Wednesday, July 31, 2013

কে জানে, আমার জীবনে কালকের ভোর নাও আসতে পারে!




  
ভদ্রলোকের দিকে এক নজর তাকিয়েই বুঝতে পেরেছিলাম, ভদ্রলোক মেনোনাইট সম্প্রদায়ের। আজ আমার কাজের স্কেজিউল ছিল বিকেল পাঁচটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত, শর্ট শিফট। ওয়ালমার্টের অয়্যারলেস ডিপার্টমেন্ট রাত নয়টায় ক্লোজড হয়, এই ধরণের শর্ট শিফটে আমরা বাকী এক ঘন্টা ইলেকট্রনিকস ডিপার্টমেন্টে বন্ধুদের সাথে কাটিয়ে বাড়ী চলে আসি।

আজ বিকেল ছয়টার দিকে সেই ভদ্রলোকটি হাতে একখানা পুরনো ইঙ্ক কার্ট্রিজ নিয়ে আমাদের ডিপার্টমেন্টে এসেছে, সামনে পেয়েছে আমাকে, তাই আমাকেই জিজ্ঞেস করেছে, ঠিক এই মডেলের ইঙ্ক কার্ট্রিজ আমাদের কাছে আছে কিনা। ইঙ্ক কার্ট্রিজ হচ্ছে ইলেকট্রনিক্স ডিপার্টমেন্টের জিনিস, আমি ভদ্রলোককে কম্পিউটার আইলের কাছে নিয়ে কার্ট্রিজ এর শেলফ দেখিয়ে ফিরে এসেছি। মিনিট পনের পর ভদ্রলোক আবার ঘুরে ফিরে আমার কাছেই এসেছে, হাতে ধরা সেই পুরনো কার্ট্রিজ। ফটো ভর্তি দুটো ভারী খাম আমার দিকে এগিয়ে দিলো, আর বলল, নাহ! এই নাম্বারের ইঙ্ক কার্ট্রিজ পেলামনা, ছবিগুলোর দাম দিয়ে চলে যাই
  
ওয়ালমার্টে প্রতিদিন অ্যামিশ, মেনোনাইট, মর্মন ্সম্প্রদায়ের লোকজন দেখতে পাওয়া যায়। আগে এদের সাথে কত যে গল্প করতাম। একটু সুযোগ পেলেই ওদের সাথে দাঁড়িয়ে গল্প জুড়ে দিতাম। কত রকমের মানুষ আমাদের চারপাশে, আমার খুব ভাল লাগে মানুষের জীবনের গল্প শুনতে। যে সম্প্রদায়গুলোর নাম বললাম, এরা হচ্ছে আমাদের দেশের গোঁড়া ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মত। ওরা আধুনিকতাকে অস্বীকার করে, যান্ত্রিক সভ্যতাকে পছন্দ করেনা, ওরা নিজেদের তৈরী স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে, সেই লেখাপড়াও ধর্মীয় বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ, কারো যদি নার্সিং পড়ার ইচ্ছে থাকে, তবে সে নার্সিং পড়তে যায়। লেখাপড়া এই পর্যন্তই। ওরা অন্য সম্প্রদায়ে বিয়ে করেনা, ওরা জন্ম নিয়ন্ত্রণে বিশ্বাস করেনা, কৃষিকাজ, পশুপালন, তাঁতী, জেলে, কাঠমিস্ত্রীগিরি করে ওরা আয় উপার্জন করে। এই সম্প্রদায়ের নারীরা ভীষন পর্দানশীল হয়ে থাকে। তাদের পোশাক হয় গলা থেকে পায়ের গোঁড়ালী পর্যন্ত ঢাকা দেয়া, মাথার চুল সব সময় খোঁপা করে টুপী দিয়ে আটকানো, শীত গ্রীষ্ম বারোমাস একই ডিজাইনের পোশাক, আমেরিকান স্টাইলের গেঞ্জী প্যান্ট ওরা পড়েনা, আমেরিকান মেয়েদের মত সানবাথ করেনা, লীভ টুগেদার করেনা, ডিভোর্সও করেনা। টাকা পয়সা বুকে নিয়ে বসে থাকেনা, টাকা পয়সা যা কিছু আছে, সব নাকি চার্চে দান করে দেয়।

অ্যামিশ অথবা মেনোনাইটস সম্প্রদায়ের মানুষগুলো আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ওরা সকলেই ইমিগ্র্যান্ট। সুইৎজারল্যান্ড, জার্মানীতে ‘মেনোনাইট’ নামের বেশ বড় গোষ্ঠীর সম্প্রদায় ছিল, যারা চার্চের কঠিন নিয়মে পরিশীলিত, সুশৃংখল, কঠোর নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে মেনোনাইট সম্প্রদায়ের সদস্যগণ ঈশ্বরের বাণী প্রচারে আমেরিকায় আসে। আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটে অ্যামিশ, মেনোনাইটরা দলবদ্ধ বা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে থাকে।
ওরা আধুনিক জগতের কোন সংবাদ রাখে না। ঝলমলে আমেরিকায় বাস করে ওরা ইলেকট্রিসিটি ব্যবহার করেনা, টিভি দেখেনা, রেডিও শোনেনা, টেলিফোন ব্যবহার করেনা। মুভী দেখার প্রশ্নই উঠে না। কারণ, ওদের বিশ্বাস, টিভি দেখলে বা রেডিও শুনলে বাচ্চারা শুধু নোংরামী শিখবে। কারো বাড়ীতেই বৈদ্যুতিক আলো জ্বলেনা, ফ্যান, এসি, ফ্রীজ কিছুই চলেনা। ওদের বিশ্বাস ইলেকট্রিসিটির ব্যবহারে প্রকৃতির আলো বাতাসে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাড়ীতে ওয়াটার সাপ্লাইয়ের পানির বদলে ওরা ডিপ টিউব ওয়েলের পানি ব্যবহার করে। এখনও সারা বিশ্বে মিলিয়নের উপর মেনোনাইট সম্প্রদায়ের লোকজন আছে।

ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি মর্মন?
-না, আমি মেনোনাইট।

-আচ্ছা, আমি তো জানতাম অ্যামিশ, মেনোনাইটরা ফটো তুলেনা, কিন্তু তুমি তো দেখছি দুই প্যাকেট ছবি নিয়ে এসেছো চেক আউট করতে।

আমার প্রশ্নে ভদ্রলোক একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায়, বলে, তুমি ঠিকই বলেছো, তবে আমরা মানুষের ছবি তুলিনা, প্রকৃতির ছবি তুলি।

জানা উত্তর জেনেও আবার জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা, তোমরা যে মানুষের ছবি তোলনা, তোমাদের নানা-দাদা, নানী দাদীরা দেখতে কে কেমন ছিল কি করে জানবে?

-ঈশ্বরের সৃষ্টি মানুষ তো সবাই একরকম হয় দেখতে।
-তাতো বুঝলাম, কিন্তু সবাই এক বললেই কি সবাই এক?
-না বাইবেলে আছে, মানুষের ছবি রাখা ঠিক না।
-তাহলে তো তোমার ভবিষ্যত বংশধরেরা জানবেই না তুমি দেখতে কেমন ছিলে!
-তা জানবেনা, আমাদের বংশে কেউ ফটো তুলেনা, পুরো বাড়ীতে আমার মায়ের একটি ছবি ছিল, আমার বাবা তুলেছে, সেই ছবিটা বোধ হয় হারিয়ে গিয়েছে, নাহয় আমার বউ কোথাও রেখে দিয়েছে।
-তোমার মায়ের ছবি তুলেছিল তোমার বাবা? বিশ্বাস করতে পারছিনা।
-আমার বাবা তো আগে মেনোনাইট ছিলেননা। উনি মেনোনাইটদের চার্চে যেতেননা।
-বাবারে! তাহলে তোমার বাবা তোমার মাকে কিভাবে বিয়ে করলো? তোমরা তো নিজের সম্প্রদায়ের পাত্র পাত্রী না পেলে ছেলেমেয়ের বিয়ে দাওনা, তাহলে তোমার মা কি করে তোমার বাবাকে বিয়ে করলো?

-শোন, আমার দাদা-দাদী মেনোনাইট ছিলেননা, কিন্তু আর্লি থার্টিজের দিকে আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দাভাব দেখা দেয়, তুমি নিশ্চয়ই সেটা জানো, তখন আমার দাদা-দাদীর জীবনেও খুব অর্থকষ্ট দেখা দেয়, চারদিকে শুধু গরীব মানুষ। দাদা তখন মেনোনাইট চার্চে যাওয়া শুরু করে, মেনোনাইট চার্চে সব সময় বলা হতো বাইবেলের পথে নিজেকে চালাতে, যীশুর পায়ে নিজেকে সমর্পণ করে দিতে, তাহলেই শান্তি। এরপর আমার দাদা-দাদী চার্চের কাজ নিয়ে ক্যালিফোর্ণিয়াতে চলে যায়, ওখানে গিয়ে আমার বাবাকেও মেনোনাইট চার্চে নিয়ে যাওয়া হয়, চার্চের হয়ে কাজ করবে। বাবার বয়স ছিল ষোল বা সতের বছর, বাবা মায়ের কথামত বেশ কিছুদিন চার্চে কাজ করে, কিন্তু একসময় কাজ ছেড়ে ওখান থেকে চলে আসে। তার কাছে চার্চের নিয়ম ভালো লাগতোনা।
আমার মায়ের বাবা মাও গরীব ছিল, তারা ছিল মেনোনাইট, পুরো পরিবার মেনোনাইট চার্চ-এর হয়ে কাজ করতো, সকলকে বুঝাতো, সকলে বাইবেলে বর্ণিত পথে এসো, সব বালা মুসিবত দূর হয়ে যাবে। তখন অনেক গরীব মানুষ মেনোনাইট ধর্মে দীক্ষা নেয়। আমার নানা নানীও এভাবেই মেনোনাইট হয়েছিলেন। আমার বাবার বয়স যখন বাইশ, আমার মায়ের সাথে দেখা হয়। দুজনে মন দেয়া নেয়া হয়, এরপর তারা বিয়ে করেন।

-কিন্তু তোমরা তো নিজ সম্প্রদায়ের বাইরে বিয়ে করোনা, তোমার বাবা তো মেনোনাইট ছিলেননা, তাহলে তোমার মায়ের সাথে বিয়ে হলো কি করে?

-না না, বাবা পরে মেনোনাইট হয়েছিল।
-তোমার মাকে বিয়ে করার জন্য মেনোনাইট হয়েছিল?
-হ্যাঁ, মাকে বিয়ে করার জন্য। এরপর বাবা আর্মীতে চলে যায়, চার বছর কাজ করে আবার ক্যালিফোর্ণিয়া চলে আসে।


এমন সময় তার পকেটে থাকা ফোন বেজে উঠে। সে হ্যালো হ্যালো করে, এবং কারো সাথে কথা বলে।
-আমি বলি, আচ্ছা, তোমাদের তো ফোন ব্যবহার করাও নিষিদ্ধ, টিভি দেখা নিষিদ্ধ এবং কম্পিউটার চালানো নিষিদ্ধ, অথচ তুমি তো দেখি সব কটা নিষিদ্ধ কাজই করে যাচ্ছো, হা হা হা!

-হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছো, তবে প্রয়োজনের সময় তো ফোন লাগে। আমার স্ত্রী ফোন করেছে।

-তাহলে তুমি মেনে নিচ্ছ, প্রয়োজন যখন বড় হয়, তখন ধর্মের বাণী অকেজো হয়ে যায়?

আবার ভদ্রলোক থতমত খেলেন, বললেন, আমরা ফোন খুব জরুরী প্রয়োজনে ব্যবহার করি, আর কম্পিউটারও ব্যবহার করি প্রয়োজনে, সব কিছুতেই ফিল্টারএর ব্যবস্থা রাখি। ইন্টারনেটের ব্যবহার খুব সীমিত। যদিও টিভি দেখার নিয়ম নেই, তারপরেও কম্পিউটার চালানো মানেই টিভি দেখার মত ব্যাপার। অবশ্য প্রয়োজন ছাড়া তো কিছু করিনা।

-টিভি নিউজ দেখা কি প্রয়োজনের মধ্যে পড়েনা?

ভদ্রলোক হেসে ফেললেন। বললেন, বাইবেলে আছে, খুব সাধারণ জীবন যাপন করার কথা। টিভি না দেখেও তো জীবন চলে যাচ্ছে।

-আচ্ছা, তোমরা ছেলেমেয়েকে পাবলিক স্কুলে পাঠাওনা কেন?
-আমাদের নিজেদের স্কুল আছে তো।
-সেখানে ওরা কি শেখে? এ বি সি ডি শিখে তারপর কি বাইবেল শিখে?
-বাইবেলের বাণী তো অবশ্যই শেখে, নানা বিষয়েই শিক্ষা দেয়া হয়, তবে তার সবই বাইবেল আর যীশু সম্পর্কিত।
-কলেজে পাঠাওনা কেন?
-ক্লাস এইটের বেশী পড়ার দরকার নেই তো।
-আচ্ছা, তোমরা তো কেউই ক্লাস এইটের বেশী পড়াশুনা করোনা, কাজেই বাইরে ঘরে তো চাকুরী পাওয়ার প্রশ্নই আসেনা। তোমাদের সোর্স অফ ইনকাম কি?

-কৃষি কাজ করি, এই যেমন আমি নৌকা বানাই, এখানে অনেকেই বোটিং করে, সেইসব বোট বানাই।

-তোমাদের মধ্যে অনেক ধনী আছেন, নৌকা বানিয়ে, কৃষিকাজ করে তারা কীভাবে ধনী হয়? এই যেমন ধরো, প্রেসিডেন্ট ইলেকশানে দাঁড়িয়েছিলেন, মিট রমনি, মর্মন সম্প্রদায়ের লোক, বিশাল ধনীলোক উনি, উনি তো লেখাপড়া শিখেছিলেন, কীভাবে শিখলেন লেখা পড়া?

-আমরা ধনী নই, তবে কিছু কিছু ধনী মানুষ তো অবশ্যই আছে।

-তোমার কয় ছেলেমেয়ে?
-দুই মেয়ে দুই ছেলে।
-তারা সবাই ক্লাস এইট পাস?
-হ্যাঁ, ক্লাস এইট পাস, না, না, ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছে, আমার ছোট মেয়ে এখন স্বামী, সন্তান নিয়ে রাশিয়াতে আছে।
-রাশিয়াতে কি মেনোনাইট চার্চে কাজ করে?
-হ্যাঁ, চার্চে কাজ করে। বাকী ছেলেমেয়েরা সকলেই হাতের কাজ করে।

ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, তোমরা তো আধুনিক সভ্যতাকে পছন্দ করোনা, তোমরা যান্ত্রিক, বৈদ্যুতিক যে কোন উন্নতিকে বাইবেলে বর্ণিত ধর্মকথার পরিপন্থী মনে করো। তা ঠিক আছে, কিন্তু তোমরা যখন বাইরের জগতে আসো, এই যেমন ধরো তুমি আজ এখানে এসেছো, আমাকে দেখছো, আমার মত আরও প্রচুর মানুষকে দেখছো, আমরা কেউই মেনোনাইট নই, আমরা সকলেই টিভি দেখি, সিনেমায় যাই, হোটেল রেস্টুরেন্টে খাই, কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, চাকরী বাকরী করি, সবকিছুই তোমাদের বিশ্বাসের পরিপন্থী, আমাদের দেখে তোমাদের প্রথম অনুভূতিটা কি হয়? আমাদেরকে কি শত্রু মনে হয়, ডেভিল মনে হয়?

-উফ! তুমি পারো বটে, একদিন আসো আমাদের চার্চে, আরো অনেকের সাথে আলাপ হবে,  এমনিতে আমি তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবোনা, কারণ আমি কাউকে জাজ করতে পারবোনা।

-কাউকে জাজ করতে বলিনি, আচ্ছা, সবার কথা বলতে হবেনা, আমাকেই জাজ করো, আমি সত্যি কথাটুকু জানতে চাইছি। আমার খুব ইচ্ছে করে প্রতিটি মানুষের চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে কিছু জানি, সবার অনুভূতিটুকু জানি, তেমনই করেই আমার এখন জানতে ইচ্ছে করছে, আমি তো সম্পূর্ণ অন্য জগতের মানুষ, আমার সাথে এতক্ষন কথা বলে তোমার কি মনে হচ্ছে?

-ধরো, তোমার মত মানুষদেরকে প্রথম দেখায় সাধারণ ভালো মানুষ মনে হয়, আমার বিশ্বাসের সাথে তোমার বিশ্বাসে মিল নেই, তারপরেও তুমি ভালো, তোমার পোশাক পরিচ্ছদ, কথাবার্তা বলার ভঙ্গী অনেক ভাল, কিন্তু সত্যি কথা বলি, বাইরে বেরিয়ে কিছু কিছু ছেলেমেয়ে দেখি, ভালো লাগেনা।

-তাহলে এটা তো মানবে, একেবারে ধর্মীয় কঠিন অনুশাসনে না থেকেও আধুনিক ধ্যানধারণায় মেনে চলাফেরা করেও ইচ্ছে করলে ভালো মানুষ হওয়া যায়।

-কে জানে, আমরা বাইবেলে বর্ণিত জীবন মেনে চলতে ভালোবাসি।

-তোমার নামটিই জানা হলোনা।

-আমার নাম ডোয়াইট পিস্টার, বয়স ৬৩। পিস্টার কথাটি মনে থাকবে? ইস্টার তো জানো, ইস্টার না বলে বলবে পিস্টার।

-আচ্ছা মিঃ পিস্টার, এত ধর্ম মেনে চলো, তোমাদের মধ্যে হিংসা-দ্বেষ, ঝগড়া বিবাদ হয়? তোমরা ঝগড়া করো? মানে, তোমাদের মধ্যে কি কখনও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব হয়?

-আমরা স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া করিনা, বলেই আবার একটু থামলো, বলল, ঝগড়া করিনা বলা পুরোপুরি ঠিক হলোনা, মাঝে মাঝে ছোটখাটো বিষয়ে হয়তো মতবিরোধ হয়, কিন্তু সারাদিনে যাই হোক না কেন, রাতে বিছানায় ঘুমুতে যাওয়ার আগে আমরা প্রার্থণায় বসি, প্রার্থণা শেষে দুজনেই দিনের ঝগড়া মিটমাট করে ফেলি। দুজনেই নিজেদের আচরণের জন্য পরস্পর দুঃখপ্রকাশ করি। হাসিমুখে বিছানায় যাই।

-বাহ! ঝগড়া করে আবার ঘুমুতে যাওয়ার আগে মিটমাট করে ফেলো, কীভাবে পারো শত্রুতা ভুলে যেতে? আমি তো ঝগড়াটে স্বামীর সাথে সাত দিন কথাই বলবোনা।

-এটা করি কারণ আমি তো জানিনা, আমার জীবনে আগামী সকাল আসবে কিনা। আমরা কেউই জানিনা আজ রাত পেরিয়ে কালকের ভোর দেখবো কিনা, তাই আজকের দিনের খারাপ স্মৃতি মনে নিয়ে ঘুমাতে যাওয়া ঠিক নয়। এইজন্যই বিছানায় যাওয়ার আগে মন পরিষ্কার করে নিতে হয়।

-সত্যি করে বলি, এতক্ষণে একটা ভীষন দামী কথা শুনলাম, পুরো দার্শনিকের কথা, মনে থাকলে আমি আজ থেকেই তা নিজের জীবনে চালু করবো, শুধু স্বামী কেন, পুত্র-কন্যা, বন্ধু বান্ধবের কাছেও ক্ষমা চেয়ে বিছানায় যাওয়া উচিত, কে জানে, আমার জীবনে কালকের ভোর নাও আসতে পারে!

Monday, July 22, 2013

আমার সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বেলে~~~


গত বছরের ২২শে জুলাই সন্ধ্যা, আমি বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরেছি, উত্তরার অস্থায়ী ফ্ল্যাটের প্রতিটি রুম কাপড় চোপর, গিফটের প্যাকেট, হাঁড়ি-পাতিল, স্যুটকেস, হাত ব্যাগে ভর্তি হয়ে আছে। পরের দিন ২৩শে জুলাই আমাদের ফ্লাইট, আড়াই মাসের বাংলাদেশ সফরের সমাপ্তি। কিচ্ছু গোছানো হয়নি, কখন গোছাবো তারও ঠিক ঠিকানা নেই, মাথা পুরোপুরি এলোমেলো। কেউ কিছু বললেই মেজাজ দেখাচ্ছি, তাই কেউ ধারে কাছে ঘেঁষছেও না।  বাসায় ছিল আমার ছোটমাসী, তার মেয়ে মিত্রা, আমার স্বামী, দুই মেয়ে মিশা ও মিথীলা। আর কেউ ছিল কিনা মনে পড়ছেনা।
মাসীর মেয়ে মিত্রা আগের দিন চিটাগাং ইউনিভার্সিটি থেকে এসেছে। মিত্রার সাথে আমার সম্পর্ক বোনের চেয়েও আরও বেশী কিছু। মিত্রা আমার বড় মেয়ে মৌটুসীর বয়সী, ওর সাথে আমি সব ধরণের সুখ-দুঃখের গল্প করি। ও জানে, প্রতিবার আমেরিকা ফিরে যাওয়ার সময় আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়, দেশ ছেড়ে চলে আসবো, প্রিয়জন ছেড়ে চলে আসবো, সেই কষ্ট আমি ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারিনা বলেই তুচ্ছ কারণেই রেগে উঠি, তারপর হয়তো হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করি।
মিত্রা খুব ঠান্ডা মাথার মেয়ে, ওর মায়ের মত স্বভাব।  আমাকে সব সময় স্যুটকেস গোছাতে সাহায্য করে। আমাকে সাহায্য করবে বলে এবার ওর পরীক্ষা সামনে রেখেই চলে এসেছে, ও শুনেছে, আমার স্যুটকেসের ওজন একেকটা ৬০ পাউন্ডের বেশী হয়ে যাচ্ছে। এই টেনশানে আমার ঘুমও হচ্ছেনা। তাই একুশে জুলাই ও আমাদের বাসায় আসে। আমার ছোটমাসী আরও অনেক আগে থেকেই আমার সাথে ছিল। ছোটমাসীর সাথে আমার সম্পর্ক হচ্ছে, 'ফেভিকল' এর আঠার মত। এই উপমা দিয়েছেন আমার মা জননী। যতক্ষণ এয়ারপোর্টের দরজা দিয়ে প্রবেশ না করি, আমাদের আঠা নাকি ছুটেনা। এমন সব উদ্ভট উদ্ভট কথা মা বলতো।

বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় আমি এক বছর একটানা লিখেছিলাম, এই পত্রিকার সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক, উপ সম্পাদক সাহেবের প্রতি এত বেশী কৃতজ্ঞ ছিলাম যে মিত্রাকে সাথে করে বিকেলে ওখানে গিয়েছিলাম বিদায়ী ধন্যবাদ জানাতে। রমজান মাস ছিল, আমার খুব ইচ্ছে ছিল পত্রিকা অফিসের সকলকে মিষ্টি খাওয়াই। কিন্তু রোজার মাসে সব মিষ্টি দোকান বিকেল পর্যন্ত পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে, আমার কেন জানি খুব অস্বস্তি হয় পর্দা ঢাকা সরিয়ে খাবার কিনতে। তাই অফিসে যাওয়ার সময় কিছু কিনে নিয়ে যেতে পারিনি, সবার সাথে দেখা করে, শুভেচ্ছা বিনিময় করে যখন চলে আসি, ততক্ষণে বিকেল প্রায় শেষ। বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার সময় আমার মাথায় ছিল স্যুটকেস গোছানোর নয় মণ চিন্তা, সদ্য প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদ স্মরণে কিছু লিখবার তাগিদ, এবং প্রতিটি স্যুটকেসের ওজন পঞ্চাশ পাউন্ডের মধ্যে সীমিত রাখা। এত চিন্তা মাথায় নিয়ে উত্তরার আলীবাবা মিষ্টির দোকানে ঢুকে দেখি প্রতিটি আইটেম অল্প অল্প করে  আছে। মেজাজটা তখনই খিঁচড়ে গেলো, খুবই অভদ্রের মত এলোমেলোভাবে মিষ্টি কিনে পাঠিয়ে দিলাম পত্রিকা অফিসে।

মনটা খুব খারাপ করেই উত্তরার অস্থায়ী ফ্ল্যাটে ঢুকলাম। আমার এবারের বাংলাদেশ সফরটা যেন কেমন হলো, অনেক কাজই করেছি, কিন্তু মনের কোথায় যেনো একটা অস্বস্তি রয়েই গেছিল। কি যেন করিনি, কি যেন পাইনি, কি যেন হারিয়ে যাচ্ছে আমার জীবন থেকে, এমন একটা হুতাশ ভাব নিয়ে আমার শেষ মুহূর্তগুলো কাটছিল। আমার এত সাধের বাপের বাড়ীতেও এবার থাকা হয়নি, আড়াই মাস বাংলাদেশে থেকে নারায়ণগঞ্জে থেকেছি মাত্র দুইটি রাত। কোথায় যে হাহাকার হচ্ছিল, ধরতেই পারছিলামনা। মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতেও পারিনি, মায়ের কাছে অপরাধী হয়েছিলাম। আমি প্রতিবার আমেরিকা ফিরে আসার দুই দিন আগেই মা চলে আসে, দাঁড়িয়ে থেকে সব গোছগাছ করায়। এবারও মা বলেছিল, দুই দিন আগে যেন গাড়ী পাঠিয়ে দেই, আসবে। মায়ের মন, মায়ের বুকেও নিশ্চয়ই কষ্ট ছিল, তার একটা মাত্র মেয়ে, মা'কে ভুলে কেমন দিব্বি আড়াই মাস আলেং ফালেং করে কাটিয়ে দিল। মা আসবে বলেও শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলে ফেললো, জানালো আসতে পারবেনা, এই প্রথম মা মেয়ের বিদায়ের আগে এলোনা। আগে কখনও এমন হয়নি, আমারও রাগ হলো, অভিমান হলো, মা'কে ফোনও করলামনা, জেদ উঠে গেলো, তুমি আসলেনা, আমিও তোমার সাথে কথা বলবোনা। তোমাকে ফোনও করবোনা, মজাটা বুঝবে।



২২ তারিখ সন্ধ্যায় ফোনটা  যখন এলো, আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, জগ থেকে জল ঢালছিলাম গ্লাসে, জগ রেখে দিলাম, ফোনের রিসিভ বাটনে চাপ দিয়ে  হ্যালো বলতেই ছোট ভাইয়ের বউ, অনীতা বললো,
"ফুলদি, নমিতা মামী কথা বলবে আপনার সাথে"।
নমিতা মামী হচ্ছেন মায়ের প্রতিবেশী, প্রতিবেশী বললে কম বলা হয়, মায়ের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী বলা যায়। রতন স্যার নারায়ণগঞ্জ বার একাডেমী স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, রতন স্যারের বাবা 'বিনয় মাস্টার'ও ছিলেন অনেক আগের নামকরা শিক্ষক। বিনয় মাস্টারকে আমার মা ছোটবেলায় বোধ হয় কাকা বা জ্যেঠামশায় ডাকতেন, সেই সুবাদে রতন স্যার মায়ের ছোট ভাই। আমার মাও তো শিক্ষক ছিলেন। সেই হিসেবেও ভাই আর দিদি। পরে প্রতিবেশী হয়ে সম্পর্ক আরও বেশী গভীর হয়েছে।
নমিতা মামী খুব স্মার্ট, করিৎকর্মা, পরোপকারী, এবং খুবই মিশুক টাইপের মানুষ। আমার মা'কে 'দিদি' ডাকতো এবং সম্মান করতো। মা ইদানিং নমিতা মামীর উপর খুব নির্ভর করতেন। প্রায়ই উনাদের বারান্দায় গিয়ে বসতেন, পাড়া-প্রতিবেশীদের সংবাদ নিতেন। আমি যখনই আমেরিকা থেকে মা'কে কল দিতাম, যে কোন সুযোগ পেলেই মা নমীতা মামীর কথা বলতেন। বুঝতাম, এত বড় বাড়ীতে এঁরাই মায়ের স্বজন, এঁরাই মায়ের বান্ধব। আমি বা ছোটমাসী তো কত দূরে থাকি, সব সময় মন চাইলেই তো আর আমার সাথে কথা বলতে পারেনা। আমি যখন ঢাকায় ছিলাম, মা-বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম। কোম্পাণীর গাড়ী ছিল, ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ চলে আসতাম, বাবাকে, মাকে গাড়ীতে তুলে নিয়ে চলে যেতাম ঢাকার বিখ্যাত ডাক্তারদের কাছে। আগাগোড়া চেক আপ করিয়ে নিজেও নিশ্চিন্ত হতাম, তাঁদেরকেও নিশ্চিন্ত করতাম। ঈশ্বরের কৃপা ছিল, আমার মা এবং বাবা, দু'জনের কারো কোনরকম সমস্যা ছিলনা।

গতবার যখন বাংলাদেশে যাব, একদিন ফোনে মা জানালো, তার শরীরটা বেশী ভাল লাগেনা। মায়ের শরীর ভাল লাগেনা শুনে আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল। মায়ের কেন শরীর খারাপ হবে? মায়ের শরীর খারাপ হওয়া মানেই আমাদের সব আনন্দ অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া মায়ের আদরের নাতনীর বিয়ে, কোথায় মা আনন্দে লাফাবে, তা না করে কেমন নিস্তেজ মনমরা হয়ে আছে। ইচ্ছে করে এমন করছে, মা আমাকে দুই চোখে দেখতে পারেনা, সব সময় আমার সাথে খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে, কোথাও বেড়াতে যেতে দিতে চায়না, মাসীকে নিয়ে যদি ডি আই টি মার্কেটেও যাই, মার্কেট থেকে ফেরার সাথে সাথে শুরু হয়ে যাবে ট্যারা ট্যারা কথা।

মা ফোনেই বলল, " মিঠু, এইবার যখন তুই আসবি, তোর সাথে যাব ডাক্তারের কাছে"। দিলাম এক ধমক, " আমার জন্য বসে থাকবে? আমি তো ব্যস্ত থাকবো মৌটুসীর বিয়ে নিয়ে, এতদিন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে আগেই যাও ডাক্তারের কাছে"।
" না তুই আসলেই যাব"।
"আচ্ছা, ঠিক আছে, এতদিন বরঞ্চ একটু শক্তি সঞ্চয় করো, মৌটুসী তোমার প্রথম নাতনী, তুমি কিন্তু নিজের হাতে বিয়ে দিবে।"
" দেখা যাক, সময় আসুক"।
মায়ের কন্ঠ খুব নিস্তেজ ছিল। আমি কিছু বুঝিও নি। আমার মাথায় তখন মেয়ে বিয়ের চিন্তা, আমার স্বামীকে দেশে নিয়ে যেতে পারছি, এতেই আমি কৃতার্থ। দেশে কমিউনিটি সেন্টার ঠিক করা, খাওয়ার ম্যেনু ঠিক করা, রাঁধুনী ঠিক করা থেকে শুরু করে প্রতিটি বিষয়ে আমাকে মাথা ঘামাতে হয়েছে। আমি আমেরিকায় বসে থেকেই দেশে আমার দাদাদের মাধ্যমে এইসব কিছু ব্যবস্থা করেছি। আমার লোকবল খুব ভাল। অদিতি টুম্পা নামে আমার এক ভাগ্নী আছে। ও হচ্ছে আমার ডানহাত এবং বাম হাত। মৌটুসী, মিত্রাদের বয়েসী, আমাকে মামী ডাকে। টুম্পা হচ্ছে আমার 'চেলা'। ওর যা ক্ষমতা, ওর বাবা বা মায়েরও এমন ক্ষমতা নেই। ওর নেটওয়ার্ক খুবই শক্তিশালী। টুম্পার অনেক সাহায্য নিয়েছিলাম মেয়ের বিয়ে আয়োজন করতে গিয়ে।

মেয়ের বিয়েতেই ব্যস্ত ছিলাম জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত, তারপর বন্ধু বান্ধব নিয়ে ব্যস্ততা, বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় নতুন লিখি, সেই লেখা নিয়ে উৎকন্ঠা, কিছু শপিং, কিছু নেমন্তন্ন খাওয়া, নিজের বাড়ীতে নেমন্তন্ন খাওয়ানো, সুনামগঞ্জ ছোটমাসীর বাড়ীতে বেড়াতে যাওয়া, সেখান থেকে জাফলং ঘুরতে যাওয়া, এই সব করতে করতেই জুলাই মাসের ২২ তারিখ চলে এসেছে। হঠাৎ খেয়াল হয়েছে, আমি নারায়ণগঞ্জে গিয়ে থাকিনি, আমরা রওনা হওয়ার আগে মা আসবে বলেছিল, শরীর ভাল লাগেনা বলে শেষ পর্যন্ত মা আসতে পারেননি। আমি মায়ের কাছে থাকলামনা এটা আমার একবারও মনে হলোনা, মনের মধ্যে একরাশ অভিমান জন্মালো, আমি চলে আসবো জেনেও মা এলোনা বলে। এইজন্য মা'কে ফোনও করতামনা, মা জানে, আমার অনেক রাগ, আমার অনেক অভিমান। আমি সব সময় চাইতাম, সবাই আমার কাছে এসে থাকবে, আমি যাওয়ার সময় যেন সবাইকে দেখতে পাই। এইবার আমার মেয়েটা শ্বশুরবাড়ী চলে গেলো, এমনিতেই আমার বুকটা ফাঁকা হয়ে আছে, এরমধ্যে মাও এলোনা, ভীষন কষ্ট বুকে জমেছিল, জলের গ্লাসটা ভরছিলাম, জলটুকু খেয়েই মিত্রাকে নিয়ে স্যুটকেসগুলো ধরবো।

নমীতা মামী বললো, " মিঠু, আমি তোমার মামী। তোমার মা'কে নিয়ে আজকে ডাক্তারের কাছে গেছিলাম। তোমাকে জানানো দরকার, তোমার মায়ের রিপোর্ট ভালো আসে নাই। ডাক্তার আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে বলছে, রিপোর্ট ভালোনা, বায়োপসী করতে হবে"।

আমার মনে হলো, মামী এসব কি বলছে? মায়ের কীসের রিপোর্টের কথা বলছে? হঠাৎ করে খেয়াল হলো, এক সপ্তাহ আগে মামীর সাথে মা ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল, অতিরিক্ত স্রাবের সমস্যা নিয়ে। আমাকেও মা বলেছিল ফোনে, আমি বলেছিলাম, চিন্তা না করতে। আমার ছোট মাসীর ননদ গায়নোকোলজিস্ট, তার পরামর্শমত ওষুধ মা'কে খাওয়ানো হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম, সব মহিলাদেরই মাঝে মাঝে এই ধরণের সমস্যা হয়ে থাকে, তখন মেট্রানিডাজোল কোর্স করলেই সেরে যায়, নিশ্চয়ই মায়েরটাও সেরে গেছে। না সারলে তো মা বলতোই। মা অবশ্য বলেছে, তবে আমাকে না, নমীতা মামীকে বলেছে। ডাক্তার প্যাপস্মিয়ার টেস্ট করেছে, তার রিপোর্ট আরও পাঁচ দিন আগেই নিয়ে এসেছে, আলসেমী করে অথবা ভয়ানক খারাপ কিছু শুনতে হবে ভয়ে মা ডাক্তারের কাছে যায়নি। আজ বিকেলে বোধ হয় রিপোর্ট নিয়ে গেছিল, তখন ডাক্তার মামীকে বলেছে, রিপোর্ট খারাপ এসেছে। বায়োপসী করার কথা শুনলে সকলেরই ভয় করে। মামীরও ভয় করেছে, তাই আমাকে জানিয়েছে। মামী আমাকে ঐ ডাক্তারের ফোন নাম্বারও দিয়েছে, যদি আমি কথা বলতে চাই।

আমার মাথাটা ঘুরে উঠলো, ডাক্তারের নাম্বারে ডায়াল করলাম, ডাক্তার ফোন ধরেই খুবই অভদ্রভাবে বললেন, " হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি কথা বলেন, আমার রুগী আছে"।
আমি বললাম, " ডক্টর, আমিও রুগীর পক্ষ থেকে ফোন করেছি। রুগী আমার মা'।
" হ্যাঁ আমি তো বলেই দিয়েছি, বায়োপসী করতে হবে"।
"ডক্টর, আমি উনার মেয়ে, কালকেই চলে যেতে হচ্ছে , কী হয়েছে আমার মায়ের, একটু খুলে বলবেন প্লীজ?
" এখন বলা যাবেনা, বায়োপসী না করে। এখন রাখি।"
-প্লীজ ডক্টর, একটু শুধু বলেন, কিসের  বায়োপসী করতে চাচ্ছেন ?
'ঐ তো, আপনার মায়ের ইউটেরাসের অবস্থা খুব খারাপ, সেটার বায়োপসী করতে চাই।
-আপনার কি মনে হচ্ছে ক্যান্সারাস কিছু হতে পারে?
-অসম্ভব না।

নমিতা মামীকে ফোন করে জানলাম, ডাক্তার নাকি বলেছে, মা'কে কাল সকালে একটি ক্লিনিকে নিয়ে যেতে, ডাক্তার ঐ সময় ঐ ক্লিনিকে কোন একটা সার্জারী নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন, এক ফাঁকে মায়ের ইউটেরাস থেকে স্পেসিমেন সংগ্রহ করে আমার ভাইয়ের কাছে দিয়ে দিবেন। ভাইকে ঐ স্পেসিমেন সাথে নিয়ে ঢাকা আসতে হবে, ডাক্তারের নির্দেশীত কোন প্যাথলজীতে স্পেসিমেন দিয়ে আসতে হবে। তারা টেস্ট করে পরে রিপোর্ট নেয়ার ডেট জানিয়ে দিবে।

আমি অনেক বছর ধরে আমেরিকা আছি, ধ্যান ধারণা তো কিছু পাল্টেছেই। আমার মাথায় ঢুকছিলনা, এমন একটি জরুরী স্পেসিমেন কি করে রুগীর স্বজনের হাতে দিয়ে দেয়া যায়? কি করে রুগীর স্বজন ঐ স্পেসিমেন নিয়ে চার ঘন্টা ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে থেকে ঢাকা গিয়ে পৌঁছায়? এতবড় গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষা, যার উপর একজন রুগীর চিকিৎসা নির্ভর করে, যদি কোন কারণে স্পেসিমেনের কৌটো হাত থেকে পড়ে যায়, অথবা রাস্তার গরমে স্পেসিমেন নষ্ট হয়ে যায়, অথবা ল্যাবরেটরী যদি তেমন একটা সুবিধার না হয়, পরীক্ষা যদি সঠিক না হয়, রিপোর্ট তো সঠিক আসবেনা।

আমার স্বামীকে সব খুলে বললাম, আমার মুখের চেহারা সাদা হয়ে গেছে, মাসীর চেহারা সাদা হয়ে গেছে, আমার বুকটার মধ্যে কে যেনো হাতুড়ী দিয়ে পেটাচ্ছিল। আমি শুরু করে দিলাম চোটপাট, ডাক্তারের মুন্ডুপাত করতে থাকলাম। আমি কোনভাবেই মত দিতে পারছিলামনা এমন সিদ্ধান্তের উপর। আমার স্বামী আমেরিকা যাওয়ার আগে চার পাঁচ বছর স্কয়ার ফার্মাতে আর এন্ড ডি'র জিএম হিসেবে কর্মরত ছিলেন। স্কয়ার ফার্মার প্রতিষ্ঠাতা স্যামসান চৌধুরীকে আমার স্বামী কাকাবাবু ডাকতেন, উনার ছেলেদের সাথে ছোটবেলায় ঢাকা ব্যাপটিস্ট মিশনে ছিলেন। কলেজ লাইফ থেকেই উনাদের সাথে আমার স্বামীর ঘনিষ্ঠতা ছিল। পরিচয়ের সেই সূত্র ধরেই আমি স্বামীকে অনুরোধ করলাম,

" আমাদের ফ্লাইট কাল মাঝরাতে, তুমি কি সকালে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দিতে পারোনা, মায়ের ইউটেরাসের বায়োপসীটা যদি স্কয়ার হাসপাতাল থেকে করাতে পারি, তাহলে রিপোর্ট সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে পারবো। এই হাসপাতালের যন্ত্রপাতি সবই তো আধুনিক, ফলাফল অ্যাকুরেট আসার সম্ভাবনা।"  সন্ধ্যার ফোনে আমাদের সকলের হতচকিত অবস্থা। স্বামী বললেন, " টুম্পাকে কল দাও, ও ব্যবস্থা করতে পারবে।"

এই সেই টুম্পা, অদিতি টুম্পা, আমার পাগলী ভাগ্নী, রক্তের সম্পর্ক নেই, আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই, অথচ ও আমার আত্মার অংশ। আমাকে ও কি যে ভালোবাসে, কোন কারন ছাড়া ভালোবাসা, স্বার্থ ছাড়া ভালোবাসা। ওর বাবা চাকরী করেন স্কয়ারে। কিন্তু বাবাকে মাধ্যম ধরেনা ও, আগেই বলেছি, ওর নেটওয়ার্ক খুব শক্তিশালী, সকলেই ওর কাকু হয়, সকলেই ওর মামু হয়। ওকে ফোন করলাম, আমার গলার আওয়াজ শুনে টুম্পা প্রায় কেঁদে ফেলে। চিন্তা করতে মানা করলো। দশ মিনিট পরেই জানালো, "সকাল দশটার সময় অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেছে, দিদাকে নিয়ে চলে এসো হাসপাতালে। আমার এক মামা থাকবে ওখানে, মামার ফোন নাম্বার রেখে দাও, প্রয়োজনে ফোন করো"।

অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেছে শুনে আমার বুকের ভেতর থেকে সেই নয় মণ বোঝা নেমে গেলো। মনে হলো, আর চিন্তা নেই। স্কয়ারে বায়োপসী করলেই জানা যাবে, কিছু হয়নি। হয়তো ইউটেরাসে ইনফেকশান হয়েছে, নারায়ণগঞ্জের ডাক্তার অনেক ব্যস্ত মানুষ, হয়তো খেয়াল করেননি। বাসায় ফোন করে বললাম, কাল সকালে গাড়ী যাবে, মা যেন নমিতা মামীকে সাথে নিয়ে চলে আসে। স্কয়ার হাসপাতালে মায়ের ইউটেরাসের বায়োপসী করা হবে।" আমার ছোট ভাই খুব অফেন্ডেড হয়েছে, ওরা নারায়ণগঞ্জে থাকে, ওখানের সকলের সাথে মৌখিক পরিচয় আছে, ডাক্তারের সাথে কথা পাকা হয়ে গেছে  পরদিন মা'কে ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হবে, এরমধ্যে আমি হঠাৎ করে সব বদলে দিলাম। ভাই নিজে সরকারী কলেজের অধ্যাপক,  প্রেস্টিজের একটা ব্যাপারও তো আছে। ভাইয়ের কথাও ঠিক, কিন্তু আমার যে মন মানেনি যখন শুনেছি ক্লিনিক থেকে না পাঠিয়ে রুগীর স্বজনের হাতে ধরিয়ে দিবে স্পেসিমেন, তাতেই আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। যাই হোক, ভাইকে নরম স্বরে বুঝালাম, বায়োপসী রিপোর্টের উপর নির্ভর করে রোগ নির্ণয় করা হবে, যদি ভালো কোন জায়গা থেকে টেস্ট না করানো হয়, পরে তো ভুল চিকিৎসা হবে। আমি শুধু বায়োপসীটা করানোর ব্যবস্থা করি, বাকী চিকিৎসা নারায়ণগঞ্জের ডাক্তারের কাছেই করাবি। ভাই বলল, " না, টেস্ট যেখান থেকে করানো হবে, চিকিৎসাও সেখান থেকেই করানো হবে। তোমরা তো চলে যাবে, এক ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরিয়ে আনলে সেই ডাক্তারের কাছে আর যাওয়া যায়না। অসুবিধা নাই, টেস্ট করানো নিয়ে কথা, সেই টেস্ট আগে করানো হোক। কালকে মা'কে পাঠিয়ে দিব।"



আমার মনে পড়ে গেলো, দেশে আসার আগে মা আমাকে বলেছিল, আমার সাথে ঢাকা এসে ডাক্তার দেখাবে। আমি ভুলে গেছিলাম, আমি ভুলে থেকেছিলাম, মা মনে কষ্ট পেয়েছে, মা আমাকে আর বলেনি, কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নমিতা মামীর শরণাপন্ন হয়েছে। হায় ঈশ্বর! আমাকে তুমি কীভাবে এমন এক পরীক্ষার ভেতর ফেলে দিলে? আমি তো খুব দূর্বল মনের মানুষ, কালকেই চলে যাচ্ছি, আর আজকেই শুনতে হলো মায়ের এই রোগের কথা। মায়ের কি সত্যি ক্যানসার হয়েছে? তা কি করে হয়? মা'কে সব সময় সুস্থ সবল দেখেছি, গত মাসে মৌটুসীর বিয়ের সময় মা কি হুজ্জুতেপনাটাই করলো, আমাকে কি বকাটাই না বকলো, আমি নাকি আতিথেয়তা ঠিকমত করতে পারিনি, মৌটুসীর বিয়ের প্রতিটি কাজ নিজে নিজে করলো, মৌটুসী যখন বিদায় নিচ্ছিল, আমি তো তখন আরেক ঘোরে ছিলাম, তখনও মা দিব্যি সুস্থ ছিল, মৌটুসীর দিকে কেমন করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল, ভেবেছি, প্রাণের টুকরা নাতনী, এইতো সেদিন ওটি থেকে বের হয়ে দিদার কোলে উঠেছিল, সেই পুচকীটা  আজ শ্বশুরবাড়ী চলে যাচ্ছে !! এটা ভেবেই হয়তো অমন করুণ চোখে তাকিয়েছিল।

মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, কাল সকালে গাড়ীতে আমিও থাকবো, আমাকে যেতে হবে, আমি নিজে গিয়ে মা'কে নিয়ে আসবো, হাসপাতালে আমিই নিয়ে যাব। গোছগাছের দরকার নেই, হাতের কাছে যা পাব ঢুকিয়ে নেবো স্যুটকেসে। আমার স্বামীকে বলতেই উনিও রাজী হয়ে গেলেন। আমার কাছটিতে এসে মিত্রা বলল, " ফুলদিভাই, আমিও যাব তোমার সাথে। আমিও থাকবো হাসপাতালে"। মিত্রা সাথে থাকবে জেনে বুকে অনেক বল পেলাম।  (চলবে)

Tuesday, July 9, 2013

আওয়ামীলীগ-বিএনপি কী আসলেই মুদ্রার এপিঠ -ওপিঠ???

বাংলাদেশের রাজনীতি প্রসঙ্গে কোন কথা উঠলেই অনেককে বলতে শোনা যায়, আওয়ামীলীগ আর বিএনপি হচ্ছে মুদ্রার এপিঠ  আর  ওপিঠ---এর মানে কি? এর মানে কী  দু'দলই সমমানের রাজনীতি করে? নাকি দুদলই  নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি হিসেবে দাবী করলেও আদর্শিক দিক বিচারে দুটি দলই ভিন্ন, মুদ্রার দুই পিঠের ভিন্ন ছবির মতই ভিন্ন? যদিও তাঁরাই মনে করেন আওয়ামীলীগ ও বিএনপি একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ, যাঁরা বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে সরাসরি মন্তব্য করতে ভয় পান। তারা দুটি দলকেই এক পাল্লায় রেখে নিরপেক্ষ মন্তব্য হিসেবে বলে থাকেন, দুটি দল হচ্ছে সমান, মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তাই তারা মুদ্রার দুই পিঠের দিকেও ভাল করে তাকিয়ে দেখেননা।  বাস্তবে  মুদ্রার দুই পিঠে কখনওই একই ছবি থাকেনা। বাংলাদেশের একটি মুদ্রার এপিঠে যদি থাকে শাপলা ফুল, অন্যপিঠে থাকে 'পরিবার' অথবা কোন ঐতিহাসিক মসজিদের ছবি, তাহলে কী ছবি দুটোর অর্থ এক হয়? কখনওই না, শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল, আর পরিবার হচ্ছে জনগণ। সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষিত, ভিন্ন অর্থ। সেই অর্থে অবশ্য আওয়ামীলীগ আর বিএনপিকে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ বলা যেতে পারে। যদিও মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ বলতে সাধারণতঃ নির্দিষ্ট দুজনের একই স্বভাব বা বৈশিষ্ট্যকে বুঝানো হয়ে থাকে।

 আওয়ামীলীগ আর বিএনপি্কে যদি একটি মুদ্রার সাথে তুলনা করা যায়,  দুটিই রাজনৈতিক দল হলেও  তাদের মূল্যমান এক নয়, একটি দল অতি প্রাচীন, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী দল, যে দলের 'প্রধান'এর  নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। সেই দলটির নাম আওয়ামীলীগ, আর অপর দল বিএনপির জন্ম হয়েছিল স্বাধীনতার অনেক পরে, এই দলের প্রধান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন,  বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন, দল হিসেবে আওয়ামীলীগের তুলনায় বিএনপি'র বয়স কম, দুই দলের রাজনৈতিক আদর্শে বিস্তর ফারাক না থাকলেও কিছুটা ব্যবধান  অবশ্যই আছে।

দলের গঠণতন্ত্রে আদর্শগত ফারাক থাকলেও দুই দলের শাসনামলেই প্রচুর অন্যায়, প্রচুর ভুল, প্রচুর দলাদলি, কোন্দল, রেষারেষি হয়। কিন্তু সমালোচনা যেন আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধেই বেশী হয়,  আওয়ামীলীগ যখন অন্যায় করে, ভুল করে, নিজেদের মধ্যে কোন্দল করে, তা নিয়ে দেশব্যাপী হইচই হয়, বাদ-প্রতিবাদের ঝড় উঠে, পত্র-পত্রিকা, টিভি টকশো গুলোতে আওয়ামী পন্থী বুদ্ধিজীবিরাও তীব্র ভাষায় আওয়ামীলীগ প্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, নেতা, নেত্রীদের  বিরুদ্ধে তুমুল সমালোচনা করে থাকেন, আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, সমালোচনা করার ব্যাপক সুযোগ পেয়ে থাকেন। এর  কারণ কি হতে পারে? আওয়ামীলীগ কি জনগণের দাবীর প্রতি সহানুভূতীশীল? আওয়ামীলীগ কি জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্য সদা সচেষ্ট? আওয়ামীলীগ কি বিএনপি বা অন্যান্য দলের চেয়ে তুলনামূলক অর্থে কিছুটা ভাল? নাকি এমনও হতে পারে, আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ হাসিনা  দেরীতে হলেও এক সময়  নিজেদের ভুল স্বীকার করেন, হয়তো কখনও কখনও ভুল শোধরাণোর চেষ্টাও করেন।

পক্ষান্তরে বিএনপি যখন অন্যায় করে, ভুল করে, নিজেদের মধ্যে কোন্দল করে, তা নিয়ে দেশব্যাপী হইচই হয় না, দেশব্যাপী বাদ-প্রতিবাদের ঝড় উঠেনা,  পত্র-পত্রিকায় আবদুল গাফফার চৌধুরী এবং মুনতাসীর মামুন ছাড়া আর কোন কলামিস্ট বিএনপির কোন সমালোচনা করেননা, টিভিতে তখন 'টকশো' নামে কোন অনুষ্ঠান হয় না, এমনকী দলীয় কোন্দলও নীরবেই মিটমাট হয়ে যায়, কেউ দলীয় নেতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেনা। কেন এমনটি হয়? জনগণ কি ধরেই নেয় যে বিএনপি দলীয় প্রধান বাস্তবেই আপোষহীন, উনার নিজস্ব নীতিতে উনি অটল থাকেন, নাকি জনগণ ধরেই নেয় যে বিএনপি যেটাই করে, সবই সমালোচনার ঊর্ধ্বে? অথবা বিএনপি প্রধানকে তাদের কাছে অনেক দূরের মানুষ মনে হয়, কখনওই আপনার জন মনে হয় না? ভুল বা অন্যায় তো বিএনপির আমলে কম হয় না!  কিন্তু আওয়ামীলীগপন্থী দুই একজন কলামিস্ট /সাংবাদিক ছাড়া আর কারো কাছ থেকে সমালোচনা হতে দেখিনা, কোথাও কোন সমালোচনা হয় না বলেই হয়তোবা  বিএনপি নেত্রী নিজের ভুল বুঝতেও পারেননা, তাই ভুল স্বীকারের প্রশ্নও আসেনা।

আওয়ামীলীগের যে কোন অপকর্মের বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ হয়, বিএনপির যে কোন অপকর্ম জনগণ অবধারিত হিসেবে মেনে নেয়। জলজ্যান্ত উদাহরণ  হিসেবে বিএনপির গত শাসনামলের একেবারে শেষের দিকের নির্যাতনের শিকার 'পার্থ প্রতীম সাহা' এবং বর্তমান আওয়ামীলীগের হাল আমলের নির্যাতনের শিকার 'লিমন' এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে।

পার্থপ প্রতীম সাহা এবং লিমন, দুজন নিরপরাধ যুবক, দুই সরকারের আমলে উক্ত দু'জন নিরপরাধ যুবককে অন্যায়ভাবে নির্যাতন করা হয়েছে।   নির্যাতন যে ভোগ করেছে, তার কাছে নির্যাতনের আলাদা কোন সংজ্ঞা নেই, ক্ষতি যতটুকু হওয়ার তা হয়েই যায়, মানসিক এবং শারীরিক, দুইভাবেই ক্ষতি হয়, পারিবারিক ক্ষতির কথা বলাই বাহুল্য। যে বা যারা নির্যাতন করে, নির্যাতন করে তারা পৈশাচিক আনন্দ পায়। আর সেই নির্যাতন যদি সরকারী নির্দেশে হয়ে থাকে, তার তো কোন বিচারও হয় না। যদিও সরকারী অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ করার সুযোগ থাকে এবং ক্ষেত্র বিশেষে প্রতিবাদ হয়,  জনগণের প্রতিবাদের প্রতি সরকার নমনীয় হবেন কিনা, নতি স্বীকার করবেন কিনা, সেটা একান্তই সরকারের ইচ্ছের উপর নির্ভরশীল। এখানেই আওয়ামীলীগ এবং বিএনপির আদর্শে পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। আওয়ামীলীগ নিজেদেরকে জনগণের দল হিসেবে দাবী করে বলেই জনগণের চাওয়ার প্রতি মাঝে মাঝে নমনীয় হয়, জনগণও সেটা বুঝতে পারে বলেই আওয়ামীলীগের কাছে তারা চায়। পক্ষান্তরে বিএনপি নিজেদেরকে জনগণের দল দাবী করলেও জনগণ বোধ হয় তা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনা। তাই জনগণ বিএনপির ভুল বা অন্যায়ের ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকে।

পার্থ এবং লিমন, দুই সরকারের আমলের দুই নিরপরাধ যুবক, দুই সরকারের আমলে সরকারের প্রতিরক্ষা বাহীনির সদস্য কর্তৃক নির্যাতিত, যদিও দুজনই নিরপরাধ এবং দুজনেই সরকারীভাবে নির্যাতিত, তারপরেও সরকারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা বা প্রতিবাদের জোয়ার ছিল দুই রকম। পার্থ নির্যাতিত হয়েছিল, বিএনপি আমলে, বিএনপি সরকারের সরাসরি নির্দেশে, আর লিমন নির্যাতিত হয়েছে আওয়ামীলীগ আমলে, সরকার নয়, সরকারী বাহীনি র‍্যাব এর একজন সদস্যের সরাসরি আক্রমণে। অথচ বিএনপি আমলে ঘটেছিল বলে পার্থ প্রতীম সাহা'র পক্ষে সেদিন জনজোয়ার সৃষ্টি হয়নি অথবা প্রতিবাদ করে লাভ নেই ভেবে জনগণ নির্লিপ্তি দেখিয়েছে, এবং তার মাশুল দিতে হয়েছে পার্থ সাহা এবং তার পরিবারকে, বিএনপি সরকারকে কোন মাশুল গুনতে হয়নি, পার্থ সুবিচারও পায়নি। পক্ষান্তরে আওয়ামীলীগ সরকার জনগণের দাবীর প্রতি নমনীয় হতে পারে, এই ভরসায়  লিমনের পক্ষে  জনজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, জনদাবীর কাছে আওয়ামীলীগ সরকারকে নতি স্বীকার করতে হয়েছে, ফলে আশা করা যায় লিমনের প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে, তার মাশুল  আওয়ামীলীগ সরকারকে গুনতে হবে, এবং আশার কথা, লিমন কিছুটা সুবিচার  পাবে।এখানেই আওয়ামীলীগ আর বিএনপির' রাজনীতিতে বিরাট পার্থক্য।

'লিমন'কে সরকারী প্রতিরক্ষা বাহিণী র‍্যাবের কোন এক সদস্য সরকারী নির্দেশ ছাড়াই বিনা কারণে পায়ে গুলী করে আহত করেছে, যার করুণ পরিনতিতে জীবন রক্ষার প্রয়োজনে চিকিৎসকগণ  লিমনের দেহ থেকে 'পা' খানিকে কেটে বাদ দিয়েছে, লিমনকে বরণ করতে হয়েছে পঙ্গুত্ব। এখানেই গল্পের শেষ হয়নি, র‍্যাব থেকে এই অপরাধের জন্য ক্ষমা তো চাওয়া হয়ইনি, উপরন্তু ছেলেটির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা হয়েছে। ঘটনাটি আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে ঘটেছে বলেই সারাদেশে নিন্দার ঝড় উঠেছে, নানা সামাজিক সংগঠন থেকে শুরু করে আমার মত অকর্মণ্য মানুষও বাদ যায়নি এই জঘন্য ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠতে। পত্র পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, ফেসবুকে অনেকেই নিজের ছবির বদলে 'এক পা বিহীন লিমনের' ছবি দিয়ে প্রোফাইল পিকচার বানিয়েছে।

এভাবেই দুই বছর কেটে গেছে। নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে, রাজনীতির মাঠে নতুন নতুন ইস্যু তৈরী হয়েছে, পঙ্গু লিমন মায়ের কাছে ফিরে গেছে।  সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে আসার পথে, এই সময়টিতে প্রতিটি সরকারের ভুলের মাত্রা বেড়ে যায়, আওয়ামীলীগের ভুলের মাত্রা বাড়তে শুরু করেছে, তেমনই একটি ভুল হচ্ছে অসহায় পঙ্গু লিমনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানার সংবাদটি। দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে লিমন গ্রেফতারের কাহিনী। দলটি যেহেতু আওয়ামীলীগ, তাই বাদ-প্রতিবাদের ঝড় নিজ ঘর থেকেও উঠেছে। আওয়ামীপন্থী হিসেবে সর্বজন পরিচিত প্রবীন সাংবাদিক এ বি এম মুসা সাহেবও সেদিন বলেছেন যে বর্তমান সরকারের অন্যায় -অত্যাচার এমনই মাত্রাছাড়া হয়ে উঠেছে যে আগামী সংসদ নির্বাচনে উনি প্রার্থী হবেন, প্রতীক চাইবেন, 'লিমনের কাটা পা'! দলটি আওয়ামীলীগ বলেই মুসা সাহেব এমন উক্তি করবার মত সাহস দেখিয়েছেন। ্মুসা সাহেব যে হতাশা থেকেই এমন বক্তব্য দিয়ে থাকুন না কেন,
মুসা সাহেবের মত কিছু সুযোগসন্ধানী আওয়ামী কোকিল ছাড়া, এখনও অনেকেই বিশ্বাস করে, অল্প হলেও গণতন্ত্রের চর্চা আওয়ামীলীগেই হয়, এই দলের নেত্রীর বিরুদ্ধে সত্যি-মিথ্যে মিলিয়ে হাজার রকমের প্রচার-অপপ্রচার থাকলেও একমাত্র শেখ হাসিনার কাছেই সমস্ত অন্যায়ের প্রতিকার চাওয়া যায়, এই নেত্রীর সাজ-পোশাকের দিকে তাকালেও মনে ভরসা জাগে। যেহেতু সময়ের কাজ সময়ে করা হয়নি, সেই র‍্যাব সদস্যটিকে শাস্তি দেয়া হয়নি, তাই একজন র‍্যাব সদস্যের কেলেংকারী, অন্যায় -অপরাধের দায় কাঁধে নিতে হচ্ছে শেখ হাসিনাকে।

এবার বলছি পার্থ সাহার কথা। পার্থ সাহাও ছিল একজন উচ্চশিক্ষিত, নির্বিরোধী, সংখ্যালঘু যুবক। সবেমাত্র ভারতের ব্যাঙ্গালোর থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স কমপ্লীট করে দেশে ফিরে এসেছে। ঢাকা বোনের বাসায় থেকে পাশের গলির সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে ইন্টারনেটে চাকরীর সন্ধান করছিল। সময়টি ছিল বিএনপির শাসনামল। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিল তারেক জিয়ার আস্থাভাজন  লুৎফুজ্জামান বাবর, যাকে সকলেই 'পাঙ্কু বাবর' নামেই চিনত। সেই সময়ে তৎকালীন বিরোধীনেত্রী শেখ হাসিনাকে কে বা কারা ইন্টারনেটে হত্যার হুমকী দিয়েছিল। বিএনপি আমলে শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকী দেয়া ছিল প্রতিদিনের ডাল-ভাত রান্নার মত অতি সাধারণ ব্যাপার। একবার তো হাতে কলমেই হত্যার চেষ্টা হয়েছিল, গ্রেনেড মেরেও 'কই মাছের প্রাণ' এই নারীকে হত্যা করতে পারেনি, ২৪ জন নিরপরাধ নেত্রী ও কর্মীর প্রাণ সংহার করা হয়েছিল, আর শেখ হাসিনার শ্রবনেন্দ্রিয় জখম করা হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু শাসকের গদীতে ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া, তাই এত বড় বিধ্বংসী ঘটনায় সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠার মত সুযোগই রাখা হয়নি। এইজন্যই শেখ হাসিনাকে নানাভাবে হত্যার হুমকী দেয়া অব্যাহত ছিল।

তেমনই এক হুমকীর ই-মেইল এসেছিল শেখ হাসিনার কাছে, বিরোধীনেত্রীর দলীয় কার্য্যালয় থেকে এর প্রতিবাদ জানিয়েছিল, তখনই আইন প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের  নির্দেশে পুলিশ পার্থ সাহাকে তার বোনের বাসা থেকে, তার মায়ের কোল থেকে টানতে টানতে নিয়ে এসেছিল, এবং স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী বাবরের সরাসরি নির্দেশে পার্থ সাহাকে জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রেখে 'গরুপেটা' করে কোমড় ভেঙ্গে একেবারে প্রায় মেরেই ফেলেছিল।  পার্থ সাহার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ ছিল? অভিযোগ ছিল, ভারতের ব্যাঙ্গালোর থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স ডিগ্রী সমাপ্ত করে পার্থ ঢাকা বোনের বাসার কাছাকাছি সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে চাকরী খোঁজার উছিলায় শেখ হাসিনাকে 'হত্যার হুমকী' দিয়ে ই-মেইল করেছিল। পাংকু বাবরের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল স্কুল পর্যায় পর্যন্ত, তাই তার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে এমন একটি জবরদস্তিমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। কোন তথ্য প্রমান ছাড়াই প্রতিমন্ত্রী সাহেব আধমরা পার্থ সাহার বিরুদ্ধে মামলাও করেছিল।

যেহেতু ওটা ছিল বিএনপি শাসনামল, এবং পার্থ ছিল পার্থ সাহা, অর্থাৎ সংখ্যালঘু হিন্দু, তাই কোথাও প্রতিবাদের তুমুল ঝড় উঠেনি, কেউ পার্থ সাহার ছবি দিয়ে ফেসবুক আইডি বানায়নি [ যদিও তখন ইন্টারনেট অমন রমরমা ছিলোনা, ফেসবুকের প্রচলন ছিলোনা, যদিও দ্রুত ইন্টারনেট, ফেসবুক বর্তমান আওয়ামীলীগের শাসনামলের আধুনিক অবদান, তারপরেও বলা যায়, বিএনপি শাসনামলে যদি ফেসবুক থাকতো, একমাত্র হিন্দুরা ছাড়া আর কেউ বোধ হয় পার্থর ছবি দিয়ে প্রোফাইল আইডিও বানাতো না] । শাসনামলটি বিএনপির ছিল বলে, আওয়ামীপন্থী সাংবাদিক এ বি এম মুসা সাহেব অথবা এককালীন ছাত্রলীগের রাজনীতি করা সাংবাদিক, বামপন্থীদের গালি দেয়া সাংবাদিকসহ কেউ কলম চালায়নি এমন একটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে। পত্রিকার পাতা তন্ন তন্ন করেও কোথাও বিএনপি পন্থী অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়ার বক্তব্য পাইনি। কখনও কানে আসেনি যে অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া অথবা অধ্যাপক এমাজজুদ্দিন বলেছেন, তাঁরা সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াবেন, প্রতীক হিসেবে চাইবেন 'পার্থ সাহার ভাঙ্গা কোমড়'। কোথাও শুনিনি, কোন আসরেও শুনিনি, বিএনপিপন্থী কোন বন্ধুর মুখেও তারেক জিয়া এবং তার আজ্ঞাবাহী পাঙ্কু বাবরের বিরুদ্ধে এতটুকু অভিযোগও শুনিনি। বেগম খালেদা জিয়াকেও এমন একটি নিষ্ঠুর অন্যায়ের বিরুদ্ধে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখিনি, আমিও দেখিনি, একজন দেশবাসীও দেখেনি।

লিমনের প্রতি অত্যন্ত অন্যায় করা হয়েছে, সরাসরি সরকারীভাবে করা না হলেও,  সরকারী বাহীনির সদস্য এই কাজটি করেছে। তরতাজা সুস্থ সবল যুবক, যার তখন কলেজে পড়ার কথা, র‍্যাব সদস্যের আক্রোশের শিকার হয়ে তাকে এক পা হারিয়ে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছিল। জনরোষ সৃষ্টির আগেই যদি সরকার থেকে তৎক্ষনাৎ র‍্যাব সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতো, লিমনের পাশে দাঁড়াতে হতো, লিমনের বিরুদ্ধে সকল মামলা তখনই তুলে নেয়া হতো, লিমনের পরিবারের প্রতি সহানুভূতি দেখানো হতো, তাহলেই জল ঘোলা হতোনা, ছেলেটিও সুবিচার পেত।

কথায় বলে, সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। তারপরেও বিলম্বে হলেও সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে, লিমনের বিরুদ্ধে র‍্যাব কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা তুলে নেয়া হয়েছে, হয়তো সরকার থেকেই লিমনের ভবিষ্যতে মাথা তুলে দাঁড়াবার ব্যবস্থাও করা হবে, এই শুভ বুদ্ধি উদয়ের পেছনে যে যত খুশী কারণ খুঁজুক, আমি  উল্লসিত সরকারকে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে বাধ্য হতে দেখে। আমাদের সকলের উচিত লিমনের ব্যাপারে সরকারের সঠিক সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো, সরকারের সমালোচনা  যেমন করা যায়, তেমনি সরকারের ভাল কাজের প্রশংসা করতে বাধা কোথায়? সরকারে আওয়ামীলীগ আছে বলেই কি সব সময় ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতেই হবে?

পার্থ সাহাও তো লিমনের মতই নিরীহ যুবক ছিল, তাকেও তো চিরতরে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল, আদালতের বিচারক পর্যন্ত আঁতকে উঠেছিলেন যখন আসামী হিসেবে বাবরের পুলিশেরা ধরাধরি করে পার্থ সাহার নিষ্প্রাণ, নির্বাক, নিশ্চল দেহটিকে এনে বিচারকের সামনে হাজির করেছিল। তখন তো কেউ জোর প্রতিবাদ করেনি, বিএনপি সরকারকে 'দুয়ো' দেয়নি।  এমন কি পার্থ সাহার কোন ছবিও প্রকাশিত হয়নি পত্র পত্রিকায়! সে তুলনায় আওয়ামীলীগ সরকার জনগণের দাবীর কাছে মাথা নত করেছে, এতেই তো জনগনের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা প্রমানিত হয়েছে।

জনগণ তো এটুকুই চায়। ভুল হতেই পারে, ভুল স্বীকার করে ভুল শোধরাণোর অভিপ্রায় থাকাটি একটি সরকারের জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। আওয়ামীলীগের মধ্যে সেই অভিপ্রায় মাঝে মাঝেই দেখা যায়, বিএনপির মধ্যে কখনওই তা দেখা যায়নি, দেখা যাচ্ছেনা। এইজন্যই মুদ্রা একই হলেও মুদ্রার দুই পিঠে একই ছাপ থাকে না। একটি মুদ্রার একপিঠে যদি থাকে জাতীয় ফুল শাপলা, অন্যপিঠে থাকে 'জনগণ'। ভিন্ন ছবি, ভিন্ন অর্থ। আওয়ামীলীগ আর বিএনপি রাজনৈতিক দল হলেও, একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ হলেও আদর্শগত বিচারে কিছু ভিন্নতা থেকেই যায়।