Friday, September 28, 2012

বহুদিন পরে ভ্রমর এসেছে পদ্মবনে!


 ছুটির দিনে কম্পিউটারে বসে লেখালেখি করছি, এমন সময় বাইরে থেকে কেউ আমাদের কলিংবেল টিপে তার আগমণ বার্তা জানাতেই ঝট করে নীচে নেমে এলাম, জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি একজন কালো ভদ্রমহিলা দরজায় দাঁড়ানো। অচেনা কাউকে দেখে দরজা খুলে দিতে আমার সব সময় ভয় করে, কিনতু তবুও দরজা খুলি। আজকেও দরজা খুলে 'হাই' বলতেই ভদ্রমহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ওগুলো কি গাছ? প্রথমটায় বুঝতে পারিনি, কোন গাছের কথা জানতে চাইছে! একফাঁকে দেখে নিলাম তাঁর গাড়ি আমাদের পার্কিং স্পেসে পার্ক করা। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, আমাদের বাড়ির প্রবেশমুখে বিশাল জায়গা জুড়ে 'জ্যাকারান্ডা' গাছ আছে। ভাবলাম এর কোন একটা শাখায় উনার গাড়ি ধাক্কা খেয়েছে কি না কে জানে! এখনই হয়তো পুলিশ ডাকবে। ভয় গোপন করেই হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলাম, ঠিক কোন গাছের কথা উনি জানতে চাইছেন। উনি আঙুল তুলে স্থলপদ্ম গাছের দিকে দেখালেন। স্থলপদ্ম গাছ উনি চেনেন না? এটা তো হতে পারেনা, আমি বলি স্থল পদ্ম, কিনতু এর আমেরিকান নাম আছে, আমার অবশ্য আমেরিকান নামটা মনে নেই।  আমার ভাষাতেই বললাম, 'আমাদের দেশে এই গাছের নাম হচ্ছে স্থল পদ্ম, মানে স্যান্ড লোটাস অথবা ল্যান্ড লোটাস"। আমাকে আশ্বস্ত করে এবং তার চেয়েও বেশী খুশী করে  উনি বললেন, " তোমার বাড়ির চারপাশে এমন সুন্দর গাছ দেখেই আমি গাড়ি থামালাম, খুব জানতে ইচ্ছে করছে, এগুলো কি গাছ? এমন সুন্দর পাতা আর এমন মিষ্টি গোলাপী রঙের এত বড় বড় ফুল, আগে দেখিনি"! আমি ভাবি, বলে কি!  খুশী হয়ে  উনাকে সবিস্তারে বললাম গাছগুলোর জন্মবৃত্তান্ত  এবং আনন্দের আতিশয্যে কথা দিয়ে ফেললাম, " ডিসেম্বারের দিকে তুমি এসো, গাছগুলো কেটে খন্ড খন্ড ডালা বের করে তোমাকে দেবো। জলে ভিজিয়ে রেখো, শেকড় গজালেই মাটিতে পুঁতে দিবে। গাছ হবে"। ভদ্রমহিলা ভিনদেশী এক মহিলার আন্তরিকতায় খুশী হয়ে 'আবার আসবো' কথা দিয়ে চলে গেলো। আর আমি অসম্ভব খুশী মনে ঘরে ঢুকে গেলাম। দরজা বন্ধ করে দিয়ে আবার কম্পিউটার টেবিলে বসেই লেখার টপিক বদলে ফেললাম।



আমাদের বাড়ীতে স্থল পদ্মের গাছ আছে প্রচুর। অবশ্য  চার বছর আগে বাড়ী যখন কিনেছিলাম, তখন বাড়ীর ব্যাক ইয়ার্ডে  স্থলপদ্মের একটা মাত্র গাছ ছিল। সেপ্টেম্বারে গৃহপ্রবেশ করেছিলাম, তখনও ফুল ফোটার সময় হয়নি বলেই ফুল ফোটেনি।  আমি গাছ-গাছালি  ভালোবাসি,  গাছের নাম না জেনেও ভালোবাসি। এখানে  বেশীর ভাগ গাছেরই নাম জানিনা, কিনতু চারদিকের সবুজ দেখে মুগ্ধ হই। সব গাছের নাম না জানলেও বাড়ীর ব্যাক ইয়ার্ডের গাছটির পাতার দিকে তাকিয়েই চিনে ফেলেছি,  খুবই খুশী হয়েছি  নিজ বাড়ীর আঙিনায় স্থল পদ্মের গাছ দেখে। 'নিজ বাড়ি' বলাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত জানিনা,  যদিও অভ্যাসবশতঃ সকলের কাছে 'আমাদের বাড়ি' টার্মটি ব্যবহার করে থাকি, তারপরেও মনে মনে জানি এটা 'নিজের বাড়ী' না।  কারন ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে বাড়ী কিনেছি,  ব্যাঙ্কের কাছে ঋণী হয়ে আছি ১৫ বছরের চুক্তিতে।  মাসে মাসে সুদ সমেত ঋণ শোধ করে যাই। এটাকে কি 'নিজ বাড়ি' বলা যায়!  ১৫ বছরে বা ৩০ বছরে যখন সুদসহ সমস্ত ঋণ পরিশোধ হয়ে যাবে, তখনই শুধু বলতে পারবো, নিজের বাড়ী। তারপরেও অবচেতন মনেই ঋণের বাড়িকেই  'নিজ বাড়ী' বলতে ভাল লাগে, এক ধরনের অধিকারবোধ জন্মায়, মনের মত করে সাজাতে ইচ্ছে করে।

প্রবাসে সকলেই যার যার সুবিধামত, পছন্দমত বাড়ী কিনে নিজের রুচী অনুযায়ী বাড়ীকে ঢেলে সাজায়। আগ জীবনে আমারতো বাড়ী-ঘর বলতে কিছু ছিলনা, এমনকি লোনের বাড়ীও না, হঠাৎ করেই জীবনের মাঝপথে এসে আমরাও ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে চার বছর আগে ছোট্ট একটা বাড়ী কিনে ফেললাম। ছোট বলতে ছোটই, আমেরিকার অন্যান্য বিশাল বাড়ীর তুলনায়। বাড়ীটির মালিক ছিলেন অবিবাহিতা এক বৃদ্ধা। বৃদ্ধার মধ্যযৌবনে তাঁর বাবা মেয়ের জন্য বাড়িটি তৈরী করে দেন, যেন শেষ বয়সে মেয়েকে কষ্ট করতে না হয়। একজনের বাসযোগ্য বাড়ী বলেই সবকিছু মাপমত করা হয়েছে। কোথাও বাড়তি কিছু নেই।  বাড়তি কোন গাছপালাও না। এমন কি বাড়ির কোথাও সাজানো বাগানও ছিলনা। স্থায়ীবৃক্ষ  কয়েকখানা  লাগানো ছিল, কে লাগিয়েছিল জানিনা, জানার সুযোগ হয়নি,  কারন বৃদ্ধার মৃত্যুর পরে তার আত্মীয়-স্বজনেরা বাড়ীটি বিক্রী করে দেয়। আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা হয়নি, তাই বাড়ীর ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানিনা। বাড়ি বিক্রী করে টাকা হাতে পেয়েই সবাই লাপাত্তা।

সেই ছোট বাড়ির পেছন দিকের বাগানে পেয়েছি একখানা স্থল পদ্ম, আর একখানা ডুমুর গাছ। হ্যাঁ, বাড়ির জানালা লাগোয়া  এক খন্ড অতি সুন্দর স্পেস ছিল, আমার ঘরের জানালার ধার ঘেঁষে, ফার্ণ দিয়ে সাজানো এক চিলতে জমি। চোখ জুড়িয়ে যায়, কিনতু চোখ জুড়ানো ফার্ণের ঝোপ আমি লোক দিয়ে কাটিয়ে ফেলেছি। ফার্ণ খুবই দামী, ফার্ণের ঝোপ দেখতেও ভারী সুন্দর,  তা সত্বেও ঝোপটি কাটিয়েছি কারন বাড়ির দালাল বলেছে, ফার্ণের ঝোপে সাপ থাকে। এই কথা শোনা মাত্র আমার শরীরে ইলেকট্রিক শকের মত জোর ধাক্কা লাগতেই আমার স্বামী সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, ফার্ণের ঝোপের মূলোৎপাটনের। বাড়ীতে উঠে চারপাশে তাকাই, কেমন ম্যাড়মেড়ে লাগে, কোথাও কোন ফুলের গাছ নেই, পদ্মফুল গাছ ভেবে যে গাছটিকে চিহ্নিত করেছি, সেটাতেও কোন ফুল নেই। বাড়ির মালকিন অসুস্থ অবস্থায় এক বছর ক্লিনিকে ছিলেন বলেই বাড়ীঘরের কোন যত্ন হয়নি। চারদিকে আগাছা জন্মেছে, বাড়িটি বিক্রী করতে দেয়ার আগে যতটুকু সম্ভব পরিষ্কার করে তবেই ওরা 'সেল লিস্টে' দিয়েছে। বাড়ীটি কোন ভাবেই আহামরি কিছু নয়। তবে বাড়ির লোকেশান আমাদের অনুকূলে হওয়াতেই বাড়ীটি কেনার সিদ্ধান্ত নেই (অবশ্যই ব্যাঙ্ক লোনে)।  'নিজের বাড়িতে' উঠার মাস খানেকের মধ্যেই  স্থল পদ্ম গাছে ঝেঁপে ফুল ফুটতে শুরু করে। সে যে কী সুখ, কী সুন্দর, কী দারুণ অনুভূতি তা বলে বুঝাতে পারবো না। ঠিক ঐ মুহূর্তে একবারের জন্যও মনে হয় নি, এ আমার নিজের বাড়ী না।

বাড়ীর মালকিনের এক ভাইপো একদিন এসে আমাদের দেখিয়ে দিয়ে যায়, শীতে কিভাবে স্থল পদ্মের ডালগুলোকে গোড়া পর্যন্ত কেটে দিতে হয়। গোড়া পর্যন্ত কেটে দিয়ে খড়-বিচালী দিয়ে গাছের গোড়া ঢেকে রাখতে হয় সমস্ত শীতকাল, আর কাটা ডালগুলোকে টুকরো টুকরো করে খন্ড গুলো বালতির জলে বা যে কোন ফ্লাওয়ার ভাসে অর্ধেক ডুবিয়ে রাখলে ডালগুলোতে শেকড় গজায়। শেকড় সমেত ঐ ডালগুলো শীতের শেষে মাটিতে লাগিয়ে দিলেই নতুন গাছ বের হয়। এভাবেই ইচ্ছে করলে গাছের সংখ্যা বাড়ানো যায়। ভদ্রলোক নিজে হাতেই গাছের ডাল-পালা একেবারে গোড়া পর্যন্ত কেটে দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিল কিভাবে ছোট ছোট টুকরোগুলোর অর্ধেক অংশ জলে ভিজিয়ে রাখতে হয়। উনাকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম, এরপর প্রতিদিন একবার করে দেখি ডাল থেকে শেকড় বের হয় কিনা। একসময় আমার অপেক্ষার পালা শেষ হয়, ডাল থেকে শেকড় গজায়, শেকড়সহ ডালাটি মাটিতে পুঁতে দিতেই নির্দিষ্ট সময়ে একটি ডাল থেকে আরো অসংখ্য ডালপালা বের হয়ে সবুজ পাতায় ভরে যায়।

আমি আশেপাশের বাড়িগুলোর দিকে তাকাই, সকল বাড়ির সামনের সুন্দর সাজানো বাগানের দিকে তাকাই। নয়ন জুড়ানো বাগান দেখে দৃষ্টি সার্থক হয়, মনের গভীরে একটু সূক্ষ্ম বেদনা টের পাই। খুব মাঝে মাঝে আমারও ইচ্ছে করে, অমন সুন্দর করে বাগান তৈরী করতে। ইচ্ছেগুলোকে বেশীক্ষন লালন করিনা, খুব দ্রুত বাস্তবে ফিরে আসি। অমন সুন্দর বাগান করতে প্রচুর খরচ, এবং রেগুলার  সেই খরচ বহন করার মত সক্ষমতা আমাদের কোনকালেই ছিলনা। কিনতু ইচ্ছেগুলোকে তো আর অবহেলা করতে পারি না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নানা রকম চিন্তা করি, কিভাবে বাড়িকে সবুজে ঘিরে ফেলা যায়। বাঙ্গালের বুদ্ধি, কিভাবে স্বল্প খরচে বেশী ফল পাওয়া যায়, সেই চিন্তাতেই বিভোর থেকেছি, এরপরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাড়িটাকে স্থলপদ্মের সবুজে ঘিরে ফেললে কেমন হয়! পদ্মফুল গাছে ঘেরা বাড়ির নাম দেবো, 'পদ্মবাড়ি'। যেমন ভেবেছি, তেমনই শুরু করেছি। একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতেই হয়, আমার যে কোন ইচ্ছেতে আমার স্বামী বাধা দেন না।

এদেশে বাড়িঘর নিয়ে বাংলাদেশী বা ভারতীয়দের মাঝে একধরনের আবেগ কাজ করে, যে আবেগের বশবর্তী হয়ে অনেকে বাড়িঘরে কাউকে নেমন্তন্ন করেও খাওয়ায় না। পাছে অতিথিদের আগমনে ঘরে-দুয়ারে এতটুকু দাগ পড়ে যায় অথবা দামী কার্পেটে কোকের গ্লাস উলটে পড়ে যায়! এমনি অনেক ধরনের বাতিক নিয়েই তারা বাড়িঘরকে 'ইন্দ্রপুরী' বানিয়ে রাখে এবং একধরনের 'সুখতৃপ্তিতে' আচ্ছন্ন থাকে। সেই দিক থেকে চিন্তা করলে আমরা এখনও 'গাঁইয়া' রয়ে গেছি। গাঁইয়া বলেই বাড়ি কেনার প্রথম বছরেই  পেছনের আঙিনা জুড়ে মাটি কুপিয়ে লাউ-কুমড়া, আলু, বেগুনের চাষ শুরু করে দিয়েছিলাম। প্রথম বছর সব্জীর ফলন ভালো হয়েছে।  এর রেশ ধরেই 'পদ্মবাড়ি' বানানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দ্বিতীয় বছরে  স্থল পদ্মের প্রচুর ডালা তৈরী করলাম। নিজে নিজেই মাটি খুঁড়ে  বাড়ির সামনের রাস্তার দুই পাশে পদ্মডালা লাগিয়ে দিয়েছি। এরপর বাড়ির চারপাশেও লাগিয়েছি আরও কতগুলো ডালা। প্রথম দিকে কী যে বিচ্ছিরী লাগতো দেখতে, ইঁট বিছানো রাস্তার দুই পাশে কাঠি বসানো, এখন হাসি পায় সে দৃশ্য মনে পড়লে। আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসে দুই একজন দামী অতিথি (বাঙ্গালী) মুখ টিপে হেসেও গেছে আমার পাগলামী দেখে। ত্যাছড়া মন্তব্য করতেও ছাড়েনি। ওদের বাড়ি-ঘর ইন্দ্রপুরীর মতই সাজানো-গোছানো, আমার এমন বেহাল অবস্থা দেখে বাঁকা হাসি দেয়ার অধিকার ওদের আছে, আমি শুধু আগামীর অপেক্ষায় থেকেছি। কল্পনায় দেখতাম, বিনা খরচেই আমার বাড়িকে সবুজ সুন্দর করে ফেলেছি।


 তৃতীয় বছরে কিছু গাছ বেড়েছে, কতগুলো একেবারেই বাড়েনি। কতগুলোতে ফুল ফোটার সীজনে ১০/১২টার বেশী ফুলও ফোটেনি। এদিকে বাড়ির পেছনের মূল গাছটিতে অসুখ হয়ে কেমন যেনো জবুথবু অবস্থা হয়ে গেছে দেখে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেছে। স্টোর থেকে 'সেলে' স্থায়ী জাতের কিছু ফুলের 'বালব' এবং বীজ ছড়িয়ে দিলাম। সময়মত সেগুলোতে ফুল ফুটলো। জিনিয়া ফুল এমনভাবে ফুটেছে যে অনেক দূর থেকেও এর উজ্জ্বল বেগুণী ও কমলা রঙ সকলকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডেকে আনে। বাড়ির পুরনো গাছগুলোর মধ্যে দুই তিনখানা খুব ভালো জাতের গোলাপ ফুলগাছ ছিল। সেগুলই মাঝে মাঝে ফুটে আমাকে সান্ত্বণা দিয়েছে। বছরের শেষে এবার আর গাছের ডালপালা কাটা হয়নি। শীতের তীব্রতায় সমস্ত পাতা ঝড়ে গিয়ে দূর্বল শরীরে ন্যাড়ামুন্ডি ডালপালা নিয়েই আমার স্থলপদ্মের গাছগুলো  দাঁড়িয়েছিল। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেছিল, পরিকল্পণা সার্থকতা না পাওয়ায়।


 কিনতু চতুর্থ বছরে এসেই আমার স্বপ্ন সার্থকতা পেতে শুরু করেছে। বাড়ির চারদিক সবুজ স্থলপদ্মের ছায়ায় ঢেকে যেতে শুরু করে।  স্বাভাবিক হিসেবে গাছগুলোতে ফুল ফোটে সেপ্টেম্বারের শেষে। 'বেবী পিঙ্ক' বা হালকা গোলাপী রঙের বড় বড় ফুলে ছেয়ে থাকে সমস্ত গাছ। ভ্রমর আর প্রজাপতি, মৌমাছিদের আনাগোনা শুরু হয়। আগে রাস্তা থেকে আমাদের বাড়িটি খোলামেলা দেখা যেত। এখন ঘন সবুজ, কচি সবুজের ফাঁক দিয়ে বাড়িটিকে উঁকি মারতে দেখা যায়। আমাদের প্রয়াত মালকিন বাড়ির প্রবেশ পথে আকাশ ছোঁয়া জ্যাকারেন্ডা গাছ লাগিয়েছিলেন, সেখানেও গ্রীষ্মের শেষে হালকা ম্যাজেন্টা রঙের ফুল ফুটে। এই গাছ দুটো খুবই সুন্দর, এই গাছের গোড়াতেই ধাক্কা লাগিয়ে চ্যাপ্টা করে ফেলেছিলাম আমাদের বিশাল টয়োটা ভ্যানের পেছন অংশ। তারপরেও গাছের উপর রাগ করিনি। গাছগুলোকে যত্ন করার সুযোগ পাইনা, শুধুই ভালোবাসি। গাছের প্রান আছে বলেই ওরা আমাদের ভালোবাসা বুঝতে পারে, আমাদের অপারগতায় কষ্ট  নেয়না, বিনা যত্নেই ওরা আমাদের ফুল-লতা-পাতায় ঘিরে রেখেছে।

আলসেমী করেই গত বছরের শেষে স্থলপদ্মের গাছগুলোকে কাটা হয়নি, ভেবেছিলাম শীতের শেষে ওরা আর সবুজ হবে না। আমাদের অবাক করে দিয়ে শীত শেষ না হতেই সারা গাছে পাতা আসতে শুরু করে। একসময় দেখি ওরাও বড় হয়ে আমাদের বাড়ির উচ্চতা ছাড়িয়ে আকাশ ছুঁতে চাইছে। প্রবেশ পথের দুই ধারে যে পদ্মের যে ডালা লাগিয়েছিলাম, সেগুলো বড় হয়ে দুই পাশ থেকে তোরণের মত  অবয়ব সৃষ্টি করেছে। ফুল ছাড়াই দেখতে ভাল লাগে। মাঝে মাঝে আমার স্বামী ভাবেন, গাছগুলোকে কেটে ফেলতে হবে। খুব বেশী বড় হয়ে গেছে। ভেবেছেন, এখনও কাটেন নি। ভালোবাসেন তো, এই জন্যই কাটতে পারছেন না। এ বছরের ২৯শে সেপ্টেম্বার আমাদের গৃহপ্রবেশের চার বছর পূর্ণ হবে। আমাদের অবাক করে দিয়ে অক্টোবারের বদলে জুলাই মাস থেকেই প্রতিটি গাছে একটা দুটা করে ফুল ফুটতে শুরু করেছে।  গাছের চারপাশে রঙ বেরঙের প্রজাপতির পাখায় আন্দোলন দেখি আর কানে আসে ভ্রমরের গুঞ্জন! এই তো চেয়েছিলাম, চাওয়া পূর্ণ হতে তিনটি বছর লেগে গেলো!

 প্রতি বছর দূর্গা পূজোতে নিবেদনের জন্য  থালিতে সাজানো নৈবেদ্যর সাথে  'পদ্মবাড়ির' স্থলপদ্মও নিয়ে যাই। দূর্গা পূজোতে পদ্মফুল লাগে। অক্টোবারে  দূর্গা পূজা হলে স্থলপদ্ম পেতে সমস্যা হয়না, কিনতু গত বছর একটু আগে হয়েছিল পূজা, গাছের উপর টর্চ ফেলে খুঁজে পেতে ১০/১২টা ফুল পেয়েছিলাম,  এতে আমার মন ভরে নি। এবার পূজা অক্টোবারের শেষে, আমার গাছে জুলাই থেকে ফুল ফুটতে শুরু করেছে, ভাবছি  এবারের  পূজাতে  কত ফুল নিতে পারবো!  ইচ্ছেমত ডালি সাজিয়ে ফুল নিয়ে যাব, আমাদের ভালোবাসার অর্ঘ্য দেবীর চরণে ঢেলে দেবো।

Thursday, September 27, 2012

আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনঃ জীবনের প্রথম ভোটটি কাকে দিতে পারি!


আগামী ৬ই নভেম্বার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আমেরিকার ৫৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এবারের নির্বাচন আমার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারন এবারই আমি প্রথমবারের মত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার অর্জন করেছি। নাগরিকত্ব পেয়েছি গত বছর, তাই সেই সুবাদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজের মত প্রকাশ করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করছি।
কিনতু আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা কোন প্রার্থীকে আমার ভোটটি দেবো। দেশে থাকতে জীবনে একবারই জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার মনোনীত প্রার্থী নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন। মনটাই খারাপ হয়ে গেছিল, জীবনের প্রথম ভোটটি এভাবে নষ্ট হয়ে গেল বলে। তাই এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আমার প্রথম ভোটটি নষ্ট হতে দেবো না। েমন একজনকে ভোটটা দিতে চাই, যিনি আগামী চার বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। আমি আমেরিকান রাজনীতি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাইনা, আমার কাছে ভাল লাগে দেশের রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করতে। দেশের সবকিছুতেই এক ধরনের হৈ হৈ, রৈ রৈ ব্যাপার থাকে, আমেরিকানদের মত এমন ম্যাড়ম্যাড়ে ভাব নেই আমাদের মধ্যে। এই যে এত বড় একটা নির্বাচন হতে যাচ্ছে, আমেরিকার রাস্তা-ঘাটে, হাটে বাজারে কোথাও কোন টুঁ শব্দটিও নেই! অথচ আমাদের দেশে নির্বাচনের এক বছর আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় নির্বাচন নিয়ে নানারকম কড়চা। পত্র পত্রিকায় তো বটেই, গ্রামের মেঠোপথের ধার ঘেঁষে নড়বড়ে যে চায়ের দোকান থাকে, সেখানেও ঘর ফিরতি হাটুরেদের রাজনীতি, দেশের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করতে দেখা যায়। এমনকি আমেরিকান নির্বাচন নিয়েও বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই শোরগোল পড়ে গেছে, অথচ খোদ আমেরিকার জনজীবনে এর বাহ্যিক কোন প্রভাব নেই। যে যার মত রুটিনমাফিক কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের দেশের নির্বাচনে কারো ভোট দেয়ার সুযোগ না থাকলেও নির্বাচন নিয়ে যে ডামাডোল সৃষ্টি হয়, চারদিকে থাকে উৎসবের আমেজ, মানুষের সেই উন্মাদনা দেখেও সুখ।

আমি থাকি আমেরিকার দক্ষিনী রাজ্য মিসিসিপিতে। মিসিসিপি আমেরিকার সবচেয়ে গরীব রাজ্য। জনগোষ্ঠীর অর্ধেক বা তার কিছু কম-বেশী হচ্ছে আফ্রিকান আমেরিকান। কালো জনগোষ্ঠির সকলেই ওবামার সমর্থক। যদিও মিসিসিপি রাজ্যের গভর্ণর রিপাবলিকান এবং মিসিপির গভর্ণর পদে আজ পর্যন্ত কোন ডেমোক্র্যাটকে নির্বাচিত হতে দেখা যায়নি। এই হিসেবে মিট রমনির গ্রহণযোগ্যতা আমাদের এখানে বেশী হওয়ার কথা। আমি চাকুরী করি ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টারে, যেখানে মিসিসিপির নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে সাধারন মধ্যবিত্তেরাই আসা-যাওয়া করে। উচ্চ মধ্যবিত্তরাও আসে বাজার করতে, তবে তাদের সংখ্যা খুব কম। সেই হিসেব মাথায় রেখেই আমার সহকর্মী এবং পরিচিত কিছু গ্রাহকের মধ্যে থেকে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল, সাদা এবং কালো মিলিয়ে কুড়িজনের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ওবামা এবং মিট রমনির মধ্যে কার জয়ের সম্ভাবনা খুব বেশী?

কালো আমেরিকানদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে আমাদের বাঙ্গালীদের অনেকাংশেই মিল আছে। বাঙ্গালী যেমন হৈ হৈ করতে ভালোবাসে কালোরাও সারাক্ষন হৈ চৈ, আনন্দ ফূর্তির মেজাজে থাকতে ভালোবাসে, এদের গলার জোরও অনেক বেশী। ব্ল্যাকদের সকলেই খুব উঁচু গলায় বলেছে, তারা ওবামাকে সমর্থন করে। ওবামার সমর্থক বুঝানোর জন্য অনেকেই ওবামার হাসিমুখের ছবি সম্বলিত টি শার্ট পড়ে থাকতে ভালোবাসে।

যে কয়জন হোয়াইট আমেরিকানকে প্রশ্ন করেছি, তাদের মধ্যে মতভিন্নতা পেয়েছি। দুইজন বলেছে, তারা ভোট দিতে যায় না। তাদের আগের প্রজন্ম থেকে এই রীতি চলে আসছে। ভোট দেওয়া নাগরিক দায়িত্ব স্বীকার করেও ভোট দেয়ার মধ্যে তারা কোন সার্থকতা খুঁজে পায়না। তাদের মতে, ‘যে যায় লংকা, সে-ই হয় রাবণ’। ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান, যে-ই জয়ী হোক, সাধারণ জনগনের কোন লাভ নেই। তাদের সেই উঁচু মূল্যে গ্যাস কিনতেই হয়, অগ্নিমূল্যে নিত্য ব্যবহার্য্য জিনিস কিনতেই হয়, অসুস্থ হলে হাসপাতালের উচ্চমূল্যের চিকিৎসা খরচের বিল মাসে মাসে পরিশোধ করতেই হয়, অথচ চাকুরীতে বেতন বাড়ে না, যে কোন সময় চাকুরী হারাবার ভয় থাকে। কাজেই নির্বাচন নিয়ে তারা ভাবে না।

আরেক হোয়াইট লেডী ওবামাকে ভোট দেবেনা তা জোর গলায় বলেছে এবং সেই সাথে এটাও বলেছে যে যারা ডেমোক্র্যাটদের ভোট দেয় তারা গাধার বেহদ্দ। এমন কথা শুনে পাশে থাকা ওবামার সমর্থক কালো মেয়ের মুখটি আরও কালো দেখায়। কিনতু সহকর্মীর সামনা সামনি কিছুই বলার সাহস না পেলেও, আড়ালে গিয়েই বাকী কালো বন্ধুদের একসাথে জড়ো করে শুরু করে দেয় ফিসফাস, সমালোচনা। তবে ব্যাপারটা আর বেশীদূর গড়ায়নি।

আরেকজন বলেছে, সে ওবামা বা রমনি, কাউকেই ভোট দেবেনা। রমনিকে সে যোগ্য প্রার্থী হিসেবে মনে করেনা বলেই রিপাবলিক দলের সমর্থক হয়েও তার মূল্যবান ভোটটি অপছন্দের ব্যক্তিকে দিবেনা। কৌতুহল থেকেই জানতে চাইলাম, সারা আমেরিকাবাসী ওবামা আর রমনি থেকে একজনকে বেছে নিবে, আর তোমার মত কিছুলোক ভোট না দিয়ে নিজের ভোটটা জলে ফেলতে চাচ্ছ কেন? উত্তরে সে বললো যে অধিকাংশ আমেরিকানদের মাথায় ঘিলু বলে কিছু নেই। তারা অলস, বুদ্ধি বিবেচনা বলে একটা বস্তু যা ওর পোষা কুকুরের মাথায়ও আছে, তার ছিটে ফোঁটাও অলস আমেরিকানদের মাথায় নেই। তার ভোট জলে যাক অসুবিধা নেই, কিনতু তার বিবেক তো জলে যাচ্ছেনা।

আমি সর্বমোট বিশজন আমেরিকানকে প্রশ্ন করেছিলাম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে তারা কি ভাবছে! বিশজনের মধ্যে ১২জন (সকলেই আফ্রিকান-আমেরিকান) ওবামাকে ভোট দিবে, ৪ জন (হোয়াইট) রমনিকে ভোট দিবে, একজন (কালো) বলেছে ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশী তাকে দেবো’ আর বাকী তিনজন (হোয়াইট) ভোটই দিবেনা।

সাধারন আমেরিকানদের মতামত শুনে সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি বলেই প্রবাসী বন্ধুদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম। প্রথম ব্যক্তিটি আমার স্বামী। আমেরিকান নাগরিক হিসেবে জীবনের প্রথম ভোটটি ওবামাকে দিবেন, এর মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। গত ইলেকশানে আমার স্বামী ও দুই কন্যা ওবামার সমর্থনে ক্যাম্পেইন করেছিল। আমি ছিলাম হিলারী ক্লিন্টনের সাপোর্টার। প্রার্থী নির্বাচনে হিলারী হেরে যেতেই নির্বাচন নিয়ে আমার সকল উৎসাহে ভাঁটা পড়েছিল। মনে  দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে, আমি যাকে সমর্থণ করি, সে শেষ পর্যন্ত হেরে যায়।

হিলারী ক্লিন্টনকে আমি সমর্থন করেছিলাম অনেকগুলো কারনে। তাঁর মত এমন সুন্দরী, উচ্চশিক্ষিতা, স্মার্ট এবং বুদ্ধিমতী নারী আমার জীবনে আমি দেখিনি। স্বামী বিল ক্লিন্টনের ‘মনিকা’ সম্পর্কিত কেলেংকারী যেভাবে উনি ট্যাকল করেছিলেন, আমি জানিনা আমেরিকার অন্য ফার্স্ট লেডীরা ওই অবস্থায় পড়লে কি করতেন। তাছাড়া হিলারীতো শুধুই ফার্স্ট লেডী ছিলেন না, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার মত সকল যোগ্যতা তাঁর ছিল। এমনকি হিলারী ক্লিন্টন প্রেসিডেন্ট হলে আমেরিকার যুদ্ধবাজ পলিসিতেও অনেক পরিবর্তন আসতে পারত। যাই হোক, আমেরিকান জনগন কোন নারীকে দেশের প্রধান হিসেবে দেখতে চায় না। তারা নারীকে ফার্স্ট লেডী হিসেবে, স্বামী সোহাগীনি হিসেবে দেখতে ভালোবাসে, নেত্রী হিসেবে চায়না। এই একটা ব্যাপারে আমরা আমেরিকানদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী নেত্রী দুজনেই নারী, ভারতে ইন্দিরা গান্ধী তো ছিলেন রূপে গুনে, বিদ্যা-বুদ্ধিতে অতুলণীয়, পাকিস্তানেও বেনজীর ভুট্টোকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়েছিল পাকিস্তানী জনগন অথচ গনতন্ত্রের দেশ আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে কোন মহিলাকে নির্বাচিত হতে দেখেনি বিশ্ববাসী।

প্রবাসী বন্ধুদের সকলেই উচ্চশিক্ষিত, মোটামুটি স্বচ্ছল। সকলেই ওবামার সাপোর্টার। ওবামার মধ্যে সকলেই নিজেদের জীবনের মিল খুঁজে পায়। অধিকাংশই মনে করে, মিট রমনি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছেন, দারিদ্র্য বা অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা সম্পর্কে তাঁর কোন ধারনাই নেই। সেই তুলনায় ওবামার জীবনটাই ছিল এক বিশাল সংগ্রামের। তাঁকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে বড় হতে হয়েছে। একমাত্র তিনিই বুঝতে পারবেন মধ্যবিত্তের নিত্য জীবনের যন্ত্রনা। সকলেই মনে করে, রমনি শুধু বড় বড় স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, স্বপ্ন বাস্তবায়ন কিভাবে করবেন সেই সম্পর্কে কোন ধারনাই দিচ্ছেননা, যেখানে ওবামা স্বপ্নও দেখাচ্ছেন এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের সম্ভাব্য পথগুলিও দেখাচ্ছেন। ওবামার প্রেসিডেন্ট হিসেবে চার বছরের অভিজ্ঞতা আছে যেখানে রমনি একেবারেই নতুন। ওবামা বিরোধীদের মতে, ওবামা প্রথমবারের দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি। ওবামা সমর্থকের উত্তর তৈরী, যে জঞ্জাল জর্জ বুশ রেখে গেছিলেন, এক টার্মে সেই জঞ্জাল পরিষ্কার করা সম্ভব হয় নি, সেই জন্যই ওবামাকে আরেক টার্মের জন্য নির্বাচিত করা উচিত।

অবশ্য দুজনের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কারো মনে কোন প্রশ্ন নেই, দুজনেই বিখ্যাত হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাশ করেছেন। দাম্পত্য জীবনেও দুজনকেই সুখী মনে করে সকলে,  পিতা হিসেবেও দুজনই ভাল। দুজনেই সুদর্শন এবং স্মার্ট। তবে বয়সের দিক থেকে তরুণ ওবামা এগিয়ে আছেন। সাধারন জনগনের মতে, ওবামা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি, রমনি উচ্চবিত্তের প্রতিনিধি। জনগন যদি নতুন কিছু পাওয়ার আশায় পরিবর্তন চায় তাহলে রমনি হচ্ছে যোগ্য ব্যক্তি, আর অনিশ্চিতের পথে না গিয়ে পরীক্ষিত প্রতিনিধি চাইলে ওবামাই হচ্ছে যোগ্য প্রার্থী।

তাহলে কে জয়ী হবেন আসন্ন নির্বাচনে? আপাততঃ সরল হিসেব অনুযায়ী ডেমোক্র্যাট ভোট দিবে ওবামাকে, রিপাবলিকান ভোট দিবে রমনিকে, প্রবাসীদের অধিকাংশই ভোট দিবে ওবামাকে। বাকী থাকে নীরব ভোটার এবং নির্দলীয় ভোটার। তারা অপেক্ষা করছে দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য ডিবেটটির জন্য। ওবামা সমর্থকদের দৃঢ় বিশ্বাস, তুখোড় বক্তা ওবামার মনোমুগ্ধকর বক্তব্য শুনে নীরব ভোটারদের অধিকাংশই ওবামাকেই ভোটটি দিবে। আর রমনির সমর্থবৃন্দ মনে করে, আমেরিকান জনগন চার বছর ওবামার শাসন প্রত্যক্ষ করেছে। আমেরিকাবাসী সব সময়ই পরিবর্তন চায়। তাই রমনিকেই তাদের ভোটটি দিবে।
আর আমার মত নির্দলীয় ভোটাররা অপেক্ষা করবো আসন্ন ডিবেটটি দেখার জন্য। সেদিনই আমেরিকার আগামী প্রেসিডেন্টের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাবে।

Wednesday, September 26, 2012

মজনুর ঠোঁটে চেপে রাখা ছোট্ট টুথপিকের কাঠি


হুমায়ুন আহমেদের' কোথাও কেউ নেই' নাটকের 'মজনু'কে মনে আছে? যার মুখে সব সময় ছোট্ট একটি কাঠি  থাকত। কথা বলার সময় কাঠিটি সে নিপুন দক্ষতায় ঠোঁটে চেপে রাখতো।  মজনু ছিল বখে যাওয়া এক যুবক, যে আরেক বখে যাওয়া যুবক 'বাকের ভাই' এর চেলা ছিল। বখে যাওয়া যুবকদের নিজস্ব কিছু স্টাইল থাকে। বাকের ভাইয়ের হাতে থাকতো একখানা চেইন, যা সে সারাক্ষন বনবন করে ঘুরাতো এবং মজনুর ছিল ঠোঁটে চেপে রাখা কাঠি। বদি'র কোন নিজস্ব স্টাইল ছিলনা বলেই বদিকে ঠিক বখে যাওয়া যুবক মনে হতো না।  সমাজের বখে যাওয়া যুবকদের কেউ ভালোওবাসেনা, মনেও রাখেনা। একমাত্র  'কোথাও কেউ নেই' র বাকের, বদি, মজনু ব্যতিক্রম। সেইজন্যই মজনুর মুখে কাঠি ধরে রাখার ছোট্ট কৌশল থেকে শুরু করে প্রতিটি ডায়ালগ এখনও সবার মনে আছে।

'কোথাও কেউ নেই' নাটকে মজনুকে দেখার প্রায় আঠারো বছর পরে আবার আরেক মজনুকে দেখছি গত দুই বছর ধরে, একই ভঙ্গীতে খুবই নিপুনভাবে একখানা টুথপিক দুই ঠোঁটে চেপে রাখতে।  তবে ইনি  কোন বখা যুবক নন, যথেষ্ট বয়স্ক একজন ভদ্রলোক, আমাদের ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের সম্মানিত গ্রাহক।  গত দুই বছর ধরে ফোন সম্পর্কিত যে কোন প্রয়োজনে বৃদ্ধ মজনু সরাসরি আমার ডেস্কে চলে আসেন, তাঁর ধারনা আমি ছাড়া আর কেউ তাঁকে সাহায্য করতে পারবেনা।  কিছু কিছু গ্রাহকের আমার প্রতি এই ধরনের মনোভাবকে আমি খুবই পজিটিভলি দেখি। এমনও হয়, কেউ কেউ এসেই আমার খোঁজ করে, আমি যদি অনুপস্থিত থাকি, ওরা জেনে নেয় পরবর্তী কোনদিন আমি থাকবো। নির্দিষ্ট দিনে যখন অফিসে যাই, সহকর্মীরা জানিয়ে দেয়, আজকে তোমার 'কাজিন' অথবা 'আঙ্কল-আন্টি' আসবে। আমি ওদের কথা শুনে হেসে ফেলি। আসল কথা, আমি বাঙ্গালী কায়দায় 'আসেন, বসেন' স্টাইলে গ্রাহকদের সাথে কথা বলি, এতেই বয়স্করা খুব খুশী হয় এমন আন্তরিকতা দেখে। আমার আলোচিত 'মজনু' হচ্ছে ঐ গুটি কয় আঙ্কলদের একজন।

ভদ্রলোককে প্রথম দিন দেখেই আমার 'মজনু'র কথা মনে পড়েছিল। কারন, কথা বলার সময় তাঁর মুখের কাঠি একবারও এদিক সেদিক হয়না, এবং খুবই আশ্চর্য্যজনকভাবে তাঁর গলায়ও  মজনুর স্টাইলে শীত গ্রীষ্ম বারোমাস একখানা মাফলার জড়ানো থাকে। আমি গ্রাহকদের সাথে অনেক রকমের গল্প করি নিজের প্রয়োজনে, আমার খুবই ভাল লাগে মানুষকে জানতে। কত ধরনের নতুন নতুন গল্প শুনি তাদের কাছ থেকে। দুই বছরের বাচ্চা থেকে শুরু করে আশি বছরের বৃদ্ধের সাথে গল্প করে আমি আনন্দ পাই, অবশ্যই তারাও যদি আমার সাথে গল্প করে মজা পায়। আমেরিকান মজনুকে অবশ্য  গত দুই বছরে  একবারও জিজ্ঞেস করিনি মুখে কাঠি রাখার কারন কি। আজ তাঁকে দেখামাত্রই  মনে মনে ঠিক করে নিয়েছি, মুখে কাঠি রাখার মাহাত্ম্য জানতে চাইব। যথারীতি উনার ফোন রিলোড করে দিলাম এবং জানতে চাইলাম,

-আচ্ছা, তোমাকে তো সব সময় মুখে একখানা কাঠি নিয়ে ঘুরতে দেখি, ঘুমের মধ্যেও কি কাঠিটি তোমার মুখে থাকে?

-না না না, বিছানায় যাওয়ার আগেই কাঠি ফেলে দেই  (আমার প্রশ্ন শুনে বেশ অপ্রস্তুত দেখায় তাঁকে)

-যদি কিছু মনে না করো, আমি কী জানতে পারি কাঠিটি মুখে রাখার কারন কি? এটা কি তোমার ছেলেবেলার অভ্যাস?

- না, ছেলেবেলার অভ্যাস না, দশ বছরের অভ্যাস। আমি ছিলাম চেইন স্মোকার, কিনতু আরও অনেক বছর বাঁচার আশায় দশ বছর আগে স্মোকিং ছেড়ে দেই। আসলে স্মোকিং আমার অনেক ক্ষতি করেছে, তাই  ডাক্তারের  কঠিন নিষেধ ছিল।  কিশোর বয়সে সিগারেট ধরেছি, এত বছরের নেশা কী এক কথায় ছাড়া যায়?  অথচ ছাড়তেই হবে, কাঠিটি তখন থেকে মুখে রাখতে শুরু করি, সিগারেটের বিকল্প হিসেবে।

-সিগারেটের বিকল্প এই কাঠি? সিগারেটের বিকল্প তো আরও কতকিছুই পাওয়া যায় এদেশে। কাউকে আমি কাঠি মুখে নিয়ে ঘুরতে দেখিনি এর আগে।

-সিগারেটের বিকল্প অনেক কিছুই পাওয়া যায় খুবই সত্যি, তবে সেগুলোও পয়সা দিয়ে কিনতে হয়। সিগারেটের পেছনে যা খরচ, সিগারেটের বিকল্প কিনতে গেলে খরচ বেশী ছাড়া কম না।

- তা অবশ্য ঠিক। তা বিনা খরচে সিগারেটের নেশা ভুলে থাকার এই পদ্ধতিটি  কে বলেছে , তোমার স্ত্রী? 

উপরের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ঈশ্বর দিয়েছেন এই বুদ্ধি।  স্মোকিং  ছেড়ে আমার তখন খুব কষ্ট হতো, রাতের পর রাত ঘুম আসতো না,  ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করতাম। উনিই আমাকে বুদ্ধিটা মগজে ঢুকিয়ে দেন।

- ছোট্ট একখানা কাঠি, তোমাকে নানা রকম কঠিন ব্যাধির আক্রমণ থেকে দূরে রেখেছে! এই কাঠির অনেক শক্তি দেখছি!

-হুম, একটা দেশলাই কাঠির মতই ক্ষমতা!

ভদ্রলোক দেশলাই কাঠির কথা বলতেই আমি বললাম, আমাদের দেশের এক কবি অনেক আগে দেশলাই কাঠির ক্ষমতা নিয়ে একখানা কবিতা লিখেছিলেন।

ধূমপান যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তা পৃথিবীর সকলেই জানে। প্রতিটি দেশেই ধূমপানের বিরূদ্ধে প্রচারণা আছে কিনা তা আমি সঠিক জানিনা, তবে আমাদের দেশে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে, ' ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর'। ডাক্তারের কাছে গেলে সেখানেও রুগীকে সিগারেট না খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়। কিনতু ধূমপান যাদের নেশা, সেই নেশা কাটাতে গেলে বিকল্প কিছুর ব্যবস্থা না থাকলে রুগীকে মহা সমস্যায় পড়তে হয়। ডাক্তারের ভয়ে প্রথম দুই একদিন সিগারেট খাওয়া বন্ধ রাখলেও পাঁচ দিনের মাথায় তা আবার  পূর্ণ উদ্যমে শুরু হয়। যুক্তি হিসেবে সকলেই প্রায় একটি কথাই বলে, মনের উপর নানাদিক থেকে আসা চাপ কমাতে নিকোটিনের ধোঁয়ার বিকল্প আর নেই। সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যেই থাকে 'মনভুলানী' গান।  'সিগারেট  স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর'  শ্লোগান বার বার শুনতে শুনতেই বোধ হয় অনেকে  ভাবে, ভাল ব্র্যান্ডের সিগারেট খেলে ক্ষতি কম!  ব্র্যান্ড নেম এর সিগারেটে নিশ্চিন্ত মনে টান দিয়ে যায়, সব বুঝেও মানতে চায় না, যা ক্ষতিকর, তা সব নামেই ক্ষতিকর। বিড়ি যা ক্ষতি করবে, ফিল্টার দেয়া তামাকও একই ক্ষতিই করে।  তাছাড়া অর্থদন্ডীর দিকটাও কম ইম্পর্ট্যান্ট নয়!  খুব ভাল ব্র্যান্ডের সিগারেটের প্যাকেট এত বেশী দামী হয় যে ধনী ব্যতীত কিনতে গেলে অন্য যে কারো পকেটে টান পড়ে। এই কারনেই  নেশ ধরে রাখতে  ফিরে যেতে হয়  সেই চিরপরিচিত সস্তা দামের সিগারেট অথবা বিড়ির অভ্যাসে।

এদেশে অবশ্য সিগারেট কিনতে গেলে আই,ডি দেখাতে হয়। যে কোন তামাক জাতীয় দ্রব্য কিনতে গেলেই ক্রেতাকে কমপক্ষে ২১ বছর বয়সী হতে হবে। এর নীচে কারো কাছে টোব্যাকো বিক্রী করা আইনতঃ দন্ডনীয় অপরাধ। তামাক বা সিগারেটের স্টলেই থাকে সিগারেটের বিকল্প নানা জিনিস। তামাক ছাড়া সিগারেট, তামাকের ফ্লেভারে নানা রকমের লজেন্স বিক্রী হয়। আরেকটি জিনিস বিক্রী হয়, তা হচ্ছে 'প্যাচ'। প্যাচ হচ্ছে একটা ছোট ডিভাইস যা হাতের পাতলা চামড়ার নীচে লাগিয়ে দেয়া হয়। প্যাচ থেকে যে কেমিক্যাল নির্গত হবে, সেই কেমিক্যালই ধূমপায়ীর দেহে বা মস্তিষ্কে ধূমপানের আকাংক্ষা মেটানোর কাজ করে। তবে এ সবই ডলার খরচ করে কিনতে হয়। টোব্যাকো প্রোডাক্ট যেমন চড়া মূল্যে কিনতে হয়, টোব্যাকো নেশা থেকে পরিত্রাণের রসদও চড়া মূল্যেই কিনতে হয়।

এখানে পুরুষ ও নারী, উভয়েই ধূমপান করে সমানতালে। কেউ কারো চেয়ে কম যায় না। তাদের সংসার খরচের বিরাট এক অংশ জুড়ে আছে সিগারেট। নিজেরা স্বীকার করে সিগারেটের ক্ষতির কথা, অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্য, দুই দিক থেকেই যে সিগারেট ক্ষতি করে চলেছে তা স্বীকার করে নিয়েও তারা রেগুলার সিগারেট টানে।   কারো কারো নেশা এমনই বেশী যে কাজ চলাকালীন সময়ের মধ্যেই টুক করে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। সিগারেট টেনে আবার কাজে ফিরে। কে কৈফিয়ত চাইবে? মাথার উপর 'ম্যানেজার' নামের বস যিনি থাকেন, তিনি নিজেও এই একই দোষে দুষ্ট। সহকর্মীদের দেখি, পকেটে টান পড়লে দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়, কিভাবে পরবর্তী দিনগুলো চলবে তা ভেবে মাথা এলোমেলো হয়। অথচ একবারও ভাবেনা, সিগারেটের নেশা কাটাতে পারলেই বিরাট বড় মুশকিল আশান হয়ে যায়। মুখে স্বীকার করে, সিগারেটের পেছনেই তাদের অর্ধেক খরচ, তারপরেও পারেনা এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে।

নানা রকম বিধি নিষেধ, সিগারেটের বিকল্প এত কিছু থাকার পরেও, উন্নত দেশগুলোতে ধূমপায়ীদের সংখ্যা বাড়ছে ছাড়া কমছেনা, আর আমাদের দেশের কথা ভাবলেই চোখে সর্ষে ফুল দেখি। নুন আনতে পান্তা ফুরায় যাদের, তারা কোথায় পাবে দামী ফিল্টার লাগানো সিগারেট? তাদের কাছে বিড়িই সম্বল। তাছাড়া ফিল্টার লাগানো সিগারেটই কি খুব ভাল?  লেখক হুমায়ূন আহমেদ  তো নিশ্চয়ই ভালো সিগারেটই খেতেন, তবুও কি পেরেছেন নিজের লাংস দুটোকে সুস্থ রাখতে! আমার  এক বন্ধু, যার দুইবার হার্ট এটাক অলরেডী হয়ে গেছে, তার দুই আঙ্গুলের মাঝে  দামী সিগারেটের শলা একটার পর একটা পুড়তে থাকে। ডাক্তারের কড়া নিষেধ থাকা সত্বেও নেশা কাটাতে পারছেনা বন্ধুটি, অথচ সে স্বপ্ন দেখে আরও অনেক বছর বেঁচে থাকার, মেয়ে বিয়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখে, নাতি-নাতণীদের সাথে খেলা করার স্বপ্ন দেখে।  মাঝে মাঝে মনে হয়, দেহের জন্য, জীবনের জন্য ক্ষতিকর নেশা গুলোর প্রতিই মানুষের এত ঝোঁক কেন! যে মানুষটি জীবনের নানা কঠিন যুদ্ধে জয়লাভ করে সাফল্যের চূড়ায় উঠতে পেরেছে, সে-ই কিনা সিগারেটের মত তুচ্ছ একটি জিনিসের বিরূদ্ধে লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে!  জীবনের অর্জিত সাফল্য ভোগ করতে হলেও তো সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে হবে! কে জানে, হয়তো তামাকের গন্ধের ভেতরই তারা বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজে পায়!  আমার বন্ধুটিও হয়তো এজন্যই সব জেনে বুঝেও একটার পর একটা সিগারেট টেনে চলে।

সিগারেটের ক্ষতিকর দিক  নিয়ে যুগ যুগ ধরেই গবেষণা হয়েছে, নতুন করে লেখার কিছু নেই। হঠাৎ করেই লিখে ফেললাম, লিখেই মনে হচ্ছে, জানা জিনিস নিয়ে কচকচানি করার কোন অর্থই হয় না। এই লেখাটি লেখারও কথা ছিল না,  কেনো যে  আমেরিকান মজনু'কে দেখামাত্র কোথাও কেউ নেই' নাটকের মজনুকে মনে পড়ে গেলো!  সেই মজনুকেও নাটকের কোন এপিসোডে  সিগারেটে টানতে দেখিনি! বৃদ্ধ মজনুও গত দশ বছর ধরে সিগারেট ছেড়েছেন। নাটকের মজনু মুখে কাঠি কেনো রাখতো তা অবশ্য জানা নেই, তবে আমেরিকান 'মজনু' সাহেব মুখে কাঠি চেপে রেখে সিগারেটের ভয়াল নেশা থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন। বলতেই হয়, আমেরিকান মজনুর মনের জোর আছে, বেঁচে থাকার আকুলতা আছে। তাঁর এই মনের জোরটাই আমাকে লেখাটি লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে। লেখাটির ঊদ্দেশ্য হচ্ছে, মুখে  চেপে রাখা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি অথবা ছোট্ট টুথপিক কাঠির আইডিয়া ছড়িয়ে পড়ুক সকল ধূমপায়ীদের মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, বেঁচে থাকুক সকলেই আরও কিছু বছর সুস্থ দেহে।

Monday, September 24, 2012

পেনী ডানকান ও তার কুকুর স্পার্কী

পেনী ডানকানের সাথে প্রায়ই আমার দেখা হয়। আমি ওয়ালমার্ট নামের যে সুপার সেন্টারের ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে চাকুরী করি, পেনী তার আশেপাশেই অন্য ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। পেনী হোয়াইট আমেরিকান হলেও দেখতে গড় আমেরিকান মেয়েদের মত সুন্দরী না। তার উপর ওর হিয়ারিং প্রবলেম আছে বলে কারো সাথেই সে সাবলীলভাবে গল্প করতে পারেনা। ওর বয়স আটাশ ঊনত্রিশের বেশী হবেনা। ওর সাথে বেশীর ভাগ সময় দেখা হয় টী-রুমে। ফেস টু ফেস কথা বললে তবেই ও কথা বুঝতে পারে। তবে মেয়েটি খুব ভালো। টী ব্রেকে মাঝে মাঝেই ওকে হাই হেলো দেই।

দিন পনেরো আগের কথা বলছি। আমি ফ্রেশ রুমে ঢুকতেই পেনীকে দেখলাম চোখ মুছছে। কাউকে কাঁদতে দেখলে আশেপাশের সকলে উতলা হয়ে ক্রন্দনরতকে জিজ্ঞেস করে, ' ইজ এনিথিং রং? আর ইউ ওকে"? এটা আমেরিকায় একটি সামাজিক রীতি, আমিও রপ্ত করেছি আমেরিকান এই সুন্দর রীতি। পেনীর কাছে গিয়ে ওর পিঠে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম, " আর ইউ ওকে? ইজ এনিথিং রং"? আমার কথা শুনে পেনীর কান্না বেড়ে গেল। সে শুধু বলতে পারলো, ওর খুব খারাপ সময় যাচ্ছে। দিনটা খুবই খারাপ ওর জন্য। আমি ভেবেছি, চাকুরী নিয়ে কোন সমস্যা হলো কি না! জিজ্ঞেস করলাম যে ম্যানেজার কিছু বলেছে কিনা। ও বললো, " না ম্যানেজার কিছু বলেনি,  আমার বেবীর অবস্থা খুব খারাপ। ওকে হসপিটালে পাঠাতে হয়েছে"।
-কী হয়েছে তোমার বেবীর? বেবীকে হসপিটালে পাঠিয়ে তুমি এখানে কেনো? ছুটি নিয়ে চলে যাও!
-না, ওকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
-চিন্তা করোনা, ঠিক হয়ে যাবে। ওর বয়স কত?
-সাত বছর। কালকেই ওর শরীর বেশী খারাপ করেছে, ভেটেরেনারী হাসপাতালেই ছিল, অপারেশান শেষে বাড়িতে পাঠিয়েছিল, কিনতু কাল থেকে ওর কিডনি ফাংশান একেবারেই বন্ধ।
-ওয়েইট ওয়েইট, তুমি কার কথা বলছো এতক্ষন ধরে?
-আমার বেবী, আমার স্পার্কি ,আমার প্রিয় ডগি'র কথা বলছি।
আমি ওকে বুঝতে দিলামনা যে আমি এতক্ষন ওর বাচ্চার কথা ভেবেছিলাম। এদেশে কুকুর-বেড়ালকেও ওরা 'বেবী' মনে করে, মানুষের বাচ্চার মতই আদর যত্ন করে। জানতে চাইলাম ওর 'স্পার্কী'র কি হয়েছে।
-স্পার্কির কিডনীতে স্টোন হয়েছিল। অপারেশান করে স্টোন বের করা হয়েছে, গত সপ্তাহেই ওকে বাড়ী নিয়ে এসেছি। কিনতু গতকাল থেকেই ও আর পি পি করছেনা দেখে আবার ওকে পশু হসপিটালে এডমিশান করিয়েছি। ডাক্তার কোন হোপ দেখছেনা, ইনজেকশান দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে।
-তুমি কেঁদোনা, তোমার স্পার্কী ভাল হয়ে যাবে।
-জানিনা, ডাক্তার বলেছে ওর কিডনী একেবারেই ফেইলড। কিডনী ফাংশান না করলে কি যে হবে!
-তোমার কি মনে হয়, কিডনী ফাংশান না করলে ডায়ালিসিস করা হবে?
-হতে পারে!
 এ পর্যন্ত শুনে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। গেল বছর আমার কাজিনের হাজব্যান্ড মারা গেল কিডনী ফেইল করে, ডায়ালিসিস করা অনেক ব্যয় সাপেক্ষ ব্যাপার হওয়া সত্বেও তা করানো হয়েছিল। কিনতু শেষ রক্ষা হয়নি। আমরা মানুষের কিডনী ফেইলিওরের কথা শুনে অভ্যস্ত, কুকুরের কিডনী আদৌ আছে কিনা, থাকলেও মানুষের কিডনীর মতই তা অতি জরুরী কিনা সেটা নিয়ে ভাবার অবকাশ পাইনি কোনদিন।
আমাদের দেশেও শহরের কিছু বাড়িতে দুই একটি বেড়াল বা কুকুর পুষতে দেখা যায়। কিনতু তারা কী কুকুরের জন্য  ঠিক পেনীর মত করেই কাঁদে?  জানিনা, তেমন অভিজ্ঞতা আমার হয়নি। তবে ছোটবেলায় আমরা কেঁদেছিলাম 'টমি'র জন্য। আমার  দাদুর বাড়ীতে দারুন সুন্দর এক কুকুর ছিল, নাম 'টমি'। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা সবাই চলে গেছিলাম শহর ছেড়ে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাড়ী ফিরে দেখি 'টমি' শুয়ে আছে বাড়ীর উঠোনে। এই কয়মাস কে ওকে খেতে দিয়েছে, কে জানে! তবে খাওয়া দাওয়ার খুব কষ্ট হয়েছিল, তা ওর শরীরের দিকে তাকিয়েই বোঝা গেছিল। আমরা বাড়ী ছেড়ে পালিয়েছিলাম নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য। এত আদরের 'টমি'র কথা মনেও পড়েনি, অবশ্য টমি যদি মানুষ হতো, অবশ্যই সাথে করে নিয়ে যেতাম। কুকুর তো কুকুরই। ওকে ফেলেই চলে গেছিলাম। তবে টমি এই বাড়ী ছেড়ে কোথাও যায়নি। আমরা ফিরে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই টমি মারা যায়। মৃত্যুর আগে টমি বোবা চোখে তাকিয়েছিল আমাদের দিকে। চোখ দিয়ে জল পড়ছিল ওর, আমরাও কেঁদে ফেলেছিলাম। ওর মৃত্যুর পরে ওকে অনেক যত্ন করেই মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল। ব্যস! ঐ পর্যন্তই।  পাড়া গাঁয়ের প্রায় সব বাড়ীতেই এক আধটা কুকুর দেখা যায়। দুপুরে সকলের খাওয়া দাওয়া শেষ হলে উচ্ছিষ্ট খেতে দেয়া হয় ওদেরকে, সেটাই ওরা সোনামুখ করে খায়। ঘরে-দুয়ারে ঢুকতে পারেনা, ফেলে দেয়া কাঁটা, মাংসের হাড্ডি খেয়ে দেয়ে বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। এই তো, আমাদের দেশে কুকুর বেড়ালের জীবন চিত্র।

মুক্তিযুদ্ধের আগে দেখতাম, ভাদ্রমাস এলেই মিউনিসিপ্যালিটি থেকে ট্রাক নিয়ে ডোমেরা বের হয়ে আসতো, রাস্তায় কোন কুকুর দেখলেই হাতের সাঁরাসি দিয়ে সেই বেওয়ারিশ কুকুরের গলা চিপে ধরে মেরে ফেলতো। সেই মরা কুকুরকে ট্রাকের ভেতরে থাকা আরও অসংখ্য মৃত কুকুরের উপর ফেলে দিত। আমরা তখন ব্যস্ত হয়ে পড়তাম যার যার নিজেদের বাড়ীর পোষা কুকুরের গলায় বেল্ট পরিয়ে রাখতে। তবে ট্রাকের ভেতর নিথর দেহের কুকুরগুলো দেখে আমার সেই ছোট্ট শিশু শরীর ভয়ে কুঁকড়ে যেত।

স্পার্কির কথায় ফিরে আসি। তিনদিন পরেই পেনীর সাথে আবার দেখা হতেই স্পার্কীর শরীর কেমন আছে জানতে চেয়েছিলাম। ও খুব খুশী মুখে বলেছে স্পার্কী ভাল হয়ে যাচ্ছে। এটা শুনে কৃত্রিম ভদ্রতা দেখিয়ে বললাম, " দেখেছো, সেদিন বলেছিলাম স্পার্কী ভাল হয়ে যাবে"। পেনী আমাকে অনেক ধন্যবাদ দিতে লাগলো, ওর স্পার্কীর জন্য প্রে করেছি বলে, বারবার স্পার্কীর খোঁজ নিয়েছি বলে। শুকনো হাসি দিয়ে আমি চলে এসেছি। নিজের মনে একটু অপরাধ বোধ হলো, আমি তো ওর স্পার্কীর জন্য প্রে করিনি, স্পার্কীর কথা ভুলেই গেছিলাম। অথচ ও জানে যে আমি খুব প্রে করেছি। আমি কিভাবে পেনীর কুকুরের জন্য প্রে করবো? আমি তো নিজের দেশের ভাই বোন, মা বাবার রোগ শোক নিয়েই জর্জরিত। আমার কাছে পেনীর কুকুরতো আর কোনভাবেই মানুষের চেয়েও জরুরী হতে পারেনা!

তিনদিন আগেই পেনীর সাথে আবার দেখা টী রুমে। জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি কেমন আছো? তোমার বেবী কেমন আছে"?
-আমার স্পার্কীকে ডাক্তার ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।
-কেন ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে কেন?
-কারন ওর কিডনী আর কাজ করছেনা।
-ঘুম পাড়িয়ে কতদিন রাখবে?
-ঘুম পাড়িয়েই দিয়েছে।
আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না, ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারটা। সরাসরি জিজ্ঞেস করতেও পারছিলাম না, কুকুরটা মারা গেছে কি না। অলরেডী আমি অনেক অন্যায় করে ফেলেছি ওর সাথে অভিনয় করে। তবুও জিজ্ঞেস করলাম, পেনী তোমার স্পার্কীকে কি চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে? ও বললো, হ্যাঁ। বলেই সাথে সাথে বললো, " এখন আমাদের আরেকটা ডগি' চলে এসেছে"। এত তাড়াতাড়ি আরেকটা 'ডগি' চলে এসেছে? তোমরা কী এখন স্পার্কীকে ভুলে যাবে আস্তে আস্তে?
"না না , স্পার্কীকে ভুলবো কেনো? তবে আমরা এখন নতুন ডগি' কে নিয়ে সবাই ব্যস্ত সময় পার করছি"। বলে তার 'আই ফোন' থেকে নতুন ডগি'র ছবি দেখাতে লাগলো। কী সুন্দর একটা কুকুরের ছবি। দেখলে আদর করতে ইচ্ছে করে।

-আচ্ছা, তোমার স্পার্কীর ছবি আছে তোমার কাছে?
-হ্যাঁ আছে।
বলেই অনেক খুঁজে পেতে সবচেয়ে সুন্দর ছবিটা আমাকে দেখাতেই আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কী সুন্দর একটা কুকুর, বেড়ার লাঠি ধরে দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানো। আমার বুঝতে দেরী হলোনা। ওরা শূণ্যতা রাখেনা, এক কুকুরের মৃত্যু হতেই আরেকটিকে নিয়ে এসেছে। ওরা কারো শূণ্যতা নিয়ে হাহাকারও করেনা। 'আই ফোনের' ফটো গ্যালারী এখন নতুন কুকুরের ছবিতে ভর্তি, স্পার্কীর ছবি এখন অনেক খুঁজে বের করতে হয়। এরাই পারে কুকুরকে মানুষের সমান মর্যাদায় ভালোবাসতে। আমরাও হয়তো পারতাম, হয়তো আরও অনেক বেশীই পারতাম। কিনতু আমরা নিজের সন্তানের মুখেই দুই বেলা দুই মুঠো খাবার দিতে পারিনা, কুকুরকে খাওয়াবো কি?

Thursday, September 20, 2012

'অলি বারবার ফিরে আসে'!

সেদিন অফিসে কাজ করছিলাম, আমাদের কাউন্টারের পাশ দিয়েই কেউ একজন হেঁটে যাচ্ছিল। এমন অনেকেই আমাদের কাউন্টারের পাশ দিয়ে যাওয়া আসা করে। মানুষের আসা যাওয়া দেখতে যতই ভালো লাগুক না কেনো, কাজে ব্যস্ত থাকলে আমার পাশ দিয়ে হাতী চলে গেলেও টের পাই না। কিনতু যে মুহূর্তটির কথা বলতে চাচ্ছি, সেই মুহূর্তে আমার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মহিলাটির দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে না তাকিয়ে উপায় ছিল না। কারন মহিলাটি যাওয়ার সময়ই আমার নাকে হঠাৎ করে 'কান্তা' সেন্টের গন্ধ এসে ঝাপ্টা মেরেছে। 'কান্তা' সেন্ট কোন নামকরা ব্র্যান্ডের পারফিউম না। তাছাড়া এই নামে কোন সেন্ট আদৌ পাওয়া যায় কিনা, সেটাও জানিনা। এই সেন্টের নাম শুনেছি অনেক ছোটবেলায়, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে। 'কান্তা' সেন্টের সৌরভের সাথে আমার শৈশব মিশে আছে। এ গন্ধ আমি ভুলি কি করে! অথচ 'কান্তা' সেন্ট নামে কোন পারফিউম বাংলাদেশেই হয়তো পাওয়া যায় না, তো আমেরিকায় 'কান্তা' আসবে কোত্থেকে! এটাকেই কি ভীমরতি ধরা বলে?

শৈশবের শুধু কান্তা সেন্টই নয়, শৈশবের আরও অনেক সৌরভ ইদানিং আমাকে আনমনা করে দেয়। আমার এক দাদা'র মেয়ের জন্ম হয় '৭০ সালের শেষের দিকে। আমি নিজেই তখন শিশু। ঢাকা গেছিলাম সেই দাদা'র বাড়ীতে বেড়াতে। একটানা সাতদিন ছিলাম। সেই সাতদিনে আমি 'গ্ল্যাক্সো' নামের পাউডার মিল্কের সাথে পরিচিত হয়েছি খুব ভালোভাবে। আমার সামনেই বৌদি বাচ্চার জন্য দুধ বানাতেন। আমার জিভ দিয়ে জল গড়াতো, কিনতু লজ্জায় মুখ ফুটে বলতে পারতাম না আমিও দুধটা খেতে চাই। তখনকার সময়ে বাচ্চাদের দুধের বোতল দেখতে ছিল নৌকার মত। কাঁচের বোতলের দুই মুখ ছিল, যার একদিকে টুপীর মত রাবারের ঢাকনা পরানো থাকতো আর অন্য মাথায় থাকতো মূল নিপল, যাকে আমরা বলতাম 'চুষনি'।

এই নৌকা শেপের বোতল বাকী জীবনে আর কোথাও দেখিনি। বৌদি দুধের কৌটা খুলে যখন প্লাস্টিকের চামচে করে দুধ তুলতো, আমি মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে দুধের গন্ধ নিতে চেষ্টা করতাম, কী যে মিষ্টি গন্ধ, এভাবেই দুধের গন্ধ মেমরীতে আটকে আছে। আরেকটু বড় হয়ে দেখেছি, অনেকের বাড়ীতেই চায়ের জন্য পাউডার দুধের টিন থাকতো, আমি নাক টেনে গন্ধ নেয়ার চেষ্টা করতাম, সেই মিষ্টি গন্ধ আর কোনদিন পাইনি। এরপর নিজের ঘরেই 'ডানো', 'রেড কাউ', 'ডিপ্লোমা' নামের সবকটি দুধের টিনেই খুঁজে ফিরলাম শৈশবের সেই 'গ্ল্যাক্সো' দুধের গন্ধ, পাই নি, কোত্থাও ফিরে পাইনি আমার শৈশবকে। কিছুদিন আগেই আমি এখানে 'গোলাপজাম' বানানোর জন্য পাউডার দুধের প্যাকেট কিনে এনেছি। প্যাকেট খুলে দুধ কৌটায় ঢালতে যেতেই এক মুহূর্তের জন্য সেই বিয়াল্লিশ বছর আগের 'গ্ল্যাক্সো' দুধের গন্ধ নাকে এসে ঝাপ্টা দিল। মুহূর্তের জন্য, কারন সাথে সাথে আমি দুধের প্যাকেটে নাক এগিয়ে নিতেই আর পেলামনা সেই শৈশবের গন্ধ। এর আগেও আমি অনেকবার এনেছি এই প্যাকে্ট, কোনদিন এমন তো হয় নি। একেই কি ভীমরতি ধরা বলে?
শুধুই কি পাউডার মিল্ক? কনডেন্সড মিল্কের কথাই ধরি না কেনো। খুব ছোট বেলায় আমাদের পাশের বাড়ীতে চা বানাতো কনডেন্সড মিল্ক দিয়ে। কৌটার গায়ে নাম লেখা ছিল, এখন নাম মনে পড়ছেনা, কিনতু কনডেন্সড মিল্কের স্বাদ এখনও জিভে লেগে আছে। আমি, আমার মেজদা, আর পাশের ঘরের ছেলেমেয়েরা চা বানানোর সময় গিয়ে ঐ বাড়ির 'কাকীমার' সামনে হাজির হতাম। হাত পেতে বসে থাকতাম। চায়ের কাপে দুধ ঢালা শেষ হলেই আমাদের মেলে ধরা হাতের তালুতে একটু একটু করে দুধ ঢেলে দিত কাকীমা। হাত চেটে খেতাম, কি অপূর্ব স্বাদ! এখন আমার ঘরে কনডেন্সড মিল্কের কৌটা সারি সারি সাজানো থাকে। মিষ্টি দই বানাতে কাজে লাগে। একদিন চামচে করে একটুখানি দুধ মুখে দিয়ে সাথে সাথে ফেলে দিয়েছি। কিছুতেই মিলেনা, কিছুতেই সেই বেড়া দিয়ে ঘেরা রান্নাঘরে কাকীমাকে ঘিরে বসে যে কনডেন্সড মিল্ক আমরা খেতাম, তার সাথে মিলেনা। ছোটবেলার সবকিছু অন্যরকম, সবকিছু সরল, সবকিছুই মোহময়।

আমার ঘন কালো কোঁকড়া চুলে বাবা অনেক যত্ন করে শ্যাম্পু করিয়ে দিতেন। খুব ছোট্ট বয়সের কথা। চুল শুকিয়ে গেলে ক্রীম মেখে দিতেন চুলে। শ্যাম্পুর গন্ধ মনে পড়ে না। কারন শ্যাম্পু দেয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে অসহ্য মনে হতো। মাথা নীচু করে থাকতে হতো বলে ঘাড় ব্যথা করতো, শ্যাম্পুর ফেনা চোখে ঢুকে চোখ জ্বালা করতো। কাজেই এই তিক্ত স্মৃতির গন্ধ মেমরী ধরে রাখেনি। কিনতু ক্রীমটা আমার খুব পছন্দের ছিল। ক্রীম মাখানোর সময় বাবা তাঁর স্নেহ মেখে দিতেন মাথার চুলে। সবাইকে ডেকে ডেকে বলতেন, আমার মেয়ের মাথার চুলগুলো হয়েছে ইন্দিরা গান্ধীর মত। আমার মেয়েকে ইন্দিরা গান্ধী বানাবো। ইদানিং যখন তখন বাবার কথা কানে আসে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুণী চালাতে গেলেই মনে পড়ে যায় বাবার 'ইন্দিরা গান্ধী' প্রকল্পের কথা। বাবা তো আর জানেনা, কোঁকড়া চুলগুলো আর আগের মত কোঁকড়া নেই। আধুনিক ফ্যাশানের 'লেয়ার কাট' দিয়ে ইন্দিরা গান্ধী মার্কা চুল কবেই হারিয়ে গেছে, শুধু ক্রীম মাখানোর স্মৃতি হারায়নি। ফিরে ফিরে আসে।

চুলের দিকে তাকালেই মায়ের স্মৃতিও আসে। আমি ছিলাম বাবা মায়ের কালো মেয়ে। কালো হওয়াতে মায়ের মনে তেমন কোন আক্ষেপ ছিল কিনা জানিনা, তবে আমার মাথার চুলগুলো নিয়ে মায়ের খুব গর্ব ছিল। মাথার ঘন কালো চুল দেখেও অনেক পাত্রের বাবা মা মুগ্ধ হন। সেই স্বপ্নে বিভোর হয়েই হয়তোবা আমার মা ইন্ডিয়া থেকে 'জবা কুসুম' তেল আনাতেন। নিজে হাতে জব জবে করে আমার চুলে তেল মাখিয়ে দিতেন। আমার অসহ্য লাগতো। তেলের এত তীব্র গন্ধ আমি সহ্য করতে পারতাম না, কিনতু চুল সুন্দর রাখার জন্য এটা আমাকে মেনে নিতেই হতো। চুলগুলো শেষ পর্যন্ত সুন্দরই ছিল, অন্তঃত বিয়ের আগে পর্যন্ত। বিয়ের পরে স্বাধীনতা পেয়ে স্টাইল করার জন্য প্রথমেই বেছে নিয়েছিলাম বাজার চলতি 'হেয়ার কাট'। যদিও আমার স্বামীর মত ছিলনা এভাবে চুলগুলোর সর্বনাশ করতে, কিনতু আমার ইচ্ছেটাকেও তো ফেলে দিতে পারি না। চুল আবার বড় হবে, কিনতু ইচ্ছেটা তো আর বসে থাকবে না। আমার মা এখন মৃত্যুশয্যায়। এতকাল আমার মনে আফসোস আসেনি ঝরে যাওয়া চুলের জন্য, কিনতু ইদানিং আমার চোখ ঠেলে জল আসে, সেদিনের স্মৃতিগুলো মায়ের স্নেহ মমতা হয়ে ঝরে ঝরে পড়ে। 'জবাকুসুম' তেলের গন্ধ এখনও আমার স্মৃতিতে ধরা আছে, তবে গন্ধটা এখন আর তীব্র লাগেনা। স্নিগ্ধ সৌরভ নিয়েই আমার চারিপাশ আচ্ছন্ন করে রাখে।

শুধুই কি শৈশব আর কৈশোর! বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের হোস্টেলে রান্না করা খিঁচুড়ির গন্ধও কি নাকে আসেনা! আসে, সেই স্পেশ্যাল খিঁচুড়ির গন্ধ হঠাৎ হঠাৎ করে নাকে এসে ঝাপ্টা মারে! নওয়াব ফয়জুন্নেছা হলের প্রায় প্রত্যেক রুম থেকেই সকালবেলা খিঁচুড়ির গন্ধ বের হতো। আমি আর আমার রুমমেট অরুনা প্রতি সকালে খিঁচুড়ি রান্না করতাম। কি নিয়ে যেনো অরুনার সাথে মনোমালিণ্য হতেই অরুনা চলে গেলো অন্যদলে, আমি চলে গেলাম ফরিদার সাথে। পাশের রুমেই থাকতো ফরিদা (চুয়াডাঙ্গা সরকারী কলেজের কেমিস্ট্রির সহকারী অধ্যাপিকা)। ফরিদা রান্না করতে পছন্দ করতোনা বলে আমরা 'রাশিদা খালা' কে ঠিক করেছিলাম সকালের খাবার বানিয়ে দেয়ার জন্য।। খালা প্রতিদিন সকালে ছোট এক হাঁড়ি খিঁচুড়ী রেঁধে এনে দিত। আহা! কী স্বাদ। শুধুই চাল, মুসুরের ডাল, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ দিয়ে রান্না খিঁচুড়ী। অমৃত অমৃত! আমার বিয়ের পরেও আমি সকালে বাসা থেকে হোস্টেলে এসেই খিঁচুড়ী দিয়ে ব্রেকফাস্ট করতাম। আমি এখন অনেক পাকা রাঁধুনী। নতুন নতুন কত রান্নাই যে করি। কিনতু হোস্টেলের সেই সুস্বাদু খিঁচুড়ী আজও রাঁধতে পারলাম না! গত মাসে একদিন হঠাৎ করেই চারদিকে খিঁচুড়ির গন্ধ পাচ্ছিলাম। কোথা থেকে আসবে এই গন্ধ! আমার আশেপাশে তো সব খাঁটি আমেরিকানদের বসবাস। ওরা কেউ দুপুরবেলা নওয়াব ফয়জুন্নেছা হলের রাশিদার খালার স্টাইলে খিঁচুড়ি রাঁধবে না নিশ্চয়ই! তাহলে আমি কেন সেদিন রাশিদা খালার খিঁচুড়ীর গন্ধ পেলাম! একেই কি ভীমরতি ধরা বলে!

এবার ফিরে আসি 'কান্তা 'সেন্টের কথায়। মুক্তিযুদ্ধের আগে আমরা থাকতাম শীতলক্ষ্যা নদীর পারে, খানপুর নামে এক ছোট্ট শহরে। আমাদের ঘর থেকেই নদী দেখা যেত। বারান্দায় বসে বসে আমরা দেখতাম নদীতে নৌকা, লঞ্চের অবাধ চলাচল। আমি সবচেয়ে খুশী হতাম যখন নৌকায় মাইক বাজানো হতো। যে নৌকায় মাইক বাজতো, সেই নৌকায় করে নতুন বৌ যেত। " ঢেউ দিও না ঢেউ দিও না ঢেউ দিও না জলে" গানটি আমি প্রথম শুনি নৌকায় বাজানো মাইক থেকে। এই গানটি যে কোন নতুন বৌ' এর নৌকায় বাজতোই বাজত। আরেকটি গান ছিল, " জ্বালাইলে যে জ্বলে আগুন নেভানো বিষম দায়, আগুন জ্বালাইস না আমার গায়"। কতদূর দিয়ে নৌকা যেত, আর আমি বারান্দায় বসেই 'কান্তা 'সেন্টের গন্ধ পেতাম। আসলে ঐ সময়টাতে মধ্যবিত্তের সংসারে 'সেন্ট' ব্যবহার হতো কিনা জানিনা। আমাদের পরিবারে হতো না, সেটি মনে আছে। তবে কোন বিয়ে বাড়ীতে গেলে, বৌদের শাড়ী থেকে 'কান্তা সেন্টের গন্ধ আসতো। সেন্টের নাম 'কান্তা' জেনেছি সবার মুখে শুনে শুনে। আমার দুই দাদা (কাজিন) বিয়ে করেছিলেন '৬৯ সালে। সেই বৌদিদের দেখতাম, বেড়াতে যাওয়ার সময় 'কান্তা 'সেন্ট মাখতে। একবার সবাই মিলে ' যে আগুনে পুড়ি' সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। দুই বৌদির পরনে ছিল নীল রঙের নেটের শাড়ী, শাড়িতে সেন্ট, ছোট্ট আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম, আমার 'গুলশান' জামাতেও দুই ফোঁটা সেন্ট মাখিয়ে দিয়েছিল বৌদি। সেই গন্ধ নাকে আটকে গেছে। জীবনে কত নামী দামী ফরাসী পারফিউম মাখলাম, কিনতু আমার সেই 'গুলশান' জামার থেকে আসা 'কান্তা' সেন্টের গন্ধ আর কিছুতেই পেলাম না!

আর কৈশোরের সেই 'অলি' সেন্ট! সেটিই কি ভুলতে পেরেছি? আমাদের সাধারন মধ্যবিত্তের সংসারে আমার মেজদা কিভাবে কিভাবে যেনো একটু শৌখিন প্রকৃতির হয়ে গেল! তার সব সময় একখানা সেন্ট চাই ই চাই। আমাদের দিদিমা বছরে একবার কি দুইবার কলকাতা বেড়াতে যেতেন। ফেরার সময় আমার জন্য আনতেন চুলের বাহারী ক্লিপ আর মেজদার জন্য 'অলি' সেন্ট। একেবারে রজনীগন্ধা ফুলের গন্ধ। একটুও ভুল বলছি না। কারন এই গন্ধটাও মাথায় আটকে গেছে। তখন ভাই-বোন দুজনেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। একদিন দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে উঠেছি, মেজদা আমার পেছনের সীটেই বসা ছিল। বাসে ছিল ভিড়। ছাত্রীদের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে উঠেছিল, " কি রে! এতো ভীড়ের মধ্যে রজনীগন্ধার গন্ধ পাচ্ছি কেনো? কারো হাতেই তো ফুল দেখছিনা"। কথাটা শুনে আমি ঘাড় ফিরিয়ে মেজদার দিকে তাকিয়ে একটা অর্থপূর্ণ হাসি দিতেই মেজদা হাসিতেই প্রতি উত্তর দিল। সেই 'অলি' সেন্ট কি আর পাওয়া যায়? জানিনা, কারন এখন তো আর একেবারে সাধারন মধ্যবিত্ত নই আমরা, আমাদের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে, মাঝে মাঝে আমরাও ব্র্যান্ড নেমের জিনিস কিনি। 'কান্তা বা অলি' না কিনে ফরাসী পারফিউম কিনি। তবে সত্যি কথা হচ্ছে, দামী পারফিউমের গন্ধ ছাড়িয়ে 'কান্তা' আর 'অলি'ই বার বার ফিরে আসে।

খুব সম্প্রতি এমনি হরেক রকম শৈশব, কৈশোর মাখানো গন্ধ পেতে শুরু করেছি। ২১শে সেপ্টেম্বারও বছরে একবার ফিরে আসে, আয়ুর সঞ্চয় থেকে একটা বছর খসে যায়। পরিনতির দিকে আরেকটি বছর এগিয়ে যাই। শৈশব, কৈশোর পেছন থেকে টানতে শুরু করেছে। বয়স হলেই নাকি ভীমরতি ধরে। আমার কোন অসুবিধা নেই, ভীমরতির মাঝেই যদি শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যকে ফিরে ফিরে পাই, ক্ষতি কি! না হয় একটু আধটু ভীমরতি ধরলোই বা!

Wednesday, September 12, 2012

সবচেয়ে জনপ্রিয় ফাস্টফুড 'ম্যাকডোনাল্ড'স'


চিকেন বার্গার খেতে পছন্দ করেনা এমন বাচ্চার সংখ্যা খুবই কম। শুধু বাচ্চাই বা বলি কেনো,  বার্গার খেতে ছোট বড় সকলেই পছন্দ করে।  আগে আমাদের দেশে ছেলেমেয়েরা আড্ডায় বা ভ্রমনে ঝালমুড়ি, ফুচকা খেতেই বেশী পছন্দ করতো। কিনতু বিশ্বায়নের যুগে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসেও অনেক পরিবর্তন এসেছে।   দেশে বড় বড় শহরগুলোতে প্রচুর ফাস্টফুড শপ দেখা যায়, যেখানে চিকেন বার্গার, বিফ বার্গার পাওয়া যায়।  ছোট ছেলে মেয়ে, তরুন-তরুনীদের কাছে বার্গার খুবই প্রিয় হলেও, দামের দিক থেকে মোটেও সস্তা নয়। কিনতু  পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে  বার্গার  দামে সস্তা, সহজলভ্য একটি খাবার। অনেকটাই আমাদের দেশের ঝালমুড়ি বা ফুচকার মতই যে কোন স্থানে পাওয়া যায়। দামেও সস্তা বলে  দৈনন্দিন খরচের বাজেটে টান পড়লে বার্গার খেয়েই লাঞ্চ বা ডিনার সেরে ফেলা যায়। একটি বার্গার মাত্র এক ডলার। এক ডলারের একখানা বার্গার থেকে কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিন, দুইই পাওয়া যায়। পাশ্চাত্যে বিশেষ করে আমেরিকায়, বার্গার বলতে  'মাগডোনাল্ড'স এর চিকেন বার্গার, হ্যাম বার্গার অথবা চীজ বার্গারকে বুঝানো হয়।  খেতে সুস্বাদু বার্গার নামের খাবারটিকে আমেরিকাতে  জনপ্রিয় করে তুলেছে  'ম্যাকডোনাল্ড'স এর স্বত্বাধিকারী  রিচার্ড এবং মরিস ম্যাকডোনাল্ড ভ্রাতৃদ্বয়।

রিচার্ড এবং মরিস ম্যাকডোনাল্ড ১৯৪০ সালে ক্যালিফোর্ণিয়াতে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা শুরু করেন, প্রথমে ওটা ছিল শুধুই বারবিকিউ রেস্টুরেন্ট। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে  নতুন আইটেম হিসেবে  'হ্যামবার্গার' যোগ করা হয়।  'স্পিডি সার্ভিস সিস্টেম' ব্যবস্থায় অতি দ্রুত সময়ে হ্যামবার্গার গ্রাহকের হাতে তুলে দেয়ার ব্রত নিয়েই তারা ব্যবসা শুরু করেন। অতি অল্প সময়ে তাদের  'দ্রুত সময়ে প্রস্তুত হ্যামবার্গার' জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে।  ম্যাগডোনাল্ড'স এর শুরুর দিকের মাসকট ছিল   'স্পিডী' নামের একজন শেফ, যার মাথায় 'হ্যামবার্গার শেপের টুপী থাকতো। ১৯৬৭ সালে 'স্পিডী' নাম  বদলে নতুন নামকরন করা হয় 'ম্যাকডোনাল্ড'স। ১৯৬৮ সালের নভেম্বার মাসে  ম্যাকডোনাল্ড'স এর নতুন লোগো ঠিক করা হয় ইংরেজী  লেটার  'M' '(এম ),  লোগোর রঙ ঠিক হয় হলুদ।

আমেরিকায় ম্যাকডোনাল্ড'স তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করার পর, এই ব্যবসা পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও বিস্তার লাভ করতে শুরু করে।  আন্তর্জাতিক বাজারে ম্যাকডোনাল্ড'সের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারকে ' সিমবল অব গ্লোবালাইজেশান' মনে করা হয়।  দ্রুত সময়ে মুখরোচক খাবার হাতের মুঠোয় পৌঁছে দেয়ার এই পদ্ধতির ভেতর দিয়েই ' আমেরিকান ওয়ে অব লাইফ' এর একটি চিত্র ফুটে উঠে। এই মুহূর্তে পৃথিবীর প্রায় ১১৯টি দেশে ম্যাকডোনাল্ড'স এর রেস্টুরেন্ট আছে। সর্বমোট ৩১,০০০ রেস্টুরেন্ট চালু আছে, যেখানে দেড় মিলিয়ন কর্মচারী নিয়োজিত  আছে। প্রতিদিন ৬৮ মিলিয়ন ক্রেতা র চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে  দেড় মিলিয়ন কর্মচারি তাদের নিরলস কাজের মাধ্যমে।

 



ম্যাকডোনাল্ড'স এ প্রধানতঃ পাওয়া যায় 'হ্যামবার্গার,  ম্যাকচিকেন (চিকেন বার্গার), চীজ বার্গার, ফিশ 'ও  ফিলে, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই (আলু লম্বা চিকন করে কেটে মচমচে ভাজা),  বেকড আপেল পাই, সানডি, পারফে,  মিল্ক শেক ,  কফি। গ্রাহকের চাহিদানুসারে সালাদ, চিকেন র‌্যাপ, ফ্রুটস, স্মুদি পাওয়া যায়।  এই খাবারগুলো পাওয়া যায় বেলা দশটার পর থেকে। দশটার আগে  ব্রেকফাস্ট আইটেম বিক্রী হয়। ব্রেকফাস্ট আইটেমের মধ্যে থাকে 'প্যান কেক উইথ ম্যাপল সিরাপ', সসেজ, বিস্কুট , স্ক্রামবলড  এগ, কফি।

আমেরিকান লাইফ দ্রুত গতিসম্পন্ন। সব কিছুতেই গতি। এই দ্রুত গতির সাথে তাল মিলিয়েই দ্রুত গতির ফাস্ট ফুড হিসেবে ম্যাগডোনাল্ড'স পরিচিত। গ্রাহকের সময় বাঁচাতে 'ড্রাইভ থ্রু' এর ব্যবস্থা রাখা আছে। ড্রাইভ থ্রু ব্যবস্থায় কাউকেই গাড়ী থেকে নামতে হয়না। রেস্টুরেন্টের জানালার পাশে গাড়ী থামালেই ভেতর থেকে কর্মচারী ছেলে বা মেয়েটি জানালার কাছে এসেই খুব দ্রুত গতিতে অর্ডার নিয়ে ভেতরে চলে যাবে। গাড়ীর পেছনে আরও গাড়ী এসে জমা হতে থাকে। অর্ডার দিয়েই প্রথম গাড়ীটি সামনের দিকে এগিয়ে আরেকটি জানালার পাশে থামতেই কর্মচারী মেয়েটি বা ছেলেটি ম্যাগডোনাল্ড'স এর নিজস্ব কাগজের প্যাকেটে মুড়ে গ্রাহকের হাতে খাবার তুলে দেয় এবং খাবারের দাম নিয়েই ভেতরে চলে যায়। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে যতক্ষণ রেস্টুরেন্ট খোলা থাকে।  কোন কোন রাজ্যে ম্যাগডোনাল্ড'স খোলা থাকে দিবা- রাত্রি।

 যে সকল গ্রাহকের হাতে কিছুটা সময় থাকে অথবা যারা রেস্টুরেন্টের ভেতরে চেয়ার টেবলে বসে খেতে চায়, তাদের জন্য 'সেলফ সার্ভিস' এর ব্যবস্থা থাকে। খাবারের অর্ডার দিয়ে, খাবারের দাম মিটিয়ে খাবারসহ ট্রে হাতে নিয়ে চেয়ার টেবিল দখল করে থাকা যায়, যতক্ষন ইচ্ছে ততক্ষন। পরিবারের সাথে আসা শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্যও ব্যবস্থা আছে। ম্যাগডোনাল্ড'স শপ এর ভেতরে এবং বাইরের ছোট চাতালে বাচ্চাদের খেলাধূলা করার জন্য  নানা আয়োজন করা থাকে। বাচ্চাদের জন্য স্নেক পাইপ, দোলনা, সী-স,  ক্লাইম্বারসহ মোটামুটি বেশ ভাল ব্যবস্থা থাকে। এই জন্যই  ম্যাগডোনাল্ড'স  এত বেশী জনপ্রিয়।  পৃথিবীজুড়ে এর পরিচিতি।

এত জনপ্রিয় হওয়া সত্বেও ম্যাগডোনাল্ড'স এর বার্গার এর খাদ্য গুন নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে। আমেরিকায় 'ওবিসিটি' (অতিরিক্ত মোটা) দিনে দিনে একটি ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। অতিরিক্ত মেদবহুল মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। পুষ্টিবিদগন 'ওবিসিটি'র জন্য ফাস্টফুড বা দ্রুত সময়ে প্রস্তুত খাবারকে দায়ী করে থাকে। ম্যাগডোনাল্ড'স এর বিপনণ বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে ' স্পিডি সার্ভিস'। ম্যাগডোনাল্ড'স কর্তৃপক্ষ সবদিক বিবেচনা করেই বেকড ফিশ, সালাড, বেকড আপেল পাই এর ব্যবস্থা রেখেছে।  তবুও  ম্যাগডোনাল্ড'স এর বার্গার স্বাস্থ্য সচেতন জনগন সব সময় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। তারপরেও ম্যাগডোনাল্ড'স এর ব্যবসা থেমে নেই। মাত্র এক ডলারে একখানা বার্গার পাওয়া গেলে এর চাহিদা না বেড়ে উপায় কি!

ম্যাকডোনাল্ড'স এর দৈনিক আয় প্রায় সাড়ে ছয় কোটি ডলার।  ব্যবসা সফল প্রতিষ্ঠানটি অনুদান তহবিলে মোটা অংকের টাকা দান করে থাকে।  দুস্থদের জন্য ফান্ড রেইজিং তহবিলে, প্রাকৃতিক দূর্যোগে আক্রান্ত মানুষের সেবায়  ম্যাগডোনাল্ড'স কর্তৃপক্ষ  রেগুলার সাড়া দিয়ে থাকে। এই  চেইন ব্যবসায় 'ম্যাক হ্যাপী ডে' নামে  বার্ষিক ফান্ড রেইজিং প্রোগ্রাম আছে, ঐদিনের মোট বিক্রয়মূল্য থেকে নির্দিষ্ট একটা অংশ অনুদান তহবিলে জমা দেয়া হয়। ২০০৭ সালে আমেরিকা,  কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর ১৭টি দেশে 'ম্যাক হ্যাপী ডে' পালিত হয়। অস্ট্রেলিয়ান পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৯ সালের ম্যাক হ্যাপী ডে' থেকে প্রায় ২১ মিলিয়ন ডলার অনুদান তহবিলে জমা পড়ে। সফল ব্যবসায় এটাই রীতি, নিজের মুনাফা লাভের পাশাপাশি অন্যের সুখ, সুবিধার প্রতি সুনজর দেয়া। ১৯৪৮ সালে হ্যামবার্গার দিয়ে  ম্যাকডোনাল্ড'স নামের যে রেস্টুরেন্টটি যাত্রা শুরু করেছিল, মাত্র ৫০-৬০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর ১১৯ দেশে ৩১ হাজারের বেশী রেস্টুরেন্ট খোলার ভেতরেই নিহিত আছে বানিজ্য লক্ষ্মীর কৃপা লাভের  সাফল্যগাঁথা।















Tuesday, September 11, 2012

‘টুইন টাওয়ার’ঃ মানুষের হাতেই সৃষ্টি, ধ্বংস, আবারও সৃষ্টি!



২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বার আমেরিকায় যখন সকাল, বাংলাদেশে তখন ১১ তারিখ সন্ধ্যা। আজ থেকে ১১ বছর আগের সেই সন্ধ্যায় আমি ছিলাম রান্নায় ব্যস্ত, আমার স্বামী মাত্রই অফিস থেকে ফিরে টিভিতে সিএনএন খুলে বসেছেন। চা পান করছিলেন এবং সিএনএন এ নিউজ দেখছিলেন। আমাদের তখন আমেরিকা চলে আসা সময়ের ব্যাপার। হঠাৎ করেই তিনি আমার নাম ধরে খুব জোরে জোরে ডাকছিলেন। ড্রয়িং রুম থেকে কিচেনের দুরত্ব খুব বেশী ছিলনা। যাচ্ছি যাই করতে করতেও পনের মিনিট পার হয়ে যেতেই আবার উনার গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। এবার আমার নাম ধরে না ডেকে শুধুই বলছিলেন, "অসম্ভব! অসম্ভব ব্যাপার! এটা হতেই পারেনা"। আমি আর এক মুহূর্ত দেরী না করে চুলার চাবি অফ করে দিয়েই ড্রয়িং রুমের দিকে ছুটে গেলাম। আমার মাথায় তখন ঘুরছে, নিশ্চয়ই ছোট্ট মিথীলার কিছু হয়েছে। ড্রয়িং রুমে ঢুকেই দেখি আমার স্বামীর হাতে টিভি রিমোট কন্ট্রোল, বাটন টিপে শুধু চ্যানেল বদলাচ্ছে আর বলছে, " অসম্ভব ঘটনা ঘটে গেছে। আমি নিজের চোখে দেখলাম। বিরাট একসিডেন্ট। পর পর দুইটা প্লেন নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারের ভেতরে ঢুকে গেছে। দুই বিল্ডিংয়েই আগুন ধরে গেছে। বুঝা যাচ্ছেনা দুইটা প্লেনই কিভাবে পর পর একসিডেন্ট করলো"।

আমার স্বামীর প্লেন ফোবিয়া এখনও আছে, তখনও ছিল। পৃথিবীর এত দেশ ঘুরেও মানুষটির প্লেন ফোবিয়া কিভাবে হয়, তা আমার জানা নেই। তার ধারনা, বাসে বা গাড়িতে একসিডেন্ট হলে কিছু মানুষ বেঁচে যায়, প্লেন দূর্ঘটনাতে সে সম্ভাবনা একেবারেই নেই। কয়েকদিন পরেই আমাদের আমেরিকা যাত্রা, এর মধ্যে এমন ঘটনা! তার ধারনা হয়েছে, প্লেন দুটোই নিশ্চয়ই টাইমের আগেই একটু নীচে নেমে গেছিল, তাই টাওয়ারে ধাক্কা খেয়ে বিল্ডিংযের ভেতরে ঢুকে গেছে। টিভিতে দেখছিলাম, মানুষজনের ছোটাছুটি, ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার। আমার রান্না শেষ করার কথা ভুলে গিয়ে টিভি পর্দায় চোখ রেখে বসেছিলাম কিছুক্ষন। ততক্ষনে খবর বের হতে শুরু হয়েছে, একই সময়ে ওয়াশিংটন ডিসিতেও একই ঘটনা ঘটেছে। পেন্টাগন হাউজেও প্লেন হামলা হয়েছে। আমার কাছে সব কিছুই কেমন যেন খেলা খেলা (অবিশ্বাস্য) ব্যাপার মনে হচ্ছিল। মানুষের ভয়ংকরতা বা নিষ্ঠুরতার সাথে দুইবারই পরিচয় হয়েছিল আমার, ১৯৭১ এবং ১৯৭৫ সালে। '৭১ এ ভয়ংকরতা বুঝার বয়স ছিলনা, '৭৫ এর ১৫ই আগস্ট ছোট হলেও না নৃশংসতা না বুঝার মত বয়স ছিলনা। আর ৯/১১ এর ঘটনা আমি ছাড়াও পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের কাছেও বোধগম্য ছিলনা। 

আমেরিকায় ১১ তারিখের সকালটি ছিল আর দশটি সকালের মতই উজ্জ্বল সুন্দর। নিউইয়র্কের আকাশ ছিল ঝকঝকে পরিষ্কার, কর্মব্যস্ত মানুষের পদচারণায় পথঘাট ছিল মুখরিত। ম্যানহাটন নিউইয়র্কের প্রাণকেন্দ্র, সেই ম্যানহাটনের প্রান ভ্রোমরাটি ছিল ওয়ার্লড ট্রেড সেন্টার, যা সারা দুনিয়ায় ‘টুইন টাওয়ার’ হিসেবেই বেশী পরিচিত ছিল। প্রতিদিন নানা পেশার মোট ৫০,০০০ লোক কাজ করত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে, এবং ২০০,০০০ দর্শণার্থীর আসা-যাওয়াও চলতো একই সাথে। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, স্ট্যাচু অব লিবার্টির মতই টুইন টাওয়ার ছিল নিউইয়র্কের আইকন।

টুইন টাওয়ারই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বারের সকালে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তেও মানুষের হাতে সৃষ্ট এই স্থাপণাটি আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে শেষবারের মত মানুষের গৌরব ঘোষনা করেছিল। কত হাজার মানুষের শ্রম, এই স্থাপণা নির্মাণে কত কোটি কোটি ডলার ব্যয়, কী বিশাল বিস্তৃতি, কত হাজার হাজার মানুষের রুটিরুজির কর্মস্থল ‘টুইন টাওয়ার’কে মানুষরূপী একদল হায়েনা যারা ওসামা বিন লাদেনের মতানুসারী ছিল, তারা নিজেদের জীবনের তোয়াক্কা না করেই চলন্ত বোয়িংসহ টুইন টাওয়ারের ভেতরে ঢুকে যায়। তারা নিজেরাও মরে, টুইন টাওয়ারে কর্মরত হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ মারা যায়, সবশেষে মানুষের পদচারনায় একদা মুখর টুইন টাওয়ারটিও আগুনে জ্বলতে জ্বলতে, আগুনের তাপে গলতে গলতে এর ভেতরে থাকা সকল মানুষকে নিয়েই মাটির সাথে মিশে যায়।  ৯/১১ ঠিক একমাস পরেই আমরা চলে এলাম আমেরিকাতে। আগেই সবকিছু ঠিকঠাক হয়েছিল, বাকী ছিল ভিসা পাওয়া। আমেরিকান এমব্যাসীতে ভিসা আনতে গিয়ে দেখেছিলাম, অফিসারদের চোখে কেমন এক কুটিল চাহনি। স্বামীর মুখে আমেরিকার কত জয়গান শুনেছি, কিনতু আমেরিকার মাটিতে পা ফেলার সাথে সাথেই যেন হাহাকার টের পেলাম চারদিকে। এয়ারপোর্টের প্রতিটি স্পটেই টিভিতে দেখাচ্ছিল মানুষের কান্না, আর দুমড়ে মুচড়ে পড়ে যেতে থাকা টুইন টাওয়ারের দৃশ্য। এ যেন এক মহীরূহের পতনের সাথেই তুলনীয়।

সেদিনের এই অভাবিত ঘটনায় সারা পৃথিবীর মানুষ শোকে স্তব্ধ, হতবিহবল হয়ে যায়, কত শত পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। কত স্ত্রী বিধবা হয়, কত শিশু পিতৃমাতৃহীণ হয়ে যায়। প্রেমিক হারায় তার প্রেমিকাকে, আমাদের বাংলাদেশের সাতটি পরিবার হারায় তাদের প্রিয় সন্তানটিকে, একই সাথে হারায় উপার্জ্জনক্ষম মানুষটিকে। আর আমরা, সারা পৃথিবীর মানুষ হারাই পারস্পরিক বিশ্বাস, একের প্রতি অপরের শ্রদ্ধাবোধ।শুরু হয় অর্থনৈতিক মন্দা, চাকুরীর বাজারে ধ্বস নামে, আমেরিকার সোনালী দিন হারিয়ে যেতে শুরু করে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে মানুষের আমেরিকায় সহজ আগমন জটিল হয়ে যায়। অর্থনৈতিক মন্দা কাটানোর অজুহাতে আমেরিকায় অবৈধ বসবাসকারীদের উপর প্রথমবারের মত সরকারী নজর পড়ে। ধর পাকড় শুরু হয়, অবৈধভাবে বসবাসকারীদের ধরা মাত্রই একেবারে খালি হাতে যার যার নিজের দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেই সকল অসহায় অবৈধভাবে বসবাসকারীদের মধ্যে বাংলাদেশের কত নিরীহ মানুষও ছিল, যাদের কষ্টের উপার্জনে দেশে সংসার চলতো। এক ওসামা বিন লাদেনের বদ খেয়ালের খেসারত দিতে হয়েছে এবং এখনও দিতে হচ্ছে আমেরিকা তথা সারা বিশ্বের নিরীহ জনগনকে। 

টুইন টাওয়ারের ছোট্ট ইতিহাসঃ

টুইন টাওয়ার বলতে মুলতঃ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা দুইটি বিল্ডিংকেই বুঝানো হতো। তবে বিল্ডিং দুটি ছিল সাতটি বিল্ডিং কম্পলেক্সের অন্যতম। সেই বিল্ডিং কম্পলেক্সের নাম ছিল ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার কম্পলেক্স, যার ল্যান্ডমার্ক ছিল পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা দুইটি টাওয়ার, সারা বিশ্বে যা পরিচিত ছিল ‘টুইন টাওয়ার’ নামে। আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটির লোয়ার ম্যানহাটনে অবস্থিত টুইন টাওয়ারটি আকাশের দিকে মাথা তুলে সগর্বে যেন মানুষের সৃষ্টির বিজয় ঘোষণা করতো। টুইন টাওয়ার কম্পলেক্স এর একটি অংশ প্রথম উন্মুক্ত করা হয় ১৯৭৩ সালের ৪ঠা এপ্রিল। এপ্রিল ’৭৩ থেকে সেপ্টেমবার ২০০১, মাত্রই ২৮ বছর বয়স হয়েছিল অনবদ্য এই স্থাপণাটির। যে মানুষের হাতে এই অনবদ্য সৃষ্টি, সেই মানুষরূপী কিছু নিষ্ঠুর প্রতিক্রিয়াশীলের হাতেই তার অপমৃত্যু হয়।

টুইন টাওয়ারের একটি টাওয়ার ছিল উত্তরমুখী, আরেকটি দক্ষিনমুখী, যা পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং হিসেবে পরিচিত ছিল। কম্পলেক্সের বাকী বিল্ডিংগুলো ’৭৫ সাল থেকে ’৮৫ সালের ভেতর সম্পূর্ণ হয়েছিল। ১৯৬০ সালে ১১০ তলা বিশিষ্ট টুইন টাওয়ার এর ডিজাইন করেছিল মিশিগানের মিনরু ইয়ামাসাকি এন্ড এসোসিয়েটস এবং নিউইয়র্কের এমেরি রুথ এন্ড সন্স। মাটি খনন শুরু হয়েছিল ১৯৬৬ সালের ৫ই আগষ্ট। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বারে শেষ হয় টুইন টাওয়ারের উত্তর অংশ, ’৭৩ এর জুলাই মাসে শেষ হয় দক্ষিন অংশ। কন্সট্রাকশানে খরচ হয়েছিল ৪০০ মিলিয়ন ডলার যার বর্তমান বাজার মূল্য ২৩০ কোটি আমেরিকান ডলার। নিউইয়র্ক সিটি ডাউনটাউনের হার্ট ছিল এই টুইন টাওয়ার, এর ভেতরকার বিশাল আয়তন আন্দাজ করা যাবেনা। শুধুমাত্র অফিস স্পেস ছিল ১৩.৪ মিলিয়ন স্কোয়ার ফিট, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে কল্পনা করা খুবই দুরূহ ব্যাপার।
রেস্টুরেন্ট ‘উইন্ডোজ অন দ্য ওয়ার্ল্ড’ ছিল উত্তর টাওয়ারের ১০৬ এবং ১০৭ তলায়,  ‘টপ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটি অবস্থিত ছিল দক্ষিন টাওয়ারের ১০৭তম তলায়। ১৯৭৬ সালে তৈরী বিখ্যাত মুভী ‘কিং কং’সহ আরও অনেক ছায়াছবিতে টুইন টাওয়ারের দৃশ্য বেশ কয়েকবার দেখানো হয়েছে।

টুইন টাওয়ারে আক্রমনঃ

২০০১ সালের সর্বশেষ এটাকের আগেও বেশ কয়েকবার এই যমজ স্থাপণাটির উপর হামলা করা হয়েছে।’৭৫ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারী তারিখে এই বিল্ডিং-এ আগুন লাগে। ’৯৩ এর ২৬শে ফেব্রুয়ারী বিল্ডিংটিতে বম্বিং এর ঘটনা ঘটে। রামজে ইউসুফ নামের এক হামলাকারী উত্তর মুখি টাওয়ারের গর্ভস্থলে বোমাটি ফিট করে। বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার সাথে সাথে ১০০ ফিট গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়, চারদিকে হুলুস্থূল পরে যায়। ছজনের মৃত্যু ঘটে, ৫০,০০০ মানুষ কোন না কোনভাবে আহত হয়। ইউসূফ পাকিস্তানে পালিয়ে যায় এবং ইসলামাবাদে ধরা পড়ে। যেখানে বোমা বিস্ফোরিত হয়েছিল, তার খুবই কাছাকাছি আন্ডারগ্রাউন্ড ভল্টে রক্ষিত ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী গোল্ড ডিপোজিটরিজ, যার মালিকানা ছিল কমার্শিয়াল ব্যাংক গ্রুপের। ’৯৩ সালের বম্বিং এ গোল্ড ডিপোজিটারিজের কোন ক্ষতি না হলেও ৯/১১ এর ধ্বংসযজ্ঞের আগুন থেকে তা আর রক্ষা পায়নি।

’৯৮ সালের ১৪ই জানুয়ারী ট্রেড সেন্টারে ডাকাতি হয়, এবং ২ মিলিয়ন ডলার ডাকাতদল লুট করে নিয়ে যায়। এরপর ১৯৯৮ সালে পোর্ট অথরিটি সিদ্ধান্ত নেয় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারটিকে ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেয়ার এবং ২০০১ সালের জুলাই মাসে ‘সিলভারস্টেইন প্রোপারটিজ’ এর কাছে তা হস্তান্তর করা হয়।

সর্বশেষ আক্রমণঃ

২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বার সকালে সর্বশেষ আক্রমণ হয় পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থাপণা ‘টুইন টাওয়ারের’ উপর। দুনিয়ার সভ্য মানুষ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিল, মানুষের নিষ্ঠুর হাতের কালো থাবায় পড়ে মানুষেরই সৃষ্টি কিভাবে গলে গলে পড়েছে। আল-কায়েদা বাহিণীর একটি দল দুইটি বোয়িং ৭৬৭ জেট নিয়ে ২০ থেকে ৩০ মিনিটের ব্যবধানে সোজা ঢুকে যায় দক্ষিন ও উত্তর টাওয়ারের ভেতর। সকাল ৮ঃ৪৬ এ উত্তর টাওয়ার এবং ৯ঃ০৩ টায় দক্ষিন টাওয়ারে আক্রমণ করে। দাউ দাউ আগুনে জ্বলে জ্বলে দক্ষিন টাওয়ারটির ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে মাটির সাথে মিশে যেতে সময় লাগে ৫৬ মিনিট, উত্তর টাওয়ারটিরও একই পরিনতি ঘটতে লেগেছিল ১০২ মিনিট। সরকারী হিসেবমতে আগে ও পরে ২,৭৫৩ জনের মৃত্যু ঘটে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনায়।
নতুন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারঃ

ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার কম্পলেক্সের বাকি আধভাঙ্গা স্থাপণাগুলো ডিমোলিশ করে দেয়া হয়। সমস্ত জঞ্জাল পরিষ্কার করতে সময় লেগেছিল আটমাসের মত। মানুষের ধর্মই হচ্ছে আবার ঘুরে দাঁড়ানো। আমেরিকান জাতিও আবার ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। ওয়ার্লড ট্রেড সেন্টারের সমাধিস্থলেই আবার নতুন করে তৈরী হতে থাকে নতুন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। প্রথম বিল্ডিংটি তৈরী হয় ধ্বসে যাওয়া ৭ নাম্বার বিল্ডিংটির উপর এবং ওপেন করা হয় ২০০৬ সালের মে মাসে। নতুন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার কম্পলেক্স নতুন অবয়বে তৈরী হচ্ছে যেখানে একটি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বিল্ডিং যা ‘ফ্রীডম টাওয়ার’ নামে পরিচিত, ৭ ওয়ার্লড ট্রেড সেন্টার, তিনটি হাই রাইজ অফিস টাওয়ার এবং ‘ন্যাশনাল সেপটেম্বার ১১ মেমোরিয়াল এন্ড মিউজিয়াম’ থাকবে। ৯/১১ মেমোরিয়াল এন্ড মিউজিয়াম ওপেন করা হচ্ছে ২০১২তে, চারটি বিল্ডিং ওপেন হবে ২০১৩ তে এবং কম্পলীট ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার কম্পলেক্স ওপেন হবে ২০১৫ তে। এখানেই মানুষের সার্থকতা! মানুষ ভাঙ্গবে তবুও মচকাবেনা। নতুন করে ওয়ার্লড ট্রেড সেন্টার তৈরীর মাধ্যমে মানুষ আরেকবার প্রমান করতে যাচ্ছে, সভ্য মানুষের আনন্দ কর্মে, আনন্দ নব নব সৃষ্টিতে। মানুষের এই নব সৃষ্টির অদম্য স্পৃহা সদা জাগ্রত থাকুক।

Friday, September 7, 2012

‘চটি বই লেখিকাই' যদি, তবে তাঁকে নিয়ে এত কথা কেন!!!



গত সপ্তাহে অনলাইন সংবাদ-এ পড়লাম, তসলিমা নাসরিন টুইটারে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আক্রমণ করেছেন, কবে কোথায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাকে সেক্সচুয়্যালি এবিউস করেছে, সেই ব্যাপারে। খবরটির শিরোনাম পড়েই আমি পরবর্তী সংবাদে চলে গেছি। মাথাও ঘামাইনি তসলিমার এই অভিযোগ নিয়ে। পরক্ষণেই ভুলে গেছি তসলিমার কথা। কাকতালীয়ভাবে আমার হাতে তখন সুনীলের একটি গল্প সমগ্র। দারুন সব গল্প, ওগুলো রেখে আমার আর ইচ্ছে করেনি তসলিমার এই গঁৎবাধা অভিযোগ নিয়ে মাথা ঘামাতে। যেমন ইচ্ছে করেনি তসলিমার বই ‘ক’ প্রকাশিত হওয়ার পর যে শোরগোল পড়েছিল, সেই জোয়ারে গা ভাসাতে। ‘ক’ আমি পড়েছি। একবার পড়েই বইটি কোথায় রেখেছি সেটাও আর তাকিয়ে দেখিনি।
আমরা যারা প্রতিদিন সংবাদপত্র পড়ি, গল্পের বই পড়ি তাদের কাছে তসলিমা নাসরিন সবচেয়ে বহুল শ্রুত একটি নাম। তাঁর নাম এত বেশীবার মিডিয়াতে এসেছে যে তাকে এখন আর তার নাম দিয়ে চেনার প্রয়োজন পড়েনা। উনার জন্মসূত্রে পাওয়া নামের বদলে পাঠককুল তাঁকে ‘বিতর্কিত লেখিকা’, বিকৃত রুচীর লেখিকা’, নষ্ট মেয়েমানুষ’, ‘ভারতের দালাল’, দেশ থেকে বহিষ্কৃত একমাত্র নারী’ হিসেবেই ভাবতে পছন্দ করে। আর তাঁর লিখিত বইয়ের সংখ্যা যা-ই হোক না কেনো, ‘ক’ আর ‘লজ্জা’ ছাড়া অন্য কোন বই নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা তেমন হতে দেখা যায়না। কারন হতে পারে, এই দুটি বইই সরকার থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
বেশ কিছুদিন তসলিমা প্রসঙ্গ চাপা পড়েছিল। কিনতু তসলিমা আবার ফিরে এসেছেন। আসলে যাঁরা একবার মিডিয়ার স্বাদ পেয়ে থাকেন, তাঁদের বার বার মিডিয়াতে মুখ দেখাতে না পারলে ভাল লাগেনা। আমার কথাই ধরিনা কেন, আমি কোনদিনই লেখালেখির ধারে কাছে দিয়েও হাঁটিনি। সংসার করেছি মন দিয়ে, স্বামী-সন্তান নিয়ে বেশ আনন্দেই কাটিয়েছি এতটা কাল। কিনতু সন্তান বড় হয়ে তার নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র বেছে নিতেই আমি অনেকটাই নিঃসঙ্গ বোধ করতে শুরু করি। ফেসবুকের মাধ্যমেই ব্লগের সাথে পরিচিতি। দুই একজন ব্লগার বন্ধুর উৎসাহে ব্লগে লিখতে শুরু করি। ধীরে ধীরে পাঠকের মন্তব্য পেতে শুরু করি। লেখার নেশায় পায় আমাকে। নিঃসঙ্গতা কাটতে শুরু করে, সংসারের দৈনন্দিন কাজে ভাটা পড়ে। প্রতিদিন একটা কিছু না লিখতে পারলে দিনটা মাটি মাটি মনে হয়। মনে হতে থাকে, দুই দিন না লিখলেই পাঠকরা আমাকে ভুলে যাবে। ব্লগে লিখেই আমার এই অবস্থা, আর সারা দুনিয়ায় বিতর্কের ঝড় তোলা তসলিমা নাসরিনের কী অবস্থা হতে পারে, সেটা বলাই বাহুল্য।
তসলিমা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছেন সম্প্রতি হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে লিখে। দৈনিক আমাদের সময়ে লেখাটি মুদ্রিত হতেই পাঠক হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। আমাদের সময় পত্রিকার অনলাইন সংস্করনে পাঠকের মতামত দেয়ার সুযোগ আছে। তসলিমাকে ‘নোংরা লেখিকা’ বলে যারা আখ্যায়িত করে থাকে, সেই পাঠক সমাজই মতামত অপশনে গিয়ে ‘নোংরাতম’ ভাষায় তাঁকে গালিগালাজ করে। একজন লেখকের সাথে পাঠকের যোগাযোগ এর সূত্রই হচ্ছে লেখালেখির বিষয়। লেখক লিখবে। পাঠক পড়ে তা নিজের মনেই বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিবে, এই লেখকের লেখা ভবিষ্যতে সে আর পড়বে কিনা। ভালো লাগলে আবার পড়বো, ভালো না লাগলে পড়বোই না। কিনতু লেখককে ব্যক্তিগত আক্রমণ করার মানসিকতা কখনওই কারো কাম্য হতে পারেনা।
তসলিমা নাসরিনের লেখায় সাহিত্যমান আছে কি নেই, সেটাও বিচার করবে পাঠক। সেই বিচারেই হয়তোবা পাঠককুল তসলিমা নাসরিনের লেখা বইগুলোকে ‘চটি বই’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। বিভিন্ন ঘরাণার লেখক যেমন আছেন, পাঠকের মধ্যেও শ্রেণীভাগ আছে। কেউ কবিতা পড়তে ভালোবাসে, কেউ ভালোবাসে গল্প-উপন্যাস, কেউ ভালোবাসে সায়েন্স ফিকশান, কেউ ভালোবাসে রাজনৈতিক বিষয়। আরও কিছু পাঠক আছেন, তাদের কেউ কেউ ভালোবাসেন সানন্দা পড়তে, কেউ বা ভালোবাসেন সিদ্দীকা কবিরের রান্নার বই, কেউ ভালোবাসে শুধুই ‘হিমু’, কেউ ভালোবাসে শুধুই ‘মিসির আলী’ পড়তে। কিছু উঁচু শ্রেণীর পাঠক ভালোবাসেন কঠিন প্রবন্ধ, আবার অনেকে ভালোবাসেন চটুল লেখা পড়তে। ‘চটি বই’ এর পাঠক সংখ্যাও কম নয়। সকলের সামনে ভাল বই হাতে রেখে, আড়ালে ‘চটি বই’ পড়ার পাঠক প্রচুর আছে। নাহলে ‘চটি বই’ গুলো এত ছাপাও হতোনা, বিক্রীও হতোনা। নীলক্ষেতের এক বই বিক্রেতার কাছ থেকে আগে অনেক পুরানো বই সস্তায় কিনতাম। তার এই অল্প টাকায় সংসার চলে কিনা জিজ্ঞেস করতেই সে খুব আস্তে করেই বলেছিল, আমার মতো ক্রেতা খুব কমই আসে তার কাছে, পোকায় খাওয়া পুরানো বই বিক্রীর টাকায় সংসার চলেনা বলেই চটের ঢাকা সরিয়ে টুকরীর ভেতর আসল বই দেখালো। ‘চটি বই’ শব্দটি সেই আনোয়ার নামের বই বিক্রেতার মুখে প্রথম শুনেছিলাম। যাই হোক, চটি বই যারা লিখে তারাও যেমন লেখক, যারা সেই সমস্ত বই কিনে, তারাও পাঠক। যেহেতু শ্রেণীবিন্যাস করাই আছে, কারো সাথে কারোর রেষারেষি তো হওয়ার কথা নয়। তারপরেও কেনো তসলিমাকে নিয়ে এত আলোচনা? ‘বিতর্কিত’কে আবার প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা!
হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে তসলিমার লেখাটি আমি মন দিয়েই পড়েছি। দুই একটা মন্তব্যে পাঠক হিসেবে আহত হয়েছি ( বাংলাদেশের পাঠকদেরকে উনি অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বলেছেন), কিনতু লেখার কোথাও আমি অশ্লীলতা খুঁজে পাইনি। উনার মতামত উনি দিয়েছেন, উনার বিশ্বাস থেকেই উনি লিখেছেন। সম্প্রতি বিখ্যাত এক কলামিস্ট তাঁর লেখায় তসলিমা নাসরিনকে একহাত নিয়েছেন। কলামিস্ট সাহেব তসলিমার নিন্দা করেছেন এই বলে যে হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুতে তাঁর পাঠককুল যখন শোকাভিভূত, ঠিক ঐ সময় তসলিমা হুমায়ুন আহমেদকেও একহাত নিয়েছেন। অথচ হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে লেখাটিতে তসলিমা হুমায়ুন আহমেদের প্রশংসাই বেশী করেছেন সারা লেখাতে। এই প্রথম আমি তাঁর লেখা পড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি। কিনতু যেহেতু লেখাটি লিখেছে তসলিমা নামের বিতর্কিত মহিলা, তাই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে! হুমায়ুনের সমালোচনা না করে তসলিমা আসলে আমাদের পাঠকসমাজের সমালোচনাই বেশী করেছেন এই লেখাতে। উনি বিশ্বাস করেন মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করেও হুমায়ুন আহমেদ যেভাবে আমাদের পাঠক সমাজে নন্দিত লেখক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন, এই একই ধরনের কাজ যদি তসলিমা করতেন, তাহলে তাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলা হতো। কথাটির মধ্যে একটি সত্যি তো অবশ্যই লুকিয়ে আছে। সেটা কি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে হবে? হুমায়ুন যেই তরুণীকে প্রকাশ্যে, ধর্মীয় বিধান মেনেই বিয়ে করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সেই বিবাহিত দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীকে তো আমাদের সমাজে অনেকটাই একঘরে করে দেয়া হয়েছে। বিয়ের সাত বছর পর স্বামীর মৃত্যুতে তার মাথায় কেউ সান্ত্বনার পরশ বুলায়নি, বরং হুমায়ুনকে কেন পটিয়ে বিয়ে করেছে, তার জন্য ধিক্কার দিয়েছে। কিনতু যিনি বিয়েটা করলেন, তাঁকে তো এর জন্য দায় নিতে হয়নি। কাজেই তসলিমাকে আমি অপছন্দ করতে পারি, তাঁর লেখার সাথে সহমত পোষণ না-ই করতে পারি, ভাল লাগেনা বলে তাঁর লেখা না পড়তে পারি, তাই বলে তার বিবেক বা বিচারবোধ থেকে প্রসূত লেখা বন্ধ করার অন্যায় দাবী তো করতে পারিনা!
আমি কারও লেখাতেই সাহিত্য খুঁজে বেড়াইনা। সাহিত্য খুঁজতে গেলে পাঠকের পড়ার আনন্দ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। লেখায় সাহিত্য খুঁজবে সাহিত্যবোদ্ধারা, আমার মত সাধারণ পাঠকের কাজ পড়ে আনন্দ পাওয়া। এই জন্যই হুমায়ুন আহমেদের লেখা আমার ভাল লাগে, সুনীল, সমরেশ ভালো লাগে। মহাশ্বেতা দেবীর লেখার চেয়ে আশাপূর্ণা দেবীর লেখা আমাকে বেশী টানে। প্রকৃতি ভালোবাসি বলেই বুদ্ধদেব গুহ’র লেখা ভালো লাগে। বুদ্ধদেব গুহের লেখাতে কিছু কিছু অস্বস্তিকর অংশ থাকে, লেখার প্রয়োজনেই হয়তো নর-নারীর মেলামেশার আদি ব্যাপারগুলো উনি নিয়ে আসেন লেখাতে, সেগুলোকে অস্বীকার না করেই আমি বন-জঙ্গলের রূপ বর্নণা পড়ি, মনে হয় আমি বুঝি সেই গভীর অরণ্যের ভেতর দিয়েই হেঁটে যাচ্ছি।
সেভাবেই আমি তসলিমার লেখাও পড়ি। তসলিমার ‘মেয়েবেলা’ পড়ে অসহায় মেয়েদের জন্য কষ্টে আমার বুক ফেটে গেছে। কারন তসলিমার আগে আর কারো লেখা আমি পড়িনি যেখানে মেয়েদের অসহায়ত্বের কথা কোন রাখঢাক না রেখেই বলা হয়েছে। যতটুকু মনে পড়ে ‘আমার মেয়েবেলা’তেই তসলিমা তার বাবার কথা লিখেছে। লিখেছে তাদের বাড়ীর কাজের মেয়ের সাথে তার বাবার অবৈধ সম্পর্কের কথা। লিখেছে তার মায়ের প্রতি তার বাবার নির্যাতনের কথা। পড়ে আমার দুই চোখ ফেটে জল এসেছে। বুকে কতটা কষ্ট জমে থাকলে, কতটা অপমান জমে থাকলে, তবেই একটা মেয়ে এই কথাগুলো বলতে পারে। তসলিমার লেখা এই বইটিতে সবাই নোংরামী খুঁজে পায়, কিনতু মত প্রকাশের সরল সাহসকে খুঁজে পায়না। তসলিমার লেখার মান যাই হোক না কেনো, তিনি অন্যের কুকীর্তি নিয়ে সমালোচনা করার আগে নিজের ঘরের থেকে ময়লা বের করার মত দুঃসাহস দেখিয়েছেন। তসলিমার দূর্ভাগ্য, যে মেয়েদের পক্ষে লিখতে গেছেন তিনি, সেই মেয়েরাই তাঁকে ঝাঁটা মারতে আসে সবার আগে।
কলামিষ্ট সাহেবের দুইদিন আগের সেই লেখায় পড়লাম, তসলিমা এতটাই বিকৃত রুচীর লেখিকা যে তার বাপকেও ছাড়েনি। কিনতু বাপের যে অপকর্ম নিয়ে তসলিমা লিখেছে, সেই অপকর্মগুলো একজন পুরুষের করা উচিত কি না তা অবশ্য কলামিষ্ট সাহেব বলেননি। লেখক সাহেব তাঁর লেখাতে তসলিমার নানা অপকীর্তির কথা প্রকাশ করতে গিয়ে তসলিমার মতই ভাষা ব্যবহার করেছেন। যা পড়ে আমার খারাপ লেগেছে। অনেক ব্যক্তিগত তথ্যও প্রকাশ করে দিয়েছেন যে দোষে তসলিমাও দুষ্ট। তাহলে তসলিমার লেখার সাথে তফাত থাকলো কোথায়! লেখক আরও বলেছেন, তসলিমা ‘লজ্জা’ লিখে ভারতের মৌলবাদীদের বাহবা কুড়িয়েছেন। একই লেখাতে কলামিষ্ট সাহেব লেখকের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করেছেন, আবার প্রিয় নবীর বিরূদ্ধে লিখে উনার ধর্মীয় প্রাণে আঘাত করেছেন বলে তসলিমাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। একদিকে মাওলানা সাহেবের হুমকীকে সমর্থণ করতে পারেননি, অথচ অন্যদিকে বলেছেন, মাওলানা সাহেবের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছিল বলেই মাওলানা সাহেব তসলিমার মাথার মূল্য পঞ্চাশ হাজার টাকার ঘোষণা দিয়েছিল।
কারো ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করার মধ্যে আমি নান্দনিক কিছুই খুঁজে পাইনা। আমি কলামিষ্ট সাহেবের সাথে এই ব্যাপারে একমত প্রকাশ করছি। তসলিমা এক লাফে গাছের মগডালে উঠতে চেয়েছিল। সে ধর্মপ্রাণ মানুষের আবেগ অনুভূতির তোয়াক্কা না করেই ধর্মকে নিয়ে কঠিন ভাষায় সমালোচনা করেছেন। কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা খুবই নিন্দণীয়, খুবই নিষ্ঠুর কাজ। ্মানুষ তার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পেলে সেটা হৃদয়ে কতটা রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করে, আমি নিজেও অনেকবার হৃদয়ে সেই রক্তক্ষরণ টের পেয়েছি। তবে কাউকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাইনি আজ পর্যন্ত। কারন আমি বিশ্বাস করি, ধর্মীয় বিশ্বাস এমনই এক বিষয়, যতক্ষন নিজে বিশ্বাসে অটল থাকি, ততক্ষন বাইরে থেকে কেউ শত আঘাতেও আমার বিশ্বাসে ফাটল ধরাতে পারবেনা। হাজার হাজার বছর ধরে হৃদয়ে ধারন করে থাকা বিশ্বাস কি একজন তসলিমার এক কথাতেই ভেঙ্গে যেতে পারে? ধর্মীয় বিশ্বাস কি এতই ঠুনকো? তবে তসলিমার নিজের বিশ্বাসে ফাটল ধরেছিল বলেই যে সে যাহা খুশী তাহাই লিখবে, এটাও আমি মানতে নারাজ। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে বলেই তার অপব্যবহার করা ঠিক না।তবে আমার বিশ্বাসে জোর থাকাটাকেই আমি প্রাধান্য দেই, অন্যের বিশ্বাসের প্রতিও শ্রদ্ধা রাখি।
কলামিষ্ট সাহেবের ধর্মীয় অনুভূতির প্রেক্ষিতেই নিজের দুটো কথা বলি। যেহেতু আমি হিন্দু ধর্মাবলম্বী, তাই ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি হিন্দুরা গরুর মাংস খায় না। আমাদের সাথে সাথে ধর্মীয় সংস্কৃতির এই ব্যাপারটি মুসলিমরাও জানেন, এমনকি অনেক ভিনদেশীও জানেন। কিনতু দেশে যেহেতু আমরা ছিলাম সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু ছেলেমেয়েরা কোরবাণী ঈদের সময় গরুর মাংস খাওয়ার পর বড় বড় হাড্ডিগুড্ডি আমাদের আঙিনাতে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলত। থালার মধ্যে মুড়ি আর গরুর মাংস নিয়ে আমাদের ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে বেড়াত আর ছড়া কাটত, “ নম নম তুলসীপাতা, হিন্দুরা খায় গরুর মাথা’। ঐসব ছেলেমেয়েদের অভিভাবকরা শুনেও না শোনার ভাণ করতেন। আর খেলতে গিয়ে ঝগড়া লাগলে ‘মালাউনের বাচ্চা’ বলে গালি দিয়ে খেলাতে হেরে যাওয়ার প্রতিশোধ তুলত। এভাবেই আমরা অন্তর ক্ষয়ে বড় হয়েছি।
আমার মা গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। উনার সহকর্মী মুসলিম শিক্ষিকার ছেলে নামকরা এক হিন্দু অধ্যাপকের মেয়েকে বিয়ে করেছে। সেই অধ্যাপককে একনামে সকলেই চিনতো। তখন হিন্দুকে মুসলমান বানানোর মধ্যে দারুন আনন্দের ব্যাপার থাকত। সেই আনন্দের রেশ ধরেই বিয়ের দুই দিন পর সেই শিক্ষিকা স্কুলে এসে তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরে যেতে চাইলেন। কারন হিসেবে বলেছিলেন, “ আজকে আমাদের বৌ কে গরুর মাংস খাওয়ানো হবে। সেই উপলক্ষ্যে বাড়ীতে অনেক মেহমান আসবে”। শুনেই বাকী মুসলিম সহকর্মী শিক্ষকেরা আনন্দোল্লাস করে উঠেছিলেন। শিক্ষকরুমে আমার মা ছাড়াও আরও কয়েকজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষক ছিলেন। আনন্দ প্রকাশের সময় তাঁদের অনুভূতির কথা একবারও কেউ ভেবে দেখেনি। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার মেয়েও একসময় মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করে। সেই শিক্ষিকা ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী। ধর্মীয় আচার পালনে বিশ্বাস করতেননা। কিনতু তা বললেই কি হয়? স্কুলের অন্যান্য শিক্ষক শিক্ষিকারা অতি উৎসাহে কোর্ট ম্যারেজ শেষে প্রধান শিক্ষিকার বাড়ীতে মুসলিম রীতি অনুসারে বিয়ের আয়োজন করে। নামে হিন্দু প্রধান শিক্ষিকার মেয়ের মুসলিম রীতিতে বিয়ের অনুষ্ঠানে অনেকের সাথে আমার মা’কেও নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। আমার বাবা একটি কথাই বলেছিলেন, “ প্রয়োজনে চাকুরী ছেড়ে দিও, কিনতু চাকুরী রাখার খাতিরে নিজের আদর্শ জলাঞ্জলী দিয়ে প্রধান শিক্ষিকাকে খুশী করার প্রয়োজন নেই। তুমি যাবেনা এমন বিতর্কিত অনুষ্ঠানে”। পরদিন আমার মা স্কুলে যেতেই প্রধান শিক্ষিকা একফাঁকে বলেছিলেন, “ আপনি আসেননি, আমি খুবই খুশী হয়েছি। এই অনুষ্ঠান আয়োজনে আমার কোন হাত ছিলনা। মিসেস খাতুন নিজ দায়িত্বে এই অনুষ্ঠান আয়োজন করেছেন”। এই একটি কথার মধ্যেই প্রধান শিক্ষিকার মনের অসহায়তার কথা ফুটে উঠেছিল। উনি উনার নীতির কারনে ধর্মীয় আচার পালন করতেন না, কিনতু এটাকে অজুহাত ধরে নিয়ে সেদিন সংখ্যাগুরু শিক্ষকের দল যে কাজটি করেছিল, সেটা ছিল সংখ্যালঘুর ধর্মীয় অনুভূতিতে চরম আঘাত।
এখনও অনেক মুসলিম বন্ধুদের বাড়ীতে বেড়াতে গেলে টেবিলে খাবার দাবারের প্রচুর আয়োজনের মধ্যে ‘গরুর মাংস’ও থাকে। গরুর মাংস খাইনা বললে, সাথে সাথে একদল নিমন্ত্রিত অতিথির উপস্থিতেই আলটপকা কেউ বলে ফেলে,“কেন, অনেক হিন্দুই তো আজকাল গরুর মাংস খায়, আপনি খাবেন না কেনো”? প্রথম কথা, হিন্দু অতিথির সামনে ‘গরুর মাংস’ পরিবেশন করাটাই হচ্ছে এক নম্বর অভদ্রতা, দুই নাম্বার অভদ্রতা হচ্ছে , অন্যেরা গরু খায় বলে তাকেও গরুর মাংস খাওয়ার জন্য অন্যায় আবদার করা। এগুলোওতো একধরনের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের শামিল। ধরে নিলাম, অনুষ্ঠানে হিন্দু –মুসলিম অনেকেই থাকে, তাই গরুর মাংস রান্না করা হয়। কিনতু এমনও হয়েছে, শুধুই আমরাই নিমন্ত্রিত, এমন অবস্থায়ও টেবিলে গরুর মাংস রাখা হয়েছে। আমরা যেহেতু উচ্চশিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে পড়ি, তাই আমাদের যে সমস্ত বন্ধু-বান্ধবের কথা বললাম, তারাও উচ্চশিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যেই পড়ে। তাদের কখনও মনে হয়নি, বছরের বারোমাসই তো গরুর মাংস খাওয়া যায়, একটা দিন কী একটি হিন্দু পরিবারের সম্মানে আইটেমটা বাদ দেয়া যায়না! এগুলোও অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিকে তোয়াক্কা না করার মতই ব্যাপার।
উপরের কথাগুলো লেখার ইচ্ছে ছিলনা। কলামিষ্ট সাহেবের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের প্রসঙ্গে সহমত পোষণ করেই নিজের না বলা কষ্টগুলো প্রকাশ করলাম। সমাজে কিছু মানুষ থাকে, যাদের কাছে নিজের মতটাকেই বেশী মূল্যবান মনে হয়, অন্যের ভালো লাগা বা মন্দ লাগার ব্যাপারটিকে গ্রাহ্যই করেনা। তবে সবাই তো আর এক রকম না। মেলবোর্ণের ডঃ লুৎফর ভাই এবং ভাবীর মত ধর্মপ্রাণ এবং সুবিবেচক বন্ধুও আমাদের ছিল, বাংলাদেশে শফিক ভাই এবং ডাঃ হাসমত আরা ভাবীর মত ধর্মপ্রাণ কিন্তু সুবিবেচক বন্ধু আমাদের আছে, যাঁদের মুখ থেকে কখনও অন্যের প্রতি ঈর্ষা বা বিদ্রূপ- বিদ্বেষমূলক কথা শুনিনি। আমেরিকাতেও তেমন বন্ধু আছে। এভাবেই আশেপাশে দুই চারজন অকৃত্রিম বন্ধু পেয়ে অভিমান বুকে চাপিয়ে হাসিমুখেই বাকী সকলের সাথে মেলামেশা করি।
লজ্জা বইটির কথা বলতে গেলে বলতে হয়, সংখ্যাগুরুদের কাছে তা অস্বস্তির হলেও পৃথিবীর সকল সংখ্যালঘুদের জন্য বইটি ছিল সান্ত্বনাস্বরূপ। এই সংখ্যালঘু যে কেউ হতে পারে। সে বাংলাদেশের হিন্দুও হতে পারে, পাহাড়ী আদিবাসীরাও হতে পারে, ফিলিস্তিনি অসহায় মুসলিম জনগনও হতে পারে। এরা হতে পারে আমেরিকান ইনডিয়ান, হতে পারে অস্ট্রেলিয়ার এবরিজিনিজ। ‘লজ্জা’ বইটি আমাদের মত ডরপুক, বোবা শ্রেণীর সংখ্যালঘুদের জন্য একটি দলিলস্বরূপ। কারো ভালো লাগতে পারে, কারো কাছে খারাপ লাগতে পারে। কিনতু ‘লজ্জা’র কাহিণী বিন্যাসে সাহিত্য না থাকলেও ঘটনা তো অনেকটাই সত্যি। কলামিষ্ট সাহেব নিজে অত্যন্ত ভালো মানুষ, অসাম্প্রদায়িক। আপনি হয়ত সংখ্যালঘুদের মনের খবর জানেননা, তাই আপনি ‘লজ্জা’ পড়ে যুগপৎ ক্ষুব্ধ ও অবাক হয়েছেন। কিনতু তসলিমা নিশচয়ই তেমন ভুক্তভোগীদের অনেক কাছাকাছি যেতে পেরেছেন, তাই তার নিজের বিবেক থেকে ‘লজ্জা’ লিখেছেন। উনার লেখা নিয়ে কেউ রাজনীতি করবে, এমন ভেবে তো আর তিনি ‘লজ্জা’ লিখেননি! আর ভারতের হিন্দু মৌলবাদীরা এই বই নিয়ে বিশ্রী রাজনীতি করেছে, বাংলাদেশের সরকার রাজনৈতিকভাবেই তার জবাব দিতে পারত, তা না দিয়ে বইটি নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। নিষিদ্ধ ঘোষনার পরেই বইটি পাঠকের হাতে হাতে পৌঁছে গেছে। নাহলে কার এত দায় পড়েছে, পয়সা খরচ করে ওসব ‘ছাইপাশ’ পড়ার। তবে আমি পড়েছি ‘লজ্জা’, বেশ কয়েকবার। সান্ত্বণা পেয়েছি বইটি পড়ে, মনে হয়েছে একজনকে পেলাম যাঁর মর্মে পৌঁছেছে আমাদের অসহায় বোবা কান্না।
তসলিমা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে টুইটারে যা-ই লিখে থাকুক না কেনো, সেটা তেমন কারো নজরেই আসতোনা। এই লেখার বিরূদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হতেই পাঠক আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। শুধু পাঠকই বা বলবো কেনো, প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকরাও দেখি আবার মুখ খুলতে শুরু করেছেন। প্রখ্যাত এক কবি অভিযোগ করেছেন, ‘ক’ বইটিতে তসলিমা তাঁকে যথাযথ সম্মান না দিয়ে সাধারন মানের লেখক বলেছেন। অতি আলোচিত-সমালোচিত বই ‘ক’ তে তসলিমা দেশের নামকরা কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে মুখরোচক সব কাহিণী লিখেছেন। বই প্রকাশিত হওয়ার পর কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, কেউ বা তসলিমার বিরূদ্ধে কোটি টাকার মানহানির মামলা করেছিলেন। বইটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। নিষিদ্ধ জিনিসের পেছনে ছোটা মানুষের আদিম অভ্যাস। বই নিষিদ্ধ ঘোষণার সাথে সাথে বই ফুটপাতে বিক্রী শুরু হলো। মানুষও হুমড়ী খেয়ে ‘ক’ কিনতে শুরু করলো। যে বই থাকতে পারতো কিছু সংখ্যক পাঠকের কাছে, তা হয়ে গেল উন্মুক্ত।
সরকার থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত বই তো আর লাইব্রেরীতে পাওয়া যাওয়ার কথা না, তাই তসলিমার বই চলে গেল ফুটপাতের চটি বইয়ের সারিতে। এভাবেই তসলিমাও হয়ে গেল চটি লেখিকা। এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিনতু আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবি সমাজ সেটা আর হতে দিচ্ছেন কই? নাহলে ‘ক’ তে যেখানে উক্ত কবির নামে কোন মুখরোচক কথা নেই, এতেই তো উনার হাঁফ ছেড়ে বাঁচার কথা, উনি হাঁফ না ছেড়ে খুঁচিয়ে আবার নিয়ে আসছেন সেই পুরানো দিনের হারিয়ে যাওয়া গল্প। উনার লেখা পড়ার পর অনেক নতুন পাঠক অনলাইনে গিয়ে আবার ‘ক’ পড়বে, যে গল্প শেষ হয়ে গিয়েছিল, তা আবার নতুন করে শুরু হবে। সেই নতুন পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগবে, “ এই চটি বইয়ের লেখিকাকে নিয়ে এখনও এত কথা কেনো? তবে কি উনার লেখায় সত্যতা আছে, যা সকলকেই দহন করে চলেছে”!! নাকি তসলিমার কথাই ঠিক, আমাদের সমাজে সে ‘নারী’ বলেই তার এমন হেনস্তা??
বর্তমান সময়ের পাঠকের মনে আরেকটি প্রশ্নও জাগবে, তসলিমা কে ‘ক’ এর মত এমন একটি বই লিখতে হলো কেনো? আজকে লেখকসমাজ যেভাবে তসলিমার বিরূদ্ধে সোচ্চার হয়েছে, যেদিন তসলিমাকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হলো, সেদিন লেখকসমাজ কেনো প্রতিবাদ করেনি? সেও তো লেখক সমাজেরই অংশ ছিল! না কি আসলে সে একটু ব্যতিক্রম স্বভাবের নারী বলেই, সে খুব সহজে সব পুরুষের সাথে মিশত বলেই তাকে তখন মিথ্যে খাতির করা হয়েছিল! তাকে দারুন লেখিকা বলে ভুলভাল বলে আকাশে তুলে দেয়া হয়েছিল! কলামিষ্ট সাহেব বলেছেন, তসলিমা তাঁর লেখা ছাপানোর জন্য তরুন লেখদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতেন। এটা কেমন কথা হলো! লেখালেখি ভেতর থেকে আসতে হয়। কাউকে খাতির করলেই যদি মগজ থেকে লেখা আপনি আপনি বেরিয়ে আসতো, তাহলে তো সারাদেশে লেখিকার হাট বসে যেত। তারপরেও তখনকার লেখক সমাজ তসলিমাকে তো তাদের একজন হিসেবেই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তাহলে তাঁর বিপদের সময় কেনো তাঁর পাশে দাঁড়ালেন না! কেনো যেই মাত্র তাকে দেশছাড়া করা হয়েছে, অমনি তার পায়ের কাছ থেকে ‘মই’টিও সরিয়ে নেয়া হয়েছে। মই সরে যাওয়ায় তসলিমা যে আছাড় খেয়েছেন, চরম ব্যথা পেয়ে তার ঘোর নিশ্চয়ই কেটে গেছে। যাদের বন্ধু ভেবে নাচন কুদন করেছিল, বিপদের দিনে তারা সরে যেতেই আক্রোশে সে সব ফাঁস করতে শুরু করেছে। তসলিমাকে আমি এই কারনেই অপছন্দ করি। সে ‘ক’ বইটিতে যে সমস্ত কান্ড কীর্তির উল্লেখ করেছে, তা কোনভাবেই নারীদের সপক্ষে যায়না। তা একেবারেই তার নিজস্ব। এটা এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতাও। লেখক সমাজ তার বিপদে তার পাশে না দাঁড়িয়ে কাপুরুষতার পরিচয় দিয়েছেন আর তসলিমা লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে ‘ক’ বইটি লিখে এককালের বন্ধুদের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতাই করেছেন।

Sunday, September 2, 2012

আজ আমেরিকায় ‘লেবার ডে’ বা শ্রমিক দিবস


আমেরিকায় ‘লেবার ডে’ বা শ্রমিক দিবস


আজ আমেরিকায় ‘লেবার ডে’ বা শ্রমিক দিবস। প্রতি বছর সেপ্টেম্বার মাসের প্রথম সোমবার লেবার ডে উদযাপিত হয়। আজ সরকারী ছুটি্র দিন। আমেরিকার রাস্তাঘাটে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে সেই সমস্ত লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের সম্মান দেখানো হয়, যাদের নিরলস আন্দোলনের পথ বেয়ে শ্রমের মর্য্যাদা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এদেশে শ্রমিক বলতে আলাদা কোন শ্রেণী নেই, প্রত্যেকটি নাগরিকই যার যার অবস্থানে থেকে কাজ করে চলেছে, সেই হিসেবে প্রত্যেকেই একেকজন শ্রমিক। সকলের মিলিত শ্রম আমেরিকাকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে কফি শপের সবচেয়ে তরুন কর্মীর শ্রমের বিনিময়েই আমেরিকা আজ বিশ্বে ‘সুপার পাওয়ার’ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।  এই আদর্শের ভিত্তিতেই ‘লেবার ডে’ বা শ্রমিক দিবস অত্যন্ত আনন্দ-উৎসবের ভেতর দিয়ে পালিত হয়।

লেবার ডে উদযাপনঃ
বেশীর ভাগ আমেরিকান (সাধারণ জনগন) লেবার ডে’র তাৎপর্য্য নিয়ে মাথা ঘামায়না। লেবার ডে বলতে কী বুঝায়, লেবার ডে প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, এই দিনটির স্বপ্নদ্রষ্টা কে ছিলেন, এগুলো জানার ব্যাপারে কারো তেমন একটা উৎসাহ নেই। বরং সারা সপ্তাহ পরিশ্রম করার পর দুই তিন দিন হাতে পাওয়া গেলে ঐ সময়টা আনন্দ করে কাটাতেই এরা বেশী আগ্রহী। সরকারী ক্যালেন্ডারে সেপ্টেম্বারের প্রথম সোমবার ( ‘লেবার ডে’ ) সরকারী ছুটির দিন হিসেবে চিহ্নিত থাকে। ক্যালেন্ডার দেখে বছরের শুরুতেই সকলে প্ল্যান করে, লেবার ডে উইকএন্ড কিভাবে কাটাবে।
সেপ্টেম্বারের প্রথম সপ্তাহ থেকেই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন সেমেস্টার শুরু হয়। আস্তে আস্তে শীতের আগমন টের পাওয়া যায়। এখানে শীতকালে প্রচন্ড ঠান্ডা পড়ে বলেই শীতকালে কেউ বেড়াতে যায়না। এই জন্যই সামার শেষের লং উইকএন্ডটির জন্য সবার অমন অধীর অপেক্ষা। অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে দূরে কোথাও বেড়াতে চলে যায়, কেউবা দলবেঁধে মাছ ধরতে যায়, বন্ধুবান্ধব মিলে পিকনিক করে, ক্যাম্পিং করে, অথবা চলে যায় কাছাকাছি কোন সমুদ্র সৈকতে। যেহেতু সামারের শেষ, সকলেই উৎসবমুখর মেজাজে থাকে, বছরের শেষ সামারের পোষাক পড়ে, যদিও সমাজের উঁচুতলার বাসিন্দারা লেবার ডে তে সাদা পোষাক পড়াকেই ফ্যাশান মনে করে। আর তরুণ-তরুণীরা মনে করে, উইকএন্ডটি হবে বন্ধুদের সাথে সামারের শেষ ‘হ্যাং আউট’ (চরম আড্ডা)।
অবশ্য আমেরিকায় কিছু কিছু কল কারখানা, দোকান-পাট, মার্কেট (ওয়াল-মার্ট), ওষুধের দোকান (ওয়াল গ্রীন) দিবা রাত্রি চব্বিশ ঘন্টা চালু থাকে, ঐ সকল প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কর্মচারী এক দিনের বেতন বোনাস হিসেবে পেয়ে থাকে।

ক্রীড়াজগতেও লেবার ডে’র সপ্তাহকে লীগ শুরুর সীজন হিসেবে নির্বাচন করা হয়। ন্যাশনাল ফুটবল লীগ ( এন এফ এল) এবং কলেজ ফুটবল সীজন সেপ্টেম্বারের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হয়। ফুটবল লীগও লেবার ডে’র সপ্তাহ বা তার আগের সপ্তাহ থেকে শুরু হয়।
The First Labor Day Parade, New York City, September 5, 1882
প্রথম ‘লেবার ডে’ প্যারেড, নিউ ইয়র্ক সিটি,  ৫ই সেপ্টেমবার, ১৮৮২

শ্রমিক আন্দোলনের গোড়ার দিকের কথাঃ

বছরের নির্দিষ্ট একটি দিন শ্রমিকদের নামে উৎসর্গীকৃত হওয়ার পেছনের ইতিহাসে, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামগাঁথা লেখা আছে।
অসহায় দরিদ্র মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম করে মজুরী যা পেত, তাতে নুন আনতে পান্তা ফুরাতো। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই মানুষ প্রতিবাদ করতে শেখে। দুই তিন শতক আগের দরিদ্র জনগনের মধ্যেও নিজের প্রাপ্য আদায়ের চেতনা জাগ্রত হয়েছিল। সেই চেতনা থেকেই ন্যায্য পাওনা আদায়ের দাবী উঠে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই ছিল একই চিত্র। ন্যায্য অধিকার আদায়ে লক্ষ শ্রমিকের দেহের ঘাম ঝরেছে, কত শত শ্রমিক জীবন দিয়েছে, লাগাতার হাঙ্গার স্ট্রাইক, ধর্মঘট, মিছিল, মিটিং এর পথ ধরেই এই সাফল্য এসেছে।
শত বছর ব্যাপী ধারাবাহিক আন্দোলন শেষে তারা তাদের দাবী অনুযায়ী বেতনের নির্দিষ্ট স্কেল পেয়েছে, দিনরাতব্যাপী কাজ করার পরবর্তে নির্দিষ্ট আট ঘন্টা কাজ করার অধিকার, নির্দিষ্ট সময়ের অতিরিক্ত কাজের জন্য অতিরিক্ত পারিশ্রমিক, সন্তোষজনক মজুরী, সাপ্তাহিক ছুটি, অসুস্থ হলে সিক লীভ, বাৎসরিক ছুটি, পরবের ছুটি পেয়েছে, এ সবই আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।
‘লেবার ডে’র স্বপ্নদ্রষ্টা ম্যাকগায়ার ও ম্যাগায়ারঃ
প্রথম ‘লেবার ডে’ উদযাপিত হয় ১৮৮২ সালে। ১০,০০০ শ্রমিকের এক বিরাট দল নিউ ইয়র্কের সিটি হল থেকে মার্চ পাস্ট করে ইউনিয়ন স্কোয়ারে যায়। প্যারেড শেষে সকলে মিলে রিজার্ভার পার্কে পিকনিক, গান বাজনা করে পুরো দিনটি মাতিয়ে তোলে। লেবার ডে’র প্যারেডসহ দিনটির সমস্ত আয়োজনে ছিলেন পিটার জে ম্যাকগায়ার, আমেরিকান ইউনিয়ন মুভমেন্টের বিশিষ্ট নেতা, যিনি পেশায় ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রী।
একই বছর নিউইয়র্ক সেন্ট্রাল লেবার ইউনিয়নের সেক্রেটারী, ম্যাথিউ ম্যাগায়ার, যিনি পেশায় ছিলেন কারখানার মেশিনচালক, সর্বপ্রথম সরকারের কাছে ‘শ্রমিক দিবস’কে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে ঘোষনা করার প্রস্তাব করেন। ফলে, শ্রমিক দিবস বা লেবার ডে’র স্বপ্নদ্রষ্টা প্রকৃতপক্ষে কোনজন তা নিয়ে আজও বিতর্ক আছে। তবে ম্যাকগায়ার অথবা ম্যাগায়ার, দুজনের নামই লেবার ডে’র সাফল্যের সাথে জড়িত, এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই।


‘লেবার ডে’ সরকারী ঘোষণাঃ
১৮৮৭ সালে ওরিগন স্টেটে ‘লেবার ডে’ সর্বপ্রথম ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। তবে ওটা সরকারীভাবে স্বীকৃত ছিলনা। তখনও আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী আদায়ের লক্ষ্যে ধারাবাহিকভাবেই আন্দোলন চলছিল। সেই ধারাবাহিকতার পথ ধরে ১৮৯৪ সালে ইলিনয় রাজ্যের পুলম্যান শহরের শ্রমিকদের কম মজুরীর প্রতিবাদে ‘শ্রমিক ইউনিয়ন’  লাগাতার ধর্মঘট ডাকে। সেই ধর্মঘটের রেশ আমেরিকার নানা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, চারিদিকে বিক্ষোভ দানা বাঁধে। বিক্ষোভ ভয়ংকর আকার ধারন করলে তৎকালীণ প্রেসিডেন্ট ক্লীভল্যান্ডের নির্দেশে পুলম্যান শহরে সেনাবাহিনী নামানো হয়। শ্রমিক-সেনাবাহিণী সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৩ জন শ্রমিক নিহত হয়, ৫৭ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। তিন লক্ষ ডলার মূল্যের সম্পদ বিনষ্ট হয়।
পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রেসিডেন্ট ক্লীভল্যান্ড দ্রুত শ্রমিক আন্দোলনের প্রধান নেতা রেস এর সাথে আলোচনায় বসেন এবং আলোচনা শেষে শ্রমিকদের দাবী মেনে নিয়ে ‘লেবার ডে’ সরকারী স্বীকৃতি প্রদান করেন। ‘নিউ ইয়র্কের শ্রমিক ইউনিয়নের’ প্রস্তাব অনুযায়ীই সেপ্টেম্বারের প্রথম সোমবার ‘লেবার ডে’ নির্বাচিত হয়। তবে প্রতি বছর দিনটি ‘সোমবার’ হলেও তারিখটি বদলে যায়। যেমন ২০১২ সালের লেবার ডে’ ৩রা সেপ্টেম্বার (সরকারীভাবে স্বীকৃত) হলেও ১৮৮২ সালের প্রথম ‘লেবার ডে’ ছিল সেপ্টেম্বারের ৫ তারিখ (বেসরকারী)।

জাতীয় ছুটিঃ
আগে লেবার ডে উপলক্ষ্যে বিশাল প্যারেড বা শোভাযাত্রা বের হতো। সফল আন্দোলনের প্রতীকী মিছিলগুলো ছিল আনন্দ উল্লাসপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে লেবার ডে’ উদযাপনে কিছু পরিবর্তন এসেছে। কিছু কিছু রাজ্যে আনন্দ মিছিল বের হলেও অধিকাংশ রাজ্যগুলোতে আগের মত আর বিশাল বিশাল প্যারেড হয়না। তার পরিবর্তে পত্র পত্রিকা, টিভি, রেডিওসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় বড় বড় নেতা নেত্রীদের বক্তব্য, বিবৃতি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে প্রচারিত হয়। তাদের বক্তব্যে আমেরিকার অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে লেবার ডে’র গুরুত্ব স্বীকৃতি পায়। বক্তব্যের ভেতর আমেরিকার প্রতিটি নাগরিককেই শ্রমিকের মর্য্যাদায় ভূষিত করা হয়। এই শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে কারখানার সাধারণ শ্রমিক যেমন আছে, তেমনি আছে বড় বড় শিল্পপতি, ইউনিয়ন এর নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবি, শিক্ষক, সরকারী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে স্বল্প আয়ের কেরাণী।
রাষ্ট্রিয়ভাবেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে আমেরিকার প্রতিটি নাগরিকের শ্রমকে, যেই শ্রমের বিনিময়ে আমেরিকার প্রতিটি নাগরিক পেয়েছে সুন্দর, সুস্থ, উচ্চমানের জীবন। প্রতিটি নাগরিকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শ্রমের বিনিময়ে আমেরিকা পৃথিবীর বুকে শক্তিশালী, গনতান্ত্রিক এবং নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সেজন্যই লেবার ডে’তে আমেরিকান জাতি সকল শ্রমিকদের প্রতি ফ্ল্যাগ উড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করে।

Saturday, September 1, 2012

তুমি কি একজন ভাল মানুষ?

 আমি মানুষের মাঝে থাকতেই বেশী ভালোবাসি। মাঝে মাঝে দুই এক ঘন্টার জন্য একা থাকা যায়, কিনতু এরপরে আমার অস্থির লাগতে শুরু করে।  আমি বড় হয়েছি  লোকালয়ের ভেতর। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের মাঝে  থেকেছি মাত্র দেড় বছর, অনার্স ২য় বর্ষেই বিয়ে হয়ে যায়।  বিয়ের পর শুরু হয় টোনাটুনীর সংসার।  টোনাটুনীর সংসার শুরু হতেই একাকীত্ব ব্যাপারটির সাথে পরিচয়। স্বামী অফিসে চলে গেলেই পুরো বাড়ী ফাঁকা, নিস্তব্ধতা আমাকে গ্রাস করতো।  ঠিক তখনই আমার গল্পের বই পড়া শুরু। একসময় গল্পের বইয়ের চরিত্র গুলোই আমার বন্ধু হয়ে উঠে।  পর্যায়ক্রমে কোলজুড়ে এক দুই করে তিন মেয়ের আবির্ভাবের সাথে সাথে কর্মব্যস্ততা বেড়ে যায়, একাকীত্ব দূর হয়ে যায়।

আমেরিকা এসে আবার অন্যরকম একা হয়ে পড়ি। গল্পের বইয়ের ভান্ডার শেষ হয়ে যায়, দুই মেয়ে কলেজে চলে যায়, বাকী থাকে শুধু স্বামী আর ছোট মেয়ে। এরাও এদের কাজে চলে গেলে আমি যে কে সেই। আবার একা। একাকীত্ব কাটাতেই ঢুকে গেলাম কাজে। মিসিসিপিতে আমার অর্জিত বিদ্যা কাজে লাগানোর সুযোগ পাইনি। আমি অনার্স মাস্টার্স করেছি কেমিস্ট্রিতে। আমাদের বাড়ীর ধারে কাছে কোথাও কোন ল্যাবরেটরী নেই যেখানে আমি এপ্লাই করতে পারি। তাছাড়া আমি তখন ড্রাইভিংও জানতামনা, তাই দূরে কোথাও চাকুরীর সন্ধান করিনি। খুব কাছাকাছি ছিল ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার। সেখানেই চাকুরী চেয়েছি ও পেয়েছি।

ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার হচ্ছে ছোট আরেকটা পৃথিবী, যেখানে আলপিন থেকে শুরু করে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের জন্য অপরিহার্য্য জিনিসের সবই পাওয়া যায়।  সাত বছর আগে আমি ওয়ালমার্টে জয়েন করি, ঐ বছর আমাদের ওয়ালমার্ট সুপারসেন্টারে মোবাইল ফোন সার্ভিস ওপেন করা হয়। তিনটি বড় বড় ফোন কোম্পাণির ডিলারশীপ নেয় আমাদের স্টোর। আমেরিকাতে খাবার দাবারের পাশাপাশি মোবাইল ফোন  মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য্য।  সাধারণ মানুষ অক্সিজেন ছাড়া বাঁচেনা, আমেরিকানদের  বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেনের পাশাপাশি একখানা সেল ফোন দরকার হয়। নাহলে ওদের অর্ধেক অঙ্গহানি ঘটে যাবে। এত বেশী ভীড় থাকে ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের সামনে, তা আর বলার নয়।

 আমি চেয়েছিলাম ওদের অফিসে কাজ করতে।  কিনতু তৎকালীন ম্যানেজার জেসী স্মিথ আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে নিয়ে আসে। আমি যত বলি যে সাউদার্ণ ইংলিশ আমি বুঝিনা, ততই সে হাসে। সে আমাকে বলে, লোকের কথা বুঝার দরকার নেই, ওরা প্রশ্ন করার আগেই তুমি ওদেরকে সব বুঝিয়ে বলে দিবে, যাতে আর প্রশ্ন করার সুযোগ না পায়। অফিসের কর্তার ইচ্ছেতেই কর্ম চলে, তাই অনিচ্ছাসত্বেও আমাকে ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টেই আসতে হয়েছে।  আস্তে আস্তে আমি কাজটা এনজয় করতে শুরু করি। কাজটিতে সারাক্ষন কথা বলতে হয়, প্রতি মুহূর্তে গ্রাহকের আনাগোনা চলতেই থাকে। আমার একাকীত্ব দূর হয়ে যায়।

প্রতিদিন নানা বয়সের, নানা বর্ণের , নানা দেশের মানুষ আসে আমাদের কাছে। কাজটা করতে অনেক ধৈর্য্য থাকা দরকার।  আমার ধৈর্য্যশক্তি মনে হয় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশী, নাহলে সাত বছর ধরে এই কাজে লেগে থাকতে পারতামনা। প্রমোশনাল পরীক্ষায় পাশ করেও এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের পোস্ট নেইনি। ম্যানেজারদের কাজ অনেক ঝামেলার, আমি আমার কাছে আসা শত লোকের মাঝেই আনন্দে থাকি।  কত রকমের মানুষের সাথে যে পরিচয় হয়, লিখে রাখতে পারলে বিরাট ভ্যলুমের বই হয়ে যেত।

 অনেকেরই ধারনা হয়ে গেছে, আমি খুব হেল্পফুল।  বিশেষ করে বয়স্ক গ্রাহক, মেক্সিকান, চায়নিজ গ্রাহকেরা আমার কাছে সাহায্য পেতে চায়। তাদের কথা অন্যেরা মনোযোগ দিয়ে শুনতেও চায়না, বুঝতেও চেষ্টা করেনা। তাই এই ধরনের গ্রাহকেরা ডিপার্টমেন্টে এসেই আমার খোঁজ করে। আমার ছুটি থাকলে প্রয়োজনে ওরা পরের দিন আসে। ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে। মানুষের বিশ্বাস অর্জন করার মধ্যে এক ধরনের তৃপ্তি আছে। আমি কাজের ফাঁকে ওদের সাথে গল্প জুড়ে দেই। কত রকমের কাহিণী শুনতে পাই, আমার দারুন লাগে।  এদের প্রায় প্রত্যেকে আমার নাম জানে, ওয়ালমার্টে অন্য কাজে আসলেও আমার সাথে দেখা করে যায়। সেদিন এক মেনোনাইট ভদ্রলোক এসে দেখা করে গেল। প্রায় চার পাঁচ মাস আগে তাঁর কাছে আমি আমিশ, মেনোনাইটদের জীবন ধারার গল্প শুনতে চেয়েছিলাম। আরেক কালো বয়স্ক লোক আমাকে দেখে জানতে চাইলো, এতদিন আমি কোথায় ছিলাম? দেশে গেছিলাম শুনে সে বললো যে আমি ছিলামনা বলে কেউ তার প্রিপেইড ফোনে অতিরিক্ত মিনিট যোগ করে দেয়নি। আসলে আমার সাথে যারা কাজ করে, এরা সব ইয়াং ছেলেপেলে, একটু ফিচেল ধরনের। কাজে ফাঁকী দিয়ে আনন্দ পায়। বয়স্ক  বা এশিয়ান কেউ আসলেই আঙ্গুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে দেয়।
এভাবেই সাত বছরে অনেকেই আমার কাছে খুব পরিচিত হয়ে গেছে। আমার এই আপনজনেরা প্রায়ই আমাকে কিছু না কিছু গিফট দিতে চায়। আমি কারো কাছ থেকেই কিছু নেইনা বলে, আর কিছু না হোক একখানা চকোলেট, নাহয় তো একখানা কলম দিতে চায়।  সেদিন এক বুড়া-বুড়ী এসেছে আমার জন্য একখানা 'ক্রস' নিয়ে। নিজেরাই বানিয়েছে। আমি সব  ধর্মের প্রতি সবসময়ই শ্রদ্ধাশীল। বিনা বাক্যে 'ক্রস' হাতে নিতেই ওদের মুখ হাসিতে ভরে গেল। আমাকে বললো, " তুমি খুব ভালো। পবিত্র আত্মা তোমার। তুমি আমাদের সব সময় সাহায্য করো বলে আমরা খুব খুশী। ক্রসটা তোমাকে উপহার দিলাম"। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে মনে মনে বলি, " ভালো মানুষ হওয়া কি অত সহজ"?  অবশ্য বুড়ো বুড়ীরাই আমাকে উপহার দেয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠে, কারন এরা বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছে মনে হয় একা হয়ে যায়, তাই আমার মত ভিন দেশীর কাছ থেকে সতঃস্ফূর্ত সাহায্য পেয়ে খুশীতে আটখানা হয়ে যায়।

আজকে  দারুন সুন্দরী দুই তরুণী এসেছিল তাদের আগের ফোন ফেরত দিয়ে আরও ভালো ফোন নিতে। দুই তরুণী সম্পর্কে বোন হয়। বড় বোনের সাথে ফুটফুটে দুই বাচ্চাও এসেছে। সাথে  আইডি, ফোন চার্জার আনতে ভুলে গেছে।  ওগুলো নিয়ে আসতে বললাম, নাহলে কাজটা শুরু করতে পারবোনা বুঝতে পেরেই  একজন  বাইরে গেল এবং আধ ঘন্টা পর ফিরে এলো সব কিছু সাথে নিয়ে।  ঐ আধঘন্টা আমি আমার নিজস্ব কাজ করছিলাম, আর ফাঁকে ফাঁকে  বাচ্চা দুটোর সাথে মজা করছিলাম।  প্রথমদিন বড়বোন তার স্বামী, দুই বাচ্চা নিয়ে এসেছিল। তাদের ফোন কন্ট্র্যাক্ট আমিই করে দিয়েছিলাম। সব কাজ যখন প্রায় শেষের দিকে, বড় বোনটি আমার কাছে একটা কলম চাইতেই আমি তাকে কলম এগিয়ে দিয়ে পেপারস রেডী করছিলাম। পেপারসে যখন মেয়েটির সাইন করা শেষ, তখন মেয়েটি আমার দিকে ছোট্ট একখানা বই এগিয়ে দিয়ে বলল, " তুমি একজন ভালো মানুষ। এই বইটার পেছনে আমার ফোন নাম্বার লিখে দিলাম। বইটা পড়ে তুমি আমাকে ফোন করো, প্লীজ"। ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে সবটুকু কথা বলে মেয়েটি সবাইকে নিয়ে চলে গেল।

 বইটির উপরের পাতায় লেখা আছে, " ARE  YOU  A  GOOD  PERSON'?   ছোট্ট বইটি হাতে নিয়েই বুঝলাম, পবিত্র বাইবেলের কিছু হবে।  বইয়ের পাতা উল্টাতেই দেখলাম, লেখা আছে, সকলেই দাবী করে তারা ভালো মানুষ। আসলে সেটা সঠিক নয়। তুমি একজন ভালো মানুষ কিনা তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য বাইবেলের দশটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, সঠিক উত্তর, মিথ্যে বললে হবেনা। সত্যি উত্তর দিয়ে তুমি নিজেই জানতে পারবে তুমি আদৌ ভাল না মন্দ।

আমি অবশ্য জানি যে আমি ভালো নই, তাই প্রশ্ন পড়েও লাভ নেই।  তবুও এমন সুন্দরী এক মেয়ে আমাকে ডেকে বলেছে যে আমি খুবই ভালো, আমার পবিত্র আত্মা।  এ কথার মর্যাদা দেয়ার জন্যই আমি প্রশ্নগুলো পড়তে শুরু করলাম। সবই সাধারণ প্রশ্ন, সব ধর্মেই যা করা হয়ে থাকে। "তুমি মিথ্যা কথা বল কিনা", "তুমি চুরী করেছো কি না', 'তুমি বাবা মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছ কিনা", "কারো উন্নতি দেখে ঈর্ষা করো কিনা' জাতীয় দশখানা প্রশ্ন। একফাঁকে এটাও পড়লাম,  মিথ্যে কথা বললে নরকের গনগনে আগুনে ফেলে পোড়ানো হবে মিথ্যেবাদীকে। আমার একটু হাসি পেল। ছোটবেলায় গাজীর পট নিয়ে একজন লোক আসতো। তার সাথে আনা পোস্টারে নরকের নানা ভয়ংকর সব দৃশ্য আঁকা থাকত। যেদিন সেই লোক আসত, দিনের বাকী সময় খুব সাবধানে চলতাম, যেন কোন পাপ কাজ না করে ফেলি। পরেরদিন থেকে যে কে সেই।

আমি ধরেই নিয়েছি দশ প্রশ্নের পরীক্ষায় আমি ফেল করবো। কারন আমি সদা সত্য কথা বলিনা।  মাঝে মাঝে  মিথ্যে বলি। তবে আমার নিজের জন্য আমি কখনও মিথ্যে বলিনা। এই একটা ভালো দিক আছে আমার মধ্যে। নিজের অপরাধ সব সময় স্বীকার করি, কাউকে বাঁচাতে হলে মিথ্যে বলে দেই।

চুরী?  বড় হওয়ার পর আর করিনি। ছোটবেলায় চুরী করে রসগোল্লা খেতে গিয়ে বিষম খেয়ে মরার যোগার হয়েছিল। ছোটখাট চুরী করেছি ছোটবেলায়। মানুষের বাড়ীর গাছ থেকে ফুল চুরী করাও একটা চুরী।

বাবা মায়ের সাথে বেয়াদবী করিনা বললেই কি হয়? গলা উঁচু করে কথা বললেই বাবা মা বলতো, " বেশী বেয়াদব হয়ে গেছে, আজকাল মুখে মুখে তর্ক করে"।

কারো উন্নতিতে ঈর্ষা করি?? না,  মনে হয় ঈর্ষা করিনা। তবে ঈর্ষা না করলেও 'ইনফেরিয়রিটি কম্পলেক্সে ভুগি। মনটাতে অস্বস্তি হয়, বুঝিনা কিসের জন্য, কার জন্য অস্বস্তি হচ্ছে। পরে খেয়াল হয়, কারো ভালো কিছু শোনার পর থেকে নিজের অক্ষমতার কথা মনে হয়েই এই অশান্তি।

বাকী প্রশ্ন পড়ার প্রয়োজন মনে করিনি। আমি শুরুতেই ফেল। কোনটাতেই পাশ করিনি। মেয়েটাকে ফোন করবো আর দুই দিন পরে। ফোন করে বলবো, তুমি যা ভেবেছো তা ঠিক নয়। আমি ভাল মানুষ নই, আমার আত্মা পবিত্র নয়। আমি পাপী মানুষ, অযথাই লোকে আমাকে দেখলেই ভালো বলে। কোন কারন দেখিনা আমাকে ভাল বলার পিছনে।

আমি জানি মেয়েটি আমাকে বলবে, "তুমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছো, এটাই বা ক'জন পারে? বইটাতে শেষের দিকে কি লেখা ছিল, পড়োনি? ওখানে লেখা ছিল, ঈশ্বরের কাছে অতীতের খারাপ কাজের জন্য তওবা কাটতে। খারাপ কাজের জন্য তওবা কেটে নতুন করে জীবন শুরু করে বাকী জীবন ভালো কাজ করে গেলেই মৃত্যু সহজে গ্রাস করবেনা"।

আমার উত্তরও রেডী থাকবে, "এই সমস্ত উপদেশবাণী ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি। আমরা বিশ্বাস করি, সব ধর্মের মূল বাণী এক, শুধু ধর্ম চর্চ্চার পদ্ধতিতে পার্থক্য থাকে। সব জেনেও আমরা কিছুই মানিনা। তুমিও জানো, সব ধর্মের মূল বাণী এক, তারপরেও তুমি বলবে তোমার ধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। আমি বলবো আমার ধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এবার দেখো, সব জেনেও আমরা ধর্ম বিশ্বাস নিয়েই একমত হতে পারিনা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, কত নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করি, অথচ মনের মধ্যে একবারও প্রশ্ন জাগেনা, কি লাভ এসব হানাহানি করে? কেনো মানতে পারিনা যার যার ধর্ম তার তার কাছে? নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দূর্বলকে সব সময় আঘাত করে চলেছি।

তবে মেয়েটিকে বলা যাবেনা, আমি এমন এক দেশ থেকে এসেছি যে দেশে প্রতি মুহূর্তে পাপ কাজ হচ্ছে। হত্যা, লুন্ঠন, চুরী, ডাকাতি, দূর্নীতির মত পাপ হচ্ছে সমাজের সাধারন স্তরে, আর সমাজের উপরের স্তরে কী যে হচ্ছে, তা আমাদের বুঝার সাধ্য নেই। তুমি যেমন করে বাইবেলের বাণী সংবলিত বই বিলি করে বেড়াও, আমাদের দেশেও রাস্তা ঘাটে, গ্রামে গঞ্জে পাপ-পূণ্যের বর্নণা দিয়ে ওয়াজ মাহফিল হয়, মন্দির থেকে কাসর ঘন্টার আওয়াজ ভেসে আসে, গির্জা থেকেও ঘন্টা শোনা যায়।  তারপরেও আমরা পাপ কাজেই বেশী আনন্দ পাই। দেশের একেবারে উঁচুর দিকে যাঁরা বসে আছেন, তাঁরা মনে হয় উঁচু মাপের অন্যায়  করে, আর সাধারন স্তরের মানুষ সাধারন অন্যায় করে। কিনতু সর্ব স্তরেই অন্যায়, অকাজ, কুকাজ চলছে। ভালো মানুষও আছে, তবে তাঁদের সংখ্যা অতি নগণ্য। সেই ভালো মানুষেরাও কি মাঝে মাঝে একটু আধটু পাপ করেনা? ঠিকই করে। কাজেই ভাল মানুষ খুঁজতে হলে চালুনি দিয়ে ছেঁকে দেখতে হবে। সেই চালুনির ছিদ্র হতে হবে খুবই সূক্ষ্ম, যাতে দুই একজন  মোটামুটি ভাল মানুষ জালে আটকা পড়ে।