Friday, January 12, 2018

কুয়াশা কুয়াশা দৃষ্টি! ( দিনলিপি)







জানুয়ারি ১১, ২০১৮ 

অনেকদিন পর অনেকটা দিন মিথীলাকে কাছে পেলাম। এক মাস কাটালো আমাদের সাথে। গত এক মাস আমাদের খালি খালি লাগা ছোট্ট বাড়িটা কেমন যেন ভরা ভরা হয়ে উঠেছিল।

সেই যে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে মিথীলা চলে গেলো এমোরি ইউনিভারসিটিতে, ঘর খালি করে বুক খালি করে কোল খালি করে মেয়েটাকে ডর্মে পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম! সেই থেকে আমার বুক খালি, কোল খালি ঘর তো খালিই। মিথীলা যদি মেয়ে না হয়ে ছেলে হতো, তাহলে হয়তো ঘর খালি মনে হতো না। যেমন আমার বাবা মায়ের ঘর কখনও খালি হয়নি, আমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও না। বাবা মায়ের ছিল তিন ছেলে, একজন কাছে না থাকলে আরেকজন থাকে, দুই জন না থাকলে একজন হলেও কাছে থাকে। বাবা মায়ের কাছে আমি কন্যা ছিলাম বোনাস। তিন ছেলের সাহচর্য্য পাওয়ার সাথে মেয়ের সান্নিধ্য ঘন দুধের উপর সরের মত আর কি!

আমার যেমন কপাল, মায়ের ঘরে তিন ছেলে জন্মালো, অথচ আমার ঘরে একটি ছেলেও নয়। মিথীলাটা ছেলে হয়ে জন্মালে কী এমন ক্ষতি হতো! এমোরিতে ভর্তি হওয়ার পর মনে মনে বলতাম, লেখাপড়া করতে ইউনিভারসিটিতে গেছে । আমার মায়ের যেমনি মনে হতো, ছেলেরা লেখাপড়া করতে ইউনিভারসিটিতে গেছে, আমার বেলায় তা মনে হয়নি। আমার বেলায় মনে হয়েছে, আমার মেয়েটা ইউনিভারসিটিতে গেলো, এই যাওয়াই যাওয়া। মেয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলো একেবারে, ছেলেরা লেখাপড়া শেষ করে ঘরে ফিরে আসবে, মেয়ে ফিরবেনা, সে চলে যাবে অন্য ঘরে। বাঙালির এই এক দোষ, পুত্র সন্তান আর কন্যা সন্তান মায়ের নাড়ি ছেঁড়া সন্তান হলেও সামাজিকতায় কেমন যেন আড়াআড়ি নিয়ম ব্যবস্থা। ছেলেই সকল শক্তি আর সাহসের মন্ত্র যেন, মেয়ে হচ্ছে ভয় হতাশা দুশ্চিন্তার আধার! সব কথা কি খুলে বলা যায়! আমি নিজেও তো মেয়ে, সমাজের এই আড়াআড়ি নিয়মের জলছিটে কি আমার গায়েও লাগেনি!

অবশ্য একদিক থেকে বাঁচোয়া, আমার তিনটাই কন্যা, মিথীলা কেন ছেলে হলোনা বলে যতই গলা খুশ খুশ করিনা কেন, ্মিথীলা  ছেলে হয়ে জন্মালে আমি কি আর সামাজিক নিয়মের বাইরে যেতাম! মুখে যতই বলি, না না, আমার কাছে ছেলে মেয়ে দুইই সমান, মন তো তা বলতো না। মাঝখান থেকে বড় মেয়ে দুটা আদর যত্ন কম পেতো।

তবে মিথীলা ছেলে না হলেই কি, তৃতীয় কন্যা হলেই কি, আদর আহ্লাদ তো কম পাচ্ছেনা। সকলে আদর করে ওকে, যেন সাত কন্যার পর এই একটা মাত্র পুত্র সন্তান আমার! সাত বোন পারুলের এক ভাই চম্পা। সত্যিই মিথীলা অনেক আদর পায়। কেন পায়? এই কেন'র উত্তর দিতে গেলে মিথীলাকাব্য লিখতে হবে। তা লিখার দরকার নেই। একটা মাত্র কথা দিয়ে মিথীলাকাব্য রিপ্রেজেন্ট করি বরং,কথাগুলো এরকমঃ

আমার সব সময় মনে হয়, আমি মিথীলার পূর্ণভাবে বড় হওয়া দেখে যেতে পারবোনা। তার আগেই পৃথিবী ছাড়ার ডাক আসবে। আমার বড় দুই মেয়ের সাথে মিথীলার বয়সের বেশ তফাৎ আছে। মৌটুসি, মিশার চেয়ে মিথীলা যথাক্রমে ১৩ এবং ৯ বছরের ছোট। মৌটুসি এবং মিশা আমার কম বয়সের সন্তান, তাই আমি বুড়ো হওয়ার আগেই ওরা লেখাপড়া শেষ করে চাকরি শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু মিথীলাতে এসেই থমকে গেছি, মনে মনে ভাবি, মিথীলা যখন চাকরি করবে, ওর ইচ্ছে করবে আমার খুশির জন্য অনেক টাকা খরচ করতে। কারণ অনেক দেরীতে পৃথিবীতে এসেছে বলেই মিথীলা আমাকে পেয়েছে একেবারে পুরোপুরিভাবে। কোন ভাগীদার ছিলনা, মিথীলা যখন কিশোরী, মৌটুসি মিশা তখন স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেছে আরও বড় ঘরের পানে। তখন মিথীলা সম্পূর্ণ একা আমায় পেয়েছে। আমিও দুই কন্যা বিহনে মিথীলাকে আঁকড়ে ধরেছিলাম। স্বভাবের কথা যদি বলি, মিথীলা আদ্যোপান্ত একটি ভাল মেয়ে। আমার ভাগ্যে এও ছিল! ছেলে নেই বলে দুঃখ, ঈশ্বর সেই দুঃখ আরেকভাবে পুষিয়ে দিলেন! হ্যাঁ, মিথীলা আমার তেমনই এক মেয়ে, যেজন্য সেদিন মিথীলাকে ডেকে বললাম,
" মিথ, তুমি যখন বড় হয়ে যাবে, খুব ভাল চাকরি করবে তখন হয়তো আমি থাকবোনা। তোমার হয়তো মন খুব খারাপ লাগবে, তুমি চাকরি করছো, এত টাকা পাচ্ছো কিন্তু মা দেখতে পাচ্ছেনা। মা'কে ওয়ার্ল্ড ট্যুর করার জন্য টাকা দিতে পারছোনা! শোন বাচ্চা, যদি এমনটাই ভাগ্যে থাকে, তাহলে আমি না থাকলেও তুমি মন খারাপ করোনা। আজ বলে দিচ্ছি, মেমোরিতে নোট করে নাও, ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত তুমি আমাকে যে সুখ দিয়েছো, যে সেবা দিয়েছো, যে ভালোবাসা আদর যত্ন দিয়েছো, তাতেই আমি পরিপূর্ণ হয়ে গেছি মা। খুব কম মায়ের কপালে তোমার মত মেয়ে জুটে। "

এখন বাজে রাত ১২টা। কাজ থেকে ফিরেছি সন্ধ্যা ৭টার পরে। ঘরে ঢুকবার পর থেকে বিশ্রাম বিলাস করা ছাড়া আমাকে আর কিছু করতে হয়নি। নিত্য পূজো দেয়া, ভাত রান্না করা, ফ্রিজ থেকে তরকারি বের করে বাবা মায়ের জন্য সাজিয়ে রাখা, আমাকে খাবার গরম করে প্লেট হাতে তুলে দেয়া, এরপর কিচেন ক্লিন করে আমার জন্য এক কাপ অসাধারণ চা তৈরী করা---এসবই মিথীলা করেছে। আজ বৃহস্পতিবার চলে গেলো, মিথীলা চলে যাবে সোমবার ভোরে।

মিথীলার জন্য বাসের টিকেট কেনার সময় মিথীলার বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, রোববারের টিকিট কাটবো নাকি সোমবারের? বলেছিলাম, সোমবারের টিকিট কাটো।
ওর বাবা বলে, কিন্তু সোমবার তো তোমাকে কাজে যেতে হবে, গুড্ডুকে বাসে তুলে দিতে যেতে পারবেনা।
বললাম, আমাকে তো রোববারেও কাজে যেতে হবে। কিন্তু রোববার কাজ থেকে ফিরে তবুও তো রাতটুকুর জন্য মিথীলাকে পাব। কুড়িয়ে বাড়িয়ে যেটুকু পাই, সেটুকুই আমার লাভ। লাভের অংশ কে ছাড়তে চায় বলো! এক মাস মেয়েটা ছিল, আমার চারদিকে সব ছিল। মিথীলা চলে যাওয়ার পর তো আমি আর তুমি, তুমি আর আমি, একতলা দোতলার সংসার দুজনে। সারাদিনে হয়তো দুজনের দেখা মিলবে শুনশান রাতে, কুয়াশা কুয়াশা দৃষ্টিতে ঘুমের চাদরে ঢাকা নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে!

এমন একটি নিঃসঙ্গ জীবন পাওয়ার জন্যই সেই কবে থেকে দিবানিশি তারতম্য না করেই চোখ মুখ বুজে দিনাতিপাত করে গেছি, সকলেই করে, আরও সকলেই করছে, ভবিষ্যতের বাবা মায়েরাও করবে।









2 comments:

  1. দারুণ!মা ও মেয়ের ভালোবাসা লালনপালনের এই মন ভেজানো গল্পটি পড়ে আমার মতো সকল পাঠক আপ্লুত হবেন। প্রিয় লেখিকা ও তার উত্তম কুমার এবং আদরের তিন কন্যার জন্য শুভকামনা।

    ReplyDelete
  2. অনেক ভালো লাগলো৷৷মায়ের মমতা,ভালোবাসা অতুলনীয়!!

    ReplyDelete