Friday, October 2, 2015

নয়ন সমুখে তুমি নাই

                                                                    ০১/১০/১৫


মা,                                            

কেমন আছো তুমি? দেখতে দেখতে তিন বছর পেরিয়ে গেলো, তুমি চলে গেছো দূরে, বহুদূরে। অথবা কোথাও যাওনি, আছো আমাদের সকলের মাঝে অদৃশ্য হয়ে। তোমায় অনুভব করি কিন্তু দেখতে পাইনা। তোমায় চিঠি লিখছি প্রায় দুই বছর পরে, গত দুই বছর কেন লিখিনি জানো?

তুমি মারা গেলে ২০১২ সালের ৮ই অক্টোবার তারিখে, এরপর অনেকদিন আমি ছিলাম ভীষণ এক ঘোরের মধ্যে। সেই ঘোর থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল এক ধরণের উন্মাদনা। আমায় পেয়ে বসেছিল চিঠি লিখার নেশায়। মনে আছে তোমার, তোমার মৃত্যুর পর প্রতি মাসের আট তারিখে আমি আকাশের ঠিকানায় তোমাকে চিঠি লিখতাম। সেই চিঠিগুলো লেখার সময় আমার কমপিউটার টেবিল চোখের জলে ভেসে যেত, অনেক সময় কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠতো। কেন কাঁদতাম জানো, তুমি মারা গেছো এই সত্যিটুকু মানতে পারতামনা। আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখছি অথচ মানতে পারছিনা তুমি আকাশে চলে গেছো। কি এক যন্ত্রণায় কেটেছে সময়টা। চিঠিতে কোনভাবেই তুমি মারা গেছো, তোমার মৃত্যু লিখতে পারতামনা। অথচ তোমার মৃত্যু আমাদের চোখের সামনে হয়েছে। আসলে আমি তখনও ভাবতাম, তোমার মৃত্যু হয়েছে এই কঠিন কথাটি শোনার জন্য তুমি প্রস্তুত ছিলেনা। কারণ তোমারতো মরবারই কথা ছিলনা। আমি এখনও ভাবি, তোমার মরবার কথা ছিলনা, মৃত্যুকে তোমার বরণ করতে হয়েছে। আমি তো জানি, কত জনের কত ভুলে তোমার মৃত্যু হয়েছে, সেই ভুল করনেওয়ালাদের মধ্যে আমি যেমন আছি, আছে ডাক্তারগণ। ধীরে ধীরে সবই লিখবো তোমাকে, তুমি অবাক হয়ে যাবে আমার সহজে বলা সত্যি কথাগুলো শুনে, মনে মনে বলবে, আমার মাইয়াটা এখনও ফাজিল রয়ে গেলো, কেমন করে সহজভাবে আমার মনে জমে থাকা দুঃখের কথাগুলি বলে দিচ্ছে। মানুষ শুনলে বলবে কি? মা, মানুষ কি বলবে তা নিয়ে আমি কি কখনও পরোয়া করেছি? তুমি কি ভাববে এটা নিয়েই কি কখনও পরোয়া করেছি? বাবার পক্ষ নিয়ে তোমার সাথে কত নাক মুখ নাচিয়ে কথা বলেছিনা?

মা, সেসব দিনের কথা মনে পড়লে কেমন জানি লাগে। জানো, সেদিন ফেসবুকে মুন তসলিমা শেখ নামের এক মেয়ের সাথে কথা হলো। মেয়ে নয়, মহিলা, আমারই বয়সী, আর কয়দিন পরেই ওর পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবে। ওর মা মারা গেছেন এই বছরেই, এপ্রিল মাসে। তসলিমা মুন মেয়েটা দারুণ অন্যরকম, আমার মত ভ্যাবলা নয়, তুখোড় মেয়ে। ফেসবুকে খুব ধারালো স্ট্যাটাস লিখে, ভীষণ সংস্কৃতিমনা। ও সেদিন বলেছিল, সেও নাকি আমার মত চোপাটি ছিল। মায়ের সাথে চোপা করতো, নিজের কাছে যা সঠিক মনে হতো, মাকে সে কথা শুনাতে ছাড়তোনা। আমিও যেমন ভাবিনি, তুমি মরে যাবে, মুনও ভাবেনি ওর মা মারা যাবেন। অথচ দুজনের মা মরে গেলে, এদিকে মেয়ে দুটো কাটা পাঁঠার মত যন্ত্রণায় ছটফট করে। মুন বলেছে, ওর হৃদয়টা নাকি এ ফোঁড় ও ফোঁড় হয়ে যায়।


যাই হোক, যা বলছিলাম, প্রতি মাসের আট তারিখে চিঠি লিখা শুরু করে একটানা এক বছরে দশখানা চিঠি লিখে ক্ষান্ত দিয়েছিলাম। তুমি অংকের শিক্ষক ছিলে, নিশ্চয়ই ভাবছো, প্রতি মাসে যদি একখানা চিঠি লিখে থাকি, বারো মাসে দশখানা চিঠি হয় কেমনে? মনে মনে বলছো, আমেরিকার মত উন্নত দেশে থাইকা দেখি মাইয়ার অংকের ঘিলু নষ্ট হইয়া গেছে। কে বলবে এই মাইয়া মেট্রিকে অংকে ৯৫ পাইছিল? মৌখিক অংকে কত ভাল ছিল মাইয়া, এখন কয়ে বারো মাসে দশ চিঠি?

মা, প্রথম দুই মাস কিছু লিখিনি, তখনতো আমি আমাতেই ছিলামনা। ২০১৩ সালের জানুয়ারীতে তোমায় প্রথম চিঠি লিখেছিলাম, অক্টোবারে শেষ চিঠি, তাহলে দশখানা চিঠিইতো হয়, তাইনা? অক্টোবার মাসে সিদ্ধান্ত নিলাম, যেদিন আমি লিখতে পারবো বা বলতে পারবো, আমার মা মারা গেছেন সেদিন থেকে আবার তোমাকে চিঠি লিখা শুরু করবো। আমার কথা শুনে মন খারাপ করছো? ভাবছো, বাহ! মেয়ে আমার মৃত্যু নিয়ে এখন বেশ ঘটা করে কথা বলছে। মেয়ে তাহলে এতদিনে মাকে ভুলে যেতে শুরু করেছে?

মা, অংকের হিসেব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মজার একটা কথা মনে পড়ে গেলো। এই কয়দিন আগে, ২৮শে সেপ্টেমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন ছিল। ১৯৪৭ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাই উনাকে ৬৮তম হ্যাপী বার্থডে বলে ফেসবুকে উইশ করেছি। ওমা, কয়েক ঘন্টা পরেই একটার পর একটা মেসেজ পাই, দিদি, শেখ হাসিনার ৬৯তম জন্মদিন লিখেছে পত্রিকায়, টিভি নিউজেও বলেছে ৬৯তম জন্মদিন। মা, এখনও সেই একই ভুল করে মানুষ, জন্মদিনের হিসেবে গোলমাল করে ফেলে। সোজা হিসেব বুঝেনা, আমি বললাম, বাচ্চার এক বছর পূর্ণ হলে প্রথম জন্মদিন পালন করো নাকি দ্বিতীয় জন্মদিন? সাধারণ নিয়মে বুঝিয়ে দিয়েছি বয়সের হিসেব, তবুও দেখবে, আগামী বছরও একই ভুল করবে। আমিতো ঠ্যাটা, এখনও ঠ্যাটাই আছি, বলে দিয়েছি, টিভিতে বা পত্রিকায় যে এই হিসেবের ভুল করেছে, সে মানস অংকে আমার চেয়ে কাঁচা।



মা, তিন বছরে আমি আগের চেয়ে সুস্থির হয়েছি, এখন যদিও আঙ্গুল কাঁপছে তুমি মারা গেছো কথা লিখতে, তবুও লিখছিতো, তাইনা? আমি এখন অনেক সুস্থির হয়েছি মা, কথা কম বলি। আগে বেশী কথা বলতাম তাই তুমি আমাকে ফাজিল মাইয়া, অসভ্য মাইয়া বলে কত বকাবকি করতে। আসলে তখন আমাদের জগৎটা ছিল একরকম, তোমার মৃত্যুর পর জগৎ পুরো বদলে গেছে। একজন মানুষের শারীরিক অনুপস্থিতি এমন বদলে দিতে পারে আশপাশ, চারপাশ জানা ছিলোনা। আফসোস লাগে, এখন আমি ভাল হয়ে গেছি তুমি দেখতে পাচ্ছোনা। নাহ! ভুল বলেছি, তুমি দেখতে পাচ্ছো, আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছিনা, কিন্তু অনুভব করি। এই যে তোমাকে চিঠি লিখছি, তুমি কি বুঝতে পারছোনা? সবই বুঝতে পারছো, নিশ্চয়ই ঠোঁট চেপে মুচকী হাসছো। তোমাকে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে মা।


কয়েকদিন আগে হঠাৎ খেয়াল হলো, সোনার গয়নাগুলো গুছিয়ে রাখার কথা। সোনার গয়না কী-ইবা আছে আমার, আমি সোনার গয়নার জন্য কখনও লালায়িত ছিলামনা। তবুও টুকিটাকি যা আছে, সেটিও ফেলনা নয়। আমি এখনও অগোছালোই রয়ে গেছি, তুমি চলে যাওয়ার পর আরও বেশী অগোছালো হয়ে গেছি। সোনার গয়না কোথায় রেখেছি সেটাই মনে করতে পারছিলামনা। একটা ব্যাগে কয়েকটি বাক্স পেলাম, বাক্সে টুকিটাকি গয়না। আমি কি করেছি শোন, আমার বিয়ের গয়নাগুলো তিন মেয়ের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে দিয়েছি। সোনার বালা জোড়া দিয়েছি মৌটুসীকে, মিশাকে দিয়েছি বরের বাড়ি থেকে পাওয়া বৌভাতের গয়না, আর বিয়ের মূল গয়না সব মিথীলার জন্য। মিথীলাকে বেশী দিয়ে দিচ্ছি? দিলে দিয়েছি, বেশ করেছি। মিথীলাতো আমাকে বেশীদিন পাবেনা, মিশা মৌটুসী আমাকে ওর চেয়ে অনেক বেশী দিন পেয়েছে, মিথীলা আমাকে পেলো মাত্র পনেরো বছর, হোস্টেলে চলে গেলো, আরতো আমার কাছে আসবেনা, তাইনা? আমি মরে গেলে মিথীলা আমার গয়নার মাঝেই আমাকে খুঁজবে।

শোন ঘটনা কি হয়েছিল, গয়নার বাক্স ঘাঁটবার সময় আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল, কেন জানো তো? তোমাকে বলা হয়নি, তোমার বিয়ের নেকলেসটা আছে না? যেটা ছোট বৌকে দিয়েছিলে, সেই নেকলেস গতবছর দেশ থেকে ফেরার সময় তোমার ছোট বৌমা মিথীলাকে উপহার হিসেবে দিয়েছে। অনিতা যখন নেকলেস আমার হাতে দিয়ে বলেছিল, ফুলদি, মায়ের এই নেকলেসটা মিথীলাকে দিলাম, মায়ের শখের জিনিস, মায়ের চিহ্ন আর কাউকে দিলামনা, মিথীলা খুব গোছানো মেয়ে, মিথীলা যত্নে রাখবে। আমি থতমত খেয়ে বলেছি, সেকি! মা এই নেকলেস তোমাকে দিয়েছে, তুমি কেন মিথীলাকে দিচ্ছো। অনিতা বলল, মিথীলারেই দিলাম, আমি যাইই কোথায় যে নেকলেস পরবো। মিথীলার বিয়েতো দেখতে পারবোনা, ছোট মামা-মামীর তরফ থেকে মিথীলাকে উপহার দিলাম।  একবার বলতে চেয়েছিলাম, অতনুর জন্য রেখে দাও,কিন্তু বলিনি। অনীতা নিশ্চয়ই কষ্ট পেতো। হয়তো মনে মনে বলতো, ফুলদি, জানেনইতো, অতনু আর দশটা ছেলের মত স্বাভাবিক হয়নি, ও যে অটিস্টিক তাতো সকলেই জানে। ও নিজের যতনই করতে পারেনা, নেকলেসের মর্ম বুঝবে কি। থাক, অতনু আমাদের অতনু সোনা হয়েই থাক।

নেকলেস হাতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছিলো, তোমার বিয়ের সকল গয়না ভেঙ্গে নতুন গয়না গড়িয়ে আমায় বিয়েতে দিয়েছিলে। নেকলেসটাও ভাঙ্গতে চাইছিলে, তখন দিদিমা তোমাকে বলল, তোর বিয়ের নেকলেসটা ভাঙ্গিসনা, রানুর বৌয়ের জন্য রেখে দে। রানু তোর কত যত্ন করে, সকালে বিকালে চা বানিয়ে খাওয়ায়, যখন যা কস তাই শোনে, নেকলেসটা ওর জন্যই রেখে দে
তুমি নেকলেস ভাঙ্গলেনা। এই নেকলেসটা আমার কাছেও খুব ভাল লাগত, যদিও তোমার গলায় কখনও দেখিনি। তোমার গলায় থাকতো সোনা বাঁধানো ঝিনুকের লকেটসহ চেইন। ঝিনুকের লকেটটা এখনও আমার চোখে ভাসে। লকেটের শেপটা ছিল অসম বাহু চতুষ্কোণা। লকেটের চারধার সোনার লতাপাতায় বাঁধানো, মাঝখানে জোড়া ময়ূর। তখন এই সৌন্দর্য্যের মানে বুঝতামনা, আমার বিয়ের গয়না বানাতে সেই অদ্ভুত সুন্দর ঝিনুক লকেট চেইনটাও ভেঙ্গে ফেললে। বড়লোক বাপের মেয়ের যদি গরীব স্বামীর ঘর করতে হয়, সেই মেয়েটিকে তোমার মত নির্লোভ, উদার, বাসনাহীন হলে মানিয়ে যায়।

আমি তোমার মত নির্লোভ, উদার ছিলামনা। তোমার নেকলেসটার দিকে আমার নজর ছিল। রানুর বিয়ের সময় আমরা অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরেছি, আমার স্বামী ভাল বেতনের চাকরিতে ঢুকেছে, আমি আর গরীব নই। তুমি যখন ছোট বৌকে দেবে বলে নেকলেস আবার সোনা রঙ করাচ্ছো, আমি বললাম, মা, এই নেকলেসের যা ওজন, সেই সমান ওজনের সোনা দিয়ে আরেকটি নেকলেস বানিয়ে দেই, নতুন নেকলেসটা বৌকে দাও, তোমার বিয়ের এই নেকলেসটা আমাকে দিয়ে দাও। পুরনো জিনিসের প্রতি আমার দারুণ আকর্ষণ, শুধু স্মৃতি রক্ষা করতে ভালো লাগে। আমার কথায় তুমি একটু থমকেছিলে, বলেছিলে, তোর দিদিমা কইছিল, রানু আমার এত যত্ন করে, তাই নেকলেসটা রানুর বৌকে দিতে। তোর দিদিমা মারা গেছে কবে, কথাটা রয়ে গেছে
মরীয়া হয়ে আমি বলেছিলাম, মা, আমিতো সমান ওজনের স্বর্ণ দিয়েই নতুন নেকলেস বানিয়ে দেব, বৌয়ের কাছে নেকলেসটাই শাশুড়ির উপহার, এর ইতিহাসতো গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার কাছে থাকলে আমি জানবো, এই নেকলেসটা আমার মায়ের গলায় ছিল, তুমি যখন থাকবেনা তখন নেকলেসের গায়ে তোমার পরশ থাকবে
তুমি বলেছিলে, অপেক্ষা কর, রানুকে জিজ্ঞেস করে দেখি
রানুকে জিজ্ঞেস করতেই রানু বলেছিল, নাহ! মায়ের চিহ্ন শুধু মেয়েই মূল্য দিবে, কেন ছেলে হলে কি মূল্য দিতে পারেনা?

নেকলেস আর পাওয়া হলোনা। তোমার মৃত্যুর পরে আমাদের চার ভাইবোনের জীবনের নামতা উলটাপালটা হয়ে গেছে মা। কতকাল পরে হঠাৎ করে রানু আর অনিতা নেকলেসটা আমাকে দিয়ে দিল, মিথীলাকে দেয়ার জন্য। মা, আমরা কেউই নিজেদের কাছে তোমার নেকলেস রাখলামনা, নেকলেস ছাড়াই তোমার চিহ্ন আমাদের হৃদয়ে রয়ে গেছে।

যে কথা বলছিলাম, সেদিন গয়না গুছাতে গিয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে গেছিলো কারণ তোমার নেকলেসের বাক্স খুঁজে পাচ্ছিলামনা। কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলামনা, অত্যন্ত দামী বলে কি আরও বেশী যত্নে আর কোথাও রেখেছিলাম? সেটাও মনে করতে পারছিলামনা। বার বার মনে পড়ছিল, অনিতার কথা, কত যত্ন আর বিশ্বাসে কলজে ছেঁড়া ধন আমার হাতে তুলে দিয়েছিল, আর আমি কিনা তা খুঁজে পাচ্ছিনা? যখন হাত পা ছেড়ে দেয়ার জোগাড়, তখনই পাঁচবার দেখা হয়ে যাওয়া ব্যাগে ষ্ঠবার হাত দিতে ম্যাজিকের মত নেকলেসের বাক্স হাতে পেলাম। বাক্স খুলে দেখলাম নেকলেসটাকে, হাত রাখলাম নেকলেসের গায়। তোমার ছবির দিকে তাকালাম, ছবিতে তুমি হাসছোনা অথচ আমি স্পষ্ট দেখলাম তুমি হাসছো। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, তোমার কাছে আবার চিঠি লেখা শুরু করব। আজ ১লা অক্টোবার নতুন করে চিঠি লিখতে বসলাম।

তোমার

মিঠু

No comments:

Post a Comment