Tuesday, July 9, 2013

আওয়ামীলীগ-বিএনপি কী আসলেই মুদ্রার এপিঠ -ওপিঠ???

বাংলাদেশের রাজনীতি প্রসঙ্গে কোন কথা উঠলেই অনেককে বলতে শোনা যায়, আওয়ামীলীগ আর বিএনপি হচ্ছে মুদ্রার এপিঠ  আর  ওপিঠ---এর মানে কি? এর মানে কী  দু'দলই সমমানের রাজনীতি করে? নাকি দুদলই  নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি হিসেবে দাবী করলেও আদর্শিক দিক বিচারে দুটি দলই ভিন্ন, মুদ্রার দুই পিঠের ভিন্ন ছবির মতই ভিন্ন? যদিও তাঁরাই মনে করেন আওয়ামীলীগ ও বিএনপি একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ, যাঁরা বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে সরাসরি মন্তব্য করতে ভয় পান। তারা দুটি দলকেই এক পাল্লায় রেখে নিরপেক্ষ মন্তব্য হিসেবে বলে থাকেন, দুটি দল হচ্ছে সমান, মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তাই তারা মুদ্রার দুই পিঠের দিকেও ভাল করে তাকিয়ে দেখেননা।  বাস্তবে  মুদ্রার দুই পিঠে কখনওই একই ছবি থাকেনা। বাংলাদেশের একটি মুদ্রার এপিঠে যদি থাকে শাপলা ফুল, অন্যপিঠে থাকে 'পরিবার' অথবা কোন ঐতিহাসিক মসজিদের ছবি, তাহলে কী ছবি দুটোর অর্থ এক হয়? কখনওই না, শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল, আর পরিবার হচ্ছে জনগণ। সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষিত, ভিন্ন অর্থ। সেই অর্থে অবশ্য আওয়ামীলীগ আর বিএনপিকে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ বলা যেতে পারে। যদিও মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ বলতে সাধারণতঃ নির্দিষ্ট দুজনের একই স্বভাব বা বৈশিষ্ট্যকে বুঝানো হয়ে থাকে।

 আওয়ামীলীগ আর বিএনপি্কে যদি একটি মুদ্রার সাথে তুলনা করা যায়,  দুটিই রাজনৈতিক দল হলেও  তাদের মূল্যমান এক নয়, একটি দল অতি প্রাচীন, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী দল, যে দলের 'প্রধান'এর  নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। সেই দলটির নাম আওয়ামীলীগ, আর অপর দল বিএনপির জন্ম হয়েছিল স্বাধীনতার অনেক পরে, এই দলের প্রধান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন,  বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন, দল হিসেবে আওয়ামীলীগের তুলনায় বিএনপি'র বয়স কম, দুই দলের রাজনৈতিক আদর্শে বিস্তর ফারাক না থাকলেও কিছুটা ব্যবধান  অবশ্যই আছে।

দলের গঠণতন্ত্রে আদর্শগত ফারাক থাকলেও দুই দলের শাসনামলেই প্রচুর অন্যায়, প্রচুর ভুল, প্রচুর দলাদলি, কোন্দল, রেষারেষি হয়। কিন্তু সমালোচনা যেন আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধেই বেশী হয়,  আওয়ামীলীগ যখন অন্যায় করে, ভুল করে, নিজেদের মধ্যে কোন্দল করে, তা নিয়ে দেশব্যাপী হইচই হয়, বাদ-প্রতিবাদের ঝড় উঠে, পত্র-পত্রিকা, টিভি টকশো গুলোতে আওয়ামী পন্থী বুদ্ধিজীবিরাও তীব্র ভাষায় আওয়ামীলীগ প্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, নেতা, নেত্রীদের  বিরুদ্ধে তুমুল সমালোচনা করে থাকেন, আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, সমালোচনা করার ব্যাপক সুযোগ পেয়ে থাকেন। এর  কারণ কি হতে পারে? আওয়ামীলীগ কি জনগণের দাবীর প্রতি সহানুভূতীশীল? আওয়ামীলীগ কি জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্য সদা সচেষ্ট? আওয়ামীলীগ কি বিএনপি বা অন্যান্য দলের চেয়ে তুলনামূলক অর্থে কিছুটা ভাল? নাকি এমনও হতে পারে, আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ হাসিনা  দেরীতে হলেও এক সময়  নিজেদের ভুল স্বীকার করেন, হয়তো কখনও কখনও ভুল শোধরাণোর চেষ্টাও করেন।

পক্ষান্তরে বিএনপি যখন অন্যায় করে, ভুল করে, নিজেদের মধ্যে কোন্দল করে, তা নিয়ে দেশব্যাপী হইচই হয় না, দেশব্যাপী বাদ-প্রতিবাদের ঝড় উঠেনা,  পত্র-পত্রিকায় আবদুল গাফফার চৌধুরী এবং মুনতাসীর মামুন ছাড়া আর কোন কলামিস্ট বিএনপির কোন সমালোচনা করেননা, টিভিতে তখন 'টকশো' নামে কোন অনুষ্ঠান হয় না, এমনকী দলীয় কোন্দলও নীরবেই মিটমাট হয়ে যায়, কেউ দলীয় নেতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেনা। কেন এমনটি হয়? জনগণ কি ধরেই নেয় যে বিএনপি দলীয় প্রধান বাস্তবেই আপোষহীন, উনার নিজস্ব নীতিতে উনি অটল থাকেন, নাকি জনগণ ধরেই নেয় যে বিএনপি যেটাই করে, সবই সমালোচনার ঊর্ধ্বে? অথবা বিএনপি প্রধানকে তাদের কাছে অনেক দূরের মানুষ মনে হয়, কখনওই আপনার জন মনে হয় না? ভুল বা অন্যায় তো বিএনপির আমলে কম হয় না!  কিন্তু আওয়ামীলীগপন্থী দুই একজন কলামিস্ট /সাংবাদিক ছাড়া আর কারো কাছ থেকে সমালোচনা হতে দেখিনা, কোথাও কোন সমালোচনা হয় না বলেই হয়তোবা  বিএনপি নেত্রী নিজের ভুল বুঝতেও পারেননা, তাই ভুল স্বীকারের প্রশ্নও আসেনা।

আওয়ামীলীগের যে কোন অপকর্মের বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ হয়, বিএনপির যে কোন অপকর্ম জনগণ অবধারিত হিসেবে মেনে নেয়। জলজ্যান্ত উদাহরণ  হিসেবে বিএনপির গত শাসনামলের একেবারে শেষের দিকের নির্যাতনের শিকার 'পার্থ প্রতীম সাহা' এবং বর্তমান আওয়ামীলীগের হাল আমলের নির্যাতনের শিকার 'লিমন' এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে।

পার্থপ প্রতীম সাহা এবং লিমন, দুজন নিরপরাধ যুবক, দুই সরকারের আমলে উক্ত দু'জন নিরপরাধ যুবককে অন্যায়ভাবে নির্যাতন করা হয়েছে।   নির্যাতন যে ভোগ করেছে, তার কাছে নির্যাতনের আলাদা কোন সংজ্ঞা নেই, ক্ষতি যতটুকু হওয়ার তা হয়েই যায়, মানসিক এবং শারীরিক, দুইভাবেই ক্ষতি হয়, পারিবারিক ক্ষতির কথা বলাই বাহুল্য। যে বা যারা নির্যাতন করে, নির্যাতন করে তারা পৈশাচিক আনন্দ পায়। আর সেই নির্যাতন যদি সরকারী নির্দেশে হয়ে থাকে, তার তো কোন বিচারও হয় না। যদিও সরকারী অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ করার সুযোগ থাকে এবং ক্ষেত্র বিশেষে প্রতিবাদ হয়,  জনগণের প্রতিবাদের প্রতি সরকার নমনীয় হবেন কিনা, নতি স্বীকার করবেন কিনা, সেটা একান্তই সরকারের ইচ্ছের উপর নির্ভরশীল। এখানেই আওয়ামীলীগ এবং বিএনপির আদর্শে পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। আওয়ামীলীগ নিজেদেরকে জনগণের দল হিসেবে দাবী করে বলেই জনগণের চাওয়ার প্রতি মাঝে মাঝে নমনীয় হয়, জনগণও সেটা বুঝতে পারে বলেই আওয়ামীলীগের কাছে তারা চায়। পক্ষান্তরে বিএনপি নিজেদেরকে জনগণের দল দাবী করলেও জনগণ বোধ হয় তা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনা। তাই জনগণ বিএনপির ভুল বা অন্যায়ের ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকে।

পার্থ এবং লিমন, দুই সরকারের আমলের দুই নিরপরাধ যুবক, দুই সরকারের আমলে সরকারের প্রতিরক্ষা বাহীনির সদস্য কর্তৃক নির্যাতিত, যদিও দুজনই নিরপরাধ এবং দুজনেই সরকারীভাবে নির্যাতিত, তারপরেও সরকারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা বা প্রতিবাদের জোয়ার ছিল দুই রকম। পার্থ নির্যাতিত হয়েছিল, বিএনপি আমলে, বিএনপি সরকারের সরাসরি নির্দেশে, আর লিমন নির্যাতিত হয়েছে আওয়ামীলীগ আমলে, সরকার নয়, সরকারী বাহীনি র‍্যাব এর একজন সদস্যের সরাসরি আক্রমণে। অথচ বিএনপি আমলে ঘটেছিল বলে পার্থ প্রতীম সাহা'র পক্ষে সেদিন জনজোয়ার সৃষ্টি হয়নি অথবা প্রতিবাদ করে লাভ নেই ভেবে জনগণ নির্লিপ্তি দেখিয়েছে, এবং তার মাশুল দিতে হয়েছে পার্থ সাহা এবং তার পরিবারকে, বিএনপি সরকারকে কোন মাশুল গুনতে হয়নি, পার্থ সুবিচারও পায়নি। পক্ষান্তরে আওয়ামীলীগ সরকার জনগণের দাবীর প্রতি নমনীয় হতে পারে, এই ভরসায়  লিমনের পক্ষে  জনজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, জনদাবীর কাছে আওয়ামীলীগ সরকারকে নতি স্বীকার করতে হয়েছে, ফলে আশা করা যায় লিমনের প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে, তার মাশুল  আওয়ামীলীগ সরকারকে গুনতে হবে, এবং আশার কথা, লিমন কিছুটা সুবিচার  পাবে।এখানেই আওয়ামীলীগ আর বিএনপির' রাজনীতিতে বিরাট পার্থক্য।

'লিমন'কে সরকারী প্রতিরক্ষা বাহিণী র‍্যাবের কোন এক সদস্য সরকারী নির্দেশ ছাড়াই বিনা কারণে পায়ে গুলী করে আহত করেছে, যার করুণ পরিনতিতে জীবন রক্ষার প্রয়োজনে চিকিৎসকগণ  লিমনের দেহ থেকে 'পা' খানিকে কেটে বাদ দিয়েছে, লিমনকে বরণ করতে হয়েছে পঙ্গুত্ব। এখানেই গল্পের শেষ হয়নি, র‍্যাব থেকে এই অপরাধের জন্য ক্ষমা তো চাওয়া হয়ইনি, উপরন্তু ছেলেটির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা হয়েছে। ঘটনাটি আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে ঘটেছে বলেই সারাদেশে নিন্দার ঝড় উঠেছে, নানা সামাজিক সংগঠন থেকে শুরু করে আমার মত অকর্মণ্য মানুষও বাদ যায়নি এই জঘন্য ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠতে। পত্র পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, ফেসবুকে অনেকেই নিজের ছবির বদলে 'এক পা বিহীন লিমনের' ছবি দিয়ে প্রোফাইল পিকচার বানিয়েছে।

এভাবেই দুই বছর কেটে গেছে। নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে, রাজনীতির মাঠে নতুন নতুন ইস্যু তৈরী হয়েছে, পঙ্গু লিমন মায়ের কাছে ফিরে গেছে।  সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে আসার পথে, এই সময়টিতে প্রতিটি সরকারের ভুলের মাত্রা বেড়ে যায়, আওয়ামীলীগের ভুলের মাত্রা বাড়তে শুরু করেছে, তেমনই একটি ভুল হচ্ছে অসহায় পঙ্গু লিমনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানার সংবাদটি। দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে লিমন গ্রেফতারের কাহিনী। দলটি যেহেতু আওয়ামীলীগ, তাই বাদ-প্রতিবাদের ঝড় নিজ ঘর থেকেও উঠেছে। আওয়ামীপন্থী হিসেবে সর্বজন পরিচিত প্রবীন সাংবাদিক এ বি এম মুসা সাহেবও সেদিন বলেছেন যে বর্তমান সরকারের অন্যায় -অত্যাচার এমনই মাত্রাছাড়া হয়ে উঠেছে যে আগামী সংসদ নির্বাচনে উনি প্রার্থী হবেন, প্রতীক চাইবেন, 'লিমনের কাটা পা'! দলটি আওয়ামীলীগ বলেই মুসা সাহেব এমন উক্তি করবার মত সাহস দেখিয়েছেন। ্মুসা সাহেব যে হতাশা থেকেই এমন বক্তব্য দিয়ে থাকুন না কেন,
মুসা সাহেবের মত কিছু সুযোগসন্ধানী আওয়ামী কোকিল ছাড়া, এখনও অনেকেই বিশ্বাস করে, অল্প হলেও গণতন্ত্রের চর্চা আওয়ামীলীগেই হয়, এই দলের নেত্রীর বিরুদ্ধে সত্যি-মিথ্যে মিলিয়ে হাজার রকমের প্রচার-অপপ্রচার থাকলেও একমাত্র শেখ হাসিনার কাছেই সমস্ত অন্যায়ের প্রতিকার চাওয়া যায়, এই নেত্রীর সাজ-পোশাকের দিকে তাকালেও মনে ভরসা জাগে। যেহেতু সময়ের কাজ সময়ে করা হয়নি, সেই র‍্যাব সদস্যটিকে শাস্তি দেয়া হয়নি, তাই একজন র‍্যাব সদস্যের কেলেংকারী, অন্যায় -অপরাধের দায় কাঁধে নিতে হচ্ছে শেখ হাসিনাকে।

এবার বলছি পার্থ সাহার কথা। পার্থ সাহাও ছিল একজন উচ্চশিক্ষিত, নির্বিরোধী, সংখ্যালঘু যুবক। সবেমাত্র ভারতের ব্যাঙ্গালোর থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স কমপ্লীট করে দেশে ফিরে এসেছে। ঢাকা বোনের বাসায় থেকে পাশের গলির সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে ইন্টারনেটে চাকরীর সন্ধান করছিল। সময়টি ছিল বিএনপির শাসনামল। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিল তারেক জিয়ার আস্থাভাজন  লুৎফুজ্জামান বাবর, যাকে সকলেই 'পাঙ্কু বাবর' নামেই চিনত। সেই সময়ে তৎকালীন বিরোধীনেত্রী শেখ হাসিনাকে কে বা কারা ইন্টারনেটে হত্যার হুমকী দিয়েছিল। বিএনপি আমলে শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকী দেয়া ছিল প্রতিদিনের ডাল-ভাত রান্নার মত অতি সাধারণ ব্যাপার। একবার তো হাতে কলমেই হত্যার চেষ্টা হয়েছিল, গ্রেনেড মেরেও 'কই মাছের প্রাণ' এই নারীকে হত্যা করতে পারেনি, ২৪ জন নিরপরাধ নেত্রী ও কর্মীর প্রাণ সংহার করা হয়েছিল, আর শেখ হাসিনার শ্রবনেন্দ্রিয় জখম করা হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু শাসকের গদীতে ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া, তাই এত বড় বিধ্বংসী ঘটনায় সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠার মত সুযোগই রাখা হয়নি। এইজন্যই শেখ হাসিনাকে নানাভাবে হত্যার হুমকী দেয়া অব্যাহত ছিল।

তেমনই এক হুমকীর ই-মেইল এসেছিল শেখ হাসিনার কাছে, বিরোধীনেত্রীর দলীয় কার্য্যালয় থেকে এর প্রতিবাদ জানিয়েছিল, তখনই আইন প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের  নির্দেশে পুলিশ পার্থ সাহাকে তার বোনের বাসা থেকে, তার মায়ের কোল থেকে টানতে টানতে নিয়ে এসেছিল, এবং স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী বাবরের সরাসরি নির্দেশে পার্থ সাহাকে জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রেখে 'গরুপেটা' করে কোমড় ভেঙ্গে একেবারে প্রায় মেরেই ফেলেছিল।  পার্থ সাহার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ ছিল? অভিযোগ ছিল, ভারতের ব্যাঙ্গালোর থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স ডিগ্রী সমাপ্ত করে পার্থ ঢাকা বোনের বাসার কাছাকাছি সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে চাকরী খোঁজার উছিলায় শেখ হাসিনাকে 'হত্যার হুমকী' দিয়ে ই-মেইল করেছিল। পাংকু বাবরের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল স্কুল পর্যায় পর্যন্ত, তাই তার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে এমন একটি জবরদস্তিমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। কোন তথ্য প্রমান ছাড়াই প্রতিমন্ত্রী সাহেব আধমরা পার্থ সাহার বিরুদ্ধে মামলাও করেছিল।

যেহেতু ওটা ছিল বিএনপি শাসনামল, এবং পার্থ ছিল পার্থ সাহা, অর্থাৎ সংখ্যালঘু হিন্দু, তাই কোথাও প্রতিবাদের তুমুল ঝড় উঠেনি, কেউ পার্থ সাহার ছবি দিয়ে ফেসবুক আইডি বানায়নি [ যদিও তখন ইন্টারনেট অমন রমরমা ছিলোনা, ফেসবুকের প্রচলন ছিলোনা, যদিও দ্রুত ইন্টারনেট, ফেসবুক বর্তমান আওয়ামীলীগের শাসনামলের আধুনিক অবদান, তারপরেও বলা যায়, বিএনপি শাসনামলে যদি ফেসবুক থাকতো, একমাত্র হিন্দুরা ছাড়া আর কেউ বোধ হয় পার্থর ছবি দিয়ে প্রোফাইল আইডিও বানাতো না] । শাসনামলটি বিএনপির ছিল বলে, আওয়ামীপন্থী সাংবাদিক এ বি এম মুসা সাহেব অথবা এককালীন ছাত্রলীগের রাজনীতি করা সাংবাদিক, বামপন্থীদের গালি দেয়া সাংবাদিকসহ কেউ কলম চালায়নি এমন একটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে। পত্রিকার পাতা তন্ন তন্ন করেও কোথাও বিএনপি পন্থী অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়ার বক্তব্য পাইনি। কখনও কানে আসেনি যে অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া অথবা অধ্যাপক এমাজজুদ্দিন বলেছেন, তাঁরা সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াবেন, প্রতীক হিসেবে চাইবেন 'পার্থ সাহার ভাঙ্গা কোমড়'। কোথাও শুনিনি, কোন আসরেও শুনিনি, বিএনপিপন্থী কোন বন্ধুর মুখেও তারেক জিয়া এবং তার আজ্ঞাবাহী পাঙ্কু বাবরের বিরুদ্ধে এতটুকু অভিযোগও শুনিনি। বেগম খালেদা জিয়াকেও এমন একটি নিষ্ঠুর অন্যায়ের বিরুদ্ধে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখিনি, আমিও দেখিনি, একজন দেশবাসীও দেখেনি।

লিমনের প্রতি অত্যন্ত অন্যায় করা হয়েছে, সরাসরি সরকারীভাবে করা না হলেও,  সরকারী বাহীনির সদস্য এই কাজটি করেছে। তরতাজা সুস্থ সবল যুবক, যার তখন কলেজে পড়ার কথা, র‍্যাব সদস্যের আক্রোশের শিকার হয়ে তাকে এক পা হারিয়ে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছিল। জনরোষ সৃষ্টির আগেই যদি সরকার থেকে তৎক্ষনাৎ র‍্যাব সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতো, লিমনের পাশে দাঁড়াতে হতো, লিমনের বিরুদ্ধে সকল মামলা তখনই তুলে নেয়া হতো, লিমনের পরিবারের প্রতি সহানুভূতি দেখানো হতো, তাহলেই জল ঘোলা হতোনা, ছেলেটিও সুবিচার পেত।

কথায় বলে, সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। তারপরেও বিলম্বে হলেও সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে, লিমনের বিরুদ্ধে র‍্যাব কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা তুলে নেয়া হয়েছে, হয়তো সরকার থেকেই লিমনের ভবিষ্যতে মাথা তুলে দাঁড়াবার ব্যবস্থাও করা হবে, এই শুভ বুদ্ধি উদয়ের পেছনে যে যত খুশী কারণ খুঁজুক, আমি  উল্লসিত সরকারকে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে বাধ্য হতে দেখে। আমাদের সকলের উচিত লিমনের ব্যাপারে সরকারের সঠিক সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো, সরকারের সমালোচনা  যেমন করা যায়, তেমনি সরকারের ভাল কাজের প্রশংসা করতে বাধা কোথায়? সরকারে আওয়ামীলীগ আছে বলেই কি সব সময় ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতেই হবে?

পার্থ সাহাও তো লিমনের মতই নিরীহ যুবক ছিল, তাকেও তো চিরতরে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল, আদালতের বিচারক পর্যন্ত আঁতকে উঠেছিলেন যখন আসামী হিসেবে বাবরের পুলিশেরা ধরাধরি করে পার্থ সাহার নিষ্প্রাণ, নির্বাক, নিশ্চল দেহটিকে এনে বিচারকের সামনে হাজির করেছিল। তখন তো কেউ জোর প্রতিবাদ করেনি, বিএনপি সরকারকে 'দুয়ো' দেয়নি।  এমন কি পার্থ সাহার কোন ছবিও প্রকাশিত হয়নি পত্র পত্রিকায়! সে তুলনায় আওয়ামীলীগ সরকার জনগণের দাবীর কাছে মাথা নত করেছে, এতেই তো জনগনের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা প্রমানিত হয়েছে।

জনগণ তো এটুকুই চায়। ভুল হতেই পারে, ভুল স্বীকার করে ভুল শোধরাণোর অভিপ্রায় থাকাটি একটি সরকারের জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। আওয়ামীলীগের মধ্যে সেই অভিপ্রায় মাঝে মাঝেই দেখা যায়, বিএনপির মধ্যে কখনওই তা দেখা যায়নি, দেখা যাচ্ছেনা। এইজন্যই মুদ্রা একই হলেও মুদ্রার দুই পিঠে একই ছাপ থাকে না। একটি মুদ্রার একপিঠে যদি থাকে জাতীয় ফুল শাপলা, অন্যপিঠে থাকে 'জনগণ'। ভিন্ন ছবি, ভিন্ন অর্থ। আওয়ামীলীগ আর বিএনপি রাজনৈতিক দল হলেও, একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ হলেও আদর্শগত বিচারে কিছু ভিন্নতা থেকেই যায়।

No comments:

Post a Comment