Wednesday, May 30, 2012

প্রচন্ড গরম, যানজট, ধূলিবালি তবুও এ আমারই দেশ!!

আমরা যারাই প্রবাসে থাকি, দৈনন্দিন জীবনে আমাদের সুখের সীমা নেই! চারিদিকে বিলাস-ব্যসনের ছড়াছড়ি, গাড়ী-বাড়ীর ঠাট-বাট, অফুরন্ত খাবার-দাবার, কোনকিছুর অভাব নেই। বাতাসে ধূলিবালি নেই, রাস্তায় যানজট নেই, বাতাসে গাড়ীর কালো ধোঁয়া নেই, রাস্তা ঘাটে পথচারী নেই, ভিখিরী নেই, চোরের উপদ্রব নেই, গরমে ঘামাচি হয়না, শীতে হাত পায়ের চামড়া ফাটেনা সবেতেই এক ধরনের নিশ্চিন্ততা! প্রবাসে রাজনীতি নেই তাই পথে ঘাটে গরম গরম বক্তৃতা বিবৃতি নেই, বিরোধী দল আছে কিনতু হরতাল নেই, সরকারী দল থাকলেও সরকারী দলের দাপট নেই, হরতাল নেই, জ্বালাও পোড়াও নেই, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশান জট নেই। বেকারত্ব আছে তবে বেকার ভাতাও আছে, কেউ না খেয়ে থাকেনা। মুমূর্ষু রোগীকে হাসপাতালের ইমার্জেন্সীতে নিয়ে গেলে আগে চিকিৎসা পরে অন্যকথা, গরীব রোগীদের জন্য সরকারী অনুদান বা ফ্রী চিকিৎসাসহ সবই আছে।
প্রবাস জীবনে সবই আছে অথচ কিছুই যেনো নেই! সুখ আছে স্বস্তি আছে, শুধু শান্তি নেই। সারাটাদিন বিদেশী ভাষায় চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলা, খাওয়ার সময় তিনবেলা হাত দিয়ে ভাত মেখে খাওয়ার বদলে ছুরী কাঁটা চামচে আওয়াজ না তুলে স্যানডুইচ, স্টেক খাওয়া, মা বাবাকে দেখতে হলেই স্কাইপে যাওয়া, বৃষ্টির দিনে বন্ধুদের সাথে চা মুড়ির আড্ডা মিস করা, রবীন্দ্র জয়ন্তী, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের আনন্দ মিস করা--কাহাতক ভালো লাগে! আমার ভালো লাগেনা! আমার ভালো লাগেনা বলেই আমি বার বার ফিরে আসি। কষ্টের উপার্জন থেকে একটু একটু করে সঞ্চয় করি, অপেক্ষায় থাকি কখন আমার সঞ্চয় ফুলে ফেঁপে উঠবে, কখন আমি অনায়াসে প্লেনের টিকিট কাটতে পারবো! নতুন গাড়ীর বদলে পুরানো গাড়ী চালাই, সাধারন মানের বাড়ীতে থেকেই খুশী থাকি। ডায়মন্ড বসানো আংটি কিনিনা, ডলার জমাই আর দিন গুনি, মাস গুনি, এরপর বছর গুনি। দুই বছর শেষ হতেই বাক্স প্যাঁটরা গোছাতে শুরু করি। পরিবারের সকলকে নিয়ে রওনা দেই দেশের পথে।
আমি থাকি আমেরিকাতে। দেশে আসি সামারের ছুটিতে। কারন সামারেই বাচ্চাদের স্কুল-কলেজ দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ থাকে। তাছাড়া এত পয়সা খরচ করে দেশে এসে দুইটা মাস অন্তঃত না থাকতে পারলে ভালো লাগেনা। দেশে আসার সময় আমাকে কয়েকবার ফ্লাইট পাল্টাতে হয়, সরাসরি কোন ফ্লাইট নেই। ফলে একদিনের পরিবর্তে দুই দিন লাগে দেশের মাটি স্পর্শ করতে। প্লেনের ভেতরের হিমঠান্ডা পরিবেশের মধ্যে থেকেই জানালার কাঁচে মুখ লাগিয়ে রেখে বাংলাদেশ দেখার চেষ্টা করতে থাকে আমার মত কিছু ক্ষ্যাপাটে বাঙ্গালী। মিডল ইস্ট থেকে আসা বাংলাদেশের ছেলেপেলেদের জ্ঞানগর্ভ মন্তব্য শুনতে কি যে ভালো লাগে! দেশের টান এমনই এক জিনিস যে আকাশের উপরে থেকেই তারা প্রবাসী জীবনের কষ্টগুলোর সাথে দেশে থাকার সুখ নিয়ে তুলনামূলক আলোচনায় মেতে উঠে। কি যে ভালো লাগে শুনতে যখন কেউ একজন বলে উঠে, " মরুভূমিতে থাইক্কা থাইক্কা আরব বেডাদের অন্তরটাও মরুভূমি হইয়া গেছে। আমরার দেশে যেই বিষ্টি হয়, তার অর্ধেকও যদি হেই দেশে হইত, তাইলেই বাঙ্গালীগো মত মনডা নরম হইত"। এমন জ্ঞানের কথা একবার বলে আর মোটা কাঁচের জানালা দিয়ে চোখ ভরে দেখার চেষ্টা করে বাংলার শোভা। জানালার মোটা কাঁচ ভেদ করে কি আর বাংলার রূপ দেখা যায়! বাংলার রূপ দেখতে হলে বাংলার মাটিতে নামতে হয়। ওদের সাথে সাথে আমিও বাংলার মাটিতে নেমে আসার অপেক্ষায় থ্যাকি।
বিমান শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করার সাথে সাথেই আমার সহযাত্রীরা বিমানের নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করেই সীট বেল্ট খুলে দাঁড়িয়ে পড়ে আর দেশী স্টাইলেই হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দেয় লাগেজ নামানোর জন্য। বিমানবালারা এগিয়ে আসেন এই যাত্রীদেরকে আবার সীটে বসিয়ে দেয়ার জন্য। তখন ছেলেপেলেদের মুখে চোখে ফুটে উঠে এক ধরনের সারল্যমাখা হতাশা সকলের আগে নামতে না পারার দুঃখে। কি যে ভালো লাগে এমন সব দৃশ্য দেখতে। প্রাণভরে আমি দেখি। এরপরে বিমানবন্দরের ভেতরে ইমিগ্রেশানের লাইনে দাঁড়ানোর যে প্রক্রিয়া থাকে সেখানে দেশী পাসপোর্ট আর বিদেশী পাসপোর্টের আলাদা লাইনের দিকে না তাকিয়ে কিছু কিছু যাত্রী বিদেশী পাসপোর্টের লাইনেই হয়ত দাঁড়িয়ে যায় তাড়াতাড়ি বের হতে পারবে আশায়। সেখানেও তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয়, পাঠিয়ে দেয়া হয় দেশী পাসপোর্টধারীদের লম্বা লাইনে। ওদের মুখটা করুন হয়ে উঠে, আমার মনটা খারাপ হয়। ওদের জন্য মমতা বোধ করি।
আমি আমাকে নিতে আসা গাড়ীতে উঠার সাথে সাথেই ড্রাইভার সাহেব থেকে শুরু করে সকলেই খুব সচেতন হয়ে পড়ে আমার সুখ সুবিধার কথা চিন্তা করে। যেন আমাদের গরম না লাগে, যেন আমাদের খাওয়া দাওয়াতে কোন রকম অসুবিধা না হয়! আমি খুবই বিব্রত বোধ করি আমাদের জন্য সকলকে এমন উতলা হতে দেখে। আবার ভালো লাগে যখন ভাবি এইতো আমার দেশ, এইতো আমার কৃষ্টি। এটাইতো হওয়ার কথা। বাঙ্গালী অতিথিপরায়ণ জাতি। আমাদের জীবনে অভাব আছে, দুঃখ আছে, ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ আছে, কিনতু তারপরেও আমাদের সকলের হৃদয়ের গভীরে সকলের জন্য মমতা আছে, টান আছে। এই মমতাবোধই আমাদেরকে এখনও হাজার হাজার মাইল দূর থেকে, বিলাসী জীবনের মোহ থেকে বার বার টেনে নিয়ে আসে। সুখী জীবনে অভ্যস্ত আমার মেয়েরা প্রতি বছর দেশে আসতে চায় শুধুমাত্র এই ভালোবাসা, আদর, স্নেহ মমতা পাওয়ার জন্য। কি প্রচন্ড গরম এখন বাংলাদেশে, আমাদেরকে নিয়ে সকলেই তটস্থ, আমাদের আরামের জন্য সকলেই খুব চিন্তিত! আর আমরা? আমরা থোড়াই কেয়ার করছি এই গরম, ট্র্যাফিক জ্যাম, ধূলা বালি, মানুষের কোলাহল! আমরা মহা আনন্দিত এই কোলাহলের মধ্যে থেকে। যতই কষ্ট লাগুক তারপরেও একটা অনুভূতিই কাজ করে চলেছে, " দীন দুঃখিনী মা যে আমার এর বেশী তার সাধ্য নাই"। এইতো আমার দেশ, এই আমার ঠিকানা!

Saturday, May 19, 2012

দেশে যাওয়ার পথে পথে-(পর্ব ২)

আগের পর্বে আমি ২০০৬ সালের দেশযাত্রা নিয়ে অল্প-বিস্তর লিখেছি। আসলে আমি যদি ঘুণাক্ষরেও জানতাম যে জীবনের একটা পর্যায়ে আমি লেখালেখি শুরু করবো, তাহলে আরও অনেক পুংখানুপুঙ্খরূপে লিখতে পারতাম। যাই হোক ২০০৬ সালে দেশে গিয়েছিলাম পরিবারের পাঁচজন মিলেই। তারপর দেশ থেকে ফিরে এসেই খাতা কলম নিয়ে বসে গেছি, প্রথমে বছর গুনি, পরে মাস গুনি, তারপরে দিন গুনতে গুনতেই ২০০৮ সাল চলে এসেছে। ২০০৮ এ আমার স্বামী যাননি। আমি আর আমাদের তিন মেয়ে গেছিলাম দেশে। ঐ বছর আমাদের বড় মেয়ে  মৌটুসী কলেজ গ্র্যাজুয়েশান শেষ করেছে, মেজো মেয়ে মিশা স্কুল গ্র্যাজুয়েশান শেষ করেছে। দুই মেয়ের গ্র্যাজুয়েশান উপলক্ষে আমরা এখানে গ্র্যাজুয়েশান পার্টি করেছিলাম। ৭০ জন অতিথিকে নিমন্ত্রন করেছিলাম এবং নিজে হাতে সব রান্না করেছিলাম। ধান ভানতে শীবের গীত গাইছি, কারন অবশ্য একটা আছে। আমাদের দেশে যাওয়ার দিনটি ছিল পার্টির ঠিক পরের পরের দিন। আমিতো পার্টির আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, সাথে দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি।

এবারেও চার পাঁচ মাস আগে থাকতেই শপিং শুরু করেছিলাম। এত আগে শপিং করার একটাই কারন, আমেরিকাতে একেকটা অকেশানে 'সেইল' দেয়। আমার মত অতি সাধারন আয়ের মানুষের পক্ষে রেগুলার দামে জিনিস কেনা কঠিন। কারন আমি শুধু নিজের পরিবারের জন্য গিফট কিনিনা,  মায়ের প্রতিবেশী, মায়ের পরিচিত জন, নিজের আত্মীয় স্বজনদের কথাও মাথায় রাখি। দেশে গেলে মাঝে একবার ইন্ডিয়াতে যাওয়ার চেষ্টা করি। ফলে তাদের জন্যও ছোটখাট জিনিস কিনি। আমার ভালো লাগে প্রত্যেককে কিছু না কিছু দিতে। সেজন্যই 'সেইলে'র অপেক্ষায় থাকি। শ্যাম্পু, লোশান, সাবান এগুলোর যা ওজন হয়, আমাদের চার দ্বিগুনে আট লাগেজের প্রত্যেকটাই ওভারওয়েইট হয়ে যায়। তা সেবারও আট লাগেজের অবস্থা কাহিল দেখে আমি নিজেই কাহিল হয়ে পড়েছি। পার্টির কারনে আগের সাত দিন বিশ্রাম পাইনি, পার্টি শেষে সব গুছিয়ে, বরের জন্য রান্না করে খাবার ফ্রীজ করে দিয়ে এর ফাঁকেই লাগেজ তৈরী করা কি যে কঠিন, তা আমি সেবার টের পেয়েছিলাম।

যেদিন রওনা হলাম, আমাদের বিরাট টয়োটা ভ্যানে সবগুলো লাগেজ চাপিয়ে পাঁচজনতো গাড়ীতে উঠে বসলাম। আমার স্বামীই এবার আমাদেরকে এয়ারপোর্টে ড্রপ করেছে। এবার একটা মজার ব্যাপার ছিল। আমাদের সাথে আমাদের আরেক বন্ধু পিংকীও রওনা দিয়েছিল। পিঙ্কীরা  তখন আমাদের শহরে নতুন এসেছে। কলকাতার মেয়ে, আমাদের পুরো ফ্যামিলির সাথেই ওদের খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায়। পিঙ্কী এয়ার ইন্ডিয়া বা লুফথানজা'তে টিকেট না কেটে শুধু আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য 'এমিরেটস'এর টিকিট কেটেছে। আমরা ২০০৮ এ এমিরেটস এ গিয়েছিলাম। আমরা যার যার গাড়িতে করে বার্মিংহাম এয়ারপোর্টে পৌঁছেছি। পিঙ্কী খুব ফুরফুরে মেজাজে ছিল, কারন ওর বর সব্যসাচী  খুব গুছানো মানুষ। ওর বরই ওর লাগেজ ওজন টোজন করে দিয়েছে। আমার বরও গুছানো, কিনতু আমার অবিবেচনার কাছে সকল গুছানো মানুষের হার মানতে হয়। এয়ারপোর্টে নেমেই হঠাৎ করে খেয়াল হলো আমার বড় মেয়ে মৌটুসীর হাতের ঘড়িটা কোথাও পড়ে গেছে। শুরু হলো আমার মাথা গরম হওয়ার প্রথম ধাপ। আমার চেহারার দিকে তাকিয়েই পিঙ্কী দৌড়ে গিয়ে রাস্তার উপর থেকে ভেঙ্গে যাওয়া ঘড়ি নিয়ে এসে আমাকে শান্ত হতে বললো। আমি দাঁত কিড়মিড় করেই থেমে গেলাম।

লাগেজ নিয়ে চেক ইন এ ঢুকেই মিশার ডাক পড়লো। মৌটুসী পাশেই মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে ছিল। মনে মনে একটু কষ্টও লাগছিল, কিনতু আমার তখন শিরে সংক্রান্তি। নিজের চোখেই দেখলাম পিঙ্কীর লাগেজ কি সুন্দর করে ঠিকঠাকভাবে বেল্টে চলে গেলো। আমি জানতাম আমার লাগেজ আটকাবে। মিশাকে বললাম, " মিশা , আমার ভয় লাগছে। তুই ঐ কালো ছেলেটার কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়া। কালো ছেলেগুলো খুব ভালো হয়। ওরা বেশী ওজন দেখলেও কিছু বলবেনা। একটু সুন্দর করে হাসি দিয়ে কথা বলবি, দেখবি আমাদের লাগেজ ঠিকঠাক বেল্টে চলে গেছে"। আমার মিশা মেয়ে সাথে সাথে হাসতে হাসতে জোরে জোরে বলতে শুরু করলো, " এই তোমরা কি কখনও কোন মা'কে বলতে শুনেছো, মেয়েকে বলছে ফ্লার্ট করতে। আমি নাকি ঐ কালো ছেলের কাছে গিয়ে হাসি দিলেই আমার লাগেজ ক্লীয়ার করে দিবে"। ব্যস, পিঙ্কী শুরু করে দিল হাসি। হাসি সংক্রমিত হতে শুরু করলো। মিশা কালো ছেলের কাউন্টারেনা গিয়ে এক সাদা মহিলার কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালো। আমার তখন বিপর্যস্ত অবস্থা। প্রতি লাগেজে পঞ্চাশ পাউন্ড এলাউ করে। আমার দ্বিতীয় লাগেজের ওজন হয়েছে আটান্ন পাউন্ড। বেল্ট থেকে ফিরে এসেছে। আরেকটার ওজন হয়েছে আটচল্লিশ পাউন্ড। এবার সাদা মহিলাটি মিশাকে বললো যে যে গুলোতে বেশী ওজন হয়েছে তার থেকে ওজন কমিয়ে কম গুলোতে ঢুকিয়ে দিতে। এমন সিগন্যাল পেয়েই আমার মাথা খুলে গেলো। আমার আট লাগেজের পাঁচটাই ছিল ওভারওয়েইট। একেকটা লাগেজ অনুমোদন পায় আর আমি অন্যটার থেকে ভারী ভারী শ্যাম্পুর বোতল, মিল্ক অব ম্যাগনেসিয়ার বোতল , লোশনের বোতল টেনে বের করে অন্যটাতে ঢুকিয়ে দেই। পিঙ্কীও আমাকে সাহায্য করছিলো। আমার তখন কেঁদে ফেলার অবস্থা। এভাবেই সবগুলো লাগেজ বেল্টে তুলে দিয়েছিলাম।

আমরা ভেতরে চলে যাওয়ার আগে আমার স্বামী আমাকে বললো, " প্রতিবার তোমার এমন হয়, এটা কেমন কথা! দেশে যাবে, কোথায় আনন্দে থাকবে তা না, সারাটা পথ টেনশান করতে করতে যাও। যাই হোক, লাগেজের ঝামেলা গেছে, এবার বাকী পথ নিশ্চিন্তমনে যেও। মেয়েদের সাথে রাগারাগি করোনা। ওরাই তোমাকে ঠিকভাবে নিয়ে যাবে"। আমার তখন ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে, যে কোন কথাই শুনতে ভালো লাগছিল। মৌটুসীর এতো দামী ঘড়িটা ভেঙ্গে যাওয়ার দুঃখও ভুলে গেছিলাম। এরপর প্লেনে উঠেই আমার খুব জল পিপাসা পেয়ে গেল। বার্মিংহাম থেকে আমেরিকান এয়ারলাইনসে হিউস্টন। হিউস্টন থেকে এমিরেটসে দুবাই। আমেরিকান এয়ারলাইনসে কিচ্ছু খেতে দেয়না, এমন ছোটলোক। আড়াই ঘন্টার জার্নিতে একটা জুসের ক্যান আর ছোট্ট এক প্যাকেট চিনেবাদাম, এই হলো খাবার। আমার তখন পিপাসায় কাতর অবস্থা, দুই ঘন্টা পরে বুড়ি এয়ারহোস্টেস জুসের ক্যান দিয়ে যেতেই বাংলাতেই একটা বকা দিলাম মনে মনে। তারপর হিউস্টনে পৌঁছে পাঁচ ঘন্টার জন্য নিশ্চিন্ত হয়ে বসলাম। পিঙ্কী থাকাতে খুব ভালো লাগছিল। পিঙ্কী খুবই সরল মনের এক মেয়ে। দারুণ স্টাইলিস্ট, বড়লোকের বউ, কিনতু আমাদের সাথে প্রাণ খুলে মিশে যায়। আমার মেয়েরাও স্টাইল জানে, ফলে পিঙ্কী আন্টির সাথে খুব দহরম মহরম খাতির।

ওয়েইটিং চেয়ারে বসে আছি। পিঙ্কী আমার কাছে গল্প করে যাচ্ছিল আমাদের পরিচিত আরেক ফ্যামিলির দাম্পত্য অশান্তির কথা। ও কোন কুটকচালি করছিলোনা, আমার সাথে শেয়ার করছিলো ওর ফিলিংস। পিঙ্কীর একমাত্র ছেলে ঋষি আমার ছোট মেয়ে ঋষিজার সম বয়সী হওয়াতে ওরা দুজনে মিলে খেলা করছিল, বাকী দুই মেয়ের একজন একটু পর পর নানা রকম তথ্য এনে হাজির করছিল। ততক্ষনে আমার মাথা ঠান্ডা। হঠাৎ করেই দুই বুড়া যাত্রী আমাদের কাছে এসে স্প্যানিশ ভাষায় কিছু জিজ্ঞেস করছিল। আমি জানতাম মিশা ও মৌটুসী স্কুলে স্প্যানিশ পড়েছে। বিশেষ করে মিশা মাত্র স্কুল গ্র্যাজুয়েশান করে এসেছে, ওরতো জানার কথা স্প্যানিশ। অথচ মিশা কিছুই বুঝতে পারছেনা বুড়াদের কথা। আমি সাথে সাথে রেগে গেলাম, " এই মেয়ে তুমি কি শিখেছ এতদিন, এখন এক বর্ণও বুঝতে পারছোনা"। মিশা আমাকে উলটা ধমকী দিলো, " তোমার খেদমত করতে গিয়ে সব ভুলে গেছি"। মৌটুসী এগিয়ে এলো। পাঁচ বছর আগে শেখা স্প্যানিশ জ্ঞাণ দিয়েই ও পারলো বুড়ো দুটোর কথা বুঝতে। ওদেরকে মৌটুসী যতটুকু সাহায্য করার তা করলো। মিশা ততক্ষনে সবার জন্য খাবার কিনে নিয়ে এসেছে দেখে ওর প্রতি আবার আমি নমণীয় হলাম।

হিউস্টন থেকে এমিরেটসে উঠেই মিশা, পিঙ্কী, মৌটুসী কাছাকাছি বসে গেলো। আমি দখল করলাম জানালার পাশের সীট। ওরা প্লেন ছাড়তেই মুভী চালিয়ে দিল, আর পকর পকর শুরু করে দিল। আমি জানালার কাঁচে মাথা রেখে আকাশের মেঘ দেখতে লাগলাম। মেঘেদের খেলা যারা বুঝতে পারে তাদের জন্য কত রকম খেলা যে অপেক্ষা করে! মাঝে মাঝে আমি মনিটরে দেখি কত ফিট উঁচুতে আছি, মাঝে মাঝে ম্যাপ দেখি, আন্দাজ করি প্লেন এখন ঠিক কোন দেশের উপর দিয়ে যাচ্ছে। মেয়েরা একটু উঁকি দেয় আমার স্ক্রীণে, আমাকে জিজ্ঞেস করে কোন মুভী দেখতে চাই কিনা। আমি মুভী দেখিনা। বরং মেঘেদের খেলা দেখি। সুন্দরী স্মার্ট এয়ারহোস্টেস কাছে আসে খাবারের ট্রে নিয়ে, কখনও আসে ড্রিঙ্কসের ট্রে নিয়ে। আমাকে ভাবতে হয়না খাবার নিয়ে। আমার মিশা জানে আমার জন্য কোন খাবার ঠিক। আমার খাবার ও ঠিক করে দেয়। আর পিঙ্কী, মিশা, মৌটুসী তিনজনেই মোটামুটি সর্বভুক। ওরা সব সময় নতুন নতুন খাবার ট্রাই করে। সী ফুড ওদের বেশী পছন্দ। রেস্টুরেন্টে গেলেও এই তিনজনই শামুক, ঝিনুক, সী উইডস, আরও যত রকমের থলথলে ল্যাতল্যাতে খাবার আছে সেগুলো অর্ডার করে। বীফ ছাড়া ওরা সব খায়।

এমিরেটস দুবাই পৌঁছালে আমরা কয়েক ঘন্টা একসাথে থেকে ঘুরাঘুরি করি। মৌটুসী পারফিউমের দোকানে ঢুকে যায়। সেবার মৌটুসী আশি ডলার দিয়ে এক শিশি পারফিউম কিনতেই মিশা আমাকে টেনে নিয়ে গেলো দোকান গুলোতে। মিশা সব টেস্টার থেকে একটু একটু করে নিজের গায়ে স্প্রে করতে থাকলো, আমার গায়েও স্প্রে করে দিয়ে বললো, " মা দিদিসোনা একটা বোকা, আশি ডলার দিয়ে পারফিউম না কিনে আমাদের মত মাগনা পারফিউম গায়ে মেখে ডলারটা দেশে নিয়ে ভাঙ্গালে পরে ঐ টাকায় কত কিছু কিনতে পারতো। তোমার এই মেয়ে পুরা বড়লোকী মেয়ে হইছে। আর আমি হইছি বুদ্ধিমতী"। আমি হাসি মিশার পাগলামী দেখে। এইবেলা অবশ্য পিঙ্কী মৌটুসীর সাথে। যাই হোক একটা সময় পরে আমরা দুই ভাগ হয়ে গেলাম। পিঙ্কীরা ধরলো দুবাই টু কলকাতা ফ্লাইট, আমরা ধরলাম দুবাই টু ঢাকা ফ্লাইট। দুবাই টু ঢাকা ফ্লাইটে নতুন কিছু ছিলনা। একই রকম বাংলা কথা চারিদিকে, বাচ্চাদের ট্যাঁ ট্যাঁ, মাঝখানে কোন কোন ধার্মিক ব্যক্তিকে দেখলাম আসা যাওয়ার প্যাসেজের মধ্যেই নামাজ পড়তে বসে যেতে।

এবার আমি আর বাথরুমে যাওয়ার কথা মাথাতেই আনিনি। কিনতু বাংলায় একই ঘোষণা দিয়েছিল এবারও। বাথরুম পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে। এই ঘোষনা যতবার শুনি, আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। এতো বছর প্রবাসে কাটিয়েও বাঙ্গালীদের কিছু কিছু খাসলত থেকেই যায়।  এবারও জানালা দিয়ে সূর্য্যোদয় দেখলাম, জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠ দৃশ্যগুলোর একটি। নেপালের দিক দিয়ে যখন প্লেন বাঁক নেয়। হিমালয়ের সারি দেখে আমার চোখ আর মন ভরে যায়। আমার মেয়েরা তখনও মুভী দেখে। মাঝে মাঝে আমাকে ডিঙ্গীয়ে বাইরের দৃশ্য একটু দেখে নেয়। ঢাকার কাছাকাছি আসলেই মিশার মেকাপ বক্স ওপেন হয়ে যায়। আলতো করে গালে কপালে ফেসপাউডার বুলিয়ে নেয়, মাথার ঝাঁকড়া চুলে একটু ব্রাশ বুলিয়ে নেয়। আমাকেও একটু ফ্রেশ হতে বলে। আমি পাত্তা দেইনা। অপেক্ষায় থাকি কখন প্লেন মাটি ছোঁবে। একসময় প্লেন মাটি ছোঁয়, আমি আবারও মিশে যাই আমাদেরকে নিতে আসা স্বজনের মাঝে।

দেশে যাওয়ার পথে পথে (পর্ব-১)



আমেরিকাতে আসার পর থেকে প্রতি দুই বছরে একবার দেশে যাওয়াটা আমার রুটিন হয়ে গেছে। আমেরিকাতে এসেছিলাম ২০০১ সালে। প্রথমবার দেশে গেছিলাম ২০০৩ সালে। এরপর ২০০৬, ২০০৮, ২০১০ এ গিয়েছি। এবার ২০১২ তে আবার যাচ্ছি। বরাবরের মত এবারও আমি খুবই এক্সাইটেড। আমি খুবই হোমসিক। দেশে থাকা বাবা মা, ভাই বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব আমাকে অহর্নিশি হাতছানি দিয়ে ডাকে। প্রতিবার দেশ থেকে ফিরেই আবার খাতা কলম নিয়ে বসে যাই, বছর গুনি, মাস গুনি এরপর দিন গুনি। দিন গোনা শেষ হলে মুহূর্ত গুনতে শুরু করি।

দেশে যাওয়ার সময় আমি এতটাই এক্সাইটেড থাকি যে মাঝে মাঝে আমার বোধ বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। আমার সাথে থাকা মেয়েদের উপর সব দায়িত্ব ছেড়ে দেই। ওরাই আমাকে নিয়ে যায়, আবার ওরাই আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। আমার সংসারে আমিই মেইন ভয়েস। তবে স্বৈরাচারী নই। মেয়েদেরকে শাসন করতে ভালো লাগে, তাই শাসন করি। আমি চাইলেই প্রতি বছর দেশে যেতে পারি, কিনতু ভয়ের চোটে চাইনা। কারন আমি একা একা পথ চলতে জানিনা। অনেক টাকা পয়সা নেই বলে সবাই মিলে প্রতিবছর দেশে যাওয়ার উপায় নেই। তাই কখনও সবাই মিলে, কখনও বা মেয়েদেরকে নিয়েই দেশে যাই। মেয়েদের সাথে গেলেও দেশে যাওয়ার সময় হলেই আমার চেহারা পালটে যায়। মেইন ভয়েস কেমন যেনো চুপসে যায়। কারন আছে। আনন্দের সাথে সাথে কিছুটা ভয়ও আমাকে গ্রাস করে। ছোটবেলাতে একবার হারিয়ে গেছিলাম, এরপর থেকেই আমার কেবলই মনে হতে থাকে একা চললেই আমি বোধ হয় হারিয়ে যাব, ঠিকমত প্লেনে উঠতে পারবোনা। এক টার্মিনাল থেকে আরেক টার্মিনালে যেতে পারবোনা। ভুল করে ভুল প্লেনে উঠে যাব। আমার অবশ্য মনে থাকেনা দেশে যাওয়ার পথে আমি কি কি উদ্ভট আচরন করে থাকি। দেশে যাওয়ার পরে দুইদিন দুইরাত মেয়েরা সব আত্মীয়-স্বজনদের সাথে জলসা বসায়, জলসাতে আমাকে নিয়েই সংগীত রচিত হয়। আমি বোকার মত সব শুনি আর সকলকে হেসে লুটিয়ে পড়তে দেখি।



 আমি যতবার দেশে গিয়েছি, যাত্রাপথে কতরকম মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা যদি লিখে রাখতাম কতই না ভালো হতো। অন্যের কথা কি বলবো, আমি নিজেই আমার মেয়েদেরকে হাসির খোরাক যুগিয়েছি। একেকটা কাজ করি আর মেয়েরা আমাকে নিয়ে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে।

২০০৩ সালে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে করে বাংলাদেশ গেছি। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া থেকে আমরা প্লেনে না উঠে ভার্জিনিয়ার ডুলাস এয়ারপোর্ট থেকে ফ্লাই করেছি। আমার স্বামীর এক আমেরিকান ছাত্র আমাদেরকে এয়ারপোর্টে ড্রপ করে দিয়েছিল। ছেলেটির নাম কার্টিস আর ওর গার্ল ফ্রেন্ডের নাম ছিল নাতাশা। কার্টিস আর নাতাশাকে দেখেই আমি অবাক হয়ে গেছি। কার্টিস বিশাল মোটা আর নাতাশা একেবারেই বাঁশপাতার মত পাতলা ছিল। আমরা বাসা থেকে রওনা হয়ে তিন ঘন্টা পরেই পথের মধ্যে একটি কান্ট্রি রেস্টুরেন্টে গাড়ী থামিয়ে ভেতরে ঢুকতেই রেস্টুরেন্টটি আমার ভালো লেগে গেলো। কাঠের গুঁড়ির বেঞ্চ এবং ডাইনিং টেবিলে বসেই খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। আমরা কেউই ক্ষুধার্ত ছিলামনা কার্টিস আর নাতাশা ছাড়া। কিনতু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমার জন্যও খাবার অর্ডার করতে বললাম। প্লেটে বিরাট বড় মুরগীর পা দেখে আমি খুশী হয়েই খেতে শুরু করলাম। কার্টিস দুই প্লেট খেয়ে ফেলেছে দেখেই আমি বলে ফেললাম, “ এই রে! এই ছেলে এত খায় কেনো? ওর স্বাস্থ্যের যা অবস্থা”। আমার মেয়েরা বললো, “ তুমি একটু আগেই বাসা থেকে পেট ভরে খেয়ে এসে যদি এখানে ফুলপ্লেট খাবার অর্ডার দিতে পারো” বলতেই তাদের বাবা শরীর দুলিয়ে হাসতে লাগলো। আমি আমতা আমতা করে বলতে লাগলাম, “ রেস্টুরেন্টে নেমেছি, কিছুতো খেতে হবে। নাহলে ওরা যদি আমাদেরকে উঠিয়ে দেয়”! আমার স্বামী বললেন, “ আমাদের দেশে হলে উঠিয়ে দিত। তাছাড়া তুমি এই কাজটি অনেক বছর আগেও একবার করেছিলে”। আমার মনে পড়ে গেলো বিয়ের পরে আমাদের ঢাকার সংসার একটি ট্রাকে চাপিয়ে ঐ ট্রাকে করেই আমরা সাভার যাচ্ছিলাম। মিরপুরের কাছাকাছি আসতেই ট্রাক থামানো হলো। রেস্টুরেন্টে ঢুকে ড্রাইভারকে খাবার দিতেই আমিও খাবার অর্ডার করলাম। রেস্টুরেন্টটির নাম ছিল ‘কিছুক্ষন’। সাইনবোর্ডে একটা ছাগল ও একটি মুরগীর ছবি আঁকা ছিল। ভেতরের পরিবেশ আমার জন্য মোটেও খুব একটা আনন্দদায়ক ছিলনা। কেমন গা ঘিনঘিন করা পরিবেশ। এরমধ্যেই আমি শুধুমাত্র রেস্টুরেন্টে ঢুকেছি বলেই ভদ্রতা করে বিস্বাদ সিঙ্গারা আর চা নিয়েছিলাম। খেতে ভালো লাগছিলনা তবুও খাচ্ছিলাম দেখে আমার স্বামী (তখনও বিয়ের একমাস হয়নি) খুব নরম সুরেই বলেছিলেন, “ তোমার ওগুলো খেতে হবেনা। নিলেই খেতে হবে? ভালো না লাগলে রেখে দাও”।

২০০৬ সালে দ্বিতীয়বার পরিবারের পাঁচজন মিলে দেশে গেছি। দেশে যাওয়ার সময় একমাস আগে থেকেই হুলুস্থুল শুরু হয়ে যায়। পাঁচজন মিলে দশটি স্যুটকেস নিতে পারবো জেনে আমি পাঁচমাস আগে থেকে বাজার শুরু করি। আহামরি কিছুই কিনিনা। তবে সবার জন্য টুকিটাকী কিনে নেয়ার চেষ্টা করি। পাঁচমাসে একটু একটু করে কিনতে কিনতে দেখা যায় জিনিসের পাহাড় জমে গেছে। একবার যখন কিনেইছি তখন সবকিছু লাগেজে না আঁটানো পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। আমার স্বামী ভদ্রলোক আমার এই ধরনের দৌরাত্ম্যপনা মুখ বুজে সহ্য করেন। মেয়েরা সহ্য না করে যাবে কোথায়! দশটা লাগেজ ফাটিফাটি করা অবস্থায় নিয়ে যাই এয়ারপোর্টে। আমার মেয়েরা প্রশ্ন করেনা কার জন্য এতকিছু নিয়ে যাই। ওরা জানে দেশে গিয়ে অমুক বুয়া, ওপাড়ার বিন্তি থেকে শুরু করে মায়ের স্কুলের দারোয়ান, দপ্তরীদের জন্যও কিছু না কিছু থাকে। জিনিস কেনা আমার কাজ, জিনিস স্যুটকেসে ঢুকানোও আমার কাজ কিনতু এয়ারপোর্টে পৌঁছে ওভারওয়েইট লাগেজ টানাটানি থেকে শুরু করে চেক ইন করতে গেলে মেয়ে মিশাকে আমার পাশে চাইই চাই। আমার মেজো মেয়েটি মায়ের চেয়ে অনেক বেশী পছন্দ করে তার বাবাকে। তারপরেও আমার বিপদের দিনে সেইই আমার একমাত্র সহায়। লাগেজ চেক ইন করিয়ে দিয়ে আমার দিকে একটা কৌতুক মিশ্রিত দৃষ্টি যখন হানে, আমি বুঝে যাই কি এর মানে।
সেবার আমরা গিয়েছিলাম গালফ এয়ারে, কারন টিকিট একটু সস্তায় পাওয়া গিয়েছিল। এখানেও একটা ব্যাপার আছে। আমার স্বামীর প্লেন ফোবিয়া আছে, ২০০১ এর প্লেন হাইজ্যাকিং এর পর থেকে ফোবিয়া বাড়ছে। আমি সেই জন্য মিডল ইস্ট এর এয়ারলাইন্স পছন্দ করি। স্বামীকে অভয় দেই, মিডল ইস্টের এয়ারলাইন্স কেউ হাইজ্যাক করবেনা। গালফ এয়ারে আমার কথাতেই টিকিট কেটেছিল। এয়ারলাইনস হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছেই বেগড়বাই শুরু করেছে। প্রথমে বুঝিনি। আমাদের লন্ডন টু ঢাকা ফ্লাইট ডিলে হতে দেখে আমার হুঁশ এসেছে। স্পীকারে জানানো হচ্ছিল ‘টেকনিক্যাল ত্রুটির’ জন্য দেরী হচ্ছে। আমারতো ভয় ঢুকে গেছে মনে। পাশে বসা স্বামীকে বলি, “ এই যাওনা, একটু দেখে আসোনা, কি সমস্যা হচ্ছে। চারঘন্টা অলরেডী পার হয়ে গেছে”। আমার স্বামী হাসতে হাসতে বললেন, “ যাই ঘটে থাকুক, আমিতো এর কিছুই বুঝবোনা। চুপচাপ বসে থাকো। প্লেন ঠিক হলে তোমাকে নিয়ে উড়বে”। আমি একটুক্ষন চুপ করে থেকে আবার খোঁচাই স্বামীকে। এবার আমার বর বললো, “ তুমি নিজেওতো গিয়ে দেখে আসতে পারো। তোমার মনে যা যা প্রশ্ন আছে ওদেরকে জিজ্ঞেস করে আসতে পারো”।

বুঝলাম এই দিক থেকে সাহায্য পাবোনা। অথচ টেনশান বেড়েই যাচ্ছে আমার। এয়ারলাইনস থেকে যাত্রীদের সবাইকে ম্যাঙ্গো জুস, কুকী খেতে দেয়া হচ্ছিল। বাঙ্গালীদের দোষ দেয় সবাই, ঐদিন দেখলাম প্লেনের সকল যাত্রী হুমড়ী খেয়ে পড়েছে একটু জুস পাওয়ার আশায়। আমি বাঙ্গালী ছিলাম সবার পেছনে। আমার চেহারাতে টেনশান দেখে এবার আমার মুশকিল আসান মেয়ে মিশা দুই হাতে জুসভর্তি দুই কাপ এনে বললো, “ মা, টেনশান করে কোন লাভ নাই। নাও সাইড লাইন দিয়ে ঢুকে তোমার জন্য জুস নিয়ে আসছি। আমি জানি তোমার মেয়ের এমন কীর্তিতে তুমি খুশীই হবে। তাকিয়ে দেখো লাইনের অবস্থা, তুমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলে, জুস আর পেতে না। দেখো তোমার জন্য দুই কাপ জুস এনেছি। চুপচাপ বসে বসে জুস খাও। কেউ জানেনা কি হয়েছে, জিজ্ঞেস করে এসেছি একজন এয়ারহোস্টেসকে, বলেছে টেকনিক্যাল সমস্যা”। আমি বলি, “ দেখনা চেষ্টা করে, কাউকে আবার জিজ্ঞেস কর, কত বড় সমস্যা, প্লেন আকাশে উঠেই কি ভেঙ্গে পড়বে নাকি”? মিশা বললো, “ এবার দিদিসোনাকে পাঠাও। আমি বার বার যাবো কেনো”? বড়মেয়েকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, তবুও বললাম, “ ও মামনি, আমার ভয় লাগছে। তুইতো ভালো ইংরেজী পারিস, যা না গিয়ে একটু ডিটেইলে জেনে আয়না মা, সমস্যা কতটা গুরুতর”। মেয়ের জবাব, “ তুমি নিজেওতো ইংরেজী বলতে পারো, তুমিই জিজ্ঞেস করো। তোমার ভয় পাওয়া মুখ দেখলেই ওরা সব বলে দিবে। আমি যাচ্ছিনা, কারন প্রথম কথা, আমি জানি যতক্ষণ পর্যন্ত ওরা প্লেন এর ত্রুটি সারাই না করতে পারবে প্লেন নিয়ে ওরা উড়বেনা। প্লেনে শুধু তুমি আর আমিই যাচ্ছিনা, চারশ যাত্রী যাচ্ছে, পাইলট, ক্রু যাচ্ছে, তাদের জীবনের মায়া নেই? শুধু শুধু টেনশান করে শরীর খারাপ করছো কেনো”? আমি শুধু বললাম, “ ফাজিল মেয়ে, বেশী জ্ঞাণী হয়ে গেছো। এরপরে আর একটাও কথা শুনতে চাইনা তোমার কাছ থেকে”। আমার মত আর কাউকেই এই ব্যাপারে চিন্তিত দেখলাম না। ঘুরেফিরে আবার স্বামীর কাছে যেতেই এবার স্বামী বললেন, “ শোন, সবার যা হবে আমাদেরও তা হবে। প্লেনে এমন যান্ত্রিক গোলযোগ হতেই পারে। এত দেরী হচ্ছে কারন ওরা ভাল করে খুঁজে খুঁজে দেখছে। ঠিক হলেই প্লেন ছাড়বে”।
আমি বললাম, “ আসলে আমরা মরে গেলে কোন ক্ষতি নেই। আমাদের মেয়েগুলো জীবনের কিছুই দেখলোনা, কোন কারন ছাড়াই যদি এভাবে বেঘোরে ওদের প্রাণ দিতে হয় সেটা কেমন হবে”। আমার বড় মেয়ে ফট করে বললো, “ মৃত্যু আসার আগেই তুমি মরে যাচ্ছো। নিজে টেনশান করছো আমাদেরকেও ভয় দেখাচ্ছো। তুমি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, প্লেন ঠিক হয়ে গেলে আমরাই তোমাকে ধরাধরি করে প্লেনে বসিয়ে দেবো। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেশে গিয়ে চোখ খুলবে। এর আগে না”।

আমি বুঝতে পারছিলাম, আমি খুব বেশী রিএক্ট করে ফেলছি। এবার চুপ হয়ে গেলাম। তারপরেই নিজের মনকে সান্ত্বণা দিলাম, পাইলট, এয়ারহোস্টেস সকলেইতো আমাদের সাথে উঠবে। প্লেন একসিডেন্ট হলে ওরাওতো মারা যাবে। নিজের মৃত্যু কি কেউ চায়! তাহলে নিশ্চয়ই প্লেন ভালো করেই ঠিক করবে। মনে মনে এগুলো বলছিলাম, আর কারো সাথেই কথা বলছিলামনা। এক সময় মিশা আরেক কাপ জুস হাতে করে এসে বললো, “ ভালো খবর নিয়ে এসেছি। প্লেন এক্কেবারে ঠিক হয়ে গেছে। একটু পরেই ছাড়বে। তুমি ম্যাঙ্গো জুস ভালোবাসো বলে এবার আরেক কাপ নিয়ে এলাম তোমার জন্য। জুস শেষ হয়ে গেছে, এয়ারহোস্টেসের সাথে খাতির করে এক্সট্রা কাপ এনেছি তোমার জন্য। আর রাগ করে না থেকে জুসটা খাও। এখনই প্লেন ছাড়বে”। আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। প্রথমে ভেবেছিলাম মিশা আমাকে খুশী করার জন্য এমন ইতং বিতং করছে। কিনতু পাঁচ মিনিটের মধ্যেই যখন প্লেন ছাড়ার এনাউন্সমেন্ট শুনতে পেলাম তখন বুঝলাম মিশা সঠিক খবর নিয়ে এসেছে। এরপরে আর কোন অসুবিধা হয়নি। প্লেন ছেড়েছে ঠিকভাবেই।

প্লেনে উঠেই চারিদিকে অনেক বাঙ্গালীর ক্যাঁচর ম্যাঁচর শুনতে পেলাম। আমার কি যে ভালো লাগতে শুরু করলো। আমেরিকাতে যেখানে থাকি বাংলা কথা শুনতে পাইনা তেমন করে। এখন লন্ডনের আকাশে সিলেটি বাংলা শুনে বেশ ভালো লাগতে শুরু করলো। বাচ্চাদের ট্যাঁ ট্যাঁ শুনছিলাম। কানে তালা লাগার জোগাড়। তবু ভালো লাগছে। বাথরুমে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। মিশাকে ইন্সপেকশানে পাঠালাম। মিশা এসে দুঃসংবাদ দিল। প্লেনের বাথরুমের ছোট্ট ঘরটিতে নাকি বাচ্চাদের নোংরা ডায়াপার পড়ে আছে। এই এক সমস্যা। বাঙ্গালী পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত থেকেই প্লেনে উঠুক না কেনো, প্লেনে উঠেই তারা এটাকে নিজের ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলে। গেলামনা আর বাথরুমে। প্লেন ঢাকার কাছাকাছি আসতেই বাংলাতে ঘোষণা শুনতে পাচ্ছিলাম, “আপনারা দয়া করে বাথরুম নোংরা করবেন না। বাচ্চাদের নোংরা ডায়াপার ডাম্প করার জন্য বাথরুমেই ট্র্যাশ ক্যান রাখা আছে। দয়া করে নোংরা ট্র্যাশ ক্যানে ট্র্যাশ করুন”।

ঢাকাতে প্লেন এর চাকা মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথে আমার চেহারাতে আলো ফুটে উঠলো। ভুলে গেলাম ঘটে যাওয়া যত ঘটনা-অঘটনা। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই মিশে গেলাম রিসিভ করতে আসা প্রিয়জনের মাঝখানে।

Wednesday, May 16, 2012

অনলাইনে সংবাদ পাঠের বিড়ম্বনা!

ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ কিছুদিনের জন্য বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়েছেন, এটা দেশের প্রতিটি মানুষই জানে। টিভিতে, পত্রপত্রিকাতে ফলাও করে এর প্রচার চলছে। একজন হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে প্রচার চলবে, এমনটাই প্রত্যাশিত। হুমায়ুন আহমেদতো আর পাড়ার দোকানদার কেউ নন যে কোথা দিয়ে আসলো, কোথা দিয়েইবা বের হয়ে গেলো, কেউ দেখতেই পারলোনা। হুমায়ুন আহমেদ নিজের যোগ্যতাবলেই আজ এখানে এসে পৌঁছেছেন। আমি এখানে হুমায়ুননামা লিখতে চাইছিনা। কারন হুমায়ুন আহমেদ সম্পর্কে আর দশজন যা জানে, আমি তার চেয়ে হয়তোবা একটু আধটু বেশী জানি। আমি বলছি অন্যকথা। হুমায়ুন আহমেদ এক সময় আমার স্বামীর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী তথা বন্ধু ছিলেন। উনি যখন অসুস্থ হলেন, উনার সাথে দুই চারটি স্মৃতিকে জড়িয়ে একটি লেখা ব্লগে পোস্ট করেছিলাম, ‘হুমায়ুন ভাইয়ের জন্য যত প্রার্থণা’ নামে। সেই হুমায়ুন ভাই দেশে গেছেন তা টিভিতে আমার স্বামী দেখছেন। আমি ব্লগে এলোমেলো বিষয় নিয়ে লিখি তা আমার স্বামী জানেন। আজকেই বিকেলে আমি কাজ থেকে ফিরতেই উনি আমাকে বললেন, হুমায়ুন আহমেদের নতুন উপন্যাস শুরুর সাথে সাথেই এমন বিতর্ক শুরু হয়েছে যে পত্রিকাতে প্রতিদিন তা নিয়ে লেখা হচ্ছে। হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে লেখা হচ্ছে সেটা নিয়ে আমার স্বামী চিন্তিত নন, পাঠকেরা মন্তব্য করতে গিয়ে হুমায়ুন আহমেদের মেয়েদের নামে, তার দ্বিতীয় স্ত্রী শাওনের নামে এমন সব কুরুচীপূর্ণ কথা লিখেছে যে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়তে হয়। পত্রিকার সম্পাদক দায়ী থাকার কথা এমন নোংরা মন্তব্য বিনা সেন্সরে প্রকাশিত হওয়ার জন্য। অনেকের বাড়ীতেই বাবা, মা, ছেলে মেয়ে অনলাইনে একই পত্রিকা পড়ছে, তারাতো লজ্জা পায়। এই বিষয়টির উপর আলোকপাত করে আমি যেনো কিছু লিখি, সেরকম একটি সাজেশানই উনি আমাকে দিয়েছেন।
যখন দেশে ছিলাম তখন বাড়ীতে দুইটার বেশী পত্রিকা রাখতামনা। বাংলা পত্রিকার আগাপাশতলা না পড়তে পারলে আমার ঘুম হতোনা। প্রথম প্রবাস জীবনে ঘরে কম্পিউটার ছিলনা বিধায় অনলাইনের ব্যাপারগুলোও ছিলনা। তাছাড়া নিজের কমপিউটার থাকলেইতো আর হলোনা, পত্র পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ থাকতে হবেতো! কিনতু তখন এসবের কিছুই ছিলনা।সময়টা ছিল পঁচানব্বইয়ের দিকে। দেশ ছাড়ার আগে আমার স্বামী আমার জন্য ‘যায় যায় দিন’ নামের সাপ্তাহিকটি এক বছরের জন্য সাবস্ক্রাইব করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণে থেকে সপ্তাহে দুইদিন সিডনী বেতার থেকে প্রচারিত আধাঘন্টার বাংলা অনুষ্ঠান শুনতাম আর দেশ থেকে আসা ‘যায় যায় দিনের’ দুইটি করে পৃষ্ঠা প্রতিদিন পড়তাম যেন সপ্তাহের প্রতিটিদিন বাংলা ম্যাগাজিনের সাথে অন্তঃত সম্পর্কটা অটুট থাকে। সাথে করে নিয়ে গেছিলাম কিছু ‘সানন্দা’। সানন্দা কখনওই পুরাণো হয়না। তাই এভাবেই মিলিয়ে ঝিলিয়ে আমার বাংলা পাঠের পিপাসা মিটাতাম।
২০০১ এ আমার দ্বিতীয়বারের প্রবাস জীবনের প্রথমদিকে সাথে করে নিয়ে আসা এক ট্রাঙ্ক বাংলা গল্পের বই দিয়েই বেশ ভালোভাবেই চালিয়ে নিচ্ছিলাম। তাছাড়া ২০০১ এর শেষের দিকে আমেরিকাতে এসে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের বিষাদের সাথে যোগ হয়েছিল দেশ ছেড়ে আসার আগের নির্বাচন পরবর্তী সন্ত্রাসের দুঃসহ স্মৃতি। সব মিলিয়ে মনটা এমনিতেই কাতর হয়ে থাকতো, তাই গল্পের বইয়ের মধ্যেই ডুবে থাকতাম। দুই বছর পরেই আমার মাথায় আবার সংবাদপত্র পাঠের ভুত মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই কম্পিউটারে বসা শুরু করলাম। দেশে থাকতেই নিজেদের ঘরে কম্পিউটার ছিল এবং আমি তা কখনও ছুঁইয়েও দেখিনি। ভয় পেতাম কোন বাটন টিপতে কোন বাটন টিপে ফেলি, কম্পিউটার নষ্ট হয়ে যেতে পারে, সেই ভয় আমেরিকাতে এসেও রয়ে গেছিল বলে কম্পিউটারের বিশাল রত্ন ভান্ডার আমার কাছে অধরাই থেকে গেছিল। ঘরের সদস্যদের অভয়বাণী শুনে, বিশেষ করে আমার স্বামী যখন বলেছিলেন যে কম্পিউটারে বাটন টিপলেই যে কম্পিউটার নষ্ট হয়ে যাবে এমন ধারণা ত্যাগ করতে, তখন থেকে একটু একটু করে কম্পিউটারে বসা শুরু করলাম।
কমপিউটারে বসেই আমি পত্রিকা পড়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। তখন এতো ওয়েব সাইট ছিলনা বা থাকলেও আমি জানতামনা। খুব সহজে সব পত্রিকা একসাথে যেনো পেতে পারি তার জন্য আমার এক ভাই আমাকে ই-মেলা ডট কম এ যেতে বলেছিল। সেখানে গিয়ে বাংলাদেশ, ভারতের বাংলা পত্রিকার বিশাল সম্ভার দেখেই আমার মন ভরে গেলো। ইলেকট্রিসিটির সমস্যা নেই, হাতে প্রচুর অবসর সময়, আমাকে আর পায় কে! বাংলা পত্রিকার আদ্যোপান্ত পড়তাম এমনকি শোক সংবাদও বাদ দিতামনা। তখন পত্রিকাতে সংবাদ পাঠের নীচে পাঠকের মতামত দেয়ার অপশন ছিলনা। একেকটা সম্পাদকীয় বা খোলা কলম পড়তাম, অথবা বিশেষ কোন ফিচার পড়তাম, মাঝে মাঝে মনে হতো নিজের মতামত জানানোর উপায় থাকলে ভালো হতো। কিনতু তা আর হয়ে উঠেনি। তাছাড়া ইন্টারনেটের স্পীড এত স্লো ছিল যে পত্রিকা পড়তে পেরেই সন্তুষ্ট ছিলাম।
পরবর্তীতে আরও বেশী আধুনিক অবয়বে বেশ কিছু নতুন পত্রিকা বের হতে লাগলো। নতুন পত্রিকার সব কিছুই নতুন। নতুন ধরনের লেখা, ভিন্ন আঙ্গিকে সংবাদ পরিবেশনতো ছিলই, সাথে যোগ হয়েছে পাঠকের মতামত জানানোর জন্য স্পেস। পাঠকের মতামত পড়তেই আমার বেশী ভালো লাগতো। কারন একটি সংবাদ কার মনে কিভাবে কাজ করে, মতামত থেকে তা জানা যায়। পাঠকের মতামত পড়ে দেশের হালচাল বুঝা যায়। আমি সেইজন্যই পাঠকের মতামত অথবা কোন একটি বিষয়ের উপর পাঠক জরীপের ফলাফল খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। কখনও কখনও আমিও দুই একটা মন্তব্য করেছি। তবে মন্তব্য করতে গেলে নাম ধাম, ই-মেইল আইডি দিতে হয় বলে আমি ওখানেই মতামত দেয়ার ব্যাপারে সমাপ্তি টেনেছি। কারন এগুলো স্মার্ট মানুষদের কাজ বলেই ধরে নিয়েছি।
কিনতু গত দুই বছর ধরেই পত্রিকা পাঠের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছি। কারন বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহার খুব সহজ হয়ে গেছে বলেই কিনা জানিনা, ইন্টারনেট এখন শিক্ষিত, রুচিশীল মানুষের হাত ছাড়িয়ে রাম শ্যাম যদু মধুদের হাতে চলে গেছে। এইসব যদু মধুরা অনলাইনে মতামত দেয়ার সুযোগ পেয়ে যাহা খুশী তাহাই লিখে চলেছে। সংবাদের বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্ক নেই , অথচ তারা মতামত দেয়। মতামতে যত নোংরা ভাষা, কুৎসীত গালিগালাজ ব্যবহার করা যায় তার সবটুকুই তারা করে থাকে। মাননীয় নেতা নেত্রীদেরকে পতিতালয় ঘুরিয়ে নিয়ে আসে, প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী নেত্রীকেও রেহাই দেয়না এরা। পাঠকের মতামত পড়ে প্রথমদিকে আমি হতভম্ব হয়ে যেতাম। সবাইতো আর খারাপ কথা লিখেনা, ভাল কথা খুঁজতে গিয়ে দশটা খারাপ কথা পড়তেই হতো। কেউ বাধ্য করেনি পড়তে, তবুও আমি পড়তাম অনেকটাই কৌতুহলের বশে। দেখতে চাইতাম, মানুষ কত নীচে নামতে পারে। একজন কমেন্টদাতা আরেকজন কমেন্ট দাতার মা’কে, বোনকে নিয়ে তার শয্যায় তুলছে হরহামেশা, কেউ কাউকে চোখে না দেখেও বলে দিতে পারে একজন আরেকজনের মা বোনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বর্নণা! ভাবা যায়! এরাই আবার মা দিবসে মায়ের জন্য গোলাপ হাতে ঘরে ফিরে! এরাই মা’কে নিয়ে কত গান বাঁধে। এরাই নিজের মা’কে মাথায় রেখে অন্যের মা’কে কথার আঘাতে শয্যাসঙ্গিণী করে ফেলে। এগুলো বেশী দেখা যায় রাজনৈতিক সংবাদের বেলাতে প্রযোজ্য। একজনের সাথে আরেকজনের মতের মিল না হলেই একজনের পছন্দের নেত্রীকে নিয়ে টানাটানি করছে, না হয়তো মা বোনকে নিয়ে টানাটানি করছে।
আমি ব্লগে লিখতে গিয়েও একই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। আমার নিজের লেখাতেও কত গালিগালাজ শুনেছি। একেকটা লেখা ব্লগে পোস্ট করেছি, তারপরেই পাঠকের প্রতিক্রিয়া দেখে দুই রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। ব্লগতো অনেক বেশী কাছের, ব্লগের পাঠকরা কেউ যদু মধু টাইপ নয়, এরা সবাই শিক্ষিত সমাজের মানুষ। আসল নাম গোপন রেখে ছদ্মনামে যাহা খুশী তাহা মন্তব্য করে যায়। পত্রিকার পাতায় মন্তব্য দেখে ভেবেছিলাম এরা বাপের পয়সা ধ্বংস করে ইন্টারনেটের মিসইউজ করে চলেছে। কিনতু ব্লগে ঢোকার পরে থেকে আমার ধারণা বদলেছে। এমন কদর্য ভাষাতে মতামত প্রদান দেখে একটি কথাই মনে হচ্ছে, আসলে কিছু মানুষের মধ্যে আছে রুচি, মননশীলতা, নিয়মানুবর্তিতার অভাব। এরা নিজেরা ভালো থাকেনা বলেই কাউকে ভালো থাকতে দিতে চায়না। একটি ব্লগে রীতিমত বলে দেয়া আছে, পাঠকের মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। ঐ ব্লগটিতে সবচেয়ে বেশী নোংরা কথার চাষ হয়। সেখানে নোংরা ভাষা ব্যবহারকারীদের অনেকেই আবার বিদেশী ডিগ্রীপ্রাপ্ত। এইসব ডিগ্রীর নিকুচি করতে ইচ্ছে করে। আবার বিডিনিউজ২৪ এর ব্লগসহ আরও বেশ কিছু প্রগতিশীল ব্লগে পাঠকের মন্তব্য ব্লগ টিম কর্তৃক মডারেটেড হতে দেখি। লেখার সাহস ফিরে পাই।
সংবাদপত্রে সংবাদের জন্য সম্পাদক দায়ী থাকেন। অনেক খবর নাকি সেন্সরড হয়েই পত্রিকাতে ছাপা হয়। তারপরেও মাঝে মাঝেই দেখি সম্পাদক ভুল বা অসত্য সংবাদ পরিবেশিত হলে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে থাকেন। তাই যদি হবে তাহলে পত্রিকার অনলাইন সংস্করনের ব্যাপারে সম্পাদক এমন নির্লিপ্ত কেনো? সব পত্রিকাতে না হলেও খুবই জনপ্রিয় কিছু পত্রিকার অনলাইন পাঠকের মন্তব্য সেন্সর করা উচিৎ বলে মনে করি এবং দাবীও করি। মেয়েরা ঘরে-বাইরে কত রকম বৈপরীত্যের ভেতর দিয়ে মানিয়ে গুনিয়ে চলছে, বাসে, ট্রামে, হাটে বাজারে, মার্কেটে, শপিং মলে কিছু অসাধু পিশাচের হাতের নোংরা স্পর্শে বিচলিত না হয়েও নিজের কাজ করে যাচ্ছে, এতেও পোষাচ্ছেনা ঐসব নপুংসকদের যারা যে কোন একটা উছিলা পেলেই মেয়ে নামের অতি নিরীহ প্রাণীটিকে লেখনীর মাধ্যমেই বলাৎকার করে চলেছে। আর অনলাইনের বদৌলতে সেইসকল মন্তব্য ছেলে বুড়ো, মা-কন্যা, বাপ-বেটা সকলেই পড়ছে। এখানেই লজ্জা বা অস্বস্তির কথা। তাই মনে হয় সবটুকু না পারলেও সম্পাদক সাহেব পাঠকের মতামত মনিটর করার জন্য একটা স্থায়ী ব্যবস্থা নিতে পারেন! এতে করে দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্য কমলে কমতেও পারে, মা-বোনেরাও একটু সস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে।

Tuesday, May 15, 2012

সেদিনের সেই ‘রোগাভোগা’ ‘ফাঁকীবাজ’ ছোট্ট মিশা!



দুই সপ্তাহ আগেই মিশা আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল যে ও কলেজের ২০১২ সালের ‘ হল অব ফেম’ এওয়ার্ড পেয়েছে। আমি সাথে সাথেই জানতে চাইলাম ‘হল অব ফেম’ এওয়ার্ডের গুরুত্ব। হাসতে হাসতে ফোনের মাধ্যমেই মিশা আমাকে বলেছে যে এই এওয়ার্ডটাই হচ্ছে চার বছরের কলেজ জীবনের সামগ্রিক মূল্যায়ন। মোট চারজনকে দেয়া হয় এই এওয়ার্ড। চার বছরের পরীক্ষার গ্রেড, লীডারশীপনেস, আচার ব্যবহার, নিয়মানুবর্তিতা,  নানারকম সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ, নাচ, গান, থিয়েটারসহ চার বছরের সামগ্রিক কার্যক্রমের মূল্যায়ন শেষে নির্বাচক মডলী সিদ্ধান্ত নিয়ে সেরা চারজন নির্বাচিত করেন। চারজনের ছবি বড় করে প্রিন্ট করে বাঁধাই করে মূল বিল্ডিং এর ভেতরের দেয়ালে টানিয়ে দেয়া হয়। ওর কাছে এমনটা জানতে চাওয়ার কারন আছে। গত মাসে আমার বড় মেয়ে মৌটুসী ডাক্তারী পাশ করার সাথে সাথেই আমি মৌটুসীর ছোটবেলা থেকে শুরু করে বড়বেলা পর্যন্ত যত ঘটনা আমার স্মৃতিতে ছিল, তা নিয়ে লিখে ব্লগে পোস্ট করে দিয়েছিলাম। মিশা সেগুলো দেখেছে আর আমার কাছে জানতে চেয়েছে ওকে নিয়ে কিছু লিখবো কিনা। আমি বলেছিলাম, যখন সময় হবে তখন দেখা যাবে। মিশার সাথে আমার সম্পর্ক যতখানি মা- মেয়ের, তার চেয়েও বেশী বন্ধুর সম্পর্ক। আমার তিনটি মেয়ে। তিন মেয়ের সাথেই আমার খুবই ভালো সম্পর্ক। তবে মিশার সাথে সম্পর্কটা টক ঝাল মিষ্টি টাইপ। মিশা এই আমাকে ভালোবেসে একেবারে দিওয়ানা হয়ে যাচ্ছে, আবার পরক্ষনেই হয়তোবা আমার উপর রেগে মেগে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই মিশা এরকম।


মিশা জন্মের পর থেকেই অসুস্থ থাকত।। প্রথম তিন মাস কিছুই বুঝতে পারিনি, কিনতু তিনমাস না যেতেই ওর কানের ইনফেকশান হয়, এবং সেই থেকে বিরতিহীন ভাবে একটার পর একটা অসুখ ওর লেগেই থাকতো। টাইফয়েড, হাম, চিকেন পক্স, স্কিনে ইনফেকশান, স্টমাকে ইনফেকশান ছাড়াও প্রতি প্নের দিন পর পর ঠান্ডা লেগে কেমন যেনো এজমার মত শ্বাসকষ্ট হতো। এক দেড় বছরের বাচ্চা ছিল সে, ডাক্তারের দেওয়া ‘এন্টিবায়োটিক’ খেতে খেতে একসময় সকল এন্টিবায়োটিকও ওর ছোট্টদেহে আর কাজ করতোনা। ওর যখন দুই বছর বয়স, তখনই ‘নেফ্রোটিক সিনড্রোম নামে কিডনীর অসুখ হয়। নেফ্রাইটিস যখন হয়েছিল, ওর ছোট্ট শরীরে প্রচুর পানি জমে গেছিল। কি ভারী হয়ে গেছিল মিশা! মিশা খুব বেশী কথা বলতে শিখেনি তখনও, যা কিছু প্রয়োজন সব ইশারাতে বলতো। ও ওর শারীরিক কষ্টের কথা বুঝিয়ে বলতে পারতোনা। আসলে রোগে শোকে মেয়েটার শরীরের ভেতরটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছিল। তাৎক্ষণিক চিকিৎসায় ওকে অনেকগুলো ইঞ্জেকশান (নাম জানিনা) দেওয়া হয়েছিল। স্টেরয়েড ট্যাবলেট ‘প্রেডনিসোলন’ দেয়া হয়েছিল। প্রেডনিসোলন হচ্ছে ‘বিষতিতা’ এক ওষুধ। সেই বিষাতিতা ওষুধ একসাথে ছয়টি খেতে দেয়া হতো ওকে। আমি ট্যাবলেটগুলোকে গুঁড়ো করে মধুর সাথে মিশিয়ে ওকে কোনরকমে খাওয়াতাম। প্রতিটি কাজ আমাকে করতে হয়েছিল। কারন মিশার বাবা মেয়েদের কষ্ট সহ্য করতে পারতোনা। সারাক্ষন মেয়েদের পাশে থাকলেও মেয়েদের কষ্টের মুহূর্তগুলোতে একটু আড়ালে থাকতেন।

যত রকমের অপ্রিয় কাজগুলো আমাকে করতে হতো বলেই মনে হয় ছোট্ট মিশা আমাকে দেখলেই একটু ভয় পেতো। স্বাভাবিকভাবেই বাবার প্রতি ওর টান বেড়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি। ছোট্ট মিশাকে যখন ইঞ্জেকশানের সুঁচ ফোটানো হতো, আমি ওকে ধরে রাখতাম ঠিকই, কিনতু আমার মনে হতো সূঁচগুলো বুঝি আমার বুকে গিয়ে বিঁধছে। কান্নায় ক্লান্ত মেয়েটাকে বুকে চেপে ধরে কান্না থামাতাম। আমার বুকে থেকে যে উষ্ণ পরশ ও পেয়েছে, সেই থেকেই মনে হয় আমার জন্য নিজের অন্তরেও একটু উষ্ণতা টের পায়। মিশার চার বছর বয়স পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশে ছিলাম। সেই চার বছরের পুরোটা সময় মিশাকে নিয়ে আমাদের কষ্টের সীমা ছিলনা। এরপরেই আমরা অস্ট্রেলিয়া চলে যাই। অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে মিশা সুস্থ হতে শুরু করে। অস্ট্রেলিয়াতে তিন বছর থেকে আবার যখন দেশে ফিরে আসি, তখন মিশা অনেক বড় হয়ে গেছে। সাত বছর বয়সী ঝলমলে মিশা। যখন মুড ভালো থাকে তখন মিশা খুব ভালো, কিনতু মুড খারাপ হলেই আমার উপর রেগে আগুন। তার বাবাকে ডেকে ডেকে বলতো, “ ও বাবাগো, এই মহিলাটাকে তুমি বিয়ে করলে কেন গো? হায়রে কপাল, এই মহিলা কেনো আমার মা হলো?” মিশার সেই ডায়ালগগুলো এখনও আমার কানে লেগে আছে।

আমার উপর মিশার রাগ হওয়ার আরেকটি কারন হচ্ছে আমি পড়ালেখা নিয়ে কথা বলতাম। মিশা খুব বুদ্ধিমতী ছিল, বই পড়ার চেয়েও ওর অনেক বেশী মনোযোগ ছিল এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটির প্রতি। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়তো, প্রায়ই হোমওয়ার্ক মিস করার জন্য শাস্তি পেত। প্রথম দশ জনের মধ্যে নাম থাকলেও প্রথম বা দ্বিতীয় স্থাণ পেতোনা। আমরা কিছুই বলতামনা। ওর খুশীর উপর সব ছেড়ে দিয়েছিলাম। এত চঞ্চলতার পরেও স্কুলের প্রতিটি টিচার ওকে অনেক ভালোবাসতো। টিচারের ভালোবাসা ও অস্ট্রেলিয়াতেও পেতো, সেই ধারা এখনও ও বজায় রেখেছে। বাংলাদেশে থাকতেই স্কুলের পরীক্ষার কোন একটা পেপারে খারাপ নাম্বার পেয়ে আমাদের কাছে আর নিয়ে আসেনি খাতা। নিজে নিজে বাবার সাইন নকল করে জমা দিয়েছিল। অনেক পরে ওর কাছ থেকেই আমরা তা জেনেছি। ও আগে কেনো আমাদের জানায়নি তা জানিনা। আমরা ওদের গায়ে হাত তুলতামনা, বিশেষ করে মিশাকে পিটাইনি। তারপরেও মনে হয় মিশার ভেতরে ভেতরে খুব লজ্জা লেগেছিল কম নাম্বার পেয়ে।

মিশা আমেরিকাতে এসেও স্কুলে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথেই টিচারদের নেক নজরে পড়ে গেছে প্রথম থেকেই। আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, মিশা ঘরে আমার সাথে যতই জেদ করতো না কেন, ঘরের বাইরে পা দেয়ার সাথে সাথেই ও অন্য মানুষ। বাংলাদেশে থাকতেই সব বাড়ীর কাজের মেয়ে বা কাজের বুয়াদের সাথে মিশার খাতির দেখলে যে কেউ অবাক হয়ে যেত। ওর মন খুব বেশী নরম। বড়লোকের বাচ্চাদের সাথে খেলতেও যেমন ওর জুড়ি ছিলনা, কাজের মেয়েদের সাথে গলাগলি করতেও ওর জুড়ি ছিলনা। মিশা সেই তিন বছর বয়সের সময় ঘরের জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বস্তির ছেলেমেয়েদেরকে ডেকে ডেকে গ্লাস, বাটি, পুতুল, খেলনা দিয়ে দিত। যার সব ভালো, তাকে পড়ার কথা বললেই মাথায় বাজ পড়তো। আর এই একটা জায়গাতে এসেই সে আমাকে তার শত্রু মনে করতো। মিশার ধারণা ছিল, আমি বুঝি ওর দিদিসোনাকেই ভালোবাসি, ওকে বাসিনা। কিনতু এত ছোট বয়সে ওকে বুঝাই কেমন করে, মায়ের ভালোবাসা কারো প্রতিই কম বেশী হয়না। আমি মাঝে মাঝে অনেক কষ্টও পেতাম মনে, যখন মেয়েটা তারস্বরে চেঁচাত আর বলতো, হায়রে! এই মহিলাটা কেন আমার মা হলোরে! এখন অবশ্য হাসি পায়।

ওর যখন চৌদ্দ বছর বয়স, আমরা ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ছেড়ে চলে আসি মিসিসিপিতে। ততদিনে আমাদের বড়মেয়ে মৌটুসী খুবই ভালো রেজাল্ট করে কলেজে ভর্তি হয়েছে ফুল স্কলারশীপ পেয়ে। টিন এজের মিশা মনে হয় এতে করে একটু বিপর্যস্ত বোধ করতে থাকে। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে মিশার বন্ধুর সংখ্যা ছিল অগুনতি। সবাইকে ছেড়ে মিসিসিপিতে চলে আসতে ওর মনে হয় পাঁজরে গিয়ে ব্যথাটা লেগেছে। মিসিসিপিতে এসে মিশা এখানের পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয়েছে। স্কুলে যায়-আসে, মুখে হাসি নেই, আনন্দ নেই। পড়ালেখাতে ফাঁকী দিলেও মিশা ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে থাকতে কত যে স্পীচ কম্পিটিশান, সোশ্যাল স্টাডিজ ফেয়ারে অংশগ্রহন করেছে এবং সবগুলোতে ফার্স্ট হয়ে এসেছে। পত্রিকাতে ওদের দুই বোনের ছবিও উঠেছে। একবার স্কুলের ফুটবল খেলার সময় স্টেডিয়ামে এককভাবে আমেরিকার জাতীয় সংগীত গাওয়ার মত বিরল সৌভাগ্য ওর হয়েছে।

সেই মিশা মিসিসিপিতে এসে পনের’শ ছাত্রছাত্রীর সাথে গায়ে গা লাগিয়ে স্কুলে পড়তে গিয়ে কেঁদেকেটে অস্থির হয়েছে। একদিন বাবার কাছে কাঁদতে কাঁদতেই বলছিল ওকে যেনো ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে দুইটা দিনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায়ই স্কুল থেকে বাড়ী ফিরেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিত। ডাকলেও সাড়া দিতনা। আমি যে কি ভয় পেতাম। একদিন ও যখন স্কুলে ছিল, ওয়ার্ড্রোবের উপর একটা বড় সাদা কাগজ পেয়ে খুলে দেখি, মেয়ে ঈশ্বরের কাছে ওর জীবনের কষ্ট জানিয়ে চিঠি লিখেছে। এক জায়গাতে লিখেছে বন্ধুদের জন্য এতো বেশী মন খারাপ যে এই জীবন আর রাখতে চায়না। তাই প্রায়ই সে বালিশ চাপা দিয়ে দম বন্ধ হয়ে মরে যাওয়ার প্র্যাকটিস করে। এই পর্যন্ত পড়ে আমার মাথা ঘুরাতে শুরু করে। ওর বাবা বাড়ী ফিরলে ওর বাবাকে বললাম কথাগুলো। একদিন ওর বাবা ওকে সুন্দর করে অনেকক্ষণ বুঝিয়েছে। বাবা বুঝালে সব ঠিক, মা বুঝালে সব বেঠিক যে মেয়ের কাছে, তাকেতো বাবার বুঝাতে হবেই। আমি একদিন মিশাকে বলেছিলাম, “ তোমার কাছে কিচ্ছু চাইনা, তুমি যদি মিসিসিপির ম্যাথস এন্ড সায়েন্স স্কুলে চান্স পাও, ভবিষ্যতে আমি কোনদিন তোমাকে পড়ার কথা বলবোনা”। মিসিসিপির ম্যাথস এন্ড সায়েন্স স্কুল প্রোগ্রাম হচ্ছে ইলেভেন এন্ড টুয়েলভ গ্রেডের জন্য। সারা মিসিসিপির বেস্ট ছেলেমেয়েদের ইন্টারভিঊ করে তবেই ১১০ জনকে নেওয়া হয়। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম মিশা চান্স পাবেনা। কারন ওর এসিটি টেস্ট স্কোর খুবই কম ছিল। মিশা লিখিত পরীক্ষাতে পাশ করে মৌখিক পরীক্ষার ডাক পেয়েছে, এতেই আমরা খুশী ছিলাম। যেদিন মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে এসে বাড়ীতে ফিরে খুব কনফিডেন্টলি বললো, যে ভাইভা ভালো হয়েছে, তখন থেকেই বুকে আশা জাগতে লাগলো। কারন আমরা জানি মিশা কথা বলতে পারে খুব ভালো। স্পীচ কম্পিটিশানে প্রথম হওয়া মেয়ে ও। রেজাল্ট বের হলে দেখা গেলো মিশার অবস্থান প্রথম দশ জনের মধ্যে।

আমি চেয়েছিলাম মিশা মিসিসিপি স্কুল ফর ম্যাথস এন্ড সায়েন্স ( স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন) এ চান্স পাক, কারন আমি জানতাম এই স্কুলের এত ভাল পরিবেশে থাকলে মিশাকে নিয়ে আর ভাবতে হবেনা। আমার ধারনা সত্যি হয়েছে। এরপরে সেই মিশাকে নিয়ে আর ভাবতে হয়নি আগের মত। তবে একটা সমস্যা হচ্ছে, মিশার একদমই আত্মবিশ্বাস নেই। ও শুধু কাজ করে যায়, কাজের স্বীকৃতি পেলে ও সারা মুখে লজ্জা এনে এমন এক ভাব করে যে অন্যদের মনে হবে কোথাও কোন ভুল হয়েছে নিশ্চয়ই। এই স্কুলেও টুয়েলভ গ্রেডে ও আমাদেরকে না জানিয়ে ‘বিল গেটস’ স্কলারশীপের জন্য এপ্লাই করেছিল। দশটি এসে লিখতে হয়েছে নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর, স্কুলের পরিক্ষার গ্রেড, টিচারদের রিকমেন্ডেশান লেটারসহ আরও যাবতীয় আনুষঙ্গিক কাগজপত্রসহ এপ্লাই করার পরে দেখা গেলো সারা আমেরিকাতে এক হাজার জন নন আমেরিকান ছেলেমেয়ে এই স্কলারশীপ পেয়েছে, তাদের মধ্যে আমাদের মিশা একজন। এটা এমনই এক স্কলারশীপ, যা কিনা ও সারাজীবন মানে পিএইচডি করা পর্যন্ত পেয়ে যাবে। একই সময়ে মিশা লোকাল টিভি কেন্দ্র থেকে পরিচালিত আরেকটি এসে কম্পিটিশানে ফার্স্ট হয়ে এক হাজার ডলারের চেক, টিভিতে সাক্ষাৎকার দেয়ার সুযোগ পেয়েছে। শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালে ঐ স্কুল থেকেই একশ পঞ্চাশ জন স্টুডেন্ট এর মধ্যে যে সাতজন স্টুডেন্ট ‘আউটস্ট্যান্ডিং’ রেজাল্ট করেছে, মিশা তাদের মধ্যে একজন।

মিসিসিপির প্রাইভেট কলেজ মিলস্যাপস কলেজে ওর নিজের ইচ্ছেয় ভর্তি হয়েছে। স্কলারশীপ পেয়েছে বিল গেটস ফাউন্ডেশান থেকে। চার বছরে ও এমন পরিচিতি লাভ করেছে কলেজে যা কিনা কেউ ধারনাও করতে পারবেনা। ঐ কলেজে বছরে একটাই কালচার‌্যাল প্রোগ্রাম হয়। মিশা প্রতিবার একঘন্টার পুরো কালচার‌্যাল অনুষ্ঠান তৈরী করা থেকে শুরু করে আমেরিকান ছেলেমেয়েদেরকে দিয়েই অনুষ্ঠানটি শেষ করেছে খুবই সফলভাবে। মিশার নাচের ভঙ্গীতে ছবি বেশ কয়েকবার নানা পত্রিকাতে ছাপা হয়েছে। আমার মিশা খুব ছোট থাকতেই টিভিতে হিন্দি গান দেখে দেখে হুবহু নায়িকাদের মত নাচ করতো। অস্ট্রেলিয়াতে থাকতে যে কোন অনুষ্ঠানে মিশার নাচ থাকতই। মিশা কোনদিন কোথাও নাচ শিখেনি, তারপরেও মিশা এমন ভাল নাচ করে যে কেউ বুঝতেই পারেনা এই মেয়ের নাচের উপর কোন শিক্ষা নেই। মিশার বাবার ছবি আঁকার হাত ছিল। আমার বড় মেয়ের ছবি আঁকার হাত ঈর্ষণীয় পর্যায়ের ভালো। আমি খুব গর্ব করতাম মৌটুসীর আর্ট নিয়ে। মিশা মনে মনে খুব রাগ হতো মনে হয় আমার আদিখ্যেতা দেখে। টুয়েলভ ক্লাসে একটা কোর্স নিয়েছিল আর্টের উপর। সেই বছর ও যে কয়টা আর্ট করেছে তার মধ্যে পাঁচটা আর্ট নানা কম্পিটিশানে ফার্স্ট হয়েছে। এরপরে মিশা আর্ট বাদ দিয়ে দিয়েছে। সে শুধু নিজেকে একবার যাচাই করে দেখতে চেয়েছিল আর্ট পারে কিনা। মিশার বাবার ফটোগ্রাফীতে হাত পাকা ছিল। মিশা এটা পেয়েছে। ওর ফটোগ্রাফী পর পর দুই বছর পুরস্কার পেয়েছে। গতবছর মিসিসিপিতেই ফটোগ্রাফীর অনলাইন কম্পিটিশান ছিল। একটাই ‘বেস্ট’ পুরস্কার ছিল। ১৫৯টি ফটোগ্রাফীর মধ্যে যেটি বেস্ট হয়েছে সেটি আমার মিশার তোলা। ‘আইপ্যাড’ পেয়েছে পুরস্কার হিসেবে।

গতবছর আমার এই মেয়ের গাড়ীকে ধাক্কা মেরেছিল আরেক গাড়ী। আমার মেয়েটার গাড়ী একেবারে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে, ঈশ্বর আমাদের মেয়েটিকে প্রানে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। এই একটা বিরাট দূর্ঘটনার পরে আমরা স্বামী স্ত্রী খুব বেশী হতভম্ব হয়ে গেছি। আমি এরপর থেকে কেমন যেনো হয়ে গেছি। শুধু ভাবি আমাদের মেয়েগুলো বেঁচে থাক। আমি আর রেজাল্ট নিয়ে ভাবিনা। আমার মিশার বয়স এখন ২১ বছর। এর মধ্যে কি ওর জীবনে বসন্ত আসেনি? হয়ত এসেছিল। হয়তো আমার মেয়ের মনে দুঃখ দিয়ে পাখী উড়ে গেছে। আমার মেয়েটার খুব খারাপ সময় গেছে কয়েকটা মাস। মেয়েকে অনেক কাঁদতে দেখেছি। আমার মিশা আমার সাথে খুব ফ্রি। ওর মনের কষ্টগুলো আমাকে ও বলে, যখন মনের ভেতর আর চেপে রাখতে পারেনা। আমি মা হিসেবে কেমন জানিনা, কিনতু আমি মেয়েদের দুঃসময়ে বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দেই। তখন মায়ের চোখ রাঙ্গানি বন্ধ থাকে। আমার মেয়েরা আমাকে খুব ভালো বুঝে। যাই হোক আমার মেয়ের সেই দুঃসময় কেটে গেছে সময়ের সাথে সাথে। ওর জীবনে অনেক ভালো ভালো বন্ধুরা এসে জুটে যায়। আবার কিছু ধুর্ত ছেলেমেয়েরাও জুটে। সবই আছে।

সেদিন মিশা দুঃখ করে বলেছে, “ মা, জানো আমি নিজেও জানতামনা এতবড় পুরস্কার পাব। এটা হচ্ছে সিক্রেট এওয়ার্ড। সবার বাবা মা এসেছে তোমরা ছাড়া। তোমাদের দেখিনি বলে আমিও বুঝেছি আমি এটা পাইনি। কিনতু আমার নাম ধরে ডাকতেই এত মানুষের সামনে আমি থতমত খেয়ে গেছিলাম”। মেয়ের মুখ থেকে এমন কথা শুনে মনটা খুব খারাপ হয়েছে। ওর গ্র্যাজুয়েশান অনুষ্ঠানে গেছি। আগের দিনই দুপুরে যাওয়ার কথা ছিল। কিনতু এদিকে আমাদের ছোট মেয়ে মিথীলার একটা প্রোগ্রাম ছিল। সেটা বাদ দিয়ে যেতে পারলামনা। কিনতু আমার খুব ইচ্ছে করছিলো মিশার প্রোগ্রামে থাকতে। রাত নয়টার সময় একটা ককটেল পার্টি ছিল। ডিজে পার্টি। গিয়ে দেখি সবাই নাচছে। বাবা মা, বন্ধু বান্ধবী সবাই। আমার মিশা আমার হাত ধরে নিয়ে গেল ফ্লোরে। আমি যত বলি আমি নাচ করতে পারিনা মেয়ে তত বলে ওকে ফলো করার জন্য। কানের কাছে মুখ এনে বলে রাইট, এবার লেফট, হাত উঁচু করো, কোমড় একটু দোলাও। আমিও মেয়ের সাথে সাথে আনন্দের সাথেই নাচলাম। মেয়ে নিজের স্কলারশীপের পয়সায় বাবা মা-কে থাই রেস্টুরেন্টে ডিনার করালো। পরের দিন মেয়ে গ্র্যাজুয়েশান করে ফেললো।

মিশার জার্নি এখানেই শেষ হয়নি। মিশার স্বপ্ন ছিল এমরি ইউনিভার্সিটিতে ‘পাবলিক হেলথ’ এর উপর মাস্টার্স এন্ড পিএইচডি করার। ওর কলেজের ডীন রিকমেন্ডেশান লেটার পাঠিয়েছে। সেই লেটারের কপি মিশা আমাকে মেইল করেছে। লেটারটি পড়ে আমি অনেকক্ষন কেঁদেছি। সাফল্যের কান্না। আমরা দেশে ছিলাম রাজার হালে। আমেরিকাতে জীবন সংগ্রাম করে চলেছি। মেয়েগুলো এখনও একশতভাগ সৎ আছে। তিনজনেই তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের এর বেশী কিছু চাওয়ার ছিলনা। যে মেয়েটির বাঁচার কথা ছিলনা, ছোটবেলাতেই কি ভয়ংকর সব অসুখ হয়েছিল, মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়ার যোগাড় হয়েছিল, সেই মেয়ে ভয়াবহ গাড়ী দূর্ঘটনায় পড়ে প্রাণে বেঁচেছে, সেই মেয়েটা আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে, ঈশ্বরতো ওর দিকে তাকাবেনই। ও এমরিতে চান্স পাবেনা তো কে পাবে! আমার মেয়েটি যে কয়টা ভালো ভালো ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করেছিল, সবগুলো থেকেই একসেপট্যান্স লেটার এসেছে। কিনতু মিশা যাবে ওর স্বপ্নের 'এমরী'তে।

Monday, May 14, 2012

‘মা' দিবস'-এর দিনটি হোক সকল মায়ের জন্য


১৩ই মে, রবিবার বিশ্বের অধিকাংশ দেশে মহা ধুমধাম করে মা দিবস বা মাদারস ডে উদযাপিত হচ্ছ্বে। সাধারণতঃ মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারটিতে মাদারস ডে পালিত হয়ে থাকে। যদিও কিছু কিছু দেশে তাদের রীতি অনুযায়ী বিভিন্ন দিনেও মাদারস ডে পালিত হয়ে ্থাকে। তবে মহাপরাক্রমশালী আমেরিকাতে যেহেতু মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মাদারস ডে পালিত হয়, তাই এর সাথে তাল রেখে অধিকাংশ দেখেই একই দিনে মাদারস ডে উদযাপিত হয়।

মাদার ডে কখন শুরু হয়েছিল, কোথা থেকেই বা শুরু হয়েছিল তা নিয়ে নানা ধরনের গল্প প্রচলিত আছে। যেমন প্রাচীনকাল থেকেই কোন কোন দেশে ধর্মীয়ভাবেই একটি নির্দিষ্ট দিনে মাকে শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জানানোর রীতি ছিল। মাতৃত্ব, সন্তানের সাথে নাড়ীর বন্ধন, মমতা- স্নেহ-ভালোবাসার ক্ষমতা মাকে দেবীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। প্রাচীনকালে মাকে নিয়ে গ্রীক উৎসব সাইবেল (Cybele,) ,   রোমান উৎসব হিলারিয়া, ব্রিটিশ উৎসব মাদারিং সানডে ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যের সাথে উদযাপিত হতো। ধারনা করা হয়, বর্তমান সময়ে মাদারস ডে দিবসটি প্রাচীনকালের মা উৎসবের আধুনিক সংস্করন।

আমাদের দেশে আগে মা দিবস বা বাবা দিবস বলে কোন উৎসবের প্রচলন ছিলনা। কোন দিবস উদযাপন না করেই মা কে নিয়ে মুনী ঋষি থেকে শুরু করে দরবেশ, পীর, ফকির, সুফী, সাধক, আউলিয়া, কবি, লেখক, গীতিকার, সুরকারসহ অনেকেই বহু যুগ ধরেই নানাভাবে মাতৃবন্দনা করে গেছেন, কত গান, কবিতা রচনা করে গেছেন। কিনতু আলাদা করে মা দিবস উদযাপনের কোন রীতি ছিলনা আমাদের সংস্কৃতিতে। কালের পরিক্রমায় আমাদের দেশেও পাশ্চাত্যের ছোঁয়া লেগেছে। উন্নত বিশ্বের আধুনিক সভ্যতার অনেক কিছুই আমাদেরকে প্রভাবিত করছে। তার মধ্যে মা দিবস, বাবা দিবস, বা ভালোবাসা দিবসের মতো নান্দনিক ব্যাপারগুলোও আছে।

পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে মা দিবস বা বাবা দিবস মহা ধুমধামের সাথে পালিত হয়। আমেরিকার মত বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটিতেও মা দিবসে প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে নামগোত্রহীন ছেলেটিও মায়ের জন্য দিনটিকে তুলে রাখে। পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ত মানুষ থেকে শুরু করে পরিবারের নির্দয়, উদাসীন মানুষটি পর্যন্ত মায়ের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। যে সন্তান কোনদিন নিজে হাতে রাঁধেনি, সেও চেষ্টা করে মায়ের জন্য স্পেশ্যাল কিছু রান্না করতে। প্রতিদিনের খরচ থেকে কিছু বাঁচিয়ে রাখে বছরের এই দিনটিতে মাকে ভাল কিছু উপহার কিনে দেয়ার জন্য। যে মা মুভী দেখতে ভালোবাসে তাকে মুভী থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া, বাইরে দামী রেস্টুরেন্টে নিয়ে আপ্যায়ন করা, মায়ের পছন্দের ড্রেস, পারফিউউম কিনে দেওয়া থেকে শুরু করে আরও কত কি যে করে থাকে মায়েদের জন্য তার কোন ইয়ত্তা নেই। কার্ড, গোলাপের দামী তোড়া, কেক নিয়ে ছেলেমেয়েরা ভোর সকালেই এসে হাজির হয় মায়ের কাছে। এমনকি ওল্ডহোমে থাকা মায়ের জন্যও দিনটি হয়ে উঠে স্বর্গীয় আনন্দে ভরপুর।

আমেরিকায় মাদারস ডে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে ১৯৩৪ সালে। ১৮৬৮ সালে এনা জার্ভিস নামের এক মা প্রথম উদ্যোগটি নিয়েছিলেন। যে সকল মায়েদের সন্তানেরা আমেরিকান সিভিল ওয়্যার এ অংশগ্রহণ করেছিল এবং যারা শহীদ হয়েছিল, সেই সকল মাকে একসাথে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন এনা জার্ভিস। বছরের একটি দিনকে মাদারস ফ্রেন্ডশীপ ডে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার বাসনায় মিস জার্ভিস এই উদ্যোগটি নিয়েছিলেন। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া রাজ্যের একটি সানডে স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন উনি। উনার এই উদ্যোগের পরে আরও অনেকেই চেষ্টা করেছে উদ্যোগটিকে সামনে এগিয়ে নিতে। কিনতু তেমনভাবে কেউ সফল হতে পারেনি। ১৯০৫ সালে এনা জার্ভিসের মৃত্যুর পরে উনার অসমাপ্ত কাজ চালিয়ে নিয়ে যায় তাঁর মেয়ে আনা জার্ভিস। নারী শান্তি সংগঠনের সাহায্যে আনা জার্ভিস ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার সেই সানডে স্কুলেই তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯০৪ সালে  একটি সংগঠনের প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্ক ই হেরিং সর্বপ্রথম মাদার্স ডে কে সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা করার জন্য প্রথম আবেদন করেন। ১৯০৮ সালে আনা জার্ভিস মায়ের সেই সানডে স্কুলে সীমিত পরিসরে প্রথম মাদার্স ডে উদযাপন করেন। তাছাড়া একটানা আবেদন নিবেদনের ধারাতেই ১৯১০ সালে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া রাজ্য সরকার মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারটিকে মাদার্স ডে হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

১৯১৪ সালের ৯ই মে তারিখে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উডরো উইলসন প্রথমবারের মত মাদার্স ডে কে জাতীয়ভাবে পালনের আবেদনে সম্মতি প্রদান করেন। জাতীয়ভাবে মাদার্স ডে পালন করার স্বীকৃতি পাওয়া যায় ১৯৩৪ সালে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট মাদার্স ডে দিনটিকে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার সারা আমেরিকায় মহা উৎসাহে মা দিবস পালন করা হয়। মহা সমারোহে উদযাপনের প্রক্রিয়াটি তরান্বিত করতে আমেরিকার বানিজ্যালয়গুলো সারা বছরই মুখিয়ে থাকে। মাকে নিয়ে কত ধরনের নিত্য নতুন, অভিনব সব সামগ্রীর ডালা সাজিয়ে এরা নিয়ে আসে আমেরিকানদের সামনে। ভালো না লেগে উপায় কি! আমেরিকাতে মা কে মা হিসেবেই দেখা হয়। সব মাকে একই হ=কায়দায় সম্মান করা হয়। কত সুন্দর সুন্দর বাণী দিয়ে কার্ড তৈরী করা হয়। সন্তানের হাত থেকে কার্ডটি পেয়ে মায়ের চোখ আবেগে ভাসে। একটি দিন শুধুই আমার এই ভাবনায় প্রতিটি মা আচ্ছন্ন হয়ে থাকে।

আমাদের দেশেও গত কয়েক বছর ধরেই মহা উৎসাহে মা দিবস পালিত হয়ে থাকে। মা শব্দটি খুব ছোট্ট হলেও এই শব্দ উচ্চারণে এক স্বর্গীয় শান্তি পাওয়া যায়। যার যার মা তার তার কাছে দেবীতুল্য। বাংলাদেশে ঘটা করে রত্নগর্ভা উপাধী দেয়া হয় নামী দামী ব্যক্তিবর্গের মাকে। এই উপাধী দিয়ে গুটিকয়েক মাকে সকল মা থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। কিনতু মায়ের মাতৃত্বতো আলাদা করার বিষয় নয়। রত্নগর্ভা মায়েরা যে মমতায় সন্তানকে মানুষ করেছেন, অরত্নগর্ভা মায়েরাও একই মমতায় সন্তান বড় করেছেন। রত্নগর্ভা মায়েদের গর্ভের ভেতরটা অরত্নগর্ভা মায়েদের গর্ভের মতই একই অর্গ্যান দিয়ে সাজানো থাকে। কারো গর্ভের ভেতর রত্ন বানানোর মেশিন থাকেনা। সন্তান ভুমিষ্ঠ হওয়ার পরে ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে টের পাওয়া যায় কে রত্ন হবে আর কে অরত্ন হবে। ছেলেমেয়ে মানুষের মত মানুষ করতে গেলে মায়েদের সাথে সাথে পরিবারের বা সমাজের আরও অনেকের সাপোর্ট দরকার হয়। তবেই রত্ন তৈরী হয়। শুধুমাত্র একা মায়ের পক্ষে তার সন্তানকে রত্ন তৈরী করা কঠিন বা অসম্ভব। সমাজের সহযোগীতা পেলে অনেক দীন দুঃখীর ছেলেমেয়েও জীবনে আলোর মুখ দেখে। সহযোগীতা পেলে ঘুঁটেকুড়াণীর ছেলেমেয়েও রত্ন হতে পারে বৈকী! কিনতু মাতৃত্ব একক, মাতৃত্ব অতুলনীয়, মাতৃত্ব আলাদা করা যায়না।

আসলে মায়ের কোন ক্যাটাগরী থাকতে পারেনা। মা হচ্ছে মা। মায়ের কাছে সন্তান নিরাপদ, মায়ের কাছে সন্তানই সব। কথায় বলে সন্তান কু হতে পারে কিনতু কুমাতা কখনও হয়না। সব মা চায় তার একটি সুস্থ সন্তান হোক। তারপরেও নানা কারণে ইদানিং প্রতিবন্ধী শিশু জন্মের হার বেড়ে যাচ্ছে। সেই সকল প্রতিবন্ধী শিশুদের মায়েদের কথা স্মরণ করলেই বিনম্র শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে, যারা কারো বিরুদ্ধে কোন নালিশ না করে পরম মমতায় নিজের বক্ষের উষ্ণতায় রেখে অসহায় প্রতিবন্ধী শিশুটিকে সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাঁচিয়ে রেখেছে। এই হচ্ছে মা। এই হচ্ছে মাতৃত্ব। একে কি করে রত্নগর্ভা অরত্নগর্ভা বলে ক্যাটাগরাইজড করা যায়! প্রধানমন্ত্রীর মায়েরা যে স্নেহে তাঁদের সন্তানদের বড় করেছেন, রাস্তার দীন ভিখারী মাটিও একই মমতায় তার নাড়ীছেঁড়া ধনটিকে বড় করে থাকে। নিজের পেটে খাবার নেই, স্তনে দুধের ছিঁটে ফোঁটাও থাকেনা, তবু দীন দুঃখীনি মা তার আদরের মানিককে সেই শুকিয়ে যাওয়া স্তনের মধ্যেই চেপে ধরে রাখে পরম মমতায়। একেই বলে মাতৃত্ব। এই মাতৃত্বকে বড়লোকী কায়দায় ক্যাটাগরাইজড করে মাতৃত্বের মহিমাকে ছোটই করা হয়। তার চেয়ে ভালো লাগবে সকল মা যদি বছরের একটি দিন অন্তঃত শুধু মা হওয়ার গৌরবে গৌরবান্বিত হতে পারে। বছরের এই একটি দিন হোক সকল মায়ের জন্য।
পৃথিবীর সকল মাকে মা দিবসের শুভেচ্ছা!!

Thursday, May 10, 2012

‘মাদার’স ডে শুধুই মায়েদের জন্য, কিনতু ওরা মা নয়!!



আগে প্রচলন ছিলনা, কিনতু বেশ কিছু বছর ধরেই বাংলাদেশে ‘মাদার’স ডে মহা ধুমধামের সাথে পালিত হয়ে থাকে। কোন একটি কোম্পাণী থেকে ‘রত্নগর্ভা’ পদক প্রদান করা হয়ে থাকে দেশে প্রতিষ্ঠিত বা পরিচিত ব্যক্তিদের মায়েদেরকে। ভালো খুবই ভালো, এমন উদ্যোগকে নিজে একজন মা হিসেবে একটা সালাম দিতেই হয়। তবে রত্নগর্ভা শব্দটি নিয়ে মনে একটু খটকা থেকেই যায়। ‘গর্ভে’ থাকতে সব শিশুই একই রকমভাবেই বাড়ে। সব মেয়ের গর্ভের অভ্যন্তর একই কাঠামোতে সাজানো। সেখানে কারোর গর্ভেই আলাদা করে রত্ন তৈরীর মেশিন থাকেনা। বাচ্চা ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে শুরু হতে পারে রত্ন বানানোর প্রক্রিয়া, তার আগেতো নয়। তবে হ্যাঁ, যে মা যত বেশী সচেতন, যে মা যত বেশী বুদ্ধিমতী, জ্ঞাণী, সেই মায়ের সন্তান পরিনত বয়সে রত্নই হয় বটে। কাজেই মা’কে যদি পুরস্কৃত করতেই হয়, তাহলে ‘রত্নগর্ভা’ উপাধীর বদলে ‘মা রত্ন’ অথবা ‘রত্ন মা’ উপাধী দিলেই বেশী যুক্তিযুক্ত মনে হয়।

আমার তিনটি মেয়ে। মেয়ে তিনটি ছোটবেলা থেকেই লক্ষ্মী টাইপ ছিল। এইজন্য আমার পরিচিত সকলেই আমাকে ‘রত্নগর্ভা’ বলে মজা করতো অথবা আদর করেই হয়তো সম্বোধনটি করতো। আমিও শ্বাশ্বত বাঙ্গালী মায়েদের মত একটু তৃপ্তির হাসি হাসতাম। মনে মনে একটু গর্বও বোধ করতাম হয়তো। এর বেশী কিছু ভাববার অবকাশ ছিলনা এবং ভাবতামও না। পরবর্তীতে আমেরিকাতে চলে এসেছি। এরপর আমাকে নিয়ে আর কেউ মজা করার সুযোগ পায়নি। আমেরিকাতে এসে মেয়েগুলো আর দশজন এশিয়ান ছেলেমেয়েদের মত করেই ভালো ফলাফল করতে শুরু করলো স্কুল-কলেজে। আমি আবারও বেশ খুশীমনে দেশে ফোন করে খুব গর্বের সাথে মেয়েদের সাফল্যের কথা বলতে লাগলাম।


আমি জীবনের একটা সময় অস্ট্রেলিয়াতেও ছিলাম তিন বছর। ঐ সময়ে আমার দুই মেয়ে খুব ছোট ছিল, তারা স্কুলে চলে যেতেই আমি একা হয়ে পড়তাম। তাই আমি অড জব করতে শুরু করি। অড জব করার এক পর্যায়ে আমি বিখ্যাত প্রসাধন সামগ্রী ‘ল’রিয়েল’ কোম্পানীর প্যাকেজিং ফ্যাক্টরিতে কাজ করেছি কিছুদিন।  অস্ট্রেলিয়াতে থাকার সময় আমি ছিলাম নিরেট বাঙ্গালী। বিদেশী হালচাল তখনও রপ্ত হয়নি, অথবা ইচ্ছে করেই বিদেশী কালচার শিখতে চাইনি। তাই মাদার’স ডে বা ফাদার’স ডে সম্পর্কেও আমার কোন ধারনা ছিলনা। ল’রিয়েল কোম্পাণীতে কাজ করার সময় মাদার’স ডে উপলক্ষে মায়ের জন্য নানা ধরনের প্রসাধন সামগ্রী দিয়ে ‘গিফট বক্স’ তৈরী করা হচ্ছিল। আমিও সেই প্যাকেজিং টীম এ কাজ করছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম নিজের মায়ের কথা। এক মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, মাদার’স ডে তে আমি কি করবো! আমি প্রশ্নটা শুনে একটু থতমত খেয়ে গিয়ে বলে ফেলেছিলাম, আমদেরতো মাদার’স ডে নেই। যারাই আমার উত্তরটা শুনেছে তাদের প্রত্যেকের মুখে প্রথমে বিস্ময়, পরে কৌতুকের হাসি ছড়িয়ে পড়তেই আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। বুঝেছি উত্তরটা বোকার মত হয়ে গেছে। আমি সাথে সাথে বললাম, “আমাদের দেশে বছরের প্রতিটি দিনই মায়ের জন্য তোলা থাকে। তাই আলাদা করে ‘মাদার’স ডে পালন করা হয়না। ওরা কি বুঝেছিল, কতটুকু বিশ্বাসইবা করেছিল কে জানে। কিনতু সমস্ত বিদেশীদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অমন একটি পরিস্থিতিতে পড়ে আমি এমন উত্তর দিতে পেরে মনে মনে অনেক খুশী হয়েছিলাম।

এরপরে যখন আমেরিকাতে চলে আসি ততদিনে পাশ্চাত্যের অনেক কৃষ্টির সাথে কিছুটা হলেও পরিচিতি হয়েছে। আমেরিকাতে মাদার’স ডে বা ফাদার’স ডে অনেক ঘটা করে পালিত হয়। পরিনত বয়সে এসেই বুঝতে পারলাম পাশ্চাত্যে ‘মা’ কে মায়ের সম্মান দেয়া হয়। মা’টি কুমারী মা নাকি বিবাহিতা মা তা বিচার করা হয়না। দেশে থাকতে আমরা হরহামেশা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনেক কিছু নিয়েই সমালোচনা করতাম। বিশেষ করে মা বাবা বৃদ্ধ হলে ‘ওল্ড হোমে’ পাঠিয়ে দেয়া নিয়ে তীব্র সমালোচনা করে এক ধরনের নিষ্ফল আনন্দ পেতাম। কিনতু এখানে থেকে দেখেছি, বৃদ্ধ বাবা মায়েদের সাথে কথা বলে জেনেছি, আমরা অযথাই ‘ওল্ড হোম’ নিয়ে নিজেদের মনগড়া কথা বলি। আসলে ওল্ড হোমে থাকাটা অনেকেই জীবনের একটি অংশ মনে করে। ওলড হোমে থেকেও মায়েদের সাথে তার সন্তানের এতটুকুও দুরত্ব তৈরী হয়না। আমাকে যেটা সবচেয়ে অবাক করেছে, সেটা হচ্ছে এখানে মায়ের কোন জাত নেই।

এখানে এসেই টের পেলাম, দেশে মাতৃত্ব সামাজিকভাবে স্বীকৃতি না পেলে মা হওয়ার সমস্ত গৌরব ধূলায় লুটিয়ে যায়। এখানে মা হওয়ার সাথে বিয়ের কোন সম্পর্ক নেই। ফলে বিবাহিতা অথবা কুমারী মেয়েরা হরহামেশাই মা হচ্ছে। এখানে ‘অবৈধ সন্তান’ বলে কিছু নেই, অবৈধ মা বলেও কিছু নেই। একজন ছেলে ও একজন মেয়ের মধ্যেকার সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়, কিনতু সন্তানের সাথে মায়ের সম্পর্কে কোন ফাটল ধরেনা। এখানেই ‘মা’ হওয়ার সার্থকতা। আমার সহকর্মী চ্যাসিটি মা হতে গিয়ে যে প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গিয়েছে, হিলারী ক্লিন্টন বা মিশেল ওবামাকেও একই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই মা হতে হয়েছে। নয়মাস শিশু গর্ভে ধারনকালীন সময়ে চ্যাসিটিকে যে সকল শারীরিক কষ্ট, মা হতে যাওয়ার আনন্দ বা মৃত্যুভয়ের শঙ্কামিশ্রিত এক অনুভূতি ঢেকে রাখতো, হিলারী বা মিশেল এমনকি হলিউড কাঁপানো এঞ্জেলিনা জোলীকেও একই অনুভূতি আচ্ছন্ন করে রাখতো নিশ্চয়ই। আর একমাত্র এখানেই দেখলাম ‘মা’ হচ্ছে মা। সিঙ্গেল মাম এর সাথে তার সন্তানের যে সম্পর্ক, বিবাহিত মায়ের সাথেও সন্তানের একই সম্পর্ক।

মাদার’স ডে নিয়ে আগে আমার কোনই আদিখ্যেতা ছিলনা। আর দশজন বাঙ্গালীর মত করে আমিও বিশ্বাস করতাম, বছরের প্রতিটি দিনই মাদার’স ডে। কিনতু আমরা কি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করি যে প্রতিটি দিনই মাদার’স ডে! না, এটা কথার কথা। আমরা মাতৃত্বের গুরুত্বই বা বুঝি কতটুকু। মা হতে গেলে একটি মেয়েকে রীতিমত মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে হয়, মা হতে গেলে একটি মেয়েকে সমাজের কাছে বৈধতা অবৈধতার পরীক্ষা দিতে হয়। উন্নত বিশ্বে যেখানে ‘মা’ হতে পারাটাকেই গৌরবের মনে করা হয়, বৈধ অবৈধ মাতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়না সেখানে আমাদের দেশে বৈধ সন্তানের মা হতে গিয়েও কতরকম সামাজিক কৌতুহলের সম্মুখীন হতে হয়। সন্তান ছেলে না মেয়ে, এটাতো একটা লাখ টাকার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। পুত্র সন্তান জন্ম দিতে ব্যর্থ হয়ে কত মেয়েকে সতীনের ঘর করতে হয়, কত মেয়ের তালাক হয়ে যায়। এখনও অনেকের মাথাতেই আসেনা যে একটি মেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সন্তান দেহে ধারন করে ঠিকই, কিনতু সন্তানটি ছেলে নাকি মেয়ে হবে, তা নির্ধারণ করে প্রকৃতি এবং সেটা পুরুষের মাধ্যমে।    

বৈধ সন্তান জন্ম দিতেই মেয়েদের যখন এই অবস্থা, তার আবার অবৈধ? নবৈচ নবৈচ! মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ বলে গলা ফাটাই, মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি উচ্চারণ করার আগে ‘মহান’ শব্দটি যোগ করে বলি ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ’ অথচ মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরে আমরা শুধু  মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েই কথা বলি। মুক্তিযোদ্ধা তাদেরকেই বলি যারা সমরে অংশ নিয়েছে। কিনতু যারা অস্ত্র হাতে তুলতে পারেনি, কিন্তু যুদ্ধের নয়টিমাস হায়েনাদের ধারালো দাঁত ও নখের আঁচরে জর্জড়িত হয়েছে, তাদেরকে কোন সম্মান দিতে পারিনি। লোকদেখানো আদর করে তাদেরকে ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধী দিয়েছি। কিনতু বীরাঙ্গনা কেন, তাদেরকেও মুক্তিযোদ্ধা বলা যাবেনা কেন? কত যন্ত্রনা, কত লাঞ্ছনা তাদের দেহকে নীল করেছে, কত চোখের জলে তাদের দিবানিশি ভেসেছে, তার মূল্য কি শুধু এই ছোট্ট একটি ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে!

এই যে মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই লাখ নারীকে পাকিস্তানী বাহিনীর সৈন্যেরা জোরপূর্বক ধর্ষণ করেছিল, সেই পাশবিকতার ফলে কত মেয়েই হয়ত সন্তান সম্ভবা হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধের ডামাডোলে অথবা ক্যাম্পে থাকার কারনে ঐ সমস্ত অবাঞ্ছিত ভ্রূনগুলোকে হত্যা করা যায়নি( আমি দুঃখিত মা হয়ে এমন কথা বলতে হচ্ছে বলে), তাদের সকলেরই নিশ্চয়ই গর্ভধারণের নয়মাস পরেই সন্তান ভুমিষ্ঠ হয়েছে। সেই বাচ্চাগুলোর কি গতি হয়েছিল? ওদের অনেককেই ‘এতিমখানায়’ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদেরকে ‘যুদ্ধশিশু’ নামে অভিহিত করা হয়। আর সেই সকল অসহায় নারীদের ভাগ্যে জুটেছে’ বীরাঙ্গনা’ খেতাব। আমার ভাবতেই কান্না পায়, একজন মেয়ে (‘বীরাঙ্গনা’) অন্যের পাশবিক অত্যাচারের যে স্বীকৃতি গর্ভে ধারন করেছিল, নয়মাস তার শারীরিক অনুভূতি বা কষ্টগুলি কি কম ছিলো? শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি ছিল সামাজিক নিন্দার ভয়! কি মানসিক কষ্ট! যেভাবেই মেয়েগুলো গর্ভবতী হয়ে থাকুকনা কেন, তারাতো ঐ বাচ্চাগুলোর ‘মা’ ছিল। তারা কি পেয়েছে সেই মায়ের স্বীকৃতি? সমাজের ভয়ে অনেক বেদনা সয়েও পৃথিবীর বাইরে নিয়ে আসা তুলতুলে নিষ্পাপ শিশুটির দিকে কখনও কি মায়ের দৃষ্টি নিয়ে তাকাতে পেরেছে? বাচ্চাটির মুখ থেকে নিজেও মা’ ডাক শুনতে পেলোনা, বাচ্চাটিও জানতেই পারলোনা কোন অপরাধে সে মায়ের বুকের উষ্ণতা থেকে বঞ্চিত হলো।

একই ব্যাপার ঘটে কুমারী মায়েদের বেলা্য অথবা একজন পতিতার বেলায়।   জীবিকার প্রথা অনুযায়ী  অতিথির মনোরঞ্জন করতে গিয়ে কখনও না কখনও সেই সমাজের 'অচ্ছ্যুত' পতিত মেয়ের গর্ভেও নতুন প্রানের সৃষ্টি হতে পারে এবং তা হয়।  তাদের সন্তানগুলোও সমাজে 'অচ্ছ্যুৎ'ই থেকে যায়।  ওইসব 'অচ্ছ্যুৎ' ছেলেমেয়েরা তাদের জন্মদাত্রীকে প্রাণভরে মা ডাকতে পারে বলে মনে হয়না। জন্মদাত্রীও সন্তান জন্ম দিয়েই  পেটের টানে, বাঁচার টানে তার পেশাতে মনোযোগী হয়ে পড়ে। মা হওয়ার যে কি গৌরব, তা সে জানতেই পারেনা।  মুহূর্তের ভুলে যখন একটি কুমারী মেয়ে গর্ভধারন করে ফেলে, তাকেও সমাজে নিগৃহীত হতে হয়। প্রেমিক পুরুষের প্রতি আবেগ ভালোবাসার বেখেয়ালেও কত মেয়ের জীবনে সর্বনাশ ঘটে যায়। সমাজ তখন একবারের জন্যও ভাবেনা,  একা একটি মেয়েতো আর যাদু দিয়ে মা হতে পারেনা, মা হতে গেলে বা কাউকে মা বানাতে গেলে মায়ের সাথে বাবারও অবশ্য প্রয়োজন হয়।  কিনতু ‘কুমার বাবা’ বলে কোন শব্দ নেই বলেই হয়তো বাবাগুলো অনায়াসে কোনরকম কোন কিছুর দায় না নিয়েই কত মেয়ের সর্বনাশ করে ফেলে। সর্বনাশইতো, কুমারী অবস্থায় ‘মা’ হলে তাকে আমরা মায়ের স্বীকৃতি দেইনা, ফলে মেয়েটিও তার নাড়ী ছেঁড়া ধনটিকে লোকনিন্দার ভয়ে পৃথিবীর আলো দেখানোর সুযোগ পায়না। পরিবর্তে ধাইয়ের কাছে গিয়ে অথবা হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে গর্ভের সুরক্ষিত অন্দর থেকে তার বাবুটিকে খুঁচিয়ে বের করে নিয়ে আসে। কোন রকম অসতর্কতার কারনে যদি বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হয়েই যায়, হয় সেই বাচ্চার গন্তব্য হয় ডাস্টবিন না হয়তো এতিমখানা। নয়মাসের কষ্ট এভাবেই সমাপ্তি পায়। এভাবেই তার মা হওয়ার গৌরব ধূলায় মিশে যায়। মা হওয়ার সমস্ত প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গিয়েও তারা ‘মা’ হতে পারেনা। ‘মাদার’স ডে তাদের মত ‘অগৌরবের’, ‘হতভাগী’,’লক্ষীছাড়ী’ মায়েদের জন্য নয়। কারন সন্তান জন্ম দিলেও ওরা 'মা' নয়।

Monday, May 7, 2012

পারমিতার চিঠি




প্রিয় মানসী,
আমার চিঠি পেয়ে অবাক হয়ে গেছিস নিশ্চয়ই। অবাক হওয়ারই কথা। এই ডিজিটাল যুগে কেউ আাবার চিঠি লিখে? আসলে হাতে এখন অখন্ড অবসর। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেলে যা হয়। তোকেতো বলেইছি পুটুস চাকুরী পেয়ে গেছে, কুটুসও এই বছর ল’ পাশ করে যাবে। আর গুড্ডু, সেও তো আর ছোটটি নেই, ক্লাস এইটে পড়ছে। নিজের কাজ নিজেই করে নেয়। এখন আমাকে সাতসকালে উঠে বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিতে হয়না, বিকেলে বাড়ী ফিরে ওরা কি খাবে, তা নিয়ে ভাবতে হয়না, এমনকি তোর দাদাও এখন ইচ্ছে হলেই নিজে নিজেই ঝাল মুড়ি বানিয়ে খেয়ে নেয়। এবার বুঝে দেখ, কেমন রাজসুখে আছি আমি। হায়রে! একটা সময় ছিল, একটু অবসরের জন্য কেমন হাপিত্যেশ করে মরেছি, আর এখন অবসর কাটেইনা। মাঝে মাঝে টিভি অন করে দুই একটা ভালো মুভি দেখালে দেখি। গতকাল টিভি অন করে দেখলাম কতকাল আগের দেখা মুভি ‘উইটনেস’ দেখাচ্ছে। এতোকাল পরেও মুভিটা দেখে খুব ভালো লাগলোরে!

কিরে! মনে পড়ে? দেশে থাকতে দুই বান্ধবী মিলে ‘উইটনেস’ ছবিটি দেখেছিলাম ভিসিয়ারে!  “আমেরিকার ‘আমিশ’ সম্প্রদায়কে নিয়ে ছবি, খুব ভালো ছবি” বলে তোর দাদাও আমাদের সাথে ছবি দেখতে বসে গেছিলো। তুই হয়তো কিছু কিছু জানতি এমিশদের সম্পর্কে, কিনতু আমিতো জানতামইনা আমিশ নামের কোন সম্প্রদায় আছে আমেরিকা বা কানাডার মত দেশে। অমন উন্নত আলো ঝলমলে দেশেও অমন ব্যতিক্রমী জীবন, ভাবাই যায়না! কি ভালোই যে লেগেছিলো ছবিটা। ছবি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আমি আহাজারি করেছিলাম, আহারে! ‘আমিশ’দের মত করে আমিও যদি কোলাহলের বাইরে আলাদা থাকতে পারতাম, সাথে সাথে তুই হই হই করে উঠেছিলি, বলেছিলি,যারা অমন কট্টরপন্থী, আধুনিকতাকে স্বীকার করেনা, তাদের মত জীবন তুই মরে গেলেও চাসনা। আমি কি আর তোর সাথে কখনও কথা বলে পেরেছি? ভয়ের চোটে চুপসে গেছিলাম। কিনতু মনের মধ্যে একটা কৌতুহল রয়েই গেছিল, কেনো এরা অমন সাদামাটা জীবনকে বেছে নিয়েছে, আধুনিক সভ্যতাকে অস্বীকার করার পেছনে কি কারন থাকতে পারে, অথবা জীবনের প্রতি এমন নির্মোহ থেকেই বা ওরা কি এমন মোক্ষ লাভ করেছে, সেটাও জানতে ইচ্ছে করতো।

গতকাল উইটনেস ছবিটি দেখার পরেই হঠাৎ করে মনে হলো, তুই হয়তো ‘আমিশ’ দের দেখা পেলে পেতেও পারিস। তোদের ওখানেতো আমেরিকান ইন্ডিয়ান থেকে শুরু করে কত বর্ণের মানুষ বাস করে। তোর কাছেই কত রকম মানুষের কত রকমের গল্প শুনেছি। কত নতুন নতুন গল্প তুই শুনিয়েছিস এ পর্যন্ত। আচ্ছা মানসী, সত্যি করে বলতো, কখনও কি কোন এমিশের দেখা পেয়েছিস? যদি কারো দেখা পেয়ে থাকিস আমাকে জানাবি। এখানটায় বড্ড বেশী মানুষ চারদিকে, চারদিকের এত কোলাহল আর ভালো লাগেনা। অন্য রকম জীবনের গল্প শুনতে চাই। আপাতত এখানেই শেষ করছি। ভালো থাকিস। তোর উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম। ওহ! ভালো কথা, কবীর ভাইকে আমার শুভেচ্ছা জানাবি। তাপসী ও মানসকে আমার ভালোবাসার সবটুকু দিবি। তোর জন্য আমার শুভকামনা।

পারমিতা

দুই.

পারমিতা,
আজকের ডাকেই চিঠিটা পেলাম। মানস কলেজ থেকে ফেরার সময় লেটার বক্স থেকে চিঠিটা এনে আমার হাতে দিয়েই টিপ্পণী কেটেছে, “মা, এখন কি আর কেউ চিঠি লিখে? একমাত্র পারমিতা মাসীই মনে হয় রবীন্দ্র যুগে পড়ে আছে!” আমিও মানসের তালে তাল মিলিয়ে বলেছি, এই পাগলী ছাড়া আর কেউ এভাবে চিঠি লিখে আমার খোঁজ নেবেনা। মানসের হাত থেকে চিঠিটা নিয়েই খুলে ফেললাম, চিঠি খুলেই আমি অবাক। তুই সত্যিই পাগল। নাহলে কবে কোনকালে ‘উইটনেস’ ছবিটি দেখেছিলাম, ভুলেও গেছি ছবির  কথা, আর তুই কিনা কোথাকার কোন এমিশদের নিয়ে একটা গোটা চিঠিই লিখে ফেললি! হ্যাঁ রে, তোর এখনও মনে হয়, অমন একটা জীবন পেলে তুই খুশী হতি? আমিতো অমন করে লোকালয়ের বাইরে গিয়ে বাঁচতেই পারবোনা। তুই নিউইয়র্কের এমন ছন্দময় জীবন ভালোবাসিসনা! আর আমি এখানের এই ভ্যাতভ্যাতে জীবন ভালোবাসিনা। এক কাজ করি আয়, জায়গা পাল্টাপাল্টি করি। তোরা চলে আয় এখানে, আমরা চলে যাই নিউইয়র্কে। হা হা হা !!

হ্যাঁ, সুপার সেন্টারের ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে বহাল তবিয়তেই আছি। এখানে থেকে নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। কত রকমের মানুষ যে দেখা যায় এখানে! আমারতো লেখার হাত নেই তাই লিখতে পারিনা। তুইতো একসময় লিখতি, অবসর কাটেনা বলছিস, লেখালেখি শুরু করে দে, আমিই তোকে গল্পের প্লট দেবো। তবে একটা শর্ত আছে, বই যখন প্রকাশ করবি, তথ্যসূত্রে আমার নামটা যেনো থাকে। নাহলে তোর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেবো। এবার আসল কথায় আসি, দেখেছি তোর এমিশ’দেরকেও দেখেছি, তবে দূর থেকে। ওদেরকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ নেই। তবে ওদেরই কাছাকাছি সম্প্রদায়ের মেনোনাইটদের দেখি প্রতিদিনই। এমিশদের দেখবো কি করে, ওরাতো ওদের লোকালয় ছেড়ে বের হয়না, আমারতো মনে হয় পৃথিবীর কোন খবরও ওরা রাখেনা। তবে মেনোনাইটরা ওরকম না, প্রতিদিনই কেউ না কেউ বাজার করতে আসে এই সুপার সেন্টারে। তুইতো জানিস, আমি এমনিতেই প্যাঁচালী, তার উপর আমার এই ফোন সার্ভিস এরিয়াতে গ্রাহকের ভীড় লেগেই থাকে। বুঝিসইতো, ফোনের ব্যাপার! না খেয়ে থাকতে অসুবিধা নেই, কিনতু ফোন ছাড়া এক মুহূর্তও আমেরিকানরা বাঁচবেনা।

আমাদের এখানে আমেরিকান ইন্ডিয়ান যেমন আছে, তেমনি এমিশ, মর্মেন, মেনোনাইট, মেক্সিকান, ইথিওপিয়ান, ভারতীয়সহ নানা সম্প্রদায়ের মানুষজন আছে। আমিতো আগে খুব বেশী কিছু জানতামনা মেনোনাইট, মর্মেন বা এমিশদের সম্পর্কে। শুধু দেখতাম স্টোরে আসা নানা জাতের মানুষের ভেতর কিছু মানুষ দেখতে একেবারেই আলাদা, তাদের পোষাক থেকে শুরু করে চলন বলন সব কিছু আলাদা। আমেরিকার মত এমন খুল্লাম খুল্লার দেশে মেয়েগুলো আসে হাঁটুর নীচ ছাড়ানো লম্বা ঢিলেঢালা জামা পড়ে, এদের মাথার চুল কখনওই খোলা থাকেনা, সব সময় টাইট খোঁপা করে বাঁধা, খোঁপাগুলো আবার গোল নামাজী টুপীর মত লেসের ঢাকনা দিয়ে আটকানো থাকে। সেই টুপীগুলো সাদা বা কালো লেসের তৈরী হয়ে থাকে। মজার কথা কি জানিস, এই এমিশ, মেনোনাইট, মর্মেন, ওদের নিজেদের মধ্যেই কিনতু মারাত্মক শ্রেণীভেদ আছে। ছেলেদেরকে দেখে একরকম লাগলেও মেয়েগুলোকে সাদা টুপি, কালো টুপি, টুপি ছাড়া খোঁপা দিয়ে কাস্ট আলাদা করা যায়। সাদাটুপীর মেয়ের সাথে কালো টুপীর গোত্রের ছেলের বিয়ে হবেনা, যদিও ওরা দুজনেই মেনোনাইট। তেমন বিয়ে হলে খবর আছে। এমন কঠিন ওদের সমাজ ব্যবস্থা। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো ওদের সাথে কথা বলার। তা একদিন পেয়ে গেলাম সুযোগ।

সেদিন এক ভদ্রলোক আমার কাউন্টারে এসে হাজির। ভদ্রলোকের ড্রেস দেখে, মুখের দাড়ি, কথা বলার বিনয়ী ভঙ্গী দেখেই আমি বুঝেছি, এই লোক হয় এমিশ নয়তো মর্মন বা মেনোনাইট। আমি ভদ্রলোককে ফোনের ব্যাপারে সাহায্য করলাম, তারপরেই তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ তুমি কি এমিশ?’

ভদ্রলোক একটু চমকালো এমন সরাসরি প্রশ্নে। আমি তাকে বললাম, “আসলে আমি আমিশ সম্প্রদায়ের উপর তৈরী করা একটা মুভী দেখেছিলাম অনেক আগে, আমার খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছিল, কিনতু কখনও কাউকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়নি আমার। বই পড়েও জানা যায়, তবে সরাসরি কারো মুখ থেকে শুনতেই বেশী ভালো লাগবে বলেই তোমার কাছে জানতে চাইলাম।”
এবার ভদ্রলোক সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে দিয়ে নিজের পরিচয় দিলো, “ আমার নাম ফিলিপ। আমি এমিশ নই, আমরা মেনোনাইট। কোন এমিশকে তুমি এখানে পাবেনা, ওরা সকলের সাথে কথাও বলেনা। তুমি আমাদের সম্পর্কে জানতে চাইছো দেখে নিজেকে সম্মানিত বোধ করছি। তবে এত অল্প সময়ে একটি সম্প্রদায় সম্পর্কে কতটুকুই বা জানা যায়, বলো! আমি বরং আজকে তোমাকে সংক্ষেপে বলি, পরের উইকে আমি তোমার জন্য আমাদের সমস্ত বুকলেটসহ আরও অনেক বেশী তথ্য এনে দেবো। তাহলে তুমি আরও পরিষ্কারভাবে আমাদের কথা জানতে পারবে”।

তিন.

আমি ফিলিপের কাছে এমিশদের কথাই আগে জানতে চেয়েছি, কেনোনা মেনোনাইট পুরুষ মহিলাদের সব সময় দেখা যায় এখানে, যে কোন সময় ওদের কথা শোনা যাবে, কিনতু এমিশদের কথা জানার সুযোগতো আর সব সময় আসবেনা। সেজন্যই ফিলিপকে বলেছি এমিশদের কথাই আগে বলতে। আমার কথার পিঠে কথা সাজিয়ে সে যতটুকু বলেছে সেটাই বরং ফিলিপের বয়ানেই তোকে লিখছি।

“আমাদের সাথে এমিশদের অনেক পার্থক্যও আছে আবার কিছু কিছু মিলও আছে। এমিশরা অনেক বেশী কট্টরপন্থী, গোঁড়া। নিজেদের মত করে থাকতে পছন্দ করে।  খুবই সাদামাটা ওদের জীবন, আধুনিকতাকে ওরা ঘৃণা করে। ইলেকট্রিসিটিকে মনে করে সাক্ষাত শয়তান, ওরা ইলেকট্রিসিটি ব্যবহার করেনা। ওরা টিভি দেখেনা, রেডিও শোনেনা, টেলিফোন ব্যবহার করেনা। ওরা মুভিও দেখেনা। ওদের বিশ্বাস, টিভি দেখলে বা রেডিও শুনলে বাচ্চারা শুধু নোংরামী শিখবে। ওদের কারো বাড়ীতেই বৈদ্যুতিক আলো জ্বলেনা, ফ্যান, এসি, ফ্রীজ কিছুই চলেনা। ওদের বিশ্বাস ইলেকট্রিসিটির ব্যবহারে প্রকৃতির আলো বাতাসের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।  বাড়ীতে  ওয়াটার সাপ্লাইয়ের পানির বদলে ওরা ডিপ টিউব ওয়েলের পানি ব্যবহার করে। এমিশরা মোটর গাড়ী, ট্রেন বা প্লেন, কোনটাতেই চড়েনা। ওরা চড়ে ঘোড়ায় টানা ‘বাগি’ তে। এমিশ মহিলারা খুবই পর্দানশীন, বাড়ীর ভেতরেই এদের যাবতীয় কর্মকান্ড সীমাবদ্ধ থাকে। হাট বাজার করতে হলে ঘরের পুরুষেরাই কাছাকাছি ওদের নিজস্ব হাট থেকে বাজার সদাই করে আনে। মেয়েরা অন্দরের যাবতীয় কাজ করে থাকে। রান্না বান্না থেকে শুরু করে ঘর পরিষ্কার করা, ছেলেমেয়েদের পরিচর্য্যা, পুরুষদের যত্ন আত্তিসহ যাবতীয় ঘরোয়া কাজ মেয়েরাই করে। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সকলের জামা কাপড়, বিছানা বালিশ ওরা ঘরেই বানায়। এমিশ মেয়েদের পোষাক হয় পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত ঢাকা। মেয়েদের মাথা ঢাকা থাকে কানঢাকা টুপীতে, যাতে করে ওদের মাথার চুল কেউ না দেখতে পারে। ছেলেরা লম্বা দাড়ি রাখে, মাথায় হ্যাট পড়ে, জামা কাপড় বলতে সাধারন প্যান্ট শার্ট পড়ে। অন্য সাধারন  আমেরিকানদের মত ওরা মদ পান করেনা, সিগারেটও খায়না। কোন নেশা ভাঙের মধ্যে এরা নেই। ওরা ছবি তোলেনা। এক প্রজন্ম তার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে দুই তিন পুরুষ আগের প্রজন্মের গল্প শোনায়। কে কেমন দেখতে ছিল, তার একটা কাল্পনিক বর্ণণা দেওয়া হয়।

মেয়েরা ঘরে থাকলেও কখনও যদি আত্মীয় স্বজনের বাড়ী যেতে হয়, তাহলে তারা ঘোড়ায় টানা ‘বাগি’তে চড়ে যায়। (‘বাগি’ হচ্ছে সোজা বাংলায় ‘টাঙ্গা’)। বাগির ভেতর মহিলারা থাকে পর্দায় ঢাকা, পুরুষেরা বাগি চালায়। ওদের ছেলেমেয়েরা পাবলিক স্কুলে যায়না, ওদের নিজস্ব স্কুল আছে যেখানে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়। ওদের আয়ের উৎস হলো কৃষি ও পশুপালন। কৃষি থেকে উৎপাদিত পণ্যেই ওদের সংসার জীবন চলে যায়। এমিশদের বিয়ের ব্যাপারে বলতে গেলে শুধু এটুকুই বলা যায়, নিজেদের গোত্রের বাইরে ওরা ছেলেমেয়েকে বিয়ে দেয়না। উপযুক্ত পাত্র না পেলে প্রয়োজনে মেয়েরা বা ছেলেরা সারাজীবন অবিবাহিত থেকে যায়। কেউ যদি অন্য সম্প্রদায়ের কাউকে পছন্দ করেও ফেলে, প্রথমে তাকে বাধা দেওয়া হয়, অবাধ্য হলে শাস্তি দেয়া হয়, প্রয়োজনে তাকে সমাজচ্যুত করা হয়।

জন্মনিয়ন্ত্রণে ওরা বিশ্বাস করেনা, এবরশনের প্রশ্নই আসেনা। ঈশ্বর যাকে যেভাবে পাঠিয়েছেন পৃথিবীতে, তাকে সেভাবেই থাকতে হবে মৃত্যু পর্যন্ত। পুনঃবিবাহ বা ডিভোর্স, কোনোটাই নেই ওদের মধ্যে। বিবাহিত দম্পতির মধ্যে কেউ একজন যদি আরেকজনের সাথে প্রতারণা করে, তাহলে তার বিচার হয়, বিচারেই শাস্তির বিধান দেওয়া হয়। বিধবা হলে বা কুমারী থেকে গেলে বাকী জীবন ঈশ্বরের সেবায় নিয়োজিত থাকতে হয়। এভাবেই চলেছে যুগের পর যুগ। এর বেশী কিছু বলতে পারছিনা। আমি এর বেশী কিছু জানিনা”।

চার.

পারমিতা,
ফিলিপ আমাকে সেদিন আমিশ সম্পর্কে অতটুকুই বলেছিল। এবার বাকীটুকু তুই গুগল সার্চ করে জেনে নিস। সেই বিকেলে ফিলিপ চলে যাওয়ার আগে বলেছিল, পরের সপ্তাহে আবার আসবে। আমাকে অবাক করে দিয়ে পরের সপ্তাহে ফিলিপ কিনতু ঠিকই এসেছিল, মেনোনাইট সম্পর্কে সে খোলাখুলি কথা বলেছিল আমার সাথে। ফিলিপ সাথে করে বেশ কিছু লিফলেট, ছোট ছোট বই নিয়ে এসেছিলো আমাকে দেওয়ার জন্য। পড়ে দেখি সবই ধর্মের কথা। ধুস! মানব ধর্ম বড় ধর্ম, এটা জানলেই তো চলে। যাই হোক, এই চিঠির সাথে ফিলিপের দেয়া কাগজগুলোও তোকে পাঠাচ্ছি। মেনোনাইট সম্পর্কে দুই একটা মজার তথ্যও জানলাম সেদিন। পরের চিঠি লিখবো মেনোনাইটদেরকে নিয়ে, তুই তোর অখন্ড অবসরে ওদের উপর একটা বই লিখতে পারিস। একেবারে নতুন ধরণের গল্প, যা আমাদের দেশের অনেকেই জানেনা। আচ্ছা, এক কাজ কর, আপাততঃ এমিশদেরকে নিয়েই একটা ফিচার লিখে ফেল, খুবই ভালো হবে। বিনে পয়সায় অনেক গল্প শুনালাম তোকে। লিখে ফেল সবকিছু মনে থাকতে থাকতে। এতে করে তোর সময়টাও ভালো কাটবে। তোকে যত গল্প শুনিয়েছি এই পর্যন্ত, বিরাট বড় উপন্যাস লেখা হয়ে যাবে। যতটুকু জানলি, মনে হয়না এরপরে তোর আর এমিশদের মত অমন আলুনিমার্কা জীবন ভালো লাগার কথা। আরে, কোলাহলের মধ্যেইতো প্রাণের সাড়া পাওয়া যায়। নিরালায় তো একদিন সকলেই যাবো, তার আগে আয় প্রাণের আনন্দেই ভরিয়ে রাখি নিজেকে আর পাশের জনকে! ভালো থাকিস। চিঠির উত্তর দিস। দাদাকে আমার নমস্কার। গুড্ডু, কুটুস ও পুটুসকে আমার আদর জানাস। পুটুস আর কুটুস বড় হয়ে গেলো, টুক্কী বয়সে বিয়ে করে ভালোই করেছিলি, এখন কি মজা তোর! আর তোর জন্য আমার সবটুকু ভালোবাসা। কবীর, মানস ও তাপসীসহ আমরা সবাই ভালো আছি।

মানসী