সারা উত্তর আমেরিকায় আজ ধুমধামের সাথে পালিত হচ্ছে ‘থ্যাঙ্কস গিভিং’ উৎসব। দিনটি সরকারী ছুটির দিন। নভেম্বার মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার থ্যাংকস গিভিং উদযাপিত হয়, সে হিসেবে এ বছরের ২২শে নভেম্বার, বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে থ্যাঙ্কস গিভিং ডে।
থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’র মূল ঊদ্দেশ্য, পরিবার, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবসহ সকলে একত্রিত হয়ে প্রত্যেকের জীবনের প্রতিটি সাফল্যের জন্য, দেশ ও জাতির সাফল্যের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানানো। যদিও আমেরিকানদের অনেকেই জানেনা থ্যাঙ্কস গিভিং কবে থেকে শুরু, কেনই বা উৎসবটির নাম থ্যাঙ্কস গিভিং ডে হলো, কাকেই বা এমন ঘটা করে থ্যাঙ্কস জানানো হচ্ছে! তারা জানে, থ্যাঙ্কস গিভিং মানেই পার্টি, বিশাল ভোজ আয়োজন, পারিবারিক মিলনমেলা। ভুরিভোজনের তালিকায় থাকে টার্কী রোস্ট, ক্র্যানবেরী সস, মিষ্টি আলুর ক্যান্ডি, স্টাফিং, ম্যাশড পটেটো এবং ঐতিহ্যবাহী পামকিন পাই। আর কিছু না হোক, অতি সাধারণ আয়োজনেও টার্কী রোস্ট উইদ ক্র্যানবেরী সস এবং পামকিন পাই থাকবেই। অর্থাৎ থ্যাঙ্কস গিভিং মানেই টার্কী। ( টার্কীঃ ময়ুরের মত বড় সাইজের বনমোরগ জাতীয় পাখী)।
আমেরিকাতে নভেম্বারের চতুর্থ বৃহস্পতিবার থ্যাঙ্কস গিভিং উদযাপিত হলেও কানাডাতে থ্যাঙ্কস গিভিং হয় অক্টোবারের দ্বিতীয় সোমবার। তারিখ ভিন্ন হলেও উৎসব উদযাপনের নিয়ম রীতি একই রকমভাবে পালিত হয়। কেউই থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’র ভাবার্থ বা ঊদ্দেশ্য নিয়ে মাথা ঘামায় না। অতি গুরুত্বপূর্ণ ছুটির দিনটি পরিবারের সকলে মিলেই কাটায়, একসাথে খাওয়া দাওয়া করে, টিভিতে ফুটবল গেইম দেখে অথবা থ্যাঙ্কস গিভিং প্যারেড দেখে। থ্যাঙ্কস গিভিং প্যারেডে পিলগ্রিম (ব্রিটিশ অরিজিন, যারা ধর্মযাজক হিসেবে অজানার ঊদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রা করেছিল এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে আমেরিকার মেসাচুসেটসে প্লীমথ কলোনীতে তাদের সন্ধান পাওয়া যায়), আমেরিকান ইন্ডিয়ান ( আদি আমেরিকান)দের ডিস্পলে দেখানো হয়ে থাকে। থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’র সারাদিন আনন্দে কাটিয়ে সকলেই প্রস্তুত হয় পরেরদিন ‘থ্যাঙ্কস গিভিং সেল’ এর জন্য। প্রতি বছর, আমেরিকায় থ্যাঙ্কস গিভিং সেল এর রমরমা ব্যবসা দেশটির অর্থনীতির সূচককাঁটা ঘুরিয়ে দেয়। ফলে থায়ঙ্কস গিভিং ডে’র ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্য অপেক্ষা বাণিজ্যিক দিকটাই বেশী প্রকাশিত হয়ে পরে।
থ্যাঙ্ক গিভিং ডে উৎসবের সূচনাঃ
১৬২০
সালের আগস্ট মাসে ‘মে ফ্লাওয়ার’ নামের ১০৮ টনের এক জাহাজ ইংল্যান্ডের সাউথ
হ্যাম্পটন থেকে যাত্রা করে। জাহাজে ছিল ১০২ জন যাত্রী, ইংল্যান্ডে বসবাসকালীন সময়ে
স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা করায় তাদের অনেক বাধা ছিল, তাই স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা করার
ঊদ্দেশ্যে ‘মে ফ্লাওয়ারে’ চেপে ইংল্যান্ড ছেড়ে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে বের হয়। দুই
তিন মাস বাদে তারা আমেরিকার মেসাচুসেটস বে তে এসে পৌঁছে। ততদিনে যাত্রীদের অনেকেই
অর্ধাহারে, অনাহারে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে, কিছু যাত্রীর মৃত্যু হয়। নতুন স্থানে
পৌঁছে অনেকেই শীতের তীব্রতায় অসুস্থ ও দূর্বল হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে তারা মেসাচুসেটসেই
যাত্রা বিরতি করে। যারা সুস্থ ছিলো, জাহাজ থেকে তীরে এসে নামে। যদিও তাদের গন্তব্য
ছিল ভার্জিনিয়া কোস্ট, যেখানে আরও অন্যান্য পিলগ্রিমদের বসবাস ছিল, সেখানে পৌঁছাতে
না পেরে মেসাচুসেটসেই তাদের প্লীমথ কলোনী গড়ে তোলে। শুরু হয় মুক্ত স্বাধীনভাবে
বেঁচে থাকার সংগ্রাম, স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার উদ্যোগ। তবে শুরুতেই তাদের অনেক
কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়। নতুন দেশ, নতুন আবহাওয়া, শীতের তীব্রতায় প্রতিদিনই দুই
একজনের জীবন সংকট দেখা দিতে থাকে। কেউ কেউ মারাও যায়।
শীত
পেরিয়ে যখন বসন্তের আগমন ঘটে, বেঁচে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা
দেয়। তারা ধীরে ধীরে ঘর-বাড়ি বানাতে শুরু করে, আশেপাশের স্থাণীয় ইন্ডিয়ান
উপজাতিদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলা, উপজাতিদের সাহায্যে চাষ-বাস করাসহ বেঁচে থাকার
তাগিদে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে দেয়। উপজাতিদের সাথে উৎপাদিত দ্রব্য বিনিময় প্রথা
চালু হয়। এভাবেই ধীরে ধীরে প্লীমথ কলোনী বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে।
১৬২১
সালের নভেম্বার মাসে প্লিমথবাসী প্রথমবারের মত নিজেদের উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলে।
ফসলের মধ্যে ভুট্টার ফলন এত বেশী ভালো হয়েছিল যে তৎকালীন গভর্নর উইলিয়াম
ব্র্যাডফোর্ড এই উপলক্ষে সমস্ত ইন্ডিয়ান উপজাতি এবং প্লি্মথ কলোনিবাসীদের সৌজন্যে
‘ফিস্টি’ আয়োজন করেন। ফিস্টির দিনটিকে সকলে ঈশ্বরের নামে উৎসর্গ করে। সকলেই কৃতজ্ঞ
চিত্তে ঈশ্বরকে স্মরণ করে, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায়, কারন ঈশ্বরের কৃপায় তারা বেঁচে
আছে, প্রভুর দয়ায় তাদের সকলের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠেছে, পতিত বন্যভূমিকে সকলে মিলে
বাসযোগ্য কলোনি হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছে, ঈশ্বর কৃপা করেছে বলেই উৎপাদিত ফসলে
তাদের গোলা ভরে উঠেছে, ফসলের ফলন এত বেশী হয়েছে যে আগামী শীত কেটে যাবে কোন খাদ্য
ঘাটতি ছাড়া। ঈশ্বরের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন শেষে নিজেদের মধ্যে ধন্যবাদ বিনিময় হয়,
খাওয়া দাওয়া হয়, সকলে মিলে আনন্দ-ফূর্তিতে কাটিয়ে দেয় একটি দিন। সেই থেকে
অনুষ্ঠানটি আমেরিকার সর্ব প্রথম ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
প্লীমথ কলোনিবাসীর দেখাদেখি থ্যাঙ্কস গিভিং ডে উদযাপনের এই রীতি অন্যান্য
কলোনিবাসীদের মাঝে প্রচলিত হতে থাকে। তবে বছরের নির্দিষ্ট দিনে তা পালিত হতো না।
কলোনিবাসীদের নিজেদের সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী তারা বছরের একটি দিন থ্যাঙ্কস গিভিং ডে
উদযাপন করতো।
সরকারীভাবে
সর্ব প্রথম ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ উদযাপিত হয়েছিল নিউইয়র্কে, ১৮১৭ সালে। এরপর থেকে
প্রতি বছর অন্যান্য স্টেটেও উৎসবটি পালিত হতে থাকে। নিউইয়র্ক এবং অন্যান্য স্টেটে
দিনটি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষিত ছিল। পরবর্তীতে সকল স্টেট থেকে থ্যাঙ্কসগিভিং ডে’কে
জাতীয় ছুটির দিন ঘোষণা করার পক্ষে জোর দাবী উঠতে থাকে। ১৮২৭ সালে বিখ্যাত নার্সারী রাইম ‘মেরি হ্যাড আ
লিটল ল্যাম্ব’ রচয়িতা সারাহ যোসেফা উদ্যোগ নেন, দীর্ঘ ৩৬ বছর তিনি একটানা
আর্টিক্যাল, এডিটোরিয়েল লিখাসহ এই আবেদনের সপক্ষে প্রচুর চিঠিপত্র গভর্নর, সিনেটর,
প্রেসিডেন্ট, রাজনীতিবিদদের কাছে পাঠিয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত ১৮৬৩ সালে তৎকালীন
প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, সারাহ যোসেফের আবেদন খুব গুরুত্ব সহকারে গ্রহন করেন
এবং ‘সিভিল ওয়ার’ চলাকালীন সময়েই জনগনের উদ্দেশ্যে আবেদনমূলক ঘোষনা দেন, সকলেই যেন
পরম করুনাময় ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা জানায়, “হে ঈশ্বর! তোমার স্নেহের পরশ, অপার
করুণা তুমি তাদের উপর বর্ষন করো, যারা সিভিল ওয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যে নারী
স্বামী হারিয়েছে, যে সন্তান পিতৃহারা হয়েছে, যা ক্ষতি সমস্ত জাতির হয়েছে, সমস্ত
ক্ষতি যেনো দ্রুত সারিয়ে তোলা যায়। জীবিত সকলের যেন মঙ্গল হয়’। একই বছর
প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন নভেম্বার মাসের শেষ বৃহস্পতিবার ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ হিসেবে
সরকারী ছুটির দিন ঘোষনা করেন।
পরবর্তীতে,
বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা শুরু হয়। ‘গ্রেট
ডিপ্রেশান’ হিসেবে পরিচিত অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠার লক্ষ্যে ১৯৩৯ সালে তৎকালীন
প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট রিটেল সেল বাড়ানোর ঊদ্দেশ্যে এই ছুটি এক সপ্তাহ
এগিয়ে আনা্র ঘোষনা দেন, এবং সেই থেকে শেষ বৃহস্পতিবারের পরিবর্তে নভেম্বার মাসের
চতুর্থ বৃহস্পতিবার ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ পালিত হয়।
যদিও
বর্তমানে অধিকাংশ আমেরিকাবাসীর কাছেই থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’র ঐতিহাসিক গুরুত্ব বা
তাৎপর্য্য খুবই কম, বাণিজ্যিক জৌলুসটাই সকলের নজরে আসে, তারপরেও শুধু আমেরিকা বা
কানাডাতে দিনটি উদযাপিত না হয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও তা পালিত হতে পারে। ঈশ্বরকে
ধন্যবাদ তো প্রতি নিয়তই দেয়া উচিত এমন সুন্দর এক পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন বলে,
ধন্যবাদ দেয়া উচিত, এই সুন্দর পৃথিবীর সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য আমাদের সৃষ্টি
করেছেন বলে, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য পৃথিবীটাকে নানা ধনসম্পদে ভরিয়ে রেখেছেন বলে।
আমাদের সকলেরই তো সপ্তদশ শতাব্দীর জাহাজ ‘মে ফ্লাওয়ার’ থেকে নেমে আসা পিলগ্রিমদের
মতই পরিশ্রম করে ফসল ফলানোর কথা, শত্রু নয় বন্ধু নীতিতে চলার কথা, তা না করে
আধুনিক বিশ্বে মানুষ হয়ে উঠছে স্বার্থপর, নিষ্ঠুর, অমানবিক। প্রতিদিন নিষ্ঠুর
গোলার আঘাতে হত্যা করে চলেছে অসহায় নারী, পুরুষ, শিশু। যে আমেরিকাতে থ্যাঙ্কস
গিভিং ডে’ উৎসবের শুরু, সেই আমেরিকাই এখন সারা বিশ্বে যুদ্ধবাজ দেশ হিসেবে পরিচিতি
লাভ করেছে।
থ্যাঙ্কস
গিভিং ডে’ শুধুমাত্র প্রতীকী দিবস হিসেবে পালিত না হয়ে, আক্ষরিক অর্থেই পারস্পরিক
বন্ধুত্ব, ভালো কাজের স্বীকৃতি, পারস্পরিক সহযোগীতা, সহমর্মিতা ও উদারতায় পরিপূর্ণ
হোক। মানুষ যুদ্ধ বিগ্রহ ভুলে, হানাহানি, মারামারি বন্ধ করে, প্রতিবেশী, প্রতিবেশী
দেশ তথা সারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের সাথে বন্ধুত্ব অথবা সন্ধি করার কথা ভাবুক,
তবেই ঈশ্বরও আমাদের জীবনে তাঁর করুণা
বর্ষণ করবেন। ঈশ্বরের করুণায় সিক্ত হয়ে আমরাও প্রতিদিন অথবা প্রতি মাস অথবা বছরের
একটি দিন, ঈশ্বরের জয়গান করতে পারি, ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে পারি আমাদের প্রতি অবারিত
করুণা বর্ষনের জন্য।
No comments:
Post a Comment