Monday, November 12, 2012

নিজের কাছেই কৈফিয়ত!

আমাকে  প্রায়ই  একটি  প্রশ্নের  সম্মুখীন হতে হচ্ছে,   " তুমি/আপনি তো  সারাক্ষন   ফেসবুক  আর  ব্লগ  নিয়ে  মেতে  থাকো/থাকেন।  রান্না-খাওয়া  কখন  করো/করেন"?  প্রশ্নের উত্তর দেই না, ভেতরে ভেতরে চাপা অস্বস্তি বোধ করি, কিনতু মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখি। তবে আমিও মানুষ, মাঝে মধ্যে একটু আধটু রাগ-অভিমান হয় না, তা বলি কী করে!  এটা তো সত্যি, দিন-রাতের অনেকটা সময় আমি অনলাইনে থাকি। ব্লগ ছাড়াও 'বাংলাদেশ প্রতিদিন' নামের দৈনিকটিতে মাসে দুই তিনটি লেখা পাঠাই। যে কোন বিষয়ের উপর লেখার আগে, উইকিপিডিয়াতে একটু পড়ে নিতেই হয়, না পড়ে  আন্দাজে লিখে দেয়ার মত জ্ঞান বা সাহস, ইহজীবনে হবে না, তাই আমাকে পড়ার জন্যও অনলাইনে থাকতে হয়। যারা আমাকে অনলাইন দেখে, তাদের মনেই প্রশ্ন জাগে, এই ভদ্রমহিলার কি খেয়ে দেয়ে আর কোন কাজ নেই, সারাক্ষণ ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকে। কখনও এসকল প্রশ্ন শুনে দেন-দরবার করিনি, কিনতু আজই কেনো যে মনে হলো, দেখিতো সারাদিনের হিসেব করে, কোথাও কোন ভুল ত্রুটি থেকে যাচ্ছে কিনা!


আজ  আমার  ওয়ালমার্টের  কাজের  শিডিউল  ছিল  সকাল  ৯:৩০  থেকে  বিকেল  ৫:৩০  পর্যন্ত।

আমি  গতরাত  ৩টায়  ঘুমাতে  গেছি,  আজ  সকাল  ৮টায়  ঘুম  থেকে  উঠেছি।  ঘর-দুয়ার  ঝাঁট-পাট  দিয়ে,  বিছানা  গুছিয়ে  টুছিয়ে  নিজে  ফ্রেশ  হয়ে  কিচেনে  ঢুকেছি।  সোমবার  আমাদের   ভেজিটেরিয়ান  ফুড  ডে,  নো  আমিশ।  পেঁয়াজও  খাইনা,  কঠিন  নিয়ম  পালন  করি।  সোমবার  উত্তম  কুমারের  ল্যাব  থাকেনা,  দুপুরে  সরাসরি  বাড়ী  এসে  লাঞ্চ  করে।  ঝট  করে  নুডলস  রান্না  করে  ফেললাম।  ডিম  ছাড়া,  পেঁয়াজ  ছাড়া  নুডলস?  ওকে!   আমার  নিজের  তৈরী  নিয়ম  নিজ  দায়িত্বে  একটু  শিথীল  করলাম,  পেঁয়াজ  ব্যবহার  করলাম রান্নায়।  অন্য  কোন  সব্জী  ছিলনা,  শুধু  বাঁধাকপি  কুচিয়ে,  পেঁয়াজ  কুচি,  ধনে  পাতা  কুচি,  গোলমরিচ  থেঁতো,  কাঁচামরিচ কুচি  দিয়ে  অতি  সুস্বাদু  নুডলস  করে  ফেললাম।  সুস্বাদু  বললাম  নিজ  দায়িত্বেই,  রান্না  খেতে  ভাল  না  হলে,  আমি  নিজেকেও  ক্ষমা  করিনা।  চুলা  নিবিয়ে,  দরজা  জানালা  চেক  করে  গাড়ীতে  গিয়ে  উঠে  দেখি  ৯:২৯।  ওয়ালমার্টে  পৌঁছে  ক্লক-ইন  করেছি  ৯:৩৯।

দুই  ঘন্টা  পর  টী  ব্রেকে  সুনীলের  উপন্যাস  সমগ্র  খুলে  বসে  নুডলস  খেলাম  আর  অসমাপ্ত  উপন্যাস  গোগ্রাসে  গিললাম।  এরই  ফাঁকে  ভাবতে  লাগলাম,  রাতের  রান্না  কখন  করবো।  আজতো  নিরামিষ,  তিন  আইটেমের  কম  খেতে  দেই  কী  করে!  উপন্যাস  পড়তে  পড়তেই  ঠিক  করলাম,  আজ  রান্না  হবে  'মুগের  ডাল,  মিষ্টি  কুমড়ো  টুকরো  করে  দেবো,  সাথে  দুই  একটা  ঝিঙ্গেও  টুকরো  করে  দিতে  হবে।  ঘি,  কাঁচামরিচ  দিয়ে  রান্না  করলে  'অমৃত'!  টী  ব্রেক  শেষ  হতেই  কাজে  ফেরা।  আরও  দুই  ঘন্টা  পরে  'ওয়ান   আওয়ার'  লাঞ্চ  ব্রেক।  সাত  বছর  হয়ে  গেলো আমার  ওয়ালমার্ট  জীবন।  লাঞ্চ  ব্রেকে  আমি  কখনওই  বাড়ী  যেতাম না,  রসিয়ে  রসিয়ে  গল্পের  বই  পড়তাম,  ব্রেক রুমে  বসে।  আমাকে  সবাই  ' বুক ওয়ার্ম'  ডাকে,  শুনতে  খারাপ  লাগে না।  সেই  আমি  গত  কয়েক মাস  হয়ে  গেল,  লাঞ্চ  ব্রেকে  বাড়ী  ফিরে  আসি,  এক  ঘন্টার  ব্রেক,  আসতে ১০ মিনিট,  যেতে  ১০  মিনিট,  বাড়ীতে  থাকি  মাত্র  ৪০  মিনিট।  কী  করি?  ফেসবুকে  বসে  যাই,  আর  কিছু  না  পারি,  স্ট্যাটাস  আপডেট  করি,  দুই  একজনের  মেসেজের  উত্তর  দেই।  ব্লগগুলো  ঘুরে  দেখি।  কম্পিউটার  অন  করে  ইন্টারনেট  কানেকশান  পেয়ে  ফেস বুকে  যেতেও  খরচ  হয়  ৫  মিনিট,  অফ  করতে  ৩  মিনিট।  আমি  হাতে  পাই  সর্বমোট  ৩২  মিনিট।

দুই  তিনদিন  হয়ে  গেল,  লাঞ্চ  ব্রেকে  বাড়ি  ফিরি না,  সুনীলে  মজে  থাকি।  আজ  ফিরেছিলাম,  রাতের  রান্না  এগিয়ে  রাখবো  বলে।  বাড়ী  ফিরে  হিসেবের  ৩২  মিনিটের  মধ্যেই  'কাঁচা  মুগ'  লোহার  তাওয়ায়  অল্প তাপে  ভাজলাম( কাঁচা  মুগের  ডালে  মুগের  গন্ধ  থাকেনা,  গন্ধহীন  ডাল  খেতে  হলে  কাঁচা  মুগ  খাওয়া  ভাল)।  ততক্ষনে  দ্বিতীয়  আইটেম  কী  হবে,  তা  সিদ্ধান্ত  নিয়ে  ফেলেছি।  আলু,  ফুলকপির  ডালনা।  ছুটির  পরে  বাড়ী  ফিরেই  যেনো ঝটাপট  আলু, কপি  কাটা  শুরু  করতে  পারি,  তারজন্যই  রেফ্রিজারেটরের  ভেতরে  রাখা  ফুলকপিটা  বাইরে  রেখে  দিয়ে  গেছি,  আলুর  ব্যাগ  অবশ্য  বাইরেই  থাকে।

কাজে  ফিরে  গেছি  সময়মতই।  দেড়ঘন্টা  পরেই  পেলাম  লাস্ট  টী  ব্রেক।  আগামীকাল  মঙ্গলবার,  অফ ডে  পেয়েছি,  মাসে  একটা  ব্রত  করি,  শনি বা  মঙ্গলবার  ধরে  করতে  হয়  ব্রতটি।  এই  ব্রত  উদযাপন  করতে  'আনারস' হলে  ভালো  হয়,  সাথে  কলা,  কিসমিস।  মঙ্গলবার  যখন  অফ  পেয়েই  গেছি,  অবশ্যই  ব্রত পূজো  করবো।  ব্রেক  টাইমেই  টুকিটাকি  কেনাকাটা  করে  ফেললাম।  ( ওয়ালমার্ট  সুপার  সেন্টারে  'মানুষ'  বাদ  দিয়ে,  সবকিছুই  বিক্রী  হয়)।  ঘড়িতে  দেখি  মিনিট  পাঁচ  এখনও  হাতে  আছে।  সুনীল  নিয়ে  বসলাম,  পাঁচ  মিনিটের  জায়গায়  দশ  মিনিট  নিয়ে  নিলাম  বাপ্পাদিত্য  আর  মুন্নীর  কী  হলো  জানার  জন্য।  এরপরেই  দে  ছুট,  বাড়ীর  দিকে।

বাড়ী  ফিরে  কর্তা বা  কন্যাটিকে  পাওয়া  গেলোনা,  উনারা  গেছেন  পিয়ানো  টিচারের  বাড়ী,  বাইরে  অন্ধকার  রাত,  ঘরে  আমি  একা,  আর  কী  লাগে!  ভুতের  ভয়ে  আমি  সব  সময়  কাঁটা  হয়ে  থাকি,  বসে  রইলাম  দরজার  কাছেই  চেয়ার  টেনে।  যদি  ভুত  আসে  দরজা  খুলে  দৌড়  দেবো  বলে।  দরজা  লক  করিনি,  সেজন্য।  পিয়ানো  টিচারের  বাড়ী  কয়েক  ব্লক  দূরে।  ১৫  মিনিটের  মধ্যেই  বাবা-কন্যা  ঘরে  ফিরেছে,  আমিও  চুলায়  ডাল  চাপিয়ে  দিয়েছি।  চার  বার্ণারের  চুলা,  আমি  ব্যবহার  করি  দুই  বার্ণার।  এক  বার্ণারে  ডাল  বসিয়ে  আরেক  বার্নারে  ফ্রাইপ্যান  চাপিয়ে চিন্তা  করলাম,  তিন  নাম্বার  আইটেম  কী  হতে  পারে!  সাথে  সাথে  সিদ্ধান্ত  নিলাম,  ভেজিটেরিয়ান  ডে'তে  একটু  শাক  না  খেলে  চলে!  আমাদের  দেশে  রাতের  বেলা  শাক  খেতে  মানা  করে,  বদ হজম  হতে  পারে  ভয়ে।  আমরা  এখানে  ভাত  খাই  রাতে,  ভাতের  সাথেই  শাক  যায়  ভাল,  আমি  রুটির  সাথে  মরে  গেলেও  শাক  খাব না।  তাই  ফ্রোজেন  শাক  রান্না  করে  ফেললাম।  চুলায়  শাক  হচ্ছিল,  আমি  এই  ফাঁকে  আলু,  ফুলকপি  কেটে  রেডি  করে ফেলেছি।  কাঁচামরিচের  এক  বিরাট  পোঁটলাতে  মরিচগুলো  ভিজে  উঠছিল,  সবগুলো  মরিচের  বোঁটা  ফেলে  না  রাখলে  পচে  যাবে।  এক চুলায় ডাল ফুটে, আরেক  চুলায়  আলু  ফুলকপির  ডালনা  ফুটে।  আমি  কাঁচামরিচের  বোটাগুলো  ফেলে  কিচেন  টাওয়েলে  জড়িয়ে  ভাল  করে  শুকিয়ে  ঝরঝরে  করে  ফেললাম।  মিষ্টি  কুমড়ো  আর  ঝিঙ্গে  টুকরো  করে  রেখেছিলাম  এক  ফাঁকে।  ডাল  সেদ্ধ  হতেই  ঘুটনি  দিয়ে  দিলাম  এক  ঘুটা।  ব্যস!  এবার  কুমড়ো,  ঝিঙ্গে  টুকরো  ছেড়ে  দিলাম  ডালের  ভেতর।  একটু  নরম  হতেই  শুকনো  লঙ্কা আর জিরে ফোড়ন দিয়ে  ডাল  সম্বার দিলাম।  কাঁচামরিচ , দুই চামচ ঘি দিয়েই ডালের চুলা অফ করে দিলাম।  সময়  বাঁচানোর জন্য  ফাঁকে ফাঁকে  ন্যাকরা ভিজিয়ে চুলার চারধার মুছে পরিষ্কার করে ফেলেছি, বেসিনে জমে থাকা বাসন-কোসন মেজে ধুয়ে ফেলেছি।  এই যে  কাজ  করছিলাম,  এরই  ফাঁকে  ফাঁকে  কিনতু  আমি  লেখার  প্লট নিয়েও ভাবছিলাম।  আজ ছিল ভেটের‌্যান'স ডে,  আগামীকাল  প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিন, গল্প কবিতা ডট কমে এ মাসের গল্প লিখে জমা দিতে হবে, এর সাথে সাথে ফেসবুকে স্ট্যাটাসও লিখতে হবে।  সবকিছু নিয়েই ভাবছিলাম।

বাড়ী  ফিরেছিলাম  সন্ধ্যে  ছ'টায়, রান্না শুরু  করেছি  সোয়া  ছ'টায় , রান্না-বান্না শেষ  করেছি  সাড়ে  সাতটায় ( বাসন মাজা, ঘর  পরিষ্কারসহ)।  সারাদিন  মনের  মধ্যে একটু কষ্ট ছিল,  মেয়েটাকে  কালকে অনেক বকেছিলাম,  আমাকে  ফোন করে না বলে, মনকে  সান্ত্বণা দিচ্ছিলাম,  বকেছি ভাল করেছি, নাহলে শিখবে কিভাবে, তারপরেও মন মানে না, আমার মেয়েকে আমি জানি, এই মেয়েটি অন্য ঘরানার, সংসারের কুটকচাল বোঝেনা, নিজেও কারো উপর রাগ বা অভিমান করেনা, অন্যের রাগ-অভিমানের খবরও রাখেনা। আমার এই ভাল মেয়েটাকে বকে কী শান্তিতে থাকতে পারি! ফোন করলাম, হসপিটালে ডিউটিতে ছিল, ফোন ধরতে পারেনি, পরে এক ফাঁকে কল ব্যাক করেছে। মেয়েকে সরি বললাম, নিজের বুকটা হালকা হলো, মেয়েও পালটা বললো, কোন অসুবিধে নেই, মনের ভেতর চেপে থাকা কথা বলে দিয়ে নাকি ভালই করেছি।

আমার কাজ শেষ, এখন আমি ফেসবুকে বসতেই পারি।  মিথীলা সময়মত ভাত রান্না করবে, তার বাবার জন্য শসা কেটে রাখবে ( উত্তম কুমার যে কোন খাবারের সাথে শসা খেতে ভালোবাসে)। রাত পৌণে আটটায় ফেসবুকে বসেই মনে হলো, আজকের সারাদিনের হিসেব লিখে ফেলি।  ভেবেছিলাম, চার পাঁচ লাইনের স্ট্যাটাসে লিখে দেবো, 'যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে", এখন দেখছি, পাঁচ লাইন গিয়ে দাঁড়িয়েছে পঞ্চাশ লাইনে। এখানেই আমার উত্তর দেয়া হয়ে গেলো, ফেসবুকে বসে আমি কী করি!  পাঁচ লাইনের জায়গায় পঞ্চাশ লাইন লিখতে গেলেতো পাঁচ মিনিটের বদলে পঞ্চাশ মিনিট লেগে যাবেই। তবে, যারা প্রশ্ন করে, তাদেরকে উত্তর দেয়া যায়, কিনতু যারা প্রশ্ন করে না, অথচ ঠারেঠোরে বলার চেষ্টা করে, " ওরে বাবা! ফেসবুকে আমি নাই, ভীষন  বাজে  নেশা,  অযথা সময় নষ্ট,  কাজকর্ম বাদ দিয়ে ফেসবুক  নিয়ে বসে থাকার মত এনার্জী নেই,  সংসারে আরও কতকিছু করার আছে! "  এ ধরণের মন্তব্য শুনে গা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করি, তবে মাঝে মাঝে একটু আধটু বিচলিতও হই। অবশ্য  ক্ষণিক বাদেই সব ভুলে যাই, পরবর্তী লেখার টপিক মাথায় ঘুরতে থাকে।  যেহেতু আগামীকাল আমার অফ ডে, আজকের মধ্যে দুই তিনটি লেখা আমাকে শেষ  করতে  হবে।  খুব কঠিন কিছু মনে হচ্ছে না। ফেসবুক হয়তো অনেকের জীবনে কুফল বয়ে এনেছে, আনবে, আমার জীবনেও যে কিছু কিছু কুফল বয়ে আনেনি, তা নয়, তবে এই ফেসবুকের কল্যানেই আমি পেয়ে গেছি আমার স্বপ্নলোকের চাবি!

No comments:

Post a Comment