০৩/১০/১৫
মা,
মিসিসিপিতে এখন রাত বারোটা বেজে বারো
মিনিট, বাংলাদেশে অক্টোবারের ৩ তারিখ, বেলা ১১টা বেজে ১২ মিনিট। এখন বাংলাদেশের
সাথে মিসিসিপির ১১ ঘন্টা ব্যবধান। তিন বছর আগের এই দিনে আমি তখন হসপিটালের সুবিশাল
অট্টালিকা বিল্ডিং এর তিন তলায় আই সি ইউ’র ওয়েটিং রুমে বসে
আছি। এই দিনেই সকালে ঢাকা পৌঁছেছি, আমি একা। হ্যাঁ মা, যে আমি রাস্তায় বেরোলে দিক
হারিয়ে ফেলতাম, যে আমি নারায়ণগঞ্জ শহরে বড় হয়েও নারায়ণগঞ্জ ডি আই টি মার্কেট,
সান্ত্বনা মার্কেট, শীতল মার্কেট চিনিনা, সে আমি আমেরিকা থেকে একা একা বাংলাদেশে
চলে গেছিলাম। কোথাও হারিয়ে যাইনি। এখনও আমি মাঝে মাঝে ভাবি, কি করে একা চলে
গেছিলাম?
এরপরেও আমি আরেকবার দেশে গেছি মা, ২০১৪
সালে। বইমেলায় গেলাম, সেবছরই আমার লেখা প্রথম বই ‘ঠাকুরবাড়ির
আঁতুড়ঘরে’ প্রকাশিত হলো। হুম, আমি বই লিখেছি, তোমার ভাষায় ‘ফাজিল মাইয়া, অসভ্য মাইয়া’ রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের জোড়াসাঁকোর বাড়ির পটভূমিকে সামনে রেখে বিশাল বড় বই লিখে ফেলেছে। এই
কথাটুকু লিখতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ২০১২ সালের মে মাসে বাংলাদেশে গেলাম,
সবাই মিলে গেলাম। মৌটুসীর বিয়ে হবে দেশের মাটিতে, দাদু দিদার উপস্থিতিতে, তাই
নিয়েই মহাব্যস্ত ছিলাম। মহাব্যস্ততো থাকবোই, কন্যার পিতা যদি আলাভোলা হয়, প্লেনে
চড়তে ভয় পাওয়া কন্যার পিতাকে যদি ধরে বেঁধে প্লেনে চড়িয়ে দেশে নিয়ে যেতে হয়, দেশে
গিয়ে কন্যা বিয়ের আয়োজন যদি কন্যার মা’কে দেখভাল করতে
হয়, কন্যার মা’কে তো মহাব্যস্ত থাকতেই হবে।
মা, আমার বিয়ের সময় কি তুমি মহাব্যস্ত
ছিলে? ছিলেনা, কারণ বাবা ছিল ঘোর সংসারী, বাবাই সব কিছু সামাল দিয়েছে। অবশ্য এইসব উৎসব আয়োজনে আমার
দাদু ছিলেন যথেষ্ট দায়িত্বশীল।
তুমি তো ছিলে বাবার বিপরীত, মোটেও সংসারী
ছিলেনা। সংসার কোথা দিয়ে কিভাবে চালাতে হয় তা নিয়ে ভাবতে হতো না তোমাকে। ধনী পিতার
আদুরে সন্তান ছিলে, সাধারণ মধ্যবিত্তের সংসারে তোমায় মানাবে কি করে? তবুও তুমি
মানিয়ে নিয়েতোছিলে।
এখনও মনে পড়ে, সন্ধ্যেবেলা বাবা আমাদের
ইংরেজী পড়াতো, একই সময় তোমার কাছে বাজার খরচের হিসেব চাইতো। তুমি হিসেব দিতে, বাবা
হিসেবের খাতায় তা লিখে রাখতো। হিসেব লিখতে গিয়ে ধরা পড়তো তুমি হিসেবের বাইরে বাজার
করিয়েছো। বাবা হিসেব করে টাকা দিত বাজারের জন্য, তুমি হিসেবের বাইরে খরচ করতে।
প্রতিদিন বাবা তোমাকে বকতো অতিরিক্ত
খরচের কারণে, তুমি বাবার বকাগুলো এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিতে।
তখন বাবার রাগ দেখলে ভয় পেতাম, এখন বুঝতে পারি, তোমাদের এই দৈনন্দিন হৈ চৈ টুকু
ডাল ভাত খাওয়ার মত প্রাত্যহিক অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছিল। আমি কিন্তু তোমাদের
দৈনন্দিন বাজারের হিসেব নিকেশের নাটক দেখে দারুণ শিক্ষা নিয়েছিলাম। নিজের সংসার
জীবনে আমার স্বামীর অপছন্দের কাজগুলো করতে যাইনি।
তুমি ছিলে পদ্মপাতার মত, গায়ে জল পড়লে সে
জলের ফোঁটা পাতায় লাগতোনা। আমি আবার তা নই, তোমার পেটে জন্মেও পদ্মপাতা হইনি,
হয়েছি জলবিছুটি। গায়ে জলের ফোঁটা পড়লে গা চুলকুনি শুরু হয়ে যায়। কাজেই গা চুলকুনি
হয় এমন কাজই করিনি।
বাজারের হিসেবে গোলমাল হতো মাছ নিয়ে, তুমি
ছিলে মাছের পোকা, প্রতিদিন মাছ ছাড়া তোমার চলতোনা, তেমন আহামরি কোন মাছ নয়, দুই
তিন ভাগা কেচকি, অথবা মলাইয়া মাছ। মাছ রান্না করতে এত্তগুলো আলু বেগুন ঝিঙ্গে কুচি
মিশিয়ে, আমার মেজাজ গরম হয়ে যেত। এমন সস্তা মাছ খাওয়ার চেয়ে নিরামিষ তরকারী অনেক
বেশী ভাল মনে হতো। কিন্তু তুমি মাছের সাথে কোন কমপ্রোমাইজ করতে চাইতেনা। মাছের
গন্ধটুকু দিয়েই তোমার ভাত খাওয়া হয়ে যেত।
বাবার পছন্দ ছিল নিরামিষ, বলতো সপ্তাহে
দুই দিন নিরামিষ খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। তুমি মানতে চাইতেনা, আড়ালে বলতে, “ তোর বাপে নিজেও মাছ ভালোবাসে, মাছের টুকরা যখন পাতে দেই, কাঁটাটাও চিবিয়ে
ছাতু কইরা ফেলে, এদিকে ভাব দেখায় নিরামিষ পছন্দ করে, আসল কারণ নিরামিষে খরচ কম হয়”।
আমি হয়তো ফোঁস করে উঠতাম, “ মা, নিরামিষে পয়সা কম খরচ হয় কে বলছে? ঘি, গরম মশলা কিনতে টাকা লাগেনা?”
তুমি কথা বদলে ফেলতে, বলতে,” কম বয়সে বাবা মারা গেছেতো, সংসারের হাল ধরার কেউ ছিলনা, বিধবা মা নিরামিষ
খাইতো, মায়ের সাথে তোর বাপ কাকারাও নিরামিষ খাইতো। তোর বাপে এত হিসাব হিসাব করে
কারণ, কষ্টের ভিতরে বড় হইছে, এখন কষ্ট করাই অভ্যাস হয়ে গেছে, টাকা খরচ করতে শিখে
নাই।“
মা, আসলে বাবারও দোষ ছিলনা, সেই ’৭২ থেকে ’৭৯ ছিল আমাদের জন্য কঠিন সময়, জিনিসের অগ্নিমূল্য, আমরা চার
ভাইবোন স্কুল-কলেজে পড়ি, বাবার একা রোজগার, তার উপর সততা। সাধারণ চাকরির পয়সায়
আমাদের লেখাপড়া ঠিকমত চালিয়ে নিয়েছে, তাতেই অনেক শোকরিয়া। তবে তোমারও দোষ দেখিনা,
তুমি হিসেবের বাইরে যাকিছু খরচ করতে, আমাদের জন্যই করতে। ‘নলা’ মাছের মাথা তোমার অতি পছন্দের, কিন্তু মাথা দিতে বাবার
পাতে, এরপর ক্রমানুসারে বড়দা, মেজদার পাতে। আমাকে দিতে চাক, নিজে খেতে মাছের লেজ।
উফ! নলা মাছ ছিল আমার দুই চোখের বিষ, কাঁটা গিজগিজ করতো। এই কাঁটার মধ্যেই তুমি কত
আনন্দ পেতে।
তুমি যখন গল্প করতে, দাদুর মক্কেল বিশাল
মাছ নিয়ে আসতো, জেলেরা মাছ ধরে ভাল মাছ পেলেই দাদুকে দিত, দাদু পয়সা দিয়েই কিনতো,
তবুও সেরা জিনিসটা পেতে। দিদিমার রান্নার হাততো দ্রৌপদীর মত ছিল, শুনতে শুনতে আমি
কল্পনার রাজ্যে চলে যেতাম। বিয়ের আগের সতের বছর বাপের ঘরে কত সুখে ছিলে, বাবা
মায়ের প্রথম সন্তান ছিলে তুমি। আমার বাবার হিসেবের সংসারে গিয়ে অনেক কিছুই তোমাকে
বাদ দিতে হয়েছিল হয়তো। তবুও তোমার মুখের হাসির কমতি ছিলনা।
মেয়ের বিয়েতে মহাব্যস্ত থাকার কথা
বলছিলাম, তখনও দেশে যাওয়ার কিছু দেরী আছে, তোমার সাথে ফোনে কথা বলি, তোমার প্রিয়
নাতনীর বিয়ে, অথচ তোমার কন্ঠে উচ্ছ্বাস নেই, সব কিছুতেই বলো, “ আগে দেশে আয়, দেশে এলেই সব হয়ে যাবে। দাদার কথা বলতে তুমি, “শংকর সব দেখবে”। আমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার শরীর ভালো আছে কিনা।
বলেছিলে, ভাল নেই। ডাক্তারের কাছে যেতে বলেছি, বলেছিলে, “তুই আয়, তুই আসলে তোর সাথে যাব ডাক্তারের কাছে”। আমি বুঝতেই
পারিনি তোমার চাওয়াটুকু কতখানি তীব্র ছিল। নিজের জন্য কখনও কিছু চাওনি তোমরা, না তুমি
না বাবা। তোমার চাওয়ার তীব্রতা বুঝবো কি করে বলো।
আমি বাংলাদেশে গেছি, মেয়ে বিয়ের বাজার
করি, হিসেব নিকেশ করি, ছুটোছুটি করি, একবারও মনে পড়েনি, তুমি বলেছিলে আমার সাথে
ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। মেয়ে বিয়ে হলো জুন মাসে, মেয়ের বিরহ ভুলতে চলে গেলাম
কলকাতা, সাত দিনের জন্য। তখনও মনে পড়েনি, তোমার শরীর খারাপের কথা। আমি ঘুরে এলাম
জোড়াসাঁকো, দেশে ফিরে ঈদসংখ্যার জন্য লিখে ফেললাম ‘ঠাকুরবাড়ির
আঁতুড়ঘরে’। দেশে ফিরেও আরও একমাস ছিলাম, মেয়ে বিরহে পাগল আমি ঘুরে
বেড়াই, জাফলং, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, ঢাকা শহর। পার্টিতে যাই, নিজের ঘরে
পার্টি করি, ভুলে যাই তুমি বলেছিলে, আমি এলে আমার সাথে ডাক্তার দেখাতে যাবে।
আমার অভিমানী মা তুমি, আমার উপর কী ভীষণ
অভিমান হয়েছিল তোমার। আমি যদি জুন মাসে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম, হাতে
কিছুটা সময় পেতাম চিন্তা ভাবনা করার। মা, কেন আমার উপর অভিমান করেছিলে? কেন মুখ
ফুটে বললেনা তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা? আমাকে বিয়ে দেয়ার পর কি তোমার
মন-মাথা সুস্থির ছিল? তুমি কি তখন তোমার মায়ের শরীরের সংবাদ নিতে? নিশ্চয়ই ঐ
মুহূর্তে এসব কথা মনে পড়েনা। আমারও মনে পড়েনি, মনে যদি পড়তো, আজকে হয়তো এই চিঠি
আকাশের ঠিকানায় না লিখে নারায়ণগঞ্জের ঠিকানায় লিখতাম। বড্ড বেহিসেব হয়ে গেছে।
মা, যতবার দেশে যেতাম, তুমি মনোযোগ দিয়ে
আমাদের মুখ থেকে যাত্রাপথের বর্ণনা শুনতে, আমি, মৌটুসী, মিশা ৩৬ ঘন্টার জার্নিতে
যত মজার কান্ড ঘটতো, সব অভিনয় করে দেখাতাম। কী সুন্দর আড্ডা হতো আমাদের ঘরে, তুমি,
ছোট মাসি, মেজদা, রানু, অপু, তোমার দুই বৌমা, মামাবাবু, আমরা একসাথে কী আড্ডাটাই না
দিতাম। এত বড় বাড়ির অন্য ভাড়াটে বৌদিরাও যোগ দিত আড্ডায়, আমাকে সবাই ‘মিঠু ঠাকুরঝি, মিঠুদি’ ডাকে ওরা, আমি
দেশে গেলে নারায়ণগঞ্জ বাসার পাড়া প্রতিবেশীরাও খুশী হয়।
ভেবেতোছিলাম, তোমাকে সজ্ঞানে পাব,
হাসপাতালে দিনরাত কাটাবো, ক্যান্সারের অসহ্য যন্ত্রণার কথা শুনেছি, কিন্তু
যন্ত্রণার ভয়াবহতা আন্দাজ করতে পারিনা এখনও। ভেবেছিলাম, তোমাকে আমার ২৭ ঘন্টার
জার্নির গল্প শুনিয়ে ক্যান্সারের যন্ত্রণা ভুলিয়ে রাখবো। কত মজার গল্প জমেছিল
স্টকে, শুনলে তোমার রোগ যন্ত্রণা ভুলে যেতে, একা একা আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ চলে
যাওয়া, সোজা কথা? কিন্তু গল্প শোনাবো, তা আর হলো কই? আমি প্লেনে বসে মৌটুসীর বাবার
ফোন কল পেলাম, তোমার শারীরিক অবস্থার অবনতির গতি স্লো হয়েছে। আমি গিয়ে না পৌঁছা
পর্যন্ত তোমাকে অপারেশান টেবিলে নিবেনা। কপাল আমার, সারা পথ আমি শান্তি মনে এলাম
তোমার শরীর স্ট্যাবল আছে শুনে, এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করতে এলো টুম্পার বাবা,
অঞ্জন দা। অঞ্জনদা’র মুখের চেহারাটাই এমন যে সব সময় হাসে। সেই কাক ডাকা ভোরেও
হেসেছি্ল, অঞ্জনদা’র হাসিতে আমি নিশ্চিন্ত বোধ করেছিলাম কিনা জানিনা, কিন্তু
কোথাও একটা শূন্যতা অনুভব করছিলাম। মাত্র দুই মাস আগে এই পথেই আমেরিকা ফিরে
গেছিলাম, তখন চারদিক প্রাণবন্ত ছিল, দুই মাস পর এয়ারপোর্টের ভেতরেও কেমন
নিস্তব্ধতা টের পাচ্ছিলাম। হয়তো সবই স্বাভাবিক ছিল, আমার মনের অবস্থাটাই স্বাভাবিক
ছিলনা। লাগেজ বেল্টের সামনে দাঁড়িয়েছি, আমার সামনে দিয়েই আমার স্যুটকেস দুইবার চলে
গেলো, আমি চিনেও চিনলামনা।
গাড়িতে উঠেই অঞ্জনদা’কে বললাম, আমাকে হসপিটালে নিয়ে চলেন। অঞ্জনদা বললেন, আগে আমাদের বাসায় চলেন।
আমি বললাম, না দাদা, স্যুটকেস নিয়ে আমি সরাসরি মায়ের কেবিনে যাব। ওখানেই থাকবো।
অঞ্জনদা যখন বলল, মাসীমাতো কেবিনে নেই। আমার কান বন্ধ হয়ে গেলো, কিছু শুনতে
পারছিলামনা। তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করলাম, মা কেবিনে নেই মানে কি? মা মরে গেছে?
অঞ্জনদা কায়দা করে কথা বলতে পারেনা,
অল্পেই ঘেমে নেয়ে যায়। আমাকে বলল, মাসীমার অপারেশান হয়েছে গত রাতে, এখন আইসি ইউতে
আছে, জ্ঞান ফিরেনি। মা, এই কথা শোনার জন্য কি আমি বাংলাদেশে গেছিলাম? মা, তুমি কি
জানো, বাংলাদেশে যাব কি যাব না, এই নিয়ে আমি কত ভেবেছি? সেপ্টেম্বার মাসে তোমার
অবস্থার অবনতি হচ্ছিলো কিন্তু আমরা বুঝিনি অথবা ভাবিনি যে এটা অবনতি। আমরা শুধু
আশার আলো দেখি, ২১শে সেপ্টেম্বার আমার জন্মদিনে তুমি আমার সাথে কত কথা বললে ফোনে।
আমি তখনও চিন্তা করিনি তোমাকে দেখতে যাওয়ার কথা। তোমার একটু ভাল নার্সিং দরকার,
সেটা ভেবে যেতে চেয়ে তোমাকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, মা আমি আসবো? মৃত্যুর দরজায়
দাঁড়িয়ে তুমি বলেছিলে, “ কি করবি এসে? এই
কয়দিন আগেই এত টাকাপয়সা খরচ কইরা গেলি মাইয়া বিয়ায়, তুই আসলেই কি আমার ব্যথা কমে
যাবে?”
আমি তখন দোনামোনা করছি, যাব কি যাবনা।
২৫/৩০ হাজার ডলার খরচ করে এসেছি মাত্র দুই মাস আগে, এখন আবার তিন হাজার ডলার খরচ
করে গিয়ে কি হবে? ১৫ দিন পরে চলে আসতে হবে, মায়ের শরীর যদি এরপরে খারাপ হয়? অথবা
মা যদি সুস্থ হয়ে যায় তাহলে এই তিন হাজার ডলার খরচ অযথা। মা, গরীবের মনটাও গরীব
হয়, তাই এমন গরীবী ভাবনা করছিলাম। দেশে ফোন করলে মেজদা বলে, তোর আসার দরকার নাই।
আমরাই আছি, মায়ের শরীর ভাল হলেই রেডিও থেরাপী দেয়া হবে।
আমার স্বামী নিজ থেকে কিছু বলছেনা দেখে
ভেবেছি, বোধ হয় সেও চাইবেনা এখন আবার এতগুলো টাকা খরচ হোক। মা, ভুল, কী ভুল ধারণা
করেছি! আসলে মুখ চাপা মানুষ সম্পর্কে এইজন্যই মানুষ ভুল ধারণা করে। আমি মৌটুসীর
বাবাকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, “ আমার কি করা
উচিত?” মৌটুসীর বাবা এমন তীব্রভাবে আমাকে বলল, “ আমার মা বা বাবা যদি এমন অসুস্থ হতেন, আমি সব ফেলে চলে যেতাম”। আসলে মেয়েদের মনটাই তৈরী হয় ভাবনার দোলাচল দিয়ে। সংসারে মেয়েরা নিজেকে কখনও
ডিসিশান মেকার হিসেবে ভাবেওনি, অন্যেরাও মেয়েদের ডিসিশন মেকার হিসেবে কল্পনা করেনি।
তাই বিয়ের আগে মেয়ে ডিসিশন চায় বাপ ভাইয়ের কাছে, বিয়ের পর চায় স্বামী, পুত্রের
কাছে। আমিও চেয়েছিলাম, প্রথমে বাপ-ভাইয়ের কাছে, পরে স্বামীর কাছে।
মা, মৌটুসীর বাবার এই কথাটুকু আমার নিথর
দেহে প্রাণ সঞ্চার করেছিল। ওটা ছিল সেপ্টেমবারের ২৮ বা ২৯ তারিখ। আমি ফেসবুকেও
লিখেছিলাম, আমার কি করা উচিত? তখন আমার বন্ধু সংখ্যা ছিল খুব কম, সকলেই বলেছিল
দেশে যেতে। দেশ থেকে অবশ্য মেজদা আর রানু বলেছিল, তুমি ভাল আছো। কিন্তু একেবারে
শেষের দিকে মেজদা বলেছিল, “ মিঠু, মা মনে হয়
বাঁচবেনা। কিছু খাচ্ছেনা, না খেলে মানুষ বাঁচে?”
২৮ তারিখে ওয়ালমার্টে গেলাম, সহকর্মীদের
কাছে বললাম মায়ের অবস্থার কথা, সহকর্মীদের সকলে বলল, কালকেই দেশে চলে যেতে। বললাম,
মাত্র তিন মাস আগেই আড়াই মাস ছুটি কাতিয়ে এসেছি, হাতে ছুটি নেই। ওরা বলল, আগে
বাবা-মা, পরে চাকরী। এই চাকরী চলে গেলে আরও চাকরী পাবে, কিন্তু মা চলে গেলে মা
পাবেনা। মা, আমরা আমেরিকানদের সম্পর্কে কত ভুল ধারণা পোষণ করি। আমরা বলি,
আমেরিকানরা মা-বাবার খোঁজ নেয়না, ওল্ড হোমে রেখে দেয়। আমেরিকা না এলে আমিও এমনই
ভাবতাম। ওয়ালমার্টে দশ বছর চাকরী করে আমার অনেক ধারণাই বদলে গেছে। আমেরিকানরা ওদের
বাবা-মাকে অনেক ভালোবাসে, হয়তো আমাদের মত করে নয়, ওদের মত করেই ভালোবাসে। আমেরিকান
বাবা মায়েদের খুব কমই আছে যারা বাঙ্গালী বাবা মায়ের মত ‘ছেলেমেয়ে দেখেনা আমাকে’ বলে দীর্ঘশ্বাস
ছাড়ে।
হিউম্যান রিসোর্স অফিসে গিয়ে এক মাসের
ছুটি চাইলাম। বললাম, মা মৃত্যু শয্যায়। ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়, তুমি যে সত্যিই
মৃত্যুশয্যায় তাতো ভাবিনি, শুধু ছুটি পাওয়ার জন্য আমি অতি অভিনয় করে মৃত্যুশয্যায়
কথাটা বলেছিলাম। কাজ হয়েছিল এই কথায়, একজন অফিসার আছে , মারিয়া নাম, সে একটা ফরম
বের করে সেখানে সব তথ্য ফিল আপ করে আমাকে দিল, বলল বাংলাদেশের ডাক্তারের কাছে
ফ্যাক্স করে দিতে, ডাক্তার ওখান থেকে যদি বলে, তোমার মায়ের অবস্থা মরণাপন্ন, তাহলে
তুমি এক মাসের ছুটিই পাবে।
আমি বার বার তিনবার জিজ্ঞেস করেছি
মারিয়াকে, সত্যুই বলছোতো? আমি এক মাসের ছুটি পাব? তিনবারই মারিয়া বলেছে, পাবে।
আমি বাসায় এসে সেই ফরম মৌটুসীর বাবাকে
দিলাম, মৌটুসীর বাবা সাথে সাথে ফ্যাক্স করে অপুকে পাঠালো, অপু নিয়ে গেলো ডাক্তারের
কাছে, ডাক্তার সব ইয়েস করে দিল, অপু ফিরতি ফ্যাক্স পাঠিয়ে দিল। ৩০ তারিখে আমি সেই
ফরম নিয়ে আবার গেলাম মারিয়ার কাছে। মারিয়া ফরম জমা রাখলো, বলল, প্লেনের টিকেট কেটে
ফেলতে। আমি কাজে ফিরে গেলাম, কাজ থেকেই মৌটুসীর বাবাকে ফোন করে বললাম, টিকেট কিনে
ফেলতে।
ঘন্টাখানেক পরেই ওয়ালমার্টের স্টোর
ম্যানেজার ডেকে পাঠালো, যাওয়ার পরেই ম্যানেজার বলল, “তোমার মায়ের অবস্থা খারাপ জেনেছি, আমিও ব্যথিত। কিন্তু তুমিতো এক মাসের ছুটি
পাবেনা। তুমি অলরেডি আড়াই মাস ছুটি কাটিয়েছো, এখন পাবে দেড় সপ্তাহের ছুটি। আমি
স্তম্ভিত হয়ে গেছি, ওখানেই কাঁদতে শুরু করেছি। আমার কান্না দেখে ম্যানেজার নিজেও অস্বস্তিতে
পড়ে গেছে, বার বার আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে। আমার তখন মানসিক অবস্থা এমন
পর্যায়ে চলে গেছে , পারলে আমি ম্যানেজারের পায়ের উপর পড়ে যাই। আমার কান্না দেখে
ম্যানেজার বলল, “ একটু অপেক্ষা করো, আমি এরিয়া সুপারভাইজারের সাথে কথা বলি”।
আমি আবার ফ্লোরে চলে এলাম, অন্য
এসোসিয়েটরা আমাকে বলল, এরিয়া সুপারভাইজারকে সরাসরি ফোন করতে। ওরা ফোন নাম্বার দিল,
আমি ফোন করেছি দুইবার, দুইবারেই মেসেজে চলে গেছে। আমি মেসেজ রেখেছি আমাকে কল ব্যাক
করার জন্য। কোন কল আসেনি। বাসায় ফিরে আমি কি কান্না, মৌটুসীর বাবা বলল, তুমি যাও।
আমি বললাম, ১০ দিনের জন্য গিয়ে আমি কি করব? যাওয়া আসাতেই চলে যাবে চার দিন।
ছয়দিনের জন্য যাব? আবার মনের অগোচরে সেই গরীবী হিসেব চলে এলো। একদিনে টিকেট কিনতে
লাগবে ২০০০ ডলার, দুই হাজার ডলার খরচ করে মাত্র ৬ দিন থাকবো? মা, গরীবের মনটাও
গরীব হয়, তুমি ছিলে ধনীর কন্যা তাই তোমার মন গরীব ছিলনা, আমার বাবা ছিল গরীব হয়ে
যাওয়া মায়ের পুত্র, তাই মনটা গরীব ছিল। আমার মনটাও গরীব। মৌটুসীর বাবা আমাকে বলে
দিল, পরদিন কাজে গিয়ে যেন যা ছুটি দেয় তাই নিয়ে আসি, সেদিনই টিকেট কেটে ফেলবে।
পরদিন কাজে গেলাম, মনে আশা ছিল, স্টোর
ম্যানেজার হয়তো গ্রীন সিগন্যাল দিবে। কো ম্যানেজার এক মহিলা আমাকে ডাকলো
পার্সোনেলের অফিসে, সেখানে সেই মারিয়াও ছিল। ম্যানেজার মহিলা আমাকে সরাসরি বলল, “তুমি সব মিলিয়ে আট দিনের ছুটি পাবে। এর বেশী সম্ভব নয়”। আমার তখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, কান্না নয়, কঠিন গলাতেই বললাম, আমার মা মারা
যাচ্ছে, দুই দিন আগে মারিয়া আমায় বলেছে, এক মাসের ছুটি পাব, ডাক্তারের কাছ থেকে
ফরম সই করিয়ে এনেছি, মারিয়াকে আমি তিন বার জিজ্ঞেস করেছি, সত্যি এক মাস পাব কিনা।
মারিয়া বলেছে, তিন সত্যি। এরপরেও স্টোর ম্যানেজার আমায় বলল, এরিয়া সুপারভাইজারের
সাথে কথা বলবে, তা যদি নাও হয়, তবুও আমার নিজস্ব ছুটি এখনও দুই সপ্তাহ আছে, এখন
তুমি আমাকে ডেকে বলছো আট দিন?
মারিয়া চুপ করে আছে, কো ম্যানেজার বলে,
দুই সপ্তাহ কিভাবে হয়? আমার হিসেবে আট দিন হয়।
কো ম্যানেজার মহিলাটি দশ বছর আগে ছিল
সাধারণ ক্যাশিয়ার, তা থেকে কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার, তা থেকে সাঁই করে কো ম্যানেজার
হয়ে গেছে। কো ম্যানেজার অংকে এত কাঁচা হয় কি করে?
রাগে শরীর আমার কাঁপছিল, আমি
ক্যালেন্ডারে হিসেব গুনে দেখাচ্ছিলাম তবুও ম্যানেজার বুঝেনা। এক সময় বলে, আটদিন
ছুটি, তুমি নিবে কি নিবেনা তাই বলো।
আমি বললাম, “ আমার পাওনা ছুটি পনেরো দিন, আমি পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছি, তুমি বুঝতে পারছোনা
হিসেব। তুমি আমাকে আট দিনের ছুটি দিলে আটদিনের ছুটিই নেব, কারণ হাতে সময় নেই, আমার
মা মরে যাচ্ছে। তবে এখানে স্পষ্টভাবে বলে যাই, তোমরা আমার প্রতি ইনজাস্টিস করছো,
তোমরা আমার পাওনা ছুটি দিচ্ছোনা।“
এই কথায় ম্যানেজার বিরক্ত হয়ে কাগজপত্র
মারিয়ার দিকে ঠেলে দিয়ে বলে, “ ও কি বলছে আমি
বুঝিনা, তুমি বুঝো কিনা দেখো। মারিয়া আমার হিসেব দেরীতে হলেও বুঝেছে এবং বলেছে
আমার হিসেবই ঠিক। কো ম্যানেজার নিজেকে পরাজিত ভেবেই কিনা জানিনা, খুব বাজে ভাবে
বলল, “ ১৭ তারিখের মধ্যে তুমি ফিরে না এলে তোমার চাকরি থাকবে তবে
পজিশন হারিয়ে যাবে।“ বললাম, ‘মানে কি?” সে বলে, তুমি আর ফুল টাইম থাকবেনা, ফোন ডিপার্টমেন্টেও তোমার পজিশন থাকবেনা।
অন্য যে কোন জায়গায় অপেনিং থাকলে সেখানেই কাজ করতে হবে”। মহিলাটাকে আমি পছন্দ করতাম, কেমন পুতুল পুতুল ভাব আছে চলাফেরায়। সাদা গায়ের
রঙ, সোনালী চুলের সুন্দরীকে দেখে মনে হচ্ছিলো, “ তুই এত নিষ্ঠুরতা
দেখালি আমার সাথে, ভগবান তোকে ক্ষমা করুন”।
অঞ্জনদা যখন বলল, তুমি আই সি ইউতে, জ্ঞান
ফিরেনি ঠিক তখন আমাদের গাড়ির বাম পাশের জানালা দিয়ে দেখলাম, ময়লা রঙের একটা ট্রেন
কোথা থেকে যেন ঢাকার দিকে যাচ্ছে। ট্রেন দেখতে আমার কত ভাল লাগে, কিন্তু সেই
সকালের ট্রেনটা খুব ময়লা ছিল।
তোমার
মিঠু