দুই
সপ্তাহ আগেই মিশা আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল যে ও কলেজের ২০১২ সালের ‘ হল অব ফেম’
এওয়ার্ড পেয়েছে। আমি সাথে সাথেই জানতে চাইলাম ‘হল অব ফেম’ এওয়ার্ডের গুরুত্ব।
হাসতে হাসতে ফোনের মাধ্যমেই মিশা আমাকে বলেছে যে এই এওয়ার্ডটাই হচ্ছে চার বছরের
কলেজ জীবনের সামগ্রিক মূল্যায়ন। মোট চারজনকে দেয়া হয় এই এওয়ার্ড। চার বছরের
পরীক্ষার গ্রেড, লীডারশীপনেস, আচার ব্যবহার, নিয়মানুবর্তিতা, নানারকম সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ, নাচ, গান,
থিয়েটারসহ চার বছরের সামগ্রিক কার্যক্রমের মূল্যায়ন শেষে নির্বাচক মডলী সিদ্ধান্ত
নিয়ে সেরা চারজন নির্বাচিত করেন। চারজনের ছবি বড় করে প্রিন্ট করে বাঁধাই করে মূল
বিল্ডিং এর ভেতরের দেয়ালে টানিয়ে দেয়া হয়। ওর কাছে এমনটা জানতে চাওয়ার কারন আছে। গত মাসে আমার বড় মেয়ে মৌটুসী
ডাক্তারী পাশ করার সাথে সাথেই আমি মৌটুসীর ছোটবেলা থেকে শুরু করে বড়বেলা পর্যন্ত
যত ঘটনা আমার স্মৃতিতে ছিল, তা নিয়ে লিখে ব্লগে পোস্ট করে দিয়েছিলাম। মিশা সেগুলো
দেখেছে আর আমার কাছে জানতে চেয়েছে ওকে নিয়ে কিছু লিখবো কিনা। আমি বলেছিলাম, যখন
সময় হবে তখন দেখা যাবে। মিশার সাথে আমার সম্পর্ক যতখানি মা- মেয়ের, তার চেয়েও বেশী
বন্ধুর সম্পর্ক। আমার তিনটি মেয়ে। তিন মেয়ের সাথেই আমার খুবই ভালো সম্পর্ক। তবে
মিশার সাথে সম্পর্কটা টক ঝাল মিষ্টি টাইপ। মিশা এই আমাকে ভালোবেসে একেবারে দিওয়ানা
হয়ে যাচ্ছে, আবার পরক্ষনেই হয়তোবা আমার উপর রেগে মেগে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলা
থেকেই মিশা এরকম।
মিশা
জন্মের পর থেকেই অসুস্থ থাকত।। প্রথম তিন মাস কিছুই বুঝতে পারিনি, কিনতু তিনমাস না
যেতেই ওর কানের ইনফেকশান হয়, এবং সেই থেকে বিরতিহীন ভাবে একটার পর একটা অসুখ ওর
লেগেই থাকতো। টাইফয়েড, হাম, চিকেন পক্স, স্কিনে ইনফেকশান, স্টমাকে ইনফেকশান ছাড়াও প্রতি প্নের দিন পর পর ঠান্ডা লেগে কেমন যেনো এজমার মত শ্বাসকষ্ট হতো। এক দেড় বছরের বাচ্চা ছিল সে, ডাক্তারের দেওয়া ‘এন্টিবায়োটিক’ খেতে খেতে একসময় সকল এন্টিবায়োটিকও
ওর ছোট্টদেহে আর কাজ করতোনা। ওর যখন দুই বছর বয়স, তখনই ‘নেফ্রোটিক সিনড্রোম নামে
কিডনীর অসুখ হয়। নেফ্রাইটিস যখন হয়েছিল, ওর ছোট্ট শরীরে প্রচুর পানি জমে গেছিল। কি ভারী হয়ে গেছিল মিশা!
মিশা খুব বেশী কথা বলতে শিখেনি তখনও, যা কিছু প্রয়োজন সব ইশারাতে বলতো। ও ওর
শারীরিক কষ্টের কথা বুঝিয়ে বলতে পারতোনা। আসলে রোগে শোকে মেয়েটার শরীরের ভেতরটা
ঝাঁঝরা হয়ে গেছিল। তাৎক্ষণিক চিকিৎসায় ওকে অনেকগুলো ইঞ্জেকশান (নাম জানিনা) দেওয়া হয়েছিল।
স্টেরয়েড ট্যাবলেট ‘প্রেডনিসোলন’ দেয়া হয়েছিল। প্রেডনিসোলন হচ্ছে ‘বিষতিতা’ এক
ওষুধ। সেই বিষাতিতা ওষুধ একসাথে ছয়টি খেতে দেয়া হতো ওকে। আমি ট্যাবলেটগুলোকে গুঁড়ো
করে মধুর সাথে মিশিয়ে ওকে কোনরকমে খাওয়াতাম। প্রতিটি কাজ আমাকে করতে হয়েছিল। কারন
মিশার বাবা মেয়েদের কষ্ট সহ্য করতে পারতোনা। সারাক্ষন মেয়েদের পাশে থাকলেও মেয়েদের
কষ্টের মুহূর্তগুলোতে একটু আড়ালে থাকতেন।
যত
রকমের অপ্রিয় কাজগুলো আমাকে করতে হতো বলেই মনে হয় ছোট্ট মিশা আমাকে দেখলেই একটু ভয়
পেতো। স্বাভাবিকভাবেই বাবার প্রতি ওর টান বেড়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি। ছোট্ট মিশাকে যখন
ইঞ্জেকশানের সুঁচ ফোটানো হতো, আমি ওকে ধরে রাখতাম ঠিকই, কিনতু আমার মনে হতো
সূঁচগুলো বুঝি আমার বুকে গিয়ে বিঁধছে। কান্নায় ক্লান্ত মেয়েটাকে বুকে চেপে ধরে
কান্না থামাতাম। আমার বুকে থেকে যে উষ্ণ পরশ ও পেয়েছে, সেই থেকেই মনে হয় আমার জন্য
নিজের অন্তরেও একটু উষ্ণতা টের পায়। মিশার চার বছর বয়স পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশে
ছিলাম। সেই চার বছরের পুরোটা সময় মিশাকে নিয়ে আমাদের কষ্টের সীমা ছিলনা। এরপরেই
আমরা অস্ট্রেলিয়া চলে যাই। অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে মিশা সুস্থ হতে শুরু করে।
অস্ট্রেলিয়াতে তিন বছর থেকে আবার যখন দেশে ফিরে আসি, তখন মিশা অনেক বড় হয়ে গেছে।
সাত বছর বয়সী ঝলমলে মিশা। যখন মুড ভালো থাকে তখন মিশা খুব ভালো, কিনতু মুড খারাপ
হলেই আমার উপর রেগে আগুন। তার বাবাকে ডেকে ডেকে বলতো, “ ও বাবাগো, এই মহিলাটাকে
তুমি বিয়ে করলে কেন গো? হায়রে কপাল, এই মহিলা কেনো আমার মা হলো?” মিশার সেই
ডায়ালগগুলো এখনও আমার কানে লেগে আছে।
আমার
উপর মিশার রাগ হওয়ার আরেকটি কারন হচ্ছে আমি পড়ালেখা নিয়ে কথা বলতাম। মিশা খুব
বুদ্ধিমতী ছিল, বই পড়ার চেয়েও ওর অনেক বেশী মনোযোগ ছিল এক্সট্রা কারিকুলার
এক্টিভিটির প্রতি। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়তো, প্রায়ই হোমওয়ার্ক মিস করার জন্য
শাস্তি পেত। প্রথম দশ জনের মধ্যে নাম থাকলেও প্রথম বা দ্বিতীয় স্থাণ পেতোনা। আমরা
কিছুই বলতামনা। ওর খুশীর উপর সব ছেড়ে দিয়েছিলাম। এত চঞ্চলতার পরেও স্কুলের প্রতিটি
টিচার ওকে অনেক ভালোবাসতো। টিচারের ভালোবাসা ও অস্ট্রেলিয়াতেও পেতো, সেই ধারা এখনও
ও বজায় রেখেছে। বাংলাদেশে থাকতেই স্কুলের পরীক্ষার কোন একটা পেপারে খারাপ নাম্বার
পেয়ে আমাদের কাছে আর নিয়ে আসেনি খাতা। নিজে নিজে বাবার সাইন নকল করে জমা দিয়েছিল।
অনেক পরে ওর কাছ থেকেই আমরা তা জেনেছি। ও আগে কেনো আমাদের জানায়নি তা জানিনা। আমরা
ওদের গায়ে হাত তুলতামনা, বিশেষ করে মিশাকে পিটাইনি। তারপরেও মনে হয় মিশার ভেতরে
ভেতরে খুব লজ্জা লেগেছিল কম নাম্বার পেয়ে।
মিশা
আমেরিকাতে এসেও স্কুলে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথেই টিচারদের নেক নজরে পড়ে গেছে প্রথম
থেকেই। আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, মিশা ঘরে আমার সাথে যতই জেদ করতো না কেন,
ঘরের বাইরে পা দেয়ার সাথে সাথেই ও অন্য মানুষ। বাংলাদেশে থাকতেই সব বাড়ীর কাজের
মেয়ে বা কাজের বুয়াদের সাথে মিশার খাতির দেখলে যে কেউ অবাক হয়ে যেত। ওর মন খুব
বেশী নরম। বড়লোকের বাচ্চাদের সাথে খেলতেও যেমন ওর জুড়ি ছিলনা, কাজের মেয়েদের সাথে
গলাগলি করতেও ওর জুড়ি ছিলনা। মিশা সেই তিন বছর বয়সের সময় ঘরের জানালার গ্রিলের
ফাঁক দিয়ে বস্তির ছেলেমেয়েদেরকে ডেকে ডেকে গ্লাস, বাটি, পুতুল, খেলনা দিয়ে দিত।
যার সব ভালো, তাকে পড়ার কথা বললেই মাথায় বাজ পড়তো। আর এই একটা জায়গাতে এসেই সে
আমাকে তার শত্রু মনে করতো। মিশার ধারণা ছিল, আমি বুঝি ওর দিদিসোনাকেই ভালোবাসি,
ওকে বাসিনা। কিনতু এত ছোট বয়সে ওকে বুঝাই কেমন করে, মায়ের ভালোবাসা কারো প্রতিই কম
বেশী হয়না। আমি মাঝে মাঝে অনেক কষ্টও পেতাম মনে, যখন মেয়েটা তারস্বরে চেঁচাত আর
বলতো, হায়রে! এই মহিলাটা কেন আমার মা হলোরে! এখন অবশ্য হাসি পায়।
ওর
যখন চৌদ্দ বছর বয়স, আমরা ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ছেড়ে চলে আসি মিসিসিপিতে। ততদিনে
আমাদের বড়মেয়ে মৌটুসী খুবই ভালো রেজাল্ট করে কলেজে ভর্তি হয়েছে ফুল স্কলারশীপ
পেয়ে। টিন এজের মিশা মনে হয় এতে করে একটু বিপর্যস্ত বোধ করতে থাকে। ওয়েস্ট
ভার্জিনিয়াতে মিশার বন্ধুর সংখ্যা ছিল অগুনতি। সবাইকে ছেড়ে মিসিসিপিতে চলে আসতে ওর
মনে হয় পাঁজরে গিয়ে ব্যথাটা লেগেছে। মিসিসিপিতে এসে মিশা এখানের পাবলিক স্কুলে
ভর্তি হয়েছে। স্কুলে যায়-আসে, মুখে হাসি নেই, আনন্দ নেই। পড়ালেখাতে ফাঁকী দিলেও
মিশা ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে থাকতে কত যে স্পীচ কম্পিটিশান, সোশ্যাল স্টাডিজ ফেয়ারে
অংশগ্রহন করেছে এবং সবগুলোতে ফার্স্ট হয়ে এসেছে। পত্রিকাতে ওদের দুই বোনের ছবিও
উঠেছে। একবার স্কুলের ফুটবল খেলার সময় স্টেডিয়ামে এককভাবে আমেরিকার জাতীয় সংগীত
গাওয়ার মত বিরল সৌভাগ্য ওর হয়েছে।
সেই
মিশা মিসিসিপিতে এসে পনের’শ ছাত্রছাত্রীর সাথে গায়ে গা লাগিয়ে স্কুলে পড়তে গিয়ে
কেঁদেকেটে অস্থির হয়েছে। একদিন বাবার কাছে কাঁদতে কাঁদতেই বলছিল ওকে যেনো ওয়েস্ট
ভার্জিনিয়াতে দুইটা দিনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায়ই স্কুল থেকে বাড়ী ফিরেই ঘরের
দরজা বন্ধ করে দিত। ডাকলেও সাড়া দিতনা। আমি যে কি ভয় পেতাম। একদিন ও যখন স্কুলে
ছিল, ওয়ার্ড্রোবের উপর একটা বড় সাদা কাগজ পেয়ে খুলে দেখি, মেয়ে ঈশ্বরের কাছে ওর
জীবনের কষ্ট জানিয়ে চিঠি লিখেছে। এক জায়গাতে লিখেছে বন্ধুদের জন্য এতো বেশী মন
খারাপ যে এই জীবন আর রাখতে চায়না। তাই প্রায়ই সে বালিশ চাপা দিয়ে দম বন্ধ হয়ে মরে
যাওয়ার প্র্যাকটিস করে। এই পর্যন্ত পড়ে আমার মাথা ঘুরাতে শুরু করে। ওর বাবা বাড়ী
ফিরলে ওর বাবাকে বললাম কথাগুলো। একদিন ওর বাবা ওকে সুন্দর করে অনেকক্ষণ বুঝিয়েছে।
বাবা বুঝালে সব ঠিক, মা বুঝালে সব বেঠিক যে মেয়ের কাছে, তাকেতো বাবার বুঝাতে হবেই।
আমি একদিন মিশাকে বলেছিলাম, “ তোমার কাছে কিচ্ছু চাইনা, তুমি যদি মিসিসিপির ম্যাথস
এন্ড সায়েন্স স্কুলে চান্স পাও, ভবিষ্যতে আমি কোনদিন তোমাকে পড়ার কথা বলবোনা”।
মিসিসিপির ম্যাথস এন্ড সায়েন্স স্কুল প্রোগ্রাম হচ্ছে ইলেভেন এন্ড টুয়েলভ গ্রেডের
জন্য। সারা মিসিসিপির বেস্ট ছেলেমেয়েদের ইন্টারভিঊ করে তবেই ১১০ জনকে নেওয়া হয়।
আমরা ধরেই নিয়েছিলাম মিশা চান্স পাবেনা। কারন ওর এসিটি টেস্ট স্কোর খুবই কম ছিল।
মিশা লিখিত পরীক্ষাতে পাশ করে মৌখিক পরীক্ষার ডাক পেয়েছে, এতেই আমরা খুশী ছিলাম।
যেদিন মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে এসে বাড়ীতে ফিরে খুব কনফিডেন্টলি বললো, যে ভাইভা ভালো
হয়েছে, তখন থেকেই বুকে আশা জাগতে লাগলো। কারন আমরা জানি মিশা কথা বলতে পারে খুব ভালো। স্পীচ কম্পিটিশানে প্রথম হওয়া মেয়ে ও। রেজাল্ট বের হলে দেখা গেলো মিশার অবস্থান
প্রথম দশ জনের মধ্যে।
আমি
চেয়েছিলাম মিশা মিসিসিপি স্কুল ফর ম্যাথস এন্ড সায়েন্স ( স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন)
এ চান্স পাক, কারন আমি জানতাম এই স্কুলের এত ভাল পরিবেশে থাকলে মিশাকে নিয়ে আর
ভাবতে হবেনা। আমার ধারনা সত্যি হয়েছে। এরপরে সেই মিশাকে নিয়ে আর ভাবতে হয়নি আগের
মত। তবে একটা সমস্যা হচ্ছে, মিশার একদমই আত্মবিশ্বাস নেই। ও শুধু কাজ করে যায়,
কাজের স্বীকৃতি পেলে ও সারা মুখে লজ্জা এনে এমন এক ভাব করে যে অন্যদের মনে হবে
কোথাও কোন ভুল হয়েছে নিশ্চয়ই। এই স্কুলেও টুয়েলভ গ্রেডে ও আমাদেরকে না জানিয়ে ‘বিল
গেটস’ স্কলারশীপের জন্য এপ্লাই করেছিল। দশটি এসে লিখতে হয়েছে নির্দিষ্ট বিষয়ের
উপর, স্কুলের পরিক্ষার গ্রেড, টিচারদের রিকমেন্ডেশান লেটারসহ আরও যাবতীয় আনুষঙ্গিক
কাগজপত্রসহ এপ্লাই করার পরে দেখা গেলো সারা আমেরিকাতে এক হাজার জন নন আমেরিকান
ছেলেমেয়ে এই স্কলারশীপ পেয়েছে, তাদের মধ্যে আমাদের মিশা একজন। এটা এমনই এক
স্কলারশীপ, যা কিনা ও সারাজীবন মানে পিএইচডি করা পর্যন্ত পেয়ে যাবে। একই সময়ে মিশা
লোকাল টিভি কেন্দ্র থেকে পরিচালিত আরেকটি এসে কম্পিটিশানে ফার্স্ট হয়ে এক হাজার
ডলারের চেক, টিভিতে সাক্ষাৎকার দেয়ার সুযোগ পেয়েছে। শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালে ঐ স্কুল
থেকেই একশ পঞ্চাশ জন স্টুডেন্ট এর মধ্যে যে সাতজন স্টুডেন্ট ‘আউটস্ট্যান্ডিং’
রেজাল্ট করেছে, মিশা তাদের মধ্যে একজন।
মিসিসিপির
প্রাইভেট কলেজ মিলস্যাপস কলেজে ওর নিজের ইচ্ছেয় ভর্তি হয়েছে। স্কলারশীপ পেয়েছে বিল গেটস ফাউন্ডেশান থেকে। চার বছরে ও এমন
পরিচিতি লাভ করেছে কলেজে যা কিনা কেউ ধারনাও করতে পারবেনা। ঐ কলেজে বছরে একটাই
কালচার্যাল প্রোগ্রাম হয়। মিশা প্রতিবার একঘন্টার পুরো কালচার্যাল অনুষ্ঠান তৈরী করা থেকে শুরু করে আমেরিকান ছেলেমেয়েদেরকে দিয়েই অনুষ্ঠানটি শেষ করেছে খুবই সফলভাবে। মিশার নাচের ভঙ্গীতে ছবি বেশ কয়েকবার নানা পত্রিকাতে ছাপা হয়েছে। আমার মিশা খুব ছোট থাকতেই টিভিতে হিন্দি গান দেখে দেখে
হুবহু নায়িকাদের মত নাচ করতো। অস্ট্রেলিয়াতে থাকতে যে কোন অনুষ্ঠানে মিশার নাচ
থাকতই। মিশা কোনদিন কোথাও নাচ শিখেনি, তারপরেও মিশা এমন ভাল নাচ করে যে কেউ বুঝতেই
পারেনা এই মেয়ের নাচের উপর কোন শিক্ষা নেই। মিশার বাবার ছবি আঁকার হাত ছিল। আমার
বড় মেয়ের ছবি আঁকার হাত ঈর্ষণীয় পর্যায়ের ভালো। আমি খুব গর্ব করতাম মৌটুসীর আর্ট
নিয়ে। মিশা মনে মনে খুব রাগ হতো মনে হয় আমার আদিখ্যেতা দেখে। টুয়েলভ ক্লাসে একটা
কোর্স নিয়েছিল আর্টের উপর। সেই বছর ও যে কয়টা আর্ট করেছে তার মধ্যে পাঁচটা আর্ট
নানা কম্পিটিশানে ফার্স্ট হয়েছে। এরপরে মিশা আর্ট বাদ দিয়ে দিয়েছে। সে শুধু নিজেকে
একবার যাচাই করে দেখতে চেয়েছিল আর্ট পারে কিনা। মিশার বাবার ফটোগ্রাফীতে হাত পাকা
ছিল। মিশা এটা পেয়েছে। ওর ফটোগ্রাফী পর পর দুই বছর পুরস্কার পেয়েছে। গতবছর
মিসিসিপিতেই ফটোগ্রাফীর অনলাইন কম্পিটিশান ছিল। একটাই ‘বেস্ট’ পুরস্কার ছিল। ১৫৯টি
ফটোগ্রাফীর মধ্যে যেটি বেস্ট হয়েছে সেটি আমার মিশার তোলা। ‘আইপ্যাড’ পেয়েছে
পুরস্কার হিসেবে।
গতবছর
আমার এই মেয়ের গাড়ীকে ধাক্কা মেরেছিল আরেক গাড়ী। আমার মেয়েটার গাড়ী একেবারে দুমড়ে
মুচড়ে গিয়েছে, ঈশ্বর আমাদের মেয়েটিকে প্রানে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। এই একটা বিরাট
দূর্ঘটনার পরে আমরা স্বামী স্ত্রী খুব বেশী হতভম্ব হয়ে গেছি। আমি এরপর থেকে কেমন যেনো হয়ে
গেছি। শুধু ভাবি আমাদের মেয়েগুলো বেঁচে থাক। আমি আর রেজাল্ট নিয়ে ভাবিনা। আমার
মিশার বয়স এখন ২১ বছর। এর মধ্যে কি ওর জীবনে বসন্ত আসেনি? হয়ত এসেছিল। হয়তো আমার
মেয়ের মনে দুঃখ দিয়ে পাখী উড়ে গেছে। আমার মেয়েটার খুব খারাপ সময় গেছে কয়েকটা মাস।
মেয়েকে অনেক কাঁদতে দেখেছি। আমার মিশা আমার সাথে খুব ফ্রি। ওর মনের কষ্টগুলো আমাকে
ও বলে, যখন মনের ভেতর আর চেপে রাখতে পারেনা। আমি মা হিসেবে কেমন জানিনা, কিনতু আমি
মেয়েদের দুঃসময়ে বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দেই। তখন মায়ের চোখ রাঙ্গানি বন্ধ থাকে। আমার
মেয়েরা আমাকে খুব ভালো বুঝে। যাই হোক আমার মেয়ের সেই দুঃসময় কেটে গেছে সময়ের সাথে
সাথে। ওর জীবনে অনেক ভালো ভালো বন্ধুরা এসে জুটে যায়। আবার কিছু ধুর্ত ছেলেমেয়েরাও
জুটে। সবই আছে।
সেদিন
মিশা দুঃখ করে বলেছে, “ মা, জানো আমি নিজেও জানতামনা এতবড় পুরস্কার পাব। এটা হচ্ছে
সিক্রেট এওয়ার্ড। সবার বাবা মা এসেছে তোমরা ছাড়া। তোমাদের দেখিনি বলে আমিও বুঝেছি
আমি এটা পাইনি। কিনতু আমার নাম ধরে ডাকতেই এত মানুষের সামনে আমি থতমত খেয়ে গেছিলাম”।
মেয়ের মুখ থেকে এমন কথা শুনে মনটা খুব খারাপ হয়েছে। ওর গ্র্যাজুয়েশান অনুষ্ঠানে
গেছি। আগের দিনই দুপুরে যাওয়ার কথা ছিল। কিনতু এদিকে আমাদের ছোট মেয়ে মিথীলার একটা
প্রোগ্রাম ছিল। সেটা বাদ দিয়ে যেতে পারলামনা। কিনতু আমার খুব ইচ্ছে করছিলো মিশার
প্রোগ্রামে থাকতে। রাত নয়টার সময় একটা ককটেল পার্টি ছিল। ডিজে পার্টি। গিয়ে দেখি
সবাই নাচছে। বাবা মা, বন্ধু বান্ধবী সবাই। আমার মিশা আমার হাত ধরে নিয়ে গেল
ফ্লোরে। আমি যত বলি আমি নাচ করতে পারিনা মেয়ে তত বলে ওকে ফলো করার জন্য। কানের
কাছে মুখ এনে বলে রাইট, এবার লেফট, হাত উঁচু করো, কোমড় একটু দোলাও। আমিও মেয়ের
সাথে সাথে আনন্দের সাথেই নাচলাম। মেয়ে নিজের স্কলারশীপের পয়সায় বাবা মা-কে থাই
রেস্টুরেন্টে ডিনার করালো। পরের দিন মেয়ে গ্র্যাজুয়েশান করে ফেললো।
মিশার
জার্নি এখানেই শেষ হয়নি। মিশার স্বপ্ন ছিল এমরি ইউনিভার্সিটিতে ‘পাবলিক হেলথ’ এর
উপর মাস্টার্স এন্ড পিএইচডি করার। ওর কলেজের ডীন রিকমেন্ডেশান লেটার পাঠিয়েছে। সেই
লেটারের কপি মিশা আমাকে মেইল করেছে। লেটারটি পড়ে আমি অনেকক্ষন কেঁদেছি। সাফল্যের
কান্না। আমরা দেশে ছিলাম রাজার হালে। আমেরিকাতে জীবন সংগ্রাম করে চলেছি। মেয়েগুলো
এখনও একশতভাগ সৎ আছে। তিনজনেই তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের এর বেশী কিছু
চাওয়ার ছিলনা। যে মেয়েটির বাঁচার কথা ছিলনা, ছোটবেলাতেই কি ভয়ংকর সব অসুখ হয়েছিল,
মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়ার যোগাড় হয়েছিল, সেই মেয়ে ভয়াবহ গাড়ী দূর্ঘটনায় পড়ে প্রাণে
বেঁচেছে, সেই মেয়েটা আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে, ঈশ্বরতো ওর দিকে তাকাবেনই। ও
এমরিতে চান্স পাবেনা তো কে পাবে! আমার মেয়েটি যে কয়টা ভালো ভালো ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করেছিল, সবগুলো থেকেই একসেপট্যান্স লেটার এসেছে। কিনতু মিশা যাবে ওর স্বপ্নের 'এমরী'তে।
No comments:
Post a Comment