Wednesday, November 28, 2012

দুইজন 'Other Mother' এর গল্প

থ্যাঙ্কস গিভিং উপলক্ষে ওয়ালমার্টে নানা ধরণের প্রমোশনাল সেল চলছে। আমাদের ফোন ডিপার্টমেন্টে চলছে আকর্ষণীয় ডীল। কেউ যদি দুই বছরের চুক্তিতে ফোন সার্ভিস নেয়, তাহলে তাকে ৫৫০ ডলার দামের গ্যালাক্সী এস ২ ফোন দেওয়া হবে ১ ডলার মূল্যে, সাথে ১০০ ডলারের ওয়ালমার্ট গিফট কার্ড।  ৬০০ ডলার দামের গ্যালাক্সী এস ৩ পাওয়া যাচ্ছে ১৪৮ ডলার দামে। একমাত্র আই ফোন বাদে যে কোন স্মার্ট ফোনের সাথে বোনাস হিসেবে গ্রাহককে ১০০ ডলার দেয়া হচ্ছে। প্রতি বছর থ্যাঙ্কস গিভিং উপলক্ষে এই ধরণের ডীল থাকে। আগামী ১লা ডিসেম্বার পর্যন্ত এই প্রমোশন চলবে।

এমন আকর্ষণীয় প্রমোশনাল ডীল পাওয়ার জন্য অনেক গ্রাহক থ্যাঙ্কস গিভিং পর্যন্ত অপেক্ষা করে। যাদের ফোন কন্ট্র্যাক্ট রিনিউ করার সময় হয়ে গেছে, তারাও এই সীজনে চুক্তি নবায়ন করে এবং ১০০ ডলারের গিফট কার্ড পেয়ে যায়। আমি নিজে একবার তিনটি ফোন নবায়ন করে ৩০০ ডলার পেয়েছিলাম, আরেকবার পেয়েছিলাম ১৫০ ডলার।
অনেকেই ফোন সার্ভিস নবায়ন করে গেছে। আজ আমার কাছে এক ভদ্রমহিলা এসেছিল, সাথে তার কিশোরী মেয়েকে নিয়ে। ভদ্রমহিলা আমার সাথে চুক্তি নবায়ন নিয়ে যখন কথা বলছিল, কিশোরী তার মায়ের সাথে চুপ করে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিল। ভদ্র মহিলার সাথে কথা বললেও আমার চোখ আটকে যাচ্ছিল কিশোরীটির দিকে। এই বয়সের মেয়েরা সব সময় মেকাপ করে থাকতে ভালোবাসে। এই মেয়েটিও মেকাপ করে এসেছে। মেকাপের কারণেই কিনা জানিনা, মেয়েটির চোখ দুটি এমন সুন্দর লাগছিল যে বার বার আমার নজর ওর চোখে আটকে যাচ্ছিল। পূর্বে আমার ধারণা ছিল, টিন এজ ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলা অনেক কঠিন। কিনতু দিনে দিনে আমার সে ধারণা পাল্টেছে। টিন এজ ছেলেমেয়ের সাথে সুন্দর করে কথা বললে ওরা দারুণভাবে সাড়া দেয়।

মেয়েটিকে খুশী করার জন্য প্রথমেই বললাম,
-তোমার চোখ দুটি কী সুন্দর! চোখের মেকাপও দারুণ সুন্দর হয়েছে! কে করে দিয়েছে মেকাপ?
-দারুণ মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে ও বলল, আমি নিজেই করেছি।
-কতক্ষণ লেগেছে আই মেকাপ করতে?
-পাঁচ মিনিট।
পাঁচ মিনিটে তুমি অমন সুন্দর মেকাপ করেছো! আসলে তোমার চোখ দুটিই সুন্দর, মেকাপ না করলেও সুন্দর, মেকাপ করলেও সুন্দর--বলে এবার আমি হেসেছি।
পাশ থেকে মেয়েটির মা ( তাই হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু মায়ের সাথে মেয়ের চেহারায় কোনই মিল নেই) বললো, --দেখতে হবে না, বয়সটা চিন্তা করো, টিন এজ, পাঁচ মিনিটেই মেকাপ শেষ হয়ে যায় এদের।
ভদ্রমহিলা দেখতে আকর্ষণীয়া নয়, কিন্তু তার মেয়ে এমন সুন্দর, চোখ দুটো নিশচয়ই ওর বাবার কাছ থেকে পেয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, উনি তোমার কে হন?
 মেয়েটি বললো, মা' এর মত।
মা' এর মত মানে  কি? উনি তোমার মা নন, কিন্তু তোমাকে মায়ের মত ভালোবাসেন, তাই তো? তোমাকে দেখে আমারও তো দেখছি 'মায়ের মত' হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে!
 এবার ভদ্রমহিলা বললেন, আমি হচ্ছি, আদার মাদার।
-আদার মাদার?
-হ্যাঁ, আমি ওকে এডপ্ট করেছি।

এখানে অনেক পরিবার আছে, যারা বিভিন্ন দেশ থেকে, চার্চ থেকে, হসপিটাল থেকে অসহায় শিশুদের দত্তক নেয়।  অনেক ধনী পরিবার আছে, যারা নিজেদের সম্পত্তি বিভিন্ন স্কুল, কলেজ , বিশ্ববিদ্যালয়ে  কৃতী স্টুডেন্টদের জন্য স্কলারশীপ হিসেবে দেওয়ার জন্য দান করে দেয়। তবে বাচ্চা দত্তক নেয়ার ব্যাপারটা ধনী-দরিদ্র ম্যাটার করে না। অনেককেই দেখি, নিজের বাচ্চাদের সাথে আরও দুই একজন বাচ্চাকে লালন পালন করে। কিছু কিছু পরিবার হয়তো বা সরকারী অনুদান পায় এই বাবদ, তবে অধিকাংশ পরিবার মানবিক দৃষ্টিতে এই কাজটি করে থাকেন। অথচ, আমাদের দেশে কত নিঃসন্তান বাবা-মা কে দেখেছি, নিঃসন্তান থাকতে রাজী আছে, কিন্তু অন্যের সন্তান দত্তক নেয়াকে খুবই হীন কাজ মনে করে।


তবে, অনেক বছর আগে, আমরা তখন ভুতের গলিতে থাকতাম, কোন এক পরিচয়ের সুবাদে এক ভদ্রমহিলা আমাদের বাড়ীতে এসেছিল। মহিলার সাথে কয়েকবারই দেখা হয়েছে, উনার তিন ছেলে, একমেয়ে। ৯৫ সালের কথা বলছি, পরিবার পরিকল্পনা অফিসে বড় অফিসার পদে উনি কর্মরত ছিলেন। নামগোত্রহীন বাচ্চাদের কথা উঠতেই উনি নিজের মেয়ের কথা বললেন। তখনই জানলাম, উনার তিন ছেলে, মেয়েটিকে উনি দত্তক নিয়েছেন।  আট নয় বছর আগে, একদিন পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিকেই নাম গোত্রহীন এক মেয়ে শিশুকে পাওয়া যায়, কেউ ফেলে রেখে চলে গেছে, কয়েক মাস বয়সী শিশুটিকে নিয়ে সকলেই যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়,  উনি তখন এগিয়ে আসেন, শিশুটিকে  আইনসম্মতভাবে দত্তক নেন। শিশুটিকে বাড়ীতে নিয়ে উনার ছেলেদের কাছে তুলে দেন, ছোট বোন হিসেবে।  উনার স্বামী বোধ হয় একটু আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু উনার সাহসী সিদ্ধান্তের কাছে চুপ করে থাকেন। উনার ছেলে তিনটি নাকি নতুন শিশুটিকে অনেক যত্ন করতো। কখনও বুঝতে দেয়নি ও অন্য কোথাও থেকে এসেছে। তিন ছেলেই বাইরে গেলে, বাড়ী ফেরার সময় বোনের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসতো। বন্ধুদের কাছে পরিচয় দিত, 'আমাদের ছোট্ট বোন' বলে।

আমার সাথে যখন ভদ্রমহিলার পরিচয় হয়েছিল, তখন উনার বড় ছেলে আমেরিকাতে থাকে,  বাকী দুই ছেলে কলেজে পড়ে, মেয়েটির বয়স নয় বছর, আমেরিকা থেকে ছেলে সবার জন্য গিফট পাঠায়, সবচেয়ে দামী গিফটটি পাঠায় তাদের কুড়িয়ে পাওয়া বোনটির জন্য। উনি বলেছিলেন, বাচ্চাটি দেখতে রোগা প্যাকাটি ছিল, ধীরে ধীরে নাকি গোলাপের পাপড়ির মত রঙ হয়েছে, মাথাভর্তি কালো কোঁকড়া চুল, এমন বর্ণনা শুনে আমি মেয়েটির ছবি দেখার আগ্রহ প্রকাশ করি। পরের বার যখন উনার সাথে দেখা হয়, উনি সাথে করে নিয়ে আসা বাচ্চাটির ছবি  দেখান। সাত আট বছরের এক বালিকা, সুন্দর জামাকাপড় পড়ে তার আম্মুর গলা জড়িয়ে আছে। সুন্দর ফুটফুটে এক বাচ্চা। ভদ্রমহিলা কিন্তু দেখতে খুবই সাধারণ, আটপৌরে চেহারা, অথচ হৃদয়টা কী বড়! আমাকে জানালেন, মেয়েটিকে উনি সর্বোচ্চ ডিগ্রী নেওয়াবেন, সম্ভব হলে ডাক্তারী পড়াবেন, বিয়ের বয়স হলে মেয়েটির জন্ম বৃত্তান্ত প্রকাশ করেই বিয়ে দিবেন। জন্মের ইতিহাস শুনে কেউ বিয়ে করতে চাইলে, সেই ছেলেকে উনি রাজা বানিয়ে দিবেন! এমন চমৎকার আম্মুটাকে আমারও জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিল। কী চমৎকার হৃদয়ের এক মহিলার সাথে আমার দেখা হয়েছে, ভাবলেই নিজেকে গর্বিত মনে হয়। এই গল্প আমি মনের কোঠায় ধরে রেখেছিলাম, আজ তা প্রকাশ করলাম।

কতকাল পরে, সেদিনের সেই মহিলাটিকে যেনো আবার আমার চোখের সামনে দেখতে পেলাম, অন্যরূপে। এই 'আদার মাদার' টিও দেখতে খুবই সাধারণ,  কিনতু মেয়েটি দেখতে গোলাপের মত সুন্দর! এমন ফুটফুটে বাচ্চা কে কোন মায়ের প্রাণে ধরে ছেড়ে দিতে মন চাইল! আমি ভদ্রমহিলার ফোন সার্ভিস চুক্তি নবায়ন করতে করতেই মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম,

-তোমার নাম কী গো ?
-আলিশা
-আলিশা, তোমার বয়স কত? কোন গ্রেডে পড়ো তুমি?
-১৭ বছর বয়স, সিনিয়ার ক্লাসে পড়ি।
-তুমি টুয়েলভথ গ্রেডে পড়ো!  আমি ভেবেছিলাম, তুমি হয়তো নাইনথ গ্রেডে পড়ো।

-ভদ্রমহিলা বললেন, ও ডাবল প্রমোশান পেয়েছে, পড়াশুনায় খুব ভালো।

বাহ! ভবিষ্যতে কোন লাইনে পড়তে চাও?
-নার্সিং পড়বো।
-তুমি  যদি নার্সিং পড়ো, তুমি হবে অতি চমৎকার একজন নার্স, তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে রোগী অর্ধেক সুস্থ হয়ে যাবে!
ভদ্রমহিলা বললো, আমার বড় মেয়েও নার্সিং পড়ে।

তোমার আরেকটি মেয়ে আছে? এই মেয়েকেও এডপ্ট করেছো?
-নাহ, বড় মেয়েকে ঈশ্বর দিয়েছে। আমার এই মেয়েটার জন্য প্রার্থণা করো, ও যেন নার্সিং পড়তে পারে। পড়াশোনায় মেয়েটা খুব ভালো।

আমি ভদ্রমহিলাকে আন্তরিকভাবেই বললাম, তোমার ইচ্ছে পূরণ হবেই। এমন মমতাময়ী মায়ের ইচ্ছে পূরণ না হয়ে পারে! তবে তোমার ' আদার মাদার' টার্মটা আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছে! তোমাদের দুজনকে একসাথে দেখে একবারও মনে হয় না, মাদার কখনও 'আদার' হতে পারে! মাদার ইজ অলওয়েজ মাদার।

এবার আলিশা মুখ খুললো, তুমিও নিশ্চয়ই খুব ভালো মা। এইজন্যই তুমি আমাকে এত বেশীবার সুন্দর বলছো, এমন মজা করে কথা বলছো।

বললাম, ভাল মা কিনা জানি না, তবে আমারও তিনটি মেয়ে আছে। ওরাও তোমার মতই লক্ষ্মী। লক্ষ্মী মেয়েদের দিকে আমার নজর অটোমেটিকভাবে চলে যায়! তুমি ভালোভাবে পড়াশোনা করো, নার্সিং খুব ভাল প্রফেশান, অনেক নার্স খ্যাটর খ্যাটর মার্কা হয়, কিন্তু তুমি হবে অন্যরকম। অনেক মায়াবতী, অনেক শান্ত। ভালো থেকো।

[ ** আলিশা যদি শেষ পর্যন্ত নার্সিং পড়তে পারে, মেয়েটি আসলেই খুব চমৎকার একজন নার্স হবে, ওর চেহারার মধ্যে  সে সম্ভাবনা আছে।  আমার মা যখন আইসিইউ তে ছিলেন, একদিন দেখি, মায়ের মাথার বালিশ ভিজে একশা হয়ে আছে। ডিউটিরত নার্সকে বলতেই সে জবাব দিল, ' এইটা ঘামে ভিজা। সাকশান পাম্প চললে রুগী অস্থির হইয়া যায়, তখন ঘামে। বললাম, তা তো হবেই, কিন্তু বালিশের ওয়্যারটা পালটিয়ে দিন।  মেয়েটি কোন কথা না বলে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল। আমি থাকা পর্যন্ত নার্স মেয়েটি বালিশের ওয়্যার পালটায় নি। আমি নিজেই কয়েকটি টিস্যু পেপার নিয়ে মায়ের ঘাড়ের নীচে দিয়ে রেখেছিলাম। আমার আর বলার ইচ্ছে হয় নি, তোমাকে এখানে রাখা হয়েছে রুগীর সেবা করার জন্য, বিছানায় শয্যাশায়ী বলেই কী একজন মানুষকে এমন অবহেলা করতে হবে? আমি ঠিক জানিনা, বাংলাদেশে  ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে কী ধরনের ইনটেনসিভ কেয়ার নেওয়া হয়!

পরের দিন মায়ের মুখ থেকে লালা বের হয়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছিল, ডিউটিরত নার্স মেয়েটিকে ডেকে দেখালাম, এই মেয়েটি কিন্তু গতদিনের নার্সের মত 'অমানবিক' ব্যবহার করেনি, সে আরেকটি শুকনো বালিশ এনে মায়ের ভেজা বালিশটি পালটিয়ে দিয়েছিল। তবে বালিশ পাল্টানোর সময় মায়ের মাথা উঁচু করার সময় খুব বিরক্তি নিয়ে বলেছিল, " আপনের মা শরীরটারে শক্ত কইরা রাখে, সহজে নড়ানো যায় না"। বলেছিলাম, মায়ের শরীর শক্ত হয়ে গেছে, ইচ্ছে করে শক্ত করে রাখেনা বোন"।

সেদিন দুই নার্সের রুগীর প্রতি দুই রকম ব্যবহার দেখে আমার খুব কষ্ট লেগেছিল মনে, খুব আফসোস হয়েছিল, প্রফেসারের উপর রাগ করে আমি প্রায় সমাপ্ত নার্সিং পড়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। যখনই ক্লিনিক্যাল ক্লাসে হসপিটালে যেতাম, আমি নিজের অস্ত্বিত্ব ভুলে যেতাম, রুগীদের  রোগ যন্ত্রণায় যতটুকু সম্ভব আরাম দেয়ার চেষ্টা করতাম।  পড়া ছেড়ে চলে আসার অনেক পরেও কিছু কিছু রোগী ওয়ালমার্টে এসে আমাকে চিনতে পেরে জিজ্ঞেস করতো, আমি কোন হসপিটালে আছি। জবাবে বলতাম, আমি ভলান্টিয়ার নার্স ছিলাম। আমি যদি নার্সিং পড়া শেষ করতাম, আমিও নাকি খুব চমৎকার নার্স হতাম, এই কথা কয়টি বলেছিল নার্সিং কলেজের দুই প্রফেসার। বাস্তবতা হচ্ছে, সারা জীবনে আমি কিছুই হইনি।]

Tuesday, November 27, 2012

আগামীকাল ওয়ালমার্টের সকলের জন্য পাঠাচ্ছি 'সারপ্রাইজ কেক"!!

ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টারের স্টাফদের মাঝে প্রচলিত একটি রীতি হচ্ছে, সহকর্মীদের যে কারোর খুব নিকটজন কেউ মারা গেলে, স্টোরের পক্ষ থেকে সমবেদনা কার্ড তৈরী করে শোকে মুহ্যমান সহকর্মীটিকে দেয়া হয়। কার্ডের ভেতরে থাকে সকলের স্বাক্ষর, সাথে ডলার। স্বাক্ষর করার সময় যার যেমন খুশী, ডলার ভরে দেয় খামের ভেতর
। এরপরে আর কিছু আমি জানিনা। আমিও চেনা-অচেনা যে কারো কার্ডে স্বাক্ষর করে ডলার ভরে দিয়েছি খামে, অনেকবার। জানতেও চাইনি, এই ডলার কেনো দেয়া হয়? ভেবে নিয়েছি, হয়তো কফিনে ফুল দেয়ার জন্যই টাকা দেয়া হয়। যদিও ধরেই নিয়েছি, নিয়মটি শুধুই আমেরিকানদের জন্য প্রযোজ্য, কিনতু শুরু থেকেই এই রীতিটি আমার খুব ভালো লাগে। আমার মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনেও সকলেই আমার প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে, কারো কারো সমবেদনা ছিল কর্তব্য করার মতো, অধিকাংশের সমবেদনার ভাষা ছিল হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে যাওয়ার মত। সময়মত কাজে যোগদান করেছি, সকলেই মৌখিক সমবেদনা জানিয়েছে, ধরেই নিয়েছি ব্যাপারটি ওখানেই শেষ হয়ে গেছে।

দশ দিন আগে আমার সুপারভাইজার আমার হাতে একখানি 'সমবেদনা কার্ড' ধরিয়ে দিয়ে বিরাট এক 'হাগ' দিয়েছে। এমন ঘটনায় আমি এতটাই 'সারপ্রাইজড' হয়েছি যে মুখে কোন কথা সরছিল না, দু চোখ বেয়ে শুধুই অশ্রু ঝরছিল। এই প্রথমবার আমি আমেরিকানদের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম। কৃতজ্ঞতা বোধ করেছি এই ভেবে, আমাকেও ওরা ওদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে! আমেরিকান সহকর্মীদের এই কৃষ্টি দেখে মুগ্ধ হলাম।

আমাকে এমন মমতা , সমবেদনা দেখিয়ে যেভাবে ওরা চমকে দিয়েছে, আমিও তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর উপায় খুঁজছিলাম। আজকেই একমাস পূর্ণ হলো আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল মুহূর্তের মধ্যেই মাথায় আইডিয়া চলে এসেছে, চলে গেলাম বেকারী সেকশানে। আমার পরম শুভাকাংক্ষী ডেবী (বেকারীর ম্যানেজার) কাছে আসতেই তাকে বললাম, " ডেবী, আমি ওয়ালমার্টের সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, আমার কষ্টের সময়ে আমার পাশে থাকার জন্য। তোমার হেল্প চাই। আমাকে সবচেয়ে বড় সাইজের, সবচেয়ে সুস্বাদু একখানা কেক বানিয়ে দাও। কেকের রঙ হবে ধবধবে সাদা, এককোনে থাকবে হলুদ গোলাপ, লেখা থাকবে , থ্যাঙ্কস এভরিবডি ফর বিয়িং উইদ মি। কেকটা চাই আগামী শুক্রবার, যেদিন মোটামুটি সকলেই উপস্থিত থাকবে। আমার হাজব্যান্ডকে বলেছি, একখানা ধন্যবাদ কার্ড বানিয়ে দিতে। আমার প্রতি যে ভালোবাসা তোমরা দেখিয়েছো, তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর আর অন্য কোন উপায় খুঁজে পেলাম না"।

আমার প্রস্তাব শুনে ডেবী বেশ কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে, তারপরেই আমাকে জড়িয়ে ধরে শুধু বললো, " তুমি স্পেশ্যাল, তুমি শুদ্ধ আত্মার এক মানুষ, তোমাকে আমি কী পরিমান ভালোবাসি তা তুমি আন্দাজ করতে পারবেনা। আমি অনেক যত্ন করে কেক বানিয়ে দেবো। তোমার এই প্রস্তাবে আমি অবাক হয়েছি, এর চেয়ে সুন্দর আর কিছু হতে পারেনা। ২২ বছর হয়ে গেলো আমি ওয়ালমার্টে চাকুরী করছি, তুমিই প্রথম, যে সিমপ্যাথী কার্ডের বিপরীতে এভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাইছো। সবাই খুশী হবে, সকলেই সম্মানিত বোধ করবে। আই ফিল প্রাউড ফর ইউ"!

(ডেবীর বয়স ৬৫ বছর, বি এ পাশ, সময় কাটানোর জন্য চাকুরী করে, অবসরে আমার মতো সেও গল্পের বই সামনে নিয়ে বসে থাকে, চার সন্তানের সকলেই আর্মীতে চাকুরী করে, স্বামী-স্ত্রী সুখে সংসার করে)

সারপ্রাইজ কেকের অসমাপ্ত গল্প!

নভেম্বারের ৮ তারিখে আমার ওয়ালে  "আগামীকাল ওয়ালমার্টের সকলের জন্য পাঠাচ্ছি 'সারপ্রাইজ কেক"!! শিরোনামে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, শুক্রবারে ওয়ালমার্টের সকল সহকর্মীর ঊদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা কেক পাঠাবো। এরপর আরও দুই তিন শুক্রবার পার হয়ে গেছে, কেক পাঠানোর গল্প বলার সুযোগ আর হয়ে উঠেনি। আজ ছবির এলবাম ঘাঁটতে গিয়ে সেদিনের সেই 'সারপ্রাইজ কেকের' ছবি দেখে মনে পড়ে গেলো, সারপ্রাইজ কেকের গল্পটি তো শেষ করা হয় নি! 

আমি বেকারী ম্যানেজার ডেবী'র কাছে কেকের অর্ডার দিয়ে চলে এসেছিলাম। পরেরদিন বৃহস্পতিবার আমার ডে অফ ছিল, শুক্রবার বেলা ১২ টায় ছিল আমার শিফট। পৌণে বারোটার দিকেই আমি ওয়ালমার্টে পৌঁছে যাই। আগের দিন উত্তম কুমারকে দিয়ে একখানা সুন্দর 'থ্যাঙ্কস কার্ড' তৈরী করিয়েছিলাম। সেই কার্ডটি সাথে করেই আমি সরাসরি বেকারী ডিপার্টমেন্টে চলে যাই। গিয়েই ডেবীর খোঁজ করি, ডেবী'কে না পেয়ে টিনার কাছে যাই। টিনা আমাকে জানায়, কেক প্রায় রেডী, ডেকোরেশান চলছে। মাথা উঁচু করে দেখি, একটি মেয়ে ধবধবে সাদা কেকের উপর হলুদ গোলাপ বসাচ্ছে। ওদের বলে আসলাম, কেক রেডী হয়ে গেলে আমাকে জানাতে, আমি কার্ডসহ কেক টি ব্রেক রুমে রাখবো। ওদের কাছ থেকে রিসিট নিয়ে ক্যাশ রেজিস্টারে গিয়ে দাম মিটিয়ে দিলাম। এরপর  আমি ক্লক ইন করে হাতের বই, ব্যাগ ভেতরে রাখতে গিয়ে দেখি, টি-রুমের টেবিলে বিরাট এক কেক সার্ভ করা আছে। কেউ কেউ কেক কেটে খাচ্ছেও।  কেক দেখে আমি ভীষন চমকে গেছি। কালচে বাদামী 'স্পাইডার ম্যান' কেক কোথা থেকে আসলো! জানতে পারলাম,  স্পাইডার ম্যানের নতুন ডিভিডি রিলিজ উপলক্ষে ওয়ালমার্ট কর্তৃপক্ষ সকলের জন্য কেকের ব্যবস্থা করেছে। আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেলো, একটু পরেই আসবে আমার তরফ থেকে কেক, কার এতো দায় পড়েছে, এক কেক শেষ হতে না হতেই আরেক কেক খাবে! 

মন খারাপ নিয়েই আমার সময়মতো আমি আমার ডিপার্টমেন্টে চলে গেলাম। ঘন্টা দুই পরেই ডেবী ( কোন কারণ ছাড়াই এই মহিলা আমাকে দারুণ ভালোবাসে) আমার ডিপার্টমেন্টে এসে সংবাদ দেয়, কেক রেডী। আমি আমার রেজিষ্টার ছেড়ে বের হতেই দেখি, ডেবীর দুই সহকর্মীর হাতে বিশাল সাইজের কেকের ট্রে ধরা। কেকের চেহারা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। আমার মুগ্ধতা ডেবীর ইশারায় ভেঙ্গে গেল। তাড়াতাড়ি ওদের পিছু নিলাম, পৌঁছে গেলাম টি-ব্রেক রুমে। ওরা খুব যত্ন করে কেকটি সেই 'স্পাইডার ম্যান' কেকের পাশে বসিয়ে দিল। আমি থ্যাঙ্কস কার্ড কেকের পাশে রেখে উপস্থিত কর্মীদের ঊদ্দেশ্যে ছোট্ট করে বললাম, আমি যখন মায়ের মৃত্যুশোকে কাতর, আমার ওয়ালমার্ট বন্ধুরা আমার পাশে দাঁড়িয়ে যে ভালোবাসা, সহমর্মিতা দেখিয়েছে, তোমাদের সেই ভালোবাসার ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারবো না, কিন্তু আমার পাশে থাকার জন্য তোমাদের সবাইকে ছোট্ট ধন্যবাদ জানাতে চাই। 

কেক ও কার্ড রেখে আমি কাজে ফিরে আসি। ঘন্টা দুই পরে গিয়ে দেখি, কেকের এক চতুর্থাংশ খাওয়া হয়েছে। পাশের কালচে খয়েরী কেকটাকে ইচ্ছে করছিল এক ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেই। আরও পরে একজন একজন করে আমার কাছে আসতে লাগলো, আমাকে 'হাগ' করে দ্বিতীয়বার সহানুভূতি জানিয়ে গেল, সাথে এটা যোগ করতে ভুললো না, " এই কেকের আইডিয়া খুব ভালো হয়েছে, কেকটা দেখতে ভারী সুন্দর হয়েছে, আর খেতেও হয়েছে অতি চমৎকার"। নীতিগতভাবেই আমি কেক খাইনি, তবে কেকের চেহারা দেখেই বুঝেছি, এই কেক সুস্বাদু না হয়ে যায় না। এক ফাঁকে আমি আবার বেকারী ডিপার্টমেন্টে গিয়ে  ডেবী, টিনা আর ডেকোরেটার ভ্যালেরী'কে স্পেশ্যাল ধন্যবাদ দিয়ে এসেছি।

সাড়ে পাঁচ ঘন্টা পর আমি লাঞ্চ ব্রেকে যাই ( ওয়ালমার্টে এক ঘন্টার ব্রেককে লাঞ্চ ব্রেক বলে, দিন বা রাত্রি কোন ম্যাটার করে না), এবার সত্যিকার অর্থেই বিস্মিত হই। কেকের এক চতুর্থাংশ অবশিষ্ট আছে, পাশে স্পাইডার ম্যান তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।  শুরুতে স্পাইডার ম্যানকে দেখে আমি মন খারাপ করেছিলাম, ভেবেছিলাম আমার সারপ্রাইজ কেক কেউ খাবে না। এখন স্পাইডার ম্যানকে মনে মনে স্যালুট করলাম। তার কালচে খয়েরী রঙের পাশে দুধসাদা সারপ্রাইজ কেককে দেখতে স্নো হোয়াইটের মত লাগছিল। এই জন্যই সকলে স্নো হোয়াইটের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। টি রুমে আমাকে সকলেই ধন্যবাদ জানাচ্ছিল। আমার মনে আর কোন দুঃখ ছিল না। মনে মনে ভাবছিলাম, আমার মা মানুষকে খাওয়াতে খুব পছন্দ করতেন, এই জন্যই বোধ হয় উনার ঊদ্দেশ্যে দেশে বা এখানে যখনই যা কিছু আয়োজন করেছি, সব সময় সফল হয়েছি।

পরের দিন আমি যখন কাজে গেছি, ফিলিস নামের এক সহকর্মী আমাকে জানালো, " রীটা, আমি কালকে ব্রেক রুমে এসে কেক পাই নি।  আমি রাত আটটায় টি ব্রেকে এসে দেখি কেক শেষ!  যাক গিয়ে, কেকটি নিশ্চয়ই খুব ভাল হয়েছিল, আমি জানতাম না, তুমি কেকটি পাঠিয়েছো। তবে তোমার শুভেচ্ছা কার্ডটি পড়েছি। কার্ড টি পড়ে আমি অভিভূত হয়েছি। খুবই চমৎকার কার্ড। শোন, একটা কথা বলি, তোমার মা, আমাদের সকলের মা,  নিজেকে কখনও একা ভাববেনা, তুমি একা নও, আমরা সকলেই তোমার পাশে আছি। মন খারাপ হলেই আমাদের কাছে চলে আসবে, আমরা গল্প করবো, নিজেদের ফিলিংস শেয়ার করবো।  তোমার চেহারা অনেক খারাপ হয়ে গেছে, স্বাস্থ্য খারাপ হয়েছে, এটা ভাল কথা না। সকলকেই একদিন পৃথিবী ছাড়তে হবে, তোমার কষ্ট বুঝি, মা-বাবা কতদূরে থাকে, মন  চাইলেও যেতে পারো না, কষ্টতো থাকবেই। তবুও তুমি অনেক লাকী, মায়ের মৃত্যুশয্যায় পাশে ছিলে, অনেকের সেই ভাগ্য হয় না, কাছে থেকেও হয় না।  চীয়ার আপ বেবী, উই আর উইদ ইউ, প্রমিস"!  

ফিলিস এ বছর ৬০ বছর পূর্ণ করবে, ক্যাশ রেজিস্টারে কাজ করে, ২০ বছর হয়ে গেলো, ওয়ালমার্টে চাকুরী করছে। ফিলিসের সাথে দেখা হয় টি-রুমে, আফ্রিকান-আমেরিকান এই মহিলাকে আমি দূর থেকে দেখি, তার গল্প বলার স্টাইল আমাকে মুগ্ধ করে, অতি ছোট জিনিস দেখেও সে বিস্মিত হয়, ফিলিস জানেনা, আমি তাকে কত পছন্দ করি, অথবা হয়তো জানে, নাহলে সে আমাকে অমন স্নেহ করতো না। ফিলিসের গল্প আরেক দিন বলবো, শুধু এতটুকুই বলি, ফিলিসের বয়স যখন ২০, তার বাম পাশের ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ে। বানদিকের ফুসফুস কেটে বাদ দিতে হয়েছে, ডানপাশের ফুসফুস নিয়েই ফিলিস বেঁচে আছে, এখন পর্যন্ত।

Monday, November 26, 2012

বিব্রতকর! বিব্রতকর! বিব্রতকর!

নিজের গল্প দিয়ে শুরু করি। আমার ছোটবেলা কেটেছে গোমড়া মুখে, কারো সাথেই নাকি কথা বলতে চাইতাম না। এই নিয়ে আমার বিরুদ্ধে আমার মায়ের একটু অভিযোগ সব সময়ই ছিল। সেই গোমড়ামুখো আমি ক্লাস নাইন এ প্রমোশন পাওয়ার সাথে সাথে মুখে খই ফুটাতে শুরু করেছিলাম। পরিচিত-অপরিচিত সকলের সাথে যেচে যেচে কথা বলতাম। এমন কি পরীক্ষার হলে পর্যন্ত পটর পটর করতাম। পেছন থেকে কেউ কোন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে ইশারা ইঙ্গিতে উত্তর বলে দিতাম। ফলে বন্ধুদের মাঝে আমি খুব প্রিয়তা অর্জন করে ফেলি। এই বদ অভ্যাসের কারণে ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময়, আমি বহিষ্কৃত হওয়ার সম্মুখীন হয়েছিলাম। ঘটনা ঘটেছিল কেমিস্ট্রি পরীক্ষার দিন। অন্য স্কুলে সীট পড়েছে, ইনভিজিলেটার স্যারকে চিনি না, আমার আশেপাশে যাদের সীট পড়েছে, তাদের কাউকেই চিনি না, সব অপরিচিতের মাঝে বসে ভালো লাগছিল না, কিন্তু কেমিস্ট্রি প্রশ্নপত্র হাতে পেয়েই আমি খুশী। সব কমন পড়েছে, দুই ঘন্টায় পরীক্ষা শেষ, ইতি উতি তাকিয়ে দেখি, অনেকের মুখ শুকনো, হয়তো কমন পড়েনি। মনটা খারাপ হয়ে গেলো, আমার দুই সীট পেছনে বসা এক পরীক্ষার্থী স্যারকে ডেকে কাঁদো কাঁদো গলায় একটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইছিল। স্যার ছিলেন বাংলার শিক্ষক, উনার তো কেমিস্ট্রি জানার কথা নয়, কিন্তু মেয়েটির মুখের চেহারা দেখে আমার মায়া লেগে যায়, স্থান-কাল ভুলে আমি বলে ফেলি, " এইটা পারো না? আমি বলে দেই" বলেই জোরে জোরে প্রশ্নের উত্তর বলতে শুরু করি। সাথে সাথে সেই অপরিচিত স্যার এসে খপ করে আমার খাতা ধরে ফেলেন। আমি থতমত খেয়ে যাই। চিবিয়ে চিবিয়ে স্যার বলতে থাকেন, " খুব বেশী বিজ্ঞ হইয়া গেছো? মাতব্বরী করতেছো? এখন যদি তোমারে এক্সপেল কইরা দেই! দিমু এক্সপেল কইরা"?  হলভর্তি পরীক্ষার্থীর সামনে আমার এহেন হেনস্থাতে আমি খুব বিব্রত বোধ করছিলাম। ফার্স্ট গার্ল বা ফার্স্ট বয়দের মনে সব সময় কিছু অহংকার কাজ করে, সেই অহংকারেই চরম আঘাত লেগেছে আমার, তখনও মাথায় আসেনি, ওটা ম্যাট্রিক পরীক্ষার হল, নিজেদের স্কুলের পরীক্ষা নয়। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ স্যার বললেন, " তুমি শংকরীদি'র মেয়ে না"?  প্রশ্ন শুনে কেঁদে ফেলার যোগার হয়েছে। কেমিস্ট্রি পরীক্ষায় ৯৫ পাওয়ার স্বপ্ন ধুলিসাৎ হওয়ার আগ মুহূর্তে শুধুমাত্র ' শংকরী'দির মেয়ে হিসেবে ছাড়া পেয়ে গেলাম। খাতা জমা দিয়ে পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে গেলাম। এই ঘটনা বাসায় বলার প্রশ্নই উঠেনা, আজ পর্যন্ত কেউ জানতে পারেনি সেদিনের ঘটনা।

১৯৮৩ সালের ঘটনা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রি অনার্স, প্রথম বর্ষের ছাত্রী আমি। একটিমাত্র ছাত্রী হোস্টেল (নুয়াব ফয়জুন্নেসা হল)  থেকে কেমিস্ট্রি বিল্ডিং এর দূরত্ব এক মাইল বা তার কিছু বেশী হতে পারে, সঠিক জানা ছিল না। টাইমের বাসে চড়ে যাতায়াত করতাম। বেশী কথা বলার স্বভাব তখনও পুরোপুরি কাটেনি। চলার পথে অপরিচিত কারো সাথে যেচে দুটো কথা বলতে ভালো লাগতো। একদিন জাহাঙ্গীরনগরের বাসে চড়ে ঢাকা যাচ্ছিলাম। বাস  'বিশ মাইল' ঘোরার সময় লম্বামত এক মেয়ে বাসে উঠে আমার পাশেই বসে। মেয়েটিকে আমাদের হোস্টেলে কখনও দেখিনি। ভেবেছি আমার মতই ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট। আমার পাশে বসেছে বলেই যেচে জিজ্ঞেস করলাম, " তুমি কোন ডিপার্টমেন্টে আছো"?  উত্তর দিল গোমড়া মুখে, " বাংলা"। ভেবেছিলাম মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞেস করবে, আমি কোন ডিপার্টমেন্টে আছি। ১৫ মিনিটেও মেয়েটি আমার সাথে একটিও কথা বললো না দেখে আমি একটু লজ্জা পেলাম। সাভার বাসস্ট্যান্ডে মেয়েটি নেমে যায়, কিনতু নেমে যাওয়ার সময় আশেপাশের সকলকে শুনিয়ে বলে, " এই মেয়ে, তুমি কোন সাহসে আমাকে 'তুমি' তুমি' করে কথা বলছিলে? আমি মাস্টার্সের ছাত্রী, বেয়াদবী করার জায়গা পাও না" বলেই আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাস থেকে নেমে গেল। এতগুলো স্টুডেন্টের সামনে আমাকে 'বেয়াদব' ডেকেছে বলে আমার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। কিনতু পেছনের সীট থেকে আরেকটি মেয়ে আমাকে জানালো, " এই মেয়ে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের হেডমাস্টারের মেয়ে, সব সময় খ্যাঁক খ্যাঁক করে কথা বলে। তুমি মন খারাপ করোনা"। মন না হয় খারাপ করলাম না, কিনতু মাস্টার্সে পড়ে মেয়েকে কী হিসেবে আমি ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে ভাবলাম, সেটা বোধগম্য হলো না। এই ঘটনার কথা অবশ্য মা'কে বলেছিলাম। মা তখন বলেছিলেন," অপরিচিতকে শুরুতে 'আপনি' সম্বোধণ করাই উচিত, এই ঘটনা থেকে একটা শিক্ষা পেয়ে গেলি"।

বিব্রত আরেকবারঃ
অনার্স প্রথম বর্ষে আমার রুমমেট ছিল অরুণা। অরুণা ফরিদপুরের মেয়ে, স্বভাবে আমার বিপরীত। আমি হই হুল্লোড় করতে ভালোবাসতাম, আর অরুণা কেমিস্ট্রি বই নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ভালোবাসতো। ও একটু রাগী স্বভাবের ছিল বলে আমি ওকে একটু ভয়ও পেতাম। একরাতে ডাইনিং হলে গেছি দুজনে একসাথে। হলের কিচেনে  নেট লাগানো দুটি মিটসেফ ছিল। সেই মিটসেফে বাটিতে বাটিতে মাছ অথবা মাংস সাজানো থাকতো। ডাইনিং টেবিলে বড় বড় গামলা ভর্তি ভাত, আর গামলা ভরে পাতলা ডাল সাজিয়ে রাখা হতো। প্রথম দিকে হোস্টেলের 'আও বাও' কিছুই বুঝতাম না। জানতামই না, দুই মিটসেফের একটিতে থাকতো গরুর মাংসের বাটি, আরেকটিতে থাকতো খাসীর মাংসের বাটি। আমি অরুণাকে নিয়ে প্রথম মিটসেফের ভেতর থেকে দুটি মাংসের বাটি বের করে  ডাইনিং টেবিলে চলে এসেছিলাম।  ছোটবেলা থেকে আমার স্বভাব হচ্ছে ডিমের কুসুম, মাংসের টুকরা বা মাছের টুকরা প্লেটের পাশে জমিয়ে রাখা, ঝোল মেখে ভাত খেয়ে সবার শেষে আরাম করে মাংস বা মাছ খেতাম। সেদিনও আলু আর ঝোল দিয়ে ভাত মেখে মুখের কাছে নিতেই অন্যরকম একটা গন্ধ লাগলো।  অবশ্য অরুণা মাংস খায় না, কিন্তু নতুন বলে জানতেও পারিনি, মাংস না খেলে ডিম রেঁধে দেয়া হয়। ততক্ষণে অরুণা মাংস ছাড়াই দুই গ্রাস ভাত খেয়ে ফেলেছে। যাই হোক, আমার  কেমন যেন সন্দেহ হলো,  ভাত মুখে না দিয়ে আমি প্লেটের কোণায় জমিয়ে রাখা মাংসের টুকরা ভাঙ্গতে গিয়ে দেখি, মোটা মোটা আঁশ। এক দৌড়ে বেসিনে গিয়ে হাতের ভাত ফেলে দিয়ে কল ছেড়ে কুলকুচি করতে শুরু করেছি। আমার দেখাদেখি অরুণাও উঠে এসেছে, আমি শুধু বলেছি, " অরুণা, খাবার ফেলে দাও, এটা মনে হয় গরুর মাংস"। অরুণার মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। ও সেখান থেকেই দৌড়ে চলে এসেছে রুমে। আমাদের দিকে তাকিয়ে অনেকেই আঁচ করেছে, সামথিং রং!  আমি খুব শক্ত মনের মেয়ে, কাউকেই কিছু বুঝতে না দিয়ে বাইরে চলে এসেছি। নিজের বুদ্ধিতেই বুঝেছি,  ওটা একটা দূর্ঘটনা মাত্র, পৃথিবী উলটে যাওয়ার মত কিছু না। কিন্তু আমাদের তিন বছরের সিনিয়র স্মৃতি'দি, ইংলিশ অনার্সের ছাত্রী, আমার কাছে এসে বললো, " রীতা, কী হয়েছে, আমাকে বলো"। বললাম, " কিছুই হয় নি, ভুল মিটসেফ থেকে মাংসের বাটি তুলেছি। উনি বললেন, " তোমরা ফার্স্ট ইয়ার, তোমাদের কিছুই জানার কথা নয়, খালারা কেন বলে দেয় নি, দাঁড়াও, আমি গিয়ে এখনই খালাদের ধরছি"। স্মৃতি'দি খালাদের গিয়ে বকবে, ভাবতেই আমি খুব বিব্রত বোধ করছিলাম।  আমি ঘুরে বললাম, না , মাত্র ভাতের দলা মুখের কাছে নিয়েছিলাম, খাইনি, ফেলে দিয়েছি। দিদি, খালাদের কোন দোষ নেই। এখন এগুলো নিয়ে কথা বললে সুপার আপার কানে যাবে, সুপার আপা খালাদের বকবে"। স্মৃতি'দি অবশ্য খালাদের বকেনি, বুঝিয়ে বলেছে, নতুন মেয়েদের সব কিছু বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব ছিল খালাদের। রাশিদা খালা আমাদের রুমে এসে খুব লজ্জিত ভঙ্গীতে বার বার মাফ চাইছিল। আমি আর অরুণা পড়ে গেছিলাম বিব্রতকর অবস্থায়। খালাকে বললাম, "খালা শুনেন, আমরা ভাত খাইনি, মুখ থেকে ফেলে দিয়েছি। আপনার কোনই দোষ নেই, পাঁচ দিন পর মাংসের ঝোল দেখে লোভ সামলাতে পারিনি। খপ করে হাতের সামনে যেটা পেয়েছি, সেটাই নিয়েছি। বলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি! আমার হাসি দেখে অরুণার সে কী রাগ! 

সবচেয়ে মজার ঘটনাঃ

আজ মাঝবয়সী এক ভদ্রমহিলা আমাদের কাউন্টারে এসে দাঁড়িয়েছে।  গায়ের রঙ কালো, বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারা, পোশাকও দামী। আমি তখন ফোনে কথা বলছিলাম ( আমার কাজিনের সাথে)। ভদ্রমহিলাকে দেখে ফোনালাপ সমাপ্ত করে বললাম, " তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি!" মহিলা হাতে ধরা 'ব্ল্যাকবেরী' ফোন দেখিয়ে বললো, " তোমাদের কাছে মিডিয়া কার্ড আছে? পিকচার সেভ করবো"। বললাম, " তুমি বোধ হয় মেমরী কার্ডের কথা বলছো, মাইক্রো এস ডি কার্ড আছে। কোনটা চাও বলো"।

উনি বললেন, " যেইটা বেশী ভাল, সেইটা দাও।
-এখানে ভালো মন্দের কিছু নেই। বেশী মেমরী চাইলে দাম একটু বেশী, কম মেমরীর দাম একটু কম।

তুমি কী আমার পিকচার গুলো ট্র্যান্সফার করে দিতে পারবে?

আজ্ঞে না, আমি তোমার ফোনে মেমরী কার্ড ইনসার্ট করে দিতে পারবো, কিনতু পিকচার ট্র্যান্সফার করবো না। পিকচার তোমাদের পারসোন্যাল সম্পদ, আমরা  কারো পারসোন্যাল কিছু নিয়ে কাজ করি না।

আচ্ছা, তুমি ছাড়া আর কেউ নেই, যে এই কাজটা করে দেবে?

এই কথা শুনে একটু বিরক্ত হলাম, কিন্তু বিরক্তি চাপিয়ে বললাম, সরি, আমাকেই বলতে হবে। আমি ছাড়া এই মুহূর্তে আর কেউ নেই। বলে মেমরী কার্ড তার ফোনের ভেতর ইনসার্ট করছিলাম। মহিলা জিজ্ঞেস করলো,

তুমি কতদিন ধরে এই ডিপার্টমেন্টে আছো?

ছয় বছর-

বলো কি? তোমাকে কখনও দেখিনি কেন?

তুমি যেদিন এসেছো, সেদিন হয়তো আমার অফ ছিল।

এক ফাঁকে আমার সহকর্মী রেজিনা টি ব্রেক থেকে ফিরে আসতেই ভদ্রমহিলা আমাকে ডিঙ্গিয়ে রেজিনাকে বললো,

দেখো তো আমার পিকচারগুলো মিডিয়া কার্ডে ট্র্যান্সফার করতে পারো কিনা? ওই মেয়ে তো করবেনা বলে দিল।

আমার আবার রাগ হলো, আমি তাকে বললাম পার্সোন্যাল জিনিস নিয়ে আমরা কাজ করিনা। যাই হোক, রেজিনা বললো,
ব্ল্যাকবেরী ফোন আমি লাইক করিনা। খুব ভেজাল ছবি ট্র্যান্সফার করা।

মহিলা এতক্ষণে বলল, এইটা আমার ছেলের ফোন। আমি স্মার্ট ফোনের কিছুই বুঝি না। ছেলে আমাকে তার ফোন দিয়ে দিয়েছে। এখানে আমার ভাইপো'র ছবি আছে, সেই ছবিটা বের করতে হবে। ওটা এই মিডিয়া কার্ডে সেইভ করতে হবে।
রেজিনা এই ধরণের উটকো ঝামেলা পছন্দ করেনা, তারপরেও কাস্টমারের সন্তুষ্টির জন্য মাঝে মাঝে অপছন্দের কাজ করতে হয়। মুখ কালো করে রেজিনা ফোনের 'পিকচার' অপশনে গিয়ে সিলেক্ট টিপতেই ফটো গ্যালারী বের হয়ে আসলো। ফটো গ্যালারী মেয়েদের ন্যুড ছবিতে ভর্তি। রেজিনা অন্য সময় খুবই ভদ্র, আজ হঠাৎ করেই ওর মাথা গরম হয়ে গেছে। ফোন মহিলার সামনে মেলে ধরে জানতে চেয়েছে, কোন ছবি উনি কপি করতে চায়? মহিলা তো ছবির দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছে, " ও মাই গড!! এগুলো কী সমস্ত ছবি! বন্ধ করে দাও, বন্ধ করে দাও। থাক , আমার ছেলেকেই বলবো, ছবি কপি করে দিতে।

রেজিনা আমার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে নির্লিপ্তমুখে বললো, দাঁড়াও দেখি, তোমার ভাইপো'র ছবি বের করা যায় কিনা। আমি স্ক্রল ডাউন করে যাই, ভাইপো'র ছবি দেখলেই আমাকে থামতে বলো, বলে স্ক্রল ডাউন করছে আর একটা একটা করে অত্যন্ত আপত্তিকর ছবি বেরিয়ে আসছে। আমার তো মনটা খুশীতে নেচে উঠেছে। মনে মনে বলি,  "এখন বুঝো ঠ্যালা, না করেছিলাম তখন, বুড়ীর মন উঠেনি, আমার চেয়েও বেশী কে জানে খোঁজ করেছিলা, এখন দেখো ছবি ভাল করে"।
এবার মহিলা আরও জোরে বলে উঠলো, " প্লীজ বন্ধ করো, উঠতি বয়সের ছেলে, দেখো কী কান্ড করে রেখেছে। ফোন দিয়ে দাও, আমার ছেলের কাছেই নিয়ে যাব, ওর জিনিস ওই ভালো বুঝবে। ছেলেপেলের কান্ড"।

আমি বললাম, ফোনটা দিয়েছে তোমাকে ব্যবহার করার জন্য, দেয়ার আগে তোমার ছেলের উচিৎ ছিল সব ছবি ডিলিট করে দেয়া, তাহলেই তোমাকে এমন বিব্রত হতে হতো না।

এবার রেজিনা ফোনটা মহিলার হাতে দিয়ে বললো,  আমার কলিগ বলেছিল, আমরা এই সকল পারসোন্যাল জিনিসে হস্তক্ষেপ করি না, অথচ তুমি আমার সহকর্মীর কথা বিশ্বাস করোনি।

মহিলা তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে গেলো, তবে যাওয়ার আগে আমাকে 'সরি' বলে গেলো না। মহিলা চলে যাওয়ার সাথে সাথে রেজিনা ইলেকট্রনিক ডিপার্টমেন্টের বন্ধুদের ডেকে এই ঘটনা বলতে শুরু করে দিল। ঘটনা  যে শুনে, সে-ই হাসে। তবে সবচেয়ে বেশী হেসেছি আমি।

Wednesday, November 21, 2012

থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’- দিনটি হোক সকলের, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা, পৃথিবী হয়ে উঠুক সকলের জন্য বাসযোগ্য!!




সারা উত্তর আমেরিকায় আজ ধুমধামের সাথে পালিত হচ্ছে ‘থ্যাঙ্কস গিভিং’ উৎসব। দিনটি সরকারী ছুটির দিন। নভেম্বার মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার থ্যাংকস গিভিং উদযাপিত হয়, সে হিসেবে এ বছরের ২২শে নভেম্বার, বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে থ্যাঙ্কস গিভিং ডে।

থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’র মূল ঊদ্দেশ্য, পরিবার, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবসহ সকলে একত্রিত হয়ে প্রত্যেকের জীবনের প্রতিটি সাফল্যের জন্য, দেশ ও জাতির সাফল্যের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানানো। যদিও আমেরিকানদের অনেকেই জানেনা থ্যাঙ্কস গিভিং কবে থেকে শুরু, কেনই বা উৎসবটির নাম থ্যাঙ্কস গিভিং ডে হলো, কাকেই বা এমন ঘটা করে থ্যাঙ্কস জানানো হচ্ছে! তারা জানে, থ্যাঙ্কস গিভিং মানেই পার্টি, বিশাল ভোজ আয়োজন, পারিবারিক মিলনমেলা। ভুরিভোজনের তালিকায় থাকে টার্কী রোস্ট, ক্র্যানবেরী সস, মিষ্টি আলুর ক্যান্ডি, স্টাফিং, ম্যাশড পটেটো এবং ঐতিহ্যবাহী পামকিন পাই। আর কিছু না হোক, অতি সাধারণ আয়োজনেও টার্কী রোস্ট উইদ ক্র্যানবেরী সস এবং পামকিন পাই থাকবেই। অর্থাৎ থ্যাঙ্কস গিভিং মানেই টার্কী। ( টার্কীঃ ময়ুরের মত বড় সাইজের বনমোরগ জাতীয় পাখী)।

আমেরিকাতে নভেম্বারের চতুর্থ বৃহস্পতিবার থ্যাঙ্কস গিভিং উদযাপিত হলেও কানাডাতে থ্যাঙ্কস গিভিং হয় অক্টোবারের দ্বিতীয় সোমবার। তারিখ ভিন্ন হলেও উৎসব উদযাপনের নিয়ম রীতি একই রকমভাবে পালিত হয়। কেউই থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’র ভাবার্থ বা ঊদ্দেশ্য নিয়ে মাথা ঘামায় না। অতি গুরুত্বপূর্ণ ছুটির দিনটি পরিবারের সকলে মিলেই কাটায়, একসাথে খাওয়া দাওয়া করে, টিভিতে ফুটবল গেইম দেখে অথবা থ্যাঙ্কস গিভিং প্যারেড দেখে। থ্যাঙ্কস গিভিং প্যারেডে পিলগ্রিম (ব্রিটিশ অরিজিন, যারা ধর্মযাজক হিসেবে অজানার ঊদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রা করেছিল এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে আমেরিকার মেসাচুসেটসে  প্লীমথ কলোনীতে তাদের সন্ধান পাওয়া যায়), আমেরিকান ইন্ডিয়ান ( আদি আমেরিকান)দের ডিস্পলে দেখানো হয়ে থাকে। থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’র সারাদিন আনন্দে কাটিয়ে সকলেই প্রস্তুত হয় পরেরদিন ‘থ্যাঙ্কস গিভিং সেল’ এর জন্য। প্রতি বছর, আমেরিকায় থ্যাঙ্কস গিভিং সেল এর রমরমা ব্যবসা দেশটির অর্থনীতির সূচককাঁটা ঘুরিয়ে দেয়। ফলে থায়ঙ্কস গিভিং ডে’র ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্য অপেক্ষা বাণিজ্যিক দিকটাই বেশী প্রকাশিত হয়ে পরে।

থ্যাঙ্ক গিভিং ডে উৎসবের সূচনাঃ

১৬২০ সালের আগস্ট মাসে ‘মে ফ্লাওয়ার’ নামের ১০৮ টনের এক জাহাজ ইংল্যান্ডের সাউথ হ্যাম্পটন থেকে যাত্রা করে। জাহাজে ছিল ১০২ জন যাত্রী, ইংল্যান্ডে বসবাসকালীন সময়ে স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা করায় তাদের অনেক বাধা ছিল, তাই স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা করার ঊদ্দেশ্যে ‘মে ফ্লাওয়ারে’ চেপে ইংল্যান্ড ছেড়ে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে বের হয়। দুই তিন মাস বাদে তারা আমেরিকার মেসাচুসেটস বে তে এসে পৌঁছে। ততদিনে যাত্রীদের অনেকেই অর্ধাহারে, অনাহারে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে, কিছু যাত্রীর মৃত্যু হয়। নতুন স্থানে পৌঁছে অনেকেই শীতের তীব্রতায় অসুস্থ ও দূর্বল হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে তারা মেসাচুসেটসেই যাত্রা বিরতি করে। যারা সুস্থ ছিলো, জাহাজ থেকে তীরে এসে নামে। যদিও তাদের গন্তব্য ছিল ভার্জিনিয়া কোস্ট, যেখানে আরও অন্যান্য পিলগ্রিমদের বসবাস ছিল, সেখানে পৌঁছাতে না পেরে মেসাচুসেটসেই তাদের প্লীমথ কলোনী গড়ে তোলে। শুরু হয় মুক্ত স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম, স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার উদ্যোগ। তবে শুরুতেই তাদের অনেক কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়। নতুন দেশ, নতুন আবহাওয়া, শীতের তীব্রতায় প্রতিদিনই দুই একজনের জীবন সংকট দেখা দিতে থাকে। কেউ কেউ মারাও যায়।

শীত পেরিয়ে যখন বসন্তের আগমন ঘটে, বেঁচে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা দেয়। তারা ধীরে ধীরে ঘর-বাড়ি বানাতে শুরু করে, আশেপাশের স্থাণীয় ইন্ডিয়ান উপজাতিদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলা, উপজাতিদের সাহায্যে চাষ-বাস করাসহ বেঁচে থাকার তাগিদে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে দেয়। উপজাতিদের সাথে উৎপাদিত দ্রব্য বিনিময় প্রথা চালু হয়। এভাবেই ধীরে ধীরে প্লীমথ কলোনী বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে।


১৬২১ সালের নভেম্বার মাসে প্লিমথবাসী প্রথমবারের মত নিজেদের উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলে। ফসলের মধ্যে ভুট্টার ফলন এত বেশী ভালো হয়েছিল যে তৎকালীন গভর্নর উইলিয়াম ব্র্যাডফোর্ড এই উপলক্ষে সমস্ত ইন্ডিয়ান উপজাতি এবং প্লি্মথ কলোনিবাসীদের সৌজন্যে ‘ফিস্টি’ আয়োজন করেন। ফিস্টির দিনটিকে সকলে ঈশ্বরের নামে উৎসর্গ করে। সকলেই কৃতজ্ঞ চিত্তে ঈশ্বরকে স্মরণ করে, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায়, কারন ঈশ্বরের কৃপায় তারা বেঁচে আছে, প্রভুর দয়ায় তাদের সকলের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠেছে, পতিত বন্যভূমিকে সকলে মিলে বাসযোগ্য কলোনি হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছে, ঈশ্বর কৃপা করেছে বলেই উৎপাদিত ফসলে তাদের গোলা ভরে উঠেছে, ফসলের ফলন এত বেশী হয়েছে যে আগামী শীত কেটে যাবে কোন খাদ্য ঘাটতি ছাড়া। ঈশ্বরের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন শেষে নিজেদের মধ্যে ধন্যবাদ বিনিময় হয়, খাওয়া দাওয়া হয়, সকলে মিলে আনন্দ-ফূর্তিতে কাটিয়ে দেয় একটি দিন। সেই থেকে অনুষ্ঠানটি আমেরিকার সর্ব প্রথম ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্লীমথ কলোনিবাসীর দেখাদেখি থ্যাঙ্কস গিভিং ডে উদযাপনের এই রীতি অন্যান্য কলোনিবাসীদের মাঝে প্রচলিত হতে থাকে। তবে বছরের নির্দিষ্ট দিনে তা পালিত হতো না। কলোনিবাসীদের নিজেদের সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী তারা বছরের একটি দিন থ্যাঙ্কস গিভিং ডে উদযাপন করতো।



সরকারীভাবে সর্ব প্রথম ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ উদযাপিত হয়েছিল নিউইয়র্কে, ১৮১৭ সালে। এরপর থেকে প্রতি বছর অন্যান্য স্টেটেও উৎসবটি পালিত হতে থাকে। নিউইয়র্ক এবং অন্যান্য স্টেটে দিনটি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষিত ছিল। পরবর্তীতে সকল স্টেট থেকে থ্যাঙ্কসগিভিং ডে’কে জাতীয় ছুটির দিন ঘোষণা করার পক্ষে জোর দাবী উঠতে থাকে।  ১৮২৭ সালে বিখ্যাত নার্সারী রাইম ‘মেরি হ্যাড আ লিটল ল্যাম্ব’ রচয়িতা সারাহ যোসেফা উদ্যোগ নেন, দীর্ঘ ৩৬ বছর তিনি একটানা আর্টিক্যাল, এডিটোরিয়েল লিখাসহ এই আবেদনের সপক্ষে প্রচুর চিঠিপত্র গভর্নর, সিনেটর, প্রেসিডেন্ট, রাজনীতিবিদদের কাছে পাঠিয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত ১৮৬৩ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, সারাহ যোসেফের আবেদন খুব গুরুত্ব সহকারে গ্রহন করেন এবং ‘সিভিল ওয়ার’ চলাকালীন সময়েই জনগনের উদ্দেশ্যে আবেদনমূলক ঘোষনা দেন, সকলেই যেন পরম করুনাময় ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা জানায়, “হে ঈশ্বর! তোমার স্নেহের পরশ, অপার করুণা তুমি তাদের উপর বর্ষন করো, যারা সিভিল ওয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যে নারী স্বামী হারিয়েছে, যে সন্তান পিতৃহারা হয়েছে, যা ক্ষতি সমস্ত জাতির হয়েছে, সমস্ত ক্ষতি যেনো দ্রুত সারিয়ে তোলা যায়। জীবিত সকলের যেন মঙ্গল হয়’। একই বছর প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন নভেম্বার মাসের শেষ বৃহস্পতিবার ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ হিসেবে সরকারী ছুটির দিন ঘোষনা করেন।
পরবর্তীতে, বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা শুরু হয়। ‘গ্রেট ডিপ্রেশান’ হিসেবে পরিচিত অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠার লক্ষ্যে ১৯৩৯ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট রিটেল সেল বাড়ানোর ঊদ্দেশ্যে এই ছুটি এক সপ্তাহ এগিয়ে আনা্র ঘোষনা দেন, এবং সেই থেকে শেষ বৃহস্পতিবারের পরিবর্তে নভেম্বার মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ পালিত হয়।

যদিও বর্তমানে অধিকাংশ আমেরিকাবাসীর কাছেই থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’র ঐতিহাসিক গুরুত্ব বা তাৎপর্য্য খুবই কম, বাণিজ্যিক জৌলুসটাই সকলের নজরে আসে, তারপরেও শুধু আমেরিকা বা কানাডাতে দিনটি উদযাপিত না হয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও তা পালিত হতে পারে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ তো প্রতি নিয়তই দেয়া উচিত এমন সুন্দর এক পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন বলে, ধন্যবাদ দেয়া উচিত, এই সুন্দর পৃথিবীর সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য আমাদের সৃষ্টি করেছেন বলে, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য পৃথিবীটাকে নানা ধনসম্পদে ভরিয়ে রেখেছেন বলে। আমাদের সকলেরই তো সপ্তদশ শতাব্দীর জাহাজ ‘মে ফ্লাওয়ার’ থেকে নেমে আসা পিলগ্রিমদের মতই পরিশ্রম করে ফসল ফলানোর কথা, শত্রু নয় বন্ধু নীতিতে চলার কথা, তা না করে আধুনিক বিশ্বে মানুষ হয়ে উঠছে স্বার্থপর, নিষ্ঠুর, অমানবিক। প্রতিদিন নিষ্ঠুর গোলার আঘাতে হত্যা করে চলেছে অসহায় নারী, পুরুষ, শিশু। যে আমেরিকাতে থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ উৎসবের শুরু, সেই আমেরিকাই এখন সারা বিশ্বে যুদ্ধবাজ দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ শুধুমাত্র প্রতীকী দিবস হিসেবে পালিত না হয়ে, আক্ষরিক অর্থেই পারস্পরিক বন্ধুত্ব, ভালো কাজের স্বীকৃতি, পারস্পরিক সহযোগীতা, সহমর্মিতা ও উদারতায় পরিপূর্ণ হোক। মানুষ যুদ্ধ বিগ্রহ ভুলে, হানাহানি, মারামারি বন্ধ করে, প্রতিবেশী, প্রতিবেশী দেশ তথা সারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের সাথে বন্ধুত্ব অথবা সন্ধি করার কথা ভাবুক, তবেই  ঈশ্বরও আমাদের জীবনে তাঁর করুণা বর্ষণ করবেন। ঈশ্বরের করুণায় সিক্ত হয়ে আমরাও প্রতিদিন অথবা প্রতি মাস অথবা বছরের একটি দিন, ঈশ্বরের জয়গান করতে পারি, ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে পারি আমাদের প্রতি অবারিত করুণা বর্ষনের জন্য।

আজকের দিনটি হোক ঈশ্বর বন্দণায় নিবেদিত! থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’- দিনটি হোক সকলের, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা, পৃথিবী হয়ে উঠুক বাসযোগ্য!!


Sunday, November 18, 2012

প্রিয় মৌটুসী

মামনি,
বছর ঘুরে চলে এলো ১৮ই নভেম্বার, তোমার শুভ জন্মদিন। কততম জন্মদিন, বলো তো! আমার হিসেবে মিলছে না। বার বার চোখের পর্দায় ভেসে উঠছে ঢাকা ইবনে সিনা ক্লিনিকের সেই সন্ধ্যার দৃশ্য। মঙ্গলবার ছিল, বিকেল সাড়ে তিনটায় আমাকে অপারেশান থিয়েটারে নিয়ে গেল, কেউ পাশে ছিল না। ডাক্তারের নির্দেশে তোমার বাবা গেছিলেন নীচে ফার্মেসীতে, তোমার দিদা, মানে আমার মা কেবিনে গেলেন আমার জন্য কিছু একটা নিয়ে আসতে। এই ফাঁকেই আমাকে নার্সেরা ধরে নিয়ে গেল ওটিতে। সেই মুহূর্তে আমার মনে 'মা' হওয়ার  কোন আবেগ ছিল না,  মনে হচ্ছিল, আমাকে ওরা সবাই মিলে এমনভাবে নিয়ে গেছিল, যে বার বার মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আমার শেষ যাত্রা। আর ফিরবো না। অথচ গর্ভকালীন নয়টি মাস কত কিছুই কল্পনা করতাম! আমি তো জানতাম, আমার একটি ছেলে হবে, নানাজনে আমাকে দেখে তেমন কথাই বলতো।

সন্ধ্যাবেলা আমার যখন প্রকৃত জ্ঞান ফিরে আসে, আমার কানে ওঁয়াও ওঁয়াও  কান্নার শব্দ আসছিল। সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যথা, গলাতে ব্যথা, হাতে স্যালাইনের সুঁই ফোটানো ছিল, সেই ব্যথা, ব্যথায় অস্থির আমি চোখ মেলে তাকাতেই তোমার বাবা আমাকে বললো, " আমাদের  একটা কুটুকুটু মেয়ে হয়েছে। নাম রাখা নিয়ে আর ভাবতে হবেনা, মৌটুসীই থেকে গেল। আমি চেতন-অচেতনের মাঝে থেকেও একটু অবাক হয়েছিলাম। মেয়ে হয়েছে বলছে কেন, আমার তো ছেলে হওয়ার কথা ছিল। কেউ হাত দেখতে জানে শুনলেই আমি হাত সামনে মেলে ধরতাম, তারাই বলেছিল, আমার প্রথম সন্তান হবে ছেলে। তোমার নিশ্চয়ই হাসি পাচ্ছে, কেমিস্ট্রি অনার্সের ছাত্রীও কী রকম ভাগ্য গননায় বিশ্বাস করে বসে থাকে! আমি এরকমই, সব কথা বিশ্বাস করি, সবাইকে বিশ্বাস করি। যে কথা বলছিলাম, মাথা ঘুরিয়ে দেখি, পাশের বেডে আমার মা ছোট্ট একটা বিড়াল ছানাকে নিয়ে বসে আছে। বিড়াল ছানার গায়ের রঙ দেখলাম ধবধবে সাদা, সরু সরু হাত -পা নাড়ছে, আর কাঁদছে। আমার মায়ের প্রথম নাতণী, মা'কে কখনও বাচ্চা-কাচ্চা কোলে নিতে দেখিনি, তুমিই প্রথম ভাগ্যবতী, যে আমার মায়ের কোলে চড়েছো। কান্না থামাতে পারছিলনা বলে 'কমলা' নামের একজন নার্স এসে মায়ের কোল থেকে তোমাকে নিয়ে তোয়ালে, কাঁথা দিয়ে খুব দক্ষতার সাথে তোমাকে পেঁচিয়ে দিতেই তোমার কান্না থেমে গেছিল। ডাক্তারের পরামর্শে তোমার জন্য 'এস ২০' নামে ইনফ্যান্ট মিল্ক আনা হয়েছিল, তোমার বাবা, তোমার বড়মামা একটু পর পর দুধ গুলে আমার মায়ের কাছে নিয়ে আসে, আমার মা চামচ দিয়ে তোমাকে একটু একটু করে দিলেই তুমি তা মুখ থেকে ফেলে দিচ্ছিলে। তোমার দিদা বলেছিল, " হুম! তেজ আছে তো দেখি। আসলে হওয়ার কথা ছিল ছেলে, হইছে মেয়ে, কিনতু ছেলেদের জেদ লইয়া জন্মাইছে তোর মাইয়া"। আমি ছেলের প্রত্যাশায় ছিলাম, মায়ের মুখে তোমার নিন্দা শুনে সাথে সাথে বলেছিলাম, " ভাল হইছে তেজ হইছে, তুমি খাওয়াতে পার না, সেইটা দেখনা, শুধু শুধু ওর দোষ দিতেছ"। হা হা হা হা ! দেখো, এই হচ্ছে মা আর সন্তানের সম্পর্ক।

মামনি, তোমার মৌটুসী নাম তোমার বাবা অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন।  কানাডাতে থাকার সময় বোধ হয় কোথাও কারো নাম মৌটুসী শুনেছে, তখন থেকেই নাকি সে জানতো, তার প্রথম সন্তান হবে মেয়ে, এবং মেয়ের নাম হবে মৌটুসী। আমি যখন ছেলের স্বপ্নে বিভোর, সে কিনতু আমার কথায় কোন মন্তব্য করতোনা। এবার বুঝে দেখো, বাবার হৃদয়ের কোথায় তুমি বসে আছো। তোমার বাবার আরও দুই একটা কথা বলি, তোমার যখন দুই বছর বয়স, তোমাকে কোলে নিয়ে তোমার বাবা হাঁটছিল আর কথা বলছিল। কথা আর কি, ওই সব 'কিনু মিনু, কাটুস পুটুস টাইপ' কথা। তা এক সময় একটি গাছের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তোমাকে বললো, " মামনি, এই গাছটাতে কী নেই, বলোতো"? তুমি তখন কম কথা বলতে, কিনতু যাই বলতে, স্পস্ট করে বলতে। তুমি বলেছিলে, " পাতা নেই, পাতা নেই"। আমার এখনও গায়ে কাটা দিচ্ছে। তোমার বাবা এবং আমি তোমার জবাব শুনে টাসকি লেগে গেছিলাম। সত্যিই গাছে একটিও পাতা ছিল না, তোমার বাবা বলেছিল, " আমার মামনি  টা তো অনেক বুদ্ধিমতী হয়েছে, ওতো অনেক বড় বিজ্ঞানী হবে"। আমি তো জানতামই তুমি বড় হয়ে অনেক বড় কিছু হবে। তোমাকে আমি কত যত্ন করে ছড়া শেখাতাম, আড়াই বছর বয়সেই তুমি অনেক কিছু শিখে ফেলেছিলে। আসলে প্রথম সন্তান নিয়ে সব মা আদিখ্যেতা করে, আমিও এর বাইরে ছিলাম না। তোমাকে নিয়ে দাদুর বাড়ী যেতাম, ওখানে তোমার মামারা, দাদু, দিদা সবাই মিলে তোমাকে ঘিরে থাকতো। তুমি ছিলে আমার বাধ্যগত, আমি যদি বলতাম, এখানে সারাদিন বসে থাকো, তুমি তাই করতে। মামারা ডাকলে বলতে, " মামনি বলেছে এখানে বসে থাকতে"। তোমার মেজোমামা বলতো, " মায়ের চামচা হইছে"। হা হা হা হা !! তোমার হয়তো কিছুই মনে পড়ে না। আমার বাবাকে বলেছিলাম, " বাবা আমার মেয়ে দেখবা ঢাকা বোর্ডে ম্যাট্রিকে ফার্স্ট হইব"। বাবা বলেছিল, " এত আগ বাড়াইয়া কথা না কইয়া মেয়েরে যত্ন কইরা বড় করিস"। আমার মা বোধ হয় টের পেয়েছিল, ছেলে হয় নি বলে আমার আশা ভং হয়েছে। মা বারবার বলতো, " এমন লক্ষ্মী মেয়ে হইলে, পাঁচটা মেয়ে হইলেও বাপ মায়ের চিন্তা নাই"। তুমি ছিলে দিদার কলিজার টুকরা। কোনদিন তোমাকে একটা ধমক দেয় নি দিদা।

তুমি আসলেই অনেক লক্ষ্মী একটা মেয়ে হয়েছ, কেউ জানেনা, কাউকে বলিনি, আমার সৌভাগ্যের কথা। আমি যেমন চেয়েছিলাম, তুমি তেমনই হয়েছ। আমি তো শুধু একাডেমিক দিক নিয়ে ভাবতাম, তাই তুমি একাডেমিক দিক দিয়ে আমাদের অনেক শান্তি দিয়েছ। একটা টাকা খরচ করতে হয়নি তোমার পেছনে। দেশে থাকতে করেছি, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো অর্থ পিশাচ, ওরা ছাত্র ছাত্রীকে স্কলারশীপ দেয়ার কথা ভাবতে পারেনা। অস্ট্রেলিয়াতে যখন ক্লাস থ্রীতে ভর্তি হয়েছিলে, তোমার কী মনে পড়ে, ক্লাস টিচার আমাকে বলেছিল, " তোমার মেয়ে অন্যরকম, সব সময় কোন একটা চিন্তায় ডুবে থাকে। দেখলেই মনে হয়, ও স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। ওর চোখগুলো দেখেই বুঝা যায়, ও আলাদা"। আমি খুব গর্ব বোধ করেছিলাম, আমি তো জানতাম, তুমি একটু আলাদা। তুমি মায়ের কথা হুবহু মেনে চলো, মায়ের তো আনন্দ হবেই। তোমার বাবার শখ হয়েছিল, তোমাকে আর্ট ক্লাসে ভর্তি করবে। চার বছর বয়সে তোমাকে ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুলের আর্ট ক্লাসে দিয়েছিলাম। তৃতীয়দিনে গিয়ে দেখি টীচার একটু বড় বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত, তুমি বেঞ্চের উপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছ। আমার এমন রাগ উঠেছে, সেই যে তোমাকে নিয়ে এলাম, আর পাঠালাম না। কিনতু মনের ভেতর খচখচানি ছিল, আহারে, মেয়ের বাবার কত শখ ছিল। তোমাকে আমি সব সময় এই কথা বলতাম, তোমাকে আরেকটা কথা বলেছিলাম। তোমার বাবার খুব শখ, তার একতা মেয়ে ডাক্তারী পড়ুক। তোমার ছোট দুই বোন থাকার পরেও আমি তোমাকেই বলেছিলাম কথাটা। একদিন দেখি, তুমি স্কুল থেকে দারুন সুন্দর পেইন্টিং হাতে করে বাড়ী ফিরেছ। বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় এসে ক্লাস টেনে ভর্তি হয়েছিলে। আমেরিকাতে স্কুলে কত প্রাচুর্য্য, রঙ, তুলি, ক্যানভাস, সব ফ্রী। তুমি সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছো। মাত্র দুই বছরে তুমি এমন সব পেইন্টিং করেছো, যা অনেকে চার বছর আর্ট কলেজে পড়েও করেনা। তোমার আর্ট কত কম্পিটিশানে পাঠিয়েছো এবং অবধারিতভাবে সেগুলো ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে। তোমার একটা আর্ট , আমেরিকার ন্যাশনাল পর্যায়ের কম্পিটিশানে গেছিল এবং সেকেন্ড পজিশান পেয়েছে। এরপর থেকে দেখি তুমি সব কিছুতেই তুলির টানে ডিজাইন করে রাখতে ভালোবাসতে। ঘরের টেলিফোনটাও বাদ পড়েনি। সায়েন্স কমপিটিশান, সোশাল স্টাডিজ কমপিটিশান, বক্তৃতা কমপিটিশান, কতকিছুতেই অংশগ্রহণ করেছো, সব কিছুতেই প্রথম স্থান। এত বেশী  'ট্রফি' আর সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছো যে সবগুলো এখন আমার এটিকের ছাদে বস্তায় ভরে রেখে দিতে হয়েছে। কী করবো, একটা দুটা হলে মূল্য বুঝা যায়, এত এত পুরস্কার রাখার জায়গা কোথায়!

স্কুল গ্র্যাজুয়েশান করলে 'আউটস্ট্যান্ডিং' রেজাল্টসহ, কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে টপ স্কোর থাকার পরেও স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে কোন স্কলারশীপ পেলেনা, কারন আমাদের ভিসা স্ট্যাটাস ছিল এইচ ফোর, কিছুই বুঝিনা আমেরিকার নিয়ম। আমার মাথা গরম হয়ে গেছিল, আমার মেয়ের এমন দূর্দান্ত রেজাল্ট নিয়েও মেয়ে স্কলারশীপ না পেলে মেয়েকে পড়াবো কিভাবে, এই চিন্তায় অস্থির হয়েছিলাম। তুমি কিনতু একটুও বিচলিত হওনি, ভার্জিনিয়া প্রাইভেট কলেজে একটা সুযোগ পেলে। স্কলারশীপ পেতে হলে ইন্টারভিউ দিতে হবে, দুই দিনব্যাপী ইন্টারভিউ, আমেরিকার কত স্টেট থেকে মেয়েরা এসেছে, এত লম্বা লম্বা, ফর্সা সব মেয়ের সামনে তোমাকে ছোট্ট একটা বাচ্চার মত লাগছিল। তোমার কি মনে আছে, তুমি আমার হাতের ডিজাইন করা লম্বা ঝুলওয়ালা লাল জামা পড়ে ইন্টারভিউ দিতে গেছিলে। তিনদিন পরেই ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট বাসায় ফোন করলো, আমি ছিলাম বাসায়, ফোন ধরে আমি আর কথা কিছুই বুঝিনা। কী বলে, তোমার নাম বলছে, ফুল স্কলারশীপ পেয়েছো বলছে, মাত্র পাঁচজন পেয়েছে, তাদের মধ্যে তুমি একজন। কথা স্পস্ট, অথচ আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, কেঁদে ফেলেছিলাম, প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলাম, প্রেসিডেন্ট বুঝতে পেরেছিল, আমার খুশীর পরিমান, বলেছিল, তুমি খুব লাকী মাম।

আবার আউটস্ট্যান্ডিং রেজাল্ট করে আন্ডারগ্র্যাড কম্পলীট করলে, ডাক্তারী পড়ার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, সবই ঠিকমত করলে, ইন্টারভিউ দিলে, শেষ পর্যন্ত আমাদের মিসিসিপি স্টেটে এসে ভর্তি হলে। এখান থেকেই শুরু হলো আমার বিপর্যয়। আমি মনে প্রাণে চেয়েছিলাম, তুমি যেন মিসিসিপিতে পড়ো, আর তুমি চার বছর আমাদের থেকে দূরে থেকে অনেক বেশী স্বাবলম্বী হয়ে গেছিলে। আরও বড় কোন শহরে যেতে চেয়েছিলে, কিনতু মায়ের আকাঙ্ক্ষার কাছে আর সব কিছু ম্লান হয়ে গেছে। সেই ১৬ বছর বয়সে আমাদের কাছছাড়া তুমি, কত কেঁদেছি, জীবনের বাস্তবতায় ক্ষত বিক্ষত হয়েছি, আবার ভেবেছি, বাবাকে বলেছিলাম, মৌটুসী ঢাকা বোর্ডে স্ট্যান্ড করবে, আমেরিকাতে স্ট্যান্ড করাতে পারলেই আমার কথা ঠিক থাকবে। কিনতু তুমি মিসিসিপিতে এসেই মন খারাপ করে ফেললে। ভার্জিনিয়া থেকে মিসিসিপিতে এলে, তোমার মত বয়সী ছেলে মেয়েদের খারাপ লাগবেই, তার উপর আবার ডাক্তারী পড়ার মত কঠিন একটা বিষয় নিয়ে থাকতে হবে। তুমি ধীরে ধীরে ডিপ্রেসড হতে শুরু করলে। তুমি ছিলে বিনয়ী, শান্ত, স্পষ্টভাষী, সেই তুমিই হয়ে গেলে অসহিষ্ণু, মলিন। আগে কত আর্ট করতে, নাচ করতে, ভার্জিনিয়াতে থাকতে কত কালচার‌্যাল প্রোগ্রাম অর্গ্যানাইজ করেছো, কত রকম সামাজিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছো, সেই মেয়েটি মিসিসিপির আবহাওয়াতে এসে থমকে গেল! আমি কত কেঁদেছি তোমার এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে। অথচ মিসিসিপি মেডিক্যাল কলেজে তুমি পেয়েছিলে 'ফুল স্কলারশীপ"। আমেরিকার মত দেশে ডাক্তারী পড়তে গেলে সকলকেই ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে পড়তে হয়, সেখানে তুমি পেয়েছিলে ফুল স্কলারশীপ।

তুমি একদিন আমাকে ফোন করেছিলে, তোমার গলার আওয়াজ শুনেই আমি বলেছিলাম, " মামনি, তোমার গলার আওয়াজ এমন শোনা যাচ্ছে কেনো? কী হয়েছে?" তুমি কেঁদে ফেলেছিলে, বলেছিলে " মামনি, আমার এখানে একটুও ভাল লাগেনা, আমি কিছুই পড়তে পারিনা, বই নিয়ে বসে থাকি, কিছুই পড়িনা। আজকে একটা পরীক্ষায় ফেল করেছি"। আমি খুবই শকড হয়েছিলাম কিনতু তোমাকে বুঝতে দেইনি। আমি তোমাকে খুব নরমভাবে বুঝিয়েছিলাম, ডাক্তারী পরীক্ষায় পাশ মার্ক হচ্ছে ৭০, তুমি পেয়েছো ৬৮। আরও পরীক্ষা আছে, কোন চিন্তা করোনা, সেগুলো দিয়ে কভার করে ফেলো। তুমি তো একা ফেল করোনি, আরও অনেকে করেছে, ডাক্তারী যারা পড়তে যায়, তারা সকলেই মেধাবী, তোমাদের হাতে মানুষের জীবন মরণ নির্ভর করে, তোমাদেরতো ভালোভাবে শিখতে হবেই। প্রথম প্রথম একটু আধটু ফেল করার ব্যবস্থা হয়তো এরাই করে রাখে।  এক পরীক্ষায় ফেল করেছো, ভালোই হয়েছে, পাশ করার জন্য আরও অনেক বেশী পড়বে, তাহলে অনেক বেশী শিখবে। আমার কথা শুনে তোমার কান্না থেমেছে। কিনতু তোমার বাবা যখন শুনেছে, তুমি কেঁদেছো, তোমাকে ফোন করলো, মনে আছে তোমার? তোমার বাবা ফোনের উপরেই কী কান্না! আমি অবাক হয়ে গেছিলাম, তুমিও অবাক হয়ে গেছিলে। তোমার বাবাকে আমি একবার মাত্র কাঁদতে দেখেছিলাম, তোমার তিন বছর বয়সে একবার খুব অসুস্থ হয়েছিলে, ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল তোমার শরীর, তোমার বাবা তোমার শিয়রে বসে নীরবে কাঁদছিলেন। সেবার আমি শক্তহাতে হাল ধরেছিলাম, ডাক্তারের পরামর্শে সব কাজ ফেলে রেখে তোমাকে ড্রপারে করে এক ফোঁটা দুধ, এক ফোঁটা জল, এক বিন্দু মধু দিয়ে যাচ্ছিলাম। পাঁচ ঘন্টা পর তুমি উঠে বসেছিলে। এত বছর পরে আবার তোমার বাবা কাঁদতেই জিজ্ঞেস করলাম, কান্নার কারন, সে বললো, পড়ালেখা জীবনের সব নয়। মরে গিয়েও পড়তে হবে, এটা আমি মানিনা। মামণি যেন সুইসাইড টাইড না করে বসে। এই বয়সে এত চাপ সহ্য করতে পারেন অনেকেই। তোমার বাবার কথা শুনে আমি তোমাকে আড়ালে বুঝিয়েছিলাম, তুমিও আমার কথা বুঝতে পেরেছিলে। আরেকদিনের কথা বলি, তোমাদের কলেজের সামার ভ্যাকেশান চলছিল, তুমি রয়ে গেছিলে তোমার এপার্টমেন্টে। আমি তোমাকে ফোন করি, ফোন করি, কেউ ফোন ধরে না। সকাল থেকে ফোন শুরু করেছি, দুপুর দুইটায় যখন ফোন ধরছিলে না, আমার টেনশান শুরু হয়ে গেল। তোমার বাবা কে বললাম, " মামনি ফোন ধরেনা কেন? মনের দুঃখে কিছু করে ফেলেনি তো! এমনও তো হতে পারে, ও অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে একা ঘরে, কেউ তো জানবেও না। শীগগীর চলো, আমরা যাই, অন্তঃত মেয়েটাকে উদ্ধার করি"। মামনি তুমি বুঝতে পারছো, এত সুন্দর করে আমি কথাগুলো বলিনি। আরও ভয়াবহ করেই বলেছি। তোমার বাবা আমাদের নিয়ে গাড়ী ছুটিয়েছে, একঘন্টা চলার পর তুমি ফোন ব্যাল করে বললে, একটা সেমিনার ছিল, ফোন সাথে নাওনি। তোমাকে বকবো কী? তুমি যে বেঁচে আছ, এটা জেনেই আমরা খুশী। এই হলাম আমি। তোমার অবশ্য এখন আরও অনেক কথাই মনে পড়বে, তুমি যখন ভার্জিনিয়া হলিন্স ইউনিভার্সিটিতে ছিলে, প্রতিদিন পাঁচবার ফোন করতাম তোমাকে। আর আমি এত ফোন করি বলেই বোধ হয় তুমি নিজে থেকে আমাকে ফোন করতে না। একদিন রাতে ফোন করে তোমাকে না পেয়ে তোমাদের অফিসে ফোন করেছি, সেখানে কেউ ধরেনা, কি করে যেন আর কারো ফোন নাম্বার যোগার করে তাকে ফোন করেছি রাত দুইটায়। সে বলেছে তুমি কোন একটা প্রোগ্রামে আছ, ফিরতে রাত হবে। হা হা হা ! এমন পাগলামী কত করেছি, তাইনা? কেন করেছি? আমার এত দামী একটা মেয়ে, এত আদরের সন্তান আমার, আমি চিন্তা করবো না তো কে করবে?

আরেকবার তুমি যেদিন বললে, তুমি ডাক্তারী পড়তে চাও না, অন্য কিছু পড়বে, সেদিন আমি তোমাকে বলেছিলাম, " ঠিক আছে, ডাক্তারী পড়তে হবে না।" তুমি বাসা থেকে গাড়ী চালিয়ে তিন ঘন্টা ড্রাইভ করে হোস্টেলে যাবে, আমি তোমার দিকে ফিরেও তাকালাম না। কী যে কষ্ট পাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল আমার সকল স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। কারন , তুমি খুব স্পষ্টভাবে কথা বলো, তোমার কথাবার্তায় কখনও কোন অস্বচ্ছতা থাকেনা। তুমি যখন বলেছ, পড়া ছেড়ে দিবে, তাহলে তা তুমি করবেই। চার ঘন্টা পরে তুমি আমাকে ফোন করেছিলে, " মামনি, আমি ঠিক করেছি, ডাক্তারী পড়া শেষ করবো। আর কখনও পড়া ছেড়ে দেয়ার কথা বলবো না। তুমি মন খারাপ করো না, বাবিকেও বলো, আমাকে নিয়ে চিন্তা না করতে"। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, জানতে চাইলাম, হঠাৎ মত পরিবর্তন কেন? তুমি বলেছিলে, " তুমি ঠিকই বলেছ, কোন কিছুই সহজ না, ডাক্তারী পড়া ছেড়ে দিয়ে অন্য কিছু পড়বো, সেটাও যদি ভালো না লাগে, তাহলে তো সবই যাবে। তার চেয়ে ডাক্তারী পড়া শেষ করি"। তোমার সেদিনের কথা শুনে আমি আবার কেঁদেছি, আনন্দে, আমার মৌটুসীর মন থেকে সব দ্বিধা চলে গেছে, ও যখন বলেছে, পড়া শেষ করবে, তাহলে তা হবেই হবে। তুমি তা করেছো। খুব ভালোভাবেই করেছো। কত বড় শহরে তুমি এখন রেসিডেন্সী করতে গেছো। এটাই তো হওয়ার কথা ছিল। তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

এই বছর তোমার কাছে আরেকটি কারনে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে চাই। সেটা হচ্ছে, তোমার বিয়েটা দেশে আয়োজন করিয়েছো বলে। মামনি, আমি সব সময় বলতাম, আমার মেয়েদের বিয়ে বাংলাদেশে হবে। কথাটি তোমার অবচেতণ মনে ছিল। যখন তোমার বিয়ের কথা হচ্ছে, তখন তোমার বাবা মিসিসিপিতেই তা আয়োজন করতে চেয়েছে। এখন আমার একটু বয়স হয়েছে, তোমার বাবার কথার উপর বেশী কথা বলিনা, কারন তোমার বাবা তো কখনও খারাপ কিছু বলেনা। আমেরিকা থেকে দেশে গিয়ে মেয়ে বিয়ের আয়োজন করার মত শক্তি বা ক্ষমতা তোমার বাবার ছিল না। কিনতু তুমি বার বার বলেছিলে, বিয়ে করলে দেশে গিয়ে সবার মাঝে করতে চাও। আমি মনে মনে খুশী হয়েছিলাম এবং চাইছিলাম তুমি তোমার কথায় স্থির থাকো। তা তুমি ছিলে, তুমি বলেছিলে, দেশে গিয়ে বিয়ের আয়োজন না করলে তুমি মিসিসিপিতে কোন আনুষ্ঠানিকতা করতে দিবেনা। বলেছিলে, মিসিসিপিতে তুমি শুধু রেজিস্ট্রেশান করেই বিয়ে সেরে ফেলবে। মনীশ নামের যে চমৎকার ছেলেটিকে তুমি খুঁজে পেয়েছো, এই ছেলে তো শুরুতেই তোমার বশ হয়ে আছে। তুমি যদি বলেছো, বাংলাদেশে বিয়ে হবে, মনীশও বলে , ঠিক ঠিক। তুমি যদি বলেছো, আমেরিকাতে বিয়ে হলে কোন অনুষ্ঠান হবেনা, মনীশও বলে, হাঁ হাঁ ঠিক ঠিক। হা হা হা হা!! মামনি, তুমি ভাল ছেলে পেয়েছো।

তোমার বাবার কাছে তোমার আব্দারই শেষ কথা। তোমার বাবা দেশেই বিয়ের ব্যবস্থা করলেন, তোমার দিদা, দাদু, মামারাসহ সকল আত্মীয়স্বজন এসেছিল। তোমার দিদা শুধুমাত্র তোমার বিয়েতে যেন কোন বাধা না পরে, সেইজন্য নিজের দেহের যন্ত্রণা লুকিয়ে রেখেছিল। আমার মা কোনদিন কারো বিয়ের আসরে থাকেনি, এই প্রথম তোমার বিয়ে একেবারে আসরে থেকে, তোমার সাতপাঁকে ঘোরা থেকে শুরু করে প্রতিটি মাঙ্গলিক কাজ নিজে থেকে করেছে। মামনি, কথাগুলো লিখতে গিয়ে আমার বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে। তোমার বিয়ের পরে সবাই চলে আসলাম, আমার মা ডাক্তারের কাছে গেলেন, ক্যানসার ধরা পড়লো, মা'কে জানানো হয়নি, অপারেশান হলো, অপারেশানের পর মা খুশী, মিশাকে বললো, ওর বিয়েতেও থাকবে, ততদিনে ক্যান্সার সারা দেহে ছড়িয়ে গিয়ে মাত্র দুই মাসের ভেতর মা মারা গেলেন। কিনতু তোমাকে দিয়ে গেলেন শ্রেষ্ঠ উপহার। একমাত্র তোমার বিয়েতে দিদা কে পেলে, আর কারো বিয়েতে দিদা থাকবেনা। দিদা শুধু তোমার হয়ে থাকলো। তোমাকে কখনও বকেনি, কারো কোন অসুবিধা হলেই তোমাকে জিজ্ঞেস করতো কী করতে হবে, তোমার চিকিৎসা সেবা পায়নি ঠিকই, কিনতু তুমি ডাক্তারী পাশ করার পর কী যে খুশী হয়েছে। দিদা কত গরীব দুঃখীকে সাহায্য করতো, দিদার মৃত্যুর পর দুনিয়ার মানুষ এসেছে দিদাকে দেখতে। প্রত্যেকেই বলেছে, দিদার কাছ থেকে কে কত সাহায্য পেয়েছে। আমার বুক ভরে গেছে, এমন মায়ের মেয়ে হিসেবে।

মামনি, তুমিও আমার মনের আশা পূর্ণ করেছো। যখন যে বলেছি, মাথায় রেখেছো, তা কাজে করে দেখিয়েছো। তোমার কি মনে আছে, আমি বলেছিলাম, রোজগার যখন করবে, দুইজন গরীব ছেলেমেয়েকে পড়ার খরচ দিবে! চুক্তি করে নিবে, তোমার টাকায় পড়ালেখা করে যে মানুষ হবে, সে যেনো তার সাহায্যের হাত আরেক জনের দিকে বাড়িয়ে দেয়, তা হোক নিজের পরিবার অথবা অন্য কেউ! আমার মা করে গেছেন পরের উপকার, আমি কতটুকু করতে পারছি জানিনা, বাকীটুকু তুমি করো। তুমিতো নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করো, তাহলে দিদার পদাঙ্ক অনুসরণ করো, দিদার আত্মা শান্তি পাবে। শুভ স্পেশ্যাল জন্মদিন মামনি। মনীশকে নিয়ে তোমার প্রথম জন্মদিন এটা, অবশ্যই স্পেশ্যাল!!

Friday, November 16, 2012

" মিস মি বাট লেট মি গো"

হালকা ওজনের ফোল্ডিং টেবিলটি ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টারের প্রবেশপথের ঠিক মাঝখানে রাখা হয়েছে। হলুদ কাগজে টেবিলটিকে সম্পূর্ণ মুড়িয়ে, তার উপর বসানো হয়েছে দুটি ফটো ফ্রেম, আর একটি ফ্লাওয়ার ভাস। একটি ফ্রেমে 'ওটিস উইন্টার' এর হাস্যোজ্জ্বল মুখ, আরেকটিতে  গোটা গোটা ইংলিশ হরফে লেখা আছে, " উই হ্যাভ লস্ট এনআদার এনজেল"। এই লাইনটির নীচে  একখানি কবিতা, যার শিরোনাম, " মিস মি বাট লেট মি গো"। আজ বিকেলের পর থেকে যে বা যারাই আসবে ওয়ালমার্টে, তাদের প্রত্যেকে এক মুহূর্তের জন্য ওখানে থামবে, ভাল করে ওটিসের মুখখানা দেখে মনে করার চেষ্টা করবে, এই ভদ্রলোককে কোন ডিপার্টমেন্টে দেখেছি যেন!

'ওটিস উইন্টার' ওয়ালমার্টের গার্ডেন সেন্টারে কাজ করতো। যৌবনে সেনাবাহিণীতে ছিল, সেখান থেকে রিটায়ার করার পর আরও বেশ কিছু জায়গায় হয়তোবা কাজ করেছে, কিনতু গত চার বছর ধরে ওটিস উইন্টারকে আমি ওয়ালমার্টে দেখেছি। আমি চাকুরী করি কানেকশান সেন্টারে, যেখান থেকে তিনটি ফোন কোম্পাণীর ডিলার হিসেবে আমরা গ্রাহক সেবা দিয়ে থাকি। কানেকশান সেন্টার থেকে গার্ডেন সেন্টার অনেক দূর, দেখাই যায় না। তারপরেও ওটিস উইন্টারকে আমি খুব ভালোভাবে চিনতাম। ভদ্রলোকের বয়স ৮০র কাছাকাছি হবে, কিনতু তাকে আমি দেখেছি শরীর সোজা রেখে কাজ করতে। মুখে থাকতো শিশুর মত হাসি। চার বছর আগে ওটিস তার স্ত্রীকে নিয়ে আমার ডিপার্টমেন্টে এসেছিল, প্রিপেইড ফোন কেনার জন্য। সেদিন তার অফ ডে ছিল বলে, ক্যাজুয়াল পোশাকে তাকে দেখে কলিগ হিসেবে চিনতে পারিনি। তবে আমার সহকর্মীরা সকলেই জানে, বয়স্ক লোকদের আমি সাহায্য করতে ভালোবাসি। বয়স্করা এক কথা দশ বার জিজ্ঞেস করলেও আমি দশবারই উত্তর দেই। চেষ্টা করি উত্তরগুলো যত সহজ করে দেয়া যায়। আমার দাদু বেঁচেছিলেন ৯৫ বছর বয়স পর্যন্ত, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দাদু  আমাদের সবার কাছে খুবই আদর, ভালোবাসা, সম্মান পেয়েছেন। বয়স্ক একজন মাথার উপর থাকা, এ যে কতবড় আশীর্বাদ! তাছাড়া  ঢাকা থাকতে দুই বছর আমি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়িয়েছি, তাও আবার বাচ্চাদের। ফলে বাচ্চা, বুড়োদের বুঝানোর পদ্ধতি আমি খুব ভালো জানি। ফলে ওটিসকে আমি আর দশজন বৃদ্ধ গ্রাহকের মতই সম্মান করে কথা বলছিলাম। ওটিসের প্রতি আমার এমন আন্তরিকতা দেখে স্বামী-স্ত্রী খুব খুশী। তখনই ওটিস আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

-তুমি কি ভারতীয়?
-আমি বাংলাদেশের মেয়ে, বাংলাদেশ নাম শোননি? হ্যাঁ হ্যাঁ, ভারতের পাশের দেশ।
-আমার ডাক্তারের নাম ডাঃ বাটাছারিয়া,  ফ্রম ক্যালকাটা, দ্য বেস্ট ডক্টর, আই হ্যাভ এভার সীন।
-তাই নাকি? তা তোমার কী হয়েছিল, কেন ডাক্তার বাটাছারিয়া ( ভট্টাচারিয়া)র কাছে যেতে হয়েছে?
-আমার প্রোস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়েছে, খুব খারাপ অবস্থায় তার কাছে গেছি। সে খুবই ভাল ডাক্তার, গেলেই অনেক গল্প গুজব করি। আমি আমার মিলিটারী জীবনের গল্প করি, আর বাটাছারিয়া তার জীবনের গল্প বলে। তার চিকিৎসাতেই আমি এখনও বেঁচে আছি। এখনও ওয়ালমার্টে কত কাজ করতে পারি।

-তুমি ওয়ালমার্টে চাকুরী করো? ওহো! এখন তোমাকে চিনতে পারছি, তুমি গার্ডেন সেন্টারে আছো। আজকে অনেক সেজে এসেছো, তাই চিনতে পারিনি বলেই তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একটু মুচকী হাসলাম। তার স্ত্রীও দেখি স্বামীর কথায় সায় দিয়ে ডাক্তার ভট্টাচারিয়ার প্রশংসা করলো। তারা এটাও বললো, আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটে তাদের সাথে অনেক ভারতীয়ের সাথে পরিচয় হয়েছে, সকলেই নাকি খুব ভাল।

এরপর থেকে স্বামী স্ত্রী রেগুলার আসতো আমার কাছে। মাঝে মাঝে ওটিস অন্য খুচরো জিনিস কিনতে হলেও আমার এখানে চলে আসতো। ওটিস ব্যস্ত থাকলে ওটিসের বুড়ি বৌ নাতণীদের সাথে নিয়ে চলে আসতো। ওটিসের বউকে দেখলে আমাদের গ্রাম বাংলার সহজ সরল বৃদ্ধাদের কথা মনে হয়। গালের চামড়া কুচকে আছে, হাতের চামড়াও কোঁচকানো, চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে সুন্দর করে খোঁপা বাঁধা, এক্কেবারে প্যান্ট-শার্ট পরা ঠাকুমা বা দিদিমা।

গত কয়েকমাস ওটিসকে আমি দেখিনি, তাছাড়া গত তিনটি মাস আমার মা'কে নিয়েই বিভোর ছিলাম। মায়ের মৃত্যুর সময় দেশে ছিলাম, দেশ থেকে ফিরে এসেছি ২৫ দিন হলো। এই ২৫ দিন আমি পৃথিবীর সব কিছু থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছি। কোন আনন্দ আমাকে স্পর্শ করেনা, দুঃখও আমাকে নতুন করে কাঁদায় না।  সেদিন ওটিসের বুড়ী বঊ এসেছিল, সাথে ফুটফুটে সুন্দর দুই নাতণীকে নিয়ে। ক্রিসমাস চলে আসছে, উপহার কিনে দিল ওদেরকে, দামী মোবাইল ফোন। বুড়ীমা'কে  খুব মলিন দেখাচ্ছিল, অথচ ওটিসের কথা জিজ্ঞেস করা হয় নি। গত পরশুদিন, হঠাৎ করেই ওটিসের কথা মনে পড়ছিল। সেদিন মুখে কাঠি নিয়ে আসা বৃদ্ধকে ( আমার একটা লেখায় এই বৃদ্ধের কথা আছে, আমেরিকার মজনু)  দেখে ওটিসের কথা মনে পড়ে যায়। অনেক দিন দেখিনি ওটিসকে, আমাকে কী ভালোবাসে! বুড়ো-বুড়ীর চোখ থেকে স্নেহ যেন উপচে পড়ে। মুখে কাঠিচাপা বৃদ্ধ আমাকে জিজ্ঞেস করলো, " গত দুই মাস তুমি কেমন ছিলে? কেমন কেটেছে তোমার সময়"? আমি খুব চাপা স্বভাবের মানুষ, কাউকেই বুঝতে দিতে চাই না, বুকের ভেতর কী অসহণীয় ব্যথা নিয়ে ঘুরি। কিনতু কেউ আমাকে ভালোমুখে দুটি কথা বললেই আমার চোখ ফেটে জল আসে। বৃদ্ধের এমন নরম প্রশ্নের উত্তরে বললাম,

-গত দুইমাস আমার দিন খুব ভালো কাটে নি। আমার মা মারা গেলেন, আমি মাত্র ১২ দিনের জন্য দেশে গেছিলাম।
-ওহ! জেসাস! আমি খুব দুঃখিত, তোমার মুখ দেখে কেনো যে আমার বুকটা মুচড়ে উঠলো, তাই জিজ্ঞেস করলাম। চিন্তা করো না, মন খারাপ করো না, মা ভালো জায়গায় আছেন। তুমি নিজের দিকে খেয়াল করো। তোমার মুখের সেই বিখ্যাত হাসি ফিরিয়ে আনো। তোমার মা হেভেন থেকে তোমাকে দেখছেন। মন খারাপ করে থাকলে উনিও মন খারাপ করবেন।

আমি আমেরিকান মজনুর চোখে জল দেখে নিজেকে সামলে নিলাম। বাইরের কারো সামনে আমি ভাঙ্গিনা। যাই হোক, যথারীতি আজ বিকেলের দিকে আমরা কয়েকজন কানেকশান সেন্টারের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিলাম। হঠাৎ করেই ঘোষণা এলো, ওটিস উইন্টার মারা গেছেন। অরল্যান্ডো নামে এক কলিগ আছে, তার কাছে নির্দেশ এলো, ওয়ালমার্টের প্রবেশ মুখে টেবিল সেট করার জন্য। আমাদের ডিপার্টমেন্টের কাছাকাছি ফটো সেন্টার। সেখানে অর্ডার এলো, ওটিস উইন্টারের ছবি ফ্রেম করে দেয়ার জন্য।
ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টারে আছি গত সাত বছর ধরে।  কোন এসোসিয়েট মারা গেলে, তার ছবি  অত্যন্ত শ্রদ্ধা সহকারে ডিসপ্লে করা হয়ে থাকে। ফিউনারেল হয়ে গেলে ছবি সরিয়ে ফেলা হয়। ওটিস উইন্টারের ছবি আজ বিকেল থেকে  ওয়ালমার্টের সামনের প্রবেশদ্বারে রাখার ব্যবস্থা হচ্ছে দেখে, আমি আমার প্রিয় বন্ধু রয়কে বললাম,

-রয়, আমি যদি মারা যাই, আমার সবচেয়ে সুন্দর ছবি এনে ডিসপ্লেতে দিবে। তুমি তো আমার ফেসবুকে আছো, ছবির ব্যাপারে আমি খুব সেনসিটিভ, তুমি তা ভাল করে জানো। মারা যাওয়ার পরেও বাইরের মানুষ যেন আমার ছবির দিকে তাকিয়ে বলে, 'মিস ব্যাংলাডেশ' সত্যিই চমৎকার এক মানুষ ছিল। সুন্দর ছবি দিতে বলেছি যেন অনেকদিন আমাকে সবার মনে থাকে। বলেই আমি কাঁদতে শুরু করেছি। আমি তখনও জানিনা, টেবিলে রাখা ফ্রেমে লেখা আছে, " মিস মি বাট লেট মি গো"! আমার বন্ধুটির মা মারা গেছে জুন মাসে, আমি ছিলাম দেশে। দেশ থেকে এসে যখন শুনলাম, রয়ের মা মারা গেছেন, আমি স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। খুব সম্ভব এপ্রিল বা মে মাসে আমার এক প্রিয় খালাম্মা মারা গেলেন কোলন ক্যান্সারে। খালাম্মা আমাকে খুব ভালোবাসতেন, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া থেকে আমাকে ফোন করতেন, আমার সাথে কথা বলে নাকি শান্তি পেতেন। জুলাই মাসে মারা গেলেন হুমায়ুন আহমেদ, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে।  আগস্টে মারা গেলেন আমার সেজো মেসো, ক্যান্সারে। এই মেসো আমাকে উনার বড় মেয়ে বলতেন। শুধুমাত্র তাঁকে এক নজর দেখবো বলেই আমি মাত্র ছয় দিনের জন্য ঢাকা টু কলকাতা গিয়েছিলাম।  আমার মা প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিলেন, তখনও আমার মা দিব্বি হেসে খেলে বেড়ান, উনিও যে দেহে কঠিন ক্যান্সারের বাসা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তা জানার বা বোঝার কোন উপায় ছিল না।  আমার মা মারা গেলেন অক্টোবার মাসে, ক্যান্সারে।  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মারা গেলেন, যদিও বলা হয় হার্ট এটাক, উনারও প্রোস্টেট ক্যানসার হয়েছিল।  ওটিস মারা গেল নভেম্বার মাসে, ক্যান্সারে। হুমায়ুন আহমেদ  ও সুনীল গাঙ্গুলী বাদে বাকী সকলেই আমাকে কী যে ভালোবাসতো! আর আমি ভালোবাসতাম এঁদের প্রত্যেককে।

সন্ধ্যে ছটায় আমি ওয়ালমার্ট থেকে বের হওয়ার সময় দেখলাম, টেবিল সাজানো। একবার মনে হয়েছিল, পেছনে তাকাবো না, ওটিসের ছবির দিকে তাকালে মায়ের কথা মনে পড়বে। ইদানিং আমার একটা সমস্যা হয়েছে, যখন তখন মায়ের যন্ত্রণা কাতর মুখখানা মনে পড়ে, স্থান-কাল জ্ঞান থাকেনা, চোখ ফেটে জল আসে। তবুও তাকাতেই ফ্রেমে বাঁধা কবিতার শিরোনাম চোখে পড়লো সবার আগে, " মিস মি বাট লেট মি গো"।

ওটিস খুব কষ্ট পাচ্ছিল। এই বৃদ্ধ বয়সে কেমোথেরাপী চলছিল, শুকনো শরীরে হয়ত আর সইতে পারছিল না, তাই হয়ত বা তার বেলায় কথাটি খাটে, কিনতু আমার মা চলে যেতে চেয়েছিলেন কিনা, তা আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না। আমি গাড়ী চালিয়ে বাড়ীর মুখে ঢুকতেই সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে কান্না এলো। আমার মা কী চেয়েছিল, তাইতো বুঝতে পারলাম না। আমি যখন মা'কে আইসিইউ তে প্রথম দেখি, দারুন সুন্দর মা'কে দেখেই চোখ ফেটে জল আসে। দারুন সুন্দরী মা'কে দেখতে কেমন যেন ভাঙ্গাচোরা লাগছিল। নাকে মুখে হাজারটা নল বসানো, চোখ বন্ধ মা'কে   - মা, ওমা বলে ডাকতেই মা এক মুহূর্তে আমার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেললো। কী অসম্ভব জীবনীশক্তি ছিল আমার মায়ের! শেষ অপারেশান করার আগ মুহূর্তে ডাক্তাররা বলেছিল, অপারেশানের পরে রুগীর জ্ঞান না ফেরার সম্ভাবনা ৯৯ ভাগ। ওটিতে যাওয়ার আগে মা জানতো, পরদিন সকালে আমি এসে পৌঁছাব। ক্যান্সার ছড়িয়ে গেছে সারা দেহে, কিডনী অচল, কোলন থেকে এক মিটার কেটে বাদ দেয়া হয়েছে, ব্লাড প্রেসার নেমে গেছে, পালস রেট লো, লাইফ সেইভিং মেশিনে রাখা হয়েছে,  সেই রুগীর জ্ঞান ফিরে এসেছে এবং মেয়েকে দেখা মাত্র তাকিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। আমি কী করে ভুলবো, এই দৃশ্য!  আমাকে সকলেই বলে, আমি খুব শক্ত মনের মানুষ। হয়তো সত্যিই তাই, নাহলে ওখানে দাঁড়িয়ে আমি ঠিক থাকলাম কী করে! মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মিথ্যে কথা বললাম, " মা, মাগো, তুমি কান্দো কেন? আমি তো আসছি। ডাক্তারের সাথে কথা হইছে, তোমার অপারেশান ভাল হইছে, তোমার জ্ঞান ফিরছে, আর চিন্তা কি? ভাল হইয়া যাইবা"।  এই প্রথম মা'কে  'মা' মনে হয়নি, মনে হয়েছে আমার'  ' মেয়ে'। মেয়ে আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে ইশারায় বলেছিল, ' ব্যথা'। ইশারার কথা কিছুই বুঝিনি, শুধু মাথায় হাত বুলিয়েছি আর বলেছি, আর চিন্তা নাই, আমি চলে আসছি। আমার মা মাথা কাত করে বুঝিয়েছে, আচ্ছা। তারপরে চোখ বন্ধ করেছে। এভাবে পর পর চার দিন মা আমাদের সাথে কথা বলেছে ইশারায়। শেষ পর্যন্ত ডাক্তারদের কাছ থেকে আর কোন আশার বাণী না শুনতে পেয়ে এবং ডাক্তারের কাছ থেকেই যখন শুনলাম, আমার মা এই অবস্থায় ভয়াবহ কষ্ট পাচ্ছে, আমাদের উচিৎ, তাঁর লাইফ সেইভিং মেশিন খুলে শান্তিতে ঘুমাতে দেয়া, তখন আমাকে আবার কঠিন মুখোশ আঁটতেই হলো মুখে।

আমার চোখে আমি দেখেছি, আমাকে দেখে মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন, অনেকটাই এমন, এবার আর কোন কষ্ট থাকবেনা, আমার মেয়েই আমাকে সারিয়ে তুলবে। তাই আমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, লাইফ সেভিং মেশিন খুলে দেয়ার পক্ষে। আমার ভাইয়েরা প্রাণপন চেষ্টা করেছে, যত্ন করেছে মা'কে ভাল করে তোলার জন্য। তাই ভাইদেরকে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে দেই নি। আমি তো কঠিন হৃদয়ের মানুষ, তাই স্বেচ্ছায় দায়িত্ব নিয়েছি। মা'কে কাছে গিয়ে বলেছি, " মা, তোমাকে এইখানে অনেক কষ্ট দিতেছে।নাকে মুখে নল দিয়ে রাখছে, আমাদেরকেও তোমার কাছে থাকতে দেয় না। তার চেয়ে চল, আমরা বাসায় চলে যাই। নারায়নগঞ্জে গিয়ে তোমাকে অন্য ক্লিনিকে রাখবো, আমরা সবাই তোমার কাছে থাকতে পারবো"।  মা নিজেও ভাবতে পারেননি, উনি মারা যাচ্ছেন। মাত্র দুই মাস আগেই উনার ছোট বোনের স্বামী মারা গেলেন ক্যান্সারে,  অসুস্থ অবস্থায় মা বার বার বলতেন, " আমার যদি ক্যান্সার হয়, তাহলে তো কেমো দিবে, কেমো দিলে আমি আর বাঁচবো না", ফলে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি মা'কে উনার ক্যান্সার হয়েছে কথাটি না জানাতে।  ডাক্তার বা নার্সেরা জানিয়েছিল কিনা জানিনা। মাত্র দশ দিন আগেই আমার মেজো মেয়ের সাথে ফোনে গল্প করেছেন, সুস্থ হয়ে মেজো নাতণীর জন্য পাত্র খুঁজবেন, বড় নাতণীর বিয়ে দিয়েছেন দুই মাস আগে, বিয়ের পুরো অনুষ্ঠান হয়েছে তাঁর তত্বাবধানে,  এখন মেজোটার জন্য তৈরী হবেন। সেই মানুষ কি কখনও বলতে পারে,

 " মিস মি বাট লেট মি গো"!!

Thursday, November 15, 2012

যম দুয়ারে দিয়ে কাঁটা, ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা

বাঙ্গালীর বারো মাসে তেরো পার্বণের কথা কে না জানে! ভাইফোঁটা কি সেই তেরো পার্বণের একটি কিনা, তা জানা নেই। কারণ, ভাইফোঁটা কোন প্রচলিত পূজা-পার্বণ নয়, বাঙ্গালীর ঘরে ‘ভাইফোঁটা’ হচ্ছে সবচেয়ে আনন্দময়, নির্মল, একটি পরব। ভাই-বোনের মধ্যেকার অনিন্দ্যসুন্দর সম্পর্ক ঘিরেই প্রচলিত হয়েছে এই উৎসবটি। ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় ঈশ্বরের কাছে বোনের আকুতি, ভাইয়ের সাফল্য, দীর্ঘায়ু লাভের জন্য বোনের প্রার্থণাই ‘ভাইফোঁটা’ কে মহিমান্বিত করেছে। প্রথা অনুযায়ী শুক্লাতিথির দ্বিতীয়াতে ভাইফোঁটা উদযাপিত হয়। প্রয়োজনে পরবর্তী সাতদিন ভাইফোঁটা উদযাপণ করা যায়। পঞ্জিকার হিসেবমতে কালীপূজার দুই দিন পরে ভাইফোঁটা অনুষ্ঠিত হয়। ভাইফোঁটার ধর্মীয় গুরুত্ব অপেক্ষা সামাজিক ও পারিবারিক গুরুত্ব অনেক বেশী, যেখানে ভাই-বোনের মধ্যেকার প্রীতি ও ভালোবাসার স্বর্গীয় সম্পর্কটিই মূখ্য। ভাই বোন দুজনেই বছরের এই একটি দিনের অপেক্ষায় থাকে।
ভাইফোঁটা এমনই এক উৎসব যা ভাই-বোনের মধ্যেকার ভালোবাসা এবং স্নেহের সম্পর্ক খুব দৃঢ় করে। ভাই-বোনে সারা বছর ঝগড়া-ঝাঁটি থাকলেও, ভাই বোন দুজনেই বছরের এই একটি দিনের অপেক্ষায় থাকে। বোনের কাছ থেকে ভাইফোঁটার নেমন্তন্ন পেলে, দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে, যত প্রয়োজণীয় কাজ ঠেলে সরিয়ে রেখে ভাই আসবেই বোনের কাছ থেকে ফোঁটা নিতে।
ভাইফোঁটা যেভাবে উদযাপিত হয়ঃ
সাধারণতঃ শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়াতে ভাইফোঁটা্র লগ্ন ঠিক হয়। এই হিসেব ধরেই বোন তার ভাইদেরকে নিমন্ত্রণ জানায় তার বাড়ীতে। কাছে-দূরে যেখানেই থাকুক, বোনের নিমত্রণ রক্ষা করতে ভাইয়েরা ছুটে আসে। ঠিক সন্ধ্যাবেলা ভাইকে আদর সমাদর করে সূতির আসনে বসতে দেয়া হয়। বোনের হাতে থাকে ঝকঝকে পেতলের রেকাবী। রেকাবী সাজানো হয়, ঘরে তৈরী কাজল, চন্দন বাটা, ধান-দূর্বা, শুকনো পাটপাতা এবং মিষ্টি দিয়ে। পাশেই রাখা হয় ঘিয়ের প্রদীপ। বোন তার কড়ে আঙুলে কাজল ছুঁইয়ে ভাইয়ের দুই ভুরুতে এঁকে দেয়। এরপর চন্দনের ফোঁটায় কপাল অংকিত করে, কপালের ঠিক মাঝখানে কড়ে আঙুলকে স্পর্শ করে প্রচলিত ছড়া কাটেঃ
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা
যম দুয়ারে পড়লো কাঁটা
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা
আমি দেই আমার ভাইকে ফোঁটা
আজ থেকে আমার ভাই.
যম দুয়ারে তিতা।
ছড়া শেষে বোন ভাইয়ের মাথায় ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে, পাশ থেকে বেজে উঠে উলুধ্বনি আর শংখধ্বনি। শংখধ্বনিতে ভাইয়ের জীবন থেকে সকল বালা –মুসিবত দূর হয়ে যায়, ভাইয়ের মুখে একটু তেতো নিমপাতা বা পাটপাতা তুলে দিতে হয়। ভাইকে তেতো মুখে বেশীক্ষণ থাকতে হয়না, সাথে সাথে থালা ভর্তি মিষ্টি খেতে দেয়া হয়। শুধু কী মিষ্টি? মিষ্টির সাথে ভাইকে বোনের পক্ষ থেকে উপহার দেয়া হয়। অবশ্য কোন কিছুই একতরফা হয়না। বোন যেমন ভাইকে দেয়, ভাইও বড় বোনকে প্রনাম শেষে দিদির হাতে উপহার তুলে দেয়। আর বোন যদি বয়সে ছোট হয়, তাহলে বড় ভাইকে প্রনাম করে, ছোট বোনের হাতে উপহার তুলে দিতে ভাইয়ের আনন্দের সীমা থাকেনা। এভাবেই ভাই-বোনের মধ্যে ভালোবাসা ও প্রীতির সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়। এই ছোট্ট আনুষ্ঠানিকতা শেষে পরিবারের সকলে মিলে  আরও বড় পরিসরের আনন্দ-উৎসবে মিলিত হয়। বছরের অন্য দিনগুলোতে খাবারের মান যতই সাধারণ হোক না কেনো, ভাইফোঁটা অনুষ্ঠানে ভাইয়ের পছন্দের খাবার রান্না করা হয়। বোনের যতটুকু সাধ্য, ভাইকে তা উজার করে দিয়ে সুখী হয়। বোনের কাছ থেকে এই পরম মমতামাখানো ভালোবাসা পাওয়ার টানেই ভাইয়েরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে এই দিনটির জন্য।
ঠাকুমা-দিদিমাদের মুখ থেকেই শোনা, ঋকবেদে আছে, মৃত্যুদন্ডদাতা যম ও তাঁর বোন যমুনা হচ্ছে সূর্য্যের যমজ সন্তান, অর্থাৎ তারা যমজ ভাই বোন। বড় হয়ে তারা পরস্পর থেকে অনেক দূরে থাকতেন। দীর্ঘকাল অদর্শনে থেকে বোন যমুনার খুব ইচ্ছে হলো ভাই যমকে একটু দেখার। ভাইকে নিমন্ত্রণ করতেই ভাই যমরাজ বোনের বাড়ীতে এসে উপস্থিত। ভাইকে যথাসাধ্য আপ্যায়ন শেষে ভাইয়ের জন্য মন ব্যাকুল হতেই বোন যমুনা ভাইয়ের সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করে প্রার্থনা করেন, ভাই যমরাজ খুব প্রীত হন বোনের এই আকুলতা দেখে। বোনকে নিশ্চিন্ত করতে বোনের ডাক পেলেই আবার আসার প্রতিশ্রুতি দেন। যমুনা তার ভাইয়ের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে খুশীতে আনন্দাশ্রু ফেলেন। সেই থেকেই ভাইয়ের মঙ্গল কামনা উৎসবের প্রচলন। সেই থেকেই ভাইয়ের কল্যানে অনুষ্ঠিত পরবটি বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন বাঙ্গালীদের মাঝে ভাইফোঁটা, নেপালে ‘ভাই টীকা’ অথবা ভারতের নানা প্রদেশে ‘ভাইদুজ’ নামে পালিত হয়। রাখীবন্দনও ভাইফোঁটার আরেক সংস্করণ।
মানুষ সামাজিক জীব। আমাদের সমাজ তৈরী হয় প্রথমে ঘর থেকে। বাবা-মা, ভাই বোন দিয়ে যে পরিবার শুরু হয়, সেই ছোট পরিবারটিই সময়ের সাথে সাথে আত্মীয়তার বন্ধন  বিস্তৃত করে, ঘর থেকে বেরিয়ে প্রতিবেশী, প্রতিবেশী পেরিয়ে পাড়া, গ্রাম ছাড়িয়ে একদিন সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। যে ভাইয়ের একটি মাত্র বোন ছিল, চলার পথে সে আরও কত বোন, দিদি, আপুর দেখা পায়। যে মেয়েটি শুরুতে একটি ভাইয়ের আদর পেয়ে বড় হচ্ছিল, সেই মেয়েটিই জীবন চলার বাঁকে বাঁকে কত নতুন ভাই, দাদার দেখা পায়। এভাবেই সম্পর্ক বাড়তে থাকে, এবং একসময় অচেনা যে কারো সাথেই ‘ভাই’ বা ‘বোন’ সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায়। ভাই-বোন সম্পর্কে জাত, ধর্ম, গোষ্ঠীর বিভিন্নতা কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এই সম্পর্কে কোন স্বার্থ-দ্বন্দ্ব থাকেনা, ভাই-বোন সম্পর্কে কোন বিরোধ থাকেনা। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় সারা বাংলায় ‘রাখী বন্ধন’ উৎসব হয়েছিল। কবিগুরু কোন আন্দোলনে সরাসরি যোগ না দিলেও ‘রাখীবন্ধন’ উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। সেদিন হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, শিখ, মারাঠির মধ্যে কোন ভেদাভেদ ছিল না। সকলেই ভাই, প্রতিটি ঘরে ঘরে ছিল স্নেহময়ী বোন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়, কত অচেনা মায়ের ছেলেকে ‘ভাইয়ের স্নেহে’ শত্রুর আড়ালে রাখার চেষ্টা করেছে বাংলার বোনেরা। এভাবেই যুগে যুগে ভাই-বোনের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়েছে। ভাই বাইরে যতই প্রভাবশালী হোক, বোনের কাছে এলেই শিশু হয়ে যায়, বোন বয়সে বড়ই হোক অথবা ছোট হোক, মায়ের পরেই স্নেহময়ীর পদটি তার দখলে চলে যায়। ভাইয়ের কল্যান কামনায় বোন সবসময় ঈশ্বরের কাছে তার দুই হাত তুলে রাখে।

Tuesday, November 13, 2012

.দিওয়ালী বা দীপাবলীঃ আলোকেরই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও!


পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি দেশে, হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে মহা সমারোহে উদযাপিত হচ্ছে আলোক উৎসব ‘দিওয়ালী’ বা দীপাবলী। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসেবমতে অক্টোবারের মাঝামাঝি  থেকে নভেম্বারের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই তিথি অনুযায়ী ‘দিওয়ালী’ উদযাপিত হয়ে থাকে। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ‘দিওয়ালী’ ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, মরিশাস, গায়ানা, ত্রিনিনাদ, সুরিনাম, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ফিজিতে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে ঘোষিত। যদিও বলা হয়ে থাকে, দিওয়ালী হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব, কিনতু অন্য সম্প্রদায় যেমন, শিখ, জৈন, আর্য সমাজ, বৌদ্ধরাও ‘দিওয়ালী’ উদযাপন করে। ফলে প্রতি বছর অক্টোবার-নভেম্বারের মাঝামাঝি সময়ে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকায় আলোক উৎসব দিওয়ালী উদযাপিত হয়ে থাকে।  

দিওয়ালী মুলতঃ হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব হলেও, আলোকের পূণ্যশিখার ব্যাপ্তি শুধুমাত্র হিন্দুদের ঘরে আটকে থাকেনা। আলোক উৎসবের আলোকচ্ছটায় প্রতিটি মানুষের জীবন থেকে সকল অন্ধকার দূর হয়ে যায়, সকল অশুভ পালিয়ে যায়। এই হচ্ছে দিওয়ালী উৎসবের মূল বার্তা। প্রদীপের মালা অথবা ‘রো অব লাইট’ থেকেই ‘দিওয়ালী’ নামকরণ হয়েছে। দিওয়ালীর সন্ধ্যায় প্রতিটি বাড়ীর চারদিক ঘিরে সারি সারি মাটির প্রদীপ জ্বালানো হয়ে থাকে, যা সারারাত জ্বালিয়ে রাখা হয়। প্রদীপ জ্বালিয়ে সমস্ত অন্ধকার এবং অশুভকে বিদায় করে ধনলক্ষ্মী দেবীকে আবাহন করা হয়। লক্ষ্মী দেবী প্রদীপের আলোতে পথ চিনে গৃহীর ঘরে প্রবেশ করেন এবং সংসারের আসনে অধিষ্ঠিত হন। দিওয়ালী সন্ধ্যায় খুব ধুমধাম করে বাজী পোড়ানো হয়। পটাস পটাস করে বাজী পোড়ে, বিশ্বাস করা হয়, বাজী ফুটার আওয়াজে ভয় পেয়ে আশপাশে ওঁত পেতে বসে থাকা সকল বিপদ-আপদ, অসুর-শয়তানেরা দৌড়ে পালায়। এই উৎসব উপলক্ষে সকলেই নতুন জামা-কাপড় পরে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে, ছেলে-বুড়ো সকলে মিলে বাজী পোড়ায়, বাজী পোড়ানো শেষে পরিবার, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে সকলেই মিষ্টিমুখ করে।

‘দিওয়ালী’র সাথে জড়িয়ে থাকা বিশ্বাসঃ

১) অনেকেই বিশ্বাস করেন, ত্রেতাযুগে ১৪ বছরের বনবাস কাটিয়ে এই দিনে শ্রীরামচন্দ্র অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তণ করেন। শ্রী রামচন্দ্রের প্রত্যাবর্তণকে স্বাগত জানাতে ২০ সারিতে প্রদীপ জ্বালানো হয়, এবং প্রতিবছর দিবসটি রামচন্দ্রের প্রত্যাবর্তণ দিবস হিসেবে পালিত হয়। আবার অনেকের মতে, মহাভারতের পঞ্চপান্ডব ১২ বছরের বনবাস ও এক বছরের অজ্ঞাতবাস শেষে ফিরে এসেছিলেন নিজ গৃহে, এই দিনে। অন্ধকার গৃহ আবার আলোকিত হয়।

২)নরকাসুর বধঃ অনেকের বিশ্বাস, দ্বাপর যুগে গ্রামবাসীদের সাথে নরকাসুরের যুদ্ধ বাঁধে, যুদ্ধের এক পর্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে তাঁর স্ত্রী সত্যভামা দেবী নরকাসুরকে হত্যা করেন। গ্রামবাসী জয়ী হয়, নরকাসুরের মৃত্যুতে সকলের মাঝে শান্তি ফিরে আসে। ঘরে ঘরে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো হয় এবং সেই থেকে দিওয়ালী উদযাপিত হয় নরকা চতুর্দশীতে।  

৩) শিখ ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, ষষ্ঠ গুরু ‘গুরু হরগোবিন্দ সিং’ কারামুক্ত হয়েছিলেন এই দিনে। মহা সমারোহে তারা দিওয়ালী উদযাপন করে। পাঞ্জাবের অধিকাংশ শিখ পরিবারে সারাদিন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ‘গুরুগ্রন্থসাহিব’ পাঠ করা হয়, এই পবিত্র দিনে সকলে নিরামিষ খায়। সন্ধ্যায় যথারীতি আলোর মালায় সাজায় ঘর-বাড়ী, গুরুদুয়ারা। বাতাসে বাজী ছুঁড়ে দেয়, যার সরল অর্থ হচ্ছে, ‘ফ্রীডম’।

৪) বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনেকেই দিওয়ালী উদযাপন করে। তারা দিনটিকে ‘অশোক বিজয়াদশমী’ হিসেবেও গণ্য করে থাকে। তাদের বিশ্বাস, এই দিনে সম্রাট অশোক সকলকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিতে আহবান জানিয়েছিলেন।

৫) আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ দেহত্যাগ করেন ১৮৮৩ সালের ৩০ অক্টোবার। সেই থেকে আর্য সমাজে দিওয়ালী উদযাপিত হয় ‘স্বামী দয়ানন্দ প্রভুর মৃত্যুবার্ষিকী’ হিসেবে। পূণ্য এই দিনে সকলে প্রার্থণা করে, সন্ধ্যায় মঙ্গলালোক জ্বালায়।

৬) বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মিথীলার হিন্দু সম্প্রদায় দিওয়ালী উদযাপন করে ভিন্ন নামে, ভিন্ন আঙ্গিকে। দুর্গাপূজার ঠিক দুই সপ্তাহ পরেই অনুষ্ঠিত হয় কালীপূজা বা শ্যামাপূজা, যার আরেক নাম ‘দীপাবলী’। কালীপূজা হয় অমাবস্যা তিথিতে এবং মাঝরাতে। পূজার সন্ধ্যায় প্রতিটি বাড়ী সেজে উঠে সারি সারি মাটির প্রদীপের স্নিগ্ধ আলোয়। শহরে-নগরে মাটির প্রদীপের পরিবর্তে জ্বালানো হয় রঙ বেরঙের মোমবাতি। ধর্মীয় বিশ্বাস, দীপাবলীর সন্ধ্যায় ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে পূর্বপুরুষদেরকে আলো দেখানো হয়। বাঙ্গালী হিন্দুরাও রাতভর বাজী পোড়ায়, একই ঊদ্দেশ্যে, বাজী পোড়ার শব্দে সকল অশুভ শক্তি যেনো দূরে পালিয়ে যায়।

ছোটবেলায় আমরাও কত আনন্দ-উদ্দীপনা নিয়ে বাজী পোড়াতাম! বাজীর নামও ছিল কত বিচিত্র। আতশ বাজী থেকে শুরু করে মাতাব বাজী, মরিচ বাজী, কাঠি বাজী, ডিল্লা পটাশ, মালা বাজী, ব্যাং বাজী, সাপ বাজী, ফুলঝুরি, আরও কত নামের বাজী যে পাওয়া যেত! এখন হয়ত পুরানো নামের বাজীর পাশাপাশি আরও কত নতুন নামের বাজীর চল হয়েছে। ছোটবেলা পেরিয়ে এসেছি সেই কবে, কোনকালে। সংসারের প্রয়োজনে, জীবনের তাগিদে ঘুরে বেড়িয়েছি দেশ থেকে দেশান্তরে। যে দেশেই থেকেছি, যেখানেই থেকেছি, প্রতি বছরে দিওয়ালী উদযাপন করেছি। দিওয়ালীর ভাবার্থ নিয়ে ভাবিনি, বাচ্চাদের সাথে বাজী পোড়ানোতেই বেশী আনন্দ পেয়েছি। প্রবাসে বাজী পোড়ানোর ধুম লেগে যায়। ধনী দেশে কত রকমের সুবিধা, তারা জাতীয় উৎসবে 'ফায়ারওয়ার্ক' করে থাকে, সেই ফায়ারওয়ার্কে কী সব চোখ ধাঁধানো বাজী পোড়ানো হয়, এগুলো দেখে আমার মনে পড়ে যায়, ছোটবেলায় তিন পয়সায় কেনা একটি কাঠি বাজী হাতে পেলেই আনন্দে আটখানা হয়ে যেতাম। তারাবাতি হাতে নিয়ে ঘুরতাম, জ্বালালেই শেষ হয়ে যাবে, এই ভয়ে জ্বালাতামনা। আর আমার বাচ্চারা 'তারাবাতি'র দিকে ফিরেও তাকায়না। আকাশের বুকে নানা বর্ণের, নানা ডিজাইনের বাজী ফুটতে দেখেই ওদের আনন্দ, তারাবাতি'কে ওরা বলে 'দুধভাত'। বাজী পোড়ানো শেষে সবাই মিলে মিষ্টিমুখ করা হয়, সেই মিষ্টিও কত বাহারের মিষ্টি। এ সবই করা হয় মহা ধুমধামের সাথে।



মূল ভাবঃ

দিওয়ালী বা দীপাবলী উৎসব মূলতঃ ‘ফেস্টিভ্যাল অব লাইট’ নামে পরিচিত হলেও, ধর্মীয় দিক বিবেচনায় দিওয়ালীর মূল অর্থ হচ্ছে, ‘অন্তরের আলো’ বা আত্মার উজ্জ্বলতা। হিন্দু দর্শনের মূল কথাই হচ্ছে, দেহ ও মনের আড়ালে যা থাকে, তার নাম অন্তর বা আত্মা, যা  অসীম, অবিনশ্বর, এবং বিশুদ্ধ। সেই অন্তরের আলো জ্বালতে পারলেই শুভবুদ্ধির জয় হয়, অশুভ শক্তি পরাজিত হয়। মূর্খতা, অজ্ঞতা, হিংসা, ঈর্ষা, দ্বেষ, লোভ, অহঙ্কার, চৌর্য্যবৃত্তির মত অন্ধকারে যখন ঢাকা থাকে মানুষের অন্তর, তখনই মানুষের নৈতিক স্খলন ঘটে, হানাহানি, মারামারি, যুদ্ধ, ঝগড়া-বিবাদে মানুষ লিপ্ত হয়। এ সকল অশুভ রিপুর তাড়নে মানুষের প্রকৃত অন্তর আড়ালে থেকে যায়। এই সমস্ত অশুভ আড়াল কেটে যখন মানুষের বিবেক জাগ্রত হয়, তখনই সত্যের জয় হয়। মানুষ তার নিজের আত্মাকে খুঁজে পায়, অজ্ঞতা কেটে জ্ঞানের বিকাশ ঘটে, জ্ঞান বিকাশের এই অনুভূতির আরেক নাম আনন্দ বা শান্তি। যদিও গোষ্ঠী, জাতি, বর্ণ, স্থান বিশেষে ‘দিওয়ালী’ বিভিন্ন আঙ্গিকে উদযাপিত হয়, উৎসবের মূলবাণী এক—অন্তরের আলোয় দেখা, অন্তরের আলোকে দেখা।


শেষ কথাঃ

দিওয়ালীর আলোতে সকল কালিমা দূর হয়ে যাওয়ার কথা, বাজী ফুটার আওয়াজে সকল অশুভ শক্তি, দৈত্য-দানব, অসুর, প্রেতাত্মাদের ছুটে পালিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু চারদিকে যখন বিষাক্ত নাগিনীর ফোঁসফোঁসানি শুনি, প্রতিদিনের খবরের কাগজ হাতে নিয়ে ভায়ে ভায়ে, স্বামী-স্ত্রীতে, প্রতিবেশী-প্রতিবেশীতে হানাহানি, খুনোখুনি, ঝগড়া, বাদ-বিসম্বাদের সংবাদ পড়ি, মন খারাপ হয়। আমার মনের চিন্তাপোকা গুলো আমাকে কুরে কুরে খায়। তবে কি, দিওয়ালীর প্রদীপের আলো মানুষের অন্তরে পৌঁছে না! আজ থেকে কত বছর আগেই তো কবিগুরু গেয়েছিলেন,

"আজ নিখিলের আনন্দধারায় ধুইয়ে দাও
মনের কোনের সব দীনতা, মলিনতা ধুইয়ে দাও
আমার পরানবীণায় ঘুমিয়ে আছে অমৃত গান
তার নাই-কো বাণী, নাই-কো ছন্দ, নাই-কো তান
তারে আনন্দের এই জাগরনে ছুঁইয়ে দাও----------"


আগে মাটির প্রদীপ জ্বলতো, কাঠিবাজি, তারাবাতি পুড়তো, সবশেষে হাতে দু'খানা নারকোলের নাড়ু বা ক্ষীরের সন্দেশ পাওয়া যেত মিষ্টিমুখ করার জন্য। কালে কালে, যুগে যুগে মানুষের শণৈঃ শণৈঃ উন্নতি হয়েছে, চোখ ধাঁধানো জৌলুস, ধন-রত্নের ঝনঝনানি বেড়েছে, মাটির প্রদীপের স্থলে আকাশ আলোকিত বাজী পুড়ছে, কিনতু মনের উন্নতি হচ্ছেনা কেন? এত ঝলমলে আলোর রোশনাই চারদিকে, তবুও কেন আমাদের অন্তরের আলো জ্বলে না, চারদিকের আলোর ঝলকানিতে এক মাইল দূরের বস্তুও নজরে আসে, নজরে আসেনা শুধু বুকের গহীনে চুপটি করে বসে থাকা 'আত্মা'টিকে। সময় এসেছে অন্তরের আলো জ্বালাবার, সময় এসেছে চোখ খুলে নিজেকে দেখার, নাহলে বছরের বারোমাস আলোক উৎসব করেও কোন লাভ হবে না।

Monday, November 12, 2012

নিজের কাছেই কৈফিয়ত!

আমাকে  প্রায়ই  একটি  প্রশ্নের  সম্মুখীন হতে হচ্ছে,   " তুমি/আপনি তো  সারাক্ষন   ফেসবুক  আর  ব্লগ  নিয়ে  মেতে  থাকো/থাকেন।  রান্না-খাওয়া  কখন  করো/করেন"?  প্রশ্নের উত্তর দেই না, ভেতরে ভেতরে চাপা অস্বস্তি বোধ করি, কিনতু মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখি। তবে আমিও মানুষ, মাঝে মধ্যে একটু আধটু রাগ-অভিমান হয় না, তা বলি কী করে!  এটা তো সত্যি, দিন-রাতের অনেকটা সময় আমি অনলাইনে থাকি। ব্লগ ছাড়াও 'বাংলাদেশ প্রতিদিন' নামের দৈনিকটিতে মাসে দুই তিনটি লেখা পাঠাই। যে কোন বিষয়ের উপর লেখার আগে, উইকিপিডিয়াতে একটু পড়ে নিতেই হয়, না পড়ে  আন্দাজে লিখে দেয়ার মত জ্ঞান বা সাহস, ইহজীবনে হবে না, তাই আমাকে পড়ার জন্যও অনলাইনে থাকতে হয়। যারা আমাকে অনলাইন দেখে, তাদের মনেই প্রশ্ন জাগে, এই ভদ্রমহিলার কি খেয়ে দেয়ে আর কোন কাজ নেই, সারাক্ষণ ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকে। কখনও এসকল প্রশ্ন শুনে দেন-দরবার করিনি, কিনতু আজই কেনো যে মনে হলো, দেখিতো সারাদিনের হিসেব করে, কোথাও কোন ভুল ত্রুটি থেকে যাচ্ছে কিনা!


আজ  আমার  ওয়ালমার্টের  কাজের  শিডিউল  ছিল  সকাল  ৯:৩০  থেকে  বিকেল  ৫:৩০  পর্যন্ত।

আমি  গতরাত  ৩টায়  ঘুমাতে  গেছি,  আজ  সকাল  ৮টায়  ঘুম  থেকে  উঠেছি।  ঘর-দুয়ার  ঝাঁট-পাট  দিয়ে,  বিছানা  গুছিয়ে  টুছিয়ে  নিজে  ফ্রেশ  হয়ে  কিচেনে  ঢুকেছি।  সোমবার  আমাদের   ভেজিটেরিয়ান  ফুড  ডে,  নো  আমিশ।  পেঁয়াজও  খাইনা,  কঠিন  নিয়ম  পালন  করি।  সোমবার  উত্তম  কুমারের  ল্যাব  থাকেনা,  দুপুরে  সরাসরি  বাড়ী  এসে  লাঞ্চ  করে।  ঝট  করে  নুডলস  রান্না  করে  ফেললাম।  ডিম  ছাড়া,  পেঁয়াজ  ছাড়া  নুডলস?  ওকে!   আমার  নিজের  তৈরী  নিয়ম  নিজ  দায়িত্বে  একটু  শিথীল  করলাম,  পেঁয়াজ  ব্যবহার  করলাম রান্নায়।  অন্য  কোন  সব্জী  ছিলনা,  শুধু  বাঁধাকপি  কুচিয়ে,  পেঁয়াজ  কুচি,  ধনে  পাতা  কুচি,  গোলমরিচ  থেঁতো,  কাঁচামরিচ কুচি  দিয়ে  অতি  সুস্বাদু  নুডলস  করে  ফেললাম।  সুস্বাদু  বললাম  নিজ  দায়িত্বেই,  রান্না  খেতে  ভাল  না  হলে,  আমি  নিজেকেও  ক্ষমা  করিনা।  চুলা  নিবিয়ে,  দরজা  জানালা  চেক  করে  গাড়ীতে  গিয়ে  উঠে  দেখি  ৯:২৯।  ওয়ালমার্টে  পৌঁছে  ক্লক-ইন  করেছি  ৯:৩৯।

দুই  ঘন্টা  পর  টী  ব্রেকে  সুনীলের  উপন্যাস  সমগ্র  খুলে  বসে  নুডলস  খেলাম  আর  অসমাপ্ত  উপন্যাস  গোগ্রাসে  গিললাম।  এরই  ফাঁকে  ভাবতে  লাগলাম,  রাতের  রান্না  কখন  করবো।  আজতো  নিরামিষ,  তিন  আইটেমের  কম  খেতে  দেই  কী  করে!  উপন্যাস  পড়তে  পড়তেই  ঠিক  করলাম,  আজ  রান্না  হবে  'মুগের  ডাল,  মিষ্টি  কুমড়ো  টুকরো  করে  দেবো,  সাথে  দুই  একটা  ঝিঙ্গেও  টুকরো  করে  দিতে  হবে।  ঘি,  কাঁচামরিচ  দিয়ে  রান্না  করলে  'অমৃত'!  টী  ব্রেক  শেষ  হতেই  কাজে  ফেরা।  আরও  দুই  ঘন্টা  পরে  'ওয়ান   আওয়ার'  লাঞ্চ  ব্রেক।  সাত  বছর  হয়ে  গেলো আমার  ওয়ালমার্ট  জীবন।  লাঞ্চ  ব্রেকে  আমি  কখনওই  বাড়ী  যেতাম না,  রসিয়ে  রসিয়ে  গল্পের  বই  পড়তাম,  ব্রেক রুমে  বসে।  আমাকে  সবাই  ' বুক ওয়ার্ম'  ডাকে,  শুনতে  খারাপ  লাগে না।  সেই  আমি  গত  কয়েক মাস  হয়ে  গেল,  লাঞ্চ  ব্রেকে  বাড়ী  ফিরে  আসি,  এক  ঘন্টার  ব্রেক,  আসতে ১০ মিনিট,  যেতে  ১০  মিনিট,  বাড়ীতে  থাকি  মাত্র  ৪০  মিনিট।  কী  করি?  ফেসবুকে  বসে  যাই,  আর  কিছু  না  পারি,  স্ট্যাটাস  আপডেট  করি,  দুই  একজনের  মেসেজের  উত্তর  দেই।  ব্লগগুলো  ঘুরে  দেখি।  কম্পিউটার  অন  করে  ইন্টারনেট  কানেকশান  পেয়ে  ফেস বুকে  যেতেও  খরচ  হয়  ৫  মিনিট,  অফ  করতে  ৩  মিনিট।  আমি  হাতে  পাই  সর্বমোট  ৩২  মিনিট।

দুই  তিনদিন  হয়ে  গেল,  লাঞ্চ  ব্রেকে  বাড়ি  ফিরি না,  সুনীলে  মজে  থাকি।  আজ  ফিরেছিলাম,  রাতের  রান্না  এগিয়ে  রাখবো  বলে।  বাড়ী  ফিরে  হিসেবের  ৩২  মিনিটের  মধ্যেই  'কাঁচা  মুগ'  লোহার  তাওয়ায়  অল্প তাপে  ভাজলাম( কাঁচা  মুগের  ডালে  মুগের  গন্ধ  থাকেনা,  গন্ধহীন  ডাল  খেতে  হলে  কাঁচা  মুগ  খাওয়া  ভাল)।  ততক্ষনে  দ্বিতীয়  আইটেম  কী  হবে,  তা  সিদ্ধান্ত  নিয়ে  ফেলেছি।  আলু,  ফুলকপির  ডালনা।  ছুটির  পরে  বাড়ী  ফিরেই  যেনো ঝটাপট  আলু, কপি  কাটা  শুরু  করতে  পারি,  তারজন্যই  রেফ্রিজারেটরের  ভেতরে  রাখা  ফুলকপিটা  বাইরে  রেখে  দিয়ে  গেছি,  আলুর  ব্যাগ  অবশ্য  বাইরেই  থাকে।

কাজে  ফিরে  গেছি  সময়মতই।  দেড়ঘন্টা  পরেই  পেলাম  লাস্ট  টী  ব্রেক।  আগামীকাল  মঙ্গলবার,  অফ ডে  পেয়েছি,  মাসে  একটা  ব্রত  করি,  শনি বা  মঙ্গলবার  ধরে  করতে  হয়  ব্রতটি।  এই  ব্রত  উদযাপন  করতে  'আনারস' হলে  ভালো  হয়,  সাথে  কলা,  কিসমিস।  মঙ্গলবার  যখন  অফ  পেয়েই  গেছি,  অবশ্যই  ব্রত পূজো  করবো।  ব্রেক  টাইমেই  টুকিটাকি  কেনাকাটা  করে  ফেললাম।  ( ওয়ালমার্ট  সুপার  সেন্টারে  'মানুষ'  বাদ  দিয়ে,  সবকিছুই  বিক্রী  হয়)।  ঘড়িতে  দেখি  মিনিট  পাঁচ  এখনও  হাতে  আছে।  সুনীল  নিয়ে  বসলাম,  পাঁচ  মিনিটের  জায়গায়  দশ  মিনিট  নিয়ে  নিলাম  বাপ্পাদিত্য  আর  মুন্নীর  কী  হলো  জানার  জন্য।  এরপরেই  দে  ছুট,  বাড়ীর  দিকে।

বাড়ী  ফিরে  কর্তা বা  কন্যাটিকে  পাওয়া  গেলোনা,  উনারা  গেছেন  পিয়ানো  টিচারের  বাড়ী,  বাইরে  অন্ধকার  রাত,  ঘরে  আমি  একা,  আর  কী  লাগে!  ভুতের  ভয়ে  আমি  সব  সময়  কাঁটা  হয়ে  থাকি,  বসে  রইলাম  দরজার  কাছেই  চেয়ার  টেনে।  যদি  ভুত  আসে  দরজা  খুলে  দৌড়  দেবো  বলে।  দরজা  লক  করিনি,  সেজন্য।  পিয়ানো  টিচারের  বাড়ী  কয়েক  ব্লক  দূরে।  ১৫  মিনিটের  মধ্যেই  বাবা-কন্যা  ঘরে  ফিরেছে,  আমিও  চুলায়  ডাল  চাপিয়ে  দিয়েছি।  চার  বার্ণারের  চুলা,  আমি  ব্যবহার  করি  দুই  বার্ণার।  এক  বার্ণারে  ডাল  বসিয়ে  আরেক  বার্নারে  ফ্রাইপ্যান  চাপিয়ে চিন্তা  করলাম,  তিন  নাম্বার  আইটেম  কী  হতে  পারে!  সাথে  সাথে  সিদ্ধান্ত  নিলাম,  ভেজিটেরিয়ান  ডে'তে  একটু  শাক  না  খেলে  চলে!  আমাদের  দেশে  রাতের  বেলা  শাক  খেতে  মানা  করে,  বদ হজম  হতে  পারে  ভয়ে।  আমরা  এখানে  ভাত  খাই  রাতে,  ভাতের  সাথেই  শাক  যায়  ভাল,  আমি  রুটির  সাথে  মরে  গেলেও  শাক  খাব না।  তাই  ফ্রোজেন  শাক  রান্না  করে  ফেললাম।  চুলায়  শাক  হচ্ছিল,  আমি  এই  ফাঁকে  আলু,  ফুলকপি  কেটে  রেডি  করে ফেলেছি।  কাঁচামরিচের  এক  বিরাট  পোঁটলাতে  মরিচগুলো  ভিজে  উঠছিল,  সবগুলো  মরিচের  বোঁটা  ফেলে  না  রাখলে  পচে  যাবে।  এক চুলায় ডাল ফুটে, আরেক  চুলায়  আলু  ফুলকপির  ডালনা  ফুটে।  আমি  কাঁচামরিচের  বোটাগুলো  ফেলে  কিচেন  টাওয়েলে  জড়িয়ে  ভাল  করে  শুকিয়ে  ঝরঝরে  করে  ফেললাম।  মিষ্টি  কুমড়ো  আর  ঝিঙ্গে  টুকরো  করে  রেখেছিলাম  এক  ফাঁকে।  ডাল  সেদ্ধ  হতেই  ঘুটনি  দিয়ে  দিলাম  এক  ঘুটা।  ব্যস!  এবার  কুমড়ো,  ঝিঙ্গে  টুকরো  ছেড়ে  দিলাম  ডালের  ভেতর।  একটু  নরম  হতেই  শুকনো  লঙ্কা আর জিরে ফোড়ন দিয়ে  ডাল  সম্বার দিলাম।  কাঁচামরিচ , দুই চামচ ঘি দিয়েই ডালের চুলা অফ করে দিলাম।  সময়  বাঁচানোর জন্য  ফাঁকে ফাঁকে  ন্যাকরা ভিজিয়ে চুলার চারধার মুছে পরিষ্কার করে ফেলেছি, বেসিনে জমে থাকা বাসন-কোসন মেজে ধুয়ে ফেলেছি।  এই যে  কাজ  করছিলাম,  এরই  ফাঁকে  ফাঁকে  কিনতু  আমি  লেখার  প্লট নিয়েও ভাবছিলাম।  আজ ছিল ভেটের‌্যান'স ডে,  আগামীকাল  প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিন, গল্প কবিতা ডট কমে এ মাসের গল্প লিখে জমা দিতে হবে, এর সাথে সাথে ফেসবুকে স্ট্যাটাসও লিখতে হবে।  সবকিছু নিয়েই ভাবছিলাম।

বাড়ী  ফিরেছিলাম  সন্ধ্যে  ছ'টায়, রান্না শুরু  করেছি  সোয়া  ছ'টায় , রান্না-বান্না শেষ  করেছি  সাড়ে  সাতটায় ( বাসন মাজা, ঘর  পরিষ্কারসহ)।  সারাদিন  মনের  মধ্যে একটু কষ্ট ছিল,  মেয়েটাকে  কালকে অনেক বকেছিলাম,  আমাকে  ফোন করে না বলে, মনকে  সান্ত্বণা দিচ্ছিলাম,  বকেছি ভাল করেছি, নাহলে শিখবে কিভাবে, তারপরেও মন মানে না, আমার মেয়েকে আমি জানি, এই মেয়েটি অন্য ঘরানার, সংসারের কুটকচাল বোঝেনা, নিজেও কারো উপর রাগ বা অভিমান করেনা, অন্যের রাগ-অভিমানের খবরও রাখেনা। আমার এই ভাল মেয়েটাকে বকে কী শান্তিতে থাকতে পারি! ফোন করলাম, হসপিটালে ডিউটিতে ছিল, ফোন ধরতে পারেনি, পরে এক ফাঁকে কল ব্যাক করেছে। মেয়েকে সরি বললাম, নিজের বুকটা হালকা হলো, মেয়েও পালটা বললো, কোন অসুবিধে নেই, মনের ভেতর চেপে থাকা কথা বলে দিয়ে নাকি ভালই করেছি।

আমার কাজ শেষ, এখন আমি ফেসবুকে বসতেই পারি।  মিথীলা সময়মত ভাত রান্না করবে, তার বাবার জন্য শসা কেটে রাখবে ( উত্তম কুমার যে কোন খাবারের সাথে শসা খেতে ভালোবাসে)। রাত পৌণে আটটায় ফেসবুকে বসেই মনে হলো, আজকের সারাদিনের হিসেব লিখে ফেলি।  ভেবেছিলাম, চার পাঁচ লাইনের স্ট্যাটাসে লিখে দেবো, 'যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে", এখন দেখছি, পাঁচ লাইন গিয়ে দাঁড়িয়েছে পঞ্চাশ লাইনে। এখানেই আমার উত্তর দেয়া হয়ে গেলো, ফেসবুকে বসে আমি কী করি!  পাঁচ লাইনের জায়গায় পঞ্চাশ লাইন লিখতে গেলেতো পাঁচ মিনিটের বদলে পঞ্চাশ মিনিট লেগে যাবেই। তবে, যারা প্রশ্ন করে, তাদেরকে উত্তর দেয়া যায়, কিনতু যারা প্রশ্ন করে না, অথচ ঠারেঠোরে বলার চেষ্টা করে, " ওরে বাবা! ফেসবুকে আমি নাই, ভীষন  বাজে  নেশা,  অযথা সময় নষ্ট,  কাজকর্ম বাদ দিয়ে ফেসবুক  নিয়ে বসে থাকার মত এনার্জী নেই,  সংসারে আরও কতকিছু করার আছে! "  এ ধরণের মন্তব্য শুনে গা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করি, তবে মাঝে মাঝে একটু আধটু বিচলিতও হই। অবশ্য  ক্ষণিক বাদেই সব ভুলে যাই, পরবর্তী লেখার টপিক মাথায় ঘুরতে থাকে।  যেহেতু আগামীকাল আমার অফ ডে, আজকের মধ্যে দুই তিনটি লেখা আমাকে শেষ  করতে  হবে।  খুব কঠিন কিছু মনে হচ্ছে না। ফেসবুক হয়তো অনেকের জীবনে কুফল বয়ে এনেছে, আনবে, আমার জীবনেও যে কিছু কিছু কুফল বয়ে আনেনি, তা নয়, তবে এই ফেসবুকের কল্যানেই আমি পেয়ে গেছি আমার স্বপ্নলোকের চাবি!

Thursday, November 8, 2012

আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনঃ কাছ থেকে দেখা



আমেরিকার ৫৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ হয়ে গেল, জনগনের ভোটেই  বারাক ওবামা দ্বিতীয়বারের মত প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। মিট রমনি পরাজিত হয়েছেন ওবামার জনপ্রিয়তার কাছে। অবশ্য ওবামা এবং রমনি ছাড়াও আরও দুই তিনজন প্রার্থী ছিলেন এই লড়াইয়ে, তবে তাঁদের কথা ভোটারদের কারো মাথাতেই ছিল না। 

আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়, কিনতু এর প্রভাব পড়ে বিশ্বের উন্নত-অনুন্নত সকল দেশে। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। সকলের চোখ ছিল ৬ই নভেম্বারের দিকে। কে হবে আমেরিকার ৫৭তম প্রেসিডেন্ট! বারাক ওবামা দ্বিতীয়বারের মত প্রেসিডেন্ট হতে পারবে তো? এই নিয়ে জল্পনা কল্পনা চারিদিকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমেরিকার সাধারন জনগনের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে তেমন কোন তাপ উত্তাপ লক্ষ্য করা যায় নি। এমনও হতে পারে আমেরিকানরা অভিব্যক্তিশূণ্য অথবা নিজের বিশ্বাস, নিজের অভিব্যক্তি অন্য সকলের কাছ থেকে আড়াল করে রাখার মন্ত্র  জানে।  ৬ই নভেম্বার আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট ইলেকশান হলো, সকলের অধীর অপেক্ষার কালও যেনো শেষ হয়ে গেলো। বারাক ওবামা দ্বিতীয়বারের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন । ওবামা শিবিরে আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে, আর ওবামা বিরোধী শিবিরে নিশ্চয়ই হতাশা নেমে এসেছে। হিসেব নিকেশ শুরু হয়ে গেছে, রমনির পরাজয়ের পেছনে কী কী কারন ছিল, অথবা  রাজনৈতিক বিশ্লেষকগনও  বিচার বিশ্লেষণ করবেন, কেন এবং কিভাবে ওবামা জয়ী হলেন। 

২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এবারই প্রথম  বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারলাম। শুধু ভোট দেওয়াই নয়,  একই সাথে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের ভোটগ্রহণ কিভাবে সম্পন্ন করা হয়, তা নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করলাম। যদিও মিসিসিপির মত খুবই ছোট্ট এক রাজ্যে নির্বাচন প্রত্যক্ষ করে আমেরিকার পুরো চিত্র আন্দাজ করা যাবেনা, তারপরেও ভোটগ্রহন পদ্ধতি অথবা ভোটারদের মন মানসিকতা তো সর্বত্রই এক হওয়ার কথা। পার্থক্য থাকার কথা শুধুমাত্র ভোটার সংখ্যায়। ছোট রাজ্যে ইলেক্টোরেল ভোটের সংখ্যা কম, বড় রাজ্যে অনেক বেশী। এছাড়া আর তো কোন তফাৎ দেখা যায় না।  এতকাল পত্রপত্রিকায় শুধুই পড়ে গেছি, আমেরিকার কোন কোন রাজ্যগুলো রিপাবলিকান, কোনগুলো ডেমোক্র্যাট। এবারই প্রথম রিপাবলিকানদের রাজ্য মিসিসিপি থেকে ভোট দিলাম। আমাদের বাংলাদেশের সকলেই ডেমোক্র্যাট ওবামার সমর্থক। আমার পরিবারেও এর প্রভাব আছে। কিনতু এই প্রথম অভিজ্ঞতা হলো, নির্বাচনে চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে কোন রেষারেষি বা হানাহানি নেই। প্রত্যেকের স্বাধীনতা আছে যার যার প্রার্থীকে সমর্থণ করা।

আমি  মিসিসিপিতে আছি গত আট বছর যাবৎ। মিসিসিপি আমেরিকার দক্ষিণী রাজ্যগুলোর একটি। দক্ষিণী রাজ্যে কালো জনগোষ্ঠির আধিক্য বেশী। যদিও বলা হয় কালো জনগোষ্ঠীর সকলেই মোটামুটিভাবে ডেমোক্র্যাট পন্থী, তারপরেও দক্ষিণী রাজ্যগুলো থেকে রিপাবলিকান প্রার্থীরাই জয়ী হয়।  পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯৮০ সাল থেকে মিসিসিপি রাজ্যে রিপাবলিকান প্রার্থীরাই জয়ী হয়। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনি পেয়েছেন মিসিসিপি রাজ্যের ছয়টি ইলেকটোর‌্যাল ভোট। ওবামা সাহেবের ভাগ্য ভাল বলতে হবে, মিসিসিপির ইলেকটোর‌্যাল ভোট মাত্র ছয়টি, যা তাঁর বিজয় নির্ধারনে কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি।

নির্বাচন শেষ, ফলাফল ঘোষণাও শেষ। পেছনের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, যদিও মিসিসিপি থেকে রিপাবলিকান প্রার্থী বেশী ভোট পেয়েছে, তারপরেও ওবামার জন্য ক্যাম্পেইন হয়েছিল খুব জোরেশোরে। ক্যাম্পেইনের ঘটা দেখে ধারনা করেছিলাম, এবার বোধ হয় ওবামার ভাগ্যে মিসিসিপির শিকা ছিঁড়বে! ভোটের দিন যত এগিয়ে আসে, আমার উত্তেজনা তত বাড়ে। জীবনে প্রথমবার ভোট দিতে যাচ্ছি, তাও আবার আমেরিকায়, কী জানি কত হুলুস্থুলু ব্যাপারই না ঘটতে যাচ্ছে! এক মাস আগেই আমাদের ভোটার রেজিস্ট্রেশান করা হয়ে গেছে। বাকী ছিল, ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে আসা।

আমাদের দেশে নির্বাচন মানেই উৎসব চারিদিকে, স্বাভাবিক কাজ কর্ম বন্ধ, অফিস কাচারী, স্কুল-কলেজ বন্ধ, হাটে-বাজারে  ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ। বিপরীতে আমেরিকায় জীবন স্বাভাবিক গতিতে চলে, স্কুল কলেজ, অফিস কাচারী ঠিক মতই চলে।  'ভোট দেয়া নাগরিক দায়িত্ব' এবং কাজের এক ফাঁকে একটু সময় বের করে সকলেই গিয়ে ভোটটা দিয়ে আসে। মিসিসিপিতে  ভোট গ্রহন শুরু হয়েছে সকাল সাতটায়, চলেছে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। ভোটকেন্দ্র স্থাপণ করতে গিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হয় নি।  অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধীনে রিক্রিয়েশান সেন্টার থাকে, সেগুলোকেই ভোটকেন্দ্র স্থাপণের কাজে লাগানো হয়েছে। অনেকেই সকাল সাতটায় ভোটকেন্দ্রে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে যার যার কর্মস্থলে চলে গেছে। কেউ কেউ লাঞ্চ ব্রেকে ভোটকেন্দ্রে চলে গেছে, ভোট দিয়েই আবার কর্মস্থলে ফিরে গেছে। কিছু মানুষ বিকেল পাঁচটায় অফিস শেষ করে নিশ্চিন্ত মনে ভোটকেন্দ্রে গিয়েছে।

প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে আট থেকে দশটি ইলেকট্রনিক ভোট মেশিন স্থাপিত ছিল। কেন্দ্রে অভ্যর্থণা  টেবিল ছিল, প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের এজেন্টও  ছিল,  ভোট দিতে আসা মানুষটিকে দু'দলের প্রত্যেকেই হাসিমুখে সাদর সম্ভাষন জানিয়েছে। অভ্যর্থণাকারী ভোটারকে স্বাগত জানিয়ে নির্দিষ্ট টেবিলে পাঠিয়ে দিয়েছে, যেখান থেকে ভোট কার্ড নিতে হবে। ভোটকার্ড যেখান থেকে দেয়া হয়েছে, সেখানের  চার পাঁচটি টেবিল ঘিরে বসা ছিল সাত আটজন স্বেচ্ছাসেবী। স্বেচ্ছাসেবীদের  অনেকেই রিটায়ার্ড মিলিটারী, কেউ বা রিটায়ার্ড শিক্ষক। অনেক সমাজসেবীও এই ধরনের স্বেচ্ছাশ্রমে এগিয়ে আসে। টেবিল ঘিরে বসে থাকা কর্মীদের মাঝে যার যার কাজ আগেই বন্টন করা ছিল।  ওদের কাছে গিয়ে  ভোটারের নামের শেষ অংশ বা পদবী বললেই তারা তাদের ভোটার লিস্টের সাথে নাম, ঠিকানা মিলিয়ে  হাতে একটি ক্রেডিট কার্ডের মত  কার্ড ধরিয়ে দেয়। কার্ডটি নিয়ে ভোটিং মেশিনে ইনসার্ট করলেই স্ক্রীণে ভেসে উঠে নিয়মাবলী। 

নিয়মাবলীতে স্পষ্ট করে লেখা থাকে, কিভাবে পছন্দের প্রার্থীর নামের উপর আঙ্গুলের ডগায় স্পর্শ করে ভোট দিতে হয়। প্রথম পৃষ্ঠায় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের নাম তালিকা, পরের পৃষ্ঠায় সিনেটর, এর পরের পাতায় রিপ্রেজেন্টেটিভ, আরেক পাতায় সুপ্রীম কোর্টের বিচারক পদপ্রার্থীও ছিল। একমাত্র বিচারক পদপ্রার্থী ছাড়া বাকী প্রতিটি প্রার্থীর নামের পাশে নিজ দলের নাম উল্লেখ করা ছিল। অনেকটাই আমাদের দেশের মত, মার্কা দেখে ভোট দেয়া। প্রার্থীকে না চিনেও শুধু তার দল বা মার্কা জেনেই ভোট দেয়ার মত ব্যাপার। বিচারক যেহেতু নির্দলীয় পদ, তাই তাদের নামের পাশে লেখা ছিল নির্দলীয়। আমার মত আরও অনেকেই নিশ্চয় প্রার্থীকে না চিনেই দলের নাম দেখে আঙ্গুল ছুঁয়ে ভোটটি দিয়ে দিয়েছে।

ভোটকেন্দ্রে আরেকজন স্বেচ্ছাসেবী ছিল নতুন ভোটারদের সাহায্য করার জন্য। নতুন ভোটার অথবা বয়স্ক ভোটারদেরকে ভোট মেশিনের কাছে গিয়ে কিভাবে ভোটার কার্ড মেশিনে ইনসার্ট করতে হয়, ইনসার্ট করার পর কী করে ভোট দিতে হয় তা দেখিয়ে দেয় তারা। তবে ভোটার যখন ভোট দেয়ার জন্য প্রস্তুত, তখন স্বেচ্ছাসেবীটি সেখান থেকে সরে যায়। প্রতিটি প্রার্থীকেই ভোট দিতে হবে এমন কোন বাধ্য বাধকতা নেই। একেবারে শেষের পৃষ্ঠায় এসে ভোট সাবমিট করে দিলেই ভোটার কার্ডটি মেশিন থেকে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতেই বেরিয়ে আসে। কার্ডটি হাতে করে পূর্বের  টেবিলে অবস্থানকারী স্বেচ্ছাসেবীর কাছেই জমা দিতে হয়। স্বেচ্ছাসেবীটি ' আই ভোটেড' লেখা স্টিকার ভোটারের হাতে তুলে দিয়ে ভোট প্রদানের জন্য ধন্যবাদ জানায়।  এই পদ্ধতিতে ভোট দিতে একজন ভোটারের সময় লাগে পাঁচ থেকে ছয় মিনিট।  ভোটকেন্দ্রে কর্মরতদের সকলের মুখেই হাসি লেগেই ছিল, কারো চেহারা দেখেই বুঝার উপায় ছিল না, কে কোন দলের সমর্থক।  এরা মনের অভিব্যক্তি লুকিয়ে রাখতে জানে।  তবে কালোরা  মনের অভিব্যক্তি লুকায় না। অনেকেই খুব গর্বের সাথেই বলেছে, ওবামাই জিতবে। এরা জানতো, মিসিসিপি থেকে একটা ইলেক্টোর‌্যাল ভোটও ওবামা পাবেনা, তারপরেও ওরা তাকিয়ে ছিল নিউইয়র্ক, ওহাইও, ক্যালিফোর্ণিয়ার মত বিশাল রাজ্যগুলোর দিকে। রিপাবলিকান ভোটাররাও খুবই ভদ্র। তারাও জানতো, মিসিসিপির ছয়টি ইলেক্টোর‌্যাল ভোট পাচ্ছে রিপাবলিকান প্রার্থী, তা জেনেও এটা নিয়ে তারা কোন ঊচ্ছ্বাস দেখায়নি।  রাত এগারোটার মধ্যেই জানাজানি হয়ে যায়, কে হতে যাচ্ছে আমেরিকার ৫৭তম প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়, ফোনের পর ফোন আসতেই থাকে। আমার বারীতেও ফোন আসার শেষ ছিল না, দেশ থেকেও ফোন আসছিল অনবরত। এদিকে পরের দিন আবার যার যার কাজে সে সে ফিরে গেছে, মনের ভাব কেউ প্রকাশ করছিল না। কারো মনে ছিল ওবামার জয়ের উচ্ছ্বাস, কারো বা মনে ছিল রমনির পরাজয়ের বেদনা। তবে কারো মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বুঝার উপায় ছিলনা। একমাত্র আমেরিকানরাই পারে, মনের কথা মনের ভেতর ধরে রাখতে, আমরা পারিনা।


"স্বপ্ন আমার হারিয়ে গেছে, তারই স্মৃতিটুকু মনে আছে"


অনেক খুঁজে খুঁজে তবেই গানটি পেয়েছি। রাহুল দেব বর্মণের গাওয়া, " স্বপ্ন আমার হারিয়ে গেছে, তারই স্মৃতিটুকু মনে আছে"। ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গানটি গেয়েছিলেন আর ডি বর্মণ। মাথা খারাপ করে দেয়ার মতো গানই বটে, বুকের পাঁজর ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যায় সুরের ব্যঞ্জণায়। কোন ছোটবেলায় শুনেছিলাম গানটি, মনের গভীরে স্থায়ী হয়ে গেছে গানের বাণী ও সুর।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ছয় কি সাড়ে ছয়। নিতান্তই অবোধ বালিকা, পুতুল খেলার সময়। অথবা কোমরে লাল ডুরে শাড়ীর আঁচল পেঁচিয়ে হাঁড়ি-কুড়ি নিয়ে রান্না -বান্না খেলার কথা। কিনতু যে বালিকাকে শত্রুসেনাদের আক্রমণের ভয়ে ভীত -সন্ত্রস্ত বাবা মায়ের পিছু পিছু দৌড়ে গ্রাম থেকে গ্রামে পালাতে হয়, যে বালিকার নিজের দেশ ছেড়ে বাবা মায়ের সাথে অন্যদেশে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়, সে বালিকার জীবনে শৈশব থাকেনা। সুন্দর, নির্মল শৈশব ছাড়াই সে বেড়ে উঠে, বাড়তে বাড়তে একসময় মাঝ বয়সে এসে পৌঁছায়, ইচ্ছে করে পেছনে তাকাতে, ইচ্ছে করে পেরিয়ে আসা সোনালী অতীতকে আরেকবার দেখতে। কিনতু মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা বালিকা ছিল, তারা পেছনে তাকিয়ে শৈশবকে স্পষ্টভাবে দেখতে পায় না, ঐ অধ্যায়টি কালো ধোঁয়ায় ঢাকা থাকে। গোলা বারুদের গন্ধ ভেসে আসে নাকে, এখনও, এই মাঝ বয়সে এসেও। আমারও নাকে আসে বারুদের গন্ধ, চোখে ভাসে ছেড়ে আসা কোয়ার্টারগুলো পাকসেনাদের গোলার আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে। চোখে ভাসে, কাউকে না পেয়ে গুলীতে ঝাঁঝরা করে দেয়া 'অবোধ লালুর ( পোষা কুকুর) নির্জীব দেহ।


ইউ টিউবে গিয়ে গান শোনা আমার এক ধরনের নেশার মত হয়ে গেছে। খুঁজে খুঁজে পুরানো দিনের গান বের করি আর শুনি। তিন দিন আগেই আমি পাগলের মত খুঁজছিলাম রাহুল দেব বর্মণের গাওয়া গান , " স্বপ্ন আমার হারিয়ে গেছে, তারই স্মৃতিটুকু মনে আছে"। গানটি হণ্যে হয়ে খোঁজার কারন আছে, অতি সম্প্রতি 'আমার ব্লগে' সুশান্তের লেখা একটি পোস্ট দেখেছি, যেখানে সারে সারে প্রতিবাদী ছেলেমেয়ের প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়ানো ছবিও আছে। লন্ডনে সম্প্রতি জামায়াত ও বিএনপির একটি সমাবেশ চলাকালীন সময়ে প্রায় পঞ্চাশ জনের এক দল এসেছিল, সমাবেশের ভেতরে ওদের প্রবেশাধিকার ছিলনা, ওরা বিল্ডিং এর বাইরে থেকেই সাইদী বিরোধী শ্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করেছে, প্রতিবাদী প্ল্যাকার্ড নিয়ে শীতের ঠান্ডা উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থেকেছে ঘন্টাব্যাপী। লন্ডনের মানুষ দেখেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে উঠা বাঙ্গালী তরুণ-তরুণীর বিক্ষোভে ফেটে পড়া চেহারা। ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে সাথে সাথে খবর ছাপা হয়ে গেছে, সুদূর আমেরিকায় বসে এক মুহূর্তেই আমিও সেই খবর পড়ে নিয়েছি এক নিঃশ্বাসে। কাকতালীয়ভাবে গত দুইদিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াত-শিবিরের তান্ডবের সংবাদও দেশের প্রতিটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে।
গত দু'দিনের ঘটে যাওয়া বাদ-প্রতিবাদের সংবাদ পড়েই মন চলে গেলো সেই '৭১ এ। ইউ টিউবে গিয়ে টাইপ করে ফেললাম, ' স্বপ্ন আমার হারিয়ে গেছে', পেয়ে গেলাম সেই হারানো দিনের গানটি। 'চঞ্চল' নামের এক সঙ্গীত পাগলের কল্যাণে অনেক হারিয়ে যাওয়া গান ইউ টিউবে পেতে শুরু করেছি। সেই ভরসাতেই এই গানটিও খুঁজেছিলাম।


রাহুল দেব বর্মণের নাম শুনলেই 'মনে পড়ে রুবী রায়' গানটির কথাই মনে আসে। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত যুবকের জন্য গাওয়া অপূর্ব সুন্দর একখানি গান। অনেকেই জানেনা, যুবকের রক্তে আগুন জ্বলে উঠার মত একখানি গানও করেছেন রাহুল দেব বর্মণ। "স্বপ্ন আমার হারিয়ে গেছে" এক অন্তরার একটি গান, কিনতু এই এক অন্তরার গানেই উঠে এসেছে '৭১ এর ছবি, এক যুবকের সোনার সংসার লন্ডভন্ড হওয়ার করুণ বর্ণনার ভেতরেই ফুটে উঠেছে লক্ষ কোটি মানুষের সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার আর্তনাদ, লুট হয়ে যাওয়া নারীর বুকফাটা কান্না, স্ত্রী-পুত্র হারানো যুবকের হাহাকার! মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কলকাতার রাস্তা-ঘাটে , চায়ের দোকানে, পাড়ায় মহল্লায় দুইটি গান খুব বাজতো। রাহুল দেব বর্মণের গাওয়া " স্বপ্ন আমার হারিয়ে গেছে" এবং ভুপেন হাজারিকার গাওয়া "গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা'। আমি ছোট্ট হলেও গানের কথা মন দিয়ে শুনতাম। গান শোনার সময় গানের বাণী ও সুর, দুটোই শুনতে হয়, এটা ছোট বয়সেই ধরতে পেরেছিলাম।
আলোচ্য গানটিতে যখন বলে,

" ও--- আমি যখন রাঁনতে বসি, তুমি তখন বাজাও বাঁশী, ধোঁয়ার ছলে কাঁনতে বসি, মন তো মানে না"
আমি তখন কল্পনায় দেখতাম, আমাদের কোয়ার্টারের রান্নাঘরে মা' রান্না করছে, বাবা আমাকে মাথায় শ্যাম্পু করিয়ে দিচ্ছে, হঠাৎ করেই যেনো পাক মিলিটারীরা এসে আমাদের বাড়ীগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, সব দাউ দাউ করে জ্বলছে, আমরা সব ছুটে পালাচ্ছি, পালাচ্ছি, ছুটছি আর ছুটছি। এর মাঝেই কারা যেন আমার মা'কে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, ব্যস! এই পর্যন্ত ভেবেই থেমে যেতাম। মা'কে ছুঁয়ে দেখতাম, নাহ! আমার মা আমার সাথেই আছে। তখন গানের মায়ের কথা ভেবে কাঁদতাম। গানের বাবাটার জন্য কাঁদতাম। গানের ছেলেটি মারা গেছে ভেবেও কাঁদতাম, বাবাটি আর কোনদিন তার ছেলেকে পাবেনা, এটা ভেবেও কাঁদতাম। তবে ঐ বয়সে আমি একটি জিনিসই বুঝিনি, দস্যুরা কেন ছেলেটির মা'কে ধরে নিয়ে গেল??????????? মা;কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সঠিক জবাব পাইনি, বড় হয়ে নিজেই বুঝে নিয়েছি , গানের ঐ মা'কে কেন নিয়ে গেছিল দস্যুরা। [ এটা সত্যি, আমাদের কোয়ার্টারের বাড়ীগুলো মিলিটারীরা এসে আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলেছে। কারন ঐ কোয়ার্টারগুলোতে শুধুই 'হিন্দু কাফির'রা থাকতো।]


কলকাতায় আত্মীয় বাড়িতে থাকতাম, সকলেই আমাদেরকে আদর করতো, কিনতু পরাধীন জীবন কিছুতেই ভাল লাগতো না। শুধু কান্না পেতো, যখনই ভাবতাম, আমরা আর কোনদিন দেশে ফিরতে পারবো না। একবেলা ভাত খেতাম, দুই বেলা আটার রুটি আর ঝোলা গুড়। কান্না পেলেও মুখ ফুটে কিছুই বলতাম না, ঐ শিশু বয়সেই বুঝতে পারতাম, সময়টা খারাপ, পাঁচজনের সংসারে আমরা অতিরিক্ত ছয়জন ঢুকেছি, বাবার আয় রোজগার বন্ধ, সাথে কোন টাকা পয়সা নেই, আমাদেরকে এভাবেই থাকতে হবে। কবে দেশ স্বাধীন হবে, সেই অপেক্ষায় দিন গুনতাম। মনে পড়ে, সামনের চওড়া জি টি রোড ধরে ইন্ডিয়ান আর্মির ভারী ভারী ট্রাক যেত, ট্রাকে বসানো থাকতো মেশিন গান, ট্যাঙ্কের চেন লাগানো চাকা ঘর ঘর আওয়াজ তুলে গেলেই ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে আসতাম, সৈন্যদের দিকে হাত উঁচিয়ে বলতাম,
"টা টা বাই বাই" । মা শিখিয়ে দিয়েছিল, বাই বাই বলতে নাই, বলবে, আবার যেনো দেখা পাই। সাথে সাথে আমাদের বোল পালটে যেতো, " টা টা বাই বাই, আবার যেনো দেখা পাই"।
অবাঙালী সৈনিকেরা শিশুদের বাংলা শ্লোগান বুঝতোনা, কিনতু আমাদের অন্তর নিংড়ানো ভালোবাসার ভাষা ঠিকই বুঝতে পারতো। মাঝে মাঝে গাড়ী থেকে চকলেট ছুঁড়ে দিত , হাত উঁচিয়ে তারাও আমাদের ভালোবাসার জবাব দিত। ওরা চলে গেলেই স্বপ্ন দেখা শুরু করতাম, এইবার পাকিস্তানী মিলিটারীদের শেষ করে ফেলবে। মুক্তিযোদ্ধারাই জিতবে, আমরা আবার দেশে ফিরে যাব, তিনবেলা ভাত খাব, মাছ দিয়ে, আর রুটি খেতে হবেনা। মা বাবা আমাদের কথায় সায় দিত, হয়তো অবুঝ সন্তানদেরকে বুঝ দেয়ার চেষ্টা করতো, সাথে সাথে এটাও বলতো, " আমরা তো তবুও তিনবেলা খাবার পাই, মুক্তিযোদ্ধারা তো কিছুই খাইতে পায়না। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলি কিভাবে বনে-বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে জীবনপাত করতেছে"। এই কথা শুনলেই না দেখা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বুকের ভেতরটা টন টন করে উঠতো। সেই টনটনে ব্যথা আমি এখনও টের পাই। এখনও যে কোন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই পড়তে গেলে চোখের জলে বালিশ ভিজে যায়। আমি জানি, আমি খুবই ইমোশনাল, তারপরেও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি ঘটনা সত্যি, প্রত্যেকের কষ্ট-দুঃখ গুলো সত্যি, কিছুই ভুলে যাওয়ার নয়, আমিও কিছুই ভুলিনি, তাই কেঁদে ফেলি।

যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি অথবা আমার মত শৈশব হারায়নি, তারা কিভাবে জানবে মুক্তিযুদ্ধের বেদনা, যুদ্ধ জয়ের আনন্দ। মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে যাদের জন্ম, তারা তো শুধু ভারত বিরোধী কথা শুনে বড় হয়েছে, তাদের জানার কথাও না, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় মিত্র দেশ হিসেবে ভারত কতভাবেই সহযোগীতা করেছিল, নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা জানবেই বা কেমন করে, মুক্তিযুদ্ধের সারাটা সময় জুড়েই শরণার্থীদের সাথে সাথে কলকাতার বাঙ্গালীরাও অনেক কষ্ট করেছে, বিলাস-ব্যসন ত্যাগ করেছে, নিজেদের ভাগের অন্ন আমাদের সাথে শেয়ার করেছে, ওরা কি করে জানবে, অন্নদা শঙ্কর রায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য গান লিখেছিলেন, ভুপেন হাজারিকা গান গেয়েছিলেন, রাহুল দেব বর্মণ গান করেছিলেন! আরও কতভাবেই যে ঐ মানুষগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সাহসের আলো জ্বালিয়ে রাখতেন। আমরা কখনও বলিনি বলেই আমাদের সন্তানেরা জানতেও পা্রেনি, জি টি রোড ধরে ভারতীয় সেনাবাহিণীর ভারী ভারী ট্রাক প্রতিদিন বাংলাদেশ সীমান্তে যেতো, মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতো। আমাদের সামনে দিয়ে হাসি মুখে চলে যাওয়া সৈনিকদের অনেকেই হয়তো আর নিজগৃহে ফিরে আসেনি, হয়তো পাক বাহিণীর ছুঁড়ে দেয়া গুলিতে বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।

এ তো আমাদেরই অক্ষমতা, আমরা আমাদের সন্তানদের কাছে ইতিহাস ঠিকমত তুলে ধরিনি। আমাদের এই দূর্বলতার সুযোগ নিয়েছে অশুভ শক্তি। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথাতেই জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে দেশবাসীকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে এও ভাবি, আমাদের দোষই বা কতটুকু! ব্যথা বেদনার কথা কে-ইবা মনে রাখতে চায়! আমরাও চাই নি। চেয়েছিলাম নতুন করে বাঁচতে, স্বাধীন দেশে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে। বিভেদ ভুলে গিয়ে সকলের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে চেয়েছিলাম। কিনতু সর্ষের মাঝে যেমন ভুত লুকিয়ে থাকে, তেমনি আমাদের মাঝেও অশুভ শক্তি ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল। বহুরুপী মানুষ, বিচিত্র তার স্বভাব। যে সৈনিক কাঁধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল শত্রুসেনা নিধন করতে, সময়ের আবর্তে সেই সৈনিকই কিনা শত্রুকে এনে দেশের মন্ত্রী বানিয়ে দিল, গাড়ীতে জাতীয় পতাকা উড়ানোর সুযোগ করে দিল! নাহলে স্বাধীনতার ৪১ বছর পরে লন্ডনের রাস্তায় ৪০-৫০ জনকে এখনও প্রতিবাদী প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়! স্বাধীনতার ৪১ বছর পরে জামায়াত শিবিরের হাতে সরকারী পুলিশ বাহিণীর দাঙ্গা -হাঙ্গামা হয়!! এমন স্বপ্নই কি দেখেছিলাম আমি, অথবা আমরা? মাত্র দুই দিন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা দুটিই আমাকে রাহুল দেব বর্মণের গানটির কথা মনে করিয়ে দিল, স্বপ্ন আমার হারিয়ে গেছে!!!!!

কী স্বপ্ন দেখেছিলাম, আর কী পেলাম!!!!!!!