Thursday, November 8, 2012

প্রবাসী আড্ডা-২ (ঈদাশমী)

আড্ডা ঈদাশমী

'ঈদাশমী' নামে কোন শব্দ বাংলা ডিকশনারীতে পাওয়া যাবেনা। আমার মস্তিষ্কপ্রসূত শব্দ এটি। ঈদ এবং বিজয়া দশমীর আড্ডাকে  'ঈদাশমী' নাম দিয়েছি শুনে আমার এক বন্ধু চমকে উঠেছে, বাংলাভাষার এমন যথেচ্ছাচারে সে খুবই আহত বোধ করেছে। আমিও  উদাহরণ হিসেবে 'সাইফিনা' কে টেনে এনেছি। সাইফ আলী এবং কারিনা কাপুরকে যদি একসাথে 'সাইফিনা' বলা যায়, তাহলে ঈদ এবং বিজয়া দশমীকে একসাথে 'ঈদাশমী' বলা যাবে না কেনো?

এমনই এক ঈদাশমী আড্ডার ভ্যেনু ছিল এক প্রফেসরের বাড়ীতে, খাবারের মূল অংশ বিরিয়ানী, চিকেন রেজালা, সালাদ, সেমাইয়ের জর্দা করেছিলেন হোস্ট, আমি করেছিলাম রসগোল্লা, লাড্ডু আর নারকেলের নাড়ু। অনুষ্ঠানে আগত সকলেই কিছু না কিছু নিয়ে এসেছে। কেউ এনেছে গোলাপ জামুন, কেউ এনেছে পনীর কারী আর পুডিং, এক বৌদি এনেছে এঁচোড়ের ডালনা, নারকেলের নাড়ু, নিমকী, আরেক ভাবিজী এনেছে আলু টিকিয়া, সোমা এনেছে সিঙ্গারা, রানতা এনেছে ফ্রুট কাস্টার্ড। খাবার দাবারের আয়োজন ছিল অনেক। পানাহারের ব্যবস্থাও ছিল।
খাওয়া -দাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে চলছিল চরম আড্ডা। এ ধরনের  আড্ডায় সাধারনতঃ এলেবেলে কথাবার্তাই বেশী হয়। মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যেই গান, কৌতুক চলতেই থাকে। একটা ব্যাপার প্রতিটি প্রবাসী আড্ডাতেই লক্ষ্য করা যায়, প্রত্যেকেই কিছু না কিছু অতিরিক্ত গুনের অধিকারী, দেশে থাকতে হয়তো নানা কারনে তার সুপ্ত প্রতিভা আর বিকশিত হয় না।  এই ধরনের আড্ডাতেই সাধারনতঃ সকলের অনুরোধ আর বন্ধুদের চাপাচাপিতে পড়ে সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয়ে পড়ে। আমার নিজেরও সুপ্ত প্রতিভা এভাবেই বিকশিত হয়েছে! দেশে থাকতে বাথরুমে বসে গলা সাধতাম, সেই বাথরুম গায়িকা বিদেশে এসে সত্যিকারের গায়িকা বনে গেছি, সোজা কথা! এইবেলাতে প্রবাসী হওয়ার সার্থকতা খুঁজে পেয়েছি।

আলোচ্য 'ঈদাশমী' আড্ডাতেও একসময় প্রত্যেককে কিছু না কিছু বিনোদন মূলক প্রতিভা প্রকাশের জন্য অনুরোধ জানানো হলো।  ছেলে মেয়ে, নারী পুরুষ মিলিয়ে আমরা জনা তিরিশেক তো ছিলামই। যেইমাত্র প্রতিভা প্রকাশের কথা উঠলো, অমনি দেখলাম একজন একজন করে সরে যেতে শুরু করলো।  উপস্থিতদের মধ্যে দুই একজন ছিল, যারা সত্যিই ভালো গান করে। মহিলাদের মধ্যে আমি হচ্ছি 'স্বঘোষিত' শিল্পী, অপেক্ষায় থাকি কখন আমাকে কেউ গান গাইতে অনুরোধ করবে। আমি গানপাগল মানুষ, তাই গান করতে লজ্জা পাই না। 'এন্ডি' ( নিক নেম) খুব ভালো গান করে। কলকাতার মেয়ে এন্ডি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়েছে, ইংলিশে অনার্স মাস্টার্স করেছে, নিজেও স্মার্ট, বিয়েও করেছে স্মার্ট ছেলেকে। এন্ডি আর ওর স্বামী খুব ধনী হলেও মিশুক প্রকৃতির। বিশেষ করে এন্ডি। আমি ওকে দারুন পছন্দ করি, কারন ওর কথা শুনতে আমার ভাল লাগে।  বুঝে হোক অথবা না বুঝেই হোক, এমন কতগুলো বাংলা ও বলে ফেলে আসরের মাঝে, হাসতে হাসতে দম বের হয়। আমি তক্কে তক্কে থাকি, ওকে কিভাবে নাজেহাল করা যায়। ও এত সরল সোজা যে আমার হাতে ওকে ঘায়েল করার  অস্ত্র তুলে দেয়। সেদিনের আড্ডায় এন্ডিকে গান করতে অনুরোধ করা হয়েছে, সে তখন সাধারন মেয়েদের মত টালবাহানা করছিল, ততক্ষনে আমিই গেয়ে ফেললাম, হেমন্ত -শ্রাবন্তীর গাওয়া গান, "আয় খুকু আয়'। আসরে বেশ কয়েকজন ভাল 'বাবা' ছিল, তারা খুব খুশী হয়েছে আমার গান শুনে। আরেক বৌদি গাইলেন 'নয়ন ভরা জল গো তোমার'। আহাদ গাইলো , " মায়াবন বিহারিণী হরিণী'। এন্ডির বর স্যাবি গাইলো, একটা বাংলা রোমান্টিক গান এবং একখানা হিন্দী গান।  দারুন মিষ্টি মেয়ে জুলেখা গাইলো, চিত্রা সিং এর গাওয়া একটি গান। এভাবেই পালা ঘুরে গেল হোস্ট ডঃ আহমেদের কাছে। আহমেদ ভাই রাঁধতে জানেন, নাচতেও জানেন কিনতু গান করতে জানেন না। ডঃ সাহার পীড়াপিড়ীতে পরে আহমেদ ভাই হঠাৎ করেই খাস ঢাকাইয়া ভাষায় কৌতুক শুনিয়ে দিতেই এপাশ থেকে এন্ডি চেঁচিয়ে উঠলো,
'তোমরা কি একটা গান শুনেছো? দারুন হাসির গান। একটা লোক নেচে নেচে গায়।
কেউ একজন বললো, দয়াল বাবা?
এন্ডি বললো, হ্যাঁ হ্যাঁ, দয়াল বাবার কলা খাইবা---
আমি খপ করে ওকে ধরলাম, এই মেয়ে, দয়াল বাবার কলা খাইবা বলে না, দয়াল বাবা
-সাথে সাথে হাসির রোল উঠলো, এন্ডি কিছু না বুঝেই আবারও বলতে লাগলো, আরে! দয়াল বাবার কলা খাবা গানটা তো ইউ টিউবে আছে---
-এন্ডি, দয়াল বাবা বলো, বাবার বইলো না
ওপাশ থেকে স্যাবি হাসতে হাসতে বললো, ওকে খোঁচা দিলে ও কিনতু পুরো আসর হেঁজিয়ে দেবে
প্রতীক, আহাদ, মারুফ মুচকী মুচকী হাসছিল, জান্নাত খুবই কনজারভেটিভ হলেও হাসিতে যোগ দিল। ওর স্বামীও বোধ হয় হাসি থামাতে পারেনা। এদিকে সবাইকে হাসতে দেখে এন্ডি আরও মরিয়া হয়ে বলতে লাগলো,
-এই হচ্ছে টা কী, আমি কী ভুল বলেছি? আমার কাছে ল্যাপটপ আছে, আমি এখনই শুনিয়ে দিচ্ছি। তোমরা হাসছো কেনো? এটাতো একটা মজার গান, সত্যি সত্যি গানটাতে বলে, নিজের কলা ফেলে রেখে পরের কলার দিকে ড্যাবডেবিয়ে চাও!

আমি হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়েই গেলাম, আহাদ , আহাদের বউ ফারাহ দুজনেই এন্ডিকে খুব ভালোবাসে, আহাদ খুব লাজুক হলেও ফারাহ খুবই চটপটে। ফারাহ বলল, দিদি, আপনি আমাদের বাঙ্গাল ভাষার কেরামতি বুঝবেন না। গানে পরের বাড়ির কলার কথা বলেছে, এবার থেমে যান, মিঠু আন্টি আপনাকে ভাল প্যাঁচ দিছে। থেমে যান।

- লে হালুয়া, এই মিঠু'দি, এভাবে হাসছো কেন?
-তোমাকে সবাই অনুরোধ করেছিল একটা গান করার জন্য, তখন তালিবালি করছো, আর এখন ফালতু গান শুরু করছো, তাও আবার  ভুলভাল বাংলায় কথা বলে যাচ্ছ, 'র' দিয়ে গানের কথাকে -----হি হি হি

- ধেৎ তেরিকা, ঠিক আছে, চলো গান করছি বলেই জগজিৎ সিং এর একখানা গজল গাইলো, সকলেই হাসি থামিয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনলাম। এন্ডির গান থামতেই ডঃ সাহা একখানা পল্লীগীতি গাইলেন। ডঃ সাহা গায়ক নন, কিনতু বাঙ্গাল দেশের ভাষার প্রতি এখনও টান অনুভব করেন, সেই টান থেকেই মাঝে মাঝে পল্লিগীতিতে টান দেন। একটু বিরতি দিয়েই এক দাদাকে ধরা হলো। কিছু একটা পরিবেশন করার জন্য। দাদা শুরু করলেন এভাবে,

সেদিন বাংলা চ্যানেলে দেখাচ্ছিল, কিভাবে ম্যানহোলের মধ্যে মানুষ পা হড়কে পড়ে যায়। আমার জীবনেও এই ঘটনা ঘটেছে।  একবার দেশে বেড়াতে গেছি। আমার পুরানো অনেক বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে। ফিরে আসার কিছুদিন আগে আমার এক বান্ধবীর সাথে দেখা হয়েছে। যেদিন দেখা হয়েছে সেদিন আমার বউ ছিল বাপের বাড়ীতে।  এই বান্ধবীর সাথে দেখা হলো প্রায় ৩৫ বছর পর। তাকে বললাম, তুমি তো মাঝবয়সী হয়ে গেছো, আর আমি বুড়ো হয়ে গেছি। এমনি আরও নানা কথাবার্তা। বান্ধবী তার লেখা বই আমাকে উপহার দিয়েছে।বান্ধবীর  সাথে দেখা করে ফেরার পথে ফুটপাথের উপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে ম্যানহোলের ভেতর এক পা ঢুকে গেছে। হাতে ছিল বই------

বৌদি বললো, দেখো কান্ড, ৩৫ বছর পর দেখা হওয়া বান্ধবীকে কেউ 'মাঝ বয়সী' বলে?

আহাদ বললো, আঙ্কেল, আপনার বান্ধবী কি সুন্দরী ছিল?

এন্ডি বললো, ছিঃ ছিঃ দাদা, তোমার এমন অধঃপতন। বউ বাপের বাড়িতে আর তুমি সুন্দরী বান্ধবীর সাথে আড্ডা দিচ্ছিলে? সুন্দরীর কথা মাথায় ঘুরছিল বলেই আর হুঁশ ছিল না, পা হড়কে পড়েছো---

ডঃ মন্ডল বললো, এন্ডি'দিদি, সুন্দরী দেখলে তাকায় না কোন পুরুষ শুনি! আমি এখনও সুন্দরী দেখলে তাকিয়ে থাকি

এন্ডি বললো, ছিঃ ছিঃ কী বললি? ঘরে সুন্দরী বউ থাকতে বাইরে সুন্দরী খুঁজিস?

-সবাই দেখে, সুন্দরী দেখলে কত কিছু করতে ইচ্ছে করে----
এই কথা শোনার সাথে সাথে মন্ডলের বৌ বলে উঠলো, কত কিছুই করতে ইচ্ছে করে? কেউ যদি তোমাকে তার মেয়ের বাপ হতে বলে?
এন্ডি বলল, এই মন্ডল, শোন তোর বউ কী বলেছে!
মন্ডল প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি, তার বউ কী বলেছে। মন্ডল বুঝার চেষ্টা করছে আর ততক্ষনে আড্ডার সকলে হাসতে শুরু করেছে। এন্ডি এবার হাতে পেয়ে গেছে সবকিছু, একটু আগে তাকে নিয়ে সবাই হেসে গড়িয়ে পড়েছিল। মরিয়া হয়ে ডঃ মন্ডল বলে ফেললো, অসুবিধা কি, মেয়ের বাপ, ছেলের বাপ যেতাই হতে বলুক, আমি রাজী আছি।
ভাগ্যিস ভালো, আমাদের আড্ডায় কোন নাবালক ছিল না। সকলেই এডাল্ট, যারা সবচেয়ে ইয়াং, তারাও পিএইচডি স্টুডেন্ট। ডঃ মন্ডলকে বাঁচিয়ে দিতে আবার সেই দাদা আসরে ফিরলো,

-শোন, বন্ধু আমার সুন্দরী না,  আবার সুন্দরীও। দারুন গুনের মেয়ে!

বৌদি ফোড়ন কাটলো, মাঝ বয়সী আবার মেয়ে হয় কী করে!
-আহ! চুপ করো। সে অনেক গুনের , দারুন আর্ট জানে, বই লিখেছে কয়েকটা। আমাকে বলছিল, আমাদের কি আর দেখা হবে না? আমি বলেছি, কেন হবে না? আমি আসব, আমরা একসাথে বেড়াব, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক যাব

- বৌদি বললো, তোমার বান্ধবীর কি স্বামী নাই? নাহলে এমন বুড়া মানুষের সাথে সিঙ্গাপুর যেতে চায় কেন?
-সিঙ্গাপুর তো আমি নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছি---
বৌদি টাকে খুব ভাল লাগে। সব কথা খুব ভালভাবে গ্রহন করে। বৌদিই বললো, এই তোমরা শোন, যা বলতেছে তার অর্ধেক কথা বানানো। এই লোকরে নিয়া আমি সংসার করতেছি, আমি বেশী চিনি তারে। এত কথা বলার জন্য যে সাহসের দরকার হয়, তার এক কোনা সাহসও এই মানুষের বুকে নাই। সাহস নাই বইলাই বান্ধবীর সাথে দেখা হওয়ার ধাক্কা সামলাইতে পারে নাই, ম্যানহোলে গিয়ে পড়ছে। হা হা হা হা আ
ডঃ সাহা খুব হিউমার জানেন। উনি বললেন, দাদা , এমনও হতে পারে, বৌদির অবর্তমানে আপনি যুবক বয়সের বান্ধবীর পাল্লায় পড়েছিলেন, মানেই গর্তে পা দিয়েছেন, এটা বুঝানোর জন্যই ঈশ্বর আপনাকে গর্তে ফেলেছে, হা হা হা হা হা

হোস্ট ডঃ আহমেদ  আড্ডা্র  শুরু করেছিলেন, এবার তিনিই বিরতি টানলেন। সিঙ্গারা, নিমকী, আলু টিকিয়া, নাড়ু খেয়ে যে আড্ডা শুরু হয়েছিল, বিরিয়ানী, রেজালা পর্ব শুরুর আগে আড্ডায় বিরতি টানা হলো। হঠাৎ খেয়াল করলাম, প্রতীকের কাছ থেকে কিছুই শোনা হয়নি। প্রতীক নতুন এসেছে, ওর কাছ থেকে কিছু শোনা দরকার। অনুরোধ করতেই প্রতীক খুব সুন্দর একখানি বিচ্ছেদি গান গেয়ে শোনালো। গান শেষ হতেই ভোজ পর্ব শুরু হয়ে গেলো।

-

No comments:

Post a Comment