Saturday, January 13, 2018

কুয়াশা কুয়াশা দৃষ্টি ( পৌষ সংক্রান্তি)


আজ থেকে প্রায় পনেরো দিন আগে পারুল নামের এক পাঞ্জাবী মেয়ে আমাকে কল করেছিল। ইংলিশে বলল, " হেলো, আমি পারুল বলছি। আগামী ১৩ই জানুয়ারী শনিবার আমাদের বাবুটার জন্মদিন। বিকেল পাঁচটায় আমাদের বাড়িতে আপনাদের নেমন্তন্ন। আমাদের খুব ইচ্ছে ছিল আমাদের বাড়িটা কমপ্লিট হয়ে গেলে হাউজ ওয়ার্মিং পার্টি করবো আপনাদের সবাইকে নিয়ে, কিন্তু সেটি হচ্ছেনা। তার আগেই আমাদের বাবুর জন্মদিনের তারিখ চলে এলো। তাই ওর জন্মদিনটাই বরং পালন করি। এখানে এত ছোট কম্যুনিটি, কারো সাথেই পরিচয় হয়নি। আপনারা এলে খুব খুশি হবো।
পারুল আরও যোগ করলো, জানেন তো, সেদিন লোরি উৎসব। 'বন ফায়ার' করবো আমরা সবাই মিলে। লোরি উৎসবে আমরা দেশে বন ফায়ার করি, এখানেও করব।আসবেন কিন্তু।"

১৩ই জানুয়ারী শনিবার, শনিবার আমার ডে অফ থাকে, কাজেই পারুলদের বাড়িতে যেতে পারবো। পারুলকে 'হ্যাঁ' বলে দিলাম এবং 'বিশেষ' ধন্যবাদ দিলাম ওদের বাবুর জন্মদিনে আমাদের নেমন্তন্ন করার জন্য।

বিশেষ ধন্যবাদ দেয়ার কারণ আছে।যে মেয়েটি 'পারুল' পরিচয় দিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে, প্রথমে পারুল নামের কাউকে আমি চিনি, সেটাই বোধগম্য হয়নি। পারুল নামে কে এলো আমাদের শহরে? পারুলের কথা চলার মাঝেই বুঝতে পারলাম, কে এই পারুল। পারুলকে একবার মাত্র দেখেছিলাম আমার বরের এক কলিগের বাড়িতে। আমার বরের কলিগ মারোয়ারী, হায়দ্রাবাদ থেকে এসেছেন। তাঁদের সাথে আমাদের খুব ভাল সম্পর্ক, রাণী ভাবীকে তোঁ মনে হয় মাথার উপর বড় বোনের ছায়ার মত। রাণী ভাবী আমাকে খুব ভালোবাসেন, ছোট বোনকে যেমন ভালোবাসে বড় দিদি। ভাবী সবসময় চেষ্টা করেন ইন্ডিয়ান বাংলাদেশীদের সাথে বন্ধুর মত মিশতে। কেউ উনার সাথে মিশে, কেউ মিশেনা। আমি মিশি, তাই নতুন কেউ শহরে এলে ভাবী আমার সাথেও পরিচয় করিয়ে দেন।

পারুল আর তার স্বামী গৌরব তখন সবে শহরে নতুন এসেছে। কেমন করে যেন রাণী ভাবীর সাথে যোগাযোগ হয়, ভাবী এই তরুণ দম্পতীকে নিজের বাড়িতে নেমন্তন্ন করেন, সেই সাথে আমাদেরকেও ডাকেন। তরুণের নাম গৌরব দত্ত, তার বউ পারুল দত্ত, ছোট এক শিশু ওঁম দত্ত। নাম শুনেই আমার হিয়ার মাঝে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেলো, এই শহরে বাঙালি এসেছে। কতক্ষণে তাদের দেখবো সেই আগ্রহে অধীর আমি। ভাবীর বাড়ি পৌঁছে শুনলাম, পারুলের মায়ের হঠাৎ শরীর খারাপ হওয়ায় ওরা একদিনের মধ্যে প্লেনের টিকেট কেটে দেশে চলে গেছে। তা কলকাতায় কোথায় ওদের বাড়ি?
ভাবী বলল, কলকাতায় বাড়ি হবে কেন? পাঞ্জাবে ওদের বাড়ি। তার মানে ওরা পাঞ্জাবী। পাঞ্জাবীদের টাইটেল দত্ত হয়? তার উপর নামও বাঙালি, গৌরব পারুল ওঁম?
 হয়, নাম টাইটেল সবই একই রকম হয়। আমার বর বললো, সুনীল দত্ত, সঞ্জয় দত্ত কি বাঙালি?

গৌরব দত্ত কার্ডিওলোজিস্ট, নিউইয়র্কে ছিল। সেখান থেকে আরও ভাল অফার পেয়ে আমাদের শহরের হসপিটালে জয়েন করেছে। তার বউ পারুল ইন্ডিয়া থেকে ডাক্তারি পাশ করে এসেছে, আমেরিকায় এখন এমক্যাট পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে রেসিডেন্সি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এসব গল্প শুনে আমার মনে কোন প্রতিক্রিয়া হলোনা। বাঙালি ভেবে যতখানি উচ্ছ্বাস ছিল, পাঞ্জাবী শুনে উচ্ছ্বাস মিইয়ে গেছে।

রাণী ভাবী এরপর আরেকদিন নেমন্তন্ন করেছেন, গিয়েছি। ভাবীর বাড়িতে ঢুকেই দেখলাম আরও কিছু নতুন মুখ। একটি তরুণীতো দেখতে দারুণ সুন্দরী, কী গায়ের রঙ, কী তীক্ষ্ম চেহারা! আরেক তরুণ দেখলাম, খুব সুন্দর। তরুণীর কোলে এক শিশু, যেন সাক্ষাৎ দেবশিশু। বাচ্চা এত সুন্দর হয় দেখতে! পরিচয় পেলাম, এরাই ডাঃ গৌরব-পারুল দম্পতি। বেশি সুন্দরের মাঝে থাকলে আমি কেমন যেন নীরব হয়ে যাই, কথা বলা থেমে যায়, চুপচাপ শুধু ঈশ্বরের সৃষ্টি কর্ম দেখি। ঈশ্বরের মতিগতি বুঝে উঠতে পারিনা। পারুলকে এত্ত সুন্দর করে গড়েছিল, আবার একই ঈশ্বর দুলালীর মায়ের দুলালীকে গড়েছে একেবারে হেলা ফেলা করে, কেন এমন মতিভ্রম হয় ঈশ্বরের?

এরপর কমপক্ষে ছয় সাত মাস পেরিয়ে গেছে। আমিও পারুলের কথা ভুলে গেছি। তাই পনের দিন আগে পারুলের কল পেয়ে পারুলকে চিনতে পারিনি। আর এজন্যই পারুলকে বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়েছি। যে অপরূপা সুন্দরী পারুলকে আমি ভুলে গেছি, সেই সুন্দরী মেয়েটি একদিন দেখে আমাকে মনে রেখেছে, তাদের দেবশিশুর প্রথম জন্মদিন উৎসবে নেমন্তন্ন করেছে, এর জন্য বিশেষ ধন্যবাদ পারুলের প্রাপ্য।

 যাহোক, ১৩ই জানুয়ারীর অপেক্ষা করতে থাকি, মিথীলা চলে যাবে ১৫ তারিখ। আমাদের শহরে মিথীলাকে নিয়ে আমাদের কোথাও যাওয়া হয়না আজকাল। পারুলদের বাড়িতে গেলে মিথীলা 'বন ফায়ার' দেখতে পারবে। 'বন ফায়ার' অনেকেই করে, আমারও করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কোনদিন করা হয়নি। সমমনা সঙ্গী না থাকলে এসব হয়না। আমার জীবনে সমমনা সঙ্গীর খুব কম দেখা মিলেছে। পাঞ্জাবীদের লোরি উৎসব বলল মেয়েটা, মেয়েটা ধরেই নিয়েছে লোরি উৎসব সম্পর্কে আমি আগে থেকেই জানি। কারণ রাণী ভাবী লোরি উৎসব সম্পর্কে জানে, উনার ছেলের বউ যেহেতু পাঞ্জাবী। আমার খুব কৌতুহল ছিল লোরি উৎসব কেমন দেখার জন্য।


আমি ফেসবুকে ব্যান হয়ে আছি অনেকদিন যাবত, প্রথম দিকে খুব কান্না পেতো, এখন সয়ে গেছে। ফেসবুকে থাকতে ইচ্ছে করে তবে না থেকেও দিন চলে যাচ্ছে। আমি ফেসবুক ব্যবহার করতে না পারলেই কি, মেসেঞ্জারে টুং টুং করে সমানে মেসেজ আসতেই থাকে। আমিতো কারো মেসেজের উত্তর দিতে পারিনা, তবুও মেসেজ পাঠাতে কেউ ক্লান্তি বোধ করেনা। সেভাবেই গতকাল কয়েকটা মেসেজ এসেছে, " শুভ পৌষ সংক্রান্তি' 'শুভ মকর সংক্রান্তি'।

মেসেজগুলো চোখ মেলে দেখতেও ইচ্ছে করলোনা। এগুলো দেখে কি হবে? বাঙালি ব্যবহার করবে ফেসবুক? বাঙ্গালির আরও একশ বছর লেগে যাবে সামাজিক সৌজন্যতা, পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহনশীলতা শিখে উঠতে। ফেসবুক কতবড় একটা শক্তিশালী মাধ্যম ছিল নিজেকে ইতিবাচকভাবে প্রকাশিত করার, বাঙালি তা করবেনা। নিজেও করবেনা, অন্যকেও করতে দিবেনা। তারা ভাবে, ফেসবুক বুঝি পাড়ার রকে বসে এর তার পশম তুলে ফেলার হুমকি ধমকি খেলা। এরা ভাল কিছু শিখতে না পারুক, এক লাইন শুদ্ধ ইংলিশ লিখতে শিক্ষিতদেরই কলমের আগা ডগা ভেঙ্গে টুকরো হয়ে যাক, শিক্ষিত অশিক্ষিত মিলে মিশে হই হই করতে করতে অপছন্দের কারো নামে ফেসবুকে 'রিপোর্ট' করে দিতে পারে ঠিকই।

বর্বর কাজ করার জন্য ইংলিশে এম এ পাশও যেমন দক্ষ, বটতলায় বসে মানুষের দাড়ি চাছায় এম এ পাশও তেমন দক্ষ। এদের মাঝে অল্পক্ষণ থাকা যায়, বেশিক্ষণ থাকা যায় না, এরাই থাকতে দেয়না। আমাকেও থাকতে দেয়নি তাই আমি নীরবে সরে এসেছি। এখন বেহায়ার মত মেসেঞ্জারে মেসেজ পড়বো আর চোখের জল ফেলবো, ততটা নিঃস্ব এখনও হয়ে উঠতে পারিনি।

আজই সেই দিন, ১৩ই জানুয়ারী, চট করে মনে পড়ে গেলো আজ বাঙালির পৌষ সংক্রান্তি, রাণী ভাবীদের মকর সংক্রান্তি ( মকর সংক্রান্তি বাঙালিরাও বলে), পাঞ্জাবীদের লোরি উৎসব।সাথে সাথে পারুলদের লোরি উৎসবের ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। লোরি উৎসবে ওরা বন ফায়ার করে, বাঙ্গালিরা গ্রাম দেশে 'শীতের বুড়ি পোড়ানো' উৎসব করে।

বিকেল পাঁচটায় মিথীলাকে নিয়ে আমরা পারুলদের বাড়ি গেছি। ধীরে ধীরে আরও কয়েকটি দম্পতি এসে পৌঁছেছে। অনুষ্ঠানে তিনজন ছোট বাচ্চা। পারুলের ছেলে ওঁম, আকাংক্ষার ছেলে আরাব , নবনির মেয়ে ফোয়ারা। ওদের বয়সগুলোও মজার, আরাব ৩ বছর, ফোয়ারা ২ বছর, ওঁম ১ বছরের। তিন শিশু নয় যেন তিন এঞ্জেল! সকলের সাথে কথা বলে জানলাম, পৌষ সংক্রান্তিই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন নামে পালিত হয়। এবং সকলেই সন্ধ্যার পর আগুন জ্বালিয়ে খড় কুটো পোড়ায়, সেই আগুনে মনের যত পাপ ছুঁড়ে ফেলে মনকে নতুন বছরের জন্য শুদ্ধ করে নেয়।

গৌরব অতিথিদের সবাইকে ডেকে ব্যাকইয়ার্ডে নিয়ে গেলো, পেশায় ডাক্তার, তেমন বাড়িই কিনেছে। বিশাল ব্যাকইয়ার্ড, আগুন জ্বালবে বলে অনেক দামী এক মেটালিক পাত্র কিনে এনেছে, যাতে আগুন জ্বালালে পাত্রের কোন ক্ষতি হবেনা। কাঠকুটো দিয়ে আগুনের কুন্ড তৈরী করা হলো। একসময় আগুন ফন ফন করে জ্বলে উঠলো, বাইরে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা, এরমধ্যে আগুনের কুন্ড তৈরী হয়েছে। উপস্থিত সকলেই বার বার আগুনের কাছাকাছি চলে যায়।

আগুন জ্বলছে, আমার চোখের সামনে থেকে কুয়াশা কুয়াশা চাদর সরে যাচ্ছে! আমেরিকার এক ছোট্ট নিঝুম শহরের প্রান্তের এক ধনী তরুণ দম্পতির বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে 'বন ফায়ার' হচ্ছে, একই 'বন ফায়ার' হচ্ছে বাংলাদেশের গ্রামের বাড়িগুলোতে, খোলা মাঠে । গ্রামে পৌষ সংক্রান্তির আগের সন্ধ্যায় সকলে জড়ো হয় খোলা মাঠে। আগে থাকতে খড় বিচালি দিয়ে মানুষের আকৃতি এক অবয়ব তৈরী করা হয়, নাম দেয়া হয় 'শীতের বুড়ি'। কাঠকুটো দিয়ে আগুনের কুন্ড তৈরী করে সবাই মিলে 'শীতের বুড়ি'কে সেই অগ্নিকুন্ডে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, আগুনে শীতের বুড়ি পুড়ে ছাই হতে থাকে, গ্রামের মানুষ তাই দেখে দেহে উষ্ণতা অনুভব করতে থাকে।
পৌষ মাঘের শীতে বাঘ পালায়, মানুষের পালানোর উপায় নেই তাই মানুষ শীতের বুড়িকে পুড়িয়ে ফেলে যেন পরদিন থেকে শীত পালাতে শুরু করে। হ্যাঁ, গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে, পৌষ সংক্রান্তিতে শীতের বুড়ি পোড়ানোর পর নাকি শীত কমতে শুরু করে। একই বিশ্বাস পাঞ্জাবীদের মধ্যেও আছে, ডাঃ গৌরব তাই বলছিল।

কিছুক্ষণ পর পারুল একটি ডালা ভর্তি খই, তিলের নাড়ু, চিনেবাদাম নিয়ে এলো, সাথে ঘি। নিয়ম হচ্ছে, প্রত্যেকে ঘি, খই, বাদাম, তিলের নাড়ু আগুনে ছুঁড়ে দিয়ে মন্ত্র বলবে, " আমার মনের সকল পাপ, জমে থাকা গ্লানি সব এই আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মনকে শুদ্ধ করে নিলাম।" সকলেই তা করলাম, ডঃ হেডা মজা করে বললেন, " আবার কাল থেকে নতুন করে পাপ শুরু করা যাবে", সকলে হেসে উঠলো।

জানিনা আমাদের গ্রামে শীতের বুড়িকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলার সময় সকলে যার যার মনের পাপগুলোও ছুঁড়ে দেয় কিনা!

এরপর পারুল আমাদের সবাইকে বলল, ডালা থেকে তিলের নাড়ু, বাদাম, খই তুলে নিয়ে খেতে, লোরি উৎসবের নিয়ম এটা। হায়, চোখের সামনে থেকে কুয়াশা কুয়াশা দৃষ্টি আবার সরে যেতে থাকে। গ্রামে শীতের বুড়ি পোড়ানো হয়ে গেলে সকলে স্নান করে বাতাসা নাড়ু সন্দেশ খায়। এরপর মা কাকীরা বসে পিঠে বানাতে। সারা রাত সব বাড়িতে পিঠে পুলি পায়েস রান্নার ধুম পড়ে যায়। সারা দিনে মেয়েরা কাহাইল ছিয়ায় দুমাদুম করে ছেঁচে ছেঁচে নতুন চাল গুঁড়া করে পিঠার জন্য প্রস্তুত করে রাখে, ঘটি ভরা রসের গুড়, আস্ত পাটালি, দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করা হয় দুধ চিতই বানানো হবে বলে, দুধ জ্বাল দিয়ে ক্ষীর বানানো হয় পাটিসাপটা বানানো হবে বলে, নারকেল খেজুর গুড়ের কন্ডা তৈরী করা হয় পুলি পিঠা বানানো হবে বলে----কত কি, কত কি!!

আমরা শহরে বড় হয়েছি। শীতের বুড়ি পোড়ানো হতো না শহরে। তবে পিঠা পায়েসের আয়োজন হতো। আমাদের একটা কাহাইল ছিয়া ছিল। আমার মায়ের দিদিমার নাকি মায়ের ঠাকুমার আমলের। সেই কাহাইল ছিয়ায় অনেকেই চাল কুটতো, আমিও কুটতাম। আমার সব কাজেই উৎসাহ ছিল লেখাপড়া বাদে। মা এসব কাজ পারতোনা, চাল কোটা, নারকেল কোরানো, এসব কাজ আমি করতাম। শুধু ক্ষীর বানানো আর পায়েস রাঁধার কাজটুকু মা নিজের হাত থেকে ছাড়তোনা। দুধ সব সময় নাড়ার মধ্যে না রাখলে যে পাত্রের তলানীতে দুধ পোড়া লাগতে থাকে এবং এক সময় সমস্ত দুধে পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে যায়, তাতে যে পায়েস আর ক্ষীরের সাড়ে সর্বনাশ হয়, এবং পায়েসে পোড়া গন্ধ পাওয়া গেলে যে বাবা খুশি হবেনা, এই কথাটা মায়ের মুখে শুনতে শুনতে মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। মা'কে আজকাল সব কিছুতেই মনে পড়ে, বড্ড বেশি মনে পড়ে!

আমার জীবন থেকে পৌষ সংক্রান্তির পিঠে পুলির স্মৃতি ক্রমশঃ কুয়াশার চাদরে একেবারেই ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। মিথীলা আছে বাড়িতে, ও যাবে পরশু সকালে। ইচ্ছে করলে কি মিথীলাকে দুটো পাটিসাপটা পিঠে বানিয়ে খাওয়ানো যায়না? তা যায়, কিন্তু বানিয়ে কি হবে? মিথীলার কাছে পৌষ মাঘ বলে তো কিছু নেই। আজ আমি ওকে পৌষ সংক্রান্তির উৎসবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো, বাঙ্গালিত্ব শেখাবো, বাংলাদেশে যাওয়ার কথা বলবো! মিথীলা যদি আমায় প্রশ্ন করে, " মা, তুমি যে আমায় বাংলাদেশের কথা বলো, বাংলায় কথা বলতে শিখিয়েছো, বাঙালি খাবার খেতে শিখিয়েছো, হাত দিয়ে মেখে ভাত খেতে শিখিয়েছো, আমি বাংলাদেশে গেলে কি কেউ আমায় বাঙালি বলে কাছে টেনে নিবে? নিবে না, সবাই আমাকে আমেরিকান বলবে। বাংলাদেশের মানুষ আমেরিকানদের পছন্দ করেনা, আমাকেও পছন্দ করবে না। এই কথাটা আগে বুঝতাম না। এবারের ক্রিসমাস ব্রেকে এসে তোমার কান্নাকাটি দেখে সব বুঝে গেছি। তার চেয়ে এই ভাল, যে দেশে আছি, যে দেশে থাকবো সেই দেশের হয়েই নাহয় বাঁচি। পৃথিবীর সব দেশই তো জল মাটি দিয়ে তৈরী, সব দেশেই গাছপালা পাহাড় আছে, সব দেশেই মানুষ আছে, হয়তো তাদের ভাষা ভিন্ন, কিন্তু সকলের শরীরের রক্ত তো লাল। হ্যাঁ, যে দেশে আমার জন্ম হয়েছে, সে দেশের জন্য আমার মনের ভেতর অন্যরকম এক ভালোবাসা থেকেই যাবে, সেটা নাহয় অনেক যত্ন করে বুকের ভেতর রেখে দেবো, তবুও কান্নাকাটি করে একটি দিনও নষ্ট হয়ে যেতে দেবোনা"। হ্যাপি পৌষ সংক্রান্তি মা।

জানিনা মিথীলা আমাকে এসব কথা বলবে নাকি, হয়তো বলবেনা। কারণ মিথীলার মুখে এমন কথা শুনলে আগামী সাত দিন আমি কানতে কানতে অন্ধ হয়ে যাব, মিথীলা এটা খুব ভাল জানে। আহ! কে জানে, হয়তো কাল সকালে মিথীলাকে কয়েকটা পাটিসাপটা ভেজে খাওয়াবো। পারিনা মনের বিরুদ্ধে যেতে, পারবোনা কোনদিনই।

কুয়াশা কুয়াশা দৃষ্টি দিয়ে তাকাই পেছনের পথে,
"পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেই দিন
ফিরে আর আসবে কি কখনো"

Image result for image of poush pithaImage result for image of poush pitha








6 comments:

  1. তোমার স্মৃতিগুলো খুব সুন্দর করে উপস্থাপন করতে পারো দিদি। সত্যি তোমার লিখা পড়তে ভীষণ ভাল লাগে।
    --হাসান মৃধা।

    ReplyDelete
  2. আমি আগে
    তোমার বড় বড় লেখাগুলো প্রায়ই পুরোটা
    পড়তাম না, প্রথমের আর
    শেষেরদিকটা
    পড়তাম,
    কিন্তু এখন আমি
    তোমার লেখাগুলো ওয়ালে আর ব্লগে
    গিয়ে খুঁটে খুঁটে
    পড়ি.....

    'অনেক শ্রদ্ধা ও শুভকামনা তোমার জন্য,
    তুমি সারাক্ষন ভালো থেকো আপা'

    ReplyDelete
  3. খুব সুন্দর লিখেন আপনি, ভালো লাগলো আপনার লেখনি পিঠাগুলিও লোভনীয়।

    শুভকামনা রইল দিদি।

    ReplyDelete
  4. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  5. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete