চিকেন বার্গার খেতে পছন্দ করেনা এমন বাচ্চার সংখ্যা খুবই কম। শুধু বাচ্চাই বা বলি কেনো, বার্গার খেতে ছোট বড় সকলেই পছন্দ করে। আগে আমাদের দেশে ছেলেমেয়েরা আড্ডায় বা ভ্রমনে ঝালমুড়ি, ফুচকা খেতেই বেশী পছন্দ করতো। কিনতু বিশ্বায়নের যুগে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। দেশে বড় বড় শহরগুলোতে প্রচুর ফাস্টফুড শপ দেখা যায়, যেখানে চিকেন বার্গার, বিফ বার্গার পাওয়া যায়। ছোট ছেলে মেয়ে, তরুন-তরুনীদের কাছে বার্গার খুবই প্রিয় হলেও, দামের দিক থেকে মোটেও সস্তা নয়। কিনতু পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে বার্গার দামে সস্তা, সহজলভ্য একটি খাবার। অনেকটাই আমাদের দেশের ঝালমুড়ি বা ফুচকার মতই যে কোন স্থানে পাওয়া যায়। দামেও সস্তা বলে দৈনন্দিন খরচের বাজেটে টান পড়লে বার্গার খেয়েই লাঞ্চ বা ডিনার সেরে ফেলা যায়। একটি বার্গার মাত্র এক ডলার। এক ডলারের একখানা বার্গার থেকে কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিন, দুইই পাওয়া যায়। পাশ্চাত্যে বিশেষ করে আমেরিকায়, বার্গার বলতে 'মাগডোনাল্ড'স এর চিকেন বার্গার, হ্যাম বার্গার অথবা চীজ বার্গারকে বুঝানো হয়। খেতে সুস্বাদু বার্গার নামের খাবারটিকে আমেরিকাতে জনপ্রিয় করে তুলেছে 'ম্যাকডোনাল্ড'স এর স্বত্বাধিকারী রিচার্ড এবং মরিস ম্যাকডোনাল্ড ভ্রাতৃদ্বয়।
রিচার্ড এবং মরিস ম্যাকডোনাল্ড ১৯৪০ সালে ক্যালিফোর্ণিয়াতে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা শুরু করেন, প্রথমে ওটা ছিল শুধুই বারবিকিউ রেস্টুরেন্ট। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে নতুন আইটেম হিসেবে 'হ্যামবার্গার' যোগ করা হয়। 'স্পিডি সার্ভিস সিস্টেম' ব্যবস্থায় অতি দ্রুত সময়ে হ্যামবার্গার গ্রাহকের হাতে তুলে দেয়ার ব্রত নিয়েই তারা ব্যবসা শুরু করেন। অতি অল্প সময়ে তাদের 'দ্রুত সময়ে প্রস্তুত হ্যামবার্গার' জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে। ম্যাগডোনাল্ড'স এর শুরুর দিকের মাসকট ছিল 'স্পিডী' নামের একজন শেফ, যার মাথায় 'হ্যামবার্গার শেপের টুপী থাকতো। ১৯৬৭ সালে 'স্পিডী' নাম বদলে নতুন নামকরন করা হয় 'ম্যাকডোনাল্ড'স। ১৯৬৮ সালের নভেম্বার মাসে ম্যাকডোনাল্ড'স এর নতুন লোগো ঠিক করা হয় ইংরেজী লেটার 'M' '(এম ), লোগোর রঙ ঠিক হয় হলুদ।
আমেরিকায় ম্যাকডোনাল্ড'স তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করার পর, এই ব্যবসা পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। আন্তর্জাতিক বাজারে ম্যাকডোনাল্ড'সের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারকে ' সিমবল অব গ্লোবালাইজেশান' মনে করা হয়। দ্রুত সময়ে মুখরোচক খাবার হাতের মুঠোয় পৌঁছে দেয়ার এই পদ্ধতির ভেতর দিয়েই ' আমেরিকান ওয়ে অব লাইফ' এর একটি চিত্র ফুটে উঠে। এই মুহূর্তে পৃথিবীর প্রায় ১১৯টি দেশে ম্যাকডোনাল্ড'স এর রেস্টুরেন্ট আছে। সর্বমোট ৩১,০০০ রেস্টুরেন্ট চালু আছে, যেখানে দেড় মিলিয়ন কর্মচারী নিয়োজিত আছে। প্রতিদিন ৬৮ মিলিয়ন ক্রেতা র চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে দেড় মিলিয়ন কর্মচারি তাদের নিরলস কাজের মাধ্যমে।
ম্যাকডোনাল্ড'স এ প্রধানতঃ পাওয়া যায় 'হ্যামবার্গার, ম্যাকচিকেন (চিকেন বার্গার), চীজ বার্গার, ফিশ 'ও ফিলে, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই (আলু লম্বা চিকন করে কেটে মচমচে ভাজা), বেকড আপেল পাই, সানডি, পারফে, মিল্ক শেক , কফি। গ্রাহকের চাহিদানুসারে সালাদ, চিকেন র্যাপ, ফ্রুটস, স্মুদি পাওয়া যায়। এই খাবারগুলো পাওয়া যায় বেলা দশটার পর থেকে। দশটার আগে ব্রেকফাস্ট আইটেম বিক্রী হয়। ব্রেকফাস্ট আইটেমের মধ্যে থাকে 'প্যান কেক উইথ ম্যাপল সিরাপ', সসেজ, বিস্কুট , স্ক্রামবলড এগ, কফি।
আমেরিকান লাইফ দ্রুত গতিসম্পন্ন। সব কিছুতেই গতি। এই দ্রুত গতির সাথে তাল মিলিয়েই দ্রুত গতির ফাস্ট ফুড হিসেবে ম্যাগডোনাল্ড'স পরিচিত। গ্রাহকের সময় বাঁচাতে 'ড্রাইভ থ্রু' এর ব্যবস্থা রাখা আছে। ড্রাইভ থ্রু ব্যবস্থায় কাউকেই গাড়ী থেকে নামতে হয়না। রেস্টুরেন্টের জানালার পাশে গাড়ী থামালেই ভেতর থেকে কর্মচারী ছেলে বা মেয়েটি জানালার কাছে এসেই খুব দ্রুত গতিতে অর্ডার নিয়ে ভেতরে চলে যাবে। গাড়ীর পেছনে আরও গাড়ী এসে জমা হতে থাকে। অর্ডার দিয়েই প্রথম গাড়ীটি সামনের দিকে এগিয়ে আরেকটি জানালার পাশে থামতেই কর্মচারী মেয়েটি বা ছেলেটি ম্যাগডোনাল্ড'স এর নিজস্ব কাগজের প্যাকেটে মুড়ে গ্রাহকের হাতে খাবার তুলে দেয় এবং খাবারের দাম নিয়েই ভেতরে চলে যায়। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে যতক্ষণ রেস্টুরেন্ট খোলা থাকে। কোন কোন রাজ্যে ম্যাগডোনাল্ড'স খোলা থাকে দিবা- রাত্রি।
যে সকল গ্রাহকের হাতে কিছুটা সময় থাকে অথবা যারা রেস্টুরেন্টের ভেতরে চেয়ার টেবলে বসে খেতে চায়, তাদের জন্য 'সেলফ সার্ভিস' এর ব্যবস্থা থাকে। খাবারের অর্ডার দিয়ে, খাবারের দাম মিটিয়ে খাবারসহ ট্রে হাতে নিয়ে চেয়ার টেবিল দখল করে থাকা যায়, যতক্ষন ইচ্ছে ততক্ষন। পরিবারের সাথে আসা শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্যও ব্যবস্থা আছে। ম্যাগডোনাল্ড'স শপ এর ভেতরে এবং বাইরের ছোট চাতালে বাচ্চাদের খেলাধূলা করার জন্য নানা আয়োজন করা থাকে। বাচ্চাদের জন্য স্নেক পাইপ, দোলনা, সী-স, ক্লাইম্বারসহ মোটামুটি বেশ ভাল ব্যবস্থা থাকে। এই জন্যই ম্যাগডোনাল্ড'স এত বেশী জনপ্রিয়। পৃথিবীজুড়ে এর পরিচিতি।
এত জনপ্রিয় হওয়া সত্বেও ম্যাগডোনাল্ড'স এর বার্গার এর খাদ্য গুন নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে। আমেরিকায় 'ওবিসিটি' (অতিরিক্ত মোটা) দিনে দিনে একটি ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। অতিরিক্ত মেদবহুল মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। পুষ্টিবিদগন 'ওবিসিটি'র জন্য ফাস্টফুড বা দ্রুত সময়ে প্রস্তুত খাবারকে দায়ী করে থাকে। ম্যাগডোনাল্ড'স এর বিপনণ বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে ' স্পিডি সার্ভিস'। ম্যাগডোনাল্ড'স কর্তৃপক্ষ সবদিক বিবেচনা করেই বেকড ফিশ, সালাড, বেকড আপেল পাই এর ব্যবস্থা রেখেছে। তবুও ম্যাগডোনাল্ড'স এর বার্গার স্বাস্থ্য সচেতন জনগন সব সময় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। তারপরেও ম্যাগডোনাল্ড'স এর ব্যবসা থেমে নেই। মাত্র এক ডলারে একখানা বার্গার পাওয়া গেলে এর চাহিদা না বেড়ে উপায় কি!
ম্যাকডোনাল্ড'স এর দৈনিক আয় প্রায় সাড়ে ছয় কোটি ডলার। ব্যবসা সফল প্রতিষ্ঠানটি অনুদান তহবিলে মোটা অংকের টাকা দান করে থাকে। দুস্থদের জন্য ফান্ড রেইজিং তহবিলে, প্রাকৃতিক দূর্যোগে আক্রান্ত মানুষের সেবায় ম্যাগডোনাল্ড'স কর্তৃপক্ষ রেগুলার সাড়া দিয়ে থাকে। এই চেইন ব্যবসায় 'ম্যাক হ্যাপী ডে' নামে বার্ষিক ফান্ড রেইজিং প্রোগ্রাম আছে, ঐদিনের মোট বিক্রয়মূল্য থেকে নির্দিষ্ট একটা অংশ অনুদান তহবিলে জমা দেয়া হয়। ২০০৭ সালে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর ১৭টি দেশে 'ম্যাক হ্যাপী ডে' পালিত হয়। অস্ট্রেলিয়ান পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৯ সালের ম্যাক হ্যাপী ডে' থেকে প্রায় ২১ মিলিয়ন ডলার অনুদান তহবিলে জমা পড়ে। সফল ব্যবসায় এটাই রীতি, নিজের মুনাফা লাভের পাশাপাশি অন্যের সুখ, সুবিধার প্রতি সুনজর দেয়া। ১৯৪৮ সালে হ্যামবার্গার দিয়ে ম্যাকডোনাল্ড'স নামের যে রেস্টুরেন্টটি যাত্রা শুরু করেছিল, মাত্র ৫০-৬০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর ১১৯ দেশে ৩১ হাজারের বেশী রেস্টুরেন্ট খোলার ভেতরেই নিহিত আছে বানিজ্য লক্ষ্মীর কৃপা লাভের সাফল্যগাঁথা।
No comments:
Post a Comment