Thursday, November 8, 2012

আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনঃ কাছ থেকে দেখা



আমেরিকার ৫৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ হয়ে গেল, জনগনের ভোটেই  বারাক ওবামা দ্বিতীয়বারের মত প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। মিট রমনি পরাজিত হয়েছেন ওবামার জনপ্রিয়তার কাছে। অবশ্য ওবামা এবং রমনি ছাড়াও আরও দুই তিনজন প্রার্থী ছিলেন এই লড়াইয়ে, তবে তাঁদের কথা ভোটারদের কারো মাথাতেই ছিল না। 

আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়, কিনতু এর প্রভাব পড়ে বিশ্বের উন্নত-অনুন্নত সকল দেশে। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। সকলের চোখ ছিল ৬ই নভেম্বারের দিকে। কে হবে আমেরিকার ৫৭তম প্রেসিডেন্ট! বারাক ওবামা দ্বিতীয়বারের মত প্রেসিডেন্ট হতে পারবে তো? এই নিয়ে জল্পনা কল্পনা চারিদিকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমেরিকার সাধারন জনগনের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে তেমন কোন তাপ উত্তাপ লক্ষ্য করা যায় নি। এমনও হতে পারে আমেরিকানরা অভিব্যক্তিশূণ্য অথবা নিজের বিশ্বাস, নিজের অভিব্যক্তি অন্য সকলের কাছ থেকে আড়াল করে রাখার মন্ত্র  জানে।  ৬ই নভেম্বার আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট ইলেকশান হলো, সকলের অধীর অপেক্ষার কালও যেনো শেষ হয়ে গেলো। বারাক ওবামা দ্বিতীয়বারের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন । ওবামা শিবিরে আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে, আর ওবামা বিরোধী শিবিরে নিশ্চয়ই হতাশা নেমে এসেছে। হিসেব নিকেশ শুরু হয়ে গেছে, রমনির পরাজয়ের পেছনে কী কী কারন ছিল, অথবা  রাজনৈতিক বিশ্লেষকগনও  বিচার বিশ্লেষণ করবেন, কেন এবং কিভাবে ওবামা জয়ী হলেন। 

২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এবারই প্রথম  বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারলাম। শুধু ভোট দেওয়াই নয়,  একই সাথে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের ভোটগ্রহণ কিভাবে সম্পন্ন করা হয়, তা নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করলাম। যদিও মিসিসিপির মত খুবই ছোট্ট এক রাজ্যে নির্বাচন প্রত্যক্ষ করে আমেরিকার পুরো চিত্র আন্দাজ করা যাবেনা, তারপরেও ভোটগ্রহন পদ্ধতি অথবা ভোটারদের মন মানসিকতা তো সর্বত্রই এক হওয়ার কথা। পার্থক্য থাকার কথা শুধুমাত্র ভোটার সংখ্যায়। ছোট রাজ্যে ইলেক্টোরেল ভোটের সংখ্যা কম, বড় রাজ্যে অনেক বেশী। এছাড়া আর তো কোন তফাৎ দেখা যায় না।  এতকাল পত্রপত্রিকায় শুধুই পড়ে গেছি, আমেরিকার কোন কোন রাজ্যগুলো রিপাবলিকান, কোনগুলো ডেমোক্র্যাট। এবারই প্রথম রিপাবলিকানদের রাজ্য মিসিসিপি থেকে ভোট দিলাম। আমাদের বাংলাদেশের সকলেই ডেমোক্র্যাট ওবামার সমর্থক। আমার পরিবারেও এর প্রভাব আছে। কিনতু এই প্রথম অভিজ্ঞতা হলো, নির্বাচনে চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে কোন রেষারেষি বা হানাহানি নেই। প্রত্যেকের স্বাধীনতা আছে যার যার প্রার্থীকে সমর্থণ করা।

আমি  মিসিসিপিতে আছি গত আট বছর যাবৎ। মিসিসিপি আমেরিকার দক্ষিণী রাজ্যগুলোর একটি। দক্ষিণী রাজ্যে কালো জনগোষ্ঠির আধিক্য বেশী। যদিও বলা হয় কালো জনগোষ্ঠীর সকলেই মোটামুটিভাবে ডেমোক্র্যাট পন্থী, তারপরেও দক্ষিণী রাজ্যগুলো থেকে রিপাবলিকান প্রার্থীরাই জয়ী হয়।  পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯৮০ সাল থেকে মিসিসিপি রাজ্যে রিপাবলিকান প্রার্থীরাই জয়ী হয়। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনি পেয়েছেন মিসিসিপি রাজ্যের ছয়টি ইলেকটোর‌্যাল ভোট। ওবামা সাহেবের ভাগ্য ভাল বলতে হবে, মিসিসিপির ইলেকটোর‌্যাল ভোট মাত্র ছয়টি, যা তাঁর বিজয় নির্ধারনে কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি।

নির্বাচন শেষ, ফলাফল ঘোষণাও শেষ। পেছনের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, যদিও মিসিসিপি থেকে রিপাবলিকান প্রার্থী বেশী ভোট পেয়েছে, তারপরেও ওবামার জন্য ক্যাম্পেইন হয়েছিল খুব জোরেশোরে। ক্যাম্পেইনের ঘটা দেখে ধারনা করেছিলাম, এবার বোধ হয় ওবামার ভাগ্যে মিসিসিপির শিকা ছিঁড়বে! ভোটের দিন যত এগিয়ে আসে, আমার উত্তেজনা তত বাড়ে। জীবনে প্রথমবার ভোট দিতে যাচ্ছি, তাও আবার আমেরিকায়, কী জানি কত হুলুস্থুলু ব্যাপারই না ঘটতে যাচ্ছে! এক মাস আগেই আমাদের ভোটার রেজিস্ট্রেশান করা হয়ে গেছে। বাকী ছিল, ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে আসা।

আমাদের দেশে নির্বাচন মানেই উৎসব চারিদিকে, স্বাভাবিক কাজ কর্ম বন্ধ, অফিস কাচারী, স্কুল-কলেজ বন্ধ, হাটে-বাজারে  ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ। বিপরীতে আমেরিকায় জীবন স্বাভাবিক গতিতে চলে, স্কুল কলেজ, অফিস কাচারী ঠিক মতই চলে।  'ভোট দেয়া নাগরিক দায়িত্ব' এবং কাজের এক ফাঁকে একটু সময় বের করে সকলেই গিয়ে ভোটটা দিয়ে আসে। মিসিসিপিতে  ভোট গ্রহন শুরু হয়েছে সকাল সাতটায়, চলেছে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। ভোটকেন্দ্র স্থাপণ করতে গিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হয় নি।  অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধীনে রিক্রিয়েশান সেন্টার থাকে, সেগুলোকেই ভোটকেন্দ্র স্থাপণের কাজে লাগানো হয়েছে। অনেকেই সকাল সাতটায় ভোটকেন্দ্রে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে যার যার কর্মস্থলে চলে গেছে। কেউ কেউ লাঞ্চ ব্রেকে ভোটকেন্দ্রে চলে গেছে, ভোট দিয়েই আবার কর্মস্থলে ফিরে গেছে। কিছু মানুষ বিকেল পাঁচটায় অফিস শেষ করে নিশ্চিন্ত মনে ভোটকেন্দ্রে গিয়েছে।

প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে আট থেকে দশটি ইলেকট্রনিক ভোট মেশিন স্থাপিত ছিল। কেন্দ্রে অভ্যর্থণা  টেবিল ছিল, প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের এজেন্টও  ছিল,  ভোট দিতে আসা মানুষটিকে দু'দলের প্রত্যেকেই হাসিমুখে সাদর সম্ভাষন জানিয়েছে। অভ্যর্থণাকারী ভোটারকে স্বাগত জানিয়ে নির্দিষ্ট টেবিলে পাঠিয়ে দিয়েছে, যেখান থেকে ভোট কার্ড নিতে হবে। ভোটকার্ড যেখান থেকে দেয়া হয়েছে, সেখানের  চার পাঁচটি টেবিল ঘিরে বসা ছিল সাত আটজন স্বেচ্ছাসেবী। স্বেচ্ছাসেবীদের  অনেকেই রিটায়ার্ড মিলিটারী, কেউ বা রিটায়ার্ড শিক্ষক। অনেক সমাজসেবীও এই ধরনের স্বেচ্ছাশ্রমে এগিয়ে আসে। টেবিল ঘিরে বসে থাকা কর্মীদের মাঝে যার যার কাজ আগেই বন্টন করা ছিল।  ওদের কাছে গিয়ে  ভোটারের নামের শেষ অংশ বা পদবী বললেই তারা তাদের ভোটার লিস্টের সাথে নাম, ঠিকানা মিলিয়ে  হাতে একটি ক্রেডিট কার্ডের মত  কার্ড ধরিয়ে দেয়। কার্ডটি নিয়ে ভোটিং মেশিনে ইনসার্ট করলেই স্ক্রীণে ভেসে উঠে নিয়মাবলী। 

নিয়মাবলীতে স্পষ্ট করে লেখা থাকে, কিভাবে পছন্দের প্রার্থীর নামের উপর আঙ্গুলের ডগায় স্পর্শ করে ভোট দিতে হয়। প্রথম পৃষ্ঠায় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের নাম তালিকা, পরের পৃষ্ঠায় সিনেটর, এর পরের পাতায় রিপ্রেজেন্টেটিভ, আরেক পাতায় সুপ্রীম কোর্টের বিচারক পদপ্রার্থীও ছিল। একমাত্র বিচারক পদপ্রার্থী ছাড়া বাকী প্রতিটি প্রার্থীর নামের পাশে নিজ দলের নাম উল্লেখ করা ছিল। অনেকটাই আমাদের দেশের মত, মার্কা দেখে ভোট দেয়া। প্রার্থীকে না চিনেও শুধু তার দল বা মার্কা জেনেই ভোট দেয়ার মত ব্যাপার। বিচারক যেহেতু নির্দলীয় পদ, তাই তাদের নামের পাশে লেখা ছিল নির্দলীয়। আমার মত আরও অনেকেই নিশ্চয় প্রার্থীকে না চিনেই দলের নাম দেখে আঙ্গুল ছুঁয়ে ভোটটি দিয়ে দিয়েছে।

ভোটকেন্দ্রে আরেকজন স্বেচ্ছাসেবী ছিল নতুন ভোটারদের সাহায্য করার জন্য। নতুন ভোটার অথবা বয়স্ক ভোটারদেরকে ভোট মেশিনের কাছে গিয়ে কিভাবে ভোটার কার্ড মেশিনে ইনসার্ট করতে হয়, ইনসার্ট করার পর কী করে ভোট দিতে হয় তা দেখিয়ে দেয় তারা। তবে ভোটার যখন ভোট দেয়ার জন্য প্রস্তুত, তখন স্বেচ্ছাসেবীটি সেখান থেকে সরে যায়। প্রতিটি প্রার্থীকেই ভোট দিতে হবে এমন কোন বাধ্য বাধকতা নেই। একেবারে শেষের পৃষ্ঠায় এসে ভোট সাবমিট করে দিলেই ভোটার কার্ডটি মেশিন থেকে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতেই বেরিয়ে আসে। কার্ডটি হাতে করে পূর্বের  টেবিলে অবস্থানকারী স্বেচ্ছাসেবীর কাছেই জমা দিতে হয়। স্বেচ্ছাসেবীটি ' আই ভোটেড' লেখা স্টিকার ভোটারের হাতে তুলে দিয়ে ভোট প্রদানের জন্য ধন্যবাদ জানায়।  এই পদ্ধতিতে ভোট দিতে একজন ভোটারের সময় লাগে পাঁচ থেকে ছয় মিনিট।  ভোটকেন্দ্রে কর্মরতদের সকলের মুখেই হাসি লেগেই ছিল, কারো চেহারা দেখেই বুঝার উপায় ছিল না, কে কোন দলের সমর্থক।  এরা মনের অভিব্যক্তি লুকিয়ে রাখতে জানে।  তবে কালোরা  মনের অভিব্যক্তি লুকায় না। অনেকেই খুব গর্বের সাথেই বলেছে, ওবামাই জিতবে। এরা জানতো, মিসিসিপি থেকে একটা ইলেক্টোর‌্যাল ভোটও ওবামা পাবেনা, তারপরেও ওরা তাকিয়ে ছিল নিউইয়র্ক, ওহাইও, ক্যালিফোর্ণিয়ার মত বিশাল রাজ্যগুলোর দিকে। রিপাবলিকান ভোটাররাও খুবই ভদ্র। তারাও জানতো, মিসিসিপির ছয়টি ইলেক্টোর‌্যাল ভোট পাচ্ছে রিপাবলিকান প্রার্থী, তা জেনেও এটা নিয়ে তারা কোন ঊচ্ছ্বাস দেখায়নি।  রাত এগারোটার মধ্যেই জানাজানি হয়ে যায়, কে হতে যাচ্ছে আমেরিকার ৫৭তম প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়, ফোনের পর ফোন আসতেই থাকে। আমার বারীতেও ফোন আসার শেষ ছিল না, দেশ থেকেও ফোন আসছিল অনবরত। এদিকে পরের দিন আবার যার যার কাজে সে সে ফিরে গেছে, মনের ভাব কেউ প্রকাশ করছিল না। কারো মনে ছিল ওবামার জয়ের উচ্ছ্বাস, কারো বা মনে ছিল রমনির পরাজয়ের বেদনা। তবে কারো মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বুঝার উপায় ছিলনা। একমাত্র আমেরিকানরাই পারে, মনের কথা মনের ভেতর ধরে রাখতে, আমরা পারিনা।


No comments:

Post a Comment