Monday, January 22, 2018

কুয়াশা কুয়াশা দৃষ্টি (স্মৃতির মুকুরে সরস্বতী পূজো)

সময় এখন রাত ৯টা, আমেরিকার রাত। আমেরিকার উল্টোদিকে এখন সকাল হয়েছে। বাংলাদেশে সময় এখন সকাল ৯টা। আমেরিকায় আজ রবিবার, বাংলাদেশে সোমবার। আমেরিকার ছোট এক বাড়িতে আমি আজ বড্ড বেশি একা, বাংলাদেশে পরিবার পরিজন, বন্ধু বান্ধব সরস্বতী পূজোর আয়োজন নিয়ে মহাব্যস্ত।
হ্যাঁ, আজ দেশে সরস্বতী পূজো হচ্ছে। মহা ধুমধামে সরস্বতী পূজো উদযাপিত হচ্ছে নাকি শুধু কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যেই পূজো শেষ হয়ে যাচ্ছে, জানা সম্ভব নয়। একেতো আমেরিকার অনেক দূরের এক গ্রামে থাকি, তার উপর ফেসবুকে বিচরণ করতে পারছিনা, কাউকেতো জিজ্ঞেস করার উপায় নেই। মনটা একটু খারাপ খারাপ লাগছে। দেবী সরস্বতী কত কোমল মনের দেবী, মন দিয়ে সাধনা করলেই দেবীকে পাওয়া যায়। অথচ আজকের দিনে আমি একটু সাধনা করতে পারছিনা, দেবী মূর্তি চোখের সামনে না থাকলে মনোসংযোগ ঘটে? চোখের সামনে দেবীকে দেখবো কি করে, ফেসবুকে কী এক ছাইয়ের ব্যান হয়ে আছি যে! সরস্বতীকে দেখতে নিজের ওয়াল ছেড়ে এখন অন্যের ওয়ালে ঘুরতে যেতে হবে? আমি কি ছোঁচা নাকি! এর চেয়ে মনে দুঃখ চেপে রাখাই ভাল।
মনে মনে গুন গুন করে চলেছি, "মনের দুঃখ মনেই রইলো গো, কার কাছে বলে বেড়াই বলো, আমার দুঃখের কথা শুনবে তেমন মানুষ কোথা পাই"! স্বরচিত গান, এখনই রচনা করে ফেললাম। আজ দেবী সরস্বতীর পূজো বলে কথা,দেবী স্বয়ং উপস্থিত ভক্তদের মাঝে! 
কে না জানে, সরস্বতী বিদ্যার দেবী, সঙ্গিতের দেবী, জ্ঞান বুদ্ধি বিকাশের দেবী। ছোটবেলায় বাবা বলতেন, এমন দিনেই নাকি বেশি করে পড়তে হয়, সরস্বতী পৃথিবীতে এসে যাকেই বই হাতে দেখে, বিদ্যে বুদ্ধি জ্ঞান নাকি তাকেই দেয়। বাবার এই উপদেশ মানতে পারিনি কোনকালেই, তবে আজও মনে রেখেছি।  
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কাল তো অনেক বছর আগেই চুকিয়ে ফেলেছি, তাই বলে সরস্বতীর সাধনা একেবারে চুকিয়ে ফেলিনি। গল্পের বই পড়ি, ফেসবুকে কত শত লেখা পড়ি। গানের গলা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেও নীচু কন্ঠে সবসময় গুন গুন করি। এই গুন গুনানি সাধনাবলেই আজকাল অবসর সময়ে নিজে নিজে  দুই এক লাইন গান লিখে তাতে সুরারোপ করে গেয়েও ফেলি। দেবী সরস্বতীর কৃপা আছে বলতেই হয়। সরস্বতী দেবী রূপে, বসনে যেমনি শ্বত শুভ্র, দেবীর মনটাও একেবারে সাদা। বিদ্যে চাইলেই বিদ্যে দেয়, জ্ঞান চাইলে জ্ঞান দেয়, আর সঙ্গিত চাইলে কিছু নাহোক দুই চার লাইন গান রচনা করার ক্ষমতা তো দেয়! নাহলে আমি যখন তখন গান বাঁধি কি করে! দেবী লক্ষ্মীর কৃপা পাওয়া কঠিন, সাধনা করতে করতে গায়ের তেল গলে যায়, হাড়মাস কালো হয়ে যায়। তবুও লক্ষ্মী দেবী কৃপা করতে চায়না, নামে লক্ষ্মী হলেও লক্ষ্মী দেবীর অন্তর ভীষণ কঠিন, সহজে নরম হয়না। 

আমি যে আজ সত্যি সত্যি একা, আমার মনটাও যে আজ ভীষণ ফাঁকা, তা বুঝতে পারছি এলেবেলে কথা বলার ভঙ্গি থেকেই। যা মনে আসছে তাই লিখছি। আমি বুঝতে পারছি, লেখার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে এত্তগুলো কান্না ঝরে পড়ছে, এত্তগুলো অভিমান গলে পড়ছে। কুয়াশায় ঝাপসা চোখের দৃষ্টি থেকে কুয়াশার চাদর সরে সরে যাচ্ছে, আর এই মধ্য বয়সে শৈশব কৈশোরের স্মৃতিকণারা চোখের সামনে দিয়ে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে! এক ফাঁকে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসিও খেলে গেলো, কারণ সরস্বতী পূজোর দিন অতিরিক্ত বিদ্যা পাওয়ার লোভে সরস্বতী মায়ের বন্দনা করে কাগজে খাগের কলম দিয়ে লিখতাম, ওঁ সরস্বতী মায়ের চরণে নমঃ, সরস্বতী বানান লিখতে গিয়ে কলম ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হতো। বুঝতে পারতাম না, ব-ফলা কোন স এর পায়ে বসবে? যদি ভুল বানান লিখি, তাহলে সরস্বতী মা বিদ্যা দিবেনা--এই ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেতো। 
অলস বসে অলস ভাবনায় স্মৃতিকণাগুলো যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে! কত কিছুই মনে পড়ে যায়। সেই স্কুল জীবনের দিনগুলো, নবম শ্রেণীর শেষ, দশম শ্রেণীর শুরুর দিকে আমি প্রবন্ধ লিখতাম, আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় প্রবন্ধ পাঠাতাম, প্রবন্ধ লেখা শুরুর পূর্বে সরস্বতী মা'কে স্মরণ করতাম। কি করে যেন সব প্রতিযোগিতায় আমার প্রবন্ধটাই প্রথম স্থান পেতো। সেই কোনকালে ফেলে এসেছি আমার স্কুল, আমার লেখার প্রতিভা, কত কিছু, সব কিছু-----সেদিনের লেখালেখির অভ্যাসটা যদি বয়ে নিয়ে আসতাম, নিশ্চয়ই আজ লিখে ফেলতাম, 'স্মৃতির মুকুরে সরস্বতী পূজো'। কেমন হতে পারতো সেই স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধখানি!


শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজো হয়ে থাকে। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আবার চলে এলো মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী। প্রবাস জীবনে সারাটাক্ষণ গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে প্রায়ই হাঁপিয়ে উঠি। দেশে থাকতে দিনের প্রতিটি মুহূর্ত কাজ করে তো অভ্যস্ত ছিলামনা। দেশে কাজের ফাঁকে ফাঁকে কতরকম আনন্দ উৎসবে মেতে থাকতাম আমরা। আমাদের বাংলা সংস্কৃতিতে কত রকমের পালা পার্বণ, কত ধরনের যে উৎসব আছে, তাতো আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। হিন্দুদের বারোমাসে তেরো পার্বণের কথা প্রবাদের মত হয়ে গেছে। তেত্রিশ কোটি দেব দেবী নিয়ে হিন্দুদের নিত্য জীবনের নিত্য বসবাস। 
হিন্দুধর্মাবলম্বীগণ বিশ্বাস করে, জীবনের প্রতিটি পর্বে একজন করে নিয়ন্ত্রক (দেব দেবী) থাকেন, যিনি স্বর্গ থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। মানুষের জীবনে পুরুষগণ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকলেও ঐশ্বরিক ক্ষেত্রে দেবীরাই বেশী ক্ষমতা রাখেন। স্বয়ং শিবঠাকুরতো ভোলানাথ হয়ে সব ভুলে বসে থাকেন, দেবী দূর্গাকেই জাগতিক সবকিছুর দিকে খেয়াল রাখতে হয়। সব খেয়াল করতে গিয়ে নিশ্চয়ই দেবী দূর্গার মাথাটাই এলোমেলো হওয়ার যোগার হয়েছিল, তাই উনি উনার অধঃস্তনদের মধ্যে দপ্তর বন্টন করে দিয়েছেন। দপ্তর বন্টন পর্বে কন্যা সরস্বতীকে দিয়েছেন ‘শিক্ষা ও শিল্পকলা’ দপ্তর। এবং দপ্তর বন্টনকালে কন্যাটিকে উনি জানিয়ে দিয়েছেন বাংলা বছরের মাঘমাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে যেনো বাংলার মাটিতে একবার করে ঘুরে যান এবং সকল শিক্ষার্থীদের উপর উনার করুণা বর্ষণ করে যান। অন্যান্য অধঃস্তনদের কাজের পরিধি কতটুকু নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা অজানা থাকলেও দেবী সরস্বতীর কাজের পরিধি একটু বিস্তৃত আকারেই নির্ধারণ করে দেয়া আছে। দেবী সরস্বতীকে শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কথা ভাবলেই চলেনা, হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খৃষ্টান নির্বিশেষে সকলের কথা উনার ভাবতে হয়।তাই দেবী সরস্বতীকে সকল ধর্মের অনুসারীরা সম্মান করে থাকে। কারণ জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে জ্ঞান অর্জনটাই বড় কথা, এখানে ধর্ম বিবেচ্য নয়। সেইজন্যই একমাত্র সরস্বতী পূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘর ছাড়িয়ে বাংলাদেশ, ভারতের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।



সরস্বতী পূজার দিনে গায়ে কাঁচা হলুদ আর নিমপাতা বাটা মেখে ভোর সকালে স্নান করার প্রথা যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরে, এই সরস্বতী পূজার একটি আচারের মধ্যে পড়ে। মনে পড়ে, স্কুলে যখন নীচের ক্লাসে পড়তাম, সরস্বতী পূজা এলেই মন আনন্দে নেচে উঠতো। আমি ছিলাম ফর্সা মায়ের কালো মেয়ে। কালো বাবার গায়ের রংটাই যে কেনো পেয়েছিলাম তা নিয়ে অনেক আক্ষেপ ছিল মনে। 
আশেপাশের বাড়ীর সব মেয়েদের দেখতাম প্রতিদিন স্নানের আগে কাঁচা হলুদ বাটা, দুধের সর বাটা, কমলার খোসা বাটা গায়ে মাখতো, গায়ের ফর্সা রঙ আরও উজ্জ্বল করার জন্য। আমি এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে তাদের রূপ চর্চা দেখে যেতাম। আমার বাবা মনে করতেন, দেহের সৌন্দর্য্যের চেয়ে মনের সৌন্দর্য্য অনেক বেশী ইম্পর্ট্যান্ট। তাই এইসব রূপচর্চা নিয়ে ভাবার অবকাশ দিতেননা। মনে পড়লে আজও হাসি পায়, সরস্বতী পূজোর দিনে গায়ে হলুদ মাখার সুযোগ পেয়ে খুশিতে মনে মনে বাক বাকুম করতাম।থলুদ মেখে ফর্সা হওয়ার  এতবড় সুযোগটা আমি হাতছাড়া করতামনা। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই চলে যেতাম প্রতিবেশীদের ঘরে।
প্রতিবেশী মাসিমার ঘরে একটা নির্দিষ্ট পাটা-পুতা ছিলই শুধু কাঁচা হলুদ নিমপাতা বাটার জন্য। কাঁচা হলুদের সাথে কেন নিমপাতা জুড়ে দেয়া হয়েছে, এটা ভেবে আমার মন খারাপ হতো। নিমপাতার মত এমন বিশ্রী জিনিস জীবনে আর দুইটা দেখিনি। ভয় পেতাম, এমন যমতিতা জিনিস আমার কালো চামড়াতে মাখলে নাজানি আমি আরও কালো হয়ে যাব। আবার নিমপাতা না মাখলে যদি পূজার নিয়ম না মানা হয়, পাপ হলে সরস্বতী মা যদি বিদ্যা না দেয়! সেই ভয়ে একটু নিমপাতা মিশাতাম অনেকটা হলুদের সাথে। তারপর জবজবে করে হলুদ সারা মুখে, হাতে, পায়ে মেখে বসে থাকতাম। সহজে স্নানঘরে ঢুকতে চাইতামনা, স্নানের জলের সাথে সব হলুদ ধুয়ে চলে যাবে এই ভয়ে। 
 স্নান করতেই হতো, কিনতু মুখে সাবান মাখতামনা। সারাদিন হলুদ বর্ণের মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম, কালো হয়ে জন্মানোর যে দুঃখ, তা ঐ একদিনে পুষিয়ে নিতাম। বন্ধুরা অবশ্য আমাকে টিপ্পণী কাটতে ছাড়তোনা, ফর্সা দেখানোর জন্য যে আমি হলুদ মেখে বসে আছি, তা তারা কিভাবে জানি বুঝে ফেলতো।
 স্নান শেষে শুরু হতো দেবীর পায়ের কাছে বই খাতা কলম রেখে দেয়ার হিড়িক। এটা একটা রীতি যে সরস্বতী পূজার দিনে পড়তে নেই, বই খাতা দেবীর পায়ের নীচে দিয়ে রাখলে দেবী খুশী হয়ে বিদ্যা বুদ্ধি দিয়ে থাকেন ঐ বইয়ের ভেতর। দেবীর পূজার ফুল বেলপাতা বইয়ের ভেতর গুঁজে রাখলেই পরীক্ষায় ভালো ফল করা যাবে। আমাদের পরিবারে নিয়ম ছিল উলটো। উলটো নিয়ম চালু করেছিলেন আমাদের বাবা। সরস্বতী পূজার দিন সরস্বতী মা পৃথিবীতে নেমে আসে, যে বাড়িতে ছেলেমেয়েরা পড়তে বসে, সরস্বতী দেবী তাদের বেশি করে বিদ্যা দেয় বলে পূজার দিন সকালে আমাদেরকে পড়তে বসাতেন। উনার কথা ছিলো, আজকেই সুযোগ, কেউ পড়েনা, তোমরা যদি পড়ো দেবী তোমাদের উপর সন্তুষ্ট হবেন। আমাদের এক ঘন্টার জন্য হলেও বই পড়তেই হতো। বন্ধুরা জানালার কাছে এসে হাত ইশারা করতো আর আমরা বাবার ভয়ে পড়তাম। বাবা ঠিকই বুঝতে পারতেন আমাদের কষ্ট, তারপরেও কেনো জানি উনি এই ‘শাস্তি’টুকু আমাদের জন্য বরাদ্দ রাখতেন!
 সব পূজার আচারেই একেকটা নির্দিষ্ট নিয়ম থাকে। যেমন বিদ্যার দেবী তাই সরস্বতী পূজাতে ‘খাগের কলম ও দুধজলে ভরা কালির দোয়াত’ লাগে। আরও লাগে পলাশ ফুল, কুল বড়ই। নিমপাতা কাঁচা হলুদ দিয়ে স্নান করতেই হয়।পূজাতে ‘কুল বড়ই’ লাগে, তাই ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা নিয়ম চালু আছে, সরস্বতী পূজার আগে ‘বড়ই’ খেতে হয়না,  পূজার পরে যত ইচ্ছা বড়ই খাওয়া যায়। বড় হয়ে বুঝতে শিখেছি, মাঘের এই সময়টাতে কুল পাকে, অন্য সময়ে কাঁচা কুল খেয়ে অসুখ করার সম্ভাবনা থাকে। তাই সরস্বতী পূজা পর্যন্ত কুল খাওয়ার জন্য অপেক্ষার এই কঠিন নিয়ম। খাওয়া দাওয়ায় এই কঠিন নিয়মটুকু গায়ে লাগতোনা একটা বড় কারণে। সেটা হচ্ছে, সারাদিনে লেখাপড়ার সাথে কোন সম্পর্ক থাকতোনা। কারণ যাবতীয় বই খাতা কলম সরস্বতী মায়ের চরণের সামনে জমা রাখা হতো যেন দেবী আমাদের বই খাতা ভর্তি করে বিদ্যা দিয়ে যান। সারাদিন, সারারাত বই খাতা থাকতো পূজামন্ডপে। আর থাকতো আমাদের প্রত্যেকের নামে একটা করে দুধ জলে পূর্ণ দোয়াত আর খাগের কলম। দোয়াত আর কলম পরদিন সকালে কাজে লাগতো।
 সরস্বতী পূজার দিনে মেয়েদের সবাই হলুদ শাড়ি পড়ে। ছোটরা সকলে মিলে পূজো করে, পূজোর প্রসাদ গ্রহণ করে, এরপর ঘরে গিয়ে মিঠাই ক্ষীর খই দই মুড়ি নাড়ু, সন্দেশ, পায়েস খিঁচুড়ি লাবড়া চাটনি দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সারে। রাতের বেলা ইলিশ মাছ এবং কলাই শাক খাওয়া হয়। 
পরদিন সকালে আমরা দৌড়ে চলে যেতাম কলাগাছ তলায়। কলাপাতা ছিঁড়ে আনতাম, দুধ জল পূর্ণ দোয়াতে খাগের কলম চুবিয়ে তা দিয়ে কলাপাতায় লিখতাম, " ওঁ সরস্বতী মায়ের চরণে নমঃ" তিনবার লিখতাম এই কথা ক'টি। এরপর কলাপাতা ভাঁজ করে সরস্বতী মায়ের পায়ে দিয়ে আসতাম, কেউ হাতে গুঁজে দিত। এটা করার পর মনে এক অগাধ বিশ্বাস আসতো, " আমার অনেক বিদ্যা হবে"।




এতো গেলো বালিকা সময়ের কথা। যখন স্কুলের নবম- দশম শ্রেণীতে পড়ি, তখনতো মাতব্বরী করার অধিকার অর্জন করে ফেলেছি। আমি এমনিতে তেমন ডাকাবুকো ছিলামনা, নেতাগিরি আমার রক্তে নেই, তারপরেও নেতা হয়ে গেছিলাম। আসলে তখন ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল বা ফার্স্ট বয়দের মেঘ না চাইতে জলের মত করেই ক্লাস ক্যাপ্টেন হওয়ার সুবাদে হাতে নেতৃত্বের ক্ষমতা চলে আসতো। সরস্বতী পূজা বা বার্ষিক মিলাদ মাহফিলের মত অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব পেয়ে যেতাম। আমাকে কিছুই করতে হতোনা, আমাকে শিখন্ডী হিসেবে রেখে যারা মাতব্বরী করতে অভ্যস্ত ছিল, তারাই সব ব্যবস্থা করে ফেলতো।আমাকে জানিয়েই  নিজেদের জন্য অতিরিক্ত মিষ্টির প্যাকেট বরাদ্দ করা হতো। আমি ডাকাবুকো ছিলামনা, কিনতু অতিরিক্ত মিষ্টির প্যাকেটের লোভ ঠিকই ছিলো। তখনও গায়ে হলুদ মেখে রঙ ফর্সা করার উপসর্গ আমার মাঝে বেঁচেছিল, বরং নতুন আরেকটি উপসর্গ যোগ হয়েছিলো। শাড়ী পড়ে বড় সাজার হাস্যকর চেষ্টা। শাড়ি পড়তাম, বড়দের মতো করে চুল বাঁধতাম। মনে পড়ে অনুভা, ফরিদা, সেলিনা, সীমার কথা। একটা গ্রুপ ছিলাম আমরা, টিচারদের গুড বুকে আমাদের নাম ছিলো, আমি আর সেলিনা যেখানে থাকতাম, টিচাররা নিশ্চিন্ত বোধ করতেন। তাছাড়া এইসব অনুষ্ঠানে বয়েজ স্কুল থেকে ছাত্ররাও আসতো, প্রতিমা দর্শনের পাশাপাশি আমাদের চোখেও চোখ রেখে যেতো। এটাইতো কৈশোরের এক দুরন্ত মজার জিনিস। বয়েজদের স্কুলে তো আর যেতে পারতামনা আমরা, পরিবার থেকেই নিষিদ্ধ ছিল, ফলে এই চোখাচোখির ব্যাপারটা আরও বেশি আনন্দময় ছিল। 
 এরপর কলেজ, তরুণীকাল শুরু। কলেজের জীবনটা আমার জন্য একটুও সুখকর ছিলোনা। বারো জাতের স্কুল থেকে বারো জাতের মেয়েরা এসে জড়ো হয় কলেজে। সেখানে আমি কে, আর তুমিই বা কে? কেউ কারো অধীন নয়। স্কুলে সকলে ছিল আমার অধীন, স্কুলটা ছিল আমার রাজত্ব। কলেজে গিয়ে নিজের অস্তিত্বকে টেরই পেতামনা। তার উপর কলেজের পড়া, একটুও ভালো লাগতোনা। কলেজের পড়া ভালো লাগেনি, কলেজের পরিবেশটাও ছিলো খাপছাড়া। আমাদের প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম ব্যস্ত ছিলেন উনার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার কাজে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাথে উনার খুব ভালো কানেকশান ছিল। উনি আমাদের কলেজের কোন কিছুতেই খেয়াল রাখতেননা, কলেজের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড নিয়েও উনার কোন আগ্রহ ছিলোনা। ফলে কলেজে গিয়ে কেমন খেই হারিয়ে ফেলে দুই বছর মুষড়ে পড়েছিলাম। সরস্বতী পূজা কলেজে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিনা তাও আমার মনে পড়েনা।

চলে গেলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছি প্রথম তিন বছরে। জাহাঙ্গীর নগরে এসে আবার ফিরে পেয়েছিলাম রাজত্ব করার সুখ। আহ! কি মধুর স্মৃতি! এখানে প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এমন জাঁকজমকপূর্ণ হতো যে বাড়ী ঘরে ফেরার কথাও ভুলে যেতাম। সরস্বতী পূজার কথাই বলি। জাহাঙ্গীরনগরে এসেই মনে হয়েছে, সরস্বতী পূজা শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই পূজা আসলে সকল শিক্ষার্থীর জন্য বিদ্যালাভের আরাধনা। আরাধনা ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যে কেউ করতে পারে, এবং সকলে তাই করতো। 
পূজা মন্ডপে শুধুই ছাত্রছাত্রীরা থাকতাম, মন্ডপ সাজাতাম ছাত্রছাত্রীরা, শুধুমাত্র অভ্যাস নেই বলেই পূজার আয়োজনে মুসলিম মেয়েরা অংশ গ্রহণ করতোনা। তাতে কি, পূজোর নৈবেদ্য সাজানোর অংশটুকু বাদ দিলে আর বাকী সব কিছুতেই আমরা ছিলাম শুধুমাত্র শিক্ষার্থী। দিনে পূজার আনন্দ, সন্ধ্যায় আরতি। আরতি করতো ছেলে শিক্ষার্থীরা, মেয়েরা থাকতো দর্শক ও হাততালি গ্রুপে। 
স্কুল জীবনের 'চোখাচোখি' পর্বটি এখানেও চলতো, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবা মায়েরাতো আর পাহারা দিতে আসতোনা। মজাই পেতাম ছেলে মেয়ে চার চোখে তাকিয়ে। আমাদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়টির কোন বদনাম ছিলনা, দেবী সরস্বতীর কৃপা আমরা সবাই পেয়েছিলাম। আশির দশকের শেষ দিকে এসেও জাহাঙ্গীর নগরের শিক্ষার্থীরা ছিল সকলের জন্য অনুকরণীয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সরস্বতী পূজা ছিল অতি বিখ্যাত, একবার মাত্র গিয়েছিলাম পূজা দেখতে, জাঁকজমক দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। এখন কি আগের মত করেই পূজা হয় জগন্নাথ হলে, খুব জানতে ইচ্ছে করে।
আমি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শেষের দিকে বিয়ে করে ফেলেছিলাম বলেই বন্ধুদের সাথে আর নিরবচ্ছিন্ন সময় কাটাতে পারিনি। কিনতু যে সময় আমি কাটিয়ে এসেছি বন্ধুদের সাথে, আমার কন্যাদের সাথে সে সমস্ত দিনের গল্প করার সময় আমার চোখে মুখে নিশ্চয়ই আলো ফুটে উঠে! মাত্র ত্রিশ বছর আগেও আমরা কত আধুনিক মনের ছিলাম, আমাদের মধ্যে প্রেম ছিল, কিনতু কোন শঠতা ছিলনা, চরিত্রে নির্মলতা ছিলো, কোন কলুষতা ছিলোনা, আচরণে স্থিরতা ছিলো, কোন রকম অধৈর্য্যতা বা অস্থিরতা ছিলনা, অভিমান ছিল কিনতু আক্রোশ ছিলনা। আজকাল স্মৃতিতে আক্রান্ত হই। মেয়েদের কাছেই গল্প করি আমার ছাত্রজীবনের কথা। ছাত্রজীবনে স্কুল কলেজের প্রতিটি অধ্যায়ের গল্প করতে গিয়ে মনটা কেমন এক ধরণের ভালোলাগায় মাখামাখি হয়ে যায়।
ত্রিশ বছর সময় কি খুব বেশী আগের কথা! একমাত্র মোবাইল ফোন ছিলনা তখন, কম্পিউটারও ছিলনা, এটুকুই তফাৎ। তাহলে কি প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে মানুষের আচরণের বৈরীতা আছে! মনে হয় আছে, কালির দোয়াতে খাগের কলম ডুবিয়ে লিখতেন রবীন্দ্রনাথ, তাই তিনি হয়েছিলেন বিশ্বকবি, প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে আমাদের খাগের কলমের বদলে ‘ফাউন্টেন পেন’, তারপরে এলো ‘বলপেন’ , এরওপরে এলো কম্পিউটার, ল্যাপ্টপ আর কীবোর্ড। এখন আর আমাদের কলম না হলেও চলে, আমরা ল্যাপ্টপ, আইপ্যাড, কিনডেল, ট্যাবলেট, নুক নামের ইলেকট্রনিক বই ব্যাবহার করি। যুগের উন্নতির সাথে সাথে ভাষাও বদলে যাচ্ছে, আমরা এখন আর রাবিন্দ্রীক ভাষায় লিখিনা, কবিতার ভাষাও বদলে গেছে। এখন রবীন্দ্র সঙ্গীতকে বলা হয় প্যানপ্যানানি সঙ্গীত, গানের ধরণও পালটে গেছে, এখন রবীন্দ্র সঙ্গীত রিমেক করা হচ্ছে ব্যান্ডের সাথে সিনকোনাইজ করে, আরও এসেছে বাজারে র‌্যাপ, রক, হেভী মেটাল সহ আরও ভারী ভারী নামে। এখন কেউ আর রবীন্দ্র নজরুল হতে চায়না, এমনকি আইন্সটাইনও হতে চায়না। কি যে হতে চায় আমাদের সন্তানেরা, সেটাও বুঝতে পারিনা। শিক্ষাঙ্গনগুলোতে এত অস্থিরতা দেখেই কি সরস্বতী দেবীও ভয় পেয়ে গেছেন কিনা কে জানে। নাহলে এখনকার ছেলেমেয়েরা কেনো দেবীর কৃপা লাভে বঞ্চিত হচ্ছে!

নাহ! বেশিক্ষণ মন খারাপ করে থাকতে নেই। আজ রবিবারের রাত, কাল আমেরিকাতে সোমবারের ভোর হবে, এরপর সকাল হবে। কাঁচা হলুদ নেই, হলুদ গুঁড়ো জলে গুলে মুখে হাতে মেখে ছোটবেলার মত ফর্সা হবো। কাল আমার ডে অফ, ফলমূল, দই, মোয়া, দুধ কিনে এনেছি আজ। কাল সকালে স্নান সেরে নিজে নিজেই পূজোর নৈবেদ্য সাজিয়ে সরস্বতী মায়ের চরণে আমার আরাধনা, আমার সাধনা, আমার প্রার্থনা পূজোর ফুল বানিয়ে সমর্পণ করে দেবো। আমার বয়স তেপ্পান্ন, আমি স্কুল কলেজের পাট বহু বছর আগে চুকিয়ে বুকিয়ে চলে এসেছি। তাতে কি? লেখাপড়ার কি শেষ আছে? পাঠ্যবই পড়িনা, কি হয়েছে, এখনও বিদ্যাচর্চা করি, নাহয় ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখি, তাতে কি, এটাও বিদ্যাচর্চার একটি ইন্টারনেটিয় রূপ। এখানেও প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াই চলে নিরন্তর। জীবনটাই কেটে গেলো নানারকম লড়াই সংগ্রামে। এখন চলছে ফেসবুকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াই, লড়াইয়ে আমাকে জিততেই হবে। হারবার জন্য আমি জন্মাইনি, আমার মানসিক শক্তি প্রবল আছে, শুধু প্রয়োজন সরস্বতী মায়ের কৃপা। সরস্বতী মায়ের কৃপা পাবো বলেইনা আজকের এত আয়োজন!

No comments:

Post a Comment