Sunday, June 23, 2013

ফেসবুকের আপডেট!


সকলের ঈদ আনন্দের সাথে আমি আরও একটু আনন্দ যোগ করে দিচ্ছিঃ

#১ আমার মেজো মেয়ে মিশা এই সামারে বাংলাদেশে গেছে, 'স্যেভ দ্য চিলড্রেন' নামক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে,[ মিশা পাবলিক হেলথ নিয়ে পড়াশুনা করছে, এই প্রোগ্রামটি ওর ভবিষ্যতে কাজে আসবে।] প্রায় তিন মাস থাকার পর এবার মিশার আমেরিকা ফেরার সময় হয়েছে।
শেষের কয়েকটি দিন মিশা নারায়ণগঞ্জে দাদু আর মামা-মামীদের সাথে কাটাচ্ছে। মিশা চলে আসবে, মিশার ছোট মামা বাজার থেকে বিশাল বড় কচু কিনে এনেছে, ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক রান্না করিয়ে মিশার বাবার জন্য পাঠিয়ে দিবে। মিশার ছোট মামীর রান্নার হাত খুব ভাল, মিশার দিদার কাছ থেকে রান্না সুস্বাদু করার খুঁটিনাটি শিখে নিয়েছে। সমস্যা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জে গ্যাসের সরবরাহ নেই, ওরা দুই চূলার জন্য মাসিক বিল দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু রান্না করছে কেরোসিনের স্টোভে। মিশার মামীও কচু কেটে নিয়েছে কেরোসিনের চূলায় রান্না করবে বলে। কিন্তু গত দুই দিন আগে থেকে ঈদের ছুটি শুরু হওয়ায় আশেপাশের কল কারখানা, ফ্যাক্টরী বন্ধ হয়ে গেছে, তাই সব বাড়ীর গ্যাস লাইনে পূর্ণ মাত্রায় গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে।

তিন বছর পর গ্যাসের চূলা দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখে মিশার ছোট মামী খুশীতে ডগমগ হয়ে চূলার চাবি পুরা বাড়িয়ে দিয়ে পাশের ঘরে গেছে আরও কিছু সব্জী নিয়ে আসতে। মামীর মনে বোধ হয় তখন হেমন্তের গান বাজছিল, " কতদিন পরে এলে, একটু বসো, তোমায় অনেক কথা বলার ছিল, যদি শোন", ঝুড়ি ভর্তি সব্জী এনে দেখে কড়াইয়ের কচুর শাক পুড়ে গেছে। মিশার ছোট মামা তো চিংড়ি মাছের মত লাফাতে শুরু করেছে,
" এত শখের শাক পুড়ে ফেললা? আমি কত জায়গা ঘুরে তবে এগুলো যোগাড় করেছি, আরেকটু হলে কচু কেনার জন্য নদী পার হয়ে বন্দর চলে যাইতাম, দাদাভাইকে একটা জিনিস পাঠাবে, একটু যত্ন করে করবেনা? কচু রান্না বসিয়ে পাঁচ কাজ হাতে নিয়ে ফেলছো, এখন এই পোড়া শাক পাঠাবে?"

মিশার মামীর তো মন খারাপ, দাদাভাই ওর রান্না খেয়ে ভালোবাসে, মা বেঁচে থাকলে তো মা এই দিকগুলো দেখতো, আজ তিন বছর পর গ্যাস এলো, তাইতেই ও একটু হতচকিত হয়ে গেছিল। মিশার মামী তার স্বামীকে বলল, " ঠিক আছে, এটা পাঠাবোনা, তুমি কালকে আবার কচু কিনে এনো, নতুন করে রেঁধে দেবো"। মিশার মামা অবশ্য প্রস্তুত ছিলনা স্ত্রীর মুখ থেকে এমন কথা শোনার জন্য। স্ত্রীর এমন স্বীকারোক্তিতে মিশার মামা নমনীয় হয়, তারপর খেয়াল করে দেখে, কছুর শাক পুড়েনি, কড়াইয়ের তলায় একটু ধরে গেছিল।

এই পুরো ঘটনা যখন মিশা তার মা'কে স্কাইপে বলছিল, ছোটমামার নামে নালিশ দিচ্ছিল, তখন মিশার মা তার ছোট ভাইকে বকছিল, কেন বউকে বকা দিয়েছে। দিদির বকা খেয়ে মিশার মামা একটুও ঘামেনি, নিজে কিছু না বলে মিটিমিটি হাসছিল, তার বউ এসে স্বামীর হয়ে বলছিল, " ফুলদি, আপনার ভাইয়ের তো দোষ নেই, সে অনেক ঘুরে খুঁজে খুঁজে এই কছু যোগাড় করেছে, সব কচু তো ভাল হয়না, গলায় ধরতে পারে, কচুটা একটু হালকা পুড়েছে, তাইতেই তার মন খারাপ হয়েছে, দাদাভাইকে একটা জিনিস পাঠাবো, এমন তো হাতী ঘোড়া কিছুনা, সামান্য কচু, সেটাও যদি ভালভাবে নাহয়, হা হা হা হা!!"

মিশা তো অবাক, বলে উঠে, আরে! যার জন্য করি চুরী, সেই বলে চোর! মামী, তোমার পক্ষে বলেও তো কোন লাভ নেই।"
মিশার ছোট মামা মিশার দিকে তাকিয়ে ঈদের চাঁদের মত বাঁকা চোখে হাসে, আর মিশার মামী তার সারা মুখ ছড়িয়ে পূর্ণিমার চাঁদের মত হাসে।

#২ আমার আজকে অফিস টাইম দুপুরে। সকাল হতেই ভাবলাম, উত্তম কুমারের ইউনিভার্সিটি শুরু হয়ে যাচ্ছে যখন, ঈদ উপলক্ষে কিছু মিষ্টি বানাই। আনন্দ করতে আমি ধর্ম বিচার করিনা, উৎসব একটা হলেই হলো, পূজাতেও যেমন আনন্দ করি, ঈদেও আনন্দ করি। তাই গোলাপজাম বানাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। গোলাপজাম তৈরীর সমস্ত সরঞ্জাম আগেই রেডী রেখেছিলাম, আমার তো আবার ফেসবুক নাহলে চলেনা, উত্তম কুমারকে বললাম, গোল্লাগুলো রেডী করতে, আমি চূলায় সিরা জ্বাল দিতে দিতে ফেসবুকে আড্ডা দিচ্ছিলাম। গোল্লা বানানো শেষ, উত্তম ডেকে বললো, 'এই যে গোল্লা রেডী করে দিয়েছি"। আমি তাড়াতাড়ি নীচে গিয়ে গোল্লা ভাজা শুরু করে দিয়েছি। গোল্লা ভেজে সেই গোল্লা রসে ফেলেছি, আএক কড়াই গোল্লা ভেজে ট্রে তে তুলে রেখেছি, একটু পরে রসে ফেলবো বলে। গলায় সোহাগ ঢেলে উত্তমকে ডেকেছি, " শুনছো, মিষ্টি রেডী, গরম গরম একটা খেয়ে যাও"।
বেশ খানিকক্ষণ বাদে উত্তম এসে ট্রেতে রাখা ভাজা গোল্লা তুলে নিল ( যেগুলো রসে ডুববার জন্য অপেক্ষা করছিল), আমি কিছু বলছিলামনা। হাতে নিয়েও উত্তমের খেয়াল হচ্ছিলনা, মিস্টি কেন এমন মচমচে, শুকনো দেখাচ্ছে? মুখে দিয়ে বলে, " এই মিষ্টির নাম কি? এটা তো মিষ্টি লাগছেনা।"
আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি। বলি, "চোখের সামনে বাটিতে মিষ্টি রেখে দিয়েছি, সেই মিষ্টির প্রতি তোমার নজর গেলোনা, নজর গেলো ভাজা গোল্লার দিকে"?

মিষ্টি খেয়ে উত্তম বলে, " এটা তো চমচমের মতো লাগছেনা"
বললাম, " চমচম বানালে চমচমের মত লাগতো, এটা তো দেখতেও চমচমের মত না, এটার নাম গোলাপজাম,"
"মিষ্টিটা খেতে খুব ভাল হয়েছে তো"।
বললাম, " এই মিষ্টি আমি আগেও বানিয়েছি, মাঝে সব বন্ধ ছিল বলে অতীতকে এভাবে ভুলে গেলে?"
এবার আর উত্তম কিছু বলেনা, আরেকটা গোলাপজাম মুখে পুরে ' হুম! বেশ ভালো" বলে আমার সামনে থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়।

#৩ আমি গল্পকবিতাডটকম-এর ঈদসংখ্যায় ১৫০০ শব্দের সীমিত গল্পে একটি গল্প জমা দিয়েছিলাম। গল্প তো গল্পই, সত্যিও হতে পারে, ফিকশানও হতে পারে। লেখক কখনও বলেনা, কাহিনী সত্যি নাকি মিথ্যে। পাঠক যদি পড়ে প্রতিক্রিয়া দেখায়, গল্পের চরিত্র সম্পর্কে তার মতামত জানায়, তবেই লেখকের লেখা সার্থক হয়। আমার লেখা গল্প " পরমাসুন্দরী কন্যার ঈদ" গল্পটি আজকেই পোস্ট করেছি। গল্পের ফারিয়ার জন্য পাঠক অদিতি'র খুব কষ্ট হয়েছে, সে গল্পের নীচে বাংলিশে কমেন্টে লিখেছেঃ

" পরমার উচিৎ ফারিয়াকে বলা, একটা উস্টা দিয়া ( লাত্থি দেয়া) জামাইটারে, নিজের দেশে চলে আসা"।

আমার গল্প লেখা সার্থক হয়েছে!!!!
Like · · Promote ·



পর্দার অন্তরালের এক ময়ীয়সীর জন্মদিনে~~~~~

আগস্ট মাস নাম শুনলেই মনে হয় যেন শোকের মাস, ১৫ই আগস্ট তো আছেই, আরও আছে ২১শে আগস্ট, তারও পরে আছে হুমায়ুন আজাদ, কবি শামসুর রাহমান, আইভী রহমানসহ মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন অনেকের মৃত্যু দিবস। আগস্টের শোকগাঁথা বলতে শুরু করলে তা শেষ হবেনা। তার চেয়ে আগস্টের একটি আলোকিত দিন নিয়ে কথা বলি।

আজ ৮ই আগস্ট , বেগম ফজিলাতুন্নেসার ৮৩তম জন্মদিন। ১৯৩০ সালের ৮ই আগস্ট টুঙ্গীপাড়া গ্রামে ফজিলাতুন্নেসার জন্ম হয়। তাঁর ডাকনাম ছিল রেনু, রেনুর দাদা এবং মুজিবরের দাদা ছিলেন দুই ভাই, একই গ্রামে পাশাপাশি বাড়ীতে থাকতেন। রেনুর বয়স যখন সবেমাত্র তিন, তার বাবা মারা যান। রেনুর দাদা এবং মুজিবরের বাবার সম্মতিক্রমে তিন বছরের রেনুর সাথে তের বছরের মুজিবরের বিয়ে হয়। রেনুর পাঁচ বছর বয়সে রেনুর মা মারা যান এবং সাত বছর বয়সে রেনুর দাদা মারা যান। একাকী শিশু রেনুর ঠাঁই হয় বঙ্গবন্ধুর মা সায়েরা খাতুনের কোলে। শেখ বাড়ীর আর সকল ছেলেমেয়ের সাথে রেনুও বড় হতে থাকে। রেনুর যখন ১২ বছর বয়স, তখন সে শেখ মুজিবরের সাথে সংসার শুরু করে এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত সেই সংসারের হাল ধরেছিলেন।

১২ বছরের কিশোরী রেনুই একদিন বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হিসেবে সকলের হৃদয়ে ঠাঁই পেয়েছেন। প্রবাদ আছে, একজন সফল পুরুষের সাফল্যের পেছনে থাকে একজন নারীর অকুন্ঠ সমর্থণ, সহযোগীতা এবং শতভাগ সহাবস্থান। বেগম মুজিব তার সবটুকুই করেছেন, তাই শেখ মুজিবর রহমান থেকে একজন 'বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আজীবন মিছিলের সামনে ছিলেন, পর্দার আড়ালের রমনীরত্নটি আড়ালেই থেকে গেছেন, রাজনীতিবিদ স্বামীর সংসার আগলে রেখেছেন, রাজনীতিবিদ স্বামীকে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছেন, অতি সাধারণ জীবন-যাপন করে গেছেন, নিজের অলংকার বিক্রীর টাকা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দান করেছেন, রাজনীতিবিদ নেতার অনুপস্থিতিতে লাখ লাখ কর্মীর পাশে মাতৃরূপ ছায়া হয়ে থেকেছেন, নিজে কতটুকু খেয়েছেন সে সংবাদ কেউ না জানলেও উনার বাড়ীর ভাত খায়নি, এমন কর্মী, নেতার সংখ্যা কমই ছিল। যোগ্য স্বামীর যোগ্য স্ত্রী হয়েই উনি স্বামীর পাশে কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের প্রতিটি দিন, জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তাই ছিলেন।

মোশতাক খন্দকার নামের মীরজাফরটি এই মহীয়সী নারীর হাতে রান্না করা ভাত খেয়েছে, ঐ বাড়ীর নুন খেয়েছে এবং ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে বেগম মুজিবের হাতে খাওয়া নুন পরিশোধ করে দিয়েছে। মোশতাক খন্দকার আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, তার জন্মতারিখ কেউ জানেনা, তার মৃত্যুতারিখ নিয়েও কেউ মাথা ঘামায়না।

আজ কোন শোক নয়, আজ একটি উজ্জ্বল দিন, আজকের দিনে প্রজ্বলিত থাকুক বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের জন্মপ্রদীপ!

শুভ জন্মদিন বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব!
— with Shahidul Alam Swpan.
12Like · · Promote ·



'মীরজাফরদের পরিণতি'

মীরজাফরের মৃত্যু হয়েছিল ৫ তারিখে ( ফেব্রুয়ারী), মোশতাক খন্দকারের মৃত্যুও ৫ তারিখে ( মার্চ)। মীরজাফর সিরাজউদ্দৌলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, মোশতাক খন্দকার বঙ্গবন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। মীরজাফর 'কুষ্ঠরোগে' আক্রান্ত হয়েছিল, দেহ পচে মরেছিল, মোশতাক খন্দকারের দেহে কুষ্ঠ হয়েছিল কিনা জানিনা, তবে একা ঘরে মৃত্যু হয়েছিল। মীর জাফর এবং মোশতাক খন্দকার একমাত্র ব্যক্তি, যাদের মৃত্যুতে গুমোট আকাশ হেসে উঠেছিল, স্তব্ধ বাতাস হেসে উঠেছিল, বোবা পাখীরা গান গেয়েছিল, বরফ গলে ঝরণা কুলকুল বয়েছিল। এই দুই নরকীটের বিরুদ্ধে প্রকৃতি এভাবেই প্রতিশোধ নিয়েছিল।
তোমরা কেউ মীরজাফর হয়োনা, বাংলা মা তার বুকে আর কোন 'মীরজাফররূপী' মীরজাফরকে ঠাঁই দেবেনা। আজকের যত জ্বালা, আজকের যত দহন, সবকিছুর মূলে এই মীরজাফররূপী মোশতাক খন্দকার। আর নয়, এবার আমাদের বোধোদয়ের সময় এসেছে। আশপাশ থেকে সকল মীরজাফর, মোশতাক খন্দকারকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দাও! জয় বাংলা!
31Like · · Promote ·


' বিলবোর্ড' নিয়ে এক বন্ধুর 'অনাবিল' কথা!

নতুন টপিক, " বিলবোর্ড"। এই নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা ছিলনা, নিজস্ব কোন বক্তব্যও নেই, বিরোধী দলের " আমার কাছে তথ্য আছে" আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়তেই 'বিলবোর্ড আন্দোলন' শুরু হয়েছে। এরপর আরও অনেক রকমারী আন্দোলন শুরু হবে। প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে সিনেমা দেখার সুযোগ হয়না, তাই ইদানিং সিনেমা দেখি অনলাইনে। চলতি সিনেমার নাম ' বিলবোর্ড'। নাম দেখে খুব একটা উৎসাহিত হতে পারিনি। মনে হয়েছে, ধুর! এইটা একটা সিনেমা হইল? বিলবোর্ডে " খুজলি, পাঁচরা, দাদ, শ্যাম্পু, হেকিমী চিকিৎসা, জ্যোতিষী বিদ্যা, স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ, কানপাকা, গলা পাকার ওষুধের' বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে বড় হতে হতে বুড়ী হয়ে যাচ্ছি। আর এখন সিনেমা দেখায় ' বিলবোর্ডে নাকি সরকার উন্নয়নের জোয়ার দেখি্যে ভাসিয়ে ফেলছে। সরকারকেও বলিহারী যাই বাপু, বিলবোর্ডে থাকবে " অন্যকিছু' উন্নয়নের বিজ্ঞাপন, সরকারের উন্নয়নের কথা কেন? সরকারী উন্নয়নে কোন 'রস' থাকেনা, 'মজা' থাকেনা, কেমন যেন কাঠখোট্টা মনে হয়। কি দরকার দেশের মানুষকে 'রসবঞ্চিত' করার?

এমনটিই ভাবছিলাম। কয়েক ঘন্টা আগেই এক বন্ধু ( আনিকা আহমেদ) আমাকে 'ইনবক্সে' উনার বক্তব্য পাঠিয়েছেন। আমার কথার সাথে মিল পেয়ে বেশ আহ্লদিত বোধ করলাম, ভাবলাম, এত সুন্দর কথা ইনবক্সে রেখে লাভ কি? ওয়ালে পোস্ট করে দেই। [ মেসেজটি হুবহু পেস্ট করলাম,]

[বর্তমানে উন্নয়নের বিল বোর্ড দেখে অনেকের খুব কষ্ট লাগছে বোলে এই টা শেয়ার করলামঃ সেনসেশন এর জন্ম নিরোধকের ""বিশেষ ভঙ্গিমার"" বিলবোর্ড দেখলে গায়ে লাগে না।

ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড এর হীরার নামে শরীর প্রদর্শনের বিলবোর্ডে গায়ে লাগে না।

সারা ঢাকা শহরে গোপন রোগের ওষুধের বিলবোর্ডে চোখ নষ্ট হয় না।

চিকন স্বাস্থ্য এবং নানান অঙ্গ প্রত্যঙ্গ মোটাতাজাকরণের বিলবোর্ড আড় চোখে দেখতে ভালো লাগে।

পাইলস, অর্শ ভগন্দর, নাকের পলিপ-নাশা-গোটার বিলবোর্ড টাঙাইলে সেইটা মাইনা নেওয়া যায়।

অলৌকিক স্বপ্নে পাওয়া ওষুধের বিলবোর্ড দেখলে যুক্তিমনস্ক মন কথা বইলা উঠে না।

কে রহমান হাওলাদারের ভাগ্য গননা, বা অমুক স্টোন-তমুক বাবা'র ১০০% নির্ভুল ভাগ্য গননার বিলবোর্ড দেখলে জোচ্চুরি মনে হয়না।

নিষিদ্ধ ব্যবসার বিলবোর্ড বা গা-টিপানির সুড়সুড়ি মার্কা দোকান এর বিলবোর্ড দেখলে জ্বলে না।

জ্বলে শুধু বঙ্গবন্ধু-হাসিনার ছবি দেখলে, তাইনা??

(অটঃ মীর্জা ফখ্রুল ইসলাম বলেছেন, উন্নয়নের ছবি দেখায়ে লাভ নাই। কি কইতে চান তিনি? শুধু ভিত্তি-প্রস্তর আর খাম্বার ছবি দেখাইতে?? প্রশ্ন রাখলাম প্রজন্ম, সাধ্য থাকলে উত্তর দিও।)

(অট দুইঃ দায়িত্ব নিয়েই বলতেছি, প্রতিটা বিলবোর্ড এর টাকা এলাকার নেতাকর্মীরাই দিছে, মানে যার নামে বিলবোর্ড উঠছে, সেই ওই বিলবোর্ডের ভাড়ার টাকা দিছে, এইটা মাঠের রাজনীতির সব থেকে কমন নিয়ম কানুন গুলির একটা।যে নেতার নামে পোস্টার, সেই নেতাই যেই রকম ছাপায়, এইখানেও সেইম]
6Like · · Promote ·



অন্তরের দীপশিখা!

ডাঃ দীপুমনি বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বর্তমান আওয়ামীলীগের একজন যোগ্য নেত্রী। ছাত্রাবস্থা থেকেই আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে আছেন। উনার পিতাও ছিলেন আওয়ামীলীগের প্রথম সারির নেতা। পিতা এম এ ওয়াদুদ সাহেব ছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং শহীদ সোহরোওয়ার্দী সাহেবের অতি ঘনিষ্ঠজন, ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য, আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ( অনেকবার কারাবরণ করেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর কেবিনেট মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় উনাকে মিলিটারী গভঃ কারাবন্দী করেছিল)। উনার পিতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অতি কাছের মানুষ, ডাঃ দীপুমনিও আওয়ামীলীগপ্রধান শেখ হাসিনার অতি কাছের মানুষ।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনিকে নিয়ে পজিটিভ-নেগেটিভ, দু'ধরণের প্রচারণা চলে। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনিকে নয়, মন্ত্রীত্বের বাইরের একজন অসম্ভব মেধাবী, মায়াবী, গুণী নারীকে দেখি। যিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, আমেরিকার টপ র‍্যাংকিং জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি অফ পাবলিক হেলথ, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে পড়াশুনা করেছেন, ডিগ্রীও অর্জন করেছেন। মেধাবী এই নারীর শ্যামল স্নিগ্ধ, নিরহংকারী, হাসিমাখা মুখের দিকে তাকালে হৃদয়ে এক ধরণের প্রশান্তি অনুভব করি। উনার বিরুদ্ধে যত অপপ্রচারই শুনিনা কেন, তার কিছুটা সত্যি হতে পারে জেনেও উনাকে শ্রদ্ধা করি।

আমি মেধাবীদের প্রতি সবসময় একধরণের দূর্বলতা অনুভব করি, তাই 'মন্ত্রী দীপুমনি' নয়, ডাঃ দীপুমনির বিরুদ্ধে কোন কথা মেনে নিতে চাইনা, বরং মার্জিত, পরিশীলিত রুচীসম্পন্ন, মেধাবী এই ডাক্তারের নিজ পেশার প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা দেখে মোহিত হই। আমি অনেকের কাছেই শুনেছি, অতি ব্যস্ত মন্ত্রী ডাঃ দীপুমনি সময় এবং সুযোগ বের করে প্রায়ই উনার নির্বাচনী এলাকায় চলে যান, গিয়ে বিনামূল্যে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। উনার পরিচালনাধীন বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক আছে, সেখানে মেধাবী চিকিৎসকদের দ্বারা গরীব রোগীদের ফ্রী চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়।

নিন্দুকেরা নিন্দা করে, এবং তা সারা জীবনই করবে, নিজের জীবনের ব্যর্থতার গ্লানি ঢাকতেই তারা পরনিন্দা করে থাকে, এটাই নিন্দুকের স্বভাবধর্ম। ডাঃ দীপুমনি রক্তমাংসে গড়া মানুষ, দোষগুণ থাকবেই, উনারও দোষ আছে, হয়তো বেশীমাত্রাতেই আছে, তাই মানুষ উনার সম্পর্কে নিন্দামন্দ করে। উনার দোষটুকু যদি শতমুখে প্রচার করার লোক থাকে, উনার গুণটুকু প্রচার করার জন্য আমার মত দু'একজন মানুষও আশেপাশে থাকবেই।
এমন একজন গুণী, উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী ব্যক্তিত্বকে দেশ ও দশের কাজে পেয়েছি, আমরা গর্বিত।
আমি সব সময় চাই, আমার মেয়ে এবং এই প্রজন্মের সকল মেয়েদের মননে ও চেতনায় যেন আর্তের সেবা করার মহৎ গুণটুকু অমলিন থাকে, শত নিন্দা, শত দূর্ণামের পরেও যেন অন্তরের আলোটুকু জ্বলতেই থাকে!

[ভাল কাজের পক্ষে নির্দোষ প্রচারণা]
28Like · · Promote ·




সুন্দরের প্রত্যাশী!

ফেসবুকে ঢুকলে বুঝা যায়, আমাদের সহনশীলতা দিন দিন খুব দ্রুততার সাথে কমে যাচ্ছে, পরিবর্তে একে অপরের প্রতি গালিগালাজ, কটুক্তি, ঈর্ষা, জিঘাংসা বেড়ে যাচ্ছে। ফেসবুক ওয়ালে বিভিন্ন কমেন্ট পড়লেই তা অনুধাবন করা যায়। বেশীর ভাগ সময় বিষয়গুলো এড়িয়ে যাই, কিন্তু যখনই খেয়াল হয়, এখানে আমার সন্তানের বয়সী প্রচুর ছেলেমেয়ে আছে, আমার বয়সী কিছু বন্ধু আছে, এবং আমার বড় ভাই, বড় বোনের বয়সী কিছু বন্ধু আছেন, তখন বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারিনা, খুব খারাপ লাগে, খুব অস্বস্তি হয়! বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ এলেই যেন আমাদের মনের অন্ধকার অংশটুকু প্রকাশিত হয়ে পড়ে। একেকসময় মনে হয়, ফেসবুক ওয়ালটা যেন এক ধরণের সস্তা বিনোদনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

এমনিতেই আমরা সাধারণ বাংলা লিখতে গেলে একটি বাক্যের অর্ধেক শব্দ ভুল বানানে লিখি, তার উপর প্রায় প্রতিটি বাক্যে যদি একটি করে 'অসুন্দর শব্দ' ব্যবহার করি, আমাদের অজান্তেই আমরা বাংলামায়ের, এবং মাতৃভাষার অবমাননা করে ফেলি, যা একজন বাংলাভাষী বাঙ্গালীর জন্য বেদনাদায়ক! বাংলা ভাষায় কত সুন্দর সুন্দর শব্দ আছে, কাউকে গালি দিতে হলেও ভদ্রভাষায় সেটা দেয়া যায়, আর পাবলিকলি গালি দেয়ার নীতি বর্জন করতে পারলে তো কোন কথাই নেই।

তার চেয়ে যদি এমন হয়, আর গালিগালাজ নয়, হুমকী ধমকী নয়, অযথা কটুক্তি করা নয়, আমরা সবাই ফেসবুক বন্ধুই যদি, তাহলে একজন আরেকজনের প্রতি আরেকটু সহনশীল হই, রাজনৈতিক মতবিরোধকে মেনে নিয়েও একে অপরের প্রতি বন্ধুসুলভ আচরণ করি, যার যার রাজনৈতিক মতের পক্ষে প্রচারণা চালাই। প্রতিদিন ভাল কাজের প্রচার হোক, তাহলে ভালো কাজের প্রচারের লোভে আমরা প্রত্যেকেই প্রতিদিন 'এক টুকরো' ভাল কাজ করতে উৎসাহী হবো। আমরা ভালো কাজ করলে আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম গর্বিত হবেন, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আমাদেরকে অনুসরণ করবেন।

ষোল কোটি মানুষের দেশে, দশ কোটি মানুষ যদি প্রতিদিন 'এক টুকরো' ভাল কাজ করে, হোক সে পরস্পর আজন্ম শত্রু, হোক নাহয় চিরদিনের বন্ধু, প্রত্যেকের 'এক টুকরো' ভাল কাজের ফলটুকু জমা হবে আমাদের এই ছোট্ট দেশটির সোনালী ব্যাংকে! এটাই তো আমরা সকলে চাই, চাওয়া যদি সুন্দর হয়, পাওয়াটুকুও শতভাগ সুন্দর হবে।
2Like · · Promote ·


বন্ধু তুমি চিরদিনের, বন্ধু তুমি চিরকল্যাণকর!!

৪ঠা আগস্ট বন্ধুদিবস, আমার মনে ছিল না। ফেসবুকে অনেকের পোস্ট দেখে মিথীলাকে বললাম, " মিথীলা, আমাদের সময় আগামীকাল বন্ধুদিবস, মানে ফ্রেন্ড'স ডে!" মিথীলা বলল, " ওয়াও, তাই নাকি? তাহলে তো খুব ভাল। আচ্ছা মা, তোমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু কোনজন?"
বললাম, সবচেয়ে ভাল কোন বন্ধু আমার নেই।
মিথীলা বলে, " মা, ডোন্ট বী মীন! তুমি তো সব সময় বলো, ফেসবুকে তোমার অনেক ভাল ভাল বন্ধু আছে, আর এখন বলছো, সবচেয়ে ভাল কোন বন্ধু নেই"।
মিথীলাকে ধীরে ধীরে গুছিয়ে বললাম, " মিথীলা, ফেসবুকের বন্ধুরা সকলেই আমার খুব ভাল বন্ধু। সেখানে 'সবচেয়ে ভাল' বলে কেউ নেই, সবাই ভাল। সেজন্যই বলেছি, সবচেয়ে ভাল কোন বন্ধু নেই"।
এবার মিথীলা বলল, " মা, গুড অ্যানসার! এবার ঠিক আছে, আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার বন্ধুরা কি তোমাকে হ্যাপী উইশ করেছে?"
-আমার বন্ধুরা আমাকে হ্যাপী উইশ করছে, তবে আমি তো সবার বড়, সবার দিদি, তাই আমাকেই আগে এই কাজটি করতে হবে, অপেক্ষা করছি বাংলাদেশের সকালের জন্য। সকালবেলাতে হ্যাপী উইশ করবো"।
ফেসবুকের সকল বন্ধুদের ( সবাই ভাল) প্রতি বন্ধু দিবসের 'শিউলী ঝরা' শুভেচ্ছা!!!! বন্ধু তুমি চিরদিনের, বন্ধু তুমি চির কল্যাণকর!!!


‘রূপবতী-মায়াবতী’র গল্প

হুমায়ুনভক্তদের সকলেই জানে, তাঁর গল্পের নায়িকারা সকলেই রূপবতী এবং মায়াবতী হয়। আমার খুব শখ ছিল হুমায়ুন আহমেদের নাটকে অভিনয় করার। কিন্তু যেহেতু উনার গল্পের নায়িকার মত ‘রূপবতী ও ্মায়াবতী’ হয়ে জন্মাতে পারিনি, তাই আর উনার কাছে গিয়ে নিজের ইচ্ছের কথা প্রকাশ করা হয়নি। মনের ইচ্ছে মনেই চেপে রেখে চারদিকে ‘রূপবতী ও মায়াবতী’ কন্যাদের খুঁজে বেড়িয়েছি। সত্যি কথা বলতে কি, এক সময় ধরেই নিয়েছি, ‘রূপ আর মায়া’, একসাথে মিশিয়ে ঈশ্বর কোন মানবী সৃষ্টি করেননি, ‘রূপবতী আর মায়াবতী’ কন্যারা হুমায়ুনের উপন্যাসেই ঘুরে বেড়ায়।

তখনও মিত্রার বয়স দেড় বছর, হ্যাংলা কাঠি মেয়ে, ফুঁ দিলে উড়ে যাওয়ার অবস্থা। আমাদের মত বীর পালোয়ানের ফ্যামিলিতে মিত্রা কি করে এমন হ্যাংলা কাঠি হয়ে থাকলো তা নিয়ে অনেক গবেষনা চলেছে, গবেষনার পর সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, ওর মাথার ঘন কালো চোখমুখ ঢাকা চুল আর দুই চোখের ঘন কালো পাপড়ি, এ দুটোই দেহের সকল পুষ্টি নিয়ে নিচ্ছে।

মিত্রা আমার ছোট মাসীর মেয়ে, আমার বড় মেয়ে মৌটুসীর চেয়ে মাত্র আড়াই মাসের বড়। মিত্রাদের বাড়ী সুনামগঞ্জ, এখন তো সুনামগঞ্জে যেতে ছয় ঘন্টার বেশী সময় লাগেনা, ২৫ বছর আগে ্ট্রেনে ঢাকা টু সিলেট, পথে তিন চারবার ফেরী পার হয়ে সিলেট টু সুনামগঞ্জ পৌঁছাতে হতো। আমার ছোট মাসীর কপালে লেখা ছিল সুনামগঞ্জে বিয়ে হবে, নাহলে এমন বনবাসে মাসীকে পাঠানোর কোন কারণ ছিলনা। [ভাগ্যিস মেসোর ফেসবুক নেই, আমার এই লেখা চোখে পড়বেনা]। তাই একবার যদি মাসী নারায়ণগঞ্জে আসতো, পরের চার মাস মাসীকে আমরা নারায়ণগঞ্জেই রেখে দিতাম। আমিও মৌটুসীকে নিয়ে সাভার থেকে নারায়ণগঞ্জ চলে যেতাম। মাসী-বোনঝি’র ভাগ্য ভাল, তাদের এই ধরণের স্বেচ্ছাচারিতা তাদের বরগুলো হাসিমুখে না হলেও ভাল মুখেই মেনে নিত।

মাসী-বোনঝি একত্র হলে আর কথা নেই। বেড়াতে বের হয়ে যেতাম, দুই মেয়ে মৌটুসী আর মিত্রা থাকতো মামা, দিদাদের জিম্মায়। তখন থেকেই মৌটুসী আর মিত্রার মধ্যে তৈরী হয় স্বর্গীয় এক বন্ধুত্ব। সেই বন্ধন এখনও অটুট আছে, কোন দিন ফাটল ধরেনি। এমনকি দেড় বছর বয়সে উঁচু থেকে পড়ে গিয়েওনা। ঘটনা একটু খুলে বলি, আমার সাভারের বাসার বারান্দায় রেলিং দেয়া একটি পুরণো বেবীকট ছিল। দেড় বছর বয়সে মৌটুসী আর মিত্রাকে একসাথে বেবীকটে বসিয়ে রেখে আমরা মাসী-বোনঝি রান্নাঘরে কোন কাজে ব্যস্ত ছিলাম, হঠাৎ এক ধুম শব্দ শুনে বারান্দায় এসে দেখি হ্যাংলাকাঠি মিত্রা বারান্দার মধ্যে পড়ে আছে, আর বেবীকটের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে বীর পালোয়ান মৌটুসী। ব্যাপার বুঝতে আমার বেশী সময় লাগেনি, দুই বান্ধবী একসাথে রেলিং ধরে দাঁড়ানো ছিল, মৌটুসী এক ধাক্কায় মিত্রাকে রেলিং টপকে ফেলে দিয়েছে। মাটিতে পড়ে মিত্রা চীৎকার করেনি, ওর গভীর কালো দু চোখ বেয়ে জল পড়ছিল, আর আমার পালোয়ান মেয়ে ক্ষমতার গর্বে হি হি করে হাসছিল। কিন্তু অবাক কান্ড, পরমুহূর্তেই মিত্রা আবার মৌটুসীর সাথে দাঁড়ানোর জন্য দুই হাত বাড়িয়ে রেখেছিল।

মিত্রার কান্না ছিল নীরবে, কিন্তু কান্নার চেয়েও মিত্রা বেশী হাসতো। ও এত দূর্বল স্বাস্থ্যের হলেও কথা বলতে শিখেছে মাত্র এক বছর বয়সে। মিত্রা এক বছর বয়সেই কথা বলে, আর আমার মেয়ে কথা বলেনা, সেটা নিয়ে আমার তো দুঃখের শেষ ছিলনা, আমার একবারও মনে হতোনা, আহারে! আমার মেয়েটা তো তাও পালোয়ান হয়েছে, মাসীর মেয়েটা এত দূর্বল, সব মা-ই তো চায়, তার বাচ্চারা গোলগাপ্পা হয়ে উঠুক। মিত্রা গোলগাপ্পা হলোনা, একটু আগে আগে কথা শিখে ফেলেছে, সেটাতেও আমার হিংসে!

যাই হোক, আমরা সবাই মাসীর সুনামগঞ্জ থেকে বাপের বাড়ী আসার অপেক্ষায় থাকতাম। রাত সাড়ে এগারোটায় মাসী নারায়ণগঞ্জ এসে পৌঁছানোর সাথে সাথে আমরা মিত্রাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠতাম। প্রতিবার মিত্রা নুতন নুতন গান শিখে আসে, তাছাড়া আমরা তখনও সুনামগঞ্জ নামক ‘অচিনপুরী’তে যাইনি, তাই মিত্রার কাছ থেকে সুনামগঞ্জের গল্প শুনতে চাইতাম। মাত্র দুই বছর বয়সেই মিত্রা রবীন্দ্র সঙ্গীতের চরণ গেয়ে শোনাত। আর শোনাত রাধারমন। এখনও মনে পড়ে, মিত্রার কন্ঠ ছিল কোকিলের মত। কি যে সুন্দর গলার স্বর, আমি তো মনে মনে বলতাম, ইস! মিত্রা যদি পালোয়ান হতো, আর মৌটুসী যদি ওর মত খ্যাংড়ালাঠি হয়েও এত সুন্দর করে গান গাইতে পারতো। মাসী বোনঝিতে কতদিন এগুলো নিয়ে হাসি ঠাট্টা করেছি।

এভাবেই মিত্রা আর মৌটুসী বড় হচ্ছিল। আমাদের আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে সকলেই জানতো, মিত্রা –মৌটুসী হরিহর আত্মা। তাই তারা যখনই ওদের কথা জিজ্ঞেস করতো, দুজনের নাম একসাথে নিত। এভাবেই দেখতে দেখতে মিত্রা আমাদের ভক্ত হয়ে উঠে। আমরা যখন অস্ট্রেলিয়া চলে যাই, তখন মিত্রার দুই চোখে বর্ষার ধারা নামে। অস্ট্রেলিয়া যে তিন বছর ছিলাম, তার প্রায় পুরোটা সময় মৌটুসী মনমরা হয়ে থাকতো। মৌটুসী খুবই শান্ত চুপচাপ ধরণের মেয়ে। কিছুই বলতোনা, কিন্তু কথা বলতে গেলেই মিত্রার কথা বলতো। তারপর তো দেশে ফিরে এলাম, এসে দেখি মিত্রার মাথার চুল কোমড় পর্যন্ত নেমে গেছে, কি ঘন কালো চুল, সেই হ্যালা কাঠি নেই, সদ্য কৈশোরে পা দিয়েছে, ছোটবেলার চেহারা পালটে দেখতে হয়েছে বর্ষার জল লাগা লাউয়ের ডগার মত সতেজ। আমি তো ওর রূপে মুগ্ধ হয়ে গেছি। কিশোরী মিত্রা আর শিশু মিত্রার মধ্যে বিরাট ব্যবধান। শিশু মিত্রা ছিল আদরের, আর দশটি বাচ্চার মত, কিন্তু কিশোরী মিত্রা হয়ে উঠেছে হুমায়ুনের গল্পের নায়িকার মত একই সাথে ‘রূপবতী ও মায়াবতী’। এই মিত্রা ধীরে ধীরে মৌটুসীর সাথে সাথে আমারও বন্ধু হয়ে উঠতে লাগলো। মিত্রা ততদিনে খুব ভাল নাচ শিখেছে, গান শিখেছে, ঘরের কাজকর্ম শিখেছে, তবুও আমার মাসী খুশী হতে পারেনা, কারণ মিত্রা নাকি লেখাপড়ায় মৌটুসীর মত হয়নি। আমি তখন হাসি, “হে হে! সবই তুমি পাবে, সেটা হবে কেন, আমার জন্য কিছু থাক!”

অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে আমরা ঢাকাতে ছিলাম চার বছর। ততদিনে সুনামগঞ্জ যাওয়ার রাস্তা অনেক সহজ হয়েছে, ফেরী বন্ধ হয়ে পাকা রাস্তা হয়েছে, তখন আমাদের আসা-যাওয়া দুই পক্ষেই শুরু হলো। ফলে মিত্রাদের আর আগের মত চার মাস, পাঁচ মাস ধরে ঢাকাতে আটকে রাখার প্রয়োজন হলোনা। চার বছরে মিত্রা হয়ে উঠলো আমার ছায়াসঙ্গীর মত। উঠতে গেলে, বসতে গেলে আমি শুধুই ‘মিত্রা মিত্রা’ করি, আমার মেয়ে হয়তো আমাকে বকা দেয়, “মামনি, আমরা গল্প করছি, তুমি কেন মিত্রাকে ডেকে নিচ্ছো?” সাথে সাথে মিত্রা বলতো, “ছি ছি মৌটুসী, আমার ফুলদিভাইকে বকোনা, কেন ডেকেছে শুনে আসি”। আমি একা না, মিত্রাকে সবাই ডাকতো, আমার মা ডাকতো, আমার ভাইয়েরা ডাকতো, আমার উত্তম কুমার তো আমাকে সব সময় বলতো, “মিত্রার মত করে কথা বলতে পারোনা?” মিত্রাকে এত ডাকাডাকির একটাই কারণ ছিল, মিত্রা ঘরের কাজ করতে খুব ভালোবাসতো, লেখাপড়ার প্রতি কোন আগ্রহ ছিলনা। ঐ ছোট বয়সেই মিত্রা রান্না করতে চাইতো, বাসন মাজতে চাইতো, জামা কাপড় গুছাতে চাইতো, আর যে এই কাজগুলো করে দিত, তাকে আমি মাথায় তুলে রাখতাম, তার জন্য আমি বিশ্ব ব্রহ্মান্ড উজার করে দিতে চাইতাম। তাই মিত্রাকে আমি উজার করা ভালোবাসা দিতাম।

আমি মিত্রাকে খুব মিস করতে শুরু করি আমেরিকা এসে। একা হয়ে পড়ি, আগে তো মিত্রার সাথে কত পুটুর পুটুর গল্প করেছি, মাঝ রাতে মনে হলো, একটা কিছু করা দরকার, মিত্রাকে ডেকে বলেছি, কিছু করতে ইচ্ছে করছে, আয় গান করি, নাহলে বলতাম, মিত্রা, যা চা করে আন, সবাই মিলে চা খাই”। সাথে সাথে মিত্রা রাজী, পাশ থেকে কেউ হয়তো বললো, “ এই মেয়েটাকে সোজা পেয়ে ওকে খাটাচ্ছো”, আমি কিছু বলার আগেই মিত্রা বলে উঠতো, “তোমরা এমন করো কেন, ফুলদিভাই তো বিরাট কিছু চায়নি, এক কাপ চা চেয়েছে, আর সবাইকে নিয়েই তো খাবে, একা তো খাবেনা”।

আমেরিকা আসার পর আমার আর মাঝরাতে কাউকেই বলা হয়না, ‘ যা চা করে আন, চল আমরা গান গাই”। আমার খুব ইচ্ছে ছিল, মিত্রাকে আমেরিকা নিয়ে আসার। এমন এক স্টেটে থাকতাম যে ভাল কোন ছেলেও ছিলনা যার সাথে বিয়ে দিয়ে ওকে এদেশে নিয়ে আসবো। ততদিনে সুনামগঞ্জ স্কুল থেকে এস এস সি পাশ করে মিত্রা ঢাকা হলিক্রস কলেজে ভর্তি হয়েছে। অনেক কষ্ট করে, এই হোস্টেল, সেই হোস্টেলে থেকে থেকে নানা অনিয়মে থেকে থেকে মিত্রা অসুস্থ হয়ে যায়। এইচ এস সি পরীক্ষার পাঁচ মাস আগে থেকে ভুল চিকিৎসার কারণে ওর একেবারেই পঙ্গু হওয়ার মত অবস্থা। পরীক্ষা হলো, পরীক্ষার ফল বের হলো, আশানুরূপ ফলাফল হলোনা।

তারপরেও মিত্রা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোয়ালিফায়েড হয়েছিল, কিন্তু তখন ছিল বিএনপি আমল, ভর্তি বানিজ্য রমরমা অবস্থা, কি কেলেঙ্কারী হয়েছিল কে জানে, ওর সিরিয়াল মোটামুটি উপরের দিকে ছিল, পাবলিক অ্যাড বা পল সায়েন্স পড়বে ভেবে ভাইবা বোর্ডে যায়, ওকে বলা হয় ‘ইসলামিক স্টাডিজ অথবা নাট্যতত্ব’ নিতে, নাহলে ভর্তি হওয়া যাবেনা।
মিত্রা ভর্তি হলোনা, চারদিক থেকে ওর উপর বিরূপ মন্তব্য, কলেজে পড়ার সময় ফাঁকী দিয়েছে, ফোনের উপরই থেকেছে, এই বয়সের একটি মেয়েকে যা কিছু বলা যায়। আমি মিত্রাকে ফোন করি, বুঝাই, মিত্রা আমার কাছে সব কষ্টের কথা খুলে বলে, আবার বলে, “ থাক, ফুলদিভাই, আমার দোষ, বড়দেরকে বকোনা, সবাই তো আমার ভাল চায়”। পরের বছর অবশ্য মিত্রা চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা দেয় এবং পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশানে চান্স পায়।

সবার জন্য মিত্রার মায়া। চোরের জন্য মায়া, ডাকাতের জন্য মায়া, ওকে ওর বন্ধু ঠকিয়েছে, সেই বন্ধুর জন্যও মায়া। হোস্টেলে রুমমেট ছিল বিএনপি নেত্রী, নতুনদের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করতো, বিশেষ করে মিত্রার সাথে, ওর কথা, “থাক গিয়ে, আপুই তো, করুক খারাপ ব্যবহার, আমি খারাপ না হলেই হলো’! ততদিনে ইউনিভার্সিটিতে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করে ও পরিচিত হয়ে উঠেছে, ওর নির্মল সুন্দর হাসিতে সবাইকে বেঁধে ফেলেছে। কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করেনা, কোন কিছু নিয়েই অভিযোগ নেই, মাঝে মাঝে আমাকে মিস কল দেয়, আমি সাথে সাথে কল ব্যাক করলে ওর অন্তরের গভীরে লুকিয়ে রাখা কষ্টগুলো আমাকে বলে। আমি ওকে বুঝাতাম, ও বলতো, এজন্যই ও আমাকে ফোন করেছে। আমার সাথে কথা বললে নাকি ওর মন খারাপ চলে যায়। চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে সেশন জট লেগেই থাকতো, কয়েক বছর লেগে গেল ওর অনার্স পাশ করতে, একদিন ফোন করে বলে, ফুলদিভাই, আমি ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি। সেদিন আমি খুব কেঁদেছিলাম, কারণ এই রেজাল্টটি ছিল মিত্রার জীবনে বিশাল পুরস্কার।

মিত্রা মানুষকে খুশী রাখতে চায়, ও নিজে অনেক কষ্ট হাসি দিয়ে ঢেকে রাখে, কখনও অসুস্থ হলেও ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলা যাবেনা ও অসুস্থ। ও কাউকে দুঃখ দেয়নি, ও এমনই এক মানুষ যে ওর কাছ থেকে কারো দুঃখ পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু অনেকেই ওকে দুঃখ দিয়েছে। কেউ কেউ তো এমন দুঃখ-কষ্ট দিয়েছে যে আমি শুধু ঈশ্বরের কাছে বলতাম, ওর মত ভাল মেয়ের দুঃখ দূর করে দাও, এই মেয়েকে তুমি পুরস্কৃত করো। অনার্সের রেজাল্টে মনে হয়েছে, ঈশ্বর আমার পার্থণা শুনেছেন।

মিত্রাকে জিজ্ঞেস করতাম, তুই এত সুন্দর দেখতে, স্বভাব তো তার চেয়েও সুন্দর, তোকে বিয়ে করার জন্য লাইন লেগে যায়না? মিত্রা খিল খিল করে হেসে উঠতো, বলতো, “এটাই তো সমস্যা, লাইন এত লম্বা যে কাকে রেখে কাকে নেই অবস্থা, তাই কাউকেই নিচ্ছিনা”। বলতাম, “অতি বড় সুন্দরী না পায় বর”, তোর অবস্থা তেমনই হয়েছে। এক সময় ও জানায়, একজন নাছোড়বান্দা ছেলেকে কোনভাবেই তাড়াতে পারছেনা, চিমটে জোঁকের মত লেগে আছে। বললাম, চিমটে জোঁক ভালো তো, গায়ে লবন ছিটিয়ে না দেয়া পর্যন্ত আঠার মত লেগে থাকবে। চিমটে জোঁককে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দে, বাজিয়ে দেখি কেমন। মিত্রা তার ‘চিমটে জোঁকের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয় ফোনে। চিমটে জোঁক আমার সাথে কথা বলতে গিয়ে দশবার গলা খাঁকারী দেয়।
আমি বলি, ‘তুমি নার্ভাস হচ্ছো কেন?” জোঁকবাবু বলে, “ একটু ভয় লাগছে”। বললাম, “তুমি কি আমার এই বোনটাকে সত্যিই ভালোবাসো?” চিমটে জোঁক এবার কিন্তু একটুও কাশলোনা, স্পষ্ট বলে দিল, “হ্যাঁ, অনেক ভালোবাসি”। [মনে মনে বললাম, আমার বোনটা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে, ঠান্ডা লাগে, জ্বর হয়ে, মাথা ব্যথা, প্যানেপ্যানে রোগ আছে কিন্তু, বুঝে দেখো, বিয়ে করার পর যদি বলো, আগে তো জানতামনা, তাহলে কিন্তু খবর আছে। আমি কিন্তু আমার বোনকে প্রাণের চেয়েও বেশী ভালোবাসি, ওর যদি কোনরকম অবহেলা হয়, তাহলেও খবর আছে।] আর প্রকাশ্যে বললাম, মিত্রা খুবই ভাল মেয়ে, আমার দেখা একমাত্র ‘রূপবতী ও মায়াবতী”। আমি শুধুই ‘মায়াবতী’ তাই তোমার প্রতি মায়া দেখাচ্ছি, তোমাকে না দেখেই মত দিলাম। মিত্রাকে কোনদিন দুঃখ দিওনা, কষ্ট দিওনা। ওকে মাথায় করে রাখবে”। চিমটে জোঁক বলে, “ অবশ্যই ফুলদিভাই, আমি ওকে কখনওই দুঃখ দেবোনা”। বলি, ‘আরে, তুমিও দেখি আমাকে ফুলদিভাই ডাকতে শুরু করেছো, এই ছেলে, এখনও তো দিল্লী বহদূর”। মিত্রার ফুলদিভাই তো আমারও ফুলদিভাই।

গত বছর আমার মেয়ে মৌটুসীর বিয়ে হলো জুন মাসের আট তারিখে, মিত্রার বিয়ে ঠিক হলো আগস্টের তিন তারিখে। কি মিল দুজনের সব ব্যাপারে। যাই হোক, মিত্রা ছিল আরেকজনের চোখের মনি, তিনি আমার মা। নাতনীর বয়সী বোনঝিকে তার বড় মাসী যেমন্ ভালো্বাসতো, বোনঝিও তেমন তার বড়মাসীকে দিদার মত জ্ঞানে ভালোবাসতো। ২৩শে জুলাই আমার মা’কে ডাক্তার দেখিয়ে যখন গাড়ীতে করে নারায়ণগঞ্জের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে নিয়ে যাচ্ছিলাম, মায়ের হাত ধরে বসে ছিল মিত্রা। মা তখন একেবারেই ক্লান্ত, আলট্রা সাউন্ড করানোর জন্য বোতলের পর বোতল জল খাওয়ানো হয়েছিল, রাস্তায় মায়ের খুব প্রস্রাবের বেগ হয়। রাস্তায় কি ট্র্যাফিক জ্যাম, মাঝ রাস্তায় গাড়ী আটকে আছে, আমি তখন পারলে গলা ছেড়ে চীৎকার করি! মিত্রা আমাকে বলল, “ফুলদিভাই, তুমি টেনশান করোনা, একটু পরেই বারডেম চলে আসবে, আমি মাসীকে নিয়ে যাব। তুমি শান্ত হও”। সত্যিই পনের মিনিট পরে বারডেম পর্যন্ত পৌঁছালাম। মিত্রা তার বড় মাসীকে ধরে ধরে গাড়ী থেকে নামালো, ভেতরে চলে গেলো মাসীকে নিয়ে। আমাকে নিয়ে গাড়ী কার্কিং এর খোঁজে গেলো, পার্কিং না পেয়ে আবার ফিরে এলো, দেখি মা’কে নিয়ে মিত্রা দাঁড়িয়ে আছে। মাকে নিয়ে মিত্রা গাড়ীতে উঠে বসতেই মা মিত্রার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “ মিত্রা, তোর শাশুড়ি খুব ভাগ্যবতী, তোর মত একটা মেয়েকে বউ করে নিচ্ছে, তোর কাছ থেকে অনেক সেবা পাবে তোর শাশুড়ী”।

আগস্টের তিন তারিখে মিত্রার বিয়ে হয়ে গেল সেদিনের সেই চিমটে জোঁকের সাথে। আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি, ওর বড় মাসীও উপস্থিত থাকতে পারেনি। ওর বড়মাসী যখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো, তখন মিত্রার সুস্থ সবল শাশুড়ীও অসুস্থ হয়ে পড়লেন, মিত্রার মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মিত্রা তখন পালা করে তার মায়ের সেবা করে, শাশুড়ির সেবা করে। এগুলো করতে করতেই তার বড় মাসীর শেষ সময় ঘনিয়ে আসে, একেবারের শেষ দিনের দুই দিন আগে মিত্রা পড়িমরি করে বাসে চেপে ঢাকা এসে পৌঁছায়, আমার সাথে আইসিইউ তে ঢুকে, বড়মাসী,বড়মাসী বলে ডাকে, বড়মাসী মিত্রাকে চিনতে পারেনা, কারণ বড়মাসী তো মিত্রার বিয়েতে উপস্থিত হতে পারেনি, মিত্রাকে কপালে সিঁদুরের টিপ, মুখ মাস্কে ঢাকা দেখেনি, চিনবে কি করে। তবে বড়মাসী বেঁচে থাকতেই যে বড়মাসীর আশীর্বাদ মিত্রার উপর বর্ষাবে, বিয়ের এক মাসের মাথাতেই মিত্রা শশুড়বাড়ীতে ‘অপরিহার্য্য’ হয়ে উঠবে, তা কে জানতো!!

মিত্রার সাথে আমার গতরাতে চ্যাট হয়েছে। আমি বলি, হ্যাপী বিয়ের আগের রাত। মিত্রা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। বলি, তোর চিমটে জোঁকের খবর কি? বলে, আরে, আমার মাথার পোকা খুলে ফেলতেছে, বিএসএস পরীক্ষার প্রিপারেশান নেয়ার জন্য”। বলি, চিমটে জোঁককে বলিস, সকাল সন্ধ্যা তোরে ‘আমি ভালোবাসি, আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বলতে, বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে অযথা টেনশান না করতে, অনার্স, মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছাত্রী তুই, যে মেয়ে বিয়ের পর মানবিক বিভাগের সাবজেক্টে মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পায়, সে বিসিএস পরীক্ষায় দুই চোখ বন্ধ করেই পাশ করতে পারবে। পাশ না করলেও ক্ষতি নেই, চিমটে জোঁক একজন ‘রূপবতী এবং মায়াবতী’কে বিয়ে করেছে, কোন ‘বিদ্যেবতী’কে বিয়ে করে নাই।

“ হ্যাপী প্রথম বিবাহবার্ষিকী মিত্রা এবং সূর্য্য ( চিমটে জোঁক)”
— with Anindita Roy and Surjya Kanta Dash. (4 photos)
Like · · Promote ·




  1. নষ্টবাম বুঝিনা, টাটকা ডান বুঝিনা, চৈনিক বাম বুঝিনা, রাশান বাম বুঝিনা, আমেরিকান ডান বুঝিনা, অন্য কোন ডানও বুঝিনা, পুরুষ বুঝিনা, মহিলা বুঝিনা, নেতা বুঝিনা, নেত্রী বুঝিনা, আস্তিক বুঝিনা, নাস্তিক বুঝিনা, সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশে গড়ার কাজে উচ্চশিক্ষিত নতুন প্রজন্মের সাথে চাই 'ছবির মানুষটির মত সৎ, পরিশ্রমী এবং দেশপ্রেমিক 'মানুষ'! জয় বাংলা!!! — with Rukhsana Kajol and 26 others.
  2. কারণ, বেঁচে থাকলে আমিও বুড়ো হবো!

    সপ্তাহের কোন কোন দিন একেবারেই অন্যরকমভাবে কাটে, বিশেষ করে আমার কাজের জায়গায়। ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে কাজ করে এই একটা কাজের কাজ হয়েছে, মানুষ দেখতে পাই, সব বয়সের, সব পেশার, সব ধর্মের। এদেশে সাধারণ মানুষ, অসাধারণ মানুষ, সাধু, চোর, চার্চের ফাদার, আস্তিক, নাস্তিক, এশিয়ান, হিসপ্যানিক, অ্যামিশ, মেনোনাইট থেকে শুরু করে সকলের কাছে মোবাইল ফোন থাকে। তাই তারা তাদের প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আমাদের কাছে আসে।

    বিশেষ দিনের কথা বলতে চেয়েছিলাম, আজকে ছিল বিশেষ একটি দিন। আমার কাজের স্কেজিউল ছিল বেলা বারোটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত। পোডিয়ামে গিয়ে পৌঁছোতেও পারিনি, হাঁটার মাঝখানেই শুরু হয়ে গেছে প্রশ্ন, " তুমি কি এই ডিপার্টমেন্টে চাকরী করো?"
    -হ্যাঁ, করি, বল কি প্রয়োজন তোমার?
    এরপর প্রয়োজন বলা শুরু হলো, প্রয়োজনের কথা শুনে আমার যা করনীয় করলাম, এরপর নিজের জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। আমাদের রেজিস্টারের সামনেই এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসে থামলেন, বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারা, হুইল কার্ট চালিয়ে এসেছেন, দুই হাঁটুরর ভাঁজটিতে একটি ডিভিডি প্লেয়ার আটকে রেখেছেন, সামনের ছোট ঝুড়িতে দুই তিন রকমের ওষুধের প্যাকেট। ভদ্রলোকের ঘাড় একটু বাঁকা, সোজা করে তুলতে পারেনা। আমি নিজেই রেজিস্টার থেকে বের হয়ে গেলাম, নীচু হয়ে তার পায়ের কাছ থেকে ডিভিডি প্লেয়ার তুলে এনে স্ক্যান করে প্যাকেট করে দিয়ে দাম নেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। বুড়োর হাত কাঁপছে, বলল, " ্বয়স হয়ে গেছে, চারবারের রিটায়ার্ড আমি, আরেকবার মাত্র রিটায়ার করা বাকী আছে।" বুড়ো কথা বলে চলেছেন, আমি হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছি, আমার তো কিছু বলার নেই, বুড়োর পেছনে তিন মেয়ে নিয়ে এক কাঠখোট্টা চেহারার মহিলা দাঁড়িয়ে আছে, এই ধরণের চেহারার মহিলা দেখলেই আমার কেন জানি ভয় করে, এই মহিলাগুলো ভীষণ তেলেবেগুণে জ্বলে উঠা টাইপ, কেমন ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে কথা বলে, মনে হয় জীবনে সুখ বা শান্তি নিয়ে কোন চর্চা করেনি, তাই সুখ শান্তির অভিজ্ঞতা নেই।

    বুড়ো মানুষ দেখলেই আমার মনে এক ধরণের মায়া কাজ করে। আমি ভাবতে থাকি, এই মানুষগুলো একদিন জোয়ান ছিল, শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটতো, কারো কারো রূপের চ্ছটায় চারদিক আলোকিত হয়ে উঠতো, আজ বয়স কেমন করে এদেরকে জবু থবু বানিয়ে দিয়েছে। আমি সব সময় বুড়োদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে চেষ্টা করি। গত সপ্তাহে এক ভদ্রলোক এসে আমার খোঁজ করছিলেন, আমি আসতেই বললেন, " আমার ফোন সার্ভিস কন্ট্র্যাক্ট রিনিউ করতে হবে, আমার বাবা বলেছেন তোমার সাথে দেখা করতে, তুমি নাকি খুব 'কাইন্ড এন্ড নাইস'"। আমি জানিওনা, কবে কখন কোন বুড়ো-বুড়ীর মনে আস্থা অর্জন করেছি।

    এবার বুড়ো ক্রেডিট কার্ড বের করে দাম দিতে দিতে বললো, চারবারের রিটায়ার্ড মানুষ আমি, আর্মিতে ছিলাম, ফেডারেল মার্শাল ছিলাম, এমন আরও কি কি ছিল বলে, বলল, এখন আমার বয়স ৭৩ বছর।
    আমি মুখ ফসকে বলে ফেললাম, মাত্র ৭৩ বছর?
    বুড়ো বলে, মাত্র ৭৩ মানে? তুমি কি ভেবেছিলে? আরও অনেক বেশী?
    আমি থতমত খেয়ে গেছি, যে মানুষটি ঘাড় তুলতে পারছেনা, সোজা হয়ে বসতে পারছেনা, তার বয়স ৭৩ ভাবি কি করে? ৭৫ বছর বয়সে আমার মা চলে গেলেন, তখনও মা কুচি দিয়ে ব্লাউজের সাথে শাড়ী ম্যাচ করে পড়েছেন, মাথা সোজা করে হেঁটেছেন, আর আমার বাবা তো এখনও বুকটান করে হেঁটে বেড়ায়, অথচ এই বুড়োদের তুলনায় আমার বাবা-মা কতই না সাধারণ জীবন যাপন করেছেন। আমি আর কিছুই বলার না পেয়ে বললাম, না না, তোমাকে বুড়ো ভাবিনি---
    বুড়ো বলল, তুমি আমাকে দেখে কি ভেবেছো? আর্মির চাকরী আমাকে বুড়ো বানিয়ে ফেলেছে। বলেই বলল, আমি ছিলাম ফেডারেল মার্শাল। ফেডারেল মার্শাল কি জিনিস বুঝো?
    -না বুঝিনা, মিলিটারী টিলিটারি টাইপ কিছু হবে হয়তো।
    -আমার কাজ ছিল ইলিগ্যাল ইমিগ্র্যান্টদের ধরে ধরে জেলের ভেতর ঢোকানো। নিউইয়র্কে আমি প্রায় ২০ বছর এই কাজ করেছি।
    -ভাগ্য ভালো, তুমি রিটায়ার্ড এখন, নাহলে তোমাকে বুড়ো ভেবেছি, এই ভুলের কারণেও হয়তো আমাকেও জেলে ঢুকাতে, হা হা হা হা!!
    -বুড়ো হেসে দিল, বললো, আমি রিটায়ার্ড তো কি হয়েছে, আই ডোন্ট কেয়ার! পকেট থেকে একখানা কার্ড বের করে দেখালো, লেখা আছে 'ফায়ার আর্মস লাইসেন্স' জাতীয় কিছু। আমি তো বার বার পেছনে দাঁড়ানো সেই কঠিন চেহারার মহিলার দিকে তাকাচ্ছি আর ভাবছি, বুড়ো কখন যাবে। ফায়ার আর্মস লাইসেন্স বলতে কি বুঝি জানতে চাইতেই বললাম, বুঝাবুঝির কিছু নাই, যখন ইচ্ছে, যাকে ইচ্ছে কোমড় থেকে আর্মস বের করে ঠুস করে দেয়ার ক্ষমতা কার্ড এটা।
    -তুমি এত গুছিয়ে কথা বলো কিভাবে?
    -ঠেকে শিখেছি, তোমাদের মত ফেডারেল মার্শাল তো আমাদের দেশেও আছে, কিছু হলেই 'ঠুস' করে দেয়।
    বুড়ো বলল, না, কিছু হলেই ঠুস করতে পারিনা, চাকরীর নিয়ম আছে, এই যে আমেরিকাতে যার তার কাছে বন্দুক পিস্তল থাকে, এটা ভাল কথা নয়, সবাই প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘোরে, খুবই খারাপ কথা। এগুলো বন্ধ হওয়া দরকার। আজ চলি, আমাকে বুড়ো দেখা গেলেও এখনও কব্জীর জোর আছে, রিটায়ার্ড করে ফেললেও এখনও অন্যায় দেখলে হাত নিশপিশ করে, বুড়ো হয়ে গেছি, চারবারের রিটায়ার্ড, এখন আরেকবার রিটায়ার করার জন্যই অপেক্ষা।
    -তোমার মনের জোর আছে, এখনওই রিটায়ারের কথা ভাবছো কেন, সরকারের কাছে দাবী জানাও যেন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে, তোমাদের দেশে ছেলে বুড়ো সবার পকেটে পিস্তল গোঁজা থাকে, এটা ঠিক নয়।

    বুড়ো বিদেয় হয়েছে, বাকীদের সাহায্য করছি, সাড়ে চার ফুটিয়া সুন্দরী বুড়িকে আসতে দেখে মনটা দমে গেল। এই বুড়ী অনেক ঝামেলা মেকিং বুড়ি। দারুণ সাজ করেছে, ঝলমলে রঙের গোঁড়ালী ঢাকা জামা, মাথার চুল পার্লার থেকে সেট করিয়ে আসা, দুই চোখের পাতায় নানা রঙের আইশেডো মাথা। লাঠিতে ভর করে কুঁজো হয়ে এসে পৌঁছেই বলে, " আমার পুরানো ফোন আবার ফিরে চাই, পুরানো নাম্বার ফিরে চাই"।
    আমি ভেবেছি, কন্ট্র্যাক্ট রিনিউ করতে চায়, জিজ্ঞেস করলাম, কন্ট্র্যাক্ট রিনিউ করবে? উত্তরে বুড়ী ঝাঁঝিয়ে উঠলো, আমি চমকে গেলাম আমাকে বকছে ভেবে, পরে বুঝলাম, ফোন কোম্পাণীকে বকছে। নানাভাবে প্রশ্ন করেও বুঝতে পারছিলামনা, সে আসলে কি চায়। ফোন কিনতে চায় কিনা জিজ্ঞেস করতেই ব্যাগের ভেতর থেকে তিনটি পুরানো মোবাইল ফোন বের করে বলে, আমার কাছে এতগুলো ফোন থাকতে আমি আবার ফোন কিনবো কেন?
    কবে থেকে যেন জমিয়ে রেখেছে ফোন, বুঝাতে চেষ্টা করলাম, এই ফোন কাজ করবেনা, কাকে কি বুঝাই, বুড়ী উলটো আমাকে বুঝায়, কোন যুক্তি শুনবেনা, তার পুরনো নাম্বার ফিরে চায়, পুরনো ফোনেই তা ফিরে চায়।

    কোনভাবে বুঝিয়ে বললাম, ফোন সার্ভিস নবায়ন করলে মাত্র এক ডলারে সে অনেক ভালো ফোন পাবে। এবার সে জানালো, তার আগের সার্ভিস বাতিল হয়ে গেছে, এখন সে তার মেয়ের একাউন্টে আছে, কিন্তু মেয়ের সাথে থাকতে চাইছেনা, তাকে আবার নতুন করে ফোন সার্ভিস নিতে হবে এবং সে স্মার্ট ফোনের দিকে দেখিয়ে বলে, এর যে কোন একটা ফোন সে চায়।
    বললাম, স্মার্ট ফোন নিলে সাথে ইন্টারনেট ফীচার যোগ করতে হবে। ব্যস, এবার বুড়ী আমার উপর ক্ষেপে গেল, আমি কেন তাকে ইন্টারনেট নিতে বললাম। তার বাড়ীতেই ইন্টারনেট আছে, কম্পিউটার আছে, ফোনে কেন ইন্টারনেট নিবে? তার তো ইন্টারনেট দরকার নেই। বলি, সত্যিইতো, দরকার না থাকলে তুমি কেন ইন্টারনেট নিতে যাবে? তার চেয়ে অন্য ফোন নাও, যেটাতে ইন্টারনেট লাগবেনা। অন্য ফোন বুড়ির মনে ধরেনা, সে একবার আইফোন ৫, একবার গ্যালাক্সী নোট, গ্যালাক্সী ৩, ৪ হাতিয়ে দেখে, আবার মটোরোলা অ্যাট্রিক্স নিতে চায়।

    বললাম, আগে তোমার ক্রেডিট চেক করে দেখি, ততক্ষণে তুমি সিদ্ধান্ত নাও, কি করবে? তবে স্মার্ট ফোন নিতে হলে ইন্টারনেট নিতেই হবে, এটা ফোন কোম্পাণীদের পলিসি।
    ক্রেডিট হিস্টরী তার ভাল হওয়ার কথা, কাজেই ক্রেডিট চেক করার ব্যাপারে তাকে আগ্রহ দেখাতে দেখা গেল না।
    সে শেষ পর্যন্ত রাজী হলো, নন স্মার্ট ফোন নিবে। আমিও খুশী মনে তার ক্রেডিট চেক করে বললাম, জিরো ডিপোজিটে তুমি পাঁচটি ফোন লাইন নিতে পারো। এক লাইন নিলে ৪০ ডলার মাসে খরচ হবে। এখন আমাকে বলো, কোন ফোনটি চাও?
    বুড়ি বলে, ৪০ ডলার বিল দিতে হবে? মামার বাড়ীর আবদার পেয়েছো? আমাকে ভাবতে দাও। এখন বাড়ী যাই, তুমি আমার কোন উপকার করতে পারলেনা। আমার সাথে নিয়ে আসা ফোন থেকেই একটা ফোন চালু করে দিতে পারতে, সেটা দিলেনা, আমি বড় ফোন চেয়েছি, সেটাতেও ইন্টারনেট নিতে বলেছো, আমার বাড়ীতে ইন্টারনেট আছে এত করে বললাম, এখন আমাকে তুমি বলছো, ৪০ ডলার মাসে খরচ করার কথা এই সাধারণ ফোনে? তুমি তো কোন কাজেরই না।

    পাক্কা একটি ঘন্টা সময় ব্যয় করে, বুড়ির ধমক খেয়েও যখন বুড়ীর কাছ থেকে ' আমি কোন কম্মের না' শুনলাম, তখন হতাশ হয়ে বললাম, " আমি আমার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি তোমাকে বুঝাতে, এর বেশী বুঝানোর ক্ষমতা আমার নেই, তুমি বরং বাড়ী গিয়ে আরেকটু ভাব। ভেবে পরে সিদ্ধান্ত নিও, আর যেটাই করো, মেয়েকে জানিও, তোমার মেয়ে বুঝবে তোমার জন্য ঠিক কোন ফোন দরকার"।
    বুড়ি আর পেছন ফিরেও তাকালোনা, তবে যাওয়ার আগে শুধু বলল, " ামার কথায় কিছু মনে করোনা, তোমাকে অনেক কষ্ট দিলাম, আমি আজকে ফোন নিবনা, আরও ভাবতে হবে।"

    বুড়ী চলে যেতেই আমার সহকর্মী ডোরা বলল, " আমি তখন থেকে লক্ষ্য করছিলাম, তুমি এই বুড়ীকে এত পাত্তা দিলে কেন? এতক্ষণ প্যাঁচাল পারিয়ে, তোমাকে দিয়ে ক্রেডিট চেক করিয়ে এখন বলে তুমি কোন কাজের না। পড়তো আমার পাল্লায়, বুঝিয়ে দিতাম কাজের না আর কাজের মধ্যে পার্থক্য"।
    আমি হেসে ফেললাম, বললাম, বুড়ীর বয়স কত জানো? আইডিতে লেখা ১৯৩০ সালে জন্ম। ৮৩ বছর বয়সের এক বুড়ী আমাকে বকা দিতেই পারে, আসলেই তো আমি তার মনের মত কাজ করতে পারিনি, সে চেয়েছিল তার মৃত ফোনগুলোকে বাঁচিয়ে তুলতে, আমি সেটা পারিনি, রাগ তো করবেই।
    ডোরা বললো, বুড়ো-বুড়ীগুলোকে দেখতে ইচ্ছে করেনা, ভীষন জ্বালিয়ে মারে।
    আমি বললাম, আহারে, যৌবনে নিশ্চয়ই তারা এমন ছিলনা, আমাদের মতই ছিল, এখন বুড়ো হতে কিছু তো মতিভ্রম হতেই পারে, যদি বেঁচে থাকি, তাহলে আমিও তো একদিন বুড়ো হবো!!



সাত রঙা বেলুন!

১৯৭১ সালের শেষের দিকের কথা, আমরা তখন কলকাতায় ছোট কাকার ভাড়া বাসায় থাকি, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। বারাকপুরে ছোটকাকার বাসা ছিল বলে আমাদেরকে রিফিউজী ক্যাম্পে থাকতে হয়নি। আমার কাকা মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর আগে ( কারণ উল্লেখ করলামনা) পূর্ব বাংলার ভিটেমাটি ছেড়ে উত্তর কলকাতায় এসে জীবন সংগ্রাম করছিলেন।
তখন সময়টা কেমন ছিল, এখনও বুঝে উঠতে পারিনা। আমরা কত ছোট ছিলাম, তারপরেও যেন বড়দের কষ্ট বুঝতাম, একটু খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য কাকার নিরন্তর সংগ্রাম, এতগুলো সদস্য নিয়ে বাবা-মায়ের হঠাৎ করে একজন মানুষের কাঁধে এসে পড়ার যে বিড়ম্বণা, আমার বাবার প্রাণান্তকর পরিশ্রম যেনো ছোটভাইয়ের উপর চাপ কম পড়ে, আমার মায়ের রাতদিন সংসারের খাটুনী এবং সুদিনের অপেক্ষায় থাকা---এসবই আমরা বুঝতে পারতাম। কোন বায়নাক্কা ছিলনা আমাদের।

আমাদের পরিবারে অনেক আগে থেকেই বই পড়ার খুব চল, আমার বাবা, কাকা, মা থেকে শুরু করে সবাইকেই শুধু বই নিয়ে কথা বলতে শুনতাম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অস্থির সময়েও আমাদেরকে দুই বেলা বই নিয়ে পড়তে বসতে হতো। এখনও ভেবে অবাক হই, মার্চের শেষে আমরা যখন নারায়ণগঞ্জের বাসা থেকে বেরিয়েছিলাম, বাবা আমাদের ভাইবোনদের প্রত্যেককে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সাথে করে যেন ইংলিশ গ্রামার এবং অংক বই নিয়ে নেই। বাবা হয়তো ভেবেছিলেন পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে, তখন যেন উনার ছেলেমেয়েরা স্কুলে পিছিয়ে না পড়ে, পরীক্ষায় যেন ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড না হতে হয়। তার উপর আমার বড়দার ছিল সামনেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা, নারায়ণগঞ্জের সবাই জানতো, মেট্রিকে আমার বড়দা বিশাল কিছু একটা করবে। কাজেই বাবার তো চিন্তা ডাবল হয়ে গেছিল।

নারায়ণগঞ্জের বাসা ছেড়ে আমরা সোনারগাঁতে ছিলাম দুই মাস। সেখানে আমার জন্য দুই বেলা গ্রামার বই থেকে ওয়ার্ড মুখস্থ করা ছিল বাধ্যতামূলক। আমার সেজোমাসীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সব সময় আমাকে যেন ওয়ার্ড জিজ্ঞেস করে পরীক্ষা নেয়া হয়, সেজোমাসী সে দায়িত্ব প্রয়োজনের চেয়েও অতিরিক্ত উৎসাহে সম্পন্ন করতেন, তার একটাই চেষ্টা ছিল, মিঠু নামের এই ‘গালফুলা’ মেয়েকে কীভাবে টাইট দিয়ে গালদুটো আরও বেশী ফুলিয়ে দেয়া যায়, একেবারে বেলুনের মত। ‘বিস্কুট এর ইংরেজী ‘বিসকুইট’, এটা আমি শিখেছি সোনারগাঁয়ের ননীবাবু মশায়ের লাল ইঁটের পুরণো দোতলার ছাদে বসে। বিস্কুট বানান জিজ্ঞেস করলেই আমি ভুল করতাম, একদিন নিজে নিজে বুদ্ধি বের করে ঠিক করলাম, বিসকুইট’ বলে চিন্তা করলেই বানান শুদ্ধ হয়। সেই থেকে মাস্টার্স পড়া পর্যন্ত কঠিন জিনিসগুলোকে নিজের সুবিধা অনুযায়ী আজগুবী ছন্দে মনে মনে সাজিয়ে নিতাম, আর ভুল হতোনা।

সেজমাসীর অত্যাচার থেকে গিয়ে পড়লাম কাকার অত্যাচারের সীমানায়। কাকা মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আমাদের সবাইকে নিয়ে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবে। ঘরে বসে বসে নাকি আমাদের মেধা নষ্ট হয়ে যাবার যোগাড় হয়েছিল। কাকা তো জানতো, আমরা সবগুলো ভাইবোন দারুণ মেধাবী হয়েছি। নানা কারণে, প্রচন্ড অভাব-অনটনে আমার বাবা, কাকাদের লেখাপড়া শেষ করার আগেই জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে। তাই তাঁদের শিক্ষাজীবনের অসম্পূর্ণতা আমাদের উপর দিয়ে কড়ায় গন্ডায় মেটাতে চেয়েছিলেন। সেইজন্যই কাকার কাছে একটি ‘ঘোড়ার কানওয়ালা চাবুক’ থাকতো। পেটাতোনা, কিন্তু ওটা দেখিয়ে আমাদের পিলে চমকিয়ে দিত। আমরা খুব বাধ্য ছেলেমেয়ের মত গ্রামার আর অংক বই নিয়ে দুই বেলা লেখাপড়া করতাম।

আমার কাকার খুব গল্পের বই পড়ার নেশা ছিল, শুধু নিজেই পড়তোনা, আমার মায়ের জন্যও বই যোগাড় করে নিয়ে আসতো। কাকা আরেকটি জিনিস করতেন, আমাদেরকে জামা কাপড় উপহার না দিয়ে বই উপহার দিতেন। কাকার তো অর্থনৈতিক সঙ্গতি ছিলনা, তাই ছোট ছোট বই দিতেন।

১৯৭০ সালে আমরা প্লেনে চড়ে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ করেছিলাম, ঢাকা থেকে কলিকাতা। আমি তখন বেবী ক্লাস থেকে ফার্স্ট হয়ে ক্লাস ওয়ানে উঠেছি, হাতের লেখা মুক্তোর মত (আমার পিসীমার ভাষায়, আমার পিসীমা বেড়াতে এসে আমার হাতের লেখা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছিলেন, এত ছোট একটা মেয়ের হাতের লেখা এমন সুন্দর হতে পারে, তা সবাইকে দেখানোর জন্য আমার ‘হাতের লেখা খাতা’ থেকে একটি পৃষ্ঠা ছিঁড়ে নিয়ে গেছিলেন এবং কলকাতাসহ জলপাইগুড়িতে গিয়েও প্রচার করেছিলেন)। আমাকে দেখে তো কাকা খুশী, ফেরার সময় আমাকে কিনে দিলেন “খুকুমনির ছড়া’ আর মেজদাকে কিনে দিলেন “আম আঁটির ভেঁপু”। খুকুমনির ছড়া শুনলেই মনে হবে ‘ আতা গাছে তোতা পাখী’ ধরণের ছড়া, আসলে তা নয়, ইয়া মোটা এক বই ভর্তি শুধু ছড়া আর ছড়া। আমার প্রথম বই, কত ছড়া এখনও কিছু কিছু মনে আছে।

আমাকে কাকা দ্বিতীয় বইটি দিলেন ’৭১ সালের কোন এক সময়। বইয়ের নাম, “সাতরঙা বেলুন’। পাতলা, চওড়া চকচকে রঙিন বইয়ের কভারে আঁকা ছিল, ফ্রক গায়ে এক বাচ্চা মেয়ের হাতে সাত রঙের সাতটি বেলুন। আমিও তো সেই ছবির মেয়েটির মত ছিলাম, তেমনই ঝাঁকড়া চুল, কোঁকড়ানো চুলের গুছি চোখে মুখে এসে ঝুলতো, দুঃখী চেহারা নিয়ে বারান্দায় বসে থাকতাম, সামনের রাস্তা দিয়ে মিলিটারী ট্রাক যেতে দেখলেই লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে চেঁচাতাম “ টা টা বাই বাই, আবার যেন দেখা পাই। জয় বাংলা জয় বাংলা”।

আমার কাকা আমদেরকে অনেক ভালোবাসতেন, শাসনে রাখতে চাইতেন যেন কোনভাবেই বিগড়ে না যাই। কাকা কি করে বুঝেছিলেন, ‘সাতরঙা বেলুন’ বইটি আমার জন্যই লেখা হয়েছে! রাশিয়ান বই, আর আমার মেজদার জন্য কিনে এনেছিলেন, “ সোভিয়েত দেশের নানা জাতির রূপকথা”। কি অদ্ভুত সব গল্প ছিল। সাতরঙা বেলুন বইটি আমার জীবনে পাওয়া বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সেরা বই। গল্পটির মূল কথা এখনও মনে আছে।

পাঁচ-ছয় বছরের বাচ্চা একটি মেয়ে, খুবই গরীব, তিনবেলা খাবারও জোটে না, এমনও হয়, কোন কোন বেলায় একটি মাত্র ‘বনরুটি’ চার টুকরো করে ভাই বোনে ভাগ করে খায়। মেয়েটি গরীব হলেও খুব ভাল, বাবা মাকে একটুও কষ্ট দেয়না, আশেপাশের বাচ্চারা কত আনন্দ করে, বাবা মায়ের কাছ থেকে কতকিছু পা্‌য় কিন্তু মেয়েটি আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকে, আকাশে মেঘেদের খেলা দেখে।

একদিন মেয়েটি রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর পর্যন্ত চলে এসেছে, চারপাশে কোন কিছুই চেনা লাগছিলনা। বাড়ীর রাস্তা ভুলে গিয়ে কেঁদে ফেলতেই ছোট একটি পরী এসে হাজির হয়। পরী তো জানেই মেয়েটি খুব দুঃখী, তাই পরী মেয়েটির হাতে সাত রঙের সাতটি বেলুন ধরিয়ে দেয়, বেলুন দেখে মেয়েটির খুশী আর ধরেনা, কতদিন ওর শখ হয়েছে একটি লাল বেলুন কেনার, আর আজকে পরী সাত রঙের সাতটি বেলুন দিয়েছে। পরীকে ধন্যবাদ জানাতেই পরী বললো, এই সাতটি বেলুন হচ্ছে সাত ইচ্ছেপূরণের বেলুন। একটি করে ইচ্ছে বলে একটি করে বেলুন উড়িয়ে দিবে, সাথে সাথে সেই ইচ্ছে পূরণ হয়ে যাবে। বলেই পরী উড়ে চলে গেল।

মেয়েটি বেলুন পেয়ে দিশেহারা, ও সাতটি ইচ্ছে খুঁজে পাচ্ছিলনা। ও প্রথমেই চাইল, আমি কেক খেতে চাই, বেলুন উড়িয়ে দিতেই ওর চারপাশে রঙ বেরঙের সুস্বাদু, সুগন্ধী কেক, ডোনাট, মিষ্টি বনরুটি এসে চারদিক ভরে গেলো। বাচ্চা মানুষ, কত আর খেতে পারে, একবার এই কেকে কামড় দেয়, আরেকবার আরেকটিতে দেয়, তারপর আরেক বেলুন উড়িয়ে বললো, কেক নিয়ে যাও। সব কেক মিলিয়ে গেল। তৃতীয় বেলুন উড়িয়ে বলল, আমার সুন্দর সুন্দর জামা চাই, বলতেই ওর চারপাশ জামা কাপড়ের রঙিন প্যাকেটে ভরে গেল। এভাবেই ও একটি একটি করে জিনিস চায়, আবার এত বেশী জিনিসের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সব ফিরিয়ে দেয়।

মেয়েটির হাতে আর মাত্র দুটি বেলুন আছে। ও আর কি চাইতে পারে ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেলো, “বেলুন কিনতে পয়সা লাগে, আমি কোনদিন একটাও বেলুন কিনিনি, আজ আমি বেলুন পেতে চাই”। যেই না ইচ্ছে বলে ছয় নাম্বার বেলুনটি উড়িয়েছে, সারা আকাশ জুড়ে বেলুনের মেলা বসে গেছে। এক সময় আকাশ থেকে বেলুনগুলো নামতে শুরু করেছে, নামতে নামতে পুরো শহর ঢেকে ফেলেছে, চারদিকে চেঁচামেচি, দৌড়োদৌড়ি, গাড়ি ঘোড়া থেমে গেছে, বেলুনে চারধার ঢেকে গেছে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বাড়ির বাইরে ছুটে এসেছে, মেয়েটি দেখে সারা শহরে চরম বিশৃংখলা দেখা দিয়েছে, হাতে ধরা সাত নাম্বার বেলুনটি উড়িয়ে দিয়ে মেয়েটি বলল, ‘আমি চাই শহর আগের মত হয়ে যাক”। সব বেলুন মিলিয়ে গেল, এরপর মেয়েটির খেয়াল হলো, বাবা মায়ের জন্য একটি বাড়ী চাওয়া হয়নি, ঘরের জন্য খাবার চাওয়া হয়নি, মায়ের জন্য কাপড় চাওয়া হয়নি, বাবার জন্য টাকাপয়সা চাওয়া হয়নি। ওর হাতে আর একটাও বেলুন নেই, ও আবার আগের মত গরীব হয়ে গেছে, এবার বাড়ী ফেরার পথ খুঁজতে হবে, এটা হারিয়ে গেলে চলবেনা।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর খুব আনন্দে আত্মহারা ছিলাম, দেশে ফেরার সময় সাথে কি নিলাম কি ফেলে গেলাম খেয়ালে ছিলনা। স্বাধীনতার পর, যখন আমরা রেশনের চালের ভাত খেতাম, রাতের বেলা আটার রুটি খেতাম, দূর্গা পূজার সময় মায়ের হাতে সেলাই করা সাধারণ সূতির জামা পড়তাম, তখন মনে পড়তো ‘সাতরঙা বেলুন’ বইটির কথা। আমার জিনিসপত্র খুব কমই হারায়, ‘খুকুমনির ছড়া’ বইটি অনেককাল পর্যন্ত আমাদের নারায়ণগঞ্জ বাসার বুকশেলফে ছিল, ‘আম আঁটির ভেঁপু’, ‘সোভিয়েত দেশের নানা জাতির রূপকথা’ বইগুলো তো অনেক বড় হয়েও পড়েছি, কিন্তু ‘সাতরঙা বেলুন’ বইটি হারিয়ে গেছে।

ইদানিং আবার ‘সাতরঙা বেলুন’ বইটির কথা মনে পড়ছে। ভাবতে ভালো লাগে, কোন এক পরী এসে আমাকে সাতটি বেলুন দিয়ে গেলো। গল্পের মেয়েটি ছোট ছিল, তাই ও বুঝতে পারেনি বেলুন উড়িয়ে কি চাওয়া উচিত ছিল। আমি তো বুড়ো মানুষ, আমার ভুল হবেনা। আমি প্রথম বেলুন উড়িয়ে বললাম, “সকল যুদ্ধাপরাধীদেরকে কানে ধরে দোজখের আগুনে ফেলে দেয়া হোক”
দ্বিতীয় বেলুন উড়িয়ে বললাম, “পদ্মা সেতু চাই”।
তৃতীয় বেলুন উড়িয়ে বললাম, “শেয়ার মার্কেটে হারাণো টাকা যার যার একাউন্টে ফেরত চাই।
চার নাম্বার বেলুন উড়িয়ে বললাম, “নদী ভরা মাছ চাই, জমি ভরা ফসল চাই, গোতাল ভরা গরু চাই’
পাঁচ নাম্বারে, “দূর্নীতিবাজদের কঠিন শাস্তি চাই, দূর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চাই’।

আর মাত্র দুটো বেলুন হাতে আছে, হায় হায়, আরও কত কিছু চাওয়ার আছে, মনে পড়ছেনা, কি চাওয়া যায়, ছয় নাম্বার বেলুন উড়িয়ে বললাম, “বাহাত্তরের সংবিধান চাই”।

সাত নাম্বার বেলুন, শেষ বেলুন, কি চাওয়া যায়, কি চাওয়া যায়, হাতে আর সময় নেই, “দেশে শান্তি ফিরে আসুক চাই”।

শেষ, সাতটি বেলুনই শেষ। যা চেয়েছি, সব তো পেলাম, নিজের জন্য কি পেলাম? কিছুই তো পেলামনা। কেঁদে ফেলার আগে খেয়াল হলো, আমি তো নিজের জন্য আলাদা করে কিছুই চাইইনি, এখন কি হবে! সবাই তো নিজের জন্য চায়, প্রবাদ আছে ‘আপন বুঝ পাগলেও বুঝে’ আর আমি কিছুই বঝলামনা! ‘ফটাস’ শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি লাল বেলুন আকাশে উড়ে যাওয়ার আগেই ফেটে গেছে, এরপর ‘ফটাশ’ ফটাশ’ ‘ফটাশ শব্দ আরও ছয়বার শোনা গেলো, চশমাটা চোখে দিয়ে উপরের দিকে তাকালাম, সাতটি বেলুনের ছেঁড়া টুকরো মাটির দিকেই নেমে আসছে।
(4 photos)
Like · · Promote ·


ভালোবাসার মায়াবী বলয়ের কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়ছি!!

গত বেশ কিছুদিন ধরে মনটাতে এক ধরণের অস্থিরতা টের পাচ্ছি। কেবলই মনে হয় কি যেন হারিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে অথবা আমিই হারিয়ে যাচ্ছি জীবনের পরিচিত কক্ষপথ থেকে।
এই বছরের প্রথমদিকে, দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকার 'শিলালিপি' তে ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেনের একটি সাক্ষাৎকার মুদ্রিত হয়েছিল। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ডঃ মিল্টন বিশ্বাস।
ডঃ বিশ্বাস আমার বন্ধু, ফেসবুক সূত্রে বন্ধু। বন্ধু মানেই শুভাকাংক্ষী, ডঃ বিশ্বাসও আমার হিতাকাংক্ষী। হিতাকাংক্ষী হিসেবেই উনি সব সময় আমাকে উৎসাহ দেন ভালো কিছু লিখবার জন্য। আমাকে ভালো কিছু লিখবার উৎসাহ দানের অংশ হিসেবেই উনি আমাকে ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেনের সাক্ষাৎকারটি পড়তে বলেন, পড়া শেষ করে তার উপর ছোটখাটো পাঠক প্রতিক্রিয়া দিতে বলেছিলেন।

'ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেনের সাক্ষাৎকার পড়তে পারি, সাক্ষাৎকার পড়ে তার উপর মন্তব্য করার মত যোগ্যতা আমার নেই' বলে ডঃ বিশ্বাসকে জানালাম। উনি নাছোড়বান্দা, আমাকে লিখতে বললেন। আমি লিখে পাঠালাম। তেমন কিছু লিখিনি, শুধু একটি জায়গায় দ্বিমত পোষণ করেছিলাম। সেলিনা হোসেন আপা বলেছেন যে মেয়েদের লেখালেখির জগতে আসতে হলে সংসার নিয়ে মাথা ঘামালে চলবেনা, নিজেকে সংসারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত রাখতে হবে।
আমি এখানেই আমার মন্তব্য দিয়েছিলাম, ঠিক দ্বিমত পোষণ করিনি, বোধ হয় বলেছিলাম, সংসার তো আমার নিজেরই সৃষ্টি, নিজের হাতে গড়া, সংসারের প্রতিটি সদস্য আমার ভালোবাসার জন। এই ভালোবাসার জনদের ভুলে গিয়ে অথবা তাদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে নিজেকে লেখালেখির জগতে ব্যস্ত রাখবো, এটা আমি মেনে নিতে পারছিনা, আর কেউ পারলেও আমি তা পারবোনা। অমনভাবে লেখক হতে চাইনা, আমার সংসারই আমার কাব্য, কাগজে কলমে লেখা হচ্ছেনা, তবে অলিখিত হলেও সেটাই প্রকৃত কাব্য।

ইদানিং সেলিনা হোসেন আপার কথাটি খুব মনে পড়ছে। ইচ্ছেয় হোক আর অনিচ্ছেয় হোক, একাকীত্ব কাটাতে হোক অথবা ভাল লাগার কারণেই হোক, আমি দিনের যে কোন অবসর মুহূর্তে নিজকে লেখালেখিতে জড়িয়ে ফেলছি। নির্দিষ্ট কিছু ঊদ্দেশ্য নিয়ে আমি লিখিনা, প্রতিদিনের ছোট খাটো ঘটনা , অথবা আমার ফেলে আসা দিনের টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো লিখতে বেশ ভালো লাগে, তাই লিখে যাচ্ছি। আমি খেয়াল করিনি, আমার চারদিকে ভালোবাসার জনদেরকে নিয়ে যে বলয় তৈরী হয়েছিল, সেই বলয়ের কক্ষপথ থেকে কখন যেন আমি ছিটকে পড়েছি। ভালোবাসার জন তো শুধু বাবা, মা, ভাই বোন, স্বামী/স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে নিয়েই হয়না, আশপাশের বন্ধুরাও ভালোবাসার জন।

আমার ভালোবাসার জন দিয়ে তৈরী বলয়ের ব্যাস ছিল অনেক দীর্ঘ, তাই বলয় ছিল অনেক স্ফীত। কত বন্ধু, কত স্নেহভাজন ছিল এই বলয়ের ভেতর। আমি টের পাইনি, তখন আমি লেখালেখিতে আনন্দমগ্ন, কিছু বন্ধুবান্ধবের উৎসাহ পেয়ে নতুন নতুন স্বপ্ন দেখি, প্রতিদিন একটি করে উপন্যাস লিখে ফেলি, উপন্যাস লেখা শেষ হতে না হতেই রকমারী গল্প দিয়ে বই সাজাই, বইয়ের নাম ঠিক করে ফেলি, বই প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে হুমড়ি খাওয়া পাঠকের ভীড় দেখি, চারদিকে লেখক রীতা রায় মিঠুর জয়জয়কার শুনি, শুধু স্বপ্ন আর স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমি রান্না করতে ভুলে যাই, স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমি আমার মেয়েদের কথা ভুলে যাই, স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমি স্বামীর কথাও ভুলে যাই, বাবাকে প্রতিদিন ফোন করতে ভুলে যাই, ভাইদের কথা ভুলে যাই, এভাবেই আমি ভালোবাসার বলয়ের প্রথম স্তরের কক্ষপথ থেকে সরে যেতে থাকি, পুরোপুরি ছিটকে পড়তে পারিনা, কারণ বলয়ের প্রথম স্তরের কয়েকজন আমাকে খামচে ধরে আছে এখনও, কক্ষপথ থেকে একেবারে ছিটকে যেতে দিচ্ছেনা।

দ্বিতীয় স্তরে আমার আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও আমার বন্ধু, স্নেহভাজন অনেক ছেলেমেয়ে ছিল। আগে আমি সব সময় ফোন করে, অথবা আমার বাড়ীতে নেমন্তন্ন করে আমার তরফ থেকে সকলের সাথে যোগাযোগ রাখতাম। লেখালেখির স্বপ্নে বিভোর হওয়ার পর আমি সবাইকে ফোন করতে ভুলে যাই, নেমন্তন্ন করতে ভুলে যাই, রান্না করতে ভুলে যাই বলেই কাউকে নেমন্তন্ন করার কথা মনে পড়েনা, নেমন্তন্ন করিনা বলে কারো সাথে আর আগের মত দেখা সাক্ষাতও হয়না। যেটুকু দেখা সাক্ষাত হয়, সেটা ওরা আমাকে মাঝে মাঝে নেমন্তন্ন করে বলেই হয়। আমি খুব আড্ডাবাজ ছিলাম, অথচ লেখালেখির স্বপ্নে বিভোর মনে আড্ডারা আর ভীড় করেনা, আড্ডাকে আমি ভুলে গেছি। স্বপ্নে বিভোর আমি সব ভুলে গেছি, সবাইকে ভুলে গেছি, অভিমান করতেও ভুলে গেছি, কাউকে কিছু দিতেও ভুলে গেছি, কারো কাছে কিছু চাইতেও ভুলে গেছি।

আমি ভালোবাসার বলয়ের প্রথম কক্ষপথে এখনও একটু লটকে আছি, বাকী কক্ষপথগুলো থেকে ছিটকে গেছি। এই বোধটুকু আমার মাথায় ঢুকেছে দুই সপ্তাহ আগে, এবং তা ভালোভাবে ধরা পড়েছে গত সন্ধ্যায় এবং আজ দুপুরে।

অমিতাভ-সুস্মিতা, সাবর্ণি-প্রিয়াংকা, গার্গী-জীবনানন্দ, কৌস্তভ-অরুন্ধতী, শাহীন-নিশো, নামের এই তরুণ দম্পতীরা আমার ভালোবাসার বলয়ে অন্যতম জুটি ছিল, পেশাগত কারণে আজ ওরা অনেক দূরে চলে গেছে। আমি যখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করিনি, আমি যখন ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেনের কঠিন সত্যকে মেনে নিতে চাইনি, তখনও ওদের সাথে আমার খুব ভাল যোগাযোগ ছিল। এরপর আমি খেয়াল করিনি, ওরা আর আমার কাছাকাছি নেই, দূর থেকেও দূরে চলে গেছে, আমি ওদের জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা জানাতে ভুলে গেছি, আমি যেহেতু সবই ভুলে গেছি তাই অভিমান করতেও ভুলে গেছি, ওরাও যে আমাকে ভুলে গেছে, ওরাও যে আমাকে শুভেচ্ছা জানাতে ভুলে গেছে, আমার কুশল নিতে ভুলে গেছে, এটা আমার মাথায় আসেনা।

মাঝে মাঝেই কৌস্তভ আর অরুন্ধতী আমাকে ফোন করে, আমি কেমন হতবিহবল কন্ঠে ওদের সাথে কথা বলি, ওরা নিশ্চয়ই আমার কন্ঠে সেই চিরচেনা 'কাকীমা'কে খুঁজে পায়না, তাই হয়তো ভাবে, " এইরে! কাকীমাকে লেখক হওয়ার ভুতে পেয়েছে রে" অথবা দুই সপ্তাহ আগে অমিতাভ আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছে, " কাকীমা, তোমার শরীর কেমন আছে? তুমি তো এখন অনেক বড় লেখিকা হয়ে গেছো, সারা ওয়াল ভর্তি তোমার লেখা, তুমি নিজের শরীরের প্রতি খেয়াল রাখছো তো? শরীরকে অবহেলা করোনা।" নিশ্চয়ই অমিতাভ আমার কাছ থেকে প্রতিউত্তরের অপেক্ষায় ছিল, দুই সপ্তাহ চলে যেতে ও হয়তো হাল ছেড়ে দিয়েছে। সুস্মিতা, গার্গী, জীবনানন্দ আমাকে ভুলে গেছে। প্রিয়াংকার সেদিন হঠাৎ করে আমাকে মনে পড়েছে, ফোন করেছিল, আমার সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললো, ও কি বুঝতে পেরেছিল " এই রে! কাকীমা তো আর আগের মত নেই দেখছি, কেমন অচেনা মনে হচ্ছে"। তিনদিন আগে সাবর্ণি মেসেজে কোন সম্বোধন ছাড়াই জানতে চাইল, " প্রথম আলো পত্রিকায় রীনা দাস নামের একজনের লেখায় কাকুর নাম পড়লাম"। এই থেকে শুরু, আমার অস্থিরতার।

গত সন্ধ্যায় বাংলাদেশের স্টুডেন্টদের একটি গেট টুগেদারে গিয়েছিলাম। অনেক মজা করছিলাম, শিমুর বর আবদুল্লা চাকরী পেয়ে লাসভেগাস চলে গেছিল, শিমু তার মেয়েকে নিয়ে এই ডিসেম্বারেই হয়তো যেত। এমনটাই আমি জানতাম। শিমু-আবদুল্লার চার বছরের মেয়ে 'ইলহাম' আমাকে 'বিন্দি নানু' ডাকে, আমাকে দেখলেই এক ছুটে কোলে চলে আসে, আমার খুব খারাপ লাগতো যখনই ভাবতাম ওরা চলে যাবে। লাসভেগাস তো অনেক দূর, আর দেখা হবেনা ওদের সাথে। আহাদ-তাসমিন ওদের লেখাপড়া শেষ করে এনেছে। আহাদ আমাকে আন্টি বলতে পাগল ছিল, আমিও আহাদকে খুবই ভালোবাসি, শুধু আহাদ কেন, সবাইকে ভালোবাসি। তাসমিনের আম্মার সাথে দেখা করেছিলাম ঢাকাতে গিয়ে, উনার মুখে উনার জীবন যুদ্ধের অসম্ভব কাহিনী শুনে শিহরিত হয়েছি। তাসমিন-আহাদ দুজনেই বাপ মায়ের কলিজার টুকরা, এখানে একা একা আছে, ওদের দেখলেই আমার মায়া লাগে। কালকের অনুষ্ঠানে আবদুল্লাকে দেখলাম, শিমুর মুখে হাসি দেখলাম, আবদুল্লা কবে ফিরে যাচ্ছে জানতে চাইতেই শিমু জানালো, আবদুল্লা লাস ভেগাস থেকে একবারে চলে এসেছে, এখানেই কাছাকাছি জায়গায় আরও ভাল অফার পেয়েছে। আমি যদি স্বপ্নে মগ্ন না থাকতাম, এই আনন্দের সংবাদ শিমু অনেক আগেই আমাকে দিত। একটুক্ষণ পরেই আহাদ আমার কাছে এলো, বলল, " আন্টি, আমাদেরকে ভুলে গেছেন। একটু খোঁজ খবরও নেননা বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি।" আহাদের কথার উত্তর দেবো কি, আমি তো লজ্জায় মরে যাই, সাথে সাথে তাসমিন বললো, " আন্টি, আম্মু আসছে ডিসেম্বারে"। এরপর আর কিছু বলার নেই, আমার দোষ। আমি স্বপ্নে মগন ছিলাম বলেই ওরা কেউ আমাকে খুশীর খবর জানানোর সুযোগ পায়নি।

আজ ছিল ছোট্ট 'রেয়া'র প্রথম জন্মদিন। বেশ কয়েকমাস পর গেলাম কমলেশ-করবীর সুসজ্জিত প্রাসাদে। গিয়ে দেখি বিশাল আয়োজন, সব সুপরিচিত মুখ, কিন্তু সবাইকেই অনেক দূরের মানুষ মনে হচ্ছিল। এই মানুষগুলোর সাথে আগে আড্ডায় বসলে রাত কাবাড় হয়ে যেতো। সঞ্জীব'দা ভীষন আমুদে লোক, হাস্য কৌতুকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, আমাদের মত 'বৌদি'দের কাছে উনি খুবই প্রিয়, উনার স্ত্রী রীনা খুবই ভাল মেয়ে, আমাদের প্রথম বন্ধু সুকুমার'দা এবং উনার স্ত্রী তৃপ্তি, তাঁদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছিলামনা, সব্যসাচীকে দেখলাম, ওর বৌ পিংকী আমাকে 'মিঠু'দি ডাকে, আমার বরকে 'দাদা' ডাকে এবং অনেক সম্মান করে, সব্যসাচীর দিকেও বেশীক্ষণ তাকিয়ে কথা বলতে পারলামনা। থেকেছি অনেকক্ষণ, কিন্তু মনে ছিল অস্থিরতা, কারো সাথে আগের মত প্রাণখুলে গল্প করতে পারিনি, নির্দিষ্ট কোথাও বসতেও ভালো লাগেনি, সব সময় মনে হচ্ছিল এই বুঝি ধরা পড়ে যাচ্ছি, আমি যে সবার মাঝে থেকেও কারো মাঝেই ছিলামনা, আমি যে সারাটা দিন রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীতে পড়েছিলাম, এই ব্যাপারটি চেপে রাখতে গিয়েই খুব স্পষ্টভাবে বুঝে গেলাম, আমি ভালোবাসার মায়াবী বলয়ের কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়েছি।
Like · · Promote ·


আমাদের ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’ বড়দা’র শুভ জন্মদিনে!

কারো জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে আমার খুবই ভালো লাগে। মানুষ হয়ে জন্ম নেয়াটা যে কত বড় ভাগ্যের ব্যাপার, তা আঁচ করতে পারি একটি মশা, একটি মাছি অথবা একটি তেলাপোকার দিকে তাকিয়ে। যখনই মনে হতাশা নেমে আসে, তখনই ভাবি, হতাশ হতে নেই, হতাশ হবো না, এখনও এই পৃথিবীতে বেঁচে আছি, এখনও পৃথিবীর কিছু মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা পাচ্ছি, এই ভালোবাসার মূল্য নির্ধারণ করার ক্ষমতা তো আমার নেই। নতুন করে আশা বাঁধি, কিছু মানুষ, তারা সংখ্যায় খুবই অল্প, বয়সে আমার বড় অথবা ছোট, অহর্নিশি ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা দিয়ে আমাকে ঘিরে রেখেছে, যতক্ষণ তারা আমাকে ঘিরে আছে, ততক্ষণ বেঁচে থাকাতেই আমার সর্বানন্দ, সর্বসুখ।

আমার চারপাশে যে অল্প ক’জন মানুষের উপস্থিতি আমি সর্বক্ষণ অনুভব করি, তাদের মধ্যে আমার ‘বড়দা’ হচ্ছেন অন্যতম। কয়েকদিন আগে ফেসবুক নোটিফিকেশানে দেখি, Today’s Birthday list-এ আমার বড়দার নাম। আমি তো চমকে উঠেছি, আরে, আজ তো ২৭শে জুলাই না, বড়দার জন্মদিন তো ২৭শে জুলাই, আমার তো ভুল হওয়ার কথা নয়। বড়দার জন্মদিন কোনভাবেই ভুল হবেনা, কম্পিউটার ভুল করবে, কিন্তু আমি ভুল করবোনা। মায়ের মুখ থেকে বড়দার জন্মের কাহিনী শুনতে শুনতে মুখস্থ করে ফেলেছি, আর ফেসবুকে দেখাচ্ছে আজকে জন্মদিন, ইস, ফেসবুকটা আজকাল যাচ্ছে তাই হয়ে যাচ্ছে। যাক গিয়ে, ফেসবুকের সম্মান রক্ষার্থে বড়দাকে শুভ জন্মদিন জানিয়েছি, তবে শুভ জন্মদিন কথাটি লেখার আগে ‘অগ্রিম’ শব্দটি লিখতে ভুল করিনি।

বড়দার জন্ম হয়েছিল ১৯৫৭ সালের ২৭শে জুলাই, নারায়ণগঞ্জের আমলাপাড়ায়, দাদুর বাসায়। মা তাদের বড় মেয়ে, প্রথম সন্তান হবে বলে মা’কে দিদিমা নিজের বাসায় নিয়ে এসেছিলেন। তখনকার আমলে বোধ হয় বেশীর ভাগ বাড়ীতে ‘দাই’ এর হাতেই বাচ্চা প্রসব করানো হতো। কিন্তু আমার দাদু-দিদিমা ‘দাই’ ডাকার আগে ডাক্তারকে ডেকেছিলেন। ক্যাপ্টেন রহমান ছিলেন নারায়ণগঞ্জ শহরের নামকরা ডাক্তার, পাকিস্তানী আর্মি সার্ভিস থেকে রিটায়ার করে নারায়ণগঞ্জের প্রেসিডেন্ট রোডে বাড়ি কিনে সেখানেই রুগী দেখার চেম্বার খুলেছিলেন।

বড়দা যখন ভূমিষ্ঠ হলো, ডাক্তার, নার্স, দাই সকলেই বুঝলো, প্রসূতি মৃতসন্তান প্রসব করেছে। দাদু-দিদিমা, ঠাকুমা, কাকা, মামা থেকে শুরু করে সকলেরই মন খারাপ। মৃত সন্তান প্রসবের পর মায়ের মন খারাপ হয় কিনা, জানিনা। হয়তো তখন তখন বুঝা যায়না, কারণ নিজের দেহের যন্ত্রণাও তো আছে, কয়েক ঘন্টা পার হলে বোধ হয় প্রসূতী বুঝতে পারে, নাড়ী ছিঁড়ে কে চলে গেছে। যাই হোক, মৃত সন্তান পাশে নিয়ে কেউ তো বসে থাকেনা, সেটিকে ফেলে দেয়ার ব্যবস্থা হচ্ছিল। ডাঃ রহমান আরেকটু সময় দেখতে চেয়েছিলেন, শেষ চেষ্টা হিসেবে নবজাতকের গলার ভেতরে উনার আঙুল ঢুকিয়ে লালা বের করে আনছিলেন, আর পা উঁচুতে ধরে মাথা নীচে ঝুলিয়ে বোধ হয় চাপড়াচ্ছিলেন। নিজে নিজে আর কিছু করার ছিলনা বলে প্রসূতি মা ডাক্তারের প্রতিটি কর্ম দেখছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই নবজাতক ‘মিঁয়াও’ ‘মিঁয়াও’ করে উঠায় সারা বাড়ীতে খুশীর ঢেউ খেলে গেলো।
যে শিশুর ঠাঁই হতো ডাস্টবিনে, ডাঃ ক্যাপ্টেন রহমানের কৃপায় সেই শিশু তার ১৭ বছর বয়েসী মায়ের কোলে আশ্রয় পেলো। মা তার শিশুর নাম রাখলেন ‘মানিক’।
*** মায়ের মুখে আমার বড়দার জন্মের গল্প যেমন শুনেছি, তেমনটিই এখানে লিখলাম। গল্পটি ব্যক্তিগত হলেও এই গল্পে আমি একজন মহান চিকিৎসককে পাঠকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছি। এই চিকিৎসককে আমি দেখেছি, ধবধবে সাদা প্যান্ট-শার্ট ইন করে পরতো, মাথায় চুলগুলো গুড়ি ছাঁট দেয়া থাকতো, বাংলা বলতো একটু বিহারী টানে, গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলানো থাকতো, বারান্দায় রুগীর লাইন থাকতো, আমাদের যে কোন রোগ হলেই মা ক্যাপ্টেন রহমানের কাছে নিয়ে যেত। মা’কে উনি খুব স্নেহ করতেন,‘মা’ সম্বোধণ করতেন। অবিবাহিত ছিলেন, এই দেশে উনার কেউ ছিলনা, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে যখন সারাদেশে আন্দোলন চলছে, তখন উনি পশ্চিম পাকিস্তানে তার মায়ের কাছে ফিরে গেছেন।***

মৃত্যুঞ্জয়ী বড়দাকে নিয়ে আমাদের বাসায় বোধ হয় আদিখ্যেতার অন্ত ছিলনা। তখনকার আমলেই বড়দার জন্য সাত আটটি নাম দেয়া হয়েছিল, এবং সবগুলো নামেই তাকে ডাকা হতো। মা-বাবা-ঠাকুমা ডাকতো ‘মানিক’ দাদু-দিদিমা ডাকতো ‘ভক্তদাস’, বড় পিসীমা ডাকতো ‘পুলক, মেজ কাকা ডাকতো ‘বাবুলী’ আর ছোট কাকা, যিনি নিজেও একজন ডাক্তার, যাঁর সেবাযত্নে বড়দা আড়াই বছর বয়সে দাঁড়াতে শিখেছিল, নাম রেখেছিল ‘অনুপ’।

আমার বড়দা ছোটবেলা থেকেই গান পাগল ছিল, পাড়ার চায়ের দোকানে মাইকে ‘ইচক দানা বিচক দানা’ অথবা ‘হাওয়ামে উড়তা যায়রে’ গান বাজলেই বড়দা বাবার চোখ ফাঁকী দিয়ে নাকি বেরিয়ে যেত, চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গান শুনতো। আমাদের বাসা ছিল নদীর পারে, এক রাতে গান শুনে বড়দা নাকি ‘বাথরুমে যাই’ বলে বেরিয়েছে, আর ফেরার নাম নেই। বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি, রাত বাজে এগারোটা, বাবা বের হয়েছে খুঁজতে, কোথাও নেই, ঘরের সামনেই বর্ষার ভরা নদী, হিসি করতে গিয়ে নদীতেই পড়ে গেলো কিনা সেই দুশ্চিন্তায় বাবার মাথা পাগল অবস্থা। আমার মা ‘মা’ হলেও মেয়েলী আবেগ ছিলনা, বাবা সিংহ পুরুষ হলেও মেয়েলী আবেগ ছিল অনেক বেশী। বাবা ধরেই নিয়েছে বড়দা নদীতে পড়ে গেছে। শেষ চেষ্টা হিসেবে আরেকটু এগিয়ে মোহনবাবু’র চায়ের দোকানের সামনে নয় বছরের বালকটিকে দেখলো গান শোনায় মগ্ন। আবেগ সামলাতে না পেরে বাবা বড়দার কান ধরে টানতে টানতে বাসায় এনে নাকি পিটাতে পিটাতে আধমরা করে ফেলেছিল।

বাবার পিটানি বোধ হয় খুব বাজে ছিল, বড়দা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল, ঠাকুমা বুকে গরম তেল মালিশ করছিল আর কাঁদছিল, আমার বাবাকে অনেক বকছিল। মা বোধ হয় জানতো, মানিক মৃত্যুঞ্জয়ী, সে সুস্থ হয়ে উঠবে, তাই মা অত বিচলিত হয়নি, বড়দার জ্ঞানও ফিরে এসেছে আর বাবার কি রি-অ্যাকশান হয়েছিল, সেটা মায়ের কাছ থেকে শোনা হয় নি। মায়ের মনে ঘটনাটি দাগ কেটেছিল, মাস্টারীর বেতন থেকে পয়সা জমিয়ে বড়দাকে ঐ পাকিস্তান আমলেই ৪০০ টাকা দিয়ে একটি ট্র্যানজিস্টার’ কিনে দিয়েছিল। ট্র্যানজিস্টারটি আমাদের সাথে সাথেই থাকতো, স্বাধীনতার অনেক পরেও আমরা ঐ ট্র্যানজিস্টারে ‘বিবিধ ভারতী’, ‘আকাশবাণী’, ‘আগরতলা’ থেকে প্রচারিত আধুনিক গান শুনতাম। বড়দার দেখাদেখি আমরাও গান পাগল হয়ে গেলাম, বাবা আর কাউকেই গান শোনার জন্য মারধোর করেন নাই। অবশ্য আমার জ্ঞান হওয়ার পর আমি বাবা বা মা, দুজনের কাউকেই দেখিনি বড়দার গায়ে হাত তুলতে।

বড়দার একটি অদ্ভূত নেশা ছিল, রেডিও কানে লাগিয়ে রাখতো, একটি খাতায় প্রতিটি গানের কথা লিখে রাখতো, গানের গীতিকার, সুরকার, শিল্পী এবং ছায়াছবির নাম পর্যন্ত। বড়দার হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মালার মত। এত সুন্দর হাতের লেখা আমি আজ পর্যন্ত কোথাও দেখিনি। সেই মুক্তোমালা বর্ণে গানগুলো লেখা থাকতো যে কোন সস্তা খাতায়। কেউ বোধ হয় বড়দাকে ১৯৭৪ সালের একটি ডায়েরী দিয়েছিল, নেভী ব্লু রঙের বাইন্ডিং, সেই ডায়েরীতে বড়দা তার প্রিয় গানগুলো নতুন করে লিখেছিল। ডায়েরীটা আমার খুব প্রিয় ছিল, ডায়েরীর পাতা খুলতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখের একখানা স্কেচ, আমার একজন কাকা সেটি করে দিয়েছিল, সেই কাকাটি আজ নেই, এই তো সেদিন, মাত্র ৫৩ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন। রবিগুরুর স্কেচের নীচে বড়দার অদ্ভুত সুন্দর হাতের লেখা, “ কবিগুরু লহো অনুপের প্রনাম”।

বড়দা যখন ইঞ্জিনিয়ারীং পড়তে বুয়েটে চলে গেলো, আহসানউল্লাহ হলে থাকবে, আমাদের বাসাটাতে শূণ্যতার সৃষ্টি হলো। বড়দা চলে যাবে ঠিক হতেই আমরা সব ভাইবোন, ছোট মাসী, দাদু-দিদিমা সকলেরই মন খারাপ। আমাদের ঠাকুমা তখন ইন্ডিয়াতে থাকেন। আমি বড়দার কাছ থেকে গানের ডায়েরীটা নিয়ে খালি গলায় গান করতাম, আমাদের ভাই বোনদের মধ্যে গানের প্রতি প্রচন্ড নেশা ছিল বড়দার আর আমার। আমি গান শিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার বাবার সামর্থ্যে কুলায়নি শিক্ষক রেখে আমাকে গান শেখায়। বড়দা তার এত যত্নের ডায়েরীটার সাময়িক মালিকানা আমাকে দিয়ে যায়। ডায়েরীটা আমার কাছেই ছিল, বিয়ের পর এতবার ঠাঁইনাড়া হয়েছি যে এক সময় আমার কাছ থেকে ডায়েরীটা কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। ঐ ডায়েরীটা যে কোন গানপ্রেমিক মানুষের জন্য বিরাট সম্পদ হিসেবে থাকতে পারতো।

ঢাকা তো নারায়ণগঞ্জ থেকে বেশী দূরে নয়, তখন ট্র্যাফিক জ্যামও ছিলনা, প্রতি সপ্তাহে বড়দা বাসায় চলে আসতো, একবার বাসায় আসলে আর ফিরে যেতে চাইতোনা। বড়দা আগাগোড়া ছিল হোমসিক। শনিবারের বিকেলে হয়তো বাবা তাড়া দিত, “কিরে! হোস্টেলে ফিরবিনা?” বড়দা বলতো, “এই যে এখনই বের হবো”। আমরা সবাই বারান্দায় দাঁড়াতাম, আমাদের মাঝে দিয়ে বড়দা হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে বারান্দা থেকে নামতো। পেছন ফিরে তাকাতো, আমার বুক মুচড়ে উঠতো। আমি বলতাম,
“বড়দা, আজকের বিকালটা থাকো, কালকে সকালে চলে যেয়ো”। বড়দা বলতো,“না, পড়া আছে, যাই, থাকলামই তো”। আমি বলতাম, “বড়দা, যাত্রাকালে পেছন থেকে ডাকতে নাই, আমি তো ডেকে ফেলছি। আমার ভয় লাগে, তুমি যাইও না”। ব্যস! বড়দা মুখে লাজুক হাসি দিয়ে আবার ঘরে ফিরে আসতো। এটা ছিল আমাদের নিত্যদিনের ঘটনা। এইসব কান্ড দেখে বড়দাকে নিয়ে কত যে হাসাহাসি করতো সবাই।

আমরা তিন ভাই এক বোন হলেও বাকী কাকাতো, মামাতো, পিসতুতো, মাসতুতো ভাই বোন মিলে বিরাট বংশ, আর আমরা সবাই ভাই বোন, সেখানে আপন-পর নেই। আমার কাছে আমার ভাইগুলো একেকটা রত্ন, কিন্তু আমার ভাইদের সবার কাছে আমি রত্ন নই। দুই একটা ভাই ছাড়া আর কেউ আমাকে পুছেও না। বড়দা আমাকে খুব ভালোবাসতো। বড়দার মনটা ছিল মাটির মত নরম, সবার জন্য মায়া। কারো বিরুদ্ধে কখনও অভিযোগ করতে শুনিনি। সংসারের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ ছিল। বড়দা যে আমাকে কত ভালোবাসতো, তার খুব ছোট্ট একটি উদাহরণ দেইঃ
বড়দা যে বছর বুয়েটে গেল, আমি সে বছর ক্লাস এইটে উঠেছি। খুব মাপাজোখার সংসার আমাদের। হিসেবের বাইরে কিছুই আসেনা বাসায়। তখন মেয়েদের মাথার চুলে আটকাবার জন্য ‘ববি ক্লীপ’ নামে সুন্দর ক্লীপ বেড়িয়েছিল, সোনালী ক্লীপের গোড়ায় সুন্দর সুন্দর স্টীকার বসানো থাকতো। ক্লীপের দাম একেকটা ছিল দুই টাকা। আমার মাথার চুলগুলো ছিল আষাঢ়ে মেঘের মত, যেমন কালো তেমন ঘন। চুল দুই বেনী করে চুলের আগায় প্লাস্টিকের রাবার আটকে রাখতাম। স্কুলে বন্ধুদের দেখতাম রঙ বেরঙের ববি ক্লীপ আটকে আসতে। আমার ভালো লাগতো কিন্তু লোভ হতোনা। আমি জানতাম যে আমার বাবার মাপা পয়সা, ক্লীপ কেনা যাবেনা, তাই বাসায় এসে কখনও বলতামওনা। আমার দিদিমা কলকাতা যেতেন বছরে একবার, ফেরার সময় আমার জন্য দুই তিন রকমের চুলের ব্যান্ড নিয়ে আসতেন, সেগুলো যত্ন করে রেখে দিতাম, সময়ে সময়ে ব্যবহার করতাম।

ভাইফোঁটা এলো, বড়দা, মেজদা আর ছোটভাইকে ফোঁটা দিলাম। আমাদের বাসায় উপহার দেয়ার চল তখনও শুরু হয়নি, বড়দাকে প্রনাম করতেই বড়দা আমার হাতে একটি প্যাকেট দিল। প্যাকেট হাতে নিয়ে আমি তো অবাক, প্যাকেট খুলে দেখি ভেতরে একটি শ্যাম্পুর বোতল আর দুইটি ববি ক্লীপ। আমি খুশীতে আত্মহারা হয়ে গেছিলাম, শ্যাম্পুর রঙ সবুজ আর ক্লীপের একটিতে সাইকেল স্টীকার, আরেকটিতে স্মাইলী ফেইস স্টিকার। সেই ক্লীপ দুটো এখনও খুঁজলে আমার ঝাঁপির কোথাও না কোথাও পাওয়া যাবে। আর শ্যাম্পুটাকে আমি বছর লাগিয়ে ব্যবহার করেছিলাম, ব্যবহার করতে ইচ্ছে করতোনা, শেষ হয়ে যাবে ভয়ে, শ্যাম্পু এবং ক্লীপ দুটো আমার চোখের সামনে ‘ভাই-বোনের অকৃত্রিম বন্ধন, ভালোবাসার বন্ধন, স্নেহ মমতার বন্ধনকে যেন স্পষ্ট করে তুলেছিল। আমি আজও ভেবে পাইনা, বড়দা কি করে সেদিন তার একটি মাত্র বোনের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা কষ্টগুলো বুঝতে পেরেছিল।
আরেকটি উপহারের কথা বলতেই হবে। ১৯৭৯ সালে বড়দা প্রথম চাকুরী পায় ঢাকার একটি প্রাইভেট কোম্পাণীতে, কোম্পাণীর নাম ছিল ‘হাইভস’, এখানে বেতন পেতো ২৫০০ টাকা, আমদের মত পরিবারে ২৫০০ টাকা ছিল আকাশ থেকে নীচে পড়া টাকার বস্তার মত ব্যাপার। যদিও বাবা আমাদের কারো কাছ থেকেই এই জীবনে কখনও এক কপর্দকও নেননি। বড়দা অবশ্য তিন মাস পর ঐ চাকরী ছেড়ে দিয়ে সরকারী চাকরীতে জয়েন করেছিল। ঐ বছর দূর্গাপূজার সময় চাকরীর টাকায় বড়দা আমাকে জীবনের প্রথম জামদানী শাড়ী কিনে দিয়েছিল। একেকটি স্মৃতি, একেকটি স্বর্ণপদক প্রাপ্তির মত।

আমার বড়দা ছোটবেলা থেকেই প্রচন্ড মেধাবী ছিল, নারায়ণগঞ্জের প্রতিটি শিক্ষক বড়দাকে চিনতো। অংকে তো সারা নারায়ণগঞ্জ শহরে বড়দাই ছিল বেস্ট। টিউশনি করতো, বড়দার মত টিউটরের যা চাহিদা ছিল, তা ভেবে এখনও গর্ব বোধ করি। আমরা ভাই বোনেরা অংক শিখেছি বড়দার কাছে। কি পরম মমতায় বড়দা আমাদেরকে অংক করাতো। অনেক ধৈর্য্য ছিল বড়দার, মেজদা অংক ভয় পেত, মেট্রিক পরীক্ষার আগে প্রিটেস্ট পরীক্ষায় মেজদা অংকে ফেল মার্ক পেয়ে গেলো। বাবার তো মাথা গরম, মেজদাকে পারলে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ফেলার উপক্রম। বড়দা তখন হাল ধরলো, টেস্ট পরীক্ষার পর তিনমাস মেজদাকে অংক করাতো। নিজের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া, সাথে মেজদাকে অংক শেখানো। মেজদা মেট্রিকে দারুণ রেজাল্ট করেছিল, মানবিক বিভাগে নারায়নগঞ্জের একমাত্র প্রথম বিভাগ পাওয়া ছাত্র, অংকে পেয়েছিল ৬৪, আমাদের সবার কাছে এখনও এটা বিস্ময়, ৬৫’র উত্তর দিয়ে ৬৪ পাওয়া।

বড়দার কথা লিখতে গেলে ফুরোবেনা। আর বেশী কিছু লিখাও সম্ভব না। আমি তো লেখক নই, তাই গুছিয়ে লিখতেও পারছিনা। তবে এতটুকু বলতে পারি, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে, নানা ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে আমরা ভাই বোনেরা যে যেখানেই পৌঁছে থাকিনা কেন, আমাদের সেই আদি টান, রক্তের টান, মায়ার টান এখনও শক্ত অবস্থানেই রয়ে গেছে।
আমাদের বংশে পড়ার খুব চল আছে, সবাই পড়তে ভালোবাসি। ছোট বড় সবাই। লেখালেখির মধ্যে কেউ ছিলামনা। একমাত্র বড়দা রেডিও থেকে গান শুনে খাতায় লিখতো। লেখালেখি ঐ পর্যন্তই। আমেরিকাতে আমি খুব একা, তাই আমার মেয়ে আমাকে ফেসবুক ওপেন করে দেয়। আমি কয়েকমাসের মধ্যে আমার অন্যান্য বোন-ভাইদেরকেও ফেসবুকে নিয়ে আসি। প্রথম প্রথম সবারই খুব উৎসাহ, এরপর একে একে সবাই কেটে পড়ে, উৎসাহ হারিয়ে ফেলে, আমি ব্লগে লিখতে শুরু করি, বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় লেখার সুযোগ পাই। আমার পরিবারের কেউ এগুলো নিয়ে মাথা ঘামায়নি, অথবা ভেবেছে, আমার মত বাদাইম্যা মানুষের তো মতি গতির ঠিক নেই, একদিন শখ আছে, আরেকদিন শখ থাকবেনা।

প্রথম প্রথম আমার স্বামী ব্লগে আমার লেখা পড়তো, আমাকে উৎসাহ দিত, তারপর সেও চুপ হয়ে যায়। আমি থামিনি, যা মনে এসেছে লিখে গেছি, ঘরের মানুষ কেউ উৎসাহ দেয়না ভেবে মন একটু খারাপ হয়েছে। প্রায়ই পত্রিকায় লেখা বের হতো, আমার ভাইয়েরা কেউ জানতোও না। আমার বাবা জানতোনা। একদিন পাড়ার এক হোমিওপ্যাথী ডাক্তার বাবাকে প্রথম সংবাদ দেয়, বাবু, আপনার মেয়েতো পত্রিকায় লেখে। বাবা জানতে পারে আমি কিছু না কিছু লিখি, কি লিখি তা আর জানতে পারেনা। আমিও অভিমানে কাউকে কিছু জানাইনা।

একদিন বড়দা আমাকে জানায়, পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা বড়দা প্রিন্ট করে সেই প্রিন্ট আউট তার বসার ঘরের শোকেসে টাঙিয়ে রেখেছে। যে যখন বেড়াতে আসে বড়দার বাড়ীতে, তাকেই নাকি ডেকে ডেকে সেই লেখা দেখায়, “এই যে দেখেন, আমার বোন, পত্রিকায় লেখে”। এটা অনেক আগের কথা। এরপর বড়দা ফেসবুকে সক্রিয় হয়েছে, শত ব্যস্ততার মাঝেও আমার ওয়াল থেকে আমার নানা পোস্ট পড়ে, অনেক লেখা নিজের ওয়ালে শেয়ার করে, আবার সেখানে মন্তব্যের ঘরে লিখে দেয়, “ আমার বোনের এই লেখাটি সবাই পড়েন, খুবই ভাল একটি লেখা, সঠিক সময়ে সঠিক লেখা”।
বড়দার কান্ড দেখে আমি হাসি, প্রথমে একটু, তারপর আরেকটু, তারপর খিল খিল করে হাসতে থাকি, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ার মত অবস্থা। কে বলবে আমার বড়দার একটি মেধাবী মেয়ে এবং একটি মেধাবী ছেলে আছে। মেয়ে এ বছর কানাডার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট এ পড়া শেষ করে হাই ফাই চাকরী পেয়েছে, তারপরেও আমার বড়দা আগের মতই সরল সোজা রয়ে গেছে। এতটুকুও স্মার্ট হতে পারলোনা, এখনও পরিশ্রম করে, এখনও সবার জন্য কর্তব্য করে, সব কাজের ফাঁকে দূরদেশে পড়ে থাকা একটা মাত্র বোনের এলেবেলে লেখা পড়ে যায়, বোনকে খুশী করার জন্য, বোনকে উৎসাহ দেয়ার জন্য প্রায়ই মন্তব্য লিখে, “তুই পারবি, তুই অবশ্যই একদিন বড় লেখক হবি” এমন মন্তব্য পড়ে আমি আবার হাসি, প্রথমে একটু হাসি, তারপর আরেকটু বেশী হাসি, তারপর খিল খিল করে হাসি। হাসতে হাসতে আমার চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে, হাসিও থামেনা, কান্নাও থামেনা। দুটোই একসাথে চলতে থাকে।

বড়দা, তিনদিন আগে বলেছিলে, বুড়ো বয়সের জন্মদিন কে মনে রাখে। আমি মনে রেখেছি, তোমাদের কথা আমার মনে থাকে, সব সময়ই মনে পড়ে। ভাগ্যিস আমার স্মৃতিশক্তি ভাল, তাই সব কথা মনে আছে, মাত্র তো এক টুকরো স্মৃতি লিখলাম, পুরোটা লিখলে তো উপন্যাস হয়ে যাবে, সেটাও লিখবো, অপেক্ষা করো, তা দেখার জন্য আরও চল্লিশ বছর বেঁচে থাকো। তুমি তো মৃত্যুঞ্জয়ী, মৃত অবস্থা থেকে বেঁচে উঠেছিলে, মৃত্যুকে জয় করেছিলে, সেই দিনটিকে স্মরণ করেই তোমাকে শুভেচ্ছা জানাই, মা’কে ছাড়া প্রথম জন্মদিনে একটা কথা মনে পড়ছে, গত বছর আমার মেয়ে বিয়ে উপলক্ষ্যে বাংলাদেশে গেলে মা তোমাকে দেখে খুব কষ্ট পেয়েছিল, তোমার শরীর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেছে, নানা উপসর্গ দেখা দিয়েছে, মায়ের হয়তো পঞ্চান্ন বছর আগের এক দিনের স্মৃতি মনে পড়ে গিয়েছিল, তুমি ম্ররত হয়ে জন্মেছিলে, কিন্তু তখন ক্যাপ্টেন রহমান ছিলেন, তোমাকে মৃত অবস্থা থেকে বাঁচিয়েছিল, গত বছর মায়ের মনে ভয় ঢুকে গেছিল, ক্যাপ্টেন রহমান নেই, তোমার চেহারাও খারাপ হয়ে গেছে, তাই মুখ ফসকে মা বলেছিল,
“মানিক, তোর স্বাস্থ্য এত খারাপ হয়ে গেছে, ভালো থাকিস, আমার আগে মরে যাইসনা”।
বড়দা, মা তাঁর মাথার চুলের সমান আয়ু তোমাকে দিয়ে গেছেন, তুমি ততকাল বেঁচে থাকো।

হ্যাপী বার্থডে টু ইউ, আমাদের মৃত্যুঞ্জয়ী বড়দা, তুমি মৃত্যুকে জয় করে বড়দা হয়ে জন্মেছিলে বলেই আমরা বাকী তিন ভাইবোন জন্মেছিলাম, মা ফাঁকী দিয়েছে, বাবা আর তুমি মিলে আমাদের মাথার উপর ছাতা ধরে থেকো।
(4 photos)
3Like · · Promote ·





রাঁধুনীর প্রত্যাবর্তণ!

একটু আগে কাজ থেকে ফিরেই প্রথম হাঁক দিলাম, " মিথীলা, খেয়েছো"?
উত্তর, " এইতো আমার রুমে বসে খাচ্ছি'।
"তোমার পাপা খেয়েছে"?
উত্তরঃ "হ্যাঁ পাপা আরও আগেই খেয়েছে"।
অন্যদিন প্রশ্নোত্তর পর্ব এখানেই শেষ হয়ে যায়। আজকে বিষয়ে বৈচিত্র্য আনতে চাইলাম। হাতের ব্যাগ টেবিলে রেখেই লিভিং রুমের দিকে গেলাম, এবার মিথীলার পাপাকে প্রশ্নঃ " আচ্ছা, আজকের রাতের খাবারটা কেমন ছিল?"
বেশ আয়েসী ভঙ্গীতে উত্তর এলো "খুব ভালো ছিল। বেশ ভালো খেলাম আজ।"
" কোন আইটেমটা বেশী ভাল লেগেছে?"
"দুটোই খুব ভাল হয়েছে"।
-সত্যি বলছো নাকি আমার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে মাছি তাড়াচ্ছো?
-এবার মাছি তাড়াবো। বলছি খুব ভালো হয়ে ছে রান্না।

অনেকদিন এমন উত্তর শুনিনি। ব্যাপার কি, বিশাল সার্টিফিকেট পেলাম অনেকদিন পর। নিকট অতীতে তো এই রকম তৃপ্তির ঢেঁকুর কানে আসেনি। আমিও অবশ্য জানতে চাইনি, কারণ জানিতো, জিজ্ঞেস করলে দায়সারা ভাবে বলবে, “হয়েছে, খাওয়া গেছে”।
যাঁর কথা বলছি, উনি আমার স্বামী, বিয়ের পর যাকে পাখীর মত আহার করতে দেখেছি, পাখীর আহারের সামনে বসে মানুষের আহার চলেনা, তাই পেটে ক্ষিদে নিয়ে আমিও পাখীর মত আহার করেছি। এই সেই ভদ্রলোক, যাঁকে আমি এই খুঁটি খুঁটি করে খেতে শিখিয়েছি, পাখীর আহার ছেড়ে মানুষের আহার করতে শিখিয়েছি, রান্না ভাল-মন্দ বলতে শিখিয়েছি, ভাল হলে বলতে শিখিয়েছি, “দারুণ হয়েছে, খুবই ভাল হয়েছে’ জাতীয় প্রশংসা! শুধু আমার রান্না নয়, যার বাড়ীতেই খাবে, সেই বাড়ীর গিন্নীর রান্নার প্রশংসা করতে হবে, এমনও শিখিয়েছি। শিক্ষাটা মনে হয় একটু অতিরিক্ত মাত্রায় হয়েছিল, যে কারণে ভদ্রলো্কটি অন্যের বাড়ীতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে খাবার না খেয়েও বলতে থাকে, " দারুণ খেয়েছি, রান্না খুব ভালো হয়েছে"। এভাবেই অনেককাল চলেছে।

ইদানিং দেখছি ঘরে আমার রান্না খেয়ে কিছুই বলেনা, জিজ্ঞেস করলে বলে, " হয়েছে'। উত্তর শুনেই তো আমি তিড়িং করে এক লাফ দেই, " হয়েছে মানে কি? কি হয়েছে? ভাল না খারাপ? প্রশ্নের উত্তর ঠিক করে দিতে পারোনা?"
তখন বলে ' ভালই হয়েছে। নতুন করে আর কি বলবো?'।
আবার আমি লাফ দেই, “ নতুন করে কি বলবো মানে! তাছাড়া ‘ভালই আবার কি, ‘ই’ প্রত্যয় যোগ করছো কেন? সরাসরি প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিতে পারোনা? আমার রান্না খেয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত হাত চাটতো, আর তুমি আমার স্বামী হয়ে কোন প্রশংসা করতে পারছোনা"
ঠিক এই পর্যায়ে এসে আমাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ভদ্রলোক বইয়ের মধ্যে মুখ লুকোবেন।

সেই মানুষের কাছ থেকে সার্টিফিকেট পেলাম, " খুব ভাল হয়েছে রান্না। খুব ভাল খেয়েছি"। স্বাভাবিকভাবেই কৌতুহল জাগবে মনে, কি রেঁধেছিলাম আজকে! বলছি কি রেঁধেছিলাম। তার আগে আরেকটু কাহিনী বলে ফেলি। মিথীলা কখনওই আমি বাড়ী না ফেরা পর্যন্ত ভাত খায়না। ক্ষিদে পেলে হাবিজাবি খায়, কিন্তু আমার বাড়ী ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। আজ কি এমন হলো যে মিথীলাও খেতে বসে গেছে! আমি নিজের জন্য খাবার নিতে গেছি, মিথীলা উপরের ঘর থেকে নীচে নেমে এলো। আমার কাছাকাছি এসে খুব ফিসফিসিয়ে বললো,
“ মা, আজকে পাপা কি করেছে শোন। সন্ধ্যেবেলা ভাত ছাড়াই এমনি এমনি চিকেন খেয়েছে। তারপর আমাকে বলেছে, “ গুড্ডু, আজকের চিকেনটাতো খুব ভালো হয়েছে”। তখন এমনি এমনি খেয়েছে, আবার ভাত দিয়েও খেয়েছে। পাপার কথা শুনে আমারও ইচ্ছে করলো চিকেনটা খেতে। আমি আজকে আগে আগে খেয়ে ফেললাম, মা চিকেনটা অনেক ভালো হয়েছে। আমাকে শিখিয়ে দিবে কি করে রান্না করতে হয়। কারণ চিকেনের জন্য সব্জীগুলো তো আমিই কেটে দিয়েছি, হাফ কাজ তো আমি শিখে ফেলেছি, এখন শুধু রান্নাটা বলে দিবে।“

বললাম, “ এইজন্যই তো এতটুকু চিকেন পড়ে আছে বাটীতে। আচ্ছা, এখন বুঝলাম। কিন্তু শুধু তো চিকেন নয়, চিংড়ি দিয়ে যে কাঁচা কাঁঠাল রেঁধেছিলাম, সেটাও কি তোমরা দুইবার করে খেয়েছো?”
-আমি তো কাঁচা কাঁঠালের তরকারী খাইনি।
-অ্যাঁ! তাহলে এত কমে গেলো কি করে?[ মিথীলার সাথে দুষ্টুমী করছিলাম]
- পাপা তো কাঁচা কাঁঠালের ডালনাও খেয়েছে। মনে হয় পাপা খেয়েছে।আচ্ছা, কাঁচা কাঁঠালের তরকারী কি খেতে ভাল হওয়ার কথা?

-খেয়ে দেখো, এই জিনিস আমেরিকায় পাবেনা। পেতে পারো, তবে রান্না করার জন্য আমাকে তো পাবেনা। এমন রান্না শুধু আমিই করতে পারি। তোমার পাপা পর্যন্ত ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। কতকাল পরে মুখ ফুটে বলেছে, ‘ রান্না খুবই ভাল হয়েছে, খুবই ভাল খেয়েছি। হা হা হা!!!

-কিন্তু তোমার রান্না তো সব সময়ই ভাল হয়।

-সে তো তোমাদের কাছে ভাল লাগে, আমি তো তোমাদের মা, মায়ের রান্না সব সন্তানের কাছেই ভাল লাগে, তা ঠিক আছে। কিন্তু আসল প্রশংসা আসে ‘লর্ড অব দ্য ফ্যামিলি’ থেকে। তবে একটা কথা বলে রাখি মিথীলা, এই ফ্যামিলির লর্ড আমার রান্না ভাল না বললেও ক্ষতি নেই, আমি নিজে জানি আমার রান্না হচ্ছে অতি উত্তম, আর এই অতি উত্তম রান্না খেয়েই তোমার পাপার নাম হয়ে গেছে ‘উত্তম কুমার”। ব্যস! মিথীলার সাথে আর বক বক করতে মন চাইলোনা,
মিঠু’স স্পেশ্যাল চিকেন-পেপার কারী মুখে দিয়ে আমিই অর্ধেক টাসকী খেয়েছি, আর কাঁচা কাঁঠালের ডালনা মুখে দিয়ে বাকী সময়টুকু টাসকী লেগে রইলাম, মিথীলা আমাকে খোঁচা দিতে সন্বিত ফিরে পেলাম।

*** মিথীলা জিজ্ঞেস করলোঃ মা, এই দুইটা আইটেমের রেসিপি কি দিবে ফেসবুক বন্ধুদের জন্য?
বললাম, দিতে তো চাই, কিন্তু----------------------------------



লেখক গোলাম মাওলা রনি'র জন্য শুভকামনা!

আমি বেশ কিছুদিন দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় 'রকমারী' বিভাগে রকমারী বিষয় নিয়ে ফীচার লিখেছি। আমি যখন লিখতাম, তখন একই পত্রিকায় একসময়ের 'বঙ্গবীর' কাদের সিদ্দিকী এবং সরকার দলীয় তরুণ এমপি গোলাম মাওলা রনি লিখতে শুরু করেন। কাদের সিদ্দিকী শুরু থেকেই শেখ হাসিনার বিপক্ষে লিখতেন, এবং খুবই রূঢ় ভাষায় লিখতেন, আমি নিজে বঙ্গবন্ধুর কন্যার প্রতি মমতা বোধ করি বলে কাদের সিদ্দিকীর লেখা পড়ে আনন্দ পেতামনা। কিন্তু গোলাম মাওলা রনির লেখা পড়ে আনন্দ পেতাম। কত মজার মজার গল্প উনি জানতেন এবং খুব সহজ ভাষায় তা লিখতেন। আমি নিজে সহজ ভাষা পছন্দ করি, তাই তখন থেকে রনি সাহেবের প্রতি সতীর্থসুলভ অনুভূতি কাজ করতো।

এ বছরের শুরুতে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার 'রকমারী' বিভাগের ফীচারের ধরণ পালটে গেছে, আলাদা আলাদা বিষয়ের উপর লেখা না ছেপে ওরা একটি বিষয়ের উপর নানারকম ফীচার ছাপায়। আমি পুরানো নিয়মেই রকমারী বিষয়ের উপর লেখার পর লেখা পাঠিয়ে যেতাম, সেগুলো ছাপা হতোনা। ফেব্রুয়ারীর ভালোবাসা দিবস সংখ্যায় বোধ হয় আমার শেষ লেখা ছাপা হয়েছিল। লেখা পাঠিয়েও যখন লেখা ছাপা হতোনা, এক সময় লেখা পাঠানো বন্ধ করে দেই। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিদিন নিয়মিত পড়তাম। রনি সাহেব এবং বঙ্গবীরের সদর্প পদচারণায় 'বাংলাদেশ প্রতিদিন' প্রতিদিনই নতুন নতুন সাজে সেজে উঠতো। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী 'বীর' মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, বঙ্গবন্ধু ভক্ত ছিলেন, মনে হয় এখন আর তা নেই, শেখ হাসিনা বা আওয়ামীলীগ বিরোধী উনার লেখাগুলো পড়লে উনাকে আর আগের মত 'বীর' মনে হয়না, বঙ্গবন্ধু ভক্তও মনে হয়না, মনে হয় যেন পাশের গ্রামের কুচক্রী মোড়ল সাহেব।

গোলাম মাওলা রনি সাহেবও শেখ হাসিনা ভক্ত ছিলেন, এখনও হয়তো আছেন, উনার লেখাগুলো পড়লে তাই মনে হতো। ইদানিং লেখার ধরণ পালটে যাচ্ছিল, উনি সরকারী দলের এমপিদের বিরুদ্ধে এমন মারকুটে ভাষায় সমালোচনা করতেন যে মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হতো, উনি কি আওয়ামীলীগের ভাল চাইছেন বলে এভাবে দলের বিরুদ্ধে খোলামেলা কথাবার্তা বলছেন নাকি দলে 'সূঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোবার' চেষ্টা করছেন? অথবা উনারই সতীর্থ আন্দালিব পার্থ এবং মাহী চৌধুরীকে টেক্কা দিতে চাইছেন?

টকশোতে গিয়ে প্রথমদিকে উনি তেমন বেপোরোয়া ছিলেননা, বরং আশফিয়া পাপিয়া বা আন্দালিব পার্থকে দেখলেই রনি সাহেব কেমন যেন মিইয়ে যেতেন। ঐ কুতার্কিকদের সামনে আত্মপক্ষ সমর্থণ করার মত কোন বিষয়ই যেন খুঁজে পেতেননা, অথবা নিজ দলের কারো উপর ক্ষুব্ধ হয়ে ইচ্ছে করে মুখরা পাপিয়া, পার্থ, মাহী চৌধুরীকে ওয়াকওভার দিয়ে আসতেন। রনি সাহেবকে 'তৃতীয় মাত্রায়' প্রথম দেখেছিলাম, এমন বিনয়ী তরুণ বক্তা তখন খুব কম দেখেছি। বিনয়ী মানুষ আমি বরাবর পছন্দ করি, শত্রু হলেও পছন্দ করি। যেমন সাবেক প্রেসিডেন্ট হো মো এরশাদ সাহেবের কথা বলার ধরণ এত সুন্দর যে মনেই হয়না ভেতরে ভেতরে উনি এমন পালটি খাওয়া স্বভাবের। আবার ইসলামী ঐক্যজোটের প্রবীন নেতা মিসবাহুর রহমানের মত অমায়িক বক্তা আমি কম দেখেছি।

বিনয়ী স্বভাবের কারণে রনি সাহেবের কথা শুনতে ভাল লাগতো, নিজ দলের বিরুদ্ধে সমালোচনা করছেন শুনেও ভাল লাগতো। অসুবিধে কি, আত্মসমালোচনা করা তো ভাল। কিন্তু উনি এবং আমি, দু পক্ষই ভুলে গেছিলাম, দেশটি আমেরিকা বা প্রতিবেশী দেশ ভারত নয়, এটি হচ্ছে 'আধুনিক বাংলাদেশ', যেখানে মুখে মুখে 'গণতন্ত্র' চলে, কাজের বেলায় ঠনঠনে। বাংলাদেশে 'সাধারণ-অসাধারণ' মানুষের কেউই সমালোচনাকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেনা, যিনি সমালোচনা করেন, তিনিও যখন অন্যের মুখে নিজের সমালোচনা শুনেন, তখনই তেলে বেগুণে জ্বলে উঠেন। আধুনিক বাংলাদেশে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে প্রত্যেকেই একে অন্যের সমালোচনা, তা মিথ্যেই হোক, অথবা সত্যিই হোক, অল্পই হোক অথবা অতিরঞ্জিত করেই হোক, করে খুব আনন্দ পায়।

গত কয়েক মাস ধরে এটাই চলছিল। যাঁকে নিয়ে আমার এই লেখা, সেই গোলাম মাওলা রনি এমপিও একই কাজ করছিলেন। কার বা কাদের প্ররোচনায় অথবা কার বা কাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থণে উনি এই 'ঘরভেদী বিভীষন'এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তা একমাত্র উনিই বলতে পারবেন। কত মজার মজার বিষয় নিয়ে উনি কলাম লিখতেন, টকশোতে গিয়ে কত বিনয়ের সাথে উনি কথা বলতেন, সেই মানুষটি হঠাৎ করে কেন নিজ দলের বিরুদ্ধে এমন বেপোরোয়া হয়ে উঠেছিলেন কে জানে। উনি সাংবাদিক পিটিয়েছেন, এমন সংবাদ শুনে হজম করতে অনেক সময় লেগেছে। গতকাল যিনি 'সুপারস্টার ছিলেন, আজকেই তিনি 'সুপারফ্লপ' হয়ে গেলেন! দুই দিন আগেই তিনি তৃতীয়মাত্রায় ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির সংবাদ বিভাগের প্রধানের সাথে মুখোমুখি বাদ-প্রতিবাদ করলেন, পরদিনই গ্রেফতার হয়ে গেলেন।

গোলাম মাওলা রনির ইদানিং কালের ঘরভেদী লেখা যা বিরোধী শক্তির হাতে অস্ত্র তুলে দিত, টকশোতে আশফিয়া পাপিয়াদের পক্ষ টেনে কথা বলা, যা খুবই বিসদৃশ মনে হতো, অথবা প্রজন্ম মঞ্চের বিরূদ্ধে কথা বলা, নিজ দলীয় মহাজোটের শরীক দলের নেতাদেরকে নাম ধরে ধরে 'নষ্টবাম, নষ্টবাম বলে বিদ্রুপ করা আমার মত অনেকেরই ভালো লাগতোনা। কারণ এই তরুণ এমপির অনেক গুণ আছে, উনি মিতভাষী, উনি মেপে কথা বলেন, বিনয়ী, উচ্চশিক্ষিত। উনি প্রচুর পড়াশোনা করেন, উনার লেখাগুলো পড়লেই তা বুঝা যায়।

বিরোধী দলের তরুণ এমপিদের তুলনায় আওয়ামীলীগের তরুণ এমপিদের প্রায় সকলেই সুশিক্ষিত, অতি ভদ্র এবং অতি বিনয়ী। এটি আওয়ামীলীগের জন্য বিশাল গৌরবের। অর্ধশিক্ষিত, কুশিক্ষিত, দূর্বিণীত, উদ্ধত নেতা কর্মী নিয়ে মারামারি করে নির্বাচনে জয়ী হওয়া যায়, কিন্তু সেই জয়ে গৌরব থাকেনা।

এই মুহূর্তে আওয়ামীলীগের সময় খুব খারাপ যাচ্ছে, চারদিকে রাহুর নিঃশ্বাস পড়ছে, নির্বাচনের মাত্র ছয়মাস বাকী, নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে দলে শৃংখলা ফিরিয়ে আনার সময় এটা, আর এই সময়েই কিনা গোলাম মাওলা রনির মত একজন তরুণ এমপি 'সাংবাদিক পেটানোর' মত অতি কুৎসিত কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেললো! যারা রাতদিন আওয়ামীলীগের সমালোচনা করে, শেখ হাসিনার সমালোচনা করে মুখে ফেনা তুলে ফেলে, তাদের অন্ততপক্ষে এটা স্বীকার করতেই হবে, সরকারে আওয়ামীলীগ আছে বলেই কথা বলার স্বাধীনতা আছে, সেই স্বাধীনতা তারা দিনরাত ভোগ করছে, কথা বলার স্বাধীনতা আছে বলেই তারা সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করার পরিবর্তে প্রতি মুহূর্তে বিষোদগার করে চলেছে, তাদেরই পেতে রাখা ফাঁদে পা দিয়েছেন গোলাম মাওলা রনি এমপি। কথা বলার স্বাধীনতা আছে বলেই এমপি রনি'র ক্রমাগত 'সরকার বিরোধী, দলবিরোধী' অতিকথন সত্ত্বেও তাঁর বিরুদ্ধে এতদিন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, গতকাল গ্রেফতার করা হয়েছে সরকার বিরোধী কথা বলার দায়ে নয়, সাংবাদিক পেটানোর দায়ে।

গোলাম মাওলা রনির গ্রেফতার সংবাদে আমার মনটা খারাপ হয়েছে। সে অপরাধ করেছে, তাই গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু যাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে রনি সাহেবকে গ্রেফতার করা হলো, তারা কি একবার নিজের মনে ভেবে দেখবেন, কেন রনি সাহেবের মত ভদ্র মানুষ হঠাৎ করেই এমন 'অভদ্র' হয়ে উঠেছিল। গণতন্ত্র আছে বলেই কি কারো স্বাধীন চলাফেরায় বিঘ্ন ঘটাতে হবে? একজনের ব্যক্তি স্বাধীন জীবনের মুহূর্তগুলোকে 'অসহনীয়' করে তুলতে হবে? পেশাগত মূল্যবোধকে বড় করে দেখতে গিয়ে 'মানবিক মূল্যবোধ'কে অস্বীকার করতে হবে?

***পরিশেষেঃ আওয়ামীলীগের তো এখন দলে শুদ্ধি অভিযান শুরু হওয়ার কথা। হয়তো গোলাম মাওলা রনি সাহেবকে দিয়েই তা শুরু হলো। সঠিক সময়ে খুবই সঠিক সিদ্ধান্ত হয়েছে এটা। তবে গত চার মাসে এমপি রনি দলের কিছু অনিয়মের বিরুদ্ধে যা কিছু বলেছেন, তথ্যগুলো কি একটু যাচাই বাছাই করে দেখা উচিত নয়? যদি অভিযোগগুলোর সবই মিথ্যে হয়ে থাকে, তাহলে তো কোন ভয় নেই, থাকুক রনি সাহেব জেলের ভেতর, আর যদি শতকরা দশ ভাগ অভিযোগেও কোন সত্যতা থাকে, তাহলে সেই দশ ভাগ সত্যি উচ্চারণের জন্য রনি সাহেবকে 'দশভাগ' সাধুবাদ জানাতে যেন কার্পণ্য না করা হয়। গ্রেফতার হওয়ার পর তো এমপি রনি সেকথাই বলেছেন, উনার গ্রেফতারের ভেতর দিয়েও যদি দলের মঙ্গল হয়, তাতেই উনি খুশী।
** একজন লেখক গোলাম মাওলা রনির জন্য আমার মত ক্ষুদ্র লেখকের শুভ কামনা। আপনি যা কিছু করেছেন, তার সবটুকু যদি নিজ দলের মঙ্গলের স্বার্থে করে থাকেন, তাহলে দলের মঙ্গল হবে, নাহলে তো চারদিক অন্ধকার করে দিয়ে গেলেন।**
Like · · Promote ·
'আঠাইল্যা চালের ভাত'

চাল কিনতে হবে, গতমাসে কেনা চালের ব্যাগ প্রায় তলানীতে এসে ঠেকেছে। ওয়ালমার্টের গ্রোসারী সেকশান থেকে সব সময় চাল কিনি। আজকেও গেলাম গ্রোসারী সেকশানে, গিয়ে দেখি এমাসেও 'জেসমিন' চাল আসেনি। গতমাসেও জেসমিন চাল ছিল না। আমেরিকান 'আঠাইল্যা আতপ' চাল কিনে এনেছিলাম। উত্তমের মনে ধরেনি।
আমরা দেশে থাকতে দু'বেলা সেদ্ধ চালের ভাত খেতাম, আতপ চাল খেতামনা। ছোটবেলা থেকেই জানতাম, হিন্দু বিধবারা আতপ চালের ভাত খায়, আর শীতের পিঠে বানাতে আতপ চালের দরকার হয়।

আমেরিকা এসে স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে একবেলা ভাত খাই, তাই চাল কেনার ব্যাপারে একটু বাছাবাছি করি। এদেশে সেদ্ধ চালের নামে যে চাল পাওয়া যায়, সে চালের ভাত খেয়ে আমার পোষায়না। ইয়া বড় বড় দানার ভাত, রান্না হতে ঘন্টা খানেক সময় লেগে যায়। তাই আমি থাইল্যন্ডের 'জেসমিন' খাই, অথবা দেরাদুন বাসমতি। জেসমিন যদিও আতপ চাল কিন্তু খেতে ভাল, খুব সুন্দর গন্ধ আছে, আমেরিকান আঠা আতপ চাল নয়।

আমেরিকান আতপ চাল বলতে আমি ছোটবেলায় রেশন থেকে পাওয়া মোটা দানার চালকে বুঝি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে রিলিফ আসতো, নাম মনে পড়েনা, কিন্তু চাষাঢ়ার কোন একটা দোকান বা গুদামঘরের সামনে 'লাইন' ধরতাম। আমরা অবশ্য মনের আনন্দেই 'লাইনে' দাঁড়াতাম। আমি, মেজদা, ছোট মাসী। ছোটমাসী খুব 'দস্যি টাইপ' মেয়ে ছিল, তার একটা দল ছিল, সেই দলের নাম সে নিজেই দিয়েছিল, ' দস্যি রাণী সংঘ'। সেই দস্যি রাণী স্বয়ং গিয়ে লাইনে দাঁড়াতো, আমাদের্ বুকে বেশ বল ভরসা পেতাম।

রিলিফের মাল কি পেতাম মনে পড়েনা, 'পাউডার দুঢ, আর বাটার অয়েল' পেতাম এটা মনে আছে। রেশন তুলতে যেতাম, সেখানেও লাইন দিতাম, রেশান থেকে পেতাম গম, মোটা আতপ চাল, সয়াবিন তেল, বাটার অয়েল আর চিনি।

যত উৎসাহ নিয়ে রেশান তুলে আনতাম, খেতে বসলে সেই উৎসাহ ঠান্ডা হয়ে যেত। আমাদের সকালের খাবারে ছিল মোটা আতপ চালের ভাত আর পাতলা মুসুরের ডাল। আমার বাবা আর তিন ভাই সেই ডালভাত সোনামুখ করে খেয়ে নিত, সমস্যা হতো আমাকে নিয়ে। আমি ঘাড় ব্যাঁকা করে দাঁড়িয়ে থাকতাম, একটাই কথা ছিল, " আমি এই 'আঠাইল্যা ভাত আর মুসুরীর ডাইল খামুনা"। মায়ের মন, বলতো ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করতে, বাজার থেকে বেশীর ভাগ সময় 'কেচকী' মাছের ভাগা আসতো। সেই কেচকী মাছের ভাগা থেকে একটা একটা করে কুচি চিংড়ি, গুড়ি বাইল্যা আলাদা করে বেগুণ আর ঝিঙ্গে দিয়ে ঝাল করে একটা চচ্চড়ি রানতো মা। আমি আর মা সেই চচ্চড়ি দিয়ে ভাত খেয়ে স্কুলে যেতাম। মা আমার জন্য এই কাজটুকু করতো দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে, কারণ আমার মাও এই 'আঠাইল্যা' চালের ভাত খেতে পারতোনা।

বড় হয়ে জেনেছি, এই আঠাইল্যা চাল আসতো 'আমেরিকা' থেকে। আমেরিকানরা ভাত খায়না, তাই চালের মর্মও বুঝেনা, তাই এইসব ফেলনা জিনিস আমাদের মত গরীব দেশে পাঠিয়ে আমাদের মাথা কিনে নিয়েছিল। আমাদের জাতির মুক্তির দূতকে হত্যা করিয়েছিল। সেই আমেরিকায় আমি আজ দাঁড়িয়ে আছি। আমি আমেরিকান পলিসি পছন্দ করিনা, মাঝে মাঝেই বকতে থাকি, মেয়েরা বলে উঠে, " মা, আমেরিকার ভাত খাচ্ছো, আবার আমেরিকাকেই গালি দিচ্ছো"।
সোজা উত্তর দেই, " আমি আমেরিকায় মাগনা খাইনা, পরিশ্রম করে খাই, তারপরও আমেরিকার ভাত খাইনা, এই 'আঠাইল্যা' চালের ভাত খাওয়ার জন্য আমার বয়েই গেছে। আমি খাই থাইল্যান্ডের জেসমিন অথবা দেরাদুনের বাসমতি। নে, তোদের কাছে কথা পরিষ্কার করে দিলাম, আমি আমেরিকার কাছে ঋণী ছিলাম, ছোটবেলায় তাদের পাঠানো ভিক্ষার চাল খেয়েছি বলে, এখন দেহের পরিশ্রম দিয়ে সেই ঋণ শোধ করে দিচ্ছি"।
1Like · · Promote ·
গত বছর এই সময়ে মা'কে নিয়ে স্কয়ার হাসপাতালে, সাথে মাসীর মেয়ে মিত্রা, মা'কে নিয়ে লিফটে করে একবার সাত তলা, একবার পাঁচ তলা, একবার দোতলা করছিলাম, সারাটা দিনে মা'কে কি কষ্টটাই দিলাম, কাজের কাজ কিছুই হলোনা, বিকেল চারটার সময় মায়ের ক্লান্ত অবসন্ন দেহটিকে ট্যাক্সীতে তুলে দিলাম, ট্যাক্সী চলে গেলো নারায়ণগঞ্জের দিকে, আমি ফিরে এলাম উত্তরার দিকে। মায়ের সাথে এই আমার শেষ দেখা। যদি বুঝতে পারতাম, ওটাই ছিল মায়ের সাথে শেষ দেখা, মায়ের মুখটার দিকে দুই চোখ মেলে তাকাতাম। মায়ের মুখটা মনে আঁকা হয়ে থাকতো। মা, আমার জুলাইকে তুমি ক্যান্সারাক্রান্ত করে দিয়ে কোথায় চলে গেলে!
Like · · Promote ·
দেশের সার্বিক পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নিচ্ছে?--কেউ কি জানে?
গতকাল আমার বাবাকে ফোন করেছিলাম, আমার বাবা খুব সাধারণ একজন মানুষ, কেউকেটা হলেও হতে পারতেন, ভাগ্য উনাকে পরিহাস করেছে, উনি সাধারণই রয়ে গেছেন।
আমার বাবা ভীষন OPTIMISTIC ধরণের মানুষ, উনি মাথার উপর ছিলেন বলে আমরা আজ এতটুকু পথ পৌঁছাতে পেরেছি। সেই বাবা গতকাল খুব বিষন্ন কন্ঠে বললেন, " দেশ কোনদিকে যাচ্ছে জানিনা, খুব খারাপ লাগে, দেশটা রসাতলে যাওয়ার আগেই যেনো আমার মৃত্যু হয়। তোরা ভালো থাকিস, এই দেশে ফিরে আসার কথা আর ভাবিসনা।"
6Like · · Promote ·



কচু কাহিনী

আমাদের বাগানের মালী এ বছর প্রচন্ড পরিশ্রম করেছেন, আমি সাহায্য করতে চেয়েছিলাম, এক ধমক দিয়ে সরিয়েও দিয়েছেন, বলেছেন, আমি নাকি বাগানের কিছুই বুঝিনা। অতি উৎসাহে এক ইঞ্চি ফাঁকে ফাঁকে একেকটি গাছ লাগিয়েছেন, ধমক খেয়েও বেহায়া হয়ে বলেছি, এভাবে গায়ে গায়ে গাছ লাগালে একটাও হবেনা। তখন বলেছে, গাছ বড় হলে সব ঠিক করে দিবে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দুই একটি গাছ সরিয়ে অন্যত্র লাগিয়েছিলাম, তাতেই একটি কুমড়ো চারা বড় হতে পেরেছে, একশ'র উপরে ফুল ফুটে একটিমাত্র কুমড়ো হয়েছে, লাউয়ের ডগা বড়ই দূর্বল, টমেটো গাছ বড় হতে হতে আকাশ ছুঁয়ে ফেলার অবস্থা, কিন্তু টমেট ধরেনি, দুই একটাতে অবশ্য হয়েছে। শসা গাছে দুই একটি শসা হয়েছে। আমার অবশ্য তেমন একটা আফসোস নেই, কারণ লাউ কুমড়ো বাদ দিয়ে যে গাছটি হয়েছে, সেগুলো লাখ টাকা দিয়েও পাওয়া যাবেনা, এই মিসিসিপিতে। তা হচ্ছে 'কচুগাছ'। মানুষ যে কেন শত্রুকে কচু খেতে বলে বুঝিনা, কচু হচ্ছে অতি উপাদেয় একটি সব্জী, এমন সব্জী নিজে না খেয়ে কি শত্রুকে খাওয়ানো যায়? লাউ কুমড়ো শত্রুকে খাওয়ানো যেতে পারে, কারণ এই জিনিস আমেরিকান দোকানেও কিনতে পাওয়া যায়, কিন্তু কচু গাছ কোথায় পাব? আমরা কচু গাছ চাষ করেছি, বাড়ীতে টবে লাগিয়েছি, আর আমাদের এক বন্ধু বিনু অধিকারী, দুই বছর আগে মিসিসিপি ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে কচুর মুখী এমন একটি স্থানে বুনে দিয়ে গেছে, যেখানে মাটি খুব উর্বর। বিনুর হাত ছিল 'লক্ষ্মীর হাত, মাটিতে যা লাগাতো, সেটাই বড় হয়ে অজস্র ফল দিত।

ছবিতে যে কচুগুলো দেখা যাচ্ছে, এটা হলো তৃতীয়বারের তোলা ফসল। যারা রান্না করতে ভালোবাসো, তাদের জন্য রান্না করেছি, 'ঠাকুমার কচুশাক।' [এই কচু কিন্তু গলায় ধরেনা, পাপিয়া ম্যাডামের গলাতেও ধরবে না, গ্যারান্টি দিচ্ছি, বিফলে আমার রেসিপি ফেরত]

প্রণালীঃ কচুর ডগাগুলো ভাল করে ধুয়ে টুকরো টুকরো করে সেদ্ধ করেছি। এমনভাবে সেদ্ধ করতে হবে যেন কাদাকাদা হয়ে যায়। প্যানে বেশ খানিকটা তেল গরম হতে দিয়ে একফাঁকে ফোড়নের মশলাগুলো রেডী করে নিতে হবে। 'ঠাকুমার কচুশাক' রান্না করতে ফোড়নের জন্য লাগে আস্ত জিরে, এক চিমটে মেথী, শুকনো লংকা, তেজপাতা, এক টুকরো দারচিনি, দুটি এলাচ, কাঁচালংকা, এক মুঠো ছোলার ডাল এবং আধ কাপ নারকেল কোরা।
বাটা মশলা লাগে এক চা চামচ আদা বাটা, দেড় চামচ জিরে বাটা, আধ চামচ হলুদ বাটা এবং কয়েকটি কাঁচামরিচ।
তেল গরম হলে শুকনো লংকা আগে দিতে হবে, তারপর জিরে আর মেথী, তারপর তেজপাতা [তেজপাতা পুড়ে গেলে ভালো লাগেনা], একটু পরেই ছোলার ডাল দিয়ে নরম আঁচে ভাজতে হবে। ছোলার ডাল বাদামী হয়ে এলে কয়েকটি কাঁচালংকা একটু চিরে তেলের মধ্যে ফেলে দিতে হবে।[ কাঁচালংকা চিরে না দিলে গরম তেলে ফেটে গিয়ে নাকে মুখে লাগতে পারে, এতে মুখে বড় ধরণের ক্ষত তৈরী হতে পারে।]

এবার বাটা মশলাগুলো তেলে দিয়ে হাতের তালুতে করে অল্প জল ছিটিয়ে দিতে হবে। মশলা কষানো ধৈর্‍্য্যের ব্যাপার, নরম আঁচে মশলা কষালে মশলা থেকে ভালো স্বাদ ও গন্ধ বের হয়। মশলা ঘন বাদামী হবে, মশলা থেকে তেল উঠে আসবে, তখন নারকেল কোরা দিয়ে আরও কিছুক্ষণ নেড়ে চেড়ে সেদ্ধ কচু ঢেলে দিয়ে চুলার তাপ বাড়িয়ে দিতে হবে। এবার একটু বেশী আঁচে রান্না করতে হবে, তাহলে কচু থেকে বের হওয়া জল তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে।

কচু যখন দলা পাকিয়ে যাবে, কাদা ভাব থাকবেনা, এক চা চামচ গাওয়া ঘি দিয়ে, আস্ত কাঁচালংকা ফেলে নেড়েচেড়ে ঢাকা দিয়ে দিতে হবে। চুলার চাবি অফ করে দিতে ভুলে গেলে চলবেনা।

** বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে অনেক কঠিন কাজ, কিন্তু মোটেও কঠিন নয়। দেশে কচুর শাক পর্যাপ্ত পরিমানে পাওয়া যায়, কিন্তু বিদেশে পাওয়া কঠিন। চাইনীজ বা ভিয়েতনামীজ দোকানে যে কচু বিক্রী করা হয়, সেগুলো দশ ঘন্টা ধরে সেদ্ধ করলেও সেদ্ধ হয়না, কচুর ডগাগুলো তাকিয়ে থাকে। বাংলাদেশী বা ইন্ডিয়ান গ্রোসারী শপে কচুর মুখী পাওয়া যায়। সেই কচুর মুখী মাটি চাপা দিয়ে দিলেই কচুগাছ বের হয়। এবং এই কচুগুলো সুসিদ্ধ হয়, গলায় ধরেনা।
2Like · · Promote ·

শিল্পীর কাছ থেকে পাওয়া উপহার!!

তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের ছাত্রী। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ প্রত্যেক হোস্টেলে একটি করে রঙীন টিভি উপহার হিসেবে দিয়েছেন। রঙীন টিভিতে সবকিছু রঙীন দেখা যায়, কি যে অবাক লাগতো আমার কাছে, আমি লেখাপড়া বাদ দিয়ে টিভিরুমে গিয়ে বসে থাকতাম, প্রয়োজনে হামদ ও নাত দেখতাম, বিরক্তিকর আলোচনা অনুষ্ঠান দেখতাম।
তখন বয়সটাই এমন ছিল, রঙীন যা দেখি তার সবই ভালো লাগতো। এইসব 'প্যাঁচাইল্যা' অনুষ্ঠানের একফাঁকে পুরানো দিনের গান দেখাত, আধুনিক গানের প্রতি আমার নেশা ছিল মদের নেশার মত [মদের নেশা নাকি সবচেয়ে মারাত্মক নেশা, তাই উপমা হিসেবে ব্যবহার করলাম]! পরীক্ষা থাকুক আর নাই থাকুক, সপ্তাহের যে দিনটিতে পুরানো দিনের গান দেখাতো, সেদিন আমি সবার আগে টিভি রুমে গিয়ে বসে থাকতাম।

ঐ সময়ের গানের হিরো ছিলেন তিমির নন্দী, দারুণ স্টাইলিস্ট, দারুণ রোমান্টিক ভয়েস নিয়ে একের পর এক গান গেয়ে চলতেন। উনার কন্ঠে সব গানই আমার ভালো লাগতো। সবচেয়ে ভালো লেগেছিল, " তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে"~~~ গানটি শুনে রঙীন বয়সের তরুণীদের রঙীন মনে কি রকম প্রতিক্রিয়া হতো, সেটা এখন আর অভিনয় করেও দেখাতে পারবোনা। টিভি রুমে তরুণীদের কন্ঠে শুধু 'আহাহা! আহাহা" শোনা যেত। খোঁজ খবর নেয়া শুরু হলো, এই শিল্পী সম্পর্কে। অনেকেই বলে শিল্পি সুবীর নন্দীর ভাই, সুবীর নন্দীর সাথে চেহারায় মিল আছে, নামের ছন্দে মিল আছে, শুধু সাজ পোশাকে মিল নেই। সুবীর নন্দী অনেক গম্ভীর, কিন্তু তাঁর ছোট ভাই অনেক প্রাণবন্ত, অনেক ইয়াং, অনেক রোমান্টিক। [হা হা হা! তর্রুণী বেলার গল্প, শিল্পী তিমির নন্দীর কানে গেলে নিশ্চয়ই খুশী হবেন]।

বিয়ের পর ভার্সিটি লাইফ আর আগের মত ছিলনা, হোস্টেলে থাকা হতোনা, রঙীন টিভির রঙীন জগত থেকে ছিটকে রঙীন জীবনের অধ্যায় শুরু করেছিলাম। " তোমারে লেগেছে এত যে ভাল' গান শোনানোর মানুষ পেয়ে গেলাম, তিমির নন্দীকে ভুলে গেলাম।

প্রায় ২৬ বছর পর আমাদের গাড়ীতে ক্যাসেট প্লেয়ারে বেজে উঠলো, " তোমারে লেগেছে এত যে ভাল চাঁদ বুঝি তা জানে"---শিল্পী তালাত মাহমুদ নয়, সেদিনের সেই স্মার্ট, তরুণীদের অত্যন্ত প্রিয় তিমির নন্দী। আমি প্রতিদিন গাড়ীতে এই গানটি বাজাতাম, রিওয়াইন্ড করতাম, শুনতাম, আবার রিওয়াইন্ড করতাম, শুনতাম। কেন এটা করতাম তা সহজেই অনুমেয়। এই গানটি আমাকে একটানে তরুণী বয়সের সেই রঙীন দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতো, যে দিনগুলোকে আমি এখনও অতি যতনে অন্তরে ধরে রেখেছি।

ফেসবুকের কল্যানে শিল্পী তিমির নন্দীর খোঁজ পেয়ে গেলাম, বন্ধু রিকোয়েস্ট পাঠালাম, উনার কন্ঠে গীত গানটি প্রতিদিন গাড়ীতে কয়েকবার শুনি, এটা জানাতে ভুললামনা। শিল্পী আমার বন্ধুত্ব অনুরোধ গ্রহণ করলেন, আধুনিকভাবে চিত্রায়িত গানের লিঙ্ক পাঠালেন, আমি গান শুনলাম, কিন্তু উনাকে জানালাম, আমি এই গানটি শুনে মজা পেলামনা। যদি আপনার কাছে সেদিনের ভিডিও ক্লিপ থাকে, প্লীজ আমাকে দিন। উনি জানালেন, উনার কাছে নেই, বিটিভি আর্কাইভে থাকলেও থাকতে পারে।

দেড় বছর সময় পেরিয়ে গেছে, দুই সপ্তাহ আগে দাদা জানালেন, গানটির খোঁজ পাওয়া গেছে, উনি আমাকে লিঙ্ক পাঠাবেন। দাদা আমার মত সাধারণ, অতি সাধারণ ভক্ত শ্রোতার কথা মনে রেখেছেন, এই খুশীতেই আমি আত্মহারা হয়ে গেলাম। দাদাকে ধন্যবাদ জানাতেই দাদা পাল্টা বললেন, এমন পাগল ভক্তকে খুশী করতে পেরেছেন, এতে উনি নিজেও খুশী।

আজ দাদা একটি মেসেজ পাঠিয়েছেন, " তোমার ওয়ালে কিছু পোস্ট করতে পারছিনা, তাই গানের লিঙ্কটি ইনবক্সে পাঠালাম"।
কিছুদিন ধরেই নানা কারণে মন মেজাজ অস্থির হয়ে থাকে, আমি আগেও খেয়াল করেছি, যখনই আমার মন খারাপ থাকে, অথবা অস্থিরতায় ভুগি, কোন না কোনভাবে, কেউ না কেউ আমার জন্য আনন্দসংবাদ বয়ে নিয়ে আসে। আজকে তেমন একটি দিন, তিমির নন্দীর মত গুণী শিল্পী আমার মত অতি সাধারণ একজন মানুষকে মনে রেখেছেন, এত কষ্ট করে উনার কন্ঠে গীত সেদিনের সেই ভিডিও ক্লিপটি আমাকে যত্ন করে মেসেজ বক্সে পাঠিয়েছেন, এর চেয়ে বড় উপহার আর কি হতে পারে!

দাদা ( তিমির নন্দী), আপনার কাছ থেকে উপহার পেয়ে আমি আনন্দিত, আবেগাপ্লুত। আপনার এই উপহার আমাকে টেনে নিয়ে গেলো হারিয়ে যাওয়া তারুণ্যের প্রাণবন্ত দিনগুলোতে। আপনি সত্যিকারের শিল্পী, সত্যিকারের শিল্পীরা এমনই হয়! ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
— with Timir Nandy.
আওয়ামীলীগের দুঃসময়! এখন কাকেও ঠোকরায়, কোকিলেও ঠোকরায়!

গোলাম মাওলা রনি সাংবাদিক পিটিয়েছে, এমন একটি ভিডিও ক্লিপ অনলাইনে তোলপার সৃষ্টি করেছে, সারা ফেসবুক জুড়ে শুধুই গোলাম মাওলা রনি’র সাংবাদিক পেটানোর ভিডিও ক্লিপ, মহা ধুমধামে চলছে। ভিডিও ক্লিপে অবশ্য কোথাও দেখা যাচ্ছেনা, গোলাম মাওলা রনিকে সাংবাদিক পেটাতে। কিন্তু রনি’র উত্তেজিত কন্ঠস্বর শোনা যায়, বরিশালের টোন, সহজেই চেনা যায়। এই কন্ঠস্বরের সাথে আমরা সকলেই কম বেশী পরিচিত। হালের টকশো তারকা উনি। হালের কলাম লেখক উনি। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় মুঘল হেরেমের নিষিদ্ধ প্রণয় নিয়ে বেশ উপভোগ্য লেখা লিখেছেন, কয়েক পর্বে। তবে মুঘল হেরেমের কাহিণী পড়ার চেয়েও গোলাম মাওলা রনি’র রাজনৈতিক কলামগুলোই বেশী আলোচিত হচ্ছে। কারণ তার কলামগুলো শাসকদলের বিরুদ্ধে প্রখর সমালোচনায় ভরপুর থাকে। একই পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের টাইগার, বংগবন্ধুর পুত্রসম কাদের সিদ্দিকীও লিখেন। পত্রিকাটির সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদকও লিখেন। সকলেই বর্তমান সরকারের কঠোর সমালোচনা করে লিখলেও গোলাম মাওলা রনি’র ইদানিংকালের লেখাগুলো নিয়ে আলোচনা বেশী হয়।
গোলাম মাওলা রনি’র লেখা নিয়ে আলোচনা বেশী হওয়ার কারণ কি? উনি কি আব্দুল গাফফার চৌধুরীর মত লিখেন? নাকি কুলদীপ নায়ারের মত লিখেন? উনি আসলে কারো মত লিখেননা, নিজের মত করেই লিখেন। উনি বিখ্যাত সাংবাদিক কলামিস্ট নন, উনি একজন সরকার দলীয় সংসদ সদস্য। সরকারে আছে আওয়ামীলীগ, আওয়ামীলীগ দলীয় সংসদ সদস্য হয়েও নিজ দলের বিরুদ্ধে লিখেন বলেই উনার লেখাগুলো নিয়ে এক শ্রেণীর পাঠক খুব আগ্রহ দেখায়। আওয়ামীলীগ বিরোধীরা বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত কাদের সিদ্দিকীর লেখা, পীর হাবীবুর রহমানের লেখা, গোলাম মাওলা রনি’র লেখাগুলো আওয়ামী বিরোধী প্রচারণার দলিল হিসেবে রেখে দেয়। কাদের সিদ্দিকী বা পীর হাবীবুর রহমান আওয়ামী বিরোধী অথবা আওয়ামীলীগের কতিপয় নেতা নেত্রীর বিরুদ্ধে লিখতেই পারেন, কারণ উনাদের দুজনেই একসময় আওয়ামীপন্থী ছাত্র রাজনীতি করলেও পেশাগত জীবনে সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। কাদের সিদ্দিকী তো আলাদা রাজনৈতিক দলই গঠণ করেছেন যাদের মূল ঊদ্দেশ্য যাই থাকুকনা কেন, বাস্তবে আওয়ামীলীগের রাজনীতির উলত স্রোতে চলাই কাদের সিদ্দিকীর লক্ষ্য। কিন্তু গোলাম মাওলা রনি কেন নিজ দলের বিরুদ্ধে লিখেন, তা বোধগম্য নয়।

শুরুর দিকে এই সংসদ সদস্যের লেখা পড়তে ভালো লাগতো, সহজ ভাষায় একটানে লেখা, সরকারী দলের সদস্য হয়েও অনেক নেতা–উপনেতাদের কাজে ও কথার অসংগতিগুলো নিয়ে লিখতো বলে তাকে তখন খুব সাহসী, স্পষ্টভাষী, সৎ রাজনীতিবিদ মনে হতো। আধুনিক সমাজে এমন সাহসী, সৎ রাজনীতিবিদেরই তো প্রয়োজন থাকে। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে উনার লেখা কলামগুলো আর পড়া হয় না। লেখার ভাষা সহজই আছে, কিন্তু লেখার বিষয়বস্তুগুলো মাঝে মাঝেই মনের ভেতর এক ধরণের হতাশার জন্ম দেয়, পাঠকমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, সতীর্থদের মনে ক্ষোভ তৈরী করে।

বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ পক্ষশক্তি আর বিরোধীশক্তি সমর্থিত রাজনীতিতে সুস্পষ্টভাবে বিভক্ত, সরকারে আছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি আওয়ামী লীগ মহাজোট, বিপক্ষে বিএনপি, জামাত এবং সমমনা অন্যান্য দল। নির্বাচন এগিয়ে এসেছে, নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকারী দলের জনপ্রিয়তা এমনিতেই কমে যায়, তার উপর যদি নিজ দলীয় কর্মি সমর্থকদের মাঝে বিভেদ, বচসা, বাদানুবাদ বৃদ্ধি পেয়ে যায়, এবং দলটি যদি হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি, তখন খুব সহজেই মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে। বাংলাদেশে বর্তমানে সেটাই হতে চলেছে। আওয়ামীলীগের জনপ্রিয়তা কমে গেছে যতটা নিজেদের ভুল কর্মকান্ডের কারণে, তার চেয়ে বেশী দলীয় কোন্দলের কারণে। গোলাম মাওলা রনি আওয়ামীলীগের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে লিখেন, টিভি টকশোতে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে বলেন এবং এর প্রতিটি পদক্ষেপ তার সতীর্থদের কোন কাজে না এলেও আওয়ামীবিরোধী শিবিরের হাতিয়ার হিসেবে জমা হচ্ছে।

তিন বছর আগে, চ্যানেল আইয়ের তৃতীয় মাত্রায় গোলাম মাওলা রনি’কে প্রথম দেখি। তার স্পষ্ট ভাষা, বিনয়ী ভাব দেখে প্রথমেই তাকে আমার মনে ধরে যায়। রনি’র পরে দেখি আন্দালিব রহমান পার্থ এবং মাহী চৌধুরীকে। তিন জন তিন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য হলেও তিনজনের কথা শুনতেই আমার ভাল লাগতো। দুই বছর পরেই ভালো লাগাগুলো ফ্যাকাশে হতে থাকে এবং এক সময় সাদা হয়ে যায়। আন্দালিব পার্থ কথা-বার্তায় এমন দূর্বিনীত, বেপোরোয়া হয়ে উঠে যে তার চেহারায় একধরণের ্ধূর্ততা এবং ক্রুরতার ছাপ পড়ে যায়, মাহী চৌধুরীর কথায় যুক্তি থাকলেও আদর্শচ্যুত রাজনীতিবিদের কথা শুনতে ভালো লাগেনা। বাদ রইলো, গোলাম মাওলা রনি।

গোলাম মাওলা রনি তার লেখায়, টকশোতে নিজ দলের নেত্রীকে শ্রেষ্ঠ স্থানে বসাতে দ্বিধা করেননা, নেত্রীকে তিনি ভালোবাসেন এবং শ্রদ্ধাও করেন। অনেক লেখাতে তিনি বলেছেন, দলীয় প্রধান এবং অনেক সিনিয়র নেতা তাকে খুব ভালোবাসেন। অথচ ইদানিংকালের লেখা এবং টকশোতে মাওলা সাহেব এমন সব মন্তব্য করেছেন যা দলের বিপক্ষে গেছে। সে এমন কোন কেউকেটা সংসদ সদস্য নয়, তারপরেও তার বক্তব্য গুলোই তাকে হঠাৎ করে টকশো স্টার বানিয়ে দিয়েছে। কয়েকমাস আগে আমেরিকায় এসেছিলেন, তখনও দল বিরোধী নানা মন্তব্য করে গেছেন। প্রজন্ম মঞ্চ ছিল তরুণ প্রজন্মের কাছে গৌরবের, এই প্রজন্ম মঞ্চ নিয়েও রনি সাহেব কাদের সিদ্দিকী, এরশাদ সাহেবের সাথে সুর মিলিয়ে প্রজন্ম মঞ্চ বিরোধী কথা বলেছে।

একজন সংসদ সদস্য হিসেবে গোলাম মাওলা রনি সাহেবের উচিত ছিল, নিজ দলের খারাপ কাজের সমালোচনা করার পাশাপাশি দলের ভালো কাজগুলোর প্রচার চালানো। উনি তা কতটুকু করেছেন জানা নেই, কারণ ইদানিং আমি তার অংশগ্রহণে টকশো দেখিনি। তবে ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু দেখেছি, সেখানে উনাকে টকশো মডারেটরের সাথে সাথে ‘নষ্ট বাম’, নষ্ট বাম করতে দেখেছি। নষ্ট বামের একজন হলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। এই মানুষটি কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছেন, কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন, দেশ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ তো হয়েইছে, খাদ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। মতিয়া চৌধুরীর মন্ত্রনালয়ের এই সাফল্য প্রচার না করে রাজনৈতিক দৃষ্টি নিয়ে উনাকে ‘নষ্টবাম’ বলে ব্যঙ্গ করেছেন, নাম ধরে ধরে সমালোচনা করেছেন। রনি সাহেবের সমালোচনাগুলো ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারতাম যদি উনি যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমালোচনা করতেন।

শুনেছি উনি খুব বন্ধুবৎসল, নিজ দলীয় এমপিদের সাথে বন্ধুত্ব কতটুকু গভীর জানা নেই, তবে উগ্রচন্ডী পাপিয়া, নীলুফার মনি, রেহনুমা রানু, আন্দালিব পার্থের সাথে গভীর বন্ধুত্ব। পাপিয়া, রানু, নীলুফারদের উগ্র, অশোভন, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখে, নোংরা ভাষার উচ্চারণ শুনে, জাতির পিতা, প্রধানমন্ত্রী, স্পীকারকে নিয়ে ওদের মারদাঙ্গা ভঙ্গী দেখে আমরা লজ্জা পেয়েছি, কিন্তু গোলাম মাওলা রনি বলেছেন, ওরা নাকি খুব ভালো মানুষ, ওরা খুব বড় মনের, ওরা সকলেই উচ্চশিক্ষিত, সংসদে দাঁড়িয়ে কবি হেলাল হাফিজের কবিতা থেকে আওড়ানো আপত্তিকর শব্দতেও উনি বিশেষ দোষ দেখতে পাননি, এমনকি পাপিয়া এমপি যখন স্পীকারকে ‘ দে, মাইক দে’ বলে তুই তোকারী করেছে, সেটা শুনেও মাওলা সাহেব বলেছেন, এরকম হতেই পারে, বাইরের দেশের সংসদে নাকি আরও অনেক বড় কেলেংকারী হয়।

এইরকম একজন সংসদ সদস্য যদি শুধু নিজ দলের নেতাদের নিয়ে সমালোচনা অব্যাহত রাখেন, টকশো মডারেটরের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে পারেন, প্রজন্ম মঞ্চ ভুল, যে এরশাদ তার দলকে লেজে খেলাচ্ছে, যে এরশাদ মহাজোটের একটি গুরুত্বপূর্ণ শরীক হয়েও জোটের বাইরে গিয়ে হেফাজতের পক্ষাবলম্বন করে, যে এরশাদ হেফাজতের মিথ্যে প্রোপাগান্ডাকে সমর্থণ দেয়, সেই এরশাদকেও যদি রনি সাহেব খুব ভদ্রলোক বলে স্বীকৃতি দেন, যদি বলেন, নেত্রীর সাথে বেগড়বাই করলেও রনিকে দেখামাত্র পাশে বসিয়ে লিচু খাওয়ায়, লিচুর খোসা ছুলে তার মুখে তুলে দেয়, এসব শুনে পাঠক বা দর্শকের কাছে কেমন লাগবে। যেখানে নিজ দলের ভালো কাজের প্রশংসা করা জরুরী, সেখানে সে বিরোধী দলের নষ্ট, ভ্রষ্টদের নিয়ে টকশোতে কথা বলে। সে একবারও খেয়াল করেছে কিনা জানিনা, তারই সতীর্থ আন্দালিব পার্থ, মাহী চৌধুরী, পাপিয়া, নীলুফার মনি ্নিজেদের দলের ‘মহাচোর, মহাদস্যু’দের আড়ালে রেখে গোলাম রনিকে খুব উৎসাহ দিয়ে যায় ক্রমাগত আওয়ামীলীগের চোরদের মুখোশ খুলে দিতে।

সাংবাদিক পেটানো ভিডিও এতক্ষণে সকলেই দেখেছে, টিভিতেও দেখেছে, অনলাইনেও দেখেছে। গোলাম মাওলা রনির বিরুদ্ধে যতই সমালোচনা করিনা কেন, এখনও বিশ্বাস করি উনি ব্যক্তিগত জীবনে খুব স্বচ্ছ মনের মানুষ, স্পষ্টবাদী, সাহসী, এবং অবশ্যই বিনয়ী স্বভাবের একজন। লেখালেখির সাথে জড়িত, যারাই লেখালেখির সাথে জড়িত থাকেন, তাদের প্রতি একধরনের সম্ভ্রমবোধ কাজ করে থাকে। রনি সাহেব নিজ হাতে কাউকে পেটাবেন বিশ্বাস হতে চায়না, উনিও বলেছেন, উনি সাংবাদিকের গায়ে হাত তোলেননি। উনি ভদ্র এবং বিনয়ী বলেই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন, ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছেন।

আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি, কোন ভরসায় অথবা কোন যুক্তিতে গোলাম মাওলা রনি হঠাৎ করেই দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে নাম ধরে ধরে সমালোচনা করতে শুরু করেছিলেন? আওয়ামীলীগের সমালোচনা করার জন্য রনি সাহেবের কতটুকু প্রয়োজন ছিল? সমালোচনা করার মানুষের কি অভাব? আসলে, আওয়ামীলীগের এখন দুঃসময়, কাকেও ঠোকড়ায়, কোকিলেও ঠোকড়ায়। বিপক্ষ শক্তিও হুঙ্কার ছাড়ে, নিজ দলের সদস্যরাও লাগামছাড়া আচরণ করে। রনি সাহেব দলের যে ব্যক্তিটির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন, সেই ব্যক্তিটি কি দলের কারো কাছে অপরিচিত কেউ? সারা দেশের মানুষ তাকে জানে, তাকে চেনে, দলের নেতা নেত্রীরাও চেনে, তার বিরুদ্ধে নামার আগে রনি সাহেব নিজের শক্তি সম্পর্কে কতটুকু অবহিত ছিলেন? উনি কি জানতেননা যে প্রতিশোধ নেয়ার আকাংক্ষায় তার বিপক্ষ শক্তিটি নানাভাবে তাকে পরাস্ত করতে চাইবে? তাকে উস্কে দিতে চাইবে বিতর্কিত কাজ করার জন্য? মাত্র দুই দিন আগেই তো রনি সাহেব লিখেছেন, তার পেছন পেছন সাংবাদিক, লাঠিয়াল বাহিনী ঘুরে, তার অফিস, বাড়ী সর্বত্র তাদের চলাফেরা, জানি, এ এক অসহনীয় পরিস্থিতি, কিন্তু এই পরিস্থিতির দিকেই তো তাকে টেনে নিতে চেয়েছে সেই বিপক্ষ শক্তি। সাংবাদিকরা তার অফিসে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করেছে, রনি সাহেব একজন এমপি হয়ে পুলিশের সাহায্য নিলেননা, আইন নিজের হাতে তুলে নিতে গেলেন। দূর্ণাম কার হলো? আপনার দূর্ণাম তো হলোই, সাথে সাথে দলেরও দূর্ণাম হয়ে গেলো, ইচ্ছে করেই যেন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের হাতে হাতিয়ার তুলে দিলেন।
2Like · · Promote ·
ভেন্যুঃ উত্তমের বন্ধুর বাড়ী, ওয়াচিংঃ মুঘল-ই-আজম
উত্তম এবং তার বন্ধু মধুবালা'র রূপে গুণে মুগ্ধ!
উত্তম কুমারের দীর্ঘশ্বাসঃ " কিশোর কুমার সবচেয়ে ভাগ্যবান পুরুষ, চার ডাকসাইটে সুন্দরী তার গলায় মালা দিয়েছে!!!" বন্ধু মাথা দুলিয়ে সমর্থণ দিয়েছে।
আমি হাসতে হাসতে বলি, তুমিও ভাগ্যবান, নাহলে কিশোর কুমার যদি আর দশ বছর বেশী বাঁচতো, তাহলে তোমার কপালে এক সুন্দরীর মালাও জুটতোনা, পাঁচ নাম্বার মালা পেয়ে কিশোর কুমার বিশ্ব রেকর্ড করে ফেলতো!
Like · · Promote ·
এতিম

আমি ওয়ালমার্টের যে সেকশানে কর্মরত আছি, সেই কানেকশান সেন্টারের পাশেই 'ফেব্রিক সেকশান, মানে থান কাপড়, সেলাই মেশিন, সুঁই সূতো, বোতাম, সেফটিপিন, লেইস থেকে শুরু করে সেলাই জগতের যাবতীয় জিনিস যেখানে বিক্রী হয়। এই সেকশানে যে মহিলাটি প্রধান এসোসিয়েট হিসেবে কর্মরত আছে, তার নাম ম্যারী অ্যান।
ম্যারী অ্যান ওয়ালমার্টে প্রায় ২৩ বছর ধরে চাকরী করছে। সে হোয়াইট, বয়স ৬০ এর কাছাকাছি। আমি খুব মিশুক স্বভাবের নই, বিশেষ করে বাইরের জগতে গেলে সব সময় চুপচাপ থাকি, নিজের অজান্তেই স্বভাবে কেমন যেন সংকুচিত ভাব প্রকট হয়ে উঠে। কিসের জন্য সংকোচ, কার জন্য সংকোচ, তা জানিনা। সহজে কারো সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতে পারিনা, তবে একটি জিনিস পারি, চুপচাপ আশপাশের প্রতিটি জিনিস খুব নজর নিয়ে দেখি। আমার অবজার্ভেশান ক্ষমতা মোটামুটি ভাল। এই অবজার্ভেশান ক্ষমতা দিয়েই একেকটি মানুষকে বিচার করতে চেষ্টা করি। চেষ্টায় সব সময় সঠিক ফল পাইনা, ভুল হয়, তাই বলে নতুন কোন ভুল করা থেকে বিরত থাকিনা।

ম্যারী অ্যানকে দেখেও নিজের মনে একটি ধারণা তৈরী করে নিয়েছিলাম। ধারণা কি তৈরী করেছিলাম, সেটা এখন আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। ম্যারী অ্যান ওবিস, মানে বিশাল মোটা। মোটার চোটে তার মাথা আর ঘাড় আলাদা করে দেখা যায়না, থুতনীর নিচ থেকে বিশালা থলথলে চামড়া বুকের উপর নেমে এসেছে, গলা ঢাকা পড়ে গেছে। ম্যারী অ্যানের ভুঁড়ি বলে আলাদা কিছু নেই। কার্টুনে অনেক সময় মোটা মানুষকে যেভাবে আঁকা হয়, ম্যারীঅ্যানকে দেখতে তেমনই লাগে। বাড়তি হিসেবে যেটুকু দেখা যায়, তা হচ্ছে পেটের নীচের দিক থেকে অতিরিক্ত কিছু অংশ ঝোলা ব্যাগের ন্যায় ঝুলে থাকে। মিসিসিপিকে এইজন্যই ওবিসের স্বর্গ রাজ্য বলা হয়।

ম্যারীঅ্যানকে মাঝে মাঝেই দেখতাম টি-রুমে, বিশাল সাইজের এক কাঁচের বোতলে করে আইস টি নিয়ে বসা অবস্থায়, এমনিতেই সে সারাক্ষণ হাপুস হাপুস করে শ্বাস ফেলে, কিন্তু তার খাবারের দিকে তাকালে মনে হয়না যে সে খুব বেশী কিছু খায়। ঐ কাঁচের বোতল থেকে চুমুক দিয়ে আইস টি খায়, এই দৃশ্যটি আমার খুব ভালো লাগে। তাকে টিরুমে দেখতে পেলেই আমার ভালো লাগতো, একজন বয়স্ক মানুষ কিরকম করে হাপুস হাপুস করে শীতল চা খাচ্ছে, আর কারো ভালো লাগতো কিনা জানিনা, আমার ভালো লাগতো। একটু একটু করে আলাপ করা শুরু করলাম। টেবিলে ম্যারী অ্যানদের একটা দল ছিল, চার সদস্যের, প্রাণের বন্ধু তারা। তাদের মধ্যে দুইজন আমাকে খুব স্নেহ করতো, দুজনেই অন্য স্টোরে চলে গেছে। ম্যারীঅ্যান রয়ে গেছে। প্রথমদিকে ভেবেছিলাম, এই বিশালাকায়াকে নিশ্চয়ই কেউ বিয়ে করেনি। অবাক হয়ে জানলাম, তার বিয়ে হয়েছে, স্বামী, সন্তান, শাশুড়ী, দেওর, ননদ সহ সকলেই তাকে ভালোবাসে। সেও শাশুড়ীর যত্ন নেয়, ছেলেমেয়েকে মানুষ করে।

প্রায় পাঁচ বছর আগের কথা। ম্যারীঅ্যান কাজে আসেনা, ভেবেছি হয়তো চাকরী ছেড়ে চলে গেছে। একদিন একটি মোটা তরুণী আমার সেকশানে এলো ফোন সার্ভিস রিনিউ করাতে। আমি করে দিলাম, তথ্য নেয়ার সময় দেখি ম্যারীঅ্যানের নাম, ওয়ালমার্টের ঠিকানা। বললাম, "তুমি তার মেয়ে? তোমার চেহারাও তোমার মায়ের মত। তোমার মা কেমন আছে?"
মেয়েতি বললো, " মা, এখন হসপিটালেই আছে, রিকভার করতে সময় লাগবে"। " হাসপাতালে কেন? কি হয়েছে তোমার মায়ের?"
"কোলন ক্যানসার। সার্জারী হয়েছে, প্রে করো মায়ের জন্য"।
আমার বুকটাতে মোচড় দিয়ে উঠলো, ছোটবেলা থেকেই 'ক্যান্সারে' আমার খুব ভয়। কারো ক্যান্সার হয়েছে শুনলেই মনে হয়, আমারও ক্যান্সার হয়নিতো? কিভাবে বুঝবো ক্যান্সার হয়েছে কিনা"?

অনেক দিন পর ম্যারীঅ্যানকে আবার আমার পাশের ডিপার্টমেন্টে দেখে কি যে খুশী হয়েছিলাম, সেই থেকে তাকে একটু বেশী ভালোবাসার চোখে দেখতে শুরু করি। সেলাই ডিপার্টমেন্টে কাস্টমার লেগেই থাকে, মাঝে মাঝে ম্যানেজয়ারদের কাজ হয়ে দাঁড়ায় একে তাকে ধরে এনে ম্যারীঅ্যানের পাশে দাঁড় করিয়ে দেয়া, তাকে সাহায্য করা। আমি একদিন ম্যারীঅ্যানের কাছ থেকে কাপড় কাটা এবং মূল্য নির্ধারণ করার কাজ শিখে নিলাম। মাঝে মাঝে আমি ঐ ডিপার্টমেন্টে গিয়ে সাহায্য করে দেই। ম্যারীঅ্যান থপ থপ করে কথা বলে, আমি শুনি। কখনও তার ক্যান্সার নিয়ে কোন প্রশ্ন করিনা।

আজ আমার মনটা আবার খুব খারাপ ছিল। সেই একই কারণে, ক্যান্সারাক্রান্ত জুলাইয়ের কারণে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আড়ালে চোখ ভিজে উঠে, চোখের পাতা ঘন ঘন ফেলতে থাকি, চোখের জল শুকিয়ে যায়। হঠাত দেখি, কাস্টমার দাঁড়িয়ে আছে ফেব্রিক টেবিলের পাশে। ম্যারীঅ্যান নেই, আমি গিয়ে কাপড় কেটে দিলাম কাস্টমারকে, পেছন থেকে হাপুস হাপুস করে ম্যারীঅ্যান এসে উপস্থিত হলো। আমার তখন সারামন ক্যান্সারের বিষাদে মাখামাখি, মায়ের মুখ ভুলতেই পারিনা। ম্যারীঅ্যান কত ভাগ্যবতী, কোলন ক্যান্সারে হুমায়ুন আহমেদ মারা গেলো আর ম্যারী অ্যান দিব্বি বেঁচেবর্তে আছে, স্বাভাবিক কাজকর্ম করছে। জিজ্ঞেস করলাম, অপারেশানের পর তো অনেকদিন হয়ে গেলো, তুমি কেমন আছো? সে বলে, " ভালো আছি। বছরে দুইবার চেক আপ করাই, এই জানুয়ারীতেই কোলনে পলিপ পাওয়া গেছে, অপারেশান করে ফেলেছে।
বললাম, আমার ক্যান্সারে খুব ভয়। তোমাকে দেখে ভালো লাগে, তুমি ক্যান্সারকে জয় করেছো। আমার মা জয় করতে পারেনি, ধরা পড়ার সাথে সাথেই শেষ"।
-আমিও শেষ হয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু আমি শেষ হইনি, আমার মা শেষ হয়ে গেছে।
-তাই নাকি? তোমার মা ক্যান্সারেই মারা গেছেন।
-হ্যাঁ, পাঁচ বছর আগে আমার যখন সার্জারী হয়, আমার মা আমাকে সেবা যত্ন করে ভালো করে তুলেছিল। কিন্তু তার পরের বছর আমার মায়ের ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়ার তিন সপ্তাহের মাথায় মা মারা যায়। এই কথা বলে ম্যারীঅ্যান হু হু করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।

আমি তো আগে থেকেই কাঁদছিলাম, এবার সাথী পেলাম ম্যারীঅ্যানকে। দু'জনে মিলে হাসলে হাসি বাড়তেই থাকে, কান্নার বেলায় উলটো। দুজনে মিলে কাঁদলে কান্না থেমে আসে। আমাদের কান্না থামছিলনা, মাতৃহারা দুই নারী অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছি। আমি মনে মনে ভাবি, ষাট বছরের মহিলা কেন এভাবে কাঁদে? তাঁর মা মারা গেছেন বিরাশী বছর বয়সে, ব্রেস্ট ক্যান্সারে, বিশ্বাস করা যায়? আমার মা মারা গেছেন পঁচাত্তর বছর বয়সে ইউটেরাইন ক্যানসারে। ইস! নারীর এই দুটি অঙ্গই এক সময় অকেজো হয়ে যায়, আর সেই অকেজো অঙ্গে এসে বাসা বাঁধে ক্যান্সার! এই কথাগুলো বলছিলাম, বলতে বলতেই জানলাম, তার মা বছরে দুইবার ডাক্তারের কাছে যেত, ডাক্তার কখনও বুড়ীর ব্রেস্ট ম্যামোগ্রাম করায়নি, প্যাপস্মিয়ার টেস্টও করায়নি। আমি তো অবাক! আমেরিকাতে এটা হয়েছে? ম্যারীঅ্যান বললো, হ্যাঁ, আমেরিকাতেই এট আহয়েছে। ৬৫ বছর বয়সের পর থেকে মা'কে পাঠাতাম ডাক্তারের কাছে, ডাক্তার কখনও স্বাস্থ্যের এই দিকটি নিয়ে চিন্তাই করেনি, তাই মা জানতেও পারেনি কিছু। আমি সারাক্ষণ এটাই ভাবি আর কেঁদে মরি।
বললাম, আমিও তো এগুলো ভেবেই কষ্ট পাই, মা পুরোপুরি সুস্থ ছিলেন, বুঝতেও পারেননি যে থলিতে তাঁর চারটি ছেলেমেয়েকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, দেহের সেই মূল্যবান অংশটিকে ক্যান্সার খেয়ে ফেলেছে। আমার মা আরও কত বছর বাঁচতে পারতো বলো!
-তোমার বাবা বেঁচে আছেন?
-হ্যাঁ, বেঁচে আছেন, কিন্তু এই বাঁচায় কোন আনন্দ নেই, সার্থকতা নেই।
-আমার বাবা বেঁচে নেই, আমার মা বেঁচে নেই, আমার একটিমাত্র ভাই ছিল, মায়ের মৃত্যুর পরের বছর সে মারা গেছে।
-কি বলো ম্যারীঅ্যান!! তোমার তো তাহলে কেউই নেই।
-আমার স্বামী আছে, সন্তান আছে, কিন্তু তারপরও আমার কেউ নেই। আমি 'এতিম'। পরিবার বলতে তো বাপ-মা, ভাই বোনকেই বুঝায়, স্বামী সন্তান তো অন্য জিনিস। আমার পরিবারের কেউ বেঁচে নেই, পেটের মধ্যে আর্টিফিশিয়্যাল মলনালী নিয়ে আমি ম্যারীঅ্যান বেঁচে আছি। প্রতি দুই মাসে দুইশত ডলার মূল্যের 'মেডিকেটেড পলিথিন ব্যাগ' কেনা লাগে, আমি তো আর স্বাভাবিকভাবে টয়লেত ব্যবহার করতে পারিনা। আমার এই ক্ষতস্থানে আমার মায়ের পরশ আছে, মা অনেক সেবা করেছিল। আমরা মা, বাবা, ভাই বোন মিলে সুখের সংসার ছিল, সেই সংসারের একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে আমি বেঁচে আছি, একেবারে এতিম হয়ে বেঁচে আছি।
1Like · · Promote ·

উত্তম-সুচিত্রা জুটির ২৮ বছরের মামলাঃ--প্রথম ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ২৮ বছর আগে উত্তম সুচিত্রার মুখে চাঁদকে খুঁজছিল, ২য় ছবিতে ২৮ বছর পর উত্তম সুচিত্রাকে পাশে পেয়েও বিকেলের আকাশে চাঁদ খুঁজছে।
৩য় ছবিতে, ২৮ বছর আগে উত্তমকে পাশে পেয়ে সুচিত্রা বত্রিশ দন্ত বিকশিত হাসি দিয়েছিল, ৪র্থ ছবিতে ২৮ বছর পরেও সুচিত্রার মুখে বত্রিশ দন্ত হাসিই দেখা যাচ্ছে। মামলার বিষয় হচ্ছে,
সুচিত্রার বত্রিশ দন্ত বিকশিত হাসির কৃতিত্বটি কার?? উত্তমপক্ষ দাবী করেছে, "এটা উত্তম কুমারের কৃতিত্ব", সুচিত্রা পক্ষের দাবী, "এটা সুচিত্রার সর্বাবস্থায় বত্রিশ দন্ত বিকশিত হাসির কৃতিত্ব!
**এমন জটিল শুনানীর পর বিচারক 'বিব্রত' বোধ করিয়া মামলা অন্য আদালতে পাঠালেন
(4 photos)
Like · · Promote ·
ক্যান্সারাক্রান্ত জুলাই!

জুলাই মাসে আমার বিয়ে হয়েছে বলেই জুলাই মাসটি আমার কাছে অত্যন্ত স্পেশাল, খুবই আবেগময়, খুব খুব প্রিয়। জুলাইয়ের প্রতি কেন এমন ভালোলাগা? আমি কি খুব বিয়ে পাগলা মেয়ে ছিলাম যে কোন একজন উত্তম কুমার আমাকে এই মাসে বিয়ে করেছে বলে মাসটি আমার কাছে এত ইম্পর্ট্যান্ট হয়ে গেল? জানিনা, হয়তো বিয়ে পাগলাই ছিলাম, নাহলে জুলাই শুনলেই মন দ্রবীভূত হয় কেন?

গত বছর জুলাই মাসে বাংলাদেশে ছিলাম। ১৫ই জুলাই ২৭তম বিবাহবার্ষিকী উদযাপণ করলাম শুধুমাত্র ভাইদেরকে নিয়ে। ভাইদের বৌগুলোকে নিয়ে পরে আরেকবার বিবাহবার্ষিকী উদযাপণ করলাম, অবশ্য ভাইগুলোও সাথে ছিল। আমি বরাবর ভাইভক্ত, তাই ভাইদেরকে ডাবল ট্রিট করেছি। ২০১২ এর ১৫ই জুলাই পর্যন্ত ‘জুলাই মাস’ ছিল শুধুই আনন্দের, শুধুই ভালো লাগার, শুধুই বিয়ে বার্ষিকীর।

১৯শে জুলাই, ২০১২ থেকে জুলাই মাস হয়ে গেলো অন্যরকম, আনন্দের সাথে যোগ হলো ব্যথা, বেদনা, দুঃখ, হতাশা। ১৯শে জুলাই তারিখের রাত ১২টার পর থেকে এই ব্যথার শুরু। রাত বারোটার দিকে আমি ল্যাপটপে বসে বসে ঈদসংখ্যার জন্য একটি গল্প লিখছিলাম, আমার মেজো মেয়ে মিশা লাগোয়া বাথরুমে বোধ হয় ফেস ওয়াশ করছিল, মুখে সাবানের ফেনা নিয়েই অস্পষ্ট উচ্চারণে আমাকে ডেকে বললো, “মা, হুমায়ুন আহমেদ মারা গেছে”। আমি বুঝতে পারিনি, বললাম, কি হয়েছে? কে মারা গেছে? আবার বললো, ‘ হুমায়ুন আহমেদ, হুমায়ুন আহমেদ মারা গেছেন। আমাকে মেসেজ পাঠিয়ে আমার বন্ধু”।

সেই থেকে জুলাই যন্ত্রণার শুরু। হুমায়ুন আহমেদ ক্যান্সারাক্রান্ত, উনার চিকিৎসা চলছে আমেরিকার মত শক্তিশালী দেশে, হুমায়ুন আহমেদ অনেক আশাবাদী, উনি উনার ছোট ছোট লেখাগুলোতেও বলেছেন, ছোট্ট নিনিতের সান্যিধ্য উপভোগ করতে চান বলেই বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন। ছোট্ট শরীর নিয়ে উনি লড়াই ভালোই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। উনার মানসিক শক্তি দেখে মনে মনে বেশ ভরসা পেতাম, উৎসাহ পেতাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন আহমেদও হেরে গেলেন!

খুব অল্পদিনের জন্য হলেও হুমায়ুন আহমেদকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। স্বামীর সহকর্মী, স্বামীর বড় ভাই, স্বামীর বন্ধু, এই তিনটি পরিচয়ই যথেষ্ট ছিল উনাকে কাছে থেকে দেখবার জন্য। উনি আমাদের বিয়েতে এসেছিলেন, জুলাই বলে কথা, হুমায়ুন আহমেদকে আসতেই হবে, উনি আমাদের বিয়ের কার্ড করে দিয়েছিলেন, জুলাই বলে কথা, উনাকে তা করতেই হবে, উনি আমাদের প্রথম সন্তান, মৌটুসীকে দেখতে ক্লিনিকে এসেছিলেন, জুলাই দম্পতীর সন্তান বলে কথা, উনি আমাদেরকে নিজের গাড়ীতে চড়িয়ে বিটিভিতে নিয়ে গিয়েছিলেন ‘অয়োময়’ এর শ্যুটিং দেখানোর জন্য, এটাও সম্ভব হয়েছে জুলাই দম্পতী হওয়ার কারণে। এরপরেও হুমায়ুন আহমেদকে ঘিরে বেশ কিছু স্মৃতিময় ঘটনার প্রেক্ষিত তৈরী হয়েছিল, ডায়েরী লিখার অভ্যাস ছিলনা বলে কিছুই দিন তারিখ দিয়ে লিখে রাখিনি।

গত বছর দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিন পত্রিকায় আমি নিয়মিত লেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে লিখবার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম, লিখেওছিলাম। দুটি লেখাতে হুমায়ুন আহমেদকে ঘিরে কিছু স্মৃতিকথা ছাপাও হয়েছিল।

২৩শে জুলাই চলে এলাম আমেরিকাতে। সাথে নিয়ে এলাম জুলাইয়ের চিরব্যথা। গত বছর জুলাইয়ের ২৩ তারিখ সকালেই জেনে গেলাম, আমার মায়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ। ২৩শে জুলাইয়ের সকালে স্কয়্যার হাসপাতালে মা’কে নিয়ে এসেছিলাম চেক আপের জন্য, সারাদিন মা’কে অসহ্য যন্ত্রণা দিয়ে ডাক্তারের মুখ থেকে মধুবাণীটুকু শুনে এলাম। মা’কে নারায়ণগঞ্জের ট্যাক্সীতে তুলে দিয়ে নিজে উত্তরার বাসায় ফিরে এলাম। রাত একটায় প্লেনে চেপে চলে এলাম মিসিসিপিতে।

ক্যান্সারাক্রান্ত মায়ের অপারেশান জরুরী হয়ে পড়েছিল, আমরা ভাইবোনেরা দিশেহারা। কোথায় অপারেশান করালে মা সুস্থ হয়ে উঠবেন, এই নিয়ে যখন আলোচনা, আমার মা সব মুশকিল আসান করে দিলেন এই বলে,
“ কপালে মরণ থাকলে কেউ আটকাতে পারবেনা, হুমায়ুন আহমেদতো আমেরিকাতেই চিকিৎসা করালো, বলিউডের দেবানন্দও আমেরিকাতেই চিকিৎসা করালো, দুজনের কেউই তো বাঁচলোনা। কাজেই আমার অপারেশান কোথায় হবে সেইটা বড় কথা নয়, আয়ুর জোর থাকাটা আসল। আমি নারায়ণগঞ্জেই অপারেশান করাবো”। এতবড়, এমন শক্তিশালী, এমন যুক্তিবাদী কথার কাছে আমরা মাথা নোয়ালাম। মায়ের অপারেশান নারায়ণগঞ্জেই হলো। অপারেশানের পর হুমায়ুন আহমেদ যেমন বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলেন, আমার মা’ও খুব খুশী হয়েছিলেন। ক্লিনিকের বিছানায় বসে কি তড়বড় করে কথা বলছিলেন, সবাইকে কাছে ডেকে ডেকে আমার নামে বিচার দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, “মিঠু তো বলছিল, কলকাতা নিয়ে জেটে, স্কয়্যার হাসপাতালে নিয়ে যেতে, কই আমি তো এখানেই ভাল হয়ে গেলাম”।

আমার মা আর ভাল হয়ে উঠেননি। যে জুলাইয়ে মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়লো, তার আড়াই মাস পর আমার মা মৃত্যুর কাছে বশ্যতা স্বীকার করলেন। ঠিক হুমায়ুন আহমেদের মত, ঠিক দেবানন্দের মত করেই আমার মা চলে গেলেন অনন্তলোকে।

সেই থেকে জুলাই হয়ে গেলো ক্যান্সারাক্রান্ত!
1Like · · Promote ·
আমার শুভাকাংক্ষীদের জন্য সুসংবাদ!

আমার খুব ঘনিষ্ঠ জনেরা বলে, আমি নাকি সারাদিন ফেসবুকে বসে থাকি। রান্না-খাওয়া বাদ, লেখা-পড়া বাদ, গল্প লেখা বাদ দিয়ে আমি নাকি রাজনীতি নিয়ে খুব বেশী মেতে উঠেছি। তারা আরও বলে, আমি রাজনীতির 'র'-ও বুঝিনা, ['র' কিন্তু ভারতের 'র' নয়] কিন্তু রাজনীতিতে 'বিশেষজ্ঞ' ভাব দেখাই। তারা অবশ্য পুরোপুরি ভুল বলেনা, রাজনীতির 'র' বুঝিনা, এটা ঠিক আছে, কিন্তু রাজনীতিতে 'বিশেষজ্ঞ' ভাব দেখাই, এটা ঠিক নয়। অবশ্য তারা আমার শুভাকাংক্ষী বলেই হয়তো আমাকে এভাবে তিরস্কার করে। তাদের আশা ছিল, আমি গল্প-উপন্যাস লিখে 'আশাপূর্ণা দেবী' হয়ে যাব। বাস্তবে আমার কর্মকান্ডে তারা হতাশ হয়ে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে[ পুরোপুরি না]।

***আমার হিতাকাংক্ষীদের জন্য সুখবরঃ *** আমি রাজনীতি করতে করতেও 'গল্পকবিতাডটকম' এ প্রতিমাসে একটি করে গল্প লিখে যাচ্ছি। দুই দিন আগেই জানলাম, আমার লেখা গল্প 'গভীর গোপন' জুন মাসের প্রতিযোগীতায় 'তৃতীয় স্থান' পেয়েছে। এর আগে জানুয়ারী এবং ফেব্রুয়ারী মাসের পুরস্কারও পেয়েছিলাম, পর পর দুই মাস পুরস্কার পাওয়ায় ওয়েব সাইটের নিয়মানুযায়ী পরের চার মাস আমি প্রতিযোগীতায় থাকতে পারিনি, চারমাস পরেই আবার এই পুরস্কার, অর্থাৎ আমি ট্র্যাকে আছি। অবশ্য আগামী দুই মাস প্রতিযোগীতায় থাকতে পারবোনা, কিন্তু গল্প লিখে যাব। --- কি শুভাকাংক্ষীরা, খুশী তো? এখন থেকে আমার উপর ভরসা রাখতে পারো।
1Like · · Promote ·






  1. আজ সারাদিনে বেশ কয়েকবার টিভির সামনে বসেছিলাম। দু'জন সুখী চেহারার মানুষ দেখলাম, একজনের মুখে দেখলাম বাঁকা ঠোঁটের প্র্ত্যয়ী হাসি, কন্ঠে ছিল শত্রুর গোলপোস্টে পাঁচ গোল দেয়ার অহংকার, এবং ভবিষ্যতে শত গোল দেওয়ার দৃপ্ত অঙ্গীকার!
    আরেকজনের মুখে দেখলাম বিনয়ের আড়ালে ' এইবার তোমারে বাগে পাইছি' টাইপ লটারী জেতা হাসি, কন্ঠে ছিল 'হা রে রে রে' উচ্চারণ ' আমাকে বলে ঘুষখোর, কতবড় দুঃসাহস তাহার, সে ভুলেই গেছে আমার হাতে আছে ৮৫ লাখ x তাদের জীবনসঙ্গী = ১৭০ লাখ ভোটে্র চকচকে নোট। যার হাতে এত ক্ষমতা, তাকেই কিনা বলা হচ্ছে ঘুষখোর!
    ** খারাপ লাগেনি সুখী চেহারায় সুখী সংলাপ** **চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়**
  2. পাঁচ সিটি কর্পোরেশানের নির্বাচনী ফলাফল থেকে বুঝা যাচ্ছে, বাংলার জনগণ কেমন বাংলাদেশ দেখতে চায়! বাংলার জনগণের জয় হোক!!

  3. সেদিন পল্লীবন্ধু 'কবি' কাব্যিক ভাষায়, চোখ মুখ কাঁদো কাঁদো করে গণমাধ্যমে বললেন, " আমি অমুককে সমর্থণ দিলাম" আর মনে মনে বলেন " বোকা দর্শক, তুমি তো জানোনা, তলে তলে আমি আগেই বেড়া কেটে রেখেছি, হা হা হা"!
    কাটা বেড়ার কারসাজী দেখে অবাক হলাম, সাথে সাথে কবি গেয়ে উঠলেন, " আমার মতিভ্রম হয়েছিল! কী বলতে কী বলেছি, ভুল করেছি 'অমুককে' সমর্থণ দিয়ে" আর মনে মনে বলেন, " আমি কবিতা লিখি, আধুনিক কবিতা, তুমি কবিতা বুঝোনা, সেটা তোমার বেওকুফী, রবীন্দ্রযুগে পড়ে আছো, সেটাও তোমার সেকেলেপণা, তুমি কবিতা বুঝোনা, তাই বলে কী আমি কবিতা লিখবোনা"?
    1Like · · Promote ·
  4. কবি বলিয়াছেন,
    নারী, তুমি অন্তরের জীব, অন্দরের শোভা!
    নারী, তুমি গোলাপের মত সুন্দর, তুমি ঘরের শোভা!
    নারী, তুমি তেঁতুলের মত টক, তুমি আচারের বোয়ামের শোভা!

  5. Rita Roy Mithu

  6. CAST AWAY দেখলাম কাল রাতে, আজ বিকেলে দেখলাম, তিতলী!
    অনেকদিন পর পারিবারিক আবহে সময় কাটছে!
    যে উত্তম বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কোন মন্তব্য করে না, টিভিতে বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তির মুখে বর্তমান সরকারের পদত্যাগের জোর দাবী শুনে সেও দেখছি তাদের দাবীর বিরুদ্ধে তীব্র মন্তব্য করে ফেলছে! আমি তো অবাক হচ্ছি, আরে উত্তম কুমার কবে থেকে এমন রাজনীতি সচেতন হয়ে গেল!!
  7. সীক কল এবং রিল্যাক্স!

    পিসীর বাড়ীতে আজ চতুর্থ দিন। চারদিন ধরে পূর্ণ বিশ্রাম, হরেক রকমের বাহারী খাবার এবং ওয়ালমার্ট থেকে নিরাপদ দূরত্ব---------সব মিলিয়ে বিলাসী সময়।
    কথায় বলে, 'অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা'! শয়তান মস্তিষ্কে কারখানা স্থাপন করার আগেই একলাফে পিসীর রান্নাঘরে চলে গেলাম।
    মিঠু স্পেশ্যাল 'চ্যাপা শুঁটকী ভর্তা' আর বেগুণ-ঝিঙ্গে দিয়ে ইলিশ মাছের মেটে পাতুরী' রান্না করলাম।
    দুপুরে পান্তা ভাত আর...
    See More
  8. অসমাপ্ত 'রূপকথা'

    দেশ-বিদেশের নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর বিশাল গল্পভান্ডার থেকে ছোট একটি অংশ আমাদের ক্লাস ফাইভের বাংলা পাঠ্য বইয়ে সংযুক্ত ছিল। সেই ছোট অংশটুকুতে ছিল 'আফগানিস্তানের' আবদুর রহমানের গল্প[ যদি স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা না করে থাকে] । সেই ছোট অংশটুকু পড়েই আফগানিস্তান নামক একটি দেশের দারুণ মোহনীয় এক ছবি নিজের মানসপটে আঁকা হয়েছিল। স্বপ্ন দেখতাম, বড় হয়ে কোন একদিন পাহাড়ঘেরা স্বর্গীয় সুন্দর দেশ আফগানিস্তানে বেড়াতে যাব, আঙুর খাব, ফালুদা খাব, সুন্দর দেশটির চারপাশ ঘুরে বেড়াব।

    বড় হয়ে কত দেশ-বিদেশ ঘুরলাম, আরও হয়তো ঘুরবো, কিন্তু স্বপ্নের দেশ 'আফগানিস্তান' যাওয়া হবেনা। আফগানিস্তান যাব বলে শিশুমনকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম, সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবেনা, এটা কী নিজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা? নাকি আফগানিস্তানের 'আস্তিক' জনগণ এবং তারও চেয়ে বড় 'আস্তিক' শাসকগোষ্ঠী্র প্রতি অভিমান! এমন একটি সুখী সমৃদ্ধশালী দেশের কী করুণ পরিনতি! দেশটির সৌন্দর্য্য, হাজার বছরের সংস্কৃতি, স্থাপত্য, সবকিছু 'ইতিহাসের' পাতায় স্থান পেয়েছে! সেই ইতিহাসের পাতায় 'পা' দিয়ে চরম দর্পে দাঁড়িয়ে আছে কিছু ধর্মোন্মাদ!! আমি কোনদিনও যাবনা আফগানিস্তানে, কোনদিনও দেখবোনা পাহাড়ের সারি, কোনদিনও দেখা পাব না আর কোন আবদুর রহমানের, ফালুদা খেতে আফগানিস্তান যাব না, গুগুল সার্চ করে আফগানিস্তানের সোনালী অতীত পড়বো, ছবিতেই আফগানিস্তানের পাহাড় দেখবো, নিজের ঘরেই ফালুদা বানিয়ে খেয়ে নেবো।

    আমার ছোট মেয়ে মিথীলা তার দুই বছর বয়সে জন্মভূমি ছেড়ে বাবা-মায়ের সাথে পরবাসে এসেছে। ছোটবেলা থেকেই তার চোখে এঁকে দিয়েছি 'বাংলাদেশের' শ্যামল, সবুজ প্রান্তরের ছবি, লাল সবুজের মানচিত্র! ছোট মিথীলা বড় হচ্ছে, প্রায় প্রতি বছর দেশে বেড়াতে যাচ্ছে, দেশে গিয়ে মায়ের মুখ থেকে শোনা শ্যামল-সবুজ প্রান্তরের দেখা না পেলেও দেখা পায় ভালোবাসার মানুষদের, এক বুক আদর ভালোবাসা নিয়ে মায়ের সাথে ফিরে আসে ইট পাথরের নির্বান্ধব কিন্তু 'নিরাপদ', 'গনতান্ত্রিক' দেশে। নিরাপদে থেকে, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বেড়ে উঠে মিথীলা যেদিন আমার বর্তমান বয়সে পৌঁছাবে, তখন কী মিথীলা তার সন্তানের কাছে সুদূর বাংলাদেশের একদা শ্যামল-সবুজ, অসাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস শোনাবে? মিথীলা কী বলবে, " বাবুসোনা, এখন যে বাংলাদেশকে তুমি দেখছো, এটা বাংলাদেশের বর্তমান ছবি, এই বাংলাদেশ এক সময় অনেক শান্তির ছিল, মোটামুটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ছিল, বাঙ্গালীর একটি সোনালী অতীত ছিল, শিক্ষা, স্বাধীকারবোধ, সংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতার স্বাক্ষর ছিল, আর ছিল গৌরবময় '৭১! বাবুসোনা, গুগুল সার্চ করো, পেয়ে যাবে বাংলাদেশের অতীত গৌরোবোজ্জ্বল ইতিহাস! বর্তমানকে দেখে বাংলাদেশকে বিচার করোনা"। তখন কী মিথীলার বাবুসোনা বলবে, " মাম্মি, তোমার দেশের মানুষগুলো অনেক বোকা আর সেকেলে, এইজন্যই তোমার দেশের আজ এই পরিণতি!! আধুনিক মানুষ সোনালী ইতিহাসকে পাশে রেখে উজ্জ্বল সোনালী ভবিষ্যত নির্মাণ করে, তোমার দেশের মানুষ সোনালী ইতিহাসকে পাশে না রেখে বাক্সবন্দী করে ফেলেছিল, তাই তাদের বর্তমান এমন অন্ধকার, ভবিষ্যতও অন্ধকারই থাকবে যতক্ষণ না কেউ সোনালী অতীতকে 'বাক্সবন্দী' অবস্থা থেকে মুক্ত করে। ততদিন পর্যন্ত তোমাদের কাছ থেকে আমরা রূপকথার গল্প শুনেই যাব,
    "বাংলাদেশ নামে একটি সোনার দেশ ছিল, সেই দেশের চারদিকে ছিল নদ-নদী, শ্যামল সবুজ প্রান্তর, ~~~~~~~~সে দেশের মানুষ ছিল দেশপ্রেমিক, মাতৃভাষার প্রতি দায়বদ্ধ, মাতৃভূমির প্রতি নতঃশির, মানুষের অন্তর ছিল মায়ায় ভরা,~~~~~ তারপর, তারপর, তারপর অনেক কিছুই ছিলো, অনেক কিছুই হলো, সবকিছু হারালো, শেষ পর্যন্ত ~~~~~~~~~~~~
    [একটি অসমাপ্ত রূপকথা]



  1. কারো কাছ থেকে কোন হিতোপদেশ শুনতে ইচ্ছে করছেনা, রাজনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণও না, না মানেই না! আমি নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার, আমাকে প্রবাসী বলে বিদ্রুপ করেও লাভ নেই, কারণ প্রবাসে থেকেও নিজের বিচার-বুদ্ধিকে এখনও জলাঞ্জলী দেইনি, এখনও সাদাকে সাদা দেখি, কালোকে দেখি কালো! এটাই আমার নিরপেক্ষতা, এর চেয়ে বেশী নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব না।
  2. প্রবাসীর হতাশা!

    '৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় আমি থাকি ঢাকা ভুতের গলিতে। যেদিন নির্বাচন হলো, সেদিন বিকেল থেকে কত আশা নিয়ে টিভির সামনে বসেছিলাম, রাত দশটা বাজতেই মনের ভেতর আষাঢ়ের মেঘ গুরগুর করতে শুরু করেছিল, তারপর যা হওয়ার তা হয়েইছে।
    '৯৬ এর নির্বাচনের সময় দেশে ছিলামনা, ছিলাম অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণ শহরে। যেদিন নির্বাচন হলো, সেই সন্ধ্যায় মেলবোর্ণ থেকে দেশে মেজদাকে ফোন করে এক নাগাড়ে এক ঘন্টা কথা বলে শুধুই রেজাল্ট শুনেছিলাম, রেজাল্ট শুনে 'ফোন বিলে'র দুঃখ ভুলে গেছিলাম।
    ২০০১ সালের নির্বাচণের সময় ঢাকা ছিলাম, মেজদা আগেই আমাকে বলেছিল, " তুই এবার দেশে আছস, আওয়ামীলীগ হারবে। নির্বাচনের আগেই যদি তোরা আমেরিকা চলে যাইতে পারতি, তাইলে আওয়ামীলীগ জিতত"। ১লা অক্টোবার নির্বাচন হলো, ১১ই অক্টোবার আমেরিকা চলে এলাম, আওয়ামীলীগের ভরাডুবী ঘটিয়ে দিয়ে।
    ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় আমি আমেরিকাতে ছিলাম। মেজদাকে আগেই বলেছি, এইবার আওয়ামীলীগের জেতার কথা, তাইনা? মেজদা বলেছিল, " তুই দেশে নাই, আওয়ামীলীগ জিতবে"। আওয়ামীলীগ জিতলো।

    *** আমি প্রতি দুই বছরে একবার দেশে বেড়াতে যাই, ২০১২ তে গেলাম, হিসেবমত ২০১৪ সালের সামারে দেশে যাওয়ার কথা। হিসেব ঠিক ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে লেখালেখির ভুতে পেয়ে বসলো আমাকে, আগাম কিছু চিন্তা না করেই সিদ্ধান্ত নিলাম, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারীর বইমেলাতে আমি থাকবো, তাই জানুয়ারীতে দেশে যাব। এর মধ্যেই শুনতে পেলাম আগামী সংসদ নির্বাচন '১৪ এর জানুয়ারীতে হবে। এবং আওয়ামীলীগ যে পরাজিত হবে তার আগাম বার্তা এখনই পাওয়া যাচ্ছে।

    **আওয়ামীলীগের একজন শুভার্থী হিসেবে আমি কী করতে পারি? জানুয়ারীতে দেশে যাওয়ার প্রোগ্রাম বাতিল ঘোষণা করতে পারি, আমি দেশে উপস্থিত না থাকলে আওয়ামীলীগ জয়ী হয়, আমার মেজদার এই ধারণার প্রতি সম্মান রেখে আমি জানুয়ারীতে দেশে যাবনা, তাতে করে কী আওয়ামীলীগের নিষ্ক্রিয় ভোটাররা অনুতপ্ত হয়ে তার দলের প্রার্থীকে ভোট দিবে? অথবা নিজ দল ও দলের নেত্রীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে ' কী পেলাম আর কী পেলাম না" এই হিসেব করা থেকে বিরত থাকবে? নাকি তলে তলে বেড়া কাটার কাজ করেই যাবে! নিজের নাক কেটে নিজের যাত্রা ভঙ্গ বোধ হয় একমাত্র আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে দেখা যায়!
    Like · · Promote ·
    • Md M Rahman এদেশের মানুষ তাজা ক্ষত মনে রাখে...পুরানো ক্ষত ভুলে যায় বা মাফ করে দেয়...তাই মান্নানের মতো হজ্বের টাকা লুটেরাকেও ভোট দিয়ে জয়ী করেছে... আসলে তাদের ভোটটা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে পাওয়া তাজা ক্ষতের প্রতিবাদ ছাড়া অন্যকিছু আমি মনে করি না...যত যুক্তি দ্বাড় করানো...See More
    • Mohon Kumar Mondal দয়া করে ঐ সময় আসবেন না দিদি। আমি বইমেলা কর্তৃপক্ষকে অনুরাধ করবো....
    • Jitendra Acharjya অনেক বেশী আবেগ দিয়ে লিখা আওয়ামি রাজনীতির জন্য । একগুয়ে ক্ষমতালিপ্সু নেতারা কি অনুধাবন করতে পারবে সাধারন এক নাগরিক নিস্বাথভাবে কতটা ভালবাসে লীগকে ।
    • Mir Monaz Haque এবার আপনি দেশে না গেলেও আওয়ামীলীগ হারবে, তবে নির্বাচন সুষ্ঠ হবে "কেয়ার টেকার সরকার " দরকার নেই, যেটা আওয়ামীলীগ বার বার জোর গলায় বলছে । ভাবছেন তাতে যারা যুধূপরাধিদের বিচার চায় তাদের কি লাভ? হাঁ লাভ আছে বৈকি কারণ প্রধান মন্ত্রী অনেকবারই বলেছেন যে "স্বাধ...See More
  3. ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু, পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু!
    এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু, পিছনপানে তাকাই যদি কভু!
    দিনের তাপে রৌদ্রল্বালায়, শুকায় মালা পূজার থালায়
    সেই ম্লানতা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু!!!
    Like · · Promote ·
  4. মুনতাসীর মামুন ঠিকই বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু অনিচ্ছুক একটি জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন।
  5. মনের প্রথম অংশ বলে, " খেলাতে জয় পরাজয় থাকবেই, ফলাফল মেনে নিতে চাই"
    মনের দ্বিতীয় অংশ বলে, " আমি জয়ই চাই"
    মনের তৃতীয় অংশ বলে, " পরাজয় মেনে নেয়ার মত সাহস নাই"
    মনের চতুর্থ অংশ বলে, " কী আছে জীবনে, জিতলেই কী আর হারলেই বা কী! বেঁচে থাকাটাই বড় কথা"
    মনের চারটি অংশের এই টানাপোড়েনে অজানা অংশটুকু কিছুই বলতে চায়না, এই অজানা অংশের নীরবতাকেই সবচেয়ে বড় ভয়! এই অজানা অংশটুকুই নির্ধারণ করবে, বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ভাববার মত সময় বা ইচ্ছে অবশিষ্ট থাকবে কিনা!
  6. জয় বা পরাজয়, যে কোনটাতেই আছি, জয়ী হলে বুঝবো পরিশ্রম সার্থক হয়েছে, পরাজিত হলে বুঝবো চেষ্টায় ত্রুটি ছিলোনা, ~~~~~~
    সো~~~~~~~~~~~~~~~ সৎ মানুষের জয় হোক, সততার জয় হোক!!!!!!
    রেডী, গেট সেট, গো~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
    Like · · Promote ·
  7. 'যত দোষ নন্দ ঘোষ"!

    আওয়ামীলীগ ডানে হাঁটলেও দোষ, বামে হাঁটলেও দোষ, আওয়ামী লীগ চার সিটি কর্পোরেশান নির্বাচনে হেরে যাওয়াতেও দোষ, যদি জিতে যেত সেটাতেও হতো দোষ। সিটি কর্পোরেশান নির্বাচনী প্রচারে নেতারা যাননি বলেও সেটা ছিল দোষ, গাজীপুর নির্বাচনী প্রচারে নেতারা গেছেন, সেটাতেও হয়েছে দোষ, মহাজোটের অংশীদার এরশাদ সাহেব আওয়ামী প্রার্থীকে সমর্থণ দিতে দেরী করেছেন, সেটাতেও আওয়ামী লীগের দোষ [এরশাদ সাহেবকে নাকি মূল্যায়ন করা হয়নি], নির্বাচনী প্রচার শেষে এরশাদ সাহেব সমর্থণ দিছেন, এটাতেও নাকি আওয়ামীলীগের দোষ [মুসা সাহেবের মত আরেকজন বঙ্গবন্ধুপ্রেমী বলেছেন, দেশের মানুষ নাকি অবুঝ নয়, কী চাপে পড়ে এরশাদ সাহেব গাজীপুর প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে আওয়ামীলীগকে 'ধন্য' করেছে, তা নাকি ঠিকই বুঝেছে]।
    ** এরেই বলে, " যত দোষ নন্দ ঘোষ"!**
    ** যারা এই মুহূর্তে 'গাজীপুর নির্বাচন নিয়ে প্রচারকে কেন্দ্র করে আওয়ামীলীগ নেতা, কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমকে কটাক্ষ করছেন, যারা একজন বঙ্গবন্ধুর জন্য নিবেদিতপ্রাণ তোফায়েল আহমেদের সমালোচনা করছেন, তারা যখন 'বঙ্গবন্ধু' বলে হেঁচকী তুলে কাঁদেন আর বঙ্গবন্ধুর কন্যার পরাজয়ের স্বপ্নে বিভোর থাকেন, তাদের অভিপ্রায়ও কিন্তু 'বুঝদার জনগণ' ঠিকই বুঝতে পারছে!

    *গাজীপুরের জনগণ যাঁকে তাদের নেতা হিসেবে চাইবে, তিনিই জয়ী হবেন। সরকারে আছেন বলে নিজেদের প্রার্থীর জন্য আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মীরা প্রচার চালাবেনা, 'বঙ্গবন্ধুপ্রেমীদের এমন আবদার শুনলে মনে হয় উনারা যেন মামার বাড়ীতে বেড়াতে এসেছেন, মামার কাছে আবদার করছেন, হাহ!!!এটা কী সত্যিই মামার বাড়ীর আবদার নাকি? কত রকম কথা তারা বলছেন, এমনও বলছেন, গাজীপুরেও আওয়ামী প্রার্থী হারবে।
    হারবে তো হারবে, সব খেলাতে জয় অথবা পরাজয়, এই দুইয়ের বাইরে তো কিছু নেই , হোক না পরাজয়, সমস্যা কি!!!!!!

    **সৎ কাজে হেরেও সুখ! জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু!**
    11Like · · Promote ·
    • Sagar Dey দিদি, দেখে খুব ভালো লাগলো যে আপনি শেষ করলেন 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' দিয়ে।
    • Rajib Bangalee জয় বাংলার, বাংলার জয়, হবে হবে হবেই নিশ্চয়........
    • Chowdhury Abdul এভাবেই পরাজিত হবে। হচ্ছে। কারণ যুদ্ধাপরাধিদের বিচার নিয়ে সরকার তামাশা শুরু করেছে। আপিল বিভাগে শুনানিতে সরকারের আেইনজীবী যান প্রস্তুতি না নিয়ে। বলেন, স্যার আমি প্রস্তুত নই। বেশ ভাল। গোলাম আযামের বিচারের রায় ২মাস হয়ে গেলো কিন্তু কোন খবর নেই। মনে হয় ভুলে ...See More
  8. লিমনকে মুক্তি দেয়া হোক!

    বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের অত্যন্ত স্নেহ ও আস্থাভাজন , বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর কন্যার কঠোর সমালোচনাকারী প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মুসা সাহেব বলেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে উনি ভোটে দাঁড়াবেন, নির্বাচন কমিশনের কাছে 'লিমনের কাটা পা' প্রতীক হিসেবে চাইবেন, এবং সেই প্রতীক নিয়ে ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে যাবেন। কাজটি উনি করবেন লিমনকে ভালোবেসে না, আওয়ামীলীগকে একটা 'থ্যাতনা' দেয়ার জন্য। উনি জানেন, 'লিমন ইস্যু'টি আওয়ামীলীগের জন্য স্পর্শকাতর।
    গতকাল থেকে যে সংবাদটি আমাকে ভীষণভাবে কষ্ট দিচ্ছে, তা হচ্ছে লিমনকে গ্রেফতারের সংবাদ। মাননীয় সরকারের কিছু কিছু কাজকর্ম মাঝে মাঝেই আমাদের মত দুই পয়সা দামের শুভার্থীদেরকে মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করে দিচ্ছে! আমরা আমাদের শত শত সদিচ্ছা দিয়েও এই কয়েকটি 'অণর্থক অঘটনের' কালো অশুভ ছায়াকে ঢাকা দিতে পারছিনা।
    ** শারীরিকভাবে পঙ্গু লিমনকে মুক্তি দেয়া হোক, নাহলে মুসা সাহেবের মত আরও অনেকেই লিমনের কাটা পা', নাহলে সাগর-রুনীকে পুঁজি করে আওয়ামীলীগের বারোটা বাজানোর জন্য দৌড়ে আসবে! প্লীজ! সাগর রুনীকে ফিরিয়ে আনা যাবেনা, কিন্তু লিমনকে জেলগেট থেকে ফিরিয়ে এনে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়া হো--- ক!


আচ্ছা! নাহয় যাত্রাটুকুই শুভ হোক!

ঈশ্বর কেন আমাকে এত সহ্যশক্তি, এত ধৈর্য্যশক্তি দিয়েছেন!! আমার মত সাধারণ এক মানুষের জীবন -যাপন করতে এত ধৈর্য্যের প্রয়োজন নেই তো, ঈশ্বর অপাত্রে দান করতে ভালোবাসেন।

পিসীর কাছে বেড়াতে যাব বলে 'ছুটি ছুটি' করে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছি, ওরা ওদের 'জাতবোন, সবর্ণ বোনকে ছুটি দিল, তবু আমাকে দিলনা। এরপরও আমি হাসিমুখে কাজ করে যাই। যে চারদিন রেগুলার ছুটি আছে, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট আছি। আমার মেয়েরা আমাকে বর্ণবাদী বলে, ওদেরকে যদি দেখাতে পারতাম, বর্ণবাদী কেউ কারো চেয়ে কম নয়, তাহলে হয়তো অরা আমাকে আর বর্ণবাদী বলতোনা। এসবই আমি হাসিমুখে সয়ে নেই শুধুমাত্র প্রয়োজনের অতিরিক্ত সহ্যশক্তি আছে বলে।

ফেসবুকে আমার হাতে বানানো 'রসগোল্লার ছবি দেখে পিসী ফোনে বলেছে, " আমরা যখন গেলাম, তখন তো এত ভাল মিষ্টি বানাস নাই, এখন এত ভাল রসগোল্লা বানাইতেছস আর ফেসবুকে ছবি দিতেছস"। পিসীর কথা শোনার পর আমি আজ কর যত্ন করে রসগোল্লা বানালাম, তারপর ওয়ালমার্টে গেলাম, রসগোল্লাটা যেন আরেকটু ভাল হয় খেতে তাই মিথীলাকে ফোন করে বললাম, " মিথ, চূলাটা অন করো, ঘড়ি দেখে ২০ মিনিট রসগোল্লা ফুটাও, তারপর চূলা অফ করে দাও। কি বলেছি, বুঝতে পেরেছো? ভুলে যাবেনা তো? এক কাজ করো, তুমি আপাতত নীচে থাকো, চূলা অফ করে উপরে যেও। ভুলে যেওনা, তাহলে সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যাবে। রাত দশটায় বাড়ী ফিরে টেবিলের উপর 'লাল মিষ্টি' দেখে উত্তম কুমারকে জিজ্ঞেস করি, এই লাল মিষ্টি কোথা থেকে এলো? উত্তম বলে, গুড্ডু বানিয়েছে। আমি ত অবাক, আমি 'গোলাপজাম' বানাবো বলে ছানা মেখে রেখে গেছিলাম। গোলাপজাম বানানো তো অত সহজ নয় যে মিথীলা বানাতে পারবে। চোখ আটকে গেল বড় সসপ্যানের দিকে, চিনির সিরা পুড়ে আঠা হয়ে আছে। আমার বোধ ফিরে এলো, জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কি 'রসগোল্লা? উত্তম বলল, হ্যাঁ, আমি বাইরে গেছিলাম, ঘরে ফিরে দেখি গন্ধ বের হচ্ছে, তাকিয়ে দেখি রসগোল্লা শুকাচ্ছে চূলায়। আমার মাথা চক্কর দিলো, কত কষ্ট করে, কত আশা নিয়ে রসগোল্লাগুলো বানিয়েছিলাম, মিথীলাকে কত ভালোবাসি, শেষ পর্যন্ত মিথীলার হাতেই এই সর্বনাশ। উত্তম বলে, থাক, চমচমের মত খাওয়া যাবে। আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে হলোনা। উপরে গিয়ে মিথীলাকে শুধু বললাম, কেন এই সর্বনাশ করলে? আমি কত কষ্ট করে বানিয়েছিলাম, আমি ফোনে তোমাকে বললাম যেন পুড়ে না যায়, যেন ভুলে না যাও, আর তুমি সব ভুলে বসে রইলে? বলেই আমি হাউ মাউ করে কান্না শুরু করলাম। আসলে আমার সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে। আমি অতিরিক্ত সহ্যশক্তি পেয়েছি বলেই সব সময় হাসি, কাউকেই মন্দ কথা বলিনা, মিথীলাকে হাতের কাছে পেয়েও ছেড়ে দিলাম। শুধু বললাম, " আজ থেকে তোমার সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই। "

রসগোল্লা নামের এই আজব জিনিসটি পিসীর ওখানে নেয়ার প্রশ্নই আসেনা, 'গোলাপজাম' বানাবো বলে যে ছানার ডো করে রেখে গেছিলাম, সেটাও বক্সে করে ফ্রীজে তুলে রাখলাম। কিছু ভাল লাগছেনা, মনে মনে ঠিক করেছি, পিসীর ওখানে গিয়েই মিষ্টি বানাবো।

ফেসবুকে ঢুকেছি, চারটি মেসেজ দেখে বক্স ওপেন করতেই আমাকে 'আনফ্রেন্ড' করে দেয়া বন্ধুর মেসেজ পেলাম। শুরুতেই বলা আছে, মেসেজ লেখক বন্ধু নয়, বন্ধুর স্বামী এবং আমাকে 'আনফ্রেন্ড' করার কাজটি সে করেছে। কেন করেছে তার একটি কৈফিয়ত দিয়েছে। তার কৈফিয়ত যা দেয়ার দিয়েছে, কিন্তু তার অভিযোগ পড়ে মন খারাপ হয়নি, মন খারাপ হয়েছে বন্ধুর স্বামী তার বউয়ের একাউন্ট রেগুলেট করে, কন্ট্রোল করে, সে ডিসাইড করে তার বউ কাঁর সাথে বন্ধুত্ব রাখবে, আর কাঁর সাথে বন্ধুত্ব কেটে দিবে!
মনটা এত খারাপ হয়ে গেছে, স্বামী -স্ত্রী যতই কপোত-কপোতী হোক, তারপরেও দুজনেই আলাদা দুজন মানুষ, কিছু কিছু ব্যাপারে তো ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকা উচিত। একজন কেন অপরজনের ই-মেইল একাউন্ট, ফেসবুক একাউন্ট ব্যবহার করবে? এমন ঘটনা ইদানিং অনেক ক্ষেত্রেই ঘটছে। কিন্তু কেন? এটা কি পারস্পরিক ভালোবাসা নাকি পারস্পরিক অবিশ্বাস? ভালোবাসা যদি হয়, এমন দমবন্ধ করা ভালোবাসায় আমার কাজ নেই, অমন আত্মসম্মানবোধ জলাঞ্জলী দেয়া ভালোবাসার নিকুচি করি।

ছেলেটি ইংলিশ বয়ানে আমাকে এই বিশাল বড় কৈফিয়তনামা লিখেছে, পুরোটা কৈফিয়ত নয়, মাঝে মাঝেই ' আমি এটা চাই বলেই এটা করেছি' টাইপ কিছু বাক্য আছে। কোথাও কোথাও আবার বলা আছে, আমি যেন প্রশ্ন না করি কেন সে এগুলো করছে!!! কি কি জানি হেনো তেনো হরেক কথা। মেসেজটা পড়ে মনে হলো, ভাগ্যিস ঈশ্বর আমাকে অসীম ধৈর্য্য দিয়েছেন, সহ্যশক্তিও অসীম দিয়েছেন, তাই যার যখন ইচ্ছে হয়, আমাকে রূঢ় কথা শুনিয়ে দেয়, আমি হাসিমুখে মেনে নেই, আর হাসতে না পারলে মাথাটুকু নীচু করেই মেনে নেই। আজকেও তাই নিলাম, কারণ মনে হলো, যাক, যত খারাপ এক দিনে, একসাথেই ঘটে যাক। আগামীর দিনগুলো শুভ হোক। কাল ভোরে যাত্রা করবো, যাত্রাটকুই শুভ হোক।

ছবির দিকে তাকাই আর কাঁদি! যে রসগোল্লা হতে পারতো ১ম ছবির মত সুন্দর, সেই রসগোল্লার পরিনতি হয়েছে ২য় ছবির মত হোপলেস!
1Like · · Promote ·
একপক্ষীয় নীতি!

আমি ছোটবেলা থেকেই মায়ের মুখে স্বদেশী আন্দোলনের গল্প শুনেছি, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের কথা শুনেছি, আমি রান্নাবাটি বা পুতুলের বাক্স নিয়ে খেলার সুযোগ পাইনি, যে বয়সে মেয়েরা এগুলো নিয়ে খেলা করে, সেই বয়সটা পার করেছি দেশের চরম রাজনৈতিক অস্থিরতার ভেতর দিয়ে, এভাবেই আমার মানসিক গঠণ তৈরী হয়েছে, ছাত্র রাজনীতি করিনি, দলীয় রাজনীতি করিনি, তারপরেও নামের পেছনে উপাধী দেখেই বন্ধুরা জোর করেই আমাকে 'নৌকার' সমর্থক বলে দাবী করতো।
এমনকী হালে, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ব্লগে লিখতে গিয়ে 'আওয়ামীলীগের দালাল' গালি পেয়েছি। অথচ বঙ্গবন্ধু বিনে 'বাংলাদেশ' চিন্তাই করা যায়না, অন্ততঃপক্ষে কোন সত্যিকারের দেশপ্রেমিকের পক্ষে তা সম্ভব না।

***কাজেই আমি নই, আমার বন্ধুরা, ব্লগের কিছু পাঠক এবং লেখক, আমার দেশের একটি গোষ্ঠী আমাকে একটি পক্ষ অবলম্বন করতে বাধ্য করেছে। ***

প্রতিটি প্রাণী বেঁচে থাকার তাগিদে কিছু একটা খড়কূটো হলেও অবলম্বন হিসেবে ধরতে চায়। আমাদের মত 'জোর করে চাপিয়ে দেয়া রাজনীতির শিকার' মানুষগুলো বাধ্য হয়ে 'খড়কূটো' জেনেও একটি পক্ষকে অবলম্বন করেছি। জানি, যে পক্ষ অবলম্বন করেছি, সেটাও কোন 'আদর্শপূর্ণ' পক্ষ নয়, কিন্তু কিছু তো করার নেই, অন্যপক্ষ তো এগিয়ে আসেনি আমাকে আরও ভালো কোন পথের সন্ধান দিয়ে। আমি কোন ভরসায় সেই দ্বিতীয় পক্ষের দিকে হাত বাড়াবো। তাদের দিকে হাত বাড়াতে গেলে আমার জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্মীয় পরিচয়টিও খুলে ফেলতে হবে যে! কারণ অন্যপক্ষ তো ধর্মীয় চেতনায় আগাগোড়া মোড়ানো। যদি আমার এই ধারণার সাথে কেউ একমত না হতে পারেন, সেটা আপনার দায়িত্ব আমাকে ভরসা দেয়া, মনে সাহস দেয়া, তেমন কিছুর প্রমান দেয়া।

** আমি লেখক নই, লেখক হতে চাই, যদি সত্যিই ভালো কিছু লেখার যোগ্যতা বা ক্ষমতা আমার থাকে, এবং সেই লেখা বুঝবার মত ধৈর্য্য এবং সদিচ্ছা কারো থাকে, তারাই শেষ পর্যন্ত আমার পাশে থাকবে, বাকীরা নীরবে 'আনফ্রেন্ড' হয়ে যাবে। এই ব্যাপারটুকু আমি মেনে নিয়েছি, তাই বলে যা নিজের বিবেককে নাড়া দেয়, তা নিয়ে কথা বলবোনা শুধু পাঠক হারাণোর ভয়ে, তবে বুঝতে হবে আমি আসলে লিখতেই জানিনা। আমি ততক্ষণ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাব!

উদ্ভট উটের পিঠে চলেছি সবাই!

ফেসবুকে সট্যাটাস, ফ্রেন্ড/আনফ্রেন্ড, ব্লক করা~~~~মাঝে মাঝে মনে হয়, এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় নয়, আবার কখনও কখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলেই মনে হয়।
এগুলো দিয়ে মানুষের জীবন, মানুষের প্রকৃতি, পরিবেশ-পরিস্থিতি, অনেক কিছুর আন্দাজ পাওয়া যায়। তিনটি উদাহরণ দেইঃ আমাকে এ পর্যন্ত আমার খুব প্রিয় তিনজন মানুষ, আমাকে না জানিয়েই তাদের ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে 'আনফ্রেন্ড' করে দিয়েছে। 'কবে আনফ্রেন্ড করেছে জানতে পারিনি, অথবা খেয়াল করিনি। নানা উছিলায় ব্যাপারটি জেনেছি।

১)আমার এক কাজিনকে ভুমিকম্প হওয়ার সময় কি কি প্রিকশান নিতে হয়, তেমনই একটি লিঙ্ক পাঠাতে গিয়ে দেখি, ওর নাম কোথাও নেই। পরে দেখলাম, কাজিন আমাকে 'আনফ্রেন্ড' করে দিয়েছে। ফোন করে জেনেছি, আমি ব্লগে লেখালেখি করি বলে ও ভয় পেয়েছে, বাংলাদেশে ব্লগার মানেই তো 'নাস্তিক', নাস্তিকদের তো বাংলাদেশে জায়গা নেই, নাস্তিকের 'কাজিন' হওয়ার অপরাধে নিশচয়ই তারও ঠাঁই হবেনা কোথাও, তার চেয়ে আমাকে 'আনফ্রেন্ড' করে দেয়াটাই সর্বোত্তম পন্থা মনে হয়েছে। আমার ফোন পেয়ে অবশ্য চক্ষুলজ্জায় কাজিন আবার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে, কিন্তু আমি তাকে বলেছি, যে দেশের মানুষ, দেশের ক্রমাবনতিতে নিজের বোনের সাথে যোগাযোগ রাখতে ভয় পায়, সেই দেশে শান্তি ফিরে আসুক, তারপর ভেবে দেখবো তোর সাথে যোগাযোগ রাখবো কিনা!
**উপসংহারঃ উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ!

২) আমার এক বন্ধু, জাহাঙ্গীরনগরিয়ান, আমার সাথে ফেসবুকে দারুণ যোগাযোগ ছিল, প্রতিদিন অনলাইন চ্যাটিং হতো, জীবনের কত গল্প শেয়ার করতাম। দেশে গিয়ে ওর সাথে দেখা হলো, ও আমাকে একটি শাড়ী উপহার দিল, শাড়ী পড়ে আমি তো মহাখুশী, বন্ধুর পছন্দের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলাম। ্মা মারা গেলো, লেখালেখিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, তাই অনলাইন চ্যাটিং কমে গেলো। একদিন বন্ধুকে মনে পড়লো, ওকে একটি মেসেজ পাঠাতে গিয়ে ওর নাম আর খুঁজে পাইনা। আমি চিন্তাও করিনি, বন্ধু আমাকে 'আনফ্রেন্ড' করে দিয়েছে। তার নাম খুঁযে বের করে মেসেজ পাঠালাম, " তুমি আমাকে 'আনফ্রেন্ড করে দিয়েছো?? কিন্তু কেন?" উত্তর এলো, " একান্ত বাধ্য হয়ে তোমাকে আনফ্রেন্ড করেছি। শুধু তোমাকে নয়, সকল মেয়ে বন্ধুকে, এমনকি আমার খালাকেও। কারণ আমার বউ'কে অ্যাড করতে হয়েছে আমার ফ্রেন্ড লিস্টে! এটাই আমাদের সংসার টিকিয়ে রাখার শর্ত, বউ ছাড়া আর কোন নারী থাকবেনা আমার ফ্রেন্ড লিস্টে। বন্ধু তুমি আমাকে ই-মেইল করো, প্লীজ"।
জিজ্ঞেস করলাম, " বাঁচবে কয়দিন? সংসার কত বছরের? এত বছরেও পারস্পরিক বিশ্বাস জন্মালোনা? তাহলে আর বন্ধুত্ব করে কাজ নেই, বন্ধুত্বে আমি কোন গোপনীয়তা রাখিনা, বন্ধু সবাই হয়ওনা, তুমি আমার বন্ধু হলে আমাকে জানিয়ে তবেই আমাকে আনফ্রেন্ড করতে! তাছাড়া তোমার বউ তো একজন অধ্যাপিকা, কি শেখাচ্ছেন ছাত্রীদেরকে? যার নিজের আত্মবিশ্বাস কম, সে ছাত্রীদেরকে কি ভাবে আত্মবিশ্বাস শেখাবেন? তার ভয়ে তুমি আমাকে চোরের মত ই-মেইলে যোগাযোগ রাখতে বলছো? আমি কেন চোরের মত তোমার সাথে যোগাযোগ রাখবো? এমন প্রস্তাব দিলেইবা কীভাবে?
সে বলে, " বন্ধু, আমাকে ভুল বুঝোনা, প্লীজ, আমার সাথে যোগাযোগ ছেড়ে দিওনা"।
" আমার নিজেরই ইচ্ছে নেই এভাবে চোরের মত কোন কাজ করা। যে তার স্ত্রী বা স্বামীর কাছে নিজের স্বচ্ছতা আড়াল করে রাখে, তারা দাম্পত্য জীবনে সুখী হয়না। তোমার স্ত্রী ফার্স্ট প্রায়োরিটি, সুতরাং আপাতত বিদায়। তোমার সাথে আবার যোগাযোগ হবে যদি তোমার স্ত্রী আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। কি আশ্চর্য্য! এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও ,জীবনের মাঝপথে পৌঁছেও পারস্পরিক অবিশ্বাস, পরস্পরকে হারাণোর ভয়'!
** উপসংহারঃ উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে 'সংসার'!

৩) আমার এক বন্ধু, মিসিসিপিতেই পরিচয়, বন্ধুটি খুবই স্মার্ট, রুচিশীলা, উচ্চশিক্ষিতা, আমাকে 'দিদি' বলে ডাকতো, ফেসবুকেও যোগাযোগ ছিল। কয়েকমাস আগেও এক অনুষ্ঠানে দেখা হলো, গল্প হলো, হাসাহাসি হলো। গতমাসে লক্ষ্য করেছি, আমারই কোন একটি ছবিতে বন্ধুটির কমেন্ট এর পাশে দেখাচ্ছে মিউচ্যুয়াল ফ্রেন্ড নাম্বার, ভালো করে তাকিয়ে দেখি, ও আমাকে 'আনফ্রেন্ড' করে দিয়েছে। অবাক হয়েছি, ও তো বাংলাদেশের মেয়ে নয়, কাজেই আমার লেখালেখির কারণে ওকে কেউ 'নাস্তিক' বলবেনা, তাহলে আমাকে আনফ্রেন্ড করলে কেন? মেসেজ পাঠালাম, আমাকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছো? কেন? আমি কি নিজের অজান্তে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি মনে?" নো রিপ্লাই। আজকেই ওর আরেক বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পারলাম, আমার লেখা ওর পছন্দ হয়না, বোরিং লাগে, তাই 'আনফ্রেন্ড' করে দিয়েছে। হাসবো না কাঁদবো? আমার লেখার মান খারাপ হতে পারে, একঘেঁয়ে, ফালতু মনে হতেই পারে, ভাল না লাগলে পড়োনা, অথবা বন্ধুর ভাল চাইলে লেখায় ভুল গুলো ধরিয়ে দাও, তা না করে এমন চুপিসারে 'আনফ্রেন্ড' করে দিলে? তাও আবার এমন খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে? আবার হয়তো কোন অনুষ্ঠানে দু'জনের দেখা হয়ে যাবে। তখন কি আর বন্ধুত্বের বিশ্বাসী হাসি দিয়ে এগিয়ে আসতে পারবে আমার কাছে? যা আমার ভালোলাগা, আনন্দ, পরিশ্রম, সাধনার বিষয়, সেই লেখালেখির দোহাই দিয়ে আমাকে না-বন্ধু করে দিলে বন্ধন আর থাকলো কই?

**উপসংহারঃ উদ্ভট উটের পিঠে চলেছি সবাই



দীপ যা বলে গেলো!

৯৪ বছর বয়সে কেউ কেউ প্লেন চড়ে, হেলিকপ্টার চড়ে, ৮৬ বছর বয়সে মেকাপে কপালের বলিরেখা মুছে ফেলে, গালের চামড়ার ভাঁজ ঢেকে চুলে কলপ দিয়ে, গলায় লাল স্কার্ফ জড়িয়ে নতুন প্রিয়ার সন্ধান করে, ৬৮ বছর বয়সে কেউ কেউ রঙ বেরঙের শাড়ী পড়ে, গালে রুজ মাখে, বিউটি পার্লারে গিয়ে ফেসিয়াল করে, ৪৮ বছর বয়সে কেউ কেউ ফেসবুকে ব্যস্ত থাকে, সকলেই জীবনের রূপ-রস-গন্ধ দারুণভাবে উপভোগ করে,~~~~~~~~~~~

শুধু ২৪ বছরেই জীবন দেখা শেষ করে ফেলে রায়হান দীপ, সনি, বিশ্বজিতের মত তরুণ ছেলেমেয়েরা!! আমরা দীপের কথা ভুলে গেছিলাম, সবাই যার যার জীবন, জীবনের পাওনা আদায় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। 'নাই খবর মানেই ভাল খবর" ভেবে যখন স্বার্থ চিন্তায় ব্যস্ত, শত্রুর গলায় মালা দিতে ব্যস্ত, শত্রু শিবিরে গিয়ে ফিতে কাটায় ব্যস্ত, তখনই দীপের আত্মা দেহ থেকে বেরিয়ে অনন্তলোকে যাত্রা করলো, মাঝে একটু থেমে আমার কানের পাশে বলে গেলো, "তোমরা আনন্দ করো, পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ উপভোগ করো, প্রয়োজনে শতবর্ষ বেঁচে থেকো! হেলিকপ্টার চড়ো, প্লেন চড়ো, তামাশা দেখো! আমাকে ভুলে গেছিলে, ভুলেই যেয়ো, ভুলেই থেকো, আমি আর আসবোনা, চলে গেলাম অমৃতলোকের সন্ধানে!!"

** কিছু কিছু মৃত্যু জীবনের বোধগুলোকে ঝাঁকুনী দিয়ে যায়, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কত নিষ্ঠুর , কি নির্লজ্জ মানুষ, কত জঘন্য মানুষের সাথে মানুষের ক্ষমতার লড়াই! শেষ পর্যন্ত কেউই জয়ী হয়না, মৃত্যুর কাছে সবাইকেই হার মানতে হয়। নির্দোষকেও হার মানতে হয়, দোষীকেও হার মানতে হয়। দীপ মরে গেলো, দীপকে যে মেরে ফেললো, সে কি 'অমর' হয়ে থাকবে? সিরাজউদ্দৌলা মারা গেছে, মীরজাফর কি অমরত্ব পেয়েছে? বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হলো, খন্দকার মোশতাক কি অমরত্ব পেয়েছে? মৃত্যুই যেখানে শেষ কথা, সেখানে গায়ে পড়ে 'হন্তারক' সাজার কি প্রয়োজন? তবুও কিছু কিছু স্বার্থপর, হিংস্র মানুষ গায়ে পড়ে 'হন্তারক' সাজতে চায়!

মানবতার পতন!

ফেসবুকের হোম পেজে গেলে পত্রিকা না পড়লেও চলে। ঝড়ের গতিতে খবর প্রকাশিত হয়ে পড়ে, তবে আমার হোম পেজে খারাপ খবর আসে!
দীপকে অনেকেই ভুলে গেছে, আমিও ভুলেই গেছিলাম, আজ সকালে কোন কারণ ছাড়াই দীপের কথা মনে পড়ে গেল। তিন মাস আগে বুয়েটের হোস্টেলে ছেলেটিকে কেউ একজন কুপিয়েছিল। খুব জানতে ইচ্ছে করছিল, ছেলেটি কেমন আছে?
মাত্র দুই দিন আগেই একটি লেখা পোস্ট করেছিলাম, বুয়েটের শিক্ষকের 'হিংস্র স্ট্যাটাসের জের ধরে বিচারকের রায় প্রদানের বিষয়ে, আমার এক পুত্রকে ঊদ্দেশ্য করে লিখেছিলাম, আমার পুত্র মেসেজ পড়ে জানিয়েছে, সে আমার লেখাটি পড়ে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। অথচ ওখানে স্পষ্ট করেই লিখেছি, শিক্ষকের এমন উস্কাণীমূলক মন্তব্যে একজন ছাত্রও যদি উৎসাহিত হয়ে কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলে, তখন কি হবে?
প্রজন্ম মঞ্চ, গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে অনেক 'মহীয়ান পুরুষ, মহিয়সী নারী' নানা সময়ে নানা বিদ্রুপ করেছেন, করছেন। প্রজন্ম মঞ্চ শেষ হয়েছে, সরকারও হেরেছে সেই সকল মহীয়ান-মহীয়সীদের বিদ্রুপের কাছে! প্রজন্ম মঞ্চ ভেঙ্গে গেছে, রেখে গেছে কিছু স্মৃতি। দীপ সেই প্রজন্ম মঞ্চের এক টুকরো স্মৃতি। ঘাতক তাকে তার হলে গিয়ে কুপিয়েছিল আরও তিন মাস আগে, প্রজন্ম মঞ্চে তার সম্পৃকতা ছিল বলে। সে এমন কোপানোই ছিল, একটানা তিন মাস চিকিৎসাধীন থাকার পরেও বাঁচলোনা।

মায়ের মন বলেই কি আজ অচেনা, অদেখা এই ছেলেটির কথা এত বেশী মনে পড়ছিল। সকালে মনে পড়ছিল, কিন্তু সংবাদ জানার কোন উপায় ছিলনা, আর গভীর রাতেই হোম পেজে খবরটি পেলাম।
মুখের ভেতরটা এমন নিমতিতা লাগছে কেনো? নৈতিকতার পতন দেখে? মানবতার পতন দেখে? এ তো পরাজয়। ধীরে ধীরে সব দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হারতেই যদি হচ্ছে, তাহলে জীবনের বিনিময়ে কেন? কেন ম, খ, আলমগীরের মত ব্যাংক উদবোধন করে হারছিনা!! কেন হো মো এরশাদের মত তৃষ্ণার্তের মুখে পানি দিয়ে হারছিনা। কি বোকা এই তরুণেরা, শুধুই তাত্বিক কথা নিয়ে চাপান উতোর করে নিজের জীবনটাকেই বরবাদ করে দিল, চিরতরে।
** দীপের কথা কেন আজ এতবার মনে পড়ছিল?**

** আমার মন ভালো নেই, কেউ কোনরকম উস্কাণীমূলক বা তীর্যক মন্তব্য না করলে খুশী হবো। মানুষের জীবন সস্তা জিনিস নয় যে তাকে হারাবো আবার সাথে বিদ্রুপও সহ্য করবো। কাজেই কোন কুমন্তব্য নয়, নীরবতা প্লীজ!!



"বড়লুক বেগম সাবের বড়লুকী কান্ড"!

গরীবের সংসারে কত নারী কত অত্যাচার সয়েও জীবন কাটিয়ে দেয়, গরীবের মেয়েকে অন্যের হাতে মরতে দেখা যায়, কিন্তু আত্মহত্যা করার মত হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়না। আত্মহত্যার মত হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয় ধনী শ্রেণীর নারীরা, যাদেরকে জীবনে সত্যিকারের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, বঞ্চনা, নিপীড়ন ভোগ করতে হয়নি বা হয়না। তাই তারা জানতেও পারেনা বেঁচে থাকার মধ্যেই জীবনের মূল আনন্দ। আসলে বিলাসিতা আর প্রাচুর্য্যের আবরণে ঢাকা পড়ে যায় তাদের সাহস, আত্মবিশ্বাস, এবং জীবনকে ভালোবাসবার স্পৃহা!

অযথাই তারা স্বামী বা তেমনই কারো উপর অভিমান করে মূল্যবান জীবনটাকে ওড়নায় পেঁচিয়ে শেষ করে দেয়। কাজটি করার আগে তারা হয়তো ভাবে, ওড়না পেঁচানো মৃতদেহ দেখে পাষন্ড স্বামী কেমন ধাক্কা খায়, সেটাই আড়াল থেকে দেখবে আর জয়ের আনন্দে হাততালি দিবে।
বোকা নারী, বুঝতেও পারেনা, মরলেই সব শেষ, কিছুই থেমে থাকেনা, কেউই থেমে থাকেনা। স্বামীও মুখ কালো করে ঠিকই, স্বামীরও হেনস্তা হয় ঠিকই, কিন্তু এই হেনস্তা কিছুকালের জন্য। বুঝিনা, অপরকে হেনস্তা করার জন্য নিজেকে মরতে হবে কেন, বনিবনা না হলে সম্পর্ক ছিন্ন করে দাও, তবুও নিজে বাঁচো, অন্যকেও স্বস্তিতে থাকতে দাও!

মিতা নূর, কি লাভ হলো? কে হেরে গেলো? সরল অংক এটা, কোন ঘোর-প্যাঁচ নেই, তুমিই হেরে গেলে গো মেয়ে, তুমিই হেরে গেলে! তোমার চেয়েও অনেক বেশী বুদ্ধিমতী তোমার সংসারের দুই বুয়া। তারা জানে, বেঁচে থাকার মধ্যে কত আনন্দ, কারণ তারা এমনি এমনি বাঁচছে না, রীতিমত সংগ্রাম করে তবেই বেঁচে আছে, তাদের কাছে আত্মহত্যা মানে হচ্ছে, " বড়লুক বেগম সাবের বড়লুকী কান্ড"।

খুব দুঃখ পেলাম মিতা নূ্র, তোমার এমন হঠকারী সিদ্ধান্তে, আমি জীবন ভালোবাসি, বেঁচে আছি, এটা সবচেয়ে বড় সুখ! তুমি কেন এভাবে চলে গেলে? ছেলে দুটোর কথাও ভাবলেনা? স্বামীর সাথে তো শুধু ঝগড়ার স্মৃতিই থাকেনা, কত মধুর স্মৃতিও তো থাকে। সবই তো সত্য, ঝগড়া যদি সত্যি হয়, মধুর সময় যেটুকু কাটিয়েছো, সেটা কি মিথ্যে হয়ে যায়? তুমি তো স্বাবলম্বীই ছিলে, কি এমন ক্ষতি হতো যদি চিরতরে বিদায় না নিয়ে স্বামীর সংসার থেকে বিদায় নিতে! কতগুলো মানুষ অযথা শোক, দুঃখ, কষ্ট পাওয়া থেকে বেঁচে যেতো, আর তুমি বেঁচে থাকতে পৃথিবীটাকে আরও অনেক বছর দেখার জন্য!
1

পেছন ফিরে দেখা!

আজ থেকে ২৮ বছর আগের ১লা জুলাই ছিল সোমবার, আমার সাথে ছিল আমার মা, বাবা, তিন ভাই, মেজকাকা, কাকীমা, ভাই অপু দাদা, বোন পপি এবং দাদু, দিদিমা, দুই মামা, ছোট মাসী, মেজ মামী, আমার শাগরেদ ছোট্ট মামাতো ভাই অপু এবং আরও ছোট, একেবারে কুট্টি বোন টুম্পা।

এরশাদ ভ্যাকেশানের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেছি, নওয়াব ফয়জুন্নেছা হলের বন্ধুরা আমার মুখের দিকে তাকায় আর অবাক হয়। মিঠুকে কেন অমন ঝলমলে দেখা যাচ্ছে! ব্যাপার কি? কালো মেয়ের মুখে কেন অমন আলো দেখা যায়!! আমি মুখে কিছু না বলে অনেকটাই 'নির্লজ্জ গর্বের সাথে কালো ভোঁতা অনামিকা তুলে দেখাই আর বলি, ' আজ থেকে দুই সপ্তাহ পরে, আমার বিয়ে, বিশ্বাস হয়না? এই যে দেখো আমার আঙ্গুলে এটা কি ঝকঝক করছে! ১৫ই জুলাই কী বার, সোমবার না? আংটি দেখেও বিশ্বাস হচ্ছেনা যখন, বিয়ের কার্ডটা যেদিন হাতে ধরিয়ে দেবো, সেদিন মজা বুঝবে। কালো বলে বুঝি বিয়ে হতে নেই! রবিদাদু কি বলেছিল, " তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ", আমার কালো হরিণ চোখও একজন দেখেছে, একেবারে প্রেমে পড়ে গেছে, সেই বিয়ে করবে আমাকে, হা হা হা!!"
আমার বন্ধুরা আমার এই ধরণের বেলাজপনার সাথে পরিচিত, তারা বিশ্বাস করেছে, তবে মনে মনে অবাক হয়েছে একটু, মিঠুরও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে! এত তাড়াতাড়ি????

২৮ বছর পর আজকের ১লা জুলাই সোমবারে হিসেব মিলিয়ে দেখি, আমার সাথে আছে আমার উত্তম কুমার এবং একটু দূরে আছে মনীশ (জামাতা), দূরে থেকেও দূরে নেই আমার বাবা, তিন ভাই, ছোট মাসী। চিরদিনের মত দূরে চলে গেছে মা, দাদু, দিদিমা, ছোটমামা। একেবারে নিজের দেহের অংশ হয়ে আমার চারপাশ ঘিরে আছে আমার তিনটি কন্যা।
বাকীরা সংসারের চাপে নিজেদের আলাদা বলয় তৈরী করে নিয়েছে।

গত বছর ১লা জুলাই সোমবার ছিল না, কি বার ছিল মনে পড়ছেনা, আমরা ছিলাম সুনামগঞ্জে, ছোট মাসীর বাড়ী। সুনামগঞ্জের পীর মিসবাহ ভাই তাঁদের বাড়ীতে নেমন্তন্ন করেছিল, মিসবাহ ভাইয়ের বড় ভাবী, মিসবাহ ভাইয়ের স্ত্রী কতকিছু রান্না করেছিল, সবাই মিলে কি যে আতিথেয়তা দেখিয়েছিল, মুগ্ধ হয়ে গেছি। পাঁচ /সাত পদের মাছ খাইয়েছিল, সাতকড়া দিয়ে মুরগীর ঝোল, আরও কত কি কত কি!!

সোমবার আমি নিরামিষ খাই, নিজের তৈরী নিয়মে চলি। এত কথা মনে পড়তো না, ভাতের প্লেট সামনে নিয়ে তিনদিন আগে রান্না করা সব্জী দিয়ে ভাত মাখি আর ভাবি, গত বছর এই দিনে আমি বাংলাদেশে ছিলাম। আরে, মনে পড়েছে, ১লা জুলাই তো সুনামগঞ্জে ছিলাম, আরও বেশী মনে পড়েছে, মিসবাহ ভাইদের বাড়ীতে নেমন্তন্ন খেয়েছিলাম, কতকিছু খেয়েছিলাম! আর এক বছর পর একই দিনে আমি তিন দিন আগের রান্না করা ঘাস-পাতা চিবাচ্ছি! সত্যি, কবি ঠিকই বলেছেন, " চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়"।


যে কথা বলাই বাহুল্য!!

জয় এবং সাফল্য মানুষকে বিনীত করে, উদার করে, সহনশীল করে!
বাংলাদেশে তার উলটো!
গত সংসদ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয় লাভ করার পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-নেত্রীদের মধ্যে বিনয়ের বদলে অহমিকা ভর করেছে, ( এর মধ্যে মন্ত্রীরাও আছেন এবং সকলেই তাঁদের নাম জানেন), বুদ্ধি এবং চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে, পাতি নেতাদের 'ধরাকে সরা জ্ঞান' করার দিকে ঝোঁক বেড়েছে, যা দলটির জন্য অনেক ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
*** গত চার সিটি নির্বাচনে শতভাগ সাফল্যে বিএনপির মূল নেত্রী থেকে শুরু করে ক্রমানুসারে সকলের মধ্যেই অহমিকা, মিথ্যাচার, কদর্যতা, হিংস্রতা, প্রতিশোধস্পৃহা যেভাবে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে, তাতে করে দলের কতটুকু ক্ষতি হতে পারে জানা নেই, দেশ ও দশের ক্ষতি এখনই টের পাচ্ছি।
** আশফিয়া পাপিয়াকে একজন ভাল 'মা' হিসেবে জানতাম, কিন্তু উনি কী আসলেই ভাল মা? একজন ভাল 'মা' কী কখনও নিজ দেশের আপামর জনগণের অনুভূতিকে থোড়াই কেয়ার করতে পারে? একজন জাহানারা ইমাম হওয়া কী মুখের কথা? আশফিয়া পাপিয়া তার তিনটি সন্তানের মা, জাহানারা ইমাম সকল মুক্তিযোদ্ধার মা, সেই মা'কে নিয়ে সংসদে কটূক্তি করে পাপিয়া নিজেকে সমাজের কোন স্তরে নামিয়ে নিয়ে গেছেন, তা কী উপলব্ধি করতে পেরেছেন? শুধুই কী জাহানারা ইমাম? এই সেদিনও সংসদে পাপিয়া তার সতীর্থ রেনু বেগমের নোংরা বক্তব্য চলাকালীন সময়ে স্পীকার মাইক বন্ধ করেছিলেন বলে, " মাইক দে' 'মাইক দে' বলে তুই তোকারী করছিলেন। আর রানু, মনি, শাম্মিদের কথা এখানে উল্লেখ করলামনা, নোংরা কথা রিপিট করার মধ্যেও পরোক্ষ নোংরামী থাকে! নিজেকে এর থেকে সরিয়ে রাখা ভাল।

*৮*বিএনপির প্রধান নেত্রীর কথা কী আর বলবো, মহান সংসদে দাঁড়িয়ে 'মিথ্যাচার' করলেন, নিজের লেখা চিঠি, যা কিনা উনি নিজের শত্রুকে ঘায়েল করার জন্য 'আমেরিকার প্রভু'কে ঊদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন, এবং উনার চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে যেইমাত্র আমেরিকান প্রভু দ্রুত অ্যাকশান নিয়ে নিয়েছেন, অমনি উনার টনক নড়লো, উনিও সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন, প্রধানমন্ত্রীর হাতে ধরা চিঠির দিকে তাকিয়েই বললেন, উনি এই চিঠি লিখেননি।

এখনও সংসদ নির্বাচন ছয় মাস বাকী, সারা বিশ্ব থেকে জরিপ চালিয়ে বলা হয়েছে, আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে ( এমনটাই তো পত্রিকায় পড়ছি)। আসুক, যে জয়ী হবে সেই আসবে। কিন্তু চার সিটিতে জয়ের প্রতিক্রিয়াই যদি এমন ভয়াবহ হয়, সংসদ নির্বাচনে জয়ী হলে 'জয়ের প্রতিক্রিয়া' কেমন হতে পারে তা বলাই বাহুল্য!

অপরাধীকে পুরষ্কৃত অথবা তিরষ্কৃত যাহাই করো, নিজ দায়িত্বে করবে!!

কয়েকদিন আগে আমার এক পুত্র আমাকে ইনবক্সে 'প্রথম আলো' পত্রিকার একটি লিঙ্ক পাঠিয়েছে। লিঙ্কটি ছিল বুয়েটের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে আদালতের রায় সম্পর্কিত। বুয়েটের শিক্ষক ফেসবুক পাবলিক স্ট্যাটাসে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নামোল্লেখ না করেই উনাকে ( অ,আ, ক খ পড়তে জানা যে কোন শিশুও যেন বুঝতে পারে কাকে হুমকী দেয়া হচ্ছে) অতি বিভৎস ভাষায়, অতি ভয়ংকর প্রাণনাশী হুমকী দিয়েছেন।
এই স্ট্যাটাসের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর জনৈক হিতৈষী আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন এবং বিচারশেষে ্মাননীয় আদালত সেই শিক্ষককে ৭ বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন। এই মুহূর্তে সেই শিক্ষক পলাতক আছেন।
আমার পুত্রটি জানে, খুব মাঝে মাঝে আমি রাজনৈতিক স্ট্যাটাস দেই, সেখানে আমি কাউকে হেলা অশ্রদ্ধা করে কথা বলিনা, কারো কর্মকান্ড পছন্দ না হলে তার/তাদের নিন্দা-মন্দ করি, তবে সহনীয় ভাষায়। আমার পলিটিক্যাল ভিউ'র সাথে আমার পুত্র-কন্যাদের ভিউ'র মিল থাকতেই হবে, এমন দাবী কেউ করিনা। আমার এই পুত্রটিরও আমার পলিটিক্যাল ভিউ'র সাথে মতানৈক্য আছে। এইজন্যই হয়তো সে আমাকে লিঙ্কটি পাঠিয়ে এই বিষয়ে আমার মতামত জানতে চেয়েছে।

উক্ত শিক্ষকটি বুয়েটের মত একটি সম্মানিত প্রতিষ্ঠানে, শিক্ষকতার মত মহান পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। আমার পুত্রটিও বুয়েটের মত প্রতিষ্ঠান থেকে দারুণ রেজাল্ট করে পাশ করে বেরিয়েছে। এমন অমায়িক, বিনয়ী, সংস্কৃতিমনা ছেলে খুব কম দেখা যায় এবং এই ধরণের ছেলেরাই আমাকে চারপাশে সুরক্ষা বেষ্টনী দিয়ে রাখে। আমার এই পুত্রদের সাথে যদি উক্ত শিক্ষকের তুলনা করি, বেশ ভাল রকমের হোঁচট খেতে হয়। এই শিক্ষক তো আমার পুত্রদের পায়ের নখের যোগ্যও নয়।

বুয়েটের প্রচুর ছেলেমেয়ের সাথে আমার পরিচয় আছে, কারো মধ্যেই এমন 'অসুস্থ মানসিকতা' লক্ষ্য করিনি। কী তুখোড় সব ছেলেমেয়ে এরা! হয়তো উক্ত শিক্ষকও মেধার দিক থেকে সেরা, কিন্তু মন মানসিকতা?
বিচারের রায় পত্রিকায় আসার পর বেশ কিছু স্ট্যাটাসে দেখলাম, রায়টি তাদের মনঃপুত হয়নি। প্রত্যেকেই প্রশ্ন রেখেছে, একটি স্ট্যাটাসের জন্য একজনকে ৭ বছরের কারাদন্ড দিতে হয়? কেউ কেউ বলেছে, সেই শিক্ষকতো প্রধান মন্ত্রীর নামোল্লেখ করেনি, তাহলে কেন তার বিরুদ্ধে এই শাস্তি দেয়া হলো?

আমার পুত্র বোধ হয় এ ব্যাপারেই আমার মত জানতে চেয়েছে। পুত্র শোন,
আমাদের দেশের রাজনীতিতে প্রচুর হত্যাকান্ড ঘটেছে, ঘটছে এবং আরও যে ঘটবেনা, সেটাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেনা। এমতাবস্থায় কেউ যদি নিজ দায়িত্বে পাবলিকলী এমন ভয়ংকর হুমকী দেয়, হোক সেটা প্রধানমন্ত্রী বা কারো নামোল্লেখ ছাড়া হুমকী, তবুও তাতে হুমকীর হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, ভয়াবহতা কিছুমাত্র কমে না! আর যিনি এই কাজটি করেছেন, তিনি একজন শিক্ষক, কোন এলেবেলে পাঠশালার শিক্ষকও নন, দেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক, সেই তিনি যদি এমন স্ট্যাটাস দেন, আর এই স্ট্যাটাস পড়ে যদি তার অগনিত ছাত্রদের মধ্যে থেকে একজন ছাত্রও উৎসাহিত হয়ে তেমন একটি ঘটনা ঘটিয়েই ফেলে, তখন কী হবে? এমন ঘটনাতো এর আগে ঘটেছে, দেশের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের জীবনেই ঘটেছে, পরিবার পরিজনসহ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে! কাজেই এমন উগ্র মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে তো আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়াটাই উচিৎ কাজ হয়েছে।

পুত্র, তুমি হয়তো বলবে, দেশে যে এত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, বিশ্বজিতকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে, সাগর রুনীকে হত্যা করা হয়েছে, বিডিয়ার হত্যা হয়েছে, সেগুলোর কী বিচার হয়েছে? তা তো সত্যি কথা, কিন্তু সেগুলোর বিচার হয়নি বলে, অথবা সেগুলো বিচারাধীন আছে বলে নতুন কোন অপরাধের বিচার হবেনা, তাতো হতে পারেনা! একজন শিক্ষক হয়ে কী তার এমন স্ট্যাটাস দেয়া উচিত হয়েছে? তুমিও তো বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলে এবং অবশ্যই ঐ শিক্ষকের তুলনায় কোন অংশে কম ছিলেনা, তুমি কী পারবে এই ধরনের কথা বলতে? আমি জানি, মরে গেলেও তোমার দ্বারা তা সম্ভব হবেনা। এটাই শিক্ষার গুণ! তাহলে তুমিই বলো, সেই শিক্ষক নিজেই যদি এমন শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে থাকে, সে তার ছাত্রদেরকে কী শেখাবে?

তাছাড়া, এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিকভাবেই মামলা করা হয়েছে, যে কেউ একজন মামলা করেছে, আদালতে মামলা উঠেছে, বিচার চলেছে, বিচারের রায় হয়েছে। সরকার তো কিছু করেনি। যদি বলো, দেশের বিচারালয় থেকে শুরু করে সর্বত্র সরকারের প্রভাব আছে, তাহলে বলবো, যস্মিন দেশে যদাচার! আমাদের দেশে এটাই রীতি, তারপরেও বলবো, লোক দেখানো হলেও কেউই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়নি। আদালতের শরণাপন্নই তো হয়েছে। আদালতে যাব অথচ আদালতের রায়কে সরকারী সিদ্ধান্ত বলে চালাতে চাইবো, তাতো হবেনা! কয়েকমাস আগেই ব্লগ নিয়ে কী তোলপাড় হলো, কয়েকজন ব্লগারের নিজস্ব মতামতকে কেন্দ্র করে সারাদেশে কী ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হলো। ভয়ের চোটে কত ভাল ভাল ব্লগার ব্লগে তাদের লেখালেখি বন্ধ করে দিল!

বুয়েটের এই শিক্ষকের পক্ষে অনেকেই সাফাই গাইছে, দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে বলে। পুত্র, তাহলে তুমিই বলো, সেই ব্লগাররা কী দোষ করেছিল? তারাও তো মত প্রকাশের স্বাধীনতা দাবী করতে পারে! মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে পুঁজি করে যাহা খুশী তাহাই বলা যাবে, তাই যদি হয়, তাহলে ব্লগার রাজীব কী দোষ করেছিল? কেন তার বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন না হয়ে কিছু যুবক আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল? কেন এই ব্লগকে কেন্দ্র করে দেশটাকে আস্তিক-নাস্তিক দুই ভাগে ভাগ করে ফেলা হলো?

বুয়েটের শিক্ষকের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়া ঠিক হয়েছে, বিচারিক রায় নিয়ে কথা বলবোনা, এই বিচার ব্যবস্থাকেই তো মেনে নিয়েছি, যে দেশের বিচারালয়ের বিচারপতিরা জাতির পিতা হত্যার বিচার করতে গিয়ে 'বিব্রত' হয়, যে দেশে জাতির পিতার হত্যাকারীদেরকে সরকারীভাবেই অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূত বানিয়ে পুরষ্কৃত করা হয়, সেদেশে এমন শিক্ষক তৈরী হতেই পারে! এখন কথা হচ্ছে, এই সকল শিক্ষকদের তিরস্কার করবে নাকি অপছন্দের মানুষটিকে 'হুমকী' দিয়েছে বলে পুরষ্কৃত করবে? যেটাই করবে, নিজ দায়িত্বে করতে হবে, বিবেকের দংশন যেন সহ্য করার ক্ষমতা থাকে।

শত্রু বশীকরণ মন্ত্রঃ ( দুই নেত্রীর জন্য)

এই দুনিয়ায় যত শিল্পকলা আছে, তার মধ্যে রন্ধনশিল্প হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্প। একজন ভালো রন্ধনশিল্পী, সে নারীই হোক অথবা নরই হোক, তার রন্ধনকলা দিয়ে শত্রুকেও বশ করে ফেলতে পারে। কারণ একটিই, মানুষ না খেয়ে বাঁচতে পারেনা। সাধু-সন্যাসীকেও কিছু না কিছু খেতেই হয়। পৃথিবীতে সাধুর সংখ্যা তো বেশী নয়, অসাধুতেই দুনিয়া ভর্তি। এই অসাধু মানুষগুলোকে চিত্রকলা, নৃত্যকলা, সঙ্গীতকলা দেখিয়ে ঘন্টাখানেকের বেশী বশ রাখা যায়না। গা মুচড়ে আসর ছেড়ে পালাবে!! কিন্তু অসাধু মানুষগুলোর সামনে খাবারের থালা তুলে ধরো, খোলা দরজা থেকে আবার ফিরে আসবে, পরম তৃপ্তি নিয়ে খাবে, তারপর বলবে, " আহা! খেলুম বটে!" এমন তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার পর তো আর কোন কথাই থাকেনা। শত্রু হয়ে যায় মিত্র!

রন্ধনশিল্পের কথা মনে হলো আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের প্রসঙ্গে চিন্তা করতে গিয়ে। কী ঝগড়া বিবাদ যে চলছে, থামার কোন লক্ষণ দেখিনা। হঠাৎ করে মনে পড়ে গেলো, আমাদের দেশের মূল চালকের আসনে সব নারী নেত্রীরা সমাসীন হয়ে আছেন, তাঁরা সকলেই দেশের চলমান বিবাদমূলক রাজনীতির চাপে পড়ে রান্না-বান্নাও হয়তো ভুলে গেছেন। বিশেষ করে আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় দুই নেত্রী, প্রধান মন্ত্রী এবং বিরোধী নেত্রী, দুজনেই এক সময় পাকা রাঁধুনী ছিলেন। সংসার জীবনে দুজনেই ছিলেন আমাদের মতই সাধারণ গৃহীনী, চাল-ডাল, তেল নুনের হিসেব নিকেশ করেছেন। তথ্যটি পত্র পত্রিকায় এসেছে, অবিশ্বাস করার কিছুই নেই। দুজনেই সাধারণ আটপৌরে পরিবারের মেয়ে, সাধারণ গেরস্ত বাড়ীর বউ ছিলেন, স্বামী-সন্তান-আত্মীয়-স্বজন নিয়ে সংসার করেছেন, রান্না-বান্নায় পারদর্শী হওয়ারই কথা। এখন কি উনাদের সেইসব দিনের স্মৃতি মনে পড়ে? উনাদের কী মনে পড়ে, নিজ হাতের সুস্বাদু রান্না খাইয়ে শ্বশুড়বাড়ীর লোকজনকে (নারীর শত্রুপক্ষ) বশ করে ফেলেছিলেন!

আমার মনে পড়ে, '৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি যখন জয়ী হলো, তখন খালেদা জিয়ার ননদের সাক্ষাৎকার শুনিয়েছিল রেডিওতে, ননদ বলেছিল, " আমাদের ভাবী দারুণ রান্না করে, ভাবীর হাতে পোলাও-মাংস খুব ভালো হয়"।
আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রান্নার গুণের কথা তো পত্র পত্রিকাতেই কতবার এসেছে, উনার আতিথেয়তার কথা, আওয়ামীলীগের নেতারা যখন উনার বাসায় গিয়েছিলেন, হাতে খুন্তিটা ধরাই ছিল, উনি রান্না-বান্নায় ব্যস্ত ছিলেন, নেতাদেরকে বোধ হয় নিজের হাতে রান্না করা খাবার দিয়ে আপ্যায়িত করেছিলেন।

সংলাপের প্রয়োজন কী? দুই নেত্রী মুখ বুজে রান্না করুন, দুই বাটি খাবার ড্রাইভারের হাতে দিয়ে বলুন, " যাও, এই খাবারের বাটি আমার শত্রুর বাড়ীতে পৌঁছে দাও, বাটি ফিরিয়ে আনতে হবেনা"। আমি বাজী ধরতে পারি, সংলাপ ছাড়াই দুই নেত্রী পরস্পর পরস্পরের বশীভূত হবেন। আপনারা বশীভূত হলেই আপনাদের চেলা-চামুন্ডাগুলোও বশীভূত হবে, দেশে শান্তি ফিরে আসবে।


সকালে ঘুম ভাঙ্গেনা, তাই যেদিন সকালে কাজের শিফট থাকে, তার আগের রাতে আমার ঘুমাতে যেতেও ভয় করে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে চার ঘড়িতে অ্যালার্ম দেই, মিথীলাকে বলে রাখি, উত্তম কুমারকে বলে রাখি ( এই অফিসে বলতে ভয় লাগে, কারণ রাত ৪টা পর্যন্ত জেগে থেকে ঘোড়ার ঘাস কাটি বলে সে আমাকে খোঁটা দেয়), তবুও শান্তি পাইনা, বার বার ঘুম ভেঙ্গে যায়।

আজকে আমার কাজের স্কেজিউল সকাল ৮;৩০ থেকে শুরু। কাল রাত ১'৩০ -এ, ভয়ের চোটে ওয়ালমার্টের ড্রেস পড়ে রেডী হয়ে ঘুমাতে গেলাম, অ্যালার্ম বাজেনি, হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখি ফোনে সময় দেখাচ্ছে সকাল ৮ঃ৪৮। দম বন্ধ হওয়ার যোগাড়, এমন হলো কেন? ভাবলাম মিথীলার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকানী দেব আমাকে সময়মত ডেকে দেয়নি বলে, কিন্তু সে সময়টুকুও হাতে পেলামনা।
দৌড়ে বের হতে যাব, মিথীলার রুমের সাইড টেবিলের রেডিও ক্লকে দেখাচ্ছে ৬ঃ৫০। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনা, আমার সুপারভাইজার তক্কে তক্কে আছে, কীভাবে আমার ছুটি আটকানো যায়, আমিও তক্কে তক্কে আছি, কীভাবে পিসীর সাথে দেখা করতে জর্জিয়া যাওয়া যায়, সেয়ানে সেয়ানে দ্বন্দ্ব চলছে। দ্বন্দ্ব ভালো লাগেনা, কিন্তু কী আর করা, মাথার উপর নির্বোধ মহিলা ছড়ি ঘোরাচ্ছে! লেট হতে চাইনা, আক্ষরিক অর্থেই চাইনা।

'কানা ছেলের নাম 'পদ্মলোচন' বলে একটি প্রবাদ আছে, আমাদের বাগানটাকে সেই পদ্মলোচন বললে ভুল হবেনা, সেই কানা ছেলে পদ্মলোচন মার্কা বাগানে ঢুকলাম, আমাদের অতি আদরের গাছগুলোকে মন ভরে দেখে মনটাকে শান্ত করলাম, এবার ধীরে সুস্থে কাজে রওণা দেবো।

চাইর মাইল্যা ড্রাইভার!

এক ঘন্টার লাঞ্চ ব্রেকে আমি প্রতিদিন ঢাউস মার্কা সেভেন সীটার ভ্যান চালিয়ে ওয়ালমার্ট থেকে বাড়ী চলে আসি। চার মাইলের পথ, আসা-যাওয়ায় ১০মিনিট+১০মিনিট=২০ মিনিট চলে যায়, ৪০মিনিট ঘরে থাকি।
আমার ড্রাইভিং এর দৌড় এই পর্যন্তই, চার মাইল! আমার নামই হচ্ছে 'চাইর মাইল্যা ড্রাইভার', অর্থাৎ চার মাইল পর্যন্তই আমি ড্রাইভ করি। আমার উত্তম কুমার আমাকে পাত্তাও দেয়না, সব সময় বিদ্রুপ করে, কারণ আমি নাকি ড্রাইভিং এর কিছুই জানিনা।
এদিকে উত্তম কুমার জানেওনা, চার মাইল রাস্তায় আমিই রাণী, তাও আবার খেয়ালী রাণী। যখন ইচ্ছে হয় ঢিক্কুস মার্কা গাড়ীর পেছন পেছন আমিও ঢিকুস ঢিকুস করে এগিয়ে যাই, কখনও কখনও আমার মধ্যে বাংলাদেশের ট্রাক ড্রাইভারের ভুত এসে ভর করে। তখন আমি চোখে সানগ্লাস এঁটে, চোয়াল শক্ত করে সামনে থাকা গাড়ীগুলোকে একের পর এক টপকে যেতে থাকি। ৩৫মাইল /ঘন্টা পৌঁছে যায় ৫০মাইল/ঘন্টায়। সবার আগে পৌঁছে আবার চোয়াল নরম করে গান গাইতে গাইতে বাড়ী ফিরে আসি।

আজকেও ছিল তেমনই একদিন। লাঞ্চ ব্রেকে গাড়ীতে উঠে স্টার্ট দিয়েছি, অমনি বড়দা'র ফোন, একটিমাত্র ভাতিজি শ্যামা জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ দিয়ে দারুণ একটি চাকুরী পেয়েছে। আর কী লাগে জীবনে! পিসী হিসেবে আনন্দ প্রকাশ করার একটা দায়িত্ব আছেনা! দিলাম গাড়ীর স্পীড বাড়িয়ে, হেমন্ত'দা গাইছেন আমার প্রিয় গান,
'কতদিন পরে এলে'--যে গান শুনলেই আমি স্বপ্ন দেখি, আমার অতি প্রিয় কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করছে, আমি গেলেই তার মনে হবে, অনেকদিন পর তার খরখরে জীবনে বৃষ্টি এলো!!

**কোনদিন না জানি উত্তমের ফোন বেজে উঠবে, কলার আইডিতে দেখাবে ৯১১ নাম্বার, পুলিশ বলবে তোমার বৌ এই চার মাইল রাস্তায়ও ড্রাইভ করতে পারেনা, করেছে অ্যাকসিডেন্ট!! উত্তম কুমার হয়তো আপন মনেই বলে উঠবে, " মঘা তো, 'এই চাইর মাইল্যা ড্রাইভার' নিয়ে কী যে বিপদের মধ্যে আছি!

টেক্কা দেয়া

পত্র-পত্রিকায়, ফেসবুকে একটি ছবি ( তারেক জিয়া এবং একজন সাদা চামড়ার সাহেব হাস্যোজ্জ্বল মুখে একখানি বই ধরে দাঁড়িয়ে আছেন) দেখে গতকাল থেকে কিছুটা বিভ্রান্ত এবং চিন্তাযুক্ত আছি।
বিভ্রান্ত কেনঃ বইখানির রচয়িতা কে? তারেক জিয়া বইটি লিখেছেন নাকি ১৮ জন 'বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি' তারেক জিয়া সম্পর্কে এই বইটিতে লিখেছেন?
যদি তারেক জিয়া বইটি রচনা করে থাকেন, তাহলে তাঁর জন্য অনেক শুভ কামনা, কারণ ইংল্যান্ডের বিলাসী জীবনে থেকে এবং 'বাংলাদেশের কঠিন রাজনীতির' বেড়াজালে আটকে থেকেও বই লেখার মত পবিত্র একটি কাজ তিনি করেছেন, তাহলে তো সাহেবদের দেশে থেকে সাহেবের হাতে বই তুলে দিয়ে সঠিক কাজটিই উনি করেছেন।
আর যদি অন্যের লেখা দিয়ে বইটি সাজানো হয়ে থাকে, তাহলে 'সেই অন্যেরা' বইখানি সাহেবের হাতে তুলে দিলে ( তাঁদের নেতাকে যেহেতু সাহেবরা মাথায় তুলে রেখেছে, সেই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ) ছবিটির গুরুত্ব বা তাৎপর্য্য ঠিক থাকতো, আমিও বিভ্রান্ত হতামনা। এবং তেমন একখানি ছবি দিয়েই পত্রিকার পাতা অথবা ফেবসবুকের হোম পেজ সাজানো উচিত হতো।

চিন্তাযুক্ত কেনঃ বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বীকে টেক্কা দেয়ার প্রবণতা দেখে চিন্তিত হই, কারণ টেক্কা দিতে গিয়ে রাজনীতিবিদেরা 'ভাল কোন কাজে' টেক্কা দেয়না, খারাপ কাজে টেক্কা দিয়ে আরও বেশী খারাপ কাজ করা শুরু করে। ফলে খারাপ কাজ করার প্রতিযোগীতায় কে কার চেয়ে বেশী পারদর্শী, সেই প্রতিভার বিচ্ছুরণে দেশের অবস্থার বারোটা বাজে। এই তো যেমন এখন চলছে, সংসদে কে কত বেশী নোংরা কথায় বক্তব্য পেশ করতে পারে! প্রতিযোগীতায় 'কেহ কারে নাহি ছাড়ে, সমানে সমান' চলছে।
এখানেই আমার দুঃশ্চিন্তা, না জানি কোনদিন পত্রিকায় দেখবো সজীব ওয়াজেদ জয়ও একখানি বই হাতে বারাক ওবামার সাথে দাঁড়িয়ে আছেন! আমার এই আশংকা যেনো সত্যি না হয়, আওয়ামীলীগের বুদ্ধিজীবিরা যেন 'সেই ১৮ জন বুদ্ধিজীবিকে' টেক্কা দেয়ার চেষ্টা না করেন, এই প্রার্থণা করি।

** ছবিটি সংযুক্ত করলামনা, টেক্কা দিতে ইচ্ছে করলোনা**


আয়ুষ্মতী!!!

আজ একজন নানীর গল্প শুনলাম তাঁর নাত-বৌ এর কাছ থেকে। নানী শাশুড়ীর বর্তমান বয়স ৮৫ বছর। মেয়ের সাথে আমেরিকা এসেছেন গত মাসে। আমেরিকাতে নানীর নাতি এবং নাতনী, দুজনেই পিএইচডি করছে। নাতির পিএইচডি কমপ্লীট, নাতনী এখনও পিএইচডি করছে। নাতি এবং নাত বৌ, নাতনী এবং নাতজামাই, এদের মাঝে নানী কতই না সুখে আছেন! একবার নাতির বাসায় আসেন, কিছুদিন থেকে নাতনীর বাসায় যান। দুই বাসাতেই নানীর যত্নের ত্রুটি হয়না। নানীকে নিয়ে নাত-বৌ কতইনা রঙ্গ-তামাসা করে। চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে, হাতে আমেরিকান ফ্ল্যাগ ধরিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে দেয়। ফেসবুকে নিজের ছবি দেখে নানী তাঁর নাত-বৌকে হেদায়েত করেন, " ফেসবুকে আমার ছবি দিছ, আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না, সারা দুইন্যার মানুষ আমারে দেখবে"। নাত-বৌ পেশায় ডাক্তার, নানীর চিকিৎসা ভালই জানে, বলেছে, " নানী, চিন্তা করোনা, ডিলিট করে দিব ছবি", শুনে নানী আশ্বস্ত হোন।

নাতনীর ঘরে চারদিক আলো করে নতুন অতিথি এসেছে, সেই অতিথির সাথে নানীর সম্পর্ক হচ্ছে, 'বড়মা-পুতি' সম্পর্ক। নানীটি কতই ভাগ্যবতী, মেয়ের সাফল্য দেখলেন, নাতি-নাতনীর সাফল্য দেখলেন, নাতনীর ঘরে পুতি জন্মাতে দেখলেন। প্রার্থণা করি, নানী শতায়ু হোন, বেঁচে থাকলে পৃথিবীতে আরও কত কিছু দেখবেন! নানী শেষ পর্যন্ত ৮৫ বছর বয়সে সাত সমুদ্দুর পার হয়ে আমেরিকা চলে এসেছেন!! নানী আমেরিকা বেড়াতে এসেছেন, কে জানে, বেঁচে থাকলে হয়তো মঙ্গল গ্রহেও বেড়াতে যেতে পারবেন, মানুষের অসাধ্য তো কিছু নেই, মঙ্গল গ্রহে একদিন মানুষ বেড়াতে যাবেই যাবে! নানী আপনি শতায়ু হোন।

** সবার সুখ দেখি, ভাল লাগে, প্রার্থণা করি, পৃথিবীর মানুষ আমার স্ট্যাটাসের 'নানী' টির মতই ভাগ্যবতী হোক!! চতুর্থ প্রজন্মের চাঁদপানা মুখ দেখুক। আমার ভালো লাগে মানুষের এই ছোট ছোট সুখ দেখতে, মাঝে মাঝে শুধু বুকের ভেতর অব্যক্ত যন্ত্রণা জেগে উঠে, মায়ের কান্নাভেজা মুখটা ভেসে উঠে, আইসিইউর বেডে নিঃসাড় দেহ, সারা শরীরে হাজারটি নল ফিট করা, আমি গিয়ে 'মা' ডাক দিতেই চমকে উঠে আমার মুখের দিকে তাকালেন, ছোট্ট মেয়ের মত দুই ঠোঁট ভেঙ্গে কাঁদতে লাগলেন, বলতে চাইলেন যন্ত্রণার কথা, অথবা আরও অন্য কিছু, বলতে পারলেননা কিছুই, এই দৃশ্যটি আমাকে বাকী জীবন তাড়িয়ে বেড়াবে।


আমার স্ট্যাটাস!

আমি কিছু স্ট্যাটাস লিখি একেবারে ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোন থেকে, সেখানে নিজের মেয়েদের প্রশংসা করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলি। স্বাভাবিকভাবেই পুরো বিষয়টিতে আমার মেয়েরা বিব্রত হয়, অনেক পাঠক বিরক্ত হয়, এবং এর সবই আমি বিবেচনায় রাখি। তারপরেও প্রায়শঃই আমি এ কাজটি করি, কারণ কাজটি করার পেছনে আমার কিছু ঊদ্দেশ্য কাজ করে। ফেবু সম্পর্কে অনেক নিগেটিভ ধারণা আছে, বাইরের কথা বাদ, আমার নিজের পরিবারেই অনেক সদস্য/সদস্যা আছেন, যারা মনে করেন ফেবু মানেই সাড়ে সর্বনাশ! ফেবু মানেই একে তাকে মেরে ফেলার হুমকী, ফেবু মানেই আলতু ফালতু গালিগালাজ! ফেবু মানেই মূল্যবান সময়ের অপচয়। আমি নিজে তা বিশ্বাস করিনা বলেই নিজের মেয়েদেরকে 'বলির পাঁঠা' বানিয়ে পাঠকদের কাছে কিছু মেসেজ পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করি। তাঁরা সংখ্যায় অনেক নন, খুব অল্প বন্ধু আমার এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানায়, তারা বুঝতে পারে, মেয়েদের উপলক্ষ্য করে আমি কিছুটা হতাশাগ্রস্ত বন্ধুদের কাছে বার্তা পাঠাই, " হতাশ হতে নেই, শেষ পর্যন্ত দেখে যেতে হয়, নিজের মনে সৎ থাকলে কোন বাধাই আর কঠিন মনে হয়না'। সেই অল্প সংখ্যক বন্ধুদের সমর্থণে আমার বিশ্বাসের ভিত একটু একটু করে পাকা হয়ে উঠে! আমি নিজেকে লেখক হিসেবে তৈরী করতে চাই, লেখকের দায়বদ্ধতা থাকে পরিবারের প্রতি, বন্ধুদের প্রতি, সমাজের প্রতি, আমি সেটাই চর্চা করছি।

যাঁরা মনে করেন, ব্যক্তিগত স্ট্যাটাসগুলো দিয়ে নিজের বিদ্যে জাহির করি, তাঁদের এই মনে করাকে শ্রদ্ধা করি, যাঁরা মনে করেন, স্ট্যাটাসগুলোতে আমি আমার মেয়েদের নাম ব্যবহার করি ঠিকই, কিন্তু আসলে নিজের বিদ্যে জাহির করার ঊদ্দেশ্যে তা করিনা, তাঁদের এই মনে করাকে অন্তরে ধারণ করি। আমি আসলে দ্বিতীয় দলের বন্ধুদের কাছে আমার মেসেজ পৌঁছে দিতে পারছি, এটুকুই আমার তৃপ্তি, এটুকুই আমার এচিভমেন্ট।
1Like · · Promote ·


মিঠু'স কেমিস্ট্রি ল্যাব থেকেঃ মায়ের জন্য মিথীলার প্রচেষ্টা

ইদানিং আমার মনের অবস্থা খুবই খারাপ থাকে, নানা কারণে খারাপ, লেখালেখি, চাকরী, রাজনীতি সব ক্ষেত্রেই জটিলতা দেখা দিয়েছে। লেখালেখির কথা বাদই দিলাম, সংসারের হাল নড়বড়ে হয়ে গেছে, ঠিকমত রান্না-বান্না হয়না, রাজনীতির হাল আরও খারাপ, সেদিন এক বন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, " তুমি এমন বিপ্লবী কেনো? তুমি কী রোমান্টিক? নাকি তোমার মধ্যে রোমান্স একদমই নেই? তোমার উত্তম কুমার কী বলে?"
বলেছি, " রোমান্টিক মানুষেরাই বিপ্লবী হয়, আবেগশূণ্য মানুষ বিপ্লবী হয়না"। বন্ধুটি আর তর্ক করেনি, পাগলের সাথে কেউ বেশীক্ষণ তর্ক করেওনা।

কাজের ক্ষেত্রেও নানা ঝামেলা, কিছু গাধা টাইপের লোক মাথার উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে, আমি হলাম বাঙ্গালী, আমার মাথার উপর ছড়ি ঘুরাবে কতক্ষণ? ছুটি চাই, ছুটি দিবেনা। মামার বাড়ীর আবদার, এগুলো নিয়েও বিপ্লব করতে হচ্ছে, লেখালেখি মাথায় উঠেছে। ঈদসংখ্যায় লেখা পাঠাতে পারলামনা, লেখা রেডী আছে, শুধুমাত্র সম্পাদকদের সাথে সময়মতো যোগাযোগ হলো না বলে এ বছর লেখাগুলো গেলোনা। মনের উপর এর একটা প্রভাব তো থাকবেই।

আমার মন খারাপের বিষয়টি আমার মিথীলাকে খুব প্রভাবিত করছে। ছোট্ট মিথীলা বিনা নোটিশে আমার কাছে আসে, জানতে চায়, ক্ষিদে পেয়েছে কিনা, জানতে চায় কাজে কোন সাহায্য লাগবে কিনা। তের বছরের কিশোরীকে অনেক কথাই খুলে বলা যায়, কিন্তু যে কিশোরী তার মায়ের মুখের প্রতিটি রেখার পরিবর্তণ নিজের থেকেই আঁচ করতে পারে, তাকে আর ভেঙ্গে কিছু বলতে হয়না। বরং আমাকে শান্ত করতে, খুশী করতে মিথীলার ছোট ছোট চেষ্টাগুলো উপভোগ করতে ভালো লাগে। এই যেমন আজকে আমি যখন স্কাইপে মিশার সাথে কথা বলছিলাম, মিথীলা কান খাড়া করে শুনছিল। মিশাকে বলছিলাম,
"মিশা, শুধুমাত্র যোগাযোগের ব্যর্থতায় এবারের ঈদসংখ্যায় কোন লেখা পাঠাতে পারলামনা।"

মিশা বলছিলো, " মা, তুমি আগে তোমার লেখা শেষ করো, এত আগের থেকে কথা বলোনা, লেখা শেষ করে প্রকাশকদের সাথে যোগাযোগ করবে। তোমার ভাগ্নি টুম্পা কী বলেছে জানো? বলেছে, মামীকে বলবি, প্রতিদিন যেন চারটা পাঁচটা করে লেখা পোস্ট না করে, একটা করে যেন করে।
বললাম, মা রে! আগে থেকে কথা বলি নিজেকে উৎফুল্ল রাখার জন্য, সব সময় একটিভ থাকার জন্য, রেগুলার লেখা পোস্ট করি বলেই একজন প্রকাশক আমাকে সহযোগীতা করার জন্য এগিয়ে এসেছে, সে আমাকে অনেক উৎসাহ দিচ্ছে, সে বাংলাদেশে বিরাট বড় কেউ নয়, কিন্তু তার হৃদয়টা অনেক বড়, আমি জানতাম, কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে।

মিশা কী যেনো বলছিল, মিথীলা আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, দুই সেকেন্ড অপেক্ষা করে বললো,
" হ্যারীপটারের লেখিকা তার স্ক্রিপ্ট নিয়ে ১২ জন পাবলিশারের কাছে গিয়েছিল, কেউ রাজী হয়নি ওটা ছাপাতে, তের নাম্বার পাবলিশার রাজী হয়েছিল, হ্যারীপটারের পপুলারিটি দেখে এখন সেই বারো পাবলিশার অনেক আফসোস করছে।"

আমি কী করবো এই মেয়েদেরকে নিয়ে, মাথায় তুলে নাচবো নাকি কী করবো, বুঝিনা। আমার কাজ করতে কষ্ট হচ্ছে ভেবে গতকাল মিথীলা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কিছু হেল্প লাগবে কিনা। বলেছি, তুই তো রান্নাও করতে পারিসনা, রান্নায় হেল্প কর, তাহলে বুঝবো, কেমন হেল্পফুল তুই। ডিমের ঝোল রান্না করতে পারবি? আমি বলে দিচ্ছি রেসিপি, কাজ থেকে ফিরে যেনো দেখি রান্না কমপ্লীট।

আমাদের তিনজনের জন্য চারটি ডিম রেঁধেছিল মিথীলা, যখন ছবিটি তোলা হয়েছে, ততক্ষণে তার পাপার খাওয়া শেষ, তিনটি ডিম পড়েছিল। পাপাকে জিজ্ঞেস করেছে, " পাপা ডিমের ঝোল কেমন হয়েছে? পাপা বলেছে, " ভাল হয়েছে"।
আমাকে জিজ্ঞেস করার আগেই আমি দুই চক্ষু স্থির করে ফেলেছি, এত ভাল হয়েছে খেতে, মনে হয়েছে আরিচা ঘাটের হোটেলে রান্না করা ডিমের ঝোল। ঠিক তেমনই গন্ধ, আমি কত দিন চেষ্টা করেছি, পারিনি, মিথীলা পেরেছে সেই আরিচা ঘাটের ডিমের ঝোল রান্না করতে।



মা, মাটি, মানুষ!!

আমার মেজো মেয়ে মিশা দেশ থেকে প্রতিদিন আমার সাথে স্কাইপে কথা বলে। ওর হাত ধরেই আমার ফেসবুক জগতে প্রবেশ, ওর কাছেই স্কাইপ শেখা। ওর কাছ থেকে শেখা জিনিস, ওর ওপর অ্যাপ্লাই করছি। তাজ্জব দুনিয়া, বাটনের এক চাপে মা-মেয়ে মুখোমুখি।

জীবনে এ জায়গা, সে জায়গা করেছি অনেক, তাই মেয়েটি বাংলা বেশীদিন পড়তে পারেনি, তার আগেই আমেরিকায় চলে এসেছি। কিন্তু বাংলা বাংলা করে প্রাণাতিপাত করে যাচ্ছি। এই মেজো মেয়েটির মধ্যে দিন দিন আমার পাগলামীর পুরোটাই প্রকাশ পাচ্ছে। বাংলা পারুক না পারুক, বাংলাদেশের হাল হকিকত সম্পর্কে সে সদা সচেতন। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবসে তার ফেসবুকের ওয়াল ইংলিশের বদলে লাল-সবুজের বাংলা হয়ে যায়। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে, আমার আগেই ওর ওয়ালে সব খবর আপডেটেড হয়ে গেছে।

সামার রিসার্চ ওয়ার্ক নিয়ে সে বাংলাদেশেই যাবে বলে আগেই ঠিক করেছিল, সেখানেই গেছে। নিজ থেকেই ঠিক করেছে, কাজ শুরুর দশ দিন আগে দেশে পৌঁছার বিষয়টি। মামার বাড়ীর সবাইতো মিশার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। মামাবাড়ীতে মিশার ভারী আদর। মামারাতো আদর করেই, মামীগুলোও মিশার জন্য পাগল। মিশা তালের শাঁস খেতে ভালোবাসে, মিশা শুটকী ভর্তা খেতে ভালোবাসে, মিশা আটার রুটি খেতে ভালোবাসে, এই সকল তথ্য মামীদের নখদর্পণে। কোন কষ্টকেই মামীরা কষ্ট মনে করেনা। আর এবছরতো মিশার প্রতি খেয়াল আরও বেশী রাখতে হচ্ছে, দিদাশূণ্য বাড়ীতে দিদার আদরের নাতনী বেড়াতে গিয়েছে, আদর-যত্নে ত্রুটি রাখছেনা কেউ। এইসকল কারণেই মিশা এখনও দেশে যাওয়ার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

বাংলাদেশে গিয়েই সে 'দাদু' কে নিয়ে পড়লো। দাদুর সাথে হাসি ঠাট্টা করে দাদুর অবসাদগ্রস্ত মনকে একটু হালকা হতে দেয়া, দাদুর জন্য জিলাপী কিনে আনানো, ল্যাপটপে স্কাইপ চালু করে দাদুর মেয়ের সাথে দাদুর সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দেয়া, এমনই আরও অনেক কিছু। দাদু হয়তো টিভির দিকে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, মিশা ঘরে ঢুকেই দাদুর দিকে দুই হাত বাড়িয়ে বলবে, " হেল্লো দাদু, হাউ আর ইউ?" মিশার দাদু পরিবারে 'রয়েল বেঙ্গল টাইগার' নামে পরিচিত। সেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার এখন বুড়ো হয়ে গেছে, সঙ্গীনি চলে গেছে, তাই মনমরা হয়ে বসে থাকে। কিন্তু মিশা তার দাদুর মনমরা ভাব কাটিয়ে তোলার জন্য নানা রকমের পাগলামী করে, নাতনীর প্রতি দাদু মমত আবোধ করে, নাতনীকে কাছে ডাকে, দুই চারটা কঠিন কথাও নাকি হাসিমুখে শুনিয়ে দেয়, তেমনটাই মিশা আমাকে বললো। দশদিন পর তার রিসার্চের কাজ শুরু হতেই তাকে দাদুর বাড়ী ছেড়ে যেতে হয়েছে, তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি, ফোন করে করে দাদুর কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে।

মিশা আমাকে সেদিন বলছিল, মা, দাদুকে সবাই ভয় পায়, কিন্তু দাদু অনেক মজার মানুষ। আমি ইচ্ছে করে দাদুর সামনে গিয়ে বলতাম, হাই দাদু, কেমন আছো, আই লাভ ইউ! দাদু হাসতো আর বলতো, তুই কী আর বড় হইবিনা? তোরে তো কোন পাগল ছাড়া ভাল মাইনষে বিয়া করবোনা। আমি কী তোর বিয়া দেইখা যাইতে পারমু?" মা, কী সুইট করে কথা বলে দাদু। এখন দাদুকে ফোন করলে ফোন রাখার আগে দাদু নিজেই বলে, থ্যাঙ্ক ইউ, বাই বাই, সী ইউ!" সেদিন দাদুকে জিজ্ঞেস করেছি, দাদু, তোমার জন্য কী নিয়ে আসবো? দাদু বলে , ল্যাংড়া আম আনিস।" মা, সমস্যা হয়েছে, আমি নারায়ণগঞ্জ ফিরতে ফিরতে আম বাগানের আম ফুরিয়ে যাবে।

আমি বললাম, একবার তো দাদুকে আম খাইয়েছো, আম ফুরিয়ে গেলে কী আর করা!
মিশা বলে, মা, একবার খাইয়েছি, কিন্তু দাদু কখনও কিছু চায়না, মুখ ফুটে বলেছে ল্যাংড়া আমের কথা, এটা না খাওয়াতে পারলে আমার অনেক খারাপ লাগবে।
মিশা এখন ফিল্ডে আছে। রিসার্চের জন্য ডাটা কালেক্ট করতে হচ্ছে। দশ বারোজন কর্মী ওকে ডাটা কালেক্ট করতে সাহায্য করছে। গতকাল রাতে আমাকে ও বলেছিল, " মা, এই ডাটা কালেকটারদেরকে মিষ্টি খাওয়াবো, ওরা আমার জন্য কত কাজ করে দিচ্ছে। ওরা সবাই এত সরল, এত সাধারণ, আমার খুব ভালো লাগে। আমি তো এদের সবাইকে আপা ডাকি, ছেলেদেরকে ভাইয়া ডাকি। ওরাও আমাকে আপা ডাকে। বললাম, " খুবই ভাল কথা। খাওয়াইও মিষ্টি"। মিশা বলে, " মা, এখানে মানুষজন একটু মিষ্টি কথা শুনলেই খুশী হয়। আমার একটা জিনিস খারাপ লাগে, সেটা হচ্ছে, যারা একটু নীচু পোস্টে কাজ করে, তাদেরকে সবাই, যারা উপরের পোস্টে আছে, সব সময় বকে বকে কথা বলে। ছি! মানুষের প্রতি মানুষের মিনিমাম রেসপেক্ট থাকা উচিত, এটা সবাই ভুলে যায়। আমার কী মায়া লাগে ওদের মুখের দিকে তাকালে!"

বললাম, মায়া থাকা ভাল, তুমি মানুষকে ভালোবাসবে, সেই ভালোবাসা দ্বিগুণ হয়ে তোমার কাছে ফিরে আসবে।

মিশা বলে, ভালোবাসা অলরেডী দ্বিগুণ হয়ে আসতে শুরু করেছে। আমি তো মেহেন্দি দিতে ভালোবাসি, এটা তো ওরা জানে, আজ একজন বাড়ী থেকে মেহেন্দী বাটা নিয়ে এসেছে, আর দুই জন শবেবরাতের হালুয়া নিয়ে এসেছে। আমি তো মিষ্টি বেশী পছন্দ করিনা, কিন্তু ওরা ভালোবেসে নিয়ে এসেছে, তাই নিয়েছি।

ছোটবেলাতেও তুমি সব বাড়ীর কাজের বুয়াদের সাথে খুব খাতির করতে। কারো বাড়ীতে বেড়াতে গেলে তুমি হাঁটতে হাঁটতে ওদের রান্না ঘরে চলে যেতে, হা হা হা! তোমাকে খুঁজে পাওয়া যেত বুয়াদের কোলের ভেতর। যখন তোমার বয়স আড়াই বছর, তুমি ঘরের সব ছোট ছোট জিনিস বারান্দার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে ওপাশের বস্তীর ছেলেমেয়েদেরকে দিয়ে দিতে। আমার কত গ্লাস, চামচ তুমি ফেলে দিয়েছো। আর দিদিসোনার পুতুলগুলো তো তুমি গ্রীলের ফাঁক দিয়ে আমাদের কেয়ারটেকারের মেয়েকে দিয়ে দিতে। এটা খুব ভালো গুণ মিশা, মানুষকে ভালোবাসা খুব ভাল। আজকে তোমার কাছ থেকে মিষ্টি পেয়ে ওরা খুব খুশী হয়েছে, তাইনা?

-হা হা হা!! মা মজার কথা শোন, এখানে তো সবাই কত গরীব, কিন্তু সবার মনটা খুব ভাল। আমাকে বলে, " আপা , আপনের স্কাইপ আইডি দেন, চেহারা দেইখা কথা কমু। "

আমি বলি, গরীব বলছো, আবার স্কাইপ অ্যাকসেস আছে, তাহলে মন এহয় গরীবনয়া। ওরা মেয়ে নাকি ছেলে? কে চেয়েছে স্কাইপ আইডি?

স্কাইপ আইডি চেয়েছে দুই তিনটা আপা, আর দুইজন ভাইয়া ই-মেইল আইডি চেয়েছে। মা শোন, আপাগুলো এত খুশী হয়েছে আমার উপর, ওদের সাথে অন্য কেউ তো এমন নরম করে কথা বলেনা, তাই উনারা বলে, " আপা , আপনারে ফেসবুকে অ্যাড কইরা নিমুনে, তারপর চ্যাট করুম"। হা হা হাহ ! মা, বাংলাদেশ কত এগিয়ে গেছে, আমার কী ভাল লেগেছে। ওদের মোবাইল ফোনে আমার সাথে ছবি তুলেছে, সেই ছবি আবার ফোনের হোম স্ক্রীনে বসিয়েছে। মা, আমেরিকার একটি জিনিস অনেক অনেক ভাল, আমেরিকাতে কোন উপরের ক্লাস বা নীচের ক্লাস বলে কিছু নেই। সবার সাথেই সমান ব্যবহার, কিন্তু বাংলাদেশে কাজ করতে গিয়ে বড়-ছোট ব্যাপারটা আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে।

ভাল তো, কষ্ট পাওয়া ভাল, মানুষ মানুষের জন্য, এই যে তুমি একা একা এতদূর গিয়ে কাজ করছো, বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সাথে তোমার কী সুন্দর সম্পর্ক তৈরী হচ্ছে, আমার খুব ভাল লাগে। ভবিষ্যতে যদি দেশের অবস্থা ভাল হয়, তাহলে আমি বলবো, দেশে গিয়েই তোমার মেধাকে কাজে লাগাবে, টাকা -পয়সা বড় কথা নয়, সাধারণ খেয়ে পড়েও মানুষের জন্য কাজ করতে পারলে অনেক তৃপ্তি পাওয়া যায়। এই যে তুমি আমার বাবাকে এত ভালোবাসা দিয়ে ঢেকে রেখেছ, হোক তা অল্পদিনের জন্য, তবুও এটুকু দাদুর জন্য দরকার ছিল। আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ, তুমি খুব ভাল একটা মেয়ে।

মা, তোমার বাবা, আমার কিন্তু দাদু হয়, এটা ভুলে যেয়োনা। মা, আরেকটা ভালো কথা বলতেই ভুলে গেছি, এখানে স্কুলের বাচ্চাগুলি আমাকে যে কী পছন্দ করে। ক্লাসে দেখা হোক, পথে দেখা হোক, 'আপা আপা' করতে থাকে। সেদিন এক বাচ্চা আমার জন্য পদ্মফুল নিয়ে এসেছে, জল থেকে তুলে আনা, একেবারে টাটকা পদ্মফুল।

একটি ভয়েস মেসেজ

আজ আমার চতুর্থ মেয়েটি কল দিয়েছিল, কল রিসিভ করতে পারিনি। টি-ব্রেকে ফোন চেক করে দেখি ভয়েস মেসেজ এসেছে। ভয়েস মেসেজ অন করতেই শুনলাম,
" আন্টি, কেমন আছেন? আপনি আপনার নিজস্ব ব্লগে 'ফেসবুক আপডেট' দিয়েছেন, পড়েছি সব। আপনার রান্নার রেসিপি দেখে বাগান থেকে শাক-সব্জী তুলে এনে রান্না করেছি, খুব মজা হয়েছে খেতে।
আন্টি কয়দিন ধরে আমার মন ভাল নেই, পেটে প্রচন্ড ব্যথা, আমি মনে হয় আর বাঁচবোনা[ এই অংশটি বলার সময় আমার মেয়েটি খুব কাঁদছিল]। আন্টি আমার জন্য দোয়া করবেন, আমার কিছু ভাল লাগেনা। আমাকে ফোন করার দরকার নেই, আমার হাজব্যান্ড পছন্দ করেনা, আমিই আবার ফোন করবো। আমার জন্য দোয়া করবেন।"
*** না-দেখা মেয়েটি আমাকে খুঁজে বের করেছিল, আমাকে আন্টি ডেকেছিল, মেয়েটি আমার মধ্যে তার দূর দেশে থাকা মায়ের ছায়া দেখেছিল, ব্লগে লিখিনা বলে আমার লেখা মিস করছিল, তাই আমি ইদানিং আমার নিজস্ব ব্লগে ফেসবুক আপডেটগুলো দিয়েছিলাম, শুধুমাত্র আমার এই চতুর্থ মেয়েটির জন্য।আমার মেয়েটি সব পড়েছে।
ওর ভয়েস মেসেজ পাওয়ার পর থেকে আমার খুব খারাপ লাগছে, বাচ্চা মেয়ে, মা, বাবা কেউ কাছে নেই, আমি ফোন করে দুটো কথা বলবো, সেটাও পারছিনা, কী জানি, কাঁর জীবনের গতিপথ ঠিক কেমন, তাতো জানিনা। আজ মেয়েটির শরীরে যতটা কষ্ট, মনে তার চেয়ে চারগুণ বেশী কষ্ট। প্রবাসের এই একাকী জীবনে, বাচ্চা মেয়েটি যেন অতিরিক্ত একা! আমি ওর জন্য সব সময় ভাবি, মন থেকে দোয়া করি, সাত সমুদ্র তের নদীর পারে, বেঙ্গমা বেঙ্গমীর দেশে আমার মেয়েটি যেন সুখী হতে পারে। ওর স্বামীটির অন্তর থেকে সকল ভয়, হতাশা, অবিশ্বাস দূর হয়ে যাক, আশপাশের সকলকে নিয়ে ওরা সুখে থাকুক।




 পবিত্র শবেবরাতের শুভেচ্ছা!!

আজ পবিত্র শবেবরাত, বন্ধুদের সবাইকে শুভেচ্ছা। শবেবরাত শব্দটির সাথে আমার সাথে চালের আটার রুটি আর নানা রকম সুস্বাদু হালুয়ার মাধ্যমে পরিচয়।নারায়ণগঞ্জে যে বিশাল বাড়ীতে আমি বড় হয়েছি, সেখানে ১৭ টি হিন্দু ভাড়াটে, একটি মুসলিম ভাড়াটে এবং একমাত্র মুসলিম বাড়ীওয়ালা মিলেমিশে থাকতাম। আমার প্রাণের বন্ধু ছিল দিনা, সেই একটি মাত্র মুসলিম ভাড়াটে খালুর বড় মেয়ে, শবেবরাতের সকালেই পাঁচ রকমের হালুয়া সহ চালের আটার রুটি দিয়ে ট্রে সাজিয়ে আমাদের বাসায় নিয়ে আসতো। বিকেলের দিকে বাড়ীওয়ালী মামীও নানারকম সুস্বাদু হালুয়া আর চালের আটার রুটি দিয়ে ট্রে সাজিয়ে সব ভাড়াটের বাড়ীতে পাঠাতো। কত সুন্দর ছিল সেসব দিন।

গত বছর শবেবরাতের দিন আমরা ঢাকাতেই ছিলাম, আমেরিকা চলে আসার দিন এগিয়ে এসেছিলো। গাড়ীতে চড়ে কোথাও যাচ্ছিলাম, হঠাৎ করে স্মৃতিকাতর হয়ে আমার এক বন্ধুকে এসএমএস পাঠাতেই বন্ধু রিপ্লাই দিয়েছিল, তাদের বাড়ী থেকে আমাদের উত্তরার অস্থায়ী বাসায় হালুয়া রুটি পাঠাবে কিনা! নাহ! মানা করেছি। যে দিন চলে যায়, সেদিন আর আসেনা, হয় আরও ভাল দিন আসে, নাহয় আরও খারাপ দিন আসে।

আমাদের কপালে খারাপটাই জুটেছে। মানুষের অন্তর খুব সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, মানবতার চেয়েও ধর্ম অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে, ক্ষতি ছিলনা যদি ধর্মের মূলবাণী বা মূল সুরটুকু অক্ষত থাকতো!

আজকের পবিত্র রাতে আমার বন্ধুদের ভাগ্যে উজ্জ্বল, সুন্দর বাণী লিখিত হোক, এই কামণা করই।



ইদানিং কিছু কিছু জায়গায় উচিত কথা বলতে চাই, কিন্তু পারিনা! ধর্ম নিয়ে তো কোন কথাই বলিনা, কী জানি, কখন কার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগে যায়, অন্যের ধর্ম তো আর আমার ধর্মের মত হালকা, কৌতুকমিশ্রিত বিষয় নয় যে ইচ্ছে হলেই যাহা খুশী তাহা বলবো। আমার ধর্ম হচ্ছে হালকা, বিনোদনের ধর্ম, এই ধর্ম নিয়ে মজা করা যায়, দেব দেবীরা কিচ্ছু মনে করেনা, দেব দেবীদের সাথে আমাদের দেশের নামগোত্রহীন কিছু প্রাণীর খুব ভাব ভালোবাসা আছে, তারা প্রায়ই দেব দেবীর নাম করে মজা করে, হাসি ঠাট্টা করে, এ ওকে খোঁচা দেয়, দল বেঁধে শ্লোগান দেয়,
"হরে কৃষ্ণ হরে রাম
আওয়ামীলীগের বাপের নাম।"
জয় শ্রীকৃষ্ণ, জয় শ্রীরাম, তোমাদের নামোচ্চারণে যেন আমাদের মত পাপী তাপীদের পাপক্ষয় হয়!




যা কিছু সিনেমা, সব বাংলাদেশের জনগণের বিনোদনের জন্য!

নারী সাংসদ তারাণা হালিমকে আমি সেই কিশোরী বেলা থেকে পছন্দ করি। নতুন কুঁড়িতে নাচ করতো, অভিনয় করতো, আবৃত্তি করতো, সব ক্যাটাগরীতেই ফার্স্ট হতো। সেই মেধাবী তারাণা হালিম আজ মাননীয় সংসদ সদস্য, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী, বঙ্গবন্ধুর কন্যার দলে আছেন, তাকে নিয়ে আমি গর্ব অনুভব করি। তার প্রথম সন্তান এবং আমার প্রথম সন্তান, একই সময়ে , একই ডাক্তারের চিকিৎসাধীনে থেকেই হয়েছে, সেই হিসেবে তাকে আমার মিতা মনে করি।

পাপিয়া বেগম, রানু বেগম, মনি বেগম, শাম্মী বেগম-এনারাও 'মাননীয়' সংসদ সদস্য, খালেদা বেগম আন্টির অনুসারী হয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিপরীতে রাজনীতি করছেন। তাদের সাথে কোন দিক থেকেই আমার পরিচিত হবার সুযোগ মিলেনি, একবার শুধু পাপিয়া বেগমকে 'তৃতীয় মাত্রা' তে দেখেছিলাম স্বামী-সন্তানসহ। সেখানে তাকে দেখেছি একেবারে অন্যরকম, লাজনম্র নারী হিসেবে, ভাল মা হিসেবে।

আজ তারাণা হালিমদের দূর্দিন! মেধার সামনে অমেধার নাচন কুদন চলছে।
গত কয়দিন ধরেই সংসদে রানু, শাম্মী, পাপিয়া, মনিদের খুব জোর 'বাংলা সাহিত্য' চর্চা হচ্ছে, পাপিয়া নাকি এক সময় বিতার্কিক ছিলেন, মনি আপা নাকি 'সংসদীয় বক্তৃতার' উপর এক মাসের জন্য কোর্স করতে আমেরিকা এসেছিলেন, সেটা প্রমান করার জন্য উনারা দেশের সর্বস্তর থেকে বাংলা শব্দ কুড়িয়ে এনে তা দিয়ে সংসদ ফাটাচ্ছেন।

কথায় বলে, চন্দনের সাথে থাকলে চন্দন হয়, শ্যাঁওড়ার সাথে থাকল শ্যাঁওড়া হয়!!!---কথাটি বোধ হয় আংশিক সত্যি। কারণ শ্যাঁওড়া গাছের ছায়ায় থেকে হঠাৎ করেই অপু উকিল একদিনের জন্য প্রভাবিত হয়েছিল, অথচ তারাণা হালিম, সেগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, মেহের আফরোজ চুমকী, সিমিন হোসেন রিমিদের কাছাকাছি থেকেও শ্যাঁওড়া গাছে চন্দনের বাতাস লাগলোনা।
তারাণার মত চন্দনের সাথে থেকেও কীভাবে রানু, পাপিয়া, মনি, শাম্মীদের মুখ থেকে এমন দূর্গন্ধ বের হয়???

কেন বাধ্য হয়ে তারাণাকে বিএনপির সিনিয়র নেতা মওদুদ আহমেদ, এম কে আনোয়ারের কাছে মিনতি করতে হয় এই বলে যে আপনাদের দলে কী কেউ নেই উনাদেরকে এই ভাষায় কথা বলা থেকে বিরত করার? দুজনেই নাকি মিটিমিটি হেসেছেন।

তাঁরা বুঝেন, মিঠা কথা, সুন্দর ভাষা শান্তি নিকেতনে চলে, বাংলাদেশে চলবেনা। মাথা খারাপ হয়েছে উনাদের যে পাপিয়া, মনি, রানু, শাম্মিদের থামাবে? তাহলে বাংলাদেশের জনগণ টিভিতে সিনেমা দেখবে কী করে? আর সিনেমাই যদি না দেখতে পারলো, তাহলে তো ভোট দিবেনা। বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতিতে নেতা, ধর্ম, বর্ণ, রূপ, ঐশ্বর্য্য , গলার জোর, ভাষায় বৈচিত্র্য আসলকথা, এইখানে ঐ বুইরা রবিনদরের ভাষা চলবেনা! কিন্তু মেধাবী তারাণার কাছে তো আর সব কথা খুলে বলা যায়না, তাই মিটিমিটি হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, আমাদের আয়ত্ব কিছু নেই, যা কিছু, সব বাংলার জনগণের জন্য!
11Like · · Promote ·




চার সিটি কর্পোরেশান নির্বাচনের পর পত্র-পত্রিকা জুড়ে 'হেদায়েতী লেখা'র ধুম পড়েছে। কেউ বলছে, আওয়ামীলীগের দলীয় কোন্দল পরাজয়ের কারণ, আগামীতে ক্ষমতায় আসতে চাইলে দলীয় কোন্দল নিরসন করতে হবে, কেউ বলছে পদ্মাসেতুর আবুল হোসেনকে জেলে ঢুকাতে হবে, রেলের কালো বিড়াল মারতে হবে, কেউ বলছে শাহবাগ মঞ্চের নাস্তিকদের নিয়ে বেশী নাচানাচি করা হয়েছে, এখন শাহবাগকে গ্যালন গ্যালন পানি দিয়ে ধুয়ে মুছে সাফ করে ইমরান সরকারকে একটা আছাড় দিতে হবে, কেউ দাবী করছে নাস্তিক বামদেরকে গলাধাক্কা দিয়ে দেশ থেকে বের করে দিয়ে আস্তিকদের গলায় বরণমালা দিতে হবে, কেউ বলছে শেয়ার মার্কেটে সর্বস্বান্ত দুই কোটি ভোটারের হারাণো টাকা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে------হা হা হা হা হা!!! আমি বলি,
ভোটারদের প্রতিঃ ভোট দিতে চাইলে দিবেন, দিতে না চাইলে দিবেননা। এত কথার দরকার কী?
সরকারের প্রতিঃ এত কষ্ট করার দরকার কী? ক্ষমতা ছাড়াই আমরা কত সুখে আছি, কেউ আমাদেরকে হেদায়েত করার সাহস পায়না, কী দরকার এই ক্যাচালে গিয়া, তার চেয়ে ক্ষমতাগ্রহীদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে আমাদের মাঝে চলে আসেন।




আঁতে ঘা লাগা!

আমরা বড় হয়েছি বাবা মায়ের কঠিন শাসনের ভেতর। পুরোপুরি বাবা মায়ের অনুগত ছিলাম। বাবাকে তো আড়ালে সিংহ ডাকতাম, এমন হুংকার দিত যে রাস্তা থেকেও শোনা যেত বাবার কন্ঠ, একেবারে বজ্রকন্ঠ, বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত বলে কথা।
বাবার হুংকার শুনে বড় হয়েছি তো, তাই মনের ভেতর থেকে 'অনুগত' ভাব দূর করতে পারিনি। ছোটবেলায় থেকেছি বাবা মায়ের অনুগত, ছাত্রাবস্থায় শিক্ষকের অনুগত, সংসারে স্বামী/স্ত্রীর অনুগত এবং কর্মস্থলে সহকর্মী থেকে শুরু করে কর্তাব্যক্তিদের অনুগত।

আমার মধ্যে 'অনুগত' ভাবটা খুব প্রবল। আমার এই দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেকেই অনেক সময় আমার সাথে অসমীচীন ব্যবহার করে থাকেন, আমি মাথা নীচু করে থাকি, অনুগত স্বভাবের কারণে। কিন্তু হলে হবে কী, সিংহ বাবার মেয়ে আমি, সিংহের কিছুটা তেজ তো ভেতরে ভেতরে আছেই, সেই তেজটুকু দিয়েই মাঝে মাঝে হুংকার দেই। ইদানিং সিংহ ভাবটা খুব ঘন ঘন জেগে উঠছে, কেবলই হুংকার দিতে ইচ্ছে করে, অভ্যাস নেই বলে পারিনা। তবে আজকে ওয়ালমার্টে দিয়েছিলাম তেমনই এক হুংকার।

টি ব্রেকে আমি কফিরুমে বসেছিলাম। একটা মজার বিষয় হলো, ব্রেকের নাম 'টি ব্রেক, অথচ এখানে চা এর ব্যবস্থা নেই, শুধু কালো কুষ্ঠি কফি, ক্রীমার অবশ্য থাকে, কিন্তু আমি চায়ের দেশের মানুষ, দুধের স্বাদ কী ঘোলে মিটে? কফি কখনও ইস্পাহানী চা অথবা দার্জিলিং চা এর বিকল্প হতে পারেনা। সেই জন্য টি ব্রেকে ওয়ালমার্টেই থাকলেও লাঞ্চ ব্রেকে বাড়ী চলে আসি।

আজ টি ব্রেকে চা এর বদলে বসে বসে কমলা খাচ্ছিলাম। আমার পাশেই বসেছিল টাকওয়ালা জিমি। জিমি হোয়াইট আমেরিকান, গাড়ী সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে চাকুরী করে। সব সময় ফিটফাট হয়ে থাকে, পাম্পশু মশমশিয়ে হাঁটে, দেখে মনে হয়, স্টোর ম্যানেজার। হাঁটা চলার সময় দেখা হলে জিমি খুব আন্তরিকভাবে হাসে। আমিও আন্তরিকভাবেই হাসির উত্তরে প্রতি হাসি দেই। ওয়ালমার্টে কিছু কিছু এসোসিয়েট আছে, সাদা অথবা কালো, তারা আমাকে খুব স্নেহ করে, তারা খুব হৃদয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করে, আমার একাকীত্ব। যে কোন সময় আমাকে দেখলেই হলো, কোন না কোন ভাবে আমার প্রতি তাদের ভালোবাসাময় অনুভূতি জানিয়ে দেয়। আমিও তাদেরকে অনেক আপনার জন বলে গণ্য করি।
জিমির কথা বলছিলাম। ফিটফাট জিমি বছর দুই আগে এক ঝামেলায় পড়ে গেছিল, তার চাকরী নিয়ে টানাটানি। দুই বছর আগে তার এক কালো সহকর্মীকে খেয়ালের বশে অথবা গল্পচ্ছলে বলেছিল, " এক সময় তো আমরা তোমাদের প্রভু ছিলাম"। ব্যস! যায় কোথায়, সেই সহকর্মী ব্যাপারটিকে ঠাট্টা হিসেবে না নিয়ে সরাসরি স্টোর ম্যানেজারের কাছে চলে যায়।

আমাদের স্টোর ম্যানেজারের গায়ের রঙ আলকাতরার মত কালো, মাথা পুরোপুরি শেভ করা, গড় আমেরিকানদের তুলনায় বেঁটে, গাট্টা গোট্টা চেহারা, হাসি দিলে সাদা দাঁতগুলো দেখা যায়, নাক চোখ মুখ দেখা যায়না। এহেন কালো মানুষের বউটি কিন্তু হোয়াইট। যাই হোক, সেই সহকর্মী স্টোর ম্যানেজারের কাছে নালিশ করেই ক্ষান্ত হয়নি, অন্যান্য কালো সহকর্মীদের কাছেও এই কথা প্রচার করেছে।

যারা এখনও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে কালোরা এখনও বর্ণবাদের শিকার হচ্ছে, তাদের সাথে আমি দ্বিমত পোষন করি। কালোদের রাজ্যে কালোরাই রাজা, সাদারা মিনমিনে প্রজা। তবে এই রাজাগিরির মধ্যে বাহাদুরী কিছু নেই, সত্যিকারের রাজা হয়ে উঠতে প্রতিটি কালো মানুষকে বারাক ওবামা অথবা মার্টিন লুথার কিং এর মত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান হতে হবে। কিন্তু ওর আওনেক বোকা। লুথার কিং এর স্বপ্ন সফল হয়নি। বরং আমি বলি, লুথার কিং এর স্বপ্ন যদি বাস্তবায়িত না হয়ে থাকে তার জন্য সাদাদের চেয়ে কালোরা নিজেরাই দায়ী বেশী।

যাক, এ প্রসঙ্গ এখানে থাক। সেদিন সারা ওয়ালমার্টের কালো এসোসিয়েটরা জড় হয়ে ফিসফিস করে 'জিমি'র চৌদ্দ গুষ্ঠী উদ্ধার করছিল। কীভাবে জিমি'র চাকরীটা থেকে গেল, আমি জানিনা, কারণ আমি এইসব ঝামেলার মধ্যে যাইনা। সত্যি কথা বলতে কী, সাধারণ গড়পড়তা কালো ছেলেদের সাথে কথা বলা যায়, ওরা খুব হাসি খুশী আমুদে মুডে থাকে, দুই চারজন ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণ কালো মহিলাদের আমি ভয় পাই, ওদের চেহারায় সব সময় এক ধরণের হিংস্র, ঝগড়াটে ভাব ফুটে থাকে। ঘরে যদি এই কথা বলি, আমার মেয়েরা সাথে সাথে আমাকে 'রেসিস্ট' বলে, সাথে এটাও বলে যে কালোরা জীবনে প্রতারিত, তাই ওদের মন মেজাজ খিটখিটে থাকে। আমি আমার মেয়েদের সাথে তর্ক করতে যাইনা, ওরা ওদের সুন্দর মানসিকতা নিয়েই এগিয়ে যাক সামনের দিকে, আমার মানসিক গঠন আর ওদের মানসিক গঠন তো এক নয়। আমি জানি, 'সংখ্যালঘু' হয়ে সংখ্যাগুরুর মাঝে টিকে থাকার যন্ত্রণা, আমি জানি সত্যিকারের প্রতারণা কাকে বলে, সত্যিকারের জীবন যুদ্ধই বা কাকে বলে। গত তিন প্রজন্ম ধরে কালোদের সেই অতীতের বঞ্চনাকাল আর নেই, ওরা চাইলেই কত সহজে সামনের দিকে এগিয়ে জেটে পারে, কিন্তু ওদের সেই বোধটাই নেই। আমার মেয়েরা এইসব মানতে রাজী নয়। যাক, যে কথা বলছিলাম, জিমির চাকরীটা বেঁচে গেল, কিন্তু জিমি আর আগের মত ডাট দেখিয়ে, বুক চিতিয়ে, পাম্পশু মশমশ করে হেঁটে গেলেও ঠিক আগের মত আর 'স্টোর ম্যানেজার' মনে হয়না। 'কালো দাগ' পড়ে গেছে ছোট একটি হাসি ঠাট্টার ঘটনায়।

জিমি আমাকে বলল, " হেই রীটা, তোমার দেশেতো এখন প্রবল বর্ষণ হচ্ছে, প্রচুর মানুষ মারা গেছে, ৬০০ এর বেশী"।
বললাম, " জিমি, তুমি ইন্ডিয়ার কথা বলছো, আমার দেশেও বর্ষণ হচ্ছে, তবে বন্যা হচ্ছেনা।

জিমি বলল, তোমাদের ওখানে প্রায়ই প্রাকৃতিক দূর্যোগ হয়।

মিনিট দুয়েক চুপ থেকে বলবনা বলবনা করেও বলে ফেললাম, " আচ্ছা, তোমরা সব সময় আমার দেশের খারাপ সংবাদটাই পাও কেন? ভাল কিছু সংবাদ পাওনা?

জিমি থতমত খেয়ে গেল, অদূরেই আরেকটি টেবিলে বসেছিল আরেকটি সাদা ছেলে এবং একটি কালো ছেলে। ওরাও চমকে গেল, জিমি বললো, 'টিভি নিউজে নেগেটিভ খবর এলে আমরা কী করবো?

বললাম, তোমরা বলতে তোমাকে বুঝাইনি, তোমাদের টিভি মিডিয়াকেই বুঝিয়েছি, সব সময় দেখাবে এশিয়াতে সাইক্লোন, সুনামী, বন্যা, খরা, কলেরা, দালান ধ্বস, মানুষের মৃত্যু, হোয়াই? আমাদের দেশেও তো ফুল ফোটে, আমাদের দেশেও মানুষ হাসে, আনন্দে নাচে, এক জন আরেকজনকে সাহায্য করে, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা কত স্মার্ট হয়, এই যে আমাকেই দেখ, আমি কত স্মার্ট, নাহলে শতভাগ মিসিসিপিয়ানের মধ্যে আমি একা বাঙ্গালী টিকে আছি কী করে?

আরে তুমি তো স্মার্টই, আসলে টিভিতে তো ক্যালিফোর্ণিয়ার বৃষ্টিও দেখায়, মাইলের পর মাইল বন আগুনে পুড়ে যায়, সেটাও তো দেখায়। ক্যাটরিনাও দেখিয়েছে। তাই ইন্ডিয়ার বন্যা দেখায়।

-জিমি, শোন, আমার এখানে যখন ফোন কিনতে কাস্টমার আসে, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে , তুমি কী ভারতীয়? বলেই শুরু করে, তোমাদের দেশে তো শুধু মানুষ আর মানুষ। টিভিতে দেখি, বাপরে! কত মানুষ! আর তোমাদের খাবার কী ঝাল, মাগো, মরে গেলেও তোমাদের দেশে যাবনা। কেন এভাবে কথা বলে, বলতো? আমাদের দেশে মানুষ আছে বুঝলাম, তোমাদের দেশে মানুষ কম, জায়গা খালি পড়ে আছে, তোমরা এত ধনী দেশ, কিন্তু তোমাদের আত্মা ছোট, আমাদের দেশের এত মানুষ থেকে কিছু মানুষ নিয়ে আসো, জায়গা ছেড়ে দাও, ওরা চাষ বাস করুক। তা করবেনা, শুধু বলবে, মাগো, কত মানুষ। হা হা হা হা!!!

-বাপরে! তুমি তো রেগে গেছ।
-সত্যি কথা বললাম, রাগ করবো কেন? সত্যিইতো, আজ পর্যন্ত কেউ এসে বলেনি, আজ তোমার দেশের নদী দেখলা, নদীতে কী সুন্দর নৌকা দেখলাম, তা নয়া, শুধু বন্যা দেখলাম। যতসব।

ওপাশ থেকে হোয়াইট ছেলেটা বলল, আমি ইন্ডিয়ার উপর পড়াশোনা করছি, একদিন যাব, হাতীর পিঠে চড়বো। ওখানে হাতী কী সুন্দর, অনেক সুন্দর করে সাজানো থাকে, আর ওখানকার মানুষ সব সময় আনন্দ ফূর্তি করে! শুধু নাচে আর নাচে। আমার দারুণ লাগে। আরেকটা জিনিস দেখতে যাব, কিছু সাধু মানুষ এই বড় বড় কোবরাকে গায়ে পেঁচিয়ে রাখে, ওদের সামনে বাঁশী বাজায়, আর কোবরা গুলো নাচে।

আমি বললাম, প্লীজ স্টপ দিস। আমার স্নেইক ফোবিয়া আছে, এই প্রসংগ এখানেই থাক। তোমরা অবশ্যই পড়বে, শুধু নিজের দেশকেই জানো, অন্য দেশকেও জানতে হয়, সব দেশেই ভাল-মন্দ আছে। তোমাদের দেশ নিয়ে কেউ যদি খারাপ কথা বলে, তখন তোমাদের খারাপ লাগবে, একই ব্যাপার আমার বেলায়ও ঘটে। তোমরা আমার বন্ধু বলেই আমিও হাসতে হাসতে সত্যি কথাটি বলে ফেললাম। মিডিয়ার তো খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, সব দেশের মিডিয়া একই চরিত্রের।



 মায়ের গন্ধ!

প্রতিদিনই কাজ থেকে ফিরে এক মুহূর্তের জন্য মনে পড়ে যায়, একাত্তর টিভি দেখতে হবে, টিভি রুমে উঁকী দিয়ে দেখি, সিএনএন চলে, দর্শক মাত্র একজন। সিএনএন-এর দর্শককে বলি, চ্যানেল ঘুরিয়ে একাত্তর দাওতো! এটা শুনলেই সিএনএনের দর্শকের মাথা গরম হয়ে যায়। বলে, " তুমিই চেঞ্জ করে নাও, আমি গেলাম। যদি বলি, " আরে! দেশের সংবাদটা শোনো"। সাথে সাথে আমাকে সম্মান দিয়ে বলবেন, " আপনিই শোনেন দেশের সংবাদ, আমি এমনিতেই সব সংবাদ পাই।"

আজকেও একই কান্ড। মিঃ সিএনএন বললো, " তুমি পারনা চ্যানেল চেঞ্জ করতে"?
আমি বলি, থাক চ্যানেল চেঞ্জ করতে হবেনা, তুমি যেটা দেখছিলে, দেখো। একাত্তরে কী আর দেখাবে? কবি হেলাল হাফিজের বাজার এখন খুব চড়া, সেটাই দেখাবে। কিছুদিন আগে ছিল হাসনাত আবদুল হাই এর বাজার চড়া, এবার হেলাল হাফিজ। সাহিত্যের বাজার খুব রমরমা এখন, একাত্তর না দেখে বরং সাহিত্য রচনা করি গিয়ে। আমাদের 'সুখীর মা' কিছু ডায়ালগ দিত, সেগুলো মনে আছে, সেই ডায়ালগগুলো যদি নানা চরিত্রের মুখে বসিয়ে দিতে পারি আর সমানে প্রচার চালাতে পারি, আগামী বইমেলায় আমিও হিট হয়ে যাব।"

আমার প্যাঁচাল শোনার ধৈর্য্য মিঃ সিএনএন-এর নেই, সে একাত্তর টিভি অন করে দিয়ে অন্যকাজে চলে গেছে। আমি দেখি 'একাত্তর সংযোগ' দেখাচ্ছে। বরিশালে কেন শওকত হোসেন হিরণ পরাজিত হলো, তারই বিশ্লেষন। বিশ্লেষন দেখে খারাপ লাগলো, সত্যিই, ক্ষমতা মানুষকে হিংসুটে বানায়, ঈর্ষাপরায়ণ বানায়, নিজের নাক কেটে নিজেরই যাত্রা ভঙ্গ করে দেয়। কী ক্ষতি হতো নিজ দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করলে, আর কী-ইবা লাভ হলো ভেতরে ভেতরে শত্রুতা করে। আমও গেলো, ছালাও গেলো।

এসবই ভাবছিলাম, বিরতি শুরু হলো, প্যারাস্যুট নারকেল তেলের বিজ্ঞাপণ দেখাচ্ছিল। ভীষনভাবে চমকে উঠলাম, মনে পড়েছে, প্যারাস্যুট নারকেল তেলের নাম মনে পড়ছিলনা সেদিন। অনেক চেষ্টা করছিলাম তেলের নাম মনে করতে, বার বার আওড়াচ্ছিলাম, মা জানি কোন ব্র্যান্ডের তেল দিত? এই তো, এখন মনে পড়েছে, হ্যাঁ, মা প্যারাস্যুট নারকেল তেল চুলে মাখতো। আমার বাসায় বেড়াতে আসার সময় নীল রঙের বোতলটা সাথে করে নিয়ে আসতো, কারণ আমার বাসায় মাথার তেলের কারবার ছিলনা। মায়ের আরও কিছু কিছু উদ্ভট অভ্যাস ছিল, যেমন মা কখনও চুলে শ্যাম্পু ব্যবহার করতোনা। কাপড় কাচার জন্য 'জেট' পাউডার পাওয়া যেত, সেই 'জেট' পাউডার জলে গুলিয়ে মাথা শ্যাম্পু করতো। আমি আর কাউকেই দেখিনি জেট পাউডার দিয়ে চুল ধুতে। এই আমার মা, একেবারে নিজস্ব স্টাইল, নিজস্ব অভ্যাস।

আমার মায়ের বয়সী কাউকেই দেখিনি জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত শাড়ির সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ পড়তে। মেয়েরা 'ম্যাক্সী' পড়ে, অথচ আমার মায়ের দুই চক্ষের বিষ ছিল এই পোষাকটি। সব সময় বলতো, 'কোলবালিশের ওয়্যার"। ভাগ্যের কী পরিহাস, আমার মা মারা যাওয়ার সময় উনার পরণে ছিল উনার আদরের ছোট বোনের একখানা ম্যাক্সী। মা'কে যখন মুমূর্ষু অবস্থায় হসপিটালে নেয়া হলো, আমি সেই মুহূর্তে ফোন করেছিলাম, অনিতাকে বললাম, " অনিতা, মা'কে একটা ম্যাক্সী পড়িয়ে দাও, এই অবস্থায় শাড়ী পড়ানো যাবেনা"। এত যন্ত্রণার মধ্যেও মা কঁকিয়ে কঁকিয়ে বলছিলেন, " ওর কথা বাদ দাও, আমাকে শারী পড়িয়ে দাও, আমার একটা ইজ্জত আছেনা?" ছোট বৌমার সাহায্য নিয়ে সাদা জমিন লাল নক্সী ডিজাইন তাঁতের শাড়ী, সাথে ম্যাচিং লাল ব্লাউজ, কপালে লাল সিঁদুরের টিপ পড়ে গেলেন, হসপিটাল থেকে রিলিজ করে যখন নিয়ে আসি, হসপিটাল কর্তৃপক্ষ মায়ের পরণে থাকা তাদের পোষাক রেখে দিতে চাইল। আমার তখন বোধ নেই, বড়দা মাত্র প্লেন থেকে নেমে সরাসরি হসপিটালে, তাঁরও বোধ নেই, ছোট মাসী অসুস্থ শরীর নিয়ে সুনামগঞ্জ থেকে সাত সকালে এসে পৌঁছেছে, সরাসরি হসপিটালে, সেও ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখ, নার্স রুগীর পোশাক চাইছে, আমরা সকলেই দিশেহারা, মাসীর সাথে ছিল তার কাপড়-চোপড়ের ব্যাগ, তাড়াহুড়োয় মাসী ব্যাগ খুলে হাতের কাছেই পেয়ে গেল তার সবুজ সাদায় কাজ করা সূতী ম্যাক্সী। হসপিটাল থেকে মৃতপ্রায় মা'কে ম্যাক্সীটি পড়িয়ে দিল, মা'কে নিয়ে চলে এলাম। ওভাবেই মা শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন। ছোট মাসী খুব কেঁদেছে আর বলেছে, শেষ পর্যন্ত দিদি শরীরে আমার বস্ত্রখন্ড নিয়ে গেল।

আমার মায়ের নিজস্ব একটি গন্ধ ছিল, সব মায়ের যেমন থাকে। আমার মায়ের গন্ধটা তৈরী হয়েছিল প্যারাস্যুট তেল আর জেট পাউডার থেকে। হা হা হা!! মা'কে এই নিয়ে অনেক ক্ষ্যাপাতাম। আমার মায়ের মাথার বালিশ, শাড়ি, ব্লাউজ থেকেও প্যারাস্যুট তেল আর জেট পাউডারের মিশ্র গন্ধ আসতো, ওটা দিয়েই মা'কে চেনা যেত। মায়ের মৃত্যুর পর আমি যখন আমেরিকা চলে আসি, খুব কাঁদতাম নিরালায়, তেমনই এক নিরালায়, আমি ওয়ালমার্টের এক কোণে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম, হঠাৎ করে আমার মাথার চুল থেকে সেই পরিচিত গন্ধ বের হলো, চমকে গেছি, মাথার চুল টেনে সামনে এনে শুঁকে দেখি, মায়ের গন্ধ। এমনতো হওয়ার কথা নয়, আমি গত ২৫ বছর মাথায় তেল দেইনি। আমার এত ভাল লাগলো, কান্না থেমে গেল। আরেকদিন এমন হয়েছিল, সেটা আমাদের ঘরে। এবার আর চমকাইনি, বুঝলাম, মা আমার পাশে আছে, মা আমাকে ঘিরে আছে, শরীর ধারণ করতে পারেননি, কিন্তু মেয়ের কাছে তাঁর নিজস্ব 'মায়ের গন্ধ' নিয়ে এসেছিলেন।

***অনেকদিন হয়ে গেল, মা আর আসেননা, তাই প্যারাস্যুট তেলের নামটা ভুলে গেছিলাম, মনেই পড়ছিলনা, আজ 'একাত্তর টিভি'তে প্যারাস্যুটের বিজ্ঞাপণ দেখে মনে হলো, মা'কে খুঁজে পেলাম।





মিঠু'স কেমিস্ট্রি ল্যাবে প্রস্তুতঃ সরষে-সবুজ চিংড়ি

চিংড়ির কত বাহারী নাম শুনে বড় হয়েছি। ছোটবেলায় গলদা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি, লবস্টা্রের নাম শুধু শুনেছি, চোখে দেখেছি বলে মনে পড়েনা। সাধারণ মধ্যবিত্তের সংসারে তর্জনী সাইজের চিংড়ি আসতো, দুপুরের মেন্যুতে অতিরিক্ত পদ বাড়ানোর জন্য সেই তর্জনী সাইজের চিংড়ির মাথা আলাদা করে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে ভাজা হতো, আর মাথা ছাড়া দেহটুকু দিয়ে আলু ফুলকপির ডালনা, আলু পটলের ডালনা, বাঁধাকপি বা মোচার ঘন্ট জাতীয় আইটেম রান্না করা হতো।

ছোটবেলায় চিংড়ির মালাইকারী খাওয়া হয়নি, মা ছিলেন দারুণ রাঁধুনী, বাজার থেকে 'কেচকী মাছের' ভাগা আসতো, সেই কেচকীর ভেতর থেকে কুচো চিংড়িগুলো আলাদা করে ঝিঙ্গে, আলু, বেগুন সরু করে কেটে পেঁয়াজ, মরিচ, হলুদ দিয়ে ঝাল ঝাল করে কী যে একটা চচ্চড়ি রান্না করতো, ওটা খেয়ে চিংড়ির মালাইকারীর আফসোস থাকতোনা। তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝে বড়লোক বন্ধুদের মুখে 'চিংড়ি মাছের মালাইকারী'র গল্প শুনে কতবার যে ঢোঁক গিলেছি! বাসায় এসে মা'কে জিজ্ঞেস করতেই জেনেছি, নারকোলের দুধ দিয়ে বড় বড় গলদা চিংড়ির মালাইকারী হয়। তারপর চুপ হয়ে গেছি, আমরা জানতাম, নারায়ণগঞ্জের বাজারে 'ইয়া বড়' সাইজের চিংড়ি পাওয়া যায়না। এরপরতো আমার অ্যালার্জীক অসুখের কারণে আমাদের বাসায় চিংড়ির পাটই উঠে গেছিল। যখন আবার চিংড়ির অধ্যায় চালু হলো, ততদিনে আমরা এক বিঘত সাইজের চিংড়ি দেখে ফেলেছি, মাঝে মাঝে কিনেও ফেলেছি। আর একবার যখন বিঘত সাইজ চিংড়ি কেনাই হলো, নারকোলের দুধ পাওয়া তো মোটেও কঠিন কিছু নয়। নারকেল কুড়িয়ে ঈষদুষ্ণ জলে ভিজিয়ে রাখতে হয় মিনিট দশেক। তারপরতো তা চটকে ঘন দুধ ছেঁকে নিলেই পাওয়া যায় নারকোলের দুধ। বাকী ছিবড়েটাকে দ্বিতীয় দফায় আবার ভিজিয়ে সেটাকেও নিংগে নিলে নারকেলের ছিবড়ায় আর কিছু অবশইষ্ট থাকেনা। যাক গিয়ে, এখানে আমি চিংড়ির মালাকারীর গল্প করতে চাইনা, ওটা এমন আহামরি কিছু খাবার নয়। আহামরী খাবারের গল্প করি।

মাথার উপর পাকা রাঁধুনী ছিলেন আমার ঠাকুমা, দিদিমা এবং আমার মা, তাঁদের কাছ থেকে এই গুণটুকু আমি 'ইনহেরিট' করেছি। বলা ভাল, আমি তাঁদের থেকে এক ডিগ্রী বেশী এগিয়ে গেছি ( আমি ঠাট্টা করছি, ঠাট্টা করতে আমার ভাল লাগে), আমি ট্র্যাডিশন ঠিক রেখে নিজস্ব কিছু বুদ্ধি যোগ করে দিয়ে নিত্য নতুন আইটেম রান্না করি। 'সরষে-সবুজ' চিংড়ি তার মধ্যে অন্যতম। এ পর্যন্ত যারাই খেয়েছে এই আইটেমটি, তারাই দ্বিতীয়বার খাওয়ার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছে। এবার কাজের কথায় আসি। 'সরষে -সবুজ চিংড়ি যে কেউ, যখন তখন রান্না করতে পারবে, এতটাই সহজ।

সরষে সবুজ চিংড়ি রান্না করতে সময় লাগে ২০ মিনিট। উপকরণ লাগে, খোসা ছাড়ানো চিংড়ি, একমুঠো ঝাঁঝ সরষে ( লাল এবং সাদা মেশানো হলে ভাল, ইন্ডিয়ান দোকানের বড়দানা সরষে হলে চলবেনা, ওগুলো একেবারেই অপদার্থ টাইপের সরষে, ঝাঁঝ তো নেইই, খেতেও লাগে মাটির মত), এক গোছা তাজা ধনেপাতা, আট দশটি কাঁচামরিচ, এক মুঠো কোরানো নারকেল, একখানা পেঁইয়াজ, লবনতো লাগবেই।

প্যানে তেল গরম করে পেঁইয়াজের কুচি ভাজতে হবে, তেলে পেঁইয়াজ ভাজা হতে থাকবে, ঐ ফাঁকে পাটা-পুতায় নারকেল, সরষে, কাঁচামরিচ একটু লবনসহ বাটতে হবে। এখানে একটি কথা বলে রাখি, অনেকেই বিশ্বাস করে , কারো কারো হাতে বাটা সরষে নাকি তেতো হয়। কথাটি ঠিকনা। কোন সরষে যদি জাত তেতো হয়, তাহলে সেটা সব সময় তেতো হবে। যাই হোক, সরষে বাটার একটি কায়দা আছে, প্রথম দুই ডলা দিতে হবে জোরসে চেপে, এক ডলাতেই যেন সরষের খোসা ভেঙ্গে মিশে যায়। আমি অবশ্য ব্লেন্ডারে নারকেল, সরষে, ধনেপাতা, কাঁচামরিচ, একটু লবন একসাথে ব্লেন্ড করে নেই। ব্লেন্ডারেও প্রথমবার একটানা ৩ মিনিট ব্লেন্ডার চালিয়ে রাখি। একেবারে ঊদ্দেশ্য সফল হয়, সরষের প্রথম ভাঙ্গাটি খুব ভাল হয়, সরষে তেতো লাগেনা।

প্যানের পেঁইয়াজ বাদামী হয়ে গেলে চিংড়িগুলো ঢেলে দিয়ে আন্দাজমত লবন দিয়ে ( খেয়াল রাখতে হবে, সরষের সাথেও একটু লবন দেয়ার কথা) মিনিট পাঁচেক ভেজে ব্লেন্ডার খালি করে সমস্ত সরষে -ধনেপাতার পেস্ট চিংড়ির সাথে মিলিয়ে, ব্লেন্ডারে একটু জল দিয়ে সেটাকেই ধুয়ে প্যানের চিংড়িতে ঢেলে দিতে হবে। ফুটে উঠলে চুলা অফ করে দিতে হবে। হয়ে গেলো তো 'মিঠু'স স্পেশ্যাল 'সরষে -সবুজ চিংড়ি'। খাও এবার ভাতের সাথে, নাহয় পরোটা বা রুটির সাথে, আর নাহলে পোলাও বা ফ্রায়েড রাইসতো আছেই।

*** আমি হলফ করে বলতে পারি, এই সাধারণ রেসিপিতে চিংড়ি রান্না করে যদি 'সঞ্জীব কাপুর তার খানা খাজানায় চালু করতো, এই একটি আইটেমের জন্যই সঞ্জীব কাপুর 'পদ্মশ্রী' পুরস্কার পেত।
1Like · · Promote ·






ছাগলে কী না খায়!!!

বাংলা প্রবাদে বলে, ছাগলে কী না খায়! আমি কখনও ছাগল পালন করিনি, তাই ছাগলের আহারের রুচী সম্পর্কে ধারণা নেই। তবে প্রবাদ তো আর এমনি এমনি হয়না, কারণ থাকে। অবশ্য ছাগলের দোষ দিয়ে লাভ নেই, মানুষও ছাগলের মতই যা পায়, তাই খায়। মানুষের খাওয়ার বিচিত্র রূপের গল্প কম বেশী সকলেই জানে।
আমার কথাই ধরিনা কেন, যখন ঘাস-পাতা, লতা-মূল জাতীয় খাবার পরম তৃপ্তি নিয়ে খাই, যখন ডাটা চিবোই, ছাগলের মত আমারও চোখের পাতা বুজে আসে, এমন দৃশ্য দেখে আমার মেয়েরা নিশ্চয়ই আমাকে 'হা-ভাতে' ঘরের মানুষ ভাবে। হয়তো ভাবে, আহারে! আমার মামনির ভাল কোন খাবারের সাথে পরিচয় ঘটেনি বলেই বোধ হয় এভাবে মনের সুখে ঘাস-পাতা খায়! ওরা যেখানে এলিগেটার, অক্টোপাস, ব্যাঙ, শামুক, ঝিনুক খায়, আমি তখন কুমড়ো ডগার চচ্চড়ি'র কথা ভেবে কাল্পনিক অশ্রুপাত করি। এই কাল্পনিক অশ্রুপাত করতে করতেই এক সময় মনে হলো, বাড়ীর পেছনের জমিতে লাউ-কুমড়োর চাষ করলে কেমন হয়! যেই বলা, সেই কাজ। পুঁতে দিলাম লাউ-কুমড়োর বীজ।

বীজ পুঁতে দেয়ার কিছু দিনের মধ্যেই চারা বের হলো, আমি আবার লাউ এবং কুমড়োর ছোট্ট পাতা দেখে বুঝতে পারি, কোনটি লাউ, কোনটি কুমড়ো। অবশ্য লাউ বা কুমড়ো শাকের তফাৎ নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। পূর্ব জন্মে নির্ঘাৎ ছাগল ছিলাম, কোন বাছ-বিচার না করেই ঘাস-পাতা চিবিয়ে যাই। প্রতি বছর কুমড়ো ডগায় ফুল ফুটে, সেই ফুলগুলো তুলে এনে প্লাস্টিক ব্যাগে মুড়িয়ে রেফ্রিজারেটারে রেখে দেই। একসাথে ১০/১২টি ফুল হলেই ময়দা, একটু কালোজিরে, এক চিমটে হলুদ গুঁড়ো, একটু লবন মিশিয়ে গোলা তৈরী করে, সেই গোলায় ফুল গুলোকে চুবিয়ে গরম তেলে ছেড়ে দেই, এ-পিঠ ও-পিঠ ভেজে হলদে রঙ থাকতে থাকতেই তেল থেকে তুলে পেপার টাওয়েলে রেখে দেই, অতিরিক্ত তেল শুকিয়ে নেয়ার জন্য।

এ বছর বাগান তৈরী করেছে উত্তম কুমার। আমি মাঝে মাঝে শুধু দুই একবার উঁকী দিয়েছি। সে জানেনা, কোন গাছের বীজ ফেলেছে, কারণ আমার ভাঁড়ার ঘরের কৌটোয় যা যা পেয়েছে, সব বীজ ছড়িয়ে দিয়েছে। চারা বের হওয়ার পর আমি দেখে দেখে বলেছি, কোনটি কোন চারা। সে এমনভাবে বীজ ছড়িয়েছে, একসাথে গায়ের উপর গা লাগিয়ে বিশ পঁচিশটি চারা উঠে গেছে। সেগুলোকে কিছু তুলে ফেলে দিয়েছি, কিছু দূরে দূরে লাগিয়েছি। ইদানিং দেখছি কুমড়োর ডগা বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়েছে। একটু দূরে চার পাঁচটি মূলোর চারা উঠেছিল। খনার বচন আছে, " আট চাষে তুলা, ষোল চাছে মূলা", এর উল্টোটাও হতে পারে। যাই হোক, উত্তম তো দুই চাষও দেয়নি, মূলো তো ভাল হওয়ার কথা নয়। তবুও অপেক্ষা, মূলোর চারা যখন বেরিয়েছে, মূলোও বেরোবে। কুমড়ো ফুল দু'বার বড়া খেয়েছি। আবার ফুল জমাচ্ছি।

গতকাল কুমড়োর ডগা, দু'খানা মূলো, কয়েকটি ঢেঁড়স বাগান থেকে তুলে এনেছি। কুমড়ো ডগার চচ্চড়ি খেতে মন চেয়েছে। ঘরে আলু আর বেগুন ছিল, ফুলকপির ডাটা ছিল, বাগান থেকে তুলে আনা মূলো, আর দেশ থেকে অনিতার পাঠানো মাসকলাই ডালের বড়ি। ধনেপাতা আর কাঁচামরিচ এমনিতেই থাকে, ওটার হিসেব দেয়ার দরকার নেই।

কুমড়ো ডগার চচ্চড়ি (২০ মিনিট)

কুমড়োর ডগা এবং কচি পাতা ধুয়ে আঙ্গুল সমান লম্বা টুকরো করতে হয়। মূলোকে সরু পাতলা করে কেটে নিতে হয়, আলু , বেগুণও লম্বাটে করেই কাটতে হয়। ফুলকপির ডাটা গুলো ঘরে ছিল বলেই কাজে লাগিয়েছি, ওগুলোকেও সরু লম্বা করে কেটে নিয়েছি।

একটি প্যানে তেল দিয়ে, তেল গরম হতেই আঙ্গুলের চিমটি কালোজিরা সেই গরম তেলে ছেড়ে দিয়ে , গোটা চারেক কাঁচা লংকা গরম তেলে ফেলে দিয়েই মূলো আর আলুগুলো তেলে ছেড়ে একটু নাড়া চাড়া করে, আন্দাজমত লবন ( লবনের পরিমান বলার কোন মানে হয়না) ও এক চিমটে হলুদ গুঁড়ো দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে ঢাকা দিয়ে দিতে হবে। তাপ থাকবে মাঝারীর চেয়ে আরেকটু কম। মিনিট পাঁচেক পর বেগুণ আর কুমড়ো ডগা শাকসহ দিয়ে দিতে হবে। আবার নেড়েচেড়ে ঢাকা দিতে হবে। এরপর দশ মিনিট বা পনের মিনিট কোন ব্যাপার নয়, তরকারীতে আলগা জল থাকতে পারবেনা, অথবা তরকারী শুকনো খটখটে হতেও পারবেনা। নামানোর আগে চার পাঁচটি কাঁচালঙ্কা লম্বাটে করে চিড়ে দিতে হবে, ধনে পাতা কুচি দিতে হবে। কিছুক্ষণ আগে ডুবো তেলে ভেজে তোলা মাস কলাইয়ের বড়িগুলো দিয়ে চচ্চড়ি নামিয়ে ফেলতে হবে।

** বড়ি ভাজা দেয়ার পর আর ঢাকা দেয়া যাবেনা। তাহলে বড়ি মচমচে থাকবেনা।

তেল একটু বেশী দিলেও ক্ষতি নেই, তেল কম দিলেও ক্ষতি নেই। আমার ঠাকুমার কাছ থেকে শেখা রান্না, ঠাকুমা এক চামচ আন্দাজ তেল দিত, ঠাকুমার কাছে থেকে শিখেছিল আমার মা, মা তিন চামচ তেল দিত, দু'জনের রান্নার স্বাদই একরকম মনে হতো। কাজেই তেলের পরিমান বড় কথা নয়, রান্নার কৌশলটাই আসল। আলগা জল দিতে হয়না, প্রথম দশ মিনিট ঢাকা দিয়ে কম আঁচে রাঁধতে হয়, সব্জী থেকেই জল বের হবে, সেই জলেই সব্জী সেদ্ধ হবে।

**কুমড়ো ডগার চচ্চড়ির খেতে হয় অপূর্ব স্বাদ, এখন বুঝি, ছাগলে কেন ঘাস-পাতা দেখলেই চঞ্চল হয়ে উঠে!!**
1








মিঠু'স কেমিস্ট্রি ল্যাব
এখন এখানে সামার ভ্যাকেশান চলছে। সামার ভ্যাকেশান ঠিকই, গরমও প্রচন্ড, তবে আম, কাঁঠাল খাওয়ার কোন উপায় নেই, এমনকি শীতল পাটি বিছিয়ে দুপুরে ঘুমাবো, সেই ব্যাপারও নেই। রাম নেই তাই রাম রাজত্ব নেই, মিসিসিপিতে বাঙ্গালী নেই, তাই আম, কা৬ঠাল, শীতল পাটির ব্যাপার নেই। তার উপর আমাকে ওয়ালমার্টের বারোমেসে সেন্টারে চাকরী করতে হয়, উত্তম কুমারকে ভার্সিটিতে সামার ক্লাস নিতে হয়, ছোট মিথীলাকে বেলা বারোটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটাতে হয়। এইসব বিলাসিতা করবোই বা কখন!

ইদানিং আমার সংসারের রেগুলার রুটিনে বেশ কিছু উলট-পালট হয়ে গেছে। তবে ঘরের রুটিন উলট-পালট হয়ে গেলেও সংসারের কোন কিছুই আমার নজর এড়িয়ে যায়না। খেয়াল করেছি, ইদানিং উত্তম কুমার লাঞ্চ ব্রেকে বাড়ী আসেনা, আগে আসতো, যখন আমি দুপুরের জন্য পরোটা, লুচী, হাতে গড়া আটার রুটি, সব্জী, চীজ ফিলড ওমলেট, চিঁড়ের পোলাও, মিঠু'স স্পেশ্যাল নুডুলস বানিয়ে রাখতাম। এখন আমি আর আগের মত সময় পাইনা, তাছাড়া ইদানিং খুব স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে গেছি বলে কিছুদিন স্যালাড, ফলমূল, ভুষি মেশানো আটার রুটি বানিয়েছি, এগুলো আবার উত্তমের দুই চক্ষের বিষ। স্বাস্থ্য সম্মত খাবার এড়াতে সে লাঞ্চ ব্রেকে বাড়ী আসা বাদ দিয়েছে, সে প্রায়ই দেখি নিজে নিজে চিকেন গ্রীল করে, চিকেন কিমা দিয়ে ডাল রান্না করে, ভুট্টা গ্রীল করে, দোকান থেকে নানা জাতের রকমারী স্ন্যাক্স কিনে নিয়ে আসে। পুরো শাহীখানা বানিয়ে ফেলেছে আমার কিচেনকে ( কিচেনকে আমি আমার কেমিস্ট্রি ল্যাব বলি) , এই নবাবী খাবারগুলো প্যাকেট করে সাথে নিয়ে যায়। কিছুই আমার নজর এড়ায়না। আমি নাটাইয়ের সূতা ছাড়ছি, দেবো একদিন হ্যাঁচকা টান। বোকাট্টা করে দেবো ঘুড়ি! আমার এত সুন্দর করে গড়ে তোলা কেমিস্ট্রি ল্যাবকে কোনভাবেই নবাব বাড়ীর হেঁশেল বানাতে দেবোনা।

বেশীদিন আগের কথা নয়, সপ্তাহ তিনেক আগে আমাদের বন্ধু শুভাষীষ'দা এবং উনার স্ত্রী রঞ্জনা এসেছিল। কথায় কথায় বললাম, আমাদের বাগান ভাগ্য ভাল না, গাছ তো বড় হয়ইনা, ফসল ফলবার আগেই কাঠবেড়ালী এসে গাছের গোড়া কেটে দিয়ে যায়। একথা শোনার সাথে সাথেই বাগান বিশেষজ্ঞ রঞ্জনা বললো, " ন্যাপথালিন কিনে নিয়ে আসো, বাগানের চারপাশে বা ঘরের চার পাশে ন্যাপথালিন ছড়িয়ে দিলে কাঠবেড়ালীও আসেনা, সাপও আসবেনা। ওরা জানে, আমার সাপ ফোবিয়া আছে। এই প্রাণীটির নাম মুখে বলতে পারিনা, ছড়া ছবির বইয়ে ছবিও দেখতে পারিনা, পরিবারের সকলে যখন টিভি দেখে, তখন এই প্রাণীটির দৃশ্য এলে আমাকে বলতে থাকে, " চোখ বন্ধ করো, চোখ বন্ধ করো"। কাজেই রঞ্জনা যখন পরামর্শটি দিল, পরের দিনই আমি ওয়ালমার্টে গিয়ে এক কেজি ন্যাপথালিন কিনে নিয়ে এলাম।

সেদিন কোন এক কারণে আমার গাড়ীটি অকেজো হয়েছিল বলে উত্তম কুমার আমাকে ওয়ালমার্ট থেকে তুলে নিয়ে এসেছে। আসার পথে আমি বলি,
-এই শোন, ন্যাপথালিন এক কেজিতে কিছু হবেনা, আরেক কেজি আনবো, বাড়ীর চারদিকে ছড়িয়ে দেবো। কাঠবেড়ালী আসুক কি না আসুক, ঐ প্রাণীটার আসা বন্ধ করতে হবে।
সে বলে, ন্যাপথালিন দিলে সাপ আসা বন্ধ হয় কে বললো?
-এই, প্রাণীটার নাম বলবেনা, আসা বন্ধ হবে, রঞ্জনা বলেছে, কারন ন্যাপথালিনে 'কার্বলিক এসিড' আছে। এইজন্য আসবেনা।
-ন্যাপথালিনে কার্বলিক এসিড আছে? বলো কী, কেমিস্ট্রিতে ডিগ্রী নিয়ে বলছো, ন্যাপথালিনে 'কার্বলিক এসিড' আছে?
-হ্যাঁ, কার্বলিক এসিডের গন্ধ আছে ন্যাপথালিনের মধ্যে।
-হায় হায় রে! আমি কই যাব রে! ন্যাপথালিনের মধ্যে কার্বলিক এসিডের গন্ধ পায় রে, কেমিস্ট্রির কী দশা! তুমি কী ন্যাপথালিনের স্ট্রাকচার জানো?
-না, এখন ন্যাপথালিনের স্ট্রাকচার মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করিনা, শুধু জানি, বেনজিন এর স্ট্রাকচার। এটুকু মনে রাখলেই যথেষ্ট। তাছাড়া হুবহু মিল হতে হবে কেন? কার্বলিক এসিড বা ন্যাপথালিন, দুইটাই অ্যারোমেটিক কম্পাউন্ড, কাজেই কোন না কোনভাবে যোগসূত্র আছে।
-ভাল, খুব ভাল, কই যাব, কেমিস্ট্রির কী অবস্থা, কে বলবে এই মহিলা কেমিস্ট্রিতে অনার্স, মাস্টার্স করেছে।

-সবাই বলবে আমি কেমিস্ট্রিতে পাশ করেছি, প্রশ্ন করার আগেই বলে দেবো, পাশ করার ২৫ বছর পরেও, এখনও মনে আছে ওয়াটার, মিথেন, মিথিলিন, ইথেন, ইথিলিন, ইথানল, মিথানল, ফেনল, সালফিউরিক এসিড, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, বেনজিন, (হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন), ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন, সিঙ্গল বন্ড, ডাবল বন্ড, ট্রিপল বন্ড~~~~~~ আরও বলবো? শুনতে চাও?

-মাফ চাই।
-মাফ করবোনা, তুমি কেমিস্ট্রির জাহাজ হইতে পারো, আমি তো কেমিস্ট্রির 'ডিঙ্গি নাও' হইতে পারি, পারিনা?

-চুপ থাকেন, ন্যাপথালিনকে বলছেন কার্বলিক এসিড, এইটাই আগে হজম করি, নতুন করে কেমিস্ট্রি শিখতে হবে দেখছি।

আমাদের এই ঝগড়া থেমে গেলো গাড়ী বাড়ির গ্যারাজে ঢুকার সাথে সাথে। এবার আমার পালা। গাড়ী থেকে নামতে নামতে বললাম,
-তোমার ল্যাব হচ্ছে ইউনিভার্সিটিতে, গবেষনাই করো আর শিক্ষকতাই করো, পায়ে হেঁটে টেংরিয়ে টেংরিয়ে ডিপার্টমেন্টে যেতে হয়, আর আমার ল্যাব আমার নিজের বাড়ীতে। কোথাও যাওয়া লাগেনা, যখন যা এক্সপেরিমেন্ট করতে মন চায়, অ্যাপ্রনটা শুধু গলায় ঝুলায় নিলেই চলে, ইদানিং অ্যাপ্রনও ঝুলাইতে হয়না, চোখের আন্দাজ, আর অভিজ্ঞতা এত বেশী হয়ে গেছে, তাহলে কে বড় কেমিস্ট?

-সারাক্ষণ ফেসবুকে বসে না থেকে মাঝে মাঝে কেমিস্ট্রি বইয়ের পাতা উল্টিও!
-কোন দরকার নাই, অনার্স-মাস্টার্সে যা শিখছি, সেগুলো দিয়ে হাতে কলমে কাজ করছি, এই জন্যই এখন এত বড় বড় কথা বলতেছো। হুহ! আছিলা তো রোগা পটকা, কোন ল্যাবরেটরীর ভাত খেয়ে এমন উত্তম কুমার চেহারা বানিয়েছো, শুনি! 'মিঠু'স কেমিস্ট্রি ল্যাব' ই তো ভরসা।

-আমি এখন নিজেই রান্না করতে জানি, আপনার চেয়ে ভালই জানি।
- কথায় বলে, গাঙ পার হইলে মাঝি শালা। এখন তো বলবেই এই কথা। চিকেন গ্রীল মাস্টার খেতাব পেয়েছো, তা জানতে চাই, চিকেন ম্যারিনেট করা কার কাছে শিখেছো, শুনি! বেগুন দিয়ে করলা ভাজতে শিখেছো, কার কাছ থেকে, শুনি?

-আমি নিজে নিজেই শিখেছি।
-ঠিক আছে, নিজে নিজে শিখলেও তো ঐ কেমিস্ট্রির জ্ঞানকেই কাজে লাগিয়েছো। তা আমিও তো আমার কেমিস্ট্রি জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে 'মিঠু'স কেমিস্ট্রি ল্যাব' প্রতিষ্ঠা করেছি, যেখান থেকে প্রস্তুত হওয়া খাদ্য সামগ্রীর গুণে আজ তোমরা এত পটর পটর করতে শিখেছো।

এরপর নিজের মনে মনেই কিছুক্ষণ গজ গজ করলাম। কোন কুক্ষণে যে কেমিস্ট্রি পড়তে গেছিলাম। আমার পছন্দের বিষয় ছিল সাহিত্য এবং সংগীত। কেমিস্ট্রি না পড়ে যদি বাংলা সাহিত্য পড়তাম, এতদিনে আমার লেখা উপন্যাস/গল্প স্কুল কলেজে পাঠ্য হয়ে যেত, ( আমি এভাবেই স্বপ্ন দেখি, স্বপ্নই যদি দেখবো, তবে কেন একেবারে উঁচুমাপের স্বপ্ন দেখবোনা)। ম্যাট্রিক পরীক্ষার কয়েক মাস আগে আমার এক শিক্ষক, কনক কান্তি পন্ডিত, আমাকে খুব স্নেহ করতেন, কুমিল্লা 'বার্ডে' চাকরী নিয়ে চলে যাওয়ার আগে আমার উপর বিরক্ত হয়ে ( লেখাপড়ায় ফাঁকী দিতাম) বলেছিলেন, " তুমি তো ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল, তাইনা? কেমিস্ট্রিতে ফেল করবে তুমি, এই আমি বলে দিলাম"। স্যারের মুখের উপর কিছু বলিনি, ম্যাট্রিকে কেমিস্ট্রিতে ৯০ পেয়ে উনাকে চিঠিতে সেটা জানিয়েছি। এখানেই থামিনি, শুধুমাত্র স্যারের উপর জেদ করে কেমিস্ট্রি অনার্সে ভর্তি হয়েছিলাম। কেমিস্ট্রি মজার সাবজেক্ট, কিন্তু আমার মত ফাঁকীবাজের জন্য বিরক্তিকর এক সাবজেক্ট। তবুও তো ভালভাবেই পাশ করেছি। স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার করেও সময়মত অনার্স, মাস্টার্স কমপ্লীট করেছি, একেবারে তো ফেলনা কথা নয়! অনেক বছর পর কনক কান্তি স্যার পর্যন্ত আমার কাছে স্বীকার করেছেন যে জেদ বটে আমার!

সেদিন উত্তমের সাথে কেমিস্ট্রি নিয়ে তর্কাতর্কির পর ব্যাপারটি নিয়ে সীরিয়াসলী ভেবেছি, আসলেই কী আমি কেমিস্ট্রি পড়ে ভুল করেছি! আমি যখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি, তখন আমার বিয়ে হয়ে যায় কেমিস্ট্রির জাহাজের সাথে। বিয়ের পর আমি অনার্স, মাস্টার্স শেষ করি, এবং সংসারে ছোট্ট মৌটুসীকে নিয়ে খেলা করি। মৌটুসীকে পেয়ে আমার চাকরী-বাকরী করার কথা মনেই হতোনা। কিন্তু বাবা মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দিতেন,
" এত যত্ন করে তোরে লেখাপড়া শিখাইলাম, আর তুই এইভাবে জীবনটারে শেষ করতেছস?"
-মুখে মুখে তর্ক করা আমার স্বভাব, সাথে সাথে বলে দিতাম, " শেষ করছি কই? এই যে মেয়েকে মানুষ করছি"।
-মেয়ে মানুষ করতে কেমিস্ট্রি পাশ করার দরকার হয়না, তোর মায় তো কেমিস্ট্রি পাশ করে নাই, ঠিকই তো তোগোরে মানুষ করছে।
-হ, মায় সারাদিন স্কুলে কাটাইতো, আমরা কেউ মা'রে একেবারে কাছে থেকে পাই নাই, সেই দুঃখ মনের মধ্যে আছে, ঐজন্য ঠিক করছি, আমার মেয়েরে আমার কাছে রাখবো।

-মারে, চাকরী কইরাও মেয়ে মানুষ করতে পারবি, বি সি এস দে, প্রফেসারী করবি, মেয়ে মানুষ করবি, কেমিস্ট্রির মত সাবজেক্টে পড়লি, এখন রান্না ঘরে হাঁড়ি ঠেলে জীবন পার করবি?
-বাবা, বি সি এস দিলেও শেষ পর্যন্ত চাকরী পামুনা। আমি ভাইবা দিতে ডরাই, ভাইবা বোর্ডে পরীক্ষকরা আমার চেহারা দেখলেই উলটা পালটা কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে, ভয়ে হাত পা ঘামতে থাকে। তাছাড়া, মৌটুসীর বাবা তো কিছু বলেনা, তোমরা কেন এমন করো?
-তোদের ভালর জন্যই এমন করি। মেধা কাজে লাগা, রান্না তো সবাই করে, আমাদের ঘরের গীতার মা'ও রানতে পারে, রান্নাটা এমন কিছু আহামরী ব্যাপারনা।
-বাবা, আমার কাছে রান্না আহামরী ব্যাপার। হুমায়ুন আহমেদ বলছে, ভাল রান্না খাইয়ে যে কোন পুরুষের মন জয় করা যায়। তাছাড়া, আমার বরটা সারা জীবন এখানে সেখানে থেকে লেখাপড়া করছে, কোনদিন সংসারের ভাত পায় নাই, আমি তার বউ, আমার তো দায়িত্ব তাকে সারা জীবন ভাল ভাল রান্না করে খাওয়ানো।

বাবা বলেন, এই কথা কইয়া দিলি তুই আটকাইয়া। আমি ত অবশ্যই চাই জামাই বাবাজীরে লইয়া সুখে শান্তিতে সংসার কর, তোর যদি মনে হয় প্রফেসারী করতে গেলেও সুখে ভাটা পড়বো, আমি ত বাবা হইয়া সেইটা বলতে পারিনা। তবে অবসরে কেমিস্ট্রি বইয়ের পাতা উল্টাইস, চর্চা রাখিস, ভবিষ্যতে প্রয়োজনে যাতে না ঠেকস।

আমার সেই প্রয়োজন বা সুযোগ, কোনোটাই আর আসেনি। আমার আরও বেশ কিছু শুভাকাংক্ষী আমাকে বি সি এস পরীক্ষা দিতে বলতো, উত্তম কুমারের বৌদি, হলিক্রস কলেজের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন, কেমিস্ট্রি টিচারের অসুস্থতাজনিত কারণে আমাকে কলেজে দেড় মাস লীভ ভ্যাকেন্সীতে অধ্যাপনা করার সুযোগ দিয়েছিলেন। তখন দ্বিতীয় মেয়ে মিশা খুব ছোট। মৌটুসীর চার বছরের ছোট মিশা, জন্মের পর থেকেই মিশা ছিল খুব অসুস্থ, আমি পক্ষীমাতার মত আগলে রাখতাম দুই মেয়েকে। তখন বুঝতে পারতাম, অর্থনৈতিক দিক থেকে বিচার করলে, আমার একটা চাকরীর প্রয়োজন ছিল। বড়দা আমাকে সব সময় নরম স্বরে বুঝাতো, বড়দার অনুরোধে বি সি এস পরীক্ষা দিলাম, লিখিত পরীক্ষা নিয়ে আমার কখনওই চিন্তা ছিলনা, আমি ভাইবা দিতে ভয় পেতাম। বি সি এস পরীক্ষার ভাইবা এগিয়ে এলো, এর মধ্যে মিশা আবার প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়লো। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, ভাইবা দেবোনা। বড়দা আমার বাসায় এসে কত কাকুতি মিনতি করলো, আমি বললাম, আমি চাকরী করলে আমার মেয়েরা বাঁচবেনা। এমন কথা বললে কে আর এগোবে! তারপরেও বড়দা লেগেছিল আমার পেছনে, যদি একবার পাঠাতে পারে ভাইবা বোর্ডে। আমি যাইনি।

এত কিছু যে হচ্ছিল আমাকে নিয়ে, আমার উত্তম কুমার কিন্তু কখনও বলেনি কেমিস্ট্রি অনার্স, মাস্টার্স শেষ করতেই হবে, চাকরী করতেই হবে! আমার বাবার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতেই আমি অনার্স, মাস্টার্স শেষ করেছিলাম। এরফলে একটাই লাভ হয়েছে, ভাইয়েরা বিশেষ করে আমার মেজদা, কথায় কথায় খোঁটা দিত, " তোর লজ্জা করেনা, কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স তুই, এমন একজন জ্ঞানী মানুষের স্ত্রী হয়ে ঘরে বসে আছস" অথবা যদি কিছু নিয়ে তর্কাতর্কি হতো, মেজদা বলতো, 'তোর কথা বার্তা শুনলে তো মনে হয়না তুই কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করছস"। আমি হেসেই উড়িয়ে দিতাম। বলতাম, কেমিস্ট্রি পড়েছি বলে গান গাইবোনা, নাচবোনা, হাসবোনা, এমন কথা কোথায় শুনেছো? আমার ইচ্ছা হয়েছে, আমি চাকরী করবোনা, আমার ইচ্ছা হয়েছে, দুই মেয়েকে নিয়ে পুতুল খেলবো, তোমরাও আসতে পার এই খেলায়।
এরপর সংসারে মন দিয়েছি, মেয়েদেরকে একেবারে হাতে-পিঠে করে বড় করেছি। একসময় যখন মেয়েরা ভাল রেজাল্ট করতে শুরু করলো, বাবাকে বলেছি, " বাবা, দেখো, আমার কেমিস্ট্রি জ্ঞান আমি কোথায় অ্যাপ্লাই করছি। মেয়েগুলোকে মানুষ করতে গিয়ে কেমিস্ট্রি কাজে লাগছে।"
বাবা বলতেন, " তুই যা বুঝাবি, তাই বুঝবো। ঠিক আছে, মেয়ে মানুষ কর, কিন্তু চর্চা রাখিস, বলা তো যায়না, কখন কাজে লাগবে। মেয়েদের জীবন, পায়ের নীচে মাটি শক্ত রাখা দরকার"।

মেয়েরা বড় হয়েছে, উত্তমের পায়ের নীচে মাটি শক্ত হয়েছে, বিয়ের পরেই জেনেছি, আমার উত্তমের ছোটবেলা থেকেই বাইরে বাইরে কেটেছে, (গ্রামে ভাল স্কুল-কলেজ ছিলনা বলে) মনে হয়েছে, আহারে! আমরা মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্নীয়-স্বজন মিলে কত আনন্দে জীবন কাটিয়েছি, আমার উত্তম এগুলো কিছুই পায়নি, আমি চেষ্টা করবো জীবনের না-পাওয়া অংশটুকু পুষিয়ে দিতে, তাই চেষ্টা করেওছি, সংসার জীবনের আনন্দ সে পূর্ণমাত্রায় পেয়েছে, রান্না-বান্নায় আমার বরাবর উৎসাহ, হুমায়ুন আহমেদের সেই উক্তিটিকে কাজে লাগিয়েছি, ফল পেয়েছি। উত্তম আমার বশে থেকেছে সারা জীবন।

সেই উত্তম এত বছর বাদে আমাকে কেমিস্ট্রি ডিগ্রী নিয়ে খোঁটা দিল??? অনেক ভেবে চিন্তে বের করলাম কারণ, ফেসবুকে বসে থাকি বলে বাবুর গোসা হয়েছে, আমি যে স্বাস্থ্যগত দিক চিন্তা করে আগের মত চব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় খাবার রান্না করিনা, সেটা সে বুঝতে পারেনি, ভেবেছে ফেসবুকে ব্যস্ত থাকি বলে রাঁধিনা। সেইজন্য সে নিজে নিজেই রান্না শুরু করে দিয়েছে। লাঞ্চ ব্রেকেও নিজের বানানো খাবার নিয়ে যায়, আমার টনক নড়েছে। আরে! আমার উত্তম তো দেখি বশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটা তো ভালো লক্ষ্মণ নয়। আমাকে আবার কেমিস্ট্রি ল্যাব চালু করতে হবে।

গতকাল জিজ্ঞেস করলাম, " কাল তোমার লাঞ্চ ব্রেক কখন?"
-আমার আবার লাঞ্চ ব্রেক কী? ১টা থেকে ল্যাব শুরু হয়।
-থীওরী ক্লাস শেষ হয় কখন?
-১২টায়।
-তুমি লাঞ্চ খেতে বাসায় এসো।
-নাহ! ১২টা থেকে ১টা , এই এক ঘন্টার জন্য আসবো, খাবার রেডী হতে হতে ল্যাব শুরু হয়ে যাবে।
-বললাম তো, ১২টার সময় আসবে, ১টা বাজার আগেই তুমি ল্যবে ঢুকে যেতে পারবে।

উত্তম কুমার এসেছিল, সোয়া বারোটায়। এর মধ্যেই আমি স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে কম তেলে পরোটা ভেজেছি, চীজ পুর দিয়ে ডিম ওমলেট ভাজা হয়েছে ( ওমলেট অবশ্য মিথীলার হেল্প নিয়েছি), আলু ফুলকপি ভাজা ছিল, এগুলো দিয়ে খেতে দিয়েছি, ওমা! দেখি উত্তম রেফ্রিজারেটার খুলে আরেকটা বাটি বের করেছে, বলে, " চিকেন কিমা দিয়ে ডাল রেঁধেছিলাম সেদিন, পরোটা দিয়ে খেতে ভাল লাগবে, খাই"। আহারে! মনটা হঠাৎ করে মায়ায় ভরে গেলো, বাবা নেই, মা নেই, দিদিরা কেউ বেঁচে নেই, আমি আর তিনটি মেয়েই আছি তার একান্ত আপনার জন হয়ে! বললাম, " খাও, ডাল দিয়েও খাও, ডিম খাও, ফুলকপি ভাজাও খাও"। খেয়েদেয়ে দিব্বি বাবু ১টা বাজার আগেই আবার ডিপার্টমেন্টে চলে গেল। এরপর থেকে সে আমাকে আর কেমিস্ট্রি ডিগ্রী নিয়ে খোঁটা দিবে বলে মনে হয়না!

http://ritaroymithu.blogspot.com/2013/06/blog-post_19.html
Like · · Promote ·
 আওয়ামী ঘরাণার বুদ্ধিজীবিদের প্রতিঃ

ইদানিং অনেকেই আওয়ামীলীগের অথবা বর্তমান সরকারের সমালোচনা করার সময় রেফারেন্স হিসেবে প্রবীন সাংবাদিক এ বি এম মুসা সাহেবকে quote করতে পছন্দ করেন। এমনকী এই সেদিনও বি এন পি নেত্রী রানু আপা, পাপিয়া আপা, এ বি এম মুসাকে স্মরণ করেছেন। হ্যাঁ, এ বি এম মুসা সহ আওয়ামী ঘরাণার অনেক বুদ্ধিজীবি গত কয়েকটি মাস টিভি টকশো, সেমিনার, গোল টেবিল আলোচনায় সরকারকে তুলাধূনা করেছেন। এ বি এম মুসা তো প্রজন্ম মঞ্চের আদলে শ্লোগানও দিয়েছেন, 'তুই চোর' বলে।
আমি এ বি এম মুসা, আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা কলাম নিয়মিত পড়ি। আমার ধারণা, আওয়ামী বুদ্ধিজীবিগণ কাজটি করেছেন সরকারের শত্রু হিসেবে নয়, বন্ধু হিসেবেই করেছেন যাতে করে সরকার ভবিষ্যতের জন্য সাবধান হতে পারেন। ভালো কাজই করেছেন, কিন্তু ফল ভালো হয়নি। সরকারের ভালো করতে গিয়ে হিতে বিপরীত করেছেন। এখন 'দুই দিনের যুগী, ভাতকে অন্ন' বলা শুরু করেছে। মুসা সাহেবের কলাম জীবনে হয়তোবা পড়েও দেখেনি, এমন সব পন্ডিতবর্গ ( পার্থ, পাপিয়া, রানু, বানু, মনি, আরও কত শত নাম) মুসা সাহেব, কাদের সিদ্দিকীকে quote করছে দেখে ছোটবেলার একটা গল্প মনে পড়ে গেলো।

আমার বাবা ছিলেন খুব রাগী এবং সৎ, মা ছিলেন সৎ এবং জেদী। উনারা দুজনেই ঠিক করেছিলেন, চার ছেলেমেয়েকে মানুষের মত মানুষ করবেন। ছেলেমেয়ের ভাল কাজের প্রশংসা করাকে উনারা নিজ আদর্শের পরিপন্থী মনে করতেন। উপরন্তু ছেলেমেয়েরা যেন কোনভাবেই বখে না যায় তা নিশ্চিত করার জন্যই বোধ হয় আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে ছেলেমেয়ের নামে অযথা নালিশ ( প্রকারান্তরে বদনাম ) করতেন। যেমন, হয়তো বললেন, " আরে, আমার এই মেজ ছেলের কথা আর বলবেননা, পুরা বান্দর, পাজীর পা-ঝাড়া, লেখাপড়া করেনা, সারাদিন বান্দরামী কইরা বেড়ায়, অংকে মাথা নাই, মেট্রিকে ফেল করবো" অথবা মা হয়তো স্কুলে গিয়ে বলল, " রীতারে শাসনে রাখবেন, আমার মেয়ে বলে কোন খাতির করবেননা, আমার মেয়ে হয়েছে একটা ফাঁকীবাজ, আর এত চোপা জানে, মুখে মুখে তর্ক করে"। আত্মীয় স্বজনের কাছেও এই কথাগুলোই বলতো।

ফলাফলঃ আমরা চার ভাইবোনই যথেষ্ট ভাল, মেধাবী, লক্ষ্মী হওয়া সত্ত্বেও আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আমাদেরকে ভাল বলতে চাইতোনা, বলতো, " তোমাদের মা-বাবা নিজমুখে বলছে, তোমরা পাজীর পা-ঝাড়া"। ফলে আমরাও কেউ তেমন আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারিনি। অনেক পরে নিজের জীবনে আমি অনেকটাই বিএনপি ঘরাণার নেতাদের মত আচরণ করেছি আমার মেয়েদের সাথে। বাইরের কারো কাছে এতটুকুও বদনাম করিনি ছেলেমেয়ে সম্পর্কে, বাইরের কাউকেও আমার মেয়েদের সম্পর্কে এতটুকু খারাপ কথা বলার সুযোগই দেইনি। কেউ যদি একটু বেসুরে কথা বলেছে, তাহলেই পাপিয়া আপার মত তেড়ে মেরে গিয়েছি ( কাল্পনিক, আমাকে দিয়ে এমন অশোভন আচরণ ইহ জীবনে সম্ভব হবেনা, তবে সাধ হয় মাঝে মাঝে)

যাঁদের ঊদেশ্যে ঃ মাননীয় আওয়ামীবান্ধব বুদ্ধিজীবিদের বলছি, এভাবে হয়না, এভাবে হবেওনা। বিএনপি ঘরাণার বুদ্ধিজীবিদের কাছ থেকে কিছু শিক্ষা নিন, যদি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি এখনও আস্থা থাকে। জানি এবং মানি, বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর কন্যার রাজনীতিতে অনেক ফারাক, আপনাদেরকেও বুঝতে হবে, বঙ্গবন্ধুর সময়কালীন রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের সাথে তাঁর কন্যার সময়কালীন রাজনীতি এবং অ-রাজনীতিবিদদের ্মাঝে আকাশ -পাতাল ফারাক।

অবশেষে একটি সবিনয় জিজ্ঞাসা, শেখ হাসিনার পতন সইতে পারবেন যদি উনার চেয়ে ভাল কেউ না আসে??? ভেবে দেখবেন।

সাবাশ শেখ হাসিনা!!!

আমেরিকা, ইংল্যান্ড আরও আরও আরও কত দেশের মুরুব্বীদের দুঃশ্চিন্তার শেষ ছিলনা, কত রাত নির্ঘুম কেটেছে, তাদের জুতার তলা ক্ষয়ে গেছে 'তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন' করার দূতিয়ালী করার জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে করতে।

যাক! বাপের বেটি হাসিনা, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিবেন বলে পণ করেছিলেন, সব দূতিয়ালদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে সেটিই আজ উনি প্রমান করে ছাড়লেন। অনেকেই চোখের জলে ভাসছে, আমি ভাসছিনা, আমি হাসছি। এর প্রয়োজন ছিল, মেয়র নির্বাচনের ফলাফলে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল।

প্রথম কথা, বঙ্গবন্ধুর পরে একমাত্র শেখ হাসিনাই নেতৃত্বে যোগ্যতা এবং সততা দেখাতে পেরেছেন। [ দ্বিমতকারীদের প্রতি করুণা] সাবাশ শেখ হাসিনা!

এমন একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন শেষে যাঁরা বিজয়ী হয়েছেন, তাঁদেরকে অভিনন্দন, দেশের মানুষ আপনাদেরকেই চেয়েছিল, তাই আপনারা জয়ী হয়েছেন।

আমাদের লাভঃ
আপাতত টেলিভিশনে আর টকশোতে সেই বিজ্ঞ টকারদের দৌড়াদৌড়ি করতে হবেনা, কারণ উনাদের ঊদ্দেশ্য সফল হয়েছে, এবার কিছুদিন উনারা গিন্নীদের প্রতি একটু সদয় হবেন, সময়মত ঘরে ফিরবেন,[ টকশো শেষ করে ঘরে ফিরতে নিশ্চয়ই রাত গভীর হয়ে যেত], গিন্নীদের ভাতের থালা নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবেনা!!! পাপিয়া আপামনি, রেনু আপামনি, নিলো আপামনিকেও আর গলা ফাটিয়ে নোংরা ভাষায় সংসদে, টিভিতে গালিগালাজ করতে হবেনা, কিছুদিন উনারা গলায় মাফলার পেঁচিয়ে বিশ্রাম নিতে পারবেন।

এ বছরের বাবাদিবস খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপিত হবে, ছেলেমেয়েরা তাদের হাসি-খুশী প্রাণোচ্ছল বাবাকে কাছে পাবে[ এই বাবাগুলো এতদিন শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে করতে নিজের সন্তানের কথাই ভুলতে বসেছিল।

আম জনতার লাভঃ দেশের জনগণ পরিবর্তণ চেয়েছে, পরিবর্তণ এনেছে। এখন দেশে আর কোন জ্বালাও -পোড়াও হবেনা, বাসে আগুন জ্বলবেনা, যাত্রী পুড়ে মরবেনা, প্রজন্ম মঞ্চ হবেনা, গণজাগরণ হবেনা, শুরু হবে নিশ্চিন্তে গণঘুম বা গণনিদ্রা!! দেশে এবং প্রবাসে, আমরা সবাই আজ থেকে আরামে ঘুম দেবো।

সর্বশেষঃ যা হয়, মঙ্গলের জন্য হয়! শেখ হাসিনা মানুষ, উনি যন্ত্র নন, একা একজনের পক্ষে চারদিক থেকে এমন শত্রুতা মোকাবেলা করা ভীষন দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছিল। নিজের সংসার, নিজের সন্তান, নাতি নাতনি সবাইকে উপেক্ষা করে, বাবা-মা, ভাইদের কবরের মাঝে দাঁড়িয়ে, বোমার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে, নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে কাদের জন্য উনি কাজ করে গেলেন এতদিন! মাননীয় নেত্রী, আপনার জন্য কষ্ট হয়! কবিগুরু যথার্থই বলেছেন, " রেখেছো বাঙ্গালী করে, মানুষ করোনি"!!

তবুও আপনাকে নিয়ে আমাদের অনেক গর্ব হয়!!! আপনার পাশে এই প্রজন্মের তরুণরা সদা জাগ্রত আছে।

***জয়ী প্রার্থীরা কী শেখ হাসিনাকে এমন একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়ার জন্য পত্রিকায় ঘোষণা দিয়ে 'ধন্যবাদ' জানাবেন!! ***

"বাঙ্গালকে হাইকোর্ট দেখাচ্ছেন, তাইনা?"

পাপিয়া ম্যাডাম গতকাল সংসদে বক্তব্য পেশকালে বলেছেন, তারেক জিয়া তার স্ত্রী-কন্যা নিয়ে লন্ডনে ভাড়া বাড়ীতে দিনাতিপাত করছে, [তবে বাড়ী কোন পাড়ায় অথবা বাড়ী ভাড়া কত, সেকথা উল্লেখ না করেই বলেছে, তারেক জিয়ার সমস্ত টাকা পয়সার হিসাব বাংলাদেশের ইনকাম-ট্যাক্স খাতায় লেখা আছে।]। তারেক জিয়ার পরিচ্ছন্ন ইমেজের সাথে জয়ের ইমেজ তুলনা করতে গিয়ে পাপিয়া ম্যাডাম বলেছেন, তারেক জিয়ার বাঙ্গালী বউ, আর জয়ের খৃষ্ঠান/ইহুদী বউ, তাই জয়ের অপরিচ্ছন্ন ইমেজ। ম্যাডাম টেবিলে চাপর দিয়ে বলেছেন, তারেক জিয়ার বিদেশে কোন টাকা পয়সা নাই, যা আছে সবই দেশে, দেশের মানুষ তারেক জিয়ার ইনকামট্যাক্সের খবর জানে, এখন তারা জানতে চায়, আমেরিকায় জয় এবং পুতুলের লাখ লাখ ডলার খরচ করে বাড়ীর পর বাড়ী, তারও পর আরও বাড়ী, এরও পর আরও বাড়ী [বাড়ীর নাম ঠিকানা এবং ক্রয়মূল্য দিয়েছেন] ক্রয় বাবদ ট্যাক্সের হিসাব আমেরিকা সরকারের ট্যাক্স ইনকাম ফাইলে লিপিবদ্ধ করা আছে কিনা!!!!

**** পাপিয়া আপা, আমেরিকায় লেবু মিয়া, গেদু মিয়া থেকে শুরু করে আমার মত মিঠু রাণীও লাখ লাখ ডলার দামে বাড়ী কিনতে পারি, আমরা খুব ভাল নাগরিক তো, তাই বাড়ী কিনতে আমাদের এক পয়সাও খরচ করতে হয়না, আমেরিকান সরকার, আমেরিকার ব্যাংকগুলিই আমাদেরকে ডলার দেয়। তাছাড়া এই দেশে বাড়ীর দাম লাখ ডলারের নীচে নাই। ভালো মানুষের জন্য ভাল দামের বাড়ীই তো থাকবে।
পাপিয়া আপা, গেদু মিয়া যদি জ্যাকসান হাইটে মিষ্টি বেইচা এক মিলিয়ন ডলারের বাড়ীতে থাকতে পারে, আমি যদি ওয়ালমার্টে ফোন বেইচা দেড় লাখ ডলারের বাড়ীতে থাকতে পারি, আপনাদের তারেক ভাই কোন চাকরী-বাকরী না কইরা লন্ডনের অভিজাত পাড়ায় বাড়ী ভাড়া কইরা বছরের পর বছর স্ত্রী-কন্যা লইয়া দিনাতিপাত করতে পারে, তাইলে জয় একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনীয়ার এবং তার ইহুদী বউ আমেরিকার উকিল ( আপনার মত বাঙ্গালরে হাইকোর্ট দেখানের মত উকিল না) হইয়া আপনার দেয়া হিসাবমত দশটা বাড়ী কিনতে পারবোনা, এমন উদ্ভট প্রশ্ন আপনার মত জাঁহাবাজ উকিলের মাথায় এলো কীভাবে, সেটাইতো বুঝতে পারছিনা। আপনি কী জানেন যে, আমেরিকায় ডাক্তার আর উকিলদের ইনকাম কত? আপনার বন্ধু মনি ম্যাডাম জানে, উনি নাকি আমেরিকায় একবার কয়মাসের জন্য কোর্স করতে আসছিল। উনার সাথে আলাপ করলেই জানতে পারবেন।

সেদিন টকশো-তে মনি আপা সেটাই বলছিলেন, বাংলাদেশ থেকে কোন মেয়ে নাকি লাখ লাখ টাকা খরচ করে এখানে নাচ শিখতে আসছে, মনি আপা তো ভাবতেই পারছিলেননা, নাচের মত একটি আকাইম্যা জিনিস শিখতে কেউ লাখ লাখ টাকা খরচ করে? নিশ্চয়ই মেয়ের বাপের দূর্নীতির টাকা ওগুলো, পুরা হারামের টাকা। দেশে টাকার অবমূল্যায়ণের কথা বলতে গিয়ে মনি আপা এই প্রসঙ্গ এনেছিলেন। মনি আপা এটাও বলেছিলেন, সঠিক সময়ে সঠিক কথাটি বলতে পারেন বলে দলের অনেকেই নাকি উনাকে 'মন্ত্রী' হতে বলে, কিন্তু মনি আপাও তারেক ভাইয়ার মতই সৎ, দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ, মন্ত্রীত্বের লোভ নেই। কাজেই মনি আপাকে জিজ্ঞেস করলে, সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য আপনাকে দিতে পারবেন।

আপনার বক্তব্য পড়ে মনে একটি প্রশ্ন জেগেছে, জয় আর পুতুল আমেরিকার সরকারকে ট্যাক্স দেয় কিনা, সেটা আমাদের দেশের জনগণ জানতে চাইবে কেন? আমেরিকার ইনকাম ট্যাক্স অফিসের মূল শাখা কী বাংলাদেশে ট্র্যান্সফার করা হয়েছে নাকি? ইস! কত তথ্য জানিনা, একেবারে অন্ধকারে পড়ে আছি।

*** আরেকটি কথা, জয় আর পুতুল কোন বাড়ী কত দাম দিয়ে কিনেছে, সে তথ্য তো আপনার জানার কথা নয়। এদেশে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত তথ্য গোপন রাখার বিধান আছে, আমি না চাইলে, আমার তথ্য আমার স্বামীকেও সরবরাহ করা হবেনা। এমনকী হাসপাতালের রুগীর তথ্যও অথরাইজড ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ জানতে পারবেনা। অথচ আপনি জয়, পুতুলের হাঁড়ির খবরসহ সবকিছু জেনে ফেলেছেন। বাঙ্গালকে হাইকোর্ট দেখানোর একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, সেই হাইকোর্টই বুঝি দেখাচ্ছেন!! ওহ! আপনি তো আবার উকিল, বাঙ্গালকে হাইকোর্ট তো দেখাবেনই!!


‘জামাইষষ্ঠী’--আম-কাঁঠালের গন্ধে ভরা ‘জামাই-আদর’ ব্রত

বাঙালী হিন্দুর ঘরে বারো মাসে তেরো পার্বণ। নিত্য পূজো, ব্রত পূজো, মাসিক পূজো এবং বছরের পূজো। পূজো, ব্রতকথা নিয়েই ব্যস্ত সময় কেটে যায় হিন্দু নারীদের। প্রতিমাসেই লেগে আছে এই ব্রত, সেই ব্রত। কিছু কিছু ব্রতপূজোর আবার শ্রেণীভেদ আছে। উপাসনাও বয়সভেদে নির্ণিত হয়ে থাকে। যেমন একটি মেয়ের বিয়ের আগে আরাধ্য দেবতা থাকেন শিবঠাকুর, বিয়ের পর বাকী জীবন আরাধ্যদেবতার আসনে থাকেন লক্ষ্মীদেবী। একজন মা সন্তান কামনার জন্য ষষ্ঠী ঠাইরেণের কৃপা কামনা করেন এবং যুবক পুত্রের আয়-উন্নতির জন্য ‘গনেশ ঠাকুরের’ কৃপা কামনা করেন। প্রতিটি নারী সংসারের মঙ্গলের জন্য বিপদতারিণী দেবীর পূজা করেন।
নারী জীবনের প্রতিটি ধাপে একটি করে ব্রতপূজা নির্ধারিত আছে। কুমারী মেয়েদের কাছে প্রিয়তার শীর্ষে আছেন শিবঠাকুর। সব মেয়েই বিয়ের স্বপ্ন দেখে, ছোটবেলা থেকেই তাদেরকে শোনানো হয়, শিবঠাকুরের মত বর পেলে নারীজীবন সার্থক হয়। এমন কথা শোনানোর দায়িত্ব থাকে সকল মাতৃস্থানীয়াদের উপর। ভাল কাজের প্রশংসাসূচক আশীর্বাদ বাণীটি হয়, “ বেঁচে থাকো কন্যা, শিবের মত স্বামী হোক তোমার”। শুধু আশীর্বাদ করেই কর্তব্য সমাপ্ত হয়না, মেয়ের ভাগ্যে ‘শিব ঠাকুর’ জুটিয়ে দেয়ার জন্য, মায়েরা সেই ছোটবেলা থেকেই মেয়েকে দিয়ে ‘শিব পূজো’ করাতে থাকেন। নিজে তো মহিষাসুরের সাথে সংসার করতে করতে বীতশ্রদ্ধ, তাই মেয়েজামাইটি যেন শিব ঠাকুর হয়, সেই চিন্তায় অস্থির থাকেন। মেয়েকে দিয়ে প্রতি সোমবার শিবের মাথায় জল দেওয়ান, প্রতি বছর শিবরাত্রীতে মেয়েকে নিরম্বু উপবাস রেখে সন্ধ্যাবেলায় শিবের মাথায় জল, বেলপাতা, ফুল দেওয়ান, যাতে কন্যাটি শিব ঠাকুরের মত স্বামী পায়।
কেন, শিব ঠাকুর কেন? কারণ, শিব ঠাকুরের আরেক নাম ভোলানাথ, জগৎ সংসার ভুলে থাকেন, অন্দরমহলে উঁকিঝুঁকি মারেননা, স্ত্রী-কন্যাদের উপর মাতব্বরী করেননা, স্ত্রীকে অহর্নিশি বকাঝকা করেননা, তেল-মসলা, চাল-ডালের হিসেব নেন না, ভাঙের শরবত খেয়ে বাবাঠাকুর আপনমনে থাকেন। ফলে দেবী পার্বতী নিজের খেয়ালখুশীমত সংসার পরিচালনা করতে পারেন। অবশ্য মাঝে মাঝে শিবঠাকুর উগ্র চন্ডাল মূর্তি ধারণ করেন, তখন দেবী পার্বতীও নিরীহ মূর্তি ছেড়ে মহিষাসুর মর্দিনী রূপ ধারণ করেন, রূপের অমন আগুনছটায় ভয় পেয়ে শিব নিমিষেই আবার ব্যোম ভোলানাথ হয়ে যান।

এইজন্যই মায়েরা কন্যাকে দিয়ে শিবপূজো করান, আর শিবের মত স্বামী পেয়ে আনন্দে আটখানা হয়ে কন্যাগুলো শ্বশুরবাড়ীর পথে পা বাড়ায়। মেয়েকে শ্বশুরবাড়ী পাঠিয়ে মা কী নিশ্চিন্ত হতে পারেন! পারেন না! মনে পড়ে যায়, নিজের শিবঠাকুর প্রাপ্তির কথা। কত সাধনা করে উনিও শিব ঠাকুর স্বামী পেয়েছিলেন, কিন্তু সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে সাধনচর্চায় ছেদ পড়তেই শিব ঠাকুর স্বামী কখন যেন মহিষাসুর হয়ে গেলেন, উনি টেরই পেলেননা! সারাজীবন শিবের স্তুতি গেয়েছেন, দেবী পার্বতীর আরাধনা তো করেননি, তাই মহিষাসুরমর্দিনি হতে পারেননি। এইজন্যই মেয়ের বেলায় আর কোন ঝুঁকী নিতে রাজী নন। জামাইবাবাজীকে বশে রাখতে কত রকমের উপায় খুঁজেন। খুঁজে খুঁজে পেয়ে যান ‘জামাইষষ্ঠী’ ব্রতপূজা্র বিধান। বছরের একটি দিন, জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝি, যখন আম-কাঁঠালের পাকা গন্ধে চারদিক সুবাসিত, তখনই এই ব্রতটি উদযাপণ করতে হয়। শ্বশুরবাড়ীতে ‘জামাই আদরের’ ঘটা পড়ে যায়। ‘জামাইষষ্ঠী’ ব্রতপূজার যা কিছু, সবই কন্যার শিবঠাকুর স্বামীটিকে ঘিরে আবর্তিত হয়ে থাকে। জামাই ষষ্ঠী এমনই এক ব্রত, যেখানে শাশুড়ীমাতা কন্যা-জামাতার দীর্ঘায়ু কামনা করেন, জামাতার যশ কামনা করেন, জামাতার জন্য অর্থ-বিত্ত কামনা করেন, কন্যা-জামাতার কোল ভরে সুস্থ সন্তান কামনা করেন, এমনই আরও কত ধরণের মঙ্গলাকাংক্ষা করে থাকেন!
তবে শুকনো কথায় ‘মংগলাকাংক্ষা’ করলে কী জামাই বাবাজীর পেট ভরবে? মায়েরা অমন অবুঝও নন, উনারা জামাইবাবাজীকে যথাযথ সম্মান সহকারে, উপঢৌকন পাঠিয়ে শ্বশুরবাড়ী আসার জন্য নিমন্ত্রণ করেন। শাশুড়ীমায়ের নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে জামাই বাবাজী শ্বশুড়বাড়ীতে পা দেয়ার সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় জামাই অভ্যর্থণার সকল আচার-অনুষ্ঠান।

পথশ্রান্ত জামাতাকে বসবার জন্য নানা রঙ-বেরঙের নক্সাখচিত সবচেয়ে সুন্দর আসনখানি মাটিতে বিছিয়ে দেন, হাতপাখা্র শীতল বাতাসে বাবাজীর ঘামে ভেজা শরীরটিকে ঠান্ডা করেন, যত্নে তুলে রাখা শ্বেত পাথরের গেলাস ভরে ডাবের ঠান্ডা জল পান করতে দেন। এরপর ষষ্ঠীদেবীর আশীর্বাদপূর্ণ দূর্বা-বাঁশের কড়ুল, ধান, ফুল, করমচা দিয়ে বাঁধা ‘মুঠা’ জামাইবাবাজীর মাথায় ছুঁইয়ে ‘ষাট ষাট, বালাই ষাট’ করে স্নেহাশীর্বাদ করেন। আশীর্বাদ শেষে বিশাল বড় কাঁসার রেকাবী নাড়ু, মোয়া, পিঠে, সন্দেশ, মিষ্টি, ফল-মূলে সাজিয়ে খেতে দেন।

জামাইভোজের জন্য বিশাল আয়োজন করা হয়। পুকুরে জাল ফেলে সবচেয়ে বড় কাতলা মাছ তোলান, মাছের আস্ত মুড়ো জামাই বাবাজীর পাতে তুলে দেন। ষোড়শ ব্যাঞ্জনে জামাইথালা সাজান, বড় জামবাটিতে কালো গাইয়ের ঘন ক্ষীরদুধ, গাছপাকা আম, কাঁঠাল, কলা তো থাকেই। ভোজনশেষে পান-সুপুরীর বাটা, শান্তিপুরী ধুতি, ফিনফিনে পাতলা আদ্দির কাপড়ে তৈরী পাঞ্জাবী, সাথে মানানসই চিকন সূতোয় বোনা দামী উত্তরীয়, কোলাপুরী চপ্পল দিয়ে ডালি সাজিয়ে শাশুড়ীমাতা জামাইবাবাজীকে আশীর্বাদ করেন, নিজ কন্যাটিকে সুখে রেখেছেন বলে ‘শিবঠাকুর’ বাবাজীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান এবং কন্যা-জামাতার ভবিষ্যত জীবন আরও সুখের, আরও শান্তির, আরও সমৃদ্ধির হোক, সেই কামনা করেন।

** জামাইবাবাজী কিন্তু খালি হাতে শ্বশুরবাড়ী আসেনা, যতই আত্মভোলা হোক না কেন, শাশুড়ী মায়ের জন্য শান্তিপুরী তাঁত বা ঢাকাই জামদানী, ঝুড়ি ভর্তি আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, পান-সুপুরী, নদীর ঘাট থেকে কানকো নাড়ানো পাকা রুই বা কাতল মাছ, ময়রার দোকান থেকে গরম রসগোল্লার হাঁড়ি, ছানার সন্দেশ ভর্তি বাক্স সাথে আনতে ভুলেনা। শাশুড়ী মা যখন ‘শিব ঠাকুর’ জামাতাটিকে ধান-দূর্বা-উলু দিয়ে আশীর্বাদ করেন, জামাই বাবাজীও শাশুড়ীমায়ের চরণ স্পর্শ করে, চরণধূলিটুকু আশীর্বাদ হিসেবে মাথায় তুলে নেয়।


আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা!

সেদিন রঞ্জনা’রা আমাদের বাড়ীতে বেড়াতে এসেছিল। রঞ্জনা এবং শুভাশীষ’দা, আমাদের খুব ভাল বন্ধু। রঞ্জনা পাঞ্জাবের মেয়ে, জন্ম এলাহাবাদ। আর শুভাশীষ’দা বাঙ্গালী, জন্ম বার্মাতে। শুভাষীষদা’কে আমি দাদা বলে ডাকি, রঞ্জনাকে ডাকি, ‘রঞ্জনা’। দাদা নিজেকে বাঙ্গালী বলেননা, বলেন ‘বাঙ্গাল’। কারণ, উনাদের আদিনিবাস ছিল পূর্ববাংলার বিক্রমপুরে, ব্রিটিশ আমলেই উনার ঠাকুর্দা (বাবার বাবা) চাকুরী নিয়ে পরিবারসহ বার্মাতে চলে যান। সেখানেই পরবর্তী দুই প্রজন্মকে নিয়ে থেকেছেন, ঠাকুর্দার নাতি শুভাষীষদা’র জন্ম হয়েছে বার্মাতে। উনার এক জ্যেঠামশাই থাকতেন কলকাতায়, বার্মা থেকে কলকাতা উনাদের যাতায়াত ছিল, তাই উচ্চশিক্ষার জন্য ভাই-বোনেরা সবাই কলকাতা চলে যায়। সেখানেই শুভাষীষ’দার দুই দিদি ডাক্তারী পড়ে, শুভাষীষদা ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করে। ডাক্তার দিদিরা চলে আসেন আমেরিকা, পরবর্তীতে দাদাও চলে আসেন আমেরিকা।

আমাদের সাথে উনাদের বন্ধুত্ব হওয়ার মূল সূত্র বাঙ্গাল ভাষা। শুভাশীষ’দার সাথে আলাপ হয়েছিল একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে। সেদিন ছিল এক তরুণ দম্পতীর (কলকাতার বাঙ্গালী) হাউজ ওয়ার্মিং পার্টি, প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জনের সমাগম হয়েছিল। খাওয়া-দাওয়া, গান-বাজনা চলছিল, গৃহকর্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসবো, এমন সময় পেছন থেকে খুব ভারী কন্ঠে ‘নমস্কার বৌদি’ শুনে চমকে পেছন ফিরে দেখি, বাংলা সিনেমার ‘ছবি বিশ্বাস’ হাত জোড় করে নমস্কারের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছেন। আমিও প্রতি নমস্কার জানাতে উনি বললেন, “আপনার মুখে বাঙ্গাল ভাষা শুনে আপনার সাথে আলাপ করার ইচ্ছে হয়েছে”।
বললাম,“তাই নাকি? কী সৌভাগ্য আমার! বাঙ্গাল ভাষা শুনে কেউ আলাপ করতে চাইছে, এটা ভাবতেই অবাক লাগছে। আমি তো বাংলাদেশের মানুষ, আপনিও কী বাংলাদেশের নাকি?”
“আমার বাবা-মা ছিলেন ঢাকার বিক্রমপুরের মানুষ, আমার জন্ম বার্মাতে”।
“কী তাজ্জব কথা, আপনার জন্ম বার্মাতে, অথচ বাঙ্গাল ভাষা জানেন!”
“হ্যাঁ, আমি তো বাংলা বলতে একটি ভাষাই বুঝি, বাঙ্গাল ভাষা, কারণ জন্মের পর থেকে বাবা, দাদু, ঠাকুরমা, মা সবার মুখে বাঙ্গাল ভাষা শুনেছি। কলকাত্তাই বাংলা তো অনেক পরে শিখেছি”।
“দাদা, আমার খুব ভাল লাগছে, এই প্রথম কাউকে দেখলাম, যে বাংলা ভাষা বলতে ‘বাঙ্গাল ভাষা’ বুঝে! হা হা হা! কিন্তু একটু কৌতুহল থেকেই যাচ্ছে, আপনার সাথে এখন আলাপ হলো, অথচ আপনি বলছেন, আমার মুখে বাঙ্গাল ভাষা শুনে আলাপ করতে ইচ্ছে হয়েছে।
আমার মুখে আপনি কখন বাঙ্গাল ভাষা শুনলেন? আমি তো সব সময় বাঙ্গাল ভাষায় কথা বলিনা, আজকে তো বলিইনি, তাহলে?

-বৌদি, আমি আপনার মুখে বাঙ্গাল ভাষা শুনেছি দূর্গা পূজার দিন, আপনার মেয়েদের সাথে যখন কথা বলছিলেন, আমি বোধ হয় কাছে পিঠেই কোথাও ছিলাম, বাঙ্গাল কথা আমার কানে ঠিক পৌঁছেছে, কতকালের চেনা সুর। কতকাল পর শুনলাম বাঙ্গাল কথা। সেদিনই আলাপ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমরা একটু আগেই চলে এসেছিলাম বলে আলাপ হয়নি। আমার স্ত্রীর সাথে নিশ্চয়ই পরিচয় হয়েছে আপনার।
-না দাদা, মনে হয় পরিচয় হয়নি।
-হওয়ার কথা তো, বাঙ্গালের পাঞ্জাবী বৌ, এই একটাই পিস, আর কোথাও পাবেননা, হা হা হা হা!!
-বৌদি পাঞ্জাবী? না, তাহলে দেখিনি।
-দূর্গাপূজায় আমার ছোট মেয়েটা কুমারী পূজায় ‘কুমারী’ হয়েছিল, পূজোর সময় আমার বৌকে দেখেননি? পূজোর ওখানেই ছিল।

আমার মনে পড়ে গেল, ফুটফুটে সুন্দর ‘কুমারী’র কথা, পূজো চলছিল, একটু পর পর ‘কুমারী’র মাথার ওড়না ঠিক করে দিচ্ছিল এক মা, বুঝলাম ফুটফুটে মেয়েটির মা তিনি, আমার পাশেই বসেছিলেন, কথা হয়নি, যেটুকু চোখাচোখি হয়েছে, দু’জনেই একটু হালকা হাসি বিনিময় করেছি। ভদ্রমহিলা যে পাঞ্জাবী, তা তো বুঝিনি।

কৌতুহল চাপিয়ে রেখে বললাম, দাদা, আজকে বৌদির সাথে পরিচয় করিয়ে দিন।
দাদা তার বৌটিকে ডেকে নিয়ে এলেন, প্রতি নমস্কার জানিয়ে বললাম, ‘হাউ আর ইউ”? বৌদি মোটামুটি পরিষ্কার বাংলায় বলল, “আমার নাম রঞ্জনা বোস, আমাকে রঞ্জনা নামেই ডাকতে পারো, আর যদি বৌদি ডাকতে ইচ্ছে হয়, তাও ডাকতে পারো”।
আমি সত্যিই অনেক অবাক হয়েছিলাম, নিজেকে বাঙ্গালী ভাবি, আমার চেয়েও বড় বাঙ্গালী আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমিও উত্তমকে ডাকলাম, পরিচয় করিয়ে দিলাম ‘বোস পরিবারের সাথে। হয়ে গেল আমাদের বন্ধুত্ব।

মাত্র চার বছর হলো আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছে, দাদার সাথে বড় ভাই-ছোট বোন সম্পর্ক, আর রঞ্জনার সাথে মিঠু-রঞ্জনা সম্পর্ক। দাদা সুপুরুষ, বাংলা ছবির ‘ছবি বিশ্বাসের’ সাথে অনেক মিল আছে, তেমন শান্ত-সৌম্য, ধীর-স্থির একজন মানুষ, জ্ঞানের ভান্ডার। উনার সাথে আড্ডায় বসলে দারুণ সব গল্পে সময় কেটে যায়, কত ধরণের গল্প উনি জানেন, আড্ডা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করেনা। তাঁর বইয়ের লাইব্রেরী দেখলে বুঝা যায়, কী বিশাল সংগ্রহ! অবসর সময়টুকু উনি বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকেন, খুব বেশী মানুষের ভীড়ে থাকতে পছন্দ করেননা, এইজন্যই উত্তমের সাথে গলায় গলায় দোস্তি। কারণ উত্তমও একই ঘরাণার মানুষ, কথা কম বলেন, ধীর-স্থির, ভীড়, হইচই পছন্দ করেনা। কেমিস্ট্রি বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকতে ভালোবাসে। দাদা যদি হন লিটারেচারের জাহাজ, উত্তম হচ্ছে কেমিস্ট্রির জাহাজ। আড্ডায় বসলে দুই সওদাগর যার যার জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে গল্প করতেই থাকেন।

রঞ্জনার সাথে আমার খুব দোস্তি, ওদের বাড়ী বেড়াতে গেলে, রঞ্জনা বৌদির হাতের রান্না খেয়ে উত্তম বেশ কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। রঞ্জনার হাতের আলু-পরাটা, কী যে ভাল। শুভাশীষদা’র জন্য শাপে বর হয়েছে। পাঞ্জাবী খানাও খেতে পারেন, আবার বাঙ্গাল খানাও খেতে পারেন। রঞ্জনা সবই রাঁধে, বাঙ্গালীও রাঁধে, পাঞ্জাবীও রাঁধে, আমেরিকানও রাঁধে। ওর মুখে বাংলা শুনতে কী যে ভাল লাগে। পেশায় ও শিক্ষক। তাই আচরণেও শিক্ষকসুলভ ভাব আছে, রঞ্জনার সাথে আমি খুব আবদেরে গলায় কথা বলি, এটা শিখতে চাই, ওটা শিখতে চাই, রঞ্জনা অনেক যত্ন করে শেখায়।

এখন আর মনে পড়েনা, কে প্রথম কাদের বাড়ীতে আগে গেছিল। আমরা গেছিলাম নাকি ওরা এসেছিল। দুই পরিবারে এত বন্ধুত্ব থাকলেও বছরে দুই বারের বেশী কারো বাড়ীতে যাতায়াত হয়না, উনারা আসেন দুইবার, আমরা যাই দুইবার। মোট চারবার দেখা সাক্ষাৎ হয় আমাদের। যাওয়া-আসার পরিক্রমায় লাভের পাল্লা আমার দিকে বেশী ভারী থাকে। কারণ, শুভাষীষদা আমার দাদা, রঞ্জনা আমার বৌদি এবং বন্ধু। তাই যতবার ওরা আমাদের বাড়ী আসে, দুই হাত ভরে উপহার নিয়ে আসে আমার জন্য। রঞ্জনা জানে, আমি বাগান করতে ভালোবাসি, অথচ সময় পাইনা, বাগানটাও খুব বেগড়বাই করছে আজকাল। কিছুই ফলন হচ্ছেনা, মন খারাপ করে থাকি, অথচ ওদের বাগানে শত শত ঝিঙ্গে হয়, টমেটো হয়। আমি কথায় কথায় বলেছিলাম, পটল, ঝিঙ্গে, মূলো, লাউ আমার খুব প্রিয়। রঞ্জনা ব্যাগ ভর্তি করে ওদের বাগানের ঝিঙ্গে নিয়ে আসে, আমার জন্মদিন পার হয়ে যায়, তবুও আমার হাতে শাড়ী বা পারফিউম ধরিয়ে দি্যে বলে, “তোমার জন্মদিনের উপহার”।
আমি ভালোবাসার কাঙ্গাল, তাই ভালোবাসা হাত পেতে নেই, বিনিময় করিনা। যে দিতে জানে, সে পাওয়ার কথা মনে রেখে দেয়না। রঞ্জনা বা শুভাশীষদা সেই রকম মানুষ, ঐজন্যই আমি ওদের বাড়ী খালি হাতে যাই, ফিরে আসি ভালোবাসা নিয়ে।

রঞ্জনা আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। ও বাংলা বলতে পারে, ও যে বাংলা পড়তেও পারে, তা আমি জানতামই না। দুই সপ্তাহ আগে যখন ওরা আমাদের বাড়ী এলো, ঘরে ঢুকেই রঞ্জনা বলল, “আমি তোমার আজকের ম্যেনু আর্ধেকটা জানি। তোমার দাদাকে বলেছি, মিঠু কিন্তু রুই মাছের ঝোল, বাতাসী মাছের চচ্চড়ি রেঁধেছে, রসগোল্লাও বানিয়েছে। বাকীগুলো আজ সকালে রাঁধবে”।
আমি ত হাঁ, বললাম, “তুমি কী করে জানলে?
-ফেসবুকের আর সবাই যে করে জেনেছে।
-তুমি কী বাংলা পড়তে পারো?
-আমি বাংলা পড়তে পারি এবং তোমার প্রতিটি লেখা আমি পড়ি। কমেন্ট দেইনা, কিন্তু তোমার দাদাকে বলি, আজ মিঠুদের বাড়ীতে এই হয়েছে, ঐ হয়েছে। হা হা হাহ!!

আমি অবাক এবং মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পৃথিবীর কত কোণায় কোণায় আমার জন্য ভালোবাসা লুকানো ছিল, আজ আমি তা পাচ্ছি। আমার সামনে বসে থাকা ছোট-খাটো মানুষটি, শান্তও নয়, আবার আমার মত ছটফটে স্বভাবের নয়, আমরা সমবয়সী কিন্তু তার মুখে সব সময় বড়বোন সুলভ প্রশ্রয়ের হাসি লেগেই থাকে। আমি যখনই মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি, রঞ্জনা শিক্ষকসুলভ মনোভাব নিয়ে আমার পাশে দাঁড়ায়, অনেক সুন্দর করে আমাকে বোঝায়, মনোবল হারাতে না করে। মা-বাবাকে নিয়ে আমার যত আবেগ, রঞ্জনা তা প্রশ্রয় দেয়, আমার খুব ভালো লাগে। মনে হয়, এই তো বন্ধু, এই তো পরমাত্মীয়, প্রবাসে আমার আপনার জন।

সেদিন রঞ্জনা আমাদের বাড়ী এসেছিল পা টেনে টেনে। হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছিল, আর্থ্রাইটিসের যন্ত্রণায় ও কাহিল। হাঁটু ভাঁজ করতে পারেনা, উঁচু চেয়ার ছাড়া বসতে পারেনা, এখানে অনেক চিকিৎসা হয়েছে, ঠিক হলোনা কিছুই, খুব সম্ভব ‘ Knee replacement’ এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আহারে! আমার বন্ধুটির জন্য আমি কিছুই করতে পারিনা, এত দূরে থাকে যে একটু রান্না করে দেবো সে উপায় নেই।

রঞ্জনার বাপের বাড়ী এলাহাবাদ, সেখানে ওর দাদা, দিদিরা ওর জন্য অপেক্ষা করছে, ওখানে তারা ছোট বোনটির জন্য ‘ভারতীয় ভেষজ অথবা হোমিওপ্যাথী’ চিকিৎসার ব্যবস্থা করে রেখেছে। ঐ চিকিৎসাতে নাকি অনেকেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছে। সেই গল্পই রঞ্জনা শোনাচ্ছিল, শুনে আমারও খুব ভাল লাগছিল। ভাই-বোনের সম্পর্ক এমনই হয়, এমনই হওয়া উচিত। গত সপ্তাহেই রঞ্জনা চলে গেলো এলাহাবাদ, ফিরে আসবে দুই মাস পর, পুরোপুরি সুস্থ হয়ে। আমি পরিকল্পনা করে রেখেছি, ফিরে আসার পর আমার সুস্থ বন্ধুটিকে কীভাবে অভিনন্দন জানাবো।
— with Anindita Roy.
1


সরিষা ফুলের বড়া

২০০৪ সালে নিউইয়র্ক বেড়াতে গেছিলাম। আমার জাবি'র রুমমেট উমা থাকে নিউ জার্সীতে। ওর বাড়ীতেও বেরাতে গেলাম, এক রাত থাকলাম। উমা কী খুশী আমাদেরকে পেয়ে, এটা রাঁধে, ওটা রাঁধে, এভাবে অনেক কিছু রেঁধেছে। এত কিছুর মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশী পছন্দ করলাম, 'সরষে ফুলের বড়া'। বড়া বা যে কোন ভাজাভুজি খাওয়ার ব্যাপারে আমি একটু সচেতন থাকি, ভাল লাগলেও পরিমানের বেশী খাইনা। কিন্তু সেদিন সরষে ফুলের বড়া বেশ কয়েকটা খেয়ে ফেললাম। যে কোন বড়া খেতে খুব ভাল, কিন্তু সরষে ফুলের বড়া আমাকে টেনে নিয়ে গেছে একেবারে শৈশবে। আমার ঠাকুমা নিরামিষভোজী বিধবা ছিলেন, খুবই অল্প খেতেন, উনি যা রাঁধতেন, তা থেকেই অমৃত ঝরে পড়তো, সাধারণ সজনে ডাঁটার চচ্চড়ি দিয়ে এক থালা ভাত খাওয়া যেতো, এতটাই স্বাদ হতো। সেই ঠাকুমার হাতের সরষে ফুলের বড়ার স্বাদ কেমন হতে পারে, তা বলাই বাহুল্য!

উমাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওর এক প্রতিবেশী ( কলকাতার বাঙ্গালী) নিজের জমিতে সরষের বীজ ছড়িয়েছিলেন, ফুল হয়েছে, সেই ফুল উমাকে পাঠিয়েছেন। উমা তার অতি প্রিয় 'মিঠুদি'র জন্য ফুলগুলো তুলে রেখেছে। ধন্যবাদ দিয়ে উমাকে জড়িয়ে ধরলাম, ওর মাধ্যমেই সেই না-দেখা রমনীকে ধন্যবাদ জানালাম।

ঐ বছরই মিসিসিপি চলে এলাম, অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে থাকলাম একটানা চার বছর। ভাড়াবাড়ীতে বড় হয়েছি, জীবন পার করে দিতে পারতাম ভাড়া বাড়ীতে। কিন্তু গ্রামে নিজের বাড়ীতে জন্ম নেয়া উত্তমের এই পরাধীনতা ভালো লাগতোনা। কিনে ফেললো ছোট্ট বাড়ী, যাকে এখন অনায়াসে বলা যায়, 'পদ্মবাড়ী'। কারণ আমি বাড়ীটার চারপাশ স্থল পদ্ম গাছে ঘিরে দিয়েছি।

মনে পড়ে গেলো, উমার সেই প্রতিবেশীর কথা। ভাঁড়ার থেকে এক মুঠ সরষেদানা ছড়িয়ে দিলাম বাড়ীর পেছন দিকের জমিতে। সরষের চারা বের হলো, সরষে গাছ বড় হলো, কী সুন্দর হলুদ ফুল ফুটতে শুরু করলো। কিন্তু গাছের পরিমান কম বলে ফুলের পরিমানও কম হলো। কুছ পরোয়া নেহী! বলেই প্রতিদিন ফুল তুলে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে রেফ্রিজারেটারে রেখে দিলাম। পাঁচদিনের ফুল দিয়ে একদিন বানিয়ে ফেললাম 'সরষে ফুলের বড়া'। বড়া খেয়ে আমার উত্তম ভুলে গেল ধরা, মহাকাশে বেশ কিছুক্ষণ ভেসে বেড়ালো, তারপর আবার ধরার মানুষ, ধরাতে ফিরে এলো। এরপর থেকে প্রতি বছর সরষে দানা ছড়াই, গাছ হয়, ফুল হয়, ফুলের বড়া তৈরী হয়।

উপকরণঃ সরষে ফুল, আটা বা ময়দা ( বেসন না, বেসন দিলে ফুলের গন্ধ থাকেনা), অল্প বেকিং সোডা, এক চিমটে কালোজিরা ( যে কোন বড়াতে কালোজিরা স্বাদ বাড়িয়ে তুলে), হাতের কাছে থাকলে কয়েক দানা পোস্ত ( পোস্ত দানা বড়াকে মচমচে বানায়), পরিমানমত লবন, পরিমান মত জল। ডুবো তেলে ভাজার জন্য এক কাপ তেল ( একবারের ভাজা তেল ফেলে দেয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। এই তেল পরবর্তীতে মাছ বা আলু-পটল সাঁতলাতে ব্যবহার করা যায়, রাস্তার পারের তেলেভাজা দোকানদারেরা ১০ বছর ধরে একই তেল ব্যবহার করে, সেটা থেকে সাবধান)।

সবকিছু একসাথে মিলিয়ে মাখাতে হবে। খুব বেশী আঠালো বা একেবারে পাতলা হবেনা। মোটামুটি ভারী হবে গোলা। আটা বেশী দিলে বড়া কিন্তু ভাল হবেনা, আটার দলার মত স্বাদ হবে, আসলে আটা দিতে হয় ফুলগুলো ধরে থাকার জন্য। চুলায় প্যান বসিয়ে তেল দিয়ে গরম করতে হবে চড়া তাপে। তারপর তাপ কমিয়ে মাঝামাঝি এনে বড়া তেলে ছাড়তে হবে। আঁচ আরেকটু কমিয়ে বড়া এপিঠ-ওপিঠ করে ফাজতে হবে। সরষে ফুলের বড়া একেবারে 'লাল' করা যাবেনা, হলুদ থাকবে, কিন্তু মচমচে হতে হবে। বড়ার সাথে শুকনো মরিচ ভাজতে ভুলবেনা।

*** সরষে ফুলের বড়া খেতে একটু হালকা তেতো হয়, কিন্তু এর গন্ধ ও স্বাদ, অতুলণীয়!!!!
4



No comments:

Post a Comment