কয় কি, পুরা পরিবাররে মাইরা ফালাইছে! মানুষ কেমনে এমুন জালিম হইতে পারে”! আমার কেবলই দুই তিন মাস আগের কথা মনে পড়ছিল। বংগবন্ধু আমার মাথায় হাত রেখেছিলেন। এইবার আমার মা কথা বললেন। মা হাই স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। মানুষের চরিত্র ভালো বুঝতেন। আমাদের সবাইকে মা আস্তে কথা বলতে বললেন। উনি আঁচ করতে পেরেছিলেন, এতো বড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর, এর জের যে কারো উপর আসতে পারে। বিশেষ করে আমার বাবা নীচু স্বরে কখনও কথা বলতে পারেননা, উনি অনেক রাগী এবং ডিসিপ্লিন্ড স্বভাবের মানুষ। উলটা পালটা কিছু দেখলে পাড়ার ছেলে ছোকরাদেরও শাসন করতে ছাড়তেন না। মায়ের ভয় ধরে গেল, এখন এমনই একটা অরাজকতা শুরু হতে পারে, যার সুযোগ নিতে পারে অন্য যে কেউ। মায়ের কথায় আমরা সবাই মুখে তালা আঁটলাম, আর বাবা শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলো।

সেদিন বিকেলবেলাতেই ঐ ডাক্তার চাচার আত্মীয় ‘জামাল ভাই’ দুই হাতে করে চারটা মুরগী নিয়ে এসেছিল বাজার থেকে। আমাদের সকলের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলছিল, “ আজকে মুরগী জবাই হবে”। জামাল ভাই জানতেও পারেনি, তার দিকে সকলে কেমন ঘৃণার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিল।
আমাদের ঘরে রেডিও বন্ধ হয়ে গেলেও পাশের বাড়ীতে রেডিও চলতো। খান আতাউর রহমান তখন অতি উচ্ছ্বাসে একটি গান রচনা করে নিজেই তাতে সুর বসিয়ে কোরাসে গাইয়েছিলেন। গানটির কথা আমার মনে নেই, শুধু “নিপীড়িত জনতা, কোথায় সে নিপীড়িত জনতা” কথাটুকু মনে আছে। গানটির মূল বাণী ছিল, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে দেশ এক মহাবিপদের থেকে মুক্ত হলো, জনগনের জয় হলো। যেই ঘরে রেডিও বাজতো, সেই ঘরের মেসো ছিলেন খুবই অমায়িক, কথা বলতেন শুদ্ধ বাংলায়। উনাকে কখনও মুখ খারাপ করতে শুনিনি। একদিন ঐ মেসো “কোথায় সে নিপীড়িত জনতা’ বলার সাথে সাথে জোরে জোরে বলে উঠেছিল, “নিপীড়িত জনতা আমার বগলের তলে”। সারা বাড়ীর মানুষ সেদিন শুনেছিল মেসোর কথা। কী যে রাগে ফাটছিলেন উনি, সেই ছবি এখনও আমার মনে ভাসে।

আর আমার বাবার প্রতিবাদ ছিল অন্যরকম। আমাদের বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশ বেতার পালটে রেডিও বাংলাদেশ করা হইছে। যতদিন রেডিও বাংলাদেশ থাকবো, ততদিন আমার ঘরে ঢাকা স্টেশান কেউ চালাইতে পারবা না”। ৯১ সালের আগে কোন ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে যায় নাই”। ঐ জামাল ভাইয়ের সাথে আমাদের কথা বলতে মানা করে দিছিলেন।  বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরেই আমাদের পাড়ার পরিবেশ আস্তে আস্তে পালটাতে শুরু করে। চেনা মানুষকেও অচেনা লাগতো। পারস্পরিক বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ববোধেও যেনো টান ধরতে থাকে। এতকিছুর পরেও আমার বাবার গলার জোর কমেনি। অমন দুঃসহ সময়ের মধ্যেও বাবা ঠিকই বংগবন্ধুর খুনীদের ঊদ্দেশ্যে বাতাসে হুঙ্কার ছুঁড়ে দিতেন। খুনীরা না শুনুক এই খুনকে যারা সমর্থণ করেছে তারা শুনেছে আমার বাবার হুঙ্কার। বাবার ধারনা, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে যারা খুশী হয়েছে, তারাতো জানবে এখনও আমলাপাড়ার একটি ঘরে নির্ভয় প্রতিবাদী কন্ঠ এখনও গর্জে উঠে।



Tuesday, August 21, 2012

প্রবাসে ঘরোয়া আড্ডা--১


আমেরিকা নামের  বিশাল দেশের পঞ্চাশটি রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে গরীব রাজ্যটির নাম 'মিসিসিপি'। আমেরিকার দক্ষিণী রাজ্যগুলোর একটি হচ্ছে মিসিসিপি, যা মিসিসিপি নদীর পাড়ে অবস্থিত। আমরা গত আট বছর ধরে মিসিসিপিতে আছি। এখানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামীর অধ্যাপনার সূত্রেই আমাদের এই রাজ্যে বসবাস। এর আগে আমরা তিন বছর কাটিয়ে এসেছি ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া নামের পাহাড়ঘেরা রাজ্যে, যেখানে প্রকৃতি নিজেই সুন্দর সাজে সেজে থাকে। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার মত এমন সুন্দর রাজ্য আমি এর আগে আর কোথাও দেখিনি। তবে মিসিসিপিতে যেমন কালো মানুষের সংখ্যা অনেক বেশী, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে ছিল সাদা মানুষের সংখ্যা অনেক বেশী। দুই রাজ্যে থেকেই আমার নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে এবং এখনও নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে একটাই সমস্যা ছিল, তা হলো আশেপাশে দুই একটা বাঙ্গালী পরিবার ছাড়া আর কোন বাঙ্গালী ছিলনা।

২০০৪ সালে চলে আসি মিসিসিপিতে। এখানে অবশ্য বাঙ্গালীর সংখ্যা  কম হলেও ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার তুলনায় অনেক বেশী। তবে আমি কলম্বাস নামের যে শহরে আছি, সেখানে আমরাই একমাত্র বাংগালী। আমাদের শহর থেকে পঁচিশ বা ত্রিশ মাইল দূরে স্টার্কভিল নামে আরেকটি শহর, ঐ শহরটিতে মিসিসিপি স্টেট ইউনিভারসিটি অবস্থিত বলে এপার বাংলা ওপার বাংলা মিলিয়ে বাঙ্গালী স্টুডেন্ট আছে, সব মিলিয়ে  সতের আঠারো জনের মত। আর বাঙ্গালী পরিবার আছে তিনটি, তারা আবার ওপার বাংলার।


 মিসিসিপির রাজধানী শহর হচ্ছে জ্যাকসান। জ্যাকসানে এপার বাংলা ওপার বাংলা মিলিয়ে বেশ কিছু বাঙ্গালী পরিবার আছে। কিছু স্টুডেন্টও আছে। স্টার্কভিল ও জ্যাকসানে বিবাহিত স্টুডেন্টের সংখ্যাই বেশী। অনেক ছেলে মেয়ে উচ্চশিক্ষার্থে আমেরিকা আসার আগ মুহূর্তে তাদের বাবা মা ছেলে মেয়েদের নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে বিয়ে দিয়ে দেন। কিছুদিনের ব্যবধানে প্রত্যেকেই তার জীবন সঙ্গীকে আমেরিকা নিয়ে আসে এবং পড়ালেখার পাশাপাশি সংসার ধর্মও পালন করে।

বাঙ্গালীর সংখ্যা কম বলে মিসিসিপিতে স্টুডেন্টদের সাথে পরিবারগুলোর বেশ সহজ মেলামেশা হয়ে থাকে। পারিবারিক আড্ডায় স্টুডেন্টদেরকে নিমন্ত্রণ করা হয়, আবার স্টুডেন্টরাও নিজেদের ছোট্ট এপার্টমেন্টে বাঙ্গালী পরিবারের আঙ্কেল আন্টিদেরকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ায়। যে কোন তরফ থেকেই নিমন্ত্রণ হোক না কেনো, খাওয়া দাওয়ার পাশাপাশি 'আড্ডা' টাই মুখ্য হয়ে উঠে। মাসে বা দুই মাসে কারো না কারো জন্মদিন থাকে, অথবা বিবাহবার্ষিকী, নাহলে কোন একটা উপলক্ষ্য বানিয়ে নিলেই চলে। আড্ডা চলে একটানা তিন চার ঘন্টা। আড্ডা দুই ভাগে হয়। মহিলারা চলে যায় ভেতরের ঘরে, আর পুরুষেরা থাকে বসার ঘরে। আলোচনার বিষয়বস্তু শ্রেণীমতে নির্ধারিত হয়ে থাকে। মহিলাদের আসরে সাধারণতঃ মেয়েলী গল্প বেশী প্রাধান্য পায়। ছেলেদের আসরে আমেরিকার রাজনীতি, শেয়ার মার্কেট, আমেরিকান ফুটবল, সকার আলোচনা শেষে বাংলাদেশের রাজনীতি প্রসংগ  আসে।

আমি দুই আড্ডাতেই থাকি। একবার মেয়েলী আড্ডায়, আরেকবার 'ছেলেলী'  আড্ডায়। মেয়েলী আড্ডায় যখন শাড়ী গয়না নিয়ে কথা উঠে, আমি তখন আস্তে করে কেটে পড়ি। শাড়ী গয়নার ব্যাপারে আমি খুবই অজ্ঞ। সিল্কের শাড়ী আমার কাছে সবই একরকম মনে হয়। কিনতু এই সিল্কের শাড়ীরও কতরকম নাম আছে তা আমার ধারনার অতীত। তাই কোন মন্তব্য করতে পারিনা। আর গয়না? ছোটবেলা থেকেই সোনা গয়নার প্রতি এক ধরনের বিকর্ষণ বোধ করি। কেন এমন হয়, তা অবশ্য আমি জানিনা। হয়তো সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে মায়ের হাতে বা গলায় শাঁখা পলা, ব্রোঞ্জের চুড়ি ছাড়া আর কিছু দেখিনি বলেই সোনাদানার প্রতি ইন্টারেস্ট জন্মেনি।  মেয়েদের আড্ডায় যখন 'ভরি' ভরি' সোনার বিস্কুট কেনার গল্প শুনি তখন নিজেকে বোকা বোকা মনে হয়। তখনই  চলে যাই ছেলেলী আড্ডায়। ওখানে আমেরিকান রাজনীতি নিয়ে নতুন কিছু শুনি।  ওবামা ছেড়ে যখন  আমেরিকান ফুটবল, সকার নিয়ে কথা উঠে, আবার ওখান থেকে কেটে এসে যোগ দেই মেয়েলী আড্ডায়। শাড়ী গয়নার গল্প যদি তখনও চলতে থাকে আমিই হয়তো শাড়ী প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে গল্প রান্নার দিকে নিয়ে যাই। রান্নাবান্নাও মেয়েদের কাছে খুব প্রিয় একটা বিষয়। আমি নিজে খুব পছন্দ করি নতুন নতুন রান্না শিখতে।

অস্ট্রেলিয়া , আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে  ঘুরে একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, আড্ডায় বেশীর ভাগ মহিলাই কাউকে 'রান্নার রেসিপি' দিতে চায়না। কোন একটা খাবার কারো কাছে খুব ভালো লাগলে স্বাভাবিকভাবেই রাঁধুনীকে জিজ্ঞেস করে কিভাবে রান্না করেছে। সেই 'অতি চমৎকার রাঁধুনী' টি এইবেলাতে খুবই অচমৎকার আচরণ করে থাকেন। প্রশ্নের জবাবে বেশীর ভাগ সময় উত্তর পাওয়া যায়, " এইতো সোজা আছে, পরে বলবো নে। ফোন কইরেন" নাহলে  বলবে, " ইশ! এত কষ্ট কইরা রাঁধছি, এত সহজ না, অনেক কারিগরি আছে, সব কথা বললেও বুঝবেন না" নাহলে বলবে, " এইতো চিকেনটারে ভালো কইরা কাটাকুটি কইরা মশল্লা মাখাবেন, তারপর আন্দাজমত তেল দিয়া চুলায় চড়াইয়া দিবেন"। কোন কোন মশলা দিয়েছেন প্রশ্নের উত্তরে বলবে, " সবই দিছি। নিজের আন্দাজমত দিবেন"। বুঝা যায় তাঁদের রেসিপি বলার ইচ্ছে নেই, তারপরেই কিছু নাছোড়বান্দা প্রশ্নকারীনিকে বাধ্য হয়েই বলতে হয়, ' ফোন কইরেন, তখন ভাল কইরা বলে দেব"। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, বিদেশে অনেক ছেলেরাও ভালো রান্না করে। রেসিপি বলার ব্যাপারে মেয়েরা কঞ্জুস হলেও ছেলেরা খুব নিখুঁতভাবে রেসিপি বলে দেয়। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণে যখন ছিলাম, এক দাদার (ডঃ সজল পালিত)  কাছ থেকে 'চমচম' বানানোর কায়দা শিখে এসেছিলাম। উনি এত পরিষ্কারভাবে আমাকে পদ্ধতি বলে দিয়েছিলেলেন যে অনেক বছর পরে আমেরিকা এসেও চমচম বানাতে এতটুকুও অসুবিধা হয়না। অবশ্য আমেরিকাতে এসে আরেক বড় ভাই শ্রেণীর রাঁধুনীকে পেয়েছি, উনার রান্না খুবই ভালো। কিনতু রেসিপি দেয়ার ব্যাপারে উনি মেয়েদের চেয়েও বড় কঞ্জুস। মেয়েরা তবুও রেসিপির অনেকটাই বলে দেয়, বুদ্ধিমতীরা বাকীটুকু নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়ে চালিয়ে নেয়, কিনতু এই বড় ভাই রেঁধে রেঁধে সবাইকে খাওয়াবেন, রেসিপির এক অক্ষরও বলবেননা।

ছেলেদের আড্ডাতে অবশ্য উলটো। গোপন করার চেষ্টা করেনা। হাসিনা বা খালেদাকে বকতে শুরু করলো তো আর কথা নেই। চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে বলতে থাকবে। আসরে কে হাসিনা পন্থী আর কে খালেদা পন্থী তা খুব সহজেই বলে দেয়া যায়। ছেলেদের মধ্যে কে কত বেশী জানে তা জাহির করার একটা প্রবনতা থাকে।  আড্ডায় এই জানা অজানার এক অলিখিত প্রতিযোগীতা চলে। দেশের কথা উঠলেই ' অলরেডী দেশের বারোটা বেজে গেছে'  অথবা 'এই দুই মহিলারে না সরাইলে দেশের উন্নতি হবেনা' অথবা 'দেশটা একজনের বাবার আরেকজনের স্বামীর, আমরা কেউনা'  ধারনার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে  দেশীয় আলোচনার সমাপ্তি টেনে দেয়। আবার ফিরে যায় ওবামার কাছে নয়তো শেয়ার মার্কেটের দালালদের কাছে।

ঘড়িতে যখন তাকানো যায়, তখনই একমাত্র হুঁশ ফিরে আসে আড্ডায় মশগুল আড্ডাবাজদের। রাত বারোটার পরে সকলেরই ঘুমে চোখ টানে। গৃহস্বামীর একটা সুবিধা আছে, তাকে ড্রাইভ করে ফিরে যেতে হয়না, অতিথি চলে গেলেই সরাসরি বিছানা। কিনতু গৃহকর্ত্রীর অবশ্য তারপরেও কাজ বাকী থেকে যায়। অতিথি বান্ধবীরা ফিরে যাওয়ার আগে যতটুকু সম্ভব গৃহিনীর কিচেন গুছিয়ে দিয়ে যাওয়ার পরেও অনেক কাজ বাকী থেকে যায়। সেগুলো সারতে সারতে আরও একটি ঘন্টা পার হয়ে যায়। অতিথিদেরও জ্বালা কম নয়। রাত বারোটায় চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ীতে উঠতে হয়। বেশীরভাগ সময় ড্রাইভিং সীটে গৃহকর্তা বসেন, পাশের সীটে গিন্নী বসেন ঠিকই, তবে আমার মত গিন্নীরা গাড়ীতে বসেই ঘুমিয়ে পড়েন। ড্রাইভারের জন্য এ এক দূর্বিসহ অবস্থা। দুই তিন ঘন্টার ড্রাইভে পাশের সঙ্গী যদি ঘুমিয়ে থাকে তা ড্রাইভারের জন্য তিন নাম্বার বিপদ সংকেতের মত। ড্রাইভারকে খুব সজাগ হয়ে গাড়ী চালাতে হয় যা কিনা  বিনাদোষে শাস্তি পাওয়ার মত মনে হয়।

Monday, August 20, 2012

প্রসঙ্গঃ মান্না দে'র গাওয়া একটি গান

 আমি যখনই সুযোগ পাই, দিনে একবার হলেও ইউটিউবে গিয়ে গান শুনি। পুরনো দিনের বাংলা গান। নতুন দিনের গুলোও শুনি তবে পুরনো দিনের মান্না দে, হেমন্ত, কিশোর, লতা, আরতি, সাবিনা, রুনা, আব্দুল জব্বার, বশীর আহমেদসহ অনেকের গান শুনি। মাঝে মাঝে আমার পছন্দের গানগুলো থেকে ফেসবুকে দুই একটা গান শেয়ার করি।  পরে অবসরে নানা কাজের ফাঁকে ফাঁকে পছন্দের গানগুলো শুনি। আমার নিজের জন্যই আমি এই কাজটা করে থাকি। পরে লক্ষ্য করেছি, গানগুলো আরোও কেউ কেউ শোনে, কখনও কখনও শেয়ার করে।  ফেসবুক বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ আমার শেয়ার করা লিঙ্কে 'লাইক' দেয়। আমি জানি, ফেসবুকে 'লাইক' দেয়াটা এক ধরনের কর্তব্যের পর্যায়ে চলে গেছে। আমিও দেই। 'লাইক' দেয়ার মাধ্যমে বন্ধুকে জানান দেয়া, আমি তোমার পাশে আছি।

আজ শুনছিলাম মান্না দে'র গাওয়া যত প্রেমের গান। শুনতে শুনতেই দুই তিনটা গান আমার ফেসবুকে শেয়ার করে ফেলতেই এক মিনিটের মধ্যেই স্ক্রীনের উপরে দেখতে পাচ্ছিলাম নোটিফিকেশানে ব্লিঙ্ক করছে। আমি তখনও ইউটিউবেই আছি, কৌতুহল থেকেই একবার ফেসবুকে গিয়ে দেখি যে তিনটি গান শেয়ার করেছি তার মধ্যে একটি গানেই আটটি 'লাইক' পড়েছে। আট জনের মধ্যে ছয়জন ছেলে, দু'জন মেয়ে।  গানের কথা, "তুমি নিজের মুখে বললে যেদিন সবই তোমার অভিনয়, সত্যি কিছু নয়----আমি দুঃখ পেলেও খুশী হলাম জেনে"।

আমার ফেসবুক বন্ধুদের সিংহভাগই হচ্ছে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়ে। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আমার মত আধবয়সী এক মানুষের প্রতি তাদের বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বলে আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। ওরা আমাকে ওদের দলে নিয়েছে বলেই আমি এই সময়ের ছেলেমেয়েদের চিন্তা ভাবনা, বিচার বুদ্ধি, অনুভূতি, আবেগ, ভালোবাসার ধরন সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ পাই। খুব ভালো করেই বুঝতে পারি, প্রেম-ভালোবাসার ব্যাপারে ওরা খুবই আবেগপ্রবন, অনেকেই খুবই সৎ। এদের অনেকেই ভুল করে, আবার ভুল স্বীকার করার মত সৎ সাহসও আছে। ওরাও আমার মতই মন খারাপ হলে গান শোনে, গান শুনে কাঁদে আবার কেউ কেউ অতি আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়েও ঝিং চাক ঝিং চাক গান বাজিয়ে আশেপাশের সকলকে জানান দেয় মনের অনুভূতি।

আমি মান্না'দে র যে গানটির কথা এখানে উল্লেখ করেছি, তা অনেক পুরানো দিনের একটি গান, যে গান আমার মা-বাবা শুনতেন, আমি শুনেছি, এবং আমার মেয়েরাও শুনে। গান মানুষ কেনো শোনে, নিশচয়ই গানের কথাগুলোকে নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখে, হিসেব নিকেশ করে। আমাদের সময়টাতে মেলোডিয়াস গানের কদর অনেক বেশী ছিল বলে আমরা দাবী করি, বিশেষ করে দুঃখ মেশানো গানের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। আমাদের ধারনা, এ যুগের শ্রোতাদের মধ্যে বুঝিবা আগের দিনের গানগুলোর তেমন কদর নেই। তারা  দ্রুত জীবনে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে যে দুই মিনিট সময় ব্যয় করে ঐসব দুঃখ সঙ্গীত শোনার সুযোগ পায়না।  আমাদের ধারনাতে মনে হয় কিছু গন্ডগোল আছে, এটা আমি টের পাই আমার তরুন বন্ধুদের সাথে কথা বলে। ওদের সাথে যখনই গল্প করি তা সামনাসামনিই হোক অথবা অনলাইনেই হোক, ওদের আবেগ অনুভূতি গুলো আমাদের আবেগ অনুভূতি থেকে ভিন্ন মনে হয়না।  ওদের অনুভূতিগুলো খুব ছোট্ট করে শুরুতেই লিখেছি।  আমাদের সাথে ওদের অনুভূতিতে  একটু পার্থক্য আছে, তা  হলো চিন্তার গতিময়তায় পার্থক্য। গানের রিদমের মত। অনেকটাই ধীর গতির গান আর দ্রুত গতির গানে যেমন তফাৎ। গানের কথা এক, শুধু  তাল আর লয়ের পার্থক্য।

এবার প্রসংগ শেষ করি। মান্না দে'র কন্ঠে গাওয়া , "তুমি নিজের মুখে বললে যেদিন সবই তোমার অভিনয়" গানটি আমার ফেসবুক ওয়ালে 'লাইক' করেছে আটজন। তাদের মধ্যে তিন জন মাত্র পুরানো দিনের শ্রোতা, বাকী পাঁচজন এ যুগের শ্রোতা। গানটির কথা নিশচয়ই সব যুগের শ্রোতাদের মনেই একই ধরনের আলোড়ন সৃষ্টি করে।  আরেকটি ব্যাপার খেয়াল করে দেখলাম, আটজনের মধ্যে দু'জন মাত্র মেয়ে। তার মানে ৬ ঃ ২ অনুপাতে 'লাইক' পড়েছে, যার সরল অর্থ দাঁড়ায় প্রেমের অভিনয়ে মেয়েরা বেশী ওস্তাদ (!!!)। অবশ্য শুধু গান কেনো, সিনেমা নাটকেও দেখায় বহুদিনের প্রেম ভেঙ্গে যাওয়ার পেছনে 'মেয়েদের' ভূমিকা প্রধান। কী জানি, যারা নাটক লেখে বা গান লেখে তাদের অভিজ্ঞতা নিশচয়ই অনেক বেশী। অভিজ্ঞতার আলোকেই হয়তো তারা এটা করেন। নাহলে গানটি মাত্র দুইটি মেয়ে লাইক করলো!

ভালোবাসা এমনই এক অনুভূতি, যা দিয়ে কাউকে বাঁচিয়ে তোলা যায়, কাউকে মেরেও ফেলা যায়।  ভালোবাসায় তাজমহলও তৈরী হয়েছে, ভালোবাসতে গিয়ে ত্রিশ বছরের সংসারও ভেঙ্গেছে। আর প্রতারণা তো সব যুগেই চলে এসেছে।   এত কিছুর পরেও যখন তখন মানুষ প্রেমে পড়ে, প্রেমের জোয়ারে গা ভাসিয়ে উড়ে বেড়ায় নানা কল্পলোকে, আবার যখন তখন সেই কল্পনার আকাশ থেকে ধুপ করে একদিন মাটি্তেও পড়ে যায়।   তবুও প্রেমে পড়া চাই। প্রেমে পড়ার হিড়িক এই যুগের ছেলেমেয়েদের মধ্যে খুবই বেশী। গতিময়তার যুগে মানুষের দৈনন্দিন জীবনটাই এত বেশী গতিময় যে গতিময় যুগের ছেলেমেয়েরা প্রেমেও প্রতিদিন একবার করে পড়ে। এত দ্রুত গতিতে প্রেম হয়, ভালো করে পরস্পরকে বুঝে উঠার আগেই আরেকজনকে হয়তো ভালো লেগে যায়! ব্যস, পুরানো জনকে ফেলে মনের গতি নতুনের দিকে মোড় নেয়। এই ভাংগা-গড়ার খেলা আগেও ছিল, এখনও চলছে, তফাৎ শুধুই গতিতে।  তাই মনে হয় গানটিতে পুরোনো শ্রোতারা 'লাইক' দেয়ার আগেই অতি দ্রুততার সাথে এ যুগের শ্রোতারা 'লাইক' দিয়ে ফেলেছে।


Tuesday, August 14, 2012

সেই অন্ধকার ভোরে চাঁদ ডোবার সাথে সাথে সূর্য্যও ডুবে গেছে!

আগস্ট মাস আসলেই আমার মধ্যে মিশ্র এক অনুভূতি কাজ করে। অনুভুতিটুকু  আনন্দের ও শোকের।  আনন্দটুকু আমার একান্ত ব্যক্তিগত বলে নিজের মধ্যেই রাখি, আর শোক সমষ্টিগত বলে সকলের সাথে শেয়ার করি। ১৯৭৫ এর পর থেকে   'শোকের মাস' বললেই প্রাইমারী স্কুলে পড়ুয়া ছাত্রও বুঝে যায়, আগস্টের কথা বলা হচ্ছে।  সমস্ত বাঙ্গালীর জন্যই এ মাসটি শোকের, চরম বেদনার। ১৯৯০ সালের আগে পর্যন্ত আগস্ট মাসে আমার অনুভূতি আর দশটি বাঙ্গালীর মতই ছিল। '৯০ সালের ১৪ই আগস্ট আমার দ্বিতীয় সন্তান জন্মের পর থেকেই আমার ব্যক্তিগত অনুভূতিতে কিছু পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন বলতে এখন ১লা আগস্ট থেকেই আমি এখন আর শুধু ১৫ই আগস্টের জন্য অপেক্ষা করিনা, সাথে ১৪ই আগস্টের জন্যও অপেক্ষায় থাকি।

মাঝে মাঝেই মেয়েকে বলি, "তুই এমন এক মাসে জন্ম নিলি যে আনন্দ করতেও দ্বিধা। তোর জন্মদিনে আনন্দ করবো ভাবলেই শেখ রাসেলের কথা মনে পড়ে। আনন্দ নিরানন্দ হয়ে যেতে চায়"। আমার মনের ভাষা হয়তো মেয়ে বুঝতে পারে, বলে "তবুও তো আমার ভাগ্য ভাল যে ১৪ তারিখে জন্মেছি, ১৫ তারিখে জন্মালে তো তুমি আমার দিকে ফিরেও তাকাতে না"।  আসলে তা ঠিক নয়, নিজের সন্তানের দিকে ফিরেও তাকাবোনা, তা কি হয়? তবে ঘটা করে জন্মদিন পালন করতামনা ( এখনও আমরা সেটা করিনা)।  ১৫ ই আগস্টে জন্মদিন  মনে হয় একমাত্র  বেগম জিয়ার বাড়ীতেই মহা ধুমধামে পালিত হয়।   আমার এক বন্ধু বলেছে, তার কলেজ জীবনের প্রেমিকার জন্মদিন ছিল ১৫ই আগস্ট। আমার বন্ধুটি একসময় ছাত্রলীগের রাজনীতি করলেও প্রেমিকার জন্মদিন উদযাপন করেনি কখনও।

আমার এখন পর্যন্ত '১৫ই আগস্ট বেবী' চোখে পড়েনি। এতদিন শুধু বেগম জিয়ার জন্মদিন ১৫ই আগস্ট জেনে এসেছি। একসময় বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছিল যে '৭৫ এর ১৫ই আগস্টে আর কেউ কোনদিন জন্মাবেনা। একদিন আগে বা একদিন পরে জন্মাবে, কিনতু কোনভাবেই ১৫ই আগস্টে নয়। এইজন্যই ১৫ই আগস্ট বেবী দেখা হয়নি আমার। যাই হোক এগুলো সবই আবেগী, অর্থহীন কথাবার্তা। আজকেই একজন সত্যিকারের '১৫ই আগস্ট  ১৯৭৫' বেবীর দেখা পেলাম।

 অফিসে কাজের এক পর্যায়ে এক গ্রাহক নতুন ফোন সার্ভিস নিতে এসেছে। নতুন গ্রাহকদের সমস্ত ইনফরমেশান কমপিউটারে এন্ট্রি করার আগে গ্রাহককে  স্টেট আইডি  দেখাতে  হয়। নতুন গ্রাহকের আইডি তে জন্ম তারিখের দিকে তাকাতেই কেমন যেনো অস্বস্তি লাগছিল বেশ ক'বার। হঠাৎ খেয়াল করে দেখি জন্ম তারিখ ১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫। আমি এই প্রথম ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে জন্ম নেয়া কাউকে দেখলাম। আমি কল্পনাপ্রবণ মানুষ বলেই কাজের ফাঁকেই কল্পনা করতে শুরু করে দিলাম। এই ছেলেটা যখন জন্মায় সেই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর লাশ কি দাফন হয়ে গেছে? কারন আমেরিকায় ১৫ই আগস্টের  সকাল মানেই ঢাকাতে ১৫ আগস্টের সন্ধ্যা। ঐ সন্ধ্যায় কী বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফন হয়ে গেছিলো? আমার মনে পড়েনা, মনে পড়ার কথাও না। বালিকার স্মৃতিতে সেদিনের ঘটনার মুল অংশ ধরা আছে, খুঁটিনাটি কিছু মনে নেই। ছেলেটি চলে যেতেই মন চলে গেলো '৭৫ এর ১৫ই আগস্ট সকালে।

'৭৫ এর ১৫ই আগস্ট আমি ছিলাম বালিকা। আমাদের ছোটবেলা থেকেই ছকে বাঁধা কিছু নিয়ম চালু ছিল। যেমন সকাল সাতটা বাজলে ‘বাংলাদেশ বেতার ঢাকা’ স্টেশান অন হয়ে যেত, সকালের খবর শোনার জন্য। সকাল সাতটার খবর আরম্ভ হলেই আমি ঘুম থেকে উঠতাম।

নারায়নগঞ্জের শহর এলাকায় আমরা থাকতাম। ঐ এলাকাগুলো একসময় হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। আমরা যে বাড়ীতে ভাড়া থাকতাম, সে বাড়ীর মালিক ছিলেন হাজী সাহেব। হাজী সাহেবের ১৮ ঘর ভাড়াটিয়ার মধ্যে একঘর মাত্র মুসলিম পরিবার ছিল। বাকী সবাই হিন্দু। তবে হিন্দু অধ্যুষিত পাড়া হলেও আমাদের পাড়ায় হিন্দু মুসলমানের সম্পর্ক ছিল পরম আত্মীয়ের মত। আমাদের বাড়ীওয়ালা ও সেই একঘর মুসলিম ভাড়াটের সাথে আমাদের নিত্যদিন একসাথে উঠাবসা সম্পর্ক ছিল। মুসলিম ভাড়াটে চাচা ছিলেন পেশায় ডাক্তার। উনার বাড়ীতে উনারই দূর সম্পর্কের আত্মীয় থাকতো, যাকে আমরা সবাই ‘জামাল ভাই’ বলে ডাকতাম।



আমাদের ঐ বাড়ীর ভাড়াটিয়াদের রুটিনমাফিক একটি কাজ ছিল, তা হলো সকাল সাড়ে ছয়টা বাজলে সব মহিলারা সাপ্লাইয়ের জল নেওয়ার জন্য কলতলায় হাজির হতো। সেই কলতলা থেকে রাস্তা দেখা যেত। ১৫ই আগস্টের সকালে সব মাসীমারা কলতলায় বসে  পালা করে কলসী, বালতিতে সাপ্লাইয়ের জল ভরছিল। হঠাৎ করেই রাস্তা থেকে আমার মেজদা চীৎকার করে ‘ সবাই শোন, বঙ্গবন্ধুকে মাইরা ফেলছে’ বলতে বলতে দৌড়ে আসছিল। মেজদার বয়স ১৪ পূর্ণ হয়নি, সতীশ স্যারের কাছে গ্রুপে পড়তে গিয়ে এমন খবর শুনে পড়া ফেলে দৌড়ে বাড়ী চলে এসেছে।


মেজদা খুবই হাঁফাচ্ছিল। মেজদার মুখ থেকে এমন খবর শুনে কেউ বিশ্বাস করেনি। মহিলাদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হতেই পাশের ঘরে রেডিও অন করে “আমি মেজর ডালিম বলছি” শোনা গেল। আমি তখন বেশ ছোট। ঘোষণার অনেক কথাই মনে নেই শুধু ‘আমি মেজর ডালিম বলছি, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে’ ছাড়া। ততক্ষণে সবার বাড়ীতে রেডিও অন হলো, ভাবখানা এমন যেনো একেক রেডিওতে একেক রকম ঘোষণা আসবে। এক ঘন্টার মধ্যে সমস্ত পাড়া স্তব্ধ হয়ে গেলো। এমনকি কাকের কা কা পর্যন্ত শোনা গেলোনা।

ঘরে আমার বাবা শুধু একটা কথাই বলছিলেন, “ এইটা কী হইল, কী সব্বনাশ হইয়া গেলো। এইটা কয় কি, পুরা পরিবাররে মাইরা ফালাইছে! মানুষ কেমনে এমুন জালিম হইতে পারে”! আমার কেবলই দুই তিন মাস আগের কথা মনে পড়ছিল। পাগলার ঘাটে বংগবন্ধুকে অতিথিসহ সংবর্ধণা দেওয়ার জন্য সকলেই দাঁড়িয়েছিলো, হঠাৎ করেই বঙ্গবন্ধু আমাদের কাছাকাছি এসে আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, ' কি রে! কিছু খাইছস?"


বংগবন্ধুর মৃত্যুর পরেও অনেকদিন, অনেক বছর, এমনকি এখনও অনেককেই বলতে শুনি, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে দেশের কেউ কাঁদেনি। এমন কথা শুনলে সব সময়ই আমি আসর ছেড়ে উঠে যাই। অরুচীকর কোন কখা্র মধ্যে আমি থাকিনা। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে কেউ কাঁদেনি শুনলেই আমার মনে পড়ে যায় সেদিনের সকালের কথা।


বঙ্গবন্ধুকে যেদিন হত্যা করা হলো, বাংলাদেশ বেতারে সকাল সাতটার খবর প্রচারের বদলে “ আমি মেজর ডালিম বলছি-----শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে” প্রচারিত হতে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার বাবা বেশ কিছুক্ষন হতভম্ব হয়েছিলেন। ঘরে আমার বাবা শুধু একটা কথাই বলছিলেন, “ এইটা কী হইল, কী সব্বনাশ হইয়া গেলো। এইটা কয় কি, পুরা পরিবাররে মাইরা ফালাইছে! মানুষ কেমনে এমুন জালিম হইতে পারে”! এইবার আমার মা কথা বললেন। মা হাই স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। মানুষের চরিত্র ভালো বুঝতেন। আমাদের সবাইকে মা আস্তে কথা বলতে বললেন। উনি আঁচ করতে পেরেছিলেন, এতো বড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর, এর জের যে কারো উপর আসতে পারে। বিশেষ করে আমার বাবা নীচু স্বরে কখনও কথা বলতে পারেননা, উনি অনেক রাগী এবং ডিসিপ্লিন্ড স্বভাবের মানুষ। উলটা পালটা কিছু দেখলে পাড়ার ছেলে ছোকরাদেরও শাসন করতে ছাড়তেন না। মায়ের ভয় ধরে গেল, এখন এমনই একটা অরাজকতা শুরু হতে পারে, যার সুযোগ নিতে পারে অন্য যে কেউ। মায়ের কথায় আমরা সবাই মুখে তালা আঁটলাম, আর বাবা শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলো।

সেদিন বিকেলবেলাতেই ঐ ডাক্তার চাচার আত্মীয় ‘জামাল ভাই’ দুই হাতে করে চারটা মুরগী নিয়ে এসেছিল বাজার থেকে। আমাদের সকলের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলছিল, “ আজকে মুরগী জবাই হবে”। জামাল ভাই জানতেও পারেনি, তার দিকে সকলে কেমন ঘৃণার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিল।
আমাদের ঘরে রেডিও বন্ধ হয়ে গেলেও পাশের বাড়ীতে রেডিও চলতো। খান আতাউর রহমান তখন অতি উচ্ছ্বাসে একটি গান রচনা করে নিজেই তাতে সুর বসিয়ে কোরাসে গাইয়েছিলেন। গানটির কথা আমার মনে নেই, শুধু “নিপীড়িত জনতা, কোথায় সে নিপীড়িত জনতা” কথাটুকু মনে আছে। গানটির মূল বাণী ছিল, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে দেশ এক মহাবিপদের থেকে মুক্ত হলো, জনগনের জয় হলো। যেই ঘরে রেডিও বাজতো, সেই ঘরের মেসো ছিলেন খুবই অমায়িক, কথা বলতেন শুদ্ধ বাংলায়। উনাকে কখনও মুখ খারাপ করতে শুনিনি। একদিন ঐ মেসো “কোথায় সে নিপীড়িত জনতা’ বলার সাথে সাথে জোরে জোরে বলে উঠেছিল, “নিপীড়িত জনতা আমার বগলের তলে”। সারা বাড়ীর মানুষ সেদিন শুনেছিল মেসোর কথা। কী যে রাগে ফাটছিলেন উনি, সেই ছবি এখনও আমার মনে ভাসে। এই একটি উক্তির মধ্য দিয়েই উনি সারা দেশের প্রায় ৯০ ভাগ বাঙ্গালীর মনের ঘৃণা উগরে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমানের 'সূর্য সৈনিকদের' প্রতি।


আর আমার বাবার প্রতিবাদ ছিল অন্যরকম। আমাদের বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশ বেতার পালটে রেডিও বাংলাদেশ করা হইছে। যতদিন রেডিও বাংলাদেশ থাকবো, ততদিন আমার ঘরে ঢাকা স্টেশান কেউ চালাইতে পারবা না”। ঐ জামাল ভাইয়ের সাথে আমাদের কথা বলতে মানা করে দিছিলেন। এরপর ‘বাংলাদেশ বেতার’ পালটে ‘রেডিও পাকিস্তানে’র আদলে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ করা হলো, কিনতু আমাদের ঘরে ঢাকা স্টেশান আর অন করাই গেলোনা। যেদিন রেডিও বাংলাদেশ বদলে আবার ‘বাংলাদেশ বেতার’ চালু হলো, আমার বাবা ঢাকা স্টেশানে আবার সকাল সাতটার সংবাদ শুনতে আরম্ভ করলেন। 

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরেই আমাদের পাড়ার পরিবেশ আস্তে আস্তে পালটাতে শুরু করে। চেনা মানুষকেও অচেনা লাগতো। পারস্পরিক বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ববোধেও যেনো টান ধরতে থাকে। এতকিছুর পরেও আমার বাবার গলার জোর কমেনি। অমন দুঃসহ সময়ের মধ্যেও বাবা ঠিকই বংগবন্ধুর খুনীদের ঊদ্দেশ্যে বাতাসে হুঙ্কার ছুঁড়ে দিতেন। খুনীরা না শুনুক এই খুনকে যারা সমর্থণ করেছে তারা শুনেছে আমার বাবার হুঙ্কার। বাবার ধারনা, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে যারা খুশী হয়েছে, তারাতো জানবে নারায়নগঞ্জের একটি ঘরে নির্ভয় প্রতিবাদী কন্ঠ এখনও গর্জে উঠে। পরবর্তীতে নির্বাচনের সময় প্রহসনমূলক নির্বাচনেও উনার ভোট বাতিল হবে জেনেও বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির অনুসারী প্রার্থীকে ভোটটা দিয়ে আসতেন। আমরা হাসাহাসি করলে বলতেন, "আমার এই একটা ভোট গনতন্ত্রের পক্ষে একটা চীৎকার"।

আমার বাবার বয়স এখন পঁচাশি বছর। গলার জোর থাকলেও সেই জোরে আর কথা বলেননা। বর্তমান সময়ের হালচাল দেখে হয়তো মনে মনে বিভ্রান্ত হন এই ভেবে যে এমন দেশতো চাইনি। হয়তো ভাবেন, ইশ! কেউ যদি সেই সকালে ডালিম ফারুকদের ঠেকাতে পারতো, আজ তাহলে সব কিছু অন্যরকম হতো। কিনতু এটাই আমাদের নিয়তি। আমাদের সব ভালো, সব আলো, সকল আশার প্রদীপ সেই ১৫ আগস্টের সকালে নিভে গেছে। তখন এতো মানুষের মধ্যে একজন 'জামাল ভাই' ছিল, আর আজ চারিদিকে শুধুই জামাল ভাই, আর জামাল ভাই।







কে বলে আজকাল ছেলেরা বাবা মায়ের দেখভাল করেনা?

আজ আমার মনটা বেশী ভালো ছিলনা। দুপুরে অফিস যাওয়ার ঠিক আধঘন্টা আগেই দেশ থেকে ফোন আসে মায়ের অসুস্থতার খবর নিয়ে। মাত্র চারদিন আগেই আমার মায়ের হিস্টেরেক্টোমি হয়েছে (ইউটেরাস অপারেশান)।  অপারেশানের পরে প্রথামত ফেলে দেয়া ইউটেরাস থেকে টিস্যু নিয়ে বায়োপসী করতে পাঠানো হয়েছিল। যার রিপোর্ট এসেছে আজকে এবং তা পজিটিভ।  মানে ইউটেরাসে ক্যান্সার সেল পাওয়া গেছে। আমি আমার মায়ের একটা মাত্র মেয়ে, মাত্রই দুই সপ্তাহ আগে দেশ থেকে ফিরলাম। মন চাইছে এক ছুটে দেশে চলে যাই। ভাইগুলো একা একা কতটুকু সামলাবে? কিনতু কিভাবে পারবো? ছুটির মেয়াদ শেষ, চাকুরীর বাজার মন্দা। একটা গেলে আরেকটা পেতে ঘাম বের হয়ে যাবে। তাছাড়া সংসার ছেড়ে কতদিনের জন্য দূরে থাকবো? আমিও যে তিনটি মেয়ের মা। আমি আর ওদের বাবা ছাড়া এখানে ওদের আপন বলতে যে আর কেউ নেই!

আমাদের পরিবারে নিজেদের মধ্যে বন্ধন খুব দৃঢ়। প্রাথমিকভাবে আমরা তিন ভাই, এক বোন  হলেও আমাদের 'তুতো' ভাই বোনের (কাজিন)  সংখ্যা অনেক। বিশেষ করে আমাদের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে পুত্র সন্তানের আধিক্য বেশী।  (একমাত্র ব্যতিক্রম আমি। আমার কোন পুত্র সন্তান নেই, তিনটি কন্যা আমার।)  'তুতো' ভাই বোনেরা সম্পর্কে 'তুতো' হলেও এরা মায়ের পেটের ভাইবোনের মতই। এমনই এক দৃঢ় পারিবারিক বন্ধনে আমরা সকলেই বাঁধা। বাংলাদেশে আমাদের পরিবারের মূল শেকড় থাকলেও পাশের দেশ ভারতের নানা প্রদেশে আমাদের পরিবারের ডালপালা ছড়ানো আছে। কেনো ভারতে আমাদের ডালপালা ছড়িয়েছে তা ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলেই জানা যাবে। তবে ইতিহাসের পাতা ঘাঁটাওলে যা জানা যাবেনা, তা হচ্ছে শুধু ভারত নয়, পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই আমাদের শেকড় বিস্তৃত হয়েছে, সর্বত্রই আমাদের নেট ওয়ার্ক মজবুত।

এই যে আমার মায়ের অসুখটা হলো, আমার আগেই ওখানে দৌড়ে যাবে আমার 'তুতো' ভাই-বোনেরা। তারা সকলেই মনপ্রাণ ঢেলে মায়ের সেবা করবে। এতো গেলো 'তুতো' দের কথা। এবার আসি নিজ ভাইদের কথায়। আমার তিন ভাই। সবার বড় ভাই আর আমি থাকি বৈদেশে। আমার মেজভাই আর ছোট ভাই থাকে দেশে।

আমার প্রথম সন্তান যখন জন্মালো, সকলেই খুশী ফুটফুটে মেয়ে বাচ্চা দেখে।  কিনতু বাচ্চা জন্মের আগে পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধবেরা বলতো, প্রথম সন্তান 'ছেলে' হলেই ভালো। একদিক থেকে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। বংশ রক্ষার দুশ্চিন্তা করতে হয়না। এগুলো শুনে শুনে আমার তরুণী মনেও একধরনের আশা তৈরী হয়েছিল যে ছেলে হলেই ভালো।  কিনতু আমার প্রথম বাচ্চা সুস্থ হবে কিনা এই নিয়ে ডাক্তারদের মনে আশংকা ছিল (আমার আরেক লেখায় তা বলেছি)।  সে কারনেই ছেলে বা মেয়ে নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সুস্থ বাচ্চার জন্য দিন গুনেছি। সুস্থ মৌটুসীকে পেয়ে আমি খুশী,  আমরা খুশী। দ্বিতীয় মেয়ে মিশার জন্মের আগে আমার দিদিমা বাদে আর সকলেই বলেছিল 'এবার তোর ছেলে হবে'। আমি কিনতু এবার সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেছিলাম যে আমার ছেলেই হবে। কিনতু মিশার জন্মের সাথে সাথে আমার মাথা থেকে ছেলে বা মেয়ের পার্থক্য দূর হয়ে যায় পরিবারের সকলের আধুনিক ও পজিটিভ মন মানসিকতার কারনে।

তৃতীয় মেয়ে মিথীলা হওয়ার আগে অনেকের মনেই সন্দেহ ছিল একটি ছেলে বাচ্চার আশায় আমরা তৃতীয় সন্তান চাইছি। কিনতু  আমি সকলকেই বলতাম, এই বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসতে চেয়েছে এবং আমাদেরকে বাবা মা হিসেবে বেছে নিয়েছে। তাই ওর আগমন।  সে মেয়ে হবে নাকি ছেলে হবে তা নিয়ে চিন্তা করিনা।  মুখে এই কথা বললেও মনের কোথাও কিনতু ঠিকই একটা ছোট্ট ছেলে উঁকী দিচ্ছিল । সেজন্যই মনে হয়  মিথীলার জন্মের সাথে সাথেই আমি ও টি থেকেই কী যে কান্না শুরু করেছিলাম, সেই কান্না দুই দিন ব্যাপী ছিল। আমার মায়ের বকা খেয়ে কান্না থামিয়েছি। কিনতু এখনও মনে পড়ে, কাঁদতে কাঁদতে মা'কে বলেছিলাম, " তুমিতো ভাগ্যবতী। তিনটি পুত্ররত্ন পেয়েছো। তুমি কী করে বুঝবে আমার কষ্ট। আমার এই মেয়েগুলি কী আমার থাকবে? তিন মেয়ে বিয়ে হয়ে চলে গেলে আমি একা হয়ে যাবনা"?

অন্যসব মায়েদের মত আমার মা বলেছিল, " তোর তিন মেয়েই রত্ন হবে। এরা ছেলের চেয়ে কোন অংশে কম হবেনা। ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই অনেক বেশী আপন হয়"। আমি বলেছি, " তুমি অন্ততঃ এমন কথা বলোনা। আমি তোমাদের কন্যা হয়ে যেটুকু করি আমার ভাইয়েরা তার চেয়ে অনেক বেশী যত্ন করে তোমাদেরকে। আমিতো নিজের সংসার নিয়েই ব্যস্ত থাকি। তোমাদের আপদে বিপদে সব সময় তিন ছেলে মাথার কাছে , পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। তুমি অনেক ভাগ্যবতী মা, তোমার মুখে এমন কথা মানায় না"।

আমার সেদিনের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছে। ইদানিং অনেকের মুখেই একটা কথা উচ্চারিত হয়, 'মায়েরা ছেলে ছেলে করলেও বিপদের সময় মেয়েরাই আগে দৌড়ে আসে'।  ছেলে মেয়ে তুলনা করে কথা উঠলে আমি মেয়েদের পক্ষেই কথা বলি সাধারনতঃ। কিনতু এই একটা জায়গায় এসে চুপ করে থাকি।  আমার দুই ভাই আর আমার মামাত ভাই, এই তিনজন মিলে আমার মা, বাবাকে আগলে রেখেছে। আমাদের বাবা, মা বয়স হয়ে গেলেও কারো উপর নির্ভরশীল নন। সারাজীবন আমাদের উপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন, এখনও ছড়ি ঘুরান। তাঁদের যে কোন কথা অগ্রাহ্য করার শক্তি আমাদের কারোর নেই। দুজনেরই নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের কারনে অনেককাল উনারা সুস্থ থেকেছেন। এখন এই জীবন সায়াহ্নে এসে আর বোধ হয় মেরুদন্ড সটান রাখা সম্ভব হচ্ছেনা। ছেলেদের উপর নির্ভর করতেই হচ্ছে। আর আমার ভাইগুলোও যেনো এই প্রথম বাবা মায়ের জন্য কিছু করার সুযোগ পেয়ে সাধ্যের বাইরে গিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। গত বছর আমার বাবা প্রায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে ঘুরে এলেন। আমার মেজভাই, ছোটভাই আর তুতো ভাই যে কোন ব্যাপারে প্রথমে ঘাবড়ে যায়, পরে এখান থেকে আমি আর আমার স্বামী, কানাডা থেকে বড় ভাই ওদেরকে সাহস যোগাই, বুদ্ধি বাতলে দেই, ওরা জানপ্রাণ দিয়ে তা মেনে চলার চেষ্টা করে। শুধু আমার বাবা মা কেনো, আমাদের মামা, কাকা, মাসী, পিসী যখন যার প্রয়োজন আসে, সবাই মিলে তা উৎরে দেয়ার চেষ্টা করে।

এই জন্যই আমি অন্য দশজনের থেকে দূরে থাকি, কখনও বলিনা মেয়ে সন্তানের চেয়ে ছেলে সন্তান ভালো অথবা ছেলের চেয়ে মেয়ে ভালো। আমাদের পরিবারে সব সমান। ছেলেও ভালো, মেয়েও ভালো। আমার কাছে মেয়ে বাচ্চা থাকার একটাই সমস্যা, এরা বাবা-মা কে ছেড়ে অজানা রাজপুত্রের হাত ধরে চলে যায়। বাবা মায়ের কাছে আসতে হলে রাজপুত্রের অনুমতি লাগে, রাজার অনুমতি লাগে, রানী, ননদিনীর মন খুশী করা লাগে। ঘরে বাচ্চাদের সুখ সুবিধা দেখতে হয় বাবা মাকে দেখতে যাওয়ার আগে। এতে কি মেয়েদের মন ভরে?

 যারাই বলে যে আজকাল ছেলেরা কিছু হেল্প করেনা, মেয়েরা হেল্প করে, তাদের অভিজ্ঞতাকে ছোট করিনা কোনভাবেই। তবে বাস্তবকেও অস্বীকার করতে পারিনা। যাদের মেয়েরা  বিয়ের পরে অনায়াসে  বাবা মায়ের কাছে চলে আসতে পারে, তারা সত্যিই ভাগ্যবতী। তবে এতে করে মেয়ের বাবা খুশী হলেও মেয়ের শ্বশুর শাশুড়ীর তো খুশী হওয়ার কথা নয়। এই শশুর শাশুড়িই একদিন সবার কাছে বলবে, "  ছেলে ছেলে করে লাভ নেই। ছেলেতো নতুন বাবা মা (বৌয়ের বাবা মা) পেয়েছে, এখন আর আমাদের দিকে ফিরেও দেখেনা" । আর মেয়ের মা  হয়তো বলে, "আমার ছেলে নেই বলে কী হয়েছে আমার মেয়ে জামাইরাই আমার একেকটি রত্ন"।

কিনতু আমার মায়ের ভাগ্য আসলেই ভালো। আমিতো কিছুই করতে পারিনা এতদূর থেকে, আমার ভাইগুলিই মনপ্রাণ দিয়ে মা বাবার সেবা করে। মায়ের হঠাৎ করেই মনে হয়, অমুককে সাহায্য করা দরকার, তমুকের বিয়েতে ঠিক 'এত হাজার টাকা'  দামের  গিফট দেয়া উচিৎ। আমার ভাইয়েরা সব শিরোধার্য্য করে নেয়। তারা কি বৌদের অবহেলা করে বাবা মায়ের দেখভাল করে? অবশ্যই না,  বৌদেরকে পাশে নিয়ে ওরা সব কিছু করে। আর কানাডা থেকে আমার বড় ভাই সার্বিক তত্ত্বাবধান করে।  'তুতো' ভাইদের কথা না বললেই নয়। এরা আমাদের নয়নের মনি। আমি কী পারি, নিজের তিনটি মেয়ে হয়েছে বলেই ছেলেদের বদনাম করতে!

তবে  আমার মেয়েগুলো যে বিয়ে হয়ে নতুন ঘর আলোকিত করতে চলে যাবে, তার কি হবে শুনি? আমি কি শেষ জীবন একা কাটাবো নাকি? এটা কেমন বিচার হলো?????

Monday, August 13, 2012

মায়ের দেহে অস্ত্রোপচার এবং প্রাসংগিক কিছু কথা


আমার মা কঠিন ব্যক্তিত্বের অধিকারী, কিছুটা জেদীও।  অতি সম্প্রতি  উনার দেহে অস্ত্রোপচার হয়েছে, উনার পছন্দের ডাক্তারের কাছে। হিসটেরক্টোমি হয়েছে যার সোজা বাংলা হচ্ছে পেটের ভেতর থেকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ইউটেরাস, ওভারি বের করে নিয়ে আসা। মেয়েদের এই এক সমস্যা। পৃথিবীর সব দেশেই মেয়েদের জীবনের কোন এক পর্যায়ে গিয়ে দেখা যায় কারো ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়, কারো ইউটেরাসে বা ওভারিতে ক্যানসার হয়, কোন কোন মেয়ে দেহে ইউটেরাস, ওভারী নিয়েও বন্ধ্যা হয়, আবার বন্ধ্যা নারী সন্তান জন্ম না দিয়েও এইসব জটিল রোগে আক্রান্ত হয়।

উন্নত বিশ্বে মেয়েদের এই সমস্ত রোগ আগাম নির্নয়ের পাশাপাশি আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। এ সকল দেশে সরকারীভাবেই নারীদেহের গুরুত্বপূর্ণ অংশ (Vital organ) যেমন ইউটেরাস, ওভারি, সারভিক্স এবং ব্রেস্টের সুস্থতা যাচাইয়ের জন্য নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। তারপরেও এসকল দেশে কী মেয়েরা অসুস্থ হচ্ছেনা? এদেশে কী ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা আমাদের দেশের তুলনায় কম? না কম নয়, তবে এখানে আগে থাকতেই জানার উপায় আছে কার জীবন কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ, রোগ সঠিক সময়ে চিহ্নিত হয়, রোগের সুচিকিৎসা হয়, চিকিৎসায় ভুল কম হয়, ভুল হলে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে কেইস হয়, ডাক্তার ও হাসপাতালকে মিলিয়ন ডলার জরিমানা দিতে হয়। আমাদের দেশেতো এই কৃষ্টি এখনও গড়েই উঠেনি। দেশে মেয়েরা ডাক্তারের কাছে যায়না, অথবা গিয়েও নিজের সমস্যার কথা খুলে বলতে লজ্জা পায়। ডাক্তারদেরও কারো কাছে কোন জবাবদিহিতা করতে হয়না, ফলে লাজুক রোগীনির পেটের কথা পেটেই থেকে যায়, ডাক্তারও পরবর্তী রোগীনি দেখার তাগিদে সামনে বসে থাকা রোগীনির জন্য প্রেসক্রিপশানে প্যারাসিটামল, আর কতগুলি ভিটামিন ওষুধ খস খস করে লিখে পাঁচশ টাকার ভিজিট ড্রয়ারে ঢুকিয়ে দেয়।

শুধু ডাক্তারের দোষ খুঁজে বেড়ালে ব্যাপারটা একপেশে হয়ে যায়। আসল সমস্যা থাকে পরিবারের কাঠামোতেই। প্রায় প্রতিটি মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়েরা নিজের ব্যাপারে উদাসীন। তারা ছেলে মেয়ের গায়ে একটু উত্তাপ টের পেলেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান, ডাক্তারের কাছে গিয়ে জ্বরের সমস্যার কথা বলতে গিয়ে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় নানা উপসর্গের বর্নণা দিয়ে থাকেন। ডাক্তারের নির্দেশমত সমস্ত প্যাথোলজী ঘুরে, এন্টিবায়োটিকের বোঝা নিয়ে ঘরে ঢুকেন। কিনতু নিজের বেলায় পাড়ার দোকানের কম্পাউন্ডার সাহেবের শরণাপন্ন হন। অনেকে আবার সেটুকুও করেনা, নিজে নিজেই ফার্মেসীতে গিয়ে ওষুধ কিনে নিয়ে আসে। আমার অতি পরিচিত একজনের কথা বলি, তার পকেটে ‘নাপা’, ‘এন্টাসিড প্লাস’, ‘ফ্ল্যাজিল’, ‘সিপ্রোসিন’ থাকে। সে নিজেকে ‘মোবাইল ফার্মেসী’ বলে দাবী করে। প্রতি সকালে দুইটা নাপা খেয়ে দিন শুরু করে, মাথা ব্যথা বেশী হলে চার ঘন্টা পরেই আরও দুইটা খেয়ে নেয়। পেটে ব্যথা হলে ফ্ল্যাজিল খায়, বেশী ব্যথা হলে ‘সিপ্রোসিন’ খায়। আমেরিকায় এগারো বছর থাকার ফলে এসব কাহিণী শুনে আমার কেমন যেনো অস্থির অস্থির লাগে। আমি যার কথা বললাম সে কিনতু একজন না দেশে, তার মত ‘নিজে নিজে ডাক্তার’ প্রচুর আছে। এবং এভাবেই সবাই বেঁচেও আছে।

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম আমার সেই পরিচিত মানুষটিকে, ডাক্তারের কাছে না গিয়ে কেনো এমন করে? তার উত্তরেও যুক্তি ছিল, সাধারণ মাথাব্যথা বা জ্বর নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেও ডাক্তার একশ একটা টেস্ট করতে পাঠায় উনার পছন্দের প্যাথোলোজীতে, সেই সব প্যাথোলজী ছাড়া অন্য কোন প্যাথোলজী থেকে পরীক্ষা করিয়ে নিলে সেই সকল রিপোর্ট ডাক্তাররা দেখতে চান না। তারপরেও রিপোর্টে যখন দেখা যায় সবই ঠিক আছে, তখন তো সেই প্যারাসিটামলই খেতে দেয়। কাজেই মাথাব্যথার জন্য প্যাথলোজী ঘুরিয়ে তিনদিন পরে সেইতো প্যারাসিটামল বা ফ্ল্যাজিলই খেতে দিবে, অসুখ বেশী হলে এন্টিবায়োটিক দিবে। আর এখন কে না জানে এন্টিবায়োটিক হিসেবে ‘সিপ্রোসিন’ হচ্ছে সবার কাছে প্রিয় একটি নাম। কাজেই নিজে নিজে ডাক্তারী করতে তার খুব একটা অসুবিধা হয়না। ডাক্তারের ভিজিট, প্যাথলোজিক্যাল টেস্টের পয়সাও বেঁচে যায়। সেই পয়সায় অনেক কিছু কাজ করা যায়। তাছাড়া যার কপালে যতদিন আয়ু লেখা আছে সে ঠিক ততদিনই বাঁচবে, ভালো যুক্তি।


আমার মায়ের অপারেশান তিনদিন আগেই হয়েছে। কিনতু অপারেশান হওয়ার আগে অপারেশান কোথায় করাতে পারি, এই নিয়ে আমরা ভাইবোনেরা যখন বিভ্রান্ত ছিলাম, মা নিজেও সেদিন আমাদের কপালে আয়ুর জোরের কথা বলেছিলেন। আমরা চেয়েছিলাম অপারেশান ঢাকার নামকরা হাসপাতালে করাতে, কিনতু আমার মা চেয়েছেন নারায়নগঞ্জেই নিজের পরিচিত ডাক্তারের তত্বাবধানে থেকে করাতে। কিনতু সন্তান হিসেবে আমাদের মনে একটু অস্বস্তি দেখা দেয় নারায়নগঞ্জে অপারেশান করার ব্যাপারে। কারন আমার মায়ের বর্তমান বয়স পঁচাত্তর। এই বয়সে দেহে যে কোন অস্ত্রোপচারেই এক ধরনের শঙ্কা থেকেই যায়। তার উপর হিস্টেরেক্টোমি শুনতে যতই সহজ হোক না কেনো, এই বয়সী মহিলার জন্য অত সহজ নয়। অপারেশান পরবর্তী কত জটিলতা থাকে। সারাদেশে একমাত্র ঢাকায় হাতে গোনা কিছু হাসপাতাল ছাড়া আর কোথাও আধুনিক যন্ত্রপাতি মজুত আছে কিনা সে সম্পর্কেও আমাদের ধারনা নেই। অবশ্য তাই বলে কী আর দেশের কোথাও চিকিৎসা চলছেনা? চিকিৎসা চলছে এ ব্যাপারে দ্বিমত নেই, আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অনেক ভালো ভালো ডাক্তার আছেন, অনেক হৃদয়বান ডাক্তারও আছেন, এখনও অনেক ডাক্তার আছেন যাঁরা গরীব রোগীর কাছ থেকে ভিজিট নেন না। এসব কিছু জানা সত্বেও মন মানেনা বলেই মা’কে ঢাকা নিতে চেয়েছিলাম।

বাবা-মাকে দেখতে এই সামারেই দেশে গেছিলাম। আমার বাবার বয়স পঁচাশি আর মায়ের পঁচাত্তর। সারা জীবন দুজনেই খুব ডিসিপ্লিন্ড ছিলেন বলেই এখনও মোটামুটি সুস্থ আছেন। অবশ্য গত বছর আমার বাবা ব্লাডে সোডিয়াম লেভেল নীচে নেমে যাওয়ায় খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। অবশ্য এখানেও সেই পরিচিত মানুষটির মতই আমার বাবাও ‘নিজে নিজে ডাক্তারী’ করতে গিয়ে ধরা খেয়েছিলেন। পেটের পীড়ায় কম্পাউন্ডারের দেয়া চিকিৎসা চালিয়েছেন, চুরাশি বছর বয়সে কম্পাউন্ডারের চিকিৎসার ধকল সামলে উঠতে পারেননি, ব্লাডে সোডিয়াম লেভেল একেবারে নেমে যাওয়ায় মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গেছিলেন। নারায়নগঞ্জের কোন ক্লিনিকেই উনাকে রাখতে চায়নি, ঢাকার নামকরা হাসপাতালে রেখে উনার চিকিৎসা হয়। সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরে অবশ্য হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। নিজের উদাসীন ভুলে এমন বিভ্রাট ঘটায় মনে মনে একটু সঙ্কুচিতও হয়েছেন। আমার বাবাকে তো ঢাকা নেয়া গেছে (অবশ্য বাবা সংজ্ঞাহীন ছিলেন, চেতনায় থাকলে কি করতেন কে জানে), কিনতু আমার মায়ের দাপটের কাছে আমরা কুঁকড়ে গেছি। পঁয়তাল্লিশ বছর শিক্ষকতা করেছেন, দাপট উনার অস্থিমজ্জায় মিশে গেছে মনে হয়।

প্রথমতঃ উনার দেহের সমস্যা উনি আমাদের কারো কাছেই বলেননি। দুই বছর আগেই একবার আমাদের পরিচিত ডাক্তারের কাছে গিয়ে আধা বলেছেন আধা বলেন নি। সেই ডাক্তার আমাকে জানিয়েছিলেন যে আমার মা অসুস্থ, উনার কিছু টেস্ট করানো দরকার। উনি আরও বলেছিলেন যে আমার মা নাকি লজ্জায় কিছুই বলতে পারেনা। আমি আমেরিকায় বসে থেকে মা’কে বলেছিলাম ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে গিয়ে প্রয়োজনীয় টেস্টগুলো করিয়ে ফেলতে। এরপরে উনি টেস্টগুলো করিয়েছিলেন কিনা সেই খবর আর নেওয়া হয়নি। আমার মা খুব কঠিন ব্যক্তিত্বের মানুষ, আমরা ভাই বোনেরা সব সময় তাঁকে সমঝে চলি। যাই হোক, দুই বছর আগে টেস্টগুলো করালে উনার যা সমস্যা, তা সেরে যেতো। কিনতু দুই বছর চিকিৎসা না হওয়ায় উনার ইউটেরাসে কঠিন ইনফেকশান হয়ে গেছে। যেদিন আমি চলে আসবো আমেরিকাতে, তার আগের রাতেই জানতে পেলাম মায়ের এই কঠিন অবস্থার কথা। নারায়নগঞ্জের ডাক্তার উনার ইউটেরাসের টিস্যু বায়োপসী করতে চেয়েছেন। আমি সব শুনে বললাম, বায়োপসী রিপোর্টের উপর যেহেতু পরবর্তী চিকিৎসা নির্ভর করে, বায়োপসীটুকু না হয় ঢাকা ভালো কোন হাসপাতাল থেকে করিয়ে নেই।

অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে পরদিন সকালেই মা’কে ঢাকা নিয়ে এসেছি, সরাসরি হাসপাতালে চলে গেছি। এখানেতো আবার এক ডাক্তারের রিপোর্ট আরেক ডাক্তার পড়েও দেখেনা। ডাক্তারদের এটা একটা মানসিক রোগ বলেই মনে করি। আরে বাবা, দুজনেইতো একই পড়া পড়ে ডাক্তারী পাশ করেছো, তাহলে কেনো এতো বৈরীতা! একজন রুগীকে কত জায়গায় পয়সা খরচ করতে হয়! এক ডাক্তারের রিপোর্ট বাতিল হয়ে আরেক ডাক্তারের নির্দেশে নতুন করে মায়ের প্যাথোলজিক্যাল টেস্ট করানো হয়। এগুলো সারতে সারতে পাঁচ ঘন্টা পার হয়ে যায়, তারপরে ঢাকা থেকে নারায়নগঞ্জ পৌঁছাতে গিয়ে পড়ে যাই সত্যিকারের বিড়ম্বনায়। মহাখালি থেকে গুলিস্তান যেতে সময় লেগেছে তিন ঘন্টা। আলট্রাসনোগ্রাম করার আগে মা’কে প্রচুর পানি পান করানো হয়েছিল, রাস্তায় মা ব্লাডারে প্রচন্ড চাপ টের পায়। ঢাকাতে রাস্তায় মানুষের মাথা মানুষ খায়, ফেরিওয়ালা গিজ গিজ করে, অথচ একটাও পাবলিক টয়লেট দেখিনা। কেনো নেই ঢাকার রাস্তায় পাবলিক টয়লেট? পুরুষেরা আব্রুহীনভাবেই কাজটা রাস্তার ধারে সেরে ফেলে বলে? তাহলে মেয়েদের কী উপায়? তারা কী মানুষ নয়? তাদের কি প্রাকৃতিক প্রয়োজন হতে পারেনা? সেদিন আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল (আমার ভাগ্যইতো বলবো, মা’কে তো আমিই ঢাকা এনেছিলাম), হঠাৎ করেই ঢাকা বারডেম হাসপাতালের কাছে চলে এসেছি। গাড়ী হাসপাতাল চত্বরে নিয়ে গিয়ে মা’কে হাসপাতালের বাথরুমে নিয়ে গেছি।

এই একদিনের ঘটনায় মা বেঁকে বসেছে। সোজাসাপ্টা কথা,  ‘হুমায়ুন আহমেদকে তো আমেরিকাতেই নেয়া হয়েছিল, দেবানন্দকেও উন্নত চিকিৎসা দেয়া হয়েছে, তারপরেও কি দুজনের একজনকেও বাঁচানো গেছে”? সত্যিকথাই তো! হুমায়ুনের মৃত্যুর জন্য যতই শাওনকে দায়ী করা হোক না কেনো, আমেরিকান ডাক্তাররাতো আর হুমায়ুনের ক্রেজী পাঠক না, তারা হুমায়ুনের মৃত্যুর জন্য তাঁর চতুর্থ স্টেজ ক্যান্সার এবং অতি দূর্বল লাংসকেই দায়ী করেছেন। পরোক্ষভাবে হুমায়ুন আহমেদ নিজেই দায়ী তাঁর এই অকাল মৃত্যুর জন্য। উনিও বেঁচে থাকতে নিজের প্রতি উদাসীন থেকেছেন। হার্টের পেশেন্ট ছিলেন উনি, অথচ চেইন স্মোক করতেন, অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করতেন। ডায়াবেটিস ছিল, হার্টে সার্জারী হয়েছিল, হার্টের ভাল্ব দূর্বল ছিল, এমন অকেজো দেহ নিয়ে কি ক্যানসারের সাথে যুদ্ধ করা যায়? মাঝখান থেকে শাওনকে দায়ী করা হলো।

এক হুমায়ুন মৃত্যু ঘটনায় আমারও বিরাট শিক্ষা হয়ে গেছে। মায়ের মতের বাইরে যাওয়ার সাহস হয়নি। ঢাকা এনে অপারেশান করাতে গিয়ে যদি কোন বিভ্রাট ঘটে, তাহলে শাওনের মতই বিনাদোষে দায়ী হয়ে থাকবো। তারপরেও মন মানেনা, আবার এখান থেকেই আরেক ডাক্তারকে ফোন করে আমার দুশ্চিন্তার কথা বলতেই উনি আরেক হাসপাতালে অন্য ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট করিয়ে রুগী দেখার ব্যবস্থা করে দিলেন। মা’কে শরীর কেমন আছে জানতে ফোন করেছি, মায়ের উত্তর শুনে ভয়ে কুঁকড়ে গেছি। মা সোজা বলেছেন, “কেমন থাকবো আবার? যেমন রেখে গেছো তেমনই আছি। বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে। এখানেই ডাক্তার আমার চিকিৎসা করছিল, তুমি মাতব্বরী করে ঢাকা নিয়ে গিয়ে আমার চিকিৎসা বন্ধই করে দিলে”।

এমন কথা শুনে আমার দম বন্ধ হওয়ার যোগার। যে দেখি হুমায়ুন ভক্তদের মতো করে কথা বলছে! আমি নাকি বিনা চিকিৎসায় মাকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করেছি! চারদিক থেকে পাঠক, মিডিয়ার চাপে শাওনের মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল তা জানার সুযোগ হয়নি, কিনতু আমার মায়ের এই এক কথাতেই আমার মনের অবস্থা খুবই ভেঙ্গে পড়ার মতো হয়েছে। এরপর থেকে আমি একটাই কথা বলে গেছি, মা যেভাবে চাইবে সেভাবেই উনার চিকিৎসা হবে। আমার ভাইয়েরাও ব্যাপারে একমত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত মায়ের ইচ্ছেতেই নারায়নগঞ্জেই মায়ের অপারেশান হলো। যথাসময়ে মায়ের জ্ঞান ফিরে এসেছে। মায়ের সাথে আবার ফোনে কথা বলতেই মন থেকে পাথর নেমে গেলো। অনেকদিন পরে আমাদের সবার মনেই দারুন আনন্দ। এখন আর মনেই পড়ছেনা মায়ের অপারেশানের পূর্বে টেনশানের দিনগুলোর কথা।