Saturday, October 3, 2015

নয়ন সমুখে তুমি নাই

                                                                 ০৩/১০/১৫

মা,

মিসিসিপিতে এখন রাত বারোটা বেজে বারো মিনিট, বাংলাদেশে অক্টোবারের ৩ তারিখ, বেলা ১১টা বেজে ১২ মিনিট। এখন বাংলাদেশের সাথে মিসিসিপির ১১ ঘন্টা ব্যবধান। তিন বছর আগের এই দিনে আমি তখন হসপিটালের সুবিশাল অট্টালিকা বিল্ডিং এর তিন তলায় আই সি ইউর ওয়েটিং রুমে বসে আছি। এই দিনেই সকালে ঢাকা পৌঁছেছি, আমি একা। হ্যাঁ মা, যে আমি রাস্তায় বেরোলে দিক হারিয়ে ফেলতাম, যে আমি নারায়ণগঞ্জ শহরে বড় হয়েও নারায়ণগঞ্জ ডি আই টি মার্কেট, সান্ত্বনা মার্কেট, শীতল মার্কেট চিনিনা, সে আমি আমেরিকা থেকে একা একা বাংলাদেশে চলে গেছিলাম। কোথাও হারিয়ে যাইনি। এখনও আমি মাঝে মাঝে ভাবি, কি করে একা চলে গেছিলাম?

এরপরেও আমি আরেকবার দেশে গেছি মা, ২০১৪ সালে। বইমেলায় গেলাম, সেবছরই আমার লেখা প্রথম বই ঠাকুরবাড়ির আঁতুড়ঘরে প্রকাশিত হলো। হুম, আমি বই লিখেছি, তোমার ভাষায় ফাজিল মাইয়া, অসভ্য মাইয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকোর বাড়ির পটভূমিকে সামনে রেখে বিশাল বড় বই লিখে ফেলেছে। এই কথাটুকু লিখতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ২০১২ সালের মে মাসে বাংলাদেশে গেলাম, সবাই মিলে গেলাম। মৌটুসীর বিয়ে হবে দেশের মাটিতে, দাদু দিদার উপস্থিতিতে, তাই নিয়েই মহাব্যস্ত ছিলাম। মহাব্যস্ততো থাকবোই, কন্যার পিতা যদি আলাভোলা হয়, প্লেনে চড়তে ভয় পাওয়া কন্যার পিতাকে যদি ধরে বেঁধে প্লেনে চড়িয়ে দেশে নিয়ে যেতে হয়, দেশে গিয়ে কন্যা বিয়ের আয়োজন যদি কন্যার মাকে দেখভাল করতে হয়, কন্যার মাকে তো মহাব্যস্ত থাকতেই হবে।

মা, আমার বিয়ের সময় কি তুমি মহাব্যস্ত ছিলে? ছিলেনা, কারণ বাবা ছিল ঘোর সংসারী, বাবাই সব কিছু সামাল দিয়েছে। অবশ্য এইসব উৎসব আয়োজনে আমার দাদু ছিলেন যথেষ্ট দায়িত্বশীল।


তুমি তো ছিলে বাবার বিপরীত, মোটেও সংসারী ছিলেনা। সংসার কোথা দিয়ে কিভাবে চালাতে হয় তা নিয়ে ভাবতে হতো না তোমাকে। ধনী পিতার আদুরে সন্তান ছিলে, সাধারণ মধ্যবিত্তের সংসারে তোমায় মানাবে কি করে? তবুও তুমি মানিয়ে নিয়েতোছিলে।

এখনও মনে পড়ে, সন্ধ্যেবেলা বাবা আমাদের ইংরেজী পড়াতো, একই সময় তোমার কাছে বাজার খরচের হিসেব চাইতো। তুমি হিসেব দিতে, বাবা হিসেবের খাতায় তা লিখে রাখতো। হিসেব লিখতে গিয়ে ধরা পড়তো তুমি হিসেবের বাইরে বাজার করিয়েছো। বাবা হিসেব করে টাকা দিত বাজারের জন্য, তুমি হিসেবের বাইরে খরচ করতে।
প্রতিদিন বাবা তোমাকে বকতো অতিরিক্ত খরচের কারণে, তুমি বাবার বকাগুলো এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিতে। তখন বাবার রাগ দেখলে ভয় পেতাম, এখন বুঝতে পারি, তোমাদের এই দৈনন্দিন হৈ চৈ টুকু ডাল ভাত খাওয়ার মত প্রাত্যহিক অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছিল। আমি কিন্তু তোমাদের দৈনন্দিন বাজারের হিসেব নিকেশের নাটক দেখে দারুণ শিক্ষা নিয়েছিলাম। নিজের সংসার জীবনে আমার স্বামীর অপছন্দের কাজগুলো করতে যাইনি।
তুমি ছিলে পদ্মপাতার মত, গায়ে জল পড়লে সে জলের ফোঁটা পাতায় লাগতোনা। আমি আবার তা নই, তোমার পেটে জন্মেও পদ্মপাতা হইনি, হয়েছি জলবিছুটি। গায়ে জলের ফোঁটা পড়লে গা চুলকুনি শুরু হয়ে যায়। কাজেই গা চুলকুনি হয় এমন কাজই করিনি।

বাজারের হিসেবে গোলমাল হতো মাছ নিয়ে, তুমি ছিলে মাছের পোকা, প্রতিদিন মাছ ছাড়া তোমার চলতোনা, তেমন আহামরি কোন মাছ নয়, দুই তিন ভাগা কেচকি, অথবা মলাইয়া মাছ। মাছ রান্না করতে এত্তগুলো আলু বেগুন ঝিঙ্গে কুচি মিশিয়ে, আমার মেজাজ গরম হয়ে যেত। এমন সস্তা মাছ খাওয়ার চেয়ে নিরামিষ তরকারী অনেক বেশী ভাল মনে হতো। কিন্তু তুমি মাছের সাথে কোন কমপ্রোমাইজ করতে চাইতেনা। মাছের গন্ধটুকু দিয়েই তোমার ভাত খাওয়া হয়ে যেত।
বাবার পছন্দ ছিল নিরামিষ, বলতো সপ্তাহে দুই দিন নিরামিষ খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। তুমি মানতে চাইতেনা, আড়ালে বলতে, তোর বাপে নিজেও মাছ ভালোবাসে, মাছের টুকরা যখন পাতে দেই, কাঁটাটাও চিবিয়ে ছাতু কইরা ফেলে, এদিকে ভাব দেখায় নিরামিষ পছন্দ করে, আসল কারণ নিরামিষে খরচ কম হয়
আমি হয়তো ফোঁস করে উঠতাম, মা, নিরামিষে পয়সা কম খরচ হয় কে বলছে? ঘি, গরম মশলা কিনতে টাকা লাগেনা?
তুমি কথা বদলে ফেলতে, বলতে, কম বয়সে বাবা মারা গেছেতো, সংসারের হাল ধরার কেউ ছিলনা, বিধবা মা নিরামিষ খাইতো, মায়ের সাথে তোর বাপ কাকারাও নিরামিষ খাইতো। তোর বাপে এত হিসাব হিসাব করে কারণ, কষ্টের ভিতরে বড় হইছে, এখন কষ্ট করাই অভ্যাস হয়ে গেছে, টাকা খরচ করতে শিখে নাই।

মা, আসলে বাবারও দোষ ছিলনা, সেই ৭২ থেকে ৭৯ ছিল আমাদের জন্য কঠিন সময়, জিনিসের অগ্নিমূল্য, আমরা চার ভাইবোন স্কুল-কলেজে পড়ি, বাবার একা রোজগার, তার উপর সততা। সাধারণ চাকরির পয়সায় আমাদের লেখাপড়া ঠিকমত চালিয়ে নিয়েছে, তাতেই অনেক শোকরিয়া। তবে তোমারও দোষ দেখিনা, তুমি হিসেবের বাইরে যাকিছু খরচ করতে, আমাদের জন্যই করতে। নলা মাছের মাথা তোমার অতি পছন্দের, কিন্তু মাথা দিতে বাবার পাতে, এরপর ক্রমানুসারে বড়দা, মেজদার পাতে। আমাকে দিতে চাক, নিজে খেতে মাছের লেজ। উফ! নলা মাছ ছিল আমার দুই চোখের বিষ, কাঁটা গিজগিজ করতো। এই কাঁটার মধ্যেই তুমি কত আনন্দ পেতে।

তুমি যখন গল্প করতে, দাদুর মক্কেল বিশাল মাছ নিয়ে আসতো, জেলেরা মাছ ধরে ভাল মাছ পেলেই দাদুকে দিত, দাদু পয়সা দিয়েই কিনতো, তবুও সেরা জিনিসটা পেতে। দিদিমার রান্নার হাততো দ্রৌপদীর মত ছিল, শুনতে শুনতে আমি কল্পনার রাজ্যে চলে যেতাম। বিয়ের আগের সতের বছর বাপের ঘরে কত সুখে ছিলে, বাবা মায়ের প্রথম সন্তান ছিলে তুমি। আমার বাবার হিসেবের সংসারে গিয়ে অনেক কিছুই তোমাকে বাদ দিতে হয়েছিল হয়তো। তবুও তোমার মুখের হাসির কমতি ছিলনা।


মেয়ের বিয়েতে মহাব্যস্ত থাকার কথা বলছিলাম, তখনও দেশে যাওয়ার কিছু দেরী আছে, তোমার সাথে ফোনে কথা বলি, তোমার প্রিয় নাতনীর বিয়ে, অথচ তোমার কন্ঠে উচ্ছ্বাস নেই, সব কিছুতেই বলো, আগে দেশে আয়, দেশে এলেই সব হয়ে যাবে। দাদার কথা বলতে তুমি, শংকর সব দেখবে। আমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার শরীর ভালো আছে কিনা। বলেছিলে, ভাল নেই। ডাক্তারের কাছে যেতে বলেছি, বলেছিলে, তুই আয়, তুই আসলে তোর সাথে যাব ডাক্তারের কাছে। আমি বুঝতেই পারিনি তোমার চাওয়াটুকু কতখানি তীব্র ছিল। নিজের জন্য কখনও কিছু চাওনি তোমরা, না তুমি না বাবা। তোমার চাওয়ার তীব্রতা বুঝবো কি করে বলো।

আমি বাংলাদেশে গেছি, মেয়ে বিয়ের বাজার করি, হিসেব নিকেশ করি, ছুটোছুটি করি, একবারও মনে পড়েনি, তুমি বলেছিলে আমার সাথে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। মেয়ে বিয়ে হলো জুন মাসে, মেয়ের বিরহ ভুলতে চলে গেলাম কলকাতা, সাত দিনের জন্য। তখনও মনে পড়েনি, তোমার শরীর খারাপের কথা। আমি ঘুরে এলাম জোড়াসাঁকো, দেশে ফিরে ঈদসংখ্যার জন্য লিখে ফেললাম ঠাকুরবাড়ির আঁতুড়ঘরে। দেশে ফিরেও আরও একমাস ছিলাম, মেয়ে বিরহে পাগল আমি ঘুরে বেড়াই, জাফলং, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, ঢাকা শহর। পার্টিতে যাই, নিজের ঘরে পার্টি করি, ভুলে যাই তুমি বলেছিলে, আমি এলে আমার সাথে ডাক্তার দেখাতে যাবে।

আমার অভিমানী মা তুমি, আমার উপর কী ভীষণ অভিমান হয়েছিল তোমার। আমি যদি জুন মাসে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম, হাতে কিছুটা সময় পেতাম চিন্তা ভাবনা করার। মা, কেন আমার উপর অভিমান করেছিলে? কেন মুখ ফুটে বললেনা তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা? আমাকে বিয়ে দেয়ার পর কি তোমার মন-মাথা সুস্থির ছিল? তুমি কি তখন তোমার মায়ের শরীরের সংবাদ নিতে? নিশ্চয়ই ঐ মুহূর্তে এসব কথা মনে পড়েনা। আমারও মনে পড়েনি, মনে যদি পড়তো, আজকে হয়তো এই চিঠি আকাশের ঠিকানায় না লিখে নারায়ণগঞ্জের ঠিকানায় লিখতাম। বড্ড বেহিসেব হয়ে গেছে।

মা, যতবার দেশে যেতাম, তুমি মনোযোগ দিয়ে আমাদের মুখ থেকে যাত্রাপথের বর্ণনা শুনতে, আমি, মৌটুসী, মিশা ৩৬ ঘন্টার জার্নিতে যত মজার কান্ড ঘটতো, সব অভিনয় করে দেখাতাম। কী সুন্দর আড্ডা হতো আমাদের ঘরে, তুমি, ছোট মাসি, মেজদা, রানু, অপু, তোমার দুই বৌমা, মামাবাবু, আমরা একসাথে কী আড্ডাটাই না দিতাম। এত বড় বাড়ির অন্য ভাড়াটে বৌদিরাও যোগ দিত আড্ডায়, আমাকে সবাই মিঠু ঠাকুরঝি, মিঠুদি ডাকে ওরা, আমি দেশে গেলে নারায়ণগঞ্জ বাসার পাড়া প্রতিবেশীরাও খুশী হয়।

ভেবেতোছিলাম, তোমাকে সজ্ঞানে পাব, হাসপাতালে দিনরাত কাটাবো, ক্যান্সারের অসহ্য যন্ত্রণার কথা শুনেছি, কিন্তু যন্ত্রণার ভয়াবহতা আন্দাজ করতে পারিনা এখনও। ভেবেছিলাম, তোমাকে আমার ২৭ ঘন্টার জার্নির গল্প শুনিয়ে ক্যান্সারের যন্ত্রণা ভুলিয়ে রাখবো। কত মজার গল্প জমেছিল স্টকে, শুনলে তোমার রোগ যন্ত্রণা ভুলে যেতে, একা একা আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ চলে যাওয়া, সোজা কথা? কিন্তু গল্প শোনাবো, তা আর হলো কই? আমি প্লেনে বসে মৌটুসীর বাবার ফোন কল পেলাম, তোমার শারীরিক অবস্থার অবনতির গতি স্লো হয়েছে। আমি গিয়ে না পৌঁছা পর্যন্ত তোমাকে অপারেশান টেবিলে নিবেনা। কপাল আমার, সারা পথ আমি শান্তি মনে এলাম তোমার শরীর স্ট্যাবল আছে শুনে, এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করতে এলো টুম্পার বাবা, অঞ্জন দা। অঞ্জনদার মুখের চেহারাটাই এমন যে সব সময় হাসে। সেই কাক ডাকা ভোরেও হেসেছি্‌ল, অঞ্জনদার হাসিতে আমি নিশ্চিন্ত বোধ করেছিলাম কিনা জানিনা, কিন্তু কোথাও একটা শূন্যতা অনুভব করছিলাম। মাত্র দুই মাস আগে এই পথেই আমেরিকা ফিরে গেছিলাম, তখন চারদিক প্রাণবন্ত ছিল, দুই মাস পর এয়ারপোর্টের ভেতরেও কেমন নিস্তব্ধতা টের পাচ্ছিলাম। হয়তো সবই স্বাভাবিক ছিল, আমার মনের অবস্থাটাই স্বাভাবিক ছিলনা। লাগেজ বেল্টের সামনে দাঁড়িয়েছি, আমার সামনে দিয়েই আমার স্যুটকেস দুইবার চলে গেলো, আমি চিনেও চিনলামনা।

গাড়িতে উঠেই অঞ্জনদাকে বললাম, আমাকে হসপিটালে নিয়ে চলেন। অঞ্জনদা বললেন, আগে আমাদের বাসায় চলেন। আমি বললাম, না দাদা, স্যুটকেস নিয়ে আমি সরাসরি মায়ের কেবিনে যাব। ওখানেই থাকবো। অঞ্জনদা যখন বলল, মাসীমাতো কেবিনে নেই। আমার কান বন্ধ হয়ে গেলো, কিছু শুনতে পারছিলামনা। তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করলাম, মা কেবিনে নেই মানে কি? মা মরে গেছে?
অঞ্জনদা কায়দা করে কথা বলতে পারেনা, অল্পেই ঘেমে নেয়ে যায়। আমাকে বলল, মাসীমার অপারেশান হয়েছে গত রাতে, এখন আইসি ইউতে আছে, জ্ঞান ফিরেনি। মা, এই কথা শোনার জন্য কি আমি বাংলাদেশে গেছিলাম? মা, তুমি কি জানো, বাংলাদেশে যাব কি যাব না, এই নিয়ে আমি কত ভেবেছি? সেপ্টেম্বার মাসে তোমার অবস্থার অবনতি হচ্ছিলো কিন্তু আমরা বুঝিনি অথবা ভাবিনি যে এটা অবনতি। আমরা শুধু আশার আলো দেখি, ২১শে সেপ্টেম্বার আমার জন্মদিনে তুমি আমার সাথে কত কথা বললে ফোনে। আমি তখনও চিন্তা করিনি তোমাকে দেখতে যাওয়ার কথা। তোমার একটু ভাল নার্সিং দরকার, সেটা ভেবে যেতে চেয়ে তোমাকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, মা আমি আসবো? মৃত্যুর দরজায় দাঁড়িয়ে তুমি বলেছিলে, কি করবি এসে? এই কয়দিন আগেই এত টাকাপয়সা খরচ কইরা গেলি মাইয়া বিয়ায়, তুই আসলেই কি আমার ব্যথা কমে যাবে?

আমি তখন দোনামোনা করছি, যাব কি যাবনা। ২৫/৩০ হাজার ডলার খরচ করে এসেছি মাত্র দুই মাস আগে, এখন আবার তিন হাজার ডলার খরচ করে গিয়ে কি হবে? ১৫ দিন পরে চলে আসতে হবে, মায়ের শরীর যদি এরপরে খারাপ হয়? অথবা মা যদি সুস্থ হয়ে যায় তাহলে এই তিন হাজার ডলার খরচ অযথা। মা, গরীবের মনটাও গরীব হয়, তাই এমন গরীবী ভাবনা করছিলাম। দেশে ফোন করলে মেজদা বলে, তোর আসার দরকার নাই। আমরাই আছি, মায়ের শরীর ভাল হলেই রেডিও থেরাপী দেয়া হবে।
আমার স্বামী নিজ থেকে কিছু বলছেনা দেখে ভেবেছি, বোধ হয় সেও চাইবেনা এখন আবার এতগুলো টাকা খরচ হোক। মা, ভুল, কী ভুল ধারণা করেছি! আসলে মুখ চাপা মানুষ সম্পর্কে এইজন্যই মানুষ ভুল ধারণা করে। আমি মৌটুসীর বাবাকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, আমার কি করা উচিত? মৌটুসীর বাবা এমন তীব্রভাবে আমাকে বলল, আমার মা বা বাবা যদি এমন অসুস্থ হতেন, আমি সব ফেলে চলে যেতাম। আসলে মেয়েদের মনটাই তৈরী হয় ভাবনার দোলাচল দিয়ে। সংসারে মেয়েরা নিজেকে কখনও ডিসিশান মেকার হিসেবে ভাবেওনি, অন্যেরাও মেয়েদের ডিসিশন মেকার হিসেবে কল্পনা করেনি। তাই বিয়ের আগে মেয়ে ডিসিশন চায় বাপ ভাইয়ের কাছে, বিয়ের পর চায় স্বামী, পুত্রের কাছে। আমিও চেয়েছিলাম, প্রথমে বাপ-ভাইয়ের কাছে, পরে স্বামীর কাছে।

মা, মৌটুসীর বাবার এই কথাটুকু আমার নিথর দেহে প্রাণ সঞ্চার করেছিল। ওটা ছিল সেপ্টেমবারের ২৮ বা ২৯ তারিখ। আমি ফেসবুকেও লিখেছিলাম, আমার কি করা উচিত? তখন আমার বন্ধু সংখ্যা ছিল খুব কম, সকলেই বলেছিল দেশে যেতে। দেশ থেকে অবশ্য মেজদা আর রানু বলেছিল, তুমি ভাল আছো। কিন্তু একেবারে শেষের দিকে মেজদা বলেছিল, মিঠু, মা মনে হয় বাঁচবেনা। কিছু খাচ্ছেনা, না খেলে মানুষ বাঁচে?

২৮ তারিখে ওয়ালমার্টে গেলাম, সহকর্মীদের কাছে বললাম মায়ের অবস্থার কথা, সহকর্মীদের সকলে বলল, কালকেই দেশে চলে যেতে। বললাম, মাত্র তিন মাস আগেই আড়াই মাস ছুটি কাতিয়ে এসেছি, হাতে ছুটি নেই। ওরা বলল, আগে বাবা-মা, পরে চাকরী। এই চাকরী চলে গেলে আরও চাকরী পাবে, কিন্তু মা চলে গেলে মা পাবেনা। মা, আমরা আমেরিকানদের সম্পর্কে কত ভুল ধারণা পোষণ করি। আমরা বলি, আমেরিকানরা মা-বাবার খোঁজ নেয়না, ওল্ড হোমে রেখে দেয়। আমেরিকা না এলে আমিও এমনই ভাবতাম। ওয়ালমার্টে দশ বছর চাকরী করে আমার অনেক ধারণাই বদলে গেছে। আমেরিকানরা ওদের বাবা-মাকে অনেক ভালোবাসে, হয়তো আমাদের মত করে নয়, ওদের মত করেই ভালোবাসে। আমেরিকান বাবা মায়েদের খুব কমই আছে যারা বাঙ্গালী বাবা মায়ের মত ছেলেমেয়ে দেখেনা আমাকে বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

হিউম্যান রিসোর্স অফিসে গিয়ে এক মাসের ছুটি চাইলাম। বললাম, মা মৃত্যু শয্যায়। ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়, তুমি যে সত্যিই মৃত্যুশয্যায় তাতো ভাবিনি, শুধু ছুটি পাওয়ার জন্য আমি অতি অভিনয় করে মৃত্যুশয্যায় কথাটা বলেছিলাম। কাজ হয়েছিল এই কথায়, একজন অফিসার আছে , মারিয়া নাম, সে একটা ফরম বের করে সেখানে সব তথ্য ফিল আপ করে আমাকে দিল, বলল বাংলাদেশের ডাক্তারের কাছে ফ্যাক্স করে দিতে, ডাক্তার ওখান থেকে যদি বলে, তোমার মায়ের অবস্থা মরণাপন্ন, তাহলে তুমি এক মাসের ছুটিই পাবে।
আমি বার বার তিনবার জিজ্ঞেস করেছি মারিয়াকে, সত্যুই বলছোতো? আমি এক মাসের ছুটি পাব? তিনবারই মারিয়া বলেছে, পাবে।
আমি বাসায় এসে সেই ফরম মৌটুসীর বাবাকে দিলাম, মৌটুসীর বাবা সাথে সাথে ফ্যাক্স করে অপুকে পাঠালো, অপু নিয়ে গেলো ডাক্তারের কাছে, ডাক্তার সব ইয়েস করে দিল, অপু ফিরতি ফ্যাক্স পাঠিয়ে দিল। ৩০ তারিখে আমি সেই ফরম নিয়ে আবার গেলাম মারিয়ার কাছে। মারিয়া ফরম জমা রাখলো, বলল, প্লেনের টিকেট কেটে ফেলতে। আমি কাজে ফিরে গেলাম, কাজ থেকেই মৌটুসীর বাবাকে ফোন করে বললাম, টিকেট কিনে ফেলতে।

ঘন্টাখানেক পরেই ওয়ালমার্টের স্টোর ম্যানেজার ডেকে পাঠালো, যাওয়ার পরেই ম্যানেজার বলল, তোমার মায়ের অবস্থা খারাপ জেনেছি, আমিও ব্যথিত। কিন্তু তুমিতো এক মাসের ছুটি পাবেনা। তুমি অলরেডি আড়াই মাস ছুটি কাটিয়েছো, এখন পাবে দেড় সপ্তাহের ছুটি। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি, ওখানেই কাঁদতে শুরু করেছি। আমার কান্না দেখে ম্যানেজার নিজেও অস্বস্তিতে পড়ে গেছে, বার বার আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে। আমার তখন মানসিক অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেছে , পারলে আমি ম্যানেজারের পায়ের উপর পড়ে যাই। আমার কান্না দেখে ম্যানেজার বলল, একটু অপেক্ষা করো, আমি এরিয়া সুপারভাইজারের সাথে কথা বলি

আমি আবার ফ্লোরে চলে এলাম, অন্য এসোসিয়েটরা আমাকে বলল, এরিয়া সুপারভাইজারকে সরাসরি ফোন করতে। ওরা ফোন নাম্বার দিল, আমি ফোন করেছি দুইবার, দুইবারেই মেসেজে চলে গেছে। আমি মেসেজ রেখেছি আমাকে কল ব্যাক করার জন্য। কোন কল আসেনি। বাসায় ফিরে আমি কি কান্না, মৌটুসীর বাবা বলল, তুমি যাও। আমি বললাম, ১০ দিনের জন্য গিয়ে আমি কি করব? যাওয়া আসাতেই চলে যাবে চার দিন। ছয়দিনের জন্য যাব? আবার মনের অগোচরে সেই গরীবী হিসেব চলে এলো। একদিনে টিকেট কিনতে লাগবে ২০০০ ডলার, দুই হাজার ডলার খরচ করে মাত্র ৬ দিন থাকবো? মা, গরীবের মনটাও গরীব হয়, তুমি ছিলে ধনীর কন্যা তাই তোমার মন গরীব ছিলনা, আমার বাবা ছিল গরীব হয়ে যাওয়া মায়ের পুত্র, তাই মনটা গরীব ছিল। আমার মনটাও গরীব। মৌটুসীর বাবা আমাকে বলে দিল, পরদিন কাজে গিয়ে যেন যা ছুটি দেয় তাই নিয়ে আসি, সেদিনই টিকেট কেটে ফেলবে।

পরদিন কাজে গেলাম, মনে আশা ছিল, স্টোর ম্যানেজার হয়তো গ্রীন সিগন্যাল দিবে। কো ম্যানেজার এক মহিলা আমাকে ডাকলো পার্সোনেলের অফিসে, সেখানে সেই মারিয়াও ছিল। ম্যানেজার মহিলা আমাকে সরাসরি বলল, তুমি সব মিলিয়ে আট দিনের ছুটি পাবে। এর বেশী সম্ভব নয়। আমার তখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, কান্না নয়, কঠিন গলাতেই বললাম, আমার মা মারা যাচ্ছে, দুই দিন আগে মারিয়া আমায় বলেছে, এক মাসের ছুটি পাব, ডাক্তারের কাছ থেকে ফরম সই করিয়ে এনেছি, মারিয়াকে আমি তিন বার জিজ্ঞেস করেছি, সত্যি এক মাস পাব কিনা। মারিয়া বলেছে, তিন সত্যি। এরপরেও স্টোর ম্যানেজার আমায় বলল, এরিয়া সুপারভাইজারের সাথে কথা বলবে, তা যদি নাও হয়, তবুও আমার নিজস্ব ছুটি এখনও দুই সপ্তাহ আছে, এখন তুমি আমাকে ডেকে বলছো আট দিন?

মারিয়া চুপ করে আছে, কো ম্যানেজার বলে, দুই সপ্তাহ কিভাবে হয়? আমার হিসেবে আট দিন হয়।

কো ম্যানেজার মহিলাটি দশ বছর আগে ছিল সাধারণ ক্যাশিয়ার, তা থেকে কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার, তা থেকে সাঁই করে কো ম্যানেজার হয়ে গেছে। কো ম্যানেজার অংকে এত কাঁচা হয় কি করে?

রাগে শরীর আমার কাঁপছিল, আমি ক্যালেন্ডারে হিসেব গুনে দেখাচ্ছিলাম তবুও ম্যানেজার বুঝেনা। এক সময় বলে, আটদিন ছুটি, তুমি নিবে কি নিবেনা তাই বলো।

আমি বললাম, আমার পাওনা ছুটি পনেরো দিন, আমি পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছি, তুমি বুঝতে পারছোনা হিসেব। তুমি আমাকে আট দিনের ছুটি দিলে আটদিনের ছুটিই নেব, কারণ হাতে সময় নেই, আমার মা মরে যাচ্ছে। তবে এখানে স্পষ্টভাবে বলে যাই, তোমরা আমার প্রতি ইনজাস্টিস করছো, তোমরা আমার পাওনা ছুটি দিচ্ছোনা।

এই কথায় ম্যানেজার বিরক্ত হয়ে কাগজপত্র মারিয়ার দিকে ঠেলে দিয়ে বলে, ও কি বলছে আমি বুঝিনা, তুমি বুঝো কিনা দেখো। মারিয়া আমার হিসেব দেরীতে হলেও বুঝেছে এবং বলেছে আমার হিসেবই ঠিক। কো ম্যানেজার নিজেকে পরাজিত ভেবেই কিনা জানিনা, খুব বাজে ভাবে বলল, ১৭ তারিখের মধ্যে তুমি ফিরে না এলে তোমার চাকরি থাকবে তবে পজিশন হারিয়ে যাবে। বললাম, মানে কি? সে বলে, তুমি আর ফুল টাইম থাকবেনা, ফোন ডিপার্টমেন্টেও তোমার পজিশন থাকবেনা। অন্য যে কোন জায়গায় অপেনিং থাকলে সেখানেই কাজ করতে হবে। মহিলাটাকে আমি পছন্দ করতাম, কেমন পুতুল পুতুল ভাব আছে চলাফেরায়। সাদা গায়ের রঙ, সোনালী চুলের সুন্দরীকে দেখে মনে হচ্ছিলো, তুই এত নিষ্ঠুরতা দেখালি আমার সাথে, ভগবান তোকে ক্ষমা করুন



অঞ্জনদা যখন বলল, তুমি আই সি ইউতে, জ্ঞান ফিরেনি ঠিক তখন আমাদের গাড়ির বাম পাশের জানালা দিয়ে দেখলাম, ময়লা রঙের একটা ট্রেন কোথা থেকে যেন ঢাকার দিকে যাচ্ছে। ট্রেন দেখতে আমার কত ভাল লাগে, কিন্তু সেই সকালের ট্রেনটা খুব ময়লা ছিল।

তোমার
মিঠু

Friday, October 2, 2015

নয়ন সমুখে তুমি নাই

                                                                    ০১/১০/১৫


মা,                                            

কেমন আছো তুমি? দেখতে দেখতে তিন বছর পেরিয়ে গেলো, তুমি চলে গেছো দূরে, বহুদূরে। অথবা কোথাও যাওনি, আছো আমাদের সকলের মাঝে অদৃশ্য হয়ে। তোমায় অনুভব করি কিন্তু দেখতে পাইনা। তোমায় চিঠি লিখছি প্রায় দুই বছর পরে, গত দুই বছর কেন লিখিনি জানো?

তুমি মারা গেলে ২০১২ সালের ৮ই অক্টোবার তারিখে, এরপর অনেকদিন আমি ছিলাম ভীষণ এক ঘোরের মধ্যে। সেই ঘোর থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল এক ধরণের উন্মাদনা। আমায় পেয়ে বসেছিল চিঠি লিখার নেশায়। মনে আছে তোমার, তোমার মৃত্যুর পর প্রতি মাসের আট তারিখে আমি আকাশের ঠিকানায় তোমাকে চিঠি লিখতাম। সেই চিঠিগুলো লেখার সময় আমার কমপিউটার টেবিল চোখের জলে ভেসে যেত, অনেক সময় কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠতো। কেন কাঁদতাম জানো, তুমি মারা গেছো এই সত্যিটুকু মানতে পারতামনা। আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখছি অথচ মানতে পারছিনা তুমি আকাশে চলে গেছো। কি এক যন্ত্রণায় কেটেছে সময়টা। চিঠিতে কোনভাবেই তুমি মারা গেছো, তোমার মৃত্যু লিখতে পারতামনা। অথচ তোমার মৃত্যু আমাদের চোখের সামনে হয়েছে। আসলে আমি তখনও ভাবতাম, তোমার মৃত্যু হয়েছে এই কঠিন কথাটি শোনার জন্য তুমি প্রস্তুত ছিলেনা। কারণ তোমারতো মরবারই কথা ছিলনা। আমি এখনও ভাবি, তোমার মরবার কথা ছিলনা, মৃত্যুকে তোমার বরণ করতে হয়েছে। আমি তো জানি, কত জনের কত ভুলে তোমার মৃত্যু হয়েছে, সেই ভুল করনেওয়ালাদের মধ্যে আমি যেমন আছি, আছে ডাক্তারগণ। ধীরে ধীরে সবই লিখবো তোমাকে, তুমি অবাক হয়ে যাবে আমার সহজে বলা সত্যি কথাগুলো শুনে, মনে মনে বলবে, আমার মাইয়াটা এখনও ফাজিল রয়ে গেলো, কেমন করে সহজভাবে আমার মনে জমে থাকা দুঃখের কথাগুলি বলে দিচ্ছে। মানুষ শুনলে বলবে কি? মা, মানুষ কি বলবে তা নিয়ে আমি কি কখনও পরোয়া করেছি? তুমি কি ভাববে এটা নিয়েই কি কখনও পরোয়া করেছি? বাবার পক্ষ নিয়ে তোমার সাথে কত নাক মুখ নাচিয়ে কথা বলেছিনা?

মা, সেসব দিনের কথা মনে পড়লে কেমন জানি লাগে। জানো, সেদিন ফেসবুকে মুন তসলিমা শেখ নামের এক মেয়ের সাথে কথা হলো। মেয়ে নয়, মহিলা, আমারই বয়সী, আর কয়দিন পরেই ওর পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবে। ওর মা মারা গেছেন এই বছরেই, এপ্রিল মাসে। তসলিমা মুন মেয়েটা দারুণ অন্যরকম, আমার মত ভ্যাবলা নয়, তুখোড় মেয়ে। ফেসবুকে খুব ধারালো স্ট্যাটাস লিখে, ভীষণ সংস্কৃতিমনা। ও সেদিন বলেছিল, সেও নাকি আমার মত চোপাটি ছিল। মায়ের সাথে চোপা করতো, নিজের কাছে যা সঠিক মনে হতো, মাকে সে কথা শুনাতে ছাড়তোনা। আমিও যেমন ভাবিনি, তুমি মরে যাবে, মুনও ভাবেনি ওর মা মারা যাবেন। অথচ দুজনের মা মরে গেলে, এদিকে মেয়ে দুটো কাটা পাঁঠার মত যন্ত্রণায় ছটফট করে। মুন বলেছে, ওর হৃদয়টা নাকি এ ফোঁড় ও ফোঁড় হয়ে যায়।


যাই হোক, যা বলছিলাম, প্রতি মাসের আট তারিখে চিঠি লিখা শুরু করে একটানা এক বছরে দশখানা চিঠি লিখে ক্ষান্ত দিয়েছিলাম। তুমি অংকের শিক্ষক ছিলে, নিশ্চয়ই ভাবছো, প্রতি মাসে যদি একখানা চিঠি লিখে থাকি, বারো মাসে দশখানা চিঠি হয় কেমনে? মনে মনে বলছো, আমেরিকার মত উন্নত দেশে থাইকা দেখি মাইয়ার অংকের ঘিলু নষ্ট হইয়া গেছে। কে বলবে এই মাইয়া মেট্রিকে অংকে ৯৫ পাইছিল? মৌখিক অংকে কত ভাল ছিল মাইয়া, এখন কয়ে বারো মাসে দশ চিঠি?

মা, প্রথম দুই মাস কিছু লিখিনি, তখনতো আমি আমাতেই ছিলামনা। ২০১৩ সালের জানুয়ারীতে তোমায় প্রথম চিঠি লিখেছিলাম, অক্টোবারে শেষ চিঠি, তাহলে দশখানা চিঠিইতো হয়, তাইনা? অক্টোবার মাসে সিদ্ধান্ত নিলাম, যেদিন আমি লিখতে পারবো বা বলতে পারবো, আমার মা মারা গেছেন সেদিন থেকে আবার তোমাকে চিঠি লিখা শুরু করবো। আমার কথা শুনে মন খারাপ করছো? ভাবছো, বাহ! মেয়ে আমার মৃত্যু নিয়ে এখন বেশ ঘটা করে কথা বলছে। মেয়ে তাহলে এতদিনে মাকে ভুলে যেতে শুরু করেছে?

মা, অংকের হিসেব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মজার একটা কথা মনে পড়ে গেলো। এই কয়দিন আগে, ২৮শে সেপ্টেমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন ছিল। ১৯৪৭ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাই উনাকে ৬৮তম হ্যাপী বার্থডে বলে ফেসবুকে উইশ করেছি। ওমা, কয়েক ঘন্টা পরেই একটার পর একটা মেসেজ পাই, দিদি, শেখ হাসিনার ৬৯তম জন্মদিন লিখেছে পত্রিকায়, টিভি নিউজেও বলেছে ৬৯তম জন্মদিন। মা, এখনও সেই একই ভুল করে মানুষ, জন্মদিনের হিসেবে গোলমাল করে ফেলে। সোজা হিসেব বুঝেনা, আমি বললাম, বাচ্চার এক বছর পূর্ণ হলে প্রথম জন্মদিন পালন করো নাকি দ্বিতীয় জন্মদিন? সাধারণ নিয়মে বুঝিয়ে দিয়েছি বয়সের হিসেব, তবুও দেখবে, আগামী বছরও একই ভুল করবে। আমিতো ঠ্যাটা, এখনও ঠ্যাটাই আছি, বলে দিয়েছি, টিভিতে বা পত্রিকায় যে এই হিসেবের ভুল করেছে, সে মানস অংকে আমার চেয়ে কাঁচা।



মা, তিন বছরে আমি আগের চেয়ে সুস্থির হয়েছি, এখন যদিও আঙ্গুল কাঁপছে তুমি মারা গেছো কথা লিখতে, তবুও লিখছিতো, তাইনা? আমি এখন অনেক সুস্থির হয়েছি মা, কথা কম বলি। আগে বেশী কথা বলতাম তাই তুমি আমাকে ফাজিল মাইয়া, অসভ্য মাইয়া বলে কত বকাবকি করতে। আসলে তখন আমাদের জগৎটা ছিল একরকম, তোমার মৃত্যুর পর জগৎ পুরো বদলে গেছে। একজন মানুষের শারীরিক অনুপস্থিতি এমন বদলে দিতে পারে আশপাশ, চারপাশ জানা ছিলোনা। আফসোস লাগে, এখন আমি ভাল হয়ে গেছি তুমি দেখতে পাচ্ছোনা। নাহ! ভুল বলেছি, তুমি দেখতে পাচ্ছো, আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছিনা, কিন্তু অনুভব করি। এই যে তোমাকে চিঠি লিখছি, তুমি কি বুঝতে পারছোনা? সবই বুঝতে পারছো, নিশ্চয়ই ঠোঁট চেপে মুচকী হাসছো। তোমাকে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে মা।


কয়েকদিন আগে হঠাৎ খেয়াল হলো, সোনার গয়নাগুলো গুছিয়ে রাখার কথা। সোনার গয়না কী-ইবা আছে আমার, আমি সোনার গয়নার জন্য কখনও লালায়িত ছিলামনা। তবুও টুকিটাকি যা আছে, সেটিও ফেলনা নয়। আমি এখনও অগোছালোই রয়ে গেছি, তুমি চলে যাওয়ার পর আরও বেশী অগোছালো হয়ে গেছি। সোনার গয়না কোথায় রেখেছি সেটাই মনে করতে পারছিলামনা। একটা ব্যাগে কয়েকটি বাক্স পেলাম, বাক্সে টুকিটাকি গয়না। আমি কি করেছি শোন, আমার বিয়ের গয়নাগুলো তিন মেয়ের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে দিয়েছি। সোনার বালা জোড়া দিয়েছি মৌটুসীকে, মিশাকে দিয়েছি বরের বাড়ি থেকে পাওয়া বৌভাতের গয়না, আর বিয়ের মূল গয়না সব মিথীলার জন্য। মিথীলাকে বেশী দিয়ে দিচ্ছি? দিলে দিয়েছি, বেশ করেছি। মিথীলাতো আমাকে বেশীদিন পাবেনা, মিশা মৌটুসী আমাকে ওর চেয়ে অনেক বেশী দিন পেয়েছে, মিথীলা আমাকে পেলো মাত্র পনেরো বছর, হোস্টেলে চলে গেলো, আরতো আমার কাছে আসবেনা, তাইনা? আমি মরে গেলে মিথীলা আমার গয়নার মাঝেই আমাকে খুঁজবে।

শোন ঘটনা কি হয়েছিল, গয়নার বাক্স ঘাঁটবার সময় আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল, কেন জানো তো? তোমাকে বলা হয়নি, তোমার বিয়ের নেকলেসটা আছে না? যেটা ছোট বৌকে দিয়েছিলে, সেই নেকলেস গতবছর দেশ থেকে ফেরার সময় তোমার ছোট বৌমা মিথীলাকে উপহার হিসেবে দিয়েছে। অনিতা যখন নেকলেস আমার হাতে দিয়ে বলেছিল, ফুলদি, মায়ের এই নেকলেসটা মিথীলাকে দিলাম, মায়ের শখের জিনিস, মায়ের চিহ্ন আর কাউকে দিলামনা, মিথীলা খুব গোছানো মেয়ে, মিথীলা যত্নে রাখবে। আমি থতমত খেয়ে বলেছি, সেকি! মা এই নেকলেস তোমাকে দিয়েছে, তুমি কেন মিথীলাকে দিচ্ছো। অনিতা বলল, মিথীলারেই দিলাম, আমি যাইই কোথায় যে নেকলেস পরবো। মিথীলার বিয়েতো দেখতে পারবোনা, ছোট মামা-মামীর তরফ থেকে মিথীলাকে উপহার দিলাম।  একবার বলতে চেয়েছিলাম, অতনুর জন্য রেখে দাও,কিন্তু বলিনি। অনীতা নিশ্চয়ই কষ্ট পেতো। হয়তো মনে মনে বলতো, ফুলদি, জানেনইতো, অতনু আর দশটা ছেলের মত স্বাভাবিক হয়নি, ও যে অটিস্টিক তাতো সকলেই জানে। ও নিজের যতনই করতে পারেনা, নেকলেসের মর্ম বুঝবে কি। থাক, অতনু আমাদের অতনু সোনা হয়েই থাক।

নেকলেস হাতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছিলো, তোমার বিয়ের সকল গয়না ভেঙ্গে নতুন গয়না গড়িয়ে আমায় বিয়েতে দিয়েছিলে। নেকলেসটাও ভাঙ্গতে চাইছিলে, তখন দিদিমা তোমাকে বলল, তোর বিয়ের নেকলেসটা ভাঙ্গিসনা, রানুর বৌয়ের জন্য রেখে দে। রানু তোর কত যত্ন করে, সকালে বিকালে চা বানিয়ে খাওয়ায়, যখন যা কস তাই শোনে, নেকলেসটা ওর জন্যই রেখে দে
তুমি নেকলেস ভাঙ্গলেনা। এই নেকলেসটা আমার কাছেও খুব ভাল লাগত, যদিও তোমার গলায় কখনও দেখিনি। তোমার গলায় থাকতো সোনা বাঁধানো ঝিনুকের লকেটসহ চেইন। ঝিনুকের লকেটটা এখনও আমার চোখে ভাসে। লকেটের শেপটা ছিল অসম বাহু চতুষ্কোণা। লকেটের চারধার সোনার লতাপাতায় বাঁধানো, মাঝখানে জোড়া ময়ূর। তখন এই সৌন্দর্য্যের মানে বুঝতামনা, আমার বিয়ের গয়না বানাতে সেই অদ্ভুত সুন্দর ঝিনুক লকেট চেইনটাও ভেঙ্গে ফেললে। বড়লোক বাপের মেয়ের যদি গরীব স্বামীর ঘর করতে হয়, সেই মেয়েটিকে তোমার মত নির্লোভ, উদার, বাসনাহীন হলে মানিয়ে যায়।

আমি তোমার মত নির্লোভ, উদার ছিলামনা। তোমার নেকলেসটার দিকে আমার নজর ছিল। রানুর বিয়ের সময় আমরা অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরেছি, আমার স্বামী ভাল বেতনের চাকরিতে ঢুকেছে, আমি আর গরীব নই। তুমি যখন ছোট বৌকে দেবে বলে নেকলেস আবার সোনা রঙ করাচ্ছো, আমি বললাম, মা, এই নেকলেসের যা ওজন, সেই সমান ওজনের সোনা দিয়ে আরেকটি নেকলেস বানিয়ে দেই, নতুন নেকলেসটা বৌকে দাও, তোমার বিয়ের এই নেকলেসটা আমাকে দিয়ে দাও। পুরনো জিনিসের প্রতি আমার দারুণ আকর্ষণ, শুধু স্মৃতি রক্ষা করতে ভালো লাগে। আমার কথায় তুমি একটু থমকেছিলে, বলেছিলে, তোর দিদিমা কইছিল, রানু আমার এত যত্ন করে, তাই নেকলেসটা রানুর বৌকে দিতে। তোর দিদিমা মারা গেছে কবে, কথাটা রয়ে গেছে
মরীয়া হয়ে আমি বলেছিলাম, মা, আমিতো সমান ওজনের স্বর্ণ দিয়েই নতুন নেকলেস বানিয়ে দেব, বৌয়ের কাছে নেকলেসটাই শাশুড়ির উপহার, এর ইতিহাসতো গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার কাছে থাকলে আমি জানবো, এই নেকলেসটা আমার মায়ের গলায় ছিল, তুমি যখন থাকবেনা তখন নেকলেসের গায়ে তোমার পরশ থাকবে
তুমি বলেছিলে, অপেক্ষা কর, রানুকে জিজ্ঞেস করে দেখি
রানুকে জিজ্ঞেস করতেই রানু বলেছিল, নাহ! মায়ের চিহ্ন শুধু মেয়েই মূল্য দিবে, কেন ছেলে হলে কি মূল্য দিতে পারেনা?

নেকলেস আর পাওয়া হলোনা। তোমার মৃত্যুর পরে আমাদের চার ভাইবোনের জীবনের নামতা উলটাপালটা হয়ে গেছে মা। কতকাল পরে হঠাৎ করে রানু আর অনিতা নেকলেসটা আমাকে দিয়ে দিল, মিথীলাকে দেয়ার জন্য। মা, আমরা কেউই নিজেদের কাছে তোমার নেকলেস রাখলামনা, নেকলেস ছাড়াই তোমার চিহ্ন আমাদের হৃদয়ে রয়ে গেছে।

যে কথা বলছিলাম, সেদিন গয়না গুছাতে গিয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে গেছিলো কারণ তোমার নেকলেসের বাক্স খুঁজে পাচ্ছিলামনা। কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলামনা, অত্যন্ত দামী বলে কি আরও বেশী যত্নে আর কোথাও রেখেছিলাম? সেটাও মনে করতে পারছিলামনা। বার বার মনে পড়ছিল, অনিতার কথা, কত যত্ন আর বিশ্বাসে কলজে ছেঁড়া ধন আমার হাতে তুলে দিয়েছিল, আর আমি কিনা তা খুঁজে পাচ্ছিনা? যখন হাত পা ছেড়ে দেয়ার জোগাড়, তখনই পাঁচবার দেখা হয়ে যাওয়া ব্যাগে ষ্ঠবার হাত দিতে ম্যাজিকের মত নেকলেসের বাক্স হাতে পেলাম। বাক্স খুলে দেখলাম নেকলেসটাকে, হাত রাখলাম নেকলেসের গায়। তোমার ছবির দিকে তাকালাম, ছবিতে তুমি হাসছোনা অথচ আমি স্পষ্ট দেখলাম তুমি হাসছো। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, তোমার কাছে আবার চিঠি লেখা শুরু করব। আজ ১লা অক্টোবার নতুন করে চিঠি লিখতে বসলাম।

তোমার

মিঠু