Thursday, September 1, 2016

প্রযত্নে----- (ধারাবাহিক)

প্রযত্নে------ ১ম পর্ব


৮ই মে, ২০১৬
মিসিসিপি, আমেরিকা

মা,

তুমি পৃথিবীর মাটি ছেড়ে চলে গেছো প্রায় চার বছর হয়ে এলো। তোমার মুখেই শুনেছিলাম, মৃত্যুর এক বছর পর আত্মা পুনর্জন্ম নেয়। তবে তো এতদিনে তোমার জন্ম হয়ে গেছে অন্য কোন দেশে, অন্য কোন পরিবারে। সেই হিসেবে তুমি আমাদের কাছেপিঠে কোথাও নেই, তুমি আর আমাদের নেই। কিন্তু আমার যে তা বিশ্বাস হয়না, আমি প্রতি মুহূর্তেই তোমাকে দেখি, যখনই চাই তখনই তোমাকে কাছে পাই, তোমাকে অনুভব করি। শুধু কি আমিই তোমাকে অনুভব করি? ভাইবোনদের সকলেই মনে মনে তোমাকে খুঁজি, তোমাকে কাছে পেতে সারাক্ষণ হাহাকার করি। তোমার দেহের, তোমার আত্মার চারটি অংশ আজ পৃথিবীর চারদিকে ছড়িয়ে আছে। বড়দা কানাডায়, আমি আমেরিকায়, মেজদা আর রানু বাংলাদেশে।


এই মুহূর্তে তুমি কোথায় আছো? সত্যি করে বলো, এই মুহূর্তে কোথায় আছো? আমেরিকায় নাকি কানাডায়, নাকি বাংলাদেশে? আচ্ছা মা, চার সন্তানের মধ্যে কাকে রেখে কার কাছে যাবে, এমন কি কখনও মনে হয়?

অনেক আবোল তাবোল কথা দিয়ে আজকের চিঠি শুরু করেছি, বলতে চাই কত লক্ষ কথা, বলতে গিয়ে কথাগুলো পেঁচিয়ে ফেলছি। কোন কথা দিয়ে শুরু করা যায় বলো তো মা!  তুমি ২০১২ সালের অক্টোবারের আট তারিখে দুম করে মরে গেলে, এমন ঘটনার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলামনা। তাই এর পরের তিন মাস কেমন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ঘোরের মধ্যে চলে গেছিলাম। বলতে পারো আমি আমিত্ব থেকেই হারিয়ে গেছিলাম। স্বামী, তিন কন্যার সংসারে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কী যে এক দুঃসহ যন্ত্রণায় কাটছিল প্রতি মুহূর্ত, কেউ সান্ত্বনা দিতেও আসেনি। না আমার স্বামী, না আমার তিন কন্যার কেউ। ওরা সান্ত্বনা কি দেবে, ওরা নিজেরাও তো হতভম্ব হয়ে গেছিল তোমার মৃত্যুতে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে আমরা কেউ কারো সাথে স্বাভাবিক কথাও বলতাম না। সকলেই যেন মৌনব্রত পালন করছিলাম।
সে বছরই মৌটুসীটার বিয়ে হলো, তুমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নাতনীর বিয়ে দিলে, ভিডিওতে, ছবিতে সর্বত্র তোমার হাস্যোজ্জ্বল মুখ। নাতনি জামাইয়ের গলায় তুমি আর বাবা সোনার চেন পরিয়ে দিচ্ছো, সেই ছবি এত প্রাণবন্ত! নাতনি জামাই মনীশ নেপালের ছেলে কি হবে, মন মানসিকতা একেবারে আমাদের মত। বিয়ের পর দাদু-দিদা, মামা-মাসী পেয়ে খুব আনন্দিত। অথচ বিয়ের চার মাসের মাথায় মৌটুসীর দিদা মারা গেলো, মনীশ যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না। ডিসেম্বারে মৌটুসী আর মনীশ বেড়াতে এলো, তোমার মৃত্যুর পর এই প্রথম ওদের সাথে আমার দেখা। দুজনের কেউ বুঝে উঠতে পারছিলনা আমার সাথে কিভাবে কথা বলা উচিত, এটাও একটা কারণ আমাকে সান্ত্বনা না দেয়ার পেছনে।

চিঠি তো তোমাকে এই প্রথম লিখছিনা, তোমার মৃত্যুর পরের তিন মাস নাহয় স্তব্ধ হয়েছিলাম, এরপর তো গা ঝাড়া দিয়ে উঠতেই হয়েছে, নাহলে বিদেশে জীবন চলবে কি করে? আমি এখানে খুবই অসহায়, এখানে কাজের মানুষ নেই, এখানে আত্মীয় স্বজন নেই, দুই মেয়ে থাকে অন্য স্টেটে, বন্ধু বান্ধব বলতে যে কয়েকটি পরিবার আছে, একমাত্র পিঙ্কি আর ওর বর সব্যসাচী ছাড়া আমার দুঃখের দিনে আর কেউ আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল বলে মনে পড়ছেনা।

তবে যে কথা না বললেই নয়, তোমার মৃত্যুর পর আমি যখন দেশ থেকে ফিরে এলাম, তন্ময় আর সৌম্য নামের দুই তরুণ এক সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত। তন্ময় এবং সৌম্য এখানের ইউনিভারসিটিতে পিএইচডি করছিল, দুজনেই আমাকে কাকীমা ডাকে, আমি ওদের দুজনকেই পুত্র স্নেহে ভালোবাসতাম। ওরা যে সন্ধ্যায় এলো, সেই দিন বাংলাদেশে তোমার তিন পুত্র শ্রাদ্ধকাজ সুসম্পন্ন করেছে। তন্ময় আর সৌম্যকে কাছে পেয়ে আমি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। ওদের অমতেই ওদের খাওয়াবো বলে কত কিছু রান্না করলাম, ওরা সেদিন আমার কাছাকাছি বসেছিল, আমাকে কথা বলতে সুযোগ দিচ্ছিল, আমি সেদিন কথা বলতে গিয়ে অঝোরে কেঁদেছিলাম। কান্না তোমার শোকে নয়, কান্না ছিল তোমাকে বাঁচাতে পারিনি সেই অপারগতায়। সৌম্য কলকাতার ছেলে, আর তন্ময় বাংলাদেশের, কিন্তু ওরা দুজনেই বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনে থেকে লেখাপড়া করেছে। দুজনেই শাস্ত্রকথা খুব ভাল জানে, সেদিন ওরা আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছিল।
সৌম্য ব্রাহ্মণ সন্তান, সেদিন ব্রাহ্মণ ভোজন করাতে পেরেছি, মনে অন্যরকম শান্তি বোধ করছিলাম। এমনিতে আমার মধ্যে কোন সংস্কার নেই, তবুও সেই সন্ধ্যায় সৌম্য আর তন্ময় আসাতে মনে হয়েছিল, ধর্মীয় সংস্কার বিষয়টি বোধ হয় খুব ফেলনা কিছু নয়।

যাই হোক, বলছিলাম তোমায় চিঠি লিখার বিষয় নিয়ে, চলে গেছি অন্য কথায়। তোমাকে আমি চিঠি লিখতে শুরু করি নতুন বছর ২০১৩ সালের জানুয়ারী থেকে, যেহেতু তোমার প্রস্থানের দিনটি ছিল অক্টোবারের ৮ তারিখ, তাই তোমাকে প্রথম চিঠি লিখেছিলাম জানুয়ারীর ৮ তারিখে। এরপর প্রতি মাসের আট তারিখ এলেই তোমাকে একটি করে চিঠি লিখতাম। চিঠিগুলো পোস্ট করা হয়নি, তোমার ঠিকানা জানিনা তো। তুমি স্বর্গে আছো জানি, কিন্তু স্বর্গের ঠিকানা জানিনাতো, আন্দাজের উপর স্বর্গের ঠিকানা দিয়েও তো লাভ নেই। পৃথিবীর বাইরে স্বর্গ কোথায় আর আছে বলো, এই সুন্দর পৃথিবীটাই আমার কাছে স্বর্গ, তা তুমিতো এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়েই চলে গেলে। নরকের ঠিকানা জানি, কিন্তু নরকের ঠিকানায় চিঠি পাঠানোর প্রশ্নই আসেনা, নরকের দ্বাররক্ষী শংকরী দাস নামে কাউকে চিনলে তো!

মা, তুমি কোথায় আছো? তুমি কি সত্যি সত্যি মারা গেছো? মানে, মরেই গেছো ঠিক যেমনি করে অন্যের মা মরে যায়? তুমি আর আসবেনা, তাইনা? সেই পরিচিত রঙের অতি পুরনো হয়ে যাওয়া শাড়িটি আটপৌরে করে পরা, কপাল থেকে নাকের ডগায় লেপটানো সিঁদুর, পিঠ হালকা গুঁজো, গুরগুর করে হাঁটা তুমি, উফ! আজকাল মাঝে মাঝেই বুকটা ভীষণ ফাঁকা লাগে। আগেতো ওয়ালমার্টে যাওয়ার সময় ড্রাইভিং সিটে বসে হাপুস নয়নে কাঁদতাম, রাতে যখন বাড়ি ফিরতাম, চারদিক ফাঁকা থাকতো, মাথার উপরে বিশাল কালো আকাশ, তাতে হাজার হাজার তারা, এই দৃশ্য সহ্য করতে পারতামনা। গাড়ি চালাতে চালাতেই হেঁচকি তুলে কাঁদতাম। ওটাই ছিল আমার কান্নার সর্বোত্তম সুযোগ, কেউতো দেখতে পাচ্ছেনা। কাউকে দেখিয়ে কান্নাকাটি করার মানুষতো আমিও নই, তোমার তিন পুত্রও নয়। তাই, তোমার মরদেহ সামনে রেখে আমরা কেউ কাঁদতে পারিনি। সেই কান্নাটাই যার যার সুবিধামত সময়ে কেঁদেছি। আমি কেঁদেছি গাড়ি চালাতে চালাতে। আমি এখনও কাঁদতে হলেই আগের মত গাড়িতে বসেই কাঁদি, গ্যারাজে গাড়ি থামিয়ে বেশ কিছু সময় স্টিয়ারিং হুইলে মাথা রেখে কাঁদি। কেউ দেখতে পায়না, আমি বাড়িতে এক সময় ফিরলেই হয়, আমার স্বামী জানে যে আমার পথে ঘাটে বিপদ হবেনা, কাজে দেরী হতে পারে, কিন্তু বাসায় ঠিকই পৌঁছে যাব। তাই এই সুযোগটা কাজে লাগাই, বুক খালি করে কাঁদতে পাঁচ মিনিটের বেশী সময়তো লাগেনা।


ওয়ালমার্টের কাজটা ছেড়ে দেয়া হয়নি, চাকরি করতে ইচ্ছে করেনা, তবুও চাকরিটা করছি। পয়সা খুব বেশী পাইনা, হেলথ ইন্স্যুরেন্সের সুবিধা কিছু পাই, এটাই একমাত্র কারণ চাকরিতে ঝুলে থাকার পেছনে। একটা কথা মনে পড়ে খুব হাসি পাচ্ছে। তোমার মনে আছে, প্রায় এগারো বছর আগে ওয়ালমার্টে কাজে যোগ দিলাম, কেমিস্ট্রিতে অনার্স, মাস্টার্স, বিএড করা কন্যা তোমার ওয়ালমার্টে ক্যাশিয়ার পজিশনে চাকরি নিলো।

আমেরিকায় আমার প্রথম চাকরি, খুশীতে চার লাফ দিয়ে তোমাকে ক্যাশিয়ার কাকে বলে তা বুঝাতে লাগলাম, বুঝছো মা, ক্যাশিয়ার কিন্তু ব্যাংকের ক্যাশিয়ার না। ওয়ালমার্টে ক্যাশিয়ার হইলো যারা রেজিস্টারে দাঁড়িয়ে কাস্টমারদের কাছে মালামাল বিক্রি করে, অর্থাৎ মালবেচনি, আমাদের দেশে পানওয়ালা যেমন পান বেচে, বাদামওয়ালা বেচে বাদাম তেমনি ওয়ালমার্টে আমি ওয়ালমার্টের জিনিস বেচি। ওয়ালমার্ট হচ্ছে আরেক পৃথিবী, সুঁই থেকে শুরু করে সবই পাওয়া যায়। এই যেমন ধরো, কাস্টমারের কাছে ফুলও বেচি, ফলও বেচি, খাট-টেবিল, চেয়ার, টিভি, মাছ, তরকারী, দুধ, রুটি, মাংস বেচি। মাংসের সাইজ জানো কেমন, ইয়া বিশাল টুকরা, দুই হাতে তুলতে পারিনা। আমেরিকানরা যেমন ওজনদার, এখানে মাংসের চাকাগুলিও তেমনি ভারী।

তুমি খুব এনজয় করতে আমার কথা, হাসতে হাসতে সবার কাছে বলতে, মিঠু নাকি এখন ওয়ালমার্টে মাংস বেচে

কিন্তু বাবা ভীষণ আপসেট হয়েছিল। বাবা এখনও আপসেট, এবছরেই দুই মাস থেকে এলাম তো বাংলাদেশে, এর মধ্যেই বাবা বেশ কবার বলেছে, জীবনটা নিয়ে রসিকতা করে গেলি। এমন ফালতু চাকরি করিস যে কারো কাছে বুক ফুলায়ে কিছু কইতে পারিনা।

বাবাকে বললাম, যে কথা তুমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারো, সেই কথাই তুমি কাউকে বলোনা। তোমার মেয়েটা যে তিন বছরে তিনখানা বই লিখে ফেললো, এটা নিয়ে বুঝি গর্ব করা যায় না! আমার যা রেজাল্ট ছিল তা দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার তো হতেই পারতাম, আমার যোগ্যতায় ইচ্ছে করলে কেমিস্টের চাকরিও করতে পারতাম, অথবা শিক্ষকতা করতে পারতাম, এই নিয়ে গর্ব করার কিছু নাই। কিন্তু বই লেখা! চাইলেই পারা যায়? যে কেউ পারে? তুমি তাই নিয়েই গর্ব করো।!

বাবা আর কিছু বলতেই পারেনি। বলবে কি করে বলো, বাবা কি কম খুশী নাকি আমার লেখালেখি নিয়ে। সেদিনও বলেছে, তবুও দেরীতে হলেও কাজের কাজ কিছু একটা শুরু করলি। আমাদের বংশে তুইই লেখালেখিতে চলে এলি

আমি বলেছি, বাবা, আমাদের বংশে আমার আগেই রানু বই লিখে ফেলেছে, তুমি ভুলে গেছো, মা বেঁচে থাকলে কিন্তু তোমাকে উত্তর দিয়ে দিত। তোমার ছোট ছেলে একাউন্টিং এর বই লিখেছেনা?

আসলে বাবার বয়স হয়ে গেছে, স্মৃতিশক্তি বাবার কোনদিনই তেমন প্রখর ছিলনা। তোমার মৃত্যুর পর বাবা বলেছিল, একজন জীবন্ত কমপিউটার চলে গেলো। বাবা ভুলেই গেছে আমি এক বছর আগেও পত্রিকায় কলাম লিখতাম। তোমার মনে আছেতো, বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় দেড় বছর নিয়মিত লিখে প্রায় দশ হাজার টাকা উপার্জন করেছিলাম। তুমি বেঁচে থাকতে পেয়েছিলাম সাড়ে সাত হাজার টাকা, আমার আনন্দের উপার্জন, পুরো টাকা তোমাদের দুই জনকে সমান ভাগ করে প্রণামী দিয়েছিলাম। বাবা হিসেবী মানুষ, সাড়ে তিন হাজার টাকা ব্যাংকে আমার একাউন্টে জমা দিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তুমি আমার টাকা গ্রহণ করেছিলে। এখনও যখন মনে পড়ে, তোমার মৃত্যুর মাত্র দুই মাস আগে এই টাকাটা তোমাকে দিতে পেরেছিলাম, তুমি সজ্ঞানে, আনন্দিত চিত্তে টাকা নিয়েছিলে, আমার জীবন ধন্য হয়েছিল।

যাহোক, তুমি মারা গেলে ২০১২ তে, ২০১৪, ১৫, ১৬ সালে পর পর তিনখানা বই বেরুলো। আমি ছিলাম আমেরিকা, রানু এমনিতে অন্য কোথাও যেতে পারেনা, কিন্তু প্রতিবছর বইমেলায় গিয়ে নগদ টাকা দিয়ে আমার বই কিনে এনে বাবার হাতে তুলে দিয়েছে। বাবা তাঁর কন্যার লেখা বই খুলে পড়ছেন, রানু এই ছবি তুলে আমাকে পাঠিয়েছে। এবছর বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা, তুমি আমার লেখা নিয়ে কিছু বললেনা?
বাবা কিন্তু বলল, চোখে ভাল দেখিনা, তবুও প্রতি গল্পের প্রথম অংশ পড়েই বুঝেছি, তুই লিখিস ভাল, তোর লেখার ক্ষমতা আছে
তাহলে এবার তুমিই বলো মা, বাবা কি করে বলে যে আমাকে নিয়ে গর্ব করতে পারেনা? তোমার মনে আছে,  যখন পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশিত হতো, একদিন পাড়ার রাস্তায় একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার বাবাকে ডেকে বলেছিল, দাসবাবু, আপনার মেয়ে পত্রিকায় লিখে, বেশ ভাল লিখে, তখনই নাকি বাবা প্রথম জানতে পারলো আমি পত্রিকায় লিখি। কী যে করি বাবাকে নিয়ে!


মা, ইদানিং আমার খুব ক্লান্ত লাগে, এই ক্লান্তি কি দেহের নাকি মনের বুঝতে পারিনা। হাত-পা ব্যথা, সারা শরীরই ব্যথা করে। মাঝে মাঝে এও ভাবি, আমারও কি তোমার মতই ক্যান্সারে মৃত্যু হবে? কী অবিশ্বাস্য লাগে, ৭৫ বছরের এই বৃদ্ধা নারী মারা গেলো জরায়ুর ক্যান্সারে? ৭৫ বছরের নারীর দেহের ভেতরে জরায়ু নামক অঙ্গের অস্তিত্ব থাকে? আহারে! যে জরায়ুতে চারটি সন্তানকে দশ মাস নিরাপত্তা দিয়ে রেখেছিলে, যে জরায়ু ছিল আমাদের বিশাল আশ্রয়, সেই জরায়ুটাকেই কর্কট নামের বিষাক্ত রোগটা শেষ বয়সে এসে খেয়ে ফেললো? কী আজব, তাইনা?

আজ সকালের শিফটে কাজ ছিল, কিন্তু সকালে যেতে পারিনি। ঘুম ভাঙ্গার পর শরীর ম্যাজম্যাজ করছিল, কাজের জায়গায় কল দিয়ে বলেছি দেরী করে যাব। শেষে দুপুর একটায় গেলাম, কাজ থেকে ফিরেছি সন্ধ্যে সাতটায়। আগামীকাল আমাদের বাড়িতে গেস্ট আসবে। ভেবেছিলাম আজ কাজ থেকে ফিরে রান্নাবান্না কিছুটা এগিয়ে রাখবো, শরীরে কুলালোনা। বয়স হচ্ছে তা বুঝতে পারি।

ভাগ্যিস নিত্য পূজো কাজে যাওয়ার আগেই সেরে গেছিলাম, তাই সন্ধ্যায় অবসর পেলাম। নিত্য পূজো করি শুনে কি চমকে গেলে একটু? ভাবছো নিশ্চয়ই, আমাদের ঘরে পূজো আচ্চার চল ছিলনা, এই মেয়েকে কত হাতে পায়ে ধরতে হতো সন্ধ্যার সময় ধূপকাঠি জ্বালিয়ে সব ঘরে দেখানোর জন্য। সেই মেয়ে বলে কিনা নিত্য পূজো দেয়?
মা, সত্যি সত্যি আমি নিত্য পূজো দেই, তেমন আড়ম্বর করে কিছু করিনা। দেয়াল আঁটা সেলফে অনেকগুলো দেব দেবীর মূর্তি রাখা আছে, স্নান করে ঠাকুরের সামনে মোমবাতি জ্বালি, ধূপকাঠি জ্বালি, শঙ্খ ফুঁ দেই, ঘন্টা বাজিয়ে ওঁ শিবায় নমঃ বলে প্রণাম করি। হয়ে গেলো পূজো, একেবারে সহজ এবং ফাঁকি দেয়া পদ্ধতিতে পূজো। তবে হ্যাঁ, আমি মাসের এক শনিবার শনির উপোস করি, এক সোমবার শিবের উপোস করি, এক মঙ্গলবার বিপদনাশিনী মায়ের পূজো করি

হা হা হা হা!! ভড়কে যাচ্ছো কেন? তুমি বুঝি জানোনা আমি যে এত পূজো আচ্চা করছি, আমার বিছানার পাশেইতো তোমার ছবিখানা রেখেছি, ছবির ভেতর থেকেই আমার কান্ডকারখানা দিব্যি তাকিয়ে সব দেখছো, তবে কেন ভড়কাচ্ছো? এই যেমনি তুমি জানো এখন আমি কম্পিউটারের সামনে বসে আছি, চোখের সামনে এক উইন্ডোতে ফেসবুক খোলা, আরেক উইন্ডোতে ইউটিউব, ইউটিউবে বেজে চলেছে একটার পর একটা গান। আজ বাজছে দুঃখের গান, সব গানেই কষ্টগুলো উপচে উপচে পড়ছে।

অনেক দিন পর ইউটিউবে গান শুনছি। কেন জানি সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের মরমীয়া তুমি চলে গেলে দরদি আমার কোথা পাবো গানটা শুনতে ইচ্ছে হয়েছিল। গানটা শেষ হতেই অটোমেটিক বেজে উঠলো মিতালী মুখার্জীর গাওয়া, কেন আশা বেঁধে রাখি, এই গানটা মিতালী মুখার্জির দাদা মারা যাওয়ার পর নিজে লিখে নিজেই সুর করে নিজ কন্ঠে গেয়েছিল, কী হৃদয় বিদীর্ণ করা কথা আর সুর! এরপর বাজলো জগন্ময় মিত্রের সেই বিখ্যাত গান তুমি আজ কতদূরে

আর পারলাম না, বুকটায় হাহাকার করে উঠলো। গত কদিন থেকে তোমায় চিঠি লিখবো লিখবো করছিলাম, লেখা নিয়ে বসা হচ্ছিলোনা। জগন্ময় মিত্র যেন হাত ধরে আমায় লেখার টেবিলে বসিয়ে দিলেন। তাইতো আবার শুরু করলাম তিন বছর আগে থেমে যাওয়া চিঠি লেখা পর্ব, নাম দিলাম প্রযত্নে----।

এবার আর সহসা থামছিনা, সেই আগের চিঠিগুলোও তোমাকে পাঠিয়ে দেব, নতুনগুলো তো থাকবেই। কেমন আছো তুমি জানতে চাইনা, যেখানেই থাকো, ভালো থেকো। আমরা সকলেই আছি যার যার মত, তুমি থাকলে সকলেই একত্রে ভাল থাকতাম, তুমি চলে গিয়ে তা আর হতে দিলে কই?


মিঠু 





প্রযত্নে----- ২য় পর্ব

২৫শে মে
মিসিসিপি

মা,
আজ পিঙ্কিরা আমাদের স্টেট থেকে পাকাপাকিভাবে চলে গেলো অন্য স্টেটে, আর ফিরবেনা এখানে। ওদের একমাত্র ছেলে ঋষি ঐ স্টেটেরই খুব ভাল ইউনিভারসিটিতে চান্স পেয়েছে, তাই ওরা ঐ স্টেটে নতুন বাড়ি কিনে চলে গেছে। ওরা এমনই করে, ছেলে যখন যেখানে , যে স্কুলে ভর্তি হয়, ওরা সেখানেই একটা নতুন বাড়ি কিনে চলে যায়। আমেরিকাতে এসেছে ওরা নয় বছর আগে, এই নয় বছরে ওরা চার বার বাড়ি কেনা-বেচা করেছে, মানে যখনই নতুন বাড়ি কিনবে বলে মনস্থ করেছে, তখনই আগের বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে। চারবার বাড়ি কিনেছে, বলো তো তাহলে কয়বার বাড়ি বিক্রি করেছে? তোমাকে মৌখিক অংক জিজ্ঞেস করা কত বোকামী, তাইনা? তুমি ছিলে স্কুলে অংকের শিক্ষক, তোমার কাছেই আমাদের সাধারণ গণিত শেখা, আর এখন তোমাকেই কিনা প্রশ্ন করছি।

আমেরিকায় বাড়ি কেনা সহজ, ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে তুমি যতখুশী বাড়ি কেনো, কেউ আটকাবেনা। দেশে থাকতে শুনতে, অমুকের মেয়ে আমেরিকায় তিন কোটি টাকা দিয়ে বাড়ি কিনেছে, তমুকের পোলা আমেরিকায় পাঁচটা বাড়ি কিনেছে। ব্যাংক লোন নিয়মিত হারে শোধ করতে পারলে এদেশে বাড়ি কেনা কোন ব্যাপার নয়। হ্যাঁ, তবে যে ব্যাংক লোন পুরো শোধ করে দিতে পারে, সে হচ্ছে বাপের বেটা। যেমন তোমার বড় ছেলে, আমার প্রিয় বড়দা, কানাডার টরন্টোর মত বিশাল সিটিতে বাড়ির দাম পুরো শোধ করে ফেলেছে। এখন সে সত্যিকারের বাড়িওয়ালা।
বাড়ি কেনা সহজ যেমনি, কিন্তু বাড়ি বিক্রি করা খুব কঠিন, পুরো ভাগ্যের ব্যাপার। এই কঠিন কাজটি কী সহজেই পিঙ্কিরা করে তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। শুধু কি আমেরিকা, আমেরিকা আসার আগে পিঙ্কিরা চার/পাঁচ বছর কানাডাতে ছিল, ওখানেও ওরা দুই বাড়ি কিনে দুই বাড়িই বিক্রি করেছে। আসলে পিঙ্কিদের ভাগ্য খুব ভাল, ওরা মুড়ি মুড়কির মত বাড়ি কিনে ফেলে, মুড়ি মুড়কির মত বিক্রিও করে দেয়। কোথা থেকে যেন গ্রাহক জুটে যায়।

মনটা আমার বেশ খারাপ লাগছে আজ, পাক্কা নয়টি বছর কাটিয়ে গেলো ওরা, খারাপতো লাগবেই। পিঙ্কির জন্যতো খারাপ লাগছেই, কিন্তু খুব বেশী খারাপ লাগছে ওর কুকুরটার জন্য। দেড় বছর বয়সী কুকুর, নাম ব্লেইজ, কী যে সুন্দর, ছোট্ট বাবুসোনা একটা, সারা শরীর ভর্তি লোম। অনেক দামী কুকুর, পিঙ্কি বড়লোক, দামী কুকুরইতো কিনবে, লালু ভুলু মার্কা কুকুরতো কিনবেনা। যখন কিনেছে তখন ওর বয়স ছিল ছয় সপ্তাহ, তখন দেখতে বেশী ভাল ছিলনা, ওর গায়ে হাত দিতে কেমন অস্বস্তি লাগতো। ধীরে ধীরে বড় হতে হতে ওর চেহারা বদলে গেলো। বদলাবে না কেন, পিঙ্কির যা যত্ন, দামী ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু দিয়ে প্রতিদিন স্নান করিয়ে কন্ডিশনার লাগিয়ে দিত, আমাদের বাড়ি আনবার আগে ওর গায়ে পারফিউম লাগাতো। যতবার হিসি করতো ততবার বাথরুমে নিয়ে ওর হিসির জায়গা ধুয়ে মুছে দিত। সে কী কান্ড, এমন কুকুরকে মাথায় তুলে রাখা যায়। ছেলে কুকুর, তাই ওর জন্য কোট কিনে এনেছে, ওর নাম দিয়েছে ব্লেইজ ব্যানার্জি, এই নামে আবার গলার লকেট বানিয়েছে।
ব্লেইজ যখন একটু বড় হলো, দেখতে আদর আদর হয়ে গেলো, আমি ওকে ডাকতে শুরু করলাম জুজুবুজু, জুজাই, জাকাবুকা, নান্নাবাবু আরও কত কি। কুকুরটা এই নামগুলোর সাথে খুব অভ্যস্ত হয়ে গেছিল। কী যে পছন্দ করতো আমাকে আর তোমার জামাইকে। আজ যখন ওদের গাড়িটা ছেড়ে দিল, জুজাই কাঁচবন্ধ জানালায় মুখ রেখে আমাকে দেখছিল। পিঙ্কি জানালার কাঁচ নামিয়ে দিতেই জুজাই মুখটা বের করে আমার দিকে ঝুঁকেছিল। মাথায় গেঁথে গেছে জুজুবুজুর সেই করুণ চাহনিটা।

আসলে এই যাওয়াই কুকুরটার শেষ যাওয়া, পিঙ্কিরা পাকাপাকিভাবে ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে, জুজুবুজুকেও নিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ মা, সত্যি সত্যি কুকুরটাও চলে যাচ্ছে ভারতে। ওর প্লেনের টিকেট হয়ে গেছে, ওর জন্য কি কি সব আইনী কাগজপত্র সাথে নিতে হয়েছে। কী অবাক লাগে ভাবতে, একটা কুকুরের জন্ম আমেরিকাতে, কিন্তু মৃত্যু হবে ভারতে। পিঙ্কির ছেলে যেহেতু আমেরিকাতেই লেখাপড়া করছে, ছেলেটা থাকবে আমেরিকাতেই, বছরে দুই তিনবার ওরা স্বামী স্ত্রী আমেরিকা আসবে ছেলেকে দেখতে। কিন্তু জুজুবুজুতো আসবেনা। জুন মাসের ১৪ তারিখে জুজুবুজুকে নিয়ে পিঙ্কি চলে যাবে ইন্ডিয়া।

তোমাকে আজ চিঠি লিখবো ভাবিনি। কিন্তু পিঙ্কির কুকুরটার জন্য মন খারাপ লাগছে বলেই তোমায় লিখতে বসলাম। মা, তুমিতো জানতে, কুকুর বিড়াল নিয়ে আমি কখনও মাথা ঘামাতাম না। বিড়াল আমার দুই চক্ষের বিষ, অন্য বাড়িতে বেড়াল পালতে দেখলে আমার অসহ্য লাগতো। মা, মৌটুসীর বাবার সাথে যখন আমার বিয়ে ঠিক হলো, সে আমাকে তার ফ্ল্যাট দেখাতে নিয়ে গেছিলো। ফ্ল্যাট কী সুন্দর ছিমছাম করে গোছানো, বেতের চেয়ার সেট, পাশে সুদৃশ্য মোড়া পাতা। সেই মোড়ার উপর তিনটে বেড়ালের বাচ্চা গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। আমার কেমন অস্বস্তি লাগছিল। তেমন কিছু বলতেও পারছিলামনা বেড়ালের মালিককে, নতুন মানুষ, বিয়ের আগেই কি করে বেড়াল নিয়ে বিদ্রোহ করব? তবুও আলতো করে বলে ফেলেছিলাম, বিড়ালগুলো কি আপনার?
সে খুব নম্র স্বরে আগ্রহভরে বলেছিল, মনেতো হচ্ছে ওরা আমারই হয়ে গেছে। কোথা থেকে যেন এসেছে, আমি ওদের থাকতে দিয়েছি। কী কিউট, তাইনা? আমি চুপ করে ছিলাম, সে বলল, তুমি বেড়াল পছন্দ করোনা? আমার মা বেড়াল খুব ভালোবাসে। আমাদের গ্রামের বাড়িতে অনেক বেড়াল ছিল
আমি বলে ফেলেছিলাম, আমি বেড়াল সহ্য করতে পারিনা। সে হাসতে হাসতে বলেছিল, সে কী!! ওরা তাহলে কোথায় যাবে?

বিয়ের পর ফ্ল্যাটে গিয়ে বেড়ালদের দেখা পাইনি। বেড়াল কোথায় গেল, কাকে দিয়ে দিল সেকথাও জানা হয়নি আমার। অথচ বিয়ের পর আমাদের বাসায় কোথা থেকে তুমি এক কানা বিড়ালকে ঠাঁই দিলে। প্রতিদিন তিন বেলা এই বিড়ালদের তুমি খেতে দিতে। বিড়ালদের বলছি কারণ কানা বিড়ালের সাথে আরও দুটো বিড়াল আসতো। বিড়াল নিয়ে মামীর সাথেও তোমার এক ধরণের প্রতিযোগিতা ছিল। সারাজীবন বাপের বাড়ির পাশে থাকলে, আমাদের যাকিছু আবদার, আহ্লাদ এবং জেদাজেদি সব তো মাসী, মামা, মামী, মামাতো ভাইবোনদের সাথেই গড়ে উঠেছিল। মামীদের বিড়ালের নাম ছিল মন্টু, আমাদের বাড়ির বিড়ালের নাম ঘন্টু, কানা বিড়ালের নাম কানি বিড়াল। উফ! কী অসহ্য লাগতো। ছোট্ট মৌটুসীকে নিয়ে যেতাম, গিয়েও বলতাম, মা, এই বিড়ালদের ভাগাও বলছি, আমার মেয়ের ডিপথেরিয়া হবে নাহলে। হা হা হা হা!! মা, আমি কী পাগল ছিলাম, মৌটুসী ছিল আমার জান প্রাণ, মেয়েটাকে মাটিতে রাখলে পিঁপড়া কামড়াবে, মাথায় রাখলে উকুনে খাবে করতাম। মৌটুসীও ছোটবেলায় মামণি ছাড়া কিচ্ছু বুঝতোনা। দিনগুলো হারিয়ে গেছে, কোথায় হারিয়ে গেলো, কি করে হারিয়ে গেলো, মৌটুসী আমার কাছে এখনও সেই আগের মতই আছে কিন্তু আমি মৌটুসীর কাছে আর আগের মত নেই। মেয়েটাকে মনের মত মানুষ করতে গিয়ে, সমাজের নানা জটিলতা থেকে মুক্ত রাখতে গিয়ে আদরের পাশাপাশি কঠিন শাসন করতাম। মেয়েটা আমার শাসনের কথাটুকু অন্তরে গেঁথে নিয়েছে, আদরটুকু বোধ হয় জড়ো করতে ভুলে গেছে। মৌটুসীটা আগাগোড়াইতো ভুলোমনা, তাইনা মা?
এরপর মিশার জন্ম হলো, আমি তোমার একমাত্র মেয়ে, মৌটুসী মিশা তোমার আদরের নাতনি। মিশা জন্মের পর থেকেই অসুস্থ থাকতো, তাই মিশাকে মনে হয় একটু বেশীই ভালোবাসতে। যতই ভালোবাসো নাতনিদের, তাতে তোমার কানি বিড়ালের প্রতি ভালোবাসা এতটুকু কমেনি। ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছি, আমাদের বাড়িতে কুকুর ছিল, কিন্তু বিড়াল কখনও ছিলনা। যতদূর জানতাম, তুমি বিড়াল পছন্দ করতেনা। সেই তুমি কি করে একটা কানা বিড়ালের প্রতি এত সদয় হয়ে গেলে যে দুই নাতনি এলে কানা বিড়ালকে ওদের আড়ালে খেতে দিতে যেন ওরা বিড়ালের সংস্পর্শে না আসতে পারে। ঐ যে আমি বলতাম, ডিপথেরিয়া হবে!
কত কথা মনে পড়ছে আজ। পাড়াগাঁইয়ে যেমনি হয়ে থাকে, পথে ঘাটে কুকুর বেড়ালের ছড়াছড়ি, সারাক্ষণ এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরছে, এঁটোকাঁটা খাচ্ছে, কখনও ঘেউ ঘেউ, ম্যাও ম্যাঁঅ চলছে। কারো বাড়ির কোনায় গিয়ে যদি করুণ সুরে কাঁদে, তখন বাড়ির তরুণ বা মা জাতীয় কেউ যাহ যাহ! কোন অমঙ্গল নাজানি ঘটে বলে দৌড়ানি দিচ্ছে। এমনই এক অমঙ্গলের আশংকায় ঐ বাড়ির এক যুবক নিষ্ঠুরতা করেছিল, কি দিয়ে খোঁচা দিয়ে এক বিড়ালের এক চোখ কানা করে দিয়েছিল। যখন বিড়ালগুলো সুস্থ ছিল, তুমি পাত্তা দিতেনা, যেইমাত্র একজনের পৈশাচিক আনন্দে বিড়ালের এক চোখ হারিয়ে গেলো, তোমার মাতৃ হৃদয় কেঁদে উঠলো, কানি বিড়াল হয়ে গেলো তোমার বিড়াল। বাপরে! এই বিড়াল ঘরে এসে খাটের নীচে পায়খানা করে দিত, বমি করে দিত---তুমি গজগজ করতে ঠিকই, কিন্তু নিজ হাতে পরিষ্কার করতে। আমি তখন তোমার সাথে কত ঝাঁঝিয়ে কথা বলতাম।

এরপর চলে গেলাম দুই মেয়ে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া, তখনতো মোবাইল ফোন ছিলনা। বিদেশ থেকে ফোন করাও অত সহজ ছিলনা। চিঠিই ছিল ভরসা। তুমি তখন আমাকে চিঠি লিখতে, আমি তোমার একমাত্র কন্যা, আমার কাছে তুমি চিঠি লিখবে কত ইনিয়ে বিনিয়ে, তা নয়, তুমি চিঠি লিখতে শুধু আমাকে শাসন করে, আমার বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ করে। তোমার চিঠি্র খাম হাতে নিয়ে আমি চুপ করে বসে থাকতাম, সহজে খুলতামনা, ভয় লাগতো। তোমার চিঠি মানেই আমার চোখের জল, কবে তোমার সাথে কি খারাপ ব্যবহার করেছি, কবে কোন কর্তব্যে অবহেলা করেছি, এমনকি দুর্গাপূজার সময় তুমি আমার কথা ভেবে পূজামন্ডপেই যাওনি, এর জন্যও তুমি আমাকেই দায়ী করেছিলে। বলেছিলে, তুমি আমার জন্য এত কাঁদো, আমি নাকি তোমার কান্নার মূল্যই দেইনি কোনদিন। আরে মা, আমি কেন, আমাদের ভাইবোনদের সকলেই জানতাম, তুমি একজন প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী, তুমি আর দশজন মায়ের মত ছিঁচকাঁদুনে নও, তুমি ছিলে স্কুলের শিক্ষক, সব সময় আদর্শের বাণী শোনাতে। সেই তুমি আমার জন্য কাঁদো, আমি বিশ্বাস করবো কি করে? যাই হোক, সবচেয়ে মর্মান্তিক চিঠি লিখেছিলে, তোমার কানি বিড়ালের মৃত্যু সংবাদের বর্ণনা দিয়ে, এবং শেষে যোগ করেছিলে, তুই এই অসহায় কানি বিড়ালটাকেও সহ্য করতে পারতিনা। মরণের আগে খুব কষ্ট পাইছে বিড়ালটা, কত চেষ্টা করেছি ভাত খাওয়াতে, শরীর ছেড়ে দিয়েছিল। যাহ! তোর যন্ত্রণা দূর হয়ে গেছে চিরতরে
বিশ্বাস করো মা, সেদিন আমি অবুঝের মত কেঁদেছি, বাথরুমে গিয়ে কেঁদেছিলাম যেন আর কেউ না জানতে পারে আমার অপমান। অপমানই মনে হয়েছিল, নিজের কন্যার চেয়েও একটা বিড়ালের মূল্য তোমার কাছে বেশী হয়ে গেলো? হা হা হা! মা, আজ তোমার সেই সেদিনের বয়সে আমি পৌঁছেছি, আজ বুঝতে পারছি, কেন তুমি কানি বিড়ালের জন্য অমন কেঁদেছিলে।

পিঙ্কির কুকুরটার জন্য আজ মন খুব খারাপ লাগছে। যদিও ছোটবেলায় আমাদের একটা পোষা কুকুর ছিল, ছোটমামারও একটা কুকুর ছিল, ওরাতো সেই কবেই মরে গেলো, কুকুরপ্রীতিও সেই ছোটবেলাতেই ফুরিয়ে গেলো। এরপর থেকে পথেঘাটে কুকুর দেখলে প্রথমেই মনে হতো, পাগলা কুকুর নয়তো, আমাকে কামড়ে দেবে নাতো! এর বেশী কিছুতো নয়।

অস্ট্রেলিয়ায় দেখেছি, আমেরিকায় হরহামেশা দেখি, এসব দেশে কুকুর বেড়ালের ভীষণ আদর, কত আদিখ্যেতা। প্রতিটি আমেরিকানের পোষা প্রাণী যেন থাকতেই হয়, বেশীর ভাগই কুকুর পোষে, অনেকে বিড়াল পোষে। ওয়ালমার্টে কুকুর আর বিড়ালের জিনিসপত্রের জন্য বিশাল বড় সেকশান আছে। কুকুর বিড়ালের জামাকাপড়, খাবার , খেলনা, হাগু পরিষ্কার করার জন্য কত রকম জিনিস বিক্রি হয়। কুকুরগুলো দেখতে সুন্দরই লাগে, তোমার মিশা নাতনি বিড়াল পালতে চায়, কুকুর পালতে চায়, এদিকে মৌটুসী রাস্তায় এক মালিক ছাড়া কুকুরকে পেয়ে প্রথমে রেসকিউ শেল্টারে নিয়ে যায়। মালিক আর কুকুরের খোঁজ করেনি, তাই সেই শেল্টার থেকে কুকুর ওর কাছে নিয়ে আসে। কুকুরের নাম দিয়েছে মম রায়। মমকে নিয়ে মৌটুসীরও আদিখ্যেতার অন্ত নেই, ওর পেছনে কী পরিমান টাকা মৌটুসী খরচ করে ভাবতে পারবেনা। ওকে অবশ্য এটাও বলা যাবেনা যে কুকুরের পেছনে এত টাকা ব্যয় নাকরে মানুষের পেছনে ব্যয় করো। ও না করবেনা, বলবে মানুষের জন্যও করব, কুকুরের জন্যও করব। মমকে নিয়ে মৌটুসী বেড়াতে এসেছিল, মম দেখতে সুন্দর ঠিকই, কিন্তু কেন জানি মমকে নিয়ে আমার মধ্যে কোন ভাব ভালোবাসার ব্যাপার ছিল না। কারণ মম আমাদের চিনেনাতো, তাই আমাদের সাথে কোন কমিউনিকেট করেনি। আসলে আমি পিঙ্কির সেই ব্লেইজকেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। মৌটুসীর কাছে সারাক্ষণ ব্লেইজের প্রশংসা করি, মৌটুসীর মুখ কালো হয়, মুখে কিছু না বললেও বুঝতে পারি, ওর মন খারাপ হয়েছে। মৌটুসী চলে যাওয়ার পর আবার আমার মন খারাপ হয়েছে, তখন মমর জন্য মায়া লাগতে শুরু করে।

আসলে পিঙ্কির কুকুরটা আমাকে আর মৌটুসীর বাবাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিল। আমাদের কাছাকাছি থাকতো পিঙ্কি, প্রায়ই ব্লেইজকে নিয়ে চলে আসতো, খুব ট্রেইনড কুকুর। ঘরে হাগু হিসু করেনা, দেখতেও দারুণ সুন্দর। আমাদের বাড়ি এসেই সে দিশেহারা হয়ে যেতো। কোথায় যাবে বুঝে উঠতে পারতোনা। ক্ষণে এই ঘরে যায় তোঁ দিক বদলে দোতলায় চলে যায়। আবার নেমে আসে, কী ছুটাছুটি করতো। আমার জামা ধরে দাঁড়িয়ে যেত নাহলে মৌটুসীর বাবার হাঁটু ধরে দাঁড়িয়ে ল্যাপটপের তার ছুটিয়ে দিত দৌড়। লিখে বুঝাতে পারছিনা, একটা কুকুর কেমন করে মানুষের চেয়েও অনেক বেশী আপন হয়ে উঠে! ওরা চলে যাওয়ার দিন পাঁচেক আগে আমি ব্লেইজের জন্য একটা জামা কিনে এনেছিলাম, ১২ ডলার দাম নিয়েছে। দামের কথাটা কেন উল্লেখ করলাম জানো, যেখানে একটা মানুষের বাচ্চার জামা পাওয়া যায় ৪/৫ ডলারে, সেখানে ছোট্ট একটা কুকুরের জামা ১২ ডলার। ভেবে দেখো, এদেশে কুকুরের মূল্য কতখানি, মানুষের বাচ্চার চেয়েও বেশী। জামাটা ছিল মেয়েলী, লাল রঙের উপর সাদা পোলকা ডট দেয়া, জামাটা পিঙ্কি ব্লেইজকে পরাবেনা জানি, তবুও আমি দিচ্ছি তাই আমার পছন্দই বড়। পিঙ্কি অবশ্য বলেছে যে ওর ছেলে ঋষি মেয়েলি জামা পরাতে দেবেনা, আমি তর্ক করিনি। বাচ্চা কুকুরের ছেলে মেয়ে বুঝে কার কি লাভ আমি জানিনা, আমাদের বাড়িতে ব্লেইজ আসার পর জামাতা পরিয়ে দিতেই কী যে সুন্দর লাগছিল। মা, দেখো, আমিও কিন্তু আমেরিকানদের মত কুকুর নিয়ে বিশাল গল্প ফেঁদে বসেছি। যস্মিন দেশে যদাচার বলে প্রবাদ আছেনা?
গতকাল বিকেলে পিঙ্কি ব্লেইজকে নিয়ে এসেছিল, মা জানো, ব্লেইজ কিছু একটা বুঝতে পেরেছে। গতকাল ও আমাদের ঘরে ঢুকে খুব শান্তভাবে একটু এদিক সেদিক হেঁটে দেখেছে, সবগুলো রুমে ঘুরে এসে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গেছে, সেখান থেকে নীচে নেমে এসেছে, আস্তে করে আমার পায়ের কাছে এসে মাথাটা আমার পায়ে ঠেকিয়ে শুয়ে পড়েছে। একই কাজ মৌটুসীর বাবার সাথেও করেছে। মা, কুকুর কেমন করে বুঝতে পারে ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা?

মা, পিঙ্কি পিঙ্কি করছি, পিঙ্কির কথা মনে আছে তো তোমার, মনে না থাকার কথা নয়, সেই যে কলকাতার মেয়ে, খুব কটকটি। ওর গল্পতো তোমাকে করেছি। পৃথিবীর বাইরে গিয়ে হয়তো অনেকের নাম একটু একটু ভুলে গেছো, তাইনা? আচ্ছা পিঙ্কির গল্প বলছি, তাহলেই মনে পড়বে। তাছাড়া আমেরিকায় বাঙ্গালীদের জীবন যাপন সম্পর্কেও অনেক কথা জানতে পারবে।
ওরা কানাডা থেকে আমাদের শহরে এসেছিলো নয় বছর আগে। আমাদের শহরের নাম কলম্বাস, আমাদের শহরেই একটা স্টিল ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি ওপেন হয়েছিল। ওর বর সব্যসাচী পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, সব্যসাচী সেখানেই চাকরি নিয়ে এসেছিল। সব্যসাচি খুবই স্মার্ট, মাত্র দুই বছরেই সব্যসাচি প্রমোশন পেয়ে ম্যানেজার হয়, এরপর আরও প্রমোশান পায়। প্রায় আট বছর এই প্লান্টে চাকরি করলো সব্যসাচি, ওরা আমেরিকান ইমিগ্র্যান্ট হয়ে গেছে। এক বছর আগে ইন্ডিয়াতে খুবই নামকরা স্টিল ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানীতে সিইও হিসেবে জয়েন করেছে, এখন সব্যসাচি ইন্ডিয়াতে আছে, পিঙ্কিও চলে যাচ্ছে আর কিছু দিন পরে।

পিংকি বড়লোক বাবার কন্যা, বড়লোক স্বামীর বউ হলেও সবার সাথেই মিশতে পারতো। কলকাতার মেয়ে হলেও নিজেকে পরিচয় দেয় বাঙ্গাল বলে, আর বরের পরিচয় দেয় ঘটি বলে। হা হা হা! মনে আছে তোমার, আমরা পপিকে ক্ষেপাতাম ঘটি বলে, আর পপি রেগেমেগে আমাদের বলতো তোরা বাঙ্গাল, সারাক্ষণ খাইছি, গেছি করে কথা বলিস! আমরা ভাইবোনেরা ঘটি বাঙ্গাল নিয়ে কত ঝগড়া করতাম। যদিও ওর বর এসব কথায় মিটমিট করে শুধু হাসে। ওর বর ওর সব কথাতেই মিটিমিটি হাসে, ভীষণ সুখী দম্পতি ওরা।

পিংকির বাবার বাড়ি ছিল বিক্রমপুরে, এখনও সেখানে ওদের পিতৃপুরুষের ভিটা আছে। নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজের বিখ্যাত প্রিন্সিপাল জীবন কানাই চক্রবর্তি ছিলেন যে, উনি ছিলেন পিংকির বাবার জ্ঞাতি কাকা অথবা জ্ঞাতি ভাই।

পিংকিরা প্রথম যখন মিসিসিপি এলো, তখন আমরা থাকতাম ইউনিভারসিটি অ্যাপার্টমেন্টে। ওরা প্রথম নয় মাস আমাদের কাছাকাছি দূরত্ব একটা বাড়ি ভাড়া নিল, কোম্পানীই দিয়েছে সেই বাড়ি। তখন ওদের ছেলে আমাদের শহরেই একটা প্রাইভেট স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। তখন আমাদের সাথে পিঙ্কিদের প্রায় সময় দেখা সাক্ষাৎ হতো, আমিও একা থাকতে পারিনা, পিঙ্কিও পারেনা। ফলে তখন সময় আমাদের খুব ভাল কাটতো। পরে আমাদের শহর থেকে ত্রিশ মাইল দূরের আরেকটি শহর স্টার্কভিলে আরও বাঙ্গালী পরিবারের সাথে পরিচয় হওয়ার সুবাদে ওখানেই নতুন বাড়ি কিনে চলে গেলো। বলা হয়নি, ওদের ছেলেকে ঐ শহরের পাবলিক স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। স্টার্কভিলে যখন চলে গেলো ওরা, ওখানেই আরও শুভার্থী বাঙ্গালী পরিবার পেয়ে যাওয়ায় আমাদের সাথে প্রথম বছর আসা যাওয়া কমে গেলো। আসা যাওয়া কমে গেলেও পিঙ্কি আমাকে ফোন করতো, ও ছিল রয়টার। দুনিয়ার সব খবর আমার সাথে শেয়ার করতো। ও জানতো, আমার কাছে যা কিছুই বলা যায়, তার সবই সেফটি ভল্টে জমা হয়ে থাকে। ঘরে বসেই আমি পৃথিবীর সংবাদ পেতাম, আশেপাশের সবার খবরতো পেতামই, বাংলাদেশে কখন কি ঘটে যাচ্ছে, সেসব সংবাদও মাঝে মাঝে পিঙ্কি আমাকে দিয়ে দিত। সেই পিঙ্কি আজ চলে গেলো, আমার খুব ক্ষতি নাহলেও বিশেষ ক্ষতিতো হয়েইছে। আত্মীয় বলতে ধারে কাছে কেউ নেই, বন্ধুও নেই, একা আমি বাঁচি কি করে! পিঙ্কি ছিল আমার একাকীত্বে স্বস্তি। অনেক আউলা ঝাউলা কথা বলতো, সবাই যে ওকে পছন্দ করতো তাও নয়, তবে আমি ওকে পছন্দ করার চেয়েও বেশী স্নেহ করতাম। ও ভাল রান্না হলে খেতে ভালোবাসতো, একটু আদর সমাদর ভালোবাসতো। আমি তোমার মুখরা মেয়ে হলেও আদর আপ্যায়নে কিন্তু সেরা মেয়ে। ভালো কথা, আমাকে তুমি মুখরা বলতে ঠিকই, আমি কিন্তু আর একটুও মুখরা নেই।

মা, তোমাকে বলা হয়নি, যদিও আমাদের ধারে কাছে কোন বাঙালি নেই, তবুও কিছু দূরে যে কটি বাঙালি পরিবার শুরু থেকে ছিল, তারা আমাদের সাথে আর সম্পর্ক রাখেনা, আমাদের থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। কেন এমন হলো জানতে চেয়োনা, আমি বলবো না। তুমিই শিখিয়েছিলে, একজনের কথা অন্যজনকে বলতে নেই, মুখের কথা ঝট করে ফেলতে নেই। আমি অনেক সইতে পারি, অজান্তে কারো সাথে কিছু ভুল করে ফেললে তার জন্য মাথা নীচু করে ভুল স্বীকার করতে পারি অনায়াসে, তবুও আমার প্রতি কেউ চরম অন্যায় করলেও তা নিয়ে ঘাঁটাতে পারিনা। অনেক ব্যথা জমেছে মা, এই বুকটায় অনেক ব্যথা। তুমি বলতে, যে সয় সে রয়, মুখের কথা হাতের ঢিল, একবার ফসকে বেরিয়ে গেলে আর ফেরানো যায় না। এজন্যই আমি চুপ থাকি, কিন্তু ক্ষয়ে যাই না। সময় আমাকে সব পুষিয়ে দেয়।
আমাদের একাকী প্রবাসী জীবনে পিংকি-সব্যসাচী অনেকটাই আত্মীয়ের মত হয়ে উঠেছিল। আমাকে মিঠুদি ডাকলেও তোমার জামাইবাবাজিকে ডাকতো দাদা। দাদা যেমন ডাকতো, একেবারে দাদার মত মান্য করতো, ভালোওবাসতো খুব। বাসতো বলাটা ঠিক নয়, এখনও বাসে। যখন আমাদের শহর কলম্বাসে চলে এলো, প্রায়ই সন্ধ্যে হলে আমাদের বাড়ি চলে আসতো, আমরাও মাঝে মধ্যে যেতাম ওদের বাড়ি। বড়লোকের কন্যা বা স্ত্রী বলেই কিনা জানিনা, পিঙ্কির মধ্যে কিছুটা ক্ষ্যাপাটে ভাব আছে, যা অনেকে পছন্দ না করলেও আমার পছন্দ ছিল। অনেকটা আমাদের মিশার মত, যখন যা মনে হবে সেটাই করবে।

আমাদের শহরে চলে আসার কারণ শুনবে? ওদের একমাত্র ছেলে ঋষি মিসিসিপি ম্যাথস এন্ড সায়েন্স স্কুলে চান্স পেয়েছে, সেই স্কুল আমাদের শহরে। একমাত্র ছেলেকে স্কুলের হোস্টেলে পাঠিয়ে ওর পক্ষে ৩০ মাইল দূরের স্টার্কভিল শহরে থাকা নাকি সম্ভব নয়, তাই কলম্বাস শহরে চলে এলো। এই আসাও কিন্তু আমাদের মত বাড়ি ভাড়া করে চলে আসা নয়। প্রথমেতো স্টার্কভিলে নতুন বাড়ি কিনলো, এত বড় বাড়ি কিনে মনের মত করে সাজালো। ওরা ছেলে নিয়ে ভীষণ এমবিশাস, এটাই হওয়া স্বাভাবিক। ওদের বাড়িতে সকলেই উচ্চশিক্ষিত, ওদের একমাত্র ছেলে বাপ-মায়ের দুই বংশে একমাত্র নাতি, কাজেই ছেলেকে নিয়ে এমবিশাস হওয়া অবাক হওয়ার মত বিষয় নয়। একমাত্র সন্তান হওয়ার বিপদও কম নয়, বাপ মায়ের যত আশা, আকাঙ্ক্ষা সেই এক সন্তানকে ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকে। ফলে সেই সন্তানকে চোখ ছাড়া করতে ভয়, কোল ছাড়া করতে ভয়, কাছ ছাড়া করতেও ভয়। এদিকে ম্যাথস এন্ড সায়েন্স স্কুলে ইলেভেন ক্লাস ও টুয়েলভ ক্লাস পড়ার পুরো সময় ওদের হোস্টেলে থাকতে হয়, এটাই নিয়ম।



ছেলেকে ম্যাথস এন্ড সায়েন্স স্কুলে পড়ানোর পরিকল্পনা ওদের শুরু হয় আমাদের মিশাকে দেখে। ওরা যে বছর কানাডা থেকে এলো, সে বছর মিশা ম্যাথস এন্ড সায়েন্স স্কুলে টুয়েলভ ক্লাসে পড়ে, মিশাতো তোমার প্রিয় নাতনি। মিশা সেই স্কুলে দারুণ রেজাল্ট করছিল, স্কুল জুড়ে মিশাকে সবাই এক নামে চিনে। মিশা খুব মিশুক, ও নাচে, পেইন্টিং-এও সেরা। রান্নাবান্নায় দারুণ পাক্কা, ব্যস! পিঙ্কির কাছে মিশা হয়ে উঠলো ছেলের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। মিশাকে পিঙ্কি এবং সব্যসাচি তখন থেকেই অন্ধ ভালোবাসা যাকে বলে, তেমন ভালোবেসে ফেললো। তখন ওর ছেলে বোধ হয় ক্লাস ফোর বা ফাইভে পড়ে। তখন থেকে পরিকল্পনা শুরু, ওর ছেলেও ভীষণ মেধাবী, এই স্কুলে চান্স পেলো, হোস্টেলে যাওয়ার আগেই পিঙ্কিরা আমাদের শহরে আরও অনেক বেশী বড় বাড়ি কিনে ফেললো, এবং আগের বাড়ি বিক্রি করে দিল। আমার চোখে দেখা ভাগ্যবান এবং শতভাগ সুখী দম্পতি পিঙ্কি-সব্যসাচি। মা, পিঙ্কি যা চাইবে, সেটাই ঘটবে, পিঙ্কি যেদিকে তাকাবে সেদিকেই সোনা ফলবে। ঐ সময় আমেরিকায় বাড়ি বিক্রির বাজার মন্দা, সেই মন্দা সময়েই পিঙ্কিরা বাড়ি অনেক বেশী লাভ পেয়েই বিক্রি করে দিল এবং আমাদের শহরে আমাদের প্রতিবেশী হয়ে চলে এলো।

পিংকিই আমার দেখা একমাত্র মেয়ে, যে রান্না করতে পছন্দ করেনা এবং আক্ষরিক অর্থেই ঘরে রান্না করেনা। অথচ ও খেতে পছন্দ করে, মাছ খেতে এত ভালোবাসে যে আমি যেদিন মাছ রান্না করি, পিংকি মনে হয় ঘরে বসেই মাছের গন্ধ পায়। আমাকে ফোন করে, মিঠুদি, মাছ রান্না করেছো?
আমি বলি, গন্ধ পেলে কেমনে?
ও বলে, আমি বাঙ্গালের মেয়ে, রান্না করিনা তাই কি, মাছের গন্ধ ঠিক পেয়ে যাই। চলে আসছি কিন্তু রাতে। চলে আসতো সন্ধ্যায়, আমরা একসাথে অনেক মজা করে খাওয়া দাওয়া করতাম।
নিশ্চয়ই ভাবছো, পিংকি যদি ঘরে রান্নাই না করে তবে ওরা কি খায়? ওরা খায় মা, ভাল খাবারই খায় তবে তেল মশলায় রেঁধে খায়না, সব কিছু ওভেনে বেক করে খায়। রান্না করতে ভালোবাসেনা এটা এক কারণ, আসল কারণ হচ্ছে এদেশে রান্নাঘরে খোলা জানালা থাকেনা। ফলে তেল মশলার গন্ধ সারা বাড়িতে ছড়িয়ে যায়, জামাকাপড়েও মশলার গন্ধ পাওয়া যায়, মাথার চুলে গন্ধ পাওয়া যায়। পিঙ্কি বড়লোক মানুষ, বাড়ির পর বাড়ি কিনে, পছন্দ নাহলে বাড়ি বিক্রি করে দেয়। তেল মশলা গন্ধ পাওয়া যায় যে বাড়িতে, সে বাড়ির মার্কেট ভেল্যু খুব খারাপ থাকে। এটা ভীষণ সত্যি, না জেনেই কোন ভারতীয়, চায়নীজ, বাংলাদেশীদের বাড়ির ভেতর ঢুকলে বুঝা যাবে, এই বাড়ির মালিক খাস আমেরিকান নয়। ্পিঙ্কির লাইফ স্টাইল আমেরিকানদের মত, যা কিছু খাও হয় স্টিম করো নয়তো বেক করে খাও। তার উপর ও খুব স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে গেছে, সব্যসাচির বংশে ডায়বেটিস আছে তাই সব্যসাচিকে কঠিন ডায়েট রুল মেনে চলতে হয়, আমেরিকায় কত রকমের পুষ্টিকর খাবার পাওয়া যায়, ধারণা করতে পারবেনা। যেটুকু ভাত খাওয়ার, কারু বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে খায়। পিঙ্কি যখন এলো তখন বেশ ভারী চেহারা ছিল, এক্সারসাইজ আর ডায়েট কন্ট্রোল করে একেবারে স্লিম হয়ে গেছে, আর মোটা হতে চায় না। তাই বাড়িতে ভাত খায়না, ভাত রান্নাও করে না। চলে যাওয়ার সময় আমাকে কালোজিরা চালের ছোট পোঁটলা দিয়ে গেলো। ওর বাড়িতে রান্নার পাট ছিলনা বলে ও কাউকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে হলে রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাওয়াতো। আমাদেরকেইতো কতবার রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাইয়েছে। তবে প্রথম দিকে পিঙ্কি আমাদেরকে দুই একবার ওর বাড়িতে নিজের রান্না খাইয়েছে। এখানে বলে রাখি, পিঙ্কি যে বাঙ্গাল বাড়ির মেয়ে তা ধরা পড়ে যায় ওর রান্নার পরিমান দেখলে। এতটুকু কার্পন্য করেনা আয়োজনে, পাঁচজনকে খাওয়াতে গেলে আয়োজন করে পঁচিশ জনের। যে মেয়ে রান্না করতে পছন্দই করেনা, সে মেয়ে কিন্তু আমাদেরকে সাত/আট পদ রান্না করে খাইয়েছে, ওর হাতের লাবড়া তরকারী এত্ত স্বাদ হয়, কী বলবো। ওর ক্ষ্যাপাটেপনা কেমন জানো, যেহেতু আমি ওর হাতের রান্না লাবড়া স্বাদ হয় বলেছি, কতদিন যে আমার জন্য এত্তগুলো লাবড়া রেঁধে এনেছে!
আরেকটি ক্ষ্যাপাটেপনার কথা শোন, ওর প্রচুর সোনাগয়না হীরে জহরত আছে। সোনার গয়নার প্রতি আমার কোন আকর্ষণ নেই তা পিঙ্কি জানে। নতুন নতুন গয়না বানিয়ে আনার পর অন্য সব মহিলাদের যত আগ্রহ নিয়ে দেখায়, আমাকে তত আগ্রহ নিয়ে দেখাতে পারেনা বলে ওর মন খারাপ হয়। আমাকে যা দেখায়, সেটাই সুন্দর বলে দেই। বাঁ হাতে লোহা পড়েনা সব বিবাহিতারা, পিঙ্কির লোহাবাঁধানো চুড়িগুলো দেখার মত। সোনা দিয়ে বাঁধায়, এত সুন্দর সুন্দর ডিজাইন। আমাকে দেখিয়েছে, আমি বলেছি সুন্দর। ওমা, গত বছর আমার জন্য সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে এনেছে একখানা লোহার চুড়ি, আমাকে দিয়ে বলে, মিঠুদি, আমার এমন ডিজাইনের চুড়ি দেখে তুমি বলেছিলে, খুব সুন্দর। এজন্য তোমার জন্য এনেছি
 আমিও পালটা মজা করে বলেছি, সুন্দর বললেই যদি তুমি উপহার দাও, তাহলেতো তোমার হাতে যখনই নতুন ডিজাইনের গয়না দেখবো, আমি সুন্দর বলবো। এই যেমনি তোমার হাতে  লোহাবাঁধানোটা আমার দারুণ লেগেছে, পরের বার কি ঠিক অমন বানিয়ে অনে দিবে?
পিঙ্কি পড়ে যায় অস্বস্তিতে, তবুও বলেছে, দেবো, তোমাকে দেবো
মনে রেখেছে কথাটা, নিজের হাত থেকে খুলে আমার হাতে পরিয়ে দিয়ে গেলো।


তুমি যদি আমেরিকা আসতে তাহলে অনেক মজা হতো, কত গল্প শুনতে পারতে। আমাকে আঙ্গুল ব্যথা করে আর লিখতে হতোনা। আহারে, কত জনের বাবামা বেড়াতে আসে, শুধু আমার বাবা-মা এলোনা। এলে অবশ্য ভালোও লাগতোনা, একা বাড়িতে থাকতে কি কারো ভালো লাগে? একা বাড়িইতো, আমি থাকি ওয়ালমার্টে, আমার বর থাকে ইউনিভারসিটিতে, মৌটুসী ডালাস, মিশা ওয়াশিংটন ডিসি আর মিথীলাও হোস্টেলে। আশেপাশে কোন বাঙ্গালিও নেই, কাছে দূরের শহরে যে কয়টি বাঙ্গালী পরিবার আছে, তাদের মধ্যেও যে খুব ভালোবাসা আছে তাও নয়। মা জানো, দেশে বাঙ্গালীরা তাও একরকম মিলেমিশে থাকে, প্রবাসে বাঙ্গালীরা অন্তর্কলহ, পরনিন্দা, পরচর্চা, ঈর্ষা নামক রোগে আক্রান্ত হয়ে যায়। দেশে পুরুষরা সাধারণতঃ মেয়েলি ক্যাচালে নিজেকে জড়ায়না, প্রবাসে বাঙ্গালী পুরুষরাও বউয়ের সাথে সাথে নাচে। ব্যতিক্রম নেই তা নয়, তবে ব্যতিক্রম তো উদাহরণ হয়না।

মিসিসিপি নামের যে স্টেটে থাকি, এখানে কেউ আসতে চায় না। নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, ফ্লোরিডার মত তো নয়, মিসিসিপি হছে আমেরিকার সবচেয়ে গরীব স্টেট। আমেরিকা বললেও যেমন চাকচিক্য, আলো ঝলমলে, চোখ ধাঁধানো একটা ব্যাপার চিন্তায় চলে আসে, মিসিসিপি মোটেও তেমন নয়। মিসিসিপির চেয়ে আমাদের ঢাকা শহর অথবা কলকাতা শহর কয়েক গুন বেশী ঝলমলে।
তাছাড়া আমেরিকা যেই বেড়াতে আসবে সারা সপ্তাহ দিনের অনেকটা সময় তাকে একা থাকতে হবে। বিদেশে তোমাদের মত বয়সীদের বেড়াতে এসে একা থাকা মানেই জেলখানায় বন্দী থাকার মতো। রান্না করতে পারবেনা, কারণ ইলেকট্রিক্যাল ওভেন, বুঝবেনা কিছু কি করে সুইচ অন অফ করতে হয়, মাইক্রোওয়েভ ওভেনে খাবার গরম করতে দিতে গেলেও টাইম আর পাওয়ার বুঝবেনা---ইস! তখন মনে হয়, ধেৎতেরিকা, কে যে বলেছিল আমেরিকা আসতে, এত টাকা খরচ করে এলাম ঘরে বন্দী হয়ে থাকার জন্য

মা, তোমার আমেরিকা আসা হয়নি, এই নিয়ে আফসোস রেখো না। তোমাকে আমি আমেরিকার গল্প শোনাবো, সব রকমের গল্প শোনাবো। গল্প শুনে তুমি বুঝতে পারবে, স্বপ্নের আমেরিকায় আমরা কে কেমন থাকি। তোমাকে এখানে গল্প শোনানোর একটি মস্ত সুবিধা আছে, তুমি শুধু শুনবে কিছু বলতে পারবেনা, মানে আমাকে বকা দিতে পারবেনা। তুমিতো আবার আমাকে বকা দিতে ওস্তাদ ছিলে। আজ পিংকির কথা দিয়েই শুরু করেছি, ও চলে গেলোতো, আর এই স্টেটে ফিরবেনা, তাই ওর কথাই লিখছি, ধীরে ধীরে আরও কত গল্প শোনাবো। আমারতো কথা বলার সঙ্গী নেই, একদম একা আমি। পড়ন্ত বয়সে স্বামী স্ত্রীতে কত গল্প হয়, আমার স্বামী গল্পবাজ নয়। তুমি মারা যাওয়ার পর কতবার দেশে গেলাম, কত গল্প বলার ছিল, শোনার কেউ নেই বলে গল্পগুলো বলাই হলোনা।

শুরুতেই একবার লিখেছি, পিঙ্কিরা ধনী, বাড়ি গাড়ি সোনা গয়নার এন্তার প্রাচুর্য্য। ওরা ২০০৭ সালে কানাডা থেকে আসে আমাদের মিসিসিপিতে। সব্যসাচি যে স্টিল কোম্পানীতে চাকরি নিয়ে এলো, সেই কোম্পানী আমাদের কলম্বাস শহর থেকে খুব দূরে নয়। বড় চাকরির বড় ব্যাপার, কোম্পানী থেকে সব্যসাচীকে আমন্ত্রণ জানানো হলো, বউ ছেলে নিয়ে একবার কোম্পানী ঘুরে যেতে। কোম্পানীর খরচেই ওরা এলো, সব্যসাচী পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, খুবই বুদ্ধিমান স্মার্ট, ইন্টারনেট থেকেই কলম্বাস শহরে একমাত্র বাঙ্গালী হিসেবে আমার বরের নাম ঠিকানা বের করে ফেলে। ওদের রাখা হয়েছিল খুব ভাল হোটেলে, সেখান থেকেই সব্যসাচী তোমার জামাইকে ফোন করে। এখনও মনে আছে, আমার বর যখন আমায় বলেছিল, চলো, একটা তরুণ বাঙ্গালী দম্পতি এসেছে, দেখা করে আসি। এমনও হতে পারে, ওরা এখানে আসবে
এটা শোনামাত্র আমার মনটায় দুই রকমের অনুভূতি হলো, প্রথমতঃ এতকাল পর আমাদের কাছাকাছি কোন বাঙ্গালী পরিবার পাব, দ্বিতীয় মন বলল, কে জানে, ওদের সাথে মনের মিল হবে কিনা। বুঝাই যাচ্ছে ওরা অনেক স্মার্ট, তার উপর কলকাতার বাঙালি, কলকাতার বাঙালির সাথে বাংলাদেশের বাঙ্গালদের কথায় বার্তায়, চলনে বলনে অনেক তফাৎ থাকে। কলকাতার বাঙালিরা বাংলাদেশের বাঙালিদের নিয়ে বোধ হয় একটু একটু মজাও করে। এটা আমার মনে হয়, বাংলাদেশের বাঙালি শুনলেই কলকাতার বাঙ্গালিরা ভুল টোনে, অতিরিক্ত জোর দিয়ে বাঙ্গাল কথা বলার চেষ্টা করে যা আমার কাছে বিরক্তিকর লাগে। ছিলামতো অস্ট্রেলিয়াতেও, দুই বাংলার বাঙ্গালীদের মধ্যে পরস্পরকে নিয়ে মজা করার প্রবণতা পৃথিবীর সবখানেই আছে।

সেই সন্ধ্যায় আমি, আমার বর আর মিথীলা গেলাম সেই হোটেলে, যাওয়ার সময় সাথে করে ঘরে তৈরী চকোলেট কেক নিয়েছিলাম। আগেই শুনেছি আমাদের মিথীলার বয়সী ওদের একটা ছেলে আছে। এদেশে বাচ্চারা চকোলেট কেক খুব পছন্দ করে।
হোটেল লবিতে পৌঁছাতেই সব্যসাচি এগিয়ে এলো, কী সুন্দর চেহারা, মাথা ভর্তি কোকড়ানো চুল, পুরু গোঁফ, বয়সও কম। সব্যসাচিকে দেখেই পছন্দ হয়ে গেলো, এরপর সব্যসাচির ওয়াইফ এলো, ওয়াইফকে দেখে আমার মনটা চুপসে গেলো। ওর সাজ পোশাক দেখে মনে মনে ভাবলাম এই স্মার্ট মহিলা বাঙালি হলেই কি, আরবী হলেই কি, এ আমার সাথে মিলবেনা
কিন্তু দশ মিনিটের মধ্যেই জেনে গেলাম, ববকাট লালচে রঙের চুল, দুই কানে চার পাঁচটা ফুটোওয়ালা স্মার্ট মহিলাটি আসলে ভীষণরকম বাঙ্গালী। জেনে অবাক হলাম, ওদের একমাত্র ছেলে আমাদের মিথীলার বয়সী, নামও মিথীলার ভাল নামের সাথে মিলে গেছে, মিথীলার নাম ঋষিজা, ওদের ছেলের নাম ঋষি। আমি যেমনি মেয়েদের ঘরে বাংলা শিখিয়েছি, পিঙ্কিও ছেলেকে বাংলায় কথা বলা শিখিয়েছে। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারেও পিঙ্কি কাঠ বাঙ্গাল, চ্যাপা শুঁটকী থেকে শুরু করে সব খায়। আমার হাতের চ্যাপা শুটকি খাওয়ার জন্য পিঙ্কি ব্যাকুল হয়ে থাকতো।

মা, পিংকির বাবা-মা কিন্তু মিসিসিপি বেড়াতে এসেছিলেন, পিংকিতো চাকরি করতোনা, সারাদিন বাবা মায়ের সাথেই থাকতো, তবুও পিংকির বাবার কাছে এদেশে ভালো লাগতোনা,  বলে গেছেন, ওনারা আর আসবেন না। আমাদের বাড়িতে কয়েকবার এসেছিলেন ওনারা, খুব গল্প হতো। এরপর পিঙ্কির ছোট বোন-বোনজামাইও এসেছিল, ওরাও আমাদের বাড়ি এসেছিল। এখানে একটা স্যাড নিউজ আছে, পিংকির বাবা বলে গেছিলেন, এদেশে আর আসবেননা, ওনার আর আসা হবেনা, দুই বছর আগে উনি ক্যান্সারে মারা গেছেন। তোমার মৃত্যুটা যেমন আকস্মিক, বলা নেই কওয়া নেই, ক্যান্সার ধরা পড়লো, তিন মাসের মাথাতেই মরে গেলে। তেমনি পিংকির বাবারও অবস্থা, ঘরে বসে ধ্যান করছিলেন, ধ্যান থেকে আর উঠে দাঁড়াতে পারছিলেননা। উঠতে গিয়ে বসা অবস্থা থেকে পড়ে গেলেন, হাসপাতালে নেয়া হলো, ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়লো, পনেরো দিনের মাথায় মরেও গেলো।
এই মৃত্যুর কোন মানে আছে? চিকিৎসা করার সুযোগ দিলেনা, যত্ন করার সুযোগ দিলেনা, অসুখ হলো আর মরে গেলে।

পিংকির মা বাবা এদেশে এসে মাস তিনেক ছিলেন, তখন পিঙ্কি আমাদের বাড়ি থেকে ত্রিশ মাইল দূরের স্টার্কভিল শহরে থাকে। বিশাল বড় বাড়ি, চারদিকে ঐশ্বর্য্য ছড়ানো ছিল, কোথাও নাই নাই ব্যাপার নেই, সর্বত্র আছে আছে ছড়ানো। কন্যার বিয়ের পর কন্যার বাপ মায়েরাতো কন্যাকে এমন আছে আছে চেহারাতেই দেখতে ভালোবাসেন, তাইনা মা? পিংকির বাবা মাও নিশ্চয়ই কন্যার ঐশ্বর্য্য দেখে সুখী হয়েছিলেন। পিঙ্কির বাবা মা চলে যাওয়ার পর পিঙ্কির ছেলে মিসিসিপি ম্যাথস এন্ড সায়েন্স স্কুলে ভর্তি হয়, পিঙ্কিরা আমাদের শহরে আলিশান বাড়ি কিনে, পাহাড়ের উপর বাড়ি। পিঙ্কির বাবা জেনেছেন এই আলিশান বাড়ি কেনার সংবাদ।
মা জানো, আমার জীবনে আমি সব দিক থেকে সুখী মানুষ দেখিইনি বলতে গেলে। পিংকিকে দেখার আগে আমার ধারণাও ছিলোনা যে সব দিক থেকে সুখী মানুষ এই পৃথিবীতে আছে। পিংকিকে দেখার পর আমি জীবন সম্পর্কে অন্যরকম ভাবতে শুরু করলাম। কারো সুখ দেখে আনন্দ লাগে, এমন মানুষও নিশ্চয়ই খুব কম আছে এই পৃথিবীতে। আমি সেই কম মানুষের একজন, পিংকির সুখ দেখতে আমার ভালো লাগে। টাকা পয়সার সুখের কথা বলছিনা, টাকা পয়সা থাকা আহামরি কিছু সুখ নয়, টাকাপয়সা থাকা হচ্ছে নিশ্চিন্ততা। নিশ্চিন্ততার মাঝেও সুখ আছে, সেই সুখে সুখী প্রচুর মানুষ আমি দেখেছি, কিন্তু পিংকির ব্যাপারটা অন্যরকম, বলে বুঝাতে পারবোনা।

সেই পিংকিরা চলে গেছে অন্য স্টেটে। স্টেটের নাম জানতে চাইছো? স্টেটের নাম বললে কি তুমি চিনবে? আচ্ছা বলছি, পিঙ্কি আজ গেলো ইলিনয় স্টেটে, ওর ছেলে আরবানা শ্যাম্পেন ইউনিভারসিটিতে পড়বে। আর কিছু জানতে চাও? আগেও তুমি এমন করতে, ফোন করতাম যখন, যদি বলতাম অমুক দিন অমুকের বাড়ি নেমতন্ন খেতে গেছিলাম। তুমি জানতে চাইতে, কই গেছিলি? জায়গার নাম কি? তোগো বাড়ি থেকে কয় মাইল দূরে জাতীয় কথা। আমি তোমাকে বকা দিতাম, মা, তুমি এতসব জিজ্ঞেস করছো কেন? জায়গার নাম বললে তুমি চিনবে? আমি তোমাকে কিভাবে বুঝাবো, ঐ গলির পর সেই গলি, ডানদিক ঘুরে বাঁইয়ে---তুমি চুপ করে যেতে। আমি শুরুতে ভাবিনা, পরে ভাবতে বসি। তেমন করেই পরে ভেবে বুঝেছি, আমার মুখে শুনে তুমি কল্পনায় আমেরিকা দেখতে চাইতে, আমাদের মিসিসিপি দেখতে চাইতে, আমেরিকার রাস্তাঘাট, পাড়া মহল্লার চিত্র দেখতে চাইতে। মা, যা তখন করিনি, তা এখন করবো, তোমাকে আমি আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইন্ডিয়া, বাংলাদেশের সব জায়গা ঘুরিয়ে দেখাবো যেখানে তোমার যাওয়া হয়নি।

মা, ভীষণ খারাপ লাগছে আজ, এখানে আমার বন্ধু নেই, স্বজন নেই। তবুও পিংকি ছিল কাছাকাছি, মনে হতো আছে কেউ পাশাপাশি। পিঙ্কি চলে যাওয়ার সময় কাঁদছিল, অন্যের কান্না আমাকে স্পর্শ করে দ্রুত। কিন্তু পিঙ্কির কান্না আমাকে স্পর্শ করছিলনা, বরং ওকে হাসিমুখে প্রবোধ দিয়ে বলেছি, দূর পাগল, মোটেতো ৯ ঘন্টার পথ, ট্রেনে চড়ে চলে আসবে। আমাকে এক ফোঁটা অশ্রু ফেলতে না দেখে পিংকির নিশ্চয়ই মন খারাপ হয়েছে, আমি তা আন্দাজ করতে পেরেছি বলেই ওকে বলিনি, গত রাতে ওয়ালমার্ট থেকে ফেরার পথে গাড়িতেই আমি কাঁদছিলাম। পিঙ্কির জন্যই কাঁদছিলাম। গাড়ি গ্যারাজে পার্ক করেও বেশ কিছু সময় স্টিয়ারিং হুইলে মাথা ঠেকিয়ে কেঁদেছি, এমন আমি মাঝে মাঝেই কাঁদি। তোমার জন্য কাঁদি, বাবার জন্য কাঁদি, স্বামীর ব্যবহারে দুঃখ পেলে অভিমানে কাঁদি, মেয়েদের জন্য কাঁদি।
আজকাল খুব মন খারাপ লাগলে গাড়িতে বসেই আমি কাঁদি, তোমার মৃত্যুর পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি আছাড়ি পিছাড়ি করে কাঁদার সুযোগ পাইনি। তবে কাজ থেকে ফেরার পথে, গাড়ি চালাতে চালাতে অনেক কেঁদেছি, নীরব কান্না যাকে বলে। গাড়ি বাড়ির গ্যারাজে রেখে স্টিয়ারিং হুইলে মাথা ঠেকিয়ে কত যে কাঁদি, তোমার মৃত্যুর পর থেকে এভাবে কাঁদি। কেউ আপন নেই যে আমার, যার কাছে মনের ব্যথা খুলে বলবো আর তার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদবো, তাই গাড়ির স্টিয়ারিং-এ মাথা ঠেকিয়েই কাঁদতে ভাল লাগে।

পিংকির জন্যও গতকালই কেঁদেছি, আর কাঁদার দরকার হবেনা। এতদিনে সংসারের সার বুঝতে শুরু করেছি, সবই মায়া। আজ মায়া আছে, কাল অদর্শনে মায়া কেটে যাবে। মায়া কেটে গেলো তো সবই গেলো। যখন দেশ থেকে প্রথম আমেরিকা এলাম, উফ, সেসব দিনের কথা মনে পড়লে এখনও আনমনা হয়ে যাই। তোমাদের সবার জন্য সে কী কান্না, প্রতিদিন, প্রতি রাতেই কাঁদতাম, হাউ মাউ করে কাঁদতাম। এখন কি কাঁদি? ১৬ বছরের অদর্শনে মায়া কেটে গেছে।

মা, আমরা সকলেই যার যার মত ভাল আছি, অথবা ভাল থাকার অভিনয় করে যাচ্ছি। তুমি কেমন আছো তোমার ভুবনে?

মিঠু



প্রযত্নে----৩য় পর্ব


মা,

আজ জুলাইয়ের এক তারিখ, তুমি তো জানোই জুলাই আমার প্রিয় মাস। জুলাই এলেই আমায় কি যে এক পাগলামীতে পেয়ে বসে, মনে হয় সবাইকে ডেকে ডেকে বলি, তোমরা শোন, জুলাই মাস আমার অনেক প্রিয় একটি মাস, কেন আমার কাছে এত প্রিয় জানতে চাও? কারণ জুলাই মাসে আমার বিয়ে হয়েছে। হা হা হা হা! মা আমি কি বিয়ে পাগলা ছিলাম? নাহলে কেন জুলাই মাস এলেই আমার ভাবখানা এমন হয় যেন পৃথিবীতে আমারই শুধু বিয়ে হয়েছে অথবা বিয়ে বুঝি একটা মেয়ের জীবনে সব আনন্দ। আর যেন কারো বিয়ে হচ্ছে না!
না গো মা, এমনিই মজা করলাম। জুলাই মাস শুধু কেন, আমার কাছে বছরের বারো মাসই প্রিয়। প্রতিটি মাসেই আমার প্রিয় কিছু স্মৃতি জড়ানো আছে। মৌটুসী মিশা মিথীলার জন্মমাস প্রিয়, আমার বরের জন্ম মাস প্রিয়, তিন ভাইয়ের জন্ম মাস প্রিয়, স্বাধীনতার মাস প্রিয়, নববর্ষের মাস প্রিয়, বিজয় দিবসের মাস প্রিয়, আমার এনগেজমেন্টের মাস প্রিয়, সবই প্রিয় শুধু অক্টোবার মাস ছাড়া। অক্টোবার মাস অবশ্য প্রিয় এবং অপ্রিয়তে মেশানো। কারণ অক্টোবার মাসে তোমার জন্ম, বাবার জন্ম, রানুর ছেলে অতনুর জন্ম। কত্তগুলো প্রিয় ঘটনার মাঝে সবচেয়ে অপ্রিয় ঘটনা হলো, অক্টোবার মাস তোমার মৃত্যু মাস। তোমার মৃত্যুটা যে আমার হৃদয়ে কতবড় ক্ষত করে রেখেছে তা কাউকে বুঝাতে পারবোনা।


যাক গে, বিয়ের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম লেখা, বিয়ে হয়েছে আজ থেকে ৩১ বছর আগে, ৩১ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর আমার মাঝে আর সেই পাগলামী নেই। এইতো গতকাল ছিল মে মাসের ৩১ তারিখ, ৩১ বছর আগের এই দিনে আমার উত্তম কুমারের সাথে এনগেজমেন্ট হয়েছিল, তোমার কি মনে পড়ে ৩১ বছর আগের সেই দিনটির কথা? ভালো কথা, আগেই বলে রাখছি, আমি কিন্তু আমার বরকে তোমাদের আড়ালে উত্তম কুমার ডাকি। এতদিন বলিনি, লজ্জা লাগতো। এখন আর লজ্জা কি, তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে তো কথা বলতে হচ্ছেনা। তাছাড়া আমি যে বরপাগলা তাতো সকলেই জানতে।
সেই ৩১শে মের কথা মনে পড়ে? শুক্রবার ছিল, বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজন। ইন্ডিয়া থেকে বড় মামা, মামী, তাদের দুই ছেলেমেয়ে এসেছে, সেজো মামা এসেছে মামী আর দুই ছেলে নিয়ে, সেজো মাসী এসেছে মেসো আর দুই বাচ্চা নিয়ে। ওরা কেউ অবশ্য আমার এনগেজমেন্ট উপলক্ষে আসেনি। ওরা এসেছিল ছোট মাসীর বিয়ে উপলক্ষে। ছোট মাসীর বিয়ের তারিখ ছিল জুন মাসের সাত তারিখ। ছোটবেলায় ছোট মাসীর সাথে আমার যেমনই দা কুমড়ো সম্পর্ক ছিল, তরুণীবেলায় কি করে যেন সেই দা কুমড়ো সম্পর্ক পালটে হয়ে গেলো ফেভিকলের আঠা সম্পর্ক। তুমিই মাসী বোনঝিকে দেখলে ফেভিকলের আঠা বলতে। সেই ফেভিকলের আঠা আমাদের বিয়ের সময় থেকে শুরু করে আজও মজবুত আছে। কী মজার কান্ড দেখো, মাসী আমার থেকে ছয় বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও আমাদের বিয়ে হলো দেড় মাসের ব্যবধানে, আমাদের দুজনের সন্তান হলো দুই মাসের ব্যবধানে, এমনকি সেই সন্তানদের বিয়েও হলো দুই মাসের ব্যবধানে। আঠা-সম্পর্ক কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।

মা, ৩১শে মে তারিখে আমার এনগেজমেন্ট হবে কেউ কি স্বপ্নেও কল্পনা করেছিল? আমি নিজেই কি কল্পনা করেছিলাম? আমরা সকলেই তখন ছোট মাসীর বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত। ঝড়ের মত আমার ছোটবেলার বন্ধু দিনা আমাকে ডেকে নিয়ে বলল, মিঠু, তুমিতো কেমিস্ট্রিতে অনার্স পড়ছো, জীবেন রায় নামে কাউকে চিনো? জৈব রসায়ন বই বাংলায় লিখেছে। আমার তখন অহঙ্কারের উত্তর, আমরা অনার্সে ইংলিশ বই পড়ি, বাংলা অনুবাদে কেমিস্ট্রি পড়িনা। জীবেন রায়কে চিনিনা
তখন দিনা বলল, জীবেন রায় আমার বড় মামীর খুব পরিচিত। এতদিন কানাডা ছিল, দেশে এসেছে বিয়ে করবে। ঢাকা ইউনিভারসিটির প্রফেসার ছিল। বড় মামী হিন্দু মেয়ে খুঁজছে, আমাকে বলেছে যদি আমার কোন বন্ধু থাকে মামীকে জানাতে। আমি তোমার কথা বলেছি

দিনার কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়েছি, কী বলে দিনা! আমার বিয়ের কথা বলেছে? আমার এখন বিয়ে হবে নাকি? বাবাতো কবেই বলে দিয়েছে অনার্স, মাস্টার্স শেষ করার আগে আমার বিয়ে দিবেনা। তবুও তরুণী মন, দিনার প্রস্তাবে কেমন যেন কৌতুহল জাগলো। সাথে ছিল ছোটমাসী, তার নিজের বিয়ে হচ্ছে, হয়তো বিয়ের উচ্ছ্বাসে সেও দিনাকে বলল, অসুবিধা কি। বিয়ে হলে হবে নাহলে নাই। ছেলের সাথে দেখা করা যায়।
দিনা বলল আরও চমকপ্রদ কথা, মামী বলেছে, ছেলে নাকি প্রথামাফিক নিয়মে পাত্রী দেখবেনা। কারণ যদি কোন কারণে পাত্রী পছন্দ নাহয় তখন তা পাত্রীর জন্য খুবই অপমানের। এমন ঢোল পিটিয়ে পাড়া জাগিয়ে পাত্রী দেখে গিয়ে সংবাদ পাঠানো, পাত্রী পছন্দ হয়নি, তা চলবেনা। ছেলে পাত্রী দেখবে এমনভাবে যেন পাত্রী না জানতে পারে তাকে দেখানো হচ্ছে
আমি এটাতে দারুণ রোমাঞ্চের আভাস পেলাম। খুব ইচ্ছে হলো এডভেঞ্চার করার। কিন্তু একটু ভয়ও লাগছিল এই ভেবে যে এই ফালতু বিষয়ে বাবা বা মা কেউ রাজী হবেনা।
এমন একটি রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটার সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার পথে, আমার জেদ চাপলো, এই লোককে দেখতেই হবে।
মাসীকে বললাম তোমায় রাজী করাতে। কারণ বাবার কথার উপর দিয়ে তুমি যাবেনা। মাসী তোমাকে এই প্রসঙ্গে কথা বলতেই তুমি দোটানায় পড়ে গেলে। এক মন চায় মেয়েকে পাত্রপক্ষের সামনে হাজির করা হোক, সবার মেয়েকে বিয়ের বাজারে পরীক্ষা দিতে হয়। আমাদের ঐ বাড়ির মেয়েদের মধ্যে প্রায় প্রত্যেক হিন্দু বাড়িতেই পাত্রী দেখা পর্ব চলছিল, পাত্রপক্ষ দলবল নিয়ে এসে মিষ্টি খেয়ে পাত্রীর হাতে একশ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে পান চিবোতে চিবোতে বিদায় নেয়। এরপর সারা বাড়ির সকলের মধ্যে চলে উৎকন্ঠা আর অপেক্ষা। পাত্রপক্ষ থেকে কি জবাব আসে! বেশীরভাগ জবাব আসতো, পরে জানাবো
তোমার নিশ্চয়ই বুক কাঁপতো, কারণ তোমার মেয়ের গায়ের রঙ কালো, মেয়ের বাবার পয়সা নেই যৌতুক দেয়ার মত। তার উপর মেয়ের বংশে সব মেয়েদের দেরীতে বিয়ে হয়। এর মধ্যে মেয়ের বাপ নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে, মাস্টার্স শেষ নাকরে মেয়ের বিয়ের কথাই উঠানো যাবেনা। তুমি ভয় পেতে, একে তো কালো, তার উপর বয়স হয়ে গেলে মেয়ের জন্য পাত্র জুটবেনা। এমএসসি পাশ মেয়ে মানেই বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাওয়া, মেয়ের কোন গলদ থাকা যে কারণে এতদিন মেয়ের বিয়ে হয়নি।
তুমি আমতা আমতা করছিলে, মাসী বলল, ছেলেতো ঘটা করে পাত্রী দেখবেনা।দূর থেকে দেখবে, আত্মীয় স্বজন পাড়া পড়শী কেউ জানবেনা। হয়তো নিউমার্কেটে গিয়ে দেখলো, পছন্দ হলে আলাপ দিবে পছন্দ নাহলে ওখান থেকেই বিদায়। দেখতে অসুবিধা কি, যদি  পাত্রের পছন্দ হয়েই যায় তাইলে কত ভাল একটা পাত্র পাওয়া যাবে মিঠুর জন্য।
ছোট বোনের প্রস্তাব তোমার মনে ধরেছিল, তোমার মনেও হয়তো ভাগ্য যাচাই করার একটা ইচ্ছে হয়েছিল। তবে পাত্র পাত্রী দেখাদেখির এই ব্যাপারটা সত্যিই তুমি, আমি মাসী আর দিনা ছাড়া বাসার আর কেউ জানতে পারেনি, এমনকি বাবাওনা।

মা, কি করে যেন ঘটনা ঘটে গেলো! তোমার কালো রোগা পাতলা মেয়েটাকে সাহেবের মত ফর্সা, লম্বা সুন্দর পাত্রের মনে ধরে গেলো। আমার বাম চোখে বেশ বড় এবং স্পষ্ট একটা তিল আছে, ওটাই আমার বার্থ মার্ক। ছোটবেলা থেকেই তোমার মুখে শুনে বড় হয়েছি, আমারে! এত সুন্দর একটা তিল যদি আমার মাইয়ার চোখে না হইয়া গালে হইতো অথবা চিবুকে, তাইলে কত সুন্দর হইতো। এত বড় তিল কারো চোখে হয়? চোখের সৌন্দর্য্যই শেষ
তোমার কথা শুনে আমিও ধরে নিয়েছিলাম, এই তিলটার কারণেই আমার চোখের সৌন্দর্য্য প্রকাশিত হতে পারেনি। তাই তিলটার প্রতি কোন মমতা বোধ করিনি। অথচ এই তিলটির দিকেই সেদিন সাহেবী পাত্রের চোখ আটকে গেছিলো। এই একটি মাত্র কালো তিলে সে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য্য আবিষ্কার করেছিল! হ্যাঁ মা, বিয়ের অনেক বছর পরেও সে আমায় এই কথাটা বলেছে। সেই তিলই আমাকে বিয়ের পিঁড়িতে টেনে নিয়ে গেছিলো। তোমার কি মনে পড়ে, কত নাটক হয়েছিল পাত্রী দেখা নিয়ে! পাত্রী দেখা বাদই হয়ে যাচ্ছিল, কেন বাদ হয়ে যাচ্ছিল সে কথা চিঠিতে বলতে চাইছিনা, সেটা আমিও জানি তুমিও জানো। কিছু কিছু গোপন প্রকাশিত হওয়া উচিত নয়, তাতে সংসারে সমাজে সম্প্রীতির ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তোমাকে লেখা এই চিঠি যদি অন্যের চোখে পড়ে যায়, তাদের কেউ যদি মনে করে যে আমি সব গোমর কথা ফাঁস করে দিয়েছি যেখানে তাদের নাম জড়িয়ে আছে, তখন ব্যাপারটা খুব বাজে দিকে গড়াবে।

যে মুহূর্তে পাত্রীর অজান্তেই পাত্রী দেখতে চাওয়ার মত চরম উত্তেজনাকর পর্ব বাদই হয়ে যাচ্ছিলো, সেই মুহূর্তে লাজ লজ্জা ভুলে জেদী আমি তোমাকেই বলেছিলাম, আমি এই ভদ্রলোকের সাথে দেখা করব বলে ঢাকা এসেছি, তার সাথে দেখা না করে আমি যাব না। আমি দেখতে চাই মানুষটাকে, কে এমন অদ্ভুতভাবে বিয়ের পাত্রী দেখতে চাইছে, যেভাবেই হোক তুমি ব্যবস্থা করবে

তুমিতো ব্যবস্থা করবেই, কারণ তুমিওতো মনে মনে ভাগ্য পরীক্ষা করতে চাইছিলে। পাড়াপ্রতিবেশীদের সুন্দর সুন্দর মেয়ের জন্য কত জায়গা থেকে পাত্রপক্ষ সমন্ধ দেখতে আসে, সেই মেয়েদের মায়েরা প্রতিযোগিতায় তোমার থেকে অনেকটাই এগিয়ে আছে। যে কোনদিন তাদের মেয়েদের পাত্রপক্ষ পছন্দ করে ফেলবে, মেয়েদের বিয়েও হয়ে যাবে। অথচ তোমার মেয়ের বেলায় মেয়ের বাবা মাস্টার্স কমপ্লিট না করিয়ে মেয়ের বিয়ে দেবোনা বলে কনে দেখা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার সেই পথ বন্ধ করে রেখেছে। তুমি যাচাই করেও দেখতে পারছোনা তোমার বিদ্যেয় তুখোড় কালো মেয়েটার বিয়ের বাজারে মূল্য কতখানি!

মা, এসব লিখছি বলে কি রাগ করছো? রাগ করোনা, আমি সত্যি কথাগুলোই বলছি। একটা যুগ ছিল যখন কন্যার মায়েরা বিয়ের বাজারে কন্যার মূল্য কতখানি হতে পারে তা পরখ করে দেখার সুযোগ খুঁজতো, কিশোরী কন্যা আছে এমন বাড়িতে ঘটক সুযোগ্য পাত্রের সন্ধান নিয়ে আসতো। কন্যার মায়েরাও তাদের কন্যা যেন আইবুড়ো নাহয়ে থাকে সেই দুশ্চিন্তায় আগেভাগেই কন্যার বিয়ের ঘটকালি করার জন্য ঘটকের সাথে দেন দরবার করতো। দলবল নিয়ে পাত্রপক্ষ কনে দেখতে আসতো, কন্যাকে হাঁটিয়ে দেখতো, বাজিয়ে দেখতো, গায়ের চামড়ায় ঘষা দিয়ে দেখতো, খোঁপা খুলে দেখতো, পরচুলা নাকি আসল চুল তা পরখ করে দেখতো, মুগডাল রান্নায় কি ফোঁড়ন দিতে হয় তা যাচাই করে দেখতো। গান গাইয়ে, ধাঁধা জিজ্ঞেস করে কন্যার বুদ্ধির পরিমাপ করতো। কিশোরী কন্যা এত প্রশ্নের উত্তর জানলেতো উত্তর দিবে! দুই দিন পরেই পরীক্ষার ফলাফল জানা যেতো, পরীক্ষায় কন্যা ফেল করেছে। কন্যার মাকে কন্যার পরের পরীক্ষার জন্য তৈরী করতে হতো। তুমিও নিশ্চয়ই এর বাইরে ছিলে না, কালো মেয়েকে নিয়ে কি চিন্তা করোনি?নিশ্চয়ই করেছো নাহলে দিনার কথায় তুমি রাজী হলে কেন!

তুমি শেষ পর্যন্ত সেই পাত্রের সাথে আমার দেখা হওয়ার ব্যবস্থা করেছিলে। দিনা নিজে এসে আমাকে দিনার মামার বাসায় নিয়ে গেলো, ওদিক থেকে সেই ভদ্রলোকও বেড়াতে এলো। ভদ্রলোকতো জানতোনা যে পাত্রীর অজান্তে পাত্রী দেখার ব্যাপারটি পাত্রীর কাছে অজানা নেই। বরং পাত্রী নিজেই এসেছে পাত্রকে দেখতে, কে সেই জন যে এমন মজা করে কনে দেখতে চাইছে!

কত বছর আগের কথা, ৩১ বছর পেরিয়ে গেছে। তবুও চোখের সামনে স্পষ্ট সব দেখতে পাচ্ছি। আমার পরণে ছিল ছাইরঙ জমিন লাল নক্সি পাড় টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি, লাল ব্লাউজ। কালো ঘন চুল হাতখোঁপা করা, চোখে কাজল কপালে লাল টিপ। তখন আমার সাজগোজের জিনিস বলতে ছিল কাজল আর টিপ। কানে ছিল সোনার ছোট দুল, গলায় বোধ হয় সরু চেন। ভয়ে বুক কাঁপছিল, যদি আমাকে দেখে পাত্রের পছন্দ নাহয়! তেমন হলে আমার খুব ইগোতে লাগতো, প্রতিযোগিতায় নেমে হারতে রাজী নই আমি। ওটাতো েক ধরণের প্রতিযোগিতাই ছিল, বিয়ের বাজারে নিজেকে যাচাই করার প্রতিযোগিতা।

পাত্র যখন এলো, তাকে দেখেই আমি অভিভূত। এমন সুপুরুষ সুদর্শন স্মার্ট পুরুষ সিনেমাতে দেখেছি, আমার আশেপাশে কখনও দেখিনি। মা, একটা মজার কথা বলি, আগের দিন আমি কল্পনায় মানুষটিকে দেখতে চেষ্টা করছিলাম। কল্পনায় কেন যে স্বপ্নের পুরুষটির মুখে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি কল্পনা করেছিলাম জানিনা। আমার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কারো মুখেই দাড়ি ছিলনা, অথচ আমি পাত্রের মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি কল্পনা করেছিলাম! পরেরদিন যখন পাত্রকে দেখলাম, দেখি পাত্রের মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। কল্পনার মানুষটির সাথে বাস্তবে দেখা মানুষটির চেহারায় এত বড় মিল দেখে অবাক হতে পারতাম, অথচ আমি অবাক হতে ভুলে গেছিলাম। ভদ্রলোকের কথা বলার ভঙ্গী, কোমল স্বরের কথা শুনেও আমি ঘাবড়ে যাইনি। আমার কেন জানি ভদ্রলোককে খুব আপন মনে হচ্ছিল। সে সন্ধ্যাতেই ভদ্রলোক আমাকে চমকে দিয়েছিল চোখের তিল সম্পর্কে প্রশ্ন করে, তোমার বাম চোখে ওটা কি?
প্রশ্ন শুনেই আমার দম আটকে যাওয়ার অবস্থা। মনে মনে ভাবছি, মা তো তাহলে ঠিকই বলে, চোখে তিলটা নাহয়ে চিবুকে বা গালে হলে ভালো হতো। এই ভদ্রলোকও চোখের তিলটা দেখে ফেলল? যখন শুনলো, ওটা তিল, সে একেবারে শিশুদের মত বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, এতো এক্সট্রা অর্ডিনারি, চোখের মধ্যে এত বড় তিল, একেবারেই আনকমন।


যখন বুঝে গেছি যে আমাকে এই সুদর্শন এবং স্মার্ট সুপুরুষটির পছন্দ হয়েছে তখনই আমি এই ভদ্রলোককেই বিয়ে করব বলে জেদ ধরেছি। অথচ আমি জানতাম যে বাবা নামক সিংহপুরুষটি কোনভাবেই আমায় তখন বিয়ে দিতে রাজী হবেনা। তখন আমার বয়স কত ছিল, ২১ বছর। আরযাকে বিয়ে করব বলে পণ করেছি তার বয়স ৩৪। তোমার আর বাবার মধ্যে বয়সের পার্থক্য ছিল ১০ বছর, আর আমাদের বয়সের পার্থক্য ১৩ বছর। তখনও বাবা বা তুমি, এমনকি আমি নিজেও জানিনা পাত্রের পরিবার পরিজন সম্পর্কে কোন তথ্য, পাত্র যে বেকার তা নিয়েও আমার মাথাব্যথা ছিলনা।
আমার সাথে পাত্রের দেখা হওয়ার ৫ম দিনে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে দিনার মামা আর মামী নারায়ণগঞ্জে এসেছিল। মনে আছে খুব, সেদিন ছিল জামাইষষ্ঠি। আমি সকালে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঢাকা দাদার বাসা থেকে নারায়ণগঞ্জে গেলাম। বাসায় তখন ষষ্ঠি পূজোর আয়োজন চলছে, সেই সকালেই ছোট মাসীর বিয়ে উপলক্ষে কলকাতা থেকে মামা মামী মাসী মেসো এসেছে। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজন। আর সেদিন বিকেলেই দিনার মামা মামী বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির। তারিখটা মনে হয় মে মাসের ২৪ তারিখ ছিল।

বাবা সত্যিই বেঁকে বসেছিল, মাত্র সেকেন্ড ইয়ার অনার্স পড়ছি, তাও আবার কেমিস্ট্রিতে। ওহ মা, পাত্র কিন্তু খুব খুশী হয়েছিল যখন শুনেছে আমি কেমিস্ট্রিতে অনার্স পড়ছি, দ্বিতীয় দিন যখন সে আমার সাথে দেখা করল, তার নিজের লেখা জৈব রসায়ন বইটি আমায় উপহার দিল। তখনও সে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়নি।

বিয়ের প্রস্তাব এসেছে শুনে তোমার মনের অবস্থা কি হয়েছিল আমি জানিনা। তবে ধারণা করতে পারি, তুমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিলে। বাবাকে না জানিয়ে আমাকে নিয়ে বিয়ের ভাগ্য পরীক্ষা করতে গেছিলে, এভাবে ধরা খেয়ে যাবে ধারণাতেই ছিলনা তোমার। বাবাকে দিনাদের বাড়িতে যখন নিয়ে যেতে চাইলে দিনার মামা মামীর সাথে কথা বলার জন্য, বাবার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল, বাবা আঁতকে উঠেছিল, মিঠুর বিয়ে? মিঠুর বিয়ের প্রস্তাব মানে? বাবা সত্যিই বেঁকে বসেছিল, মাত্র সেকেন্ড ইয়ার অনার্স পড়ছি, তাও আবার কেমিস্ট্রিতে। মেধাবী মেয়ে, মাস্টার্স কমপ্লিট করে কলেজে অধ্যাপনা করবে, মেয়ের জন্য বিয়ের পাত্রের অভাব হবে? তুমি পড়ে গেছিলে মহাফাঁপড়ে! দিনার মামা মামী সমাজে মান্যগণ্য মানুষ, তাঁরা যেচে এসেছেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, তাও পাত্র যেন তেন নয়। পাত্র সম্পর্কে ঢাকার বাড়িতে দাদাও বিশাল বন্দনা শুনিয়েছে তোমাকে। দাদা এমনও মন্তব্য করেছেন যে এই ছেলেকে আমি চিনি। সে দারুণ ব্রিলিয়ান্ট, সব নামী দামী মানুষের সাথে তার ওঠাবসা, সে আমাদের মিঠুকে বিয়ে করবে কেন? তাকে জামাই করতে কত বাপ মেয়ে নিয়ে অপেক্ষা করছে! দাদা নিজে ঢাকা ইউনিভারসিটির প্রফেসার ছিল, দাদাতো চিনবেই অন্য যে কোন প্রতিভাবান ছেলেকে। দাদার কথা শুনে তুমি ঘাবড়ে গেছিলে, কিন্তু আমি ঘাবড়াইনি। কেন ঘাবড়াইনি তা আমি নিজেও জানিনা। ঘাবড়ে যাওয়ার কথা ছিল, কারণ আমি যে কোন ভাইবা বোর্ডে গিয়ে  ঘাবড়ে যেতাম, জানা প্রশ্নের জানা উত্তরও দিতে পারতামনা। পাত্র দেখা পর্বটাওতো ভাইবা বোর্ডের মত ব্যাপার।

বাবাকে রাজী করানো খুবই কঠিন ছিল। তুমি আর বড়দা বাবাকে বুঝালে, ঢাকা ইউনিভারসিটির লেকচারার ছিল, কানাডা থেকে পিএইচডি করেছে, আমেরিকায় পোস্ট ডক করেছে। দেশে ফিরেছে, আবার ইউনিভারসিটির চাকরিতে ফিরে যাবে। শেষে দিনার মামা আর মামী বাবাকে বুঝালো, এমন পাত্র লাখেও মিলেনা। আপনারা যদি মেয়ে বিয়ে দিতে রাজী না হন তাহলে এই ছেলেকে লুফে নেয়ার জন্য কত মেয়ের বাপ অপেক্ষা করছে। এমন প্রচ্ছন্ন অহঙ্কারী কথায় বাবা বিচলিত নাহলেও তুমি বোধ হয় বিচলিত হয়েছিলে। বাবাকে সেখানে মত দিতে বাধ্য হতে হয়েছিল।


দিনার মামা মামী জানালেন, পাত্র খুব দ্রুত বিয়ে করতে চায়। সামনের সপ্তাহেই নাহয় এনগেজমেন্ট হয়ে যাক। এনগেজমেন্টের দিন ধার্য্য করা হলো ৩১শে মে, শুক্রবার। সে কী হুলুস্থূলু কান্ড, এ যেন উঠ ছেঁড়ি তোর বিয়া লাইগাছের মত ঘটনা। এত বড় বাড়িতে সতেরো আঠারো ঘর ভাড়াটে, বাড়িতে কত মেয়ে, সকলেই তোমার মেয়ের চেয়ে রূপে গুণে অনন্যা। তোমার মেয়ের রূপ ছিলনা, কাউকে বলতে শুনিনি, মিঠুর গায়ের রঙ চাপা হলেও চুলগুলো কি সুন্দর, চোখ দুটো কি সুন্দর, হাসিটা কি সুন্দর! সবাই আমার গায়ের রঙটাই দেখতো।

আমার গায়ের রঙ নিয়ে তুমি বা বাবা কখনও মন খারাপ করোনি, তোমরা কখনও আচার ব্যবহারেও এতটুকু হতাশা প্রকাশ করোনি, তোমরা সব সময় আমার লেখাপড়ার দিকে মনোযোগ দিয়েছিলে। কিন্তু এটাতো সত্যি, বাংলাদেশের বাস্তবতায় তখনকার সমাজে মেয়েদের রূপ বিচার করা হতো গায়ের রঙ দিয়ে। তেমন এক বৈরী সমাজে তোমার এই কালো মেয়েটার এমন ভুবন আলো করা পাত্রের সাথে এক দেখাতেই বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে, পৃথিবীতে তখনও অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটতো? অবিশ্বাস্য কেন বলছি বলোতো! ভুলে গেছো, মাত্র মাস দুয়েক আগেও আমার শরীরের দগদগে ঘায়ের কথা! ইউনিভারসিটির ডাক্তার আর স্কিন স্পেশালিস্টের ভুল চিকিৎসায় আমার সারা শরীরের চামড়ায় ইনফেকশান হয়ে গেছিল! তখন কি মনে হয়েছিল আমি সুস্থ হবো। আমাকে দেখে এক পিসী বলেছিল, হায় হায়, এই কী চেহারা হইছে তোর, তোরতো বিয়া হইতোনা
পিসীর কথা শুনে আমি কাঁদিনি, বাসায় এসে তোমাদের কাছে বলেছিলাম। উরে বাব্বা , কথা শুনে বাবার সে কী রাগ! বাবা বলেছিল, আমার মাইয়ার বিয়া হইলে হইব নাহইলে নাই। আমার মাইয়া কেমিস্ট্রিতে অনার্স মাস্টার্স শেষ করে কলেজে অধ্যাপনা করে জীবন কাটাইব। কী দরকার ওর বিয়া হইয়া শ্বশুরবাড়িতে গিয়া ভাতের হাঁড়ি ঠেলার? কেমিস্ট্রি পড়তাছে কি ডেগ মাস্টারি করার জন্য?

এক বছর হোমিওপ্যাথি ট্রিটমেন্ট করতে করতেই হঠাৎ করেই যেন শরীরের চামড়া সেরে উঠতে লাগলো। জানুয়ারী মাসে আমার সারা মুখে, হাতে ঘা ছিল। অনার্সে ক্লাস চলছে, ক্লাসে নাগেলে নয় বলেই সারা দেহে দগদগে ঘা নিয়েই ক্লাসে যেতাম। তখন হারাধন কাকার বিয়ে লাগলো, কাকা নিজে আমাকে জোর করে বরযাত্রী নিয়ে গেলো। অমন দগদগে ঘা মুখে নিয়ে আমি বিয়ে খেতে যেতে চাইনি। কিন্তু কাকা এমন করে জোর করতে লাগলো বিয়ে খেতে গেলাম, আমার ধারণাতে ছিলনা সবাই আমাকে লক্ষ্য করবে। আমি তো শরীরে ঘা নিয়ে এক বছর ইউনিভারসিটিতে ক্লাস করেছি, বন্ধুদের সবাই আমার অসুখ সম্পর্কে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, ঘা নিয়ে কেউ কিছু জিজ্ঞেসও করেনা তাই আমিও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম।

সেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে হারাধন কাকার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা নাকি হাঁ হয়ে গেছিলো। তারা নাকি বার বার বলছিলো, ঐ মাইয়াটার বিয়া? কি কয়? ঐ মাইয়ার তঁ মুখ হাতে ঘা ছিল। চাইর মাসেই ক্যামনে এমন মাইয়ার বিয়া ঠিক হয়?

তাইতো কথা! দাদু যে বলতো, জন্ম মৃত্যু বিবাহ---এই তিন কর্মে মানুষের হাত নাই, ঈশ্বরের অনুমতি লাগে। দাদুর কথাই ঠিক, বিয়ে ঠিক হওয়ার মাত্র দেড় মাস আগেই হঠাৎ করেই এক বছরের পুরনো ঘা শুকিয়ে গেলো। চামড়ায় কালো দাগ থাকলেও ত্বক মসৃণ হয়ে গেছিলো। মা, বিয়ের তারিখ ঠিক হওয়ার পর আমি কিন্তু পাত্রকে বলেছিলাম, আমার অসুখের কথা। বলেছিলাম আমার সারা শরীর পচে যাওয়ার কথা। বিয়ের নেশায় পাত্র হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করেনি।

আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এই কথা পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউই বিশ্বাস করতে পারেনি। আজ ৩১ বছর পরেও সেদিনের সেই অবাক হওয়া জোড়া জোড়া চোখের সারি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। মা ভেবে দেখো, আমাদের দেশে, আমাদের সমাজে মেয়েদের নিয়ে বাপ মায়ের কত ধরণের অনিশ্চয়তা আর দূর্ভাবনা থাকে। আমার ভাগ্য ভাল যে তুমি বা বাবা কেউই আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেনা। অথবা আমার গায়ের রঙ নিয়ে তুমি হয়তো চিন্তা করতে তবে আমার রাগী বাবার সামনে প্রকাশ করতেনা। অথবা আমি তোমার এত আকাংক্ষার কন্যা বলে হয়তো কানামেয়ে পদ্মলোচন ছিলাম।

আমাদের বাড়িতে ডাবল উৎসবের আমেজ। ছোট মাসীর বিয়ে ৭ই জুন, আমার এনগেজমেন্ট ৩১শে মে। আমাদের দুই রুমের বাসা, দাদু দিদিমার দুই রুমের বাসা ভরে গেলো ছোট বড় সকল আপনজনে। বাড়িতে লেখাপড়ার পাট নেই, শুধুই হাসাহাসি, গল্প, আড্ডা, চা আর বিয়ের আয়োজন। আমার তখন ইউনিভারসিটি ছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। সামরিক শাসক হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ তখন রাষ্ট্রপতি, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছিল, আন্দোলন বানচাল করে দিতেই এরশাদ সাহেব মাঝে মাঝেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে দিতেন। শিক্ষার্থীরা হোস্টেল ছেড়ে বাড়ি চলে যেতো। এই ধরণের ভ্যাকেশানের নাম ছিল এরশাদ ভ্যাকেশান।
এই এরশাদ ভ্যাকেশানের যাঁতাকলে পড়ে কত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। আমার কথা আলাদা, আমি হোম সিক ছিলাম, এই ধরণের ভ্যাকেশান পেলে দারুণ খুশী হতাম। বাড়ি এসে এত শান্তি পেতাম। ট সেবারও এরশাদ ভ্যাকেশান চলছিল, আমাদের ঘরে টেলিফোন ছিলনা, তখন মোবাইল ফোনের যুগ ছিলনা। এমন সুদর্শন সুপুরুষের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হচ্ছে, এই সংবাদটা বন্ধুদের কাউকেই দিতে পারছিলামনা বলে আফসোসের শেষ ছিলনা। আমার প্রিয় বন্ধুদের কাছে সব সময় বলতাম, আমি বিয়ে করতে চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে। আমার সেই চাওয়া পূর্ণ হতে যাচ্ছে, সোজা কথাতো নয়। আমি কেমিস্ট্রিতে অনার্স পড়ি, আর যার সাথে আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে সে নিজেই একটা কেমিস্ট্রি বই লিখে ফেলেছে? মা, ভদ্রলোকের সাথে যেদিন আমার দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছিল, তখন সে আমাকে তার নিজের লেখা কেমিস্ট্রি বই উপহার দিয়েছিল। তার হাত থেকে বই নেয়ার সময় আমার বুক কাঁপছিল, বুঝতে পারছিলাম না বইটা কি আমাকে ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে দিচ্ছে নাকি কেমিস্ট্রির ছাত্রী হিসেবে দিচ্ছে।

৩১শে মে চলে এলো, মাঝে একটা বাধা পড়েছিল। যেহেতু দিনার মামী এই বিয়ের ঘটকালি করেছেন, সেহেতু মামা মামীই পাত্রের গার্জিয়ান হিসেবে এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠানে আসবেন। দিনার মামা মামীকে আমিও মামা মামী ডাকতাম, কিন্তু আমার হবু বর তাদের ডাকতো জাকির ভাই আর মায়া আপা বলে। আমার হবু বরের সাথে সাক্ষাতের তৃতীয় দিন চায়নীজ রেস্টুরেন্টে অনেক কথা আলাপ হয়েছিল। তখনই জেনেছিলাম, হবু বরেরা পাঁচ ভাই, দুই বোন। সে ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট, তাই আদর করে তাকে সবাই দুলাল নামে ডাকে। দাদা দিদিরা অনেক আগে ইন্ডিয়া চলে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মা চলে গেছে ইন্ডিয়া, সেও গেছিলো কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে দেশে ফিরে আসে। তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে, গ্রামের ভিটা গাছপালা ধানক্ষেত সবই আছে। ইন্ডিয়া থেকে এক দাদা বৌ বাচ্চা নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছে। বাবা মারা গেছেন মুক্তিযুদ্ধের দুই বছর আগে, তখন সে নটরডেম কলেজে পড়তো। সে থাকতো ব্যাপ্টিস্ট মিশন হোস্টেলে, সেখানে ন্যাথানিয়েল দাস সিনিয়র এক দাদাও ছিলেন, যিনি আমার হবু বরকে নিজের ভাই হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং তিনিও তাকে দুলাল নামে ডাকতেন। সেই দাদার ডাকনাম মৃদুল, ভীষণ নাকি ভালোবাসতো দুলালকে। মৃদুলদার স্ত্রী রীনা দাস ছিলেন দুলালের প্রিয় বৌদি। রীনা বৌদি হলিক্রস কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল। রীনা বৌদির বান্ধবী দিনার মামী, সেই মাধ্যমেই আমার হবু বরের সাথে পরিচয়। মায়া মামীও তাকে দুলাল বলে ডাকতো, এবং নিজের ভাই হিসেবে গ্রহণ করেন। তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে, দুলাল হিন্দু, তার দাদা খৃস্টান আর বড় বোন মুসলিম। উফ! কী চমৎকার অসাম্প্রদায়িক প্রীতির বন্ধন! বাংলাদেশে দুলালের নিকটজন বলতে রীনা বৌদি আর মায়া আপা ছিলেন। মৃদুলদা তখন দেশের বাইরে থাকেন। রীনা বৌদিও গেছেন ভ্যাকেশানে তাই দুলালের বিয়ের দায়িত্ব তার বড় বোন মায়া আপাই নিলেন। শাড়ি, আংটিসহ যাবতীয় বাজার সদাই করে ফেলেছেন। কিন্তু এনগেজমেন্টের দুই দিন আগে মায়া মামীর বাবা মারা গেলেন, উনি চলে গেলেন গ্রামে। আমাদের খুব চিন্তা শুরু হয়ে গেলো, শুভ কাজের শুরুতেই এমন দূর্ঘটনা! এনগেজমেন্ট হবেতো? এদিকে অনুষ্ঠানের জন্য সমস্ত আয়োজন হয়ে গেছে। আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেলো, পাঁড়া গাঁইয়ের ভাবনায় আমাকে পেয়ে বসলো। নিজেকে অপয়া ভাবলাম, ধরেই নিলাম এই বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হচ্ছেনা।

সেদিনই বিকেলে দিনা এসে বলল, গ্রামে যাওয়ার আগে নাকি মামী ওদেরকে ফোন করে বলেছে, এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠান হবে এবং দুলাল নিজেই মিঠুর আঙ্গুলে আংটি পরিয়ে দিবে। ৩১শে মে সকালে আমাকে মেজো মামীর লাল জামদানী পরানো হলো, দুই হাতে গোল্ড প্লেটেড চুড়ি, গলায় স্বর্ণের সরু চেইন, কানে দুল। চুল এক বেনীতে বেঁধেছি, কপালে লাল টিপ, চোখে কাজল। সবে এলার্জির অসুখ থেকে সেরে উঠেছি, কোনরকম স্নো পাউডার মাখতাম না।
আমার বিয়ের আশীর্বাদ উপলক্ষে সব ঘরের জানালায় খুব ভাল পর্দা লাগানো হলো, দেখে আমি মুগ্ধ। গরীবের সংসারে দরজা জানালায় পর্দা টাঙানো হয়নি এতকাল, আমাদের ঘরে ভাল চেয়ার টেবিল ছিলনা, আসবাবপত্র তেমন ছিলনা। এমন নামী দামী পাত্রের সাথে বিয়ে ঠিক হতে যাচ্ছে, আসবাব কেনা সম্ভব হয়নি কিন্তু সুন্দর পর্দা কেনা সম্ভব হয়েছিল। কাদের ঘর থেকে যেন কয়েকটা চেয়ার আনা হয়েছিল আজ তা মনে নেই। কথা হয়েছিল, পাত্রপক্ষকে দিনাদের বাড়িতে বসানো হবে। দিনাদের বাড়ি সাজানো গুছানো।

পাত্রপক্ষ যখন এসে পৌঁছালো, আমি আমাদের ঘরে বসেই শুনতে পাচ্ছিলাম বাইরে অনেকের গুঞ্জন। কী সুন্দর, এইটাই ছেলে? একেবারে সাহেবের মত দেখতে। হ্যাঁ, আমার বর তোঁ হলিউডের নায়কদের মতই ছিল দেখতে। ছেলেকে দেখামাত্র সারা বাড়িতে নাড়াচাড়া পরে গেলো। মিঠুর ভাগ্য কত্ত ভাল, মিঠুর কপালে এমুন সুন্দর জামাই জুটলো ক্যামনে? ঐ তো, আসলে দিনা এই বিয়েটা ঠিক করে দিছে। মিঠুর বান্ধবীতো, বান্ধবীর জন্য এমন ছেলে খুঁজে আনছে।
 মা, এই কথাগুলো আমি বিয়ের অনেক বছর পরেও শুনেছি। আমার মত এমন সাধারণ দেখতে একটা মেয়ের কি করে এমন সুন্দর, এত শিক্ষিত ছেলের সাথে বিয়ে হতে পারলো, অথচ তাদের সুন্দরী মেয়েদের কেন এমন ভাল পাত্র জুটেনা?

মা, ৩১ বছর আগে বাংলাদেশের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে সেদিন বিপ্লব ঘটে গেছিল। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে হৈ হোই রৈ রৈ পড়ে গেছিলো যখনপাত্র স্বয়ং সিমেন্টের মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে আমার অনামিকা টেনে নিজের হাতে নিয়ে খুব যত্ন করে গার্নেট আর মুক্তো বসানো সোনার আংটি পরিয়ে দিয়েছিল। সাধারণ বাঙ্গালী হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবারে এইসব মাঙ্গলিক কাজ করে থাকেন বয়োজ্যেষ্ঠরা। অথচ আমার বেলায় পাত্রের সাথে কোন বয়োজ্যেষ্ঠ আসেননি অথবা এলেও মনে হয় আংটি পরাতো পাত্র স্বয়ং। এমনটাই সে আগে থেকেই বলে দিয়েছিল, আমার বউকে আমি আংটি পরাবো



মা, যৌবনে কারো সাথে প্রেম করতে দাওনি, কিন্তু মনে মনে একজনের প্রেমেই নিমজ্জিত হয়েছিলাম, সে নায়ক উত্তম কুমার। নায়ক উত্তমকে নিয়ে কত মায়াজাল বুনেছি তার খবরতো কখনও রাখোনি। স্বভাব, চরিত্রে উত্তমের ধারে কাছে দিয়েও যায়না যদিও, তবুও আমার বরকে স্বপ্নের নায়কের নামেই ডাকি।

আমার উত্তম বুড়ো হয়ে গেছে মা। অনেক কথা ভুলে যায়, গতকাল ছিল ৩১শে মে। কত নাটকীয়তা ছিল আমাদের বিয়ের প্রস্তাবের থেকে শুরু করে এনগেজমেন্ট, বিয়ে, বৌভাতে। ৩১ বছর পরেও আমার চোখে তা এত স্পষ্ট কিন্তু আমার উত্তম কুমার ৩১শে মে তারিখের কথা কখনওই মনে রাখেনা, আগে মনে করিয়ে দিতাম, এখন আর তা করিনা। পুরনো হয়ে যাচ্ছি, তোমরা জায়গা ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছো, আমরা তোমাদের জায়গা নিচ্ছি যেখানে প্রেম, ভালোবাসা, অভিমান, বিরহের ব্যাপারগুলো ধীরে ধীরে ম্রিয়মান হয়ে আসে, এক ধরণের নির্লিপ্তিতে মন ছেয়ে যায়। কবে প্রথম দেখা হয়েছিল, কবে প্রথম হাতে হাত রেখেছিল, কখন কোথায় ভালোবাসি বলেছিল, এসব ব্যাপারগুলো পানসে মনে হয়, ঠিক বলেছিনা মা? এই আমাকেই দেখো, ১৫ বছর আগেও ২১ তারিখ নিয়ে কতই উচ্ছ্বসিত হতাম, সেই আমি ৩১ বছর পরেও তারিখটির কথা ঠিকই মনে রেখেছি, কিন্তু এখন আর তেমন শিহরণ অথবা অভিমান জাগে না মনে।

আজ ১লা জুলাই, আমার স্বপ্নের জুলাই, ভালোবাসার জুলাই, মায়াময় জুলাই, মোহময় জুলাই! ৩১ বছর পূর্বে, ৩১শে মে তারিখের বিকেলে সকলে মিলে পাটিপত্র অনুষ্ঠান হয়েছিল, পঞ্জিকা দেখে আমার বিয়ের দিন ধার্য্য করা হয়েছিল ১৫ই জুলাই, সোমবার। সেই থেকেই জুলাই মাস আমার প্রিয় মাস হয়ে গেলো।

মা, তুমি কেমন আছো? জানো, আজ বিকেলে সোফায় বসে মিনিট দুয়েকের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। স্বপ্নে দেখি গাড়িতে করেই পাহাড়ের কোলঘেঁষা এক বাড়িতে যাচ্ছি। একবার মনে হলো বাড়িটা আমাদেরই, কিন্তু বাড়ির ভেতর ঢুকে মনে হলো বাড়িটা অপুর মেজো মামার ছেলে অপুর কথা বলছি, অপুতো পরিবার নিয়ে কানাডা ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে চলে এসেছে। স্বপ্নে সেই বাড়িটাই দেখেছি। বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই সকল প্রিয়জনকে পেলাম, সকলেই বেড়াতে এসেছে।  তুমিও এসেছো, তুমি বসে ছিলে বাম পাশের দেয়াল ঘেঁষে এক চেয়ারে, তেমন সাজে যেমন সাজে তুমি আসতে আমাদের উত্তরার বাসায়। বাড়ি ভর্তি সকলের মুখে চোখে উৎসব আনন্দের ভাব। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মা যে পৃথিবীতে নেই, এটা বুঝতেও সময় লেগেছে আরও দুই মিনিট। মা, তোমার বয়স হয়েছিল যথেষ্ট, কিন্তু তুমি এত বেশী সুস্থ এবং প্রাণবন্ত ছিলে যে তোমার মৃত্যুটা আমি নিতে পারছিনা এখনও

তুমি ভালো থেকো মা, যেখানেই আছো ভালো থেকো। ওখান থেকেই আমাদের প্রতি তোমার স্নেহস্পর্শ দিও যেন কোন বিপদ আপদ আমাদের সামনে না আসতে পারে। আমরা আছি যার যার মত।

মিঠু



প্রযত্নে----৪র্থ পর্ব




মা,

১৯শে আগস্ট ছিল বিশ্ব ফটোগ্রাফি দিবস। ওই যে তুমি জানতে তো, বাবা দিবস, মা দিবস, ভ্যালেন্টাইন দিবসের কথা! ঠিক তেমনি ফটোগ্রাফি দিবস। আমেরিকা থেকে উৎপত্তি এসব দিবসের। প্রতি দিবস সেলিব্রেশানের পিছনেই একটি করে গল্প থাকে। বাবা দিবস, মা দিবস, ভ্যালেন্টাইন দিবসের গল্পগুলো জানি। ফটোগ্রাফি দিবসের গল্প জানিনা। তবে এটা বুঝি, মানুষের এমন সুন্দর, এমন অদ্ভুত আবিষ্কারের মহিমাকে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করার নিমিত্তেই বিশ্ব ফটোগ্রাফি দিবস।

ফটোগ্রাফির আবিষ্কার হয়েছিল ১৮০০ সালের প্রথম দিকেই, কিন্তু সফল ফটোগ্রাফি সম্পন্ন হয় ১৮৩৯ সালের শেষের দিকে, নিউইয়র্কে জোসেফ ড্র্যাপার নামে এক ভদ্রলোক সর্বপ্রথম তাঁর বোন ডরোথি ড্র্যাপারের ছবি ডেভেলপ করেন। কী অসাধারণ আবিষ্কার, তাইনা মা? সময়কে একটা ফ্রেমে আটকে ফেলা, কত স্মৃতি কত মুহূর্ত, কোনটি আনন্দের কোনটি দুঃখের কোনটি বা সুখের, সবই থেমে যায় ক্যামেরার একটি ক্লিকে, ফটো পেপারের একটি টুকরো স্লিপে।
সময় থামেনা, সব কিছু পেছনে ফেলে সময়ের কাজ এগিয়ে যাওয়া, ফটোগ্রাফি কৌশল বের হওয়ার আগে কত লক্ষ কোটি কোটি মানুষের লক্ষ কোটি কোটি আবেগময় মুহূর্ত সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে। আমরা সেদিক থেকে কত সৌভাগ্যবান যে আমরা ফটোগ্রাফির সুফল ভোগ করতে পারছি। এই যেমন আমার বাবার ঠাকুমার কথাই ধরো, মানে তোমার দিদিশাশুড়ির কথা বলছি। তোমার মুখে এই বুড়ির কত গল্প শুনেছি, বুড়ি পুত্রবধূদের প্রতি কী ভীষণ নির্দয় ছিলেন। মাছ কিভাবে পৈঠায় ঘষে ঘষে চকচকে করে ধুতে হয় তা দেখিয়ে দিতে বৌদের হাত পৈঠায় ঘষে হাতের ছাল তুলে ফেলতেন! বৌদের নির্দেশ দিয়ে পঞ্চ ব্যাঞ্জন রান্না করিয়ে ছেলেদের চব্য চোষ্য করে খাইয়ে বৌদের জন্য রাখতেন পাতিল চাঁছা। ছেলেদের যেন রাতে নিশ্ছিদ্র ঘুম হয়, তা নিশ্চিত করতে বৌদের নির্দেশ দিতেন যেন বাচ্চার ট্যাঁ ট্যাঁ শোনা না যায়। আরও কত স্বৈরাচারী কাহিনী যে শুনিয়েছো, তুমি শুনেছিলে তোমার শাশুড়ির কাছে, সেই গল্প শুনিয়েছিলে আমাদের। এই বুড়িমা অনেক বছর বেঁচেছিলেন, শেষের দিকে মাথা নষ্ট হয়ে গেছিলো, অন্ধ হয়ে গেছিলেন তাতেও বৌদের উপর চোটপাট কমেনি। এসব গল্প শুনে আমার সব সময় মাথায় ঘুরতো, এই বুড়ি মানুষটি দেখতে কেমন ছিল?

তোমার ছিল স্মৃতিরক্ষা ভান্ড, সেই ভান্ডে পুরনো মানুষের ছবি থেকে শুরু করে কত টুকিটাকি জিনিস যে সংরক্ষিত ছিল। সেই স্মৃতিরক্ষা ভান্ডেই একদিন খুঁজে পেয়েছিলে দিদিশাশুড়ির একখানা ফটোগ্রাফি। কাঠের হাতলওয়ালা চেয়ারে গলায় রুদ্রাক্ষের মালা গলায়, সাদা থান পরা এক বুড়ির সাদাকালো ছবি। বুড়ির মাথার চুলগুলো ছোট করে ছাঁটা যা মনে করিয়ে দেয় মাত্র একশ বছর আগেও হিন্দু বিধবা নারীদের কী করুণ জীবন ছিল। স্বামী মারা যাওয়া মানেই যেখানে একটি নারীর নানাদিক থেকে অসহায় অবস্থায় পড়ে যাওয়া, সাদা থান গায়ে জড়িয়ে বাকী জীবন কাটিয়ে যাওয়া, শাক ভাত খেয়ে কোনমতে বেঁচে থাকা, তার মধ্যে মাথার চুলগুলোকেও কেটে ছেঁটে পুরুষের মত করে দেয়া!! কী নিষ্ঠুর হিন্দু সমাজ ছিল। শুধু কি বিধবা নারীদের জন্য কঠিন ছিল সমাজ, হিন্দু মেয়েদের প্রত্যেকের জীবন ধর্মীয় কঠিন অনুশাসনে বাঁধা ছিল বলেই অনেক নারী্কে অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা, অবহেলা, অমর্যাদা, অপমান সয়ে জীবন কাটাতে হয়েছে। সম্মান বঞ্চিত সেসব নারীরাই জীবনের এক পর্যায়ে এসে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতো।

তোমার দিদিশাশুড়ি, মানে আমার বড়মার ছবি দেখে ছোটবেলায় তেমন কোন ভাবান্তর হতোনা আমার, কেবলই মনে হতো, এই বুড়িটা শয়তান ছিল, আমার ঠাকুমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। বড় হওয়ার পর আর তা মনে হয়না, নিজে নারীতো, তাই হৃদয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করি সেই বড়মার স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার কারণ। সমাজ কি খুব বেশী বদলেছে, আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায়ও নারীরা অবহেলা, বঞ্চনা, অপমান সয়ে যায়, কেউ কেউ ক্ষয়েও যায়।

যা বলছিলাম, ফটোগ্রাফী আবিষ্কৃত হয়েছিল বলেইতো স্বৈরাচারী বড়মাকে দেখতে পেলাম। জানো মা, এই বছর বাংলাদেশে গেছিলাম। সেখান থেকে কলকাতা, মেজো কাকার স্মৃতির ভান্ডারে পেয়ে গেলাম আরেক বিস্ময়, দুদু ঠাকুমার ছবি। মা, দুদু ঠাকুমার ছবি দেখে আমার চোখ ছানাবড়া। একজন অল্প বয়সী বৌ, গলায় সোনার চওড়া নেকলেস, মাথায় ঘোমটা দেয়া ভীরু চেহারার একজন নারী। সাদাকালো ছবিতেও স্পষ্ট বোঝা যায়, দুদু ঠাকুমার গায়ের রঙ ছিল ফর্সা।
দুদু ঠাকুমার ছবি দেখতে পাওয়া আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। এই মানুষটি দেখতে কেমন ছিলেন এই নিয়ে আমার মাথায় অনেক প্রশ্ন এসে ভীড় করতো। তুমি বলেছিলে, তোমার এই কাকীশাশুড়ি ছিলেন ফর্সা, ছোটখাটো এবং শুকনো স্বাস্থ্যের। আমি শুধু শুনেইছি, ১৯৬৪ সালের রায়টে আমাদের বাড়ির ৮ জনকে বিহারী মুসলমানরা হত্যা করেছিল। সেই আটজনের মধ্যে ছিল দুদু ঠাকুমা, সেইজা ঠাকুমা, ময়না পিসী

অনেকেই জানেনা ১৯৬৪ সালে পূর্ববাংলার বিভিন্ন স্থানে রায়ট হয়েছিল। ভারতের কোথায় যেন, কাশ্মীরেই কি, কোন মসজিদের সংরক্ষিত বাক্স থেকে (হযরত বাল মসজিদ?) নবী হযরত মুহম্মদের মাথার কয়েক গোছা চুল চুরী হয়ে যায়। এবং পরে তা পাওয়াও যায়। অভিযোগ তোলা হয় ওখানকার হিন্দুরা এই অপকর্ম করেছে, ব্যস, এই ধুয়া তুলে পূর্ব বাংলার মুসলীম লীগের নেতারা উস্কে দেয় সাধারণ জনগণকে, বাংলার বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়ে যায় হিন্দুদের উপর উগ্রবাদী মুসলমানের আক্রমন। এই আক্রমনের ঢেউ এসে আছড়ে পরে নারায়ণগঞ্জে। সে বছরই আমার জন্ম হয়, আমার জন্মের গল্প করতে গিয়ে তুমি এই গল্প শোনাতে। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে গল্প শুনতাম, চোখের সামনে ভেসে উঠতো দৃশ্য।

দিনটি ছিল পৌষ সংক্রান্তির, আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলছে পিঠে পায়েস বানানোর আয়োজন। বিশাল বাড়ির বড় জনগোষ্ঠী। আমার ঠাকুরদাদা জীবিত ছিলেননা, বাকী পাঁচ দাদু জীবিত, আমার ঠাকুমাসহ ছয় ঠাকুমা জীবিত। আমার ঠাকুমা থাকতেন নারায়ণগঞ্জ শহরে উনার তিন ছেলেকে নিয়ে, সুন্দর দাদু নারায়ণগঞ্জ শহরেই পাটের অফিসে চাকরি করতো, আমরা আর সুন্দর দাদুর পরিবার পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম। বাকীরা থাকতো গ্রামে। পাঁচ দাদুর মধ্যে মেজ দাদু, মেজ দাদুর মেয়ে জামাই চাকরি করত চিত্তরঞ্জন মিলে, এক দাদু গ্রামেই ডাক্তারী করতেন, সেজ দাদু আর দুদু দাদু ছিলেন গ্রামের স্কুলে মাস্টার। বাড়ি ভর্তি দাদু ঠাকুমার পোলাপান, সবচেয়ে ছোট ছিল দুদু ঠাকুমার কোলের বাচ্চাটা, মাত্র ১০ মাস বয়স। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মেজ দাদু মিলের মেস থেকে গ্রামের বাড়িতে এসেছিল, আর সুন্দর ঠাকুমা দুই মেয়ে নিয়ে গ্রামে এসেছিল।

হঠাৎ করেই চারদিকে রব উঠে, রায়ট লেগেছে। পুরান ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ শহরে ওরা চলে এসেছে, হিন্দুদের গলা কাটছে। সূতার মিল, কাপড়ের মিলে দল ঢুকে পড়েছে। রায়টের দল আমাদের গ্রামের বাড়িতেও চলে আসে। চারদিকে চিৎকার, আগুন আর ঘরবাড়ি ছেড়ে হিন্দুদের পলায়ন। আমাদের বাড়ির মানুষগুলিও লাগালো ছুট। প্রতিবেশী মুসলমান বাড়ি ছাড়া আর কোথায় আশ্রয় নিবে? কে কার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল তখন কেউ জানতোনা। কোথাও আশ্রয় না পেয়ে সেজো দাদু বাড়ির কাছে পাকুড় গাছে গিয়ে উঠেছিল, আর মেজ দাদু মুসলমানী কায়দায় লুঙ্গি পড়ে পাশের ধান ক্ষেতে ঘাস নিড়ানির কাজ করছিল।
ময়না পিসী ছিল নয় মাসের গর্ভবতী, বাপের বাড়ি এসেছিল।

দুদু ঠাকুমা, সেজ ঠাকুমা আর ময়না পিসী এক বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। দুদু ঠাকুমার ছিল সাত সন্তান, কোলের সন্তানটি ছিল মেয়ে, ১০ মাস বয়স। সাত সন্তানের ছয় সন্তান কোথায় পালিয়েছে তা তিনি জানেননা, কোলে ছিল ১০ মাসের কন্যা, তাকে নিয়েই তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন ঐ বাড়িতে। ময়না পিসীর কাছে ছিল বিয়ের গয়না, দুই ঠাকুমার কাছে ছিল তাদের গয়না। মেয়েরা জীবনের চেয়েও বেশী ভালোবাসে গয়নাগাঁটি, দুই ঠাকুমার ছেলেমেয়েরা কে কোথায় গেলো সে খবর নেই, গয়নার পোঁটলা কোমড়ে বেঁধে আনতে ভোলেনি। যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল সে বাড়ির মহিলারা ময়না পিসীর কাছ থেকে গয়নাগুলি নিয়ে নেয়, দুই ঠাকুমার কাছ থেকেও গয়না নিয়ে নেয়। তাদের আশ্বস্ত করে গয়নাগুলি যত্ন করে সিন্দুকে তুলে রেখেছে বলে। যখন বিহারীরা ছুরী হাতে গ্রামে হানা দেয়, তখন এই তিন হিন্দু মহিলাকে ঐ বাড়ির মানুষ ঘর থেকে বের করে দেয়। দুই ঠাকুমা দৌড় দেয়, কিন্তু ময়না পিসী নয় মাসের গর্ভ নিয়ে দৌড় দিতে পারেনি। বিহারীরা তাকে ধরে ফেলে এবং তাকে পিটিয়ে মাটিতে ফেলে পেটের উপর পাড়াতে থাকে। ময়না পিসীর দম বেরোতে হয়তো বেশী সময় লাগেনি।

এরপর এলো দুই ঠাকুমার পালা, গ্রামের বাড়ির বউ তারা, রাস্তাঘাটে কখনও বের হয়েছে বলে মনে হয়না। তাই দৌড় দিয়েও তেমন কোন নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছাতে পারেনি, দুই মহিলাকে ওরা ধরে ফেলে। দুদু ঠাকুমার কোল থেকে ১০ মাসের শিশুটিকে ছুঁড়ে দেয় শীতলক্ষ্যার বুকে, ঠাকুমা যেহেতু ক্ষীণ স্বাস্থ্যের ছিলেন তাই ওদের লাঠির বাড়ি খেয়েই মরে যায়। সমস্যা হয় সেজ ঠাকুমাকে নিয়ে, সেজ ঠাকুমা ছিলেন সুঠাম স্বাস্থ্যের, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে দম বের করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত হাতের ছুরী কাজে লাগাতেই হয়, জবাই করে সেজ ঠাকুমাকে মেরে ফেলে।

মেজ দাদুকেওতো ধানক্ষেতেই ধরে ফেলে, হাত পায়ের রগ কেটে দিয়ে মরে গেছে ভেবে ওরা চলে যাচ্ছিল। মেজ দাদু মরেনি, মাটি থেকে মাথা তুলেছিল মাত্র, আরেক বাড়ির মহিলা চলে যেতে থাকা উগ্রবাদীদের ডেকে বলেছিল, মরে নাই। ওরা ফিরে আসে, দাদুকে জবাই করে মৃত্যু নিশ্চিত করে যায়।
মা, নারী কোমল মনের হয়, নারী মায়াবতী হয় কথাটা বোধ হয় সব সময় ঠিক নয়। নারী ভয়ঙ্করীও হয় তার প্রমাণ আমার ময়না পিসী, দুদু ঠাকুমা, সেজ ঠাকুমা এবং মেজ দাদুর করুণ মৃত্যু। 
মা, বাকীদের কথা থাকুক, বলতে ইচ্ছে করেনা। এই কথাগুলোও বলতামনা যদি জবাই কালচার বন্ধ হয়ে যেত। মা, বাংলাদেশে আবার জবাই কালচার শুরু হয়েছে। এখন শুধু বেছে বেছে হিন্দুদেরই জবাই করা হয়, তা নয়। উগ্রবাদী মুসলমানেরা যাকেই নিজেদের শত্রু মনে করে, তাকেই চাপাতি দিয়ে জবাই করে মেরে ফেলছে। তুমি নিশ্চয়ই স্বর্গে বসে সবই দেখতে পাচ্ছো। দেখো অবস্থা, ফটোগ্রাফি দিবস নিয়ে লিখতে গিয়ে কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছি। ফটোগ্রাফি আবিষ্কার হয়েছিল বলেই দেখতে পেলাম দুদু ঠাকুমাকে। সেজ ঠাকুমার ছবিও নিশ্চয়ই ছিল, হয়তো হারিয়ে গেছে। মেজ দাদুর ছবিও দেখিনি, তবে নিশ্চয়ই তিনিও দেখতে অন্য দাদুদের মতই ছিলেন।

আগস্ট মাস যে কত ঘটনার সাক্ষী, ফটোগ্রাফী দিবসও আগস্টেই পালিত হয়। সত্যিই মা সেদিন ফটোগ্রাফী দিবস পালিত হয়েছে। বাবা দিবস, মা দিবসের মত ফটোগ্রাফি দিবস। অন্যান্য বছর খেয়াল করিনি, এ বছরই খেয়াল করলাম ফটোগ্রাফি দিবসের ব্যাপারটা, ফেসবুকের ওয়ালে অনেকেই তাদের প্রিয় ছবি পোস্ট করেছে, লিখেছে হ্যাপী ফটোগ্রাফি ডে। ফেসবুক সৃষ্টি হওয়ার ফলে নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। বিভিন্ন দিবস নিয়ে আমি অনেক ফিচার লিখেছি, পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছে লেখাগুলো। অনেকদিন হয়ে গেলো দিবস নিয়ে লেখালেখি হয়না। কিন্তু ফটোগ্রাফি দিবস নিয়ে কখনও লিখিনি, আরে ফটোগ্রাফি দিবস বলে কিছু যে আছে তাইইতো জানা ছিলনা!

একে তো বিয়ে বাড়ি তার উপর ঢোলে বারি অবস্থা আমার। ক্যামেরা বা ফটোগ্রাফ উঠানোর কথা উঠলে আমি সবার আগে ক্যামেরার সামনে দৌড়ে চলে যাই। কত হাজার ছবি আমার স্টকে জমা আছে। ফেসবুকেইতো আছে হাজারের উপর ছবি, এলবামেতো আছেই। আমি খুব ঘন ঘন ছবি পোস্ট করি ফেসবুকে, আর ফটোগ্রাফ দিবসে ছবি পোস্ট না করলে চলে? ভাবছিলাম কোন ছবি আপলোড করা যায়। সবার মত নয়, আমার পোস্টে কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকতেই হবে, এটাই আমার লক্ষ্য।

একটা থিম মাথায় নিয়ে পছন্দ করলাম চারটি ছবি। ছবি চারটির দুটিতে আমি আছি এককভাবে, বাকী দুটিতে আমার সাথে আছো তুমি। প্রথম ছবি আমার দশ মাস বয়সের, পরের ছবি আমার পাঁচ বছর বয়সের, তৃতীয় ছবি ২০১২ সালের জুন মাসে তোমার সাথে তোলা, চার নাম্বার ছবিটাও একই বছর অক্টোবারে তোমার সাথে তুলেছি। ছবিগুলোর বর্ণনা দিচ্ছি, তাহলেই বুঝবে ফটোগ্রাফি দিবসে কেন এই চার ছবি বেছে নিয়েছি। ছবির থিম এবং ক্যাপশান সম্পর্কে বলবো একেবারে শেষে।

প্রথম ছবিটি সাদাকালো, কংক্রিটের কোন স্ল্যাবে দশ মাস বয়সী এক গোলগাপ্পা কন্যাশিশু দুই হাত মাথায় তুলে আছে, শিশুর খালি গা, মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল, কোলের উপর বড় একখানা প্লাস্টিকের মাছ। শিশুটি হয়তো নেংটু ছিল, ছবি তোলার আগে কেউ একজন ওর কোলের উপর খেলনা মাছটি রেখে দেয় যাতে ছবিতে নেংটু বুঝা না যায়। ব্যাকগ্রাউন্ডে আছে উঠোনের তারে ভেজা কাঁথা শুকোতে দেয়ার দৃশ্য। কাঁথাগুলো যে এই কন্যা ভিজিয়েছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়।

ছবিতে শিশুর হাত তোলার ভঙ্গী, মুখে বিরক্তির হাসি দেখেই বুঝা যায়, এই শিশু খুব জেদী ছিল। সারা বাড়িতে একটি মাত্র কন্যা শিশু, চারদিকে শুধু ছেলে আর ছেলে, বেশী আদরে কন্যাতো জেদী হবেই। ছবিটি পঞ্চাশ বছর আগের একটি দিনের কোন সকালের কথা মনে করিয়ে দেয়। কেমন ছিল সেদিনের ঐ সকালটা? দুই ছেলের পর এই কন্যা, গায়ের রঙ মায়ের মত ধবধবে পরিষ্কার নয়, তাতে কি, মেয়ে আমাদের সাত রাজার ধন। মাটিতে রাখলে পিঁপড়ে কামড়াবে, মাথায় রাখলে উকুনে কামড়াবে। কত লক্ষ্মী মেয়ে,কোন জ্বালাতন করেনা। একটু জেদী, রেগে গেলে মাটিতে কপাল ঠুসে শুধু, এছাড়া আর কোন দোষ নেই মেয়ের। সাত রাজার ধন মানিক কন্যার ফটো তুলে রাখতে মন চায় মায়ের।

গরীবের সংসার বলে কি শখ আহ্লাদ থাকতে নেই। স্টুডিও থেকে একজন ফটোগ্রাফার ডেকে এনে ছবি তুলে ফেললেই হয়। যেই বলা সেই কাজ, ক্যামেরাম্যান চলে এলো। তাতেই সাড়া পড়ে গেলো সারা বাড়িতে, তাড়াহুড়োয় ভুলেই গেলো সবাই রাজকন্যার গায়ে জামা নেই, মাথার চুলে ঝুটি নেই চোখে কাজল নেই। বালিকা পিসীদের কোলে কোলে ঘুরে মেয়ে, গায়ে জামা থাকলেই কি নয়া থাকলেই কি! পিসী কন্যাকে দুম করে বসিয়ে দিল স্ল্যাবের উপর, তাতেই কন্যার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। পাশ থেকে কে জানি বলে উঠলো, হাতে একখান পুতুল দিলে কেমুন হয়। সাথে সাথে আরেক পিসী ঘর থেকে প্লাস্টিকের মাছ এনে মিঠুর হাতে দিতে গেলো, অমনি মিঠু দুই হাত মাথার উপরে তুলে দিল। ক্যামেরা ক্লিক করে ফেলবে, পিসী মাছটাকে মিঠুর কোলে রেখে সরে যেতেই ক্যামেরা ক্লিক করে ফেললো। ব্যস, মুহূর্ত আটকে গেলো ক্যামেরার লেন্সে।

মা, আমার কোলে যে মাছটা, এই মাছটার রঙ ছিল কলাপাতা সবুজ। মাছটা দিয়ে আমি আর ছোটভাই রানু খেলেছি তা স্পষ্ট মনে আছে। একেতো প্লাস্টিকের মাছ, তার উপর ঠাকুমা ছিলেন খুব মিতব্যয়ী। কোন কিছুই ফেলে দিতেননা বলেই প্লাস্টিকের মাছটাও আমার আর রানুর খেলা করার বয়স অবধি ছিল। একদিন দুপুরে মেলা থেকে কেনা খেলনা বটিতে ফেলে মাছটা আমি কেটে ফেলেছিলাম। আমার ধারণা ছিল, মাছটা কাটলে সত্যিকারের মাছের মত রক্ত বেরোবে। কিন্তু মাছের মাথা কাটার পর দেখা গেলো, এর ভেতর ফাঁকা, কিছুই নেই। তুমি বলেছিলে, এইটাতো খেলনা মাছ

২য় ছবিটি স্টুডিওতে তোলা হয়েছে। আমার পাঁচ বছর বয়সের ছবি। এদিনের সব কথাই মনে আছে। স্টুডিওর সিঁড়িতে বসানো হয়েছে আমাকে, ততদিনে আমি খুব বুঝে গেছি পরিবারে আমার বিশেষ আদর আহ্লাদের একটা জায়গা আছে। আমাকে তখন সবাই ডাকতো বাপ সোহাগী মাইয়া বলে। কারণ আমার যে রাগী বাবাকে ঘরে বাইরে সবাই ভয় পেতো, সে বাবা আমাকে নিয়ে সারাক্ষণ আহ্লাদ করতো বলেই আমার নাম হয়ে গেছিলো বাপের আহ্লাদী মাইয়া। বাপের আহ্লাদী মেয়েদের সকলেই সমীহ করে, আমাকেও সমীহ করে চলতো আমার থেকে তিন বছরের বড় মেজদা, ছয় বছরের বড় ছোট মাসী, নয় বছরের বড় সেজো মাসী। শুধু কি বাপের আহ্লাদী ছিলাম, আমিতো ছিলাম তোমার কাছে একটা মাত্র মাইয়া। একটা মাত্র মাইয়াকে মনের মত করে সাজাবে বলে সেলাই শেখার সুলে ভর্তি হয়েছিলে। কত নতুন ডিজাইনের জামা বানাতে শিখেছিলে তুমি। স্কুলে মাস্টারি করে যে কটা পয়সা পেতে তার সব খরচ করতে মাইয়ারে সাজাতে গিয়ে।

ছবিতে যে স্কার্ট আর ব্লাউজ পরা ছিলাম, ওটাও তোমার হাতে বানানো। এত সুন্দর জামা বানাতে তুমি, ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি। শার্টের বুকে রঙিন সূতোয় এমব্রয়ডারি করেছিলে, দুই পাশে দুই বেড়ালছানা ছাতা মাথায় দাঁড়ানো। আর স্কার্ট ছিল ফুল ছাপা। পায়ে যে জুতো ছিল, তার রঙ ধবধবে সাদা। আমার পছন্দে কিনেছিলে জুতো, আমি বলেছিলাম, সাদা রঙের টেডি জুতা চাই। তুমি বলেছিলে, সাদা রঙ ময়লা হইয়া যাইব। আমি জেদ ধরে ছিলাম, শেষে সাদা রঙের টেডি জুতোই কেনা হলো। হাতে দেখা যায় কয়েকটি চুড়ি। এই চুড়িগুলি দিদিমা কিনে দিয়েছিল। আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে, আমাদের চার ভাইবোনকে নিয়ে তুমি রিকসায় চড়ে আমলাপাড়া দাদুর বাসায় গেছিলে। দিদিমার সাথে বোধ হয় তোমার আগেই কথা হয়েছিল, পোলাপানদের স্টুডিয়োতে নিয়ে ছবি তোলানো হবে। সেখানে সেজ মাসী আর ছোট মাসীকেও রেডি পেয়েছিলাম। আমার চোখে কাজল ছিলনা, সেজ মাসী আমার চোখে কাজল দিয়ে দিল, কপালে ধ্যাবড়া টিপ। চুল আঁচড়ে দিল, আমার চুড়িগুলো তখন আংটায় ঝুলছিল। দিদিমা কিনে রেখে দিয়েছে। নীল স্বচ্ছ প্লাস্টিকের চুড়ি, দেখেই প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। সেজ মাসী বলেছিল দুই হাতে পড়তে, আমি সব চুড়ি বাম হাতে পড়েছিলাম দেখে সেজ মাসী বকা দিয়েছিল।

এই ছবিটা আমাকে শৈশবের কী মিষ্টি মধুর সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়! সবার আদরের ছিলাম আমি, তুমি প্রায় প্রায় আমার জন্য নতুন জামা বানাতে। তখন আমার গায়ের রঙ বাবার মতই কালো হয়ে গেছে, গায়ের রঙের সাথে কোন রঙ ভালো যাবে এই বিষয়ে তোমার আন্দাজ ছিল দারুণ। আমায় একটা জামা বানিয়ে দিয়েছিলে, পাতলা সূতি ভয়েলে কাপড়ে, কাপড়ের ছাপার বর্বনা দিতে পারছিনা কেন জানি। সারা জামা জুড়ে ছিল ছোট ছোট কমলা, বাকিটা কেমন আঁকিবুকি ছিল। এত্ত সুন্দর ছিল প্রিন্টটা! আরেকটা জামার বুকে ডিজাইন ছিল স্মোকিং এর কাজ। সেই জামাটাও সুন্দর। [তুমি এত ভালো সেলাই জানতে আর আমি সেলাই কাজ দুই চক্ষে দেখতে পারিনা।]

তোমার বানানো নিত্য নতুন ডিজাইনের জামা গায়ে দিয়ে তোমার সাথে রিকসায় চড়ে যেতাম আমলাপাড়া, সেখানে দিদিমা সেজে গুজে রেডি হয়ে থাকতো। এরপর তুমি আর দিদিমা আমাকে কোলে নিয়ে উঠতে আরেক রিকসায়, চলে যেতাম সিনেমা হলে। তোমরা মা আর মেয়ে আমাকে মাঝে বসিয়ে সিনেমা দেখতে। তোমাদের সাথে দেখেছিলাম, নীল আকাশের নীচে, মোমের পুতুল, আবির্ভাব। কী সুন্দর দিন ছিল, চারদিক কতো পবিত্র ছিল। সিনেমা দেখে তোমরা আমলাপাড়া ফিরতে, তুমি দিদিমার সাথে গল্প করতে, সেজো মামা আমাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতো নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে। সেখানে বাবা সন্ধ্যাবেলায় পার্ট টাইম চাকরি করতো।
সেজো মামা আমাকে অফিস ঘরের দরজায় পৌঁছে দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো। আমি বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ানো মাত্র অফিসের সব কাকুরা হই হই করে উঠতো, দাস বাবু, এইযে মেয়ে আইসা পড়ছে। আমার চুলগুলো সবাই সুন্দর বলতো।
বাবা বলতো, এইটা আমার পচি মা। পচিমা বললেই আমার লজ্জা লাগতো। সবাই জিজ্ঞেস করতো পচি মা ডাকে কেন? বাবা তখন বলে দিত, গরমের দিনে আমার মাথায়, কপালে সারা গায়ে এত ঘামাচি হয় যে ঘামাচির কারণে মাথায় ঘা হয়ে যায়। সেই ঘায়ের কারণে প্রায় গরম কালেই আমার মাথা ন্যাড়া করে দিত।
সবাই যখন আমার চুলের প্রশংসা করতো, বাবা তখন খুব গর্ব করে বলতো, আমি নিজে হাতে যত্ন করি ওর চুলের। প্রতি রবিবারে শ্যাম্পু কইরা দেই, চুল শুকাইলে বৃটিশ কোম্পানীর লেবেল দেয়া ক্রিম মাখায়ে দেই চুলে। চুল সুন্দর নাহইয়া যাইব কই?

এই এক ছবি আমাকে কোন সোনালী অতীতে নিয়ে যায়, যখন আমার সবাই ছিল, যখন আমার সব ছিল। তুমি ছিলে, দিদিমা ছিল, দাদু ছিল, ঠাকুমা ছিল, আমাকে কত কত কত আদর করার মানুষ ছিল, এখন আমাকে আদর করার কেউ নেই। বাবা আছে এখনও, বাবাই বা আর কতদিন। ৮৯ বছর বয়স হলো, তুমি নেই চার বছর। স্বামী হীন স্ত্রী যে জীবন কাটায়, সেখানে বৈধব্যের নিয়মের কাঠিন্য ছাড়া আর তেমন কোন হের ফের হয়না, কিন্তু স্ত্রী ছাড়া স্বামীদের জীবন হয় ভীষণ করুণ। তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আপন ঘরে নির্বাসন দন্ড ভোগ করে।

তোমার সাথে আমার কোন ছবি নেই কেন? তুমি নিজের ছবি তুলতে ভালোবাসতেনা, সব সময় আমার ছবি তোলাতে। আগে বুঝিনি, এখন বুঝি, তুমি লক্ষ্য করেছিলে, আমি ছবিতে ভীষণ সুন্দর। সামনে দেখতে সুন্দর নই আমি ছবিতে পুরোপুরি পালটে যাই। ক্যামেরার লেন্স আমাকে অদ্ভুতভাবে বদলে দেয়। এজন্যই সুযোগ পেলেই তুমি আমার ছবি তোলাতে। মনে পড়ে তোমার, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে কলিকাতা বেড়াতে গেলাম। তুমি আমাকে শাড়ি পরিয়ে কাকীমাকে সাথে নিয়ে স্টুডিয়োতে গেলে। আমার ছবি তোলালে, এমন ছবি যেন ঘটকের হাতে দেয়া যায়। আমার চুলগুলো তখনও দেখার মত সুন্দর ছিল, কাকীমার নির্দেশে চুল খুলে পিঠে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। সেই ছবিটা এখন কোথায় আছে কে জানে! ছবি দেখানোর দরকার হয়নি, তোমার কালো মেয়েটিকে সামনাসামনি দেখেই সে পছন্দ করে ফেলেছিল।

তৃতীয় ছবিটি তোমার সাথে আমার, আমার প্রথমা কন্যা তোমার প্রথমা নাতনীর বিয়ের সময়। ২০১২ সালের ৬ই জুন ঢাকা শহরের উত্তরাতে ছিলাম, মৌটুসীর বিয়ে পরের পরের দিন। ৬ই জুন উত্তরার অস্থায়ী ফ্ল্যাটে আমরা ফটোসেশান করেছিলাম। তখন আমাদের নিজেদেরই ক্যামেরা আছে, ডিজিটাল ক্যামেরা। ছবি তোল আর কমপিউটারে ছবি আপলোড করে দাও। জীবন কত সহজ হয়ে গেছে, স্টুডিওতে যেতে হয়না, ফটোগ্রাফার ডাকতে হয়না। এক ছবিতে মুখ বাঁকা উঠলো, ছবি ডিলিট করে আবার সুন্দর মুখের সুন্দর অভিব্যক্তি দিয়ে ছবি তুলে ফেলো। ছবিতে ছিলাম তুমি, আমি আর মৌটুসী, তিন প্রজন্মের নারী। মৌটুসী আর আমার মুখ খুশীতে ঝলমল, তোমার মুখখানায় খুশী নেই। সেবার তোমার মুখে হাসি ছিলনা, কেন হাসি ছিলনা তা নিয়ে ভাববার ফুরসত পাইনি। ধরে নিয়েছি, মেয়ে বিয়ে নিয়ে আমার ব্যস্ততা তুমি পছন্দ করছোনা। যতবার দেশে গেছি, তোমায় নিয়েই বেড়িয়েছি। তুমি বেড়াতে ভালোবাসতে, আমি ছোট মাসী তুমি অনেক বেড়িয়েছি। সেবার ছোটমাসীকে নিয়ে আমি বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত থেকেছি, তোমার কথা ভুলে যাইনি তবে আমাদের সব কাজে তুমি ভুল ধরো, তাই তোমাকে এড়িয়ে চলেছি।
নাতনীর বিয়েতে তুমি নিজে হাতে প্রতিটি মাঙ্গলিক কাজ করেছো দেখে আমার মনে অনেক শান্তি লেগেছিল। আমার মেয়েরা আমেরিকায় বড় হয়েও মেয়ে বিয়ে করতে চেয়েছে দাদু দিদাকে পাশে নিয়ে, এ যে আমার জন্য কত বড় তৃপ্তি। তুমি ৪২ বছর শিক্ষকতা করেছো, সারাজীবন তোমাকে দেখেছি দারুণ ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলতে। সেই তুমি নাতনীর বিয়ের আসরে উপস্থিত হয়ে এ যুগের মেয়েদের সাথে পাল্লা দিয়ে হাসাহাসি করবে, মজা করবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি।
মা, তুমি কি সাধ্যের বাইরে গিয়ে আনন্দ করেছিলে? শরীরের যন্ত্রণাকে অতিক্রম করে আনন্দ করেছিলে? নাতনীকে খুশী করতে আনন্দ করেছিলে? সবাই বলছিল, তুমি নাকি খুব ওভার রিঅ্যাক্ট করছিলে। কোথায় নিয়ম হচ্ছেনা, এর পিঠে থাবরা দিয়ে বলছো, নিয়ম হয় নাই, তাকে ডেকে বলছো, নিয়ম হয় নাই। এত কেন নিয়মের কড়াকড়ি করছিলে মা? এত কেন ছটফট করেছিলে! তুমি কি আঁচ করেছিলে? কিছু অমঙ্গল কি টের পেয়েছিলে? এই কথাটুকু লিখছি, চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে সব!


চতুর্থ ছবিটি একেবারেই অন্যরকম। এই ছবিতেও তুমি আর আমি, আমাদের দুজনের একসাথে তোলা শেষ ছবি। ছবিটি তোলা হয়েছে ২০১২ সালের ৮ই অক্টোবার, নারায়ণগঞ্জের একটি ক্লিনিকে বেডে তুমি শোয়া, দুই চোখ বন্ধ, নাকে অক্সিজেনের মাস্ক। তোমার বালিশে মাথা দিয়ে আমি। তুমি চলে যাচ্ছো তার আগ মুহূর্তে তোলা। তুমি অচেতন, মুখে অক্সিজেনের মাস্ক, ধীরে ধীরে নিঃশ্বাসের গতি কমে যাচ্ছে। তুমি একেবারেই চলে যাচ্ছো, আমরা সবাই হতবিহবল। আমি ক্লান্ত দেহে তোমার মাথার কাছে মাথা ঠেকিয়ে শুয়েছিলাম শেষবারের মত, ঠিক এমন করে শুতাম রবিবারের দুপুরে, স্কুলে পড়ার সময়ে। তখন রবিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন, রবিবার মানেই আমাদের ছোট্ট ঘরে সুখের বন্যা। সেদিন বাবা মা, চার ভাইবোন সকলেই বাসায় থাকে। বাবা বাজার করেন রবিবারে, সারা সপ্তাহ ডাল, ছোট মাছ খেয়ে মুখ ভোঁতা করে রাখা আমার জন্য এক সাগর আনন্দ। বাবা বাজার থেকে গলদা চিংড়ির ইয়া বড় বড় মাথা কিনে আনে, কাতল মাছের মাথা আনে, পটল আনে, আমাদের সবার পছন্দের জিনিস বাবা বাজার থেকে আনে। আর রান্নায় তুমি ছিলে দ্রৌপদী, দ্রৌপদীর চেয়েও বড় কিছু ছিলে। দ্রৌপদী ধনী বাড়িতে ছিলেন, ভাল জিনিস পেয়ে ভাল রেঁধেছেন। আর তুমি, দূর্বা ঘাসকেও পারলে এমন করে রাঁধতে যে মনে হতো অমৃত খাচ্ছি। রবিবারের দুপুরে আমরা পরিবারের ছয় সদস্য একসাথে মাটিতে বসে তৃপ্তি সহকারে খেতাম, গল্প করতাম। তুমি তোমার স্কুলে যত গল্প শুনতে তা শেয়ার করতে, বাবা বলতো বাবার গল্প, বড়দা আর মেজদাও তখন অনেক কিছু বুঝে, মতামতও দেয়। আমি শুনতাম, আর চিংড়ির মাথার মগজে চুমুক দিয়ে আহা আহা করতাম।

খাওয়ার পাট সেরে সবাই শুতাম, জোড়া দেয়া দুই তক্তপোশে বাবা, তুমি, আমি, রানু শুতাম, রেডিওতে আকাশবাণী কলকাতা চলতো। রবিবারে নাটক হতো, বড়দা আর মেজদা কাছাকাছি চেয়ারে বসে নাটক শুনতো। আমি নাটকের দিকে তত মন দিতামনা, তোমার বালিশের কোণে মাথা দিয়ে শুতাম। সাথে আয়না থাকতো, তোমার মেলে দেয়া ভিজে কোঁকড়া চুলগুলোকে নিয়ে আমার কাঁধে এমনভাবে ছড়িয়ে দিতাম যে মনে হতো, ওগুলো আমারই চুল। এই যে তোমার চুল ধরে টানাটানি করছি, তুমি একটুও বিরক্ত হতেনা। তোমার এমনিতেও অনেক ধৈর্য্য ছিল, তুমি অনেক সহ্যশক্তি সম্পন্ন মানুষ ছিলে। সংসারে কত যে কঠিন বাস্তবতাকে তুমি অবলীলায় মেনে নিয়েছো, সহ্যশক্তি না থাকলে তা সম্ভব নয়। আয়না সামনে ধরে দেখতাম, এত বড় চুলে আমাকে কেমন দেখায়। শুধু রবিবার নয়, স্কুলে নানাকারনে ছুটি থাকলেও দুপুরে তুমি বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়তে। তখন আমি তোমার পাশে ঠিক তোমার বালিশের কোণে মাথা দিয়ে শুতাম। শুতে যাওয়ার আগে তুমি আমাকে ডেকে বলতে, মিঠু সোনাধন, বুকশেলফ থিকা অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম বইটা আন, পঞ্চতপা আন, পৌষ ফাগুনের পালা আন, আমি সুভাষ বলছি, মাস্টারদা সূর্যসেন, কাল তুমি আলেয়া আন। আমি গল্পের বই পড়তামনা, গল্পের বই পড়তো মেজদা। মেজদার সাথে গল্পের বই নিয়ে তুমি যখন আলোচনা করতে, আমি সব শুনতাম। ছোটবেলায় আমি বেশী শুনতাম, বলতাম খুব কম। এখন দাবার দান উলটে গেছে, এখন সারাক্ষণই বলি, শুনিইনা। 

চার নাম্বার ছবিটাতে দেখা যায় তোমার বালিশে মাথা দিয়ে আমি নীরবে কাঁদছিলাম।ছবিটা কে ক্যামেরায় বন্দী করেছিল, নিশ্চয়ই বড়দা। বড়দা সেদিন সকালে কানাডা থেকে এসেছে, ঘটনা কিছুই বুঝতে পারছিল না। ক্যামেরা ক্লিক ক্লিক করে তোমার ছবিই তুলে যাচ্ছিল। সেই সকালে যখন আমি হসপিটালের কাগজপত্রে সাইন করে দিয়েছি তোমাকে লাইফ সেভিং মেশিন থেকে নিজ দায়িত্বে বের করে নিয়ে যাচ্ছি, বড়দা ওদিকে প্রধান ডাক্তারের কাছে জানতে চাইছে তোমাকে কি করে বাঁচিয়ে রাখা যায়। তোমার জ্ঞান আছে, লাইফ সেভিং মেশিন থেকে তোমাকে বের করে নেয়া কতখানি অমানবিক সিদ্ধান্ত! প্রধান ডাক্তার বলেছিলেন, ডায়ালিসিস করলে আরও এক মাস বাঁচবেন, তবে লাইফ সেভিং মেশিনেই থাকতে হবে। ওদিকে পাশে দাঁড়ানো জুনিয়র ডাক্তাররা মৃদু কন্ঠে জানালো, স্যার এই রুগীকে ডায়ালিসিস করা মানে আরও কষ্ট দেয়া। উনি খুব কষ্ট পাচ্ছেন। মা আমি বড়দার পিঠে হাত রেখে বলেছিলাম, বড়দা, আসো মাকে ছেড়ে দেই। মা সারাজীবন দাপটের সাথে চলেছে, সেদিন মায়ের ৭৫ বছর পূর্ণ হলো, মা সারা শরীর নাড়াতে পারছেনা, মনে হয় অবশ হয়ে গেছে। মাকে কষ্ট দিলে লাভ কি। আমরা কেউ মায়ের কাছে থাকতে পারছিনাতো, সারাদিন মাকে এই হাসপাতালের বেডে ঘুমের ইঞ্জেকশান দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়, জাগলেই মা ব্যথা পায়। মায়ের কাছে এখন শরীরের যন্ত্রণাই আসল, আমরা সবাই নকল
বড়দা বলেছিল, খুব হতাশ কন্ঠেই বলেছিল, যেইটা ভালো বুঝস, সেইটাই কর

তোমাকে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে এলাম, ক্লিনিকে উঠালাম। তোমার দেহে প্রাণ ছিল, একটু হুঁশও ছিল। ক্লিনিকের মালিক নিজেও ডাক্তার, দাদুকে চিনেন, তোমাকে চিনেন। আগে বুঝতে পারেনি মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে আনা হচ্ছে। নমিতা মামী আর মামীর বড় ছেলে সুমনকে ঢাকা থেকেই ফোন করে বলেছিলাম, নারায়ণগঞ্জে একটা ক্লিনিকে ব্যবস্থা করতে। স্কয়ার হসপিটালের নিয়মে নেই, লাইফ সেভিং মেশিন থেকে বের করে নেয়া রোগীকে নিজেদের হাসপাতালে রাখার। আমি ডাক্তারদের সকাতর অনুরোধ করেছিলাম, যদি একটা কেবন আমাদের দেয়। তোমাকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হতো, আমরা সবাই তোমাকে ঘিরে বসে থাকতাম। আমাদের মাঝে থেকেই তুমি চলে যেতে পারতে। কিন্তু হসপিটালের নিয়মে নেই বলে তোমার ভারী দেহটাকে এত কষ্ট দিয়ে এম্বুলেন্সে তোলা হলো, ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ পথে যাত্রাবাড়ির ভাঙ্গা রাস্তায় ঝাঁকুনি খাওয়ানো হলো, এরপর নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে ক্লিনিকের সরু সিঁড়ি পথ বেয়ে স্ত্রেচার ধাক্কা খাওয়াতে খাওয়াতে তোমাকে তিন তলায় উঠানো হলো। অনেক কষ্ট পেয়েছো মা, অনেক কষ্ট। যত কষ্ট পেয়েছো তার সবটুকুই আমি নিজের শরীরে টের পাই।
স্কয়ার হসপিটালে লাইফ সাপোর্টে ছিলে প্রায় পাঁচ দিন, আমি হসপিটালের আই সি ইউতে তোমায় সকাল বিকেল দেখতে যেতাম। আমরা কেউ গেলেই তুমি চোখ খুলে তাকাতে, ইশারায় কথা বলতে। শরীর নাড়াতে পারতেনা, মুখের ভেতর নল ঢুকানো ছিল বলে কথা বলতে পারছিলেনা। মা, আই সি ইউর তরুণ কয়েকজন ডাক্তার আমাকে বলেছিল, উনি খুব কষ্ট পাচ্ছেন, কষ্ট কমবেনা, বাড়তেই থাকবে। ক্যান্সার উনার সারা দেহে ছড়িয়ে গেছে, ক্যান্সারে প্রচন্ড ব্যথা। উনাকে মুক্তি দিন। তোমার মুক্তির পথ খুলে দিলাম।

মা, আই সি ইউতে জ্ঞান ফিরে প্রথম তুমি আমাকে দেখেছিলে। জানো, আমি সেই সকালেই দেশে পৌঁছেছি, কেমন দিশেহারা অবস্থা। কি হতে চলেছে কিছুই বুঝিনা। মাত্র তিন মাস আগে আমার মেয়ের বিয়েতে তুমিই ছিলে প্রধান কর্ত্রী, বিয়ের আসর দাপিয়ে চলেছো, সেই মানুষ কি করে আইসিইউতে থাকে! অপারেশান থিয়েটারে যাওয়ার আগেই তুমি শুনেছো, আমি প্লেনে উঠেছি। তুমি আমার আসার অপেক্ষায় ছিলে, তাইনা মা? নাহলে শেষ অপারেশান করে তোমাকে যে অবস্থায় উনারা আইসিইউর বেডে দিয়েছে, আর কারো জীবনে ফেরার কথা নয়। আমি আসবো জেনে তুমি ওটিতে গেলে, তোমার ব্লাড প্রেশার ফল করেছে, কিডনি ফেল করেছে, ইনটেসটাইন কেটে ফেলেছে, তোমাকে লাইফ সেভিং মেশিনে রেখেছে, তবুও তোমার জ্ঞান ফিরেছে। আমি যখন তোমাকে কাঁচের জানালা দিয়ে দেখলাম, ওখানেই মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলাম। আমার সেই সুন্দর স্বাস্থ্যের, অসম্ভব ব্যক্তিত্বের অধিকারী, দারুণ কর্মঠ মা বিছানায় কেমন অসহায়ের মত পড়ে আছে। কী ছোট্ট, দেখাচ্ছে তোমাকে।
রুমে ঢুকে যেইমাত্র আমি মা ডেকেছি, তুমি কোন গভীর তলদেশ থেকে জেগে উঠলে মনে হলো। এক মুহূর্ত, চোখ খুলেই আমাকে দেখলে, তুমি কানতে শুরু করলে। মা, তুমি কি বুঝতে পেরেছিলে, তোমার মুক্তিদূত এসে পৌঁছেছে! চার বছর পেরিয়ে গেছে, দৃশ্যগুলো মনে করিনা, ভাবি শোক সামলে উঠেছি। এখন দেখছি, শোক সামলে উঠতে পারিনি। সেই একই কান্ড, অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছি, মা বাবার কাছে সন্তান যেমনি নয়নের মণি, সন্তানের কাছেও বাবা মা নয়নের মণি। ঈশ্বর না করুন, তোমার জীবিতকালেই যদি আমি মরে যেতাম, বাকী জীবন তোমার যেমন শোক হতো, তোমার জন্য আমার তেমনই শোক হয়।

চতুর্থ ছবিটি অনেক কথা বলে। ভাগ্যিস এই ছবিটি বড়দার ক্যামেরায় উঠেছিল। মা, দেখো ফটোগ্রাফির কি মহিমা! এখন সবার সাথেই ডিজিটাল ক্যামেরা থাকে, মোবাইল ফোনগুলোতো একেকটা ক্যামেরা। ভাগ্যিস বড়দা ছবি তুলেছিল, এত বছর কানাডা থাকার ফলে বড়দা অনেক বাস্তববাদী হয়ে গেছে। বড়দার জায়গায় মেজদা বা রানু হলেই ছবি তুলতোনা। ভাবতো, এটা কি বিয়ে বাড়ি নাকি যে ছবি তুলতে হবে। আসলে ছবিতো শুধু আনন্দের মুহূর্তকে ধরে রাখার কথা বলেনা, ফটোগ্রাফি যে কোন মুহূর্তকে ধরে রাখে। মানুষ কি শুধু সুখের হিসেবই রাখে, দুঃখের হিসেব কি রাখেনা? দুখের হিসেবও রাখতে হয়, দুখের হিসেবের ফাঁক গলেই সুখ বেরিয়ে আসে।

চতুর্থ ছবিটি যে কারো দৃষ্টিতেই একখানি শোকের ছবি। কিন্তু সেদিন মানে ১৯শে আগস্ট ফটোগ্রাফি দিবসে যখন ছবি বাছাই করছিলাম, এই ছবিটির দিকে তাকিয়ে ছোট একটা সুখের বার্তা পেয়ে গেলাম। আমরা সারাজীবন নারায়ণগঞ্জের বর্তমান বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে থাকলাম, আমাদের সাথে বড় হওয়া আর সকলেই যার যার নিজস্ব ফ্ল্যাট কিনে দূর দূরান্তে চলে গেছে, রয়ে গেছে শুধু আমার মেজদা আর রানু ভাই। যখনই ঢাকা চলে আসার কথা বলা হতো, তুমি সব সময় বলতে, তিন বছর বয়সে বাবা মায়ের সাথে নারায়ণগঞ্জের এই বাড়িতে এসেছিলাম, আমি এই বাড়িতেই মারা যেতে চাই। তোরা যার যেখানে সুবিধা হয়, সেখানে চলে যা। আমি এই বাড়িতেই থাকব
তোমার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে মা। তুমি নারায়ণগঞ্জের মাটিতে এসেছিলে তিন বছর বয়সে, পঁচাত্তর বছর বয়সে পৃথিবী ছাড়ার কয়েক ঘন্টা আগে তোমাকে নারায়ণগঞ্জের মাটিতে নিয়ে আসতে পেরেছি, পথের এত ধাক্কায় তোমার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়নি, অক্সিজেনের নল খুলে যায়নি, অক্সিজেন ফুরিয়ে যায়নি, এম্বুলেন্স ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকেনি-----ঈশ্বর দয়াময়, আমাদের চার ভাইবোনকে ততটুকু দয়া করেছেন যে মাকে তাঁর জন্মভূমিতে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি।

মা, আমি ১৯শে আগস্ট এই চারটি ছবি দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলাম। সেখানে লিখেছিলাম,
ও গো মা, তোমার কোলে জনম আমার
মরণ তোমার বুকে
তোমার পরে খেলা আমার দুঃখে সুখে
তুমি মিশেছো মোর দেহের সনে, তুমি
মিলেছো মোর প্রাণে মনে
তুমি অন্ন মুখে তুলে দিলে
তুমি শীতল জলে জুড়াইলে
তুমি যে সকল সহা সকল বহা মাতার মাতা
[আজ ১৭৭ তম গটোগ্রাফি দিবস]

দুই দিন আগে ছোট মাসী আমাকে ফেসবুকে নক করে বলেছে, দিদির ঐ ছবিটা ডিলিট করে দে। ফেসবুক খুললেই ছবিটা দেখি, আমার কষ্ট হয়।

ছোট মাসীতো ছিল তোমার মেয়ের মত, তুমি ছিলে তোমার ভাইবোনদের কাছে মায়ের মত। বিশেষ করে ছোট মাসীর কাছে তুমি ছিলে সত্যিকারের মা। তোমার কষ্টে তার তোঁ কষ্ট হবেই। আমি পোস্টটাই লক করে দিয়েছি।

মা, তুমি নিশ্চয়ই ভালো আছো তোমার মত করে, জগতের যত কষ্ট জগতেই ভোগ করে গেছো, এখন তোমার সুখ পাওনা। আমরা যে যার মত করে ভালো থাকার নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছি, সব কিছুতেই তোমার শূন্যতা অনুভব করি, এই যা।

মিঠু