Monday, July 22, 2013

আমার সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বেলে~~~


গত বছরের ২২শে জুলাই সন্ধ্যা, আমি বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরেছি, উত্তরার অস্থায়ী ফ্ল্যাটের প্রতিটি রুম কাপড় চোপর, গিফটের প্যাকেট, হাঁড়ি-পাতিল, স্যুটকেস, হাত ব্যাগে ভর্তি হয়ে আছে। পরের দিন ২৩শে জুলাই আমাদের ফ্লাইট, আড়াই মাসের বাংলাদেশ সফরের সমাপ্তি। কিচ্ছু গোছানো হয়নি, কখন গোছাবো তারও ঠিক ঠিকানা নেই, মাথা পুরোপুরি এলোমেলো। কেউ কিছু বললেই মেজাজ দেখাচ্ছি, তাই কেউ ধারে কাছে ঘেঁষছেও না।  বাসায় ছিল আমার ছোটমাসী, তার মেয়ে মিত্রা, আমার স্বামী, দুই মেয়ে মিশা ও মিথীলা। আর কেউ ছিল কিনা মনে পড়ছেনা।
মাসীর মেয়ে মিত্রা আগের দিন চিটাগাং ইউনিভার্সিটি থেকে এসেছে। মিত্রার সাথে আমার সম্পর্ক বোনের চেয়েও আরও বেশী কিছু। মিত্রা আমার বড় মেয়ে মৌটুসীর বয়সী, ওর সাথে আমি সব ধরণের সুখ-দুঃখের গল্প করি। ও জানে, প্রতিবার আমেরিকা ফিরে যাওয়ার সময় আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়, দেশ ছেড়ে চলে আসবো, প্রিয়জন ছেড়ে চলে আসবো, সেই কষ্ট আমি ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারিনা বলেই তুচ্ছ কারণেই রেগে উঠি, তারপর হয়তো হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করি।
মিত্রা খুব ঠান্ডা মাথার মেয়ে, ওর মায়ের মত স্বভাব।  আমাকে সব সময় স্যুটকেস গোছাতে সাহায্য করে। আমাকে সাহায্য করবে বলে এবার ওর পরীক্ষা সামনে রেখেই চলে এসেছে, ও শুনেছে, আমার স্যুটকেসের ওজন একেকটা ৬০ পাউন্ডের বেশী হয়ে যাচ্ছে। এই টেনশানে আমার ঘুমও হচ্ছেনা। তাই একুশে জুলাই ও আমাদের বাসায় আসে। আমার ছোটমাসী আরও অনেক আগে থেকেই আমার সাথে ছিল। ছোটমাসীর সাথে আমার সম্পর্ক হচ্ছে, 'ফেভিকল' এর আঠার মত। এই উপমা দিয়েছেন আমার মা জননী। যতক্ষণ এয়ারপোর্টের দরজা দিয়ে প্রবেশ না করি, আমাদের আঠা নাকি ছুটেনা। এমন সব উদ্ভট উদ্ভট কথা মা বলতো।

বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় আমি এক বছর একটানা লিখেছিলাম, এই পত্রিকার সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক, উপ সম্পাদক সাহেবের প্রতি এত বেশী কৃতজ্ঞ ছিলাম যে মিত্রাকে সাথে করে বিকেলে ওখানে গিয়েছিলাম বিদায়ী ধন্যবাদ জানাতে। রমজান মাস ছিল, আমার খুব ইচ্ছে ছিল পত্রিকা অফিসের সকলকে মিষ্টি খাওয়াই। কিন্তু রোজার মাসে সব মিষ্টি দোকান বিকেল পর্যন্ত পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে, আমার কেন জানি খুব অস্বস্তি হয় পর্দা ঢাকা সরিয়ে খাবার কিনতে। তাই অফিসে যাওয়ার সময় কিছু কিনে নিয়ে যেতে পারিনি, সবার সাথে দেখা করে, শুভেচ্ছা বিনিময় করে যখন চলে আসি, ততক্ষণে বিকেল প্রায় শেষ। বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার সময় আমার মাথায় ছিল স্যুটকেস গোছানোর নয় মণ চিন্তা, সদ্য প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদ স্মরণে কিছু লিখবার তাগিদ, এবং প্রতিটি স্যুটকেসের ওজন পঞ্চাশ পাউন্ডের মধ্যে সীমিত রাখা। এত চিন্তা মাথায় নিয়ে উত্তরার আলীবাবা মিষ্টির দোকানে ঢুকে দেখি প্রতিটি আইটেম অল্প অল্প করে  আছে। মেজাজটা তখনই খিঁচড়ে গেলো, খুবই অভদ্রের মত এলোমেলোভাবে মিষ্টি কিনে পাঠিয়ে দিলাম পত্রিকা অফিসে।

মনটা খুব খারাপ করেই উত্তরার অস্থায়ী ফ্ল্যাটে ঢুকলাম। আমার এবারের বাংলাদেশ সফরটা যেন কেমন হলো, অনেক কাজই করেছি, কিন্তু মনের কোথায় যেনো একটা অস্বস্তি রয়েই গেছিল। কি যেন করিনি, কি যেন পাইনি, কি যেন হারিয়ে যাচ্ছে আমার জীবন থেকে, এমন একটা হুতাশ ভাব নিয়ে আমার শেষ মুহূর্তগুলো কাটছিল। আমার এত সাধের বাপের বাড়ীতেও এবার থাকা হয়নি, আড়াই মাস বাংলাদেশে থেকে নারায়ণগঞ্জে থেকেছি মাত্র দুইটি রাত। কোথায় যে হাহাকার হচ্ছিল, ধরতেই পারছিলামনা। মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতেও পারিনি, মায়ের কাছে অপরাধী হয়েছিলাম। আমি প্রতিবার আমেরিকা ফিরে আসার দুই দিন আগেই মা চলে আসে, দাঁড়িয়ে থেকে সব গোছগাছ করায়। এবারও মা বলেছিল, দুই দিন আগে যেন গাড়ী পাঠিয়ে দেই, আসবে। মায়ের মন, মায়ের বুকেও নিশ্চয়ই কষ্ট ছিল, তার একটা মাত্র মেয়ে, মা'কে ভুলে কেমন দিব্বি আড়াই মাস আলেং ফালেং করে কাটিয়ে দিল। মা আসবে বলেও শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলে ফেললো, জানালো আসতে পারবেনা, এই প্রথম মা মেয়ের বিদায়ের আগে এলোনা। আগে কখনও এমন হয়নি, আমারও রাগ হলো, অভিমান হলো, মা'কে ফোনও করলামনা, জেদ উঠে গেলো, তুমি আসলেনা, আমিও তোমার সাথে কথা বলবোনা। তোমাকে ফোনও করবোনা, মজাটা বুঝবে।



২২ তারিখ সন্ধ্যায় ফোনটা  যখন এলো, আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, জগ থেকে জল ঢালছিলাম গ্লাসে, জগ রেখে দিলাম, ফোনের রিসিভ বাটনে চাপ দিয়ে  হ্যালো বলতেই ছোট ভাইয়ের বউ, অনীতা বললো,
"ফুলদি, নমিতা মামী কথা বলবে আপনার সাথে"।
নমিতা মামী হচ্ছেন মায়ের প্রতিবেশী, প্রতিবেশী বললে কম বলা হয়, মায়ের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী বলা যায়। রতন স্যার নারায়ণগঞ্জ বার একাডেমী স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, রতন স্যারের বাবা 'বিনয় মাস্টার'ও ছিলেন অনেক আগের নামকরা শিক্ষক। বিনয় মাস্টারকে আমার মা ছোটবেলায় বোধ হয় কাকা বা জ্যেঠামশায় ডাকতেন, সেই সুবাদে রতন স্যার মায়ের ছোট ভাই। আমার মাও তো শিক্ষক ছিলেন। সেই হিসেবেও ভাই আর দিদি। পরে প্রতিবেশী হয়ে সম্পর্ক আরও বেশী গভীর হয়েছে।
নমিতা মামী খুব স্মার্ট, করিৎকর্মা, পরোপকারী, এবং খুবই মিশুক টাইপের মানুষ। আমার মা'কে 'দিদি' ডাকতো এবং সম্মান করতো। মা ইদানিং নমিতা মামীর উপর খুব নির্ভর করতেন। প্রায়ই উনাদের বারান্দায় গিয়ে বসতেন, পাড়া-প্রতিবেশীদের সংবাদ নিতেন। আমি যখনই আমেরিকা থেকে মা'কে কল দিতাম, যে কোন সুযোগ পেলেই মা নমীতা মামীর কথা বলতেন। বুঝতাম, এত বড় বাড়ীতে এঁরাই মায়ের স্বজন, এঁরাই মায়ের বান্ধব। আমি বা ছোটমাসী তো কত দূরে থাকি, সব সময় মন চাইলেই তো আর আমার সাথে কথা বলতে পারেনা। আমি যখন ঢাকায় ছিলাম, মা-বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম। কোম্পাণীর গাড়ী ছিল, ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ চলে আসতাম, বাবাকে, মাকে গাড়ীতে তুলে নিয়ে চলে যেতাম ঢাকার বিখ্যাত ডাক্তারদের কাছে। আগাগোড়া চেক আপ করিয়ে নিজেও নিশ্চিন্ত হতাম, তাঁদেরকেও নিশ্চিন্ত করতাম। ঈশ্বরের কৃপা ছিল, আমার মা এবং বাবা, দু'জনের কারো কোনরকম সমস্যা ছিলনা।

গতবার যখন বাংলাদেশে যাব, একদিন ফোনে মা জানালো, তার শরীরটা বেশী ভাল লাগেনা। মায়ের শরীর ভাল লাগেনা শুনে আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল। মায়ের কেন শরীর খারাপ হবে? মায়ের শরীর খারাপ হওয়া মানেই আমাদের সব আনন্দ অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া মায়ের আদরের নাতনীর বিয়ে, কোথায় মা আনন্দে লাফাবে, তা না করে কেমন নিস্তেজ মনমরা হয়ে আছে। ইচ্ছে করে এমন করছে, মা আমাকে দুই চোখে দেখতে পারেনা, সব সময় আমার সাথে খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে, কোথাও বেড়াতে যেতে দিতে চায়না, মাসীকে নিয়ে যদি ডি আই টি মার্কেটেও যাই, মার্কেট থেকে ফেরার সাথে সাথে শুরু হয়ে যাবে ট্যারা ট্যারা কথা।

মা ফোনেই বলল, " মিঠু, এইবার যখন তুই আসবি, তোর সাথে যাব ডাক্তারের কাছে"। দিলাম এক ধমক, " আমার জন্য বসে থাকবে? আমি তো ব্যস্ত থাকবো মৌটুসীর বিয়ে নিয়ে, এতদিন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে আগেই যাও ডাক্তারের কাছে"।
" না তুই আসলেই যাব"।
"আচ্ছা, ঠিক আছে, এতদিন বরঞ্চ একটু শক্তি সঞ্চয় করো, মৌটুসী তোমার প্রথম নাতনী, তুমি কিন্তু নিজের হাতে বিয়ে দিবে।"
" দেখা যাক, সময় আসুক"।
মায়ের কন্ঠ খুব নিস্তেজ ছিল। আমি কিছু বুঝিও নি। আমার মাথায় তখন মেয়ে বিয়ের চিন্তা, আমার স্বামীকে দেশে নিয়ে যেতে পারছি, এতেই আমি কৃতার্থ। দেশে কমিউনিটি সেন্টার ঠিক করা, খাওয়ার ম্যেনু ঠিক করা, রাঁধুনী ঠিক করা থেকে শুরু করে প্রতিটি বিষয়ে আমাকে মাথা ঘামাতে হয়েছে। আমি আমেরিকায় বসে থেকেই দেশে আমার দাদাদের মাধ্যমে এইসব কিছু ব্যবস্থা করেছি। আমার লোকবল খুব ভাল। অদিতি টুম্পা নামে আমার এক ভাগ্নী আছে। ও হচ্ছে আমার ডানহাত এবং বাম হাত। মৌটুসী, মিত্রাদের বয়েসী, আমাকে মামী ডাকে। টুম্পা হচ্ছে আমার 'চেলা'। ওর যা ক্ষমতা, ওর বাবা বা মায়েরও এমন ক্ষমতা নেই। ওর নেটওয়ার্ক খুবই শক্তিশালী। টুম্পার অনেক সাহায্য নিয়েছিলাম মেয়ের বিয়ে আয়োজন করতে গিয়ে।

মেয়ের বিয়েতেই ব্যস্ত ছিলাম জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত, তারপর বন্ধু বান্ধব নিয়ে ব্যস্ততা, বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় নতুন লিখি, সেই লেখা নিয়ে উৎকন্ঠা, কিছু শপিং, কিছু নেমন্তন্ন খাওয়া, নিজের বাড়ীতে নেমন্তন্ন খাওয়ানো, সুনামগঞ্জ ছোটমাসীর বাড়ীতে বেড়াতে যাওয়া, সেখান থেকে জাফলং ঘুরতে যাওয়া, এই সব করতে করতেই জুলাই মাসের ২২ তারিখ চলে এসেছে। হঠাৎ খেয়াল হয়েছে, আমি নারায়ণগঞ্জে গিয়ে থাকিনি, আমরা রওনা হওয়ার আগে মা আসবে বলেছিল, শরীর ভাল লাগেনা বলে শেষ পর্যন্ত মা আসতে পারেননি। আমি মায়ের কাছে থাকলামনা এটা আমার একবারও মনে হলোনা, মনের মধ্যে একরাশ অভিমান জন্মালো, আমি চলে আসবো জেনেও মা এলোনা বলে। এইজন্য মা'কে ফোনও করতামনা, মা জানে, আমার অনেক রাগ, আমার অনেক অভিমান। আমি সব সময় চাইতাম, সবাই আমার কাছে এসে থাকবে, আমি যাওয়ার সময় যেন সবাইকে দেখতে পাই। এইবার আমার মেয়েটা শ্বশুরবাড়ী চলে গেলো, এমনিতেই আমার বুকটা ফাঁকা হয়ে আছে, এরমধ্যে মাও এলোনা, ভীষন কষ্ট বুকে জমেছিল, জলের গ্লাসটা ভরছিলাম, জলটুকু খেয়েই মিত্রাকে নিয়ে স্যুটকেসগুলো ধরবো।

নমীতা মামী বললো, " মিঠু, আমি তোমার মামী। তোমার মা'কে নিয়ে আজকে ডাক্তারের কাছে গেছিলাম। তোমাকে জানানো দরকার, তোমার মায়ের রিপোর্ট ভালো আসে নাই। ডাক্তার আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে বলছে, রিপোর্ট ভালোনা, বায়োপসী করতে হবে"।

আমার মনে হলো, মামী এসব কি বলছে? মায়ের কীসের রিপোর্টের কথা বলছে? হঠাৎ করে খেয়াল হলো, এক সপ্তাহ আগে মামীর সাথে মা ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল, অতিরিক্ত স্রাবের সমস্যা নিয়ে। আমাকেও মা বলেছিল ফোনে, আমি বলেছিলাম, চিন্তা না করতে। আমার ছোট মাসীর ননদ গায়নোকোলজিস্ট, তার পরামর্শমত ওষুধ মা'কে খাওয়ানো হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম, সব মহিলাদেরই মাঝে মাঝে এই ধরণের সমস্যা হয়ে থাকে, তখন মেট্রানিডাজোল কোর্স করলেই সেরে যায়, নিশ্চয়ই মায়েরটাও সেরে গেছে। না সারলে তো মা বলতোই। মা অবশ্য বলেছে, তবে আমাকে না, নমীতা মামীকে বলেছে। ডাক্তার প্যাপস্মিয়ার টেস্ট করেছে, তার রিপোর্ট আরও পাঁচ দিন আগেই নিয়ে এসেছে, আলসেমী করে অথবা ভয়ানক খারাপ কিছু শুনতে হবে ভয়ে মা ডাক্তারের কাছে যায়নি। আজ বিকেলে বোধ হয় রিপোর্ট নিয়ে গেছিল, তখন ডাক্তার মামীকে বলেছে, রিপোর্ট খারাপ এসেছে। বায়োপসী করার কথা শুনলে সকলেরই ভয় করে। মামীরও ভয় করেছে, তাই আমাকে জানিয়েছে। মামী আমাকে ঐ ডাক্তারের ফোন নাম্বারও দিয়েছে, যদি আমি কথা বলতে চাই।

আমার মাথাটা ঘুরে উঠলো, ডাক্তারের নাম্বারে ডায়াল করলাম, ডাক্তার ফোন ধরেই খুবই অভদ্রভাবে বললেন, " হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি কথা বলেন, আমার রুগী আছে"।
আমি বললাম, " ডক্টর, আমিও রুগীর পক্ষ থেকে ফোন করেছি। রুগী আমার মা'।
" হ্যাঁ আমি তো বলেই দিয়েছি, বায়োপসী করতে হবে"।
"ডক্টর, আমি উনার মেয়ে, কালকেই চলে যেতে হচ্ছে , কী হয়েছে আমার মায়ের, একটু খুলে বলবেন প্লীজ?
" এখন বলা যাবেনা, বায়োপসী না করে। এখন রাখি।"
-প্লীজ ডক্টর, একটু শুধু বলেন, কিসের  বায়োপসী করতে চাচ্ছেন ?
'ঐ তো, আপনার মায়ের ইউটেরাসের অবস্থা খুব খারাপ, সেটার বায়োপসী করতে চাই।
-আপনার কি মনে হচ্ছে ক্যান্সারাস কিছু হতে পারে?
-অসম্ভব না।

নমিতা মামীকে ফোন করে জানলাম, ডাক্তার নাকি বলেছে, মা'কে কাল সকালে একটি ক্লিনিকে নিয়ে যেতে, ডাক্তার ঐ সময় ঐ ক্লিনিকে কোন একটা সার্জারী নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন, এক ফাঁকে মায়ের ইউটেরাস থেকে স্পেসিমেন সংগ্রহ করে আমার ভাইয়ের কাছে দিয়ে দিবেন। ভাইকে ঐ স্পেসিমেন সাথে নিয়ে ঢাকা আসতে হবে, ডাক্তারের নির্দেশীত কোন প্যাথলজীতে স্পেসিমেন দিয়ে আসতে হবে। তারা টেস্ট করে পরে রিপোর্ট নেয়ার ডেট জানিয়ে দিবে।

আমি অনেক বছর ধরে আমেরিকা আছি, ধ্যান ধারণা তো কিছু পাল্টেছেই। আমার মাথায় ঢুকছিলনা, এমন একটি জরুরী স্পেসিমেন কি করে রুগীর স্বজনের হাতে দিয়ে দেয়া যায়? কি করে রুগীর স্বজন ঐ স্পেসিমেন নিয়ে চার ঘন্টা ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে থেকে ঢাকা গিয়ে পৌঁছায়? এতবড় গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষা, যার উপর একজন রুগীর চিকিৎসা নির্ভর করে, যদি কোন কারণে স্পেসিমেনের কৌটো হাত থেকে পড়ে যায়, অথবা রাস্তার গরমে স্পেসিমেন নষ্ট হয়ে যায়, অথবা ল্যাবরেটরী যদি তেমন একটা সুবিধার না হয়, পরীক্ষা যদি সঠিক না হয়, রিপোর্ট তো সঠিক আসবেনা।

আমার স্বামীকে সব খুলে বললাম, আমার মুখের চেহারা সাদা হয়ে গেছে, মাসীর চেহারা সাদা হয়ে গেছে, আমার বুকটার মধ্যে কে যেনো হাতুড়ী দিয়ে পেটাচ্ছিল। আমি শুরু করে দিলাম চোটপাট, ডাক্তারের মুন্ডুপাত করতে থাকলাম। আমি কোনভাবেই মত দিতে পারছিলামনা এমন সিদ্ধান্তের উপর। আমার স্বামী আমেরিকা যাওয়ার আগে চার পাঁচ বছর স্কয়ার ফার্মাতে আর এন্ড ডি'র জিএম হিসেবে কর্মরত ছিলেন। স্কয়ার ফার্মার প্রতিষ্ঠাতা স্যামসান চৌধুরীকে আমার স্বামী কাকাবাবু ডাকতেন, উনার ছেলেদের সাথে ছোটবেলায় ঢাকা ব্যাপটিস্ট মিশনে ছিলেন। কলেজ লাইফ থেকেই উনাদের সাথে আমার স্বামীর ঘনিষ্ঠতা ছিল। পরিচয়ের সেই সূত্র ধরেই আমি স্বামীকে অনুরোধ করলাম,

" আমাদের ফ্লাইট কাল মাঝরাতে, তুমি কি সকালে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দিতে পারোনা, মায়ের ইউটেরাসের বায়োপসীটা যদি স্কয়ার হাসপাতাল থেকে করাতে পারি, তাহলে রিপোর্ট সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে পারবো। এই হাসপাতালের যন্ত্রপাতি সবই তো আধুনিক, ফলাফল অ্যাকুরেট আসার সম্ভাবনা।"  সন্ধ্যার ফোনে আমাদের সকলের হতচকিত অবস্থা। স্বামী বললেন, " টুম্পাকে কল দাও, ও ব্যবস্থা করতে পারবে।"

এই সেই টুম্পা, অদিতি টুম্পা, আমার পাগলী ভাগ্নী, রক্তের সম্পর্ক নেই, আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই, অথচ ও আমার আত্মার অংশ। আমাকে ও কি যে ভালোবাসে, কোন কারন ছাড়া ভালোবাসা, স্বার্থ ছাড়া ভালোবাসা। ওর বাবা চাকরী করেন স্কয়ারে। কিন্তু বাবাকে মাধ্যম ধরেনা ও, আগেই বলেছি, ওর নেটওয়ার্ক খুব শক্তিশালী, সকলেই ওর কাকু হয়, সকলেই ওর মামু হয়। ওকে ফোন করলাম, আমার গলার আওয়াজ শুনে টুম্পা প্রায় কেঁদে ফেলে। চিন্তা করতে মানা করলো। দশ মিনিট পরেই জানালো, "সকাল দশটার সময় অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেছে, দিদাকে নিয়ে চলে এসো হাসপাতালে। আমার এক মামা থাকবে ওখানে, মামার ফোন নাম্বার রেখে দাও, প্রয়োজনে ফোন করো"।

অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেছে শুনে আমার বুকের ভেতর থেকে সেই নয় মণ বোঝা নেমে গেলো। মনে হলো, আর চিন্তা নেই। স্কয়ারে বায়োপসী করলেই জানা যাবে, কিছু হয়নি। হয়তো ইউটেরাসে ইনফেকশান হয়েছে, নারায়ণগঞ্জের ডাক্তার অনেক ব্যস্ত মানুষ, হয়তো খেয়াল করেননি। বাসায় ফোন করে বললাম, কাল সকালে গাড়ী যাবে, মা যেন নমিতা মামীকে সাথে নিয়ে চলে আসে। স্কয়ার হাসপাতালে মায়ের ইউটেরাসের বায়োপসী করা হবে।" আমার ছোট ভাই খুব অফেন্ডেড হয়েছে, ওরা নারায়ণগঞ্জে থাকে, ওখানের সকলের সাথে মৌখিক পরিচয় আছে, ডাক্তারের সাথে কথা পাকা হয়ে গেছে  পরদিন মা'কে ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হবে, এরমধ্যে আমি হঠাৎ করে সব বদলে দিলাম। ভাই নিজে সরকারী কলেজের অধ্যাপক,  প্রেস্টিজের একটা ব্যাপারও তো আছে। ভাইয়ের কথাও ঠিক, কিন্তু আমার যে মন মানেনি যখন শুনেছি ক্লিনিক থেকে না পাঠিয়ে রুগীর স্বজনের হাতে ধরিয়ে দিবে স্পেসিমেন, তাতেই আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। যাই হোক, ভাইকে নরম স্বরে বুঝালাম, বায়োপসী রিপোর্টের উপর নির্ভর করে রোগ নির্ণয় করা হবে, যদি ভালো কোন জায়গা থেকে টেস্ট না করানো হয়, পরে তো ভুল চিকিৎসা হবে। আমি শুধু বায়োপসীটা করানোর ব্যবস্থা করি, বাকী চিকিৎসা নারায়ণগঞ্জের ডাক্তারের কাছেই করাবি। ভাই বলল, " না, টেস্ট যেখান থেকে করানো হবে, চিকিৎসাও সেখান থেকেই করানো হবে। তোমরা তো চলে যাবে, এক ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরিয়ে আনলে সেই ডাক্তারের কাছে আর যাওয়া যায়না। অসুবিধা নাই, টেস্ট করানো নিয়ে কথা, সেই টেস্ট আগে করানো হোক। কালকে মা'কে পাঠিয়ে দিব।"



আমার মনে পড়ে গেলো, দেশে আসার আগে মা আমাকে বলেছিল, আমার সাথে ঢাকা এসে ডাক্তার দেখাবে। আমি ভুলে গেছিলাম, আমি ভুলে থেকেছিলাম, মা মনে কষ্ট পেয়েছে, মা আমাকে আর বলেনি, কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নমিতা মামীর শরণাপন্ন হয়েছে। হায় ঈশ্বর! আমাকে তুমি কীভাবে এমন এক পরীক্ষার ভেতর ফেলে দিলে? আমি তো খুব দূর্বল মনের মানুষ, কালকেই চলে যাচ্ছি, আর আজকেই শুনতে হলো মায়ের এই রোগের কথা। মায়ের কি সত্যি ক্যানসার হয়েছে? তা কি করে হয়? মা'কে সব সময় সুস্থ সবল দেখেছি, গত মাসে মৌটুসীর বিয়ের সময় মা কি হুজ্জুতেপনাটাই করলো, আমাকে কি বকাটাই না বকলো, আমি নাকি আতিথেয়তা ঠিকমত করতে পারিনি, মৌটুসীর বিয়ের প্রতিটি কাজ নিজে নিজে করলো, মৌটুসী যখন বিদায় নিচ্ছিল, আমি তো তখন আরেক ঘোরে ছিলাম, তখনও মা দিব্যি সুস্থ ছিল, মৌটুসীর দিকে কেমন করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল, ভেবেছি, প্রাণের টুকরা নাতনী, এইতো সেদিন ওটি থেকে বের হয়ে দিদার কোলে উঠেছিল, সেই পুচকীটা  আজ শ্বশুরবাড়ী চলে যাচ্ছে !! এটা ভেবেই হয়তো অমন করুণ চোখে তাকিয়েছিল।

মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, কাল সকালে গাড়ীতে আমিও থাকবো, আমাকে যেতে হবে, আমি নিজে গিয়ে মা'কে নিয়ে আসবো, হাসপাতালে আমিই নিয়ে যাব। গোছগাছের দরকার নেই, হাতের কাছে যা পাব ঢুকিয়ে নেবো স্যুটকেসে। আমার স্বামীকে বলতেই উনিও রাজী হয়ে গেলেন। আমার কাছটিতে এসে মিত্রা বলল, " ফুলদিভাই, আমিও যাব তোমার সাথে। আমিও থাকবো হাসপাতালে"। মিত্রা সাথে থাকবে জেনে বুকে অনেক বল পেলাম।  (চলবে)

2 comments:

  1. সুখ, দুঃখ, বেদনার স্মৃতিচারণ ... সাবলীল লেখা। মন ছুঁয়ে গেল।

    ReplyDelete