Tuesday, January 16, 2018

কুয়াশা কুয়াশা দৃষ্টি (তুষারঝরা স্মৃতিকণা)

আমাদের বাস আমেরিকার মিসিসিপি রাজ্যে যেখানে জনজীবনে কোন বৈচিত্র নেই, রোজনামচায় কোন নতুনত্ব নেই, আয় উন্নতির হিসেব খাতাতেও হিসেবে কোন গরমিল নেই, আবহাওয়াতেও মরুর দাবদাহ নেই, তুষার ঝরা সৌন্দর্য নেই, নেই বসন্ত বিলাপ। বছরের একটা সময় গ্রাম উড়িয়ে নিতে টর্নেডো আসে, জনপদ ভাসিয়ে নিতে হ্যারিকেন আসে! সেটিও রুটিন ওয়ার্কের মধ্যেই পড়ে।
 দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী রোগী যেমনি করে একঘেয়ে সুরে বলতে থাকে, " হে আল্লাহ, হে ভগবান এ জীবন আর ভাল লাগেনা। এবার আমায় তুলে নিয়ে যাও"--- মিসিসিপির একঘেয়ে জীবনযাত্রায় আমিও মাঝে মাঝে বলে ফেলই, ওহ ভগবান, এই মিসিসিপি থেকে সরিয়ে আমাকে আর কোথাও নিয়ে যাও যেখানে ঘুম থেকে উঠেই জলের জন্য কলতলায় বালতি নিয়ে লাইন দিতে হয়, যেখানে বাসে উঠতে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়, বাসে উঠে খালি সিট পাওয়ার জন্য শিকারীর দৃষ্টি নিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে হয়, যেখানে রোজ থলে হাতে বাজারে যেতে হয়, বাজার থেকে ফেরার পর জিনিসপত্রের আগুন দাম নিয়ে মন্ত্রীকে গালিগালাজ করে মনের ঝাল মেটানো হয়---- এমন জায়গাতেই আমাকে নিয়ে যাও।

মিসিসিপি নামক এমন নিস্তরঙ্গ একঘেয়ে রাজ্যে মাঝে মাঝে জনজীবনে হঠাত সাড়া জাগে! সাড়া জাগানোর দুই একটা ঘটনা ঘটে শীতকালে। এমনিতে মিসিসিপির শীতকাল খুবই নিম্ন স্তরের, মানে ছোটলোকি ঠান্ডা। তুষার নেই, বরফ নেই উত্তুরে বাতাসও নেই অথচ ঠান্ডার ছুরি আমাদের দেহ ফালাফালা করে একেবারে হাড়গোড় পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এজন্যই শীতকালে মিসিসিপির মানুষগুলো কেমন যেন কুঁকড়ে মুকড়ে দলা পাকিয়ে থাকে। এই দলা পাকানো হাত পাগুলোতেই মাঝে মাঝে সাড়া জাগে! এই সাড়া জাগানোর কাজটি করে আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রায় প্রতি শীতকালের মাঝামাঝি সময়ে জানানো হয়, সাতদিন পর মিসিসিপিতে তুষারপাত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ব্যস,এতেই হয়ে গেলো। দলা পাকানো হাত পাগুলো প্যাঁচ খুলে সোজা হতে থাকে। হাত পা সোজা হওয়ার পর তাতে ঝাড়াঝুড়ির কাজ শুরু হয়। হাত পা ঝাড়াঝুড়ি সেরে সকলেই সটান হয়ে দাঁড়ায়। এরপর শুরু হয় আশেপাশের শপিং কমপ্লেক্সে ঢুঁ মারার তড়াস। তুষারপাত বলে কথা, তুষারপাত হবে, আধ ইঞ্চি স্নো হলেও তো তুষারপাত, বছরের প্রথম স্নো ফল! নিম্ন জাতের ছেমরির গায়ে ব্রাহ্মণের হালকা স্পর্শে আশির্বাদ লাগার মত!

হ্যাঁ, চার মাস দীর্ঘ শীতকালে এক আধদিন আকাশ থেকে হালকা পাতলা তুষার ঝরে! আগে ঝরতো না, বৈশ্বিক জলবায়ুতে এতটাই পরিবর্তন এসেছে যে যে মিসিসিপিতে কোনকালে তুষারপাত হতোনা, সেখানে বছরে এক আধ দিন তুষারপাত হয়। কোথাও আধ ইঞ্চি পরিমান, কোথাও বা দেড় ইঞ্চি পরিমান তুষার জমে। চৌদ্দ বছর ধরে মিসিসিপিতে সংসার করছি, এই মিসিসিপি তো আমার হয়ে গেছে! মিসিসিপিতে যেদিন হাওয়ায় হালকা হালকা তুষারকণা উড়ে যেতে দেখি, আমার বুকের ভেতর বর্ষার ময়ূর নাচতে শুরু করে। মিসিসিপিতে বর্ষাকাল বলেতো কিছু নেই, বৃষ্টিকণার বদলে তুষারকণারা ভেসে বেড়ায় চোখের সামনে, ময়ূরতো নাচবেই। সকলকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করে, তুষারপাত শুধু উত্তর আমেরিকাতেই হয়না গো, আমাদের মিসিসিপিতেও তুষারপাত হয়!

আজ ছিল তেমনই এক দিন। সাত দিন আগেই আবহাওয়াবিদেরা বলে দিয়েছে, আজ তুষারপাত হবে। তাপমাত্রা থাকবে সর্বনিম্ন ১২ ডিগ্রী ফাঃ, সর্বোচ্চ ২৮ ডিগ্রী ফাঃ। নে বাবা, তুষারপাত আটকায় কে! সত্যিকারের তুষারপাত নাহোক, আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় কাক চিল শকুনেরা জল ত্যাগ করলে সেটাও ঠান্ডায় জমে তুষার হয়ে ঝরবে। তুষার হলেই হলো। 
আমি তো ওয়ালমার্টে চাকরি করছি ১২ বছরের উপর, ঝড়, সাইক্লোন, বৃষ্টি, বন্যা, তুষার যা কিছু কপালে আছে, আমাকে আবহাওয়ার বিজ্ঞপ্তি থেকে তা জানতে হয়না। ওয়ালমার্টে দৌড়ে আসা কাস্টমারদের দৌড়ের গতি দেখে, খাবার দাবার, জলের বোতল, মোমবাতি, টর্চ দেশলাই কেনাকাটার গতি দেখলেই বুঝে যাই কবে কখন ঝড় বৃষ্টি হবে। 

এবারও বুঝেছিলাম, এবার আরেকটু বেশি বুঝেছিলাম সহকর্মিদের ফিসফাস হুসহাস শুনে। কী নাকি ভয়ঙ্কর অবস্থা হবে, ব্ল্যাক আইস জমে রাস্তাঘাট এমন বিপদজনক হবে যে গাড়ি নিয়ে বেরোলেই একসিডেন্ট। রাস্তার উপর যে ব্রীজগুলো আছে, সেগুলোতেই অ্যাকসিডেন্ট বেশি হবে। যারা একটু গ্রামের দিকে থাকে, তাদের জন্য রাস্তায় বের হওয়া বিপদজনক। বরফ জমা রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে কারো অভ্যেস নেই তো। তাছাড়া দক্ষিণে গাড়ির টায়ারও স্নোয়ে চলার মত করে তৈরী নয়, তাই সহজেই গাড়ির চাকা স্কিট করে। স্কুল বাসও চলবে না, স্কুল কলেজ ইউনিভারসিটি অলরেডি ক্লোজড বলে দিয়েছে। কাজেই এমন ভয়াবহ অবস্থায় ওয়ালমার্ট এসোসিয়েটদের পক্ষেও কাজে আসা সম্ভব নয়, ঘরে লেপের নীচে থেকে ওয়েদার ডিজাস্টার কারণ দেখিয়ে একটা ফোন করে দিলেই হবে। তারপর শুধু মজাই মজা, ঘরে বসে খাও দাও আর তুষারপাত এনজয় করো। 

গতকাল মিথীলাকে বাসে তুলে দিয়ে আমি ওয়ালমার্টে চলে গেছি। সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা শিফটে কাজ ছিল আমার। আগের রাতে মাত্র চার ঘন্টা ঘুমিয়ে সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকে চাকরি করা, খুব ক্লান্তিকর লাগে আজকাল। তাই গতকাল বাড়ি ফেরার সময় মনকে আমিও বুঝ দিয়েছি, সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিশ্চয়ই চারদিকে তুষার ঢাকা গাছপালা বাড়িঘর দেখতে পাব, সাথে সাথে ওয়েদার ডিজাস্টার কারণ দেখিয়ে ' ডে অফ' কল দিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকবো। পরের দুই দিন আমার এমনিতেই ডে অফ, তার মানে তিনদিন একটানা ছুটি, কী মজা! নিশ্চিন্তমনে রাতে ঘুম দিয়েছিলাম।

গত রাতের ঘুমটা এতটাই প্রশান্তির ছিল যে আজ ঘুম ভেঙ্গেছে সকাল নয়টায়। জানালায় চোখ গেলো, চকচকে আকাশ, বাতাসে কোথাও তুষারকণার ওড়াওড়ি নেই, বাড়িঘরের ছাদগুলো পরিষ্কার! এর মানে কি! তবে যে সবাই বলল আজ তুষারপাত হবে, আমার বরের ইউনিভারসিটি তো ক্লোজড। এখন কী বলে কল দেবো? ওয়েদার ডিজাস্টার বলার মত কোন কারণই তো নেই। তার মানে আমাকে কাজে যেতেই হবে। মন খারাপ করে দ্রুত তৈরী হয়ে নিয়ে যেই বেরোতে যাচ্ছি, ঠিক তখন বাতাসে সাদা সাদা হালকা হালকা তুলা তুলা তুষারকণারা উড়তে শুরু করলো। মুগ্ধ নয়নে যে তুষারকণাদের ওড়াওড়ি দেখবো, সে সুযোগ ছিলনা, গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে এক ছুটে ওয়ালমার্ট। 

গাড়ি চালাতে চালাতে আমার চোখের সামনে থেকে কুয়াশা কুয়াশা পর্দার ঢাকা সরে সরে যেতে লাগলো! কবে যেন আনমনে বসে বসে লিখেছিলাম তুষারের গল্প, তুষারপাতের গল্প! ফেসবুকের পাতায় পোস্ট করেছিলাম কিনা কে জানে! খুব মনে পড়ছে, কাঁচা হাতের লেখা, এলোমেলো অগোছালো করে লেখা, কিন্তু হৃদয়ের লাল রঙ বাদ দিয়ে তুষার শুভ্রতা দিয়ে লিখেছিলামঃ


তুষার দিনের সঙ্গীত!

"সোভিয়েত দেশের নানাজাতির রূপকথাবইতে তুষারের কথা পড়েছিলাম। তুষারপাত, তুষার ঝড়, তুষারকন্যার গল্প পড়ে পড়ে ছোট মনের খুব গহীনে তুষারপাত দেখার সাধ জন্মেছিল হয়তো। ধীরে ধীরে বড় হয়েছি, স্বপ্নের ডানাগুলো মেলতে শিখেছি। স্বপ্নের ডানা মেলে কখনও চলে গেছি সোভিয়েত ইউনিয়নের তুষার ঢাকা শুভ্র পাহাড়ের পাদদেশে, সেখানে হয়তো দেখা পেয়েছি চাষীর ছেলে ইভানের, অথবা তুষারকন্যার। চলে গেছি এস্কিমোদের দেশে, টুপ করে ঢুকে গেছি বরফের ঘর ইগলুতে স্বপ্নের  ডানা যখন আরেকটু পাকা হলো, উড়তে উড়তে চলে গেলাম কাশ্মীরে, কাশ্মীরের তুষার সুন্দরীদের রূপে মুগ্ধ হয়ে ফিরে এসেছি দার্জিলিং-, সবই স্বপ্ন ডানায় ভর করে ঘুরে ঘুরে দেখা।

ততদিনে বড় হয়ে গেছি, একজনের বউ, দুই কন্যার মা আমি, স্বপ্ন দেখার কাল পেরিয়েছি, সত্যি সত্যি তুষার ঢাকা ধবলগিরির সারি দেখেছি, জীবনে প্রথম বরফের চাদরে ঢাকা হিমালয়ের রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। নেপালে গিয়েছিলাম, হিমালয়ের চূড়ো দেখবো বলে নাগরকোটের আট হাজার ফিট উঁচুতে উঠেছিলাম, অত উঁচুতে উঠার পর উপরে আকাশ, পাহাড়ের চূড়ায় আমি, আশেপাশে আর কিছু নেই, অনেক নীচে সবুজ গাছের ধোঁয়াশা চারদিকে কাছে দূরে শুধুই পাহাড়ের সারি, খুব ভোরে পৌঁছেছিলাম, সূর্য্য উঠারও আগে ভূমি থেকে আট হাজার ফিট উঁচুতে বাতাসে ছিল নির্মলতা, বুক ভরে শ্বাস টেনেছিলাম, মনে হচ্ছিলো এই প্রথম আমি বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করছি।

সূর্য্য উঠার আগে কাছে-দূরের পাহাড়গুলো খুব অস্পষ্ট ছিল, বুঝতেই পারিনি কুয়াশা কেটে গেলেই চোখের সামনে স্বপ্নের তুষারঢাকা গিরি দেখতে পাব। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম, চারদিক লালচে সোনালী হয়ে উঠছে, কুয়াশা কেটে যাচ্ছে, এবং দূরে কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে তুষার শুভ্র পাহাড়ের চূড়ো উঁকি দিচ্ছে। সেই পাহাড়ের গা থেকে আলো বের হচ্ছিলো। আমি কোন স্বপ্নের কথা বলছি না, বরফে আচ্ছাদিত পাহাড়ের গায়ে লালচে সূর্য্যের নরম রশ্মি পরে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিলো।

ঊনত্রিশ বছরের তরুণী আমি, হাতে ধরে থাকা ছোট দুটি শিশু কন্যা, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিবঠাকুর স্বামী, স্বপ্নের তুষারগিরি বাস্তবে ধরা দিয়েছে, আমাদের সকলের সামনে ধরা দিয়েছে, চারজনের সুখী পরিবারের প্রত্যেকের চোখে ধরা দিয়েছে, সুখের মুহূর্ত কী এর চেয়েও অন্যরকম হয়!



নেপালে গিয়ে বরফ ঢাকা পাহাড় দেখেছিলাম, কৈশোর স্বপ্নের একাংশ পূরণ হয়েছে, তুষারপাত তো দেখা হয়নি। তুষারপাত দেখতে হলে কাশ্মীর যেতে হবে, নাহলে দার্জিলিং! কাশ্মীর বা দার্জিলিং যাওয়া হয়নি, তার আগেই চলে গেছি অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণে শীতে প্রচন্ড বৃষ্টি হয়, কিন্তু তাপমাত্রা হিমাংকের নীচে যায় না, তুষারপাত হবে কি করে? মেলবোর্ন থেকে কিছু দূরে এক পাহাড় আছে, সেখানে নাকি শীতকালে বরফ জমে, সেই বরফে সাদা পাহাড় দেখতে অনেকেই যায়, আমাদের যাওয়া হয়নি, তা নিয়ে আফসোস ছিল না, কারণ  মেলবোর্নের বরফ ঢাকা পাহাড় নিশ্চয়ই নেপালের বরফ ঢাকা অন্নপূর্ণার মত সুন্দর হবে না।


এরপর চলে এলাম আমেরিকা, প্রথমেই পৌছলাম ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া স্টেটে। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে এসেছিলাম অক্টোবারের শুরুতে, প্লেন যখন ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার আকাশ সীমায় প্রবেশ করেছিল, জানালা দিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে রঙ মশাল দেখেছিলাম। সত্যি বলছি, সেদিন আকাশে রঙের ছড়াছড়ি ছিলনা, নীচে রঙের খেলা চলছিল প্রকৃতিতে, দিকদিগন্ত জুড়ে কমলানীলবেগুনীহলুদগোলাপীলালমেজেন্টাখয়েরীরা মিলে মিশে একাকার ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া সম্পূর্ণ পাহাড়ি রাজ্য, পাহাড়ের গায়ে সবুজ বনানী, শীত শুরু হওয়ার আগে বন বনানীতে রঙের খেলা শুরু হয়। গাছের সবুজ পাতারা আর সবুজ থাকে না, সবুজ বদলে কমলা, নীল, বেগুনী, হলুদ, গোলাপী, লাল, মেজেন্টা, খয়েরী হয়ে যায়। ফলে আকাশ থেকে দেখলে মনে হয় নীচে রঙের বন্যা।

ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া পৌঁছে আমরা দিন পনের ছিলাম সেলেমনামের ছোট্ট ইউনিভার্সিটি শহরে। সেখানে ইউনিভার্সিটির গেস্ট হাউজে আমাদের থাকতে দেয়া হয়েছিল। গেস্ট হাউজ তো নয়, সুন্দর এক বাংলো। আমি তখন দেশ ছেড়ে আসার শোকে-বিরহে মুহ্যমান, তাই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যকে মন ভরে, চোখ ভরে দেখতে পারিনি। বাংলো বাড়ির সুন্দর কক্ষে মন খারাপ করে বসে থাকি, দুই বছরের ছোট মিথীলাকে বুকে চেপে কাঁদি, পাশে মন খারাপ করে বসে থাকে দুই মেয়ে মৌটুসী আর মিশা। পাহাড়ী রাজ্য, অক্টোবারের তৃতীয় সপ্তাহে খুব ঠান্ডা পরতে শুরু করেছে, মন খারাপের মাঝেও বরের কাছে জেনে নিলাম, নভেম্বার ডিসেম্বারের দিকে স্নো পড়ে। এটা জানার পর থেকে দিন গুনি, কবে অক্টোবার শেষ হবে, নভেম্বার শুরু হলেই স্নোয়ের দেখা পাব।

তারিখট আছিল ২৬শে অক্টোবার, ছোট্ট মিথীলাকে টয়লেটে নিয়ে গেছি, সেদিন সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা, টয়লেট রুমে বড় জানালা ছিল, কাঁচের পাল্লা একেবারে লক করে রাখা। জানালার দিকে চোখ যেতেই মনে হলো, বাইরে শিমূল তুলা উড়ছে। চমকাইনি, ছোটবেলায় চাঁদের বুড়ির চরকা কাটা সূতার পিছনে দৌড়াতাম, তখন তো জানতাম না, ওগুলো শিমূল ফুলের বীজ ফেটে বেরিয়ে আসা তুলো। আমি তো তখনও দেশের ঘোরে ছিলাম, তাই খেয়াল হয়নি এখানে শিমূল ফুল আসার কথা না। বাইরের ঘর থেকে মিশা দৌড়ে এলো, মা, স্নো পড়ছে। আমি বাইরে ছিলাম, স্নো উড়ছে, যে দেখো, জানালা দিয়ে স্নো উড়ছে


একটু সময়ের জন্য তুষার কণারা উড়ে ঘুরে কোথায় মিলিয়ে গেলো, কিন্তু আমার স্মৃতিতে রেখে গেলো জীবনের প্রথম তুষার ঝরার স্মৃতি। "


এরপর দেখলাম সত্যিকারের তুষারপাত। আহা, এ কী হেরিলাম! ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া উত্তর আমেরিকার স্টেট। পাহাড়ি রাজ্য যে কত সুন্দর হতে পারে, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে তিন বছর না থাকলে জানতেই পারতাম না। গরীব রাজ্য অথচ রূপে সে কী অসামান্য রূপসী! 
ওয়েট ভার্জিনিয়াতে যখন এলাম, মিথীলার বয়স ছিল দুই বছর। জীবনের প্রথম তুষারপাতের স্মৃতি ওর মনে থাকার কথা নয়। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া থেকে যখন মিসিসিপি চলে আসি, তখন মিথীলার বয়স সাড়ে চার বছর, তিনটি উইন্টার ও ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে পেয়েছে, তুষারপাতও দেখেছে। স্নো ম্যান বানিয়েছে, ঝুড়ি দিয়ে বানানো স্লেজ গাড়িতে চড়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমেছে, স্নো বল তৈরী করে চারদিকে ছুঁড়ে মেরেছে। সবই করেছে কিন্তু সেসবের বড় অংশ হয়তো কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে গেছে। মিসিসিপিতে যখনই স্নো হবে বলে স্কুল কলেজ আগেই বন্ধ ঘোষণা করে দেয়, বাচ্চারা হাঁ করে বসে থাকে স্নো দেখার জন্য, স্নো ম্যান বানাবে বলে মনে মনে তৈরী হয়ে থাকে, আমাদের মিথীলাও তেমনি অপেক্ষা করতো। স্নো ম্যান বানানোর মত স্নো ফল কখনওই হয়নি, তবুও মিথীলাকে দেখতাম ঘাসে জমে থাকা তুষারকণা জড়ো করে স্নো ম্যান বানানোর চেষ্টা করতো। তেমনই এক বিকেলে মিথীলার সাথে গল্প করেছিলাম, 


"ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে যখন ছিলাম, তখন দেখেছি সত্যিকারের তুষারপাত। তুই তখন এই এত্ত ছোট্ট ছিলি, তুষারপাতের কিছুই বুঝতিস না। বীরের বেশে আসতো তুষারঝড়! কী সুন্দর দৃশ্য! আহ! আমাদের ঘর, রাস্তার গাড়ী সব ডুবে যেতো বরফের সমুদ্রে। রাতের আকাশের দিকে তাকালেই মনে হতো স্টেডিয়ামে ফ্লাড লাইট জ্বলছে, পাতা ঝরা গাছের ডালে বরফের থোকা থোকা ক্রিস্টাল ঝুলতো, কী যে সুন্দর সেই দৃশ্য
মনে আছে, প্রথম তুষারপাতের কথা। সকাল থেকে তুষারপাত হলো, বিকেলবেলা সব বাচ্চারা রাস্তার উপর হুটোপুটি খাচ্ছিল। আমি এই প্রথম দেখলাম স্নো কী জিনিস! তোর পাপা তো কানাডাতে থাকতেই স্নো দেখেছে, সে থাকতোই স্নো এর দেশে, আমি তো দেখিনি। মিশা তোকে নিয়ে ঘরের বাইরে গিয়ে অন্য বাচ্চাদের সাথে মিশে গেলো। তোকে কানমাথা ঢাকা গোলাপী জ্যাকেট পরিয়েছিল। 
তোরা যখন বাইরে খেলছিলি, আমার তখন ইচ্ছে করছিল, বাইরে গিয়ে স্নোএর  উপর গড়াগড়ি খাই। মিশা ছোট হলেও আমার মনের গোপন ইচ্ছেগুলো টের পেতো। ঘরে এসে আমাকে বলেছিল, পাপাকে সাথে নিয়ে বাইরে আসতে। 
আমি তোর পাপাকে বলেছিলাম, " চল না, আমরা স্নোএর রাস্তা হেঁটে আসি'" তোর পাপা আমাকে নিয়ে বের হয়েছিল। তোরা ঘরের সামনে খেলছিলি, আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। মিশা আমাকে ডেকে বলেছিল,

-মা, আমি আর দিদিসোনা 'কনি'কে দেখে রাখবো, তুমি বাবাকে নিয়ে অনেকদূর চলে যাও

আমি স্নোয়ের ভেতর ঢুকে যাচ্ছিলাম, এর আগে কখনও হাঁটিনি তো, তোর পাপা বারবার বলছিল, সাবধানে পা ফেলতে, পড়ে যাবার ভয় আছে। আমি তো শুকনো রাস্তাতেই কতবার পড়ে যাই। আমি তোর পাপাকে বললাম,

-আমার হাতটা ধরো, এখানে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই, আমি তোমার বউ, অন্যদের দিকে তাকিয়ে দেখো, এরা অনেকেই স্বামী-স্ত্রী না, কিন্তু কী সুন্দর হাত ধরাধরি করে হাঁটছে! তুমিও আমার হাত ধরো

-হা হা হা হা! মা তুমি যে কি বলো না, পাপা কী হাত ধরেছে?

-অবশ্যই ধরেছে, আমি যা বলবো, তা মানতেই হবে, হাত ধরে তোর পাপা আমাকে অনেকদূর পর্যন্ত নিয়ে গেছে, কানাডার গল্প করেছে, কত মানুষ স্নোএর মধ্যে হাঁটতে গিয়ে পড়ে কোমড় ভেঙ্গেছে, হা হা হা হা! অমন সুন্দর মুহূর্তে তোর পাপার মাথায় কোমর ভাঙ্গার ভয় ঢুকেছে! হা হা হা হা!

-হি হি হি! আমার সব কথা মনে আছে মা, আমরা স্নোম্যান বানাতাম, মিয়া আমার জন্য স্লেজ গাড়ী বানিয়েছিল, আমাকে সেইটাতে বসিয়ে পাহাড়ের স্লোপ দিয়ে টেনে নামাতো, আমাদের নেইবার সারাহ আসতো আমাদের সাথে খেলতে, কিন্তু সারাহ অনেক মোটা ছিল, মিয়ার অনেক কষ্ট হতো ওকে নামাতে

-তোর সেসব কথা মনে আছে? দারুণ স্মৃতিশক্তি তো! আচ্ছা, তোর কি মনে আছেমিশা  আর মৌটুসী শাবল দিয়ে রাস্তার স্নো পরিষ্কার করতো! ওরা এত পছন্দ করতো স্নো পরিষ্কারের কাজ যে আমাদের নেইবারদের ঘরের সামনের রাস্তাও পরিষ্কার করে দিত। একদিন পাশের বাড়ীর মোটা-মোটি মিশাকে দুই ডলার দিতে চেয়েছিল। 
মিশা তো অবাক হয়ে গেছে, বার বার বলছিল, " না না, পয়সা দিচ্ছো কেনো, আমার কাছে খুব ভালো লাগে স্নো পরিষ্কার করতে, তাই তোমাদের রাস্তাটাও পরিষ্কার করে দিচ্ছি।

মোটি বলেছিল, " এখানে সবাই পয়সার বিনিময়ে কাজ করে। তুমি স্নো পরিষ্কার করেছো, এটা তোমার পারিশ্রমিক" বলে জোর করে মিশার হাতে ডলার গুঁজে দিয়েছিল

-মোটি কার নাম ছিল? সারাহর মায়ের নাম?

-মোটি কারও নাম না, সারাহর মায়ের নাম ক্যারেন। আমি বলছি অন্য লেডীর কথা। তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পাহাড়ের মত মোটা ছিল

-হ্যাঁ, মনে পড়েছে, আমাদের পাশের বাড়ীর নেইবার, কিন্তু মা তুমি মীন হচ্ছো কেনো?  মোটা-মোটি বলছো কেনো ওদেরকে?

-হা হা হা ! আমি মীন হচ্ছি না, বাংলাদেশের মানুষ এভাবেই কথা বলে। আমি তো তাও শুদ্ধভাবে বলেছি মোটা-মোটি, দেশে থাকলে বলতাম, 'মোটকা মুটকী'! শোন, সব কিছু জেনে রাখা ভালো। আমি চাই তোরা দেশে যাবি, দেশে গেলে ভালো-মন্দ সবই দেখবি, শুধু ভালোটুকু শিখলে এখনকার দুনিয়ায় চলতে পারবি না। তোরা মন্দ হইস না, কিন্তু মন্দকে চিনে রাখা ভালো, তাহলে মন্দকে এভয়েড করতে পারবি

-মা, এবার থামো, আজকে তোমার মাথাটা একটু গন্ডগোল হয়ে গেছে ( এইসব শব্দ আমার কাছ থেকে শেখা)

-হুম, বড়ই সুখের দিন ছিল। সেই স্নোয়ের সাথে আজকের এই স্নো কে যদি কমপ্যায়ার করি, তুইই বল, এটাকে কী 'ছ্যাপ' বলতে পারি না?

--- ছ্যাপ কি?
-ছ্যাপ হলো মুখ থেকে পিচ করে ছুঁড়ে দেয়া থুতু।
- হাহাহাহহা! ছ্যাপ বলো, তবে এর চেয়ে আর কোন সুন্দর ওয়ার্ড নেই?

না, আমাদের বাংলা ভাষায় শুধু সুন্দরকেই সুন্দর বলা যায়, অসুন্দর বা  কুৎসিতকে ভদ্রতার খাতিরেও সুন্দর বলা যায় না, তাহলে সুন্দরের অপমান হয়। যাহ! এবার রেডি হতে হবে আমাকে। তোরা 'ছ্যাপ' স্নো এনজয় কর, আমি কাজে বেরিয়ে যাই।"


আহারে চাকরি। সেদিনও স্নো এনজয় করা বাদ দিয়ে আমাকে কাজে যেতে হয়েছিল, আজও লেপের তলার উমের আরাম বাদ দিয়ে আমাকে কাজে যেতে হচ্ছে। চোখ দুটো কুটকুট করছে কেন! মন খারাপ হওয়া ভাল নয়। কাজেই আনন্দ কাজেই মুক্তি।Image result for image of snow fallingImage may contain: 1 person, smiling, eyeglasses and closeup

1 comment:

  1. shafiul1957@yahoo.comJanuary 17, 2018 at 5:40 AM

    অসম্ভব সুন্দর শব্দের গাঁথুনীতে তুষারপাতের স্মৃতিকথা। মিঠু ছোড়দি তুমি অনন্যা, অতুলনীয়া।

    ReplyDelete